বাংলাদেশ: এ স্টাডি অব দ্য ডেমোক্রেটিক রেজিমস-মওদুদ আহমদ, ইউপিএল ২০১২
মওদুদ আহমদ বাংলাদেশের রাজনীতির একটি অন্যতম কৌতূহলোদ্দীপক চরিত্র। বাংলাদেশের সমসাময়িক ইতিহাসজুড়ে তাঁর রাজনৈতিক উপস্থিতি লক্ষণীয়। তিনি কখনো নন্দিত, কখনো নিন্দিত। আমরা মওদুদ আহমদের বইয়ের আলোচনায় প্রবেশের আগে তাঁর সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অবস্থান স্মরণ করে নিতে পারি। কারণ তিনি এমন একটি সময়ে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করেছেন, যখন তিনি নিজেই অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় নিপীড়িত হয়েছেন। অবশ্য রাজনীতির বোদ্ধারা সাধারণত এটা কবুল করে থাকেন যে মওদুদ রাজনীতিতে কখন কী (সুবিধাবাদিতা এর অন্যতম) করছেন, আর তিনি সে সম্পর্কে কী লিখছেন, তাকে এক করে দেখা যাবে না। এর অর্থ দাঁড়ায় এই যে তিনি যতটা সম্ভব নির্মোহ অবস্থানে থেকে রাজনীতি ও রাষ্ট্রব্যবস্থা বিশ্লেষণের চেষ্টা করছেন।
অবশ্য দেশে তাঁর এই মিশ্র অবয়ব সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক অঙ্গনের অনেকেই, বিশেষ করে অস্ট্রেলীয়-ব্রিটিশ সাংবাদিক ও লেখক জন পিলজার—নোয়াম চমস্কি যার কাজকে বলেছেন অন্ধকারে আলোকসংকেত, আবার উইলিয়াম শোক্রসের মতে ইংরেজি ভাষার অন্যতম লেখক—মওদুদের গুণমুগ্ধ। এক-এগারোতে লেখনীর মাধ্যমে পিলজার অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে মওদুদের পাশে দাঁড়ান। এমনকি তাঁর জামিন চেয়ে ফখরুদ্দীন আহমদকে পাঠানো পিলজারের ই-মেইল আদালতে উপস্থাপন করা হয়েছিল। গ্রানাডা টিভির হয়ে একাত্তরে যুদ্ধ কভার করতে এসে মওদুদের সঙ্গে পিলজারের এক ‘চন্দ্র অনালোকিত রাতে’ দেখা হয়েছিল। ব্রিটিশ ট্যাবলয়েড ডেইলি মিরর-এর সঙ্গে দীর্ঘদিন যুক্ত থাকা পিলজারের চোখে মওদুদ সাহসী, আদর্শস্থানীয় রাজনীতিক। এমনকি তিনি তাঁকে টমাস পেইনের সঙ্গে তুলনা করেছেন। অষ্টাদশ শতাব্দীর অ্যাংলো-আমেরিকান পেইন রাজনীতির তাত্ত্বিক, দার্শনিক ও বিপ্লবী ছিলেন। দণ্ডিত হয়েছেন, জেল খেটেছেন বহুবার। ফরাসি বিপ্লবে যোগ দিয়েছেন, আমেরিকার স্বাধীনতার জন্য লিখেছেন প্যামফ্লেট। পিলজার মওদুদের জন্য ২০০৮ সালে লিখেছেন, সেই লেখাটিই সময়োপযোগী করে পুনরায় লিখেছেন গার্ডিয়ান-এ (১৫ ডিসেম্বর ২০১৩)। উভয় লেখায় একজন বন্দী মওদুদের কারামুক্তির ওপরই বিশেষ জোর দিয়েছেন পিলজার। কিন্তু যেটা এখানে প্রতিপাদ্য সেটা হলো, পিলজারের বর্ণনায় মওদুদ বিরাট মাপের গণতান্ত্রিক এবং স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধাচরণের এক অবিসংবাদিত সিপাহসালার। ধরে নিতে পারি পিলজার তাঁর বন্ধু মওদুদকে যেভাবে চিনেছেন, চিত্রিত করেছেন, সেই পরিচয়ে পরিচিত হতে, স্বীকৃতি পেতেই মওদুদের ঝোঁক থাকতে পারে। কিন্তু সেটা যে আসলে একটি খণ্ডিত চিত্র তা অনেকেই মানবেন।
মওদুদের এই বইয়ের আলোচনায় পিলজারকে প্রাসঙ্গিক করে তোলা এ কারণে যে মওদুদ নিজেকে গণতন্ত্রের বরপুত্র ভাবতে পছন্দ করেন। তাঁর ধূসর রাজনৈতিক জীবনের কোনো ব্যাখ্যা আমরা তাঁর বইয়ে পাই না। এমন একজন চিন্তাবিদের কাছ থেকে আমরা গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার অপেক্ষাকৃত নিরপেক্ষ আলোচনা ও বিশ্লেষণ পাচ্ছি। পিলজার লিখেছেন, ‘মুজিবের আমলে মওদুদ গণতন্ত্রের একজন “অতন্দ্রিত রক্ষী” হওয়ায় কারাবরণ করেছিলেন। আর পরবর্তী সময়ে হত্যা, অভ্যুত্থান ও পাল্টা অভ্যুত্থানের রাজনীতিতে মওদুদ নিজেকে কারাগার ও সংসদের মধ্যে ঠাঁই করে নিয়েছেন। কারাগারে থেকেও তিনি সংসদীয় আসনে জয়ী হয়েছেন। বাংলাদেশের সংক্ষিপ্ত আয়ুষ্কালের অধিকাংশ সময় ফিউডালিস্ট ও ডেমোক্র্যাটদের এবং সম্প্রতি ফান্ডামেন্টালিস্টদের মধ্যে লড়াই চলেছে।’ গণতন্ত্রের লড়াই নিশ্চয় বাংলাদেশে চলছে। মওদুদ এই লড়াইয়ে সব সময় গণতন্ত্রীদের পক্ষে ছিলেন কি? বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের নির্বিচারে জেলে পোরা কি শেখ হাসিনাই প্রথম করেছেন? কবি হাসনা মওদুদ পিলজারকে বলেছেন, বিশ্বকে জানতে হবে যে গোটা দেশটা কারাগারে পরিণত হয়েছে। এটা অসত্য নয়। কিন্তু বিএনপি আমলে যখন ঘটেছে তখন তাতে মওদুদের ভূমিকা কী ছিল।
মুক্তবুদ্ধিবৃত্তিকতার চর্চার প্রশ্নে মওদুদের এই স্ববিরোধিতার কথা তিনি নিজেও স্বীকার করেন। এই পটভূমিটি মনে রেখেই তাঁর এই বইয়ের আলোচনা করা হলো। মওদুদের আলোচ্য বইয়ে ২০টি পরিচ্ছেদ রয়েছে। প্রথমটিতে তিনি ১৯৭১ সাল থেকে বাংলাদেশ গণতন্ত্রের প্রেক্ষাপট বর্ণনা করেছেন। তবে সেটাও নিরস নয়, কারণ সেখানে তথ্য আছে যে ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া ১৪০ আসন পেয়ে কী উপায়ে আরও ১১টি আসন সংগ্রহ করে তাঁর প্রথম সরকার গঠন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। বামদলীয় ১৩টি আসন বিএনপির সঙ্গে যোগ দিতে রাজি ছিল কিন্তু সেটা কাজ করেনি। মানতেই হবে ১৯৯১ সালে বাংলাদেশ আবার তার জাতীয় রাজনীতিকে সেক্যুলার রাখার সুযোগ হাতছাড়া করেছিল। মওদুদ গণতন্ত্রের প্রথম শর্ত পূরণের প্রবক্তা হতে চাননি। তিনি ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে পৃথক করতে কখনো কোনো চেষ্টা চালিয়েছিলেন বলে জানা যায় না। কারণ ১৯৯১ সালে ক্ষমতা এবং সংবিধান সংশোধনের সুযোগ পেয়ে বিএনপি গিয়েছিল তার যৌক্তিক পরিণতির দিকে। আধা চরম ডানই তার নিয়তি ও গন্তব্য। তবে তার প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগও তার থেকে যথেষ্ট আলাদা কিছু, তাও বলা যাবে না। সে কারণে দ্বাদশ সংশোধনী পাসের সময় জোড়াতালি দিয়ে একটি স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার ধারাবাহিকতাই অনুসরণ করা হয়েছে। বাংলাদেশি শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের গণতান্ত্রিক পথে হাঁটতে সুচিন্তিতভাবে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।
সদ্য ক্ষমতাচ্যুত এরশাদকে নিয়ে খালেদা জিয়ার তখন সরকার করতে না পারাটা কোনো গণতান্ত্রিক ব্যর্থতা ছিল না। ছিল কৌশল ও সুবিধাবাদী রাজনীতির সুবিধা-অসুবিধার প্রশ্ন। বিশ্ব বাংলাদেশ গণতন্ত্রের যাত্রাকে পিলজারের মতো ফিউডালিস্টদের সঙ্গে লড়াই দেখলে তো চলবে না। সত্যের অপলাপ হবে। কারণ কে কখন ফিউডালিস্ট আর কে কতক্ষণ কোন মাত্রায় কতটুকু গণতন্ত্রী তার ওজন দেওয়া দুরূহ। জেনারেল এরশাদকে পেলেও চলত বিএনপির কিন্তু তার গায়ের সামরিক গন্ধ বাতাসে ভাসছে তখনো। জেনারেল মোহাম্মদ নূরউদ্দীন খান ক্রান্তিকালে অসাধারণ অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছিলেন। আমরা জানতাম জেনারেল এরশাদকে তিনি চূড়ান্ত মুহূর্তে ‘না’ বলতে পেরেছিলেন। আর তাই খালেদা জিয়ার প্রথম সরকার গঠনে তিনিই অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেন।
