আ ওয়ার্ল্ড উইদাউট ইসলাম—গ্রাহাম ই ফুলার; নিউইয়র্ক: ব্যাক বে বুকস, লিটল ব্রাউন অ্যান্ড কোম্পানি, এপ্রিল ২০১২ (ইন্টারন্যাশনাল ম্যাস মার্কেট এডিশন)
প্রারম্ভিক কথা
আবির্ভাবের এক হাজার ৪০০ বছর পর ইসলাম ধর্ম আজকে সারা দুনিয়ায় একটি অদ্ভুত বিরূপ সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। একদিকে পশ্চিমা দুনিয়ার একাংশ ইসলাম ও সন্ত্রাসবাদকে সমার্থক করে তোলার নিরন্তর প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে এই পশ্চিমা বিশ্বেরই আরেকাংশ ইসলামকে একটি সহনীয় গণতান্ত্রিক পরিসরে রেখে এগিয়ে নিতে আগ্রহী। ইসলামের বিষয়টি সারা দুনিয়াতেই তাই এখন একটি জটিল রূপ নিয়েছে। সন্ত্রাসবাদের সমতুল্য বা মদদদাতা হিসেবে ইসলামকে দাঁড় করানোর প্রয়াসটিকে অবশ্য জোরদার করেছে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক ইসলাম ধর্মাবলবম্বী গোঁড়া বা উগ্রপন্থীদের নানা কার্যক্রম। ফলে ইসলামকে একটি জঙ্গিবাদী ধর্মের লেবাসে নিয়ে আসা যাচ্ছে। আর তাই উদারপন্থী বা মধ্যপন্থী ইসলামি চিন্তাধারার সঙ্গে পশ্চিমা দুনিয়ার মেলবন্ধনের আগ্রহটি কঠিনতর হয়ে উঠছে। এই টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে অনেকেই এখন মনে করছে যে পৃথিবীতে ইসলাম না থাকলে সন্ত্রাসবাদ থাকত না, ধর্মের নামে পবিত্র যুদ্ধ থাকত না, সভ্যতার সংঘাত হতো না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে ইসলামভীতি ছড়িয়ে দিয়েছে, তা ইউরোপ আরও জোরদার করেছে। এশিয়া ও আফ্রিকা এই ভীতিতে আক্রান্ত হয়ে পড়েছে।
একটু লক্ষ করলেই দেখা যায় যে দুনিয়াজুড়ে সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমে প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের খবর আসছে, যেখানে ইসলামকে দায়ী হিসেবে সম্পৃক্ত করে দেওয়া হচ্ছে। আত্মঘাতী বোমা হামলা, দাঙ্গা, ফতোয়াবাজি, গেরিলা আক্রমণ, ভিডিও বার্তায় হুমকির মতো বিভিন্ন ঘটনা দুনিয়ার যেখানেই ঘটছে, সেখানেই চালিকা হিসেবে দেখানো হচ্ছে ইসলামকে। পাশ্চাত্যের নয়া রক্ষণশীলেরা এখন ‘ইসলামোফ্যাসিজম’ বা ইসলামি ফ্যাসিবাদ নিয়ে লেগেছে আর বিশ্বকে এই ধারণা দিচ্ছে যে ‘তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ’ হবে ইসলামের সঙ্গে সভ্যতার।
এ রকম অবস্থায় তাই কেউ কেউ এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছেন যে ইসলাম যদি পৃথিবীতে না আসত, তাহলে কি সত্যিই দুনিয়ার পরিস্থিতি অন্য রকম হতো? অনেকে খুব সোজাসাপ্টা জবাব খুঁজে পেয়েছেন। তাঁদের মত হলো, ইসলাম না থাকলে আজকে এই ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হতো না, এ রকম সংঘাত থাকত না। কিন্তু এ রকম একটি জটিল প্রশ্নের এত সহজ উত্তরই বা কীভাবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে? বরং কেউ কেউ মনে করেন, ইসলাম না থাকলেও এই ধরনের সন্ত্রাস ও সংঘাত অব্যাহত থাকত, হয়তো কিছুটা ভিন্ন রূপে। গ্রাহাম ই ফুলার এই চিন্তাধারার একজন জোরালো সমর্থক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স কাউন্সিলের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান তাঁর আ ওয়ার্ল্ড উইদাউট ইসলাম শীর্ষক গ্রন্থে এ চিন্তাই ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহ ও প্রাসঙ্গিক তথ্য-উপাত্ত সহযোগে বিশ্লেষণ করেছেন, যুক্তির কষ্টিপাথরে যাচাই করেছেন ও বাস্তবতার নিরিখে উপস্থাপন করেছেন। বর্তমানে কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়ার ভ্যাংকুভারের সাইমন ফ্রেজার বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক গ্রাহাম ফুলারের বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ২০১০ সালে। অবশ্য তার আগেই ২০০৮ সালের জানুয়ারিতে ফরেন পলিসি ম্যাগাজিনে এর সারসংক্ষেপ নিবন্ধ আকারে প্রকাশিত হয়েছিল।
২.
‘কল্পনা করুন, অবশ্য যদি আপনি করতে চান, এমন এক দুনিয়া যেখানে ইসলাম নেই। এটা তো প্রায় অসম্ভব মনে হবে যখন আমাদের পত্রপত্রিকার শিরোনাম, বায়ুতরঙ্গ, কম্পিউটারের পর্দা ও রাজনৈতিক বিতর্কে ইসলামের ছবি ও কথা প্রভাব বিস্তার করে রয়েছে। আমরা তো জিহাদ, ফতোয়া, মাদ্রাসা, তালিবান, ওয়াহাবি, মোল্লা, শহীদ, মুজাহিদ, ইসলামি গোঁড়া আর শরিয়া আইনের মতো শব্দগুলো নিয়ে বড়ই উচ্চকিত। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আমেরিকার প্রতিটি লড়াইয়ের এবং দুনিয়ায় বিভিন্ন স্থানে দীর্ঘমেয়াদি প্রতিশ্রুতি নিয়ে শুরু করা “সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বৈশ্বিক যুদ্ধের” কেন্দ্রে ইসলামকে নিহিত দেখা যায়। বস্তুত, মধ্যপ্রাচ্যের বেশির ভাগ ঘটনার তাত্ক্ষণিক ও সরল বিশ্লেষণ যেন ইসলামেই আছে, যার মাধ্যমে আজকের নিয়ন্ত্রণহীন বিশ্বের অর্থ পাওয়া যায়। এভাবে ইসলামের দিকে অভিহিত করে আমরা সবকিছুকে “পশ্চিমা মূল্যবোধ” ও “মুসলিম বিশ্বের” মধ্যকার লড়াইয়ের সংকীর্ণ পরিসরে নামিয়ে আনছি। কিছু নয়া রক্ষণশীলের কাছে “ইসলামোফ্যাসিজম” হয়ে উঠেছে আসন্ন চতুর্থ বিশ্বযুদ্ধ বা “দীর্ঘ যুদ্ধে” আমাদের মুখ্য ঘোষিত শত্রু। এটি এক বিরাট আদর্শিক লড়াই হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, যা শুধু ধর্মের ওপরই আলোকপাত আর দীর্ঘদিন ধরে গড়ে ওঠা পূর্ব-পশ্চিম সংঘাতে ভূমিকা রাখা অন্য উপাদানগুলোকে অবজ্ঞা করছে। এই বইয়ে পুরো বিষয়টি বিপরীত দিক থেকে যুক্তিসহকারে আলোকপাত করা হয়েছে। যদি কোনো ইসলাম না থাকত, যদি একজন নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর আগমন না ঘটত, যদি মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়া ও আফ্রিকার বিশাল এলাকাজুড়ে ইসলামের বিস্তারের ঘটনা না ঘটত, তাহলে কি আজকে পশ্চিমা বিশ্ব ও মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যকার সম্পর্ক সম্পূর্ণ ভিন্ন রকম হতো না? না। আমি বরং বলছি যে সম্পর্কটা প্রায় এ রকমই থাকত।’ (পৃ. ২-৩)
আ ওয়ার্ল্ড উইদাউট ইসলাম গ্রন্থের সূচনার তিনটি অনুচ্ছেদ এ রকম। এ থেকেই ধারণা করা যায় যে লেখক গ্রাহাম ফুলার কেন এই বইটি রচনা করেছেন। ইসলামের আবির্ভাব ও বিস্তারের কেন্দ্রভূমি হলো আরব তথা মধ্যপ্রাচ্য। আর তাই ইসলামের ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষণে সবার আগে মধ্যপ্রাচ্যই চলে আসে। আজকে আমেরিকা-ইউরোপ তথা পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে ইসলামের দ্বন্দ্ব-সংঘাত তাই প্রধানত মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে দ্বন্দ্ব-সংঘাত। সে কারণেই ফুলার তাঁর বইয়ের আলোচনায় প্রাধান্য দিয়েছেন মধ্যপ্রাচ্যকে। তিনি দেখাতে চেয়েছেন: বিশ্বে যে ইসলামের নামে দ্বন্দ্ব-সংঘাত-সন্ত্রাস ঘটছে, তার কারণ ইসলাম নয়। বরং ইসলাম হলো একটি শক্তিশালী বাহন, যা কিনা পাশ্চাত্যের বিভিন্ন বৈষম্যমূলক ও আগ্রাসী কর্মকাণ্ডের প্রতিরোধে ব্যবহূত হচ্ছে। আর সে কারণেই ইসলাম না থাকলে যে দুনিয়ায় সর্বত্র গণতন্ত্রের ঢেউ খেলে যেত, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য হয়ে উঠত গণতন্ত্রের এক শান্তিময় স্থান, তা মোটেও ঠিক নয়। ফুলার বলতে চেয়েছেন, মধ্যপ্রাচ্য তথা ইসলামের সঙ্গে পাশ্চাত্যের বিরোধকে সুদীর্ঘ ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে বিচার করতে হবে, ইতিহাসের পথপরিক্রমাকে বিবেচনায় নিতে হবে।
ফুলার বলছেন, ‘পশ্চিম, বিশেষভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গত অর্ধ শতক আগেও মধ্যপ্রাচ্যে কোনো টেকসই বা ভীষণ কোনো আগ্রহ প্রদর্শন করেনি। আমরাও এই অঞ্চলে শত শত বছর, এমনকি হাজার বছরের বেশি সময় ধরে পশ্চিমা হস্তক্ষেপের বিষয়টি সম্পর্কে অজ্ঞ থাকতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। আমরা বরং পশ্চিমা রাজনীতি সম্পর্কে মধ্যপ্রাচ্যের সমালোচনা নিয়ে অতিমাত্রায় সচেতন, যেখানে স্থান পায় তেল, অর্থায়ন, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, পশ্চিমা সমর্থনপুষ্ট অভ্যুত্থান, পশ্চিমাপন্থী একনায়কদের প্রতি পশ্চিমা সমর্থন এবং জটিল ফিলিস্তিনি সমস্যায় ইসরায়েলের প্রতি আমেরিকার নির্বিচার সমর্থন, যার শিকার, সবকিছুর পরও, ইসলামের মধ্যে নেই, বরং আছে ইউরোপীয় ইহুদিদের ওপর পশ্চিমাদের নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞের মধ্যে। ইউরোপের ক্ষমতাধরেরা তাদের স্থানীয় বিবাদকে বাইরে রপ্তানি করেছে এবং তা দুটি বিশ্বযুদ্ধে রূপান্তরিত করেছে, যার কিছু অংশ সংঘটিত হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের মাটিতে। একইভাবে হয়েছে ঠান্ডাযুদ্ধের ক্ষেত্রেও। এসব কিছুই আসলে নির্দেশ করে যে আরও অনেক কার্যকারণ উপাদান রয়েছে, যা কিনা বিদ্যমান গোলযোগ ব্যাখ্যার ক্ষমতা রাখে, যেমনটি রয়েছে “ইসলামের” মধ্যে। অনেকেই মনে করতে পারেন যে এখানে শুধু পশ্চিমকে দায়ী করা হচ্ছে।
বিষয়টি অত সরলীকৃত নয় মোটেও। আমি বরং বলতে চাচ্ছি যে গভীরতর ভূরাজনৈতিক উপকরণগুলো প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যকার বিপলুসংখ্যক সংঘাতমূলক উপাদান তৈরি করেছে, যা ইসলামের আগে থেকে শুরু হয়েছে, ইসলামের সঙ্গে অব্যাহত থেকেছে, ইসলামকে ঘিরে হয়েছে এবং সম্ভবত অন্তর্নিহিত আছে ভূখণ্ডগত গুরুত্ব ও ভূরাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে। আর এই দৃষ্টিভঙ্গি সেসব রাষ্ট্র অধিগ্রহণ করেছে ধর্মীয় বিবেচনা উপেক্ষা করেই। অবশ্যই এটা বলা খুব বালখিল্য হবে যে প্রাচ্য-পাশ্চাত্য সংঘাতের বর্ণময় উপাদানগুলোতে ইসলামের কোনো ভূমিকা নেই। ইসলাম একটি শক্তিশালী ও গভীর সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করে, যা কিনা গোটা মধ্যপ্রাচ্য ও এর বাইরেও ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। কিন্তু প্রাচ্য-পাশ্চাত্য সম্পর্কের বিবেচনায় আমি বলতে চাই যে এটা আসলে প্রাথমিকভাবে অন্যান্য গভীরতর বৈরিতা ও সংঘাতময়তার একটি পতাকা বা ব্যানারের কাজ করছে।’ (পৃ. ৫-৬)
গ্রাহাম ফুলার অবশ্য শুরুতেই এটা পরিষ্কার করে দিয়েছেন যে তিনি ‘বিশ্বে ইসলাম না থাকার’ ধারণাটি মূল পাশ্চাত্যের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের বিরোধ-সংঘাতের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্লেষণ করতে চেয়েছেন, গোটা দুনিয়ার পরিপ্রেক্ষিতে নয়। ইসলাম যদি না থাকত, তাহলে আজকে পাশ্চাত্যের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের সম্পর্ক কেমন দাঁড়াত, এই প্রশ্নের উত্তর নিবিড়ভাবে অনুসন্ধানের চেষ্টাই করেছেন। অর্থাত্ লেখক তাঁর আলোচনার পরিসরকে যুক্তিসংগতভাবে সীমিত রেখেছেন।
৩.
