মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর কথোপকথন*, এ কে খন্দকার, মঈদুল হাসান ও এস আর মির্জা, প্রথমা, ঢাকা ২০১১।
* ইতিহাসের একটি ঘটনারই নানা রকম ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ হয়ে থাকে। এই বইতে মূলত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণকারী সংগঠকদের তিনজন মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের নিজস্ব একটি ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। এই বইয়ের তথ্য নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে। এই মতবিরোধ বিবেচনায় রেখেই গ্রন্থটি বৃহত্তর পাঠকদের সামনে তুলে ধরতে উত্সাহিত হয়েছি। গ্রন্থটিতে বেশ কয়েকটি জায়গায় মতপার্থক্যের সুযোগ আছে। প্রথমত, ২৫ মার্চের ঘটনার আগে প্রতিরোধমূলক যুদ্ধের প্রয়োজন ছিল, যা রাজনৈতিক নেতৃত্ব করতে পারেনি। কিন্তু এই প্রস্তুতির ধরন কী হবে, সেটিই হলো মূল রাজনৈতিক প্রশ্ন। এই রাজনৈতিক প্রশ্নের মীমাংসার পরিণতিতে আমরা দেখি, আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব জনসম্পৃক্ততার পথ ধরেই বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম পরিচালনা করেছিলেন। দ্বিতীয়ত, ২৫ মার্চের ঘটনাকে এই গ্রন্থের লেখকেরা একটি ‘রাজনৈতিক ব্যর্থতা’ বলে মনে করেছেন। এ ক্ষেত্রে নানা মত ও ব্যাখ্যার সুযোগ রয়েছে। একটি মত হচ্ছে—মুজিব যদি গ্রেপ্তার না হতেন, তাহলে বাংলাদেশ ইস্যুটি এত দ্রুত বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ পেত না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা, মুজিবের মুক্তি, দেশে প্রত্যাবর্তনের পরপরই ভারতীয় সৈন্যদের ফিরিয়ে নেওয়া ইত্যাদি ঘটনার মধ্য দিয়ে মুজিবের গ্রেপ্তার যে কৌশলগতভাবে ঠিক ছিল, তা ইতিমধ্যে ইতিহাস-স্বীকৃত। তৃতীয়ত, বইটিতে বলা হয়েছে, মুজিব বাহিনী কেবল বামপন্থীদের ঠেকানোর জন্যই গঠন করা হয়েছিল। বাস্তবতাসহ এই দৃষ্টিভঙ্গি একপেশে। কারণ, মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে ভারত-সোভিয়েত চুক্তি এই দৃষ্টিভঙ্গিকে সমর্থন করে না। এমন সব বিষয়ে দ্বিমত থাকা সত্ত্বেও আমরা এ ধরনের লেখা ছাপালাম। এর মূল কারণ, প্রতিচিন্তা একটি বহুত্ববাদী চিন্তার পাটাতন হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আশা করি, পাঠকেরা আমাদের এই দৃষ্টিভঙ্গিকে সমর্থন ও উত্সাহিত করবেন। — সম্পাদক।
ব্রিটিশ ও মার্ক্সবাদী ইতিহাসবিদ এরিক হবস্বম বর্তমান অথবা সাম্প্রতিক কালের ইতিহাস রচনায় বিড়ম্বনার ওপর তাঁর রচিত অন হিস্ট্রি গ্রন্থের একাংশে (পরিচ্ছেদ ১৮, ২১) আলোকপাত করেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি একটি ঘটনা উল্লেখ করেন। ১৯৪৪ সালে নািস বাহিনী ইতালি থেকে পশ্চাদপসরণের সময় আরেজ্জো প্রদেশের সিভিটেলা গ্রামের ১৭৫ জন যুবাপুরুষকে হত্যা করে এবং তাদের মৃতদেহগুলো পুড়িয়ে ফেলে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ৫০ বছর পর ১৯৯৪ সালে নািস হিংস্রতার স্মরণে ইউরোপীয় ইতিহাসবিদ ও সমাজবিজ্ঞানীদের যে অধিবেশন হয়, সেখানে একটি অদ্ভুত ঘটনা ঘটে।
জার্মান ইতিহাসবিদেরা বিব্রত বোধ করলেন। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীও ওই অঞ্চলে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে বলে একজন ইতিহাসবিদ দাবি করলেন। রুশ প্রতিনিধিরা মনে করলেন যে সম্পূর্ণ অধিবেশনের মূল উদ্দেশ্য হলো, স্টালিন আমলের ভীতিকর ব্যবস্থা থেকে জনগণের দৃষ্টি অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া। স্থানীয় জনসাধারণ, যাদের অনেকেই নািস হত্যাকাণ্ডের চাক্ষুষ দর্শক এবং জীবিত, তাদের মধ্যেও ঘটনার মৌখিক বর্ণনায় পার্থক্য দেখা দিল। দক্ষিণপন্থী ক্যাথলিক অধিবাসীদের বর্ণনা নািস প্রতিরোধকারী বামপন্থীদের বর্ণনা থেকে বেশ ভিন্ন। একই ঘটনা, কিন্তু তার বর্ণনা ও মূল্যায়ন ভিন্ন। যাঁরা গ্রামবাসীর সঙ্গে সাক্ষাত্কার ও আলোচনার মাধ্যমে ঘটনা সম্পর্কে অধিবেশনে উপস্থিতির জন্য তথ্য সংগ্রহ করছিলেন, তাঁদের জন্য একটি বড় ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হলো।