খালেদা জিয়া ও গোলাম আযমের মধ্যে দূতিয়ালির কাজটিও এই জেনারেল করেন। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামো গঠনের প্রক্রিয়া এ দেশে এভাবেই সামনে অগ্রসর হয়েছে। ইতিহাসের কী আশ্চর্য যোগাযোগ, ইয়াহিয়া কেবিনেটের সদস্য, এটা লক্ষণীয় যে মওদুদ তাঁর এই পরিচয় না উল্লেখ করে লিখেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জি ডব্লিউ চৌধুরীর বাসায় এক জেনারেলের উপস্থিতিতেই বেগম জিয়া, গোলাম আযম ও মতিউর রহমান নিজামীর মধ্যে বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়। ১৮টি আসনের অধিকারী জামায়াত এই বৈঠকের পর রাষ্ট্রপতিকে লিখিতভাবে বিএনপিকে সমর্থনের কথা জানিয়ে দেয় এবং ইতিহাসের আরও পরিহাস এই যে জাতীয় জীবনের এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা এবং তার কিছুকাল পর শহীদজননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গণ-আদালতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পরও জামায়াতের সঙ্গে আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে ঐক্য গড়ে তুলেছিল।
আমরা আরও স্মরণ করতে পারি যে বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রথম নির্বাচিত সরকারটি তার নির্বাচিত পার্লামেন্টকে সুশাসনের শর্ত পূরণে ব্যবহার করেনি। কেবল ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে ক্রমেই অধৈর্যশীল হয়ে পড়া আওয়ামী লীগের কারণে তাকে কার্যকর হতে দেয়নি। মওদুদ তাঁর বইয়ে ১৯৯৬-পরবর্তী বিএনপির বিরোধীদলীয় দাবি মোকাবিলা করার যে চিত্র বিস্তারিত উপস্থিত করেছেন তার আরেকটি পর্ব আমরা ১৯৯৬ পূর্বকালে দেখেছি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি ওঠার পর তারা বর্তমান আওয়ামী লীগের মতোই নির্বাচিত-অনির্বাচিতের দ্বন্দ্বকে প্রকট করেছিল। আর সত্যি বলতে কি, ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পরে সংবিধানে একাধিক স্থানে যতই তারা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনার সংকল্প গ্রহণ করুক না কেন, তাদের মাথা থেকে গণতান্ত্রিক রীতিনীতি একেবারে গোড়াতেই নির্বাসিত হয়েছিল। এর প্রমাণ তারা একদলীয় শাসন চালু করতে দ্বিধা করেনি। বিনা নির্বাচনে রাষ্ট্রপতি ও সংসদের মেয়াদ বাড়িয়ে নিতেও তারা পিছপা হয়নি। আবার একদলীয় শাসনের সমালোচনা করে যে প্রতিবিপ্লব হলো, সেই প্রতিবিপ্লবীদের অন্যতম পুরোধা মওদুদ। সামরিক শাসকদের জুনিয়র পার্টনার হিসেবে তাঁর যে খ্যাতি বা অখ্যাতি তাকে ফিউডালিজমের আভা থেকে খুব বিচ্ছিন্ন করে দেখার সুযোগ সীমিত। একদলের নামে সামরিক শাসন থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণের নামে শাসক দলের গোটা চেষ্টার মধ্যে কখনোই সত্যিকারের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের সদিচ্ছা প্রকাশ পেতে দেখা যায়নি। জন পিলজার লিখেছেন, মওদুদ জিয়ার সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন এই শর্তে যে জিয়া সেনাপ্রধানের পদ ছেড়ে দেবেন। অথচ মওদুদ এ কথা আমাদের কাছে অস্বীকার করেন না যে মশিউর রহমান যাদু মিয়া শর্ত দিয়েছিলেন যে ক্ষমতা কুক্ষিগত করা যাবে না। তখন মওদুদ যাদু মিয়াকে সমর্থন দেওয়াকে যাঁরা বাস্তবসম্মত বলে মানতে পারেননি, মওদুদ ছিলেন তার অন্যতম। সিদ্ধান্ত গ্রহণ-প্রক্রিয়ার গণতন্ত্রায়ণ প্রশ্নে জিয়া-যাদু চুক্তির বাস্তবায়ন প্রশ্নে মওদুদকে কখনো সোচ্চার হতে দেখা যায়নি।
বাংলাদেশ শাসকেরা সব সময় গণতন্ত্রকে প্রচারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের সবচেয়ে বেশি প্রবণতা দেখিয়েছে। তারা গণতন্ত্রকে ক্ষমতা করায়ত্ত করার উপায় হিসেবে দেখছে। বেসামরিক শাসকেরা ব্যালটকে ও সামরিক শাসকেরা বুলেটে ক্ষমতা নিলেও তারাও দ্রুততার সঙ্গে ব্যালট ব্যবহারের জনপ্রিয় প্রবণতা দেখিয়েছে। কিন্তু বিকেন্দ্রীকরণ কোথাও ছিল না। গণতন্ত্রের শর্তে তেমন কোনো ত্যাগ তারা করতে চায়নি।
মওদুদ আহমদ জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির ১৯৯১ সালের সমঝোতার বিষয়ে চমকপ্রদ তথ্য দিয়েছেন। তিনি দেখিয়েছেন, দুই শর্তে জামায়াত বিএনপিকে সরকার গঠনে সমর্থন দিয়েছিল। জামায়াতে ইসলামীর আমির হিসেবে গোলাম আযমের নিয়োগ এবং তাঁর নাগরিকত্ব দান। মওদুদ আহমদ বিস্তারিত উল্লেখ না করে তাত্পর্যপূর্ণভাবে এই ইঙ্গিত করেছেন যে সেদিন খালেদা জিয়া প্রকারান্তরে জামায়াতের সঙ্গে বিশ্বাস ভঙ্গ করেছিলেন। গোলাম আযমের নাগরিকত্ব না দিয়ে বরং তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। পুরো রমজান মাস গোলাম আযম কারাগারে ছিলেন, এ কথা উল্লেখ করতে বিস্মৃত হননি মওদুদ। সে ক্ষেত্রে এই প্রশ্ন আসে যে গোলাম আযমকে নির্বাহী আদেশে নাগরিকত্ব না দিয়ে বরং যাতে তিনি নাগরিকত্ব না পান সে জন্য সুপ্রিম কোর্টে সর্বাত্মক আইনি লড়াই চালানোর নির্দেশ কেন সেদিন দেওয়া হয়েছিল তত্কালীন অ্যাটর্নি জেনারেলকে। এতে সন্দেহের অবকাশ কম যে প্রয়াত অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট আমিনুল হক গোলাম আযমের নাগরিকত্ব মামলায় প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলেন। বিএনপি সরকারের পক্ষ থেকে আদালতে এই সাক্ষ্য-প্রমাণ হাজির করা হয়েছিল যে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পরও গোলাম আযম কীভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের বিরোধিতা করেছিলেন।
মওদুদ দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে নির্বাচন ও গণতন্ত্র নিয়ে আলোচনা করেছেন। প্রশাসনের দলীয়করণ এবং খালেদা জিয়ার শাসনপদ্ধতি সম্পর্কে বলেছেন। তিনি ৭৭ পৃষ্ঠায় তথ্য দিয়েছেন খালেদা জিয়ার কোনো কিচেন কেবিনেট ছিল না, তিনি এমনকি সংসদে ডেপুটি লিডার নিয়োগ দেননি। এই দশম সংসদে এসেও শেখ হাসিনা ডেপুটি লিডার নিয়োগ দেননি। এটা প্রমাণ করে যে সময় গড়াচ্ছে ঠিকই কিন্তু শাসকদের শাসন স্টাইলে তাঁরা কোনো পরিবর্তন আনতে নারাজ। অপশাসনগত স্থিতাবস্থা যাতে ভেঙে না যায়, সে বিষয়ে তাঁরা সতর্ক।
খালেদা জিয়া যেসব বিষয়ে মনে করতেন সেসব বিষয়ে অনুমোদন পেতে আলোচনার জন্য কেবিনেটের জ্যেষ্ঠ সদস্যদের ডাকতেন। কিন্তু তাঁদের কথায় তিনি চলতে চাইতেন, সেটা মওদুদ বলেননি। সবচেয়ে বিপজ্জনক তথ্য দিয়ে তিনি বলেছেন, ‘মন্ত্রিসভা কিংবা দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী স্ট্যান্ডিং কমিটিতে কোনো রাজনৈতিক বিষয়ে আলোচনা হতো না।’ তাঁর এমন সব অকপট ও সাহসী উচ্চারণ তাঁর বইয়ের বহু ক্ষেত্রে ছড়িয়ে আছে। তিনি বলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের কোনো ধরনের কাঠামোগত জবাবদিহির ব্যবস্থা নেই। তাই তারা যেকোনো বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারে। বাণিজ্যিক চুক্তি, উন্নয়ন প্রকল্প, সরকারি ক্রয়, কর্মকর্তাদের কর্মস্থল নির্ধারণ ও বদলি, সংবিধিবদ্ধ সংস্থা এবং সুপ্রিম কোর্টে বিচারক নিয়োগ তাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে। মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় কোনো মন্ত্রীকে প্রায়ই ডাকা হয় না। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর হয়তো অন্য মন্ত্রীদের ডাকে কিন্তু সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীদের ছাড়া।’ মওদুদ লিখেছেন, ‘ভারতের মতো কতিপয় দেশ রাজনৈতিক বিষয়ে একটি আনুষ্ঠানিক কেবিনেট কমিটি গঠন করে থাকে। বাংলাদেশ দুর্ভাগ্যবশত এমন কিছু দেশকে অনুসরণ করে, যেখানে সরকারপ্রধান কোনো ধরনের কমিটি বা কোনো প্রতিষ্ঠান বা কোনো পদ্ধতির সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভরশীল নন।’ (পৃ. ৭৮) মওদুদ অত্যন্ত খাঁটি কথা বলেছেন। ব্যক্তিগত ঘরানার শাসনপদ্ধতি বাংলাদেশের সব গণতান্ত্রিক সরকারে দেখা গেছে।
