সাক্ষ্যপ্রমাণ ও দলিলপত্র
মার্কিন দলিলপত্রের সাক্ষ্য: কেন বুদ্ধিজীবী হত্যা? কীভাবে জামায়াত জড়িত?
প্রথম আলোর পক্ষ থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল আর্কাইভে ২০১২ সালের ১ নভেম্বর থেকে ৮ জানুয়ারি ২০১৩ পর্যন্ত আমি গবেষণাকাজে নিয়োজিত ছিলাম। এ সময় আমি প্রধানত যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ফ্রিডম অব ইনফরমেশন অ্যাক্টের আওতায় ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত অবমুক্ত করা গোপনীয় নথিপত্র পরিদর্শন করি। আমি সেখানে দেখি, ঢাকার মার্কিন কনসাল হার্বার্ট ডি স্পিভাক ১৯৭১ সালের ২০ ডিসেম্বর ওয়াশিংটনে পাঠানো একটি তারবার্তায় (আমার নোটবুক অনুযায়ী এর ক্রমিক নম্বর ঢাকা ৫৭২৪) উল্লেখ করেছেন, বুদ্ধিজীবী হত্যায় জামায়াতি দুর্বৃত্ত বা ‘জামায়াত থাগস’রা জড়িত।
ওই তারবার্তায় স্পিভাক লিখেছেন, ‘নিহত বুদ্ধিজীবীরা সংখ্যায় কত তা নিয়ে মতভেদ থাকতে পারে কিন্তু আমরা বিশ্বাস করি, এটা “জামায়াত থাগস”রা ঘটিয়েছে। এটা ব্যাপকভাবে বিশ্বাস করা হয় যে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ‘কনাইভেন্স’ বা তাদের সম্মতিতে এটা ঘটেছে। এই ঘটনা অবাঙালিদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধপরায়ণতা এবং যুদ্ধাপরাধের দাবি তুলতে পারে।’
আর নির্দিষ্টভাবে আলবদরই যে এর নেতৃত্ব দিয়েছে সে বিষয়ে মার্কিন দলিলপত্রে যেমন তেমনি তা পাশ্চাত্যের গবেষকেরাও নিশ্চিত করেছেন। এর মধ্যে ইরানি বংশোদ্ভূত মার্কিন অধ্যাপক ড. সাইদ ভালি রেজা নসরের নাম প্রণিধানযোগ্য। তিনি জামায়াতে ইসলামী ও মাওলানা আবুল আলা মওদুদী সম্পর্কে দুটি গবেষণামূলক বইও লিখেছেন।
ভালি রেজা নসর বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিন্স স্কুল অব অ্যাডভান্সড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের ডিন হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা সরকারের মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের ফরেন অ্যাফেয়ার্স পলিসি বোর্ডের সদস্য। এর আগে তিনি আফগানিস্তান ও পাকিস্তানবিষয়ক যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ প্রতিনিধি (২০০৯-২০১১) হিসেবে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত রিচার্ড হলব্রুক
সিনিয়র অ্যাডভাইজারের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ইসলামি বিশ্ব ও মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক একজন শীর্ষস্থানীয় বিশেষজ্ঞ হিসেবে স্বীকৃত। ১৯৯১ সালে এমআইটি থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে তিনি পিএইচডি করেছেন। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি মার্কিন সিনেটে তাঁকে উদ্ধৃত করে বক্তব্য রেখেছেন। এবং মার্কিন কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড হাস নসরকে আমেরিকার ‘ন্যাশনাল রিসোর্স’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। ভালি নসরের লেখা বই দ্য ভ্যানগার্ড অব দি ইসলামিক রেভল্যুশন: দ্য জামায়াত-ই-ইসলামি বইয়ের ৬৬ পৃষ্ঠায় তিনি জামায়াতের অঙ্গসংগঠন ইসলামি জমিয়তে তুলাবা আইজেটির সঙ্গে আলবদরের সম্পর্ক এবং তাদের দ্বারা বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য দিয়েছেন। এটাও গুরুত্বপূর্ণ যে তাঁর এই বইয়ে মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর নাম আছে।
ভালি নসর লিখেছেন, ‘এটা বিস্ময়কর নয় যে ইসলামি জমিয়তে তুলাবা (আইজেটি) ১৯৬৯ থেকে ১৯৭১ সালের মধ্যে যখন আইয়ুব খানের শাসন ভেঙে পড়ে এবং পিপলস পার্টি ও বিচ্ছিন্নতাবাদী বাঙালি পার্টি আওয়ামী লীগের মধ্যে বিরোধের কারণে গৃহযুদ্ধ ঘটে এবং পাকিস্তান ভেঙে যায়, তখন তুলাবা পুনরায় রাজনৈতিক লাইমলাইটে চলে আসে। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় আইজেটি পশ্চিম পাকিস্তানে পিপলস পার্টি ও আওয়ামী লীগ এবং পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে পরিচালিত জামায়াতের ন্যাশনাল ক্যাম্পেইনের নেপথ্যের মূল শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। এই প্রচারণার ফলে জাতীয় রাজনীতিতে আইজেটির অবস্থান নিশ্চিত হয়, বিশেষ করে ১৯৭১ সালের মে মাসে। এ সময় আইজেটি পূর্ব পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর বিদ্রোহ দমন অভিযোনে যোগ দেয়। সেনাবাহিনীর সাহায্যে আইজেটি দুটি আধা সামরিক বাহিনীর ইউনিট সংগঠিত করে। আর তা হলো আলবদর ও আলশামস। তাদের কাজ ছিল বাঙালি গেরিলাদের সঙ্গে যুদ্ধ করা। অধিকাংশ আলবদর নেওয়া হয়েছিল আইজেটি সদস্যদের মধ্য থেকে, যারা পূর্ব পাকিস্তানে মুহাজির সম্প্রদায়ের প্রতি সমর্থন জুগিয়েছিল। আইজেটির নাজিম-ই-আলা মতিউর রহমান নিজামী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আলবদর ও আলশামস সংগঠিত করেন। গৃহযুদ্ধে তাঁদের ওই ভূমিকার কারণে তাঁদেরকে চরম মূল্য দিতে হয়।’
