সারসংক্ষেপ
আমাদের সমাজের ইতিহাস লেখার দৃষ্টিভঙ্গি মূলত পুরুষতান্ত্রিক। পুরুষদেরকেই আমরা ইতিহাসের নায়ক বা খলনায়ক হিসেবে দেখে অভ্যস্ত। কিন্তু ইতিহাসের নানান বাঁকে নারীরাও রেখেছিলেন গৌরবোজ্জ্বল অবদান। এমনই এক মহীয়সী নারীর নাম লীলাবতী নাগ। আসামের গোয়ালপাড়া শহরে ১৯০০ সালের ২ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করা লীলাবতী নাগ ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের এক অগ্রবর্তী সৈনিক। তবে তিনি শুধু রাজনীতিতেই তাঁর কর্মকাণ্ডকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। নারীশিক্ষা এবং নারীদের রাজনীতিসচেতন করে তুলতে তাঁর অবদান প্রাতঃস্মরণীয়। বিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই ছিলেন দক্ষ সংগঠক। প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘দীপালী সংঘ’ নামে নারী সমিতি। ১৯২৮ সালে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘নারীশিক্ষা মন্দির’ নামে বিদ্যালয়। ১৯৩১ সালে প্রকাশ করেন জয়শ্রী নামক নারীদের পত্রিকা। এই পত্রিকার বিস্তার ঘটল সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক দূরদৃষ্টির প্রসার ঘটানোর প্রয়াসে। তাঁর সাধনা ছিল নতুন সমাজ, নতুন জীবন, নতুন মানুষ গড়ে তোলার। রাজনৈতিক শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য, মানুষের কল্যাণের জন্য, ব্রিটিশদের শাসনমুক্ত হওয়ার স্বাধীনতার স্বপ্ন যখন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার রক্তে ভেসে যাচ্ছিল, তখন ১৯৪৭ সালে তিনি ঢাকায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন শান্তি কমিটি। দেশভাগের পর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা আর নিরাপত্তা-সংকটের জন্য পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দু সম্প্রদায়ের জনস্রোত সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে বাস্তুত্যাগী হতে শুরু করলে, তিনি পশ্চিমবঙ্গে তাদের জন্য আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক পুনর্বাসনের কাজে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন। এই প্রবন্ধে লীলা নাগের কর্মময় জীবনের মূল বিষয়গুলো আলোচিত হয়েছে। একই সাথে উঠে এসেছে ওই সময়কার সমাজবাস্তবতায় একজন নারীর পক্ষে সক্রিয় রাজনীতিতে অংশ করা কতটা সাহসের বিষয় ছিল, সেই দিকটিও।
মুখ্য শব্দগুচ্ছ
নারীশিক্ষা, লীলাবতী নাগ, নারী আন্দোলন, দীপালী সংঘ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন।
তুমি কি কেবলই ছবি, শুধু পটে লিখা।
ওই-যে সুদূর নীহারিকা
যারা করে আছে ভিড় আকাশের নীড়
ওই যারা দিনরাত্রি
আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী গ্রহ তারা রবি,
তুমি কি তাদের মতো সত্য নও।
হায় ছবি, তুমি শুধু ছবি
নয়নসমুখে তুমি নাই,
নয়নের মাঝখানে নিয়েছ যে ঠাঁই—আজি তাই
শ্যামলে শ্যামল তুমি, নীলিমায় নীল।
আমার নিখিল তোমাতে পেয়েছে তার অন্তরের মিল।
নাহি জানি, কেহ নাহি জানে—
তব সুর বাজে মোর গানে,
কবির অন্তরে তুমি কবি—
নও ছবি, নও ছবি, নও শুধু ছবি ১
এক
শ্রদ্ধেয় লীলাবতী নাগ, আপনার সঙ্গে আমার প্রথম পরোক্ষ সাক্ষাত্ ঘটেছিল ১৯৫৪ সালে। সেই বছর চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিলাম আপনার প্রতিষ্ঠিত ‘নারীশিক্ষা মন্দির’ (২ ফেব্রুয়ারি ১৯২৮) বিদ্যালয়ে।২ বিদ্যালয়টির বড়দিদির (প্রধান শিক্ষয়িত্রী) অফিস ঘরের দেয়ালে একটি বড় বাঁধানো আলোকচিত্র টানানো ছিল আপনার। স্কুলের শিক্ষয়িত্রীরা শিক্ষাবর্ষের শুরুতে ছাত্রীদের কাছে আপনার পরিচিতি, কর্মকাণ্ড, শিক্ষাচর্চা বিষয়ে বিশদভাবে বলতেন।
সে সময়ে পরম শ্রদ্ধায় আপনার কথা বলতেন বিদেশিনী দিদি, জ্যোতি দিদি, ইনু দিদি। ভাসা-ভাসা বুঝতাম আপনি মেয়েদের শিক্ষার জন্য জীবন উত্সর্গ করেছেন। বড় হতে হতে জানলাম আপনি কলকাতায় শিক্ষা, রাজনীতি, পূর্ববঙ্গের বাস্তুত্যাগীদের জন্য নানা কর্মকাণ্ডে নেতৃত্ব দিয়ে সাংগঠনিকভাবে সক্রিয় থেকে কাজ করে যাচ্ছেন।৩
আপনার প্রতিষ্ঠিত ‘নারীশিক্ষা মন্দির’ বিদ্যালয়ে আমি ১৯৬০ সাল পর্যন্ত পড়েছি; ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে ভর্তি হয়েছিলাম ইডেন কলেজে। আইএ পাস করে ভর্তি হই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তত দিনে জেনেছি আপনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দুজন ছাত্রীর একজন, যিনি সহশিক্ষার বন্ধ দরজা উন্মুক্ত করতে একরোখা প্রতিবাদে জয়ী হয়েছিলেন। খুব দেখার ইচ্ছা হতো আপনাকে। আপনি কেন চলে গেলেন নিজের দেশ আর জন্মভূমি ছেড়ে? কর্মযজ্ঞের বিপুল সাফল্যময় সুকীর্তিগুলো অসমাপ্ত রেখে চলে গেলেন কেন? ধীরে ধীরে জেনেছি চলে যেতে আপনাকে বাধ্য করেছিল (১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর)—পাকিস্তান সরকার ১৯৪৮ সালে। পাকিস্তান সরকার আপনার প্রতিষ্ঠিত ‘নারীশিক্ষা মন্দির’ স্কুলের নাম বদলে ‘শের-এ-বাংলা বালিকা বিদ্যালয়’ করেছিল। জানি না আপনি জেনেছিলেন কি না। আপনার প্রতিক্রিয়ার বিষয়েও জানি না। তবে আমরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলাম বাংলাদেশের নারী-মানবাধিকার সামাজিক আন্দোলনের পথিকৃত্ কবি সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে।
আপনি কেন একবারও পূর্ব পাকিস্তানে আসেননি? জেনেছি, সেটাও রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞার জন্য। দেশভাগের পর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা আর নিরাপত্তা-সংকটের জন্য পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দু সম্প্রদায়ের জনস্রোত সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে বাস্তুত্যাগী হতে শুরু করলে পশ্চিমবঙ্গে তাদের জন্য আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক পুনর্বাসনের কাজে আপনি সম্পৃক্ত হলেন। আজীবন তাদের পাশে ছিলেন।
আপনার জীবনের তিন দশক (’২০, ’৩০, ’৪০—দশকের) বা ত্রিশটি বসন্তের যত ফুল, যত গান, যত কবিতা, যত কর্মোদ্যোগ ‘ঢাকা’-কে ঘিরে উত্সারিত হয়েছিল, সেসব ধ্বংস হতে শুরু করল। সেসবের প্রাণভোমরা ছিলেন আপনি। আপনাকে ঘিরে কর্ম-উদ্দীপক হাজার হাজার নারী-পুরুষের জীবন অস্থিতিশীল হয়ে পড়ল। তাদের পাশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় বিধ্বস্ত হিন্দু সম্প্রদায়ের নারী-পুরুষ সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে চলে যেতে বাধ্য হলেন। তাদের পাশে আপনি ছিলেন পশ্চিমবঙ্গে। বড় হতে হতে সেই সব কর্মকাণ্ডের ইতিহাস পাঠে আপনার স্থির-অবিচল, যন্ত্রণাবিদ্ধ-সফল জীবনযাত্রার অনুষঙ্গী হওয়ার প্রেরণা পেয়েছিলাম।
ভেবেছিলাম যদি সুযোগ পাই একবার কলকাতায় গিয়ে আপনার সাক্ষাত্ পেতে চেষ্টা করব। তা আর হলো না। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় কলকাতায় ভারতের নারী সংগঠনগুলোর সহযোগিতায় যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে কাজ করার সুবাদে আমরা অধীর আগ্রহে আপনার সাক্ষাত্ পাওয়ার আশা করেছিলাম। দুঃখে-কষ্টে-অশ্রু ভারাক্রান্ত হয়ে শুনলাম, ১৯৬৮ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি সেরিব্রাল আক্রমণে অসুস্থ হয়ে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় আড়াই বছর পর ১৯৭০ সালের ১১ জুন রাত ১২টা ২০ মিনিটে ইহজীবন ত্যাগ করেছেন।৪ এই দুঃখ আমি আজও বহন করে চলেছি। দেখা হলো না, সাক্ষাতে জানা হলো না আপনাকে।
