আমার স্মৃতিতে সারওয়ার মুরশিদ সবচেয়ে ভদ্রলোকদের একজন, যিনি ছিলেন অসহিষ্ণু ও বিভাজিত সমাজে আটকা পড়া এক মানুষের মতো। তাঁর মৃদুভাষণ, সংস্কৃতি, শব্দ ব্যবহার, পরিহাসবোধ, পোশাক-পরিচ্ছদের অপরিবর্তনীয় মার্জিতভাব—এসব দেখে মনে হতো, তিনি যেন অন্য যুগের বা ভিনগ্রহের মানুষ। কেউ যদি এর উত্স খুঁজতে যান, সেই অনুসন্ধান সম্ভবত তাঁকে আলোকায়নের যুগে নিয়ে যাবে। মনে হয়, আলোকায়নের দর্শন তাঁর মূল্যবোধকে উজ্জীবিত করেছে।
মুরশিদ প্রকাশিত নিউ ভ্যালুস (নতুন মূল্যবোধ) শীর্ষক সাময়িকীটি শুধু তাঁর বিশ্বাসের প্রতিফলন নয়, এটি তাঁর ব্যক্তিত্বেরও প্রতিফলন। এটি ১৯৪৭-পরবর্তী পাকিস্তানে নির্বোধ গোঁড়ামির বিরুদ্ধে বুদ্ধিবৃত্তিক চ্যালেঞ্জ ছিল। যেটাকে বিশ্বাসভিত্তিক সমাজ হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছিল, সেই সমাজভিত্তিক রাষ্ট্রের জন্মের এক বছর পর উদীয়মান শাসক শ্রেণির মাত্রাছাড়া লোভ আড়াল করতে বেখাপ্পাভাবে ধর্মের ব্যবহার, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নিয়ে হতাশা, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মের সাংস্কৃতিক পরিচয়—এ সবকিছু পুরো জাতির সংবেদনশীলতাকে আঘাত করেছিল। ফলে ভণ্ডামি যে মানুষের মূল বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছিল, তাতে বিস্ময়ের কিছু ছিল না।
মুরশিদ যে শোভন সমাজের প্রতি এরূপ মারাত্মক আঘাতের জবাবে এভাবে রুখে দাঁড়াবেন সেটার কারণ হচ্ছে, তাঁর সেই আলোকায়ন প্রভাবিত ব্যক্তিত্ব। প্রতিবাদ করতে তিনি মুষ্টি পাকাতেন না বা গলা চড়াতেন না। তিনি নতুন মূল্যবোধকে উদার রাজনীতির কণ্ঠস্বর হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন। শুধু তা-ই নয়, উদার মূল্যবোধ তাঁর কাছে ছিল মানবিক অর্থনীতি ও মানবিক আইনের ন্যায্য দর্শন এবং সর্বোপরি জনযুক্তিচর্চার (পাবলিক রিজনিং) এক রূপ। বিষয়বস্তুর দিক থেকে যা ছিল সভ্য, প্রকাশভঙ্গির দিক থেকে শোভন। এর লক্ষ্য ছিল ভিন্নমতাবলম্বীদের বুঝিয়ে নিজের পথে নিয়ে আসা, তাঁদের মুগুরপেটা করে স্তব্ধ করে দেওয়া নয়। মুরশিদের কাছে ইংরেজি লিবারেলিজম (উদারতা) শব্দের ছোট হাতের এল অক্ষরটির মূল্যবোধ ছিল খুবই তীব্র। পাকিস্তান রাষ্ট্রে এই উদারতার একান্ত অভাবের কারণে তিনি মৃদু চ্যালেঞ্জের পথ বেছে নেন। নিউ ভ্যালুস-এর প্রতিটি ছত্রে যুক্তি শাণিত করে তিনি পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতি চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন কাঠামো যুক্তির ভাষায় কর্ণপাত করেনি। ফলে মুরশিদের মতো ভদ্র, সভ্য ও যুক্তিশীল বিদ্যায়তনিক মানুষও ক্রমে রাজনৈতিক কর্মীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। কালক্রমে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উপদেষ্টা হন। বঙ্গবন্ধু তখন পাকিস্তান রাষ্ট্রের অস্তিত্বের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন। যে সংগ্রাম একসময় জাতীয় মুক্তির যুদ্ধে রূপ নেয়।
