প্রাক্-কথন
১৯৭১ সালে পৃথিবীর মানচিত্রে জন্ম হলো একটি নতুন রাষ্ট্রের, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। স্বাধীনতা অর্জনের পথটি ছিল খুবই কঠিন একটি পথ। নতুন রাষ্ট্রের পতাকা দেশটিতে পতপত করে ওড়ার আগেই লাখ লাখ মানুষ ঘরছাড়া হয়েছে, আশ্রয় নিয়েছে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে। লক্ষ লক্ষ মানুষ নির্যাতনের শিকার হয়ে মৃত্যুকে বরণ করে নিয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় মুক্তি আন্দোলনকে গলা টিপে মারার অপচেষ্টার কারণে উপমহাদেশে যুদ্ধ পরিস্থিতির উদ্ভব হয়, এই সংকটের ফলে পাকিস্তানি প্রতিক্রিয়াশীল সরকারের পতন ঘটে।
এই বইয়ের লেখক, সোভিয়েত টেলিভিশনের প্রতিবেদক বরিস কালিয়াগিন এবং ইজভেস্তিয়া পত্রিকার প্রতিবেদক ভ. স্কসিরিওভ ছিলেন এই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। সাংবাদিকতার প্রতি বিশ্বস্ত থেকে তাঁরা প্রথমে গেছেন শরণার্থী শিবিরে, তারপর গিয়েছেন পাকিস্তান-ভারত সীমান্তে, যেখানে চলছিল যুদ্ধ এবং তারপর তাঁরা গেছেন সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বাংলাদেশের ভূখণ্ডে। তাঁরা দুজন তাঁদের ডায়েরিতে যা লিখেছেন, তারই নির্যাস হলো এই ‘বাংলার ডায়েরি’।
লেখক দুজনই সংকটের ধারাবাহিক বিশ্লেষণ করেননি, বাংলাদেশের সামনে কী ধরনের সংকট আছে, তা নিয়েও কথা বলেননি। তাঁরা আসলে যুদ্ধের মাঠ থেকে যে ধরনের প্রতিবেদন লিখতে হয় এবং তা লেখার জন্য যে তথ্য সংগ্রহ করতে হয়, তারই বয়ান করে গেছেন। ১৯৭১ ও ১৯৭২ সালে যখন রাষ্ট্রটির জন্ম হলো এবং যখন রাষ্ট্রটি তার জীবনের প্রথম পদক্ষেপগুলো ফেলছে, সে সময়ের কিছু কথাই ধরা থাকল এখানে। আশা করি এই ঘটনাগুলো সাধারণ পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করবে।
এই ট্র্যাজেডির ভূমিকা
সূর্য যখন পশ্চিমাকাশে হেলে পড়েছে, তখন ঢাকার রাস্তা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে সেনা প্রহরা নিয়ে রাষ্ট্রপতির কালো ‘মার্সিডিজ’। মুহূর্তের জন্য বিমানবন্দরে ঢোকার দরজার কাছে একটু থামে, তারপর গাড়িটি সোজা চলে আসে রানওয়েতে, পাকিস্তান বিমানবহরের সাদা-সবুজ বোয়িংয়ের সামনে এসে দাঁড়ায়। প্লেনটি ওড়ার জন্য তৈরি। তেল নেওয়া হয়েছে, প্লেনের স্টাফরা উড়ানোর জন্য প্রস্তুত। গন্তব্য করাচি।
পাকিস্তানের তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান তাঁর পূর্বদিকের প্রদেশের এই রাজধানীতে আগেও এসেছেন অনেকবার। এর আগে প্রতিবারই তাঁর বিদায়ের সময় উপস্থিত ছিল স্থানীয় প্রশাসনের লোকজন। কিন্তু এবার, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে, সেখানে ছিল উর্দিপরা লোকেরা। পুরো রাস্তা দখল করে দাঁড়িয়ে ছিল সৈন্যদল। বিমানবন্দরে তারাই ছিল সতর্ক প্রহরায়। বালুর বস্তা সামনে রেখে নিজেদের প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা করে তারা রাজধানীর দিকে উঁচিয়ে রেখেছিল তাদের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র।
পরিবেশ ছিল অসম্ভব রকম থমথমে। অপেক্ষমাণ যাত্রীদের মনে তখন আতঙ্ক। এই যাত্রীদের বেশির ভাগই পশ্চিম পাকিস্তানি—পাঞ্জাবি, পশ্তুন। মূলত ঢাকা ও বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরে এসেছিলেন ব্যবসা করতে। পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে এখানকার রাজনৈতিক নেতারা অসহযোগ আন্দোলন শুরু করার পর এই ব্যবসায়ীরা পেয়েছেন প্রচণ্ড ভয়, তাঁরা পশ্চিম পাকিস্তানে ফেরার জন্য মরিয়া হয়ে বিমানবন্দরে এসেছেন, প্লেনের টিকিটের জন্য কেরানিদের কাছে ধরনা দিয়েছেন। বিমানবন্দরে প্রেসিডেন্টের আগমন যাত্রীদের উত্কণ্ঠা দূর করল, যাত্রীদের মধ্যে যে ভয়ার্ত ফিসফিস চলছিল, তার অবসান ঘটল। অপেক্ষমাণ ব্যক্তিরা জানালা দিয়ে দেখতে লাগলেন প্রেসিডেন্টকে। আর তখন ঢাকার কেন্দ্রভাগে চলছিল মিছিলের পর মিছিল, অগণিত মানুষ এগারো তলার নির্মেদ ‘ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল’-এর পাশ দিয়ে এগিয়ে চলেছিল ধানমন্ডির ‘৩২ নম্বর’ সড়কের দিকে। সেখানেই আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি।
যেদিন ইসলামাবাদে বসে জেনারেল ইয়াহিয়া খান রেডিওতে ভাষণ দিয়ে জানালেন, ১৯৭১ সালের জাতীয় ও প্রাদেশিক নির্বাচনে বিজয়ী দলের হাতে এখনই ক্ষমতা ছেড়ে দিতে তিনি প্রস্তুত নন, সেই পয়লা মার্চ থেকেই ঢাকায় বিক্ষোভ চলছে, থামছেই না। সামরিক স্বৈরাচার এর আগে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, এই ঘোষণার সঙ্গে তার কোনো মিল ছিল না। বাংলার কোটি জনতা, যাঁরা আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছিলেন, তাঁরা একে প্রেসিডেন্টের ওয়াদার বরখেলাপ হিসেবে চিহ্নিত করলেন। ঢাকায় এর প্রতিবাদে শুরু হলো হরতাল। প্রদেশের রাজধানীর জনজীবন থমকে গেল। সরকারি প্রতিষ্ঠান ও কলকারখানা বন্ধ হয়ে গেল, বন্ধ হয়ে গেল দোকানপাট, থেমে গেল যানবাহন। পরদিনই সারা প্রদেশে ছড়িয়ে পড়ল হরতাল। ইসলামাবাদের নির্দেশ এখানে কোনো কাজেই আসছিল না।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে কথা বলার জন্য মার্চের মধ্যভাগে ঢাকায় এলেও কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে এই অসহযোগ আন্দোলন চলতেই থাকল। এই স্বৈরাচারী সেনা সরকার সত্যিই ক্ষমতা হস্তান্তর করবে, বাঙালিরা এ কথা একেবারেই বিশ্বাস করত না। জনসভায় নেতারা সরাসরি বলতে লাগলেন, প্রেসিডেন্ট ঢাকায় এসেছেন শুধুই কালক্ষেপণ করতে, আর তৈরি হচ্ছেন ঢাকায় দেশপ্রেমিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে সামরিক হামলা চালানোর জন্য।
এই আশঙ্কাই সত্য হলো। জেনারেল ইয়াহিয়া শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে বৈঠক চালিয়ে যাওয়ার কথা ভাবলেন না। ২৫ মার্চের প্রথম অর্ধবেলা কাটালেন সেনানিবাসে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে এবং তারপর চলে গেলেন বিমানবন্দরে। প্রেসিডেন্টকে বিদায় দেওয়ার আনুষ্ঠানিকতা শেষ করা হলো খুব দ্রুত। সাদা-সবুজ বোয়িং বিমানটি আকাশে উড়ে গেল। এই বিমানটি পাকিস্তানে অবতরণ করার চার ঘণ্টা পর করাচির সেনানিবাস থেকে ঢাকায় এল কোড বার্তা। সেই নির্দেশ পেয়ে অপারেশনের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করল পাকিস্তানি বাহিনী। পূর্ব বাংলার রাজধানীতে আঁধার নেমে আসতেই সৈনিকেরা অস্ত্র হাতে বেরিয়ে পড়ল, বের করা হলো ট্যাংক। প্রথম অস্ত্রের ঝংকার শোনা গেল রাত ১১টা ৩০ মিনিটের দিকে। রাতের আঁধারের সহায়তায় সামরিক শাসকের দল নির্যাতন চালাতে শুরু করল।
আমরা আবার এই হূদয়বিদারক কাহিনির কাছে ফিরে আসব, কিন্তু তার আগে এই সংকটের কারণটা খুঁজে বের করা দরকার, যে কারণটি দক্ষিণ এশিয়ার এই এলাকার রাজনৈতিক মানচিত্রটাকেই বদলে দিয়েছে। এই সংকটের শুরু ১৯৪৭ সালে, যখন ব্রিটেনের সাম্রাজ্যবাদ তাদের ভারত উপনিবেশটিকে ধর্মীয় কারণে দুভাগে ভাগ করল। ভারত উপমহাদেশের একেবারে বিপরীত দুই প্রান্তে থাকা দুটি ভূখণ্ড মিলে হলো পাকিস্তান।
প্রাকৃতিকভাবে পশ্চিম পাকিস্তান আর পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে কোনো মিল নেই। পশ্চিম পাকিস্তানে রুক্ষ জমি, মরুভূমি আর পাহাড়ে ঘেরা তা। জনঘনত্ব এখানে খুব কম, ৬১ মিলিয়ন মানুষ বাস করে যে ভূখণ্ডে, তা ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের মিলিত ভূখণ্ডের সমান। অন্যদিকে পূর্ব বাংলাকে বলা হয় সারা পৃথিবীর মধ্যে অন্যতম জনঘনত্বসম্পন্ন দেশ, এখানে বাস করে ৭৫ মিলিয়ন মানুষ। এই দেশের সমতলে ধান ও পাটের চাষ হয়, পুরো দেশজুড়ে বয়ে চলে এশিয়ার দুটি বিশাল নদী: গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র। বন্যা এখানকার প্রতিবছরের ঘটনা, চলাচলের ক্ষেত্রে প্রধান যানবাহন নৌকা। পশ্চিম ও পূর্ব প্রদেশকে শুধু ১ হাজার ৬০০ কিলোমিটারের দূরত্ব আর প্রাকৃতিক বৈসাদৃশ্যই আলাদা করেনি, আলাদা করেছে ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য। পূর্ব প্রদেশটির সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণই বাঙালি (৯৮ শতাংশ), পশ্চিম পাকিস্তানে পাঞ্জাবি, পশতুন, সিন্ধি, বেলুচি ও বেশ কিছু ক্ষুদ্র জাতিসত্তার বসবাস। পূর্ব ও পশ্চিমের দুই দিকেই মূল জনগোষ্ঠী ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী, তবে পূর্ব বাংলায় হিন্দু সমপ্রদায়ের অনেক মানুষই বাস করে। ১৯৬১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী এই সংখ্যা ১৮ দশমিক ৪ শতাংশ।
পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানিদের মধ্যে চেহারায়ও কোনো মিল নেই। বাঙালিরা শ্যামলা। যেসব পার্থক্যের কথা বলা হয়েছে, রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টির জন্য এগুলোই মুখ্য নয়। সংকটের মূল কারণ হলো ইসলামাবাদের শাসকগোষ্ঠী, তারা পশ্চিম পাকিস্তানের সামন্তশ্রেণির একচেটিয়া রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব চাপিয়ে দিত পূর্ব বাংলার ওপর, বাঙালি তা অনুসরণ করতে বাধ্য হতো।
ব্রিটিশ ভারতের দেশভাগ দুই দেশের জন্যই ভয়াবহ ক্ষতি ডেকে এনেছে। তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পাকিস্তানের পূর্ব দিকের অংশটি। বিশ্বে উত্পাদিত তিন-চতুর্থাংশ পাটের জন্মস্থান বাংলা। কিন্তু পাটের সঙ্গে যুক্ত সব কারখানা, যন্ত্রপাতি ইত্যাদি ছিল কলকাতায়, মানে এখনকার ভারতে। পূর্ব বাংলায় শিল্প গড়ে ওঠেনি (অল্প কয়েকটি পাটের, কয়েকটি চায়ের কারখানা আছে কেবল)। বাংলায় প্রাকৃতিক সম্পদ নেই বললেই চলে, যা দিয়ে দেশের বিকাশ ঘটানো সম্ভব। পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার ক্ষেত্রে এই দুর্বলতা তাদের পিছিয়ে রাখে। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর পশ্চিম পাকিস্তানে ধনসম্পদ নিয়ে ভারত থেকে আসা মুসলিম বুর্জোয়ারা বাণিজ্য শুরু করে দেয়। ‘যখন লন্ডন তার পুরোনো উপনিবেশের ওপর ছুরি চালাল, ঠিক তখনই সংঘাতের তিক্ত বীজ রোপিত হয়ে গেল, যার ইতি ঘটল এক পাকিস্তান ভেঙে যাওয়ার মাধ্যমে।’ ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড লোশাক, যিনি দীর্ঘদিন পত্রিকার প্রতিনিধি হয়ে এশিয়ায় কাটিয়েছেন দিন, এ ভাষ্য তাঁরই।
পাকিস্তানের সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর ও অর্থনীতিবিদদের তথ্য-উপাত্ত থেকে জানা যায়, সামরিক স্বৈরশাসনের সময়টাতে দেশের শিল্প খাতের দুই-তৃতীয়াংশ এবং ব্যাংক খাতের চার-পঞ্চমাংশ পশ্চিম পাকিস্তানের ২২টি পরিবারের একচেটিয়া সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছে (এই পরিবারগুলোর মধ্যে আছে আদমজী, সায়গল, ভালিকা, হারুণ, হাবিব পরিবার)। বড় বাণিজ্যের এই প্রতিভূরা অর্থনৈতিক ক্ষমতা নিজেদের হাতে কুক্ষিগত করে রাখার কারণে পূর্ব বাংলার মানুষ ও সম্পদকে শোষণ করতে পারে। পশ্চিম পাকিস্তানের একচেটিয়া কারবার পূর্ব বাংলাকে তাদের বাজারে পরিণত করেছে। নিম্নমানের কাপড়শিল্প তার মধ্যে একটি। রাষ্ট্রীয় সম্পদ বা রসদ বিতরণের ক্ষেত্রেও পূর্ব বাংলাকে অবহেলা করা হতো। পূর্ব বাংলায় বাস করত পাকিস্তানের ৫৫ শতাংশ মানুষ। এই অংশের মানুষ পাট ও চা উত্পাদন করত। এই পাট ও চা রপ্তানি করেই পাকিস্তান বিদেশি মুদ্রার দুই-তৃতীয়াংশ আয় করত। অথচ পঞ্চাশের দশকে কেন্দ্রীয় সরকার অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য যে অর্থ খরচ করত, তার মাত্র ২০ থেকে ২৬ শতাংশ ব্যয় করা হতো পূর্ব বাংলায়। ষাটের দশকে তা দাঁড়ায় ৩২ থেকে ৩৬ শতাংশে। দেশের এই অঞ্চলে আমদানি পণ্যের এক-তৃতীয়াংশেরও কম এবং বিদেশি সাহায্যের মাত্র এক-চতুর্থাংশ আসত। যার ফলে স্বাভাবিকভাবেই দেশের দুই অংশের জনগণের মাথাপিছু আয়ে চরম বৈষম্যের সৃষ্টি হলো। ১৯৫৯-৬০ সালে এই ব্যবধান ছিল ৩২ শতাংশ। ১০ বছর পর তা বেড়ে দাঁড়াল ৬১ শতাংশে!