দুই
সিলেটের আদর্শনিষ্ঠ নাগ পরিবারে মা কুঞ্জলতা দেবী চৌধুরী ও বাবা গিরিশচন্দ্র নাগের সাত সন্তানের অন্যতম ও একমাত্র কন্যা ছিলেন আপনি। এসডিও বাবার কর্মস্থল আসামের গোয়ালপাড়া শহরে ১৯০০ সালের ২ অক্টোবর আপনি জন্মগ্রহণ করেন। পারিবারিকভাবে আপনার নাম রাখা হয় ‘লীলাবতী নাগ’। ‘বুড়ী’ নামে ডাকতেন মা-বাবা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সময়ে ‘লীলাবতী নাগ’ ও ‘লীলা নাগ’—দুই নামে আপনার অন্তর্ভুক্তি হয়েছিল বলে তথ্য দিয়েছেন দীপংকর মোহান্ত, যিনি আপনার জীবন ও কর্মকাণ্ড বিষয়ে গবেষণামূলক বই লিখেছেন (লীলা নাগ ও বাংলার নারী জাগরণ)। তাঁর দেওয়া তথ্যে জানা যাচ্ছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টেবুলেশন শিটে আছে, ‘লীলা নাগ, ১৯২৩ সাল, এমএ পরীক্ষা, রোল ১৬, ইংলিশ গ্রুপ-এ’। অধ্যাপক রঙ্গলাল সেন (প্রয়াত) দীপংকর মোহান্তকে প্রামাণ্য তথ্যে জানিয়েছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় ১৯২১ সালে ঢাকা হলের সংযুক্ত ছাত্রী হিসেবে আপনার নাম আছে ‘লীলাবতী নাগ’। ১৯৩৯ সালের ১৩ মে ঢাকার বিপ্লবী সংগঠন শ্রী সংঘের প্রতিষ্ঠাতা নেতা অনিল রায়ের সঙ্গে বিয়ের পর আপনি পরিচিত হলেন ‘লীলা রায়’ নামে।৫
আপনি যে উচ্চ শিখরে অবস্থান করছেন, যে স্বনামধন্য ও কৃতী ব্যক্তিত্ব রূপে অবস্থান নিয়েছেন সর্বভারতীয় বাংলার—বাংলাদেশের শিক্ষা-সংস্কৃতি, রাজনীতি, নারী-জাগরণের-প্রগতির ক্রমবিকশিত ইতিহাসে—সে অবস্থানে নামে কিছু আসে যায় না। তবুও আমরা এ নিয়ে বারবার তথ্য-বিতর্ক করতে থাকি শুধু আপনার মতো ব্যক্তিত্বদের নিখুঁত পরিচয় নতুন প্রজন্মকে দেওয়ার জন্য।
তেমনি আরও একটি তথ্য-বিতর্ক অনেক দিন চলেছিল যে, আপনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী কি না?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সহশিক্ষার আইন থাকা সত্ত্বেও৬ আপনি যখন ইংরেজি সাহিত্যে এমএ প্রথম পর্বে ভর্তি হতে চাইলেন ১৯২১ সালে, তখন অনুমতি না পাওয়ায় আপনিই প্রথম অবিচল থেকে প্রতিবাদ জানিয়ে সহশিক্ষার অনুমোদন পেলেন। সেই সময়ে আপনি ইংরেজি বিভাগে এমএ প্রথম পর্বে এবং সুষমা সেনগুপ্ত অর্থনীতি বিভাগে বিএ সম্মান শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিলেন। অধ্যাপক রঙ্গলাল সেন তথ্য দিয়েছেন, আপনারা দুজন খুবই অন্তরঙ্গ ছিলেন। আপনাদের মধ্যে খুবই হূদ্যতা ছিল। দুজন একসঙ্গে ‘লেডিজ ওয়েটিং রুম’-এ বসে থাকতেন। তখনকার রেওয়াজ অনুযায়ী আপনারা অধ্যাপকদের সঙ্গে নিজ নিজ ক্লাসে যেতেন।৭
সেই রেওয়াজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-ক্যাম্পাসে বহু বছর ছিল। কিন্তু আপনি তো মনের দিক থেকে, চেতনার দিক থেকে প্রগতিবাদী ছিলেন। তাই এসব নিয়ম মানার জন্য মেনেছেন কিন্তু অবরুদ্ধ থাকেননি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র অনিল রায় ১৯২৩ সালে এমএ পাস করেন। তিনি অনুশীলন দলের গোপন নেতা ছিলেন। সেই গোপন কাজ করার জন্য তিনি Social Welfare League গঠন করেছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নের অধ্যাপক ড. জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ ছিলেন সেই সংস্থাটির প্রথম সভাপতি আর অনিল রায় ছিলেন সম্পাদক। শ্রদ্ধেয় লীলা নাগ, আপনি অনিল রায়ের সংস্পর্শে আসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় এবং তাঁর পরিচালিত সমাজকল্যাণ সমিতির সঙ্গে যুক্ত হন। The History of the University of Dacca বইটিতে অধ্যাপক এম আব্দুর রহিম লিখেছেন: ‘Many students of the university including women joined the societies of Anil Roy and Lila Nag. Under the social welfare services, they secretly conducted their programme of revolutionary activities.’8
এসব তথ্য যতই জেনেছি, ততই আপনার সম্পর্কে আরও জানার জন্য, আপনার বিপ্লবী-চেতনার ক্রমবিকশিত পরিচয় জানার জন্য নিবিড় অনুসন্ধান চর্চা করতে উদ্দীপ্ত হয়েছি।
তিন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে আপনি (১৯২১-১৯২৩) সামাজিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়েছেন সত্য, কিন্তু তার আগেও ঢাকায় ইডেন স্কুলে মাধ্যমিকে পড়ার সময়ে (১৯১১-১৯১৭), কলকাতায় বেথুন কলেজে (১৯১৭-১৯২১) আইএ ও বিএ পড়ার সময়ে আপনার সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের তথ্যাদি থেকে জানা যায়, আপনি বহুমুখী কর্মকাণ্ডে নেতৃত্ব দিতেন সহজাত প্রতিভায়। প্রতিবাদী ছিলেন। সংগঠক ছিলেন।
সাংগঠনিক দক্ষতা ও ব্যক্তিত্বগুণের জন্য বেথুন কলেজের প্রিন্সিপাল শ্রীমতি রাইট আপনাকে ‘সিনিয়র স্টুডেন্ট’ মর্যাদায় সম্মানিত করেছিলেন। বেথুন কলেজে প্রথম ছাত্রী-রিইউনিয়ন (ছাত্রী-পুনর্মিলনী) গড়ে তুলেছিলেন আপনি। অন্যদিকে আপনার রাজনৈতিক আদর্শের সঙ্গে সংঘর্ষ হওয়ায় বিরোধও ঘটিয়েছিলেন। ১৯২১ সালের ১ আগস্ট লোকমান্য বাল গঙ্গাধর তিলকের মৃত্যু হওয়ায় তাঁর প্রতি সম্মান জানাতে ছুটি ঘোষণার দাবি জানালে শ্রীমতি রাইট আপনাদের জাতীয় চেতনায় আঘাত দেন। ফলে তাত্ক্ষণিক সিদ্ধান্তে কলেজে ‘ছাত্রী-ধর্মঘট’-এর ডাক দিলেন। বাধ্য হয়ে প্রিন্সিপাল ক্ষমা চেয়ে অপ্রীতিকর সংকটের সমাধান করেছিলেন।৯
বেথুন কলেজে আপনার অন্যতম সহপাঠী প্রীতি চট্টোপাধ্যায় একটি লেখায় (জয়শ্রী পত্রিকায় প্রকাশিত)১০ জানিয়েছেন আপনার শিক্ষা, সংস্কৃতি, খেলাধুলা, রাজনীতি চর্চার বিষয়ে। আপনি ও আপনার সতীর্থ প্রীতি চট্টোপাধ্যায় ‘বেথুনের বড় বড় থামওয়ালা চওড়া বারান্দাগুলোতে লম্বা-লম্বা পা ফেলে বেড়াতে বেড়াতে’ জল্পনা-কল্পনা করতেন, কেমন করে নিজেদের জীবনকে কাজে লাগাবেন, কেমন করে কোন পথে দেশের মুক্তিসংগ্রামে নিজেদের উত্সর্গ করে দেবেন ইত্যাদি আলোচনায়।
আপনার পুরো জীবন ইতিহাস যেহেতু আমরা নানা লেখা, চর্চা, জীবনী বই থেকে জেনেছি, সেই সূত্রে জানতে পেরেছি, ১৯১৭ সালের ২ অক্টোবর বাবাকে লিখেছিলেন আপনার জীবনের আদর্শের কথা। লিখেছিলেন:
আমার ক্ষুদ্র শক্তি যদি একটি লোকেরও উপকার করতে পারতো তবে নিজেকে ধন্য মনে করতুম। সত্যি বলছি—এ আমার বক্তৃতা নয়, এটা আমার প্রাণের কথা, এই আমার ideal.
...আমার উদ্দেশ্য নয় এই পৃথিবীতে লোকের প্রিয় হওয়া কিন্তু এই পৃথিবীতে খাঁটি হওয়া। খাঁটি হয়েও যদি প্রিয় হতে পারি তবে তো কথাই নেই।১১
আমরা নিশ্চিত হচ্ছি, আকস্মিকভাবে দৃঢ়চেতা লীলা নাগের আবির্ভাব ঘটেনি। কারণ, শৈশব-কৈশোরে স্বপ্নসাধনা, রাজনীতি-সচেতন জীবনচর্চা, সাংগঠনিক-চর্চা ও অনুশীলনে ব্যাপৃত থাকা আপনার প্রতিষ্ঠা ও জীবনসাফল্যের মূল সূত্র।
চার
আপনার কাজ, দক্ষতা ও সাধনার প্রতিটি ধাপ সুশৃঙ্খলভাবে রূপায়িত হয়েছে। যদিও প্রশ্ন জাগে আমার মনে, আপনি নারী শিক্ষাব্রতী এবং নারী আন্দোলনের নেত্রী হিসেবে ঢাকায় প্রতিটি এলাকায়, বাড়িতে বাড়িতে যখন খুঁজেছেন শিশু, কিশোরী, তরুণী ছাত্রী আপনার প্রতিষ্ঠিত ১২টি স্কুলে ভর্তির জন্য; তখন কি শুধুই সমাজসেবামূলক দৃষ্টি আপনাকে উদ্দীপিত করেছিল? নাকি আপনার
মন ও দৃষ্টি পরিপূর্ণ ছিল রাজনৈতিক-স্বদেশি বিপ্লবী ভাবধারা এবং সক্রিয় আন্দোলনমুখী কর্মধারায়?
