সারসংক্ষেপ
বিশ্ব স্বাস্থ্যের ধারণার জন্ম হয়েছে জনস্বাস্থ্য ধারণা থেকে। জনস্বাস্থ্যে একটি জনগোষ্ঠীর সুস্বাস্থ্যের কথা বলা হয়। জনস্বাস্থ্যকে একই সাথে বলা হয় বিজ্ঞান ও শিল্প। এশিয়া-আফ্রিকার উপনিবেশগুলোতে রোগ সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে গিয়ে ঔপনিবেশিক আমলে আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য ধারণাটি চালু হয়েছিল। কিন্তু বিশ্বায়নের প্রভাবে আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্যের ধারণাটি আর টিকে থাকেনি। এর ফলে তখন তা হয়ে ওঠে বৈশ্বিক স্বাস্থ্য। বিশ্ব স্বাস্থ্য শব্দটি নানা অর্থে ব্যবহূত হলেও আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য ও বিশ্ব স্বাস্থ্য শব্দ দুটি সমার্থক অর্থে ব্যবহার করা হয়। বেশ কিছু কারণে বিশ্ব স্বাস্থ্য নিয়ে ভাবা প্রয়োজন। যেমন: বিশ্বের সকল দেশগুলোর মধ্যে সমতা নিশ্চিত; মাতৃমৃত্যু, শিশুমৃত্যু ও বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত মৃত্যুর হার কমানোর জন্য মানবিক সহায়তা; সার্স, বার্ড ফ্লু, এইডসের মতো রোগের সরাসরি প্রত্যক্ষ প্রভাব; বিশ্ব নিরাপত্তার প্রশ্ন এবং পারস্পরিক জ্ঞান, অভিজ্ঞতা বিনিময়। বিশ্ব স্বাস্থ্যের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে ঔপনিবেশিক শাসক দেশগুলো এবং উপনিবেশগুলোর ভেতর স্বাস্থ্য, চিকিত্সাবিষয়ক যোগাযোগ ঘটেছে দুটি উপায়ে—ক্রিশ্চিয়ান মিশনারিদের ধর্মপ্রচার ও ঔপনিবেশিক শাসকদের প্রভাব। ঔপনিবেশিক দেশগুলো স্বাধীন হওয়ার পর থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থার উদ্যোগে বিশ্বের রোগ প্রতিরোধ এবং রোগ নির্মূলের উদ্যোগ নেওয়া হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্যের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতেও বেশ কিছু অগ্রগতি ঘটেছে, যেমন: জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার হ্রাস, মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি, মাতৃমৃত্যুর হার হ্রাস, শিশুমৃত্যুর হার হ্রাস। কিন্তু বিশ্ব পরিবেশের পরিবর্তনের প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের মতো দেশে স্থানীয় স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রেও।
শব্দগুচ্ছ
আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য, বিশ্ব স্বাস্থ্য, জনস্বাস্থ্যবিজ্ঞান, রোগতত্ত্ব, আয়ুর্বেদীয়, ইউনানী, রোগতত্ত্ব, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফ, জনমিতি, রেডক্রস, গণস্বাস্থ্য, স্বাস্থ্যবিমা।
প্রারম্ভিক কথা
বিশ্ব স্বাস্থ্য বিষয়ে কথা বলতে গেলে কয়েকটা ধারণা শুরুতে স্পষ্ট করে নেওয়া দরকার। যেমন আমাদের বোঝা দরকার জনস্বাস্থ্য (Public Health), আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য (International Health) এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য (Global Health) ধারণাগুলোর মধ্যে পার্থক্য কী? আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য বা বিশ্ব স্বাস্থ্য ধারণার জন্ম হয়েছে জনস্বাস্থ্য ধারণা থেকে। জনস্বাস্থ্যের একাডেমিক সংজ্ঞা এ রকম:
The science and art of preventing disease, prolonging life and promoting health through the organized efforts and informed choices of society, organizations, public and private, communities and individuals.
(1920 Winslow in Skolnik 2008)
অর্থাত্, মোটা দাগে বললে জনস্বাস্থ্য হচ্ছে সরকারি, বেসরকারি, সামাজিক বা ব্যক্তি পর্যায়ে রোগ প্রতিরোধ, আয়ু বৃদ্ধি এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য সংগঠিত এবং সঠিক তথ্য জানা সাপেক্ষে নেওয়া সামাজিক উদ্যোগবিষয়ক বিজ্ঞান ও শিল্প। উল্লেখ্য, জনস্বাস্থ্যবিজ্ঞান শুধু ব্যক্তির স্বাস্থ্য নিয়ে ভাবে না, বরং একটা জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য নিয়ে ভাবে। জনস্বাস্থ্যবিজ্ঞান শুধু রোগমুক্তির ওপর জোর দেয় না, বরং রোগ প্রতিরোধ এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষার ওপর জোর দেয়। জনস্বাস্থ্য যেহেতু একটা পুরো জনগোষ্ঠীর সুস্বাস্থ্যের বিষয়ে কথা বলে, ফলে এ ক্ষেত্রে চিকিত্সাবিজ্ঞান ছাড়াও রোগতত্ত্ব, পরিসংখ্যান, অর্থনীতি, সমাজবিজ্ঞানসহ আরও নানা মানবিক বিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্তির প্রয়োজন পড়ে। জনস্বাস্থ্য তাই একাধারে বিজ্ঞান ও শিল্প। এই জনস্বাস্থ্যের ধারণা যখন একটি বিশেষ জনগোষ্ঠী বা একটি বিশেষ দেশের সীমানা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়, তখন আসে আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য বা বিশ্ব স্বাস্থ্যবিষয়ক ধারণা। আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য ও বিশ্ব স্বাস্থ্য ধারণা দুটি খুব কাছাকাছি হলেও এর ভেতর একটা সূক্ষ্ম পার্থক্য রয়েছে।
আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য ধারণাটি মূলত চালু হয়েছিল ঔপনিবেশিক আমলে। ঔপনিবেশিক দেশগুলো যখন তাদের উপনিবেশ বিস্তার করছিল, তখন তাদের অন্যতম একটি চ্যালেঞ্জ ছিল ঔপনিবেশিক অঞ্চলের রোগসমূহ। এশিয়া, আফ্রিকার উপনিবেশ অঞ্চলের রোগ সম্পর্কে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক দেশগুলোর ধারণা ছিল খুব কম। কলেরা, ম্যালেরিয়া, কালাজ্বর ইত্যাদি রোগ, যা এশিয়া-আফ্রিকায় ছিল প্রকট, তার সম্পর্কে ইউরোপীয় চিকিত্সাশাস্ত্রের জ্ঞান ছিল কম। কিন্তু স্বাস্থ্য, রোগ ইত্যাদি বিষয় তাদের উপনিবেশ বিস্তারের জন্য ছিল গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ। ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক দেশগুলোর দরকার ছিল উপনিবেশে সুস্থ একটা শ্রমশক্তি, সেই সঙ্গে দরকার ছিল তাদের ঔপনিবেশিক কর্মকর্তাদের রোগমুক্ত রাখা। ফলে এশিয়া, আফ্রিকা এসব অঞ্চলের রোগ নিয়ে তাদের গবেষণা, চর্চা, রোগ প্রতিরোধের নানা ব্যবস্থা করার প্রয়োজন পড়ে ঔপনিবেশিক অর্থনীতির স্বার্থে। এ সময়ই ইউরোপে আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য ধারণাটির প্রচলন ঘটতে থাকে। সে সময় চিকিত্সাবিজ্ঞানে দুই ধরনের চর্চা শুরু হয়। একটা হচ্ছে ইউরোপীয়দের নিজস্ব অঞ্চলের স্বাস্থ্য, অন্যটি ‘আন্তর্জাতিক’ স্বাস্থ্য। অর্থাত্ স্বাস্থ্যবিষয়ক যা কিছু ইউরোপীয় নয়, তা আন্তর্জাতিক। আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য বলতে তখন এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকার ঔপনিবেশিক অঞ্চলের স্বাস্থ্যকেই বোঝাত। কিন্তু বিংশ শতাব্দীতে এসে উপনিবেশ-উত্তরকালে পরিস্থিতি বদলেছে। পৃথিবী ক্রমেই বিশ্বায়নের অধীনে এসে পড়ায় অতীতের সেই ঔপনিবেশিক এবং অ-ঔপনিবেশিক দেশের বিভাজন ঠিক আগের মতো আর থাকে না। নানা দেশের ভেতর পারস্পরিক যোগাযোগের মাত্রাটা ঘটে আরও দ্রুততায়, আরও জটিল প্রক্রিয়ায়। মোটা দাগে বিশ্বায়নের অর্থ বললে দাঁড়ায়, বিশ্বব্যাপী পণ্য, মানুষ ও চিন্তার চলাচল। এই চলাচল ইতিহাসে সব সময়ই ছিল কিন্তু বিংশ শতাব্দী পেরিয়ে একবিংশ শতাব্দীতে এসে এই চলাচলের মাত্রা হয়েছে দ্রুততর এবং ব্যাপক। এই পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যকেও শুধু ইউরোপীয় আর অ-ইউরোপীয় হিসেবে বিভাজিত করে রাখার আর কোনো উপায় নেই। এই সূত্রে ক্রমেই বিশ্ব স্বাস্থ্য ধারণাটি আলোচনায় আসে। বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্যবিষয়ক পারস্পরিক সহযোগিতামূলক প্রতিষ্ঠান বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৪৮ সালে। কিন্তু আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য ধারণাটি আরও ব্যাপক আকার নিয়েছে। আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য বলতে একসময় বোঝাত মূলত স্বল্প ও নিম্ন আয়ের দেশসমূহ, যারা গড়ে তৃতীয় বিশ্ব নামে পরিচিত, সেসব দেশের স্বাস্থ্যকে। কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য কোনো নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমার স্বাস্থ্য নয়, পুরো বিশ্বেরই স্বাস্থ্য। আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্যবিষয়ক কার্যক্রম সাধারণত হতো দুটি দেশের পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে। কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্যবিষয়ক কার্যক্রমে বিশ্বের সব কটি দেশের অংশগ্রহণই জরুরি। ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য’ শব্দটি এখন নানা অর্থে ব্যবহূত হয়। কখনো এটি একটি ধারণা হিসেবে ব্যবহূত হয়, যাতে বোঝায় সাম্প্রতিক বিশ্বের জনগণের স্বাস্থ্য, কখনো এটি ব্যবহূত হয় উদ্দেশ্য হিসেবে অর্থাত্ সুস্থ জনগোষ্ঠীর একটি পৃথিবী গড়ার লক্ষ্য বোঝাতে। বিশ্ব স্বাস্থ্য কখনো একটি গবেষণার বিষয়, কখনো এটি মাঠপর্যায়ে কাজের বিষয়। যদিও আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য শব্দ দুটি এখনো অনেক ক্ষেত্রেই সমার্থক হিসেবে ব্যবহার হয় কিন্তু ক্রমেই আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য শব্দটির ব্যবহার কমে আসছে এবং তার জায়গা দখল করছে বিশ্ব স্বাস্থ্য শব্দটি। প্রথমত, আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য শব্দটার সঙ্গে ঔপনিবেশিকতার একটা সম্পর্ক আছে বলে এবং দ্বিতীয়ত, বিশ্বায়ন ক্রমেই প্রবল হয়ে ওঠায় পৃথিবীর সমস্যাগুলো এখন পরস্পর যুক্ত, এই ধারণা শক্তিশালী হয়ে ওঠার কারণে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য নিয়ে ভাবা কেন প্রয়োজন?
উত্তরে কয়েকটা শর্ত ভাবা যেতে পারে:
ক. সমতা নিশ্চিত করার কারণ: আমরা একটা বৈষম্যমূলক পৃথিবীতে বাস করি। দেখা গেছে, বিশ্বের স্বাস্থ্যবিষয়ক ৯০ শতাংশ সমস্যা পৃথিবীর যে অঞ্চলে রয়েছে, সেখানে আছে মাত্র ১০ শতাংশ সম্পদ। উল্টোভাবে যেখানে মাত্র ১০ শতাংশ সমস্যা, সেখানে আছে ৯০ শতাংশ সম্পদ। একে বলা হয় ৯০/১০ বিভাজন। যেমন ধরা যাক আফ্রিকার দেশ মালাউয়ের জনসংখ্যা ১ কোটি ২০ লাখ। এখন সেই পুরো দেশে ২০১০ সালের হিসাবে অর্থোপেডিক সার্জন আছেন মাত্র একজন। অন্যদিকে লন্ডন একটা শহর, যার জনসংখ্যাও ১ কোটি ২০ লাখ, কিন্তু এই একটা শহরেই অর্থোপেডিক সার্জন আছেন ২০০-এর ওপরে। সেভাবে মালাউতে স্বাস্থ্য খাতে মাথাপিছু ব্যয় যেখানে তিন ডলার, সেখানে ব্রিটেনে স্বাস্থ্য খাতে মাথাপিছু ব্যয় ১ হাজার ৮০০ ডলার। কিংবা ধরা যাক, নেপালে এক হাজারে শিশুমৃত্যুর হার ৫৫ জন, অন্যদিকে ব্রিটেনে এক হাজারে শিশুমৃত্যুর হার মাত্র চারজন। বিশ্বব্যাপী বৈষম্যের এমন অগণিত উদাহরণ দেওয়া যায়। বিশ্বের জনপদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য তাই প্রয়োজন স্বাস্থ্য খাতে অর্থ ও সম্পদের সমবণ্টন। পৃথিবীব্যাপী স্বাস্থ্য খাতে একটা ন্যায়ভিত্তিক সমবণ্টন নিশ্চিত করতে হলে আমাদের বিশ্ব স্বাস্থ্য নিয়ে ভাবতে হবে।
