'সওগাত' ও আমার জীবনকথা

মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন
মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন

[মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন ১৮৮৮ সালের নভেম্বর মাসে, কুমিল্লা জেলার চাঁদপুর থানার পাইকারদি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে তিনি ব্যক্তিগত উদ্যোগে একজন স্বশিক্ষিত মানুষ। শুরুতে তিনি বিমা কোম্পানির একজন বিমাকর্মী হিসেবে কাজ শুরু করেন। তারপর তিনি এ পেশা ছেড়ে কলকাতায় এসে সাংবাদিকতা শুরু করেন। ১৯১৮ সালের ২ ডিসেম্বর তিনি প্রথম সচিত্র সাহিত্যিক পত্রিকা সওগাত প্রকাশ করেন। কিন্তু অর্থের অভাবে ১৯২২ সালে সওগাত পত্রিকা প্রকাশ বন্ধ হয়ে যায়। তারপর তিনি ১৯২৬ সালে এটি আবার প্রকাশ শুরু করেন, যা ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। ১৯২৬ সালে তিনি সওগাত সাহিত্য মজলিশ গঠন করেন। যার মাধ্যমে তরুণ লেখকদের সাহিত্যের প্রতি উত্সাহিত করে তোলেন। ১৯৩৩ সালে তিনি কলকাতায় সওগাত কালার প্রিন্টিং প্রেস প্রতিষ্ঠা করেন, যা মুসলিম সমাজ সংস্কারে ভূমিকা পালন করে। এ ছাড়া ১৯৪৬ সালে তিনি নারীদের জন্য বেগম পত্রিকা নামে আরেকটি সচিত্র সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। দেশভাগের পর তিনি ঢাকায় চলে আসেন এবং ১৯৫৪ সাল থেকে সওগাত  আবার প্রকাশ হতে থাকে। তিনি একুশে পদক, বাংলা একাডেমী পুরস্কার, স্বাধীনতা পুরস্কারসহ বিভিন্ন পদক ও পুরস্কারে ভূষিত হন। ১৯৭৬ সাল থেকে তাঁর নামে ‘নাসিরউদ্দীন স্বর্ণ পদক’ চালু হয়, যা তরুণ লেখক ও সাংবাদিকদের দেওয়া হয়। মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন ১৯৯৪ সালের ২১ মে ঢাকায় মারা যান। এ লেখায় ১৯৪১-’৪২ সাল অব্দি সময়ের তাঁর জীবনের বিশেষ বিশেষ অংশ তুলে ধরা হয়েছে। একজন সম্পাদক হিসেবে তার এ জীবন-অধ্যায় বর্তমান সময়ের বিবেচনায় আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়েছে।]

১. জীবনকথা

আমার জীবন বলতে সওগাত-এর জীবনকেই বুঝি। কারণ, আমার ব্যক্তিগত জীবনে তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু নেই। আমার  যা-কিছু অর্জন, তার সবই সওগাত-এর কারণে। বাংলা সাহিত্যে সওগাত যুগ  নামে আমার লেখা একটা বই আছে। এ বইতে সেকালে যাঁরা লেখক-লেখিকা ছিলেন, তখন তাঁরা কীভাবে কোন পরিবেশ থেকে লিখতেন, সে কথাও আছে। বইটা এসব কিছুরই সংকলন এবং আমার নিজেরও কিছু কথা আছে তাতে। এভাবেই শেষ করেছি বইটি।

সাধারণ গৃহস্থঘরেই আমার জন্ম। নিজের চেষ্টা-চরিত্রের জোরেই কাগজটা প্রতিষ্ঠা করেছিলাম। প্রেস করেছিলাম। আমি দাঁড়িয়েছি একমাত্র নিজের চেষ্টায়।

আমার জন্ম কুমিল্লা জেলার তখনকার চাঁদপুর থানার পাইকারদি গ্রামে। ছোট্ট গ্রাম। ওখানেই আমার জন্ম ১৮৮৮ সালের নভেম্বর মাসে। সেকালে কেউ কিছুটা আরবি-ফারসি মুখস্থ করতে পারলেই তাকে শিক্ষিত বলা হতো। মাতৃভাষা যে বাংলা, তখনকার মুরব্বিরা সে ব্যাপারে, বলতে গেলে, গুরুত্বই দিতেন না। তার চর্চাও করতেন না। বলতেন, বাংলা হিন্দুদের ভাষা। তাহলে আমাদের ভাষাটা কী?

জবাবে বলতেন, আরবি, ফারসি। অথচ তাদের কেউ আরবি-ফারসি শব্দের মানেই জানতেন না। আর সেটাই ছিল শিক্ষার বাহন এবং সেই যে শিক্ষা, তার পরিণতি হয়েছিল এই যে, কাজকর্ম, চাকরি-বাকরি, সাহিত্যচর্চা ইত্যাদি সবকিছু হিন্দুরাই করতেন। অথচ বাংলার মুসলমানদেরও সবাই বাংলায় কথা বলে। এই অবস্থায় আমার বাবা ঠিক করলেন যে আমাকে মক্তবে পাঠিয়ে প্রথমে নামাজ-রোজা অর্থাত্ ধর্মকর্ম ইত্যাদি শেখাবেন। তারপর পাঠশালায় পাঠাবেন। তখনকার দিনে মুসলমানদের বাংলা পাঠশালা ছিল না। তাই মক্তবের পাঠ শেষে এক হিন্দুপণ্ডিত, তাঁর নাম চন্দ্রকুমার পাল, তাঁর প্রাইমারি স্কুলে (পাঠশালায়) আমার বাবা আমাকে ভর্তি করিয়ে দিলেন। গ্রামের লোকজন বললেন, মক্তবে না দিয়ে ছেলেকে পাঠশালায় দিলেন কেন?

বাবা বললেন, বাংলা-ইংরেজি না জানলে ছেলেটা খাবে কী করে? ভালো কোনো কাজ তো করতে পারবে না। উনিও কিছু বাংলা জানতেন, আর গ্রাম্য ভাষায় পদ্য রচনা করতেন। সেকালে দেখেছি সন্ধ্যার পর তাঁদের সবাই জটলা করে বসতেন এবং নিজেদের মধ্যে পুঁথি পড়া নিয়ে অনেকটা কবির লড়াইয়ের মতো করে প্রতিযোগিতা করতেন। পাঠশালায় যেদিন ভর্তি করালেন, সেদিন তিনি পণ্ডিত মশাইকে দিলেন কিছু মিষ্টি আর এক হাঁড়ি দই। কারণ, বাবা বলতেন যে, পণ্ডিত যদি প্রসন্ন থাকেন, তাহলে ছেলের পড়াশোনা ভালো হবে। সেই কালে এসব পণ্ডিত ও শিক্ষিত লোকজনকে গ্রামের সাধারণ মানুষ খুবই মান্য করতেন। ছাত্ররা যেমন শিক্ষকদের মানতেন, তেমনি অভিভাবকেরাও তাঁদের মানতেন।

পাঠশালায় পড়া শেষ হলে বাবা এবার আমাকে ইংরেজি স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেন। ব্যাপারটা দেখে গ্রামের লোকজন আপত্তি তুললেন। স্বজনরা নানা ধরনের কথা বলতে লাগলেন। বাবা তাদের সমস্ত ওজর-আপত্তি অগ্রাহ্য করে বললেন যে, আমার ছেলেকে আমি ইংরেজি স্কুলেই পড়াব। করলেনও তাই। স্কুলটা ছিল বেশ দূরে। ওটার নাম ছিল হরিনাথ হাইস্কুল। চাঁদপুরের কাছে। আমাদের গ্রাম থেকে তিন-চার মাইল দূরে। সেখানে যেতে হতো মাঠ, সুপারির বাগান—এই সব পার হয়ে। সেই স্কুলে অনেক ছেলে ছিল। তিন শরও বেশি। তার মধ্যে মাত্র তিন কি চারজন মুসলমান ছাত্র। কারণ ইংরেজি স্কুলে মুসলমান ছেলেদের পড়তে দিলে মোল্লা-মৌলবিরা নিন্দা করতেন।

২. সহশিক্ষার প্রতি বিশেষ আগ্রহ

যা-ই হোক, স্কুলে তো ভর্তি হলাম। ছোটবেলা থেকেই আমার খবরের কাগজ আর ছবির বইয়ের ব্যাপারে দারুণ কৌতূহল ছিল। আকর্ষণও ছিল দুর্বার। তখনকার দিনে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যাওয়া বা গ্রামের কোনো নাটক কি যাত্রাগানের অনুষ্ঠান ইত্যাদি দেখতে যাওয়া, বিশেষ করে মুসলমানের ছেলেদের, এমনকি বড়দের জন্যও ছিল নিষিদ্ধ। কেউ গেলে গ্রামের লোকজন বিচার করে তাদের শাস্তি দিতেন। তার পরও আমি যেতাম। শারদীয় পূজার সময় আমাদের গ্রামে বা তার আশপাশের গ্রামে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ইত্যাদি হতো। কিন্তু মুসলমানরা এসবে তেমন বেশি যোগ দিত না। যা-কিছু হতো, হতো হিন্দু ছেলেদের উদ্যোগেই। আমার ওপরের ক্লাসে পড়া একটি ছেলে একদিন আমাকে একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নিতে বলল। আমি বললাম, বাবা যদি ধরে পিটুনি দেয়, তাহলে কী হবে? তখন কী করব?

ছেলেটা বলল, যা বলছি করে ফেল। ‘সোহরাব-রোস্তম’ থেকে কয়েকটা সিন তৈরি করে নিল। তারপর আমাকে বলল, এতে তোমাকে পাট দিলাম। এই ফাঁকে কে বা কারা আমার বাবাকে বলে দিল যে আমি নাটক করেছি। আমার বাবা আমাকে ধরে জিজ্ঞেস করলেন, ব্যাপারটা সত্যি কিনা?

বললাম, হ্যাঁ, সত্যি। আমার ভালো লাগে বলেই করেছি।

বাবা বললেন, গুনাগারির কাজ করেছ।

শাস্তি হলো। কান ধরে উঠবস করানো হলো।

কিন্তু শাস্তি হলে কী হবে, আমার কাছে যে জিনিসটা ভালো লাগত, সেটা আর কিছু নয়, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখা, বই আর পত্রিকা পড়া, নাটক করা, আবৃত্তি করা—এই সব। এসব কিছুর প্রতি প্রবল আকর্ষণ ছিল। ক্লাস সেভেন-এইটে পড়ার সময়ই সচেতনভাবে প্রথম এই অভাবটা বোধ করলাম যে, মুসলমানদের লেখা বই-পুস্তক, পত্রপত্রিকা একেবারেই কম। অঙ্গুলিমেয়ও নয়। আমাদের ক্লাসে একটু অবস্থাপন্ন ঘরের একটা হিন্দু ছেলে ছিল। সে প্রায়ই কলকাতা থেকে বই, পত্র-পত্রিকা—এই সব আনাত। সেগুলো নিয়ে সে ক্লাসে আসত। সে যে অনেকগুলো পত্রপত্রিকা আর বইয়ের মালিক— এই রকম একটা মনোভাব দেখাত। আমি তার কাছে একবার একটা ছোটদের মাসিক পত্রিকা পড়তে চেয়েছিলাম। সে দেয়নি। উপরন্তু অপমানজনক একটা উক্তি করেছিল। বলেছিল, তোদের মুসলমানদের কী আছে! আমার এসব নিয়ে টানাটানি করিস কেন?

৩. বইয়ের প্রতি আগ্রহ

আমাদের লাইব্রেরিয়ান আমাকে খুব ভালোবাসতেন। আমি একদিন তাঁকে গিয়ে বললাম, স্যার, আমাদের মুসলমানদের লেখা কোনো গল্প-উপন্যাসের বই কিংবা পত্রিকা কিছুই কি নেই?

জবাবে তিনি বললেন, বাবা, তোমাদের যদি কিছু থাকত, তবে আমরা জানতাম। স্কুলপাঠ্য কোনো বইয়েও মুসলমানদের লেখা আমাদের নজরে পড়ে না।

সেদিন মনে খুব দুঃখ পেয়েছিলাম। এত বড় একটা জাতি, এত বড় একটা সমাজ, তারা বাংলা ভাষায় কথা বলে, অথচ তাদের বাংলা কোনো পত্রপত্রিকা নেই! এ নিয়ে ভাবতে গিয়ে মনটা ভয়ানক খারাপ হয়ে গেল। মাথায় কেবলই ঘুরপাক খেত ব্যাপারটা। ওই বয়সেই ছবির বই কিংবা পত্রপত্রিকা প্রকাশ করার স্বপ্ন দেখতাম। রাতে ঘুম হতো না।

আমাদের লাইব্রেরিতে সাধারণভাবে ইংরেজি বই, ‘ঈশপের উপকথা’ জাতীয় বই দেখেছি। তাতে ছবিটবি ছিল। বিলাতি বই তো! এমন সুন্দরভাবে বাঁধাই করা ছিল যে, দেখে চোখ জুড়িয়ে যেত। পড়ে অনেক সময় সব বুঝতাম না; কিন্তু মনোযোগ দিয়ে ছবিটবি দেখতাম। খুবই উঁচুমানের বই ছিল সব। আমি ছোটদের বই-ই বেশি পড়তাম। যেমন ডা. আবুল হোসেনের ‘যমজ ভগিনী কাব্য’ বলে একটা বইয়ের নাম করতে পারি। ওটা তো মাইকেলি ঢঙে ভাষায় লেখা ছিল। বইটার বাঁধাই ভালো ছিল। বেশ মোটা কলেবরের যে ছিল, আমার এখনো বেশ মনে আছে। আরম্ভটা ছিল এ-রকমের: ‘কুক্ষণে রে কাপুরুষ, কৃষ্ণ দাস তুই গিয়েছিলি কলিকাতা লয়েছিলি ইংরেজদের আশ্রমে আশ্রয়।’ এ রকমভাবে আরম্ভ করা হয়েছিল বইটা। সিরাজউদ্দৌলার শাসনের সময় ইংরেজের সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব-সংঘাত নিয়েই বইটা লেখা। আসলে ওই সময় অনেক বই পড়েছি কিন্তু তেমন বুঝতাম না। যেমন মাইকেলের লেখা বুঝতাম না। তাঁর ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ বুঝতাম না। কিন্তু না বুঝলেও যেটুকু পড়তাম, ভালো লাগত। মাইকেলের ‘মেঘনাদবধ কাব্য’-র তো লাইনের পর লাইন আমার মুখস্থ। একটুখানি শোনাই:

সম্মুখ সমরে পড়ি, বীর-চূড়ামণি / বীরবাহু, চলি যবে গেলা যমপুরে / অকালে, কহ, হে দেবি অমৃতভাষিণি, / কোন্ বীরবরে বরি সেনাপতি-পদে, / পাঠাইলা রণে পুনঃ রক্ষঃকুলনিধি / রাঘবারি? কি কৌশলে, রাক্ষসভরসা / ইন্দ্রজিত্ মেঘনাদে— অজেয় জগতে— / ঊর্মিলাবিলাসী নাশি, ইন্দ্রে নিঃশঙ্কিলা? / বন্দি চরণারবিন্দ, অতি মন্দগতি / আমি, ডাকি আবার তোমায়, শ্বেতভুজে / ভারতি! যেমতি, মাতঃ, বসিলা আসিয়া, / বাল্মীকির রসনায় (পদ্মাসনে যেন) / যবে খরতর শরে, গহন কাননে, / ক্রৌঞ্চবধূ সহ ক্রৌঞ্চে নিষাদ বিঁধিলা, / তেমতি দাসেরে, আসি, দয়া কর, সতি। / কে জানে মহিমা তব এ ভবমণ্ডলে? / নরাধম আছিল যে নরকুলে / চৌর্যে রত, হইল সে তোমার প্রসাদে, / মৃত্যুঞ্জয়, যথা মৃত্যুঞ্জয় উমাপতি! / হে বরদে, তব বরে চোর রত্নাকর / কাব্যরত্নাকর কবি! তোমার পরশে, / সুচন্দন-বৃক্ষশোভা বিষবৃক্ষ ধরে! / হায়, মা, এহেন পুণ্য আছে কি এ দাসে? / কিন্তু যে গো গুণহীন সন্তানের মাঝে / মূঢ়মতি, জননীর স্নেহ তার প্রতি / সমধিক। ঊর তবে, ঊর দয়াময়ি / বিশ্বরমে! গাইব, মা, বীররসে ভাসি, / মহাগীত; ঊরি, দাসে দেহ পদছায়া। / —তুমিও আইস, দেবি, তুমি মধুকরী / কল্পনা! কবির চিত্ত-ফুলবন-মধু / লয়ে, রচ মধুচক্র, গৌড়জন যাহে / আনন্দে করিবে পান সুধা নিরবধি।

এই যে সূচনা, এটা এতটা বীরত্বব্যঞ্জক, এতটাই কাব্যমণ্ডিত যে বলে শেষ করার নয়।

আমি তখন ম্যাট্রিক পাস করিনি। ওই নজরুলের যে অবস্থা, আমারও অনেকটা তা-ই হয়েছিল। ও যেখানে গিয়ে থেমেছিল, আমিও সেখানে গিয়েই থেমেছিলাম। ম্যাট্রিক, এখনকার এসএসসি পরীক্ষা দেবার ঠিক আগেভাগে হঠাত্ করেই বাবা মারা গেলেন। পরিবারের জ্যেষ্ঠ সন্তান হওয়ায় তখন এমন একটা মুশকিলে পড়ে গেলাম যে, সংসার চলবে কী করে, কে চালাবে আমাদের—এই ভাবনা গভীরভাবে পেয়ে বসল। এত অল্প বয়সে একটা বিরাট দায়িত্ব কাঁধে এসে চাপল। কী করব, বুঝে উঠতে পারছিলাম না! না আমি ব্যবসা করতে পারি, না এ ব্যাপারে আমার কোনো অভিজ্ঞতা আছে! বড় ধরনের একটা চাকরি পাব, তেমন সম্ভাবনাও নেই। কোনো দিক দিয়েই কোনো রকমের সম্ভাবনা ছিল না। ফলে ভেবেচিন্তে শুরু করলাম ছোটখাটো একটা ব্যবসা। মৌসুমে কাঁচা সুপারি স্টক করে রেখে দিতাম। শুকোলে ছয় মাস পর এগুলো বিক্রি করতাম। আমি তখন চারদিকে শুধু অন্ধকার দেখছি। এছাড়া তেমন কিছু করারও তো ছিল না। খাওয়া-পরা, সংসারের নিত্যদিনের খরচ—এসব কিছু কোথা থেকে কীভাবে আসবে, এই চিন্তায় পাগল হওয়ার জোগাড়। চারদিকে ছুটোছুটি করেও কোনো উপায় করতে পারছিলাম না।

আমরা ছিলাম পাঁচ ভাই-বোন। একজন মারা গিয়েছিল। আর ছিলেন মা। ফলে খুবই কষ্টের মধ্যে পড়ে গিয়েছিলাম। তখন আমাদের ওখানে স্টিমার স্টেশন ছিল। তাতে স্টিমার এসে ভিড়ত। মূলত দুটো জাহাজ কোম্পানিরই জাহাজ এই লাইনে চলাচল করত। একটা জাহাজ কোম্পানির নাম ছিল মেসফিল কোম্পানি আর একটার নাম ছিল আরএসএল অ্যান্ড আইজিএম কোম্পানি। আমাকে একদিন স্টিমার ঘাটে হাঁটতে দেখে স্টেশনমাস্টার, হিন্দু ভদ্রলোক, বললেন, ‘আমি একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট নিয়োগের অনুমতি পেয়েছি। ঘোরাঘুরি বন্ধ করে তুমি আমার সাথেই থাকো।’

কথাটা তিনি বললেন খুবই সহানুভূতির সঙ্গে।

বললাম, কত টাকা মাইনে হবে?

বললেন, ‘কুড়ি টাকা। তাতে তোমার খাওয়া-পরা চলে যাবে।’

তখন তো ভালো চালের মণও ছিল দুই টাকা। কাজেই তখনকার দিনে কুড়ি টাকা ছিল অনেক টাকা।

স্টেশনটার নাম ছিল নরসিংহপুর। এখন আর নেই। নদী ভেঙে নিয়ে গেছে। আমার কাজ ছিল টিকিট বিক্রি করা এবং টিকিট সংগ্রহ করে সেগুলো জমা দেওয়া। সারা দিনে দুই বার স্টিমার থামত—একবার সকালে আর একবার বিকেলে। সারা দিন আর কোনো কাজ নেই। ওই দুই বেলা যাত্রীদের টিকিট সংগ্রহ করতাম। তারপর সন্ধ্যায় জমা দিতাম।

কাজটা পাওয়ার পরও মনটা বেশ খারাপ হয়ে থাকত। একসময় ভাবনা এল, এটা কী রকমের চাকরি! সামান্য একটু কাজ। তারপর সারা দিন হাত গুটিয়ে বসে থাকা। একদিন একটা স্টিমার ঘাটে ভিড়ল। তার থেকে একজন যুবক নামলেন। তার নাম এম সি দত্ত, আমাদের স্কুলে আগে পড়তেন। তিনি একটা জীবন বিমা কোম্পানিতে কাজ করেন। কোম্পানির নাম ‘চায়না মিউচ্যুয়াল লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি’। তিনি আমাকে ডেকে বললেন, তুমি এখানে কী করো?

