ব্যাপক নির্যাতনের মুখে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর পালিয়ে আসা অব্যাহত রয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে বছরের পর বছর ধরে তাদের প্রতিকূল অবস্থার সঙ্গে কঠিন লড়াইয়ের প্রতি দৃষ্টিপাত করা যাক।
বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী আরাকান (বর্তমানে রাখাইন প্রদেশ) মিয়ানমারের (সাবেক বার্মা) একটি প্রদেশ। বঙ্গোপসাগরের পূর্বকূলবর্তী এই এক ফালা ভূমি চট্টগ্রামের সীমান্তবর্তী নাফ নদী থেকে কেপ নেগ্রাইস পর্যন্ত বিস্তৃত। আরাকানের ইউমা রেঞ্জ এবং বঙ্গোপসাগরের মধ্যবর্তী এই রাখাইন প্রদেশ। উত্তর থেকে দক্ষিণ পর্যন্ত বিস্তৃত ইউমা রেঞ্জ এই প্রদেশকে মিয়ানমারের বাকি অংশ থেকে পৃথক করেছে। আরাকানের মোট আয়তন ১৩ হাজার ৫৪০ বর্গমাইল। এর জনসংখ্যা প্রায় ২০ লাখ। এই প্রদেশেই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ও তাদের পরিচয়কে ঘিরে রাজনীতি ও সহিংসতা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আবর্তিত হচ্ছে।
অষ্টম শতাব্দী
রোহিঙ্গা নামে দক্ষিণ এশিয়ার একটি জনগোষ্ঠী বর্তমানে মিয়ানমারের (সাবেক বার্মা) রাখাইন প্রদেশ নামে পরিচিত স্বাধীন আরাকান রাজ্যে বসবাস করা শুরু করে।
নবম থেকে চৌদ্দ শ শতাব্দী
জনশ্রুতি অনুযায়ী, আরব ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে রোহিঙ্গারা ইসলামের সংস্পর্শে আসে। আরাকান ও পূর্ববঙ্গের মধ্যে সংযোগ স্থাপিত হয়।
১০৫৭
রাজা আনাওরাহতা পাগানে প্রথম একক বার্মিজ রাষ্ট্র স্থাপন করেন এবং থেরাভাদা বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করে।
১৭৮৪
বর্মি রাজা বোদাওপায়া আরাকান দখল করেন এবং শরণার্থীরা বাংলায়
পালিয়ে আসে।
১৭৯০
ব্রিটিশ বাণিজ্যস্বার্থ নিশ্চিত করতে ক্যাপ্টেন হিরাম কক্সকে দূত হিসেবে রেঙ্গুনে বর্মি রাজার দরবারে পাঠানো হয়। বলা হয়ে থাকে, যে এলাকা পূর্ব পাকিস্তান এবং পরে বাংলাদেশ হয়েছে সেখানে শরণার্থীদের পুনর্বাসনের মাধ্যমে কক্সই আরাকান শরণার্থী ও স্থানীয় রাখাইনদের মধ্যে শতাব্দীব্যাপী দ্বন্দ্ব নিরসন করেন। তিনিই কক্সবাজার শহরের গোড়াপত্তন করেন, যেখানে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে এমন গোষ্ঠীগুলো বর্তমানে বসবাস করে।
১৮২৪-২৬
ইয়ান্দাবো চুক্তির মাধ্যমে প্রথম অ্যাংলো-বর্মি যুদ্ধের অবসান ঘটে। সে অনুযায়ী চট্টগ্রাম ও কেপ নেগ্রাইসের মধ্যবর্তী আরাকানের উপকূলীয় এলাকাকে বর্মি ব্রিটিশ ভারতের কাছে সমর্পণ করে।
১৮৫২
দ্বিতীয় অ্যাংলো-বর্মি যুদ্ধের মাধ্যমে ব্রিটিশরা রেঙ্গুনসহ বার্মার নিম্নাঞ্চল স্বরাজভুক্ত করে।
১৮৮৫-৮৬
তৃতীয় অ্যাংলো-বর্মি যুদ্ধের পরে ব্রিটিশরা মান্দালয়া দখল করে নেয়। এর ফলে বার্মা ব্রিটিশ ভারতের একটি প্রদেশে পরিণত হয়।
১৯১১
১৯১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, রোহিঙ্গারা ভারতীয় বংশোদ্ভূত একটি নৃগোষ্ঠী হিসেবে ভারতীয় জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হয়।
১৯২১
১৯২১ সালের আদমশুমারিতে রোহিঙ্গাদের আরাকানীয় হিসেবে শ্রেণিভুক্ত
করা হয়।
১৯৩৭
ব্রিটেন বার্মাকে ভারত থেকে আলাদা করে এবং রাজ উপনিবেশে রূপান্তর করে।
১৯৪২
জাপানি প্রশিক্ষিত বার্মা স্বাধীনতা সেনাদের (বিআইএ) সহায়তায় জাপান বার্মা দখল করে। যখন ব্রিটিশরা পিছু হটে, তখন বর্মি জাতীয়তাবাদীরা মুসলিমদের আক্রমণ করা শুরু করে। মুসলিমরা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে সুবিধা পেয়েছে বলে তারা অভিযোগ করে। পরবর্তী সময়ে বিআইএ ফ্যাসিস্টবিরোধী গণমুক্তি সংঘে (এএফপিএফএল) রূপান্তরিত হয় এবং জাপানি শাসন প্রতিরোধ করে।
১৯৪৫
অং সানের (অং সান সু চির বাবা) নেতৃত্বে বর্মি জাতীয়তাবাদী এবং রোহিঙ্গা যোদ্ধাদের সহায়তায় ব্রিটেন বার্মাকে জাপানের কাছ থেকে মুক্ত করে। ব্রিটিশরা আরাকানের স্বায়ত্তশাসনের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি বলে রোহিঙ্গারা আবার প্রতারিত হয়েছে বলে মনে করে।
১৯৪৭
ইউ শ ছিলেন একজন জাতীয়তাবাদী প্রতিদ্বন্দ্বী। তাঁর নেতৃত্বে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ অং সান এবং তাঁর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ছয়জন সদস্যকে হত্যা করে। জাপানি দখলদারির সময়ে শাসন করা ‘বা মাও’য়ের সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইউ নুকে এএফপিএফএল এবং সরকারপ্রধান হতে বলা হয়।
১৯৪৮
ইউ নুয়ের প্রধানমন্ত্রিত্বের সময়ে বার্মা স্বাধীন হয়। প্রথম বছরেই রিপাবলিক অব দ্য ইউনিয়ন অব বার্মা ভেঙে পড়ার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছায়। পূর্ব দিকে, নৃতাত্ত্বিক কারেন সামরিক ইউনিটগুলো বিদ্রোহ করে এবং কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরে। উত্তর দিকে শিগগিরই হতে যাওয়া লাল চীনের সীমান্তে কমিউনিস্ট বিদ্রোহীদের উত্থান ঘটে। অবশেষে বর্মি সামরিক বাহিনী বিদ্রোহ দমনে সফল হয়। তবে দেশের প্রান্তিক পার্বত্য অঞ্চলে জাতিগত দ্বন্দ্ব টিকে যায়, যা দেশের পরবর্তী ক্রমবিকাশে গভীর প্রভাব রাখে।
রোহিঙ্গাদের সঙ্গে উত্তেজনা বজায় আছে, যাদের অনেকেই চেয়েছিল আরাকান মুসলিম অধ্যুষিত পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হোক। রোহিঙ্গা সরকারি কর্মকর্তাদের বরখাস্ত করার মাধ্যমে সরকার এর প্রতিশোধ নেয়।
১৯৫০
মুজাহিদ নামে সশস্ত্র গোষ্ঠীর নেতৃত্বে কিছু রোহিঙ্গা সরকারকে প্রতিরোধ করে। ক্রমেই বিদ্রোহ অবদমিত হয়ে পড়ে।
১৯৫৮-৬০
ক্ষমতাসীন এএফপিএফএল দলের মধ্যে ভাঙনের সৃষ্টি হলে সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ নো উইনের নেতৃত্বে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসে।
১৯৬০
নির্বাচনে ইউ নুয়ের দলীয় একটি অংশ চূড়ান্ত বিজয়ী হয়। কিন্তু নু বৌদ্ধধর্মকে রাষ্ট্রধর্মে উন্নীত করায় এবং বিচ্ছিন্নতাবাদ সহ্য করায় সেনাবাহিনী ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে।
১৯৬২
১৯৬২ সালের মার্চ মাসে সেনাবাহিনী, বা ‘তাতমাদাও’, অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে। তাদের যুক্তি ছিল, বার্মার বিবদমান রাজনীতিবিদেরা দেশকে একতাবদ্ধ রাখতে অক্ষম। এর মধ্য দিয়ে বার্মায় অর্ধশতকেরও বেশি সময়ের সামরিক শাসনের সূচনা হয়। জেনারেল নো উইনের নেতৃত্বে ঘটা সামরিক অভ্যুত্থানে ইউ নুয়ের উপদল বিতাড়িত হয়। নো উইন যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারব্যবস্থা বিলুপ্ত করে এবং ‘সমাজতন্ত্রের বর্মি পন্থা’ চালু করেন। তিনি অর্থনীতিকে জাতীয়করণ করেন, একদলীয় রাষ্ট্র প্রবর্তন করেন এবং স্বাধীন পত্রিকা নিষিদ্ধ করে দেন। সামরিক জান্তা রোহিঙ্গাদের প্রতি কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে।
১৯৭৪
নতুন সংবিধান প্রণীত হয়, যেখানে সশস্ত্র বাহিনীর কাছ থেকে নো উইন ও অন্যান্য সাবেক সামরিক নেতার নেতৃত্বে একটি গণপরিষদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হয়।
ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউ-এ একজন লেখক বলেছেন যে ‘সমাজতন্ত্রের বর্মি পন্থা’ এবং এর প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো—নৃতাত্ত্বিক উগ্র জাতীয়তাবাদ ও অর্থনৈতিক স্বয়ম্ভরতা—ছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সময়ের প্রতিক্রিয়া। কারণ সে সময়ে নিম্নভূমির বর্মি সংখ্যাগুরুদের বদলে অভিবাসী ও সংখ্যালঘু মানুষদের ক্ষমতাপ্রাপ্ত করা হয়েছিল।
জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব উ থান্টের দেহ অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার জন্য বার্মায় ফিরিয়ে আনা হয়েছিল। বার্মার সামরিক বাহিনী তাঁকে রাষ্ট্রীয় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া দিতে অস্বীকৃতি জানালে রেঙ্গুন আর্টস অ্যান্ড সায়েন্স ইউনিভার্সিটির (আরএএসইউ) ছাত্র কর্মীরা সরকারি শোভাযাত্রা থেকে তাঁর দেহ ছিনিয়ে নেয়। সরকার বিশ্ববিদ্যালয় তছনছ করে দেহ হস্তগত করে। এই কঠোর অভিযানের ফলে শহরব্যাপী দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়লে সরকার মার্শাল ল জারি করে।
১৯৭৫
আঞ্চলিক সংখ্যালঘু গোষ্ঠীগুলো বিরোধী ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট গঠন করে। তারা গেরিলা বিদ্রোহ বাড়াতে থাকে।
১৯৭৭
জান্তা অপারেশন নাগামিন বা ড্রাগন কিং শুরু করে। তাদের দাবি ছিল, বিদেশিদের জন্য জনসংখ্যা আড়ালে নেওয়ার উদ্দেশ্যে এই অপারেশন চালানো হয়েছিল। সেনাবাহিনীর নির্যাতনের অভিযোগে দুই লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। সেনাবাহিনী সব ধরনের অন্যায় আচরণ অস্বীকার করে।
১৯৭৮
রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের জন্য বাংলাদেশ জাতিসংঘের হস্তক্ষেপে বার্মার সঙ্গে একটি চুক্তি করে, যার অধীনে বেশির ভাগ রোহিঙ্গা ফেরত আসে।
১৯৮১
অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল সান ইউয়ের কাছে নো উইন রাষ্ট্রপতিত্ব ছেড়ে দেন, কিন্তু ক্ষমতাসীন সোশ্যালিস্ট প্রোগ্রাম পার্টির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে থাকেন।
১৯৮২
মিয়ানমারের জাতীয়তা আইন তিন ধরনের নাগরিকত্ব শ্রেণিবিভক্ত করে: নাগরিক, সহযোগী নাগরিক এবং ন্যাচারালাইজড বা অঙ্গীভূত করা হয়েছে এমন নাগরিক। ১৯৪৭ সালের সংবিধানের সংজ্ঞা অনুযায়ী, নাগরিক তারাই যারা ‘আদি জাতি’-এর অন্তর্ভুক্ত অথবা ১৯৪২ সালের আগে ব্রিটিশ বার্মায় বসবাস করেছে। অ-নাগরিকদের ফরেন রেজিস্ট্রেশন কার্ড (এফআরসি) দেওয়া হয়। যেসব নাগরিকের পিতামাতা এফআরসিপ্রাপ্ত, তারা সরকারি কাজের জন্য অনুমতি পাবে না। এই আইন রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের ১৩৫টি নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর একটি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। ফলে মিয়ানমারের বেশির ভাগ নাগরিকত্ব সুবিধা থেকেই তারা বঞ্চিত।
১৯৮৮
মুদ্রা অবমূল্যায়নের ফলে অনেক মানুষের সঞ্চয় বিনষ্ট হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সরকারবিরোধী দাঙ্গা শুরু হয় এবং এতে সহস্র মানুষ নিহত হয়।
জেনারেল শ মং শক্তিশালী রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার কাউন্সিল (এসএলওআরসি) গঠন করেন।
১৯৮৯
এসএলওআরসি মার্শাল ল জারি করে, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের সমর্থকসহ হাজার হাজার মানুষকে গ্রেপ্তার করে এবং বার্মার নামকরণ করে ‘মিয়ানমার’ আর রেঙ্গুনের নামকরণ করে ইয়াঙ্গুন। অং সানের কন্যা ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) নেত্রী অং সান সু চিকে গৃহবন্দী করা হয়।
১৯৯০
সাধারণ নির্বাচনে এনএলডি বিপুল ভোটে জয়লাভ করে, কিন্তু সামরিক বাহিনী তা প্রত্যাখ্যান করে।
১৯৯১
শান্তিপূর্ণ পরিবর্তনের জন্য সু চিকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয়। ২ লাখ ৫০ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে যায়। রাখাইনে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হাতে তারা জোরপূর্বক কাজ, ধর্ষণ ও ধর্মীয় নির্যাতনের শিকার বলে দাবি করে।
১৯৯২
এসএলওআরসির চেয়ারম্যান, প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে জেনারেল শ মুংয়ের স্থলে জেনারেল থান শয়ে অভিষিক্ত হন। মিয়ানমারের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি রক্ষার্থে কিছু রাজনৈতিক বন্দীকে মুক্তি দেওয়া হয়।
১৯৯৫
ছয় বছর পরে সু চিকে গৃহবন্দী দশা থেকে মুক্তি দেওয়া হয়।
১৯৯৬
মুক্তির পর সু চি প্রথম এনএলডি কংগ্রেসে যোগদান করেন; দলীয় কংগ্রেসে যাওয়ার পথে ২০০ জনের বেশি এনএলডি প্রতিনিধিকে এসএলওআরসি গ্রেপ্তার করে।
১৯৯২-৯৭
আরও একটি প্রত্যাবাসন চুক্তির আওতায় প্রায় ২ লাখ ৩০ হাজার রোহিঙ্গা বর্তমানে রাখাইন নামে পরিচিত আরাকানে ফিরে আসে।
১৯৯৭
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জাতিগুলোর সংগঠন আসিয়ানে মিয়ানমারকে যুক্ত করা হয়। এসএলওআরসির নাম বদল করে রাষ্ট্রীয় শান্তি ও উন্নয়ন কাউন্সিল (এসপিডিসি) রাখা হয়।
১৯৯৮
এনএলডি সদস্যদের কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হয়, সংসদ আহ্বানের জন্য এনএলডি যে সময়সীমা দিয়েছিল তা পালন করতে ক্ষমতাসীন কাউন্সিল অস্বীকৃতি জানায়, ছাত্র আন্দোলন ছত্রভঙ্গ করা হয়।
১৯৯৯
সু চির স্বামী মাইকেল এরিস ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে যুক্তরাজ্যে মারা যান। তাঁকে দেখতে যাওয়ার জন্য ক্ষমতাসীন কাউন্সিল সু চিকে যেসব শর্ত দেয় তা তিনি প্রত্যাখ্যান করেন।
সেপ্টেম্বর ২০০০
ক্ষমতাসীন কাউন্সিল সু চি ও জ্যেষ্ঠ এনএলডি সদস্যদের চলাফেরার ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। সু চি ক্ষমতাসীন কাউন্সিলের সঙ্গে গোপন আলোচনা শুরু করেন।
২০০১
ক্ষমতাসীন কাউন্সিল প্রায় ২০০ জন গণতন্ত্রপন্থী কর্মীকে মুক্তি দেয়। সরকার দাবি করে যে এই মুক্তি গৃহবন্দী থাকা বিরোধীদলীয় নেত্রী অং সান সু চির সঙ্গে আলোচনায় অগ্রগতির প্রতিফলন।
ফেব্রুয়ারি ২০০১
থাইল্যান্ডের সীমান্তে বর্মি সেনাবাহিনীর সঙ্গে শান বিদ্রোহীদের সংঘর্ষ হয়।
জুন ২০০১
তখন থাই প্রধানমন্ত্রী থাকসিন সিনাওয়াত্রা মিয়ানমারে আসেন এবং বলেন যে সম্পর্ক সঠিক পথে ফিরে এসেছে।
মে ২০০২
প্রায় ২০ মাস গৃহবন্দী থাকার পর সু চিকে মুক্তি দেওয়া হয়।
আগস্ট ২০০৩
খিন নিন্ট প্রধানমন্ত্রী হন। গণতন্ত্রের ‘রোডম্যাপ’ হিসেবে নতুন সংবিধানের খসড়া প্রণয়নের লক্ষ্যে তিনি ২০০৪ সালে একটি সম্মেলন আয়োজনের প্রস্তাব করেন।
নভেম্বর ২০০৩
জাতিসংঘের মানবাধিকার দূত মিয়ানমার ভ্রমণ করার পরে পাঁচজন জ্যেষ্ঠ এনএলডি নেতাকে গৃহবন্দী দশা থেকে মুক্তি দেওয়া হয়।
জান্তার ‘রোডম্যাপ টু ডিসিপ্লিন-ফ্লারিশিং ডেমোক্রেসি’ এবং প্রেসিডেন্ট থেইন সেইনের চেষ্টা কোনো আত্মসমর্পণ ছিল না, বরং তা ছিল ২০০৮ সালের সংবিধানে নিয়মতান্ত্রিকভাবে চলে যাওয়া। এর ফলে ‘তাতমাদাও’ সংসদে এক-চতুর্থাংশ আসন নিশ্চিত করে এবং ৭৫ শতাংশ ভোট প্রয়োজন এমন যেকোনো সংশোধনীর বিরুদ্ধে কার্যত ভেটোও আরোপিত হয়। এর ফলে সু চি একজন বিদেশিকে বিয়ে করায় দেশের রাষ্ট্রপতি হতে পারবেন না বলে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়।
জানুয়ারি ২০০৪
সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত সবচেয়ে তাত্পর্যপূর্ণ কারেন বিদ্রোহী এবং সরকার দ্বন্দ্ব নিরসনে একমত হয়।
মে ২০০৪
এনএলডির নেত্রী সু চি গৃহবন্দী থাকায় তারা সাংবিধানিক সম্মেলন বর্জন করে। কিন্তু তবুও সম্মেলন শুরু হয়। জুলাইয়ে সম্মেলন মুলতবি হয়।
অক্টোবর ২০০৪
ক্ষমতার লড়াই চলছিল এমন খবরের মধ্যেই খিন নিন্ট প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে পদচ্যুত হন। তাঁকে গৃহবন্দী করা হয়।
নভেম্বর ২০০৪
হাজারো বন্দীর মুক্তির অংশ হিসেবে নেতৃস্থানীয় ভিন্নমতাবলম্বীদেরও মুক্তি দেওয়া হয়। এর মধ্যে ১৯৮৮ সালের গণতন্ত্রপন্থী ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী মিন কো নাইংকেও মুক্তি দেওয়া হয়।
জানুয়ারি ২০০৭
সংখ্যালঘু ও বিরোধী গোষ্ঠীগুলোর ওপর নির্যাতন বন্ধে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে যুক্তরাষ্ট্র একটি প্রস্তাব উত্থাপন করে। চীন ও রাশিয়া এতে ভেটো দেয়।
এপ্রিল ২০০৭
২৪ বছর পরে মিয়ানমার ও উত্তর কোরিয়া কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করে। মিয়ানমার কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছিল এই অভিযোগে যে মিয়ানমার ভ্রমণে আসা দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্রপতিকে হত্যায় উত্তর কোরীয় এজেন্ট ভয়াবহ বোমা বিস্ফোরণের পরিকল্পনা করেছিল।
মে ২০০৭
আরও এক বছরের জন্য সু চির গৃহবন্দী দশা বৃদ্ধি করা হয়।
আগস্ট ২০০৭
জ্বালানির দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদে গণবিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। বেশ কিছু কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। বৌদ্ধ ভিক্ষুরা রাস্তায় নামে, যাকে অপরিপক্বভাবে ‘স্যাফ্রন রেভল্যুশন’ বলে আখ্যায়িত করা হয়।
সেপ্টেম্বর ২০০৭
১৪ বছরের সাংবিধানিক আলোচনা সমাপ্ত হয়েছে বলে সামরিক সরকার ঘোষণা দেয় এবং জাতীয় সম্মেলন বন্ধ করে দেয়।
অক্টোবর ২০০৭
ব্যাপক সামরিক উপস্থিতিতে রেঙ্গুনে স্বাভাবিকতা ফিরে আসে। অনেক ভিক্ষুকে গ্রেপ্তার করার পর তারা অনুপস্থিত হয়ে পড়ে।
জানুয়ারি ২০০৮
দেশে সিরিজ বোমা হামলা ঘটে। রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম কারেন বিদ্রোহীসহ ‘বিদ্রোহী ধ্বংসকারীদের’ এর জন্য দায়ী করে।
এপ্রিল ২০০৮
সরকার প্রস্তাবিত নতুন সংবিধান প্রকাশ করে, যেখানে সংসদের এক-চতুর্থাংশ আসন সামরিক বাহিনীর জন্য বরাদ্দ করা হয় এবং বিরোধী নেত্রী অং সান সু চির কার্যালয়ে প্রবেশ নিষিদ্ধ করে।
নভেম্বর ২০০৮
গোপনে চলা অনেকগুলো বিচারকাজে অনেক রাজনৈতিক কর্মীকে ৬৫ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
ডিসেম্বর ২০০৮
মানবাধিকারকর্মীদের প্রতিবাদ সত্ত্বেও চারটি বিদেশি কোম্পানির একটি কনসোর্টিয়ামের সঙ্গে সরকার পার্শ্ববর্তী চীনে প্রাকৃতিক গ্যাস নেওয়ার জন্য পাইপলাইন স্থাপনে চুক্তি করে।
জানুয়ারি ২০০৯
থাইল্যান্ডের উপকূলে চলে আসা শত শত সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমকে সে দেশ থেকে বিতাড়িত করা হয়। মিয়ানমার এসব সংখ্যালঘুর অস্তিত্ব অস্বীকার করে। কয়েক শ রোহিঙ্গাকে পরবর্তী সময়ে ইন্দোনেশিয়ার উপকূলে নৌকা থেকে উদ্ধার করা হয়।
এপ্রিল ২০০৯
প্রধান বিরোধী দল এনএলডি সুপরিকল্পিত নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে সম্মত হয়। শর্ত থাকে যে সরকার সব রাজনৈতিক বন্দীকে মুক্তি দেবে, সংবিধান পরিবর্তন করবে এবং আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষককে কাজ করতে দেবে।
আগস্ট ২০০৯
মে মাসে একজন অনাকাঙ্ক্ষিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকের সঙ্গে দেখা করায় সু চিকে গৃহবন্দী দশার শর্তভঙ্গের জন্য অভিযুক্ত করা হয়। প্রাথমিকভাবে নির্ধারণ করা তিন বছরের কারাদণ্ড কমিয়ে ১৮ মাসের জন্য গৃহবন্দী করা হয়।
সেপ্টেম্বর ২০০৯
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন সামরিক শাসকদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের পরিকল্পনা ঘোষণা করেন।
অক্টোবর ২০০৯
সু চি মিয়ানমারের সামরিক নেতাদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেন এবং তাঁকে পশ্চিমা কূটনীতিকদের সঙ্গে দেখা করার অনুমতি দেওয়া হয়।
ফেব্রুয়ারি ২০১০
এনএলডির ভাইস চেয়ারম্যান টিন ওকে কর্তৃপক্ষ মুক্তি দেয়। সু চির এই সহকারী কারাগার বা গৃহবন্দী দশায় এক দশকেরও বেশি সময় পার করেন।
মার্চ ২০১০
সরকার ঘোষণা করে যে দীর্ঘ প্রতীক্ষিত নির্বাচনী আইন পাস করা হয়েছে। কিন্তু একটি নির্বাচন কমিশনের যে বিধান ছিল, জান্তা তা পছন্দমতো বাছাই করে।
অক্টোবর ২০১০
সরকার দেশের পতাকা, জাতীয় সংগীত এবং সরকারি নাম পরিবর্তন করে।
নভেম্বর ২০১০
সামরিক বাহিনী সমর্থিত দল ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (ইউএসডিপি) ২০ বছরের মধ্যে প্রথম নির্বাচনে বিজয়ী হয়। বিরোধী দল নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ তোলে এবং নির্বাচনকে জাল অভিহিত করে নিন্দা জানায়। সু চিকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত রাখা হয়েছিল। নির্বাচনের এক সপ্তাহ পরে গৃহবন্দী দশা থেকে সু চিকে মুক্তি দেওয়া হয়।
মার্চ ২০১১
থেইন সেইন নতুন নামসর্বস্ব একটি বেসামরিক সরকারের রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন।
সেপ্টেম্বর ২০১১
প্রতিবাদের মুখে উত্তরাঞ্চলের কাচিন প্রদেশে বিতর্কিত চীনা হাইড্রোপাওয়ার প্রকল্প থেকে সরকার সরে আসে।
অক্টোবর ২০১১
সাধারণ ক্ষমার অংশ হিসেবে কিছু রাজনৈতিক বন্দীকে মুক্তি দেওয়া হয়। ইউনিয়ন করতে দেওয়া প্রসঙ্গে নতুন শ্রম আইন পাস করা হয়।
নভেম্বর ২০১১
সু চির দল রাজনৈতিক প্রক্রিয়া পুনরায় শুরু করলে তিনি সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার কথা বলেন।
জানুয়ারি ২০১২
সরকার কারেন নৃগোষ্ঠীর বিদ্রোহীদের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি চুক্তি সই করে। আংশিক মুক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
এপ্রিল ২০১২
সংসদীয় উপনির্বাচনে এনএলডির প্রার্থীরা ভালো ফল করেন, সু চিও নির্বাচিত হন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বার্মার বিরুদ্ধে সব ধরনের বেসামরিক অবরোধ এক বছরের জন্য প্রত্যাহার করে।
জুন ২০১২
২৮ মে ২০১২ সালে রামরি পৌরসভায় তিনজন মুসলিম পুরুষ ২৮ বছর বয়সী একজন আরাকান নারীকে ধর্ষণ ও হত্যা করেন বলে অভিযোগ ওঠে। ফলে জুন মাসে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। জুনের ৩ তারিখে, রামরির দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত টাওনগপ শহরে আরাকানের গ্রামবাসীদের একটি বড় দল বাস থামিয়ে ১০ জন মুসলিমকে পিটিয়ে ঘটনাস্থলেই হত্যা করে।
আরাকান রাজ্যে স্থানীয় আরাকানীয় বৌদ্ধদের সঙ্গে রোহিঙ্গা মুসলিমদের ভয়াবহ সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। আরও চারটি শহরে সাম্প্রদায়িক সংঘাতের ঘটনা ঘটে। ৮৮ জন মানুষের মৃত্যু এবং ৯০ হাজার মানুষ উচ্ছেদ হয়ে যাওয়ার পরে রাষ্ট্রপতি থেইন সেইন জরুরি অবস্থা জারি করেন।
পরবর্তী সব বর্মি সরকারই রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব অস্বীকার করে। নতুন এনএলডি প্রশাসনও তাদের নাগরিকত্ব অস্বীকার করার পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ থেকে আগত অবৈধ ‘ছিঁচকে চোর’ বলে দাবি করে। বৌদ্ধ সংঘগুলোতে উগ্র জাতীয়তাবাদীরা এ ধরনের মনোভাব উসকে দেয়। তারা দাবি করে যে ক্রমবর্ধমান মুসলিম জনসংখ্যায় দেশ ভরে যাওয়ার হুমকি তৈরি হয়েছে।
জুলাই ২০১২
রাষ্ট্রপতি থেইন সেইন ইউএনএইচসিআরকে বলেন যে সরকার তাঁর দেশের নাগরিকদের দায়িত্ব নিতে পারবে, কিন্তু ‘সীমান্ত পার হয়ে আসা অবৈধ রোহিঙ্গা মুসলিম, যারা আমাদের জাতি নয় তাদের শনাক্ত করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়’। তিনি বলেন যে রোহিঙ্গারা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি এবং তাদের ‘নিতে আগ্রহী’ এমন তৃতীয় কোনো দেশে পুনর্বাসন করতে হবে।
জুলাই ২০১২
জাতিসংঘের মানবাধিকার-বিষয়ক হাইকমিশনার নাভি পিল্লাই আরাকান/রাখাইন প্রদেশে মুসলিম, বিশেষ করে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং দ্রুত স্বাধীন তদন্তের আহ্বান জানান।
আগস্ট ২০১২
জুন মাসের সহিংসতার প্রতিক্রিয়ায় মিয়ানমারে জাতিসংঘের মানবাধিকার-বিষয়ক বিশেষ দূত থমাস ওজেয়া কুইন্টানা নিরাপত্তারক্ষী বাহিনী কর্তৃক মানবাধিকার লঙ্ঘন ও অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের অভিযোগ স্বাধীনভাবে তদন্তের আহ্বান জানান।
আগস্ট ২০১২
পশ্চিমাঞ্চলে রাখাইন বৌদ্ধ ও রোহিঙ্গা মুসলিমদের মধ্যে সংঘটিত যে সহিংসতায় বেশ কিছু প্রাণহানি ঘটে তা তদন্তে রাষ্ট্রপতি থেইন সেইন একটি কমিশন গঠন করেন। মিয়ানমার সরকার গণমাধ্যমের ওপর থেকে প্রকাশপূর্ব সেন্সরশিপ তুলে নেয়।
সেপ্টেম্বর ২০১২
বার্মা তার দেশের ২ হাজার ৮২ জনের নাম কালো তালিকা থেকে বাদ দেয়। ফলে ১৯৮৮ সালের ছাত্র আন্দোলনের নেতা মো থি জুন নির্বাসন থেকে ফিরে আসেন।
অক্টোবর ২০১২
সিত্তিতে সর্ব-আরাকান ভিক্ষু সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। আরাকানের বৌদ্ধ জনগণের ওপর ভিক্ষুদের খুবই উঁচুমানের নৈতিক কর্তৃত্ব রয়েছে। সেসব ভিক্ষু উগ্রভাবে একটি রোহিঙ্গাবিরোধী ফতোয়া জারি করে, যেখানে শহরতলিকে একতাবদ্ধ হয়ে এই ‘সমস্যা’ ‘সমাধানে সাহায্যের’ আহ্বান জানানো হয়।
আরাকান/রাখাইন প্রদেশের নয়টি পৌরসভায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা পুনরায় বিস্ফোরিত হয়ে ওঠে। এর ফলে আরও প্রায় ৩৫ হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়, যাদের বেশির ভাগই মুসলিম। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনে বলা হয় যে রোহিঙ্গা ও কামান মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে অক্টোবরের এই হামলা সংগঠিত, প্ররোচিত ও বাস্তবায়িত হয়েছে স্থানীয় আরাকানীয় রাজনৈতিক দলীয় গোষ্ঠী, বৌদ্ধ সন্ন্যাস এবং সাধারণ আরাকানের নাগরিকদের মাধ্যমে, যেখানে সময়ে সময়ে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তারক্ষী বাহিনী সহায়তা করেছে। রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ ও শিশুকে হত্যা করা হয়েছে, অনেককে গণকবরে পুঁতে রাখা হয়েছে এবং তাদের গ্রাম ও আশপাশ সম্পূর্ণ ধ্বংস করা হয়েছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে ২৫ বছর বয়সী নির্যাতনের শিকার হয়েও বেঁচে যাওয়া একজন বলে, ‘প্রথমে সেনারা আমাদের বলল, “তোমরা চুপ করে থাকো, আমরা তোমাদের রক্ষা করব,” সে জন্যই আমরা তাদের বিশ্বাস করেছিলাম। কিন্তু পরে তারা সেই প্রতিশ্রুতি রাখেনি। আরাকানের স্থানীয়রা সহজেই আমাদের পিটিয়েছে এবং হত্যা করেছে। নিরাপত্তারক্ষীরা আমাদের রক্ষা করেনি।’
আসিয়ানের মহাসচিব সুরিন পিটসুভান দাবি করেন যে আরাকান/রাখাইন প্রদেশে সহিংসতা দমনে আসিয়ান, জাতিসংঘ এবং সরকারের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় আলোচনা শুরু করার জন্য আসিয়ানের দেওয়া প্রস্তাব মিয়ানমার সরকার প্রত্যাখ্যান করেছে।
জুন থেকে সহিংসতায় ১ লাখ ২৫ হাজার রোহিঙ্গা ও অন্যান্য মুসলিম, এবং অল্পসংখ্যক আরাকানের স্থানীয় মানুষকে অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু ব্যক্তিদের (আইডিপি) ক্যাম্পে বাস্তুচ্যুত করে পাঠিয়েছে।
নভেম্বর ২০১২
১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইনে রোহিঙ্গা মুসলিমদের রাষ্ট্রহীন করা হয়েছে। ‘রোহিঙ্গাদের সমান নাগরিকত্ব নিশ্চিত করতে’ নাভি পিল্লাই মিয়ানমার সরকারকে সেই নাগরিকত্ব আইন পুনর্বিবেচনা করার আহ্বান জানান।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ মিয়ানমারের মানবাধিকার অবস্থা বিষয়ে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে। সেখানে চলমান মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারে উদ্বেগ জানানো হয়। এ ছাড়া ‘কাচিন প্রদেশে চলমান সশস্ত্র সংঘাত দমনে ও রাখাইন প্রদেশে ছড়িয়ে পড়া ভয়াবহ সহিংসতা এবং নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘু, বিশেষ করে রোহিঙ্গাদের ওপর প্রভাব ফেলে এমন বৈষম্য ও মানবাধিকার লঙ্ঘন বন্ধে’ সরকারকে আহ্বান জানানো হয়।
আসিয়ানের ইন্টারপার্লামেন্টারি মিয়ানমার ককাস একটি বিবৃতি দেয়, যেখানে ২৬ নভেম্বরের প্রস্তাবকে স্বাগত জানানো হয়। সেখানে এ-ও বলা হয় যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে স্বীকৃতি দিতে সরকারের অস্বীকৃতি আন্তসম্প্রদায় উত্তেজনা ও সহিংসতার অবনতি ঘটাবে।
একজন বৌদ্ধ নারীকে ধর্ষণ ও হত্যার দায়ে রোহিঙ্গা পুরুষদের অভিযুক্ত করা হয়। এর প্রতিশোধ হিসেবে বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদীরা রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়, ২৮০ জনেরও বেশি মানুষকে হত্যা করে এবং হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে বাস্তুচ্যুত করা হয়। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ রোহিঙ্গাবিরোধী সহিংসতাকে ‘জাতিগত নিধন অভিযানের’ অংশ হিসেবে সংঘটিত ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ’ হিসেবে আখ্যায়িত করে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামা অধিক সংস্কারের বিনিময়ে ‘বন্ধুত্বের হাত’ বাড়িয়ে দেওয়ার প্রস্তাব দেন। তিনি রোহিঙ্গা সংখ্যালঘুদের সঙ্গে সমঝোতা করার অনুরোধ জানান।
রোহিঙ্গা ও রাখাইন জনগোষ্ঠীর মধ্যে দাঙ্গায় ১০০ জনেরও বেশি প্রাণ হারায়, যার অধিকাংশই রোহিঙ্গা। হাজার হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার রোহিঙ্গাকে রাখাইনের ক্যাম্পে জোরপূর্বক পাঠানো হয়।
জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি ২০১৩
সামরিক বাহিনী কাচিন বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে থাকা সবচেয়ে বড় শহর লাইজা ঘিরে ফেলে। সরকার ও বিদ্রোহীরা যুদ্ধবিরতি ও চীনের মধ্যস্থতায় রাজনৈতিক সংলাপ শুরু করতে রাজি হয়।
মার্চ ২০১৩
বৌদ্ধ ও মুসলিমদের মধ্যে আন্তসাম্প্রদায়িক সহিংসতা মিকতিলা শহর ছেয়ে ফেলে এবং আরও কিছু এলাকায় তা ছড়িয়ে পড়ে। এর ফলে অন্তত ৪০ জন নিহত হয় এবং ১২ হাজার বাস্তুচ্যুত হয়। রাষ্ট্রপতি থেইন সেইন মিকতিলায় জরুরি অবস্থা জারি করেন।
ভূ-উপগ্রহের মাধ্যমে সংগ্রহ করা ছবিতে জুন ২০১২ সাল থেকে চলতে থাকা সহিংসতা ঘটেছে এমন ১৩টি পৌরসভার ৫টিতে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ২৭টি অস্বাভাবিক ধ্বংস এলাকা খুঁজে পায়। সিত্তির আক্রান্ত এলাকার ছবিতে জুন ২০১২ সালে ঘটা ধ্বংসযজ্ঞে ২ হাজার ৫৫৮টি ধ্বংসপ্রাপ্ত স্থাপনা পাওয়া যায়। সহিংসতার এই খণ্ডচিত্র থেকে বোঝা যায় যে জুন থেকে আরাকান প্রদেশে অন্তত ৪ হাজার ৮৬২টি স্থাপনা ধ্বংস করা হয়েছে, যা সব মিলিয়ে মূলত আবাসিক সম্পত্তির ৩৪৮ একর এলাকাব্যাপী বিস্তৃত।
জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে, যেখানে রাখাইন প্রদেশে সহিংসতার জন্য দায়ীদের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে সরকারকে অনুরোধ করা হয়। এ ছাড়া কার্যকর মানবিক সহায়তা সহজতর করা এবং রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে বৈষম্য বন্ধের দাবি জানানো হয়।
মুসলিম ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মধ্যে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ায় মিয়ানমারে জাতিসংঘের মানবাধিকার-বিষয়ক বিশেষ দূত উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং সহিংসতা ছড়িয়ে পড়া বন্ধে সরকারকে আশু ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানান। তিনি বলেন যে বৈষম্য এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ নিরসনে সরকার যথেষ্ট ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।
এপ্রিল ২০১৩
অস্ত্র অবরোধ ও অভ্যন্তরীণ দমন-পীড়নে ব্যবহূত হতে পারে এমন যন্ত্রে অবরোধ ছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাকি সব ক্ষেত্রে মিয়ানমারের ওপর থেকে অবরোধ তুলে নেয়।
জুন ও অক্টোবর ২০১২ সালে রাখাইন প্রদেশে সংঘটিত সহিংসতার সময়ে কেন্দ্রীয় সরকার ও স্থানীয় কর্তৃপক্ষের ভূমিকার বিষয়ে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ একটি তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে দেখা যায় যে ২০১২ সালের জুনে রোহিঙ্গা ও কামান মুসলিম জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে পরিচালিত অপরাধমূলক কার্যক্রম মানবতাবিরোধী অপরাধের সমতুল্য এবং জাতিগত নিধনের অংশ হিসেবে এটা করা হয়েছিল।
রাখাইন প্রদেশে সংঘাত তদন্ত কমিশন জুন ও অক্টোবর ২০১২ সালের সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ওপর প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে উদ্বাস্তু শিবিরগুলোয় মানবিক সহায়তা বৃদ্ধি এবং সব গোষ্ঠীর মানবাধিকার সুরক্ষা নিশ্চিত করার আহ্বান জানানো হয়।
মে ২০১৩
প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন ওয়াশিংটন সফর করেন। প্রেসিডেন্ট ওবামা মিয়ানমারের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির প্রশংসা করেন, কিন্তু রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে পরিচালিত সহিংসতার সমালোচনা করেন। মার্চ মাসে মিকতিলায় সহিংসতার জন্য ছয়জন মুসলিমকে জেলে পাঠানো হয়। কোনো বৌদ্ধ অভিযুক্ত হয়নি।
ওবামা মিয়ানমারের ওপর চলমান অবরোধ আরও এক বছর বাড়িয়ে দেন, কিন্তু ১৯৯৬ সালের ভিসা অবরোধ তুলে নেন।
রাখাইন প্রদেশের মংডু জেলার সরকারি কর্তৃপক্ষ রোহিঙ্গা পরিবারের ওপর দুই সন্তান পর্যন্ত সীমারেখা টেনে দেয়।
শান প্রদেশের লাসিওতে মুসলিমবিরোধী সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। বৌদ্ধ রায়তকারীরা একটি মসজিদ, এতিমখানা এবং মুসলিমদের ব্যবসা ধ্বংস করে দেয়। ফলে ১ হাজার ৪০০ মুসলিম উদ্বাস্তু হয়ে পড়ে।
মিয়ানমারের মানবাধিকার অবস্থার বিষয়ে জাতিসংঘের বিশেষ দূত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর দুই সন্তান নীতি আরোপের ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণে কেন্দ্রীয় সরকারকে আহ্বান জানান। তিনি বলেন যে এটা ‘স্পষ্ট মানবাধিকার লঙ্ঘন, যেখানে একটি বিশেষ নৃগোষ্ঠী ও ধর্মীয় গোষ্ঠীকে লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে।’
জুন ২০১৩
রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে পরিচালিত সহিংসতা ও ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের সমালোচনা করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে। মিয়ানমার সরকারকে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সুরক্ষা নিশ্চিত করা এবং জাতিসংঘের একটি মানবাধিকার কার্যালয় স্থাপনের জন্য সেখানে অনুরোধ করা হয়, যাতে করে মানবাধিকার পরিস্থিতির পর্যাপ্ত নজরদারি করা যায়।
জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল মিয়ানমারে ব্যাপক আকারে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে, বিশেষ করে রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গা ও অন্যান্য মুসলিম সম্প্রদায়ের বিষয়ে। সেখানে সব ধরনের সহিংসতা বন্ধে ও রোহিঙ্গাদের সম্পূর্ণ নাগরিকত্ব প্রদানে জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণের ব্যাপারে সরকারকে অনুরোধ করা হয়।
ইয়াঙ্গুনে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা বৌদ্ধ নেতাদের সম্মেলনে মিলিত হয়ে একটি আন্তধর্মীয় বিবাহ আইন প্রস্তাব করেন। সেখানে বৌদ্ধ নারী মুসলিম পুরুষকে বিয়ে করার ব্যাপারে বিধিনিষেধ আরোপ করার কথা বলা হয়। এ ছাড়া কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনুমতি নেওয়া এবং মুসলিম পুরুষকে ধর্মান্তরিত হওয়ার বিধান রাখার প্রস্তাব করা হয়।
মিয়ানমার-বিষয়ক জাতিসংঘের আবাসিক ও মানবিক সমন্বয়ক অশোক নিগামের দাখিল করা প্রতিবেদনে দেখা যায় যে রাখাইনে জুন ও অক্টোবর ২০১২ সালের সহিংসতা থেকে এই পর্যন্ত ১ লাখ ৪০ হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। এ ছাড়া ১৬৭ জন মানুষের মৃত্যু ঘটেছে এবং ১০ হাজার ভবন ধ্বংস করা হয়েছে।
নাভি পিল্লাই মিয়ানমারের সরকারকে নৃতাত্ত্বিক ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে চলমান বৈষম্য দমনে আহ্বান জানান।
ইসলামি সহযোগিতা সংগঠনের মহাসচিব একমেলেদ্দিন এহসানোগলু মিয়ানমার সরকারকে মুসলিমদের বিরুদ্ধে সব ধরনের প্ররোচনা ও বৈষম্য অপসারণের দায়িত্ব গ্রহণের অনুরোধ জানান। তিনি রোহিঙ্গাদের ওপর আরোপ করা দুই সন্তান নীতির ব্যাপারেও ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানান।
প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী নাসাকা ভেঙে ফেলার ঘোষণা দেন। নাসাকার বিরুদ্ধে রোহিঙ্গাদের বিচারবহির্ভূত হত্যা, যথেচ্ছাচার গ্রেপ্তার ও আটক, নির্যাতনসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের দীর্ঘদিনের অভিযোগ রয়েছে।
জানুয়ারি ২০১৪
মংডু ও রাখাইন প্রদেশের রাজধানী সিত্তেতে রোহিঙ্গাবিরোধী রাষ্ট্রীয় সহিংসতার নতুন ঢেউ শুরু হয়।
সিত্তির কাছে রোহিঙ্গা থে চুয়াং শরণার্থী শিবিরের জন্য একমাত্র সরকারি হাসপাতাল থেকে স্টাফ ও ওষুধপত্র প্রত্যাহার করে নেয়।
ফেব্রুয়ারি ২০১৪
প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন মুসলিম পুরুষ ও বৌদ্ধ নারীদের আন্তধর্মীয় বিয়ে বন্ধে আনীত বিলের প্রতি তাঁর সমর্থন ঘোষণা করেন।
সরকার চিকিত্সা সাহায্য এনজিও মেডিসিন সানস ফ্রন্টিয়ার্সকে বহিষ্কার করে। এ ছাড়া উত্তর রাখাইন প্রদেশে সব ধরনের প্রাপ্তিসাধ্য জরুরি ও স্বাস্থ্যসেবা কার্যকরভাবে অপসারণ করে।
থাইল্যান্ড ঘোষণা করে যে তারা নভেম্বর ২০১৩ থেকে এই পর্যন্ত প্রায় ১ হাজার ৩০০ রোহিঙ্গা মিয়ানমারে ফেরত পাঠিয়েছে।
মিয়ানমারের মানবাধিকার অবস্থাবিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ দূত সে দেশে তাঁর শেষ সফর সমাপ্ত করেন। তিনি ‘রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ঘৃণায় প্ররোচনা দিতে পরিচালিত অভিযান’, মুসলিম সম্প্রদায়কে বিচ্ছিন্ন করার চলমান প্রক্রিয়া এবং মুসলিমদের নির্যাতনকারী ও হত্যাকারীদের দায়মুক্তির ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। প্রতিবাদকারীরা তার ‘বাঙালি’প্রীতির ব্যাপারে অভিযোগ করে এবং রোহিঙ্গা পরিচয় অস্বীকার করে।
মেডিকেল সানস ফ্রন্টিয়ার্সকে মিয়ানমার থেকে বহিষ্কারের পর তাদের তত্ত্বাবধানে থাকা হাজার হাজার রোহিঙ্গা রোগীর ভবিষ্যত্ বিষয়ে বিবৃতি প্রকাশ করে।
মার্চ ২০১৪
রাখাইন জাতীয়তাবাদীরা রোহিঙ্গাদের সহায়তাকারী বিদেশি সাহায্যকারীদের ওপর আক্রমণ চালায়।
সরকারি তদন্ত কমিশন দু চি ইয়ার তান গ্রামের ঘটনার ওপর তাদের চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে মৃত্যুর ‘কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি’ এবং রোহিঙ্গাবিরোধী সহিংসতা ঘটেছে বলে যেসব অভিযোগ, তাও অস্বীকার করা হয়।
মিয়ানমারের মানবাধিকার-বিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ দূত তাঁর চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। সেখানে বলা হয় যে রাখাইন প্রদেশে ‘ব্যাপক বৈষম্য ও মানবাধিকার লঙ্ঘন ঠেকাতে রাষ্ট্রীয় ও প্রদেশ পর্যায়ে কোনো স্পষ্ট পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি’ এবং রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ‘যে ধরনের ব্যাপক ও পদ্ধতিগত মানবাধিকার লঙ্ঘন ঘটেছে’, বিশেষ করে ২০১২ সালের জুন থেকে, তা মানবতাবিরোধী অপরাধের সমতুল্য।
বৌদ্ধ গোষ্ঠীগুলো সিত্তেতে কাজ করা আন্তর্জাতিক সাহায্য গোষ্ঠী ও জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর কার্যালয় ও কর্মীদের ঘরবাড়িতে আক্রমণ চালায়। প্রায় ১২০ জনেরও বেশি কর্মী সাময়িকভাবে সেই অঞ্চল ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।
জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল ‘মিয়ানমারের মানবাধিকার পরিস্থিতি’র ওপর সর্বসম্মতভাবে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে, বিশেষ দূতের আজ্ঞা আরও এক বছর বৃদ্ধি করে, রোহিঙ্গা ও অন্য সংখ্যালঘুদের পরিস্থিতির ব্যাপারে গুরুতর উদ্বেগ প্রকাশ অব্যাহত রাখে এবং সব সহিংসতা ও নির্যাতনের স্বাধীন তদন্তের অনুরোধ করে।
আন্তধর্মীয় বিয়ের ওপর জারি করা নিষেধাজ্ঞাবিষয়ক প্রস্তাবিত আইনের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়ার জন্য মানবাধিকার-বিষয়ক আসিয়ানের সাংসদদের সংগঠন এপিএইচআর মিয়ানমারের আইনপ্রণেতাদের আহ্বান জানায়। আসিয়ানের সাংসদেরা খসড়া আইনকে ‘বৈষম্যমূলক’ এবং ‘স্বাধীনতা ও ধর্মীয় বিশ্বাসবিষয়ক মৌলিক অধিকারের আন্তর্জাতিক চুক্তির সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক’ বলে আখ্যায়িত করে।
মিয়ানমার ১৯৮৩ সালের পর প্রথম আদমশুমারি পরিচালনা শুরু করে এবং ঘোষণা করে যে তারা রোহিঙ্গাদের নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃতি দেবে না।
এপ্রিল ২০১৪
তিন দশকের মধ্যে প্রথম অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া মিয়ানমারের ২০১৪ সালের আদমশুমারিতে মুসলিমদের ‘রোহিঙ্গা’ হিসেবে নিবন্ধন করা থেকে নিষিদ্ধ করা হয়।
জাতিসংঘের মানবিক বিষয়াবলি সমন্বয়ের কার্যালয় প্রতিবেদনে বলে যে সিত্তি আক্রমণের পরে সহায়তায় বিঘ্ন ঘটায় রাখাইনে মানবিক কার্যক্রম ‘গুরুতরভাবে আক্রান্ত’ হয়েছে।
জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিল বলে যে দেশটির আদমশুমারি প্রায় সম্পন্ন হয়েছে। প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ গণনা করা হয়েছে। রাখাইনে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী এবং কাচিন প্রদেশে কাচিন স্বাধীনতা সংগঠনের নিয়ন্ত্রণাধীন মানুষের গণনা করা সম্ভব হয়নি।
উত্তরে সরকারি সৈন্য ও কাচিন বিদ্রোহীদের সংঘর্ষে অন্তত ২২ জন মানুষ
নিহত হয়।
মে ২০১৪
যুক্তরাষ্ট্র আরও এক বছরের জন্য কিছু নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ বৃদ্ধি করে। বলা হয় যে সাম্প্রতিক কালে সংস্কার হলেও অধিকার হরণ এবং রাজনীতি ও অর্থনীতিতে সেনাবাহিনীর প্রভাব রয়ে গেছে।
লন্ডনের কুইন মেরি কলেজের গবেষণা দল যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনকে চিঠি লেখে: রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সহিংসতা ও বৈষম্য বৃদ্ধির রাষ্ট্রীয় চর্চা রুয়ান্ডা, জার্মানি ও বসনিয়ায় ব্যাপক আকারে হত্যার সময়ের পরিস্থিতি প্রতিফলিত করছে।
জুন ২০১৪
জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর বলে যে যেসব রোহিঙ্গা ও অন্য মুসলিমরা আরাকান প্রদেশে সংঘটিত সহিংসতা ও নির্যাতন থেকে বাঁচতে নৌকায় করে পালিয়েছে তাদের ওপর চালানো নির্যাতন ও শোষণের ক্রমবর্ধমান খবর সংস্থাটির কাছে আসছে। সংস্থাটি আরও বলে যে ২০১২ সাল থেকে ৮৬ হাজারেরও বেশি মানুষ নৌকায় চড়ে পালিয়েছে, যার মধ্যে ২০১৩ সালব্যাপী পালিয়েছে ৫৫ হাজার এবং জানুয়ারি ও এপ্রিল ২০১৪ সালে ১৫ হাজার।
জাতিসংঘের মানবিক সহায়তাবিষয়ক সহকারী সমন্বয়ক কিয়ুং-ওয়া ক্যাং বলেন যে সাহায্যকর্মীদের ওপর মার্চ মাসের আক্রমণের পর আরাকানে চলমান মানবিক সহায়তা কমিউনিটির বর্তমান সক্ষমতা ‘এখনো আগের তুলনায় ৬০ শতাংশ কম’।
মিয়ানমারে ধর্মীয় স্বাধীনতা, সংখ্যালঘু বিষয় ও মানবাধিকার পরিস্থিতিবিষয়ক জাতিসংঘের তিনজন বিশেষ দূত ‘ধর্মান্তরিতকরণ’ বিষয়ে নেওয়া খসড়া বিল বাতিলে মিয়ানমার সরকারকে আহ্বান জানান। তাঁরা সতর্ক করে দিয়ে বলেন যে এই বিল ধর্মীয় ও নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘুবিরোধী বৈষম্য সৃষ্টি করবে এবং ‘মানবাধিকারকে সম্মান জানানো ও রক্ষা করা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের একজন দায়িত্বশীল সদস্য হওয়ার পথ থেকে মিয়ানমারের বিচ্যুত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি করবে।’
এপিএইচআর বলে যে মিয়ানমার সরকার মেডিকেল সানস ফ্রন্টিয়ার্সকে বহিষ্কার করার ফলে অনেক রোহিঙ্গা প্রতিরোধযোগ্য রোগে মৃত্যুবরণ করেছে।
জুলাই ২০১৪
মান্দালায় মুসলিমদের দোকান, বাড়ি ও একটি মসজিদ আক্রমণ করা হয়। দুজন নিহত হয়।
আগস্ট ২০১৪
ইউএনএইচসিআর তাদের প্রতিবেদনে বলে যে ২০১২ সালে ছড়িয়ে পড়া সহিংসতায় প্রায় ৮৭ হাজার মানুষ রাখাইন প্রদেশ থেকে বঙ্গোপসাগর দিয়ে পালিয়েছে, যাদের বেশির ভাগই রোহিঙ্গা। এ সময়ে অন্তত ২০০ মানুষ নিহত হয়।
অক্টোবর ২০১৪
মিয়ানমারে জাতিসংঘের বিশেষ দূত জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ভাষণ দেন। সেখানে তিনি মিয়ানমারের সংস্কার-প্রক্রিয়ার উল্টোরথের নজির বিষয়ে সতর্ক করে দেন। এর মধ্যে রাখাইন প্রদেশে ‘ব্যাপক গোলমেলে’ পরিস্থিতির কথাও বলেন, যেখানে ‘চলাফেরার স্বাধীনতায় বিধিনিষেধ আরোপ করায় স্বাস্থ্যসেবা, জীবিকা, পানি, খাদ্য ও পয়োনিষ্কাশনের মতো মৌলিক অধিকার মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হয়েছে’। এ ছাড়া ‘রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীবিরোধী বৈষম্যের দীর্ঘ ইতিহাসে মানবাধিকার লঙ্ঘন যোগ হয়েছে।’
অক্টোবর-নভেম্বর ২০১৫ সালে সংসদ নির্বাচন ধার্য করা হয়। সরকার ৩ হাজার বন্দীর মুক্তি ঘোষণা করে। মিয়ানমারের পরিস্থিতির ওপর নজর রাখা ব্যক্তিরা বলেন যে এসব বন্দীর মধ্যে সাবেক সামরিক গোয়েন্দা কর্মকর্তারাও রয়েছেন, যাঁরা ২০১২ সালে মুক্তি পাওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী খিন নিন্তের সঙ্গে কারাবন্দী হয়েছিলেন।
নভেম্বর ২০১৪
নে পাই তাওয়ে পূর্ব এশিয়া সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ওবামা গণমাধ্যমকে বলেন যে যুক্তরাষ্ট্র ‘একটি নতুন পরিকল্পনা দেখতে চায় যেখানে আত্মচিহ্নিতকরণ ছাড়াই স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে।’
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের তৃতীয় কমিটি একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে, যেখানে রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতি সম্পর্কে গুরুতর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। সেখানে মিয়ানমার সরকারকে চলাফেরার স্বাধীনতা, পরিপূর্ণ নাগরিকত্বে সমান অধিকার এবং রোহিঙ্গাদের জন্য আত্মচিহ্নিতকরণের সুযোগ দেওয়ার দাবি জানায়।
জানুয়ারি ২০১৫
রাখাইন ন্যাশনাল পার্টির মুখপাত্র সাক্ষাত্কারে বলেন যে ‘যখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তাদের (রোহিঙ্গা) অনেক বেশি খাদ্য ও দান প্রদান করবে, তখন তারা আরও বেশি মোটা ও শক্তিশালী হবে এবং তারা আরও বেশি সহিংস হবে।’
ফেব্রুয়ারি ২০১৫
চীন সীমান্তে শান প্রদেশে কোকাং বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে সংঘর্ষে প্রায় ৫০ জন সৈন্য নিহত হয়। সরকার কোকাং অঞ্চলে সাময়িকভাবে মার্শাল ল জারি করে।
প্রস্তাবিত সাংবিধানিক গণভোটকে সামনে রেখে বৌদ্ধদের রাস্তায় বিক্ষোভের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার মুসলিম রোহিঙ্গাদের দেওয়া সাময়িক ভোটাধিকার প্রত্যাহার করে নেয়।
মার্চ ২০১৫
মিয়ানমারের মানবাধিকার পরিস্থিতিবিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ দূত তাঁর সফর শেষে এক বিবৃতিতে বলেন যে আটক মুসলিম উদ্বাস্তুদের ‘ব্যাপক অধিকার সীমিতকরণ’ করা হয়েছে, যেখানে ‘অপরিহার্য সেবাগুলোও’ রয়েছে। তিনি ‘রোহিঙ্গা সংখ্যালঘুদের পরিপূর্ণ নাগরিকত্বে সমান অধিকার দেওয়ার’ দাবি পুনরায় ব্যক্ত করেন।
অনেক রোহিঙ্গার কাছে থাকা পরিচয়পত্র (সাদা কার্ড) মিয়ানমার সরকার অবৈধ ঘোষণা করে। সরকার রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ থেকে আসা অবৈধ অভিবাসী বলে আখ্যায়িত করে তাদের ‘বাঙালি’ হিসেবে নাগরিকত্বের জন্য আবেদনে বাধ্য করে।
সরকার ও ১৬টি বিদ্রোহী গোষ্ঠীর মধ্যে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
মে ২০১৫
লন্ডনভিত্তিক কুইন মেরি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা দল প্রতিবেদনে বলে যে আগে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে মিশ্রাবস্থায় বসবাস করা ১ লাখ মুসলিমকে সিত্তির উপকণ্ঠে জনবহুল ও বিচ্ছিন্ন আটককেন্দ্রের নোংরা শিবিরে জোরপূর্বক পাঠানো হয়েছে। আরও ৪ হাজার ২৫০ জন রোহিঙ্গা সিত্তি শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত অং মিঙ্গালার নামক সামরিক ঘাঁটিতে নিরাপত্তাহীনভাবে বেঁচে আছে।
শত শত রোহিঙ্গা মুসলিম বাংলাদেশ থেকে আসা অভিবাসীদের সঙ্গে মিলে লগবগে নৌকায় সমুদ্র পাড়ি দেয়। দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলো তাদের উদ্ধার করতে ব্যর্থ হওয়ায় জাতিসংঘ সে দেশগুলোর সমালোচনা করে।
জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা, আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক অভিবাসন ও উন্নয়নবিষয়ক জাতিসংঘের মহাসচিবের বিশেষ প্রতিনিধি একটি বিবৃতি প্রকাশ করে, যেখানে বঙ্গোপসাগর ও আন্দামান সাগরে নৌকায় অসহায় অভিবাসী ও শরণার্থীদের সুরক্ষা দিতে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডের নেতাদের অনুরোধ করা হয়। এ ছাড়া নৌকা থেকে তাদের নিরাপদে উদ্ধার ও জীবন রক্ষা, অধিকার রক্ষা ও মানবিক মর্যাদা অক্ষুণ্ন রাখতেও সেসব দেশের নেতাদের অনুরোধ করা হয়।
তথাকথিত ‘জাতি ও ধর্ম রক্ষা’ চারটি বিলের প্রথমটি জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ স্বাস্থ্যসেবা বিল আইনে পরিণত করায় জাতিসংঘের পাঁচজন বিশেষ দূত সতর্কতা জারির মাধ্যমে একটি বিবৃতি প্রকাশ করেন। সেখানে বলা হয় যে ‘এই বিল বিশেষ করে নৃতাত্ত্বিক ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রতি বৈষম্যমূলক এবং দেশে বিদ্যমান উত্তেজনা বাড়াতে পারে।’
আর্চবিশপ ডেসমন্ড টুটু ‘রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ধীর গণহত্যা সংঘটন করা হচ্ছে’ বলে সতর্ক করে দেন।
রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমারের নির্যাতন বন্ধে অসলো সম্মেলন
অনুষ্ঠিত হয়।
জুলাই ২০১৫
জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে, যেখানে মিয়ানমার সরকারকে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব প্রদান ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে বৈষম্য ও পক্ষপাত ছড়ানো বন্ধের দাবি জানানো হয়।
অক্টোবর ২০১৫
মিয়ানমারের মানবাধিকার পরিস্থিতিবিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ দূত জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যেখানে ‘মানবাধিকার-বিষয়ক পূর্ববর্তী উদ্বেগগুলোর কোনো বড় ধরনের অগ্রগতি পাওয়া যায়নি, বিশেষ করে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে দীর্ঘস্থায়ী ও প্রাতিষ্ঠানিক বৈষম্য।’
নভেম্বর ২০১৫
মিয়ানমারে ১৯৯০ সালের পর প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। অং সান সু চির নেতৃত্বাধীন বিরোধী দল এনএলডি সংসদীয় নির্বাচনে সরকার গঠনের জন্য পর্যাপ্ত আসন লাভ করে।
ফেব্রুয়ারি ২০১৬
ইউএনএইচসিআর এক প্রতিবেদনে বলে, ২০১২ সাল থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ২ হাজার মানুষ বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে মারা গেছে, যাদের বেশির ভাগই রোহিঙ্গা মুসলিম।
মার্চ ২০১৬
হিন কোয়াও প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। ৫০ বছর সামরিক শাসনের পর সু চির গণতান্ত্রিক আন্দোলন ক্ষমতা গ্রহণ করায় একটি ‘নতুন যুগের’ সূচনা ঘটে।
অক্টোবর ২০১৬
শত শত ইসলামি উগ্রবাদী তিনটি সীমান্তরক্ষীদের চৌকিতে হামলা করে নয়জন পুলিশ সদস্যকে হত্যা করে বলে পুলিশ দাবি করে। প্রাথমিকভাবে পুলিশ দাবি করেছিল আক্রমণকারীদের সঙ্গে অনেক দিন ধরে বিলুপ্ত থাকা উগ্রবাদী গোষ্ঠী হিসেবে তকমা পাওয়া রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের সংযোগ রয়েছে। সেই এলাকাকে ‘সন্ত্রাসবিরোধী জোন’ ঘোষণা করা হয়। পরে সরকার দাবি করে যে আক্রমণকারীরা আকা-মুল-মুজাহিদিন নামে একটি জিহাদি গোষ্ঠীর সদস্য, যার নেতাকে পাকিস্তানে তালেবানরা প্রশিক্ষণ দিয়েছে। কয়েক দিন পরে ভারত ভ্রমণে গিয়ে হিন্দুস্তান টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাত্কারে সু চি দাবি করেন যে এটা শুধু একটি উত্স থেকে পাওয়া একটি তথ্য, আমরা এটাকে চূড়ান্তভাবে সঠিক হিসেবে ধরে নিতে পারি না।
