স্বামীর প্রবাসকালে গ্রামীণ বাংলার নারী: ক্ষমতা, শক্তি ও অধীনতার ধারণার পুনর্ব্যাখ্যা

সারসংক্ষেপ

নিম্নমুখী কৃষি খাত, বিশাল জনসংখ্যা, কর্মসংস্থানের অভাব এবং ব্যাপক দরিদ্রতার কারণে বিদেশে শ্রম অভিবাসন ক্রমে বাংলাদেশিদের জন্য একটি বিকল্প জীবিকায় পরিণত হয়েছে। অদক্ষ বা স্বল্প দক্ষ কাজের জন্য বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর কয়েক লাখ পুরুষ তাঁদের স্ত্রী, সন্তান ও পরিজনকে গ্রামে রেখে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শ্রম অভিবাসন করেন। শ্রম অভিবাসী স্বামীর অভিবাসনকালে বাংলাদেশি গ্রামীণ নারীর অভিজ্ঞতার বিষয়টি নিয়েই এ প্রবন্ধ। বাংলাদেশের দুটি অভিবাসন-বহুল গ্রামের শ্রম অভিবাসীর স্ত্রীদের প্রাত্যহিক জীবনযাত্রা, সাংসারিক দায়দায়িত্ব এবং প্রাধান্য-বিস্তারকারী জেন্ডার রীতিনীতি ও মূল্যবোধের প্রতি আচরণ ইত্যাদি গভীরভাবে অবলোকনের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত এখানে পর্যালোচনা করা হয়েছে। নারীর ‘ক্ষমতা’ ও ‘ইচ্ছেশক্তি’র অর্থ এবং তাত্পর্যকে তাঁদের একক, যৌথ বা মা-বাবার পরিবারে অবস্থানের প্রেক্ষাপটে বিশ্লেষণ করে আমি দেখিয়েছি যে এসব নারীর ক্ষমতা, শক্তি, অধীনতা এবং ইপ্সিত জীবন উদার নারীবাদের ‘নারী জাগরণ’ ও ‘নারীর ক্ষমতায়ন’ মডেলের ঊর্ধ্বে উঠে পুনর্ব্যাখ্যা দাবি করে।

মুখ্য শব্দগুচ্ছ

শ্রম অভিবাসন, বাংলাদেশি নারী, ক্ষমতা, ইচ্ছেশক্তি, জেন্ডার রীতিনীতি, প্রবাসীর স্ত্রী।

ভূমিকা

বিগত কয়েক দশক যাবত্ দক্ষিণ এশিয়া এবং অন্যান্য স্থানে অভিবাসনবিষয়ক গবেষণায় জেন্ডারভিত্তিক বিশ্লেষণ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। পূর্বে এ জাতীয় গবেষণায় নারীর স্বাধীনতা, ক্ষমতায়ন এবং জাগরণ বা মুক্তির বিষয় প্রাধান্য পেলেও বিশ্লেষণের মাধ্যম হিসেবে জেন্ডার আলোচনায় বর্তমানে বিশেষত্ব, স্থানের বৈশিষ্ট্য, পরিবর্তন, নারী ও পুরুষের অভিবাসন অভিজ্ঞতায় পার্থক্য ইত্যাদির ওপর ক্রমাগত জোর দেওয়া হচ্ছে। সেই ধারাবাহিকতায় এ প্রবন্ধ অভিবাসী পুরুষের অনুপস্থিতিতে নারীর জীবনযাপন ও অভিজ্ঞতাকে তাত্ত্বিক আলোচনার ভেতর দিয়ে উপস্থাপন করেছে। অভিবাসী স্বামীর অনুপস্থিতিতে একক, যৌথ এবং মা-বাবার পরিবারে বসবাসকারী প্রবাসী বাংলাদেশির স্ত্রীদের প্রাত্যহিক জীবনযাত্রা অনুসরণ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার ভিত্তিতে এ আলোচনা উঠে এসেছে। উদার নারীবাদ বা উন্নয়নবিদ্যার মতো এ প্রবন্ধে নারীর ওপর চাপিয়ে দেওয়া সামাজিক/জেন্ডার নিয়মকানুনগুলো নির্মূল করার কথা বলা হয়নি, বরং সমাজ কর্তৃক আরোপিত নারীর বিশেষ ভূমিকা পালন বা বিরোধিতা করতে গিয়ে নারী যে বিভিন্ন প্রকার ‘শক্তি’ ও ‘ক্ষমতা’ ব্যবহার করে, সে বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে।

দক্ষিণ এশীয় দেশগুলো থেকে পুরুষ অভিবাসনের ফলে নারীর কী ধরনের অভিজ্ঞতা হয়, তা নিয়ে সৃষ্ট তাত্ত্বিক ও অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান থেকেই এ লেখার আগ্রহ তৈরি হয়। এ প্রসঙ্গে লীলা গুলাতির বেশ আগের একটি কাজের উদাহরণ দেওয়া যাক। ভারতের কেরালা রাজ্য থেকে মধ্যপ্রাচ্যগামী পুরুষ শ্রম অভিবাসীদের দেশে রেখে যাওয়া নারীর ওপর গবেষণায় দেখিয়েছেন যে পুরুষের অভিবাসন নারীর সামাজিক নীরবতা বা বিচ্ছিন্নতা ভাঙতে সাহায্য করে এবং বাড়ির বাইরে বৃহত্তর গণ্ডির সঙ্গে তাদের যোগাযোগ ও চলাফেরা বাড়িয়ে তোলে।১ অন্যদিকে মাহারজান ও তাঁর সহকর্মীদের গবেষণায় উঠে এসেছে যে প্রত্যন্ত নেপালি গ্রাম থেকে পুরুষেরা যখন কাজের উদ্দেশে অন্যত্র যায়, গ্রামে রয়ে যাওয়া নারীর সঙ্গে তার সমাজের সম্পৃক্ততা স্বাভাবিকভাবেই তখন বেড়ে যায়।২ সংসারের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া, সংসারের খরচ জোগানো, অভিবাসনের মাধম্যে সম্পদ বাড়ানো ইত্যাদিতে নারীর সম্পৃক্ততা তার ক্ষমতায়ন এবং ক্ষমতারোহণ—দু-ই করে থাকে। একই ধরনের এক গবেষণায় দত্ত ও মিশ্র দেখিয়েছেন যে বিহারে নারীর কাজের ভার, চলাফেরা এবং পরিবারের ভেতরে ও বাইরের গণ্ডির সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধি পায়, যখন তাঁদের স্বামীরা কাজের জন্য অন্য গ্রাম বা শহরে যান।৩ এ ক্ষেত্রে অবশ্য লেখকদ্বয় দাবি করেন যে এ পরিবর্তন নারীর জীবন চালানোর পেছনে দুই বিশেষ বিষয়—পুরুষ গোষ্ঠীতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা (patriarchy) বা বর্ণপ্রথা, কোনোটাই বাতিল করতে পারেনি। দেশাই ও ব্যানার্জি বলেন, স্বামীর অনুপস্থিতিতে নারীর জীবন কীভাবে প্রভাবিত হবে, তার একটা মুখ্য নিয়ামক হলো সংসারের গঠন। বৃহত্তর পরিসরে সংগৃহীত তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করে গবেষণাকারীরা দেশে অবস্থানরত প্রবাসী শ্রমিকের স্ত্রীদের সামাজিক মুক্তির বিভিন্ন দিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন এবং দেখান, যেসব নারী স্বামীর অবর্তমানে একান্নবর্তী পরিবারে থাকে না, তারা অন্যদের চেয়ে অধিক কাজের দায়িত্ব ও চাপ মোকাবিলা করেন, আবার একই সঙ্গে অনেক বেশি স্বাধীনতা ভোগ করেন।৪ একান্নবর্তী পরিবারে রেখে যাওয়া নারীর এই চাপ বা স্বাধীনতা কোনোটিই নেই।

এ বিষয়ে বাংলাদেশি নারীর ওপরও গবেষণা হয়েছে। লন্ডনে সিলেটি অভিবাসী জনগোষ্ঠীর ওপর গার্ডনারের গবেষণায় বেরিয়ে আসে যে পুরুষের অভিবাসনের ফলে নারীর সাংসারিক ও অর্থনৈতিক বিষয়ে ক্ষমতার প্রয়োগ বাড়ে।৫ ১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশকে যাদের স্বামী ব্রিটেনে ছিল, এমন কিছু অভিবাসী নারীর ওপর গবেষণায় গার্ডনার দেখান যে এই নারীরা তাদের প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে যে সম্পর্ক তৈরি করেছিল, সেই নেটওয়ার্কের ওপর ভিত্তি করে পরবর্তীকালে সিলেট এলাকা থেকে আরও অভিবাসন হয়েছে।৬ মধ্যপ্রাচ্যে শ্রম অভিবাসনে যাওয়া পুরুষের রেখে যাওয়া স্ত্রীদের বৃদ্ধিপ্রাপ্ত অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, জীবনযাপনের মান এবং সামাজিক অবস্থার ওপর আরেক গবেষণায় আকরাম ও করিম দেখান যে পুরুষ অভিবাসনে নারীর ‘মুক্তি’ ও ‘ক্ষমতায়ন’ হয়।৭ তবে তাঁরা এও দেখান যে স্বামীর অবর্তমানে দেশে থাকা নারীর ওপর পুরুষ ও তার পরিবারের নিয়ন্ত্রণ করার প্রবণতা বাড়ে। বাংলাদেশের চারটি জেলার ১০০টি পরিবারের ওপর পরিচালিত এ গবেষণায় লেখকেরা দেখিয়েছেন যে স্বামীর অভিবাসনে নারীর ওপর ইতিবাচক প্রভাব পড়ে: নারীর আত্মবিশ্বাস ও নিজে চলার শক্তি বাড়ে, একক পরিবারে থাকা নারীদের অনেকেই সংসার পরিচালনার ভার নেন, জমিজমা, সন্তানের লেখাপড়া, দেনা পরিশোধ এবং বিদেশ থেকে প্রেরিত অর্থের ব্যবহার নিশ্চিত করতে গিয়ে নারী তা অর্জন করেন।৮

ওপরে আলোচিত গবেষণাগুলো পুরুষ শ্রম অভিবাসনে নারীর ওপর প্রভাব, যেমন: অতিরিক্ত কাজের চাপ, দায়িত্ব, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, আত্মবিশ্বাস, সামাজিক অবস্থান ইত্যাদি বিষয়ে মূল্যবান তথ্য উপস্থাপন করলেও সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। প্রথমত, নারীর অভিজ্ঞতাকে মুক্তি ও ক্ষমতায়নের কাঠামোতে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বেশির ভাগ গবেষণাই উন্নয়নবিদ্যার মতোই বাংলাদেশি এবং অন্যান্য অনুন্নত দেশের নারীদের ‘নিপীড়িত’, ‘অসহায়’ ও ‘অক্ষম’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।৯ ‘মুক্তি’ ও ‘ক্ষমতায়ন’-এর কাঠামোতে শ্রম অভিবাসীদের রেখে যাওয়া নারীর খাপ খাওয়ানোর বিষয়টি যখন গবেষণা করা হয়, তখন অনেকাংশেই তাদের ইচ্ছে ও শক্তি, ঈপ্সিত জীবন এবং প্রতিনিয়ত পুরুষ গোষ্ঠীতান্ত্রিক সমাজের নিয়মনীতির সঙ্গে বোঝাপড়া বা খাপ খাওয়ানোর বিষয়গুলো প্রতিফলিত হয় না। প্রকৃতপক্ষে, বহিরাঙ্গনে নারীর অবাধ পদচারণ দিয়ে নারীর ক্ষমতায়নকে বিচার করা যায় না।১০ তদুপরি, আলোচিত গবেষণার প্রায় সব কটিতেই যদিও বলা হয়েছে যে অভিবাসনের ফলে সংসারের অভ্যন্তরে ক্ষমতার সম্পর্কে, ব্যবহারে ও চর্চায় পরিবর্তন আসে, পুরুষ অভিবাসী দেশে প্রত্যাবর্তনের পর সেগুলো কতটা বহাল থাকে বা পরিবর্তিত হয়, সে ব্যাপারে কোনো আলোকপাত করা হয়নি।

বাস্তবে, নারীর ওপর পুরুষ অভিবাসনের প্রভাব ও ফলাফল এতই জটিল একটি বিষয় যে তাকে কেবল ‘ক্ষমতায়ন’ দিয়ে বিচার করলে তা ভালোভাবে উপলব্ধি করা যায় না। পুরুষের শ্রম অভিবাসনকে নারী কীভাবে মোকাবিলা করে তা বুঝতে হলে নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর জানা জরুরি: স্বামী বিদেশে চলে যাওয়ার পর স্ত্রী নিজের কর্তব্য বা ভূমিকা সম্পর্কে কী ভাবেন? আপাত স্থানিক দূরত্ব পুরুষকে বিদ্যমান জেন্ডার নিয়ম ও নীতিগুলো নারীর ওপর প্রয়োগ করার সুযোগকে বাড়িয়ে তোলে, নাকি নারী তার পুরুষের শ্রম অভিবাসনের কারণে প্রচলিত কর্তৃত্বকারী জেন্ডার নিয়মনীতিকে অবজ্ঞা করার সুযোগ পায়? এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য এ প্রবন্ধে আমি ‘ক্ষমতায়নের’ ধারণাগত কাঠামোতে আবদ্ধ না থেকে জোর দিয়েছি ‘আমিত্ব’ ((selfhood)), ‘ইচ্ছাশক্তি’ (agency) এবং ‘ক্ষমতা’র (power) মতো ধারণার ওপর, যার গুরুত্ব দেশে অবস্থানকারী বাংলাদেশি শ্রম অভিবাসীর স্ত্রীর প্রাত্যহিক জীবনকৌশল অনুধাবনের জন্য অপরিসীম।

