সারসংক্ষেপ
কয়েক দশক ধরে বিশ্বজুড়ে সমাজবিজ্ঞানী ও নীতিনির্ধারকদের অন্যতম আলোচনার বিষয় হচ্ছে সেক্যুলারিজম। বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকেই নানাভাবে সেক্যুলারিজম নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক নানা পরিবর্তন চলমান এই আলোচনায় যোগ করছে নতুন নতুন মাত্রা ও বৈচিত্র্য। সেক্যুলারিজম নিয়ে অতিসরলীকৃত ব্যাখ্যা এবং গভীর বিশ্লেষণ উভয়ই বিদ্যমান। সুতরাং এটা দাবি করা যায় যে, সেক্যুলারিজম বৈচিত্র্যহীন একক কোনো বিষয় নয়। মতাদর্শ এবং রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে এর বিভিন্ন ধরন আছে এবং এটি একটি বিতর্কিত এবং বিতর্কযোগ্য বিষয়। এসব বিষয় মাথায় রেখে এই প্রবন্ধে সেক্যুলারিজম ধারণাটির বিভিন্নমুখী দৃষ্টিভঙ্গির একটি সমালোচনামূলক আলোচনা হাজির করা হয়েছে। একই সাথে সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে সেক্যুলারিজম ধারণাটির রূপান্তরসমূহ, রাষ্ট্রপরিচালনার নীতি হিসেবে সেক্যুলারিজমের ধারণাগুলো এবং অপশ্চিমা সমাজগুলোতে রাষ্ট্র ও সেক্যুলারিজমের মধ্যকার সম্পর্ক বিশ্লেষণ করা হয়েছে। রাষ্ট্রপরিচালনার নীতি হিসেবে সেক্যুলারিজমকে বিশ্লেষণ করার ক্ষেত্রে ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে ‘সেক্যুলার রাষ্ট্রের’ চারটি মডেলের উদ্ভব হয়েছে। এগুলোকে সাধারণভাবে ফরাসি, ব্রিটিশ, আমেরিকান এবং ভারতীয় মডেল হিসেবে অভিহিত করা হয়। এই মডেলগুলো সংক্ষিপ্তাকারে বর্ণনা করা হয়েছে।
মুখ্য শব্দগুচ্ছ
সেক্যুলারিজম, সেক্যুলারকরণ, ধর্ম এবং রাজনীতি, জনপরিসর ও ব্যক্তিপরিসর।
বিশ্বজুড়ে কয়েক দশক ধরে ধারণা, প্রপঞ্চ, বিশ্ববীক্ষা এবং রাষ্ট্রপরিচালনার ধরন হিসেবে সেক্যুলারিজম সমাজবিজ্ঞানী এবং নীতিনির্ধারকদের গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। আক্ষরিক এবং রূপক—দুই অর্থেই অত্যুত্সাহী প্রবক্তারা এবং কঠোর বিরোধীরা সেক্যুলারিজম নিয়ে লড়াইয়ে লিপ্ত আছেন। বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকেই সেক্যুলারিজমের মান-নির্ণায়ক (বা নরমেটিভ) এবং প্রায়োগিক (ইম্পিরিকাল) দিক, এর শক্তি ও দুর্বলতা, এর অতীত ও ভবিষ্যত্ নিয়ে বিতর্ক চলছে। নির্দিষ্ট জাতীয় অভিজ্ঞতা এই বিতর্কগুলোকে শুধু প্রভাবিতই করছে তা নয়, কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিতর্কগুলোর রূপ ও মাত্রাও নির্ধারিত হচ্ছে এসব অভিজ্ঞতা দিয়ে। বৈশ্বিক রাজনীতির দৃশ্যপটের রূপান্তর, বিভিন্ন রাষ্ট্রে দৈনন্দিন রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন, বেশ কিছু রাষ্ট্রে গণতন্ত্রায়ণ-প্রক্রিয়ার সূচনা, রাজনীতি এবং জনপরিসরে (বা পাবলিক স্ফেয়ারে) ধর্মের ক্রমবর্ধমান প্রভাব এবং অনেকগুলো ইউরোপীয় রাষ্ট্রের জনসংখ্যার পরিবর্তন ইত্যাদি সেক্যুলারিজম বিষয়ক আলোচনাকে সবার সামনে নিয়ে এসেছে। এর আরও কারণ রয়েছে। সমাজবিজ্ঞানে নতুন নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, যা প্রচলিত প্রথাগত পাণ্ডিত্যকে চ্যালেঞ্জ করছে, এর একটি অন্যতম কারণ। আমরা এও দেখেছি যে গত কয়েক দশকে ধর্ম বিষয়ে বিদ্যায়তনে, গবেষণা প্রতিষ্ঠানে উত্সাহ, আলোচনা, গবেষণা বৃদ্ধি পেয়েছে; সেক্যুলারিজম বিষয়ক আলোচনায় তা সমানভাবে প্রযোজ্য। এসব বিষয়ে সারা বিশ্বেই গণমাধ্যমে অতিসরলীকৃত মন্তব্য ও আলোচনা সহজেই লক্ষণীয়; রাষ্ট্র ও রাজনীতির নীতিনির্ধারকদের মধ্যেও রয়েছে অতিসরলীকৃত ব্যাখার প্রতি পক্ষপাত। কিন্তু আশার বিষয় হচ্ছে, একই সঙ্গে গভীর বিশ্লেষণও প্রকাশিত হচ্ছে এবং সেগুলোও জনমনে, উত্সাহীদের মধ্যে ছাপ ফেলতে সক্ষম হচ্ছে। বাংলাদেশে সেক্যুলারিজম কোনো অপরিচিত বিষয় নয়; সংবিধানে এবং রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনায় তার উপস্থিতি সহজেই চোখে পড়ে। কিন্তু ধারণা হিসেবে সেক্যুলারিজমকে তীক্ষভাবে খতিয়ে দেখার ধারা, বিশেষত নতুন বিতর্কগুলোর আলোকে এবং সমাজ ও রাজনীতিতে এই নতুন চিন্তার প্রভাব বিষয়ে আলোচনার ধারা খুব একটা শক্তিশালী নয়।
সেক্যুলারিজম বিষয়ক আলোচনা খুব সহজ নয়, বলা যায় সমস্যায় আকীর্ণ। আবেগপ্রসূত এবং বিতর্কযোগ্য কথাবার্তা থেকে এই আলোচনাকে দূরে রাখা যেমন দুরূহ, তেমনি দুরূহ হচ্ছে বিদ্যমান দুই দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করা। বিদ্যমান দুই দৃষ্টিভঙ্গি বলতে আমি বোঝাচ্ছি সেক্যুলারিজমকে একটি সর্বজনীন মতবাদ হিসেবে দেখার ধারা এবং কনসেপ্ট হিসেবে এর বৃহত্তর দিককে অবজ্ঞা করে প্রেক্ষাপট ও নির্দিষ্ট দেশ-কালকে মাত্রাতিরিক্ত গুরুত্ব দেওয়া। এই দুই দৃষ্টিভঙ্গির কোনোটিই এককভাবে এই বিষয়ের প্রতি সুবিবেচনা করতে পারে না, বিষয়টিকে বিচক্ষণতার সঙ্গে তুলে ধরতে পারে না।
এসব বিষয় মাথায় রেখে আমি আমার জন্য একটি সুনির্দিষ্ট এবং সীমিত লক্ষ্য নির্ধারণ করেছি; তা হলো সেক্যুলারিজম ধারণাটির বিভিন্নমুখী দৃষ্টিভঙ্গির একটি সমালোচনামূলক আলোচনা হাজির করা। এটা ধরে নিয়ে আমাদের আলোচনা শুরু করা দরকার যে সেক্যুলারিজম একটি বিতর্কিত ও বিতর্কযোগ্য বিষয়। বিশেষত, আমাদের অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে ‘সেক্যুলারিজম ঐতিহাসিকভাবে একটি পরিবর্তনশীল বিষয়, যার উদ্ভবের একটি বৈচিত্র্যময় ইতিহাস রয়েছে’।১ সম্ভবত আমাদের প্রত্যেককে এটা মেনে নিতে প্রস্তুত থাকতে হবে যে ধর্ম ও রাজনীতির মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক সম্পর্ক যেমন বিভিন্ন রকমের হতে পারে, তেমনি সেক্যুলারিজম শব্দটির অর্থ কী হবে সে বিষয়েও আলোচনা এবং পুনঃআলোচনা হতে পারে। এর জন্য প্রত্যেককে একটি বিষয় কাটিয়ে উঠতে হবে, যেটাকে ইয়ুর্গেন হাবারমাস বর্ণনা করেছেন ‘সংকীর্ণ সেক্যুলারপন্থী সচেতনতা’২ হিসেবে।
সেক্যুলারিজম এবং সেক্যুলারকরণ কী?
