সীমান্ত ইতিহাস
১৮৭৪-১৯৪৭ কালপর্বে বাংলা-আসামের সীমান্তে অদলবদল এবং সিলেটের গণভোটের ইতিহাস
সারসংক্ষেপ
ব্রিটিশ শাসনামলে ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের আকৃতি দেওয়ার ক্ষেত্রে ১৮৭৪ সালে একটি নতুন প্রদেশ হিসেবে আসামের সৃষ্টি এবং বাংলা থেকে সিলেটকে আসামে স্থানান্তর ছিল নিছক এক ‘তামাশা’। ১৮৭৪ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত সিলেট আসাম প্রদেশের একটি অংশ হয়েই থাকল, যেটি এই অঞ্চলে একটি তাত্পর্যময় পরিণতি ডেকে এনেছিল। এই প্রবন্ধে রাজনৈতিক সঞ্চালনশীলতার বা গতিশীলতার ওপর ভিত্তি করে সংরক্ষিত সরকারি উত্স যাচাই ও পুনঃ যাচাই, প্রাসঙ্গিক আত্মজৈবনিক টেক্সট পাঠ করা হয়েছে। উপনিবেশ ও উত্তর-উপনিবেশ সময়কালে বিকশিত ইতিহাসবিদ্যার আলোকে বাংলা ও আসামের মধ্যবর্তী একটি স্বতন্ত্র অঞ্চলকে ‘কাল্পনিক’ ইতিহাস থেকে মুক্ত করে ‘অভিজ্ঞতাবাদী’ ইতিহাসের সাহায্যে জানার প্রচেষ্টা করা হয়েছে। দেশভাগের মূল পাঠ (বাংলা) থেকে বিভাজনের এই যে উপ-পাঠ (সিলেট) সেটা আরও বেশি কৌতূহলোদ্দীপক বা ষড়যন্ত্রমূলক ছিল। কারণ, সিলেটের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো এই বিষয়ের ইতিহাসকে আমাদের ক্ষুদ্র পর্যায়ে পাঠ করতে প্রস্তাব দেয়। কয়েক প্রজন্মের ইতিহাসবিদদের লেখায় সিলেটের আপামর জনগণের মনোজগেক ভাসা-ভাসা দৃষ্টিভঙ্গিতে (বাস্তবতা থেকে কিছুটা দূরে গিয়ে হালকাভাবে) দেখার একটি প্রবণতা বা ঝোঁক লক্ষ করা যায়। যার ফলে, বর্তমান এই প্রবন্ধটি সমন্বিত উেসর পরীক্ষা-নিরীক্ষার ওপর ভিত্তি করে এই যুক্তি প্রদান করছে যে আসলে পুরো বাংলা এবং আসাম সীমান্তজুড়ে এই নতুন প্রদেশটি বাস্তবায়িত হয়েছিল ইতিহাসকে ডিঙিয়ে। মূলত ১৮৭৪ সাল থেকেই নতুন এই প্রদেশে এলিটদের কণ্ঠস্বর (যার অধিকাংশই হিন্দু এবং আংশিক মুসলিম এলিট) ছিল প্রভাবশালী। ১৯৪৭ সালের গণভোটে বিশেষ করে ‘পাকিস্তানপন্থী’ দলিত (নিম্নবর্ণীয় হিন্দু) এবং মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিত ‘ভারতপন্থী’ মৌলভিগণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ‘খেলোয়াড়’ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। তবে সিলেটের গণভোট, বিশেষ করে ওই অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তগুলোর ওপর আলোকপাত করে পরিচালিত তেমন কোনো গবেষণা পাওয়া যায়নি। ফলে বর্তমান গবেষণা প্রবন্ধে ১৮৭৪ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত আসাম প্রদেশের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং সিলেটের গণভোট বিষয়টির ক্ষেত্রে উত্থাপিত বহুমুখী প্রশ্নের সম্ভাব্য জবাব কেবল অনুসন্ধানের মাধ্যমে এক নতুন মাত্রা উন্মোচন করা হবে এবং সেই সঙ্গে এই প্রবন্ধ এ সীমান্ত জেলার মানুষের মধ্যে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ এবং ‘ধার্মিক’ শক্তির পরস্পর বিরোধিতার চেয়ে অধিক পরিমাণে ‘সাম্প্রদায়িক চৈতন্য বা মানস’ বিদ্যমান রয়েছে, সেদিকেও এক পলক নজর দেওয়ার চেষ্টা করবে।
মুখ্য শব্দগুচ্ছ: আসাম প্রদেশ, সিলেট, চা, ব্রিটিশ-সিলেটি, গণভোট, সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদী।
ভূমিকা
১৮৭০-এর দশকের সূচনাপর্বে ব্রিটিশ-ভারতের উত্তর-পূর্ব প্রান্তের একটি সীমানা প্রদেশ হিসেবে আসামের জন্ম ছিল উল্লেখযোগ্য ঘটনা এবং ওই নতুন কাঠামোতে সিলেটের অন্তর্ভুক্তি ছিল ‘নাটকীয়’ ও কৌতূহলোদ্দীপক এক বিষয়। বৈশ্বিক পণ্য হিসেবে চা-এর আবির্ভাব সিলেটের সীমান্ত স্থানান্তরের পেছনে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে কাজ করেছিল। ১৮৭৪ সালে বাংলা থেকে এ অঞ্চলের পৃথক্করণ এর হিন্দু এবং অল্পসংখ্যক মুসলিম ধনিক/এলিট শ্রেণিকে আসামে ঔপনিবেশিক প্রক্রিয়ায় রাজনীতি, প্রশাসন এবং শিক্ষায় আধিপত্যবাদী অবস্থান দিয়েছিল। এ প্রবন্ধে যে প্রশ্নগুলোর উত্তর জানতে চাওয়া হবে সেগুলো হলো: ঔপনিবেশিক শাসক কর্তৃক জন্ম নেওয়া নতুন রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কাঠামো প্রতিষ্ঠায় সিলেটিদের প্রতিক্রিয়া কী ছিল? এর ফলাফল বা পরিণতিগুলো কী ছিল?
১৮৭৪ সাল থেকে রাজনৈতিক সঞ্চালনশীলতার দিকে দৃষ্টিপাত করে জাতিরাষ্ট্র বা রাষ্ট্রসমূহ নির্মাণের ইতিহাস পর্যবেক্ষণ এবং পুনঃপরীক্ষা করে দেখা হবে কীভাবে দক্ষিণ এশিয়ায় আত্মসত্তার রাজনীতি ও ‘পরিচয়সমূহ’ আবির্ভাবের সমান্তরালে ধর্মীয় সম্প্রদায়সমূহ ও নিম্নবর্গীয় মানুষের বুদ্ধিদীপ্ত রাজনীতিও কাজ করেছিল। অভিজাত হিন্দুদের ‘সুবিধাবাদী’ রাজনৈতিক অবস্থান বা পরিস্থিতি অনুযায়ী তাদের ‘ভোল পাল্টানো’র কর্মটি ছিল খুবই মজার এক বিষয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে তারা ১৯২০ ও ১৯৩০ সালে সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছিল ‘বাংলায় ফিরে আসা’ আন্দোলনেই, কিন্তু পরে বিশেষ করে ১৯৪৭ সালের ভাগ্যনির্ধারণী মুহূর্তে ওই একই নেতারাই তাঁদের সেই অবস্থানের সম্পূর্ণ উল্টো পথে হেঁটেছিলেন এবং বাংলার সঙ্গে সিলেটকে পুনরায় একত্রীকরণের বিরুদ্ধে তাঁদের সমস্ত রাজনৈতিক শক্তিকে সচল করেছিলেন। এসব ‘আত্মস্বীকৃত’ বাঙালি জাতীয়তাবাদীরাই ১৯৪৭-পরবর্তী নতুন রাষ্ট্রে ক্ষমতা হারানোর সম্ভাব্য প্রভাব সম্পর্কে সচেতন হয়েছিলেন এবং একই সঙ্গে মুসলিম কৃষক সম্প্রদায় এবং নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণির মুসলমানদের ক্ষমতাকাঠামোতে আবির্ভূত হওয়ার ফলে একটি সংকীর্ণ সামাজিক পরিসর সৃষ্টির ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন। কিছু সংশয়ের সঙ্গে ওসব ভয় চূড়ান্তভাবে ১৯৪৭ সালে তাঁদের বাধ্য করল এই দাবি জানাতে যে সিলেটকে অবাঙালি অধ্যুষিত আসাম অংশের সঙ্গেই রাখা উচিত হবে। ১৮৭৪ থেকে আসামের রাজনীতি, বাঙালি বনাম অহমীয়া এলিটদের প্রতিযোগিতা ও সিলেটের গণভোটের ওপর আলোকপাত করে এই প্রবন্ধে দেখানো হয়েছে যে কীভাবে তৃণমূল পর্যায়ে শ্রেণি, গোত্র ও ধর্মের ওপর ভিত্তি করে বহুমুখী ‘পরিচয়সমূহ’ কাজ করে। এমনকি পূর্ব লন্ডন— যদিও তা পাঁচ হাজার মাইল দূরে অবস্থিত, সেখানে যেসব সিলেটি বসবাস করছিল, তারাও ১৯৪৭ সালের ঘটনাপ্রবাহে জড়িয়ে পড়েছিল। এই প্রবন্ধে আসাম কর্তৃক সিলেটকে বর্ধিত অংশ হিসেবে সংযোজন এবং পরে ১৯৪৭ সালে আবার তা পূর্ব বাংলায় ফিরিয়ে দেওয়ার আনুপূর্বিক ইতিহাস উপস্থাপন করা হবে। ১৮৭৪ থেকে যে পরিবর্তন তা করার ফলে কি হিন্দু, কি মুসলিম, কি আসামের অধিবাসী—সবার জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এসবের ফলে সর্বদাই তাদের সাড়াশব্দে পরস্পরবিরোধী একটা পরিবেশ বিদ্যমান ছিল। এতে মনে হয় মৌলভি এবং দলিতরা নীরব ছিলেন না বরং তাঁদের উল্লেখযোগ্য একটি অংশকেও গণভোটকালীন সচেতন দেখা গেছে; তা সত্ত্বেও ওই বিষয়ে তাঁদের সাড়া বা মতামত শুধু বিচিত্রই ছিল না, একই সঙ্গে জটিলও ছিল।
বিদ্যমান গবেষণার পুনঃপরিদর্শন এবং অনুসন্ধানের ক্ষেত্র
ব্রিটিশ-ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বিশেষ করে আসাম এবং সিলেট বিষয়ে প্রচুর সেকেন্ডারি (দ্বৈতয়িক) উত্স থেকে সংগৃহীত তথ্য-উপাত্ত রয়েছে। ওসব বইপত্র খুব কমই পণ্ডিতদের আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে কিছু উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম রয়েছে—অমলেন্দু গুহ আসামে শ্রেণি-সংগ্রাম এবং শ্রেণি-গঠনের বিষয়টি মার্ক্সবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে বিশ্লেষণ করেছেন। এ ধরনের ইতিহাসবদ্ধ বিবরণে ‘পরিচয়’ প্রশ্নটির ব্যাপারে খুব কমই আলোচনা করা হয়েছে। সম্প্রতি জয়িতা শর্মা তাঁর গবেষণায় আসাম অধিবাসীদের পরিচয়ের বিষয়টির ওপর আলোকপাত করেছেন কিন্তু তিনি তাঁর গবেষণায় সিলেটিদের পরিচয়ের ব্যাপারে তেমন কোনো নজরই দেননি। তা ছাড়া, তাঁর এ গবেষণাটির পরিসর ১৯৩৫ সালের মধ্যেই সীমাবদ্ধ এবং এতে সিলেটের গণভোটের বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।১ দক্ষিণ এশিয়ার ভূমিস্বত্ব পুঁজিবাদের ওপর ভিত্তি করে ডেভিড লাদেনের একটি পরীক্ষা-নিরীক্ষামূলক প্রধান গবেষণা পাওয়া যায়, যাতে দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন বিষয়ে দৃষ্টি আকৃষ্ট করে। সম্প্রতি তাঁরই আরও একটি গবেষণা সিলেট এবং আসামের ওপর ভিত্তি করে পাওয়া যায়, যা একদিকে নৃতত্ত্ব যেমনখাসিয়া জনগোষ্ঠীর ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে, অন্যদিকে তা আধুনিকতা ও পরিসর (ঝঢ়ধপব) সম্পর্কেও ধারণা দেয়। অনিন্দিতা দাসগুপ্ত বলছেন যে জনপ্রিয় বা গবেষণামূলক লেখা উভয় ক্ষেত্রেই অনুমানের চেয়ে ‘সিলেটি-বাঙালি-হিন্দু’দের ‘শরণার্থিত্ব’ সম্পর্কে অনেক বেশি (বহুত্ববাদী) অভিজ্ঞতা ছিল। যা হোক, ইতিহাস গবেষণায় এই বহুত্ববাদী অভিজ্ঞতার ওপর ভবিষ্যতে আরও অনুসন্ধান করা উচিত।২ যদিও এটি খুবই বিস্ময়কর যে প্রায় সবাই আসামের ইতিহাস গবেষণায় সিলেটের গণভোটের ব্যাপারটি অন্তর্ভুক্ত করেননি, কারণটি উপলব্ধিযোগ্য। হাজার হাজার বছর ধরে সিলেট বাংলার অবিচ্ছেদ্য বা অখণ্ড অংশ ছিল; এটি শুধু ১৮৭০ সালে আসামের অংশ করে নেওয়া হয়। গবেষকেরা সংরক্ষিত দলিল এবং সরকারি নথিপত্রের ওপর ভিত্তি করেই গবেষণাকর্ম পরিচালনা করেছেন। তাই তাঁরা সিলেটকে একটি ভিন্ন প্রশাসনিক কাঠামো হিসেবে দেখতে পেয়েছেন, যার দাপ্তরিক নথিপত্রও বিচ্ছিন্নভাবে পাওয়া যায়। সে কারণে খুব সহজেই বিষয়টি বাদও পড়ে যায়। এভাবে প্রথমে ১৮৭৪ সালে এবং পরে ১৯৪৭ সালেও সিলেটের সীমানা পুনরায় রূপ দেওয়া হয়, যা এটিকে উপর্যুক্ত গবেষণার গতানুগতিক আঙ্গিক থেকে ভিন্ন মাত্রায় আলোচনার ইঙ্গিত প্রদান করে। এ ক্ষেত্রে অনিন্দিতা দাসগুপ্ত একেবারে ভুলে যাওয়া বিভাজনের গল্প থেকে মুসলিম এবং হিন্দুদের কণ্ঠস্বরের রহস্য উদ্ঘাটনের বা আবিষ্কারের চেষ্টা করেছেন কিন্তু তিনি নিজেকে প্রধানত সিলেটি হিন্দু ‘ভদ্রলোক’ এই কাজে সীমাবদ্ধ রেখেছেন।৩
সুতরাং এই প্রবন্ধ সেসব ‘পুরোনো’ ও ‘নতুন’ ইতিহাস-বিষয়ক বিবরণের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন বা ব্যতিক্রমী এক উদ্যোগ। এতে খণ্ডিত গবেষণা পদ্ধতিতে পরিচালিত বিদ্যমান কাল্পনিক ইতিহাস-বিষয়ক বিবরণের বাইরে গিয়ে ‘বহুমাত্রিক গবেষণা পদ্ধতি’ অবলম্বন করে ঐতিহাসিক তথ্যাদি যাচাই-বাছাই করে প্রকৃত ইতিহাস উদ্ঘাটন করার প্রয়াস নেওয়া হয়েছে বা বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে, যা একই সঙ্গে বাস্তব অভিজ্ঞতায় অর্থাত্ গৃহীত সাক্ষাত্কারে প্রতিফলিত হয়েছে। এখানে বলা যেতে পারে যে ১৮৭০ থেকে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত আসামের রাজনীতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সংকটপূর্ণ একটি বিষয় ছিল। একদিকে এটি ছিল বাঙালি বনাম আসামি, অন্যদিকে কখনো হিন্দু বনাম মুসলিম। সিলেটে স্থানীয় এলিট শ্রেণির লোক সব সময়ই যেকোনো সঞ্চালনশীলতার অগ্রভাগে ছিলেন। তা সত্ত্বেও নিপীড়িত বা হতভাগ্য যেমন: কৃষক, শ্রমিক, দলিত এবং মৌলভিরা অনেক তাত্পর্যময় অবদান রেখেছেন। এই প্রক্রিয়ায়, অসংখ্য বিভাগ এবং বিরোধ আবির্ভূত হয়েছিল, বিশেষ করে এলিটদের মধ্যে অন্তঃসারশূন্যতা ও স্ববিরোধিতার কিছু নমুনা আমরা দেখতে পাই। উদাহরণস্বরূপ, আসাম থেকে সিলেটের ‘বাংলায় ফিরে আসা’ আন্দোলন ছিল হিন্দু এলিট শ্রেণির মস্তিষ্কনিঃসৃত পরিকল্পনা বা উদ্ভাবন, যাঁরা দশকের পর দশক জুড়ে এর অগ্রভাবে ছিলেন, কিন্তু ১৯৪৭ সালে এসব ব্যক্তি পুরোপুরি বিপরীত অবস্থান নিয়েছিলেন। এ বিষয়গুলোই আরও বিস্তৃত আকারে ঔপনিবেশিক দক্ষিণ এশিয়ার সামাজিক, রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত কাঠামোতে ফেলে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এ প্রবন্ধের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে বিদ্যমান গবেষণা থেকে নতুন দিকে দৃষ্টি ফেরানো এবং সেগুলোর স্বরূপ অনুসন্ধান বা উদ্ঘাটন করা, বহুমুখী সীমান্তের ইতিহাস জানা, যেখানে প্রক্রিয়াগুলো শুধু শক্তিশালী উপনিবেশ শাসক বা তাঁদের সহায়তাকারী ব্যক্তিদের দ্বারা সংঘটিত ছিল না বরং শ্রেণি, ধর্ম, গোত্র অথবা উচ্চ-মধ্য-নিম্ন বিত্ত বা বর্ণের স্থানীয় অধিবাসীদের দ্বারাও নিরপেক্ষভাবে প্রভাবিত হয়েছে। এখানে যুক্তি দেওয়া হবে যে এলিট শ্রেণির জন্য সিলেটের গণভোট শুধু সন্ধিক্ষণ বা বিভাজনরেখাই ছিল না বরং এটি একই সঙ্গে কৃষক সম্প্রদায়, মৌলভি, সমুদ্রগামী সিলেটি জাহাজি, চা-শ্রমিক এবং দলিতদের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ এক সন্ধিক্ষণ ছিল।
আধুনিক দক্ষিণ এশিয়ার অনেক ইতিহাসবিদের এই প্রবণতা রয়েছে যে তাঁরা শুধু বিভাজন বা স্ববিরোধিতা বিশ্লেষণে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়কে হয় যুগ্মভাবে বা একসঙ্গে আলোচনা করার প্রসঙ্গ টেনে আনেন অথবা তাঁরা বৃহত্তর বাঙালির প্রসঙ্গ টেনে আনেন। খুব কম গবেষকই অনুসন্ধান করতে সক্ষম হয়েছিলেন যে কীভাবে ব্রিটিশরা ক্ষমতা হস্তান্তরের সময় সীমান্ত নিয়ে ‘ছেলেখেলা’ বা ‘ফ্যাশন’ করেছিল। কেবল মুষ্টিমেয় উদ্ভাবনমূলক গবেষণায়ই আড়াআড়ি-সীমান্ত ইতিহাসের বিষয়টি উঠে এসেছে, বিশেষ করে বাংলার ক্ষেত্রে। যেমন: উইলিয়েম ভ্যান শ্যান্ডেল যুক্তি দিচ্ছেন এই বলে যে ১৯৪৭ সালের বিভাজনটি আসলে কিছু ‘সীমানাভূমি সমাজ’ তৈরি করেছিল।৪ ব্রিটিশ বাংলার ওপর জয়া চ্যাটার্জির তাত্পর্যপূর্ণ গবেষণায় দক্ষিণ এশিয়ায় ধর্ম এবং জাতীয়তাবাদী রাজনীতির মধ্যে একধরনের জটিল সম্পর্কের বিষয়টি উঠে এসেছে। তিনি তাঁর গবেষণায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উপস্থাপন করেছেন যে কীভাবে ভদ্রলোকেরা কংগ্রেসের প্ররোচনায় এবং হিন্দু মহাসভার নেতৃত্বে বাংলা বিভাজন লীগ গঠন করেছিলেন। তিনি বাংলার রাজনীতিতে মুসলিম কৃষক সম্প্রদায়ের উত্থান এবং হিন্দুত্ববাদী মানসিকতার পুনঃ অভ্যুত্থানের যমজ প্রক্রিয়ার ওপরও গুরুত্ব আরোপ করেছেন।৫ অপর দিকে বিদ্যুত্ চক্রবর্তী যুক্তি দিচ্ছেন যে বাংলা ও আসামের বিভাজন ‘সম্ভবত অনিবার্য’ ছিল।৬ তিনি তির্যকভাবে ইঙ্গিত করেছেন যে জনমিতিক তথ্য-উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে সিলেটের বিভাজনের অনুকূলে গণভোটের ফলাফল নির্ধারিত হয়েছিল। পরিতাপের বিষয় হচ্ছে যে বাছাইকৃত তথ্য প্রয়োগ করে তিনি সিলেটের বিভাজন ও গণভোটের আংশিক চিত্র উপস্থাপন করেছেন। চক্রবর্তী পরামর্শ দিচ্ছেন যে লীগের দাবিসমূহ জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে মৌলভিদের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।৭ এসব যুক্তি সমর্থনযোগ্য নয় এ কারণে যে মৌলভিরা কেবল পাকিস্তানের কারণটিকেই সমর্থন দিয়েছিলেন। ফলে বিদ্যুত্ চক্রবর্তীর এ ধরনের সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি পরিস্থিতির মূল জটিলতা বুঝতে আমাদের খুব বেশি সাহায্য করে না। যেমন: অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্থানীয় বামপন্থীরা ঝুঁকে পড়েছিল ‘হিন্দু এলিট’ শ্রেণির দিকেই, যদিও মুসলিম ধর্মীয় গোষ্ঠী, যেমন: ‘জমিয়েত-ই-উলামা হিন্দ’ (মুসলিম ধর্মতাত্ত্বিকদের ভারতীয় সংগঠন অতঃপর উলামা-ই হিন্দ), বিশেষ করে সিলেটে, ব্রিটিশ-ভারত ভেঙে দুটি পৃথক রাষ্ট্রের পরিবর্তে ‘একক রাষ্ট্রের’ ধারণাকেই সমর্থন করেছিল। এ প্রবন্ধটি তাই রাজনৈতিক সঞ্চালনশীলতার ওপর ভিত্তি করে সনাতন এবং অন্যান্য উত্স পুনরায় পর্যালোচনা করবে এবং ‘কাল্পনিক’ ও ‘একদেশদর্শী’ ইতিহাস রচনার প্রবণতা পরিহার করে অংশগ্রহণকারীদের জীবনে ঘটে যাওয়া অভিজ্ঞতাকে গুরুত্ব দেবে। অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এবং বিষয় সরকারি নথিপত্রে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি এবং এভাবে ঔপনিবেশিক আমলে সংরক্ষিত নথিপত্রেও বিষয়গুলো স্থান পায়নি। ফলে ইতিহাসের এই জটিল পর্বটি অনুধাবন করার জন্য আত্মজীবনী, পারিবারিক দলিল-নথি এবং সাক্ষাত্কার থেকেও তথ্য নেওয়া হয়েছে।
গবেষণা পদ্ধতি এবং তথ্য-উপাত্ত
বর্তমান প্রবন্ধ রচনায় আর্কাইভসমূহে সংরক্ষিত নথিপত্র, সরকারি দলিল এবং বেসরকারি পত্রপত্রিকা, আইনসভার কর্মপ্রক্রিয়ার বিষয়াবলি, ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে রক্ষিত ১৮৭৪ সালে আসাম প্রদেশ গঠন-সংক্রান্ত নথিপত্র, সিলেটের গণভোট-সংক্রান্ত সরকারি নথিপত্র, পত্রপত্রিকা, আদমশুমারি এবং সরকারি প্রজ্ঞাপনসমূহের সাহায্য নেওয়া হয়েছে। সরকারি নথিপত্রের বাইরের উত্স, বিশেষ করে, মৌখিক ইতিহাস এবং আত্মজীবনীকে উত্স হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। ১৯৪৭ সালের সিলেটের গণভোটে অংশগ্রহণকারী ও প্রত্যক্ষদর্শী হাজি মুহাম্মদ ইউনূস, আবুল মাল আবদুল মুহিত এবং নূরুল ইসলামের সাক্ষাত্কার নেওয়া হয়েছে। হাজি মুহাম্মদ ইউনূস যেমন আমাদের জানাচ্ছেন যে ১৯৪৭ সালে যারা নয় আনা করে কর দিত, তারাই কেবল ভোট দেওয়ার যোগ্য ছিল। ১৯৯৬ সালে গৃহীত দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের সাক্ষাত্কারও সিলেটের গণভোটের তথ্য বিশ্লেষণে যথেষ্ট সাহায্য করেছে।৮ আজরফ ‘আসাম প্রদেশ মুসলিম লীগ’-এর পক্ষ থেকে কলকাতায় গিয়ে সীমান্ত কমিশনে (বাউন্ডারি কমিশন) যুক্তি উপস্থাপন করেছিলেন। ১৯৯৭ সালে মেজর জেনারেল (অব.) সি আর দত্তের সাক্ষাত্কারও গ্রহণ করা হয়েছে। জেনারেল দত্ত ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় সিলেট অঞ্চলে মুক্তিবাহিনীকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।৯ উপরিউক্ত সাক্ষাত্কারের সবগুলো আমি ব্যক্তিগতভাবে গ্রহণ করেছি এবং প্রয়াত ক্যারোলিন অ্যাডামস কর্তৃক গৃহীত সাক্ষাত্কারের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা ‘ওরাল হিস্ট্রি আর্কাইভ’ থেকেও তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। ক্যারোলিন ১৯৮০-এর দশকে প্রথম প্রজন্মের ‘ব্রিটিশ-সিলেটি’দের দীর্ঘ সাক্ষাত্কার গ্রহণ করেছিলেন। তিনি এ বিষয়ে বেশ কিছু পত্রপত্রিকা এবং টেপ (রেকর্ড) চমত্কারভাবে সংগ্রহ করেছিলেন এবং সেগুলো টাওয়ার হেমলেট লোকাল হিস্ট্রি লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে।১০ দেশে-বিদেশে সিলেটিদের রাজনৈতিক সঞ্চালনশীলতা বোঝার জন্য এসব মৌখিক সাক্ষ্যপ্রমাণও ব্যবহার করা হয়েছে।