ধারণাগত কাঠামো

আগেই বলেছি যে পারস্পরিকভাবে সম্পর্কিত কয়েকটি ধারণার ওপর এ প্রবন্ধের মূল আলোচনা নির্ভর করছে। এগুলো হলো: অধীনতা (subordination), ইচ্ছেশক্তি ও ক্ষমতা । নারীবাদী তত্ত্বে ‘অধীনতা’র ধারণা অনেক আগে থেকেই ব্যবহূত হয়ে আসছে, যেখানে দাবি করা হয় যে বিশ্বজনীন নারী পুরুষ গোষ্ঠীতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় পুরুষের অধীন এবং এ ‘অধীনতা’ থেকে নারীর ‘মুক্তি’ প্রয়োজন। তবে, ১৯৭০-এর দশক থেকে চলে আসা ‘তৃতীয় বিশ্বের নারীবাদ’, যা অধীনতার কাঠামোর ভেতরে মানবিক ইচ্ছের ওপর জোর দিয়ে আসছে এবং তাদের মতে নারীর স্বার্থ, আগ্রহ ও ইচ্ছেগুলো শ্রেণি, গোত্র, জাতি বা স্থানভেদে ভিন্ন হতে পারে।১১ ভিন্নতার এ তত্ত্বই বলে দেয় যে ‘অধীনতা’র ধারণা ততটা সরল নয়, যা বর্তমান প্রবন্ধেও প্রমাণিত হয়েছে।

নারীর ক্ষমতায়ন ও জাগরণবিষয়ক তত্ত্বের সীমাবদ্ধতা বুঝতে হলে ‘ক্ষমতা’র যে ধারণাগুলো গত কয়েক দশকে জন্মলাভ করেছে, তা আলোচনা করা প্রয়োজন। লিউকের মতে, প্রতিষ্ঠান ও সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণই কেবল ক্ষমতা নয়, বরং অন্যের বিষয় ও চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করার মধ্য দিয়েই ‘ক্ষমতা’ বিকশিত হয়।১২ উত্তর-কাঠামোবাদীগণ (post-structuralists) এ ধারণাকে আরও এগিয়ে নিয়ে গেছেন। যেমন ফুকো ক্ষমতাকে দেখেছেন কোনো বিষয়ের ওপর প্রভাব খাটানোর চেয়ে বেশি কিছু হিসেবে। তাঁর কাছে ‘ক্ষমতা’ হলো বুদ্ধি ও কৌশলে নতুন নতুন ধারণা, ইচ্ছে, সম্পর্ক ও জ্ঞান (discourse) সৃষ্টির শক্তি।১৩ তাঁর মতে, ‘ক্ষমতা’ এমন কোনো বিষয় নয়, যা ব্যক্তি বা গোষ্ঠী ধারণ করবে, বরং এটি সমাজের ভেতর দিয়ে প্রবহমান, পরিবর্তনশীল ও আপেক্ষিক।১৪ জনগণের নিত্য ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক আদান-প্রদানের বা প্রতিষ্ঠানের মধ্য দিয়ে তা অবস্থান করে। স্বামীর অবর্তমানে বাংলাদেশি নারীদের অবস্থান ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে ‘ক্ষমতা’র এ ধারণাই আমি ব্যবহার করব।

নারীর ‘ইচ্ছেশক্তি প্রসঙ্গে আমার প্রধান সংলাপী হলেন নৃতাত্ত্বিক সাবা মাহমুদ। ‘ইচ্ছেশক্তি’কে যাঁরা ‘প্রতিরোধ’দের সমতুল্য মনে করেন, তাঁদের বিপরীতে এই লেখক দাবি করেন যে—

ইচ্ছেশক্তির অর্থ ও ভাব আগে থেকে নির্দিষ্ট করা যায় না; তা বেরিয়ে আসে সুনির্দিষ্ট অবস্থিতি, দায়িত্ব ও কার্যকারিতা আছে এমন কিছু ধারণার বিশেষ বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে। সেদিক থেকে দেখলে, অগ্রগামিতার ধারণায় যাকে শোচনীয় নিষ্ক্রিয়তা বা অপ্রতিরোধ্যতা এবং বাধ্যতা বলে মনে হয়, তা আসলে একধরনের ‘ইচ্ছেশক্তি’। কিন্তু তাকে বুঝতে হলে সেই প্রচলিত ধারণা বা অধীনতার কাঠামোর ভেতরেই তাকে খুঁজতে হবে, কেননা সেটাই এই ‘ইচ্ছেশক্তি’ ধারণের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দেয়। সেই অর্থে ‘ইচ্ছেশক্তি’র ক্ষমতা কেবল প্রচলিত নিয়মকে প্রতিহত বা অবজ্ঞা করার মধ্যেই নয়, বরং তা প্রচলিত নিয়মের মধ্যে বসবাস ও সেগুলোকে নানাভাবে আত্মস্থ করার মধ্যে নিহিত আছে।১৫

‘ইচ্ছেশক্তি’র এ ধারণাটিই আমার প্রবন্ধের মূল। ‘শক্তি’র দুই রকম অর্থ, ‘প্রতিহত করা’ ও ‘আত্মস্থ করা’কে ব্যবহার করে এ প্রবন্ধে বাংলাদেশের পুরুষ কর্তৃত্বকারী গ্রামীণ সমাজের সাংস্কৃতিক নিয়মের বিরুদ্ধে অভিবাসীদের রেখে যাওয়া নারীদের কখনো আনত, কখনো গতিশীল নারীবাদী সচেতনতাকে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। বাংলাদেশে নারী ও জেন্ডারবিষয়ক সাহিত্য সাধারণত পরিবারে, সমাজে ও অর্থনীতিতে নারীর মান ও অবস্থানকে পুরুষ গোষ্ঠীতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা ও নির্ভরশীলতার নিরিখে বিচার করে।১৬ মাহমুদ অবশ্য দেখিয়েছেন যে নারীর অধস্তন অবস্থান কখনো কখনো স্বেচ্ছাপ্রণোদিত এবং নারীর ‘ইচ্ছেশক্তি’ এবং নারীবাদী সচেতনতার এক গুরুত্বপূর্ণ রূপ। ক্ষমতা ও ইচ্ছেশক্তি ও উত্তর- কাঠামোবাদী ধারণার ওপর ভিত্তি করে এ প্রবন্ধে দেখানো হয়েছে যে সত্যিকার অর্থে স্বামীর অনুপস্থিতিতে একজন ‘ভালো স্ত্রী’, একজন ‘ভালো পুত্রবধূ’, ‘একজন সফল গৃহকর্ত্রী’ অথবা ‘একজন ভালো কর্মজীবী নারী’ হতে চাওয়া বাংলাদেশিদের বাস্তবতায় ভিন্নতা ও বৈপরীত্য আছে। এ বাস্তবতা অধীনতা ও ক্ষমতায়িত হওয়ার ব্যাপারে নারীর প্রতি যে মূল্যায়ন তাকে চ্যালেঞ্জ করে।

গবেষণাপদ্ধতির ওপর কিছু কথা

২০০৪-০৮ সালে মনপুর ও ঝুমপুর—বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলার দুটো অভিবাসনবহুল গ্রামে পরিচালিত আমার উচ্চতর শিক্ষা (পিএইচডি) গবেষণা থেকে এই প্রবন্ধের উত্পত্তি।১৭ প্রাথমিক তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের উদ্দেশ্যে গ্রামে একজন জাতিতাত্ত্বিক গবেষক (Ethnographer) হিসেবে আমার উপস্থিতি এবং জনগণের সঙ্গে মেলামেশায় শহুরে মধ্যবিত্ত পরিবারে বড় হওয়া এবং ইউরোপে উচ্চশিক্ষারত একজন নারী হিসেবে আমার পরিচয় যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছিল।১৮ উপরন্তু, গ্রামগুলোর সঙ্গে আমার ছিল বৈবাহিক সূত্রে পূর্ব আত্মীয়তার সম্পর্ক, যা আমাকে মানুষের কাছাকাছি আসতে সাহায্য করে। কিন্তু একই সঙ্গে আমার শহুরে এবং বিদেশে থাকার অভিজ্ঞতা আমাকে তাদের সঙ্গে একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব তৈরি করতে সাহায্য করেছিল। এ থেকে একদিকে যেমন আমি একজন বিদেশি জাতিতাত্ত্বিক গবেষকের মতোই গবেষণার সমাজকে একজন ‘বহিরাগত’র দৃষ্টি থেকে দেখতে পেয়েছি, অন্যদিকে তেমনি বাংলাদেশি জাতীয়তা ও এলাকার ‘পুত্রবধূ’ হিসেবে পরিচয় আমাকে গবেষণা এলাকায় ‘নিজের লোক’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল। আঞ্চলিক জাতিতাত্ত্বিক গবেষক সম্পর্কে নারায়ণের সেই উক্তি এখানে উল্লেখ্য: ‘আমরা যারা নিজেদের সমাজ নিয়ে গবেষণা করি, তারা ধারণাগত উপাদানগুলোকে জেনে তারপর মাঠপর্যায়ে তা কতটা প্রযোজ্য তা দেখার বদলে আমাদের পূর্ব অভিজ্ঞতার আলোকে বিশ্লেষণের উপাদানগুলোকে পুনর্নামকরণ ও পুনর্গঠন করে থাকি।’১৯ সত্যি বলতে কি, অংশগ্রহণমূলক পর্যবেক্ষণ ও সমাজ বিশ্লেষণের ভাষা আমাকে সাহায্য করেছে মনপুর ও ঝুমপুরের নারী ও পুরুষের জীবনকাহিনির এক নতুন অর্থ উদ্ঘাটন করতে। এ প্রবন্ধে প্রবাসী শ্রমিকের স্ত্রীর জীবন আলোচনা করতে গিয়ে এমন অনেক কাহিনি আমি ব্যবহার করেছি।

এ গবেষণাটি করার জন্য গ্রাম দুটি থেকে বাছাই করা ১১০টি অভিবাসী পরিবারের কাছ থেকে উপর্যুপরি গুণগত তথ্য সংগ্রহ করা হয় নিরীক্ষা, অংশগ্রহণমূলক পর্যবেক্ষণ, অনানুষ্ঠানিক সাক্ষাত্কার এবং কেস স্টাডি সংগ্রহের মধ্য দিয়ে। ২০১০-১১ সালে গ্রাম দুটি আমি পুনঃপরিদর্শন করি এবং তথ্যগত দিক থেকে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনগুলো বোঝার চেষ্টা করি। এ সময় আমি দেখি যে কোনো কোনো নারী তার স্বামী বিদেশে যাওয়ার কারণে বা বিদেশ থেকে ফিরে আসার পর বাসস্থান বদলে শ্বশুরবাড়ি থেকে বাবার বাড়ি বা বাবার বাড়ি থেকে শ্বশুরবাড়িতে ফিরে এসেছে। নিজে নারী হওয়ার কারণে গ্রামের পুরুষদের তুলনায় সব বয়সী নারীদের সঙ্গে আমার সখ্য গড়ে উঠেছিল। তা সত্ত্বেও আমি নারী ও পুরুষ সবার জীবনের কাহিনিই সতর্কতার সঙ্গে রেকর্ড করি এবং তাদের গল্পের বিষয়বস্তু ও উদাহরণে পার্থক্য দেখতে পাই। নারীরা যেখানে সাংসারিক বিষয় যেমন: সন্তানের দেখভাল, সাংসারিক আয়-ব্যয়, শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয়ে কথোপকথনে বেশি আগ্রহী ছিল, পুরুষেরা তাদের অভিবাসন অভিজ্ঞতা বর্ণনাতেই অধিক সময় ব্যয় করেন।

আলোচনার সুবিধার্থে প্রবন্ধের বাকি অংশটিকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রথম অংশে উপস্থাপন করা হয়েছে বাংলাদেশ থেকে শ্রম অভিবাসনের একটি সংক্ষিপ্ত চিত্র এবং গবেষণার গ্রামগুলোর আর্থসামাজিক অবস্থা। অভিবাসী স্বামীর অবর্তমানে নিজের ও স্বামীর একক পরিবারে, স্বামীর যৌথ বা একান্নবর্তী পরিবারে বা নিজের মা-বাবা, ভাইবোনের সঙ্গে বসবাসরত নারীদের জীবনকে কেন্দ্র করে মাঠপর্যায়ের তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে দ্বিতীয় অংশে। শেষাংশে তথ্যগুলোকে ক্ষমতা, ইচ্ছেশক্তি এবং নারীর অধীনতার তত্ত্ব দিয়ে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। বিশ্বব্যাপী নারীবাদী সচেতনতা বোঝার জন্য ক্ষমতা, ইচ্ছেশক্তি ও অধীনতার গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হলেও এ ব্যাপারে আমার মতামত হলো, এ ধারণাগুলো সর্বদাই পরিবর্তনশীল এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের ওপর নির্ভর করে।

