ফ্রম প্রোটেস্ট টু ফ্রিডম: দ্য বার্থ অব বাংলাদেশ-মোকাররাম হোসেন, সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা, ২০১০
এক
মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস নিয়ে কম বই লেখা হয়নি। ইতিহাসবিদ ও গবেষক থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণকারী ও প্রত্যক্ষদর্শীদের লিখিত বিভিন্ন বই ১৯৭১ সালকে ধারণ ও বিশ্লেষণ করেছে বিভিন্ন আঙ্গিকে। তবে বহির্বিশ্বের কাছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এর যৌক্তিক পটভূমিসহযোগে তুলে ধরার জন্য ইংরেজি ভাষায় রচিত বইয়ের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম। আবার যাঁরা লিখেছেন, তাঁদের বেশির ভাগই বিদেশি গবেষক ও বিশ্লেষক। সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন ও পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করেছেন, এমন ধারার ইংরেজি লেখক কম। ড. মোকাররাম হোসেন তাঁর ফ্রম প্রোটেস্ট টু ফ্রিডম: দ্য বার্থ অব বাংলাদেশ গ্রন্থটি রচনার মধ্য দিয়ে সেই ধারায় একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন ঘটিয়েছেন। কেননা, বহির্বিশ্বের কাছে মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে বস্তুনিষ্ঠভাবে তুলে ধরার দুরূহ কাজের প্রতিফলন আছে বইটিতে।
বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির সোশিওলজি, সোশ্যাল ওয়ার্ক ও ক্রিমিনাল জাস্টিস বিভাগের প্রফেসর ড. মোকাররাম হোসেন তাঁর কর্মজীবন শুরু করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষক হিসেবে, এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই সমাজবিজ্ঞানে অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রি গ্রহণের পর। এরপর কিছুদিন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ও পরে চার বছর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার পর যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান উচ্চতর ডিগ্রি লাভের জন্য। ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, রিভারসাইড থেকে পিএইচডি সম্পন্ন করার পর যোগ দেন অধ্যাপনায়। পাশাপাশি চলতে থাকে তাঁর গবেষণা, যা প্রধানত সমাজতত্ত্ব ও অপরাধতত্ত্ব নিয়ে। তবে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তিনি নীরবে কাজ করেছেন, যার ফসল এই বইটি। আর কাজটি হয়েছে মূলত তাঁর ভেতরকার তাগিদ থেকে। যৌবনের প্রারম্ভে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপ্রেরণায় অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেওয়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে লাখ লাখ তরুণের মতো তিনিও যুক্ত হন। ছেড়ে দেন পাকিস্তান প্রেস ইন্টারন্যাশনালের চাকরি। এরপর মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে তিনি সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সোনামুড়ায় প্রবেশ করেন। সেখান থেকে কলকাতা। বইয়ের ভূমিকায় তিনি তাই লিখেছেন, ‘১৯৭১ সালের স্মৃতিগুলো এখনো আমার কাছে সজীব, যেন এই তো সেদিনের ঘটনাগুলো। আর শুধু ১৯৭১ সাল নয়, আমার স্মৃতিতে পাকিস্তানের ইতিহাসের সেই ২৫ বছরের ঘটনাগুলো এখনো তরতাজা। ১৯৫২ সালে যখন পাকিস্তানি প্রশাসন নিরীহ বাঙালিদের ওপর গুলি চালাতে দ্বিধা করেনি, তখন আমি দ্বিতীয় শ্রেণির স্কুলছাত্র। এর মাত্র দুবছর পর নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট মুসলিম লীগকে পরাজিত করে। ১৯৫৮ সালে আইউব খান যখন সমস্ত শক্তি ও ব্যাপ্তি দিয়ে তাঁর সামরিক শাসন চাপিয়ে দেন, তখন আমি অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। আমরাই ছিলাম আইউবের প্রবর্তিত নতুন ব্যবস্থায় উচ্চমাধ্যমিক (এইচএসসি) পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী প্রথম দল। ১৯৬৩ সালে আইউব খান কর্তৃক নিযুক্ত পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনেম খান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাও পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ দ্বারা নির্বাচিত নয় এমন একজন চ্যান্সেলরের কাছ থেকে ডিগ্রি গ্রহণ না করতে দৃঢ় অবস্থান নেয়। এর ফলে ছাত্র ও আইন প্রয়োগকারীদের মধ্যে সংঘাত দেখা দেয়। এটি সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে গণপ্রতিবাদে রূপ নেয়। মোনেম খানের পুলিশ কয়েক শ ছাত্রকে গ্রেপ্তার করে, যার মধ্যে আমার বড় ভাই রহমতুল কিবরিয়াও ছিলেন।
সামরিক শাসনের বিরোধিতা ও গণপ্রতিবাদের অন্য ঘটনাগুলো আমার চারপাশেই ঘটছিল। আমিও ওই সব ঘটনাপ্রবাহ ও সেগুলোর ঐতিহাসিক ব্যাপ্তির একজন নিবিড় পর্যবেক্ষক ছিলাম। সেই দিনগুলোতে আমাদের কাছে সংবাদপত্র ও বই পড়া ছাড়া আরও অনেক বিকল্প ছিল না। আমার বাবা পাকিস্তান অবজারভার ও ইত্তেফাক রাখতেন। তাঁর প্রত্যেক ছেলেমেয়েকে এই দুটো খবরের কাগজ পড়তে হতো। আমি যদিও সমাজ, রাজনীতি ও অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে যা ঘটছে সে সম্পর্কে পড়তাম ও পর্যবেক্ষণ করতাম, রাতে নৈশভোজের সময় বিষয়গুলো আমাদের পরিবারে নিয়মিতই আলোচনা হতো। তখন বিভিন্ন বিষয়ে আমার বাবার সঙ্গে আমার বিতর্ক হতো। মোট কথা, আমি সংযুক্ত পাকিস্তানের ২৫ বছরের ইতিহাস সম্পর্কে একটি অবস্থানগত ধারণা তৈরি করেছিলাম। আর আমার মতে, এই ধারণা পূর্ব পাকিস্তানের নীরব অথচ সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মনোভাবেরই প্রতিফলন, যা এই বইয়ের মধ্য দিয়ে তুলে ধরা প্রয়োজন।’ (পৃ. ৭-৮)