এ ছাড়া আত্মজীবনী থেকে প্রাপ্ত বিবরণী ও সরকারি দলিলপত্র ও মৌখিক সাক্ষ্যপ্রমাণাদির সঙ্গে মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করা হয়েছে। তা সত্ত্বেও এটা বলা যায় যে সরকারি সংরক্ষিত দলিলপত্রে অনেক তথ্য রয়েছে, যা গোপন করা হয়েছে নতুবা উপস্থাপন করা হয়নি। ব্যক্তিক ইতিহাসের উপাদান অর্থাত্ পারিবারিক কাগজপত্র, আত্মজীবনীগুলোতে প্রদত্ত তথ্য ও মৌখিক সাক্ষ্যপ্রমাণাদি থেকে অনেক বেশি জানার বিষয় রয়েছে। উনিশ শতকের শেষের দিক থেকে ১৯৭০-এর দশকের প্রথম পর্যন্ত হিন্দু, মুসলিম এবং ইউরোপের ধনিক শ্রেণির লোকেরা ঘটনার নানামাত্রিক বর্ণনা প্রদান করেছেন। এ ধরনের উত্সসমূহ এখনো পরীক্ষা-নিরীক্ষার যথেষ্ট অভাব রয়েছে এবং এসব উত্স ইতিহাসবিদ, যাঁরা সাধারণত গতানুগতিক তথ্য এবং সংরক্ষিত তথ্যই বেশি ব্যবহার করে থাকেন, তাঁদের দ্বারা তথ্যকে অতিরঞ্জিত করারও একটি প্রবণতা লক্ষ করা যায়। এটি বিশ্লেষণ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে ঔপনিবেশিক শাসক বা কোনো জাতীয়তাবাদী নেতা বা সামাজিকভাবে একজন এলিট তাঁদের সময় ও পরিসর সম্পর্কে কী রকম চিন্তা করেন এবং উভয় পক্ষের বর্ণনা-বিবৃতি থেকে অনেক কিছুই জানা যেতে পারে। যা হোক, আত্মজীবনীধর্মী উত্স থেকে তথ্য নেওয়ার সময় খুবই সচেতন হওয়া প্রয়োজন। কলিন হে-উড বলছেন যে ‘আত্মকেন্দ্রিক বা আত্মজীবনী’ থেকে তথ্য গ্রহণের ক্ষেত্রে খুঁটিনাটি বিষয়েও খুবই সচেতনতা অবলম্বন করা দরকার, যেখানে অন্যান্য প্রাথমিক উেসর ব্যবহার করার মতোই একজন ঐতিহাসিকের জবাবদিহিরও একটি ব্যাপার রয়েছে এবং সেটাও তথ্যগ্রহীতাকে বিবেচনায় রাখতে হয়, যাতে এ বিষয়ে কোনো রকমের প্রশ্নের মুখোমুখি না হতে হয়। একটি নির্দিষ্ট সময়ে লিখিত সাহিত্য-বিষয়ক নিয়মকানুনও জানা দরকার। সেই সঙ্গে ওই নির্দিষ্ট সময়ে লেখকের ব্যক্তিগত আলোচ্যসূচি কী ছিল অর্থাত্ তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে বা অবচেতন মনে ঘটনাপ্রবাহকে বিকৃত করতে চেয়েছেন কি না, সে সম্পর্কেও ধারণা থাকতে হবে।১১ এগুলো মনে রেখেই, স্থানীয় ব্যক্তিদের আত্মজীবনী, যাঁরা রাজনৈতিক ও সামাজিক এলিট—যাঁরা তাঁদের যুক্তি-তর্ক জোড়া লাগানোর মাধ্যমে—আত্মজীবনী গ্রন্থিবদ্ধ করেছেন, এই গবেষণায় তা যাচাই-বাছাই করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রজন্মের তিনজন কংগ্রেস নেতার স্মৃতিচারণামূলক আত্মজীবনীগুলো বাছাই করা হয়েছে। তাঁরা তিনজন হলেন বিপিন চন্দ্র পাল,১২ ব্রজেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী১৩ এবং সুহাসিনী দাস।১৪ জাতীয়তাবাদী রাজনীতির রকমফের; বিশেষ করে মুসলিম লীগের দৃষ্টিভঙ্গি (অ্যাপ্রোচ) থেকে কংগ্রেস পার্টির দৃষ্টিভঙ্গির ফারাক কোথায় তা বোঝার জন্য উপর্যুক্ত তিনজনের বর্ণনাগুলো খুবই কৌতূহলোদ্দীপক। সিলেট কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতাদের একজন ও সিলেট গণভোটকালীন গঠিত কংগ্রেস-কমিউনিস্ট ভলান্টিয়ার কোর-এর কমান্ডার চঞ্চল কুমার শর্মা১৫ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিবরণ দিয়েছেন। মুসলিম লীগের দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ১৬ (যিনি পরবর্তী সময়ে প্রিন্সিপ্যাল হিসেবে পরিচিত) এবং গণভোটের সময় মুসলিম লীগের ছাত্রকর্মী সি এম আবদুল ওয়াহেদ১৭ ওই সময়ের রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং রাজনীতি সম্পর্কে মুসলিম মধ্যবিত্তদের চিন্তাধারা সম্পর্কে কিছু উদাহরণ উপস্থাপন করেছেন। সংক্ষেপে তাঁদের এসব বিবরণ মূলত একটি যুগের বুদ্ধিবৃত্তিক সংকট ও দ্বন্দ্ব এবং সমসাময়িক রাজনীতিকে প্রভাবিত করার যে উদ্যোগ, সে ভাবনাকেই সুনির্দিষ্টভাবে তুলে ধরে।
শুধু তা-ই নয়, এ বিষয়ে স্থানীয় বর্ণনা-বিবরণ ব্যতীত ইউরোপ থেকে আগত কর্মকর্তা কর্তৃক লিখিত পর্যাপ্ত আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থও পাওয়া যায়। স্যার হেনরি কটন১৮ এবং জি পি স্টিওয়ার্ট প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবেও সে সময় কী অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন তা তাঁদের নিজ বক্তব্যে তুলে ধরেছেন। উনিশ শতকের শেষ দিকে আসামের প্রধান কমিশনার হিসেবে হেনরি কটন ভারতে ব্রিটিশ প্রশাসনের যাবতীয় কলকবজার ওপর চা আবাদকারী ইউরোপীয় এলিটদের প্রভাব সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন। ১৯৩০ সালে জি পি স্টিওয়ার্টকে সিলেটে সহকারী কমিশনার হিসেবে নিযুক্ত করা হয়েছিল এবং ১৯৩৬ সালে তাঁকে পদোন্নতি দিয়ে সিলেটে ডেপুটি কমিশনার করা হয়, যা জেলার প্রধান কর্মকর্তার মর্যাদার সমান দাবিদার। তাঁর আত্মজীবনী এখনো অব্যাখ্যাত, যা বিভিন্ন কারণেই খুবই কৌতূহলোদ্দীপক। এতে আসামের একজন জেলা কর্মকর্তার জীবন এবং কর্ম সম্পর্কে নিশ্চিয়ই ঐতিহাসিক কিছু বিবরণ পাওয়া যাবে। তাঁর অতৃপ্ত বর্ণনা থেকে জানা যায় সেখানে উদ্ভাবিত নতুন এক ‘সংকর সংস্কৃতি’র কথা—যা চা উত্পাদন অর্থনীতি থেকে উদ্ভাবিত হয়েছিল—নিঃসন্দেহে এটি ঐতিহাসিক গবেষণার জন্য সহায়ক। তিনি ১৯৩০ সালে আসামি জনগোষ্ঠীর ইতিহাসে সিলেটের গুরুত্ব সম্পর্কে একটি নকশা তৈরি করেছিলেন।১৯
আসাম চা উত্পাদক রাজ এবং সিলেট: বিদ্রোহী একটি অঞ্চলের অন্তর্ভুক্তিকরণ
১৮৭৪ সালে ব্রিটিশ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশ হিসেবে আসাম সৃষ্টির আগে সিলেট বাংলার একটি বৃহত্ ও গুরুত্বপূর্ণ সীমান্ত জেলা ছিল২০। প্রত্যক্ষদর্শী হওয়ার সুবাদে বিপিন চন্দ্র পালের ব্যক্তিগত কথোপকথনে ও বক্তব্যে উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে সিলেটের এই স্থানান্তরের রাজনৈতিক অস্থিরতা সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য উঠে এসেছে। তিনি তাঁর ব্যক্তিগত জীবনীর কাহিনিমালার সঙ্গে তাঁর সময়ে ইতিহাসের ঘটনা পরিক্রমা একই সুতায় গাঁথার চেষ্টা করেছেন। তাঁর আত্মজীবনী, যা ১৯৩২ সালে তাঁর আকস্মিক মৃত্যুর মাত্র পাঁচ দিন আগে প্রকাশিত হয়েছিল, তাতে তিনি নিম্নোক্ত ভাষায় সিলেটের পুনর্গঠন সম্পর্কে বর্ণনা করেছিলেন:
আমি কার্তিক মাসের ২২ তারিখ, ১৭৭৯ শকাব্দ (বাংলা ১২৬৫ সাল), ৭ নভেম্বর ১৮৫৮ সালে সিলেট জেলার একটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছি। সিলেট এখন আসাম প্রদেশের প্রশাসনিক একটি অংশ কিন্তু আমার জন্মের সময় এবং পরবর্তী সময়ে অনেক বছর পর্যন্ত যখন আমার শৈশবকাল ছিল তখন সিলেট ঢাকা বিভাগীয় কমিশনারের অধীন একটি জেলা ছিল। আসামও তখন একজন কমিশনারের অধীনে বাংলার লেফটেন্যান্ট-গভর্নরের একটি অংশ ছিল। যখন ১৮৭৪ সালে একজন প্রধান কমিশনারের অধীনেই আসাম প্রদেশকে একটি প্রদেশ করা হয়েছিল, তখন এসব জেলা যেমন: সিলেট এবং কাছাড়ের জনগোষ্ঠীর যাঁরা মূলত বাঙালি ছিলেন (আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভব মনে হলেও তা সত্যি ছিল), তাঁদের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই অনেকটা নতুন প্রশাসনের অধীনে এগুলোকে স্থানান্তর করা হয়েছিল এবং যাঁরা তখনো পুনরায় বাংলার সঙ্গে একত্র হওয়ার জন্য চিত্কার-চেঁচামেচি করছিলেন।২১
বিপিন পাল জানাচ্ছেন যে সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহাসিকভাবে সিলেট বাংলার একটি জেলা ছিল। তিনি দেখাচ্ছেন যে ১৮৭০ সালে ব্রিটিশরাজের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সীমান্ত প্রদেশ হিসেবে আসামের আবির্ভাবের আগে বাংলার অংশ হিসেবে ব্রিটিশরা আসামকে শাসন করেছে। আর এভাবেই সিলেটকে আসামে অন্তর্ভুক্তিকরণের ফলে জেলাটিতে একধরনের আত্মপরিচয় সংকটে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। সময়ের আবর্তে সিলেটিদের জন্য এই পরিচয়সংকটই প্রধান গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়ায়, বিশেষ করে, যারা বাংলা ও আসামের সীমান্ত এলাকায় বসবাস করছে, তাদের কাছে। আমার সাক্ষাত্কারদাতাদের মধ্যে একজন ছিলেন নুরুল ইসলাম, যিনি মাত্র ১৭ বছর বয়সে সিলেটের গণভোটের সময় প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন। তিনি ব্যাখ্যা দিচ্ছেন যে কীভাবে নতুন পরিচয় নির্মাণ হয়েছিল এবং পুনরায় ভেঙে ভিন্নভাবে নির্মাণ হয়েছিল। এই পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি বিস্তৃত প্রসঙ্গ টেনে বলছেন যে:
নতুন কোনো অঞ্চল এবং রাষ্ট্রসমূহ সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে এই পরিবর্তন হয়ে থাকে। যেমন আমি ১৯৩০ সালে সিলেটে জন্মগ্রহণ করেছিলাম এবং ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত এটি ব্রিটিশ শাসনামলে ছিল। আমরা তখন ব্রিটিশ রাজা-রানির অধীনস্থ ছিলাম। পরিচয়ের দিক থেকে আমরা তখন ভারতীয় ছিলাম। আমাদের দ্বিতীয় পরিচয় ছিল যে আমরা বাঙালি। ওই সময় আমরা প্রথমে বৃহত্তর বাংলায় এবং পরে আসামে বসবাস করতাম। যদিও আমরা আসামে ছিলাম কিন্তু তারপরও কখনো আমরা নিজেদের আসামি জনগোষ্ঠী বলতে পারতাম না। আসামি জনগোষ্ঠী আমাদের বলত সিলেটিরা হচ্ছে বাঙালি। আর এদিকে বাঙালিরাও আমাদের ডাকত আসামি জনগোষ্ঠী। সুতরাং আমরা একই সঙ্গে বাঙালি, আমরা ভারতীয় এবং আমরা আসামি জনগোষ্ঠী ছিলাম; তারপর আমরা পাকিস্তানি হলাম। ১৯৭১ আবার পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে আমরা বাঙালি বা বাংলাদেশি হলাম।২২
সুতরাং, যেকোনো বাঙালি থেকে একজন সিলেটির পরিচয়ের দৃষ্টিভঙ্গিটা কমবেশি স্বতন্ত্র। অনুরূপভাবে, ভাষাগত বিষয়বস্তু দেখাচ্ছে যে সিলেটিদের পরিচয়ের ভাষাগত অভিব্যক্তি হলো সিলেটি নাগ্রির। চৌদ্দ শতকে এই উপমহাদেশে আধ্যাত্মিক পীর শাহজালালের আগমন উত্তর-পূর্ব ভারত এবং সিলেটে এক নবযুগের সূচনা করেছিল। শাহজালাল এবং তাঁর ৩৬০ জন অনুুসারী এক চমত্কার সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার রেখে গেছেন।২৩ পণ্ডিতগণ বলছেন যে শাহজালালের সময়েই ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বিষয়গুলো লিখে রাখার জন্য সিলেটি নাগ্রি ভাষা হিসেবে আবির্ভাব হয়েছিল। বাংলা লিখতে এটি বিকল্প হস্তলেখ হিসেবে ব্যবহার করা হতো এবং যখন অঞ্চলটিতে ‘ইসলাম ধর্ম’ একটি সামাজিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছিল, সে সময় সম্পর্কে তথ্যের নতুন উেসর ধারণা দেয় ও স্থানীয় ইতিহাসের জটিল সময়কে নথিবদ্ধ করে। এভাবে ফারসি-আরবি ঐতিহ্যের সঙ্গে স্থানীয় সংস্কৃতির মিথস্ক্রিয়ার ফলাফল হিসেবে সিলেটি নাগ্রি সাংস্কৃতিক মূল উপাদানগুলোর মধ্যে একটি বিষয়রূপে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল।২৪ এটি মুসলিম পরিচয় গঠনের ক্ষেত্রে একটি বাহন হিসেবে কাজ করেছিল এবং আঞ্চলিক জনপ্রিয় সংস্কৃতির অভিব্যক্তি হিসেবে উন্নত বা ‘উঁচু মানের’ ইসলামের যে ঐতিহ্য, সেটা থেকে পৃথক ছিল। আঠারো শতক থেকে সিলেটি নাগ্রি ইতিহাসের পাঠ নারীদের দিকে ধাবিত হচ্ছিল, যারা এসব ধর্মীয় গদ্য-পদ্যের প্রাথমিক ভোক্তা ছিল। বি সি অ্যালেন লিখেছেন যে সিলেটি মুসলমানদের নিম্নবর্ণের মানুষগণ সিলেটি নাগ্রি ব্যবহার করতেন। এই মতামতের বিপরীতে নগেন্দ্র নাথ বসু বলছেন যে ধর্মান্তরিত নাগর ব্রাহ্মণরা (হিন্দু পুরোহিত) মুসলমানদের ধর্মীয় চরিত্রসমূহকে সিলেটি নাগ্রি গ্রন্থে লিখেছিলেন।২৫ এই পরস্পরবিরোধী মতামত দৃষ্টিগোচর করছে যে মানুষের মতামত যাচাই-বাছাইয়ের ক্ষেত্রে সিলেটি নাগ্রি ছিল একটি জনপ্রিয় হস্তলেখ বা লিপি। এমনকি, আজও বহু মানুষ বলছেন যে শাহজালালকে স্মরণীয় করে রাখতে একে জালালাবাদ নাগ্রি বলা হয়।২৬ অধিকন্তু, শাহজালাল ও তাঁর অনুসারীদের বংশের সঙ্গে পারিবারিক ইতিহাস যুক্ত হওয়ার বিষয়টি সিলেটে খুবই সাধারণ একটি বিষয়। এসব তথ্যের আলোকে মনে হচ্ছে যে এই বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গিটি সিলেটের গণমানুষের, যার বৃহদংশ মুসলিম। এদের কল্পনাশক্তিকে আয়ত্তে আনতে সক্ষম হয়েছে এবং এই বিশ্বাসগুলোই শাহজালালকে স্মরণ করে রাখার জন্য ভক্তিমূলক গানের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত প্রতিফলিত হচ্ছে এবং যা এখনো সিলেটে ও লন্ডনের ব্রিকলেনেও সর্বাধিক প্রচার হিসেবে সেগুলোই ব্যবহার করা হয়। এভাবেই সিলেটি পরিচয়টি দেওয়া-নেওয়া বা লেনদেনপূর্ণ পরিচয় হিসেবে গণ্য হচ্ছে। এই প্রবন্ধের পরবর্তী অংশে কিছু নথিপত্র, সাক্ষ্যপ্রমাণ দেখানো হবে যে কীভাবে ‘ব্রিটিশ-সিলেটিরা’ সশরীরে ও মানসিকভাবে ১৯৪৭ সালের গণভোটের পারিপার্শ্বিক ঘটনাপ্রবাহে জড়িয়ে পড়েছিল। যদিও ১৯৭১ সালের বিষয়টি এই প্রবন্ধে আলোচনা করা হবে না, তবে যে কেউই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ‘ব্রিটিশ-সিলেটিদের’ অংশগ্রহণ সম্পর্কে সাক্ষ্যপ্রমাণ বা নথিপত্র খুঁজে দেখতে পারেন। অসংখ্য গবেষণায় দেখা গেছে যে সিলেটিদের একটি দীর্ঘমেয়াদি অভিবাসী (ডায়াসপরিক) জীবনের অভিজ্ঞতা রয়েছে।২৭ রবার্ট লিন্ডজি তাঁর আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেছেন, আঠারো শতকের শেষ দিকে তিনি সিলেটের শাসক ছিলেন এবং তিনি নিয়মিতই সিলেটিদের সাহায্যে সিলেট থেকে কলকাতায়, মাঝে মাঝে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়ও, ব্যবসা-বাণিজ্যের কাজ চালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন। লিন্ডজি আরও লিখেছেন যে ১৮০৯ সালে তিনি যখন স্কটল্যান্ডে অবসর জীবন যাপন করছিলেন, তখন তিনি সৈয়দ উল্লাহ নামে এক ব্যক্তিকে প্রথম সিলেটি অভিবাসী হিসেবে ব্রিটেনে দেখতে পান।২৮ যা হোক, উনিশ শতকের একেবারে শেষ দিকে, আসাম ও সিলেট প্রদেশের ভেতরে নদীতে বাষ্পচালিত ইঞ্জিন এবং রেল যোগাযোগ শুরু হয়ে যাওয়ায় নদীনির্ভর নৌকা বা জাহাজের মাধ্যমে ব্যবসার ক্ষেত্র অনেক কমে গিয়েছিল। ফলে আসাম থেকে সিলেট হয়ে কলকাতায় পণ্যসামগ্রী খুব সহজে এবং দ্রুতই আনা-নেওয়া করা যেত। এভাবেই শত শত সিলেটি, যাঁরা দেশি নৌকা দিয়ে পরিবহন ব্যবসা করতেন, তাঁরা কর্মহীন হয়ে পড়েছিলেন। এঁরাই আবার খুব শিগগিরই কলকাতায় গিয়ে সমুদ্রে চলমান জাহাজে নিয়োগ পেয়েছিলেন, যাঁদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল সচ্ছল কৃষকও। এভাবে তাঁরা নদী থেকে সাগরে পাড়ি জমালেন। ব্রিটিশরা শুরু করল জাহাজের ব্যবসা। তা সত্ত্বেও অভিজ্ঞ নাবিকদের প্রয়োজন পড়েছিল তাঁদের পরিচালনা করার। কলকাতাভিত্তিক একজন লেখক শংকর বলছেন যে বাঙালিদের মধ্যে ‘সমুদ্র জয়ের’ প্রথম পথপ্রদর্শক ছিলেন সিলেটের মানুষ। তিনি বলছেন যে সহজাতভাবেই সিলেটিরা ছিলেন ‘সাহসী’ এবং তাঁরা বিশ্ব পরিমণ্ডলে সমুদ্রপথে যাত্রার গুণাবলিও দেখিয়েছিলেন। তাঁরা সমুদ্রে জাহাজ পরিচালনার বিদ্যা আয়ত্ত করে ইতিহাস তৈরি করেছিলেন এবং বিশ্ববাণিজ্যে অংশ নিয়েছিলেন।২৯ পরে, বিশেষ করে, প্রথম মহাযুদ্ধের পর থেকে সিলেটিরা ব্রিটেনে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে লাগলেন। এখনো পর্যন্ত যুক্তরাজ্যে বসবাসকারী বাংলাদেশ-বংশোদ্ভূত ৯০ শতাংশই হলো সিলেটি। একজন অভিবাসী কবি এবং অভিনেত্রী শামীম আজাদ বলছেন, ‘আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে এসব সমুদ্রযাত্রীর মধ্যে সম্ভবত একটি বিশেষ ভ্রমণপিপাসু বংশের উপাদান ছিল, যা তাদের এই বিশাল বিশাল সমুদ্র এবং নদী পার হতে তাড়না দিয়েছে।’৩০
আসামে ঔপনিবেশিক কর্মকর্তা এবং স্থানীয় বাঙালি অভিজাত সম্প্রদায় এটাকে বাংলার সম্প্রসারণ বলেই মনে করত। অপর দিকে, চা আবাদকারীরা দীর্ঘদিন ধরে রাষ্ট্রীয় অর্থের পর্যাপ্ত ব্যবহার এবং তাদের নিজেদের স্বার্থের নিরাপত্তা প্রদানের জন্য একটি বিশেষ ও নিবিড় প্রদেশ তৈরির দাবি জানিয়ে আসছিল। ক্রমবর্ধমান হারে চা আবাদকারীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে ওখানে কাজের পরিধিও বেড়ে গিয়েছিল এবং প্রশাসনের সব শাখায় চা-শ্রমিকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছিল। এসবের সঙ্গে সঙ্গে প্রশাসনিক খরচও বৃদ্ধি পায় এবং এরই সঙ্গে স্থানীয় বাসিন্দাদের জন্য নিয়মকানুন বা বিধিবিধানের খসড়া সরবরাহের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ১৮৭৪ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি বৃহত্তর আসাম, কাছাড়, গোয়ালপাড়া, গারো পাহাড় এবং অন্যান্য পাহাড়ি জেলাকে অন্তর্ভুক্ত করে একটি নতুন প্রদেশ সৃষ্টি করা হয়েছিল। যদিও চার মিলিয়ন জনসংখ্যাসহ এটি একটি বিশাল ভূখণ্ড নিয়ে গঠিত হয়েছিল, তথাপি এর স্বল্প পরিমাণে রাজস্ব পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল।৩১ প্রাথমিকভাবে সিলেট এই নতুন প্রদেশের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত হয়নি কিন্তু মাত্র ছয় মাসের মধ্যেই ঔপনিবেশিক প্রশাসন বুঝতে পারল যে আসামের মানচিত্র নতুন করে আঁকতে হবে। অর্থনৈতিকভাবে এটিকে টিকিয়ে রাখার জন্য এবং পেশাগত গোষ্ঠীর চাপে এ উদ্যোগ আরও বেশি ত্বরান্বিত হয়েছিল। ফলে ১৮৭৪ সালের সেপ্টেম্বরেই নতুন প্রদেশে বাংলার জনবহুল জেলা সিলেটের বাংলাভাষীদের যুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এবং আসাম প্রদেশে ১ দশমিক ৭ মিলিয়ন মানুষসহ সিলেট অন্তর্ভুক্ত হয়। ঐতিহাসিক ও নৃতাত্ত্বিকভাবে সিলেট বাংলার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল। মূলত নতুন এই প্রদেশ সৃষ্টি করাতে দৃশ্যত চারটি অসম বা বন্ধুর অঞ্চলের আবির্ভাব ঘটিয়েছিল। এই বৈষম্যগুলো হলো ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার আসামি-ভাষী পাঁচটি জেলা যা আসাম অঞ্চল হিসেবে পরিচিত, এটি দেখতে অনেকটা ত্রিভুজসদৃশ; একই উপত্যকার গোয়ালাপাড়া জেলা, যেখানে আসামি-বাঙালি উভয় সংস্কৃতির দ্বারা আবৃত; পাহাড়ি জেলাসমূহ, যেখানে বিভিন্ন উপভাষী বা আঞ্চলিক ভাষার মানুষ বসবাস করে; সবশেষ সিলেট এবং কাছাড়ের মতো জনবহুল এবং বাংলাভাষী দুটো জেলার অন্তর্ভুক্তকরণ। ঠিক এভাবেই নতুন এ প্রদেশটা সৃষ্টি করা হয়েছিল এবং এটি ১৮৭৪ থেকে ১৯০৫ সাল পর্যন্ত কোনো আইন পরিষদ ব্যতীতই টিকে থাকল। ১৯২০ থেকে ১৯৪০ সালের মাঝামাঝিতে প্রাদেশিক আইন পরিষদ বেশ কার্যকর ছিল, যাতে চা-আবাদকারী ইউরোপীয় এলিটগণ এবং স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিরা ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের একেবারে শেষ পর্যন্ত তাত্পর্যময় প্রভাব বজায় রেখেছিলেন। উল্লেখ্য, ১৮৭৪ সালে নতুন প্রদেশ সৃষ্টির আগে গোয়ালাপাড়া, সিলেট এবং কাছাড় তিনটিই অবিভক্ত বাংলার জনবহুল এবং বাংলাভাষী জেলা ছিল, যার মধ্যে কেবল সিলেট (তাও এক-চতুর্থাংশ অর্থাত্ করিমগঞ্জ মহকুমা কেটে রাখা হয়) ১৯৪৭ সালে পূর্ব বাংলায় ফিরে এসেছিল।৩২
আসামের সঙ্গে সিলেটের যুক্ত করার কারণে বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীকে মেঘনার একদিকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল। অন্যদিকে, সুরমা উপত্যকা এবং আসামের জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিরোধিতার কারণে আসামে প্রদেশের অখণ্ডতাই হুমকির কবলে পতিত হয়েছিল। ব্রিটিশরাজের পূর্বাঞ্চলের প্রশাসনিক পুনর্গঠন, চা ব্যবসায়ীদের সার্বক্ষণিক স্বার্থ এবং জনগণের পরবর্তী আন্দোলন সম্পর্কে জানতে গোটা অঞ্চলটির রাজনৈতিক অর্থনীতির বিশ্লেষণ করা দরকার। দৃশ্যত, সিলেটকে সব সময়ই বাংলার সঙ্গে পুনরায় অন্তর্ভুক্ত করার দাবি অব্যাহত ছিল। বাংলার সঙ্গে সিলেটের মানুষের এ একাত্মতা ১৮৭৪ সালে যখন নতুন প্রদেশ গঠিত হয়েছিল, তখন থেকেই জোরালো ভিত্তি পেয়েছিল।৩৩ সিলেটিরা এটি উপলব্ধি করতে পেরেছিল যে তাদের জেলাটি আসাম প্রদেশের সঙ্গে একত্রীভূত করার লক্ষ্যে বাংলা থেকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবেই ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলা হয়েছিল, যা কখনোই এটিকে অর্থনৈতিকভাবে কোনো সুগম পথ করে দিতে পারেনি। এলিট শ্রেণি—যার অধিকাংশই হিন্দু—তারা প্রথমে সিলেটের স্থানান্তরের বিরুদ্ধে ছিল, যেহেতু তারা এটিকে তাদের অগ্রসরমাণ বাংলা প্রদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে এক ‘পশ্চাত্পদ অঞ্চলে’ বেঁধে দেওয়ার শামিল হিসেবে বিবেচনা করত। হিন্দু এলিট শ্রেণি কলকাতায় এবং সিলেট থেকে প্রকাশিত সংবাদপত্রের মাধ্যমে আপামর জনগোষ্ঠীর জনমতকে সরকারের বিরুদ্ধে নেওয়ার প্রাণপণ চেষ্টাও করেছিল। যেমন কলকাতার প্রভাবশালী পত্রিকা হিন্দু পেট্রিয়ট সিলেটকে নিয়ে বাঙালির হূদয়ানুভূতিতে অনুরণনের ঝড় তুলতে ধারাবাহিকভাবে নিবন্ধ এবং সম্পাদকীয় ছাপাত। এ শক্তিশালী প্রচারণার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন হিন্দু পেট্রিয়ট-এর সম্পাদক স্বয়ং কে দাস পাল, যিনি তাঁর সম্পাদকীয়তে লিখেছিলেন যে ‘বাংলা প্রদেশের স্বর্ণময়ী অঞ্চল সিলেটকে আসাম প্রদেশ নামক নতুন দেবীর মনোরঞ্জনের জন্য বলি দেওয়া হচ্ছে।’৩৪
