বর্তমান বিশ্বে দক্ষিণ পন্থার উত্থান প্রবণতাটি স্পষ্টভাবে লক্ষণীয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নির্বাচনে দক্ষিণপন্থী দলগুলো বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসছে। এই ডামাডোলে রাজনৈতিক ইসলামের উত্থানের পাশাপাশি উগ্র জাতীয়তাবাদ ও অভিবাসনবিরোধী শক্তিগুলো ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে এসেছে। এই দুই দলই একে অপরের পরিপূরক শক্তি হিসেবে কাজ করছে। যে কারণে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মুসলিম ও অভিবাসনবিরোধী হিসেবে পরিচিত দক্ষিণপন্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয়ে জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট উল্লাস প্রকাশ করেছে। যেসব ঘৃণাপূর্ণ বক্তব্য দ্বারা ট্রাম্প তার জনসমর্থন আদায়ের চেষ্টা করেছে, সেগুলোই দক্ষিণপন্থী ইসলামিক স্টেটের পাল্টা বক্তব্য হিসেবে জনসমর্থন আদায়ে সহায়ক হবে বলে তারা মনে করে।
সাম্প্রতিক সময়ে ইউরোপে উগ্র জাতীয়তাবাদ এমন আকার ধারণ করেছে যেখানে মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোও সহিষ্ণুতা, উদারতা ও বৈচিত্র্যপূর্ণ সমাজব্যবস্থার মূলনীতি থেকে সরে আসতে বাধ্য হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের আগে যুক্তরাজ্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে আসে, যার পেছনে মূল নিয়ামক ছিল অভিবাসনবিরোধী আন্দোলন। ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস ও অন্যান্য ইউরোপীয় দেশে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যপদ বিষয়ে ব্রেক্সিটের মতো গণভোটের দাবি উঠেছে।
ডান পন্থার উত্থানের পেছনে অর্থনৈতিক সংকট থেকে আবির্ভূত হতাশা, প্রত্যাশা পূরণ না হওয়া এবং অর্থনৈতিক অসমতাকে অনেকে দায়ী করে থাকে। কিন্তু শুধু অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ দিয়ে এর পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। এর জন্য প্রয়োজন আরও বিস্তৃত দৃষ্টিভঙ্গি। সাম্প্রতিক কালে ‘ইসলামিক স্টেট’ সারা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তাদের জঙ্গিবাদী কার্যক্রম শুধু মধ্যপ্রাচ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বিশ্বের নানা দেশ এবং হাজার হাজার সাধারণ মানুষ তাদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। বাংলাদেশও জঙ্গি হামলায় আক্রান্ত হয়েছে। তাই ‘ইসলামিক স্টেট’ নামক গোষ্ঠী সম্পর্কে বিশদভাবে ওয়াকিবহাল থাকা জরুরি বলে আমরা মনে করি। এই বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি রেখেই প্রতিচিন্তার এই সংখ্যায় ছাপানো হয়েছে বদরুল আলম খানের ‘জঙ্গিবাদের আবর্তে বিশ্বরাজনীতি’ শীর্ষক প্রবন্ধটি। এই প্রবন্ধে আইএস-এর আবির্ভাব কী কারণে হলো, কেন এত বর্বরতা দিয়ে সে তার আদর্শকে প্রকাশ করছে এবং তার ভবিষ্যত্ কী—এই দিকগুলো বিস্তারিতভাবে আলোচিত হয়েছে।
দক্ষিণপন্থী শক্তিগুলোর উত্থানের পেছনে বিশ্বরাজনীতির ভূমিকা রয়েছে। বাংলাদেশেও আমরা দেখেছি দক্ষিণপন্থী শক্তিগুলো বিভিন্ন সময়ে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এসব শক্তি কখনোই একেবারে শেষ হয়ে যায়নি। আর্থসামাজিক বৈষম্য দক্ষিণ পন্থার উত্থানে বড় ভূমিকা রাখে, সে কথাও অনস্বীকার্য। বিশ্বব্যাপী যে বৈষম্য বিরাজমান তার স্বরূপ হিসেবে বলা যায়, বিশ্বের এক ভাগ মানুষ বাকি নিরানব্বই ভাগের চেয়ে বেশি সম্পদের মালিক। বাংলাদেশেও একই রকম বৈষম্য আমরা দেখতে পাই। এর মূল কারণ নিহিত সম্পদের বণ্টন-প্রক্রিয়ার মধ্যে। তবে এক্ষেত্রে ঐতিহাসিক কারণগুলো এই বিশ্লেষণের জন্য খুব জরুরি।
