ভূমিকা
২০০৬ সালের শেষ ভাগে বাংলাদেশে নবগঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ এবং ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা নিয়ে ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দলের মধ্যে তীব্র মতপার্থক্যের সৃষ্টি হয়। প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে যাঁর অধিষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল, আর যাঁকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল, ওই দুজন সম্পর্কে বিরোধী দলের মূল্যায়ন ছিল, তাঁরা ক্ষমতাসীন দলের অতি ঘনিষ্ঠ; তাঁরা সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করার মতো যথেষ্ট নিরপেক্ষ বা স্বাধীন নন। সুতরাং, তাঁদের স্থলে উভয় দলের কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তির আসা উচিত। কিন্তু ক্ষমতাসীন দল এই বিষয়গুলোতে বিরোধী দল ও তার মিত্রদের কাছে গ্রহণযোগ্য কোনো ছাড় দিতে অস্বীকৃতি জানায়। এ কারণে বিরোধী দল ও তার মিত্ররা প্রতিবাদ-বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকে। দুই দলের কর্মীদের মধ্যে এবং বিরোধী দলের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর সংঘর্ষ বাধতে থাকে। এই সংঘর্ষ কখনো কখনো সহিংস হয়ে ওঠে। এতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডসহ স্বাভাবিক জীবনযাত্রা স্থবির হয়ে পড়ার হুমকি দেখা দেয়।
তবু পূর্বনির্ধারিত সময়সূচি অনুযায়ীই নির্বাচন করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ থাকেন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়। ক্ষমতাসীন দল কর্তৃক নিযুক্ত রাষ্ট্রপতি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্বও তুলে নেন নিজ কাঁধে। নির্বাচন অনুষ্ঠানের কাজ চলতে থাকে। ২০০৬ সালের ৯ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতি বেসামরিক প্রশাসনকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজে সহায়তার জন্য সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন করেন। ২০০৭ সালের ৩ জানুয়ারি প্রধান বিরোধী দল ও এর জোটের অন্য দলগুলো ঘোষণা দেয়, তাদের দাবি না মানা হলে নির্বাচনে তারা অংশ নেবে না এবং দেশব্যাপী প্রতিবাদ-বিক্ষোভ চালিয়ে যাবে।
এই পরিস্থিতিতে কেবল বলপ্রয়োগের মাধ্যমেই নির্বাচন করা সম্ভব ছিল। নির্বাচন অনুষ্ঠানে বিরোধী দলগুলো বাধা সৃষ্টি করতে চাইলে তাদের বলপ্রয়োগে, এমনকি সামরিক শক্তি ব্যবহার করে, সহিংসভাবে দমন করেই কেবল তা করা যেত। ২০০৭ সালের ১০ জানুয়ারি সেনাবাহিনীকে নির্বাচন অনুষ্ঠানে বা ভোটদানের প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত চেষ্টাকারী যেকোনো ব্যক্তিকে ওয়ারেন্ট ছাড়াই গ্রেপ্তার করে তাদের হেফাজতে নেওয়ার ক্ষমতা অর্পণ করা হয়। অর্থাত্, নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব স্পষ্টত সেনাবাহিনীর হাতে দিয়ে দেওয়া হয়, যাতে সরকারের অনুকূলে নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে আসা সম্ভব হয়।
২০০৬ সালের শেষ কয়েক মাস থেকে শুরু করে এই সময়ের পুরোটা জুড়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো প্রধান শক্তিগুলো এবং বাংলাদেশ সফরে আসা সেই সব দেশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা একটি সমঝোতায় পৌঁছানোর জন্য বারবার তাগিদ দেন। প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেত্রীর সঙ্গে তাঁরা একের পর এক বৈঠকে বসেন। তাঁদের সমঝোতায় পৌঁছানোর জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে গেলেও কোনো কাজে আসেনি। একই সময়ে জাতিসংঘের মহাসচিবও বিদ্যমান পরিস্থিতি নিয়ে তাঁর উদ্বেগ জানিয়ে বিরোধের শান্তিপূর্ণ মীমাংসার আবেদনও রাখেন।
তবে খালেদা জিয়া দাতাদের চাপের কাছে নতি স্বীকার করার মেজাজে ছিলেন না। নির্বাচনের আগে ও পরে গোলযোগের কারণে অর্থনৈতিক জীবন স্থবির হয়ে পড়লে দাতারা যৌক্তিক কারণে সহায়তা বন্ধ করে দিতে পারতেন। এসব দেশ তো শুধু প্রধান দ্বিপক্ষীয় দাতাই ছিল না; বহুপক্ষীয় যেসব সংস্থা বাংলাদেশের বহিস্থ সহায়তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উত্স, সেগুলোর সিদ্ধান্ত প্রভাবিত করার ক্ষমতাও এদের রয়েছে। লক্ষণীয় যে, বৈদেশিক সাহায্যের ওপর বাংলাদেশের অনেক নির্ভরতা থাকা সত্ত্বেও খালেদা জিয়া দাতাদেশগুলোর প্রত্যক্ষ চাপকে প্রতিরোধ বা অগ্রাহ্য করার সিদ্ধান্ত নিলেন। যদিও দাতাদেশগুলোর সহায়তা বন্ধ করে দেওয়ার প্রচ্ছন্ন হুমকি থেকে গিয়েছিল।
অতীত অভিজ্ঞতায় খালেদা জিয়া দেখেছেন, সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে অতীতে যেসব সরকার এদেশে ক্ষমতাসীন হয়েছে, সেগুলোর বৈধতার প্রশ্নে তাদের সঙ্গে দাতাদের স্বাভাবিক সম্পর্ক চালিয়ে যেতে সমস্যার সৃষ্টি করেনি। খালেদা জিয়া হয়তো ভেবেছেন, বিরোধী দলের অনুপস্থিতিতে নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনের মাধ্যমে এবং সেনাবাহিনীর সহায়তায় তাঁর বেসামরিক সরকার ক্ষমতায় এলে তাঁর সরকারের সঙ্গে দাতাদের আচরণ ভিন্ন হওয়ার কোনো কারণ নেই। এমনটা ধারণা করা যেতেই পারে। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, তাঁর প্রতি দেশের সামরিক কর্তৃত্বের নিঃশর্ত সমর্থন আছে এবং তারা তাঁর প্রতি অনুগত। সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ ব্যক্তিরা তো তাঁর সময়ে তাঁর দ্বারা নিযুক্ত।
তদুপরি খালেদা জিয়া হয়তো ভেবেছেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তাঁর প্রতি ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করে। তিনি একটি নির্ভেজাল পাশ্চাত্যমুখী ও রক্ষণশীল দলের প্রতিনিধিত্ব করেন, যার ইসলামি জঙ্গিবাদ বা বাম চিন্তার প্রত্যক্ষ নজির নেই। সর্বোপরি, সৌদি আরবসহ আরব বিশ্বের রক্ষণশীল সরকারগুলোর বেশ পছন্দনীয় তিনি। এসব আরব দেশীয় সরকার পশ্চিমা গণতান্ত্রিক দেশগুলোর (উদাহরণস্বরূপ যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের কথা বলা যায়) ঘনিষ্ঠ মিত্র। সুতরাং, দাতারা সহায়তা বন্ধ করে দিতে পারে, এটা তিনি আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করেননি।
সবচেয়ে খারাপ যে অবস্থা হতে পারত তা হলো, অল্প সময়ের জন্য সহায়তার প্রবাহটা কমে যেত। দাতাদের অবধারিতভাবেই এই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করতে হতো। কারণ, শুধু নির্বাচন পরিচালনার ধরন পছন্দসই না হওয়ার কারণে বাংলাদেশের মতো একটি দরিদ্র দেশকে সহায়তাবঞ্চিত না করার জন্য তাদের ওপর প্রচণ্ড চাপ থাকত। শাসকের স্বৈরাচারী অপকর্মের দায়ে সহায়তা বন্ধ করে গরিব দেশের বঞ্চিত জনগণকে শাস্তি দেওয়ার নীতি পশ্চিমা গণতন্ত্রে অতীতে খুব একটা জনপ্রিয়তা পায়নি।
তবু প্রধানত গরিবের উপকারে লাগে এমন মানবিক সহায়তা, যেমন—সামাজিক নিরাপত্তাজাল কর্মসূচি ইত্যাদিতে দেওয়া সহায়তা দাতাদের বন্ধ করে দেওয়ার সম্ভাবনা ছিল ক্ষীণ। সরকারি খাতের জরুরি প্রয়োজনীয় চলতি ব্যয়ভার বহন করার জন্য পর্যাপ্ত অভ্যন্তরীণ সম্পদ বাংলাদেশে সৃষ্টি হতো। স্বল্প সময়ের উন্নয়ন ব্যয়ের জন্য একদিকে যেমন বিদেশি সহায়তার ওপর প্রচণ্ড নির্ভরতা ছিল, অন্যদিকে পুঞ্জীভূত স্বল্প-ব্যবহূত সহায়তা সরকারের নিয়ন্ত্রণে ছিল।
এই পর্যায়ে এসে এই প্রশ্ন উত্থাপন প্রাসঙ্গিক, বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধানের ব্যাপারে এবং সমাধানে পৌঁছাতে ব্যর্থ হলে রাজনৈতিক অচলাবস্থা ও সহিংসতা বন্ধে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপের জন্য তাদের ওপর চাপ প্রয়োগে দাতা গোষ্ঠী কেন এতটা উত্সাহী ছিল।
এই রাজনৈতিক গোলযোগে দাতারা কেন এতটাই আগ্রহী যে তাদের সক্রিয় হস্তক্ষেপ করতে হয়? পৃথিবীর বহু দেশ এমন গোলযোগের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। সবখানে তো দাতারা হস্তক্ষেপ করে বলে মনে হয় না। বাংলাদেশে দাতাদের হস্তক্ষেপের কয়েকটি কারণের কথা ভাবা যেতে পারে:
প্রথমত, রাজনৈতিক সংঘাত এবং ফলস্বরূপ সামাজিক-অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা অত্যন্ত গরিব একটি দেশের উন্নয়নে গুরুতর ব্যাঘাত ঘটাবে, আর এভাবে দারিদ্র্য-পরিস্থিতি আরও শোচনীয় হয়ে উঠবে। দক্ষিণ এশিয়ায় ১৫ কোটিরও বেশি জনসংখ্যার একটি দেশের দশা নাজুক হলে তা এই অঞ্চল বা এই অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য সহায়ক নয়। অধিকন্তু, এই পরিস্থিতি দাতাদের উন্নয়ন-সহায়তা কর্মসূচিগুলোকে ঝুঁকিতে ফেলবে। দাতাদেশগুলোর সহায়তাদানকারী প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিদের সহায়তা কর্মসূচি চালু থাকার ব্যাপারে প্রাতিষ্ঠানিক স্বার্থ তো আছেই। এ দিক বিবেচনায় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা তারা দেখতে চায়।
দ্বিতীয়ত, একটি বিকল্প অথচ সম্পর্কিত কারণ হলো, পাকিস্তান থেকে মালয়েশিয়া হয়ে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত ইসলামি দেশের যে বৃত্ত, বাংলাদেশের অবস্থানও সেই বৃত্তের পরিধির মধ্যে। আফগানিস্তান-পাকিস্তান সীমান্ত অঞ্চলকে বলা যেতে পারে চরমপন্থী ইসলামি মতাদর্শের এপিসেন্টার। এখানে (ক) বিপুলসংখ্যক ইসলামি বিদ্যাপীঠ আছে, উপসাগরীয় দেশগুলো থেকে এগুলোতে নিয়মিত প্রচুর সম্পদ আসে। জনশ্রুতি আছে, এসব বিদ্যাপীঠের বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানই চরমপন্থী মতাদর্শের দীক্ষা দেয়, এবং (খ) সন্ত্রাসবাদী কলাকৌশল শেখানোর জন্য এদের কতগুলো প্রশিক্ষণকেন্দ্র আছে, যেখানে বহু দেশ থেকে সদস্য সংগ্রহ করে আনা হয়। বাংলাদেশের সঙ্গে সেই অঞ্চলের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ থাকায় এই দেশ যদি রাজনৈতিক গোলযোগ এবং তজ্জনিত আর্থসামাজিক অস্থিতিশীলতায় পতিত হয়, তা হলে সেই অঞ্চল থেকে এখানে চরমপন্থী মতাদর্শের বিস্তারের ঝুঁকি বাড়বে এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোতে চরমপন্থী গোষ্ঠীর উত্থান বা উত্সাহ জোগাতে বাংলাদেশ রাস্তা হিসেবে কাজ করতে পারে। বাংলাদেশ ও তার প্রতিবেশী দেশগুলোতে ইতিমধ্যে সহিংসপ্রবণ এমন কতগুলো গোষ্ঠীকে চিহ্নিত করা গেছে।
তৃতীয়ত, বাংলাদেশের উত্তরে অবস্থিত ভারতের রাজ্যগুলোতে কয়েকটি মাওবাদী গোষ্ঠী আর ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোয় বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর সক্রিয়তা দেখা যায়। এরা ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে অস্থিতিশীলতার কারণে রাষ্ট্রযন্ত্র নাজুক হয়ে পড়লে হয়তো এসব গোষ্ঠীর কার্যক্রমের পরিধি আরও ব্যাপক হবে এবং তাদের সংগ্রাম চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্র ও গোলাবারুদের জোগান সহজে মিলবে। এখানে বর্ণিত সব উপাদান একসঙ্গে হলে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে, তা দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শান্তি ও স্থিতিশীলতাকে হুমকিতে ফেলবে—এটা উন্নত বিশ্ব, পশ্চিমা দেশগুলোসহ বাদবাকি দুনিয়ার বড় উদ্বেগের কারণ। এদের তো এশিয়ায় সুদূরপ্রসারী এবং ব্যাপক মাত্রার বাণিজ্য ও বিনিয়োগ-স্বার্থ রয়েছে।
জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রম দপ্তরের হস্তক্ষেপ
এই পরিস্থিতিতে প্রধান শক্তিগুলোর বা দাতাদের চাপ প্রয়োগের একমাত্র কার্যকর পথ ছিল তাঁর সবচেয়ে নাজুক জায়গা, অর্থাত্ সেনাবাহিনীর সমর্থনকে টার্গেট করা। সেনাবাহিনীর ওপর দাতাদের একমাত্র সুবিধাজনক জায়গা ছিল জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী মিশনে অংশগ্রহণ করার সুযোগ হারানোর ভয় দেখানো। এসব মিশনে কাজ করার উচ্চমর্যাদা এবং অর্থনৈতিক লাভের জন্য সেনাবাহিনীর কাছে এই মিশনগুলো অত্যন্ত লোভনীয় ছিল।
গত কয়েক বছরে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী মিশনে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ দেশ ও দেশের বাইরে অনেক প্রশংসিত হয়েছে। এ ধরনের মিশনে অংশগ্রহণ বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর বিদেশে যে শুধু মর্যাদা বাড়িয়েছে তা-ই নয়, বরং বিভিন্ন সমাজ ও সংস্কৃতির সংস্পর্শে নিজেদের অভিজ্ঞতার পরিধি বিস্তৃত হতে সহায়তা করেছে এবং বিভিন্ন দেশের সেনাবাহিনীর ঐতিহ্য ও চর্চার সঙ্গে পরিচয় ঘটিয়েছে। অধিকন্তু, এতে অংশগ্রহণকারী সেনাসদস্যরা উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বাড়তি আয় করতে পেরেছেন। পালাক্রমে বহু সেনা ও সেনা কর্মকর্তা এ ধরনের মিশনে অংশ নিয়েছেন (সংযুক্তি টেবিল দেখুন)।১
জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশন সরকারের ওপর এ ধরনের চাপ প্রয়োগ করেছে, তার কী প্রমাণ আছে? এ ব্যাপারে পত্রিকায় অনেক প্রতিবেদন ও গুজব প্রকাশিত হয়েছে, যা সংশ্লিষ্ট পক্ষ, বিশেষ করে জাতিসংঘ স্বীকার বা প্রতিবাদ কোনোটাই করেনি।২ কিছুকাল আগেও জাতীয় সংসদে এক বিতর্কে ক্ষমতাসীন দলের কয়েকজন সাংসদ জাতিসংঘের বিরুদ্ধে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি সেনাবাহিনী দ্বারা তৈরি অগণতান্ত্রিক সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলোকে সমর্থন দেওয়ার অভিযোগ করেছেন। তাঁরা বলেছেন, জাতিসংঘের ঢাকা দপ্তরকে কাজে লাগিয়ে এটা করা হয়েছিল।৩
এ বিষয়ে প্রকাশিত একমাত্র নির্ভরযোগ্য প্রতিবেদন হলো সেনাপ্রধানের আত্মজীবনী।৪ সেখানে তিনি দুটো ঘটনার বর্ণনা দেন: একটিতে গুরুত্বপূর্ণ দাতাদেশগুলোর সরকার সেনাপ্রধানের সঙ্গে সাক্ষাতে জানায়, সেনাবাহিনী যদি সেই সময়ে বাংলাদেশে বিরাজমান পরিস্থিতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানে সহায়তা করে, তা হলে তারা জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী দপ্তরকে শান্তিরক্ষা কর্মসূচি পরিচালনায় বাংলাদেশ থেকে সেনা নেওয়ার বিষয়টি পুনর্বিবেচনা অথবা নিষিদ্ধ করতে অনুরোধ করবে। দ্বিতীয় যে ঘটনাটির উল্লেখ তিনি করেছেন, সেটি ঘটে ১০ জানুয়ারি, যখন শান্তিরক্ষা কর্মসূচি পরিচালনার আন্ডার সেক্রেটারি জ্যঁ-মেরি জিহেন্নো সেনাপ্রধানকে একই অনিবার্য শর্ত মেনে নিতে বলেন, অর্থাত্, শান্তিরক্ষা কর্মসূচি পরিচালনায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণ ঝুঁকিতে পড়বে, যদি সেনাবাহিনী এই নির্বাচন অনুষ্ঠানে সহায়তা করে। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কর্মসূচি পরিচালনা দপ্তর থেকে সেনাপ্রধানের এসব বিবৃতি কখনো স্বীকার করে নেওয়া হয়নি এবং এগুলোর প্রতিবাদও করা হয়নি। তা ছাড়া জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কর্মসূচি পরিচালনা দপ্তরের আন্ডার সেক্রেটারি জ্যঁ-মেরি জিহেন্নোর এ ধরনের হস্তক্ষেপের ঘটনা মহাসচিবের সম্মতি বাদে ঘটতে পারত না।৫
বিরোধী দলগুলোর বয়কট করা এবং তাদের কাছে অগ্রহণযোগ্য কোনো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে তাতে রাজনৈতিক গোলযোগ ও অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির বড় আশঙ্কা ছিল। এ অবস্থায় এমন একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে সেনাবাহিনীর সহায়তা করার মতো অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহে সেনাবাহিনীর ভূমিকাকে ভিত্তি করে এসব মিশনে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীকে অংশগ্রহণ করতে না দেওয়া জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কর্মসূচি পরিচালনা দপ্তরের আওতার মধ্যে পড়ে কি না, কিংবা এটা করার কর্তৃত্ব দপ্তরটির আছে কি না, এমন প্রশ্ন উঠেছে। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রম সম্পর্কে বাইরে থেকে অথবা প্রকাশিত দলিল থেকে যতটুকু জানা যায়, তার ওপর ভিত্তি করে এই প্রশ্নের ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব নয়। তবে সবাই অবগত, সংঘর্ষ বা গৃহযুদ্ধ ইত্যাদি সমস্যাসংকুল কোনো জায়গা বা দেশে শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠানোর সিদ্ধান্ত জাতিসংঘের মহাসচিবের সুপারিশক্রমে সাধারণ পরিষদ গ্রহণ করে। শান্তিরক্ষী মিশনের সদস্যসংখ্যা এবং প্রয়োজনীয় সম্পদের বিষয়টিও সাধারণ পরিষদ অনুমোদন করে। অনুমোদিত হওয়ার পর এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ভার ছেড়ে দেওয়া হয় জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা দপ্তরের ওপর। শান্তিরক্ষী বাহিনীর জন্য যথোচিতসংখ্যক সদস্য সংগ্রহ করা এবং এসব কার্যক্রমে সেনা পাঠাতে আগ্রহী দেশগুলো থেকে সেনা সংগ্রহ করে বাহিনী গঠন করার কাজ করত এই দপ্তর।
জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা দপ্তর জাতিসংঘের সদস্যদেশগুলোকে এই কার্যক্রমে সেনা পাঠাতে আমন্ত্রণ জানায়; কোনো সদস্যদেশ সেনা পাঠাবে কি না এবং পাঠালেও তার সংখ্যা কত হবে, সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত শুধু সেই দেশটিই নিতে পারে। একটি দেশ থেকে শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে কত সেনা চায় এবং শান্তিরক্ষা মিশনে কাজের জন্য সেনাদের কোন কোন ক্ষেত্রে দক্ষতা ও বিশেষ জ্ঞান দরকার, সেই সিদ্ধান্ত নেয় এই দপ্তর। তবে এটিও অনুধাবনযোগ্য, কোনো দেশ সেনা পাঠাতে চাইলেও সেই দেশের সশস্ত্র বাহিনীর দক্ষতা, সামর্থ্য ও অভিজ্ঞতার অভাবের কারণে প্রয়োজনীয় যোগ্যতা পূরণ না-ও করতে পারে।
আর সব দেশ সেনা পাঠাতে চায় না। আসলে, গত কয়েক বছরে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে সেনার চাহিদা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। প্রয়োজনীয়সংখ্যক সেনা সংগ্রহ করতে জাতিসংঘকে বারবার অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ ২০০৮ সালের কথা বলা যেতে পারে। সে বছর অনুমোদিত ও মোতায়েন করা সেনাসদস্যের মধ্যে ফারাক ছিল ১৮ হাজার। মোতায়েন করা সেনাসংখ্যা ছিল ৭৭ হাজার। ২০০৮ সালের নভেম্বরে জাতিসংঘ দপ্তর ইঙ্গিত দিয়েছিল যে সেনাস্বল্পতার চ্যালেঞ্জের মুখে পড়লে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের মতো প্রধান সেনা সরবরাহকারী দেশগুলোর দ্বারস্থ হবে। এই দেশগুলো ১৯৯৮ সাল থেকেই জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীর বড় অংশ ক্রমাগত বর্ধিত হারে পাঠিয়ে গেছে।৬
সুতরাং, এই আলোকে মনে হয়, জাতিসংঘের মহাসচিবের (এবং তাঁর আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেলের) এ ধরনের কাজের জন্য সাধারণ পরিষদ অথবা নিরাপত্তা পরিষদের কোনো অনুমোদনের দরকার হয় না। কেননা, জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রম সম্পর্কে যা জানা যায়, তা থেকে মনে হয়, জাতিসংঘের এমন সব সংগঠন শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে কোন দেশ কত সেনা দেবে, সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা বাছাইয়ের কাজে জড়িত নয়। এটা সেনা পাঠানো দেশগুলো এবং জাতিসংঘের সচিবালয় অর্থাত্, মহাসচিবের দপ্তরের মধ্যকার বিষয়। শান্তিরক্ষা কার্যক্রম পরিচালনায় অর্থের জন্য মহাসচিবের দপ্তর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দাতাদেশের ওপর প্রচণ্ড নির্ভরশীল। তাই এসব দেশের পক্ষ থেকে কার্যকর চাপে থাকতে হয়।৭
জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল সেনাপ্রধানকে সময়সীমা বেঁধে দেওয়ায়, সেনাপ্রধানের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী, তিনি তাঁর সামনে খোলা বিভিন্ন পথের বিষয়ে গভীরভাবে চিন্তা করেন। একদিকে তিনি বলপ্রয়োগের মাধ্যমে নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকারকে সহায়তা করতে পারতেন, এর ফলস্বরূপ জাতিসংঘের মিশনগুলোতে সেনাদের অংশগ্রহণের সুযোগ হারাতে পারতেন। অন্যদিকে তিনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রকৃতি ও গঠন পরিবর্তনে হস্তক্ষেপ করতে পারতেন, যা নির্বাচন স্থগিত করত।
সেনাপ্রধানের মতে, সব পর্যায়ের সেনা কর্মকর্তারা জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনে অংশ নেওয়ার সুযোগের অপেক্ষায় থাকেন। এখান থেকে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা মোটা অঙ্কের অর্থ অতিরিক্ত আয় করে সরকার থেকে পাওয়া তাঁদের অল্প বেতন ও সুযোগ-সুবিধার অপ্রতুলতা পুষিয়ে নিতে পারেন। তাঁর মতে, এই সুযোগ হাতছাড়া হলে সাধারণ সেনাদের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ সৃষ্টি হতে পারত এবং ১৯৭৫ সালের শেষ ভাগে যেমন সশস্ত্র বাহিনীর অভ্যন্তরে শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছিল, তেমনি শৃঙ্খলা বিপন্ন অথবা ভেঙে পড়তে পারত। সশস্ত্র বাহিনীর জন্য প্রণোদনা এবং তাদের মনোবল ধরে রাখার জন্য শান্তিরক্ষী বাহিনীতে যাওয়ার সুযোগ অপরিহার্য ছিল। এসব বিবেচনা করে সেনাপ্রধান সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন, কিছু একটা করার কোনো বিকল্প তাঁর কাছে নেই।৮
সেনাপ্রধানের হস্তক্ষেপের ধরন কী হবে, তা দাতারা সুনির্দিষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছিল কি না, সেটি সেনাপ্রধানের বর্ণনা থেকে স্পষ্ট হয় না। তাঁর বর্ণনা অনুযায়ী, তাঁর হস্তক্ষেপ করার দুটো পথ খোলা ছিল। একটি হলো ১৯৭৫ ও ১৯৮২ সালের মতোই সংবিধান স্থগিত করে সামরিক আইন জারি করা এবং পুরোদস্তুর এক সেনা সরকার প্রতিষ্ঠা করা। অন্যটি সংবিধানের আনুষ্ঠানিক সীমার মধ্যে থেকে অথবা সংবিধানের ছদ্মাবরণের ভেতরে অবস্থান করেই সেনাবাহিনী কিছু করতে পারত এবং রাষ্ট্রপতিকে নিজ কর্তৃত্ববলে জরুরি অবস্থা ঘোষণার জন্য বোঝাতে বা প্ররোচিত করতে পারত। এ ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর পছন্দসই বেসামরিক ব্যক্তিদের নিয়ে সরকার গঠিত হতো; সেনাসহায়তা ও পৃষ্ঠপোষকতায় তারা প্রশাসন চালাত, যাতে সেনাবাহিনী সব সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং সব ক্ষমতার উত্স হিসেবে থেকে যেতে পারে। এ অবস্থায়, প্রতিদিনকার প্রশাসনিক কাজকর্মের দায়িত্বে সেনাবাহিনীর উপস্থিতি দৃশ্যমান থাকত না; এর ঘোষিত উদ্দেশ্য ছিল স্বল্পতম সময়ের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং সংসদীয় গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া পুনঃপ্রতিষ্ঠা। গুজব শোনা গিয়েছিল, যদিও সেনাবাহিনীর একটি অংশ চেয়েছিল, তবু দাতারা সংবিধান স্থগিতকরণ এবং সামরিক আইন জারির বিরোধিতা করেছিল। অবশ্য সেনাপ্রধানের আত্মজীবনীতে এ বিষয়ের ওপর কোনো আলোকপাত করা হয়নি। সামরিক আইন জারি করে সরাসরি বা খোলাখুলিভাবে ক্ষমতা গ্রহণে সেনাবাহিনীর ভেতরে একমত না হতে পারা কিংবা এ ব্যাপারে দাতাদের বিরোধিতা, যে কারণেই হোক না কেন, শেষ পর্যন্ত পরোক্ষ পথই বেছে নেয়।