পূর্বের প্রদেশটিতে বেকারত্ব বাড়ল চরমভাবে, বিশেষত এই বেকারত্ব বাড়ল কলেজ শেষ করা যুবকদের মধ্যে। সরকারি ও সেনাবাহিনীর চাকরির ক্ষেত্রে বাঙালিদের সঙ্গে চরম বৈষম্য দেখানো হয়। কেন্দ্রীয় সরকার ও বাঙালিদের মধ্যে আরেকটি বড় সংকট চলছিল ভাষা নিয়ে। উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিল, যদিও পূর্ব বাংলার ২ শতাংশ মানুষেরও মাতৃভাষা উর্দু ছিল না। উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণার পর পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পূর্ব বাংলায় চলতে থাকে বিক্ষোভ, মিছিল। অবশেষে ১৯৫৪ সালে পৌঁছে সরকার বুঝতে পারল জেলজুলুম কিংবা হত্যাযজ্ঞ ভাষা প্রশ্নে বাঙালিদের অবস্থানকে টলাতে পারবে না, তখন বাংলাকে প্রজাতন্ত্রের দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তাতে সংকট খুব একটা কাটেনি। ১৯৫৪ সালের পরও শিল্পকারখানার বড় পদগুলো, বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানের বড় পদগুলো, যানবাহন পরিচালনার বড় পদগুলো যারা আঁকড়ে ধরে ছিল, তাদের বেশির ভাগই ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি কিংবা ভারত থেকে আসা লোকেরা, যাদের বেশির ভাগই ছিল উর্দু ভাষাভাষী। ফলে ভাষার প্রশ্নটি ছিল খুবই উচ্চকিত।
বাঙালিদের শোষণ এমন একপর্যায়ে চলে গিয়েছিল যে তা নিয়ে খোদ ইসলামাবাদেই সমালোচনা শুরু হয়। ‘আমার ধারণা (বাঙালির, লেখক) তাদের এই অসন্তোষ অবোধ্য বা ব্যাখ্যাতীত নয়’—১৯৬৯ সালের গ্রীষ্মে এই ঘোষণা দিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান। সবাই তা ভাবছিল বটে, কিন্তু প্রয়োজনীয় সংস্কার করার কাজে কেউ এগিয়ে এল না। ক্ষমতার কাছে থাকা বুর্জোয়া আমলা ও সেনা আমলারা এই সংস্কারকাজে সব সময়ই বাধা দিয়ে এসেছে। জাতীয় অধিকার আদায়ে বাঙালিদের আন্দোলন আরও সক্রিয় হলো। দেশের দুই অংশের মানুষই তখন সেনা স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমেছে। এ ছাড়া তাদের দাবি ছিল গণতন্ত্র, সাম্রাজ্যবাদী জোট সিয়েটো ও সেন্টো থেকে পাকিস্তানের বেরিয়ে আসা।
ষাটের দশকের শেষ দিকে বাঙালির জাতীয় নেতায় পরিণত হন শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি ১৯২০ সালের ২২ মার্চ (তথ্যটি হবে ১৭ মার্চ—অনুবাদক) পূর্ব বাংলার একটি ক্ষুদ্র কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে পড়াশোনা করেন, পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন। ছাত্রাবস্থায়ই শেখ মুজিবুর রহমান ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ছিলেন। ১৯৪৯ সালে তাঁকে নবগঠিত আওয়ামী লীগের সম্পাদক করা হয়। এই সময় তিনি পাকিস্তানের সরকারবিরোধী আন্দোলনের কারণে জেলে ছিলেন। এরপর বহুবার তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, সব মিলে বছর এগারো তিনি জেলে ছিলেন। কিন্তু জেল-জুলুম তাঁকে তাঁর আদর্শ থেকে একচুলও সরাতে পারেনি। তিনি লিখেছেন অসাধারণ প্যামফ্লেট আমাদের অধিকার, আমাদের জীবন, যেখানে প্রথমবারের মতো উচ্চারিত হয়েছে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের প্রস্তাব।
এই কর্মসূচি নিয়েই পরবর্তীকালে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল আওয়ামী লীগ। কর্মসূচিতে এই দফাগুলো ছিল:
১. লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে সংবিধান রচনা করে পাকিস্তানকে একটি ফেডারেশনে পরিণত করতে হবে, যেখানে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার থাকবে এবং প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকদের ভোটে নির্বাচিত আইন পরিষদ সার্বভৌম হবে;
২. ফেডারেল সরকারের হাতে থাকবে শুধু দুটি বিষয়, প্রতিরক্ষা ও বৈদেশিক সম্পর্ক এবং অপর সব বিষয় ফেডারেশনে অন্তর্ভুক্ত রাজ্যসমূহের হাতে ন্যস্ত থাকবে;
৩. পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য দুটি পৃথক অথচ সহজে বিনিময়যোগ্য মুদ্রা চালু করতে হবে। যদি তা সম্ভব না হয় তাহলে সমগ্র পাকিস্তানের জন্য ফেডারেল সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন একটিই মুদ্রাব্যবস্থা থাকবে, একটি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক ও দুটি আঞ্চলিক রিজার্ভ ব্যাংক থাকবে। তবে এ ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পুঁজি যাতে পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার হতে না পারে তার ব্যবস্থাসংবলিত সুনির্দিষ্ট বিধি সংবিধানে সন্নিবিষ্ট করতে হবে;
৪. দুই অঞ্চলের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পৃথক হিসাব থাকবে এবং অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা রাজ্যের হাতে থাকবে। তবে ফেডারেল সরকারের জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা দুই অঞ্চল থেকে সমানভাবে কিংবা উভয়ের স্বীকৃত অন্য কোনো হারে আদায় করা হবে;
৫. দুই অংশের মধ্যে দেশীয় পণ্য বিনিময়ে কোনো শুল্ক ধার্য করা হবে না এবং রাজ্যগুলো যাতে যেকোনো বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে, সংবিধানে তার বিধান রাখতে হবে।
৬. প্রতিরক্ষায় পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাবলম্বী করার লক্ষ্যে আধা সামরিক রক্ষীবাহিনী গঠন, পূর্ব পাকিস্তানে অস্ত্র কারখানা স্থাপন এবং কেন্দ্রীয় নৌবাহিনীর সদর দপ্তর পূর্ব পাকিস্তানে স্থাপন করতে হবে।
দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো প্রাপ্তবয়স্ক সব নাগরিকের অংশগ্রহণে জাতীয় ও প্রাদেশিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জাতীয় ও প্রাদেশিক নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে, তাই এটা পরিষ্কার যে দেশের সরকার গঠনের দায়িত্ব পাবে এই দলটিই। কিন্তু আইন পরিষদের সভা ডাকতে জেনারেল ইয়াহিয়া নানা রকম টালবাহানা করতে থাকেন। পরের বছরের শুরুতে পাকিস্তানের প্লেনে করে সৈন্যরা আসতে থাকে ঢাকায়। কেউ যেন অভিসন্ধি বুঝতে না পারে, সেটা নিশ্চিত করতে সৈন্যদের পরিয়ে আনা হয়েছিল সাধারণ পোশাক। ২৫ মার্চের মধ্যেই প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছিল আর সে রাতেই সেনারা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল শান্তিকামী সাধারণ বাঙালিদের ওপর।
সেনা স্বৈরাচারের এই পদক্ষেপে শঙ্কিত হয়ে পড়ল পৃথিবীর শান্তিপ্রিয় সব দেশ। সোভিয়েত ইউনিয়নের সুপ্রিম সোভিয়েতের প্রেসিডেন্ট ন. ভ. পদগোর্নি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টকে এই মুহূর্তে রক্তপাত ও নৃশংসতা বন্ধ করার ও শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে সংকট উত্তীর্ণ হওয়ার আহ্বান জানালেন। এ ধরনের মানবিক আবেদন, যা লেনিনের পররাষ্ট্রবিষয়ক ভাবনার প্রতিফলন, পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ বাধানোর আগ পর্যন্ত তা নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন আহ্বান জানিয়ে গেছে। কিন্তু সে ন্যায় ও মানবতার আহ্বান সেনা স্বৈরাচারের কানে ঢোকেনি। ২৬ মার্চেই পাকিস্তান সরকার পূর্ব বাংলা থেকে বিদেশি সব সাংবাদিককে বের করে দেয়। তাই যুদ্ধের প্রথম কয়েক সপ্তাহের খবরাখবর বিচ্ছিন্নভাবে নানা মারফতে শোনা যায়। এই বিশাল হত্যাযজ্ঞের খবর কেবল তখনই প্রকাশিত হলো, যখন লাখ লাখ মানুষ নিজের মাটি ত্যাগ করে, ভিটা ত্যাগ করে ভারতে শরণার্থী হলো।
দারিদ্র্যের পথ ধরে
কলকাতা, ৭ অক্টোবর ১৯৭১
বনগাঁ, কলকাতার উত্তর-পূর্বদিকে ৮০ কিলোমিটার দূরের একটি শহর। রাস্তাটা বিশাল নারকেলগাছ পরিবৃত। দুই ধারেই ধানখেত, পাটের খেত। এ দৃশ্য সবখানেই। পূর্ব ভারতের সবখানেই আমরা এ দৃশ্য দেখেছি। কিন্তু এ পথে কিছুটা এগোনোর পর ছবির মতো প্রাকৃতিক দৃশ্যগুলো পরিবর্তিত হয়ে গেল। গাড়ি চলছে অসংখ্য খড়ের জীর্ণ কুঁড়ের পাশ দিয়ে, তার সামনে শুকনো, ভেঙে পড়া শরীরের মানুষ। অনেক অনেক শিশু। তারা ধুলোয় গড়াগড়ি খাচ্ছে, চলে আসছে একেবারে গাড়ির চাকার কাছে। ‘এরা সবাই পাকিস্তান থেকে আসা উদ্বাস্তু। সীমান্তের কাছাকাছি এলাকায় তাদের বাড়ি ছিল’—এ কথা বলে গাড়ির চালক প্রবলভাবে ব্রেক চাপল। ব্রেক চাপল একটি ট্রাককে যাওয়ার রাস্তা করে দিতে, যে ট্রাকটি যাচ্ছিল চালের বস্তা নিয়ে। ট্রাকের গায়ে লেখা ‘উদ্বাস্তুদের সাহায্য করার জন্য’। যে মুহূর্ত থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের পূর্ব দিকের প্রদেশের ওপর অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ল, সেদিন থেকেই ভারতে উদ্বাস্তুদের আসা শুরু হয়েছে। প্রায় ৯০ লাখ মানুষ এখানে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তান লাগোয়া ভারতের চারটি প্রদেশে এসে তারা আশ্রয় নিয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি মানুষ আশ্রয় নিয়েছে ভারতের পশ্চিম বাংলায়, সরকারি হিসাবেই এই মানুষের সংখ্যা প্রায় ৭০ লাখ।
এই মানুষেরা কোথায় আশ্রয় পাবে? তারা কী খেয়ে বাঁচবে? কীভাবে মহামারি ঠেকানো হবে, এই প্রশ্নগুলোর ব্যাপারে দরকার ছিল ত্বরিত সিদ্ধান্তের। অন্য কিছু ভাবার উপায় যেমন ছিল না, সামর্থ্যও ছিল না। জানালেন বনগাঁর উদ্বাস্তু বিষয়ের প্রধান আ. সুর। তিনি বললেন, ‘আমরা বেশির ভাগ মানুষকে শরণার্থী শিবিরে জায়গা করে দিয়েছি। কিন্তু তাতে ঠাঁই নেই। কিছুদিন আগে ভয়াবহ সাইক্লোন হয়ে যাওয়ায় শিবিরের কিছু অংশ পানিতে তলিয়ে গেছে। বের হওয়ার পথ একটাই, যারা এরই মধ্যে এসে পৌঁছেছে, তাদের এখান থেকে সরিয়ে দেশের আরও ভেতরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তাদেরই আপনারা দেখেছেন কলকাতা থেকে এদিকে আসার পথে...।’
উপস্থিত উদ্বাস্তুদের কোলাহলের সুরে কথা তলিয়ে যায়। সেখানে নতুন উদ্বাস্তুরা রেডক্রসের তাঁবুর সামনে ভিড় জমিয়েছে। তাদের দেওয়া হচ্ছে কলেরার টিকা। একই সময়ে তাদের দেওয়া হচ্ছে বিনা পয়সায় খাদ্য পাওয়ার জন্য কার্ড। সুর আমাদের জানালেন খরচের হিসাবটাও, যা অবশ্য কলকাতাতেই আমরা জেনেছিলাম। এই উদ্বাস্তুদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য প্রতিদিন ভারত সরকারের ব্যয় হচ্ছে আড়াই কোটি রুপি। খুব কাছের শিবির থেকে শহরের উদ্বাস্তু সমন্বয় কেন্দ্রের দূরত্ব পাঁচ মিনিটের হাঁটা পথ। কেন্দ্রের প্রধান বিমানবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এ শংকর সামনের দিকে হাত উঁচিয়ে বললেন, ‘১০ হাজার মানুষের জন্য এই শিবিরটা করা হয়েছিল, কিন্তু এরই মধ্যে এখানে বাস করছে ১৮ হাজার মানুষ।’ ‘শিবির’ শব্দটা আসলে প্রতীকী শব্দ হিসেবেই ব্যবহার করা হয়েছে। কারণ, আদতে এটা বাঁশ আর খড় দিয়ে তৈরি তাঁবু, যার ওপরে প্লাস্টিকের ছাউনি। ৩০ মিটার লম্বা আর ৬৭ মিটার চওড়া একেকটা তাঁবুতে ৫৫টা পরিবার বসবাস করছে।
পরিবারের প্রতিটি পূর্ণবয়স্ক সদস্যের জন্য দিনে ৪০০ গ্রাম চাল, ৫০ গ্রাম সবজি, অল্প পরিমাণ তেল আর লবণ বরাদ্দ। এই রেশন নিয়মিত সরবরাহ করা যায় না। সব সময় খাদ্য আসে না, যানবাহনের সংকট, বহু রাস্তা পানির নিচে। বন্যার কারণে পয়োনিষ্কাশন ও স্বাস্থ্যরক্ষায় সমস্যা বিদ্যমান। মি. শংকর জানালেন, কলেরার প্রকোপ থামানো গেছে, তবে পেটের পীড়া ধরনের রোগ বাড়ছে। একটু নীরব থেকে আবার বললেন তিনি, শীতকাল আসছে, খুব শিগগিরই দরকার হবে শীতের পোশাক, কম্বল, না হলে বাঁচা কঠিন হয়ে যাবে...। এখানে সমবেত হয়েছে নানা ধর্ম, বর্ণ, গোত্রের মানুষ: ধনী কৃষক, খেতমজুর, ব্যবসায়ী আর শ্রমিক, শিক্ষক আর ছাত্র। দুঃখ সবাইকে এক করেছে। কয়েকজন ঘরছাড়া মানুষের সঙ্গে আমরা কথা বলি। প্রায় মাস খানেক ধরে এই শিবিরে আছেন রাজেন্দ্রনাথ। বয়স তাঁর ষাটেরও কম, কিন্তু দেখে মনে হয় একেবারে বৃদ্ধ। তিনি বললেন, ‘জুলাই মাসে ফরিদপুরে আমাদের গ্রামে পাকিস্তানি সেনারা হানা দিয়েছিল। জেরা করা শুরু করেছিল, আওয়ামী লীগের সদস্যদের খুঁজে চলেছিল তারা। আমাদের পরিবারকেও দেখছিল সন্দেহের চোখে, যদিও আমাদের পরিবারের কেউ আওয়ামী লীগ করত না। তখন আমরা পালিয়ে আত্মীয়দের বাড়িতে আশ্রয় নিই। যখন আমরা ফিরে এলাম, দেখলাম, বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে, আসবাবপত্র সব ধ্বংস করে দিয়েছে।’
হালিম মিয়ার পরিবারের ভাগ্যেও ঘটেছে একই ঘটনা। কালিকাপুর গ্রামের একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী তিনি। তাঁর এবং তাঁর গ্রামের মানুষের জীবনে এই দুর্ভাগ্য নেমে এসেছিল শুধু এই কারণে যে, তাঁরা সবাই গত নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের দলকে ভোট দিয়েছে। ‘আমি অবশ্যই আমার গ্রামে ফিরতে চাই।’ বললেন হালিম মিয়া। ‘কিন্তু এখন কেউ জানে না, কাল কী হবে। যত দিন পর্যন্ত পরিস্থিতি শান্ত না হয়, আমরা এখানেই থাকব।’
৪ জুলাই ব্যানার্জি নামের যশোরের একজন ছাত্র নাম লিখিয়েছেন এই শিবিরে। তিনি জানালেন, তাঁদের গ্রামে পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর হামলা চালিয়েছিল মুক্তিবাহিনী। হামলার সময় দুজন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়েছিল। মুক্তিবাহিনী সরে পড়েছিল। পাকিস্তানিরা চেয়েছিল গ্রামবাসীকে উচিত শিক্ষা দিতে। পরদিন গ্রামের অর্ধেক বাড়িই তারা জ্বালিয়ে দিয়েছিল, ১২ জন গ্রামবাসীকে হত্যা করেছিল। আমরা শহরের হাসপাতালে গেলাম। ওয়ার্ডগুলোতে অসংখ্য রোগী। দুই বিছানার ফাঁকেও রোগীর অবস্থান। ‘আমাদের বেশির ভাগ রোগীই উদ্বাস্তু। উদ্বাস্তু শিবিরের মতোই এখানেও স্থান সংকুলান করা কঠিন।’ হাসপাতালের পরিচালক শুরুতেই এ কথা স্বীকার করে নেন। ‘যে রোগীদের অবস্থা খুব বিপজ্জনক নয়, তাদের ঠাঁই হচ্ছে মেঝেতে...’। হাসপাতাল থেকে যখন আমরা বের হলাম, তখন তীব্র বাতাস বয়ে যাচ্ছে, মুষলধারে বৃষ্টির আভাস এটা। আমরা খুব দ্রুত বনগাঁ ছাড়ার চেষ্টা করলাম, কিন্তু রাস্তাজুড়ে মানুষের ভিড়ে গাড়ি দ্রুতগতিতে চালানো যাচ্ছিল না। শেষপর্যন্ত শেষ বাড়িটিও পেছনে পড়ে রইল। রাস্তার ধারে আবার দেখা গেল একে অন্যের সঙ্গে লেগে থাকা তাঁবু আর কুঁড়ে। আমরা হিসাব করে দেখলাম, যাদের ভারত সরকার উদ্বাস্তু শিবিরে জায়গা করে দিতে পারেনি, তারা প্রায় তিন কিলোমিটারজুড়ে নিজেদের ঠাঁই খুঁজে নিয়েছে।
প্রথম শট
অমৃতসর-দিল্লি, ৫ ডিসেম্বর
৩ ডিসেম্বর, শুক্রবার। এই দিনটিতে কোনো অঘটনের পূর্বাভাস ছিল না। লোকসভায় চলছিল সাধারণ বিতর্ক। সরকারি কর্ণধারেরা ছিলেন রাজধানীর বাইরে। ইন্দিরা গান্ধী ছিলেন কলকাতায়, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জগজীবন রাম ছিলেন পাটনায়, অর্থমন্ত্রী চ্যাবন ছিলেন মুম্বাইয়ে। এমনকি ছয়টা বাজতে তিন মিনিট আগে যখন বিমান হামলার সতর্ক সাইরেন বেজে উঠেছিল, আলো নিবিয়ে দেওয়ার সংকেত দেওয়া হচ্ছিল, তখনো কেউ তা গা করেনি: এ ধরনের প্রশিক্ষণ দিল্লিতে নতুন কিছু ছিল না। তবে ঘণ্টা খানেক পর ভারতের কেন্দ্রীয় রেডিও থেকে জরুরি বার্তা দেওয়া হলো যে পাকিস্তানি বিমানবাহিনী সীমান্তসংলগ্ন শহর অমৃতসর, পাঠানকোট ও শ্রীনগরে হামলা করেছে। সরকারি তথ্য বিভাগ থেকে আমাদের টেলিফোনে জানানো হলো রাত ১১টায় সাংবাদিকদের জন্য সংবাদ সম্মেলন হবে। দারুণ কষ্ট করে অন্ধকার শহরের পথ বেয়ে আমরা সম্মেলনস্থলে হাজির হলাম। ব্ল্যাকআউটের চুল পরিমাণ ব্যত্যয় হলেই বেজে উঠছে বাঁশি, সতর্ক করে দেওয়া হচ্ছে নাগরিকদের।