বইটি মোট তিনটি পর্বে বিভক্ত। প্রথম পর্বের শিরোনাম ‘উত্পথ ও ক্ষমতা’। এই পর্বে ছয়টি অধ্যায়ে ইসলাম ও খ্রিষ্টধর্মের মধ্যকার সাযুজ্য ও বিরোধের ঐতিহাসিক চিত্র অঙ্কন ও বিশ্লেষণ করা হয়েছে, দেখানো হয়েছে ইব্রাহিমীয় বিশ্বাসের ও ইসলামের মধ্যে সম্পর্কসূত্র। খ্রিষ্টধর্মের ক্ষমতা, উত্পথ (বা নব্যতন্ত্র) ও বিবর্তনের পথরেখা তুলে ধরা হয়েছে। এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়টি হলো ‘বাইজেনটাইনীয় বনাম রোমান: খ্রিষ্টীয় মেরুকরণের যুদ্ধ’, যেখানে খ্রিষ্টীয় ধর্মবিশ্বাসের মেরুকরণের ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে, বিশ্লেষণ করা হয়েছে এই মেরুকরণের কারণ ও প্রভাব। বলা যেতে পারে, আজকে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের দ্বন্দ্বের এক বড় ঐতিহাসিক শিকড় রয়ে গেছে খ্রিষ্টীয় ধর্মবিশ্বাসের এই মেরুকরণের ভেতরেই। পশ্চিমা ইতিহাসবিদ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা অনেকটা সচেতনভাবেই এই ঐতিহাসিক সত্যটি বিভিন্ন সময়ে কৌশলে এড়িয়ে এসেছেন, এখনো এড়িয়ে চলছেন। কেননা এই ঐতিহাসিক সত্যটি স্বীকার করে নিলে আজকে একতরফাভাবে ইসলামকে যাবতীয় সমস্যার মূল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জ্ঞানপাপজনিত প্রয়াসটি নৈতিকভাবে বেশ দুর্বল হয়ে পড়ে যে!
ফুলার তাই বইয়ের সূচনাতেই বলেছেন, ‘এই বইয়ের প্রধান মনোনিবেশের জায়গাটি হলো প্রাচ্যের গোঁড়া খ্রিষ্টবাদ এবং পশ্চিমের বা রোমান গোঁড়া খ্রিষ্টবাদের মধ্যে উত্তেজনা ও মতভেদসমূহের ওপর আলোকপাত করা। যদি ইসলাম এসে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে খ্রিষ্টীয় শাসনকে হটিয়ে না দিত, তাহলে এই গোটা অঞ্চলই আজকে প্রাচ্য গোঁড়া খ্রিষ্টবাদের অধীনে থাকত বলে মনে করা যায়। আর নানা বিষয়ে অভিন্ন প্রথা ও ঐতিহ্য থাকা সত্ত্বেও গোঁড়া ও ক্যাথলিক মতবাদের মধ্যকার সম্পর্ক প্রায় দুই সহস্রাব্দ ধরে সন্দেহ ও ঘৃণায় আবর্তিত। সুতরাং এটা মনে করার খুব চমত্কার ভিত্তি রয়েছে যে পশ্চিমের বিরুদ্ধে মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষোভ স্পষ্টভাবে প্রকাশের ধর্মীয় ও আদর্শিক পাটাতন হিসেবে গোঁড়া খ্রিষ্টধর্মই কাজ করত। আর ঐতিহাসিক ধারায় আজকে এই মতবাদের কেন্দ্রভূমি হতো মস্কো। এই বিবেচনা ধরেই ক্রুসেডের পূর্বাপর পরীক্ষা করতে গিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয়: এটা কি ধর্মীয়, না ভূরাজনৈতিক ঘটনা? ক্রুসেড খ্রিষ্টবাদ ও ইসলামের মধ্যে লড়াই—এই প্রচলিত ধারণার চেয়েও বেশি সত্যি হলো এটি প্রকৃতপক্ষে প্রাচ্য খ্রিষ্টবাদ, পাশ্চাত্য খ্রিষ্টবাদ ও ইসলামের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ত্রিমুখী রাজনৈতিক লড়াই।’ (পৃ. ১৪)
প্রাচ্য খ্রিষ্টবাদ যে পাশ্চাত্যের প্রতি ঐতিহাসিকভাবেই বিরূপ, তাও ইতিহাসের ঘটনাপ্রবাহ তুলে ধরে দেখিয়ে দিয়েছেন ফুলার। তিনি বলেছেন, ‘আমাদের পশ্চিমা সনাতন ধারায়, আমরা বরং প্রাচ্যের গোঁড়া গির্জা সম্পর্কে অন্ধ রয়েছি। আমাদের আশপাশে এসব গির্জা খুব কম দেখি আর তাই এটা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছি যে খ্রিষ্টবাদ ও মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসে প্রাচ্য গির্জার কতটা গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান রয়েছে। প্রথমত, রোমান ক্যাথলিক চার্চের তুলনায় এটা মধ্যপ্রাচ্যে একেবারে প্রথমদিকের ও সবচেয়ে “নেটিভ” খ্রিষ্টধর্ম। রোমান ক্যাথলিক চার্চ জেরুজালেম থেকে অনেক দূরে সরে গিয়ে ধর্মতত্ত্ব, রাজনীতি ও দৃষ্টিভঙ্গিতে অনেক আলাদাভাবে বিকশিত হয়েছে। আবার এই গোঁড়াবাদ এখনো মুসলিম মধ্যপ্রাচ্যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় রূপে বিরাজ করছে। এটার গর্ব এই যে এটা রূপে ও চেতনায় প্রকৃত গির্জার (খ্রিষ্টবাদের) সবচেয়ে কাছে; এর সূচনা হয়েছে প্রকৃত গির্জার ভূমিতে এবং এই বিশ্বাসই লালন করেছে যে পাশ্চাত্যের লাতিন গির্জার মতবাদগত ও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি এড়িয়ে গেছে। পশ্চিমা-বিরোধিতার গভীর শিকড়সমূহ এখনো এই গোঁড়া গির্জায় বিদ্যমান। আরও বেশি বিস্ময়কর যে এসব গির্জার পশ্চিমবিরোধী অনুভবসমূহের অনেক কিছুই আজকে পশ্চিমের প্রতি মুসলমানদের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে ভীষণভাবে মিলে যায়, যা আবার পাশ্চাত্যের প্রভাব, মতলব ও হস্তক্ষেপের প্রতি একটি অভিন্ন ভূরাজনৈতিক উত্স থেকে সঞ্চারিত দৃষ্টিভঙ্গি, ক্ষোভ ও সন্দেহের অংশীদারমূলক প্রকাশ হিসেবে বিবেচনা করা যায়। আমরা ইতিমধ্যে ইসলামের সঙ্গে এই বন্ধনের কথা উল্লেখ করেছি যে কীভাবে যিশুখ্রিষ্ট সম্পর্কে বিভিন্ন খ্রিষ্ট মতবাদ তাঁর সম্পর্কে ইসলামের কিছু দৃষ্টিভঙ্গির মিল রয়েছে আর এসব খ্রিষ্ট মতবাদ পরবর্তী সময়ে গির্জা কর্তৃপক্ষ নাকচ করে দিয়েছে। পশ্চিমা শক্তির প্রতি গোঁড়া গির্জা ও ইসলামের অংশীদারমূলক ক্ষোভ এটা নির্দেশ করে যে সভ্যতার বিরোধরেখাগুলো শুধু এসব ধর্মের সংস্কৃতিগত বিশিষ্টতা নয়, বরং বহুলাংশে পাশ্চাত্যের স্বভাবের সঙ্গে জড়িত এবং মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে যার সংঘাতসমূহ বহু পুরোনো। রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পার্থক্যসমূহ প্রায়ই ছোটখাটো ধর্মমতগত পার্থক্যকে বিরাট উত্পথ ও বিদ্রোহে রূপান্তর করতে পারে। [ইসলামের ভেতর সুন্নি-শিয়া বিরোধ সম্পর্কে এটি সত্যি যেখানে মহানবীর উত্তরাধিকার নিয়ে প্রাথমিক মতভেদগুলোর তেমন কোনো ধর্মগত বৈশিষ্ট্য না থাকলেও পরবর্তী সময়ে তা গভীর সাম্প্রদায়িক বৈরিতায় রূপ নেয়। (পৃ. ৭০-৭১)]’