তৃতীয় পরিচ্ছেদে তিনি ৮৩ পৃষ্ঠা থেকে ৮৮ পৃষ্ঠার মধ্যে সংসদবিষয়ক আলোচনা শেষ করেছেন। এটা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও শাসনগত ব্যবস্থায় সংসদের গুরুত্ব নির্দেশ করে। রাজনৈতিক দলগুলো সরকার ও বিরোধী দলনির্বিশেষে কী করে সংসদকে কার্যকর করার সুযোগ হাতছাড়া করেছে সেই দুঃখগাথা তিনি চিত্রিত করেছেন। সংসদীয় কমিটিগুলোকে শ্বেতহস্তী করে রাখতে সব দলের ভূমিকার কথাও তিনি অকপটে বলেছেন। চতুর্থ পরিচ্ছেদে তিনি আইনসভার সংস্কার সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন। কিন্তু তাতে মৌলিক বিষয়গুলোর আলোচনা নেই বললেই চলে। সেখানে ধূমপানবিরোধী পদক্ষেপ উল্লেখ আছে। ভূমি সংস্কারের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা আছে, ঋণখেলাপিদের কথা আছে কিন্তু সেখানে নেই দণ্ডপ্রাপ্তদের নির্বাচনে অযোগ্য করার উপযুক্ত আইন প্রণয়নে সংসদীয় ব্যর্থতার কথা। দণ্ডপ্রাপ্তরা নির্বাচন করবেনই। আর তাঁরা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কখনো দেবেন না। কারণ রাজনীতিকদের কারাগারে যাওয়াকে সব আমলের বিরোধীরা রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন মনে করেন। আর তাঁদের এই মনে করাটা যাতে কখনো মানুষের চোখে গ্রহণযোগ্যতা না হারায় সেটা প্রত্যেকে মনে রাখেন। এর যোগফল হলো বিচার বিভাগের স্বাধীনতা না দেওয়া।
পঞ্চম পরিচ্ছেদে আইনি ব্যবস্থার সংস্কার, দ্রুত বিচার আইন ও ট্রাইব্যুনাল, দেওয়ানি আইন সংস্কার, বিরোধ নিষ্পত্তির বিকল্প ব্যবস্থা, মামলার দীর্ঘসূত্রতা ও খরচ, মামলা ব্যবস্থাপনা, আদালত প্রশাসন আর বার কাউন্সিল নিয়ে আলোচনা আছে (পৃ. ১৩৪-১৩৯)। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে ১৩৯ পৃষ্ঠায় মওদুদের বক্তব্য সত্যের অবলোপন বলে মনে হওয়ার যৌক্তিক কারণ রয়েছে। তাঁর এই অসতর্কতা মার্জনা করা চলে না বললে অত্যুক্তি হবে না। কারণ তিনি খুব ভালো করেই জানেন ১৯৭২ সালের সংবিধানে বিচার বিভাগ পৃথকক্রণের বিধানগুলো চতুর্থ সংশোধনীতে কেড়ে নেওয়ার পর তা আর পুরোপুরি কখনোই ফিরিয়ে দেওয়া হয়নি। এই বিষয়ে অন্তত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের তিনটি রায় আছে। পঞ্চম সংশোধনী মামলার রায়েও বলা আছে, বাহাত্তরের ১১৬ অনুচ্ছেদকে অবিকল ফিরিয়ে না আনা পর্যন্ত অধস্তন আদালতের স্বাধীনতা বাংলাদেশে দূরবর্তী ঢোলের শব্দ হয়েই থাকবে। কারণ ১১৬ অনুচ্ছেদ সুপ্রিম কোর্টকে বিচারক নিয়োগ ও বদলির ক্ষেত্রে পুরো ক্ষমতা দিয়েছে। আর এটা এখন অনেকখানি নিয়ন্ত্রণ করে সরকার। অথচ মওদুদ কী অবলীলায় লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট তার ম্যাজিস্ট্রেসি এবং অধস্তন আদালতগুলো সংবিধানের আওতায় পুরোপুরি এবং সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করছে। আদালতের কক্ষগুলোতে তাদের অলঙ্ঘনীয় স্বাধীনতা কখনো প্রশ্নবিদ্ধ হয়নি।’ এটা একেবারেই অসত্য। জামিন পেতে একজন জন পিলজারের ই-মেইল কি কাজে লাগার কথা?
মওদুদ আহমদ অবশ্য ১৪৮ পৃষ্ঠায় যা বলেছেন তাতেই তাঁর বক্তব্যকে সাংঘর্ষিক করে তোলে। বিচার বিভাগ পৃথক্করণের প্রসঙ্গের উপশিরোনাম দিয়েছেন ব্যর্থতা। তবে এখানে অকপট সত্য উচ্চারণ করে বলেছেন, ‘রাষ্ট্রের নির্বাহী অঙ্গ থেকে বিচার বিভাগকে যে পৃথক হতে হবে, সেই মৌলিক উপলব্ধি প্রধানমন্ত্রীসহ জ্যেষ্ঠ মন্ত্রীদের মধ্যে প্রায় অনুপস্থিত বলা চলে। এই পৃথকক্রণের প্রক্রিয়ায় রাজনীতিকদের চেয়ে আমলাতন্ত্রই চরম শৈথিল্য দেখিয়ে থাকে।’ মানবাধিকার কমিশন সম্পর্কে মওদুদের পরিহাস ও প্রহসনমূলক মন্তব্য নাটকীয় পর্যায়ে উন্নীত হয় যখন তিনি বলেন, একটি কেবিনেট কমিটি মানবাধিকার কমিশন গঠনে অর্ধডজন বৈঠকের পর বিয়োগান্তভাবে সিদ্ধান্ত নিতে অপারগ থাকে। চার বছর ধরে আন্তমন্ত্রণালয় চিঠি চালাচালির পর এক-এগারো সরকার তাদেরই খসড়া কাজে লাগিয়ে মানবাধিকার কমিশন গঠন করে, যদিও তখন মৌলিক অধিকার স্থগিত ছিল।
মওদুদ আহমদ মনে করেন, ২০০১ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ সরকারবিরোধিতার রাজনীতিতে আরও তীব্রতা এনেছিল। তারা ত্রিমাত্রিক আক্রমণ পরিচালনা করেছিল। এর প্রথমটিতে রয়েছে শেখ হাসিনার মনস্তাত্ত্বিক বিরোধিতা। তিনি কিছুতেই বিএনপির নিরঙ্কুশ বিজয় মেনে নিতে পারেননি। দ্বিতীয়ত, তারা নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সততা ও উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তোলে এবং এর পরিবর্তন দাবি করে। তৃতীয়ত, বিরোধী দল একটি আন্তর্জাতিক প্রচারণা শুরু করে, যার লক্ষ্য হচ্ছে বাংলাদেশকে একটি ‘ধর্মীয়’ রাষ্ট্র, একটি ‘ইসলামি মৌলবাদী’ রাষ্ট্র, একটি ‘ব্যর্থ রাষ্ট্র’ হিসেবে চিত্রিত করা। তাঁর কথায়, তারা তালেবানদের সম্পৃক্ত করে যে বক্তব্য নিয়ে আসে তার পটভূমিতে অবশ্য হরকাতুল জিহাদ এবং মুফতি হান্নান, আবদুর রহমান ও বাংলা ভাইয়ের মতো ব্যক্তির নেতৃত্বে হরকাতুল জিহাদ ও জামাআতুল মুজাহিদীনের মতো সংগঠনের উত্থান ঘটে। যদিও এদের অধিকাংশের উত্থানের সূচনা ঘটেছিল আওয়ামী লীগ যখন সরকারে ছিল তখন। (পৃ. ৪২৬) কিন্তু মওদুদ এটা বলতে ভুলে গেছেন
যে জেনারেল এরশাদ ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করে একটি প্রেক্ষাপট তৈরির অশুভ সূচনা করেছিলেন আর তিনিও সেই প্রক্রিয়ার অংশীদার ছিলেন। শাসকেরা প্রত্যেকে নিজের মতো করে ধর্মকে ব্যবহার করেছেন। এই শক্তির সঙ্গে সংকীর্ণ স্বার্থে আপস করেছেন। এটা লক্ষণীয় যে মওদুদ স্বীকার করেছেন যে বিএনপি সরকার ওই মৌলবাদী সমস্যার গুরুত্ব অনুধাবন করতে দেরি করে ফেলেছিল। ‘কিন্তু বিএনপির শাসনের শেষ বছরে উগ্রপন্থীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে, যার ফলে শীর্ষ নেতাদের কার্যকর বিচার ও তাদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া সম্ভব হয়। এটা দেশে-বিদেশে প্রশংসিত হয়েছে। বিএনপির নেওয়া অনেক কঠোর পদক্ষেপের ফলে পরিস্থিতি সাফল্যের সঙ্গে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়।’
এটা লক্ষণীয় যে ২০০১-এর সাধারণ নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার পুনর্গঠনের প্রশ্নটি মাঝে মাঝে যথেষ্ট বিরতি দিয়ে উল্লেখ করেছে। কিন্তু মওদুদ ৪২৬ পৃষ্ঠায় দেখিয়েছেন, নির্বাচনে হারার দিনটি থেকেই আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার পুনর্গঠনের আন্দোলন শুরু করে এবং তারা ‘সত্যিকারের অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের’ জন্য একটি প্যাকেজ প্রোগ্রাম নিয়ে আসে। নাগরিক সমাজেরও বিভিন্ন গোষ্ঠী বিভিন্ন ধরনের প্রস্তাব তোলে। কিন্তু তিনি এটা বলেননি যে কেন তিনি এর প্রতি উদাসীন ছিলেন? তাঁর এ ধরনের উদাসীনতার কোনো যৌক্তিক ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। সচেতনভাবে হোক আর অসচেতনভাবেই হোক, তাঁর গৃহীত বিচারকদের বয়সসীমা বাড়ানোর পদক্ষেপ প্রকারান্তরে সেই সংবেদনশীলতাকেই বহুলাংশে উসকে দিয়েছে।
