সারসংক্ষেপ
আমাদের জাতীয় জীবনে ১৯৭১ সাল একটি অতীব তাত্পর্যপূর্ণ বছর। এই বছরই বাংলাদেশ পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের নাগপাশ থেকে মুক্ত হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর দোসর হিসেবে কাজ করেছিল এদেশীয় রাজাকার, আলবদর, আলশামস নামধারী কিছু নরপশু। দীর্ঘদিন পর হলেও বর্তমানে এসব রাজাকার, আলবদর নেতার বিচার হচ্ছে। এই বিচার চলাকালে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি নিয়ে স্বাধীনতাবিরোধীরা মাঠে নেমেছে। এই বিকৃতির অন্যতম লক্ষ্যবস্তু হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের সময় সংগঠিত নির্মম গণহত্যায় প্রাণ হারানো মানুষের সংখ্যা। যদিও যেকোনো গণহত্যাতেই সংখ্যা প্রধান বিচার্য বিষয় নয়, তারপরও সংখ্যার একটি সাংকেতিক তাত্পর্য রয়েই যায়। এই প্রবন্ধে যুক্তি দেখানো হয়েছে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়কার গণহত্যায় নিহত মানুষের সংখ্যা ৩০ লাখের কম নয়। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রচারমাধ্যম এবং গবেষণাপত্র ব্যবহার করে এই দাবির সত্যতা উপস্থাপন করা হয়েছে। অন্যদিকে ১৯৭১-এর গণহত্যায় নিহতের সংখ্যা নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ঘিরে ‘৩ লক্ষ বনাম ৩ মিলিয়ন’ শিরোনামে যে বিতর্ক করা হয়, তার জবাবও খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে এই প্রবন্ধে। এ ছাড়া দীর্ঘ ৯ মাসের যুদ্ধে ভারতের শরণার্থী শিবিরগুলোতে মারা যাওয়া মানুষদের কেন গণহত্যার শিকার বিবেচনা করা উচিত, সে যুক্তিগুলোও প্রবন্ধে উপস্থাপন করা হয়েছে। পরিশেষে বিশ্বের আরও কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গণহত্যার সঙ্গে তুলনামূলক ব্যাখ্যার সাহায্যে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার গণহত্যায় যে ৩০ লাখের অধিক বাঙালি গণহত্যার শিকার হওয়া কোনো মিথ নয়, বরং বাস্তবতা তা তুলে ধরা হয়েছে।
মুখ্য শব্দগুচ্ছ
১৯৭১, মুক্তিযুদ্ধ, গণহত্যা, ৩০ লাখ, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, শরণার্থী, বঙ্গবন্ধু।
প্রারম্ভিক কথা
‘১৯৭১ সালের যুদ্ধটা নিয়ে সব সময়ই একটু বেশি বাড়াবাড়ি করা হয়। সে সময় এমন বড় কিছুই হয়নি, সেনাবাহিনী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের একটু শায়েস্তা করেছে, এই যা। ভারত ষড়যন্ত্র করে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মুসলমান দেশকে ভেঙে দুই ভাগ করেছে। যাঁরা দাবি করেন একাত্তরের গন্ডগোলের সময় ৩০ লাখ মানুষ মারা গেছে তাঁরা বোকার স্বর্গে বাস করছেন। মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা বড়জোর তিন লাখ, এমনকি কমও হতে পারে। আর মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা তিরিশ লাখ, এই আষাঢ়ে গল্পের প্রবক্তা শেখ মুজিব। আর সেই আষাঢ়ে গল্পটা প্রথম মঞ্চস্থ হয় বাহাত্তরের আটই জানুয়ারি, মুজিব যখন পাকিস্তান থেকে লন্ডনে আসেন। সেখানে সাংবাদিকেরা মুক্তিযুদ্ধে দেশের ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে জানতে চান। শেখ মুজিব একদিকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত ছাত্র ছিলেন, স্বাভাবিকভাবেই ইংরেজি ভালো জানতেন না। শেখ মুজিব দেশে আসার সময় বিমানবন্দরে তাকে বিদেশি সাংবাদিকেরা যখন ক্ষয়ক্ষতির কথা জিজ্ঞাসা করে তখন ‘স্বল্পশিক্ষিত’ মুজিব (তাদের মতে) মৃতের সংখ্যা “থ্রি লাখ” বলতে গিয়ে “থ্রি মিলিয়ন” বলে ফেলেন। সেই থেকে দেশের সব মানুষ এই সংখ্যাটাকে সঠিক ধরে নিয়েছে, যার আসলে কোনো ভিত্তি নেই।’
ওপরের লেখাটা নিয়ে যদি আজও আপনি এ দেশের ঘরে ঘরে যান তাহলে অন্তত মোট দশ ভাগের চার ভাগ মানুষ এই লেখার কিছুটা অংশের সঙ্গে হলেও একমত হবে। বাকি চার ভাগ মানুষের তিন ভাগ এই লেখাটা দেখামাত্র ছুড়ে ফেলে দেবেন আর বাদবাকি দুই ভাগ মানুষ হবেন বিভ্রান্ত। আজকের লেখা এই বিভ্রান্ত মানুষদের জন্য। আমাদের দুর্ভাগ্য, স্বাধীনতার ৪৪ বছর পরও স্বাধীনতার অনেক মৌলিক প্রশ্নে আমরা মতৈক্যে পৌঁছাতে পারিনি। সরকারের যথেষ্ট পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এবং স্বাধীনতাবিরোধীদের লাগাতার অপপ্রচারের কারণে এসব মৌলিক প্রশ্নে আমাদের মধ্যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। এই নিবন্ধের পরবর্তী পর্যায়ে বিভিন্ন স্তরে আমরা এসব মৌলিক প্রশ্নের উত্তর খুঁজব।
একাত্তরে শহীদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন উঠলেই বঙ্গবন্ধুর ‘থ্রি লাখ’ ‘থ্রি মিলিয়ন’ বিভ্রান্তির গল্প বলা হয়। প্রথমেই এই মিথটি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব। দেখব বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে আসার আগেই দেশি-বিদেশি সংবাদপত্রে ৩০ লক্ষাধিক শহীদের খবর ছাপা হয়েছিল। সংবাদপত্রে প্রকাশিত হলেই একটা খবর সত্য হয়ে যায় না, আর সে জন্যই এখানে উদ্ধৃত করেছি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেই বিভিন্ন আন্তর্জাতিক দৈনিকে শহীদের সংখ্যা পর্যায়ক্রমে বৃদ্ধি পাওয়ার তুলনামূলক চিত্র। যেটাতে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত করার সুযোগ নেই কোনো পক্ষেরই, যেটা প্রমাণ করবে ৩০ লাখ সংখ্যাটা কোনো স্বপ্নে পাওয়া সংখ্যা নয়, বাস্তবসম্পন্ন পরিসংখ্যান।
যেহেতু সংবাদপত্র কখনোই বিভ্রান্তির ওপরে নয়, সে জন্য আলোচনা করেছি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শহীদের সংখ্যা নিয়ে করা বেশ কয়েকটি গবেষণার কথা। উল্লেখ করব বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা যেমন জাতিসংঘের পরিসংখ্যান, বিভিন্ন এনসাইক্লোপিডিয়ায় মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা সম্পর্কে মতামত এবং কয়েকজন গণহত্যা গবেষকের পর্যালোচনা। এরপর একজন গণহত্যা গবেষকের সম্পূর্ণ গবেষণাপদ্ধতি এবং বাংলাদেশ সম্পর্কে তাঁর গবেষণার পুরো চিত্র তুলে ধরব। এরপর ৫০ বছর ধরে আমাদের দেশের মৃত্যুহারের তুলনামূলক পর্যালোচনা তুলে ধরব। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাওয়া মৃত্যুহারের সঙ্গে স্বাভাবিক অবস্থায় পাওয়া মৃত্যুহারের তুলনা করে দেখানো সম্ভব ১৯৭১ সালে শহীদের সম্ভাব্য সংখ্যাটি। যাঁরা দাবি করেন এত কম সৈনিক এত কম সময়ে এত বেশি মানুষকে মেরে ফেলতে পারে না, তাদের জন্য বিভিন্ন যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি এবং সময়ের
সাপেক্ষে সৈনিক ও হতাহতের তুলনা করা হবে। শেষে আলোচনা করব শরণার্থী শিবিরে মৃত মানুষের সংখ্যা নিয়ে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পত্রপত্রিকা এবং গবেষকদের গবেষণা থেকে আমরা ধারণা করে নিয়েছি, ১৯৭১ সালে ভারতে চলে যাওয়া প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ শরণার্থীর ভেতর ৬ থেকে ১২ লাখের ভাগ্যে মৃত্যু নেমে এসেছিল।
বঙ্গবন্ধু কি আসলেই তিন লাখ বলতে গিয়ে ত্রিশ লাখ বলেছিলেন?
থ্রি লাখ বনাম থ্রি মিলিয়ন আসলেই খুবই চমত্কার একটি তত্ত্ব, এই তত্ত্বের সমাধানের জন্য সমস্যাটার কয়েকটা গুরুতর অংশ নিয়ে আমি প্রথমেই আলোচনা করব। এই ইস্যু নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে ভালোই জল ঘোলা করা হচ্ছে। বিতর্কিত সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান সম্প্রতি তাঁর ব্লগেও একই কথার সমর্থন দিয়েছেন।১ আমরা খোঁজ করেছি এই গল্পের প্রথম প্রচারকের এবং খুঁজেও পেয়েছি। ‘বাংলাদেশিদের মৃত্যু নিয়ে মুজিবের বিভ্রান্তি’ (মুজিবস কনফিউশন অন বাংলাদেশি ডেথস) শিরোনামে লন্ডনের বিখ্যাত দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান- এ প্রকাশিত এক চিঠিতে (২৪ মে, ২০১১) বিবিসির বাংলা বিভাগের সাবেক উপপ্রধান সিরাজুর রহমান লিখেছেন, ‘২১ মে আইয়ান জ্যাক স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলাদেশিদের মৃত্যুর যে সংখ্যা উল্লেখ করেছেন তা ঠিক নয়। ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি পাকিস্তান থেকে মুক্তি পেয়ে লন্ডনে আসার পর আমিই ছিলাম স্বাধীনতাসংগ্রামের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাত্কারী বাংলাদেশি। তাকে হিথরো (বিমানবন্দর) থেকে ক্ল্যারিজেস হোটেলে নিয়ে এসেছিলেন লন্ডনে ভারতের হাইকমিশনার আপা ভাই পান্থ। এর ঠিক পরপরই আমি সেখানে উপস্থিত হয়েছিলাম। মিস্টার পান্থ তাকে “ইওর এক্সিলেন্সি” বলে সম্বোধন করায় মুজিব অবাক হচ্ছিলেন। আমি যখন তাঁকে বলেছি, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেছে এবং আপনার অনুপস্থিতিতে আপনাকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করা হয়েছে, মুজিব তখন বিস্মিত এমনকি অনেকাংশে স্তম্ভিত হয়েছিলেন। স্পষ্টত তিনি এমন ধারণা নিয়েই লন্ডনে এসেছিলেন যে পূর্ব পাকিস্তানিদের হয়তো পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হয়েছে, যার জন্য তিনি আন্দোলন করছিলেন। সেদিন আমি এবং উপস্থিত অন্য সকলে তাকে যুদ্ধ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানিয়েছিলাম। আমি ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছিলাম, এখনো পর্যন্ত হতাহতদের সঠিক সংখ্যা জানা যায়নি। কিন্তু বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে আমাদের অনুমান, যুদ্ধে তিন লাখ (৩,০০,০০০) মানুষ মারা গেছে।
‘আমাকে বিস্মিত ও স্তম্ভিত করে পরবর্তী সময়ে ডেভিড ফস্টারকে মুজিব বলেছিলেন, পাকিস্তানিরা “আমার তিন মিলিয়ন মানুষকে” হত্যা করেছে। তিনি “লাখ”কে “মিলিয়নের” সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেছিলেন, নাকি তাঁর বিভ্রান্ত মনই এ জন্য দায়ী ছিল আমি জানি না। কিন্তু বহু বাংলাদেশি এখনো বিশ্বাস করেন, তিন মিলিয়নের সংখ্যাটা কল্পনাপ্রসূত এবং অবিশ্বাস্য।’২
এই নিবন্ধের উদ্দেশ্য এটা নিরূপণ করা নয়, মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা কত। সত্য-মিথ্যা যা-ই হোক আসল উদ্দেশ্য এটা খুঁজে বের করা মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা তিরিশ লাখ এই গল্পের প্রথম প্রবক্তা কি সত্যিই শেখ মুজিব কি না। কারণ যদি ধরে নিই একাত্তরে ৩০ লাখ মানুষের শহীদ হওয়াটা একান্তই মুজিবের মস্তিষ্কপ্রসূত, আসল সংখ্যাটা তিন লাখ; তাহলে প্রথমেই জেনে নেওয়া দরকার মুক্তিযুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিয়ে এই তিন লাখ ফিগারটিই এল কোথা থেকে। বঙ্গবন্ধুর আগে কি কেউ এই সংখ্যা উচ্চারণ করেছেন? করলে কোথায় করেছেন? ত্রিশ লাখ আগে এসেছে নাকি তিন লাখ? এ ছাড়া আর কোনো ফিগার কি আছে?
আমরা দেখব, বঙ্গবন্ধু দেশে আসার আগ পর্যন্ত অর্থাত্ ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ থেকে ৮ জানুয়ারি ১৯৭২ পর্যন্ত দেশি সংবাদপত্র কী বলছে হতাহতের সংখ্যা নিয়ে। একটু ঘাঁটাঘাঁটি করতেই বেরিয়ে এল তিরিশ লাখের প্রথম উচ্চারণ। একাত্তর সালেই মুক্তিযুদ্ধের প্রথম লগ্নে অর্থাত্ মার্চে পাকিস্তানে জেনারেল ইয়াহিয়া খান প্রথম সদম্ভে ঘোষণা করেছিলেন, ‘ওদের ত্রিশ লাখ হত্যা করো, বাকিরা আমাদের থাবার মধ্যে থেকেই নিঃশেষ হবে।’
সত্যি বলতে, দেখা যাচ্ছে প্রথম ভুলটা ছিল জেনারেল ইয়াহিয়া খানের, তিনিই সম্ভবত তিন লাখ বলতে গিয়ে ত্রিশ লাখ বলে ফেলেছিলেন। কিন্তু তিনিই শেষ না; মাওলানা ভাসানী যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়েই দশ লাখ মানুষ হত্যাকাণ্ডের কথা বলেছিলেন। কবি আসাদ চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধের সময় লিখেছেন তাঁর বেশ কয়েকটি কবিতা। সেসব কবিতায় বারবার উঠে এসেছে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যুর কথা। মুক্তিযুদ্ধকালীন তাঁর দুটো কবিতার কথা উল্লেখ করছি। আসাদ চৌধুরী তাঁর ‘রিপোর্ট ১৯৭১’৩ কবিতার ৫৪ নাম্বার লাইনে লিখেছেন ১০ লাখ গলিত লাশের কথা:
‘জনাব উথান্ট,
জাতিসংঘ ভবনের মেরামত অনিবার্য আজ।
আমাকে দেবেন, গুরু, দয়া করে তার ঠিকাদারী?
