ব্যাংক-ব্যবস্থা ও নৈতিকতাবোধ

ভূমিকা

বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা সত্তরের দশকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অযাচিত হস্তক্ষেপের প্রতিবাদে লিখেছিলেন, ‘মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব হলো মন্ত্রণা দেওয়া, যন্ত্রণা দেওয়া নয়।’ বাংলাদেশের মতো অনুদার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মহামহিম মন্ত্রণালয় সম্পর্কে এ ধরনের মন্তব্যের জন্য অসম সাহসের প্রয়োজন। এ কাজটি করেছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের একসময়ের ডেপুটি গভর্নর এ এফ এম নুরুল মতিন (১৯২৮-৭৮)। দুর্ভাগ্যবশত তিনি মাত্র ৫০ বছর বয়সে ১৯৭৮ সালে পরলোকগমন করেন। তিনি শুধু সাহসীই ছিলেন না, সক্রেটিসের অভিধায় তিনি ছিলেন নীতিবান ব্যক্তিত্ব।

আজকের বিশ্বে লোভতাড়িত অন্তর্বিস্ফোরণের ফলে ব্যাংক ও অব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো বারবার বিপর্যস্ত হচ্ছে। করপোরেট জগতে ঘটছে পৌনঃপুনিক রগরগে কেলেঙ্কারি, ব্যাংক-ব্যবস্থায় নৈতিকতাবোধ আজ আর নুরুল মতিনের মতো মুষ্টিমেয় বিবেকবান ব্যক্তিদের বিমূর্ত আদর্শ নয়। ব্যাংক-ব্যবস্থায় নৈতিকতা আজকের বিশ্বে জীবন-মরণ সমস্যা। নৈতিকতা ব্যাংক-ব্যবস্থার ধূসর পটভূমি নয়, নৈতিক দায়বদ্ধতা নিশ্চিতকরণ আজকের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সবচেয়ে জরুরি সমস্যা।

ত্রিশের দশকের মহামন্দার পর বিশ্ব অর্থনীতি কখনো আজকের মতো নাজুক পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়নি। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের হিসাব অনুসারে বিশ্ববাজারে কু ও মন্দ ঋণের জন্য ব্যাংকগুলোতে তাদের সম্পদের তালিকা থেকে চার ট্রিলিয়ন ডলার (অর্থাত্, চার লাখ কোটি ডলার বা ২৮০ লাখ কোটি টাকা) অবলোপন করতে হবে। এ অঙ্ক উন্নত রাষ্ট্রগুলোর বার্ষিক মোট জাতীয় উত্পাদের প্রায় ১১ শতাংশ। অর্থনৈতিক মন্দায় শেয়ার, গৃহ ইত্যাদি সম্পদের মূল্যও নাটকীয়ভাবে কমে গেছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, সম্পদের মূল্য কমে যাওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রে ৮ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন ডলার (আট লাখ ৩০ হাজার কোটি ডলার বা ৫৮১ লাখ কোটি টাকা) ক্ষতি হয়েছে। এই অঙ্ক যুক্তরাষ্ট্রের বার্ষিক জাতীয় উত্পাদের প্রায় তিন-চতুর্থাংশের সমান। ফলে বিশ্বব্যাপী মন্দা দেখা দিয়েছে, যা একই সঙ্গে শিল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বিস্তৃত হয়েছে।

তবে ২০০৭-০৯ সময়ের মন্দা মোটেও আকস্মিক নয়। নিরন্তর নজরদারি, বিধিভিত্তিক নিয়ন্ত্রণ (regulatory restrictions) এবং সতর্কতামূলক নীতিমালা সত্ত্বেও সম্প্রতি আর্থিক খাতে সংকটের তীব্রতা বেড়েই চলেছে। যুক্তরাষ্ট্রে আশির দশকে সঞ্চয় ও ঋণ সমিতিগুলোর (Saving and Loan Associations) কেলেঙ্কারি থেকে শুরু করে বিগত দশকে করপোরেট হিসাব কেলেঙ্কারি পর্যন্ত আর্থিক ও করপোরেট খাতে বারবার অশনিসংকেত দেখা গেছে। আর্থিক ব্যবস্থার দুর্বলতাকে আরও নাজুক করে তোলে করপোরেট প্রশাসনের মারাত্মক অস্বচ্ছতা। কখনো কখনো এসব কেলেঙ্কারিতে যোগসাজশে ছিল লব্ধপ্রতিষ্ঠ ও শ্রদ্ধাভাজন  হিসাব নিরীক্ষক সংস্থাগুলো। অথচ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বাইরের ব্যক্তিদের আমানত হেফাজতের জন্য নজরদারি ব্যবস্থার এরাই হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। এসব মর্মান্তিক অভিঘাতের পেছনে কাজ করছে অতিরিক্ত মুনাফার জন্য অবিরাম তাড়না, যা ন্যায়-অন্যায় বোধ, শুভ-অশুভ বোধ এবং নিস্পৃহভাবে কাজ করার ক্ষমতাকে খর্ব করে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সুশাসনের খামতি এসব সংকটকে আরও প্রকট করে তুলেছে। এসব দেশে সুশাসনের অনুপস্থিতি মানুষের হীন প্রবৃত্তিগুলোকে চাগিয়ে দিয়েছে।

বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধের মূল লক্ষ্য হলো, ব্যাংকিং খাতে জরুরি নৈতিক সমস্যাগুলোর সমীক্ষা। এটি পাঁচটি খণ্ডে বিভক্ত। প্রথম খণ্ডে রয়েছে উপক্রমণিকা, দ্বিতীয় খণ্ডে ব্যাংক খাতে মৌলিক নৈতিক সমস্যাগুলো বিশ্লেষণ করা হয়েছে এবং এসব সমস্যা সমাধানের বিকল্পগুলো আলোচিত হয়েছে। তৃতীয় খণ্ডে আর্থিক খাতে নজরদারির জন্য বিদ্যমান ব্যবস্থাগুলোর কার্যকারিতা নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। চতুর্থ খণ্ডে বাংলাদেশে আর্থিক খাতের সংকটগুলো সংক্ষেপে বর্ণিত হয়েছে এবং এসব সংকট থেকে উত্তরণের উপায়গুলোর বিশ্লেষণ করা হয়েছে। সর্বশেষ খণ্ডে এ প্রবন্ধের মূল বক্তব্য ও সুপারিশগুলো সংক্ষেপে বিবৃত হয়েছে।

২. ব্যাংকিং খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নৈতিক প্রশ্নগুলো

অ্যাডাম স্মিথ তাঁর Wealth of Nations গ্রন্থে দ্বিতীয় খণ্ডে ব্যাংকে মানুষের আস্থার জন্য তিনটি অত্যাবশ্যক শর্ত উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে এগুলো হচ্ছে ‘fortune, probity and prudence’ (ঐশ্বর্য, বিশ্বস্ততা ও বিচক্ষণতা)। ঐশ্বর্যের প্রয়োজন ব্যাংকের পর্যাপ্ত পুঁজির জন্য। বিচক্ষণতার প্রয়োজন ব্যাংক সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য। এ দুটি শর্ত যেকোনো করপোরেট প্রতিষ্ঠানের জন্যই অত্যাবশ্যক। কিন্তু ব্যাংকের সঙ্গে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি বড় প্রভেদ এই, সব করপোরেট প্রতিষ্ঠানে বিশ্বস্ততা অত্যাবশ্যক শর্ত নয়। কিন্তু ব্যাংকের ক্ষেত্রে এ শর্ত অপরিহার্য। বিশ্বস্ততা শুধু ব্যক্তির কাছে নয়, নীতির প্রতিও বিশ্বস্ত হতে হবে। Webstars Third New International Dictionary-তে probity বা বিশ্বস্ততার নিম্নরূপ সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। ‘সর্বোচ্চ নীতি ও আদর্শের আপসহীন অনুসরণ (uncompromising adherence to highest principles and ideals)। Business Dictionary.com অনুসারে বিশ্বস্ততা বা Probity শব্দের অর্থ হলো ‘adherence to a code of conduct based on undeviating honesty. especially in commercial (monetary) matters and beyond legal requirements’ [আইনি বাধ্যতার অতিরিক্ত আচরণবিধি প্রতিপালন, যা বিশেষ করে বাণিজ্যিক (আর্থিক) বিষয়ে আপসহীন সততার ওপর প্রতিষ্ঠিত]।

ব্যাংক-ব্যবস্থার ভিত্তিই হলো পারস্পরিক আস্থা। স্যার জন হিকস তাঁর Theory of Economic History গ্রন্থে ব্যাংক-ব্যবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে একই বাক্যে Trust বা আস্থা শব্দটি দুবার ব্যবহার করেছেন। বাক্যটি নিম্নরূপ “Here the loan is given to an intermediary (one of these who is trusted by prime lender) in order that he should relend to those whom he trusts” [এখানে একজন মধ্যবর্তীকে (যার ওপর মূল মহাজনের আস্থা আছে) ঋণ দেওয়া হয়, যাতে সে আবার অন্য ব্যক্তি যার ওপর তার আস্থা আছে, তাকে ধার দিতে পারে]। আস্থার সম্পর্ক পারস্পরিক নির্ভরশীলতার ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়। সাধারণত যাঁরা কাজে ও চিন্তায় নীতিবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল বলে প্রতীয়মান হন, তাঁরাই অন্যের আস্থা অর্জন করেন। আস্থা পারস্পরিক সহযোগিতার সামাজিক পরিবেশ রচনা করে। অব্যাহতভাবে আস্থার সম্মান রাখতে পারলে সমাজে পারস্পরিক নির্ভরতা বাড়ে এবং পারস্পরিক আস্থা আরও সম্প্রসারিত হয়। অন্যদিকে আস্থা অটুট রাখতে ব্যর্থ হলে সমাজে সন্দেহ ও অনিশ্চয়তার পরিবেশ সৃষ্টি হয়। তাই একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে তার প্রতি আস্থা অক্ষুণ্ন রাখতে ব্যর্থ হলে এর প্রভাব শুধু প্রতিষ্ঠানটিতে সীমাবদ্ধ থাকে না, তা সমগ্র সমাজে ছড়িয়ে পড়ে। নিয়ন্ত্রণহীন আতঙ্ক সৃষ্টি করে এবং অনাস্থার সংক্রমণ ছড়িয়ে দিয়ে এ ধরনের ঘটনা সারা দেশের আর্থিক ব্যবস্থার জন্য একটি হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। সুতরাং, বৈষয়িক সম্পদের দুর্গ হিসেবে পরিচিত ব্যাংকগুলো নৈতিকতা বোধের সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত না হলে ঠুনকো থেকে যাবে।

 অনুজ্ঞাভিত্তিক (Normative) নৈতিকতার প্রাসঙ্গিকতা

বিশ্বকোষ ব্রিটানিকায় নীতিশাস্ত্রের নিম্নরূপ সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে: “The branch of philosophy that is concerned with what is morally good and bad, right and wrong, a synonym for it is moral philosophy” (দর্শনের একটি শাখা, যা নৈতিকভাবে কী ভালো ও মন্দ এবং কী সঠিক ও ভ্রান্ত, তা নির্ধারণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, এর সমার্থক শব্দ হচ্ছে নৈতিক দর্শন)। কিন্তু নীতিশাস্ত্রের নীতিগুলো যথা ভালো ও মন্দ এবং ন্যায় ও অন্যায় সম্পর্কে দার্শনিকদের মধ্যে কোনো মতৈক্য নেই। মোটা দাগে অনুজ্ঞাভিত্তিক নৈতিকতা নিয়ে তিনটি স্বতন্ত্র ঘরানা (school) রয়েছে।

প্রথমত, অনুজ্ঞাভিত্তিক নৈতিকতার সবচেয়ে জনপ্রিয় ঘরানা মনে করে, নৈতিকতা হচ্ছে ব্যক্তির সদ্গুণ (virtue ethics)। প্রাচীন গ্রিক দর্শনে বিশেষ করে, প্লেটো ও অ্যারিস্টটলের রচনায় এ ধারণা উপস্থাপিত হয়েছে। এই মত অনুসারে ন্যায়পরায়ণতা বা সদাশয়তা ব্যক্তির গুণ। শুধু বিধি বা পরিণামের ভিত্তিতে ব্যক্তির কার্যকলাপ সব সময় মূল্যায়ন করা যায় না। যা নীতিবিগর্হিত, তা সব সময়েই সব ব্যক্তির কাছে অগ্রহণীয় থাকবে। মিথ্যা নীতিবিগর্হিত, তবু মিথ্যা সব সময় ক্ষতিকর নয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মিথ্যার ফলাফল কল্যাণকর হতে পারে। যেমন ধরুন, একজন খুনি একজন নিরীহ লোককে হত্যার জন্য খুঁজে বেড়াচ্ছে। আপনি জানেন নিরীহ লোকটি কোথায় আছে। খুনি আপনাকে জিজ্ঞেস করল, লোকটি কোথায় আছে আপনি জানেন কি না। আপনি যদি সত্য কথা বলেন, নিরীহ লোকটি মারা যাবে এবং এতে একটি বড় অন্যায় সংঘটিত হবে। আপনি যদি মিথ্যা কথা বলেন, তবে লোকটি বেঁচে যাবে, কিন্তু আপনি নীতিভ্রষ্ট হবেন। এ ধরনের দ্বন্দ্ব নিয়ে বিগত শতাব্দীতে কলকাতার এক ব্রাহ্ম নীতিবাগীশ সম্পর্কে একটি সুন্দর গল্প প্রচলিত রয়েছে। এই ব্রাহ্ম ভদ্রলোক রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলেন। এমন সময় একজন মাতাল তাঁকে বলল, ‘মশাই, বেশ্যাবাড়ির রাস্তাটি কোথায় বলবেন কি?’ ভদ্রলোক পাড়ায় থাকেন। তিনি রাস্তা ঠিকই চেনেন, কিন্তু বেশ্যাবাড়িতে যাওয়ায় সহায়তা করা নীতিবিরুদ্ধ। তাই মাতালকে বেশ্যালয়ের ঠিকানা তিনি বলবেন না। আবার ঠিকানা জানেন না, এরূপ মিথ্যা কথা বলতেও তাঁর নীতিতে বাধে। তাই তিনি জবাব দিলেন, ‘আমি রাস্তা চিনি, কিন্তু আমি আপনাকে বলব না।’ এখানে ভদ্রলোকটি সুচতুরভাবে সত্য-মিথ্যার দ্বন্দ্ব এড়িয়ে গেছেন। কিন্তু সর্বক্ষেত্রে দ্বন্দ্ব এড়ানো সম্ভব নয়। একটি বিশেষ ক্ষেত্রে মিথ্যা বলার সুফল বা কুফল সদ্গুণ-নৈতিকতার উপজীব্য নয়। ফলাফল যা-ই হোক না কেন, মিথ্যা উক্তি ব্যক্তির নৈতিক চরিত্রের দুর্বলতার চিহ্ন এবং ভালো উদ্দেশ্যে মিথ্যা বললেও তা গ্রহণযোগ্য নয়।

সক্রেটিস বলতেন, অপরীক্ষিত জীবনের কোনো দাম নেই (The unexamined life is not worth living)। নিজেকে মূল্যায়নের তাগিদ আসে বিবেক থেকে। বিবেকের ইংরেজি প্রতিশব্দ Conscience। এর সংজ্ঞা হলো ‘a personal sense of moral goodness or blameworthiness in ones conduct, intention or character with regard to a feeling of obligation to do right or be good’ (ন্যায় কাজটি করার জন্য অথবা উত্তম থাকার উদ্দেশ্যে ব্যক্তির আচরণে, অভিপ্রায়ে ও চরিত্রে নৈতিক দিক থেকে গ্রহণযোগ্য বা নিন্দনীয় কাজ সম্পর্কে ব্যক্তিগত বোধই হচ্ছে বিবেক)। বিবেক হচ্ছে মানুষের একটি স্বাভাবিক গুণ। কিন্তু ব্যাংক মানুষ নয়। তার কোনো প্রাকৃতিক অস্তিত্ব নেই। ব্যাংক হলো আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত একটি কৃত্রিম সত্তা। এর কোনো বিবেক নেই। যদিও ব্যাংকের বোর্ডের সদস্যরা এবং ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ মানুষ, তবু এরা করপোরেশনের কৃত্রিম সত্তার অবগুণ্ঠনে (corporate veil) প্রকৃত মানুষের জগত্ হতে বিচ্ছিন্ন।

ব্যাংক সাধারণত স্টক মার্কেটে নিবন্ধিত যৌথ মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান হয়। এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকদের দায় তাদের শেয়ারের অভিহিত মূল্যের বেশি নয়। অতিসম্প্রতি অনেক দেশেই আদালত করপোরেট অবগুণ্ঠন-সংক্রান্ত আইনি কল্পকথায় (myth) বড় বড় ছিদ্র খুঁজে বের করেছেন। এই মত অনুসারে কোম্পানি তার মালিকদের থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র সত্তা নয়। কোম্পানির দায় মালিকদের দায় নয়, এ মতবাদ ভ্রান্ত। বিভিন্ন আদালতের সিদ্ধান্ত অনুসারে অনেক ক্ষেত্রেই করপোরেশনের দায় বোর্ড সদস্যদের ও শেয়ারমালিকদের ব্যক্তিগত দায় হিসেবে পরিগণিত হওয়ার যোগ্য।

সম্প্রতি ব্যাংকে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ব্যক্তিগত নৈতিক দায় নতুনভাবে জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। গ্রাহক ও ব্যাংকের মধ্যে ব্যক্তিগত সম্পর্ক চুকিয়ে ইলেকট্রনিক বা ই-ব্যাংক আর্থিক খাতে লেনদেন মানবিক সম্পর্কের বাইরে নিয়ে গেছে। বর্তমানে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো অভাবিত গতিতে টাকা সৃষ্টি করতে পারে, আবার ধ্বংসও করতে পারে। আধুনিক অর্থব্যবস্থার কোনো কোনো উপকরণ যথা এখনো সম্পদ সৃষ্টি হয়নি তবে ভবিষ্যতে সম্পদে রূপান্তরিত হবে, এ ধরনের আর্থিক উপাদান বা derivative ডিনামাইটের মতো প্রলয়ংকরী হতে পারে। ব্যাংক পরিচালনার সঙ্গে কিছু কর্মকর্তাকে বিকেন্দ্রীকৃত কাঠামোয় বড় বড় তাত্ক্ষণিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা দিতে হয়। উদাহরণস্বরূপ ব্রিটিশ বিনিয়োগ ব্যাংক বেরিংসের অভিজ্ঞতা স্মরণ করা যেতে পারে। এই প্রতিষ্ঠানের মার্ক লিসন (Mark Leason) নামের একজন মাঝারি পর্যায়ের কর্মকর্তা একক সিদ্ধান্তে এক বিলিয়ন ডলারের (প্রায় সাত হাজার কোটি টাকার) লোকসান কোম্পানির ওপর চাপিয়ে দেয়। দীর্ঘদিন সুনাম নিয়ে কাজ করছিল যে প্রতিষ্ঠান, সে প্রতিষ্ঠানটি মাত্র একজন কর্মকর্তার হঠকারিতায় বিলুপ্ত হয়ে গেল। এই পরিবেশে ব্যাংকের পরিচালকদের তুলনায় ব্যাংকের কর্মচারীদের দায়িত্ব কোনো অংশেই কম নয়। যেসব ব্যক্তি ব্যাংক পরিচালনা করেন, তাঁদের চরিত্র এবং ব্যক্তিগত গুণাবলির ওপর আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব অনেকাংশে নির্ভর করে। ব্যাংকের মালিক ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মধ্যে অভিপ্রেত নৈতিক গুণাবলি নিশ্চিত করা একবিংশ শতাব্দীর আর্থিক খাতে একটি বড় চ্যালেঞ্জ।