শ্রম অভিবাসন ও গ্রামীণ বাংলাদেশ

বাংলাদেশকে কর্মসংস্থানের দিক থেকে প্রায়ই অভিহিত করা হয় দ্বৈত অর্থনীতি হিসেবে, যার একটি ছোট শিল্প খাত এবং অপেক্ষাকৃত প্রভাবশালী একটি কৃষি খাত রয়েছে।২০ ১৬ দশমিক ৫ কোটি মানুষের ৭০ ভাগের বেশি যেখানে কৃষির ওপর নির্ভরশীল, সেখানে কৃষি খাত জিডিপির মাত্র ১৫ শতাংশ।২১ নিম্নমুখী কৃষি খাত, বিশাল জনসংখ্যা, কর্মসংস্থানের অভাব এবং ব্যাপক দরিদ্রতার কারণে বিদেশে শ্রম অভিবাসন ক্রমশ বাংলাদেশিদের জন্য একটি বিকল্প জীবিকায় পরিণত হয়েছে।

বাংলাদেশ থেকে বিদেশে শ্রম অভিবাসন

সরকারি মতে, ১৯৭৬ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ৮ দশমিক ৭ মিলিয়ন বাংলাদেশি স্বল্পমেয়াদি শ্রম চুক্তিতে বিদেশে গেছেন। সবচেয়ে বেশিসংখ্যক বাংলাদেশি যান সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, ইরাক, লিবিয়া, বাহরাইন, লেবানন ও দক্ষিণ কোরিয়ায়।২২ পরিসংখ্যানগতভাবে, শতকরা ৭৩ ভাগ বাংলাদেশি বিদেশে স্বল্প দক্ষ কাজে নিয়োজিত আছে। মাত্র ২৭ ভাগ বাংলাদেশি পোশাক বা অন্যান্য প্রস্তুতকারী শিল্প, গাড়িচালক, মেশিন অপারেটর, কাঠমিস্ত্রি, দরজি, রাজমিস্ত্রি বা এ জাতীয় পেশায় আছে। পেশাজীবী অর্থাত্ চিকিত্সক, নার্স, প্রকৌশলী ও শিক্ষক বিদেশে কর্মরত শ্রমশক্তির মাত্র শূন্য দশমিক ১৩ শতাংশ।২৩ মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার তুলনায় ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ায় কর্ম ভিসায় অবস্থিত বাংলাদেশির সংখ্যা তুলনামূলকভাবে অনেক কম।

আমার গবেষণা এলাকায় জুলাই ২০০৮ সালে ১১০টি পরিবার ছিল, যেখান থেকে শ্রম অভিবাসন হয়েছে। দুই গ্রামের ৩১৫টি পরিবারের মধ্যে মনপুরে ৪৩টি এবং ঝুমপুরে ৬৭টি অভিবাসী পরিবার ছিল। এ এলাকা থেকে অভিবাসন আরম্ভ হওয়ার সময় থেকে গবেষণার সময় পর্যন্ত ১১০টি পরিবার থেকে ১৯১টি যাত্রা আমি রেকর্ড করি, যার অর্থ হলো কোনো কোনো পরিবার থেকে এক ব্যক্তি একাধিকবার অথবা একই পরিবার থেকে একাধিক ব্যক্তি অভিবাসন করেছে। এই ১৯১টি যাত্রার শতকরা ৬০ ভাগ ছিল মধ্যপ্রাচ্যে, ৩৫ ভাগ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এবং ৫ ভাগ অন্যান্য এলাকায়। জাতীয় চিত্র অনুযায়ী এই সংখ্যাগুলো যথাক্রমে শতকরা ৮২, ১৪ ও ৪ ভাগ।

বাংলাদেশের শ্রম অভিবাসীর ৯৫ ভাগ পুরুষ। নিম্ন মজুরি, স্বল্পমেয়াদি চাকরি এবং শ্রম গ্রহণকারী দেশে অভিবাসীদের ওপর নির্ভরশীলদের (ডিপেনডেন্ট) আনা ও রাখার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা থাকায় নিম্ন আয়ের অদক্ষ, স্বল্প দক্ষ ও দক্ষ শ্রমিকেরা তাঁদের পরিবারকে সাধারণত দেশে রেখে যান। সুতরাং অদক্ষ বা স্বল্প দক্ষ কাজের জন্য পুরুষ বিদেশে যায় এবং নারী গ্রামে থেকে সংসারের দেখাশোনা করে, সাধারণভাবে এটাই গ্রামীণ বাংলাদেশের শ্রম অভিবাসনের জেন্ডার চিত্র।

ঝুমপুর ও মনপুর—বাংলাদেশি দুই গ্রাম

ঢাকা থেকে সড়কপথে মাত্র ৫২ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি উপজেলায় অবস্থিত পাশাপাশি দুটি গ্রাম—মনপুর ও ঝুমপুর। সবচেয়ে কাছাকাছি বাজারটি আধা কিলোমিটার দূরে আর সবচেয়ে কাছের শহরটি পাঁচ কিলোমিটার। ঝুমপুরের নিজস্ব প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও মনপুরের শিশুদের শিক্ষার জন্য যেতে হয় পার্শ্ববর্তী গ্রামের স্কুলগুলোতে। একটু বড় বাচ্চারা কাছাকাছি কিংবা দূরের স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় যায়। কাছের এক গ্রামেই আছে মেয়েদের জন্য মাদ্রাসা। গ্রামের আধা কিলোমিটারের মধ্যে একটি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র আছে। জরুরি বা জটিল চিকিত্সা বা দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে এলাকাবাসী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যায় স্বাস্থ্যসেবার জন্য।

গ্রাম দুটির পরিবারের গড় জনসংখ্যা ৫ দশমিক ৬ এবং গড় ব্যয় মাসে পাঁচ হাজার ৫০০ টাকা। গ্রামে বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষের বাস, যেমন: কৃষক, কৃষিশ্রমিক, পরিবহনশ্রমিক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, দোকানদার, বেতনভোগী কর্মচারী এবং বিদেশে কর্মরত শ্রমিক। জীবিকায় বৈচিত্র্য থাকলেও প্রায় সব পরিবারই কৃষি মৌসুমে নিজস্ব অথবা ধারে নেওয়া (বর্গা বা কট) জমি চাষ করে থাকে। মেঘনার অববাহিকায় অবস্থিত বলে ছয় থেকে আট মাসের বেশি এ অঞ্চলে চাষবাস করা যায় না। ৩১৫টি পরিবারের মধ্যে ২৭ শতাংশ ভূমিহীন এবং মাত্র ৭ শতাংশ লোকের চার একরের চেয়ে বেশি জমি আছে। মোট জনসংখ্যার শতকরা ৯৬ জন ইসলাম ধর্মের অনুসারী।

গ্রামীণ বাংলাদেশের সামাজিক গঠন বুঝতে হলে গুষ্টি (পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থার একক) এবং পরিবারকে জানাটা জরুরি। একটি গ্রামে সাধারণত কয়েকটি গোষ্ঠী থাকে। ঝুমপুর এবং মনপুরে যথাক্রমে এ রকম ২৬ ও ১৯টি গোষ্ঠী আছে। প্রতিটি গোষ্ঠী আবার একাধিক পরিবারে বিভক্ত। একটি আদর্শ পরিবার একজন পুরুষ, তার স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে গঠিত। তবে, বাংলাদেশের অন্য অনেক জায়গার মতোই মনপুর ও ঝুমপুরে স্ত্রী ও সন্তানকে পুরুষের একান্ত পরিবার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ব্যাপক অর্থে পরিবার বলতে একজন ব্যক্তির মা-বাবা, মা-বাবার মা-বাবা এবং বিবাহিত বা অবিবাহিত ভাইবোন যারা একই সংসারে, উঠানে, ভিটায় বা গ্রামে বসবাস করে বা করে না—এদের সবাইকে বোঝায়। বাংলাদেশে পরিবার প্যাট্রিলোকাল এবং প্যাট্রিলিনিয়াল। প্রচলিত প্রথায় মেয়েরা বিয়ের পর মা-বাবার সংসার ছেড়ে স্বামীর সংসারে স্থানান্তরিত হয়। অনেক ক্ষেত্রে ছেলেরা বিয়ের পর মা-বাবার সংসার থেকে ভিন্ন হয়ে নিজের স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে আলাদা সংসার গড়ে তোলে।

বাংলাদেশে নারীর জীবন অনেকাংশে পর্দাপ্রথা দিয়ে পরিচালিত হয়। তবে, মধ্যপ্রাচ্যের অনেক ইসলামি দেশের মতো নারীর ওপর পর্দা এ দেশে বাধ্যতামূলক নয়। গ্রামে যেমনটা দেখেছি, উন্নত রাস্তাঘাট, পরিবহনব্যবস্থা এবং স্থানীয় বাজার প্রসার লাভ করার সঙ্গে সঙ্গে নারীর এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাতায়াত বেড়েছে বহুগুণ। মেয়েরা গৃহে পরিসীমায় আবদ্ধ থাকবে, এমনটি আজকাল আর আশা করা হয় না। তবে, সমাজ তাদের কাছ থেকে আশা করে যে তারা যেভাবেই হোক, নির্দিষ্ট মাত্রায় নিজেদের পর্দা মেনে চলবে। প্রবন্ধের পরবর্তী অংশে এ নিয়ে আরও আলোচনা রয়েছে। মূলত, এ প্রেক্ষাপটেই বাংলাদেশি নারীর ভূমিকা ও অন্যদের সঙ্গে সম্পর্ক আবর্তিত হয়।

অভিবাসী স্বামীর অবর্তমানে স্ত্রীর জীবন

আমার জাতিতাত্ত্বিক গবেষণায় দেখেছি যে পুরুষ অভিবাসনের ক্ষেত্রে নারীর জন্য সাধারণত তিন ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়: ক. অভিবাসীর স্ত্রী তার সন্তানদের নিয়ে স্বামীর গ্রামেই নিজস্ব একক পরিবারে থাকে, খ. স্ত্রী তার সন্তানদের নিয়ে গ্রামে বা শহরে স্বামীর যৌথ পরিবারে থাকে এবং গ. সে তার সন্তানদের নিয়ে নিজের বাবার বাড়িতে চলে যায়। এই তিন ক্ষেত্রেই নারীদের দেওয়া সাক্ষাত্কার থেকে বিশদ তথ্য উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে নিচে তুলে ধরা হলো যে পুরুষের অনুপস্থিতিতে নারী কীভাবে তার চারপাশের জগত্ রচনা করে।

ক. ‘সংসারপ্রধান’ নারী

প্রতিদিন ফজরের ওয়াক্তে২৪ আমার ঘুম ভাঙে। নামাজ পড়ার পর ঘর পরিষ্কার করি। রাতের অধোয়া থালাবাসন নিয়ে পুকুরপাড়ে যাই। এরপর সকালের নাশতা তৈরি করি। সকাল নয়টার মধ্যে ছোটটা (দুই বছর বয়স) ছাড়া আমার সব বাচ্চা স্কুলে চলে যায়। তারা নিজেরাই চলে যায়। দুইটার আগে তারা ফেরত আসে না। সংসারের কাজ, যেমন: উঠান ঝাঁট দেওয়া, লাকড়ি আনা, মুড়ি তৈরি করা, ধান শুকানো, দুপুরের খাবার বানানো ইত্যাদির জন্য আমি যথেষ্ট সময় পাই।...

... গত বছর আমরা সারা বছরের খোরাকি চালানোর জন্য ধান, আলু—এসব চাষ করে ঘরে তুলেছিলাম (সংগ্রহ করেছিলাম)। কিন্তু তেল, পেঁয়াজ, মরিচ—এসব তো প্রতি মাসেই কিনতে হয়। মাছ, মাংস বা শাকসবজি রাখার জন্য আমার কোনো ফ্রিজ নেই, প্রায় প্রতিদিনই এগুলো কেনা লাগে। বাজার করার জন্য সব সময় লোক পাই না। আমার বড় ছেলে (১২ বছর বয়স) যা পারে করে, মাঝেমধ্যে বাসার সামনে দিয়ে প্রতিবেশীরা বাজারে গেলে তাকে বলে প্রয়োজনীয় জিনিস আনিয়ে নিই। বোঝেন তো, আমাদের মতো নারীরা বাজার গেলে ভালো দেখায় না।...

বাচ্চারা স্কুল থেকে ফিরে খাওয়াদাওয়া করতে করতে বেলা দুইটা। কিন্তু বিকেল তিনটা-চারটার আগে আমার কাজই শেষ হয় না। খাওয়াদাওয়ার পর বিকেলে একটু বিশ্রাম নিই। নিজস্ব সময় বলতে আমার এটাই। মাঝেমধ্যে আশপাশের বাসার আত্মীয়-পরিজন মেয়েরা আসে, একসঙ্গে বসে টেলিভিশন দেখি, গল্প করি।...সন্ধ্যার পর বাচ্চাদের লেখাপড়া দেখি। একটু না দেখলে পড়তে চায় না।...আমি সাধারণত রাতের রান্নাও দিনে করে ফেলি। রাতে রান্নাঘরের কাজ তেমন রাখি না।...

আমাদের আড়াই বিঘার (.৭৫ একর) মতো জমি আছে। আমার স্বামী দেশে থাকতে আমরা নিজেরাই সেটা চাষবাস করতাম। নিজে খাটতে পারলে নিজের জমি চাষ করে লাভ আছে। তা ছাড়া নিজের জমি চাষ করাটা লাভজনক হয় না। স্বামী বিদেশে যাওয়ার পর আমি বদলি-মুনি (কৃষিশ্রমিক) দিয়ে চাষ করানোর চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু দেখা যায় তাদের ভাড়া করতেই অনেক খরচ। আবার ফসল তুলতেও একার জন্য অনেক পরিশ্রম হয়ে যায়। তাই কয়েক বছর ধরে আমি জমিটা বর্গা (ভাড়া) দিয়ে দিই আর এর বদলে উত্পাদিত ফসলের অর্ধেক আমি পাই। প্রতিবছর অবশ্য এক নিয়মে হয় না। কখনো কখনো টাকার বিনিময়ে জমি কট (দীর্ঘমেয়াদি ভাড়া) দিয়ে দিই। তখন আর ফসলের ভাগ পাই না।...