সাল, মাস, দিন হিসেবে আপনার কাজের ক্রমধারায় রাজনৈতিক-স্বদেশি-বিপ্লবী পদক্ষেপগুলো শিক্ষাজীবনের প্রতিটি ধাপে এবং পরবর্তী সময়ে চেতনা বিকাশের বিস্তৃত পরিসরে সুস্পষ্ট হয়ে আছে—যা সমাজ, দেশ ও জনগণের স্বাধীনতাকেই প্রধান আকাঙ্ক্ষিত ও উদ্দিষ্ট বলে চিহ্নিত হচ্ছে। তাই নিজের প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাই, আপনার জীবনব্যাপী কর্মসাধনা বিপ্লবী চেতনার নিরলস স্রোতধারায় বহমান ছিল।
এই একুশ শতকের (২০১৬) দ্বিতীয় দশকে অর্থাত্ বিশ শতকের (১৯১৬) দ্বিতীয় দশক থেকে এক শ বছর পরও সেই চেতনা ও অনুশীলন আমাদের (ঢাকা, পূর্ববঙ্গ) বাংলাদেশে প্রগতির আন্দোলনে অতি প্রয়োজনীয় বলে আমরা অনুসন্ধান করি এবং বহু মনীষীর জীবনসাধনার তালিকায় আপনার নাম বারবার উচ্চারণ করি, সংযোজন করি, অব্যাহতভাবে অনুশীলন করি।
এই ধারায় আমরা বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত নারী সমাজ ও নারী সংগঠনগুলো আপনার নারী আন্দোলনের কর্মধারা থেকে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি, অনুসরণ করেছি এবং প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছি।
১৯২১ সালে আপনি যখন বিএ পাস করেছেন, সেই বছরে শুরু হয়েছিল নারীদের ভোটাধিকার আন্দোলন। কুমুদিনী বসুর নেতৃত্বে গড়ে ওঠা ‘সারা বাংলা নারী ভোটাধিকার কমিটির (নিখিল বঙ্গ নারী ভোটাধিকার সমিতি) সহ-সম্পাদিকার দায়িত্ব পেয়েছিলেন আপনি। আপনার কর্মস্থল ঢাকায় নারীদের সংগঠিত করলেন। ভোটাধিকার বিষয়ে আন্দোলন করার লক্ষ্যে মহিলাদের সভার আয়োজন করলেন। সভানেত্রীত্ব করার জন্য আপনার আহ্বানে যোগ দিয়েছিলেন ইডেন স্কুলের প্রিন্সিপাল শ্রীমতি স্বর্ণলতা দাস।১২
১৯২২ সালে সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে পরিচালিত উত্তরবঙ্গ বন্যাত্রাণের কাজে যুক্ত হয়ে ঢাকায় ‘ঢাকা মহিলা কমিটি’ গঠন করে বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে অর্থ ও বস্ত্র সংগ্রহ করেছেন। ১৯২৮ সালে সাইমন কমিশন-বিরোধী হরতাল কর্মসূচিতে ঢাকার মহিলাদের সংগঠিত করে মিছিলে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন আপনি।১৩
আপনার কৈশোর ও কৈশোর উত্তীর্ণ শিক্ষালয় ইডেন স্কুলের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিলেন আপনি। শিক্ষা ও সংস্কৃতির রস আপনি সেই স্কুলের শিক্ষকবৃন্দ, শিক্ষা কার্যক্রম থেকে আহরণ করেছিলেন সাত বছর ধরে। (১৯১১-১৯১৭) ছিলেন হোস্টেলে ম্যাট্রিক ও আইএ পড়ার সময়ে (ইডেন স্কুল ও বেথুন কলেজে)। ছুটিতে বাড়িতে যেতেন। তখনো ভাইদের কাছে স্কুলের আনন্দময় পরিবেশের গল্প উজাড় করে বলতেন।
বাড়িতে থেকে পড়ার জন্য মানসম্মত স্কুল-কলেজ পেতেন না বলে বদলির চাকরিতে কর্মরত বাবা আপনাকে ঢাকায়, কলকাতায় আবাসিক স্কুল-কলেজে পড়িয়েছেন। পরিবারের সমৃদ্ধ শিক্ষা-সাংস্কৃতিক আদর্শ ও স্বদেশানুরাগ আপনার চারিত্রিক দৃপ্ত আদর্শ গড়ে তুলেছে নিয়ত পরিচর্যায়, আদরে, যত্নে। সেই পারিবারিক প্রভাব-যত্ন এবং স্কুলের ঘরোয়া আন্তরিক যত্ন, পরিবেশ ও শিক্ষা-সংস্কৃতির চর্চার প্রভাবে পরিবার-বিচ্ছিন্নতার বিষণ্নতা আপনার মধ্যে স্থান পায়নি। উপরন্তু রবীন্দ্র-প্রভাবও গুরুত্বপূর্ণ ছিল আপনার জীবনে।
আপনি বলেছেন আপনার ‘জীবনের প্রাথমিক বুনিয়াদ রবীন্দ্র-প্রসাদ সিঞ্চনে’ ‘উন্মিষিত’ হয়েছে। বলেছেন, ‘মনে পড়ে প্রতি সকালে সন্ধ্যায় পারিবারিক সম্মিলিত প্রার্থনায় অথবা ছাত্রাবস্থায় দৈনন্দিন সম্মিলিত সঙ্গীতে প্রধানত রবীন্দ্রনাথের গানের মাধ্যমে ধীরে ধীরে উন্মিষিত হয়েছে। জীবন সম্বন্ধে
নিষ্ঠা, গাম্ভীর্য, বিপদে নিঃশঙ্কতা ও আত্মপ্রত্যয়, অর্থাত্ অলক্ষ্যে পত্তন হয়েছে জীবনের প্রাথমিক বুনিয়াদ রবীন্দ্র-প্রসাদ সিঞ্চনে। লক্ষ উপদেশাবলী যা করতে পারত কিনা সন্দেহ, রবীন্দ্র সঙ্গীতের ভাব ভাষা ও সুর অতি সহজে স্বাভাবিকভাবে তা করেছে।’১৪
বাংলাদেশের প্রতিটি গণ-আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথ পথ দেখিয়েছেন। দেখাচ্ছেন আজও। পাকিস্তান শাসনামলে রবীন্দ্রশতবর্ষ উদ্যাপনে (১৯৬১) তীব্র বাধার বিরুদ্ধে লড়েছি আমরা। মুক্তিযুদ্ধোত্তর স্বাধীন বাংলাদেশে জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা’ হূদয়ে ধারণ করে চলেছি।
শ্রদ্ধেয় লীলা নাগ, আপনার প্রিয় কর্মস্থল ঢাকায় ও বাংলাদেশে বর্তমান সময়ে আমরা শিক্ষা ও শিক্ষাকেন্দ্রে মানবিক-সাংস্কৃতিক-আদর্শ সংকট, তরুণ সমাজের একাংশের আদর্শ বিচ্যুতি ও পরিবার বিচ্ছিন্নতার সংকট, সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের নৃশংসতার অন্ধকার দূর করার সংগ্রামে লিপ্ত রয়েছি। এই সংকট থেকে উত্তরণের পথ খুঁজতে আপনার জীবনচর্চা কিছুটা হলেও আমাদের পথ দেখাচ্ছে।
আপনার যুগে প্রগতির সংগ্রামে, স্বাধীনতার জন্য বিপ্লবী আন্দোলনে তরুণ-তরুণীরা সশস্ত্র অগ্নিপরীক্ষায় জীবন উত্সর্গ করেছেন দলে দলে। কারাবরণ, আত্মাহুতি, ফাঁসির মঞ্চে জীবনের জয়গান গেয়েছেন বিপ্লবীরা।
বিপ্লবী দলেও ভিন্নমতের বিরোধ ছিল। হিংসা, সহিংসতা বিপ্লবীদের মূল লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করেছিল। ‘শ্রীসংঘ’ও সেই সংকটের মুখোমুখি হয়েছিল।
আকাঙ্ক্ষিত বিপ্লবী আদর্শের লক্ষ্য পূরণ হয়নি বলে আপনি ও আপনার মতো শত-সহস্র বিপ্লবী দেশপ্রেম থেকে বিচ্যুত হননি, হতাশ হলেও নতুন উদ্যমে নতুন পথে সংগঠন-আন্দোলনকে মানুষের কল্যাণে প্রবাহিত করেছেন।
সামন্তবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, শ্রেণিবৈষম্য, ধনবৈষম্য আজও টিকে আছে, আজও আকাঙ্ক্ষিত সুন্দর মানব প্রগতির পথ রুদ্ধ করে আছে। বাংলাদেশে নানা উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে, উন্নয়নের নতুন নতুন অর্জনের মধ্য দিয়ে, মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত স্বাধীনতার (১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১) ৪৫ বছর পরে উত্তরণের লক্ষ্যে বহু মত ও পথ বিশ্লেষণ করতে করতে নতুন পথ তৈরি করতে আমরা উদ্যোগী হই। বহু জনের আদর্শ জীবনের মধ্যে পথ অনুসন্ধান করি। আপনার জীবন আদর্শ আজও ধ্রুবতারার মতো পথ দেখায় আমাকে—আমাদের অনেককে।
আপনি যখন ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছিলেন, তখন বাবার স্থায়ী আবাসস্থল ৩, বকশীবাজারে থাকা শুরু করেছেন। প্রতিবেশী ও সহপাঠী অনিল রায় থাকতেন ৭, বকশীবাজার, নিভৃতনিলয় বাড়িতে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠের সময় থেকেই সামাজিক-সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক সহযাত্রায় আপনারা চলেছিলেন পারস্পরিক হূদ্যতায়। ১৯২৩ সালে এমএ ডিগ্রি অর্জনের পর প্রতিষ্ঠা করলেন ‘দীপালী সংঘ’। এর লক্ষ্য ছিল নারীমুক্তি সংগ্রাম। গোপন বিপ্লবী দল ‘শ্রীসংঘ’-এর কাজে যুক্ত হলেন ১৯২৪ সালে। নারীমুক্তির লক্ষ্যে গড়ে তোলা দীপালী সংঘের সব কার্যক্রমে বিপ্লবী আদর্শ যুক্ত হতে থাকল। ১২টি স্কুল প্রতিষ্ঠিত হলো ঢাকায় মেয়েদের শিক্ষাদানের জন্য। নিউ হাইস্কুল বা দীপালী স্কুল, নারীশিক্ষা মন্দির (১৯২৮), শিক্ষা ভবন, শিক্ষা নিকেতন, বারোটি অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করলেন। মেয়েদের জন্য ইংরেজি স্কুল প্রতিষ্ঠা করলেন। মেয়েদের জন্য বয়স্ক শিক্ষা, কারিগরি শিক্ষা প্রচলনে আপনিই ছিলেন পথিকৃত্। দীপালী স্কুলই পরে ‘কামরুন্নেসা বালিকা বিদ্যালয়’ নামে চালু আছে। অর্থ সহযোগিতা করেছিলেন সমাজের অর্থবান প্রগতিশীল ব্যক্তিবর্গ এবং আপনার বাবা।১৫
