অনেকেই আলি শারিয়াতিকে ১৯৭৯ সালের ইরানি বিপ্লবের ‘মতাদর্শিক নেতা’ বা ‘স্থপতি’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।১ তাঁকে একই সঙ্গে র্যাডিক্যাল ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মার্ক্সবাদ ও অন্যান্য ‘পশ্চিমা দার্শনিক বিভ্রান্তি’ বা ফ্যালাসির বলিষ্ঠ সমালোচনা উত্থাপনকারী বুদ্ধিজীবী২ এবং ‘মার্ক্সবাদী সমাজচিন্তা দ্বারা প্রভাবিত’ একজন সংস্কারবাদী ইসলামি চিন্তক হিসেবেও বিবেচনা করা হয়।৩
লাখ লাখ শিক্ষিত ইরানি যুবকের আদর্শিক রূপান্তর ও পরিশীলনের ক্ষেত্রে শারিয়াতির ভূমিকা নিয়ে মতভেদ নেই বললেই চলে। আধুনিক সামাজিক বিজ্ঞানে ব্যবহূত ‘বৈজ্ঞানিক’ ধারণা প্রয়োগের মাধ্যমে ইসলামের পুনর্ব্যাখ্যা তৈরি করে শারিয়াতি তাঁর অনুসারীদের দিয়েছিলেন দৃঢ় ও মজবুত আদর্শিক ভিত্তি। প্রথাগত ইসলামি ধর্মগুরুরা এই পুনর্ব্যাখ্যা তৈরি করতে অক্ষম ছিলেন।
১৯৭০-এর দশকের শেষ দিকে, তেহরানের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যখন ইসলাম বনাম বামপন্থা বিতর্কে ডুবেছিলেন, তখন আমি দেখেছি বিবদমান ‘ইসলামপন্থী শিক্ষার্থী’রা তাঁদের ঝাঁজালো তর্ক-বিতর্কের সমর্থনের জন্য সম্পূর্ণভাবে মুয়াল্লিমদের [প্রথাগত ধর্মীয় পণ্ডিত] শিক্ষার ওপর নির্ভর করত। সে সময় প্রত্যেক আদর্শিক ক্যাম্পের নিজস্ব সংগঠন, সভা, স্টাডি গ্রুপ, গ্রন্থাগার, পর্বতারোহণ দল, ড্রেস কোড এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে, ছিল স্বতন্ত্র ডিসকোর্স। দুই দলই তাদের কর্মকাণ্ডে তীব্র প্রতিযোগিতায় লিপ্ত থাকত। কিন্তু অবরোধের পরিকল্পনা, লিফলেট বিতরণ এবং একই ধরনের অন্যান্য কার্যক্রমের ক্ষেত্রে তাদের একটা অ্যাডহক কৌশলগত মৈত্রীতেও আবদ্ধ হতে হয়েছে। দুই গ্রুপেরই বীর ছিল। আমাদের যেমন, তাদেরও ছিল নিজস্ব বীর। আমরা যাদের আরাধনা করতাম, এর মধ্যে ছিলেন আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিমান মার্ক্স, লেনিন, স্টালিন, কাস্ত্রো, ফাঁনো, চে গুয়েভারা, মাও এবং এ রকম আরও অনেকে। সংখ্যায় বেশি না হলেও আমাদের মতোই তাদেরও ছিল বৈচিত্র্যপূর্ণ পূজনীয় বীর। এর মধ্যে ছিলেন আল-আফগানি, ইকবাল লহুরি, ইমাম মুসা সদর থেকে শুরু করে জাঙ্গালি, রেজায়ী ভ্রাতৃদ্বয়, খোমেনি ও মাসুদ রজবী। তবে তাদের শ্রেষ্ঠতম বীর ছিলেন শারিয়াতি।
শারিয়াতির দৃশ্যমান বুদ্ধিবৃত্তিক পরিশীলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল তাঁর র্যাডিক্যাল রাজনৈতিক অবস্থান, যা ইরানের সেই অস্থির ও দমনমূলক সময়ে তাঁর অনুসারীদের চেতনাকে দখল করে নিয়েছিল। সম্ভবত এই একটা তথ্যের মধ্যেও তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক পরিশীলনের প্রতিফলন ঘটে যে, তাঁর চিন্তাকর্মের ওপর ইরানি বুদ্ধিজীবীদের করা একটা চিন্তাশীল ও বিচার-বিশ্লেষণমূলক (critical) মূল্যায়নও প্রকাশিত হতে দেখা যায়নি।৪ অন্যদিকে, শারিয়াতির রাজনৈতিক অবস্থান দৃশ্যমান হয়েছে ১৯৭৯ সালের রাজতন্ত্রবিরোধী আন্দোলনের সময়। তখন তিনি ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। তাঁর হাজার হাজার টেপকৃত লেকচার ও পাম্পলেট বিলি করা হয়েছিল প্রধানত ইসলামপন্থী তরুণদের মধ্যে। তাঁর জনপ্রিয়তা ইরান ছাড়িয়ে যায় এবং তাঁর লেখার বড় অংশ ইংরেজি, আরবি, জার্মান, মালয় ও অন্যান্য ভাষায় অনূদিত হয়। তাঁকে সমসাময়িক কালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একজন ইসলামি চিন্তাবিদ হিসেবে বিবেচনা করা হতো।
(বিস্তারিত দেখুন এপ্রিল-জুন ২০১৮ সংখ্যায়)