সংবাদ সম্মেলনের বিশাল মিলনায়তনটিকে মনে হলো খুবই ছোট। তিল ধারণের ঠাঁই নেই। কয়েক মিনিট উত্কণ্ঠার সঙ্গে অপেক্ষার পর তথ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব এলেন এবং উপস্থিত সবাইকে অবহিত করলেন, প্রেসিডেন্ট ভি ভি গিরি দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছেন। কয়েকজন দেশি ও বিদেশি সাংবাদিককে সরকার আমন্ত্রণ জানাচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানের সীমান্তসংলগ্ন শহরগুলোতে এবং পাকিস্তানি বিমান হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করে আসতে। সে রাতে প্রায় ঘুম হলো না। রাত একটার সময় ভারতীয় কেন্দ্রীয় রেডিও থেকে ভেসে এল প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কণ্ঠস্বর, যিনি দ্রুত ফিরে এসেছেন রাজধানীতে। খুবই শান্তস্বরে কথা বললেন তিনি। সীমান্ত এলাকার সামগ্রিক অবস্থার ব্যাখ্যা করলেন। বললেন, এই আগ্রাসন প্রতিহত করতে হবে এবং জানালেন, দেশের সব রাজনৈতিক দল সরকারকে সমর্থন করছে। ভোর পাঁচটায় আমাদের বাস রাজধানী ছাড়ল। তখনো সারা শহর অন্ধকার। কারও ঘুম আসছিল না। সবাই ছিল উত্তেজিত, পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা চলছিল, কেউ রেডিওর নব ঘুরিয়ে কিছু শোনার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল।
আক্রমণ যে হয়েছিল, তার লক্ষণ বোঝা যাচ্ছিল সীমান্তের ২০০ কিলোমিটার আগ থেকেই। পশ্চিম প্রান্তে ধাবমান সৈন্য ও অস্ত্রবাহী গাড়ির সংখ্যা বেড়ে গিয়েছিল রাস্তায়। আবার উল্টো দিক থেকে আহত ও ঘরছাড়া মানুষদের নিয়ে আসছিল ছোট ছোট গাড়ি আর বাস। কেউ কেউ ছুটছিল নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য। ফিলিং স্টেশনগুলোতে পড়ে গিয়েছিল গাড়ি, মোটরসাইকেলের বিশাল লাইন। জ্বালানি তেল রেশন করে দেওয়া হচ্ছিল। রাস্তার ওপরই বিক্রি হচ্ছিল সারি সারি সাজানো হারিকেন। এগুলো এত বেশি পরিমাণে ছিল যে দেখে সত্যিই বিস্ময় জাগে মনে। হঠাত্ করেই বেড়ে গিয়েছিল এর চাহিদা: পুরো উত্তর ভারতেই ছিল ব্ল্যাকআউট।
আমরা প্রথম গেলাম অমৃতসরে। পাঁচ লাখ মানুষের বসবাস এই শহরে। শহরটি এই অঞ্চলের বিশাল শিল্পকেন্দ্র। পাঞ্জাবের বড় জংশনও এটা। সীমান্ত থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরত্বে এর অবস্থান। ৩ ডিসেম্বর অমৃতসরে হামলা হয়েছিল। পশ্চিমা রেডিওগুলো শুরুতেই এমন খবর পরিবেশন করতে শুরু করল, যাতে মনে হলো অমৃতসর শহরে বিশাল ধ্বংসযজ্ঞ চলেছে। কিন্তু তা ছিল অনেক বাড়িয়ে বলা। যদিও শঙ্কার মধ্যে ছিল সবাই, কিন্তু শহরের জীবনযাত্রায় তা সে রকম প্রভাব ফেলেনি। না থেমেই কাজ করে চলেছিল শিল্পকারখানা, বাজারে চলছিল স্বাভাবিক কেনাকাটা, সিনেমা হলে চলছিল চলচ্চিত্র প্রদর্শন।
অমৃতসরে বিমান হামলার কথা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে আমরা জানতে শুরু করি এয়ারপোর্টে বসে। এখান থেকেই সাধারণ বিমান ও যুদ্ধবিমান একই সঙ্গে ওড়ে। বেসামরিক বিমান চলাচল বিভাগের প্রধান ড. গিল আমাদের বললেন, ‘গোধূলিলগ্ন তখন, এ সময় ১৫০-২০০ মিটার ওপরে অজানা দুটো প্লেনের আনাগোনা দেখা গেল। বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেল তারপর। কিছু সময় পরে হামলার পুনরাবৃত্তি হলো। তখন আমাদের বিমানও সক্রিয় হলো। সে রাতে কম করে হলেও চারবার বোমা হামলা হয়েছে।’ ‘ক্ষতির পরিমাণ কেমন?’ আলোচনার সময় উপস্থিত বিমানবাহিনীর মেজর টেংরির কাছে আমরা জানতে চাইলাম। তিনি বললেন, ‘আমাদের নাগরিক ও যানবাহন নিরাপদেই আছে। হতাহত নেই। হামলায় ক্ষতি হয়েছে রানওয়ের। তবে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আমরা তা ঠিক করে নিয়েছি।’ হ্যাঁ, আমরা দেখতে পেলাম, রানওয়ের অন্তত পাঁচটি জায়গায় গাঢ় ছাইরঙের বিটুমিনের প্রলেপ। ‘হামলার ফলে গর্তগুলো হয়েছিল দেড় থেকে দুই মিটার গভীর। বিমানবন্দর আবার কাজ করা শুরু করেছে।’ জানালেন টেংরি। তাঁর কথা প্রমাণ করার জন্যই বুঝি একটি যুদ্ধবিমান এসে নামল বিমানবন্দরে। দুটো প্যারাস্যুট উড়িয়ে দিয়ে ব্রেক কষল।
অমৃতসর থেকে পাঠানকোটের দিকে যাওয়া রাস্তায় দুই মানুষসমান ঘাস। তা থেকে শস্য বের করে নেয় গ্রামের মেয়েরা। আমাদের আর্মি জিপ পার হয়ে যায় শস্যভরা মহিষ বা গরুর গাড়ি। যুদ্ধের কিছুই এখান থেকে বোঝা যায় না। যুদ্ধ চলে গেছে উত্তর পাঠানকোটে। শুধু আকাশে টহল দেওয়া বিমানের কর্কশ আওয়াজ স্মরণ করিয়ে দেয় অনতিদূরেই বাজছে যুদ্ধের দামামা। শহরতলি দাসুইতে এসে আমরা পড়ে গেলাম একটি জনসভার মধ্যে। সোভিয়েত সাংবাদিকদের কাছে এসে হাজির হলেন অজানা নাগরিকেরা, স্বতঃস্ফূর্তভাবে হাতে মেলালেন হাত। বুঝলাম, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে সোভিয়েত প্রতিনিধির রাখা বক্তব্যের খবর এখানে পৌঁছে গেছে। তাসের খবরও পৌঁছে গেছে, যেখানে বলা হয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়ন পাকিস্তানের ভারত আক্রমণের তীব্র সমালোচনা করেছে। অনতিবিলম্বে রক্তপাত বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়নকে ধন্যবাদ জানিয়ে আইনজীবী ব. কাপুর ও স্থানীয় বিদ্যালয়ের শিক্ষক আভতার সিং বললেন যে ভারত কখনোই যুদ্ধ চায়নি। দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে যে সংকট চলছে, তার আশু সমাধান প্রয়োজন। কাশ্মীর যাওয়ার পথে গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত স্থান এই পাঠানকোটে পশ্চিম ফ্রন্টের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল ই. প. কানদেত সাংবাদিকদের বরণ করে নিলেন। তিনি তাঁর ধারণার কথা বললেন। বললেন, পাকিস্তানিদের লক্ষ্য কাশ্মীর দখল করে নেওয়া।
পাঠানকোটের এয়ারপোর্টে দেখা হলো অ্যান্টিএয়ারক্রাফ্ট ব্যাটালিয়ানের মেজর মালহোত্রার সঙ্গে। তিনি বসে ছিলেন বালু দিয়ে ঘেরা, জাল দিয়ে জড়ানো, সাধারণ মানুষের চোখ থেকে লুকানো অ্যান্টিএয়ারক্রাফ্ট অস্ত্র নিয়ে। তিনি দেখালেন পাকিস্তানি বাহিনীর বিমান হামলার গতিপথ। আমরা এখানে এসে পৌঁছানোর পাঁচ ঘণ্টা আগে এখানে চারবার বিমান হামলা হয়েছে। মালহোত্রা বললেন, প্লেনগুলো খুব নিচু হয়ে উড়ছিল, যেন রাডারে ধরা না পড়ে আর ইতস্তত যেখানে যেভাবে পেরেছে রকেটবোমা বর্ষণ করেছে যত্রতত্র। একটি হামলার সময় মালহোত্রার ব্যাটালিয়ন একটি বিমানকে ভূপাতিত করেছে। বৈমানিক আত্মসমর্পণ করেছে। তাকে স্থানীয় জনগণ ধরে এনে সেনাবাহিনীর হাতে সঁপে দিয়েছে। মেজরের কাছ থেকে যখন আমরা বিদায় নিচ্ছি, তখন এখানে রকেট টারবাইনের শব্দে কানে তালা লেগে গেল। ভারতীয় বাহিনী এখানে মহড়া করছে।
কঠিন সময়
৭ ডিসেম্বর দিল্লি
সীমান্তে সংঘাত ভারতীয় রাজধানীর মুখেও তার পরশ রাখল। কলেজ ও সরকারি বিদ্যায়তনগুলোর সামনে শিক্ষার্থীরা বিমান হামলা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ট্রেঞ্চ খুঁড়তে শুরু করল। চিকিত্সকদের সমিতি বেশি বেশি রক্ত দেওয়ার জন্য দেশের নাগরিকদের আহ্বান জানাল। এখন সকাল থেকেই হাসপাতালগুলোয় রক্ত দিতে ইচ্ছুক মানুষের সারি দেখা যাচ্ছে প্রতিদিন।
পার্লামেন্টে বক্তৃতা করার সময় ইন্দিরা গান্ধী দেশের জনগণকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, সামনে কঠিন সময়। যুদ্ধের সংকটের মুখে প্রথমেই পড়ল শ্রমিকেরা, এমনিতেই তাদের জীবন খুব একটা সুখকর ছিল না। দিল্লির দক্ষিণভাগের আবাসন শ্রমিকেরা আমাদের জানাল, এরই মধ্যে আটা, চাল, কেরোসিন আর চিনির দাম বেড়ে গেছে। কোনো কোনো পণ্য দোকান থেকে হাওয়া হয়ে গেছে। বিশাল কাঁধের লম্বা ৪০ বছর বয়সী লোকটা, বনওয়ারি লাল যাঁর নাম, তিনি দেশি সস্তা তামাক দিয়ে বানানো সিগারেটে টান দিয়ে সেটা পাশে বসা আরেকজনকে দিয়ে ব্যাখ্যা করলেন বিষয়টা, ‘সিগারেটের দামও বেড়ে গেছে! যদি আমাদের সেনাবাহিনীর জওয়ানদের ভালো খাওয়া, পরার জন্য সরকার জিনিসপত্রের দাম বাড়াত, তাহলে আমরা তা সানন্দে মেনে নিতাম। কিন্তু এই মুদ্রাস্ফীতি তো সরকারের কারণে ঘটছে না। এটা ঘটাচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীরা।’ বনওয়ারি লালের পাশে বসা মুনশী রাম যোগ করলেন, ‘কালোবাজারিদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম আরও জোরদার করতে হবে।’
সরকার খুবই চেষ্টা করছে পণ্য পরিবহন ও জনগণকে পণ্যপ্রাপ্তির নিশ্চয়তা দিতে। রাজধানী ও অন্যান্য শহরে কার্ডের মাধ্যমে রেশন দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে, যেন ন্যায্যমূল্যে পণ্য পাওয়া যায়। শীতের ফসলপ্রাপ্তির ওপর এই সংকটের ভবিষ্যত্ নির্ভর করছে। দেশের কৃষিমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন, এবার দেশজুড়ে ফসল খুব ভালো হয়েছে। গুদামে প্রচুর পরিমাণে খাবারের মজুত আছে, সুতরাং দেশের মানুষের আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। এ সময়টায় পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা উদ্বাস্তুদের ঠিকভাবে রাখার জন্য জোরদার কাজ করে যাচ্ছিল সরকারের একটি বিভাগ। এই বিভাগের প্রধান গ. কাহলোনের টেলিফোনটা সকাল থেকে নিশুতি রাত পর্যন্ত বাজতেই থাকত, বাজতেই থাকত...।
‘আগে যেমন, তেমনই’ তিনি বলতে থাকেন, ‘আমাদের প্রতিদিন অসংখ্য প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। আমাদের প্রথম দায় শিশুরা, যারা না খেতে পেরে কাহিল অবস্থায় আছে। আমরা শিবিরে বিশেষ ধরনের খাবার পাঠানোর চেষ্টা করছি। আসামের পাহাড়ি এলাকায় আর পশ্চিম বাংলার সমতলে আশ্রয় নেওয়া উদ্বাস্তুরা সামনের শীতে কাহিল হয়ে পড়বে, তাদের বাঁচানোর জন্য এখনই কম্বল আর গরম কাপড় পাঠানো শুরু করেছি। দুঃখের বিষয় হলো, মুষলধারে বৃষ্টি কোনো কোনো জায়গায় ট্রেন চলাচলে বিঘ্ন ঘটাচ্ছে। রাস্তাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাই সময়মতো পণ্য পৌঁছানো কঠিন হয়ে পড়েছে। ‘এই অর্থনৈতিক বছরে আমরা উদ্বাস্তুদের জন্য ৭০০ মিলিয়ন ডলার খরচ করব। ভারত সরকারের অর্থনৈতিক অবস্থার জন্য এটা দারুণ কঠিন সময়’ বললেন কাহলোন। স্বয়ং জীবন এখন যুদ্ধের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে এবং এই সংকটের শান্তিপূর্ণ মীমাংসার জন্য উদগ্রীব হয়ে রয়েছে।
যাব কোথায়
কলকাতা, ১২ ডিসেম্বর
অমৃতসর থেকে ফেরার পর থেকে শুরু হলো আমাদের ভয়াবহ প্রতীক্ষা। আমরা খুবই মনোযোগ দিয়ে ভারতীয় রেডিও শুনছিলাম, যেখানে প্রতি ঘণ্টায় ফ্রন্টের অবস্থা জানিয়ে দেওয়া হচ্ছিল। ভারতীয় সরকারের প্রতি সন্ধ্যার ‘ব্রিফিং’ (সংক্ষিপ্ত সংবাদ সম্মেলন) আমাদের যুদ্ধাবস্থা সম্পর্কে অবহিত করত এবং আমরা মস্কোতে খবরগুলো পৌঁছে দিতে পারতাম। কিন্তু আমাদের সম্পাদকমণ্ডলীকে কি এই খবরটুকু তৃপ্তি দিতে পারত? সরকারি এই ব্রিফিং তো আমাদের দিল্লির তাস থেকেই সরবরাহ করা হতো। তাসের কর্মীরা দিনরাত ২৪ ঘণ্টা টেলিটাইপের সামনেই থাকত। আমরা বুঝতে পারছিলাম, সংবাদের স্বার্থে আমাদের আবার যেতে হবে মূলত ঘটনাগুলো যেখানে ঘটছে, ফ্রন্টে। কিন্তু একটা প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার খুব দরকার ছিল: যাব কোথায়, পশ্চিম ফ্রন্টে নাকি পূর্ব ফ্রন্টে? আবার এমন না হয়ে বসে, খবরের জন্য আমরা গেলাম একদিকে কিন্তু ঘটনা ঘটল অন্যদিকে। এই প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেলাম সপ্তাহ খানেক পরে, যখন তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। বোঝা গেল, পশ্চিম ফ্রন্টে কঠিন যুদ্ধ হলেও, ট্যাংকে ট্যাংকে টক্কর হলেও এদিকটায় নাটকীয় কিছু ঘটবে না। ইন্দিরা গান্ধী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রামের দেওয়া ঘোষণায় প্রতিফলিত হয়েছিল ভারতীয় সরকারের অবস্থান, তাঁরা বলেছিলেন, ভারত এখানে কোনো সীমান্তযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়নি, ভারত যা করছে তা আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধ। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সম্ভবত হামলা করার মতো যথেষ্ট শক্তি জড়ো করে উঠতে পারেনি। এই সময়ে পূর্ব ফ্রন্টে মুক্তিবাহিনী আর ভারতের মিত্র বাহিনী একই সঙ্গে সামনে এগিয়ে চলেছিল। বাংলাদেশ প্রজাতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণে থাকা অঞ্চল দিনকে দিন বাড়ছিল।
আমরা ঠিক করে ফেললাম, কী করতে হবে আর তাই পরদিনই কলকাতায় ফেরার প্লেন ধরলাম (প্লেনের নিয়মিত ফ্লাইট বাতিল করা হয়নি, যদিও ফ্লাইটের সংখ্যা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে)। আমরা খুবই অবাক হলাম কলকাতাবাসীর মনে বিমান হামলার ভয় একেবারেই নেই দেখে। জানতে পারলাম, পূর্ব ফ্রন্টে ভারতের বিমানযুদ্ধে ভারত এতটাই এগিয়ে ছিল যে কলকাতাবাসীর বিমান হামলার বিপদ একবারেই ছিল না। স্থানীয় তথ্যকেন্দ্রে যোগাযোগ করলে তারা আমাদের পাঠিয়ে দিল কর্নেল রিকখির কাছে, তিনি ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় সেনাবাহিনীর প্রেসের দিকটা সামলাচ্ছেন। শহরের একেবারে কেন্দ্রে তাঁর অফিসে অনেক সাংবাদিক কাজ করছিলেন। এখানে ভারতীয় সাংবাদিকদের চেয়ে পশ্চিম ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের সাংবাদিকদেরই সংখ্যাধিক্য ছিল। তাঁরা সবাই ফ্রন্টে যাওয়ার অনুমতির জন্য কর্নেলের কাছে আবেদন করছিলেন। আমাদের উত্তেজনা ধাক্কা খেল...।
তবে খুব শিগগিরই আমরা বুঝতে পারলাম, যতটা ভেবেছি, অবস্থা ততটা খারাপ নয়। ভারতীয় বাহিনী ঠিক করল সীমানা পেরিয়ে বাংলাদেশে ঢুকবে আর যাদের তারা নিয়ে যাবে, সেই দলে জায়গা হবে আমাদের। এরপর ভারতীয় বাহিনীর কমান্ডার আমাদের একটি ঘোষণা বা অঙ্গীকারপত্রে স্বাক্ষর করতে বললেন। সেখানে লেখা ছিল যুদ্ধসাংবাদিক হিসেবে আমরা যদি কোনো সরাসরি যুদ্ধের মধ্যে পড়ি, তাহলে ভারতীয় সরকার তার দায় বহন করবে না। বলা যায়, এই অঙ্গীকার করাটা ছিল শুধু আনুষ্ঠানিকতা। আমাদের সাংবাদিকদের যে অফিসার ফ্রন্টে নিয়ে যাচ্ছিলেন, তাঁরা সেই রাস্তাটাই ধরেছিলেন, যেখানে পাকিস্তানিদের হম্বিতম্বি শেষ হয়ে গেছে। শুধু একদিন, আকস্মিকভাবেই গোলাগুলির মধ্যে পড়তে হয়েছিল আমাদের। শিল্পশহর খুলনায় আমরা মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তানি বাহিনীর গোলাগুলির মধ্যে পড়েছিলাম, তখনো পাকিস্তানিরা সেখানে অস্ত্র সমর্পণ করেনি।
যশোরে ভোর
যশোর-কলকাতা, ১৪ ডিসেম্বর
জনা পনেরো মানুষ, যার মধ্যে আছে নারী, তরুণ, নানা বয়সের কচি ছেলেমেয়ে, সামনের দিকে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছিল যুদ্ধশকটের দিকে কোনো রকম ভ্রুক্ষেপ না করে। সবার আগে লাঠি হাতে এগিয়ে চলেছিলেন বছর আশি বয়সের এক বৃদ্ধ। তিনি এই পরিবারের প্রধান। বোঝা যাচ্ছিল, পথ চলতে কষ্ট হচ্ছে তাঁর। শ্বাস নেওয়ার জন্য একটু থেমে তিনি তাকাচ্ছিলেন পূর্বদিকে যত দূর চোখ যায়। কলকাতা থেকে বাংলাদেশের সীমান্তের দিকে ধাবমান মানুষের অভিযাত্রায় এদেরই প্রথম দেখেছি তা নয়। হাজার হাজার সাময়িক উদ্বাস্তু মানুষ ভারতের শিবির ছেড়ে স্বাধীন হওয়া ভূখণ্ডে পা রাখছে। না ভারত সরকার না বাংলাদেশ সরকার, কেউই এ বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করছিল না, এক কোটি মানুষকে স্বাধীন ভূখণ্ডে ফেরত পাঠানোর মতো অবস্থায় তারা ছিল না, স্বতঃস্ফূর্তভাবেই মানুষ ফিরে যাচ্ছিল নিজ গ্রামে, নিজ দেশে, কিন্তু স্বাধীন ভূখণ্ড এখনো তাদের গ্রহণে প্রস্তুত হয়নি, কিন্তু নিজ বাসভূমিতে ফিরে যাওয়ার এই গতিকে থামানোর সাধ্য কার?