সেনাবাহিনী একটি অন্তর্বর্তীকালীন বেসামরিক সরকার নিয়োগ দিয়েছিল, যেটি নির্বাচন কমিশন, নির্বাচনী আইন ও বিধিবিধানে পরিবর্তন আনার পর এবং নতুন ভোটার তালিকা প্রস্তুত করে তাদের তত্ত্বাবধানে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠান করবে।
সেনাবাহিনী ও জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশন—কিছু প্রশ্ন
ওপরের বিশ্লেষণের আলোকে প্রাসঙ্গিকভাবে দুটি প্রশ্ন উত্থাপন করা হতে পারে: সেনাসদস্যদের দেওয়া মোট বেতন-ভাতা কি সেনাবাহিনীতে নিয়োগ এবং একটি পরিতৃপ্ত ও উদ্দীপ্ত সেনাবাহিনী চালানোর ক্ষেত্রে অপর্যাপ্ত? সেনাপ্রধানের মতানুসারে তাই শান্তিরক্ষী কার্যক্রম থেকে বাড়তি আয়ের সুযোগই তাহলে একমাত্র অবলম্বন? এই পরিপ্রেক্ষিতে আরও কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করা যেতে পারে। গত শতকের আশির দশকের শেষ দিক পর্যন্ত যখন শান্তিরক্ষী মিশনে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর কোনো অংশগ্রহণ ছিল না, তখন সেনাবাহিনীর মধ্যে উদ্দীপনা ও মনোবলের অবস্থা কী ছিল?৯ সেই সময় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বেতন কি অপর্যাপ্ত ছিল? তারা কি বঞ্চিত ছিল? আর এ জন্য কি তখন সেনাবাহিনী ক্ষুব্ধ কিংবা অসুখী ছিল? নাকি তারা মোটামুটি সন্তুষ্টই ছিল কিন্তু পরবর্তী সময়ে শান্তিরক্ষা মিশনের মাধ্যমে বাড়তি আয়ের সুযোগ ভোগ করার পর তারা এতে অভ্যস্ত হয়ে উঠল এবং এটিকে তাদের প্রত্যাশিত আয়ের একটি অংশ হিসেবে বিবেচনা করতে থাকল? এটা আসলে যতটা না প্রয়োজনীয় বা অত্যাবশ্যক প্রণোদনা, তার চেয়ে বরং বেড়ে যাওয়া প্রত্যাশার ব্যাপার হয়ে দাঁড়াল। সুতরাং, সেনাবাহিনীকে খুশি ও সন্তুষ্ট রাখার ক্ষেত্রে শান্তিরক্ষী মিশনের পথ বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা এতটা গুরুতর ব্যাপার হয়ে দাঁড়ানো ছিল খুবই অপ্রত্যাশিত।
তবে অনেক দরিদ্র দেশের সেনাবাহিনী জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী মিশনে যোগদান করে না অথবা করলেও তাদের অংশগ্রহণ খুবই সীমিত। কীভাবে তারা সেনাবাহিনীর জন্য একটি প্রণোদনা কাঠামো উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়েছে, যার দ্বারা লড়াই করার পর্যাপ্ত মনোবলসমৃদ্ধ একটি সন্তুষ্ট সেনাবাহিনী তারা প্রতিপালন করতে পারে—এটি যাচাই করাটা বেশ আগ্রহোদ্দীপক ব্যাপার হবে।
অন্যান্য দেশের সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের চেয়ে আমাদের দেশের সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের মোট বেতন-ভাতা কম—এই যুক্তি এখানে প্রাসঙ্গিক নয়। বাংলাদেশের সরকারি খাতের সব কর্মীর ক্ষেত্রে এই যুক্তি খাটে। সামরিক বা বেসামরিক যে প্রশাসনেরই হোক না কেন, তার সদস্যদের বেতন-ভাতা নির্ভর করে সেই দেশের আয়ের স্তর এবং সরকারি সমস্ত ব্যয় মেটানোর জন্য সম্পদের প্রাপ্যতার ওপর।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে বাকি সব সরকারি সেবা খাত বা প্রশাসনের সাপেক্ষে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের বেতন-ভাতা উন্নত কিংবা উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় বাংলাদেশে কম না বেশি, সেটা কেউ বিবেচনা করতে পারেন। বেসামরিক প্রশাসন বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং বিডিআর১০ সদস্যদের বেতন-ভাতার সঙ্গে তাঁদের বেতন-ভাতার তুলনা করলে কী দাঁড়ায়? এসব বিষয়ে ভালো ধারণার অধিকারী ব্যক্তিদের দৃঢ় মত যে স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, বাসস্থান ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা যেমন—ভোগ্যপণ্য ও অন্যান্য গৃহস্থালির সরঞ্জাম ক্রয়ের ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর সদস্য হিসেবে যে বিশেষ সুযোগ-সুবিধা তাঁরা পান, তা বেসামরিক প্রশাসনে কর্মরত নানা স্তরের কর্মকর্তাদের চেয়ে অনেক বেশি। নানা সুবিধাসহ সেনাসদস্যদের মোট বেতন-ভাতা সম্পর্কে কোনো তথ্য সামাজিক পরিসরে অনায়াসে পাওয়া যায় না।১১
আভাস দেওয়া হয়েছে, সশস্ত্র বাহিনীর বেতন-ভাতার সঙ্গে বেসামরিক প্রশাসনের বেতন-ভাতার তুলনা করা সম্যকভাবে ঠিক নয়। কেননা, বেসামরিক কর্মকর্তারা নানাভাবে দুর্নীতি ও ঘুষের মাধ্যমে তাঁদের আয়ের ঘাটতি পুষিয়ে নিতে পারেন, কিন্তু সশস্ত্র বাহিনীর সেই ধরনের কোনো সুযোগ নেই। এ ক্ষেত্রে যুক্তি দেওয়া যেতে পারে, প্রতিরক্ষা খাতে সরঞ্জামাদি এবং অস্ত্রশস্ত্র ও রসদ কেনার প্রক্রিয়া দুর্নীতিমুক্ত নয়। আসলে বিশ্বজুড়ে পরিচালিত ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিরক্ষা খাতে কেনাবেচায় দুর্নীতি হয় অত্যন্ত বেশি। কারণ, এ ধরনের কাজ লোকচক্ষুর আড়ালে এবং অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় ঘটে অনেক বেশি। এই কেনাবেচার বাজার খুব একটা প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নয়। সাধারণত দুই দেশের সরকার অথবা কোনো সরকার এবং কোনো বৃহত্ প্রতিরক্ষা ঠিকাদার ও সরঞ্জাম প্রস্তুতকারক বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এ ধরনের চুক্তি হয়। তবে সশস্ত্র বাহিনীর প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম এবং অনিরাপত্তা জোগান কেনার ক্ষেত্রে দুর্নীতির সুবিধাভোগী হওয়ার সম্ভাবনা মূলত সশস্ত্র বাহিনীর ওপরের দিককার পদে অধিষ্ঠিত কর্মকর্তাদের, যেখানে বেসামরিক প্রশাসনে দুর্নীতির ক্ষেত্রে সব স্তরের কর্মকর্তারা সুবিধাভোগী হন বলে মনে করা হয়।
এই বিশ্বাস অত্যন্ত জোরালো যে শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে অর্থনৈতিক সুবিধা লাভের সুযোগ অন্য সরকারি খাতের চাকরিজীবীরা (কিছু মাত্রায় পুলিশের কর্মকর্তারাও এই সুযোগ পান) না পাওয়ায় প্রতিরক্ষা-সংশ্লিষ্ট অন্যান্য খাতসহ সরকারি খাতের কর্মীদের মধ্যে পরশ্রীকাতরতা ও অসন্তুষ্টি কাজ করে। কিছুকাল আগে সংঘটিত বাংলাদেশ রাইফেলসের (বিডিআর) বিদ্রোহের সময় তাদের অসন্তুষ্টির অন্যতম জায়গা হিসেবে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়েছে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণে সুযোগ না পাওয়ার বিষয়টি। যদিও জাতিসংঘ মিশনে কাজ করার সামর্থ্য কিংবা যথেষ্ট প্রশিক্ষণ তাদের ছিল কিংবা তেমন প্রশিক্ষণ করিয়ে নেওয়া সম্ভব ছিল।
সর্বোপরি আগামী দিনগুলোতেও নিয়মিতভাবে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণের সুযোগ রয়ে যাবে, এমন ধারণাও করা যায় না। ভবিষ্যতে যদি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ঘটনাবলির সঙ্গে যোগসূত্রহীন কোনো কারণে শান্তিরক্ষী মিশনে অংশগ্রহণের সুযোগ কমে যায় অথবা একেবারে বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে কী হবে?
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ২০০৯ সালে প্রায় ১০ হাজার সেনাসদস্য এসব মিশনে যোগদান করেছেন; দেশের মোট সেনাসদস্যের সংখ্যাটি যদি প্রায় এক লাখ ৫০ হাজার ধরি, তাহলে সেই সংখ্যা মোট সেনাসদস্যের প্রায় ৭ শতাংশ। পাকিস্তান অথবা ভারতের ক্ষেত্রে অবস্থা এমন নয়। শান্তিরক্ষা মিশনে তাদের সেনাসংখ্যা আমাদের চেয়ে সামান্য বেশি। কিন্তু দুই দেশেরই সেনাবাহিনী আকারের দিকে থেকে বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বড়।১২
সর্বোপরি, শান্তিরক্ষা মিশনে সশস্ত্র বাহিনীর বড় একটি অংশ জড়িত থাকার মানে হলো, কোনো মুহূর্তে ব্যবহারোপযোগী বাহিনীর আকার কার্যত কম হওয়ায় বাহিনীর সামর্থ্য প্রত্যাশিত সামর্থ্যের চেয়ে কম হয়। এই হিসেবে তাই দেশের প্রতিরক্ষাজনিত চাহিদার বিষয়টি উন্মোচিত হয়। উল্টো দিক থেকে এমন অর্থও করা যেতে পারে, প্রতিরক্ষার জন্য অপরিহার্যভাবে যে আকারের সেনাবাহিনী দরকার, তার চেয়ে বর্তমানে সেনাবাহিনীর আকার বড়।
এ অবস্থায় ভালো মনোবলের একটি সেনাবাহিনীর ভরণ-পোষণের জন্য মোট বেতন-ভাতা যদি অপর্যাপ্ত বিবেচিত হয়, তা হলে ব্যাপারটি সমন্বিত ও নিয়মতান্ত্রিকভাবে আলোচিত হওয়া উচিত। সেনাসদস্যদের বেতন-ভাতা বাড়াতে হলে হয় মোট প্রতিরক্ষা ব্যয় বাড়াতে হবে, অথবা ব্যয় অপরিবর্তিত রাখার জন্য সেনাবাহিনীর আকার ছোট করতে হবে। সেনাবাহিনীর যথার্থ আকার কেমন হবে, সেটি নির্ধারণ করতে হয় কোনো দেশের প্রতিরক্ষার চাহিদা এবং সম্পদের পরিমাণের আলোকে। আবার প্রতিরক্ষার চাহিদা মেটানোর জন্য যথার্থ সেনাবাহিনীর আকার নির্ভর করে বহিস্থ হুমকির বৈশিষ্ট্য, কোন ধরনের কর্মকাণ্ডে নিজেকে জড়াতে পারে এবং যে রাষ্ট্রের কাছ থেকে প্রতিরক্ষা করতে হবে, সে দেশের বৈশিষ্ট্য ও সামর্থ্যের ওপর। দেশের প্রতিরক্ষা চাহিদার মধ্যে চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলোর অভ্যন্তরীণ অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকাণ্ডের আশঙ্কা রোধ করা এবং এমন কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সুরক্ষা দেওয়াও অন্তর্ভুক্ত। চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলো এখন অনেক অস্ত্রসজ্জিত হয়ে থাকে আর সাম্প্রতিক কালে এদের অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকাণ্ডের বিস্তারও ঘটছে। নানা ধরনের নিরাপত্তা-চাহিদা মেটানোর জন্য সেনাবাহিনীর আকার এবং গঠনের প্রশ্নে বিভিন্ন উপায় আছে। যথাযথভাবে নিরাপত্তা-চাহিদা নিরূপণ করা অপরিহার্য আর শেষতক এটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ব্যাপার। কেননা, সরকারের প্রাপ্য অপ্রতুল সম্পদের বিকল্প ব্যবহারের প্রশ্ন এর সঙ্গে জড়িত।
অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে জাতিসংঘ মিশনে অংশগ্রহণের তাত্পর্য
সেনাবাহিনীর জন্য শান্তিরক্ষা মিশন যদি এতটাই গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়, আর তাদের অংশগ্রহণ যদি এসব মিশনের অর্থ জোগানদাতা দেশগুলোর সিদ্ধান্তের ব্যাপার হয়, তা হলে এমন যুক্তি আসতে পারে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক গতিধারাকে দাতাদের পছন্দসই আদলে গড়ে নিতে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ করার ব্যাপারে দাতারা যখন খুশি তখন প্রভাব বিস্তার করতে পারে—২০০৭ সালের শুরুর দিকে যেমনটা দেখা গেছে। কোন সময় সেনারা হস্তক্ষেপ করবে, তা নির্ধারণই শুধু নয়, হস্তক্ষেপের প্রকৃতি ও স্থায়িত্বকালও তারা ঠিক করতে পারে।১৩
জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রম দপ্তরের এ ধরনের হস্তক্ষেপ, অর্থাত্, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অবস্থাকে প্রভাবিত করার জন্য দাতাদের অর্থ প্রদানের কী প্রভাব পড়বে ভবিষ্যতে এমন হস্তক্ষেপের সম্ভাব্যতার ওপর? সাম্প্রতিক কালের এই হস্তক্ষেপ ভবিষ্যতে দেশের স্বার্থে না যাক, কিংবা সাধারণভাবে জনগণের কাঙ্ক্ষিত না হোক, কিন্তু বৃহত্ শক্তিগুলোর ভূ-রাজনৈতিক বা কৌশলগত স্বার্থেই পরিচালিত হওয়ার পথ করে দেয় না কি?