সদ্গুণভিত্তিক নৈতিকতার একটি বড় আকর্ষণ এই যে এ ঘরানার দার্শনিকেরা ব্যাংকিং সেক্টরে প্রাকৃতিক ব্যক্তিদের ভূমিকাকে প্রাধান্য দেয়। কিন্তু এই দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাংকের নৈতিক সমস্যা সমাধানের জন্য যথেষ্ট নয়। প্রথমত, সদ্গুণের সংজ্ঞা সম্পর্কে কোনো মতৈক্য নেই। এই সংজ্ঞা দেশ এবং সাংস্কৃতিক পরিবেশভেদে ভিন্ন। এমন কোনো গ্রহণযোগ্য মাপকাঠি নেই, যার ভিত্তিতে পুণ্য থেকে পাপ এবং ন্যায় থেকে অন্যায় পৃথক করা যাবে। তাই সত্ মানুষের সংজ্ঞা নির্ধারণ সহজ নয়। দ্বিতীয়ত, সদ্গুণভিত্তিক নৈতিকতা ব্যক্তির আচরণের ওপর নির্ভর করে। ব্যাংকের মতো কৃত্রিম ব্যক্তিদের আচরণে সদ্গুণ নৈতিকতা নিশ্চিত করার কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেই।

অনুজ্ঞাভিত্তিক নৈতিকতার দ্বিতীয় ঘরানা Deontology বা (দায়িত্ব শাস্ত্র) অথবা deontological ethics অথবা দায়িত্বজাত নৈতিকতা নামে পরিচিত। Deontology শব্দটি গ্রিক শব্দ deon থেকে উদ্ভূত হয়েছে। গ্রিক ভাষায়, deon শব্দের অর্থ হলো বাধ্যবাধকতা বা দায়িত্ব। দায়িত্বজাত নৈতিকতা নিয়মভিত্তিক নৈতিকতা নামেও পরিচিত। এখানে ব্যক্তির গুণাবলি মুখ্য নয়। এখানে মূল বিষয় হলো, প্রচলিত নিয়ম অনুসারে কোনো দায়িত্ব বা বাধ্যবাধকতার অনুজ্ঞা আছে কি না। নিয়ম অনুসারে যে কাজ করার দায়িত্ব বা বাধ্যবাধকতা আছে তা করতেই হবে, তার পরিণাম যতই অপ্রিয় বা ক্ষতিকর হোক। আপনি যদি দায়িত্বজাত নৈতিকতায় বিশ্বাস করেন, তবে কোনো সন্ত্রাসী যদি অন্যায় উদ্দেশ্যে আপনার ছেলের ঠিকানা জানতে চায়, তাকে আপনার সত্য কথা বলতে হবে। এ দায়িত্ব একতরফা। সন্ত্রাসী তার নৈতিক দায়িত্ব অস্বীকার করলেও দায়িত্বজাত নৈতিকতা অনুসারে আপনাকে আপনার কর্তব্য পালন করতে হবে।

দায়িত্বজাত নৈতিকতার সবচেয়ে সুন্দর ব্যাখ্যা দিয়েছেন জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল ক্যান্ট। তাঁর মতে, এ ধরনের নৈতিকতার উত্স হলো categorical imperative বা নিঃশর্ত নৈতিক কর্তব্য। এই নিঃশর্ত নৈতিক কর্তব্যবোধ সম্পর্কে দার্শনিক উইল ডুরান্ট বলেছেন: “The unconditional command of our conscience to act as if the maxim of our action were to become by our will a universal law of nature” (দায়িত্ব পালনের জন্য আমাদের বিবেকের নিঃশর্ত নির্দেশ যেন আমাদের ইচ্ছাশক্তির বলে প্রকৃতির বিশ্বজনীন বিধানে পরিণত হয়)। এই ঘরানার দার্শনিকেরা মনে করেন, নীতিবোধ মানুষের সহজাত প্রবণতা এবং আমাদের হূদয়ে নৈতিক বিধান নিঃশর্ত ও চূড়ান্ত। এই ঘরানার অন্য একটি গোত্রের দার্শনিকেরা মনে করেন, নৈতিক বাধ্যবাধকতার উত্পত্তি বিধির বিধান থেকে। এখানে শুধু দায়িত্ব পালন করাই যথেষ্ট নয়, যেমন স্বাস্থ্যগত কারণে উপোস করলে রোজা হবে না। আল্লাহর নির্দেশ বিশ্বাস করে রোজা রাখতে হয়। এ ধরনের দায়িত্ব পালনের তাগিদ আসতে হবে বিধাতার নির্দেশের পবিত্রতা উপলব্ধি থেকে। আরেক গোত্রের দার্শনিকেরা মনে করেন, নৈতিক বিধানগুলো স্বতঃসিদ্ধ। যতটুকু সম্ভব এসব নৈতিক বিধান প্রতিপালন আমাদের অবিতর্কিত কর্তব্য। যদিও একই ঘরানার বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে নৈতিক বাধ্যকতা সম্পর্কে মতৈক্য নেই, তবু তারা সবাই স্বীকার করে, আমাদের নৈতিক কর্তব্যবিধি বিধান বা আচরণবিধি দ্বারা নির্ধারণ করা সম্ভব।

কয়েকটি দুর্বলতার জন্য দায়িত্বজাত নৈতিকতা ব্যাংক-ব্যবস্থার সন্তোষজনক নৈতিক ভিত্তি হতে পারে না। প্রথমত, এ ধরনের মতবাদ নৈতিক বাধ্যবাধকতার নিঃশর্ত ও চূড়ান্ত প্রাধান্যে বিশ্বাস করে। এই মত অনুসারে বড় পাপ আর ছোট পাপ উভয়ই পাপ। কোনো পাপই করা যাবে না। এ প্রসঙ্গে একটি উদাহরণ বিবেচনা করুন। এক দুষ্ট লোক রেললাইনের শেষ মাথায় আটকে পড়া পাঁচজন লোককে হত্যার জন্য দ্রুতগতিতে একটি ট্রলি চালিয়ে আসছে। আপনি রেললাইনের পাশে দাঁড়িয়ে দেখলেন, দ্রুতগামী ট্রলিটি আসছে। এটিকে ঠেকানোর একমাত্র উপায় হলো রেললাইনের পাশে দাঁড়ানো কোনো একজন নিরীহ ব্যক্তিকে ট্রলির সামনে ঠেলে ফেলে দেওয়া, যাতে ট্রলিটি থেমে যায়। এখানে যে লোকটিকে ফেলে দেওয়া হবে, তিনি মারা যাবেন। নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা পাপ। এটা করা যাবে না, অন্যদিকে একটি মানুষকে মারলে পাঁচটি লোককে বাঁচানো যাবে। একটি জীবনের চেয়ে পাঁচটি জীবন অনেক বেশি মূল্যবান। সুতরাং, একটি লোককে মেরে পাঁচটি লোক বাঁচানোরও যৌক্তিকতা রয়েছে। কিন্তু কাজটি ছোট পাপ হলেও পাপ। এটাও করা ঠিক হবে না।

আরেকটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে বাংলা সাহিত্য থেকে। মধ্যযুগে বাংলাদেশের মুসলিম আলেমরা বিশ্বাস করতেন, পবিত্র কোরআন ও হাদিসের বাণী পৌত্তলিক বাংলা ভাষায় অনুবাদ করা পাপ। শেখ মুত্তালিব (১৫৯৫-১৬৬০) মুসলমান ধর্মগ্রন্থ বাংলায় অনুবাদ করেন এবং তাঁর এই আত্মস্বীকৃত দুষ্কর্মের যৌক্তিকতা হিসেবে লিখলেন:

আরবীতে সকলে না বুঝে ভালো মন্দ

তে কারণে দেশী ভাষে রচিলু প্রবন্ধ।

মুসলমানী শাস্ত্রে কথা বাঙ্গালা করিলু

বহু পাপ হৈল মোর নিশ্চয় জানি লু।

কিন্তু মাত্র ভরসা আছয়ে মনান্তরে

বুঝিয়া মুমিন দোয়া করিবে আমারে

মুমিনের আশীর্বাদে পুন্য হইবেক

অবশ্য গফুর আল্লা পাপ খেমিবেক।

বাংলায় মুসলমানি শাস্ত্রকথা লেখা পাপ, এ বক্তব্য শেখ মুত্তালিব স্বীকার করেন। তবু কাজটি পাপ হলেও এর সুফল রয়েছে। পাঠকেরা আরবি ভাষায় মুসলমান শাস্ত্র পাঠ করতে পারেন না। বাংলা ভাষায় শাস্ত্র পাঠ করে মুমিন মুসলমানেরা লেখককে দোয়া করবেন। এসব দোয়ার বরকতে কবিরা গুনাহ মাফ হয়ে যাবে, অর্থাত্ কোনো পাপের যদি সুফল থাকে, তবে আল্লাহ এ ধরনের পাপ মাফ করবেন। সুতরাং ছোট পাপ করে বড় পুণ্য অর্জন সম্ভব।

দ্বিতীয়ত, দায়িত্বজাত নৈতিকতা দুটি পরস্পরবিরোধী দায়িত্বের দ্বন্দ্ব নিরসনে অক্ষম। মনে করুন, আপনি একটি দুর্ভিক্ষপীড়িত অঞ্চলের পুলিশ কর্মকর্তা। এলাকার মানুষ দীর্ঘদিন অনাহারে থেকে মহাজনের গোলা লুট করতে আসছে। নিরন্ন মানুষের মুখে অন্ন তুলে দেওয়া আপনার নৈতিক দায়িত্ব। আবার পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে আপনার নৈতিক দায়িত্ব হলো সাধারণ মানুষের জানমাল হেফাজত করা। আপনি কি বুভুক্ষু জনতাকে খাদ্য লুট করতে দেবেন এবং আপনার জেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভেঙে পড়তে দেবেন? নাকি শক্তি প্রয়োগ করে বুভুক্ষু মানুষকে ছত্রভঙ্গ করে মহাজনের জানমালের নিরাপত্তা হেফাজত করবেন? এ ধরনের দ্বন্দ্বের কীভাবে নিরসন করা হবে, সে সম্পর্কে দায়িত্বজাত নৈতিকতায় কোনো নির্দেশনা নেই।

তৃতীয়ত, এ ঘরানার দার্শনিকেরা বলে থাকেন, ন্যায়-অন্যায়সংক্রান্ত নীতিমালা বিধাতার নির্দেশ, প্রাকৃতিক বিধান অথবা বিশ্বজনীন যুক্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু এসব নীতিমালা নিয়ে কোনো মতৈক্য নেই। মূলত এ ধরনের নীতি মনোগত (subjective), নৈর্ব্যক্তিক নয়। কাজেই ব্যাংকের মতো কোনো বড় প্রতিষ্ঠানের সবাই কোনো দিনই এক ধরনের নৈতিক নীতি অনুসরণ করবে না।

অনুজ্ঞাভিত্তিক নৈতিকতার তৃতীয় ঘরানা পরিণামবাদ বা consequentialism নামে পরিচিত। তাঁদের মতে, কোনো কাজের নৈতিক ঔচিত্য নির্ণয়ের একমাত্র উপায় হলো তার পরিণাম বিশ্লেষণ করা। সংক্ষেপে বলতে গেলে এঁরা বিশ্বাস করেন, পরিণামই কোনো কর্মের নৈতিক যৌক্তিকতা নির্ধারণ করে। কোনো কাজই এমনিতে ন্যায় বা অন্যায় নয়। পরিণামই নির্ধারণ করে কোন কাজ সঠিক এবং কোন কাজ ভুল। প্রয়োগগত দিক থেকে এ মতবাদের কয়েকটি সুবিধা রয়েছে। প্রথমত, সম্ভাব্য পরিণাম বিবেচনা করে এই পদ্ধতিতে সর্বোত্তম ব্যবস্থা চিহ্নিত করা সম্ভব। নৈতিক দিক থেকে সর্বোত্তম কাজ হলো সেটি, যা সবচেয়ে বেশি সংখ্যক লোককে সবচেয়ে বেশি সুখ দেয়। দ্বিতীয়ত, এই মাপকাঠি ব্যবহার করে যেমন ব্যক্তির জন্য সর্বোত্তম কর্মপন্থা নিরূপণ করা সম্ভব, তেমনি সমাজের জন্য কী কল্যাণকর, তাও নির্ধারণ করা সহজ।

পরিণামবাদের কিছু আকর্ষণীয় সুবিধা সত্ত্বেও এর অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। প্রথমত, এই দর্শন অনুসারে যিনি কাজ করেন আর যে কাজ করা হয়, তার মধ্যে একটি কৃত্রিম ব্যবধান সৃষ্টি করা হয়েছে। পরিণামবাদে কর্মের কর্তা গৌণ, কর্মই হচ্ছে মুখ্য। অথচ বাস্তব জীবনে কর্তা ছাড়া কর্ম নেই। পরিণামবাদের প্রত্যাশা এই যে, যাঁরা কোনো কাজ করেন, তাঁরা তাঁদের ব্যক্তিগত স্বার্থ এবং ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ অগ্রাহ্য করে সম্পূর্ণ নৈর্ব্যক্তিক পদ্ধতিতে সবচেয়ে হিতকর ব্যবস্থা নিয়ে থাকেন, এ অনুমান অবাস্তব। দ্বিতীয়ত, যাঁরা কাজ শুরু করেন, তাঁরা কখনো নিশ্চিত করতে পারেন না যে তাঁদের কৃতকর্ম অভিপ্রেত পরিণাম এনে দেবে। অনেক সময় সঠিক কাজের অনভিপ্রেত পরিণাম দেখা দিতে পারে। ধরুন, একটি ব্যাংক নিম্ন আয়ের ব্যক্তিদের জন্য একটি আবাসিক এলাকা প্রতিষ্ঠার জন্য ঋণ দেয়। প্রকল্প সমাপ্তির পর দেখা গেল, আবাসিক এলাকাটি মাস্তান ও মাদক ব্যবসায়ীরা কার্যত দখল করে নিয়েছে। ব্যাংককে কি এই অনভিপ্রেত পরিণামের জন্য দায়ী করা যাবে?

নৈতিক পরিণামবাদ তখনই গ্রহণযোগ্য হবে, যখন প্রতিটি কর্মের কার্যকারণ (cause and effect) সম্পর্ক সুস্পষ্টভাবে নির্ধারণ করা যাবে। কিন্তু এ কাজটি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সম্ভব হয় না। কারণ, কোনো ঘটনাই বিচ্ছিন্ন নয়, প্রতিটি ঘটনারই পরম্পরা রয়েছে। তাই বিশেষ একটি কাজের কারণ নির্ণয় করা শক্ত। এ প্রসঙ্গে বুখারার আমিরের সঙ্গে মোল্লা নাসির উদ্দিনের বাহাসের কিংবদন্তি স্মরণ করা যেতে পারে। আমির বললেন, প্রতিটি ঘটনার কারণ নির্ধারণ করা সম্ভব। মোল্লা ভিন্নমত পোষণ করলেন। আমির বললেন, মোল্লা যদি তাঁর বক্তব্য প্রমাণ না করতে পারেন, তবে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে। মোল্লা বললেন, এক্ষুনি তার প্রমাণ দেবেন। এ সময় রাস্তা দিয়ে একজন পাগলকে ফাঁসি দেওয়ার জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। কিছুক্ষণ আগে পাগলটি একটি নিরীহ পথচারীকে খুন করেন। আমিরের দরবারে তাঁকে কোটাল ধরে নিয়ে আসে। সাক্ষ্যপ্রমাণ বিবেচনা করে আমির তাঁকে খুনের দায়ে ফাঁসির আদেশ দেন। লোকটির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে মোল্লা বললেন, হুজুর, কিছুক্ষণ আগে খুনের দায়ে এ পাগলকে আপনি ফাঁসির হুকুম দিয়েছেন? আমির বললেন, ‘হ্যাঁ দিয়েছি, এবং সব সাক্ষ্য শুনেই দিয়েছি। কী বলতে চাও তুমি?’ মোল্লা বললেন, ‘হুজুর, এ ক্ষেত্রে প্রকৃত খুনি কে, এটি ভেবে দেখেছেন কি? সত্য কথা, পাগল নিরীহ মানুষ খুন করেছেন। কিন্তু এ জন্য কি পাগল দায়ী, না যারা তাঁকে পাগল করেছে তারা দায়ী? হুজুর, এই ব্যক্তির স্ত্রী তাঁর সব টাকা-পয়সা নিয়ে পরপুরুষের সঙ্গে চম্পট দিয়েছেন। এতে তিনি পাগল হয়ে যান। অপ্রকৃতিস্থ বলেই তিনি খুন করেছেন। এই খুনের জন্য কি তিনি দায়ী, না তাঁর স্ত্রী দায়ী? হুজুর, এখানেই শেষ নয়। ওই পাগল দোকানে গিয়ে ছুরি কেনেন? দোকানদার কেন পাগলের কাছে ছুরি বিক্রয় করল? এই খুনের জন্য কি দোকানদার দায়ী নয়? হুজুর, পাগলটি যখন ছুরি নিয়ে রাস্তায় নামেন, তখন অনেক লোক দেখতে পায়। তাদের কি দায়িত্ব ছিল না কোতোয়ালকে ডেকে পাগলটিকে নিরস্ত্র করা? খুনের জন্য কি পাগল একাই দায়ী? রাস্তার লোকগুলোর কি কোনো দায়িত্ব ছিল না? হুজুর, এরপর পাগলটি যখন ছুরি নিয়ে নিরীহ ব্যক্তিকে আক্রমণ করেন, তখন রাস্তায় কি অনেক লোক উপস্থিত ছিল না? পাগলের হাত থেকে তারা তো লোকটিকে বাঁচাতে চেষ্টা করতে পারত। এ খুনের জন্য কি তাদের কোনো দায়িত্ব নেই? এবার বলুন হুজুর, আমরা এখানে খুনের দায়িত্ব কীভাবে নিরূপণ করব? সমস্যা শুধু পরম্পরার নয়, কোনো ঘটনা আগে ঘটলেই তাকে পরবর্তী ঘটনার কারণ বলা যাবে না। অনেক ক্ষেত্রে যে উদ্দেশ্যে কোনো কাজ করা হয়, তার উল্টোটাও ঘটতে পারে।’ রুমানিয়ার একনায়ক চসেস্কু জনসমর্থন বাড়ানোর জন্য জন্মনিয়ন্ত্রণের আইনকানুন শিথিল করেন। এতে রুমানিয়ার জনসংখ্যা বেড়ে যায় এবং তরুণ প্রজন্মের সংখ্যা বেড়ে যায়। চসেস্কু আশা করেছিলেন, তরুণ প্রজন্ম তাঁকে সমর্থন করবে। অথচ এই তরুণ প্রজন্মই চসেস্কুকে ক্ষমতা থেকে টেনে নামিয়ে আনে। কী কাজের কী ফল হবে, আগে থেকে সব সময় বলা যায় না। কাজেই শুধু পরিণামের ভিত্তিতে নৈতিকতার সংজ্ঞা নির্ধারণ করা সম্ভব নয়।

প্রথাগত অনুজ্ঞাভিত্তিক কোনো নৈতিক পদ্ধতিই ব্যাংক-ব্যবস্থার নৈতিক ভিত্তির জন্য পর্যাপ্ত নয়, যদিও প্রতিটি পদ্ধতিতেই কিছু গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ রয়েছে। তাই ব্যাংক-ব্যবস্থায় নৈতিকতা হতে হবে বিবিধগ্রাহী (ecletic) ব্যাপক ও অর্জনযোগ্য। প্রায়োগিক দিক থেকে, ব্যাংক-ব্যবস্থায় নৈতিকতা সম্পর্কে চারটি মৌলিক প্রশ্ন রয়েছে: ক. কেন? খ. কে? গ. কী? ঘ. কীভাবে?

