সারসংক্ষেপ
বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতিতে গত কয়েক বছরের সংঘটিত ঘটনাবলি ও প্রবণতা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় যে দুটি বড় ধরনের পরিবর্তন সংঘটিত হয়েছে বা হচ্ছে। এর একটি হচ্ছে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সংকট, অন্যটি হচ্ছে রাজনীতি ও সমাজে ধর্মের ব্যাপক প্রভাব। এই ঘটনাবলির প্রেক্ষাপট হচ্ছে বাংলাদেশের গত কয়েক দশকের উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন, যা দেশে একটি নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব ও বিকাশে সাহায্য করেছে। অতীতে এ কথা তত্ত্বগতভাবে এবং বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতার আলোকে বলা হতো যে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং মধ্যবিত্তের বিকাশ একাদিক্রমে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করে ও সমাজ ও রাজনীতিতে ধর্মের রাজনৈতিক আবেদন হ্রাস করে। বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা কি তার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ? এই নিবন্ধে বাংলাদেশের সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি ও রাষ্ট্রের সম্পর্কের কয়েকটি সুনির্দিষ্ট বিষয়ে কিছু প্রশ্ন তোলা এবং কিছু অনুমান বা হাইপোথিসিস উপস্থাপন করা হয়েছে। এই বিষয়ে গবেষণা ও আলোচনার তাগিদ দেওয়া এই লেখার প্রধান লক্ষ্য, যা বাংলাদেশের বর্তমান সামাজিক ও রাজনৈতিক চালচিত্র বোঝার জন্য জরুরি, নীতিনির্ধারকদের এবং সমাজ পরিবর্তনে আকাঙ্ক্ষীদের জন্যও এ ধরনের আলোচনা সহায়ক। কিন্তু এ ধরনের গবেষণা ও আলোচনার আবশ্যিক শর্ত হচ্ছে পূর্বধারণার বৃত্তে নিজেদের সীমিত না রাখা।
মুখ্য শব্দগুচ্ছ
বাংলাদেশ, প্রবৃদ্ধি, মধ্যবিত্ত, গণতন্ত্র, ধর্ম, রাজনীতি, রাজনৈতিক সংস্কৃতি।
ভূমিকা
আমার এই নিবন্ধের লক্ষ্য হচ্ছে আলোচনার জন্য বাংলাদেশের সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি ও রাষ্ট্রের সম্পর্কের কয়েকটি সুনির্দিষ্ট বিষয়ে কিছু প্রশ্ন তোলা এবং কিছু অনুমান বা হাইপোথিসিস উপস্থাপন করা। ফলে আমি এই নিবন্ধে কোনো রকম উপসংহার তুলে ধরার চেষ্টা করব না। বাংলাদেশের সমকালীন রাজনীতিকে সামনে রেখে এসব প্রশ্নের উত্থাপন। এসব প্রশ্ন এবং অনুমানের একটি ভিত্তি হচ্ছে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কতিপয় তত্ত্ব, অন্য আরেকটি ভিত্তি হচ্ছে বাংলাদেশের চলমান রাজনীতি ও সমাজ বিষয়ে পর্যবেক্ষণ। ফলে এগুলো যেমন বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা বুঝতে সাহায্য করবে বলে আশা করি, তেমনি এগুলোর দ্যোতনা (ইমপ্লিকেশন) রয়েছে সংশ্লিষ্ট তত্ত্বসমূহের জন্যও।
পটভূমি
বাংলাদেশের রাজনীতি যাঁরা ঘনিষ্ঠভাবে অনুসরণ করেন এবং গত কয়েক বছরের ঘটনাবলির দিকে যাঁরা নজর রেখেছেন, তাঁদের কাছে এটা স্পষ্ট যে রাজনীতিতে দুটি বড় ধরনের পরিবর্তন সংঘটিত হয়েছে বা হচ্ছে। এর একটি হচ্ছে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সংকট, অন্যটি হচ্ছে রাজনীতি ও সমাজে ধর্মের ব্যাপক প্রভাব।
বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সংকট নতুন নয় এই অর্থে যে স্বাধীনতার পর থেকেই দেশটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে স্থায়ী রূপ দিতে ব্যর্থ হয়েছে। ১৯৯০ সালের পর এ অবস্থার পরিবর্তনের সম্ভাবনা তৈরি হয়। কিন্তু সে ক্ষেত্রেও প্রথম দেড় দশকে সাফল্যের মাত্রা আশাব্যঞ্জক ছিল না। ২০০৬ সালে রাজনৈতিক সংকটের প্রেক্ষাপটে অপ্রত্যক্ষ সেনাশাসনের সূচনায় অনেকেই এই আশঙ্কা ব্যক্ত করেন যে বাংলাদেশ ১৯৭৫ সালে ফিরে যাবে। যাঁরা ঘটনাবলিকে দীর্ঘ মেয়াদের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখেন, তাঁদের এই আশঙ্কার কারণ কেবল বাংলাদেশের ইতিহাসই ছিল না, ছিল বাংলাদেশের বাইরের অভিজ্ঞতাও। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা গত কয়েক দশকের অভিজ্ঞতায় দেখেছেন যে কোনো দেশে ভঙ্গুর গণতন্ত্র থাকলে তা দীর্ঘ মেয়াদে টিকিয়ে রাখা সম্ভব হয় না। ‘ভঙ্গুর গণতন্ত্র’ থেকে কর্তৃত্ববাদী শাসনের উত্থানের আশঙ্কাই বেশি। সেই প্রেক্ষাপটে এবং বাংলাদেশের অতীত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এই রকম মনে করা হতে থাকে যে সামরিক কর্তৃত্ববাদের পথেই দেশটি অগ্রসর হচ্ছে। কিন্তু অচিরেই এটা বোঝা যায় বাংলাদেশে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হচ্ছে না। ২০০৮ সালের শেষে একটি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশে বেসামরিক নির্বাচিত সরকার তৈরি হয়। ধরে নেওয়া হয় যে বাংলাদেশ কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিপদ থেকে রক্ষা পেয়েছে। কিন্ত সংবিধানের পরিবর্তন এবং ক্ষমতাসীন দলের আচরণ ভিন্ন রকম ইঙ্গিত দিতে থাকে। ২০১৪ সালে প্রায় সব বিরোধী দলের বর্জন সত্ত্বেও ক্ষমতাসীন দল এককভাবেই নির্বাচন সম্পন্ন করে, যার ফলে সংসদে বিরোধী দলের কোনো অস্তিত্বই নেই (নির্বাচনের আগের ও নির্বাচনের সময়কার রাজনৈতিক অবস্থার জন্য দেখুন, রীয়াজ ২০১৪)। ওই নির্বাচনের আগে এবং ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর ক্ষমতাসীন দল এমন সব ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে, যা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বা মর্মবস্তুর দিক থেকে গণতান্ত্রিক বলে বিবেচিত হতে পারে কি না তা প্রশ্নসাপেক্ষ। বাংলাদেশের ইতিহাস বিবেচনা করলে দেখা যায় যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের মূল বাণীটি ছিল গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের তিনটি ভিত্তি—মানবিক মর্যাদা, সাম্য ও সামাজিক ন্যায়বিচার—তার সারবস্তু হচ্ছে সব নাগরিকের সমতা ও গণতান্ত্রিক অধিকারের নিশ্চয়তা। এই প্রতিশ্রুতি নিয়ে দেশ স্বাধীন হলেও বাংলাদেশে গণতন্ত্র শুধু প্রাতিষ্ঠানিক রূপলাভেই ব্যর্থ হয়েছে তা নয়, এখন প্রশ্ন উঠছে কয়েক দফা কর্তৃত্ববাদী শাসনের অভিজ্ঞতার পরও দেশটি আবার সেই পথেই যাত্রা শুরু করেছে কি না।
দ্বিতীয় যে বিষয়টি গবেষকদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে এবং ২০১৭ সালে এসে বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতি-বিষয়ক আলোচনায়, তা গণমাধ্যমেই হোক কি নীতিনির্ধারক পর্যায়েই হোক, বারবার আলোচিত হচ্ছে তা হলো সমাজ ও রাজনীতিতে ধর্মের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। ১৯৭২ সালে রচিত বাংলাদেশের সংবিধানে ‘সেক্যুলারিজম’কে (যাকে সংবিধানের বাংলা ভাষ্যে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ বলা হয়) রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে ঘোষণা এবং ধর্মভিত্তিক সংগঠন তৈরির ওপরে নিষেধাজ্ঞা আরোপের পরিপ্রেক্ষিতে এই ধারণাই পাওয়া গিয়েছিল যে রাষ্ট্র ও ধর্মের মধ্যকার সম্পর্কের বিষয়টির নিষ্পত্তি হয়েছে এবং সেই নিষ্পত্তি হচ্ছে: এই দুইয়ের মধ্যে দেয়াল তুলে দেওয়া গেছে, রাজনীতি ও সমাজে ধর্মের প্রত্যক্ষ প্রভাবের অবসান করা গেছে। কিন্তু সত্তরের দশকের শেষভাগ থেকে ক্রমান্বয়ে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা অপসারিত হয়, রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসেবে সেক্যুলারিজমের/ধর্মনিরপেক্ষতার অবসান হয়, রাজনীতিতে ধর্মভিত্তিক দলের আবির্ভাব ঘটে, রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলাম সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয় এবং দল-নির্বিশেষে ধর্মীয় প্রতীক ও রেটরিক ব্যবহূত হতে থাকে। নব্বইয়ের দশকে কেবল যে রাজনীতিতেই ধর্মের প্রভাব বৃদ্ধি পায় তা নয়, সমাজে ও দৈনন্দিন জীবনাচরণে ধর্মের ব্যাপক এবং দৃষ্টিগ্রাহ্য উপস্থিতি লক্ষণীয় হয়ে ওঠে। ইসলামপন্থী দলের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় এবং বিভিন্ন ধরনের ইসলামপন্থী দলের—সংস্কারবাদী, রক্ষণশীল, উগ্রপন্থী, সহিংস চরমপন্থী—বিকাশ লাভ করে। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’কে সংবিধানে পুনঃস্থাপন করা হলেও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বহাল থেকেছে এবং ধর্মের প্রশ্নে রাষ্ট্রের নিরপেক্ষতার কোনো লক্ষণই আর উপস্থিত নেই। এর পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক ধরনের ইসলামপন্থী জঙ্গি সংগঠনের উপস্থিতি ঘটতে শুরু করে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে সমাজজীবনে ইসলামের উপস্থিতি। বাংলাদেশের সমাজে দীর্ঘদিন ধরে যে স্থানীয় ও সমন্বয়বাদী (সিনক্রেটিক) ইসলামের প্রাধান্য ও প্রভাব ছিল বলে ধারণা করা হতো, তার পরিবর্তে একটি আক্ষরিক (লিটারালিস্ট) ও বৈশ্বিক ব্যাখ্যার ইসলামেরই প্রভাব দৃশ্যমান হয়ে ওঠে এবং তা ক্রমবর্ধমান।
