মেকিং গ্লোবালাইজেশন ওয়ার্ক—জোসেফ ই স্টিগলিত্স, নরটন পেপারব্যাক ২০০৭
সম্ভবত, গত দুই দশকে সারা পৃথিবীতে বিশ্বায়ন শব্দটিই সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছে। এর পক্ষে-বিপক্ষে অনেক কথা হয়েছে। কিন্তু গত এক বছরেরও কম সময়ে ব্রেক্সিট এবং মার্কিন নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো একজন জনতুষ্টিবাদী ব্যক্তির নির্বাচিত হওয়ার পর বিশ্বায়নের ভবিষ্যত্ হুমকির মুখে পড়ে গেছে। অন্যভাবে বললে, বিশ্বায়নের কারণেই এই দুটি যুগান্তকারী ব্যাপার ঘটেছে। প্রথমত, ব্রিটেন বিশ্বায়নের ‘কুপ্রভাব’ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে গেল। দ্বিতীয়ত, ট্রাম্পের মতো একজন খাপছাড়া ধনকুবের বিশ্বায়নবিরোধী স্লোগান দিয়ে বিশ্বায়নের নেতৃত্বদানকারী দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন। এতকাল শুধু গরিব দেশগুলো বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ ছিল, এখন তাদের সঙ্গে ধনী দেশগুলোও যুক্ত হলো। বাস্তবতা হলো, বিশ্বায়নবিরোধী সবচেয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া এখন সেখানেই দেখা যাচ্ছে।
কিন্তু কেন এমন হলো, কথা ছিল, বিশ্বায়নের বদৌলতে সবারই উন্নয়ন হবে। এটি মূলত অর্থনৈতিক বিশ্বায়ন নিয়ে লিখিত। ঠিক এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ জোসেফ ই স্টিগলিত্স মেকিং গ্লোবালাইজেশন ওয়ার্ক নামের বইটি লিখেছেন। স্টিগলিত্স ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত তত্কালীন মার্কিন রাষ্ট্রপতি বিল ক্লিনটনের কাউন্সিল অব ইকোনমিক অ্যাডভাইজার্সের চেয়ারম্যান এবং ১৯৯৭ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত বিশ্বব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট ও প্রধান অর্থনীতিবিদ হিসেবে কাজ করেছেন। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই তিনি বুঝতে পারেন, বিশ্বায়ন নিয়ে মানুষের মধ্যে এত অসন্তোষ কেন। হোয়াইট হাউস ও বিশ্বব্যাংকের একদম কেন্দ্রে বসে তিনি দেখেছেন, কীভাবে নীতি প্রণীত হয়। ফলে বিশ্বব্যাংক ছাড়ার পর তিনি প্রথমে গ্লোবালাইজেশন অ্যান্ড ইটস ডিসকনটেন্টস নামে একটি বই লেখেন। সেই বইয়ে তিনি আন্তর্জাতিক অর্থব্যবস্থা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ব্যর্থতার বিবরণ লিপিবদ্ধ করেন। তিনি দেখিয়েছেন, বিশ্বায়নের কারণে যত মানুষের উপকৃত হওয়ার কথা ছিল, তত মানুষ উপকৃত হয়নি। আর বক্ষ্যমান বইয়ের মুখবন্ধে তিনি বলেন, এই সমস্যার জাদুকরি সমাধান নেই তা সত্য। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই পরিবর্তনের সুযোগ আছে। সে যেমন আমাদের নীতি প্রণয়নের জায়গায় পরিবর্তনের সুযোগ আছে, তেমনি অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান, বিধিবিধান ও মনোভাবেও পরিবর্তন আনার সুযোগ আছে। এতে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য বিশ্বায়ন অধিকতর কার্যকর হবে। তিনি বলেন, কিছু কিছু পরিবর্তন অনিবার্যভাবেই আসবে। চীন ও ভারতের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, প্রথম দেশটি বিশ্ব অর্থনীতিতে উত্পাদক হিসেবে এবং দ্বিতীয় দেশটি আউটসোর্সিংয়ে সফলতা অর্জন করায় ইতিমধ্যে বৈশ্বিক চিন্তা ও নীতিতে পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে।
কিছুদিন আগেই জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন কার্যালয়ের পরিচালক ড. সেলিম জাহানের সাক্ষাত্কার নিলাম। বিশ্বায়ন প্রসঙ্গে তিনি বললেন, বিশ্বায়নের বদৌলতে পণ্য, পুঁজি ও সেবার অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত হয়েছে। কিন্তু মানুষের অবাধ যাতায়াত নিশ্চিত হয়নি। আবার বিশ্বব্যাংক, আইএমএফের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালের রীতিতে চলছে। অর্থাত্ বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট হবেন একজন মার্কিন নাগরিক, আর আইএমএফের প্রধান হবেন একজন ইউরোপীয় নাগরিক। এরপর রাশিয়া এখনো জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য। কথা হচ্ছে, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এসব চলতে পারে না। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এসব প্রতিষ্ঠানে কাঠামোগত পরিবর্তন আনতে হবে। বিশ্বব্যবস্থায় ভারসাম্য আনার জন্যই এটা দরকার।