আমার স্বামী তিন মাস অন্তর বিদেশ থেকে টাকা পাঠায়। সংসারের খরচ চালানোর জন্য আমি প্রতি মাসে ব্যাংক থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণে টাকা ওঠাই। দাউদকান্দি সদরে (জেলা শহর) জনতা ব্যাংকে আমার একটা অ্যাকাউন্ট আছে, এখান থেকে বেশি দূরে না, পাঁচ কিলোমিটার হবে। আমার অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠিয়েই আমার স্বামী ফোন করে। তখন আমি গিয়ে টাকা উঠিয়ে নিয়ে আসি। মাঝেমধ্যে টাকা শেষ হয়ে গেলে আশেপাশে শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়-প্রতিবেশীদের কাছ থেকে ধার করি। বিদেশ থেকে টাকা এলেই সঙ্গে সঙ্গে সেই ঋণ শোধ করে দিই।২৫

স্বামীর অবর্তমানে একক সংসারের প্রধান মরিয়ম (৩৫) তার জীবনচিত্র এভাবেই আমার সামনে তুলে ধরেছিলেন। মরিয়মের মতো অনেক নারীই অভিবাসী স্বামীর অবর্তমানে তাঁদের দায়িত্ব অতিরিক্ত ও ভারবহুল মনে করেন। পারুল (৩০) নামে আরেক গৃহবধূ আমাকে বলেছিলেন, ‘বিদেশ করবে জানলে আমার মা-বাবা কখনোই আমাকে এই লোকের (বর্তমান স্বামী) সঙ্গে আমার বিয়ে দিত না। বিদেশে যাওয়ার আগে আমাদের বলা হয়েছিল যে গ্রামে তার ছোটখাটো ব্যবসা আছে।’ একক অভিবাসী পরিবারের প্রধান কয়েকজন নারী আমাকে বলেছেন যে তাঁরা কখনো অভিবাসীর কাছে তাঁদের মেয়ের বিয়ে দেবেন না, কারণ তাঁরা জানেন, ‘অভিবাসী স্বামীর ঘর করতে কেমন লাগে।’ অন্য ভাষায়, পুরুষ গোষ্ঠীতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় পুরুষের ‘অধীনে’ থাকার চেয়ে ‘মুক্তি’ ও ‘স্বাধীনতা’ যে সব সময় নারী বেশি চায়, তা নয়। এসব নারীর সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে যে তাঁদের স্বামীর উপস্থিতিতেই তাঁরা নিজেদের অধিক ‘ক্ষমতাবান’ মনে করেন।

গবেষণায় দেখেছি যে বেশির ভাগ অভিবাসীই নিয়মিত দেশে আসেন এবং জমিজমা বর্গা/কট দেওয়া/নেওয়া এবং বাচ্চাদের লেখাপড়া বা বিয়েসংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো দেশে থাকা অবস্থায় সুরাহা করে যান। পরিবারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয় যেমন মেয়ের বিয়ে বা ছেলের বিদেশে যাওয়া ইত্যাদিতে বিদেশে অবস্থানের কারণে স্বামীর মতামত পাওয়া কঠিন হয়ে পড়লে স্ত্রী সাধারণত তার নিজের বা স্বামীর বড় ভাই বা অন্য কোনো বয়স্ক আত্মীয়স্বজনের পরামর্শ নেন। খুব কম নারীই আমি দেখেছি, যাঁরা তাঁদের স্বামী, ভাই, ছেলে বা শ্বশুরবাড়ির সাহায্য ছাড়া স্বাধীনভাবে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

খ. যৌথ পরিবারে রেখে যাওয়া নারী

আমি যখন মাঠপর্যায়ে তথ্য সংগ্রহ করছিলাম গবেষণার গ্রামে, তখন অভিবাসীর স্ত্রীদের শতকরা প্রায় ৫০ ভাগ শ্বশুরালয়ে যৌথ পরিবারে অবস্থান করছিল। তাদের একজন নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছিলেন: ‘তারা (দেশে থাকা পরিবারের পুরুষ) বাজার আনে আর আমাদের (বউরা) কাজ হলো সবার জন্য রান্না করা।’ সত্যিকার অর্থে, যৌথ পরিবারের নারীরা অপেক্ষাকৃত বড় পরিবারের সবার অন্ন নিশ্চিত করার জন্য অর্ধেকের বেশি সময় রান্নাঘরে কাটান, যা একক পরিবারের ‘সংসারপ্রধান’ নারীর তুলনায় অনেক গুণ বেশি। তাঁদের অন্য কাজের মধ্যে অন্যতম হলো বৃদ্ধ শ্বশুর-শাশুড়িকে দেখভাল করা, শিশুদের যত্ন নেওয়া ও মেহমান, বিশেষ করে স্বামীর বিবাহিত বোন ও তার স্বামীদের আপ্যায়ন করা। নারীপ্রধান পরিবারের চেয়ে পুরুষ লোকবল বেশি থাকায় যৌথ পরিবারগুলো খোরাকি (সারা বছরের খাদ্য) নিশ্চিত করার জন্য কৃষিকাজ করে থাকে। ফসল উত্পাদনের মৌসুমে ফসল তোলার কষ্টসাধ্য কাজ থাকে বলে যৌথ পরিবারে থাকা স্ত্রীদের পরিশ্রম বেড়ে যায় অনেক গুণ। এত কিছু সত্ত্বেও নারীপ্রধান একক পরিবারের চেয়ে যৌথ পরিবারের নারীর কর্মভার কম, কেননা যৌথ পরিবারে নারী তাঁর কর্মভার অন্য নারী ও পুরুষের সঙ্গে ভাগ করে নেন। একক পরিবারে যেখানে নারী নিজের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কাজ করে থাকেন, যৌথ পরিবারে সাধারণত পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ নারীকে (শাশুড়ি বা বড় ছেলের বউ) কে কী কাজ করবে তা ভাগ করে দেন। অপেক্ষাকৃত নববিবাহিতদের ক্ষেত্রে তাঁদের ওপর আরোপিত দায়িত্ব সুচারুভাবে পালন করতে হয়। কিন্তু এ অবস্থাকে ‘ক্ষমতাহীন করা’বলে মূল্যায়ন করা ঠিক নয়। এসব নারীর ক্ষমতা ও শক্তিকে দেখতে হবে গ্রামীণ বাংলাদেশের অধস্তনতা/অধীনতার যে ধারণা এবং কাঠামো নারীকে একজন ‘ভালো পুত্রবধূ’, ‘ভালো মা’ বা ‘ভালো স্ত্রী’ হিসেবে দেখতে চায়, তার নিরিখে।

গ্রামে অন্তত ১৩টি পরিবার আমি পেয়েছি, যেখানে অভিবাসী ব্যক্তির মা তাঁর স্ত্রী ও সন্তানদের সঙ্গে বসবাস করছিলেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, বিধবা মা তাঁর প্রবাসী ছেলের স্ত্রী ও সন্তানদের সঙ্গে বসবাস করছেন, বিশেষ করে নববিবাহিত পুত্রবধূর সঙ্গে অথবা প্রবাসীরা যখন শিশুসন্তান দেশে রেখে যান। সাধারণভাবে সমাজ ধরে নেয় যে অল্প বয়সী বিবাহিত বা অবিবাহিত মেয়ের একা থাকা উচিত নয়, তারা সহজেই পুরুষের যৌন আক্রমণের শিকার হতে পারে। এ ধরনের বদনাম থেকে দূরে থাকার জন্য প্রবাসীরা তাদের স্ত্রীদের সঙ্গে মায়েদের থাকাটা শ্রেয় মনে করে। তবে একই গৃহে বসবাসকারী পুত্রবধূ ও শাশুড়ির মধ্যে সংসার পরিচালনায় কে দায়িত্ব নেবে, সেটা অনেকগুলো বিষয়ের ওপর নির্ভর করে, যেমন: ব্যক্তিত্ব, বুদ্ধি, বয়স ইত্যাদি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখেছি শাশুড়ি অতিরিক্ত বৃদ্ধ ও সংসারের দায়িত্ব নিতে অপারগ হওয়ায় প্রবাসীর স্ত্রীই শাশুড়িকে দেখাশোনাসহ সংসারের সব ভার নিয়েছেন। যা-ই হোক না কেন, সংসারে শাশুড়ির উপস্থিতি নারীর জন্য প্রবাসীর স্ত্রীর সামাজিক সম্মানকে বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে।

গ্রামে প্রবাসীদের অনেক মা আছেন, যাঁরা স্বামীকে অপেক্ষাকৃত কম বয়সে হারিয়ে খুব কঠিন হাতে সন্তানকে মানুষ করেছেন। অল্প বয়সে বিধবা হওয়া এসব নারীর অনেকেই নিশ্চিত কোনো আয়ের উত্স ছিল না। প্রচণ্ড প্রতিকূল পরিবেশে মা-বাবা, শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়স্বজন বা গ্রামের অবস্থাপন্নদের সাহায্য নিয়ে অনেক কষ্ট করে তাঁরা তাদের সন্তানদের মানুষ করেন এবং বিদেশে পাঠান। মা-ছেলের একসঙ্গে জীবনসংগ্রামের অভিজ্ঞতা ছেলেকে মায়ের সংসার চালানোয় বিচক্ষণতা ও বিদেশ থেকে পাঠানো টাকার সঠিক ব্যবহারের বিষয়ে আস্থা তৈরি করতে সাহায্য করেছে। বিধবা মায়ের ক্ষমতার তুলনায় স্ত্রীদের সংসার পরিচালনায় নিতান্তই অদক্ষ ধরা হয়। কুয়েতফেরত কালামের (৩৭) ভাষ্যে তা স্পষ্টই ধরা পড়ে। তিনি বলেছিলেন: ‘আমি আমার স্ত্রীকে এক টাকা পাঠালে সে দুই টাকা খরচ করে; আর মাকে এক টাকা পাঠালে আট আনা (.৫০ টাকা) খরচ করে আর আট আনা রাখেন ভবিষ্যতের জন্য।’ সংঘাত এড়ানোর জন্য বেশির ভাগ পুত্রবধূ শ্বাশুড়ি যত দিন চান, তত দিনই সংসার চালানোর বিষয়টি মেনে নেন।

একক সংসারে নারীরা যেমন জমি বর্গা দেওয়া, ঋণ পরিশোধসহ বিদেশ থেকে পাঠানো টাকা কীভাবে খরচ করা হবে ইত্যাদি সব আর্থিক ব্যাপারগুলো সামলান, যৌথ পরিবারে প্রবাসীর স্ত্রীদের তা করতে হয় না; যেহেতু পরিবারের পুরুষেরা এ দায়িত্ব নিয়ে থাকেন। যে পরিবারে প্রবাসীর বিধবা মা সংসারের দায়িত্বে, সেখানেও প্রবাসীর স্ত্রীরা কোনো আর্থিক বিষয় দেখেন না। এ কথা সত্যি, বিদেশ থেকে পাঠানো টাকা যেসব যৌথ বা মাপ্রধান পরিবারে একধরনের বিমা এবং আয়ের গুরুত্বপূর্ণ উপায় হিসেবে কাজ করে, সেখানে নারী তাঁর জীবিকা ও অর্থনৈতিকভাবে ভালো থাকার জন্য তাঁর আত্মীয়স্বজনের ওপর নির্ভর করেন।২৬

অবশ্য, অনেক যৌথ পরিবারে প্রবাসীর স্ত্রী ও প্রবাসীর মা-বাবার মধ্যে বিদেশ থেকে প্রেরিত টাকা গ্রহণ ও নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সংকট সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশে প্রচলিত সামাজিক রীতিতে সংসারের বয়োজ্যেষ্ঠ সক্ষম পুরুষেরাই এই ভূমিকা পালন করার কথা। দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হয় তখনই, যখন প্রবাসী তাঁর নিজের নামে জমি কেনার জন্য অথবা সঞ্চয়ের লক্ষ্যে তাঁর স্ত্রীর কাছে সরাসরি টাকা পাঠান। এসব ক্ষেত্রে প্রবাসীর স্ত্রীকে সাধারণত দোষারোপ করা হয় তাঁর স্বামীর ওপর অতিরিক্ত ‘প্রভাব’ বিস্তার করার জন্য আর স্বামীকে বলা হয় যে তিনি তাঁর মা-বাবার প্রতি নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করছেন না। তবে, সামজিক অবস্থান, অথনৈতিক নিরাপত্তা, স্বামীর সঙ্গে সুসম্পর্কের জন্য শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক রাখাটা যেখানে খুবই জরুরি, প্রবাসীর স্ত্রীরা এ ধরনের সমস্যা মোকাবিলায় বিভিন্ন প্রকার কৌশল অবলম্বন করেন। ফিরোজার (৩৫) কেসটাই ধরা যাক:

বিদেশ যাওয়ার পর আমার স্বামী সব সময় আমার কাছেই টাকা পাঠাত। আর আমি সেখান থেকে নিজের খরচের টাকাটুকু রেখে বাকিটা আমার শ্বশুরকে দিতাম। একদিন আমার শ্বশুর বললেন যে ছেলের কামাই পুত্রবধূর কাছ থেকে নিতে তাঁর খারাপ লাগে। ছেলেকে টেলিফোনে জানালেন যে তার কাছ থেকে সরাসরি টাকা না পাওয়ায় তিনি অসম্মানবোধ করছেন। পরদিন আমি তাঁকে ব্যাংকে নিয়ে গিয়ে একটা হিসাব খুলে দিলাম এবং আমার স্বামীকে বললাম সে যেন আমার হাতখরচ ও সংসার খরচের টাকা আলাদাভাবে যথাক্রমে আমার ও তার বাবার অ্যাকাউন্টে পাঠায়।২৭

বৃহত্তর পরিবারের সঙ্গে টানাপোড়েন এড়িয়ে স্ত্রীর প্রয়োজন মেটানোর জন্য প্রবাসীরা কখনো কখনো যৌথ পরিবারে রেখে আসা স্ত্রীদের জন্য গোপনে তাঁদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অথবা বন্ধুবান্ধব বা আত্মীয় মারফত অর্থ পাঠান। মোবাইল ফোনে স্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে প্রবাসীরা এটি করতে পারেন। বাংলাদেশের বিস্তৃত গ্রামীণ অঞ্চল এখন বেসরকারি মোবাইল ফোন কোম্পানি যেমন: গ্রামীণফোন, রবি, বাংলালিংক ইত্যাদির নেটওয়ার্কের আওতাধীন। নারীপ্রধান প্রবাসী একক পরিবারগুলোতে নারীরা যখন মোবাইলে তাঁদের স্বামীদের সঙ্গে কথা বলেন, তখন টাকাপয়সাসংক্রান্ত বিষয়ই বেশি প্রাধান্য পায়।

গ. মা-বাবার সংসারে প্রবাসীর স্ত্রী

মাঠপর্যায়ে কাজ করার সময় আমার সঙ্গে ঝুমপুর ও মনপুর গ্রামের বেশ কয়েকজন মেয়ের সঙ্গে সাক্ষাত্ হয়, যাঁরা স্বামী বিদেশে যাওয়ার কারণে তখন বাবার বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। এ রকম একজন হলেন রেবেকা (২২), যিনি আমাকে ব্যাখ্যা করেছিলেন বাবার বাড়িতে থাকার কারণ:

নিজের গ্রামে থাকার সুবিধা অনেক। গ্রামের সবাই আমাকে চেনেন, হয় তারা আমার আত্মীয়-পরিজন অথবা প্রতিবেশী। আমি সব জায়গায় ঘুরে বেড়াতে পারি। কেউ আমার নামে বদনাম করবে না। সত্যি বলতে কি, আমার শ্বশুরবাড়িতে কখনোই বিয়ের পর সেভাবে থাকা হয়নি। আমার স্বামী বিদেশে যাওয়ার আগ পর্যন্ত আমি তার সঙ্গে ঢাকায় থাকতাম। সে যাওয়ার পরও কিছুদিন আমার শাশুড়িকে নিয়ে সেখানে থেকেছি। শাশুড়ি মারা যাওয়াতেই আমাকে এখানে আসতে হলো। আমার স্বামীর বড় দুই ভাই আছেন, যাঁরা আমার স্বামীর গ্রামে থাকেন। সেখানে আমি যেতে পারতাম, কিন্তু স্বামী ছাড়া সেখানে গিয়ে থাকতে কেমন যেন অস্বস্তি হয়। কে কীভাবে চিন্তা করে তা তো বলা যায় না। আমাদের দেশে (কুমিল্লা অঞ্চলে) মানুষ বাড়ির বউ কী করে না করে সবকিছু খেয়াল করে। আমি স্বামীর সঙ্গে শ্বশুরবাড়ি গিয়ে থাকতেই বেশি পছন্দ করি। বাচ্চার লেখাপড়ার দিকটাও তো দেখতে হবে...এই সবকিছুই আমি তাকে (স্বামীকে) বুঝিয়ে বলেছি। সে আমাকে এখানে (মা-বাবার সঙ্গে) এসে থাকতে বলেছে। আমি আর আমার মেয়ে আমার দাদির সঙ্গে এই রুমে থাকি। কিছুদিন আগে বাবার স্ট্রোক হয়েছে...তিনি এখন আমাকে ছাড়া কিছুই বোঝেন না। মা-বাবার জন্য কিছু করার এটা একটা সুযোগ। কিন্তু আমি থাকায় তাদের ওপর বাড়তি চাপ পড়ুক, সেটাও আমি চাই না। তাদের আর্থিক অবস্থাও খুব একটা ভালো নয়। স্বামী টাকা পাঠালে তার কিছু অংশ আমি প্রতি মাসেই তাদের দেওয়ার চেষ্টা করি।২৮

বেশির ভাগই একান্নবর্তী পরিবারের ভাঙন বা শ্বশুর-শাশুড়ির মৃত্যুর কারণেই প্রবাসীর স্ত্রীরা তাঁদের মা-বাবার সঙ্গে থাকতে বাধ্য হন। কোনো কোনো মা-বাবা অবশ্য জোর করেই জামাইয়ের অবর্তমানে মেয়েকে নিজের কাছে নিয়ে আসেন। অর্থনৈতিক অবস্থা যে রকমই হোক না কেন, বিবাহিত মেয়েরা বাবার বাড়িতে সব সময়ই সমাদৃত। ঘরের বউদের মতো, বাড়ির বিবাহিত বা অবিবাহিত মেয়েদের পরিবারের সদস্যদের প্রতি বা সাংসারিক কাজে তেমন সামাজিক দায়বদ্ধতা নেই। বরং সন্তান প্রতিপালনে বিবাহিত মেয়েরা মা-বাবা, ভাইবোনের কাছ থেকে পূর্ণ সহযোগিতা ও সহমর্মিতা পেয়ে থাকেন।

বিগত কয়েক দশকে এই গ্রামগুলোতে একই গ্রামের দুই পরিবারের মধ্যে বিয়ের প্রবণতা লক্ষ করা যায়, অভিবাসনের সঙ্গে যার একটা সম্পর্ক রয়েছে। এ ধরনের বিয়ে হওয়া পুরুষ বিদেশে যাওয়ার সময় তাঁর স্ত্রীকে তাঁর গ্রামেই রেখে যেতে পারেন, কারণ স্ত্রীও একই গ্রামের মেয়ে। বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকার মতোই, ঝুমপুর ও মনপুর গ্রামের যেসব মেয়ের একই গ্রামের ছেলের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে, তাঁরা স্বাভাবিক কারণেই অন্য গ্রামে বিয়ে হওয়া মেয়েদের তুলনায় নিজের বাবার বাড়ির সঙ্গে গভীর যোগাযোগ রক্ষা করেন। এ ধরনের পরিস্থিতিতে বরং প্রবাসীর স্ত্রীকে দুই পরিবারের বয়স্ক ব্যক্তিদের (নিজের ও স্বামীর মা-বাবা) দেখভাল করার দ্বৈত দায়িত্ব পালন করতে হয়। স্বামীর পরিবারের সঙ্গে একাত্মতা ও নিজের বাবার পরিবারের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক—এই দুয়ের মিশ্রণে নারীর ‘মেয়ে’ ও ‘বধূ’ হিসেবে ভিন্ন যে পরিচয়, তা অনেক সময় ম্লান হয়ে যায়। বিষয়টি নারীপ্রধান প্রবাসী পরিবারের জন্য বেশি সত্যি, কেননা সেখানে মেয়েদের নিজের প্রয়োজনেই বাবার বাড়ির নিয়মিত সাহায্য দরকার হয়।২৯ বাংলাদেশের প্রচলিত রীতি অনুযায়ী, বিবাহিত মেয়েরা কেবল বিশেষ অনুষ্ঠানে বা মাঝেমধ্যে বাবার বাড়িতে বেড়াতে আসে। স্বামী বিদেশে থাকার কারণে গ্রামীণ এ নিয়মে যথেষ্ট ব্যত্যয় পরিলক্ষিত হয়।

ঘ. প্রবাসীর কর্মজীবী স্ত্রী

কিন্ডারগার্টেন স্কুলে আমি পড়ানো আরম্ভ করি মাত্র এক বছর আগে, কিন্তু ছোট বাচ্চাদের আমি বাসায় পড়াই বেশ কবছর ধরেই। গতবার হাফিজ (তার স্বামী) যখন বিদেশে যায়, আমাদের পরিবারের অবস্থা ভালোই ছিল। তার চাকরিটা ভালো ছিল এবং প্রতি মাসেই টাকা পাঠাতে পারত। সে সময় আমার চাকরি করা এতটা জরুরি হয়ে ওঠেনি। এবার (স্বামীর দ্বিতীয়বার অভিবাসন) সে নিয়মিত টাকা পাঠাতে পারছে না। সৌদি আরবে গিয়ে এবার সে প্রায় আট মাসের মতো বেকার ছিল। ধারদেনা করে সব মিলিয়ে দেশে মাত্র ৩০ হাজার টাকার মতো পাঠাতে পেরেছে। দুর্ভাগ্যবশত এবার সে বিদেশ যাওয়ার টাকা জোগাড় করতে গিয়ে আমাদের অনেক টাকা ঋণ হয়েছে। হাফিজের পাঠানো টাকার ৮০ ভাগ ঋণ পরিশোধ করতে গেছে। বাকি টাকা দিয়ে আমরা কীভাবে চলব? এটা কি সম্ভব?

...আমার শ্বশুর বাজারে একটা সিগারেটের দোকান চালান। বেশি হলে প্রতিদিন ১০০ টাকার মতো তিনি ঘরে আনতে পারেন, যেটা দিয়ে ঘরের কাঁচাবাজারটা কোনোরকম হয়। কিন্তু সংসারে আরও তো অনেক রকম খরচ থাকে: আমার তিন বছরের বাচ্চার দুধ, যক্ষ্মায় আক্রান্ত শাশুড়ির চিকিত্সা, ক্লাস নাইনে পড়া দেবরের পড়াশোনার খরচ, বিবাহযোগ্য এক ননদ, তার খরচ।

 উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে আমি স্নাতক প্রথম বর্ষে পড়ার জন্য স্থানীয় এক কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে পড়াশোনা ছেড়ে দিতে হলো। বাধ্য হয়েই এই চাকরিটা নিয়েছি। স্কুল কর্তৃপক্ষ মাসে আমাকে মাত্র ৯০০ টাকা দেয়। এটা দিয়ে কী হয়? তা-ও আমি চালিয়ে যাচ্ছি, কারণ স্কুলের অনেক বাচ্চা আবার আমার কাছে প্রাইভেট পড়তে আসে। তাতে কিছু বাড়তি আয় হয়।৩০

ঝুমপুর গ্রামের মেয়ে এবং বউ শাপলা (২৫) এভাবেই ব্যাখ্যা করেছিলেন চাকরিতে যোগ দেওয়ার কারণগুলো। গ্রামে কোনো মধ্যবিত্ত ঘরের নারী বাইরে চাকরি করা মানে তাঁর স্বামী তাঁকে ঠিকমতো ভরণপোষণ দিতে অপারগ। সারা বাংলাদেশের মতোই গবেষণার গ্রামগুলোতেও দেখেছি যে দাম্পত্য জীবনে অশান্তি এড়ানো ও তা দীর্ঘতর করার চেয়ে চাকরি করে অর্থ উপার্জন করাটা নারীর কাছে বেশি জরুরি নয়। তবে শাপলার ক্ষেত্রে যেমনটা দেখা গেছে যে অভিবাসনের প্রাথমিক বছরগুলোতে বিদেশ থেকে সংসারের প্রয়োজন মেটানোর মতো যথেষ্ট টাকা না এলে, স্বামী বা তাঁর পরিবারের প্রয়োজনেই বউয়ের চাকরি করাটা গ্রহণযোগ্য হতে পারে। অন্য অনেক প্রবাসীর স্ত্রী যেখানে অর্থনৈতিকভাবে তাঁর স্বামী বা বাবার পরিবারের ওপর নির্ভরশীল, প্রবাসীদের কর্মজীবী নারী নিজের শিক্ষা ও দক্ষতাকে জীবিকার প্রয়োজনে ব্যবহার করেন। অবশ্য এ জন্য তাঁদের অনেক সমালোচনা সহ্য করতে হয়, যেহেতু বাংলাদেশের সামাজিক ব্যবস্থা পুরুষকে প্রধান উপার্জনকারী এবং নারীকে সংসার দেখাশোনার কর্ত্রী হিসেবে চিহ্নিত করে।

এ অবস্থায় কোনো কোনো নারী স্বামীর অসম্মানের বিষয়টি বিবেচনা করে ঘরে বসে উপার্জনের পথ বেছে নিয়েছেন। উদাহরণস্বরূপ নাজমার কথা বলতে পারি। মনপুর গ্রামের নাজমা (৩৬) বড় একটা গরুর ফার্ম চালান। ছয় বছর আগে গ্রামীণ ব্যাংকের ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে তিনি এই ফার্মটি চালু করেন। আমার সঙ্গে সাক্ষাত্কারের সময় এই ফার্ম থেকে নাজমার নিট লাভ ছিল প্রতি মাসে কমপক্ষে ১০ হাজার টাকা, সংসারের খরচ চালানোর জন্য যা যথেষ্ট। স্বামী মালয়েশিয়া থেকে অনিয়মিতভাবে কিছু টাকা পাঠালেও এই ফার্মের সুবাদে নাজমাই আসলে হয়ে উঠেছেন সংসারপ্রধান, যদিও নিজেকে সেভাবে জাহির করার কোনো চেষ্টা তাঁর মধ্যে দেখিনি। শ্বশুরবাড়ি ও বাপের বাড়ির লোকজনকে বিদেশে পাঠানোর পেছনেও তাঁর আর্থিক অনেক অবদান রয়েছে।