মওদুদের ভাষায়, ‘২০০৪ সালের মার্চে চতুর্দশ সংশোধনী পাসের পর সংস্কারের দাবি আরও জোরালো হয়ে ওঠে। ওই সংশোধনীতে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অবসরের বয়সসীমা ৬৫ থেকে ৬৭তে উন্নীত হয়। আওয়ামী লীগ ব্যাখ্যা দেয় যে বিচারপতি কে এম হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পরবর্তী প্রধান উপদেষ্টা পদে যোগ্য করে তুলতেই ওই সংশোধনী আনা হয়েছে। বিচারপতি হাসান যদিও ২৫ বছর আগে বিএনপির একজন সদস্য ছিলেন। কিন্তু তিনি কখনোই বিএনপির সক্রিয় কর্মী ছিলেন না। অন্যদিকে সুপ্রিম কোর্টের একজন বিচারক হিসেবে প্রায় ১০ বছর এবং প্রধান বিচারপতি পদে দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে বার এবং বেঞ্চে অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল হয়েছিলেন। তাঁর সততা, নিরপেক্ষতা কিংবা কোনো রাজনৈতিক পক্ষপাত নিয়ে কখনোই প্রশ্ন তোলা হয়নি। কিন্তু আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির সংস্কারের অনুকূলে এই সংশোধনীকে ব্যবহার করে। ২০০৫ সালের ১৫ মার্চ প্রধানমন্ত্রী তাঁর সমাপনী ভাষণে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের ধারণাকে বিতর্কিত এবং বাইরের শক্তির স্বার্থে দেশকে অস্থিতিশীল করতে বিরোধী দলকে অভিযুক্ত করেন। যেহেতু রাজপথ নয়, সংসদই সংবিধান সংশোধনসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনার উপযুক্ত স্থান, তাই প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলকে সংসদে এসে নির্দিষ্ট প্রস্তাব দেওয়ার আমন্ত্রণ জানান। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার কী সংস্কার লাগবে তা সংসদে এসে বলতে আবেদন রাখেন (পৃ. ৪২৭)।’
এখানে আমরা লক্ষ করি, মওদুদ নিজেকে একজন ম্যাকিয়াভেলীয় রাজনীতিক হিসেবে তুলে ধরেছেন। তাঁর শিক্ষাবিদ হওয়ার জায়গাটি কিছুটা হলেও প্রশ্নসাপেক্ষ হয়ে পড়েছে। কারণ বাংলাদেশের সংসদীয় গণতন্ত্রের অভিযাত্রায় এটা রীতিমতো অপ্রিয় বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে যে সরকারি দল সংবিধান ও সংসদকে যে চোখে দেখে, সেভাবে বিরোধী দলের পক্ষে সংবিধান কিংবা সংসদকে দেখার কোনো সুযোগ নেই। সরকার যার সংবিধান ও সংসদ তার। একেবারে খাসতালুক। পদ্ধতিগত সাংবিধানিক গলদের কারণেই বিশ্বের অন্যান্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আইনসভা যেভাবে নির্বাহী বিভাগের প্রতিকূলে একটি ওয়াচডগ হিসেবে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে, বাংলাদেশে সেটা সম্ভব নয়। মওদুদ এই বিষয়টি স্বীকার না করে প্রকারান্তরে নিজেকে সরকারদলীয় একজন চিরায়ত মুখপাত্র হিসেবে চিত্রিত করেছেন বলেই প্রতীয়মান হয়। এটা অবশ্য তাঁর জ্ঞাতসারে কিংবা অজ্ঞাতসারেও হতে পারে। ’৯৬ প্রহসনের নির্বাচনের পরে ত্রয়োদশ সংশোধনী আওয়ামী লীগ সংসদে এসে দেয়নি। তবু তাঁরা স্বেচ্ছায় দিয়েছিলেন বা দিতে বাধ্য হয়েছিলেন।
মওদুদ ৪২৭ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘২০০৫ সালের ১৮ মার্চ আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও নির্বাচনী আইনসমূহ সংস্কার না করলে নির্বাচন বয়কটের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। তাদের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির বৈঠক শেষে এই ঘোষণা আসে। কিন্তু কী সংস্কার করা হবে তার বিবরণ তারা দেয়নি। এটা অনেকটা সরকারের বিরুদ্ধে একটি রাজনৈতিক স্লোগান হিসেবেই মনে হয়েছে। ২০০৫ সালের মাঝামাঝি যদিও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও নির্বাচন কমিশনের সংস্কারে ৩১ দফা প্রস্তাব দেয়।’ আমরা দেখি, মওদুদ এই ৩১ দফা বিএনপির পক্ষে বিবেচনার জন্য দ্রুততার সঙ্গে গ্রহণ না করার অপারগতার জন্য আক্ষেপ করেননি। এ জন্য তাঁর কোনো অনুশোচনা নেই। একজন টিপিক্যাল বাংলাদেশি রাজনীতিকের মতোই তিনি যুক্তি দিচ্ছেন, ‘১৪-দলীয় জোটের ওই প্রস্তাবগুলো সভা-সেমিনার ও জনসভায় আলোচিত হয়েছে। কিন্তু তাঁরা সংসদে তোলেননি।’ তিনি বলেন, সরকারি নেতারা বারবার তাদের প্রস্তাবগুলো সংসদে উত্থাপনের আহ্বান জানালেও তা করা থেকে তাঁরা বিরত ছিলেন।’ অথচ বিএনপি ওই সময় ১৪-দলীয় জোটের সংস্কার প্রস্তাবের ভিত্তিতে একটি সংসদীয় কিংবা দলীয় পর্যায়ে একটি কমিটি বা কমিশন গঠন করতে পারত এবং সে অনুযায়ী তারা সংসদে প্রস্তাব আনতে পারত। কিন্তু তারা কেবলই একটি টেকনিক্যাল যুক্তির ওপর দাঁড়িয়ে ক্ষমতালিপ্সা আড়াল করার চেষ্টা করেছে। মওদুদ লিখেছেন, ‘১৪-দলীয় জোট শর্ত দেয় যে সরকারের সঙ্গে এ-সংক্রান্ত আলোচনার আগে তাদেরকে এ বিষয়ে “নীতিগতভাবে প্রস্তাব মানার” ঘোষণা দিতে হবে।’ অথচ গণতন্ত্রের চর্চা করলে আওয়ামী লীগের ৩১ দফার পুরোটা অবিকল না হলেও এর আংশিক বা উল্লেখযোগ্য অংশের বিষয়ে নীতিগত সম্মতি জানালে মহাভারত অশুদ্ধ হতো না এবং সেটাই ছিল গণতন্ত্রের দাবি। মওদুদ সেদিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেননি। তিনি লিখেছেন, ‘আওয়ামী লীগ সেদিকে না গিয়ে সরকারকে আলটিমেটাম দিল, তারা বলল, তাদের প্রস্তাব না মানলে তারা সরকার পতনের আন্দোলনে যেতে বাধ্য হবে। সংসদের পাঁচটি অধিবেশনের ৪৩৭ দিবস বয়কট শেষে ২০০৬ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগ সংসদে যোগ দিল। শেখ হাসিনার জন্য এটা ছিল তার নিজের আসন রক্ষার্থে অধিবেশনে যোগ দেওয়া। কারণ সংবিধান অনুযায়ী একটানা ৯০ কার্যদিবস অনুপস্থিত থাকার কারণে শেখ হাসিনার সদস্যপদ শূন্য হতে আর মাত্র দুদিন বাকি ছিল।’
মওদুদ আবারও টেকনিক্যাল দিকটি তুলে ধরতে বিস্মিত হননি। এই অপকৌশল তাঁরাও ব্যবহার করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘সরকারকে তুলাধোনা করতে শেখ হাসিনা ৫৫ মিনিটের ভাষণ দিলেন এবং একই সঙ্গে ১৪-দলীয় জোটের পক্ষে ৩১ দফার প্যাকেজ সংস্কার প্রস্তাব উত্থাপন করলেন। অথচ পার্লামেন্টে ১৪টি দলের মধ্যে ১৩টির কোনো প্রতিনিধিত্ব ছিল না।’ কিন্তু সংস্কার প্রস্তাবে সংসদের প্রতিনিধিত্ব বিষয়ে প্রকৃতপক্ষে কোনো ধরনের গণতান্ত্রিক বাধ্যবাধকতা আছে কি না সে বিষয়ে তাঁর কোনো বক্তব্য অনুপস্থিত। ১৪ দল না বলে কেবল আওয়ামী লীগের দেওয়া প্রস্তাব বিবেচনায় নিয়েও সেটাকে আলোচনার জন্য গ্রহণ করার যথেষ্ট যুক্তি ছিল।