খ. মানবিক কারণ: কয়েকটি পরিসংখ্যানের দিকে চোখ বোলানো যাক। পৃথিবীতে এ মুহূর্তে প্রতিদিন গড়ে এক হাজার শিশু তার এক মাস বয়স পূর্ণ হওয়ার আগেই মারা যায়, প্রতিবছর পাঁচ লাখের বেশি নারী প্রসবকালীন জটিলতায় মারা যায়, প্রতিবছর ১০ লাখের বেশি মানুষ যক্ষ্মায় মারা যায়। কিন্তু এই মৃত্যুগুলোকে বিখ্যাত জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ পল ফারমার নাম দিয়েছেন ‘বাজে’ বা ‘অহেতুক’ মৃত্যু বলে। বাজে এ জন্য যে এসব মৃত্যু খুব সহজেই ঠেকানো যায়। যেসব কারণে এই মৃত্যুগুলো ঘটে তা প্রতিরোধ করা, চিকিত্সা করা খুবই সহজ। কিন্তু এই মৃত্যু ঠেকানোর জন্য যে প্রযুক্তি, যে ব্যবস্থার প্রয়োজন, তা তাদের কাছে পৌঁছায়নি। যে দেশ, ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠানের কাছে এই মৃত্যুগুলো ঠেকানোর জ্ঞান, প্রযুক্তি, রসদ আছে তা যথাস্থানে ব্যবহার করে এই অর্থহীন মৃত্যুগুলো বন্ধ করা তাদের দায়িত্ব।
গ. প্রত্যক্ষ প্রভাবসংক্রান্ত কারণ: আজকের এই বিশ্বায়নের পৃথিবীতে মানুষ এবং পণ্যের মতো রোগও পৃথিবীর নানা প্রান্তে খুব দ্রুত ছড়িয়ে যেতে পারে। রোগ সহজেই একটা দেশের সীমানা ছাড়িয়ে অন্য দেশের জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে। সাম্প্রতিক কালে সার্স, বার্ড ফ্লু ইত্যাদি রোগের ক্ষেত্রে আমরা তা দেখেছি। এ ছাড়া এইডস একটা অবিরাম ঝুঁকি হিসেবে পৃথিবীতে তো রয়ে গেছেই। সুতরাং কোনো দেশই নিজেদের রোগের ব্যাপারে নিরাপদ ভাবার কোনো কারণ নেই। পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তের একটা সংক্রামক রোগ অন্য যেকোনো দেশের জন্য একটা ঝুঁকি। রোগের পারস্পরিক এই প্রত্যক্ষ প্রভাবের কারণেই বিশ্ব স্বাস্থ্য নিয়ে ভাবাটা জরুরি।
ঘ. পরোক্ষ প্রভাবসংক্রান্ত কারণ: দারিদ্র্য থেকে যেমন রোগ ঘটে, তেমনি রোগও দারিদ্র্যের জন্ম দেয়। যক্ষ্মা, ম্যালেরিয়া, এইডস ইত্যাদি রোগের প্রকোপ বিভিন্ন দেশে বেড়ে যাচ্ছে, যা জন্ম দিচ্ছে দারিদ্র্য, বেকারত্ব। এই দারিদ্র্য ও বেকারত্ব থেকে জন্ম হচ্ছে নানা রকম রাজনৈতিক অস্থিরতা, মানুষ নিজের দেশ ত্যাগ করে হচ্ছে অভিবাসী, অনেক ক্ষেত্রেই বাড়ছে অবৈধ অভিবাসন। কোনো একটা নির্দিষ্ট দেশের দারিদ্র্য, বেকারত্ব তাই অন্য দেশের নিরাপত্তার জন্যও হয়ে উঠছে হুমকি। সুতরাং রোগের সঙ্গে বিশ্বের নিরাপত্তারও একটা পরোক্ষ যোগ রয়েছে। বিশ্ব নিরাপত্তার কথা ভাবতে হলে আমাদের বিশ্ব স্বাস্থ্যের কথাও ভাবতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্যের কথা ভাবলে তা দরিদ্র দেশগুলো কিংবা ধনী দেশগুলোর দরিদ্র অঞ্চলের অর্থনৈতিক অবস্থার ওপরও প্রভাব ফেলবে, যা শেষ বিচারে বিশ্বব্যাপী শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখবে।
ঙ. পারস্পরিক শিক্ষাসংক্রান্ত কারণ: পৃথিবীর সব দেশই একে অন্যের কাছ থেকে শিখতে পারে। এমন নয় যে জ্ঞান শুধু উন্নত দেশগুলোতেই রয়েছে। অর্থনৈতিকভাবে অনুন্নত দেশগুলোর মানুষের রয়েছে সমস্যা সমাধানের নানা উদ্ভাবনী জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা। সেই জ্ঞান অনেক ক্ষেত্রেই প্রয়োজনীয় হতে পারে উন্নত দেশগুলোর কাছেও। তাদের জন্যও সেখানে রয়েছে শিক্ষণীয় অনেক কিছু। ব্রিটেনের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এনএইচএসের প্রধান নাইজেল ক্রিসপ ২০১০ সালে প্রকাশিত তাঁর বইয়ে লিখছেন,
Richer Countries import many health workers from poorer countries, whilst at the same time exporting their ideas and ideologies about health. It is an unfair exchange. What would it be like, if it were the other way round-and poorer countries imported health workers from richer ones and exported their ideas and experience about health? (নাইজেল ক্রিসপ ২০১০)
তিনি পৃথিবীব্যাপী পরস্পরিক জ্ঞান, অভিজ্ঞতা বিনিময়ের গুরুত্বের কথা বলেছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য নিয়ে ভাবার প্রয়োজনে উন্নত, অনুন্নত সব দেশের স্বাস্থ্যসংক্রান্ত জ্ঞান, অভিজ্ঞতা বিনিময় প্রয়োজন।
বিশ্ব স্বাস্থ্যের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
এবার বিশ্ব স্বাস্থ্যের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটটির দিকে লক্ষ করা যাক। প্রাচীনকালে ও মধ্যযুগে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের ভেতর চিকিত্সাসংক্রান্ত জ্ঞান অভিজ্ঞতা বিনিময়ের নজির আছে। ভারতীয়, আরব, গ্রিক অঞ্চলে বিকশিত চিকিত্সাশাস্ত্রের ভেতর পারস্পরিক যোগাযোগ, মতবিনিময় ঘটেছে। আয়ুর্বেদীয়, ইউনানী, চীনা চিকিত্সাপদ্ধতির ভেতর পারস্পরিক যোগাযোগের নজির রয়েছে। আমি এখানে আলোচনা মূলত সাম্প্রতিক ইতিহাসে সীমিত রাখব। ঊনবিংশ শতাব্দীর দিকে লক্ষ করলে আমরা দেখব, সে সময়ের ঔপনিবেশিক শাসক দেশগুলো এবং উপনিবেশগুলোর ভেতর স্বাস্থ্য, চিকিত্সাবিষয়ক ব্যাপক যোগাযোগ ঘটেছে। মূলত ঔপনিবেশিক দেশগুলোতে বিকশিত মেডিকেল শাস্ত্র ক্রমেই উপনিবেশের সনাতন চিকিত্সাপদ্ধতিকে দুর্বল করে দিয়েছে। এই যোগাযোগটা ঘটেছে মূলত দুটি পথে। এক ক্রিশ্চিয়ান মিশনারিদের হাত ধরে, অন্যটি ঔপনিবেশিক শাসকদের হাত ধরে। ক্রিশ্চিয়ান মিশনারিরা এশিয়া, আফ্রিকার প্রত্যন্ত অঞ্চলে খ্রিষ্টধর্ম প্রচারের উপায় হিসেবে প্রায় ক্ষেত্রে সেসব অঞ্চলে একটা হাসপাতাল করেছে। হাসপাতালের চিকিত্সাসেবার মধ্য দিয়ে তারা স্থানীয় জনগণের মন জয় করেছে এবং পরবর্তী সময়ে তাদের ধর্মান্তরিত করেছে। ফলে হাসপাতাল ক্রিশ্চিয়ান মিশনারিদের