যুক্তি দেখানো হতে পারে, জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণের সুযোগ বাতিলের হুমকি শুধু বিশেষ পরিস্থিতিতেই ব্যবহার করা যেতে পারে। প্রথমত, বাংলাদেশে যে ধরনের হস্তক্ষেপ ঘটেছে, তেমন কোনো হস্তক্ষেপ প্রয়োজনীয় কি না, সে ব্যাপারে প্রধান দাতাদেশগুলোর (এখন যেমন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত রাষ্ট্রগুলো) মধ্যে একটি বোঝাপড়া থাকতে হবে। দ্বিতীয়ত, এ ধরনের হস্তক্ষেপ জনগণের কাছে ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্য হতে হবে। সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের পূর্বশর্ত হিসেবে আইনশৃঙ্খলার পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য বাংলাদেশে শক্তিশালী জনমত ছিল। সেটি কোনো সাধারণ পরিস্থিতি ছিল না। অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক গড়ন তৈরিতে হস্তক্ষেপের জন্য ক্ষমতাধর দাতাদেশগুলোর এমন প্রচণ্ড বা অপ্রতিরোধ্য চাপের সামনে সেনাবাহিনীকে ছেড়ে দেওয়া শেষ পর্যন্ত আকাঙ্ক্ষিত কি না, সেটা এক বিতর্কের বিষয়। বিশেষ করে, যখন সেনাবাহিনীর হাতে রয়ে গেছে বলপ্রয়োগের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ।
সৌভাগ্যক্রমে বাংলাদেশে সেনা হস্তক্ষেপ শিগগিরই শেষ হয়েছে; দুই বছরের মধ্যে সংসদীয় গণতন্ত্র তার সব খারাপ গুণসহকারে খোলাখুলিভাবে ফিরে এসেছে। যা হোক, সেনাসমর্থিত সরকারের মেয়াদ অনেক বেশি হয়ে গেছে—এমন জনমত দিন দিন বাড়ছিল। এবং নির্বাচন হওয়ার আগ পর্যন্ত নির্বাচন আদৌ হবে কি না, আর হলে কবে হবে, সে বিষয়ে অনেক অনিশ্চয়তা ছিল। কেননা, সেনাসমর্থিত সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর কিছুদিনের মধ্যেই মনে হচ্ছিল, শুধু অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের চেয়ে বড় এজেন্ডা সেনাদের আছে। প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে পরিবর্তনের জন্য পেছন থেকে কলকাঠি নেড়ে এবং দল পরিচালনায় অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়ায় সংস্কার এনে দেশের রাজনৈতিক ময়দান বদলে ফেলার উদ্দেশ্য তাদের ছিল। নতুন রাজনৈতিক দল গঠনে তারা উত্সাহ জুগিয়েছে, যদিও তা বাস্তবায়িত হয়নি। আস্তে আস্তে তাদের এজেন্ডায় আরও বেশ কিছু বিষয় যুক্ত হয়, যেমন—বিচার বিভাগের সংস্কার, নির্বাচিত স্থানীয় সরকারের হাতে প্রশাসনিক ও আর্থিক ক্ষমতা অর্পণ এবং নানা ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার। দুর্নীতিবাজ রাজনীতিক এবং কিছু ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট আমলাদের ফৌজদারিতে সোপর্দ করার জন্য অত্যন্ত বড় মাপের দুর্নীতিবিরোধী অভিযান শুরু করা হয়। তবে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ার প্রতি শ্রদ্ধাশীল না থেকে অনেক ক্ষেত্রে পরিচালিত হয়েছে বলে জনগণ মনে করতে থাকে। আর শিগগিরই তা নিঃশেষ হয়ে পড়ে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নানা রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সংস্কারের স্থায়িত্ব প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। যদি এর সময়সীমা এতটা দীর্ঘায়িত না হতো, তাহলে হয়তো এমনটা হতো না। সেনা কর্মকর্তারা নির্জলা দুর্নীতি যদি না-ও করে থাকেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহারের খবর পাওয়া গেছে। নিম্ন ও মধ্যস্তরের সেনা কর্মকর্তারা তখন বেসামরিক প্রশাসনের ওপর গুরুত্বপূর্ণ কর্তৃত্বের অধিকারী বলে মনে হয়েছে। রাজধানীতে এই কর্তৃত্ব যদি ততটা দৃশ্যমান না-ও হয়, বিভিন্ন জেলায় ছিল তা বিশেষভাবে প্রকাশিত। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। সারা বিশ্বেই যখন সেনাবাহিনী রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে এবং বেসামরিক প্রশাসনে জড়িয়ে যায়, তখন সে দেশের ঐতিহ্য ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির সব খারাপ দিক অর্জন করার প্রবণতা দেখা যায়। এরই মধ্যে আবার অভ্যন্তরীণ খাদ্য উত্পাদন কম হওয়ার দরুন বিশ্বে খাদ্য-সংকটের তাপ অনুভূত হতে থাকা, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও অর্থনীতির ওপর মুদ্রাস্ফীতিজনিত সার্বিক চাপের নেতিবাচক প্রতিফলন দেখা দিতে থাকে সেনাসমর্থিত অন্তর্বর্তী সরকারের নৈপুণ্য ও বৈধতার ক্ষেত্রে। ২০০৭ সালের প্রথম দিকে সরকারের প্রতি যতটা জনসমর্থন দেখা গিয়েছিল, ২০০৮ সালে এসে তা ক্ষয় হতে শুরু করে।
এসব বিষয় মিলে ধীরে ধীরে সরকার জনবিচ্ছিন্ন হতে থাকে, জনগণের মোহমুক্তি ঘটতে থাকে। পাশাপাশি সেনাবাহিনীর নানা ভূমিকার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার ঝোঁক দেখা যায়। অন্তর্বর্তী সরকার কত দিন ক্ষমতায় থাকবে এবং সরকারের প্রকৃতি কেমন থাকবে—এমন সব জরুরি প্রশ্নে সেনাবাহিনীর ভেতরে মতপার্থক্য থাকার আভাস পাওয়া যাচ্ছিল। প্রথম দিকে যেসব কাজ করা হয়, শিগগিরই তা উল্টে যেতে দেখা গেল। সংবাদ প্রচারিত হয়েছিল, সেনাবাহিনীর কট্টর একটি অংশ অন্তর্বর্তী শাসনকে আরও দীর্ঘায়িত করতে চাইছিল আর বাকি অংশ স্বল্প সময়ের মধ্যে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া পুনঃপ্রতিষ্ঠার পক্ষপাতী ছিল। আদিতে যে দাতারা অত্যন্ত বিতর্কিত একটি নির্বাচন বন্ধ করতে সেনা হস্তক্ষেপের আহ্বান জানিয়েছিল এবং একে সমর্থন করেছিল, তারাই তখন প্রকাশ্যে যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সরকারের পুনঃপ্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তাদের অতিশয় আশাবাদ ব্যক্ত করতে শুরু করে, আর একান্ত আলাপে সেনাসমর্থিত সরকারের প্রতি এ ব্যাপারে জোরালো আহ্বান জানায়। তবে ধারণা করা যায়, দাতারা প্রথমে সেনাবাহিনীকে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করার আহ্বান জানানোর ফলে তারা হয়তো সেনাসমর্থিত অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আরও কিছুদিন তাদের সমর্থন অব্যাহত রাখত, কিন্তু যে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছিল, তা ছিল অনিশ্চয়তায় ভরা। শেষ পর্যন্ত শিগগির গণতান্ত্রিক সরকারের পুনঃপ্রতিষ্ঠার পক্ষে সেনাবাহিনীর অংশ এবং দাতাদের সংশোধিত কৌশলের জয় হয়।১৪
অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা ছাড়ার পর বাংলাদেশ কমবেশি আবার দুই বছর আগের অবস্থায় ফিরে যায়। পার্থক্য শুধু এই যে, একটি নির্ভরযোগ্য ভোটার তালিকার ভিত্তিতে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। রাজনীতির ঘড়ি পুনরায় ২০০৬ সালের সঙ্গেই মিলিয়ে রাখা হয়। একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক মূল্যায়নের দিক থেকে এই দুই বছরের অন্তর্বর্তী সময়ে কোনো নিট অর্জন নেই। সম্মতিভিত্তিক এমন একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া যেখানে রাজনৈতিক দলগুলো প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে, কিন্তু পরস্পরের সঙ্গে সংঘর্ষে যাবে না এবং ‘বিজয়ী সবকিছু নেবে না’—তেমন প্রক্রিয়ার দেখা মেলেনি। রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় কোনো ধরনের গুণগত পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে হয়নি। এই অভিজ্ঞতা থেকে সায় মেলে যে রাজনৈতিক ময়দানকে পুনর্গঠন এবং গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার অপরিহার্য বিধিগুলো প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সেনা হস্তক্ষেপ খুব কমই সফল হয়।
এই ফাঁদ থেকে বের হওয়ার উপায় কী?
জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণের সুযোগবঞ্চিত হওয়ার হুমকির প্রতিক্রিয়ায় সেনা নেতৃত্বের পক্ষে বেসামরিক সরকারের কার্যকর ক্ষমতা গ্রহণকে এড়াতে পারত কি না, সেটা বিবেচনার দাবি করে। একটি বিকল্প দৃশ্যকল্পের কল্পনা করা সম্ভব, যেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিরোধের ক্ষেত্রে সেনাবাহিনী পুরোপুরি নিরপেক্ষ থাকার সিদ্ধান্ত নেবে। ২০০৬ সালের শেষ ভাগে যখন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দেনদরবার চলছিল, তখন সেনাবাহিনী তত্কালীন সরকারের কাছে স্পষ্ট করতে পারত যে রাজনৈতিক বিরোধে হস্তক্ষেপ তাদের কাজ নয়—রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মধ্যস্থতা করা কিংবা এক দলের পক্ষ হয়ে আরেক দলের বিরুদ্ধে হস্তক্ষেপ সেনাবাহিনীর কাজ নয়। সেনাপ্রধান ও তাঁর জ্যেষ্ঠ সহকর্মীরা সেই পর্যায়ে তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার দ্বারস্থ হতে পারতেন এবং তাঁকে নিশ্চিত করে জানিয়ে দিতে পারতেন যে বলপ্রয়োগে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে দমন করে নির্বাচনের প্রক্রিয়াকে সহজতর করার জন্য তিনি তাঁদের ওপর নির্ভর করতে পারবেন না। তাঁর পক্ষে সেনাবাহিনী কোনো পরিস্থিতিতেই হস্তক্ষেপ করবে না—খালেদা জিয়ার যদি এই দৃঢ় বিশ্বাস তৈরি হতো, তাহলে তাঁর আপসের পথে যাওয়ার সম্ভাবনাই ছিল সবচেয়ে বেশি। তিনি কেবল পুলিশ বাহিনীর সহায়তায় বিরোধী দলগুলোকে দমন এবং নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে পারতেন না। হতে পারত যে প্রধান দুই দল তাদের সমর্থকদের সমবেত করে রাজপথে বড় জমায়েত তৈরি করত। আর এই জমায়েত সহিংস হয়ে ওঠার আশঙ্কা তো ছিলই। কিন্তু রাজপথে দুই দলের সমর্থকেরা পরস্পরের সমকক্ষ হওয়ায় তাদের মধ্যে রাজপথে যে লড়াই হতো, তার ফল কী হতো, তা কেউ বলতে পারে না। তাই খালেদা জিয়ার সামনে আপস করা ছাড়া অন্য কোনো পথ খোলা থাকত না। সেনা নেতৃত্ব যদি খালেদা জিয়ার পক্ষে হস্তক্ষেপ না করার সিদ্ধান্তে ঐক্যবদ্ধ থাকত, তাহলে বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে আপসে না গিয়ে কোনো নির্বাচন হতে পারত না। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রম দপ্তরের কোনো হস্তক্ষেপের দরকার হতো না। আর ২০০৭ সালের জানুয়ারির নির্বাচনে সহায়তা না করার জন্য সেনাবাহিনীর ওপর কঠিন চাপ প্রয়োগেরও দরকার হতো না।
এই প্রকল্প (হাইপোথিসিস) অথবা দৃশ্যকল্প কি বাস্তবসম্মত? কিংবা এটা কি অতিরিক্ত আশাবাদী? বিকল্প আরেকটি দৃশ্যকল্প হতে পারত, সেনাবাহিনী নিরপেক্ষ থাকল, কোনো হস্তক্ষেপ করল না। কিন্তু রাষ্ট্রপতি, যিনি সদ্য বিদায় হওয়া সরকার কর্তৃক নিযুক্ত, নিজে সেনাবাহিনীর সহায়তা ছাড়াই নির্বাচন অনুষ্ঠানের কাজ চালিয়ে গেলেন। কিন্তু এ কাজে তাঁকে সহায়তা দিলেন বিগত সরকারের কর্মী-সমর্থকেরা; অস্ত্রশস্ত্র তাঁদের নাগালের একেবারে বাইরে ছিল না এবং বিরোধী দলের কর্মী-সমর্থকদের চেয়ে যেকোনো দিক থেকে এদের অনেক ভালোভাবেই সশস্ত্র হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। চরম অবস্থায় বোঝা যাচ্ছিল, বিরোধী দলগুলোর অংশগ্রহণ ছাড়াই কোনো রকমে নির্বাচন করা হতে পারে। কিন্তু সে ক্ষেত্রে নির্বাচনের পরপর রাজপথে বিক্ষোভ হতো, দুই দলের মধ্যে সংঘর্ষ বেধে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ত। যুক্তি দেখানো যেতে পারে, এসব সংঘর্ষের ঘটনা অল্প কিছুদিন চলত, তারপর থেমে যেত। কিন্তু বিরোধী দলগুলোর সংখ্যাগত শক্তি এবং সারা দেশে তাদের প্রতি বিপুল জনসমর্থন বিবেচনায় তেমনটা ঘটার সম্ভাবনা ছিল খুবই কম। সুতরাং, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংঘর্ষ অপ্রশম্য গতিতে চলতে থাকত। সে অবস্থায় স্বাভাবিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটত। এমন অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে দাতারা তাদের স্বাভাবিক কাজকর্ম চালিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও ছিল ক্ষীণ।
এই পরিস্থিতিতে একদলীয় নির্বাচনের ফলাফল বাতিল এবং উভয় দলের অংশগ্রহণে নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠানসহ রাজনৈতিক আপসে পৌঁছার ব্যাপারে সাধারণ মানুষের দিক থেকে চাপ থাকার সম্ভাবনা ছিল অত্যন্ত বেশি। তবে ইতিমধ্যে দেশের মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড মারাত্মকভাবে ব্যাহত হতো, এমনকি কিছু জীবনও ঝরে যেতে পারত। এসব সম্ভাব্য বিকল্প দৃশ্যকল্পের সম্ভাব্যতা নিয়ে দেশের ভেতরে বিতর্ক ও মতভিন্নতা এখনো চালু আছে।
রাজনৈতিক বিরোধ সম্পর্কে সেনাবাহিনী কেন নিরপেক্ষ থাকার সিদ্ধান্ত নিল না? কারণ, সম্ভবত সেনাবাহিনীর উচ্চপর্যায়ের নেতৃত্ব তখনকার সরকার কর্তৃক নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে-বিপক্ষে বিভক্ত ছিল অথবা সেনা নেতৃত্বের মধ্যে মতৈক্য ছিল, যে দলটিই ক্ষমতাসীন হোক না কেন, রাজনৈতিক সরকারের বদলে সেনা সরকারই আসা উচিত। যারা অসমর্থনযোগ্য বা অগ্রহণযোগ্য নির্বাচনকে সমর্থনের বিরুদ্ধে কিন্তু সরাসরি সামরিক শাসন অথবা জরুরি ব্যবস্থার বিশেষ ক্ষমতাসহ সেনাসমর্থিত বেসামরিক সরকার যে রূপেই হোক না কেন তার জন্য সেনা হস্তক্ষেপের জন্য আকুল ছিল, জাতিসংঘের চাপ প্রয়োগ পরিস্থিতি তাদের অনুকূলে নিয়ে আসে। সেনাবাহিনীর ভেতরে পুরোপুরি নিরপেক্ষ থাকার পক্ষে কোনো সমর্থন ছিল না। যদি সেনাবাহিনীর ভেতরে নিরপেক্ষতার প্রতি দায়বদ্ধতা এবং এর পক্ষে একতা থাকত, তাহলে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রম দপ্তরের কোনো জায়গা বা হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হতো না। কেননা, সে ক্ষেত্রে বিরোধী দলগুলোর দাবিগুলোতে ক্ষমতাসীন দল কর্তৃক ছাড় না দিয়ে এবং বিরোধী দলগুলোর অংশগ্রহণ ছাড়া কোনো নির্বাচন হতে পারত না।
আওয়ামী লীগ সেনা হস্তক্ষেপকে মেনে নিয়েছিল। কারণ, পরিকল্পিত নির্বাচন বাতিল হয়েছিল আর নতুন নির্বাচন কমিশনারের মাধ্যমে নতুন ভোটার তালিকা প্রস্তুত করে নতুনভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রতিশ্রুতি পাওয়া গিয়েছিল সেনাবাহিনীর কাছ থেকে। তবে আওয়ামী লীগ প্রত্যাশা করেছিল, একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পর যে দলই জিতুক, তার কাছে সরকারের শাসনভার অর্পণ করে সেনাবাহিনী নিজের জায়গায় ফিরে যাবে। কিন্তু অতীতে বাংলাদেশ বা অন্য কোনো দেশে সেনা হস্তক্ষেপের পরিসমাপ্তি এভাবে ঘটেনি। সেনাবাহিনী যখন একবার রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করে, তখন সাধারণত ক্ষমতা ছাড়তে চায় না। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশকে এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হয়নি। বেশ কিছু কারণে এই পরিণতি এড়াতে পেরেছে: দাতাদের চাপের বিষয়টি বিশদভাবে আগেই উল্লেখ করা হয়েছে; অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতির পাশাপাশি সেনাবাহিনীর ভেতরে বিভক্তিও এতে ভূমিকা রেখেছে। কিছু অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হলেও সেনা হস্তক্ষেপ দুই বছরের বেশি টিকতে পারেনি। নির্বাচনে বিজয়ী দলের কাছে ক্ষমতা সমর্পণ করতে সেনাবাহিনী রাজি হয়েছিল। কিন্তু অবশেষে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সেনা হস্তক্ষেপের নীতি অপরিবর্তিতই রয়ে গেছে এবং একে অস্বীকৃতি জানানো হয়নি। রাজনৈতিক বিরোধে সেনাবাহিনীর পুরোপরি নিরপেক্ষতার ধারাটি প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
গত তিন দশকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার কোনো সুযোগ হাতছাড়া করেনি। সেনাবাহিনী সব সময় কোনো না কোনোভাবে বিপথগামী রাজনীতিকদের শায়েস্তা করার ভার নিজের কাঁধে তুলে নেওয়া এবং সেই সব রাজনীতিককে তাঁদের উপযুক্ত জায়গায় পাঠানোকে দায়িত্ব মনে করেছে। যদিও ১৯৯১ সালের পর সেনা কর্তৃত্ব প্রকাশ্য রাজনৈতিক ক্রিয়া করা থেকে পশ্চাদপসরণ করেছে কিন্তু রাজনৈতিক দৃশ্যপটের নিরপেক্ষ ও আগ্রহশূন্য দর্শক হয়ে থাকেনি। দেড় যুগ ধরে (১৯৭৫-১৯৯১) যে অভ্যাস তৈরি হয়েছে, সেটি ভাঙা এত সহজ নয়। এত দীর্ঘ সময় ধরে সেনাবাহিনী প্রতিদ্বন্দ্বীহীন বা বাধাবিপত্তিহীন ক্ষমতাচর্চার যে স্বাদ পেয়েছে, তাতে সাধারণভাবে রাজনীতিবিদদের সম্পর্কে তাদের যে শুধু নিচু ধারণা তৈরি করেছে, তা-ই নয়; বরং যখনই তাদের মনে হয়, কোনো রাজনৈতিক সরকার বিপথগামী, তখনই সেটিকে অপসারণ করাকে নিজেদের চূড়ান্ত দায়িত্ব বোধ করে।
আর রাজনীতিকেরা বিরোধ মীমাংসার গণতান্ত্রিক রাজনীতির নিয়মাবলি রপ্ত করতে পারেননি। দেনদরবার, যুক্তি দিয়ে বোঝানো এবং মতৈক্যে পৌঁছানোর জন্য ‘দেওয়া-নেওয়ার’ প্রক্রিয়ায় আপস—এগুলো তাঁরা শেখেননি। ১৯৪৭ সালের পর বাংলাদেশ পাকিস্তানের অংশ থাকাকালে অধিকাংশ সময়ই সামরিক সরকার ক্ষমতাসীন ছিল। স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের অত্যন্ত অস্থিতিশীল সময়ে কয়েক বছর গণতান্ত্রিক রাজনীতি চালু থাকার পর বড় একটি সময়জুড়ে বাংলাদেশ (১৯৭৫-১৯৯১) সামরিক শাসনের ভেতর দিয়ে গেছে। এই সময়টায় সরকারি আমলাদের সহযোগিতায় সরকার চালিয়েছে সেনাবাহিনী। সাধারণত ক্ষমতাহীন অথবা ছায়া সংসদ রাখা হতো, যেখানে সমাবেশ ঘটানো হতো, অনেক ক্ষেত্রে নানা দলের রাজনীতিকদের, যাঁরা ‘ ‘পাতানো’ নির্বাচনে জয়ী হয়ে এসে সংসদে গৌণ ভূমিকা পালন করতেন অথবা সেনা শাসককে বৈধতা প্রদানের আবহ তৈরিতে সহায়ক হতেন।
১৯৯১ সালে গণতান্ত্রিক রাজনীতির পুনঃপ্রতিষ্ঠার দিকে ফিরে তাকালে দেখা যাবে, রাজনীতিবিদেরা সংসদীয় গণতন্ত্রের মৌলিক রীতিনীতি শেখার এক বিরাট সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু তা তো হওয়ার নয়। ‘দেওয়া-নেওয়া’ বা আপসের নীতি অনুসরণ করা হলো না; ‘বিজয়ীর দখলি মানসিকতা’ থেকে রাজনৈতিক দলগুলো তখন মুখোমুখি অবস্থানে চলে গেল। গণতান্ত্রিক রাজনীতির রীতিনীতি রপ্ত করার সময় তেমন পাওয়া গেল না। বিভিন্নভাবে বাধাগ্রস্ত হলো। তা ছাড়া রাজনৈতিক দলগুলোর নিজেদের মধ্যে গণতন্ত্র বিশেষ ছিল না। একেকটি দল চালিত হচ্ছিল একেকজন অত্যন্ত প্রতাপশালী নেতার মাধ্যমে, যাঁদের বিপুল জনপ্রিয়তা ছিল। তাঁরা দল চালাতেন সারা দেশে দলের বিভিন্ন স্তরের নেতা-কর্মীদের প্রশ্নহীন আনুগত্যের ভিত্তিতে। ফলে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অথবা প্রধান ক্ষমতা থাকত তাঁদের হাতেই। তাই প্রতিটি দলের রাজনীতিক বা সাংসদ হতে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের নিজ নিজ এলাকায় স্বতন্ত্র জনভিত্তি তৈরি করার চেয়ে দলীয় নেতৃত্বের সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা অর্জনেই আত্মনিয়োগ করতে হয়। এর ফলে যখন কেউ দলীয় প্রধানের আশীর্বাদ বা সমর্থন অর্জন করতে সক্ষম হন, সেই ব্যক্তিই তৃণমূল পর্যায়ের কর্মী-অনুসারীদের সমর্থন লাভ করেন।