দেশ তাদের জন্য কী নিয়ে অপেক্ষা করছে? এই প্রশ্নটি প্রত্যেক শরণার্থীর চোখে দৃশ্যমান, আমরা যে সাংবাদিকেরা পূর্ববঙ্গের বড় প্রশাসনিক কেন্দ্র যশোরের দিকে যাচ্ছিলাম, তাদেরও প্রশ্নটি তাড়িত করছিল। রাস্তাটা নয়নাভিরাম: ছবির মতো আম, কলার বাগান, প্রথম দর্শনে বিশ্বাসই হতে চায় না এ রকম অসাধারণ সৌন্দর্যমণ্ডিত অঞ্চলে কী করে এ রকম বিয়োগান্তক ঘটনা ঘটতে পারে, কী করে সেই বেদনাময় আখ্যান লাখ লাখ মানুষের জীবন কেড়ে নিতে পারে? কিন্তু একটু এগোলেই যখন দেখা যায় নদীর ওপর ভাঙা সেতু, শস্যহীন খেত, সন্ত্রাসের রাজত্ব শুরু হওয়ার পর কৃষকেরা জমিতে আর শস্য বুনতে পারেননি। যশোর আমাদের বরণ করে নিল অবিশ্বাস্য এক স্তব্ধতার মধ্য দিয়ে। একতলা বাড়িগুলো থেকে লতিয়ে উঠেছে লালরঙা বাগানবিলাস। চারপাশের পরিস্থিতি দেখে মনে হলো হতবিহ্বল পাকিস্তানি বাহিনী তড়িঘড়ি শহর ছেড়ে পালিয়েছে। তাই শহরের এই এলাকায় ক্ষতির ছাপ দেখা গেল না। মনে হলো, শেষ কয়েক মাসের ঘটনা এই শহরকে রক্ষা করেছে। কিন্তু আমাদের এই ধারণা পরিবর্তিত হতে বেশি সময় লাগল না। স্থানীয় ডাকঘরের একজন কর্মী আমাদের নিয়ে গেলেন শংকরপুরের এক পতিত জমিতে। আমাদের চোখের সামনে উঠে এল বীভত্স এক চিত্র: অগভীর পাথরের কুয়ো ভরে আছে করোটি আর মানুষের হাড়ে। কাছেই, জঙ্গলের মধ্যে আরও বড় এক বধ্যভূমি।
গণহত্যা থেকে বেঁচে যাওয়া প্রত্যক্ষদর্শীরা হত্যার শিকার হওয়া মানুষের সংখ্যা বলতে পারলেন না। তাঁরা বললেন, গত দুই মাস এই পতিত জমিটি হত্যাকাণ্ডের জন্য ব্যবহূত হতো। প্রতিদিন রাতে পাকিস্তানিদের কাছ থেকে পয়সা খাওয়া রাজাকারেরা বাঙালিদের রুমালে চোখ বেঁধে, হাত পিছমোড়া করে বেঁধে এখানে নিয়ে আসত। যশোরের প্রশাসনিক ভবনে দেখা পাওয়া গেল বেশ কিছু মানুষের, যাঁরা অলৌকিকভাবে মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গেছেন। মার্চ মাসে যখন সবাই অসহযোগ আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন, তখন খুলনার জনপ্রশাসনের কর্মী সানোয়ার আলীও অফিস করেননি। তাঁকে গ্রেপ্তার করার কারণ ছিল সেটাই। ‘আমাকে সকাল সাতটার সময় বাড়িতে এসে ধরে নিয়ে গেল’ স্মৃতিচারণা করলেন সানোয়ার আলী। ‘যশোরের সেনাছাউনিতে নিয়ে গেল। আমাকে জেরা করল গোয়েন্দা বিভাগের মেজর ওমর খুশিদ। তবে এটাকে জেরা বলা যায় কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। তিনি আমার নাম লিখে ফেলার পরই সৈন্যরা আমাকে পেটাতে শুরু করে দিল। এরপর একটা ঘরে আটকে রাখল। সেখানে পাথরের মেঝেতে একজন অপরিচিত বন্দী পড়ে ছিলেন। তাঁর চোখে-মুখে কালশিটে পড়ে গিয়েছিল, সারা শরীর ছিল রক্তে মাখামাখি। তখন আমি তাঁকে চিনতে পারিনি। কয়েক ঘণ্টা পর আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো আরেকটি ঘরে। পরদিন আমার সঙ্গী বন্দীকে দুবার নিয়ে গেল জেরা করার জন্য। সেদিন বিকেলে আমি প্রথমবারের মতো তাঁর দুর্বল কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম, সে কণ্ঠ যন্ত্রণায় কাঁপছিল। আমি তাঁর মুখের কাছে কান রাখলাম, শুনলাম তিনি বিড়বিড় করে প্রার্থনা করছেন, যে প্রার্থনা প্রতিটি ধর্মভীরু মুসলমান মৃত্যুর আগে করে। পরে আমি জানতে পারলাম, তিনি ছিলেন আওয়ামী লীগের জনপ্রিয় নেতা মশিয়ুর রহমান। তিনি ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। সেদিনের পর থেকে তাঁকে কেউ দেখেনি। আমি নিশ্চিত, তিনি শহীদ হয়েছেন’ কথা শেষ করলেন সানোয়ার আলী।
সামরিক সরকারের পক্ষে স্বাধিকার আন্দোলনের কণ্ঠ রোধ করার চেষ্টা সফল হয়নি। নেতাদের বড় একটি অংশ গা-ঢাকা দিয়েছিল। এখন পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের জনপ্রতিনিধিরা যশোরে আঞ্চলিক কমিটি গঠন করেছেন। এই কমিটি এখানকার নতুন প্রশাসন গড়ে তুলছে। এই প্রশাসনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন ওয়ালিউল ইসলাম। তিনি আগে যশোরেই কাজ করতেন। তাঁর কাজের জায়গা ছিল অস্ত্রাগার। যখন পাকিস্তানি বাহিনী সাধারণ মানুষের ওপর নৃশংসতা শুরু করল, তখন ওয়ালিউল ইসলাম অস্ত্রাগারের দরজা খুলে দিয়েছিলেন এবং নিজে যোগ দিয়েছিলেন মুক্তিবাহিনীতে। এখন এই ৩০ বছর বয়সী লোকটির কাঁধে অনেক বড় দায়িত্ব। তাঁকে এখন এই অঞ্চলের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ফিরিয়ে আনতে হবে। এখানে বাস করে প্রায় এক কোটি মানুষ।
‘পলায়নের সময় পাকিস্তানি বাহিনী আমাদের যোগাযোগব্যবস্থা, যানবাহন, জ্বালানি তেলের পাম্প—সব ধ্বংস করে দিয়ে গেছে। আমাদের এখানে জ্বালানি তেল আর খাদ্যপণ্যের অভাব। তবে প্রজাতন্ত্রের সরকার শক্তিশালী হচ্ছে।’ ওয়ালিউল ইসলাম বলতে থাকেন কথা। ‘টেলিফোন, ডাকঘর ও টেলিগ্রাফ এরই মধ্যে কাজ করতে শুরু করেছে। কলেরার হাত থেকে বাঁচানোর জন্য ইতিমধ্যেই জনগণকে টিকা দেওয়া শুরু হয়েছে। ভারতীয় সেনাবাহিনী এ ব্যাপারে আমাদের সাহায্য করছে। ভারতীয় সেনাবাহিনী এরই মধ্যে আমাদের বিদ্যুেকন্দ্র সচল করার জন্য জ্বালানি দিয়েছে, অবকাঠামো গড়ে তোলার জন্য পণ্য সরবরাহ করছে। এ কথা সত্যি, সবকিছু নতুন করে শুরু করা খুব কঠিন। এখন তো ধ্বংসযজ্ঞ কাটিয়ে ওঠাটাই একমাত্র কাজ নয়, দেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শুরু করাও দরকার। আমাদের শক্তি শ্রমিক, কৃষক ও ছাত্র; তারাই তো স্বাধীনতার আন্দোলনকে বেগবান করে তুলেছে।’
হঠাত্ করেই তাঁর সঙ্গে কথা থামাতে হলো। তাঁর কাছে এসেছে ছাত্ররা। ছাত্রলীগের সভাপতি সিদ্দিকী (নূরে আলম সিদ্দিকী) বললেন, ‘আমাদের সমর্থন করার জন্য আপনাদের দেশকে ধন্যবাদ জানাই। আমাদের দেশের বিরুদ্ধে চীন-মার্কিন ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দিয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়ন। যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান আমাদের জানা, কিন্তু চীন কেন এ ধরনের আচরণ করল, তা আমি একেবারেই বুঝে পেলাম না। জনগণ আন্দোলন অগ্রাহ্য করে সাম্রাজ্যবাদের পক্ষে দাঁড়াল। আমি ৭ ডিসেম্বর ছাত্রদের উদ্দেশে রেডিওতে দেওয়া আমার ভাষণে এ কথাই বলেছি।’ দিনের মধ্যভাগে আমরা আমাদের নব্যপরিচিত মানুষের কাছ থেকে বিদায় নিলাম। রাস্তায় মানুষের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। রিকশার হ্যান্ডেলে, বাড়ির বাগানে, ছাদে, এমনকি তালগাছের মাথায়ও উড়ছে বাংলাদেশের পতাকা, সবুজ জমিনে লাল গোলক, মাঝখানে দেশের মানচিত্র (দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, সবুজ জমিনে লাল গোলকই হবে বাংলাদেশের পতাকা)। যশোর থেকে তিন কিলোমিটার দূরে হঠাত্ করে থেমে গেল জিপ: রাস্তা ভাঙা। কোদাল হাতে ভারতীয় সেনাবাহিনী সে ভাঙা রাস্তা জোড়া দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে। তাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে যাচ্ছে রঙিন কাপড়ে নিজেদের মোড়ানো কৃষকেরা। তারা মাটি সরাচ্ছে, ইট আনছে।
‘স্থানীয় জনগণ স্বেচ্ছায় আমাদের সাহায্য করছে।’ কাছে-ধারে থাকা অফিসার আমাদের বললেন, ‘আমরা তাদের এক পয়সাও দিচ্ছি না, তবে তাদের কাজ করার জন্য জোরও করছি না। কিন্তু প্রতিদিন শত শত মানুষ কাজ করার জন্য চলে আসে। এটা তাদের দেশের মাটি, তাই তারা দ্রুত সবকিছু ঠিকঠাক করে ফেলতে চায়।’ যখন ফিরলাম, তখন রাত হয়ে গেছে। রাজপথ শূন্য। গাড়ির আলোয় কখনো কখনো স্পষ্ট হয় কর্তব্যপালনরত কোনো মুক্তিসেনার অবয়ব। পূর্ব বাংলার আকাশে নতুন ভোর আসছে।
মুক্ত ঢাকায় প্রথম দিন
ঢাকা, ১৭ ডিসেম্বর
২৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় সবাই জেনে গেল, পূর্ব বাংলায় পাকিস্তান বাহিনীর কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজি আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেছেন। কলকাতার ‘গ্রান্ড ইস্ট হোটেল’-এ বসে আমরা মাথা কুটে মরছি, কী করে ঢাকায় পৌঁছানো যায়। একের পর এক পরিকল্পনা আসছে মাথায়, কিন্তু সে পরিকল্পনাগুলো বাস্তবে রূপায়ণ করা অসম্ভব। ভারতীয় প্রশাসন বিদেশি সাংবাদিকদের সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকা যাওয়ার প্রশ্নে একেবারেই বাদ সাধেনি। ব্যাপারটা হচ্ছে, কী করে যাবে। ঢাকা বিমানবন্দরের রানওয়ে ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে, ঢাকায় প্রবেশের সময় তিন দিক থেকে যে তিনটি নদীর ওপর সেতু ছিল, সেগুলো ভেঙে ফেলা হয়েছে, রেলপথও ধ্বংস করা হয়েছে।
কোনো উপায় বের করতে না পেরে অগত্যা আমরা ঘুমানোর কথাই ভাবলাম। রুশ প্রবাদ বলে, ‘রাত পোহালে বুদ্ধি খোলে’। প্রাচীন এই রুশ প্রবাদ আমাদের ঠিক পথেই নিয়ে গেল। সকাল ৯টা ৩০ মিনিটে টেলিফোন বেজে উঠল, ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রেস সেন্টার থেকে লেফটেন্যান্ট কর্নেল সিকলি ফোন করেছেন। তিনি বললেন, ৪৫ মিনিট পর কলকাতার দমদম বিমানবন্দর থেকে একটি যুদ্ধ হেলিকপ্টার ঢাকায় যাবে, সেই হেলিকপ্টারে আমরা চাইলে যেতে পারি। তৈরি হতে আমাদের ১০ মিনিটের বেশি লাগল না। ক্যামেরায় নতুন ফিল্ম ভরলাম, নতুন ক্যাসেট ভরলাম টেপরেকর্ডারে, ডায়েরি এবং ফিল্ম ঢুকালাম ব্রিফকেসে। ব্যস তৈরি। ছোট, কিন্তু আরামদায়ক কাচঘেরা হেলিকপ্টারটি প্রথমে একটু এদিক-ওদিক দুলল, তারপর না কেঁপে উড়ে গেল আকাশে, ধরল উত্তর-পূর্ব পথ। নামার আগে ঢাকার আকাশে বেশ কয়েকবার ঘুরপাক খেল হেলিকপ্টার। আমরা দেখতে পেলাম ছোট ছোট বাড়ির মসৃণ ছাদ, সবুজে ঢাকা পড়ে যাওয়া রাজপথ।
রাজধানীর মানুষের মনের অবস্থা কোন পর্যায়ে, সেট বুঝলাম এয়ারপোর্টের লাইন দিয়ে নির্দিষ্ট করে দেওয়া জায়গায় হেলিকপ্টারটি নামার পরপরই হাজার হাজার মানুষ এসে উচ্ছ্বসিত স্লোগান দিতে লাগল হেলিকপ্টারের কাছে এসে। ‘জয় বাংলা’, ‘জয় ভারত’ স্লোগানে কাঁপছিল চারদিক। হেলিকপ্টারের চালকদের আলিঙ্গনাবদ্ধ করা হলো, করমর্দন করতে হলো তাদের। কিছুক্ষণের মধ্যেই হেলিকপ্টারের সামনে হাজির হলো যুদ্ধট্রাক। সে ট্রাক নির্দিষ্ট পোশাক ও সাদা পোশাকের যুবকে ঠাসা। তারা বলছিল, ‘ভারতবাসী আমাদের বন্ধু। আমাদের দেশের মাটিতে তাদের স্বাগত জানাই। কিন্তু এয়ারপোর্টে ভিড় বাড়িয়ে সমস্যা তৈরি করা ঠিক হবে না। মিটিং করুন অন্য কোথাও, এখানে নয়।’ কথা শুনল মানুষ। সরে গেল হেলিকপ্টার ছেড়ে। লেফটেন্যান্ট কর্নেল সিকলি বললেন, ট্রাকের এই যুবকেরা মুক্তিবাহিনীর সদস্য। নতুন প্রশাসন এসে ক্ষমতা হাতে নেওয়ার আগে ওরাই শহরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে।
আমাদের চারদিকে মানুষের ঢল, সবাই ঘিরে রেখেছে আমাদের, তার মাঝ দিয়েই আমরা বিমানবন্দর থেকে বের হওয়ার রাস্তার দিকে এগোই। ট্যাক্সি থাকার কোনো প্রশ্নই আসে না, কিন্তু বেশ কয়েকজন গাড়ির মালিক স্বেচ্ছায় আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী ঘুরে দেখানোর প্রস্তাব করলেন। আমাদের সঙ্গে থাকলেন সিকলি, আমরা গিয়ে উঠলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মনজুরের ছোট ফিয়াট গাড়িতে। মাত্র তিন ঘণ্টার মধ্যে আমাদের ঘুরে বেড়াতে হবে ঢাকা, এরপর আবার আমাদের হেলিকপ্টার কলকাতার উদ্দেশে রওনা দেবে। দারুণ ব্যাপার। তার ওপর আমাদের গাইড মনজুর একসঙ্গে জমে থাকা সব কথা বলে দিতে চাইছে, এক মুহূর্তের জন্য তার মুখ থামছে না। সারা ঢাকা শহর আনন্দ-উল্লাসে মত্ত। বাড়িতে, দরজায়, দেয়ালে, গাছে, সবখানেই নতুন প্রজাতন্ত্রের জাতীয় পতাকা। তিলধারণের ঠাঁই নেই, এমন ট্রাকগুলো যাচ্ছে যুবকদের নিয়ে, তাদের কণ্ঠ থেকে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান নামতেই চায় না। চারদিকে তৃপ্ত, সুখী সব মুখ। মানুষ একে অন্যকে অভিনন্দন জানাচ্ছে, গান গাইছে, স্লোগান দিচ্ছে, পাকিস্তানি সৈন্যদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া অস্ত্র থেকে ফাঁকা গুলি করছে।