উল্লেখ্য, ২০০৭ সালের ৮ ডিসেম্বর লন্ডনের দি ইকোনমিস্ট ‘গিল্টি অ্যাট বার্থ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে নিজামীকে আলবদর বাহিনীর প্রধান হিসেবে উল্লেখ করলে নিজামী তার প্রতিবাদ করেন। নিজামী দাবি করেন যে আলবদরের সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পর্ক ছিল না। অথচ আলবদরের সঙ্গে নিজামীর সম্পৃক্ততা মাওলানা নিজামীরই দেওয়া একটি সাক্ষাত্কারের বরাতে দাবি করেছেন অধ্যাপক ভালি নসর। অধ্যাপক নসর তাঁর বইয়ের ফুটনোটে নির্দিষ্টভাবে এর তথ্যসূত্র হিসেবে ১৯৮১ সালে লাহোর থেকে প্রকাশিত সৈয়দ মুত্তাকিল রহমানের য্যাব ভু নাজিম-ই আলা দি-এর বরাত দিয়েছেন।
মার্কিন কূটনীতিকেরা সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে জামায়াত ও মওদুদী গোড়া থেকেই সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী ও প্রতিক্রিয়াশীল এবং ইসলামের নামে নানা ব্যাখ্যা হাজির করেছেন। তবে বুদ্ধিজীবী হত্যার পেছনে জামায়াতের বদর বাহিনী গঠনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে। আর এটা আমরা আমেরিকান সরকারের নথিপত্রের সাহায্যেই অনেকটা খতিয়ে দেখতে পারি। আমরা দেখি যে পাকিস্তান সৃষ্টির পরপরই পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমানদের লক্ষ করে মাওলানা মওদুদী জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে নািসবাদের মতোই একটি জামায়াতবাদ বা মওদুদীবাদের সূচনা করেন।
এ অঞ্চলের মার্কিন কূটনীতিকেরা ধারাবাহিকভাবে পঞ্চাশের দশক থেকেই জামায়াতে ইসলামী ও তার প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা আবুল আলা মওদুদীর রাজনৈতিক দর্শনে বাঙালি, বাংলা সাহিত্য ও বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের প্রতি জামায়াতের ঘৃণা ও বিদ্বেষ লক্ষ করেন। জামায়াতের এই অবস্থান বিশেষ বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত বলেই প্রতীয়মান হয়। ইসলাম বা অন্যান্য নামে বা কারণে স্বাধীনতার বিরোধিতাকারীদের থেকে এই অবস্থান জামায়াতকে আলাদা করেছে।
জামায়াত গোড়া থেকেই বাংলা, বাঙালি, বাঙালি সংস্কৃতি, পূর্ববঙ্গের স্বায়ত্তশাসন ও নািসদের মতো বর্ণবাদী অবস্থান নিয়ে প্রতিটি বুদ্ধিবৃত্তিক ইস্যুকে নির্দিষ্টভাবে ইসলামের বিপরীতে দাঁড় করিয়েছে। এটাকেই আমি বলি জামায়াতবাদ। নািসবাদের মতো এটা নিষিদ্ধ করার দাবি রাখে। মওদুদী স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধীনতার আন্দোলনকে ইসলামবিরোধী, যৌথ নির্বাচনপদ্ধতিকে ইসলামবিরোধী এবং সর্বোপরি পদ্ধতিগতভাবে বুদ্ধিজীবী হত্যায় জড়িত হয়ে নিজেকে অন্য সব ইসলামি দল বা গোষ্ঠী থেকে পৃথক করেছে। তাই রংপুরে বাংলা ভাষার দাবিতে অধ্যাপক গোলাম আযমের তিন সপ্তাহ জেল খাটার একটি বিচ্ছিন্ন দাবির সঙ্গে তাদের যাবতীয় কর্মকাণ্ডের কোনো মিল নেই ।
অধ্যাপক গোলাম আযম তাঁর বইয়ে [জীবনে যা দেখলাম] মওদুদীর তারজুমানুল কোরান পড়ে তাঁর মুগ্ধতার বিবরণ দিয়েছেন। ভালি নসর লিখেছেন, ১৯৫১ সালের জুনে তারজুমানুল কোরান-এর একজন পাঠকের প্রশ্নের জবাবে মওদুদী ঘোষণা দেন যে ভারত দারুল কুফর (ল্যান্ড অব ব্লাসফেমি) এবং ভারত প্রত্যাগতদের বিয়ে করা পাকিস্তানিদের জন্য হারাম। এ ছাড়া মওদুদী মাহদি ও আহমেদিঘেঁষা হিসেবেও উলেমাদের দ্বারা অভিযুক্ত হন। এ জন্য তিনি ভারত ও পাকিস্তানের সব মতবাদের অনুসারী উলামাদের সমালোচনার শিকার হন (পৃ. ১২৯)। ভালি নসর আরও লিখেছেন, ‘১৯৭১ সালের গৃহযুদ্ধে জামায়াত তার শক্তি-সামর্থ্য দিয়ে [ইয়াহিয়া] সরকারের পাশে দাঁড়ায় এবং পূর্ব পাকিস্তানের বাংলাদেশ হওয়া ঠেকাতে সংঘাতে অংশ নেয়। সমাজতন্ত্রের ধারক ভুট্টোর জনপ্রিয় হয়ে ওঠাকেও তারা ইসলামের প্রতি চ্যালেঞ্জ (এটাও জামায়াতবাদ) হিসেবে দেখে এবং সে কারণে তারা ১৯৭২-৭৪ সালে [ভুট্টো কর্তৃক] বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের বিরোধিতা এবং নতুন করে আহমেদিয়া দাঙ্গা শুরু করে’ (পৃ. ৫৬)।
১৯৫৩ সালের ১২ মে (টেলিগ্রাম নং ১৭১১) করাচির মার্কিন কনস্যুলেট ওয়াশিংটনকে জানায়, সামরিক আদালতে লাহোরে আহমেদিয়া সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে রায়ট বাধানোর জন্য মওদুদীকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। ১১ মে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে। মওদুদী পাকিস্তানের শীর্ষস্থানীয় মোল্লা। পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্রসচিব উভয়ে তাঁকে ‘পাকিস্তানের সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যক্তি’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
১৯৫৬ সালের ১৪ জুন করাচির মার্কিন দূতাবাসের (ফরেন সার্ভিস ডেসপাচ নং ৮৯৩) প্রথম সচিব গ্যারেট এইচ সোলেন ‘মাওলানা মওদুদী অ্যান্ড দি ইলেকটরাল সিস্টেম অব পাকিস্তান’ শীর্ষক তারবার্তায় লেখেন, পাকিস্তানের সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থোডক্স প্রেসার গ্রুপ জাতীয় ভোট প্রদান পদ্ধতিতে ধর্মীয় পার্থক্য সৃষ্টির জন্য ব্যাপকভিত্তিক প্রচারণা শুরু করেছে।