উত্তর আরাকান প্রদেশের মংডু, বুথিডং ও রাথিডং শহরের আশপাশে সৈন্য সমাবেশ করা হয়। আবদ্ধ পরিস্থিতির কয়েক দিনের মাথায় প্রদেশের রাজধানী সিত্তিতে ৮ শতাধিক আরাকানের বৌদ্ধ জড়ো হয়। ১২০০-এর বেশি মুসলিম তাদের গ্রাম ছেড়ে পালায় এবং বুথিডং শহরে আশ্রয় নেয়। রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে খবর আসে যে বৌদ্ধদের নিরাপত্তার কারণে হেলিকপ্টারে করে সরানো হয়। প্রথম আক্রমণের পর এক ডজনেরও বেশি মানুষ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয় বলে নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় বলা হয়।
মিয়ানমার টাইমস-এর জন্য কাজ করা স্কটিশ অনুসন্ধানী সাংবাদিক ফিওনা ম্যাকগ্রেগর প্রতিবেদনে বলেন যে অপারেশন জোনে বার্মার নিরাপত্তা বাহিনী কর্তৃক রোহিঙ্গা নারীদের ওপর যৌন নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে বলে অধিকারকর্মীরা নিশ্চিত করেছেন। এই প্রতিবেদনের পর ‘পত্রিকার সুনাম ক্ষুণ্ন হয়েছে’ বলে ম্যাকগ্রেগরকে বরখাস্ত করা হয়। তাঁর সম্পাদক ডগলাস লংকে সাংবাদিক রক্ষার্থে করা কমিটির প্রতিনিধির কাছে এ ঘটনার কথা বলার দুই সপ্তাহ পরে বরখাস্ত করা হয় এই বলে যে তিনি ‘পত্রিকার মিশন নষ্ট করেছেন’।
নভেম্বর ২০১৬
আরাকান প্রদেশের পুলিশপ্রধান সেইন লুইন বলেন যে স্থানীয় পুলিশ অমুসলিম অধিবাসীদের একটি বেসামরিক নিরাপত্তা বাহিনীকে সশস্ত্র করবে ও প্রশিক্ষণ দেবে। আইনজীবীদের আন্তর্জাতিক কমিশন এটাকে ‘দুর্যোগের কৌশল’ হিসেবে আখ্যায়িত করে। রয়টার্স এক প্রতিবেদনে বলে যে এই পরিকল্পনা ইতিমধ্যে প্রদেশের রাজধানী সিত্তিতে বাস্তবায়িত হচ্ছে।
মংডুর কাছের গ্রামগুলোয় বার্মার সেনাবাহিনী হেলিকপ্টার থেকে গোলাবর্ষণ শুরু করে। দুই দিনে এই সহিংসতায় আনুমানিক ১৫ হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়। কোনো কোনো পর্যবেক্ষক এই ঘটনাকে বর্ণনা করেন ‘ফোর কাট’ কৌশল হিসেবে। দেশটির অসংখ্য সশস্ত্র নৃতাত্ত্বিক বিদ্রোহী গোষ্ঠীকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য দশকের পর দশক এই কৌশল ব্যবহার করা হচ্ছে।
বার্মার রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম ট্রু নিউজ ইনফরমেশন টিম অব ডিফেন্স সার্ভিস চালু করে, যা স্থানীয় ও আঞ্চলিক গণমাধ্যমে হতাহত ও সম্পদ ধ্বংস-সম্পর্কিত খবরের ‘জালিয়াতি’ যাচাই করবে। কমপক্ষে একজন মুসলিম সাংবাদিক হত্যার হুমকিসহ ইন্টারনেট হয়রানির শিকার হয়।
ডিসেম্বর ২০১৬
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ওবামা মিয়ানমারের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয় এই বলে যে দেশটি মানবাধিকার বিষয়ে যথেষ্ট উন্নতি করেছে। রোহিঙ্গাদের ওপর হামলার মধ্যেই এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। কেউ কেউ যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপকে অপরিপক্ব বলে আখ্যায়িত করে।
আগস্ট ২০১৭
রোহিঙ্গা বিদ্রোহীরা ৩০টি পুলিশ স্টেশনে হামলা করে। এর ফলে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক সামরিক অভিযান শুরু হয়। হাজার হাজার রোহিঙ্গা রাখাইন প্রদেশ থেকে পালিয়ে যায়।
সেপ্টেম্বর ২০১৭
বাংলাদেশ শুরুতে সশস্ত্র সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে (বিজিবি) রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে দিতে নির্দেশ দেয়। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সীমান্ত দিয়ে বয়ে চলা নাফ নদী অতিক্রম করার সময় শত শত রোহিঙ্গা মারা যায়।
যখন নাফ নদীতে মৃত শিশু ও ডুবে যাওয়া নৌকার ছবি প্রচারিত হয়, তখন বাংলাদেশের ভেতর থেকে শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ার দাবি উঠতে থাকে। সরকার অবস্থান বদলে রোহিঙ্গাদের দেশের ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দেয়।
সংকট দ্রুতগতিতে বাড়তে থাকলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সাড়া দেওয়ার চেষ্টা করে। জাতিসংঘ জরুরি অধিবেশন আহ্বান করে, কিন্তু চীন স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা দেয় যে তারা যেকোনো প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভেটো দেবে।
সু চি নির্যাতনের ঘটনা অস্বীকার করেন, ‘এই ধরনের ভুয়া তথ্য...বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে অনেক সমস্যা তৈরির লক্ষ্যে এবং সন্ত্রাসীদের স্বার্থ রক্ষার্থে ব্যবহূত বিকৃত তথ্যের বিরাট তুষারস্তূপের চূড়ামাত্র।’
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে ইঙ্গিত দেওয়া হয় যে ১ লাখ ২৫ হাজার রোহিঙ্গা শুধু হেঁটেই বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। জাতিসংঘের দ্বিতীয় আরেকটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ৩০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী রাখাইন প্রদেশের পার্বত্য এলাকায় ফাঁদে আটকা পড়ে আছে। তাদের খাদ্য বা পানির কোনো সুবিধা নেই।
জাতিসংঘ বিবৃতি দিয়ে বলে যে প্রায় ৩ লাখ রোহিঙ্গা সহিংসতা থেকে বাঁচতে মিয়ানমারের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে এসেছে। সেই বিবৃতিতে শরণার্থীদের জন্য খাদ্য সরবরাহে সংগঠনটির জরুরি অর্থসংকটের সতর্কতা দেওয়া হয়। অভ্যন্তরীণ বেসরকারি হিসাবে বলা হয়েছে, নতুন করে শরণার্থী রোহিঙ্গার সংখ্যা ৫ লাখ ছাড়াতে পারে।
বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গারা ধর্ষণ, বেপরোয়া হত্যাকাণ্ড ও ব্যাপক হারে পুরুষ, নারী ও শিশু পুড়িয়ে মারার কথা বলেছে। ভূ-উপগ্রহ থেকে তোলা ছবিতে রোহিঙ্গা গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
বামপন্থী রাজনৈতিক দল গণসংহতি আন্দোলন ঢাকায় জাতিসংঘের কার্যালয় ঘেরাও কর্মসূচি নিলে পুলিশ তা বানচাল করে দেয়।
বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে আদিবাসী জুম্মরা স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে তিন দশকব্যাপী সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। তারা নিজেদের বৌদ্ধ ধর্মবিশ্বাসের কারণে প্রতিশোধ আক্রমণের শঙ্কায় ভুগছে। ২০১২ সালে রামু আক্রমণের মতো ঘটনার আশঙ্কায় জুম্ম আন্দোলনকর্মীরা চিন্তিত।
জাতিসংঘের মানবাধিকার-বিষয়ক প্রধান রোহিঙ্গা মুসলিমদের ‘টেক্সটবুক’ জাতিগত নিধনের দায়ে মিয়ানমারকে অভিযুক্ত করেছে।
লেখাটি আলাল ও দুলাল কালেক্টিভ থেকে নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কাজ করে এমন একটি লেখক মোর্চা এই আলাল ও দুলাল কালেক্টিভ। এই মোর্চা তৈরি পোশাকশিল্পে নিরাপত্তাহীন শ্রমিক, মধ্যপ্রাচ্যে অসহায় অভিবাসী শ্রমিক এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসী জুম্ম বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর সংগ্রাম বিষয়ে লেখালেখি করে থাকে।
* অনুবাদ: খলিলউল্লাহ্