এই দুই প্রপঞ্চের উপস্থিতির প্রেক্ষাপট হচ্ছে একটি পরিবর্তনশীল দেশ ও রাষ্ট্র। উনিশ শ একাত্তর সালে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের উদ্ভবের পর ৪৬ বছর অতিবাহিত হয়েছে। এই সময়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও সমাজে পরিবর্তন ঘটেছে। রাষ্ট্রগঠন একটি অব্যাহত প্রক্রিয়া, ফলে পরিবর্তন এখনো অব্যাহত আছে এবং তা অস্বাভাবিক নয়। বাংলাদেশের গত কয়েক দশকের পরিবর্তনের কথা উঠলেই যেটি কমবেশি সবাই প্রথমেই বলেন তা হচ্ছে এর অর্থনীতির পরিবর্তন—একসময় যে দেশটি ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’তে পরিণত হবে বলে আশঙ্কা করা হয়েছিল এবং বলা হয়েছিল এটি একটি ‘উন্নয়নের পরীক্ষাগার’, সেই দেশটি এখন অর্থনৈতিকভাবে সম্ভাবনার দেশ বলে বিবেচিত হচ্ছে। প্রাইসওয়াটারহাউস কুপারের হিসাব অনুযায়ী ২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশ পৃথিবীর ২৮তম বৃহত্ এবং ২০৫০ সাল নাগাদ ২৩তম বৃহত্ অর্থনীতিতে পরিণত হবে। মোট অর্থনীতির আকার দাঁড়াবে ৬২৮ বিলিয়ন ডলার থেকে যথাক্রমে ১৩২৪ বিলিয়ন ডলার এবং ৩০৬৪ বিলিয়ন ডলার (জামাল, ২০১৬)।
আমার আলোচনার পটভূমি হচ্ছে এই তিনটি দিক—বড় আকারের বা সামষ্টিক অর্থনৈতিক সাফল্য, সামাজিক ক্ষেত্রে ধর্ম, অর্থাত্ ইসলামি ভাবধারার ব্যাপক বিস্তার এবং রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ক্রমাগত সংকোচন। আমার লক্ষ্য হচ্ছে, এই তিন দিকের মধ্যকার সম্পর্কের কিছু পর্যবেক্ষণ তুলে ধরা এবং প্রশ্ন উত্থাপন করা।
তত্ত্বগত কাঠামো
রাষ্ট্র, সমাজ, অর্থনীতি নিশ্চল বা অপরিবর্তনীয় বিষয় নয়; এসবের পরিবর্তনই স্বাভাবিক। উপরন্তু এগুলো পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন নয়, একটি অন্যটিকে প্রভাবিত করে। এর একটি পরিবর্তিত হবে কিন্তু অন্যগুলো স্থির থাকবে, এমন মনে করা সঠিক নয়। কোনটি কোনটিকে প্রভাবিত করে, এ নিয়ে সমাজবিজ্ঞানে বিতর্ক দীর্ঘদিনের। যাঁরা ‘অর্থনৈতিক নির্ণয়বাদ’ বা ইকোনমিক ডিটারমিনিজমে আস্থা রাখেন; যাঁরা অর্থনীতিকে, বিশেষ করে কোনো সমাজের উত্পাদন-কাঠামো এবং উত্পাদন সম্পর্ককে ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করেন, তাঁরা অর্থনীতির পরিবর্তনকেই অন্যান্য পরিবর্তনের চালক বলে দাবি করেন। মার্ক্সবাদীদের একাংশ এ ধারণার অনুসারী। অর্থনৈতিক নির্ণয়বাদের অনুসারীদের বাইরেও সমাজবিজ্ঞানী আছেন, যাঁরা অর্থনীতির ওপরে গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তাঁরা দেখিয়েছেন যে এটা কেবল অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির বিষয় নয়, যেকোনো রাষ্ট্র কীভাবে বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত, বৈশ্বিক অর্থনীতিতে তার কী ভূমিকা, সেটাও রাষ্ট্রের কাঠামো এবং সমাজের বিভিন্ন দিককে প্রভাবিত করে, ক্ষেত্রবিশেষে নির্ণায়কের ভূমিকা পালন করে। বিশ্ব অর্থনীতির কাঠামোর পরিবর্তনের ইতিহাস নিয়ে যাঁরা আলোচনা করেছেন, তাঁরা দেখান যে বৈশ্বিক ব্যবস্থা হিসেবে পুঁজিবাদের বিস্তৃতি এবং সেই কাঠামোয় কোন রাষ্ট্র কী ভূমিকা পালন করবে, তার ওপরে রাষ্ট্রের চরিত্র, প্রকৃতি, সক্ষমতা নির্ভরশীল। ইম্মানুয়েল ওয়ালেরস্টিন, আন্দ্রে গুন্ডার ফ্রাঙ্ক এবং তাঁর অনুসারী যাঁরা বিশ্বব্যবস্থা তত্ত্ব (ওয়ার্ল্ড সিস্টেমস থিওরি) এবং নির্ভরশীলতার তত্ত্বের (ডিপেনডেন্সি থিওরি) আলোকে সমাজ-রাজনীতি বিশ্লেষণে উত্সাহী, তাঁদের বক্তব্যের সহজ সারাংশ এই রকম (ফ্রাঙ্ক, ১৯৬৬, ১৯৬৭, ১৯৬৯; ওয়ালেরস্টিন, ১৯৭৪, ১৯৮০, ১৯৮৯)।
অনেক সমাজবিজ্ঞানী মনে করেন যে সমাজে বিরাজমান শক্তিগুলো কেবল অর্থনৈতিক সম্পর্কের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় না। তাঁদের বক্তব্য হচ্ছে সমাজের প্রচলিত রীতি-নীতি, মূল্যবোধ, আচার-আচরণ অনেকাংশেই নির্ণায়কের ভূমিকা পালন করে। তাঁদের বিবেচনায় সংস্কৃতির মধ্যে ধর্ম, বিশ্বাস, শিক্ষাও অন্তর্ভুক্ত; কেউ কেউ এর মধ্যে বর্ণ এবং এথনিসিটি বা জাতীয়তাকেও অন্তর্ভুক্ত করেন। এঁদের আমরা ‘সাংস্কৃতিক নির্ণয়বাদী’ বলতে পারি। সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ভেবারের আলোচিত গ্রন্থ দ্য প্রোটেস্ট্যান্ট এথিক অ্যান্ড দ্য স্পিরিট অব ক্যাপিটালিজম (১৯০৪-৫)-এর একটা বড় যুক্তি হচ্ছে এই যে, উত্তর ইউরোপে পুঁজিবাদের বিকাশ ও সাফল্যের কারণ হচ্ছে পিউরিটান এথিকস। ভেবার ধর্মের সঙ্গে সমাজ ও অর্থনীতির প্রসঙ্গ, অর্থাত্ ধর্মের সমাজতত্ত্ব, আরও তিনটি বইয়ে আলোচনা করেছেন। ধর্মকে আমরা যদি সংস্কৃতি বলে মানি, তাহলে ভেবারের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট—সংস্কৃতির প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ। (স্যামুয়েল হান্টিংটন তাঁর বহুল আলোচিত ‘থার্ড ওয়েভ অব ডেমোক্রেসি’ তত্ত্বে বলেন যে প্রোটেস্ট্যান্ট সংখ্যাগরিষ্ঠ অধিকাংশ দেশেই ১৯৭০-এর আগেই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, হান্টিংটন, ১৯৯১)। একই ধরনের কথা ইউরোপের বাইরের সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি ও রাষ্ট্র বিশ্লেষণে ব্যবহার করেছেন অনেক সমাজতত্ত্ববিদ। যেমন গোটা পূর্ব এশিয়া, বিশেষত চীনা সমাজে পদসোপানের বা হায়ারার্কির গ্রহণযোগ্যতা এবং রাষ্ট্র গঠনে তাঁর ভূমিকা বিশদভাবে আলোচিত। বলা হয়ে থাকে যে এর পেছনে আছে কনফুসিয়ানিজমের প্রভাব (শি, ২০০৮; চেন, ২০১৩)। অর্থাত্ সমাজে বিরাজমান মূল্যবোধ বিশেষ ধরনের রাষ্ট্র গঠনে ভূমিকা রেখেছে। ১৯৯০-এর দশকে সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার কর্তৃত্ববাদী শাসনের ধারণা প্রতিষ্ঠা এবং তাদের অর্থনৈতিক সাফল্যের ব্যাখ্যা হিসেবে ‘এশিয়ান ভ্যালুজ’ বা ‘এশীয় মূল্যবোধের’ ধারণা প্রচার করা হয়েছিল (ইনুগুচি ও নিউম্যান, ১৯৯৭)। সাংস্কৃতিক নির্ণয়বাদের ওপরে এককভাবে নির্ভর করার বিপদ হচ্ছে এই যে তা ভুলভাবেও ব্যবহূত হতে পারে। এটি আমরা এশীয় মূল্যবোধের তত্ত্বে যেমন দেখি, তেমনি দেখতে পাই মধ্যপ্রাচ্য-বিষয়ক আলোচনায়ও; হান্টিংটনের বহুল আলোচিত-সমালোচিত সভ্যতাসমূহের সংঘাত (ক্ল্যাশ অব সিভিলাইজেশনস) তত্ত্ব এর উল্লেখযোগ্য উদাহরণ (হান্টিংটন, ১৯৯৬)। কোনো কোনো বিশ্লেষক মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে গণতন্ত্রের অনুপস্থিতিকে ইসলাম ধর্মের বৈশিষ্ট্য বলেই দেখানোর চেষ্টা করেছেন। ফলে এটা স্পষ্ট করে বলা আবশ্যক যে সমাজ পরিবর্তনে সংস্কৃতি গুরুত্বপূর্ণ বলার অর্থ এই নয় যে তা এককভাবে নির্ণায়কের ভূমিকা পালন করে।
অর্থনৈতিক নির্ণয়বাদ এবং সাংস্কৃতিক নির্ণয়বাদের সমর্থকেরা একার্থে এক জায়গায় একমত বলেই প্রতীয়মান: তাঁরা মনে করেন যে রাষ্ট্র নির্ণায়ক নয়, বরং অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ফসল।