উপমহাদেশের ইতিহাসে যে কয়জন নারীর অবদান অনস্বীকার্য, লীলা নাগ তাদের অন্যতম। তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দুজন ছাত্রীর একজন। তিনি ছিলেন নারীমুক্তি এবং ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম অগ্রবর্তী নারী কর্মী। তিনি ছিলেন বিনা বিচারে আটক প্রথম ভারতীয় নারী রাজবন্দী। এই রাজনীতিসচেতন বিপ্লবী নারীকে নিয়ে আলোচনা করেছেন নারীনেত্রী ও গবেষক মালেকা বেগম। তাঁর প্রবন্ধের শিরোনাম ‘লীলা নাগ ও তাঁর জীবনসাধনা’। এই প্রবন্ধ পাঠকদের লীলা নাগ সম্পর্কে আরও বেশি জানতে উত্সাহিত করবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। লীলা নাগকে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য করা তত্কালীন পাকিস্তান রাষ্ট্রের দক্ষিণ পন্থার একটি উদাহরণ। পাকিস্তান রাষ্ট্র শুধু সাধারণ মানুষকেই নয়, লীলা নাগের মতো অসংখ্য প্রতিভাবান ব্যক্তিত্বকে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির মাধ্যমে দেশত্যাগে বাধ্য করেছিল।
সম্প্রতি বাংলাদেশের কাছে পাকিস্তান তাদের ‘অনাদায়ী সম্পদের পাওনা’ দাবি করবে বলে গণমাধ্যমে আমরা দেখতে পাই। যদিও রাষ্ট্রীয় উত্তরাধিকারের ভিত্তিতে বাংলাদেশই পাকিস্তানের কাছে বিস্তর পাওনার দাবিদার। এ বিষয়ক বিস্তারিত হিসাবনিকাশ প্রতিচিন্তার অক্টোবর-ডিসেম্বর ২০১৫ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে। ব্রিটিশ আমলের সম্পদ পাচার এবং বৈষম্যের বোঝা ঘাড়ে নিয়ে যে রাষ্ট্র জন্ম নিল, সেই পাকিস্তানের শাসকশ্রেণি বৈষম্যকে রাষ্ট্রীয়ভাবে কাঠামোবদ্ধ করেছিল। সে কাঠামো আজকের বাংলাদেশ থেকে পুরোপুরি দূর হয়েছে কি না তা তর্কসাপেক্ষ। বর্তমান বাংলাদেশে বৈষম্যকে বুঝতে হলে বাংলাদেশের প্রতি পাকিস্তানের বৈরী নীতি ও বৈষম্যকে আরও ভালোভাবে জানা প্রয়োজন। একই সাথে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশে উগ্রবাদ বা দক্ষিণপন্থী শক্তিগুলোর উত্থান বিষয়ে আলোচনা করতে হলে বিশ্বরাজনীতির যে প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ রাষ্ট্র জন্ম নিল তা তখনকার বিশ্বরাজনীতির খেলোয়াড়দের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বোঝা প্রয়োজন। প্রতিচিন্তার এবারের সংখ্যায় তত্কালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের লেখকদের বাংলাদেশ সম্পর্কে বিশ্লেষণ ছাপানো হয়েছে। এসব লেখায় শুধু ঘটনার বর্ণনা আমাদের উপজীব্য নয়, ঘটনা বিশ্লেষণের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিই আমাদের মূল নজর।