তাহলে দেখা যাচ্ছে, পশ্চিমের প্রতি বিরূপ মনোভাবের উত্স ইসলামে নিহিত নেই। ইসলামের আবির্ভাবের আগে থেকেই মধ্যপ্রাচ্যে বিরাজমান খ্রিষ্টধর্ম এই বিরোধিতা করে আসছে। বিষয়টি বর্তমান বিশ্বে মধ্যপ্রাচ্য তথা ইসলামের সঙ্গে ইউরোপ-আমেরিকার সংঘাতের গভীর কারণগুলো সঠিকভাবে বোঝার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আরও পিছিয়ে গেলে দেখা যাবে, পারস্য সম্রাটেরা এথেন্সের দ্বারে আঘাত হেনেছিলেন আর এনাতোলিয়ায় যারা বসবাস করত, অনন্তকাল ধরে তাদের কাছে শত্রু পরিগণিত হয়েছিলেন। পারসিকদের সঙ্গে সেমেটিকদের বিরোধ-সংঘাতও প্রাক-ইসলাম যুগেরই।
আসলে বাইজেনটাইন সাম্রাজ্যের সঙ্গে রোমান সাম্রাজ্যের ঐতিহাসিক দ্বন্দ্ব-বিরোধই পরবর্তীকালে মধ্যপ্রাচ্যে ও পূর্ব আফ্রিকার সঙ্গে ইউরোপের ও আমেরিকার বিরোধের আধুুনিক রূপ। যদিও বাইজেনটাইন সাম্রাজ্য ছিল রোমান সাম্রাজ্যেরই একটি অংশ, যাকে বলা হয় পূর্ব রোমান। কিন্তু ইতিহাসের পথরেখায় দেখা যায়, মূল রোমান বা পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের সঙ্গে রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এমনকি ধর্মীয় দিক থেকে বাইজেনটাইন সাম্রাজ্যের অনেক পার্থক্য ছিল। এই সাম্রাজ্যের রাজধানী কনস্ট্যান্টিনেপল (আধুনিক ইস্তাম্বুল) ছিল গ্রিক সংস্কৃতির সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত, গ্রিক ভাষাভাষীর কেন্দ্রভূমি।। খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকেই এই নগরের কথা জানত গ্রিকরা। আর ৩৩০ খ্রিষ্টাব্দে রোমান সম্রাট কনস্ট্যানটাইন এই শহরের পুনরাবিষ্কার করায় নামকরণ হয় কনস্ট্যানটিনেপল।
তিনি এটাকে রোমান সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় রাজধানী হিসেবে গড়ে তোলার চিন্তা করেন। তত দিনে রোমান সাম্রাজ্য বিশেষত পশ্চিমাংশ মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে। ৪৭৬ খ্রিষ্টাব্দে জার্মান আগ্রাসনের কাছে রোমের পতন ঘটে। অবসান ঘটে রোমান সাম্রাজ্যের। অন্যদিকে, তখন পূর্বে কনস্ট্যানটিনেপলকে ঘিরে বিকশিত হচ্ছে বাইজেনটাইন সাম্রাজ্য। রোমান ঐতিহ্য-প্রথা-ধারার অনেক কিছু উত্তরাধিকারী হিসেবে বহন করেও ভাষা-সাংস্কৃতিক ও ভৌগোলিক অবস্থানের পার্থক্য ক্রমেই বাইজেনটাইন সাম্রাজ্যকে রোমান সাম্রাজ্য থেকে স্বতন্ত্র করে ফেলে, যেখানে প্রাচ্য খ্রিষ্টবাদ হয়ে ওঠে ধর্মের মূল কেন্দ্র। বাইবেলের নিও টেস্টামেন্ট রচিত হয় গ্রিক ভাষায়। কনস্ট্যানটিনেপলে লাতিন ভাষার চর্চা থাকলেও প্রাধান্য ছিল গ্রিকের। আর তাই পশ্চিমে লাতিন সাম্রাজ্য আর প্রাচ্যে গ্রিক সাম্রাজ্য—এই আলোচনা তাত্পর্যবাহী হয়ে ওঠে। মজার বিষয় হলো, মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়া মাইনরে বাইজেনটাইন সাম্রাজ্য আসলে রোমান সাম্রাজ্য হিসেবেই পরিচিত ও বিবৃত হতো। আরবি, ফারসি ও তুর্কি ভাষায় প্রাচ্যের খ্রিষ্টান সাম্রাজ্য ‘রুম’ সাম্রাজ্য হিসেবেও পরিচিতি পেয়ে এসেছে, যার প্রতিফলন পাওয়া যায় ‘রুম সালতানাত’ শব্দগুচ্ছে। পবিত্র কোরআন শরিফে সূরা রুমে এই সাম্রাজ্যভিত্তিক খ্রিষ্টানদের কথাই বলা হয়েছে। মূলত ষোড়শ শতকে একজন জার্মান ঐতিহাসিক প্রথম প্রাচ্যের এই রোমান সাম্রাজ্যকে বাইজেনটাইন
সাম্রাজ্য হিসেবে আখ্যায়িত করেন এবং পরবর্তী সময়ে ইউরোপে এভাবেই এর পরিচিতি ঘটে। কিন্তু প্রাচ্যে রোমান সাম্রাজ্যের পরিচিতিকে পাশ্চাত্যের অর্থাত্ ইউরোপের রাজ-রাজা ও গির্জার পুরোহিত-পাদরিরা মেনে নিতে পারেননি। তাঁরা বরং এটাকে গ্রিক সাম্রাজ্য হিসেবেই অভিহিত করতে স্বাচ্ছন্দ্য পেতেন। ১৪৫৩ সালে মুসলিম তুর্কিদের হাতে কনস্ট্যানটিনেপলের পতন ঘটার মধ্য দিয়ে বাইজেনটাইন সাম্রাজ্যের অবসান ঘটে। তত দিনে প্রাচ্য খ্রিষ্টবাদ তার নিজস্ব অবস্থান সুশক্ত করে নিয়েছে। আর তাই আজও প্রাচ্য খ্রিষ্টবাদের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে ইস্তাম্বুল স্বীকৃত।
ফুলার দেখিয়েছেন, কীভাবে রোমান ক্যাথলিক ও প্রাচ্য গোঁড়া খ্রিষ্টবাদের মধ্যকার বিরোধ বর্তমান যুগেও রক্তপাত ঘটিয়েছে। তিনি লিখছেন, ‘প্রাচ্য (বাইজেনটাইন) সাম্রাজ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উত্তরাধিকার ছিল পূর্ব ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে জাতীয় গির্জাগুলোর সৃষ্টি। এসব গির্জা আজও সংস্কৃতিগত ও আবেগীভাবে সুনির্দিষ্ট ভাষা বা নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পৃক্ত। গির্জাসমূহের এই ঐতিহাসিক জাতীয়করণের প্রভাব আজকেও আমাদের রক্তাক্ত ইতিহাসে তাড়িয়ে বেড়ায়। ১৯৯০-এর দশকে যুগোস্লাভিয়ার ভাঙন তো প্রাচ্য অর্থোডক্স সার্বীয় খ্রিষ্টানদের বিরুদ্ধে রোমান ক্যাথলিক ক্রোটদের অবস্থানের মধ্যেই নিহিত ছিল।’ (পৃ. ৭৮-৭৯)
প্রথম পর্বের আরও তিনটি অধ্যায় আছে। এগুলো হলো: ‘প্রাচ্য খ্রিষ্টবাদের সঙ্গে ইসলামের সাক্ষাত্’, ‘মহা ক্রুসেডসমূহ (১০৯৫-১২৭২)’ এবং ‘অংশীদারমূলক প্রতিধ্বনি: প্রোটেস্টান সংস্কার ও ইসলাম’। এই তিনটি অধ্যায়ে লেখক ইসলামের বিকাশ ও বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে খ্রিষ্টধর্মের অন্তর্গত পরিবর্তনের ঐতিহাসিক ধারাক্রমটিও তুলে ধরেছেন। ফলে পাশাপাশি একটি তুলনা ও সম্পৃক্ততা স্পষ্ট হয়েছে।
৪.