পরিবর্তনের নির্ণায়ক হিসেবে রাষ্ট্রকে একেবারে খারিজ করে দেওয়ার ধারণাকে তত্ত্বগতভাবে চ্যালেঞ্জ করেন মার্ক্সবাদীদেরই একাংশ; তাঁরা দেখান যে সাধারণভাবে রাষ্ট্র শ্রেণিস্বার্থের প্রতিভূ হলেও, অর্থাত্ অর্থনীতি নির্ণায়কের ভূমিকা পালন করলেও, ব্যতিক্রম হিসেবে এমন পরিস্থিতি সম্ভব যেখানে রাষ্ট্র নিজেই আপেক্ষিকভাবে স্বাধীন (বা স্বায়ত্তশাসিত) ভূমিকা পালন করতে পারে। রাষ্ট্রের অপেক্ষিক স্বাধীনতার এই ধারণার উত্স কার্ল মার্ক্স হলেও ইতালীয় মার্ক্সবাদী সমাজবিজ্ঞানী আন্তোনিও গ্রামসি তাঁর বিশদ ব্যাখ্যা দেন (গ্রামসি, ১৯৭১)। অন্যান্য নিও-মার্ক্সবাদীরাও (যেমন পুলানসাস ও মিলিবান্ড, ১৯৭২) এই বিতর্কে অংশ নেন। এই আলোচনার পাশাপাশি ১৯৮০-এর দশকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে নতুন করে ‘রাষ্ট্র’ বিষয়ে উত্সাহ পরিলক্ষিত হয় (ইভান্স, রুয়েশমায়ার ও স্কচপল, ১৯৮৫), যার একটি কারণ হচ্ছে পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি । তাঁদের যুক্তি হচ্ছে যে এসব দেশে রাষ্ট্রের ভূমিকা এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে অন্যান্য তত্ত্ব এসব দেশের অর্থনৈতিক পরিবর্তনের পরিপূর্ণ ব্যাখ্যা দিতে পারে না। পূর্ব ইউরোপ ও লাতিন আমেরিকার (যেমন চিলির) অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায় যে রাষ্ট্র কেবল শাসনের উপকরণ নয়, রাষ্ট্র সমাজের শ্রেণি-কাঠামো বদলে দিতে পারে, এমনকি নতুন শ্রেণি তৈরি করতে পারে। এটা উল্লেখ্য যে রাষ্ট্র শ্রেণি তৈরি করতে পারে, এই ধারণা আগে শুধু ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে আলোচিত হয়েছে। কোনো কোনো গবেষক (যেমন হামজা আলাভি, ১৯৭২) বলেছিলেন যে ঔপনিবেশিক শাসনের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা রাষ্ট্র নতুন শ্রেণি তৈরি করতে পারে এবং করে। এসব আলোচনায় একটা বিষয় অনুপস্থিত থেকেছে তা হলো রাষ্ট্রের আদর্শিক ভূমিকা, অর্থাত্ রাষ্ট্র নিজেই ভাবাদর্শ বা আইডিওলজি তৈরির হাতিয়ার হতে পারে। রাষ্ট্র নতুন আদর্শের জন্ম দিতে এবং তার মাধ্যমে রাষ্ট্রের গৃহীত পদক্ষেপের বৈধতা দিতে সক্ষম (রীয়াজ, ২০০৫)। পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে ‘জাতীয় উন্নয়নের’ আদর্শের নামে এবং লাতিন আমেরিকায় ‘জাতীয় নিরাপত্তার’ আদর্শের নামে রাষ্ট্রগুলো অপ্রতিনিধিত্বশীল ও অগণতান্ত্রিক, এমনকি কর্তৃত্ববাদী শাসনকে বৈধতা প্রদান করেছে।
এককভাবে রাষ্ট্র, সমাজ বা অর্থনীতিকে পরিবর্তনের নির্ণায়কের ভূমিকায় স্থাপন করলে রাজনীতির ঘটনাপ্রবাহকে একটিমাত্র দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখার সুযোগ হয় এবং তাতে করে একধরনের সীমাবদ্ধতা তৈরি হয়। দুটি উদাহরণ আমার বক্তব্য বুঝতে সাহায্য করবে। আমি এই দুটো উদাহরণ ব্যবহার করছি এসবের তাত্ত্বিক গুরুত্বের জন্য যেমন তেমনি বাংলাদেশের জন্য এগুলোর প্রাসঙ্গিকতার জন্যও।
প্রথমটি হচ্ছে সমাজ-রাষ্ট্র-ধর্মের মধ্যকার সম্পর্কের বিষয়। ঊনবিংশ শতাব্দীতে ‘সেক্যুলারিজমের’ একটি ধারণা বিস্তার লাভ করে যে সেক্যুলারিজম হচ্ছে সমাজ ও ধর্মের সম্পর্কের বিষয়। এই বিবেচনার আলোকে ঊনবিংশ এবং বিংশ শতাব্দীতে বলা হয় যে সমাজের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে সমাজে ধর্মের প্রভাব হ্রাস পাবে। সমাজের অগ্রগতির লক্ষণ হিসেবে ‘আধুনিকায়ন’ এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কথা বলা হয়েছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীর সমাজবিজ্ঞানীরা, যেমন অগাস্ট কোঁত্, হার্বার্ট স্পেন্সার, এমিল ডুর্খেইম, ম্যাক্স ভেবার, কার্ল মার্ক্স—সবাই ধর্মের ভূমিকা সম্পর্কে আলোচনায় এই উপসংহার টেনেছেন যে সময়ের পরিক্রমায় সমাজে ধর্মের গুরুত্ব ও প্রভাব হারিয়ে যাবে। ‘আধুনিকায়ন’ ধীরে ধীরে ধর্মকে জনপরিসর থেকে বিদায় করবে, এটাই ছিল মূল যুক্তি। আধুনিকায়ন অবশ্যই কেবল অর্থনীতির বিষয় নয়, আধুনিকায়নের সঙ্গে জড়িত আছে ‘মডার্নিটি’র বিষয়, যা আবার যুক্ত সমাজের মূল্যবোধের সঙ্গে (রীয়াজ, ২০১৬)। কিন্তু ‘আধুনিকায়নের’ যে সীমাবদ্ধ ধারণা সেক্যুলারিজমের বিস্তারের কারণ হিসেবে সবচেয়ে বেশি এবং ক্ষেত্রবিশেষে একচ্ছত্র বলে প্রচারিত হয়েছিল তা হচ্ছে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি। অর্থাত্ অর্থনৈতিক নির্ণয়বাদই শেষ বিচারে সেক্যুলারিজমের ধারণাকে নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে। এটি বিশেষভাবে ঘটে বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা আধুনিকায়ন তত্ত্বের প্রবক্তাদের কারণে।
বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে এসে আমরা দেখতে পেলাম যে সমাজ থেকে ধর্মের অবসান তো ঘটেইনি, বরং সমাজ ও রাজনীতিতে ধর্ম একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছে, তার প্রভাব বেড়েছে, রাজনৈতিক আদর্শ হিসেবে তাঁর আবির্ভাব ঘটেছে। অর্থাত্ অর্থনৈতিক নির্ণয়বাদের আলোকে আমরা যদি ধরে নিই যে অর্থনৈতিকভাবে পরিবর্তন ঘটলে সামাজিক পরিবর্তন একটি বিশেষ পথরেখা অনুসরণ করবে, সেটা সঠিক না-ও হতে পারে। ধর্মের নতুন ভূমিকা আমাদের সে ইঙ্গিতই দিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সমাজের সাংস্কৃতিক পরিবর্তন কেবল আমাদের অনুমিত পথে এগোবে, এমন মনে করা বাঞ্ছনীয় নয়। অর্থনীতি ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক ভিন্ন ভিন্ন পথ অনুসরণের পেছনে রাষ্ট্রেরও ভূমিকা থাকে। সমাজ ও রাজনীতিতে ধর্মের উত্থান, বিশেষত ‘উন্নয়নশীল’ দেশগুলোতে এ উত্থানের পেছনে রাষ্ট্রের ভূমিকাকে অস্বীকার করা যায় না। এটি কেবল সেসব ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয় যেখানে রাষ্ট্র নিজেই ধর্মকে সামনে নিয়ে এসেছে, সেখানেও প্রযোজ্য যেখানে রাষ্ট্র ধর্মকে ব্যক্তিগত পরিসরে (প্রাইভেট স্ফেয়ার) ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করেছে (রীয়াজ, ২০১৬)।
আধুনিকায়ন তত্ত্বের আরেকটি বিষয় ছিল গণতন্ত্রের বিকাশের প্রশ্ন। আমি সেটিকেই দ্বিতীয় উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করতে চাই। ১৯৬০-এর দশকে এই ধারণার ব্যাপক প্রচার শুরু হয় যে গণতন্ত্রের সঙ্গে অর্থনীতির বিভিন্ন ধরনের যোগসূত্র আছে, বিশেষ করে মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব ও বিকাশের সঙ্গে গণতন্ত্রের সম্পর্ক গভীর। স্মরণ করা দরকার যে আধুনিকায়ন তত্ত্বের প্রবক্তারা এ ধারণার জনক এমন দাবি করা যাবে না, গণতন্ত্রের জন্য মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রয়োজনীয়তার প্রশ্নটি একার্থে অ্যারিস্টটলের, যিনি বলেছিলেন যে দরিদ্র ও ধনীদের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষায় মধ্যবিত্তের দরকার; তবে আধুনিকায়ন তত্ত্বের প্রবক্তারা যে একে আলোচনায় এবং নীতিনির্ধারণের কেন্দ্রে নিয়ে আসেন, সেটা অনস্বীকার্য। যোগসূত্রগুলোর বিভিন্ন দিকের সারসংক্ষেপ এই রকম—গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য বিশেষ অর্থনৈতিক অবস্থার দরকার হয় না—অর্থাত্ কেবল ধনী দেশেই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হবে তা নয়, তবে অর্থনৈতিক উন্নয়ন গণতন্ত্রের সম্ভাবনা বৃদ্ধি করে (যাকে বলা হয় ‘লিপসেট হাইপোথিসিস’)—এই সম্ভাবনার পেছনে কারণ হচ্ছে শিক্ষার প্রসার ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ এবং নাগরিকের আয়ের বৃদ্ধি ঘটলে কর্তৃত্ববাদী দেশ ক্রমেই গণতান্ত্রিক হয়ে ওঠে (লিপসেট, ১৯৫৯: ৮৩-৮৪); ‘বুর্জোয়ারা না থাকলে গণতন্ত্র হবে না’ (বেরিংটন মুরের উদ্ধৃতি ‘নো বুর্জোয়াজি, নো ডেমোক্রেসি’, মুর, ১৯৬৬); যেভাবেই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হোক না কেন, (অর্থনৈতিকভাবে) উন্নত দেশে গণতন্ত্র টিকে থাকে (প্রেজওরস্কি, ১৯৯২)। পরবর্তী দশকগুলোতেও গণতন্ত্র, গণতন্ত্রায়ণ এবং রাজনৈতিক পরিবর্তনের আলোচনায় মধ্যবিত্তের ভূমিকা বিভিন্নভাবে আলোচিত হতে থাকে। এ ক্ষেত্রে আলোচনার দুটো ধারা সহজেই শনাক্ত করা যায়। প্রথমটি হচ্ছে একরৈখিক, অর্থাত্ যাঁরা মনে করেন যে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উন্নয়ন একরৈখিকভাবে চলে, অর্থনৈতিক উন্নয়ন হলেই রাজনৈতিক উন্নয়ন ঘটবে। সিমোর লিপসেট (১৯৫৯), স্যামুয়েল হান্টিংটন (১৯৯১), রোনাল্ড গ্ল্যাসম্যান (১৯৯৫) এই ধারার প্রতিনিধি। অন্যদিকে যাঁরা মনে করেন সম্পর্কটি শর্তসাপেক্ষ, তাঁদের বক্তব্যের সারকথা হচ্ছে গণতন্ত্রের পক্ষে মধ্যবিত্তের ভূমিকা অন্যান্য আর্থসামজিক ও আর্থরাজনৈতিক অবস্থা দিয়ে প্রভাবিত হয়। এই ধারার প্রতিনিধিদের মধ্যে আছেন ডেইল জনসন (১৯৮৫), হেগেন কু (১৯৯৭), আকেমগলু ও রবিনসন (২০০০) এবং ব্রুস ডিকেনসন (২০০৩)। কেউ কেউ এ কথাও বলেন যে রাজনৈতিক পরিবর্তনে মধ্যবিত্ত ভূমিকা রাখলেও শ্রমজীবীরাই গণতন্ত্রায়ণের মূল শক্তি (রুয়েশমায়ার, স্টিফেন্স ও স্টিফেন্স, ১৯৯২)।