সেক্যুলারিজম বিষয়ে সবচেয়ে প্রচলিত ধারণা হচ্ছে, এটি রাষ্ট্র ও ধর্মের মধ্যকার সম্পর্ক কী হবে সেই বিষয়ে একটি মতাদর্শগত কাঠামো প্রদান করে। এই প্রচলিত ধারণার অর্থ হচ্ছে যে সেক্যুলারিজম এমন সব প্রতিষ্ঠান তৈরি করবে যেগুলো ধর্ম ও রাজনীতি বিষয়ে সবার মতৈক্যের বাস্তবায়ন করবে এবং ধর্ম ও রাষ্ট্রের পৃথক্করণ বজায় রাখবে। এই মতাদর্শিক কাঠামোর মধ্যে এটা ধরে নেওয়া হয় যে, ‘সেক্যুলার যুক্তির কারণে রাজনৈতিক জীবন থেকে ধর্মকে বাদ দেওয়া উচিত’; ‘ধর্মীয় যুক্তির ভিত্তিতে বা ধর্মীয় উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে রাষ্ট্রের সক্রিয় হওয়া উচিত নয়’ এবং ‘ধর্মীয়ভাবে অনুপ্রাণিত ব্যক্তিবর্গ এবং গোষ্ঠীর ততক্ষণ পর্যন্ত রাজনৈতিক বিষয়ে অংশগ্রহণ করা উচিত নয় যতক্ষণ না পর্যন্ত তারা তাদের ধর্মীয় প্রত্যয় ত্যাগ করে সেক্যুলার বিবেচনার ওপর নির্ভর করতে প্রস্তুত হচ্ছেন’।৩ সেক্যুলারিজমের একটি অন্যতম পুরোনো সংজ্ঞা পাওয়া যায় জর্জ জ্যাকব হোলিওক থেকে; তাঁকে এই শব্দটির জনক বলেই বর্ণনা করা হয়ে থাকে। ১৮৫১ সালে, হোলিওক তাঁর বই দ্য প্রিন্সিপলস অব সেক্যুলারিজম-এ সেক্যুলারিজমকে সংজ্ঞায়িত করেন:
সেক্যুলারিজম হচ্ছে বস্তুবাদী উপায়ে মানবকল্যাণ বাড়ানো, উপযোগবাদী ধারায় মানবকল্যাণকে পরিমাপ করা এবং অন্যের সেবা করাকে জীবনের কর্তব্যে পরিণত করার জ্ঞান। সেক্যুলারিজম মানুষের বর্তমান অস্তিত্ব, এমন সব বিষয় এবং কাজের সঙ্গে যুক্ত যেগুলোকে জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে যাচাই করা যায়। এর লক্ষ্য হচ্ছে সমাজের মুখ্য কর্তব্য হিসেবে মানুষের শারীরিক, নৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তির সম্ভাব্য সর্বোচ্চ মাত্রার উন্নয়ন বিধান করা; আস্তিকতা, নাস্তিকতা বা খ্রিষ্টধর্মের বাইরে প্রাকৃতিক নৈতিকতার ব্যবহারিক পর্যাপ্ততার বিষয়টি মনের মধ্যে দৃঢ়ভাবে স্থাপন করা।৪
এরপর থেকে সংজ্ঞাটি পরিবর্তিত হয়েছে; কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে এর সংজ্ঞাটিতে এখন আর কোনো অস্পষ্টতা নেই। শব্দটির বহুল ব্যবহার সত্ত্বেও চার্লস টেইলর উপসংহার টেনেছেন এই বলে যে, ‘সেক্যুলারিজম দ্বারা কী বোঝায় তা [এখনো] সম্পূর্ণভাবে স্পষ্ট নয়’।৫ যেহেতু তিনটি ভিন্ন জ্ঞানের ধারায়, অর্থাত্ দর্শন, সমাজতত্ত্ব এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানে—সেক্যুলারিজম পঠনপাঠন করা হয়, তাই এই ধারণার সঙ্গে তিনটি ভিন্ন ব্যাখ্যা সাধারণভাবে প্রচলিত আছে। দার্শনিকভাবে এই বিষয়টিকে অতীন্দ্রিয়বাদ এবং অধিবিদ্যাকে বাতিল করে অস্তিত্ববাদ এবং অভিজ্ঞতাবাদের গ্রহণ হিসেবে দেখা হয়। সমাজতাত্ত্বিকভাবে এই ধারণা দিয়ে জনজীবন এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর ধর্মের প্রভাবের হ্রাস নির্দেশ করা হয়। রাজনৈতিকভাবে এটাকে ব্যক্তিগত (প্রাইভেট) এবং জনপরিসরের (পাবলিক স্ফেয়ারের) পৃথক্করণ হিসেবে দেখা হয়, যা ধর্ম ও রাষ্ট্রের পৃথক্করণ নির্দেশ করে। এগুলোই হচ্ছে সেক্যুলারিজম ধারণাটির সবচেয়ে প্রচলিত ব্যাখ্যা।৬ এই ব্যাখ্যাগুলো একটি আরেকটি থেকে বিচ্ছিন্ন বলা যাবে না, বরং সবগুলো মিলিয়েই একটি রাজনৈতিক মতবাদ হিসেবে সেক্যুলারিজমের পরিচিতি। যেকোনো রাজনৈতিক মতবাদ তৈরি হয় বিরাজমান ব্যবস্থা বা ধারণায় যখন অপূর্ণতা, অসংগতি বা ত্রুটি আছে বলে মনে করা হয়। সেক্যুলারিজম তার ব্যতিক্রম নয়। সেক্যুলারিজমের ধারণার উদ্ভবের ক্ষেত্রে ধর্মকে ওই অপর্যাপ্ততা হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। এটাও মনে রাখতে হবে যে কোনো রাজনৈতিক মতবাদই সমাজের ক্ষমতা সম্পর্ক থেকে মুক্ত নয়। সেক্যুলারিজমের জ্ঞানভাষ্য বা ডিসকোর্স বিভিন্ন ধরনের ক্ষমতার, অর্থাত্ রাজনৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক, সাংস্কৃতিক ও নৈতিক ক্ষমতার মধ্যে অসম আদান-প্রদানের মাধ্যমে বর্তমান রূপ লাভ করেছে। তুরস্কের সাংবিধানিক আদালতের দেওয়া সেক্যুলারিজমের আইনগত ব্যাখ্যার মধ্যে এর ব্যাপক প্রকৃতিটি উঠে আসে। ১৯৯৮ সালের জানুয়ারিতে দেওয়া এক রায়ে আদালত উল্লেখ করেন যে, সেক্যুলারিজম বলতে ‘ধর্ম থেকে সামাজিক জীবন, শিক্ষা, পরিবার, অর্থনীতি, আইন, আচরণ, পোশাকের ধরন ইত্যাদির পৃথক্করণ বোঝায়’।৭ এই দৃষ্টিকোণ থেকে মতবাদটি ব্যাপক এবং এর আওতায় সামাজিক, রাজনৈতিক ও নৈতিক সব আচরণকে বিবেচনা করতে হবে। সাবা মাহমুদ প্রায় এ রকমই একটি ব্যাখ্যা দেন, যখন তিনি বলেন, ‘সাধারণভাবে রাষ্ট্রের একটি মতবাদ হিসেবে বা একগুচ্ছ বিচারসংক্রান্ত রীতিনীতি হিসেবে সেক্যুলার উদারতাবাদকে চিহ্নিত করা যাবে না: এটার বৃহদাকার তাত্পর্য বিবেচনা করলে এটাকে একার্থে জীবনাচরণ বলেই বুঝতে হবে’।৮
সেক্যুলারিজমের এই সংজ্ঞা সেক্যুলারিজম এবং সেক্যুলারকরণের মধ্যকার ব্যবধান কিছুটা অস্পষ্ট করে তুলেছে। কিন্তু অধিকাংশ বিদ্যায়তনিক জ্ঞানভাষ্যে এই পার্থক্য স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। সেক্যুলারিজম মতবাদ বা নীতি হিসেবে রাষ্ট্র ও ধর্মের পৃথক্করণের ওপর জোরারোপ করে, অন্যদিকে সেক্যুলারকরণ বলতে এমন একটি প্রক্রিয়াকে বোঝা হয়, যা ব্যক্তিগত ও জনপরিসরের মধ্যে একটি পার্থক্য তৈরি করে এবং ধর্মকে ব্যক্তিপরিসরে সীমাবদ্ধ করে। সেক্যুলারকরণের মাধ্যমে সমাজে ধর্মের প্রভাবের ক্রমাগত হ্রাসকেও নির্দেশ করা হয়।
পিটার বার্গার সেক্যুলারকরণের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন, এটি ‘সামাজিক জীবন এবং ব্যক্তিগত চেতনাবোধ উভয় ক্ষেত্রে ধর্মের ভূমিকার সংকোচন ঘটায়’।৯ যদিও একবিংশ শতাব্দীতে সেক্যুলারকরণের ধারণা ব্যাপক আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয়, কিন্তু এর একটি দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। উনবিংশ শতাব্দীর সমাজবিজ্ঞানীরা যেমন অগাস্ট কোঁত্, হার্বার্ট স্পেন্সার, এমিল ডুর্খেইম, ম্যাক্স ওয়েবার, কার্ল মার্ক্স সবাই ধর্মের ভূমিকা সম্পর্কে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনা করেছেন এবং এই উপসংহার টেনেছেন যে সময়ের পরিক্রমায় সমাজে ধর্মের গুরুত্ব ও প্রভাব হারিয়ে যাবে। এ যুক্তির ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছিল এই ধারণা যে ‘আধুনিকায়ন’ ধীরে ধীরে ধর্মকে জনপরিসর থেকে বিদায় করবে। হোসে ক্যাসানোভার মতে, সেক্যুলারকরণ তিনটি প্রক্রিয়াকে নির্দেশ করে। প্রক্রিয়াগুলো হচ্ছে: ১. ‘আধুনিক সমাজগুলোতে ধর্মীয় বিশ্বাস এবং চর্চার হ্রাস’; ২. ‘ধর্মের ব্যক্তিগতকরণ’; এবং ৩. ‘সেক্যুলার পরিসরসমূহের (রাষ্ট্র, অর্থনীতি, বিজ্ঞান) পৃথক্করণ’।১০ সেক্যুলারকরণ প্রতিপাদ্যের প্রবক্তারা১১ তাঁদের যুক্তির প্রমাণ হিসেবে গবেষণালব্ধ উপাত্ত উপস্থাপন করেন, যেখানে দেখা যায় প্রাথমিকভাবে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোতে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে এবং অনেকে ধর্মকে একেবারেই ব্যক্তিগত বিশ্বাস হিসেবে গ্রহণ করছেন। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে এসে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ধর্মীয় আন্দোলন এবং ধর্মীয়-রাজনৈতিক শক্তিগুলোর উত্থানের ফলে প্রথমোক্ত দাবি দুটি প্রশ্নের সম্মুখীন হয়। যাঁরা ঈশ্বরের মৃত্যু ঘোষণা করেছিলেন, তাঁরা তাঁদের অবস্থানের পুনর্মূল্যায়ন করেন।১২ সেক্যুলারকরণ প্রতিপাদ্যের প্রবক্তারা, যেমন পিটার বার্গার তাঁর