বিশ্বাস করুন রক্তমাখা ইটের যোগান
পৃথিবীর সর্বনিম্ন হারে একমাত্র আমি দিতে পারি
যদি চান শিশু ও গলিত খুলি, দেওয়ালে দেওয়ালে শিশুদের রক্তের আল্পনা
প্লিজ, আমাকে কন্ট্রাক্ট দিন।
দশ লক্ষ মৃতদেহ থেকে
দুর্গন্ধের দুর্বোধ্য জবান শিখে রিপোর্ট লিখেছি—পড়, পাঠ কর।’
মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হতো ‘চরমপত্র’। সেই চরমপত্রের শেষ প্রচার দিবস অর্থাত্ ১৬ ডিসেম্বরের কিছু অংশ সরাসরি তুলে দিচ্ছি:
‘...২৫ মার্চ তারিখে সেনাপতি ইয়াহিয়া খান বাঙ্গালিগো বেশুমার মার্ডার করনের অর্ডার দিয়া কি চোটপাট! জেনারেল টিক্কা খান সেই অর্ডার পাইয়া ৩০ লাখ বাঙ্গালির খুন দিয়া গোসল করল। তারপর বঙ্গাল মুলুকের খাল-খন্দক, দরিয়া-পাহাড়, গেরাম-বন্দরের মইদ্দে তৈরি হইল বিচ্ছু...’ (চরমপত্র; পৃ: ৩২৫)।
এবার আসি সংবাদপত্রে। বঙ্গবন্ধুই যদি ভুলটি করে থাকেন তাহলে ১৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১ থেকে ৯ জানুয়ারি, ১৯৭২ পর্যন্ত নিচের সংবাদ প্রতিবেদনগুলোতে ত্রিশ লাখ শহীদের কথা কী করে এল। যেমন দৈনিক পূর্বদেশ-এর সম্পাদক তাঁর পত্রিকায় ১৯৭১ সালের ২২ ডিসেম্বর ‘ইয়াহইয়া জান্তার ফাঁসি দাও’ শিরোনামে একটি সম্পাদকীয় লেখেন। সেখানে পরিষ্কার লেখা হয়, ‘হানাদার দুশমন বাহিনী বাংলাদেশের প্রায় ৩০ লাখ নিরীহ লোক ও দুশতাধিক বুদ্ধিজীবীকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে...’। এরপর রাশিয়ার প্রাভদা, ৩ জানুয়ারি, ১৯৭২ ত্রিশ লাখের কথা উল্লেখ করে। মর্নিং নিউজ, ৫ জানুয়ারি ১৯৭২ ত্রিশ লাখের কথাই আবার উল্লেখ করে সেই সংখ্যাটা পৃথিবীময় ছড়িয়ে দেয়। ঢাকার পত্রিকা দৈনিক অবজারভার শিরোনাম করে এভাবে, ‘পাক আর্মি কিল্ড ওভার ৩০ লাখ পিউপল’, যেটা প্রকাশিত হয় ০৫.০১.১৯৭২ তারিখে মুজিব দেশে আসার ৩ দিন আগে। ৪ জানুয়ারি আজাদ পত্রিকাও প্রাভদার কথা উল্লেখ করে তাদের সংবাদে। দৈনিক বাংলা পত্রিকা তাদের, ৬ জানুয়ারি, ১৯৭২ ‘জল্লাদের বিচার করতে হবে’ শিরোনামে করা প্রবন্ধ ত্রিশ লাখ শহীদের পক্ষে সাক্ষ্য দেয়। যেটা প্রকাশিত হয় ৮ তারিখের আগে।
সুতরাং দলিলপত্র যাচাই করে এই পর্যন্ত পড়ে আসা যেকোনো একজন সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ নিশ্চয়ই মেনে নিতে বাধ্য হবেন ত্রিশ লাখ ফিগারটা মুজিবের মাথায় হঠাত্ করে আসেনি। শহীদের সংখ্যা ধীরে ধীরে বেড়েছিল এবং আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রচার হচ্ছিল। স্বাধীনতার পর দেশি পত্রিকাগুলোতেও এই সংবাদ প্রচারিত হতে থাকে এবং মুজিব জেলে থাকতে থাকতেই সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে এই সত্য পৌঁছে গিয়েছিল।
এবার আসুন খুঁজে দেখি একাত্তরের বিদেশি সংবাদপত্রগুলো ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের আগ পর্যন্ত হতাহতের সংখ্যা সম্পর্কে কী ধারণা দেয়। যদিও মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ ছিল প্রায় বিদেশি সাংবাদিকমুক্ত। সাংবাদিকদের বড় অংশকেই বের করে দেওয়া হয় ২৫ মার্চ রাতে, দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ-এর ২৭ মার্চ ১৯৭১ সংখ্যাটা পড়লে সবার কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার করে বের করে দেওয়ার ঘটনাটি। আমি ওই রিপোর্ট থেকে খানিকটা উদ্ধৃত করছি:
‘স্বাধীনতা আন্দোলনকে ধূলিসাত্ করতে সেনাবাহিনী যখন অভিযানে নামে সেই সময় থেকেই পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানরত সকল বিদেশি সাংবাদিককে অস্ত্রের মুখে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে অবরুদ্ধ করে রাখা হয় এবং পরে সবাইকে ধরে প্লেনে উঠিয়ে করাচিতে নিয়ে যাওয়া হয়।
ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকার সংবাদদাতা সাইমন ড্রিং হোটেলের ছাদে লুকিয়ে থেকে গ্রেপ্তার এড়াতে সক্ষম হন; যদিও তাঁকে গ্রেপ্তার করার জন্য অবিরাম চেষ্টা চালানো হয়েছে। সাইমন ড্রিং ছাড়া কেবল অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস-এর ফটোগ্রাফার মাইকেল লরেন্ট গ্রেপ্তার এড়াতে সক্ষম হয়েছিলেন। সাইমন ড্রিং জ্বলন্ত ঢাকা শহরে ব্যাপকভাবে ঘুরে দেখার সুযোগ পান। গতকাল একটি প্লেনে করে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে আসতে সক্ষম হন। দু দুবার তার বস্ত্র উন্মোচন করে তল্লাশি চালানো এবং তার লাগেজ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হলেও, কৌশলে তিনি ঢাকায় নেওয়া নোটগুলোসহ সোমবার সকালে ব্যাংকক পৌঁছে এই রিপোর্ট পাঠান’ (দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ, ২৭ মার্চ ১৯৭১)।
সাইমন ড্রিংয়ের মতো হাতে গোনা যে কয়েকজন সাংবাদিক লুকিয়ে ছিলেন তাঁদের কাছে আসলেও সামগ্রিক ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া অসম্ভব ছিল, কারণ অভিযান চলছিল সারা দেশে। পুরো দেশের সব খবর একত্র করে একটা ফিগার নির্ণয় করা প্রায় অসম্ভব একটা কাজ ছিল এবং এই কথা সেই সময়ের সংবাদপত্রগুলোতেও এসেছে বারবার। পড়তে গিয়ে দেখেছি যখনই একটা ফিগারের কথা বলা হচ্ছে তখনই আবার বলা হচ্ছে সামগ্রিক অবস্থা আমরা জানি না, সংখ্যাটা এর চেয়েও অনেক বেশি হতে পারে। তাই প্রথম দিকে একাত্তরে আসলে কী ঘটছিল পাকিস্তানে, সেটা পৃথিবীর মানুষ খুব একটা জানত না। খবরে হয়তো দেখা যেত খানিক গন্ডগোলের কথা কিন্তু পুরো চিত্রটা মানুষের কাছে পরিষ্কার ছিল না।
পরিষ্কার করেছিলেন যে মানুষটি, তিনি ছিলেন পাকিস্তানি। পাকিস্তানি সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাস ছিলেন প্রথম মানুষ, যিনি সারা বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিস্তারিত বর্ণনা তুলে ধরেছিলেন। একাত্তরের এপ্রিলে যখন সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের ওপর নির্বিচারে নিপীড়ন চালাচ্ছিল, হত্যা করছিল, ঠিক তখনই পাকিস্তানি সরকার সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাসকে যুদ্ধাবস্থার প্রতিবেদন তৈরির জন্য সেখানে আমন্ত্রণ জানায়। শাসকশ্রেণি ধারণা করেছিল মাসকারেনহাস তাদের মিথ্যা প্রচারণায় সায় দেবেন। কিন্তু তারপরের ঘটনা ইতিহাস। অ্যান্থনি মাসকারেনহাস সেই কাজটাই করলেন, যেটা একজন বিবেকবান মানুষের করা উচিত। আসুন দেখা যাক এত কিছুর পরও বিভিন্ন টাইমলাইনে আন্তর্জাতিক সংবাদপত্রগুলো কী লিখেছে মুক্তিযুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে:
১. টাইমস একাত্তরের এপ্রিলের শুরুতেই লিখেছে ৩ লাখ ছাড়িয়েছে এবং বাড়ছে।
২. নিউজউইক এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে ১৯৭১ লিখেছে সাত লাখ।
৩. দ্য বাল্টিমোর সান ১৪ মে ১৯৭১ লিখেছে ৫ লাখ।
৪. দ্য মোমেন্টো, কারাকাস জুনের ১৩ তারিখে লিখেছে ৫ থেকে ১০ লাখ।
৫. কাইরান ইন্টারন্যাশনাল ২৮ জুলাই লিখেছে ৫ লাখ।
৬. ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল ২৩ জুলাইয়ে রিপোর্ট করেছে, সংখ্যাটা ২ থেকে ১০ লাখ।
৭. টাইমস সেপ্টেম্বরে বলছে ১০ লক্ষাধিক।
৮. দ্য হ্যাম্পস্টেড অ্যান্ড হাইগেট এক্সপ্রেস, লন্ডন ১ অক্টোবর ১৯৭১ বলেছে শহীদের সংখ্যা ২০ লাখ।
৯. ন্যাশনাল জিওগ্রাফি ১৯৭২ সালের সেপ্টেম্বরে লিখেছে শহীদের সংখ্যা ৩০ লাখ।
সংবাদপত্রের ওপর জোর দিচ্ছি, কারণ যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের সময় ৩০ লাখ শহীদের ব্যাপারটা বাড়াবাড়ি মনে করেন, দাবি করেন সংখ্যাটা অনেক কম এবং উদ্দেশ্যমূলকভাবে বানানো, তাঁদের কাছে তুলে ধরতে যে সংখ্যাটা হঠাত্ করে গজিয়ে ওঠেনি। আন্তর্জাতিক দৈনিক বলছে এপ্রিলে সাত লাখ, জুলাইতে দশ লাখ, সেপ্টেম্বরে বিশ লাখ তাহলে ডিসেম্বরে তিরিশ লাখ শহীদ আকাশ থেকে আসা ফিগার মনে হওয়ার কোনো কারণ নেই।
এবার আমরা আলোচনা করব পৃথিবীময় বিভিন্ন গণহত্যা, রাজনীতি, সংঘাত গবেষকের দৃষ্টিতে ১৯৭১ সালে হতাহতের সংখ্যা। দেখব বিভিন্ন গবেষণাপত্র, ডিকশনারি, এনসাইক্লোপিডিয়ায় এই গণহত্যা সম্পর্কে কী বলা আছে। সত্যি বলতে সংখ্যাটা ত্রিশ লাখ, তিন লাখ, এক লাখ অথবা ছাব্বিশ হাজার যাই হোক না কেন, এটা তো অবশ্যই এক বাক্যে মানতে হবে যে সংখ্যাটা অনেক বড়। সংখ্যাটা যে অনেক বড়, সেটা এমনকি এক বাক্যে স্বীকার করে নিয়েছিলেন তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের সেনা প্রশাসকের দায়িত্বে থাকা জেনারেল রাও ফরমান আলী। উল্লেখ্য, এই রাও ফরমান আলী বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের নীলনকশাকারী, যুদ্ধের পর তার ডায়েরি থেকে নিজ হাতে তৈরি করা বুদ্ধিজীবীদের তালিকা পাওয়া যায়। সেই তালিকায় থাকা কাউকেই স্বাধীন বাংলায় খুঁজে পাওয়া যায়নি। ডক্টর মুনতাসীর মামুন বছর কয়েক আগে পাকিস্তানি জেনারেলদের মধ্যে যারা জীবিত আছে তাদের সাক্ষাত্কার গ্রহণ করেন। সেসব দুর্লভ সাক্ষাত্কার পাওয়া যাবে তাঁর গ্রন্থ সেই সব পাকিস্তানি-তে। ড. মামুনকে সেই বইতে দেওয়া এক সাক্ষাত্কারে রাও ফরমান আলী সেনাবাহিনীর হাতে বিরাট সংখ্যার হত্যাকাণ্ডের পক্ষে স্বীকারোক্তি দেন। সেই দীর্ঘ সাক্ষাত্কারের নির্বাচিত চুম্বক অংশ পাঠকের উদ্দেশ্যে তুলে ধরছি:
‘...মামুন : ওই সময় একজন সক্রিয় জেনারেল হিসেবে আপনি এত ব্যাপক আকারে হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে জানতেন না?
ফরমান : আমি বিশ লাখ লোক নিহত হওয়ার হিসাব মেনে নিতে পারছি না।
মামুন : না, আমি ওটা নিয়ে তর্ক করতে চাচ্ছি না।
ফরমান : সংখ্যাটা ৪০-৫০ হাজারের মতো হবে।
মামুন : তাহলে আপনার বিবেচনায় এই ৪০-৫০ হাজার বিরাট সংখ্যা নয়?
ফরমান: না... এটা...।
মামুন : সেনাবাহিনী নিরীহ, নির্দোষ লোকদের হত্যা করেছে।
ফরমান : জি হ্যাঁ, সংখ্যাটা বিরাট। আমি স্বীকার করছি সংখ্যাটা সত্যিই বিরাট...’