মনপুর ও ঝুমপুরে কোনো কোনো পেশা মেয়েদের জন্য বেশি প্রযোজ্য। যেমন: স্কুলের শিক্ষক, বেসরকারি সংস্থার কর্মী, বিমা কোম্পানির প্রতিনিধি ইত্যাদি যেখানে মূলত নারী ও শিশুদের নিয়েই কাজ করতে হয়। নারীদের আকৃষ্ট করার জন্য কোনো কোনো স্কুলে নারী শিক্ষকদের জন্য বোরকা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, যেন তাঁর সামাজিক রীতিনীতি অক্ষুণ্ন রেখেই বাইরে কাজ করতে পারেন। বেতন পুরুষ শিক্ষকের তুলনায় কম হওয়া সত্ত্বেও গ্রামীণ মধ্যবিত্ত পরিবারের অনেক নারী বাইরে কাজ করার এ ধরনের সুযোগ গ্রহণ করছেন।

আলোচনা ও বিশ্লেষণ

ওপরের আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে মনপুর ও ঝুমপুরে নারীর দৈনন্দিন জীবন পরস্পরবিরোধী বৈশিষ্ট্য ও কৌশলে ভরপুর। নিচে চারটি ভিন্ন পরিস্থিতিকে বসবাসরত নারীর প্রাত্যহিক জীবনে চলার কৌশল ও বৈশিষ্ট্যগুলো তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করা হলো:

একক পরিবারে থাকা নারীর ক্ষমতা ও শক্তি

এ প্রবন্ধে উল্লিখিত একক পরিবারের প্রতিনিধি মরিয়ম যে ‘ক্ষমতায়ন’ ও ‘নারী জাগরণ’-এর সীমাবদ্ধতা তুলে ধরে দেখিয়েছেন যে নারীর জীবনে ইচ্ছাশক্তি ও ক্ষমতার অন্য রকম বহিঃপ্রকাশও ঘটে। নারীপ্রধান পরিবার বলতে সাধারণভাবে সেসব পরিবারকে বোঝানো হয়, যেখানে ‘নারী হচ্ছেন প্রধান ভরণপোষণকারী, রক্ষাকর্ত্রী, ধারক-বাহক এবং সিদ্ধান্তপ্রণেতা।’৩১ বাংলাদেশে স্বল্পমেয়াদি শ্রম অভিবাসী পরিবারের নারীপ্রাধান্য অবশ্য আমাদের সামনে অন্য একটি চিত্র উপস্থাপন করে, যেখানে নারী প্রধান ভরণপোষণকারীও নন, আবার প্রধান সিদ্ধান্তপ্রণেতাও নন। শারীরিক অনুপস্থিতি সত্ত্বেও বিদেশে কর্মরত স্বামী হলেন প্রধান উপার্জনকারী এবং টেলিফোন যোগাযোগ থাকায় সর্বক্ষণই তিনি সংসারের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করেন। কেবল তা-ই নয়, এমন অনেক স্ত্রীর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে, যাঁরা সংসারের হাল ধরা সত্ত্বেও স্বামীর কাছ থেকে সংসার চালানোর জন্য মূল অর্থটুকুই কেবল পেয়ে থাকেন। সুতরাং ‘স্বামী বিদেশে আছেন’ বললেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংসারের সব ক্ষমতা স্ত্রীর হাতে চলে এসেছে—এ কথাটি বলা যায় না। ক্ষমতায়নের যে তত্ত্ব পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার ভেতরেও পরিবারপ্রধান নারীকে পুরুষের সমান ক্ষমতাসম্পন্ন মনে করে, আমার নৃতাত্ত্বিক এ গবেষণা তাকে সমর্থন করে না। বরং মরিয়মের ক্ষেত্রে যেমনটা দেখা গেছে, ‘সংসারের পূর্ণ দায়িত্বভার নেওয়া’ এবং ‘সব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া’র কাজটি একক পরিবারে নারীপ্রধানদের দায়বদ্ধতা এবং তাঁদের স্বামী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়ার সুযোগকে বাড়িয়ে তোলে, যা যৌথ পরিবারে রেখে যাওয়া নারীর ক্ষেত্রে ঘটে না।

আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো স্বামী বিদেশ থেকে ফিরে আসার পর নারীর পারিবারিক অবস্থান পরিবর্তিত হয়ে যায়। এমনকি স্বল্প সময়ের জন্য ছুটিতে এলেও অভিবাসী স্বামী সংসারপ্রধানের ভূমিকা পালন করে। স্বামীর উপস্থিতিতে নারীর সাংসারিক কর্মভার হয়তো বেড়ে যায় বা অপরিবর্তিত থাকে, কিন্তু জমিজমা, ঋণ, নিত্য বাজার-হাট ইত্যাদির দায়দায়িত্ব স্বামী নেওয়াতে নারী মানসিকভাবে অনেক ভারমুক্ত হন।

উদার নারীবাদী ভাবনায় সংসারের বাইরের বিষয়ে নারীর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার ক্ষমতা এবং বহির্বিশ্বের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ পুরুষতান্ত্রিক রীতিনীতিকে চ্যালেঞ্জ করে বলে দাবি করা হলেও আমার গবেষণায় বিষয়টিকে এতটা সহজ মনে হয়নি, তা অনেকটাই জটিল। মরিয়ম এবং আরও কয়েকজন প্রবাসীর স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে যে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ‘ক্ষমতা’, ‘স্বাধীনতা’, ‘মুক্তি’—এ বিষয়গুলো নারী সব সময় উপভোগ করেন না। এ ক্ষেত্রে আসলে অর্থ, সম্পদ, প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি (প্রবাসীর স্ত্রী) বা গোষ্ঠীর (পরিবার) কাছে থাকা কোনো বস্তুর ওপর নিয়ন্ত্রণকে ক্ষমতা বলা যাবে না।৩২ ক্ষমতা হচ্ছে সমাজে বহমান ধারণা, ধারা ও নিয়মনীতির ওপর কৌশলগত সম্পর্ক আরোপ করার শক্তি।৩৩ বাংলাদেশের সামাজিক ব্যবস্থায় নারীর সে বিবাহিত বা অবিবাহিত হোক, একাকী থাকাটা স্বীকৃত নয়। কিন্তু গ্রামে এই নিয়মের ভেতরেই যথেষ্ট পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। গ্রামের অনেক একক পরিবার থেকে পুরুষপ্রধানেরা শ্রম অভিবাসী হওয়ার কারণে তাঁদের স্ত্রীর একা থাকতেই হচ্ছে। সমাজের শক্তিশালী যে জেন্ডার ধারণা নারীকে সংসার লালনকারী হিসেবে দেখে, সে সমাজই এখন অভিবাসী পরিবারের নারীর একক অবস্থান ও স্বামীর অবর্তমানে বহিরাঙ্গনের কাজ করাকে স্বীকার করে নিচ্ছে। সুতরাং, মরিয়মের ক্ষমতা স্বামীর অবর্তমানে সংসার পরিচালনায় ততটা নয়, যতটা রয়েছে সমাজ নারীকে যেভাবে দেখতে চায় সে ধারণা ও নিয়মের ভেতরে পরিবর্তন নিয়ে আসাতে, তা যত কম বা বেশিই হোক।

যৌথ পরিবারে নারীর ক্ষমতা ও শক্তি

স্বামীর পরিবারে রেখে যাওয়া নারীদের ক্ষমতা ও শক্তির আরেক রকম অর্থ আমরা খুঁজে পাই। আকরাম ও করিম তাঁদের এক গবেষণায় দেখিয়েছিলেন যে স্বামীর অভিবাসনে তাঁর স্ত্রীর অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, জীবনযাপনের মান এবং সামাজিক অবস্থান বাড়লেও স্ত্রীর ওপর তাঁর স্বামী এবং স্বামীর আত্মীয়দের প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণও সেই সঙ্গে বাড়তে পারে।৩৪ কিন্তু শ্বশুরবাড়ির লোকদের হাতে নির্যাতিত হওয়ার ভয়ে নারীর ‘নাজুক’ অবস্থায় থাকার চিত্রটি আমার গবেষণায় দেখা যায়নি, বরং আমার কাছে মনে হয়েছে যে স্বামীর অবর্তমানে শ্বশুরবাড়িতে অবস্থান করায় নারী শারীরিকভাবে নিরাপদ, অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল এবং সামাজিকভাবে সম্মানজনক বলে মনে করছেন, বিশেষ করে যাঁরা একক পরিবারে থাকেন, সেসব নারীর তুলনায়।

এসব নারীর ঈপ্সিত ‘স্বাধীনতা’ বা ‘মুক্তি’র বিষয়টি গ্রামীণ বাংলাদেশে বৃহত্তর সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বিবেচনা করতে হবে। বাংলাদেশি গ্রামীণ সংস্কৃতিতে তিনিই একজন ‘ভালো মেয়ে বা গুণী নারী’ এবং ‘ভালো বউ’, যে তাঁর স্বামীর পরিবারের প্রতি সব সামাজিক দায়িত্ব ও কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করেন। দক্ষিণ এশীয় প্রেক্ষাপটে একজন নারীর জীবনে বিয়ে অনেক পরিবর্তন নিয়ে আসে। বিয়ের পরে কেবল তাঁর ঠিকানা নয়, তাঁর আনুগত্য স্বামী ও তাঁর পরিবারের দিকে নিয়ে যেতে হয়। পূর্বাপর গবেষণায় পণ্ডিতেরা দেখিয়েছেন যে ভালো বউ হওয়ার সবচেয়ে বড় গুণ হলো নিজেকে স্বামীর পরিবারে নিবেদন করা।৩৫ একক পরিবারে একজন গৃহিণীকে যখন বিচার করা হচ্ছে সংসার পরিচালনা ও ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় করার ব্যাপারে তিনি কতটা বুদ্ধি, দক্ষতা ও বিবেচনার পরিচয় দিচ্ছেন, যৌথ পরিবারে একজন ‘ভালো বউ’কে পরিমাপ করা হয় স্বামীর পরিবারের সদস্যদের প্রতি তাঁর ‘ভদ্রতা’, ‘দায়িত্ববোধ’ এবং ‘পরিচর্যা’র ওপর। নারীত্বের এই আদর্শে উদ্বুদ্ধ বাংলাদেশের অনেক নারীই জীবনের লক্ষ্য নিয়মনীতি মেনে একজন ‘আদর্শ বউ’ হওয়া। প্রগ্রেসিভ নারীবাদে যে ‘মুক্তি’ ও ‘স্বাধীনতার’ কথা বলা হয়, তা হয়তো এই নারীদের জীবনে নেই, কিন্তু নারী এর মধ্যেই তাঁর বিশেষ জায়গাটি খুঁজে পান।৩৬ ‘বাড়ির ভালো বা আদর্শ বউ’ হওয়ার ওপর জড়িত নারীর সঙ্গে তাঁর স্বামীর সম্পর্ক। যৌথ পরিবারে একজন পুরুষের সুনাম এবং সম্মান অনেকটাই প্রভাবিত হয় তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে তাঁর মা-বাবা ও পরিবারের অন্যদের সম্পর্ক কেমন, তার দ্বারা। অভিবাসী স্বামীর দেওয়া আর্থসামাজিক নিরাপত্তা ও সামাজিক অবস্থানের বিপরীতে যৌথ পরিবারে অবস্থানকারী স্ত্রী তাঁর স্বামীকে দিতে চান একটি নির্ঝঞ্ঝাট দাম্পত্য জীবন, যার পূর্বশর্ত হলো স্বামীর পরিবারের লোকজনের সঙ্গে মানিয়ে চলা এবং একজন ‘আদর্শ বউ’ হওয়া। সব নারী যে এতে সফল হন, তা নয়। যাঁরা ব্যর্থ হন, তাঁরা শ্বশুরবাড়ি থেকে আলাদা হয়ে নিজে সংসার গড়েন অথবা তাঁর মা-বাবার পরিবারে স্থানান্তরিত হতে হয়।