মওদুদী ও জামায়াতের এই দৃষ্টিভঙ্গিই বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে তাদের অবস্থান নির্দিষ্ট করে দেয়। উল্লেখ্য, ১৯০৯ সালে মন্টেগু-চেমসফোর্ডের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে মর্লি-মিন্টোর ব্যাপকভিত্তিক সাংবিধানিক সংস্কারের আওতায় মুসলমান ও হিন্দুদের জন্য ব্রিটিশ ভারতে পৃথক নির্বাচনপদ্ধতি চালু করেছিল। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের রেকর্ড থেকে দেখা যাবে, সেটা তারা মুসলিম লীগের দাবি বিবেচনায় নিয়ে করলেও সেখানে আল-কোরআন, ধর্ম ও বর্ণ একেবারেই বিবেচ্য ছিল না। মুসলমানরা সমাজের অনগ্রসর অংশ বিবেচনায় পৃথক নির্বাচনপদ্ধতি করা হয়েছিল। অথচ মাওলানা মওদুদী ১৯৫৬ সালে সংবিধান প্রণয়নের সময় এই বিষয়টিকে কোরআনের আলোকে গ্রহণযোগ্যতা দিয়ে একটি ফতোয়া দেন। তিনি ডন পত্রিকায় তিন কিস্তিতে নিবন্ধ লেখেন, মওদুদীর আসল মাথাব্যথা যে ছিল পূর্ব পাকিস্তান, তা এই নিবন্ধে ফুটে উঠেছে।
করাচির মার্কিন দূতাবাস যথার্থই বলেছিল, ‘মওদুদীর এই প্রপাগান্ডার লক্ষ্য হচ্ছে রাজনৈতিক পরিবেশ উত্তপ্ত করা। পাকিস্তানের উভয় অংশের লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলি যাতে হিন্দু ও মুসলমানদের জন্য আলাদা নির্বাচনপদ্ধতি সংরক্ষণ করে ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির কাছে সুপারিশ পাঠায়। যুক্ত পদ্ধতিতে পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দুরা অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী থাকবে। জয়েন্ট ইলেকটরেট হলে তা হিন্দুদের দুর্বল করবে, এই যুক্তি ‘সবচেয়ে বড় প্রতারণা’ মনে করেন মওদুদী। তাঁর কথায় জয়েন্ট ইলেকটরেট হওয়ার পরিণাম হবে হিন্দুরা যতটা না পারবে, তার চেয়ে বেশি তাদের জন্য করে দেবে মুসলমানরা। যারা সেক্যুলার ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা, তারাই কার্যকরভাবে হিন্দুদের স্বার্থ সংরক্ষণ করবে।’
মার্কিন কূটনীতিক গ্যারেট সোলেন এরপর লেখেন, এই বিষয়ে মওদুদীর লেখা একটি নিবন্ধ ধারাবাহিকভাবে ডন পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। এতে মওদুদীর বাঙালি জাতীয়তাবাদ আন্দোলনের ভীতি ফুটে উঠেছে। যদি শুধু মুসলিম জনসংখ্যা নিয়ে পৃথক ভোট পদ্ধতি করা যায়, তাহলে সেটাই হবে বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রতিহত করার কার্যকর হাতিয়ার। যুক্ত নির্বাচন পদ্ধতির প্রস্তাবকে মওদুদী ইসলামের উদ্দেশ্য নষ্ট করার হাতিয়ার হিসেবে চিহ্নিত করেন। তাঁর কথায় কেবল মুসলিম ভোটাররাই একটি আদর্শ ইসলামি রাষ্ট্র পরিচালনা করতে পারে। হিন্দুরা ‘এর দৃশ্যপটে একেবারেই আসতে পারে না।’ যারাই জয়েন্ট ইলেকটরেট চাইবে, তাদের উদ্দেশ্য হবে একটি ‘প্রকৃত ইসলামি জীবনব্যবস্থা’ প্রতিরোধে শামিল হওয়া। যুক্ত পদ্ধতির সমর্থন করা মানেই ‘মুসলিম ভণ্ড ও নাস্তিকদের নির্বাচন’ বলে গণ্য হবে। মার্কিন কূটনীতিক তাঁর তিন পৃষ্ঠার প্রতিবেদনের মন্তব্য অংশে লেখেন, মওদুদীর বিশ্লেষণের মধ্যে কিছু উল্লেখযোগ্য স্ববিরোধিতা রয়েছে। পাকিস্তান যেখানে একটি বহুধর্মীয় সমাজ, সেখানে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি সেক্টেরিয়ান বা তাতে উপদলীয়তা প্রকাশ পাচ্ছে। মওদুদী স্বীকার করেছেন যে মুসলমানরা বিভক্ত। কারণ, একটি গোষ্ঠী বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ চায়। তিনি সংখ্যালঘুর প্রতিনিধিত্বের আইনগত অধিকার মঞ্জুর করেন। কিন্তু আবার এ কথাও বলেন, একটি প্রকৃত ইসলামি সমাজে হিন্দুদের কোনো বক্তব্য থাকতে পারে না। এরপর সোলেন আরও লিখেছেন, পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামী লীগ বিশ্বাস করে যে যদি যৌথ নির্বাচকমণ্ডলীর আওতায় নির্বাচন হয় তাহলে বর্তমানে হিন্দু এমএলএরা যে ৫০টি আসন দখল করে আছে, সেগুলোতে তারা জয়লাভ করবে। মার্কিন কূটনীতিক নির্দিষ্টভাবে এ কথা উল্লেখ করেন যে মওদুদীর সমর্থকেরা প্রধানত আওয়ামী লীগের ক্ষমতায়ন এবং তাঁর প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের কর্মসূচিতে শঙ্কিত।
উল্লেখ্য যে ১৯৫৬ সালের ৪ জুন মওদুদী ডন-এ তাঁর দ্বিতীয় কিস্তির নিবন্ধে ‘মুসলমান ও হিন্দুর জীবনের সবকিছুই পৃথক। আমরা তাই কেবল ব্যালট বাক্সে একত্র হতে পারি না। হিন্দু ও মুসলমানের পার্থক্য এতটাই মৌলিক যে জীবনের প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রগুলোর কোনোটিতেই তাদের একমত হওয়ার সুযোগ নেই। পাকিস্তান হলো মুসলিম জাতির ঐক্যের বহিঃপ্রকাশ এবং একে অবশ্যই ধরে রাখতে হবে।’ জিন্নাহকে এভাবে উদ্ধৃত করে মওদুদী লিখেছেন, ‘বাঙালি সাহিত্য মূলত হিন্দু লেখকদের সৃষ্টি। শিক্ষিত মুসলমানদের এই সাহিত্য দিয়েই বুদ্ধিভ্রম ঘটানো হয়। পূর্ব পাকিস্তানে এমন অনেক সাময়িকী ও সংবাদপত্র রয়েছে, যাতে কেবল মুসলমানদের নাম ব্যবহার করা হয় কিন্তু আসলে তা হিন্দুদের টাকায় এবং তাদের বুদ্ধি-পরামর্শেই চালিত হয়ে থাকে। কিছু গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দলও হিন্দু অর্থায়নের ওপর নির্ভরশীল। যদি পাকিস্তানে জয়েন্ট ইলেকটরেট প্রবর্তন করা হয়, তাহলে ভারত থেকে তেমন ধরনের মুসলমানরা এসে ঘাঁটি গড়বে, যারা ধর্মনিরপেক্ষতা এবং মুসলিম জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী।’
১৯৫৬ সালের জুনে ডন-এ মওদুদী এই নিবন্ধটি লেখার আগে তাঁর জীবনের প্রথম পূর্ব পাকিস্তান সফরটি করেন। ১৯৫৬ সালের ২৬ জানুয়ারি থেকে ৬ মার্চ পর্যন্ত মওদুদীর এই সফর সম্পর্কে গোলাম আযম গভীর উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে ২০০২ সালে কামিয়াব প্রকাশন প্রকাশিত তাঁর জীবনে যা দেখলাম, দ্বিতীয় খণ্ডের ১৪৮ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘৩৮ দিন মাওলানার ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য আমার আদর্শিক ও সাংগঠনিক জীবনের একটি স্মরণীয় ঘটনা।’