বইটির দ্বিতীয় পর্বের নাম ‘ইসলামি সভ্যতার সীমান্তে মিলন’। এই পর্বে ফুলার মূলত স্যামুয়েল হানটিংটনের বহুল আলোচিত সভ্যতাসমূহের সংঘাত বইয়ের মূল সুরকে এক প্রকার চ্যালেঞ্জ করেছেন, হানটিংটনের ‘ইসলামের রক্তাক্ত সীমানা’ ধারণা-বিশ্লেষণকে ঐতিহাসিক তথ্য ও যুক্তির নিক্তিতে পরীক্ষা করেছেন। ফুলার বলছেন, ‘...এটা মনে রাখা প্রয়োজন যে একটি সীমানা রক্তাক্ত হতে হলে সাধারণত দুটি পক্ষ লাগে।’ (পৃ. ৭৮-৭৯) তিনি আরও বলেছেন যে ইসলাম নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে আসলে মুসলমানদের সম্পর্কে, মুসলমানরা যা ভাবছে, বলছে ও করছে, সে সম্পর্কে আলোকপাত করা হচ্ছে। অন্যরা ইসলাম সম্পর্কে কী ভাবল, তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো মুসলমানরা নিজেদের ধর্ম ও সংস্কৃতি নিয়ে কী ভাবছে এবং তার ভিত্তিতে কী করছে। কেননা, ‘শেষ পর্যন্ত ইসলাম হলো তা-ই, যা কিনা মুসলমানরা বলে ও করে। তবে তা বহুবিধ হতে পারে।’ অর্থাত্ ফুলার বোঝাতে চেয়েছেন যে মুসলমানরা যেহেতু ইসলাম ধর্মাবলম্বী কিন্তু নানা ভাষা, সংস্কৃতি ও নৃতত্ত্বের অধিকারী হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে আছে, তাই বিস্তারিত আলোচনায় মুসলমান হিসেবে আলোকপাত করা অধিক যুক্তিযুক্ত ও বাস্তবসম্মত। তাহলে মুসলমান ও অমুসলমানদের মধ্যকার মিলন-বিরোধের বিষয়টি বিশ্লেষণ সহজতর হয়। তিনি হানটিংটনের ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে এও বলেছেন, ‘ইসলামের সীমানাসমূহের’ বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহ আসলে কোনো সীমানা নয়, বরং অমুসলমান সংস্কৃতির ভেতরে মুসলমানদের সম্পর্ক বিশেষত সংখ্যালঘু হিসেবে এই সম্পর্কের মাত্রা।
আসলে হানটিংটনের বইটি পাশ্চাত্যে এত বেশি আলোচিত এবং তা নিয়ে অধিকাংশ পশ্চিমা পণ্ডিত এত বেশি উদ্বেলিত যেন এ রকম গবেষণা কখনো হয়নি, এমনভাবে সভ্যতার বিভিন্ন দিক আমাদের সামনে উন্মোচিত হয়নি। যথারীতি বাংলাদেশেও হানটিংটন নিয়ে আলোচনা বহুলাংশে পাশ্চাত্য প্রভাবিত। ‘ইসলামের রক্তাক্ত সীমান্তসমূহের’ ধারণায় হানটিংটন এটাই প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন যে ‘মুসলমানরা শান্তিপূর্ণভাবে অন্যান্য সভ্যতা ও প্রতিবেশীর সঙ্গে বসবাসে সমস্যা সৃষ্টি করে থাকে।...মুসলমানরা বিশ্ব জনসংখ্যার পাঁচ ভাগের এক ভাগের অংশীদার। কিন্তু সে তুলনায় বিশ্বে সংঘটিত আন্তগোষ্ঠী দ্বন্দ্ব ও সংঘাতে তাদের অংশীদারি অন্যান্য সভ্যতার তুলনায় অনেক বেশি।’ (পৃ. ১৫৯) এই বক্তব্যের সমর্থনে হানটিংটন কিছু পরিসংখ্যানও তুলে ধরেছেন। তিনি দেখিয়েছেন যে ১৯৯৩-৯৪ সময়কালে সংঘটিত নৃগোষ্ঠীগত সংঘাতের ৫০টির মধ্যে মুসলমানরা ২৬টিতে অংশ নিয়েছিল। এর মধ্যে ২০টি সহিংস ঘটনা ঘটেছে বিভিন্ন সভ্যতার ভেতর, যার মধ্যে ১৫টিই ছিল মুসলমান ও অমুসলমানদের মধ্যে। এ রকম আরও কিছু পরিসংখ্যান তুলে ধরে হানটিংটন উপসংহার টানছেন, ‘১৯৯০-এর দশকের প্রারম্ভে মুসলমানরা নিজেদের মধ্যে সংঘাতে বেশি ব্যস্ত ছিল। তারপর তারা অমুসলমানদের সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়েছে। অধিকাংশ আন্তসভ্যতা যুদ্ধই কিন্তু মুসলমান ও অমুসলমানদের মধ্যে ঘটতে দেখা যায়। মুসলমানদের সীমান্ত ছিল রক্তাক্ত আর এটি হলো তার অভ্যন্তরীণ মর্মকথা।’১
অবশ্য পরিসংখ্যানের পাল্টা পরিসংখ্যানও হয়। ফুলার ইউরোপোলের পরিসংখ্যান উদ্ধৃত করে দেখিয়েছেন যে ২০০৬ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নে ৪৯৮টি সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে ৪২৪টি সংঘটিত হয়েছে বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী দ্বারা, ৫৫টি চরম বামপন্থী দল দ্বারা, ১৮টি অন্যান্য সন্ত্রাসী গোষ্ঠী দ্বারা এবং মাত্র একটি ইসলামপন্থীদের দ্বারা। মুসলমানদের নির্বিচারে সন্ত্রাসী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার পাশ্চাত্যের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার বিপরীতে এটি একটি ক্ষুদ্র চপেটাঘাত বিবেচিত হতে পারে বৈকি।
ফুলার বরং মনে করেন, ‘শক্তিশালী অমুসলমানদের সঙ্গে বসবাসের ক্ষেত্রে মুসলমানরা সৃজনশীল সম্পর্ক গড়ে তুলতে পেরেছিল। তবে তারা সবকিছুর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি নীতি থেকে বিচ্যুত হয়নি। আর তা হলো: এসব রাষ্ট্রের মধ্যেও ইসলাম ও মুসলমান সমাজকে লালন ও রক্ষা করা। এর মানে হলো নিজেদের মুসলমান পরিচয় বিসর্জন না দেওয়া বা এমনতর সংস্কৃতিগতভাবে আত্তীকৃত না হওয়া যেন নিজস্ব সংস্কৃতি মুছে যায়। এর মানে আবার এই নয় যে তারা তাদের সমাজে সক্রিয় নাগরিক হিসেবে পুরোপুরি সম্পৃক্ত হবে না। ইহুদিরাও এই ধরনের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গেছে। তাদের ইতিহাসে তারা বরাবরই নিজেদের সম্প্রদায়কে রক্ষা করেছে, নিজেদের মূল্যবান সংস্কৃতির অনন্যতাকে লালন করেছে, আবার একই সঙ্গে আত্তীভূত হওয়া ও মুছে যাওয়াকে প্রতিরোধ করেছে। আমরা দেখতে পাই যে মুসলমানরাও সহাবস্থান করতে এমনকি সমাজে সাংস্কৃতিক মিথস্ক্রিয়ার অংশীদার হয়েছে, যা কি না প্রায়ই চেতনাগতভাবে বহু-সাংস্কৃতিক ছিল না। একাধিক কৌশল মুসলমানরা অনুসরণ করেছে বলে প্রতীয়মান হয়: খাপ খাওয়ানো, সংমিশ্রণ, হুমকির মুখে পড়লে প্রতিরোধ গঠন এবং অমুসলমান রাষ্ট্রে নিজেদের সংখ্যালঘুত্বের বাস্তবতা মেনে নেওয়া।’ (পৃ. ১৬০-১৬১)
ফুলার এ প্রসঙ্গে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের অবতারণা করেছেন। সেটি হলো পাশ্চাত্য-বিরোধিতা বা পশ্চিমাবিদ্বেষ। একটি ধারণা দুনিয়াজুড়ে গেড়ে বসেছে যে ইসলাম মৌলিকভাবে পশ্চিমাবিদ্বেষী। কিন্তু ফুলার বলছেন, ‘সত্য হলো, বেশির ভাগ বিশ্বই বিভিন্ন সময়ে পশ্চিমের প্রতি একই সঙ্গে শ্রদ্ধা ও ঘৃণার অনেক কারণ খুঁজে পেয়েছে। পশ্চিমের প্রতি ক্ষোভ শুধু যে একচেটিয়াভাবে মুসলমানদের, বিষয়টি তা নয়। যদিও একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বৈশ্বিক যুদ্ধের সুনির্দিষ্ট কিছু বিষয় মুসলমানদের মধ্যে প্রবল আমেরিকাবিরোধী মনোভাব গড়ে তোলে। একটা সময়ে এটি শেষ হবে। কিন্তু আমেরিকাবিরোধী বা পশ্চিমাবিরোধী আবার প্রজ্বলিত হয়ে উঠতে পারে, যেমনটি চীনা ও লাতিন আমেরিকার মতো অন্যান্য সংস্কৃতিতে অতীতে হয়েছে।’ (পৃ. ১৬৩-১৬৪)
ফুলার সাবলীল ভাষায় ব্যাখ্যা করেছেন যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের যে সূত্রপাত ঘটান, তা আজকে মুসলিম বিশ্বে একধরনের আত্মসচেতনতামূলক ঐক্য গড়ে তুলতে ভূমিকা রেখেছে, যদিও তারা একই সঙ্গে শোকাহত ও বিভ্রান্ত হয়ে গোঁড়ামি ও অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এ ধরনের আবেগময় ঐক্য হয়তো সরাসরি কোনো রাষ্ট্র দ্বারা ব্যবহূত হতে পারবে না, তবে তা সময়ে সময়ে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটাতে পারে এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্যের বিরুদ্ধে শক্তিশালী বাধা হতে পারে।
আসলে ২০০১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে আল-কায়েদার সন্ত্রাসী হামলার পর গোটা দুনিয়াকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার প্রতিপক্ষ বানিয়ে ফেলে। নয়-এগারোর জবাব দিতে গিয়ে দুনিয়াজুড়ে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বৈশ্বিক যুদ্ধ’ ঘোষণা করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ। কিন্তু এক যুগের বেশি সময় পরে এসে এটা প্রমাণিত যে সারা দুনিয়াকে এ জন্য অনেক বেশি মূল্য দিতে হয়েছে ও হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই লড়াই বরং পরিগণিত হচ্ছে ‘সন্ত্রাসের যুদ্ধ’২ হিসেবে। সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলার নামে গোটা দুনিয়ায় মানবাধিকার, আইনের শাসন ও স্বাধীনতা ভীষণভাবে খর্ব করা হয়েছে ও হচ্ছে। বলা যায়, ‘১১ সেপ্টেম্বরের পর এক দশক ধরে বিশ্ব প্রত্যক্ষ করেছে ব্যাপক রক্তপাত ও দুরবস্থা। বুশ প্রশাসন তাত্ক্ষণিকভাবে (নয়-এগারো হামলার) জবাব দিয়েছে আফগানিস্তানে আক্রমণ চালিয়ে ও আগ্রাসন অব্যাহত রেখে। সঠিকভাবে যথাযথ জবাব দেওয়ার বদলে বুশ প্রশাসন বরং সেসব সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নতুন ক্রুসেড পরিচালনার কথা বলেছে, যাদের ওয়াশিংটন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় ভয়াবহ হামলার জন্য দায়ী করেছে। যুক্তরাষ্ট্রকে আরব ও মুসলিম বিশ্বের অপছন্দের কারণ হয়ে ওঠার জন্য গভীর বিশ্লেষণে না গিয়ে বুশ প্রশাসন বরং নয়-এগারোকে ব্যবহার করেছে তাদের স্বল্পমেয়াদি ভূকৌশলগত লক্ষ্য অর্জনে। আরব ভূমিতে মার্কিন দখলদারি এবং অনিষ্পন্ন ফিলিস্তিন সমস্যা ছিল সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর মূল উদ্দীপনা। ২০০৯ সালে কায়রো ভাষণে প্রেসিডেন্ট ওবামা ঘটনার কেন্দ্রে ফিলিস্তিন সংকটের বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তবে নয়-এগারোর পর ইসরায়েলের নির্মম দখলদারি ও তা সম্প্রসারণে আমেরিকার সমর্থন কেবল জোরদারই হয়েছে।’৩