আমি বললাম, এই কাজ করি। সেই সঙ্গে এও বলি আমি খুব কষ্টের মধ্যে আছি। তিনি বললেন, দেখো আমারও তোমার মতোই এ রকম অবস্থা হয়েছিল। আমিও সংসার নিয়ে বিপদে পড়েছিলাম, অল্প বয়সে গার্জিয়ানহারা হয়ে। গার্জিয়ান মারা যাওয়ায় আমিও কষ্ট পেয়েছিলাম। তারপর আমি লাইফ ইন্স্যুরেন্সে কাজ নিই। এখন তো আমি ভালোই আছি।

আমাদের বাড়ি থেকে তাঁর বাড়ি ছিল মাইল তিন-চারেক দূরে। তিনি আরও বললেন, তুমি লাইফ ইন্স্যুরেন্সের কাজ করলে কোনো পুঁজি লাগবে না। অন্য আর কিছু লাগবে না। খালি কথা বলতে পারলেই হয়। তাহলেই তুমি ভালোভাবে চলতে পারবে।

আমি রাজি হয়ে গেলাম। পরে দেখা করলাম তাঁর সাথে। দেখলাম লোকটা বেশ সচ্ছল। আমাকে কেবল খাওয়া-দাওয়াই করালেন না, বেশ হাসিখুশিতেও রাখলেন। আমাকে বললেন, তুমি বিলেতি কোম্পানির কাজ করতে পারবে না। কারণ, তাহলে আরও বেশি লেখাপড়া শেখার দরকার। তোমার জন্য ভারতীয় কোম্পানিই ভালো হবে। বাংলাদেশে কোনো মুসলমান এজেন্ট নেই। এসব কাজকে মৌলবিরা গুনাগারির কাজ বলে মনে করে থাকেন। তাই এসব জায়গায় কাউকেই লাইফ ইন্স্যুরেন্সের কথা বোলো না। ব্যাংকের সাথে কোনো যোগাযোগ রেখো না।

যা-ই হোক, কিছুদিনের মধ্যেই ওই কোম্পানিতে আমার চাকরি হয়ে গেল। আমাকে মিস্টার দত্ত সবকিছু দেখিয়ে-বুঝিয়ে দিলেন। উপদেশ দিলেন কোন কোন জায়গায় ধরবে, এত বছর বয়সের ছেলে হলে এই হবে তার প্রিমিয়াম। দশ বছর পর এই হবে তার প্রফিট। ‘সুদ’ বলবে না। খবরদার, সুদ বললে লোকজন মারবে। তুমি বলবে, প্রফিট। বইতেও প্রফিটই লেখা আছে। কাজেই এভাবে আরম্ভ করে দাও। আমি দেখলাম অর্থের যদি কোনো সংস্থান না থাকে, তাহলে আমি কোনো কাজই করতে পারব না। তাহলে এভাবে চললে, আমি না খেয়েই মারা যাব। সে জন্যই আমি খুব উত্সাহের সঙ্গে কাজটা আরম্ভ করে দিলাম। কিন্তু অবস্থাপন্ন লোক যারা, তাদের কাছে গেলেই তারা আমাকে নিন্দা করত, এ কী রকম মুসলমান! মৌলবি, পীর, মাওলানারা বলে দিয়েছেন, জীবন বিমা ও ব্যাংকের সঙ্গে কেউ কোনো ধরনের যোগাযোগ রাখবে না। এসবই গুনাগারির কাজ। তখনকার দিনে যত জমিদার-মহাজন ছিলেন, তাদের সবাই হিন্দু। মুসলমানরা তখনকার দিনে খুব গরিব ছিল। দত্ত আমাকে শিখিয়ে দিলেন সব কিছুর কায়দা-কানুন। আমি তাঁর কথামতো একজনকে বললাম, দেখেন, এটা তো সুদ না, কোম্পানি এটাকে তো প্রফিট বা লাভ বলে ঘোষণা করেছে। আমার কথা শুনে তিনি বললেন, আপনার কথা শুনব, না মৌলবি-মাওলানাদের কথা শুনব? তিনি আমাকে পাল্টা প্রশ্ন করলেন, এর মধ্যে কয়জনার ইন্স্যুরেন্স করেছি আমি?

আমাদের ওদিকে আসাম বেঙ্গল রেলে তখন অনেক মুসলমান কাজ করত। চাঁদপুর ছিল বড় রেলস্টেশন। সেখানে তাদের আড্ডায় আমি ঢুকলাম। আমার কথা শুনেটুনে সেখানে সবাই কিছু কিছু পলিসি গ্রহণ করল। তখনকার দিনে ম্যাজিস্ট্রেটের মাইনা ছিল ১৫০ টাকা এবং সাব-রেজিস্টাররা পেতেন মাসে ৬০ টাকা করে। আমার প্রথম মাসের বিল হয়েছিল ৩০০ টাকা, যা এখনকার ৩০ হাজার টাকার সমান। তখন আমার ফুর্তি দেখে কে! এরপর একজন তো বলেই বসলেন, এখানে একটা ছোট্ট অফিস করে বসো। চাঁদপুরে আমি যেখানে বসে কাজকর্ম করছিলাম, সেটা ছিল একজন হিন্দু ডাক্তারের ঘর। বেশ প্রশস্ত ছিল ঘরটা।

ডাক্তার সাহেব বললেন, তুমি এখানে থাকো। তাহলে আমার ঘরটার পাহারার কাজও হবে। আমি তো নামেমাত্র ডাক্তার। কাজ করি কন্ট্রাকটারির। তুমি এখানে থাকলে ভালোই হয়। ফলে সেখানেই থাকতে শুরু করলাম। আর, এদিক-ওদিক কেবলি ঘুরতে লাগলাম। আগেই বলেছি ঘরটা ছিল বেশ বড়সড়। মাসে ভাড়া ছিল ৭ টাকা। সঙ্গে রান্নাঘরও ছিল। কিছু আসবাবপত্র এনে সাইনবোর্ড লাগিয়ে সেখানেই আমার আস্তানা গেড়ে বসলাম। আর একটা কাজের লোক ছিল নাম মহব্বত আলি। বাড়ি ছিল তার নোয়াখালী। সে রান্নাবান্নার কাজটা করত। আমার অভ্যেস ছিল সাধারণত শিক্ষিত লোকজনদের সঙ্গে মেলামেশা করা, বিকেল হলে তাদের সঙ্গে বসে চা-নাশতা করা। বিকেল বেলা যেসব উকিল-মুন্সেফ বেরুতেন, তাঁরা আমার সেই সাজানো-গোছানো ঘর দেখে সেখানে চলে আসতেন। তাঁদের আমি চা-টা খাওয়াতাম। একদিন জহুরুল কাইয়ুম চৌধুরী নামের একজন ম্যাজিস্ট্রেট, চাটগাঁর লোক, তিনি আমার সেই ঘরে এলেন। চা-টা খাবার পর বললেন, আপনার লাইফ ইন্স্যুরেন্সের কাজ। তা আপনি এখানে ঢুকলেন কী করে?

তাঁকে বললাম আমার এ কাজে ঢোকার ইতিহাস। বলার পর জানালাম এখানে ঢোকার পর আমার একরকম ভালোই চলে যাচ্ছে। তবে অবস্থাপন্ন মুসলমান যারা, তাঁরা আমার সঙ্গে বড় একটা ভালো ব্যবহার করছেন না। ইন্স্যুরেন্স করতে তাঁরা রাজি না। তাঁদের সাফ মতামত এটা নাকি গুনাগারির কাজ।

এ কথা শুনে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব চটে গেলেন। বললেন, ব্যাটারা কিচ্ছু বোঝে না, মোল্লা-মৌলবিরা জ্বালিয়ে শেষ করে গেল আমাদের। সবকিছু নষ্ট করে দিচ্ছে।

এই ভদ্রলোক খুবই উত্সাহী ছিলেন। জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কার কাছে গিয়েছিলেন?

আমি একজন আড়তদারের নাম বললাম।

শুনে বললেন, আপনি এক কাজ করুন। একজনকে বলে তাকে আমার কাছে নিয়ে আসুন। বলুন যে আমি ডাকছি।

আমি সেই আড়তদারকে গিয়ে বললাম যে আপনাকে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব ডেকেছেন।

শুনে তো তিনি অস্থির, আমি আবার কী অপরাধ করেছি যে হুজুর আমাকে তলব করেছেন। তখনকার দিনে পুলিশের কনস্টেবলকে দেখলেই লোকজন ভয় পেয়ে যেত। ভয়ে কেউ দারোগা-ম্যাজিস্ট্রেটদের ধার-কাছ দিয়েও হাঁটত না।

আমি বললাম, অপরাধ-টপরাধ কিছু না।

তাহলে আমার মতো লোককে হুজুর কেন ডাকবেন? নিশ্চয়ই আমার বিরুদ্ধে কিছু আছে!

আমি বললাম, না, ও-রকম কিছু না। তবে যখন দেখা করতে বলেছেন তখন চলেন না গিয়ে দেখা করে আসবেন।

এ কথা বলে তাকে নিয়ে এলাম আমার সেই ডেরায় বসে থাকা ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের কাছে। তিনি সেই আড়তদারকে অভ্যর্থনা জানিয়ে বললেন, আসেন, আসেন, বসেন।

তবুও বসে না লোকটা। কেবল হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে থাকে।

এই অবস্থায় তিনি তাঁকে একটা ধমক দিয়ে বললেন, এ রকম হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? বসেন এখানে।

সঙ্গে সঙ্গে তিনি বসতে বসতে বললেন, হুজুর, আপনি আমাকে তলব করেছেন বলে আমি একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।

ম্যাজিস্ট্রেট বললেন, আচ্ছা, আপনার কাছে নাসিরউদ্দীন সাহেব গিয়েছিলেন লাইফ ইন্স্যুরেন্স করার জন্য?

শুনে বললেন, হ্যাঁ হুজুর, গিয়েছিলেন।

তো আপনি কী বলেছেন?

আমি বললাম, উনি বলেছেন যে মওলবি আর পীর সাহেবরা বলে দিয়েছেন, এসব গুনাগারির কাজ।

ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব তখন জিজ্ঞেস করলেন, দেখুন, আপনার গায়ে যে জামাটা, এটা দেশি কাপড়, না বিলেতি কাপড়?

এটা হুজুর বিলেতি কাপড়।

আচ্ছা, এই কাপড়টা এ দেশে কী করে এল, আপনি তার খবর রাখেন?

না, হুজুর। আমি দোকান থেকে কিনেছি।

তাহলে আমার কাছ থেকে শোনেন। এ কাপড়টা যখন এ দেশে আসে তার আগে এটাকে ব্যাংকে জমা দিতে হয়েছে। ব্যাংকওয়ালারা এটাকে এনসিওর করেছে। তারপর এটা বিলেত থেকে চাঁদপুরে এসেছে। তারপর আপনি কিনেছেন। কাজেই আপনি গুনাগারির কাজ অনেক করেছেন। ইন্স্যুরেন্সের টাকাও দিয়েছেন, ব্যাংকের টাকাও দিয়েছেন।

কাইয়ুম সাহেব এভাবে সেই আড়তদারকে সবকিছু বুঝিয়ে দিলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, আপনার ছেলেপিলে আছে?

আছে স্যার।

তাদের কি লেখাপড়া শেখাচ্ছেন?

হ্যাঁ, কেউ শিখছে, কেউ আমার সঙ্গে কাজ করছে।

আচ্ছা, আপনার কারবার যদি না চলে, যদি আপনি মরে যান, তাহলে এদের কী অবস্থা হবে? এরা তো খেতে পারবে না। তার চাইতে আপনি যদি এখন ৫০০০ টাকার ইন্স্যুরেন্স করেন, আর আপনি যদি মরেও যান, তারা কিছু করে-টরে খেতে পারবে। কাজেই এটা গুনার কাজ না। এটা ছোয়াবের কাজ।

লোকটা তখন বললেন, এটা যদি ছোয়াবের কাজ হয়, তাহলে হুজুর আমি ৫ হাজার টাকার ইন্স্যুরেন্স করব।

এভাবে লাইফ ইন্স্যুরেন্সের কাজ আস্তে আস্তে বেশ জমে উঠল। তখন আমি আর গরিব না, বেশ সচ্ছল অবস্থায় পৌঁছে গেছি। কিন্তু এই যে আমি টাকা-পয়সা, অর্থ উপার্জন করছি, এটা আমার মনে শান্তি দিচ্ছিল না। তিন বছরের মাথাতেই আমি হাঁফিয়ে উঠেছিলাম। কেবল সাহিত্য নিয়ে ভাবনা। এসব নিয়েই আলোচনা করে সময় পার করি। এই অবস্থায় একদিন ঠিক করলাম, দেখি চেষ্টা করে আমাদের মুসলমান সমাজ থেকে একটা পত্রিকা বের করা যায় কি না? এই উদ্দেশ্য নিয়েই আমি একদিন সোজা কলকাতা চলে গেলাম। ১৯১৭ সালে আমি সেখানে গিয়েছিলাম। ওই বিশাল মহানগরে আমার কোনো আত্মীয়স্বজন ছিল না। তবে খোঁজ পেয়েছিলাম যে, মেছুয়া বাজারে আমাদের ফরিদপুরের একজন লোক আছেন। তিনি সাহিত্যচর্চা-টর্চা করে থাকেন। আমি সোজা তাঁর কাছে চলে গেলাম। তিনি সবকিছু শুনেটুনে তো মহাখুশি। এই রকম একটা কাজে কেউ এগিয়ে আসছে না বলে সমাজকে তিনি গালাগাল করতে করতে বললেন, আপনার কোনো চিন্তা নেই। আমার এখানে থাকবেন, খাবেন। তাঁর নাম ছিল আমির হোসেন খান। লিখতেন-টিখতেন না। তবে পড়তেন খুব বেশি। সামাজিক কাজ-কর্মও করতেন। ব্যবসা করতেন। পারফিউমের ব্যবসা। এছাড়া চা মজুত করে তা বিক্রি করতেন। অবস্থা ভালোই ছিল। সবকিছু শুনেটুনে তিনি বললেন, আপনি চেষ্টা করে যান। এখানে আপনার থাকা-খাওয়ার জন্য কোনো খরচ লাগবে না। কিছু নাম দিয়ে বললেন, এই এই লোকের কাছে যান। অবস্থাপন্ন সবাই। তাঁর কথামতো আমি যার কাছেই যাই, তিনিই তওবা তওবা করে বলে ওঠেন, এই হিন্দুদের কাগজের মতো গল্প-উপন্যাস নিয়ে ছবিটবি দিয়ে পত্রিকা বের করবেন, এটা কেমন কথা! আপনি বরং ইসলামি কাগজ বের করেন। আমরা সাহায্য করব। এ রকম সবাই বললেন! আমি তখন চলে গেলাম আবার চাঁদপুরে। সেখানে কিছুকাল থেকে আবার কলকাতায় চলে এলাম। এবার স্থির সিদ্ধান্ত নিয়ে এলাম, যে করেই হোক কাগজ বা পত্রিকা আমাকে বের করতেই হবে। আমার সঙ্গে তখন আর একজন এসে জুটলেন। তাঁর নাম মওলানা সাহাদাত হোসেন। তিনি ‘আঞ্জুমানে ওলামায়ে বাংলা’র প্রচারক ছিলেন। জিজ্ঞেস করলেন, কাগজ বের করবেন শুনলাম?

আমি বললাম, হ্যাঁ।

খুব ভালো কাজ, তিনি বললেন। তাঁর হাতে দেখলাম প্রবাসীসহ আরও কিছু কাগজ। তখন মোহাম্মদী  মাসিক ছিল না। ছিল সাপ্তাহিক। আকরম খাঁ সাহেবের। তখন মওলানা সাহাদাত হোসেন বললেন, আমি যে প্রচারকাজ করছি, সে উপলক্ষে বহু লোকের সঙ্গে আমার আলাপ-পরিচয় আছে এবং তাঁদের কে কোথায় আছেন, আমি সব জানি। আমি তোমাকে সেই সব জায়গায় নিয়ে যাব।

সত্যি সত্যি তিনি নিয়ে গেলেন মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী আর হাকিম মশিউর রহমানের মতো বিশিষ্ট মানুষজনের কাছে। তারপর ব্যারিস্টার আমিনুর রহমানের বাড়িতেও নিয়ে গেলেন। তাঁর চা-বাগান ছিল। খুব বিত্তশালী লোক। তিনি কাউন্সিলের মেম্বারও ছিলেন। ব্যারিস্টার সাহেব তাঁর বাড়িতে আমাদের ভূরিভোজে আপ্যায়িত করেছিলেন। একেবারে সাহেবি কায়দায়। ওই পর্যন্তই। এ ধরনের কাজে সাধারণত বড়লোকদের পাওয়া যায় না। ব্যারিস্টার সাহেবও তাঁর বাইরে ছিলেন না। তখন মওলানা সাহাদাত হোসেন আমাকে বললেন, আরেকজন লোক আছেন। তিনি আপনাদের দেশি।

আমি বললাম, কে?

বললেন, ব্যারিস্টার আব্দুল রসুল। খুব তেজি লোক আর এসব কাজে তিনি সব সময় এগিয়ে আসেন। সিদ্ধান্তমতো আমরা দুজন তাঁর ওখানে একদিন গেলাম।

৪. সওগাত-এর আরম্ভ

উনি বললেন, সাহিত্য পত্রিকা মুসলমান সমাজ থেকে আরও ৫০ বছর আগেই বের হওয়া উচিত ছিল। ব্যারিস্টার সাহেব বলে চললেন, এ সমাজে তো কিছু করার উপায় নেই। আমি একটা কাগজ বের করেছি। সাপ্তাহিক দি মুসলমান। মওলানা মুজীবুর রহমানকে দিয়েছি সম্পাদনার দায়িত্ব। তিনি চালান। কিন্তু শুরুটা আমিই করিয়ে দিয়েছি। ওটা প্রকাশ করার প্রাথমিক খরচাপাতিও দিয়েছি আমিই।

রসুল সাহেব আমাকে বললেন, তুমি এক কাজ করো। প্রথমে একটা পরিকল্পনা করে ফেলো। তারপর সেই পরিকল্পনা অনুসারে এগিয়ে চলো।

আমি তাঁর পরামর্শমতো বিলেতি ম্যাগাজিন আর আমাদের প্রবাসীসহ আরও কিছু সাময়িকী দেখে ও পড়ে নিজে একটা পরিকল্পনাগত ছক তৈরি করে নিলাম। পত্রিকাটা হবে আধুনিক মেজাজ ও মননের। ছবি থাকবে। যাঁরা স্বাধীনভাবে লিখবেন, চিন্তা করবেন, তাঁদের লেখা ছাপা হবে। বিভিন্ন বিভাগ থাকবে। এসব কিছু ঠিকঠাক করে মনে করেছিলাম, আমি তাঁর কাছে আবার যাব। হঠাত্ খবর পেলাম তিনি হার্টফেল করে মারা গেছেন। সন্তান বলতে তাঁর একটি মাত্র মেয়ে। তার বিয়ে ঠিক হয়েছিল বোম্বাইয়ের কোনো এক ব্যবসায়ীর ছেলের সঙ্গে। পরের দিন বিয়ে। তার ঠিক আগের দিন রাতেই তিনি মারা যান। যা হোক, তিনি আমাকে যে উত্সাহ দিয়েছিলেন, সেটাই ছিল আমার কাছে একটা বড় সম্বলস্বরূপ। সিদ্ধান্ত নিলাম, তাঁর উত্সাহে যে পরিকল্পনা করেছিলাম, সে অনুসারেই কাগজ বের করব। কিন্তু প্রথমেই হোঁচট খেলাম উপযুক্ত লেখা পাওয়ার ব্যাপারটি নিয়ে। আমি চাই জ্ঞান-বিজ্ঞানবিষয়ক লেখা বেশি প্রকাশ করতে। কিন্তু যার কাছেই লেখার জন্য যাই, তিনিই বলেন হযরত ওমরের জীবনী লিখে দেব। কেউ বলেন তাপসী রাবেয়ার জীবনীটা লিখে দেব। আমি বললাম, শতকরা ৫০ ভাগ বই-ই এ জাতীয় লেখায় ভরা। আমি চাই, আপনারা আধুনিক সাহিত্য সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করে আমাদের আধুনিক সাহিত্যের চেহারাটা কেমন হবে—তা নিয়েই লিখুন। কিন্তু সে রকম কোনো লেখা আর জোগাড় করা সম্ভব হলো না। তবু কয়েকজনের লেখা পেলাম। একটা লেখা পেলাম আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের। উনি একটা লেখা পাঠালেন প্রাচীন বাংলা সাহিত্য নিয়ে। লেখাটা ভালো। কবি শাহাদাত্ হোসেন লেখা পাঠালেন। উনি সোজাসাপটা বলে দিলেন, আমি আপনার সাথে আছি।

লেখা চেয়ে সবার কাছেই চিঠি পাঠিয়েছিলাম। এমনকি রবীন্দ্রনাথের কাছে, সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কাছে, কুমুদরঞ্জন মল্লিকের কাছে। সবার কাছেই আলাদা আলাদাভাবে চিঠি পাঠিয়েছিলাম। কাউকে বাদ দিইনি। কাগজ বা পত্রিকার নাম ঠিক করতে গিয়ে আমি বেশ মুশকিলে পড়েছিলাম। মুসলমানরা তখন পত্রপত্রিকার আরবি নাম রাখত। যেমন— আল-ইসলাম, মোহাম্মদী, নবনূর ইত্যাদি। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, আমি আমার কাগজের এমন নাম রাখব, যাতে সবাই সেটা পছন্দ করে। এই করতে গিয়ে আমি অনেক কাগজ নষ্ট করেছি। আর অভিধানের কোনো পাতা পড়ার বাকি রাখিনি। কোন নাম রাখব—এই চিন্তায় তখন বিভোর আমি। তারপর খুঁজতে খুঁজতে ‘সওগাত’—এই শব্দ বা নাম আমি বাংলা অভিধানেই পেয়ে গেলাম। তাতে লেখা আছে আন্তরিকতার সাথে কিছু উপহার দেওয়াকেই ‘সওগাত’ বলে। উর্দুভাষী একজন লোককে জিজ্ঞেস করলাম, আমি আমার পত্রিকার নাম ‘সওগাত’ রাখতে চাই, তখন তিনি খুবই উত্সাহিত হলেন এবং বললেন, এর চেয়ে সুন্দর ভালো নাম আর হতে পারে না। আপনি তো সাহিত্যের ‘সওগাত’ দিচ্ছেন, তাই না! সত্যি, এর চেয়ে ভালো নাম আর হতেই পারে না।