১৮৭৪ সালের ১০ আগস্ট হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের নেতারা সিলেটকে স্থানান্তরের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে একটি স্মারকলিপি ভারতের শাসক ভাইসরয়কে প্রদান করেছিলেন।৩৫ যদিও সরকার তাত্ক্ষণিকভাবে সেই প্রতিবাদ প্রত্যাখ্যান করেছিল। তবে গভর্নর জেনারেল লর্ড নর্থব্রুক জনসাধারণকে এই প্রতিশ্রুতি দিতে সিলেটে এসেছিলেন এবং এলিট/ধনিক শ্রেণি লোকদের ডেকে প্রতিশ্রুতি দেন যে নতুন প্রশাসনিক আয়োজনে তাঁদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ওপর কোনো প্রভাব ফেলবে না। এ প্রশাসন আরও সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে শিক্ষা ও বিচারের বিষয়গুলো যথাক্রমে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলকাতা হাইকোর্ট থেকে পরিচালনা করা হবে। নতুন এই প্রদেশের প্রশাসন দুটি প্রধান নীতিকে গ্রহণ করেছিল: প্রথমত, বহিরাগত ব্যক্তিদের মধ্য থেকে চা-শ্রমিকদের নিয়োগপ্রক্রিয়া সম্পূর্ণ মসৃণভাবে করার নিশ্চয়তা বিধান করা এবং দ্বিতীয়ত, পূর্ব বাংলার জেলাগুলো থেকে অভিবাসী বাঙালি কৃষক সম্প্রদায়ের জন্য সিলেট এবং আসামের কৃষিব্যবস্থার সম্প্রসারণ করা। ‘আরও বেশি খাদ্য উত্পাদন কর’—এই আদর্শ বাক্য বা স্লোগানের অধীনে এটি করা হয়েছিল। স্পষ্টতই, ঔপনিবেশিক শাসকশ্রেণি যখন আসামকে নতুন প্রশাসনিক প্রদেশ হিসেবে ঘোষণা করেছিল, তখন এ অঞ্চলের ঐতিহাসিক অথবা সাংস্কৃতিক সংলগ্নতা বুঝতে পারেনি।
যদিও প্রাথমিকভাবে সিলেট এবং কলকাতার হিন্দু অভিজাত সম্প্রদায় নতুন এই প্রদেশ সৃষ্টির ব্যাপারে বিরোধিতা করেছিল, তথাপি পরবর্তী সময়ে খুব শিগগিরই তারা তাদের সেই অবস্থান কিছু কারণে বদলাতে শুরু করেছিল। প্রথমত, তারা গভর্নর জেনারেল লর্ড নর্থব্রুকের কাছ থেকে এই নিশ্চয়তা পেয়ে আশ্বস্ত হয়েছিল যে সিলেটের শিক্ষা এবং বিচারব্যবস্থা পরিচালিত হবে বাংলার প্রশাসন থেকে। দ্বিতীয়ত, তারা এটিও লক্ষ করেছিল যে চা-শিল্পের বিকাশ তাদের নতুন প্রদেশে বেশ সুযোগ-সুবিধা করে দিতে পারবে এবং এতে তাদের কল্যাণই বয়ে আনবে। যেমন: যাঁরা শিক্ষিত ছিলেন, তাঁদের অনেকেই চা-শিল্পে কেরানি এবং চা-বাগানে ‘ডাক্তার বাবু’র চাকরি পাওয়া যাবে। তৃতীয়ত, চা-শ্রমিকদের খাদ্যের ক্রমবর্ধমান চাহিদার জন্য সিলেটের চালের দাম উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যাবে। ফলে সিলেটের অধিকাংশ হিন্দু জমিদার আগে যে দামে বাংলায় চাল রপ্তানি করতে বাধ্য ছিলেন, নতুন পরিস্থিতিতে তাঁরা আরও বেশি দামে আসামে চাল বিক্রির সম্ভাবনা দেখতে পেয়েছিলেন। বিভিন্ন তথ্যের আলোকে মনে হচ্ছে যে আসামের ঔপনিবেশিক আমলাতন্ত্রে ও চা-শিল্পের বিভিন্ন কাজে সিলেটি-বাঙালিদের আধিপত্য সৃষ্টি হয়েছিল। ১৯৯৯ সালে সঞ্জীব বড়ুয়ার লেখায় দেখা যায় যে ২০ শতকের প্রথম দিকে আসামে বাঙালিরা আইন, মেডিকেল এবং শিক্ষকতা পেশায় আধিপত্য বিস্তার করতে শুরু করেছিল এবং রেল ও ডাক কার্যালয়ে কেরানি ও মধ্যবর্তী পদমর্যাদাপূর্ণ পদে চাকরি পেতে শুরু করল। ব্রিটিশ ভারতের সবচেয়ে সক্রিয় ও অগ্রসরমাণ প্রদেশ বাংলার অংশ হয়ে সিলেটবাসী আসামের অধিবাসীদের চেয়ে ইংরেজি শিক্ষায় এগিয়ে ছিল এবং ঔপনিবেশিক শাসনে পেশাজীবী হিসেবে কিছুটা বেশি অভিজ্ঞতাই অর্জন করেছিল, যা তাদের তাত্ক্ষণিকভাবে নতুন অঞ্চলে চালু হওয়া বিভিন্ন সুযোগ গ্রহণ করার সুবিধা করে দিয়েছিল। বড়ুয়া বলছেন যে ‘যেহেতু আসামের আমলাতন্ত্রের অধিকাংশ পদ দখল করেছিল বাঙালিরা এবং তাদের আধিপত্যটা—বিশেষ করে বহু অহমিয়াভাষী শিক্ষিত শ্রেণির আবির্ভাব হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত—অসন্তুষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।’৩৬
১৮৭০-এর দশকে এভাবেই সিলেট বাংলার বৃহত্তর জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল এবং ওই অবস্থায়ই তা দীর্ঘ ৩০ বছর অব্যাহত ছিল। ১৯০৫ সালে সিলেটকে আবার বাংলার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে যুক্ত করা হয়। কারণ, ওই বছরই ঢাকাকে রাজধানী করে স্বল্পমেয়াদি পূর্ব বাংলা ও আসাম নামে একটি প্রদেশ (বাংলাকে ভাগ করার মাধ্যমে) সৃষ্টি করা হয়েছিল।৩৭ ১৯১২ সালে বাংলাকে যখন পুনরায় একত্র করা হলো, তখন আসামকে আবার প্রদেশের মর্যাদা দেওয়া হলো, যেখানে আবারও সিলেট অন্তর্ভুক্ত হলো। ফলে, জেলাটির গুরুত্বপূর্ণ গ্রাম, হাটবাজার এবং শহর প্রতিবাদে প্রবলভাবে আলোড়িত হচ্ছিল। প্রাদেশিক আইন পরিষদের সদস্যগণ কর্তৃক স্বাক্ষরযুক্ত আবেদনসংবলিত প্রতিবাদ নিয়ে বিভিন্ন জনসভা অনুষ্ঠিত হচ্ছিল। প্রতিবাদকারী জমিদার এবং আইনজীবীরা ১৯১২ সালে লর্ড হার্ডিঞ্জের কাছে তাঁদের প্রতিবাদসংবলিত স্মারকলিপি প্রেরণ করেন, যদিও তাঁরা কোনো সফলতার মুখ দেখেননি।৩৮
১৯২০ সালে ব্রজেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরীর পৃষ্ঠপোষকতায় সিলেট রি-ইউনিয়ন লীগ গঠিত হয়েছিল। এটি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে এর নিয়োজিত প্রতিনিধিদের উচিত ভাইসরয়ের কাছে প্রতিবাদ হিসেবে স্মারকলিপি প্রদান করা, যা দেওয়াও হয়েছিল। কিন্তু ওই আন্দোলন বেশিদূর অগ্রসর হয়নি, কারণ খেলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনের বিষয় উদ্ভূত হওয়ায় তা সাময়িক সময়ের জন্য বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।৩৯ ১৯২০-এর দশকে আসাম আইনসভায় সিলেট ও কাছাড় জেলার ‘বাংলায় ফিরে যাওয়া’ নিয়ে প্রচুর বিতর্কের সাক্ষ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়; সেখানে দেখা যায়, হিন্দু এবং মুসলমান অভিজাত শ্রেণির গুরুত্বপূর্ণ সদস্যরা বাঙালি পরিচয়ের বিষয়গুলোর জন্য যৌথভাবে লড়াই করেছিলেন এবং প্রথম দিকে একটি লক্ষ্যই ছিল, যাতে সিলেটের হিন্দু-মুসলিম উভয়েই বাংলায় ফিরে যাওয়া নিয়ে একটি ঐক্যবদ্ধ অবস্থান গ্রহণ করেছিল। তখন হঠাত্ করে একটি সম্ভাবনা তৈরি হলো যে হয়তো সিলেট তার শিক্ষা ও বিচারের বিষয়ে যে বিশেষ মর্যাদা রয়েছে, তা হারাতে পারে। আসামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠারও প্রশ্ন ছিল। এসব বিষয়ে হিন্দু-মুসলিম এলিট উভয়ের স্পষ্টতই প্রচুর উদ্বেগ ছিল। ১৯২০ থেকে ১৯৩০ সালের মধ্যে আসাম প্রদেশ কংগ্রেসের অন্যতম নেতা সিলেটের বিখ্যাত জমিদার ব্রজেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী সিলেটকে বাংলার সঙ্গে পুনরায় একত্রীকরণের জন্য মুখপাত্রের ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি সিলেটি বাঙালিদের নৃতাত্ত্বিক বিষয়গুলো সম্পর্কে প্রচলিত সমসাময়িক ‘কল্পনা’ করায়ত্ত করেছিলেন। ১৯২৪ সালের আগস্টে আসামের আইনসভায় তিনি যুক্তি উপস্থাপন করেছিলেন যে:
পরিবর্তিত ও উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আমার এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা দরকার যে এ প্রশাসন থেকে সিলেটকে স্থানান্তর করে বাংলার সঙ্গে সংযুক্ত করাটাই সিলেটি জনপ্রতিনিধিত্বের প্রধান উদ্বেগ। মূলত এটিই আমাদের একমাত্র রাজনীতি...আমি সম্মানিত সদস্যদের একটি করে বুকলেটের প্রতিলিপি সরবরাহ করেছি, যাতে রায় বাহাদুর গিরিশ চন্দ্র নাগ আমাদের মিনতি করে বলেছেন ‘বাংলায় ফিরে চল’। এই রায় বাহাদুর ছিলেন আসাম সিভিল সার্ভিস-এর একজন অভিজ্ঞ উঁচুপদস্থ ব্যক্তি। শুধু তা-ই নয়, তিনি আসাম আইনসভার প্রথম অধিবেশনে সিলেটের জনপ্রতিনিধিও ছিলেন...চা আবাদের জন্য ছোট্ট পরিসরে শ্রমিক আমদানি ব্যতীত সিলেটের প্রায় শতভাগ আদিবাসী সবাই বাংলায় কথা বলে, যারা নৃতাত্ত্বিকভাবে বাঙালি বংশধরের স্বত্বাধীন এবং তাদের চলন-বলনে, আচার-আচরণে, প্রথা-মূল্যবোধ-চিন্তা এবং ঐতিহ্যে—একই রকম চেতনার বহিঃপ্রকাশ লক্ষ করা যায়। যেহেতু বাংলাদেশে তাদের ভ্রাতৃবর্গ বাঙালি এবং অবিচ্ছেদ্যভাবেই সিলেটিরা তাদের সঙ্গে সামাজিক সম্পর্ক এবং রক্তের বন্ধনে আবদ্ধ [গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে]।৪০
আসাম আইনসভার এক গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে চৌধুরী আরও ঘোষণা করেছিলেন:
যদি কলকাতা উচ্চআদালতের সুরক্ষা থেকে একজন মানুষও সিলেটকে স্থানান্তর করার চিন্তা করে, তাহলে আমরা সিলেটিরা তার বিপক্ষে প্রতিরোধ গড়ে তুলব। ঐতিহ্যের বন্ধন আমাদের বাঙালিদের ঐতিহ্যের সঙ্গে অটুট রেখেছে... আমি কি পারি অথবা সিলেট থেকে এই আইনসভায় আর কোনো সদস্য কি আছেন, যিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ও কলকাতা হাইকোর্ট থেকে যে সুবিধা পাবেন, যদি সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত হন তা সহ্য করতে? আসামের জন্য যে ব্যয় হবে সিলেটিরা কেন সে খরচ বহন করবে? আমাকে কঠিন নির্ভেজাল সত্যটি বলতে দিন: সিলেটিরা কোন শর্তে সিলেটের পরিবর্তে আসামে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে সম্মত হবে? এটি হলো আসামের ললাটে অনিচ্ছাকৃত ও বিদ্রোহীসুলভ অংশীদারের সঙ্গে জোর করে একত্রীকরণের দুঃখজনক উত্তরাধিকার [শব্দটির ওপর জোর দেওয়া হয়েছে]।৪১
আসামি জনগোষ্ঠীও তাদের নিজস্ব ভূখণ্ডের স্বপ্ন দেখেছিল এবং তারা এও বুঝতে পেরেছিল যে বাংলাভাষী সিলেটই তাদের সে স্বপ্ন পূরণের ক্ষেত্রে প্রধান প্রতিবন্ধক। সুতরাং আসাম থেকে সিলেটকে বাদ দেওয়ার জন্য জোরাহাট সর্বজনীন সভা (আসামের একটি সামাজিক সংগঠন) একটি প্রস্তাব পাস করেছিল, যেটি আসামি সংবাদপত্রগুলোর সমর্থনও করেছিল।৪২ ১৯৩৩ সালে আসাম অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট জনসম্মুখে যুক্তি দিয়েছিলেন, যত দিন পর্যন্ত সিলেট আসামের সঙ্গে থাকবে, তত দিন পর্যন্ত আসাম তার নিজস্ব বিশ্ববিদ্যালয় ও নিজস্ব উচ্চ আদালত নাও পেতে পারে। শুধু তা-ই নয়, আসাম তার নিজ ভাষা ও সাহিত্যের উন্নয়নও করতে পারবে না।৪৩
আসাম ও সিলেটের অভিজাতবর্গের রাজনীতিতে নীতি ও বদলের বিষয়টি ছিল কৌতুকপ্রদ। যেহেতু আসাম এবং সিলেটের উচ্চবিত্ত শ্রেণির মুসলমানেরা প্রাদেশিক রাজনীতিতে ক্রমেই ক্ষমতাশীল হচ্ছিলেন এবং তাঁদের নেতাদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ সদস্য যেমন খান বাহাদুর আলাউদ্দিন চৌধুরী, মৌলভি দেওয়ান ওয়াসিল চৌধুরী ‘বাংলায় ফিরে যাওয়া’ নিয়ে পুরোনো অবস্থান বদলে ফেলেন। তাঁরা সিলেটের বাংলার সঙ্গে পুনরেকত্রীকরণের বিরুদ্ধে নাটকীয়ভাবে জোরালো বক্তব্য দেওয়া শুরু করেন এবং জেলাগুলোর মুসলমানেরা এটিকে সমর্থন করবে কি না সে সম্পর্কেও প্রশ্ন তোলেন।৪৪ একসময়ের কংগ্রেসের নেতা সিলেটের আবুল মতিন চৌধুরী তখন মুসলিম লীগের প্রভাবশালী নেতায় পরিণত হয়েছেন। তিনি ১৯২৪ সালে আসামের আইনসভার সদস্যদের কাছে চিঠি লিখে এই ঘোষণা করেন যে সিলেটের মুসলমানেরা বাংলার অংশ হতে চায় না এবং যুক্তি দেন যে একমাত্র যারা এটি চায়, তারা হলো সিলেটি হিন্দু।৪৫ খান বাহাদুর আলাউদ্দিন চৌধুরী তাঁর অবস্থান বদলের কারণ বিশ্লেষণ করে বলেন, ‘ইতিমধ্যে আমি আমার বক্তব্যে স্বীকার করেছি যে আমি তাদের মধ্যে একজন, যারা ১৯১৮ সালে সিলেটকে বাংলার সঙ্গে পুনরায় একত্রীকরণের স্বপক্ষে ছিলাম কিন্তু আমি আমার মতামত ১৯২০ সালে এসে পরিবর্তন করেছি। ...একজন জ্ঞানী মানুষ মতামত পরিবর্তন করতে পারে কিন্তু একজন বোকা তা পারে না।’৪৬
সারণি: ১
১৯২৪ সালের আগস্টে পুনরায় সিলেটের বাংলায় স্থানান্তরের ওপর আসামের আইন পরিষদের ‘হ্যাঁ’ ভোট
ক্রমিক নম্বর নাম পরিচয়
১ রায় বাহাদুর অমরনাথ রয় হিন্দু
২ রায় বাহাদুর বিপুন চন্দ্র দেব লস্কর হিন্দু
৩ রায় সাহিব হার কিশোর চক্রবর্তী হিন্দু
৪ বাবু ব্রজেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী হিন্দু
৫ বাবু গোপেন চন্দ্র লাল চৌধুরী হিন্দু
৬ মাননীয় রায় বাহাদুর প্রমদ চন্দ্র দত্ত হিন্দু
৭ বাবু কৃষ্ণ সুন্দর দাম হিন্দু
৮ বাবু কিশোরচন্দ্র দেব হিন্দু
৯ বাবু বিরাজ মোহন দত্ত হিন্দু
১০ শ্রীযুক্ত কমোখরাম বড়ুয়া হিন্দু
১১ শ্রীযুক্ত কমলাকান্দ দাস হিন্দু
১২ শ্রীযুক্ত মহাদেব শর্মা হিন্দু
১৩ শ্রীযুক্ত বিষ্ণুচরণ বরাহ হিন্দু
১৪ মি. তারাপ্রসাদ চলিহা হিন্দু
১৫ শ্রীযুক্ত রোহিনীকান্ত বড়ুয়া হিন্দু
১৬ শ্রীযুক্ত কোলাধর চলিহা হিন্দু
১৭ শ্রীযুক্ত সদানন্দ দোয়েরা হিন্দু
১৮ মৌলভি আবদুল হামিদ মুসলমান
১৯ মৌলভি দেওয়ান আবদুল রহিম চৌধুরী মুসলমান
২০ মৌলভি আবদুল হান্নান চৌধুরী মুসলমান
২১ মৌলভি মোহাম্মাদ মোদাব্বির হোসাইন চৌধুরী মুসলমান
২২ মৌলভি নাজমুল ইসলাম চৌধুরী মুসলমান
সূত্র: আসাম আইন পরিষদের কার্যবিবরণী, আগস্ট, ১৯২৪ আসাম গেজেট, পার্ট ৪, শিলং, ১৯২৪, পৃ. ৬১৯-২০।
সারণি: ২
১৯২৪ সালের আগস্টে পুনরায় সিলেটের বাংলায় স্থানান্তরের ওপর আসামের আইন পরিষদের ‘না’ ভোট
ক্র. নং নাম পরিচয়
১ মাননীয় খান বাহাদুর কুতুবুদ্দিন আহমেদ মুসলিম
২ মাননীয় মি. জে ই ওয়েবস্টার ইউরোপবাসী
৩ মি. এ ডব্লিউ বোথাম ইউরোপবাসী
৪ মি. জে ই সোয়েমস ইউরোপবাসী
৫ মি. ও এস ই ডেসেনি ইউরোপবাসী
৬ মি. জে আর কানিংগ্যাম ইউরোপবাসী
৭ মি. ডব্লিউ সি এস ড্যানডাস ইউরোপবাসী
৮ শ্রীযুক্ত নীলমণি পোখান আসামবাসী বা অহমিয়া
৯ মৌলভি দেওয়ান মোহাম্মদ ওয়াসিল চৌধুরী মুসলিম/আবাদকারী
১০ র্যাভ. জে সি ইভেন্স ইউরোপবাসী/ধর্মযাজক
১১ খান বাহাদুর আবুল ফজল আহাম্মেদ মুসলিম
১২ র্যাভ জেমস মোহন নিকোলাস রায় দেশীয় খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী
১৩ মৌলভি রাশিদ আলী লস্কর মুসলিম
১৪ খান বাহাদুর আলাউদ্দিন আহাম্মেদ চৌধুরী মুসলিম
১৫ মাননীয় মৌলভি সৈয়দ মোহাম্মদ সাদুল্লাহ্ মুসলিম
১৬ মি. ই এস রফেই ইউরোপবাসী
১৭ মি. এম এইচ ক্লার্কে ইউরোপবাসী
১৮ মি. ই এ এ জোসেফ ইউরোপবাসী
সূত্র: আসাম আইন পরিষদের কার্যবিবরণী, আগস্ট, ১৯২৪ আসাম গেজেট, পার্ট ৪, শিলং, ১৯২৪, পৃ. ৬১৯-২০।
সারণি ১ ও ২ থেকে সুনির্দিষ্ট করে দেখা যাচ্ছে যে সিলেটের স্থানান্তরের ওপর আসামের আইন পরিষদে ভোটের ধরন খুবই কৌতূহলোদ্দীপক একটি বিষয়। এসব সারণিতে বিন্যস্ত তথ্য দেখাচ্ছে যে ১০ জন ইউরোপবাসী কর্মকর্তা এবং চা আবাদকারী, একজন স্থানীয় খ্রিষ্টান, ছয়জন মুসলিম, একজন অহমিয়া নেতা সিলেটকে পুনরায় বাংলায় স্থানান্তরের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছিলেন, যেখানে সব হিন্দুই এর পক্ষে বা অনুকূলে ভোট দিয়েছিলেন। যা হোক, সিলেটের মুসলিম নেতারা বিষয়গুলোর ওপর বিভক্ত হয়ে গিয়েছিলেন, যেখানে পাঁচজন মুসলিম সদস্য বাংলার সঙ্গে সিলেটকে যুক্ত করার পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন, সেখানে ছয়জন এর বিপক্ষে ভোট দিয়েছিলেন। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো যে মুসলিম সদস্যদের ভোটেই চৌধুরীর প্রস্তাব পাস হয়। একই রকমের আরেকটি প্রস্তাব ১৯২৬ সালের জানুয়ারি মাসে সিলেটের চারজন মুসলমান সদস্যের সহায়তায় আসামের আইনসভায় পাস হয়েছিল।৪৭ যা হোক, খুব শিগগিরই হিন্দু রাজনীতিবিদদের নেতৃত্বে বাংলায় ফিরে আসা আন্দোলনের প্রতি সিলেটের মুসলিম রাজনীতিবিদেরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলেন। এর কারণ ছিল প্রধানত দুই রকমের—প্রথমত, আসামের রাজনীতিতে মোহাম্মদ সাদুল্লাহ্র আবির্ভাব, যিনি আসামের একজন অভিজাত মুসলিম ছিলেন।৪৮ তিনি ইউরোপবাসী চা উত্পাদনকারী এবং ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের সহায়তায় আসামের আইন পরিষদকেন্দ্রিক রাজনীতিতে আধিপত্য স্থাপন করেছিলেন। তিনি সরাসরি যুক্তি দিয়েছিলেন যে সিলেটের উচিত আসামের সঙ্গেই থাকা। তিনি এও বলেছিলেন যে ‘যদি আমরা আসাম থেকে সিলেটকে চলে যাওয়ার অনুমতি দিই তাহলে কিসের ভিত্তি বা নীতিমালায় আমরা কাছাড় ও গোয়ালপাড়াকে [বাংলার সাবেক দুটি জেলা] চলে যাওয়া থেকে বন্ধ করতে পারব?’৪৯ ১৯২৫ সালের জুলাইয়ে সাদুল্লাহ্ সিলেট পরিদর্শনে গিয়ে দেখেন যে দেশটিতে মতামত বিভক্ত। তিনি পরের মাসেই সরকারের কাছে সরেজমিনে পরিদর্শনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে একটি রিপোর্ট দিয়েছিলেন। এতে তিনি লিখেছিলেন, ‘সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বলতে গেলে যা বলা যায় তা হলো সিলেটের স্থানান্তর দুই দিকেই। অর্থাত্ আসাম ও সিলেটের মুসলমানদের দুঃখ-কষ্ট দীর্ঘায়িত করবে।’৫০ সুতরাং বলা যায়, সাদুল্লাহ্র আগ্রহ ছিল নিজের রাজনৈতিক ভবিষ্যেক নিরাপদ রাখা। পরবর্তী দশকগুলোতে তিনি ‘ধর্মীয় পরিচয়’ নিয়ে অত্যন্ত সুচতুরভাবে খেলা করেছিলেন। অনেক অভিজাত মুসলিমও বিশ্বাস করতেন যে আসামের সঙ্গে সিলেটের অন্তর্ভুক্তকরণই ভবিষ্যতে এটিকে মুসলিম-আধিপত্যবাদী প্রদেশ থেকে নেতৃত্ব দিতে পারে। যেমন: ১৯২৬ সালে আসাম থেকে সিলেটের পৃথক্করণের প্রস্তাবের বিরোধিতা করে মৌলভি দেওয়ান ওয়াসিল চৌধুরী আইনসভায় পরামর্শ দিয়েছিলেন যে নতুন এই প্রদেশ থেকে সিলেটিরা উপকার নিতে পারবে। তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন যে আসামে সরকারি চাকরির পদগুলো বাঙালিদের দ্বারাই পূর্ণ ছিল কিন্তু এখন সিলেটিরা তাদের হটিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। বাঙালিদের থেকে স্বতন্ত্র হিসেবে সিলেটিদের দৃষ্টিভঙ্গি কখনো মুছে যায়নি এবং হিন্দু-মুসলিম বিভাজন বৃদ্ধির সঙ্গে সেই দৃষ্টিভঙ্গি কখনোই আবৃত্ত হয়ে যায়নি। ওয়াসিল চৌধুরী আরও যুক্তি দিয়েছিলেন যে রাজনৈতিকভাবেই সিলেট আসামের সঙ্গে যুক্ত ছিল। ওই সময়ই কিছু মুসলিম রাজনীতিক প্রথম সিলেটের মুসলমানদের বোঝাতে ‘সিলেটি’ শব্দের উদ্ভাবন করেছিলেন। পরে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ তাঁর ‘পাকিস্তান’ পরিকল্পনায় আসামকেও যুক্ত করেছিলেন। তিনি আসামের মুসলিম লীগের সম্পাদক মাহমুদ আলীর কাছে বলেছিলেন, ‘যুবক, আমি তোমাকে বলছি, আসাম ব্যতীত কোনো কিছুই আমাকে সন্তুষ্ট করতে পারবে না।’৫১ সুতরাং, মুসলিম রাজনীতিবিদদের সমর্থন হারিয়ে আসামের আইনসভায় সিলেটের ‘বাংলায় ফিরে আসো’ প্রস্তাব তার ভিত্তি হারিয়েছিল। সিলেটের মুসলিম রাজনীতিবিদ যেমন: ওয়াসিল চৌধুরী, মাহমুদ আলী, আবদুল মতিন চৌধুরী আসামকে তাঁদের ‘ভবিষ্যত্ মুক্ত ভূখণ্ড’ হিসেবে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলেন। ১৯৩০ এবং ১৯৪০ সালে শুরুর দিকে তাঁরা ব্রিটিশ সরকারের অধীনে প্রদেশে মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন। যা হোক, ১৯৪০ সালের প্রথম দিকে, আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের প্রধান উদ্বেগ ছিল আসামকে ‘পাকিস্তান পরিকল্পনা’র সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করা।৫২