কাছে শুধু চিকিত্সাকেন্দ্র ছিল না, ছিল ধর্মপ্রচারের একটা বাহন। একইভাবে ঔপনিবেশিক শাসকেরা তাঁদের উপনিবেশগুলোতে স্থাপন করেছেন পশ্চিমা ধাঁচের হাসপাতাল। এসব হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার পেছনে ছিল মূলত ঔপনিবেশিক উদ্দেশ্য। মূলত দুটি উদ্দেশ্য লক্ষ করা যায়। বলা বাহুল্য ঔপনিবেশিক অর্থনীতি সচল রাখার জন্য ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর প্রয়োজন ছিল সুস্থ একটি শ্রমশক্তির। ফলে শহর থেকে গ্রাম-গ্রঞ্জে তারা যে হাসপাতাল, ডিসপেনসারি প্রতিষ্ঠা করেছিল, তার একটা বড় কারণ ছিল স্থানীয় শ্রমবাজারকে সুস্থ রাখা, যে কথা আগেই উল্লেখ করেছি। তা ছাড়া এসব হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা ঔপনিবেশিকদের একটা মানবিক চেহারাও তুলে ধরেছিল স্থানীয় জনগণের কাছে। ১৯১৪ সালে ভারতীয় মেডিকেল সার্ভিসের ব্রিটিশ প্রধান ক্রাউফোর্ড গেজেটে নিম্নলিখিত মন্তব্য করেছিলেন:
The peaceful and civilizing influence of the work done in the dispensaries and by regimental surgeons on the frontiers of India has been in political importance equivalent to the presence of some thousands bayonets. It is because of such unexpected philanthropy that, as conquerors, we hold a position in the minds of the people which would not otherwise be possible. (Crawford : Medical Gadget of India 1914)
লক্ষণীয়, তিনি হাসপাতালকে বেয়নেটের সঙ্গে তুলনা করছেন। স্থানীয় বাসিন্দাদের স্বাস্থ্যরক্ষার পাশাপাশি উপনিবেশ অঞ্চলে আসা ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক কর্মকর্তাদের স্বাস্থ্যও ছিল তাদের একটি ভাবনার বিষয়। আগেই বলেছি কলেরা, ম্যালেরিয়া, কালাজ্বর এশিয়া, আফ্রিকার এসব অচেনা রোগ ছিল তাদের ভীতির কারণ। বহু ইউরোপীয় সেনা এবং কর্মকর্তা মারা গেছেন এসব রোগে। ফলে উপনিবেশ অঞ্চলে হাসপাতাল তৈরির আরেকটা প্রণোদনা ছিল ঔপনিবেশিক কর্মকর্তাদের স্বাস্থ্য রক্ষা করা। এ সময় ইউরোপীয় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে উপনিবেশ অঞ্চলের রোগতত্ত্বের ওপর গবেষণার জন্য নানা প্রতিষ্ঠান চালু হয়। ট্রপিক্যাল মেডিসিনের ওপর নতুন বিভাগ চালু হয়। ব্রিটেনে লন্ডন স্কুল অব হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিন বা হল্যান্ডে ‘রয়েল ট্রপিক্যাল ইনস্টিটিউট’ এখনো তাদের সেই ঐতিহ্যে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে। ঔপনিবেশিক কালপর্বে মোটা দাগে বললে এসবই ছিল বিশ্ব স্বাস্থ্যের কর্মকাণ্ড।
বিশ শতকের ১৯৪০-এর দশক থেকে ঔপনিবেশিক দেশগুলো এক এক করে স্বাধীন হতে থাকে। তবে সদ্য স্বাধীন দেশগুলোতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ঔপনিবেশিক আমলের স্বাস্থ্যব্যবস্থাই বহাল থাকে। সেখানে মূলত হাসপাতালকেন্দ্রিক চিকিত্সাব্যবস্থাই অব্যাহত থাকে এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্য, রোগ প্রতিরোধ ইত্যাদির ওপর জোর কম থাকে। ষাটের দশকের পর থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য ভাবনায় একটা পরিবর্তন আসে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফ এসব আন্তর্জাতিক সংস্থার উদ্যোগে বিশেষ রোগ প্রতিরোধ এবং রোগ নির্মূলের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় উদ্যোগ স্মল পক্স বা গুটিবসন্ত এবং ম্যালেরিয়া নির্মূলের কর্মসূচি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রত্যন্ত গ্রামপর্যায়ে টিকা কর্মসূচির মাধ্যমে গুটিবসন্ত নির্মূলের ব্যাপক কর্মসূচি নেওয়া হয়। এ জন্য স্থানীয় পর্যায়ে বিশেষ কর্মী বাহিনী তৈরি করা হয়। এতে ১৯৭০-এর দশকের মধ্যেই পৃথিবী থেকে গুটিবসন্ত নির্মূল হয়ে যায়। এটি বিশ্ব স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে একটি বড় অর্জন। একই ধরনের উদ্যোগ ম্যালেরিয়ার রোগের ক্ষেত্রে নেওয়া হলেও এ ব্যাপারে তেমন সাফল্য আসেনি। পৃথিবীর নানা প্রান্তে এখনো ম্যালেরিয়ার প্রকোপ আছে। এ বিষয়ক কর্মসূচি এখনো অব্যাহত আছে। ম্যালেরিয়ার পর বিশ্ব থেকে পোলিও নির্মূল এখন আরেকটি লক্ষ্য।
বিশ্ব স্বাস্থ্যবিষয়ক কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে একটা মাইলফলক ১৯৭৮ সালে তত্কালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের কাজাখস্তানের আলমা আটা শহরে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গৃহীত ঘোষণা। এটি আলমা আটা ডিক্লারেশন নামে পরিচিত। এই ঘোষণায় প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাকে জনস্বাস্থ্য নিশ্চিত করার প্রধান উপায় হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। শুধু হাসপাতালকেন্দ্রিক এবং ডাক্তার পরিচালিত চিকিত্সাসেবা নয়, গুরুত্ব দেওয়া হয় গ্রামীণ পর্যায়ে স্বাস্থ্যকর্মী তৈরি করে জনগণের ন্যূনতম স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার দিকে। শুধু একটি-দুটি রোগ নির্মূলের কর্মসূচি নয়, মানুষের দোরগোড়ায়, সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণে কী করে সমন্বিত উদ্যোগে জরুরি এবং ন্যূনতম চিকিত্সা, স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়া যায়, সে ব্যাপারে জোর দেওয়া হয় এ ঘোষণায়। পৃথিবীর বহু দেশ এরপর প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নামে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করে। এরপর ১৯৮০ সালে আবার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ‘২০০০ সালের মধ্যে সবার জন্য স্বাস্থ্য’ এমন একটি নীতিমালা ঘোষণা করে। সেই লক্ষ্যে বিশ্বব্যাপী নানা সমন্বিত স্বাস্থ্য কর্মসূচি নেওয়া হয়। তবে নানা সীমাবদ্ধতার কারণে ২০০০ সালের মধ্যে সবার জন্য স্বাস্থ্য নিশ্চিত হয়নি। এখনো পৃথিবীর বিশাল জনগোষ্ঠী ন্যূনতম স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত। এটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে স্বাস্থ্য ও অর্থনীতি পরস্পর ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এই পরিপ্রেক্ষিতে ২০০০ সালে জাতিসংঘ ‘সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য’ ইংরেজিতে ‘মিলিনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল’ নামে পরিচিত ঘোষণাটি দেয়। এ ঘোষণায় আটটি লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। এই ঘোষণা অনুযায়ী, ২০১৫ সালের মধ্যে দারিদ্র্য, ক্ষুধা নিবারণ, প্রাথমিক শিক্ষা, লিঙ্গবৈষম্য দূর করে নারীর ক্ষমতায়ন, শিশুমৃত্যুর হার কমানো, মাতৃত্বজনিত মৃত্যুর হার কমানো, এইডস, ম্যালেরিয়াসহ অন্যান্য রোগ মোকাবিলা করা, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করার অঙ্গীকার করা হয়। ২০১৫ সাল সমাসন্ন কিন্তু বলা বাহুল্য উপরোল্লিখিত অঙ্গীকারের অধিকাংশ বাস্তবায়নই এখনো সুদূরপরাহত। এই অবস্থা মোকাবিলায় আরও নতুন নতুন পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
তবে এ কথাও অনস্বীকার্য যে গত অর্ধশতাব্দীতে বিশ্ব স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে অর্জনও হয়েছে অনেক। যেমন ১৯৫০ সালের পর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত শিশুমৃত্যুর হার ব্যাপক হারে কমেছে। এক হাজার শিশুতে যে মৃত্যুর হার ছিল ১৪৮ তা হয়েছে ৬৫, মানুষের গড় আয়ু ৪০ বছর থেকে বেড়ে হয়েছে ৬৫ বছর, পৃথিবী থেকে বসন্ত নির্মূল হয়েছে এবং বিশ্বব্যাপী বিপুলসংখ্যক শিশু টিকার আওতায় আসায় প্রতিরোধযোগ্য রোগের প্রকোপ অনেক কমেছে। বিশ্বব্যাপী সমন্বিত উদ্যোগের ফলেই সেটা ঘটেছে। এই অর্জন সত্ত্বেও বিশ্বব্যাপী সবার জন্য স্বাস্থ্য নিশ্চিত করা এখনো কঠিন একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে। বর্তমান পৃথিবীতে স্বাস্থ্যবিষয়ক যে চ্যালেঞ্জগুলো রয়েছে, সেগুলোকে কতগুলো ভাগে ভাগ করা যায়।
প্রথমত, পৃথিবীর জনসংখ্যা একটা রোগতত্ত্বগত বা এপিডেমিওলজিক্যাল ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। অর্থাত্ একসময় পৃথিবীর মানুষ মূলত ভুগত নানা রকম সংক্রামক রোগে। যেমন: কলেরা, বসন্ত, যক্ষ্মা, ম্যালেরিয়া। কিন্তু পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে এসব রোগের প্রকোপ কমে সেখানে অসংক্রামক দীর্ঘমেয়াদি রোগ যেমন: ডায়াবেটিস, হূদেরাগ, মানসিক রোগ, স্থূলতা এসবের প্রকোপ বেড়েছে। জীবনযাত্রার মান এবং স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নয়নের কারণে সেসব দেশে সংক্রামক রোগ কমে গেলেও, আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর জীবনযাপন, বিশ্বায়ন ইত্যাদির কারণে জীবনযাত্রায়, খাদ্যাভ্যাসে, মানসিক প্রশান্তির ওপর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে, যা জন্ম দিয়েছে হূদেরাগ, ডায়াবেটিস ইত্যাদি ধরনের অসংক্রামক রোগের। উন্নয়নশীল দেশের পরিস্থিতি এ ক্ষেত্রে আরও জটিল। কারণ, সেসব দেশে সংক্রামক রোগগুলো একদিকে নির্মূল হয়নি কিন্তু অন্যদিকে বিশ্বায়নের প্রভাবে জীবনযাত্রার পরিবর্তনে জন্ম নিয়েছে নানাবিধ অসংক্রামক রোগেরও। ফলে অনুন্নত দেশগুলোতেও ডায়াবেটিস, হূদেরাগ ইত্যাদির প্রকোপ বাড়ছে। আবার পুরোনো সংক্রামক রোগের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এইডসের মতো নতুন ধরনের সংক্রামক রোগ। উন্নয়নশীল দেশের এই ত্রিমুখী রোগ মোকাবিলা বিশ্ব স্বাস্থ্যের জন্য এখন তাই একটা বড় হুমকি।
দ্বিতীয়ত, জনমিতি বা ডেমোগ্রাফিরও একটা ক্রান্তি সূচিত হয়েছে পৃথিবীতে। পৃথিবীর মানুষের গড় আয়ু বেড়ে যাওয়ায় ক্রমেই বয়োবৃদ্ধ মানুষের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। বৃদ্ধ মানুষদের শারীরিক ও সামাজিক জীবনযাপনের দাবি ভিন্নতর। কিন্তু পৃথিবীর বহু দেশই এই ক্রমবর্ধমান বয়স্ক জনসংখ্যা এবং তাদের বার্ধক্যজনিত সেবাদানে প্রস্তুত নয়। এটাও বিশ্ব স্বাস্থ্যের একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
তৃতীয়ত, পৃথিবীর এই যে রোগতত্ত্বগত ও জনমিতিগত পরিবর্তন হচ্ছে, সেটিকে ভালোভাবে বোঝার জন্য, ব্যাখ্যা করার জন্য, একে মোকাবিলার জন্য নতুন কর্মপন্থা, স্বাস্থ্যসেবা-ব্যবস্থা খুঁজে পাওয়ার জন্য যে গবেষণা-দক্ষতা, তথ্য-উপাত্ত দরকার তা অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশে নেই। রোগবিষয়ক সঠিক তথ্য সংগ্রহ, গবেষণা সুবিধার অভাব বিশ্ব স্বাস্থ্যের আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ।
চতুর্থত, সাম্প্রতিক পৃথিবীতে পরিবেশ বিপর্যয়, ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যুদ্ধবিগ্রহ ইত্যাদির কারণে প্রতিনিয়তই মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর, জীবনের ওপর নতুন নতুন সংকট নেমে আসছে। এসব সংকট মোকাবিলাও বিশ্ব স্বাস্থ্যের একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