মওদুদী বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে যে ধারণা পোষণ করেছিলেন, তাতে কখনো কোনো ভ্রান্তি দেখেনি জামায়াত। আশ্চর্যের বিষয়, সংখ্যালঘুদের জন্য ‘পৃথক’ পদ্ধতি আজও জামায়াত তার গঠনতন্ত্রে ধারণ করে আছে। গোলাম আযম তাঁর বইয়ে অসাম্প্রদায়িক হতে আওয়ামী লীগের যুক্ত নির্বাচনপদ্ধতি গ্রহণকে কটাক্ষ করেন। ১৫৯ পৃষ্ঠায় যুক্ত পদ্ধতির নির্বাচন গ্রহণ সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, ‘অমুসলিমদের নিকট পরিপূর্ণরূপে গ্রহণযোগ্য হওয়ার “মহান উদ্দেশ্যেই” আওয়ামী লীগ সম্পূর্ণরূপে “অসাম্প্রদায়িক” ও “ধর্ম নিরপেক্ষ” হওয়ার মহাগৌরব (?) অর্জন করে।’
আমার কাছে প্রতীয়মান হয়েছে এই মওদুদীবাদ কিংবা জামায়াতবাদ জার্মানিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আইন করে নিষিদ্ধ ঘোষিত ফ্যাসিবাদের সঙ্গে তুলনীয় এবং স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশেও এই অপরাজনীতির কোনো ঠাঁই হতে পারে না। ওই ‘জামায়াতবাদের’ অনুশীলন সংবিধান পরিপন্থী বলেই প্রতীয়মান হয়।
মওদুদী ও জামায়াতের ওই ঐতিহাসিক হিন্দু বিদ্বেষ থেকেই একাত্তরের বুদ্ধিজীবী হত্যা ও গণহত্যার বিষবৃক্ষ রোপণ করা হয়েছিল। এর ভিত্তিতেই আলবদর, আলশামস, শান্তি কমিটি গঠন করতে পেরেছিল জামায়াত।
মার্কিন নথিই সাক্ষ্য দিচ্ছে, মওদুদীর ওই মতবাদই হয়ে উঠেছিল গণহত্যার মূল ‘আদর্শগত’ ভিত্তি। একটি নথিতে বলা হয়, ‘১৯৭১ সালের ৭ সেপ্টেম্বর পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনেম খান “হাতে গোনা কতিপয় বুদ্ধিজীবী” এবং লেখক “পরিকল্পিত উপায়ে সংস্কৃতজাত বাঙালি শব্দ” ব্যবহার করছেন এবং তাঁরাই এখন “বাঙালিবাদ এবং হিন্দু প্রভাবিত সংস্কৃতির প্রবক্তা” হয়ে উঠেছেন। গভর্নর অভিযোগ করেন যে সীমান্তের ওপারের লোকজন তাদের মদদ দিচ্ছে। ১৫ সেপ্টেম্বর নিয়মিত বেতার ভাষণে মালেক অভিযোগ করেন যে ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বরের যুদ্ধে যারা পাকিস্তানের রণক্ষেত্র থেকে উত্খাত হয়েছিল, তারাই ছদ্মবেশ ধরে এখন সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে কব্জা করতে চাইছে। পশ্চিম পাকিস্তানের রণক্ষেত্র থেকে যুদ্ধ এখন পূর্ব পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক ফ্রন্টে স্থানান্তরিত হয়েছে।’
একাত্তরে মার্কিন কংগ্রেসের শুনানিগুলোতে স্পষ্ট যে বুদ্ধিজীবীরা আগাগোড়া পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের দোসরদের টার্গেট ছিলেন।
১৯৭১ সালের ২২ সেপ্টেম্বর হেনরি কিসিঞ্জারের জন্য প্রস্তুত একটি স্মারকে উল্লেখ করা হয় যে ইয়াহিয়া ৪ সেপ্টেম্বর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছেন কিন্তু ঢাকার মার্কিন কনস্যুলেট জানিয়েছে যে বুদ্ধিজীবীদের গ্রেপ্তার অব্যাহত রয়েছে (আমেরিকান পেপারস, পৃ. ৬৭০)।
১৯৭১ সালে ঢাকায় মার্কিন কনসাল জেনারেল অর্চার ব্লাড তাঁর বিখ্যাত টেলিগ্রামে ২৫ মার্চে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের কথাও উল্লেখ করেছিলেন। তাঁকে সরিয়ে তাঁর স্থানেই দায়িত্ব নিয়েছিলেন হার্বার্ট ডি স্পিভাক। ১৯৪৯ সালের ২৯ আগস্ট ঢাকায় প্রথম মার্কিন কনস্যুলেট খোলা হয়। ১৯৭২ সালের ১৮ মে ঢাকায় পূর্ণাঙ্গ মার্কিন দূতাবাস প্রতিষ্ঠালগ্নে স্পিভাক ছিলেন চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স।
আমি লক্ষ করি যে একাত্তরের মার্কিন কংগ্রেস ও সিনেটের শুনানি ও আলোচনায় গণহত্যা বিশেষ করে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড বিশেষ মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল। কংগ্রেসের আগ্রহের কারণেও ঢাকার মার্কিন কনসাল স্পিভাক বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে বিশেষ নজর রেখেছিলেন বলে প্রতীয়মান হয়। সুতরাং তাঁর বর্ণনায় জামায়াতের নাম আকস্মিকভাবে আসেনি।
১৯৭১ সালের ২০ ডিসেম্বর লেখেন (তারবার্তা নম্বর ঢাকা ৫৭১৪), ‘বাঙালি সৈন্যরা কথিতমতে এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার ও হত্যা করেছে। যুদ্ধ শেষ হওয়ার অল্প আগে গ্রেপ্তার হওয়া কয়েক শ বুদ্ধিজীবীর মধ্যে ওই ব্যক্তি অন্তত ২০ জন বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করেন বলে অভিযোগ আছে।’ এটা লক্ষণীয় যে মার্কিন কনসাল মূল বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড ১৪-১৬ ডিসেম্বরে সংঘটিত হয় বলে বর্ণনা করেন। এটা ঘটে জামায়াত নিষিদ্ধ হওয়ার পরে।
প্রফেসর ইমেরিটাস ড. আনিসুজ্জামান সাক্ষ্য দিয়েছেন যে তিনি চৌধুরী মুঈনুদ্দীনকে ১৯৭৯ সালে লন্ডনের পাবলিক লাইব্রেরির ইন্ডিয়া অ্যাফেয়ার্স বিভাগে ১৯৭১-এর স্টেটসম্যান পত্রিকার মাইক্রোফিল্ম দেখতে পেয়েছিলেন। এই স্টেটসম্যান-এ ১৯৭১ সালের ১২ ডিসেম্বর খবর ছাপা হয়েছিল যে বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম ১১ ডিসেম্বর ’৭১ ‘গণবিরোধী এবং সাম্প্রদায়িক তত্পরতার’ দায়ে পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি, মুসলিম লিগ, জামায়াতে ইসলামী এবং নিজাম-ই-ইসলামকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। এ বিষয়ে কলকাতার মার্কিন কনসাল গর্ডন ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর ওয়াশিংটনে তারবার্তায় (কলকাতা ৩০২৮) জানান, ছয়টি দলকে (মুসলিম লিগ তিনটি স্বতন্ত্র ও উপদলের সমন্বয়ে) নিষিদ্ধ করার মূল কারণ তাদের সন্দেহভাজন ‘কোলাবরেশনিস্ট অ্যাক্টিভিটিজ’। ঢাকার মার্কিন পলিটিক্যাল অফিসারের সঙ্গে আলোচনা করে কর্ন ওই বার্তা পাঠান বলেও উল্লেখ করেন।
