বিশ শতকের প্রথমার্ধে দক্ষিণ এশিয়ায় চলচ্চিত্রের দেশীয়করণ: আন্তর্দেশীয় থেকে স্বদেশীয় জনপরিসর

সারসংক্ষেপ

চলচ্চিত্র সংস্কৃতির একটি শক্তিশালী মাধ্যম। পশ্চিমা আবিষ্কার হলেও, খুব দ্রুতই চলচ্চিত্র দক্ষিণ এশীয় জনপরিসরে জায়গা করে নেয়। বিনোদনের মাধ্যম ছাড়াও জাতীয় পরিচয় ও মনস্তত্ত্ব তৈরি এবং দেশীয় জনপরিসরে পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম হয়েছিল চলচ্চিত্র। ভিনদেশি সংস্কৃতির একটি মাধ্যম কীভাবে দেশীয় অন্যান্য বিনোদন মাধ্যমের সংস্পর্শে এসে পরিবর্তিত হয়েছিল এবং গণমানুষের রুচি এবং রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষায় পরিবর্তন সাধন করেছিল তা অনুধাবন জরুরি। বিশ শতকের প্রথমার্ধে দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তর সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিসরে, উত্পাদন থেকে গ্রহণ পর্যায়ে, চলচ্চিত্র কীভাবে এ দেশের হয়ে উঠেছে, তা এই প্রবন্ধে আলোচিত হয়েছে। সাংস্কৃতিক রূপান্তরের প্রক্রিয়াকে এখানে ‘বিভিন্ন সামাজিক গোষ্ঠীর মধ্যে যুগপত্ বিনিময় এবং বিরোধ’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। ফলে বিশ শতকের প্রথম ছয় দশকে পূর্ব বাংলায় চলচ্চিত্র মাধ্যমের সাংস্কৃতিক গ্রহণ প্রক্রিয়াকে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর জন্য বিবিধ কিন্তু পরস্পর সংযুক্ত জনপরিসরের ভিত্তিতে দেখা যেতে পারে; যেখানে সব সময়ই জাতিসত্তা ও রূপান্তরের মধ্য দিয়ে গিয়েছে।

মুখ্য শব্দগুচ্ছ: চলচ্চিত্র, জনপরিসর, দেশীয়করণ, দক্ষিণ এশিয়া, সংস্কৃতি, জাতিসত্তা।

গত এক দশক বা তার কাছাকাছি সময়ে গবেষণার ক্ষেত্রে বলিউড বা ভারতীয় হিন্দি চলচ্চিত্র একটি জনপ্রিয় ধারায় পরিণত হয়েছে। কিন্তু বিশ্বপরিসরে এখনো অন্যান্য দক্ষিণ এশীয় চলচ্চিত্র—জাতীয় বা আঞ্চলিক, তেমন আলোচিত নয়। পুরো দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে মাধ্যম হিসেবে চলচ্চিত্র কীভাবে অধিকৃত হয়েছে, সে আলোচনাও সেভাবে হয়নি। এ অঞ্চলের চলচ্চিত্র অধ্যয়নের এ শূন্যস্থান পূরণের একটি প্রচেষ্টা হিসেবে নিবন্ধটির অবতারণা। চলচ্চিত্র আবিষ্কারের প্রাথমিক সময় থেকে মধ্য-বিশ শতকের বাংলাদেশে বৃহত্তর সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিসরে, উত্পাদন থেকে গ্রহণ পর্যায়ে, চলচ্চিত্র কীভাবে এ দেশের হয়ে উঠেছে, তা-ই এখানে অনুসন্ধানের বিষয়। এ সময়টুকুতে বাংলাদেশ প্রথমে ছিল ব্রিটিশ উপনিবেশাধীন পূর্ব বাংলা, ১৯৪৭ সালের পর পূর্ব পাকিস্তান। কীভাবে চলচ্চিত্রের মতো একটি আন্তদেশীয় (transnational) সাংস্কৃতিক আঙ্গিক এ অঞ্চলের সংস্কৃতিতে গৃহীত হলো? এ ক্ষেত্রে কী ঘটতে পারে যখন আগত মাধ্যম পশ্চিমের আর উপনিবেশ-উত্তর দক্ষিণ এশিয়া সেটির গ্রাহক?

এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দেওয়ার জন্য, সাংস্কৃতিক অধিগ্রহণের প্রক্রিয়ায় কীভাবে চলচ্চিত্র মাধ্যমটি ১৯০০ থেকে ১৯৬০-এর দশক পর্যন্ত পূর্ব বাংলা/পাকিস্তানে বিভিন্ন সামাজিক গোষ্ঠীর মধ্যে দ্বন্দ্বের একটি ক্ষেত্রে পরিণত হয়, তা বিবেচনা করা প্রয়োজন। সাংস্কৃতিক রূপান্তরের প্রক্রিয়াকে আমি ‘বিভিন্ন সামাজিক গোষ্ঠীর মধ্যে যুগপত্ বিনিময় এবং বিরোধ’ হিসেবে নিয়েছি।১ সুতরাং, আমার মতে, বিংশ শতাব্দীর প্রথম ছয় দশকে পূর্ব বাংলায় চলচ্চিত্র মাধ্যমের সাংস্কৃতিক গ্রহণ প্রক্রিয়াকে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর জন্য বিবিধ কিন্তু পরস্পর সংযুক্ত জনপরিসরের ভিত্তিতে দেখা যেতে পারে; যেখানে সব সময়ই জাতিসত্তা ও রূপান্তরের মধ্য দিয়ে গিয়েছে।

এই প্রবন্ধে জনপরিসর (Public sphere) ধারণাটি ব্যবহার করে বাংলাদেশে চলচ্চিত্রের দেশীয়করণ প্রক্রিয়ার অনুসন্ধান করা হবে। যেসব ঘটনা ও প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পূর্ব বাংলায় চলচ্চিত্রের স্থানীয়করণ ঘটেছে, আমি এখানে সেগুলোর পুনর্বিচার করেছি। কারণ এগুলো বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর জন্য বিকল্প কিন্তু সম্পর্কিত জনপরিসর নির্মাণ-প্রক্রিয়ার উদ্যোগ। কীভাবে ঔপনিবেশিক শাসকেরা, ঔপনিবেশিক পূর্ব বাংলার অবাঙালি এবং বাঙালি মুসলমানরা নানা উপায়ে চলচ্চিত্রকে নিজেদের করে নিয়েছে, তা আমি ব্যাখ্যা করেছি। পরবর্তী সময়ে উপনিবেশ-উত্তর পূর্ব পাকিস্তানে একই সঙ্গে শহুরে ও গ্রামীণ বাঙালি মুসলমানরা নিজেদের পছন্দসই পরিচিতি নির্মাণে চলচ্চিত্রের দেশীয়করণ ঘটিয়েছে, তাও আমার আলোচনায় উঠে এসেছে। বিভিন্ন জনপরিসরে চলচ্চিত্রের আত্তীকরণের এ রকম ঘটনাগুলো আমি চিহ্নিত করেছি। এই জনপরিসরগুলোর মধ্যে আন্তর্দেশীয় এবং ঔপনিবেশিক থেকে সাংস্কৃতিক-জাতীয়তাবাদী এবং গ্রামীণ-স্বদেশীয় জনপরিসরগুলো রয়েছে। আমার ব্যবহূত জনপরিসরের ধারণাটিতে জনপরিসরগুলো নিজের মধ্যে এবং পরস্পরের সঙ্গে সর্বদা রূপান্তর ও মিথস্ক্রিয়ায় লিপ্ত। এই ধারণাগুলো ব্যবহার করে এখানে আমি এমন একটি ধারণাগত কাঠামো নির্মাণ করতে চেষ্টা করেছি, যার মাধ্যমে বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে মধ্যভাগ পর্যন্ত গ্রামীণ, কৃষিজীবী পূর্ব বাংলার বিভিন্ন স্থানীয় গোষ্ঠী কীভাবে চলচ্চিত্রের দেশীয়করণ ঘটিয়েছে, তা অনুধাবনের সুযোগ হবে।

জনপরিসর, চলচ্চিত্রের ইতিহাস ও বাংলাদেশের জাতীয়তা

এশীয় চলচ্চিত্র বিষয়ে প্রথম সারির পণ্ডিত বিমল দিসানায়েক বলছেন, ভারতীয় চলচ্চিত্র (পড়ুন বলিউড) নিয়ে সম্প্রতি যে গবেষণাগুলো বেরিয়েছে, তার অধিকাংশগুলোতে ভারতীয় চলচ্চিত্রকে তাত্ত্বিকভাবে বুঝতে জনপরিসরের ধারণাটি ব্যবহূত হয়নি।২ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য জাতীয় ও আঞ্চলিক চলচ্চিত্রের জন্যও এটি সত্য। তাই এ নিবন্ধ যেটি জনপরিসরের ধারণাকে ব্যবহার করে বাংলাদেশে চলচ্চিত্র মাধ্যমের প্রাথমিক পর্যায়গুলোর একটি পুনঃপাঠ, দক্ষিণ এশীয় চলচ্চিত্র বোঝার ক্ষেত্রে একটি নতুন প্রচেষ্টা বলে গণ্য হতে পারে।

১৯৭০ থেকে জনপরিসরের ধারণাটি নৃতত্ত্ব, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, উত্তরাধুনিক শিল্পকলা, জেন্ডার স্টাডিজ, কুইয়ার পলিটিকসের মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে আলোচিত হয়েছে। য়ুর্গেন হাবারমাসের ১৯৬২ সালের গবেষণা দ্য স্ট্রাকচারাল ট্রান্সফরমেশন অব দ্য পাবলিক স্ফেয়ার প্রকাশের পর বিভিন্ন ক্ষেত্রে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনা ও বিতর্ক হয়েছে পশ্চিমা শিক্ষায়তনে।৩ হাবারমাস জনপরিসরকে বিবেচনা করেছেন সামাজিক জীবনের সেই ক্ষেত্র হিসেবে, যেখানে সাধারণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন ইস্যুতে পরস্পরের দৃষ্টিভঙ্গি বিনিময়ের মাধ্যমে জনমত গড়ে ওঠে। উদাহরণ হিসেবে হাবারমাস চিহ্নিত করেছিলেন আঠারো শতকে পশ্চিম ইউরোপে জনপরিসরের উত্থানকে, যেখানে সামন্ততন্ত্র ও তার কার্যকৌশল স্থানান্তরিত হয়েছিল জাতিরাষ্ট্র, মধ্যবিত্ত শ্রেণি ও মুদ্রণপ্রযুক্তি দিয়ে।৪ জনপরিসরকে দেখা হয়েছে ‘যোগাযোগের সেই জগত্ হিসেবে, যা বিতর্কের একটি নতুন ক্ষেত্র, একটি অধিকতর উন্মুক্ত, সুগম এবং সামাজিক, শহুরে জনবলের একটি অবয়ব’।৫ হাবারমাস জনপরিসরকে কল্পনা করেছেন এমন এক পরিসর হিসেবে, যেখানে জনসাধারণ তাঁদের সাধারণ সমস্যা নিয়ে ‘কথা’ বলে। এমন একটি পরিসর, যা রাষ্ট্র থেকে স্বতন্ত্র এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে সমালোচনার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে।৬ যেমনটা হাবারমাস উল্লেখ করেছেন, ‘জনপরিসরকে প্রতিষ্ঠান কিংবা সংগঠন হিসেবে কল্পনা করা যাবে না। এমনকি এটা নিয়মনীতির ভিত্তিতে একটি কর্মকাঠামোও না, যার জন্য ভিন্ন ভিন্ন কর্মদক্ষতা, রীতি, সদস্যপদের নীতিমালা প্রভৃতি আছে...বরং এটা উন্মুক্ত, সুগম এবং পরিবর্তনশীল।’৭