বাল্যবিবাহের ঘোর বিরোধী ছিলেন আপনি। মেয়েদের আত্মপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে উচ্চশিক্ষা, আয়-উপার্জন, স্বাধীন চিন্তা, নারী-পুরুষের সম-অধিকার—এসবই আপনি অব্যাহতভাবে প্রচার করতেন এবং গঠনমূলক কাজের মধ্য দিয়ে বাস্তবায়িত করতেন।
আপনার বাবা তাগাদা দিতেন বিয়ের জন্য। ১৪-১৫ বছর বয়স থেকে আপনি বাবার সেই সব তাগাদা বাতিল করে চলেছিলেন। রাগান্বিত হয়ে বাবাকে চিঠি লিখতেন যেন কখনো কারও সঙ্গে আপনার বিয়ের প্রস্তাব তিনি না দেন। আপনার ছোট ভাই প্রভাতচন্দ্র নাগ লিখেছেন, ‘দিদির বয়স যখন ১৪/১৫ তখন থেকে দিদিকে বিবাহ দেবার জন্য বাবার চেষ্টার অন্ত নেই; কতবার কত প্রস্তাবই না বাবা এনেছেন দিদির জন্য। কিন্তু দিদি সবটাই ফিরিয়ে দিয়েছেন; শেষবার বাবা হাল ছেড়ে দিলেন। মা কোনো সময়ই বেশি জোর করেননি এই সম্পর্কে। মা বলতেন, বুড়ীর যখন ইচ্ছা হবে তখন তো নিজেই ঠিক করবে—জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার আমি কোনো দিনই পক্ষপাতী নই—এতে অনিষ্টই হয়—মঙ্গল হয় না কখনো।’১৬
বিপ্লবী সাথি অনিল রায়ের সঙ্গে বিয়ের সময় (১৯৩৯) আপনার মা বেঁচে ছিলেন না, বাবা উপস্থিত ছিলেন। সেই সব ব্যক্তিগত জীবনের দুঃখময় স্মৃতিতে বিপ্লবী লীলা রায়কে, স্নেহপরায়ণ এক নারীকে চেনা যায়।
পাঁচ
‘ঢাকা দীপালী সংঘ’ ছিল সেই সময়ের একমাত্র মহিলা সমিতি। সভ্যসংখ্যা ১৯২৫ সালে ১০০ নারীর বেশি বলে জানিয়েছিলেন আপনি বঙ্গলক্ষ্মী, ১ম বর্ষ ২য় সংখ্যায়—১৯২৬ সালে প্রকাশিত আপনার লেখায়। ঢাকা শহরের পাড়ায় পাড়ায়—যথা ওয়ারী, বকশীবাজার, রাজার দেউরী, তাঁতিবাজার, নারিন্দা-ওয়ারী এলাকায় নারীদের পড়াশোনা, শিল্প শিক্ষা, বেতের ব্যাগ তৈরি, চরকায় সুতা কাটা শেখানো হতো। লেডি ডাক্তার, রোগীর পরিচর্যা, সন্তান পালন ইত্যাদি যেমন অতি প্রয়োজনীয় পাঠ্যসূচি বলে ভেবেছিলেন, তেমনি সংস্কৃতিচর্চা, নারীর সম-অধিকার বিষয়ে জাগরণমূলক কর্মসূচিও ছিল পাঠ্যসূচিতে। ছিল ব্যায়ামাগার। সেখানে লাঠি, ছুরিখেলা, শরীরচর্চা শেখানো হতো আত্মরক্ষার উদ্দেশ্যে।
দীপালী সংঘ প্রতিষ্ঠায় আপনার লক্ষ্য ছিল মূলত দুটি। বলেছেন আপনি, প্রথম লক্ষ্য ছিল স্বামী ও ভাইদের দেশের জন্য প্রাণোত্সর্গে নারীদের উদ্বুদ্ধ করা। দ্বিতীয় লক্ষ্য ছিল, অস্ত্রশস্ত্র, বিপ্লবী পলাতক ও চিঠিপত্র চালাচালির সন্দেহমুক্ত স্থান সৃষ্টি করা।
এই প্রসঙ্গে আপনাকে এবং আমাদের বর্তমান সময়ের সচেতন, নারী জাগরণে উদ্বুদ্ধ নারী-পুরুষ ব্যক্তিবর্গকে জানাতে চাই, সেই সময়কাল থেকে ৯১ বছর পেরিয়ে এসে এখনো আমরা সেই ধারাতেই নারী সংগঠন, নারী জাগরণের কাজ করছি। আন্তর্জাতিক সেতুবন্ধনে নারীবাদের আওয়াজ তুলছি, জেন্ডার বৈষম্যের বিরুদ্ধে, আর্থসামাজিক ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে নারী জাগরণ আন্দোলনকে সংগঠিত করছি ঠিকই, কিন্তু শত বছরের ইতিবাচক সংগঠিত নারী আন্দোলনের প্রগতির ধারাটি বাধাগ্রস্ত আজও। বহুমুখী নারী সংগঠন-আন্দোলনের কাজ সামাজিক বিস্তার থেকে আজ পিছিয়ে যাচ্ছে আত্মকেন্দ্রিকতায়। গড়ে উঠছে মানববন্ধনের কাজ। যুগের নানামুখী সাফল্যগাথায় ব্যক্তি নারীর অগ্রযাত্রা আমাদের চোখে পড়ে কিন্তু সমষ্টিগত অগ্রযাত্রা আজও প্রশ্নবিদ্ধ।
আপনি সেই সময়েই স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন, শুধু সমাজ পরিবর্তন ও নারীর কল্যাণমুখী কাজ দিয়ে নারী-মুক্তি হবে না, চাই রাজনৈতিক মুক্তি, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক পরাধীনতা ভেঙে দিয়ে চাই স্বাধীনতার মুক্তি। যোগ দিলেন ‘শ্রীসংঘ’-এ। ‘Social Welfare League’ একই সঙ্গে ‘শ্রীসংঘ’ নামে রাজনৈতিক গুপ্ত বিপ্লবী দল হিসেবে কাজ শুরু করেছিল। নারী বিপ্লবীকে দলে নেওয়া, নেতৃত্বে যুক্ত করার বিরুদ্ধে পরশ্রীকাতর, ভিন্নধারার পুরুষ বিপ্লবীদের মতামত সোচ্চার হয়েছিল।
বিশ্লেষণ করেছেন প্রথিতযশা অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, প্রথমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সময়ে ১৯২১ সালে ‘নারী’ বলে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার লড়াইয়ে আপনি উত্তীর্ণ হয়ে এসেছিলেন, কিন্তু আবারও ‘নারী’ বলে বাধা পেলেন ‘শ্রীসংঘ’-এর পুরুষ বিপ্লবীদের কাছ থেকে। দ্বিতীয় বাধাও চূর্ণ করেছেন। কেননা তাঁর ভেতরে আগুন ছিল।১৭
আপনার ভেতরের এই আগুন, সচেতনতা, মানবসেবার ব্রত, নারী জাগরণের জন্য বৈপ্লবিক কর্মতত্পরতা আমাদের জন্য অনুকরণীয় শিক্ষা হিসেবেই অব্যাহত আছে।
দীপালী সংঘের সদস্য হয়েছিলেন বিপ্লবী চেতনায় উদ্দীপ্ত তরুণী প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার (১৯১১-১৯৩২)। ইডেন কলেজে পড়ার সময়ে জনৈক শিক্ষয়িত্রী তাঁকে একটি ফর্ম দিয়ে দীপালী সংঘের সদস্য হওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। দীপালী সংঘের সদস্য হওয়ার অন্যতম শর্ত আপনি যুক্ত করেছিলেন, ‘প্রয়োজন হইলে দেশের মুক্তি সংগ্রামে আমার সর্বস্ব, জীবন পর্যন্ত আমি ত্যাগ করিতে প্রস্তুত আছি।’ এই শর্তটিতে প্রীতিলতা আকর্ষিত হয়েছিলেন।
চট্টগ্রামের বিপ্লবী সূর্যসেনের বিপ্লবী দলের সঙ্গে যুক্ত আত্মীয় দাদার মাধ্যমে পরোক্ষভাবে বিপ্লবী দলের কাজে যুক্ত প্রীতিলতা দলের নেতার মতামত পেয়েছিলেন দীপালী সংঘের সদস্য হতে পারবেন কিন্তু সূর্যসেনের বিপ্লবী দলের সঙ্গে তাঁর যোগসূত্রতা গোপন রাখতে হবে। প্রীতিলতা তা মেনেছেন, অস্ত্র চালনা শিখেছেন, দেশের স্বাধীনতার সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। বিপ্লবী আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে বিপ্লবী দলে যোগ দিতে অনুমোদন পেয়েছেন অনেক পরে। সূর্যসেনের বিপ্লবী দলের সদস্য হয়েছিলেন, চট্টগ্রামের ইউরোপিয়ান ক্লাবে সশস্ত্র আক্রমণ চালিয়েছেন এবং গুলিবিদ্ধ হয়ে বিপ্লবী দলের নির্দেশ মেনে ‘পটাশিয়াম সায়োনাইড’ খেয়ে ১৯৩২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর জীবন বিসর্জন দিয়েছেন।
পুরুষ-নারীর বৈষম্য তাঁকে তীব্র বেদনা দিয়েছে। মৃত্যুর পর তাঁর পোশাকের মধ্যে পাওয়া বিবৃতিতে তিনি বহু বিপ্লবী আদর্শিক ঘোষণার সঙ্গে লিখেছেন, ‘দেশের মুক্তি-সংগ্রামে নারী ও পুরুষের পার্থক্য আমাকে ব্যথিত করিয়াছিল। যদি আমাদের ভাইয়েরা মাতৃভূমির জন্য যুদ্ধে অবতীর্ণ হইতে পারে, আমরা ভগিনীরা কেন উহা পারিব না?’১৮
শ্রদ্ধেয় লীলা নাগ, আপনার এবং প্রীতিলতার মতো আরও বহু বিপ্লবী নারী এই বিক্ষোভ জানিয়েছেন, চূর্ণ করেছেন বাধা। কিন্তু সেই বাধা চলেছে আজও। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের জন্য সশস্ত্র প্রশিক্ষণে মেয়েদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। মুক্তিযোদ্ধা বাহিনীতে শুধু পুরুষ তরুণদের স্বীকৃতি ছিল মুক্তিযুদ্ধের সময়ের সরকারি বিধানে। তা সত্ত্বেও মেয়েরা গেরিলা যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা হতে পারেননি সরকারি নথিপত্রে। সেই সময় দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলজুড়ে গ্রামে-শহরে, বাড়িতে বাড়িতে নারীদের নির্যাতিত হতে হয়েছে। পাক-সামরিক বাহিনীর সেনারা ও দেশের ভেতরে তাদের দোসর রাজাকাররা নারীদের অত্যাচার নির্যাতন করেছে, বাংকারে আটকে রেখেছে, শারীরিকভাবে অত্যাচার করেছে। স্বাধীনতার পর তাঁদের উদ্ধার করে পুনর্বাসন কেন্দ্রে রাখা হলো, ‘বীরাঙ্গনা’ বলা হলো। ‘মুক্তিযোদ্ধা’র সম্মান দেওয়ার জন্য বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের নিরলস দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি (২০১৫) নারীদের মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতির আইনি পরিসর তৈরি হয়েছে।১৯