শহরটাকে দেখে মনে হয়, এ যেন বড় এক যুদ্ধশিবির। ট্রাকে করে আসছে সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধারা, ট্রাকে করে আসছে ভারতীয় সৈন্যরা। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের সামনে ট্যাংক, সেখানে সশস্ত্র পাহারা। ছাদে বিশাল কাপড়ে লেখা রেডক্রস। এই ভবনটি যুদ্ধাবস্থায় নিরপেক্ষ এলাকা হিসেবে বিবেচিত হতো। রেডক্রসের কার্যক্রম এখান থেকে পরিচালিত হতো। মূল শহরে ক্ষতি হয়েছে খুব কম। ভারতীয় সেনাবাহিনী বোমা ফেলেছে শহরের বাইরে শুধু সামরিক স্থাপনার ওপরই। সেনা চেকপোস্টের কাছে এসে ব্রেক করল আমাদের গাড়ি। এই রাস্তা গেছে ক্যান্টনমেন্টের দিকে। সেখানে যুদ্ধবন্দী পাকিস্তানি সেনারা যাচ্ছে। তাদের দেখে মনে হলো না, তারা খুব শঙ্কার মধ্যে আছে। বরং যুদ্ধ শেষ হয়েছে, এ কথা ভেবে তাদের মনে বেশ খানিকটা তৃপ্তি।
ঢাকায় পাকিস্তানি সৈন্যসংখ্যা কত? ভারতের ৩১১ মাউনটেন্ট পদাতিক বাহিনীর অফিসার, যাঁরা প্রথম ঢুকেছে এ শহরে, ক্যাপ্টেন চক্রবর্তী বললেন, এখনো মোট আত্মসমর্পণ করা সেনাদের সংখ্যা নিরূপণ হয়নি। আন্দাজে বললে সংখ্যাটা হবে ১৫ হাজার। ‘আত্মসমর্পণের আন্তর্জাতিক সব নিয়ম কঠোরভাবে মেনে চলছি আমরা। যুদ্ধবন্দীদের সঙ্গে আমরা মানবিক আচরণ করছি’ বললেন তিনি। ঢাকায় যখন আমাদের অবস্থানের সময় প্রায় শেষ, সে সময় আমরা গেলাম সোভিয়েত দূতাবাসে। এটা ছিল শহরের এক প্রান্তে। খুব কঠিন সময় পার করলেও দূতাবাসের সবাই কাজ করে যাচ্ছিলেন নিয়মমতো। আমাদের দেখে দূতাবাসের কর্মকর্তা ও কর্মীরা খুব খুশি হলেন। থেকে যেতে বললেন। দূতাবাসে আমাদের থাকার মতো ঘর আছে বলে জানালেন। আমরা লেফটেন্যান্ট কর্নেল সিকলিকে জানিয়ে দিই, ঢাকায় আমাদের দূতাবাসে আমরা কয়েক দিন থাকব। অফিসার চলে গেলেন কিন্তু ঠিক তারপর থেকেই আমরা খুব দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গেলাম। জানা গেল, বহির্বিশ্বের সঙ্গে ঢাকার টেলিফোন ও টেলিগ্রাফের যোগাযোগ এখনো স্থাপিত হয়নি। এর মানে, আমরা এখানে থেকে গেলে আমাদের দেশে কোনো খবরই পাঠাতে পারব না।
খুব অল্প সময়ের মধ্যে সংশয় কাটিয়ে আমরা ছুট দিলাম বিমানবন্দরের দিকে। বিমানবন্দরে এরই মধ্যে কিছুটা নিয়মানুবর্তিতা যোগ হয়েছে। বাইরের মানুষদের সরিয়ে নেওয়া হয়েছে রানওয়ে থেকে। রানওয়েতে যাওয়ার দরজায় দাঁড়িয়ে আছে অস্ত্র হাতে সেনা। আমরা নিশ্চিত এই সেনারা আমাদের মতো বিদেশিদের রানওয়েতে যেতে অনুমতি দেবে না। বিস্মিত হয়ে দেখলাম, আমাদের হেলিকপ্টারের পাখা এরই মধ্যে ঘুরতে শুরু করেছে। এখন কী করব? ভাবনায় ডুব দেওয়ার সময় নেই। সেনাদের ভড়কে দিয়ে এয়ারপোর্টের দেয়াল টপকে গেলাম এবং সেনাদের সতর্ক হুইসেল ও চিত্কার-চেঁচামেচি অগ্রাহ্য করে হেলিকপ্টারের দিকে ছুট লাগালাম। ছুটতে ছুটতেই দেখলাম, অফিসার সেনাদের জানিয়ে দিলেন, আমাদের যেন হেনস্তা করা না হয়। লেফটেন্যান্ট কর্নেল সিকলি হেলিকপ্টারের কাচের দরজার ভেতর দিয়ে আমাদের দিকে হাত নাড়ছেন।
যুদ্ধের পদচিহ্ন ধরে
খুলনা, ১৯ ডিসেম্বর
বাংলাদেশের সীমান্তসংলগ্ন গ্রামগুলোয় যুদ্ধের চিহ্ন নেই বললেই চলে। সাবেক পাকিস্তানের কাস্টমস হাউসের জানালা ভাঙা, গাছগুলোতে শেলের আঘাত, বেনাপোল থেকে খুলনা যাওয়ার পথে এটুকুই শুধু কয়েক দিন আগের যুদ্ধের কথা মনে করিয়ে দেয়। বেনাপোল থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে গর্ত খুঁড়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েছিল পাকিস্তানি সেনারা। পাকিস্তানের প্রতিরক্ষার মূল ঘাঁটিই ছিল এটা। কিন্তু মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনী এ জায়গা দিয়ে এ দেশে প্রবেশ করেনি, এই শক্ত ঘাঁটির সঙ্গে সংঘাত এড়িয়ে গেছে। আত্মসমর্পণের পর এখানে সব ধরনের গোলাবারুদ, যুদ্ধ সরঞ্জাম ফেলে গেছে পাকিস্তানিরা।
একটি ফার্মে প্রহরায় ছিল ভারতীয় এক সৈন্য। খুশিতে গদগদ হয়ে সে সাংবাদিকদের খুলে দিল দরজা। এখানে স্তূপ করে রাখা হয়েছে পাকিস্তানি বাহিনীর ফেলে যাওয়া অস্ত্রশস্ত্র। ১০৫ মিমি গোলা, ট্রাক, জিপ, আর্টিলারির বাক্সে মার্কিন ছাপ মারা, পাকিস্তানের জন্য আমেরিকার সামরিক সহযোগিতার চিহ্ন। তার পাশেই মাইনের বাক্স। আর তাতে চীনা অক্ষর, ইয়েরোগ্লিফ। এ যেন প্রতীকী দহরম-মহরম। ওয়াশিংটন ও পিকিং সরাসরি সাহায্য করেছে পাকিস্তানি খুনি সরকারকে। স্বাধীন খুলনার রাস্তায় মানুষ আর মানুষ। এখানে নতুন প্রশাসনের কাউকে যে পেয়ে যাব, এমনটা ভাবা কঠিন। সাংবাদিকদের নিয়ে কয়েকটি গাড়ি গিয়ে থামল একটি দ্বিতল বাড়ির সামনে। সে বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়েছিল গোটা বিশেক শ্মশ্রুমণ্ডিত যুবক। শিকাগো ডেইলি নিউজ-এর প্রতিনিধি বাড়িতে ঢুকেই সাক্ষাত্কার নেওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে পড়লেন। যাঁর সঙ্গে কথা হচ্ছে, তাঁর নাম জানার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি প্রশ্ন করতে শুরু করলেন, ‘কতজন পাকিস্তানি সেনাকে আপনি নিজের হাতে হত্যা করেছেন?’ ‘অস্ত্রগুলো নিয়ে কী করবেন? সরকারকে দিয়ে দেবেন নাকি নিজের কাছে রেখে দেবেন?’
মুক্তিবহিনীর কমান্ডার সাইদ ইসা বিদেশি সাংবাদিককে আনন্দের সঙ্গে বরণ করে নিলেন কিন্তু প্রশ্নগুলোর উত্তর না দিয়ে নিজেই প্রশ্ন করলেন সাংবাদিককে, ‘আপনি কোন পত্রিকার প্রতিনিধিত্ব করছেন?’ আমেরিকান নিজের পরিচয় দিলেন, এরপর তার বন্ধু স্ক্যান্ডানেভিয়ান টেলি এজেন্সির সাংবাদিকেরও পরিচয় দিলেন। সাইদ ইসা ও তাঁর বন্ধুরা কোনো প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে চুপ করে থাকলেন। সাক্ষাত্কার নেওয়া আর হলো না। তখন আমরা বললাম যে আমরা মস্কোর সাংবাদিক, আমরা আপনাদের প্রশ্ন করতে চাই। আকস্মিক এক প্রতিক্রিয়া পেলাম আমরা। ইসা আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন, আলিঙ্গনে আবদ্ধ করলেন। তিনি জানালেন, খুলনা ছেড়ে গিয়ে তিনি তাঁর স্কোয়াডটি খুলনার ১০০ যোদ্ধা নিয়ে এপ্রিলে গঠন করেছিলেন। আপনার কল্পনায় বাংলাদেশকে ঠিক কেমন দেখছেন? আওয়ামী লীগ তাদের ইশতেহারে যে কথা বলেছে, আমরা সেটা সমর্থন করি। নতুন দেশ যে মূলনীতিগুলো নিয়ে চলবে, তা হলো গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা।
ইসা আমাদের দেখাল, কোথায় মুক্তিবাহিনীর আঞ্চলিক অফিস খোলা হয়েছে। সেখানে আমরা একজন কমান্ডারের সঙ্গে পরিচিত হলাম, হুদা তাঁর নাম। তাঁর অধস্তন ব্যক্তিরা তাঁকে ‘মেজর’ বলে ডাকল কিন্তু তাতে হুদা (খন্দকার নাজমুল হুদা, পঁচাত্তরের ৭ নভেম্বর নিহত হন) হাসলেন। ব্যাখ্যা করলেন এই বলে যে এই পদবিটি প্রতীকী অর্থে দেওয়া হয়েছে। যদি কেউ এক হাজার বা তার বেশি যোদ্ধাকে নেতৃত্ব দেন, তাহলে তাঁকে মেজর নামে ডাকা হয়। যোদ্ধারা দুই ধরনের বাহিনী গড়ে তুলেছিল। নিয়মিত বাহিনী (মুক্তিফৌজ), যার কেন্দ্রে ছিল সাবেক পাকিস্তানি সেনারা। ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট ও পদাতিক বাহিনী। আর ছিল অনিয়মিত বাহিনী (মুক্তিবাহিনী), এই দলে যোগ দিতে পারত মুক্তিকামী যেকোনো মানুষ। প্রশিক্ষণের ওপর নির্ভর করত এদের কে কোথায় কাজ করবে। পুরো দেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়েছিল, সেই সেক্টরগুলোর মধ্যে আবার ছিল কিছু উপভাগ। সেক্টর কমান্ডার ও তাঁদের সহযোগীরা ছিলেন নিয়মিত সেনাবাহিনীর সদস্য। হুদা নিজে ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে এবং তাঁর পদবি ছিল ক্যাপ্টেন। বাঙালিদের অসহযোগ আন্দোলন সমর্থন করায় তাঁকে নিরস্ত্র করে ফেলা হয়।
তিনি খুলনায় চলে আসেন এবং এখানকার ছাত্র, শ্রমিক ও কৃষকদের নিয়ে নিজের বাহিনী গড়ে তোলেন। এই দলে এসে যোগ দেন পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সাবেক সদস্যরা। সব মিলে প্রায় ছয় হাজার মানুষ এই দলে যোগ দেন। তারপরও, হুদা খুব ভালো করেই জানতেন, দারুণ দেশপ্রেম থাকলেও ট্যাংক, আর্টিলারি আর বিমানসমৃদ্ধ একটি নিয়মিত বাহিনীর মুখোমুখি হওয়ার মতো যোগ্য নয় তাঁর বাহিনী। এ থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় একটাই, গেরিলা যুদ্ধ। পুরো দলটি কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে গ্রামেগঞ্জে ছড়িয়ে গেল। গ্রামে পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর হামলা চালানো অপেক্ষাকৃত সহজ ছিল, একের পর এক নদী, জলাবদ্ধ ধানের খেত পাকিস্তানিদের আর্টিলারি আর পদাতিক বাহিনীর চলার গতি কঠিন করে দিত। পাকিস্তানি বাহিনী রাস্তা থেকে বেশি দূরত্বে যাওয়ার ঝুঁকি নিত না। তাই প্রতিটি গ্রামই গেরিলাদের জন্য হয়ে উঠেছিল নির্ভয় আশ্রয়স্থল। এলাকা মুক্ত করে মুক্তিবাহিনী স্থানীয় প্রশাসনকে বসিয়ে দেওয়া শুরু করল এবং তা দিনে দিনে বাড়তেই থাকল। সেখানেই স্বেচ্ছাসেবীদের গেরিলা বাহিনীতে যোগ দেওয়ার সুযোগ তৈরি করা হয়েছিল।
মেজরের মতে, ডিসেম্বর মাসে তাঁদের বাহিনীর সদস্যসংখ্যা ৩০ হাজার ছাড়িয়ে গিয়েছিল। যখন ভারতীয় বাহিনী খুলনায় এল, তখন মুক্তিবাহিনী শহরের মধ্যেই আক্রমণ চালানো শুরু করল। আর পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পণ করার পর পুলিশ যে কাজটা করে, সেটাই এখানে করে চলেছে মুক্তিবাহিনী। চশমা চোখে মাঝারি গড়নের হুদাকে কলেজের শিক্ষক হিসেবেই মানাত ভালো, সেনা অফিসার হিসেবে ততটা নয়। তাঁর পরনে ছিল সাধারণ নাগরিকদের মতো প্যান্ট, হাফহাতা শার্ট। সে যে সেনাবাহিনীর লোক, সেটা শুধু বোঝা যাচ্ছিল কোমরে হোলস্টারে গোঁজা পিস্তলের কারণে। আমরা প্রশ্ন করলাম, ‘আপনি তো মনে হয় নিয়মিত সেনাবাহিনীতেই রয়ে যাবেন?’ ‘স্বাধীনতার পর আমি সাংবাদিক হতে চাই। সময় এখনো আছে। আমার তো মাত্র তেত্রিশ বছর বয়স!’
মুক্তিবাহিনীর কেন্দ্রীয় অফিস থেকে বেরিয়ে আমরা গেলাম এবার পৌরসভা ভবনে। বোঝা যাচ্ছিল, নতুন প্রশাসন এরই মধ্যে নিজেদের হাতে লাগাম ধরা শুরু করেছে। আমাদের উত্সুক করেছিল প্রশ্নগুলো, শহরে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা নিশ্চিত করার জন্য প্রশাসন কী করছে, নাগরিকদের প্রাথমিক চাহিদা মেটানোর জন্য প্রশাসন কী করছে? এখানে এসে শিকাগো ডেইলি নিউজ-এর সহকর্মীর সঙ্গে আমাদের বিচ্ছেদ ঘটে। তিনি প্রশাসনের বিভিন্নজনের মধ্যে মতদ্বৈধতা খুঁজতে এবং কোথাও মুক্তিবাহিনী ও নিয়মিত সেনাবাহিনীর মধ্যে কোলাহল হচ্ছে কি না, সে খবর নিতে অন্য কোথাও চলে যান। সমুদ্র পার হয়ে যাওয়া দেশগুলোতে তখন এই ধরনের গুজব খুব করে ছড়িয়ে পড়ছিল।
খুলনার সহকারী কমিশনার কমল সিদ্দিকীর (কামাল সিদ্দিকী—সম্পাদক) ঘরে রাষ্ট্রীয় আঞ্চলিক অফিসের বেশ কয়েকজন কর্মচারীর দেখা মিলল। যশোরের মতোই এখানেও যে প্রশ্নটির সমাধান করতে হচ্ছে তা হলো, কত দ্রুত খাদ্য ও জ্বালানি সরবরাহের ব্যবস্থা করা যায়, কীভাবে ফিরতে থাকা শরণার্থীদের বরণ করে নেওয়া যায়। যাঁরা এখানে এসেছেন, তাঁদের মধ্যে অনেকেই আছেন, যাঁদের পরিবারে ঘটেছে ভয়াবহ নৃশংসতা। একজন অনুরোধ করলেন ভয়াবহ সন্ত্রাসের সময় হারিয়ে যাওয়া মানুষদের খুঁজে বের করতে। অন্যদের কেউ কেউ এসেছেন এই প্রশ্ন নিয়ে, ‘পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তো ঘরদোর সব পুড়িয়ে দিয়েছে, সেই বাড়ি গড়ার আগ পর্যন্ত আবাসনের কী হবে?’