মওদুদ যুক্তি দিচ্ছেন, ‘৩১ দফার সংস্কার প্যাকেজে প্রকৃতপক্ষে ৫১টি প্রস্তাব ছিল এবং এগুলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গঠন, নির্বাচন কমিশনের পুনর্গঠন এবং নির্বাচনী আচরণবিধি-সংক্রান্ত। ৫১টির মধ্যে ১৪টি ইতিমধ্যেই বিদ্যমান বিধিতে যুক্ত করা হয়েছিল এবং অন্য ২৪টির বিষয়ে মেনে নিতে তেমন কোনো বিরোধই ছিল না।’ ভোট গ্রহণের এক মাস আগে বিদেশি পর্যবেক্ষকদের তালিকা প্রকাশ, স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স প্রবর্তন, প্রার্থীদের সম্পদ বিবরণী প্রকাশ, ব্যাংকের ঋণখেলাপিদের মনোনয়ন না দেওয়া, কালোটাকার মালিক ও সন্ত্রাসীদের মনোনয়ন না দেওয়া, রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় সব দলের সমান সুযোগ, সব প্রার্থীর জন্য সমান সুবিধা ইত্যাদি উল্লেখ করেছেন মওদুদ। এরপর তিনি লিখেছেন, ‘বাকি ১৩টি প্রস্তাবের মধ্যে ১০টি সংশোধন করতে হলে সংবিধান সংশোধন লাগে এবং বাকি তিনটির জন্য সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধি পরিবর্তন করা দরকার। সরকারের প্রতিক্রিয়া ছিল তাদের কিছু প্রস্তাব বাস্তবায়নের জন্য যে সময় দরকার তা পাওয়া যাবে না। কিছু ছিল অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক বিবেচনায় অবাস্তব।’ এগুলোর মধ্যে মওদুদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি কীভাবে তাঁর দল থেকে আলাদা তা বোঝা যায় না। এখানে তিনি বিএনপির নেতা হিসেবে আওয়ামী লীগকে যেন মাঠে মোকাবিলা করেছেন।
মওদুদ বলেছেন, ‘পরিচয়পত্রসহ তথ্যভিত্তিক ভোটার তালিকা এবং ইলেকট্রনিক ভোটিং ব্যবস্থা চালুর সঙ্গে সময় ও অর্থ জড়িত। যদিও নীতিগত কোনো আপত্তি নেই।’ এটা ছিল ২০০১ বা তারও আগের কাজ। যা তারা করেনি। এরপর মওদুদ সংবিধান সংশোধনের জায়গায় এসেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘এর মধ্যে দুটো মানতে কোনো বিতর্ক নেই এবং তা অনেকাংশে আইন সংশোধন করেই পূরণ করা সম্ভব। এর একটি হচ্ছে নির্বাহী বিভাগ থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীন করে একটি পৃথক নির্বাচন কমিশন সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করা। যে সচিবালয় তাদের উপজেলা অফিস পর্যন্ত নিজেদের কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগ করতে পারবে। দ্বিতীয়ত সংসদে অনুমোদনের পর বাজেট অনুযায়ী চলতে কমিশন সম্পূর্ণভাবে আর্থিক স্বাধীনতা ভোগ করবে। বাকি আটটির মধ্যে রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তি চুক্তি অনুযায়ী উপজাতি জনগোষ্ঠীর জন্য, পার্বত্য পরিষদের স্থায়ী বাসিন্দাদের জন্য একটি নতুন ভোটার তালিকা তৈরি। নির্বাচনী প্রচারণায় ধর্মের ব্যবহার, ধর্মভিত্তিক প্রচারণা কিংবা প্রকাশনা কিংবা ধর্ম ব্যবহার করে ভোট চাওয়া এবং সংরক্ষিত আসনের সংখ্যা আরও বৃদ্ধি করা। এটা তারা চেয়েছিল প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে।’ এই প্রস্তাব সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘এটা প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছিল, কারণ বিএনপি মহিলা আসন ইতিমধ্যেই ৩০ থেকে ৪৫ আসনে উন্নীত করেছিল।’ অথচ নারীর ক্ষমতায়নের প্রশ্নে এই উন্নীতকরণ ছিল ঠুনকো। ক্ষমতাসীন দলের ইচ্ছাপূরণের হাতিয়ার।
এখানেও আমরা দেখি, মওদুদ নিজেকে একজন দলীয় রাজনীতিকের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ঊর্ধ্বে তুলতে পারেননি। কারণ তিনি এই ব্যাখ্যা দেননি যে নারীদের সংরক্ষিত আসন যে ১৫টি উন্নীত করা হবে, এই আলোচনা তাঁরা কবে থেকে শুরু করেছিলেন এবং তখন এ বিষয়ে বিরোধী দলের মতামত গ্রহণের জন্য তাঁরা আদৌ কোনো কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন কি না। মওদুদ এমন ভাব প্রকাশ করেছেন যে ওই সময় পর্যন্ত যদি নারীদের আসনে সংশোধনী না আনা হতো, তাহলে তাঁরা আওয়ামী লীগের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচনের প্রস্তাবটি বিবেচনা করতে পারতেন। কিন্তু বিষয়টি যে তা মোটেই নয়, আওয়ামী লীগের প্রস্তাব এবং বিএনপির প্রস্তাবের মধ্যে মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গিগত যে কোনো পার্থক্য নেই—তার প্রমাণ আমরা পরবর্তীকালে পেয়েছি। আমরা দেখেছি, আওয়ামী লীগ প্রত্যক্ষ ভোটে নারীদের নির্বাচনের ব্যবস্থাসংবলিত বিধান সংবিধানে সংযোজন করেননি। আরও লক্ষণীয় যে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে বিএনপি কেন অপারগ থেকেছিল সে বিষয়ে এখানে তিনি কোনো ব্যাখ্যা দেননি। ধর্মভিত্তিক প্রচারণা প্রতিরোধে বিএনপি কেন অপারগ ছিল, এই প্রশ্নের উত্তর জানাটাই ছিল সবচেয়ে জরুরি অথচ মওদুদ ঠিক এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া থেকে নিজেকে বিরত রাখাই শ্রেয় মনে করেছেন।
৪২৯ পৃষ্ঠায় মওদুদ লিখেছেন, ‘আওয়ামী লীগের ৩১ দফার প্রস্তাবের আরও দুটি বিষয়ে আলোচনা করা দরকার। এ দুটি বিষয় হলো যারা স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছে এবং যুদ্ধাপরাধের জন্য দোষী তারা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবে না। পরিহাস হচ্ছে, আওয়ামী লীগ সরকারের ১৯৭২-৭৫ আমলে যারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য আইন করেছিল, তারাই পরে তা পরিত্যক্ত ঘোষণা করেছিল। তারা কাউকে বিচারের আওতায় আনেনি কিন্তু তারা এখন এই অসামঞ্জস্যপূর্ণ প্রস্তাব নিয়ে হাজির হয়েছে, যা থেকে প্রতীয়মান হয় যে প্রকৃতপক্ষে তারা সংস্কারের যে প্রস্তাব নিয়ে এসেছে তার বাস্তবায়ন তারা চায় না। তারা তাদের প্রস্তাবের ৫ক’তে এমন প্রস্তাব এনেছিল, যার জন্য সংবিধানের সংশোধন দরকার ছিল।’ মওদুদের উল্লিখিত দৃষ্টিভঙ্গি সর্বতোভাবে অগ্রহণযোগ্য। এটা লক্ষণীয় যে আওয়ামী লীগের ওই দাবি অবাস্তব, নীতিহীন কিংবা দলীয় দৃষ্টিভঙ্গিপ্রসূত কিংবা অপ্রয়োজনীয় বলে অভিমত তিনি দেননি। তিনি যদি এখানে তাঁর ব্যক্তিগত এবং দলের দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীতে যদি নিরপেক্ষ মতামতের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে পারতেন, তাহলে সেটা অধিকতর যুক্তিসংগত বলে গণ্য হতো। এটাও লক্ষণীয় যে ওই ৫ক’তে কী বিষয়ে আওয়ামী লীগ প্রস্তাব করেছিল মওদুদ তা উল্লেখ করেননি। আমরা এর ইতিবাচক দিক লক্ষ করব। আমরা ধরে নেব মওদুদ ওই প্রস্তাবের শক্তি অস্বীকার করতে পারেননি।
আওয়ামী লীগের চারটি প্রস্তাব তিনি বিস্তারিত উল্লেখ করেছেন এবং বলেছেন, এটা বিস্তারিত ব্যাখ্যা করা দরকার, কারণ পরবর্তীকালে তা জাতীয় রাজনীতির মূল প্রতিপাদ্য হিসেবে গণ্য হয়। আর সে জন্য দরকার ছিল সংবিধানের উল্লেখযোগ্য সংশোধনী। ১। রাষ্ট্রপতি সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনার পর সর্বসম্মত কিংবা মতৈক্যের ভিত্তিতে একজন ব্যক্তিকে প্রধান উপদেষ্টা এবং অন্যান্য উপদেষ্টা নিয়োগ করবেন, যাঁরা জনগণের চোখে আস্থাভাজন ও বিশ্বাসী ও গ্রহণযোগ্য হিসেবে গণ্য হন।