হার্বার্ট স্পিভাক ঢাকা ৫৯৯৬ নম্বর তারবার্তায় ১৯৭১ সালের ১৮ ডিসেম্বর ওয়াশিংটনকে অবহিত করেন যে ঢাকার পশ্চিম পাশে ইটখোলাসংলগ্ন পতিত একটি মাঠের গর্তে ৩০টি গলিত মরদেহের সন্ধান মিলেছে। বিশ্বাস করা হয় যে পশ্চিম পাকিস্তানি আর্মির স্থায়ীভাবে নিয়োগ করা সমর্থক ও রাজাকার আত্মসমর্পণের শর্তাবলি যাতে তাদের অনুকূল হয়, সে জন্য প্রায় ৩০০ জন বুদ্ধিজীবীকে গ্রেপ্তার করেছিল ‘হোস্টেজ’ হিসেবে ব্যবহার করার জন্য। ওই লাশগুলো গ্রেপ্তারকৃত বুদ্ধিজীবীদেরই হবে। নারী প্রফেসর এবং কতিপয় মেডিকেল স্পেশালিস্টকে আত্মসমর্পণের মাত্র দুই দিন আগে হত্যা করা হয়। স্থানীয় বাসিন্দারা বলেছেন, ইটের কারখানার কাছে অনেককেই হত্যা করে গর্তে নিক্ষেপ করা হয়। কথিতমতে, রাজাকাররা এখনো ইটখোলায় লুকিয়ে আছে। ভারতীয় একটি টহল দল শনিবার অতর্কিতে অভিযান চালিয়ে কয়েকজন রাজাকারকে আটক করেছে। কথিতমতে, তারা ওই হত্যাযজ্ঞে অংশগ্রহণের কথা স্বীকার করেছে।
১৯৭১ সালের ২১ ডিসেম্বর [তারবার্তা নম্বর ৫৮৪৩] স্পিভাক ওয়াশিংটনকে জানান, ‘ঢাকার প্রেস এবং জনগণ সার্বক্ষণিক এই চিন্তায় আছেন যে, “বাংলাদেশকে বুদ্ধিজীবীশূন্য” করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। বাংলাদেশ সরকারের সেক্রেটারি জেনারেলের বরাতে বলা হয়েছে জেনারেল ফরমান আলী এবং অন্যরা ১৫-১৬ ডিসেম্বরে যারা নিহত হয়েছে, তাদের তালিকা তৈরিতে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিল।’ আরেকটি নথিতে আছে, কেলি নামে ঢাকায় ইউনিসেফের একজন কর্মকর্তা ছিলেন। ভারতীয় হাইকমিশনের জে এন দীক্ষিত (পরে পররাষ্ট্রসচিব) কেলিকে একান্তে বলেছেন, ভারতীয়রা ফরমান আলীর দপ্তর থেকে কিছু নথিপত্র পেয়েছেন, যা থেকে অনুমান করা চলে যে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডে তাঁর ভূমিকা ছিল।
১৯৭১ সালের ২৮ জানুয়ারি ওয়াশিংটন থেকে তত্কালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম পি. রজার্স ঢাকার মার্কিন কনস্যুলেটে পাঠানো এক তারবার্তায় [নম্বর ১৬৮৯২] বলেন, বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে তথ্য জানতে মার্কিন কংগ্রেস অব্যাহতভাবে আগ্রহ দেখিয়ে চলেছে। তাই ডিসেম্বরের গোড়ায় যেসব বুদ্ধিজীবী মারা গেছেন, তাঁদের নাম এবং নিহত হওয়ার প্রেক্ষাপট জানিয়ে অতিরিক্ত তথ্য জানতে চাইছে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর।
তাই বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে মার্কিন প্রশাসনের কাছে বিস্তারিত তথ্য রয়েছে বলেও প্রতীয়মান হয়। ধারণা করা যায় যে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডে মুক্তিযোদ্ধাদের দায়ী করা হয়েছিল। ১৯৭১ সালের ২৩ ডিসেম্বর হার্বার্ট স্পিভাক ৫৭৭২ নম্বর কনফিডেনশিয়াল তারবার্তায় ওয়াশিংটনকে জানিয়ে দেন যে ‘বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের জন্য মুক্তিবাহিনীকে দায়ী করা নিম্নোক্ত কারণে সন্দেহ সৃষ্টি করে:
(১) আমাদের জানামতে, ১৪-১৫ ডিসেম্বরে (আগের [তারবার্তায়] এই তারিখ ১৫-১৬ ডিসেম্বর উল্লেখ করা হয়েছিল) হত্যাকাণ্ড ঘটে। ওই সময়ে পাকিস্তানি আর্মির নিয়ন্ত্রণে ছিল এবং কারফিউ পুরোপুরি কার্যকর ছিল। (২) ওই সময়ে মুক্তিবাহিনীর সক্রিয় থাকার ব্যাপারে সামান্যই সাক্ষ্য প্রমাণ রয়েছে। (৩) নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে কয়েকজনের নাম উল্লেখ করা হলো, তাঁদের কেউ ‘কোলাবরেটর’ ছিলেন না। বরং তাঁদের অধিকাংশই বাঙালি জাতীয়তাবাদী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ...যদিও তাঁদের অনেকেই ঢাকায় অবস্থান করেছেন কিন্তু প্রকাশ্যে তাঁরা তাঁদের বক্তব্য দেননি।
বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে আটজনের মৃত্যু স্পিভাক নিশ্চিত করতে পেরেছিলেন। তাঁরা হলেন: অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক এম এফ রাব্বী, শহীদুল্লা কায়সার, সিরাজুদ্দীন হোসেন, এস এ মান্নান, নিজামউদ্দিন আহমেদ, অধ্যাপক এ খায়ের ও ড. আলীম চৌধুরী।
‘বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের হত্যা’ শীর্ষক ওই তারবার্তায় [৫৭৭২] আরও তিনটি বার্তার [ঢাকা ৫৭২৪ ও ৫৭৪৩: ইসলামাবাদ ১২৮৫৬] উল্লেখ দেখেছি। মনে হচ্ছে, ওই বার্তাগুলো বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডবিষয়ক, এগুলোর হদিস আমি পাইনি।
