সংকটের দুষ্টচক্রে ছিটমহলের মানুষ:একটি বিনিময়-উত্তর পর্যালোচনা

সারসংক্ষেপ

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে ২০১৫ সাল ছিল নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ বছর। এ বছর বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ১৯৭৪ সালে স্বাক্ষরিত ঐতিহাসিক স্থলসীমা চুক্তিটি সুদীর্ঘ ৪১ বছর পর ভারতের পার্লামেন্টের অনুসমর্থন (ratification) লাভ করে। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বিদ্যমান সীমান্ত সমস্যা নিরসন ও ছিটমহল বিনিময়ের মতো বিষয়গুলো ৪১ বছর ধরে ওই অনুসমর্থনের অপেক্ষায় ছিল। বলাবাহুল্য, ছিটমহলে অবরুদ্ধ মানুষদের মুক্তির দাবিতে উভয় দেশে গড়ে ওঠা জনমতের চাপে ছিটমহল বিনিময়কে সামনে রেখেই স্থলসীমা চুক্তি ভারতীয় পার্লামেন্টে অনুসমর্থিত হয়। অবশেষে ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই মধ্যরাতে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ছিটমহল বিনিময় কার্যকর হয়। ফলে প্রায় ৫২ হাজার ‘ছিটের লোক’-এর জীবন থেকে ৬৮ বছরের অবরুদ্ধতার অবসান ঘটেছে। মিলেছে রাষ্ট্র ও নাগরিক পরিচয়। মিলেছে জীবনের নিরাপত্তা ও মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা। কিন্তু ছিটমহল বিনিময় হলেও সাবেক ছিটমহলবাসীর জীবন-জীবিকায় রাষ্ট্রহীন সাত দশকের পুঞ্জীভূত কিছু সমস্যার যেমন সমাধান হয়নি, অন্যদিকে ছিটমহল বিনিময়ের প্রক্রিয়ায় নতুন করে আরও কিছু সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। ফলে উভয় দেশের বিলুপ্ত ছিটমহলের মানুষদের অনেকেই এখনো নানামুখী সংকটের মুখে। সবচেয়ে বড় কথা কিছু মানুষ এখনো নাগরিকত্বই পায়নি। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিলুপ্ত ছিটমহলের মানুষদের জীবন-জীবিকার কিছু সমস্যা ও সংকটকেই এই প্রবন্ধের বিষয়বস্তু করা হলো।

মুখ্য শব্দগুচ্ছ

ছিটমহল বিনিময়, বিলুপ্ত ছিটমহলের মানুষ, ‘নেই-মানুষ’, ভারতে প্রত্যাগমনকারী, ‘ছিটমহল শিবির’, সংকট, নাগরিকত্ব, শিক্ষা সনদ, জমির মালিকানা, পুনর্বাসন।

ভূমিকা

নানা উত্থান-পতন সত্ত্বেও ভারত ও বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক সর্বদাই ‘বন্ধুত্বপূর্ণ’ থেকেছে। এই দুই দেশের মধ্যে কখনো বড় রকমের কোনো সীমান্ত সংঘর্ষও ঘটেনি। তবুও ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত এখন পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বিপজ্জনক সীমান্ত হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। এর মূল কারণ সম্ভবত অবিচ্ছেদ্য এলাকার ওপর দিয়ে চাপিয়ে দেওয়া র্যাডক্লিফ সীমানায় ভারতের বিপজ্জনক কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ এবং সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর নির্বিচারে বাংলাদেশি মানুষ হত্যা। কেবল সীমান্ত পারাপারকারীদেরই হত্যা করা হয়নি, হত্যা করা হয়েছে সীমান্তবর্তী কৃষিখেতে কর্মরত অনেক কৃষককেও। বিএসএফের নির্যাতন থেকে বাদ যায়নি শিশু-কিশোরও। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী মানুষের ওপর বিএসএফের নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ড প্রায় নিত্যদিনের ঘটনায় পরিণত হয়েছে। অন্যদিকে ভারতের নদী আগ্রাসনের কারণে এক ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে বাংলাদেশের সমগ্র উত্তরাঞ্চল। শুকিয়ে যাচ্ছে ‘নদীমাতৃক’ বাংলাদেশের সব নদ-নদী। একটি দেশ যখন তার ভাটিতে অবস্থিত আরেকটি প্রতিবেশী দেশকে যৌথ (আন্তর্জাতিক) নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত করে মরুকরণের দিকে ঠেলে দেয় তখন ওই দুই দেশের সম্পর্ক কতটা বন্ধুত্বপূর্ণ, কতটা প্রতিবেশীসুলভ তা নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হয় বৈকি। তদুপরি ২০১৪ সালে আন্তর্জাতিক আদালতে ভারত-বাংলাদেশ সমুদ্রসীমা-সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তি এবং ২০১৫ সালে ছিটমহল বিনিময়ের মধ্য দিয়ে দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে আস্থা বৃদ্ধি পেয়েছে। অবিলম্বে তিস্তার পানির ন্যায্য বণ্টনের মধ্য দিয়ে এই সম্পর্ক আরও অনেক বেশি দৃঢ় করা সম্ভব।

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে ২০১৫ সাল ছিল নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ বছর। এ বছর বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ১৯৭৪ সালে স্বাক্ষরিত ঐতিহাসিক স্থলসীমা চুক্তিটি সুদীর্ঘ ৪১ বছর পর ভারতের পার্লামেন্টের অনুসমর্থন লাভ করে। বলাবাহুল্য, ছিটমহলে অবরুদ্ধ মানুষদের মুক্তির দাবিতে উভয় দেশে গড়ে ওঠা জনমতের চাপে ছিটমহল বিনিময়কে সামনে রেখেই স্থলসীমা চুক্তি ভারতীয় পার্লামেন্টে অনুসমর্থিত হয়। ২০১৫ সালের ৬ জুন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরকালীন ভারত-বাংলাদেশ শীর্ষ বৈঠকে চুয়াত্তরের স্থলসীমা চুক্তি ও ছিটমহল বিনিময় বিষয়ক ২০১১ সালে স্বাক্ষরিত প্রটোকলের অধীনে ছিটমহল বিনিময় কার্যকরের সিদ্ধান্ত হয় এবং ২০১৫ সালের ৩১ জুলাইকে ‘অ্যাপয়েন্টেড ডে’ বা নিরূপিত দিন হিসেবে ধার্য করা হয়। ওই দিন মধ্যরাতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থাকা ১৭ হাজার ১৬০ দশমিক ৬৩ একর আয়তনের ভারতীয় ১১১টি ছিটমহল বাংলাদেশের ভূখণ্ডে পরিণত হয়। অপরপক্ষে ভারতের অভ্যন্তরে থাকা ৭ হাজার ১১০ দশমিক ২ একর আয়তনের ৫১টি বাংলাদেশি ছিটমহল ভারতের ভূখণ্ডে পরিণত হয়। ফলে প্রায় ৫২ হাজার ‘ছিটের লোক’-এর জীবন থেকে ৬৮ বছরের অবরুদ্ধতার অবসান ঘটেছে। মিলেছে রাষ্ট্র ও নাগরিক পরিচয়। মিলেছে জীবনের নিরাপত্তা ও মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা। কিন্তু ছিটমহল বিনিময় হলেও সাবেক ছিটমহলবাসীর জীবন-জীবিকায় রাষ্ট্রহীন সাত দশকের পুঞ্জীভূত কিছু সমস্যার যেমন সমাধান হয়নি, অন্যদিকে ছিটমহল বিনিময়ের প্রক্রিয়ায় নতুন করে আরও কিছু সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। ফলে উভয় দেশের বিলুপ্ত ছিটমহলের মানুষদের অনেকেই এখনো নানামুখী সংকটের মুখে। সবচেয়ে বড় কথা কিছু মানুষ এখনো নাগরিকত্বই পায়নি।