ব্যাপারটা হলো, দুটি বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকা দেখার পর উন্নত দেশগুলোর বোধোদয় হয়, এসব করে লাভ নেই। বরং এবার যুদ্ধবিগ্রহ থামিয়ে পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে চলতে হবে। সে কারণেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে নানা রকম বহুপক্ষীয় প্রতিষ্ঠানের উদ্ভব হয়। ১৯৪৫ সাল থেকে আন্তর্জাতিকতাবাদই সব ক্ষেত্রে প্রাধান্য পেতে থাকে। তারা সহযোগিতা ও বহুপক্ষীয় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে শান্তি, নিরাপত্তা, আর্থিক স্থিতিশীলতা ও টেকসই পরিবেশের মতো বৈশ্বিক সেবা সবার দ্বারে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। তাদের মডেলটা এ রকম: জাতিরাষ্ট্রগুলোকে এক সূত্রে বেঁধে অভিন্ন মানদণ্ড, রীতি ও চুক্তির ভিত্তিতে পরিচালনা করা।
জাতির মহিমা খুঁজতে গিয়ে হিটলার কী করেছিলেন, তা আমাদের অজানা নয়। তাঁর কারণে সারা পৃথিবীতে রক্তস্রোত বয়ে গিয়েছিল, যাকে বলে হলোকাস্ট। ধ্বংস হতে বসেছিল এতকালের সভ্যতা। এটাকে দ্বিপক্ষীয় ব্যবস্থার চূড়ান্ত পরিণতি বলা যেতে পারে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তত্কালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল ১৯৪১ সালে আটলান্টিক সনদ স্বাক্ষর করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালের বিশ্বব্যবস্থা হিসেবে এতে ঘোষণা করা হয়, শান্তির ভিত্তি হচ্ছে স্বাধীনতা। তাই দ্বিপক্ষীয় ব্যবস্থা সংকুচিত করতে হবে। ছোট দেশ বড় দেশের করদ রাজ্য হিসেবে থাকতে পারে না। আর কোনো ভূমি দখল নয়, নতুন করে জোরপূর্বক শুল্ক আরোপ নয়; অন্যদিকে সমুদ্র স্বাধীন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তির জয় ও আটলান্টিক সনদ থেকে আমরা এক নতুন বৈশ্বিক চুক্তি পেলাম। অর্থাত্ তখন থেকে আন্তর্জাতিক নিয়ম ও প্রতিষ্ঠান মেনে চলে সব দেশ বৈশ্বিক খেলায় অংশ নিতে শুরু করে। এটাকে বহুপক্ষীয় বিশ্ববাদ বলা যায়। ফ্রান্স ও জার্মানির মধ্যে পুনঃসমঝোতা হয়, যার মাধ্যমে ইউরোপের মতো দীর্ঘ দ্বন্দ্ব-বিবাদে জর্জরিত অঞ্চল সহযোগিতার অসাধারণ নজির স্থাপন করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে জাতীয় সার্বভৌমত্বের রাশ টেনে ধরা হলো, ফলে পৃথিবীর সমৃদ্ধির চাকা অনেক দ্রুতগতিতে ছুটতে শুরু করল। কোটি কোটি মানুষ দারিদ্র্যের চক্র থেকে বেরিয়ে এল। আপেক্ষিকভাবে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হলো।
বইয়ের প্রথম অধ্যায়ে স্টিগলিত্স আমাদের বলেন, গত দেড় শতকে পৃথিবীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কেন্দ্র ছিল জাতিরাষ্ট্র। কিন্তু বিশ্বায়নের কারণে এই জাতিরাষ্ট্রের ভূমিকা ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে। একদিকে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক শক্তি, অন্যদিকে ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের রাজনৈতিক দাবি—এ দুইয়ে মিলে এমনটা হচ্ছে। পৃথিবীর দেশগুলো ক্রমশ অঙ্গীভূত হচ্ছে, ফলে অনেক ক্ষেত্রেই এখন সামষ্টিক ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা সৃষ্টি হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই, একত্রে কাজ করতে গেলে সমন্বয়ের বিকল্প নেই। আমাদের সামনে এখন এত এত সমস্যা আছে, যেগুলো কেবল বৈশ্বিক পরিসরেই সমাধান করা সম্ভব: বাণিজ্য, পুঁজি ও পরিবেশ। বিশেষ করে, পরিবেশের কথা আমরা বলতে পারি, কারণ, বাংলাদেশের মতো দেশ বৈশ্বিক উষ্ণায়নে কিঞ্চিত্ ভূমিকা রাখলেও এ কারণে যে কটি দেশ বেশি ভুগছে, বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম। স্টিগলিত্স আমাদের বলছেন, জাতিরাষ্ট্র দুর্বল হলেও আন্তর্জাতিক পরিসরে এমন কোনো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি, যার মাধ্যমে বিশ্বায়নসৃষ্ট সমস্যাসমূহ কার্যকরভাবে আমলে নেওয়া সম্ভব।