১৯৭২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি স্পিভাক অপর এক তারবার্তায় (ঢাকা ৩৯৩) যুদ্ধ শেষ হওয়ার আগমুহূর্তে প্রায় ২০০ থেকে ৩০০ বুদ্ধিজীবী হত্যার তথ্য উল্লেখ করেন। অন্যান্য বড় শহর থেকেও একই ধরনের খবর এসেছে, তবে তা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। তালিকার সবাই বাঙালি কিন্তু সাধারণভাবে তাঁরা রাজনৈতিকভাবে নিষ্ক্রিয়। তাঁদের অধিকাংশই ১১ ডিসেম্বরের রাত এবং ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে তাঁদের বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার হয়েছেন। প্রায়ই উর্দি পরিহিত সামরিক জওয়ানদের পরিহিত থেকে সশস্ত্র ব্যক্তিরা তাঁদের আটক করে। সংবাদপত্র, কনস্যুলেটের স্থানীয় স্টাফ এবং আমেরিকান সংবাদদাতাদের ভাষ্য অনুযায়ী, ঢাকার উত্তর-পশ্চিমাংশের একটি ইট কারখানায় তাঁদের অধিকাংশকে হত্যা করা হয়। মার্কিন সাংবাদিকেরা প্রায় ২০টি লাশ প্রত্যক্ষ করেছেন এবং তাঁরা বলেছেন, মৃত্যুর আগে তাঁদের ওপর নির্যাতন চলেছে। ইউসিসের স্থানীয় জ্যেষ্ঠ স্টাফদের রিপোর্ট করেছেন যে ইতিপূর্বে গণনায় ধরা হয়নি এমন অনেক নিখোঁজ বুদ্ধিজীবীকে মোহাম্মদপুর বিহারি ক্যাম্পে অন্তরীণ রাখা হয়েছিল এবং তাঁদের হত্যা করা হয়। এই তারবার্তাটির পরের অংশ আমি পাইনি।
মার্কিন কংগ্রেস যে বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে একাত্তরেই অবহিত ছিল তার সাক্ষ্য দেবে মার্কিন কংগ্রেশনাল রেকর্ড। উপরন্তু ওই সময়ে জাতিসংঘও স্বীকার করেছে যে একাত্তরের ডিসেম্বরের পরিস্থিতি মার্কিন কনস্যুলেটই সবচেয়ে ভালোভাবে নজরদারি করতে পেরেছে।
১৯৭১ সালের ২৯ এপ্রিল মার্কিন কংগ্রেসে উইলিয়াম বি. স্যাক্সবি মার্চের গণহত্যা সম্পর্কে ঢাকার ইউএসএইডে কর্মরত এক মার্কিন চিকিত্সকের একটি চিঠি উপস্থাপন করেন। ১৭ এপ্রিল, ১৯৭১ ওহাইও থেকে ডা. জন ই রোড লিখেছেন, প্রিয় সিনেটর স্যাক্সবি, আমি ও আমার স্ত্রী কদিন আগে ঢাকা থেকে এসেছি। ...এই অধ্যাপকদের অনেকের পরিবারের সদস্যদেরও গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। ড. রোড আর্চার ব্লাডের বার্তাগুলোর কথাও উল্লেখ করেন।
হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি সেন্টার ফর পপুলেশন স্টাডিজের রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট ড. রিচার্ড ডি ট্যাবরস ও তাঁর স্ত্রী প্যাটন ও ট্যাবরস ১৯৭১ সালের ১৬ মে বোস্টন গ্লোবে লিখেছেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষস্থানীয় অধ্যাপকদের তাঁদের বাসভবন থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়...’ [১৮ মে, ১৯৭১, কংগ্রেশনাল রেকর্ড সিনেট, পৃ. ১৫৪৮৪]।
এখানে লক্ষণীয় যে ’৫৬ সালে বাঙালির জাতীয়তাবাদের প্রতি মওদুদীর ঘৃণা কোনো বিচ্ছিন্ন বিষয় ছিল না। পাঞ্জাবিদের কব্জায় থাকা আর্মি চিন্তায়ও তা ছিল। মওদুদী একে ইসলাম দিয়ে ব্যাখ্যা করে আরও ভয়ংকর করে তুলেছিলেন।
সে কারণে একাত্তরের ২৯ মার্চ ব্যাংকক ডেটলাইনে ওয়াশিংটন পোস্ট-এ সেলিন এস. হ্যারিসন লিখেছেন, ‘পঞ্চাশের দশকে পাকিস্তানকে যুক্তরাষ্ট্র যখন সমরাস্ত্র সরবরাহ শুরু করে তখন প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী যুক্তরাষ্ট্র সফরে এসে ঘরোয়াভাবে সতর্ক করেছিলেন যে এসব অস্ত্র একদিন বাঙালির আকাঙ্ক্ষা দমনেই ব্যবহূত হবে।’
১৯৭১ সালের ১৮ মে মার্কিন কংগ্রেসের ফ্লোরে দাঁড়িয়ে বাঙালি হত্যায় মার্কিন অস্ত্র ব্যবহার সম্পর্কে বলতে গিয়ে হ্যারিসনের ওই প্রতিবেদনটির বরাত দিয়েছিলেন সিনেটর চার্চ (সূত্র: মে ১৮, ১৯৭১, কংগ্রেশনাল রেকর্ড সিনেট, পৃ. ১৫৪৬৯) একই দিনে কংগ্রেস নথিবদ্ধ করে ১৬ মে ১৯৭১ ম্যালকম ডব্লিউ ব্রাউনের নিউইয়র্ক টাইমস-এ প্রকাশিত লেখা, ‘সৈন্যরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের তাড়া করেছে এবং ঠান্ডা মাথায় তাদের এবং তাদের পরিবারকে হত্যা করেছে’ (১৮ মে, ৭১, কংগ্রেশনাল রেকর্ড পৃ. ১৫৬০৯)।
৭ জুন ১৯৭১, নিউইয়র্ক টাইমস-এ অ্যান্থনি লিউস (Anthony Lewis) লিখেছেন, ‘পাকিস্তান সেনাবাহিনী হত্যাযজ্ঞ “সিলেকটিভ”। আর্মির নির্দিষ্ট টার্গেট হলো বুদ্ধিজীবী এবং সমাজের জনমত গঠনকারী অংশ—চিকিত্সক, অধ্যাপক, ছাত্র ও লেখক’ [১১ জুন, ১৯৭১, মার্কিন কংগ্রেসের বিতর্ক, পৃ. ১৯৫১৭]।
১০ জুন ১৯৭১ সিনেট ফরেন রিলেশনস কমিটির শুনানিতে অনর্গল বাংলা বলতে পারা হার্ভার্ডের মেডিকেল স্কুল স্নাতক ড. জন রোড, যিনি এর আগে সিনেটর স্যাক্সবিকে চিঠি লেখেন, তিনি এ দিন শুনানিতে অংশ নেন। তিনি বলেন, আমি ২৫ মার্চ রাতে ঢাকার রাস্তায় ট্যাংকবহরে আমেরিকান এম-২৪ প্যাটনস দেখেছি। তিনি আরও বলেন, পাকিস্তান আর্মির সামরিক আইন নম্বর ১৪৮ আমাকে ১৯৩০-এর দশকে নািস জার্মানির ‘শান্তি প্রতিষ্ঠার’ ফরমান স্মরণ করিয়ে দিয়েছে।
১৯৭১ সালের ২৫ মে নিউইয়র্ক টাইমস-এ সিডনি এইচ শ্যানবার্গ দিল্লি ডেটলাইনে লিখেছেন, ‘রক্তস্নাত প্রতিশোধের অন্যতম লক্ষ্যবস্তু হচ্ছেন তরুণ, বুদ্ধিজীবী, নিষিদ্ধঘোষিত আওয়ামী লীগের সদস্য এবং সংখ্যালঘু হিন্দু’ [সূত্র: ৮ জুলাই, ১৯৭১, রেকর্ড, পৃ. ২৪০৬৭]।
হিন্দু নিশ্চিহ্নকরণের যে যৌক্তিকতা দিয়েছেন জেনারেল টিক্কা খান তারও মূলে রয়েছে ওই জামায়াতবাদ বা জামায়াতিজম। মার্কিন কংগ্রেস অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের সানডে টাইমস-এ লেখা একটি প্রতিবেদন বিবেচনায় নেয়। সেখানে মাসকারেনহাস লিখেছেন, ১৮ এপ্রিল ১৯৭১ আমি রেডিওতে টিক্কার কণ্ঠ শুনলাম ‘পাকিস্তান সৃষ্টিতে মুখ্য ভূমিকা পালনকারী পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমানদের সংখ্যাগরিষ্ঠের কণ্ঠস্বর আসলে সহিংস ও উচ্চকিত সংখ্যালঘুদের কারণেই চাপা পড়েছে, তারাই আওয়ামী লীগকে ধ্বংসের পথে যেতে বাধ্য করেছে [সানডে টাইমস, লন্ডন, ১৩ জুন, ৭১ মাসকারেনহাস [কংগ্রেশনাল রেকর্ড জুলাই ৮, ৭১, পৃ. ২৪০৭৯]। নবম ডিভিশনের দপ্তরে কর্নেল নাজিম তাঁকে বলেন, ‘হিন্দুরা তাদের অর্থ দিয়ে মুসলিম জনগোষ্ঠীকে একেবারে নত করে ফেলেছে। ...বাঙালি সংস্কৃতি মানে হিন্দু সংস্কৃতি।’