এই প্রসঙ্গ নিয়ে আমরা যখন চর্চা করি নারীবৈষম্য ও নারীর প্রতি রাজনৈতিক পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়ে, তখন অবধারিতভাবে আমাদের পূর্বসূরি বিপ্লবী আপনি লীলা নাগ, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন, সুফিয়া কামালসহ সকল নারী বিপ্লবী-সমাজকর্মী, স্বাধীনতাসংগ্রামী নারীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই, আপনাদের আদর্শ অনুসরণ করতে উদ্দীপ্ত হই।
আপনার সাধিত কাজগুলোর সময়কাল ধরে ধরে এগিয়ে যেতে যেতে বুঝতে পারি যে, আপনার প্রতিটি কাজের মধ্যে যোগসূত্রতা ছিল: নারী জাগরণ ঘটাতে হবে তাই স্কুল করতে হবে; পাঠ্যসূচিতে যেমন থাকতে হবে সামাজিক দায়িত্ব পালনের কুশলতা অর্জনের শিক্ষা অনুশীলন, তেমনি থাকতে হবে বিপ্লবী চেতনার প্রেরণা-উদ্দীপনা। থাকতে হবে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাদি। এসবের সঙ্গে সঙ্গে সংগঠিত ও অসংগঠিত নারী সমাজকে উদ্দীপ্ত করার জন্য সংবর্ধনা জানিয়েছেন, অভিনন্দন জানিয়েছেন, আমন্ত্রণ জানিয়েছেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে, মহাত্মা গান্ধীকে, সরলা দেবী চৌধুরানীকে। প্রয়াত দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতেও সভার আয়োজন করেছেন।
সংবর্ধনার উত্তরে বিশিষ্ট সংবর্ধিত ব্যক্তিত্ববৃন্দ আপনাদের সংগঠিত কাজের কৃতিত্বে বিস্ময় জানিয়েছেন, আনন্দ প্রকাশ করেছেন।
৮ ফেব্রুয়ারি ১৯২৬ সালে ঢাকা ব্রাহ্মসমাজ প্রাঙ্গণে২০ কবি রবীন্দ্রনাথের সংবর্ধনা সভার বিবরণীতে আপনি লিখেছেন:
সমবেত বোধ হয় দশ পনেরো হাজার বা তার চেয়েও বেশি সংখ্যক মেয়েরা সুসজ্জিত সুশৃঙ্খল পরিবেশে কবি গুরুকে তাঁদের শ্রদ্ধা জানাবার জন্য এসে মিলিত হলেন। ছোট্ট ছোট্ট সুসজ্জিত মেয়েরা পুষ্পবন্দনে অর্ঘ্য সাজিয়ে কবিকে বরণ করল: ‘ওহে সুন্দর মরিমরি।’ কবি ওদের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে গুণ গুণ করে গান করলেন। সে এক অপূর্ব দৃশ্য। তারপর তাঁর সে আশ্চর্য কণ্ঠে তিনি শুরু করলেন—‘সমস্ত এশিয়াতে মেয়েদের এত বড় সভা দেখিনি কোথাও...।’ আনন্দে মন ভরে উঠল। মেয়েদের আহ্বান জানালেন ‘গৃহকে তোমরা আপন করেছ বাহিরকেও তোমাদের আপন করতে হবে। বাহিরকে আপন করে আত্মীয়—পরের গণ্ডী দূর করতে হবে।...সমস্ত সমাজের মাঝে, কাজের মাঝে, ভাবনার মাঝে এগিয়ে এসে তোমাদের অংশ নিতে হবে। তবেই সমস্ত সহজ হবে সার্থক হবে।’২১
উল্লেখ্য, ঢাকা শহরের মোট নারী সংখ্যা ১৯২১ সালে ছিল ৫২,১৭১। ১৯৩১ সালে ছিল ৫৯,১৫৩ জন।২২ বর্তমান পুরান ঢাকা ছিল ঢাকার ভৌগোলিক এলাকা। দীপালী সংঘে আপনারা সংগঠিত করেছিলেন বিপুলসংখ্যক নারী সদস্যকে।
আপনার লেখায় ফুটে উঠেছে; রবীন্দ্রনাথ আপনার চলার পথে, আপনার জীবনে পথনির্দেশক হয়েছেন প্রায় সময়ই। সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন নারী আন্দোলনের মুখপত্র হিসেবে মেয়েদের মধ্যে ‘দেশাত্মবোধ ও শঙ্কাহীন দেশসেবার ভাব জাগ্রত করবার উদ্দেশ্য নিয়ে’। রবীন্দ্রনাথ আপনার অনুরোধে পত্রিকাটির নাম দিলেন জয়শ্রী। সেই সঙ্গে তিনি কবিতা পাঠালেন:
বিজয়িনী নাই তব ভয়,
দুঃখে ও ব্যথায় তব জয়।
অন্যায়ের অপমান
সম্মান করিবে দান,
জয়শ্রীর এই পরিচয়।
জয়শ্রী আত্মপ্রকাশ করেছিল ১৯৩১ সালের মে মাসে। কেবল মেয়েদের পত্রিকা হিসেবে বা সাহিত্য পত্রিকা হিসেবে নয়, এর বিস্তার ঘটল সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক দূরদৃষ্টির প্রসার ঘটানোর প্রয়াসে। আপনার সাধনা ছিল নতুন সমাজ, নতুন জীবন, নতুন মানুষ গড়ে তোলার প্রয়াসে জয়শ্রীর প্রকাশ অব্যাহত রাখা। ঘোষণা দিয়েছিলেন, পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচন এবং সমাজ পরিবর্তনের লক্ষ্য সামনে রেখে, সর্বপ্রকার দেশসেবার উদ্দেশ্যে জয়শ্রী প্রকাশিত হচ্ছে।
ব্রিটিশরাজের বিরুদ্ধতার জন্য জয়শ্রী রাজরোষে পড়েছিল একাধিকবার। শেষ পর্যন্ত ১৯৩৫ সালে সরকারি নিষেধাজ্ঞায় চূড়ান্তভাবে বন্ধ হয়ে যায় ঢাকা থেকে প্রকাশিত জয়শ্রী পত্রিকা। জয়শ্রী পুনরায় দ্বিতীয় পর্যায়ে কলকাতা থেকে প্রকাশিত হলো ১৯৩৮ সালের জুলাই মাসে।২৩
ছয়
আপনার বিপ্লবী সত্তা, বিপ্লবী কাজ, রাজনীতির বিপ্লবী পদক্ষেপগুলো ছিল সুশৃঙ্খল এবং পরস্পর সম্পর্কিত। রাজনৈতিক বিপ্লবী পদক্ষেপগুলো প্রত্যক্ষভাবে শুরু করেছিলেন ‘শ্রীসংঘ’-এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে। একমাত্র নারী সদস্য এবং নারী নেতৃত্বের প্রতিভূ আপনাকে মুখোমুখি হতে হয়েছিল তীব্র পুরুষতান্ত্রিক বিরোধিতার। দলের মধ্যে প্রশ্ন উঠেছিল: ‘Shall we be guided by a woman?’ স্থির লক্ষ্যে আপনি বিপ্লবী দলের কাজ করে গেলেন। বিভিন্নজনের স্মৃতিচারণে আমরা সেই সময়ের সংকটময় পরিস্থিতির তথ্য জানতে পারছি। সেই সব তথ্য শতবছরের ইতিহাসের আকর হয়ে আছে।২৪
অন্যান্য বিপ্লবী দলে নারী সদস্য স্বীকৃত ছিল না। সূর্যসেনের নেতৃত্বে বিপ্লবী দলে নারী সদস্য গ্রহণযোগ্য হয়েছিল প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, কল্পনা দত্ত প্রমুখের ঐকান্তিক বিপ্লবী প্রচেষ্টার তাগিদে।
ঢাকায় বিপ্লবী দল শ্রীসংঘ দুভাগ হয়ে যায় ১৯২৯ সালে। শ্রীসংঘ থেকে বেরিয়ে যাওয়া দলের নাম হলো বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স বা বি.ভি। সন্ত্রাস-সংঘর্ষ আপনাকে কষ্ট দিয়েছে কিন্তু সব দ্বন্দ্ব-কষ্ট ঝেড়ে শ্রীসংঘের নেতা অনিল রায়ের সহযোগী হয়ে চালিয়ে গেলেন বিপ্লবী কর্মকাণ্ড। আপনারা বাংলা, আসাম, ত্রিপুরার বহু শহরে গড়ে তুললেন দল এবং দলের কাজ। ১৯৩০ সালে চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ ও অস্ত্রাগার দখলের ফলে ব্রিটিশ সরকারের ভিত কেঁপে ওঠার সময়ে ভাবলেন সব বিপ্লবী দলের ঐক্যের গুরুত্বের কথা। নারী-পুরুষ গোপন কর্মীদের দলে সংঘবদ্ধ করতে থাকলেন। প্রকাশ্যে কংগ্রেসের রাজনৈতিক মঞ্চে যোগ দিলেন, গোপনে গড়ে তুললেন শ্রীসংঘের শক্ত ভিত্তি।
ইতিহাসের পাতায় এসব গোপন বিপ্লবের কাহিনি সশ্রদ্ধ স্বীকৃতিতে সমুজ্জ্বল। ব্রিটিশশাসন মুক্ত করে দেশের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সশস্ত্র অভ্যুত্থান সমর্থন করে আপনি সকল বিপ্লবী সশস্ত্র দলগুলোর চাহিদা পূরণ করেছেন অস্ত্র সরবরাহ করে। আপনি এবং অনিল রায় অস্ত্র উত্পাদনের কথাও ভেবেছিলেন। অস্ত্র সংগ্রহ, অর্থ সংগ্রহ, অস্ত্রাগার রক্ষা করা, এসব কাজের জন্য বিপ্লবী নারী-পুরুষ কর্মীদের তৈরি ও সংগঠিত করার কাজে আপনাদের নিরলস নেতৃত্ব আজও বিস্ময়কর হয়ে আছে।