এই পরিপ্রেক্ষিতে স্টিগলিত্স বলছেন, অর্থনৈতিক বিশ্বায়নের গতি রাজনৈতিক বিশ্বায়নের গতি ছাড়িয়ে গেছে। আমাদের বৈশ্বিক শাসনব্যবস্থাটা বিশৃঙ্খল ও সমন্বয়হীন হয়ে পড়েছে। একগাদা কিছু প্রতিষ্ঠান গজিয়ে উঠেছে, কিছু মতৈক্য ও বন্দোবস্ত আছে, কিন্তু বৈশ্বিক সরকার-জাতীয় কিছু গড়ে ওঠেনি। বিভিন্ন দেশের অর্থমন্ত্রীরা আন্তর্জাতিক মুদ্রা সংস্থায় গিয়ে অর্থনৈতিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেন। তাঁদের সিদ্ধান্ত কীভাবে পরিবেশ বা বৈশ্বিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় প্রভাব ফেলছে, সে ব্যাপারে তাদের ভ্রুক্ষেপ নেই। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন নিয়ে পরিবেশমন্ত্রীরা হয়তো কিছু করার আহ্বান জানাতে পারেন, কিন্তু সেটা চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো ক্ষমতা তাঁদের হাতে নেই।
জাতিরাষ্ট্রের উদ্ভবের সঙ্গে মানুষ দেশের মধ্যে অন্য মানুষের প্রতি যুক্ততা বোধ করেছে। স্বাভাবিকভাবেই এটি ঘটেছে, কিন্তু স্টিগলিত্স আমাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার স্মরণ করিয়ে দেন। তিনি বলেন, বিশ্বায়িত পৃথিবীতে জাতিরাষ্ট্রের ভূমিকা সংকুচিত হওয়া সত্ত্বেও মানুষের আনুগত্য কিন্তু জাতিরাষ্ট্রের প্রতিই রয়ে গেছে। এ ক্ষেত্রে খুব একটা পরিবর্তন আসেনি। যুদ্ধের সময় ব্যাপারটা একদম পরিষ্কার হয়ে যায়: ইরাক যুদ্ধের সময় মার্কিনরা নিজেদের সেনা মারা যাওয়ার পইপই হিসাব রাখত, কিন্তু যখন ইরাকি সেনা ও জনগণের তালিকা আসত, সেটা নিয়ে অত আলোচনা হতো না। অথচ মার্কিন সেনাদের চেয়ে অন্তত ৫০ গুণ বেশি ইরাকি ওই যুদ্ধে মারা গেছে। এই ব্যবস্থায় আমাদের অন্যদের জায়গায় নিজেকে বসিয়ে চিন্তা করতে হবে।
এসব সমস্যা নিরসনে শক্তিশালী আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তা আছে। কিন্তু আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল। যে প্রতিষ্ঠানগুলো সিদ্ধান্ত নেয় তাদের মধ্যে গণতন্ত্রের ঘাটতি থাকাটা পরিষ্কারভাবেই সমস্যা। ব্যাপারটা হচ্ছে ধরুন তুরস্কে ভূমিকম্প হলো বা ইথিওপিয়ায় দুর্ভিক্ষ ও ইন্দোনেশিয়ায় সুনামি হলো, বিশ্বায়িত গণমাধ্যমের সুবাদে আমরা হয়তো সেই দৃশ্য দেখছি বা তাদের জন্য সাহায্য পাঠানো হচ্ছে; কিন্তু আমাদের শুধু এটুকু করলেই চলবে না, এর চেয়ে আরও বেশি কিছু করতে হবে।
স্টিগলিত্স আমাদের বলেন, উন্নত দেশগুলো নিজেদের মতো করে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যনীতি সাজিয়ে তার কারখানা ও কৃষকদের বাঁচিয়ে দেয়, যাতে তাদের উন্নয়নশীল বিশ্বের অধিকতর দক্ষ উত্পাদকদের মুখোমুখি হতে না হয়। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো আমাদের যে ক্ষতি করে, তার দায়ও এরা এড়িয়ে যায়। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের নেতৃত্বে বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থা অপব্যয়ী, অর্থাত্ ধনী ঋণগ্রহীতাদের পুরস্কৃত করলেও গরিব ঋণগ্রহীতাদের শাস্তি দেয়। বহুজাতিক ব্যাংকগুলো উন্নয়নশীল দেশে গিয়ে অন্য বহুজাতিক ও বড় বড় করপোরেশনের ব্যাংকার হিসেবে কাজ করে। স্থানীয় শিল্পের বিকাশে তাদের তেমন নজর থাকে না।
স্টিগলিত্স এই বইয়ে পাঠকদের নানা ইস্যুর মধ্য দিয়ে নিয়ে যান, বাণিজ্য থেকে শুরু করে, বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদের অধিকার, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা পর্যন্ত। বইয়ের প্রতিটি অধ্যায়ে একটি করে সমস্যা উপস্থাপন করা হয়েছে, যার সঙ্গে আছে বিশ্লেষণ। স্টিগলিত্স এখানেই থেমে থাকেন না, তিনি সমাধানেরও প্রস্তাব দেন। পাতার পর পাতায় স্টিগলিত্স আমাদের বলেন, বিশ্বায়ন আমাদের অনেক ভালো করতে পারে। কিন্তু ধনী দেশগুলো নিজেদের স্বার্থে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা প্রণয়ন করে। সে কারণে এই ব্যবস্থা অসম ও অদক্ষ। তো এবার আমরা বিষয়ভিত্তিক আলোচনায় যাব:
মুক্ত বাণিজ্য
বিশ্বায়ন নিয়ে আলোচনা করতে গেলে মুক্ত বাণিজ্যের প্রসঙ্গটি সবার আগে চলে আসে। এটি নিয়েই সবচেয়ে বেশি আলোচনা হয়। উন্নয়নের পেছনে বাণিজ্যের বড় ভূমিকা আছে, সেটা কিন্তু দৃশ্যমান। বিশ্বায়নের বদৌলতেই তা সম্ভব হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে বা শিল্পবিপ্লবের সময় যখন পশ্চিমের শনৈঃ শনৈঃ উন্নতি হয়েছে, তখনো তাদের প্রবৃদ্ধির হার কদাচিত্ ৩ শতাংশ অতিক্রম করেছে। আর ১৯৯০ সালের পর যখন বিশ্বায়ন-প্রক্রিয়া দ্রুততর হলো, তারপর চীনের প্রবৃদ্ধির হার এর তিন গুণ হয়ে যায়। যদিও এখন সেটা কিছুটা কমে এসেছে। শুধু চীন নয়, ভারত ও বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হারও ৭-এর ঘর ছুঁয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও উন্নয়নশীল দেশগুলোর কিন্তু অনেক অভিযোগ।