লক্ষণীয় এই যে এসব আলোচনায় মধ্যবিত্ত শ্রেণির ধারণা কার্যত অর্থনৈতিকভাবে—আয় ও সামাজিক অবস্থানের আলোকে—নির্ধারিত হয়েছে, যদিও মধ্যবিত্ত এ ধারণার কোনো সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। মধ্যবিত্তবিষয়ক বিভিন্ন গবেষণায় ব্যবহূত সংজ্ঞাগুলোর সারাংশ বিবেচনায় নিয়ে চেন (২০১৩) দেখান যে এদের দুভাবে ভাগ করা যায়—সাবজেকটিভ (বিষয়ী/ধারণাপ্রসূত) এবং অবজেকটিভ (বৈষয়িক/বস্তুগত)। সাবজেকটিভ বা বিষয়ী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বলা হয় যে শ্রেণি হচ্ছে একধরনের মানসিক অবস্থান, যা একজন মানুষের সামগ্রিক আত্মধারণার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট; সহজ ভাষায় একজন মানুষ নিজেকে মধ্যবিত্ত মনে করছেন কি না, নিজেকে সেভাবে বিবেচনা করেন কি না, তার ওপর নির্ভর করছে তাঁকে আমরা সেই শ্রেণিভুক্ত করব কি না। অন্যদিকে অবজেকটিভ বা বৈষয়িক দৃষ্টিভঙ্গির মূলকথা হচ্ছে কোনো সামাজিক-রাজনৈতিক শ্রেণি নির্ধারিত হয় কতগুলো সামাজিক-অর্থনৈতিক সূচক দিয়ে। এই সূচক নির্ধারণের দুটি ধারা রয়েছে—একটি হচ্ছে সংখ্যাতাত্ত্বিক বা পরিমাণবাচক (কোয়ান্টিটেটিভ), যেমন আয়, শিক্ষা, পেশা ইত্যাদি। অন্যটি হচ্ছে গুণবাচক (কোয়ালিটেটিভ), যেখানে বলা হচ্ছে যে মধ্যবিত্ত হচ্ছে তারাই যারা কিছু নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য ধারণ করে, যা তাদের অন্য শ্রেণিগুলো থেকে আলাদা করে চিহ্নিত করে (চেন, ২০১৪: ৩২-৩৪)।
গণতন্ত্রের পক্ষে মধ্যবিত্তের এই ভূমিকা কেন, সেটা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সাধারণত যে প্রধান কারণের কথা বলা হয়েছে তা হচ্ছে বৈষয়িক লাভ। মধ্যবিত্ত যেহেতু সম্পদের মালিকানা ভোগ করে, সেহেতু তারা চায় যে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হোক, যাতে করে খামখেয়ালি ব্যবস্থার শিকার হয়ে তাদের কিছু হারাতে না হয়। এই প্রেক্ষাপটে এটাও উঠে আসে যে মধ্যবিত্ত একধরনের মূল্যবোধ ধারণ করে, যার মধ্যে আছে আত্মসম্মানবোধ, যার দিকে গুণবাচক ধারার গবেষণাগুলো গুরুত্ব দিয়ে এসেছে। শিক্ষায় তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার ফলে এবং অর্থনৈতিক অবস্থানের কারণে তাদের পছন্দ হচ্ছে চিন্তা ও মতপ্রকাশের অধিকার লাভ করা। এই তত্ত্বের প্রমাণ হিসেবে গোড়াতে পশ্চিমা বিশ্ব, বিশেষত ইউরোপের উদাহরণ দেওয়া হতো। কিন্তু ১৯৮০-৯০-এর দশকগুলোতে বেশ কিছু অর্থনৈতিকভাবে সফল দেশে আন্দোলনের মাধ্যমে কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসানকে এভাবে ব্যাখ্যা করা হয় যে সেসব দেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ এবং তাদের চাপের মুখেই গণতন্ত্রায়ণের পথ প্রশস্ত হয়েছে। ১৯৮৭ সালে দক্ষিণ কোরিয়ায় গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সাফল্যকে সেভাবে ব্যাখ্যা করা হয়। হান্টিংটন গণতন্ত্রের তৃতীয় ঢেউ বা থার্ড ওয়েভ অব ডেমোক্রেসির যেসব কারণ হাজির করেন তার একটি হচ্ছে নগরকেন্দ্রিক মধ্যবিত্তের বিকাশ। এসব আলোচনায় কখনো প্রত্যক্ষভাবে, কখনো পরোক্ষভাবে এ ধারণাই দেওয়া হয় যে কোনো দেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যদি একটি শক্তিশালী মধ্যবিত্ত শ্রেণি তৈরি করে, তবে সেখানে গণতন্ত্রায়ণ ঘটে বা তার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়।
ওপরের আলোচনার সারসংক্ষেপ করলে দাঁড়ায় যে প্রচলিত (কিন্তু একেবারে সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়) তত্ত্বগুলো বলছে যে মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ হলে গণতন্ত্র এবং ‘সেক্যুলারিজমের’ একটি রূপ প্রতিষ্ঠিত হয় বা তার সম্ভাবনা বাড়ে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির ‘সাফল্য’ এবং মধ্যবিত্তের বিকাশ
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে ভারতে, বিশেষত বাংলায়, মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভবসংক্রান্ত আলোচনায় এটা গবেষণালব্ধ ফলাফলের ভিত্তিতেই সুপ্রতিষ্ঠিত
যে বাঙালি মধ্যবিত্ত ‘ভদ্রলোক’ শ্রেণির—যে শ্রেণির সদস্যরা ছিলেন কলকাতাকেন্দ্রিক, ধর্মবিশ্বাসে হিন্দু—উদ্ভব হয়েছিল ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের পরিপোষণে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মধ্যেই এই মধ্যবিত্তের বীজ নিহিত ছিল, কলকাতাকেন্দ্রিক ‘বাবু’ সম্প্রদায় শিক্ষা ও চাকরির সূত্রেই মধ্যবিত্ত হয়ে ওঠে। পাকিস্তানের ক্ষেত্রেও রাষ্ট্রীয় অনুকূল্যেই মধ্যবিত্তের বিকাশ ঘটেছে। কেবল পশ্চিম পাকিস্তানেই নয়, পূর্ব পাকিস্তানে যে মুসলিম মধ্যবিত্তের সূচনা সেটিও রাষ্ট্রের আনুকূল্যেই। একার্থে ১৯৫০ সালে জমিদারি প্রথা বিলোপের আইনি ব্যবস্থা মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভবের পথ উন্মুক্ত করে। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষেত্রে এটি ঘটে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দেড় দশক পর, কার্যত ১৯৬০-এর দশকে, সামরিক শাসক আইয়ুব খানের আমলে। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর যে অর্থনীতি উত্তরাধিকারসূত্রে রাষ্ট্রপরিচালকেরা লাভ করেন, সেখানে মধ্যবিত্তের আকার ছিল ছোট, প্রধানত ঢাকা শহরকেন্দ্রিক। এই মধ্যবিত্তের একটি অংশই রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিল। অতীত অভিজ্ঞতা, শ্রেণিচরিত্র এবং বাস্তবতার আলোকে এই শ্রেণি তার বিকাশের জন্য রাষ্ট্রের মুখাপেক্ষী হয়েছিল, রাষ্ট্রকে ব্যবহার করেই তার বিকাশ ঘটাতে চেয়েছে। সে কাজে সূচিত সাফল্যের গতিকে দ্রুততর করার কাজটি ঘটে ১৯৭৫-পরবর্তী সেনাশাসকদের হাত ধরে, যখন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। ফলে ১৯৯০ সালে যখন প্রত্যক্ষ সেনাশাসনের অবসান ঘটল, বাংলাদেশে তখন একটি মাঝারি আকারের মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে উঠেছে (রীয়াজ, ২০০৫)। ইতিমধ্যেই বাংলাদেশ বৈশ্বিক অর্থনীতিতে অংশভূত বা ইন্টিগ্রেটেড হয়েছে।
বাংলাদেশের সমাজে শ্রেণিকাঠামোয়, বিশেষত মধ্যবিত্ত শ্রেণির ক্ষেত্রে, কী ঘটেছে সেটা অনুধাবন করতে আমাদের তাকানো দরকার বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সহজে দৃশ্যমান বিষয়গুলোর দিকে। গত কয়েক দশকে, বিশেষত ২০০১ সালের পর, অর্থনৈতিকভাবে ব্যাপক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে; গত দশকগুলোতে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে উত্থান-পতন এবং অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সত্ত্বেও গড়ে বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের কাছাকাছি থেকেছে, এই সময়ে দারিদ্র্যের হার কমেছে এবং মাথাপিছু আয় বেড়েছে। বাংলাদেশে কোটিপতির সংখ্যা ২০১৬ সালের জানুয়ারির হিসাব অনুযায়ী ১ লাখ ১৯ হাজারের বেশি, যা সমাজে সম্পদের উপস্থিতির প্রমাণ দেয় (মানবজমিন, ২০১৬)। সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে এর একটি ধারা আমরা দেখতে পাই।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ১৯৭২ সালে দেশে কোটিপতি অ্যাকাউন্টধারী ছিল মাত্র ৫ জন। ১৯৭৫ সালের ডিসেম্বর শেষে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ৪৭ জনে। ১৯৮০ সালের ডিসেম্বরে ছিল ৯৮ জন। এরপর ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে কোটিপতির সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৯৪৩ জনে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৬ সালের জুনে কোটিপতির সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৫৯৪। ২০০১ সালের সেপ্টেম্বর শেষে কোটিপতির সংখ্যা দাঁড়ায় ৫ হাজার ১৬২ জনে। এরপর অক্টোবর ২০০১ থেকে ডিসেম্বর ২০০৬ পর্যন্ত কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছিল ৮ হাজার ৮৮৭ জন। অর্থাত্ এ সময়ে কোটিপতির সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ১৪ হাজারে। আর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ২ বছরে, অর্থাত্ ২০০৭-০৮ সালে বেড়েছিল ৫ হাজার ১১৪ জন। এ সময়ে কোটিপতির সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ১৯ হাজারের বেশি। পরিসংখ্যানে আরও দেখা গেছে, ২০০৮ সালের ডিসেম্বর শেষে দেশে মোট কোটিপতির সংখ্যা ছিল ৪৪ হাজার ৩৬৯ জন। ২০০৯ থেকে ২০১৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সাত বছরে দেশে মোট কোটিপতির সংখ্যা দাঁড়ায় ১ লাখ ১৯ হাজার ৩৬১ জনে (মানবজমিন, ২০১৭)।