হানটিংটন যে বৃহত্তর ‘সভ্যতাসমূহের সংঘাত’ নিয়ে আলোচনা করেছেন, ফুলার তাকে অতিমাত্রায় তাত্ত্বিক বা কল্পনাপ্রসূত বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলছেন, ‘গোটা একটি সভ্যতার সঙ্গে আরেকটি সভ্যতাকে সংঘাতে লিপ্ত করা খুব কঠিন, কিন্তু হাল আমলে এটি বরং কিছুটা সহজ হয়ে গেছে, যখন যোগাযোগের সুবিধা থাকায় একধরনের দলীয় সমর্থন অনেক বড় আকারে গড়ে ওঠে। টেলিভিশনের পর্দায় অনেক দূরে কোথায় শত্রু দেখতে পেয়ে নিজের ঘরে বসেই একধরনের আবেগ তৈরি হয়—“এরা তো খ্রিষ্টান”, কিংবা “এরা তো মুসলমান” কিংবা “এরা তো পশ্চিমা” এ রকমভাবে। ক্রুসেডই হলো সম্ভবত একটি সভ্যতার সংঘাতের সবচেয়ে কাছাকাছি ঘটনা, যা দুনিয়া ওই সময়ে দেখতে পেয়েছে।’ (পৃ. ১৬২) ফুলার আরও বলছেন, ‘ইসলামের রক্তাক্ত সীমান্ত’ ধারণা নিয়ে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে বরং অনেক জটিল ঘটনা ও বিষয় চলে আসে, যার মধ্যে আছে বাইরের আক্রমণ থেকে নিজস্ব সংস্কৃতিকে রক্ষা করা, পশ্চিমের আগ্রাসী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে অংশীদারি প্রতিরোধ এবং বিভিন্ন রাষ্ট্রে নিজ জনগোষ্ঠীকে সমজাতীয় করে তোলার প্রয়াস। ইসলাম না থাকলে পশ্চিমাবিরোধী মনোভাব আর দেখা যেত না, এমনটা চিন্তা করা অতিসরলীকরণ। তিনি রাশিয়া, চীন ও ভারতের ইতিহাস বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে এই তিনটি সভ্যতার প্রতিটিতেই পশ্চিমাবিরোধী মনোভাব প্রবল আর মুসলমানরা এসব সভ্যতায় নিজেদের খাপ খাইয়ে নিয়েছে।
বইয়ের এই পর্বে পাঁচটি অধ্যায় হলো: ‘তৃতীয় রোম এবং রাশিয়া: গোঁড়া খ্রিষ্টবাদের উত্তরাধিকার রাশিয়া’, ‘রাশিয়া ও ইসলাম: বাইজানটাইনীয় বেঁচে থাকা!’ ‘পশ্চিমে মুসলমান: অনুগত নাগরিক অথবা পঞ্চম বাহিনী?’ ‘ইসলাম ও ভারত’ এবং ‘ইসলাম ও চীন’।
রাশিয়ার সঙ্গে ইসলামের ঐতিহাসিক সম্পর্কের উত্থান-পতন বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ফুলার লিখেছেন, ‘রাশিয়া তার মুসলিম জনগোষ্ঠীকে বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে দেখেছে। প্রথমে দেখেছে শত্রু হিসেবে, তারপর দেখেছে জার সাম্রাজ্যের স্তম্ভ হিসেবে অথবা রুশ সাম্রাজ্যের অনুগত সদস্য হিসেবে অথবা প্রাচ্যে কমিউনিস্টদের সাম্রাজ্যবাদী নীতির বিরোধিতাকারীর সম্ভাব্য নেতৃত্ব হিসেবে অথবা পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আদর্শিক মিত্র হিসেবে অথবা অনির্ভরযোগ্য জাতীয়তাবাদী, ভয়ংকর বিচ্ছিন্নতাবাদী বা সন্ত্রাসী হিসেবে অথবা আরও একবার যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে সম্ভাব্য জোট হিসেবে।’ (পৃ. ১৮৮) তিনি দেখিয়েছেন যে রাশিয়ার অর্থোডক্স খ্রিষ্ট মতবাদ বরাবরই পশ্চিমাদের সন্দেহের চোখে দেখে এসেছে। আর পশ্চিমারাও অর্থোডক্স বা গোঁড়া খ্রিষ্টবাদের প্রতি ভীষণ বিরূপ মনোভাব পোষণ করে আসছে। আর তাই রুশ-মার্কিন বিরোধের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উত্স হলো অর্থোডক্স-লাতিন খ্রিষ্টবাদের বিরোধ। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর রাশিয়ায় ক্যাথলিক ধর্মযাজকদের আনাগোনা বেড়ে যায়। একপর্যায়ে রুশরা বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ে। আর তাই ২০০১ সালে এক আইন করে রাশিয়ায় বিদেশিদের ধর্ম প্রচার কার্যক্রম সীমিত করা হয়, ‘যার লক্ষ্য পাশ্চাত্য খ্রিষ্টবাদ, ইসলাম নয়।‘ তাই ফুলার বলছেন, ‘এভাবে অর্থোডক্স চার্চ রাশিয়ায় ক্যাথলিক, প্রোটেস্টান বিশেষত ইভানজেলিক চার্চের জন্য ধর্মান্তর কার্যক্রম, গির্জা খোলা বা সংগঠিত হওয়া দুরূহ করে দেয়। আরও একবার প্রথাগত জাতীয় ধর্ম সাংস্কৃতিক গৌরব ও জাতীয়তাবাদের গুরুত্বপূর্ণ বাহন হয়ে ওঠে। আর এই ঘটনা পুরোপুরি মুসলিম বিশ্বের সেই ঘটনারই সমান্তরাল বিবেচনা করা যায়, যখন মুসলমান সম্প্রদায় শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ পাশ্চাত্যের মোকাবিলা করেছে ও ধরে নিয়েছে পাশ্চাত্যের কার্যক্রম ইসলামকে দুুর্বল করার জন্যই পরিচালিত হচ্ছে। এটা তাই ধর্মীয় কোনো বিষয় নয়, বরং এটা হলো পরিচিতির বিষয়।’ (পৃ. ১৮৩-১৮৪)
দেখা যাচ্ছে, গোঁড়া খ্রিষ্টবাদের সঙ্গে লাতিন খ্রিষ্টবাদের যুগের পর যুগ চলে আসা বিরোধ যতটা প্রবল, ইসলামের সঙ্গে গোঁড়া খ্রিষ্টবাদের বিরোধ ততটা নয়। এই অবস্থায় যদি ইসলাম না থাকত, তাহলে আজকের মধ্যপ্রাচ্যে প্রাধান্য থাকত গোঁড়া খ্রিষ্টবাদের। আর তাই মধ্যপ্রাচ্যের ওপর রাশিয়ার প্রভাবও অনেক বেশি থাকত। আর তাই এটা মনে করার কোনো কারণ নেই যে খ্রিষ্টান-অধ্যুষিত ইরাকে মার্কিন আগ্রাসনকে ইরাকিরা স্বাগত জানাত। তা ছাড়া একজন প্রবল জাতীয়তাবাদী ও ধর্মনিরপেক্ষ নেতা সাদ্দাম হোসেনকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গদিচ্যুত ও হত্যা করেছে, তিনি মুসলমান হওয়ার কারণেই নয়। ফুলারের বিশ্লেষণ ধরেই বলা যায় যে মুসলমান হওয়ার কারণে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কাজটা সহজ হয়েছে।
প্রাচ্যের গোঁড়া খ্রিষ্টানরা আজও পশ্চিমের ক্রুসেডারদের দ্বারা ১২০৪ সালে ‘খ্রিষ্টান কনস্টানটিনেপল’ আক্রমণ ও ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর কথা ভুলে যায়নি। এই অপরাধ তারা ক্ষমাও করেনি। সে কারণেই প্রায় ৮০০ বছর পরে পোপ দ্বিতীয় জন পল ১৯৯৯ সালে এই ক্ষত নিরাময়ের ক্ষুদ্র প্রয়াস হিসেবে অর্থোডক্স খ্রিষ্টজগত্ সফর করেছিলেন। এটি ছিল হাজার বছরের মধ্যে কোনো ক্যাথলিক পোপের প্রাচ্য সফর।
ফুলার দেখিয়েছেন যে রাশিয়া, চীন ও ভারতে ইসলামের বিস্তার এবং নানা আঘাত ও প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে টিকে থাকা ও এগিয়ে যাওয়ার সুদীর্ঘ পরিক্রমা ইসলামের অন্তর্নিহিত সহনক্ষমতারই বহিঃপ্রকাশ। তিনটি দেশেই মুসলমানরা সংখ্যালঘু হওয়ার পরও তিনটি সভ্যতায় ইসলাম শুধু সম্পৃক্তই হয়নি, বরং সভ্যতাগুলোকে ঋদ্ধ করেছে। বিশেষত ভারতীয় সভ্যতা-সংস্কৃতিতে ইসলামের প্রভাব ও অবদান তো অনেক বিস্তৃত ও সুদূরপ্রসারী। আর তাই ইসলাম না থাকলে বা ইসলাম না এলে হিন্দু-মুসলমান মিশ্রিত মোগল সভ্যতার ঋদ্ধতা থেকে পৃথিবী বঞ্চিত হতো।
৫.
শেষ পর্বটির নাম ‘আধুনিক বিশ্বে ইসলামের অবস্থান’। এখানে তিনটি অধ্যায় হলো: ‘উপনিবেশবাদ, জাতীয়তাবাদ, ইসলাম ও স্বাধীনতার সংগ্রাম’; ‘যুদ্ধ, প্রতিরোধ, জিহাদ ও সন্ত্রাসবাদ’ এবং ‘করণীয় কী? মুসলিম বিশ্বকে সঙ্গে নিয়ে একটি নতুন নীতি’।
এই পর্বে ফুলার যা জোরালোভাবে উপস্থাপন করতে চেয়েছেন, তা হলো ‘প্রতিরোধের বাহন’ হিসেবে ধর্ম, বিশেষত ইসলামের অবস্থান। যখন একটি শক্তিশালী গোষ্ঠী আরেকটি দুর্বল গোষ্ঠীকে অন্যায়ভাবে আঘাত হানে, তার সত্তা ও সংস্কৃতি অস্বীকার করতে চায়, তখন দুর্বল গোষ্ঠী সামর্থ্য অনুযায়ী এই আঘাতের প্রতিরোধে সচেষ্ট হয়। প্রতিরোধের জন্য তার দরকার হয় কিছু মাধ্যম বা বাহন। আর ধর্ম বা ধর্মীয় চেতনা-উদ্দীপনা এ ক্ষেত্রে শক্তিশালী বাহন হতে পারে। ইসলামও সেই বাহনেরই কাজ করেছে বহু ক্ষেত্রে, বিশেষত পশ্চিমা আগ্রাসন ও দখলদারির বিরুদ্ধে, পশ্চিমা আক্রমণের বিরুদ্ধে। আর এই প্রতিরোধকে মোকাবিলার জন্য পশ্চিমা বিশ্বই আবার ধর্মকে সম্পৃক্ত করেছে। তারাই খ্রিষ্টধর্ম ও ইহুদি ধর্মকে ইসলাম ধর্মের মোকাবিলায় দাঁড় করিয়েছে নিজেদের আগ্রাসনকে যুক্তিসংগত হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য।