উদার বাণিজ্যপন্থীরা বিশ্বাস করেন, এর মাধ্যমে অভূতপূর্ব উন্নয়ন সম্ভব। তাঁরা চান, উন্নত দেশগুলো উন্নয়নশীল দেশের পণ্য আমদানির জন্য বাজার খুলে দিক, বাজারের উদারীকরণ করুক এবং পণ্য ও সেবার যাতায়াত পথের প্রতিবন্ধকতা তুলে নিক। তাঁরা মনে করেন, এতে বিশ্বায়নের ভেলকি দেখা যাবে। কিন্তু স্টিগলিত্স আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন, বাণিজ্য উদারীকরণ বিশ্বায়নের সবচেয়ে বিতর্কিত দিক। অনেকেই মনে করেন, এর ফলে মজুরি কমে যাওয়া, ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব ও জাতীয় সার্বভৌমত্ব হারানোর হুমকি থাকে, যেগুলোর প্রভাব এর সম্ভাব্য উপকারের চেয়ে অনেক বেশি।
অংশত মুক্ত বাণিজ্য কখনো সংঘটিত হয়নি, কারণ এই চেষ্টা কখনো হয়নি। অতীতকালে যত বাণিজ্য চুক্তি হয়েছে তার কোনোটি মুক্ত ও ন্যায্য ছিল না। এগুলো অসম ছিল, যার মাধ্যমে উন্নয়নশীল দেশের বাজার উন্নত দেশের পণ্যের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু এর পূর্ণাঙ্গ প্রতিদানের ব্যবস্থা ছিল না। নানা ধরনের সূক্ষ্ম ও কার্যকর বাণিজ্য বাধা রাখা হয়েছে। এতে উন্নয়নশীল দেশগুলোর অবস্থা খারাপ হয়েছে। বাস্তবে মুক্ত বাণিজ্য না থাকলে এরা অতটা ক্ষতিগ্রস্ত হতো না, যতটা তারা হয়েছে এই মুক্ত বাণিজ্যের কারণে।
আবার উল্লিখিত বাণিজ্য বাধা দূর করা হলেই যে সবাই এ কারণে উপকৃত হবে, এমন কথা নেই। উন্নত দেশগুলো সহজেই এর সুযোগটা নিতে পারে। কারণ, তাদের অবকাঠামো ও প্রস্তুতি আছে। দেখা যায়, অনেক দেশের সেই অবকাঠমো নেই, যার মাধ্যমে তারা পণ্য বাজারে নিয়ে যেতে পারে। আবার উন্নত দেশগুলোর পণ্যের গুণমানের যে শর্ত দেয়, তা পূরণ করাও তাদের পক্ষে কঠিন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ইউরোপ ২০০১ সালে নিজের বাজার দরিদ্রতম দেশগুলোর জন্য খুলে দিলেও এর ফলে নতুন বাণিজ্য হয়নি। ফলে বাণিজ্য উদারীকরণ হলে যে বাণিজ্য বাড়বে—এমন প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে আরও অনেক কিছু করা দরকার।
স্টিগলিত্স নর্থ আমেরিকান ফ্রি ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট বা নাফটার প্রসঙ্গ টেনে মুক্ত বাণিজ্যের বৈসাদৃশ্য বুঝিয়েছেন। ১৯৯৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও মেক্সিকোর মধ্যে এই চুক্তি হয়। ওই সময় এটা পৃথিবীর বৃহত্তম মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল ছিল। এর মাধ্যমে পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী দেশের বাজার মেক্সিকোর জন্য উন্মুক্ত হয়ে গেল। এতে মেক্সিকোর অর্থনীতি প্রথম দিকে কিছুটা ফুলেফেঁপে উঠলেও পরবর্তীকালে তাদের তেমন অগ্রগতি হয়নি। দেখা গেল, একসময় মেক্সিকো আরও বেশি করে মার্কিন অর্থনীতির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। অর্থাত্ মার্কিন অর্থনীতি যেমন ঠিকঠাক এগোয়নি, তেমনি মেক্সিকোর অর্থনীতিও এগোয়নি। বরং বলা যায়, এর মাধ্যমে এর কারণে মেক্সিকোয় দারিদ্র্য আরও বৃদ্ধি পায়। এতে হলো কী, মেক্সিকোর গরিব কৃষকদের উচ্চ ভর্তুকিপ্রাপ্ত মার্কিন কৃষিপণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামতে হলো। যদিও দেশটির শহুরে নাগরিকেরা কম দামের পণ্যের কারণে লাভবান হলো। এই বাণিজ্য চুক্তি যদি ন্যায্য হতো, তাহলে মার্কিনদের পক্ষে কৃষিতে ভর্তুকি দেওয়া সম্ভব হতো না। একইভাবে, দেশটিতে চিনির মতো কৃষিপণ্য আমদানির ওপরও নিষেধাজ্ঞা থাকত না। এমনকি যুক্তরাষ্ট্র যদি ভর্তুকি তুলে নাও নিত, তাহলে অন্তত মেক্সিকোকে কাউন্টারভেইল করার সুযোগ দিতে হতো। অর্থাত্ তাকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা ভর্তুকিপ্রাপ্ত পণ্যে শুল্ক আরোপের সুযোগ দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু নাফটায় সেই সুযোগ নেই।