বাংলাদেশের নগর ও গ্রামাঞ্চলের সাধারণ পর্যবেক্ষণ থেকেও এ কথা বলা সম্ভব যে অর্থনৈতিকভাবে অবস্থা আপাতদৃষ্টে ভালো। অর্থনৈতিক এই পরিবর্তনের ফলে দেশে যে ধনীর সংখ্যা বাড়ছে, তা সহজেই বোধগম্য। এখন বিশ্বের সবচেয়ে ধনীদের তালিকায় একজন বাংলাদেশিও অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন (ইত্তেফাক, ২০১৭)। ২০১৫ সালে বাংলাদেশ থেকে সুইস ব্যাংকগুলোতে রাখা অর্থের পরিমাণ আগের বছরের তুলনায় বেড়েছিল সাড়ে ১০ শতাংশ। মোট পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ৫০৪ কোটি ১৯ লাখ ৯৫ হাজার টাকা (হোসেন, ২০১৬)। পরের বছর তা আরও বৃদ্ধি পায়। ২০১৬ সালে সুইস ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশ থেকে জমা হওয়া অর্থের পরিমাণ ছিল বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৫ হাজার ৬৮৫ কোটি টাকা। ‘আগের বছরের চেয়ে এ জমার পরিমাণ প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা বা ২০ শতাংশ বেড়েছে’ (মহাজন, ২০১৭)।
বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের পরিমাণ আরেকটি উদাহরণ হতে পারে (চিত্র ১)। ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির (জিএফআই) তৈরি করা হিসাব অনুযায়ী ২০০৫ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে প্রায় ৭ হাজার ৫৮৫ কোটি ডলার বা ৬ লাখ ৬ হাজার ৮৬৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০১৪ সালেই প্রায় ৯১১ কোটি ডলার পাচার হয়েছে। টাকার অঙ্কে যা প্রায় ৭২ হাজার ৮৭২ কোটি টাকা (প্রথম আলো, ২০১৭)।
চিত্র ১: বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ ২০০৪-২০১৪ (বিলিয়ন ডলারে)
সূত্র: গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি (জিএফআই)
এর পাশাপাশি অর্থনৈতিক বৈষম্য বেড়েছে, যা আমরা জিনি সহগের মধ্যে দেখতে পাই। বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে প্রকাশিত ২০১৫ সালে এমডিজি প্রোগ্রেস রিপোর্টে জিনি সহগের আলোকে বলা হয়েছে যে জাতীয়ভাবে ২০০০ থেকে ২০১০ সালে আয়ের ক্ষেত্রে বৈষম্য প্রায় স্থির থেকেছে, কিন্তু গ্রামাঞ্চলে তা বেড়েছে (শূন্য দশমিক ৩৯৩ থেকে শূন্য দশমিক ৪৩০) (বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশন, ২০১৫, ২৪)। রিপোর্টে আরও বলা হচ্ছে যে জাতীয় আয়ে দরিদ্র এক-পঞ্চমাংশ ভাগ কমেছে। ১৯৯১ সালে দরিদ্র ২০ শতাংশের ভাগ ছিল ৬ দশমিক ৫২ শতাংশ, ১৯৯৫-৯৬ সালে ৫ দশমিক ৭১ শতাংশ, ২০০০ সালে ৬ দশমিক ১৫ শতাংশ, ২০০৫ সালে ৫ দশমিক ২৬ শতাংশ এবং ২০১০ সালে ৫ দশমিক ২২ শতাংশ। অর্থাত্ ১৯৯১ সালের তুলনায় গরিব এক-পঞ্চমাংশ এখন আরও দরিদ্র হয়েছে। এখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে প্রায় ৩০ শতাংশ মানুষ বাস করছে (চিত্র ২ ও ৩)।
চিত্র ২: জাতীয় আয়ে দরিদ্র এক-পঞ্চমাংশ ভাগ
চিত্র ৩: জাতীয় আয়ে গ্রামীণ দরিদ্র এক-পঞ্চমাংশ ভাগের ধারা, ১৯৯১-২০১০
দেশে তরুণদের, বিশেষত শিক্ষিত তরুণদের এক বড় অংশ, বেকার জীবন যাপন করছে এবং তাদের সংখ্যা বাড়ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপ অনুযায়ী ২০১৩-১৪ ও ২০১৪-১৫ দুই বছরে মাত্র ছয় লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে, অথচ এই সময়ে দেশের কর্মবাজারে প্রবেশ করেছে প্রায় ২৭ লাখ মানুষ। অর্থাত্ মাত্র দুই বছরে দেশে বেকারের সংখ্যা বেড়েছে ৪৮ লাখ। অথচ ২০০৩ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর চাকরি বা কাজ পেয়েছে ১৩ লাখ ৮০ হাজার মানুষ (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২০১৬, ইসলাম ২০১৭) (চিত্র ৪)।
চিত্র ৪: নতুন কর্মসংস্থান ১৯৯৯-২০০০ থেকে ২০১৫-১৬ (লাখের হিসেবে)
সূত্র: বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো
মোটা দাগের এসব অর্থনৈতিক তথ্যকে নিশ্চয় গ্রামীণ ও নগর—এভাবে ভাগ করা যায়। সে ক্ষেত্রে আবারও সাধারণ পর্যবেক্ষণ থেকে আমরা বলতে পারি যে গ্রামীণ অর্থনীতিতেও পরিবর্তন ঘটেছে এবং সেখানেও বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়েছে। তার অর্থ হচ্ছে যে নতুন ও বিকাশমান মধ্যবিত্তের কথা আমি উল্লেখ করেছি, তা কেবল নগরকেন্দ্রিক নয়। কৃষি ও অকৃষি খাতে কর্মসংস্থান, অর্থনীতির কাঠামোগত পরিবর্তন, বিভিন্ন ধরনের উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে সেখানেও নতুন মধ্যবিত্ত তৈরি হয়েছে।
অর্থনৈতিক এসব প্রবণতার পাশাপাশি বিবেচ্য হচ্ছে সামাজিক সূচকগুলো। যেসব সামাজিক সূচক দিয়ে কোনো দেশের সাফল্য বিবেচনা করা হয়, যেমন শিশু, নবজাতক ও প্রসূতিমৃত্যুর হার, লিঙ্গসমতা, নারীদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অবদানের হার, মেয়েদের স্কুলে পড়ার হার, সক্ষম দম্পতির জন্মনিয়ন্ত্রণব্যবস্থা গ্রহণের হার ইত্যাদি, সেখানেও বাংলাদেশ সমপর্যায়ের উন্নয়নশীল অন্যান্য দেশের চেয়ে ভালো, বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশকে পেছনে ফেলতে সমর্থ হয়েছে।
এসব সূচকের সাফল্যের সঙ্গে যেমন অর্থনৈতিক দিক জড়িত, তেমনি জড়িত সমাজে বিরাজমান মূল্যবোধের। যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সাফল্যের একটি খুঁটি হচ্ছে দেশের তৈরি পোশাকশিল্প। এই শিল্পের শ্রমিকগোষ্ঠী হচ্ছে নারীরা। পোশাক খাতে চল্লিশ লাখ শ্রমিক নিয়োজিত এবং তার ৭০ শতাংশের চেয়ে বেশি হচ্ছেন নারী। এসব তথ্যকে মনে রাখলে আমরা অপ্রত্যক্ষভাবেই বলছি যে বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজে নারীর ব্যাপারে দৃষ্টিভঙ্গিগত একটা পরিবর্তন ঘটেছে, কেননা এই নারীদের এক বড় অংশই এসেছে গ্রামাঞ্চল থেকে। সেই পরিবর্তনের সূচনা সত্তর ও আশির দশকে এনজিগুলোর বিভিন্ন কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে। অন্যদিকে আনুষ্ঠানিক শ্রমবাজারে নারীদের এই অংশগ্রহণের প্রভাব পড়েছে জন্মহার নিয়ন্ত্রণের ওপরে। নারী শ্রমিকদের জীবনাচরণ কেবল যে তাঁদের কর্মক্ষেত্রে সীমিত থেকেছে তা নয়, তার প্রভাব পড়েছে তাঁদের নিজ নিজ পরিবার এবং যেখানে তাঁদের স্থায়ী ঠিকানা। একার্থে তাঁরা পরিবর্তনের প্রভাবক বা ক্যাটালিস্ট হিসেবে কাজ করছেন। সমাজে পরিবর্তনের আরেক প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে স্বল্পমেয়াদি অভিবাসী জনগোষ্ঠী। ব্যুরো অব ম্যানপাওয়ার, এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড ট্রেনিং থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশ থেকে গত কয়েক দশকে এক কোটির বেশি মানুষ (১,০৪,৫৬,৪১৮) স্বল্পমেয়াদি কাজের কারণে দেশের বাইরে গেছেন (এই হিসাবে ছাত্র, দীর্ঘমেয়াদি অভিবাসন এবং শিক্ষিত জনগোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি) এবং দেশে ফিরে এসেছেন। অর্থনীতিতে এই জনগোষ্ঠীর ভূমিকা আলোচিত হলেও তাদের সামাজিক ভূমিকা স্বল্পালোচিত।