১৯৩০-এর দশকে অনেক অহমিয়া রাজনীতিবিদ বিষয়গুলোকে আরও বেশি জটিল করে তোলেন, যখন তাঁরা ‘সিলেট থেকে মুক্তি’ পেতে চেয়েছিলেন এবং এ বিষয়টিকে অতি উচ্চপর্যায়ে উপস্থাপনের জন্য উদ্যোগ নেন। কারণ, নতুন উদ্ভাবিত এই অহমিয়া মধ্যবিত্ত শ্রেণি তাদের ‘ভূখণ্ড’ নির্ধারণ করার উদ্যোগ নিয়েছিল, যা ছিল (ক) অহমিয়া জন্য আসাম তৈরি করা এবং (খ) বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রতিযোগিতা থেকে মুক্তি পাওয়া। ১৯৩১ সালে দ্বিতীয় গোলটেবিল সম্মেলনের প্রাক্কালে আসামের সদস্য চন্দ্রধর বড়ুয়া তাঁর দাখিল করা বিবরণে সিলেটকে পৃথক করে ভাষার ওপর ভিত্তি করে আসামের ভূখণ্ড পুনরায় বণ্টন করার জন্য শক্তিশালী যুক্তি দিয়েছিলেন।৫৩ আসামের সরকারও ১৯৩৪ সালের ৫ সেপ্টেম্বর আসাম থেকে সিলেটকে বাংলায় স্থানান্তরের বিষয়ে পুনঃসংস্কার কার্যালয়ে (রিফর্ম অফিস) একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন। এতে বলা হয়েছিল:
আসাম থেকে সিলেটকে বাংলায় স্থানান্তরের বিষয়ের ওপর চলমান উত্তেজনা সম্পর্কে আসাম সরকার বিবেচনা করছে একটি প্রশ্ন, যা এই প্রদেশের ভবিষ্যত্ সরকারের সামনে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বিষয় হিসেবে থেকে যাবে। আসাম ভ্যালি অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিনিধি প্রশ্নটি উত্থাপিত করেছেন, যাতে আসাম সরকার ভারতের সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। মূল কথা হচ্ছে, এই সরকারের মতে বিষয়টি এ প্রদেশের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ও বিবেচনাযোগ্য।৫৪
লন্ডনে ওই সময় রিচার্ড অস্টিন বাটলার৫৫ ভারতীয় পররাষ্ট্রসচিবের অধীনে কাজ করছিলেন। বাংলার সঙ্গে সিলেটের পুনরায় একত্রীকরণ সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়ে তিনি বেশ সচেতন ছিলেন। অবশ্য তিনি সেসব বিষয় আমলাতন্ত্রের দ্বারাই জানতে পেরেছিলেন। ১৯৩৪ সালের ১২ ডিসেম্বর বাটলার সাংসদ স্যার ওয়াল্টার স্মাইলসহ চন্দ্রধর বড়ুয়ার সাক্ষাত্কার নিয়েছিলেন।৫৬ সাক্ষাত্কারটি মূলত বাংলার সঙ্গে সিলেটের একত্রীকরণের প্রশ্ন ও প্রাসঙ্গিক বিষয়ের ওপর আলোকপাত করেই নেওয়া হয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, সাক্ষাত্কারে আসাম থেকে সিলেটকে বাদ দেওয়ার যে দাবি অহমিয়া এলিটরা করেছিল, সে বিষয়কেও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। বাটলার উল্লেখ করেছিলেন:
তিনি (বড়ুয়া) বললেন যে আসামে একটি বিরাট অনুভূতি কাজ করেছে যে সিলেটিদের কারণে আসামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় আর একটি হাইকোর্ট প্রতিষ্ঠার আশা পূরণ হচ্ছে না। কারণ, সিলেটিরা এসবের কোনোটিই চায়নি, যেহেতু তারা দেখতে পেয়েছিল যে প্রতিবেশী বাংলা প্রদেশে এসব পর্যাপ্ত সংখ্যায়ই রয়েছে... আমি তাকে সিলেটকে বাংলায় স্থানান্তরের বিষয়ে নতুন কোনো বিল বা আইন প্রণয়ন হতে পারে এমন কোনো আশার বাণীই শোনাতে পারছিলাম না।৫৭
ওই বৈঠকে বাটলার এবং স্মাইল বড়ুয়াকে ব্যাখ্যা করেছিলেন যে কেন ব্রিটিশ প্রশাসন বাংলার সঙ্গে সিলেটকে স্থানান্তরের পরিবর্তে আসামের সঙ্গে রাখতে অগ্রাধিকার দিয়েছিল। বড়ুয়ার উদ্দেশে বাটলারের স্পষ্ট বক্তব্য ছিল: ‘এ বিষয়ে কোনো ঐকমত্য নেই। এমনকি সেই মুসলমানেরাও, যাঁরা সিলেটে সংখ্যাগরিষ্ঠ তারাও সিলেটের স্থানাস্তরের ব্যাপারে বিরোধিতা করেছে।’৫৮ মনে হয়েছিল যে আসামের সীমান্ত, বিশেষ করে আসামের সঙ্গে সিলেটের একত্রীকরণ মূলত চা-আবাদকারীদের স্বার্থে এবং প্রশাসনিক সুবিধাসমূহের ওপর ভিত্তি করেই করা হয়েছিল। আসাম সরকারের পক্ষে আর্থার উইলিয়াম বোথাম একটি গোপন চিঠির মাধ্যমে সরকারি অবস্থান স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছিলেন। নিচে তা তুলে ধরা হলো:
এমনকি বর্তমানে আসামের আংশিক বিভক্তিও প্রশাসনিক এবং রাজনৈতিক উভয় ক্ষেত্রেই সাংঘাতিক জটিলতা তৈরি করতে পারে এবং যদি এর ভূখণ্ড বা জনসংখ্যা বস্তুগতভাবে কাটছাঁট করা হয়, তাহলে এটি অনিশ্চিত যে সিলেট ব্যতীত এ প্রদেশ তার মর্যাদা ধরে রাখতে পারবে কি না।৫৯
যদিও বাংলার সঙ্গে সিলেটের স্থানান্তরের বিষয়ে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ আসাম, কলকাতা, দিল্লি এবং লন্ডনে বিভিন্ন পক্ষের মতামত শুনেছিল, তারপরও সরকারের মোটামুটি অবস্থান অপরিবর্তিতই ছিল। ব্রিটিশ প্রশাসনের অনেকেই চা আবাদকারী হিসেবে একই পরিবারের স্বত্বাধীন ছিল এবং এমনকি কিছু ক্ষেত্রে তারা নিজেরা চা-ব্যবসায় গুপ্তভাবে বিনিয়োগও করেছিল।৬০ ১৯ শতকের শেষের দিকে চা আবাদকারীরা ব্রিটিশ ভারতে শক্তিশালী সুবিধাবাদী বা লবিগোষ্ঠী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। ওই শতাব্দীর শেষদিকে আসামের ছোট লাট স্যার হেনরি কটন শ্রমিকদের অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশা দেখে মোটামুটি সন্তোষজনক একটি সংস্কারের পরিকল্পনার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। যা হোক, চা আবাদকারীদের বাণিজ্যিক স্বার্থের কাছে এই ভদ্রবেশী উদ্যোগও প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল। কটনের আত্মজীবনী থেকে আবাদকারীদের প্রভাব ও ক্ষমতা উপলব্ধি করা যেতে পারে:
একটি ক্ষমতাবানগোষ্ঠী হিসেবে চা আবাদকারী এবং চা-ব্যবসায়ীরা সরকারের নিয়ন্ত্রণ ও হস্তক্ষেপের প্রতি এত অসহিষ্ণু হয়েছিল যে তারা আসামের সরকারি কর্মকর্তাদের যেকোনো নির্দেশকে মর্যাদা খর্বকারী বিষয় হিসেবে দেখত এবং চা-শ্রমিক নিয়ে নিতান্ত প্রয়োজনীয় কোনো কোনো পদক্ষেপ নিলেও অসম্মানিত বোধ করত। যার ফলে সরকারি কর্মকর্তারা এদের একেবারেই শত্রুতে পরিণত হয়েছিল। ওই সম্প্রদায়ের একটি অংশ প্রশাসনের নিয়ম ও আইনকানুন অমান্য করত।৬১
স্যার হেনরি বলেছিলেন যে তাঁর সঙ্গেও চা আবাদকারীরা বিদ্বেষ এবং প্রতারণামূলক আচরণ করত, যদিও তিনি একটি অভিজাত পরিবারের সন্তান ছিলেন, যে পরিবারটি ভারতে পাঁচ-পাঁচটি প্রজন্ম পর্যন্ত আমলা হিসেবে সেবা দিয়েছিল। স্যার হেনরির বক্তব্য-বিবৃতির চেয়ে ভাইসরয় লর্ড কার্জনের আসামের শ্রমিকদের কল্যাণ-বিষয়ক বক্তব্য-বিবৃতিগুলো অধিক শক্তিশালী ছিল এবং এভাবেই তাদের মধ্যে দাপ্তরিক যোগাযোগ হচ্ছিল। তা সত্ত্বেও লর্ড কার্জনকে চা আবাদকারীদের বিরোধিতার মুখে পিছু হটতে হয়েছিল। স্যার হেনরির মতে, ‘তিনি (কার্জন) তাঁর গা বাঁচিয়ে চলছিলেন আর আমাকে নেকড়েগুলোর সামনে ঠেলে দিয়ে বিপদে ফেলেছিলেন।’৬২ ফলে স্যার হেনরি বাংলার লে. গর্ভনরের চাকরিতে উন্নীত হওয়ার পরিবর্তে দ্রুত অবসরে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। এহেন চা আবাদকারীরা যখন নিজেদের স্বার্থে সিলেটের মতো একটি অগ্রসর অঞ্চলকে আসামে ধরে রাখতে চায়, তখন বাংলার সঙ্গে সিলেটের পুনরেকত্রীকরণ অসম্ভব এক বিষয়ই ছিল।
বিভিন্ন পক্ষের দাবির মুখে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জনমতের ধারণা পেতে নিজস্ব একটি জরিপও পরিচালনা করেছিল। সরকারের নির্দেশনায় ১৯২৫ সালের জুনে সিলেটের ডেপুটি কমিশনার ক্রিস্টোফার গিমসন তৃণমূল পর্যায়ে এ বিষয়ে বহু মানুষের সঙ্গে পরামর্শ করেছিলেন। তিনি উল্লেখ করেছিলেন যে সিলেটের জনগণের প্রকৃত ইচ্ছাটা কী সে বিষয়ে বলা তাঁর আয়ত্তের বাইরে। তিনি লিখেছিলেন যে ‘মূলত ৭৫ শতাংশ মানুষই কৃষি পেশায় নিয়োজিত। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের মতামত বা দৃষ্টিভঙ্গি জানাটা অসম্ভব।’৬৩ তিনি আরও উল্লেখ করেছিলেন যে মাত্র শতকরা ১০ ভাগ মানুষ এ বিষয়ে আগ্রহ দেখিয়েছিল এবং অধিকাংশ মুসলিম চেয়েছিল আসামের সঙ্গেই থাকতে। তিনি আরও উল্লেখ করেছিলেন যে এটিও বিস্ময়কর ছিল না যে যাঁরা ব্যবস্থাপক হিসেবে চা-বাগানে কাজ করতেন, তাঁদেরও ‘সিলেটের আসামের সঙ্গে থাকাটাই অধিক পছন্দের ছিল।’৬৪ এভাবে দাপ্তরিক জরিপের ওপর ভিত্তি করে ব্রিটিশ শাসকেরা অত্যন্ত সচেতনভাবে আসামের ঔপনিবেশিক সীমানাগুলোর নকশা করেছিল, যাতে করে সিলেট একটি মূল উপাদান হয়ে উঠেছিল। ১৯২৮ সালে আসাম রিভিউ-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল যে এ বিষয়ে চা আবাদকারীরা সব সময়ই সরকারের পক্ষে ভোট দিয়েছে।৬৫ ১৮৭০-এর দশকে প্রধানত হিন্দু এলিটদের নেতৃত্বে পরিচালিত আবেদন-নিবেদন ও অবিশ্রান্ত লবিং সত্ত্বেও সিলেটকে আসামের সঙ্গে একীভূত করা হয়। বিশিষ্ট কংগ্রেস নেতা ব্রজেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরীর নেতৃত্বে ১৯১০, ১৯২০ ও ১৯৩০ দশকে কখনো আসামের আইনসভায় তুমুল বিতর্ক ও প্রস্তাব পাস করে আবার নানা রকম আন্দোলন করেও সিলেটের বহু বাঙালিদের—যার অধিকাংশই ছিলেন হিন্দু এলিট—দৃঢ়সংকল্প ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছিল এবং ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত সিলেট বাংলায় ফিরে আসতে পারল না। কিন্তু বিস্ময়কর হলেও সত্য যে ব্রজেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরীর নেতৃত্বে এদের অনেকেই আবার ১৯৪৭ সালে আসামে থাকার জন্য প্রচারণা চালালেন। ইতিহাসের এই কৌতুকপদ অথচ নিদারুণ রসিকতার চিত্র বিভিন্ন মহাদেশের মহাফেজখানাগুলোর হাজার হাজার দলিলপত্রে লুকিয়ে আছে। এই প্রবন্ধের পরবর্তী অংশে তার কিছু নমুনা উপস্থাপন করা হবে।
মনোজগতে সাম্প্রদায়িকতা (কমিউনালিজম) এবং সিলেটের গণভোটে ‘স্ববিরোধিতার মুখোশ’
স্পষ্টত, ১৯২০-এর দশক পর্যন্ত সিলেটে আন্তসাম্প্রদায়িক সম্পর্কটি অত্যন্ত আন্তরিক ছিল। কারণ, শাহজালাল এবং শ্রী চৈতন্যের সাংস্কৃৃতিক উত্তরাধিকার ওই অঞ্চলের মানুষের সমন্বিত মনস্তত্ত্বের ওপর একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব বিস্তার করেছিল, যা তাদের উদার মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রতিফলিত হয়েছিল। অঞ্চলটির আধ্যাত্মিক বা মরমি গানে সেসব উদারতা পর্যবেক্ষণ করা যেতে পারে, যা এই সীমান্ত সংস্কৃতির মিথস্ক্রিয়া থেকেই সৃষ্ট।৬৬ এই শক্তিশালী প্রীতিকর সংস্কৃতিটা ধীরে ধীরে মলিন হতে শুরু করে, যখন ১৯২০-এর দশকের শেষের দিকে এবং ১৯৩০ এবং ১৯৪০-এর দশকে সিলেটের এলিট শ্রেণি ক্রমেই বিরোধমূলক অবস্থান গ্রহণ করে। এই বিতর্কিত পরিস্থিতিতে, সাম্প্রদায়িক অনুভূতিগুলো হিন্দু ও মুসলিম ব্যবসায়ীদের দ্বারাও প্রভাবিত হচ্ছিল, যারা তাদের কোম্পানির নাম সাম্প্রদায়িকভাবে নামকরণ করতে শুরু করেছিল—যদিও শুরুতে প্রবণতাটা ছিল অসাম্প্রদায়িকই। যেমন: ১৯১৯ সালে কিছু উদ্যোক্তা তাঁদের কোম্পানির নামকরণ করেছিলেন ‘হিন্দু-মুসলিম চা কোম্পানি’। পরে, অর্থাত্ ১৯২০-এর দশকে হিন্দু ও মুসলিম ধনিক শ্রেণি তাদের কোম্পানিগুলোকে ‘ধর্মীয়’ নামে নিবন্ধিত করেছিল। যেমন ‘বীণাপাণি’, ‘জয়-তারা’ এবং ‘দারু-সালাম’ ইত্যাদি।৬৭
সিলেটের গণভোটের ফলে আসাম এবং পূর্ব বাংলার সীমান্তের ওপর একটি নতুন মানচিত্র আঁকাটা ছিল অঞ্চলটির ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। সিলেটের জনসংখ্যার অধিকাংশই ছিল মুসলিম এবং মুসলিম লীগ সক্রিয়ভাবেই সিলেটকে পাকিস্তানের সঙ্গে অন্তর্ভুক্তকরণের জন্য প্রচারাভিযান চালিয়েছিল। একই সঙ্গে কংগ্রেসের সিলেট শাখা সক্রিয়ভাবে প্রচারাভিযান চালিয়েছিল, যাতে সিলেট আসামের সঙ্গে থাকে। সিলেটের গণভোট ছিল এমন এক ‘মহা-ঘটনা’, যেখানে সবাই কমবেশি জড়িয়ে পড়েছিল—তা কংগ্রেসই হোক আর মুসলিম লীগই হোক, কমিউনিস্ট হোক, অথবা ভারতীয় পন্থী মৌলভিই হোক, কিংবা ‘পাকিস্তানপন্থী’ দলিত, সবাই এবং অবশেষে ব্রিটিশরাও সম্পৃক্ত ছিল। ১৯৪০ সালে সিলেটের জনসংখ্যাকে নিম্নোক্তভাবে বণ্টন করা হয়েছিল: মুসলিম ৬০ দশমিক ৭ শতাংশ, বর্ণ হিন্দু ২৫ দশমিক ১ শতাংশ, নিম্নবর্ণ হিন্দু বা দলিত ১১ দশমিক ৬ শতাংশ এবং ক্ষুদ্র জাতি ২ দশমিক ২ শতাংশ। যা হোক, সিলেট জেলার জন্য আসাম আইনসভায় ভোটারদের নিম্নোক্তভাবে বিভক্ত করা হয়েছিল: মুসলিম ৩ লাখ ১১ হাজার ৭০৭ জন এবং সাধারণ ২ লাখ ৩৫ হাজার ৮০৮ জন।৬৮ যদিও সিলেটের মোট জনসংখ্যার ৬০ দশমিক ৭ শতাংশ ছিল মুসলিম, তথাপি জেলাটির মোট ভোটাধিকার প্রয়োগের ক্ষেত্রে তাদের মাত্র ৫৪ দশমিক ২৭ শতাংশ প্রতিনিধিত্ব ছিল। সুতরাং, ১৯৪৭ সালের জুনে লিয়াকত আলী খান তাঁর এক চিঠিতে মাউন্টব্যাটেনকে যুক্তি দিয়েছিলেন যে মুসলমানদের ভোট তাঁদের প্রকৃত শক্তিকে প্রতিফলিত করেনি। এর প্রতিকার করতে তিনি পরামর্শ দিয়েছিলেন যে বাদ পড়া মুসলমানদের নতুন করে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। চা-শ্রমিকদের প্রশ্নে তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন, আমি অনুমান করছি যে বিশেষ নির্বাচনী এলাকার নির্বাচকমণ্ডলী যেমন চা-শ্রমিক (ভূমিপুত্র না হওয়ায়), চা আবাদকারী, বণিক সংঘ ইত্যাদি গণভোটে অংশ নিতে পারছেন না। ১৯৪৭ সালের ২৫ জুন মাউন্টব্যাটেন তাঁকে ফিরতি চিঠিতে লিখেছিলেন যে ‘তার প্রথম পরামর্শ গ্রহণ করা যাচ্ছে না (বাদ পড়া মুসলমানদের নতুন করে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা)। কারণ, এত সময় তাঁর হাতে নেই। ফলে, বিদ্যমান নির্বাচকমণ্ডলীর ভিত্তিতেই সিলেটের গণভোট অনুষ্ঠিত হবে’।৬৯ তবে মাউন্টব্যাটেন লিয়াকত আলীর দ্বিতীয় পরামর্শ গ্রহণ করেছিলেন, যাতে করে বিশেষ নির্বাচনী এলাকার নির্বাচকমণ্ডলীরা—চা-শ্রমিক এবং চা আবাদকারীরা (ভূমিপুত্র না হওয়ায়) সিলেটের গণভোটে অংশ নিতে পারবেন না।
চা-শ্রমিকের বিষয়টি হঠাত্ করেই আলোচনার টেবিলে আনা হয়েছিল। মজার বিষয় হলো, তাঁরা স্থানীয় শ্রমিক ছিলেন না; তাঁদের প্রায় সবাই ছোট নাগপুর উপত্যকা এবং সাঁওতাল পরগনা থেকে নতুন সৃষ্ট আসাম প্রদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এসেছিলেন। উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে এই আন্তভূমি শ্রমিক অভিবাসন সিলেট ও আসাম প্রদেশের অর্থনৈতিক আলোচনার অন্যতম বিষয় হয়ে উঠেছিল এবং তা ১৯৪০-এর দশকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত চলমান ছিল।৭০ ১৮৭৬ সালে অভিবাসন-বিষয়ক অধ্যক্ষ (সুপারিনটেনডেন্ট) জে জি গ্র্যান্ট লিখেছিলেন যে পশ্চিম বাংলা এবং ছোট নাগপুর থেকে চা আবাদকারী জেলাগুলোর জন্য শ্রমিক সরবরাহ করা হয়। উনিশ শতকের মাঝামাঝিতে খরা বা অনাবৃষ্টির কারণে ওসব অঞ্চলে খাদ্য উত্পাদন ব্যাহত হয়েছিল এবং কয়েকবারই দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল। ১৮৭০, ১৮৮০ এবং ১৮৯০-এর দশকে চুক্তিকারী ও তাদের উপপ্রতিনিধিদের যেমন আরকাট্টি (দেশীয় নিয়োগকারী) মাধ্যমে চা-শ্রমিকদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। যদিও বাগানের সর্দারদের (শ্রমিকনেতারা) দ্বারা নিয়োগপ্রক্রিয়া স্বাধীনভাবে হয়েছিল কিন্তু বিশালসংখ্যক শ্রমিককে নিয়োগ করা হয়েছিল তাড়াহুড়ো করে। চা আবাদের সবচেয়ে ভালো বছরগুলোতে, বিশেষ করে ১৮৯০-এর দশকে বড় বড় প্রতিষ্ঠান যেমন: জেমস ফিনলে, অ্যান্দ্রে ইয়েলে, অক্টাভিয়াস স্টিল এবং ডানকান ব্রাদার্স তাদের নিজস্ব নিয়োগ সংস্থা খুলেছিল। প্রধান কর্মচারী হিসেবে বাগানের সর্দারদেরও অনুমতিপত্র দেওয়া হয়েছিল, যার অর্ধেক অনুমতিপত্র উপচুক্তিকারী যেমন আরকাট্টি এবং সর্দার নিয়োগ অঞ্চলে সক্রিয় ছিল। বাংলার অভিবাসন বিভাগের একটি প্রতিবেদন থেকে দেখা যায় যে জেমস ফিনলে সিলেটের সবচেয়ে বড় চা কোম্পানি হিসেবে অনেক চা-বাগান পরিচালনায় যুক্ত ছিলেন এবং তাঁরা ১৮৯০ সালে শ্রমিক নিয়োগের জন্য সবচেয়ে বেশি অনুমতিপত্র পেয়েছিলেন।৭১ যেমন সে সময় জেমস ফিনলে কোম্পানির ১৬টি অনুমতিপত্র ছিল, যেগুলো নিম্নোক্ত অঞ্চলে শ্রমিক নিয়োগের জন্য দেওয়া হয়েছিল: সিংভুম, মানভুম, দুমকো, হাজারীবাগ, গিরিদা, গেই, পাটনা, রাজমহল, সাহেবগংগ, গোবিন্দ্রপুর, অ্যারেই, রানিগঞ্জ, মেহিজাম, বর্ধমান, বীরভূম, লোহারডুগা, বাকুরা, নদীয়া, পঞ্চমবু, চব্বিশ পরগনা, মুংগের, ভাগলপুর ও মোজাফফরপুর। ১৮৯৬ সালের ডিসেম্বরে কলকাতায় ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসের এক সভায় বিপিন চন্দ্র পাল তাঁর বক্তৃতায় উল্লেখ করেছিলেন যে গত কয়েক বছর যাবত্ সাঁওতাল পরগনা জেলাটি ‘চা-শ্রমিক’ সংগ্রহের এক উর্বর ভূমি হিসেবে পরিণত হয়েছে।৭২ অধিকাংশ ক্ষেত্রে আসামে শ্রমিক অভিবাসনের প্রক্রিয়াটি দীর্ঘস্থায়ী একটি বিষয় হিসেবে সংঘটিত হয়েছিল। বিশ শতকের প্রথম দশকে ক্রমান্বয়ে সম্প্রসারিত রেল যোগাযোগ চা-বাগানগুলোতে চা-শ্রমিকদের পরিবারসহ স্থানান্তরের ক্ষেত্রে একটি বিশাল ভূমিকা রেখেছিল।
এই ঐতিহাসিক বক্ররেখা ঔপনিবেশিক-উত্তর অনেক ‘হিন্দু’ তত্কালীন ঘটনাপ্রবাহকে ভুলভাবে চিত্রিত করছেন। অর্থাত্ এঁরা বাস্তবে যা ঘটেছিল, তার বিকৃত বিবরণ বা বক্তব্য ‘অতি-জাতীয়তাবাদী’ মোড়কে বর্তমানে উপস্থাপন করেছেন। ভারতের স্বাধীনতার ৫০তম বার্ষিকীতে, ১৯৯৮ সালের ২১ আগস্ট, সিলেটের গণভোটের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ অনুসন্ধানের উদ্দেশে দক্ষিণ আসামের ভারতীয় ইতিহাস সংকলন সমিতির পক্ষ থেকে শিলচরে একটি সেমিনারের আয়োজন করেছিল। এতে একজন অংশগ্রহণকারী, জন্মজিত্ রায় সিলেটের চা-শ্রমিকের সমকালীন পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্ভবত সচেতন ছিলেন না। কারণ, রায় যুক্তি দিয়েছিলেন যে:
ভূমিপুত্র না হওয়ার অজুহাতে ১৯৪৬ সালের বিধানসভার নির্বাচনে চা-বাগানের শ্রমিকদের মধ্যে প্রায় দেড় লাখ হিন্দু ভোটারের ভোটাধিকার হরণ করা হয়েছিল বা ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল। যদি তাদের ভোটাধিকারের অনুমতি দেওয়া হতো এবং শুধু যদি ৪০ শতাংশকে এ সুযোগ দেওয়া হতো, তাহলে ভোটের ফলাফলের মোড় ঘুরে যেত। তারা নির্বাচনের মাত্রাটাই পরিবর্তন করে ফেলতে পারত। সুতরাং তথাকথিত সিলেটের গণভোট চোখে ধুলো দেওয়া ছাড়া আর কিছুই ছিল না।৭৩
জন্মজিত্ রায়ের এই কথা সঠিক নয়। কারণ, প্রথমত, সব চা-শ্রমিক ‘হিন্দু’ ছিলেন না। অনেকেই ছিলেন সর্বপ্রাণবাদ এবং আদিবাসী ধর্মীয় প্রথার অনুসারী, যাঁদের সঙ্গে বর্ণহিন্দুদের ধর্মের খুব কমই সংযোগ ছিল। সরকারি নথিপত্র থেকে দেখা যায়, ১৯৪৬ সালের নির্বাচনের ভোটার তালিকায় ১১ হাজার ৪৪৯ জন চা-শ্রমিক ভোটার ছিলেন। ওই বছর সিলেটে একটি শ্রমিক নির্বাচনী এলাকা অর্থাত্ শ্রীমঙ্গল থেকে সর্দার জীবন সাঁওতাল আসামের আইন পরিষদের নির্বাচনে সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন।৭৪ স্পষ্টতই, শ্রমিকদের মধ্যে চা-শ্রমিকদেরই বেশি সুবিধা দেওয়া হয়েছিল। অবশ্য ভূমিপুত্র না হওয়ায় চা-শ্রমিক ভোটাররা সিলেটের গণভোটে অংশ নিতে পারেননি, তবে গণভোটে সিলেট পূর্ব বাংলায় যুক্ত হবে; সে জন্য ভোট পড়েছিল পাঁচ গুণ বেশি অর্থাত্ ৫৫ হাজার। যার অর্থ দাঁড়ায়, চা-শ্রমিক ভোটাররা সবাই সুযোগ পেলেও ফলাফলের কোনো হেরফের হতো না। যা হোক, সরকারি একটি প্রতিবেদনে সমসাময়িক পরিস্থিতি তুলে ধরে বলা হয়েছে এভাবে:
এ ক্ষেত্রে শ্রীমঙ্গল চা-বাগান শ্রমিক নির্বাচনী এলাকার অবস্থানটি কোনো না কোনোভাবে ভিন্ন। পর্যাপ্ত বৈশিষ্ট্যযুক্ত শর্ত ছিল এই যে স্থায়ী কর্মচারী হিসেবে ভোটারদের যোগ্যতাসম্পন্ন চা-বাগানে কমপক্ষে ১৮০ দিনের বেশি কাজ করতে হবে। এভাবে তারা জেলাটিতে চলমান জনসংখ্যায় তেমন কোনো ঝুঁকি ছাড়া প্রতিনিধিত্ব করতে পারবে। এ ছাড়া এ বিষয়ে তেমন জোরালো কোনো কারণ নেই, যাতে চা-শ্রমিকদের সিলেটের গণভোটে বিশেষ সুবিধা দেওয়া উচিত বলে মনে করেছে, যেখানে অন্য শ্রমিকদের যেমন শিল্প শ্রমিকদের বা কৃষি শ্রমিকেরাও সে সুবিধা পায়নি। আমরা এখানে সাধারণ কিছু নীতিমালা গ্রহণ করেছি যে গণভোটের ক্ষেত্রে বিশেষ নির্বাচনী এলাকার ভোটারদের অংশগ্রহণের অনুমতি দেওয়ারও প্রয়োজন পড়বে না [শব্দটিতে জোর দেওয়া হলো]।৭৫
আইন অনুযায়ী, কৃষকদের মধ্যে একমাত্র তারাই ভোটাধিকার প্রয়োগের যোগ্য, যারা সরকারকে ৯ আনা করে খাজনা দিতে পারত।৭৬ দরিদ্র কৃষক এবং কৃষি শ্রমিক যেমন নানকার ৭৭ অথবা ছাতক সিমেন্ট কারখানার শিল্প-শ্রমিকেরা এই মানদণ্ড পূর্ণ করতে পারেনি এবং ভোটের অধিকারও পায়নি। অন্যদিকে, চা-শ্রমিকদের ভোটার হওয়ার জন্য পর্যাপ্ত বৈশিষ্ট্যও ছিল। কারণ, তারা ছিল চা-বাগানে স্থায়ী কর্মচারী। সে মোতাবেক ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে স্থায়ীভাবে কর্মরত সব চা-শ্রমিক তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করার সুযোগ পেয়েছিল। সুতরাং চা-শ্রমিকদের ভোট দেওয়ার বিষয়ে যেসব বিতর্ক তা নিঃসন্দেহে বর্তমানের ‘অতি-জাতীয়তাবাদী’ কল্পনা থেকে উত্পাদিত। এমনকি কমিউনিস্ট নেতা-কর্মীরাও এসব ফাঁকা গল্প তাঁদের আত্মজীবনীতে লিখে যাচ্ছেন।৭৮
বিভাজনের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ সিলেটে গণভোটের আহ্বান করেছিল এ কারণে যে জেলাটি পূর্ব বাংলায় (১৯৫৫ পর্যন্ত নাম পূর্ব বাংলাই ছিল, এর নামকরণ হয় পূর্ব পাকিস্তান) নাকি আসামের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত থাকতে চায় সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য। ১৯৪৭ সালের জুনের ৩ তারিখে ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে একটি বক্তব্য দেওয়া হয়েছিল, যা নিম্নরূপ:
একটি দাবি রয়েছে যে বাংলা বিভাজনের ঘটনায় সিলেটের উচিত বাংলার মুসলিম অংশের সঙ্গে সংযুক্ত থাকা... সিলেটে একটি গণভোট অনুষ্ঠিত হবে... যদি এই গণেভোটের ফলাফল পূর্ব বাংলার সংযুক্ত থাকার বিষয়ে অনুকূলে পাওয়া যায়, তাহলে পাঞ্জাব ও বাংলার ন্যায় অনুরূপ একটি সীমান্ত কমিশন গঠন করা হবে। এই কমিশন যাতে সিলেট ও পার্শ্ববর্তী মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাগুলো চিহ্নিত করবে এবং সেগুলো পূর্ব বাংলায় স্থানান্তর করা হবে।৭৯
আসাম প্রাদেশিক কংগ্রেসের আসামভাষী নেতাদের বাংলাভাষী সিলেটের প্রতি খুব কমই আগ্রহ ছিল। অমলেন্দু গুহ যুক্তি দিচ্ছেন যে, গণভোটের অন্য আরেকটি কারণ ছিল আসামভাষী নেতৃত্ব ‘সিলেট থেকে মুক্তি পাওয়া’র বিষয়ে বেশি মাত্রায় উদ্বিগ্ন ছিলেন এবং ভাষার দিক থেকে ‘সমজাতীয়’ প্রদেশ তৈরি করতে উত্সাহী ছিলেন। ফলে যখন গণভোটের ফলাফল ঘোষণা করা হয়েছিল, তখন ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় একধরনের স্বস্তির অনুভূতি লক্ষ করা গিয়েছিল।৮০ অন্যদিকে, প্রকাশ্যে সিলেট জেলা কংগ্রেস প্রাণপণ চেষ্টা করেছিল সিলেট জেলাকে আসামের সঙ্গে রাখার জন্য। গণভোটে হেরে যাওয়ার পর তারা সীমান্ত কমিশনের কাছে কার্যকর প্রতিনিধির মাধ্যমে জেলাটির কিছু অংশ রক্ষা বা উদ্ধার করার চেষ্টা করেছিল। অবশ্য, নেতৃত্বের প্রশ্নে মুসলিম লীগও বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। এক পক্ষে ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী স্যার সাদুল্লাহ্, অন্যদিকে ছিলেন মাওলানা ভাসানী। দুজন প্রভাবশালী সিলেটি রাজনীতিবিদ, মাহমুদ আলী ও মতিন চৌধুরী ভাসানীকে সমর্থন দিয়েছিলেন এবং গণভোটের সময় দেখা গিয়েছিল যে তাঁরা মুসলিম সমর্থন অর্জনের ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পেরেছিলেন। প্রশিক্ষিত লীগ স্বেচ্ছাসেবকদের মুসলিম ন্যাশনাল গার্ডের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
একই সঙ্গে ‘হিন্দুত্ববাদী’ অনলবর্ষী রাজনীতিবিদ শ্যামা প্রসাদ মুখার্জি হিন্দু মহাসভা থেকে স্বেচ্ছাসেবকদের পাঠিয়েছিলেন সিলেটকে আসামের সঙ্গে একত্রীকরণের সমর্থনে হিন্দুদের সমবেত করার জন্য। ‘সীমান্ত গান্ধী’ খান আবদুল গাফফার খান পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ধারণাকে বলিষ্ঠভাবে বিরোধিতা করেছিলেন এবং তিনি ‘লাল শার্ট’ হিসেবে পরিচিত অনেক স্বেচ্ছাসেবককে সিলেটে পাঠিয়েছিলেন কংগ্রেসের সঙ্গে কাজ করার জন্য।৮১ এভাবে সব ধরনের দ্বন্দ্বমূলক কর্মতত্পরতা ও পরস্পরবিরোধী পক্ষগুলোর চলা তর্ক-বিতর্ক গণভোটকে বাদ-প্রতিবাদের একটি উত্তপ্ত বিষয় করে তুলেছিল। কমিউনিস্ট বা মার্ক্সবাদী নেতা চঞ্চল শর্মার আকর্ষণীয় আত্মজীবনীতে হিন্দু-মুসলিমদের বিভাজনের একটি চিত্র পাওয়া যায়। এতে দেখা যায়, কোনো মধ্যবিত্ত বা উচ্চবর্ণের হিন্দু সম্প্রদায়ের কেউই সিলেটকে পূর্ব বাংলা বা পাকিস্তানের সঙ্গে একত্রীকরণের পক্ষে প্রচারাভিযান চালায়নি বা সমর্থন করেনি। এমনকি কমিউনিস্ট নেতাদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশও মুসলিম নানকারসহ অন্যান্য মানুষকে পাকিস্তানের সঙ্গে সিলেটের সংযুক্তির বিরুদ্ধে সমবেত করার চেষ্টা করেছিল। দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ লিখেছিলেন যে স্থানীয় কমিউনিস্ট নেতারাও মুসলিম লীগের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন, কিন্তু গণভোটের সময় সে বন্ধন ভেঙে গিয়েছিল।৮২ এই যুক্তিতে কেউ সন্দেহ করতেই পারে, যেহেতু প্রায় সব কমিউনিস্ট হিন্দু সম্প্রদায়ের এবং অনেকেই হবিগঞ্জের ব্রাহ্মণ-অধ্যুষিত প্রভাবশালী বেজুরা৮৩ গ্রাম থেকে এসেছিল, ফলে তাদের মনের গহিন কোণে ‘হিন্দুত্ববাদী’ প্রচারণার প্রতি একধরনের সহানুভূতি ছিল। একসময় সিলেটের কংগ্রেস নেতারা সিলেটকে বাংলায় ফেরত নিয়ে আসতে অনেক আন্দোলন করেছেন, কিন্তু এখন তাঁরা অবস্থান বদল করে আসামে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তখন কমিউনিস্ট পার্টি কংগ্রেসের সঙ্গে একটি ‘যৌথ স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী’ গঠন করে। কমিউনিস্ট পার্টির নেতা চঞ্চল শর্মাকে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধান হিসেবে বাছাই করা হয়েছিল। শর্মা তাঁদের কৌশল ও কার্যক্রম সম্পর্কে বিশ্লেষণ করে লিখেছেন:
আমাদের ‘যৌথ স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী’ সিলেটে একটি মিছিলের আয়োজন করেছিল যেটি শহরের বাইরেও কুচকাওয়াজ করতে সক্ষম হয়েছিল। হিন্দু জনগোষ্ঠীও ব্যাপক হারে এ মিছিলে অংশগ্রহণ করেছিল কিন্তু মুসলমানদের মধ্যে তেমন কেউই ছিল না। আমরা গুণকীর্তন করছিলাম, ‘ভেঙে দিও না সোনালী সিলেট এবং আসাম ছেড়ে ভঙ্গুর বাংলায় যেও না’। আমাদের কৌশলটা কিছু মুসলমানকে ভারতের পক্ষে ভোট দিতে উত্সাহিত করা, কিন্তু তারপরও আমরা ব্যর্থ হয়েছি...হিন্দুরা ভোট দিয়েছিল ভারতের পক্ষে এবং মুসলমানরা ভোট দিয়েছিল পাকিস্তানের পক্ষে।৮৪
শর্মার কথাটা সর্বাংশে সত্য নয়, অনেক মুসলিম—যাদের মধ্যে অভিজাত ও মাওলানারাও ছিলেন—সেই সময় ভারতের পক্ষে ভোট দিয়েছেন। পক্ষান্তরে উচ্চ বর্ণ থেকে উঠে আসা কমিউনিস্টরা কংগ্রেসের পেছনে সারি বেঁধে দলবদ্ধ হলেও নিম্নবর্ণের হিন্দু বা দলিতদের একটি বিশাল অংশই মুসলিম লীগের অনুকূলে ছিল। বিশেষ করে, পূর্ব বাংলার দলিত নেতা যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল সিলেটের দলিতদের ওপরে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছিলেন। ১৯৪৪ সালে জিন্নাহ তাঁর বক্তব্যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে লীগই দলিতদের অধিকারের সুরক্ষা দেবে।৮৫ যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল ১৯৪৭ সালের ২ জুলাই মাউন্টব্যাটেন ও নেহরুর নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের একজন আইনমন্ত্রী হিসেবে সিলেট পরিদর্শন করে চা শ্রমিকদের এবং কমিউনিস্টদের কর্মকাণ্ড-সম্পর্কিত একটি টেলিগ্রাম মাউন্টব্যাটেনকে পাঠিয়েছিলেন:
গতকাল সিলেটে পৌঁছেছিলাম। কমিউনিস্ট ও কংগ্রেসের নেতৃত্বে চা-বাগান শ্রমিকেরা আমাকে উত্তেজিত করেছিল। মুসলিম ন্যাশনাল গার্ডের লোকেরা কুলাউড়া ও সিলেটের মধ্যে ভ্রমণ করার সময় দক্ষিণবাগ চা-বাগানের শ্রমিকদের আক্রমণের শিকার হয়েছিল এবং অনেকেই লাঠি-তিরের আঘাতে আহত হয়েছিল। সিলেট ও কুলাউড়ার ৩৮ মাইল দূরত্বের মাঝেই ওইসব শ্রমিক ২১ বার ট্রেনটি থামিয়ে দিয়েছিল। চা-শ্রমিক ও কংগ্রেস কর্তৃক সৃষ্ট সহিংসতায় মুসলিমরা আতঙ্কিত। তারা সামরিক বাহিনীর সদস্য হিসেবে ইউরোপীয়দের অথবা সমানসংখ্যক হিন্দু ও মুসলিমকে মোতায়েনের অনুরোধ করছিল। এ বিষয়ে আমি আপনার দ্রুত মনোযোগ প্রত্যাশা করছি।৮৬
যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলের মতোই যে-কেউ সিলেটের গণভোটকালীন কমিউনিস্টদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেন। যা হোক, তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গিতে এটি সাম্প্রদায়িক বিষয় ছিল না, যেহেতু তাঁরা অনুভব করতেন যে সিলেট আসামের সঙ্গে থাকলে শ্রেণি রাজনীতি করার অনুকূল পরিবেশ পাওয়া যাবে এবং চঞ্চল শর্মা স্পষ্টভাবে বলছেন যে এটি ছিল দলীয় সিদ্ধান্ত।৮৭ সিলেটে জন্ম নেওয়া হেমাঙ্গ বিশ্বাস ও নির্মলেন্দু চৌধুরী দুজনই আসামের নেতৃত্বস্থানীয় কমিউনিস্ট ও তাদের সাংস্কৃতিক শাখা গণনাট্য সংঘের সদস্য ছিলেন এবং দুজনই লোকসংগীত গায়ক হিসেবে সিলেটের উজ্জ্বল ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার বহন করছিলেন। গণভোটকালে তাঁরা যেসব গান ও স্লোগান রচনা করতেন তা হলো: ‘হিন্দু-মুসলিম ভাই ভাই’ ‘চলো সবাই মিলে আসাম যাই’ এবং ‘ও প্রিয়, কেন সোনালী সিলেটকে ভেঙে টুকরো টুকরো করছ?’৮৮ প্রত্যুত্তরে মুসলিম লীগ ও মুসলিম ন্যাশনাল গার্ড জবাব দিয়েছিল, ‘হিন্দু-মুসলিম ভাই ভাই, চলো দুয়ে মিলে গরু খাই’। কিছু দলিত নেতাও কংগ্রেসের অনুকূলে ছিলেন। যেমন বাংলার আইনসভার সদস্য বিরাট মণ্ডল সিলেট পরিদর্শন করেছিলেন এবং বেশ কয়েকটি সভায় ভাষণও দিয়েছিলেন। ভাষণ প্রদানকালে তিনি দলিতদের কাছে আবেদনও করেছিলেন যে তারা যাতে সিলেটকে ভারতের সঙ্গে সংযুক্ত রাখার জন্য ভোট দেয়। তবে এই পরিদর্শন তাদের ওপর খুব কম প্রভাব ফেলেছিল। বর্ণভিত্তিক বিভাজনের উত্সগুলো স্থানীয় সামাজিক কাঠামোয় বিদ্যমান ছিল। গান্ধীবাদী সমাজকর্মী সুহাসিনী দাস যেমন উল্লেখ করেছিলেন:
আমরা বিভিন্ন গোত্রের মানুষের সঙ্গে তাদের সমর্থন পাওয়ার জন্য তালিকানুযায়ী দলিতদের মধ্যে কাজ করেছিলাম। কিন্তু আমরা সেদিন তাদের তেমন কোনো সাড়া পাইনি...উচ্চ বর্ণের হিন্দুরা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে নিচু বর্ণের হিন্দুদের কাছ থেকে নিজেদের দূরে রেখেছিল সুতরাং এই উচ্চ বর্ণের নেতাদের আহ্বানে সিলেটের গণভোটের সময় নিচু বর্ণের মানুষজন তেমন কোনো সাড়া দেয়নি।৮৯
গণভোটে সমর্থন অর্জনের জন্য উচ্চ বর্ণের হিন্দু নেতারা সুনামগঞ্জে অস্পৃশ্য বা অচ্ছুতদেরসহ একটি উত্সবের আয়োজন করেন, যেখানে রান্না করা একই খাবার সব বর্ণের মানুষের একসঙ্গে বসে গ্রহণের ব্যবস্থা ছিল। সংকটকালে ভোটের রাজনীতি কত শক্তিশালী হতে পারে, তার একটি নমুনা ছিল এটি। সেদিন বর্ণ হিন্দুরা বাধ্য হয়েছিলেন এই অচ্ছুতদের সঙ্গে একই থালায় ভাত খাওয়ার আহ্বান জানাতে, কিন্তু অচ্ছুতেরা অস্বীকৃতি জানায়। তখন একজন দলিত বা নিম্নবর্ণের নেতা দারিকনাথ বাড়ৈ ঘটনাস্থলে এসে উপস্থিত হলেন এবং অচ্ছুতদের আহ্বান করলেন, ‘এটা খাবার নয়, এটি বিষ, দয়া করে এই খাবার খেয়ো না।’৯০
সিলেটের মোট জনসংখ্যার ৬০ শতাংশ ছিল মুসলিম এবং বর্ণ হিন্দু ও নিম্নবর্ণের হিন্দু যৌথভাবে ছিল ৩৮ শতাংশ। সুতরাং কংগ্রেসের কাছে তখন মুসলিমদের ভোটগুলো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। অমন একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে মাওলানা হোসেইন আহমেদ মাদানি এবং তাঁর দল উলামা-ই হিন্দ কংগ্রেসের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছিল। তাঁর অনুসারীরা অধিকাংশই নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণির মৌলভি ছিলেন, যাঁরা আসামের মুসলমানদের ওপর একটি উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছিলেন। যেহেতু তিনি ভারত বিভাগের বিরুদ্ধে ছিলেন, তিনি তাঁর অনুসারীদের নির্দেশ দিয়েছিলেন, যাতে তাঁরা সিলেটকে পূর্ব বাংলার সঙ্গে একত্রীকরণের পরিবর্তে ভারতে অন্তর্ভুক্ত করতে প্রচারণা চালান।৯১ মাওলানা মাদানি এক শক্তিশালী যুক্তি উপস্থিত করেছিলেন যে ‘আধুনিক জাতিসত্তা নির্ধারিত হয় এর ভৌগোলিক সীমানা দিয়ে এবং তা কোনোভাবেই ধর্মীয় বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে নয়’। তিনি ‘মোত্তাহিদা কিয়ামত আওয়ার ইসলাম’ (কম্পোজিট ন্যাশনালিজম অ্যান্ড ইসলাম) শিরোনামে ব্যাপক আলোচিত একটি লেখা লিখেছিলেন, যাতে বিশেষ করে ড. মোহাম্মদ ইকবালের পৃথক মুসলিম ভূখণ্ডের যে মতাদর্শ, তার বিরুদ্ধে জবাব দিয়েছিলেন। মাদানি যুক্তি দিয়েছিলেন যে ধর্ম হিসেবে ইসলাম সাধারণ মাতৃভূমির ওপর ভিত্তি করে জাতীয়তাবাদ গঠনে বিরোধিতা করে না। নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য এবং ভাষা যার মাধ্যমে কতগুলো বিষয়ে মুসলিম ও অমুসলিম উভয়কে তা আদান-প্রদান করতে পারে ও একই জাতীয়তাবাদ গঠন করতে পারে। আবদুল মজিদ কোরেশী প্রত্যক্ষ করেছিলেন যে মাদানি সিলেটে এসে আহ্বান করেছিলেন ‘ভারতকে সমর্থন করো এবং আমাদের সঙ্গে যোগদান করো’।৯২ ১৯৪৬ সালের আসাম আইন পরিষদের নির্বাচনে (পৃথক নির্বাচকমণ্ডলীর ওপর ভিত্তি করে অনুষ্ঠিত হয়েছিল) উলামা-ই হিন্দ সিলেটে মুসলিম লীগের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে দুটি আসন পেয়েছিল এবং মুসলিম ভোটারদের ৪৬ শতাংশ নিশ্চিত করতে পেরেছিল। উলামা-ই হিন্দের ওপর নির্ভর করে কংগ্রেস দেখতে পেল যে গণভোটে তাদের পক্ষেই রায় যাওয়ার সম্ভবনা আছে। মাওলানা মাদানিও সিলেটে তাঁর অনুসারী কর্তৃক আয়োজিত বেশ কয়েকটি সভাতেই ভাষণ দিয়েছিলেন এবং আহ্বান জানিয়েছিলেন যে সিলেটকে যেন ভারতের সঙ্গে সংযুক্ত রাখতে সবাই ভোট দেন।৯৩ অবশ্য মাওলানা শাব্বির ওসমানী মাওলানা মাদানিকে একটি খোলা চিঠি দিয়ে এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। চিঠিতে তিনি এই যুক্তি তুলে ধরেছিলেন যে যদি সিলেটের মানুষ একটি মুসলিম দেশ চায়, তাহলে তাদের উচিত পাকিস্তানের পক্ষে ভোট দেওয়া।৯৪
মুসলিম লীগ কেন্দ্রীয়ভাবে ব্রিটিশ-ভারত ভাগ করে একটি পৃথক আবাসভূমি চেয়েছিল, যার মধ্যে আসামও অন্তর্ভুক্ত ছিল। যখন আসাম পাওয়া গেল না, সিলেটকে পুনরায় পূর্ব বাংলায় অন্তর্ভুক্ত করতে একটি শক্তিশালী সাংগঠনিক সমিতি গঠন করেছিল।৯৫ তাদের কর্মীরা সিলেটের গ্রাম, শহর, বাজার ও রাস্তায় রাস্তায় জনমত গঠনে সময় ব্যয় করে এবং কঠোর পরিশ্রমের স্বাক্ষর রেখেছিল। মূলত মুসলিম ভোটারদের সংগঠিত করার জন্য সভার পর সভার আয়োজন করেছিল, যাতে গণভোটে তারা পাকিস্তানকে সমর্থন করে। ১৯৪৭ সালের ২৪ এপ্রিল পুলিশ মুসলিম লীগের সভার ওপর গুলি ছুড়েছিল এবং আকলাস নামের এক লোক ঘটনাস্থলেই নিহত হন। এই বিয়োগান্ত ঘটনা তাদের স্লোগানকে আরও বেশি বেগ ও শক্তি দিয়েছিল এবং পরবর্তী সভাগুলোয় তারা উচ্চ স্বরে বলতে লাগল, ‘আসামে আর থাকব না, গুলি খেয়েও মরব না’। আসাম মুসলিম লীগের সম্পাদক মাহমুদ আলীর মতে, ‘এই স্লোগানই পূর্ব বাংলার সঙ্গে সিলেটকে সংযুক্ত হওয়ার সমর্থনে পুরো মুসলিম সম্প্রদায়কে একই বন্ধনে আবদ্ধ করে ফেলেছিল’।৯৬ এমনকি যুক্তরাজ্যে প্রবাসী সিলেটিরা গণভোটকালীন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নেওয়ার জন্য সিলেটে ফিরে এসেছিলেন। কেউ কেউ এতে এত বেশি জড়িয়ে পড়েছিলেন যে কঠোর পরিশ্রম করতে করতে তাঁরা তাঁদের স্বাস্থ্যের প্রতিও খেয়াল রাখতে পারেননি। এমন একটি বর্ণনা আমরা পাই ক্যারোলিন অ্যাডামসকে দেওয়া ১৯৮০ দশকে সৈয়দ আবদুল মজিদ কোরেশীর সাক্ষাত্কারে। কোরেশী বর্ণনা দিচ্ছেন:
আমি ১৯৪৬ সালের সেপ্টেম্বরে এ দেশ (ইংল্যান্ড) ত্যাগ করে ১৯৪৭ পর্যন্ত সময়টাতে বাড়িতেই ছিলাম। তখন অর্থাত্ সিলেটের গণভোটকালে আমি দিনে ও রাতেও প্রচারণার কাজ করছিলাম। আমি খাওয়ার জন্য কোনো সময়ও পাইনি। আমাকে তখন এখানে-সেখানে কথা বলতে হতো এবং মানুষকে বোঝাতে হতো কেন আমরা পাকিস্তান চাই। যেহেতু পাকিস্তান ইতিমধ্যেই প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে, সেহেতু এই প্রশ্নটি একমাত্র সিলেটিদের কাছেই ছিল যে আমরা কি ভারতের সঙ্গে যোগ দেব নাকি পাকিস্তানের সঙ্গে যোগ দেব। আমি একমাত্র সে প্রশ্নের ভিত্তিতেই কথা বলছিলাম। পাকিস্তানের পক্ষে সিলেটের ঘোষণা না আসা পর্যন্ত এসব কাজে কঠোর পরিশ্রমের কারণে আমি কিছুদিন অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। প্রতিটি গ্রাম, শহর এবং বাজারে ভোট নেওয়া হয়েছিল। আমি পকেটের টাকা দিয়ে মাইক এবং খাবারের ব্যবস্থা করেছিলাম।৯৭
কোরেশীর বিবরণ থেকে প্রতীয়মান হয় যে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা সিলেটিদের জন্য গণভোটের এই মুহূর্তটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল—তারা শারীরিক ও মানসিকভাবে এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছিল। সিলেটে মুসলিম লীগ কর্তৃক গঠিত ‘গণভোট সমিতি’র সভাপতি ছিলেন আবদুল মতিন চৌধুরী, যিনি কয়েকবারই আসামের মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তিনি বাংলার প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী, বাংলার সাবেক প্রধানমন্ত্রী ফজলুল হক, মাওলানা আকরম খান এবং শিল্পপতি আবুল ইস্পাহানি প্রমুখ নেতাকে দাওয়াত করে সিলেটে নিয়ে এসেছিলেন। তাঁদের বলেছিলেন পাকিস্তানের অনুকূলে প্রচারাভিযান চালানোর জন্য। আসাম মুসলিম লীগের সভাপতি মাওলানা ভাসানীর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। তাঁর নেতৃত্বের শিকড় তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। তিনি শ্রমিক ও কৃষক সম্প্রদায়ের অধিকার রক্ষায় আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। মাওবাদীদের প্রতি ঝুঁকে যাওয়ার কারণে তাঁকে ‘লাল মাওলানা’ উপনামেও ডাকা হতো। কলকাতায় দৃঢ়চেতা তরুণ-মুখ ও উদীয়মান রাজনীতিক হিসেবে পরিচিত—পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা—শেখ মুজিবুর রহমানও সিলেটের গণভোটে প্রচারাভিযানে এসেছিলেন। হাজার হাজার স্থানীয় কর্মী তৃণমূল পর্যায়ে কাজ করেছিলেন।৯৮ ১৯৪০ সালের মাঝামাঝিতে, মুসলিম আশরাফের (অভিজাত সম্প্রদায়) ও উদীয়মান মধ্যবিত্তের নেতৃত্বাধীন মুসলিম লীগ পূর্ব বাংলার অনেক জেলার মতো সিলেটেও জনপ্রিয় ছিল। বাংলা ও আসামের বিদ্যালয় এবং মহাবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও গণভোটের কাজের জন্য সিলেটে এসে সমবেত হয়েছিল। তারা সিলেটের সর্বত্রই প্রচারপত্র বিলি করেছিল। নিম্নবর্ণের হিন্দু বা দলিতদের সঙ্গে তারা যৌথভাবে কাজ করেছিল এবং যুক্তি দিয়েছিল যে পাকিস্তান হবে ‘সর্বহারা বা মজলুম’দের রাষ্ট্র।৯৯
যদিও মিডিয়া হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক রেখায় ভাগ হয়ে গিয়েছিল, তথাপি এটি সরকার এবং এর বিরোধী পক্ষের মতামতগুলোর সমালোচনা বেশ গুরুত্ব দিয়েই প্রকাশ করেছিল। যেমন দিল্লি থেকে প্রকাশিত মুসলিম লীগের মুখপত্র ডন মুসলিমদের বিরুদ্ধে হিন্দুদের প্রচারাভিযান বা ‘ষড়যন্ত্র’ নিয়ে সোচ্চার ছিল। পত্রিকাটির সম্পাদক আলতাফ হোসেন ছিলেন একজন সিলেটি এবং সে সময়ের এক বিখ্যাত সাংবাদিক, যিনি পাঠকমহলে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর ক্ষুরধার সম্পাদকীয় অক্লান্তভাবে মুসলিম লীগের নীতিমালা ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোকে ব্রিটিশ সরকার ও সচেতন মহলের সামনে হাজির করত। ১৯৪৭ সালের ২৮ জুন ডন পত্রিকায় ‘সিলেট গণভোট’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ ছাপা হয়েছিল। এতে অভিযোগ করা হয়েছিল যে ‘পুরো বিষয়টিই আসামে কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিপরিষদের হাতে রাখা হয়েছে। তদুপরি মুসলিম লীগের দৃষ্টিভঙ্গিবিরোধী এক কুখ্যাত ব্রিটিশ প্রতিনিধিকে গণভোট পরিচালনা করার জন্য নিযুক্ত করা হয়েছে, যিনি কংগ্রেসের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠছেন।’ এতে উল্লেখ করা হয়েছিল যে:
ব্রিটিশ সরকার গণভোট কমিশনার হিসেবে একজন ইউরোপবাসী আইসিএস (মি. স্টুয়ার্ট) কর্মকর্তাকে নিয়োগ করেছেন। এই পদের জন্য ওই কর্মকর্তা অনুপযুক্ত কারণ: প্রথমত, তিনি সিলেটের একজন হিন্দু মন্ত্রীর সরাসরি অধীন। দ্বিতীয়ত, তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালীন তুরস্কের যুদ্ধে পরাজিত হয়ে তুর্কি জেলে কয়েদি হিসেবে বন্দী ছিলেন, যার ফলে ‘তুরস্কের পদমর্যাদার প্রতীক টুপি’-এর প্রতি তাঁর মনে বিদ্বেষ জন্ম হওয়াই স্বাভাবিক, বিশেষ করে মুসলিম লীগের সদস্যরা ‘তুর্কি টুপি’ পরিধান করে থাকেন। সুতরাং আসামের মুসলিমরা তাঁকে বিশ্বাস করবে না।১০০
ডন সমালোচনা করে আরও লিখেছিল যে মুসলিম লীগের কারও সঙ্গে পরামর্শ ছাড়াই ব্যালট বাক্সের প্রতীকের বিষয়টি নির্ধারণ করা হয়েছে। পত্রিকাটি যুক্তি দিয়েছিল যে ‘কুঁড়েঘর বা ছাউনি’ ব্যালট বাক্সের প্রতীক হিসেবে সিলেটের আসামে থেকে যাওয়ার পক্ষে বা হ্যাঁ ভোটের জন্য পছন্দ করা হয়েছে, যা সিলেটকে পূর্ব বাংলা বা পাকিস্তানের সঙ্গে সংযুক্তির বিরুদ্ধে প্রচারণার হাতিয়ার হিসেবে কাজ করবে। পক্ষান্তরে, ‘কুড়াল’কে বাছাই করা হয়েছে ‘না’ প্রতীক হিসেবে, যাঁরা আসামে থাকতে ইচ্ছুক নয় অর্থাত্ পূর্ব বাংলা বা পাকিস্তানের সংযুক্তকরণের পক্ষে ভোট দিতে চান, তাঁদের জন্য। এ প্রতীকগুলো নিয়ে জনমানসে কুসংস্কার বা আবেগনির্ভর পটভূমি রয়েছে। একটি হলো সৃষ্টির, অন্যটি ধ্বংসের। ডন নিম্নোক্তভাবে বিষয়টি বিশ্লেষণ করছিল:
কংগ্রেস প্রচারকারীরা ইতিমধ্যে একটি জনপ্রিয় কুসংস্কার নিয়ে খেলা করা শুরু করে দিয়েছে। জনগণের কাছে আহ্বান করছে যে যদি তারা তাদের নিজেদের বাড়িতে শান্তিতে থাকতে চায়, তাহলে তাদের উচিত ‘কুঁড়েঘর’ প্রতীক চিহ্নিত ব্যালট বাক্সে ভোট দেওয়া। অবশ্য যদি তারা তাদের অঙ্গচ্ছেদ করতে চায় বা নিজেদের আহত করতে চায়, তাহলে তাদের উচিত ‘কুড়াল’ প্রতীকে ভোট দেওয়া।১০১
আরও একটি নিবন্ধে ডন অভিযোগ করেছিল যে গণভোটের জন্য তারিখ নির্ধারণটাও খুব দ্রুত হয়ে গিয়েছিল এবং যেখানে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ব্রিটিশ সামরিক কর্মকর্তাই পাঠানো হয়নি, যাতে শান্তি বজায় রাখতে অথবা নির্বাচন তত্ত্বাবধান প্রক্রিয়া ঠিক রাখতে পারে। শিখ সামরিক কর্মকর্তা সরদার বলদেভ সিংয়ের নেতৃত্বে জেলাটিতে সামরিক বাহিনীর ব্যাপক সংখ্যক অমুসলিম সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে।১০২ ডন আরও একটি অভিযোগ করেছিল যে কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন আসাম সরকার মুসলিম লীগকে স্বচ্ছ ভোটার তালিকা দিতেও দেরি করছিল, যেখানে কংগ্রেস কর্মীরা এসব কিছুই গোপনে গোপনে অনেক আগেই পেয়ে গিয়েছিল। ডন উল্লেখ করেছিল যে:
মুসলিমদের দ্বারা প্রকাশিত পত্রপত্রিকাগুলোর ক্ষেত্রে অধিক মাত্রায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল। এমনকি জেলার বাইরে বসবাসকারী সিলেটিদের কাছে বা ভারতের বিভিন্ন অংশে লীগের কর্মী এবং সদস্যদের নিকট প্রেরিত টেলিগ্রাম পাঠানোও স্থগিত করা হয়েছে এবং আসাম প্রদেশ সরকার এগুলো আটকে দিয়েছে। অনেক মুসলিম লীগের কর্মীদের অন্যায়ভাবে আটক করে রাখা হয়েছে।১০৩
দিল্লিতে সরকারি গোয়েন্দারা এসব নিবন্ধ সংগ্রহ করেছিল এবং মাউন্টব্যাটেনের মনোযোগ আকৃষ্ট করেছিল। মাউন্টব্যাটেন তখনই আসামের সরকারের কাছে দ্রুত উত্তর চেয়ে একটি টেলিগ্রাম প্রেরণ করেন। ১৯৪৭ সালের ১৭ জুলাই মাউন্টব্যাটেন কর্তৃক প্রেরিত টেলিগ্রামের জবাবে আসামের গভর্নর লেখেন:
আপনার টেলিগ্রামে উত্থাপিত প্রশ্নের জবাবে জানাচ্ছি যে মুসলিম লীগের মতিন চৌধুরী প্রস্তাব করেছিলেন পূর্ব বাংলার সঙ্গে রাখার পক্ষে ব্যালট বাক্সের প্রতীক যেন হয় ‘অর্ধচন্দ্র’ যা সিলেটের জাতীয়তাবাদী মুসলিমদের (কংগ্রেস-সমর্থিত) দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হতে পারত এবং সাম্প্রদায়িক অনুভূতিও লালন করতে পারত। আমার পক্ষে কুড়াল নিয়ে স্থানীয় কুসংস্কার কিংবা মি. স্টুয়ার্ট, আইসিএস সম্পর্কে মুসলিমদের নেতিবাচক মনোভাব জানা সম্ভব নয়।১০৪
সিলেটের ভোট পর্যবেক্ষণের সময়, নিম্নবর্ণের হিন্দু বা দলিতদের নেতা যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে হিন্দুদের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট ঘটনার সাক্ষ্যপ্রমাণাদি সংগ্রহ করেছিলেন এবং এসবের ওপর ভিত্তি করে তিনি মাউন্টব্যাটেনকে একটি টেলিগ্রামও পাঠিয়েছিলেন। এতে তিনি লিখেছিলেন:
সিলেটের হবিগঞ্জের মুসলিম লীগের সচিব আমার কাছে লিখিত একটি বক্তব্য পাঠিয়েছেন যে সরকার তাদের নৌকা জব্দ করে নিয়েছেন। শিডিউল কাস্ট (নিম্নবর্ণের হিন্দু) এবং মুসলিম ভোটার যারা প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাস করেন তাদের অধিকাংশই জটিলতায় পড়েছেন। এটি তাদের ভোটদানের সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে বঞ্চিত করবে। কর্তৃপক্ষের কাছে বিষয়টি উত্থাপন করা হয়েছে কিন্তু প্রার্থনাটি বাতিল হয়ে গেছে। সরকার কর্তৃক নৌকা জব্দ সম্পর্কে আমার মতামত হলো এই যে বিষয়টি অসন্তুষ্টি, ক্ষোভ ও ঘৃণার জন্ম দেবে, দ্রুতই বিষয়টি আপনার বিবেচনায় নেওয়া উচিত।১০৫
সিলেটের গণভোট ১৯৪৭ সালের ৬ ও ৭ জুলাইয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছিল এবং পাকিস্তানের সঙ্গে একীভূত হওয়ার অনুকূলেই ফলাফল গিয়েছিল। নানা রকম তথ্যপ্রমাণ থেকে এটা প্রতীয়মান হয় যে বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া গণভোট প্রায় অবাধ ও শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তবে ভোটের পরে একটি সহিংস ঘটনা ঘটেছিল। যেমন ৭ জুলাই দক্ষিণ সিলেটের আমতৈলে মুসলিমদের জনাকীর্ণ সমাবেশে পুলিশ গুলি ছোড়ে। এতে একজন নিহত ও তিনজন আহত হয়েছিল। সিলেট শহরের কাছে লীগের কর্মীরা কংগ্রেসের কর্মীদের ওপর আক্রমণ করেছিলেন। এতে ১২ জন আহত হয়েছিলেন, যাঁদের মধ্যে আটজনকেই চিকিত্সাকেন্দ্রে নিতে হয়েছিল।১০৬ সিলেটের গণভোটের ফলাফল ছিল নিম্নোক্ত: পূর্ব বাংলায় যোগদানের পক্ষে বৈধ ভোট ছিল ২৩৯,৬১৯ এবং আসামে থাকার জন্য ছিল ১৮৪,০৪১। পূর্ব বাংলায় যোগদানের জন্যই অধিকাংশ ভোট পড়েছিল এবং ভোটের পার্থক্য ছিল ৫৫,৫৭৮।১০৭
সিলেট ‘টুকরো টুকরো হয়ে গেল’
দেওয়ান আজরফ যেমন তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, সেই একই কথা তিনি সাক্ষাত্কারেও বলেছেন। তিনি দাবি করেছেন যে গণভোটের পর সিলেটকে কেটে টুকরো টুকরো করার পেছনে কোনো ন্যায়বিচারের মানদণ্ড অনুসরণ করা হয়নি। তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন যে কাছাড় জেলাটি, বিশেষ করে হাইলাকান্দি অঞ্চলটির নিশ্চিতভাবে পাকিস্তানের সঙ্গে যোগদান করা উচিত ছিল। কিন্তু ‘শেষ মুহূর্তে আমাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে’। আসামের আইনসভায় কাছাড় জেলার দুটো মুসলিম আসন ছিল এবং এর মধ্যে ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে উলামা-ই হিন্দ একটি পেয়েছিল—সংগঠনটি পাকিস্তান সৃষ্টির বিরোধিতা করেছিল—এবং গণভোটে হেরে গিয়ে করিমগঞ্জ আসামে রাখার জন্য দাবি করেছিল।১০৮ গণভোটের পর সিলেটের নতুন সীমানা তৈরির ওই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে উচ্চ পর্যায়ের ‘লবি’ বা প্রভাব বিস্তারকারী গোষ্ঠী কাজ করছিল যারা সিলেটের চা-বাগানগুলোকে আসামের সঙ্গে একত্রে রাখতে চেয়েছিল এবং রেডক্লিফের সিদ্ধান্তের ওপর প্রভাব ফেলেছিল। তাদের পরিকল্পিত কর্ম শুরু হয় ঠিক গণভোটের ফলাফল প্রকাশের কিছু পরেই। গণভোটের ফলাফলের ওপর অভিযোগ উত্থাপন করে নেহরু মাউন্টব্যাটেনকে লিখেছিলেন:
আজ আমার কাছে সিলেট থেকে হিন্দু-মুসলিমদের মিলিত একটি প্রতিনিধি দেখা করতে এসেছিলেন। তারা আমার সামনে অনেকগুলো অভিযোগ উত্থাপন করেছেন এবং যেসব তথ্য-উপাত্ত তারা আমার সামনে রেখেছেন, সেগুলো উল্লেখযোগ্য...আমি মনে করি আমার অবশ্যই এসব অভিযোগ সম্পর্কে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করা উচিত এবং যেহেতু এসব অভিযোগ গুরুতর এবং যদি এসব বিষয় সত্য হয়, তাহলে সিলেটের গণভোট সন্দেহপূর্ণ হবে। সংক্ষেপে আমি কি আপনাকে কিছু পরামর্শ দিতে পারি, সরকারের পক্ষ থেকে অভিযোগগুলো অনুসন্ধান বা তদন্ত করে একটি প্রতিবেদন তৈরি করা উচিত। সিলেটের গণভোটের ফলাফল প্রকাশের পূর্বে অবশ্যই তদন্ত করে একটি প্রতিবেদন দেওয়া উচিত।১০৯
নেহরু যখন মাউন্টব্যাটেনকে এই অভিযোগ করেন একই দিনে জিন্নাহও একটি চিঠি লিখেছিলেন মাউন্টব্যাটেনকে। এতে জিন্নাহ গণভোটের সময় আসামের কংগ্রেস মন্ত্রিসভার দুজন সিলেটি মন্ত্রীর হস্তক্ষেপের বিষয়ে বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করেছিলেন এবং এ বিষয়ে একটি তদন্তও দাবি করেছিলেন। জিন্নাহর এসব অভিযোগের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে নেহরুর প্রতি মাউন্টব্যাটেনের পরামর্শ ছিল নিম্নরূপ:
আমার কোনো সন্দেহ নেই যে যদি কোনো তদন্ত অনুষ্ঠিত হয়, তাহলে এ পর্যায়ে এটি হবে দীর্ঘ এবং লজ্জাজনক প্রতিযোগিতা। আমার মতে এটি ভালো হবে না। তার চেয়ে বড় কথা, আমি ইতিমধ্যে ফলাফলগুলো লন্ডনে টেলিগ্রাম করে দিয়ে দিয়েছি এবং কর্তৃপক্ষ আগামীকাল সেগুলো প্রকাশ করবে, যার অর্থ দাঁড়াচ্ছে যে সেসব তথ্য সম্ভবত অনেক সংবাদপত্র কার্যালয়ে পৌঁছেও গেছে এবং এখন ওইগুলো সংবাদপত্র কার্যালয় থেকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হলে একধরনের নজিরবিহীন প্রতিক্রিয়া ও উত্তেজনা সৃষ্টি করবে।...আমি মনে করি যেকোনো নির্বাচন অথবা গণভোট পরিচালনার সময়ই সর্বদা কিছু না কিছু অভিযোগ থাকে। এ ক্ষেত্রে আসামের লে. গভর্নর, যিনি সরাসরি আমার অধীনে, তিনি দ্রুত ফলাফল ঘোষণার অনুরোধ করেছেন, যার সুস্পষ্ট অর্থ হচ্ছে তিনি এতে সন্তুষ্ট হয়েছেন।১১০
কৌতুকের বিষয় হচ্ছে যে আসামের গভর্নর স্যার আকবর হায়দারি ছিলেন কংগ্রেস সমর্থক ও নেহরুর ঘনিষ্ঠ এক বন্ধু। ভারতের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নেহরু যে কয়েকটি ‘বিতর্কিত’ নিয়োগ দিয়েছিলেন, তার মধ্যে আসামের গভর্নর স্যার আকবর হায়দারির নিয়োগটি ছিল অন্যতম। মাউন্টব্যাটেন নেহরুর উপরিউক্ত অভিযোগটি তত্ক্ষণাত্ আসামের গভর্নর স্যার আকবর হায়দারির কাছে প্রেরণ করে গণভোটের সম্পর্কিত ঘটনার বিস্তারিত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ তৈরি করে নেহরু ও তার কাছে প্রেরণ করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। সে মোতাবেক, হায়দারি মাউন্টব্যাটেন ও নেহরুর কাছে একটি প্রতিবেদন পাঠিয়েছিলেন, যাতে তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন যে এসব অভিযোগের বহু অংশই সুনির্দিষ্ট কোনো প্রমাণের ওপর ভিত্তি করে উত্থাপন করা হয়নি। সামরিক বাহিনী ও পুলিশ কর্মকর্তা যাঁরা স্থানীয় পর্যায়ে রয়েছেন, তাঁদের মতে এগুলো আসলে ‘মিথ্যা’ অভিযোগ ছিল। হায়দারি লিখেছেন যে ‘সিলেট থেকে আসাম সরকারের একজন হিন্দু মন্ত্রী যিনি এসব অভিযোগের বেশির ভাগই করেছিলেন, তিনি এখন বলছেন এগুলো তাত্ক্ষণিক হতাশা থেকে সৃষ্ট যা ভালোভাবে প্রতিষ্ঠিত করা যাবে না।’১১১ ফলে নেহরু গণভোটের ফলাফল বা রায় গ্রহণ করেন এবং ফলাফল নিরপেক্ষ হয়েছে বলে ঘোষণা করেন। এরপর সীমান্ত বিষয়ে দর-কষাকষির জন্য নেহরু পরবর্তী উদ্যোগ নেন, যাতে তিনি সিলেটের কিছু কিছু অঞ্চল পাওয়ার আশা করেছিলেন। সুতরাং ১৫ জুলাই মাউন্টব্যাটেনকে লেখা একটি পত্রে তিনি সিলেটের বিভাজনের পক্ষে নিম্নলিখিত যুক্তি দিয়েছিলেন:
একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে, যাতে আসামের প্রধানমন্ত্রী গোপিনাথ বরদোলাই আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। এটি হচ্ছে যে সীমান্ত কমিশনের প্রতিবেদনের পরে সিলেট জেলার বিশেষ বিশেষ অংশ আসামের সঙ্গে চলে আসার সম্ভাবনা রয়েছে...চূড়ান্ত সীমানা নির্ধারণের পরে স্থানান্তরের প্রক্রিয়াটি অবশ্য সমাধা হওয়া উচিত। তবে, এটির আয়োজন করার সহজ উপায় হলো ১৫ আগস্টের পূর্বে সীমান্ত কমিশনের প্রতিবেদন হাতে পাওয়া।১১২
অবশ্য সিলেটের হাজার বছরের পুরোনো সীমানা ব্যবচ্ছেদের এই প্রক্রিয়ায় নেহরু একা ছিলেন না। চা আবাদকারী দেশীয় পুঁজিপতিদের (কংগ্রেস সমর্থক) একাংশ, কমিউনিস্টদের প্রায় সবাই এবং চা-শ্রমিক সংঘও জড়িত ছিল। দেশীয় চা আবাদকারী হিসেবে আসাম আইনসভায় সুরমা উপত্যকার প্রতিনিধি এবং আসাম মন্ত্রিপরিষদের মন্ত্রী ছিলেন বৈদ্যনাথ মুখার্জি। ভোটে হেরে গিয়ে তিনি দক্ষিণ সিলেটের সমগ্র এলাকাটিকে আসামে সংযুক্ত করতে মরিয়া হয়ে ওঠেন। গণভোটের সময় জিন্নাহ মুখার্জিকে ‘পক্ষপাতদুষ্ট’ হিসেবে সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহারকারী হিসেবে অভিযুক্ত করেছিলেন। কমিউনিস্ট নেতারা যেমন ব্যারিস্টার এম সেন, বিরেশ মিশ্র ও অচিন্ত্য ভট্টাচার্যও একই রকম অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন, যাঁরা আসামের সঙ্গে পুরো চা-বাগানগুলো রাখার দাবি জানিয়ে শ্রীহট্ট-কাছাড় চা মজদুর ইউনিয়ন-এর পক্ষে স্মারকলিপি দিয়েছিলেন।১১৩ এভাবে গভর্নর স্যার আকবর হায়দারির ওপর চাপ সৃষ্টি করা হয়েছিল, যাতে তিনি দাপ্তরিকভাবে সিলেটকে কেটে টুকরো টুকরো করতে বাধ্য হন। তদুপরি আকবর হায়দারি ছিলেন কংগ্রেস সমর্থক এবং নেহরুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে এসব উদ্যোগের প্রতি তাঁর সহানুভূতিও ছিল। সরকারি দলিলপত্রে দেখা যাচ্ছে যে গভর্নর স্যার আকবর হায়দারিও নতি স্বীকার করতে বাধ্য হন। একপর্যায়ে আকবর হায়দারি মাউন্টব্যাটেনের কাছে তাঁর মনোভাব ব্যক্ত করে লিখেছেন:
আমার ব্যক্তিগত মতামত হচ্ছে যে এই রাস্তা (খাসি পাহাড় থেকে কাছাড় ও লুসাই পাহাড় পর্যন্ত) আসামের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য এত গুরুত্বপূর্ণ যে সীমান্ত কমিশনের চেয়ারম্যান যেন আসাম সরকারের অনুরোধ মঞ্জুর করেন। আমি আমার মন্ত্রীকে বোঝাতে সক্ষম হব যে সিলেট জেলার উক্ত অংশের (করিমগঞ্জ) বিনিময়ে অন্যান্য অংশ থেকে তারা যাতে দাবি প্রত্যাহার করে। আমি মনে করি এই সুবিধা আসাম এবং পূর্ব বাংলার মধ্যে ভালো অনুভূতি বৃদ্ধিতেও সাহায্য করবে যাতে উভয় প্রদেশের অর্থনৈতিক স্বার্থও লালিত রয়েছে।১১৪
আকবর হায়দারির এই প্রস্তাব মাউন্টব্যাটেন কর্তৃক গৃহীত হয়েছিল। ফলে ১৯৪৭ সালের ১১ আগস্ট তিনি হায়দারিকে লিখেছিলেন, ‘র্যাডক্লিফ সচিবালয় তোমার টেলিগ্রাফ দেখেছে এবং এটি যাচাই-বাছাই হয়েছে এবং সরকারের পক্ষে তোমার দেওয়া মতামতই সীমান্ত কমিশন গ্রহণ করেছে।’১১৫ এর ফলাফল ছিল এই যে জেলাটির বড় অংশটি পূর্ব বাংলায় সংযুক্ত করা হয়েছিল। শুধু করিমগঞ্জ মহকুমার থানাগুলো যেমন: পাথরকান্দি, রাতবাড়ি, করিমগঞ্জ ও বদরপুর কেটে নেওয়া হয়। এই চারটি থানা আসামের সঙ্গে ত্রিপুরার সংযোগস্থল হিসেবে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এই চারটি থানা দিয়ে প্রবাহিত রাস্তাটি ত্রিপুরার সঙ্গে যোগাযোগের জন্য খাসি পাহাড় থেকে কাছাড় ও লুসাই পাহাড়ের রাস্তায় প্রবেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সিলেটের এই বিভাজনের ফলে ৫৫টি চা-বাগান ভারতে চলে গিয়েছিল। এমনকি একজন ব্রিটিশ কর্মকর্তাও ‘সিলেটের সীমানা ব্যবচ্ছেদের’ ধারণা পছন্দ করলেন না। তিনি স্পষ্টভাবে তাঁর সন্দেহের কথা জানিয়েছিলেন এবং ভবিষ্যতে বিবাদ পরিহারের জন্য যৌথ জরিপ করার বিষয়েও যুক্তি দিয়েছিলেন।১১৬
‘কলকাতা চলে গিয়েছিল’
এভাবে উপমহাদেশের বিভাজন সিলেটে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এনেছিল, যাতে কলকাতায় সিলেটি সমুদ্রযাত্রী জাহাজিদের জন্যও কিছু ভয়াবহ পরিণতি ডেকে এনেছিল। উনিশ শতকের শেষের দিক থেকে সিলেটে মানুষদের একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ ছিল, যা ১৯৪৭ সালের পরবর্তীকালে স্থায়ীভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ওই সময় লক্ষাধিক সিলেটি কলকাতায় স্থায়ী হয়েছিল যার মধ্যে একটা অংশ গভীর সমুদ্রে জাহাজি হিসেবে কাজ করতেন এবং আরেকটি অংশ পরবর্তী জাহাজে চাকরি পাওয়ার আশায় কলকাতায় সিলেটি বাড়িওয়ালাদের বোর্ডিংয়ে থাকতেন। কলকাতায় তখন কয়েক হাজার সিলেটির ছিল ছোট ও মাঝারি ব্যবসা। কলকাতার খিদিরপুর এলাকায় একটি ‘ছোট সিলেট’ ছিল যেমন এখন লন্ডনের ব্রিকলেনে হয়েছে। ১৯৪৭ সালের গণভোট অব্যবহিত পরের প্রভাব সম্পর্কে একজন প্রত্যক্ষদর্শী বলছেন:
ব্রিটিশ ভারতের ভাগ সিলেটের জনগণের ওপর একটি প্রভাব ফেলেছিল। এই প্রভাবটি ছিল বিশাল ও ব্যাপক। কলকাতায় সিলেটি ব্যবসায়ীরা বিভাজনের কারণে তাদের ব্যবসায় আকর্ষণ হারিয়েছিল। কলকাতায় দাঙ্গা হয়েছিল। সিলেটিরা তখন ভাবতে শুরু করেছিল যে ‘এটি আর আমাদের দেশ না, আমরা আর এখানে বসবাস করতে পারব না।’ বাড়ির মালিকেরা তাঁদের জিনিসপত্র প্যাকেট করা শুরু করেছিলেন। এরপর পাসপোর্ট ও ভিসা হলো, ট্রেনে চড়াও খুব সহজ ছিল না এবং কলকাতায় যাওয়া অনেকটা অসম্ভব হয়। আগের মতো কলকাতায় গিয়ে জাহাজের চাকরির জন্য অপেক্ষা করার বিষয়টি অতীতের সুখস্মৃতিতে পরিণত হলো।১১৭
সমুদ্রগামী সিলেটিদের জন্য কলকাতা যেন হঠাত্ করে একটি ভিন্ন পৃথিবী হয়ে গেল। পুরো নেটওয়ার্ক ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ল এবং সমুদ্রে চাকরিজীবীদের জন্য যা ছিল বড়ই দুঃখের। এ ছাড়া যেসব চা-শ্রমিক এক হাজার কিলোমিটার দূর থেকে এসেছিল তারাও উপমহাদেশের বিভাজনের কারণে তাদের গ্রামের বাড়ি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল।
‘হিন্দ, এলিটরা কি দ্বিগুণ শাস্তি পেয়েছিল?’