ভুল স্বীকার করেন। ১৯৯৬ সালে তিনি ঘোষণা করেন, ‘এই ধারণাটি মিথ্যা যে আমরা একটি সেক্যুলার বিশ্বে বাস করি’।১৩ যাই হোক এটা আমাদের অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে তৃতীয় উপাদানটির, সেক্যুলার পরিসরগুলোর পৃথক্করণের গুরুত্ব সেক্যুলারিজমের আলোচনার বাইরেও আছে, কারণ এটি উদারবাদী ধনতান্ত্রিক জাতিরাষ্ট্রের নির্দেশক চিহ্নে (হলমার্ক) পরিণত হয়েছে; ‘সমাজ’ এবং ‘রাষ্ট্র’কে আলাদা করা বা ব্যক্তিপরিসর এবং জনপরিসরের মধ্যে ফারাক তৈরি করার যে ধারণা এখন গ্রহণযোগ্য বলেই মনে করা হয় তাই প্রমাণ করে যে পৃথক্করণ ঘটেছে।
দুটো প্রশ্ন এখানে প্রাসঙ্গিক: সেক্যুলারকরণের ধারণাটিকে কীভাবে সর্বজনীন করে তোলা হয়েছে? সেক্যুলারিজম এবং সেক্যুলারকরণের মধ্যে সম্পর্ক কী? সেক্যুলারকরণের ধারণাকে সর্বজনীন করে তোলার বিষয়টি আধুনিকীকরণ বা মডার্নাইজেশন তত্ত্বের সঙ্গে জড়িত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালে আধুনিকীকরণ তত্ত্ব জোর দিয়ে বলে যে ‘উন্নয়নশীল’ বা ‘পশ্চিমা নয়’ এমন সমাজগুলো পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর অনুসরণে প্রগতির পথে চলতে বাধ্য, যার মাধ্যমে সমাজগুলো সনাতন সমাজ থেকে ‘আধুনিক’ সমাজে পরিণত হবে; যার ফলে ওই সমাজগুলোতে উন্নতি আসবে এবং একটি সাংস্কৃতিক পরিবর্তন সাধিত হবে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন চিরাচরিত মূল্যবোধগুলোকে প্রতিস্থাপন করবে, যার একটি অখণ্ড অংশ হচ্ছে ধর্ম। ফলে সংকীর্ণতা ও ধর্মীয় প্রভাবের হ্রাস ঘটবে। এই মতবাদ এবং উন্নয়ন মডেলের বাছবিচারহীন অনুসরণের ফলে সেক্যুলারকরণ একটি সর্বজনীন ধারণার রূপ লাভ করেছে। এই আলোচনায় সেক্যুলারকরণ এবং সেক্যুলারিজমের মধ্যকার সম্পর্ক বিশদভাবে আলোচনায় আসেনি। কিন্তু ইউরোপিয়ান ইতিহাসের যতটুকু আমাদের সবারই জানা তার ওপর ভিত্তি করে এটা বলা যায় যে রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে সেক্যুলারিজমের উদ্ভব হয় ইউরোপীয় ধর্ম-যুদ্ধের পর, যখন ধর্ম ও সমাজ উভয়ই ধীরে ধীরে নিজেদের মধ্যকার পার্থক্য মেনে নিয়েছিল। সত্যিকার অর্থে, ‘পবিত্র ধারণা’ বা ‘সেক্রেড’ অর্থাত্ খ্রিষ্টধর্মের সেক্যুলারকরণের মাধ্যমে রাজনৈতিক মতবাদ হিসেবে সেক্যুলারিজমের উদ্ভব হয়।
পশ্চিমা দুনিয়ার বাইরে অর্থাত্ অ-পশ্চিমা সমাজগুলোতে এই প্রক্রিয়াটি স্পষ্টত উল্টোভাবে ঘটেছে। সেখানে আমরা দেখি যে সেক্যুলারিজমের ভিত্তি গড়ে ওঠার আগেই রাষ্ট্রীয় নীতি এবং রাষ্ট্রের একটি প্রকল্প হিসেবে সেক্যুলারিজমকে গ্রহণ করা হয়েছে। সাধারণভাবে বলতে গেলে আমরা আধুনিকতা বা মডার্নিটির চারটি পথ চিহ্নিত করতে পারি। প্রথম ঐতিহাসিক পথটি হচ্ছে পশ্চিমা এবং মধ্য-ইউরোপীয় পথ, যেখানে আধুনিকতা ছিল একটি অভ্যন্তরীণ উন্নয়ন। দ্বিতীয় পথটি হচ্ছে যেখানে ইউরোপীয় অভিবাসী বা বসতি স্থাপনকারীরা (স্যাটেলাররা) পৌঁছেছিল: যেমন আমেরিকা এবং অস্ট্রেলেশিয়া যাকে পশ্চিমারা বলে ‘নতুন বিশ্ব’। সেখানে বসতি স্থাপনকারীরা সংখ্যাগুরুতে পরিণত হয় এবং শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে আধুনিকতার বিরোধীদের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীতে পরিণত করা হয়। তৃতীয় পথটি হচ্ছে ‘ঔপনিবেশিক এলাকা’, যেখানে আধুনিকতা এসেছিল বাইরে থেকে। প্রতিরোধের চেষ্টাগুলোকে দমন করা হলেও, তা একেবারে নির্মূল করা যায়নি। চতুর্থ পথটি হচ্ছে ‘বাইরে থেকে প্ররোচিত আধুনিকায়ন’, যেখানে এলিট শাসকশ্রেণি তাদের পছন্দমতো আধুনিকতার ধারণা আমদানি করেছিল। অধিকাংশ অ-পশ্চিমা সমাজগুলো তৃতীয় ও চতুর্থ পথে আধুনিকতার সঙ্গে পরিচিত হয়েছিল, ফলে রাজনৈতিক আধুনিকতা অভ্যন্তরীণভাবে তৈরি না হয়ে বরং বাইরের থেকে চাপিয়ে দেওয়া বা প্রোথিত ধারণায় পরিণত হয়েছে।১৪ টি এন মদনের মতে, আধুনিকতার মতোই সেক্যুলারিজমও আরোপিত ছিল: ‘অ-পশ্চিমা সমাজগুলোর ধর্মীয় ঐতিহ্যকে বা এই সব ঐতিহ্য উপহার হিসেবে কী দিতে পারে তা আমলে না নিয়েই আধুনিকায়নের মডেলগুলো অ-পশ্চিমা সমাজগুলোতে সেক্যুলারিজম স্থানান্তরের পরামর্শ দিয়েছিল’।১৫ সে কারণেই, সেক্যুলারকরণ প্রক্রিয়া নিয়ে ভাবার আগেই রাজনৈতিক মতবাদ হিসেবে সেক্যুলারিজম অ-পশ্চিমা সমাজগুলোতে পৌঁছে যায়। সাধারণভাবে ভাবা হয়েছিল যে রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে সেক্যুলারিজমকে গ্রহণ করলেই সমাজের সেক্যুলারকরণ প্রক্রিয়া এগিয়ে যাবে।
(আধুনিকতা বলতে আমি এখানে পশ্চিমা ধারার আধুনিকতার কথাই বলেছি, যদিও আমি মনে করি না যে আধুনিকতার একটাই অর্থ। এর একটি ঐতিহ্য বা একরৈখিক ইতিহাসেও আমার আপত্তি আছে। ইউরোপের আধুনিকতার ইতিহাসকে একমাত্র আধুনিকতা বলে আমি মানতে নারাজ এবং এই প্রশ্নে আমি তালাল আসাদের সঙ্গে একমত।)১৬
‘সেক্যুলারিজম’-এর রূপান্তরসমূহ
আমরা এখন যে অর্থে সেক্যুলারিজমকে বিবেচনা করি তা তৈরি হয়েছে তিনটি স্বতন্ত্র রূপান্তরের মাধ্যমে। ব্যুত্পত্তিগতভাবে সেক্যুলারিজম শব্দটির উত্পত্তি সেক্যুলাম থেকে, যা সময় পরিমাপের একটি একক। রোমানরা এটাকে এক প্রজন্মের সমমান এবং সাধারণ জীবনচক্র হিসেবে ব্যবহার করত। ধীরে ধীরে এর প্রমিতকরণ হয় এবং এটি এক শতাব্দী হিসেবে ব্যবহূত হতে থাকে। এই অর্থের প্রথম রূপান্তর ঘটে ত্রয়োদশ শতাব্দীতে, যখন খ্রিষ্টধর্মের যাজকদের কাজের মধ্যে দুটি আলাদা ধারা দেখা গেল। এই বিভক্তি ঘটে ‘পারলৌকিক’ এবং ‘ইহজাগতিক’র মধ্যে: ‘যেসব যাজক নিজেদের ইহজাগতিক বিষয় (সেক্যুলাম) থেকে প্রত্যাহার করে নেয়, তারা জন্ম দেয় ধর্মীয় যাজকমণ্ডলীর; আর যারা ইহজাগতিক বিষয়ে নিজেদের সম্পৃক্ত রাখে, তারা জন্ম দেয় সেক্যুলার যাজকমণ্ডলীর’।