যা-ই হোক, যদিও বুর্জোয়া বা পশ্চিমা মডেলের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বিকাশমান গণতন্ত্রে উদারনৈতিক জনপরিসরের ধারণাটি আদর্শ মনে হয়, কিন্তু বাস্তবে এখানে জনগণ বলতে নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর কিছু মানুষকেই বোঝায়। বুর্জোয়া-উদারনৈতিক জনপরিসরের ধারণার মধ্যে এই বৈপরীত্যটি স্পষ্ট করে তুলে ধরেন আলেক্সান্ডার ক্লুগে ও অস্কার নেগ্ট তাঁদের পাবলিক স্ফিয়ার অ্যান্ড এক্সপেরিয়েন্স (১৯৭২) গবেষণায়।৮ তাঁদের মতে, জনপরিসরের ধারণা অনুযায়ী এটি কোনো একক পরিসরকে বোঝায় না। এটা বোঝা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে জনপরিসর ধারণাটি একটি সামষ্টিক ব্যাপার। জনপরিসর হলো অর্থনৈতিক, প্রযুক্তিগত, সামাজিকসহ বিবিধ অসংহত গঠনের জনজীবনের একটি মিশ্রণ, যা আঞ্চলিক থেকে আন্তর্জাতিক পর্যায় পর্যন্ত বিস্তৃত। হাবারমাসের বুর্জোয়া জনপরিসর তত্ত্বকে অস্বীকার ও সমালোচনা করে ক্লুগে ও নেগ্ট বুর্জোয়া, শিল্প-বাণিজ্যিক ও সর্বহারা জনপরিসরের সীমানা চিহ্নিত করেছেন। তবে তাঁরা বলেন, এগুলোর কোনোটিই আলাদা থাকতে পারে না। বরং এদের মধ্যে সমঝোতাপূর্ণ সহাবস্থান, অধিক্রমণ ও মৌলিক বৈপরীত্য একই সঙ্গে থাকে। এভাবে তাঁরা জনপরিসরের ধারণাকে নির্দিষ্ট জায়গা ও কার্যক্রম, যা একটি অবাধ যোগাযোগের ক্ষেত্র, তার চেয়ে অনেক বিস্তৃত করে দেখার সুযোগ করে দেন। তারা জনপরিসরকে অভিজ্ঞতার সামাজিক দিগন্ত হিসেবে দেখেন, যে পরিসর বস্তুগত, মানসিক ও সামাজিক ‘পুনরুত্পাদন’ ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে।৯

হাবারমাসের জনপরিসর ধারণা ঘিরে এসব সমালোচনাকে মনে রেখে ও মিরিয়াম হানসেনের ভাষ্যমতে আমিও মনে করি জনসম্পৃক্ততার দিক থেকে চলচ্চিত্র নিয়ে ভাবলে সামগ্রিকভাবে ভাবলে নানা পর্যায়ের অনুসন্ধান ও পদ্ধতি মিলিয়ে একটি তাত্ত্বিক কাঠামো খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয়। একদিকে চলচ্চিত্র মাধ্যমটি বিশেষ ধরনের উত্পাদন, বিতরণ ও প্রদর্শনের নির্ভরতার কারণেই একটি জনপরিসরের ক্ষেত্র তৈরি করে। অন্যদিকে, ‘চলচ্চিত্র জনজীবনের অন্য অধ্যায়গুলোকেও স্পর্শ করে, তার সাথে আদান-প্রদান করে।... দুদিক থেকেই প্রশ্ন ওঠে: কোন অভিজ্ঞতার ডিসকোর্সগুলো সামনে আসবে? কোনগুলো গোপন (private) থাকবে? কীভাবে এই ডিসকোর্সসমূহ সংগঠিত হবে, কে, কার জন্য, কী উদ্দেশ্যে, নির্দিষ্ট অবস্থা ও পরিস্থিতির মধ্যে, কীভাবে জনগণ সামষ্টিক ও আন্তর্ব্যক্তিক ক্ষেত্র হিসেবে গঠিত হয় এবং নিজেদের গঠন করে’।১০

জনপরিসরের এই বৈশিষ্ট্যগুলোকে স্বীকৃতি দিয়ে হেনসেনের মতো আমিও মনে করি, ‘এটি একটি ডিসকার্সিভ বিন্যাস বা প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে সামাজিক অভিজ্ঞতাগুলোর নির্মাণ, ব্যাখ্যা, সমঝোতা এবং প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়; যার কাঠামো মূলত আন্তর্ব্যক্তিক, সামষ্টিক এবং একই সাথে বিরোধধর্মী।’১১ জনপরিসরের দিক থেকে চলচ্চিত্রকে দেখতে গিয়ে আমি এর দুটি দিক মিলিয়ে দেখি: এর টেক্সট ও তার সার্বিক প্রেক্ষাপট (কনটেক্সট)।

জনপরিসরের ধারণাকে ভিত্তি ধরে বাংলাদেশে চলচ্চিত্রের দেশীয়করণ প্রক্রিয়া অনুসন্ধানকল্পে প্রথমে খুব সংক্ষেপে বাংলাদেশের জাতীয়তার ইতিহাস অন্বেষণ করব। বাংলাদেশ স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র হিসেবে জন্মানোর প্রায় সাত দশক আগে (১৮৯৮) এখানে চলচ্চিত্র প্রথম প্রদর্শিত হয়। আরও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, বাংলাদেশ হচ্ছে সেই বিরল জাতিরাষ্ট্র, যা দু’দুবার উপনিবেশ থেকে মুক্ত হয়েছে। প্রথমে ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশদের কাছ থেকে মুক্ত হয়ে এটি পূর্ব পাকিস্তানে পরিণত হয়। তারপর ১৯৭১ সালে একটি রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। এ থেকে বোঝা যায়, জাতীয়তার বোধ এখানে এক জায়গায় সুনির্দিষ্ট ছিল না, পূর্ব বাংলায় এবং বাংলাদেশে এ ধারণা বিভিন্ন পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গিয়েছে।

চলচ্চিত্র ইতিহাসবেত্তাদের কাছে চলচ্চিত্রের দেশীয়করণ একটি সোজাসুজি ব্যাপার। জাতীয়তাবাদী জ্ঞানভাষ্যের মধ্যে তাঁরা চলচ্চিত্রের ইতিহাসের পাতা থেকে কিছু ‘মহামানব’কে চিহ্নিত করেন, যাঁরা ‘প্রথম’ চলচ্চিত্র উত্পাদন-প্রক্রিয়ায় ছিলেন এবং যাঁরা বিশ শতকের শেষভাগ ও একুশ শতকের প্রথম ভাগের প্রভাবশালী জনপরিসরের সঙ্গে খাপ খান। তাঁদের জন্য, চলচ্চিত্র হলো তার আধেয় (text), তাঁদের ইতিহাস অন্বেষণে চলচ্চিত্র প্রদর্শন বা বিপণনের তেমন গুরুত্ব নেই। সুতরাং চলচ্চিত্রের দেশীয়করণকে তাঁরা চিহ্নিত করেন কীভাবে বাঙালি মুসলমান দর্শকের আসন থেকে নির্মাতা বা প্রযোজকের আসনে বসল এবং চলচ্চিত্রের আধেয় নির্মাণের দায়িত্ব নিল।১২ যা-ই হোক, আমি চলচ্চিত্রকে বুঝে থাকি তার আধেয়, তার সাথে সংশ্লিষ্ট সমাজ-সংস্থা ও দর্শক সবটা মিলিয়ে এবং এগুলোর মিথস্ক্রিয়া ও প্রেক্ষাপটের সম্পর্কের নিরিখে। এ জন্য বাংলাদেশে চলচ্চিত্রের দেশীয়করণ কীভাবে হলো তা নির্ণয় করতে আমি শুধু বহুল আলোচিত প্রথম চলচ্চিত্র উত্পাদনের দিকে নির্দেশ করি না, বরং চলচ্চিত্র আস্বাদন, বিতরণ ও প্রচারসংক্রান্ত আরও অনেক কম উল্লেখিত ঘটনার দিকেও নির্দেশ করি। বাংলাদেশে জাতীয়তার বোধকে নির্মাণাধীন ধরে, আমি ১৮৯৮ থেকে ১৯৬৫ সালের মধ্যে সংঘটিত চলচ্চিত্রবিষয়ক ঘটনাগুলোর একটি তালিকা তৈরি করেছি। এসব ঘটনা এ দেশে চলচ্চিত্রের দেশীয়করণে গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হলেও সেগুলো আমাদের চলচ্চিত্র ইতিহাসে বেশি গুরুত্ব পায়নি। কারণ, এসব ঘটনাকে সমসাময়িক বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী জ্ঞানভাষ্য ও প্রভাবশালী জনপরিসরে সহজে খাপ খাওয়ানো যায় না। এ প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ অনেকগুলো চলচ্চিত্র ও চলচ্চিত্রের ঘটনা রয়েছে, যেগুলো চলচ্চিত্রের দেশীয়করণের অমসৃণ পথকে চিহ্নিত করে, কিন্তু বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসের পাতায় এগুলো কেবল অগুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে স্থান পায়।