বিশ্ব স্বাস্থ্যের এই ব্যাপক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা কোনো একটি দেশ বা সংস্থার পক্ষে এককভাবে সম্ভব নয়, তেমনি সম্ভব নয় শুধু একটি কোনো জ্ঞানকাণ্ড দিয়ে তাকে মোকাবিলা করা। চিকিত্সাবিজ্ঞানের সঙ্গে জনস্বাস্থ্য বিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান ও রাজনৈতিক অর্থনীতির জ্ঞান সমন্ব্বিত করেই একে মোকাবিলা করতে হবে। সরকারি, বেসরকারি, জাতীয়-আন্তর্জাতিক নানা যৌথ উদ্যোগে একে মোকাবিলা করতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য মোকাবিলায় যাঁরা নিয়োজিত আছেন, এখানে তাঁদের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। ঔপনিবেশিক আমলে বিশ্বব্যাপী ঘটে যাওয়া কতগুলো গুরুতর কলেরা মহামারি মোকাবিলায় ঊনবিংশ শতাব্দীতে কতগুলো আন্তর্জাতিক রোগ নিয়ন্ত্রণবিষয়ক কনফারেন্স হয় মূলত ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর আয়োজনে। তবে এগুলো ছিল বিচ্ছিন্নভাবে মাঝেমধ্যে নেওয়া কিছু উদ্যোগ। আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য বিষয়ে প্রথম সংগঠিত ধারাবাহিক উদ্যোগের পথিকৃত্ বলা যায় আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘রেডক্রস’। সুইজারল্যান্ডের অধিবাসী অঁরি ডুনান্টের উদ্যোগে ১৮৬৪ সালে রেডক্রস প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি ব্যবসার সূত্রে ফ্রান্সের উপনিবেশ আলজেরিয়ায় গিয়ে সেখানে এক যুদ্ধের ভয়াবহতা এবং যুদ্ধাহত ব্যক্তিদের চিকিত্সাসেবার ন্যূনতম ব্যবস্থার অভাব দেখে অত্যন্ত মর্মাহত হন এবং মূলত যুদ্ধাহতদের সেবার লক্ষ্যেই একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা গঠনের উদ্যোগ নেন। সেই সূত্রেই জন্ম নেয় রেডক্রস। রেডক্রসের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে ১৯০১ সালে চালু হওয়া প্রথম শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান অঁরি ডুনান্ট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৮ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে বলা যায়, পরবর্তীকালের সবচেয়ে বড় আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য মোকাবিলার উদ্যোগ, যার কথা আগে উল্লেখ করেছি। বর্তমানে আরও অগণিত সংস্থা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বিশ্ব স্বাস্থ্য মোকাবিলায় যুক্ত আছে। তাদের একটা সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধরা যায়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ছাড়াও জাতিসংঘের আরও কয়েকটি সংস্থা রয়েছে যারা আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে কাজ করে, যেমন: ইউনিসেফ, ইউএনএআইডি, ইউএনডিপি, ইউএনএফপিএ। এ ছাড়া বিশ্বব্যাংক, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, আফ্রিকান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক প্রভৃতি আন্তর্জাতিক ব্যাংকও স্বাস্থ্য খাতে কাজ করে। এর বাইরে বেশ কিছু আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থা বা এনজিও স্বাস্থ্য খাতে নানা কর্মসূচি পালন করে থাকে। যেমন: অক্সফাম, কেয়ার, ডিএফআইডি, সেভ দ্য চিলড্রেন। ‘ডক্টরস উইদাউট বর্ডার’ নামে আরেকটি সংস্থা রয়েছে, যারা মূলত আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য ক্ষেত্রেই কাজ করে এবং কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ তারাও নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে। ব্যক্তি উদ্যোগে আরও কিছু সংস্থা রয়েছে, যারা আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য খাতে সাম্প্রতিক কালে বিশেষ ভূমিকা রাখছে। এ ক্ষেত্রে বিল অ্যান্ড মিলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া রকফেলার ফাউন্ডেশনও দীর্ঘদিন আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করছে। এ ছাড়া ‘গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর টিবি ড্রাগ ডেভেলপমেন্ট’, ‘ইন্টারন্যাশনাল এইডস ভ্যাকসিন ইনিশিয়েটিভ’ও আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্যের উল্লেখযোগ্য সংস্থা। এর বাইরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানে বিশ্ব স্বাস্থ্য নিয়ে নিয়মিত গবেষণা এবং অধ্যয়ন চলছে। উপরোল্লিখিত সংস্থাগুলো স্বাভাবিক ও জরুরি উভয় অবস্থাতেই আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে আসছে, বিশ্ব স্বাস্থ্য বিষয়ে নতুন নতুন জ্ঞান আহরণ এবং বিতরণ করছে, স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির নানা রকম কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে।
তবে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কর্মকাণ্ডে নানা সমস্যা আছে। অনেক সংস্থা আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে কাজ করলেও তাদের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া বা সমঝোতার সমস্যা আছে। এতে করে দেখা যায়, একই দেশে বিভিন্ন সংস্থা একই রকম কাজ করে পুনরাবৃত্তি ঘটাচ্ছে কিন্তু একে অন্যের অভিজ্ঞতা সমবায় করছে না। অনেক সময় এই সংস্থাগুলো ওপর থেকে নিজেদের তৈরি কোনো কর্মকাণ্ড বিভিন্ন দেশে চাপিয়ে দেয়, যা সব সময় সেসব দেশের উপযোগী নয়। এতে করে স্থানীয় মানুষের অংশীদারি থাকে না। স্থানীয় মানুষের অংশগ্রহণবিহীন ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া এমন অনেক কর্মসূচিই তাই ব্যর্থ হয়। এসব সংস্থার অভ্যন্তরীণ সুশাসন নিয়েও অনেক সমস্যা আছে। এমনকি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিও তাদের কাজকে প্রভাবিত করে। স্বাস্থ্য খাতে কর্মরত কিছু কিছু সংস্থা ধর্মীয় মৌলবাদী বা কোনো স্বৈরশাসককে সহায়তা করেছে, এমন নজিরও আছে।
বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট
বিশ্ব স্বাস্থ্যের এই প্রেক্ষাপটে সংক্ষেপে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের ওপরও একটা সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করা যেতে পারে। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতে বেশ কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন হয়েছে। চার দশক ধরে কিছু জনস্বাস্থ্য সূচকে ধারাবাহিক অগ্রগতি ঘটেছে বাংলাদেশে। স্বাধীনতার পর থেকে ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমেছে, গড় আয়ু বেড়েছে, মাতৃমৃত্যুর হার কমেছে, কমেছে শিশুমৃত্যুর হার। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অর্জন শিশুমৃত্যুর হার কমানো। সত্তরের দশকে যেখানে হাজারে শিশুমৃত্যুর সংখ্যা ছিল ১৫০, তা ২০০৭ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ৫২-তে। এ হার দক্ষিণ এশিয়ার পরিপ্রেক্ষিতে খুবই উল্লেখযোগ্য। এমনকি শক্তিশালী অর্থনীতির পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের শিশুমৃত্যুর হার বাংলাদেশের চেয়ে বেশি। বাংলাদেশ প্রমাণ করেছে, অর্থনৈতিক সূচকে পিছিয়ে থাকলেও কোনো কোনো জনস্বাস্থ্য সূচকে উল্লেখযোগ্য অর্জন সম্ভব। এটি পৃথিবীর অনেক উন্নয়নশীল দেশের জন্য দৃষ্টান্তস্বরূপ। শিশুমৃত্যু রোধে এই অর্জনের জন্য তাই সংগত কারণেই জাতিসংঘ পুরস্কৃত করেছে বাংলাদেশকে।
একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় নানাবিধ কর্মকাণ্ডে বাংলাদেশে শিশুমৃত্যুর হার কমেছে। একটি বড় কারণ এ দেশে শিশুদের কয়েক দশক ধরে রোগ প্রতিরোধক টিকা কর্মসূচির সাফল্য। সত্তরের দশকে যেখানে টিকার আওতায় ছিল শতকরা মাত্র দুই ভাগ শিশু, ২০০৭ সালে সেখানে টিকার আওতায় এসেছে ৮২ ভাগ শিশু। এটি সম্ভব হয়েছে ব্যাপক মাঠপর্যায়ের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে। টিকা কর্মসূচিকে গ্রামের মানুষের দোরগোড়ায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়েছে মাঠপর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মীদের মাধ্যমেই। একইভাবে বাংলাদেশে জন্মহার কমেছে মাঠকর্মীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রী পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যমে। এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে অবদান রেখেছেন নারী স্বাস্থ্যকর্মীরা। অত্যন্ত প্রতিকূল সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে তাঁরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে জন্মনিয়ন্ত্রণের মতো স্পর্শকাতর একটি ব্যাপারকে গ্রহণযোগ্য করে তুলেছিলেন। কোনো কোনো গবেষক উল্লেখ করেছেন, বাংলাদেশের তুলনামূলক উদার ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি এবং জাতিগত সমসত্ত্বতাও এ ধরনের মাঠপর্যায়ে কর্মকাণ্ডে সফলতা আনতে সহায়তা করেছে। উল্লেখ্য, পাকিস্তানে ধর্মীয় রক্ষণশীলতা এবং নানা জাতিগত বিভেদের কারণে ব্যর্থ হয়েছে জনসংখ্যা কর্মসূচি। বাংলাদেশে শিশুমৃত্যুর হার কমার আরও একটি কারণ ডায়রিয়া ও কলেরা নিয়ন্ত্রণ। একটা সময় ছিল যখন গ্রামের পর গ্রাম নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত কলেরায়। এখনো কলেরা ও ডায়রিয়ার প্রকোপ রয়েছে কিন্তু সেসব ভয়াবহ মহামারির তুলনায় তা সামান্য। এটি সম্ভব হয়েছে মূলত ওরাল স্যালাইন আবিষ্কারের কারণে। আর এই সত্য প্রতিষ্ঠিত যে এই ওরাল স্যালাইন আবিষ্কৃত হয়েছে বাংলাদেশেরই আইসিডিডিআরবির গবেষণাগারে। টাইম ম্যাগাজিন ওরাল স্যালাইনকে চিকিত্সাক্ষেত্রে গত শতাব্দীর অন্যতম প্রধান একটি আবিষ্কার হিসেবে বর্ণনা করে প্রচ্ছদ কাহিনি করেছিল। গত চার দশকে বাংলাদেশের সেবা খাতে বেসরকারি সংস্থাগুলোর ভূমিকা একটি বাস্তবতা। স্বাস্থ্য খাতের নানা সেবাকে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে এসব সংস্থার ভূমিকাও অনস্বীকার্য। বিশেষ করে ব্র্যাকের স্বাস্থ্যসেবিকারা যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে বিবিধ জনস্বাস্থ্য কর্মকাণ্ডে যুক্ত আছেন। কেয়ার, সেভ দ্য চিলড্রেন ইত্যাদি আন্তর্জাতিক সংস্থাও এ দেশের স্বাস্থ্য খাতে ভূমিকা রাখছে। স্বাধীনতার ঊষালগ্নে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে চিকিত্সাকে হাসপাতালের চার দেয়ালের বাইরে আনার নানা যুগান্তকারী উদ্যোগ নিয়েছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী প্রমুখ তাঁদের গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের মাধ্যমে। পরবর্তীকালে নানা কারণে বিতর্কিত হয়েছেন তিনি কিন্তু তাঁর উদ্যোগে আশির দশকে বাংলাদেশে বহুজাতিক কোম্পানির প্রভাবমুক্ত একটি ওষুধনীতি প্রণয়ন ছিল তৃতীয় বিশ্বের কোনো দেশের জন্য একটি বিপ্লবী কর্মকাণ্ড। তবে এসব অর্জনকে বিবেচনায় রেখেও বলতে হয়, বিশ্ব প্রেক্ষাপটের সামগ্রিক জনস্বাস্থ্যচিত্রে আমাদের অবস্থান এখনো একেবারে তলার দিকে। জনস্বাস্থ্যে আমাদের ব্যর্থতাও ব্যাপক।