তারপর ঠিক করলাম, মুসলমান যেসব লেখকের লেখা পেয়েছি, সেগুলো তো আছেই। হিন্দু লেখকদের কাছ থেকেও লেখা এনে পত্রিকাটা প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নিলাম। যেই কথা সেই কাজ। গেলাম ভারতবর্ষ-র সম্পাদক রায়বাহাদুর জলধর সেনের কাছে। বয়স্ক মানুষ তিনি। আমার অনুরোধের মুখে তিনি বললেন, আমি তো ভ্রমণবৃত্তান্ত লিখি। তা তুমি এ ধরনের মাসিক কাগজ বের করছ শুনে আমি খুব আনন্দিত হয়েছি। মুসলমান সমাজ যত দিন শিক্ষিত না হবে, যত দিন তারা সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চা না করবে, তত দিন বাঙালি জাতির কোনো উন্নতির সম্ভাবনা নেই।

রায়বাহাদুর আরও বললেন, আমি পল্লির একটা ঘটনা নিয়ে গল্প লিখেছি। তোমাকে দুই-তিন দিনের মধ্যে সেটা পাঠিয়ে দিচ্ছি।

সত্যিই তিনি পাঠিয়েছিলেন সেই গল্পটা।

তারপর গেলাম সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কাছে। তিনি বললেন, আপনারা তো খুব ভালো কাজ করছেন। কিন্তু আমার চোখে অসুবিধা হয়েছে। আমার লিখতে মানা। তবে আমি ‘সওগাত’ নামটা খুব পছন্দ করেছি। ভালো নাম দিয়েছেন। আমি কষ্ট করে হলেও সওগাত-এর জন্য একটা কবিতা লিখে পাঠিয়ে দিচ্ছি।

কথা রেখেছিলেন তিনি- পাঠিয়েছিলেন শাহজাদি জেবুন্নেসার একটি ফারসি কবিতার অনুবাদ। শিরোনাম ছিল ‘সৌন্দর্য-সূর্যের প্রতীক’।

অনেকে তখন কবিতাটা পড়ে বলেছিলেন, এত সুন্দর ছন্দ, মনে হয়, মূল ফারসি কবিতা পড়ছি।

কুমুদরঞ্জন মল্লিকের কাছে চিঠি দিয়েছিলাম। তিনি খুশি হয়ে একটা কবিতা লিখে পাঠিয়েছিলেন। তারপর গিয়েছিলাম রবীন্দ্রনাথের বাড়িতে। এভাবে যদুনাথ সরকার ও ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতেও গিয়েছিলাম। ব্রজেন্দ্রনাথ আমাকে বলেছিলেন, আমার লেখালেখি তো মুসলমানদের ঐতিহাসিক ঘটনা ইত্যাদি নিয়েই। আমার তো অন্য কোনো বিষয় নেই। আমাদের অর্থাত্ হিন্দু সম্প্রদায়ের পত্রপত্রিকা সেগুলোকে প্রাধান্য দিতে চায় না। কাজেই আমার খুব সুবিধা হবে, আমি একটা লেখা আপনার পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে লিখব। লিখব একজন মোগল বিদুষীকে নিয়ে। আমি লেখাটা নিয়ে তোমার ওখানে যাব।

তিনি কথা রেখেছিলেন। লেখা নিয়ে এসে খুবই উত্সাহ দিয়েছিলেন আমাকে।

যা-ই হোক, প্রথম সংখ্যার লেখা তো জোগাড় করলাম, জোগাড় করলাম কিছু ছবিও। কিন্তু মুশকিল হলো যেসব হাফটোন ছবি ছাপব, রঙিন ছবি ছাপব, সেসব-কিছু ছাপার জন্য মুসলমানদের তেমন কোনো প্রেস নেই। সারা কলকাতা ঘুরলাম আমি আর মওলানা সাহাদাত হোসেন। প্রেসে প্রেসে ঘোরাঘুরির এই সময়টায় একজন বললেন, কয়ড়া রোডে ইসলামিয়া আর্ট প্রেস নামে একটা প্রেস আছে। মালিকের নাম ইমদাদ আলী। সেখানে গেলাম। গিয়ে দেখি কম্পোজ করার কেসটেস আছে; কিন্তু মেশিন বেশি নেই। মাত্র একটা কি দুটো, তাও ভীষণ পুরোনো। মাত্র দুজন কম্পোজিটার কাজ করছেন। ম্যানেজার বসে বসে ঝিমুচ্ছেন।

আমি গিয়ে বললাম, আর্ট প্রেস নাম দিয়েছেন তো বুঝলাম। কিন্তু আমি যেভাবে কাগজ বের করব, হাফটোন ছবিটবি ছাপব, আপনারা তো তাহলে এসব কিছু ছাপাতে পারবেন না। তিনি বললেন, আমাদের এখানে বইয়ের ফর্মাটর্মা ছাপা হলেও ছবিটবি ছাপা হয় না। তার কথা শুনে নিরাশ হয়ে গেলাম। এই সময় একজন ভদ্রলোক আমাকে বললেন, আপনি রায়বাহাদুর কালী সিংহের নাম শুনেছেন? মহাভারত ছেপেছিলেন? জমিদার, খুব বড় জমিদার ছিলেন।

আমি বলি, শুনেছি। তিনি উত্তর কলকাতার বড় জমিদার ছিলেন। কলকাতা শহরে একটা বড় প্রেস করেছিলেন। তাদের কথামতো সেখানে গেলাম। গেলাম ম্যানেজারের কাছে। ম্যানেজার বললেন, আপনাদের কিছু আমরা ছাপতে পারব না।

কেন?

বললেন, আমরা আরবি-ফারসি টাইপ কোথায় পাব? আপনাদের কাগজের তো অর্ধেকই আরবি-ফারসি লেখা থাকে। মুসলমানদের পত্রিকা বলতে ওটাই বোঝায়। আমাদের ও ধরনের টাইপ-টুইপ নেই।

আমার হাতে তখন পত্রিকায় ছাপা-হতে-যাওয়া কপি ইত্যাদির ফাইল। বললাম, আপনি প্রবাসী  ছাপতে পারবেন? ভারতবর্ষ  ছাপতে পারবেন?

বললেন, হ্যাঁ, পারব।

আমি বললাম, ঠিক সেই ধরনের পত্রিকাই আমি ছাপব।

এ কথা শুনে ম্যানেজার খুশি হলেন। নানা হাঙ্গামার পর পত্রিকা তো বের করলাম। কভার-টভার দিয়ে খুব ভালোভাবেই বের করলাম। পাঠকমহলে একটা ভালো প্রতিক্রিয়াও হয়েছিল।

এসবই সেই ১৯১৮ সালের ঘটনা। সওগাত বাংলা ১৩২৫ সনের অগ্রহায়ণ মাসে বেরিয়েছিল। প্রথম সংখ্যা বের হওয়ার পর সাহিত্যিক-কবিরা দেখলেন, বড় বড় কবি-লেখক তাতে লিখেছেন, ছাপানোও হয়েছে সুন্দরভাবে। ফলে চারদিকে সাড়া পড়ে গেল। মুসলমানদের মধ্য থেকে এ রকম একটা পত্রিকা কেমন করে বেরুতে পারে, অনেকেই যেমন অবাক হলেন, তেমনি খুব প্রশংসাও করলেন। আর মোল্লা-মৌলবিরা ক্ষিপ্ত হলেন তাদের কোনো কথা আমার পত্রিকায় ছিল না বলে। তাঁদের হাদিসের কথা, বাহাসের কথা, যেগুলো নিয়ে তারা ঝগড়া-ফ্যাসাদ করতেন, তার কোনো কিছুই এতে নেই। আর ছবি আছে। ছবি দেখে তাঁরা আমার বিরুদ্ধে ভয়ানক খেপে গেলেন। তাঁরা বলতে লাগলেন, যে লোক ছবি ছাপছে, সে কী রকম মুসলমান? এসব নিয়ে তো তাঁদের মধ্যে একটা হইচই পড়ে গেল। তবে এসব ব্যাপার নিয়ে আমি মওলানা আকরম খাঁর সঙ্গে দেখা করিনি। কথাও বলিনি। আমার পত্রিকা বের করার ব্যাপার নিয়ে কখনো তাঁর কাছে যাইনি। আমি তো তাঁদের কাগজ দেখেছি। মোহাম্মদী সাহিত্য পত্রিকা নয়। তার কাজ কেবল অনেকটা ধর্মীয় কোন্দলে জড়িয়ে পড়া। কোনটা ছহি, কোনটা নকল, কোনটা কী—এসব নিয়ে তাঁরা ঝগড়া করেন। আমাদের কাগজ অর্থাত্ সওগাত  ছিল একটা মৌলিক চিন্তার ধারক। লেখকেরা এখানে তাঁদের স্বাধীন মত নিয়ে লেখালেখি করবেন স্বাধীনভাবে।

মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী ছিলেন নিরপেক্ষ লোক। তিনি নিজে যা পড়াশোনা বা পর্যবেক্ষণ করতেন, তা-ই লিখতেন তাঁর প্রবন্ধে। তিনি ‘আল-এসলাম’-এর সাথে যুক্ত ছিলেন। তিনি যা জানতেন, সেটা জানতেন ভালোভাবে। তাঁর মনে কোনো দ্বিধা ছিল না, সরলভাবে তাঁর মত প্রকাশ করতেন। ব্যবসায়িক ঘোর-প্যাঁচ ছিল না তাঁর মধ্যে। আমি মোল্লা, মওলানা ও পীর—এই জাতীয় কোনো লোকের কাছে যাইনি ইচ্ছে করেই। কারণ, তাঁদের কার্যকলাপ সম্পর্কে জানা-বোঝার পর, অনেক আগেই আমার মন বিষাক্ত হয়ে গিয়েছিল। আমি যখন স্কুলে পড়তাম সেই সময়ই আমার মনের এই দশা হয়েছিল। সে সব কথা বলে আর লাভ কী! আমাদের সমাজ যেসব কাজ করে, সেই তুলনায় একই সময়ে আমাদের প্রতিবেশী সম্প্রদায়ের লোকজন আরও কত ভালো কাজ করে! তারা সাহিত্য করে, সংস্কৃতি করে—সবদিক দিয়ে তারা অগ্রগামী। তারা ব্যবসা-বাণিজ্য সবকিছু করে আমাদের চেয়ে অনেক ভালোভাবে।

বস্তুত কিশোরকাল থেকেই মোল্লাদের সম্পর্কে ব্যক্তিগতভাবে আমার ভালো ধারণা ছিল না। কাজেই আমার লেখক নির্বাচনের ব্যাপারটা ছিল ভিন্ন ধরনের। যেমন মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ সাহেবের কথাই ধরুন। দার্শনিক গোছের মানুষ। আমাকে তিনি বলেছিলেন, আমার অনেক লেখা আছে মুসলমানদের ইতিহাস এবং তাদের দার্শনিক সাধনা বিষয়ে। কিন্তু আমার লেখা কেউ ছাপে না। কারণ, আমার লেখায় অনেক জিজ্ঞাসা থাকে। জিজ্ঞাসা থাকে সৃষ্টির বিষয়ে, সৃষ্টিকর্তার বিষয়ে।

আমি তাঁকে বললাম, আপনি লেখা দেন, আমি ছাপব। সে দায়িত্ব আমার। তারপর উনি লেখা দিলেন। দিলেন তাঁর দার্শনিক প্রবন্ধগুলো। তাঁর পারস্য প্রতিভার সব কটা প্রবন্ধই আমার সওগাত-এ ছাপা হয়। কিন্তু প্রশ্ন করাটাই বিপজ্জনক ব্যাপার ছিল সেকালে। বরকতুল্লাহ সাহেবের প্রত্যেকটা দার্শনিক প্রবন্ধেই জিজ্ঞাসা আছে, প্রশ্ন আছে এবং তার জবাবও আছে। যা-ই হোক, এভাবে আমি কয়েকজনকে নিয়ে তিন বছর কাগজ চালালাম। চালিয়ে দেখি যে, আমি যা চিন্তা করেছিলাম, যেভাবে কাগজ চালাব ভেবেছিলাম, সে রকমভাবে লেখক সংগ্রহ করতে পারিনি, পারিনি উপকরণ সংগ্রহ করতেও। এদিকে আমার অনেক টাকা খরচ হয়ে গেছে। লোকসানের পরিমাণ অনেক বেশি। তখন আমি চিন্তা করলাম যে সাময়িক কিছুকাল সওগাত বন্ধ রাখা যাক। ইচ্ছার রাশ কিছুটা টেনে ধরি। তা-ই করলাম। তারপর আমি আবার আমার সেই ওরিয়েন্টাল লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির অফিসে ফিরে গেলাম। তাদের ক্লাইভ রোডের বিশাল অফিসে গিয়ে আমার পরিচয় দিয়ে বললাম, আমি কয়েক বছর আগে আপনাদের এজেন্ট ছিলাম। তখনো তারা মুসলমান এজেন্ট পাননি। আমি বললাম, আমি কাজ করব। সেখানে আমার কাজ হয়ে গেল। তখন মুসলমানরা কিছু কিছু চাকরি পাচ্ছে। আমি বেশ কিছু লাইফ পলিসি করিয়ে দিলাম। এভাবে কিছু কাজ করে অর্থ উপার্জন করে সওগাত-এর সব দেনাটেনা শোধ করলাম। তার পরও আমার হাতে কিছু পয়সা থেকে গেল। তখন আবার সওগাত বের করার চিন্তা পেয়ে বসল আমাকে। ভাবলাম, এমন লেখকদের আমার সাথে নেব, যাঁরা সমমনা। আমার এই চিন্তার ভালো ফল পেলাম আমি।

এই সময় আমার সঙ্গে আমি পেয়েছিলাম মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলীকে। তিনি তখন মোহাম্মদী  অফিস থেকে বিতাড়িত। তাঁর অবস্থাও খুবই খারাপ ছিল। আর পেলাম আবুল মনসুর আহমদ ও কবি শাহাদাত্ হোসেনকে। এ রকমভাবে চার-পাঁচজনকে পেলাম। আমরা সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম, এই কাগজে ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে সংগ্রাম চলবে। আবুল মনসুর সাহেব বললেন, আমি যা লিখব সেটা তো মুসলমান সমাজের এসব ভণ্ডামির বিরুদ্ধে। আমার যা চিন্তা, মুসলমান সমাজ তা হজম করতে পারবে না।

ওয়াজেদ আলী সাহেবও বললেন, আমি নিয়মিত কাজ করব সওগাত-এ। আবুল মনসুর বললেন, আমি পার্টটাইম কাজ করব বিকেলে। বললাম যে, এক কাজ করি, বিকেলের দিকে ওখানে একটা সাহিত্যের বৈঠক বসানোর ব্যবস্থা করা যাক।

এসবই বাংলা ১৩৩৩ এবং ইংরেজি ১৯২৬ সালের কথা। সওগাত-এর নব পর্যায়ের কথা। পত্রিকাটি তখন নতুন করে বার করছি।

৫. সওগাত-এর  অফিস

সওগাত-এর অফিস ছিল প্রথমে কলুটোলায়। তারপর ওয়েলেসলি স্ট্রিটে। ওখানেই সওগাত-এর লেখকদের আড্ডা বসত। তাঁরা স্বাধীনভাবে আধুনিক ধরনের লেখা লিখতেন। আর তাই নিয়ে মওলানা সাহেবের সঙ্গে লেগে গেল। মওলানা সাহেব মানে মাওলানা আকরম খাঁ সাহেব। তাঁরা বললেন, এরা তো ইসলামের বিরোধিতা করছে। অথচ প্রত্যেকটা লেখাই মুসলমানদের সমর্থনে। তবে তাঁদের চিন্তাধারা ছিল স্বাধীন এবং যুক্তিবহ। এভাবে চলতে আরম্ভ করল।

তাঁরা যখন আমাদের আক্রমণ করতেন, তখন লিখিতভাবেই সেটা করতেন। হানাফী ও মোহাম্মদী  ছাড়া তখন কাগজ তো বেশি ছিল না। এই দুটো কাগজের একটাতেও কবিতা, গল্প, উপন্যাস—এসব কিছু ছাপা হতো না। যা ছাপা হতো, তার বেশির ভাগই ছক-বাঁধা গোছের লেখা। নিয়মের ভেতরে তাঁরা থাকতেন। মওলানা-মৌলবিরা সব সময় আমাদের গালিগালাজ করেছেন। কিন্তু আমরা তা ভ্রুক্ষেপ করিনি। এসব সত্ত্বেও আমাদের দল ক্রমেই বেশ ভারী হয়ে উঠছিল। সওগাত-এর লেখকদের দল মানেই যাঁরা বয়সে তরুণ, তাঁরা। যাঁরা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন বা যাঁরা আধুনিক চিন্তার সাথে যুক্ত আছেন, এমন তরুণ-যুবারাই যোগ দিয়েছেন সওগাত-এর দলে। এই দুটো দলের আত্মপ্রকাশ ঘটে গেল সেই সময়। নজরুল ইসলামের জীবনের প্রথম লেখা আমিই ছেপেছি সওগাত-এ। নজরুল মাঝখানে চলে গিয়েছিলেন কংগ্রেসে। তিনি বাস্তবিকই কোনো দলের লোক ছিলেন না। কমিউনিস্ট দলের লোক এবং কংগ্রেসের বিপ্লবী একটা শাখার লোকজনের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল। নজরুল যা লিখেছেন তার অল্প কিছু ছাড়া বেশির ভাগই আমাদের কাগজে ছাপতে পারিনি। যেমন তিনি লিখেছিলেন দুর্গা পূজার সময় ‘রক্তাম্বরধারিণী মা’। স্বাধীন চিন্তা স্বাধীন লেখা আমি পছন্দ করি। তা সত্ত্বেও ওই ধরনের লেখা আমি ছাপিনি। কারণ, তাতে একটা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা ছিল। তখন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার সময় ছিল না। ওই সময়টায় নজরুল কমিউনিস্টদের সঙ্গে ছিলেন। আমরা তাদের সমর্থন করতাম না। কাজেই নজরুলকে তখন কোনো লেখা দেওয়ার জন্য বিরক্ত করিনি। আমাদের কাগজ চলছে। ইতিমধ্যে আমরা ‘সওগাত সাহিত্য মজলিশ’ গঠন করেছি। নিয়ম করা হয় যে যেখানেই চাকরি করুক, বিকেলে বা সন্ধ্যার সময় ওই মজলিশে এসে তাকে যোগ দিতে হবে। এর মধ্যে একদিন খান মুহাম্মদ মঈনুদ্দীন হঠাত্ করে এসে খবর দিলেন যে, নজরুল ইসলাম কৃষ্ণনগরে জ্বরে শয্যাগত। তাঁর আর্থিক অবস্থা এতটাই খারাপ যে, রোজ বাজার করতে পারেন না।

আমি বলি, কেন?

মঈনুদ্দীন বললেন, কংগ্রেসের লোকেরা তাকে কৃষ্ণনগর নিয়ে গিয়েছিল। কংগ্রেসের অধিবেশন উপলক্ষে সেখানে তাঁকে দিয়ে উদ্বোধনী সংগীত লিখিয়ে নিয়েছিল তারা। অনেক গানও গাইয়েছিল তারা তাঁকে দিয়ে। আর বলেছিল, কৃষ্ণনগরে তোমাকে বাড়ি দেব, বাড়িভাড়া আমরা দেব, তোমার সমস্ত ব্যয় আমরা বহন করব—এই বলে নিয়ে গিয়েছিল।

হেমন্তকুমার সরকার তখন কংগ্রেসের ওই কৃষক পার্টি শাখার সভাপতি। তিনিই নজরুলকে সেখানে নিয়ে যান এবং দুই কি এক মাস কিছু খরচ-টরচ দিয়েছিলেন। এখন বাড়িভাড়াও দেন না। আহারবিহারের প্রতিশ্রুত খরচাপাতিও দেন না। এক মাস কিছু খরচ দিয়েছিলেন। নজরুলের কাগজ লাঙ্গল তখন বন্ধ হয়ে গেছে। এখন আছেন তিনি চরম অসহায় অবস্থায়।

মইনুউদ্দীনকে আমি বললাম, তুমি এক কাজ করো, নজরুলকে নিয়ে আসো এখানে। গাড়ি ভাড়ার টাকা নিয়ে যাও।

৬. সওগাত-এ নজরুলের অন্তর্ভুক্তি

মঈনুদ্দীন নজরুলের খুব ভক্ত ছিলেন। তিনি চলে গেলেন কৃষ্ণনগরে। তারপর একদিন নজরুল এলেন। দেখলাম একটু শুকিয়ে গেছেন। কিন্তু আমি আশ্চর্য হলাম, মানুষটা শারীরিক অসুস্থতা সত্ত্বেও ঘরে বসেই হইচই করতে আরম্ভ করলেন। জোরে কথা বলতে লাগলেন এই বলে, আরে খুব ভালো অফিস করেছেন, বেশ করেছেন। কাগজ তো বেশ ভালোই চলছে। আমি তাকে বললাম, আপনি এক কাজ করুন, কৃষ্ণনগর থেকে এখানে চলে আসুন।

নজরুল বললেন, আমি এখানকার বাড়িভাড়া চালাব কী করে?

আমি বললাম, সেটা দেখা যাবে। আপনি তো কিছুদিন নওরোজ-এ কাজ করেছেন। কত টাকা পেতেন?

তিনি বললেন, এক শ টাকা।

আমি বললাম, এক শ টাকায় আপনার চলত?

বললেন, এক শ টাকায় চলে যেত।

আমি বললাম, তাহলে আপনাকে আমি এক শ নয়, দেড় শ টাকা দেব। নওরোজ-এর মতো একই শর্ত—আপনি এখানে কাজ করবেন, থাকবেন। সাহিত্যিকদের সাথে আড্ডা দেবেন। আর উপন্যাস, গল্প, গজল—এসব লিখবেন। আর এই যে, হলঘরটা আছে, এখানে বসে যখন খুশি গান গাইবেন।

আমার কথা শুনে খুবই খুশি হলেন তিনি। বললেন, তাহলে খুবই ভালো হয়।

সপরিবারে এরপর নজরুল কলকাতায় চলে এলেন। এসে উঠলেন হাসির গানের লেখক নলিনীকান্ত সরকারের বাড়িতে। নলিনীকান্ত নজরুলের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। কিন্তু নজরুলের পক্ষে সেখানে বেশিদিন থাকা সম্ভব হয়নি। নলিনীকান্তের স্ত্রীর হিন্দুয়ানি গোঁড়ামি ছিল। পরে নজরুল চলে আসেন আমার এখানে। এখানকার বাড়িটার ওপরের তলায় ছিল সওগাত-এর অফিস আর নিচতলায় ছিল প্রেস। তার পাশেই ছিল দুই কামরার একটা ফ্ল্যাট। এটা ১৯২৬ সালের ঘটনা। কিন্তু এখানে একটা অসুবিধা দেখা দিল। নজরুল ছিলেন খুবই চঞ্চল প্রকৃতির। হই-হুল্লোড় পছন্দ করতেন। সব সময় তিনি এখানে বসে গানটান করতেন। একদিন দেখি পাশের মসজিদের শ্মশ্রুমণ্ডিত বিহারি ইমাম সাহেব ধেয়ে আসছেন। এসেই বললেন, এখানে গানবাজনা হচ্ছে, গোলমাল হচ্ছে। নামাজ পড়তে পারি না। আপনারা এসব কী আরম্ভ করলেন?