গণভোটের পর পরই সিলেটের পরিস্থিতিটা খুব বেশি দ্রুত পরিবর্তন হয়নি, যদিও সেখানে তখন একধরনের অস্থিরতা ছিল। মুসলমানদের জন্য সাম্প্রতিক স্মৃতিচারণা ছিল যে সেখানে ভোট চলার সময়ে বিক্ষিপ্ত সহিংসতার ঘটনা ঘটেছিল, যাতে পুলিশের গুলিতে দুজন মুসলমান নিহত হয়েছিল। হিন্দু সম্প্রদায়ের মাঝেও একধরনের নিরাপত্তাহীনতা অনুভূত হচ্ছিল। সুতরাং কংগ্রেস, কমিউনিস্ট ও মুসলিম লীগের নেতারা খুব শিগগির মিলিত হলেন এবং সিলেট শহরে সব দলের পক্ষ থেকে আয়োজিত শান্তি মিছিলে যোগদান করলেন। মিছিলের পরে তারা একে অন্যকে চা ও মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করেছিল।১১৮ দু-তিন বছর শান্ত পরিবেশ বিরাজ করলেও সিলেটের পরিস্থিতির পরে কিছুটা অবনতি হয়েছিল। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে জেলা প্রশাসক হিসেবে নোমানি সিলেটে এসে ‘সাম্প্রদায়িকতা’ উসকে দিতে কৌশলি ভূমিকা রাখেন। বিশেষ করে ১৯৫০ সালে সৃষ্ট দাঙ্গায় হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে তিক্ততার সৃষ্টি হয়েছিল। ফলে অসংখ্য শিক্ষিত হিন্দু একদিকে যেমন চিরতরে সিলেট ত্যাগ করেছিলেন, অন্যদিকে এলিট মুসলমানরা আসামের করিমগঞ্জ ছেড়ে সিলেটে চলে এসেছিলেন। উচ্চ বর্ণের হিন্দুরা অনেকেই চলে যাচ্ছিলেন কারণ তারা ভবিষ্যত্ নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ‘সাম্প্রদায়িকতা’র শিকার হচ্ছিলেন। যেন এই প্রথমবারের মতো কিছু প্রতিবেশী একে অপরের প্রতি হঠাত্ শত্রুভাবাপন্ন হয়ে উঠছিল, যা ১৯৪৭ পরবর্তীকালে সর্বত্রই সীমান্ত এলাকাজুড়ে লক্ষ করা যায়।১১৯ বিখ্যাত রাজনৈতিক মাহমুদ আলী ৫০০ কলেজ শিক্ষার্থীর সমন্বয়ে একটি স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন করেছিলেন এবং সিলেটে একটি দাঙ্গা দ্রুত বন্ধ হয়েছিল। কিন্তু দাঙ্গা প্রতিরোধে আলীকে প্রশংসা না করে বরং নোমানি তাঁকে আটক করেন। এই ঝড় থামাতে লিয়াকত আলী খান সিলেটে এসেছিলেন এবং নোমানিকে অন্যত্র বদলি করে দেওয়া হয়েছিল। ফলে দ্রুত পরিস্থিতির উন্নতি হয়।১২০ ১৯৫০ দশকের শুরুর দিকে সংখ্যালঘু কমিশনের সদস্য হয়েছিলেন ব্রজেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী কিন্তু ১৯৬২ সালের দিকে সিলেট ছেড়ে চিরদিনের জন্য তিনি কলকাতায় চলে গিয়েছিলেন। সুভাষ চন্দ্র বোস একসময় চৌধুরীকে ‘সুরমা উপত্যকার মুকুটহীন রাজা’ উপাধি দিয়েছিলেন কিন্তু বৈরী পরিবেশে ক্ষমতা হারিয়ে এই ‘প্রান্তিক রাজা’ তাঁর আত্মজীবনীতে কবিতায় ঢঙে দুঃখ প্রকাশ করে লিখলেন:
তখন হূদয়ে মৃত্যুতুল্য অনুভূতিশূন্যতা বা অসারতা
নিঃশব্দ ঘৃণা হামাগুড়ি দিয়ে চলছে,
এটি কাউকে পরোয়া বা তত্ত্বাবধান করছে না,
কারও জন্য দুঃখও করছে না
কারও নিজস্ব কোনো অনুভূতি দেখানোর সাহসও পাচ্ছে না।১২১
কলকাতায় বসে ব্রজেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী যখন আত্মজীবনীটি লিখেছেন তখন তাঁর বয়ষ ৮০ পেরিয়ে গেছে। ফেলে আসা ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে অশীতিপর বৃদ্ধের মনে তখন কি কোনো অনুশোচনার জন্ম হয়েছিল? সম্ভবত তার মনের গহিনে রক্তক্ষরণের চোরা স্রোত প্রবাহিত হচ্ছিল, যা তিনি কবিতার আকারে প্রকাশ করতে চেয়েছেন। কারণ, এই সেই ব্রজেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী যিনি ১৯১০, ১৯২০ ও ১৯৩০ দশকে আসামে বাঙালি জাতীয়তাবাদের চ্যাম্পিয়ন ছিলেন, গঠন করেছিলেন রি-ইউনিয়ন লীগ এবং সিলেটকে বাংলার সঙ্গে পুনরায় একত্রীকরণের জন্য মুখপাত্রের ভূমিকা পালন করেছিলেন। ১৯২০ দশকে আসাম প্রাদেশিক আইনসভায় জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়ে একত্রীকরণের পক্ষে একাধিক প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন এবং তাঁর একটি প্রস্তাব সিলেটি অভিজাত মুসলিম সদস্যদের সহায়তায় আইন পরিষদে পাসও হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে অভিজাত মুসলিম সদস্যরা সমর্থন তুলে নিলে চৌধুরীর আর কোনো প্রস্তাব পাস হতে পারেনি। সেই ব্রজেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী যখন ১৯৪৭ সালে নিজের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সিলেটকে বাংলার পরিবর্তে আসামে রাখার জন্য লড়লেন তখন ইতিহাসের এক নির্মম ‘প্রতিশোধের’ শিকার হলেন তিনি। তিনি তাঁর সম্পত্তির একাংশ সিলেট মহিলা কলেজকে, বাকি অংশ বিক্রি করে বা অবৈধ দখলদারদের হাতে ছেড়ে দিয়ে ১৯৬২ সালে চিরতরে মাতৃভূমি ত্যাগ করেন। তারপরও হিন্দু এলিটদের অনেকেই কোনো অসুবিধা বা অস্বস্তি বোধ করেননি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে ১৯৭১ সালে সি আর দত্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে মেজর হিসেবে কর্মরত ছিলেন। যুদ্ধ যখন শুরু হয়, তখন তিনি হবিগঞ্জে নিজ বাড়িতে অবস্থান করছিলেন এবং ওই অবস্থায় বিদ্রোহ করে সিলেট অঞ্চলে বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীকে নেতৃত্ব দেন। জেনারেল দত্তের তথ্য অনুযায়ী সিলেটে তাঁর অধীনে কর্মকর্তা ও নিয়মিত সেনা সদস্য ছিলেন যথাক্রমে ৯,০০০ ও ৪,০০০।১২২ মাসিমা হিসেবে অধিক পরিচিত গান্ধীবাদী সমাজকর্মী সুহাসিনী দাস ১৯৪৭ সালের পরে স্বেচ্ছায় নতুন বাষ্ট্র পাকিস্তানের নাগরিকত্ব গ্রহণ করে সিলেটে একটি দাতব্য সংস্থা গঠন করেছিলেন, সমাজ উন্নয়নের কাজ করেন এবং সব ধরনের বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়েছিলেন, যা ২০০৯ সালে তাঁর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। ২০০৫ সালে প্রকাশিত তাঁর আত্মজীবনীতে দেখা যায় যে কীভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি মুসলিমদের সঙ্গে এক কাতারে দাঁড়িয়ে তিনি পাকিস্তান রাষ্ট্রের সাম্প্রদায়িকতা ঠেলে অসাম্প্রদায়িক এক বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভিত রচনা করতে সাহায্য করেছিলেন।১২৩
উপসংহার
১৮৭৪ সালে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে চা-এ বিনিয়োগ ছিল আসাম প্রদেশ সৃষ্টির একটি প্রধান কারণ এবং এটি চা-আবাদকারীদের ‘রাজ্য হিসেবে পরিচিত’ পেয়েছিল, যার প্রভাব সমাজের সব ক্ষেত্রেই পড়েছিল। মানচিত্রের এই নতুন বিন্যাসে সিলেটসহ বাংলার আরো দুটি সীমান্তবর্তী জেলা (কাছাড় ও গোয়ালপাড়া) নবগঠিত আসাম প্রদেশের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল। ১৯৪৭ সালে সিলেটের বৃহদংশ বাংলায় ফিরে এলেও কাছাড় ও গোয়ালপাড়া আসামেই থেকে গেছে। সংগত কারণে, বর্তমান প্রবন্ধে সীমানার এই অদল-বদলের ওপর একটি মহুমাত্রিক বিশ্লেষণ হাজির করা হয়েছে। তবে বিশেষভাবে আলোকপাত করা হয়েছে ১৮৭৪ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত প্রায় ৭৫ বছরের দীর্ঘ ইতিহাসের ওপর। ঐতিহাসিকভাবে, প্রাচীনকাল থেকে আসামের সঙ্গে সিলেটের অর্থনৈতিক সুবিধা বিনিময় এবং বুদ্ধিবৃত্তিক আদান-প্রদানের একটি কার্যকর সংযোগ ছিল। যা হোক, সিলেটের অভিজাত বাঙালি, বিশেষ করে, অভিজাত হিন্দু সম্প্রদায় তাদের সীমানার এই নব-আকৃতি প্রদানের চরম বিরোধিতা করেছিল। তবে ব্রিটিশ শাসকেরা নতুন প্রদেশে ‘সিলেটকে বিশেষ মর্যাদা’ প্রদান করলে তাদের বিক্ষোভ থেমে গিয়ে অতি দ্রুত সহযোগিতায় রূপ নিয়েছিল। বাংলা থেকে শিক্ষা এবং আদালতের সুবিধা তাদের কিছু বস্তুগত সুবিধা দিয়েছিল। যা হোক, ১৯১০ দশক থেকে পেশাগত চাকরিগুলো চরম প্রতিযোগিতামূলক হয়ে উঠেছিল এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা শিক্ষিত মুসলিম এবং মধ্যবিত্ত আসামভাষীদের দখলে চলে যাচ্ছিল। ফলে আবার বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায় ‘বাঙালি সিলেট’-এর আসামের সংযুক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় তুলেছিল। লন্ডনে ব্রিটিশ সরকার, ভারতে তার ঔপনিবেশিক আমলাতন্ত্র, ইউরোপীয় চা-আবাদকারী এবং আসামের মুসলিম সম্প্রদায়ের অনেক অভিজাত মানুষই ‘চা-পুঁজিবাদের নতুন স্বর্গ’ আসাম প্রদেশ থেকে সিলেটকে ছেড়ে দেওয়ার ব্যাপারে অনিচ্ছুক ছিলেন। উল্লেখ্য, ১৮৭০ সাল থেকে ১৯৪০ দশকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত আসামে সিলেটি/বাঙালি পরিচয় খুবই শক্তিশালী ছিল এবং কখনো কখনো হিন্দু-মুসলিম বিভাজন ছাপিয়ে সেই পরিচয়টাও অনেক বড় হয়ে উঠত।
১৯১০ থেকে ১৯৩০ দশকে ব্রজেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত রি-ইউনিয়ন লীগ-এর আন্দোলন চলে, যা প্রথমদিকে গতি পেলেও পরে তা ব্যর্থ হয়েছিল। সিলেটকে বাংলার সঙ্গে পুনরায় একত্রীকরণের জন্য মি. চৌধুরী ১৯২০-এর দশকে আসাম প্রাদেশিক আইনসভায় জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়ে একত্রীকরণের পক্ষে একাধিক প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন এবং তার একটি প্রস্তাব মুসলিম সদস্যদের সহায়তায় আইন পরিষদে পাস হয়েছিল। পরবর্তীকালে অভিজাত মুসলিম সদস্যরা সমর্থন তুলে নিলে আর কোনো প্রস্তাব পাস হতে পারেনি। ১৯৪৭ সালে যখন সিলেট বাংলায় পুনরায় সংযুক্ত হবে কি না, এই প্রশ্ন উত্থাপিত হলো তখন ব্রজেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরীসহ সব হিন্দু এলিট সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থানে দাঁড়িয়ে বাংলার পরিবর্তে আসাম রাখার জন্য প্রাণপাত করতে লাগলেন। ইতিহাসে এর চেয়ে বড় রসিকতা আর কী হতে পারে।
এ ক্ষুদ্র পর্যায়ের গবেষণা থেকে দেখা যাচ্ছে যে, হিন্দু-মুসলিম এলিট/ধনিক শ্রেণির মধ্যে বিভাজনের রেখাটি অনেক গভীরে বদ্ধমূল ছিল। একই সঙ্গে উচ্চ, মধ্যবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত এবং নিম্নশ্রেণির মধ্যে একধরনের বিরোধ ছিল, শিক্ষিত অভিজাত ও মধ্যবিত্ত মুসলমানরা মূলত ছিলেন পাকিস্তানপন্থী যাঁরা মুসলিম কৃষকদের সংগঠিত করতে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন। পক্ষান্তরে, নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণির মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিত ‘মৌলভি’রা বিরাট সংখ্যায় ছিলেন ভারতপন্থী যাঁরা গণভোটের মতো তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাকালীনও পৃথক আবাসভূমির পরিবর্তে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে ‘এক জাতি এক দেশ’-এর জন্য লড়েছিলেন। যার ফলে, এটি কেবল ‘সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতিতত্ত্ব’ অনুসারী বনাম ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শক্তির লড়াই ছিল না। জাতি, ধর্ম, শ্রেণি ও বর্ণ অনুযায়ী যে সরল বিভাজন হয়েছে তাও নয়, বরং এর ভেতরে নানামুখীন দ্বন্দ্ব ছিল, যা শুধু পরস্পরবিরোধীই ছিল না বরং মাঠপর্যায়ে এটি একটি জটিল বিষয় হিসেবেই আবির্ভূত হয়েছিল। সময়ের ব্যবধানে অনেকেই আবার স্ববিরোধী অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন। যেমন হিন্দু অভিজাত শ্রেণি যারা জন্মগতভাবেই বাংলার সঙ্গে সিলেটের অন্তর্ভুক্তকরণের জন্য একমত ছিল তারাই ১৯৪৭ সালে সেই মতাদর্শ পরিবর্তন করে প্রচণ্ডভাবে আসামের সঙ্গে থাকার জন্য মনস্থির করেছিল। ১৯৪৭ সালে কংগ্রেস ও কমিউনিস্ট পার্টি যৌথভাবে একটি সংঘ গঠন করেছিল যে সংগঠনটি সিলেটকে আসামের সঙ্গে ধরে রাখার জন্য বিভিন্ন ধরনের প্রচারাভিযানের আয়োজনও করেছিল। নিম্নবর্ণের কিছু লোক ছাড়া, উচ্চবর্ণের হিন্দুদের কেউই বাংলার সঙ্গে সিলেটের অন্তর্ভুক্তকরণের জন্য ভোট দেয়নি। অন্যদিকে, মাদ্রাসা শিক্ষিত মাওলানাদের মত, কিছু ‘জাতীয়তাবাদী’ অভিজাত ও মধ্যবিত্ত মুসলিম ‘অবিভক্ত’ ভারতের পক্ষে ভোট দিয়েছিল।
১৯৪৭ সালের গণভোটের মাধ্যমেই সিলেটের ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল। ঘটনার ধারাবাহিকতা নির্দেশ করছে যে, যখন সিলেটের সীমানা নির্ধারণের জন্য সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছিল, তখন জনগণের রায় বা সম্মতির প্রতি পুরোপুরি ‘সম্মান’ দেখানো হয়নি। সিলেটের এক-একটি অংশ কেটে টুকরো টুকরো করা হয়েছিল। বিভাজনের এই নতুন প্রক্রিয়ায় নেহরু নিজে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। শক্তিশালী ‘লবি’ও কাজ করছিল, যার মধ্যে ছিলেন চা-বাগানে বিনিয়োগকারী ‘হিন্দু পুঁজিপতি’, সিলেটের কমিউনিস্ট নেতারা এবং উলামা-ই হিন্দ-এর মাওলানারা। তারাই ভারত রাষ্ট্রের স্বার্থে আসামের সঙ্গে সিলেটকে সংযুক্ত রাখতে চেয়েছিলেন। তথাপি, অভিজাত হিন্দুদের কেউ কেউ আগের মতোই অসন্তুষ্ট ছিলেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কলকাতায় বসবাসরত আইনজীবী সিলেটের রবীন্দ্রনাথ চৌধুরী মাউন্টব্যাটেনের কাছে লিখেছিলেন, ‘মহামান্য! কারচুপির গণভোট বাদ দিয়ে আরও একটা গণভোটের আয়োজন করুন।’১২৪ অবশ্য সিলেটের কৃষক সম্প্রদায় থেকে উঠে আসা জাহাজিদের (সমুদ্রযাত্রী) এবং হাজার মাইল দূর থেকে সিলেটে কাজ করতে আসা চা-শ্রমিকদের জন্য ১৯৪৭ সালের বিভাজন পুরোপুরিই ভিন্ন একটি বিষয় ছিল। এই দুটি গোষ্ঠীর মানুষ কেবল সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হলো: বিশেষ করে কলকাতায় সিলেটি মাঝারি-ব্যবসায়ী, লজিং হাউসের মালিক এবং সমুদ্রগামী জাহাজে চাকরিজীবী মানুষগুলো নতুন পরিস্থিতিতে সুবিধাবঞ্চিত হয়ে ক্রমেই তাদের জীবিকা হারিয়েছিল। অন্যদিকে, ১৯৪৭ সালে নতুন সীমানা নির্মাণের ফলে চা-শ্রমিকেরা তাদের গ্রামের বাড়ি থেকে চিরতরে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল।
পাদটীকা
এই গবেষণাটি একটি বিশেষ সময়ের একটি বিশেষ অঞ্চলের ইতিহাসকে উপস্থাপন করছে। এটার সময়কাল হলো ১৮৭৪ থেকে ১৯৪৭। যার ইতিহাস ১৯৪৭-পরবর্তী ইতিহাস থেকে গুণগতভাবে আলাদা। সাধারণভাবে দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য হলেও বিশেষ করে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে [সিলেটসহ] এই গুণগত পরিবর্তন হয়েছে সবচেয়ে বেশি। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বৃহত্তর বাংলায় পাকিস্তান আন্দোলনের নেতা কেবল সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম ও যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল ছিলেন তা নয়, মাঠপর্যায়ে আন্দোলনের দুজন সংগঠক ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাজউদ্দীন আহমদ (বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী ও তাজউদ্দীনের ডায়েরি দ্রষ্টব্য)। পাকিস্তান কৃষক প্রজা তথা ‘মজলুম’ বা ‘সর্বহারাদের’ রাষ্ট্র হবে, এই প্রতিশ্রুতি যেমন জিন্নাহ যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলকে দিয়েছিলেন, তেমনি ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি কৃষি প্রশ্নের একটি সংক্ষিপ্ত সমাধান হবে ভেবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দাবিকে যৌক্তিক বলে রায় দিয়েছিল। ১৯৪০-এর দশকে ‘মুসলিম কৃষক’ ও ‘নিম্নবর্ণীয় হিন্দু’দের ঐক্যের রাজনীতি উভয় সম্প্রদায়ের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন এবং শিক্ষার অগ্রগতির বেশ সাফল্য বয়ে এনেছিল।
কিন্তু, ইতিহাসের এক নির্মম পরিহাস হলো পাকিস্তান সৃষ্টির কিছুদিন পর পশ্চিম পাকিস্তানি তথা পাঞ্জাবি এলিটগণ নজিরবিহীন চতুরতার আশ্রয় নেন। স্বয়ং জিন্নাহ বাংলা ভাষা প্রশ্নে বাঙালিদের বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন। পাকিস্তান পুরোপুরি সামপ্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত হলো। দাঙ্গা হলো এবং যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল পাকিস্তান থেকে পালিয়ে গেলেন। শুরু হলো প্রতিরোধ, যার গুণগত পরিবর্তন সূচিত হয়েছিল ভাষা আন্দোলনে এবং পূর্ণতা পায় ১৯৭১ সালে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’, ‘অসামপ্রদায়িক’ ও ‘সমতাভিত্তিক’ বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ যখন নিজেকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করে, তখনো ভারতের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা সংযোজিত হয়নি। ভারতের সংবিধানে এটি গ্রহণ করা হয়েছে আরও পাঁচ বছর পরে, ১৯৭৫ সালে। এই অভূতপূর্ব অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ শুধু নিজের দেশেই নয়, বরং সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ায় অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করেছে।
বিশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলা দুবার বিভক্ত হয়েছিল। দুই বিভক্তিকালে বাঙালিদের সবচেয়ে অগ্রসর অংশ উচ্চবর্ণীয় হিন্দুদের ভূমিকা ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। অর্থাত্ দুই রকম। প্রথমবার তাঁরা চেয়েছেন ‘আমার সোনার বাংলা’কে এক রাখতে, দ্বিতীয়বার অর্থাত্ ১৯৪৭ সালে বাংলাদেশ বিভক্তির ব্যাপারে এঁরাই আবার নেতৃত্ব দিয়েছেন। ইতিহাসের এই কৌতুকপ্রদ বিষয়ের স্ববিরোধিতা নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো জয়া চ্যাটার্জির বেশ কিছু গবেষণা। এ ছাড়া তপন রায় চৌধুরীর আত্মজীবনী বাঙালনামা, দেবেশ রায়ের উপন্যাস বরিশালের যোগেন মণ্ডল ইত্যাদিতে উচ্চবর্ণীয় হিন্দুদের একটি বড় অংশের ঐতিহাসিক ব্যর্থতার ছবি ফুটে ওঠে। ১৯৪০-এর দশকে গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় ‘ভয়ানক সাম্প্রদায়িক উন্মাদনা’ লাখ লাখ মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়েছিল, সহায়-সম্পত্তি ফেলে কোটি কোটি মানুষের ‘নিরাপদ দেশে’ স্থানান্তরের মিছিলকেও দীর্ঘায়িত করছিল। এর পেছনে যে কেবল দ্বিজাতিতত্ত্ব দায়ী ছিল তা নয়, বরং আরও দুটি কারণও মোটাদাগে দায়ী ছিল। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের ‘ভাগ করো ও শাসন করো’ এবং ‘হিন্দু এলিট বা উচ্চবর্ণীয় ব্যক্তিবর্গের সুবিধাবাদী রাজনীতি’ দক্ষিণ এশিয়ায় ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতা উত্সবকে কলঙ্কিত করেছে। ১৯৭১ সালে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ সৃষ্টির আন্দোলন দক্ষিণ এশিয়ার এই সাম্প্রদায়িক উন্মাদনাকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করে গোটা অঞ্চলে অসাম্প্রদায়িকতার আলো ফেলেছিল।
অবিভক্ত বাংলার রাজধানী কলকাতা থেকে বেশ দূরে উত্তর-পূর্ব দিকে বৃহত্তর বাংলার তিনটি জেলা সিলেট, কাছাড় ও গোয়ালপাড়া নিয়ে ১৮৭৪ সালে আসাম নামে একটি নতুন প্রদেশ হলো। এটি শিগগিরই পরিচিতি পেল চা-প্রদেশ হিসেবে। ওই প্রদেশর রাজনীতি, প্রশাসন ও অর্থনীতিতে বাঙালিরা বিশেষত সিলেটের বাঙালিরা (হিন্দু ও মুসলিম) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ১৯৪৭ সালে বাঙালি জেলাগুলোর মধ্যে কেবল সিলেটই ফিরে আসে ঐতিহাসিক গণভোটের মাধ্যমে। যা হোক, বর্তমান গবেষণায়, ১৮৭৪-১৯৪৭ সাল কালপর্বে আসাম ও সিলেটের রাজনীতি, প্রশাসন, অর্থনীতি ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে হিন্দু, মুসলিম ও অহমীয়া এলিট, মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবর্গীয় মানুষের ভূমিকার একটি অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
তথ্যসূত্র
১. জয়িতা শর্মা, ‘দ্য মেকিং অব মডার্ন আসাম, ১৮২৬-১৯৩৫’, পিএইচডি, কেমব্রিজ, ২০০৩।
২. অনিন্দিতা দাসগুপ্ত, ‘ডেনাইল অ্যান্ড রেজিসটেন্ট: সিলেট পারটিশন “রিফিউজি” ইন আসাম’, কনটেম্পোরারি সাউথ এশিয়া, ১০(৩), ২০০১।
৩. দাসগুপ্ত, ‘ডেনাইল অ্যান্ড রেজিসটেন্ট’, পৃ. ৩৪৩।
৪. উইলিয়েম ভ্যান শ্যান্ডেল, দ্য বেঙ্গল বর্ডার ল্যান্ড: বিয়ন্ড স্টেট অ্যান্ড নেশন ইন সাউথ এশিয়া, লন্ডন, ২০০৫, পৃ. ৩৮৫।
৫. জয়া চ্যাটার্জি, বেঙ্গল ডিভাইডেড: হিন্দু কমিউন্যালিজম অ্যান্ড পারটিশন, ১৯৩২-১৯৪৭, কেমব্রিজ, ১৯৯৪।
৬. বিদুত্ চক্রবর্তী, দ্য পারটিশন অব বেঙ্গল অ্যান্ড আসাম, ১৯৩২-১৯৪৭, লন্ডন, ২০০৪, পৃ. ২৭।