সে কারণেই দেখা যায়, হানটিংটনসহ অনেক পশ্চিমা পণ্ডিত বেশ সাফল্যের সঙ্গে ‘ইসলাম বনাম ইহুদি-নাসারা’ তত্ত্ব প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছেন। এ প্রসঙ্গে ফুলারের প্রতিধ্বনি করেই যেন আইজাজ আহমদ লিখেছেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশনীতিতে সবচেয়ে বেশি প্রভাব সৃষ্টিকারী খ্যাতিমান পণ্ডিত বার্নাড লুইস হলেন সভ্যতাসমূহের সংঘাত-তত্ত্বের প্রকৃত লেখক। স্যামুয়েল হানটিংটনের অনেক আগেই তিনি লিখেছিলেন যে কমিউনিজমের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বিজয় সম্পন্ন হওয়ার পর পৃথিবীর মৌলিক ও বিসংগত সংঘাত হবে ইহুদি-খ্রিষ্টান সভ্যতার সঙ্গে মুসলমান সভ্যতার। তিনি ঘোষণা করেছিলেন যে নয়-এগারো ছিল ইসলাম ও ইহুদি-খ্রিষ্টান সভ্যতার চূড়ান্ত লড়াইয়ের সূচনার তোপধ্বনি।...সভ্যতা নিয়ে এই বিতর্কের দুটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে। প্রথমত, এটি মুসলমানদের ভূমিতে ইউরোপীয় উপনিবেশবাদের পুরো ইতিহাসকে অস্বীকারের চেষ্টা করছে। অথচ পশ্চিমের বিরুদ্ধে মুসলমানদের ক্ষোভের শিকড় নিহিত আছে এই ইতিহাসে। দ্বিতীয়ত, ক্রমাগত পশ্চিমের “ইহুদি-নাসারা” বৈশিষ্ট্য প্রচার করছে, সেমেটিক-বিরোধী পশ্চিমের পুরো ইতিহাস অস্বীকার করছে, ইসরায়েলকে পশ্চিমের অংশ হিসেবে চিহ্নিত করছে আর এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ঐতিহাসিক ফিলিস্তিনি ভূমিতে ইসরায়েলের দখলদারি-ঔপনিবেশিক চরিত্রকে অস্বীকার করছে। ফিলিস্তিন প্রশ্নে মুসলমানদের স্পর্শকাতরতা তাই এভাবেই পুনর্লিখিত হয়েছে যে এটা ঔপনিবেশীকরণের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া নয়, বরং ইহুদি-নাসারাদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের প্রচণ্ড ঘৃণার প্রকাশ।’৪
ফুলার নিবিড় বিশ্লেষণ করে তাঁর বইয়ে জোরালো ভাষায় বলেন যে ফিলিস্তিন সমস্যার সূত্রপাতের সঙ্গে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই, সম্পর্ক নেই আরব-ইসরায়েল সংকট সৃষ্টিতেও। বরং ইউরোপ থেকে গণহারে ইহুদিদের
আরব ভূমিতে অভিবাসী হওয়ার মধ্য দিয়ে এই সংকট তৈরি করা হয়েছে। পূর্ব ইউরোপ থেকে ইহুদিরা এসে আবাস গড়তে থাকায় স্বাভাবিকভাবে ফিলিস্তিনিরা বিচলিত হয়ে ওঠে। তিনি বলছেন, ‘হোলোকাস্টের অপরাধ পুরোপুরি ইউরোপীয়দের কাঁধে বর্তায়। আর এই হোলোকাস্টই ইহুদিদের চূড়ান্তভাবে ফিলিস্তিনের দিকে ধাবিত করে, যাকে আবার সমর্থন জোগায় অপরাধী ইউরোপীয়রা। তিন-চতুর্থাংশ ফিলিস্তিনি শেষ পর্যন্ত ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের ফলে ইসরায়েলের নৃতাত্ত্বিক শুদ্ধি অভিযান ও নিপীড়নের শিকার হয়ে নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদ হয়। এভাবে ইউরোপীয়দের পাপের মূল্য দিতে হয় ফিলিস্তিনিদের।
যদি ইসলাম না থাকত, তাহলেও খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী ফিলিস্তিনিরা খুশিমনে ইহুদিদের কাছে নিজেদের ভূমি ছেড়ে দিত না কিংবা গেরিলা প্রতিরোধ গড়ে তোলা থেকে বিরত থাকত না। বাস্তবে খ্রিষ্টান ফিলিস্তিনিরাও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গেরিলা আন্দোলন গড়ে তোলায় ভূমিকা রেখেছিল। কালক্রমে ফিলিস্তিনি-ইহুদি জাতিগত বিরোধ ধর্মীয় রূপ নিলেও এর উেস ইসলামের কোনো কিছুই করার ছিল না।’ (পৃ. ৩০৩-৩০৪)
ফুলার সন্ত্রাসবাদের ওপর বিস্তারিত আলোকপাত করেছেন এবং ইসলাম ও সন্ত্রাসবাদকে সমর্থক করে তোলার পশ্চিমা অপচেষ্টার বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছেন। তিনি বলছেন যে দুনিয়ায় কেউই সন্ত্রাসবাদকে নির্মূল করতে পারবে না। তবে একে অবশ্যই নিয়ন্ত্রিত ও সীমিত করা যায়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান নীতি সেদিকে না গিয়ে বরং সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। যেভাবে সন্ত্রাসবাদকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে তার মানে দাঁড়ায়: ‘সন্ত্রাসবাদ হলো, আমি যা বলি তা-ই।’ (পৃ. ৩২৯) কেননা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিভাগ সন্ত্রাসবাদকে সংজ্ঞায়িত করেছে এভাবে: ‘নির্দিষ্টভাবে মাপজোখ করে বেআইনি সহিংসতা বা বেআইনি সহিংসতার হুমকি ব্যবহারের মাধ্যমে ভীতি সৃষ্টি করা এবং তা করে সাধারণত রাজনৈতিক, ধর্মীয় বা আদর্শিক লক্ষ্য অর্জনে সরকার বা সমাজকে চাপ প্রয়োগ করা।’ (পৃ. ৩২৯) ফুলার বলেন যে সহিংসতার বেআইনি ব্যবহার আসলে কী, তা স্পষ্ট করা হয়নি। তার মানে হলো, রাষ্ট্র যা অনুমোদন করে না তাই বেআইনি। এভাবে ‘রাষ্ট্র সমান আইনি’ সমীকরণ তৈরি করা হয়েছে, যা পশ্চিমা বিশ্বের বেশির ভাগ গণতান্ত্রিক দেশে সত্যি হলেও অন্যত্র বিশেষত স্বৈরতান্ত্রিক দেশগুলোতে প্রযোজ্য নয়। কেননা, সেখানে সব বিরোধী পক্ষকে বেআইনি অভিহিত করা হয়।
ফুলার ইতিহাসের বিভিন্ন ঘটনা উল্লেখ করে প্রশ্ন তুলেছেন যে সন্ত্রাসবাদ কি তাহলে পশ্চিমা বিশ্বের সুবিধামতো সংজ্ঞায়িত ও চিহ্নিত হবে কি না। কেননা, সাম্প্রতিক বিশ্বে রাজনৈতিক সহিংসতার অসংখ্যা ব্যবহার হয়েছে আর তার অনেকগুলো হয়েছে বিভিন্ন দেশ-জাতির স্বাধীনতাসংগ্রামে। তিনি বলেন যে যদি পেন্টাগনের সংজ্ঞায়িত ‘বেআইনি সহিংসতা’ মেনে নিতে হয়, তাহলে ১৭৭৬ সালে আমেরিকার বিপ্লবীরা যে বৈধ ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে এই বেআইনি সহিংসতা প্রয়োগ করেছিল, তা গ্রহণ করা যায় না। আর তাহলে আজকের আমেরিকাও পাওয়া যেত না। তিনি আরও বলেন যে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালিত করার পরও কেনিয়ার জোমো কেনিয়াটা বা ইসরায়েলের মেনশাম বেগিন পরবর্তীকালে সফল রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে স্বীকৃত হয়েছেন। আবার বিরাট পরিসরে সন্ত্রাস চালিয়ে প্রতিপক্ষের ওপর প্রচণ্ড ভীতি তৈরি করে জয়ের কৌশলও তো আছে। এ প্রসঙ্গে তিনি হিরোশিমা-নাগাসাকিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আণবিক বোমা নিক্ষেপের উল্লেখ করে বলেন যে এটা তো ভয়ংকর-দানবীয় এক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। ফুলার বরং মনে করেন, ‘অন্য জাতীয়তাবাদীদের মতো বেশির ভাগ মুসলমান যারা জাতীয়তাবাদী অন্যায্যতা-বঞ্চনার নামে লড়াই করছে, তাদের অবশ্যই “সন্ত্রাসী” হিসেবে আখ্যায়িত করা যায় না। বরং তারা হলো রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, যাদের সঙ্গে রাজনৈতিক আচরণ বা সমঝোতা প্রয়োজন। “অন্তর্ঘাত” অবৈধ হতে পারে, তবে অন্যায়ের শিকার হলে এটা হবে মানবিক প্রতিক্রিয়ার নির্যাস।’ (পৃ. ৩৩৪)
ফুলারের এই নিবিড় বিশ্লেষণ অনেককে এই বলে বিভ্রান্ত করতে পারে যে তিনি হয়তো সন্ত্রাসবাদকে সমর্থন করছেন বা কিছুটা হলেও উত্সাহিত করছেন। আসলে সন্ত্রাসবাদের আগা-গোড়া সম্পর্কে অস্পষ্টতা ও ঐতিহাসিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট সম্পর্কে অজ্ঞতাই এই বিভ্রান্তির কারণ। আর তাই ফুলারের বিশ্লেষণ খুব মনোযোগ সহকারে পর্যালোচনা করা প্রয়োজন।
তা ছাড়া ফুলার স্পষ্ট করেই বলেছেন, ‘শেষ পর্যন্ত সন্ত্রাসবাদ শেষ করার বোঝা বা দায় মুসলমান জনগোষ্ঠীর নিজেদের কাঁধেই পড়ে। তবে এটা করতে হলে অবশ্যই প্রথমে সেসব পরিস্থিতির অবসান ঘটাতে হবে যা কিনা উগ্রবাদ ও ব্যাপকভিত্তিক আমেরিকাবিরোধী মনোভাব তৈরি করেছে। এর মানে হলো মুসলমানদের ভূমিতে আর কোনো ভিনদেশি বুট নয়, বিদেশি সৈন্য দ্বারা কোনো আক্রমণ নয়।...মুসলমান সমাজদের অবশ্যই শান্ত ও স্থিত হয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসার সুযোগ দিতে হবে। আর শুধু মুসলমানরাই সন্ত্রাসবাদ সত্যিকারভাবে মোকাবিলায় নিজেদের সমাজের ভেতরে চিন্তা-চেতনায় পরিবর্তন আনতে পারে।’ (পৃ. ৩৩৪) তিনি এও বলেছেন যে সবকিছুর জন্য ইসলামকে যেমন দায়ী করা যায় না, তেমনি যাবতীয় সমস্যার জন্য পশ্চিমা বিশ্বকেও একতরফাভাবে দায়ী করা যায় না।
৬.