আমি তখন ইমাম সাহেবকে লক্ষ করে বললাম, এখান দিয়ে যে ট্রাম যায়, ট্রামের আওয়াজে কান একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। এটা কি বন্ধ করতে পারেন না? নামাজ পড়েন কী করে? গান তো ভালো, সুরে হয়। ওই রকম শব্দ হয় না। আপনি এটা কেন বন্ধ করেন না? ট্রাম-গাড়ির শব্দ যদি বন্ধ করতে পারেন, তাহলে আমিও এই গানবাজনা বন্ধ করে দেব।

ইমাম সাহেব তখন একটু নরম হলেন। তারপর আর কোনো উত্পাত করেননি। সেই থেকে নজরুল ওখানে বসে গানটান করতেন। আসর বসিয়ে এমনভাবে গল্পসল্প করতেন যে হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যেত। আমি তো ওখানে তেমন একটা বসতাম না। আমার তখন কেবল একটাই চিন্তা কোথায় প্রেস, কোথায় কাগজ, কোথায় ব্লক, কোথায় ছবি, কোথায় লেখা—এই ধান্দা নিয়ে কেবলি দৌড়ে বেড়াতাম। কিন্তু নজরুল এবং তার সাঙ্গপাঙ্গরা হই-হল্লা করত, বলতে গেলে, প্রায় সর্বক্ষণই। আর গাইত হাসির গান।

নজরুলের এই আড্ডায় জুটেছিলেন আরেকজন হাস্য-রসিক। নাম ঠাকুর শরত্চন্দ্র পণ্ডিত। তিনি যখনই হাসির যে কথা বলতেন, তাতেই লোকজন হাসতে হাসতে পাগল হয়ে যেত। আর নলিনীকান্ত সরকারের কথা বলেছি, তিনিও ছিলেন হাসির গানের ওস্তাদ। তাদের গাওয়া একটা হাসির গান ছিল এই রকমের:

‘মরি হায় কলিকাতা কেবল ভুলে ভরা।

উল্টা ডিঙ্গির খালে গিয়া দেখি সোম ডিঙ্গি-ভরা,

শ্যামবাজারে গিয়া দেখি শ্যাম গেছেন

অনেক দূরে...।’

ওই রকম অবস্থায় আমি যেই ঘরে ঢুকতাম, অমনি আমাকে লক্ষ করেই গেয়ে উঠতেন তারা, মরি হায় কলিকাতা কেবল ভুলে ভরা,/ঘাড়ের উপর এতবড় শির,/নাম রেখেছে তার নাসির।/মরি হায় কলিকাতা কেবল ভুলে ভরা।’

আবার এই যে হাসি-ঠাট্টা, কৌতুক আর বিদ্রূপ, তার পাশাপাশি সেই একই মজলিশে বসে তাঁরা রচনা করছেন সিরিয়াস সব লেখা। এভাবে আমাদের সেই সময়কার দিনগুলো সেখানে ভালোই কেটেছে। আমাদের সেই আসরে কত নতুন নতুন লেখক আসতেন, তার বিবরণ তুলে ধরা সত্যিই কঠিন। তাদের আমি লিখতে বলেছি। উত্সাহ দিয়েছি, তাদের ছবি ছেপেছি, মাঝেমধ্যে তাদের ছবি দিয়েও সংখ্যা বের করেছি। আর একটা কথা না বললেই নয়, মেয়েদের লেখা পেতে তখন আমার খুব কষ্ট হয়েছিল।

৭. সুফিয়া কামাল

একদিন সুফিয়া কামালের একটা লেখা তাঁর এক আত্মীয় (তখন তিনি সুফিয়া এন. হোসেন ছিলেন) আমার কাছে নিয়ে এলেন। বললেন, উনি (খালাম্মা) এটা লিখেছেন। তাঁর আরও লেখা আছে; কিন্তু তিনি লেখা বাইরের কাগজে দেন না।

বললাম, কেন?

ছেলেটি বলল, কারণ পরিবারের লোকজন এটা পছন্দ করেন না বেপর্দার কাজ হয়ে যায় বলে। হাতের লেখা বাইরে গেলে নাকি মুসলমানি নিয়ম মতে বেপর্দার কাজ হয়ে যায়।

আমি তো শুনে একেবারে অবাক হয়ে গেলাম। বলে কী? সে কবিতা লিখবে, আর সেই কবিতা কাগজে ছাপলে বেপর্দার কাজ হয়ে যাবে—এটা কোন্ ধর্ম? এটা তো বুঝতে পারলাম না। লেখাটা রাখলাম। তবে সুফিয়া কামালের হাতের লেখা পড়া যায় না। হাতের লেখাটা খুবই খারাপ। আঁকাবাঁকা, কমা নেই, দাঁড়ি নেই, কবিতার নামও নেই। কী আর করা, এসব ঠিকঠাক করে কবিতার নাম দিলাম ‘আমার এ বনের পথে ভুলে করত না কেউ আসা যাওয়া’। সংশোধন ইত্যাদি করার পর নজরুলকে দেখালাম। বেশির ভাগ সংশোধন নজরুলই করেছে। আমি শুধু দাঁড়ি-কমাগুলো ঠিক করেছিলাম। করার পর নজরুলকে দিয়েছিলাম চূড়ান্ত সংশোধনের কাজ করার জন্য। পড়ে নজরুলও লাফিয়ে উঠল। বলল, আমি আগেই ওর নাম শুনেছি। বলে দিচ্ছি ও মস্তবড় কবি হবে, বাংলাদেশের মস্তবড় একজন মহিলা কবি হবে সে। আপনি ওর লেখা আনেন।

সুফিয়া কামালের লেখাটা ছাপা হয়ে গেল। ছাপা হয়ে যাবার পর সবাই প্রশংসা করল। প্রথম লেখা ছাপাবার পর সুফিয়া কামালের কবিতার পুরো খাতাটাই আনানো হলো। নজরুল কিছুটা সংশোধন করে দিলেন। তারপর আমি সওগাত-এ ছাপতে শুরু করলাম। এই হলো সুফিয়া কামালের কবিতা ছাপানোর কাহিনি।

প্রথমে বরিশালের কোনো একটা কাগজে তাঁর লেখা ছাপা হয়েছিল। কিন্তু আমরা তা জানতাম না। কাজেই সওগাত-এ তাঁর কবিতা বেরিয়ে যাওয়ার পর চারদিক থেকে সবাই জিজ্ঞেস করতে শুরু করল, কে এই সুফিয়া? কে এই সুফিয়া এন. হোসেন?

আমি বললাম, সে শায়েস্তাবাদের নওয়াব বাড়ির মেয়ে। পর্দার অন্তরালে থাকে। সেই অবস্থাতেই সে লেখালেখি করে। একদিন দেখি কি সুফিয়া নিজেই এসে হাজির। ভেলভেট কাপড়ের খুব দামি বোরকা পরে। তাঁর সঙ্গে একটা ছেলে। ওদেরই আত্মীয়স্থানীয় কেউ। নাম তার লালা। তাকেই সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে। এসে বলল, আদাব, আদাব।

খুব তাড়াতাড়ি কথা বলত।

আমি বললাম, আরে সুফিয়া, বসো বসো। তুমি তো কবি হয়ে গেছ। সবাই তোমার কবিতার প্রশংসা করছে। আরে কবি মানুষ যদি বোরকা পরে, তাহলে ব্যাপারটা কেমন দাঁড়ায় বলো তো? জিনিসটা তো বেমানান।

সুফিয়া লালাকে বললেন, লালা, বোরকা খুললাম। তুই এটা রেখে দে। সম্পাদক সাহেব বোরকার ব্যাপারটা পছন্দ করছেন না। আমি খুব আনন্দিত হয়েছিলাম তাঁর লেখা পেয়ে। তার পর থেকে প্রায়ই আসত। কিন্তু তার কথা ছিল যখন ঘর থেকে বের হব, তখন বোরকা পরেই বের হব। কারণ, পারিবারিক বাধাবিঘ্ন ছিল অনেক। না হলে গোলমাল লেগে যাবে। আমি বললাম, আচ্ছা তাই-ই করো। এই করতে করতেই ওর লেখা ছেপে চলেছি আমি। আরও দুই-একজন লেখিকা, যেমন—নুরুন্নেসা বিদ্যাবিনোদিনী (ড. আহম্মদের সহধর্মিণী) ও আয়শা আহম্মদ—এই রকম সাত-আটজন লেখিকা সওগাত-এর সঙ্গে যুক্ত হলেন।

আরও পরের দিকে অর্থাত্ সওগাত-এর গোড়ার দিককার যাঁরা, তাঁদের লেখাটেখা জোগাড় করে তাঁদের ছবিসহ ছাপালাম। ‘মহিলা জগত্’ আলাদা করে দিলাম। তাতে করে আরও ক্ষিপ্ত হয়ে গেলেন মোল্লা-মৌলবিরা।

তাঁরা বলাবলি করতে লাগলেন, কত সাহস—মহিলা বিভাগ করে আবার মেয়েদের ছবিও ছাপছে! এদের আস্পর্ধা বড্ড বেশি! সাংঘাতিক অন্যায় কাজ করছে। এই ধরনের খবর পেতাম। কবি শাহাদাত্ হোসেন, তার পাশাপাশি মইনুদ্দীন হোসেন (নূর লাইব্রেরির মালিক) আমাদের সমর্থক ছিলেন। তাঁরা খবর আনতেন, মওলানা এই বলছেন, ওটা বলছেন, এটা করছেন, ওটা করছেন। আপনার বিরুদ্ধে খুব ষড়যন্ত্র চলছে। আপনি মেয়েদের ছবি ছাপছেন, তাদের লেখা ছাপছেন, আপনি তো খুব বিপদে পড়বেন। মওলানারা বলাবলি করছেন, সওগাত-এ আপনি যেসব লেখা আর ছবি ছাপছেন, তাতে করে আমাদের ইসলাম থাকবে না, ইসলাম নষ্ট হয়ে যাবে ইত্যাদি।

৮. মহিলা সওগাত

এই অবস্থার মুখে আমি ঠিক করলাম মোল্লা-মৌলবিদের বিরুদ্ধে যদি সংগ্রাম করতে হয়, তাহলে আমি পিছিয়ে যেতে পারি না। আমি এমন একটা কাজ করব, যা হিন্দুরাও করেনি কোনো দিন। কেবল মহিলাদের ছবি আর লেখা দিয়ে ‘মহিলা সওগাত’ বের করব। দেখি তারা কী বলে, কী করে! কারণ, আমি কিছু কিছু পড়েছি, আগেকার দিনে এমন সব মুসলিম মহিলা ছিলেন, যাঁরা রাজত্ব করেছেন, কেউ কবিতা লিখেছেন, কেউ রণক্ষেত্রে সশরীরে হাজির হয়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন, যুদ্ধও করেছেন, কেউ কেউ দরবারও পরিচালনা করেছেন—এসব কিছু আমার জানা ছিল। কাজেই আমার মোটেও সাহসের অভাব ছিল না। সিদ্ধান্ত নিলাম তাদের আস্তানা বা ঘাঁটিতেই আমাকে আঘাত হানতে হবে। ‘মহিলা সওগাত’ বের করব—দেখি তারা কী করে? কিন্তু কাজটা করতে গেলে তো মহিলাদের লেখা আর তাদের ছবির দরকার। তখনকার দিনে ছবি জোগাড় করা ছিল খুবই মুশকিলের ব্যাপার। একজন এসে বললেন, ব্যাটা তো বড় বদমাশ, পরের বউয়ের ছবি ছাপায়। নিজের বউয়ের ছবি ছাপিয়ে দেখুক না দেখা যাবে কত বড় তার বুকের পাটা! তখন আমি আমার স্ত্রীকে নিয়ে গেলাম ফটো তুলতে। ওরও ছবি ছাপলাম। তারপর মহিলা সংখ্যা বের হলো। কিন্তু বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একটা ভারি মজার ব্যাপার ঘটল, সেটা নিয়ে আমার এখনো মনে হাসির উদ্রেক হয়। মহিলা সংখ্যা যেদিন বের হয়, সেদিন সওগাত অফিসে সবচেয়ে বেশি ভিড় করেছিলেন মোল্লারাই। তাদের প্রত্যেকের মাথায় সাদা টুপি। এই রকম একটা অদ্ভুত জিনিস মুসলমান সমাজে বেরিয়েছে—মেয়েদের ছবি ছাপা হয়েছে, আর আমরা দেখব না! একদিকে ধর্মের কথা বলে, আর অন্যদিকে মেয়েদের ছবি না দেখলে তাদের চলবে না।

আসলে মুসলমান মেয়েদের ছবি তো কেউ এর আগে দেখেনি। সেকালে কোনো দিনই দেখেনি। আমাকে মনসুর সাহেব লিখেছিলেন, মুসলমানদের কোনো কাগজের অফিসে হকারদের এ রকম ঠেলাঠেলি এর আগে আর কখনো দেখিনি। আমি দোতলা থেকে দেখতাম আর হাসতাম। এ কী কাণ্ড, এরা যে ধর্মের কথা বলে সেটা তাহলে ধর্মের কথা নয়, এরা তাহলে ওটা নিয়ে ব্যবসা করে! আমার সাহস আরও বেড়ে গেল। তারপর প্রায়ই ওই ‘মহিলা সওগাত’ বের করতাম ছবি-টবি দিয়ে একইভাবে। ওটা ছাড়াও সওগাত-এ নিয়মিত ‘মহিলা জগত্ বিভাগ’ নামের একটা বিভাগ থাকত। তাতে দেশ-বিদেশের, তুরস্কের, পারস্যের ও মিসরের মেয়েদের নানা তত্পরতার খবর ও ছবি থাকত। ছবি বিদেশ থেকে নানাভাবে জোগাড় করে আনতাম। আমি লিখতাম এই ছোটখাটো নানা বিষয় নিয়ে। তবে সম্পাদকীয় আর অন্যদের লেখা ইত্যাদি আমাকেই দেখে দিতে হতো। অর্থাত্ সম্পাদনার প্রাথমিক কাজটা আমি নিজেই করতাম। বাদবাকিটা ছেড়ে দিতাম আমার যাঁরা সহযোগী, তাঁদের ওপর। লেখার বিষয়টা দেখে দিতাম, আর মোটামুটি ভাষাটা দেখতাম।

আমার সঙ্গে তখন অনেকেই ছিলেন। সহকারী সম্পাদক হিসাবে মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী, আবুল মনসুর আহমদ, আবুল কালাম শামসুদ্দীন—এই তিনজনই ছিলেন প্রধান। আর হবীবউল্লাহ বাহার, খান মুহাম্মদ মঈনুদ্দীনসহ এই রকম আরও কয়েকজন ছিলেন। তাঁরা উত্সাহী লোক, তাঁরা সাহিত্যে উত্সাহী। এ ছাড়া তাঁরা সওগাত-এর জন্য লেখাটেখা জোগাড় করে দিতেন। সে সময় এ রকম আরও অনেকে ছিলেন। সিরিয়াস ধরনের বেশির ভাগ লেখাই নির্বাচন ও সম্পাদনা করতেন মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী, আবুল কালাম আহম্মদ। আর সমালোচনা করার দায়িত্বটা ছেড়ে দিয়েছিলাম আবুল মনসুর আহমদ ও শামসুদ্দীনের ওপর। সওগাত  যখন প্রথম বেরিয়েছে, তখনই তিনি কায়কোবাদের মহাশ্মশান-এর একটা সমালোচনা করেছিলেন। তখন তিনি ধরতে গেলে ছাত্র। এই ছাত্র অবস্থায় সমালোচনাটা করে পাঠিয়েছিলেন আমাদের কাছে। আস্তে আস্তে অনেকে আমাদের সঙ্গে ভিড়ে গেলেন। তাঁদের সবাই যে প্রত্যক্ষভাবে আমার সঙ্গে কাজ করতেন, তা নয়, তবে সওগাত-এ এসে আসর জমাতেন। বাঙালি মুসলমান সমাজে একটা উত্সাহের সৃষ্টি করতে হবে—আমাদের সকলের মধ্যেই এই রকমের একটা আকাঙ্ক্ষা বা ইচ্ছা প্রবলভাবে কাজ করত।

যা-ই হোক, নজরুল ইসলাম যখন সওগাত অফিসে এসে যোগ দিলেন, তখন আমাদের যারা তরুণ সাহিত্যিক, যারা চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিলেন, তাঁদের সবাই এসে সওগাত  অফিসে ভিড় জমালেন। নজরুলের সাথে দলবদ্ধ হয়ে কবিতা, গান ইত্যাদি লিখতে আরম্ভ করলেন। আর নজরুল ইসলাম ছিলেন সেই দলের নেতা। মুসলমানদের মধ্যে যাতে সাহিত্যের প্রচার বেশি হয়, তাদের মধ্যে যাতে জাগরণ আসে, তরুণ-যুবকেরা যাতে সক্রিয় হয়, এ ব্যাপারে তাদের সব রকমভাবে উত্সাহ দেওয়াটাই সে সময় নজরুলের প্রধান কাজ ছিল। তবে এটা কোনোমতেই সাম্প্রদায়িক কোনো প্রয়াস ছিল না। হয়তো কেউ একে সাম্প্রদায়িক বলে আখ্যায়িত করতে পারেন; কিন্তু আসলে কাজটা ছিল একটা অনুন্নত জাতি, যাদের কোনো সাহিত্য নেই, যাদের মধ্যে অন্য কিছুই নেই, তাদের জাগিয়ে তোলা, সত্যিকার অর্থেই একটা মহত্ কাজ ছিল। কোনোভাবেই সেটা সাম্প্রদায়িক কাজ ছিল না। তিনি যে কাজটা করেছেন, সেটা আমাদের সমাজের জন্য একটা বড় ধরনের কাজ ছিল। তিনি এসেই আমাদের যুবক-তরুণ সম্প্রদায়কে জাগানোর জন্য নানা ধরনের চেষ্টা করেছেন। তিনি ‘রণ-সঙ্গীত’ রচনা করেছেন। যেমন—‘চল্ চল্ ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল’ জাতীয় গান। তরুণদের লক্ষ করে এ রকমের আরও অনেক কবিতা তিনি লিখেছেন। সেগুলো তিনি আবার সওগাত  সাহিত্য মজলিশে সবার সামনে আবৃত্তিও করতেন। কোনো কোনোটায় সুরারোপ করে গাইতেনও। তাতে করে একটা দারুণ উত্সাহের সৃষ্টি হয়েছিল। যেমন তিনি তরুণদের লক্ষ করে ‘অগ্র-পথিক’ কবিতাটা লিখেছিলেন। সেটা খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল। আর আমাদের তরুণ সাহিত্যিকরা সেটা পড়ে অপরিসীম উত্সাহিত হয়েছিলেন। ওই কবিতার একটা জায়গায়, আমার মনে আছে, তিনি তরুণদের লক্ষ করে বলেছিলেন:

পাতিত করিয়া শুষ্ক বৃদ্ধ অটবীরে

বাঁধ বাঁধি চলি দুস্তর খর স্রোত-নীরে।

রসাতল চিরি হীরকের খনি করি খনন,

কুমারী ধরার গর্ভে করি গো ফুল সৃজন,

পায়ে হেঁটে মাপি ধরণীতল!

অগ্র-পথিক রে চঞ্চল,

জোর কদম         চল্ রে চল্

এ ধরনের লেখা তিনি অনেক লিখেছেন, বিশেষত তাঁর যে গজল গান, জাতি-ধর্মনির্বিশেষে অর্থাত্ হিন্দু-মুসলমাননির্বিশেষে এ দেশের সবাই তা উপভোগ করেছেন। এ ছাড়া তাঁর খুব সাধারণ কথার একটি গান আছে, যার প্রথম চরণটা এ রকমের:

‘কে বিদেশী মন উদাসী

বাঁশের বাঁশী বাজাও বনে।’...