যারা এখন সত্যিকারের ‘নেই-মানুষ’

ছিটমহল বিনিময়ের প্রক্রিয়ায় উভয় দেশের ছিটমহলের মানুষদের দুই দেশের যেকোনো একটির নাগরিকত্ব গ্রহণের সুযোগ প্রদান করা হয়েছিল। উল্লেখ্য, ২০১১ সালের জুলাই মাসে ছিটমহলগুলোতে যৌথভাবে পরিচালিত জনগণনার সময় যাঁরা তালিকাবদ্ধ হয়েছিলেন এবং ওই সময় থেকে ছিটমহল বিনিময়ের দিন পর্যন্ত যেসব শিশু ছিটমহলগুলোতে জন্মগ্রহণ করেছিল কেবল তারাই সেই সুযোগ পেয়েছে। কিন্তু উভয় দেশের ছিটমহলের যেসব মানুষ মূলত জীবিকার প্রয়োজনে দূরবর্তী স্থানে অবস্থান করার কারণে সেই সময়ে ছিটমহলে উপস্থিত হতে পারেনি, তারা সেই জনগণনা থেকে বাদ পড়ে যায়। অনেকে জনগণনা শেষ হয়ে যাওয়ার পর খবর পেয়েছেন। যা-ই হোক, ছিটমহল বিনিময় কার্যকর করার আগে ২০১৫ সালে আরেকটি চূড়ান্ত জরিপ হলেও ২০১১ সালের জনগণনায় নানা কারণে বাদ পড়া মানুষদের আর তালিকাবদ্ধ করা হয়নি। এমতাবস্থায় অনেকে আর তাদের নাম তালিকাভুক্ত করার কোনো চেষ্টাও করেনি। আবার অনেকে নিজেদের তালিকাভুক্ত করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছে অনেক ধরনা দিয়েও সফল হননি। ফলে নানা অনিবার্য কারণে যাঁরা ২০১১ সালের জনগণনা থেকে বাদ পড়েছিলেন তাঁরা চূড়ান্তভাবে উভয় দেশের নাগরিকত্ব থেকেই বঞ্চিত হলেন। বাংলাদেশে এদের অবস্থান আছে কি না, সে বিষয়ে কোনো তথ্য নেই। তবে ভারতের কোনো কোনো স্থানে এঁদের বসবাসের যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ আছে (কেইস ১)। তাঁরা এখন কোনো দেশেরই নাগরিক নন। সত্যিকার অর্থেই তাঁরা এখন ‘নেই-মানুষ’-এ পরিণত হয়েছেন। জীবিত থেকেও দুই দেশের কোথাও তাঁরা নেই। তাদের সঠিক সংখ্যাও কারও জানা নেই।

কেইস ১

ভারতীয় ছিটমহল থেকে ছিন্নমূল দিল্লির বস্তিবাসী তসলিমরা

এখন কোন দেশের নাগরিক?১

তসলিম শেখ। পেশায় রিকশাচালক। বসবাস দিল্লির ওখলার যোগবাই এক্সটেনশনের বস্তিতে। ৩০ বছর আগে কোচবিহারের ছিটমহল (বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ) ছেড়ে পেটের ধান্ধায় চলে এসেছিলেন দিল্লিতে। তারপর থেকে দিল্লিতেই আছেন। বিয়ে করেছেন। হয়েছে সন্তানও। উভয় দেশের ছিটমহলগুলোতে ২০১১ সালে যখন জনগণনা হয়েছিল তখন রুটি-রোজগার ছেড়ে ছিটমহলে গিয়ে হাজির হতে পারেননি। তা ছাড়া তারা চাইলেও ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের ভারতীয় কাঁটাতারের বেড়া ডিঙিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ছিটমহলে গিয়ে হাজির হওয়াটা সহজ ছিল না। যেতে হতো ফেলানীর মতো মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে।২ কিন্তু ছিটমহল বিনিময়ের পর তাঁর জন্মভিটা এখন বাংলাদেশের সঙ্গে অঙ্গীভূত হয়েছে। তারা এখন বুঝতে পেরেছেন যে ভবিষ্যতে চাইলেও আর ফিরে যেতে পারবেন না নিজের জন্মভিটায়। তসলিমের মতো আরও অনেকে আছেন যাঁরা সেই জনগণনার খবরটুকুও পাননি। সব শেষ হয়ে যাওয়ার পরে শুনেছেন। তাই নিজের পরিচয় ঠিক কী, কোন দেশের বাসিন্দা তাঁরা, তা ভেবে কূল পাচ্ছেন না দিল্লির বস্তিবাসী তসলিম, রিয়াজ বা মহম্মদ আসগরেরা। ভারত না বাংলাদেশ, কোন দেশের নাগরিক তাঁরা—এই নিয়ে সংশয়ের মধ্যে এখন তাঁরা কোনোভাবে আঁকড়ে ধরতে চাইছেন দিল্লির পরিচয়কেই। দীর্ঘদিন দিল্লিতে থাকার ফলে আধার কার্ড (ভারতের জাতীয় পরিচয়পত্র) বা ভোটার কার্ড বানিয়ে নিয়েছেন অনেকেই। সেটাই আপাতত তাঁদের ভরসা। তবে তাতেও অবশ্য পুলিশের জুলুম কিছু কমেনি। মাঝেমধ্যেই দিল্লি পুলিশের ‘বাংলাদেশি সেল’ আচমকা হানা দেয় যোগবাই বস্তিতে। ওই বস্তির আরেক বাসিন্দা নিয়াজ বলেন, ‘আমাদের আধার কার্ড আছে। বাচ্চারা যারা এখানে জন্মেছে তাদের জন্মসনদও রয়েছে। তবু পুলিশ আমাদের বাংলাদেশি বলে হুজ্জুতি চালায়। স্থানীয় পরিচয়পত্র দেখানো সত্ত্বেও আমাদের পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পরিচয়পত্র দেখানোর জন্য চাপ দিচ্ছে। কোথা থেকে কীভাবে তা জোগাড় করব কিছুই বুঝতে পারছি না।’