শহর শত্রুমুক্ত হওয়ার পরপরই পাওয়া গেল পাকিস্তানি ও রাজাকারদের চালানো নৃশংসতার নতুন খবর। বধ্যভূমির সৃষ্টি হয়েছে রেডিওস্টেশনের খুব কাছেই। যাঁরা স্বজন হারিয়েছেন, তাঁদের মানসিক অবস্থা কী হতে পারে, তা তো সহজেই বোঝা যায়। খুলনা শত্রুমুক্ত হওয়ার পরপরই খুনের শিকার হওয়া মানুষের স্বজনেরা নিজের হাতে তুলে নিয়েছিল আইন। তারা প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিল। কমল সিদ্দিকী (কামাল সিদ্দিকী) বললেন, ‘আমাদের প্রশাসন খবর পাওয়ার পর থেকেই চেষ্টা করছে এ ধরনের ঘটনা যেন আর না ঘটে, সেটা নিশ্চিত করতে।’ যারা এই হত্যাযজ্ঞ ঘটিয়েছে, অবশ্যই তাদের দাঁড়াতে হবে আদালতের কাঠগড়ায়। বাংলাদেশ সরকার অবাঙালিদের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন হওয়া বা তাদের শোষণ করার বিরুদ্ধে। সংখ্যালঘু উর্দু ভাষাভাষীরা দেশের যেকোনো নাগরিকের মতোই অধিকার ভোগ করবেন।
ঢাকা ক্ষত সেরে উঠছে
ঢাকা, ২২ ডিসেম্বর
ঢাকা শহরটিকে দেখলে সেই মানুষটির কথা মনে পড়ে, যিনি দারুণ এক ট্র্যাজেডির ধকল কাটিয়ে ধীরে ধীরে শরীরে আর মনে শক্তি সঞ্চয় করছেন। অনেক বাড়ির দেয়ালে বন্দুক আর মেশিনগানের গুলির স্মৃতি থাকলেও শহরের প্রান্তভাগ মাইনমুক্ত করা হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসন স্বাভাবিক জীবনযাত্রা নিশ্চিত করার জন্য কঠোর পরিশ্রম করে চলেছে। শহরের প্রশাসনের প্রথম দায়িত্ব নাগরিকদের জন্য খাদ্যের ব্যবস্থা করা। পুরোনো ঢাকায়, যেখানে ব্যবসা চলত তুমুলভাবে, সেখানে এখনো ব্যবসায়ীরা ব্যবসা শুরু করতে পারেননি। তাঁরা ভালো সময়ের জন্য অপেক্ষা করছেন। কিন্তু সেখানে বাজারগুলো খুলে গেছে। আছে প্রচুর চাল আর সবজির সরবরাহ, এগুলোই বাঙালির মূল খাদ্য। আমাদের জানানো হলো, গ্রাম থেকে শহরে খাদ্য সরবরাহ বাড়ছে। যে কৃষকেরা শহরে পণ্য নিয়ে আসতে ভয় পেতেন, তাঁরা সেই ভয় কাটিয়ে উঠেছেন, বাজারে আসছেন মাল নিয়ে। কিন্তু এটা পরিষ্কার, সরবরাহব্যবস্থা খুব দ্রুত আয়ত্তে আনা যাবে না। আরও কিছু সময় যাবে, ভেঙে যাওয়া সেতু মেরামত করতে, রেল রাস্তা আর রাজপথ মেরামত করতে। ঢাকার সঙ্গে দেশের অন্য অংশকে এগুলোই বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। ফলে আপাতত নৌপথই সরবরাহব্যবস্থার মূল শক্তি হিসেবে কাজ করছে।
বুড়িগঙ্গা নদীর ঘাটে এসে প্রতিমুহূর্তে লাগছে কোনো না কোনো নৌযান। কখনো তা ভারী বার্জ, কখনো ত্রিকোণ পালতোলা সাম্পান, কখনো মালসমেত ট্রলার, কখনো ছোট ছোট নৌকা, যা ব্যবহূত হচ্ছে ঘাট পারাপারে। দারুণ হাসিতে চারপাশ ভরিয়ে দিয়ে বৈঠায় হাত দিচ্ছেন খেয়ানৌকার মাঝি। পন্টুন আর বিশ্রামকক্ষে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। সেনানিবাসেও নিয়মানুবর্তিতা ফিরে এসেছে। ঢোকার মুখে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সদস্যরা রয়েছেন সশস্ত্র প্রহরায়। পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দীরা ক্যান্টনমেন্টের সে জায়গাগুলোতেই আছে, যেখানে আগে ছিল। এই যুদ্ধশহরে সেনাবাহিনীর লোকজনের পাশে সিভিল প্রশাসনের লোকজনদেরও দেখা যাচ্ছে। শহরে এরই মধ্যে বিদ্যুত্ব্যবস্থা ও পানি সরবরাহব্যবস্থা চালু হয়েছে। কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনীর নির্দেশে টেলিসংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর থেকে এখনো তা পুনঃস্থাপিত হয়নি। ফলে আমরা বিদেশি সাংবাদিকেরা পড়েছি সমস্যায়, এখান থেকে আমাদের সংবাদ ভারতীয় যুদ্ধবিমানে করে কলকাতায় আমাদের এজেন্সির কাছে পাঠাচ্ছি। তারা সেটা প্রচার করছে। ঢাকা এয়ারপোর্টের রানওয়ে মেরামত করার কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে, বোমা হামলায় তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।
দেশের সামনে এখন শুধু অর্থনৈতিক সংকট নয়। সংকট রাজনৈতিকও। বাংলাদেশ এরই মধ্যে স্বাধিকার আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী বিশেষজ্ঞদের সরকারি চাকরিতে নিয়োগ দিচ্ছে। সে রকমই একজন সরকারি কর্মকর্তা কাদেরকে পেলাম আমরা। সামনের সংকটের ব্যাপারটা কাদের (এম নূরুল কাদের) মোটেই আড়াল করলেন না। ‘লক্ষ লক্ষ শরণার্থীকে ফিরিয়ে আনা আমাদের সামনে একটা বড় কাজ। তাদের ফেরার জন্য পরিবহন, খাওয়ার জন্য খাবার এবং অস্থায়ীভাবে থাকার জন্য ঘর দরকার। আমাদের প্রথম কাজই হবে এই বিষয়টির দিকে নজর দেওয়া। আমার বিশ্বাস, দেশের মানুষের, বিশেষ করে তরুণদের সক্রিয় সহযোগিতায় আমরা এই কাজটি করতে পারব’ বললেন কাদের। সন্ধ্যাবেলায় মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা ঢাকার রাজপথ টহল দেন। তাঁদের কাজ হচ্ছে সন্ত্রাসীদের হাত থেকে নাগরিকদের রক্ষা করা। এই সন্ত্রাসীরা এখনো অস্ত্র হাতে পুলিশের চোখ এড়িয়ে ঘাপটি মেরে আছে কোথাও না কোথাও।
গানের ফিরে আসা
ঢাকা, ২৩ ডিসেম্বর
করিমুল আলমের ভাবুক চোখ, যুবকের মতো কণ্ঠস্বর। খুবই সাধারণ পোশাক তাঁর। চকরাবকরা টি-শার্ট আর সুতির প্যান্ট। তিনি আমাদের সামনে বসে আছেন এবং বিচিত্র নামে একটি সুরযন্ত্র বাজাচ্ছেন, এটি একটি তারের বাদ্যযন্ত্র।
আমার সোনার বাংলা
আমি তোমায় ভালোবাসি
এটা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা গান। এখন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত। শেষবারের মতো এই গান গাওয়া হয়েছে নয় মাস আগে, মিছিল আর অসহযোগ আন্দোলনের সময়। এরপর গানটি গাওয়ার কোনো উপায় ছিল না। বিষয়টি করিমুল আলমের চেয়ে কে আর বেশি জানে! করিমুল স্মৃতিচারণা করেন, ‘২৫ মার্চ রাতে বন্ধুদের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে ছিলাম। গুলির আওয়াজে রাতের ঘুম ভেঙে গেল আমাদের। আমরা জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম এবং বুঝতে পারলাম, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ করে বাঙালিদের ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। গোলাগুলি চলতেই থাকল শেষ রাত অবধি। কেউই বুঝতে পারছিল না, কী ঘটছিল শহরে। কিন্তু দেখা যাচ্ছিল শহরের রাস্তাজুড়ে কেবল সৈন্য আর সৈন্য। দুপুরের দিকে সেনাবাহিনী আমাদের হল ঘেরাও করল। এরপর আমরা করিডরে ভারী বুটের আওয়াজ, পাশের ঘরে দরজায় খটখট, বাঁচার জন্য প্রার্থনা এবং গুলি শুনতে পেলাম।’ ‘সময়টা ছিল ভয়াবহ। আমাদের মনে কোনো সন্দেহই ছিল না, কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা আমাদের ঘর পর্যন্ত আসবে। সৈন্যরা আমাদের ঘরের দরজা ধাক্কাল। আমি দরজা খুলে দিলাম। তাঁরা দেয়ালের সামনে আমাদের সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়াতে বলল। তারপর আমাদের দিকে বন্দুক তাক করল। এরপর কী ঘটল তা কুয়াশার মতো মনে আছে। আমি মেঝেতে পড়ে গিয়েছিলাম, পাশে আমার বন্ধুরা। আমি মরে গেছি, এমন ভাব করে নিথর শুয়ে রইলাম।’
করিমুলের কথা এগিয়ে নিয়ে যান মনজুরুল। ‘বিকেল পর্যন্ত করিমুল শুয়ে থাকে সেখানে। সন্ধ্যা হওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়াল টপকে বেরিয়ে আসে করিমুল। গোলাগুলিতে ধ্বংস হয়ে যাওয়া একটি বাড়ির সামনে এসে পড়ে যায়। সেখানেই আমরা ওকে খুঁজে পাই। ডাক্তারদের পক্ষে ওকে হাসপাতালে ধরে রাখা সম্ভব হয়নি, একজন স্বজনের বাড়িতে ও লুকিয়ে থাকে।’ আলম তাঁর শরীরের কোথায় গুলি লেগেছিল, তা আমাদের দেখান। ঘাড়ের নিচে গুলিটা ঢুকেছিল, অল্পের জন্য ফুসফুসে স্পর্শ না করে বেরিয়ে গিয়েছিল গুলিটা। ভাগ্য ভালো বলেই বেঁচে গিয়েছিলেন তিনি। সামরিক জান্তা ভেবেছিল এই সন্ত্রাস স্বাধিকার আন্দোলনকে দমিয়ে দেবে। কিন্তু হলো ঠিক তার উল্টো। ছাত্র, শ্রমিকেরা শহর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল, যোগ দিল গেরিলা বাহিনীতে। পাকিস্তানের ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের সাবেক সেনাদের অধীনে লোকালয় থেকে দূরে গড়ে উঠছিল গেরিলা বাহিনী। আঠারো-বাইশের তরুণেরাই ছিল এই বাহিনীর প্রাণ। ভাবুক, সংগীতে নিমজ্জিত, কবিতায় আচ্ছন্ন করিমুল আলমও অস্ত্র হাতে নিলেন। যুদ্ধ কী, তা তিনি জানতেন না।
পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করেছে যারা, তাদের মধ্যে তরুণেরাই সবদিক থেকে এগিয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে এসে এরা ডেরা গেড়েছে, প্রতিমুহূর্তেই এদের কেউ না কেউ ছুটছে মিটিংয়ে, বিতর্কে। তারা নিজের ভূখণ্ডের মালিক হয়েছে। ভবিষ্যতেও মালিক থাকবে। আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের কার্যালয়ে গেলাম। হলের সামনের সবুজ চত্বরে অসংখ্য মানুষ। শোনা গেল, আগামীকাল ছাত্র ইউনিয়নের যে মিছিল হবে, তারই প্রস্তুতি চলছে এখন। এই মিছিলের নেতৃত্ব দেবেন যাঁরা, তাঁরা ঝুঁকে পড়ে দেশের মানচিত্র দেখছেন। কোন রাস্তা দিয়ে কোন দিকে মিছিলটি এগোবে তা ঠিক করার জন্যই এই আয়োজন। ব্ল্যাকবোর্ডে চক দিয়ে লেখা, ‘স্বাধীন বাংলাদেশের জয়’। দীর্ঘাঙ্গী, শুকনো যুবক, ছাত্র ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট নুরুল ইসলাম (নুরুল ইসলাম নাহিদ, বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী) করমর্দনের জন্য আমাদের দিকে হাত বাড়িয়ে দেন। ‘আমাদের কাছের লক্ষ্য দেশের স্বাধীনতা, সে লক্ষ্য পূরণ হয়েছে। কিন্তু সংগ্রাম এখনো চলছে। শহরে এখনো পাকিস্তানিদের দোসরেরা রয়েছে, রয়েছে মার্কিন এজেন্টরা। আমাদের দল আহ্বান জানাচ্ছে গণতান্ত্রিক এই আন্দোলনকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ও চীনা নেতৃত্বের বিরুদ্ধে পরিচালিত করতে। আমরা সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বের বন্ধন দৃঢ় করতে চাই। এই স্লোগান নিয়েই আমাদের মিছিল হবে কাল।’ বললেন নূরুল ইসলাম।
ফিরে এলেন মুজিবুর রহমান
ঢাকা, ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সাল
যে দিনটির জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল বাংলাদেশের জনগণ, সে দিনটি এল। সারা বিশ্বের সংবাদমাধ্যম ছড়িয়ে দিল সর্বত্র এ খবর: শেখ মুক্তি পেয়েছেন, এখন তিনি পাকিস্তান এয়ারলাইনসের একটি প্লেনে, তাঁর গন্তব্য লন্ডন। পূর্ব বাংলার নেতা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত জানতেন না প্লেনটা তাঁকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছে। তিনি দাবি করেছিলেন, সবচেয়ে কম সময়ের মধ্যে নিজের দেশে ফিরে যেতে। কিন্তু পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিল না। ভারত এই দায়িত্বটা নিতে চাইছিল কিন্তু পাকিস্তান তা বাতিল করে দিয়েছিল। আপস ফর্মুলা হিসেবে তারা দুই দেশ শরণাপন্ন হয়েছিল ইংল্যান্ড সরকারের। ১০ জানুয়ারি সকাল থেকেই বিমানবন্দরের দিকে বয়ে যাচ্ছিল মানুষের স্রোত। এয়ারপোর্ট থেকে রেসকোর্স পর্যন্ত পুরো পথই লোকে লোকারণ্য। রেসকোর্সেই ভাষণ দেবেন শেখ মুজিবুর রহমান। এখানেই ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ মুজিব ভাষণ দিয়েছিলেন, চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিলেন পাকিস্তানের সামরিক শাসককে, জাতির অধিকার আদায়ের মরিয়া সংগ্রামের ডাক দিয়েছিলেন। নয় মাসের ব্যবধানে এখানেই দখলদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছিল।
পুরো রাজপথই উত্সবমুখর। জাতীয় পতাকা টানানো হয়েছে সর্বত্র। বেজে চলেছে অর্কেস্ট্রা। কখন তিনি এসে পৌঁছাবেন, তার নির্দিষ্ট সময় কারও জানা ছিল না: মুজিবুর রহমান দিল্লিতে নেমেছেন। সেখানে তিনি ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন এবং জনসভায় ভাষণ দিয়েছেন। এই তো আকাশে দেখা যাচ্ছে চার ইঞ্জিনের প্লেন, ব্যাপক ক্ষতির শিকার হওয়া ঢাকা এয়ারপোর্ট মেরামত করার পর এই প্রথম কোনো বড় বিমান নামছে এখানে। প্লেন থামতেই প্রটোকল গেল কোথায় ভেসে! মুজিব প্লেন থেকে বেরিয়ে আসতেই পুলিশ কর্ডন ভেঙে জনস্রোত এগিয়ে গেল তাঁর দিকে। মুহূর্তের মধ্যেই মুজিব বন্দী হলেন জনমানুষের হাতে। শেখ মুজিব ও তাঁর সতীর্থরা লাল ও আকাশি রঙে রং করা একটি খোলা ট্রাকে উঠে এলেন। আরও অনেক বাস, ট্রাক, গাড়িতে চড়ে বসলেন রাজনৈতিক নেতা, নতুন প্রশাসনের কর্মকর্তা, ছাত্রনেতা, ট্রেড ইউনিয়ন নেতা ও মুক্তিবাহিনীর কমান্ডাররা। এই বিশাল মিছিলটিকে সঙ্গ দিচ্ছিল ঢোলের বাড়ি, স্লোগান, গলা ছেড়ে গান। যে পথ অনায়াসে ২০ মিনিটে পাড়ি দেওয়া যায়, তা পার হতে লাগল কয়েক ঘণ্টা!