মাসকারেনহাস লেখেন, টিক্কা খান ঢাকায় ইস্টার্ন কমান্ডের সদর দপ্তরে আমাকে বলেন, তিনটি নীতি বাস্তবায়ন করছেন তিনি। ১. বাঙালিরা ‘অবিশ্বস্ত’ তাই পশ্চিম পাকিস্তানিরাই তাদের শাসন করবে ২. বাঙালিদের ইসলামীকরণ করতে হবে ৩. হিন্দু নিধন ও নির্মূলের পর তাদের সম্পদ দরিদ্র মুসলিমদের মধ্যে বিতরণ করা হবে। ...ইয়াহিয়া ও টিক্কা তাদের এ রকম কর্মসূচির প্রতি এ পর্যন্ত বাঙালি আইনজীবী মৌলভি ফরিদ আহমেদ, ফজলুল কাদের চৌধুরী ও জামায়াতে ইসলামীর প্রফেসর গোলাম আযমের সমর্থন পেয়েছেন [জুলাই ৮, ১৯৭১, কংগ্রেশনাল রেকর্ড, পৃ. ২৪০৯৯]।
১৯৭১ সালের ১৪ জুলাই সিডনি এইচ শ্যানবার্গ নিউইয়র্ক টাইমস-এ লিখেছেন, সেনাবাহিনীর সৃষ্টি করা শান্তি কমিটিকে সেনাবাহিনীর দীর্ঘদিনের অনুগত ও সহায়তাকারী হিসেবে পরিচিত মুসলিম লিগ ও জামায়াতে ইসলামীর মতো ডানপন্থী ধর্মীয় দলের অনুসারীরা রয়েছে (১৪ জুলাই, ১৯৭১ কংগ্রেশনাল রেকর্ড, পৃ.৩)। এর মাত্র ১২ দিন পর ১৯৭১ সালের ২৬ জুলাই মার্কিন কংগ্রেসে শুনানিতে পেশ করা হয়েছিল কেবল শান্তি কমিটির ওপর তৈরি একটি বিশেষ প্রতিবেদন। ১৯৭১ সালের ২৩ জুলাই ওয়াশিংটন পোস্ট-এ প্রকাশিত লি লেসকেজের তৈরি করা ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘শান্তি কমিটির সদস্যরা বাস্তবে অত্যন্ত ক্ষমতাধর ছিল। কাউকে গ্রেপ্তার বা হত্যা করতে তাদের তরফে সেনাবাহিনীর কাছে একটি শব্দ উচ্চারণই যথেষ্ট ছিল (২৬ জুলাই ১৯৭১, কংগ্রেশনাল রেকর্ড, পৃ. ২৭১৩৪)। নিউইয়র্কভিত্তিক হিউম্যান রাইটস ওয়াচ যুদ্ধাপরাধের বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুললেও তারা তাদের ওয়েবসাইটে লিখেছে, গোলাম আযম শান্তি কমিটির সদস্য ছিলেন।
আমি আমার অনুসন্ধানে দেখেছি, বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে পাকিস্তানি আর্মি ও জামায়াতইজমের কোনো অমিল নেই। বরং জামায়াতই বুদ্ধিজীবী নিধনকে ইসলামের দোহাই দিয়ে একে প্রকারান্তরে ধর্মযুদ্ধের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল বলে প্রতীয়মান হয়। বাঙালি মুসলমানের বর্ণ, গোত্র ও রক্ত নিয়ে প্রশ্ন তোলার বিষয়টিকে ধর্মের বাতাবরণে যথার্থতা দিয়ে জামায়াত মুসলিম সভ্যতাকেই কলঙ্কিত করেছে।
পাকিস্তানি লেখক হুসেইন হাক্কানিও ভালি নসরকে সমর্থন করেছেন। হাক্কানি তাঁর পাকিস্তান: বিটুইন মস্ক অ্যান্ড মিলিটারি গ্রন্থে লিখেছেন, সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের অবাঙালি বেসামরিক নাগরিক ও পাকিস্তানপন্থী ইসলামি গ্রুপগুলোর মধ্য থেকে এক লাখ রাজাকার নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। জামায়াতে ইসলামী বিশেষ করে তার ছাত্র শাখা ইসলামি জমিয়ত-ই-তালাবা (আইজেটি) দুটি আধা সামরিক কাউন্টার ইনসার্জেন্সি ইউনিট গঠনে সামরিক বাহিনীর প্রচেষ্টার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছে। আইজেটি বিপুলসংখ্যক ব্যক্তির নিয়োগের সঙ্গে সম্পৃক্ত। সেপ্টেম্বরের মধ্যে ৫০ হাজার রাজাকারের নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। পশ্চিম পাকিস্তানের সেক্যুলার রাজনীতিকেরা অভিযোগ করেছিলেন যে এটা হলো ‘অ্যান আর্মি অব জামায়াতে ইসলামি নমিনিজ।’ ইসলামি ক্যাডারদের দুটি স্পেশাল ব্রিগেডের নামকরণ করা হয় আলশামস (আরবিতে সূর্য) এবং আলবদর (চন্দ্র)। পরে পাকিস্তান ইস্টার্ন কমান্ডের অধিনায়ক জেনারেল নিয়াজি রাজাকারদের ভূমিকা ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে: একটি পৃথক রাজাকার ডাইরেক্টরেট প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল...দুটি পৃথক শাখার নাম ছিল আলবদর ও আলশামস। আলবদরকে স্পেশালাইজড অপারেশনস বিষয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল।
সিনডি সি. কম্বস ও মার্টিন স্ট্যান্ড এনসাইক্লোপিডিয়া অব টেররিজম বইয়ে লিখেছেন ১০ হাজার বাঙালি বুদ্ধিজীবীকে হত্যার সঙ্গে আলবদরের সম্পৃক্ততার অভিযোগ রয়েছে।
১৯৭১ সালের মে থেকে জুলাইয়ের মধ্যে সিনেট জুডিশিয়ারি কমিটির শুনানিতে বুদ্ধিজীবী হত্যা প্রসঙ্গটি আসে। বলা হয়, ‘পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যরা বাঙালি ছাত্র, বুদ্ধিজীবী, প্রফেসরস, আর্মি অফিসারস, ইঞ্জিনিয়ারস, ডাক্তার ও সম্ভাবনাময় অন্য যে কেউ’ (পৃ. ১১৭)। এর ৩১২ পৃষ্ঠায় আছে, East Pakistanis accuse the West Pakistan Army of genocide—of the selected killing of Bengali intellectuals and of perpetuating a reign of terror so that they will be unable to raise effective opposition for many years to come. সিডনি শ্যানবার্গের ২৩ সেপ্টেম্বরের নিউইয়র্ক টাইমস-এ প্রকাশিত এই রিপোর্টও জুডিশিয়ারি কমিটি বিবেচনায় নিয়েছে, যেখানে তিনি বলেন, ‘Moslem League and Jamaat-i-Islami, which have usually backed the military regime.’