পেটের দায়ে ছিটমহলের বাইরে যাওয়ার দোষেই আজ তাঁদের এই পরিণতি। তাই এ নিয়ে তেমন কোনো অভিযোগও নেই। এই হতভাগ্য মানুষগুলোর কেউ হয়তো ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী’ হিসেবে পুলিশের হাতে আটক হয়ে সারা জীবন জেলে কাটাবে, কেউ হয়তো ‘পুশ ইন’ হয়ে বাংলাদেশে আসবে। আবার কেউ হয়তো পুলিশের তাড়া খেয়ে এক শহর থেকে আরেক শহরে, এক বন্দর থেকে আরেক বন্দরে ভেসে বেড়াবে। যত দিন গায়ে-গতরে শক্তি আছে তত দিন কোনো না কোনো কাজ করে পেটের অন্ন জোগাতে পারবে। এভাবে ভাসতে ভাসতে একদিন শেষ হয়ে যাবে জীবনতরি! কেউ তাদের খবর রাখবে না। কারও বিরুদ্ধে তাদের কোনো অভিযোগও নেই। কিন্তু যারা ছিটমহলে স্থায়ীভাবে বসবাস করেও নাগরিকত্বই পেল না, তাদের কী দোষ?

ছিটমহলে থেকেও যারা নাগরিকত্ব পেল না

ছিটমহল বিনিময়ের লক্ষ্যে ২০১১ সালে উভয় দেশের ছিটমহলগুলোতে জনগণনা হয়েছিল। সে সময় যারা তালিকাভুক্ত হয়েছিল, ২০১৫ সালের চূড়ান্ত সমীক্ষায় কেবল তাদেরই অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং নাগরিকত্ব প্রদান করা হয়। ফলে বিবিধ কারণে যারা ২০১১ সালের তালিকা থেকে বাদ পড়েছিল তারা এখনো নাগরিকত্বহীন রয়ে গেল। ৬৮ বছর পর বিলুপ্ত ছিটমহলগুলোর প্রায় সবাই যখন নাগরিকত্ব পেল তখন অল্পসংখ্যক মানুষ যারা আবারও নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত হলো তাদের মানসিক অবস্থার বয়ান দেওয়া সত্যি অসম্ভব। তবে উদাহরণ হিসেবে কোনো কোনো পরিবারকে উপস্থাপন করা যায়। যেমন বাংলাদেশের সঙ্গে অঙ্গীভূত হওয়া সাবেক ছিটমহল দাসিয়ারছড়ার বাসিন্দা মো. নবীর উদ্দিনসহ তাঁর পরিবারের ৮ জন ২০১১ সালের জনগণনা থেকে বাদ পড়েন। এ বিষয়ে পত্রপত্রিকায় সংবাদ প্রকাশের পর প্রশাসনের উচ্চপর্যায় থেকে বিষয়টি খতিয়ে দেখার নির্দেশও দেওয়া হয়েছিল। এ থেকে বোঝা যায় যে বিষয়টি প্রশাসনের নজরে আছে। কিন্তু এই হতভাগ্য মানুষেরা ঠিক কবে তাদের নাগরিকত্ব পাবে তা কেউ জানে না। অবশ্য বাংলাদেশের স্থানীয় প্রশাসন ও ছিটমহল আন্দোলনের নেতারা তাদের বাড়ির হোল্ডিং নম্বর বসিয়ে দিয়েছেন। তাই তাদের বাড়িতে বিদ্যুত্সংযোগও দেওয়া হয়েছে। ভোটার তালিকায়ও তাদের নাম উঠেছে। তবু জাতীয় পরিচয়পত্র না পাওয়া পর্যন্ত তাদের দুশ্চিন্তা কাটবে না। তবে বাংলাদেশে যেহেতু ‘ভারতীয় অনুপ্রবেশকারী’ সংক্রান্ত কোনো রাজনৈতিক ইস্যু নেই, তাই এই ব্যক্তিরা অন্তত পুলিশি হয়রানির শিকার হবে না তা বলা যায়। কিন্তু ভারতের ছিটমহলে যারা এখনো নাগরিকত্ব পেল না তাদের কী হবে?

ভারতের সাবেক বাংলাদেশি ছিটমহল দক্ষিণ মশালডাঙার দশটি পরিবারের প্রায় পঞ্চাশ জন মানুষ এখনো ভারতের নাগরিকত্ব পায়নি। ২০১১ সালের জনগণনায় তাদের নাম লিপিবদ্ধ না হওয়ার কারণেই তারা এই সংকটের মুখোমুখি। অথচ ২০১৫ সালে যখন সমীক্ষা হয়েছিল তখনই এই মানুষগুলো তাদের নাম তালিকাভুক্ত করার আরজি করেছিল। কিন্তু ২০১১ সালের তালিকায় নাম ছিল না বলে প্রশাসন জেনেশুনেই এই মানুষগুলোকে চূড়ান্ত তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেনি। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে অনেক আবেদন-নিবেদন করে এখনো কোনো লাভ হয়নি। ছিটমহল বিনিময়ের পর ওই মানুষগুলোর বিপদ বরং বেড়ে গেছে। কারণ এখন তো আর ছিটমহল নেই যে তারা ছিটমহলের মানুষ হিসেবে পরিচয় দিতে পারবে। সেই মানুষগুলোর ভাষা যেহেতু ‘বাংলা’ তাই সত্যিকার অর্থেই তাদের আতঙ্কের যথেষ্ট কারণ আছে। ভারতে ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী’ বিষয়টি একটি বড় রাজনৈতিক ইস্যু। তাই বাংলাভাষী যে কেউ ভারতের জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদর্শন করতে না পারলে তাকে ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী’ আখ্যা দিয়ে বাংলাদেশে ‘পুশ ইন’ করার চেষ্ট করা হতে পারে অথবা ‘অবৈধ অনুপ্রবেশের’ অভিযোগে আটক করা হতে পারে। হতে পারে জেল-জরিমানা। ভারতের সঙ্গে অঙ্গীভূত হওয়া দক্ষিণ মশালডাঙা ছিটমহলের নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত মোহাম্মদ তালেব আলী (৬০/২০১৬) এ প্রসঙ্গে বলেন,