বর্তমান কালের ইতিহাস রচনায় এরূপ বিভ্রাট সম্পূর্ণ নতুন নয়। একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে সম্রাট আকবরের রাজনীতি ও প্রশাসনব্যবস্থা নিয়ে ইতিহাস-রচয়িতা বদাউনি ও সুপণ্ডিত আবুল ফজলের পরস্পরবিরোধী মতামত। ইতিহাস রচনায় সমস্যার সৃষ্টি হয় তখনই, যখন সাম্প্রতিক ঘটনার মূল্যায়নে ইতিহাস-রচয়িতা অথবা বর্ণনাকারী তাঁর নিজস্ব সংস্কারে আবদ্ধ হয়ে পক্ষপাতহীন হতে পারেন না। তাঁরা ইতিহাস রচনায় আংশিক অথবা অসম্পূর্ণ তথ্যের ওপর কিছু কল্পনা এবং নিজস্ব মতের সংযোগ করেন। তাঁদের রচনাকে ‘সংযোজক ইতিহাস’ বলা যেতে পারে। অন্য পক্ষে যাঁরা প্রামাণ্য তথ্যের ভিত্তিতে রচনা করেন, তাঁদের রচনাকে বস্তুনিষ্ঠ ‘প্রামাণ্য ইতিহাস’ বলাই সংগত হবে। শেষ পর্যন্ত সিভিটেলার হত্যাকাণ্ডের ওপর অধিবেশন সফলভাবে সমাপ্ত হলো, কেননা ইতিহাসবিদেরা তথ্যের প্রমাণযোগ্যতা ও বস্তুনিষ্ঠতার ওপর তাঁদের অঙ্গীকার দৃঢ়ভাবে প্রয়োগ করেছিলেন।
বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর সমাজ ও রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটনাবহুল হলেও তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ ও গবেষণামূলক ইতিহাস রচনার কাজ খুব বেশি অগ্রসর হয়নি। এর শুধু একটি ব্যতিক্রম এবং তা হলো, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, বিশেষ করে সামরিক বাহিনীর সদস্যরা, তাঁদের কেউ কেউ আংশিক ও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা সম্বল করে কিছু কিছু বই লিখেছেন। মরহুম হাসান হাফিজুর রহমান গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও দলিল সংগ্রহ করে সরকারি সাহায্যে পুস্তক আকারে প্রকাশ করেছেন। সাম্প্রতিক কালে মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্রের একটি মূল্যবান কাজ হলো, যুদ্ধ সম্পর্কে যাঁদের ব্যক্তিগত ও চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা আছে, তাঁদের ‘মৌখিক বর্ণনা’ মোট ২২ খণ্ডে প্রকাশ করা। ভবিষ্যতে ইতিহাসবেত্তাদের জন্য এসব বর্ণনা মৌলিক তথ্য হিসেবে গৃহীত হবে, কিন্তু যতক্ষণ প্রমাণের কষ্টিপাথরে তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা নির্ণয় না করা হচ্ছে, ততক্ষণ বর্ণনা শুধু বর্ণনাই, ইতিহাস নয়।
সত্যতা যাচাই না করে অথবা দুর্বল বর্ণনার ভিত্তিতে বক্তব্য রাখার প্রবণতা কিছুটা উত্কৃষ্টতর গ্রন্থেও দেখা যায়। যেমন বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত হিস্ট্রি অব বাংলাদেশ-এর প্রথম খণ্ডের ২০ নম্বর পরিচ্ছেদে (৬২২ নম্বর পৃষ্ঠা) বলা হচ্ছে, ‘Moment before he was incarcerated, Mujib, the Bangabandhu, proclaimed Bangladesh as a sovereign, independent nation...’ কিন্তু ২১ নম্বর অধ্যায়ে (৬৩৪ পৃ.) বলা হয়েছে:
‘I major Zia provisional commander-in-chief of the Bangladesh Liberation Army hereby proclaim on behalf of our great national leader Sheikh Mujbur Rahman, the independence of Bangladesh.’ সম্পূর্ণ অনুচ্ছেদ উদ্ধৃত করা হয়েছে এবং দেখা যায় যে আইনসমর্থিত ও গঠিত বাংলাদেশ সরকারের প্রতি ও গণহত্যার বিরুদ্ধে বিশ্ববাসীর সমর্থনের দিকে লক্ষ রাখা হয়েছে। মেজর জিয়ার ঘোষণার আগের দিনে একই বেতার কেন্দ্র থেকে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের নেতা আবদুল হান্নানের দেওয়া একটি ভাষণ উল্লেখ করে পাদটীকায় বলা হয়েছে, বেতার কেন্দ্রের ট্রান্সমিটারের সীমিত ক্ষমতার কারণে অনেকেই হান্নান সাহেবের ভাষণ শুনতে পারেননি। অবশ্য পরের দিন জিয়ার ভাষণ অনেকেই শুনেছেন।
একই গ্রন্থের দুই ভিন্ন অধ্যায়ে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য রচনার মানকে নিষ্প্রভ করে। দুই অধ্যায়ের রচনাকার ভিন্ন। গ্রন্থের সম্পাদক ইতিহাসবিদ সিরাজুল ইসলামের পাণ্ডিত্যের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখে বলব যে তিনি তাঁর পূর্বসূরি হিস্ট্রি অব বেঙ্গল-এর সম্পাদক ড. আর সি মজুমদার এবং দ্বিতীয় খণ্ডের সম্পাদক স্যার যদুনাথ সরকারের পথ অবলম্বন করে কিঞ্চিত্ শক্ত হাতে ইতিহাস রচনার মূল শৃঙ্খলা, অর্থাত্ প্রমাণযোগ্য বস্তুনিষ্ঠতা প্রয়োগ করতেন, তাহলে এই ইতিহাসবিভ্রাট ঘটত না।
মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের সাম্প্রতিক কালের রচনায় সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে এই শাস্ত্রচর্চার বিকৃত রাজনৈতিকীকরণ। আমার নেতার শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখতে হলে ওদের নেতাকে খাটো করতে হবে, তাঁর কর্মকাণ্ডকে মসীলিপ্ত করতে হবে—এই হলো ইতিহাসের অতি রাজনৈতিকীকরণের আশ্রয়বাক্য। ‘ওই কবরে অমুক নেতার লাশ নেই’, ‘উনি আবার কবে মুক্তিযুদ্ধ করলেন?’ এই ধরনের উদ্ভট উক্তি উচ্চপর্যায়ে অহরহ ব্যক্ত হচ্ছে। মিথ্যাচারের আশ্রয় নিয়ে কোনো রাজনৈতিক পয়েন্ট অর্জন করা যায় না, কোনো নেতাকে শ্রেষ্ঠতর করা যায় না, কোনো জাতির উজ্জ্বল ভবিষ্যত্ সৃষ্টি করা যায় না, প্রামাণ্য ইতিহাস তো একেবারেই না।
এই লালিত্যহীন ধূম্রজালে আবদ্ধ বোধশক্তির দশকে সেদিন একটি বই পড়লাম ও চমত্কৃত হলাম। বইয়ের নাম মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর কথোপকথন, লেখক ও কথক তিনজন—এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকার (মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর উপপ্রধান, বর্তমানে সরকারের মন্ত্রী), মঈদুল হাসান (প্রবাসী বাংলাদেশ প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী, প্রাক্তন সাংবাদিক ও মূল ধারা ’৭১-এর লেখক) এবং পাকিস্তান বিমানবাহিনীর সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য গঠিত যুবশিবিরের মহাপরিচালক এস আর মির্জা। তাঁদের প্রত্যেকেই প্রবাসী সরকারের নীতিনির্ধারণসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন।
এই তিন প্রত্যক্ষদর্শকের যৌথ আলোচনার ভিত্তিতে লিখিত বইটির রচনাশৈলী কিছুটা প্লেটোর ডায়লগ স্মরণ করিয়ে দেয়। তফাত প্রধানত দুটি: আলোচনার বস্তু কোনো তাত্ত্বিক বিষয় নয়, যেমন নৈতিক বিশুদ্ধতা অথবা আদর্শ রাষ্ট্র। কথোপকথনের বিষয়বস্তু হলো, মুক্তিযুদ্ধের সময় কোনো ঘটনা, ব্যক্তিগত অবস্থান বা সমষ্টিগত কর্মকাণ্ড এবং তার অন্তর্নিহিত কারণগুলো অভিজ্ঞতা ও যুক্তির মাধ্যমে অনুসন্ধান করা। দুই নম্বর পার্থক্য হলো, কথোপকথনে কোনো প্রশ্ন ও উত্তরের মাধ্যমে সত্য নিরূপণের প্রচেষ্টা নেই। যা আছে তা হলো, ১০টি অধ্যায়ে বিভিন্ন বিষয়ের অবতারণা করা হয়েছে এবং বেশির ভাগ বিষয়ই তিন কথকের জ্ঞান বা অভিজ্ঞতার সম্পূর্ণ বাইরে নয়। তাঁরা একেকটি বিষয়ের ওপর আলোচনা করেছেন, ক্ষেত্রবিশেষে নতুন তথ্য ও ব্যাখ্যা উপস্থিত করেছেন এবং এভাবে পরস্পরের মতামতকে কিছুটা সংশোধিত অথবা পরিবর্ধন করেছেন। যার ফলে বেশ কিছু বিষয়ের অন্তর্নিহিত কারণ আগে অজ্ঞাত থাকলেও পরে দৃশ্যমান হয়েছে। তথ্য ও যুক্তিনির্ভর এই পন্থা অনুসরণের ফলে প্রতিটি আলোচিত বিষয়ে একটি গ্রহণযোগ্য উপসংহারে আসা সম্ভবপর হয়েছে।
কথোপকথনে ১০টি অধ্যায়ে সংশ্লিষ্ট বিষয়সমূহ আলোচিত হয়েছে। বেশ কয়েকটি অধ্যায়ের তথ্যপ্রমাণ ও বক্তব্য যেকোনো পর্যালোচনায় অগ্রাধিকারের দাবি রাখে। বিষয়গুলো নিম্নরূপে শ্রেণীবদ্ধ করা যায়।
১. দিকনির্দেশনায় রাজনৈতিক দোলাচল
২. প্রতিরোধ ও মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন পর্যায়ের অগ্রগতি
৩. তাজউদ্দীনের আংশিক মূল্যায়ন
৪. মুজিব বাহিনী
দিকনির্দেশনায় রাজনৈতিক দোলাচল
১৯৭১ সালের ১ মার্চ পাকিস্তানের সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খানের এক ঘোষণায় পূর্বনির্ধারিত জাতীয় সংসদের অধিবেশন স্থগিত করা হয় এবং সঙ্গে সঙ্গেই পূর্ব পাকিস্তানে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। সম্ভবত ১৮ ফেব্রুয়ারি রাওয়ালপিন্ডিতে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিপরিষদের এক বৈঠকে ইয়াহিয়া খান ১৯৭০ সালের গণভোটে নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে তাঁর অনিচ্ছা উল্লেখ করেন। এর পরপরই পূর্ব পাকিস্তানে পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর শক্তি বৃদ্ধির প্রক্রিয়া শুরু হয়। এই প্রক্রিয়া উদ্বেগের সঙ্গে সশস্ত্র বাহিনীর বাঙালি সদস্য এবং অন্যরা লক্ষ করেন।