এই প্রবণতাগুলোর দৃশ্যমান দিক হচ্ছে বিত্তের বিবেচনায় মধ্যবিত্তের সংখ্যা বৃদ্ধি। বোস্টন কনসাল্টিং গ্রুপ, যার কাজ হচ্ছে বিভিন্ন দেশে ভোক্তা ও বাজারের সম্ভাবনা বিচার করা এবং বিনিয়োগকারী ও বাবসায়ীদের পরামর্শ দেওয়া, ২০১৫ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলেছে যে বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৭ শতাংশ বা ১ কোটি ২০ লাখ হচ্ছে ‘মধ্য ও বিত্তশালী ভোক্তা’ (‘মিডল অ্যান্ড এফলুয়েন্ট কনজিউমার’), এই ভোক্তা শ্রেণির বার্ষিক বৃদ্ধির হার ১১-১২ শতাংশ; ফলে ২০২০ সালে তা দাঁড়াবে মোট জনসংখ্যার ১২ শতাংশে, অর্থাত্ ১ কোটি ৯৩ লাখে; ২০২৫ সালে ৩ কোটি ৪০ লাখে (বিসিজি, ২০১৫)। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের গবেষক বিনায়ক সেনের হিসাব অনুযায়ী ২০১৫ সালে মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশকে মধ্যবিত্ত বলে বিবেচনা করা যায়, যা ২০২৫ সালে দাঁড়াবে ২৫ শতাংশে (ডেইলি স্টার, ২০১৫)। তিনি বলছেন এক দশক আগে মধ্যবিত্ত ছিল ৯ শতাংশ, ২০৩০ সালে দাঁড়াবে ৩৩ শতাংশে (ঢাকা ট্রিবিউন, ২০১৫)।
বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান দিকগুলোর আলোচনা থেকে এই উপসংহারে পৌঁছানো যায় যে গত কয়েক দশকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে এবং তার ফলে মধ্যবিত্ত শ্রেণি আকারে বড় হয়েছে।
এখানে আমরা এই শ্রেণির বিত্তের সম্ভাব্য উেসর দিকে মনোযোগ দিতে পারি। গত কয়েক দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতির কাঠামোগত পরিবর্তন ঘটেছে (চিত্র ৫)। স্বাধীনতার আগের দশকে (১৯৬১-৭০) বাংলাদেশের অর্থনীতি ছিল কৃষিনির্ভর। গড়ে মোট অভ্যন্তরীণ আয়ের ৫৫ শতাংশ আসত কৃষি থেকে, সেবা খাতের অবদান ছিল ৩৫ শতাংশ, শিল্প খাতের অবদান ছিল ১০ শতাংশ। স্বাধীনতার প্রথম দশকে (১৯৭১-৮০) এই অবদান হয় যথাক্রমে ৪৫, ৪৪ ও ১১ শতাংশ। ১৯৮১ থেকে ১৯৯০—এক দশকের গড় হচ্ছে ৩২, ৫৬ ও ১২ শতাংশ। নব্বইয়ের দশকে ১৯৯১ থেকে ২০০০ সালে এই অবদান হয় ২৫, ৬০ ও ১৫ শতাংশ। লক্ষণীয় হচ্ছে সেবা খাতের বিকাশ। ২০০০ সালের পর আমরা এ ধারাকেই অব্যাহত থাকতে দেখি। ২০০১ থেকে ২০১১-এর দশকে গড় ছিল—কৃষি ১৮ শতাংশ, সেবা খাত ৫২ শতাংশ, শিল্প খাত ৩০ শতাংশ। ২০০০ সালে যেখানে কৃষি খাতের অবদান ছিল ২৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ, তা ২০১৫ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ১৫ দশমিক ৫০ শতাংশে। সেবা খাতের অবদান ২৩ দশমিক ৩১ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৮ দশমিক ১৪ শতাংশ, শিল্প খাত ৫২ দশমিক ৯১ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ৫৬ দশমিক ৩৪ শতাংশ। মাঝারি আয়ের দেশগুলোতে মোট অভ্যন্তরীণ উত্পাদনে অকৃষি খাতের অবদান বৃদ্ধি মোটেই অস্বাভাবিক ঘটনা নয়।
চিত্র ৫: বাংলাদেশের অর্থনীতির কাঠামোগত পরিবর্তন, ১৯৬১-২০১৪
অর্থনীতির এই কাঠামোগত পরিবর্তনের চিত্র থেকে এটা অনুমান করা যায় যে গত দুই দশকে যে মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে উঠেছে, তাদের বিত্তের সূত্রের প্রধান উত্স হচ্ছে বিকাশমান সেবা খাত। বিআইডিএসের গবেষণা থেকে আমরা জানতে পারি যে ‘মধ্যবিত্তদের মধ্যে ৪৮ দশমিক ৪ শতাংশ বেসরকারি চাকরি করে। ২০ শতাংশ সরকারি চাকরি এবং ২২ শতাংশ ব্যবসা করে’ (খালেক, ২০১৫)। এই বেসরকারি চাকরির একটা বড় অংশই সেবা খাতের চাকরি। সেবা খাতের যে দুটি বৈশিষ্ট্যের দিকে আমি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই তা হচ্ছে উত্পাদনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সম্পর্কের অভাব এবং বিশ্বায়নের ফলে তার বৈশ্বিক যোগাযোগ। এই দুই-ই এই শ্রেণির সদস্যদের বিশ্ববীক্ষা, মানস গঠন এবং তাদের সামাজিক-রাজনৈতিক ভূমিকায় প্রভাব ফেলবে বলে আমরা অনুমান করতে পারি।
মধ্যবিত্তের সামাজিক-রাজনৈতিক ভূমিকা
রাষ্ট্র, সমাজ, অর্থনীতি ও রাজনীতির সম্পর্কবিষয়ক তত্ত্বের আলোচনায় আমরা দেখেছিলাম যে মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ গণতন্ত্রের আবশ্যকীয় শর্ত না হলেও কিংবা মধ্যবিত্ত শ্রেণির উপস্থিতি গণতন্ত্রের নিশ্চয়তা প্রদান না করলেও মধ্যবিত্ত শ্রেণি গণতন্ত্রের বিকাশের অনুকূল বলেই বিবেচিত হয়ে এসেছে। বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতার বাইরে সুনির্দিষ্টভাবে বাংলাদেশের ইতিহাস ও শিক্ষা তা-ই বলে। মধ্যবিত্ত শ্রেণির সামাজিক ও রাজনৈতিক ভূমিকার বিষয়টি সংক্ষেপে তুলে ধরেছেন বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, ‘পাকিস্তানের যুগে শ্রমিক-কৃষকের ভাত-কাপড়-রুটি-রুজির দাবিতে ও অন্যান্য অর্থনৈতিক-সামাজিক দাবিতে জনগণকে কম আন্দোলন করতে হয়নি। কিন্তু এসব আন্দোলনকে অতিক্রম করে আগাগোড়া প্রধান হয়ে সামনে হাজির হয়েছে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য এবং বাঙালি জাতির জাতীয় অধিকার তথা জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রামের ইস্যু। এসব সংগ্রামের সূত্রপাত হয়েছিল প্রধানত শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্য থেকে। সে সময়কার জাতীয় সংগ্রামে ছাত্রসমাজের ছিল অগ্রণী ও প্রধান উদ্যোগী ভূমিকা। মধ্যবিত্ত শ্রেণির ভূমিকা ছিল প্রধান’ (সেলিম, ২০১৫)। একই কথা বলেছেন যতীন সরকার, ‘দেশের মুক্তিসংগ্রামে সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল যাঁদের, তাঁদের গরিষ্ঠসংখ্যকই ছিল গ্রামের কৃষকসমাজের মানুষ। অর্থনৈতিক বিচারে এরা অধিকাংশই ছিল নিম্নবিত্ত গোষ্ঠীর, কারও কারও অবস্থান ছিল পুরোপুরি বিত্তহীনের কোটায়। কিন্তু সে সংগ্রামের নেতৃত্ব তাদের হাতে ছিল না। মূলত মধ্যবিত্ত গোষ্ঠীর মানুষের নেতৃত্বেই পরিচালিত হয়েছিল বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম’ (সরকার, ২০১৬)। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পটভূমিবিষয়ক গবেষণালব্ধ ফলাফলগুলোয়ও সুস্পষ্টভাবে এটাই চিহ্নিত যে বাংলাদেশের স্বাধিকার এবং স্বাধীনতা আন্দোলনে মধ্যবিত্ত শ্রেণি অগ্রণী ভূমিকা পালন করে এসেছে। তদুপরি ১৯৮০-এর দশকে সেনাশাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামেও এই শ্রেণি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
কিন্তু গত এক দশকে আমরা কি মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্য থেকে এমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখতে পাচ্ছি? একজন বিশ্লেষক বলছেন, রাষ্ট্রের চরিত্র কী হবে, সেখানে গণতন্ত্র ও জবাবদিহি কীভাবে নিশ্চিত হবে, রাষ্ট্রপরিচালনায় জনগণের অংশগ্রহণ কীভাবে বাড়ানো যাবে ইত্যাদি বিষয়েও সাধারণ জনগণের মধ্যে ক্রমেই একধরনের নির্লিপ্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে (খান, ২০১৬)। একই সময় সরকার-সমর্থক বুদ্ধিজীবীদের একাংশের কাছ থেকে ‘গণতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্রের’ ধারণা প্রচার ও তা প্রতিষ্ঠার দাবি তোলা হয়েছে। এ ধারণায় একই সময়ে একদিকে ‘জনগণের জন্য গণতন্ত্রের সব সুযোগ ও অধিকার’ অব্যাহত রাখা এবং অন্যদিকে বিশেষ বিশেষ রাজনৈতিক শক্তির বিরুদ্ধে (যুদ্ধাপরাধী জামায়াত এবং তাদের সহযোগী সব শক্তির বিরুদ্ধে) একনায়কত্ব আরোপের এক নতুন শাসনব্যবস্থা চালুর কথা বলা হয়েছে (হোসেন, ২০১৪)। এই ব্যবস্থার আওতায় নাগরিকদের মৌলিক মানবাধিকার না রাখার পরামর্শও দেওয়া হয়েছে (হোসেনের ভাষায়, ‘অনুচ্ছেদ ১৪১/সি-এর ক্ষমতাবলে জরুরি অবস্থা চলাকালীন সময়ে ফান্ডামেন্টাল রাইটস আরোপ করার অধিকার স্থগিত থাকবে।’) একই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ক্ষমতাসীনদের প্রতিপক্ষকে ‘রাষ্ট্রীয় বল প্রয়োগ করেও দুর্বল ও নিঃশেষিত’ করা এবং তাতে কোনো রকম বাধা না প্রদানের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এই পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, এ কথা স্বীকার করে নিয়েও যে ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে ‘বিভিন্ন আপসকামিতা, দুর্নীতি, অনাবশ্যক বাড়াবাড়ি ও ফ্যাসিবাদী প্রবণতা’ উপস্থিত আছে (আকাশ, ২০১৫)।
এখানে এ কথাও বিশেষভাবে উল্লেখ করা দরকার যে গত কয়েক বছরে বিশেষত ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর থেকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের মধ্যে একটি বিভাজনরেখা টানা হচ্ছে এবং এদের পরস্পরের বিকল্প বা প্রতিদ্বন্দ্ব্বী হিসেবেই উপস্থাপন করা হচ্ছে (চৌধুরী, ২০১৫; জাকারিয়া, ২০১৫)। এই ধারণার আলোকে ক্ষমতাসীন দল এবং তার সমর্থকদের বক্তব্য হচ্ছে যে প্রচলিত গণতন্ত্র রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা তৈরি করে, যা উন্নয়নের পথে বাধাস্বরূপ, ফলে ‘কম গণতন্ত্র, বেশি উন্নয়ন’-এর পথই দেশের জন্য ইতিবাচক। এই ক্ষেত্রে তারা যেসব দেশকে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করে, তার মধ্যে আছে মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুর। গণতন্ত্র ও উন্নয়নের এই বিভাজন ও একটিকে অন্যটির বিকল্প হিসেবে উপস্থাপনের বিষয় নিয়ে বিতর্ক সুবিদিত। ২০১৪ সাল থেকে বিভিন্ন বক্তব্যে প্রতিভাত হয় যে সেই বিতর্ককে পাশ কাটিয়ে এবং এর অন্যান্য রাজনৈতিক-প্রাতিষ্ঠানিক উপাদানের দিকগুলোকে ধর্তব্যে না নিয়েই ‘উন্নয়নের’ একটি বিশেষ ধারণাকে সামনে নিয়ে আসা হয়েছে। ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ সেদিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন এবং বাংলাদেশে কথিত ‘মালয়েশিয়া মডেল’-এর প্রয়োগযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন (মাহমুদ, ২০১৪)। সরকারের এই অবস্থানকে স্বৈরতান্ত্রিক বলেও বর্ণনা করা হচ্ছে (আমাদের বুধবার, ২০১৫)। একই সঙ্গে এটাও স্মর্তব্য যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাপত্রে যে লক্ষ্যসমূহ উল্লেখিত হয়েছিল তার সঙ্গে এ ধরনের অবস্থান মর্মবস্তুর দিকে থেকে সাংঘর্ষিক।
সাম্প্রতিক কালে আমরা বাংলাদেশের সমাজে, বিশেষত সমাজের মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত শ্রেণির মধ্যে, ধর্মের ব্যাপারে ব্যাপক আগ্রহ দেখতে পাচ্ছি, যার প্রকাশ ঘটছে ধর্মাচরণকে জনসমক্ষে উপস্থাপনের মাধ্যমে। দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহূত বিভিন্ন ধরনের বাক্য, বাগ্ধারা, সম্ভাষণ থেকেও এর সপক্ষে প্রমাণ মেলে। এর সবচেয়ে দৃষ্টিগ্রাহ্য প্রমাণ হচ্ছে কিছু কিছু আরবি শব্দের ব্যাপক প্রচলন, যেমন বহুল প্রচলিত ‘খোদা হাফেজ’-এর পরিবর্তে ‘আল্লাহ হাফেজ’-এর ব্যবহার। তদুপরি বাংলাদেশে প্রচলিত পোশাক-পরিচ্ছদেও এর প্রভাব দৃশ্যমান। একে কেউ কেউ চিহ্নিত করেছেন ‘আরবীকরণ’ বলে (হাশমি, ২০১৪; হার্ডিগ ও সাজ্জাদ, ২০১৫)। এই নিবন্ধের শুরুতে যেটা আমি উল্লেখ করেছি, বাংলাদেশের রাজনীতিতে গত কয়েক দশকে ধর্মের প্রশ্নটি যথেষ্ট গুরুত্ব নিয়েই উপস্থিত হয়েছে, কিন্তু এ বিষয়ে পলেমিকাল বা একপাক্ষিক আলোচনার বাইরে ধর্ম ও রাজনীতি, ধর্ম ও সমাজ এবং ধর্ম ও রাষ্ট্রের মধ্যকার সম্পর্ক বিষয়ে ভূয়োদর্শনলব্ধ আলোচনা খুব সীমিত। বাংলাদেশের বিকাশমান মধ্যবিত্ত, যাদের রেহমান সোবহান বর্ণনা করেছেন ‘এক্সক্লুসিভ’ এবং বিশ্বায়িত বা গ্লোবালাইজড বলে, তাদের মধ্যে ধর্মের প্রতি পক্ষপাতের বিষয়টি বিভিন্নভাবেই চিহ্নিত হচ্ছে। সোবহান মনে করেন, এরা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ, যার মধ্যে ‘সেক্যুলারিজম’ অন্যতম, তাকেই জলাঞ্জলি দিয়েছেন (সোবহান, ২০০৬)। যতীন সরকার এই প্রবণতাকে ‘পাকিস্তানীকরণ’ বলে বর্ণনা করে মধ্যবিত্তকে ‘মোনাফেক’ বলে চিহ্নিত করেছেন (সরকার, ২০১৬)। এই দুই ধরনের ব্যাখ্যার কোনোটির সঙ্গেই সম্পূর্ণভাবে একমত না হয়েও বলা যায়, দেশে ইসলাম ধর্মের বিভিন্ন ধরনের প্রকাশ এখন সহজেই চোখে পড়ে।
কয়েকটি প্রশ্ন ও অনুমান
বাংলাদেশে ক্রমাগতভাবে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়া, নির্বাচনী প্রক্রিয়ার সততা (ইন্টেগ্রিটি) প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়া, ভিন্নমত প্রকাশের স্পেস সংকুচিত হওয়া, বিরাজমান একাধিক আইনের অপব্যবহার (যেমন তথ্য ও যোগাযোগ আইনের ৫৭ ধারা, যার আওতায় সরকার বা সরকারি দলের নেতাদের সমালোচনার জন্য আনীত মামলার সংখ্যা ২০১৬ সালে ছিল ৩৫টি), ভিন্নমত নিয়ন্ত্রণমূলক নতুন আইনের প্রস্তাব (যেমন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতিকরণ অপরাধ আইন ২০১৬), ক্রমবর্ধমান বিচারবহির্ভূত হত্যা (২০১৬ সালে এই সংখ্যা ছিল ১৭৮) এবং গুমের (২০১৬ সালে ছিল ৯০ জন) ঘটনা বৃদ্ধি সত্ত্বেও (অধিকার, ২০১৭) এসব বিষয়ে মধ্যবিত্ত শ্রেণির যথেষ্ট উদ্বেগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না।
এই থেকে এ প্রশ্ন তোলা যায় যে গত এক দশকে বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্য থেকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা এবং শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে ভূমিকা পালনে কী অনুত্সাহিতা লক্ষ করা যাচ্ছে? গণতন্ত্র, এই প্রত্যয়ের কি ভিন্ন কোনো ধারণা তাদের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে? ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে ‘উন্নয়ন’কে গণতন্ত্রের বিকল্প হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা হচ্ছে, তা কি এই মধ্যবিত্ত শ্রেণির কাছে গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হচ্ছে? বাংলাদেশের গত কয়েক দশকে গণতন্ত্রের যে রূপ আমরা দেখতে পাই, তাতে নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলেই বিবেচিত হয়েছে, নির্বাচনে প্রদত্ত ভোটের হারের দিকে তাকালেও এ বক্তব্যের সপক্ষে তথ্য পাওয়া যাবে, সে ক্ষেত্রে ২০১৪ সালের পর থেকে স্থানীয় নির্বাচনে সাধারণ মানুষের ভোট প্রদানের প্রতিকূল পরিবেশ এবং ভোটাধিকার কার্যত অনুপস্থিত হওয়াকে তাঁরা কীভাবে বিবেচনা করেন? প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ্য, ‘১৯৯২ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে অর্থাত্ গণতান্ত্রিক সরকারগুলোর আমলে দেশে উল্লেখযোগ্য হারে মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ ঘটেছে’ (খালেক, ২০১৫)।
এসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্যই বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত সমাজের মানসিক গঠন এবং বিশ্ববীক্ষা বিষয়ে গবেষণা চালানো জরুরি। আমরা কেবল ভূয়োদর্শনলব্ধ বা ইম্পিরিক্যাল উপাত্তের মাধ্যমেই এ প্রশ্নের সঠিক জবাব আশা করতে পারি। এই প্রবন্ধের একটি লক্ষ্য হচ্ছে সে ধরনের গবেষণার প্রয়োজনের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা এবং তার জন্য তাগিদ দেওয়া। আমি মনে করি যে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ভবিষ্যত্ পথরেখা বোঝার জন্যই এ ধরনের গবেষণা জরুরি। এই পর্যবেক্ষণ যদি যথাযথ বলে প্রতীয়মান হয় যে বাংলাদেশের বিকাশমান মধ্যবিত্ত গণতন্ত্রের, বিশেষত তার যে উদারনৈতিক দিকগুলো রয়েছে সেই বিষয়ে অনাগ্রহী, তবে ইতিমধ্যে বাংলাদেশে যে ধরনের ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে, যাকে ‘দো-আঁশলা’ গণতন্ত্র (বা হাইব্রিড রেজিম) বলেই বর্ণনা করা যায় (ডায়মন্ড, ২০০২) তা কেবল অব্যাহতই থাকবে না, বরং আরও শক্তিশালী হবে। অথবা বিপরীতক্রমে সমাজের অন্যান্য শ্রেণি, বিশেষত নিম্নবিত্তদের মধ্য থেকে কাঠামোগত পরিবর্তনের জন্য চাপ সৃষ্টি হবে। সেই বিবেচনায় আমার দ্বিতীয় প্রশ্ন বাংলাদেশে কি মধ্যবিত্ত শ্রেণির রাজনৈতিক ভূমিকার অবসানের আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে কি না।
একইভাবে বলা যায় যে বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণির এক বড় অংশের মধ্যে জনসমক্ষে ধর্মাচরণের প্রচারের মধ্য দিয়ে কি ভবিষ্যতে রাষ্ট্র ও ধর্মের মধ্যকার বিভাজন না থাকারই ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে? বাংলাদেশের সমাজে সেক্যুলারাইজেশনের প্রক্রিয়া কখনোই শক্তিশালী ছিল না, কিন্তু সমন্বয়বাদী ইসলামের যে ধারাটি প্রধান ধারা বলে বিবেচিত হতো, মধ্যবিত্ত শ্রেণির এক বড় অংশই সম্ভবত এখন আর সেই ধারাকে বহন করে না। এই পরিবর্তনের পেছনে কারণগুলো চিহ্নিত করা অত্যন্ত প্রয়োজন।