‘২০১১ সালে সার্ভে হলো। আমার পরিবারের ৬ জন লোক। সমস্ত লিখে দিলাম। ২০১৫ সালে পুনরায় সার্ভে করার জন্য যখন লোক আসল, তখন তাদের কাছে থাকা ২০১১ সালের তালিকায় দেখলাম আমাদের নাম নেই। সব ছিটমহলের মানুষের নামের তালিকা খোঁজাখুঁজি করে দেখলাম যে আমার ঘরসহ পরপর দশ ঘরের কোনো নাম ওই তালিকায় নেই। সামনে আছে, পিছে আছে, মাঝখান থেকে আমাদের দশ ঘরের নাম নেই। দক্ষিণ মশালডাঙার মাঝখানের এই দশটি বাড়ির মানুষের নাম ক্যামনে বাদ পড়ে তা এখনো বুঝে উঠতে পারলাম না। আমরা পূর্বপুরুষ থেকেই এই ছিটমহলে স্থায়ীভাবে বসবাস করতেছি। এত বছর পর, এত আন্দোলন-সংগ্রাম করবার পর সবাই যখন নাগরিকত্ব পাইল তখন আমরা বাদ পড়লাম! এই চিন্তায় তখন আমার হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল। আমাকে কোচবিহার হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। তিন দিন হাসপাতালে ছিলাম। তিন দিনে হাসপাতালের বিল হয় পঁয়তাল্লিশ হাজার টাকা। সুস্থ হয়ে আসার পর নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য পঞ্চায়েত, ডিএম, এসডিওসহ অনেকের কাছে গেলাম। বহু জায়গায় দরখাস্ত করা হইল, বাদ পড়া দশ ঘরের নাম দেওয়া হইল। খালি কইল হবে হবে। আজ পর্যন্ত হইল না। আজ পর্যন্ত আমার আধার কার্ড হইল না, ভোটার কার্ড হইল না। কিছুই হইল না আমার!’

উল্লেখ্য, এই বিষয়টি নিয়েও শুরু হয়েছে নির্মম ভোটের রাজনীতি। ছিটমহল বিনিময়ের পর ছিটমহল বিনিময় আন্দোলনের শেষ দিককার এক নেতা (যিনি ছিটমহলের বাসিন্দা ছিলেন না) পশ্চিমবঙ্গের ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে ছিটমহলের কিছু মানুষকে সঙ্গে নিয়ে বিজেপিতে যোগ দেন। কিন্তু ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনেও তৃণমূল কংগ্রেস নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকার গঠন করে। ফলে স্থানীয় সরকারের সব প্রতিষ্ঠান তৃণমূল কংগ্রেসের নিয়ন্ত্রণে। এমতাবস্থায় ছিটমহলের কিছু মানুষ বিজেপিতে যোগ দেওয়ায় তৃণমূল কংগ্রেসের স্থানীয় নেতারা ছিটমহলের মানুষদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ মনে করছে। যাঁরা এখনো নাগরিকত্ব পাননি তাঁরাও স্থানীয় প্রশাসন ও ক্ষমতাসীনদের সহযোগিতা পাচ্ছেন না বিজেপিতে যোগ দেওয়ার কারণেই। তৃণমূল কংগ্রেসের দায়িত্বপ্রাপ্তরা এই মানুষগুলোকে ভোটার কার্ড প্রদানের মাধ্যমে বিজেপির ভোট বাড়িয়ে দিতে আগ্রহী নয় বলেই মাঠ গবেষণায় জানা যায়। এমতাবস্থায় আদৌ তাঁরা নাগরিকত্ব পাবেন কি না, পেলেও কবে পাবেন তা নিয়ে ওই মানুষগুলো ভীষণভাবে শঙ্কিত।

শিক্ষাসনদ-সংক্রান্ত সংকট

ছিটমহল বিনিময়ের পর শিক্ষার সুযোগসংক্রান্ত সংকট কেটে গেলেও আগের শিক্ষাসনদ নিয়ে এক অভূতপূর্ব সংকটে পড়েছে বিলুপ্ত ছিটমহলের মানুষেরা। ছিটমহলের অধিবাসীরা কখনোই শিক্ষার অধিকার পায়নি। কোনো ছিটমহলেই কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল না। ফলে ছিটমহলের ছেলেমেয়েদের শিক্ষার জন্য স্বাগতিক দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে যেতে হতো। কিন্তু ছিটমহলের পরিচয়ে সেসব স্কুলে তারা ভর্তি হতে পারত না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির একটাই উপায় ছিল। আর তা হলো প্রকৃত পিতা-মাতার পরিচয় গোপন করে স্বাগতিক দেশের কাউকে পিতা-মাতা পরিচয় দেওয়া। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ছিটমহলের মানুষেরা এই মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে বড় ধরনের কোনো ঝামেলা ছাড়াই তাদের ছেলেমেয়েদের স্কুলে ভর্তি করতে পারত। মানবিক দিক বিবেচনায় বাংলাদেশে এই বিষয়টি ‘ওপেন সিক্রেট’-এ পরিণত হয়েছিল। অর্থাত্ বিষয়টি সবাই জানত কিন্তু কেউ বাধা দিত না। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে বসবাসরত ছিটমহলের মানুষদের জন্য বিষয়টি সহজ ছিল না। কারণ অনেক বছর আগে থেকেই ভারতে স্কুলে ভর্তির ক্ষেত্রে আধার কার্ডের ব্যবহার শুরু হয়েছিল। স্কুলে ভর্তির ক্ষেত্রে আধার কার্ডের আবশ্যকতার পাশাপাশি সেখানে ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী’ ইস্যু থাকায় ছিটমহলের মানুষদের সন্তানদের স্কুলে ভর্তির ক্ষেত্রে ভারতের যেসব নাগরিক তাঁদের পরিচয় ব্যবহার করতে দিতেন, তাঁদের জন্যও কাজটি ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। তাই অধিকাংশ ক্ষেত্রে ছিটমহলের মানুষদের এই সুযোগ গ্রহণ করার জন্য বড় অঙ্কের অর্থ দিতে হতো। অর্থাত্ অর্থের বিনিময়ে অন্যকে নিজ সন্তানের পিতা-মাতা পরিচয় দিয়ে সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করতে হতো। এই ছিল ছিটমহলের মানুষদের বাস্তবতা। পশ্চিমবঙ্গে ছিটমহলের আশপাশের গ্রামগুলোতে এই পরিচয় প্রদানের বিষয়টি প্রায় ব্যবসায় পরিণত হয়েছিল। ছিটমহল বিনিময়ের পর তাদের ছেলেমেয়েদের স্কুলে ভর্তির ক্ষেত্রে এখন আর কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু ছিটমহল বিনিময়ের আগে যারা প্রকৃত মাতা-পিতার পরিবর্তে অন্য মানুষকে মাতা-পিতা পরিচয় দিয়ে শিক্ষাসনদ অর্জন করেছে, তাদের ভাগ্যে এখন কী ঘটবে?