এখানে স্বীকারোক্তির পাশাপাশি আরও একটা জিনিস পাওয়া যাচ্ছে সেটা হচ্ছে, মৃত মানুষের সংখ্যার ব্যাপারে বিভ্রান্তি। পাকিস্তান ১৯৭২ সালে করা তাদের হামুদুর রহমান কমিশনের রিপোর্ট৪ অনুসারে মুক্তিযুদ্ধে হতাহতের সংখ্যা ২৬,০০০। ১৯৭২ সালের পর থেকে লাগাতার ভিত্তিহীন এই অপপ্রচার তারা চালিয়ে যাচ্ছে আজ পর্যন্ত, ড. মুনতাসীর মামুন এই সাক্ষাত্কার নেন নব্বইয়ের দশকে, সুতরাং কমিশনের বলা ২৬,০০০ সংখ্যাটা ফরমান জানতেন না তা অসম্ভব। তারপরও তিনি ড. মামুনকে বলেন সংখ্যাটা ৪০-৫০ হাজার।
এসব বিভ্রান্তির জবাব নির্মোহভাবে দিতে পারে মুক্তিযুদ্ধের ওপর করা বিভিন্ন বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণা। যেখানে গণহত্যার পর হতাহতের সংখ্যা বের করার গাণিতিক সূত্র মেনে মৃত মানুষের সংখ্যা সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে হওয়া অনেকগুলো গবেষণা থেকে কয়েকটি নিয়ে আলোচনা করব আমরা।
১. ‘সেন্টার ফর সিস্টেমেটিক পিস’-এর ডিরেক্টর ড. মার্শাল জোবি, ‘মেজর এপিসোডস অব পলিটিক্যাল ভায়োলেন্স ১৯৪৬-২০১৪’ প্রবন্ধে দেখিয়েছেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ১০ লাখ মানুষ নিহত হয়েছে।
২. ড. টেড রবার্ট গার এবং ড. বারবারা হার্ফ দুজন গণহত্যা গবেষক। এঁদের মাঝে ড. টেড রবার্ট গার বর্তমানে ম্যারিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আর ড. বারবারা হার্ফ ইউএস নেভি একাডেমিতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক। তাঁরা দুজনই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের দিকপাল হিসেবে পরিচিত। তাঁদের বিখ্যাত গবেষণা, যেটা পরবর্তী সময়ে পুস্তক হিসেবেও সমাদৃত হয়, টুয়ার্ড অ্যাম্পিরিক্যাল থিওরি অব জেনোসাইডস অ্যান্ড পলিটিসাইডস, প্রকাশিত হয় ১৯৮৮ সালে। সেই বইতে উল্লেখ করা হয়েছে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে ১২,৫০,০০০ থেকে ৩০,০০,০০০ মানুষ নিহত হয়েছে।
৩. মিল্টন লিটেনবার্গের গবেষণাপত্র, যেটা প্রকাশিত হয় কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, ‘ডেথস ইন ওয়ারস অ্যান্ড কনফ্লিক্টস ইন দ্য ২০ত সেনচুরি’ শীর্ষক সেই প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধে নিহতের সংখ্যা ১.৫ মিলিয়ন অর্থাত্ ১৫ লাখ।
৪. ড. জ্যাক নুস্যান পোর্টার একজন লেখক, গবেষক, সমাজকর্মী এবং যিনি ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব জেনোসাইড স্কলার্সের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট, তাঁর সাড়া জাগানো বই জেনোসাইড অ্যান্ড হিউমেন রাইটস। এই বইতে গুরুত্ব সহকারে উল্লেখ করা হয়েছে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে শহীদের সংখ্যা ১০ থেকে ২০ লাখ।
৫. ১৯৪৫ থেকে ১৯৯৫ সালের মধ্যে ৩০০টি আন্তর্জাতিক সংঘাত সম্পর্কে বলা হয়েছে ইন্টারন্যাশনাল কনফ্লিক্ট: আ ক্রোনোলজিক্যাল এনসাইক্লোপিডিয়া অব কনফ্লিক্টস অ্যান্ড দেয়ার ম্যানেজমেন্ট, ১৯৪৫-১৯৯৫ বইটিতে। লেখকদ্বয় জ্যাকব বারকোভিচ এবং রিচার্ড জ্যাকসন দুজনেই আন্তর্জাতিক সংঘাত বিশেষজ্ঞ।
৬. গণহত্যা গবেষক টম হার্টম্যান এবং জন মিচেল তাঁদের লেখা আ ওয়ার্ল্ড অ্যাটলাস অব মিলিটারি হিস্টিরি, ১৯৪৫-১৯৮৪ বইতে বলেছেন একাত্তরের যুদ্ধে দশ লাখ মানুষ মারা যায়।
৭. ওয়ার্ল্ড অ্যালামন্যাক, যাদের বলা হয়ে থাকে তথ্যপঞ্জির জগতে সর্বশ্রেষ্ঠ, তারা তাদের বেস্ট সেলার ১৯৮৪ সালের সংখ্যায় বলেছে, ১৯৭১ সালের সংঘাতে নিহতের সংখ্যা ১০ লাখ।
৮. কম্পটনস এনসাইক্লোপিডিয়া তাদের গণহত্যা পরিচ্ছদে মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা লিখেছে ৩০ লাখ।
৯. এনসাইক্লোপিডিয়া অ্যামেরিকানা তাদের ২০০৩ সালের সংস্করণে
বাংলাদেশ নামক অধ্যায়ে একাত্তরে নিহত মানুষের সংখ্যা উল্লেখ করেছে ত্রিশ লাখ।
১০. গণহত্যা গবেষক লিও কুপার তাঁর বিখ্যাত জেনোসাইড বইতে উল্লেখ করেছেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হয়েছে।
১১. ১৯৮১ সালের জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার ৩৩তম বছর উপলক্ষে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুসারে ‘মানব ইতিহাসে যত গণহত্যা হয়েছে এর মধ্যে বাংলাদেশের ১৯৭১ সালের গণহত্যা স্বল্পতম সময়ে সর্ববৃহত্। গড়ে প্রতিদিন ৬,০০০ থেকে ১২,০০০ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। এটি হচ্ছে গণহত্যার ইতিহাসে প্রতিদিনে সর্বোচ্চ নিধন হার। এই ঘোষণা যেহেতু মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হওয়ার প্রায় দশ বছর পরে দেওয়া হয়েছে, সুতরাং গণহত্যা যে ২৬৬ দিন চলেছিল তারা সেটা জানত। রাউন্ড ফিগার ২৬০ দিন ধরে বাঙালি নিধন হয়েছে ১৫,৬০,০০০ থেকে ৩১,২০,০০০ পর্যন্ত।
১২. পুলিত্জার পুরস্কার বিজয়ী আ প্রোবলেম ফ্রম হেল: অ্যামেরিকা অ্যান্ড দ্য এইজ অব জেনোসাইড গ্রন্থের লেখিকা সামান্তা পাওয়ার পৃথিবীর বিভিন্ন গণহত্যার খতিয়ান বের করেছেন। বেস্ট সেলার এই বইটিতে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে নিহত মানুষের সংখ্যা বলা হয়েছে ১০ থেকে ৩০ লাখ।
১৩. বিশিষ্ট রাজনীতিবিজ্ঞানী রুডল্ফ জোসেফ রুমেলের স্ট্যাটিসটিকস অব ডেমোসাইড বইটিকে দাবি করা হয়ে থাকে বিশ্বে গণহত্যা নিয়ে সংখ্যাগতভাবে অন্যতম কমপ্রিহেনসিভ বই। বইটির অষ্টম অধ্যায়ে স্ট্যাটিসটিকস অব পাকিস্তান’স ডেমোসাইড এস্টিমেইটস, ক্যালকুলেশনস অ্যান্ড সোর্সেস নিবন্ধে তিনি দেখিয়েছেন বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের মুক্তির সংগ্রামে ১৫,০৩,০০০ থেকে সর্বোচ্চ সম্ভাবনার ঘরে ৩০,০৩,০০০ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। বিভিন্ন প্রবন্ধে তিনি বিভিন্ন সময় সংখ্যাটা ১৫ লাখ বলেই উল্লেখ করেছেন। অনেকের মনে খটকা লেগে থাকতে পারে যে বেশির ভাগ গবেষকের মতে, সংখ্যাটা ১০ থেকে ১৫ লাখের ভেতরে ঘুরপাক খাচ্ছে। তাদের উদ্দেশে বলছি, গল্পটা এখানেই শেষ হয়নি। শরণার্থী শিবিরে নিহত মানুষের বেশির ভাগ গবেষক গণনায় আনেননি। এক কোটি বিশ লাখ মানুষের স্থানান্তরে প্রচুর মানুষের মৃত্যু অনিবার্য। আমাদের ধারণা অনুসারে কেবল শরণার্থী শিবিরে নিহত মানুষের সংখ্যাই ৬ থেকে ১২ লাখ হতে পারে। এ ছাড়া হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈশ্বিক স্বাস্থ্য এবং জনসংখ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. রিচার্ড ক্যাস বলেছেন:
‘আমরা পাবলিক হেলথের লোক হিসাবে যুদ্ধের সরাসরি প্রাণহানি ছাড়াও কোল্যাটারাল ড্যামেজের দিকে নজর রাখতে চাই এবং এই যুদ্ধের ফলে প্রায় দশ মিলিয়ন মানুষকে ঘরছাড়া হয়ে ভারতে পালাতে হয়েছিল, পাঁচ লাখ মানুষ যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে মারা গিয়েছিল’। এই সব অতিরিক্ত প্রাণহানির দায় কার, সবই ঈশ্বরের লীলা? নাকি যারা এই যুদ্ধ এনেছিল তাদের?’
জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার ও ত্রিশ লাখ শহীদ
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মৃত্যুহার নাটকীয়ভাবে বেড়ে যায়। বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের ওপর জাতিসংঘের রিপোর্ট থেকে জানা যায়, ১৯৫০-৫৫ সালে আমাদের দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ১৪.৬, ১৯৫৫-৬০ সালে ১৫.৩, ১৯৬০-৬৫ সালে ১৫.৩, ১৯৭০-৭৫ সালে হঠাত্ এটা হয়ে যায় ৫.৫, আবার ১৯৭৫-৮০ সালে ১৪.২, ১৯৮০-৮৫ সালে ১৪.৫ এভাবে চলছে।
জাতিসংঘের হিসাবমতে বাংলাদেশের জনসংখ্যা:
সাল ১৯৫০ ১৯৫৫ ১৯৬০ ১৯৬৫ ১৯৭০ ১৯৭৫ ১৯৮০ ১৯৮৫ ১৯৯০
জনসংখ্যা ৩৯৭ ৪৩৪ ৫০১ ৫৭৮ ৬৬৯ ৭০৬ ৮০৬ ৯২৩ ১০৫৩
(লাখ)
বৃদ্ধির হার ১৪.৬ ১৫.৩ ১৫.৩ ১৫.৭ ৫.৫ ১৪.২ ১৪.৫ ১৪.১
(%৫ বছরে)
সত্তর থেকে পঁচাত্তরের ভেতর স্বাভাবিক জন্মহার বিবেচনায় তাহলে হারিয়ে যাওয়া মানুষের সংখ্যা দাঁড়ায় ৬৫ লাখ!