নাফটা শুল্ক বাধা নিরসন করলেও দেখা গেল, নানা রকম অশুল্ক বাধা দাঁড়িয়ে গেল। নাফটা স্বাক্ষরিত হওয়ার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার বাজারে মেক্সিকোর পণ্য প্রবেশে বাধা দেওয়ার জন্য নানা রকম অশুল্ক বাধা আরোপ করতে শুরু করে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ১৯৯৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রে যখন মেক্সিকোর টমেটো ঢুকতে শুরু করল, ফ্লোরিডার টমেটোচাষিরা কংগ্রেস ও ক্লিনটন প্রশাসনকে চাপ দিতে শুরু করলেন, যাতে তারা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়। যদি দেখানো যায়, মেক্সিকোর টমেটো উত্পাদনমূল্যের চেয়ে কম দামে বিক্রি হচ্ছে, তাহলে তার বিরুদ্ধে ডাম্পিংয়ের অভিযোগ আনা যাবে। তখন আবার অ্যান্টিডাম্পিং শুল্ক আরোপ করা যায়। কিন্তু মেক্সিকো টমেটোতে ডাম্পিং করছিল না। যে কারণে মনে হচ্ছিল, মেক্সিকো কম দামে টমেটো বিক্রি করছিল তা হলো, তারা কিছুটা ভারসাম্যহীনভাবে এই দাম নির্ধারণ করছিল। কিন্তু মেক্সিকো বিচারের মুখে পড়তে চায়নি, তাই তারা টমেটোর দাম বাড়াতে রাজি হয়। এতে মেক্সিকোর টমেটোচাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হন। কিন্তু ফ্লোরিডার চাষিরা যা চাচ্ছিলেন সেটা পেয়ে গেলেন।
তবে এই চুক্তি থেকে মেক্সিকো একেবারে লাভবান হয়নি তা নয়। বিশেষ করে, দেশটির দক্ষিণ সীমান্তবর্তী অঞ্চলে বড় বড় মার্কিন কোম্পানির জন্য সস্তা দামে যন্ত্রাংশ উত্পাদনের ছোট ছোট কারখানা গড়ে ওঠে। কিন্তু পরবর্তীকালে চীনা কোম্পানিগুলো এই জায়গা দখল করে নেয়। কারণ, শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে চীন মেক্সিকোর চেয়ে ঢের বেশি বিনিয়োগ করেছিল। ফলে শুধু শুল্কই একমাত্র বিবেচ্য নয়, এই বিষয়টি আমাদেরও বিবেচ্য হওয়া দরকার। শিক্ষা ও গবেষণা খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা কী, সেটা আমাদের এই নাফটার ইতিহাস থেকে বোঝা উচিত।
তাহলে বাণিজ্যের ন্যায্য নীতি বলতে কী বোঝায়? স্বাভাবিকভাবে যে বাণিজ্যে ভর্তুকি ও বাধা থাকবে না, সেটাই হবে ন্যায্য বাণিজ্য। তবে নিশ্চিতভাবেই আমাদের পৃথিবী এ রকম বাণিজ্যের আশপাশেও নেই। উদারীকরণের এই অসমতার কারণে এক গোষ্ঠীর বিনিময়ে আরেক গোষ্ঠী লাভবান হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, এখনকার অধিকাংশ বাণিজ্যনীতিতে কৃষি ছাড়া অন্য সব ক্ষেত্রে ভর্তুকি নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু যেসব উন্নয়নশীল দেশের কৃষকেরা ভর্তুকি পান না, এ কারণে তাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হন। আর উন্নয়নশীল দেশের ৭০ শতাংশ মানুষ যেখানে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল, তাই এসব দেশের মানুষের আয় কমে যায়। অর্থাত্ যে মানদণ্ডেই দেখা হোক না কেন, এখনকার আন্তর্জাতিক বাণিজ্য উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য অন্যায্য। ব্যাপারটা হয় কি, চীনের মতো দেশগুলো কৃষকের ক্ষতি কমাতে কৃষিতে ভর্তুকি দিতে পারে, কিন্তু সেটা হলে তাদের উন্নয়ন ব্যয় কমে যাবে। আবার দেখা যায়, উন্নয়নশীল দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এমন পণ্যের বাণিজ্য উদারীকরণের বেলায় নানা সীমাবদ্ধতা থাকে, যেমন কৃষি ও টেক্সটাইল। বিশেষ করে, টেক্সটাইলের ক্ষেত্রে দেশ ও পণ্যভিত্তিক নানা কোটা দেখা যায়। একইভাবে, উন্নত দেশগুলো কৃষিকে সুরক্ষিত রাখতে ভর্তুকি দেয়, যেটা আমরা আগেও দেখেছি। ১৯৯৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা গঠিত হয়। কিন্তু এই সংস্থার কার্যক্রম নিয়ে মানুষের মধ্যে এত অসন্তোষ সৃষ্টি হয় যে এর বিভিন্ন সম্মেলনের সময় মানুষ প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসে।