গ্রাহাম ই ফুলারের দীর্ঘ গবেষণালব্ধ ও পরিশ্রমের ফসল এই বইটির তাত্পর্য সুদূরপ্রসারী। আজকের দুনিয়ায় যখন ইসলাম ও সন্ত্রাসবাদকে সমার্থক হিসেবে প্রতিষ্ঠার পশ্চিমা প্রয়াস ক্রমেই সাফল্য পাচ্ছে, তখন এর বিরুদ্ধ স্রোতের যাত্রী হিসেবে ফুলার আমাদের নিয়ে যান এক আশ্চর্য ও বিচিত্র অভিযাত্রায়। তিনি ইতিহাসের পথপরিক্রমা ধরে বিশ্লেষণ করে আমাদের দেখান যে ইসলাম না থাকলেও মধ্যপ্রাচ্যে আরব, পারসিক, তুর্কি, কুর্দি, ইহুদি এমনকি বারবার ও পশতুনের মতো নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠী ভূরাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করত ও বিরোধে লিপ্ত থাকত। আর ইসলাম না থাকলে খ্রিষ্টধর্ম বিশেষত গোঁড়া খ্রিষ্টবাদই হতো মধ্যপ্রাচ্যের প্রধান ধর্ম। আর থাকত আজকের মতোই অল্প কিছু ইহুদি ও জরাথ্রুস্টবাদী। তাতে করে পশ্চিমের সঙ্গে মিলেমিশে শান্তিপূর্ণভাবে থাকা নিশ্চিত হতো না। মধ্যপ্রাচ্যের খ্রিষ্টানরা অস্ত্র হাতে আগত ইউরোপের খ্রিষ্টানদের স্বাগত জানাত না।
ফুলার প্রশ্ন রাখেন, যদি মধ্যপ্রাচ্যে ও উত্তর আফ্রিকায় গোঁড়া খ্রিষ্টবাদীরা প্রাধান্য বিস্তার করে থাকত, তাহলে কি তারা নিজেদের মাটিতে ইউরোপীয়দের উপনিবেশ বা ঘাঁটি গাড়ার জন্য স্বাগত জানাত? উত্তরটাও তিনি দেন এভাবে যে না, খ্রিষ্টান-অধ্যুষিত মধ্যপ্রাচ্য পশ্চিমা তেল কোম্পানিগুলোকে খুশিমনে স্বাগত জানাত না। বরং নিজেদের ভূমি, বাজার, সার্বভৌমত্ব ও ভাগ্যকে পশ্চিমা নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করতে উপনিবেশবাদবিরোধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলন গড়ে তুলত, যেমনটা গড়েছে ভারতের হিন্দুরা, চীনে কুনফুশীয়রা, ভিয়েতনামে বৌদ্ধরা এবং আফ্রিকায় খ্রিষ্টানরা। এ প্রসঙ্গে ফুলার লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে তেল, অর্থনীতি ও রাজনীতিতে মার্কিন আধিপত্যের বিরুদ্ধে সেখানকার মানুষের লড়াইয়ের দীর্ঘ ইতিহাসের কথা স্মরণ করিয়ে দেন। তিনি বলেন যে নিশ্চিতভাবেই ফরাসিরা খ্রিষ্টান-অধ্যুষিত আলজেরিয়া দখল করে নিত সমৃদ্ধ কৃষিভূমির জন্য এবং সেখানে উপনিবেশ গড়ে তুলত। ইথিওপিয়াবাসীর খ্রিষ্টান হওয়া কোনোভাবেই ইতালীয়দের বিরত করত না সেখানে নিষ্ঠুরভাবে উপনিবেশ গড়ে তোলায়। সোজা কথা, ইসলামপ্রধান মধ্যপ্রাচ্য যেভাবে ইউরোপীয় উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল, ইসলামের বদলে খ্রিষ্টধর্ম থাকলেও প্রতিরোধ-প্রতিক্রিয়া এ রকমই হতো।
ইসলাম না থাকলে মধ্যপ্রাচ্য নিশ্চয়ই অনেক বেশি গণতান্ত্রিক হতো? এই প্রশ্নের ইতিবাচক জবাব দেওয়ার পক্ষে নন ফুলার। তিনি বলেন যে ইউরোপের একনায়কতন্ত্রের ইতিহাস পরিক্রমায় নিলে এ রকম আশা করা যায় না। সত্তরের দশকের মাঝামাঝি এসে স্পেন ও পর্তুগালের কঠোর একনায়কতন্ত্রের সমাপ্তি হয়েছে। মাত্র কয়েক দশক আগে গির্জাসম্পৃক্ত একনায়কতন্ত্র থেকে গ্রিক বেরিয়ে এসেছে। খ্রিষ্টান-অধ্যুষিত রাশিয়ায় কার্যত এখনো একনায়কতন্ত্র। লাতিন আমেরিকায় একনায়কেরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মদদে ও ক্যাথলিক গির্জার সহযোগিতা নিয়েই বছরের পর বছর ক্ষমতা আঁকড়ে থেকেছে। বেশির ভাগ খ্রিষ্টান-অধ্যুষিত আফ্রিকার অবস্থাও ভালো নয়। তাই ফুলারের পাল্টা প্রশ্ন, যদি খ্রিষ্টপ্রধান মধ্যপ্রাচ্য হতো, সেটা কেন ব্যতিক্রমী হতো?
মধ্যপ্রাচ্যে ফিলিস্তিন সমস্যার উল্লেখ করে ফুলার বলেন, সহস্র বছরের বেশি সময় ধরে খ্রিষ্টানরাই নির্লজ্জভাবে ইহুদিদের ওপর নির্যাতন চালিয়েছে, খ্রিষ্টানরাই হোলোকাস্ট ঘটিয়ে লাখ লাখ ইহুদি নিধন করেছে। সেমেটিকবিরোধী ভয়াবহ কর্মকাণ্ড গভীরভাবে প্রোথিত আছে পশ্চিমা খ্রিষ্টবাদের মাটিতে ও সংস্কৃতিতে। আর তাই ইহুদিরা ইউরোপের বাইরে নিজেদের আবাসভূমির সন্ধান অব্যাহত রাখত, জায়নবাদী আন্দোলন এখনকার মতোই অব্যাহত থাকত আর ফিলিস্তিনেই ঘাঁটি গাড়ত। নয়া ইহুদি রাষ্ট্র ফিলিস্তিনের সাড়ে সাত লাখ আরব অধিবাসীকে নিজেদের মাটি থেকে বিতাড়িত করত যদি তারা সবাই খ্রিষ্টান হতো, তাহলেও। বাস্তবে তো বিতাড়িত আরবদের মধ্যে খ্রিষ্টানও ছিল, যারা নিজ ভূমি রক্ষায় লড়াই করেছিল। আর তাই ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সমস্যা আজও অব্যাহত থাকত জাতীয়তাবাদী, নৃৃতাত্ত্বিক ও ভৌগোলিক সংঘাত হিসেবে, যা কিনা সম্প্রতি এসে ধর্মীয়ভাবে উজ্জীবিত হয়েছে। ফুলার এও মনে করিয়ে দেন যে মধ্যপ্রাচ্যে আরব জাতীয়তাবাদের উত্থানের প্রথম পর্বে আরবীয় খ্রিষ্টানদেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। প্রথম প্যান-আরব বাথ পার্টির আদর্শিক স্থপতি হিসেবে সরোবনে শিক্ষা গ্রহণকারী সিরীয় খ্রিষ্টান মিশেল আলফাকের নাম করা হয়।
ফুলার জোর দিয়ে বলেন যে ইসলাম যদি না থাকত আর মধ্যপ্রাচ্যে যদি প্রাচ্য খ্রিষ্টানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ অবস্থায় বসবাস করত, তাহলেও পশ্চিমাদের সাম্রাজ্যবাদী অভিযান এখানে বজায় থাকত তেল ও অন্যান্য স্বার্থে। পশ্চিমা শক্তি নিজেদের স্বার্থেই মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্রে রদবদল করত আর নিজেদের অনুগত সরকার বসাত। আর তাই আজকের মতো ফিলিস্তিনকে পুড়তে হতো, ইরানিরা প্রবল জাতীয়তাবাদী হিসেবে থাকত। দেখা যেত ফিলিস্তিনিরা ইহুদিদের, চেচেনরা রুশদের, পারসিকরা আমেরিকান ও ব্রিটিশদের, কাশ্মীরিরা ভারতীয়দের, তামিলরা সিংহলিদের আর উইঘুর ও তিব্বতিরা চীনাদের প্রতিরোধ করত।
ইসলামকে নিয়ে আজকে পশ্চিমা দুনিয়া ও অন্যত্র যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি আলোচিত, তা হলো সন্ত্রাসবাদ। এই বইয়ে ফুলার প্রশ্ন করেছেন, ইসলাম না থাকলে কি নয়-এগারো হতো না? জবাবও তিনি দিয়েছেন এভাবে যে মধ্যপ্রাচ্যে বছরের পর বছর আমেরিকার নীতি ও কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে জমে থাকা ক্ষোভের প্রকাশ তো অন্য কোনোভাবে হতো। তিনি বলেন যে যখন আরও অনেক দীর্ঘস্থায়ী ক্ষোভ থাকে, তখনো শুধু ধর্মের সম্পৃক্ততাকেই খুব সহজে দায়ী করা যায়। আল-কায়েদার সন্ত্রাসীদের কাছে ইসলাম তো একটি আতশি কাচের মতো ব্যবহূত হয়েছে যে আতশি কাচ কিনা সূর্যালোক থেকে অগ্নি প্রজ্বলন করতে পারে। জমে থাকা অভিন্ন ক্ষোভ ও হতাশাকে একত্র করে বিদেশি আগ্রাসনকারীদের বিরুদ্ধে আঘাত হানা হয়েছে।
ফুলার আমাদের এটাও মনে করিয়ে দেন যে পশ্চিমারা সন্ত্রাসবাদের জন্য ইসলামকে অভিযুক্ত করে ইতিহাসের বিকৃতি ও বিস্মৃতি ঘটিয়েছে। তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, ফিলিস্তিনি ইহুদি গেরিলারা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদ চালিয়েছিল। শ্রীলঙ্কার হিন্দু তামিল ‘টাইগাররা’ আত্মঘাতী বোমা হামলার কৌশল উদ্ভাবন করেছিল এবং এক দশকের বেশি সময় ধরে এই কাজে বিশ্বব্যাপী নেতৃত্ব দিয়েছিল। ভারতের প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী তো তামিলদের আত্মঘাতী বোমা হামলায়ই নিহত হন। শিখদের সুসংগঠিত সন্ত্রাসবাদে প্রাণহানি ঘটে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর। সারা ভারতে আতঙ্ক তৈরি করে শিখ সন্ত্রাসীরা তো আটলান্টিকের ওপর এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান হাইজ্যাক করেছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় মেসিডোনিয়ার সন্ত্রাসীরা বলকান অঞ্চলে আতঙ্ক তৈরি করেছিল। ১৯ শতকের শেষ ভাগে ও ২০ শতকের প্রথম দিকে ইউরোপ ও আমেরিকায় ‘নৈরাজ্যবাদীরা’ কয়েক ডজন বড় বড় হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছিল। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে কয়েক দশক ধরে আইরিশ রিপাবলিকান আর্মির সন্ত্রাস কিংবা ভিয়েতনামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কমিউনিস্ট গেরিলা ও সন্ত্রাসীদের আঘাত অথবা মালয়েশিয়ায় কমিউনিস্টরা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে, কেনিয়ায় মাউ মাউ সন্ত্রাসীরা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের আশ্রয় নিয়েছিল। তালিকা অনেক দীর্ঘ হতে পারে উল্লেখ করে ফুলার বলেন যে সন্ত্রাসবাদ চালাতে গেলে মুসলমান হতে হয় না। তিনি আরও বলেন যে অব্যাহতভাবে ইসরায়েল বা সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন, দখলদারি, উত্খাত ও হস্তক্ষেপে ক্ষুব্ধ হয়ে আরব মুসলমান বা খ্রিষ্টানরা তাহলে কেন একই ধরনের গেরিলা কায়দা বা সন্ত্রাসী তত্পরতার পথ বেছে নেবে না? বরং প্রশ্ন হতে পারে যে এটা আরও আগে কেন হয়নি? যদি ইসলাম আধুনিকতা ঘৃণাই করবে, তাহলে নয়-এগারো পর্যন্ত কেন অপেক্ষা করতে হলো হামলা চালানোর জন্য? কেন ২০ শতকেই ইসলামি চিন্তাবিদেরা সংস্কৃতিগত স্বতন্ত্র রক্ষা করেই আধুনিকতা গ্রহণ করার জন্য আহ্বান জানিয়েছিলেন?