মওদুদ সেই আক্ষরিক পথটিই বেছে নিয়েছেন, তিনি চেতনাগত তাত্পর্যকে অনেকাংশেই এড়িয়ে গেছেন। বিষয়টিকে কেন্দ্র করে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে যে আলোচনার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল তা তাঁর আলোচনায় উঠে আসেনি। এটি এমন একটি বিষয় ছিল, যার সঙ্গে যেকোনো সরকারি দলের নীতিগতভাবে সম্মত হওয়ার যথেষ্ট সুযোগ ছিল। যেমনটা ২০১৪ সালে এসে বিএনপি নিশ্চয় হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। যার প্রমাণ মওদুদ নিজেই ২০১২-১৩ সালে এসে দেখিয়েছেন। কারণ তিনি আওয়ামী লীগকে লক্ষ্য করে ওই একই কথা বলেছেন এবং বলছেন। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে বলেছিলেন, বর্তমান সংবিধানের কাঠামোর মধ্যেই নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়ে সরকারি দলের সঙ্গে সমঝোতায় আসা সম্ভব। কিন্তু সে জন্য সর্বাগ্রে দরকার সরকারি দলের পক্ষ থেকে নীতিগত সম্মতি। মির্জা ফখরুলের এই বক্তব্য অবশ্যই যুক্তিসংগত। যেভাবে যুক্তিসংগত ছিল আওয়ামী লীগের ৩১ দফা দেওয়া ওই প্রস্তাব। বিএনপি সেটি আদৌ গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত ছিল না। অথচ মওদুদ যুক্তি দিচ্ছেন, ‘সরকারের জন্য এটা গ্রহণ করা সম্ভব ছিল না, কারণ তা ছিল সাংবিধানিকভাবে অসমর্থনযোগ্য একটি ফর্মুলা। কারণ প্রায় ১০০টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে কোনো রাষ্ট্রপতির পক্ষে সর্বসম্মতভাবে কারও বিষয়ে মতৈক্যে পৌঁছানো সম্ভব নয়। এ রকম বিধান কোনো কাজ তো করবেই না, বরং এটা অবাস্তব। এতে একটা নৈরাজ্যকর বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়ে দেশকে একটি ভয়ংকর অচলাবস্থার দিকে ঠেলে দেবে । কোনো আইনবিদ কিংবা সাংবিধানিক বিশেষজ্ঞ সংবিধানে এ ধরনের অস্পষ্ট এবং অনিশ্চিত বিধান সংযোজনের প্রস্তাব মেনে নেবেন না।’ যাঁরা ইয়াজউদ্দিনের মতো একটি বিতর্কিত সরকারব্যবস্থার অবতারণা ঘটিয়েছেন এবং পরবর্তী সময়ে সে ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার ব্যাপারে সচেষ্ট ছিলেন, আলোচনার ব্যাপারে তাদের আন্তরিকতা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ থেকেই যায়।
এবার মওদুদ আমাদের জানাচ্ছেন, বিএনপি সরকার এই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েছিল যে ৯০ দিনের অন্তর্বর্তীকালে কোনো সংসদীয় সরকারের অস্তিত্ব থাকে না। সুতরাং বিরোধী দলের দাবির কোনো ভিত্তি ছিল না। যুক্তি দেওয়া হয়েছিল যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদে রাষ্ট্রপতিই একমাত্র নির্বাচিত ব্যক্তি হিসেবে থাকেন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সীমিত সময়ে নীতিনির্ধারণী কোনো সিদ্ধান্ত ব্যতিরেকে কেবল রুটিন কাজ করার দায়িত্বপ্রাপ্ত। একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন মূলত একটি সামগ্রিক শাসনপদ্ধতি বা সুশাসনের অংশ হিসেবে গণতান্ত্রিক সমাজে প্রতিষ্ঠিত। যে দলীয় সরকার অসংকীর্ণ নির্দলীয় নিরপেক্ষভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করতে পারে, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করেই শাসনকার্য চালাতে পারে, সংসদের সার্বভৌমত্বে বিশ্বাস করে, তারাই অবাধ নির্বাচন দিতে পারে। বাংলাদেশ প্রথমটা না পারলে কখনো সুষ্ঠু নির্বাচনও করতে পারবে না।
ব্রিটেনে আমরা সিরিয়ায় সেনা প্রেরণ প্রশ্নে হাউস অব কমনসে ক্ষমতাসীন দলকে পরাস্ত হতে দেখলাম। এভাবে চলতে পারলে দলীয় সরকারের পক্ষে স্থানীয় সরকারের নির্বাচন শুধু নয়, জাতীয় সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানও সম্ভব। কিন্তু বাংলাদেশে ওয়েস্টমিনস্টার মডেলে এর সব কটি প্রায় অনুপস্থিত বা কোনো না কোনোভাবে বিতর্কিত। তাই মওদুদ আহমদের বিস্ময় ও বিশ্লেষণের সঙ্গে আমরা একমত হতে পারি না। একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করতে মওদুদ রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য থাকার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করে নেন, অথচ জনসাধারণকে শাসনের সময় সেই ভারসাম্যের কোনো প্রয়োজনীয়তা তিনি স্বীকার করেন না। তাঁর এ-সংক্রান্ত বক্তব্য খণ্ডিত এবং তা অনেকাংশে বিএনপির রাজনৈতিক অবস্থানকে সমর্থন করার উদ্দেশ্যে পরিচালিত ও প্রণোদিত। তিনি লিখেছেন, ‘রাষ্ট্রপতি যাতে অন্তর্বর্তীকালে একজন অভিভাবক হিসেবে ভূমিকা রাখতে সক্ষম হন সে জন্য রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে একটি চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স আনা অপরিহার্য।’
মওদুদ ৪৩১ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল ‘সিইসি ও অন্যান্য কমিশনারগণ সকল রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে নিয়োগ করতে হবে।’ মওদুদ একেও আক্ষরিক অর্থে নিয়ে অবাস্তব ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হিসেবে চিহ্নিত করেন। তাঁর যুক্তি, সংবিধানে এমন বিধান আরোপ করা যাবে না, যা বাস্তবায়নের অযোগ্য এবং দেশে সেটা নৈরাজ্য ডেকে আনবে। মওদুদ যেহেতু আক্ষরিক অর্থে বিরোধী দলের প্রস্তাবগুলোকে গ্রহণ করেছেন, তাই তাঁর যুক্তিকে আক্ষরিক হিসেবে গ্রহণ করলে তার একটা যৌক্তিকতা খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু বাংলাদেশ ১৯৭২ সাল থেকেই রাষ্ট্রগঠনের মৌলিক শর্তাবলি পূরণ না করার সংকটে ভুগছে। মওদুদের লেখায় এ প্রসঙ্গে সংসদীয় পদ্ধতি প্রবর্তন সত্ত্বেও কী করে সর্বময় ক্ষমতা কেবল প্রধানমন্ত্রীর হাতে ন্যস্ত করা হয়েছিল এবং সেটা আমাদের শাসনগত ব্যর্থতা কিংবা সীমাবদ্ধতার ক্ষেত্রে কী প্রভাব রেখেছে তার একটা আলোচনার যে প্রত্যাশা সৃষ্টি হয়েছিল, সে ক্ষেত্রেও অনেকটা নিরাশ হতে হয়েছে। সম্প্রতি তাঁর সঙ্গে এক দীর্ঘ আলোচনায় মওদুদ আমাকে বলেন যে বাহাত্তরের সংবিধানের খসড়া তৈরির সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন না।
ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ সামরিক শাসনামলে আরও গুরুতর রূপ নিয়েছে এবং সামরিক শাসন থেকে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার উত্তরণে যেসব বেসামরিক রাজনীতিক অগ্রণী ও অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছেন, মওদুদ তাঁর অন্যতম। আমরা জানতে পারি না জিয়াউর রহমান এবং হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে গণতন্ত্রে উত্তরণে সহায়তা দিতে গিয়ে তিনি নিজে কতটা কিংবা অন্য আর কাউকে আদৌ যৌথ নেতৃত্বের ধারণা গ্রহণ করাতে ভূমিকা রেখেছিলেন কি না। মসিউর রহমান যাদু মিয়ার সঙ্গে জেনারেল জিয়াউর রহমানের সম্পাদিত একটি গোপন লিখিত চুক্তিতে যৌথ নেতৃত্বের চেতনা সমুন্নত রাখা হয়েছিল। এবং মওদুদ নিজেই লেখকের কাছে স্বীকার করেছেন সর্বময় ক্ষমতা যাতে জিয়াউর রহমানের হাতে থাকে সেই বিতর্কে তিনি যাদু মিয়াকে নয়, জিয়াউর রহমানকে সমর্থন করাই তত্কালীন প্রেক্ষাপটে বাস্তবসম্মত মনে করেছিলেন।