ঢাকার বকশীবাজার, ওয়ারী, ঠাটারিবাজার, গেন্ডারিয়া, বাংলাবাজার, লক্ষ্মীবাজার, ফরাসগঞ্জ, সিদ্ধেশ্বরী, তাঁতিবাজার, কায়েতটুলী, চাঁদনিঘাট, আজিমপুর এলাকাগুলোতে অস্ত্রঘাঁটি বানিয়ে যে নারীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন রুনু বসু, হেলেনা দত্ত, রেণু কণা সেনগুপ্ত, লতিকা দাস, অনুপমা বসু—তাঁরাও আমাদের শ্রদ্ধেয়।
চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের ধৃত বিপ্লবীদের মামলা পরিচালনার অর্থ সংগ্রহের জন্য বিপ্লবী ইন্দুমতী সিংহের (অনন্ত সিংহ-র বড় বোন) অনুরোধে আপনি অর্থ সংগ্রহ করেছিলেন।
এসব বিস্তৃত ঘটনার বিবরণ দিয়ে শেষ করা যাবে না।
কিন্তু তার চেয়েও অশেষ যে বিস্ময় আমাকে, আমাদের সকলকে প্রশ্নাকুল করে তুলেছে, তা হলো আপনি গঠনমূলকভাবে বিপ্লবী আন্দোলনকে কীভাবে সশস্ত্র এবং নিরস্ত্র দুই পথেই ধৈর্যের সঙ্গে দ্রুততালে এগিয়ে নিতে পেরেছিলেন? সেই সবের উত্তর আপনার জীবনব্যাপী কর্মধারায় বহমান।
সেই সময় (১৯৩১) দূর থেকে দেখে এবং জেনে সাহিত্যিক (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্কালীন অধ্যাপক) বুদ্ধদেব বসু বলেছিলেন, ‘তাঁর প্রতি একটি বিস্ময় মিশ্রিত শ্রদ্ধা অনুভব করতাম।’২৫
সাত
আপনার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ভীত ব্রিটিশরাজ কারাদণ্ড দিয়েছিল ১৯৩১-১৯৩৭ পর্যন্ত প্রথম দফায় ৭ বছর। আপনি ছিলেন বিনা বিচারে প্রথম ভারতীয় মহিলা রাজবন্দী।
পুনরায় ১৯৪০ সালে কারাবন্দী হলেন। আপনার বিয়ে হয়েছিল ১৯৩৯ সালে শ্রীসংঘের নেতা শ্রী অনিল রায়ের সঙ্গে। আপনার সহযোদ্ধা জীবনসাথী অনিল রায়কেও ব্রিটিশরাজ কারাদণ্ড দিয়েছিল ১৯৪০ সালে।
দুরারোগ্য ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে শ্রী অনিল রায় প্রয়াত হলেন ১৯৫২ সালে। জীবনসাথিকে হারিয়ে দুঃখ-বেদনায় বিদীর্ণ হলেও থামাননি কর্মোদ্যোগ।
আপনাদের জীবন ছিল পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসায় আপ্লুত। কারাবাসের সময়কালীন দিনলিপি, চিঠিপত্র সাক্ষ্য দিচ্ছে আপনারা দুজন ছিলেন পরস্পরকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য প্রতিশ্রুতিশীল। অনিল রায় অনুরোধ জানিয়েছিলেন, নারী আন্দোলন বিষয়ে লেখার জন্য, জেলখানা থেকে চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘তোমার memoirs লিখলে ভালো হয়। রাজনৈতিক বিষয়, জীবনের বিভিন্ন দিক, শিক্ষা সম্বন্ধে stray thoughts ইত্যাদি লিখবার আপত্তি বা বাধা কিছু নেই তো। creative work কিছু করা এটা ভাবতে খুব ভালো লাগে।... আমার খুব অনুরোধ জানবে।’২৬
আপনি কেন লেখেননি আপনার স্মৃতিকথা? নারী আন্দোলনের, রাজনৈতিক আন্দোলনের অকথিত ইতিহাস জানার সুযোগ আমরা হারালাম।
অন্যদের লেখা নানা স্মৃতিকথা, নানা লেখা থেকে আমরা জানতে পারছি আপনাদের সুন্দর সমদর্শী জীবনের আনন্দ-বেদনার কথা, আদর্শের কথা, মানুষের জন্য জীবন উত্সর্গের কথা। আপনার কারাগারে বন্দিজীবনের নারী সাথিরা লিখেছেন কারাজীবনেও আপনার সৃজনশীল লেখাপড়ার কথা, অন্যদের অনুপ্রাণিত করার কথা, হাসিখুশি আনন্দে জীবনের কষ্ট, বেদনা, হতাশা থেকে উত্তরণের ইতিবাচক উদ্যমের কথা।
আট
আমরা নারীদের লেখা বহু তথ্যসমৃদ্ধ স্মৃতিকথা পেয়েছি, যা থেকে জানতে পারছি কীভাবে আপনি বহুবিধ কাজে তাঁদের সহযোগিতা চেয়েছেন এবং পেয়েছেন অথবা রাজনৈতিক মতভেদ সত্ত্বেও বন্ধুত্বের অন্তরঙ্গতা পেয়েছেন।
ঢাকার বিখ্যাত স্বদেশী নেত্রী আশালতা সেন (১৮৯৪-১৯৮৬) লিখেছেন: ‘লীলা নাগ (পরে রায়) আমার সঙ্গে আলোচনা করেছেন আমাকে সশস্ত্র বিপ্লবের কাজে টানার জন্য। আমাদের উভয়ের লক্ষ্যই ছিল দেশের স্বাধীনতা; কিন্তু আমাদের পথ ছিল ভিন্ন। তিনি মনে করতেন অন্য অনেক দেশের মতো ভারতের স্বাধীনতাও দৃঢ়চিত্ত এবং গেরিলা যুদ্ধক্ষম তরুণ গোষ্ঠীর সাহায্যে সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমেই আনতে হবে। আমার বিশ্বাস ছিল যে, অহিংস গণ-আন্দোলনের পথই ভারতের পক্ষে শ্রেয়। আলোচনায় আমাদের মতবিভেদ দূর হলো না। আমাদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক আগের মতোই বন্ধুত্বপূর্ণ থাকল; কিন্তু আমাদের কর্মধারা বিভিন্ন রয়ে গেল।’২৭
১৯৩০ সালে মহাত্মা গান্ধীর ডাকে সত্যাগ্রহ আন্দোলনে ঢাকায় আশালতা সেনের সঙ্গে ‘মহিলা সত্যাগ্রহ কমিটি’ গঠন করে কাজ করেছিলেন আপনি।
সুহাসিনী (১৯১৫-?) দাস লিখেছেন, ১৯৩৯ সালের ২৪-২৭ ফেব্রুয়ারি সিলেটের সুরমা উপত্যকায় অনুষ্ঠিত ‘শ্রীহট্ট মহিলা সংঘ’-এর সম্মেলনে সুদীর্ঘ ও জ্বালাময়ী ভাষণে আপনি বলেছিলেন, ‘আমাদের সর্ব প্রথম কর্তব্য মেয়েদের সংঘবদ্ধ হওয়া। এই সংঘবদ্ধ হওয়ার প্রয়োজন এইজন্য যে, বিচ্ছিন্নভাবে মেয়েরা নিজেদের এবং জাতির জন্য যা করেছেন বা করবেন, তাতে উদ্দেশ্যসিদ্ধি কিছুতেই হবে না। কাজেই জাতির কল্যাণ যাদের কাম্য তাদের উচিত অবিলম্বে সংঘবদ্ধ হওয়া।’২৮
সিলেটের সরলাবালা দেব এবং জোবায়দা খাতুন চৌধুরী (১৯০১-১৯৮৫) কংগ্রেসের রাজনীতিতে যুক্ত থাকার সূত্রে আপনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন। ১৯৪২-এর আন্দোলনের সময়ে আপনি এবং অরুণা আসফ আলী সিলেট মহিলা সংঘের নেত্রীদের সহায়তায় গোপন আশ্রয়ে ছিলেন।
ঢাকার সমাজ-সাহিত্য সেবী স্বনামখ্যাত সারা তৈফুর (১৮৮৮-১৯৭১) ১৯২২ সালে আপনার প্রতিষ্ঠিত ‘দীপালী সংঘ’-এর সদস্য হয়েছিলেন। দীপালী সংঘের ‘শিল্প মেলায়’ তিনি সক্রিয় ছিলেন। একই সময়ে তিনি কলকাতায় রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন (১৮৮০-১৯৩২) পরিচালিত ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতীনে ইসলাম’ নারী সংগঠনের সক্রিয় সদস্য ছিলেন।২৯
আমরা জেনেছি, ১৯৪৬ সালে নোয়াখালীর ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময়কালে মহাত্মা গান্ধী যখন আহ্বান জানিয়েছিলেন এবং গিয়েছিলেন দাঙ্গাবিধ্বস্ত মানুষের পাশে তখন আপনিও ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট’ নামে সেবা প্রতিষ্ঠান গড়েছিলেন দাঙ্গা বিধ্বস্ত মানুষের কল্যাণে।৩০
রাজনৈতিক শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য, মানুষের কল্যাণের জন্য, ব্রিটিশদের শাসনমুক্ত হওয়ার স্বাধীনতার স্বপ্ন যখন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার রক্তে ভেসে যাচ্ছিল, তখন আপনি ঢাকায় শান্তি কমিটি গড়ে তুললেন ১৯৪৭-এ। দেশভাগের পর আপনি কলকাতা থেকে ঢাকায় চলে আসেন। ঢাকায় সলিমুল্লাহ এতিমখানায় আশ্রিত কলকাতা থেকে সদ্য ঢাকায় আসা কবি সুফিয়া কামালকে (১৯১১-১৯৯৯) খুঁজে বের করে স্বামীবাগ-হাটখোলার ‘তারাবাগ’-বাড়িতে তাঁর থাকার ব্যবস্থা করে শান্তি কমিটির কাজে আহ্বান জানালেন। কবি লিখেছেন, ‘যখন ঢাকায় এলাম, “নারী শিক্ষা মন্দির”-এর প্রতিষ্ঠাতা স্বনামধন্যা লীলা নাগ (লীলা রায়) আমাদের লীলাদি তখন হিন্দু মুসলমান মহিলাদের নিয়ে গড়ে তুলছেন “শান্তি কমিটি”। তাঁর ডাকে তাঁর সাথে যোগ দিলাম। তখনকার দিনের এম.এল.এ আনোয়ারা খাতুন, ইনুদি, ডলিদি আরও অনেক মহিলা এসে ঢাকা শহরতলী ছাড়িয়ে দূর গ্রামবন্দর গঞ্জে শান্তি কমিটির কাজে যোগ দিলেন।... অসীম ধৈর্য ছিল লীলাদির। বলতেন ওদের সাথে না মিশলে, সমব্যথী না হলে ওরা আমাদের কথা শুনবে কেন? এই একটা শিক্ষা তাঁর কাছে পেয়েছি।’৩১