১৭ প্রথমোক্তরা নিজেদের কেবল ধর্মীয় বৃত্তিতে নিয়োজিত করেন এবং শেষোক্তরা সেক্যুলার বৃত্তিগুলোতে জড়িয়ে পড়েন। এই বিভেদ অগাস্টিনের ‘দেবতার শহর’ এবং ‘মানুষের শহর’ পার্থক্যের ভিত্তি গড়ে দেয়। দ্বিতীয় রূপান্তর ঘটে ষোড়শ শতাব্দীতে, যখন শব্দটির সঙ্গে ঈশ্বরহীনতার বিষয়টি বাদ দেওয়া হয়; ফলে সেক্যুলারকৃত বলতে কোনো ব্যক্তি বা বস্তুকে গির্জার মালিকানা থেকে পার্থিব মালিকানায় হস্তান্তর বা অন্যার্থে গির্জা-সম্পৃক্ততা থেকে নাগরিক-সম্পৃক্ততায় রূপান্তর বোঝানো হতো। ক্যাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্টদের মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধগুলো যা ‘ত্রিশ বছরের যুদ্ধ’ (১৬১৮-১৬৪৮) বলে পরিচিত তার অবসানের পরে এই অর্থ প্রাধান্য লাভ করে। এ কথা বলা যায় যে, ‘পিস অব ওয়েস্টফেলিয়া’ (১৬৪৮) সেক্যুলারিজমের এই অর্থকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়। কিন্তু ওয়েস্টফেলিয়ার চুক্তিগুলোর দুটি উপাদান ছিল: একটি হচ্ছে এই নীতিকে প্রতিষ্ঠা করা যে ধর্মের প্রসঙ্গ না টেনেই রাষ্ট্রগুলোর মধ্যকার বিবাদগুলো সমাধান করা হবে; অপরটি হচ্ছে এটা মেনে নেওয়ায় যে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে ‘কিয়ুস রেজিও, ইয়ুস রিলিজিও’ অর্থাত্ যার রাজত্ব, তার ধর্ম। যার অর্থ হচ্ছে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক থেকে ধর্মকে বিদায় দেওয়া হলেও, ধর্মের ওপর ভিত্তি করে যে রাষ্ট্র গড়ে উঠতে পারে তা উড়িয়ে দেওয়া হয়নি; অন্য অর্থে ‘এটি ধর্মভিত্তিক (কনফেশনাল) রাষ্ট্রের বৈধতা দান করেছিল’।১৮ তৃতীয় রূপান্তরটি ঘটে ঊনবিংশ শতাব্দীতে, যখন হোলিওক সেক্যুলারিজম শব্দটির প্রচলন করেন। পরবর্তী সময়ে এটি ধর্ম ও রাজনীতির মধ্যকার সম্পর্কের পৃথক্করণের আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত হতে থাকে। এরপরের শতাব্দীতে সেক্যুলারিজমকে প্রগতি ও উন্নয়নের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে ধরে নেওয়া হয়।
সেক্যুলারিজমের অর্থের এই রূপান্তরগুলো স্পষ্টতই এটাই দেখায় যে এটি কোনো নিশ্চল ধারণা নয় এবং গত সাত শতাব্দী ধরে এটি বিভিন্ন পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গিয়েছে। সুতরাং, বর্তমানে প্রচলিত অর্থটিকে এই ধারণার চূড়ান্ত সংস্করণ হিসেবে ধরে নেওয়া বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক নাও হতে পারে।
এই প্রেক্ষাপটে বর্তমান দশকগুলোতে এই প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়েছে যে ‘জনপরিসর এবং দৈনন্দিন জীবনচর্চার ক্ষুদ্র এবং বৃহত্ পর্যায়ে রাজনীতি, আইন এবং জনজীবনে ধর্মের সাম্প্রতিক চ্যালেঞ্জগুলো পাঠ এবং ব্যাখ্যা করতে রাজনৈতিক মতবাদ হিসেবে সেক্যুলারিজম যথেষ্ট পরিপ্রেক্ষিত প্রদান করে কি না’।১৯ শুধু শক্তিশালী রাজনৈতিক মতবাদ হিসেবে ধর্মের উত্থানই সেক্যুলারিজমের সঙ্গে বিবাদ এবং সেক্যুলারিজমের প্রতি চ্যালেঞ্জের কারণ নয়। এটা ঠিক যে জনজীবনে ধর্মের প্রভাব হ্রাস পাবে বা অ-পশ্চিমা সমাজগুলোতে ধর্মের ব্যক্তিগতকরণ হবে বলে যে আশা করা হয়েছিল তা ভুল প্রমাণিত হওয়ায় এবং পশ্চিমা সমাজগুলোতে শক্তি হিসেবে ধর্মের পুনরাবির্ভাবের কারণে সেক্যুলারিজম ধারণাটির সমালোচনামূলক মূল্যায়নে উত্সাহ তৈরি হয়েছে। কিন্তু পুনর্মূল্যায়নের প্রাথমিক কারণ হলো ধরে নেওয়া হচ্ছে যে, ‘সেক্যুলারিজমের ধারণাগত এবং অভিজ্ঞতালব্ধ কাঠামোর মধ্যেই’ ত্রুটি আছে। বিভিন্ন ধারার সমাজবিজ্ঞানীরা ‘সেক্যুলারিজমের’, অন্ততপক্ষে সেক্যুলারিজমের প্রচলিত ধারণার, বিরোধিতার বিষয়টিকে সামনে নিয়ে এসেছেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হচ্ছেন: পার্থ চট্টোপাধ্যায়, আশীষ নন্দী, টি এন মদন, তালাল আসাদ, চার্লস টেইলর, উইলিয়াম কনোলি, জন কেইন, ক্রেইগ ক্যালহিউন এবং য়ুরগেন হাবারমাস। তবে অন্যরা, যেমন রাজীব ভার্গভা এবং অচিন ভানায়েক ধারণাগতভাবে সেক্যুলারিজমের পক্ষে যুক্তি দিলেও তাঁরা ধারণাটির পুনর্বিবেচনার (বলা যায় পুনঃসূত্রবদ্ধকরণ বা নতুন করে সংজ্ঞায়নের) প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেছেন। এই সমালোচনা যে কত প্রবল সেটা বোঝা যায় আশীষ নন্দীর দ্ব্যর্থহীন উক্তিতে। নন্দীর মতে, সেক্যুলারিজম ‘সাধারণভাবে সকলের সঙ্গে ভাগ করে জীবনের ধর্মমত হিসেবে গ্রহণ অসম্ভব, রাষ্ট্রীয় কাজের ভিত্তি হিসেবে অচল এবং সুদূর ভবিষ্যতের পরিকল্পনা হিসেবে ব্যর্থ’।২০
এই সমাজবিজ্ঞানীদের মধ্যে চিন্তার পার্থক্য বিস্তর, কিন্তু যে বিষয়গুলো তাঁদের এক কাতারে ধরে রেখেছে তার একটি হচ্ছে, তাঁরা সবাই সেক্যুলারিজমের মৌলিক ভিত্তি হিসেবে ‘রিজন’ বা যুক্তির সমালোচনা করেন। অথচ এই কিছুদিন আগে পর্যন্ত র্যাশনালিটি বা যৌক্তিকতার ওপর নির্ভর করায় সেক্যুলারিজমের প্রশংসা করা হতো। এটাকে দেখা হতো আলোকায়ন বা এনলাইটেনমেন্টের ফলাফল হিসেবে; এনলাইটেনমেন্ট ঐতিহ্য এবং ধর্মের বিপরীতে যুক্তি, বিশ্লেষণ এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছিল। তবে ‘যুক্তি’র ওপর এর প্রাপ্যের চেয়ে বেশি গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছিল কি না তা এখন প্রশ্নবিদ্ধ, তা এখন বিতর্কের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। স্টিভেন স্মিথ তাঁর বই দ্য ডিসঅ্যানচেন্টম্যান্ট অব সেক্যুলার ডিসকোর্স-এ এই বিতর্কের প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো সংক্ষিপ্তাকারে তুলে ধরেছেন। তাঁর মতে, কোনো যুক্তিই নিজে নিজে সেক্যুলার নয়, কেন একজন মানুষ এক ধরনের কর্মপদ্ধতির বদলে অন্য ধরনের কর্মপদ্ধতির সিদ্ধান্ত নেয় তার যৌক্তিকতা প্রমাণের কোনো সেক্যুলার যুক্তি নেই। সেক্যুলারিজম সম্পর্কিত বিতর্ক প্রসঙ্গে ক্রেইগ ক্যালহিউনের মত হচ্ছে:
ধর্মের বিপরীতে যুক্তির সপক্ষে তর্ক করতে গিয়ে কিছু সমর্থক দুর্ভাগ্যবশত যুক্তির সরল, কার্যত মৌলবাদী (ফান্ডামেন্টালিস্ট) ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেন। তাঁরা যুক্তিকে, যা সম্ভবপর তার চেয়েও কোনো না কোনোভাবে বেশি স্বয়ংসম্পূর্ণ বলে কল্পনা করেন। এই ধরনের বিবরণ একই সঙ্গে সমর্থন অযোগ্য এবং নাগরিকদের [চিন্তার] মধ্যে ব্যাপকার্থে সমন্বয়সাধন ও একই ধরনের উপলব্ধিতে পৌঁছানোর পথে বাধা।২১
একইভাবে ফিলিপ গরস্কি ও অন্যরা যুক্তির ওপর তাদের অগাধ বিশ্বাসের জন্য সেক্যুলারপন্থীদের কঠোর সমালোচনা করেছেন। তাদের মতে, ‘সম্ভবত ধর্মবাদীরা নয়, বরং সেক্যুলারপন্থীরাই অন্ধ ছিল। তবে তা অন্ধকারের কারণে নয়, আলোকায়নের যুক্তির আলোকচ্ছটায়’।২২
সমালোচকেরা বিদ্যমান সেক্যুলারিজমের ধারণাগত অপর্যাপ্ততার দিকই শুধু নির্দেশ করেননি, অনুভূত দুর্বলতাগুলোর প্রতিকারও তাঁরা বাতলে দিয়েছেন। এর মধ্যে কয়েকটি হচ্ছে হোজে ক্যাসানোভার জনধর্মসমূহ২৩, আলফ্রেড স্টেপানের ‘দ্বৈত সহিষ্ণুতা’২৪, চার্লস টেইলরের ‘বৈপ্লবাত্মক সেক্যুলারিটি’২৫ এবং রাজীব ভার্গভার ‘নীতিনির্ভর দূরত্ব’২৬। স্টেপানের ‘দ্বৈত সহিষ্ণুতা’ রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ এবং ধর্মীয় নেতৃত্ব ও গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে স্পষ্ট দূরত্ব ও পারস্পরিক শ্রদ্ধার ওপর গুরুত্বারোপ করে। ‘যখন সত্যিকার পৃথক্করণ সম্পন্ন হবে, তখন ধর্মীয় খাত কাজের স্বাধীনতা উপভোগ করবে এবং রাজনৈতিক ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ না করেই এর সদস্যদের শান্তিপূর্ণভাবে প্রভাবিত করতে সমর্থ হবে’।২৭ একইভাবে রাজীব ভার্গভার ‘নীতিনির্ভর দূরত্ব’ভিত্তিক সেক্যুলারিজম এটা বলে যে রাষ্ট্র বা জাতির বৈশিষ্ট্য নির্ধারণে এবং আগে থেকেই লিখিতভাবে ধর্মের বিশেষ জনগুরুত্ব নাও থাকতে পারে। তবে এর অর্থ এই নয় যে ধর্মের কোনো জনগুরুত্বই নেই।২৮ আমি এই ধারণাগুলোর বিস্তারিত ব্যাখ্যা এবং সমালোচনা উপস্থাপন করছি না সময় এবং স্থানাভাবে; এদের মধ্যে কোনোটির প্রতি আমার কোনো পক্ষপাতও নেই। আমার বক্তব্যের উদ্দেশ্য এটা নজরে আনা যে সেক্যুলারিজমের ধারণাটি আবার আলোচনায় উঠে এসেছে এবং এখন চতুর্থ রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