১৯৯১-পরবর্তী প্রধান দুই রাজনৈতিক দল পাল্লা দিয়ে সামরিক বাহিনীকে খুশি রাখার প্রতিযোগিতায় নামে। সেনাবাহিনীর অনুকূলে প্রসন্ন থাকে। ক্ষমতাসীন থাকাকালে উভয় দল সেনাবাহিনীকে বরাদ্দ ও সুযোগ-সুবিধা প্রদানের ক্ষেত্রে উদারতা দেখায়। মোট সেনাসদস্যের তুলনায় অসামঞ্জস্যপূর্ণ পরিমাণে উচ্চপর্যায়ের সেনা কর্মকর্তা (ব্রিগেডিয়ার ও জেনারেল) নিয়োগ করা হয়। এভাবে রাজনৈতিক ক্ষমতার অন্বেষণে তাদের পক্ষে সেনাবাহিনীর সুস্পষ্ট সমর্থন যদি পাওয়া নাও যায়, তবু যেন সায় বা আনুগত্য অর্জন সম্ভব হয়, সে জন্য তারা প্রতিযোগিতায় নামে। সেনা নেতৃত্বের সমর্থন আদায়ের এই প্রতিযোগিতায় প্রধান দুই দল ‘সমান সুযোগ’ (ইকুয়েল প্লেয়িং ফিল্ড) পেত না বলে মনে করা হয়। কেননা, একটি দলের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন জেনারেল থেকে রাজনীতিবিদে পরিণত হওয়া এক নেতা এবং ধারণা করা হয়, সত্তরের দশকের মধ্যভাগ থেকে সেনাবাহিনীর নানা স্তরের সদস্যদের সঙ্গে দলটির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। ঐতিহাসিকভাবে ঘনিষ্ঠ এই সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা এবং জোরদার করা গেলেই দলটির চলে। অন্য দলটির নেতা ১৯৭৫ সালে সেনা অভ্যুত্থানে নিহত হন। এটি ১৯৯১-পরবর্তী সেনাবাহিনীর সঙ্গে পারস্পরিক অবিশ্বাসের অবসান ঘটানো এবং অস্বস্তির সম্পর্ক মেরামত করার প্রচেষ্টায় দলটির প্রাথমিক প্রতিকূলতা ছিল। বিতর্কিত ঐতিহাসিক উত্তরাধিকারের কারণে এই দলের সেনাবাহিনীর কাছ থেকে আস্থা বা তাদের পক্ষে সেনাবাহিনীর সায় অর্জন করার কাজটি ছিল অত্যন্ত দুরূহ।
ক্ষমতাসীন থাকাকালে প্রতিটি দলই সেনাবাহিনীর উচ্চপদে এমন ব্যক্তিদের নিয়োগ দিতে চায়, যাঁরা দলটির প্রতি সহানুভূতিশীল বলে মনে হয়। এটা করতে গিয়ে তারা সেনাবাহিনীর ভেতর বিভক্তিকে উত্সাহিত করেছে। এই অশুভ ব্যাপারটি সেনাবাহিনীর পেশাদারির একেবারে বিপরীত। সেই মতো তখন সরকারের সঙ্গে সেনাবাহিনীর সম্পর্ক অনেক সময় মনে করা হতো, সেনা নেতৃত্ব কেমন করে বা কোন দিকে ঝুঁকেছে এবং সেনাবাহিনীর নানা স্তরের ওপর সেই নেতৃত্বের নিয়ন্ত্রণ কতটুকু তার ওপর নির্ভরশীল।
রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে ধরনের মতবিরোধই থাকুক না কেন, তারা ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য কোনো পরিস্থিতিতেই সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ বা সহায়তা চাইবে না—এমন কোনো মতৈক্যে পৌঁছার কোনো তাগিদ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ছিল না। কোনো রাজনৈতিক দলকে ক্ষমতায় রাখার জন্য যখনই সেনাবাহিনী হস্তক্ষেপ করে, তখনই দলটির কর্তৃত্ব ও ক্ষমতার একাংশ অবশ্যম্ভাবীরূপে সেনাবাহিনীর কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে যদি না-ও হয়, তবু বাস্তবে সমর্পণ করতে হয়। কিন্তু বিষয়টি রাজনৈতিক দলগুলো উপলব্ধি করে বলে মনে হয় না।
সেনাবাহিনীর কোনো রাজনৈতিক ভূমিকা পালন করা উচিত নয়—এ ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কিংবা সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে কোনো মতৈক্য না থাকার কারণে দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশ এমন এক ফাঁদে আটকা পড়ে যাচ্ছে, যেখানে কিছু সময় অন্তর রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় সামরিক হস্তক্ষেপ ঘটে।
এই ফাঁদ থেকে বের হওয়ার উপায় কী? রাজনৈতিক বিকাশের প্রক্রিয়ায় আরও এক উপাদান আছে, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে। অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চাকুরে, অন্যান্য পেশাজীবীসহ বাংলাদেশের সুশীল সমাজের বৃহত্ এক অংশ মনে করে, রাজনীতিবিদদের অকার্যকর নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং দুর্নীতির মতো অপশাসনের সমাধান হলো সামরিক সরকারের শাসন।১৫ বাংলাদেশে সেনাশাসিত সরকারে তারা নীতিনির্ধারণী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে।
এমন কেন ঘটে, সে ব্যাপারে সম্ভাব্য দুটি ব্যাখ্যা রয়েছে। একটি হলো রাজনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার চেয়ে সামরিক সরকারকে পেশাজীবীরা অনেক দৃঢ়, দক্ষ ও কম অসত্ হিসেবে গণ্য করে। রাজনৈতিক সরকার অনেক সময়ই সুস্থিত হয় না। অনেক ক্ষেত্রে বহুদলীয় জোটের অন্তর্ভুক্ত রাজনৈতিক দলগুলোর অদলবদল কিংবা দ্বিদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সাংঘর্ষিক কৌশল প্রয়োগের কারণে রাজনৈতিক সরকার অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে। উল্টো দিকে, সামরিক স্বৈরতান্ত্রিক সরকার যখন কার্যকর উন্নয়নকেন্দ্রিক নীতিমালা গ্রহণ করে, তখন সেগুলোর বাস্তবায়ন অধিকতর দ্রুত ও দক্ষতার সঙ্গে হতে পারে। সে ক্ষেত্রে কোনো স্বার্থান্বেষী মহলের হস্তক্ষেপ বা বাধা সৃষ্টির সুযোগ তাতে থাকবে না। বিভিন্ন ধরনের স্বার্থগোষ্ঠী কিংবা কোনো ধরনের দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্যের প্রতি আনুকূল্য প্রদর্শন করার দরকার সামরিক সরকারের নেই। একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় কোনো সমঝোতা বা মতৈক্যে পৌঁছা এবং সেটির পক্ষে ব্যাপক জনসমর্থন অর্জনের জন্য নানামুখী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে অনেক তর্কবিতর্কের পর একটি সমাধানে আসতে হয়। এ কারণে গণতান্ত্রিক শাসনের অধীনে নীতি প্রণয়ন এবং এর বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াটিকে নাজুক, কষ্টসাধ্য ও সময়সাপেক্ষ হিসেবে গণ্য করা হয় আর অনেক ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তায় ভরা থাকে। এমন যুক্তিবিন্যাসে, অংশগ্রহণমূলক ও জবাবদিহিমূলক গণতান্ত্রিক সমাজের বিবর্তনের চেয়ে আর্থসামাজিক উন্নয়নকে অধিকতর অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে দরিদ্র দেশগুলোতে গণতন্ত্রের জন্য প্রতীক্ষা চলতে পারে, কিন্তু উন্নয়নের জন্য নয়।
এই পরিপ্রেক্ষিতে দূরপ্রাচ্যের এশীয় দেশগুলোর উদাহরণ প্রায়ই দেখানো হয়, যেখানে স্বৈরশাসনের অধীনে দ্রুত উন্নয়ন ঘটেছে। তবে সেই সব দেশে একটি বিশেষ ঐতিহাসিক পরিস্থিতি ছিল, সেখানে অভ্যন্তরীণ অন্তর্ঘাত এবং/অথবা বাইরের আগ্রাসনের মাধ্যমে কমিউনিজম বড় ধরনের হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল, যা কর্তৃত্ববাদী সরকারকে উন্নয়নমুখী হতে উত্সাহিত করেছে। তারা জনগণের সঙ্গে অখণ্ড রফা করে নিয়েছিল, যেটির মাধ্যমে তারা তাদের বৈধতা বজায় রাখার জন্য রাজনৈতিক স্বাধীনতার পরিবর্তে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিয়ে আসার ওপর মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করেছে।১৬
সুশীল সমাজের বহু সদস্য কেন শক্তিশালী সামরিক সরকার অথবা সেনাসমর্থিত সরকারের পক্ষে, তার আরেকটি কারণ হলো, এ ধরনের সরকারে পেশাজীবী ও বিশেষজ্ঞদের পক্ষে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা ও কর্তৃত্বসম্পন্ন পদে যাওয়া অনেক সহজ হয়। গণতান্ত্রিক সরকারের সময় রাজনৈতিক দলের কাছে তাঁদের গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যেতে হয় এবং বিশিষ্টতা বা কর্তৃত্বের অবস্থানে পৌঁছাতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও লড়াই করে তাঁদের ধাপে ধাপে এগোতে হয়। এই প্রক্রিয়াটি ঝুঁকিপূর্ণ ও অনিশ্চিত এবং দরকার হয় উচ্চমানের যোগ্যতা। যেমন—যুক্তি দিয়ে কাউকে বোঝানো, দেনদরবার ও নেতৃত্বের দক্ষতার পাশাপাশি সাংঘর্ষিক বা বিরোধী দৃষ্টিভঙ্গির অথবা গোষ্ঠীর মধ্যে সমঝোতা গড়ে তোলার দক্ষতা থাকা প্রয়োজন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এসব গুণের অধিকারী নন বিশেষজ্ঞরা।
সব সামরিক শাসক উন্নয়নমুখী হবেন, এমন কোনো কথা নেই। প্রায়ই দেখা যায়, তাঁরা দুর্নীতিগ্রস্ত। প্রায়ই দেখা যায়, সশস্ত্র বাহিনীর সমর্থন অটুট থাকা এবং ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য সামরিক শাসকেরা বিশেষ আনুকূল্য দেখিয়ে জাতীয় সম্পদ সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের, বিশেষত সেনাবাহিনীর উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের দিকে প্রবাহিত করার জোরালো তাগিদ বোধ করেন। তা ছাড়া, জনগণের ওপর নগ্নভাবে নিষ্ঠুর বলপ্রয়োগের মাধ্যমে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তো বেশি দিন ক্ষমতায় থাকা যায় না। জনগণের সমর্থন যদি পাওয়া না-ই যায়, নিদেনপক্ষে সামরিক শাসনের প্রতি জনগণের মৌন সম্মতি বা প্রশ্রয় তো থাকা প্রয়োজন। না হলে জনগণ তো অবিরত বিদ্রোহে লিপ্ত থাকবে। সুতরাং, সামরিক শাসকদের সম্পদের অপব্যবহার ও নির্লজ্জ পৃষ্ঠপোষকতা প্রদানের মাধ্যমে সমাজের ক্ষমতাশীল অংশকে (মূলত সরকারি কর্মকর্তা এবং বাণিজ্যিক বা শিল্প খাতের গুরুত্বপূর্ণ অভিজাত ব্যক্তিরা) কাছে টানতে দেখা যায়।
জনসমর্থন ও বৈধতা না থাকলে কর্তৃত্ববাদী শাসন শেষ পর্যন্ত বেশি দিন টিকে থাকতে পারে না, ইতিহাসে এমন ভূরি ভূরি নজির পাওয়া যায়। একটি কর্তৃত্ববাদী সরকারের স্থলাভিষিক্ত হয় আরেকটি। ফলে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হয়। ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়ে প্রায়ই সামরিক নেতৃত্বের ভেতরকার সম্পর্কে ফাটল ধরে, প্রতিদ্বন্দ্বিতা তৈরি হয়। যখন সামরিক শাসনের অবসান ঘটে, তখন অনেক সময়ই সেই শাসনের সময়কার অর্থনৈতিক ও সামাজিক অর্জনগুলো হারিয়ে যায়। তাদের শাসনের সমাপ্তিকালে অর্থনীতি দুর্বলতর হয়ে পড়ে।
আসলে কর্তৃত্ববাদী শাসনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ত্রুটি হলো নিয়মসিদ্ধভাবে ক্ষমতার শান্তিপূর্ণ হস্তান্তরের কোনো প্রক্রিয়া না থাকা। এর ফলে ভবিষ্যত্ সম্পর্কে বড় অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। বাংলাদেশের প্রথম সামরিক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা দখলের পর পরবর্তী সামরিক সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় ১৯৮১ সালে। এই মধ্যবর্তী সময়টি অভ্যুত্থান আর পাল্টা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে অতিবাহিত হয়েছে। কিন্তু এই সামরিক সরকার থেকে গণতান্ত্রিক সরকারে পরিবর্তনের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত। এই পরিবর্তনের পটভূমিতে ছিল কয়েক সপ্তাহ ধরে চলমান প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ। অবশ্য তত্কালীন সামরিক শাসকের পক্ষে দাঁড়িয়ে সেনাবাহিনী বলপ্রয়োগে জনবিক্ষোভ দমন করতে অস্বীকৃতি জানানোর কারণেই মূলত বড় মাপের রক্তপাত ঘটেনি। কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান ঘটিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করার ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। অস্থিতিশীলতার একটি পর্যায় পার না হয়ে এবং উন্নয়নের ক্ষেত্রে সামরিক সরকারের অর্জনগুলো নস্যাত্ না হয়ে সাধারণত এই পরিবর্তন ঘটে না।
