সম্পাদকীয়

শুরুতেই আমরা প্রতিচিন্তার উপদেষ্টা পর্ষদের সদস্য অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে ভারত সরকার কর্তৃক পদ্মভূষণ পুরষ্কার লাভের জন্য অভিনন্দন জানাচ্ছি। তাঁর এ প্রাপ্তিতে প্রতিচিন্তা পরিবার গভীরভাবে আনন্দিত ও গর্বিত। আমরা তাঁর সুস্বাস্থ্য কামনা করি। প্রতিবারের মতো এই সংখ্যাটিতে অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজসহ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়টি আলোকপাত করা হয়েছে।

জাতীয়তাবাদের প্রশ্নে বাংলাদেশ যে সংকটকাল পার করছে, সেটার একটি মূল্যায়ন করেছেন বদরুল আলম খান। ভবিষ্যত্ বাংলাদেশের, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম, কোন ধারায় তাদের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ-দর্শন, সংস্কৃতি ইত্যাদি নিয়ে এগোবে; এটি কি ইসলামবহির্ভূত বাঙালি জাতীয়তাবাদ, না ইসলামি জাতীয়তাবাদ? আত্মপরিচয় নির্ধারণের কি একটি মাত্র পথই খোলা আছে? এসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মাধ্যমে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিশ্লেষণ করেছেন লেখক।

মহিউদ্দিন আহমেদ নবধারার নাগরিক আন্দোলনের উদ্ভব, বিকাশ এবং বর্তমান অবস্থা তুলে ধরতে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে নাগরিক সমাজের ভূমিকা আলোচনার পাশাপাশি আমাদের দেশে এর অবস্থা ব্যাখ্যা করেছেন। বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সিভিল সোসাইটি বা নাগরিক সমাজের দায়িত্ব-কর্তব্য এবং রাষ্ট্রের সঙ্গে এর সম্পর্কের ধরন বিশ্লেষণে এই ধরনের আলোচনা তাত্পর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করি।

হায়দার আলী খানের লেখাটি বর্তমান বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই লেখায় অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করতে কোন ধরনের রাজনৈতিক সংস্কার দরকার, সেটি বুঝতে সাহায্য করবে। রাজনৈতিক সমস্যাগুলো কোথায় সে বিষয়ে লেখক গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রশ্নের মাধ্যমে আলোচনা এগিয়ে নিয়ে গেছেন। এ ছাড়া, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সক্ষমতা বা শক্তির জায়গাগুলো আলোচনার মাধ্যমে আমাদের সম্ভাবনাময় ভবিষ্যত্ আঁকার চেষ্টা করেছেন। অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে লেখক পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর উদাহরণ দিয়ে বাংলাদেশে কোন কৌশলগুলো কেন প্রয়োগ করা যাবে এবং কোনগুলো যাবে না তার বিশ্লেষণ দাঁড় করিয়েছেন।

বাংলাদেশের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় খাতগুলোর মধ্যে পোশাক খাত অন্যতম। সাম্প্রতিক সময়ে পোশাক কারখানাগুলোতে দুর্ঘটনা এবং হতাহতের ঘটনা বাংলাদেশসহ আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়। এই খাতের মূল সমস্যা হলো সামাজিক কমপ্লায়েন্স বিষয়টি। শ্রমিকদের শারীরিক সক্ষমতা ও কর্মপরিবেশগত উন্নয়নের জন্য এই বিষয়টি অত্যাবশ্যকীয়। খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম ও ফারজানা সেহরীনের লেখাটি সে বিষয়ে আলোকপাত করেছে। আন্তর্জাতিক উত্পাদন চেইনে বাংলাদেশের পোশাক খাতের প্রতিযোগিতা সক্ষমতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে এই খাতে শ্রমিক ইস্যু সম্পর্কিত সামাজিক অগ্রগতির অবস্থা কী, তা-ই এই আলোচনার মূল প্রতিপাদ্য।

গণতান্ত্রিক ধারায় উত্তরোত্তর উন্নয়নের জন্য একটি দেশের সামরিক-বেসামরিক সম্পর্কটি বেশ গুরুত্ববহ। এই সম্পর্ক সুষ্ঠুভাবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর পেশাদারি বৃদ্ধি অত্যধিক তাত্পর্য বহন করে। জাতিসংঘের মতো একটি বহুজাতিক সংস্থার অধীনে শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণ নিঃসন্দেহে সেনাবাহিনীর পেশাদারি বৃদ্ধিতে অন্যতম ভূমিকা পালন করে। এ বিষয়ে রাশেদ উজ জামান ও নিলয় রঞ্জন বিশ্বাসের লেখাটি বাংলাদেশের শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণের যৌক্তিকতা, এর সামনে চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা বিশ্লেষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

বই আলোচনা অধ্যায়ে এবার মিজানুর রহমান খানের মার্কিন দলিলে মুজিব হত্যাকাণ্ড এবং গ্যারি জে বাসের ব্লাড টেলিগ্রাম: নিক্সন, কিসিঞ্জার অ্যান্ড ফরগটেন জেনোসাইড গ্রন্থদ্বয়ে আলোচনা করা হয়েছে। প্রথমটি আলোচনা করেছেন আ স ম আলী আশরাফ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পেছনে সম্ভাব্য মার্কিন সম্পৃক্ততা খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হয়েছে এই বইটিতে। মার্কিন দলিলপত্রে সে বিষয়ে কী প্রমাণাদি রয়েছে, তারও একটি ভালো বিশ্লেষণ রয়েছে। লেখক তাঁর লেখায় সমালোচকের দৃষ্টিকোণ থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন রেখেছেন, যা মুজিব হত্যাকাণ্ড নিয়ে পরবর্তী গবেষকদের সহায়তা করবে বলে মনে করি।

দ্বিতীয় বইটি নিয়ে আলোচনা করেছেন খলিলউল্লাহ্। এই বইয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য বৃহত্ শক্তির ভূমিকা কী ছিল এবং ইন্দো-মার্কিন সম্পর্ক কীভাবে মুক্তিযুদ্ধকে স্নায়ুযুদ্ধের অংশে পরিণত করে, তার গুরুত্বপূর্ণ তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়। কারণ, হোয়াইট হাউসে তত্কালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন এবং তাঁর নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জারের মধ্যকার কথোপকথনের অডিও টেপ সাম্প্রতিক সময়ে এসে অবমুক্ত হয়েছে। এই বইটির একটি গুরুত্বপূর্ণ উত্স হচ্ছে সেসব অডিও টেপ। লেখক এই বইয়ের আলোকে ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে বিশ্লেষণ করেছেন।