চলচ্চিত্র মাধ্যমকে বাংলাদেশে গ্রহণ করার প্রক্রিয়াকে গতানুগতিক ধারার দৃষ্টিভঙ্গি, যা হাবারমাসের জনপরিসরের ধারণার সঙ্গে একমত পোষণ করে, তার বিপরীতে আমি একটি বিকল্প সামাজিক-ঐতিহাসিক উপায়ে ব্যাপারটিকে দেখার চেষ্টা করব, যেটি চলচ্চিত্রের দেশীয়করণকে দেখে বিভিন্ন ছোট-বড় ঘটনার মধ্য দিয়ে, যেগুলো একটি প্রভাবশালী জনপরিসরের ধারণার সঙ্গে সহজে খাপ খায় না। আমার যুক্তি, যদিও চলচ্চিত্র বহুজাতিক মাধ্যম হিসেবে বিশ শতকের প্রথম দিকে পূর্ব বাংলায় প্রবেশ করে, কিন্তু পরে এটি বেড়ে উঠেছে বিভিন্ন বিকল্প এবং দেশীয় জনপরিসরে, যেমন এটি ঔপনিবেশিক-আধুনিকতাপন্থী, সাংস্কৃতিক-জাতীয়তাবাদী এবং গ্রামীণ জনপরিসরের সঙ্গে মিলিত হয়েছে। চলচ্চিত্রের অগ্রযাত্রায় এসব জনপরিসরকে প্রথম দৃষ্টিতে যদিও মনে হতে পারে একরৈখিক, কালানুক্রমিক পর্যায়, কিন্তু এগুলো অবশ্যই ছিল একে অপরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। এভাবে চলচ্চিত্রের আত্তীকরণের প্রক্রিয়ায় ভিন্ন ভিন্ন জনপরিসরের ধারণাগুলো পূর্ব বাংলায় চলচ্চিত্র মাধ্যমের সাংস্কৃতিক অনুবাদের অমসৃণ প্রক্রিয়াকে অনুধাবনে আমাদের সহায়তা করে।

পূর্ব বাংলায় প্রথম বিদেশি চলচ্চিত্র পৌঁছানো: আন্তর্দেশীয়

জনপরিসর হিসেবে চলচ্চিত্র

১৮৯৮ সালে ঢাকায় প্রথম চলচ্চিত্র প্রদর্শন একটি বহুজাতিক উদ্যোগ, যেহেতু এটি এশিয়ার অন্যান্য অংশেও ঘটেছিল। পূর্ব বাংলায় প্রথম চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয় উপমহাদেশে প্রথম প্রদর্শনের ২১ মাস পর। ১৮৯৬ সালের ৭ জুলাই বোম্বের ওয়াটসন হোটেলে বিখ্যাত লুমিয়ার ভ্রাতৃদয় প্রথম চলচ্চিত্র দেখান। আর ঢাকার প্রদর্শনীটি হয় ক্রাউন থিয়েটারে (এখন বিলুপ্ত), কলকাতাভিত্তিক ব্রেডফোর্ড সিনেমাটোগ্রাফ কোম্পানি ১৭ এপ্রিল ১৮৯৮ সেখানে চলচ্চিত্র প্রদর্শন করে।১৩ প্রদর্শনীর মধ্যে ছিল দ্য ডায়মন্ড জুবিলি প্রোসেশন অব কুইন ভিক্টোরিয়া, দ্য গ্রিক-টার্কিশ ওয়ার অব ১৮৯৭, প্রিন্সেস ডায়ানা’স জাম্প ইন দ্য ওয়াটার ফ্রম অ্যাবভ ৩০০ ফিট, করোনেশন সিরিমনি অব রাশান জার, অ্যাক্টিভিটিজ অব এ ম্যাড বারবার, স্ট্রম ইন দ্য সি, গেম বিটুইন এ লায়ন অ্যান্ড ইটস ওনার, ক্রাউড ইন দ্য স্ট্রিট অব ফ্রান্স, ফ্রেঞ্চ সোলজারস রাইডিং অন হর্সেস, রেইল প্যাসেঞ্জারস ইন ফ্রান্স এবং প্লে অন দ্য আইস অব ইংল্যান্ড। তখনকার ঢাকার কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত ক্রাউন থিয়েটার বিখ্যাত ছিল কলকাতার সুপরিচিত নাটকগুলো ঢাকায় মঞ্চায়নের জন্য। প্রবেশমূল্য ছিল আধা রুপি (আট আনা) থেকে তিন রুপি। তখনকার দিনে এটি ছিল বেশ ব্যয়বহুল বিনোদন, সেই সময় একজন দিনমজুরের দৈনিক আয় ছিল আধা রুপি। উচ্চ প্রবেশমূল্য ও ইউরোপকেন্দ্রিক চলচ্চিত্র আধেয় প্রমাণ দেয় যে একটি আন্তর্দেশীয় জনপরিসর হিসেবে চলচ্চিত্রের আগমন ঘটে মূলত ঢাকার ঔপনিবেশিক অভিজাতদের জন্য।

২৪ এপ্রিল ১৮৯৮ তারিখে তখনকার ঢাকার প্রধান সাপ্তাহিক ঢাকা প্রকাশ-এ প্রদর্শনীর ওপর যে প্রতিবেদনটি ছাপা হয়েছিল তাতে অন্যান্য স্থানীয় বিনোদনের ওপরে চলচ্চিত্র মাধ্যমকে প্রশংসা করা হয় একটি আন্তর্দেশীয়-ঔপনিবেশিক আবিষ্কার হিসেবে: ‘এই চমত্কার জাদু সত্যিকার অর্থে বিস্ময়কর... এই সিনেমাটোগ্রাফের আবিষ্কারক অবশ্যই খুব জ্ঞানী। এই যন্ত্রের ব্যবহারকারীকেও আমরা ধন্যবাদ জানাই। আমরা মনে করি, এই বিস্ময়

দেখার জন্য অর্থ ব্যয় করা বোকামি হবে না। আমরা না বলে পারছি না যে জীবন্ত মানুষের করা নাটক বা সার্কাস দেখার চেয়ে এটা (দেখা) হাজার গুণে ভালো।’১৪

প্রথম চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর পর আমেরিকান, ইউরোপীয় ও ভারতীয় চলচ্চিত্র পূর্ব বাংলার বিভিন্ন থিয়েটারে প্রদর্শন শুরু হয়ে যায়, ১৯১০-এর দশক থেকে ১৯৬০-এর দশক পর্যন্ত যা চলতে থাকে। ১৯০০ এবং ১৯১০-এর দশকের চলচ্চিত্রগুলো প্রদর্শিত হয় বাণিজ্যিক থিয়েটারের জন্য নির্ধারিত মিলনায়তনে এবং মেলা প্রাঙ্গণে যেখানে জাদু ও সার্কাসের মতো অন্য আকর্ষণগুলোও ছিল। নিয়মিত চলচ্চিত্র প্রদর্শনী ঢাকায় শুরু হয় ১৯১৩-১৪ সালের দিকে, আরমানীটোলার একটি পাটের গুদামে। এটাই পরিণত হয় পিকচার হাউসে, যেটি পূর্ব বাংলার প্রথম প্রেক্ষাগৃহ। গ্রেটা গার্বো অভিনীত একটি চলচ্চিত্র দিয়ে প্রথম প্রদর্শনী শুরু হয়। ১৯২০ দশকের শেষের দিকে আরও তিনটি প্রেক্ষাগৃহ ঢাকায় স্থাপিত হয়। সেগুলো ছিল সিনেমা প্যালেস (১৯২৪), পরে নাম হয় রূপমহল, লায়ন সিনেমা (১৯২৭) ও মুকুল (১৯২৯)। ১৯২০-এর দশকে পূর্ব বাংলার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর চট্টগ্রামেও দুটি প্রেক্ষাগৃহ স্থাপিত হয়—সিনেমা প্যালেস ও রঙ্গম।১৫ পরবর্তী দশকে তখনকার পূর্ব বাংলার আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শহরে প্রেক্ষাগৃহ স্থাপিত হয়। ১৯৩০-এর দশকের মধ্যে পূর্ব বাংলায় চলচ্চিত্র অবসর বিনোদনের লাভের জনপ্রিয় মাধ্যমে পরিণত হয়, যা অনেকাংশে বাণিজ্যিক থিয়েটারের জায়গা নিয়ে নেয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ওই সময় অনেকগুলো বাণিজ্যিক থিয়েটার সরাসরি প্রেক্ষাগৃহে রূপান্তরিত হয়।

১৯০০ থেকে ১৯৩০-এর দশক পর্যন্ত পূর্ব বাংলায় স্থানীয় চলচ্চিত্র নির্মাণ ছিল খুবই স্বল্প পর্যায়ে। বেশির ভাগ চলচ্চিত্র ছিল আমেরিকা, ইউরোপ ও ভারত থেকে আমদানিকৃত এবং সেগুলো পরিবেশিত হতো অবাঙালি, অমুসলিম এবং পূর্ব বাংলার নব্য শহুরে বাঙালি মুসলমানদের সামনে। অনুপম হায়াতের বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাস বইতে বলা আছে, চার্লি চ্যাপলিনের দ্য কিড (১৯২১) ও মডার্ন টাইমস (১৯৩৬), সিডনি ফ্রাঙ্কলিনের দ্য গুড আর্থ (১৯৩৭) এবং রবার্ট স্টিভেনসনের কিং সলোমন’স মাইনস (১৯৩৭)-এর মতো মার্কিন ও ব্রিটিশ চলচ্চিত্র ঢাকার প্রেক্ষাগৃহে দেখানো হয়েছিল ১৯২০ ও ১৯৩০-এর দশকে। হায়াত ভারতীয় বাংলা ও হিন্দি চলচ্চিত্রের একটি তালিকাও দেন, যেগুলো তখন পূর্ব বাংলায় দেখানো হয়েছিল: জ্যোতিষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিল্বমঙ্গল (১৯১৯) ও জয়দেব (১৯২৬), প্রিয়নাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের দুর্গেশনন্দিনী (১৯২৭), আর্দেশির ইরানির বোম্বাই কা বিল্লি (ওয়াইল্ডক্যাট অব বোম্বে) (১৯২৭), দেবকী বসুর চণ্ডীদাস (১৯৩২) ও সোনার সংসার (১৯৩৬), শিশিরকুমার ভাদুড়ীর সীতা (১৯৩৩), প্রেমাঙ্কুর আতর্থীর কপালকুণ্ডলা (১৯৩৩) এবং নিতিন বসুর ডাকু মনসুর (১৯৩৪)।১৬ বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় চিত্রশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী স্মরণ করেন আলফ্রেড হিচককের স্পেলবাউন্ড (১৯৪৫) ও ডায়াল এম ফর মার্ডার (১৯৫৪), উইলিয়াম ওয়াইলারের দ্য বেস্ট ইয়ারস অব আওয়ার লাইভস (১৯৪৬) ও রোমান হলিডে (১৯৫৩), ভিনসেন্ট মেনেলির লাস্ট ফর লাইফ (১৯৫৬) এবং চার্লস ভিদরের এ ফেয়ারওয়েল টু আর্মস (১৯৫৭)-এর মতো সুপরিচিত ইংরেজি ও হলিউডের চলচ্চিত্রগুলো ১৯৪০ ও ১৯৫০-এর দশকে ঢাকার প্রেক্ষাগৃহে দেখানো হয়েছিল।১৭