সারা দুনিয়ার অভিজ্ঞতা থেকে আমরা দেখি, রাজনৈতিক বিকাশের প্রক্রিয়াটিকে বিশৃঙ্খল, কখনো কখনো বিভ্রান্তিকর বা অপরিকল্পিত পথে না গিয়ে, প্রতিনিধিত্বশীল ও জবাবদিহিমূলক সরকার পাওয়ার কোনো সোজাসাপ্টা পথ নেই। গণতন্ত্র সরকারের সবচেয়ে ভালো ব্যবস্থা নয়, কিন্তু গণতন্ত্রের বিকল্প আরও অনেক খারাপ—এ কথা তো সবার জানা। অপরিপক্ব গণতন্ত্রে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার কিছুসংখ্যক রাজনৈতিক সংঘাত এড়ানো সম্ভব হবে না। এসব সংঘাত পুরোপুরি শান্তিপূর্ণও হবে না। গণতন্ত্রের বিকাশে শেখার প্রক্রিয়া বিশৃঙ্খলাপূর্ণ হয়ে থাকে এবং প্রতিটি দেশের পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে তা দীর্ঘমেয়াদি হতে পারে।
বহু নবীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আইনের শাসন, স্বাধীন বিচারব্যবস্থা, মুক্ত গণমাধ্যম ও কার্যকর সরকার প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া যেমন ক্রমাগত থেমে থেমে এগিয়ে চলেছে, বাংলাদেশও তেমন ভাগ্য বরণ করা এড়াতে পারে না। এই পথ খুব মসৃণ হবে না, বরং বন্ধুর। এই পথে অনেক অস্থিতিশীল, অনেক প্রতিবন্ধকতা থাকবে। তাই লক্ষ্য হওয়া উচিত, কেমন করে আপস ও মৈত্রীবন্ধনের মাধ্যমে অস্থিতিশীলতার মাত্রাকে সীমাবদ্ধ রাখা যায়। এই প্রক্রিয়ায় বিঘ্ন সৃষ্টির প্রচেষ্টা কোনো কাজে আসে না। গত ৩০ বছরে আমরা যা শিখলাম তা হলো, এ ধরনের প্রতিটি সামরিক হস্তক্ষেপের পর গণতান্ত্রিক সমাজের রীতিনীতি আমাদের পুনরায় শিখতে হবে অথবা একেবারে শুরু থেকে এসব রীতিনীতি তৈরি বা শেখার কাজে নামতে হবে।
সাম্প্রতিক কালে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার পরিপ্রেক্ষিতে দেশের ভবিষ্যতের কথা ভেবে সুশীল সমাজের নানা অংশকে আবশ্যিকভাবে অতীতের ঘটনাবলি বিশ্লেষণ এবং প্রচুর তর্কবিতর্কের মাধ্যমে এগুলো থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। সুশীল সমাজের সদস্যদের তাঁদের আগেকার ধারণা পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে। ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্রের সমাধান কম গণতন্ত্র নয়, বরং আরও বেশি গণতন্ত্র—এই বিশ্বাসে তাদের একতাবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন। স্বাধীনতার মূল্য দিতে অবিরত তদারকি প্রয়োজন। রাজনীতিবিদদের মধ্যে যে ধরনের বিরোধের পরিস্থিতিই বিরাজ করুক না কেন, কোনো অবস্থাতেই রাজনীতিতে কিছুদিন পর পর সামরিক হস্তক্ষেপ চলবে না—এ ব্যাপারে সুশীল সমাজের সব অংশকে নিয়মতান্ত্রিকভাবে জনশিক্ষামূলক প্রচারাভিযানের মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা চালানো আবশ্যক।
বাংলাদেশ গণতন্ত্র বিকাশের একটি প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় শিক্ষার ব্যাপক বিস্তারে সবাই মিলে সচেষ্ট হওয়া আবশ্যক। এই শিক্ষা হতে হবে এখনকার চেয়ে অনেক বেশি কার্যকর এবং ন্যায়সংগত, যাতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে অংশগ্রহণমূলক পদ্ধতির গুরুত্ব এবং এ সম্পর্কে সচেতনতার ব্যাপক বৃদ্ধি ঘটে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন জারি থাকলে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আকার বৃদ্ধি প্রত্যাশিত। একটি বৃহত্ শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী গণতান্ত্রিক রাজনীতির অপরিহার্য শর্ত। একটি বৃহত্ মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে কোনো স্বৈরাচার সরকার সহজে কবজা করতে পারে না। বৃহত্ মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদানের মাধ্যমে কবজা করার জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদ বাংলাদেশে নেই। বৃহত্ মধ্যবিত্তের নানা রকম দৃষ্টিভঙ্গি এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাদের বাসনাকে জায়গা দিতে বহুদূর প্রসারিত অংশগ্রহণমূলক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া প্রয়োজন।১৭
তা ছাড়া, বাংলাদেশের সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা কিছু বিষয়ের পরিমার্জনা করা প্রয়োজন কি না, তা ক্ষুদ্র স্তরে যাচাই করে দেখা যথার্থ হবে। বহু ওয়াকিবহাল লোক এমন পুনঃঅনুসন্ধানের প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে সচেতন। একটি উদাহরণ দেওয়া যাক: বলা হয়ে থাকে, প্রধানমন্ত্রীর হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হলে তা মন্ত্রিসভা ও সংসদের ক্ষমতাকে অসংগতভাবে সংকীর্ণ করতে পারে। আমরা আইনত সংসদীয় ব্যবস্থাকে শেষ পর্যন্ত কার্যত রাষ্ট্রপতিশাসিত ব্যবস্থায় পরিণত করেছি বলে মনে হয়। কিন্তু কোনো ব্যবস্থার সুবিধাগুলো আমরা পাচ্ছি না। রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরেও এই সংস্কৃতি প্রাধান্য বিস্তার করে আছে। দলগুলোর অভ্যন্তরে পর্যাপ্ত অংশগ্রহণমূলক প্রক্রিয়া ও কার্যপ্রণালী অথবা দল চালানোর ক্ষেত্রে নেতা-কর্মীদের ক্ষমতার অপব্যবহার রোধে নিয়ন্ত্রণব্যবস্থার অভাব আছে। রাষ্ট্রপতিশাসিত ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা নিয়ন্ত্রিত হয় স্বাধীনভাবে নির্বাচিত সংসদ এবং স্বাধীন বিচার বিভাগের নিয়ন্ত্রণব্যবস্থার মাধ্যমে। সংসদীয় ব্যবস্থায় তর্কসাপেক্ষে বলা যেতে পারে, সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক দলের নিয়ন্ত্রণ প্রধানমন্ত্রীর হাতে থাকায় তিনি অসীম ক্ষমতাধর শাসকের মতো শাসনকার্য পরিচালনা করতে পারেন। আরেকটি বিষয়ও যাচাই করে দেখা যেতে পারে, বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি সব রাজনৈতিক দলের মতৈক্যের ভিত্তিতে নির্বাচিত হওয়া উচিত, নাকি সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের মনোনীত কেউ হবেন। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি হিসেবে আসেন প্রধানমন্ত্রীর অনুগত কেউ। অনুরূপভাবে, স্থানীয় সরকারপ্রতিষ্ঠানের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, যাঁরা কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ থেকে বাইরে নিজেদের স্বাধীন অবস্থান বজায় রেখে ঐতিহাসিকভাবে রাজনৈতিক বহুত্ববাদ, অর্থাত্ রাজনৈতিক ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ এবং গণতান্ত্রিক সমাজে শাসনকাজে অধিকতর অংশগ্রহণের জায়গা হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ উত্স হয়ে আছেন। কেন্দ্রীয় সরকারে থাকা দলের সব স্থানীয় সরকারপ্রতিষ্ঠানকে নিয়ন্ত্রণ করার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। এর ফলে বিরোধী দলগুলো এর মাধ্যমে তাদের রাজনৈতিক প্রভাব খাটানোর একটি বড় সুযোগ পায়।
এগুলো এবং অনুরূপ আরও কতগুলো বিষয় পরীক্ষা করে দেখার জন্য বিশেষজ্ঞ ও সুশীল সমাজের সদস্যদের নিয়ে একটি সাংবিধানিক কমিশন গঠন করা যেতে পারে। যে সাংবিধানিক ব্যবস্থা এবং বিধিবিধানই করা হোক না কেন, রাজনীতিবিদদের যদি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় বিশ্বাস না থাকে, তাহলে তাঁরা সেসব ব্যবস্থা আর বিধান ধ্বংস করে দিতে পারেন—এ কথা মোটা দাগের অতিরঞ্জন। সাংবিধানিক ব্যবস্থা এবং বিধিবিধান যথেষ্ট নয়, এগুলো অপরিহার্য শর্ত। রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সংগঠনের তত্ত্ব ও চর্চা আভাস দেয়, আচরণ বদলানোর ক্ষেত্রে এসব সংগঠনের ভূমিকা থাকে। কোনো যথাযথ উত্তর আমাদের সামনে নেই, পরীক্ষা-নিরীক্ষার হয়তো প্রয়োজন হতে পারে। ওপরে উল্লিখিত নানাবিধ সংস্কার প্রস্তাবনাগুলো বাংলাদেশে অতীতেও আলোচনা করা হয়েছে। কিন্তু গুরুত্বসহকারে এগুলো যাচাই করে দেখার ক্ষেত্রে কোনো চাপ নেই। বৃহত্তর সুশীল সমাজের সদস্যদের জন্য এটি একটি চ্যালেঞ্জ। অবশ্য যদি তাঁদের এসব সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে দৃঢ় বিশ্বাস থাকে এবং এ কাজে তাঁরা জনমত তৈরিতে সক্রিয় ও অত্যুত্সাহী ভূমিকা পালন করতে আগ্রহী হন।
টীকা
১. বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের ক্ষেত্রেও এর ভূমিকা রয়েছে: ক) মিশনে অংশগ্রহণকারীরা আয়ের একটা অংশ দেশে পাঠান, এবং খ) বাংলাদেশ কর্তৃক যে পরিমাণে সেবা প্রদান করা হয়, সে অনুপাতে জাতিসংঘের কাছ থেকে সরকার আনুষঙ্গিক মূল্য পেয়ে থাকে। বাংলাদেশ এটি থেকে কত বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে, সে বিষয়ে বাইরে থেকে খুব একটা তথ্য জানা যায় না।
২. সেনাবাহিনীকে সরকারের ওপর সমর্থন প্রত্যাহার করে নিতে বলেছে জাতিসংঘ, এমন গুজব থেকে শুরু করে এমন গুজবও প্রচারিত হয়েছে যে অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সামরিক সরকার গঠনের জন্য সেনাবাহিনীকে আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ।
৩. দ্য ডেইলি স্টার, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০০৯।
৪. ম. ইউ. আহমেদ, শান্তির স্বপ্নে, সময়ের স্মৃতিচারণ, ২০০৯, ঢাকা, পৃ. ৩৩১-৩৩৯।
৫. আগেই বলা হয়েছে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক অচলাবস্থার শান্তিপূর্ণ সমাধানের কোনো আবেদন মহাসচিব নিজে ২০০৬ সালের শেষ ভাগে করেননি।
৬. অল্প কয়েকটি দেশই শুধু বর্তমান চাহিদা মেটানোর সামর্থ্যসম্পন্ন সেনা ও পুলিশ সরবরাহ করতে পারে। আর সম্ভাব্য সেনা সরবরাহকারী কয়েকটি দেশ নিজেদের জাতীয় নিরাপত্তা এবং যে দেশে সেনা পাঠাতে হবে, সে দেশের পরিবেশগত ও নিরাপত্তাজনিত পরিস্থিতির মতো রাজনৈতিক কারণে সেনা পাঠাতে ইচ্ছুক না-ও হতে পারে। ‘... প্রয়োজনীয় সেনাসদস্য ও সম্পদ পেতে সমস্যার প্রভাব পড়েছে চলমান শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পুরোপুরি সম্পাদন করার সামর্থ্যের ওপর... শান্তিরক্ষী বাহিনীতে সেনাসদস্যের চাহিদা জোগানকে ছাপিয়ে যায় বারবার। সেনাবাহিনীর সামর্থ্য এবং শান্তিরক্ষী কার্যক্রমে অংশগ্রহণের আগ্রহ বিবেচনায় যে তিনটি দেশ সামনের সারিতে, সেগুলো হলো বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান’। বৈদেশিক সম্পর্কবিষয়ক কমিটির কাছে পাঠানো জিএও, যুক্তরাষ্ট্র সরকার, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা প্রতিবেদন, যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট, ২০০৮, পৃ-২২-২৪।
৭. উল্লেখ্য, শান্তিরক্ষা কার্যক্রম পরিচালনায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দাতা দেশ যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় দেশগুলো ও জাপান। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ কর্তৃক প্রদত্ত হিসাব অনুযায়ী, ২০০৩ সালে প্রধান অর্থ জোগানদাতা দেশগুলোর তালিকা হলো: যুক্তরাষ্ট্র (প্রায় ২৭ শতাংশ), জাপান (১৯.৫ শতাংশ), নেদারল্যান্ডস (১৭ শতাংশ), জার্মানি (৮.৭ শতাংশ), ফ্রান্স (৭.৩ শতাংশ), যুক্তরাজ্য (৭.৪ শতাংশ), ইতালি (৪.৯ শতাংশ), কানাডা (২.৮ শতাংশ) এবং সুইডেন (২ শতাংশ)। এরা সবাই বাংলাদেশের জন্য দাতা দেশ (জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৫৮তম অধিবেশন, সাধারণ পরিষদের সিদ্ধান্ত ৫৫/২৩৫ এবং ৫৫/২৩৬-এর বাস্তবায়ন। মহাসচিবের প্রতিবেদন, ১৭ ডিসেম্বর ২০০৩)। ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের সামপ্রতিকতম সভায় সেনা পাঠানোর দিক থেকে শীর্ষ ১০টি দেশের সরকারপ্রধানকে আমন্ত্রণ জানানো হয় শান্তিরক্ষী বাহিনীতে তাদের অবদানের বিষয়ে আলোচনা করার জন্য। এই সভাতেও শান্তিরক্ষী বাহিনীর জন্য ‘অতিরিক্ত চাহিদার’ অত্যাবশ্যকীয়তা দেখা গেছে।