১৯৫০-১৯৭০ সাল পর্যন্ত প্রতি ৫ বছরে
জনসংখ্যা গড়ে ১৫.৩% হারে বৃদ্ধি পেয়েছে
যদি ১৯৭০-১৯৭৫ সালে জনসংখ্যা এই হারে (১৫.৩/৫ বছর)
বৃদ্ধি পেত তাহলে ১৯৭৫ সালে জনসংখ্যা দাঁড়াত ৭৭১ লাখ
অর্থাত্ ১৯৭০-১৯৭৫ সালে আমাদের দেশ থেকে
হারিয়ে যাওয়া মানুষের সংখ্যা ৭৭১-৭০৬ = ৬৫ লাখ
আচ্ছা এই মানুষগুলো কোথায় হারিয়ে গেল। আসুন দেখি উল্লেখযোগ্য কী কী ঘটনা ঘটেছিল এই পাঁচ বছরে, যেটা এত মৃত্যু কিংবা হারিয়ে যাওয়ার কারণ হতে পারে:
১. সত্তরের ঘূর্ণিঝড়
২. চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ
৩. যুদ্ধের পর ভারত থেকে ফিরে না আসা শরণার্থী
৪. একাত্তরের যুদ্ধ + অন্য আনুষঙ্গিক
১. সত্তরের ঘূর্ণিঝড়ে বলা হয়ে থাকে নিহতের সংখ্যা তিন লাখ, যদিও উইকিপিডিয়া অনুসারে সর্বোচ্চ ফিগার ধরা হয় ৫ লাখ। এর বেশি কাউকে আমি দাবি করতে শুনিনি।
২. ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ নিয়ে একটা সামান্য গরমিলের ব্যাপার আছে। ঘটনা হচ্ছে তত্কালীন সরকারের মতে সেই দুর্ভিক্ষে ২৭ হাজার মানুষ মারা যায়, যদিও বিভিন্ন সূত্র অনুসারে সংখ্যাটা মোটমাট ১০ থেকে ১৫ লাখ। আমরা যদি এর মাঝামাঝি একটা সংখ্যা ধরি তাহলে সাড়ে বারো লাখ।৫ এই দুর্ভিক্ষে আসলে মানুষ মারা গিয়েছে অনেক পরে, যেটাকে বলে পোস্ট-ফেমিন। মোট মৃত মানুষের ৫ লাখই এই পোস্ট-ফেমিনে মারা যায়। বলা বাহুল্য এই দুর্ভিক্ষ ৭৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত চলে, সুতরাং পোস্ট-ফেমিনে মৃত মানুষেরা আমাদের টাইম লাইনে পড়বে না। অর্থাত্ আমাদের টাইম লাইনে ৭৪ দুর্ভিক্ষজনিত মৃত মানুষের সংখ্যা বিয়োগ করতে হবে সাড়ে সাত লাখ।
৩. শরণার্থী শিবিরে সত্যিকার অর্থে থেকে যাওয়া মানুষের সংখ্যাটা বের করা আসলে সম্ভব না, যদিও দ্য হিন্দু পত্রিকার৬ প্রতিবেদন থেকে আমরা জানি, ৯২ লাখ শরণার্থী দেশে ফিরেছে ১৯৭২ সালের মার্চের ভেতরেই। এদিকে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট আমাদের বলছে:
‘পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বর্বরোচিত আক্রমণ ও নির্যাতনের শিকার হয়ে বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশী ভারতে গমন করেন। ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকায় ১৪১টি শরণার্থী শিবির স্থাপিত করা হয়। এই শিবিরগুলিকে মোট ৯,৮৯৯,৩০৫ বাংলাদেশী আশ্রয় গ্রহণ করেন। পশ্চিমবঙ্গে ৭,৪৯৩,৪৭৪, ত্রিপুরাতে ১,৪১৬,৪৯১, মেঘালয়ে ৬৬৭,৯৮৬, আসামে ৩১২,৭১৩ ও বিহারে ৮৬৪১ সংখ্যক বাংলাদেশী শরণার্থী আশ্রয় গ্রহণ করেন।’
অর্থাত্ প্রায় সাত লাখ শরণার্থী ফিরে আসেননি।
৪. এই তিন উত্স থেকে আমরা দেখি মোট হারিয়ে যাওয়া/মৃত মানুষের সংখ্যা (৭+৭.৫+৫) অর্থাত্ ১৯.৫ লাখ। এবার আমাদের হাতে থাকা ৬৫ লাখ থেকে বাদ পাচ্ছি ৪৫.৫ লাখ মানুষ নিখোঁজ/ নিহত।
বিহারি হত্যাকাণ্ড আর তত্কালীন রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের সর্বোচ্চ সীমা ধরে হিসাব করে দেখুন সবকিছুর বিবেচনায় শহীদের সংখ্যা কত হয়? যেকোনো সোর্স থেকে মুক্তিযুদ্ধ ছাড়া বাদবাকি প্যারামিটারে সর্বোচ্চ মানগুলো গ্রহণ করলে মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা ত্রিশ লাখের চেয়ে অনেক বেশি।
গাণিতিক হিসাব
এবার আলোচনা করব কিছু গাণিতিক হিসাব নিয়ে। দেখব পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে মাত্র নয় মাসে ত্রিশ লাখ বাঙালিকে মেরে ফেলা আদৌ সম্ভব কি না। কারণ এ ধরনের কথা আমরা হরহামেশাই শুনে এসেছি যে এত কম সময়ে এত বেশি মানুষকে হত্যা করা নাকি অসম্ভব। আমরা এ জন্য তুলনা করব একাত্তর-পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সময়ে বিশ্বব্যাপী ঘটে যাওয়া কয়েকটি যুদ্ধে হতাহতের সংখ্যা, হতাহতের সঙ্গে হত্যাযজ্ঞে লিপ্ত সেনাবাহিনীর অনুপাত, মোট জনগোষ্ঠী হিসেবে ক্ষয়ক্ষতির শতকরা হার ইত্যাদি। ১৯৭১ পৃথিবীতে কিন্তু একবারই এসেছিল, অর্থাত্ আপনি নিশ্চয়ই পৃথিবীতে ১৯৭১ সালের আগে বা পরে এমন কোনো যুদ্ধ আশা করতে পারেন না যে যুদ্ধ ঠিক নয় মাসই টিকেছিল এবং যে যুদ্ধে ঠিক তিন মিলিয়ন মানুষই মারা গিয়েছিল বিরানব্বই হাজার অ্যাকটিভ সৈন্য এবং লাখ খানেক প্যারামিলিটারি আলবদর রাজাকারদের হাতে। আমরা হয়তো এ রকম যুদ্ধ পাব, যেখানে যুদ্ধটা আরও কম অথবা বেশি সময় টিকেছে, কিন্তু প্রতি মাসে বাংলাদেশের চেয়ে বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। আবার হয়তো এমন যুদ্ধ পাব যেখানে মোট জনগোষ্ঠীর শতকরা হিসেবে আমাদের চেয়ে বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, কিন্তু প্রতিদিনের হত্যাকাণ্ডের হার হয়তো আমাদের চেয়ে কম। আবার এমন যুদ্ধ পাওয়া যাবে, যেখানে কম সৈনিকের হাতে বেশি গড়ে আমাদের চেয়ে বেশি মানুষের হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। এভাবে যুদ্ধগুলো তুলনা করলেই বোঝা যাবে আমাদের দেশে মৃতের সংখ্যায় কি অতিরঞ্জন করা হয়েছে, নাকি এটা একটা স্বাভাবিক ধারণা।
প্রথমেই আমাদের জানা দরকার ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সৈনিকের সংখ্যা কত। অনেকের কাছেই তিরানব্বই হাজার অ্যাকটিভ সেনাবাহিনীর ব্যাপারটা তো মীমাংসিত। আসলে ব্যাপারটা নিয়েও আজকাল বিতর্ক সৃষ্টি করার চেষ্টা করছে একটি চক্র। ভারতীয় লেখিকা শর্মিলা বোস, পাকিস্তানের জেনারেল নিয়াজিসহ অনেকেই ৯৩,০০০ সৈন্যের ব্যাপারে আপত্তি জানিয়েছেন। তিনি তাঁর ডেড রেকনিং বইতে লিখেছেন:
‘১৯৭১ সালের মার্চ মাসে পাকিস্তানে সৈনিক সংখ্যা ছিল ১২,০০০। সংকট মোকাবেলায় আরও সৈন্য আনা হয়েছিল ১৯৭১ সালের এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত। পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের কমান্ডার লে জে এ এ কে নিয়াজি এ ব্যাপারে লিখেছেন, আমার হাতে মোট সৈনিক বা যোদ্ধা ছিল ৪৫,০০০। এর মাঝে ৩৪,০০০ ছিল সেনাবাহিনী থেকে ও এগারো হাজার সিএএফ (সিভিল আর্মড ফোর্সেস এবং প্যারামিলিটারি) ও পশ্চিম পাকিস্তানি বেসামরিক পুলিশ ও অস্ত্রধারী নন-কমব্যাট্যান্টস। ৩৪,০০০ নিয়মিত সেনার মধ্যে ২৩,০০০ ছিল পদাতিক বাহিনীর সৈন্য, বাকিরা ছিল সাঁজোয়া, গোলন্দাজ, ইঞ্জিনিয়ারিং, সিগন্যালস ও অন্যান্য সহায়ক বাহিনী।’
শর্মিলা এরপর পাঠকের কাছে প্রশ্ন রাখেন, ‘তাহলে কীভাবে ৩৪,০০০ সেনাসদস্য ও ১১,০০০ বেসামরিক পুলিশ ও অন্যদেরসহ মোট ৪৫,০০০ সদস্যের বাহিনীর দ্বিগুণেরও বেশি ৯৩,০০০ সৈন্য হয়ে ডিসেম্বর মাসে ভারতে যায় যুদ্ধবন্দী হিসেবে?’
তাঁর মতে, বারবার যে ৯৩,০০০ পাকিস্তানি সৈন্যের কথা বলা হচ্ছে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে, তা সঠিক নয় এবং এভাবে পূর্ব পাকিস্তানের সেনা শক্তিকে অনেকখানি বাড়িয়ে বলে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা হয়েছে। কিন্তু ১৯৭১ সালের আন্তর্জাতিক সংবাদপত্রগুলো কিন্তু সে কথা বলে না। একাত্তরজুড়ে আন্তর্জাতিক সংবাদপত্রগুলোতে বারবারই উঠে এসেছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সংখ্যা বৃদ্ধির কথা। কিছু প্রতিবেদনের বিবরণ একটু দেখে আসা যাক:
১. টাইমস ১৫ মার্চ ১৯৭১ বলছে বর্তমান সৈন্যসংখ্যা ৬০,০০০
২. লন্ডন থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ইকোনমিস্ট পত্রিকা ৩ এপ্রিল ১৯৭১ তাদের প্রতিবেদনে সৈন্যসংখ্যা উল্লেখ করেছে ৭০ হাজার
৩. টাইমস পত্রিকা ৫ এপ্রিল ১৯৭১ লিখেছে বর্তমান সৈন্যসংখ্যা ৮০ হাজার
৪. সিঙ্গাপুরের দ্য নিউ নেশন পত্রিকা ৬ এপ্রিল ১৯৭১ সৈন্যের সংখ্যা উল্লেখ করেছে ৭০ হাজার।
৫. ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউ ২৫ আগস্ট ১৯৭১ লিখছে সৈন্যসংখ্যা এখন ১ লাখ।
প্রশ্নটা হচ্ছে, কেন বারবার একটি মহল থেকে এই নিষ্পত্তি হওয়া পাকিস্তানি ৯৩,০০০ যুদ্ধবন্দীর সংখ্যা কমিয়ে ২০-২৫ হাজারে নিয়ে আসার একটা তীব্র প্রচেষ্টা আমরা লক্ষ করছি? কী তাদের স্বার্থ? এককথায় উত্তর খুবই সহজ, সৈনিক সংখ্যা কম দেখানো সম্ভব হলে যুদ্ধে ক্ষয়ক্ষতি, হতাহত, ধর্ষণের সংখ্যা কমিয়ে দেখানো যাবে। সৈন্যসংখ্যা কম হলে জনপ্রতি খুন/ধর্ষণের হার বেড়ে যায়। আর তখন সেটাকে অবাস্তব বলে উড়িয়ে দেওয়া যায়।
বধ্যভূমি
আমরা জানি আমাদের দেশে বিভিন্ন সময়ে ৩৫টি স্থানকে বধ্যভূমি হিসেবে চিহ্নিত করে সেগুলো সংরক্ষণ করা হচ্ছে সরকারিভাবে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় মোট কতগুলো বধ্যভূমি আছে সেটা এখন পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট করা সম্ভব হয়নি। তবে ওয়্যার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং (ডব্লিউসিএফসি) এ দেশে প্রায় ৯৪২টি বধ্যভূমি চিহ্নিত করেছে। তারা জানিয়েছে, এই সংখ্যাটা এখানেই শেষ হয়নি। এর মধ্যে কেবল চট্টগ্রামেই আছে ১১৬টি। এ ছাড়া দেশের আনাচকানাচে সংরক্ষণের অভাবে হারিয়ে গেছে আরও অগণিত বধ্যভূমি। এর মধ্যে চট্টগ্রামের পাহাড়তলী বধ্যভূমি স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদের আহ্বায়ক প্রফেসর ড. গাজী সালেহ উদ্দিন৭ জানান, স্বাধীনতার পর এ বধ্যভূমির শুধু একটি গর্ত থেকেই প্রায় ১ হাজার ১০০ মাথার খুলি উদ্ধার করা হয়। সংগৃহীত কঙ্কাল এখনো সংরক্ষিত রয়েছে চট্টগ্রাম সেনানিবাসের স্মৃতি অম্লান জাদুঘরে। একাত্তরের এপ্রিল থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত এখানে ২০ হাজারের মতো বাঙালিকে হত্যা করা হয়েছে। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধকালে ঢাকায় হত্যা করে রায়েরবাজারে এনে ফেলে রাখা হতো। আর চট্টগ্রামে লোকজনদের ধরে এনে হত্যার কাজটি চলত পাহাড়তলীতে। যেখানে বধ করা হয় সেটাই বধ্যভূমি। সে হিসেবে পাহাড়তলী বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বদ্ধভূমি। ড. সুকুমার বিশ্বাস, স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্রের অন্যতম গবেষক। বাংলা একাডেমিতে কর্মরত অবস্থায় ১৯৭২ থেকে ১৯৭৪ পর্যন্ত তিনি সারা দেশে ঘুরেছেন এবং একাত্তরের বধ্যভূমি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করেছেন। তাঁর অনেক লেখায় তিনি বলেছেন, রাজশাহীর একটি বধ্যভূমিতে একশটি গণকবর থেকে দশ হাজার মানুষের কঙ্কাল উদ্ধার করা হয়। গল্লামারী বধ্যভূমি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের একেবারে পাশেই অবস্থিত। একাত্তরে খুলনা শহর মুক্ত হওয়ার পর গল্লামারী খাল ও এর আশপাশের স্থান থেকে প্রায় পাঁচ ট্রাক ভর্তি মানুষের মাথার খুলি ও হাড়গোড় পাওয়া যায়। ধারণা করা হয়, ওই স্থানে আনুমানিক ১৫০০০ মানুষ হত্যা করা হয়। বরিশাল সদরের পানি উন্নয়ন বোর্ডসংলগ্ন কীর্তনখোলা তীরে সরকারিভাবে স্তম্ভ নির্মিত বধ্যভূমিতে হত্যা করা হয় এক থেকে দেড় হাজার লোক। এ রকম অনেক অনেক আছে অথচ রায়েরবাজার এবং জল্লাদখানার মতো বিখ্যাত বধ্যভূমির মোট লাশের সংখ্যা কখনোই নির্ণয় করা সম্ভব হবে না। তারপরও আমরা যদি না পাওয়া বধ্যভূমির কথা হিসাব করে সর্বসাকল্যে মোট ১০০০ বধ্যভূমির সংখ্যা ধরে নিই এবং প্রতি বধ্যভূমিতে ১০০০ করে লাশ থাকলে তাহলেই বধ্যভূমিতে মোট প্রাণ হারানো বাঙালির সংখ্যা হয় ১০ লাখ। এ ছাড়া নদীমাতৃক দেশে হাজার হাজার মানুষকে নদীর পাড়ে নিয়ে এসে হত্যা করা হয়েছে, এ রকম চাক্ষুস তথ্য আমাদের দিয়েছেন সাবসেক্টর কমান্ডার রুহেল আহমেদ চৌধুরী। তাঁর ব্যক্তিগত মতে, ‘তিরিশ লক্ষ শহীদ একটা মুখের কথা, বিলিভ মি সংখ্যাটা চল্লিশ লাখ ছাড়িয়ে গেলেও আমি অবাক হব না। আই ওয়াজ দেয়ার অ্যান্ড আই প্রক্লেইম দ্যাট।’৮