এ কথা সত্য, শিশুমৃত্যুর হার কমিয়ে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে বাংলাদেশ। এও সত্য যে শিশুরা বেঁচে আছে, কিন্তু তাদের পুষ্টির মান পৃথিবীর নিম্নতম স্তরে। মায়েদের মৃত্যুর হার প্রথম তিন দশকে কমলেও তা স্থিতিশীল রয়েছে প্রায় এক দশক ধরে এবং সে হার এখনো বিপজ্জনক। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে অতীতে যে সাফল্য এসেছিল বাংলাদেশে, সেটি হুমকির মুখে পড়েছে আবার। বেড়ে যাচ্ছে জন্মের হার। আর সামগ্রিকভাবে বৈষম্য আমাদের স্বাস্থ্যচিত্রের একটা প্রধান বৈশিষ্ট্য হিসেবে রয়ে গেছে এখনো। স্বাস্থ্যের মান এবং স্বাস্থ্যসেবা নেওয়ার ক্ষেত্রে এ দেশে ব্যাপক বৈষম্য রয়েছে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে, শহর ও গ্রামের মধ্যে, এমনকি শহরের উচ্চবিত্ত ও নিম্নবিত্তের মধ্যে, নারী ও পুরুষের মধ্যে, বাঙালি ও অন্যান্য ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে স্বাস্থ্য অবকাঠামো থাকলেও তার ব্যবহার অত্যন্ত সীমিত। এসব কেন্দ্রে প্রায়ই থাকে না প্রয়োজনীয় জনবল, থাকে না ওষুধ, যন্ত্রপাতি। সরকারি বরাদ্দ যা থাকে একদিকে তা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল, অন্যদিকে যতটুকু সরবরাহ থাকে সেটিও অব্যবস্থাপনা আর দুর্নীতির কারণে পৌঁছায় না গ্রাহকের কাছে। স্বাধীনতার পর প্রথম তিন দশকের স্বাস্থ্য বাজেটে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় উল্লেখযোগ্য বরাদ্দ থাকলেও ২০০৩ সালে এইচএনএসপিপি নামে যে নতুন স্বাস্থ্য পরিকল্পনা করা হয়েছে, তাতে প্রাইমারি স্বাস্থ্যে বরাদ্দ কমিয়ে বাড়ানো হয়েছে টারসিয়ারি স্তরে বিশেষজ্ঞ স্বাস্থ্যসেবায়। গ্রামাঞ্চলে অধিকাংশ মানুষ এখনো চিকিত্সার জন্য নির্ভর করেন নানা অপ্রাতিষ্ঠানিক এবং অপেশাদার চিকিত্সাসেবা দানকারীদের ওপর। ওদিকে স্বাস্থ্যবিমা বিষয়টিও বিকাশ লাভ করেনি আমাদের দেশে। শহরে যাঁরা অর্থ দিয়ে স্বাস্থ্যসেবা কেনার সামর্থ্য রাখেন, তাঁরাও যে মানসম্পন্ন সেবা পাবেন, তার নিশ্চয়তা নেই। চিকিত্সার মান নিয়ন্ত্রণের কার্যকর কোনো ব্যবস্থা আমাদের নেই, রোগীর অধিকার বলে কোনো প্রসঙ্গ আমাদের চিন্তার জগতে নেই। যাঁদের সামর্থ্য আছে, তেমন একটি বিরাট সংখ্যক রোগী যে বিদেশে চলে যান, গবেষণায় দেখা গেছে তার অন্যতম একটি কারণ এ দেশের ডাক্তারদের আচরণ, রোগীর মর্যাদার প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করা। এ ছাড়া স্বাস্থ্যক্ষেত্রে দক্ষ পেশাজীবীরও রয়েছে ব্যাপক ঘাটতি। জনসংখ্যা অনুপাতে চিকিত্সাদানকারীর যে আন্তর্জাতিক স্বীকৃত সংখ্যা রয়েছে, তাতে আমাদের আরও ৬০ হাজার ডাক্তার প্রয়োজন, প্রয়োজন প্রায় তিন লাখ নার্সের। সর্বোপরি স্বাস্থ্য খাতে নানা সংকীর্ণ রাজনৈতিক বিবেচনায় নেওয়া বিপরীতমুখী সিদ্ধান্তে বারবার মুখ থুবড়ে পড়েছে এর অগ্রগতি। বলা বাহুল্য, একটি দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নতি তার সামগ্রিক উন্নতি থেকে বিচ্ছিন্নভাবে ভাবার কোনো সুযোগ নেই। স্বাস্থ্যকাঠামো দেশটির সামগ্রিক অর্থনৈতিক কাঠামোর সঙ্গেও যুক্ত। স্বাস্থ্যসেবাকে মুক্তবাজারের পণ্য করে তাকে ব্যক্তি খাতে রেখে দেওয়ার কারণে এ দেশে স্বাস্থ্যসেবায় ব্যাপক বৈষম্য রয়ে গেছে।
বাংলাদেশের এই স্বাস্থ্যচিত্র থেকে আমরা আবার ফিরে যেতে পারি বিশ্ব স্বাস্থ্যের প্রেক্ষাপটে। বিশেষভাবে স্মরণযোগ্য এই যে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর যেকোনো দেশের স্বাস্থ্যবিষয়ক পরিকল্পনার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্যের যে নানা শর্ত ও শক্তিগুলোর কথা আগে উল্লেখ করা হয়েছে, সেদিকে নজর রাখা প্রয়োজন। বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন একটি দেশের স্বাস্থ্য প্রশাসন বিশ্ব প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত, যেখানে নানা দেশ, নানা আন্তর্জাতিক সংস্থা, দাতা সংস্থার বিবিধ স্বার্থ কাজ করে, স্থানীয় স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করে বিশ্ব পুঁজিবাজার, বিশ্বব্যাপী মানুষের, তথ্যের, সংস্কৃতির যে চলাচল ঘটছে সেটাও স্থানীয় স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করছে, সর্বোপরি বিশ্ব পরিবেশের পরিবর্তনও প্রভাব ফেলছে স্থানীয় স্বাস্থ্যের ওপর। আমাদের তাই ভাবতে হবে বিশ্ব প্রেক্ষাপটে, কিন্তু কাজ করতে হবে স্থানীয় পরিপ্রেক্ষিতে।
তথ্যসূত্র:
Huyen, M.M., P.Martens, H.B. Hilderlink, ‘The Health Impact of Globalization: a Conceptual Framework’, Globalization and Health, (2005) 1:14
Labonté, R., & Schreker, T. ‘Globalization and Social Determinants of Health: The Role of Global Marketplace (part 2 of 3)’. Globalization and Health, 3 (6), (2007a), p.1-17 (p.1).
Lee, K., D. Yach, & A. K. Scott, ‘Globalization and Health’, in Merson, M., Black, R., Mills, A. (Eds) Global Health: Diseases, Programs, Systems and Policies. (London: Jones & Bartlett Publisher, 2012), p 885-908.
Markle, W., Fisher, M., Smego, R. (Eds) Understanding Global health. (Ohio: McGraw-Hill Professional, 2007).
Merson, M., Black, R., Mills, A. (Eds) Global Health: Diseases, Programs, Systems and Policies. (London: Jones & Bartlett Publisher, 2012).
Skolnik, R., Essentials of Global Health. (London: Jones & Bartlett Publisher, 2008).
Zaman, S., Broken limbs, broken lives: Ethnography of a hospital ward in Bangladesh. (Publisher: Het Spinhuis, Amsterdam, The Netherlands, 2005).