১ এই প্রক্রিয়া সেনাবাহিনীর বাঙালি কর্মকর্তা ও অন্যরা আওয়ামী লীগ নেতাদের কাছে পৌঁছে দেন। প্রতিদিন সৈন্য বৃদ্ধি যে পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যই করা হচ্ছে, এ নিয়ে কারও মনে দ্বিধা ছিল না। মঈদুল হাসান শেখ মুজিবের সঙ্গে মেজর মসিহ-উদ-দৌলার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে আলোচনা করেন এবং পাকিস্তানিদের ঠেকাতে একটি Pre-emptive strike-এর কথাও উল্লেখ করলেন। যেহেতু মার্চ মাসের প্রথম দুই সপ্তাহে বাঙালি সেনারা সংখ্যায় বেশি, সে কারণে সময়মতো প্রথমেই আঘাত করলে সফল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি ছিল, এ কথা বাঙালি অফিসাররা বিশ্বাস করতেন। এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকারও এ কথা বলেছেন।
শেখ মুজিব মঈদুল হাসানের কথা শুনে নিজে কিছু না বলে, তাজউদ্দীনের সঙ্গে কথা বলতে বললেন, অর্থাত্ বিষয়টি এড়িয়ে গেলেন। পাকিস্তানি সেনাদের দ্রুত শক্তি বৃদ্ধি (যার একটিই অর্থ হতে পারে) সত্ত্বেও সিদ্ধান্তে তাঁর এই অনীহা কেন? এর দুটি কারণ হতে পারে। এক. পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি ও সামরিক জান্তার চাপ এবং অপর দিকে ছাত্রলীগ ও তরুণ কর্মীদের আপসহীন চাপ—এই দুই চাপ মিলে কোনো সুষ্ঠু সিদ্ধান্ত নেওয়ার পক্ষে এক ধরনের বাধার সৃষ্টি করেছিল। দুই. ছয় দফার ভিত্তিতে স্বায়ত্তশাসন আদায়ের অঙ্গীকারে শেখ মুজিব নির্বাচিত হয়েছেন। তখনো পর্যন্ত এই অঙ্গীকারে তিনি বিশ্বাসী। মঈদুল হাসান ৭ মার্চের বক্তব্যের তাত্পর্যের ওপর কিছুটা আলোচনা করেছেন। ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’, এই উক্তি থাকলেও ওই ভাষণের মূল বক্তব্য হচ্ছে তিনটি শর্ত সাপেক্ষে: ১. সান্ধ্য আইন প্রত্যাহার, ২. সামরিক আইন প্রত্যাহার ও ৩. সেনাবাহিনী কর্তৃক হত্যা ও নির্যাতনের ক্ষতিপূরণ। এসব শর্তে সংসদের অধিবেশনে যোগদানের ইচ্ছা প্রকাশ, অর্থাত্ অহিংস ও নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির মাধ্যমে স্বায়ত্তশাসন আদায়। ‘স্বাধীনতার সংগ্রাম’ কথাটি বিভিন্ন অর্থে ব্যাখ্যা করা যায়। পূর্ণ স্বাধীনতা থেকে স্বায়ত্তশাসনের সীমিত স্বাধীনতা, সব সম্ভাবনাই বিভিন্ন অর্থে বিদ্যমান। তবে পূর্ণ স্বাধীনতা এবং শর্ত সাপেক্ষে সংসদ অধিবেশনে যোগদানের ইচ্ছা প্রকাশ পরস্পরবিরোধী অবস্থান।
মঈদুল হাসান প্রশ্ন রেখেছেন: সেই সামরিক সরকার যারা এক দিনের জন্যও সৈন্য ও সমরসম্ভার নিয়ে আসা থেকে বিরত হয়নি, তারা তাঁকে স্বায়ত্তশাসন দেবে? কারা শেখ মুজিবকে আস্থা জুগিয়েছিল? এ প্রসঙ্গে মঈদুল হাসান মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট প্রকাশিত তথ্যের বরাত দিয়ে বলেন, ঢাকায় আমেরিকান কনসাল জেনারেল আর্চার ব্লাড শেখ মুজিবের গোপন প্রতিনিধি আলমগীর রহমানকে জানান যে, ইয়াহিয়া ১৫ মার্চ আলোচনার জন্য ঢাকায় আসছেন এবং মুজিব-ইয়াহিয়া বিবাদ নিষ্পত্তির জন্য আর্চার ব্লাডের একটি পরিকল্পনা আছে, যা তিনি কিছু পরেই স্টেট ডিপার্টমেন্টকে জানান। কিন্তু তার পর থেকে ২৮ মার্চ পর্যন্ত অধিকাংশ দলিলই প্রকাশিত না হওয়ার জন্য ওই সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা কী ছিল, তা জানা যায় না। তথ্যপ্রমাণের ওপর নির্ভরশীল কথকত্রয় এ নিয়ে আর অগ্রসর হননি। মঈদুল হাসান শুধু একটি ইঙ্গিত করেই এ সম্পর্কে বক্তব্য শেষ করেছেন।
শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক নেতারা দুঃসময়ে কোনো দিকনির্দেশনা দিতে পারলেন না। শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করা হলো। তাঁর সহকর্মী ও বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতারা আত্মগোপন করলেন এবং পরে বিদেশে, বিশেষ করে ভারতে আশ্রয় নিলেন। শুরু হলো নারকীয় হত্যাকাণ্ড ও সশস্ত্র প্রতিরোধযুদ্ধ। পাকিস্তানিদের নারকীয় তাণ্ডব শুরু হওয়ার আগে ২৫ মার্চ সন্ধ্যাবেলায় শেখ সাহেবের বাড়িতে তাজউদ্দীন একটি খসড়া ঘোষণা পড়তে বলেন। তাজউদ্দীন ওই ঘোষণায় স্বাক্ষর করতে অথবা টেপ রেকর্ড করতে শেখ সাহেবকে রাজি করাতে পারেননি। যা-ই হোক, মেজর জিয়া কালুরঘাটে বিদ্রোহী বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন এবং এই ঘোষণার ফল হলো অসামান্য। তিনজন অংশগ্রহণকারীর সবাই বলেছেন, ঘোষণাটি পড়ার পর সারা দেশের ভেতরে ও সীমান্তে যত মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, তাঁদের মধ্যে এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা বড় ধরনের ইতিবাচক প্রভাব পড়ে।