কিন্তু এ কথা আর অস্বীকার করা চলে না যে, যে ত্রয়োদশ সংশোধনী ১৯৯৬ সালে সংবিধানের দেহে প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল, সেটা কোনোভাবেই আদর্শগতভাবে গণতন্ত্রসম্মত ছিল না। বরং একে বাংলাদেশি মানের গণতন্ত্র হিসেবে চিহ্নিত করাই অধিকতর যুক্তিযুক্ত। বিশেষ করে মাত্র দুটি নির্বাচন সাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে লাভ করার বিনিময়ে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের ক্রমেই রাজনৈতিকীকরণ আমাদের প্রত্যক্ষ করতে হয়েছিল। সংক্ষেপে সুপ্রিম কোর্টের শুদ্ধতার বিনিময়ে আমরা দুটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন পরিচালনা করতে পেরেছি এবং তত্ত্বগত দিক থেকে এই ধরনের ব্যবস্থার ভেঙে পড়া অবশ্যম্ভাবী ছিল। মওদুদের আলোচনায় এই বিষয়ে কোনো স্বীকৃতি নেই। অথচ তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে লিখেছেন, ‘বিরোধী দলের সংস্কার প্রস্তাবগুলো গ্রহণযোগ্যতার চরম সংকটে পড়েছে এবং ব্যাপকভিত্তিক জনসমর্থন কুড়াতেও তা ব্যর্থ হয়েছে।’ এখানেও আমরা দেখি, ব্যাপকভিত্তিক জনসমর্থন কথাটিকে তিনি বাংলাদেশের নিম্ন ও ভঙ্গুর রাজনৈতিক সংস্কৃতির বাতাবরণেই মূল্যায়নের প্রয়াস পেয়েছেন। বাংলাদেশকে ব্যাপকভিত্তিক সাংবিধানিক ও শাসনগত সংস্কারের দিকে যেতে হলে রাজনীতিবিদদেরই ইতিহাসের কোনো না কোনো পর্বে সংসদের ফ্লোরে বসতে হবে। আলোচনার টেবিলে মৌলিক বিষয় মেনে নিয়েই সমাধানসূত্র খুঁজে বের করতে হবে। বিশ্বের যেসব রাষ্ট্র ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, বিচার বিভাগের পৃথক্করণ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বায়ত্তশাসনের ধারণা তাদের জাতীয় রাজনীতির দেহে প্রতিস্থাপন করেছে, তারা কিন্তু এসব কাজ করার আগে ‘ব্যাপকভিত্তিক জনসমর্থন’ যাচাই করার প্রয়োজনীয়তা মনে করেনি। কিংবা তাকে বাস্তবসম্মত বলেও গণ্য করেনি। এটা দুর্ভাগ্যজনক যে সদ্য অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিকে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে আপনাআপনি শপথ গ্রহণের যে বিধান রাখা হয়েছিল, সেই বিষয়ে দেশের সচেতন মহল ত্রয়োদশ সংশোধনী পাসের সময়ই খুব বড় মুখ করে আপত্তি তুলতে ব্যর্থ হয়েছিল। তারা তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করতে পারেনি। প্রয়াত বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানকে এ বিষয়ে তাঁর অনীহা প্রকাশ করতে দীর্ঘ সময় নিতে দেখেছিলাম। তাঁরা বলেছেন, এটা হচ্ছে রাজনীতিবিদদের পারস্পরিক অনাস্থার প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ। অথচ মওদুদ লিখেছেন, বিরোধী দলের প্রস্তাবগুলো জনগণের ব্যাপক সমর্থন পায়নি, তার কারণ ত্রয়োদশ সংশোধনীর আওতায় ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং কোনো রাজনৈতিক দল এই পদ্ধতির কোনো ত্রুটি সম্পর্কে অভিযোগ করেনি। কিন্তু তার উল্লেখ করা উচিত ছিল যে সুনির্দিষ্টভাবে না হলেও এই ব্যবস্থা যেকোনো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হতে পারে না, তার একটা পরোক্ষ স্বীকৃতি আওয়ামী লীগ মহল থেকে একেবারেই যে অনুচ্চারিত থেকেছে, তা নয়। এর প্রমাণ, ক্ষীণস্বরে এবং অনির্দিষ্টভাবে হলেও তিন মেয়াদের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একটা কথা তারা বলেছিল।
মওদুদ ঠিকই লিখেছেন, ‘১৯৯৬ সালে এই নতুন ব্যবস্থার আওতায় আওয়ামী লীগ জয়ী হয়েছিল। ২১ বছর ক্ষমতা থেকে দূরে থাকা দলটি সরকার গঠন করতে পেরেছিল। তারা তাদের আমলে এই পদ্ধতির কোনো সংস্কারের কথা বলেনি। ২০০১ সালের নির্বাচনের আগেও আওয়ামী লীগ এই ব্যবস্থার কোনো ত্রুটি সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন তোলেনি এবং নির্বাচনে জয় লাভের আশায় নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। ২০০১ সালের নির্বাচনে পরাজয়ের পরই তারা কেবল অভিযোগ তুলতে শুরু করে। রাষ্ট্রপতি থেকে শুরু করে নির্বাচনী প্রক্রিয়ার প্রত্যেক কর্মকর্তার দিকে তাদের অঙ্গুলি নির্দেশিত হয়। তাদের অভিযোগ, তারা প্রতারিত হয়েছে এবং এই পদ্ধতির পরিবর্তন দাবি করে। তাদের উচিত ছিল এই ব্যবস্থার পরিবর্তন আনার উদ্যোগ ক্ষমতায় থাকাকালেই গ্রহণ করা।’ তার এই দৃষ্টিভঙ্গি সমর্থন করি। কারণ আওয়ামী লীগ যদি বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রতি হুমকি বিবেচনায় নিয়ে কাঠামোগত সংস্কারের দিকে যাত্রা শুরু করতে পারত এবং তারই অংশ হিসেবে নির্বাচনসংক্রান্ত বিধিবিধানের পরিবর্তন আশা করত, তাহলে সেটা নিশ্চয় ব্যাপকভিত্তিক জনসমর্থন পেত। কিন্তু মওদুদ যেভাবে বিএনপিকে সংস্কার করতে বলার কারণকে চরমভাবে অযৌক্তিক বলেছেন, সেটা কোনো তর্ক ছাড়াই গ্রহণ করা কঠিন। মওদুদ বলেছেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সংস্কারে বিরোধী দলের প্রস্তাব তোলার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল একটা অচলাবস্থার সৃষ্টি করা, যাতে সরকার পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়।’
মওদুদের এই সরলীকরণকে নাকচ করা যাবে না। বিরোধী দল কোনো শাসনগত সংস্কারের শুদ্ধাচারমূলক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সংস্কারের প্রস্তাব তোলেনি। আবার এও ঠিক বিএনপি একে নাকচ করেছিল গণতন্ত্র নষ্ট হবে বলে নয়; বরং ক্ষমতা কুক্ষিগত করাই ছিল এর প্রধান উদ্দেশ্য। ত্রয়োদশ সংশোধনীর কারণে বিচার বিভাগের প্রাতিষ্ঠানিক বিপর্যয় দেখে আওয়ামী লীগ নয়, বিএনপিও উদ্বিগ্ন ছিল না। সত্যি বলতে কি, এমন কোনো সংস্কার বা এমন কোনো আইনি কাঠামোর পরিবর্তন দুই প্রধান দল কোনো পর্বেই আশা করে না, যা থেকে তারা তাত্ক্ষণিক কোনো ফায়দা লাভ করতে না পারে। সোজা কথায় ভোটের বাক্সে ফল তোলা যাবে না, বরং তা ব্যাহত হতে পারে এমন কোনো সংস্কারে তাদের কারও কোনো রুচি নেই। অথচ সরকারি দল হিসেবে বিএনপি ২০০৫ সালেই বিরোধী দলের সংস্কার প্রস্তাবের আলোকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে সংলাপে জড়িত হতে পারত। সেটা সংসদের ভেতরে কিংবা বাইরে একযোগে কিংবা বিচ্ছিন্নভাবে
চলতে পারত। যখন তারা বিচারপতি কে এম হাসানের বয়স বাড়িয়েছিল সেই সংশোধনীর বিষয়ে তারা বিরোধী দলের সমর্থন আদায়ে সব রকম প্রচেষ্টাই নিতে পারত এবং এটাও সত্য যে বিচারপতিদের বয়সসীমা বাড়ানোর বিষয়টি কেবল মওদুদের দুরভিসন্ধির আলোকে দেখা ঠিক হবে না। কারণ, বয়স বাড়ানোর ক্ষেত্রে প্রধান বিচারপতিরা যথেষ্ট সক্রিয় ভূমিকা রাখছিলেন এবং এই বিষয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নির্বিশেষে সব মতাদর্শের বিচারকদের মধ্যে মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু বিএনপি এটা কেবল বিচারকদের জন্যই করেছিল তার প্রমাণ দিতে তারা ব্যর্থ হয়েছিল। এই ব্যর্থতার ব্যক্তিগত দায়ভাগ মওদুদকে অনেকটা নিতে হবে।
দ্বাদশ সংশোধনী পাসের সময় বিএনপি যে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল, সেটা অনুসরণযোগ্য। তত্কালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগকে সম্পৃক্ত করতে যথেষ্ট প্রয়াস নেওয়া হয়েছিল। এমনকি বিচার বিভাগ পৃথক্করণ-সংক্রান্ত একটি সর্বদলীয় সংসদীয় কমিটি ২০টির বেশি বৈঠকে মিলিত হয়েছিল। সুতরাং এ কথা সত্য নয় যে সংসদীয় পদ্ধতি প্রবর্তনের পর দেশের প্রধান বিরোধী দলের পক্ষে সংবিধান সংস্কারে কোনো নিয়মতান্ত্রিক আলোচনায় অংশগ্রহণ করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। বরং বিএনপি তাকে বাস্তবে রূপ দিতে ব্রতী হয়নি।