মিসরীয় নারীদের মসজিদভিত্তিক ইসলামি আন্দোলনের ওপর লেখা মাহমুদের নৃতাত্ত্বিক গবেষণায় তিনি দেখিয়েছেন যে নারী মৌলবাদ, নারীর অধস্তনতা, সামাজিক রক্ষণশীলতা ও সাংস্কৃতিক পশ্চাত্পদতা ইত্যাদিকে ব্যবহার (রহাড়শব) করে কীভাবে পুরুষনিয়ন্ত্রিত উপাসনালয়, মসজিদে ধর্মীয় আন্দোলন পরিচালনা করছেন। সেসব মিসরীয় নারীর সঙ্গে স্বামীর যৌথ পরিবারে রেখে যাওয়া বাংলাদেশি শ্রম অভিবাসীর স্ত্রীদের অনেক মিল খুঁজে পাওয়া যায়। দুই ক্ষেত্রেই নিয়মনীতিকে প্রত্যাখ্যান বা প্রতিহত করছে, এ রকম সুনির্দিষ্ট কোনো ‘নারীবাদী ইচ্ছেশক্তি’ কোনো বহিঃপ্রকাশ এখানে খুঁজে পাওয়া মুশকিল।৩৭ বরং তাঁদের অনেক কর্মকাণ্ডে মনে হয় ‘নারীর শোষণের হাতিয়ার’ হিসেবে ব্যবহূত হয় এমন বিষয়গুলোকে যেন নারীরা অবলম্বন করছেন।৩৮ দুই দেশের ক্ষেত্রেই উদার নারীবাদীরা হয়তো এসব নারীর ব্যবহারে পুরুষ শাসন নস্যাত্ করার উদ্যোগ আছে, এমন কোনো বহিঃপ্রকাশ বা উপাদান খুঁজে পাবেন না। তবে মাহমুদের মতো আমিও বলতে চাই যে যৌথ পরিবারে রেখে যাওয়া প্রবাসীর স্ত্রীদের ‘ক্ষমতা’ ও ‘ইচ্ছেশক্তি’কে সে দেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নিয়ম ও রীতির মধ্যে খুঁজতে হবে, যেখানে বাংলাদেশি নারী তাঁর ক্ষমতা পান একজন ‘আদর্শ স্ত্রী’ বা ‘ভালো বউ’ হওয়ার মধ্যে। উপরন্তু, মাহমুদ দেখিয়েছেন যে মিসরীয় নারীদের ধর্মচর্চার একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল হলো ‘নিয়ম আত্মস্থ করা বা নিয়মের মধ্যে বসবাস’।৩৯ মিসরীয় নারীরা যে ইসলামি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত, তা সাধারণত ‘নারীমুক্তি’র পক্ষে ক্ষতিকর বলেই বিবেচনা করা হয়। একইভাবে, বাংলাদেশি নারীরা যেভাবে পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার নিয়মগুলোকে পালন করতে পছন্দ করেন, তাতে আপাতদৃষ্টিতে তাদের ‘অধস্তনতাই’ প্রকাশ পায়। অথচ সত্যি বিষয়টি হলো, এ দুই ক্ষেত্রেই নারীরা ‘বাধ্য’ হওয়ার মধ্য দিয়েই পুরুষতান্ত্রিক নিয়মের সঙ্গে মোকাবিলা করেন। সুতরাং, নারীর ‘নমনীয়তা’ দিয়ে কখনোই তাঁর ‘জাগরণ বা মুক্তি’র প্রয়োজনীয়তাকে পরিমাপ করা যায় না।

যৌথ পরিবারে প্রবাসীর মা যে ভূমিকা পালন করেন, সেটি নিয়েও আলোচনার অবকাশ আছে। দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষাপটে নারীর জীবন, তাঁদের জেন্ডার ভূমিকা এবং পারিবারিক সম্পর্ক জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে পরিবর্তিত হয়। নারীত্ব সম্পর্কে যে আদর্শ তা নারীর বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এবং ‘মেয়ে’, ‘স্ত্রী’, ‘মা’ ইত্যাদি হিসেবে ভূমিকা পালন করার সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হয়। নৃতত্ত্ববিদ ল্যাম্বের মতে, নারী তাঁর জীবনের বিভিন্ন দশায় কর্তৃত্বকারী আত্মীয়তার সম্পর্ক ও জেন্ডার নিয়মগুলোকে সমালোচনা ও প্রতিরোধ করে থাকেন এবং এ সম্পর্কে বিভিন্ন রকম ব্যাখ্যা দিতে পারেন।৪০ এটা সত্যি যে বয়স হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিবারে নারীর অবস্থান ও গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। তবে তাতে যে নারী পরিবারের ভেতরে খুব ‘ক্ষমতাধর শাসক’-এ পরিণত হন, তা বলা যাবে না।৪১ মনপুর ও ঝুমপুরের ক্ষেত্রে বরং দেখেছি যে পরিবারের পুরুষ আত্মীয়দের ওপরে নির্ভরশীলতা বয়স্ক নারীর ক্ষমতাকে অনেকাংশে খর্ব করে। প্রবাসীর বিধবা মায়েদের দেখেছি সারা বছরের খাবার কেনা, জমি ক্রয়-বিক্রয়, ঋণ দেওয়া-নেওয়া ইত্যাদির জন্য তাঁদের বাবার বাড়ির সাহায্য নিতে। তবে পুত্রবধূর সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক সব সময়ই পুরুষ শাসকদের সঙ্গে তাঁদের নির্ভরশীলদের মতোই অসমান।

বাবার বাড়িতে বসবাসকারী শ্রম অভিবাসীর স্ত্রীর ক্ষমতা ও শক্তি

স্বামীর একক বা যৌথ পরিবারে বসবাসরত স্ত্রীদের তুলনায় বাবার বাড়িতে অবস্থানকারী শ্রম অভিবাসী স্ত্রীরা তাঁদের কল্যাণ নিশ্চিত করার জন্য অধিকতর যৌক্তিক ও কৌশল বৃদ্ধির সুযোগ পান। স্বামীর অবর্তমানে কোথায় বসবাস করবেন, এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা এবং অন্যকে করানোর মধ্যেই এসব নারীর ক্ষমতা ও শক্তির উত্স খুঁজে পাওয়া যায়। ‘গ্রামের মেয়ে’ (গ্রামে জন্ম, বড় হওয়া বা মা-বাবার সূত্রে গ্রামের সঙ্গে সম্পৃক্ত) হিসেবে সামাজিক ভাবমূর্তি এবং বিবাহপূর্ব জীবনে প্রতিবেশীর সঙ্গে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গ্রামে মেয়েদের চলাফেরা ও জীবনযাপনে স্বাধীনতা দেয়। অন্যভাবে বলতে গেলে, বাবার বাড়িতে থাকা নারী, স্বামীর যৌথ পরিবারে থাকা নারীর তুলনায় অধিক স্বাধীনতা ও সমর্থন পেয়ে থাকেন। গ্রোভারের মতে, ‘বাবার বাড়ির সমর্থন কোনো নারীর জন্য অর্থ উপার্জনের ক্ষমতার চেয়েও বড় দর-কষাকষির অস্ত্র, কেননা নারীকে এটি এমন একটি পরিবেশে বসবাসের গ্যারান্টি দেয়, যেখানে নারীর একা থাকাটা সামাজিকভাবে স্বীকৃত নয়।৪২ ইতিপূর্বে আলোচিত রেবেকা বা পারুলের জীবন অনেক কঠিন হতো, যদি তাঁদের বাবার বাড়ির সমর্থন ও সাহায্য না থাকত। বাবার বাড়ির আশ্রয় ও সাহায্য প্রবাসী স্বামীর স্ত্রীদের জন্য এক পরম প্রাপ্তি। এ সাহায্য পাওয়ার মতো পরিবেশ সৃষ্টি করাতেই এসব নারীর ক্ষমতা ও শক্তি নিহিত। মাহমুদের ভাষায়, ‘স্বনির্ধারিত লক্ষ্য ও পছন্দ তৈরি ও গ্রহণ করানোর জন্য নারীর অপেক্ষাকৃত বৃহত্তর মুক্তির পথ প্রণয়নেই’ এসব নারীর ক্ষমতা।৪৩

প্রবাসীর কর্মজীবী স্ত্রীদের ক্ষমতা ও শক্তি

প্রবাসীর কর্মজীবী স্ত্রীদের যে কেসগুলো আলোচনা করা হয়েছে, তাতে একটি বিষয় স্পষ্ট যে নারী সব সময় পুরুষের কর্তৃত্বের কাছে আনত হন না। পুরুষশাসিত সমাজের নিয়মনীতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া এবং তাকে প্রতিহত করার কৌশল অবলম্বন—এ দুয়ের মধ্য দিয়েই নারী অবস্থা মোকাবিলা করে থাকেন। ঝুমপুর গ্রামে রেখে যাওয়া প্রবাসী হাফিজের স্ত্রী শাপলা নামের যে মেয়েটির কাহিনি এ প্রবন্ধে উপস্থাপন করা হয়েছে, তাতে প্রতীয়মান হয় যে নারীর প্রতিদিনের জীবন কঠিন বাস্তবতায় ভরা, যেখানে পরস্পরবিরোধী ধারণা/জ্ঞান  বা নিয়মনীতির চর্চা করা হয়। যে সমাজ নারীদের বাইরে চাকরি করাকে সুনজরে দেখে না, সে সমাজে থেকেও শাপলা একদিকে স্বামীর অবর্তমানে স্কুলে চাকরি করার মতো দুঃসাহস দেখিয়েছেন। অন্যদিকে পরিবারের দেখভাল করার বিষয়েও তিনি যথেষ্ট মনোযোগী, সমাজ যেটা মেয়েদের প্রধান কাজ বলে মনে করে। প্রকৃতপক্ষে, শাপলার কেসটি নির্দেশ করে, কীভাবে গ্রামের কর্মজীবী নারী নিত্যপ্রয়োজন এবং জেন্ডার বিষয়ে সামাজিক নিয়মের মধ্যে একটা ভারসাম্য রক্ষা করে চলেন। গ্রামীণ বাংলায় নারীদের বিষয়ে সামাজিক রীতিনীতিকে না ভেঙেও কীভাবে ঘরে বসে অর্থকরী কাজে নিযুক্ত হওয়া যায়, তার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে নাজমা। বাড়ির বাইরে এসে কর্মক্ষেত্রে অনাত্মীয় পুরুষের সঙ্গে মেলামেশা করাটা বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজ নারী ও পরিবারের জন্য অবমাননাকর বলে মনে করে।

ঢাকা ও লন্ডনে বাংলাদেশি নারীদের শ্রমবাজার বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে কী বিষয়গুলো কাজ করে, সে সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে কবীর বলেছেন যে ঢাকার মেয়েরা যেখানে বাড়ির বাইরে পোশাক কারখানায় কাজ করাটি সামাজিকভাবে আইনসিদ্ধ করার জন্য ‘পর্দা’কে দর-কষাকষির একটি হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছে, লন্ডনে বসবাসরত বাংলাদেশি মেয়েরা এই ‘পর্দা’ রক্ষা করার জন্য কারখানার কাজের বদলে ‘ঘরে বসে করা যায়’ এমন কাজ বেছে নিয়েছেন। পরিবর্তিত সামাজিক নিয়ম ও মূল্যগুলো ঢাকায় তৈরি পোশাক কারখানাগুলোকে ‘নারীর স্থান’ হিসেবে চিহ্নিত করলেও লন্ডনের শ্রমবাজার বাংলাদেশি নারীর জন্য একটি নিষিদ্ধ স্থান। এর ভিত্তিতে কবীর মন্তব্য করেছেন যে বাংলাদেশে তৈরি পোশাক কারখানায় কাজ করা মেয়েদের জীবিকা বাছাই করার ক্ষমতা ‘পশ্চিমা দেশে’ অবস্থানরত বাংলাদেশিদের স্ত্রীর তুলনায় বেশি।৪৪

কবীরের গবেষণার নারীদের সঙ্গে আমার গবেষণায় প্রবাসীর দেশে রেখে যাওয়া স্ত্রীদের অনেক মিল খুঁজে পাওয়া যায়। দুই গবেষণাতেই ‘পর্দাপ্রথা’ নারীর সামাজিক নিয়মের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর একটি মাধ্যম হিসেবে এসেছে। উদার নারীবাদে যদিও পর্দাকে ধরা হয় পুরুষশাসিত সমাজে নারীকে অধস্তন ও অক্ষম করে রাখার একটি হাতিয়ার হিসেবে; প্রকৃতপক্ষে, আমার গবেষণার গ্রামে যেমনটি দেখেছি, নারী পর্দাকে ব্যবহার করছে ইচ্ছেশক্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে।

যৌথ পরিবারে বসবাসরত প্রবাসী স্ত্রীদের প্রসঙ্গে আগে উল্লেখ করা হয়েছে নিয়মরীতিকে ভাঙা বা প্রতিহত করা হলো নারীর ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগের একটিমাত্র বহিঃপ্রকাশ, অন্যটি হলো নিয়মরীতিগুলোকে আয়ত্ত করা।৪৫ অনেক সময় নারী নিয়ম মেনে চলার মধ্যেই তার ইচ্ছেশক্তি অর্জন করে, উদার নারীবাদে যাকে হয়তো নারীর স্বার্থবিরোধী মনে হতে পারে।

ওপরের আলোচনায় একটি বিষয় ইঙ্গিত করে, সেটা হলো নারীর ওপর পুরুষের শ্রম অভিবাসনের প্রভাব যেমন জটিল ও বহুমুখী, তেমনি ‘আদর্শ নারী’ কিংবা ‘নারীর জীবনের লক্ষ্য বা মূল্য’ কী হবে, তার কোনো সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই। অবশ্য একটি বিষয় অনস্বীকার্য যে পুরুষশাসিত সমাজের অনেক নিয়মকানুন ও মূল্যবোধ নারীর জীবনকে নেতিবাচকভাবে নিয়ন্ত্রণ এবং শৃঙ্খলাবদ্ধ করতে চায়, অনেক নারীই তাঁর শিকার হয়। তবে এ ধরনের শোষণ থেকে মুক্তির জন্য যে নারী তার প্রতিদিনের ব্যবহারে সমালোচনা, পুনর্ব্যাখ্যা বা প্রতিহত করার ভেতর দিয়ে ‘প্রাত্যহিক প্রতিঘাত’ রচনা করছেন, এমন ব্যাখ্যাও আসলে ভুল।৪৬ প্রতিহত করা নিয়ে যে প্রবল ‘ভাবাবেগ’তা উদার নারীবাদী ধারণার বাইরে নারীর ক্ষমতা ও ইচ্ছেশক্তিকে ব্যাখ্যা করা বা দেখার দৃষ্টিকে নষ্ট করে দেয়।৪৭