যা হোক, এই অসমতা দূর করতে স্টিগলিত্স সমাধান বাতলে দেন। তিনি প্রস্তাব করেন, উন্নয়নশীল দেশগুলোকে পৃথকভাবে দেখতে হবে। কিন্তু বিদ্যমান ব্যবস্থায় এই ব্যাপারটা উন্নত দেশের মর্জির ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এখন এই উন্নয়নশীল দেশগুলো যদি উন্নত দেশের কথা না শোনে, তাহলে উন্নত দেশগুলো এদের দেওয়া প্রাধিকারমূলক সুযোগ-সুবিধা ফেরত নিতে পারে। এটা এখন উন্নত দেশগুলোর হাতে রাজনৈতিক অস্ত্র হয়ে গেছে। স্টিগলিত্স বলেন, স্রেফ একটি সংস্কার এর প্রতিকার করতে পারে। সেটা হলো, উন্নত দেশগুলোকে প্রতিদানের আশা এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শর্ত ছাড়াই স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য বাজার খুলে দিতে হবে। অন্যান্য স্বল্পোন্নত দেশকেও সে এই সুবিধা দিতে পারবে—এমন বিধানও থাকবে। তবে অন্য উন্নত দেশগুলোকে সে এই সুবিধা দিতে পারবে না। মধ্য আয়ের দেশগুলোকেও এই কাজ করতে হবে। তবে তারাও উন্নত দেশকে এই সুবিধা দিতে পারবে না, এতে তাদের শিল্পের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সুযোগ থাকবে না। অর্থাত্ শুধু সমতা নয়, ন্যায়সংগতভাবে প্রাধিকারমূলক সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে।
একই সঙ্গে, স্টিগলিত্স দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তি নিরুত্সাহিত করে বলেছেন, এতে উন্নত দেশগুলো লাভবান হয়। ব্যাপারটা খুব সহজেই বোঝা যায়, বিশ্বায়িত ব্যবস্থা না থাকলে বাংলাদেশকে যদি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য করতে হতো, তাহলে আমাদের পক্ষে দেশটিতে রপ্তানি করা সম্ভব হতো না। কারণ, তাদের শর্ত পূরণ করার মতো জায়গায় আমরা নেই। অন্যদিকে শুল্ক বাধা এখন অনেকটা কমে এলেও বড় দেশগুলো নানা রকম অশুল্ক বাধা আরোপ করে, যেমন পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ-সংক্রান্ত জটিলতা। যেমন ভারত বাংলাদেশের বিএসটিআইয়ের মান নিয়ন্ত্রণ নিয়ে প্রশ্ন তুলে কিছু পণ্য আমদানি বন্ধ করে দিয়েছিল। এখন দুই দেশের মান নিয়ন্ত্রক সংস্থার মধ্যে সমন্বয় হওয়ায় এই বাধা কমে আসছে। আবার নিজের দেশের শিল্প রক্ষার্থে বড় দেশ দাবি করে, রপ্তানিকারক দেশ পণ্যে ডাম্পিং করে তাদের দেশে কম দামে বিক্রি করছে। এর প্রতিকার হিসেবে তারা অ্যান্টিডাম্পিং শুল্ক আরোপ করছে। এসব অভিযোগ নিয়ে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় যাওয়ার সুযোগ আছে, কিন্তু পণ্যের মান ও মূল্য নির্ধারণে বহুপক্ষীয় বা সর্বজনীন ব্যবস্থা না থাকলে এর হাত থেকে আমাদের নিস্তার নেই। স্টিগলিত্স আমাদের সেই পরামর্শই দেন।
মেধাসম্পদ
একসময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও উন্নত দেশগুলো উত্পাদননির্ভর থাকলেও ধীরে ধীরে তারা সেখান থেকে বেরিয়ে এসে উচ্চপ্রযুক্তি ও সেবা খাতনির্ভর হয়ে পড়ে। ফলে আবিষ্কার ও পণ্যের মেধাস্বত্ব তাদের জন্য আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। স্টিগলিত্স আমাদের বলেন, ক্ষেত্রবিশেষে আবিষ্কারকে উত্সাহিত করতে এর দরকার আছে। কিন্তু সেটা যখন একচেটিয়াত্ব তৈরি করে, তখনই ঝামেলা শুরু হয়। অর্থাত্ সাধারণ মানুষ ভুক্তভোগী হয়।
১৯৯৪ সালের ১৫ এপ্রিল উরুগুয়ে রাউন্ডে বাণিজ্যমন্ত্রীরা স্বাক্ষর করেন। এর মধ্যে একটি ছিল ট্রেড রিলেটেড অ্যাসপেক্টস অব ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টি রাইটস (ট্রিপস), যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত দেশগুলো অনেক দিন ধরেই চেয়ে আসছিল। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সব সদস্যদেশের ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য। এর মাধ্যমে তারা অন্য দেশগুলোকে তাদের পেটেন্ট ও কপিরাইট মানতে বাধ্য করে। মূলত ওষুধের উচ্চ দাম নিশ্চিত করতেই এটা করা হয়। বাজারে জেনেরিক ওষুধের আগমন বিলম্বিত করেও উচ্চ মুনাফা নিশ্চিত করা হয়। এর মধ্য দিয়ে মানুষের স্বাস্থ্য ও জীবনের ওপর করপোরেট স্বার্থ প্রাধান্য পায়।
ফলে ভারসাম্যপূর্ণ মেধাস্বত্ব আইন করতে গেলে একটি কঠিন প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে, সেটা হলো, কিসের পেটেন্ট করা যায়? এর মেয়াদ কত দিনের হবে? এর আওতাই বা কত বড় হবে। এর উত্তরের সঙ্গে আবার অর্থনীতির প্রতিযোগিতা ও উদ্ভাবনের মাত্রার সম্পর্ক আছে। কথা হচ্ছে বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদই শেষ কথা নয়, এটা লক্ষ্য অর্জনের পথ। কিন্তু আমরা কি এমন ব্যবস্থা করতে পারি না, যার মাধ্যমে একদিকে সামাজিক ন্যায্যতা নিশ্চিত করা যাবে, আবার উদ্ভাবনও চলতে থাকবে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর যেন বেশি ভুগতে না হয়, এমনভাবে কি এই বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা করা যায় না? স্টিগলিত্স বিশ্বাস করেন, এটা সম্ভব। তিনি বলেন, এর জন্য আমাদের আগে দেখতে হবে, আমরা কী অর্জন করতে চাই। ২০০৪ সালের অক্টোবর মাসে জেনেভায় ওয়ার্ল্ড ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টি অর্গানাইজেশনের (ডব্লিউআইপিও) সাধারণ সভায় ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার পেশকৃত প্রস্তাব গৃহীত হয়। তারা সেখানে উন্নয়নমুখী বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ ব্যবস্থাপনার কথা বলে।