অথচ আপনি পারলেন না নিজের দেশে বাস করতে। পাকিস্তান সরকার ১৯৪৮ সালে আপনাকে দেশত্যাগে বাধ্য করেছিল। শ্রদ্ধেয় লীলা নাগ (রায়), আপনার কাছ থেকে পাওয়া শিক্ষা এবং রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের কাছ থেকে পাওয়া শিক্ষা কবি সুফিয়া কামাল প্রোথিত করেছিলেন সেই সময়কালের কর্মকাণ্ডে এবং তা অব্যাহতভাবে চলেছে ১৯৫০-১৯৯৯ পর্যন্ত। এ সময়ের মধ্যে গঠিত নারী সংগঠনের সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলনে এবং মুক্তিযুদ্ধকালীন কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত নারীকর্মী ও সংগঠকদের আপনার প্রতিষ্ঠিত চেতনাই পথ দেখিয়েছে।
আমরা নারী আন্দোলনের কর্মকাণ্ডে রাজনৈতিক বিপ্লবী আদর্শকে যুক্ত করে চলতে শিখেছি সেই শিক্ষা শিরোধার্য করে। আপনার কাছে আমরা ঋণী। সেই ঋণ স্বীকার করার লক্ষ্যেই এই স্মারক-লেখা আপনাকে উত্সর্গ করলাম।
সূত্র
১. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, গীতবিতান, বিশ্বভারতী গ্রন্থবিভাগ, কলকাতা, অখণ্ড পুনমুর্দ্রণ, ১৩৭২, পৃ. ৫৭৭
২. সুবর্ণজয়ন্তী, শের-এ-বাংলা বালিকা মহাবিদ্যালয় (পূর্বতন নারীশিক্ষা মন্দির), ঢাকা
৩. ‘লীলা নাগ পরিচিতি’, লীলা নাগ শতবর্ষের শ্রদ্ধাঞ্জলি, (সম্পাদনা পরিষদ: অজয় রায় আহ্বায়ক, আনিসুজ্জামান, রঙ্গলাল সেন, মাহফুজা খানম, আবুল হাসনাত, মফিদুল হক) বিপ্লবী লীলা নাগ জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন পরিষদ, সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা, ২০০৩
৪. আগমনী লাহিড়ী ও বিজয় কুমার নাগ, শিখাময়ী লীলা রায়, জয়শ্রী প্রকাশনী, কলিকাতা-৯, ১৯৯৯, পৃ. ৭৭
৫. দীপংকর মোহান্ত, লীলা রায় ও বাংলার নারী জাগরণ, সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা, ১৯৯৯, পৃ. ১৮
৬. ড. রতন লাল চক্রবর্তী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী ১৯২১-১৯৫২, কল্যাণ প্রকাশন, ঢাকা, ২০০৬, পৃ. ১৭
উদ্ধৃতি: ‘১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার বছরেই এখানে নারীর উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সূচনা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইনে তথা Dacca University Act. ১৯২০ (Act XVII of 1920) নীতিগতভাবে সহশিক্ষার বিষয়টি স্বীকৃত ছিল। এই আইনের ৫ নং ধারায় বলা হয়েছে যে, “The University shall be open to all persons of either sex and of whatever race, creed or class...” নীতিগতভাবে নারীর উচ্চশিক্ষা গ্রহণের বিষয়টি স্বীকৃত থাকলেও, বাস্তবে কোনো ব্যবস্থা ছিল না। প্রথম হতেই সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, ঢাকা হল ও জগন্নাথ হলে ছাত্রদের আবাসিক সুযোগ থাকলেও ছাত্রীদের জন্য কোনো সুবিধা বা আবাসিক পরিকাঠামো ছিল না। এতত্সত্ত্বেও ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার আকাঙ্ক্ষা ও দাবী নিয়ে এগিয়ে আসেন দুজন নারী—লীলাবতী নাগ ও সুষমা সেনগুপ্ত। উভয় ভর্তিচ্ছু নারীর অদম্য আগ্রহ ও দৃঢ় মনোভাবের জন্য উপাচার্য পি.জে হার্টগ বাধ্য হয়েছিলেন তাঁদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ও অধ্যয়নের ব্যবস্থা করতে।’—রতনলাল চক্রবর্তী, প্রাগুক্ত।
৭. রঙ্গলাল সেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী বিপ্লবী লীলা নাগ; বিপ্লবী লীলা নাগ জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন পরিষদ সম্পাদিত, লীলা নাগ শতবর্ষের শ্রদ্ধাঞ্জলি, সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা ২০০৩, পৃ. ২৩
৮. সৈয়দ বদরুদ্দিন হোসাইন, বাংলার উজ্জ্বলতম অগ্নিকন্যা: লীলা নাগ, লীলা নাগ শতবর্ষের শ্রদ্ধাঞ্জলি, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৪১
৯. শিখাময়ী লীলা রায়, প্রাগুক্ত, পৃ. ১১ এবং Uttara Chakraborty, Gertrude Mariam Wright (1918-1928) The Turbulent Days, In the Footsteps of Chandramulche, 125 Years of Bethune College, Kolkata, 2004, P.111
১০. প্রীতি চট্টোপাধ্যায়, লীলা, জয়শ্রী সুবর্ণজয়ন্তী গ্রন্থ, জয়শ্রী সুবর্ণ জয়ন্তী উদ্যাপন কমিটি, কলিকাতা, ১৯৮৩, পৃ. ৪০৩-৪০৫
১১. শিখাময়ী লীলা রায়, প্রাগুক্ত, পৃ. ১১
১২. শিখাময়ী লীলা রায়, প্রাগুক্ত, পৃ. ১২
১৩. প্রাগুক্ত
১৪. লীলা রায়, আমাদের রবীন্দ্রতর্পণ, লীলা নাগ শতবর্ষের শ্রদ্ধাঞ্জলি, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৭৭
১৫. শিক্ষাময়ী লীলা রায়, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৭
১৬. প্রভাতচন্দ্র নাগ, দিদিকে যেমনটি দেখেছি, জয়শ্রী সুবর্ণজয়ন্তী গ্রন্থ, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৩৩
১৭. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, প্রদীপ, মশাল এবং অন্ধকার, লীলা নাগ শতবর্ষের শ্রদ্ধাঞ্জলি, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৬৮
১৮. পূর্ণেন্দু দস্তিদার, বীরকন্যা প্রীতিলতা, অনুপম প্রকাশনী, ঢাকা, ২০০৮, পৃ. ৭০-৭১
১৯. মালেকা বেগম, মুক্তিযুদ্ধে নারী, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১১ এবং Ayesha Banu, ‘Feminism in Bangladesh: 1971-2000 voices from the Women's Movement’ (অপ্রকাশিত পিএইচডি থিসিস), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ২০১৫
২০. চিন্মোহন সেহানবীশ, রবীন্দ্রনাথ ও বিপ্লবী সমাজ, বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ, কলকাতা, ১৩৯২, পৃ. ১২২, উদ্ধৃত, দীপংকর মোহান্ত, লীলা রায় ও বাংলার নারী জাগরণ, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪১
২১. লীলা রায়, আমাদের রবীন্দ্র তর্পণ, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৮০
২২. নজরুল ইসলাম ও মেহেদী হাসান খান, জনবিন্যাস: নারী ও নগর, সংকলিত: সোনিয়া নিশাত আমিন সম্পাদিত, ঢাকা নগর জীবনে নারী, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, ২০১০, পৃ. ৩৯
২৩. জয়শ্রী, সুবর্ণ জয়ন্তী সংখ্যা, প্রাগুক্ত, পৃ. ভূমিকা, ১০
২৪. সুনীল দাস, অনিল চন্দ্র ঘোষ, নিকুঞ্জ সেন, চঞ্চল শর্মা, বঙ্গেশ্বর রায় প্রমুখ। জয়শ্রী সুবর্ণজয়ন্তী গ্রন্থ, প্রাগুক্ত।
২৫. মুনতাসীর মামুন, ঢাকা স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী, অখণ্ড, অনন্যা, ঢাকা, ২০১৫, পৃ. ৪৮০-৪৮৪
২৬. শিখাময়ী লীলা নাগ, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৯
২৭. আশালতা সেন, সেকালের কথা, সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি, ২০০৫, পৃ. ১৯
২৮. সুহাসিনী দাস, লীলা নাগকে যেমন দেখেছি, লীলা নাগ শতবর্ষের শ্রদ্ধাঞ্জলি, প্রাগুক্ত, পৃ. ১০৮-১১১
২৯. শামিমা ইসলাম, অনন্যা, ঢাকা, ১৯৮৮, পৃ. ৭২
৩০. সুহাসিনী দাস, প্রাগুক্ত।
৩১. সুফিয়া কামাল, একালে আমাদের কাল, সাজেদ কামাল সম্পাদিত, সুফিয়া কামাল রচনা সংগ্রহ, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ২০০২, পৃ. ৫৯২
পরিশিষ্ট ১
লীলা নাগ পরিচিতি
নাম : লীলাবতী নাগ/পরবর্তীকালে: লীলা নাগ বিবাহোত্তর কালে—লীলা রায়
জন্মতারিখ : ২ অক্টোবর ১৯০০
জন্মস্থান : গোয়ালপাড়া শহর, আসাম (তখন পিতা গোয়ালপাড়া মহকুমার এস.ডি.ও)
মাতা : কুঞ্জলতা দেবী চৌধুরী
পিতা : গিরিশচন্দ্র নাগ; নিবাস: গ্রাম-পাঁচগাঁও, থানা: রাজনগর, জেলা: মৌলভীবাজার