প্রকৃতপক্ষে, পুরুষ শ্রম অভিবাসনে নারীর জীবনের যে চিত্র এখানে উপস্থাপিত হলো, তাতে আমরা দেখি যে নারীকে নিয়ন্ত্রণকারী রীতিনীতি এবং তার প্রয়োগকে নারী কখনো নস্যাত্ করেছেন, কখনো জোরদার করেছেন আবার কখনো বা পুনঃসমন্বয় করেছেন। এটা প্রতীয়মান যে এসব নারীর জীবনে ‘ক্ষমতা’ আসলে প্রবাহিত হতে থাকে সমাজের দেহজুড়ে, যেখানে নারীর প্রতিনিয়ত গভীর চেষ্টা থাকে একজন ‘ভালো গৃহিণী’, ‘ভালো পুত্রবধূ, অথবা ‘ভালো কর্মজীবী নারী, যিনি কাজ ও সমাজের মধ্যে সমন্বয় করতে পারবেন’, তা হওয়ার।৪৮ একক পরিবারের প্রধান নারীর ‘ক্ষমতা’ যেখানে দেখি স্বামীর অবর্তমানে সংসারের দেখভাল করার মধ্যে এবং প্রচলিত জেন্ডার নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে সংসারের নিত্যকর্ম সম্পাদন, যৌথ পরিবারে রেখে যাওয়া প্রবাসীর স্ত্রীর শক্তি খুঁজে পাওয়া যায় তাঁর স্বামীর পরিবারে একজন ‘ভালো পুত্রবধূ’ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করা ও সুনাম অর্জনের মধ্যে। এই সুনাম নারীর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ, যা ব্যবহার করে স্ত্রী তাঁর স্বামীর সমর্থন ও পরিবারের মধ্যে ভালো একটি অবস্থান পেতে পারে। আবার কর্মজীবী নারীর ক্ষমতা ও শক্তি দেখা যায় প্রচলিত জেন্ডার নিয়মগুলোকে প্রতিহত ও আয়ত্ত করার মধ্যে। এককথায় বলা যায়, অভিবাসন নতুন ক্ষমতার সম্পর্ক তৈরির একটি হাতিয়ার, যেখানে নারীর অধস্তনতা সৃষ্টিকারী নিয়ম ও চর্চাগুলোই আবার নারীকে একজন সচেতন ব্যক্তি হিসেবে বিকশিত হতে সাহায্য করে।৪৯

উপসংহার

এ প্রবন্ধে বাংলাদেশি অভিবাসী শ্রমিকের দেশে রেখে যাওয়া নারীর গ্রামীণ জীবনকে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এখানে আমি দেখিয়েছি যে স্বামীর অবর্তমানে স্ত্রীর একক, যৌথ বা বাবার পরিবারে থাকার ব্যবস্থা এবং সে বিশেষ পরিবেশে বিভিন্ন কৌশল নিয়োগ করার ওপর তাঁর জীবনযাপন পদ্ধতি, সাংসারিক দায়দায়িত্ব এবং জেন্ডার নীতির প্রতি সম্পৃক্ততা বা অসম্পৃক্ততার মাত্রা নির্ভর করে। স্বামীর যৌথ পরিবার বা মা-বাবার পরিবারে রেখে যাওয়া নারীর তুলনায় একক পরিবারের দায়িত্বে থাকা নারীর বিদেশ থেকে প্রেরিত অর্থের ওপর অপেক্ষাকৃত বেশি দখল থাকে এবং সাংসারিক কাজে বেশি স্বাধীনতা থাকে, কিন্তু একই সঙ্গে তাঁদের সাংসারিক দায়িত্ব অনেক বেশি পালন করতে হয়। একইভাবে, শ্বশুরবাড়িতে থাকা নারীরা সামাজিকভাবে বেশি মর্যাদা পেলেও স্বামীর পাঠানো টাকার ওপর তাঁদের নিয়ন্ত্রণ কম থাকে। আবার মা-বাবার পরিবারে অপেক্ষাকৃত স্বাধীনভাবে অবস্থানরত স্ত্রীদের তুলনায় ‘ভালো পুত্রবধূ’ হওয়ার দায়টা যৌথ পরিবারের স্ত্রীদের ওপর অনেক বেশি। গ্রামীণ বাংলাদেশে বিয়ের পর মেয়েরা সাধারণত স্বামীর বাড়িতে স্থানান্তরিত হয় এবং বাবার বাড়ি অনেকটা ‘পর’ হয়ে যায়। কিন্তু এ গবেষণায় দেখা গেল যে স্বামীর শ্রম অভিবাসন অনেক সময় স্ত্রীকে তাঁর মা-বাবার কাছাকাছি নিয়ে আসে।

পুরো প্রবন্ধে আমি নারীজীবনকে এঁকেছি উদার নারীবাদী ধারণার ঊর্ধ্বে। উদার নারীবাদ বিশ্বাস করে যে পৃথিবীর সব নারীর কর্তৃত্বের সম্পর্ক থেকে মুক্তির প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু এ ধারণা ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে থাকা নারীর সত্যিকার অবস্থানকে সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে পারে না। মাহমুদের গবেষণার ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের এ কেসটি জেন্ডার ও অভিবাসনের বৃহত্তর ধারণার ভেতরে তুলে ধরার পেছনে আমার মূল উদ্দেশ্য হলো এটা দেখানো যে অনুদার সমাজব্যবস্থায় থাকা অনেক নারীর জীবনে চর্চিত ক্ষমতা ও শক্তিকে কেবল ‘ক্ষমতায়ন’ বা ‘জাগরণ’-এর কাঠামোয় অনুধাবন করা সম্ভব নয়। গ্রামীণ বাংলাদেশি নারীদের চাহিদা ও পছন্দকে তাঁদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে আলোচনা করে আমি দেখিয়েছি যে বাংলাদেশি গ্রামীণ নারীর জীবনের বিশেষ আদর্শ আছে, যেটা তাঁরা অর্জন করতে সব সময় তত্পর। জীবনকে তাঁরা যেভাবে দেখেন, তা উদার নারীবাদে হয়তো অনুপযোগী ও অর্থহীন মনে হতে পারে, কিন্তু আলোচ্য নারীদের জীবনে এর বিপুল সামাজিক ও সাংস্কৃতিক তাত্পর্য আছে। প্রকৃতপক্ষে, আপন সংস্কৃতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নিয়মনীতি মেনে চলে গ্রামীণ বাংলায় শ্রম অভিবাসীর স্ত্রীরা এক অন্য ধরনের ‘ক্ষমতা’র চর্চা করেন, যা তাঁদের অস্তিত্বের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

তথ্যসূত্র

1.      Leela Gulati, In the Absence of their Men: the Impact of Male Migration on Women (New Delhi: Sage Publication, 1993).

2.     Amina Maharjan, Siegfried Bauer, and Beatrice Knerr, “Do Rural Women Who Stay Behind Benefit From Male Out-Migration? A Case Study in the Hills of Nepal,” Gender, Technology and Development 16:1 (March 2012), pp. 95-123.

3.     Amrita Datta and Sunil K. Mishra, “Glimpses of Women’s Lives in Rural Bihar: Impact of Male Migration,” The Indian Journal of Labor Economics 54:3 (January 2011), pp. 457-477.

4.     Sonalde Desai and Manjistha Banerji, “Negotiated Identities: Male Migration and Left-Behind Wives in India,” Journal of Population Research 25:3 (October 2008), pp. 337-355.

5.     Katy Gardner, Global Migrants, Local Lives: Travel and Transformation in Rural Bangladesh (Oxford: Clarendon Press, 1995), pp. 98-127.

6.     Ibid.

7.     Shahzada M. Akram and Khandaker R. Karim, Security and Empowerment: The Case of Left Behind Wives of Bangladeshi Migrant Workers (Dhaka: Bangladesh Freedom Foundation, 2004).

8.     Ibid., p. 105.

9.     For a wider discussion see Sarah C. White. Arguing with the Crocodile: Gender and Class in Bangladesh. (London: Zed Books, 1992), p.158.

10.     See Jane Parpart, Shirin Rai, Kathleen Staudt, eds., Rethinking Empowerment: Gender and Development in a Global/Local World, Vol. 3 (London: Routledge, 2002).

11.     See for example Lila Abu-Lughod, Veiled Sentiments: Honor and Poetry in a Bedouin Society (Berkeley: University of California Press, 1999 (1986)); Chandra T. Mohanty, Feminism without Borders: Decolonizing Theory, Practicing Solidarity (New Delhi: Zubaan, 2003).

12.     Steven Lukes, Power: A Radical View (London: Macmillan, 1974), pp 23-24, cited in Stewart R. Clegg, Frameworks of Power (London: Sage Publications Limited, 1989).

13.     For a wider discussion on post-structural construction of ‘power’ see Michel Foucault, The History of Sexuality Vol. 1 (London: Pelican, 1981); Michel Foucault, “Truth and Power” in Power/Knowledge: Selected Interviews and Other Writings 1972-1977, ed. Colin Gordon (Brighton: Harvester Press, 1980), pp.122-128.

14.     Foucault, The History of Sextuality.

15.     Saba Mahmood, Politics of Piety: The Islamic Revival and the Feminist Subject (Princeton: Princeton University Press, 2011 (2005)), pp. 14-15. Italics in the original.

16.     See Jitka Kotalová, Belonging to Others: Cultural Construction of Womenhood in a Village in Bangladesh (Dhaka: University Press Ltd, 1996); Santi Rozario, Purity and Communal Boundaries: Women and Social Change in a Bangladeshi Village (Dhaka: University Press Limited, 2001 (1992)).

17.     Syeda Rozana Radhid, Uncertain Tomorrows: Livelihood and Social Protection in International Labor Migration from Bangladesh (Dhaka: University Press Limited 2014) (forthcoming).

18.     I have used pseudonyms for the villages and respondents in order to maintain confidentiality.

19.     Kirin Narayan, “How Native is a ‘Native’ Anthropologist,” American Anthropologist 95:3 (September 1993), p. 678.

20.     See, Mohammad A. Hossain, Inflation, Economic Growth and the Balance of Payments in Bangladesh: A Macroeconomic Study (New Delhi: Oxford University Press, 1995), Chapter 2.

21.     Government of Bangladesh (GoB), Year Book 2011 (Dhaka : Bangladesh Bureau of Statistics, 2011).

22.     Tasneem Siddiqui and Selim Reza, Labor Migration from Bangladesh 2013: Achievements and Challenges (Dhaka: RMMRU and MJF, 2014).

23.     Ibid.

24.     Time to offer Morning Prayer. Usually this is at 5 o’clock in the morning.

25.     Author’s interview with Marium, Jhumpur village, Comilla, August 23, 2005

26.     See Alain Lefebvre, Kinship, Honour and Money in Rural Pakistan: Subsistence Economy and the Effects of International Migration (Richmond: Curzon Press, 1999), pp. 257-258.

27.     Author’s interview with Firoza, wife of a migrant from Monpur, village, Comilla, February 17, 2006.

28.     Author’s interview with Rebecca, Monpur village, September 20, 2005.

29.     For further discussion see Sylvia Vatuk, Kinship and Urbanization: White Collar Migrants in North India (Berkeley: University of California Press, 1972), p. 147.

30.     Informal conversation with Shapla of Jhumpur village, November 18, 2005. She was also my research assistant.

31.     See Ranjana Kumari, Women-Headed Households in Rural India (London: Sangam, 1989), p. 37.

32.     Lukes, Power: a Radical View; Foucault, The History of Sexuality, and Foucault, “Truth and Power.”

33.     Lukes, Power: a Radical View; Foucault, The History of Sexuality, and Foucault, “Truth and Power.”

34.     Akram and Karim, Security and Empowerment, p. 105.

35.     See Kotalova, “Belonging to Others,” p. 19-20; Betsy Hartmann and James K. Boyce, A Quiet Violence: View from a Bangladesh Village (Dhaka, University Press Limited, 1983). Pp. 88-91.

36.     See for example Sherry B. Ortner and Harriet Whitehead, eds., Sexual Meanings (Cambridge: Cambridge University Press, 1981)

37.     Mahmood, Politics of Piety, pp.5-8.

38.     Ibid, p. 15.

39.     See Sarah Lamb, White Saris and Sweet Mangoes: Aging, Gender, and Body in North India (Berkeley: University of California Press, 2000); Katy Gardner, Age, Narrative and Migration: The Life Course and Life Histories amongst Bengali Elders (London: Berg, 2002).

40.     Lamb, “White Saris and Sweet Mangoes,” p.198.

41.     Ibid., p. 242.

42.     Shalini Grover, Poor Women’s Experiences of Marriage and Love in the City of New Delhi: Everyday Stories of Sukh aur Dukh. Unpublished DPhil Thesis (Brighton, University of Sussex, 2006) p. 63.

43.     Mahmood, Politics of Piety, p. 10.

44.     See Naila Kabeer, The Power to Choose: Bangladeshi Women and Labor Market Decisions in London and Dhaka (London:Verso, 2000).

45.     Mahmood, Politics of Piety, p. 15.

46.     See for example Gloria G. Raheja, and Ann G. Gold. Listen to the Heron’s Words: Reimagining Gender and Kinship in North India (Berkeley, University of California Press, 1994).

47.     Lila Abu-Lughod, “The Romance of Resistance: Tracing Transformations of Power through Bedouin Women,” American Ethnologist 17: 1 (February 1990), p. 42.

48.     See Michel Foucault, Discipline and Punish: The Birth of the Prison (Harmondsworth: Penguin, 1979 (1975)).

49.     Mahmood, Politics of Piety, p. 17.