উভয় দেশের বিলুপ্ত ছিটমহলগুলোতে অনেক শিক্ষার্থী আছে, যারা অন্য মানুষকে পিতা-মাতা পরিচয় দিয়ে স্কুল পাস করে বর্তমানে কলেজে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে, তাদের আগের শিক্ষাসনদ নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে এক অভূতপূর্ব সংকট। কারণ ওই সব শিক্ষাসনদে নকল পিতা-মাতার নাম লিপিবদ্ধ। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায়, বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম জেলার ভূরুঙ্গামারী উপজেলার বিলুপ্ত ছিটমহল ছোট গাড়লঝোড়া-২-এর অধিবাসী বাচ্চু মিয়ার ছেলে বাসার বাদল বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে ২০১২ সালে দাখিল পরীক্ষা পাস করে পরবর্তী সময়ে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে প্রকৌশল বিষয়ে ডিপ্লোমা পাস করেছেন। এখন তাঁর ইচ্ছা প্রকৌশল বিষয়ে উচ্চশিক্ষা লাভ করা। কিন্তু তাঁর শিক্ষাসনদে তাঁর জন্মদাতা মাতা-পিতার নাম নেই। মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড প্রদত্ত দাখিল সার্টিফিকেট ও বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড প্রদত্ত ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপ্লোমা সার্টিফিকেটে বাবার নাম লেখা আছে জাহাঙ্গীর আলম। কারণ জাহাঙ্গীর আলম নামক বাংলাদেশি এক নাগরিককে পিতা পরিচয় দিয়েই বাসার বাদলকে ভর্তি করা হয়েছিল। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়ার আর কোনো উপায় ছিল না তাঁর। ছিটমহল বিনিময় হওয়ার ফলে বর্তমানে বাসার বাদল ও তাঁর মাতা-পিতা এখন বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পেয়েছেন। তাঁদের প্রকৃত নাম-পরিচয় সব জায়গায় প্রকাশিত হয়েছে। তাই বাসার বাদল আর নিজেকে জনৈক জাহাঙ্গীর আলমের পুত্র হিসেবে পরিচয় দিতে পারবেন না। অথচ তাঁর শিক্ষাসনদে পিতা হিসেবে জনৈক জাহাঙ্গীর আলমের নাম লিপিবদ্ধ। এমতাবস্থায় বাসার বাদলের বিশেষ করে সরকারি চাকরি পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। কারণ সরকারি চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রচলিত পুলিশ ভেরিফিকেশনে তাঁর প্রকৃত পরিচয় ও শিক্ষাসনদের পরিচয় হুবহু না মিললে চাকরি মিলবে না। ছিটমহল বিনিময়ের পর এখন এই জটিল সংকটে পতিত হয়েছেন বাসার বাদল ও তাঁর পরিবার। সরকারি চাকরি পাওয়ার অনিশ্চয়তা ছাড়াও যে প্রশ্নটি অত্যন্ত জরুরি তা হলো, বাসার বাদলকে কেন সারা জীবন মিথ্যা পরিচয় বহন করতে হবে? বাসার বাদল কেন তাঁর শিক্ষাসনদে জন্মদাতা মাতা-পিতার নাম লিপিবদ্ধ করতে পারবেন না?

দুই বাংলার বিলুপ্ত ছিটমহলগুলোর এমন অনেক শিক্ষার্থী এখন আতঙ্কে আছেন। নানা প্রশ্ন তাঁদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে—তাঁদের ওই সব শিক্ষাসনদ এখন গৃহীত হবে তো? পরিস্থিতির শিকার হয়ে তাঁরা যে মিথ্যা পরিচয়ে এত দিন পড়ালেখা করেছেন সরকার তা সংশোধন করার সুযোগ দেবে তো? ওই সব শিক্ষাসনদ নিয়ে চাকরি পাওয়া যাবে তো? তাঁরা তাঁদের জন্মদাতা মাতা-পিতার নাম তাঁদের কষ্টার্জিত শিক্ষাসনদে লিপিবদ্ধ করার সুযোগ পাবেন তো? ভারতের সাবেক বাংলাদেশি ছিটমহল দক্ষিণ মশালডাঙার স্নাতক অধ্যয়নরত আজিবর শেখ বলেন, নাগরিকত্ব পাওয়ার পরেও আমরা এখন এমন অবস্থায় আছি যে নিজের প্রকৃত বাবা-মাকে বাবা-মা হিসেবে পরিচয় দিতে চাইলে আমাদের শিক্ষাসনদের আর কোনো গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না।

ওই সব শিক্ষার্থীর আগের শিক্ষাসনদগুলোতে মাতা-পিতার নাম সংশোধনের সুযোগ দিলে শিক্ষাসনদের পাশাপাশি তাদের ভবিষ্যত্ নিয়েও সব অনিশ্চয়তা কেটে যাবে। সর্বোপরি ওই মানুষগুলোকে সারা জীবন মিথ্যা পিতা-মাতার পরিচয় বয়ে বেড়াতে হবে না। অনতিবিলম্বে তাঁদের সেই সুযোগ দেওয়া কি রাষ্ট্রের দায়িত্ব নয়?

জমির মালিকানা নিয়ে উদ্বেগ-উত্কণ্ঠা

বিনিময়ের পর ছিটমহলের মানুষেরা তাদের জমির মালিকানা নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে। কারণ তাদের কারও কাছেই ভোগদখলকৃত জমির কোনো দলিলপত্র নেই। জমির মালিকানা-সংক্রান্ত উদ্বেগ-উত্কণ্ঠা উভয় দেশের সঙ্গে অঙ্গীভূত হওয়া সাবেক ছিটমহলগুলোতে মোটামুটিভাবে একই ধরনের। ২০১৫ সালের আগস্ট মাসে ভূমিসংক্রান্ত সব রেকর্ড ও নথিপত্র বিনিময়ের লক্ষ্যে প্রশাসনিক পর্যায়ে একটি দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে পুরোনো কিছু দলিলপত্র বিনিময় হলেও উভয় পক্ষই পরস্পরকে জানিয়ে দেয় যে ছিটমহলের জমির ব্যক্তিমালিকানা-সংক্রান্ত কোনো নথিপত্র সংশ্লিষ্ট ভূমি অফিসগুলোতে খুঁজে পাওয়া যায়নি। দীর্ঘ ৬৮ বছরে ছিটমহলের ভূমিসংক্রান্ত সরকারি নথিপত্র যেমন নষ্ট হয়ে গেছে, তেমনি ছিটমহলের মানুষদের ব্যক্তিগত দলিলপত্রও নষ্ট হয়ে গেছে। ফলে ছিটমহলের জমির মালিকানা নির্ধারণের একমাত্র উপায় ক্যাডেস্ট্রাল সার্ভে। ভূমি অধিদপ্তর কর্তৃক ক্যাডেস্ট্রাল সার্ভে রেকর্ড করার কথা থাকলেও এখনো তার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি।

ছিটমহল বিনিময়ের অব্যবহিত পরেই উভয় দেশের ছিটমহলগুলোতে জমির মালিকানা নিয়ে হাঙ্গামা শুরু হয়। ছিটমহলের বাইরের স্থানীয় প্রভাবশালীরা ছিটমহলের জমি জবরদখল করার চেষ্টায় লিপ্ত হয়। বাংলাদেশের সঙ্গে অঙ্গীভূত হওয়া সাবেক ছিটমহলগুলোতে জমি নিয়ে বিরোধ ও দাঙ্গা-হাঙ্গামার খবরও গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার হয়। জমিসংক্রান্ত দাঙ্গা-হাঙ্গামা নিয়ন্ত্রণের জন্যই মূলত বাংলাদেশের সাবেক ছিটমহলগুলোতে অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। দাসিয়ারছড়া ছিটমহলের এক যুবক বলেন,

গরু মরলে শকুনেরা যেমন কাড়াকাড়ি করে, বিনিময়ের পর ছিটের জমি নিয়েও তা-ই হয়েছে।

এমতাবস্থায় স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে সরেজমিন পরিদর্শন করে ভোগদখলের ভিত্তিতে আপাতত স্থিতাবস্থা বজায় রেখে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে।৩ কিন্তু দীর্ঘ সাত দশকের বঞ্চনা ও অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে স্থানীয় প্রভাবশালীরা ছিটমহলের অসহায় মানুষদের জমিজমা জবরদখল করেছে কি না তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়নি। শুধু দখলি স্বত্বের ভিত্তিতে জমির মালিকানা নির্ধারণের ফলে ছিটমহলের বাইরের মানুষের মালিকানায় চলে যাচ্ছে ছিটমহলের জমির একটি বড় অংশ। অপরপক্ষে ভূমিহীন থেকে যাচ্ছে ছিটমহলের অনেক মানুষ। কারণ স্থানীয় প্রভাবশালীরা ছিটমহলের অনেক জমি ভোগদখল করছেন। ছিটমহলের বাসিন্দারা প্রায় সাত দশক সকল প্রকার প্রশাসনিক ও আইনি সুযোগ থেকে বঞ্চিত ছিল। এমতাবস্থায় তাদের জমিজমা জবরদখল হওয়া অস্বাভাবিক ছিল না। ভূমি জরিপের মাধ্যমে এ ধরনের অভিযোগও খতিয়ে দেখা দরকার ছিল, যা করা হয়নি।

ভারতের সঙ্গে অঙ্গীভূত হওয়া ৫১টি ছিটমহলের প্রায় সাড়ে তিন হাজার পরিবারও তাদের জমির মালিকানা নিয়ে উদ্বেগ-উত্কণ্ঠার মধ্যে আছে। সেখানেও ভূমি প্রশাসন কর্তৃক ভূমি জরিপ হওয়ার কথা। কিন্তু এ বিষয়ে এখনো পর্যন্ত কার্যকর কোনো উদ্যোগ গৃহীত হয়নি। মাঠপর্যায়ে গবেষণার সময় স্থানীয় প্রশাসনের এক কর্মচারীকে দক্ষিণ মশালডাঙার জমির মালিকানাসংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করতে দেখা গেছে। তিনি স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে কথা বলে কোন দাগে কতটুকু জমি এবং তা কার দখলে সে সংক্রান্ত তথ্য সাদা কগজে লিপিবদ্ধ করেন। কিন্তু ভূমি জরিপসংক্রান্ত নির্দিষ্ট কোনো ফরম ব্যবহার করা হয়নি। জমি পরিমাপ করা বা সীমানা চিহ্নিত করার কোনো সরঞ্জামও তাঁর কাছে ছিল না।

দক্ষিণ মশালডাঙার জমির মালিকেরা এ ধরনের জরিপে সন্তুষ্ট তো ননই, বরং তাঁরা শঙ্কিত। অনেকেই এ ধরনের জরিপের প্রতি আস্থা রাখতে পারছেন না বলে তাতে সহযোগিতাও করছেন না। যখন ছিটমহল ছিল তখন সেখানে সরকারের কোনো কর্তৃত্ব ছিল না। ফলে ছিটমহলের মানুষেরা তাদের নিজেদের ব্যবস্থা অনুযায়ী জমি কেনাবেচা ও ভোগদখল করত। কিন্তু ছিটমহলগুলো এখন ভারতের অংশ হওয়ায় জমির প্রকৃত মালিকানা সরকারের হাতে চলে গেছে। ফলে এখন সরকার যাকে জমির মালিকানা বুঝিয়ে দেবে সেই ব্যক্তিই জমির মালিক হবে। ছিটমহল বিনিময়ের পর স্থানীয় প্রভাবশালীদের অনেকেই ছিটমহলের জমির ওপর লোলুপ দৃষ্টি দিয়েছে। কয়েকটি ছিটমহলে জমি দখলের ছকও তৈরি হয়েছে।৪ তাই বিলুপ্ত ছিটমহলের মানুষেরা এত দিন যে জমিটুকু আগলে রাখতে পেরেছিল এখন তা পারবে কি না তা নিয়ে সংশয়ে আছে। যত দিন পর্যন্ত সরকার তাদের জমির মালিকানা বুঝিয়ে না দেবে তত দিন পর্যন্ত তাদের শঙ্কা কাটবে না। তাই ছিটমহল বিনিময়ের ফলে কী পেলেন—এমন প্রশ্নের উত্তর আসে এভাবে,

যেমন ছিলাম তেমনই আছি। জমিগুলো নিয়ে বরং অনিশ্চয়তা বেড়েছে।৫

বাংলাদেশ থেকে ভারতে প্রত্যাগমনকারীদের জীবনে সংকটের নতুন অধ্যায়

ছিটমহল বিনিময়ের সময় বাংলাদেশের সাবেক ভারতীয় ছিটমহলগুলো থেকে যে ৯৭৯ জন মানুষ ভারতের নাগরিকত্ব নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে গিয়েছে, তাদের একটি বড় অংশ ইতিমধ্যেই ভাবতে শুরু করেছে যে তারা ভারতে গিয়ে ভুল করেছে কি না। অথচ নাগরিকত্ব নিয়ে সে দেশে প্রবেশের সময় সীমান্তে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পক্ষ থেকে উত্সবমুখর পরিবেশে তাদের ফুলেল শুভেচ্ছা দিয়ে বরণ করে নেওয়া হয়েছিল। অনেক স্বপ্ন দেখানো হয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকার উভয়ের পক্ষ থেকে। এটাই হয়তো দক্ষিণ এশিয়ার বিস্মৃতির সংস্কৃতি। কোনো কিছু নিয়ে যখন জোয়ার ওঠে তখন অনেক প্রতিশ্রুতি আসে, অনেক শুভেচ্ছাবাণী আসে। কিন্তু জোয়ার থেমে গেলে সবাই সবকিছু ভুলে যায়। ছিটমহল বিনিময়ের আগে-পরে ভারতের নাগরিকত্ব গ্রহণ করা মানুষদের পুনর্বাসন-সংক্রান্ত বিভিন্ন পরিকল্পনার কথা পশ্চিমবঙ্গ সরকার ও ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়েছিল। নগদ টাকা, পাকা বাড়ি, কর্মসংস্থান, ছেলেমেয়েদের শিক্ষালাভের সুনিশ্চিত ব্যবস্থাসহ নানা লোভনীয় প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। ওই সব প্রতিশ্রুতির প্রতি আকৃষ্ট হয়েই অনেকে ভারতের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছিল। কিন্তু এখন তাদের অভিযোগ, ছিটমহল বিনিময়ের আগে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে যেসব আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল, গত দেড় বছরে তার কোনো কিছুই তারা পায়নি।