আজকের পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে তৃতীয় বিশ্বের দারিদ্র্য। উন্নয়নশীল দেশগুলোর অধিকতর সম্পদ, সহায়তা ও সুযোগ দরকার। কিন্তু স্টিগলিত্স লক্ষ করেছেন, উন্নয়নশীল দেশগুলো উন্নত দেশগুলো থেকে শুধু সম্পদের কারণে ভিন্ন নয়, তাদের মধ্যে জ্ঞানগত পার্থক্যও আছে। বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে এই পার্থক্য যেমন কমানো যায়, তেমনি আবার বাড়ানোও যায়। সে কারণে উন্নয়নশীল দেশগুলো জ্ঞানের ভান্ডারে আরও বেশি প্রবেশাধিকার চায়। ব্যাপারটি আসলে এ রকম যে এসব দেশের বাজেট তো এমনিতেই কম, ফলে ওষুধের পেছনে অতিরিক্ত এক ডলার ব্যয় করা মানে শিক্ষা বা স্বাস্থ্য খাতে এক ডলার কমে যাওয়া। ওষুধের দামের প্রভাব ব্যাপক, সে কারণে যৌক্তিক দামে জীবন রক্ষাকারী ওষুধের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা এতটা গুরুত্বপূর্ণ। পাঠক, চোখ বন্ধ করে একবার আমাদের স্বাস্থ্যসেবা ও ওষুধের দামের কথা ভাবুন!
এই পরিপ্রেক্ষিতে স্টিগলিেসর পরামর্শ হচ্ছে, এই বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা উন্নয়নশীল দেশের সাপেক্ষে নির্ধারণ করতে হবে। তার সঙ্গে জীবন রক্ষাকারী ওষুধের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করতে হবে। তিনি বলেন, উন্নত দেশগুলোর উচিত, উন্নয়নশীল দেশগুলোর ওপর বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ বাবদ করারোপ না করা, যাতে তারা নিজেদের জনগণের জন্য বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ ব্যবহার করতে পারে। এতে এসব দেশের মানুষেরা উত্পাদনের খরচে ওষুধ কিনতে পারে। এতে অনেকেই বলতে পারেন, উন্নয়নশীল দেশ কি উন্নত দেশের ঘাড়ে চড়ে বিনা পয়সায় সব পাবে। স্টিগলিত্স বলেন, অবশ্যই, তাদের এই সুযোগ দেওয়া উচিত। কারণ, এই উন্নত দেশগুলো উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে বহু কিছু নিয়েছে। এ ছাড়া ওষুধশিল্প পৃথিবীর সবচেয়ে নিয়ন্ত্রিত শিল্পের একটি। ওষুধের দাম মূলত বিমা কোম্পানি ও সরকার পরিশোধ করে থাকে। এ ছাড়া তিনি খেয়াল করেছেন, ওষুধ কোম্পানিগুলো বিজ্ঞাপনের জন্য যতটা ব্যয় করে, গবেষণা খাতে অতটা ব্যয় করে না। ফলে দাম বেশি আরোপ করা হলে তা যে গবেষণায় প্রণোদনা দেয়, এ কথা হলফ করে বলা যায় না। সাধারণ বুদ্ধিতেই আমরা বলতে পারি, ব্যাপারটা নির্ভর করে রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপর। একই সঙ্গে, স্টিগলিত্স বায়োপাইরেসি বন্ধ করে স্থানীয় জ্ঞান সংরক্ষণে জোর দেন।
এ ছাড়া স্টিগলিত্স এই বইয়ে বৈশ্বিক রিজার্ভ ব্যবস্থাপনা, বহুজাতিক করপোরেশনের ভূমিকা, সম্পদ বণ্টন প্রভৃতি বিষয়েও বিস্তর আলোচনা করেছেন। এ ব্যাপারে কী করণীয় সে পরামর্শও দিয়েছেন। তিনি বলেন, বিশ্বায়ন কার্যকর করতে হলে এমন এক আন্তর্জাতিক জমানা গড়ে তুলতে হবে, যেখানে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে ভারসাম্য থাকবে। তিনি এটার নামকরণ করেছেন নিউ গ্লোবাল সোশ্যাল কনট্রাক্ট (নব্য বৈশ্বিক সামাজিক চুক্তি)। এর মূল বিষয়গুলো নিম্নরূপ:
১. ন্যায্য বাণিজ্য জমানা তৈরিতে উন্নত দেশগুলোর অঙ্গীকার, যার মাধ্যমে প্রকৃত অর্থেই উন্নয়নের বাড়বাড়ন্ত হবে।
২. বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদের ব্যাপারে নতুন মনোভঙ্গি গ্রহণ ও গবেষণায় অধিকতর পৃষ্ঠপোষকতা। উদ্ভাবনের জন্য প্রণোদনা ও বিনিয়োগ, এতে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জ্ঞানের ভান্ডারে প্রবেশাধিকার নিশ্চিত হবে। ফলে জীবন রক্ষাকারী ওষুধের দাম আয়ত্তের মধ্যে চলে আসবে। প্রথাগত সম্পদ রক্ষায় উন্নয়নশীল দেশগুলোর অধিকার।