লেখকের এই ভূমিকা থেকেই আরেকটি বিষয় স্পষ্ট হয় যে তিনি বইটিতে শুধু ১৯৭১ সালের ঘটনাপ্রবাহ ও তার বিশ্লেষণে কেন্দ্রীভূত থাকেননি, বরং ১৯৭১ তথা মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার প্রেক্ষাপট ও সংযুক্ত পাকিস্তানের সিকি শতাব্দীর ইতিহাসকে নিয়ে এসেছেন। মুখবন্ধে তাই তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশ গঠনের যেসব সামাজিক-রাজনৈতিক গতিময়তা কাজ করেছে, সেসব সম্পর্কেই এই বইটি রচিত। এতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে সেসব ঘটনা যেগুলো ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটিয়েছে, উপমহাদেশের মুসলমানদের স্বশাসনের দাবিকে সুসংহত করে পাকিস্তানের অভ্যুদয় ঘটিয়েছে (১৯৪৭), সংযুক্ত পাকিস্তানের মৃত্যু ঘটিয়েছে এবং সেসব ঘটনার কালপঞ্জি যেগুলো ছিল জনগণের বিপুল সম্পৃক্ততায় একের পর এক সামাজিক আন্দোলন বা প্রতিবাদ যার মধ্য দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ স্বশাসনের জন্য একটি গণতান্ত্রিক সমাজ গঠনের চেষ্টা করেছে। একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে দেখা দরকার ধারাবাহিক প্রতিবাদসমূহের একটি ফল হিসেবে। এসব প্রতিবাদকে ধারাবাহিক সামাজিক আন্দোলনও বলা যায়। বাংলাদেশ ছিল পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের সামষ্টিক প্রতিবাদ বা কার্যক্রমের সৃষ্ট ফল। পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যালঘু নেতৃত্ব বাঙালিদের ওপর যে সরকারি প্রশাসনিক পদ্ধতি চাপিয়ে দিয়েছিল তার বিরুদ্ধে ছিল এসব প্রতিবাদ।’ (পৃ-২৪)। অর্থাত্ লেখক দেখাতে চেয়েছেন যে পশ্চিম পাকিস্তানের ক্ষমতালোভী রাজনৈতিক নেতৃত্ব বরাবরই ক্ষমতায় থাকার জন্য নানা কৌশল ও যৌক্তিকতা প্রয়োগ করেছে আর জনসাধারণকে দেশের ভবিষ্যত্ নির্ধারণ করার অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। এর বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও জনসাধারণ একের পর এক প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে, যা চূড়ান্ত পরিণতিতে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটিয়েছে। লেখকের এই প্রতিপাদ্যের ধারণাটি একেবারে নতুন নয়। তবে এর উপস্থাপন ও বিশ্লেষণের প্রণালিটি কিছুটা ভিন্ন। আর এই প্রতিপাদ্যের প্রসঙ্গে প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ এ এফ সালাহউদ্দীন আহমদের পর্যবেক্ষণের যে মিল পাওয়া যায়, সেটিও তাত্পর্যপূর্ণ। তিনি বলছেন, ‘উনিশশ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির ইতিহাসের সর্বকালের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল ঘটনা। এই মুক্তিযুদ্ধের ফলে আমাদের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে। কিন্তু একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ কোনো আকস্মিক বা বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না। এটি ছিল বাঙালির দীর্ঘকালের আত্মানুসন্ধান, দীর্ঘদিনের আন্দোলন এবং ইতিহাসের অমোঘ প্রক্রিয়ার পরিণতি।’ [আহমদ, সালাহউদ্দীন, বাঙালির সাধনা ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, পৃ-১৩৩ (ঢাকা: সাহিত্য প্রকাশ, ১৯৯২)] তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছেন বাঙালির কয়েক শতাব্দীর ঐতিহাসিক ধারাক্রমের নিরিখে, নিকট ইতিহাসকে দূর অতীতের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে। মোকাররাম হোসেন এই ধারাকে অনেকটাই অনুসরণ করেছেন। এখানে উল্লেখ করা বোধ হয় অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে সালাহউদ্দীন আহমদ সম্পর্কে মোকাররাম হোসেনের আপন চাচাতো ভাই। তাঁদের পিতামহ মৌলভী আহমদ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম বাঙালি মুসলমান গ্র্যাজুয়েটদের অন্যতম।
নয়টি অধ্যায়ে বিভক্ত বইটিতে মোকাররাম হোসেন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস ‘অরাজনৈতিক’ ও ‘নির্দলীয়’ দৃষ্টিভঙ্গিতে তুলে ধরার ও ব্যাখ্যা প্রদানের চেষ্টা করেছেন। লক্ষণীয় যে আরও অনেক গবেষকই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লিখতে গিয়ে ‘নির্দলীয়’ দৃষ্টিভঙ্গি বা বিশ্লেষণের ওপর জোর দিয়েছেন এ জন্য যে এ বিষয়টি নিয়ে কিছু চরমভাবে দলীয় মনোভাবাসম্পন্ন বই রচিত হয়েছে, দলীয় সংকীর্ণ দৃষ্টিকোণ থেকে মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপরের ঘটনাসমূহ বিশ্লেষণ করা হয়েছে এবং সর্বোপরি দলীয় বিবেচনায় ইতিহাসের বিকৃতি ঘটানো হয়েছে। এতে করে মানুষের মনে এ রকম একটি ধারণাও তৈরি হয়েছে যে ১৯৭১ বা মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক যেকোনো রচনাই বোধ হয় দলীয় রাজনীতির প্রভাবদুষ্ট। গোলাম মুরশিদ তাই বলেছেন, ‘কিন্তু সবচেয়ে বিকৃত ইতিহাস লিখেছেন, যাঁরা দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে মুক্তিযুদ্ধকে দেখেছেন, তাঁরা। বিশেষ করে রাজনৈতিক বিশ্বাস এবং দলীয় আনুগত্যের কারণে অনেকে রীতিমতো ইতিহাস দখলের প্রয়াস চালিয়েছেন।” [মুরশিদ, গোলাম, মুক্তিযুদ্ধ ও তারপর: একটি নির্দলীয় ইতিহাস, পৃ-৭, (ঢাকা, প্রথমা প্রকাশন, ২০১০)]
মোকাররাম হোসেন প্রথম অধ্যায়ে ব্রিটিশ শাসনামলে ও পাকিস্তান গঠনের আন্দোলনে বাঙালি মুসলমানের ভূমিকা ও পূর্ব বাংলার মুসলমানদের আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির বিবর্তনের ওপর সংক্ষেপে আলোকপাত করেছেন। দ্বিতীয় অধ্যায়ে তিনি দেখিয়েছেন যে কীভাবে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের আশা-আকাঙ্ক্ষা পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনীতিবিদদের কর্মকাণ্ড দ্বারা বিচূর্ণ হয়েছে। তৃতীয় অধ্যায়ে বিশ্লেষণ করা হয়েছে সামরিক শাসন ও মৌলিক গণতন্ত্রের প্রভাব যা কিনা বাঙালিদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। চতুর্থ অধ্যায়ে পাকিস্তানের দুই প্রদেশের মধ্যে অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য কীভাবে উন্নয়নবৈষম্য তৈরি করে সে বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। পঞ্চম অধ্যায়ে পাকিস্তানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় বাঙালিদের সংগ্রামের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছেন লেখক। ষষ্ঠ অধ্যায়ে আইউবের পতন ও ইয়াহিয়ার উত্থান সম্পর্কে বলা হয়েছে। সপ্তম অধ্যায়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দখলদারির নয় মাস ও বাঙালির প্রতিরোধের ওপর আলোকপাত করেছেন লেখক। অষ্টম অধ্যায়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর চালানো গণহত্যা ও এ বিষয়ে বিশ্বের প্রধান দেশগুলোর নির্লিপ্ততা সম্পর্কে বিশ্লেষণ করেছেন লেখক। নবম অধ্যায়ে মুক্তিবাহিনী গঠন, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ও পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের ঘটনাসমূহ বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
দুই.