এ পর্যায়ে এসে আমাদের সবার জানা কিছু উপাত্তের বিষয়ে সত্যতা নিশ্চিত করি। আমরা জানি, একাত্তরে বাংলার জনসংখ্যা ছিল ৭ কোটি ৫০ লাখ। পাকিস্তানি বাহিনী মোট আত্মসমর্পণকৃত সদস্যসংখ্যা ৯২ থেকে ৯৩ হাজার এবং মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে মোট ২৬৬ দিন। এবার একটু ক্যালকুলেটর নিয়ে বসি। যদি, আমরা ধরি শহীদের সংখ্যা ৩ লাখ, তাহলে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতি সদস্যকে প্রতিদিন হত্যা করতে হয় ৩ লক্ষ/৯২ হাজার/২৬৬ দিন = ০.০১২২৫৮৯০৮১৩ জনকে। অর্থাত্ প্রতিদিন শহীদ হয়: ৩০০,০০০/২৬৬=১,১২৮ জন। আর যদি, শহীদের সংখ্যা ধরি ৩০ লক্ষ, তাহলে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতি সদস্যকে প্রতিদিন হত্যা করতে হয় ৩ লক্ষ/৯২ হাজার/২৬৬ দিন = ০.১২২৫৮৯০৮১৩ জনকে। অর্থাত্ প্রতিদিন শহীদ হয় ৩০০০০০০/২৬৬= ১১২৭৮.১৯৫৪৮৮৭ জন।
একটু লক্ষ করুন, আগেই বলেছি, জাতিসংঘের দেওয়া তথ্য অনুসারে৯ ১৯৬৫ থেকে ১৯৭০ সালে প্রতিবছর আমাদের দেশে গড়ে ১১ লাখ মানুষ স্বাভাবিকভাবেই মৃত্যুবরণ করে। সে হিসেবে গড়ে প্রতিদিন ৩০১৩ জন মানুষ মারা যেত স্বাভাবিক অবস্থায়ই, একটা বিরাট যুদ্ধের মধ্যে আমরা যদি দাবি করি প্রতিদিন ১,১২৮ জন মারা যাচ্ছে তাহলে সেটা হাস্যকরই মনে হয়। মৃত্যুহারের বিবেচনায় ১১,২৮০ অর্থাত্ ৩০ লাখই বেশি যুক্তিযুক্ত বলে মনে হয়। আগেই উল্লেখ করেছি, ১৯৮১ সালে জাতিসংঘ সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার ৩৩তম বছর উপলক্ষে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন মতে, মানব ইতিহাসে যত গণহত্যা হয়েছে এর মধ্যে বাংলাদেশের ১৯৭১-এর গণহত্যা স্বল্পতম সময়ে সর্ববৃহত্ সংখ্যা। গড়ে প্রতিদিন ৬০০০ থেকে ১২০০০ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। দেখা যায় যে ২৫ মার্চ ১৯৭১ থেকে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, এই মোটামুটি ২৬০ দিনে দিনপ্রতি ৬০০০-১২০০০ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। এই তথ্যটি দিয়ে একটু হিসাব করলে দেখা যাবে হত্যার সর্বনিম্ন সংখ্যা: ৬০০০ ঢ ২৬০=১৫,৬০০০০ (পনের লাখ ষাট হাজার) এবং সর্বোচ্চ সংখ্যা: ১২০০০ ঢ ২৬০=৩১,১২০০০ (একত্রিশ লাখ বারো হাজার)। আমরা যদি এই পরিসংখ্যানের মাঝামাঝি ধরে হিসাব করি তাহলে এ সময় মৃত্যুর সংখ্যা ২৩,৪০০০০ (তেইশ লাখ চল্লিশ হাজার)। এখন, একাত্তরে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিল প্রায় সাত কোটি পঞ্চাশ লাখ। প্রতি পরিবারে সদস্যসংখ্যা ৫ জন করে ধরলে পরিবার সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ১ কোটি পঞ্চাশ লাখ। তাহলে প্রতি পরিবারে মারা গিয়েছে প্রায় ০.১৬ জন, অর্থাত্ ১৯৭১-এ শতকরা ১৬% পরিবারের কেউ না কেউ মুক্তিযুদ্ধে মারা গিয়েছিল। এখানে অন্তত শব্দটা ব্যবহার করা হয়েছে, কারণ এমন অনেক পরিবার আছে যারা মুক্তিযুদ্ধে একাধিক সদস্য হারিয়েছে, একইভাবে বলা যায় এমন পরিবারও আছে যারা কোনো সদস্য হারায়নি। আবার একই সঙ্গে এটাও বলা যায়, কোনো কোনো পরিবার পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। একটা বিষয় লক্ষ করবেন, এই পরিবারগুলো একাত্তরের পরিবার, আজকে ২০১৪ সালের পরিবার নয়। ২০১৪ সালের হিসাবে এখন একাত্তর-পরবর্তী তৃতীয় প্রজন্ম। সহজ ভাষায় বললে একাত্তরের পরিবার থেকে তার পরবর্তী পরিবার এবং সেই পরিবারের পরবর্তী পরিবার এখন চলছে। অর্থাত্ এখনকার শতকরা ষোলটা পরিবারে আপনি একাত্তরের ভিকটিম পাবেন না। আপনাকে যেতে হবে আপনার দাদার পরিবারে, দাদার পরিবারের ভেতর দাদার ভাই-বোনও বিবেচনায় আসবে (তিরিশ-ঊর্ধ্বদের ক্ষেত্রে বাবার পরিবার)। আপনার দাদার-বাবার পরিবারের সাপেক্ষে বিবেচনা করে দেখুন একশ পরিবারে শহীদের খোঁজ পান কি না।
বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রে গণহত্যা
আমরা এখন অন্যান্য রাষ্ট্রের গণহত্যার খতিয়ান হাজির করব। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে, যে গাণিতিক যুক্তি আগে হাজির করা হয়েছে ঐতিহাসিক বাস্তবতার নিরিখে সেই দাবিটা পর্যালোচনা করা। মূলত এটাই প্রকৃত গবেষণার পদ্ধতি। আমরা ইতিহাসের যে গণহত্যা নিয়ে আলোচনা করব সে গণহত্যার নির্মমতা আর ভয়াবহতা বাংলাদেশকেও ছাড়িয়েছে।
কম্বোডিয়া: এখন আমরা তুলনা করে দেখব যে ১৯৭৫-১৯৭৯ সালের মধ্যে কম্বোডিয়ার খেমাররুজরা যে গণহত্যা চালিয়েছিল তার সঙ্গে ১৯৭১-এর গণহত্যার। কম্বোডিয়ায় খেমাররুজরা ক্ষমতায় ছিল চার বছর, ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত। এই চার বছরে তারা হত্যা করেছে প্রায় ১৭ থেকে ৩০ লাখ মানুষ। হ্যাঁ, অনেকে বলতে পারেন কোথায় চার বছর আর কোথায় ২৬০ দিন, তারপরও তো কম্বোডিয়ার গণহত্যা ৩০ লাখ ছাড়ায়নি। যাঁরা এ রকম ভাবছেন তাঁদের বলি, দাঁড়ান, একটু ধৈর্য ধরুন। তখন কম্বোডিয়ার জনসংখ্যা বাংলাদেশের মতো সাড়ে সাত কোটি ছিল না, খেমাররুজরা ক্ষমতায় যাওয়ার সময় কম্বোডিয়ার জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৭৬ লাখ। তাহলে ভাবুন, ৭৬ লাখের মধ্যে ১৭-৩০ লাখকে মেরে সাফ করে ফেলেছে!
১৯৭৪-৭৫ সালে কম্বোডিয়ায় ১৫ লাখ ২০ হাজার পরিবারের বসবাস ছিল। কাজেই প্রত্যেক পরিবারে মারা গিয়েছে ১.১৮ জন করে, যেখানে বাংলাদেশের হিসাবটা ছিল ০.১৬। তাহলে বলতে হয় গড়ে কম্বোডিয়ার প্রত্যেক পরিবারই কাউকে না কাউকে হারিয়েছে, যা বাংলাদেশে ঘটেনি। জনসংখ্যার ২২ ভাগ মানুষের মৃত্যু নিশ্চিত করতে খেমাররুজরা সময় নিয়েছিল ৪৮ মাস (৪–১২=৪৮), তাহলে সেই হারে জনসংখ্যার ৪ ভাগ নিশ্চিহ্ন করতে খেমাররুজদের সময় লাগত সাড়ে আট মাস। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে কাজ পাকিস্তানি বাহিনী নয় মাসে করেছে, খেমাররুজরা প্রায় সাড়ে আট মাসেই সেটা করতে পারত। তুলনামূলকভাবে খেমাররুজরা পাকিস্তানি বাহিনীর চেয়ে অনেক বেশি নৃশংস ছিল, আগেই বলা হয়েছে কম্বোডিয়ায় এক পরিবারে মারা গিয়েছিল ১.১৮ জন, যেখানে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে হিসাব ০.১৬, সুতরাং খেমাররুজরা পাকিস্তানি বাহিনীর তুলনায় ৭ গুণেরও বেশি নৃশংস ছিল (১.১৮/০.১৬)। অথচ কম্বোডিয়ার গণহত্যার ফিগার নিয়ে কিন্তু এত বিতর্ক হয়নি আজও।
নাইজেরিয়া: ৬ জুলাই ১৯৬৭ থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৭০ সাল পর্যন্ত চলা নাইজেরিয়ার যুদ্ধের দিকে এবার একটু আলোকপাত করব। প্রায় আড়াই বছর স্থায়ী এ যুদ্ধে প্রায় ত্রিশ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। নাইজেরিয়ার অচল অবস্থায় ‘ইগবো’ নিয়ন্ত্রিত মিলিটারি বাহিনী দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমের তেলসমৃদ্ধ অঞ্চল ‘বায়াফ্রা’কে ৩০ মে ১৯৬৭ সালে ‘দ্য রিপাবলিক অব বায়াফ্রা’ নামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করে। কেবল পাঁচটি দেশ বায়াফ্রাকে একটি নতুন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে চিহ্নিত করেছিল। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, তাদের আন্দোলন আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের মতো ছিল না মোটেও। যুদ্ধে হতাহত এই ত্রিশ লাখ জনগোষ্ঠী আবার আমাদের মতো একই গোত্রের বা অঞ্চলের ছিল না, বিভিন্ন অঞ্চলে মোট হতাহতের সংখ্যা ছিল এটা। ব্রিটিশ শাসনামলের পর ১৯৬০ সালে স্বাধীনতার পর কার্যত তিন ভাগে ভাগ হয়ে যায় দেশটি এবং তাঁর পরিণতিতেই এই গৃহযুদ্ধের সূচনা হয়। যদিও ‘বায়াফ্রা’ নামক রাষ্ট্রটির পতন ঘটে, তারপরও বিশ্ব গণহত্যার মানচিত্রে নাইজেরিয়ার গৃহযুদ্ধের কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সব মিলিয়ে এই যুদ্ধে উভয় পক্ষের সক্রিয় সৈন্য ছিল ৩৫,০০০ থেকে ৭৫,০০০। তাহলে সর্বনিম্ন এবং সর্বোচ্চ যেকোনো হিসাবের সৈনিক সংখ্যাকে বিবেচনায় নিয়ে নাইজেরিয়ার গৃহযুদ্ধ থেকে পরিষ্কারভাবে বলা যায়, ৯০ হাজারের কম সৈনিক নিয়ে ত্রিশ লক্ষাধিক মানুষকে মেরে ফেলা অসম্ভব কিছু নয়।
রুয়ান্ডা: রুয়ান্ডা গণহত্যার কথা আমরা সবাই জানি, কারণ রুয়ান্ডা তাদের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাজ শুরু করতে পেরেছে আমাদেরও আগে, রুয়ান্ডায় যে মূল দুই গোষ্ঠীর অস্তিত্ব আছে তারা হচ্ছে হুতু ও তুতসি। সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায় হুতু এবং তুতসিরা সংখ্যালঘু। ১৮৯৪ সালে জার্মানরা রুয়ান্ডা দখল করে নেওয়ার পর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তা বেলজিয়াম দখলে নেয়। রুয়ান্ডা দখলের পর তারা তুতসিদের রুয়ান্ডার ক্ষমতায় বসায়। রুয়ান্ডায় ব্যবসা-বাণিজ্য এই তুতসিরা নিয়ন্ত্রণ করত। ১৯৬২ সালে বেলজিয়ানরা রুয়ান্ডা ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় ক্ষমতা চলে যায় সংখ্যাগুরু হুতু সম্প্রদায়ের কাছে। এবার হুতুরা তুতসিদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে যায়। এ অবস্থা দিন দিন বাড়তে থাকে। ১৯৯৪ সালের ১৭ এপ্রিল এই দ্বন্দ্ব গৃহযুদ্ধে রূপ নেয় এবং ১৯৯৪ সালের জুলাইয়ের মাঝামাঝি পর্যন্ত চলতে থাকে। মাত্র ১০০ দিনের যুদ্ধে হুতুরা প্রায় ১০ লাখ তুতসি হত্যা করে। যা ছিল পুরো দেশের জনসংখ্যার ২০ ভাগ। এই যুদ্ধ থেকে আমরা দেখি মাত্র ১০০ দিনে দশ লাখ মানুষকে মেরে ফেলা খুবই সম্ভব। যেটা আমাদের দেশে সংগঠিত গণহত্যার প্রায় সমান। আমরা জানি পাকিস্তানি বাহিনী তাদের সংগঠিত অভিযানে ২৬৬ দিনে ত্রিশ লক্ষাধিক বাঙালিকে হত্যা করে। এর সঙ্গে সঙ্গে রুয়ান্ডার গণহত্যা থেকে আমরা আরও দেখতে পাই, ১০০ দিনের ভেতরে একটি দেশের মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশ শেষ করে ফেলে অর্ধশিক্ষিত বর্বর একটি সেনাবাহিনী। সুতরাং ২৬৬ দিনে একটি জনগোষ্ঠীর সাড়ে সাত কোটি মানুষের মধ্যে ত্রিশ লাখ অর্থাত্ ৪ শতাংশ মেরে ফেলা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম যুদ্ধবাজ একটি সেনাবাহিনীর পক্ষে অসম্ভব কিছু নয়।