ওই গানটা কেবল আমাদের মতো লোকজনই নয়, গ্রামের ছেলেবুড়ো, অর্থাত্ চাষাভুষোরাও তখনকার দিনে যেখানে-সেখানে যখন-তখন গাইতেন। তাদের প্রাণের গান হয়ে উঠেছিল ওটা। নজরুলের অনেক গান আমার এখনো মনে পড়ে। ওই যে একটা গান আছে না:

এত জল ও কাজল চোখে পাষাণী

আনলে বল কে,

টলমল জলমোতির মালা

দুলিছে হিয়ার ফলকে।

এসব গানের লাইন এখনো মাঝেমাঝেই আমার মনে পড়ে এবং নিজেই মনে মনে আউড়াই। ভীষণ আনন্দ লাগে। এসব গানের সুর, কথা ও গানের ভঙ্গি আমাকে এখনো ভীষণ আনন্দ দেয়। নজরুল সম্পর্কে বলতে গেলে টানা দুদিন ধরে বললেও আমার কথার শেষ হবে না।

আসলে আমি নজরুলকে যেভাবে দেখেছি, তিনি যেভাবে আমাদের সঙ্গে মিশেছেন এবং সওগাত পত্রিকায় তাঁর কাজ করার ফিরিস্তি বা বিবরণ অর্থাত্ তাঁর সম্পর্কে আমার যা জানা, সে সম্পর্কে অনেক কিছু আমার বাংলা সাহিত্যে সওগাত যুগ বইয়ের ‘সওগাত ও নজরুল ইসলাম’ শিরোনামযুক্ত একটা বিশেষ অধ্যায়ে আমি লিখেছি। একে ঠিক নজরুলের জীবনী বলা যাবে না। কারণ, যাঁরা নজরুলের জীবনী লিখেছেন, তাঁরা সেটাকে ইতিহাসের মতো করেই লিখেছেন। যা জানেন না তাও তাঁরা গুছিয়ে লিখেছেন। অনেকে শোনা কথা লিখেছেন। অনেকে আবার অন্যের বই পড়েটড়ে নজরুলের জীবনী রচনা করেছেন। কিন্তু আমি যা লিখেছি, লিখেছি তাঁর সঙ্গে আমার সরাসরি সম্পর্কসূত্রের ভিত্তিতে।

৯. প্রসঙ্গ নজরুল

আমি যেভাবে নজরুলকে জানতে পেরেছি, আর যে ঘনিষ্ঠতা তাঁর সঙ্গে আমার ছিল, কীভাবে তার সূচনা হলো, কীভাবে এত বছর একসঙ্গে কাটল, কখন তিনি কোন কাজটা কীভাবে করেছেন, নিজের লেখাটা কীভাবে লিখেছেন, তারই বিবরণ আমি আমার ওই লেখাতে তুলে ধরেছি। এবং তিনি যেকোনো সময় সভা-সমিতিতে যেতে পছন্দ করতেন না, সে কথাও আমি লিখেছি। সভা-সমিতিতে যাওয়ার ব্যাপারে ওপরে ওপরে প্রতিশ্রুতি দিলেও সেখানে যাবার সময় হওয়ার আগেই তিনি পালিয়ে যেতেন। কোথায় পালাতেন? হয় ফুটবল খেলার মাঠে, নয় দাবা খেলার আসরে চলে যেতেন। নয়তো চলে যেতেন কোনো আড্ডায়। কারণ, তাঁর এসবকিছুই ভালো লাগত। সভা-সমিতিতে গিয়ে হাত তালি নেওয়া বা বক্তৃতা দেওয়া—এমন কিছু নজরুলের জীবনে খুব অল্পই হয়েছে। যখনই তিনি কোনো সভা-সমিতিতে গিয়েছেন, মনে করতে হবে, তাঁকে সেখানে জোর করেই ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ওই সব সভা-সমিতিতে গিয়ে তিনি খুব সুন্দর সুন্দর কথা বলেছেন। আমার খুব ভালো লাগত তাঁর সেসব অভিভাষণের কথা। যেমন বর্ধমানে নিখিল বঙ্গ মুসলিম যুব সম্মেলনে উদ্যোক্তারা তাঁকে ধরেই নিয়ে গিয়েছিলেন; কিন্তু সেখানে গিয়ে তিনি যে ভাষণটা দিয়েছিলেন, সেটা সত্যিকার অর্থেই, একটা স্মরণীয় ভাষণ। তারপর—‘চল্ চল্ ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল’ বলে যে গানটি গেয়েছিলেন, সেটা গাওয়ার পর তা নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। কেউ বলেছেন এই রকম গান আর নেই। কেউ বলেছেন, যেভাবে গানটা গেয়েছেন, সেটা ঠিক নয়, সওগাত-এ যেটা ছাপা হয়েছে তার টেক্সটাই সঠিক। টেক্সট অনুসরণ করেই তিনি গানটা সব সময় গাইতেন। এ ছাড়া যুবকদের সম্পর্কে তিনি এত সব কথা বলেছেন যে তার শেষ নেই। বলেছেন তাদের অধঃপতনের কারণ সম্পর্কে, মুসলমানদের অধঃপতনের কারণ সম্পর্কে। বলেছেন আমাদের দুর্দশার নেপথ্যের কারণ সম্পর্কে। বলেছেন আমাদের মধ্যে ভাস্কর নেই, কবি নেই, গায়ক নেই, শিল্পী নেই। তিনি যুব সমিতিতে যেসব কথা বলেছিলেন, তারও বিবরণ আমি তুলে ধরেছি আমার স্মৃতিকথায়। আর একটা ব্যাপার আমি লক্ষ করেছি, সওগাত-এ আসলে নজরুলের যেসব কাজ করার কথা ছিল, তিনি তা করতে পারেননি। তাঁকে দিয়ে আমি লিখেয়েছি মৃত্যুক্ষুধা  উপন্যাস। আপনারা শুনে আশ্চর্য হবেন একটা উপন্যাস লিখতে হলে আগের থেকে একটা প্লট ঠিক করে নিতে হয়। কিন্তু নজরুলের মাথায় তেমন কিছু ছিল না। হয়তো প্রাথমিক একটা ধারণা ছিল। অথচ নজরুল সেই উপন্যাস সওগাত-এ ধারাবাহিকভাবে লিখেছেন। তিনি সওগাত  অফিসে একদিন এলেন লিখবেন বলে। আগের লেখা কিছু ছিল না। এসেই আমার মেয়েকে বলতেন, নুর (নুরজাহান বেগম) গত মাসের সওগাতটা নিয়ে আয় তো কী লিখেছিলাম একটু দেখে নিই। তখন আমরা আশ্চর্য হয়ে যেতাম যে একটা উপন্যাস লিখে যাচ্ছেন তিনি, এত বড় একটা কাজ আর তিনি বলছেন যে গত মাসের কাগজটা নিয়ে আয়। অনেক জায়গায় হয়তো বইটা একটু খাপছাড়া হয়েছে, তার কারণ উপন্যাসটা তিনি একনাগাড়ে লেখেননি। তাকে ধরে আনতাম আর অফিসে বসিয়ে তার পরের অংশটা লিখিয়ে নিতাম। জিনের বাদশা, শিউলি মালা নামের গল্প দুটো তাঁকে দিয়ে আমিই লিখিয়ে নিয়েছিলাম। তাতে দেখা যায় যে তাঁর বেশির ভাগ গল্পই আমার অনুরোধে বা চাপাচাপিতে লেখা। তার তিনখানা উপন্যাসের দুখানাই আমি তাঁকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছিলাম। উপন্যাস দুটো হলো—মৃত্যুক্ষুধা আর কুহেলিকা। আর একটা পত্র-উপন্যাস করাচিতে বসে লিখেছিলেন। সেটা ছাপা হয়েছিল মোসলিম ভারত-এ। এই তিনটিই তাঁর উপন্যাস। কিন্তু এসব কাজ করতে গিয়ে আমাকে অনেক বেগ পেতে হয়েছে। কারণ, নজরুল ছিলেন একজন প্রকৃত কবি। তাঁর মনে যখন যে ভাবের উদয় হতো, তা-ই তিনি লিখতেন, তা-ই তিনি বলতেন। আপনার কথামতো, আমার কথামতো যা-কিছু লিখেছেন, সেগুলো ভালো কিছু হয়নি। বলেছি, এ ধরনের লেখা তিনি হয়তো বিপদে পড়ে লিখেছেন। নজরুলের গল্প বলুন, উপন্যাস বলুন, যেগুলো আপনারা এখন পড়ছেন, আমি বলব, সেগুলো ঠিক গল্প-উপন্যাস হিসেবে উতরায়নি। ওসবে যে ধরনের সাহিত্য বা শিল্পগুণ থাকা উচিত ছিল, তার অনুপস্থিতি লক্ষ করা যায়। কারণ, তাঁকে দিয়ে এসবই জোর করে লিখিয়েছি আমরা। কিন্তু তাঁর গান ও গজলগুলো তিনি তাঁর অন্তর থেকেই লিখতেন। সেগুলো আমাদের কথামতো লেখেননি। তাই সেগুলো ভালো হয়েছে। কীভাবে তাঁর মনে গজল গান লেখার ভাবের উদয় হয়েছিল, এবার সে কথা আপনাদের একটুখানি বলছি।

১০. নজরুলের গজল

ঘটনাটা এখনো আমার মনে গেঁথে আছে। মিসর থেকে একজন আরব মহিলা এসেছিলেন। তার নাম ছিল ফৌজিয়া। তিনি আরবিতে গান গাইতেন। কলকাতার আলফ্রেড রঙ্গমঞ্চে গান গাওয়ানোর জন্য তাঁকে চুক্তির ভিত্তিতে এখানে আনা হয়েছিল। নজরুল এসে আমাকে বললেন যে, ফৌজিয়া ভালো গান করে এবং নাচেও ভালো। চলেন শুনে আসি। আমি বললাম, ঠিক আছে আপনি বসে বসে লিখতে থাকুন। আমি যাওয়ার ব্যবস্থা করছি। আমি খান মুহাম্মদ মঈনুদ্দীনকে বললাম যে, তুমি ওপরের ক্লাসের তিনটা টিকিট নিয়ে আসো। নজরুলের একটা, তোমার একটা আর আমার জন্য একটা। নজরুলের লেখা শেষ হলে আমরা সন্ধ্যার সময় গেলাম আলফ্রেড মঞ্চে। গিয়ে দেখি খুব সাজানো হয়েছে মঞ্চটা। চারদিকে জৌলুশের ছড়াছড়ি। আমরা তিনজন বসলাম। এমন সময় ফৌজিয়া মঞ্চে এলেন। এসেই প্রথমে একটা নাচ দেখালেন। তারপর কয়েকটা আরবি গান গাইলেন। আমরা তো কিছুই বুঝলাম না। নজরুলও কী বুঝল না-বুঝল জানি না। তবে গানের সুরে সুরে, তালে তালে তিনি একাই মাথা নাড়াতে শুরু করলেন। নানা অঙ্গভঙ্গি করতে লাগলেন। মানে তাঁর খুব ভালো লেগেছে। এরপর ফৌজিয়া একটা উর্দু গজল গাইলেন। গজল গানটা শুনে নজরুল একেবারে বিমোহিত হয়ে গেলেন। এই ভালো লাগার প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করতে নজরুল বললেন যে, আমার গজল গান লিখতে ইচ্ছে করছে। আমি একটা গান লিখে আপনাকে দেব। আপনি এ মাসের সওগাত-এ সেটা ছাপবেন। তিনি ঠিক সময়মতোই নিয়ে এলেন। সওগাত-এ তাঁর প্রথম যে গজল গানটা বেরিয়েছিল, তার প্রথম দুটো লাইন ছিল এরকমের:

‘আজি এ বসন্ত ফুলবনে

সাজে বনভূমি সুন্দরী।’...

সবগুলোর কথা আমার আজ মনে পড়ছে না। যা-ই হোক, এই গানটা সওগাত-এ ছাপা হলো। এরপর দেখি যে অনবরতই তিনি গজল গান লিখে চলেছেন। এবং প্রত্যেক মাসেই তা সওগাত-এ ছাপতে দিচ্ছেন। গজল লেখায় তাঁর বিরাম নেই। সত্যি বলতে কী গজল গানের প্রতি তাঁর আকর্ষণ বেড়ে গেল বহুগুণে। আর আমাদেরও তা শুনতে এত ভালো লাগত যে বলে শেষ করার নয়। সবাই এ গান পছন্দ করত।

ওদিকে গজলের দিকে বেশি করে ঝুঁকে যাওয়ার ফলে কবিতা লেখার অভ্যাসটা তিনি বলতে গেলে ছেড়েই দিলেন। কবিতা আর লিখতেই চান না। লিখলেও লিখতেন তাঁর খেয়ালখুশিমতো। যেমন ফজিলাতুন্নেসার সাথে তাঁর সম্পর্ক গড়ে উঠলে তিনি লিখলেন ‘রহস্যময়ী’ কবিতা। এই সময় তাঁর আর্থিক অবস্থাও একটু ভালোর দিকে যাচ্ছিল। কারণ, হিজ মাস্টার ভয়েজ গ্রামোফোন কোম্পানির তরফ থেকে তাঁকে বলা হলো, তুমি আমাদের গানের বিভাগটা একটু তদারকি করবে আর যারা গান করে তাদের চালিয়ে নিলে ভালো হয়। সেখানে তাঁর আয়-রোজগার বেশ ভালোই হচ্ছিল। পাশাপাশি তিনি গান, গজল ও অন্যান্য গান গ্রামোফোন কোম্পানিকে দিতে আরম্ভ করলেন। তারপর ‘হিন্দুস্তান রেকর্ড কোম্পানি’ এসে বলল, আমাদেরও গান দিতে হবে। তারপর তার পেছনে এসে জুটল যত থিয়েটার কোম্পানি। আর যারা সিনেমার লোকজন, তারাও এসে বলল, আমাদেরও গান লিখে দিতে হবে। এর মূলে আর কিছুই না, নজরুলের গান ছাড়া কোনো আসর তখন জমে না। যেমন সিরাজউদ্দৌলা নাটকের আলেয়া এবং লুত্ফুন্নেসা চরিত্রের মুখের গান তাঁকেই লিখে দিতে হলো। আমার আশ্চর্য লাগত লোকটা একাকী কী করে রোজ এতগুলো গান লিখতেন আর সেসব গানে সুরও দিতেন! তখন গান লেখা আর সেই গানে সুর দেওয়া ছাড়া অন্য কোনো কাজ ছিল না নজরুলের। এই গানের জগতে যাওয়ার পর তাঁর কবিতা লেখা খুব কমে গিয়েছিল। তিনি গানই লিখেছেন বেশি। মাঝেসাঝে দুই একটা চলচ্চিত্রে অভিনয়ও করেছেন। তবে তিনি অভিনয়ে সফল হতে পারেননি। কারণ তিনি ছিলেন প্রকৃতপক্ষে কবি।

এ সময় মুসলমান সমাজ, বিশেষ করে সেই সমাজের রক্ষণশীল অংশটি নানাভাবে নজরুলের বিরোধিতা করত। কেন করত, সে কথা বলতে গেলে আবার গোড়ার কথায় যেতে হয়। প্রথম দিকে নজরুল করাচি থেকে যা-কিছু লিখতেন, সেগুলো উঁচু দরের কবিতা ছিল না। সেগুলোতে অনেকটা উচ্ছ্বাস ছিল। তখন তাঁর বয়সই-বা কত! আর তখন তিনি অত বেশি সাহিত্যচর্চা করার সুযোগ পাননি। আল্লাহ তাঁকে অসীম প্রতিভা দিয়েছিলেন। এবং সেই প্রতিভার জোরেই তিনি আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। প্রথম দিকে নিজের থেকেই তিনি লিখতেন। করাচি থেকে তাঁর প্রথম দিকে পাঠানো লেখাগুলো আমি ছাপতে পারতাম না। কারণ, সেগুলো কাঁচা হাতের লেখা ছিল। সেগুলোয় যথেষ্ট উচ্ছ্বাস থাকলেও কাব্যের বিচারে সর্বাংশে সুন্দর ছিল না। তবে তাঁর তখনকার সব কবিতাই যে আমরা ফেলে দিতাম, সেকথা বলব না। রেখেই দিতাম। এভাবে সেগুলো আর ছাপা হতো না। তখন নজরুল ইসলাম লিখলেন যে আমি এত কবিতা লিখলাম, কিছুই ছাপা হলো না। তার পরই তিনি ‘কবিতার সমাধি’ বলে একটা কবিতা লিখে তাতে জানালেন যে, আমি আর সওগাত-এ কবিতা দেব না। ‘কবিতার সমাধি’ ছিল একটা ব্যঙ্গ কবিতা এবং এটাই সওগাত-এ প্রকাশিত নজরুল ইসলামের প্রথম কবিতা। তিনি তখন যা-কিছু লিখতেন, সে ব্যাপারে এটুকু বলতে পারি যে, তাঁর লেখার একটা নতুন ধরন পাওয়া গিয়েছিল। তাঁর লেখায় একটা প্রাণ ছিল, চাঞ্চল্য ছিল। এরই পরিচয় আমরা পেয়েছিলাম নজরুলের প্রথম লেখাতেই। তারপর নজরুল যখন করাচি থেকে এখানে এলেন, তখন আমাদের মুসলমান সমাজে এমন কোনো আশ্রয়স্থল তিনি পাননি, যেখানে থাকলে তিনি তাঁদের সাথে মেলামেশা করতে পারেন বা তাদের হয়ে লিখতে পারেন। এমন কোনো সুযোগ-সুবিধা তিনি পাননি। তিনি মুসলমান সমাজের সাহচর্য বিশেষ পাননি। তার কারণ, আমাদের মুসলমানদের মধ্যে কবি-সাহিত্যিক কম ছিল। তাদের প্রকাশিত পত্রপত্রিকাও ছিল না। কাজেই কংগ্রেস দলের হয়ে যাঁরা রাজনীতি করতেন, তাঁরাও তাঁকে ডাকতেন, আর হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে যাঁরা লেখক, কবি এবং সাহিত্যিক, তাঁরাও তাঁকে টেনে নিতেন। তাঁদের কথাই বলেছেন তিনি তাঁর কবিতার ভেতর দিয়ে। অনেক সময় এমন অনেক কবিতা লিখেছেন, যেগুলো চমকে দিয়েছে মুসলমান সমাজকে। যেমন তাঁর ‘রক্তাম্বরধারিণী মা’ কবিতার কথাই ধরা যেতে পারে। এটা যে তিনি লিখেছিলেন, তাতে মুসলমানদের কিছু যায় আসেনি। তিনি তখন যাঁদের (হিন্দুদের) সাথে ছিলেন, তাঁরা তাঁর খুবই প্রশংসা করেছিলেন। এই লেখার দরুন আমাদের যে সমাজ, ধরুন কট্টর মোল্লা সমাজের কথাই যদি বলি, তাঁরা এসব লেখা সহ্য করতে পারতেন না। নজরুলের এসব প্রগতিশীল লেখার জন্য তাঁরা বলতে শুরু করলেন যে তিনি এসব কী লিখছেন? যত সব হিন্দুয়ানি লেখা! বলতে বলতে এমন অবস্থা হলো যে তাঁর বিরুদ্ধে রীতিমতো অপপ্রচার শুরু করে দিলেন মৌলবি সাহেবরা। তাঁরা বলতে লাগলেন যে, নজরুল ইসলাম যা লিখছেন, তা ইসলাম বিরুদ্ধ। অথচ আমাদের সমাজের সঙ্গে কিন্তু ওইসব লেখার কোনো সম্পর্কই ছিল না। তিনি কীর্তন লিখেছেন কিন্তু একজন মুসলমান লেখকের পক্ষে সফলভাবে কীর্তন লেখা কম কৃতিত্বের কথা নয়। যথেষ্ট কৃতিত্বের কথাই অথচ তাঁরা এ নিয়ে মোটেও ভাবেননি।

তাঁরা বলতেন, তিনি কীর্তন কেন লিখলেন? তিনি শ্যামা সংগীত কেন লিখলেন? এই নিয়ে তাঁরা ঝগড়াবিবাদ করতেন। কিন্তু একজন কবি যেকোনো বিষয় নিয়ে লিখতে পারেন। তার অর্থ এই নয় যে তিনি অন্য ধর্ম অবলম্বন করেছিলেন। ভাই গিরীশচন্দ্র সেন কোরআন শরিফের প্রথম বাংলা অনুবাদ করেছেন, তাতে তো ব্রাহ্মরা তাঁকে বলেনি যে তুই ব্যাটা কোরআন শরিফ কেন অনুবাদ করলি, তোর ধর্ম গেল। এ রকমটা কেউ বলেনি। অনেক ইংরেজ মুসলমান সম্পর্কে, মুসলমানদের ধর্ম ইসলাম সম্পর্কে অনেক বাড়িয়ে লিখেছেন। কিন্তু তারা তো ইংরেজদের বলেনি তোরা মুসলমানদের সম্পর্কে কেন লিখলি? আমাদের সমাজের মোল্লারা খুবই অবিবেচক। নজরুলের লেখার জন্য তাঁরা তাঁর বিরুদ্ধে বহু রকমের ফতোয়া দিয়েছেন, এমনকি ‘কাফের’ বলেও ফতোয়া দিয়েছেন। কিছু বাকি রাখেননি তাঁরা। কিন্তু তাতে করে নজরুলের কিছু এসে যায়নি। আমরা যতই চিত্কার করেছি, তার ফলে তাঁর যে প্রতিভা, তাঁর যে লেখার বা বলার শক্তি, সেটা বরং আরও বেড়েছে। কোনো মতেই কমেনি।

১১. নজরুলকে নিয়ে বিতর্ক

নজরুলকে পৃষ্ঠপোষকতা করার জন্য আমাদের ওপর যে আক্রমণ এসেছে, সেটা ঠিক নজরুল ইসলাম, আমার বা আমাদের সাহিত্যিক গোষ্ঠীর ব্যক্তিগত ব্যাপার হয়ে থাকেনি। এই আক্রমণের মধ্যে একটা মস্তবড় বিষয় ছিল। আমরা বুঝতে পেরেছিলাম যে আমাদের সমাজে প্রগতিশীল, মুক্তবুদ্ধি ও স্বাধীন চিন্তার কোনো লেখক নেই। কাজেই আমরা চেয়েছিলাম যে আমরাও আমাদের সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করব, চিন্তাশীলতার মাধ্যমে, স্বাধীন চিন্তা ও যুক্তির মাধ্যমে সমাজকে, সাহিত্যকে উন্নত করব। এবং এই যে একটা প্রোগ্রাম, কর্মসূচি বা অভিযান, এটা যদি কার্যকর করা যায়, তাহলে তখন যাঁরা লিখতেন অর্থাত্ যাঁরা মুসলমানদের মধ্যে প্রাচীনপন্থী ধারার লেখক-কবি ছিলেন, তাঁরা ভেবে বসলেন যে, আমাদের গোষ্ঠীটা যদি দাঁড়িয়ে যায়, তাদের পায়ের নিচের মাটি যদি শক্ত হয়ে যায়, তাহলে তাদের অর্থাত্ রক্ষণশীল তথা প্রাচীনপন্থীদের কোনো অস্তিত্ব থাকবে না—আমাদের তাদের আক্রমণ করার এটাই ছিল মূল কারণ। তাঁরা মনে করলেন যে আধুনিক লেখকেরা যদি নিজেদের বুদ্ধিবিবেচনামতে কথা বলতে পারে, তাহলে তো আমাদের কোনো মূল্যই থাকবে না। আসলে এই ব্যাপারটাই ঝগড়ার মূল কারণ। নজরুল ইসলাম বা আমাদের গোষ্ঠীর লেখকেরা যখন ইসলামকে, ইসলাম ধর্মকে ব্যবহার করে কিছু লিখেছেন, তখনই কুসংস্কারপন্থীরা হই-হট্টগোল বাধিয়ে দিয়েছেন। তাদের এই রকম হই-হট্টগোল আর মারমুখী প্রবণতার মুখে আমাদের গোষ্ঠীর লেখক-কবিরা যুক্তি দেখিয়ে বলতে চেয়েছেন যে, ইসলাম ধর্ম কি বাস্তবিকই এমন একটা ধর্ম, যা মানুষজনকে কিছুই বুঝতে দেয় না! তাঁরা আরও বলেছেন যে, ইসলাম বলেছে তোমরা বোঝো, আরও বেশি করে বোঝো, পয়গম্বররা বলেছেন, তোমরা প্রশ্ন করো; কিন্তু রক্ষণশীলদের কথা হলো, তোমরা প্রশ্ন করতে পারবে না। যা আছে তাই মুখস্থ করতে হবে। আমাদের দলের যাঁরা তরুণ লেখক, তাঁরা বললেন যে, আমরা ইসলামকে বুঝব এবং ইসলাম কী জিনিস, তা আমাদের সমাজকে বোঝাব। তাদের মনে যে কুসংস্কার, তাদের মনে যে গোঁড়ামি আছে, সেগুলো দূর করতে হবে। গোঁড়ামি মানে ইসলাম নয়, তরুণ সমাজ বলতেন, আমরা সেগুলো দূর করব। এবং দূর করব বলে তাঁরা যখন লিখতে আরম্ভ করলেন, তখনই রক্ষণশীল যাঁরা, তাঁরা বললেন যে, আমাদের আঘাত করা হয়েছে। এবং তাঁরা কুসংস্কারাচ্ছন্ন যে জনসমাজ, সেই সমাজের উদ্দেশ্যে একটা ধর্মের দোহাই দিয়ে বলতে লাগল যে, এই যে নজরুল যা-কিছু লিখছেন, তার সবই অনৈসলামিক, ইসলামবিরুদ্ধ। এভাবে তাঁরা নজরুলকে তথা তরুণ সমাজকে জব্দ করা যাবে বলে মনে করলেন। কাজেই সেভাবেই তাঁরা তাঁদের আক্রমণ শানাতে শুরু করলেন।

১২. সওগাত-এর সমালোচনা

বস্তুত আমি সওগাত যখন আরম্ভ করি, তখন মোহাম্মদী পত্রিকার সম্পাদক বা কর্তৃপক্ষ ভাবতেও পারেনি যে বাংলা ভাষায় এ ধরনের কোনো পত্রিকা দুই মাসও টিকে থাকতে পারবে। তাদের ধারণা ছিল, ওর যা ইচ্ছা তা-ই করুক। আমরা এ নিয়ে কিছু করব না বা বলব না। মুখোমুখি হলে বলত ভালো কাজই করেছ। তাদের আরও ধারণা ছিল যে, এই লোকটা যা করতে যাচ্ছে, এই সমাজে তা চলতে পারে না বা চলবে না। প্রথম দিকে সে কারণেই তাঁরা এসব কিছু উপেক্ষা করেছেন আর আমাকে মুখে মুখে প্রশংসা করেছেন। বার্ষিক সওগাত যখন বের করলাম, তখন মওলানা আকরম খাঁ সাহেব আমাদের আশীর্বাদ জানালেন এই বলে যে মুসলমান সমাজের এই অধঃপতিত সমাজে ইনি যে প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন, সেটা খুব ভালো একটা কাজ। একথা আমি লিখেওছি বার্ষিক সওগাত-এ।

১৩. নতুন লেখকের আবির্ভাব

এ সব করতে করতে একপর্যায়ে এসে আমাদের ভেতর থেকে আমাদের সাহিত্যের ক্ষেত্রে শক্তিশালী বেশ কিছু লেখক আবির্ভূত হলেন। ব্যাপারটা দেখে তাঁরা মানে রক্ষণশীলরা ভাবলেন যে এরা যদি এভাবে আরও এগিয়ে যান, তাহলে তাদের অর্থাত্ রক্ষণশীলদের, সেকেলেদের আর কোনো অস্তিত্বই থাকবে না এবং এটাই ছিল সংঘাতের মূল কারণ। আসলে ব্যক্তিগত কারণে এটা হয়নি। ব্যক্তিগত কারণটা তখনই দেখা দিয়েছে, যখন তাঁরা মনে করলেন যে, নজরুল যদি এভাবে উঠে যান, তাহলে ছোটখাটো কবি যাঁরা, তাঁদের আর কোনো অস্তিত্বই থাকবে না। আসলে হয়েও ছিল তা-ই। নজরুলের সঙ্গে তরুণদের দল যতই এগিয়ে চলল, তাঁদের একটু আগে থেকে যাঁরা কবিতা লিখতেন— যেমন গোলাম মোস্তফাসহ আরও কারও কারও ধারণা হলো যে নজরুল যা লিখছে, সেগুলো তো ঠিক কবিতা হচ্ছে না। তবে পদ্য ভালো হচ্ছে। এই ধারণা ছিল তাদের। এই দলে আরও অনেকে ছিলেন, নাম বলব না। গোলাম মোস্তফা তো ভালো ছিলেন। অনেক কিছু লিখেছেন, কিন্তু অন্য আর যাঁরা কবিতা লিখতেন, তাঁরা এই আধুনিক কবিতা লেখকদের পাত্তাই দেননি এবং এখান থেকেই অসুবিধার সৃষ্টি হয়েছিল। আমাদের সাহিত্য জগত্ স্পষ্ট দুটো ভাগে ভাগ হয়ে গেল। একটা রক্ষণশীলদের দল আর একটা আমাদের আধুনিক প্রগতিশীলদের দল। আমাদের সাহিত্য জগতের যা-কিছু উন্নতি দেখছেন বা যেসব শক্তিশালী সাহিত্যিক গোষ্ঠীর সৃষ্টি হয়েছে, তার মূলে কিন্তু প্রগতিশীলরা। তবে এসব কিছু এক দিনে হয়নি। এই সূত্রেই একে একে আমাদের সাহিত্য জগতে প্রথমে এলেন মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী, তারপর এলেন আবুল মনসুর আহমদ। তারপর এলেন আবুল কালাম শামসুদ্দীন, এস ওয়াজেদ আলি, বরকতুল্লাহর মতো ধীমান লেখকেরা। এ রকমভাবে আস্তে আস্তে তাঁদের আগমন ঘটল, যাঁদের শক্তি ছিল, তাঁদের সবাই একে একে সাহিত্য ক্ষেত্রে এসে দাঁড়িয়ে গেলেন। কাজেই এই যে আমাদের দলটা ছিল, যতই ঝগড়া হোক না কেন, তাঁদের রুখতে পারা যায়নি। আর যাঁরা কলহ করেছেন, তাঁরা আর কোনো দিন উঠতে পারেননি। তাঁরা যদি প্রগতিশীল তরুণ সমাজকে এ কথা না বলতেন যে, এরা ধর্মবিরুদ্ধ কাজ করছে, এরা মুসলমান নয়, এরা মেয়েদের ছবি ছাপছে, এরা গানবাজনা করছে, এরা মঞ্চে নাচছে, নাচ শিখছে—এ ধরনের কথা যদি তাঁরা না বলতেন, এই কলহটা যদি না হতো, তাহলে আমরা এত সহজে উঠতে পারতাম না। এবং তাঁদের এই আক্রমণের ফলেই যাঁরা আধুনিক স্কুল-কলেজে পড়ে বা যারা একটু শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয়েছিলেন, তাঁরা এসব লেখা পড়ে বেশ আনন্দ উপভোগ করলেন। তাঁরা এঁদেরকে খুব উত্সাহ দিলেন। বললেন, এ ধরনের লেখা আরও বেশি বেশি করে লিখতে। কাজেই আমাদের প্রগতিশীল লেখক-কবিরা আরও বেশি বেশি উত্সাহ পেলেন। আর যাঁরা ধর্ম নিয়ে কলহ করেছেন, ধর্ম গেল, সমাজ গেল বলে বলে যাঁরা প্রতিনিয়তই শোরগোল তুলেছেন, তাঁদের অস্তিত্ব আস্তে আস্তে লুপ্ত হয়ে গেল। আরও আশ্চর্যের বিষয়, যাঁরা নজরুলকে ‘কাফের’ বলেছেন, এমন একটা সময় এল, যখন তাঁরা নজরুলের একটা লেখা পাওয়ার জন্য তাঁর বাড়িতে দিন-রাত ঘুরঘুর করেছেন। ফলে, আমি বলব যে, শেষ পর্যন্ত আমাদের প্রগতিশীল লেখকদেরই জয় হয়েছে। আপনারা শুনে আরও অবাক হবেন যে, যে সময়ের কথা বলছি, তখন মুসলমানদের উদ্যোগে প্রকাশিত একটা কাগজের ৫০০ গ্রাহক হওয়াটা ছিল একটা উল্লেখ করার মতো ঘটনা। কিন্তু একসময় যখন আমাদের কাগজের সতেরো হাজার গ্রাহক হয়েছে, তখন পোস্ট অফিস থেকে আমাদের এই বলে চিঠি দেওয়া হতো যে আপনাদের সওগাত  যদি পোস্টিং করতে হয়, তাহলে দুই-তিন দিন আগে আমাদের জানাতে হবে। কারণ এত বেশি প্যাকেট হ্যান্ডল করার মতো লোক আমাদের নেই। কাজেই সেদিন হেড অফিস থেকে আমরা স্পেশাল লোক এনে রাখব। এবং আরও অবাক হওয়ার ব্যাপার এই যে আমাদের গ্রাহক সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রক্ষণশীল দলের কাগজ তখন আর চলল না—এটা একটা দারুণ ব্যাপার। এই ব্যাপারটার একটা ঐতিহাসিক মূল্য ছিল। তার মানে তখন আমরা জাগ্রত হয়েছি, আমাদের কবি-সাহিত্যিক, সাহিত্য জগত্ জাগ্রত হয়েছে, আমাদের পাঠকসমাজ জাগ্রত হয়েছে। সওগাত-এর কল্যাণে নজরুল এবং তাদের দলের কার্যকলাপ এবং লেখনির প্রভাবে, তাঁর কবিতা এবং গানের মাধ্যমে, বলা যেতে পারে, একটা নিদ্রিত সমাজকে তখন আঘাত করা হয়েছিল।

১৪. সওগাত-এর প্রথম পর্যায়ের লেখা

প্রথম আমি যখন সওগাত বের করলাম, তখন আমি ভালো লেখক পাইনি। সেই রক্ষণশীল দলের লেখক যাঁরা ছিলেন, তাঁদের সেই একঘেয়ে লেখাই ছাপাতাম। কারণ মুসলমান সমাজে সে রকম লেখক তখন পর্যন্ত সৃষ্টি হয়নি। আর লেখকেরাও তখন সুযোগ পাননি। চিন্তাভাবনা করলেও তেমন কিছু লেখার সুযোগ তাঁরা পাননি। মনে করতেন, ও রকম কিছু যদি আমি লিখি, তাহলে লোকে আমাকে নিন্দা করবে। আমি অপমানিত হব। তখন আমাদের সমাজটাই ছিল এ রকমের। কাজেই আমাদের মধ্যে যাদের শক্তি ছিল, তাঁরাও তখন লেখেননি। আমি তখন মনে করলাম যে এ ধরনের লেখাই আমি ছাপব। তখন আমি লেখার মতো উপযুক্ত লোক খুঁজে পাইনি। ফলে আমার খুব অসুবিধা হয়েছিল।

বলতেই হবে, প্রথম তিন বছরে আমার মূল উদ্দেশ্য সাধিত হয়নি। ফলে আমার অনেক আর্থিক ক্ষতি হয়। আমার মনে হয়, সওগাত তখন জোর এক হাজার কপি ছাপা হতো। তখন আমি কিছুদিন কাগজটা বন্ধ রেখে দিয়ে লোক জোগাড় করার চেষ্টা করতে লাগলাম। আমার পরিকল্পনা আমি নতুন করে সবকিছু আরম্ভ করব। ফলে আমি আবার লাইফ ইন্স্যুরেন্সের চাকরি নিলাম। তবে আমি জানতাম যে যারা চাকরি করে তারা সাধারণত কোনো দায়িত্ব নিতে পারে না। সাধারণত দায়িত্বটা এভাবে নিতে হয় যে যত বিপদই আসুক, এটা আমি চালাবই—এ ধরনের মনোভাব না থাকলে এ জাতীয় কাজ করা যায় না। চাকরিতে থাকা অবস্থাতেও আমার মাথায় কী যে ব্যারাম ঢুকল, আমার কেবলই ভাবনা আমাদের সাহিত্য নেই কেন? সাহিত্যিক নেই কেন? এই যে একটা ব্যারাম, এই যে একটা চিন্তা—এটা ছাড়া আমার আর অন্য কোনো চিন্তা ছিল না। কাজেই এই কাজটা আমি কোনো লাভের আশায় করিনি। এটা যে লাভজনক কাজ নয়, সেটা সকলেই জানে। এবং এ কাজের পরিণতি কী হবে, আমি জানতাম না। কোনো লাভ-লোকসানের চিন্তা আমার মাথায় ঢোকেনি। কী করে সওগাত বের করব, কী করে লেখক সৃষ্টি হবে, কী করে লেখিকা সৃষ্টি হবে—এই চিন্তাতেই আমি বিভোর ছিলাম। এবং এখন পর্যন্ত এ চিন্তা আমাকে ছেড়ে যায়নি।

১৫. মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী

কাগজ বন্ধ রেখে দ্বিতীয়বার যখন তার প্রকাশনা শুরু করি, তখন প্রথম পেলাম মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলীকে। তিনি মোহাম্মদী অফিসে চাকরি করতেন। ওখানে চাকরি করলেও তিনি স্বাধীনভাবে চিন্তা করতেন। স্বাধীনভাবে লিখতেন; কিন্তু সে লেখা মোহাম্মদী-তে ছাপা হতো না। এই নিয়ে তিনি খুব মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করছিলেন। কোনো সাহিত্যিককে যদি ক্ষুদ্র গণ্ডির বৃত্তে ধরে রাখতে চান, এবং তাঁকে যদি বলেন, কেবল এ ধরনের লেখাই লিখবেন, তাহলে সারা জীবনেও তিনি আর সাহিত্যিক হতে পারবেন না। আমার মনে সব সময় এ ধরনের একটা বিশ্বাস কাজ করেছে। মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী তখন মোহাম্মদী  অফিস থেকে আমার এখানে চলে এলেন। এ প্রসঙ্গে একটা অপ্রীতিকর ঘটনার কথা না বললেই নয়। মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী যখন মোহাম্মদী  অফিসে চাকরি করতেন, তখন বাইরের একটা পার্টির সঙ্গে তাঁর চুক্তি হয়। পার্টি তাঁকে বলল যে, আপনি একটা বই লিখবেন, আমরা সেটা ছাপব। উনি কিছু টাকা পেয়ে তার প্রস্তাব মেনে নিলেন এই মর্মে। বিজ্ঞাপনও দেওয়া হলো যে, এ রকমের একটা বই বেরুচ্ছে, তার গ্রাহক করা হবে। অনেকে টাকা পাঠালেন। কিন্তু বইটা আর বের হলো না। ফলে গ্রাহকদের কেউ হয়তো এই বলে পুলিশে খবর দিল যে, এরা প্রতারক। বই ছাপার কথা বলেও বই ছাপেনি। অথচ টাকা নিয়েছে। কিন্তু ওয়াজেদ আলী এসবের কিছুই জানতেন না। কোম্পানির নাম ছিল মিনার কোম্পানি এবং তারাই এটার জন্য দায়ী। কিন্তু পুলিশ এসে লেখককে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে গেল। থানায় নিয়ে যাওয়াতে কে-বা কারা দৌড়ে গেলেন মওলানা আকরম খাঁর কাছে। গিয়ে তাঁকে তাঁরা অনুরোধ করল যে তাঁকে থানা থেকে জামিনে নিয়ে আসুন। উনি বললেন, লোকটা বড় বেয়াড়া। ও  তো যা-ইচ্ছে তাই লেখে। আমি এসবের মধ্যে যাব না। তখন একজন লোক দৌড়ে এলেন সওগাত অফিসে। এর আগে ওয়াজেদ আলীকে সামনাসামনি দেখিনি। কিন্তু একজন সাহিত্যিকের বিপদ। তাঁর লেখাও পড়েছি। তখন একটা ট্যাক্সি করে গেলাম বেনিয়াপুকুর থানায়। এই তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা। আমাকে দেখে তিনি হু-হু করে কাঁদতে আরম্ভ করলেন। বললাম, আপনি চিন্তা করবেন না। নিশ্চিন্তে থাকেন। ওসিকে জিজ্ঞেস করলাম এ দেশে যদি একজন কবি-সাহিত্যিকের এই দশা হয়, তাহলে আমরা যাব কোথায়? আপনি তাকে গ্রেপ্তার করলেন একটা চিঠির ওপর নির্ভর করে!

ওসি বললেন, সুপারিশ ছিল কোনো পুলিশ অফিসার বা অন্য কারও। এ কথা শুনে আমি বললাম, আমি তার জামিনদার হব। আপনি জামিন দেবেন?

ওসি বললেন, আপনি তো সওগাত-এর মালিক, তাই না?

আমি বলি, হ্যাঁ।

শুনে তিনি বললেন, আপনাকে আমরা জামিন দিতে পারি না এ জন্যে যে কলকাতায় আপনার কোনো বাড়িঘর নেই। যাদের ল্যান্ড প্রপার্টি আছে, কেবল তাকেই জামিনদার করার নিয়ম আমাদের। আপনি যদি একজন উকিল বা মোক্তার আনতে পারেন, তাহলে আর কোনো অসুবিধা হবে না।

আমি তখনো ট্যাক্সিটা ছাড়িনি।

ড্রাইভার বললেন, আমার জানা একজন মুসলমান মোক্তার আছেন। খুব ভালো লোক।

তাঁর কথামতো গেলাম তার কাছে। তখন দু-একজন মুসলমান মোক্তার ছিলেন। খুঁজতে খুঁজতে গিয়ে শুনি যে, তিনি বাড়ি চলে গেছেন। বাড়ি কোথায়? জানা গেল অমুক জায়গায় গ্রামের ভেতরে। খুব কষ্ট করে ওখানে গিয়ে দেখি মোক্তার সাহেব বাড়িতে নেই। বলি, কোথায় গেছেন?

জানানো হলো, কোর্ট থেকে এখনও তিনি আসেননি। একটুক্ষণ বসলাম। বসার পর মোক্তার সাহেব এলেন। আমি তাকে বললাম, আসসালামু আলাইকুম।

ওয়াআলাইকুম আসসালাম, মোক্তার সাহেব আমার মুখের দিকে তাকান। বলেন, কী ব্যাপার?

তাকে বলি ঘটনার আদ্যোপান্ত।

শুনেটুনে তিনি বললেন, আপনি সওগাত-এর এডিটর নাসিরউদ্দীন সাহেব না?

বলি, হ্যাঁ।

তিনি আর কোনো কথা না বাড়িয়ে সোজা থানায় এসে জামিনদার হলেন। অবশ্য পরে ওই কেসে কিছু হয়নি।

ওয়াজেদ আলীর বইটা ছিল মুসলিম ইতিহাসের ওপর। তিনি আমাকে জানিয়েছিলেন, বইটার যেখানে যেখানে চিন্তার খোরাক ছিল, জাতির জন্য যা উপকারী হতে পারত, সেই জায়গাগুলো মওলানা আকরম খাঁ ছেঁটে ফেলে দিয়েছিলেন। তিনি ওয়াজেদ আলীকে বলেছিলেন, ইসলামি লেখা লেখেন। ওসব ছেড়ে দেন। তাই তাঁর সঙ্গে আমার আর বনিবনা হচ্ছে না।

আমি বললাম, আমি সওগাত আবার বের করব। আপনার মতো যদি তিন-চারজন লোক পাই, তা হলেই আমার কাগজ চলবে।

১৬. আবুল মনসুর আহমদ

এটা বাংলা ১৩৩২ আর ইংরেজি ১৯২৬ সালের কথা। ওয়াজেদ আলী সাহেব এসে সওগাত-এ যোগ দিলেন। আর তাঁর সঙ্গে এসে জুটলেন আবুল মনসুর আহমদ। আবুল মনসুরের কথা ছিল, আমি অনেক বিষয় নিয়ে চিন্তা করি। আমার মাথায় এসব চিন্তা সব সময় কিলবিল করে। কিন্তু কথা হলো আমার লেখা কেউ ছাপবে না।

আমি বলি, কেন ছাপবে না?