ক. কেন?: ব্যাংক-ব্যবস্থার কার্যাবলিতে নৈতিকতাবোধের ওপর জোর দেওয়ার তিনটি যৌক্তিকতা মোটা দাগে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে:

  •  লাভজনক ব্যবসার হাতিয়ার হিসেবে নৈতিকতা
  •  নৈতিকতার জন্য নৈতিকতা
  •  নৈতিকতাই ব্যাংক ব্যবসা

 লাভজনক ব্যবসার হাতিয়ার হিসেবে নৈতিকতা

এই যৌক্তিকতা অনেকাংশে করপোরেট সামাজিক দায়িত্বসংক্রান্ত ভাবধারায় অনুপ্রাণিত। করপোরেট সামাজিক দায়িত্ব হচ্ছে একটি অন্তর্গ্রথিত ও স্বনিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা, যার মাধ্যমে নৈতিক বাধ্যবাধকতা এবং স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক আইনের বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ নিশ্চিত করা হয়। এর মূল বক্তব্য তিনটি ‘পি’ আদ্য অক্ষরযুক্ত ইংরেজি শব্দে বর্ণনা করা যায়। People (মানুষ), Planet (পৃথিবী) ও Profit (মুনাফা)। এর লক্ষ্য হলো ক্রেতা ও সেবা গ্রহণকারীকে (মানুষ) সন্তুষ্ট করা, পরিবেশগত টেকসই কার্যক্রম গ্রহণ করে পৃথিবীকে বাসযোগ্য রাখা এবং সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজনীয় মুনাফা অর্জন। এটি এমন ব্যবস্থা, যাতে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও তার ব্যবহারকারীরা উভয়ই লাভবান হয়। হংকং মুদ্রা কর্তৃপক্ষের ডেভিড কার্স এ প্রসঙ্গে যথার্থই লিখেছেন, ‘ব্যাংকে উঁচুমানের নৈতিকতা বিলাসিতাও নয়, বিমূর্ত ধারণাও নয়। প্রকৃতপক্ষে এ ধরনের নৈতিকতাবোধ ব্যাংকের সুনাম রক্ষা করে ও বাড়িয়ে দেয় এবং দীর্ঘ মেয়াদে এর বাণিজ্যিক সাফল্য নিশ্চিত করে। সঠিকভাবে নৈতিক দায়িত্ব পালন শুধু একটি কর্তব্য নয়, কাজটি লাভজনকও বটে।’

নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এ ধরনের বক্তব্য শূন্যগর্ভ। ভালো ব্যবসা বা মুনাফা যদি করপোরেট সামাজিক দায়িত্বের মূল প্রণোদনা হয়, তবে উচ্চতর মুনাফার জন্য অনৈতিক কাজের বাধা কোথায়? করপোরেট সামাজিক দায়িত্বতত্ত্বের সমালোচকেরা বলে থাকেন, এ তত্ত্ব হচ্ছে একধরনের বিপণি বাতায়নসজ্জা, যার উদ্দেশ্য হলো কোম্পানির বিতর্কমূলক (যথা পরিবেশদূষণ অথবা ক্ষতিকর পণ্য বিপণন) কার্যকলাপ থেকে জনগণের দৃষ্টি সরিয়ে নেওয়া। নৈতিকতাবোধ এবং এ ধরনের কার্যকলাপের সম্পর্ক অতি ক্ষীণ।

নৈতিকতার  জন্য নৈতিকতা

নৈতিকতা নিয়ে কোনো দর-কষাকষি চলে না। নৈতিকতার ক্ষেত্রে কোনো আপসও নেই। হোলি রোমান সম্রাট প্রথম ফার্ডিনান্ড তাই বলতেন, ‘Let justice be done though the world perished’ (পৃথিবী ধ্বংস হয়ে গেলেও ন্যায়বিচার করতে হবে)। অবশ্য পৃথিবী ধ্বংস হলে ন্যায়বিচার কোনো কাজে লাগবে কি না, এ ব্যাপারে তিনি উদ্বিগ্ন নন।

ইসলামিক ব্যাংকের মতো যাঁরা নৈতিক ব্যাংকিংয়ের কথা বলেন, তাঁদের বক্তব্য নৈতিকতা লক্ষ্যে পৌঁছানোর একটি উপায় মাত্র নয়, নৈতিকতাই হচ্ছে লক্ষ্য। এ ধরনের মনোভাবের কয়েকটি দুর্বলতা রয়েছে। প্রথমত, নৈতিক ব্যাংকের কাছে কোনো নৈতিক বিচ্যুতিই গ্রহণযোগ্য নয়। বাস্তব জগতে অনেক ক্ষেত্রেই আপসহীন নৈতিকতার বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ব্যাংক চালানোর জন্য উপযুক্ত নৈতিক গুণাবলিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব পাওয়া যায় না। এতে অনেক ক্ষেত্রেই নৈতিকতা বাণিজ্যিক কার্যকলাপের মুখোশ হিসেবে ব্যবহূত হয়। শেষত, অনেক নৈতিক ব্যাংকের লক্ষ্যগুলো সংকীর্ণমনা, যা শুধু বিশেষ গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য এবং বিশ্বজনীন নয়। উপরন্তু ব্যাংক একটি ব্যবসা। ব্যাংকের মালিকদের ন্যায্য মুনাফা নিন্দনীয় নয়। তাই নৈতিকতার জন্য নৈতিকতা ব্যাংক-ব্যবস্থার কার্যকলাপের একমাত্র নিয়ন্ত্রক হতে পারে না। তবু নৈতিকতা ব্যাংকিং ব্যবসাসহ মানুষের সব কর্মকাণ্ডে একটি বলিষ্ঠ শক্তি হিসেবে ক্রিয়াশীল রয়েছে।

নৈতিকতাই  ব্যাংক ব্যবসা

শুধু উপায় ও লক্ষ্যের দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাংক ব্যবসায় নৈতিকতার ভূমিকা উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। তৃতীয় ঘরানার বক্তব্য হলো, নৈতিকতা ছাড়া ব্যাংক-ব্যবস্থার অস্তিত্বই সম্ভব নয়। ব্যাংক-ব্যবস্থায় নৈতিকতার যে গুরুত্ব রয়েছে, ব্যবসার জগতে অন্য কোথাও তা এত অত্যাবশ্যক নয়। ব্যাংক শুধু অন্য লোকের অর্থ হেফাজতের দায়িত্ব গ্রহণ করে না, ব্যাংক এই প্রত্যাশায় অতিরিক্ত অর্থ সৃষ্টি করে যে ব্যাংক থেকে ওঠানো টাকা আবার নতুন আমানত হিসেবে ফিরে আসবে তাদের ব্যাংকেই। আমানত সংগ্রহ ও নতুন অর্থ সৃষ্টিতে তাদের সাফল্য নির্ভর করে বাজারে ব্যাংকের সুনামের ওপর। ব্যাংক-ব্যবস্থা তাই আমানতকারীদের আস্থার ওপর সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল। ব্যাংকের ওপর আস্থা অটুট রাখার জন্য ব্যাংক অনির্ভরযোগ্য ঋণগ্রহীতাকে এবং অলাভজনক ব্যবসাকে ঋণ মঞ্জুর করতে পারে না। নির্ভরযোগ্য গ্রহীতাদের সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে ব্যাংকগুলো পারস্পরিক আস্থার বলয় সম্প্রসারণ করে। ব্যাংকের ওপর অটুট আস্থা একটি শুভ চক্রের সৃষ্টি করে এবং পারস্পরিক আস্থার সম্প্রসারণের ফলে অর্থব্যবস্থায় লেনদেন ত্বরান্বিত হয়। পক্ষান্তরে বিশ্বাসের খেলাপ দুষ্টচক্রের সৃষ্টি করে, যাতে ব্যাংক-ব্যবস্থায় আতঙ্ক ও টাকা তুলে নেওয়ার হিড়িক দেখা দেয়। এ ধরনের বাজার-বিশৃঙ্খলা সারা অর্থব্যবস্থায় ছোঁয়াচে রোগের মতো ছড়িয়ে পড়ে। ব্যাংকের সঙ্গে বড় গ্রাহকদের লেনদেন বাজার নিবিড়ভাবে পরিবীক্ষণ করে। সন্দেহজনক ব্যবসায় ব্যাংকের আপত্তিকর সংযোগ শুধু ব্যাংকের বিশ্বাসযোগ্যতার মানই কমিয়ে দেয় না, তা সামগ্রিক অর্থব্যবস্থাকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে। ব্যাংকের নিজের আচরণ প্রশ্নাতীত হওয়াই যথেষ্ট নয়। সাধারণ প্রত্যাশা এই যে, ব্যাংকগুলো অবাঞ্ছিত গ্রাহক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চিহ্নিত করে সামগ্রিক অর্থব্যবস্থার অতন্দ্রপ্রহরী হিসেবে কাজ করবে।

খ. কে?: মোটা দাগে ব্যাংক খাতে মূল সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীরা তিন পর্যায়ের হতে পারেন:

  •  করপোরেট
  •  যৌথ
  •  ব্যক্তি

 করপোরেট পর্যায়ে নৈতিকতা

ব্যাংক যদিও একটি কৃত্রিম সত্তা, তবু একে নৈতিক দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া সম্ভব নয়। কৃত্রিম সত্তা হওয়া সত্ত্বেও ব্যাংকের লেনদেন প্রকৃত মানুষের সঙ্গে। নীতিশাস্ত্রের একটি মৌল অনুজ্ঞা হলো, প্রত্যেকেই অন্যের কাছ থেকে ন্যায় আচরণ প্রত্যাশা করে এবং বিনিময়ে অন্যদের সঙ্গে লেনদেনেও তার পক্ষ থেকে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে। যদি আইনের সৃষ্ট কৃত্রিম সত্তাগুলো নৈতিকতা অগ্রাহ্য করে, তবে নৈতিকতার পারস্পরিক নির্ভরশীলতা ও পারস্পরিক বিশ্বাস ভেঙে পড়বে। এ কথা সত্য, আইনের সৃষ্ট কৃত্রিম সত্তাগুলোর কোনো বিবেকের তাড়না নেই। কাজেই ব্যাংকের ক্ষেত্রে নৈতিক দায়িত্ব শুধু সব আইন ও বিধি প্রতিপালনে সীমিত। কিন্তু সব নৈতিক বিষয় আইনের অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব নয়। কাজেই নৈতিক দিক থেকে ব্যাংকগুলোর জন্য নির্ধারিত বিধিবিধান অসম্পূর্ণ। তবে করপোরেট সত্তা হিসেবে ব্যাংকের সব ক্রিয়াকাণ্ড পরিচালিত হয় না। ব্যাংকের পক্ষে মানুষই কাজ করে। এ ক্ষেত্রে যেসব প্রকৃত মানুষ ব্যাংক পরিচালনা করেন, তাঁদেরও বহুলাংশে দায়িত্ব রয়েছে। তাঁরা ব্যক্তিগতভাবে ও যৌথভাবে দায়ী।

যৌথ পর্যায়ে নৈতিকতা

প্রতিষ্ঠানের বাইরের জগত্ ও প্রতিষ্ঠানের ভেতরের পরিবেশ ও সম্পর্কের ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনার সিদ্ধান্তে নৈতিকতার প্রয়োগ যৌথ নৈতিকতার বিষয়।৯ এটি হচ্ছে আইনের ঘোমটা ছাড়া করপোরেট নৈতিকতার মানবিক রূপ। যৌথ নৈতিক দায়িত্ব বোর্ডের সদস্য ও সর্বোচ্চ ব্যবস্থাপনার—যাঁরা ব্যাংক চালান তাঁদের—সম্মিলিত দায়িত্বের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে। ব্যাংকগুলো নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠান। অনেক ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রকদের ভুলভ্রান্তি ব্যাংকে অনৈতিক কাজ উত্সাহিত করতে পারে। এ ক্ষেত্রে নৈতিকতার খেলাফের জন্য নিয়ন্ত্রকেরাও দায়ী বলে বিবেচিত হবেন।

ব্যক্তিগত পর্যায়ে নৈতিকতা

আদর্শ ব্যবস্থায় ব্যাংকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে নৈতিকতা নিশ্চিত করার জন্য ব্যাংকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব ব্যক্তিকে নৈতিক আদর্শ ও রীতিনীতি মেনে চলতে হবে। এ ধরনের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দুই ভাগে ভাগ করা যায়— প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ। প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা হচ্ছেন ব্যাংকের পরিচালক থেকে দারোয়ান পর্যন্ত সব কর্মকর্তা-কর্মচারী। পরোক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন আমানতকারী, ঋণগ্রহীতা এবং ব্যাংকের লেনদেনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যে কেউ। পরোক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট সব ব্যক্তি নৈতিকতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল না-ও হতে পারেন। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকের দায়িত্ব হচ্ছে পরোক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট অনৈতিক ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা এবং তাদের সঙ্গে লেনদেন বন্ধ করা বা সীমিত রাখা। শুধু প্রত্যক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নৈতিকতা বাস্তবায়নই যথেষ্ট নয়। মোটামুটিভাবে নৈতিকতাকে দুটি দৃষ্টিকোণ থেকে সংজ্ঞায়িত করা যেতে পারে—সামগ্রিকতাবাদ (holism) আর ন্যূনতমবাদ (Minimalism)। প্রথমত, সামগ্রিকতাবাদ বিশ্বাস করে, সর্বকালের সব মানুষ ও প্রকৃতি একটি অচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ। ব্যক্তি বলতে শুধু আজকের জীবিত ব্যক্তিদেরই বোঝায় না, এর মধ্যে ভবিষ্যত্ প্রজন্মকেও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। প্রকৃতি সম্পর্কেও আমাদের বৃহত্তম পরিসরে চিন্তা করতে হবে। দ্বিতীয়ত, সামগ্রিকতাবাদ মনে করে, মানুষ স্বেচ্ছায় ভালো কাজ করে, আইন রীতি বা আচার মানতে বাধ্য হয়ে মানুষ নৈতিক দায়িত্ব পালন করে না। তবে সমস্যা হলো, এত ব্যাপক নৈতিকতার বাস্তবায়ন অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব নয়। অর্থনীতিবিদেরা তাই সামগ্রিকতাবাদী নৈতিকতার স্থলে অসম্পূর্ণ নৈতিকতা মেনে নেন। বুকানন যুক্তি দিয়েছেন, সামাজিক শান্তির জন্য প্রয়োজন সবার কাছে গ্রহণযোগ্য সর্বনিম্ন নৈতিক মানগুলো।১০ অমর্ত্য সেন তাঁর The Idea of justice গ্রন্থে ন্যায়পরায়ণতার সামগ্রিকতাবাদী সংজ্ঞার ক্ষেত্রে আপত্তি করেছেন।১১ তিনি মনে করেন, ন্যায়পরায়ণতা চিরদিনই অসম্পূর্ণ থেকে যাবে, কেননা সব তথ্য কখনো পাওয়া যাবে না। উপরন্তু বিভিন্ন বিপরীতমুখী বিষয়ের সামঞ্জস্যতা নিয়ে বিচারকদের মতবিরোধ থাকবেই। তাই সব তথ্য পাওয়া গেলেও ন্যায়ের পূর্ণাঙ্গ সংজ্ঞা দেওয়া সম্ভব নয়। ন্যায়পরায়ণতার মতো ব্যাংক-ব্যবস্থায়ও নৈতিকতা অসম্পূর্ণ থাকবে। উপরন্তু ব্যাংক-ব্যবস্থার নৈতিক লক্ষ্যগুলো স্থির নয়, অর্থব্যবস্থা এবং সমাজের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে লক্ষ্যগুলো পরিবর্তিত হবে। ব্যাংক-ব্যবস্থার নৈতিক লক্ষ্যগুলো প্রতিনিয়ত নতুন করে নির্ধারণ করতে হবে।

গ. কী: ব্যাংকের নৈতিক দায়িত্ব সম্পর্কে দুই ধরনের চরমপন্থী মতামত রয়েছে। প্রচলিত ধারণা হচ্ছে, ব্যাংকের দায়িত্ব হলো আইন ও বিধি দ্বারা নির্ধারিত শর্ত পালন সাপেক্ষে সর্বাধিক মুনাফা অর্জন করা। এই ধারণার মূলে রয়েছে করপোরেট সামাজিক দায়িত্ব সম্পর্কে মিল্টন ফ্রিডম্যানের মতবাদ। মিল্টন ফ্রিডম্যান লিখেছেন, ‘আমি বলেছি, ব্যবসার একটি এবং মাত্র একটি সামাজিক দায়িত্ব রয়েছে অর্থাত্, আইনের আওতায় থেকে এবং কোনো প্রতারণা বা জালিয়াতি না করে মুক্ত ও স্বাধীন প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ব্যবসার মুনাফা বৃদ্ধির জন্য তার সব সম্পদ ও কর্মকাণ্ড নিয়োজিত করা।’১২ বাজার অর্থনীতির নিয়মাবলি আইন ও বিধিতে রয়েছে। ব্যাংকের আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষার জন্য আইন রয়েছে, তবে ন্যায়বিচার, সুযোগের সমতা এবং দুর্বলের জন্য বিশেষ সুযোগের যথেষ্ট ব্যবস্থা ফ্রিডম্যানের বাজার অর্থনীতিতে নেই।

আরেক চরমপন্থী মতবাদ নৈতিক ব্যাংক (ethical bank); যা বিকল্প ব্যাংক, সামাজিক ব্যাংক এবং সমমনা ব্যক্তিদের অর্থায়ন (affinity finance) নামে পরিচিত। নৈতিকতা এসব প্রতিষ্ঠানের কার্যপ্রণালি নয়, নৈতিকতা হচ্ছে এসব প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্বের ভিত্তি। এসব প্রতিষ্ঠান অর্থের ভুবনে নৈতিক, ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধের আলোকবর্তিকা তুলে ধরতে চায়। নৈতিক ব্যাংক সমমনা ব্যক্তিদের জন্য মূল্যবোধভিত্তিক আর্থিক সেবা প্রদান করে। সমবায় ব্যাংক, ইসলামি ব্যাংক এবং ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী অলাভজনক প্রতিষ্ঠানগুলো এই শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের কয়েকটি বড় দুর্বলতা রয়েছে। নৈতিক ব্যাংক অথবা সমমনাদের অর্থায়ন গোটা অর্থব্যবস্থার একটি অতি নগণ্য অংশ। এরা যখন বাইরের ব্যাংকগুলোর সঙ্গে লেনদেন করে, তখন তাদের প্রচলিত ব্যাংক-ব্যবস্থায় নিয়মকানুনের মধ্যেই কাজ করতে হয়। এ কথাও সত্য নয়, নৈতিক ব্যাংকগুলো সব নৈতিক দায়িত্ব পালন করে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, ইসলামি ব্যাংকগুলো সমাজে ধনবৈষম্য সম্পর্কে উদাসীন। এদের অনেকেই তাদের লাভও দারিদ্র্য নিরসনে ব্যয় করে না।