২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গেই প্রতিরোধযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, জয়দেবপুর, ঢাকা, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, যশোর, দিনাজপুর, ময়মনসিংহসহ প্রায় সব জায়গায় প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। সামরিক, আধা সামরিক বাহিনীর বাঙালি সদস্য পুলিশ, সাধারণ মানুষ যোগদান করেছিল সেই প্রতিরোধযুদ্ধে। তখন রাজাকার শব্দটির উত্পত্তি হয়নি এবং অত্যন্ত রক্ষণশীল রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদেরও প্রতিরোধযোদ্ধাদের সাহায্য করতে শুনেছি। আক্রান্ত হয়ে প্রতিরোধের এই যুদ্ধ বিক্ষিপ্তভাবে এপ্রিল মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত চলে। মুক্তিযোদ্ধারা সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের নিরাপদ আশ্রয়স্থলে অবস্থান গ্রহণ করেন। তাঁদের সামনে রয়েছে বৃহত্তর মুক্তিযুদ্ধের দায়িত্ব। প্রাথমিক প্রতিরোধপর্ব সমাপ্ত হওয়ার পর চলমান মুক্তিযুদ্ধকে চারটি অংশে ভাগ করা যায়।
১. Retreat বা প্রস্থান
এই Retreat আমরা অনেক সশস্ত্র বিপ্লবে দেখেছি। যেমন চীনের বিপ্লবী কমিউনিস্ট মুক্তিযোদ্ধাদের বিশাল চীনের দক্ষিণ থেকে উত্তরে কৌশলগত প্রস্থান (Long March)। বাংলাদেশ অনেক ক্ষুদ্রতর রাষ্ট্র হওয়ার কারণে মুক্তিযোদ্ধাদের ভারতে আশ্রয় নিতে হয়েছে। শুধু রাজনীতির কারণে নয়, রণনীতির সাফল্যের জন্য এর প্রয়োজন ছিল খুবই পরিষ্কার।
২. Regrouping and Consolidation বা শক্তির পুনর্বিন্যাস
৪ এপ্রিল তেলিয়াপাড়ায় অনুষ্ঠিত বৈঠকে সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সেনাবাহিনী পুনর্গঠনে তাঁদের মতামত ব্যক্ত করেন। এগুলো হলো:
ক. অবিলম্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য একটি নিয়মতান্ত্রিক সরকার গঠন করা প্রয়োজন।
খ. কর্নেল ওসমানী মুক্তিবাহিনীর সর্বপ্রধান হবেন।
গ. মুক্তিবাহিনীর পুনর্বিন্যাসের জন্য পরিকল্পনা প্রয়োজন।
প্রায় একই সময়ে ইন্দিরা গান্ধী তাজউদ্দীনের সঙ্গে আলোচনার সময়ে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠনের প্রয়োজনীয়তা ব্যক্ত করেন। ১০ এপ্রিল তাজউদ্দীন সাহেবের নেতৃত্বে প্রবাসী সরকার গঠিত হলো। প্রধানমন্ত্রী ১১টি সেক্টরবিশিষ্ট চারটি সামরিক অঞ্চল ঘোষণা করলেন। আঞ্চলিক কমান্ডাররা হলেন মেজর সফিউল্লাহ, মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর খালেদ মোশাররফ ও মেজর আবু ওসমান চৌধুরী। কর্নেল ওসমানী হলেন মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক।২
মুক্তিবাহিনীর প্রশাসনিক কাঠামো যত সহজে গঠন করা গেল, সশস্ত্র বাহিনীর পুনর্গঠন তত সহজসাধ্য ছিল না। কথোপকথনে কিছু মারাত্মক দুর্বলতার কথা বিভিন্নভাবে আলোচিত হয়েছে। একটি প্রথম শ্রেণীর দুর্বলতার কারণ, সেনাবাহিনীর প্রধান কর্নেল ওসমানীর খামখেয়ালি ও সিদ্ধান্তহীনতা। খেয়াল হলো ব্রিগেড গঠন করতে হবে। ব্রিগেড গঠিত হলো। চিন্তা করলেন না পর্যাপ্ত লোকবল ও উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের অভিজ্ঞতা আছে কি না। মুক্তিযুদ্ধের প্রধান রণকৌশল ছিল শত্রুর অবস্থান জেনে সুবিধাজনক স্থানে অতর্কিত আক্রমণ ও ত্বরিত প্রস্থান। কর্নেল ওসমানী গেরিলা যুদ্ধকৌশল বুঝতেন না বলে প্রতীয়মান হয়।
দ্বিতীয় অসুবিধা হলো, ১৪০০ মাইল বিস্তৃত সীমান্তজুড়ে যে রণক্ষেত্র, তার প্রতিটি সেক্টর ও সাবসেক্টরে যোদ্ধাদের অবস্থান, শক্তি ও দুর্বলতা, চাহিদা জানা ও নির্দেশনা দেওয়া—এসব ক্রিয়াকাণ্ডের জন্য যে যোগাযোগব্যবস্থা দরকার, তা বাংলাদেশ বাহিনীর ছিল না। বেতারব্যবস্থা এবং সিগন্যালের জন্য ভারতীয় সেক্টর অধিনায়কদের মাধ্যমে কাজ করতে হতো। এতে অনেক সময় লাগত। তা ছাড়া অনেক বিষয় ছিল, যা বাংলাদেশ সেক্টরপ্রধানদের জানানো দরকার কিন্তু সরকারের পদস্থ কর্মকর্তারা ভারতীয়রা জানুক, এটা চাইতেন না। মঈদুল হাসান ও এ কে খন্দকার দুজনই এভাবে বিষয়টি দেখেছেন। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন বিকল্প ব্যবস্থার সম্ভাবনা নিয়ে এ কে খন্দকারের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। যা-ই হোক, যোগাযোগের অপ্রতুলতা চলমান মুক্তিযুদ্ধের জন্য একটি প্রতিকূল অবস্থার সৃষ্টি করেছিল (পৃষ্ঠা-৫৯)।