রেসকোর্স ময়দানে স্বাধীন প্রজাতন্ত্রের নাগরিকদের সামনে শেখের প্রথম বক্তৃতা। স্বাধিকার আন্দোলনের সময় সংগ্রাম ও আত্মাহুতির কথা স্মরণ করে কথা বলতে গিয়ে তিনি চোখের জলে ভাসলেন, কান্নার আবেগে কিছুক্ষণ নীরব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। মুজিবুর রহমান ঘোষণা করলেন, নতুন এই প্রজাতন্ত্র শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও জোটনিরপেক্ষ থাকবে, রাষ্ট্রের মূলমন্ত্র হবে গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতা ও সমাজতন্ত্র। স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে অবস্থান করার জন্য তিনি হূদয়ের অন্তস্তল থেকে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানালেন। এই স্মরণীয় দিনটিতে বাংলাদেশ টেলিভিশন সোভিয়েত ইউনিয়নের চলচ্চিত্র ‘আলেক্সান্দর পারখোমেনকো’ প্রদর্শন করে।
তথ্যের খোঁজে
ঢাকা, ১২ জানুয়ারি
দেশের অবস্থা সম্পর্কে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পাব কোথায়? সারা পৃথিবী থেকে বাংলাদেশে এসে জড়ো হওয়া সাংবাদিকদের কাছ থেকে এই প্রশ্ন শুনতে শুনতে হিমশিম খেয়ে গেল সরকারের গণমাধ্যমবিষয়ক বিভাগ। তারা খুব একটা সহযোগিতা করার মতো অবস্থায় ছিল না। যুদ্ধের আগে যাঁরা সেনা শাসনের সময় মিডিয়ার এই কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাঁদের নতুন সরকার বিশ্বাস করতে পারছিল না। ফলে বিদেশি সাংবাদিকদের জিজ্ঞাসার খোরাক মেটায়, তাদের কাছে এমন কোনো গ্রহণযোগ্য কোনো তথ্যই ছিল না। সংবাদকর্মীরা নিজেদের মতো করেই একটা ‘পুল’ তৈরি করে নিল। যে যেখানে যাচ্ছে, সেখানে যা ঘটছে, তা সবাই মিলে আলোচনা করে নিচ্ছে। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে প্রতি সন্ধ্যায় বসতাম, সারা দিন ধরে যে যা পেয়েছে, সেই তথ্য একে অন্যকে জানাতাম। নানা ধরনের সাংবাদিকের মিলনমেলা ছিল সেটা। সেখানে দেখা যেত পশ্চিমা বিশ্বে আলোড়ন তোলা স্যুট পরিহিত পক্বকেশ সাংবাদিককে, যিনি চলতেন সেক্রেটারি নিয়ে। দেখা যেত বাবরি চুল মাথায় জিনস-শার্ট পরা বছর বাইশের ফরাসি টেলিসাংবাদিককে। হোটেলের হলরুমে দেখা যেত মাথা কামানো সুস্বাস্থ্যের অধিকারী, খেলোয়াড়ি দেহের অধিকারী একদল মানুষকে, যারা নিজেদের পরিচয় দিত পশ্চিম ইউরোপ অথবা যুক্তরাষ্ট্রের বেসরকারি সাহায্য সংস্থার লোক বলে। তারা বলত, উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সাহায্য করাই তাদের কাজ।
দিল্লিতে পরিচয় হওয়া এক অস্ট্রেলীয় সাংবাদিক একদিন ওই লোকগুলোর একজনকে দেখিয়ে বললেন, ‘রেডক্রসের পরিচয়ে এসেছে এরা, কিন্তু আমি সাইগনে মার্কিন সেনাদের শিবিরে একে দেখেছি।’ ঢাকা শত্রুমুক্ত হওয়ার দিন দশেক পর আমাদের পক্ষে কাজ করা সহজ হয়ে গেল। ঢাকা থেকে কয়েকটি বাংলা ও ইংরেজি পত্রিকা প্রকাশিত হওয়া শুরু হলো। ছোট, চার পৃষ্ঠার সে পত্রিকা। সে চার পৃষ্ঠার মধ্যেই দেশ-বিদেশের গুরুত্বপূর্ণ খবরগুলো তারা ছাপা শুরু করল। বাংলাদেশের সাংবাদিকদের জন্য পত্রিকা প্রকাশ করা ছিল খুব বড় অর্জন। মনে রাখা দরকার, পাকিস্তান প্রশাসন কড়া নজরদারির মাধ্যমে গণমাধ্যমের অধিকার খর্ব করে রেখেছিল, সে সময় মূলত যারা কাজ করত, তারা ছিল প্রশাসনের কাছের লোক (স্বাধীনতার পর তারা গা-ঢাকা দিয়েছিল)। প্রগতিশীল পত্রিকাগুলোর কণ্ঠ রোধ করা হয়েছিল। ২৬ মার্চ রাতে পাকিস্তানিরা ইত্তেফাক ভবন পুড়িয়ে দিয়েছিল। ইত্তেফাক আওয়ামী লীগের পক্ষে প্রচারণা চালাত। সেদিন বেশ কয়েকজন সংবাদপত্রকর্মী অফিসে নিহত হয়েছিলেন। বামপন্থী পত্রিকা সংবাদও পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। ইত্তেফাক এখনো প্রকাশিত হয়নি, তবে সংবাদ-এর প্রথম সংখ্যা জানুয়ারির শুরুতেই প্রকাশিত হওয়া শুরু হয়েছে। অর্ধ ভগ্ন অফিসের টিকে থাকা কয়েকটি ঘরেই কোনোভাবে কাজ করে তাঁরা পত্রিকাটি বের করছেন।
‘গত বছরের মার্চ মাসে আমাদের পত্রিকার ৭০ শতাংশ কর্মীই গেরিলা বাহিনীতে নাম লিখিয়েছিল’ বললেন সম্পাদক আহমদুল কবীর। ‘দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই তারা ফিরে এসে যে যার কাজে লেগে পড়েছে। অনেক সংকটের মধ্য দিয়ে আমাদের যেতে হচ্ছে। কিন্তু সাংবাদিক, সংবাদদাতা, প্রেসের শ্রমিকদের দুর্দমনীয় আকাঙ্ক্ষা না থাকলে পত্রিকা বের করা সম্ভব হতো না। আমরা পত্রিকার সার্কুলেশন বা প্রচার বাড়ানোর কথা ভাবছি। পত্রিকার পেশাদারি মান আরও উঁচুতে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি। সব সময়ই আমাদের অবস্থান প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে। আমরা সব সময়ই গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের পক্ষে।
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখাসাক্ষাত্
ঢাকা, ১৬ জানুয়ারি
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আসা সাংবাদিকেরা শেখ মুজিবুর রহমানের একটা সাক্ষাত্কার পাওয়ার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু রেসকোর্স ময়দানে বক্তৃতা করার পর সাংবাদিকেরা আর তাঁকে দেখেননি। ১১ ও ১২ জানুয়ারি শোনা গেল শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর দলীয় নেতাদের নিয়ে একের পর এক বৈঠক করে যাচ্ছেন। শেষ পর্যন্ত ১৩ জানুয়ারি জানা গেল, তিনি নতুন মন্ত্রিপরিষদ গঠন করে ফেলেছেন, এ দিনই সেই মন্ত্রিপরিষদের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান। ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে যখন আওয়ামী লীগের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা স্বাধীন বাংলাদেশের ঘোষণা দিয়ে সরকার গঠন করলেন, তখন দেশটা ছিল পাকিস্তান বাহিনীর দখলে আর দলীয় প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন পাকিস্তানের কারাগারে। শেখ মুজিবুর রহমানের নাম দেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ হন প্রধানমন্ত্রী। আওয়ামী লীগের সহসভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম হন দেশের উপ-রাষ্ট্রপতি, শেখ মুজিবুর রহমানের অবর্তমানে তিনি অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন।
শেখ মুজিবুর রহমান দেশে ফিরে আসার পর পদগুলোর পুনর্বিন্যাস হয়। ক্ষমতাসীন দল সিদ্ধান্ত নিয়েছিল রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারের জায়গায় সংসদীয় গণতন্ত্র চালু করবে, আর তাতে ক্ষমতা থাকবে সরকারপ্রধানের হাতে, তাই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ঘোষণা করা হলো শেখ মুজিবুর রহমানের নাম (তাঁর হাতে থাকল প্রতিরক্ষা ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়)। দেশের রাষ্ট্রপতি হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আবু সাঈদ চৌধুরী। শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সতীর্থ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ ও আবদুস সামাদ আজাদ পেলেন যথাক্রমে শিল্প ও বাণিজ্য, অর্থ আর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান হলো সাবেক গভর্নর হাউসে, এখন যা রাষ্ট্রপতি ভবন। ভবনটি যুদ্ধের সময় যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। দেয়ালে দেয়ালে বন্দুক আর মেশিনগানের আঘাতের চিহ্ন দৃশ্যমান। জানালার কাচ ভাঙা, ঘরের আসবাবও ক্ষতির হাত থেকে রেহাই পায়নি। মাস খানেক শূন্য থাকার পর আবার এই ভবনে মানুষের আনাগোনা। ভবনের একটি বিশাল হলে এসে জড়ো হয়েছিলেন জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের বড় নেতারা, কূটনীতিকেরা আর অনেক সাংবাদিক। মধ্যযুগের আদলে প্রধান বিচারপতির পোশাক, তিনি মাথায় পরেছেন পরচুলা। প্রধানমন্ত্রীকে তিনি শপথ পাঠ করালেন।
১৪ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী একটি সংবাদ সম্মেলন ডেকে নতুন রাষ্ট্রের মূলনীতিগুলো ঘোষণা করেছেন। এর পরদিন তিনি বাছাই করা পত্রিকা, রেডিও ও টেলিভিশনের কয়েকজন সাংবাদিককে তাঁর সাক্ষাত্কার নেওয়ার অনুমতি দিয়েছেন। দ্বিতল পাথরের ভবন, আছে টেনিস কোর্ট, গোলাপ বাগান। সামনে পতপত করে উড়ছে জাতীয় পতাকা। এটি প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসস্থান। আগে এটি ছিল প্রেসিডেন্ট ভবন। এখানেই ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের বৈঠকগুলো হয়েছিল। আকস্মিকভাবেই সে আলোচনা ভেস্তে গিয়েছিল। অভ্যর্থনা কক্ষ লোকে লোকারণ্য। প্রধানমন্ত্রীর কক্ষের সামনে তাঁর প্রেসসচিব আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন। ‘অনুরোধ করছি, দয়া করে ১৫ মিনিটের বেশি সময় নেবেন না’ প্রধানমন্ত্রীর কক্ষের দরজা খুলে দিয়ে আমাদের কানে কানে ফিসফিস করে তিনি বললেন। বিশাল ঘরের এক কোণের বিশাল টেবিলের ওপার থেকে আমাদের অভ্যর্থনা জানাতে উঠে দাঁড়ালেন সেই দীর্ঘাঙ্গী, বছর পঞ্চাশের চশমা পরা মানুষটি, যাকে বহু ছবিতে দেখেছি। কাঁচাপাকা চুল, কাঁচাপাকা গোঁফ, ক্ষুরধার অবয়ব।
মুজিবুর রহমানকে দেখলেই মনে হয়, রাজনীতিবিদ হয়েই বুঝি তিনি জন্মেছেন: চলাচলের মধ্যে রয়েছে দৃঢ়তা, কণ্ঠস্বর ঋজু, দৃষ্টি গভীর। মুজিবুর রহমান সব সময় একধরনের পোশাক পরেন। জাতীয় পোশাক। সাদা প্যান্ট আর কলারবিহীন সাদা শার্ট (পায়জামা, পাঞ্জাবি—অনুবাদক)। এর ওপরে পরেন কালো হাতাবিহীন কোট, যা এরই মধ্যে ‘মুজিব কোট’ নামে পরিচিতি পেয়েছে। তিনি অ্যালকোহলযুক্ত পানীয় পান করেন না, সরকারি পার্টিতেও তা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবে তিনি ধূমপায়ী, মুহূর্তের জন্যও ধূমপানের পাইপকে হাতছাড়া করেন না।
আমরা ছোট একটি টেবিলের চারপাশে বসলাম। মুজিবুর রহমানই কথা বলতে শুরু করলেন। ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর জন্য সবার আগে আমি সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি, দেশটির নেতাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। জাতির কঠিন দিনগুলোয় সোভিয়েত ইউনিয়নের এই সহযোগিতার কথা বাংলাদেশের জনগণ কখনোই ভুলে যাবে না। যৌবনে আমি আপনাদের দেশের ইতিহাস নিয়ে অনেক বই পড়েছি। রুশ বিপ্লবীদের কথা পড়েছি, যাদের জার নির্বাসনে পাঠিয়ে দিত সাইবেরিয়ায়। পাকিস্তানের কারাগারে থাকাকালীন আমি বারবার তাদের কথা ভেবেছি এবং বিশ্বাস করেছি রাশিয়া যেভাবে মুক্ত হয়েছে, সেভাবেই আমাদের দেশে স্বাধীনতা আসতে আর দেরি নেই।’
২৬ মার্চের পর থেকেই পূর্ব বাংলার নেতার ভাগ্যে কী ঘটেছে, তা নিয়ে সারা পৃথিবীর গণমাধ্যমে একে অন্যের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ নানা ধরনের খবর বেরিয়েছে। আমরা শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে সে দিনগুলোর ব্যাপারে জানতে চাইলাম। ‘সামরিক স্বৈরাচার কী করতে পারে, সে ব্যাপারে আমাদের একটা ধারণা ছিল।’ শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতিচারণা করেন, ‘আমার নির্দেশে আওয়ামী লীগের নেতারা আত্মগোপন করে। আমি বাড়িতেই থাকলাম। আমার বাড়িটা দিনরাত ২৪ ঘণ্টাই ছিল পাকিস্তানি গোয়েন্দাদের নজরে। আমাদের কাছে খবর ছিল, শত্রুরা আমার জীবনের ওপর হামলা চালাবে এবং দোষটা চাপিয়ে দেবে চরমপন্থী বামদের ওপর। নৃশংস হামলা চালানোর জন্য এই ঘটনাকে ব্যবহার করবে সামরিক জান্তা। রাতে আমার বাড়িতে ট্রাকে করে এল কমান্ডোরা। গুলি করতে করতে তারা আমার বাড়ির ভেতর ঢুকল। আমি বেরিয়ে এসে বললাম, ‘আমাকে যদি নিতে এসে থাক, তাহলে আমাকে গ্রেপ্তার করো কিন্তু তার আগে গোলাগুলি বন্ধ করো।’
মুজিবুর রহমানকে ১ এপ্রিল পর্যন্ত রাখা হয়েছিল ঢাকা সেনানিবাসে, এরপর গোপনে তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় পশ্চিম পাঞ্জাবের মরুভূমিতে তৈরি জেলখানায়। বাইরের পৃথিবীর কিছুই তাঁকে জানতে দেওয়া হতো না, এমনকি পত্রিকা পড়া বা চিঠি পাওয়ার অধিকারও কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। ইয়াহিয়া খান যখন পদত্যাগ করতে বাধ্য হলেন এবং ভুট্টো হলেন প্রেসিডেন্ট, তখন ভুট্টো বাঙালির নেতার কাছে গিয়েছিলেন এবং তাঁকে বোঝাতে চেষ্টা করেছেন কেন অখণ্ড পাকিস্তান ধরে রাখা দরকার। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান দৃঢ়কণ্ঠে বলেছেন, তিনি শুধু দেশে ফিরে যাওয়ার পর এবং দলের নেতাদের সঙ্গে কথা বলেই এ ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নেবেন। দেশে ফিরে শেখ মুজিবুর রহমান বুঝলেন যে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান আর জোড়া লাগার নয়: স্বাধীনতাযুদ্ধে অসংখ্য দেশপ্রেমী বাঙালি প্রাণ দিয়েছে। নবীন দেশটির মূলনীতি কী হবে, তা জানতে চাইলাম আমরা শেখের কাছে। ‘আন্তর্জাতিকভাবে আমরা জোটনিরপেক্ষ থাকব, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকবে সব দেশের সঙ্গে। অভ্যন্তরীণ লক্ষ্য: দেশ বিকশিত হবে সমাজতান্ত্রিক পথ ধরে। তবে এটা সত্য যে আমাদের সব সমস্যা আমরা খুব দ্রুত সমাধান করে উঠতে পারব না। তাই রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানা, ব্যাংক, বিমা কোম্পানির পাশাপাশি বেসরকারি খাতও কাজ করবে। একচেটিয়া মনোভাবকে আমরা প্রশ্রয় দেব না। ‘আমার মনে হয়, সরকারি, বেসরকারি সবখানেই শ্রমিকদের প্রতিনিধিরাই কারখানার নেতৃত্ব দেবে।’ বললেন শেখ মুজিবুর রহমান। ‘কৃষি খাতের দিকে আমাদের সরকার গভীর মনোযোগ দিচ্ছে। অনেক কৃষকই ভূমিহীন। আমরা কৃষকদের মধ্যে খাসজমি বণ্টন করার কথা ভাবছি। ধীরে ধীরে গ্রামে যৌথ খামার বা সমবায়ভিত্তিক অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করব, তাদের ঋণ দেব। প্রতিবছর বন্যার সময় কৃষকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আমরা উন্নতমানের সেচব্যবস্থার জন্ম দেব। ক্ষতি সামলে নিতে পারলে জমিতে ফসল হবে এবং তা দেশের চাহিদা পূরণ করবে। এই লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়ার জন্য আমরা দেশের জনগণ ও অন্যান্য প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলের সহযোগিতা নেব।’
কে পাঠাল খুনিদের?
ঢাকা, ১৮ জানুয়ারি-২২ মার্চ
ছাইরঙা পাথরের দেয়ালের পাশাপাশি দেড় মানুষ উঁচু তারকাঁটার বেড়া। দরজার ওপর ঝুলছে ‘শারীরিক শিক্ষা ইনস্টিটিউট’। মাঠের পেছনে দেখা যাচ্ছে কয়েকটি দ্বিতল ও তিনতলা ভবন। এগুলো হলো ক্লাসঘর ও হোস্টেল। ছাদে বালুর বস্তা দিয়ে আগ্নেয়াস্ত্র রাখার ব্যবস্থা। মাঠে বাস্কেটবল খেলার জায়গাটিতে ক্ষতচিহ্ন। ‘আপনারা কারা?’ আমরা সোভিয়েত সাংবাদিক এ কথা শুনে এই অপরিচিত মানুষটি বাড়িয়ে দেন হাত। ‘আপনারা আমাদের বন্ধু। আপনাদের জন্য আমাদের দরজা সব সময় খোলা’ বললেন তিনি। এই ভদ্রলোকের নাম খান মজলিশ। তিনি এই ইনস্টিটিউটের পরিচালক। এই ইনস্টিটিউটটি একাত্তর সালের ঢাকার সবচেয়ে নৃশংস কার্যাবলির সাক্ষ্য বহন করছে। এখানে উগ্র ডানপন্থী ধর্মান্ধ সংগঠন ‘আলবদর’-এর অফিস ছিল। ‘সেপ্টেম্বর মাসের শুরুতে আলবদর বাহিনী এই ইনস্টিটিউট দখল করে নেয়। ওদের সহজেই চেনা যেত। ওরা একধরনের খাকি পোশাক পরত, সবার মুখে ছিল দাড়ি, তারা মনে করত এটা সাচ্চা মুসলমান হওয়ার নিশানা। তাদের হাতে সব সময়ই থাকত চীনের তৈরি আগ্নেয়াস্ত্র। তারা এখানকার ছাত্র, শিক্ষক, কর্মচারীদের বের করে দিয়েছিল। আমাকেও বের করে দিয়েছিল। আমি এই ইনস্টিটিউটের খুব কাছেই একটি বাড়ি ভাড়া করেছিলাম। আর তাই এই ইনস্টিটিউটের ভেতরে সে সময় কী ঘটেছিল, তা দেখতে পেয়েছি। আমি ছিলাম ওই নৃশংসতার প্রত্যক্ষদর্শী।’
পরিচালক আমাদের নিয়ে গেলেন জিমন্যাস্টিক হলে। ছিমছাম গোছানো বাস্কেট বলের কোর্ট দেখে কে বলবে কিছুদিন আগেই এখানেই ছিল নির্যাতন কক্ষ? কিন্তু সেটাই সত্য। গত কয়েক মাস এটা ছিল নির্যাতন শিবির। প্রতিদিন বাঙালিদের গ্রেপ্তার করে এখানে নিয়ে আসা হতো। ‘মূলত রাতের আঁধারে নির্যাতন করা হতো।’ খান মজলিশ বলে যান, ‘আমরা চিত্কার আর কান্নার আওয়াজ শুনতে পেতাম। গুলির আওয়াজও শুনতে পাওয়া যেত। ঢাকা শত্রুমুক্ত হওয়ার পর আমরা যখন প্রথম এখানে এলাম, তখন পুরো মেঝেতে বয়ে যাচ্ছিল রক্তস্রোত।’ জেরা করা হতো ছেলেদের হোস্টেলে, ফুটবল মাঠের বিপরীত দিকে যার অবস্থান। কয়েকজন শ্রমিক ছোট একটি গর্ত খুঁড়ছিল, হঠাত্ শক্ত কী যেন লাগল তাদের কোদালে। মানুষের মাথার খুলি। খুব বেশি অবাক হলো না শ্রমিকেরা। তারা সবুজ ঘাসের ওপর এনে রাখল নরমুণ্ডুটি। এ রকম ‘আবিষ্কার’ নতুন নয়। সাধারণত আলবদরেরা মানুষকে রায়েরবাজারের ইটখোলায় নিয়ে হত্যা করত। ইনস্টিটিউট থেকে তারা খুব বেশি দূরে অবস্থিত নয়। যারা নির্যাতনের সময় মরে যেত, তাদের এখানেই গর্ত করে পুঁতে ফেলত।