চিরাচরিত ব্যাংক-ব্যবস্থার সঙ্গে নৈতিক ব্যাংক-ব্যবস্থায় দায়িত্ব একত্র করে সি জে কাউটন (C. J. Cowton) অভিমত প্রকাশ করেছেন, ব্যাংকের নৈতিক দায়িত্ব হলো তিনটি: ১. সততার সঙ্গে ব্যাংক পরিচালনা, ২. ঋণদানে দায়িত্বশীল থাকা এবং ৩. সমমনাদের আদর্শ বাস্তবায়ন করা।১৩ ব্যাংক-ব্যবস্থা টিকে থাকতে হলে ও সমৃদ্ধ হতে হলে যে আস্থার প্রয়োজন, তা সৃষ্টির জন্য সততা অত্যাবশ্যক। ব্যাংকের ঝুঁকি কমানোর জন্য দায়িত্বের সঙ্গে ঋণ দেওয়াও জরুরি। সততার সঙ্গে ব্যাংক পরিচালনা ও দায়িত্বশীলভাবে ঋণ প্রদান ব্যাংকের জন্য শুধু নৈতিক দায়িত্ব নয়, আইনগত বাধ্যবাধকতাও বটে। গতানুগতিক ব্যাংক-ব্যবস্থায় টিকে থাকার জন্য এগুলো পূর্বশর্ত। সমমনাদের মূল্যবোধের ভিত্তিতে পরিচালিত ব্যাংকগুলো সামাজিক বা বিকল্প ব্যাংক হিসেবে পরিচিত। এসব ব্যাংক আর্থিক মুনাফার চেয়ে সামাজিক মূল্যবোধের ওপর বেশি জোর দেয়। তবে এরা গতানুগতিক ব্যাংকের জন্য মোটেও হুমকি নয়। এরা মুনাফাভিত্তিক ব্যাংকের সঙ্গে সহজেই সহাবস্থান করতে পারে। কিন্তু নৈতিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে নৈতিক দায়িত্ব নিয়ে মতদ্বৈধতা রয়েছে। এরা সবাই বিশ্বজনীন নৈতিকতায় বিশ্বাস করে না। এদের নৈতিক দায়িত্বের সংজ্ঞা তাদের গোষ্ঠীগত বিশ্বাসের ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়। কাউটনের এই বিশ্লেষণ ব্যাংকগুলোর নৈতিক দায়িত্ব নির্ধারণের জন্য যথেষ্ট নয়।

ব্যাংকগুলোর নৈতিক দায়িত্ব বাস্তবায়নের জন্য গতানুগতিক ব্যাংক বা নৈতিক ব্যাংক কোনোটিই যথেষ্ট নয়। ব্যাংকগুলোর দায়িত্ব দুই ভাগে বিভক্ত করা যায়—মুখ্য ও গৌণ। মুখ্য দায়িত্ব হচ্ছে সেসব দায়িত্ব, যা সঠিকভাবে প্রতিপালিত না হলে ব্যাংক আদৌ টিকে থাকতে পারবে না। এসব দায়িত্বের মধ্যে রয়েছে আমানতের হেফাজত এবং ঋণদানে যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন। গৌণ দায়িত্বগুলো প্রতিপালন না করলে ব্যাংকের আর্থিক সাফল্য প্রভাবান্বিত হবে না, তবে তার নৈতিক দায়িত্ব অপূর্ণ থেকে যাবে। নৈতিক দিক থেকে মুখ্য ও গৌণ উভয় দায়িত্বেরই গুরুত্ব সমান। তবে যেহেতু ব্যাংক টিকে না থাকলে অন্য দায়িত্ব পালন সম্ভব হবে না এবং মুখ্য দায়িত্ব পালন না করলে ব্যাংক টিকে থাকবে না, সেহেতু ব্যাংকের দায়িত্ব মুখ্য ও গৌণ দুই ভাগে বিভক্ত করার প্রস্তাব করা হচ্ছে।

অমর্ত্য সেনের ন্যায়পরায়ণতা-সম্পর্কিত তত্ত্বের আলোকে ব্যাংক-ব্যবস্থার গৌণ নৈতিক দায়িত্ব নির্ধারণ করা যেতে পারে। অমর্ত্য সেন মনে করেন, ন্যায়পরায়ণতার সঠিক সংজ্ঞা কখনো নির্ণয় করা যাবে না। কিন্তু ন্যায়পরায়ণতার সঠিক সংজ্ঞা নেই, এই অজুহাতে সুস্পষ্ট অবিচার (manifest injustice) চলতে দেওয়া যায় না। অমর্ত্য সেনের বক্তব্যের প্রতিধ্বনি করে বলা যেতে পারে, ব্যাংকের নৈতিক দায়িত্ব হচ্ছে ‘সুস্পষ্ট অবিচার হ্রাস করা’, কিন্তু ‘সুস্পষ্ট অবিচার’ ধারণাটি আপাতদৃষ্টিতে ছলনাময়, এর কোনো সংজ্ঞা নেই।১৪ তবে এতে হতাশ হওয়ার কারণ নেই। আদালতে এ ধরনের অস্পষ্ট ধারণা অনেক ক্ষেত্রেই ব্যবহূত হচ্ছে। অমর্ত্য সেনের ‘সুস্পষ্ট অবিচারের’ ধারণাটি বিচারপতি পটার স্টুয়ার্টের (Potter Stewart) অনুকরণ করে পাঁড় অশ্লীলতার সংজ্ঞার সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। বিচারপতি স্টুয়ার্ট লিখেছেন, ‘I shall not attempt further to define the kinds of material I understand to be embraced within that shorthand description (hardcore pornography) and perhaps could never succeed in intellingibly doing so. But I know when I see it’ (পাঁড় অশ্লীলতা শিরোনামে কী ধরনের উপাদান অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত মনে করি, আমি তা সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করব না এবং করতে চাইলেও আমি সবার জন্য বোধগম্য সংজ্ঞা প্রণয়ন করতে সমর্থ হব না। তবে আমি যখন উপাদানটি দেখতে পাই, তখন আমি জানি, আমি কী দেখছি।’)১৫ অবশ্য সুস্পষ্ট অবিচারের কোনো তালিকাই সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। কোনো কোনো গোষ্ঠী (যথা ইসলামিক ব্যাংকের প্রবক্তারা) তাঁদের ধর্মীয় বিশ্বাসের আলোকে সুস্পষ্ট অবিচারের সংজ্ঞা নির্ধারণ করেন। আবার অনেকে ধর্মীয় বিশ্বাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে বিশ্বজনীন নৈতিকতার আলোকে সুস্পষ্ট অবিচার নির্ধারণের চেষ্টা করে থাকেন। এসব মতবিরোধ সত্ত্বেও যেসব নৈতিক ঘাটতি সুস্পষ্ট অবিচারের জন্ম দেয়, তার একটি মোটামুটি তালিকা প্রণয়ন সম্ভব। একটি দৃষ্টান্তমূলক তালিকা নিম্নরূপ হতে পারে:

১. মুষ্টিমেয় লোকের জন্য অতিরিক্ত ঋণসুবিধা প্রদান। এ কাজ ঝুঁকিপূর্ণ। যদি বড় ঋণগ্রাহকদের ব্যবসায় মন্দা দেখা দেয়, তবে ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে যেতে পারে। এতে বড়লোকেরা আরও ফুলেফেঁপে ওঠে এবং দরিদ্ররা নিঃস্বতর হয়। অনেক ক্ষেত্রে এ ধরনের ঋণব্যবস্থা সম্পর্কভিত্তিক পুঁজিবাদের (relational capitalism) জন্ম দেয়, যেখানে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আশীর্বাদপুষ্ট একই মালিক আর্থিক, শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর একচেটিয়া ব্যবসা বাজারে প্রতিষ্ঠা করে এবং সমগ্র অর্থনীতিতে আধিপত্য স্থাপন করে।

২. দরিদ্রের জন্য অপ্রতুল ঋণ। এতে দরিদ্রদের মৌলিক অধিকার হরণ করা হয়। এ ব্যবস্থা নৈতিক দিক থেকে সম্পূর্ণ অগ্রহণীয়।

৩. অতিরিক্ত ঝুঁকি গ্রহণ। যত বেশি ঝুঁকি, তত বেশি মুনাফা, ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগের লোকসানের দায়িত্ব বর্তায় আমানতকারীদের ওপর। কেননা ঝুঁকির কারণে ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে যেতে পারে।

৪. পরিবেশ দূষণ। ইচ্ছাকৃতভাবে পরিবেশ দূষিত করে, এ ধরনের প্রতিষ্ঠানকে ঋণ প্রদান।

৫. মানবাধিকার লঙ্ঘন। মানবাধিকার লঙ্ঘন করে এমন প্রতিষ্ঠানে ঋণদান এবং গণহত্যার জন্য অভিযুক্ত রাষ্ট্রকে ঋণদান সুস্পষ্ট অবিচার।

৬. দুর্বল, বঞ্চিত ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য ইতিবাচক কর্মসূচির অনুপস্থিতি। এর জন্য ব্যাংকগুলোর মানসিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে হবে। এ কথা মোটেও ঠিক নয়, দরিদ্র ও সুযোগবঞ্চিত ব্যক্তিরা বিত্তবানদের চেয়ে কম দায়িত্বশীল।

৭. ব্যাংকের মালিক ও কর্মকর্তাদের অন্যায় আচরণ। ব্যাংকের সব মালিক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যাতে কোনো অন্যায় না করেন, তা নিশ্চিত করতে হবে। এটি একই সঙ্গে ব্যক্তিগত ও যৌথ দায়িত্ব।

সুস্পষ্ট অবিচার চিহ্নিত করাই যথেষ্ট নয়। নৈতিক বাধ্যবাধকতা হিসেবে এদের হ্রাস করার লক্ষ্যে তিনটি সমস্যার সমাধান করতে হবে। প্রথমত, অনেক সময় একটি সুস্পষ্ট অবিচার কমাতে গেলে অন্য একটি সুস্পষ্ট অবিচার বেড়ে যেতে পারে। ধরুন, দরিদ্রদের ঋণ দিতে গেলে ব্যাংকের ব্যয় ও ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে। ঝুঁকি বেড়ে গেলে আমানত বিপন্ন হতে পারে। এ ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য ঝুঁকির মাত্রা ব্যাংককে নির্ধারণ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, ব্যাংক কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে কি শুধু ঋণের প্রত্যক্ষ ফলাফল বিবেচনা করবে, না পরোক্ষ পরিণামও বিবেচনা করবে? ধরুন, একটি খবরের কাগজের মালিক বর্ণবাদী রাজনীতিবিদদের আর্থিক পোষকতা করেন, কিন্তু কাগজে বর্ণবাদের প্রতি কোনো পক্ষপাত দেখা যায় না। এ ক্ষেত্রে কি কোনো ব্যাংকের পক্ষে কাগজটিকে ঋণ দেওয়া নৈতিক হবে? সবশেষে ব্যাংকের আমানতকারীদের মধ্যে নৈতিক প্রশ্নে মতবিরোধ থাকতে পারে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, কোনো ব্যাংক যদি সমকামীদের জন্য কোনো বিশেষ ঋণসুবিধা দেয়, তা শিল্পায়িত দেশগুলোতে সমাদৃত হবে। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশগুলোতে যেখানে ধর্মের প্রাধান্য রয়েছে, সেখানে নিন্দিত হবে। উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে কাজ করে, এমন একটি বহুজাতিক ব্যাংক এ ধরনের দ্বন্দ্ব কীভাবে নিরসন করবে? এসব সমস্যার কোনো সর্বজনীন সমাধান নেই। প্রতিটি ব্যাংককে নিজস্ব অভিজ্ঞতার আলোকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

ঘ. কীভাবে?:  দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল নৈতিকতা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে যথার্থই লিখেছেন, ‘We have in fact, two kinds of morality side by side. One which we preach but do not practice and another which we practice but seldom preach’ (পাশাপাশি দুই ধরনের নৈতিকতা রয়েছে। একটি নৈতিকতা হচ্ছে, যা আমরা প্রচার করি, অথচ আমল করি না। আরেকটি নৈতিকতা হলো, যা আমরা আমল করি, কিন্তু প্রকাশ্যে কদাচিত্ স্বীকার করি)।১৬ নৈতিকতার আদর্শ ও আমলের মধ্যে তাই রয়েছে প্রচণ্ড ফারাক। কাজেই নৈতিকতার প্রয়োগ কীভাবে নিশ্চিত করা যায়, সেটা একটি বড় প্রশ্ন।

ব্যাংক-ব্যবস্থায় নৈতিক দায়িত্ব তিনভাবে বলবত্ করা যেতে পারে। প্রথমত, অনেক ক্ষেত্রে আইন, বিধি, প্রবিধি বা নৈতিক চাপ সৃষ্টি করে রাষ্ট্র এবং তার অধীন প্রতিষ্ঠানগুলো নৈতিকতার কোনো কোনো অনুজ্ঞা বলবত্ করে। আইন করার সুবিধা হলো, এর বাস্তবায়নের দায়িত্ব রাষ্ট্র গ্রহণ করে। তবে যেহেতু এসব বাধানিষেধ ওপর থেকে আরোপিত হয়, অনেক ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো আইনের ফাঁকফোকর বের করে অথবা নিয়ন্ত্রককে প্রতারণা করে নৈতিক দায়িত্ব এড়ানোর চেষ্টা করে।

দ্বিতীয়ত, নৈতিক দায়িত্বগুলো বাস্তবায়নের জন্য কোনো ব্যাংক একা অথবা কতিপয় ব্যাংক একত্রে আচরণ বিধিমালা প্রণয়ন করতে পারে। এ ধরনের আচরণ বিধিমালা যেসব নৈতিক প্রশ্নের ক্ষেত্রে আইন নীরব, সেসব ক্ষেত্রে নির্দেশ দিতে পারে। তবে এসব আচরণ বিধিমালা ভেতর থেকে ব্যাংককেই বলবত্ করতে হবে।

তৃতীয়ত, আইন ও আচরণবিধি যথেষ্ট নয়। নৈতিকতা বলবত্ করার জন্য বিবেকের তাড়না থাকতে হবে। আইন ও আচরণবিধি বাস্তবায়ন করে ব্যক্তি। কাজেই চূড়ান্ত বিচারে নৈতিক বাধ্যবাধকতা মেনে চলার মূল দায়িত্ব হলো ব্যাংক যাঁরা চালান তাঁদের। এটা শুধু তাঁদের যৌথ দায়িত্ব নয়, এটা তাঁদের ব্যক্তিগত নৈতিক দায়িত্বও বটে। কোনো একটি বিশেষ ব্যবস্থাই আর্থিক প্রতিষ্ঠানে নৈতিকতা বলবত্ করার জন্য যথেষ্ট নয়। ব্যাংক-ব্যবস্থার নৈতিকতা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন করপোরেট, যৌথ ও ব্যক্তি পর্যায়ে যৌথ উদ্যোগ এবং আর্থিক লেনদেনের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা ও স্পষ্ট অবিচার নিরসনের জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া।

৩. শিল্পোন্নত দেশগুলোতে ব্যাংক-ব্যবস্থায় নৈতিকতা  বলবত্  করার  অভিজ্ঞতা

প্রতিটি ব্যাংকের আর্থিক সুস্থতা অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সুষ্ঠু ক্রিয়াকলাপে সবার স্বার্থ নিবিড়ভাবে জড়িত। ব্যাংকের ওপর আস্থায় চিড় ধরলে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে এবং এর ছোঁয়াচে প্রভাব সামষ্টিক অর্থনীতিতে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে পারে। সারা পৃথিবীতেই তাই ব্যাংক প্রতিষ্ঠানগুলো নিবিড়ভাবে নিয়ন্ত্রিত। সরকারের দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাংকে লেনদেন নিরাপদ রাখার প্রাথমিক দায়িত্ব সুস্পষ্ট অবিচার নিরসনের গৌণ দায়িত্বের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

সাম্প্রতিককালে অর্থব্যবস্থার স্থাপত্য তিনটি স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। এগুলো হচ্ছে আমানত বিমা, পুঁজির প্রতুলতা এবং বিচক্ষণবিধির ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ। উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর অভিজ্ঞতা থেকে এ কথা প্রতীয়মান হয়, চিরাচরিত ব্যবস্থাগুলো ব্যাংকে বিপন্ন অবস্থা এবং সামগ্রিক অর্থব্যবস্থায় পৌনঃপুনিক সংকট রোধ করার জন্য যথেষ্ট নয়।

আমানত বিমা

আমানত বিমা একটি দুফলাবিশিষ্ট তরবারি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি একই সঙ্গে আশীর্বাদ ও অভিশাপ। আপাতদৃষ্টিতে আমানত বিমা আমানতকারীদের আশ্বস্ত করে। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে এ বিমার দুটি অবাঞ্ছিত প্রভাব দেখা দেয়। অর্থনীতিবিদেরা এ প্রভাব দুটির নাম দিয়েছেন বিরূপ নির্বাচন (adverse selection) ও নৈতিক ঝুঁকি (moral hazard)।১৭ আমানত বিমার ফলে ব্যাংকের অর্থ গচ্ছিত রাখার ঝুঁকি আমানতকারীদের ওপর থেকে সরকারের ওপর বর্তায়। তাই আমানতকারীরা অর্থনৈতিক দিক থেকে নিরাপদ ব্যাংক বেছে নিতে কোনো আগ্রহ বোধ করেন না। ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাংকে অতিরিক্ত ফিরতি বা মুনাফা পাওয়া গেলে তাঁরা ঝুঁকি অগ্রাহ্য করে সেখানেই বিনিয়োগ করেন। কেননা, ব্যাংক দেউলিয়া হলে সরকার আমানতকারীকে ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য। আমানত বিমা তাই দুর্বল অবাঞ্ছিত প্রতিষ্ঠানগুলোতে অতিরিক্ত বিনিয়োগে আকৃষ্ট করে। অন্যদিকে ব্যাংকগুলো জানে, তারা দেউলিয়া হয়ে গেলে সরকার তাদের দায়দায়িত্ব গ্রহণ করবে। ফলে ব্যাংকগুলোর ঝুঁকি গ্রহণের প্রবণতা বেড়ে যায়। অর্থনীতিবিদেরা এ পরিস্থিতিকে ‘নৈতিক ঝুঁকি’ হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকেন। আমানত বিমা তাই কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঝুঁকি হ্রাস করলেও অনেক ক্ষেত্রে ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।