চীন: নৃশংস হত্যাকাণ্ডের কথা এলে সবাই ‘দ্য ন্যানকিং ম্যাসাকার’ কিংবা ‘রেইপ অব ন্যানকিং’-এর কথা বলে থাকে। ১৯৩৭ সালের ১৩ ডিসেম্বর থেকে ১৯৩৮ সালের জানুয়ারির শেষ সময়ের ভেতর জাপানি সেনাবাহিনী চীনের রাজধানী ন্যানকিন শহরটিকে একদম গুঁড়িয়ে দেয়। প্রচুর পরিমাণে ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ড এবং লুটতরাজ চলতে থাকে। শেষে হিসাব করে দেখা যায়, এই অল্প সময়ে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ। বলা হয়ে থাকে সেই যুদ্ধে এক তলোয়ারে ১০০ মানুষকে জবাই করা হতো। এই হত্যার বিচারের উদ্দেশ্যে ১৯৪৬ সালে গঠিত হয় ‘ন্যানকিন ওয়ার ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল’। জাপানের এই হত্যাকাণ্ড থেকে আমরা দেখতে পাই এক মাসেরও কম সময়ে কীভাবে একটি জনগোষ্ঠীর প্রায় তিন লাখ মানুষকে মেরে ফেলা সম্ভব।
আর্মেনিয়া: আর্মেনিয়া ইউরোপের একটি রাষ্ট্র। জর্জিয়া ও আজারবাইজানের সঙ্গে এটি দক্ষিণ ককেশাস অঞ্চলে কৃষ্ণসাগর ও কাস্পিয়ান সাগরের স্থল যোজকের ওপর অবস্থিত। ইয়েরেভান দেশটির রাজধানী ও বৃহত্তম শহর। জাতিগত আর্মেনীয়রা নিজেদের হায় বলে থাকে। আর্মেনিয়ার ৯০ শতাংশ লোক এই ‘হায়’ জাতির লোক। ১৯২২ সালে এটি সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত হয় এবং ১৯৯১ সালে রাষ্ট্রটি স্বাধীনতা লাভ করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তুর্কিরা আর্মেনীয়দের ওপর নির্বিচারে গণহত্যা চালায়। একটি রাষ্ট্রে কোনো ধর্মীয় সম্প্রদায়কে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক ধরে নিলে তাদের ওপর গণহত্যার সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধে হয়। ১৯১৫ সালের আর্মেনীয় গণহত্যা তারই উজ্জ্বল প্রমাণ। ষাটের দশকে আমরাও ছিলাম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর চোখে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। সামরিক রাষ্ট্র অটোমানদের সঙ্গে পাকিস্তানের অনেক মিল। তিন বছর ধরে চলা এই গণহত্যায় সেই দেশে ১৫ লাখ মানুষ মারা যায়। সে সময় আর্মেনিয়ার জনসংখ্যা ছিল মাত্র ৪৩ লাখ। তার মানে এই যুদ্ধে ৩৪ শতাংশ জনগোষ্ঠী নিঃশেষ হয়ে যায় তিন বছরে। আর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আমাদের জনগোষ্ঠীর ৪ শতাংশকে হত্যা করে নয় মাসে। আর্মেনিয়ার হত্যাকাণ্ড থেকেও বোঝা যায়, জনসংখ্যার শতকরা হারে আমাদের গণহত্যাকেও ছাড়িয়ে যায় আর্মেনিয়ার গণহত্যা।
এ রকম আরও অনেক আছে। আমি কেবল দৈবচয়নে গণহত্যা হয়েছে এমন কয়েকটি দেশ নির্বাচিত করেছি এবং এই অল্প কয়েকটি দেশে চলা গণহত্যাকে পর্যবেক্ষণ করে দেখেছি আমাদের গণহত্যা নির্মমতার দিক দিয়ে অন্যতম হলেও পৃথিবীময় চলা বিভিন্ন গণহত্যায় এই শতকেই আমাদের গণহত্যাকেও ছাড়িয়েছে অনেক দেশ। সাধারণ জনগণের ওপর রাষ্ট্রীয় হত্যাযজ্ঞের যে নির্মমতর নজির বর্বর তুর্কিরা, খেমাররুজরা, হুতুরা কিংবা পাকিস্তানিরা স্থাপন করেছে সে ক্ষত পুষিয়ে যুদ্ধহীন একটা সমাজ তৈরি করে নিতে এই জাতিগুলোর আরও সময় প্রয়োজন।
শরণার্থী শিবিরে নিহত: শহীদ নাকি মৃত
কথাসাহিত্যিক অদিতি ফাল্গুনীর বড় ভাই শরণার্থী শিবিরে মারা যান। অদিতি জানিয়েছেন তখন তাঁর বড় ভাই অনেক ছোট ছিল। শরণার্থী শিবিরে পর্যাপ্ত খাদ্যের অভাবে তাঁর বড় ভাইয়ের মৃত্যু ঘটে। জানতে চেয়েছিলাম, আপনি কি শরণার্থী শিবিরে নিহত আপনার বড় ভাইকে ৩০ লাখ শহীদের অন্তর্ভুক্ত মনে করেন? তিনি বললেন, ‘আমি শহীদই মনে করি, তাঁর মৃত্যুর জন্য পাক আর্মিই দায়ী। আমার আরেক বড় ভাই তাঁর বয়স তখন চার, মাইলের পর মাইল বাবা-মার সাথে হাঁটতে হাঁটতে বলত ‘বাবা পাক আর্মি কখন আসবে? ওরা কখন গুলি করবে? আমাদের গুলি করে না কেন?’ সে ভাবত গুলি করাটা বোধ হয় কোনো মজার খেলা। তিনি এখন একজন কবি এবং স্থপতি, কানাডায় থাকেন। তাঁর নাম তুষার গায়েন’।১০
শরণার্থী শিবিরে নিহত ভাগ্যহত মানুষগুলো কি মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হিসেবে গণ্য হবেন কি না সে ব্যাপারে দ্বিমত আছে। যদিও সেসব নিহত মানুষদের আত্মীয়স্বজনেরা তাঁদের শহীদই মনে করেন, কারণ এই মৃত্যুর জন্য কোনো বুলেট না লাগলেও এই মৃত্যু ঘটেছিল পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মমতার কারণে। এই নিবন্ধে আমরা দেখব শরণার্থী শিবিরে শরণার্থী হয়ে যাওয়া মানুষের সংখ্যা কত আর তাদের মাঝে শহীদ হয়েছিল কত। আমাদের দেশের মানুষদের কাছে দেশ ছেড়ে শরণার্থী শিবিরে চলে যাওয়া মানুষদের সংখ্যাটা নিয়ে তেমন কোনো দ্বিমত নেই। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট থেকে জানা যায় শরণার্থীদের একেবারে সঠিক পরিসংখ্যান। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে:
‘পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বর্বরোচিত আক্রমণ ও নির্যাতনের শিকার হয়ে বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশী ভারতে গমন করেন। ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকায় ১৪১টি শরণার্থী শিবির স্থাপিত করা হয়। এই শিবিরগুলিকে মোট ৯,৮৯৯,৩০৫ বাংলাদেশী আশ্রয় গ্রহণ করেন। পশ্চিমবঙ্গে ৭,৪৯৩,৪৭৪, ত্রিপুরাতে ১,৪১৬,৪৯১, মেঘালয়ে ৬৬৭,৯৮৬, আসামে ৩১২,৭১৩ ও বিহারে ৮৬৪১ সংখ্যক বাংলাদেশী শরণার্থী আশ্রয় গ্রহণ করেন।’
কিন্তু ৭১ সালে ইয়াহিয়া খান শরণার্থীদের সংখ্যা নিয়ে প্রচণ্ড মিথ্যাচার করেন। নিউজউইক-এর জ্যেষ্ঠ সম্পাদক আর্নড দ্য বোর্চগ্রেভ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার একটি সাক্ষাত্কার নেন। সাক্ষাত্কারটি তাত্ক্ষণিকভাবে ইন্টারন্যাশনাল হেরাল্ড ট্রিবিউনসহ অনেক পত্রিকায় অনূদিত হয়। সেখানে শরণার্থী ইস্যুতে খোলাখুলি আলোচনা করা হয়। সাক্ষাত্কারটির চুম্বক অংশ তুলে ধরছি পাঠকের উদ্দেশে:
‘প্রশ্ন : এখনো প্রতিদিন ২০,০০০ থেকে ৩০,০০০ শরণার্থী পূর্ব পাকিস্তান সীমান্ত পেরিয়ে ভারত চলে যাচ্ছে—এটাকে আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
উত্তর : না, তারা যাচ্ছে না। এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা। যেভাবে ভারতীয়রা গোলা নিক্ষেপ করছে সীমান্তবর্তী মানুষদের এমনিতেই প্রাণের ভয়ে ছুটোছুটি করতে হচ্ছে। সীমান্ত চীনের প্রাচীরের মতো নয়। সীমান্তে চিহ্ন নেই। ভারতীয়রা বিদেশি সাংবাদিকদের ভারতের ভেতরের ভূখণ্ড দেখিয়ে বলে এটাই সীমান্ত।
প্রশ্ন : মাত্র কয়েক মাসে ৯০ লাখ মানুষ কীভাবে নিজের দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়?
উত্তর : সংখ্যাটা আমি মানতে নারাজ। ২০ থেকে ৩০ লাখ হতে পারে। নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক দিয়ে গুনলে ৪০ লাখও পাওয়া যেতে পারে।’
ইয়াহিয়া খানের এই চরিত্র অজানা নয় আমাদের। যুদ্ধের সময়ে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কম দেখানোর জন্য এরা মরিয়া হয়ে ছিল। আপনারা হয়তো জানেন, মুক্তিযুদ্ধের পর পাকিস্তানে গঠিত হামুদুর রহমান কমিশন রিপোর্ট প্রকাশ করে, যুদ্ধের সময় বাংলাদেশে নিহত মানুষের সংখ্যা ২৬,০০০। ত্রিশ লাখকে যারা ছাব্বিশ হাজার বানিয়ে দিতে পারে, তারা এক কোটি শরণার্থীকে ২০ থেকে ৩০ লাখ বললে আমরা বরং একটু অবাক হই, এতটা বড় ফিগার তারা স্বীকার করে নিল কী করে!
আসলে ইয়াহিয়া খানের হাতে আর কোনো উপায়ও ছিল না। ৭১ সালে সমগ্র পৃথিবীর দৃষ্টি ছিল আমাদের দিকে। বিশ্বময় সংবাদপত্রগুলোতে একবার চোখ বুলিয়ে আসলে যেকোনো মানুষ স্বীকার করতে বাধ্য হবে ১৯৭১ সালে ভারতে বাঙালি শরণার্থীর সংখ্যা ছিল এক কোটি কিংবা তার চেয়েও বেশি। মুক্তিযুদ্ধকালীন বিশ্বময় প্রকাশিত দেড় শতাধিক পত্রিকা থেকে আসুন একটু খুঁজে বের করার চেষ্টা করি শরণার্থীদের প্রকৃত সংখ্যা। প্রতিটি রিপোর্ট একটা একটা করে পড়ে দেখা অসম্ভব, সে জন্য আমি সবগুলো প্রতিবেদন থেকে আমাদের প্রয়োজনীয় সংখ্যাটি আলাদা করে বের করেছি। একটা কথা খেয়াল রাখবেন, সমস্ত শরণার্থী কিন্তু এক দিনেই ভারতে পাড়ি জমাননি, আর তাই সংখ্যাটা বেড়েছে ক্রমান্বয়ে।
- ডেইলি টেলিগ্রাম ৩০ মার্চ ১৯৭১ লিখেছে; ২৫ মার্চ ১৫,০০০ মানুষ দেশ ছেড়ে পালায়।
- নিউইয়র্ক টাইমস-এর ২৪ মে ১৯৭১ সালের তাদের পত্রিকায় বলেছে, এখন ভারতে শরণার্থী সংখ্যা ১৫ লাখ।
- একই পত্রিকা ৬ জুন ১৯৭১ লিখেছে ২০ লাখ।
- এরপর একই পত্রিকার ১৩ জুন ১৯৭১ সালের সংখ্যায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানিয়েছে ৫০ লাখ।
- সাপ্তাহিক ইকোনমিস্ট বলেছে প্রতিদিন ৬০,০০০ মানুষ পালাচ্ছে।
- দ্য স্পেক্টেটর তাদের পত্রিকায় ১৯ জুন ১৯৭১ বলছে ৫০ লাখ।
- সানডে টাইমস ২০ এবং ২১ জুন ১৯৭১ লিখেছে ৬০ লাখ
- ইকোনমিস্ট নিউজউইক ২৬ জুন বলেছে ৬০ লাখ।
- ওয়াশিংটন ডেইলি নিউজ ৩০ জুন ১৯৭১ লিখেছে ৬০ লাখ।
- দ্য পালাভার উইকলি ৮ জুন ১৯৭১ বলেছে প্রতিদিন ৫০,০০০ মানুষ দেশ ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে।
- ১৭ জুলাই ১৯৭১ ইকোনমিস্ট বলছে ৬৮ লাখ।
- হেরাল্ড ট্রিবিউন ৯ আগস্ট ১৯৭১ বলেছে শরণার্থী এখন ৭০ লাখ।
- কাইহান ইন্টারন্যাশনাল ২ আগস্ট ১৯৭১ রিপোর্ট করেছে ৭৫ লাখ।
- সেনেগালের লে সেলাই ৭ সেপ্টেম্বর বলেছে ৮০ লাখ।
- টরন্টো টেলিগ্রাম ১৩ সেপ্টেম্বর বলছে ৮০ লাখ।
- দ্য ইভিনিং স্টার ৩০ সেপ্টেম্বর লিখেছে ৮০ লাখ শরণার্থীর কথা।
- ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউ ২৫ সেপ্টেম্বর বলছে ৮৫ লাখ।
- দ্য অ্যাডভান্স মরিশাস ২৭ সেপ্টেম্বর বলেছে ৮৫ লাখ।
- দ্য ওয়েস্টার্ন মেইল ২৮ সেপ্টেম্বর বলেছে ৯০ লাখ।
- নিউইয়র্ক টাইমস ১১ অক্টোবর বলছে ৯০ লাখ।
- লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমস ১৮ অক্টোবর বলেছে ৯০ লাখ।
- লা লিবর বেলজিক ১৮ অক্টোবর বলছে সংখ্যাটা ১ কোটি ছাড়িয়েছে।
- নিউজউইক ৬ ডিসেম্বর বলেছে ১ কোটি।