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের সবচেয়ে আলোচিত ব্যক্তিত্ব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। একজন ব্যক্তি একটি রাষ্ট্র গঠন-প্রক্রিয়ায় কী ধরনের অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারেন, মুজিব তার উত্কৃষ্ট উদাহরণ। মুজিবের জীবন নিয়ে অনেক আলোচনা হলেও তাঁর নেতৃত্বগুণের সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ যথাযথভাবে হয়নি। এই শূন্যতা পূরণের লক্ষ্যে প্রতিচিন্তার এই সংখ্যায় ছাপা হলো ‘শেখ মুজিবুর রহমান: একটি ঝড় ও বাংলাদেশের অভ্যুদয়’ শিরোনামের প্রবন্ধটি। এই প্রবন্ধের লেখক মার্কিন সমাজতাত্ত্বিক জন পি থর্প। লেখক এই প্রবন্ধে শেখ মুজিবুর রহমানের সৃষ্ট বিশেষ বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধ কীভাবে ধীরে ধীরে জন-আকাঙ্ক্ষায় পরিণত হয় তার সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করেছেন। এর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে চলমান আলোচনায় নতুন মাত্রা যোগ হবে বলে আমরা প্রত্যাশা করি।
মুক্তিযুদ্ধ কোনো একমাত্রিক বিষয় ছিল না। এর সঙ্গে জড়িত ছিল জাতীয়, আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক বহু বিষয়। ফলে মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাপ্রবাহের বর্ণনায় আমরা বৈচিত্র্য খুঁজে পাই। মুক্তিযুদ্ধ সময়কার ঘটনাপ্রবাহের যেসব বর্ণনা আমরা দেখতে পাই, তার মধ্যে অন্যতম তথ্যসমৃদ্ধ এবং সূক্ষ্ম বর্ণনাগুলো করেছেন তত্কালীন এই অঞ্চলে কর্মরত বিদেশি সংবাদকর্মীরা। এই বর্ণনাগুলো মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অন্যতম প্রধান রসদ বলে আমরা মনে করি। ফলে প্রতিচিন্তার এই সংখ্যায় ছাপা হলো সোভিয়েত সংবাদকর্মী বরিস কালিয়াগিন এবং ভ্লাদিমির স্কসিরিওভের মুক্তিযুদ্ধকালীন ডায়েরির অংশবিশেষ। ১৯৭১ সালে যখন বাংলাদেশের জন্ম হলো এবং যখন রাষ্ট্রটি তার জীবনের প্রথম পদক্ষেপগুলো ফেলছে, সে সময়ের কিছু কথাই উঠে এসেছে এই প্রবন্ধে। এই প্রবন্ধটির শিরোনাম ‘বাংলার ডায়েরি’।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের পটভূমি ব্যাখ্যা করতে গেলে নিশ্চিতভাবেই এই অঞ্চলের ওপর পাকিস্তানি রাষ্ট্রব্যবস্থার চাপিয়ে দেওয়া নীতির প্রসঙ্গটি চলে আসে। অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাসের লক্ষ্যে উত্থাপিত হয়েছিল ঐতিহাসিক ছয় দফা। ছয় দফা রচিত হয়েছিল ‘দুই অর্থনীতি’র তত্ত্বের ভিত্তিতে। এই ‘দুই অর্থনীতি’ তত্ত্বের প্রবক্তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন রেহমান সোবহান। সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে তাঁর স্মৃতিকথা আনট্রাঙ্কুয়েল রিকালেকশনস: দ্য ইয়ারস অব ফুলফিলমেন্ট। স্মৃতিকথা হলেও এই বইয়ে উঠে এসেছে ওই সময়ের ঘটনাপ্রবাহ এবং ইতিহাসের নানা চরিত্র। ফলে বইটি হয়ে উঠেছে ইতিহাসের এক নির্মোহ দলিল। প্রতিচিন্তার এই সংখ্যায় বই আলোচনা অংশে এই বইটি নিয়ে ‘এক তরুণ শিক্ষকের অ্যাকটিভিস্ট হয়ে ওঠার গল্প’ শিরোনামে লিখেছেন মহিউদ্দিন আহমদ।
এই বিষয়টি এখন স্বীকৃত যে তত্কালীন পূর্ববঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শাসন ছিল ঔপনিবেশিক কায়দার। পাকিস্তানের ভাঙনের যে কয়টি মূল কারণ, তার মধ্যে এই অর্থনৈতিক বৈষম্য একটি অন্যতম প্রধান বিষয় ছিল। এই বিষয়টির উপর পাঠকদের বিস্তারিতভাবে অবহিত করার প্রত্যাশায় প্রতিচিন্তার এই সংখ্যার বই আলোচনা অংশে ছাপানো হলো ১৯৭১ সালে প্রকাশিত ডি. আর. মানকেকারের বইপাক কলওনিয়্যালিজম ইন ইস্ট বেঙ্গল নিয়ে আলোচনা। ‘পূর্ববঙ্গে পাকিস্তানি উপনিবেশবাদ’ শিরোনামের বই আলোচনাটি করেছেন মো. ফজলে রাব্বি।