রাষ্ট্রপরিচালনার নীতি হিসেবে সেক্যুলারিজম
সেক্যুলারিজমের দুটি দিকের মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি প্রভাবশালী দিকটি হচ্ছে রাষ্ট্রপরিচালনার নীতি। কারণ, এটি জনগণের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত। রাষ্ট্রপরিচালনার নীতি হিসেবে সেক্যুলারিজম বলতে ধর্ম এবং রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের পৃথক্করণের কিছু নীতিকে বোঝায়। এই নীতি বিভিন্ন কারণে মেনে চলা হতে পারে: প্রতিটি ধর্মের ব্যাপারে রাষ্ট্রের নিরপেক্ষতা বজায় রাখার স্বার্থে বা প্রত্যেক ব্যক্তির চিন্তার স্বাধীনতার সুরক্ষা প্রদানের নিমিত্তে, অথবা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণে ধার্মিক বা অধার্মিক সব নাগরিকের সমান সুবিধা নিশ্চিত করতে। এ ধরনের রাষ্ট্রপরিচালনার মতবাদ ‘ধর্ম’ সম্পর্কে কোনো স্বতন্ত্র ‘তত্ত্ব’কে, তা ইতিবাচক বা নেতিবাচক যা-ই হোক না কেন, পূর্বশর্ত হিসেবে ধরে নেয় না বা এর প্রয়োজনও হয় না।২৯
সাধারণভাবে এটা ধরে নেওয়া হয় যে রাষ্ট্রপরিচালনার মতবাদ হিসেবে দুটি নীতির প্রয়োজন: পৃথক্করণের নীতি এবং রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের নীতি। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই দুটি নীতিকে আলাদা করা যায় না। এই ধারণার ওপর ভিত্তি করে, ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে ‘সেক্যুলার রাষ্ট্রের’ চারটি মডেলের উদ্ভব হয়েছে। এগুলোকে সাধারণভাবে ফরাসি, ব্রিটিশ, আমেরিকান এবং ভারতীয় মডেল হিসেবে অভিহিত করা হয়। তবে কিছু পণ্ডিত এই মডেলগুলোকে দুটি বৃহত্ ধারায় ভাগ করেছেন: অ্যাসার্টিভ সেক্যুলারিজম এবং প্যাসিভ সেক্যুলারিজম।৩০ তবে এগুলোর মধ্যে বিদ্যমান পার্থক্যের কারণে আমরা চারটি মডেলের আকারে আমাদের আলোচনা করব। ফরাসি মডেলের মূল ভিত্তিগত ধারণা হচ্ছে এই যে রাষ্ট্র ধর্ম থেকে নাগরিকদের সুরক্ষা দেয় এবং এর পরিবর্ধিত বিষয় হচ্ছে যে রাষ্ট্র ধর্মীয় বিষয়গুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে। লেইসিটে (laïcité) নামে পরিচিত এই মডেল জনপরিসর—রাজনৈতিক এবং সামাজিক উভয় পরিসর—থেকে ধর্মকে নির্বাসিত করে। সংক্ষেপে এটাকে বলা যায় যে ধর্মীয় বিশ্বাসের ব্যাপারে রাষ্ট্র নিরপেক্ষতা পালন করে এবং ধর্মীয় পরিসর ও জনপরিসরকে সম্পূর্ণভাবে পৃথক করে। অলিভিয়ার রয়ের মতে, লেইসিটে ‘পশ্চিমা সেক্যুলারিজমের একটি আতিশয্যিক (এক্সাসারেটেড), রাজনীতিকৃত এবং মতাদর্শগত ধরন’ এবং এটার আইনগত ও মতাদর্শগত দুই ধরনের উপাদানই রয়েছে।৩১ তিনি ঠিকই বলেছেন যে ‘লেইসিটেকে রাষ্ট্র এবং ধর্মের মধ্যে একটি সাদাসিধে সম্পর্ক হিসেবে চিন্তা করা নিরর্থক; এটা বরং সমাজ কীভাবে নিজেকে রাজনৈতিকভাবে সংজ্ঞায়িত করে, সেই পথই ঠিক করে দেয়।’৩২ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম সংশোধনীর মাধ্যমে সেক্যুলারিজমের ধারণাটি সংবিধানে বিধিবদ্ধ হয়; ‘কংগ্রেস ধর্মীয় সংস্থাপনাকে সম্মান জানিয়ে বা ধর্মের অবাধ চর্চাকে বাধা প্রদান করতে কোনো আইন প্রণয়ন করবে না।’ এটা সাধারণভাবে ‘পৃথক্করণের প্রাচীর’ (‘wall of separation’) বা ‘রাষ্ট্র এবং চার্চের মধ্যে পৃথক্করণ’ হিসেবে পরিচিত। এটাকে জনপরিসরে ধর্মকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টার পরিবর্তে, একটিকে অপরটি থেকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য চার্চ এবং রাষ্ট্রের পৃথক্করণ হিসেবে দেখা যেতে পারে। পৃথক্করণের এই ব্যাখ্যার কারণে সমাজে ব্যাপকাকারে ধর্মচর্চা থাকলেও রাষ্ট্র ধর্ম থেকে দূরত্ব বজায় রাখে। ব্রিটিশ মডেলে সমাজ অধিক মাত্রায় সেক্যুলার, কিন্তু রাষ্ট্র প্রতীকীভাবে হলেও ধর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত। ব্রিটিশ রাজা/রানি চার্চ অব ইংল্যান্ডের সুপ্রিম গভর্নর এবং সরকারের উচ্চকক্ষ, হাউস অব লর্ডসের ২৬ জন সদস্য বিশপ। তবে কমপক্ষে পৃথক্করণ অর্থে হলেও সমাজের সেক্যুলারকরণ বেশ গভীর। সেক্যুলারিজমের ভারতীয় মডেলের মূল কথা হচ্ছে ‘সর্বধর্মসম্ভাবা’ (অর্থাত্ সব ধর্মই সত্য এবং সমান)। এটা এই মতের ওপর জোর দেয় যে ‘সব ধর্মই অর্থপূর্ণ এবং জাতীয় জীবনে সব ধর্মেরই যথাযথ স্থান থাকা উচিত।’৩৩ এই নীতি রাষ্ট্রকে নির্দেশনা প্রদান করে, কিন্তু রাষ্ট্র ও ধর্মের মধ্যে সম্পর্ক কী হবে তা অস্পষ্টই থেকে গেছে। এই নীতির ফলে জনসমাজের সেক্যুলারকরণের বিষয়টি, অচিন ভানায়েকের ভাষায়, ‘কার্যকরভাবে [একটি] প্রশ্নাতীত’ বিষয়ে পরিণত করেছে।৩৪ তার অর্থ হলো এই যে ধরেই নেওয়া হয়েছে যে জনসমাজ সেক্যুলার, বাস্তবে তা থাকুক অথবা না থাকুক।
সেক্যুলার রাষ্ট্রের এই মডেলগুলো নিছক বিশ্ববীক্ষা হিসেবে সেক্যুলারিজমের প্রতিচ্ছবি নয়, বরং অধিক গুরুত্বের বিষয় হচ্ছে, এগুলো সেই সব সমাজের ঐতিহাসিক বিবর্তনেরও ফল: ‘পশ্চিমা গণতন্ত্রগুলোতে সেক্যুলার রাষ্ট্রের উদ্ভব বিমূর্ত সেক্যুলার আদর্শগুলোর প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ ছিল না, বরং তা ছিল নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার নির্দিষ্ট প্রায়োগিক ফল। যখন এই ধরনের দূরত্ব কার্যকর ছিল না, তখন ধর্মীয়-সামপ্রদায়িক বিবাদের ইতিহাস থেকে চার্চ এবং রাষ্ট্র উভয়ই যে শিক্ষা গ্রহণ করেছে তার ফসল হচ্ছে এই সব প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা।৩৫ উদাহরণ হিসেবে ফরাসি মডেলের কথাই বিবেচনা করা যাক। ফ্রান্সে কঠোর সেক্যুলার রাষ্ট্রের উদ্ভবের কারণ হচ্ছে যাজকদের শক্তি, ফরাসি বিপ্লবের সময়ে এবং পরে তাঁদের ভূমিকা এবং সমাজে যাজকতন্ত্রের বিরোধিতা। ফরাসি রিপাবলিকের প্রতি ডানপন্থী ক্যাথলিক জাতীয়তাবাদীদের বৈরিতার কারণে রিপাবলিকের সমর্থকদের দৃঢ়প্রতিজ্ঞ প্রতিক্রিয়ার ফসল হচ্ছে এই কঠোর ব্যবস্থা। ‘সেক্যুলারিজমের এই কঠোর সংস্করণ ছিল চার্চের সংস্রব ত্যাগসংক্রান্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতার, যাজকীয় কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে সংগ্রামের ফল। এটা ঊনবিংশ এবং বিংশ শতাব্দীতেও চলমান ছিল।’৩৬
সুতরাং, রাষ্ট্রপরিচালনার নীতি হিসেবে সেক্যুলারিজমের বিভিন্ন ধরন রয়েছে। সেক্যুলার রাষ্ট্রের কোনো একক মডেল নেই।
সমালোচনার কাঠগড়ায় সেক্যুলার রাষ্ট্র?