বিশ শতকের প্রথম ভাগে পূর্ব বাংলায় প্রদর্শিত বিদেশি চলচ্চিত্র আস্বাদনের ও গ্রহণের একটি পূর্ণাঙ্গ ছবি তৈরির প্রক্রিয়া এখনো অসম্পূর্ণ। তবুও এ পর্যায়ে আমার প্রস্তাবনা, এ ধরনের বহুজাতিক চলচ্চিত্রের প্রদর্শন ও গ্রহণের কারণে এখানে একটি অবাঙালি অমুসলিম আন্তসাংস্কৃতিক (transcultural) জনপরিসর এখানে তৈরি হয়েছিল। এই জনপরিসর ঔপনিবেশিক-এলিট (ব্রিটিশ ও বাঙালি হিন্দু) এবং উপনিবেশবিরোধী উঠতি মধ্যবিত্ত (যারা মূলত নব্য শহুরে বাঙালি মুসলমান), দুই পক্ষকেই সন্তুষ্ট করেছিল। এভাবে বিশ শতকের প্রথম ভাগে পূর্ব বাংলার প্রেক্ষাগৃহগুলো প্রায় আক্ষরিক অর্থেই পরিণত হয়েছিল ‘বহু, বিচিত্র ও অসম ক্ষেত্রের মানুষের ডিসকার্সিভ (discursive) প্রতিযোগিতার জায়গায়’।১৮

পূর্ব বাংলায় প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণ: ঔপনিবেশিক-আধুনিকতাবাদী

জনপরিসর হিসেবে চলচ্চিত্র

বিশ শতকের প্রথম ভাগে পূর্ববঙ্গে যেমন চলচ্চিত্রের কল্যাণে একটি বহুজাতিক জনপরিসর তৈরি হয়েছিল, চলচ্চিত্রের দেশীয়করণও এখানে বিভিন্ন ধরনের হয়েছিল। এমন একটি বিশেষ ধরনকে বলা যেতে পারে ঔপনিবেশিক-আধুনিকতাবাদী জনপরিসর। বিশেষ করে পূর্ব বাংলার অভিজাতদের প্রথম দিককার চলচ্চিত্র নির্মাণ প্রচেষ্টাকে এই আধুনিকতাবাদী জনপরিসরের উত্থানের সঙ্গে বিবেচনা করা যেতে পারে। পূর্ব বাংলায় প্রথম দিককার চিত্রধারণ ও চলচ্চিত্র নির্মাণের ধারাকে এমন একটি জনপরিসরের মধ্যে চিহ্নিত করা যায়। এসব প্রচেষ্টা অবশ্য তাঁরাই নিয়েছিলেন, যাঁরা ঔপনিবেশিক আধুনিকতার কাছাকাছি ছিলেন। যেমন হীরালাল সেন ছিলেন সুপরিচিত বাঙালি হিন্দু চিত্রগ্রাহক এবং ঢাকার নবাবেরা ছিলেন অবাঙালি সামন্ততান্ত্রিক পরিবার, যাঁদের বিশ শতকের প্রথম তিন দশকে ঔপনিবেশিক রাজনীতিতে যথেষ্ট প্রভাব ছিল।

ঢাকার কাছে মানিকগঞ্জের বাগজুরি গ্রামের হীরালাল সেন (১৮৬৬-১৯১৭) ছিলেন একজন বিখ্যাত আলোকচিত্রশিল্পী। তিনি ১৮৯৮ থেকে ১৯০০ সালের মধ্যে বাস্তব জীবনের দৃশ্যধারণ শুরু করেন কলকাতা ও ঢাকায়। তিনি ছিলেন হিন্দু জমিদার ও আইনজীবী চন্দ্র মোহন সেনের পুত্র। তাঁর দাদা গোকুল কৃষ্ণ সেন মুন্সি ছিলেন একজন সুপরিচিত আইনজীবী। উনিশ শতকের ঢাকায় তিনি ছিলেন অভিজাত সমাজের সদস্য। হীরালাল শিক্ষা নিয়েছিলেন তাঁর গ্রামে, ঢাকায় ও কলকাতায়। তরুণ অবস্থায় তিনি স্থিরচিত্র তোলা শুরু করেন। ১৮৮৭ থেকে ১৮৯৮ সালের মধ্যে তিনি সর্বভারতীয় পর্যায়ের প্রতিযোগিতাগুলোতে ৭টি পুরস্কার পান। তাঁর প্রতিপক্ষ ছিল ভারতীয় ও ব্রিটিশ আলোকচিত্রীরা। ১৮৯০ সালে তিনি নিজের একটি স্টুডিও ‘এইচ. এল. অ্যান্ড ব্রাদারস’ খুলেছিলেন। ১৯০০-১৯০১ সালের মধ্যে তিনি তখনকার বিখ্যাত নাট্যকার অমরেন্দ্র নাথ দত্তের সহায়তায় কলকাতার ক্ল্যাসিক থিয়েটারে বিভিন্ন নাটকের মঞ্চাভিনয়ের চিত্র ধারণ করেন। মঞ্চে তোলা এসব দৃশ্য—আলী বাবা, সরলা, বুদ্ধ, ভ্রমর ও সীতারাম—প্রথম ক্ল্যাসিক প্রদর্শিত হয় ১৯০১ সালের ফেব্রুয়ারিতে। নাটকের দৃশ্যধারণ ছাড়াও হীরালাল কলকাতা, মানিকগঞ্জ, দিল্লির দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন ঘটনার দৃশ্য ধারণ করেছিলেন। এগুলোর মধ্যে ছিল দিল্লির দরবার হল (১৯০৩-এ ধারণকৃত); ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে একটি মিছিল; স্বদেশি আন্দোলনের একটি মিছিল; কলকাতার চিতপুর রোডের মানুষ ও যানবাহন; মানিকগঞ্জের বাগজুরি গ্রামের পুকুরে স্নানরত মানুষ এবং ১৯১১ সালে দিল্লিতে রাজা পঞ্চম জর্জের রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠানের দৃশ্য।১৯

ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসবেত্তা আশীষ রাজাধ্যক্ষ ও পল উইলমেনের মন্তব্য, হীরালাল সেনের ডান্সিং সিনস ফ্রম দ্য ফ্লাওয়ার অব পারসিয়া, ১৮৯৮ সালের কলকাতার দৃশ্যগুলো হলো একজন ভারতীয়ের তোলা সবচেয়ে প্রথম চিত্রধারণের উদাহরণ। তাঁরা আরও বলেন, ১৮৯৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হীরালালের রয়্যাল বায়োস্কোপ কোম্পানি ঔপনিবেশিক বঙ্গদেশের প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণ ও প্রদর্শন সংস্থা।২০ তবে বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের জরিপভিত্তিক ইতিহাসবেত্তা অনুপম হায়াতের মতে, হীরালাল ৪ এপ্রিল ১৮৯৮-এ কলকাতায় কোম্পানিটি প্রতিষ্ঠা করেন তাঁর ভাই মতিলাল সেন, দেবকী লাল সেন ও ভাইপো ভোলানাথ গুপ্তের সঙ্গে। তাঁর মতে, হীরালাল প্রথম চলচ্চিত্র দৃশ্য ধারণ করেন পূর্ব বাংলার মানিকগঞ্জ মহকুমায়, ১৯০০-১৯০১ সালের দিকে। তিনি বিশ শতকের গোড়ার দিকে বটকৃষ্ণ পাল অ্যান্ড কোম্পানির তৈরি এডওয়ার্ডের ম্যালেরিয়ারোধী ওষুধ, সি কে সেন অ্যান্ড কোম্পানির জবা কুসুম তেল ও ডব্লিউ মেজর অ্যান্ড কোম্পানির সলসপিলার মতো আরও কিছু বিজ্ঞাপনী চলচ্চিত্র তৈরি করেন।২১

ভারতীয় বাংলা চলচ্চিত্রের অন্যতম ইতিহাসবেত্তা কালীশ মুখোপাধ্যায় তখনকার সময়ের বহুল পঠিত পাক্ষিক বঙ্গবাসী (২১ আগস্ট ১৯০৩)-এ ছাপা প্রতিবেদন থেকে হীরালালের রয়্যাল বায়োস্কোপের অর্জনকে তুলে ধরেন: ‘সত্যিকার অর্থেই রয়্যাল বায়োস্কোপ কোম্পানি প্রশংসার দাবিদার। চমত্কার এবং সুপরিচিত ঘটনাগুলোর জীবন্ত এবং চলমান ছবি দেখানোর মাধ্যমে তারা ভারতীয় জনগণকে বিনোদন জুগিয়েছিল। তারা পশ্চিমা (পড়ুন ব্রিটিশ) চলচ্চিত্র দেখিয়ে ক্ষান্ত হয়নি, নিজেরা অনেক অর্থ ব্যয় করে স্থানীয় ঘটনাগুলোর চলমান চিত্রও ধারণ করেছে।’২২ তারপরে বাংলাদেশের আদি চলচ্চিত্রে হীরালাল সেনকে প্রথম চিত্রগ্রাহক, নির্মাতা ও প্রদর্শক হিসেবে কৃতিত্ব দেওয়া যায়। কিন্তু বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের জরিপভিত্তিক ইতিহাসের ধারা তাঁর প্রচেষ্টাকে স্বীকৃতি দেয়নি।২৩ কারণ হীরালাল তাঁর চলচ্চিত্র নির্মাণ ও প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে একটি ঔপনিবেশিক-আধুনিকতাবাদী জনপরিসরকে রূপ দিতে সক্রিয় ছিলেন। বাংলাদেশ-পূর্ব সময়কার চলচ্চিত্র নিয়ে লেখা জরিপ ইতিহাসগুলো বিশ শতকের শেষের দিকের বাংলাদেশে লিখিত। সেখানে বাংলাদেশি/বাঙালি-মুসলমান জাতীয়তাবাদী জনপরিসরের দৃষ্টিতে হীরালালকে প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়নি। হীরালালের ধারণকৃত নানা ঘটনার দৃশ্যগুলো, যেমন ব্রিটিশ শাসকের কলকাতায় পৌঁছানো এবং বিভিন্ন মঞ্চনাটকের খণ্ডাংশ, এগুলো তাঁর ঔপনিবেশিক-আধুনিকতাবাদী আনুগত্যের নিশ্চিত প্রমাণ। খবরের প্রতিবেদনে তাঁর অর্জনের সীমারেখাটি (ব্রিটিশ চলচ্চিত্র প্রদর্শন এবং খবরযোগ্য ঘটনাগুলো ‘অনেক টাকা খরচ করে’ ধারণ করা) তাঁকে আরও ঔপনিবেশিক-আধুনিকতাবাদী হিসেবে চিহ্নিত করে। এ ধরনের ঔপনিবেশিক-আধুনিকতাবাদী চলচ্চিত্রের কাজ সমসাময়িক বাংলাদেশের বাঙালি-মুসলমান সাংস্কৃতিক আধুনিকতার কাঠামোর মধ্যে মূল্যায়িত হতে পারে না। হীরালালের অতীত পরিপ্রেক্ষিত (একটি বাঙালি-হিন্দু জমিদার পরিবার) তাঁকে ঔপনিবেশিক-আধুনিকতাবাদী নির্মাতা-প্রদর্শক হিসেবে যেমন সুবিধা দিয়েছিল, তেমনি একই সঙ্গে বাংলাদেশের বাঙালি-মুসলমান মধ্যবিত্ত সমাজের প্রভাবশালী জাতীয় জনপরিসরে তিনি সহজেই বাদ পড়েছেন।