যোগাযোগসংক্রান্ত অবিশ্বাস ছাড়াও অন্য অনেক ক্ষেত্রে ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে সম্পর্ক ত্রুটিপূর্ণ ছিল, এটাও প্রতীয়মান হয়। যেমন বাংলাদেশি যুবকদের গেরিলা প্রশিক্ষণ ও তাদের তত্পরতার প্রকৃতি। মাত্র তিন সপ্তাহের সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে ১০ জনের একটি গেরিলা দলকে একটি পিস্তল ও ১০টি গ্রেনেড দিয়ে বাংলাদেশ সেক্টর অধিনায়কদের না জানিয়ে ভারতীয় কর্মকর্তারা দেশের অভ্যন্তরে পাঠাতেন। এই সামান্য অস্ত্র নিয়ে কিছুই করা সম্ভব ছিল না। এস আর মির্জা উল্লেখ করেছেন, এক ভারতীয় সেনা কর্মকর্তা আমাদের ৩০ জন গেরিলা যোদ্ধাকে শুধু হ্যান্ডগ্রেনেড দিয়ে বগুড়ায় পাঠিয়েছিলেন যুদ্ধের জন্য। ৩০ জনের মধ্যে ২৮ জনই ধরা পড়ে এবং পাকিস্তানিরা তাদের হত্যা করে। এ কে খন্দকার বলেছেন, ‘আমাদের নিয়মিত বাহিনীর সদস্য ও আরও অনেকের মধ্যে যে ভারতবিদ্বেষী মানসিকতা সৃষ্টি হয়েছিল, তার জন্য কিছুটা দায়ী এসব ঘটনা।’
আর একটি প্রধান অসুবিধা ছিল, সেটা হলো, মুক্তিযোদ্ধা নির্বাচনকে রাজনৈতিকীকরণ। শুধু এমএনএ ও এমপিরা দলের সমর্থক যুবকদের নির্বাচন করবে, এ ধরনের একটি সিদ্ধান্ত ও তাঁর নিজস্ব প্রতিবাদের কথা মির্জা এক স্থানে উল্লেখ করেছেন। মির্জা যুবশিবিরের দায়িত্ব নেওয়ার পর দেখলেন, আওয়ামী লীগের এক স্তরে বামপন্থীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যাপারে ব্যাপক অনীহা বিদ্যমান। মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত স্বরূপ—এটা একটি জনযুদ্ধ, তা উপলব্ধি করা ছিল অনেকেরই চিন্তা ও মানসিকতার বাইরে।
৩. প্রস্তুতি, গেরিলা যুদ্ধ ও প্রতি-আক্রমণ
৯ আগস্ট চীনকে সম্ভাব্য আক্রমণ থেকে বিরত রাখার লক্ষ্যে ভারত সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে মৈত্রী চুক্তি সম্পাদন করে। নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার সামরিক ব্যবস্থার একটি অংশ হিসেবে ব্যাপক হারে মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ কর্মসূচি গ্রহণ করে। কিছুদিন পর বামপন্থী যুবকদের ওপর থেকে প্রশিক্ষণের বাধানিষেধ বাতিল করা হয়। এ কে খন্দকার বলেছেন, ইন্দো-সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তির পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে অধিকতর অস্ত্রশস্ত্র ও রসদ প্রদান ও গেরিলা যোদ্ধাদের প্রশিক্ষণে অর্থ প্রতি মাসে ২০ হাজারে উন্নীত করলে অক্টোবর মাস থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের তত্পরতা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা, যার উল্লেখ আগে করা হয়েছে, তা অনেকটা দূরীভূত হয়। যেমন গেরিলাদের নিয়মিত বাহিনীর কর্তৃত্বের অধীনে নিয়ে আসা হলো। মঈদুল হাসান মন্তব্য করেছেন, গেরিলা ও মুক্তিযোদ্ধাদের দেশের অভ্যন্তরে পাঠানো শুরু হয় জুন-জুলাই মাসে। তাদের কৌশল ও দক্ষতা আসতে দুই-তিন মাস লেগেছে। সে জন্য অক্টোবরের আগে পুরো প্রতিক্রিয়া (মুক্তিযোদ্ধাদের কাজের ফলাফল) বোঝা যায়নি। মুক্তিযোদ্ধারা ছাড়াও বিভিন্ন বাহিনী যেমন: কাদেরিরা বাহিনী, হেমায়েত বাহিনী ইত্যাদি যারা কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের বাইরে নিজেদের লোকবল ও উদ্যোগে প্রশংসনীয় কৌশলে ও বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেছে, তাদের কার্যকলাপের ফলাফল কথোপকথনে বিশদভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এ কে খন্দকার বলছেন, অক্টোবরের শেষের দিকে এবং নভেম্বর মাসে পাকিস্তানিরা বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি স্থানেই প্রচণ্ড রকমের মার খায় এবং হতাহতের শিকার হয়ে মানসিকভাবে দুর্বল বা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। (পৃষ্ঠা-৮৫)।
৪. শেষ অধ্যায় হচ্ছে, সার্বিক আক্রমণ ও দেশে প্রত্যাবর্তন