তিনি বললেন, মুসলমান সমাজে এমন কোনো কাগজ নেই যারা আমার লেখা ছাপবে। কারণ, আমি প্রথমেই আক্রমণ করব কুসংস্কারের বিরুদ্ধে, ভণ্ডামির বিরুদ্ধে, এই সংসারে যত ভণ্ড আছে, তাদের বিরুদ্ধে। বলুন ভণ্ডরা কি তাদের কাগজে ছাপবে এ রকমের লেখা? এসবই বললেন আবুল মনসুর আহমদ।

আমি বললাম, আমি ছাপাব আপনার লেখা। আপনি আমাদের সঙ্গে থাকেন।

তিনি বললেন, আপনি যে ছাপবেন আপনাকে তারা পিটুনি দেবে।

আমি বললাম, তাহলে তো আর সাহিত্যকর্ম করা যাবে না। পিটুনির ভয়ে যদি সমাজের কুসংস্কারের বিরুদ্ধে কথা না বলি, তাহলে এ পথে আমার চলাই উচিত হবে না।

মনসুর সাহেব কতক্ষণ ভেবে বললেন, আপনি বেশ সাহস করেছেন। ঠিক আছে, আমি লিখব।

এরপর তিনি লেখা দিলেন। নাম ‘লীডরে কওম’! তারপর ‘হুযুর কেবলা’। তার মানে আবুল মনসুর আহমদের আয়না বইতে যত ব্যঙ্গ রচনা আছে, তার সবই আমি তাঁকে দিয়ে লিখিয়েছি। এ ছাড়া আরও অনেক লেখা আছে। তার সঙ্গে সঙ্গে এলেন আবুল কালাম শামসুদ্দীন। আর এদিকে ছিলেন খান মুহাম্মদ মঈনুদ্দীন, আমাদের কলেজ সহপাঠী কবি ফজলুর রহমান, পরে বড় কবি হয়েছেন আর হবীবুল্লাহ বাহার চৌধুরী। হবীবুল্লাহ তখন সম্পাদকীয় লিখতেন। এসব লোক জোগাড় করে আমি ১৯২৬ সালে নতুন করে সওগাত বের করতে শুরু করলাম। তখন আমি একটা জিনিস চালু করলাম, যা এর আগে অন্য কেউ করেননি। আমি মনে করলাম যে একটা সাহিত্য মজলিশ করে তাতে যদি সাহিত্যিকদের আপ্যায়ন করা যায়, তা হলে তাঁরা আরও উত্সাহিত হবেন। কারণ, সাহিত্যিকদের তো টাকা পয়সা দিয়ে খুশি করা যায় না, তাদের মন ভালো রাখতে হবে, তাদের খুশি রাখতে হবে। এ রকম একটা ধারণা নিয়েই আমরা কাজ শুরু করলাম।

১৭. সওগাত-এর নতুন দৃষ্টিভঙ্গি

সিনেমায় যখন কোনো ভালো সিনেমা আসত দল বেঁধে সবাই গিয়ে তা দেখে আসতাম। আমাদের লক্ষ্য ছিল কোরআন-হাদিসের সঠিক তথ্য, তার আসল যা-কিছু, তা মুসলমান সমাজের মধ্যে প্রচার করতে হবে। আর যা-কিছু আধুনিক, সমাজের জন্য তত দরকারি না, তা নিয়ে আমরা মাতামাতি করব না। করিওনি। মূল কথা হলো আমাদের ব্যক্তিগত জীবন, সমাজ এবং জাতির জন্য যেটুকু দরকার, কেবল সেসব কিছুই বেশি বেশি করে প্রচার করা হতো।

আর যারা ইসলাম ধর্ম নিয়ে ভণ্ডামি করবে, তাদের সেই ভণ্ডামির মুখোশ উন্মোচন করা হবে, তাদের ভণ্ডামির বিরুদ্ধে এমন আঘাত হানা হবে, যাতে করে এসব কিছু তারা আর না করে। করার সাহস না পায়। ফলে আমাদের দলভুক্ত লেখকেরা উত্সাহিত হলেন, উদ্দীপিত হলেন। বয়সে তখন তাঁরা সবাই তরুণ। লেখার শক্তি আছে। সেই লেখার শক্তিও প্রবল। এই সময় ফুরফুরা শরিফের পীরসাহেব এই বলে ফতোয়া দিলেন যে, বল খেলা হারাম। লেখকেরা পীর সাহেবের এই বক্তব্যের বিরোধিতা করে এমন লেখা লিখলেন যে, একেবারে তাঁর বারোটা বাজিয়ে ছাড়লেন।

আসলে রক্ষণশীলেরা যা বিশ্বাস করতেন, সেগুলো প্রকৃত ইসলামের চিন্তাধারার সঙ্গে কিছুমাত্র যুক্ত ছিল না। সভ্য জগতেরও কোনো কিছু ছিল না। কাজেই আমি আমার দলভুক্ত লেখকদের বলেছিলাম যার ওপরে ভর দিয়ে জাতি উঠে দাঁড়াতে পারবে, ঠিক সেভাবেই প্রচারটা চালান—এটাই ছিল আমার বক্তব্য।

তখনকার দিনে আবুল মনসুর আহমদ ও তাঁর সতীর্থ আর যেসব লেখক ছিলেন, তাঁদের সবাই এই ভণ্ডামির বিরুদ্ধে কলম ধরেছিলেন এবং জোরেশোরেই তাঁদের সেই লেখনী-অভিযান চালিয়ে গিয়েছিলেন। আবুল মনসুর সাহেবই এ ব্যাপারে বেশি উদ্যমী ছিলেন। তিনি যখন হুযুর কেবলা লিখলেন, তখন রক্ষণশীলরা বা আরও একটু বেশি বিশেষণ যোগ করে বলতে গেলে বলতে হয় কাঠমোল্লারা ভীষণ খেপে গিয়েছিলেন। আবার যখন লীডরে কওম লিখলেন মওলানা আকরম খাঁকে লক্ষ করে, সেটা তাঁরা সহ্য করতে পারেননি। তাঁরা খুব উত্তেজিত হয়ে গিয়েছিলেন, এবং চারদিকে এমন উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছিল যে, সওগাত-কে তাঁরা একটা বিভীষিকা বলেই মনে করতেন। একটা মাসিক কাগজকে নিয়ে এ রকম আলোড়ন বা আন্দোলন খুব কমই হয়। কিন্তু সে সময় এসব শক্তিশালী লেখক সমাজের কুকর্ম ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে আঘাত দেওয়ার ফলে সারাটা সমাজ যেন গা ঝাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা করল।

তখন আমাদের ভয়ানক সাহস দেখাতে হয়েছিল। অফিসের কাজ শেষে বিকেলে বাসায় ফিরতে পারব কি-না, তার কোনো নিশ্চয়তা ছিল না। তবে আমরা বুঝেছিলাম যে এ টুকু ঝুঁকি না নিলে কাজ হবে না। কাজ করতে হলে এ টুকু দায়িত্ব তো নিতেই হবে। এ রকম কাজ করে যদি কেউ মারাও যায়, তবু তো বলবে, লিখে রাখবে যে লোকটা এ রকম একটা কাজ করেছিল। এ কাজের জন্য সে মারা গেছে। তাতেও একটা লাভ আছে। আর এ রকম কিছু না করে জীবনটা কাটিয়ে দিলাম, তার কোনো মানেই হয় না।

যা-ই হোক, আমি সাধারণত যাঁরা রাজনীতি করেন, সভা-সমাবেশ করেন, তাঁদের সঙ্গে বেশি মিশতাম না। কারণ, তাঁদের কাজই হলো ওসব করা। আর আমরা যারা ব্যবসা করি, পত্রিকা চালাই, প্রেস চালাই, তারা যদি ওসব করতে যাই, তাহলে আমাদের কারবার বা পত্রিকা ফেল করবে। এ ধারণা আমার মনে এখনো খুবই দৃঢ়। নজরুলের সঙ্গে আমার যেমন দীর্ঘদিনের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, তাঁর অসুস্থ হওয়ার আগ পর্যন্ত আমাদের সেই বন্ধুত্ব অটুট ছিল।

১৮. এ কে ফজলুল হকের সঙ্গে নানা প্রসঙ্গ

এ কে ফজলুল হক সাহেবের সঙ্গেও সে রকম একদিন হঠাত্ করেই আমার দেখা হয়ে যায়। কথাবার্তাও হয়। এর আগে তাঁর মতো এত বড় নেতার সঙ্গে কোনো দিন আমার দেখা-সক্ষাত্ হয়নি। কারণ, আমি আগেই বলেছি, সমাজের যাঁরা নেতা বা লিডার, তাঁদের কাছে বেশি যেতাম না। ফজলুল হক সাহেবের বাড়ি ছিল তালতলা রোডে। তাঁর বাড়ির পাশের একটা বাড়ি আমি ভাড়া নিয়েছিলাম। তাঁর বাড়ির সঙ্গে আমার বাড়ির ব্যবধান ছিল মাত্র চার ফুট সরু একটা গলির। আমি সেখানে নিচের তলায় থাকতাম। ফজলুল হক সাহেবের নিজের বাড়ি ছিল ঝাউতলায়; কিন্তু সেখানে এত লোকের ভিড় আর এত হই-হল্লা হতো যে, আমি কোনো দিন ওসবের মধ্যে যাইনি। একদিন আমি আমার গাড়ি চালু করার চেষ্টা করছিলাম; কিন্তু স্টার্ট নিচ্ছিল না কিছুতেই। হক সাহেব ওপর থেকে দেখে বললেন, ‘কী গাড়ি স্টার্ট নিচ্ছে না!’ এই বলে উনি নিচে এসে প্রথমেই আমার কাঁধের ওপর হাত রেখে বললেন, পাশের বাড়িতে আপনি থাকেন। আমার স্ত্রী জিনাতুন্নেসা আপনার পত্রিকার নিয়মিত পাঠিকা। সওগাত  আমার ঘরে এখনো বাঁধাই করা আছে। আর আপনি কি-না আমার বাড়িতে একদিনও এলেন না। দেখাও করলেন না! এটা কী রকম ব্যাপার, বলুন তো!

আমি বলি, আমি তো একজন ব্যস্তসমস্ত মানুষ, আর আমি সাধারণত বড় লোকদের বাড়িতে যাই না।

উনি বললেন, ‘মনে কষ্ট পেলাম আপনার কথা শুনে। এই দুঃখ আমার মন থেকে যাবে না। এ পৃথিবীতে আমার চেয়ে গরিব আর কেউ নেই।’ কথাটা শেষ করেই বললেন, ‘সন্ধ্যার পর আপনি আমার এখানেই খাবেন।’

আমি তাঁর দাওয়াত কবুল করলাম।

উনি আরও বললেন, ‘জানেন, আমার নামে কয়টা মামলা আছে? কয়টা ওয়ারেন্ট আছে? আমি দেনার দায়ে ডুবে রয়েছি। আমি বাড়ি থেকে পালিয়ে বেড়াই। আমার নামে কোর্ট থেকে ওয়ারেন্ট আসে। রাতের বেলা আমি ঘুমাই না। একটা টেবিলের ওপর কোনো মতে মাথা রেখে সারা রাত আমি কাত হয়ে পড়ে থাকি।’

বললাম, এত কিছু তো আমি জানতাম না।

এসবই বরিশালে স্যার নাজিমউদ্দিনের সঙ্গে তাঁর ভোটযুদ্ধ হওয়ার মাস কয়েক আগেকার কথা। প্রথম যখন স্বায়ত্তশাসনের ওপর ভোট হলো, ঠিক তখনকার কথা। সাক্ষাতে উনি বললেন, ‘আমি একটা কথা বলার জন্য আপনাকে ডেকেছি। আসেন, আগে খাওয়াদাওয়া করে নিই।’

খাওয়াদাওয়া শেষ হলে আমার হাতে টাইপ করা একটা কাগজ তুলে দিয়ে তিনি বললেন, ‘আমি কৃষক প্রজা পার্টির পক্ষ থেকে দাঁড়াব আর গরিবের ডাল-ভাতের সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করব। এটাই হলো আমার নির্বাচনী প্রচারের মূল কথা। গরিবের জন্য আমি খাটব, কৃষক প্রজা পার্টির জন্য কাজ করব; কিন্তু আমার মুশকিল হলো যে, যখন মুসলমানের কথা বলি, তখন হিন্দুরা বলে সাম্প্রদায়িক, আবার যখন হিন্দুদের কথা বলি, তখন মুসলমানরা দেয় গাল। দেখেন আমার সমস্যাটা তাহলে কী রকম! কাজেই আমি যে কথাগুলো বলি, আমি ঠিকই বলি; কিন্তু বুঝবার ভুলে লোকজন আমাকে এ রকমভাবে নাস্তানাবুদ করে ছাড়ে। কাগজে নানা ধরনের লেখালেখি হয়।’

ফজলুল হক সাহেবের কথা শুনে আমি বলি, যারা কাজ করে যারা কর্মী, তারা এসব কথা গায়ে মাখে না। তারা কাজ করেই যায়।

উনি বললেন, ‘খুব খুশি হলাম। আপনি আমার এই প্রোগ্রামটা একবার দেখেন।’

দেখলাম এ দেশের গরিবদের জন্য, কৃষক-প্রজাদের উন্নতির জন্য কী কী করা যায়, এসব লেখা আছে হাতে লেখা নির্বাচনী কর্মসূচিতে। আমি বললাম, আপনার নির্বাচনী-কর্মসূচির সঙ্গে আমার সওগাত-এর লক্ষ্যের অনেকটা মিল আছে। আমিও সাহিত্যের মাধ্যমে সমাজের কুসংস্কার, কৃষকের উন্নতি, জাতির উন্নতি—এগুলো চাই। কাজেই আপনার কর্মসূচি আমার খুব ভালো লেগেছে।

উনি বললেন, ‘আমি যে ইলেকশন করব, তার প্রচারকাজের জন্য আমার নিজস্ব প্রেস, টাকাপয়সা নেই। খরচ জোগাতে পারছি না। আপনি আমার জন্য কী করতে পারেন?’

আমি বললাম, আমারও পকেট খালি, তবে আপনার যে উদ্দেশ্য সেটা আমি সমর্থন করলাম এবং আমার প্রেসে ছাপার যাবতীয় বিল আপনি নির্বাচনের পরে দিতে পারেন।

তিনি বললেন, ‘তাহলে তো একটা সমস্যা মিটল। তবে কাগজ পাব কোথা থেকে, কীভাবে?’

আমি বললাম, দেখি ভোলানাথ দত্তের ওখান থেকে কাগজ আনতে পারি কি না। দোকানে গিয়ে বলি যে হক সাহেব নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন, আপনি কাগজটা দেবেন।

শুনে দোকান থেকে বলা হলো যে আমার কাছ থেকে কাগজ নিয়েই উনি নবযুগ চালিয়েছিলেন। পাঁচ হাজার টাকা বাকি পড়ে আছে। এখনো দেননি। হাইকোর্টে কেস করেছি। তাঁর নামে ডিক্রি হয়ে আছে; কিন্তু আমি অ্যাকশন নিইনি।

আমি বলি, আপনি এক কাজ করেন, ইলেকশনের জন্য যা কাগজ লাগবে দেন। বিল করবেন সওগাত-এর নামে।

এ কথা শুনে তাঁরা বললেন, তাহলে দিতে পারব।

তারপর ফজলুল হক সাহেব নাজিমুদ্দিন সাহেবের বিরুদ্ধে কী রকম পোস্টার ছাপলেন, তাতে কী লিখলেন, জানেন? লিখলেন, ‘ভাইসব, তোমাদের পোস্ট কার্ডের দাম ছিল এক পয়সা, সেই পোস্ট কার্ডের দাম তিন পয়সা করল কে?—নাজিমুদ্দিন।’

‘ভাইসব, তোমরা যে নুন দিয়া পান্তাভাত খাও, সেই নুনের ওপর ট্যাক্স বসাল কে?—নাজিমুদ্দিন।’ এ ধরনের কথাবার্তাই লিখলেন।

নির্বাচন হলে ১২/১৩ হাজার ভোটের ব্যবধানে হক সাহেব পাস করলেন। নাজিমুদ্দিন সাহেবের পক্ষে গভর্নর নিজে সব ধরনের নির্বাচনী রসদ জুগিয়েছেন। তিনি তাঁকে মোটর লঞ্চ দিয়েছেন, লোকজন দিয়েছেন, নৌকা ভাড়া করে দিয়েছেন। অন্যদিকে ছেঁড়া কাপড় পরে হক সাহেবের পক্ষে গ্রামের ছেলে-ছোকরারা নৌকা ঠেলেছে। ইলেকশনের খবর শুনে আমি আমার পরিচিত লোকজনদের বলি, হক সাহেব জিতেছেন, যাও রাস্তার ধারের রেলিংয়ে রেলিংয়ে মোমবাতি জ্বালাবার ব্যবস্থা করো। ফলে তারা বাতি জ্বালিয়ে উত্সব শুরু করে দেয়। কতক্ষণ পর হক সাহেব রাস্তা থেকে ওপরের দিকে চেয়ে দেখেন অবাক কাণ্ড। দৌড়ে এসেছেন ওপরে। আমি সামনে পড়তেই বলে ওঠেন, এখানে বাতি জ্বালাল কে?

আমি বলি, খবর জানেন না?

বললেন, না তো।

আমি বলি, আপনি এত হাজার ভোটের ব্যবধানে জিতে গেছেন। কথাটা শুনে ওখানে দাঁড়িয়েই দুই হাত তুলে আল্লাহর দরবারে মোনাজাত করলেন তিনি। বললেন, ‘দেখি আমাদের সমাজের জন্য, সকলের জন্য কিছু করতে পারি কি না। চেষ্টা করব।’

তবে নির্বাচনের পর মন্ত্রিসভা করতে গিয়ে তিনি বিপাকে পড়লেন। প্রথমত, তিনি হিন্দুদের ছাড়া মন্ত্রিসভা করতে পারবেন না। দ্বিতীয়ত, তিনি কৃষক প্রজা পার্টির লোক হলেও পার্টিতে যাঁরা আছেন, তাঁদের নিয়ে কাজ করা সম্ভব ছিল না। শেষ পর্যন্ত তিনি বললেন, ‘দেখো, যদি দেশের কাজ করতে হয়, তাহলে শত্রুকে মিত্র বানাতে হবে। তা না হলে কাজ করতে পারবে না।’

আমি তো অবাক হয়ে গেলাম। বললাম, শত্রু কে? বললেন, নাজিমুদ্দিন। তারপর সঙ্গে সঙ্গে বলেন, তাঁকেও মন্ত্রিসভায় নিতে হবে। নাজিমুদ্দিন সাহেব যখন আমার সঙ্গে মন্ত্রিসভায় আসবেন, তখন দুনিয়া দেখবে—আমি প্রধানমন্ত্রী আর নাজিমুদ্দিন আমার সঙ্গে কাজ করছেন। এতবড় একটা ব্যাপার। এ কথা বলার পরপরই তিনি আরও বললেন, ‘আরে, বন্ধু তো বন্ধু আছেই। শত্রুকে যে আপন করতে পারে, আসলে সে-ই বড়।’ এই সাংঘাতিক কথাটা তিনি আমাকে বলেছিলেন। শেষে দেখলাম, ঢাকার নবাব স্যার নাজিমুদ্দিন, মহারাজা মনীন্দ্রচন্দ্র নন্দী, নলিনীরঞ্জন সরকার, সৈয়দ নওশের আলী (এই একজনই কৃষক প্রজা পার্টি থেকে গেলেন)—এঁদের নিয়ে তিনি তাঁর মন্ত্রিসভা গঠন করলেন। এবং আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, হক সাহেব মন্ত্রীদের যাঁকে যা বলতেন, তাঁদের সবাই তা-ই করতেন। কোনো প্রতিবাদ করতেন না। তাঁরা তাঁকে খুবই মানতেন। এই যে তিনি বিরোধী দলের লোক নিয়ে তাঁর মন্ত্রিসভা গঠন করলেন, তাঁদের কেউই কোনো দিন তাঁর বিরোধিতা করেননি। এ দেশে এক অর্থে রাজনীতি করা কোনো লোকের পক্ষেই সম্ভব নয়, যেখানে নীতির কোনো বালাই নেই, যেখানে আমাদের নেতারা সকালে একদিকে তো বিকালে আর একদিকে যান। এসবই খুব খারাপ ব্যাপার। অসুবিধা হয়। তা সত্ত্বেও তিনি জীবনভর এভাবেই চালিয়ে গেছেন। এভাবেই চলেছেন। এমনটা তাঁর পক্ষেই সম্ভব ছিল। আর কারও পক্ষে সম্ভব হতো না। বিশেষ করে, মানুষটা যা-কিছু করতেন, করতেন আন্তরিকতার সঙ্গেই। দরিদ্র মানুষের জন্য ছিল তাঁর অপরিসীম দরদ। আর মুসলমান সমাজের জন্য এমন কাজ নেই, যা তিনি করতে পিছপা হতেন।

একদিন তাকে বললাম, কলকাতার উপকণ্ঠে এক জায়গায় মুসলমান আর হিন্দু গোয়ালাদের মধ্যে ঝগড়া লেগেছে। আপনি না গেলে মারামারি আরও ছড়িয়ে পড়বে।

শুনে বললেন, ‘চলেন এখনই যাই।’

আপনার জামাটা ছেঁড়া, যাওয়ার আগে জামাটা পাল্টে নিলে ভালো হয়।

আমার কথার জবাবে বললেন, জামা যায় না, ফজলুল হক যায়।

আমি আর কিছু বললাম না। সোজা ঘটনাস্থলে চলে এলাম। আসার পর গোয়ালারাও পায়ে পড়ে সালাম করে আর মুসলমানরাও এসে সালাম করে। দুপক্ষই সালাম করে। তখন বেশ মজা হলো।

উনি বললেন, ‘কী নিয়ে তোমাদের ঝগড়া? ব্যাপারটা তোমরা আমার ওপর ছেড়ে দাও। মানো তো?’

ওরা বলল, হ্যাঁ, মানি।

বললেন, ‘যাও, দুপক্ষই হ্যান্ডসেক করো।’

আমি বলি, তাতে কী হলো?