১৯০০-এর দশকে হীরালালের এক রিলের নির্বাক ছবিগুলোর পর ইতিহাসবেত্তারা ১৯২০-এর দশকে পূর্ব বাংলায় স্থানীয় চলচ্চিত্র নির্মাণের আরও দৃষ্টান্ত পান। ঢাকার নবাব পরিবারের তরুণ সদস্যরা পূর্ব বাংলায় নির্বাক চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু করেছিলেন। নবাবরা ছিলেন নেতৃস্থানীয় মুসলমান সামন্ততান্ত্রিক জমিদার পরিবার, স্থানীয় রাজনীতির হর্তাকর্তা, সেই সঙ্গে ব্রিটিশ সমর্থিত। ১৯২৮ সালে প্রথমে তাঁরা সুকুমারী (দ্য গুড গার্ল) নামের একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য নির্বাক চলচ্চিত্র নির্মাণ শেষ করেন। নবাব পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ছিলেন খাজা আজমল, খাজা নসরুল্লাহ, খাজা আজাদ, খাজা আকিল, খাজা আকমল ও খাজা জহির। এসব নবাবের অধিকাংশের শরীরচর্চার শিক্ষক অম্বুজ গুপ্ত চলচ্চিত্রটি পরিচালনার ভূমিকায় ছিলেন। নসরুল্লাহ নায়কের ভূমিকায় ছিলেন এবং আবদুস সোবহান, আরেকজন তরুণ, চলচ্চিত্রের নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। সামাজিক ও ধর্মীয় নিষেধের কারণে পূর্ববঙ্গের কোনো নারীকে চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য পাওয়া যায়নি।২৪

সুকুমারীর পর একই দল ১৯২৯ সালের অক্টোবর মাসে কাহিনিচিত্র দ্য লাস্ট কিস নির্মাণের কাজ শুরু করে। দুজন বাংলাদেশি চলচ্চিত্র ইতিহাসবেত্তা, অনুপম হায়াত ও মির্জা তারেকুল কাদের, এই চলচ্চিত্র নির্মাণের বিস্তারিত তথ্য দিয়েছেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাস এবং বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্প বইগুলোতে। দ্য লাস্ট কিস-এ আজমল নায়কের ভূমিকা নেন, যেখানে সুকুমারীর নায়ক নসরুল্লাহ খলনায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেন। ১৪ বছর বয়সী ললিতাকে আনা হয় ঢাকার কুখ্যাত যৌনপল্লি বাদামতলী থেকে, নায়িকা চরিত্রে অভিনয়ের জন্য। সেটি ছিল আজমলের স্ত্রীর চরিত্র। চলচ্চিত্রটি তিনটি ভাষায় নির্মিত হয়—বাংলা, ইংরেজি ও উর্দুতে ইন্টারটাইটেলসহ। নির্বাক এই চলচ্চিত্রটি ১৯৩১ সালে ঢাকার মুকুল থিয়েটারে মুক্তি পায় এবং এক মাস বা তার কাছাকাছি সময় ধরে চলে। ভারতের নামকরা ইতিহাসবেত্তা রমেশ চন্দ্র মজুমদার—তখনকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক—চলচ্চিত্রটির প্রিমিয়ার শো উদ্বোধন করছিলেন।২৫

১৯৮০-এর দশকের প্রথম দিকে হায়াত দ্য লাস্ট কিস-এর ব্যাপারে নবাব পরিবারের কয়েকজন সদস্যের সাক্ষাত্কার নিয়েছিলেন। তাঁদের বিভিন্ন বর্ণনার মধ্য দিয়ে বোঝা যায় যে চলচ্চিত্রটির কাহিনি একাধিক দ্বন্দ্বকে চিত্রিত করেছে। এ দ্বন্দ্ব বিশ শতকের প্রথম দিককার ঔপনিবেশিক-আধুনিকতাবাদী অভিজাতদের বিভিন্ন ধারার নিজেদের মধ্যে, আবার একই সঙ্গে ঔপনিবেশিক-আধুনিকতাবাদী ও গ্রাম্য, অনাধুনিক শক্তির মধ্যে। খাজা শাহেদ এটিকে বলেছিলেন দুই জমিদার পরিবারের দ্বন্দ্ব; বিচ্ছেদের সময় দুই পরিবারের দুই শিশু পরস্পরকে চুমু খায়, সে কারণে চলচ্চিত্রের নাম দ্য লাস্ট কিস। জহির বলেন, যখন জমিদার নায়ক (আজমল) তার স্ত্রীর (ললিতা) সঙ্গে যাত্রা দেখতে যাচ্ছিল, তখন খলনায়ক, আরেক জমিদার (নসরুল্লাহ) তার দলবল নিয়ে ললিতাকে অপহরণ করে। আজমল ললিতাকে নসরুল্লাহর শোবার ঘরে দেখতে পায় এবং দুই দলের মধ্যে তখন যুদ্ধ শুরু হয়। সবশেষে, আজমল ও ললিতা দুজনই মারা যায়। যা-ই হোক, শাহেদ ও জহির, দুজন গল্পকথকই নিশ্চিত করেন যে চলচ্চিত্রে একটি দৃশ্য ছিল যেখানে একটি পরিবারের শিশু শাহেদ ডাকাত-সর্দার শৈলেন রায়ের হাতে অপহূত হয়।২৬

ঔপনিবেশিক-আধুনিকতাবাদী পূর্ব বাংলায় দ্য লাস্ট কিস-এর সামন্ততান্ত্রিক-রোমান্টিক গল্প এবং নির্মাণশিল্পীদের অবস্থা (নারী চরিত্র ললিতা ও চারুবালাসহ, যাঁরা চলচ্চিত্র নির্মাণ শেষে যৌনপল্লিতে ফেরত যান) চলচ্চিত্রটিকে একটি ঔপনিবেশিক-আধুনিকতাবাদী উদ্যোগে পরিণত করে। সুকুমারী ও দ্য লাস্ট কিস, উভয় ছবিই একটি আধুনিকতাবাদী অভিযানসুলভ নির্মাণ প্রচেষ্টার উদাহরণ। ১৯৩০ ও ১৯৪০-এর দশকের পূর্ব বাংলায় আজমলের পশ্চিমঘেঁষা আধুনিকতাবাদী ‘অর্জন’ (আজমল ছিলেন প্রথম পূর্ববঙ্গের বাঙালি, যিনি বিমানে চড়েছিলেন এবং মোটরগাড়ি কিনেছিলেন২৭) পরিষ্কার প্রমাণ করে যে তাঁর শক্তিশালী আধুনিকতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গিই তাঁকে পূর্ব বাংলার প্রথম দিককার কাহিনিচিত্র নির্মাণের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়।

আমার যুক্তিতে হীরালাল বা নবাবেরা, সামন্ততান্ত্রিক বা আধা-সামন্ততান্ত্রিক পরিবার থেকে আসা অমুসলিম কিংবা অবাঙালি যাঁরা ছিলেন ঔপনিবেশিক প্রশাসনের সঙ্গে সংযুক্ত, তাঁরাই সে সময় চেয়েছিলেন পশ্চিমা আধুনিকতার সর্বসাম্প্রতিক এই প্রযুক্তিগত জাদুকে ঘিরে অনুসন্ধান করতে ও সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে। ঔপনিবেশিক দক্ষিণ এশিয়ার আধা-গ্রামীণ প্রতিবেশের মধ্যে তাঁদের আধুনিকতাবাদী আগ্রহ স্থানীয় চলচ্চিত্র নির্মাণের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে। তাঁদের বিবেচনা করা যেতে পারে ভারতীয় চলচ্চিত্রের জনক দাদাসাহেব ফালকের সঙ্গে, যিনি সচেতনভাবে ‘নতুন অর্জিত চলচ্চিত্র কলাকে দেশীয়করণ করা ও স্থানীয় নান্দনিকতার বোধের সঙ্গে সেটাকে মেলাতে পারার’ জন্য প্রশংসিত।২৮

প্রথম বাঙালি-মুসলমান ‘টকি’: সাংস্কৃতিক-জাতীয়তাবাদী জনপরিসরে চলচ্চিত্র

বেশির ভাগ বাংলাদেশি ইতিহাসবেত্তা বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের ইতিহাস রচনা করতে গিয়ে আন্তর্দেশীয় চলচ্চিত্র দিয়ে স্থানীয় হলগুলো দখল হয়ে যাওয়ার ঘটনা কিংবা হীরালাল সেন এবং নবাবদের চলচ্চিত্র নির্মাণ-উদ্যোগগুলোকে অনেকাংশে এড়িয়ে যান। ১৯৪৭-পরবর্তী পূর্ব পাকিস্তানে একটি বাঙালি-মুসলমান জনপরিসর তৈরি করতে সাহিত্য ও অন্যান্য বিভিন্ন শিল্পমাধ্যমের মতো সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদী মধ্যবিত্ত বাঙালি-মুসলমানের বাংলা চলচ্চিত্র নির্মাণের ব্যাপারটি তাঁরা বরং উপস্থাপন করেন। সে জন্য বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের প্রমিত ইতিহাসে একটি নির্দিষ্ট ঘটনা (১৯৫৫ সালে পাকিস্তানে মুখ ও মুখোশ-এর নির্মাণ) সামনে চলে আসে এবং বারবার ব্যবহার হতে থাকে পূর্ব বাংলা, অর্থাত্ এখনকার বাংলাদেশে চলচ্চিত্রের দেশীয়করণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ হিসেবে।২৯

বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসে বাঙালি-মুসলমান সাংস্কৃতিক-জাতীয়তাবাদী জনপরিসরের অংশ হিসেবে মুখ ও মুখোশকে স্থাপনের দাবি বেশ সমর্থন পেয়েছে।৩০ এসব ইতিহাসে (এবং আরও কিছু, যেগুলো তালিকাভুক্ত হয়নি) এই মাইলফলক ঘটনাকে বিস্তারিতভাবে, অনেক সময় ও শক্তি নিয়ে বর্ণনা করে বলা হয়, স্থানীয়ভাবে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে গিয়ে আবদুল জব্বার খান (মুখ ও মুখোশ-এর নির্মাতা, চিত্রনাট্যকার ও প্রযোজক) কী কী বাধার সম্মুখীন হন। এই চলচ্চিত্র দেখানো হয় উপনিবেশ-বিরোধী প্রতিবাদ হিসেবে। আবদুল জব্বার খান ১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশকের পূর্ব পাকিস্তানের অবাঙালি চলচ্চিত্র-ব্যবসায়ী ফজল আলিদিনা দোসানির চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন, ১৯৫৩ সালে ঢাকায় সাংস্কৃতিক কর্মীদের এক সভায়। দোসানির মতে, ‘পূর্ব বাংলার আবহাওয়া চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য অনুপযোগী। আর টেকনিশিয়ান, যন্ত্রপাতি ও পেশাদার শিল্পীর অভাবের কথাতো বলাই বাহুল্য’।৩১ এভাবে একটি সাংস্কৃতিক-জাতীয়তাবাদী ল্যান্স দিয়ে চলচ্চিত্র ইতিহাসবেত্তারা মুখ ও মুখোশকে পূর্ববঙ্গের একজন বাঙালি মুসলমান দ্বারা, বাঙালি মুসলমানের জন্য, বাঙালি মুসলমানের প্রথম চলচ্চিত্রিক প্রতিনিধি হিসেবে স্থাপন করেন। পূর্ব বাংলায় চলচ্চিত্র মাধ্যমের স্থান করে নেওয়ার ক্ষেত্রে এই অবশ্য গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে তাঁরা স্থাপন করেন একটি উপনিবেশ-বিরোধী, সাংস্কৃতিক-জাতীয়তাবাদী কাঠামোয়।

বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের প্রচলিত ইতিহাসগুলো মুখ ও মুখোশকে পূর্ব বাংলায় চলচ্চিত্রের দেশীয়করণে প্রধান হিসেবে স্থান করে দেয়। চলচ্চিত্রটির এই গুণকীর্তনকে এই মাধ্যমের ভূমিকা একটি নির্দিষ্ট উপায়ে নির্ধারণের উপনিবেশবিরোধী মধ্যবিত্ত সমাজের বিশেষ অভিপ্রায়ের সঙ্গে যোগ করা যায়। পূর্ববঙ্গের মধ্যবিত্ত সমাজ চেয়েছিল চলচ্চিত্র মাধ্যমকে অন্যান্য শিল্প ও সংস্কৃতি মাধ্যমের মতো একটি সাংস্কৃতিক-জাতীয়তাবাদী জনপরিসর হিসেবে গড়ে তুলতে। এই জনপরিসর আছে, যা পূর্ব বাংলা এবং পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে মূলত উপনিবেশবিরোধী সংগ্রাম এবং জাতিগঠন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সংহত রূপ লাভ করেছে।

ঢাকা চলচ্চিত্রশিল্পের প্রথম জনপ্রিয় চলচ্চিত্র: গ্রামীণ-স্বদেশি

জনপরিসর হিসেবে চলচ্চিত্র

১৯৪৭ সালে পূর্ব বাংলা থেকে পূর্ব পাকিস্তানে রূপান্তরের ঘটনাটি মধ্যবিত্ত বাঙালি-মুসলমানকে ১৯৪০-এর দশক ও ১৯৫০-এর শুরুর দিকের সময়টায় একটি জাতীয়তাবাদী ও সাংস্কৃতিক-আধুনিকতাবাদী চেতনা গড়ে তুলতে উদ্বুদ্ধ করে। আধুনিকতার এ ধারণা লক্ষণীয় করে তুলতে মুখ ও মুখোশ মুক্তির এক বছর পর ১৯৫৭ সালে ঢাকায় নির্মিত হয় পূর্ব পাকিস্তান চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন স্টুডিও। এই স্টুডিও ঢাকায় দ্বিতীয় বাংলা চলচ্চিত্রশিল্পের সূচনা (কলকাতার পর) করে, বাঙালি-মুসলমানের জন্য ও বাঙালি-মুসলমানের তৈরি সামাজিক-বাস্তবিক কাহিনিচিত্রের মাধ্যমে। যা-ই হোক, এসব চলচ্চিত্র বাণিজ্য ও দর্শক-উপস্থিতির দিক থেকে সফল হয়নি। অন্য কথায়, ১৯৫০-এর দশকের শেষ ও ১৯৬০-এর দশকের শুরুর দিকে তৈরি বাঙালি শিল্পসম্মত চলচ্চিত্র পূর্ব বাংলার দর্শকদের আকর্ষণে ব্যর্থ হয়। এঁরা বহুজাতিক চলচ্চিত্র ও বিনোদনমূলক চলচ্চিত্র দেখতে অভ্যস্ত ছিলেন। আলমগীর কবিরের ভাষায়, বোম্বে ও লাহোর থেকে হিন্দি ও উর্দু ‘যৌন আবেদনময় উন্মত্ততা’ আমদানি হয়েছিল এখানে।৩২

সামাজিক-বাস্তববাদী নির্মাতা ও সাংস্কৃতিক ভাষ্যকারদের মতো মধ্যবিত্ত বাঙালি-মুসলমানরা চেয়েছিলেন চলচ্চিত্র প্রভাবশালী জনপরিসরের অংশ হবে বা সাংস্কৃতিক-জাতীয়তাবাদী জনপরিসরে পরিণত হবে। তাঁদের এ ধরনের অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও ১৯৬০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে চলচ্চিত্র সাংস্কৃতিকভাবে অন্য পথ, অর্থাত্ জনপ্রিয় পথে হাঁটে। চলচ্চিত্রের দেশীয়করণে স্পষ্ট হয়েছে একটি গ্রামীণ-স্বদেশি জনপরিসর, বিশেষ করে গ্রামীণ একটি যাত্রাপালার ওপর ভিত্তি করে নির্মিত চলচ্চিত্র রূপবান (১৯৬৫)-এর মধ্যে।

বহুজাতিক বিনোদনমূলক চলচ্চিত্রের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে প্রথমবারের মতো রূপবান প্রচুর পরিমাণে গ্রামীণ দর্শকদের পূর্ব পাকিস্তানের প্রেক্ষাগৃহগুলোতে আকৃষ্ট করে। ঢাকার চলচ্চিত্র নির্মাণকেন্দ্রকে টেকসই দর্শকসহ মধ্য পর্যায়ের জাতীয় চলচ্চিত্রকেন্দ্রে পরিণত করার ক্ষেত্রে এটি ছিল প্রথম পদক্ষেপ। এই চলচ্চিত্রের নির্মাণ ও গ্রহণ শুধু ঢাকাই চলচ্চিত্রশিল্পকে শক্ত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করেনি, সঙ্গে সঙ্গে তখনকার কৃষিভিত্তিক ইসলামিক সমাজে চলচ্চিত্রের জন্য একটি বিস্তৃত সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করেছিল। এ জন্য আমার মতে, পূর্ব পাকিস্তানে চলচ্চিত্রের দেশীয়করণে রূপবান চলচ্চিত্রটি একটি বিশাল পদক্ষেপ। এটি প্রথমবারের মতো দেখিয়েছিল, একটি স্বদেশি, জনপ্রিয় চলচ্চিত্র নির্মাণশিল্প এখানে টেকসই হতে পারে। এভাবে চলচ্চিত্রটি ক্ষীয়মাণ বাংলা চলচ্চিত্রশিল্পকে গ্রাম থেকে নতুন দর্শক আনার মাধ্যমে পরিণত করেছিল একটি স্পন্দনশীল স্বদেশি জনপরিসরে।

কবিরের মতে, বাংলা বাস্তবিক চলচ্চিত্রের ব্যর্থতার জন্য এ বছরগুলোতে ঢাকাই চলচ্চিত্রশিল্প দ্রুত একটি বিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল, যতক্ষণ না এহতেশাম চান্দা (১৯৬২) তৈরি করলেন। এটি ঢাকায় নির্মিত প্রথম উর্দু চলচ্চিত্র। পূর্ব ও পশ্চিম, উভয় পাকিস্তানের বক্স অফিসে খুব ভালো করেছিল চলচ্চিত্রটি এবং এরপর উর্দু চলচ্চিত্র নির্মাণের একটি চল শুরু হয়েছিল। ১৯৬২-১৯৬৫ সালের মধ্যে ১৮টি বাংলা ছবির সঙ্গে ১৯টি ছবি উর্দু ভাষায় নির্মিত হয়।৩৩ এটি একটি নতুন আপাতবিরোধী সত্য নির্মাণ করে। এখন ঢাকাভিত্তিক বাংলা চলচ্চিত্রশিল্পকে (তখনো তার শৈশবকালে) শুধু আমদানিকৃত চলচ্চিত্র নয়, দেশে তৈরি উর্দু চলচ্চিত্রের সঙ্গেও যুদ্ধ করতে হচ্ছিল। বাঙালি দর্শকদের একটি টেকসই ভাগ অর্জনের জন্য বাংলা চলচ্চিত্র। যা-ই হোক, ১৯৬৫ সালের মধ্যে বাংলা বা উর্দুতে নির্মিত চলচ্চিত্রগুলো দর্শক আনতে ব্যর্থ হওয়া শুরু করেছিল। ১৯৬৫ সালের নভেম্বরে ঢাকাই চলচ্চিত্রশিল্প আবার যখন বন্ধ হওয়ার মুখে, রূপবান-এর মুক্তি শিল্পটিকে বাঁচিয়ে দেয়। কবির রূপবানকে সংজ্ঞায়িত করেন ‘বাণিজ্যিকভাবে সফল চলচ্চিত্রের অগ্রদূত’ হিসেবে, যা বাঙালি-মুসলমান দর্শকের জন্য বাংলা চলচ্চিত্র নির্মাণে ঢাকার স্টুডিওকে টিকে থাকতে সাহায্য করে।৩৪ বাংলা চলচ্চিত্রের নির্মাণ আবার নাটকীয়ভাবে বেড়ে যায়: ১৯৬৫ সালে ৫টি, ১৯৬৬ সালে ১৪টি এবং ১৯৬৮ সালে ২৫টি বাংলা চলচ্চিত্র নির্মিত হয়।৩৫