১৬ ডিসেম্বরে ভারতীয় বাহিনীর নেতৃত্বে গঠিত যৌথ কমান্ডের কাছে পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করে এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। মঈদুল হাসান বলেছেন, ভারতীয় বাহিনী হয়তো আদৌ আসত না, যদি জনগণ যুদ্ধকে সমর্থন না করত এবং মুক্তিযোদ্ধারা সাফল্য লাভ না করত। ১৬ ডিসেম্বরের আগেই ৯ ডিসেম্বর প্রথম আত্মসমর্পণের কথা ওঠে, কিন্তু বিভিন্ন কারণে (তার মধ্যে জাতিসংঘের কথাও আছে) তা হয়ে ওঠেনি। আক্রমণের মাত্র ছয় দিনের কম সময়ের মধ্যে ৯৩ হাজার সেনার একটি আধুনিক ও সুশিক্ষিত বাহিনীর পরাজয়ের দৃষ্টান্ত আর কোথাও নেই। সেটা সম্ভব হতে পেরেছে, কেননা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষে আর যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া সম্ভবপর ছিল না। কুষ্টিয়া, যশোর থেকে সংঘবদ্ধভাবে ঢাকার দিকে না এসে তারা বিভিন্ন পথে পালাতে শুরু করল। এ থেকে বোঝা যায়, তারা কতখানি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল (পৃষ্ঠা ১১৪)। যৌথ বাহিনী গঠনের প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন বলেছেন, বাংলাদেশের সীমান্তে যদি পাকিস্তানি বাহিনীকে নড়বড়ে না করা যায়, তাহলে ভারতীয় বাহিনী আক্রমণের ঝুঁকি নেবে না। মুক্তিযোদ্ধারা সীমান্তে এবং অভ্যন্তরে পাকিস্তানি বাহিনীর খুঁটিকে শুধু নড়বড়েই করেনি, অনেক জায়গায় তা প্রায় উপড়ে ফেলেছিল। এ ছাড়া, পাকিস্তানি বাহিনীর এক স্থান থেকে অন্য স্থানে চলাচল করার অসমর্থতার অন্য কোনো ব্যাখ্যা নেই।
প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের দূরদর্শিতা
কথোপকথনে স্বল্প কথায় তাজউদ্দীনের একটি মূল্যায়ন হয়েছে। সেটি এই রূপ:
তাঁকে কেউ বলে যায়নি অথবা তিনি জানতেন না তাঁকে কী করতে হবে। ক্রমে ক্রমে তিনি সম্ভাবনার সূত্র খুঁজে নিতে শুরু করেন, লক্ষ্য স্থির করেন, সংগঠন গড়ে তোলেন, বিশ্বের সহায়ক শক্তিগুলোর আস্থা ও সাহায্য অর্জন করে দেশকে স্বাধীন করতে সমর্থ হন (পৃ. ৩২)। এই মূল্যায়নের সঙ্গে দ্বিমতের কোনো অবকাশ নেই, তবে কথোপকথনে বর্ণিত তথ্যের ভিত্তিতে কিছু মতামত সংযোজন করা যায়।
তাজউদ্দীনকে শুধু প্রবাসী সরকারের প্রধান হিসেবে না দেখে তাঁকে একটি War Cabinet-এর প্রধান হিসেবে দেখা যায়। এই সরকারকে দেশ শাসন করতে হয়নি, দেশ যখন শত্রুর কবলে, তখন দেশ শাসনের প্রশ্ন ওঠে না। যা করতে হয়েছে তা হলো, যুদ্ধের মাধ্যমে দেশকে শত্রুমুক্ত করা, ভারতের সঙ্গে পারস্পরিক স্বার্থের ভিত্তিতে একটি কার্যকর সম্পর্ক স্থাপন করা ও অন্যান্য সহায়ক শক্তি, যেমন বিশ্বজনমত ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রভাবকে কাজে লাগানো।
স্বাধীনতার ঘোষণা, প্রাথমিক পর্যায়ের প্রতিরোধযুদ্ধ, তেলিয়াপাড়ায় সেনা কর্মকর্তাদের বৈঠকে নিয়মতান্ত্রিক সরকার গঠনের আশু প্রয়োজনীয়তা—এসব ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর অগ্রণী ভূমিকা তিনি লক্ষ করেন। ১০ এপ্রিল তাঁর নেতৃত্বে প্রবাসী সরকার গঠনের সঙ্গে সঙ্গেই তিনি মুক্তিবাহিনীর পুনর্বিন্যাসের নির্দেশ জারি করেন।
খামখেয়ালি ও বয়স্ক সেনাপ্রধান জেনারেল ওসমানীকে সামলানো একটা বড় ব্যাপার ছিল। বিশেষ করে যৌথ সামরিক কমান্ড গঠনে ওসমানীর বিরোধিতা অগ্রাহ্য করে তাজউদ্দীন শক্তভাবেই তাঁকে সামলান। মুক্তিযোদ্ধাদের অভাবনীয় সাফল্যের পরও, চূড়ান্ত বিজয়ের লক্ষ্যে যে Final Thrust দরকার, তা একটি যৌথ কমান্ড ছাড়া আসবে না, তা তিনি ভালো করেই বুঝেছিলেন। প্রাথমিক পর্যায়ে স্বল্প সময়ে প্রশিক্ষিত গেরিলাদের ওপর ভারতীয় সেনা কর্মকর্তাদের খবরদারি, অপরিকল্পিত গেরিলা আক্রমণ, ভারতীয়দের মাধ্যমে সেক্টর কমান্ডারদের সঙ্গে যোগাযোগ ও সিগন্যালের কাজ করা ইত্যাদি বিরক্তিকর অসুবিধা দূর করার জন্য প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন পরিষ্কারভাবে তাঁর মত ব্যক্ত করেন এবং ধীরে ধীরে বিশেষ করে ৯ আগস্টের পর অসুবিধাগুলো প্রায় দূরীভূত হয়ে যায়। ভবিষ্যতের স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনে দলের ঊর্ধ্বে কার্যক্রম গ্রহণের একটি সর্বদলীয় ব্যবস্থার দরকার, এটা তাজউদ্দীন বুঝেছিলেন। মওলানা ভাসানী ভারতে আশ্রয় নেওয়ার পর পরই ভাসানীসহ বয়োজ্যেষ্ঠ রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে একটি সর্বদলীয় উপদেষ্টা কাউন্সিল গঠন করেন। বামপন্থী যুবকদের মুক্তিযুদ্ধে প্রশিক্ষণের বাধাগুলো বিলুপ্ত করা হয়, তা আগেই বলা হয়েছে।