২০০৫ সালের সংস্কার প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে সরকারি দলের পক্ষে সংসদে বিল আনার কৌশল গ্রহণ করার বিকল্প খোলা ছিল। বিরোধী দল সংসদে বিল জমা দেয় না, তার কারণ, সরকারি দলের সমর্থন ছাড়া তা পাস হওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। তেমনি এ কথাও সত্য নয় যে সরকারি দলের বিল আনা মানেই বিরোধী দলের কাছে তাদের পরাজয় কিংবা সেই বিল সংসদে তোলা হলে তা তাদের পাস করতে কোনো বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি হয়। মওদুদ যে বিবরণ দিয়েছেন তা থেকে বোঝা যায়, তাঁরা বিরোধী দলের স্পর্শকাতরতা কিংবা কৌশলগত রাজনীতির গভীরতা অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন কিংবা নিজেকে সেভাবে প্রতিপন্ন হতে দিয়েছেন। তাঁরা সেদিন খুব সহজেই বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনার কৌশলগত সংসদ অধিবেশনে যোগদানকে কটাক্ষ করার দিকে মনোনিবেশ না করে তাঁর প্রস্তাবের আলোকে স্পিকারকে দিয়ে যৌথ কমিটি গঠনের আন্তরিক কিংবা কৌশলগত উদ্যোগ নিতে পারতেন। সব দলের মতৈক্যের ভিত্তিতে কোনো ব্যক্তিকে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ করা সম্ভব নয়—এ কথা উপহাসভরে মাঠে ময়দানে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়ার বিকল্প বেছে নেওয়াকেই বিএনপি বেশি যুক্তিযুক্ত মনে করেছিল। বাংলাদেশ শাসকেরা এটাই করেন। ৫ জানুয়ারির (২০১৪) একতরফা নির্বাচনের দুর্বলতাকে যেভাবেই চিত্রিত করা হোক না কেন, বিশ্ব যেভাবেই দেখুক, এটি অস্বীকার করার উপায় নেই যে এ নির্বাচনই আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রাখতে সক্ষম হয়েছে এবং বিএনপি তা প্রতিহত করতে ব্যর্থ হয়েছে। সুতরাং যে সমালোচনা সহে সে রহে। এটাই বাংলাদেশ গণতন্ত্র। একে যথার্থতা দিতে অতীতের বিতর্কিত কোনো অধ্যায়কে টেনে এনে বৈধতা বা গ্রহণযোগ্যতা দিতে কারও বাধে না। কখনো কারও বাধেনি। মওদুদ এই গণতন্ত্রের স্বরূপ উদ্ঘাটনের চেষ্টা করেছেন।
বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে যথেষ্ট সময় নষ্ট করেছিল। ২০১১ সাল থেকে আওয়ামী লীগ যেভাবে সময় নষ্ট করেছে। কী পরিহাস, ইতিহাসের একই পুনরাবৃত্তি। মওদুদ আহমদ নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে তত্কালীন বিরোধী দলের কাছে যে দৃষ্টিভঙ্গি বা পদক্ষেপ আশা করেছিলেন এবং তাকেই কার্যত একমাত্র গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা হিসেবে দেখেছিলেন, ঠিক একই দৃষ্টিভঙ্গি ও মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ ক্ষমতাসীন দল বিরোধী দলের প্রতি করছে। মওদুদ লিখেছেন, ‘বিএনপি আওয়ামী লীগের দাবি প্রত্যাখ্যান করে চলছিল, কারণ তার শর্ত ছিল শেখ হাসিনাকে সংসদে এসে বলতে হবে। এবং শেখ হাসিনা ১২ ফেব্রুয়ারি ২০০৬ সংসদে এসে প্রস্তাব দেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে দুই সপ্তাহের মধ্যে ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০০৬ প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ঘোষণা দেন যে, বিরোধী দলের প্রস্তাব খতিয়ে দেখতে উভয় পক্ষের সদস্যদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হবে। দুই দলের অবিশ্বাস এতটাই গভীর যে বিরোধী দল দাবি করে, প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা লিখিত হতে হবে এবং তারা তাতে সম্মতি দেওয়ার আগেই বিরোধী দলের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে অবহিত করতে হবে। এর পরই শুরু হয় দুই দলের মহাসচিবদের মধ্যে পত্রবিনিময় এবং যার পরিণতিতে আলোচনা শুরু হয়।’
অথচ এই দৃশ্য ২০০৫ সালে শুরু করতে সরকারি দলের সামনে কোনো বাধা ছিল না। কারণ আইন বা সংসদীয় গণতন্ত্রের এমন কোনো শর্ত বাধা নেই যে বিরোধী দল সংসদের ফ্লোরে এসে প্রস্তাব না দিলে তা সরকারি দল গ্রহণ করতে পারে না। কমিটি গঠনের উদ্যোগ নিতে পারে না। কোনো সংবিধান বিশেষজ্ঞ এ রকমের কোনো বাধানিষেধ কোনো কিতাব থেকে দেখাতে পারবেন না। কিন্তু বাংলাদেশে আশ্চর্যজনকভাবে এই বিষয়কে অহেতুক গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। দুই দলের মধ্যকার গভীর অবিশ্বাস, সন্দেহ, অনাস্থা ও অশ্রদ্ধাকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলার কোনো উদ্যোগ গ্রহণ না করেই এ ধরনের আনুষ্ঠানিকতার দোহাই দেওয়া হচ্ছে। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে মূল সংকট দুই দলের প্রতি পারস্পরিক অবিশ্বাস, যার একটি ঐতিহাসিক পরম্পরা রয়েছে। একটি মতাদর্শগত বিভাজনও রয়েছে। কিন্তু এটা এমন নয় যে বিশ্বের আরও অনেক জাতির জীবনে এমনটা নেই। বাংলাদেশে দশকের পর দশক একই শীর্ষ নেতৃত্বের বাস্তবতার কারণে সন্দেহ-অবিশ্বাসের শিকড় মাটির আরও গভীরে প্রোথিত হয়েছে। বাংলাদেশ অদূর ভবিষ্যতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা নির্বাচনকালীন সরকারের বিতর্ক থেকে বের হতে পারবে না। কারণ অদূর ভবিষ্যতে এই ধারা ভেঙে দেওয়া যাবে না। যেখানে দলের প্রধান, সরকারের প্রধান, সংসদের প্রধান এবং কার্যত বিচার বিভাগের প্রধান এক ব্যক্তি থাকবেন, সেখানে স্থিতাবস্থা অটুট থাকবে। অদূর ভবিষ্যতে কোনো কারণে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারলেও গণতান্ত্রিক শাসনের সংকট ঘুচবে না।
২০০৬ সালে আমরা দেখলাম দুই বড় দলের মহাসচিব কোন স্থানে বৈঠকে বসবেন সে বিষয়ে একমত হতে পারেননি। এই অচলাবস্থা নিরসনে তত্কালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত আব্দুল জলিল ও মান্নান ভূঁইয়াকে তাঁর বাসভবনে চায়ের আমন্ত্রণে ডেকেছিলেন। আওয়ামী লীগ তা গ্রহণ করলে বিএনপি তা বর্জন করে। বিএনপির যুক্তি ছিল এটা গ্রহণ করার অর্থ হবে জনগণের মর্যাদা ও অহংকারকে ভূলুণ্ঠিত করা। এরপর তাঁরা সংসদের একটি কমিটি কক্ষে কয়েক দফার ব্যর্থ বৈঠকে বসেছিলেন। ২০১৩ সালে এসে আমরা দেখলাম, জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন খালেদা জিয়ার সঙ্গে টেলিফোন আলোচনায় বিএনপির দুজন নেতাকে নিউইয়র্কে আমন্ত্রণ জানালেন। সম্ভবত তাঁরা বুঝলেন স্যার নিনিয়ান যে কারণে ব্যর্থ ছিলেন, সেই কারণগুলো বাংলাদেশ রাজনীতিতে এখনো পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান। তাই এবার বিদেশি মধ্যস্থতায় কোনো আলোচনা হলো না। আর টেলিফোনের একটি নৈশভোজের আমন্ত্রণ নিয়ে কেবল হইচইটাই সবার নজরে পড়ল। এটাই ওঁরা চেয়েছিলেন। খালেদা জিয়া দ্বিতীয় পর্ব শুরু করেছেন। এবার প্রধানমন্ত্রীকে তিনি ইফতার পার্টিতে দাওয়াত দিয়েছেন। কিন্তু কথা হলো, এসবের সঙ্গে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক বিনির্মাণের সম্পর্ক আগের মতোই আলগা।
মওদুদ আহমদ দুই নেত্রীর নেতৃত্বে বাংলাদেশের ভবিষ্যত্ দেখেছেন। এর সঙ্গে গণতন্ত্রের প্রশ্ন কতটা, তার চেয়ে অনেক বেশি সত্য হলো এটাই বাস্তবতা। এটা বাংলাদেশ গণতন্ত্রের শক্তি। এটা বাংলাদেশ গণতন্ত্রের দুর্বলতা। একজন মওদুদ আহমদ তাঁর অনন্যসাধারণ সচেতন কুশলীব। বাংলাদেশ রাজনীতিকে বুঝতে হলে মওদুদের রাজনৈতিক সাহিত্য হবে আলোকবর্তিকা। জেলে বসে নিজেকে রাজনৈতিক লেখায় নিয়োজিত রাখার যে ধারা তিনি চালু করেছেন তা বিরল। এই প্রশংসা ওঁরই প্রাপ্য।