ধরে আনার আগে আলবদরেরা নির্দিষ্ট ব্যক্তির ঠিকানায় চিঠি পাঠাত। মিউনিসিপ্যাল করপোরেশনের কর্মকর্তা তাজুল ইসলামের কাছে লেখা তেমন একটি চিঠি: ‘আমাদের লোকেরা তোমার দিকে নজর রেখেছে। তারা জেনেছে, তুমি এখনো তোমার কুকর্ম থেকে সরে আসোনি, ভারতীয় আর তথাকথিত বাংলাদেশ রেডিও শুনে গুজব ছড়াচ্ছ, সরকারবিরোধী কাজ করেই চলেছ। তোমাকে সতর্ক করে দিচ্ছি, এখনই এসব বন্ধ করো। আমাদের নির্দেশ যদি অগ্রাহ্য করো, তোমার জীবন আর তোমার সম্পদ ঝুঁকিতে পড়ে যাবে। মনে রেখো, প্রথমবারের মতো সতর্ক করে দেওয়া হলো, এই সতর্কতার সময়সীমা ১৬ দিন। তোমার ভাগ্য নির্ভর করছে তোমার কাজের ওপর। তোমার দিকে সব সময়ের জন্য আমাদের লোক নজর রাখছে।’
একই ধরনের সতর্কবার্তা পেয়েছিলেন ঢাকা শহরের কয়েক শ শিক্ষক, বিজ্ঞানী, সাহিত্যিক, চিকিত্সক ও সাংবাদিক। তাঁদের বেশির ভাগই আজ আর বেঁচে নেই। বাংলাদেশ এই নারকীয় হত্যাযজ্ঞের বিচার চায়। আলবদর বলতে আসলে কী বোঝায়, তা এই তো সেদিন পর্যন্ত কারও জানা ছিল না। ধর্মান্ধ প্রতিক্রিয়াশীল জামায়াতে ইসলামী এই যোদ্ধা দলটির মূলে। আলবদরের সদস্যরা (বেশির ভাগের বয়সই ১৮ থেকে ২৫) বিশ্বাস করত, বাংলাদেশের জাতীয় আন্দোলনকারী ও ভারতীয় দালালদের কারণে ধর্ম বিপদে পড়েছে। বোঝা যায়, জামায়াতে ইসলামী পিকিংয়ের নেতাদের সমর্থন পেয়েছে। গোপন বৈঠকে তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এই দেশের সব শহরের নামই পাকিস্তান ও চীনের সেনা কর্মকর্তাদের নামে নামকরণ করা হবে। সেই সিদ্ধান্তের আরও যে বিষয়গুলো আছে, সেগুলো হলো, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও শত্রুভাবাপন্ন দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করতে হবে, হিন্দু সমপ্রদায়ের সব সম্পদ বাজেয়াপ্ত করতে হবে, পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু করতে হবে, বাংলা সব নাম পরিবর্তন করতে হবে, বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের ও সরকারি কর্মকর্তাদের ওপর সার্বক্ষণিক নজরদারি করতে হবে। যদি এদের কেউ বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতিশীল হয় তবে তাদের বিচার করে হত্যা করতে হবে।
এখন রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দারা দেশের নাগরিকদের হত্যার জন্য যারা দায়ী, তাদের ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করছে। যারা এই গণহত্যার তথ্য সংগ্রহ করছে, তাদের মধ্যে সংস্কৃতি জগতের সাতজন বিশিষ্ট ব্যক্তি রয়েছেন। এই কমিটির প্রেসিডেন্ট চলচ্চিত্র পরিচালক জহির রায়হান আমাদের বললেন, ‘আলবদরের কুকর্ম সম্পর্কে জানতে পারার পর আমরা এ ধরনের অপরাধ ঘটানোর কারণগুলো অনুসন্ধান করছি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ঢাকার চারপাশে বধ্যভূমিতে মানুষ যখন তাদের বাবা ও ভাইয়ের লাশ খুঁজছিল, তখন আমাদের মনে হয়েছিল যুদ্ধে পাকিস্তান বাহিনীর পরাজয় নিশ্চিত জেনে কিছু করতে না পারা থেকে উদ্ভূত ক্রোধের বশবর্তী হয়ে ধর্মান্ধ গোষ্ঠী এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। পরে আমরা বুঝেছি, বিষয়টি সে রকম ছিল না। হত্যার শিকার হয়েছিলেন সেই বুদ্ধিজীবীরা, যাঁরা সাম্রাজ্যবাদবিরোধী মনোভাব পোষণ করতেন।’
বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি জগতের কয়েকজনের কথা বলি, পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণের আগে যাঁরা আলবদরদের হাতে হত্যার শিকার হয়েছেন: সিরাজুদ্দীন হোসেন, প্রগতিশীল পত্রিকা ইত্তেফাক-এর সম্পাদক, আমেরিকার আগ্রাসী রাজনীতি ও পাকিস্তানের কোনো যুদ্ধজোটে যোগদানের বিরুদ্ধে যিনি ছিলেন সোচ্চার, সাহিত্যিক শহীদুল্লা কায়সার, পূর্ব পাকিস্তানের আফ্রো-এশিয়ান সলিডারিটির সভাপতি, পাকিস্তান-সোভিয়েত মৈত্রী সমিতিরও একজন নেতা, চিকিত্সক আলীম চৌধুরী, চিকিত্সকদের সমিতির সভাপতি তিনি, মার্কিন-পাকিস্তানি প্যাক্টের বিরুদ্ধে সোচ্চার, তিনি ছাত্রাবস্থায় বামপন্থী ছাত্রসংগঠন ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ডিন মুনীর চৌধুরী, যিনি বরাবর প্রগতিশীল আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, আর এ জন্য বারবার জেল খেটেছেন।
‘মৌলবাদী আলবদরের চোখে সব সাহিত্যিক, অধ্যাপকেরা একই ধরনের মানুষ।’ বলে যেতে থাকেন জহির রায়হান, ‘তারপরও তারা জেনে-বুঝে সেই সব বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করেছে, যাঁদের গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধা আছে। এর মানে দাঁড়াচ্ছে স্বেচ্ছাসেবী এই আলবদরের সদস্যরাও এই হত্যাকাণ্ডের সময় ওপরের কারও নির্দেশ মেনে চলেছে।’ কারা এই হত্যাকারীদের পেছনে ছিল? ১৭ ডিসেম্বর থেকেই আলবদর বাহিনীর বিষয়ে নানা তথ্য প্রকাশিত হতে শুরু করে। আলবদর নেতাদের লেখা নির্দেশনা, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর উঁচু স্তরের কর্মকর্তাদের নির্দেশনারও দেখা মেলে। পাকিস্তানি সেনা অফিসারেরাই এই জল্লাদদের প্রশিক্ষণ দিত। ওদের প্রশিক্ষণের রুটিন উদ্ধার করা হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, প্রশিক্ষণ শিবিরে লেকচার দিত যারা, তাদের সবাই পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সদস্য, এদের মধ্যে ব্রিগেডিয়ার বশীর, ক্যাপ্টেন কাইয়ুম প্রমুখের নাম বেশি দেখা যায়।
ঢাকা শহরে এখনো আতঙ্কের সঙ্গে উচ্চারণ করা হয় আশরাফ আলী খানের নাম। এই লোকটির নেতৃত্বেই গড়ে ওঠে বিশেষ বাহিনী, যাদের কাজই ছিল বাঙালিদের কতল করা। তার গাড়ির চালকের ভাষ্য অনুযায়ী, আশরাফ আলী খান ১৪ ডিসেম্বর সকালে ঢাকার প্রান্তিক এলাকার একটি কবরস্থানের পাশে সাতজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে নিজ হাতে গুলি করে হত্যা করেছে। মুক্তিযোদ্ধারা তার বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে আশরাফ আলীকে লেখা গভর্নরের উপদেষ্টা রাও ফরমান আলী স্বাক্ষরিত চিঠি উদ্ধার করেছে। সে চিঠিতে লেখা ছিল, আলবদর বাহিনীর এই মুখ্য জল্লাদ বাংলা নামের প্রদেশের সব জায়গায় মুক্তভাবে যেতে পারবে, স্থানীয় সরকারকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তাকে যেন সর্বাত্মক সহযোগিতা করা হয়।
গেরিলা যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ার পর থেকেই পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তারা স্থানীয় পুলিশ বাহিনীর ওপর আর আস্থা রাখতে পারছিল না। তারা পুলিশকে এড়িয়ে মূলত সখ্য গড়ে তুলেছিল এই ‘স্বেচ্ছাসেবী’ বাহিনীর সঙ্গে, যা রাও ফরমান আলীর ডায়েরি থেকে জানা যায়, পুলিশকে সরিয়ে নিয়ে আসা দরকার (যেসব জায়গায় তুমুল গেরিলা যুদ্ধ চলছিল, সে সব জায়গার কথা বলা হচ্ছে—লেখক)। সেখানে আলবদরদের দায়িত্ব দেওয়া হোক। দেওয়া হোক আধুনিক অস্ত্রের জোগান। ২ ডিসেম্বর জল্লাদ বাহিনীর কাঠামোতে পরিবর্তন আনা হলো। বিশেষ কয়েকটি গ্রুপ তৈরি করা হলো, এক দল গ্রেপ্তার করবে, এক দল নির্যাতন করবে আর এক দল নির্যাতন শেষে হত্যা করবে। এসব কাগজপত্র দেখে সহজেই অনুমান করা যায়, পূর্ব বাংলার পত্রিকায় প্রকাশিত বা রেডিওতে প্রচারিত খবরের বিষয়ে সরকারের মনোভাব কী ছিল। সাংবাদিক নিজামুদ্দীন আহমদের নামের পাশে রাও ফরমান আলী লিখে রেখেছেন, ‘বস্তুনিষ্ঠ খবর পরিবেশন করেন না’। এর পরপরই নিজামুদ্দীন আহমদ উধাও হয়ে গেলেন। সম্প্রতি জানা গেল, তাঁকে হত্যা করা হয়েছে। বিচার বা আইনের ধারেকাছেও যাওয়ার প্রয়োজন ছিল না, রাও ফরমান আলীর ডায়েরির পাতাই ছিল একজন মানুষকে গ্রেপ্তার ও হত্যা করার জন্য যথেষ্ট।
ঘটনাটির শিকড় আরও গভীরে। তথ্য ঘেঁটে আর প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান থেকে জানা যায়, যারা আলবদরের মতো বাহিনীর জন্ম দিয়েছে এবং যে বাহিনী অন্ধ মৌলবাদে দীক্ষিত হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে দেশের সূর্যসন্তানদের হত্যা করার জন্য, তারা সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোরও মদদ পায়। এই জেনারেলের ডায়েরি থেকেই জানা যায় দুই মার্কিন নাগরিকের নাম, যারা ১৯৭১ সালে ঢাকা সফর করেছিল। হেইট ও ডভেসপিক, এই দুটি নামের পাশে লেখা ছিল যুক্তরাষ্ট্র। আর লেখা ছিল ডিজিআইএসই, যার মানে দাঁড়ায় অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা বাহিনীর মহাপরিচালক। হেইটের নামের সঙ্গে আরও লেখা আছে, ‘রাজনীতি বিষয়ে ৬০, ৬২ ও ৭০’। আরেকটি দলিলে দেখা গেল, রাও ফরমান আলীর সহযোগিতায় এই দুই মার্কিন পাকিস্তান এয়ারলাইনসের ঢাকা-ব্যাংকক ফ্লাইটের প্লেনের টিকিট পেয়েছিল।
এই হেইট ও ডভেসপিক কে? এ ব্যাপারে বাংলা পত্রিকা দৈনিক বাংলা বলছে, ‘হেইটের জন্ম ১৯২৮ সালে। ১৯৪৬-১৯৪৯ সালে তিনি ছিলেন মার্কিন সেনাবাহিনীতে। ১৯৫৩ সাল থেকে কাজ করছেন গোয়েন্দা বাহিনীতে। ১৯৫৪ সাল থেকে মার্কিন মিশনগুলোয় রাজনৈতিক অ্যাটাশে হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এই দায়িত্ব পালন করতে তিনি কলকাতা, কায়রোতে ছিলেন। ঢাকায় ছিলেন ১৯৬০-১৯৬২ ও ১৯৭০ সালে। এক বছর পর সিআইএর এজেন্ট ডভেসপিকের সঙ্গে ঢাকায় আসেন এবং রাও ফরমান আলীর সঙ্গে বসে বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের একটা কালো তালিকা তৈরি করেন। সে তালিকায় তিন হাজার নাম ছিল। এই তালিকা জেনারেলের শোবার ঘর থেকে উদ্ধার করা হয়েছে।
বোঝাই যায়, সিআইএর সঙ্গে পাকিস্তান সরকারের যোগাযোগ ছিল গোপনে, সাধারণ আলবদর বাহিনীর সদস্যরা এতটা গভীর থেকে বিষয়টি জানত না। তা সত্ত্বেও এই জল্লাদ বাহিনীর পালের গোদারা এবং জামায়াতে ইসলামী দলের নেতারা দলের সাধারণ কর্মীদের মনে উত্সাহ-উদ্দীপনা জাগিয়ে তোলার জন্য পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের প্রগাঢ় রাজনৈতিক সম্পর্কের কথা বলত। ১২ ডিসেম্বর জামায়াতে ইসলামীর ঢাকার সেক্রেটারি (সম্ভবত আমির বোঝানো হচ্ছে—অনুবাদক) প্রজ্ঞাপন জারি করেন। তাতে লেখা ছিল, ‘দেশের বাইরেও আমাদের বন্ধু আছে...আমেরিকা ও চীন আমাদের সমর্থন করছে।’ এখন সমুদ্রের ওপারের গোয়েন্দা বাহিনী বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক নাগরিকদের হত্যার দায়ভার গ্রহণ না করে কী করে এ থেকে নিজেদের সন্দেহমুক্ত রাখা যায়, সে কসরত করে চলেছে। কিন্তু যে তথ্য প্রকাশিত হচ্ছে, তাতে বোঝা যাচ্ছে এই হত্যাযজ্ঞে সাম্রাজ্যবাদীদের অংশগ্রহণের খবর আরও বের হবে।
***
শেষবার আমরা ডায়েরি লেখার পর দুই মাস কেটে গেছে। আমরা আবার ঢাকায় ফিরে এসেছি। এখানে আবার বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ঘটে গেছে। সমুদ্রের ওপারের বিদেশি মদদে দেশের উগ্র ডানপন্থীরা দেশপ্রেমিকদের ভয় দেখানোর জন্য ঘটিয়ে চলেছে এই হত্যাকাণ্ড। জহির রায়হানও এই হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। বোঝাই যাচ্ছে, এই চলচ্চিত্র পরিচালক যে কমিটির প্রধান ছিলেন, সেই কমিটি এই জল্লাদদের নিয়ে যে শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন, তার ভিত্তি ছিল, তারা প্রতিশোধের ভয়ে এখনো হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে। জহির রায়হানের জন্য ফাঁদ পাতা হয়েছিল: তাঁকে ফোন করা হয়েছিল এবং এক জায়গায় সাক্ষাত্ করতে বলা হয়েছিল। খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য তাঁকে দেওয়া হবে, সে কথা বলে জহির রায়হানকে সেখানে নিয়ে আসা হয়েছিল। বিষয়টি নিয়ে কিছুটা সন্দেহ থাকায় জহির রায়হান গাড়িতে দুজন সৈনিককেও নিয়ে গিয়েছিলেন। এরপর কী ঘটেছে, তা আর জানা যায় না। জহির রায়হান ও তাঁর দুই সঙ্গীকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি, তাঁদের গাড়িটি ঢাকার এক প্রান্ত থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। পুলিশ সন্দেহ করছে, তাঁরা ফাঁদে পড়েছেন এবং হত্যার শিকার হয়েছেন। প্রতিক্রিয়াশীলদের এই নতুন হত্যাযজ্ঞ দারুণ ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। সাপ্তাহিক এক্সপ্রেস তাদের বিশেষ সংখ্যা উত্সর্গ করেছে জহির রায়হানকে। তারা বলেছে, ‘বাংলাদেশের গণমন্ত্রমনা বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করার সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত এখনো চলছে।’ ম্যাগাজিনটি সরকারের কাছে সাম্রাজ্যবাদের এজেন্টদের নিশ্চিহ্ন করার দাবি জানিয়েছে। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র ইনস্টিটিউটে জহির রায়হানের নাম যুক্ত করা হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রাম নিয়ে নির্মাণ করা তাঁর চলচ্চিত্রগুলো দেশের সিনেমা হলগুলোয় চলছে।
কবিতার সোনার তরী
ঢাকা, কুষ্টিয়া, ২৪ মার্চ
পাথুরে পথটা একটি ছোট চত্বরের দিকে এগিয়ে গেছে, শীর্ণদেহী, শুভ্রকেশী নারী, খুব ধীরে সিঁড়ি ভেঙে উঠলেন সেই চত্বরে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে মাথা নুইয়ে শ্রদ্ধা জানালেন, তারপর আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করতে যে আন্দোলন হয়, তাতে অংশ নিতে গিয়ে যাঁরা প্রাণ দিয়েছেন, তাঁদের স্মরণ করে এখানে ছিল শহীদ মিনার। গত বছর ২৬ মার্চ বর্বর হামলার মাধ্যমে তা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সেনাশাসনামলে ধর্মীয় মৌলবাদীরা এই মিনারকে ভয় পেত। আমাদের কবিরা জাতীয় ঐতিহ্য নিয়ে কবিতা লিখলেও তা রাষ্ট্রদ্রোহী কবিতা হিসেবে বিবেচনা করা হতো।’ ‘সুখের বিষয়, শঙ্কাগুলো এখন অতীত। যুবকেরা, শিক্ষার্থীরা এখন এখানে আসে তাজা ফুল নিয়ে। ধ্বংস হয়ে যাওয়া মিনারের জায়গায় খুব দ্রুত উঠবে নতুন মিনার: বাংলাদেশ সরকার নকশা জমা দিতে বলেছে, সেরা নকশা অনুসারে গড়ে উঠবে এই মিনার।’
আমাদের সঙ্গে যে নারী কথা বলছিলেন, তিনি শিক্ষিত মানুষের কাছে খুবই পরিচিত একটি নাম। তিনি কবি সুফিয়া কামাল। আমরা কথা বলছিলাম, নতুন প্রজাতন্ত্রের শিল্প ও সাহিত্য নিয়ে। ‘কীভাবে দেশটি গড়ে তোলা যায়, সেটাই প্রতিটি লেখককে ভাবতে হবে এখন। সেনা স্বৈরশাসকেরা চেষ্টা করেছিল কীভাবে ভারত, ভারতের সংস্কৃতির প্রতি মানুষের মনে ঘৃণার সঞ্চার করা যায়। আমরা আমাদের জনগণকে বলতে চাই, আমাদের কাছে মুসলিম কবি নজরুল ইসলাম ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মধ্যে কোনো ভেদ নেই। তাঁরা দুজন দুই ভিন্ন ধর্মাবলম্বী হলেও তাঁরা বাংলা সাহিত্যের ধ্রুপদি দুই জ্যোতিষ্ক।’ বিদায়বেলায় কবি আমাদের শিলাইদহ যাওয়ার আমন্ত্রণ জানালেন, এই গ্রামে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়িটিকে জাদুঘর করা হয়েছে। কুষ্টিয়ায় যাওয়ার পর সে সুযোগ আমাদের করে দিয়েছিল জেলা প্রশাসন। পশ্চিমের এই কেন্দ্র থেকে শিলাইদহের দূরত্ব ১০ কিলোমিটারের চেয়েও কম। কিন্তু সেখানে পৌঁছাতে লেগে গেল কয়েক ঘণ্টা: কখনো নৌকায়, কখনো দুই ধারে ছড়িয়ে থাকা ধানখেতের মধ্য দিয়ে মেঠোপথে হেঁটে। শেষে কয়েকটি আম্রকানন পার হওয়ার পর আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে ত্রিতল প্রাসাদ, রবীন্দ্রনাথের পৈতৃক সম্পত্তি। এখানে বসেই মহান এই কবি বাংলার কৃষকদের সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি জানতে পেরেছিলেন। এই জানাশোনা তাঁর পরবর্তী জীবনের লেখনীতে ফেলেছে প্রগাঢ় ছাপ। শিলাইদহতেই তিনি গ্রামবিষয়ক মূল গল্পগুলো লিখেছিলেন। আর এখানেই লেখা হয়েছিল কবিতার বই সোনার তরী।
জাদুঘর কর্তৃপক্ষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিচিহ্ন রক্ষা করতে পেরেছে। প্রথমতলায় পাঠাগার, এই পাঠাগার ব্যবহার করতেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। গাইড আমাদের ওপরতলায় নিয়ে গেলেন। কবি এখানে বসে লিখতেন। বসতেন চেয়ার-টেবিলে, খোলা থাকত সামনের জানালা। খোলা জানালা দিয়ে তিনি দেখতেন পদ্মা নদী।
রুশ থেকে অনুবাদ: জাহীদ রেজা নূর