ব্রিটিশ শাসনমালে অবিভক্ত ভারতের অবিভক্ত বাংলায় মুসলমানদের দুর্দশা ও সেই দুর্দশা থেকে ধীরে ধীরে উত্তরণের প্রয়াসটি ছিল সুদীর্ঘ দেড় শ বছরের বেশি সময়ের এক যাত্রা। অপ্রিয় হলেও সত্যি যে হিন্দু-মুসলমান সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক বিভাজনটি এই সময়কালে ক্রমাগত যেমন প্রকট হয়েছে, তেমনি পিছিয়ে পড়া বাঙালি মুসলমানদের ভেতর থেকেও একদল শিক্ষিত-সচেতন গোষ্ঠীর উদ্ভব হয়েছে। এরা ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ ও পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের ভাবধারার সঙ্গে পরিচিত হয়ে পিছিয়ে পড়া স্বজাতির মুক্তির জন্য যাঁর যাঁর অবস্থান থেকে চেষ্টা চালিয়েছেন। কালক্রমে গোটা ভারতের মুসলমানদের মধ্যে যে রাজনৈতিক সচেতনতার সঞ্চার হয়, তাতে বাঙালি মুসলমান শিক্ষিতদের একটা তাত্পর্যপূর্ণ অবদান ছিল। সে কারণেই ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয় পূর্ব বাংলার ঢাকায়, যা পর্যায়ক্রমে পাকিস্তান আন্দোলনে রূপ নেয়। আসলে ১৯০৫ সালে ব্রিটিশ সরকার যে ‘বঙ্গভঙ্গ’ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তা হিন্দু জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের তীব্রতায় ১৯১১ সালে ‘বঙ্গভঙ্গ রদ’ করা হয়। এটা বাঙালি হিন্দু ও মুসলমানদের পরস্পরের মধ্যে সন্দেহ-অবিশ্বাসের মাত্রা নতুন উচ্চতায় নিয়ে যায়। বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে সাধারণভাবে এই ধারণা দৃঢ় হয় যে হিন্দুরা তাদের উন্নতি ও অগ্রগতি চায় না, চায় না সুযোগ-সুবিধার ভাগ দিতে। ফলে ভারতে মুসলমানদের পৃথক আবাসভূমি সৃষ্টির কোনো বিকল্প নেই। প্রথম অধ্যায়ে এসব ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহ সংক্ষেপে বিশ্লেষণ করেছেন মোকাররাম হোসেন। তিনি লিখেছেন, ‘এই প্রেক্ষাপটে বৃহত্তর ব্রিটিশ ভারত ভাগ হয়ে যায় এবং দুটি স্বাধীন জাতি রাষ্ট্র—ভারত ও পাকিস্তান—স্থাপিত হয়। পাকিস্তান দুই অংশ নিয়ে সৃষ্টি হয়—পূর্ব ও পশ্চিম। পূর্ব পাকিস্তান পরবর্তীতে হয় বাংলাদেশ।’ (পৃ-৫৯)।
দ্বিতীয় অধ্যায়ে লেখক দেখিয়েছেন যে কেন ও কীভাবে পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার অল্প পরেই বাঙালিদের মোহভঙ্গ হতে শুরু করে। অথচ বাঙালি মুসলমানরাই পাকিস্তান গঠনে বিরাট ভূমিকা রেখেছিল। বাস্তবে দেখা গেল যে তারা যে প্রত্যাশা ও আকাঙ্ক্ষা থেকে পাকিস্তান আন্দোলনে শরিক হয়েছিল, সেই প্রত্যাশা ও আকাঙ্ক্ষা ক্রমাগত হতাশা ও ক্ষোভে রূপ নিচ্ছে। মোকাররাম হোসেন লিখেছেন, ‘পাকিস্তানের শুরু থেকেই যে নেতৃত্ব কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেছিল, তারা গণতান্ত্রিক রীতিনীতি ও মূল্যবোধের প্রতি কোনো শ্রদ্ধা পোষণ করেনি। বরং তারা নিজেদের প্রয়োজন ও স্বার্থানুসারে গণতান্ত্রিক রীতিনীতি পাল্টে ফেলতে থাকে। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের কার্যক্রম থেকে এটা পরিষ্কার হয়ে যায় যে তারা সাধারণ জনগণের রায়কে বিশ্বাস করতে পারছিল না। অথচ জনগণের রায়ই হলো একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মৌলিক নীতি। এই নেতৃত্ব তাই একটি গণতান্ত্রিক জাতি গঠনের জন্য কৌশল উন্নয়নের কোনো চেষ্টাই করেনি, বরং স্বৈরতান্ত্রিকভাবে দেশ শাসনের জন্য ক্ষমতালিপ্সু কোটারি গোষ্ঠী তৈরি করে। অথচ পাকিস্তানের প্রথম দিককার নেতৃত্বর কাছে একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক প্রথা প্রতিষ্ঠার সব রকম সুযোগ ও জনসমর্থন ছিল। সাধারণভাবে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার লগ্নে অত্যন্ত খুশি ও উত্সাহী ছিল। শুরুর দিকে ছোট-বড় সব শহরেরই তরুণ প্রজন্ম আন্তরিকভাবে ১৪ আগস্ট উদ্যাপন করত। মুকুল ফৌজ ও সবুজ সেনার সদস্যরা ভোরবেলা পাকিস্তানের জয়গান গেয়ে শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করত। তবে এই উত্সাহ-উদ্দীপনা মিইয়ে যেতে থাকে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃত্বের নেতিবাচক আচরণের কারণে। পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃত্ব জনগণের ভোট ও সমর্থন পাওয়ার বিষয়ে ভীত ছিল। আর তাই ১৯৭০ সালের আগ পর্যন্ত কখনোই এক ব্যক্তির এক ভোট নীতি চালু হয়নি। আর ১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলাফলের প্রতি কখনোই তারা সম্মান দেখায়নি। ক্রমাগত জনগণের রায়কে অবনমন করার সম্মিলিত ফল হিসেবে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়েছে।’ (পৃ-৬৭)