কীভাবে রূপবান এত জনপ্রিয় হতে পেরেছিল যে এটি ঢাকাই চলচ্চিত্রশিল্পের বাংলা চলচ্চিত্রকে একটি জনপ্রিয়-স্বদেশি জনপরিসরে রূপান্তরিত করেছিল? এর কারণ হচ্ছে, চলচ্চিত্রটি একটি সুপরিচিত কাহিনি ও গ্রামীণ যাত্রাপালার চরিত্রায়ণের মাধ্যমে বাঙালি-মুসলমান গ্রামবাসীকে চলচ্চিত্রের মতো একটি পশ্চিমা, আধুনিক এবং প্রযুক্তিগত মাধ্যমের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে সাহায্য করেছিল। রূপবান পরিণত হয়েছিল একটি উপস্থাপনানির্ভর মাধ্যম (গ্রামীণ অপেরা) থেকে চলচ্চিত্রে। পূর্ব বাংলার গ্রামগুলোতে বিনোদন মাধ্যম ছিল ঐতিহ্যবাহী শিল্পমাধ্যম যাত্রা। পরিবেশনার এ ধরনটিকে বলা যেতে পারে বাঙালি গ্রামীণ অপেরেট্টা। এটি সাধারণত ফসল উত্তোলনের সময়টাতে মধ্যরাত থেকে ভোর পর্যন্ত গ্রামের কেন্দ্রে কোনো জায়গায় একটি কাঠের বেদির ওপরে পরিবেশিত হয়। জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় অথবা দর্শকদের থেকে কিছু চাঁদার বিনিময়ে (যেমন অনেক সময় একটি পরিবার থেকে চাঁদা হিসেবে এক কেজি চাল দিতে হতো) আয়োজিত এ যাত্রাগুলোতে চরিত্রাভিনেতাদের সবাই ছিলেন পুরুষ। কাহিনির ধারণা ছিল সুপরিচিত কিংবদন্তি বা জনপ্রিয় পুরাকথার ওপর ভিত্তি করে, যেখানে ভালো-মন্দের দ্বন্দ্ব থাকত এবং অবশ্যই নায়ক-নায়িকা খলচরিত্রকে হারিয়ে দিত। কিছু কিছু আখ্যানে থাকতে পারে কয়েক প্রজন্ম।৩৬

গ্রামের মানুষেরা রূপবান-এর মতো যাত্রাপালা দেখতে অভ্যস্ত ছিল। তাই যখন এটি চলচ্চিত্র হিসেবে তৈরি হলো, তখন তাঁরা ভেবেছিলেন পালাটাই বড় পর্দায় দেখানো হচ্ছে, যেটা আগে মঞ্চে হতো, সেটাই এখন পর্দায় হবে। সালাহউদ্দিন, রূপবান-এর পরিচালক, যখন যাত্রাকে চলচ্চিত্রে ‘রূপান্তরিত’ করছিলেন, তখন তিনি ব্যবহার করেছিলেন ‘মঞ্চের ঐতিহ্যবাহী প্রবেশ-সংলাপ-প্রস্থানশৈলী’।৩৭ এই উপায়ে গ্রামীণ দর্শকের গ্রামের মধ্যের যাত্রার দর্শক থেকে কাছাকাছি শহরের চলচ্চিত্রের দর্শকে পরিণত হতে পারতেন। তানভীর মোকাম্মেল, বাংলাদেশের একজন চলচ্চিত্র সমালোচক ও লেখক, পূর্ব বাংলার গ্রামের মানুষদের মধ্যে শনাক্ত করেছেন একটি ‘তীব্র স্মৃতিকাতরতা’। তাঁরা ভীষণ খুশি হন যে যাত্রার পরিচিত চরিত্রগুলো মঞ্চ-পরিবেশনা থেকে বড় পর্দায় নড়াচড়া করছে।৩৮ দিসানায়েক ভারতের চলচ্চিত্রকে নতুনভাবে চিন্তা করার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন জনপরিসরের ধারণার জায়গা থেকে: ‘সাংস্কৃতিক পরিবেশনা ও জনগণের তাতে অংশগ্রহণ লিখিত ও প্রকাশিত শব্দকে পূর্ণ করে।’৩৯ রূপবান-এর ক্ষেত্রে আমরা যেমনটা দেখি, এ ধরনের সাংস্কৃতিক পরিবেশনা এবং বিশালাকার দর্শক অংশগ্রহণ চলচ্চিত্রটিকে জনপ্রিয়তার দিকে নিয়ে গিয়েছিল। এর ফলে পূর্ব পাকিস্তানে নিজস্ব সাংস্কৃতিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত অন্যান্য জনপ্রিয় পরিবেশনার পাশাপাশি চলচ্চিত্রেরও একটি জায়গা খুঁজে পাওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চলেও এটি বিকশিত হয়েছিল।

গ্রামীণ অপেরার সঙ্গে আন্তসম্পর্ক থাকায় রূপবান সামাজিক ও ধর্মীয় ট্যাবুগুলো ভাঙতে পেরেছিল, যে ট্যাবুগুলো ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত অনেক গ্রামীণ বাঙালি মুসলমানকে চলচ্চিত্র থেকে দূরে রেখেছিল। ১৯৫৬ সালে মুখ ও মুখোশ-এর মতো সাংস্কৃতিক-জাতীয়তাবাদী চলচ্চিত্র নির্মিত হলেও, তখন পর্যন্ত চলচ্চিত্রকে পাপ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। ১৯৬০-এর দশকে পূর্ব বাংলার গ্রামীণ মুসলমানরা ছবি তোলা বা চলচ্চিত্র ধারণ করাকে হিন্দুদের মূর্তিপূজার সমতুল্য মনে করতেন। একটি ‘ইসলামি’ ভুল (ধারণা) প্রচলিত ছিল যে ছবি দেখা বা সংরক্ষণ করা পাপের কাজ। ১৯৭১ সালে কবির লিখেছেন:

শহরের সিনেমা হলে রূপবান’র প্রদর্শনী হবে, এমন খবর প্রচারিত হওয়া মাত্রই, তা দেখার জন্য অভূতপূর্ব ভিড় জমেছিল। গ্রামবাসীরা, যারা সব সময় চলচ্চিত্রকে শয়তানের

প্ররোচনা হিসেবে দেখত, তারা হাজারে হাজারে পরিবারসহ শহরে জমা হতে থাকল। টিকেট না পেয়ে, তারা সিনেমা হলের বাইরে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করছিল। তাদেরকে

যখন প্রশ্ন করা হয়েছিল, চলচ্চিত্র দেখার জন্য এ ধরনের উন্মাদনা পাপ কিনা। তারা একেবারে অকপটভাবেই জবাব দিয়েছিলেন: ‘আমরা রূপবান (যাত্রা) দেখতে এসেছি, সিনেমা না!৪০

অন্য কথায় মুসলমান গ্রামবাসীর যুক্তি ছিল, চলচ্চিত্র দেখা পাপ হতে পারে, কিন্তু ভিডিও করা যাত্রা দেখা পাপ হতে পারে না। কারণ এটাসহ অনেক যাত্রা নাটক তারা ইতিমধ্যে দেখেছে। গল্প ছাড়াও, মূল যাত্রাতে ব্যবহূত হয়েছিল এমন কয়েকটি জনপ্রিয় লোকগানও চলচ্চিত্রটিতে ব্যবহার করা হয়। এই গানগুলো নিশ্চিতভাবে বিখ্যাত নাটকটির সঙ্গে চলচ্চিত্রটির সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছিল।

কবির এবং চিন্ময় মুত্সুদ্দীর মতে, রূপবান পূর্ব বাংলায় চলচ্চিত্রের দর্শক বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। কবিরের মতে, ‘এটা গ্রামীণ এলাকা থেকে চলচ্চিত্রের নতুন দর্শক তৈরি করেছিল, ইতিহাসে প্রথমবারের মতো এই নতুন দর্শকেরা চলচ্চিত্র দেখার জন্য শহরে আসার অভ্যাস করেছিল’।৪১ ১৯৬০-এর দশকের প্রথম দিকে যেখানে অন্যান্য বাংলা চলচ্চিত্রের মাত্র চার বা পাঁচটি রিলিজ ছাপা হতো, সেখানে রূপবান-এর ১৭টি রিলিজ ছাপানো হয়েছিল। শুধু রূপবান-এর প্রদর্শনীর জন্য গ্রামীণ এলাকায় অনেক অস্থায়ী প্রেক্ষাগৃহ তৈরি করা হয়েছিল।৪২

ফলে ১৯৬০-এর দশকের পূর্ব বাংলার গ্রামীণ জনগণ রূপবানকে যেভাবে গ্রহণ করেছিল, সেটিকে এই অঞ্চলের সক্রিয় সামাজিক ও সাংস্কৃতিক রীতির সঙ্গে স্থানীয় প্রচলিত চলচ্চিত্রের একেবারে প্রাথমিক বোঝাপড়া হিসেবে দেখা যেতে পারে। এই অঞ্চলের সক্রিয় সামাজিক ও সাংস্কৃতিক রীতির মধ্যে যাত্রার মতো লোকজ ও মঞ্চাভিনয় থেকে শুরু করে ধর্মীয় ও অবসরকালীন কাজগুলোও অন্তর্ভুক্ত। এর আগে পর্যন্ত ‘চলচ্চিত্র’ ছিল শুধু শহুরে, আধা-পশ্চিমায়িত লোকেদের বিনোদনের মাধ্যম। এই প্রথমবারের মতো পূর্ব বাংলার গ্রামের মানুষ চলচ্চিত্র দেখার জন্য দল বেঁধে ভিড় জমিয়েছিল। এভাবে পূর্ব পাকিস্তানে চলচ্চিত্রের দেশীয়করণ ১৯৬০-এর দশকে একটি জনপ্রিয় চলচ্চিত্রশিল্প

তৈরির পথ প্রসারিত করেছিল। এই সময় চলচ্চিত্র সাধারণ, গ্রামীণ বাঙালি মুসলমানদের নিত্যদিনের জীবনের এবং একইভাবে গ্রামীণ-স্বদেশীয় জনপরিসরের অংশে পরিণত হয়।

উপসংহার

এই প্রবন্ধে একাধিক জনপরিসরের মাধ্যমে স্থানীয় জনসাধারণের সঙ্গে চলচ্চিত্র মাধ্যমের প্রাথমিক সাক্ষাত্গুলো চিহ্নিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। পূর্ব বাংলায় চলচ্চিত্রের সাংস্কৃতিক অধিগ্রহণকে আমি বিভিন্ন বিকল্প জনপরিসরের মাধ্যমে বুঝিয়েছি। আমার প্রস্তাব হচ্ছে খান, সেন ও নওয়াবরা এবং তাঁদের চলচ্চিত্র নির্মাণ প্রচেষ্টা; প্রথম দিকের প্রদর্শনীগুলো, সিনেমা হলগুলো; আন্তর্দেশীয় চলচ্চিত্রগুলোকে এবং একই সঙ্গে রূপবানসহ প্রথম দিকের স্বদেশি জনপ্রিয় চলচ্চিত্রগুলোকে গ্রহণ করার মতো কিছু বিষয় বিভিন্ন ধরনের জনপরিসরের উপস্থিতিকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। এই বিষয়গুলোই পূর্ব বাংলার বাঙালি-মুসলমান সাংস্কৃতিক পরিবেশে চলচ্চিত্রকে গ্রহণ করার প্রক্রিয়ায় অবদান রেখেছে।