সেক্যুলারিজম-সম্পর্কিত আলোচনায় একটি বিষয় ঘুরে-ফিরে আসে, তা হলো অপশ্চিমা সমাজগুলোতে সেক্যুলার রাষ্ট্রগুলোর কার্যক্রম; এই রাষ্ট্রগুলো কী করেছে, কী করেনি। সাধারণত এটা দেখা যায় যে আধিপত্যবিরোধী একটি মতাদর্শ হিসেবে ধর্মের এবং রাষ্ট্রের প্রতি একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে ধর্মীয়-রাজনৈতিক শক্তির উত্থানের পেছনে সেক্যুলার রাষ্ট্রের কার্যক্রমের ভূমিকা রয়েছে। সেক্যুলারিজমের বিরোধীরা (বিরোধীরা, সমালোচকেরা নয়) প্রায়ই জোর দিয়ে বলেন যে সেক্যুলার রাষ্ট্রসমূহ ব্যর্থ হয়েছে এবং এই ব্যর্থতার কারণ রাষ্ট্রগুলোর মতাদর্শিক অবস্থান।
সেক্যুলার রাষ্ট্রের কার্যক্রম এবং সেক্যুলারিজমের প্রতি চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যকার সম্পর্ক নির্ণয়ের জন্য অপশ্চিমা সমাজগুলোতে রাষ্ট্রের উদ্ভব ও বিকাশ সম্পর্কে কিছু বিষয় মনে রাখা একান্ত প্রয়োজন। প্রথমত, ইতিহাস থেকে দেখা যায়, অপশ্চিমা সমাজগুলোতে রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়েছে ঔপনিবেশিকভাবে বা যেখানে তা ঔপনিবেশিক কারণে বিকশিত হয়নি (যেমন: থাইল্যান্ড, চীন, রাশিয়া বা তুরস্ক) সেখানে রাষ্ট্রগুলো সচেতনভাবেই ইউরোপীয় মডেলের ওপর ভিত্তি করে আধুনিকায়ন প্রচেষ্টার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। যদিও এটা সত্য যে এই রাষ্ট্রগুলোর নিজেদের কিছু স্থানীয় বৈশিষ্ট্য আছে, কিন্তু এগুলোকে যেন ঔপনিবেশিক শাসনের সময় প্যারাসুটের মতো করে আকাশ থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে, আর স্বাধীনতাসংগ্রামের নেতারা তাকেই, সেই সীমান্ত, সেই প্রশাসন, সেই আইনি কাঠামোসহ সবকিছুকেই গ্রহণ করেছেন, অব্যাহত রেখেছেন।৩৭ যে রাষ্ট্রগুলো এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গেছে, সেগুলো উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছে কিছু মতাদর্শ, যার মধ্যে সেক্যুলারিজমও আছে।
দ্বিতীয়ত, সেক্যুলার জাতীয়তাবাদের—বিশেষত উত্তর-ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রগুলোতে—‘বৈধতা ইতিহাস বা অতীতের কাছ থেকে উদ্ভূত হয়নি, বরং তা হয়েছে দেয় প্রতিশ্রুতিগুলো থেকে; এই বৈধতার উত্পত্তি উত্স থেকে নয়, এর প্রত্যাশিত প্রভাবগুলো থেকে।’৩৮ সুতরাং, রাষ্ট্রগুলোকে বিচার করা হয় প্রতিশ্রুতি পালনের সাফল্যের বিবেচনা থেকে, তাদের কর্মদক্ষতার ওপর, তাদের সাফল্য ও ব্যর্থতার ভিত্তিতে।
তৃতীয়ত, অপশ্চিমা, বিশেষত উত্তর-ঔপনিবেশিক সমাজগুলোতে রাষ্ট্র একটি গুরুত্বপূর্ণ বা কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয় এবং প্রায়ই রাষ্ট্র সমাজের চেয়ে বেশি শক্তিশালী হয়ে থাকে। রাষ্ট্র শুধু অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিবেচনাতেই কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয় না, বরং তারও বাইরে অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ার জন্য যে কাজগুলো দরকার, সেগুলোর সঙ্গেও রাষ্ট্র জড়িত থাকে। এই সব সমাজে রাষ্ট্র হেজিমনির এজেন্সি/কর্তৃত্বের প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। এই ধরনের পরিস্থিতিতে শাসকশ্রেণি, সে যেই হোক না কেন, রাষ্ট্রকে হেজিমনি/কর্তৃত্বের এজেন্সি হিসেবে ব্যবহার করে এবং এর মাধ্যমে একটি নতুন মতবাদ (বা মূল্যবোধ ব্যবস্থা) চাপিয়ে দেয়, যে মতবাদকে অন্য সব মতবাদ থেকে শ্রেয় বলে ধারণা দেওয়া হয়। প্রায়ই এই নতুন মতবাদ সেক্যুলার জাতীয়তাবাদেরই একটি ভিন্ন রূপ হয়। সেক্যুলার জাতীয়তাবাদ তখন শাসকশ্রেণির এবং সর্বব্যাপ্ত, হস্তক্ষেপবাদী ও লুণ্ঠনপরায়ণ রাষ্ট্রের বৈধতা দানকারী মতবাদে পরিণত হয়। এই অবস্থায় সেক্যুলারিজম শুধু রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতাই ভোগ করে না, তা রাষ্ট্রের একটি প্রকল্পেও পরিণত হয়।
অপশ্চিমা সমাজগুলোতে রাষ্ট্রের এই তিনটি বৈশিষ্ট্যের কারণে সেক্যুলারিজম ও রাষ্ট্রের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য রূপ লাভ করে। ফলে রাষ্ট্রের কার্যক্রম, তাঁর সাফল্য-ব্যর্থতা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরিণত হয়। ১৯৯৪ সালে মার্ক য়ুর্গেনস্মায়ার দেখান যে ‘পৃথিবীর অনেক অংশে সেক্যুলার রাষ্ট্রসমূহ তাদের রাজনৈতিক স্বাধীনতা, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে পারেনি।’৩৯ ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত উইলিয়াম মাইলসের গবেষণায় এই দাবিগুলো পুনর্ব্যক্ত হয় এবং তিনি আরও উল্লেখ করেন যে ‘গোষ্ঠী পরিচিতিতে এবং রাষ্ট্রীয় রাজনীতিতে ধর্মীয় মাত্রা’ নতুন বিষয় হিসেবে যুক্ত হয়েছে।৪০ আমরা বলতে পারি যে শাসক এলিট শ্রেণির কার্যক্রমের বৈধতার অভাব (অর্থাত্ সাধারণ কল্যাণ প্রদানে সেক্যুলার এলিটদের সামর্থ্যহীনতা) কর্তৃত্ববাদ যা সেক্যুলার সিভিল সোসাইটিকে দুর্বল বা ধ্বংস করে দেয় এবং যার ফলে জনপরিসর হিসেবে এককভাবে ধর্মীয় কেন্দ্রগুলো (যেমন: মসজিদ, মন্দির, গির্জা) টিকে থাকে। নগরায়ণসহ অসম অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সেক্যুলারপন্থী রাজনীতির হেজিমনির অবসান এবং সেক্যুলার দলগুলোর সুবিধাবাদী রাজনীতি সারা দুনিয়াজুড়ে ধর্মীয়-রাজনৈতিক শক্তিগুলোর উত্থানের গুরুত্বপূর্ণ কারণ।৪১ এখানে স্মরণ করা দরকার যে রাজনৈতিক বহিঃপ্রকাশের অন্য পথগুলোর অনুপস্থিতিতে ধর্মীয় ও ধর্মভিত্তিক কেন্দ্রগুলো সবার দৃষ্টিগোচরে আসে। এই অবস্থায় এই প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণ মানুষের সক্রিয়তার জন্য ভৌত ও নৈতিক পরিসর, নৈতিক নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব প্রদানের সুযোগ তৈরি করে। গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, এসব বিষয় পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন নয়, আবার এই সব বিষয় একসঙ্গেই ঘটতে হবে তেমনটিও জরুরি নয়।
কয়েক দশক ধরে উত্তর আফ্রিকা, পশ্চিম এশীয় এবং দক্ষিণ এশীয় অনেক রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছে কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা। উদাহরণ হিসেবে আলজেরিয়া, মিসর, ইরাক, সিরিয়া, সুদান, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা এবং নেপালের কথা উল্লেখ করা যায়। নাগরিকদের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা অনুভব না করা এসব রাষ্ট্রের ইতিহাসের একটি বড় বৈশিষ্ট্য। এসব ব্যর্থতা রাষ্ট্রগুলোকে এবং এলিট শাসকশ্রেণিকে বৈধতাহীন করেছে। যেহেতু শাসক এলিট শ্রেণি সাধারণ জনগণের ওপর আর হেজিমনি বা কর্তৃত্ব বজায় রাখতে পারছে না, ফলে এসব সমাজের মধ্যে পরস্পরবিরোধী, যুযুমান বিভিন্ন ধারার উদ্ভব হচ্ছে। একদিকে এলিট শাসকশ্রেণি ক্ষমতার ওপর নিজেদের কর্তৃত্ব ধরে রাখতে নানা পন্থার আশ্রয় নিচ্ছে; অন্যদিকে ধর্মীয়-রাজনৈতিক শক্তিগুলো এটা দেখাতে চেষ্টা করছে যে এসব ব্যর্থতা সেক্যুলারপন্থী উদারনৈতিক মতাদর্শের সঙ্গে মজ্জাগতভাবে সম্পৃক্ত। একটি হেজিমনিক মতাদর্শের অনুপস্থিতির কারণে ধর্ম সেই শূন্যস্থান পূরণ করতে সচেষ্ট হচ্ছে এবং দৈনন্দিন জীবন, ডিসকোর্স ও রাজনীতি ধর্মীয় বা ধর্মসংশ্লিষ্ট প্রতীক, কথাবার্তা এবং বুলিতে পূর্ণ হয়ে উঠছে। বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলে যে দেশকে বর্ণনা করা হয়, সেই ভারতের ক্ষেত্রেও এই কথাটি সত্য। ভারতে যখন ইন্দিরা গান্ধীর সরকার (১৯৭১-১৯৭৭) অধিক কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠে এবং স্বল্পমেয়াদি লাভের জন্য ধর্মকে ব্যবহার করা শুরু করে, তখন জনগণ কংগ্রেসের প্রতি আকর্ষণ হারিয়ে ফেলে। আশুতোষ ভার্সনে উল্লেখ করেন যে, ভারতীয় কংগ্রেস ‘জাতি তৈরি এবং গঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত একদা শক্তিশালী একটি সংগঠন,... [১৯৮০-এর দশকে] একটি বিবর্ণ, দুর্বল চরিত্রের, অতিকায় মূর্তিতে পরিণত হয়।’৪২ অধিকন্তু, ‘১৯৮০-এর দশকের শেষের দিকে ভারতীয় রাজনীতিতে একটি সাংগঠনিক এবং মতাদর্শিক শূন্যতা তৈরি হয়েছিল। সাংগঠনিকভাবে কংগ্রেস ছিল অবসন্ন। মতাদর্শিকভাবে ঠিক কোন বিষয়ে বিশ্বাস করত, সে সম্পর্কে নিজেরাই নিশ্চিত ছিল না।’৪৩ সেই সময়েই ধর্মীয়-রাজনৈতিক শক্তিগুলো মূলধারার রাজনীতিতে প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়।
রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সেক্যুলারিজমের উদ্ভবের ক্ষেত্রে আরেকটি বিষয় সহজেই দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়, তা হলো রাষ্ট্র এবং জনসমাজের ভেতরে পার্থক্য। রাষ্ট্রের আধুনিকায়ন-সেক্যুলারকরণের দাবি ও আচরণ সত্ত্বেও জনসমাজে বাস্তবে পরিবর্তন ঘটে ধীরগতিতে। স্পষ্টত রাষ্ট্রের দাবি আর ‘পরিবর্তনের বাস্তবতার মধ্যে থাকে স্পষ্ট অসমতা’। সেক্যুলারকরণের অনুপস্থিতির কারণে রাষ্ট্র ধর্মের সামগ্রিক প্রভাব হ্রাস করতে প্রায়ই ব্যর্থ হয়। সেখানে তার প্রভাব কেবল রাষ্ট্র থেকে জোর করে সরিয়ে দেওয়া হয় সমাজে। সেখানে ধর্ম থাকে সুপ্ত অবস্থায়, সম্পূর্ণভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর এবং রাষ্ট্রীয় প্রভাববলয়ে প্রবেশ করার সামর্থ্য তার অবসিত হয় না।৪৪
উপসংহারের বদলে
আমার এই আলোচনার, বিশেষ করে সেক্যুলারিজম বিষয়ে যেসব নতুন দৃষ্টিভঙ্গির, আলোচনার, চিন্তার কথা আমি উল্লেখ করেছি তার সারসংক্ষেপ দেওয়া আমার লক্ষ্য নয়। আলোচনার উপসংহার আমি কেবল কয়েকটি বিষয়ের দিকে মনোযোগ আকর্ষণ করতে চাই।
প্রথমত, প্রচলিত দ্বিধা বিভাজিত চিন্তা—‘রক্ষণশীল’ ধর্ম বনাম ‘প্রগতিশীল’ সেক্যুলারিজম—নিয়ে ভাবনাচিন্তা করা দরকার, এই বিভাজনকে চ্যালেঞ্জ করার বিষয়টি সম্ভবত জরুরি হয়ে পড়েছে। এর কারণ হচ্ছে, সেক্যুলারিজম সম্পর্কিত সাধারণ ধারণা ঐতিহাসিকভাবে এবং জ্ঞানতাত্ত্বিকভাবে একটি বিশেষ ধর্মের নির্দিষ্ট ব্যাখ্যার সঙ্গে জড়িত। সেক্যুলারিজমকে আধুনিকতা, যুক্তি এবং মুক্তির সমকক্ষরূপে বিবেচনা করার বিষয়টি এখন প্রশ্নবিদ্ধ। আধুনিকতা, যুক্তি এবং মুক্তির পথ কেবল প্রচলিত অর্থে সেক্যুলারিজমের মধ্যেই নেই। অনেকের কাছে এটি একটি অপ্রয়োজনীয় বিষয়। কারণ, এই দৃষ্টিকোণ থেকে সেক্যুলারিজমের সমালোচনা করার একটি সমৃদ্ধ ঐতিহ্য ইতিমধ্যেই গড়ে উঠেছে। তবে বাংলাদেশে সেক্যুলারিজম বিষয়ে আলোচনার অবস্থাদৃষ্টে আমার কাছে মনে হয়েছে এই বিষয়টি মনে করিয়ে দেওয়া অতীব জরুরি।
দ্বিতীয়ত, আমি এই বিষয়টি তুলে ধরার চেষ্টা করেছি যে সেক্যুলারিজমের নির্দিষ্ট কোনো একক ধারণা নেই। মতাদর্শ এবং রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে এর বিভিন্ন ধরন আছে। আমরা দেখি যে নরমেটিভ বিবেচনায় এবং বাস্তবে সেক্যুলারিজম বিভিন্ন আকার ধারণ করেছে। এই সব বৈচিত্র্য নির্দিষ্ট সমাজ ও রাষ্ট্রের নিজস্বতার কারণে সৃষ্টি হয়েছে। তবে সেটাই বৈচিত্র্যের একমাত্র কারণ নয়। সেক্যুলারিজম সম্পর্কে একবচনে কথা বলার অর্থ হলো এটা বলা যে আদর্শ হিসেবে সেক্যুলারিজমের একটি সর্বজনীন ধারণা আছে। সুতরাং, ধারণাটি সম্পর্কে সম্ভবত আমাদের বহুবচন ব্যবহার করার, সেক্যুলারিজমগুলো বলার বোধ তৈরি করা উচিত।
তৃতীয়ত, সাধারণভাবে দক্ষিণ এশিয়ায় এবং নির্দিষ্টভাবে বাংলাদেশে সেক্যুলারিজমের ভবিষ্যত্ সম্ভাবনা এবং গতিপ্রকৃতি বিষয়ে জোরালো আলোচনার দাবি রাখে। এই বিষয়ে আমি টি এন মদনের সঙ্গে একমত, ‘দক্ষিণ এশীয় রাষ্ট্রগুলোতে সেক্যুলারিজম ধারণাটির হস্তান্তরযোগ্যতা [অর্থাত্ বাইরে থেকে এনে চালু করার বিষয়] সমস্যায় আকীর্ণ এবং এটাকে অবধারিত বলে ধরে নেওয়াও উচিত নয়। সেক্যুলারিজমকে অবশ্যই যথাযথভাবে বিবেচনা করতে হবে; যার অর্থ এটিকে বাতিল করে দেওয়া নয়, বরং এর অভিব্যক্তির উপযুক্ত উপায় খুঁজে বের করা। এটা মেনে নেওয়া উচিত যে দক্ষিণ এশিয়ার মতো বহুধর্মমতের সমাজগুলোতে সেক্যুলারিজমকে কেবল যুক্তিবাদের মধ্যে আটকে রাখা যাবে না, এটি ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং যুক্তিবাদ (পশ্চিমে যেভাবে বোঝা হয়) জাতিরাষ্ট্রের একক প্রেরণাশক্তি নয়। এ রকম অবস্থানের প্রাতিষ্ঠানিক দিকগুলো কী হবে তা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন এবং সেগুলো খুঁজে বের করতে হবে।’৪৫
চতুর্থত, পূর্ববর্তী আলোচনার সঙ্গে আমি আরও যোগ করতে চাই যে এই প্রাতিষ্ঠানিক বন্দোবস্ত অবশ্যই একটি অংশগ্রহণমূলক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নির্ধারিত হওয়া উচিত, যাতে করে জনগণ মতাদর্শিক বিশ্বাসের পার্থক্য সত্ত্বেও বিভিন্নভাবে এই আলোচনায়, নতুন প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা রচনায় সমানভাবে অংশ নিতে পারে। এই বিষয়ে আমি চার্লস টেইলরের সঙ্গে একমত যে ‘আমরা মনে করি সেক্যুলারিজমের (বা লাইসেটির) বিষয় হচ্ছে রাষ্ট্রের সঙ্গে ধর্মের সম্পর্কের বিষয় কিন্তু আসলে এটি হচ্ছে সমাজে বিরাজমান বৈচিত্র্যের প্রতি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের (সঠিক) প্রতিক্রিয়ার বিষয়।’৪৬ ফলে আমি যে আলাপ-আলোচনার, মিথস্ক্রিয়ার কথা বলছি তা অবশ্যই মৌলিক গণতান্ত্রিক নীতির ওপর ভিত্তি করে হতে হবে অর্থাত্ বহুত্ববাদ এবং বৈচিত্র্যের সুরক্ষা এবং সহনশীলতা হবে তার মূল ভিত্তি। গণতন্ত্র সবার জন্য—ধর্ম, লিঙ্গ, রাজনৈতিক বিশ্বাস এবং এই রকম সব বিষয়ের ঊর্ধ্বে উঠে ব্যক্তির অধিকার এবং স্বাধীনতার নিশ্চয়তা প্রদান করে। সেক্যুলারিজমকে ন্যায্যতা দান করতে এসব নীতি থেকে বিচ্যুত হওয়া ইতিবাচক তো নয়ই, এমনকি তা সেক্যুলারিজমের জন্যই ক্ষতিকর।
পঞ্চমত, যদি আমার পূর্বোক্ত বক্তব্যের মাধ্যমে স্পষ্ট না হয়, তবে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় আমি এই কথাটি পুনরাবৃত্তি করতে চাই যে আমি সেক্যুলারিজমের কোনো বিকল্পকে সমর্থন করছি না, বরং আমি বিকল্প অনেক ধরনের সেক্যুলারিজমের কথা বলছি। কোনো একটি পূর্ব-নিরূপিত সমাধানের কথা মাথায় না রেখে এবং কোনো একটি নির্দিষ্ট প্রাতিষ্ঠানিক বিন্যাসকে লক্ষ্য হিসেবে আগেই ধরে না নিয়ে রাজনীতি এবং জনজীবনে ধর্মের ভূমিকা-সম্পর্কিত চলমান আলোচনায় সবার অংশগ্রহণের গুরুত্ব আমি তুলে ধরতে চেয়েছি। এমনকি যখন সেক্যুলারিজমকে একবচনে বলা হয় তখনো সেক্যুলারিজম বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ এবং বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক বিন্যাসকে ধারণ করে। যেহেতু বিভিন্ন ধরনের শক্তিসম্পর্কের পরিণতি হিসেবে সেক্যুলারিজমের ধারণার উত্থান ঘটেছে, তাই এটাকে সচল এবং পরিবর্তনশীল ধারণা হিসেবে দেখা প্রয়োজন।
ভিনসেন্ট পিকোরা বলেছেন, ‘সেক্যুলারিজম নিজে কেবল একটি সাধারণ শব্দ নয়, যা ধর্মীয় বিশ্বাসের অনুপস্থিতির—তার অর্থ যা-ই হোক না কেন—সেই রকম একটি নেতিবাচক অবস্থাকে প্রতিনিধিত্ব করে; বরং এটি এমন একটি শব্দ, যা প্রায় ‘‘ধর্ম”র মতোই অস্পষ্টতা সৃষ্টি করে।’ আশীষ নন্দী মনে করেন, সেক্যুলারিজম অর্থ হচ্ছে অপশ্চিমা ধর্মীয় গোষ্ঠীর ওপর পশ্চিমা মূল্যবোধ আরোপ করার শামিল, তালাল আসাদ মনে করেন সেক্যুলারিজম একটি নির্দিষ্ট শাসকশ্রেণির কার্যক্রম। আমরা যদি এই সব বক্তব্যের সঙ্গে একমত নাও হই, তবুও আমরা আর সেক্যুলারকে নিরপেক্ষ, ইতিহাসবর্জিত, রাজনীতিবর্জিত এবং বিশুদ্ধ যৌক্তিকতার আলোয় দেখার বিলাসিতা করতে পারি না।৪৭
তথ্যসূত্র:
1. Saba Mahmud, ‘Secularism, Hermeneutics, and Empire: The Politics of Islamic Reformation.’ Public Culture, 18 (2), 2006, 323 (323-347)
2. Jurgan Habermas, ‘Religion in the Public Sphere’, European Journal of Philosophy, 14 (1), 2006, 16 (1-25)
3. Richard Ekins, ‘Secular Fundamentalism and Democracy’, Journal of Markets and Morality, 8 (1), Spring 2005, 82 (81-93).