লেখক মূলত দেখাতে চেয়েছেন যে পূর্ব বাংলার বা পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা বঞ্চিত হতে হতে প্রতিবাদী হয়ে উঠেছে। আর পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী কোনো রকম প্রতিবাদ-প্রতিরোধ সহ্য করতে প্রস্তুত ছিল না। আর সে কারণে পাকিস্তান সৃষ্টির ১১ বছরের মধ্যেই সামরিক শাসন জারি হয়। অবশ্য ইস্কান্দার মির্জা ও আইউব খান দুজনই গণতন্ত্রের ব্যর্থতার জন্য রাজনীতিকদের দায়ী করেন। বাস্তবে পাকিস্তানের শুরু থেকেই গণতন্ত্রকে কার্যকর করতে দেওয়া হয়নি। বরং সামরিক শাসকেরা জনগণের ভালোর জন্য দেশের শাসনভার হাতে তুলে নেওয়ার নাম করে আসলে নিজেদের আখের গোছানোর কাজটি খুব ভালোভাবে করেছে। এর ফলে সামরিক শাসনামলে দুই পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্য ক্রমাগত বেড়েছে আর বঞ্চিত হতে হতে বাঙালির প্রতিবাদ দেশের দুই অংশের মধ্যে উত্তেজনা ও বিরূপতাও বাড়িয়েছে। তৃতীয় অধ্যায়ে এ বিষয়টির ওপর আলোকপাত করতে গিয়ে মোকাররাম হোসেন সমসাময়িক কালে সামরিক শাসনের ধরন পরিবর্তন সম্পর্কেও প্রাসঙ্গিক বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি বলছেন, ‘সমসাময়িক কালে সামরিক শাসকেরা আর অন্যান্য গণতান্ত্রিক ও আধা গণতান্ত্রিক জাতির কাছ থেকে সর্বাত্মক সমর্থন পায় না যেমনটা তারা পেত পঞ্চাশ বা ষাটের দশকে। তবে সামরিক বাহিনী বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে এখনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে আগ্রহী আর তা তারা করে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। সে কারণেই বাংলাদেশের সর্বশেষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার (২০০৭-২০০৮) সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে, সামরিক সরকার হিসেবে নয়। তবে, ’৬০-এর দশকে সামরিক শাসনের প্রতি বিশ্বের বিশেষত পশ্চিমা দুনিয়ার মনোভাব ছিল ভিন্ন রকম। বহু পশ্চিমা চিন্তাবিদ মনে করতেন যে অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য স্থিতিশীলতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আর সামরিক বাহিনী সেই বহু প্রয়োজনীয় স্থিতিশীলতা দিতে পারে। সে কারণেই পাকিস্তানের রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর সক্রিয় উপস্থিতি ও ক্ষমতা গ্রহণ পশ্চিমা সরকারগুলোর প্রত্যক্ষ না হলেও পরোক্ষ সমর্থন পেয়েছিল। পাকিস্তান হয়ে উঠেছিল তৃতীয় বিশ্বে সামরিক বাহিনীর ভূমিকা বিষয়ে পশ্চিমা দর্শনের একটি পরীক্ষার বস্তু।’ (পৃ-৮৫) লেখকের এই পর্যবেক্ষণটি বিশেষভাবে তাত্পর্যপূর্ণ। তিনি তাঁর এই পর্যবেক্ষণের সমর্থনে বেশ কিছু যুক্তি-তর্ক তথ্য-উপাত্তসহযোগে উপস্থাপন করেছেন। দেখিয়েছেন যে পাকিস্তানের সামরিক সরকারের নেতৃত্ব গৃহীত অর্থনৈতিক নীতির মাধ্যমে পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উন্নয়নের প্রতি ওই সময়কালে বিশ্বব্যাংক ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন আসলে যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশনীতির সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ। ওই সময়টায় চলছিল ট্রুম্যান ডকট্রিন, যার অন্যতম নীতি ছিল কমিউনিজমের হুমকির মধ্যে থাকা দেশগুলোতে মার্কিন সেনা ও অর্থনৈতিক উপেদষ্টা প্রেরণ করা। লেখক বলছেন, ‘দক্ষিণ আমেরিকা ও মধ্য আমেরিকায় যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি হস্তক্ষেপ করলেও পাকিস্তানে তা প্রয়োজন হয়নি এ জন্য যে সেখানে মার্কিন বিদেশনীতির সমর্থক লোকের অভাব ছিল না আর তারা আমেরিকা থেকে সংকেত আসার অপেক্ষাতেই ছিল।’ (পৃ-৮৭)
এই অধ্যায়ে লেখক বেশ বিস্তারিতভাবে আইউব খানের মৌলিক গণতন্ত্রের উদ্ভব ও প্রভাব সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন। পাশাপাশি দেখিয়েছেন যে কীভাবে বিশ্বব্যাংক ও আমেরিকার পুঁজিবাদী দর্শন অনুসরণ করতে গিয়ে অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য প্রকট হয়ে ওঠে। তিনি লিখেছেন, ‘পাকিস্তানের পরিকল্পনা কমিশন পরামর্শ নিত ও পরিচালিত হতো যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক মডেলে বিশ্বাসী অর্থনীতিবিদদের দ্বারা যারা [পাকিস্তানের] জনগণের স্বতন্ত্রতা ও সামাজিক কাঠামোর বৈশিষ্ট্যের দিকে মোটেও মনোযোগ দেয়নি। জনগণ বিশেষত যারা পাকিস্তান সৃষ্টির জন্য ভোগান্তির শিকার হয়েছিল ও আত্মত্যাগ করেছিল, তারাই হওয়ার কথা ছিল সমাজের সবচেয়ে ক্ষমতাবান শক্তি। শুরু থেকেই দেশের জনগণের ভালো থাকার দিকে নজর না দেওয়া ছিল বিরাট ভুল। যাঁরা উন্নয়ন-প্রক্রিয়ার দিকনির্দেশনা দিচ্ছিলেন, তাঁদের সঙ্গে দেশের সিংহভাগ জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি ও অবস্থার বিরাট পার্থক্য ছিল।’ (পৃ-১০৮)। তিনি এ প্রসঙ্গে কথিত ‘হার্ভার্ড অ্যাডভাইজরি গ্রুপে’র অন্যতম সদস্য প্রফেসর গুস্তাভ এফ পাপানেকের ভূমিকা বিশেষভাবে তুলে ধরেছেন। পাপানেক পাকিস্তানের পরিকল্পনা কমিশনের উপদেষ্টা ছিলেন কয়েক বছর। তিনি উদ্যোক্তা তৈরি করাকেই পাকিস্তানের উন্নয়নের প্রধান উপায় হিসেবে তুলে ধরেন ও সে রকম যাবতীয় পরামর্শ দিয়ে যান। যার ফলে ২২ পরিবারের জন্ম হয়। পাপানেক অবশ্য ১০০ পরিবার তৈরির কথা বলেছিলেন। তিনি ও তাঁর সহকর্মীরা পাকিস্তানে পুঁজিবাদী উন্নয়ন বয়ে আনার জন্য সামরিক সরকারের ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন। তাঁর মতাদর্শের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদ মাহবুব উল হক। ‘পাপানেক ও মাহবুব উল হক দুজনেই জেনেশুনে এই বিশেষ ধরনের অর্থনৈতিক উন্নয়ন-প্রক্রিয়া সমর্থন করেছিলেন, যা কিনা দুই অঞ্চলের মধ্যে ব্যাপক বৈষম্য তৈরি করেছিল। তাদের কাছে এই ব্যাপক বৈষম্য কোনো বিষয় ছিল না যতক্ষণ পর্যন্ত পরিকল্পনায় সামষ্টিক অর্থনৈতিক সূচক গুরুত্ব পেত।’ (পৃ-১০৭) মজার বিষয় হলো ১৯৭১ সালে পাপানেক এক লেখায় পাকিস্তানের উন্নয়নের প্রশংসা করে বলেছিলেন যে অন্যান্য স্বল্পোন্নত দেশের জন্য পাকিস্তান গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষণীয়। অথচ এত বড় অর্থনীতিবিদ তখনো টের পাননি যে সংযুক্ত পাকিস্তান বলে আর কিছু থাকছে না। বছরের পর বছর পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে সম্পদ স্থানান্তর করে এবং পূর্ব পাকিস্তানকে বিনিয়োগে বঞ্চিত করে যে আর্থসামাজিক বৈষম্য তৈরি করা হয়েছিল, তা এসব অর্থনীতিবিদের কাছে কোনো গুরুত্বই পায়নি। বরং দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নে এ রকমটি হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়—এই ধারণাই তাদের মগজে গাঁথা ছিল।
আবার আরেকটি আশ্চর্যের বিষয় হলো, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাপানেক বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে সমর্থন ব্যক্ত করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে কাজও করেছিলেন। আর তাই ২০১৩ সালে তাঁকে ৬৮ জন বিদেশি বন্ধুর সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা প্রদান করা হয়। তার আগে তিনি ২০১০ সালে বিনিয়োগ বোর্ডের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করতে বাংলাদেশে এসেছিলেন।
মোকাররাম হোসেন পূর্ব পাকিস্তানের আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক বঞ্চনা ও তা থেকে সৃষ্ট বৈষম্যের ওপর বিশেষভাবে জোর দিয়েছেন। বস্তুত মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের নেপথ্যে এই বৈষম্য ও তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ যে বিরাট চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছে, এই প্রতিষ্ঠিত ধারণাকে তিনি আরেকটু জোরালো করেছেন।
তিন.
একদিকে বঞ্চনা-বৈষম্য, অন্যদিকে স্বকীয়তা-স্বতন্ত্রতায় আঘাত—এই দুইয়ের মধ্য থেকেই পাকিস্তান আমলে বাঙালি জাতীয়তাবাদ নতুনভাবে জেগে ওঠে। ১৯৪৮ সালে জিন্নাহর উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের এর প্রতিবাদ—এর মধ্য দিয়েই বাঙালি সত্তায় আঘাত ও এই সত্তার নবরূপে জেগে ওঠার আভাস মিলেছিল। পরবর্তীকালে প্রমাণিত হয় যে ভাষা আন্দোলনের রক্তস্নাত পথ বেয়ে বাঙালির স্বকীয়তা সমুন্নত রাখার পাশাপাশি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নিরন্তর লড়াইয়ে লিপ্ত হতে হয় পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিকে, যার প্রতিফলন ঘটে শেখ মুজিবের ছয় দফা ঘোষণা ও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার মধ্য দিয়ে। এ-সংক্রান্ত ঘটনাপ্রবাহ সংক্ষেপে তুলে ধরার পাশাপাশি বিশ্লেষণ করার মধ্য দিয়ে লেখক অগ্রসর হয়েছেন। দেখিয়েছেন যে এই প্রতিবাদ-আন্দোলনের তীব্রতাই সামরিক শাসক আইউব খানের পতন ঘটাতে বড় ভূমিকা রাখে। এরপর সত্তরের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু স্বভাববশত পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হিসেবে শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা শুরু করে। মূলত ১৯৭১ সালের ১ মার্চ ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করার ঘোষণা দিয়ে পাকিস্তানের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়ার স্পষ্ট অনীহা প্রকাশ করেন। কিন্তু এর মধ্য দিয়ে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের গণ-আন্দোলন ও রাজনীতির গতিমুখকে কার্যত বদলে দেন। পাশাপাশি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের কাছে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃত্ব ও রাজনীতিকদের বিশ্বাসযোগ্যতার সামান্য যেটুকু অবশিষ্ট ছিল, সেটুকুও শেষ করে দেন। আর সেনাবাহিনীর সঙ্গে আঁতাতকারী জুলফিকার আলী ভুট্টো এরপর ঢাকায় এসে শেখ মুজিবের সঙ্গে আলোচনায় বসার ঘোষণা দেন। লেখকের মতে, ভুট্টো একটা তামাশা করছিলেন। একদিকে তিনি জাতীয় পরিষদে মুজিবের সঙ্গে বসবেন না, অন্যদিকে আবার জাতীয় পরিষদের বাইরে মুজিবের সঙ্গে আলাপ করবেন। এর মধ্যে ইয়াহিয়া ঢাকায় আসেন ৩ মার্চ মুজিবের সঙ্গে আলোচনার জন্য।