পুঁজির পর্যাপ্ততা

ব্যাংকের মালিকেরা যাতে অতিরিক্ত ঝুঁকি না নিতে পারেন, তার জন্য পুঁজির পর্যাপ্ততার বিধান করা হয়েছে। কিন্তু এ ব্যবস্থার সাফল্য নির্ভর করে ব্যাংকে ঝুঁকির সংজ্ঞার ওপর। সংজ্ঞায় ফাঁকফোকর থাকলে কম পুঁজি নিয়ে বেশি ঝুঁকি নেওয়া যায়। উপরন্তু ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগের হিসাব সম্পর্কে যথাসময়ে প্রয়োজনীয় তথ্য না পাওয়া গেলে এবং ঋণ নিয়ন্ত্রণসংক্রান্ত বিধিগুলোর দুর্বলতার ফলে পুঁজির পর্যাপ্ততা সম্পর্কে বিধানগুলো সব সময় ঈপ্সিত ফল বয়ে আনে না। সারা বিশ্বে ব্যাংক ব্যবস্থা আজ তাই অগ্নিপরীক্ষার সম্মুখীন। সাপ্তাহিক দি ইকোনমিস্ট তাই লিখেছে: ‘ব্যাংক একটি ব্যর্থ শিল্প। এদের দায়িত্ব ছিল স্বল্পব্যয়ে ঋণ সরবরাহ করা, এরা নিজেরাই এখন লেনদেনের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছে।’

কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর তত্ত্বাবধানের ব্যর্থতা

ব্যাংক-ব্যবস্থায় সাম্প্রতিক সংকট ও কেলেঙ্কারির ফলে সনাতন ব্যাংক-ব্যবস্থার পুনর্মূল্যায়নের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। এ সম্পর্কে সাম্প্রতিক গবেষণায় ব্যাংক তত্ত্বাবধানে নিম্নলিখিত চারটি বিষয়ে ব্যর্থতা প্রাধান্য পেয়েছে। বিষয়গুলো নিম্নরূপ:

  •  ঝুঁকি গ্রহণ
  •  তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণের অপ্রতুলতা
  •  ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতা
  •  বিকল্প ব্যাংক-ব্যবস্থার অনুপস্থিতি

 অত্যধিক ঝুঁকি

ব্যাংকের ক্রিয়াকলাপে ঝুঁকি হচ্ছে সবচেয়ে বড় নৈতিক সংকট। ঝুঁকি ছাড়া ব্যাংক-ব্যবস্থা অকল্পনীয় ও অকার্যকর। ঝুঁকি এড়ালে মুনাফা হ্রাস পায়। আবার অতিরিক্ত মুনাফা অর্জন করতে গেলে অনেক ক্ষেত্রে ভয়ংকর ক্ষতি হতে পারে, যা ব্যাংকের অস্তিত্ব বিপন্ন করে তোলে। ব্যাংক-ব্যবস্থায় অত্যধিক ঝুঁকি স্পষ্টতই নৈতিক দায়িত্বের খেলাপ।

সম্প্রতি আর্থিক খাতে বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তনের ফলে ব্যাংকের ঝুঁকির মাত্রা বেড়ে গেছে। প্রথমত, প্রয়োজনীয় খুচরা ব্যাংক (utility retail bank) এবং অতি ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ ব্যাংকের (casino investment bank) প্রভেদ ঘুচে গেছে। সাদামাটা খুচরা ব্যাংকও অনেক ঝুঁকি নিচ্ছে। দ্বিতীয়ত, বিশ্বায়নের ফলে ব্যাংকগুলোর জন্য নতুন সুযোগ সৃষ্ট হচ্ছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে অপরিচিত বাণিজ্যিক পরিবেশে কাজ করতে হচ্ছে। তাই এরা অতিরিক্ত ঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছে। শেষত রয়েছে বিনিয়োগের নতুন নতুন ঝুঁকিপূর্ণ খাত। যে সম্পদ এখনো সৃষ্টি হয়নি, ভবিষ্যতে সৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে, তার ওপর চুক্তি (derivatives) করছে এবং এ-সংক্রান্ত ঝুঁকি বিভক্ত করে তার দায়িত্ব গ্রহণ (securitization) করছে ব্যাংকগুলো।

এসব পরিবর্তনের ফলে ব্যাংক পরিচালনাসংক্রান্ত মূল নীতিগুলো ঢেলে সাজানোর প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে, দুটি বিষয় জরুরি সংস্কারের জন্য চিহ্নিত হয়েছে। প্রথমত, ব্যাসেল-২ ও ৩ নীতিমালায় প্রদত্ত ঋণের ঝুঁকির ভিত্তিতে পুঁজির পর্যাপ্ততা নতুন সংজ্ঞা অনুসারে নির্ধারণ করা হয়েছে। সাধারণত এসব নীতিমালার তাত্পর্য এই যে, যত বেশি ঝুঁকি তত বেশি পুঁজি থাকতে হবে, যাতে ব্যাংক সচ্ছল ও কার্যকর থাকে।১৮

দ্বিতীয়ত, নিরীক্ষা প্রতিবেদনে নির্ভুল তথ্য না পাওয়া গেলে ঝুঁকি হ্রাসের জন্য কোনো অর্থবহ ব্যবস্থা সম্ভব নয়। হিসাবসংক্রান্ত সাম্প্রতিক কেলেঙ্কারিগুলো বহির্নিরীক্ষকদের বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষুণ্ন করেছে। নিরীক্ষার স্বাধীনতা ও কার্যকারিতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ২০০২ সালে যুক্তরাষ্ট্রে সারবেইনস অকসলি আইন, যার পোশাকি নাম হচ্ছে Public Company Accounting Reform and Investor Protection Act. of 2000, জারি করা হয়েছে। এ আইনে নিরীক্ষা তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি স্বাধীন এবং নিরপেক্ষ বোর্ড স্থাপন করা হয়েছে। এ বোর্ডের আনুষ্ঠানিক নাম হচ্ছে The Public Company Accounting Oversight Board। এ ছাড়া নিরীক্ষক ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সম্পর্ক, নিরীক্ষক পরিবর্তন, নিরীক্ষা নয় এমন কাজে নিরীক্ষকদের সংশ্লিষ্টতা এবং করপোরেট জগতে অনিয়মের তথ্য ফাঁসকারীদের (whistle blowers) নিরাপত্তা সম্পর্কে এরই মধ্যে বিধি প্রণীত হয়েছে।১৯

এসব বিস্তারিত সংস্কার সত্ত্বেও ২০০৭-০৯ সময়কালে আর্থিক সংকটের সময় বিপন্ন ব্যাংকগুলোকে বিপুল সরকারি আর্থিক সহায়তা ও ঋণ দিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে হয়েছে। ২০০৯ সালে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাজারের তত্ত্বাবধান বা সতর্কতামূলক তত্ত্বাবধান কোনোটিই ব্যাংকে অত্যধিক ঝুঁকি হ্রাস করতে পারেনি।২০ বাইরে থেকে চাপানো বিধি বা তত্ত্বাবধান কোনোটিই ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণের জন্য যথেষ্ট নয়। ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণের কোনো সহজ পন্থা নেই। সম্পূর্ণরূপে ঝুঁকি এড়ানোর চেষ্টা ব্যাংকে সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনশীলতা ব্যাহত করে। অত্যধিক ঝুঁকি কখনো কখনো অপ্রত্যাশিত মুনাফার সুযোগ সৃষ্টি করলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মর্মান্তিক ব্যর্থতার সৃষ্টি করে। বার্নস্টাইন যথার্থই মন্তব্য করেছেন, ঝুঁকি বিধির বিধান নয়, ঝুঁকি হচ্ছে ব্যক্তির নিজস্ব সিদ্ধান্তের বিষয়।২১আমানতকারীদের স্বার্থে ব্যাংকারদের জুয়া খেলার মোহ খর্ব করতে হবে।

তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণের অপ্রতুলতা

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের মতো আন্তর্জাতিক আর্থিক কাঠামোয় কয়েকটি দুর্বলতা রয়েছে।২২যতক্ষণ পর্যন্ত এসব দুর্বলতা দূর না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত ব্যাংকগুলোকে বাইরের অভিঘাত থেকে নিরাপদ করা যাবে না। এ প্রসঙ্গে নিম্নলিখিত সংস্কারগুলোর ওপর জোর দেওয়া হয়েছে:

১. ব্যাংক তত্ত্বাবধানের সতর্কতামূলক দৃষ্টিকোণ পরিবর্তন করতে হবে, যাতে ব্যাংক তত্ত্বাবধানে শুধু ব্যাংক বিশেষের নিরাপত্তা ও কর্মক্ষমতার মূল্যায়নে সীমাবদ্ধ না রেখে সামগ্রিক অর্থব্যবস্থার ঝুঁকিও বিবেচনা করা হয়।

২. আর্থিক খাতের নজরদারির সীমানা বাড়াতে হবে, যাতে অনিয়ন্ত্রিত অথবা অপেক্ষাকৃত কম নিয়ন্ত্রিত আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সৃষ্ট ঝুঁকি হ্রাস করা যায়। এসব প্রতিষ্ঠানকে ব্যাংক-ব্যবস্থার ছায়া (Shadow Banking Institutions) বলা হয়ে থাকে। এরা ব্যাংকের অনেক কাজই করে, কিন্তু তারা ব্যাংকের মতো নিয়ন্ত্রিত নয়।

৩. তত্ত্বাবধানব্যবস্থায় সামগ্রিক আর্থিক ব্যবস্থার ওপর জোর দিতে হবে এবং বিভিন্ন ধরনের তত্ত্বাবধায়কের মধ্যে নিয়ন্ত্রণের তারতম্য হ্রাস করতে হবে, যাতে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের পছন্দমতো নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা বেছে নিতে না পারে।

৪. বিদ্যমান নিয়ন্ত্রণমূলক এবং প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়াকে পর্যালোচনা করতে হবে, যাতে সুনির্দিষ্ট নীতির ভিত্তিতে তত্ত্বাবধানব্যবস্থার অর্থনৈতিক চক্রকে জোরদার করার প্রবণতা হ্রাস করা যায়।

৫. স্বল্পনিয়ন্ত্রিত আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং স্থিতিপত্রবহির্ভূত আর্থিক লেনদেন সম্পর্কে তথ্যের ফাঁক পূরণ করতে হবে, যাতে তত্ত্বাবধায়ক ও বিনিয়োগকারীরা সঠিক তথ্য সম্পর্কে গোচরীভূত হওয়ার সুযোগ পান।

৬. বিভিন্ন দেশের আর্থিক সংস্থার মধ্যে লেনদেন নিয়ন্ত্রণে রাজনৈতিক ও আইনগত জটিলতা নিরসন করতে হবে।

৭. তারল্যপ্রবাহ নিশ্চিত করার জন্য এবং সামগ্রিক অর্থব্যবস্থায় সংকটের ক্ষেত্রে সাড়া দেওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সক্ষমতা বাড়াতে হবে।

৮. সামষ্টিক অর্থব্যবস্থায় সংকটকালে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য জাতীয় কর্তৃপক্ষগুলোর সক্ষমতা বাড়াতে হবে এবং দেশের ভেতরে ও বাইরে গৃহীত ব্যবস্থার সমন্বয়ের জন্য প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

৯. সংকট ঠেকিয়ে রাখা এবং সংকট-পরবর্তী পর্যায়ে সরকারি অর্থ বরাদ্দের কাঠামো গড়তে হবে এবং সরকারি সাহায্য প্রত্যাহারের কৌশল নির্ধারণ করতে হবে।

ব্যাংক-সংক্রান্ত নতুন প্রবিধান প্রণয়ন ও বলবত্করণ প্রয়োজনীয়। তবে এসব প্রবিধান তিনটি কারণে ব্যাংকগুলোর আর্থিক সুস্থতা নিশ্চিত করার জন্য যথেষ্ট নয়। প্রথমত, ব্যাংকগুলোর নিয়ন্ত্রণমূলক বিধিবিধান পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, নতুন বাস্তবতা মোকাবিলা করতে নতুন বিধি প্রণয়ন করতে সময় লাগে। পুরোনো ভ্রান্তি এড়ানোর জন্য এসব বিধি প্রণীত হয়; ভবিষ্যতে ভুলের আশঙ্কা অনুমান করে এসব বিধি প্রণীত হয় না। কাজেই এসব বিধিবিধান ব্যাংক-ব্যবস্থার স্থিতিশীলতার জন্য যথেষ্ট নয়। দ্বিতীয়ত, নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা অনেক সময় ব্যাংকগুলোতে আত্মতুষ্টির সৃষ্টি করে। মনে করা হয়, যতক্ষণ পর্যন্ত কোনো ব্যাংক ব্যাংকের আইন ভঙ্গ করার জন্য দণ্ডিত না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত তাকে কোনো ভুলভ্রান্তির জন্য দায়ী করা যাবে না। কিন্তু সব নৈতিক দায়িত্ব আইনকানুনে অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব নয়। সুতরাং, নিয়ন্ত্রণমূলক বিধিবিধানে স্পষ্ট নির্দেশের অভাব ব্যাংকগুলোর নৈতিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার যৌক্তিকতা হতে পারে না। প্লেটো বলতেন, ভালো ব্যক্তিদের দায়িত্বশীলভাবে কাজ করার জন্য আইনের প্রয়োজন নেই, আর যারা খারাপ লোক, তারা আইন থাকলেও তার ফাঁকফোকর খোঁজে।২৩ নতুন বিধিবিধান তাই যথেষ্ট নয়। ব্যাংক খাতে অনৈতিক ব্যক্তিদের ভূমিকাও খর্ব করতে হবে।

ব্যবস্থাপনায় ব্যর্থতা

আন্তর্জাতিক লেনদেনের জন্য ব্যাংকের (Bank for International Settlements) মতে, দুর্বল ব্যবস্থাপনা ব্যাংকের দেউলিয়া হওয়ার একটি বড় কারণ।২৪ বিশ্ব উন্নয়ন প্রতিবেদন ১৯৮৯ ব্যাংকে চার ধরনের অব্যবস্থা চিহ্নিত করেছে: ১. কারিগরি অব্যবস্থা, ২. প্রসাধনমূলক কার্যকলাপের আড়ালে অব্যবস্থা, ৩. দুর্দশাগ্রস্ত ব্যবস্থায় অব্যবস্থা ও ৪. প্রতারণা।২৫

কারিগরি অব্যবস্থার সৃষ্টি হয় নেতৃত্বের দুর্বলতা থেকে। এ ধরনের ব্যাংকে কুঋণের কারণ হলো অপর্যাপ্ত ঋণ বিশ্লেষণ, দুর্বল অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ও রাজনৈতিক চাপ। ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার ফলে সম্পদ ও দায়ের মধ্যে ভারসাম্যের অভাব দেখা দেয়। ফলে স্বল্পমেয়াদি আমানত ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণের মধ্যে অসামঞ্জস্য দেখা দেয়।

প্রসাধনমূলক কার্যকলাপের আড়ালে অব্যবস্থাপনা দেখা দেয়, যখন বর্তমান ও অতীতের লোকসান লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়। তবে ব্যবস্থাপনা একা এ ধরনের অনাচার টিকিয়ে রাখতে পারে না। এসব ক্ষেত্রে দোসর হিসেবে কাজ করে বহিরাগত নিরীক্ষকেরা এবং অনেক ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রকেরা। দুর্দশাজনিত অব্যবস্থাপনা ঘটে, যখন ক্ষতির পরিমাণ এত বেশি যে হিসাবের ধূম্রজাল সৃষ্টি করেও তা লুকিয়ে রাখা সম্ভব হয় না। এ ধরনের অব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে চড়া সুদে ঝুঁকিপূর্ণ প্রকল্পে ঋণদান, স্টক মার্কেটে ফাটকাবাজি, ভূসম্পত্তি নিয়ে ফাটকাবাজি এবং চড়া সুদে আমানতে আকৃষ্ট করা। তবে দুর্দশাজনিত অব্যবস্থাপনা শুধু ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় ব্যর্থতার চিহ্ন নয়। এ ধরনের অব্যবস্থাপনা অতিদ্রুত বন্ধ করতে না পারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতো নিয়ন্ত্রণমূলক কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতাও বটে।

প্রতারণা ফৌজদারি আইনে দণ্ডনীয় অপরাধ। তবে প্রতারণা শুধু ব্যাংকেই ঘটে না। একটি সমীক্ষায় দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মোট আয়ের ৬ শতাংশ তাদের কর্মচারীদের প্রতারণার জন্য ক্ষতি হয়।২৬ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের তুলনায় ব্যাংকে প্রতারণা প্রতিষ্ঠানের সুনাম অনেক বেশি ক্ষুণ্ন করে। তবে সাধারণ মানুষ সব ধরনের অব্যবস্থাপনাকেই প্রতারণা গণ্য করে থাকে।

এ কথা সুস্পষ্ট যে ব্যাংকের অব্যবস্থাপনার উত্পত্তি হয় নৈতিক বিচ্যুতি অথবা অকার্যকারিতা থেকে। ব্যাংকের পক্ষে নৈতিকতা মেনে চলাই যথেষ্ট নয়, ব্যাংককে এমনভাবে চালাতে হবে, যাতে তার নৈতিক আচরণ দৃশ্যমান হয়। এতে জনমনে ভুল ধারণা সৃষ্টি হবে না। এর জন্য প্রয়োজন ব্যক্তিগত ও যৌথ পর্যায়ে নৈতিকতার বাস্তবায়ন।

ব্যক্তিগত পর্যায়ে নৈতিকতার বৈশিষ্ট্যসূচক শর্তগুলো হচ্ছে সততা, স্বার্থের সংঘাত রোধ করা এবং বৈষম্য, স্বজনপ্রীতি ও তস্করবৃত্তি প্রতিরোধ করা। ব্যাংকের কর্মচারীদের ক্রিয়াকাণ্ডে নৈতিক মূল্যবোধ প্রতিফলনের আইনগত ও নৈতিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তবে ব্যাংকের কর্মচারীরা ব্যক্তিগতভাবে কাজ করেন না। ব্যাংকে ব্যক্তিদের কার্যকলাপ করপোরেট সংস্কৃতি ও আচরণ দ্বারা বহুলাংশে প্রভাবিত হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, ব্যক্তির নিজের মূল্যবোধের চেয়ে প্রাতিষ্ঠানিক মূল্যবোধ কর্মচারীদের ক্রিয়াকাণ্ডকে অধিকতর প্রভাবান্বিত করে। করপোরেট সংস্কৃতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো কোম্পানির নৈতিক সংস্কৃতি।২৭ যেখানে কোনো প্রতিষ্ঠান তার কর্মকর্তাদের মুনাফার অন্বেষায় ইঁদুর দৌড়ে ব্যস্ত রাখে, সেখানে করপোরেট নৈতিক সংস্কৃতি বিকশিত হয় না। করপোরেট নৈতিক সংস্কৃতি গড়ে ওঠে নৈতিকতা সম্পর্কে করপোরেট নীতি, ব্যবস্থাপনার নৈতিক আচরণ, কর্মচারীদের নৈতিকতার মান এবং অনৈতিক কার্যকলাপের সুযোগের মতো বিভিন্ন উপাদানের মিথস্ক্রিয়ায়।

যৌথ নৈতিক দায়িত্বের ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা হচ্ছে পরিচালনা পরিষদের এবং শীর্ষস্থানীয় নির্বাহীদের। ব্যাংকে আর্থিক ঘাটতিজনিত দুর্দশা রোধের আইনগত দায়িত্ব পরিচালনা পরিষদের। বোর্ড সদস্যদের আর্থিক জিম্মাদারির দায়িত্ব (fiduciary responsiblity) রয়েছে। তাঁরা ব্যাংকের অর্থের মালিক নন, তাঁরা হচ্ছেন অছি (trustee)। তাঁদের দায়িত্ব হলো আমানতকারীদের স্বার্থ সর্বোত্তম উপায়ে রক্ষা করা। এই জিম্মাদারির দায়িত্ব কারও কাছে হস্তান্তর করা যায় না। দুর্ভাগ্যবশত ব্যাংক পরিচালনা পরিষদের সদস্যদের অনেক ক্ষেত্রে পেশাগত যোগ্যতা নেই, তাঁরা তাঁদের দায়িত্ব হালকাভাবে নেন এবং তাঁদের পদ থেকে ফায়দা উসুল করতে চান। পরিচালনা পরিষদের সদস্যরা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করছেন কি না, সে সম্পর্কে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিরবচ্ছিন্ন পরিবীক্ষণের প্রয়োজন রয়েছে। ব্যাংক পরিচালনা পরিষদের সদস্যদের ন্যূনতম যোগ্যতাও সুস্পষ্টভাবে নির্ধারিত হওয়া প্রয়োজন।