- টাইমস ২০ ডিসেম্বর বলেছে ১ কোটি।
একটু বিশ্লেষণী দৃষ্টি নিয়ে লক্ষ করলে দেখবেন, ২৫ মার্চ অর্থাত্ যুদ্ধের প্রথম প্রহর থেকেই শরণার্থীরা দেশ ত্যাগ শুরু করেন এবং সেই সংখ্যাটা মে মাসে এসে দাঁড়ায় ১৫ লাখ। জুনের মাঝামাঝি সংখ্যাটা হয় প্রায় ৫০ লাখ, যেটা আগস্টে এসে ৭০ থেকে ৭৫ লাখ হয়ে যায়। সেপ্টেম্বরে ৮৫ লাখ ছাড়িয়ে যায় এবং বাদবাকি সময়ে সংখ্যাটা ছাড়িয়ে যায় কোটির ঘর।
পৃথিবীর কোনো দেশই হঠাত্ করে এক কোটি শরণার্থীকে একসঙ্গে খাওয়াতে-পরাতে পারে না। এটা এক কথায় অসম্ভব। আর যখন এই শরণার্থীদের বড় অংশই শিশু ও বৃদ্ধ, তখন একটা অনিবার্য জিনিস ছিল মৃত্যু। এ ছাড়া গাদাগাদি করে থাকার কারণে মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়ে কলেরা, প্রাণ হারায় লাখ লাখ শিশু। মাঝখানে শীতের প্রকোপেও অনেক শিশুর মৃত্যু ঘটে।
এবার একটু ধারণা নেওয়ার চেষ্টা করব ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিয়ে। পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী আলফ্রেড কাস্টলার লা ফিগারো, প্যারিস পত্রিকায় ৮ অক্টোবর ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের শরণার্থী সমস্যাকে হিরোশিমার পারমাণবিক বোমা হামলার চেয়েও ভয়াবহ বলে উল্লেখ করে বলেন, যাঁরা হিরোশিমা ঘটনার শিকার, তাঁরা ছিলেন ভাগ্যবান। কারণ, কিছু বুঝে ওঠার আগের তাঁরা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন কিন্তু পাকিস্তানের শরণার্থীদের দুর্দশা—এর চেয়েও ভয়াবহ। তিনি লিখেছেন, পাকিস্তানি (বাংলাদেশ) শরণার্থীদের জন্য যে তহবিল সংগ্রহ করা হয়েছে, তা ফুরিয়ে গেছে। খাবার ও রসদ সরবরাহ থেমে গেছে, এটা নিশ্চিত। এখন থেকে কয়েক দিনের মধ্যে হাজার হাজার শিশুর মৃত্যু ঘটবে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, ‘এখনই যদি খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করা না যায়, তাহলে তিন থেকে পাঁচ লাখ বা তার চেয়েও বেশি শিশু মৃত্যুবরণ করবে।’
এরপর দেখি মালয়েশিয়ার দ্য স্ট্রেইট টাইমস ৮ জুন লিখেছে কলেরার মহামারির কথা। সেখানে বলা হয়েছে, মহামারিতে শরণার্থী শিবিরে এখন পর্যন্ত মৃত মানুষের সংখ্যা আট হাজার। দ্য গব্লাতে নরওয়ে লিখেছে, তিন লক্ষাধিক শিশু তীব্র অপুষ্টিজনিত মৃত্যুঝুঁকিতে রয়েছে। দ্য অর্ডিন্যান্স নরওয়ে ২৭ সেপ্টেম্বর লিখেছে, শুধু ক্ষুধা ও ঠান্ডায় লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যু ঘটেছে।
ব্রিটিশ এমপি বার্নার্ড ব্রেইন দ্য টাইমস পত্রিকায় এক দীর্ঘ প্রতিবেদন লেখেন, শরণার্থী ইস্যুতে যেটা আলোচনার দাবি রাখে। তিনি লিখেছেন, দিনের পর রাত আসবে, এটা যেমন সত্য, আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ না এলে পাকিস্তানে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ আসবে, এটাও তেমনি সত্য কথা। তিনি লিখেছেন, পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হচ্ছে। এর মধ্যে ৭৫ লাখ শরণার্থী ভারতে পাড়ি জমিয়েছে এবং এই সংখ্যাটা বেড়েই চলছে। খাদ্য উত্পাদনের ঘাটতি দেখিয়ে তিনি বলেন, শুধু খাবারের জন্য ৩০ লাখ মানুষ মৃত্যুর মুখোমুখি হতে পারে।
শরণার্থী ইস্যুতে জাতিসংঘের টনক নড়ানোর জন্য যুক্তরাজ্যভিত্তিক সহায়তা প্রতিষ্ঠান অক্সফাম এগিয়ে আসে। তারা প্রকাশ করে ‘টেস্টিমনি অব সিক্সটি’।১১ ষাটজন বিশ্ববরেণ্য মানুষের সাক্ষ্য। সাক্ষ্যদাতাদের মাঝে আছেন মাদার তেরেসা, সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি, সাংবাদিক জন পিলজার, মাইকেল ব্রানসন, নিকোলাস টোমালিন, অ্যান্থনি মাসকারেনহাসসহ অনেকে। বিরাট সেই দলিলে সাংবাদিক নিকোলাস টেমালিনের লেখা থেকে কিছু অংশ উদ্ধৃত করছি; ‘যদি এই শিশুদের অতিরিক্ত প্রোটিন দেওয়া না হয়, তাহলে এরা অবশ্যই মারা যাবে। শিশুদের চার ভাগের তিন ভাগ নয় মাসের মধ্যে অবশ্যই মারা যাবে। তার মানে—১০ লাখ শিশু।’
ষাটজনের সাক্ষ্য থেকে সিনেটর কেনেডির লেখাটি উল্লেখযোগ্য। উল্লেখ্য, সিনেটর কেনেডি বেশ কয়েকটি শরণার্থী শিবিরে যান। তিনি লিখেছেন: ‘গত ত্রিশ বছরে পৃথিবী যত দুর্যোগ মোকাবিলা করেছে, তার মধ্যে ভয়াবহটি হচ্ছে পাকিস্তানের সংকট।’ তিনি লিখেছেন, ‘সপ্তাহের পর সপ্তাহ গড়াচ্ছে আর মৃত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। কেউ কেউ ভারতে যাচ্ছেন আর ৯০ লাখের মধ্যে মাত্র কয়েক শ জনকে খাওয়াচ্ছেন এবং শুশ্রূষা দিচ্ছেন।’
কলকাতার সল্ট লেকের শরণার্থী শিবির ঘুরে এসে তিনি জানান, ওখানকার ২ লাখ ৫০ হাজার শরণার্থী মোটামুটি ভালো আছেন; তারপরেও তাঁর মতে সেখানকার শিশুদের অবস্থা ছিল খুবই খারাপ। বিদেশি ও ভারতীয় বিশেষজ্ঞদের মতে, এই অবস্থা চলতে থাকলে মোট শিশুদের তিন-চতুর্থাংশ নয় মাসের মধ্যেই মারা যাবে; সংখ্যাটা ১০ লাখ!
তিনি লিখেছেন, ৩০ হাজার শরণার্থীর দিয়ারা ক্যাম্পের কথা, যেখানে বন্যায় পুরো ক্যাম্পটাই তলিয়ে যায়। সেখানকার পরিবারগুলো কাদায় ঢাকা, নিজেদের মলমূত্র কখনোই ঠিকমতো পরিষ্কার করা সম্ভব হয় না। পানি ভেঙে খাবার আনতে হয়, ওষুধ থেকেও তারা বঞ্চিত পুরোপুরি। বন্যার পর আসছে শীত, এ মুহূর্তে ৯০ লাখ মানুষের চাই ৩০ লাখ কম্বল। এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কাপড় ও তাঁবু; এর সঙ্গে বাড়ছে কলেরার প্রকোপ। সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডির লেখাটি থেকে খানিকটা উদ্ধৃত না করলে এই লেখা সম্পূর্ণ হবে না। আমি তাঁর লেখা থেকে অল্প কিছু উদ্ধৃত করছি। তিনি লিখেছেন:
আমি দেখেছি এক ক্যাম্প থেকে অন্য ক্যাম্পের অবস্থার মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য। কিন্তু অধিকাংশই বর্ণনা দেওয়া অসম্ভব। ক্যাম্পগুলোতে শিশু ও বৃদ্ধের সংখ্যা মোট শরণার্থীর ৫০ শতাংশ। যাদের বয়স পাঁচ থেকে কম এবং যারা বয়োবৃদ্ধ তারাই সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী। এ রকম বয়সের মানুষের সংখ্যাই শিবিরগুলোতে বেশি। এরা মোট শরণার্থীর ৫০ শতাংশ। এদের বেশির ভাগই মৃত্যুবরণ করছে। শরণার্থী শিবিরের মাঝখান দিয়ে হেঁটে গেলে দেখে দেখে শনাক্ত করা সম্ভব, এক ঘণ্টার মধ্যে কারা মারা যাবে আর কাদের ভোগান্তি চিরতরে শেষ হওয়াটা কেবল কয়েক দিনের ব্যাপার মাত্র। শিশুদের দিকে দেখুন, তাদের ছোট্ট হাড় থেকে আলগা হয়ে ভাঁজে ভাঁজে ঝুলে পড়া ত্বক, এমনকি তাদের মাথা তোলার শক্তিও নেই। শিশুদের পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখুন, পা ও পায়ের পাতার পানি নেমে অপুষ্টিতে ফুলে আছে। তাদের মায়ের হাতও নিস্তেজ। ভিটামিনের অভাবে তারা অন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আর সবচেয়ে বেশি কঠিন দৃশ্য, গত রাতে যে শিশুটি মারা গেছে, তার মৃতদেহও এখানেই। আমি যখন একজন শরণার্থী শিবিরের পরিচালককে জিজ্ঞাসা করলাম, তাঁর সবচেয়ে জরুরি প্রয়োজনটি কী। জবাব এল: একটি শব-চুল্লি। পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্ একটি ক্যাম্পের তিনি পরিচালক।’
এবারে আসুন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দলিলটি নিয়ে। আর সেই দলিল নিয়ে আমার আগেই দুজন যোগ্য মানুষ কাজ করেছেন। তাঁদের একজন কুলদা রায় আরেকজন কিংবদন্তিতুল্য মুক্তিযুদ্ধ গবেষক এম এম আর জালাল। জেনোসাইড নামের একটা বই আছে, যার লেখক প্রখ্যাত গণহত্যা গবেষক লিও কুপার। বইটির প্রচ্ছদ করা হয়েছে কিছু সংখ্যা দিয়ে। লেখা হয়েছে—১৯১৫ : ৮০০,০০০ আর্মেনিয়ান। ১৯৩৩-৪৫ : ৬০ লাখ ইহুদি। ১৯৭১ : ৩০ লাখ বাংলাদেশি। ১৯৭২-৭৫ : ১০০,০০০ হুতু। নিচে লাল কালিতে বড় করে লেখা জেনোসাইড। এই অঙ্কের মানুষ গণহত্যার শিকার। এই ৮ লাখ, ৬০ লাখ, ৩০ লাখ, ১ লাখ—সংখ্যাগুলো একেকটি প্রতীক। গণহত্যার প্রতীক। ক্যালকুলেটর টিপে টিপে হুবহু মিলিয়ে দেওয়া পূর্ণ সংখ্যার হিসাব এখানে পাওয়া যাবে না। পাওয়া যাবে পরিকল্পিত গণহত্যার মানবিক বিপর্যয়ের ইতিহাসের প্রতীক। জেনোসাইড বইটি নিয়ে অসাধারণ একটি প্রবন্ধ লিখেছেন মুক্তিযুদ্ধ গবেষক এম এম আর জালাল এবং কুলদা রায়।১২ তাঁদের প্রবন্ধ থেকে উল্লেখযোগ্য কিছু অংশ তুলে ধরছি:
১৯৭১ সালের জুন মাসে লাইফ ম্যাগাজিনের সাংবাদিক জন সার কোলকাতায় এসেছিলেন। সঙ্গে ছিলেন ফটোগ্রাফার মার্ক গডফেরি। তাঁরা দুজনে একটি গাড়িতে করে ঘুরে ঘুরে দেখেছেন শরণার্থীদের চিত্র। সময়টা জুন মাসের মাঝামাঝি। জন সার গিয়েছেন করিমপুরে। বৈষ্ণব ভক্তিবাদের প্রবক্তা চৈতন্য মহাপ্রভুর জন্মস্থান পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরের এই গ্রামটি পাকিস্তান সীমান্ত থেকে মাত্র তিন মাইল দূরে। এখানে রাস্তা দিয়ে সীমান্ত পার হয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ আসছে পূর্ব পাকিস্তান থেকে। পাক হানাদার বাহিনীর বর্বর গণহত্যার শিকার হয়ে এরা হারিয়েছেন এদের স্বজন, গবাদিপশু, ঘরবাড়ি, সহায়সম্পদ। ধারাবাহিক মৃত্যুর তাড়া খেয়ে এইসব ভয়ার্ত মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য ভারতে ছুটে আসছে। সরাসরি গুলির হাত থেকে ঈশ্বরের দয়ায় এরা বেঁচে এসেছে। কিন্তু নতুন করে পড়েছে নতুন নতুন মৃত্যুর ফাঁদে। এদের পিছনে মৃত্যু। সামনে মৃত্যু। বায়ে মৃত্যু। ডানে মৃত্যু। সর্বত্রই মৃত্যুর ভয়ঙ্কর থাবা এদের তাড়া করে ফিরছে।
সাংবাদিক জন সার করিমপুরের রাস্তায় দেখতে পেলেন অসীম দৈর্ঘ্যের লম্বা শরণার্থী মানুষের মিছিল। তাদের কারো কারো মুখে রুমাল গোঁজা। একটা লোকের কাছে তিনি গেলেন। কোনোভাবে রুমালটি মুখ থেকে সরিয়ে লোকটি শুধু বলতে পারলেন, কলেরা। কলেরা। আর কিছু বলার নেই। পিছনে পাক সেনাদের গুলি। আর সঙ্গে কলেরা। সামনে অন্ধকার। কোথায় চলেছে তারা কেউ জানে না। মৃত্যুকে সঙ্গী করে তবু তারা এগিয়ে চলেছে। করিমপুরের মধ্যে দিয়ে যে রাস্তাটি চলে গেছে কোলকাতা বরাবর, তার বামদিকে শরণার্থী শিবির। এখানে আশ্রয় নিয়েছে ১৫০০০ মানুষ। এই শরণার্থী শিবিরে কলেরা নির্মমভাবে হানা দিয়েছে। ৭০০ জন ইতিমধ্যে মারা গিয়েছে। বাকীরা শিবির ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু পালাবে কোথায়? কলেরাও তাদের সঙ্গে চলেছে। খোলা জায়গায় পড়ে আছে মরা মানুষ।