এভাবে দক্ষিণ এশিয়ার একটি মুসলিমপ্রধান এবং কৃষিভিত্তিক সমাজে চলচ্চিত্রের মতো একটি পশ্চিমা প্রযুক্তির সাংস্কৃতিক অধিগ্রহণের নির্দিষ্ট প্রক্রিয়াটি আমরা বোঝার চেষ্টা করেছি। আমার দৃষ্টিভঙ্গি বাংলাদেশ এবং অন্যান্য জায়গার চলচ্চিত্রের ইতিহাসবিদদের প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীত। তাঁরা মূলত একটি জাতীয়তাবাদী জ্ঞানভাষ্যের মধ্যে কাজ করেন এবং চলচ্চিত্রকে প্রভাবশালী জাতীয় জনপরিসরের শুধু একটি অংশ হিসেবে চিহ্নিত করেন। পূর্ব বাংলার সাংস্কৃতিক প্রতিবেশে চলচ্চিত্রের অধিগ্রহণ ব্যাখ্যায় এই জাতীয়তাবাদী, প্রায়োগিক-প্রযুক্তিগত ইতিহাস রচনাকে আমি চ্যালেঞ্জ করছি, এই পদ্ধতি উত্তরাধিকারসূত্রে হাবারমাসীয় বুর্জোয়া জনপরিসরের ধারণা ব্যবহার করে।

এখানে আমি স্থানীয় গোষ্ঠীগুলোর সামাজিক প্রতিবেশে চলচ্চিত্রের সাংস্কৃতিক ভাষান্তরের প্রক্রিয়া এবং শর্তগুলোকে চিহ্নিত করেছি। এই প্রক্রিয়া বৈচিত্র্যহীন এবং নির্দিষ্ট ছিল, যদিও অনেক ইতিহাসবিদ এ রকমটা মনে করেন। আমি বরং রে চওর কথা ধার করতে পারি, যার কাছে সাংস্কৃতিক ভাষান্তর প্রক্রিয়াটি এ রকম: ‘কখনোই পশ্চিম পূর্বকে বা পূর্ব পশ্চিমকে ভাষান্তর করেনি... [কিন্তু] এই প্রক্রিয়ায় একগুচ্ছ কর্মকাণ্ড অন্তর্ভুক্ত; যার মধ্যে ঐতিহ্য থেকে আধুনিকতায়, সাহিত্য থেকে দৃশ্যতায়, এলিট পাণ্ডিত্যপূর্ণ সংস্কৃতি থেকে গণসংস্কৃতিতে, দেশজ থেকে বিদেশিতে পরিবর্তন এবং পুনঃপরিবর্তন প্রভৃতি অন্তর্ভুক্ত’।৪৩ আমি দেখিয়েছি যে পূর্ব বাংলায় ১৯০০-এর দশক থেকে ১৯৬০-এর দশক পর্যন্ত চলচ্চিত্র একটি অস্থিতিশীল দেশীয়করণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গিয়েছে এবং ওপরে বর্ণিত ঘটনা এবং উদ্যোগগুলো এই প্রক্রিয়ার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আমার মূল আলোচনার কেন্দ্রীয় বিষয় হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার এই অংশে বৈচিত্র্যময় জনগণের জন্য বিভিন্ন জনপরিসর তৈরিতে চলচ্চিত্র মাধ্যম কীভাবে ভূমিকা পালন করেছে। আমার মতে, আমরা যদি চলচ্চিত্রকে বহুবিধ, অধিক্রমণকারী জনপরিসর হিসেবে এবং এই জনপরিসরগুলোর সমান্তরাল হিসেবে বিবেচনা করি, যেগুলো অন্যান্য জ্ঞানভাষ্যের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া এবং প্রতিযোগিতায় লিপ্ত; তাহলে আমরা দক্ষিণ এশিয়ায় চলচ্চিত্রের সাংস্কৃতিক অধিগ্রহণের আরও জটিল এবং বৈচিত্র্যময় প্রক্রিয়াটিকে উপলব্ধি করতে পারব।

অনুবাদ: প্রণব ভৌমিক

তথ্যসূত্র:

1.            Rey Chow, Primitive Passions: Visuality, Sexuality, Ethnography, and Contemporary Chinese Cinema (New York: Columbia University Press, 1995), 197.

2.            Wimal Dissanayake, “Rethinking Indian Popular Cinema: Towards Newer Frames of Understanding,” in Rethinking Third Cinema, ed. Anthony Guneratne and Wimal Dissanayake (London: Routledge, 2003), 214 – 15.

3.            This study was translated and published in English as late as in 1989. See Jürgen Habermas, The Structural Transformation of the Public Sphere: An Inquiry into a Category of Bourgeois Society, trans. Thomas Burger (Cambridge: Polity Press, 1989).

4.            Habermas, Structural Transformation, 12 – 26.

5.            James Van Horn Melton, The Rise of the Public in Enlightenment Europe (Cambridge: Cambridge University Press, 2001), 4.

6.            Nancy Fraser, Justice Interruptus: Critical Reflections on the ‘Postsocialist’ Condition (London: Routledge, 1996), 70.

7.            Jürgen Habermas, Between Facts and Norms: Contributions to a Discourse Theory of Law and Democracy, trans. William Rehg (Cambridge: MIT Press, 1996), 360.

8.            Oskar Negt and Alexander Kluge, Public Sphere and Experience: Toward an Analysis of the Bourgeois and Proletarian Public Sphere, trans. Peter Labanyi, Jamie Owen Daniel, and Assenka Oksiloff (Minneapolis: University of Minnesota Press, 1993).

9.            Miriam Hansen, ‘Early Cinema, Late Cinema: Permutations of the Public Sphere,’ Screen 34 (1993): 203.

10.          Miriam Hansen, Babel and Babylon: Spectatorship in American Silent Film (Cambridge: Harvard University Press, 1991), 7 – 8.

11.          Hansen, ‘Early Cinema,’ 201.

12.          Syed Salahuddin Zaki, ‘Bangladesh Cinema: A Brief Review,’ Celluloid 20, no. 1 (1997): 20 – 23; Alamgir Kabir, Film in Bangladesh (Dhaka: Bangla Academy, 1979), 22 – 24; Anupam Hayat, A History of Bangladesh Cinema (Dhaka: Bangladesh Film Development Corporation, 1987), 43 – 55; Chinmoy Mutsuddi, Social Commitment in Bangladesh Cinema (Dhaka: Bangladesh Shilpokola Academy, 1987), 19 – 22; and Mirza Tarequl Quader, Bangladesh Film Industry (Dhaka: Bangla Academy, 1993), 96 – 97, 103 – 19.

13.          Quader, Bangladesh Film Industry, 43 – 44; and Kabir, Film in Bangladesh, 1 – 2.

14.          Quoted in Hayat, History, 1 – 3.

15.          ibid., 6 – 7.

16.          ibid., 6 – 8.

17.          Kaiyum Chowdhury, ‘Gregory Peck: Our Favorite Hero,’ Daily Prothom Alo, no. 5, 4 July 2003.

18.          Hansen, foreword to Public Sphere and Experience, xxvii.

19.          Mofidul Huq, ‘The Tribute of the Centenary of Cinema: Hiralal Sen,’ Celluloid 20, no. 1 (1997) 13 – 18; and Hayat, History, 3 – 4.

20.          Ashish Rajadhyaksha and Paul Willemen, Encyclopedia of Indian Cinema (London: British Film Institute, 1994), 17, 195.

21.          Hayat, History, 1 – 4; and Anupam Hayat, ‘Silent Era of Dhaka Cinema,’ Dhrupadi 5 (1985): 14.

22.          Kalish Mukherjee, The History of Bengali Film Industry (Calcutta: Rupamancha, 1961), 27.

23.          Zaki, ‘Bangladesh Cinema,’ 20; and Mutsuddi, Social Commitment in Bangladesh Cinema, 19.

24.          Mutsuddi, Social Commitment in Bangladesh Cinema, 19; Hayat, ‘Silent Era of Dhaka Cinema,’ 19; Jahangir Alam Khan, ‘The Development of the Bangladesh Film Industry,’ Chinta 19 (1995): 39 – 40; and Mahmudul Hossain, ‘Mainstream Cinema: a Brief Introduction,’ View from Bangladesh (Dhaka: Bangladesh Federation of Film Societies, 1991), n.p.

25.          Hayat, History, 10 – 15; and Quader, Bangladesh Film Industry, 73 – 76.

26.          Hayat, History, 12.

27.          ibid., 14.

28.          Dissanayake, ‘Rethinking Indian Popular Cinema,’ 216.

29.          Zaki, ‘Bangladesh Cinema,’ 20 – 23; Kabir, Film in Bangladesh, 22 – 24; Hayat, History, 43 – 55; Mutsuddi, Social Commitment in Bangladesh Cinema, 19 – 22; and Quader, Bangladesh Film Industry, 96 – 97, 103 – 19.

30.          ibid.

31.          Kabir, Film in Bangladesh, 22.

32.          Alamgir Kabir, ‘Bangladesh Film Industry,’ Celluloid 2, no. 2 (1981): 5.

33.          Quader, Bangladesh Film Industry, 135.

34.          Kabir, Film in Bangladesh, 29.

35.          Golam Mostafa, ‘Thoughts about Cinema,’ Chalachchitra 1, no. 2 (1975): 25; and Kabir, ‘Bangladesh Film Industry,’ 5.

36.          Alamgir Kabir, ‘A Study of the Pakistani Cinema,’ in The Performing Arts in Asia, ed. James R. Brandon (Paris: Unesco, 1971), 148.

37.          Kabir, Film in Bangladesh, 28.

38.          Tanvir Mokammel, The Aesthetics of Cinema (Dhaka: Agami, 1998), 169.

39.          Dissanayake, ‘Rethinking Indian Popular Cinema,’ 215.

40.          Kabir, ‘Pakistani Cinema,’ 149.

41.          Kabir, Film in Bangladesh, 29.

42.          Mustsuddi, Social Commitment in Bangladesh Cinema, 32.

43.          Chow, Primitive Passions, 192.