৮. তাঁর বইতে তিনি বর্ণনা দিয়েছেন, সেনাবাহিনীর সীমিত সম্পদ নিয়েও তিনি কেমন করে সেনাবাহিনীর জন্য নানা অতিরিক্ত সুবিধাদি দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। তাঁর এসব প্রচেষ্টার মধ্যে ছিল: দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়ানো অত্যন্ত সুন্দর ও নান্দনিক স্থানে সেনাদের বিশ্রাম ও চিত্তবিনোদনের জন্য কয়েকটি উচ্চমানের অতিথিশালা/বিশ্রামাগার এবং ঢাকা সেনানিবাসের গলফ ক্লাবে পর্যাপ্ত সুবিধার ব্যবস্থা করা ইত্যাদি। এই সবকিছুর উদ্দেশ্যই ছিল সেনাবাহিনীকে খুশি রাখা, এর মনোবল চাঙা রাখা।
৯. বাংলাদেশ সেনাবাহিনী শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণ করা শুরু করে কেবল ১৯৮৮ সালে (দ্য ডেইলি স্টার, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০০৯)।
১০. বাংলাদেশ রাইফেলস, একটি সীমান্তরক্ষী বাহিনী। কিছুকাল আগে অবশ্য বিডিআর-এর নাম বদলে ‘বর্ডার গার্ডস অব বাংলাদেশ’ (বিজিবি) করা হয়েছে।
১১. এই পরিপ্রেক্ষিতে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই বেশ কিছু বাণিজ্যিক ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিক। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকানায় সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের অংশীদারি কেমন ও কতটা এবং এসব প্রতিষ্ঠানের আয় বা লাভ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তাদের উপকারে আসে তা জানা যায় না।
১২. ১৯৮৮ সাল থেকে সেই সময় পর্যন্ত বাংলাদেশ মোট ৮২ হাজার ৯৬৬ জন সদস্য শান্তিরক্ষী বাহিনীতে পাঠিয়েছে। (দ্য ডেইলি স্টার, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০০৯)।
১৩. উন্নয়নশীল দেশগুলোতে যে বেসামরিক সরকারগুলোকে বৃহত্ শক্তিগুলো অপছন্দ করত কিংবা যে সরকারগুলোকে তারা তাদের স্বার্থবিরোধী গণ্য করত, সেই সব সরকারকে অস্থিতিশীল অবস্থার মধ্যে ফেলতে অথবা ক্ষমতাচ্যুত করতে তাদের বিরুদ্ধে সেনা হস্তক্ষেপকে উত্সাহিত করতে অথবা তা সংগঠিত করতে মুখ্য ভূমিকা রাখার বহু নজির অতীতে আমরা দেখেছি। কিন্তু সেই সব ক্ষেত্রে সাধারণত সেই উন্নয়নশীল দেশের সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে এক বা একাধিক বৃহত্ শক্তির প্রতিরক্ষা বাহিনীর ঘনিষ্ঠ ও দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্ক থাকে। এই সম্পর্ক কোনো প্রতিরক্ষা চুক্তির মাধ্যমে হতে পারে আবার প্রতিরক্ষাসামগ্রী সরবরাহ এবং সামরিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাসহ নানা সামরিক সহযোগিতার রূপে হতে পারে।
১৪. দেশে-বিদেশে বহু সামরিক হস্তক্ষেপের ঘটনায় সাধারণত দেখা যায় যে, যদিও সেনাবাহিনী গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠায় সব সময় দ্রুত নির্বাচন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়, কিন্তু প্রায়ই দীর্ঘ সময় সেনাশাসন (প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ) চলতে থাকে। বাংলাদেশে ১৯৭৫ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত এমনটাই ঘটেছে।
১৫. যুদ্ধ-পূর্ববর্তী সময়ে পূর্ব এশিয়া, লাতিন আমেরিকা ও আফ্রিকার বেশ কয়েকটি উন্নয়নশীল দেশে বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবীরা সাধারণত সামরিক সরকারকে জোরালো ও সক্রিয় সমর্থন জুগিয়েছেন।
১৬. মাইকেল সুম্যান, দ্য মিরাকেল: দি এপিক স্টোরি অব এশিয়াস কোয়েস্ট ফর ওয়েলথ, হারপার কলিন্স, নিউইয়র্ক, ২০০৯।
১৭. গণতন্ত্র একটি বড় আকারের, শিক্ষিত এবং নিজের ভাবনা ও অনুভূতিকে স্পষ্ট ভাষায় রূপদানে সক্ষম—নিজেদের স্বার্থ বিবেচনার ক্ষমতাসমৃদ্ধ—একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অস্তিত্বের শর্তাধীন। আর মধ্যবিত্ত শ্রেণী কেমন হবে তা অর্থনৈতিক বিকাশের ওপর নির্ভর করে। অর্থনীতিতে কাঠামোগত পরিবর্তন নিয়ে আসে উন্নয়ন: কলাকৌশলগত পরিবর্তন এবং শিল্পায়নকে কাজে লাগিয়ে শ্রমশক্তিকে এমন সব পেশার দিকে চালিত করা হয়, যেখানে কার্যক্ষেত্রে স্বাধীন চিন্তা, উদ্যোগ ও বিচার-বিবেচনার দরকার হয়; জনগণ আরও স্পষ্ট ভাষায় নিজের ভাবনা ও অনুভূতিকে রূপদানে সক্ষম হয়ে ওঠে; উন্নয়ন জনগণের মূল্যবোধ ও প্রণোদনার রূপান্তর ঘটায়, স্বাধীনভাবে বাছাই করতে পারার এবং তাদের জীবনে প্রভাব ফেলে এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে অংশগ্রহণের বাসনা সঞ্চার করে। রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করার জন্য মধ্যবিত্তদের ভালো প্রস্তুতি থাকে। ১৯৭০ থেকে ১৯৯০ সালের মধ্যে যেসব দেশে গণতন্ত্রায়ণ হয়েছে, তাদের মধ্যে যেসব দেশে ক্রান্তিকালীন আয়ের পর্যায় ১৯৯০-এর দশকের আর্জেন্টিনার মতো বা তারও বেশি ছিল, তাদের প্রতিটিতে গণতন্ত্র টিকে থাকতে পেরেছে। যেসব দেশে এই পরিবর্তনের সময়ে আয়ের পর্যায় এর নিচে ছিল, সেগুলোতে গণতন্ত্র গড়ে আট বছর টিকতে পেরেছে। (আর ইনগেলবাস্ট এবং সি ওয়েেজল, হাউ ডেভেলপমেন্ট লিডস টু ডেমোক্রেসি—হোয়াট উই নো অ্যাবাউট মডার্নাইজেশন, ফরেন অ্যাফেয়ার্স, ভলিউম ৮৮, নম্বর ২, মার্চ/এপ্রিল ২০০৯)। নিম্ন আয়ের দেশ হওয়া সত্ত্বেও ভারত এই সাধারণীকরণের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। ভারতে গণতন্ত্রে উত্তরণের কাজ স্বাধীনতার পরপরই শুরু হয় এবং ৬০ বছরের মতো সময় ধরে তা অব্যাহত চলতে থাকে। ১৯৪৭ সালে ভারত সাড়া জাগানো রাজনৈতিক দল পেয়েছিল, যাদের কর্মকাণ্ডের সূচনা হয়েছিল ১৯ শতকের ব্রিটিশ ভারতে এবং ঔপনিবেশিক কালে তারা সীমিত পর্যায়ে হলেও স্বশাসনের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিল। ভারতের গণতন্ত্রে উত্তরণ এখনো সম্পূর্ণ হয়নি। ভারতে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বিকাশে যে ব্যতিক্রমী উপাদানগুলো কাজ করছে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে দেখুন: রামচন্দ্র গুহ, ইন্ডিয়া আফটার গান্ধী: দ্য হিস্ট্রি অব দ্য ওয়ার্ল্ডস লারজেস্ট ডেমোক্রেসি, হারপার কলিন্স, ২০০৭।
সংযুক্তি টেবিল
জাতিসংঘের কর্মসূচিতে সেনা ও পুলিশ প্রদান করা রাষ্ট্রগুলোর অবস্থান
ক্রম দেশ সদস্যের সংখ্যা
১. পাকিস্তান ১০,৬১৮
২. বাংলাদেশ ৯,৮৪৯
৩. ভারত ৮,৬১২
৪. নাইজেরিয়া ৫,৮৮২
৫. নেপাল ৩,৮৮৪
৬. রুয়ান্ডা ৩,৫৮৫
৭. ঘানা ৩,৪১২
৮. জর্ডান ৩,২৩১
৯. মিসর ২,৯০২
১০. ইতালি ২,৭৬২
১১. উরুগুয়ে ২,৫২৯
১২. ইথিওপিয়া ২,৩৯৩
১৩. ফ্রান্স ২,২৫৩
১৪. সেনেগাল ২,১৫৩
১৫. চীন ২,১৫১
১৬. দক্ষিণ আফ্রিক ১,৯৭৯
১৭. ইন্দোনেশিয়া ১,৬২১
১৮. মরক্কো ১,৫৫৯
১৯. বেনিন ১,৩৫৭
২০. ব্রাজিল ১,৩৪৭
২১. পোল্যান্ড ১,১৫৬
২২. স্পেন ১,১০৩
২৩. শ্রীলঙ্কা ১,০৩৯
২৪. কেনিয়া ৯৭৪
২৫. মালয়েশিয়া ৯৪৪
২৬. আর্জেন্টিনা ৮৮৮
২৭. টোগো ৮০৮
২৮. জাম্বিয়া ৭১৯
২৯. ফিলিপাইন ৬১৩
৩০. নাইজার ৫৭৪
৩১. তুরস্ক ৫৪২
৩২. অস্ট্রিয়া ৫২৬
৩৩. চিলি ৫১৭
৩৪. তিউনিসিয়া ৫০১
৩৫. আয়ারল্যান্ড ৪৬৪
৩৬. বলিভিয়া ৪৪৫
৩৭. রিপাবলিক অব কোরিয়া ৩৯৬
৩৮. বেলজিয়াম ৩৯৪
৩৯. ইউক্রেন ৩৭৭
৪০. পর্তুগাল ৩৫৫
৪১. রাশিয়া ৩৫০
৪২. জার্মানি ৩০৮
৪৩. ইংল্যান্ড ২৯০
৪৪. গুয়াতেমালা ২৮৭
৪৫. গাম্বিয়া ২৮১
৪৬. ফিজি ২৬৮
৪৭. মঙ্গোলিয়া ২৫৯
৪৮. নরওয়ে ২৩৯
৪৯. ইয়েমেন ২৩৪
৫০. পেরু ২৩২
৫১. স্লোভাকিয়া ১৯৮
৫২. কানাডা ১৮৩
৫৩. মালাবি ১৬৯
৫৪. ক্রোয়েশিয়া ১৫৯
৫৫. আইভরি কোস্ট ১৫৯
৫৬. বারকিনা ফাসো ১৫৪
৫৭. কম্বোডিয়া ১৪৩
৫৮. জিম্বাবুয়ে ১৩৫
৫৯. তানজানিয়া ১২৬
৬০. ক্যামেরুন ১২৪
৬১. এল সালভাদর ১১৩
৬২. সিয়েরা লিওন ১০৩
৬৩. অস্ট্রেলিয়া ১০২
৬৪. হাঙ্গেরি ১০১
৬৫. গিনি ১০১
৬৬. মালি ১০০
৬৭. রোমানিয়া ৯৬
৬৮. যুক্তরাষ্ট্র ৯৫
৬৯. উগান্ডা ৯৩
৭০. ইকুয়েডর ৯১
৭১. ফিনল্যান্ড ৮২
৭২. প্যারাগুয়ে ৭৯
৭৩. সুইডেন ৭৩
৭৪. আলবেনিয়া ৬৬
৭৫. নামিবিয়া ৫৯
৭৬. গ্রিস ৫৬
৭৭. জিবুতি ৫৩
৭৮. শাদ ৫১
৭৯. নেদারল্যান্ডস ৫০
৮০. মাদাগাস্কার ৪০
৮১. জাপান ৩৯
৮২. নিউজিল্যান্ড ৩৯
৮৩. ডেনমার্ক ৩৭
৮৪. থাইল্যান্ড ২৮
৮৫. সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক ২৭
৮৬. বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা ২৩
৮৭. সিঙ্গাপুর ২৩
৮৮. কলম্বিয়া ২২
৮৯. সুইজারল্যান্ড ২২
৯০. ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব দ্য কঙ্গো ২২
৯১. সামোয়া ২০
৯২. কিরগিজস্তান ২০
৯৩. সার্বিয়া ১৯
৯৪. ভানুয়াটু ১৮
৯৫. স্লোভেনিয়া ১৭
৯৬. জ্যামাইকা ১৭
৯৭. চেক রিপাবলিক ১৭
৯৮. বুরুন্ডি ১৩
৯৯. হন্ডুরাস ১২
১০০. মোজাম্বিক ১০
১০১. আলজেরিয়া ৬
১০২. মলদোভা ৬
১০৩. লিবিয়া ৫
১০৪. ব্রুনাই ৫
১০৫. তাজিকিস্তান ৫
১০৬. কাতার ৩
১০৭. গ্রানাডা ৩
১০৮. গ্যাবন ৩
১০৯. লিথুয়ানিয়া ২
১১০. মন্টেনিগ্রো ২
১১১. আইসল্যান্ড ২
১১২. পালাউ ২
১১৩. এস্তোনিয়া ২
১১৪. সাইপ্রাস ২
১১৫. বুলগেরিয়া ২
১১৬. কাজাখস্তান ১
১১৭. ম্যাসিডোনিয়া (সাবেক যুগোস্লাভ প্রজাতন্ত্র) ১
মোট ৯৩,৮১৩
সংযুক্তি টীকা
জাতিসংঘের ৬৩টি শান্তিরক্ষী মিশনের মধ্যে বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত ৪৫টিতে অংশগ্রহণ করেছে। এগুলোর মধ্যে ৩০টি মিশন ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে আর ১২টি চলমান। এখন পর্যন্ত ৭৬ হাজার বাংলাদেশি জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীতে কাজ সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে পুলিশ সদস্যদের দিক থেকে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশের অবস্থান সবার ওপরে।
সেনা বা পুলিশ দল পাঠানোর ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ১২ বছর ধরে নিয়মিতভাবে শান্তিরক্ষীদের অন্তত ১০ শতাংশ সরবরাহ করে যাচ্ছে। তারা ‘ব্লু হেলমেটস’-এর অধীনে দুর্গম, দুঃসাধ্য এবং অনেক ক্ষেত্রে বৈরী পরিবেশে শান্তি রক্ষায় কাজ করছে। বর্তমানে ১৮টি শান্তিরক্ষা মিশনে মোতায়েন করা মোট ৯২ হাজার ১৯৬ জন শান্তিরক্ষীর মধ্যে বাংলাদেশ একাই ১১টি দেশে ১২টি মিশনে নয় হাজার ৪৪৫ জন শান্তিরক্ষী প্রদান করেছে। এখন পর্যন্ত শান্তিরক্ষা মিশনে সেনা বা পুলিশ প্রদানকারী ১১৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়।
জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনের জন্য বাহিনীগুলোকে প্রশিক্ষণ ও প্রস্তুত করার ব্যবস্থা তৈরি করেছে বাংলাদেশ। এসব ইউনিটে জাতিসংঘ প্রশিক্ষণ মডিউল সন্নিবিষ্ট হয়েছে। বাংলাদেশে ইনস্টিটিউট অব পিস সাপোর্ট অপারেশন্সের (বিআইপিএসওটি) দ্বারা ফরমেশন ট্রেনিং হচ্ছে। কোনো মিশনে মোতায়েন করার নির্ধারিত সময়ের ৯০ দিন আগে সেই দলটিকে পুনর্বিন্যস্ত করে মিশনের চাহিদা মোতাবেক প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিয়ে এবং যৌক্তিক প্রস্তুতি নিয়ে প্রস্তুত করা হয়। পেশাদারি ও দায়বদ্ধতার উঁচু মান বজায় রাখতে এটি সহায়তা করেছে।
(ইংরেজি থেকে অনূদিত)
অনুবাদ: আহসান হাবীব