অস্থায়ী শিবিরে মানবেতর জীবনযাপন

কোচবিহারের দিনহাটা, মেখলিগঞ্জ ও হলদিবাড়িতে তিনটি অস্থায়ী ‘ছিটমহল শিবির’ করে, ছোট ছোট টিনের চালাঘরে তাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেখানে যে অবস্থায় তাদের রাখা হয়েছে সাবেক ছিটমহলে তারা তার চেয়ে অনেক ভালো ছিল বলে অনেকে দাবি করে। পশ্চিমবঙ্গেও কোচবিহার জেলার দিনহাটার কৃষিমেলা ছিটমহল শিবিরে গিয়ে জানা যায়, ১৪দ্ধ১২ ফুট আয়তনের যেসব টিনের চালাঘরে তাদের থাকতে দেওয়া হয়েছে তা তাদের গরম বা শীত কোনোটি থেকেই সুরক্ষা দেয় না। গরমকালে ওই সব ঘরে টিকা যায় না। বিদ্যুত্সংযোগও দেওয়া হয়নি। বৈদ্যুতিক পাখাবিহীন ওই চালাঘরগুলোতে গরমকালে গাদাগাদি করে বসবাস করা কতটা কষ্টদায়ক তা সহজেই অনুমান করা যায়। উল্লেখ্য, গাছপালার প্রাকৃতিক ছায়াও নেই সেখানে। গত শীত মৌসুমে শীতের প্রচণ্ডতায় এক বৃদ্ধার মৃত্যু হয় দিনহাটা ক্যাম্পে। ক্যাম্পের তিনটি স্থানে সবার জন্য রয়েছে কয়েকটি গণল্যাট্রিন। আছে কয়েকটি গণটিউবওয়েল, যেখান থেকে সবাই খাওয়ার পানি সংগ্রহ করে। সার্বিক বিবেচনায় রীতিমতো মানবেতর জীবন যাপনই করতে হচ্ছে তাদের।

তাদের যে পরিমাণ রেশন দেওয়া হয় তা দিয়ে কোনো পরিবারেরই খাদ্যচাহিদা পূরণ হয় না। অন্যদিকে কারোরই রোজগারের কোনো ব্যবস্থা হয়নি। তাই বাংলাদেশ থেকে চলে যাওয়ার সময় গবাদিপশু, জিনিসপত্র ইত্যাদি বিক্রি করে যেটুকু টাকাপয়সা হাতে করে নিয়ে যেতে পেরেছিল, তা খরচ করেই এত দিন সংসার চালিয়েছে। এখন হাতের টাকাপয়সাও শেষ হয়ে গেছে। তাই আগামী দিনগুলোতে কীভাবে পরিবার-পরিজনের ভরণপোষণ চালাবে তা নিয়ে শঙ্কার মধ্যে আছে ছিটমহল শিবিরে বসবাসকারী মানুষেরা। প্রত্যেক পরিবার থেকে অন্তত একজনকে চাকরি দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এখনো তার কোনো কিছু হয়নি। প্রতি পরিবারকে একটি করে ১০০ দিনের (বছরে) কর্মসংস্থান কার্ড দেওয়া হয়েছে মাত্র। পরিবারের সদস্যসংখ্যা যা-ই হোক, পরিবারপ্রতি কার্ড একটাই। ওই কার্ডের অধীনে দিনপ্রতি কাজের বিনিময়ে ১৭৪ টাকা পাওয়া যায়। পূর্বতন ভারতীয় ছিটমহল দহলা খাগড়াবাড়ী থেকে যাওয়া হলদিবাড়ি শিবিরে বসবাসকারী লক্ষ্মীবর্মণ বলেন,

ওখানে সাজানো সংসার নষ্ট করে দিয়ে চলে এলাম। অনেক আশা নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু কিছুই তো পেলাম না এখন পর্যন্ত। সরকার যদি কিছু না দিতে পারে তাহলে ফেরত পাঠিয়ে দিক আমাদের।৬

লক্ষ্মীবর্মণের কথার প্রতিধ্বনি পাওয়া যায় হলদিবাড়ী শিবিরের হরি বর্মণ, সন্তোষ রায় এবং দিনহাটা শিবিরের মুহম্মদ উমর ফারুক, কাচুয়া বর্মণ এবং আরও অনেকের সুরে। তাঁদের একই কথা, ভারত সরকার যতি প্রতিশ্রুতি পালন না করতে পারে তাহলে যেন ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয় বাংলাদেশে। কিন্তু তাঁদের তো এত দিনে বুঝে ফেলার কথা যে, জাতিরাষ্ট্রের কুিসত চরিত্র তাঁদের আর সেই সুযোগ দেবে না।

স্থায়ী পুনর্বাসনের অগ্রগতি নেই

বাংলাদেশ থেকে ভারতে যাওয়া সাবেক ছিটমহলের মানুষদের স্থায়ী পুনর্বাসনের যে পরিকল্পনা ভারত সরকার ঘোষণা করেছিল গত প্রায় দুই বছরেও তা বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। অথচ সর্বাধিক দুই বছরের জন্যই ওই মানুষগুলোকে অস্থায়ী শিবিরে রাখার কথা ছিল। দ্বিতীয় পর্যায়ে চারতলা বিল্ডিং নির্মাণ করে এক একটি বিল্ডিং-এ ১৬টি করে পরিবারকে একসঙ্গে আবাসনের ব্যবস্থা করার কথা ছিল।৭ স্থায়ী পুনর্বাসনের জন্য প্রয়োজনীয় জমির সংকটের কথা রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। আসলে সমস্যাটি জমির নয়, সমস্যাটি রাজনৈতিক। পশ্চিমবঙ্গের বিগত বামফ্রন্ট সরকার কর্তৃক সিঙ্গুরে কৃষকদের জমি অধিগ্রহণ করে টাটা কোম্পানিকে দেওয়ার উদ্যোগের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন করেই প্রথমবারের মতো ভোটে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কেন্দ্র সরকার কর্তৃক জমি অধিগ্রহণ নীতির বিরুদ্ধেও তিনি সোচ্চার। একই কারণে তিনি ছিটমহল বিনিময়ের বিরোধিতা করে বলেছিলেন যে রাজ্যের এক ইঞ্চি জায়গাও তিনি বাংলাদেশকে ছাড়বেন না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই জমিতত্ত্বের কারণেই তাঁর সরকারের পক্ষে জমি অধিগ্রহণ করা সম্ভব নয়। কিন্তু সাবেক ছিটমহলগুলো থেকে যাওয়া মাত্র ৯৭৯ জন মানুষকে পুনর্বাসনের জন্য জমি অধিগ্রহণের দরকার আছে বলেও মনে হয় না। স্থানীয়ভাবে সরকারের খাসজমি খুঁজে বের করেই তাদের পুনর্বাসন করা সম্ভব বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। বিভিন্ন ব্যক্তিও ভারতে যাওয়া মানুষদের পুনর্বাসনের জন্য জমি দান করার আগ্রহ প্রকাশ করেছিল। ভারতে প্রত্যাগমনকারীদের পুনর্বাসনের জন্য ভারতের সাবেক বাংলাদেশি ছিটমহলের ১৬১ জন ব্যক্তি ১৫.৭ একর জমি নিঃশর্তে দান করার ঘোষণা দিয়েছিলেন।৮ তাদের জমি গ্রহণেরও কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। অর্থাত্ তাদের স্থায়ী পুনর্বাসন বিষয়ের এখনো কোনো অগ্রগতি হয়নি।