ফুলার আমাদের ভাবনার গভীরে নিয়ে যান এই বলে যে যদি ইসলাম কখনোই প্রতিরোধের বাহন হিসেবে না থাকত, তাহলে অবশ্যই মার্ক্সবাদ থাকত। এটা এমন এক আদর্শ যা অসংখ্য সন্ত্রাসী, গেরিলা ও জাতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনকে উদ্বুদ্ধ করেছে। কলম্বিয়ায় ফারক, পেরুতে শাইনিং পাথ, ইউরোপে রেড আর্মি ফ্যাকশন গুটি কয়েক নামমাত্র। পপুলার ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অব প্যালেস্টাইনের প্রতিষ্ঠাতা জর্জ হাবাশ ছিলেন একজন গ্রিক অর্থোডক্স খ্রিষ্টান ও মার্ক্সবাদী, যিনি বৈরুতের আমেরিকান ইউনিভার্সিটিতে পড়ালেখা করেছেন। বহু ফিলিস্তিনি খ্রিষ্টান হাবাশকে সমর্থন দিয়েছেন।
ফুলার যুক্তি দিচ্ছেন যে যারা বিদেশি আগ্রাসনকারী বা নির্যাতকদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে, তারা তাদের কাজকে গৌরবান্বিত হিসেবে প্রতিপন্ন করার জন্য কিছু ছত্রচ্ছায়া বা ব্যানার চায়। ন্যায়বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক শ্রেণিসংগ্রাম এ রকম একটি ছত্রচ্ছায়া হিসেবে বিবেচিত হয়। জাতীয়তাবাদ আরও ভালো। তবে ধর্ম হলো সর্বোত্তম। আর সর্বত্রই ধর্ম জাতীয়তা ও নৃতাত্ত্বিকতা চাঙা করতে বড় ভূমিকা রাখে, বিশেষত শত্রু যদি হয় ভিন্ন ধর্মাবলম্বী। এসব ক্ষেত্রে বিরোধ-সংঘাতের উত্স নয়, বরং বাহন হয়ে ওঠে ধর্ম।
বইটিতে ফুলার আমাদের কাছে এই অভিমতও তুলে ধরেন যে আমরা এখন এমন একটা সময়ে বাস করছি, যখন সন্ত্রাস প্রায়ই দুর্বলের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে। এটি ইতিমধ্যে আফগানিস্তান, ইরাক ও অন্যত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর অতুলনীয় শত্তিমত্তাকে বাধাগ্রস্ত করেছে। আর তাই অনেক অমুসলিম সমাজে বিন লাদেনকে ‘পরবর্তী চে গুয়েভারা’ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। প্রচণ্ড প্রভাবশালী মার্কিন শক্তিমত্তাকে সাফল্যের সঙ্গে প্রতিহত করার আহ্বানই এর কারণ। দুর্বলরা পাল্টা আঘাত হানছে, এই আবেদনটি ইসলাম বা মধ্যপ্রাচ্যের সংস্কৃতিকে ছাড়িয়ে বড় হয়ে উঠেছে।
যদি ইসলাম না থাকত, তাহলে কি পৃথিবী আরও বেশি শান্তিময় হতো না—এই প্রশ্নের উত্তর দিয়ে ফুলার তাঁর বইয়ে উপসংহার টানছেন চূড়ান্তভাবে। তিনি বলছেন, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের নিরন্তর বিরোধ-উত্তেজনায় ইসলাম নিঃসন্দেহে বাড়তি একটি মাত্রা যুক্ত করেছে, সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে জটিলতা বাড়িয়ে দিয়েছে। তবে ইসলাম এসব সমস্যার কারণ নয়। অথচ সমস্যার কারণ হিসেবে বিশ্বের একক পরাশক্তির দুনিয়া দাপিয়ে বেড়ানোর প্রভাব খুঁজে দেখার চেয়ে ইসলামকে দাঁড় করানো অনেক সোজা।
গোটা বইয়ে ইতিহাসের পরিক্রমাসহ বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণের আলোকে ফুলার তাই আরও বলছেন যে ইসলাম না থাকলেও আজকের দুনিয়া বিদ্যমান বেশির ভাগ রক্তাক্ত সংঘর্ষ অব্যাহত থাকা দেখতে পেত, যেখানে ভূরাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করত যুদ্ধ ও নির্যাতন। ধর্মের বদলে অন্য কোনো কিছু ব্যবহূত হতো জাতীয়তাবাদ ও স্বাধীনতাসংগ্রামের প্রেরণা ও ছত্রচ্ছায়া হিসেবে। নিশ্চয় ইতিহাসের পরিক্রমা এখনকার মতো হতো না। তবে মানব ইতিহাসের বৃহত্তর ঐতিহাসিক ও ভূরাজনৈতিক ইস্যু অর্থাত্ নৃতাত্ত্বিকতা, জাতীয়তাবাদ, উচ্চাশা, লোভ, সম্পদ, স্থানীয় নেতৃত্ব, গোত্র, আর্থিক প্রাপ্তি, ক্ষমতা, হস্তক্ষেপ এবং বহিরাগত, আগ্রাসনকারী ও সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে প্রবল ঘৃণার কারণে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে বিরোধ অব্যাহত থাকতই। ফুলার মনে করিয়ে দেন যে বিংশ শতকে মানব ইতিহাসের প্রধান প্রধান আতঙ্ক প্রায় সবই ধর্মনিরপেক্ষ শাসনক্ষেত্র থেকে সৃষ্ট। কঙ্গোতে নৃশংস গণহত্যা পরিচালনাকারী বেলজিয়ামের রাজা দ্বিতীয় লিওপোল্ড, হিটলার, মুুসোলিনি, লেনিন ও স্ট্যালিন, মাও এবং পল পটের নাম এ ক্ষেত্রে উল্লেখ করেছেন তিনি। আরও বলেছেন যে ইউরোপীয়রা দু-দুবার বিশ্বযুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে ও তাতে গোটা বিশ্বকে জড়িয়েছে। এর কোনো তুলনাই ইসলামের ইতিহাসের সঙ্গে হতে পারে না। আর তাই যাঁরা মনে করেন যে ইসলাম না থাকলে দুনিয়াতে দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ-সহিংসতা অনেক কম হতো, তারা সত্য ভুলে যান। কঠিন সত্য হলো এই যে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ-সহিংসতা আজকে আমরা যেমন দেখছি, ইসলামের অবর্তমানে তার খুব একটা ব্যতিক্রম হতো না।
ফুলারের বিশ্লেষণের সঙ্গে কোনো কোনো ক্ষেত্রে দ্বিমত করার অবকাশ রয়েছে। বিশেষত ইতিহাসের বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহ ও ব্যাখ্যা নিয়ে একাধিক ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে, রয়েছে পাল্টাযুক্তি। আর তাই তাঁর উপসংহারের সঙ্গেও অনেকে, বিশেষত পাশ্চাত্যঘেঁষা, পণ্ডিতেরা একমত নন। একইভাবে পাশ্চাত্য গণমাধ্যম ও প্রচারযন্ত্রের কল্যাণে দুনিয়াজুড়ে অন্য ধর্মাবলম্বী মানুষের ভেতর ইসলাম ও মুুসলমান সম্পর্কে এতটাই নেতিবাচক ধারণা গেঁড়ে বসেছে যে প্রসারিত দৃষ্টি ও মুক্তমন নিয়ে ফুলারের বিশ্লেষণ ও উপসংহার উপলব্ধি করতে সক্ষম মানুষের সংখ্যা কমই বলতে হবে। সর্বোপরি সিআইএর একজন সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কেন ও কী উদ্দেশ্যে এ রকম একটি বই রচনা করলেন বা এর পেছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরই গোপন কোনো মদদ আছে কি না, এজাতীয় সন্দেহের জাল ছড়ানোর কাজটিও রয়েছে। অবশ্য হানটিংটন সম্পর্কেও বলা হয় যে তাঁকে সিআইএ অর্থায়ন করেছে আর পশ্চিমা গোষ্ঠী বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাঁকে দিয়ে সভ্যতাসমূহের সংঘাত বইটি লিখিয়েছে গোটা দুনিয়ার ওপর তার আধিপত্য বিস্তারকে জায়েজ করতে।
এত কিছুর পরও গ্রাহাম ই ফুলারের বইটি কিন্তু গভীরভাবে চিন্তা করার বিরাট এক দুয়ার খুলে দিয়েছে। অনেক প্রশ্নের জবাব মেলে ধরেছে। অনেক বিভ্রান্তিকর ধারণার অপনোদন করেছে। এটা প্রতিষ্ঠা করেছে যে ইসলাম সভ্যতাসমূহের সংঘাত সূত্রপাতে বা বিস্তারে কোনো ভূমিকা রাখেনি, বরং সংঘাত অনিবার্য হওয়ায় মোকাবিলা করতে গিয়ে জড়িয়ে পড়েছে। ইসলাম সন্ত্রাসবাদের কোনো কারণ নয়, বরং পশ্চিমা আগ্রাসন-হস্তক্ষেপের প্রতিরোধের শক্তিশালী বাহন হয়ে উঠেছে। সর্বোপরি ইসলাম না থাকলেও আজকের দুনিয়ায় সংঘাত ও আগ্রাসনের চিত্রটি আমূল বদলে যেত না, বড়জোর কিছুটা এদিক-ওদিক হতো।
তথ্যসূত্র
১. রশীদ, মো. আবদুর (অনূদিত), স্যামুয়েল পি হানটিংটনের দ্য ক্ল্যাশ অব সিভিলাইজেশনস অ্যান্ড দ্য রিমেকিং অব ওয়ার্ল্ড অর্ডার, পৃষ্ঠা-৩০৪ (ঢাকা: অনিন্দ্য প্রকাশ, ফেব্রুয়ারি ২০১০)।
২. John Cherian, ‘War of Terror’, Frontline, Vol.28, No.20, October 7, 2011. pp-4.
৩. John Cherian, ibid, 2011, pp-5.
৪. Aijaz Ahmad, ‘Broken Countries, Broken Economies’, Frontline, Vol.28, No.20, October 7, 2011. pp-28.
গুরুত্বপূর্ণ শব্দগুচ্ছের বাংলা অনুবাদ
Islamophobia ইসলামভীতি
Neoconservative নয়ারক্ষণশীল
Islamofascism ইসলামী ফ্যাসিবাদ
Global War on Terror সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বৈশ্বিক যুদ্ধ
Heresy and Power উত্পথ ও ক্ষমতা’
Abrahamic Faiths ইব্রাহিমীয় বিশ্বাস
Byzantium versus Rome: Warring Christian Polarities বাইজানটানীয় বনাম
রোমান: খ্রিস্টীয় মেরুকরণের যুদ্ধ
Eastern Orthodox Christianity প্রাচ্যের গোঁড়া খ্রিস্টবাদ
Western or Roman Catholic Christianity পশ্চিমের বা রোমান গোঁড়া খ্রিস্টবাদ
Eastern Orthodox Church প্রাচ্যের গোড়া গির্জা
Fault Lines ফাটল রেখাগুলো
Meeting at the Civlizational Boarder of Islam ইসলামী সভ্যতার সীমান্তে মিলন
The Clash of Civilisations সভ্যতাসমূহের সংঘাত
Bloody Borders of Islam ইসলামের রক্তাক্ত সীমানাসমূহ
War of Terror সন্ত্রাসের যুদ্ধ
Vehical of Resistence প্রতিরোধের বাহন
Islam vs Judeo-Christian ইসলাম বনাম ইহুদি-নাসারা’