মানসম্পন্ন ব্যবস্থাপনাই হচ্ছে ব্যাংকের আর্থিক ব্যর্থতার সবচেয়ে বড় প্রতিষেধক। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যাংকে সুশাসনের ঘাটতির মূল কারণ বোর্ড সদস্যদের অযোগ্যতা নয় (যদিও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সমস্যাটি অনেক বেশি প্রকট)। মূল কারণ হলো, শীর্ষ ব্যবস্থাপনার জন্য যে লক্ষ্য নির্ধারিত হয়, তা অবাস্তব ও অযৌক্তিক। উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোতে ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যাংকের শীর্ষ ব্যবস্থাপনার কাজ হলো মালিকদের উমেদারি করা, আর মালিকেরা ব্যাংককে তাঁদের নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে চান। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে শীর্ষস্থানীয় নির্বাহীদের রাজনৈতিক নেতাদের তোয়াজ করে ব্যাংক চালাতে হয়। শিল্পোন্নত দেশগুলোতে ব্যাংকের শীর্ষ ব্যবস্থাপনাকে শেয়ারের মূল্যবৃদ্ধিতে সাফল্যের ভিত্তিতে বোনাস দেওয়া হয়। এতে কৃত্রিম উপায়ে শেয়ারের মূল্যবৃদ্ধির জন্য সৃজনশীল হিসাবরক্ষণ পদ্ধতি ও স্বল্প মেয়াদে লাভজনক অথচ দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতিকর সিদ্ধান্তগুলো উত্সাহিত করা হয়। জনমনে দৃঢ় বিশ্বাস এই যে, লোভী শীর্ষস্থানীয় ব্যবস্থাপকেরা কৃত্রিমভাবে শেয়ারের দাম বাড়াতে গিয়ে বিশ্বব্যাপী ব্যাংক-ব্যবস্থায় সংকট সৃষ্টি করেছেন। বিপুল লোকসান সত্ত্বেও মোটা অঙ্কের অযৌক্তিক বোনাস দেওয়ার দৃষ্টান্তগুলো ও শীর্ষস্থানীয় ব্যবস্থাপকদের অত্যধিক দক্ষিণা জনমনে প্রচণ্ড ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। ব্যাংকের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের বেতনভাতা শুধু একটি আর্থিক প্রশ্ন নয়, এর বড় ধরনের নৈতিক ও রাজনৈতিক তাত্পর্য রয়েছে।

বিকল্প ব্যাংক-ব্যবস্থার অভাব

ব্যাংকগুলোতে নৈতিক দায়িত্ববোধ প্রতিষ্ঠার একটি উপায় হলো বিকল্প ব্যাংকের সঙ্গে বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করা। সাম্প্রতিক ব্যাংক-সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন ধরনের ব্যতিক্রমধর্মী আর্থিক প্রতিষ্ঠান জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এর মধ্যে রয়েছে পরামর্শমূলক ছোট দোকান বা advisory boutiques (যাঁরা বিনিয়োগ সম্পর্কে পরামর্শ দেন ও ঋণের ব্যবস্থা করেন), সমগোত্রীয়দের ঋণের মণ্ডপ (ওয়েবসাইটের মাধ্যমে ঋণগ্রহীতারা সঞ্চয়কারীদের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করে থাকেন, যাকে peer to peer lending platform বলা হয়) এবং সমমনাদের ঋণ (affinity finance) যথা ইসলামি ব্যাংকিং, সমবায় ঋণ ও ক্ষুদ্রঋণ। তবে এসব বিকল্প ব্যাংক আর্থিক জগতের একটি অতি ক্ষুদ্র অংশের চাহিদা মেটায়। ক্ষুদ্র আকার এসব প্রতিষ্ঠানের শুধু সৌন্দর্যই নয়, তাদের শক্তিও বটে। তবে চিরাচরিত ব্যাংক-ব্যবস্থার মূল দায়িত্ব নেওয়ার ক্ষমতা এদের নেই। সনাতন ব্যাংকের মতো তাদেরও একটি বড় সমস্যা হচ্ছে স্বল্পমেয়াদি আমানতের বিপরীতে দীর্ঘমেয়াদি ঋণের সমন্বয় সাধন। এদেরও সনাতন ব্যাংকের মতো ব্যবস্থাপনার সমস্যা রয়েছে। তবু ব্যাংক-ব্যবস্থা বৈচিত্র্যায়ণের (diversifying) মাধ্যমে ঝুঁকি হ্রাসের জন্য বিকল্প ব্যাংকগুলো বিশেষ উপযোগী। উপরন্তু বিকল্প ব্যাংকের ক্ষুদ্র পরিসরে যেসব উদ্ভাবনমূলক ব্যবস্থা সাফল্য লাভ করে, তাদের সনাতন ব্যাংকের বিস্তৃত পরিসরে ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব।

উপরিউক্ত আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয়, ব্যাংক-ব্যবস্থা নিরাপদ আর্থিক লেনদেন নিশ্চিত করে এখন পর্যন্ত তার প্রাথমিক নৈতিক দায়িত্ব পালন করতে পারেনি। ব্যাংকগুলো তাদের গৌণ নৈতিক দায়িত্ব পালনেও (অর্থাত্, স্পষ্ট অবিচার হ্রাস করার বিষয়ে) পর্যাপ্ত ও বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে পারেনি। বেশির ভাগ ব্যাংকই মনে করে, ব্যাংক-সংক্রান্ত বিধিমালা মেনে চলাই তাদের জন্য যথেষ্ট। তবে সব নৈতিক সমস্যাকে আইনে রূপান্তর করা সম্ভব নয়। বেশির ভাগ ব্যাংক নিজের উদ্যোগে নতুন বিধিনিষেধ প্রয়োগ করতে চায় না। তারা ভয় করে, এতে প্রতিযোগীদের কাছে তারা বাজার হারাবে। ব্যাংকগুলোকে তাই যৌথভাবে নৈতিক আচরণবিধি প্রণয়ন করতে হবে। পরিবেশদূষণ রোধে উন্নত দেশগুলোর কয়েকটি ব্যাংক এমন একটি আচরণবিধি প্রণয়ন করেছে, যা Equator Principles বা নিরক্ষ রেখা নীতিমালা নামে পরিচিত।

৪. বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে  নৈতিক  সংকট

ব্যাংক-ব্যবস্থায় আর্থিক সংকট সৃষ্টির ফলে সারা পৃথিবীতেই ব্যাংকগুলোর নৈতিক সংকট প্রকট হয়ে উঠেছে। তবু বাংলাদেশে ব্যাংকিং খাতের সমস্যা দুটি কারণে ভিন্ন। প্রথমত, বাংলাদেশে ব্যাংকিং খাতে আর্থিক দুর্দশা অতি দীর্ঘ সময় ধরে প্রলম্বিত। ১৯৮৯ সালে বিশ্ব উন্নয়ন সমীক্ষায় বলা হয়, ১৯৮৭ সাল থেকে বাংলাদেশে ব্যাংক-ব্যবস্থায় আর্থিক দুর্দশা দেখা দিয়েছে।২৮ গত ২৩ বছরেও এ সমস্যার সমাধান করা যায়নি। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের হিসাব অনুসারে বাংলাদেশে ২০০৬ সালে অকার্যকর ঋণ (Non-performing loan) ছিল মোট ঋণের ১৪ শতাংশ। তবে গড় হার বাংলাদেশের অনেক ব্যাংকের দুর্দশার প্রকৃত চিত্র তুলে ধরে না। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের হিসাব অনুসারে বাংলাদেশে এক-পঞ্চমাংশ ব্যাংকে অকার্যকর ঋণের হার ৪১ শতাংশ এবং পরবর্তী এক-পঞ্চমাংশে ১৭ শতাংশ। সাধারণত উন্নত দেশগুলোতে ব্যাংকগুলোর আর্থিক দুর্দশা লাঘব করতে দুই থেকে পাঁচ বছর লাগে।২৯অথচ বাংলাদেশে ২৩ বছর ধরে ব্যাংকগুলোতে মন্দ ও কুঋণের কারণে নিরবচ্ছিন্ন ক্ষরণ ঘটছে। বড় বড় ঋণখেলাপি এবং ব্যাংকের ভেতরে তাদের দোসরেরা একটি অকার্যকর বিচারব্যবস্থার বর্মের আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের একটি সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের মানুষের ধারণা এই যে ৯৭ দশমিক ২ শতাংশ পুলিশ ও ৮৮ দশমিক ৯ শতাংশ আদালত দুর্নীতিগ্রস্ত।৩০ এ ধরনের পরিস্থিতিতে বিচারব্যবস্থার ওপর আস্থা কমে যায়। নৈতিক আচরণ পারস্পরিক দেওয়া-নেওয়ার ওপর প্রতিষ্ঠিত। অনৈতিক ব্যক্তিদের মধ্যে নৈতিকতা টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। বিবেকহীনতা ও বেহায়াপনার সমুদ্রে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো নৈতিকতার দ্বীপ হিসেবে কাজ করবে—এ ধরনের প্রত্যাশা ঠিক নয়, দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা তাই ব্যাংক-ব্যবস্থায় সুস্থতার জন্যও অত্যাবশ্যক।

প্রতিষ্ঠানবহির্ভূত নৈতিক সংস্কৃতি

ব্যাংকের ভেতরে ও বাইরে নৈতিক সংস্কৃতি ব্যাংকগুলোর ন্যায় ও যথোপযুক্ত আচরণের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাত্ত্বিক দিক থেকে বাংলাদেশে আর্থিক ব্যবস্থা সুনিয়ন্ত্রিত। বাস্তবে আইন ও বিধি প্রয়োগে বড় ধরনের খামতি রয়েছে। নিয়ন্ত্রকদের উচ্চপ্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থতা কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে, বিশেষ করে, নিয়ন্ত্রণব্যবস্থার নিম্নলিখিত দুর্বলতাগুলো নৈতিক পরিবেশকে কলুষিত করেছে।

আর্থিক জোচ্চুরি

বাংলাদেশে ‘হায় হায় কোম্পানি’র (যা যুক্তরাষ্ট্রে Ponzi scheme নামে পরিচিত) মতো ডাহা জোচ্চুরি ব্যাপক। এসব প্রতারক সংস্থা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, সমবায়, কোম্পানি, সমিতির নামে বিধিবিধানের শিথিলতার সুযোগ নিয়ে পরিচালিত হয়ে থাকে। গরিবেরাই হন এ ধরনের প্রতারণার শিকার। যদিও ব্যাংকের নামে এসব জোচ্চুরি ঘটে না, তবু এসব প্রতারক আর্থিক খাতের পরিবেশ কলুষিত করে। এখন পর্যন্ত একটি সুনির্দিষ্ট সংস্থাকে এসব জোচ্চুরির শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। আমানতকারীদের এসব ক্ষেত্রে হেফাজত করার আইনকানুন অত্যন্ত দুর্বল। এ ব্যাপারে আরও কার্যকর আইন প্রণয়ন করতে হবে, যাতে জোচ্চর ও প্রতারকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া যায়। এ আইন কার্যকর করার জন্য একটি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানও গড়ে তুলতে হবে।

আমানত বিমা ও উহ্য সরকারি গ্যারান্টি দ্বারা সৃষ্ট মিথ্যা প্রত্যাশা। আমানত বিমাব্যবস্থা জনমনে একটি বদ্ধ ধারণার জন্ম দিয়েছে যে ব্যাংক বা অব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হলে সরকার আমানতকারীদের ক্ষতি পূরণ করবে। জনগণ আমানত বিমার শর্তগুলো জানে না। জনমনে বদ্ধ বিশ্বাস যে ব্যাংকের দেউলিয়া হওয়ার জন্য ব্যাংকের মালিক, ব্যবস্থাপক বা আমানতকারীদের চেয়ে বেশি দায়ী হলো বাংলাদেশ সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক। কাজেই আমানতকারীদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দায়িত্ব সরকারের। এ বিশ্বাস শুধু অশিক্ষিত সাধারণ মানুষদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এ ধরনের অভিমত দেশের প্রধান বিচারপতির মতো সর্বজনশ্রদ্ধেয় ব্যক্তিরাও পোষণ করে থাকেন। বিসিআই নামের একটি অব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দেউলিয়া হওয়ার প্রসঙ্গে বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি ও রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ প্রথম নুরুল মতিন স্মারক ভাষণে বলেন, ‘মারাত্মক তারল্য সংকটে বিসিআই ১৯৯২ সালের এপ্রিল মাসে ধসে পড়ে এবং একজন ছাড়া সব পরিচালক দেশ থেকে পালিয়ে যান। এ পর্যায়ে দেখা যায়, প্রায় ২০০ কোটি টাকা উধাও হয়ে গেছে। সারা দেশে হইচই শুরু হয়ে যায়। জানা যায়, ব্যাংক ব্যবসা পরিচালনার জন্য বিসিআই বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি পায়নি, অথচ কাজটি তারা অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনেই করেছে। আমি তখনো প্রধান বিচারপতি পদে ছিলাম। আমি অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানকে ডেকে হুমকি দিলাম যে অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের বিরুদ্ধে জামানত আদায়ের জন্য দেওয়ানি মামলা করা হবে।’৩১ প্রধান বিচারপতি এ কথা মানতে রাজি নন যে আমানত বিমা আইনে এ ক্ষেত্রে সরকারের খেসারত দেওয়ার দায়িত্ব সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে। বারবার আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দায়দেনা গ্রহণ করে সরকারের দায়িত্ব সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণাকে আরও জোরদার করা হয়েছে। এ ধরনের বিশ্বাস এবং সরকারের উদার আচরণের ফলে আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বাজারভিত্তিক শৃঙ্খলা শিথিল হয়ে গেছে। বাংলাদেশে আমানত বিমাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর প্রয়োজন রয়েছে এবং এ ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত ব্যবস্থাগুলো গ্রহণ করা যেতে পারে:

১. যেসব ব্যাংক আমানত বিমার আওতায় অন্তর্ভুক্ত, তাদের প্রতিটি শাখায় আমানত বিমার মূল শর্তগুলো প্রদর্শন করতে হবে। এতে আমানতকারীরা জানতে পারবেন, কোন প্রতিষ্ঠানগুলো আমানত বিমার আওতার বাইরে।

২. বাংলাদেশ ব্যাংক অথবা বিমা আমানতকারীর (যদি ভবিষ্যতে বাংলাদেশে ব্যাংকের অতিরিক্ত কোনো প্রতিষ্ঠান হয়) পক্ষে আমানত বিমা সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করার প্রয়োজন রয়েছে। অবিমাকৃত প্রতিষ্ঠানে অর্থ জমা রাখার বিপদ সম্পর্কে জনগণকে সতর্ক করতে হবে।

৩. দীর্ঘ মেয়াদে আমানত বিমাকে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পৃথক করতে হবে। একটি স্বতন্ত্র আমানত বিমা করপোরেশন ব্যাংক-ব্যবস্থার একটি অতিরিক্ত তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে।

৪. বাংলাদেশে আর্থিক খাতে খেলাপি সংস্কৃতি সুস্থ নৈতিকতার অনুশীলনে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিহাসের বিষয় এই যে বাংলাদেশে ধনী ও শক্তিশালী ব্যক্তিরা ব্যাংকের ঋণের টাকা শোধ করে না, অথচ দরিদ্ররা ও সমাজের দুর্বল গোষ্ঠীর লোকজন করে। বড় বড় স্বেচ্ছাচারী ঋণখেলাপিকে উপযুক্ত সাজা না দিলে ব্যাংকের পয়সায় মুফতে বড়লোক হওয়ার প্রবণতা বাড়তে থাকবে। খেলাপি ঋণ সম্পর্কে আইন ও বিধিগুলো প্রতিনিয়ত পর্যালোচনা করতে হবে, হালনাগাদ করতে হবে এবং শক্তিশালী করতে হবে।

৫. অল্প পয়সায় অতি নিম্নমানের নিরীক্ষা বাংলাদেশে ব্যাংকগুলোর নিরীক্ষাব্যবস্থাকে পঙ্গু করে রেখেছে। আন্তর্জাতিক নিরীক্ষার মানগুলো বাংলাদেশে বলবত্ করার জন্য একটি নিয়ন্ত্রণমূলক কর্তৃপক্ষ স্থাপন করতে হবে।

৬. ঋণ মূল্যায়ন সংস্থাগুলোকে (Credit Rating Agency) উত্সাহিত করতে হবে এবং ব্যাংকগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করতে হবে।

অভ্যন্তরীণ নৈতিক সংস্কৃতি

বাংলাদেশের ব্যাংক-ব্যবস্থায় শুধু বাইরের নৈতিক সংস্কৃতিতেই অবক্ষয় ঘটেনি, অভ্যন্তরীণ নৈতিক সংস্কৃতিতেই অনেক ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অধোগতি দেখা গেছে। অভ্যন্তরীণ নৈতিক সংস্কৃতির দুটো উপাদান রয়েছে:

  •  যৌথ নৈতিক দায়িত্ব
  •  ব্যাংকের কর্মচারীদের ব্যক্তিগত নৈতিক দায়িত্ব

যৌথ নৈতিক  দায়িত্ব

ব্যাংকে যৌথ নৈতিক দায়িত্ব প্রথমেই বর্তায় ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদের ওপর। ব্যাংকের পরিচালকদের যোগ্যতা সম্পর্কে কিছু বিধিনিষেধ ব্যাংকিং কোম্পানি আইনে এবং আইনে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে জারি করা বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রবিধানগুলোতে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু ব্যাংকগুলোর নেতৃত্বে যথেষ্ট যোগ্যতাসম্পন্ন এবং সত্ ব্যক্তিদের অংশগ্রহণ করার জন্য এসব ব্যবস্থা যথেষ্ট নয়। অনুরূপভাবে ব্যাংকের শীর্ষস্থানীয় ব্যবস্থাপকদের সতর্কতার সঙ্গে বাছাই করতে হবে। এ সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে নিম্নলিখিত ব্যবস্থাগুলো জরুরি ভিত্তিতে গ্রহণ করা যেতে পারে:

১. পরিচালনা পরিষদের সদস্যদের যোগ্যতা আরও স্পষ্ট এবং উচ্চতর পর্যায়ের করতে হবে, বিশেষ করে, অভিজ্ঞতার দৈর্ঘ্য, পর্যায় ও ক্ষেত্র এবং যোগ্যতা সম্পর্কে শর্তগুলো আরও কঠিন করা প্রয়োজন।