১৯৭১ সালের মার্চের উত্তাল দিনগুলোতে ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণকে ঘিরে ঢাকা ও আশপাশে যে টানটান উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল, লেখক নিজে তার প্রত্যক্ষদর্শী হওয়ায় এ সম্পর্কিত বিবরণ ও বিশ্লেষণে কিছুটা আবেগের ছোঁয়া পাওয়া যায়। তিনি এই পরিস্থিতিতে শেখ মুজিবের মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলেছেন, ‘শেখ মুজিব কখনোই পূর্ব পাকিস্তানিদের স্বার্থের সঙ্গে আপস করেননি এবং আরও অনেক পূর্ব পাকিস্তানি রাজনীতিকদের মতো পশ্চিম পাকিস্তানিদের সঙ্গে যোগ দেননি। যখন কেউ বাঙালিদের স্বার্থ নিয়ে কথা বলেনি, শেখ মুজিব বলেছেন। শুধু বলেনইনি, জোরালোভাবে বলেছেন। পাকিস্তানের অগণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে তিনি অনেক সুযোগ পেয়েছেন, যেখানে বাঙালির স্বার্থে নেওয়া নিজের কঠোর অবস্থান থেকে পিছু হটতে ও আপস করতে পারতেন। কিন্তু তিনি গণতান্ত্রিক অধিকার ও অগ্রাধিকারের প্রতি নিজের প্রতিশ্রুতিতে অটল থেকেছেন। তিনি কোনো সুবিধাবাদী নেতা ছিলেন না।’ (পৃ-২১৬)
সে কারণেই ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় তিনি কী বলবেন, তা নিয়ে নানা জল্পনাকল্পনা ছিল। মোকাররাম হোসেন বলছেন, ‘৭ মার্চ মুজিবের ভাষণ ছিল অসাধারণ। তিনি কোনো একতরফা ঘোষণা দেননি, কিন্তু রাজনৈতিক গতিময়তা উজ্জীবিত রাখার জন্য সবই বলেছেন এবং নিজ নেতৃত্বের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাননি। জনগণ তখন এতটাই উদ্বেলিত ছিল যে তা আরও উপচে উঠে গণ-অভ্যুত্থানকে গণবিধ্বংসী করে তুলতে পারত, যার ওপর কোনো নেতারই নিয়ন্ত্রণ থাকত না। ... পুরো দেশ মুজিবের কথা শুনেছে। জনগণের সমর্থন ও আনুগত্য মুজিবকে কার্যত পুরো দেশের নেতা বানিয়ে দেয়। ইয়াহিয়া বা পাকিস্তানি প্রশাসন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি হারিয়ে ফেলে। মুজিব স্বাধীনতার (আনুষ্ঠানিক) ঘোষণা দেননি এ জন্য যে তা আর দেওয়ার কোনো প্রয়োজন ছিল না। ... মুজিব আসলে অবিভক্ত ভারতের গান্ধীর অনুসরণে অসহযোগ ও অহিংস আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন। অসহযোগ আন্দোলন বিরাট সাফল্য বয়ে এনেছিল। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ প্রথমবারের মতো বুঝতে পেরেছিল যে তাদেরও কিছু ক্ষমতা আছে। তারা উপলব্ধি করতে পারে যে একতাই বল। মুজিব সমঝোতার দ্বার খোলা রেখেছিলেন যদিও অসহযোগ আন্দোলন বেশ ভালোভাবেই চলছিল। মুজিব শুধু পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচিত সদস্য ও রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের সভাপতিই ছিলেন না, তিনি এই ভূখণ্ডের সবচেয়ে শক্তিশালী নেতা হয়ে উঠেছিলেন। তিনি তাঁর সেরার সেরাটা প্রদর্শন করেছিলেন। আর অনেক উঁচুতে উঠেও তিনি কখনোই বিনয়ী ও সহানুভূতিপূর্ণ স্বভাব থেকে বিচ্যুত হননি।’ (পৃ-২১৭-২১৮)
মোকাররাম হোসেনের বিশ্লেষণের সারকথা হলো, শেখ মুজিব শান্তিপূর্ণ উপায়ে ন্যায্য ও যৌক্তিক দাবি আদায়ের জন্য আন্দোলন পরিচালিত করেছেন, কিন্তু পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ভুট্টো ও অন্যান্য রাজনীতিবিদের সঙ্গে মিলে তা দমনের সহিংস পথ বেছে নেয়, যা পাকিস্তানের ভাঙন ও বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে অনিবার্য করে তোলে। ২৫ মার্চ রাতে নিরীহ বাঙালির ওপর বর্বরোচিতভাবে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ঝাঁপিয়ে পড়ার মধ্য দিয়ে যে গণহত্যার সূত্রপাত পাকিস্তান ঘটায়, তা ইতিহাসে ক্ষমার অযোগ্য বলেই বিবেচিত।
চার
বইটির অষ্টম অধ্যায়টির ওপর একটু বিশেষ পর্যালোচনা করা যেতে পারে। ‘জেনোসাইড: হোয়াট দ্য ওয়ার্ল্ড ইগনোরড’ শিরোনামের মধ্য দিয়েই পরিষ্কার হয়ে যায় যে লেখক এখানে কী তুলে ধরতে চেয়েছেন। ১৯৭১ সালের গণহত্যাকে বিশ্ব যে কতটা উপেক্ষা করেছে, তার কিছু প্রমাণও দিয়েছেন তিনি। লেখক জানাচ্ছেন যে ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশবিষয়ক ১৯৬৫-১৯৭৩ সময়কালের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোপন ও সংরক্ষিত দলিলপত্রের কিছু দলিল বরাবরই গোপন রাখা হয়েছে, যা যুক্তরাষ্ট্র সরকার কখনোই প্রকাশ করেনি। যে দলিলপত্রগুলো প্রকাশ করা হয়েছে, তার মধ্যে ১৯৭১ সালের ১৬ মার্চ থেকে ২ এপ্রিল পর্যন্ত শুধু ২৯ মার্চ তারিখের একটি বাদে আর কোনো দলিল বা নথি নেই। ২৯ মার্চ তারিখের দলিলটিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর প্রসঙ্গ রয়েছে। ‘যুক্তরাষ্ট্র সরকার ১৯৭১ সালের ১৬ মার্চ থেকে ১৯৭১ সালের ২ এপ্রিল পর্যন্ত সময়কালের দলিলপত্রগুলো যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার অজুহাতে জনসমক্ষে প্রকাশ করেনি। তবে এসব দলিল অবমুক্ত না করার মধ্য দিয়ে এটাই প্রতীয়মান হয় যে নিক্সন প্রশাসন ও পাকিস্তানের ইয়াহিয়া সরকারের মধ্যে আলোচ্য সময়কালে যেসব যোগাযোগ ঘটেছিল, সেসব তারা প্রকাশ করতে আগ্রহী নয়। প্রকাশিত দলিলগুলো বরং এই ধারণা দেয় যে পূর্ব পাকিস্তানে ওই সময়কালে কোনো গণহত্যা বা গণনিধন হয়নি। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কোনো সার্চলাইট অপারেশন পরিচালনা করেনি।’ (পৃ-২২৬) অবশ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোপন দলিলপত্র নিয়ে লেখকের পর্যবেক্ষণে কিছুটা অসম্পূর্ণতা আছে। কেননা, ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের কনসাল জেনারেল আর্চার ব্লাড ওয়াশিংটনে যেসব টেলিগ্রাম বা তারবার্তা প্রেরণ করেছিলেন, সেগুলো পরবর্তীকালে প্রকাশিত হয়েছে, যা ব্লাড টেলিগ্রাম নামে পরিচিত। তার মানে ১৬ মার্চ থেকে ২ এপ্রিল সময়কালের কোনো গোপন দলিল প্রকাশিত হয়নি, বিষয়টি ঠিক নয়। মোকাররাম হোসেন বাঙালি গণহত্যার ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানিদের দৃষ্টিভঙ্গিও তুলে ধরেছেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানে যে নৃশংসতা ও নির্মমতা সংঘটিত হয়, তা পশ্চিম পাকিস্তানিরা পুরোপুরি উপেক্ষা বা অস্বীকার করেছিল।’ (পৃ-২৩০) তিনি আরও দেখিয়েছেন, ‘শুধু নিক্সন প্রশাসনই ইয়াহিয়াকে সমর্থন জানায়নি। আরও অনেকগুলো আন্তর্জাতিক সংস্থা যেগুলো যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অধীনে ছিল, সেগুলো পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতিকে পশ্চিম পাকিস্তানি নেতৃত্বের প্রচারণার মতো করেই দেখেছিল। ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসের গোড়ার দিকে এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট একটি পর্যবেক্ষণে বলেছিল: বাস্তবতা হলো, একটি বেসামরিক সরকারের বহিরাবরণে সেনাবাহিনীর নীতি ও কার্যক্রম ক্রমাগত ও গভীরভাবে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি জনগোষ্ঠীকে বিরূপ করে তুলছে। বিষয়টা যেন এমন যে ২৫ মার্চ রাতের সেনা অভিযান তখনো বাঙালিদের বিরূপ মনোভাবাসম্পন্ন করে তোলেনি। রাজনীতি বড় বিচিত্রভাবে অগ্রসর হয়। ব্রিটিশ সরকার পাকিস্তান সরকারের নিন্দা জানাতে পারছিল না, কিন্তু কিছু ব্রিটিশ সাংবাদিক পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতার যে চিত্র তুলে ধরেছিল তাতে করে ব্রিটিশ রাজনীতিকেরা পাকিস্তানি নির্মমতাকে স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিলেন।’ (পৃ. ২৩৩-২৩৪)
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি গণচীনের সমর্থনও গণহত্যাকে ইন্ধন জোগায়। মোকাররাম হোসেন লিখেছেন, ‘পাকিস্তানি জেনারেলরা যখন যুদ্ধ অপরাধ করছিল ও গণহত্যা চালাচ্ছিল তখন তারা কোনো নিন্দার মুখে পড়েনি এ জন্য যে তারা চীনের কমিউনিস্ট শাসক ও যুক্তরাষ্ট্রের পুঁজিবাদী শাসকদের কাছ থেকে রাজনৈতিক সমর্থন পেয়েছিল। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান চীন সরকার ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একটি সম্পর্ক স্থাপনে নিক্সনকে সহযোগিতা করার মাধ্যমে নিক্সনের ঘনিষ্ঠ বন্ধুতে পরিণত হন। কিসিঞ্জার ও তাঁর চীনা অনুরূপের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনে ইয়াহিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।... প্রেসিডেন্ট নিক্সন আইউব খানকে পছন্দ করতেন আর ইয়াহিয়ার সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে চীনের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে সহায়তা করায়। তবে এই বন্ধুত্বের জের ধরে নিক্সন গণহত্যাকে “অভ্যন্তরীণ বিষয়” হিসেবে উল্লেখ করে উপেক্ষা করেন এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও পাকিস্তানের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব বজায় রেখে ভুট্টোর নতুন পাকিস্তানকে সহায়তা করেন।...এটাই রাজনীতির প্রকৃতি। যখন হাজার হাজার নিরীহ মানুষ গণহত্যার শিকার হচ্ছিল, যখন তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছিল, যখন নারীরা ধর্ষিত হচ্ছিল, তখন বিশ্বের দুই শক্তিধর জাতি—আমেরিকা ও চীন—কূটনৈতিক বোঝাপড়ায় লিপ্ত ছিল। আর এই কাজ সহজীকরণে যিনি ছিলেন, তিনি ছিলেন গণহত্যার মূল আয়োজক।’ (পৃ. ২৩৮-২৩৯)
তবে এই অধ্যায়ে গণহত্যার নীরব সমর্থক হিসেবে বা বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের বিপক্ষে ও পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান গ্রহণকারী মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশসহ অন্যান্য দেশের বিষয়ে কোনো তথ্য বা বিশ্লেষণ তুলে ধরা হয়নি। সেগুলো তুলে ধরা গেলে বিশ্ব যে গণহত্যাকে কী মাত্রায় উপেক্ষা করেছে, সে বিষয়ে বিস্তৃত ধারণা পাওয়া যেত।
পাঁচ