শুধু একটি বিষয়ে তাজউদ্দীন সফল হননি। তা হলো, মুজিব বাহিনী গঠনে সংশ্লিষ্ট ভারতীয় সংস্থাকে নিবৃত্ত করতে না পারা। মুজিব বাহিনী গঠিত হলো সম্পূর্ণভাবে বাংলাদেশ সরকার ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কর্তৃত্বের বাইরে। প্রথমে এর সৃষ্টি ও গঠনপ্রণালি সম্বন্ধে প্রধানমন্ত্রী, তাঁর ঘনিষ্ঠ সহকর্মীরা বা সেনাবাহিনীর কেউই কিছু জানতেন না। সদস্যদের বাছাই করা হয় আওয়ামী লীগের প্রতি আনুগত্যের ভিত্তিতে। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ তাদের প্রশিক্ষিত করে গোয়েন্দা সংস্থার জেনারেল উবানের অধীনে একটি বাহিনী হিসেবে গঠন করে। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর সাহায্যে গঠিত দেরাদুনের অদূরে চাকরাতা নামক স্থানে একটি অত্যাধুনিক প্রশিক্ষণকেন্দ্রে তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। বাংলাদেশ সরকার তাদের কর্তৃত্বের বাইরে এই গোপন বাহিনী গঠন, তাদের রাজনৈতিক লক্ষ্য ইত্যাদি সম্পর্কে তাদের উদ্বেগের কথা ভারতীয় কর্তৃপক্ষের বিভিন্ন স্তরে জানায়, কিন্তু ফললাভ হয়নি। মঈদুল হাসান, যিনি এসব আলোচনায় মাঝেমধ্যে অংশ নিয়েছেন, তাঁর ধারণা, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর পক্ষেও এমন কিছু অসুবিধা ছিল, যা এড়িয়ে যাওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি।
এই বাস্তব অসুবিধা কী, তা কিছুটা অনুমান করা অসম্ভব নয়। মুজিব বাহিনীর প্রধান রাজনৈতিক লক্ষ্য হচ্ছে, স্বাধীন বাংলাদেশে বামপন্থীদের দমিয়ে রাখা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনামে যুদ্ধ করেছে বামপন্থী বিপ্লব ঠেকাতে। ভারতে তখন মাওবাদী ও বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছিল। সুতরাং বিপ্লবী বামপন্থীদের দমন করা সম্পর্কে ভারত ও মার্কিন নীতির মধ্যে একটি মিলসূত্র বোধ করি খুঁজে পাওয়া যায়। চাকরাতার প্রশিক্ষণকেন্দ্রে সিআইএর সাহায্যে গঠিত ও চালিত হওয়ার আদি লক্ষ্য হচ্ছে, প্রশিক্ষিত লোকদের মাধ্যমে চীনের বিরুদ্ধে তিব্বতে গোলযোগ সৃষ্টি করা। সুতরাং, সেখানে বাংলাদেশের প্রশিক্ষিত যুবকদের কার্যকলাপ নিয়ে একটি সীমিত পরিসরের মধ্যে সিআইএর মতামত উপেক্ষা করা ভারতের পক্ষে সহজ ছিল না। সিআইএ ও ভারতীয় ‘র’-এর মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার প্রকৃতি বোঝার জন্য কথোপকথনের ১৩৪ পৃষ্ঠায় দেওয়া ‘মেমোরেন্ডাম’ পড়ে দেখা যেতে পারে।
শুনেছি মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর কথোপকথন অনেকেই বেশ আগ্রহের সঙ্গে পড়েছেন। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে ‘কথোপকথন’ জাতীয় একটি শ্রেষ্ঠ অধ্যায় বোঝার জন্য কোনো কালজয়ী অবদান রাখবে। বিভ্রান্ত, বোধশক্তির গোষ্ঠীগত বিভক্তি এবং আশ্রয়ের সময়ে বস্তুনিষ্ঠ ও বাস্তব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে রচিত একটি দলিলের প্রভাব কী হবে, তা বলা সহজ নয়। কেমব্রিজের লোকান্তরিত ইতিহাসবিদ ই এ কারের বক্তব্যের একটি উদ্ধৃতি দিয়ে প্রবন্ধটি শেষ করতে চাই। তিনি যা বলেছিলেন তা মোটা দাগে এই, ‘যে সমাজ বর্তমান নিয়ে বিভ্রান্ত এবং ভবিষ্যতে দৃষ্টিপাত করার ক্ষমতা হারিয়েছে, বিগত দিনের ইতিহাস সে সমাজে একগাদা অর্থহীন, সম্পর্কহীন ঘটনা বলে মনে হবে। তবে সমাজ যদি বর্তমানের ওপর কর্তৃত্ব ও ভবিষ্যত্ বোঝার বোধশক্তি অর্জন করতে পারে, তবে একই পন্থায়, অতীতকে বোঝার অন্তর্দৃষ্টি ফিরে পাবে।’ সে পন্থা হলো, আত্মসম্ভ্রম ও আত্মবিশ্বাস।
তথ্যসূত্র
১. এমন একজন হলেন ইয়াহিয়া মন্ত্রিসভার বাঙালি সদস্য ও পাকিস্তানের বাণিজ্যমন্ত্রী মরহুম আহসানুল হক।
২. এশিয়াটিক সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত হিস্ট্রি অব বাংলাদেশের ২১ অধ্যায়ে এ সম্পর্কে কিছুটা বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে।