আঠারো শতকের শেষ পাদে ব্রিটেনে শিল্পবিপ্লবের পর উনিশ শতকের প্রথম সিকিতে দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লব ঘটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। ঐতিহাসিকভাবে এ ঘটনা খুবই অপ্রত্যাশিত, কেননা মার্কিনরা আদর্শগতভাবে শিল্পায়নে বিশ্বাসী ছিল না। উত্পাদন ক্ষেত্রে তাদের আদর্শ ছিল কৃষি অর্থনীতি। এ আদর্শের ভিত্তি ধর্মীয় বিশ্বাস। খ্রিষ্টধর্মে কৃষিকে আদর্শায়িত করা হয়েছে, ব্যবসা-বাণিজ্য-শিল্পকে নয়। ধর্মীয় কারণ ছাড়াও আদর্শগতভাবে মার্কিনরা সমকালীন ফরাসিদের মতো ফিজিওক্রেসি তত্ত্ব অনুসরণ করত। এ তত্ত্বমতে, সামাজিক সুখ ও শান্তির জন্য একমাত্র প্রাকৃতিক উপায় কৃষি, যা খ্রিষ্টধর্মে বরাবর নন্দিত ছিল। মার্কিনরা কৃষিকে অর্থনৈতিক আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছিল মূলত ধর্মীয় কারণেই। বেনজামিন ফ্রাঙ্কলিন, জর্জ ওয়াশিংটন, জন অ্যাডামস, টমাস জেফারসন, জেমস মেডিসন প্রমুখ প্রথম সারির নেতা সবাই ছিলেন ফিজিওক্রেসি দর্শনে বিশ্বাসী। স্বাধীনতার পর মার্কিন কংগ্রেস বাজার অর্থনীতি, বৈদেশিক ব্যবসা-বাণিজ্য, মুদ্রা অর্থনীতি, ব্যাংক প্রভৃতির বিপক্ষে অবস্থান নেয়। তবে বাজার অর্থনীতিতে বিশ্বাস না থাকা সত্ত্বেও, বিশ্ববাস্তবতার নিরিখে মার্কিন কংগ্রেস সীমিতভাবে মুদ্রা ও ব্যাংক প্রবর্তনের অনুকূলে সর্বপ্রথম আইন প্রণয়ন করে ১৭৯০ সালে। তবে মুদ্রা ও ব্যাংকিং ব্যবস্থা প্রবর্তনের পরও পরবর্তী দুই দশক পর্যন্ত মার্কিন দেশে কৃষি ও পণ্য বিনিময় অর্থনীতি ছিল সবচেয়ে প্রবলভাবে অধিষ্ঠিত। এ ধারা ক্রমেই পরিবর্তিত হয়ে আধুনিক বাজার অর্থনীতির রূপ ধারণ করে শিল্পবিপ্লবের পর। অর্থাত্ ১৮২০-এর দশক থেকে।
যে অর্থনীতিতে মুদ্রার প্রচলন ছিল না, ব্যাংকিং ব্যবস্থা ছিল না, যেখানে অর্থনীতি সঞ্চালিত হয়েছে সাধারণত সরাসরি কৃষিপণ্য ও শ্রম বিনিময়ের মাধ্যমে এবং যে অর্থনীতির তাত্ত্বিক ভিত্তি ছিল শিল্পবিরোধী ফিজিওক্রেসি; বিশেষ করে যেখানে ১৮১৩ পর্যন্ত সব রাষ্ট্রপতিই ছিলেন ফিজিওক্র্যাট অর্থাত্ শিল্পায়নের বিপক্ষে, সেখানে ১৮১৩ থেকে অর্থনীতিতে স্পষ্টত একটি শিল্পবিপ্লবের সূচনা বিস্ময়কর ঘটনা বটে। এই বিস্ময় বহুগুণ বেড়ে যাবে এটা মনে রাখলে যে এই অপ্রত্যাশিত ঘটনার নেপথ্যে রয়েছে মার্কিনদের অভ্যন্তরীণ উত্পাদনব্যবস্থা নয়; এর অন্তর্নিহিত কারণ তদানীন্তন বাংলার সাথে বাণিজ্য বা সংক্ষেপে বাংলা-বাণিজ্য। অথচ, এ বাংলা-বাণিজ্য পরিচালনার জন্য না ছিল মার্কিন সরকারের কোনো সমর্থন-সহযোগিতা, না ছিল ভারত মহাসাগর ও বাংলা সম্পর্কে কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা এবং না ছিল কোনো প্রাতিষ্ঠানিক পুঁজি জোগানের ব্যবস্থা। এমনকি ভারতের কোনো স্থানীয় সরকার বা অন্য কোনো এজেন্সির সঙ্গে মার্কিনদের কোনো যোগাযোগও ছিল না। এমনকি ভারত মহাসাগরের নাব্যতা-নৌ-চালনা বিষয়ে তাদের কাছে কোনো চার্ট পর্যন্ত ছিল না। এমতাবস্থায় মার্কিনরা স্বাধীনতালাভের পরপরই কীভাবে বঙ্গোপসাগরে এসে নোঙর ফেলল, এ বিষয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন অনেক নৌ-ঐতিহাসিক।১ যা হোক, নিউ ইংল্যান্ডের ইয়াংকিরা২ এ বিপ্লবের নায়ক। ইয়াংকি বণিকদের কলকাতা বাণিজ্যে যোগদান করার মধ্য দিয়েই সর্বপ্রথম মার্কিন দেশে বাজার অর্থনীতি প্রচলিত হয় এবং বিশেষ পরিস্থিতিতে ওই বাজার অর্থনীতিরই সরাসরি প্রভাবে অচিরেই ঘটে আমেরিকায় শিল্পবিপ্লব, যা কি না পৃথিবীর শিল্পবিপ্লবের ইতিহাসে দ্বিতীয় ঘটনা।
বাংলায় ইয়াংকি বণিকদের আগমন
১৭৭৬ সালে আমেরিকার স্বাধীনতাপ্রাপ্তির পরপরই, অর্থাত্ ১৭৮৪-৮৫ সাল থেকেই আমেরিকার ইয়াংকিরা বঙ্গোপসাগরীয় বাণিজ্যে যোগদান করে এবং বাংলায় বাণিজ্যের সম্ভাবনা নিয়ে তথ্যানুসন্ধান চালায় এবং অচিরেই কলকাতার আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য প্রসার লাভ করে। প্রশ্ন তোলা যায়, যেখানে পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের ব্যবসায় মার্কিনদের সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হলো, সেখানে ব্রিটিশ ভারতে তাদের এমন সুস্বাগত জানানোর কারণ কী? এ অঞ্চলে বাণিজ্য করার কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা বা সম্পর্ক না থাকা এবং হাতে কোনো পুঁজি না থাকা সত্ত্বেও কীভাবে এরা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার যুদ্ধ করে এর পরপরই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজত্ব বাংলায় এসে খোদ ব্রিটিশদের সঙ্গে বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতে পারে? এদের ভারত মহাসাগরীয় বাণিজ্যের পুঁজি ও নৌ-বল জোগাল কারা? কৃষিনির্ভর ও ফিজিওক্রেটিক মার্কিনদের পক্ষে অজানা-অচেনা বঙ্গোপসাগরে এসে বাণিজ্য করার সিদ্ধান্ত এসব প্রশ্নের উদ্রেক করে। তবে এসব প্রশ্নের জট খুলে যায় যখন দেখি বাংলায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সিভিলিয়ানরা লুটপাট এবং বেআইনিভাবে গড়ে তোলা বিশাল অর্থসম্ভার পণ্যে রূপান্তরিত করে তা ইয়াংকিদের মাধ্যমে স্বদেশে চালান করছে। অর্থাত্ ইয়াংকিদের ভারত ব্যবসার মূলে ছিল ব্যক্তিগত স্বার্থে ইংরেজ সিভিলিয়ানদের সহযোগিতা। ব্রিটিশ সিভিলিয়ানদের লুটপাটের মাধ্যমে গড়ে তোলা ব্যক্তিগত সম্পদ স্বদেশে প্রেরণের জন্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জাহাজ ব্যবহার করা সম্ভব ছিল না। সন্দেহ নেই যে ব্রিটিশ সিভিলিয়ানদের অসদুপায়ে অর্জিত সম্পদ ইয়াংকি জাহাজে করে স্বদেশে পাঠানোর পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই ইয়াংকিদের বঙ্গ বাণিজ্যে যোগদানের জন্য উত্সাহিত করা হয়।৩ সোজা কথায়, বাংলায় ইয়াংকিদের আগমনের মূলে ছিল প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে ব্যবসা করা নয়, যা তাদের পক্ষে মোটেই সম্ভব ছিল না, কেননা তাদের পুঁজির অভাব ছিল। এর মূল কারণ ছিল দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদ অর্জনকারী ব্রিটিশ সিভিলিয়ানদের চোরাই সম্পদ মার্কিনদের মাধ্যমে দেশে প্রেরণ করার সংকল্প।
মার্কিন-বাংলার বাণিজ্যিক সম্পর্কের স্বর্ণযুগ ছিল ১৭৯৫ থেকে ১৮২০ পর্যন্ত, যখন মার্কিন শিল্পবিপ্লব সম্পন্ন হয়। যা হোক, এ প্রচেষ্টায় দেখাতে চাই যে বাংলা-বাণিজ্য থেকে মার্কিনরা বিপুলভাবে বাণিজ্যিক পুঁজি নির্মাণের সুযোগ পেয়েছিল ১৮০৭ সাল পর্যন্ত। এর পর থেকে ইউরোপে ও ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ক্রমাগত ইঙ্গ-ফরাসি যুদ্ধের পরিবেশে এবং প্রায়ই মার্কিন বাণিজ্য জাহাজ বাজেয়াপ্ত করা ও বণিকদের বন্দী করে যুদ্ধের কাজে ব্যবহার করার পটভূমিতে মার্কিন কংগ্রেস এমবার্গো অ্যাক্ট (১৮০৭)-এর মাধ্যমে মার্কিনদের বৈদেশিক বাণিজ্যের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ফলে মার্কিন বণিকদের মহালাভজনক বাংলা-বাণিজ্য পরিচালনা অসম্ভব হয়ে ওঠে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে, বিপুল পরিমাণ বাণিজ্যিক পুঁজি বিনিয়োগের বাইরে এসে অলস পুঁজিতে পরিণত হয়। এহেন পরিস্থিতিতে অলস বাণিজ্যিক পুঁজিকে উত্পাদনমুখী কাজে বিনিয়োগ করার লক্ষ্যে বঙ্গ বাণিজ্যে রত ফ্রান্সিস কেবট লয়েল ও প্যাট্রিক ট্রেসি জ্যাকসনের নেতৃত্বে কতিপয় ভারতীয় বণিক ইংল্যান্ডের আদলে আমেরিকায়ও একটি শিল্পবিপ্লব বিকাশের সিদ্ধান্ত নেন। ১৮১২ থেকে ১৮২০ সালের মধ্যেই তাঁরা নিউ ইংল্যান্ডে বেনিয়া পুঁজিবাদ থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে ইংল্যান্ডের মতো একটি শিল্পভিত্তিক পুঁজিবাদী উত্পাদনব্যবস্থা প্রবর্তনে সমর্থ হন।৪ ঐতিহাসিক ভেরা শ্লেকম্যান এই গ্রুপটির নাম দেন বোস্টন অ্যাসোসিয়েটস (Boston Associates)।৫ এই বোস্টন অ্যাসোসিয়েটসই আমেরিকার শিল্পবিপ্লবের রূপকার। এ গোষ্ঠীর সবাই কোনো না কোনো সময় কলকাতা বাণিজ্যের মাধ্যমে ভাগ্য পরিবর্তন করেন। এটা এখন সর্বস্বীকৃত সত্য যে মার্কিন শিল্পবিপ্লবের রূপকার ছিল বোস্টন অ্যাসোসিয়েটস। এ প্রবন্ধে আমাদের লক্ষ্য হবে মার্কিন শিল্পবিপ্লবে বোস্টন অ্যাসোসিয়েটসদের চিহ্নিত করা এবং মার্কিন শিল্পবিপ্লবে তাঁদের অবদান মূল্যায়ন করা।
শিল্পবিপ্লবের আগে মার্কিনদের অর্থনৈতিক জীবনধারা
কলকাতা বাণিজ্যে যোগদানকালে মার্কিনদের অর্থনৈতিক জীবনযাত্রা কেমন ছিল, এ ব্যাপারে সামান্য দৃষ্টিপাত প্রাসঙ্গিক। দাসশ্রমভিত্তিক কৃষি ছিল স্বাধীনতা-পূর্ব মার্কিন অর্থনীতির মূল বৈশিষ্ট্য। আদর্শিকভাবে মার্কিন কৃষক, ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদ সবাই ছিলেন ফিজিওক্রেসি মতবাদে বিশ্বাসী। এ মতবাদ অনুসারে, মানুষে মানুষে সাম্য ও সম্প্রীতি রক্ষার শ্রেষ্ঠ পথ কৃষি অর্থনীতি। ফিজিওক্রেসি তত্ত্বমতে, অর্থনীতির মূলমন্ত্র হওয়া উচিত কৃষি, কেননা একমাত্র কৃষি অর্থনীতিই সমাজকে সাম্যের ভিত্তিতে স্থাপিত করতে সক্ষম। সর্বোচ্চ সুখ ও শান্তির জন্য ফিজিওক্রেসি দর্শন সুপারিশ করে মানুষের জীবনকে প্রকৃতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ রেখে জীবনধারণের জন্য, অর্থাত্ কৃষির ওপর মূল উত্পাদনকাঠামোকে স্থাপিত করার জন্য। ফিজিওক্রেসি মতবাদ অনুসারে অর্থনৈতিক জীবনে ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প মানুষে মানুষে আর্থসামাজিক ব্যবধান সৃষ্টি করে এবং ওই ব্যবধান থেকে উদ্ভূত হয় শ্রেণীবৈষম্য এবং শ্রেণীতে শ্রেণীতে, জাতিতে জাতিতে প্রতিযোগিতা ও যুদ্ধ। মার্কিন সমাজ ফিজিওক্রেসিকে এমন একটি আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে, যে আদর্শ প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যে একটি দ্বন্দ্বহীন ও ভারসাম্যতার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম। আদর্শিক ও সাংস্কৃতিকভাবে মার্কিনদের মধ্যে কৃষি এমনই একটি আদর্শ ছিল যে, কোনো বিদেশি নতুন ঔপনিবেশিক আগন্তুক এলে তিনি নির্দ্বিধায় কৃষিকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করতেন। মার্কিনদের বিশ্বাস ছিল, মানুষে মানুষে সমতা ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারে একমাত্র কৃষি, যা প্রকৃতির ভারসাম্য কখনো বিনষ্ট করবে না। উল্লেখ্য যে, মার্কিন রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন যাঁরা করেছিলেন তাঁদের অধিকাংশই ছিলেন কট্টরভাবে ফিজিওক্রেসি মতবাদের অনুসারী। ফ্রাঙ্কলিন, ওয়াশিংটন, অ্যাডামস, জেফারসন, ম্যাডিসন প্রমুখ নেতা কৃষিকে তাঁদের ব্যক্তিগত জীবন ও জাতির আদর্শ হিসেবে গণ্য করে গেছেন। স্বাভাবিকভাবেই, উনিশ শতকের প্রথম দশক পর্যন্ত কৃষিই ছিল মার্কিন অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি।
প্রাচীনকাল থেকেই আন্তএশীয় বাণিজ্য এবং আন্তমহাদেশীয় বাণিজ্যের ইতিহাসে অনন্য ভূমিকা পালন করেছে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চল, বিশেষ করে বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চল। কীর্তিনারায়ণ চৌধুরী, সুশীল চৌধুরী, রজত দত্ত, ওম প্রকাশ, অনিরুদ্ধ রায়, সঞ্জয় সুব্রামনিয়ম, রিচার্ড ইটন, ডাইটমার রটরমন ও আরও অনেক নৌ-পণ্ডিতের গবেষণায় দেখা যায়, বঙ্গোপসাগর ছিল প্রাচীনকাল থেকেই বিশ্বের ব্যবসা-বাণিজ্যের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মণ্ডল। তাঁদের গবেষণা থেকে জানা যায় যে প্রাচীনকাল থেকে উনিশ শতক পর্যন্ত আন্তমহাসাগরীয় বাণিজ্যে ভারত মহাসাগর, বিশেষ করে এর বঙ্গোপসাগর এলাকা, বিভিন্ন জাতির অর্থনৈতিক ইতিহাসে পালন করেছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। তাঁদের মতে, আধুনিক ইউরোপে প্রথমে বাণিজ্যিক বিপ্লব এবং পরে শিল্পবিপ্লব পুষ্টি লাভ করেছে মূলত ভারত মহাসাগরীয় বাণিজ্য থেকে। তবে তাঁদের গবেষণায় পশ্চিমা দেশের একটি জাতির বাণিজ্যিক উপস্থিতি ও গুরুত্ব এখনো ঐতিহাসিকভাবে আলোচনায় আসেনি, যদিও সে জাতির প্রাথমিক রূপান্তরে সবচেয়ে বড় এবং সরাসরি ভূমিকা পালন করেছে বঙ্গোপসাগরীয় বাণিজ্য। এটি হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। স্বাধীনতা অর্জনের পরপরই মার্কিন দেশের ইয়াংকিদের অর্থাত্ নিউ ইংল্যান্ডের বণিকদের বঙ্গোপসাগর এলাকায় আগমন মার্কিন অর্থনৈতিক ইতিহাসের জন্য একটি যুগান্তকারী ঘটনা। কিন্তু যদিও এ ঘটনার পরিব্যাপ্তি মার্কিনদের বিশ্বসমাজে আবির্ভাব ও প্রভাব বিস্তারের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত, তথাপি এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে আমেরিকার বিদ্যমান ইতিহাসে কোনো আলোচনা দেখা যায় না। মার্কিন জাতীয় ইতিহাসের এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় বঙ্গ-মার্কিন বাণিজ্য সম্পর্ক, কেননা এ অধ্যয়টি হলো আমেরিকার শিল্পবিপ্লবের অধ্যায়। এ প্রবন্ধে আমরা দেখানোর চেষ্টা করব যে ১৮১২-১৮২৫ সময়কালে প্রথম মার্কিন শিল্পবিপ্লব যাঁরা রচনা করেছেন, তাঁদের প্রায় সবাই পুঁজির মালিক হয়েছেন বাংলা-বাণিজ্যের মাধ্যমে এবং বাংলা-বাণিজ্য থেকে অর্জিত পুঁজিই তাঁরা বিনিয়োগ করেছেন আমেরিকার শিল্পায়নে। কিন্তু মার্কিন শিল্পায়নের ইতিহাসে বাংলা-বাণিজ্যের ভূমিকা প্রায় অনুপস্থিত।
মার্কিন অর্থনৈতিক ইতিহাসে শিল্পবিপ্লবের পটভূমি ও তাত্পর্য নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে, কিন্তু বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, নিউ ইংল্যান্ডের এই শিল্পবিপ্লবের পুঁজি কীভাবে এবং কোথা থেকে আহরিত হলো সে ব্যাপারে সব ঐতিহাসিক নীরব। মার্কিন শিল্পবিপ্লবের উদ্যোক্তারা বোস্টন অ্যাসোসিয়েটস নামে পরিচিত। কারা ওই বোস্টন অ্যাসোসিয়েটস? কোথা থেকে এল এঁদের পুঁজি? মার্কিন ঐতিহাসিকেরা এ ব্যাপারে নীরব। তাঁরা জোর দিয়েছেন জাতীয় চরিত্রের ওপর, মেধা ও নেতৃত্বের ওপর। এ প্রবন্ধে আমরা জানাতে চাই যে মার্কিন দেশের প্রথম শিল্পবিপ্লবের যাঁরা কর্ণধার, বোস্টন অ্যাসোসিয়েটস নামে যাঁরা ইতিহাসে খ্যাত, তাঁরা সবাই ছিলেন কলকাতা বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত এবং কলকাতা বাণিজ্যকে কেন্দ্র করেই তাঁরা মার্কিন মুলুকের ইতিহাসে সর্বপ্রথম একটি পুঁজিপতি শ্রেণীতে পরিণত হন। ইয়াংকি বণিকেরা নিরপেক্ষ জাতি হিসেবে যখন কলকাতা বাণিজ্য থেকে অধিক থেকে অধিক হারে মুনাফা অর্জন করছিলেন, তখন শুরু হয় ইঙ্গ-ফরাসি যুদ্ধ, যার সরাসরি প্রভাব পড়ে ভারত মহাসাগরীয় বাণিজ্যের ওপর। মার্কিন বাণিজ্যের ওপর ইঙ্গ-ফরাসি যুদ্ধের প্রভাব লক্ষ করার আগে বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চলে মার্কিনদের বাণিজ্যের পরিধি ও তাত্পর্যের ওপর কিছু আলোকপাত প্রয়োজন।
বঙ্গোপসাগরীয় বাণিজ্যে ইয়াংকি বণিকদের যোগদান
মার্কিন স্বাধীনতা ঘোষণার দলিলে ও মার্কিন শাসনতন্ত্রে স্বাক্ষরকারী ও ধনী ব্যবসায়ী রবার্ট মরিস (১৭৩৪-১৮০৬) সর্বপ্রথম বঙ্গোপসাগরে ‘Empress of China’ নামের একটি জাহাজ ১৭৮৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রেরণ করেন। এর চার মাস পরই টমাস বেল-এর নেতৃত্বে ‘The United States of America’ নামে একটি পণ্যবাহী জাহাজ বঙ্গোপসাগরে এসে উপস্থিত হয়। ১৭৮৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর মাদ্রাজ বন্দরে এসে জাহাজটি নোঙর ফেলে। এ ঘটনার ভবিষ্যত্ বাণিজ্যিক তাত্পর্য নিয়ে মাদ্রাজের গভর্নর লর্ড মেকার্টনি (১৭৮১-৮৫) গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসকে উদ্দেশ করে এক দীর্ঘ প্রতিবেদন পাঠান। এর মর্ম ছিল এমন যে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক রাজ্যের বৈদেশিক বাণিজ্যে মার্কিনদের যোগদান ব্রিটিশ ভারতের অর্থনৈতিক ইতিহাসে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা করতে পারে।৬ মেকার্টনির ভবিষ্যদ্বাণী সঠিক প্রমাণিত হয়েছিল, তবে উল্টোভাবে। সে বৈপ্লবিক পরিবর্তনটি ঘটেছিল ব্রিটিশ ভারতে নয়, আমেরিকার নিউ ইংল্যান্ডে, যেখানে ভারত বাণিজ্যের অভিঘাতে ১৮১৩-১৮২০ সময়কালে একটি শিল্পবিপ্লব ঘটে যায়। যা হোক, রোড-আইল্যান্ড থেকে ‘Hydra’ নামে আরেকটি মার্কিন জাহাজ হুগলি বন্দরে এসে নোঙর ফেলে ১৭৮৫ সালের জুন মাসে। প্রভিডেন্স থেকে উইলিয়াম ব্রাউন ‘General Washington’ নামের একটি জাহাজ মাদ্রাজে প্রেরণ করেন ১৭৮৭ সালে।
উল্লেখিত সব কটি অভিযাত্রা ছিল পরীক্ষামূলক। সেলেমের ইলিয়াস হাস্কেট ডার্বিই সর্বপ্রথম বণিক, যিনি নিয়মিতভাবে কলকাতায় একাধিক বাণিজ্যিক জাহাজ পাঠানো শুরু করেন। তাঁর প্রতিটি অভিযাত্রাই ছিল সফল এবং অসাধারণ মুনাফা অর্জনকারী। ১৭৯০ থেকে কলকাতার সঙ্গে নিউ ইংল্যান্ডের ব্যবসা নিয়মিতভাবে শুরু হয়, বিশেষ করে ডার্বির বন্দর সেলেম থেকে। তখন থেকে প্রতিবছর নিউ ইংল্যান্ডের বিভিন্ন বন্দর থেকে কলকাতাগামী জাহাজের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়তে থাকে। প্রতিটি জাহাজই নিরাপদে এবং প্রচুর মুনাফা অর্জন করে দেশে প্রত্যাবর্তন করে। ১৭৯৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের মধ্যে একটি আন্তর্জাতিক সন্ধি জে ট্রিটি সম্পাদিত হয়। ওই চুক্তির অধীনে মার্কিনরা কলকাতায় অন্যান্য স্বাধীন ব্রিটিশ ব্যবসায়ীর মতো বিশেষ সুবিধায় বাণিজ্য করার অধিকার লাভ করে। এর পর থেকে ইয়াংকিদের কলকাতা বাণিজ্য পৌনঃপুনিকভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং ১৭৯৫ সাল থেকে তা ক্রমেই ব্যাপক আকার ধারণ করে।
কলকাতায় ইয়াংকি বাণিজ্যের বৈশিষ্ট্য
কলকাতা তথা বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চলে ইয়াংকিদের বাণিজ্য ব্যাপকভাবে চলে ১৮২০ সাল পর্যন্ত, যখন মার্কিন শিল্পবিপ্লবের সূচনাপর্ব শেষ হয়। এ সময়কালে বঙ্গোপসাগরে ইয়াংকিদের ব্যবসার পরিমাণ নির্ণয় করা দুরূহ বা অসম্ভব। কারণ প্রথমত, ইয়াংকিরা কলকাতায় বাণিজ্য করেছে কোম্পানিরূপে নয়, একেবারেই ব্যক্তিগতভাবে। ব্যতিক্রম ছাড়া প্রায় সবারই পুঁজি ছিল সীমিত এবং প্রায় সবাই পুঁজি ধার করতেন কলকাতায় তাঁদের নিজস্ব বানিয়াদের কাছ থেকে। অনেকেই আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য পরিচালনা করতেন বাকিতে, আবার অনেকে সুদে ধার করা পুঁজিতে। কলকাতার বাঙালি বানিয়ারা ছিলেন তাঁদের প্রধান পুঁজি সরবরাহকারী। পুঁজি গড়ে তোলার জন্য কোনো কোনো ইয়াংকি প্রথমে কলকাতায় কেনাকাটা করতেন এবং প্রাচ্যের অন্য কোনো বন্দরে নিয়ে তা বিক্রি করতেন এবং বিক্রয়লব্ধ টাকা দিয়ে ফের পণ্য কিনতেন অন্য কোথাও রপ্তানির জন্য। সমকালীন বাণিজ্য সমাজে এ ব্যবস্থাকে বলা হতো কান্ট্রি ট্রেড বা কোস্টাল ট্রেড। এসব উপকূলীয় বাণিজ্যের পাশাপাশি তাঁরা অনুসরণ করতেন আরেকটি লাভজনক বাণিজ্য। সেটি ছিল ভাড়া বা পরিবহন বাণিজ্য ক্যারিং ট্রেড। এক বন্দর থেকে অন্য বন্দরে অন্য বণিকদের পণ্য পরিবহন ছিল একটি বিনিয়োগবিহীন বাড়তি ব্যবসা। মার্কিন বণিকদের ভারত মহাসাগরীয় বাণিজ্যের গোটা আয়ের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ আসত ভাড়া-বাণিজ্য থেকে।৭ স্থানীয় বাজারে ক্রয়-বিক্রয় করাও ছিল ইয়াংকিদের আরেকটি লাভজনক ব্যবসা। ব্রিটিশ সিভিলিয়ানরা দুর্নীতির মাধ্যমে যে আয় করতেন, তা তাঁরা দেশে পাঠাতেন সাধারণত ব্যক্তিগতভাবে পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে। কলকাতা, মাদ্রাজ থেকে পণ্য কিনে তাঁরা তা ইয়াংকিদের মাধ্যমে স্বদেশে পাঠিয়ে দিতেন। রেমিট্যান্স ট্রেড নামে পরিচিত এ ব্যবসায় ইয়াংকিরা ব্রিটিশ আমলাদের বে-আইনিভাবে অর্জিত টাকা পণ্যাকারে ইউরোপে রপ্তানি করতেন। কলকাতা থেকে মালাক্কা পর্যন্ত সমগ্র এলাকার ভাড়া-বাণিজ্যের এক বড় অংশ ছিল ইয়াংকিদের নিয়ন্ত্রণে। এমনিভাবে প্রাচ্য-বাণিজ্যের সব সুযোগ ব্যবহার করে ইয়াংকিরা কলকাতায় ফিরে আসতেন শেষ লেনদেন করে স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের জন্য। দেশে ফেরার পর বাড়তি পণ্য পুনরায় রপ্তানি করা হতো ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ব্রাজিল ও অন্যান্য পশ্চিমা দেশে।
পুনরায় রপ্তানির বিপরীতে রৌপ্যমুদ্রা অর্জন করে এঁরা আবার পাড়ি জমাতেন কলকাতায় রৌপ্যের বিনিময়ে প্রাচ্যপণ্য ক্রয় করার জন্য। গোপনীয়তাসহ নানা কারণে এই ত্রিমুখী বাণিজ্যের কোনো সঠিক তথ্য নেই। অতএব, প্রাচ্য-বাণিজ্য থেকে কোন ইয়াংকি বণিক বার্ষিক কত আয় করলেন, তা বাইরের কারোর পক্ষে জানার কোনো উপায় ছিল না। তবে স্থানীয় পত্রপত্রিকায় খবর উঠত, প্রাচ্য-বাণিজ্য করে কে কত বিত্তের অধিকারী হলেন। এদের মধ্যে সবচেয়ে বড় এবং পারস্পরিকভাবে সংঘবদ্ধ ব্যাপারিরা নিউ ইংল্যান্ডে পরিচিত ছিলেন বোস্টন অ্যাসোসিয়েটস নামে। এই বোস্টন অ্যাসোসিয়েটসরাই হলেন মার্কিন শিল্পবিপ্লবের প্রথম উদ্যোক্তা। মার্কিন শিল্পবিপ্লব সম্পর্কে ওই দেশের পাঠ্যপুস্তকে, এমনকি গবেষণাগ্রন্থেও বোস্টন অ্যাসোসিয়েটস সাধারণভাবে আমেরিকার প্রথম ধনীগোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত। কিন্তু মজার ব্যাপার, ওই ধনীগোষ্ঠী যে কলকাতা বাণিজ্য থেকে পুঁজির অধিকারী হলেন, সে বিষয়ে কোনো গবেষণায় উল্লেখ নেই। কোনো পাঠ্যপুস্তকে উল্লেখ নেই যে মার্কিন শিল্পবিপ্লবের নায়কেরা প্রথম পুঁজির অধিকারী হলেন কলকাতা বাণিজ্যের মাধ্যমে এবং পরে বিশ্বপরিস্থিতি পরিবর্তনের ধাক্কায় তাঁরা সে পুঁজিকে ব্যবহার করলেন আমেরিকার শিল্পায়নের জন্য। এ তথ্যের সার্বিক আলোচনা ও বিশ্লেষণ বর্তমান প্রবন্ধের প্রধান লক্ষ্য।
উনিশ শতকের প্রথম সিকিতে ইন্ডিয়া হোয়ারফ (India Wharf) নামে বোস্টন বন্দরের সর্ববৃহত্ জেটি বা জাহাজঘাটের মালিক ফ্রান্সিস কেবট লয়েলের নেতৃত্বে বাংলায় বাণিজ্য করে ধনবান হয়েছেন এমন একটি গোষ্ঠী সমকালীন ইউরোপে যুদ্ধময় পরিবেশের প্রেক্ষাপটে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যে ঝুঁকিপূর্ণ আন্তর্জাতিক বাণিজ্য থেকে বেরিয়ে এসে তাঁরা তাঁদের পুঁজি স্বদেশের শিল্পায়নে বিনিয়োগ করবেন। তাঁরা সমাজে ছিলেন অসাধারণ প্রভাবশালী। উল্লেখ্য যে, নিউ ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লবে নেতৃত্বদানকারী এ গোষ্ঠীর সব সদস্যই যে কলকাতা বাণিজ্য থেকে প্রথম পুঁজি নির্মাণ করেছেন, এ পটভূমির কথা কোনো মার্কিন ইতিহাসে এখনো স্থান পায়নি। কলকাতায় ইয়াংকিদের ব্যবসার অধিকাংশ পুঁজির উত্স ছিল তাঁদের বাঙালি বানিয়া। বানিয়াদের কাছ থেকে সুদে বা অন্য শর্তে টাকা ধার করে মার্কিন বণিকেরা কলকাতায় পণ্য ক্রয় করে তা মার্কিন অভ্যন্তরীণ বাজারসহ বিশ্ববাজারে রপ্তানি করতেন। মার্কিনদের পুঁজির আরেকটি উত্স ছিল কলকাতার স্থানীয় বাজারে পণ্য কেনাবেচা করা। এ খাতে মুনাফার হার ছিল বিপুল। ইয়াংকিদের পুঁজি সংগ্রহের আরেকটি উত্স ছিল ভারত ও ইউরোপের মধ্যে ভাড়া-বাণিজ্য (ক্যারিং ট্রেড)।৮ ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও অন্যান্য ইউরোপীয় বেনেবাদী কোম্পানিসমূহ ও প্রাইভেট বণিকেরা তাঁদের আমদানি-রপ্তানি পণ্য পরিবহনের জন্য জাহাজ ভাড়া করতেন। এ ভাড়া-বাণিজ্যে মার্কিনরা ছিলেন একটি বড় উত্স। ভারত মহাসাগরের ভাড়া-বাণিজ্যে সাশ্রয়, দক্ষতা ও গতির জন্য ইয়াংকিরা খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। ভারত মহাসাগরে ইয়াংকিদের আরেকটি আয়ের উত্স ছিল উপকূলীয় বাণিজ্য (কোস্টাল ট্রেড) অর্থাত্ এক বন্দর থেকে পণ্য কিনে আরেক বন্দরে নিয়ে বাজারজাত করা বা অন্য বণিকদের ভাড়া বাওয়া। ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সরকারের শ্বেতাঙ্গ কর্মকর্তাদের দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ স্বদেশে পাচার করার একটি বড় মাধ্যম ছিল ইয়াংকি বণিকদের টাকা ধার দেওয়া। ইয়াংকিরা পণ্যের মাধ্যমে ওই অর্থ ব্রিটেনে পৌঁছে দিতেন। স্থানীয় বানিয়াদের কাছ থেকে ধারে পুঁজি সংগ্রহ করে পণ্য রপ্তানি করা হতো। উনিশ শতকের প্রথম সিকিতে নিউ ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লব ছিল ওই সব খাতে সংগ্রহ করা পুঁজিরই সরাসরি ফল। কিন্তু মার্কিন অর্থনৈতিক ঐতিহাসিকেরা মার্কিন বহির্বাণিজ্যের এই দিকটি সম্পর্কে একেবারেই নীরব। ঐতিহাসিকদের মধ্যে দ্বিমত নেই যে মার্কিন শিল্পবিপ্লবের উদ্যোক্তা হলেন একটি অতি সংঘবদ্ধ গোষ্ঠী, যাঁরা মার্কিন ইতিহাসে বোস্টন অ্যাসোসিয়েটস নামে পরিচিত। কিন্তু বোস্টন অ্যাসোসিয়েটস শিল্পায়নে যে পুঁজি বিনিয়োগ করেছিল, সে পুঁজির উত্স যে কলকাতা বাণিজ্য এ বিষয়ে সব ঐতিহাসিকই নীরব। এমনকি রবার্ট ডালজেল, যিনি বোস্টন অ্যাসোসিয়েটসদের নিয়ে নামী গবেষণাগ্রন্থ প্রকাশ করেছেন, তিনিও এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি।৯
সব পণ্ডিতই একমত যে কলকাতা বাণিজ্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে ফিজিওক্রেসি বা কৃষি ও কৃষিজাত বাণিজ্যই ছিল আমেরিকার অর্থনৈতিক জীবনের আদর্শ। উল্লেখ্য যে, মার্কিন অর্থনৈতিক চিন্তায় এ আদর্শকে সমুন্নত রেখেই এর পাশাপাশি সৃষ্টি করা হয় আধুনিক পুঁজিবাদ ও শিল্পায়ন। এ পথে এগোতে উদ্যোগী ভূমিকা রাখে বোস্টন অ্যাসোসিয়েটস, যার সদস্যরা পরে ‘বোস্টন ব্রাহমিন’ (ব্রাহ্মণ) নামেও সুখ্যাত হন তাঁদের সুনাম, ঐশ্বর্য ও প্রভাবের জন্য। বোস্টন অ্যাসোসিয়েটদের নেতা ফ্রান্সিস লয়েল ছিলেন বোস্টন বন্দরের ইন্ডিয়া হোয়ারফ ও ইন্ডিয়া স্টোরসের মালিক। ইউরোপীয় উপনিবেশবাদ, নেপোলিয়নিক যুদ্ধ ও সমকালীন বিশ্ব বাণিজ্য পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে লয়েল ও তাঁর সহযাত্রীরা সিদ্ধান্ত নেন তাঁদের পুঁজি ভারত মহাসাগরীয় বাণিজ্য থেকে প্রত্যাহার করে শিল্পায়নে বিনিয়োগ করার জন্য। এ পরিকল্পনায় তাঁদের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন বিখ্যাত কলকাতা বণিক অ্যাপেলটন ও জ্যাকসন।
পুঁজির উত্স
ভারত মহাসাগরে বাণিজ্যে যোগদান করার জন্য কৃষিভিত্তিক ইয়াংকিরা পুঁজি পেলেন কোথায়—এ নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায় এবং হয়েছেও। ফার্বার, পারকিনসন, বাঘাত প্রমুখ নৌ-ঐতিহাসিক এ প্রশ্ন তুলেছেন। আটলান্টিকের উপকূল থেকে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে বাণিজ্য স্থাপন করা মানে বড় আকারের জাহাজ, বিপুল আকার নগদ পুঁজির জোগান। জাহাজ ভাড়া বা নির্মাণ, মহা দূরত্ব লঙ্ঘন, পণ্য ক্রয়ে পুঁজি বিনিয়োগ, জাহাজ ব্যবস্থাপনা, সমুদ্রবক্ষে জলদস্যু থেকে আত্মরক্ষার ব্যবস্থা, সামুদ্রিক দুর্ঘটনা ও ঝুঁকি বিমা, জাহাজে উচ্চমৃত্যুহার ও ক্ষতিপূরণ প্রভৃতি কারণে একটি দূরবর্তী বাণিজ্য অভিযাত্রা ছিল বড় পুঁজির ব্যাপার। এ পুঁজি ইয়াংকি কৃষি অর্থনীতি থেকে পাওয়া ছিল অসম্ভব। ক্যালকাটা বোর্ড অব ট্রেড প্রশ্ন তুলেছিল ইয়াংকি বণিকেরা এত পুঁজি পান কোথায়? বোর্ড অব ট্রেডের তদন্তে ধরা পড়ে যে ইয়াংকিদের পুঁজি আসে নানা উত্স থেকে। সবচেয়ে বড় উত্স ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সরকারি কর্মকর্তারা ঘুষ ও লুটপাটের যে টাকা ইয়াংকিদের মাধ্যমে দেশে পাঠাতেন সেই টাকা। ইয়াংকিরা ওই টাকা ব্যবহার করতেন ধার করা পুঁজি হিসেবে। আমদানিকৃত পণ্য বিক্রয় করে প্রাপকের টাকা লন্ডনে পরিশোধ করা হতো। মার্কিন ঐতিহাসিক ফার্বারের হিসাবমতে, ইয়াংকিদের মাধ্যমে এভাবে বছরে প্রায় তিন লাখ স্টারলিং গোপনে লন্ডনে প্রেরিত হতো।১০ এ ছাড়া বাংলায় ব্রিটিশ কর্মকর্তারা মার্কিন জাহাজে সুদে বা মুনাফার ভিত্তিতে অসদুপায়ে অর্জিত টাকা বিনিয়োগ করতেন। পারকিনসন মার্কিনদের বঙ্গোপসাগরে বাণিজ্য পরিচালনার জন্য পুঁজি সংগ্রহে চারটি অসদুপায়ের কথা উল্লেখ করেন।১১ যথা:
১. সাগরবক্ষে অতি সস্তায় জলদস্যুদের লুট করা মাল কেনা;
২. ব্রিটিশ সিভিলিয়ানদের অবৈধ উপায়ে অর্জিত টাকা ধার করে এনে পণ্য কেনা এবং তা বিশ্ববাজারে বিক্রি করে প্রাপকের কাছে তাঁর পুঁজির সুদ বা লভ্যাংশসহ ফেরত দেওয়া;
৩. সুযোগ পেলে নিজেরাই খোলা সমুদ্রে দস্যুবৃত্তিতে লিপ্ত হওয়া এবং তা জাহাজের ক্রুদের পুঁজি হিসেবে ব্যবহার করা; এবং
৪. Isle de France-এ অবস্থিত জলদস্যুদের বাজার থেকে অতি সস্তায় পণ্য কেনা ইত্যাদি।
এ ছাড়া ভারতে না এসেও নিউ ইংল্যান্ডের অনেক ব্যবসায়ী বঙ্গোপসাগরীয় ব্যবসায় জাহাজের কাপ্তান ও সুপারকার্গোর মাধ্যমে পুঁজি বিনিয়োগ করতেন। জাহাজ ছাড়ার প্রস্তুতি ও দিনক্ষণ ঘোষণা দিয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়া হতো আগ্রহী খুদে বিনিয়োগকারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। পার্শ্ব ব্যবসা হিসেবে এসব খুদে বিনিয়োগকারীর বৈদেশিক ব্যবসা কমিশনের বিপরীতে দেখাশোনা করতেন জাহাজের কাপ্তান নিজেই।১২
ইয়াংকিদের কলকাতা বাণিজ্যের পরিমাণ
ইয়াংকি বণিকেরা কলকাতা বাণিজ্য শুরু করেছেন ১৭৮৪ সালে। তাঁদের প্রথম ১০ বছরের বাণিজ্যের পরিধি পরিমাপের কোনো উপায় অবশ্য নেই। মার্কিনসহ বিদেশিদের জন্য কলকাতা বন্দর আনুষ্ঠানিকভাবে উন্মুক্ত করা হয়েছিল ১৭৯৩ সালে। তা সত্ত্বেও ১৭৯৫ সাল পর্যন্ত বন্দরের আমদানি-রপ্তানির কোনো দেশওয়ারি হিসাব রাখার নিয়ম করা হয়নি। কলকাতা বন্দরের বৈদেশিক ব্যবসা-বাণিজ্যের বিস্তারিত তথ্য জানা যায় ১৭৯৫ সাল থেকে। বন্দরের আমদানি-রপ্তানি হিসাব থেকে দেখা যায় যে ১৭৯৫ সাল থেকে কলকাতা বন্দরে ইয়াংকি বণিকদের আমদানি এবং রপ্তানি উভয়ই ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। ১৭৯৫-৯৬ সালে ইয়াংকি বণিকদের কলকাতা বন্দরে মোট আমদানির পরিমাণ প্রায় ৮ লাখ টাকা থেকে ক্রমাগত বেড়ে ১৮০৫-০৬ সালে ৬৭ লাখ টাকায় উন্নীত হয়। প্রায় আট গুণ বেড়ে যায় মার্কিনদের আমদানি-রপ্তানির পরিমাণ। ১৭৯৫-৯৬ সালে কলকাতায় তাঁদের রপ্তানির পরিমাণ প্রায় ১৯ লাখ টাকা থেকে ক্রমাগত বেড়ে ১৮০৫-০৬ সালে উন্নীত হয় ৬৩ লাখ টাকায়।১৩ রপ্তানি পণ্য হিসেবে কলকাতা থেকে ইয়াংকিদের মূল পণ্য ছিল বাংলার কুটির শিল্পোত্পাদিত বহু রকমের বস্ত্র। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো এ সময়ে কলকাতা থেকে ইয়াংকিদের একক রপ্তানির পরিমাণ ছিল এশিয়া ও ইউরোপের বণিকদের সম্মিলিত রপ্তানির চেয়েও সিকি ভাগ বেশি।১৪ নিচের ছক থেকে ইয়াংকিদের কলকাতা ব্যবসার একটি পরিমাণগত চিত্র ফুটে উঠবে:
ছক- ১: কলকাতা ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে আমদানি-রপ্তানির
পরিসংখ্যান ১৭৯৫-১৮২০
সাল মোট আমদানি মোট রপ্তানি
সাল টাকা টাকা
১৭৯৫-৯৬ ৮,৪৩,১১৮ ১৯,৪৯,৩১৯
১৭৯৬-৯৭ ১৫,৪৯,৭৭৩ ২৫,৬০,২৬৭
১৭৯৭-৯৮ ১০,৪০,১০৮ ২০,২৫,৬০২
১৭৯৮-৯৯ ৩৫,২৪,৬১৪ ৩৭,৮৭,৯৩৭
১৮০০-০১ ৪৯,৭৫,৭০০ ৬১,০৬,৭০০
১৮০১-০২ ৫০,৬৫,৭৬৫ ৬৭,১৭,৪৩৩
১৮০২-০৩ ৫১,৫৬,০৩১ ৬৭,১৭,৪৩৩
১৮০৩-০৪ ৪৫,১২,৬৪০ ৪৮,৬২,১৪৭
১৮০৪-০৫ ৩৯,২৩,৩১৭ ৩৩,৪০,৫৯৩
১৮০৫-০৬ ৬৭,৬৭,৯১০ ৬২,৭৮,০৫৫
১৮০৬-০৭ ১,০৯,৯২,৯৭০ ৯০,২৭,৪৭২
১৮০৭-০৮ ৫৮,২৯,০৬৩ ৭১,১৩,২৮১
১৮০৮-০৯ ---- ৫,৭১,২১৮
১৮০৯-১০ ৬৯,৯২,৫৬৫ ৬৮,০২,৪৮৯
১৮১০-১১ ৬৭,৭১,৮৯৪ ৬৮,৩৬,৩৬৫
১৮১১-১২ ৫,৮৫,৪৩৪ ১৫,৯৫,৩৭৪
১৮১২-১৩ ৬,১৭,৩৯১ ১০,৯৪,৬০৯
১৮১৩-১৪ ২,১৫,৭৬,৯৬৫ ৪,৬৪,৫১,০৬৯
১৮১৪-১৫ ২,৬৮,২৭,২২০ ৪,৭৪,৯৯,৫০৩
১৮১৫-১৬ ৩,৫৮,৯৮,৪০৩ ৫,৬৪,১০,৮৩৫
১৮১৬-১৭ ৬,১৯,৬০,৬০৭ ৬,১৩,৫৩,৩৫১
১৮১৭-১৮ ৬,২৮,৪২,৯০০ ৬,৫৪,১৭,৯০৭
১৮১৮-১৯ ৭,৯২,২৯,৪৪১ ৫,৮৬,১১,৭৩২
১৮১৯-২০ ৫,৮৬,০৬,৬৪৭ ৬,০৯,৭৮,৮১০
Source: Amales Tripathi, Trade and Finance in the Bengal Presidency, 1793-1833, (Calcutta 1979), Appendix Charts on Trade between Calcutta and USA, pp. 273-295.
ভাড়া-বাণিজ্য ও পুনরায় রপ্তানি
উল্লেখ্য যে, এই সারণির হিসাব শুধু ইয়াংকিদের কলকাতা বাণিজ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ। বঙ্গোপসাগরীয় বাণিজ্য থেকে ইয়াংকিদের প্রকৃত আয় আরও কয়েক গুণ বেশি গণ্য করার কারণ আছে এ জন্য যে এই হিসাবে ইয়াংকিদের ভাড়া-বাণিজ্য (ক্যারিং ট্রেড) বাবদ আয় অন্তর্ভুক্ত নয়। এ ছাড়া মাদ্রাজ, পণ্ডিচেরীসহ ভারত মহাসাগরীয় বাণিজ্য-বন্দরগুলোর সঙ্গে কোস্টাল ট্রেড নামে যে আন্তবন্দর বাণিজ্য হতো এবং সে বাণিজ্য বাবদ যে বিপুল আয় হতো, ওই হিসাবে তা দেখানো হয়নি। তা ছাড়া অন্যান্য অনিয়মিত ব্যবসা থেকে আয় এই হিসাবে আনা হয়নি। এসব সূত্র থেকে পাওয়া লাভ নিয়মিত আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের সঙ্গে যোগ করলে যে বিপুল বাণিজ্যিক আয় দাঁড়ায় তা ছিল এমনই বিশাল যে সমকালীন ইয়াংকিরা বিস্মিত হয়েছে ভারত বাণিজ্যের বিশালতা দেখে।১৫ ১৮০০ সালে সমকালীন ইয়াংকি বিজ্ঞানী ও চিকিত্সক স্যামুয়েল মিশেল যেমন মন্তব্য করেন যে কলকাতা বাণিজ্য নিউ ইংল্যান্ডের ছোট-বড় সব ব্যবসায়ীর মধ্যে একটি চমকপ্রদ হিড়িক সৃষ্টি করেছে। তিনি বিস্ময় প্রকাশ করেন যে সর্বত্র সবার মুখে শুধু একই কথা: ‘Join Calcutta Commerce. It is all Commerce! Commerce!, and at all events Commerce’।১৬ এক দশক আগেও যেখানে অর্থনীতির প্রথম কথা ছিল কৃষি, সেখানে বঙ্গোপসাগরীয় বাণিজ্যে যোগদানের এক দশকের মধ্যেই ইয়াংকিদের চিন্তাধারার মধ্যে প্রাধান্য লাভ করে পুঁজিবাদী ভারত মহাসাগরীয় বাণিজ্য এবং তজ্জনিত বিপুল আমদানি-রপ্তানি।১৭
১৭৯৫ থেকে ১৮০৫ সাল পর্যন্ত বঙ্গোপসাগরীয় বাণিজ্যে সব ইউরোপীয় বাণিজ্যিক প্রতিযোগীর সম্মিলিত আমদানি-রপ্তানির তুলনায় মার্কিনদের একক ব্যবসা ছিল দ্বিগুণেরও বেশি।১৮ লক্ষণীয় যে ইয়াংকিদের এই ব্যাপক আমদানির লক্ষ্য অভ্যন্তরীণ বাজারের চাহিদা মেটানো নয়; এর লক্ষ্য ছিল পুনরায় রপ্তানি। সীমিত অভ্যন্তরীণ বাজারের চাহিদা মেটানোর পর আমদানিকৃত বাকি পণ্য বিশ্ববাজারে রপ্তানি করা হতো, বিশেষ করে দক্ষিণ আমেরিকা ও পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে। এই মহালাভজনক বাণিজ্যে হঠাত্ ধস নামে যখন ইউরোপে নেপোলিয়নিক যুদ্ধের সময় ভারত মহাসাগরে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স উভয় পক্ষই মার্কিন বাণিজ্যিক জাহাজের ওপর লুটপাটমূলক তল্লাশি চালিয়ে বিপুল আর্থিক ক্ষতি সাধন করতে থাকে। আমেরিকার কোনো নৌবাহিনী না থাকায় উপায়ান্তর না দেখে মার্কিন কংগ্রেস ১৮০৭ সালের এমবার্গো অ্যাক্ট শীর্ষক আইন প্রণয়ন করে আমেরিকার বৈদেশিক বাণিজ্যের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এর ফলে নেপোলিয়নিক যুদ্ধের অবসান পর্যন্ত ইয়াংকিদের ভারত বাণিজ্য নিবু নিবু অবস্থায় থাকে। ফলে ভারত বাণিজ্যে বিনিয়োজিত বিপুল পুঁজির ভবিষ্যত্ ব্যবহার নিয়ে ভারত-বণিকদের মধ্যে এক পরম উত্কণ্ঠা ঘনিয়ে ওঠে। এই পরিস্থিতিতে বঙ্গোপসাগরীয় বাণিজ্যে যুক্ত বণিকদের অনেকেই তাঁদের পুঁজি বাংলা বাণিজ্য থেকে প্রত্যাহার করে নেন এবং তাঁদের মধ্যে একটি গোষ্ঠী তাদের পুঁজি দেশের শিল্পায়নে বিনিয়োগ করার সিদ্ধান্ত নেয়।
মার্কিন শিল্পায়নের প্রাথমিক উদ্যোগ
আগেই বলেছি যাঁরা দেশের শিল্পায়নের পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন এবং এর বাস্তবায়নে উদ্যোগ গ্রহণ করেন, তাঁরা সবাই ছিলেন ইতিপূর্বে কলকাতা বাণিজ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত। মার্কিন শিল্পবিপ্লবের ইতিহাসে এঁরা বোস্টন অ্যাসোসিয়েটস নামে খ্যাত। কিন্ত বিস্ময়কর ব্যাপার এই যে বোস্টন অ্যাসোসিয়েটসের সব সদস্যই যে ধনবান হয়েছেন বাংলা বাণিজ্য থেকে, এ সম্পর্কে মার্কিন অর্থনৈতিক ইতিহাসে কোনো উল্লেখ নেই। সেলেমের ডার্বি পরিবার, বিভালির থর্নডাইক পরিবার ও নিউইয়র্কের গ্রেজ ও এসটর্স পরিবার আমেরিকার প্রথম কোটিপতি হিসেবে সামাজিক পরিচিতি লাভ করেন। কিন্তু তাঁদের ধনের উত্স যে বঙ্গ-বাণিজ্য সে সম্পর্কে মার্কিন অর্থনৈতিক ঐতিহাসিকেরা নীরব। এসব নব্য কোটিপতির সবাই যে প্রথম থেকেই জাহাজের মালিক বা বড় পুঁজির অধিকারী ছিলেন তা নয়। বঙ্গোপসাগরীয় বাণিজ্যে যাঁরা যোগদান করেছেন, তাঁদের অনেকে জাহাজের মালিক ছিলেন, আবার অনেকে ছিলেন না। তাঁরা অন্যের জাহাজে ভাড়ায় মাল তুলে তা বিশ্ববাজারে রপ্তানি করেছেন। অনেকে বাড়িতে বসে থেকেই কমিশন দালালের মাধ্যমে কলকাতা থেকে মালামাল আমদানি করেছেন বা পুঁজি খাটিয়েছেন অন্যান্য বণিক বা কাপ্তানের মাধ্যমে। অনেকে ছিলেন একই সঙ্গে জাহাজের কাপ্তান এবং বণিক। অনেকে খালি হাতে কলকাতায় গমন করেছেন এবং স্থানীয় বানিয়াদের কাছ থেকে নানা শর্তে লাভ দেওয়ার বিনিময়ে পুঁজি সংগ্রহ করেছেন। কলকাতার যেসব বানিয়া মার্কিনদের সঙ্গে অংশীদারি বা নির্দিষ্ট লাভের বিপরীতে পুঁজি খাটিয়েছেন এবং পুঁজিদাতা হিসেবে নিউ ইংল্যান্ডে সুপরিচিত ছিলেন, তাঁদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য রামদুলাল দে, দুর্গা প্রসাদ, রাম সুন্দর মিত্র, গোপালকৃষ্ণ মিত্র, কালি শংকর, রঘুরাম, রামসুন্দর ও আরও অনেকে।১৯ উল্লেখ্য, কৃতজ্ঞতাবশত অনেক মার্কিন বণিক তাঁদের বানিয়াদের আবক্ষ ও আপাদমস্তক মূর্তি বানিয়ে দেশে সংরক্ষণ করেছেন। সেলেম পিবডি জাদুঘরে এখনো সংরক্ষিত আছে এসব প্রতিমূর্তি। নিউ ইংল্যান্ড থেকে জাহাজের কেবিন বয় হিসেবে অনেকেই কলকাতায় আগমন করেছেন এবং কলকাতার সাথে বাণিজ্যের মাধ্যমে কোটিপতিতে পরিণত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি নাম উল্লেখ করা দরকার, কেননা তাঁরা ছিলেন আমেরিকার শিল্পবিপ্লবের প্রাথমিক উদ্যোক্তা। তাঁদের মধ্যে ছিলেন প্যাট্রিক ট্রেসি জ্যাকসন, জোসেফ লি, স্টিফেন হিগিনসন, জর্জ কেবট। এঁরা সবাই প্রাথমিকভাবে জাহাজের কেবিন বয় হিসেবে কলকাতা এসেছিলেন এবং অচিরেই বঙ্গ-ব্যবসার মাধ্যমে কোটিপতিতে পরিণত হন।২০
সমকালীন পত্রপত্রিকা, চিঠিপত্র, বাণিজ্যিক কাগজপত্র, চুক্তিপত্র, বিজ্ঞাপন প্রভৃতির ওপর ভিত্তি করে হার্ভার্ড অধ্যাপক কেনেথ উইগিন্স পোর্টার বঙ্গ-বাণিজ্যে রত সমকালীন ইয়াংকি বণিকদের একটি আর্থসামাজিক পটভূমি তুলে ধরেছেন তাঁর সম্পাদিত দ্য জ্যাকসন অ্যান্ড দ্য লিস শীর্ষক বিখ্যাত গ্রন্থে।২১ জ্যাকসন ও লি উভয়ই কলকাতায় গমন করেন সাধারণ কেবিন বয় হিসেবে এবং উভয়ই অল্পকালের মধ্যে বাংলা-বাণিজ্যের সুযোগে মহা পুঁজিপতিতে পরিণত হন। শিল্পবিপ্লবে পুঁজিপতিদের অবদানই সবচেয়ে বেশি।
শিল্পায়নে ‘বোস্টন অ্যাসোসিয়েটস’-এর উদ্যোগ
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে স্বাধীনতা লাভের অনেক আগে থেকেই আদর্শিক কারণে কৃষি অর্থনীতি অনুসরণ করছিল এবং স্বাধীনতার প্রথম ১০ বছর পর্যন্ত তারা যে একই তাত্ত্বিকরণে কৃষি অর্থনীতির আদর্শ পালন করে আসছিল সে বিষয়ে ইতিমধ্যেই আলোকপাত করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছি কীভাবে মার্কিনদের ফিজিওক্রেসি দর্শন মোতাবেক স্বাধীনতার পরও মুদ্রা, ব্যাংক, বিমা বাণিজ্য, শিল্প প্রভৃতি বাজার অর্থনীতির উপাদান বিকশিত করার ব্যাপারে সরকার ঔদাসীন্য প্রদর্শন করে। মার্কিনরা আনুষ্ঠানিকভাবে বাজার অর্থনীতিতে প্রবেশ করে ১৭৯০ সালের কারেন্সি অ্যাক্ট প্রণয়নের মাধ্যমে। এর আগে পর্যন্ত ব্রাজিল থেকে আমদানিকৃত রৌপ্যমুদ্রা, মদিরা থেকে সংগৃহীত মদ এবং নৌ-সামগ্রীই ছিল ইয়াংকিদের বঙ্গ বাণিজ্যের মাধ্যম। ১৭৯০ থেকে ১৮০৭ সাল পর্যন্ত বঙ্গ-বাণিজ্য ছিল ইয়াংকিদের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সর্বপ্রধান ক্ষেত্র। এদেরই একটি গোষ্ঠী বোস্টন বন্দরের ইন্ডিয়া হুয়ার্ফ ও ইন্ডিয়া স্টোরসের মালিক ফ্রানিস ক্যাবট লয়েলের নেতৃত্বে একটি শিল্প উদ্যোক্তা গোষ্ঠী গঠন করে, পরবর্তী সময়ে যাঁরা বোস্টন অ্যাসোসিয়েটস নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। নেপোলিয়নিক যুদ্ধের কারণে, বিশেষ করে ১৮০৭ সালে, মার্কিন সরকার কর্তৃক মার্কিনদের ওপর বৈদেশিক বাণিজ্যের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারির ফলে ভারত বাণিজ্য পরিচালনা প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে মার্কিন বণিকদের একটি গোষ্ঠী সিদ্ধান্ত্ত গ্রহণ করে, ভারত বাণিজ্য পরিত্যাগ করে স্বদেশের শিল্পায়নে পুঁজি বিনিয়োগ করার জন্য। এরই ফলে ১৮০৭ থেকে এক দশকের মধ্যে আমেরিকার নিউ ইংল্যান্ডে ব্রিটেনের আদলে একটি শিল্পবিপ্লবের পরিবেশ সৃষ্টি হয়।২২
ইয়াংকিদের মধ্যে যাঁরা বঙ্গ বাণিজ্যে যোগদান করেন, তাঁরা বিভিন্ন আর্থসামাজিক পটভূমি থেকে আগত। পোর্টারের মতে, ১৭৯০ সালে সমগ্র নিউ ইংল্যান্ডে বড় মাপের পুঁজির অধিকারী ছিলেন গুটি কয়েক মাত্র, যেমন সেলেমের ডার্বি পরিবার, বিভারলির থর্নডাইক পরিবার ও নিউইয়র্কের গ্রেজ ও এস্টারস পরিবার।২৩ এসব পরিবার ছাড়া অন্য সবাই ছিলেন হয় অল্প পুঁজির অধিকারী, নয় একেবারেই পুঁজিহীন। এঁদের অনেকেই কলকাতা এসেছিলেন জাহাজের সাধারণ কেবিন বয় হিসেবে। অনেকের জাহাজ ছিল বটে, কিন্তু পুঁজি ছিল না। তাঁরা পুঁজি সংগ্রহ করেছেন কলকাতায় এসে তাঁদের বানিয়াদের কাছ থেকে, যাঁদের মধ্যে খুবই প্রসিদ্ধ ছিলেন রামদুলাল দে (১৭৫২-১৮২৫), রাজকৃষ্ণ মিত্র (১৮১১-১৮৭২), রাজেন্দ্র দত্ত (১৮১৮-১৮৮৯) ও আরও অনেকে। তাঁরা ছিলেন নিউ ইংল্যান্ডের বণিক সমাজে সুপরিচিত নাম। অনেক ব্যবসায়ী কলকাতায় এসেছিলেন কোনো জাহাজ এবং পুঁজি ছাড়াই। তাঁরা স্থানীয়ভাবে কার্গো কেনাবেচা করেছেন কমিশন এজেন্টদের মাধ্যমে। অনেকে ছিলেন শুধুই বণিক এবং কলকাতায় না এসেই মাল কিনতেন কমিশন এজেন্ট, জাহাজের সুপার কার্গো, কাপ্তান প্রভৃতির মাধ্যমে। অনেকে আবার বাংলায় এসে বিভিন্ন বাজার-বন্দরে পণ্য কেনাবেচা করতেন এবং ফেরার সময় সঞ্চয় ও ধারে কার্গো কিনতেন। একেবারেই পুঁজি ছাড়া বা সামান্য পুঁজি নিয়ে এসব ফাটকাবাজের অধিকাংশই কলকাতা আসতেন নিউ ইংল্যান্ডের কয়েকটি অঞ্চল থেকে। যেমন সেলেম, বোস্টন, ফিলাডেলফিয়া, বিভারলি ও নিউবেরি পোর্ট এবং এঁরাই মূলত মার্কিন শিল্পবিপ্লবের পুরোধায় ছিলেন।২৪
যে পটভূমিতে শিল্পায়ন শুরু
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে কৃষিনির্ভর মার্কিন অর্থনীতি বৈদেশিক বাণিজ্যের জন্য অনুকূল ছিল না। সরকার কট্টর ফিজিওক্রেসিপন্থী বিধায় বৈদেশিক বাণিজ্যের অনুমতি প্রদান করা হয়েছিল এই শর্তে যে বৈদেশিক বাণিজ্যজনিত কোনো সমস্যা সৃষ্টি হলে সে সমস্যা নিরসনে সরকার কোনো ভূমিকা পালন করবে না। এরপরও নিউ ইংল্যান্ডের উপকূলীয় বাণিজ্যে রত কতিপয় বণিক পরিবার বঙ্গোপসাগরীয় বাণিজ্যে যোগদানের সিদ্ধান্ত নেয়। এই সিদ্ধান্তে সাহস জোগান ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেই সব দুর্নীতিপরায়ণ কর্মকর্তা, যাঁরা কোম্পানি কর্তৃক বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানি লাভের পর দুর্নীতি, শোষণ ও ব্যক্তিগত ব্যবসার মাধ্যমে ব্যাপক সম্পদের অধিকারী হয়েছিলেন। নিজ নামে ওই সম্পদ দেশে পাঠানো সম্ভব ছিল না বিধায় তাঁরা তা দেশে প্রেরণের জন্য ইয়াংকি বণিকদের বঙ্গ বাণিজ্যে যোগদানের জন্য উত্সাহিত করেন।
ব্রিটিশ পুঁজি জোগানদারদের সহযোগিতায় ইয়াংকি বণিকেরা বঙ্গ বাণিজ্যে বিপুল মুনাফা লাভ করেন এবং এর ওপর ভিত্তি করে ইয়াংকিরা অচিরেই বঙ্গ বাণিজ্যে অন্যতম সহযোগী হিসেবে আবির্ভূত হন। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে পণ্য আমদানি-রপ্তানি ছাড়াও ইয়াংকি বণিকেরা বিপুল ব্যবসা করেন আরও কয়েকটি সেক্টরে, যেমন ভাড়া-বাণিজ্য, উপকূল বাণিজ্য এবং পুনরায় রপ্তানি বাণিজ্য। বঙ্গোপসাগরীয় বাণিজ্যের এসব সেক্টরে ইয়াংকি বণিকদের ব্যবসা তুঙ্গে ওঠে নেপোলিয়নিক যুদ্ধের সময় যখন বঙ্গোপসাগরে ইংরেজ ও ফরাসিদের ব্যবসার ব্যাপক অংশ যুদ্ধজনিত কারণে ইয়াংকি বণিকদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। কিন্তু ১৮০৭ সাল থেকে যুদ্ধরত ব্রিটেন ও ফ্রান্স উভয় পক্ষ সমুদ্রবক্ষে ব্যাপক হারে নিরপেক্ষ যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক জাহাজ ও বণিক আটক করতে থাকে। এ পরিস্থিতিতে মার্কিন সরকার প্রথমে এমবার্গো অ্যাক্ট, ১৮০৭ এবং পরে নন-ইন্টারকোর্স অ্যাক্ট, ১৮০৯ প্রণয়ন করে মার্কিন বহির্বাণিজ্যের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। অবস্থার ক্রমাবনতিতে ১৮১২ সালে শুরু হয় ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যুদ্ধ। এ যুদ্ধ পরিস্থিতিতে ১৮০৭ থেকে ১৮১২ পর্যন্ত ইয়াংকিদের ১৫৯২টি বাণিজ্যিক জাহাজ যুদ্ধরত ইউরোপীয়দের হাতে আটক হয়।২৫ এর ফলে মার্কিনদের বঙ্গোপসাগরীয় বাণিজ্যে পুঁজি বিনিয়োগ ও বঙ্গোপসাগরে বাণিজ্যিক জাহাজ পাঠানো প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে আসে এবং বাণিজ্যে ব্যবহূত কোটি কোটি ডলারের পুঁজি বিনিয়োগের বাইরে এসে এর মালিকের অনুত্পাদনশীল অলস সম্পদে পরিণত হয়।
এমন পরিস্থিতিতে বঙ্গোপসাগরীয় বাণিজ্যে রত ইয়াংকি বণিকগোষ্ঠীর একটি প্রভাবশালী অংশ তাঁদের পুঁজি ভারত বাণিজ্য থেকে গুটিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় এই ভেবে যে পরিবর্তিত আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ফলে ভবিষ্যতেও এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়ে তাঁদের পুঁজির ক্ষতি সাধন করতে পারে। ঝুঁকি ও ঝঞ্ঝাটপূর্ণ বাণিজ্যিক বিনিয়োগের বিকল্প হিসেবে তাঁরা একটি ব্যবসাগোষ্ঠী গঠন করে শিল্পায়নে বিনিয়োগের চিন্তাভাবনা শুরু করেন। এ চিন্তাধারার নেতৃত্ব দেন বোস্টন বন্দরের ইন্ডিয়া হুয়ার্ফ ও ইন্ডিয়া স্টোরের মালিক ও ভারত বাণিজ্যে বিনিয়োগকারী বণিক ফ্রান্সিস কেবট লয়েল (১৭৭৫-১৮১৭)। তাঁর শিল্পায়ন পরিকল্পনায় প্রধান পুঁজিদাতা হিসেবে যোগদান করেন তাঁর শ্যালক এবং অন্যতম বড় কলকাতা বণিক প্যাট্রিক ট্রেসি জ্যাকসন (১৭৮০-১৮৪৭), যিনি কলকাতায় এসেছিলেন জাহাজের একজন কেবিন বয় হিসেবে এবং পরে কলকাতা ব্যবসার বদৌলতে পরিণত হন একজন মহা কোটিপতিতে। শিল্পায়ন পরিকল্পনায় ট্রেসি জ্যাকসনের তিন ভাইও যোগদান করেন। তাঁরা সবাই ছিলেন কলকাতা বাণিজ্যে রত এবং পরিশেষে মহাধনী। শিল্পায়নে পুঁজি বিনিয়োগে লয়েল-এর পরিকল্পনায় আরও শরিক হন কলকাতা বণিক নাথান এপলটন (১৭৭৯-১৮৬১), চার্লস জেমস ও অ্যাবট লরেন্স। মার্কিন শিল্পবিপ্লবের ঐতিহাসিক ভেরা শ্লেকমেন এসব প্রাথমিক উদ্যোক্তার নাম দেন বোস্টন অ্যাসোসিয়েটস।২৬ কারণ, তাঁরা সবাই ছিলেন বোস্টনবাসী।
তাঁদের যৌথ উদ্যোগ এবং যৌথ পুঁজিতে ১৮১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বোস্টন ম্যানুফেকচারিং কোম্পানি নামে একটি জয়েন্ট স্টক কোম্পানি, যা কি না যুক্তরাষ্ট্রের শিল্পায়নের ইতিহাসে প্রথম পুঁজিবাদী শিল্পপ্রতিষ্ঠান। বোস্টন ম্যানুফেকচারিং কোম্পানি ১৮১৪ সালে বোস্টনের অদূরে ওয়ালথামে স্থাপন করে এর প্রথম বস্ত্র কারখানা, যে কারখানায় সর্বপ্রথম একযোগে এবং একই প্রাঙ্গণে স্থাপিত হয় সুতা পাকানো থেকে বস্ত্র বয়নের সব প্রক্রিয়া এবং এর প্রতিটি প্রক্রিয়াই ছিল বিদ্যুত্চালিত। এভাবেই সূচিত হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম শিল্পবিপ্লব এবং এ বিপ্লবের নায়ক যাঁরা, তাঁরা সবাই পুঁজির মালিক হয়েছেন বঙ্গ-বাণিজ্য থেকে।২৭১৮৬০ সালে দ্বিতীয় মার্কিন শিল্পবিপ্লব পর্যন্ত এই বোস্টন অ্যাসোসিয়েটস সূচিত প্রথম শিল্প বিপ্লবই এগিয়ে নেয় মার্কিন শিল্পায়নধারা।
মার্কিন শিল্পবিপ্লবের পথিকৃত্ জাহাজ নির্মাণশিল্প। এর বিকাশ লাভ হয়েছে প্রধানত মার্কিনদের ভারত মহাসাগরীয় বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে। নিরাপত্তাব্যবস্থা ও কার্গো ধারণক্ষমতার দিক থেকে মার্কিন উপকূলীয় বাণিজ্যে ব্যবহূত সনাতন জাহাজ আকারে অপেক্ষাকৃত ছোট বিধায় এগুলো ভারত মহাসাগরীয় বাণিজ্যের জন্য তেমন অনুকূল ছিল না। তা ছাড়া মার্কিনদের বঙ্গোপসাগরীয় বাণিজ্যের সবচেয়ে লাভজনক দিক ছিল ভাড়া-বাণিজ্য। আন্তর্জাতিক ভাড়া-বাণিজ্যে সুবিধা লাভের জন্যও প্রয়োজন ছিল বড় ধারণক্ষমতার জাহাজ। পরিবহনব্যয় সাশ্রয়ের জন্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মাল পবিবহনের জন্য মার্কিন জাহাজ ভাড়া করত। তা ছাড়া ব্রিটিশ প্রাইভেট বণিক ও অনেক ইউরোপীয় প্রাইভেট বণিক মার্কিন জাহাজ ভাড়া করত পণ্য পরিবহনের জন্য। অতএব ১৭৮৫ সাল থেকেই নিউ ইংল্যান্ডের জাহাজ নির্মাণশিল্প ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠে। নেপোলিয়নিক যুদ্ধের সময় (অন্তত ১৮১২ সাল পর্যন্ত) নিরাপত্তার খাতিরে ব্রিটেন নিরপেক্ষ মার্কিন জাহাজে কলকাতা থেকে পণ্য বিশ্ববাজারে রপ্তানি করত। এসবের প্রভাবে নিউ ইংল্যান্ডে গড়ে ওঠে বড় জাহাজ নির্মাণশিল্প। জাহাজশিল্পকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে অনেক পুঁজিপতি পরিবার, যেমন সেলেমের এলিয়াস হাস্কেট ডার্বি (১৭৩৯-১৭৯৯), যিনি জাহাজশিল্প ও কলকাতা বাণিজ্যের মাধ্যমে মার্কিন মুলুকের প্রথম কোটিপতি হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। এমনিভাবে প্রভিডেন্সের মোজেস ব্রাউন (১৭৩৮-১৮৩৬) কোটিপতিতে পরিণত হন কলকাতা বাণিজ্য ও জাহাজশিল্পের মাধ্যমে। একই সময়ে কলকাতা বাণিজ্যের মুনাফায় মার্কিন মুলুুকের কোটিপতির কাতারে যোগ দেন ক্যাবট, গ্রে ও থর্নডাইক পরিবারসমূহ।২৮ তাঁরাই সর্বপ্রথম আমেরিকায় শিল্পায়নের চিন্তাভাবনা শুরু করেন এবং শিল্পায়নের পথে কিছু সক্রিয় পদক্ষেপও গ্রহণ করেন। যেমন ম্যাসাচুসেটসের অন্তর্গত বিভারলিতে ভারত বণিক এন্ড্রু কেবট ও ইসরাইল থর্নডাইক ১৭৯০ সালে স্থাপন করেন মার্কিন দেশের প্রথম শিল্পকারখানা, যদিও এর উত্পাদন সীমাবদ্ধ ছিল শুধু সুতা পাকানোর মধ্যে।২৯ কিন্তু ওই কারখানা কোনো পুরোদস্তুর আন্দোলন তৈরি করতে পারেনি, কেননা এর পরপরই কলকাতাকে কেন্দ্র করে বঙ্গোপসাগরীয় বাণিজ্য এমন জমজমাট হয়ে ওঠে যে মুনাফার দিক বিচার করলে পুঁজি বিনিয়োগের জন্য শ্রেষ্ঠ ক্ষেত্র ছিল প্রাচ্য বাণিজ্য।
শেষের মন্তব্য
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে মার্কিন শিল্পবিপ্লব অঙ্কুরিত হয়েছে ১৮১৩ সালে, যখন বোস্টন অ্যাসোসিয়েটস নামের একটি উদ্যোক্তা গোষ্ঠী ফ্রান্সিস কেবট লয়েলের নেতৃত্বে একটি জয়েন্ট স্টক কোম্পানি স্থাপন করে। এসব উদ্যোক্তা সবাই ছিলেন আসলে ভারত বণিক। ১৭৮৫ থেকে তাঁরা ভারত বাণিজ্যে যোগদান করেন এবং সাফল্যের সঙ্গে তাঁদের ভারত মহাসাগরীয় বাণিজ্য পরিচালিত হতে থাকে। ভারত বাণিজ্য বাকি অন্যান্য বাণিজ্যের চেয়ে অনেক বেশি লাভজনক বিধায় ইয়াংকি বণিকেরা প্রায় সবাই ভারত বাণিজ্যে রত হন। কিন্তু নেপোলিয়নিক যুদ্ধে মার্কিন বণিকেরা অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকেন। ব্রিটিশ ও ফরাসি উভয় যুযুধান জাতি নিরপেক্ষ মার্কিন দেশের বাণিজ্যিক জাহাজ গভীর সমুদ্রে আটক করতে থাকে। নিরপেক্ষ আমেরিকা উপায়ান্তর না দেখে এমবার্গো অ্যাক্ট, ১৮০৭ নামের আইন পাস করে মার্কিন নাগরিকদের জন্য বৈদেশিক বাণিজ্য বন্ধ করে দেয়। তদুপরি ১৮১২ সালের ইঙ্গ-মার্কিন যুদ্ধ মার্কিনদের বঙ্গোপসাগরীয় ব্যবসা আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে। ফলে ভারত বাণিজ্যে নিয়োজিত মার্কিন বণিকদের বিপুল পুঁজি বিনিয়োগের বাইরে চলে আসে। এমতাবস্থায়, ভারত বণিকদের একটি বড় গোষ্ঠী কেবট লয়েলের নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ হয় এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে তারা ভারত বাণিজ্য পরিত্যাগ করে স্বদেশে শিল্পায়ন প্রক্রিয়া শুরু করবে। তাঁরা ১৮১৩ সালে যৌথভাবে বোস্টনের অদূরে চার্লস নদীর উজানে ওয়ালথামে প্রতিষ্ঠা করেন একটি বস্ত্রকল। নাম বোস্টন ম্যানুফেকচারিং কোম্পানি। ওয়ালথাম বস্ত্রকলকে ঘিরে স্থাপিত হয় একটি শিল্পনগর, যা আমেরিকার শিল্প ইতিহাসে প্রথম। অচিরেই বিভিন্ন জায়গায় তাঁদেরই নেতৃত্বে একের পর এক বিভিন্ন বস্ত্রকল স্থাপিত হয়, যেমন: লয়াল টেক্সটাইল টাউন, বোস্টন ম্যানুফেকচারিং কোম্পানি, ম্যারিম্যাক ম্যানুফেকচারিং কোম্পানি, অ্যাপলটন ম্যানুফেকচারিং কোম্পানি, হেমিলটন কোম্পানি, ডোভার ম্যানুফেকচারিং কোম্পানি এবং সাফোকস ম্যানুফেকচারিং কোম্পানি।৩০ এক দশকের কম সময়ের মধ্যে একের পর এক বিভিন্ন স্থানে শিল্পকারখানা স্থাপন মার্কিন অর্থনৈতিক ইতিহাসে একটি চমকপ্রদ বিপ্লব বটে। এ বিপ্লবের ধারক-বাহকেরা ছিলেন একই স্থানের, একই মনের, একই পেশার এবং একই প্রতিজ্ঞা ও লক্ষ্যের একটি গোষ্ঠী, যাদের ঐতিহাসিক ভেরা শ্লেকম্যান যথার্থই নাম দিয়েছেন বোস্টন অ্যাসোসিয়েটস। কিন্তু এই গোষ্ঠীর সব সদস্যই যে জীবনে প্রথম অর্থনৈতিক সাফল্য অর্জন করেছেন বঙ্গ-বাণিজ্য থেকে এবং বঙ্গ-বাণিজ্য থেকে পাওয়া পুঁজি ও বাজারজ্ঞানকে কেন্দ্র করেই যে শিল্পায়নের পথে আমেরিকার অভিযাত্রা শুরু সে সম্পর্কে এ পর্যন্ত কোনো ঐতিহাসিক বা অর্থনীতিবিদ আলোকপাত করেননি।৩১ মজার ব্যাপার যে আমেরিকায় প্রথম ও দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লব বিষয়ে বিপুল লেখালেখি হয়েছে এবং হবেও নিশ্চয়ই। কিন্তু আমেরিকার প্রথম শিল্পবিপ্লবের পুঁজি ও নেতৃত্ব যাদের হাত ধরে এসেছে সেই বোস্টন অ্যাসোসিয়েটস-এর সব সদস্যই যে কলকাতা বাণিজ্য থেকে ধনবান হয়েছেন এবং কলকাতায় কোনো না কোনো সময় অবস্থান করেছেন—এ বিষয়ে কেউ কোনো আলোকপাত করেননি। এ নীরবতা কৌতূহলোদ্দীপক বৈকি।
তথ্যসূত্র
১ নৌ-ঐতিহাসিকদের অভিমত জানতে দেখুন, Tyler Dennett, Americans in Eastern Asia, (New York, The Macmillan Comany, 1922); Northcote C. Parkinson, Trade in the Eastern Seas, 1793-1813, (The University Press 1937).
