সম্পাদকীয়

প্রতিবারের মতো এ সংখ্যায় রাজনীতি-অর্থনীতি-সমাজের মতো প্রসঙ্গগুলো ধর্ম-ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক ও ঔপনিবেশিক আমলে সম্পদ লুণ্ঠন ইত্যাদি শিরোনামে একত্র করা হয়েছে। গুরুত্ব দিয়ে তুলে আনা হয়েছে পরিবেশ প্রসঙ্গটি।

সম্প্রতি আমাদের সরদার ফজলুল করিমকে আমরা হারিয়েছি। দার্শনিক, আজীবন জ্ঞান অনুশীলনকারী এ মানুষটির প্রতি রইল কৃতজ্ঞতা। আমরা তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি। 

ভারতে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিজেপির নিরঙ্কুশ বিজয়ের পর উপমহাদেশের রাজনীতিতে ধর্ম আবারও নতুনভাবে স্থান করে নেয় কি না, সে আশঙ্কা নতুনভাবে দেখা দিচ্ছে। এ পরিপ্রেক্ষিতটি বিবেচনায় নিলে, আকবর আলি খানের লেখাটি বর্তমান বাংলাদেশের সমাজবাস্তবতায় একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ বলে বিবেচিত হয়েছে। ভারত উপমহাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সাম্প্রদায়িক সম্প্রতির বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। লেখক এই প্রবন্ধে বাংলা অঞ্চলে হিন্দু-মুসলিম বিভক্তিসহ এ দুটি ধর্মের অভ্যন্তরীণ বিভেদগুলোর ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা আলোচনা করেছেন। এ অঞ্চলে ইসলাম ধর্মের বিস্তার কীভাবে হলো সে সম্পর্কে ভুল ধারণাগুলোও খণ্ডন করার চেষ্টা করেছেন। ভবিষ্যতে ধর্মীয় ও জাত-পাত ভেদাভেদের সঠিক ইতিহাস পর্যালোচনার মাধ্যমে সামাজিক সম্প্রতি তৈরির পথে ভুলগুলো শুধরে নেওয়া সহজ হবে।

ভারতের নির্বাচন উত্তর পরিস্থিতিতে, বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতের অবস্থান; তথা বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের বিষয়টি  নতুনভাবে আলোচনায় আসছে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় হলো দেশ দুটির পরস্পর সম্পর্কে নেতিবাচক ভাবমূর্তি বা আস্থার সংকট। এই ভাবমূর্তিটি গড়ে উঠেছে কেন এবং তা প্রতিনিয়ত চলমান থাকার কারণ কী সে সম্পর্কে আলোচনা করেছেন ইমতিয়াজ আহমেদ। সমস্যার মূল খুঁজে বের করতে পারলে তার সমাধানের পথ সহজ হয়ে যায়। সে প্রচেষ্টাকে সামনে রেখেই দুদেশের মধ্যে আস্থার সম্পর্ক তৈরির পথে অবিশ্বাসের কারণগুলো দেখা দরকার। এই আস্থাহীনতার ফলে দুদেশই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এর ফলে দুদেশেই সমাজ, অর্থনীতি ও রাজনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

বাংলাদেশের গণতন্ত্রের যাত্রায় উপনিবেশবাদের প্রত্যক্ষ প্রভাব যে এখনো আমাদের তাড়িয়ে বেড়ায় তার উদাহরণ পাওয়া যাবে সাঈদ ইফতেখার আহমেদের প্রবন্ধে। ঐতিহাসিক পর্যালোচনার পাশাপাশি আমরা বর্তমান রাজনীতি এবং সামাজিক কাঠামোয় তা কীভাবে গেড়ে বসেছে তার প্রতিচ্ছবি দেখতে পাই সবস্তরে ঔপনিবেশিক ধারণাসমূহের অন্ধ অনুকরণে। আকবর আলি খানের লেখায় ধর্মীয় বিভাজনের ঐতিহাসিক ব্যাখ্যায় আমরা যা দেখতে পাই, সেটি ইফতেখারের লেখায় এসে পূর্ণতা পায়। শুধু গণতন্ত্র নয়, ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণাও এ দেশের সমাজবাস্তবতাকে বিবেচনায় না নিয়ে অনুকরণ করার ফলে ধর্মীয় উগ্রবাদী গোষ্ঠীর উত্থান হয়েছে এবং গণতন্ত্র চর্চার ক্ষেত্রকে সংকুচিত করেছে। 

বাংলাদেশই শুধু নয়, বর্তমান বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তন ও তার নেতিবাচক প্রভাব একটি ভয়াবহ বিপর্যয় নিয়ে হাজির হয়েছে। স্থানীয় মানুষ বহুকাল ধরে প্রাকৃতিকভাবেই তাদের প্রতিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিচ্ছিল। বিভিন্ন প্রাকৃতিক সংকেতের মাধ্যমে তারা তা সম্পাদন করে আসছে। কীভাবে স্থানীয় জনগণ তাদের লোকায়ত জ্ঞানের মাধ্যমে জলবায়ুর সঙ্গে বসবাস করে, সে সম্পর্কে পাভেল পার্থের লেখায় বিস্তারিত ধারণা পাওয়া যাবে। বাংলাদেশের জলবায়ু ভাবনায় এসব লোকায়ত জ্ঞান অত্যধিক গুরুত্ব বহন করে। জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলায় এটি অবদান রাখবে।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির বহুল আলোচিত-সমালোচিত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যদিও সাময়িক পরিত্রাণ মিলেছে, তবু একটি অনিশ্চয়তাপূর্ণ রাজনৈতিক পরিস্থিতির উপস্থিতি এখনো পুরোপুরি বর্তমান। মওদুদ আহমদ রচিত বাংলাদেশের রাজনীতির বিশদ বর্ণনামূলক গ্রন্থ বাংলাদেশ : এ স্টাডি অব দ্য ডেমোক্রেটিক রেজিমস বইটি তাই পর্যালোচনার দাবি রাখে। ব্যক্তি মওদুদের চেয়ে একাডেমিক মওদুদের ভূমিকা অধিকতর গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত। বই আলোচনায় মিজানুর রহমান খান মূল লেখকের যুক্তির সঙ্গে নিজস্ব সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গির সংমিশ্রণে সমসাময়িক রাজনৈতিক বাস্তবতার একটি প্রাঞ্জল চিত্র তুলে ধরেছেন।

আসজাদুল কিবরিয়া গ্রাহাম ই ফুলারের আ ওয়ার্ল্ড উইদাউট ইসলাম গ্রন্থটি আলোচনা করেছেন। ইসলাম ধর্মকে নিয়ে সারা দুনিয়ায় দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মুূহূর্তে এই ধরনের একটি বই খুবই তাত্পর্যপূর্ণ। যেটি ধরে নেওয়া হয় যে ইসলাম না থাকলে দুনিয়ায় কোনো সন্ত্রাসবাদ থাকত না, সেই ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে এখানে। সভ্যতার সংঘাতের মতো ভ্রান্ত ধারণা দিয়ে প্রাচ্য ও প্রতিচ্যের মধ্যে যে দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক জিইয়ে রাখা হয়েছে, তার একটা কড়া জবাবের প্রচেষ্টা এই বইটি।