4. George Jacob Holyoake, The Principles of Secularism. 3rd ed rev. London: Austin, 1870, 11.
5. Charles Taylor, ‘Modes of Secularism’, in Rajeev Bhargava, ed., Secularism and Its Critics, New Delhi: Oxford University Press, 1998, 31.
6. Nader Hashmi, Islam, Secularism and Liberal Democracy: Toward a Democratic Theory for Muslim Societies, Oxford: Oxford University Press, 2009, 106.
7. The Turkish Constitutional Court, 16 January 1998, no. 1998/1.
8. Saba Mahmood, Politics of Piety: The Islamic Revival and the Feminist Subject, Princeton: Princeton University Press, 2005, 191.
9. Peter L Berger, ‘Some Second Thoughts on Substantive versus Functional Definitions of Religion’, Journal for the Scientific Study of Religion, 13 (2), June, 1974, 132, (125-133).
10. Jose Casanova, Public Religions in the Modern World, Chicago: University of Chicago Press, 1994.
11. সেক্যুলারকরণের কোনো একক তত্ত্ব কখনো ছিল না, তবে এসব তত্ত্বের মধ্যে সেক্যুলারকরণ প্রক্রিয়ার শেষ পরিণতি বিষয়ে একটি বৃহত্তর মতৈক্য রয়েছে।
12. দেখুন, ১৯৬৬ সালের ৮ এপ্রিলের সাপ্তাহিক টাইম ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদ; সাপ্তাহিক দ্য ইকোনমিস্ট পত্রিকার ২৩ ডিসেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত The ‘obituary’ of God; তবে দ্য ইকোনমিস্ট ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর সংখ্যায় লিখেছে ‘এই শতকের রাজনীতিতে ধর্ম একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।’
13. Peter L. Berger, ‘Secularism in retreat’, The National Interest. 46, Winter 1996; 3
14. David Herbert, Religion and Civil Society: Rethinking Public Religion in the Contemporary World. Aldershot, England: Ashgate, 2003
15. T N Madan, ‘Secularism in Its Place,’ in Rajeev Bhargava (ed.), Secularism and Its Critics, New Delhi: Oxford University Press, 2005, 308 (297-320).
16. তালাল আসাদের সাক্ষাত্কার, সাক্ষাত্কার নেন Saba Mahmood, SEHR, 5 (1), 1996 (http://web.stanford.edu/group/SHR/5-1/text/asad.html).
17. Elizabeth Shakman Hurd, The Politics of Secularism in International Relations. Princeton: Princeton University Press, 2008, 13.
18. Craig Calhoun. ‘The Political Future of Religion and Secularism.’ La Clé des Langues (Lyon: ENS LYON/DGESCO). ISSN 2107-7029. Mis à jour le 21 février 2013. http://cle.ens-lyon.fr/anglais/the-political-future-of-religion-and-secularism-180922.kjsp
19. Anders Berg-Sorensen, ‘Introduction: Contesting Secularism’ in Andres Berg-Sorensen (ed.), Contesting Secularism, Surrey, England: Ashgate, 2013, 2.
20. Ashish Nandy, ‘The Politics of Secularism and the Recovery of Religious Tolerance’ in Rajeev Bhargava (ed.), Secularism and Its Critics, New Delhi: Oxford University Press, 2005, 321 (321-343). ‰es
21. Craig Calhoun. ‘The Political Future of Religion and Secularism.’ 2013
22. Philip Gorski, David Kyuman Kim, John Torpey and Jonathan VanAntwerpen, ‘The Post-Secular in Question’ in Gorski et al (eds.), The Post-Secular in Question: Religion in Contemporary Society, New York: NYU Press, 2012, 6.
23. Jose Casanova, Public Religions in the Modern World, Chicago: University of Chicago Press, 1994; ‘Public Religions Revisited,’ in Hent de Vries (ed.). Religion: Beyond the Concept, Fordham: Fordham University Press, 2008, pp. 101-119; ‰es ‘Rethinking Secularization: A Global Comparative Perspective’, The Hedgehog Review, Spring & Summer 2006, 7-22.
24. Alfred Stepan, ‘The World’s Religious Systems and Democracy: Crafting the “Twin Tolerations”,’ in Arguing Comparative Politics Oxford: Oxford University Press, 2001), pp. 218-225.
25. Charles Taylor, ‘Why We Need a Radical Redefinition of Secularism’, in The Power of Religion in the Public Sphere, Judith Butler, Jurgen Habermas, Charles Taylor, Cornel West, Edited by Eduardo Mendieta and Jonathan VanAntwerpen. New York: Columbia University Press, 2011
26. Rajeev Bhargava, ‘Multiple Secularisms and Multiple Secular States’ in Andres Berg-Sorensen (ed.), Contesting Secularism, Surrey, England: Ashgate, 2013, 17-42.
27. Larry Diamond, in Larry Diamond, Marc F. Plattner and Philip J. Costopoulos (eds.) World Religions and Democracy, Stanford: Stanford University Press, 2005.
28. Bhargava, ‘Multiple Secularisms and Multiple Secular States’, 2013, 34 (17-42).
29. Jose Casanova, ‘The Secular and Secularisms’, Social Research, 76 (4), The Religious-Secular Divide: The U.S. Case, Winter 2009, 1051 (1049-1066).
30. Ahmet T. Kuru, Secularism and State Policies toward Religion. New York: Cambridge University Press, 2009.
31. Oilvier Roy, Secularism Confronts Islam, New York: Columbia University Press, 2007, xii
32. Roy, Secularism Confronts Islam, 2005, 11.
33. Stanley J Tambiah, ‘The Crisis of Secularism in India’ in Rajeev Bhargava (ed.), Secularism and Its Critics, New Delhi: Oxford University Press, 2005, 422 (418-452).
34. Achin Vanaik, The Furies of Indian Communalism: Religion, Modernity and Secularization, London: Verso, 1997, 68.
35. Vanaik, The Furies of Communalism, 1997, 66.
36. Craig Calhoun, ‘Time, World, and Secularism’, in Philip Gorski, David Kyuman Kim, John Torpey and Jonathan VanAntwerpen (eds.), The Post-Secular in Question: Religion in Contemporary Society, New York: NYU Press, 2012, 346 (335-364).
37. Teodor Shanin, ‘Class, State and revolutions: Substitutes and Realities’, in Hamza Alavi and Teodor Shanin (eds.), Introduction to the Sociology of the ‘Developing Societies,’ New York: Monthly Review Press, 1982, 315.
38. Vanaik, The Furies of Communalism, 1997, 39.
39. Mark Juergensmeyer, The New Cold War? Religious Nationalism Confronts the Secular State. California: University of California Press. 1994, 2
40. William F.S. Miles, ‘Political Para-theology Rethinking Religion, Politics and Democracy’, Third World Quarterly, 17, 1996: 525 (525-536)
41. Ali Riaz, God Willing: The Politics of Islamism in Bangladesh. Lanham, MD: Rowman and Littlefield, 2004; Salwa Ismail, Rethinking Islamist Politics Culture, the State and Islamism. London: I B Tauris. 2006; Francois Burgat, Face to Face with Political Islam. London: I B Tauris. 2003; Bobby S Sayyid, A Fundamental Fear: Eurocentrism and the Emergence of Islamism. London: Zed Books. 1997. দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনার জন্য দেখুন, Ali Riaz (ed.), Religion and Politics in South Asia, London: Routledge, 2010.
42. Ashutosh Varshney, ‘Contested Meanings: India’s National Identity, Hindu Nationalism, and the Politics of Anxiety’, Daedalus, 122 (Summer 1993): 242.
43. Ashutosh Varshney, ‘Contested Meanings’, 243
44. Vanaik, The Furies of Communalism, 1997, 38.
45. T N Madan, ‘Secularism in Its Place’, The Journal of Asian Studies, 46 (4), Nov 1987, pp. 753 (747-759).
46. Charles Taylor, ‘The Meaning of Secularism’, The Hedgehog Review, Fall 2010, 25 (23-34).
47. Vincent Pecora, ‘Rethinking secularism: Secularism, secularization, and why the difference matters’, The Immanent Frame, SSRC, 2010; http://blogs.ssrc.org/tif/2010/06/18/why-the-difference-matters/