৩. উন্নত দেশগুলোর কর্মযজ্ঞে উন্নয়নশীল দেশগুলোর যে পরিবেশগত ক্ষতি হচ্ছে, তার ক্ষতিপূরণে মতৈক্য থাকতে হবে। সেটা যেমন জীববৈচিত্র্য রক্ষার মাধ্যমে করতে হবে, তেমনি কার্বন নিঃসরণ হ্রাসের মধ্য দিয়েও। আমাদের বুঝতে হবে, উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো একই পৃথিবীতে টিকে আছে, তাই আমাদের সবাইকে কার্বন নিঃসরণ কমাতে হবে। তাই এর জন্য কে দায়ী আর কে নয়, তা নিয়ে কলহ না করে আমাদের আন্তরিকভাবে কিছু একটা করতে হবে।
৪. উন্নত দেশগুলোকে অঙ্গীকার করতে হবে, উন্নয়নশীল দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারের জন্য তারা ন্যায্য মূল্য দেবে। আর তারা এমনভাবে এটা ব্যবহার করবে যে তাতে প্রকৃতির ক্ষতি হবে না।
৫. উন্নত দেশগুলো উন্নয়নশীল দেশগুলোকে জিডিপির শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ আর্থিক সহায়তা দেওয়ার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, সেটার নবায়ন করতে হবে তাদের। এবার এর সঙ্গে এটা পূরণের লক্ষ্যে কাজও করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র যদি ইরাক যুদ্ধে ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় করতে পারে, তাহলে তারা নিশ্চয়ই দারিদ্র্যবিরোধী লড়াইয়ে বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলার দিতে পারবে।
৬. ২০০৫ সালের জুলাইয়ে ঋণ মওকুফের যে অঙ্গীকার করা হয়েছিল, তার আওতায় আরও অনেক দেশকে নিয়ে আসতে হবে। ব্যাপারটা হয়েছে কী, বিপুল পরিমাণ ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে অনেক দেশের উন্নত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা ব্যাহত হয়। এই অঙ্ক এতটা বিপুল যে গত কয়েক বছরে আমরা লক্ষ করেছি, উন্নয়নশীল দেশ থেকে টাকা উন্নত দেশগুলোতে চলে যাচ্ছে।
৭. বৈশ্বিক আর্থিক কাঠামোর সংস্কার করে এর অস্থিতিশীলতা হ্রাস করতে হবে। স্টিগলিত্স বলেন, ঝুঁকির দায়টা উন্নয়নশীল দেশের কাঁধে না চাপিয়ে উন্নত দেশের কাঁধে চাপাতে হবে, যাদের তা বহনের সক্ষমতা আছে। বিশেষ করে, তিনি বৈশ্বিক রিজার্ভ ব্যবস্থা সংস্কারের কথা বলেছেন, কারণ বিদ্যমান ব্যবস্থায় উন্নয়নশীল দেশের রিজার্ভের টাকা উন্নত দেশগুলোর হাতে চলে যাচ্ছে। অথচ এই টাকাটা ভিন্নভাবে ব্যবস্থাপনা করা হলে উন্নয়নশীল দেশগুলো শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়াতে পারত।
এর বাইরে স্টিগলিত্স বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাঠামোগত সংস্কারের পরামর্শ দেন। মূলত তিনি আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের কথা বলেন। আইএমএফে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই একমাত্র দেশ, যার কার্যকর ভেটো প্রদানের ক্ষমতা আছে। এই দুই প্রতিষ্ঠানেই সদস্যদের ভোট প্রদানের ক্ষমতা অর্থনৈতিক শক্তির ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়। তাও সেটা আজকের যুগের অর্থনৈতিক শক্তির ভিত্তিতে নয়, তাদের প্রতিষ্ঠাকালীন আর্থিক সক্ষমতার ভিত্তিতে এই ভোট প্রদানের ক্ষমতা নির্ধারিত হয়। এতে পরিবর্তন আনতে হবে। এ ছাড়া তিনি প্রতিনিধিত্বের ধরন ও নীতিতেও পরিবর্তন আনার প্রস্তাব দেন। দ্বন্দ্ব নিরসনের পদ্ধতিও উন্নত করার প্রস্তাব দেন তিনি। প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম আরও উন্মুক্ত করার পক্ষপাতী তিনি।
মোদ্দা কথা হলো, বিশ্বায়ন এখনো একরকম অর্থনৈতিক পরিসরেই সীমিত আছে। সে কারণে বড় দেশগুলো চাইলে ছোট দেশগুলোর ওপর যা খুশি তা-ই চাপিয়ে দিতে পারে। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য আমাদের একধরনের বৈশ্বিক মাতব্বর প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন। জাতিরাষ্ট্রের স্বকীয়তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে এই প্রতিষ্ঠানকে এমনভাবে ক্ষমতায়িত করতে হবে, যাতে বড় দেশ ছোট দেশের ওপর ছড়ি ঘোরাতে না পারে এবং অন্যায় যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়ে তাকে সর্বস্বান্ত করতে না পারে। যাতে করে সবাই সমান সুযোগ পায়। কিন্তু এ ধরনের প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করাটাই সবচেয়ে কঠিন কাজ। সবার রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া এটা কি আদৌ সম্ভব?