ভালি নসর ১৯৯৬ সালে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস প্রকাশিত মাওলানা মওদুদীর ওপর একটি বইয়ে মওদুদীকে সাম্প্রদায়িক হিসেবে চিহ্নিত করেন। তিনি [Mawdudi and the Making of Islamic Revivalism/Seyyed Vali Reza Nasr লিখেছেন, His discourse on the Islamic state deliberately sidestepped the ulama, depicting them as an anachronistic institution that had no place in a reformed and rationalized Islamic order.
কেমব্রিজ থেকে প্রকাশিত একটি বইয়ে প্রফেসর ক্রিশ্চিয়ান গারলেক উল্লেখ করেন যে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী হত্যায় আলবদর জড়িত। তিনি যদিও মনে করেন পাকিস্তানি আর্মি বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের সিস্টেমেটিক এক্সটারমিনেশন বা পদ্ধতিগত বিনাশ ঘটায়নি। কিন্তু তিনিও তাঁর বইয়ের ১৩৪ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, একাত্তরের ডিসেম্বরে ঢাকা, খুলনা, সিলেট ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ২৮০ জন পর্যন্ত জাতীয়তাবাদী বুদ্ধিজীবী এবং সিভিল সার্ভেন্টদের অপহরণ ও হত্যাকাণ্ড পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় যারা ঘটিয়েছে, তারা হলো প্যারা মিলিটারি আলবদর।
ডেভিড লিউস লিখেছেন, বাঙালি ‘রেসকে’ দুর্বল করতে ধর্ষণকে পদ্ধতিগতভাবে ব্যবহার করা হয়েছিল। মাসকারেনহাস দি রেপ অব বাংলাদেশ বইয়ে বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও হলগুলোতে শেল ছুড়েছিল। কারণ, সেগুলো ‘হিন্দু বুদ্ধিজীবীদের’ বলে চিহ্নিত হয়েছিল। আইয়ুব খান পূর্ব পাকিস্তানের সংকটকে ‘কতিপয় বুদ্ধিজীবীর’ সৃষ্ট সমস্যা হিসেবে দেখেন (পৃ. ৭০)। টিক্কা খান ‘কেবল ৩৫ হাজার বাঙালি বুদ্ধিজীবী’ হত্যার কথা স্বীকার করেন (পৃ. ৭২)।
ইমন মারফি জামায়াতে ইসলামী (পৃ. ৭২)-এর পক্ষে সেনাবাহিনী, বিশেষ করে আইএসআইর সঙ্গে জোট বাঁধে এবং ‘ইসলামের শত্রু’ নিধনে সক্রিয় ভূমিকা রাখে বলে উল্লেখ করেন।
মাসকারেনহাস তাঁর বইয়ের ২৫৭ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘২৫ মার্চের পর দুই সপ্তাহের মধ্যে নির্দিষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত গণহত্যার ক্যাম্পেইন চলে। এর লক্ষ্য ছিল জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত বাঙালি বুদ্ধিজীবী।’
মার্কিন দলিল সাক্ষ্য দিচ্ছে যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জামায়াত তাদের রাজনৈতিক টার্গেট করেছিল। কারণ, জামায়াত ছয় দফাভিত্তিক স্বায়ত্তশাসন ও জাতীয়তাবাদের আন্দোলনকে ধর্মবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। ১৯৭০ সালের জুনে ঢাকায় শেখ মুজিব মার্কিন কূটনীতিক কিলগোরের কাছে পশ্চিম পাকিস্তানে তার নির্বাচনী প্রচারাভিযানে জামায়াতের কাছ থেকে তিনি মারাত্মক বাধার সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা ব্যক্ত করেছিলেন (সূত্র: দি আমেরিকান পেপারস, ইউপিএল, ১৯৯৯, পৃ. ৩৬৭)।
আমেরিকান কূটনীতিকেরা জামায়াতকে কখনো গণতান্ত্রিক দল বলেনি। ১৯৭০ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি এক মার্কিন নথিতে জামায়াতকে ‘ভোসিফেরাস এবং ফেনাটিক’ এবং ১৯৭০ সালের ২২ জুন লাহোর থেকে পাঠানো অপর এক নথিতে জামায়াতকে ‘রাইটিস্ট এক্সট্রিমিস্ট’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন পিটার ডি কনস্টেবল।
মার্কিন ডকুমেন্টস সাক্ষ্য দিচ্ছে যে বাঙালির বর্ণ ও গোত্রকে নিচু হিসেবে দেখার যে দৃষ্টিভঙ্গি ১৯৫৬ সালে মওদুদী তাঁর প্রথম পূর্ব পাকিস্তান সফরে পরে দেখিয়েছিলেন, তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। ১৯৭১ সালের ৪ আগস্ট ইস্টার্ন কমান্ডের জিওসি লে. জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি মার্কিন কনসাল জেনারেল হার্বার্ট স্পিভাক এবং রবার্ট জে কার্লের সঙ্গে আলোচনা করেন। ক্যান্টনমেন্টে ইস্টার্ন কমান্ডের সদর দপ্তরে এই বৈঠক হয়। এতে বাঙালিদের সম্পর্কে নিয়াজি যা বলেছেন, তার সত্যতা আবারও নিশ্চিত করেছেন প্রয়াত মেজর জেনারেল (অব.) খাদিম হোসেন রাজা। A Stranger in My Own Country: East Pakistan, 1969-1971 (OUP, 2012)। ২০১২ সালে রাজার মৃত্যুর পরে প্রকাশিত বইয়ে তিনি বলেন, নিয়াজি যে উক্তি করেছিলেন তা উচ্চারণে চেঙ্গিস খানও বিব্রত হতেন। পূর্ব পাকিস্তানের ১৪ পদাতিক ডিভিশনের সাবেক জিওসি নিয়াজির ‘জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং’ সম্পর্কে উল্লেখ করেন যে যব he would let loose his soldiers on the women of East Pakistan till the lineage/ethnicity of the Bengali race was changed.
৪ আগস্ট ১৯৭১ নিয়াজির সঙ্গে আলোচনার পর ওয়াশিংটনকে স্পিভাক লেখেন, ‘বাঙালিদের প্রতি জেনারেলের দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্টতই অবমাননাকর। ম্যাকুলেকে বরাত দিয়ে তিনি বলেন, বাঙালি মিথ্যুক, চোর, বিশ্বাসঘাতক এবং পেছন থেকে ছুরি মারা লোক। নিয়াজি লর্ড কার্জনের বরাতে বলেন, বেঙ্গল সব সময় নিচু ভূমির দেশ, এখানে নিচু জাতের ও মিথ্যুকরা বাস করে। জেনারেল তাঁর আলোচনায় কখনোই তাঁর মিশনের রাজনৈতিক তাত্পর্য সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করেননি।’
কিন্তু মওদুদীই সেই ব্যক্তি, যিনি ১৯৫৬ সালে লিখেছেন, বাঙালি জাতীয়তাবাদ নোংরা। এর শিকড় গভীরে প্রোথিত করার জন্য জামায়াতের ছত্রচ্ছায়ায় আলবদর বাহিনী তাই বুদ্ধিজীবীদেরই টার্গেট করেছিল। আমেরিকার কংগ্রেসের একটি সাম্প্রতিক শুনানির জন্য প্রস্তুত একটি গবেষণাপত্রেও বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে আলবদরকেই চিহ্নিত করা হয়েছে।