ফজলুল হক সাহেব বললেন, চলেন, বাড়িতে ‘চলেন। দুদিন পর ওদের মধ্যে আপনা-আপনিই মিল হয়ে যাবে।’

আফতাব আলী বলে সিলেটের একজন লোক ছিলেন। তিনি ছিলেন জাহাজের কর্মচারী ইউনিয়নের সেক্রেটারি জেনারেল। তিনি একদিন এসে ফজলুল হক সাহেবকে বললেন, ‘স্যার, আমার একটা মামলা আছে। যেতে হবে।’

বললেন, ‘তোমার কাজ, তখন তো যেতেই হবে।’

মামলা শেষে আফতাব আলী বললেন, ‘আপনাকে টাকা বেশি দিতে পারলাম না। সামান্য কিছু দিলাম।’ টাকা পাওয়ার পর তিনি সেগুলো কিসের ওপর যেন রেখেছিলেন। গোসল করে খাওয়াদাওয়া সারার পর দেখলেন যে, টাকাটা যেখানে রেখেছিলেন, সেখানে নেই। তখন তিনি বললেন, ‘কী আর করা যাবে! আফতাব, আমার রেলের টিকিটটা করে দাও।’

ফজলুল হক একবার মুন্সিগঞ্জ এসেছিলেন মামলা করতে। তিনি যেখানেই যেতেন, তাঁকে দেখার জন্য লোকজন খুবই ভিড় করত। তারাও বলতেন, স্যার, গরিব মানুষ। টাকা বেশি দিতে পারলাম না।

যে যত্সামান্য টাকা তিনি তাঁদের কাছ থেকে পেতেন, সেটা তাঁদেরকেই দিয়ে বলতেন, ‘তোমাদের টাকা তোমরাই নিয়ে নাও।’

এতসব ঘটনা আমার চোখের সামনেই ঘটেছে। তেঁতুলিয়ার একটা মামলার কথা এখানে বলি। তখন হিন্দুদের কোনো মেয়ে যদি কোনো মুসলমানের সঙ্গে বেরিয়ে যেত, তখন বলা হতো মুসলমানরা সব গুন্ডা। আমার মেয়েকে তারা জোর করে ধরে নিয়ে গেছে। তাকে জেলে দাও। তেঁতুলিয়ায় মহিউদ্দিন নামে হক সাহেবের বাড়ির একজন কাজের লোক ছিল। তার সঙ্গে বরিশালের এক উকিলের মেয়ে বেরিয়ে আসে। বেরিয়ে এলে দলের বিরুদ্ধে মামলা করা হলে দল ঘাবড়ে যায়। হক সাহেব বললেন, ‘ঘাবড়িয়ো না। এই কেসটা আমি লড়ব।’

আমাকে বললেন, ‘চলেন, হাইকোর্টে একটা মামলা দেখবেন।’

কোর্টে যাওয়ার পর দেখা গেল, মেয়ের মা-বাবা আর তার আত্মীয়স্বজনদের প্রায় সবাই সেখানে উপস্থিত। হক সাহেব মেয়েকে বললেন, ‘এই মেয়ে, তুমি সত্যি করে বলো তো, মহিউদ্দিন কি তোমাকে ফুসলিয়ে এনেছে? সত্যি কি না, বলো?’

মেয়ে বলল, না ফুসলিয়ে আনেনি।

তবে কী করে এসেছ?

মেয়েটা বলল, ‘আমি নিজের ইচ্ছায় বেরিয়ে এসেছি। আমি আর হিন্দু থাকব না।’

ওর কাছে এগিয়ে গেল ওর মা। মাকে বলল, ‘এই তুমি আমাকে ছুঁয়ো না।’ দিল জোরসে এক ধমক। বাপ এগিয়ে গেলে বাপকেও বলল, ‘আমাকে ছুঁয়ো না। আমি মুসলমান হয়ে গেছি।’ তখন মামলায় মহিউদ্দিন খালাস পেয়ে গেল।

হক সাহেব বললেন, ‘নারী অপহরণের যত মামলা, তার নাইন্টি নাইন পারসেন্ট মামলার রায় হয় মুসলমানদের পক্ষে। হিন্দুসমাজের আচারব্যবহার এত খারাপ যে, তা বলার নয়। বিধবা হলে তার বিয়ে হয় না। হয়তো ১৮ বছরের মেয়ে বিধবা হয়েছে। বিয়ে হয় না। এরাই এদিক-ওদিক চলে যায়। আর যত দোষ চাপে আমাদের মুসলমান সমাজের ঘাড়ে। কাগজে বের হয় যে, মুসলমানরা অসভ্য, মুসলমানরা এটা করছে, সেটা করছে। আপনারাই কাগজে এসব ছাপেন। সে জন্যই আমি আপনাকে এখানে ডেকে এনেছি।’

দেখেন, কী রকম দূরদর্শী ছিলেন হক সাহেব। তারপর আমরা মহিউদ্দিনের ঘটনাটা সাপ্তাহিক বেগম-এ ছেপে দিই। উনি দেখে বলেছিলেন, ‘সাব্বাশ!’

নির্বাচনের পর ভোলানাথ টাকা না পেয়ে আমার নামে কোর্টে নালিশ করে দিলেন। আমি সমনটা নিয়ে হক সাহেবের ওখানে গিয়ে বলি, দেখুন, কী সর্বনাশা ব্যাপার!

শুনে বললেন, ‘মন্ত্রী হলাম মাত্র কয়দিন হলো। সমনটা পেয়ে আপনারা ঘাবড়াচ্ছেন কেন? আমার নামে তো কোর্ট থেকে ডজন ডজন নোটিশ আসে। আমি তো একদিনও ঘাবড়াইনি।’

আমি বলি, এখন বলেন আমাকে কী করতে হবে?

বললেন, ‘আপনাকে নোটিশ দিয়েছে তো, আপনি চুপ করে থাকেন। আবার নোটিশ পাবেন। তারপর ছয় মাস পর তারিখ পড়বে। আমি এই সময়ের মধ্যে কিছু রোজগার করতে পারব। আপনি এক কাজ করেন, সমনটা আমার জুনিয়রের কাছে রেখে দেন। সে এটার জবাব দিয়ে দেবে। ভোলানাথ দত্ত পাঁচ বছরেও টাকা পাবে না। আর যদি আপনি দিতে চান তো আমি মাইনেটা পেয়ে নিই টাকাটা দিয়ে দেব।’

এরপর অবশ্য টাকাটা তিনি দিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর এত বেশি বিপদ হয়েছিল যে, উনি সামাল দিতে পারতেন না। সেটা হলো এই, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর উনি যা মাইনে পেতেন, তার দশগুণ বেশি তাঁর আত্মীয়স্বজন এসে বলত, এর মেয়ের বিয়ে হয় না—এই সেই নানা কথা। সবাই বাড়িতে ভিড় করতেন আর অনেকে তাঁর বাড়িতে থেকে খাওয়াদাওয়াও করতেন।

আমাদের এলাকায় একটা লোক ছিল। নাম রায় বাহাদুর সুখলাল কার্নানি। খুব বড় ধনী লোক।

হক সাহেব ও সোহরাওয়ার্দী সাহেব যখন রাজনীতি করতেন, তখন কার্নানির কাছ থেকে টাকা আনতেন আর ওদের একটা কিছু টাইটেল দিতেন। তাঁরা আর কিছু চাইতেন না, চাইতেন কেবল সম্মান।

হক সাহেবের মাথা তোলার উপায় ছিল না। দেনায় দেনায় তিনি জর্জরিত। তাঁর এসব দেনা পরিশোধ করবে কে? সবে নির্বাচন করে এসেছেন—বরিশালে দেনা, কলকাতায় দেনা। তিনি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ভাগ্যকুলের রাজারাও তাঁর ওপর  চাপ সৃষ্টি করে তাঁকে দিয়ে দুই একটা কাজ করিয়ে নিতে চাইলেন। তাঁরা সোজা তাঁর কাছে হাজির হয়ে বললেন, টাকা দেন। আর হক সাহেব বললেন, ‘সবুর করেন।’

তারা বললেন, সবুর আর কত করব?

তখন নান্না মিয়া আমাকে বললেন, তারা সবুর করত কিন্তু তাদের উদ্দেশ্য তো ভিন্ন। আসলে উনি প্রধানমন্ত্রী বলে তাঁর ওপর চাপ সৃষ্টি করে তাঁকে দিয়ে তারা তাদের সব কাজ করিয়ে নিতে চায়।

একজন আমাকে বলেছিলেন, যাঁরা রাজনীতি করেন, তাঁরা বিপদে পড়লে রায় বাহাদুর সুখলাল কার্নানি তাঁদের নাকি ঋণমুক্ত করে থাকেন। তাঁকে বলে দেখেন তো হক সাহেবকে ঋণমুক্ত করা যায় কি না? তাঁর কথামতো আমি গেলাম সুখলাল কার্নানির কাছে। যাওয়ার পর তিনি বললেন, ‘আপনি কে?’

বললাম, সওগাত নামে আমার একটা কাগজ আছে। প্রেস আছে। আর হক সাহেব আমার খুব বন্ধু মানুষ।

শুনে তিনি বললেন, ‘ফজলুল হক সাহেবের কাছে তো আমি কয়েক হাজার টাকা পাব। সেই টাকা তিনি আর দেননি। হাইকোর্টে নালিশ হয়েছিল, ডিক্রি হয়ে পড়ে আছে। আমি আর কিছু করিনি।’

বললাম, কার্নানি সাহেব, একটা মুশকিল আছে।

বললেন, কী?

বলি, হক সাহেব যদি প্রধানমন্ত্রী থাকেন, হিন্দুদের অনেক উন্নতি হবে। আর নাজিমুদ্দিন যদি প্রধানমন্ত্রী হন, হিন্দুদের শেষ করে ফেলবেন। কারণ, উনি সাম্প্রদায়িক, আর হক সাহেব সাম্প্রদায়িক নন। ব্যাপারটা চিন্তা করে দেখেন। আপনার তো টাকার অভাব নাই। আমি প্রস্তাব দিচ্ছি ওনাকে ঋণমুক্ত করা হলে উনি নিশ্চিন্ত মনে আপনাদের সমাজের জন্য কাজ করতে পারবেন।

বললেন, ‘বলেন কত টাকা?’

বললাম, কত আর হবে, সব সুদ্ধ এক লাখ হতে পারে।

বললেন, ‘এক লাখ টাকা—এ আর এমন কি! কিছুই না।’ বলেই একটু ভেবে বললেন, ‘আমি কাল সকালে আপনার বাড়ি যাব। কোথায় থাকেন আপনি?’

আমি বলি, হক সাহেবের পাশের বাড়িতে।

বললেন, ‘আমি একটু ভেবেচিন্তে নিই। কাল সকালে আপনাদের ওখানে যাব।’

কথামতো কার্নানি সাহেব পরদিন সকাল নটার সময় বিরাট একটা গাড়ি চেপে হাজির হলেন। তাঁকে অভ্যর্থনা জানিয়ে আমি বললাম, হক সাহেবের ওখানে যান।

বললেন, ‘না, ওখানে যাব না। আমি আপনার সঙ্গে আগে কথা বলব।’ বললেন, ‘তাঁর কাছে কে কত টাকা পাবেন, তার একটা তালিকা করে আপনি আমার কাছে দেন। আমি ধাপে ধাপে সবাইকে টাকা দিয়ে দেব। টাকাটা আমি পাওনাদারকে সরাসরি দেব।’

বললাম, ভালো কথা। আমি তালিকা করে আপনাকে জানাব।

রাতে আমি হক সাহেবের কাছে গিয়ে বললাম, রায় বাহাদুর সুখলাল এসেছিলেন।

বললেন, ‘আরে উনি তো আমার কাছে টাকা পাবেন। আমি তো টাকা দিইনি।’

বললাম, সে কথাই তো আপনাকে বলছি। উনি কী বললেন জানেন, আপনার সব দেনা তিনি শোধ করে দেবেন।

ফজলুল হক সাহেব অবাক হলেন, আগেরই তো অনেক টাকা পাবেন তিনি। আবারও নতুন করে টাকা দেবেন!

আমি বলি, সবকিছু আমি দেখব। আপনি কেবল পাওনাদারদের তালিকাটা দেবেন।

বললেন, ‘আমি তো বলতে পারব না কে কে আমার কাছে টাকা পাবে। যে চেয়েছে তাকেই দিয়েছি। আবার যেখান থেকে এনেছি, তাকে আর দিইনি। আমি টাকা এনেছি। এনে আমার পকেট থেকে সেই টাকা আরেকজনকে দিয়ে দিয়েছি। কিন্তু আমার কাছে কোনো হিসাব নেই।’

ফজলুল হক সাহেবের একজন অ্যাটর্নি ছিলেন। নাম সুখময় দত্ত। তাঁকে ডাকলেন আর চরণ দাস নামের একজন জুনিয়র উকিল ছিলেন, তাঁদের ডেকে এনে তিনি বললেন, ‘তোমরা তালিকা করে দেখো তো আমার কাছে কে কত টাকা পাবে!’

তাঁর নির্দেশে তাঁরা দুজন কে কত টাকা পাবে তার একটা তালিকা করে নিয়ে এলেন।

তালিকাটা পাওয়ার পর আমি রায় বাহাদুরের সঙ্গে কথা বলতে গেলাম। সেটা দেখে তিনি বললেন, ‘এক দিনে একজনের বেশি পাওনাদারকে আমি টাকা দিতে পারব না।’

তিনি আরও বললেন, ‘আগে ভাগ্যকুলের রাজাকে ধরেন দেখি। ব্যাটা কত পাবে! বড় বেশি বাড়াবাড়ি শুরু করে দিয়েছে।’

এই হলো কাহিনি। আর নির্বাচনের সময় তাঁর জন্য যে কিছু কাজ করেছিলাম, সে কথা তিনি সারাজীবনেও ভুলতে পারেননি। তার নিজের বাড়িতে খাওয়াদাওয়ার কোনো ধরনের আয়োজন করলেই তিনি বলতেন, ‘নাসিরউদ্দিনকে ডাকো। না হলে খাওয়াই জমবে না।’ এ নিয়ে তাঁর আত্মীয়স্বজনরা রীতিমতো খেপে গিয়েছিলেন।

আর একটা কাজ তিনি জীবনে করেছিলেন, যা এর আগে আমি কারও কাছে বলিনি। আজ বলে ফেলছি। সেটা হলো এই—তিনি যখন কলকাতা মহানগরের মেয়র ছিলেন, তখন বা তার কিছু আগে জিন্নাতুন্নেসা নামের এক নারীকে তিনি বিয়ে করেছিলেন। তাঁর আগের বিবি তো আলাদা থাকতেন। যা-ই হোক, হক সাহেবের বাড়িতে একটা মেয়ে ছিল। জিন্নাতুন্নেসাই প্রতিপালন করেছিলেন তাকে। মেয়েটা তাঁর বাড়িতেই থাকত। তাঁর সেবা-শুশ্রূষা করত। এখানে কখন কোথা দিয়ে কী ঘটনা ঘটে গেছে, আমি বা আমরা জানতে পারিনি।

হক সাহেব বললেন, ‘আমার এখন পরিচর্যা, সেবা পাওয়া দরকার। আর এই বয়সে আমি তো বাইরে থেকে একটা মেয়েকে জাঁকজমক করে বিয়ে করে আনতে পারি না। আর এই মেয়েটিকে এমনি রাখলে গুনার কাজ হবে। একটা অবিবাহিতা মেয়ে আমার সেবা করবে—এটা রীতিমতো গুনার কাজ হবে। তার চেয়ে ওকে আমি নিকাহ করে নিই। সে আমার কাজকর্ম করবে। আমার খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারটা দেখবে। কথা শুনবে।’ ব্যাপারটা নান্না মিয়া জানতেন। যা হোক, মেয়েটাকে তিনি নিকাহ করে ফেললেন। এই খবর পেয়ে তাঁর আগের বিবি হক সাহেবের বাড়িতে চড়াও হলেন। বাড়িতে ঢুকেই তাঁদের ওপর রীতিমতো হামলা করে বসলেন। তোরা কেন আছিস? মেয়েটাকে বললেন, ‘ও তোর কী হয়?’ চাকু বা ছোরার মতো কী একটা হাতে নিয়ে তিনি ওদের ভয় দেখান, ‘তোদের এক্ষুনি আমি মেরে ফেলব।’ এই রকম অবস্থার মুখে হক সাহেবের নিকাহ করা মেয়েটা তো পালিয়ে এসে আমার বাড়িতে আশ্রয় নিল। হক সাহেবের কাছে এই খবর দ্রুতই পৌঁছে যায়। তিনি তখন দরবারে ছিলেন। সেখানে গিয়ে কে একজন তাঁকে এই বলে খবর দেয় যে দুটো মেয়ে তাঁর বাড়ি থেকে দৌড়ে বেরিয়ে এসে পাশের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। খবর পেয়ে হক সাহেব দৌড়ে এলেন। আমি তখন ডাক্তারখানায় ছিলাম। আমার বাড়ি থেকে একটা লোক গিয়ে আমাকে খবর দিল যে, হক সাহেব আপনার বাড়িতে দৌড়ে ঢুকেছেন। বলি, হায়, হায় কি বিপদ হলো তাহলে? কী ব্যাপার? গিয়ে দেখলাম, উনি মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন। আমাকে দেখে বললেন, ‘বসেন।’

বলি, কী খবর?

হাত দিয়ে ঘরের কোনা দেখিয়ে বললেন, বড্ড বিপদের মধ্যে আছি। এই বাড়িতে যে আমি একটু শান্তিতে থাকব, তাও পারলাম না। কোথা থেকে এসে হামলা চালিয়েছে। ওরা ভয়ে পালিয়ে আপনার বাড়িতে এসে আশ্রয় নিয়েছে।’

আমি বললাম, আপনি প্রধানমন্ত্রী। যে আপনার বাড়িতে কোনো দিন আসে না, হঠাত্ করে সে এসে এই রকম কাণ্ড ঘটাবে, আপনি বেত দিয়ে পিটুনি দেন না কেন?

বললেন, ফজলুল হক তো পিটুনি দিতে পারে, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী পারে না। আমি এ রকম একটা কিছু করলে কালকে দেখবেন আনন্দবাজার, অমৃত বাজার পত্রিকায় আমার বিরুদ্ধে কী বের হয়!

হক সাহেবের কথা বলতে গেলে নবযুগ-এর কথাও একটুখানি বলতে হয়। নবযুগ তো দুবার বের হয়েছে। প্রথমবার বের করেছিলেন মোজাফফর আহমেদ আর হক সাহেব মিলে। তখন আমি ছিলাম না। দ্বিতীয়বার প্রকাশ করার সময় হক সাহেব বললেন, ‘আমি নবযুগ বের করব। আপনি একটু সাহায্য করবেন।’ আর বললেন, ‘একটা কাজ করলে ভালো হয় না?’

বললাম, কী?

তিনি বললেন, ‘নজরুলকে সম্পাদক করে এবার কাগজটা যদি ছাপি, তাহলে কাগজ খুব বিক্রি হবে, তাই না?’

আমি বললাম, নজরুলকে তো কেউ আনতে পারবে না। আসবেন না। তাঁকে আনতে হলে আমাকে যেতে হবে।

বললেন, ‘কাল তিনটার সময় আমি এখানে বসে থাকব তাঁর আশায়। আপনি তাঁকে যে করেই হোক নিয়ে আসবেন।’

আমি গেলাম নজরুলের বাড়িতে।

তাঁর শাশুড়ি বললেন, ‘ও তো কোনো কাজকর্ম করতে পারে না।’

বললাম, তাহলে কী করেন?

বললেন, ‘আবোল-তাবোল কী সব বকে।’

জিজ্ঞেস করি, কী হলো তাঁর আবার?

বললেন, ‘কিছু বুঝিটুঝি না। যা খুশি করে। খায় না। ভারি গোলমালে পড়েছি।’

এটা ১৯৪১-৪২ সালের কথা। নজরুলের শাশুড়ি আরও বললেন, ‘এখন ওকে বাইরে যেতে দিই না। তবে তুমি যদি নিতে চাও, নিয়ে যেতে পারো। আবার সঙ্গে করে দিয়ে যাবে।’

ওপর থেকে নিচে নেমে নজরুল আমার সঙ্গে এলেন। আগে হাসতেন, হইচই করতেন, এখন কিছুই করেন না। কেবল ঝিম ধরে বসে থাকেন।

আমি নজরুলকে বললাম, আমার সঙ্গে যেতে হবে আমার বাড়িতে।

নজরুল বললেন, আচ্ছা।

আর কিছু বললেন না। বললাম, আমি আবার দিয়ে যাব।

বলেন, আচ্ছা।

আর কিছুই বলেন না।

নজরুলের শাশুড়ি ব্যাপারটা লক্ষ করে বললেন, ‘বুঝতে পারছ কী হয়েছে?’

আমি বলি, আমিও তো কিছুই বুঝতে পারছি না।

আসার পথে নজরুল আমার সঙ্গে কোনো কথাই বলেননি। আমার বাসায় আসার পর তাঁকে দেখিয়ে আমার স্ত্রীকে বললাম, এই দেখো, কে এসেছে!

অন্যদিন আমার স্ত্রীকে নজরুল (আমার স্ত্রী নামাজ পড়ত বলে) ‘মৌলভি সাহেব’ বলে ডাকতেন। বলতেন, ‘মৌলভি সাহেব’ কোথায়? দেখা হওয়া মাত্র বলতেন, আদাব আদাব। কিন্তু আজ ওসবের আর কিছুই বললেন না। নজরুল আমার সঙ্গে বসে ভালোই খাওয়াদাওয়া করলেন।

হক সাহেবের বাসায় নিয়ে আসার পরও একই অবস্থা। দুজনই চুপ করে বসে থাকলেন। কেউ কথা বলেন না।

ব্যাপারটা দেখে আমি নজরুলকে বললাম, হক সাহেব পত্রিকা বের করবেন। আপনাকে তার সম্পাদক হতে হবে। সে জন্যই আপনাকে ডেকে আনা হয়েছে। এ কথা শুনে নজরুল এক ‘আচ্ছা’ ছাড়া আর কিছুই বললেন না।

হক সাহেব বললেন, কী ব্যাপার?

হক সাহেবকে লক্ষ করে এবার নজরুল বললেন, ‘আজকাল আমার কাছে গভীর রাতে অনেক বাণী আসে। আপনার জন্য যদি কোনো বাণী আসে, তা হলে আমি জানাব।’

নজরুল তখন কিছুই লিখতেন-টিখতেন না। হক সাহেবের ওখান থেকে ফিরে আসার পর তাঁকে তাঁর শাশুড়ির হাতে তুলে দিয়ে বললাম, এই দিয়ে গেলাম।

শাশুড়ি বললেন, ‘ওকে নিয়ে তো আমি আর চিন্তায় বাঁচি না। কী হলো ওর, কিছুই বুঝি না।’

বললাম, হক সাহেবের ওখানে কিছুই খেলেন না।

তাঁর শাশুড়ি বললেন, ‘বাড়িতেও কিছু খায় না। একটু খায়, খেয়েই ফেলে দেয়।’

এসবই ছিল নজরুলের চিরকালের জন্য ‘নিশ্চুপ-নির্বাক’ হয়ে যাওয়ার প্রাথমিক লক্ষণ। তার পরের ঘটনা তো সবারই জানা।

অনুলিখন: রীতা ভৌমিক