আজ আমার এই বক্তৃতার লক্ষ্য হচ্ছে, দুজন গণব্যক্তিত্বের বীরোচিত জীবনের স্মৃতিচারণা করা। তাঁরা হলেন নূর জাহান ও সারওয়ার মুরশিদ, যাঁরা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের সংগ্রামে যুক্ত ছিলেন। আর অঙ্গীকার ছিল, এই রাষ্ট্র হবে গণতান্ত্রিক, ন্যায্য, ধর্মনিরপেক্ষ ও আত্মনির্ভরশীল। নূর জাহান রাজনৈতিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এতে যুক্ত ছিলেন। তিনি ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের এবং ১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হন। অথচ ওই যুগে খুব কম নারীই রাজনীতি করতেন। নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় তিনি ছিলেন একজন অগ্রপথিক।
অন্যদিকে সারওয়ার মৃদুকণ্ঠ ও ঝরনার মতো সাবলীল লেখনী দিয়েই তাঁর আকাঙ্ক্ষিত শোভন, সহিষ্ণু, অহিংস সমাজ নির্মাণের সংগ্রামে যুক্ত ছিলেন; যে সমাজে ক্ষমতার হাতবদল হবে শান্তিপূর্ণ, সভ্য ও রাজনৈতিক আলোচনার মধ্য দিয়ে। সারওয়ার মনে করতেন, পরিবর্তনের সংগ্রামের পথ লক্ষ্যের চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। অমর্ত্য সেনের আইডিয়া অব জাস্টিস গ্রন্থে তাঁর মূল্যবোধ প্রতিফলিত হয়েছে। সেন বলেছেন, শোভন সমাজ নির্মাণ করতে হবে জনযুক্তিচর্চার মধ্য দিয়ে। তাঁর মত হলো, জনযুক্তিচর্চার মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রের প্রথাগত ধারণার সম্প্রসারণ ঘটে; এতে গণতন্ত্র ব্যালট বাক্সের মধ্য দিয়ে মুক্তবাক্, তথ্যপ্রাপ্তির পূর্ণ অধিকার ও ভিন্নমত প্রকাশের ধারণায় ব্যাপ্ত হয়।
তবে আমার মনে হয়, মুরশিদ সরল বিশ্বাসী মানুষ ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, তাঁর একসময়ের নতুন মূল্যবোধ অনায়াসে উদীয়মান সমাজের বুদ্ধিবৃত্তিক অনুপ্রেরণা দেবে। কিন্তু যে সমাজ সহিংসতার মধ্যে জন্ম নিয়েছে, প্রতিষ্ঠাতা পিতাদের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে, দীর্ঘকাল সেনাশাসনে থেকেছে এবং যে সেনাশাসকেরা পাকিস্তানের মূল্যবোধ ফিরিয়ে আনতে চেয়েছে, সেই সমাজে এই চিন্তা করা সরলতাই বটে। কিন্তু মুরশিদ দম্পতি সারা জীবন এই মূল্যবোধ ধারণ করেছেন। যে মূল্যবোধের আলো এই সমাজকে মুরশিদের আলোকায়নের মূল্যবোধের কাছাকাছি নিয়ে যাবে বলে তাঁরা ভেবেছিলেন, সেই আলো নিভে যেতে দেখে তাঁরা সব সময় নীরবে চোখের জল ফেলেছেন।
এই বক্তৃতায় আমি মুরশিদ কথিত নতুন মূল্যবোধ থেকে সরে আসা এবং জনযুক্তিচর্চার পরিসর ধীরে ধীরে বদ্ধ হয়ে যাওয়ার বিষয়টি অনুসন্ধান করেছি। এই অনুসন্ধানের জন্য আমাকে এই রাষ্ট্রের মৌলভিত্তিগুলো আবার ঝালিয়ে নিতে হয়েছে। যে সমাজ সব সময় অস্থির, সেই সমাজে এই ভিত্তিগুলো কতটা টেকসই, তা বোঝার জন্য এটি জরুরি। এই প্রক্রিয়ায় জনযুক্তিচর্চা হারিয়ে যাওয়ার কারণটি উদ্ঘাটন করার আশা করি। আমরা যে রাষ্ট্রের মৌলভিত্তি থেকে সরে গেছি, তার পরিণতি হিসেবেই এটা ঘটেছে। যে সমাজে অনেকেই মনে করেন, উন্নয়ন ও পরিবর্তন সমাজের চালিকাশক্তি, সেই সমাজে ‘নতুন মূল্যবোধ’ পুরোনো হয়ে যায়—এ নিয়ে তর্ক করা যায়। বক্তৃতার শেষাংশে আমি পুরোনো কিন্তু মুরশিদের নতুন মূল্যবোধে নতুন করে আস্থা স্থাপনের চেষ্টা করব। আমার যুক্তি হচ্ছে, এককালের এই মহত্ চিন্তা আমাদের গণতান্ত্রিক, ন্যায্য ও অধিকতর সহিষ্ণু সমাজ নির্মাণের আকাঙ্ক্ষার জন্য এখনো প্রাসঙ্গিক। অর্থনৈতিকভাব পরিবর্তনশীল সমাজের জন্যও তা প্রযোজ্য। আর সেই সমাজ নির্মিত হবে জনযুক্তিচর্চার মধ্য দিয়ে।
[বিস্তারিত দেখুন জানুয়ারি–মার্চ ২০১৮ সংখ্যা (২২তম সংখ্যা)৷