আদি নিবাস : ঢাকার ‘বারদি’ গ্রাম
পিতৃপরিচয় : প্রথমে কটক র্যাভেনশ কলেজে দর্শনের অধ্যাপক; আইন ব্যবসা; আসাম সিভিল সার্ভিসে যোগদান। ১৯১৬ সালে অবসর গ্রহণের পর ঢাকায় বকশীবাজারে স্থায়ীভাবে বসবাস।
শিক্ষাজীবন
শৈশব : গোয়ালপাড়া শহর
প্রাথমিক : ১৯০৭-১৯১১ ব্রাহ্ম স্কুল (কলিকাতা)
স্কুল শিক্ষা : ১৯১১-১৯১৭ ইডেন গার্লস স্কুল, ঢাকা
১৯১৭ : প্রবেশিকা: ১ম বিভাগ (বৃত্তিসহ)
কলেজ শিক্ষা
১৯১৯ : মাধ্যমিক আর্টস, কলকাতা বেথুন কলেজ, ১ম বিভাগ (বৃত্তিসহ)
১৯২১ : বিএ (ইংরেজিতে সম্মানসহ), কলকাতা বেথুন কলেজ (মেয়েদের মধ্যে ১ম, বৃত্তিসহ পদ্মাবতী স্বর্ণপদক লাভ)
১৯২১ : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ইংরেজি বিভাগে ১ম পর্বে ভর্তি
১৯২৩ : এম.এ (ইংরেজি), ২য় শ্রেণি
১৯৩৯ : সহপাঠী ও সহযোদ্ধা দার্শনিক-বিপ্লবী অনিল রায়ের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ।
কর্মজীবন
১৯২১-২২ : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী অবস্থাতেই নারী শিক্ষা, নারী অধিকার আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। নারীদের ভোটাধিকার আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন, নিখিল বঙ্গীয় ভোটাধিকার কমিটির সহ-সম্পাদিকা নির্বাচিত হন। উত্তরবঙ্গে ভয়াবহ বন্যায় (১৯২২) দুস্থ মানবতার সেবায় আত্মনিয়োগ— এ উদ্দেশ্যে ‘ঢাকা মহিলা কমিটি’ গঠন। বিপ্লবী অনিল রায়ের উদ্যোগে গোপন বিপ্লবী সংস্থা ‘শ্রীসংঘ’ গঠিত হলে ১ম নারী সদস্য হিসেবে যোগদান।
১৯২৩ : ঢাকায় ‘দীপালী সংঘ’ নামে নারী সংগঠন প্রতিষ্ঠা। লক্ষ্য—‘ঘুমন্ত অর্ধচেতন নারী সমাজের রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি ও নারীদের অধিকার সচেতন করে তোলা’। দীপালী সংঘের উদ্যোগে ‘দীপালী হাই স্কুল’ প্রতিষ্ঠা; বর্তমানে এটি ‘কামরুন্নেসা হাই স্কুল’ নামে পরিচিত (অভয় দাস লেন), ঢাকা।
১৯২৪ : দীপালী সংঘের উদ্যোগে আরও একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন। এ প্রসঙ্গে তাঁর উক্তি, ‘... বর্তমান যুগে নারী শিক্ষার প্রয়োজন রহিয়াছে; কিন্তু সুযোগ ও ব্যবস্থার অভাব যথেষ্ট রহিয়াছে। বিদ্যালয়ে স্থানাভাবহেতু বহু বালিকার শিক্ষা লাভে বঞ্চিত থাকিতে হইতেছে। এই অভাব দূর করার আকাঙ্ক্ষায় ১৯২৪ সালে আর একটি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়। এই কার্যে বহু অর্থ ও অবৈতনিক সাহায্য দানে দীপালী সংঘ বিশেষ সহায়তা দান করিয়াছে।’
১৯২৬ : ‘দীপালী ছাত্রী সংঘ’ প্রতিষ্ঠা ও কলকাতায় এর কর্মকাণ্ডের সম্প্রসারণ। রবীন্দ্রনাথের ঢাকা আগমন (৭ ফেব্রুয়ারি ১৯২৬) ও দীপালী সংঘ পরিদর্শন।
১৯২৮ (২ ফেব্রুয়ারি) : লীলা নাগের অনন্য কীর্তি ভিন্নধর্মী বিদ্যানিকেতন ‘নারী শিক্ষা মন্দির’ প্রতিষ্ঠা। এখানে তিনি মহিলাদের ‘বয়স্ক শিক্ষা’ ব্যবস্থা গড়ে তোলেন। বয়স্ক মহিলাদের শিক্ষা সহায়তা দানের জন্য এখানে ছিল বেশ কয়েকটি বিশেষ বিভাগ: সংস্কৃতি বিভাগ, কোচিং বিভাগ, শিল্প বিভাগ, আশ্রয় বিভাগ...। বর্তমানে এটি শের-এ-বাংলা মহিলা মহাবিদ্যালয় নামে পরিচিত।
১৯৩০ : কলকাতায় দীপালী সংঘের কর্মকাণ্ডের সম্প্রসারণ এবং এর উদ্যোগে সেখানে ‘দীপালী শিক্ষা মন্দির’ স্থাপন।
রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড
১৯২৪ : অনিল রায় প্রতিষ্ঠিত বিপ্লবী ও সমাজসেবী সংগঠন ‘শ্রীসংঘের’ কার্যক্রমে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক ও বিপ্লবী জীবনের শুরু।
১৯২৮ : সাইমন কমিশন-বিরোধী হরতাল কর্মসূচিতে ঢাকার মহিলা মিছিলে নেতৃত্ব দান। কলকাতায় জাতীয় কংগ্রেস অধিবেশনে যোগদান; ‘মহিলা কংগ্রেস’ গঠনে নেতৃত্ব দান—সুভাষ বসুর সান্নিধ্য লাভ ও তাঁর আদর্শে উদ্বুদ্ধ হওয়া।
১৯২৯ : অনিল রায় আত্মগোপনে যেতে বাধ্য হলে ‘শ্রীসংঘে’র নেতৃত্ব গ্রহণ; সংঘের বিপ্লবী ও রাজনৈতিক কর্মতত্পরতা বৃদ্ধি, অস্ত্র সংগ্রহ ইত্যাদি কাজে আত্মনিয়োগ।
১৯৩০ : মহাত্মা গান্ধীর ডাকে সত্যাগ্রহ আন্দোলনে যোগদান; ঢাকায় আশালতা সেনের সঙ্গে ‘মহিলা সত্যাগ্রহ কমিটি’ গঠন।
১৯৩১ : লীলা নাগের উদ্যোগে ও সম্পাদনায় জয়শ্রী মাসিক পত্রিকা প্রকাশ (১ম সংখ্যা বৈশাখ ১৩৩৮): এতে লেখা হয়—‘নববর্ষে এই নূতন প্রচেষ্টা আরম্ভ করিলাম। বাংলায় মহিলাদের মুখপত্র স্বরূপ কোনো পত্রিকা এ পর্যন্ত ছিল না; এই অভাব দূর করিবার প্রয়াসে জয়শ্রী প্রকাশিত হইল।’
১৯৩১ (২৮ অক্টোবর) : জয়শ্রী পত্রিকা অফিসে পুলিশি আক্রমণ; সম্পাদককে সতর্কীকরণ।
১৯৩১ (২০ ডিসেম্বর) : বিপ্লবী কাজের জন্য গ্রেপ্তার। কারাবাস (ঢাকা, রাজশাহী, সিউড়ি,
থেকে ১৯৩৮ মেদিনীপুর, হিজলি জেলে); কারা কর্তৃপক্ষের অন্যায়ের বিরুদ্ধে সব সময় ছিলেন প্রতিবাদমুখর; হিজলি জেলে কয়েক দিন অনশনও করেছিলেন।
১৯৩৫-১৯৩৮ : জয়শ্রী পত্রিকা প্রকাশ নিষিদ্ধ
১৯৩৮ (৮ আগস্ট) : মুক্তি লাভ
১৯৩৮ : জয়শ্রী পত্রিকার পুনঃপ্রকাশ কংগ্রেস সভাপতি সুভাষচন্দ্র বসু কর্তৃক গঠিত ‘ন্যাশনাল প্ল্যানিং কমিটি’তে মহিলা উপসমিতিতে সদস্য নির্বাচিত।
১৯৩৯ : কংগ্রেসের অভ্যন্তরে সুভাষ বসু কর্তৃক বামপন্থীদের নিয়ে ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’ গঠনে অংশগ্রহণ ও যোগদান। ফরওয়ার্ড ব্লক পত্রিকা সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ।
১৯৪০ (জুলাই) : অনিল রায় ও লীলা নাগ কলকাতায় গ্রেপ্তার ও আগস্ট মাসে মুক্তি।
১৯৪১ (২৬ জুন) : সুভাষ বসুর দেশত্যাগ ও ফরওয়ার্ড ব্লক পরিচালনায় লীলা নাগকে যথাযথ নির্দেশ দান।
১৯৪২ : জয়শ্রী পত্রিকার প্রকাশ পুনরায় নিষিদ্ধ। দিনাজপুর জেলে পুনরায় কারারুদ্ধ। আজাদ হিন্দ ফৌজের সঙ্গে গোপন সংযোগ স্থাপন।
১৯৪৬ : যুদ্ধ শেষে কারাগার থেকে মুক্তি লাভ। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা রোধে কলকাতা, ঢাকা ও নোয়াখালীতে ব্যাপক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ; দাঙ্গা রোধে ‘ন্যাশনাল সার্ভিস ইনস্টিটিউট’ নামে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন গড়ে তোলা।
১৯৪৭ : দেশ বিভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত; নতুন পরিস্থিতিতে নয়া কর্মসূচি প্রণয়ন। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে দেশত্যাগ না করায় উদ্বুদ্ধকরণ। মহিলাদের উন্নয়নের লক্ষ্যে তাদের সংগঠিত করার চেষ্টায় আত্মনিয়োগ—এ উদ্দেশ্যে বেগম সুফিয়া কামালের সাথে ‘পূর্ব পাকিস্তান মহিলা সমিতি’ গঠন।
১৯৪৯ : তত্কালীন পাকিস্তান সরকার কর্তৃক সৃষ্ট পরিস্থিতিতে বাধ্য হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান’ ত্যাগ।
১৯৫০-আমৃত্যু : পশ্চিমবঙ্গের জনগণ, বিশেষ করে পূর্ববঙ্গ থেকে আগত উদ্বাস্তুদের সমস্যা সমাধানে, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে এবং ভারতীয় রাজনীতিতে অব্যাহত অংশগ্রহণ। জয়শ্রী পত্রিকার অব্যাহত প্রকাশ ও সম্পাদনা।
১৯৫২ : স্বামী অনিল রায়ের মৃত্যুবরণ।
১৯৫৩ : জয়প্রকাশ নারায়ণ প্রতিষ্ঠিত ‘প্রজা সোসালিস্ট পার্টি’তে যোগদান।
১৯৭০, ১১ জুন : মৃত্যুবরণ।
সংকলিত : বিপ্লবী লীলা নাগ জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন পরিষদ সম্পাদিত, লীলা শতবর্ষের শ্রদ্ধাঞ্জলি, সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা, ২০০৩, পৃ. ১৭-১৯