বইটির শেষ অধ্যায়ে বাঙালির প্রতিরোধ, মুক্তিবাহিনী গঠন ও পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার সংক্ষিপ্ত বিবরণ ও বিশ্লেষণ তুলে ধরা হয়েছে। এখানে লেখক একপর্যায়ে বলেছেন, ‘সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রাম প্রায় নয় মাস অব্যাহত ছিল আর তা প্রতিবেশী ভারতের কাছ থেকে বিপুল সমর্থন পেয়েছে। এই দুনিয়ায় সংগ্রামরত জনগণের অন্য দেশের কাছ থেকে সমর্থন-সহায়তা পাওয়া কখনোই সমস্যা হয়নি। ভিয়েতনামে ভিয়েতকংদের আশ্রয় দিয়েছিল কম্বোডিয়া আর বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছিল ভারত।’ (পৃ. ২৪৬)। এই অধ্যায়সহ বইটি শেষ হয়েছে ঢাকায় নিয়াজী আত্মসমর্পণের ঘটনার বিবরণী তুলে ধরার মধ্য দিয়ে।
সার্বিকভাবে বইটির মধ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের ইতিহাসকে একটি বিস্তৃত পটভূমিতে তুলে ধরার প্রয়াস রয়েছে। বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক জোরালো বিশ্লেষণই এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য যেন পাঠক বিশেষত ভিনদেশিরা ঘটনাগুলোর তাত্পর্য ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত সম্পর্কে ধারণা পেতে পারে। লেখক অবশ্য নতুন প্রজন্মের জন্য বইটি লিখেছেন বলে উল্লেখ করেছেন। এই নতুন প্রজন্মের মধ্যে আছে যারা বাংলাদেশের বাইরে বড় হয়েছে ও বেড়ে উঠেছে কিন্তু বাংলাদেশি পিতা-মাতার সন্তান বা পরের প্রজন্ম তারা। বাংলা পড়তে-লিখতে না জানার কারণে মুক্তিযুদ্ধের এই বিশ্লেষণধর্মী ইতিহাস তাদের জন্য প্রয়োজনীয়। আবার যারা বাংলাদেশ ও এর ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করতে আগ্রহী হবেন, তাঁদের জন্যও এটি একটি সহায়ক গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
বইটিতে লেখক অন্যদের গবেষণা ও লেখনী থেকে প্রচুর উদ্ধৃতি দিয়েছেন নিজের বর্ণনা ও বিশ্লেষণের সমর্থনে। এই ধরনের কাজে সেটা স্বাভাবিক। তবে সূত্রসহযোগে যেভাবে এই উদ্ধৃতিগুলো ব্যবহার করা হয়েছে, তা স্বাচ্ছন্দ্যে বই পড়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে বাধা তৈরি করে। কেননা, বারবার বন্ধনীতে লেখক বা সম্পাদকের নামসহ প্রকাশনার বছর ও বই বা পত্রিকার পৃষ্ঠাসংখ্যা [যেমন: (Frank, ১৯৯৮:১২৭) বা (Wheeler, ১৯৭০:১৬৩)] তুলে ধরায় তা যেমন দৃষ্টিকটু হয়েছে, তেমনি পড়তে গিয়ে কিছুটা হোঁচট খেতে হয়েছে। আবার অনেক ক্ষেত্রেই যথাযথভাবে উদ্ধৃতি চিহ্ন ব্যবহার করা হয়নি বা বাদ পড়ে গেছে। এতে করে কোনটুকু সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে সরাসরি উদ্ধৃত তা বোঝা দুষ্কর হয়ে পড়েছে। বরং, প্রয়োজনীয় উদ্ধৃতির ক্ষেত্রে সূত্রগুলো পাদটীকা হিসেবে অথবা প্রতি অধ্যায় শেষে দেওয়া যেত। যদিও বইয়ের শেষে তথ্যসূত্র হিসেবে ব্যবহূত বই, জার্নাল ও অন্যান্য প্রকাশনার বিস্তারিত অধ্যায়ভিত্তিকভাবে ভাগ করে তুলে দেওয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, বিভিন্ন বইয়ের পাশাপাশি লেখক লাইব্রেরি অব কংগ্রেসের আর্কাইভ থেকে লন্ডন টাইমস, গার্ডিয়ান, পাকিস্তান অবজারভার, ডন ও মর্নিং নিউজ পত্রিকার পুুরোনো সংখ্যা ঘেঁটেছেন। এই ব্যয়বহুল কাজে তাঁকে যুক্তরাষ্ট্রের স্প্রিংফিল্ড ভার্জিনিয়ার সফল বাংলাদেশি ব্যবসায়ী হাবিব খান যে সমর্থন জুগিয়েছেন, তা তিনি ভূমিকায় উল্লেখ করেছেন।
বইটির একটি বড় দুর্বলতা হলো ভারসাম্যহীন পুনরাবৃত্তি। ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহ উপস্থাপন ও বিশ্লেষণে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার পুনঃ পুনঃ উল্লেখ একটি স্বাভাবিক কাজ। কিন্তু এই বইয়ে যেভাবে বিভিন্ন ঘটনার ও বিশ্লেষণের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে, তাতে মনে হয় যে লেখক যথেষ্ট পরিকল্পনামাফিক অগ্রসর হননি বা বইয়ের অধ্যায় বিন্যাসের ক্ষেত্রে পরিকল্পনার ঘাটতি ছিল। আর তাই অনেক ক্ষেত্রেই পাঠকের আগ্রহ হারিয়ে ফেলার সুযোগ তৈরি হয়েছে।
বইটির আরেকটি বড় দুর্বলতা হলো মুদ্রণপ্রমাদ, যা অনেক ক্ষেত্রে বিভ্রান্তি তৈরি করে, তথ্যগত বিকৃতি ঘটায় ও অর্থহীন হয়ে ওঠে। বোঝাই যায়, চূড়ান্ত সম্পাদনায় যথেষ্ট যত্ন নেওয়া হয়নি। সাহিত্য প্রকাশের মতো দেশের একটি খ্যাতনামা প্রকাশনা সংস্থার কাছেও এই ধরনের ত্রুটি-বিচ্যুতি কাম্য নয় মোটেও। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক একটি গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের ক্ষেত্রে।
সব মিলিয়ে বইটি হাতে নিয়ে প্রথম দিকে যে প্রত্যাশা তৈরি হয়, পরের দিকে এসে সে প্রত্যাশায় ভাটা পড়ে যায়। তাই উল্লেখিত ত্রুটি-বিচ্যুতি সংশোধনসহ ভালোভাবে সম্পাদনা করে পরবর্তী সংস্করণ প্রকাশের চেষ্টা করা উচিত। তা না হলে বাইরের দুনিয়ার ও নতুন প্রজন্মের কাছে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস তুলে ধরার এই শ্রমসাধ্য প্রয়াসটি কাঙ্ক্ষিত মূল্যায়ন পাবে না।