২. রাষ্ট্রের মালিকানাধীন ব্যাংকগুলো অত্যন্ত বৃহত্ ও আর্থিক দিক দিয়ে নিদারুণভাবে দুর্দশাগ্রস্ত। এসব প্রতিষ্ঠানে পরিচালনা পরিষদের সদস্য মনোনয়নে আরও সতর্ক হতে হবে। বেসরকারি ব্যাংক দেউলিয়া হলে ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদের সদস্যরা এবং শেয়ার মালিকেরা যাঁরা তাঁদের নির্বাচন করেন, উভয়ই আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলো দুর্দশাগ্রস্ত হলে পরিচালনা পরিষদের সদস্যদের কোনো ব্যক্তিগত অসুবিধা হয় না। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোতে জিম্মাদারির দায়িত্ব (fiduciary responsibility) বেসরকারি ব্যাংকগুলোর তুলনায় অনেক উচ্চতর পর্যায়ের হতে হবে। বিমল জালান (২০০৭) তাঁর সপ্তম নুরুল মতিন স্মারক বক্তৃতায় রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোতে পরিচালনা পরিষদের সদস্য মনোনয়নের জন্য প্যানেল প্রস্তুতের দায়িত্ব সরকারি কর্মকমিশনের কাছে ন্যস্ত করার প্রস্তাব করেছেন।৩২ রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোর সদস্যপদকে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার অবশ্যই বন্ধ করতে হবে।

৩. ব্যাংক ও অব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক পদের জন্য রাজনৈতিক দল ও তাদের সহযোগী প্রতিষ্ঠানের সদস্যদের অযোগ্য ঘোষণা করে একটি আইন প্রবর্তন করতে হবে। পরিচালক পর্ষদে রাজনীতিবিদদের উপস্থিতি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনার ওপর আস্থা ক্ষুণ্ন করে। ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে রাজনৈতিক পরিচালকদের আধিপত্য অর্থ ও রাজনীতির মধ্যে এক অশুভ আঁতাত সৃষ্টি করে। উপরন্তু রাজনীতিবিদ পরিচালকেরা ব্যাংক নিয়ন্ত্রণকারী ও তত্ত্বাবধায়ক সংস্থাগুলোর ওপর অন্যায় চাপ সৃষ্টি করতে পারেন।

৪. বাংলাদেশ ব্যাংকে অপরাধ ও অবহেলার জন্য শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।

৫. বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক প্রণীত CAMELS মূল্যায়ন [যার উপাদানগুলো হচ্ছে Capital Adequacy (CA) বা পুঁজির পর্যাপ্ততা, Management (M) বা ব্যবস্থাপনা, Earning (E) বা আয়, Liquidity (L) বা তারল্য এবং Sensitivity বা স্পর্শকাতরতা] নিয়মিতভাবে প্রকাশ করা উচিত। এ ব্যবস্থা চালু হলে কাজের মান উন্নত করার জন্য ব্যাংকগুলোর ওপর নৈতিক চাপ সৃষ্টি হবে।

ব্যক্তিগত নৈতিক  দায়িত্ব

ব্যাংকের কর্মচারীরা হচ্ছেন তাঁদের গ্রাহকদের কাছে ব্যাংকের মানবিক চেহারা। পরিচালক থেকে শুরু করে দারোয়ান পর্যন্ত সবাইকেই সযত্নে নৈতিক দায়িত্ব পালন করতে হবে। দুর্ভাগ্যবশত অনুন্নত দেশগুলোতে ব্যাংকের সুযোগ-সুবিধা সীমিত। তাই ব্যাংকের কর্মচারীরা দরিদ্র গ্রাহকদের চাহিদার প্রতি আদৌ সংবেদনশীল হন না। বাংলাদেশে ব্যাংকগুলোতে অভ্যন্তরীণ নৈতিক পরিবেশ উন্নয়নের লক্ষ্যে নিম্নলিখিত ব্যবস্থাগুলো অত্যাবশ্যক:

১. প্রতিটি ব্যাংকের একটি পূর্ণাঙ্গ আচরণবিধি প্রণয়ন করতে হবে। আচরণবিধি বাস্তবায়নের জন্য প্রতিটি ব্যাংকে একটি অফিস স্থাপন করতে হবে।

২. প্রতিটি ব্যাংকের শাখায় একটি অভিযোগকেন্দ্র থাকতে হবে। ব্যাংকের কর্মচারীদের প্রতারণা ও হয়রানির ক্ষেত্রে ত্বরিত ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রতারণা এবং কর্মচারীদের গাফিলতির জন্য ব্যাংকের সেবা গ্রহণকারীদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। ব্যবস্থাপনা পরিচালকের অফিসে একটি কেন্দ্রীয় অভিযোগ দপ্তর স্থাপন করে ব্যাংকের সেবা গ্রহণকারীদের অধিকার রক্ষার অঙ্গীকার নিশ্চিত করতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকেও সব ব্যাংকের জন্য একটি ন্যায়পাল বা Ombudsman-এর পদ সৃষ্টি করতে হবে।

বিকল্প ব্যাংক

সনাতন ব্যাংকের দুর্বলতাগুলো বিকল্প ব্যাংকের ও সগোত্রীয় (affinity) অর্থায়নের ধারণাকে সমর্থন করে। বিকল্প ব্যাংকগুলো দেশের অর্থব্যবস্থাকে দুভাবে দৃঢ়তর করতে পারে। প্রথমত, অর্থব্যবস্থার পত্রকোষের (portfolio) বৈচিত্র্যায়ণ করে সামগ্রিক ব্যবস্থায় ঋণের ঝুঁকির আশঙ্কা কমিয়ে দেয়। যখন অর্থনৈতিক সংকট কোথাও দেখা দেয়, তখন সব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সমানভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। তাই বিনিয়োগের পত্রকোষের যত বৈচিত্র্য থাকে, তত ঝুঁকির আশঙ্কা কমে যায়। যদি মাত্র কয়েকটি ক্ষেত্রে বিনিয়োগ সীমিত থাকে, তবে অর্থনৈতিক ক্ষতির আশঙ্কা বেড়ে যায়। সব ব্যাংকই যদি সনাতন ধরনের হয়, তবে বড় সংকট দেখা দিলে সব ব্যাংকই একসঙ্গে বিপন্ন হবে। যদি ব্যাংক-ব্যবস্থায় বিকল্প ব্যাংক থাকে, তবে সনাতন অর্থব্যবস্থায় সমস্যা হলেও বিকল্প ব্যাংকগুলো নিরাপদ থাকবে। অনুরূপভাবে বিকল্প ব্যাংকে সমস্যা দেখা দিলে সনাতন ব্যাংক নিরাপদ থাকবে। দ্বিতীয়ত, সনাতন ব্যাংক সব ধরনের ক্রেতাকে আকৃষ্ট করতে পারে না। ফলে সম্ভাব্য ক্রেতাদের একটি বড় অংশ ব্যাংক-ব্যবস্থার বাইরে থেকে যায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, সুদযুক্ত ব্যাংক অনেক ধর্মপ্রাণ মুসলমানকে আকৃষ্ট করে না। ইসলামি ব্যাংকের মতো বিকল্প ব্যাংক নতুন ক্রেতাদের ব্যাংক-ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করে। এতে আর্থিক খাত সম্প্রসারিত হয়।

সৌভাগ্যক্রমে বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই এখানে বিকল্প ব্যাংক সমর্থন লাভ করেছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ২৩ অনুচ্ছেদে সরকারি ও ব্যক্তিগত মালিকানা থেকে ভিন্ন সমবায় মালিকানাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতাদের উত্সাহ ও উদার রাষ্ট্রীয় পোষকতা সত্ত্বেও বাংলাদেশে সমবায় আন্দোলন মরুপথে হারিয়ে গেছে। পক্ষান্তরে অর্থায়নের বিকল্প উত্স হিসেবে ক্ষুদ্রঋণ এবং ইসলামি ব্যাংক অনেক বেশি প্রাণোচ্ছল ও টেকসই।

ক্ষুদ্রঋণ

ঋণগ্রহীতাদের দোরগোড়ায় জামানতবিহীন ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করে ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো দরিদ্রদের প্রতি দৃশ্যমান অবিচার হ্রাসের ক্ষেত্রে একটি বলিষ্ঠ উদ্যোগ নিয়েছে। বিশ্বব্যাংকের একটি সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে ক্ষুদ্রঋণের পরিমাণ মোট বেসরকারি খাতের ঋণের প্রায় ৫ শতাংশ।৩৩ অর্থ মন্ত্রণালয়ের (২০০৯) একটি প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, মোট তিন কোটি ৯১ লাখ গ্রাহক ক্ষুদ্রঋণ নিয়েছে।৩৪ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (২০০৯) প্রাক্কলন অনুসারে বাংলাদেশে খানাপ্রতি গড়ে ৪ দশমিক ৯ জন ব্যক্তি রয়েছে।৩৫যদি প্রতি খানা থেকে একজনকে ক্ষুদ্রঋণ দেওয়া হয়, তাহলে তিন কোটি ৯১ লাখ ঋণের মাধ্যমে ১৯ কোটি ১০ লাখ লোকের ঋণের চাহিদা মেটানো সম্ভব। এ সংখ্যা বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ২৫ শতাংশ বেশি। আসলে তিন কোটি ৯১ লাখ ক্ষুদ্রঋণ দেওয়ার পরও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এখনো ক্ষুদ্রঋণের সুবিধা পায়নি। এই প্রহেলিকার কারণ হলো, একই খানায় একাধিক ব্যক্তি ঋণ পাচ্ছেন এবং একই ব্যক্তি একাধিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিচ্ছেন। এতে কিছু সৌভাগ্যবান ব্যক্তি প্রয়োজনের অতিরিক্ত ঋণ পাচ্ছেন এবং তারই ফলে অনেক দরিদ্র মানুষ আদৌ ক্ষুদ্রঋণ পাচ্ছেন না। পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের৩৬ একটি সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ঋণগ্রহীতা একাধিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নেন। একই প্রতিষ্ঠানের ২০০৬ সালের একটি সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, প্রায় ৪০ শতাংশ ক্ষুদ্রঋণগ্রহীতা একাধিক সূত্র থেকে ঋণ নিচ্ছেন।৩৭ আহমেদ (২০০৭) দেখাচ্ছেন, ৩১ শতাংশ ঋণগ্রহীতা একাধিক সূত্র থেকে ঋণ নেন।৩৮ তার মধ্যে ৬ শতাংশ তিনটি প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নেন এবং ১ শতাংশ তিনটির বেশি প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নেন। দুটি প্রতিষ্ঠান থেকে ক্ষুদ্রঋণ নেন মাত্র ২৪ শতাংশ। ভাগ্যের পরিহাস এই যে, ১ শতাংশ ক্ষুদ্রঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে চড়া সুদে অন্যদের ঋণ দিচ্ছেন; মহাজনি ব্যবস্থার প্রতিষেধক হিসেবে যে ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থার জন্ম, সে ব্যবস্থাতেই নতুন মহাজন সৃষ্টি করছে। এ কথা স্পষ্ট, অনেক বিত্তবান ও সচ্ছল ব্যক্তি ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচিতে ঢুকে পড়েছেন। অন্যদিকে, প্রায় ৪০ শতাংশ দরিদ্র ব্যক্তি এখনো ক্ষুদ্রঋণের সুযোগ পাননি। উপরিউক্ত বিশ্লেষণে বাংলাদেশে ক্ষুদ্রঋণ খাতের দুটি নৈতিক সমস্যা দেখা যাচ্ছে:

প্রথমত, সব ধরনের ক্ষুদ্রঋণ অলাভজনক ও আদর্শভিত্তিক কর্মসূচি নয়। বিভিন্ন কিসিমের ক্ষুদ্রঋণ রয়েছে। সব ক্ষুদ্রঋণকে নৈতিক অর্থায়ন বলা যাবে না। সর্বোত্তম ক্ষুদ্রঋণ হলো সামাজিক ক্ষুদ্রঋণ। এ ধরনের কর্মসূচি গ্রামীণ ব্যাংক ও ব্র্যাকের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো প্রবর্তন করেছে। সামাজিক ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি শুধু ঋণ প্রদানে সীমাবদ্ধ নয়, এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে সমমনা (Peer group) গোত্র গঠন করে তৃণমূলে সামাজিক আন্দোলন। সবচেয়ে নিকৃষ্ট ক্ষুদ্রঋণ হচ্ছে বাণিজ্যিক ক্ষুদ্রঋণ, যার উদ্দেশ্য হলো কার্যকর ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মুনাফা অর্জন। দুজন মার্কিন অর্থনীতিবিদের ভাষায়, বাণিজ্যিক ক্ষুদ্রঋণ কোমল পানীয় অথবা নরসুন্দরের ব্যবসা থেকে ভিন্ন নয়।৩৯ দ্বিতীয়ত, যদি ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানগুলো তৃণমূল পর্যায়ের গরিব মানুষের সংগঠন হয়, তবে নৈতিকভাবে তাদের দায়িত্ব হচ্ছে একে অপরের সঙ্গে সহযোগিতা করা। বাংলাদেশে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো পারস্পরিক সন্দেহ ও অবিশ্বাসের পরিবেশে কাজ করে। তাদের মধ্যে এই মুহূর্তে বাজার সম্প্রসারণের জন্য অশুভ ও অস্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা চলছে। ফলে একাধিক সূত্র থেকে ঋণ গ্রহণকারী অবাঞ্ছিত ব্যক্তিদের সংখ্যা ক্রমেই স্ফীত হচ্ছে। ক্ষুদ্রঋণের অতিরিক্ত জোগান সমমনা গোত্রভিত্তিক ঋণের শৃঙ্খলা ক্ষইয়ে দিচ্ছে। ফলে বিত্তবানেরাও অতিরিক্ত ঋণের সুযোগ নিচ্ছেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে নিম্নলিখিত ব্যবস্থাগুলো জরুরি ভিত্তিতে গ্রহণ প্রয়োজন।

  •  ক্ষুদ্রঋণের ক্ষেত্রে ক্ষুদ্রঋণ নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের (Micro credit Regulatory Authority) খবরদারি বাড়াতে হবে। বাণিজ্যিক ক্ষুদ্রঋণের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ কঠোর হতে হবে, সামাজিক ক্ষুদ্রঋণের ক্ষেত্রে তা শিথিল হতে পারে।
  •  তৃণমূল পর্যায়ে ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা সম্প্রসারণ করতে হবে, যাতে অবাঞ্ছিত ক্ষুদ্রঋণের পরিমাণ কমানো যায়।
  •  তৃণমূল পর্যায়ে সমমনা ক্ষুদ্রগোষ্ঠীর (Peer group) সংহতি এবং সামাজিক আন্দোলনের ওপর জোর দিতে হবে।

ইসলামি  ব্যাংক

মূল্যভিত্তিক ব্যাংক-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে ইসলামি ব্যাংকের যাত্রা। বর্তমানে ইসলামি ব্যাংকগুলো বাংলাদেশের ব্যাংক-ব্যবস্থায় একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে রয়েছে। ব্যাংক-ব্যবস্থার মোট আমানতের ১২ দশমিক ৯ শতাংশ রয়েছে ইসলামি ব্যাংক। এসব ব্যাংক দেশে মোট ঋণের ১৫ দশমিক ১ শতাংশের জোগান দেয়। এসব ব্যাংকের একটি বড় সমস্যা হলো, যেহেতু তারা মেয়াদ অনুসারে সুদ দেয় না (অর্থাত্ সুদ নিষিদ্ধ), সেহেতু তাদের আমানত হলো মেয়াদনিরপেক্ষ এবং আইনত স্বল্পমেয়াদি। অথচ ব্যাংক-ব্যবস্থা পরিচালনার জন্য এদের দীর্ঘমেয়াদি ঋণ নেওয়া উচিত। ফলে এদের যেকোনো সময় তারল্য সমস্যা দেখা দিতে পারে। অবশ্য এ ধরনের সমস্যা অন্য ধরনের ব্যাংকেও দেখা যায়। নৈতিক দিক থেকে ইসলামি ব্যাংকের তিনটি সমস্যা রয়েছে:

প্রথমত, ইসলামি ব্যাংকগুলো মূলত শহরাঞ্চলের বিত্তবানদের ব্যাংক। এরা প্রধানত শহরাঞ্চলে ঋণ দেয় এবং গ্রামাঞ্চলে এদের ঋণ খুবই সীমিত। অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রাক্কলন অনুসারে বাংলাদেশে সব ইসলামি ব্যাংক মিলে ২০০৮ সালে পল্লি অঞ্চলে মাত্র ৯৮ দশমিক ২ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে।৪০ এ অঙ্ক তাদের মোট ঋণের ১ শতাংশেরও কম। দ্বিতীয়ত, ইসলামি ব্যাংকগুলোর প্রদত্ত ঋণের বিশ্লেষণ থেকে দেখা যাচ্ছে, তাদের প্রদত্ত ঋণ ও সনাতন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রদত্ত ঋণের মধ্যে কোনো মৌলিক প্রভেদ নেই। ইসলামি ব্যাংকের প্রবক্তারা দাবি করে, পবিত্র কোরআনের নির্দেশ মেনে তারা সুদের ব্যবসা করে না। তারা যাদের ঋণ দেয়, তাদের সঙ্গে অংশীদারির ভিত্তিতে মুনাফা ও লোকসান ভাগাভাগি (profit-loss Sharing) করে। বস্তুত বাংলাদেশের ইসলামি ব্যাংকগুলো তাদের মোট ঋণের ১ দশমিক ৩৮ শতাংশ মুনাফা-লোকসান ভাগাভাগির ভিত্তিতে দেয়। তাদের ঋণের ৯৮ দশমিক ৬২ শতাংশ হচ্ছে পূর্বনির্ধারিত মুনাফা (mark-up) অর্থায়ন অথবা ভাড়ায় অর্থায়ন (lease financing)।৪১ এ ধরনের অর্থায়নে কোনো মূল্যবোধ নেই। মুনাফার জন্য এ ধরনের অর্থায়ন সনাতন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ইসলামি ব্যাংকের আবির্ভাবের অনেক আগে থেকেই করে আসছে। এখানে উল্লেখ্য, বিশ্বব্যাপী ইসলামি ব্যাংকগুলো মুনাফা লোকসান ভাগাভাগির ভিত্তিতে ৫ শতাংশ ঋণও দেয় না।৪২ দরিদ্রের সহায়তা ও লাভ-লোকসানের ভিত্তিতে মূল্যবোধভিত্তিক ঋণ দেওয়ার স্বপ্ন ইসলামি ব্যাংকগুলোতে অবাস্তবায়িত রয়ে গেছে। শেষত, CAMELS সূচকের ভিত্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের অভিমত অনুসারে সাতটি ইসলামি ব্যাংকের মধ্যে তিনটি ব্যাংক বিপন্ন। তিমুর কোরআন যথার্থই বলেছেন, সাচ্চা মুসলমান ছাড়া ইসলামি ব্যাংক চালানো সম্ভব নয়।৪৩ এ ধরনের ব্যক্তিরা শুধু ইসলামি আদর্শেই উজ্জীবিত নন, এঁরা কঠোর পরিশ্রম করেন, ন্যায্য মূল্যে কেনাবেচা করেন এবং অন্যদের পাওনা পরিশোধ করেন। এ ধরনের সাচ্চা মুসলমান খুঁজে পাওয়া শক্ত। অনেক ইসলামি ব্যাংকের দুর্বলতা সত্যিকার ইসলামি আদর্শে অনুপ্রাণিত ব্যক্তিত্বের দুষ্প্রাপ্যতার অনুমান সমর্থন করে। সামাজিক ন্যায়বিচার ও মুনাফা লোকসান ভাগাভাগির ভিত্তিতে ঋণ দেওয়ার ঘোষিত লক্ষ্যগুলোর বাস্তবায়নে ইসলামি ব্যাংকগুলোর আরও যত্নবান হওয়া উচিত ও তাদের মহান ধর্মের চেতনার প্রতি বিশ্বস্ত হওয়া উচিত। বিশেষ করে, এ খাতের সমস্যাজর্জরিত ব্যাংকগুলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আরও নিবিড়ভাবে তদারক করতে হবে।