৭. হাজী মুহাম্মদ ইউনুস, সাক্ষাত্কার, লন্ডন ১২ এপ্রিল ২০০৮, এবং আবুল মাল আবদুল মুিহত, সাক্ষাত্কার, জুন ২০০৮। তাঁরা উভয়েই সিলেটের গণভোটের প্রচারাভিযানকারী ছিলেন। মুহিত বর্তমানে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অর্থমন্ত্রী। হাজী মুহাম্মদ ইউনুস ১৯৩০ ও ১৯৪০ দশকের ভূমি করের ওপর আমাকে তাঁর কিছু পারিবারিক দলিলপত্র দেখিয়েছেন। দক্ষিণ লন্ডনের ৩২ গিবসন সড়কে নুরুল ইসলামের সাক্ষাত্কার নেওয়া হয়, ১৪ অক্টোবর ২০০৬ এবং ২১ জানুয়ারি ২০০৭-এ। তিনি ১৯৩০ সালে সিলেটে জন্মগ্রহণ করেছেন। তিনি একজন লেখক, যিনি প্রথম প্রবাসী সিলেটিদের ইতিহাস স্বদেশি ভাষায় লিখেছেন। তিনি তিনটি পতাকার অধীনে, যথা: ব্রিটিশ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমলে নিজ জীবনধারণের ইতিহাস (প্রত্যক্ষদর্শীর গল্প) নিয়ে আলোচনা করতে পারেন। জনাব ইসলামের দুই নানা কলকাতায় গিয়েছিলেন জাহাজি হতে, তাঁদের মধ্যে একজন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মারা যান। নুরুল ইসলাম, প্রবাসীর কথা, প্রবাসী প্রকাশনা, সিলেট, ১৯৮৯।
৮. আমি ১৯৯৬ সালে দেওয়ান মুহাম্মদ আজরফের জীবন-ইতিহাসের ওপর মৌখিক ইতিহাস প্রকল্পের প্রধান গবেষক ছিলাম। আবদুল গফুরও (এখন ব্যাংক কর্মকর্তা) একজন তদন্তকারী ছিলেন। প্রবন্ধটি তৈরি করার সময় আমি পুনরায় সাক্ষাত্কারগুলো পড়েছি, যেগুলো এখন পর্যন্ত অপ্রকাশিত। আমরা দুজনে অনেক সাক্ষাত্কার নিয়েছি, যার অনেক কিছুই এখনো আমার স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করছে।
৯. মেজর জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) সি আর দত্তের সাক্ষাত্কারও ১৯৯৭ সালের নভেম্বরে ঢাকায় নেওয়া হয়েছে। আমি ১৯৯৭ সালে মৌলভীবাজার জেলায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর আলোকপাত করে একটি বই প্রকাশ করেছিলাম। বইটিতে মৌলভীবাজার জেলায় যে যুদ্ধ হয়েছিল, তার ওপর দৃষ্টিপাত করা হয়েছে। এ জেলা সিলেটের চারটি জেলার একটি। দত্তসহ অনেকের সাক্ষাত্কারই ওই সময়ে নেওয়া হয়েছিল।
১০. ক্যারোলিন অ্যাডামসের ব্যক্তিগত (চিঠি, টেপ ও ট্রান্সক্রিপশনস ফাইল) কাগজপত্রগুলো পি/এডিএম/ শিরোনামে টাওয়ার হেমলেটস লোকাল হিস্ট্রির লাইব্রেরি এবং আর্কাইভে রাখা হয়েছে, ব্যানক্রফট রোড, লন্ডন, পি/এডিএম/২/১১-১২-১৩।
১১. কলিন হে-উড, গ্রোইং আপ ইন ফ্রান্স, কেমব্রিজ, ২০০৭, পৃ. ৩২-৩৪।
১২. বিপিন চন্দ্র পাল, মেমোরিস অব মাই লাইফ অ্যান্ড টাইমস, ৩য় সংস্করণ, বিপিন চন্দ্র পাল ইনস্টিটিউট, কলকাতা, ১৯৭৩। বিপিন চন্দ্র পাল সিলেটের এক মহান ‘ভূমিপুত্র’। তিনি সিলেটের বিখ্যাত একজন আইনজীবী ও জমিদারের ছেলে। তিনি কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ালেখা করেছেন। তিনি বাল গঙ্গাধর তিলক ও লালা রাজপথ-এর সঙ্গে ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের একজন স্থপতি। তিনি আসামভাষী চা-শ্রমিকদের সমস্যার কারণ উদ্ঘাটনে কংগ্রেসকে বাধ্য করেছিলেন।
১৩. ব্রজেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী, স্মৃতি এবং প্রতীতি, ওরিয়েন্টাল বুকস, কলকাতা, ১৯৮২।
১৪. সুহাসিনী দাস, সেকালের সিলেট, সাহিত্য প্রকাশ, ২০০৫।
১৫. চঞ্চল কুমার শর্মা, শ্রীহট্টে বিপ্লববাদ এবং সিলেট জেলায় কমিউনিস্ট আন্দোলন, কলকাতা, ১৯৮৪।
১৬. দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, আত্মজীবনী, উত্স প্রকাশন, ঢাকা, ২০০৭।
১৭. সি এম আবদুল ওয়াহেদ, সিলেটে গণভোট, ঢাকা, ১৯৯৯।
১৮. হেনরি কটন, ইন্ডিয়ান এবং হোম মেমোরিস, লন্ডন, ১৯১১।
১৯. জি পি স্টিওয়ার্ট, দ্য রাফ অ্যান্ড দ্য স্মোথ: অ্যান অটোবায়োগ্রাফি, হেরিটেজ প্রেস, ওয়েইকানেই, ১৯৯৪।
২০. মূলত, আসাম ১৮২০ সালে প্রথমবারের মতো ব্রিটিশের অধীনে এসেছিল। তার আগে সিলেট ব্রিটিশরাজের সর্বশেষ পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্ত প্রদেশ ছিল। ১৮২৪ সালে অ্যাংলো-বার্মিজ যুদ্ধে জয়ী ব্রিটিশদের সঙ্গে বার্মার ১৮২৬ সালে ইন্দাবো চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। যার ফলাফলই হলো ঔপনিবেশিক সীমান্তের স্থানান্তর।
২১. পাল, মেমোরিস অব মাই লাইফ অ্যান্ড টাইমস, পৃ. ১
২২. ইসলামের সাক্ষাত্কার, লন্ডন, ২০০৬, ২০০৭।
২৩. সিলেটি নাগ্রি স্ক্রিপ্টটি ১৪ থেকে ১৭ শতকের মাঝে বিকশিত হয়। সিলেটি শিক্ষাবিদ মৌলভী আব্দুল করিম ১৮৬০ দশকে এগুলোর কয়েকটি ছেপেছিলেন। বিশ শতকের শুরুর দিকে সিলেটি নাগ্রি ছাপার জন্যে তিনটি প্রেস ছিল, এর একটি কলকাতায় এবং বাকি দুটি সিলেটে। ১৯৫০ সালের পর এসব স্ক্রিপ্ট অনেকটাই বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
২৪. আবদুল মোসাব্বির ভূঁইয়া, জালালাবাদ নাগ্রি: আ ইউনিক স্ক্রিপ্ট অ্যান্ড লিটারেচার অব সিলেটি বাংলা, জালালাবাদ প্রেস, বদরপুর, আসাম, ১৯৯৯।
২৫. বি সি অ্যালেন, আসাম জেলা গেজেটারস: সিলেট, আসামের সরকার, কলকাতা, ১৯০৫, ভলিইম. ২, পৃ. ৭৪। নগেন্দ্রনাথ বসু, দ্য সোশ্যাল হিস্ট্রি অব কাররুপ, কলকাতা, ১৯৮৩, ভলিউম, ৩, পৃ. ১৩৯-৪০।
২৬. ভূঁইয়া, জালালাবাদ নাগ্রি, পৃ. ২-৫।
২৭. সিলেটিদের নেতৃত্বে ব্রিটেনে বাঙালি অ্যাসোসিয়েশন ১৯৫০ সাল থেকে রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধিতে সংস্থার মতো কাজ করেছিল। ১৯৬০ সালের শেষ দিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি সামরিক শাসক কর্তৃক গ্রেপ্তার হলেন এবং প্রবাসীরা ‘শেখ মুজিব ডিফেন্স তহবিল’ গঠন করেন। তাঁদের অর্থে স্যার টমাস উইলিয়াম কিউ সি-কে ঢাকায় পাঠানো হয় বঙ্গবন্ধুর আইনজীবী হিসেবে লড়তে। ১৯৭০ সালে ব্রিটেনে প্রথম আওয়ামী লীগের শাখা গঠন করা হয়েছিল। গৌছ খান সেখান সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন এবং তৈয়বুর রহমান সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাঁরা উভয়েই সিলেটি ছিলেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধেও লন্ডন কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে পরিণত হয়েছিল। দেখুন আশফাক হোসেন, ‘হিস্টোরিক্যাল গ্লোবালাইজেশন অ্যান্ড ইটস ইমপ্যাক্ট: আ স্টাডি অব সিলেট অ্যান্ড ইটস পিপল, ১৮৭৪ টু ১৯৭১’ পিএইচডি অভিসন্দর্ভ, ইউনিভার্সিটি অব নটিংহাম, ২০১০, পৃ. ১৪২-৫২। সারা গ্লিন, ‘দ্য হোম অ্যান্ড দ্য ওয়ার্ল্ড: বেঙ্গলি পলিটিক্যাল মোবিলাইজেশন ইন লন্ডন’স ইস্ট অ্যান্ড আ কম্পেরিজন উইথ দ্য জিউস’ পাস্ট’, পিএইচডি অভিসন্দর্ভ, ইউনিভার্সিটি কলেজ, লন্ডন, ২০০৩। কে টি গার্ডনার, গ্লোবাল মাইগ্রেন্টস, লোকাল লাইভস: ট্রাভেল অ্যান্ড ট্রান্সফরমেশন ইন রুরাল বাংলাদেশ, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, অক্সফোর্ড ১৯৯৫।
২৮. রবার্ট লিন্ডজি অ্যানেকডটস অব অ্যান ইন্ডিয়ান লাইফ, প্রাচ্য বিবিধ, ব্রিটিশ লাইব্রেরি, লন্ডন, ১৮৪০, ভলিউম. ৫, পৃ. ৯৮-৯৯। লিন্ডজি ১৭৮৮ থেকে ১৭৯০ সাল পর্যন্ত সিলেটের প্রশাসক ছিলেন। অঞ্চলটি সম্পর্কে তাঁর আত্মজীবনী গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেয়। ডেভিড লাদেন বলছেন যে ব্যবসায়ীরা মালদ্বীপ থেকে মুদ্রা কিনে কলকাতা ও চট্টগ্রামে পাঠাতেন এবং সেগুলো ঢাকায় মজুত করে রেখে পরবর্তী সময়ে সেগুলো নৌপথে চাল, মাছ ও অন্যান্য পণ্যের সঙ্গে সিলেটে ও আসামে পাঠাতেন। দেখুন লাদেন, দ্য ফার্স্ট বাউন্ডারি অব বাংলাদেশ পৃ. ১৪-১৫।
২৯. শংকর (যার প্রকৃত নাম মনি সংকর মুখার্জী) বাংলা ভাষার একজন জনপ্রিয় লেখক। শংকর, বঙ্গ-বসুন্ধরা, দেজ প্রকাশনা, কলকাতা, ১৯৯৯, পৃ. ২৯৪-৯৫। সিলেটি সমুদ্রযাত্রার ঐতিহ্য কমপক্ষে দুই শতাব্দী পূর্বে প্রসারিত হয়েছিল এবং সাক্ষ্যপ্রমাণ বলছে যে উনিশ শতকের শেষ দিকে এবং বিশ শতকের প্রথম দিকে লন্ডনের পূর্ব প্রান্ত, লিভারপুল, কারডিফ ও অন্যান্য বন্দর শহরে সিলেটিরা বিভিন্ন দলে বসবাস করত। দেখুন আশফাক হোসেন, হিস্টোরিক্যাল গ্লোবালাইজেশন অ্যান্ড ইটস ইমপ্যাক্ট, পৃ. ১৪২-১৫৫।
৩০. শামীম আজাদ, সাক্ষাত্কার, লন্ডন, ৬ এপ্রিল ২০০৮
৩১. হোসেন, হিস্টোরিক্যাল গ্লোবালাইজেশন অ্যান্ড ইটস ইমপ্যাক্ট, পৃ. ৫
৩২. হোসেন, হিস্টোরিক্যাল গ্লোবালাইজেশন অ্যান্ড ইটস ইমপ্যাক্ট, চৌধুরী, স্মৃতি এবং প্রতীতি, পৃ. ১৩২-৩৩
৩৩. প্রসেডিং অব দ্য আসাম লেজিসলেটিভ কাউন্সিল (অতঃপর পিএএলসি)
৩৪. আসাম সরকারের চিঠিতে বিস্তারিত দেওয়া আছে, তারিখ ৩ অক্টোবর ১৯২৪
৩৫. ইন্ডিয়া অফিস রেকর্ডস (অতঃপর আইওআর), এল/পিঅ্যান্ডজে/৯/৫৯, পৃ.৩০-৩১।
৩৬. সঞ্জীব বড়ুয়া, ইন্ডিয়া অ্যাগেইনেস্ট ইটসেলফ: আসাম অ্যান্ড দ্য পলিটিকস অব ন্যাশনালিটি, ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়া প্রেস, ফিলাডেলফিয়া, ১৯৯৯, পৃ. ৫৯।
৩৭. পিএএলসি, আগস্ট ১৯২৪, পৃ. ৫৬৯। আরও দেখুন আইওআর/এল/পিঅ্যান্ডজে/৯/৫৯, পৃ. ৩১।
৩৮. আইওআর/এল/পিঅ্যান্ডজে/৯/৫৯, পৃ. ১২।
৩৯. পিএএলসি, আগস্ট ১৯২৪, পৃ. ৫৬৮।
৪০. পিএএলসি, আগস্ট ১৯২৪, পৃ. ৫৭২-৭৩।
৪১. পিএএলসি, আগস্ট ১৯২৪, পৃ. ৫৬৯-৭০।
৪২. অরুণ চন্দ্র ভূঁইয়ান ও অন্যান্য, পলিটিক্যাল হিস্ট্রি অব আসাম ১৯২০-১৯৩৯, আসাম সরকার, গুয়াহাটি, ১৯৭৮, ভলিউম. ২, পৃ. ২৯২।
৪৩. পিএএলসি, আগস্ট ১৯২৪, পৃ. ৫৭০।
৪৪. পিএএলসি, আগস্ট ১৯২৪, পৃ. ৫৮৬-৮৭।
৪৫. পিএএলসি, আগস্ট ১৯২৪, পৃ. ৫৮৯।
৪৬. পিএএলসি, জানুয়ারি ১৯২৬, পৃ. ১২৬।
৪৭. পিএএলসি, জানুয়ারি ১৯২৬, পৃ. ৪১।
৪৮. ১৯২০ সালে মোহাম্মদ সাদুল্লাহ আসামের শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন। পরবর্তী সময়ে তিনি নাইট উপাধি পেয়েছিলেন এবং ১৯৩৫ সালের পরে তিন তিনবার আসামের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
৪৯. পিএএলসি, জানুয়ারি ১৯২৬, পৃ. ৬০।
৫০. পিএএলসি, জানুয়ারি ১৯২৬, পৃ. ২৭-২৮।
৫১. মাহমুদ আলী, রিসার্জেন্ট আসাম (আসামের পুনরুত্থান), ন্যাশনাল প্রেস, ঢাকা, ১৯৬৭, পৃ. ৯৩।
৫২. আতফুল হাই শিবলী, আবদুল মতিন চৌধুরী: ট্রাসটেড লেফটেন্যান্ট অব মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, ২০১১, পৃ. ১৬১-৬৬।
৫৩. আইওআর/এল/পিঅ্যান্ডজে/৯/৫৯, পৃ. ২৩।
৫৪. আইওআর/এল/পিঅ্যান্ডজে/৯/৫৯, পৃ. ২৩।
৫৫. ১৯৩২ সালে রিচার্ড অস্টিন বাটলার ভারতের সহকারী সচিব ছিলেন। তিনি শ্রমবিষয়ক দায়িত্ব পালন শেষে পররাষ্ট্র কার্যালয়ে সহকারী সচিব হয়েছিলেন। তিনি পরবর্তী সময়ে যান রাজস্ব দপ্তরে। ১৯৫১ থেকে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত অর্থসচিবের দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
৫৬. আইওআর/এল/পিঅ্যান্ডজে/৯/৫৯, পৃ. ১।
৫৭. আইওআর/এল/পিঅ্যান্ডজে/৯/৫৯, পৃ. ২।
৫৮. আইওআর/৫/১১/১৯৭৬। আসামের সরকারের পক্ষ থেকে চিঠি। নম্বর. পল-১৯১৭-৫৫৮৫,৩০ অক্টোবর ১৯২৪। পরিশিষ্ট এ, পিএএলসি, জানুয়ারি ১৯২৬, পৃ. ২৩-র সঙ্গে চিঠিটি যুক্ত করা হয়েছে।
৫৯. আইওআর/এল/পিঅ্যান্ডজে/৯/৫৯, পৃ. ২।
৬০. ই জে ফুলেই, দ্য সুরমা ভেলি ম্যাগাজিন, ১(৯), ১৯২৭, পৃ. ১৭। ফুলেই ১৯২০ সালে তার বাবার কাছে লিখেছিলেন যে, এইচ সি সুদারল্যান্ড, যিনি সিলেটের ডেপুটি কমিশনার ছিলেন, তিনিও চা-বাগানে অর্থ বিনিয়োগ করেছিলেন। আরও একটি উদাহরণ, জন হেনরি কার ছিলেন ইন্ডিয়ার সিভিল সার্ভিসের বিখ্যাত এক অফিসার। তিনি জন স্মিথ কারের ছেলে ছিলেন। আর জন স্মিথ ছিলেন স্কটল্যান্ডের একজন চা ব্যবসায়ী।
৬১. কটন, ইন্ডিয়ান অ্যান্ড হোম মেমোরিস, পৃ. ২৭৫।
৬২. কটন, ইন্ডিয়ান অ্যান্ড হোম মেমোরিস, পৃ. ২৭৬।
৬৩. সি গিমসনের চিঠি থেকে, নম্বর. ৫৪৫ আইআর, সিলেট, তারিখ ২৪ জুন ১৯২৫।
৬৪. পিএএলসি, জানয়ারি ১৯২৬, পৃ. ৬২-৬৩
৬৫. আসাম রিভিউ, নভেম্বর ১৯২৮, পৃ. ১৪৪। জি পি স্টিওয়ার্ট, ১৯৩০ সালে সিলেটের জেলা কমিশনার হিসেবে পর্যবেক্ষণ করছিলেন যে ‘সিলেট শহর ভারতের একটি বড় শহর ছিল। সিলেট জেলাটি আসামে ইউরোপীয়দের সবচেয়ে বড় মিলনকেন্দ্র ছিল। পুরো জেলায় চা-বাগানের ম্যানেজার, সহকারী ম্যানেজার এবং ইউরোপবাসী ছিল। এর অর্থ হলো, সিলেট শহরে বহুসংখ্যক ইউরোপীয় চা আবাদকারীর ক্লাব ছিল।’ দেখুন স্টিওয়ার্ট, দ্য রাফ অ্যন্ড দ্য স্মোথ, পৃ. ৩৫।
৬৬. চৌদ্দ শতকে উপমহাদেশে আধ্যাত্মিক পীর শাহজালাল সিলেটি এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ভারতীয়দের জন্য একটি নতুন যুগের দ্বার খুলে দেন। শ্রীচৈতন্য সিলেটে তাঁর নানার বাড়িতে বড় হয়েছেন, যিনি পরবর্তী সময়ে গোত্রবিরোধী আন্দোলনে বিখ্যাত হয়েছিলেন।
৬৭. হোসেন, হিস্টোরিক্যাল গ্লোবালাইজেশন অ্যান্ড ইটস ইমপ্যাক্ট, পৃ. ৭৫-৭৬।
৬৮. ভারতের আদমশুমারি প্রতিবেদন, ভলিউম, নয়, ১৯৪১, আসাম, পৃ. ৩৮-৪১।
৬৯. আইওআর/আর/৩/১/১৫৮, পৃ. ৪-৫। লর্ড মাউন্টব্যাটেনের কাছে লিয়াকত আলী খানের চিঠি।
৭০. ভারত সরকার, আসামের জেলাগুলোতে অভ্যন্তরীণ অভিবাসনের ওপর বার্ষিক প্রতিবেদন, কাছাড় এবং সিলেট, ৩১ মার্চ ১৮৭৬ (কলকাতা, ১৮৭৭), পৃ. ৪।
৭১. বাংলার সরকার, ১৮৮৯ সালের অভ্যন্তরীণ অভিবাসনের ওপর বার্ষিক প্রতিবেদন (কলকাতা, ১৮৯০), পৃ. ৪।
৭২. কলকাতায় অনুষ্ঠিত দ্বাদশ ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস সভার প্রতিবেদন, ২৮ থেকে ৩১ ডিসেম্বর, ১৮৯৬। দেখুন এনএবি, এ প্রসেডিং, রাজনৈতিক (হোম), ১৮৯৬, বান্ডেল নম্বর ১।
৭৩. রণজিত্ রায়, ‘নোটস অন সিলেট রেফারেন্ডাম (গণভোট)’ সুজিত কে ঘোষ (সম্পাদিত), পলিটিকস অব সাবভার্সন অব সিলেট, বি আর প্রকাশনা, দিল্লি, ২০০০, পৃ. ২৩।
৭৪. দেখুন <http://assamassembly.gov.in/mla-1946-52.html>, [accessed 15 May 2012].
৭৫. আইওআর/আর/৩/১/১৫৮, পৃ. ২৪।
৭৬. হাজী মুহাম্মদ ইউনুস, সাক্ষাত্কার, এবং এ এম এ মুহিতের সাক্ষাত্কার।
৭৭. নানকাররা স্থানীয় জামিনদারদের শ্রমিক হিসেবে বন্ধনে আবদ্ধ ছিল। তারা সিলেটে বিভিন্ন নামে পরিচিত ছিল। যেমন কিছু অঞ্চলে মুসলিম জামিনদার নানকারদের ডাকতেন ‘কিরান’ বা ‘এটে মান্দার’ আবার কিছু হিন্দু জামিনদাররা ডাকতেন ‘ভান্ডার’ বলে। নানকাররা হিন্দু ও মুসলিম ছিল। স্থানীয় কমিউনিস্টরা ১৯৫০ সালে নানকার আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেছিল।
৭৮. শর্মা, শ্রীহট্টে বিপ্লববাদ, পৃ. ২২১।
৭৯. আইওআর/আর/৩/১/১৫৮, পৃ. ৪-৫।
৮০. গুহ, প্লান্টার রাজ থেকে স্বরাজ, পৃ. ২১৯-২০।
৮১. ঘোষ (সম্পাদিত), পলিটিকস অব সাবভারশন, পৃ. ৯৯।
৮২. আজরফ,আত্মজীবনী, পৃ. ১১০।
৮৩. উল্লেখযোগ্য নামগুলো হলো: কৌমুদানন্দ ভট্টাচার্য, মৃণাল দাস, সুকুমার নন্দী ও জয়কুমার নন্দী, যাঁরা এই গ্রাম থেকে এসেছেন।
৮৪. শর্মা, শ্রীহট্টে বিপ্লববাদ, পৃ. ২১৮-১৯।
৮৫. যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল নেহরুর নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে আইনমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন এবং পাকিস্তানের সংসদীয় পরিষদের নেতা ও মুসলিম লীগের মনোনয়নপ্রার্থী হিসেবে কাজ করেছিলেন। যা হোক, জিন্নাহর মৃত্যুর পর মন্ত্রিপরিষদ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন এবং ভারতে অভিবাসী হয়েছিলেন। জগদীশ চন্দ্র মণ্ডল, মহাপ্রাণ, যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল, কলকাতা, ১৯৭৫।
৮৬. আইওআর/আর/৩/১/১৫৮, পৃ. ৬১।
৮৭. যেইমাত্র গণভোট শেষ হলো, স্থানীয় কমিউনিস্টরা নতুন রাষ্ট্রের সঙ্গে দ্রুত মানিয়ে নিয়েছিল। দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের সাক্ষাত্কার থেকে তথ্য পাওয়া যায় যে স্থানীয় বামধারার কর্মীরা মনে করতেন মুসলিম লীগ হচ্ছে কৃষক-প্রজার দল এবং তারা এর ‘পৃথক জাতীয়তাবাদ’কে পছন্দ না করলেও কৃষি প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত সমাধান হিসেবে শেষাবধি পাকিস্তান দাবিকে সমর্থন করে।
৮৮. আজরফ, আত্মজীবনী, পৃ. ১২৪।
৮৯. ডাস, সেকালের সিলেট, পৃ. ৫১।
৯০. আজরফ, আত্মজীবনী, পৃ. ১২৫।
৯১. মাহমুদ আলী, রিসার্জেন্ট আসাম, পৃ. ৮০-৮১। আরও দেখুন আজরফ, আত্মজীবনী,
পৃ. ১২০।
৯২. সৈয়দ আবদুল মজিদ কোরেশী, পি/এডিএম/২/১১-১২-১৩, পৃ. ২১।
৯৩. আলী, রিসার্জেন্ট আসাম, পৃ. ৮১। ডাস, সেকালের সিলেট, পৃ. ৫০।
৯৪. ওয়াহেদ, সিলেট-এ গণভোট, পৃ. ৪২-৪৩। তাঁর বইয়ে মাওলানা সাহোল ওসমানীর একটি মুদ্রিত লিফলেট তিনি পুনরুদ্ধৃত করেছেন।
৯৫. আলী, রিসার্জেন্ট আসাম, পৃ. ৮১-৮২।
৯৬. আতফুল হাই শিবলী, আবদুল মতিন চৌধুরী: ট্রাসটেড লেফটেন্যান্ট অব মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, ২০১১, পৃ. ১৬১-৬৬।
৯৭. সৈয়দ আবদুল মজিদ কোরেশী, পি/এডিএম/২/১১-১২-১৩,পৃ.১৬।
৯৮. আলী, রিসার্জেন্ট আসাম, পৃ. ৮১-৮২। আজরফ, আত্মজীবনী, পৃ. ১২৫। ডাস, সেকালের সিলেট, পৃ.৪৯-৫১। ওয়াহেদ, সিলেট-এ গণভোট, পৃ. ৫৭-৬৮।
৯৯. ওয়াহেদ, সিলেট-এ গণভোট, পৃ. ৪৫-৪৯।
১০০. আইওআর/আর/৩/১/১৫৮, পৃ. ৪৮।
১০১. আইওআর/আর/৩/১/১৫৮, পৃ. ৪৮।
১০২. আইওআর/আর/৩/১/১৫৮, পৃ. ৪৮-৪৯।
১০৩. আইওআর/আর/৩/১/১৫৮, পৃ. ৪৯। গণভোটকালে সিলেটের কংগ্রেসের নেতা বসন্ত কুমার দাস আসাম মন্ত্রিপরিষদে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। বিভিন্ন তথ্যে দেখা যায়, তিনি সিলেট জেলা কংগ্রেসের অনুকূলে কাজ করেছিলেন।
১০৪. আইওআর/আর/৩/১/১৫৮, পৃ. ৫৪।
১০৫. আইওআর/আর/৩/১/১৫৮, টেলিগ্রাম: যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল, আইন সদস্য, গভর্নর জেনারেল কাউন্সিল, ৭ জুলাই, পৃ.৬৪।
১০৬. আইওআর/আর/৩/১/১৫৮, টেলিগ্রাম: শিলং ও আসামের সরকারের পক্ষ থেকে দিল্লি ও লন্ডনে, ৭ জুলাই, ১৯৪৭, পৃ. ৭৩।
১০৭. আইওআর/আর/৩/১/১৫৮, টেলিগ্রাম: কনফিডেনশিয়াল ২২৪৮-এস: আসামের সরকারের পক্ষ থেকে ভাইসরয়কে, ১২ জুলাই, ১৯৪৭, পৃ. ৭৭।
১০৮. দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, সাক্ষাত্কার, ১৯৯৬। আরও দেখুন দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, আত্মজীবনী, পৃ. ১৩১-৩২।
১০৯. আইওআর/আর/৩/১/১৫৮, মাউন্টব্যাটেনকে নেহরুর চিঠি, ১৩ জুলাই ১৯৪৭, পৃ. ৮৫।
১১০. আইওআর/আর/৩/১/১৫৮, নেহরুকে মাউন্টব্যাটেনের চিঠি, ১৩ জুলাই ১৯৪৭, পৃ. ৯৫-৯৬।
১১১. আইওআর/আর/৩/১/১৫৮, টেলিগ্রাম: নেহরুকে আকবর হাইদেরি, ১৪ জুলাই ১৯৪৭, পৃ. ৮৯-৯০।
১১২. আইওআর/আর/৩/১/১৫৮, মাউন্টব্যাটেনকে নেহরুর চিঠি, ১৫ জুলাই ১৯৪৭, পৃ. ৯৫-৯৬।
১১৩. শর্মা, শ্রীহট্টে বিপ্লববাদ, পৃ. ২২০-২১। ঘোষ, পলিটিকস অব সাবভার্সন, পৃ. ৯৯।
১১৪. আইওআর/আর/৩/১/১৫৭, টেলিগ্রাম, ভাইসরয়কে আসামের সরকার, নিউদিল্লি, নম্বর.১৭৫-এমএসজি, ১০ আগস্ট ১৯৪৭। পৃ. ২৬৯।
১১৫. আইওআর/আর/৩/১/১৫৭, টেলিগ্রাম, নিউদিল্লির ভাইসরয় থেকে আসামের সরকারকে, নম্বর. ৩৩২৯-এস, ১১ আগস্ট ১৯৪৭, পৃ. ২৭৫।
১১৬. একজন বিদায়ী ব্রিটিশ কর্মকর্তা, এইচ ক্রিড লিখেছিলেন, ‘এটা মনে হচ্ছে যে পুরো সীমানা পূর্ব বাংলা (সিলেট)-র সঙ্গে রাখা উচিত (প্রধানত করিমগঞ্জ)। ভবিষ্যতে কোনো ভুল বোঝাবুঝির কোনো সম্ভাবনা পরিহার করার জন্য সীমানারেখা চিহ্নিত করা উচিত। দেখুন ১১৭ আইওআর/৫/২৪/২৬০১-২৬০২, আসামের সরকার, বার্ষিক প্রতিবেদন, বছরান্তের জরিপ বিভাগ, ৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৪৭ (শিলং, ১৯৪৮), পৃ. ৩
১১৭. ইসলাম, সাক্ষাত্কার, ২০০৬, ২০০৭। আরও দেখুন ইউসুফ চৌধুরী, দ্য রোট অ্যান্ড টেলস অব বাংলাদেশি সেটলারস, বার্মিংহাম, ১৯৯৩, পৃ. ৩৬-৩৯। বাড়িওয়ালার বিস্তারিত পরিসংখ্যান পাওয়া যায় চৌধুরীর বইয়ে। উনিশ শতকের শেষ দিকে সিলেটি বাড়িওয়ালারা কলকাতায় তাঁদের ব্যবসা শুরু করেছিলেন। ১৮৯৭ সালে, আইয়ান উল্লাহ অনেক বোর্ডিং বা বাড়ি বানিয়েছিলেন এবং সেখানে তিনি খুব দ্রুতই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হয়ে উঠেছিলেন। তিনি তাঁর সিলেটি অনুসারীদের জাহাজে চাকরি পেতে সাহায্য করছিলেন।
১১৮. শর্মা, শ্রীহট্টে বিপ্লববাদ, পৃ. ২১৯।
১১৯. দাস, সেকালের সিলেট, পৃ. ৫২।
১২০. চৌধুরী, স্মৃতি ও প্রতীতি, পৃ. ১৫২,২২৪-২৬।
১২১. চৌধুরী, স্মৃতি ও প্রতীতি, পৃ. ১৫২।
১২২. জেনারেল দত্ত, সাক্ষাত্কার।
১২৩. দেখুন দাস, সেকালের সিলেট।
১২৪. আইওআর/আর/৩/১/১৫৮, ১৯৪৭ সালের ১৭ জুলাই কলকাতাভিত্তিক সিলেটি আইনজীবী রবীন্দ্রনাথ চৌধুরী মাউন্টব্যাটেনকে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘এটি অবাধ ও নিরপেক্ষ গণভোট হয়নি। পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে যে ভাইসরয়ের মর্যাদা রক্ষা করার জন্যই পুনরায় একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ গণভোট হওয়া দরকার।’
অনুবাদ: শিল্পী বেগম
(রিসার্চ ফেলো, সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড রিসার্চ ইন আর্টস অ্যান্ড সোশ্যাল সায়েন্সেস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)।