শেষ কথা

বাংলাদেশের সঙ্গে অঙ্গীভূত হওয়া ছিটমহলগুলোতে দ্রুতগতিতে যে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে তা সত্যি প্রশংসার দাবিদার। এখন বাংলাদেশ সরকারের মনোযোগ দেওয়া উচিত বিলুপ্ত ছিটমহলের মানুষদের কর্মসংস্থানের প্রতি। বিশেষ করে যেসব শিক্ষিত যুবক অভূতপূর্ব এক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে শিক্ষালাভ করেছেন তাঁদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থায় কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা উচিত। অন্যথায় প্রায় সাত দশক রাষ্ট্রহীন থাকা ওই মানুষগুলোর প্রতি সুবিচার করা যাবে না। বিলুপ্ত ছিটমহলগুলোর ঘরে ঘরে বিদ্যুতায়ন, রাস্তাঘাটের উন্নয়ন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্র ও তথ্যপ্রযুক্তি কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা এবং তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদান ইত্যাদি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের কেন্দ্র থেকে স্থানীয় প্রশাসন পর্যন্ত যে আন্তরিক তত্পরতা দেখা গেছে তা অনেকের জন্য শিক্ষণীয় হতে পারে। কিন্তু ভারতের সঙ্গে অঙ্গীভূত হওয়া ছিটমহলগুলোর মানুষেরা ভোটার কার্ড ও রেশন কার্ড পেয়েছেন মাত্র। সেগুলোতে অবকাঠামোগত উন্নয়নের তেমন কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি। আর সত্যিকার অর্থেই সংকটের এক নতুন অধ্যায়ে পতিত হয়েছে ভারতের নাগরিকত্ব নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে যাওয়া সাবেক ছিটমহলের মানুষেরা। যে অস্থায়ী শিবিরগুলোতে তাদের রাখা হয়েছে, স্থানীয়দের কাছে সেগুলো ইতিমধ্যেই ‘ছিটমহল শিবির’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। অর্থাত্ ‘ছিটমহল’ পরিচয়টি যেন তাদের জীবন থেকে ঘোচার নয়। এক প্রকার তারের বেড়া দিয়ে ঘেরা ‘ছিটমহল শিবির’ নামক খাঁচায় বন্দী, ইতিমধ্যেই ‘রেশনভোগী’ হিসেবে নিন্দনীয়ভাবে পরিচিত সেই মানুষগুলোকে উত্সুক অনেকেই দেখতে যায়। কবে তাদের এই খাঁচায় বন্দী জীবন শেষ হবে, কবে তাদের পরিচয় থেকে ‘ছিটমহল’ শব্দটি দূর হবে, কবে তাদের নিজেদের স্বাভাবিক ঘরবাড়ি হবে—এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর তাদের কারও জানা নেই। ভারতের কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপি ও পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেসের মধ্যকার বিরোধ রাজপথ থেকে গলি পর্যন্ত দৃশ্যমান। এমতাবস্থায়, এই মানুষদের সার্বিক পুনর্বাসনের জন্য কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের মধ্যে যে সমন্বিত উদ্যোগ দরকার তার কোনো সম্ভাবনা আপাতত নেই। উপরন্তু তাদের পাল্টাপাল্টি ভোটের রাজনীতির শিকার ওই মানুষেরা। প্রতিশ্রুত পুনর্বাসনের অর্থ নিয়ে ইতিমধ্যেই দুর্নীতি ও রাজনীতি উভয়ই শুরু হয়ে গেছে, যা আগামী দিনগুলোতে অব্যাহত থাকাটাই স্বাভাবিক। আর তার মধ্য দিয়ে ভাগ্যবিড়ম্বিত ওই মানুষগুলোর দুর্ভোগ ও বঞ্চনা আরও দীর্ঘায়িত হবে—এমনটাই আশঙ্কা, যদিও তা কাম্য নয়।

তথ্যসূত্র ও পাদটীকা

১.         আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ আগস্ট, ২০১৫ থেকে সংগৃহীত ও পরিমার্জিত।

২.         ফেলানী ট্র্যাজেডি: ১৫ বছর বয়সের একটি মেয়ে। নাম ফেলানী। সে তার বাবার সাথে ‘অবৈধ’ভাবে ভারতের নয়াদিল্লি পাড়ি জমিয়েছিল সেখানকার ইটভাটায় কাজ করার জন্য। সেখানে কয়েক মাস কাজ করার পর, বাবা নুরু মিয়া মেয়ের জন্য একটি বিবাহ ঠিক করেন। বিবাহ সম্পন্ন করার উদ্দেশ্যে মেয়েকে নিয়ে নুরু মিয়া দেশে ফিরছিলেন। ২০১১ সালের ১৭ জানুয়ারি শুক্রবার সকাল ৬টার দিকে বাবা ও মেয়ে বাংলাদেশের ফুলবাড়ী উপজেলার ‘কিতাবের কুঠি অনন্তপুর’ সীমান্ত দিয়ে একটি বাঁশের মই ব্যবহার করে ভারতের কাঁটাতারের বেড়া ডিঙ্গিয়ে ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করছিলেন। নুরু মিয়া প্রথমে বেড়া পার হন। কিন্তু ফেলানী মই বেয়ে বেড়া ডিঙানোর সময় সীমান্তবেড়ার কাঁটাতারের সঙ্গে তাঁর পরনের কাপড় আটকে যায়। ফলে সে ভয় পেয়ে চিত্কার করে ওঠে। তার চিত্কার শুনে টহলরত বিএসএফ সদস্যরা তাকে গুলি করে হত্যা করে। পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা অসহায় নুরু মিয়াকে তাঁর প্রিয় কন্যার মৃত্যুযন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছে নীরবে। এই হত্যাকাণ্ডের পর ফেলানীর মৃতদেহ দীর্ঘ সময় ধরে সেই কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলছিল!

৩.        সাক্ষাত্কার, নবী নেওয়াজ, উপকমিশনার (ভূমি), ফুলবাড়ী, লালমনিরহাট।

৪.         আনন্দবাজার পত্রিকা, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৬।

৫.         আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৬।

৬.        ‘ভারতে এসে কি ভুল করলাম?’ বিবিসি বাংলা, কলকাতা, ১ আগস্ট ২০১৬।

৭.         আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৫ জুন, ২০১৫।

৮.        আনন্দবাজার পত্রিকা, ১০ জুন, ২০১৫।