সুস্পষ্ট অবিচারগুলো (Manifest Injustices)

আর্থিক খাতে সুস্পষ্ট অবিচারগুলো সময়ের ব্যাপ্ত পরিসরে পরিবর্তিত হয়। সব ধরনের সুস্পষ্ট অবিচার দূর করার সম্পদ ও ক্ষমতা বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর নেই। তাই এসব সমস্যার সমাধান দীর্ঘ মেয়াদে খুঁজতে হবে। তবে দুটি ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট অবিচার কোনোমতেই উপেক্ষা করা যায় না।

ক. গ্রামাঞ্চল থেকে  নগরাঞ্চলে সম্পদ প্রবাহ

বাংলাদেশে ব্যাংকগুলো গ্রামাঞ্চল থেকে নগরাঞ্চলে সম্পদ টেনে নেওয়ার যন্ত্র হিসেবে কাজ করে। ব্যাংকগুলোর মোট আমানতে গ্রামাঞ্চলে আমানতের হিসসা সব সময়ই তাদের মোট ঋণে গ্রামাঞ্চলে ঋণের অংশের চেয়ে কম। ২০০৮ সালে ব্যাংক-ব্যবস্থার মোট আমানতে পল্লি অঞ্চলে হিসসা ছিল ১৩ দশমিক ২২ শতাংশ। অথচ ব্যাংকগুলোর মোট ঋণের ৮ দশমিক ১৮ শতাংশ পল্লি অঞ্চলে বিতরণ করা হয়েছে। এ ধরনের সম্পদ পাচার সংবিধান-নির্ধারিত রাষ্ট্রের মৌলিক নীতির সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। সংবিধানের ১৬ অনুচ্ছেদে পল্লি ও নগরাঞ্চলে জীবনযাত্রার মানে বৈষম্য ক্রমান্বয়ে দূর করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সংবিধানের স্পষ্ট নির্দেশের আলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া উচিত। পল্লি অঞ্চলে ঋণের হিসসা যাতে পল্লি অঞ্চলে আমানতের হিসসার চেয়ে কম না হয়, সে বিষয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে যত্নবান হওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক নৈতিক চাপ (moral suasion) প্রয়োগ করতে পারে।

খ. পরিবেশ  অবক্ষয়

শিল্পায়ন ও নগরায়ণের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশে বায়ু ও পানি দূষিত হচ্ছে এবং ভূমির দ্রুত অবক্ষয় ঘটছে। এই দূষণ ও অবক্ষয় বাংলাদেশে মানব বসতির জন্য একটি বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। দারিদ্র্য ও পরিবেশদূষণ একে অপরকে মজবুত করে। বাংলাদেশে পরিবেশদূষণের সমস্যা এত গুরুত্বপূর্ণ যে এটি শুধু সরকারি পরিবেশ দপ্তরের কাছে ছেড়ে দেওয়া ঠিক হবে না। শিল্পোন্নত দেশগুলোতে ব্যাংকগুলো পরিবেশ রক্ষার জন্য নিজেদের উদ্যোগে প্রকল্প অর্থায়নের ক্ষেত্রে সামাজিক ও পরিবেশগত ঝুঁকি নির্ণয়, মূল্যায়ন ও ব্যবস্থাপনার জন্য নিয়মাবলি গ্রহণ করেছে। এই নীতিমালা Equator Principle বা নিরক্ষ নীতিমালা নামে পরিচিত। ৫৭টি বৃহত্ ব্যাংক এসব নীতিমালা গ্রহণ করেছে। এসব নীতিমালার মুখবন্ধে বলা হয়েছে: ‘আমরা এ ধরনের প্রকল্পে প্রত্যক্ষভাবে ঋণ দেব না, যেখানে ঋণগ্রহীতা আমাদের পরিবেশগত ও সামাজিক নীতিমালা ও প্রক্রিয়াগুলো প্রতিপালন করে না অথবা করতে অক্ষম।’ এ ধরনের ব্যাংক নিরক্ষ নীতিমালা মেনে চলার তথ্যসংবলিত বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। পরিবেশগত ও সামাজিক দায়িত্ব সম্পর্কে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর অনুরূপ নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন অত্যাবশ্যক।

৫. উপসংহার

ব্যাংক ব্যবসায় নৈতিকতা অলভ্য প্রোত্কর্ষের সন্ধানে অন্তহীন যাত্রা নয়। অমর্ত্য সেনের ন্যায়-সম্পর্কিত ধারণার আলোকে ব্যাংক নৈতিকতাকে নিয়ত পরিবর্তনশীল বাধ্যবাধকতা হিসেবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। এসব বাধ্যবাধকতা কখনো চূড়ান্ত নয়, তবে এরা সব সময়ই বাস্তবায়নযোগ্য। এই পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংকের নৈতিকতাবোধকে দুভাবে বিভক্ত করা যেতে পারে: ১. আর্থিক মধ্যস্থতাকরণের সততায় অটল নিষ্ঠা নিশ্চিতকরণের মুখ্য দায়িত্ব এবং ২. অমর্ত্য সেন যাকে আখ্যায়িত করেছেন ‘স্পষ্ট অবিচার’, তা হ্রাস করার গৌণ দায়িত্ব। মুখ্য ও গৌণ নৈতিক দায়িত্বের মধ্যে বিভাজনের উদ্দেশ্য এই নয় যে গৌণ নৈতিক দায়িত্বগুলো মুখ্য দায়িত্বের চেয়ে নৈতিক দিক থেকে কম গুরুত্বপূর্ণ। এই বিভাজনের মুখ্য যুক্তি হলো, মুখ্য ও গৌণ দায়িত্বের মধ্যে সংঘাত দেখা দিলে এই বিশেষ ক্ষেত্রে মুখ্য দায়িত্বকে প্রাধান্য দিতে হবে। মুখ্য দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে আর্থিক প্রতিষ্ঠান টিকে থাকতে পারবে না, আর আর্থিক প্রতিষ্ঠান টিকে না থাকলে তার পক্ষে গৌণ দায়িত্ব পালন করা সম্ভব হবে না।

অনেক স্পষ্ট অবিচার ব্যাংকগুলোর কর্মকাণ্ড থেকেই জন্ম নেয়। এ ধরনের স্পষ্ট অবিচারের মধ্যে রয়েছে স্বল্পসংখ্যক বিত্তশালীকে অতিরিক্ত ঋণ প্রদান, অনেক দরিদ্র মানুষের জন্য অত্যন্ত অপ্রতুল ঋণ, অন্যের গচ্ছিত অর্থ নিয়ে অতিরিক্ত ঝুঁকি গ্রহণ এবং পরিবেশদূষণ বা অনৈতিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত ব্যবসাকে ঋণ প্রদান, ব্যাংকগুলোর নৈতিক বাধ্যবাধকতা সব পর্যায়ে—যথা, করপোরেট যৌথ ও ব্যক্তিগত পর্যায়ে বলবত্ করা। ব্যাংকগুলোর আর্থিক সুস্বাস্থ্য শুধু নৈতিক দিক থেকেই নয়, অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ব্যাংক-ব্যবস্থায় আতঙ্ক সামাজিক ও অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার মোক্ষম দাওয়াই। সুতরাং, ব্যাংকের নিরাপত্তার বিষয়টি শুধু মালিক ও শীর্ষ ব্যবস্থাপনার হাতে ছেড়ে দেওয়া যায় না, পৃথিবীর সব দেশেই বিস্তারিত নিয়ন্ত্রণ বলবত্ করার জন্য আর্থিক খাতে শক্তিশালী কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও অন্যান্য তত্ত্বাবধায়ক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এসব সত্ত্বেও ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার বা টাকা তুলে নেওয়ার হিড়িক বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। শুধু আইন দিয়ে ব্যাংক-ব্যবস্থার ঝুঁকি হ্রাস করা যায় না। করপোরেট অবগুণ্ঠনের পেছনে যেসব অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি ব্যাংক চালাচ্ছেন, তাঁদের জবাবদিহিও নিশ্চিত করতে হবে।

সনাতন তত্ত্বের মতে, ব্যাংকে প্রবিধান ও সতর্কতামূলক নিয়মাবলি দুটো কারণে ব্যর্থ হচ্ছে। প্রথমত, এসব নীতিমালা এখনো অপ্রতুল। দ্বিতীয়ত, আমানত বিমা ও শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের জন্য অতিরিক্ত পারিশ্রমিকের ব্যবস্থা দুই ফলা তরবারির মতো কাজ করেছে। একদিকে এসব ব্যবস্থার সুফল রয়েছে; অন্যদিকে এদের ক্ষতির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে। ব্যাংকগুলো অনেক ক্ষেত্রে শুধু প্রতিষ্ঠানের আর্থিক সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করার প্রাথমিক নৈতিক দায়িত্বেই ব্যর্থ হয়নি, তারা স্পষ্ট অবিচার হ্রাস করার গৌণ দায়িত্বও পালন করছে না। এ অবস্থায় সনাতন ব্যাংকের বিকল্প আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সন্ধান সম্প্রতি আরও জরুরি হয়ে পড়েছে।

বাংলাদেশে ব্যাংক খাতের সমীক্ষা থেকে প্রতীয়মান হয়, সনাতন ব্যাংক ও তাদের বিকল্প প্রতিষ্ঠানগুলো উভয়েই নৈতিক সংকটে জর্জরিত। ঋণের ক্ষেত্রে স্বজনতোষণ, রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা ও দুর্নীতি বেশির ভাগ সনাতন ব্যাংকের আর্থিক সুস্বাস্থ্য কুরে কুরে খাচ্ছে। পক্ষান্তরে ক্ষুদ্রঋণ ও ইসলামি ব্যাংকের মতো বিকল্প ব্যবস্থাগুলো বাণিজ্যিক ও নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে প্রসাধনী কর্মকাণ্ডে পর্যবসিত হয়েছে।

বাংলাদেশে ব্যাংকের দুর্গতি দুটো কারণে অনন্য। প্রথমত, এ দুর্গতি দীর্ঘদিন ধরে আর্থিক খাতে ক্ষরণ ঘটাচ্ছে। দ্বিতীয়ত, দেশে সুশাসনের খামতি ব্যাংকের বিপন্ন অবস্থানকে তীব্রতর করছে। বাংলাদেশে ব্যাংকের আর্থিক সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করার জন্য সারা দেশে নৈতিক পরিস্থিতির উন্নয়ন প্রয়োজন। এ প্রসঙ্গে এ প্রবন্ধে উল্লিখিত সুপারিশের মধ্যে রয়েছে: আর্থিক প্রতারণা ও ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপির জন্য দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি, আমানত বিমাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো, ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের মান উন্নীত করার লক্ষ্যে পরিচালকদের যোগ্যতার শর্ত কঠোরতর করা এবং রাজনীতিবিদদের পরিচালক পদের জন্য অযোগ্য ঘোষণা করা, CAMELS পদ্ধতির ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃক ব্যাংকগুলোর মূল্যায়ন প্রকাশ, ব্যাংক কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য উপযুক্ত আচরণবিধি বলবত্ করা এবং ব্যাংকের গ্রাহকদের অভিযোগের ভিত্তিতে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য উপযুক্ত প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তোলা ও বাণিজ্যিক ক্ষুদ্রঋণ ও নৈতিক ব্যাংকের লেবাসধারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিবিড়ভাবে পরিবর্তন করা। বাংলাদেশ ব্যাংককে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ওপর নৈতিক চাপ সৃষ্টি করতে হবে, যাতে তারা পল্লি অঞ্চল থেকে নগরাঞ্চলে সম্পদ পাচারের যন্ত্র হিসেবে কাজ না করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নেতৃত্বে ব্যাংক ও অব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে যৌথভাবে পরিবেশ সংরক্ষণের নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। শেষত, সব প্রচলিত আইন, বিধি ও প্রবিধান যথাযথভাবে বলবত্ করার উদ্যোগ নিতে হবে।

বাংলাদেশে ব্যাংকগুলোর নৈতিক বাধ্যবাধকতাগুলো স্থির নয়, সময়ের সঙ্গে এগুলো পরিবর্তিত হবে। ব্যাংকগুলো একা এসব বাধ্যবাধকতার প্রতিপালন নিশ্চিত করতে পারবে না। তাই ব্যাংক-ব্যবস্থাপকদের নিজেদের, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এবং বাইরে থেকে গণমাধ্যম, গবেষক ও সিভিল সমাজের এ ব্যাপারে দায়িত্ব রয়েছে। কী কী করতে হবে, তার পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রণয়নের জন্য অপেক্ষা করলে চলবে না। যেখানে কিছু করা সম্ভব, সেখানে অতি দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।

প্রখ্যাত মার্কিন লেখক মার্ক টোয়েন (১৮৩৫-১৯১০) ১০০ বছরেরও আগে ব্যাংকারদের সম্পর্কে যে অভিযোগ করেছিলেন, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আজও তা সমভাবে প্রযোজ্য। মার্ক টোয়েন বলেছেন, A banker is a fellow who lends you the umbrella when the sun is shining and wants it back the minute it begins to rain (ব্যাংকার হচ্ছে এমন এক ব্যক্তি, যে সূর্যের আলো যখন ঝকঝক করে তখন আপনাকে ছাতা ধার দেবে আর যখনই বৃষ্টি শুরু হয় তখনই ছাতা ফেরত চায়।)৪৪ বাংলাদেশের ব্যাংকারদের ভুলে গেলে চলবে না, দুর্দিনে যারা গ্রাহকদের সমর্থন করে দীর্ঘ মেয়াদে, তারাই গ্রাহকদের সমর্থন পাবে। গ্রাহকদের ভালো-মন্দকে যেসব ব্যাংক আপন করে নিতে পারবে, তারাই হবে আগামী দিনের টেকসই ব্যাংক।

তথ্যসূত্র

১. IMF : World Economic Outlook, 2009. Washington D.C: IMF, 2009

২. Smith, Adam : The Wealth of Nations, New York: Bantam Books, 2003, P. 372

৩. Hicks, Sir John : A Theory of Economic History, Oxford : Oxford University Press, 1969, P. 78

৪. Encyclopedia Britannica (1980 Ed.) Vol. VI, P. 976

৫. প্রাগুক্ত Vol III, P. 91

৬. Durant, Will : The Story of Philosophy, New York : Time Incorporated, 1962

৭.  মুহম্মদ এনামুল হক: মুসলিম বাংলা সাহিত্য, ঢাকা: পাকিস্তান পাবলিকেশনস, ১৯৫৭ পৃষ্ঠা ১৯৮

৮. Carse, David : “Importance of Ethics in Banking” 1999. http://www.info.gov.hk/hkma/eng/speeches/speechs/david/speech _150999b.htm

৯.  Božovic, Jelena : “Business Ethics in Banking” 2007. Facta Universitatis. Vol. IV No 2

১০. Buchanan, James M. : What Should Economist Do? Indianapolis : Liberty Press, 1979, P. 211

১১. Sen, Amartya : The Idea of Justice, London : Allen Lane, 2009

১২. Friedman, Milton : “The Social Responsibility is to increase profit”. New York Time Magazine, September 30, 1970

১৩. Cowton, C. J. : “Integrity, Responsibility and Affinity : Three Aspects of Ethics in Banking”. Ethics : A European Review. Oxford : Blackwell Publishers, 2002

১৪. সেন, অমর্ত্য: প্রাগুক্ত

১৫. Stewart, Justice Potter and Ohio, Jacobellis V (1964) Quoted in  Posner, Richard : Law and Literature, Harvard : Harvard University Press, 1988, P. 38

১৬. Russell, Bertrand : Sceptical Essays, London: George Allen & Unwin, 1928

১৭. Sundararajan, V. and Baliño, Tomás J. T.: Banking Crisis : Causes and Issues, Washington D.C : IMF, 1991

১৮. Gruening, hennie van and Brajovic-Bratanovic, Sonja: Analysis and Managing Bank Risk, Washington D.C : World Bank, 2003

১৯. Coates IV, John C.: “The Goals and Promise of the Sarbanes-Oxley Act”. Journal of Economic Perspectives, Vol. 21, No. 1, Winter 2007

২০. IMF : “Lessons of Financial Crisis for Future Regulation of Financial Institutions and Markets and for Liquidity Management”, Mimeo, Washington D.C : IMF, 2009

২১. Bernstein, Peter L : Against the Gods : The Remarkable Story of Risk, New York: John Wiley and Sons, 1996

২২. IMF. প্রাগুক্ত

২৩. উদ্ধৃত Howard, Philip K : The Death of Common Sense, New york : Random House, 1994

২৪. BIS (Bank for International Settlements) : “Bank Failures in Mature Economies, Mimeo. Working Paper No. 13, 2004

২৫. World Bank : World Development Report, 1989, Oxford : Oxford University Press, 1987

২৬. Ferrell et al, O. C.  : Business Ethics : Ethical Decision Making and Cases, New Delhi: Biz tranta, 2006 

২৭. প্রাগুক্ত

২৮. বিশ্বব্যাংক (১৯৮৯) প্রাগুক্ত

২৯. Lindgren, Carl-Johan; Garcia, Gillian and Matthew : Bank Soundness and Macroeconomic Policy, Washington D.C : IMF 1996

৩০. TIB (Transparency International Bangladesh) : Survey of Corruption in Bangladesh. Mimeo, Dhaka : TIB, 1997

৩১. Sahabuddin Ahmed : Ethics in Banking, Dhaka : BIBM, 1998

৩২. Bimal Jalan : Ethics in Banking, Dhaka : BIBM, 2007

৩৩. World Bank : Economics and Governance of Nongovernmental Organizations in Bangladesh, Dhaka : World Bank, 2006

৩৪. Ministry of Finance. Government of Bangladesh : Annual Economic Survey 2009. Dhaka : Government Press, 2009

৩৫. BBS (Bangladesh Bureau of Statistics) : Statistical Yearbook of Bangladesh, 2008. Dhaka : Government Press, 2008

৩৬. PKSF (Palli Karma Sahayak Foundation) : Maps on Microcredit, Dhaka : PKSF, 2003

৩৭. প্রাগুক্ত: ২০০৬

৩৮. Ahmed, Qazi Kholiquzzaman : Socio-Economic and Indebtedness Related Impact of Microcredit in Bangladesh, Dhaka : University Press Limited, 2007

৩৯. Armendáriz, Beatriz and Morduch, Jonathan : The Economics of Microfinance, London. England : MIT Press, 2005

৪০. Ministry of Finance, Government of Bangladesh : Activities of Banks and Financial Institutions, 2008-09. Dhaka : Government Press, 2009

৪১. Sarkar, Abdul Awal : “Islamic Bank in Bangladesh : Achievements and Challenges” 
www.ibtra.com/.../Islamic%20Banking%20in%20Bangladesh- %20Achievements%20&%20Challenges.pdf

৪২. Kuran, Timur : Islam and Mammon : The Economic Predicaments of Islamism, Princeton : Princeton University Press, 2004

৪৩. প্রাগুক্ত

৪৪. উদ্ধৃত www.twainquotes.com