জন সার দেখতে পাচ্ছেন ঝাঁকে ঝাঁকে শকুন নেমে এসেছে। তীক্ষ ঠোঁট দিয়ে ছিঁড়ে খুঁড়ে খাচ্ছে মরা মানুষের দেহ। তাদের চোখ চক চক করছে। কিন্তু মৃত মানুষের সংখ্যা এত বেশী যে শকুনেরা খেয়ে শেষ করতে পারছে না। শকুনদেরও খাওয়ায় অরুচি এসে গেছে। মরা মানুষের গা থেকে ছিঁড়ে খুঁড়ে ফেলেছে জামা কাপড়। তাদের অনেকের তখনো গা গরম। সবেমাত্র মরেছে। পথে ঘাটে নালা নর্দমায় সর্বত্রই কলেরায় মরা মানুষ পড়ে আছে। জন সার দেখতে পেয়েছেন একটি শিশুর মৃতদেহ। শিশুটির গায়ে একটি শাড়ির অংশ পেঁচানো। তাঁর হতভাগী মা পেঁচিয়ে পুটুলি বানিয়েছে। ট্রাকের চলার সময় অসুস্থ শিশুটি মারা গেছে। চলন্ত ট্রাক থামেনি। মৃত ছেলের জন্য ট্রাক থামানো কোনো মানেই হয় না। আরও অনেক মৃতপ্রায় মানুষ এই ট্রাকেই ধুঁকছে। আগে পৌঁছাতে পারলে হয়তো কোনো হাসপাতাল পাওয়া যেতে পারে। তাদের সুযোগ মিলতে পারে চিকিত্সার। বেঁচেও যেতে পারে। এই আশায় সময় নষ্ট করতে কেউ চায় না। শিশুটির পুটুলী করা মৃতদেহটিকে ট্রাক থেকে রাস্তার পাশে ধান ক্ষেতে ছুড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে।
একটি ওয়ান ডেকার বাসের ছবি তুলেছে জন সারের সঙ্গী ফটোগ্রাফার মার্ক গডফেরি। বাসটির হাতল ধরে ঝুলছে কয়েকজন হতভাগ্য লোক। আর ছাদে বসে আছে, সব মিলিয়ে জনা সত্তর জন। কেউ কেউ বমি করছে। কারো কারো মুখে রুমাল চাপা। কেউ কেউ রুমালের অভাবে হাতচাপা দিয়েছে। ছাদের মানুষের বমি জানালা দিয়ে বাসের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। আর বাসের মধ্যের বমি জানালা দিয়ে বাইরে ছিটকে পড়ছে পথে-ঘাটে, মাঠে, খালে, জলাশয়ে। হাটন্ত মানুষের গায়ে। বমির সঙ্গে জীবনবিনাশী কলেরার জীবাণু। এইসব হতভাগ্য মানুষের চোখ গর্তের মধ্যে ঢোকানো। আর তার মধ্যে জ্বলজ্বল আতঙ্ক। বাসভর্তি করে কলেরা চলেছে। বাইরে পড়ে আছে একটি মৃতদেহ।
এই সব মানুষ এত বেশী সংখ্যায় মরেছে যে আমরা গুনতে পারিনি। গোনা সম্ভব নয়। একজন স্বেচ্ছাসেবক সাংবাদিক জন সারকে বলছেন, এরা জানে না তারা কোথায় যাচ্ছে। তারা চলছে তো চলছেই। তীব্র রোদে হাঁটতে হাঁটতে তারা ক্লান্ত অবসন্ন। তৃষ্ণার্ত হয়ে পথের পাশ থেকে আঁজলা ভরে কলেরাদুষ্ট পানি পান করছে। তারা এত দুর্বল হয়ে পড়ছে যে, আক্রান্ত হওয়ার পর একদিনও টিকতে পারছে না। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। তিনি লিখেছেন, কাঁটাখালি গ্রামে রাস্তার পাশ থেকে হৈচৈ করে একটি ট্রাক থামাতে চেষ্টা করছে একদল শরণার্থী। তারা করুণ স্বরে আবেদন করছে ট্রাকচালককে তাদেরকে ট্রাকে তুলে নিতে। তাদের মধ্যে যারা অসুস্থ হয়ে পড়েছে তারা রাস্তার পাশে মাটির উপরে শুয়ে আছে। তাদের পরিবার অসহায় হয়ে চেয়ে। তাদের হেঁটে যাওয়ার শক্তি নেই। যাদের সঙ্গে কিছু টাকা পয়সা আছে তারা কোনোমতে ট্রাকে উঠে পড়েছে। ট্রাকে করে তারা কৃষ্ণ নগর হাসপাতালে যেতে পারবে। সেখানে চিকিত্সা পাওয়ার চেষ্টা করবে।
করিমপুরের আশেপাশে গ্রামগুলোতে কোনো ডাক্তার নেই। কলেরা ভ্যাক্সিন নেই। নেই কোনো প্রতিষেধক অষুদপত্র। কাছাকাছি কৃষ্ণ নগরে একটি হাসপাতাল আছে। হাসপাতালের উদ্দেশে অসুস্থ মানুষ চলেছে মানুষের কাঁধে চড়ে। কেউবা বা বাঁশের তৈরি টেম্পোরারি স্ট্রেচারে করে। গরুর গাড়িতে। কেউবা রিকশায়। কৃষ্ণ নগর হাসপাতালে তিল ধারণের জায়গা নেই। যারা হাসপাতালে এর মধ্যে এসে পড়েছে—তখনো বেঁচে আছে, তাদের রাখা হয়েছে বাইরে খোলা মাঠে। যাদের চিকিত্সা শুরু হয়েছে তাদের রাখা হয়েছে অস্থায়ী ছাউনিতে। বাঁশের কাঠামোতে কাপড় বসিয়ে ছোটো ছোটো শিবির করে ছাউনি তৈরি হয়েছে।
সেখানে কিছু কিছু মানুষ বেঁচে থাকার জন্য মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে। তাদের চোখ গর্তের মধ্যে ঢুকে গেছে। অর্ধচেতন বা অচেতন জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে পড়ে আছে। তাদের মুখে মাছি পড়ছে। মশা ঘুরছে। অনন্তবিদারী দুর্গন্ধ। স্বজনদের কেউ কেউ হাত দিয়ে, তালে পাখা দিয়ে বা কাপড়ের আঁচল দিয়ে মাছি তাড়ানোর চেষ্টা করছে। সাদা এপ্রোন পরা নার্সরা তাদের শিরায় ঢোকানোর চেষ্টা করছে স্যালাইন। তাদের চেষ্টার কমতি নেই। কিন্তু নার্সের বা ডাক্তারের সংখ্যা হাতে গোনা, অপ্রতুল।
এই হতভাগ্যদের অর্ধেকই শিশু। সাংবাদিক জন সার একটি সাত বছরের ফুটফুটে মেয়ে শিশুকে তুলে এনেছে রাস্তা থেকে। তার চোখ বড় করে খোলা। তার হাত ঝুলে পড়েছে। নার্স এক পলক দেখেই বলছে, সব শেষ। কিছু করার নেই। মেয়েটি মরে গেছে। একজন ক্লান্ত ডাক্তার বলছেন, এর চেয়ে কুকুর-বিড়ালেরাও ভালো করে মরে। কিছুটা হলেও তারা চেষ্টা তদ্বির পায়। আর এই শরণার্থী মানুষদের কলে পড়া ইঁদুরের মত মরা ছাড়া কপালে আর কিছু লেখা নেই।
এতক্ষণ তো দেখলেন বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে মৃত্যুর আশঙ্কা নিয়ে অনেক অনেক লেখা, কিন্তু আদতে ঠিক কত মানুষ মারা গিয়েছিল শরণার্থী শিবিরে, সেটা আমাদের জানা নেই। আর জানা সম্ভব হবে কি না, তা-ও জানি না। তবু একটু গবেষণার পথ ধরে অনুমান করা যায় সংখ্যাটা।
দ্য ল্যানসেটকে বলা হয়ে থাকে পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং সবচেয়ে পুরোনো মেডিকেল জার্নাল। এটাকে পৃথিবীর সবচেয়ে সম্মানজনক মেডিকেল জার্নালও বলা হয়ে থাকে। তাদের রিসার্চ জার্নালে বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা নিয়েও সচেতনতা তৈরি করা হয়। মুক্তিযুদ্ধে শরণার্থী শিবির নিয়ে একটা প্রবন্ধ প্রকাশ করেছে তারা তাদের একটি জার্নালে।১৩
তাদের ভাষ্য কলকাতার একটি স্বেচ্ছাসেবক গ্রুপকে নিয়ে, যারা একাত্তরের জুনের শেষ থেকে বাহাত্তরের ফেব্রুয়ারির শুরু পর্যন্ত পাঁচ মাস চালু থাকা একটা শরণার্থী শিবিরের ওপর সার্ভে চালায় এবং তাদের সার্ভেটি খুবই বিশ্বাসযোগ্য, কারণ সেই সব ডেটা প্রতিটি ঘর থেকে আলাদাভাবে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই সার্ভের উদ্দেশ্য ছিল ক্যাম্পের জনসংখ্যা, সেখানকার মানুষের বয়সের ধরন আর মৃত্যুহার নিয়ে।
তাদের ভাষ্যমতে, ১ লাখ ৭০ হাজার শরণার্থীর ওই আশ্রয় শিবিরে কম করে হলেও ৪ হাজার মানুষ মারা যায়। তারা বলেছে, সংখ্যাটা আরও অনেক বেশি হতে পারে, স্বাভাবিক মৃত্যুকে তারা বিবেচনা করেনি এবং নিহতদের বড় অংশই ছিল শিশু। এই প্রবন্ধে আরও তথ্য আছে, তবে আমার দরকার এটুকুই।
আমাদের কাছে যে ডেটা আছে সেটা থেকে আমরা আগেই দেখছি, জুনের আগে থেকেই প্রচুর শরণার্থী ভারতে পাড়ি জমায়। টাইম পত্রিকার ২৪ মে ৭১ সংখ্যা থেকে জানা যায়, শরণার্থীর সংখ্যা তখন ছিল ১৫ লাখ, এরপর একই পত্রিকার ১৩ জুন ৭১ সংখ্যা অনুসারে সেটা বেড়ে দাঁড়ায় ৫০ লাখে। সানডে টাইমস ২১ জুন ৭১ লিখেছে শরণার্থীর সংখ্যা ৬০ লাখ, ইকোনমিস্ট লিখেছে ২৬ জুন তারিখে যে শরণার্থীর সংখ্যা তত দিনে ৬০ লাখ ছাড়িয়েছে।
এখানে দেখলাম সেই শরণার্থী শিবির খোলার আগেই প্রচুর মানুষ দেশ ছেড়েছে এবং তাদের অনেকে অবশ্যই মারা গিয়েছে। শেষ পর্যন্ত নিউজউইক-এর ৬ ডিসেম্বর ৭১ থেকে জানা যায়, শরণার্থীর সংখ্যা এক কোটি ছাড়িয়েছে। ভারতের শরণার্থী শিবিরের মধ্যে কলকাতার শিবিরগুলোই মোটামুটি ভালো বলে বিবেচিত হয়, অন্য অনেক শরণার্থী শিবিরের অবস্থা ছিল অনেক ভয়াবহ, ছিল না ন্যূনতম খাদ্য আর চিকিত্সাসেবা। সুতরাং সেসব শিবিরে মৃত্যুহার হওয়ার কথা আরও ভয়ংকর রকম বেশি, কিছু ক্যাম্পে কলেরার প্রকোপের কথাও আমরা শুনেছি। বন্যা, শীত—এসব তো বাদই দিলাম। তবু অনেক কমিয়ে এই সংখ্যাটাকেই ধ্রুব ধরে যদি শরণার্থী শিবিরে নিহত মানুষদের সংখ্যাটা কত হতে পারে, সে নিয়ে ধারণা করতে চাই, তাহলে হিসাবটা দাঁড়ায় অনেকটা এ রকম:
১ লাখ ৭০ হাজার মানুষের মধ্যে কমপক্ষে মৃত ৪ হাজার, তাহলে এক কোটি মানুষের মাঝে পাঁচ মাসে ন্যূনতম নিহতের সংখ্যা প্রায় আড়াই লাখ।
৬০ লাখ জনগোষ্ঠী দেশ ছাড়ার পর এই হিসাব করা হয়েছে। পুরো হিসাবটা আরও ভয়াবহ, হয়তো এই সংখ্যাটার দ্বিগুণ কিংবা তিন গুণ। কারণ বলা হয়েছে এটা পাঁচ মাসের হিসাব আর ক্যাম্পটা কলকাতার সেরা ক্যাম্প, যেখানে ছিল পর্যাপ্ত ডাক্তার, খাদ্য আর থাকার জায়গা আর জন সারের হিসাবে ১৫ হাজার মানুষের মাঝে মৃত ৭০০, তাহলে; এক কোটি মানুষের জন্য হিসাবটা হয় প্রায় পাঁচ লাখ।
এখানে আমরা দেখেছি, এটা জুন মাসের হিসাব। যদি ধরেও নিই এই শিবিরটা প্রথম থেকেই ছিল অর্থাত্ মার্চের শেষ দিক থেকে তাহলে মাত্র তিন মাসের মৃত্যুর হার এটা। এই ক্যাম্প যদি ডিসেম্বর পর্যন্ত স্থায়ী হয়ে থাকে, তাহলে সম্ভবত আপনারা সংখ্যাটা আঁচ করতে পারছেন। এরপর শরণার্থী শিবিরে জুন মাসেই ৫০ লাখের ৬ লাখ মারা যায়, এমন একটা নিউজ করেছিল ওয়াশিংটন ডেইলি নিউজ (২২ জুন)। মনে রাখবেন, জুন যুদ্ধ শুরুর ৪ মাস। ডিসেম্বরের আগেই শরণার্থীর সংখ্যা ছিল এক কোটির ওপরে। সেই হিসেবে হতাহতের সংখ্যা ১২ লাখের ওপরে ছিল।
শেষ কথা
আমার ব্যক্তিগত অভিমত, মুক্তিযুদ্ধে শরণার্থী শিবিরে নিহত মানুষের সংখ্যা কম করে হলেও ৬ থেকে ১২ লাখ। আজকের দিনে যারা পুরো যুদ্ধেই মৃতের সংখ্যা দুই কিংবা তিন লাখ দাবি করে, তাদের আসলে জানা উচিত শরণার্থী শিবিরে মৃত মানুষগুলোর কথা। এদের শহীদের মর্যাদা দেওয়া হবে কি না আমি জানি না, কিন্তু এদের মৃত্যুর কারণ সেই একটাই—পাকিস্তান। আশা করি সামনের দিনগুলোতে শরণার্থীদের নিয়ে আরও অনেক কাজ হবে, আমাদের কাছে মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহ অংশটির চিত্র ফুটে উঠবে আরও পরিষ্কার হয়ে।
তথ্যসূত্র:
১. http://www.theguardian.com/world/2011/may/24/mujib-confusion-on-bangladeshi-deaths
৩. “রিপোর্ট ১৯৭১” পূর্ণ কবিতার লিঙ্ক—
https://abrittiokobita.wordpress.com/2014/06/09/%E0%A6%B0
%E0%A6%BF%E0%A6%AA%E0%A7%8B%E0%A6%B0%E0
%A7%8D%E0%A6%9F-%E0%A7%A7%E0%A7%AF%E0%A7%AD%E0%A7%A7/
৪. হামুদুর রহমান কমিশন রিপোর্ট—
http://www.bangla2000.com/Bangladesh/Independence-War/Report-Hamoodur-Rahman/default.shtm
৫. https://en.wikipedia.org/wiki/Bangladesh_famine_of_1974#
endnote_Alamgir
৬. http://www.genocidebangladesh.org/refugees/
৭. http://opinion.bdnews24.com/bangla/archives/22787
৮. রুহেল আহমেদের সাক্ষাত্কার আমি নিজে গ্রহণ করেছি।
৯. https://en.wikipedia.org/wiki/Demographics_of_Bangladesh
১০. সাক্ষাত্কার আমি নিজে গ্রহণ করেছি।
১১. "The Testimony of Sixty - Oxfam"
http://www.liberationwarbangladesh.org/2015/12/the-testimony-of-sixty.html
১২. দেখুন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে গণহত্যা: ভিন্ন অধ্যায়, কুলদা রায় এবং এম এম আর জালাল, শৈলী, http://shoily.com/?p=10916
১৩. http://www.thelancet.com/journals/lancet/article/PIIS0140-6736(72)92225-8/abstract