২ আমেরিকার উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের পরস্পর লাগালাগি ছয়টি অঞ্চল বা স্টেটস নিয়ে গঠিত ছিল নিউ ইংল্যান্ড; যথা কানেটিকাট, মেইন, ম্যাসাচুসেট্স, নিউ হ্যাম্পশায়ার, রোড আইল্যান্ড ও ডারমন্ট। বিভিন্ন প্রদেশ নিয়ে এমন জুটি মার্কিন রাষ্ট্রে আর নেই। নিউ ইংল্যান্ডের অধিবাসীরা অধিকাংশই আদিতে ব্রিটিশ এবং ইয়াংকি নামে পরিচিত।
৩ কোম্পানি সিভিলিয়ানদের দুর্নীতির ওপর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পরিচালকদের সভায় বিতর্ক দ্রষ্টব্য, Court of Directors to Governor General of India, 6 November 1807, (British Library, Home Miscellaneous Series, vol. 524, Secret Department).
৪ সেকালের ভারতে যেসব স্থানীয় বণিক বিদেশি বণিকদের জন্য বাজারে মধ্যস্থতাকারী ও পুঁজি লগ্নিকারী হিসেবে ভূমিকা পালন করতেন তাঁরা বেনে বা বানিয়া হিসেবে সমাজে পরিচিত ছিলেন। অভিজ্ঞতা ও ভাষাজ্ঞান ব্যবহার করে তাঁরা বিদেশিদের সহায়তা করতেন।
৫ নামটি প্রথম ব্যবহার করেন ইতিহাসবিদ Vera Shlakmen তাঁর Economic History of a Factory Town: A Study of Chicopee, Massachusets (1935) শীর্ষক গ্রন্থে।
৬ Madras Governor Lord Macartney to Governor General Warren Hastings, 30 January, 1785, Madras Public Department, Home Miscellaneous Series, (British Library, Oriental Records), vol. 605, পৃ. ৭৫।
৭ অতিরিক্ত কর আরোপের বিরুদ্ধে মার্কিন কংগ্রেসের নিকট বাংলায় বাণিজ্যে রত ম্যাসাচুসেটস বণিক সংঘের একটি পত্রে নিউ ইংল্যান্ডের অর্থনৈতিক রূপান্তরে বঙ্গোপসাগরীয় বাণিজ্যের অবদান বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে করা মন্তব্য, ডিসেম্বর ৩১, ১৮১৯, Baker Library, Harvard Business School, Boston.
৮ Paper from the Historical Seminary of Brown University, edited by Franklin Jameson; VI; The East India Trade of Providence from 1787 to1807 by Gertrude Selwyn Kimball, (Providenc, Rhode Islam, 1896; পৃ ১-৩৪।
৯ দেখুন, Robert F. Dalzell, Enterprising Elite: The Boston Associates and the World They Made (Harvard University Press 1987).
১০ Holder Furber, John Company at Work: A Study of European Expansion in India in the Late Eighteenth Century; (Cambridge: Mass, Harvard University Press, 1951, পৃ. ১৩৯-১৪৪)।
১১ C. Northcote Parkinson, Trade in the Eastern Seas, 1793-1813, (Cambridge: University Press, 1937), পৃ. ৬৫-৬৭।
১২ G. Baghat, American in India, 1784-1860, (New York: University Press, 1970), Chapter 3.
১৩ Merchant Jacob Crowninshield to Captain Silsbee, Washington, February 5, 1804, See, Jacob Crowninshield Papers, vol. 5; Peabody Museum.
১৪ প্রাগুক্ত, পৃ. ২৫৯.
১৫ John H. Reinochl, ed. “Some Remarks on the American Trade: Jacob Crowninshield to James Madison, 1806”, William and Mary Quarterly 16, no. 1 (1959).
১৬ Bernard Bailyn et al., The Great Republic: A History of the American People, (D. C. Health and Company, Lexington, Massachusetts), 1977, পৃ. ৩৯৩।
১৭ এখানে উল্লেখ করা দরকার ইয়াংকিরা একই সময়ে বঙ্গোপসাগর ও চীনা উপসাগর বাণিজ্যে যোগদান করেছিলেন। কিন্তু যেখানে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে তাঁদের বঙ্গোপসাগরীয় বাণিজ্য ছিল ব্যাপক এবং যুগান্তকারী সে তুলনায় তাঁদের চীনা বাণিজ্য ছিল নিতান্তই অকিঞ্চিত্কর। তথাপি সমকালীন মার্কিন সাহিত্যে ব্যাপকভাবে আলোচিত হতো চীনা বাণিজ্য।
১৮ Holden Furber, “The Beginnings of American Trade with India, 1784-1812,” New England Quarterly, (11 June 1938), পৃ. ২৫৮।
১৯ Susan S. Bean, Yankee India: American Commercial and cultural Encounters with India in the Age of Sail, 1784-1860, (Peabody Essex Museum 2001), পৃ. ৩৯-৪০, ১১১-১২, ১২৮-৩০, ১৭৭।
২০ কেবিন বয় থেকে বড় বণিক বনে যাওয়া ও পরিশেষে শিল্পবিপ্লব রচনা করার নেপথ্য কাহিনির বিপুল সংখ্যক দলিল সংগ্রহ করেছেন পোর্টার। দ্রষ্টব্য, Kenneth Wiggins Porter, The Two Generations of Massachuseettss Merchants, 1765-1844, 2 vols, (Harvard University Press, 1937), পৃ. ৮৮-৯০।
২১ Kenneth Porter, The Jacksons and the Lees (Cambridge: Mass, Harvard University Press, 1937.
২২ দেখুন, Robert F. Dalzell, Enterprizing Elite: the Boston Associates and the World they Made, (Harvard University Press), পৃ. ২৮-২৯।
২৩ Porter Wiggins Porter, প্রাগুক্ত, পৃ. ৮৮-৯০।
২৪ প্রাগুক্ত।
২৫ Proceedings of the 17th Congress, 1st Session, No. 256, Communicated to the House of Representatives, March 15, 1822, পৃ. ৬৩৫।
২৬ Vera Shlakmen, Economic History of a Factory Town: A Study of Chicopee, Massachusets, 1935.
২৭ ইয়াংকি বণিকেরা যে কলকাতা বণিজ্য থেকে প্রথম পুঁজির অধিকারী হলেন এ সম্পর্কে অনেক মৌলিক তথ্য পরিবেশন করেছেন সেলেম পিবডি জাদুঘরের পরিচালক Susan S. Bean। ২০০১ সালে প্রকাশিত তাঁর Yankee India: American Commercial and Cultural Encounters with India in the Age of Sail 1784-1860 শীর্ষক গ্রন্থে তিনি মন্তব্য করেন ‘It is a little known fact that from 1795 through 1805, total American trade with India exceeded that of all the continental European nations together.’ পৃ. ৭।
২৮ ইয়াংকিদের কলকাতা বাণিজ্য ও নিউ ইংল্যান্ডের শিল্পায়নের ওপর এর প্রভাব নিয়ে আলোচনার জন্য দ্রষ্টব্য G. Baghot, Americans in India (1784-1860), New York University Press, 1970), পৃ. ৫৫-৮৫।
২৯ বিস্তারিত তথ্যের জন্য দ্রষ্টব্য, John H. Reinoehl, ed, “Some Remarks on the American Trade : Jacob Croowninshield to James Madison, 1806” , William and Mary Quarterly 16, no. (1959). পৃ. ৮৫-৯১; Ronald P. Formisano, The Transformation of Political Culture: Massachusetts Parties, 1790-1840s (London: Oxford University Press, 1983). পৃ. ১৬৩।
৩০ Kenneth W. Porter, The Jacksons and the Lees: Two generations of Massachusetts Merchants 1765-1844, প্রাগুক্ত।
৩১ এ নিয়ে বর্তমান লেখকের বিস্তৃত গবেষণার জন্য দেখুন,
“The Cargo and Culture of the New Englanders Voyages to Calcutta 1785-1850”, Journal of the Asiatic Society of Bangladesh, (Humanities), vol. 39. No. 1, June 1994;
“American Maritime Contact with Bengal, 1785-1870, Commerce, Competition, Knowledge”, Golden Jubilee Volume, Asiatic Society of Bangladesh (1952-2002);
“American Maritime Activities in Calcutta: Cases of Elephant and Ice, 1785-1880”, Journal of Asiatic Society of Bangladesh (Hum.), vol. 49 no, 1 June 2004;
“Contributions of Asian Trade to the Early Transformation of the United States of America”, Journal of the Asiatic Society of Bangladesh, (Hum.), vol. 54, no 1 June 2009;
“Americans in Calcutta Bazaars”, Journal of the Asiatic Society of Bangladesh (Hum.), Golden Jubilee Volume (1956-2005).