গণতন্ত্র ও ধর্মের প্রশ্নে মধ্যবিত্তদের আচরণ বিষয়ে এসব পর্যবেক্ষণের অর্থ এই নয় যে গোটা মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্যই তা প্রযোজ্য। অবশ্যই মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে একটি অংশ দৃশ্যত ভিন্ন আচরণ করে এবং তারা ঐতিহ্যগত ভূমিকা পালনে সচেষ্ট। কিন্তু গত এক দশকের বেশি সময়ের পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে আমি এই অনুমান করি যে এসব প্রশ্নে মধ্যবিত্ত শ্রেণির ভেতরে একটা বড় ধরনের বিভক্তি তৈরি হয়েছে। সে ক্ষেত্রে গত এক বা দেড় দশকে মধ্যবিত্তদের যে অংশের বিকাশ ঘটেছে, যাদের আমি ‘নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণি’ বলে বর্ণনা করতে চাই, তাদের ভেতরেই গণতন্ত্রের উদারনৈতিক দিকগুলোর আবেদন কম এবং একই সঙ্গে তাদের মধ্য থেকেই সমাজে ও রাষ্ট্রে ধর্মের প্রত্যক্ষ ও প্রকাশ্য ভূমিকার তাগিদ পরিলক্ষিত হচ্ছে।
নতুন ও পুরোনো মধ্যবিত্ত শ্রেণির এই পার্থক্য বোঝার জন্য আমি ফরাসি সমাজবিজ্ঞানী পিয়েরে বর্দোর ‘সাংস্কৃতিক পুঁজি’র ধারণাকে ব্যবহার করতে চাই (বর্দো, ১৯৮৬)। বর্দোর আলোচনার প্রেক্ষাপট ফ্রান্স এবং তাঁর প্রধান বিবেচনা হচ্ছে শিক্ষা। বর্দো তাঁর ‘ফর্মস অব ক্যাপিটাল’ শীর্ষক নিবন্ধে দেখান যে পুঁজি হচ্ছে তিন ধরনের—অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক। সাংস্কৃতিক পুঁজি বলতে তিনি বোঝান এমন সব প্রতীকী বা সিম্বলিক জিনিস (যেমন দক্ষতা, রুচি, আচার, পোশাক, পার্থিব জিনিসপত্র, শিক্ষা ইত্যাদি), যা একজন মানুষ অর্জন করে একটি শ্রেণির অংশ হিসেবে। বর্দো বলেছেন যে সাংস্কৃতিক পুঁজির তিনটি রূপ আছে—এমবোডিড (অর্থাত্ একেবারে অন্তর্গত, যেমন উচ্চারণ, কথা বলার ভঙ্গি); অবজেকটিফাইড (অর্থাত্ বস্তুগত, যেমন গাড়ি বা শিল্পকর্ম), আর ইনস্টিটিউশনালাইজড (বা প্রাতিষ্ঠানিক, শিক্ষা বা ডিগ্রি, যা সমাজে গৃহীত)। কোনো ধরনের সাংস্কৃতিক পুঁজি কে পাবেন, সেটা কীভাবে নির্ধারিত হয়? বর্দো সেটা ব্যাখার জন্য ‘হ্যাবিটাস’-এর ধারণা প্রবর্তন করেছেন। তিনি বলছেন যে হ্যাবিটাস সাংস্কৃতিক পুঁজির বৈষয়িক (বা ফিজিক্যাল) দিকের প্রতি আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে; ব্যক্তির জীবনযাপনের অভিজ্ঞতাই ব্যক্তির রুচি, অভ্যাস, দক্ষতা, দৃষ্টিভঙ্গি নির্মাণ করে দেয়। আমি তাঁর বক্তব্যকে আরও সম্প্রসারিত করে বলতে চাই, একটা কেবল ব্যক্তির ক্ষেত্রেই ঘটে তা নয়, একটি শ্রেণির ক্ষেত্রেও ঘটতে পারে, একটা শ্রেণি কী ধরনের ‘হ্যাবিটাসের’ মধ্যে তৈরি ও বিকশিত হয়েছে সেটা ওই শ্রেণির সদস্যদের বিশ্ববীক্ষা এবং সামাজিক-রাজনৈতিক ভূমিকা নির্ধারণ করে দেয় বলে আমি মনে করি।
নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের মধ্যবিত্তবিষয়ক আলোচনায় এই সাংস্কৃতিক পুঁজির দিকে আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করেন। তাঁর ভাষ্য অনুযায়ী ব্রিটেনের বাইরে মধ্যবিত্ত শ্রেণির বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে যে বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয় তা হচ্ছে ‘মানব, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক পুঁজি’ (ইসলাম, ২০১৪)। তিনি মনে করেন যে বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বদলাতে শুরু করেছে ১৯৮০-এর দশকে, যখন ব্যাপকাকারে মধ্যবিত্তের একাংশের উন্নত দেশগুলোতে অভিবাসন এবং একটি ছোট অংশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সুযোগ ব্যবহার করে উঁচু শ্রেণিতে উঠে যাওয়ার ঘটনা ঘটে। এর ফলে একটা শূন্যতার সূচনা হয়। সেই জায়গাটিতে আসেন গ্রাম থেকে উঠে আসা মানুষ, যাদের মানসম্পন্ন শিক্ষার এবং ‘সফিসটিকেশনের’ অভাব আছে। তাঁরা অবশিষ্ট পুরোনো মধ্যবিত্তদের ‘নিমজ্জিত’ করে ফেলেন। তিনি বলেন যে এখনো শিক্ষা (ডিগ্রির বিবেচনায়) এবং পেশার (মূলত ব্যবসা) গুরুত্ব আছে, কিন্তু সেগুলো আর নির্ণায়ক বিষয় নয়। আয় এবং সম্পদ, যা সম্প্রতি অর্জিত হয়েছে, তাই এই বিকাশমান মধ্যবিত্তের কাছে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব লাভ করে এবং সেগুলো পুরোনো মূল্যবোধ ও সেক্যুলার সংস্কৃতির জায়গাগুলো নিয়ে নিচ্ছে’ (ইসলাম, ২০১৪, ১১)। ইসলামের এই পর্যবেক্ষণের সঙ্গে আমি এখানে একমত যে এই বৈশিষ্ট্যগুলো আমার এখন আরও সুস্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু আমার ভিন্নমত হচ্ছে সময়ের বিবেচনা। আমি অনুমান করি যে এই পরিবর্তন হয়েছে ১৯৯০-এর দশকের পরে।
এই বিষয়ে সেলিম জাহানের প্রস্তাবিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিভাজন আমাদের মনোযোগ দাবি করে (জাহান, ২০১১)। জাহান বলছেন যে গত কয়েক দশকে বিশ্বায়ন ও অর্থনৈতিক উদারীকরণের ফলে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে মধ্যবিত্ত শ্রেণির আকার বৃদ্ধি পেয়েছে। এই নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশের ফলে ঐতিহ্যগতভাবে যে শ্রেণিকে আমরা মধ্যবিত্ত শ্রেণি বলে জানতাম, তাদের মধ্যে একটা বিভাজন তৈরি হয়েছে। এর এক অংশকে জাহান বলছেন ‘সামাজিক মধ্যবিত্ত শ্রেণি’, অন্যটিকে বলছেন ‘অর্থনৈতিক মধ্যবিত্ত শ্রেণি’। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ঐতিহ্যগতভাবে যে মধ্যবিত্ত শ্রেণি ছিল, তাদের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ‘সাধারণ জীবনযাপন, উঁচুমাত্রার চিন্তাভাবনা’। এই শ্রেণি কিছু আচারপদ্ধতি এবং মূল্যবোধ ধারণ করে। সমাজের ক্রান্তিকালে এই সামাজিক মধ্যবিত্ত শ্রেণি বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্ব দিয়ে এসেছে এবং সমাজের অন্য শ্রেণি, বিশেষত দরিদ্র শ্রেণি, তাদের ওপর আস্থা রেখেছে। বিপরীতক্রমে যে নতুন ‘অর্থনৈতিক মধ্যবিত্ত শ্রেণি’র বিকাশ ঘটেছে, তারা প্রধানত বয়সে তরুণ, উচ্চশিক্ষিত ও পেশাজীবী। কিন্তু সামাজিক মধ্যবিত্ত শ্রেণি যেসব মূল্যবোধ ও আচারকে গুরুত্ব দিত, তাকে একইভাবে গুরুত্ব দেয় না। ‘তারা অর্থের দ্বারা চালিত এবং ব্যবসা ও ভোক্তাবাদ তাদের মননের অংশ’ (জাহান, ২০১১: ৫)। তিনি বলছেন যে এদের ‘নতুন ধনিক’ বলে অভিহিত করা হয়। জাহানের এই পর্যবেক্ষণের জন্য যেসব দেশকে ব্যবহার করা হয়েছে তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্তর্ভুক্ত নয়, কিন্তু তাঁর এই পর্যবেক্ষণ বাংলাদেশের জন্য সমপরিমাণে সত্য। তবে অন্যত্র যেমন এই নতুন শ্রেণি মধ্যবিত্তরা তরুণ এবং প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য কি না তা প্রশ্নসাপেক্ষ।
এই বিবেচনায়ই আমি এই অনুমান বা হাইপোথিসিস আকারে উপস্থিত করছি যে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কাঠামোর বদলের ফলে যে নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব হয়েছে, সেটাই সমাজ ও রাজনীতির পরিবর্তনের অন্যতম বিষয়। পাশাপাশি এই প্রশ্নও রাখতে চাই তা হলো এই নতুন মধ্যবিত্তের ভৌগোলিক অবস্থান (নগর বনাম মফস্বল বনাম গ্রাম) কিংবা তাদের পেশার কারণে তাদের বিশ্ববীক্ষা এবং সামাজিক-রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির কোনো ধরনের পার্থক্য ঘটে কি না।
উপসংহারের পরিবর্তে
আমি আলোচনার শুরুতেই বলেছি যে এই নিবন্ধে আমি কোনো উপসংহার টানব না। কেননা, আমি এই লেখায় আমার পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে কিছু অনুমান (হাইপোথিসিস) এবং প্রশ্ন উত্থাপন করার চেষ্টা করেছি। এই লেখার উদ্দেশ্য হচ্ছে এই বিষয়ে আলোচনার সূত্রপাত করা। আমার উদ্দেশ্য হচ্ছে বাংলাদেশের বর্তমান সামাজিক ও রাজনৈতিক চালচিত্র বোঝার জন্য এই দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তনগুলোর দিকে মনোযোগ দেওয়ার জন্য তাগিদ সৃষ্টি। এতে করে বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতির ভবিষ্যত্ পথরেখা উপলব্ধি করা সহজ হবে বলে আমি মনে করি। এ ধরনের গবেষণা ও আলোচনা একাডেমিক গবেষণায় যুক্তদের জন্য যেমন কাজে দেবে, ঠিক তেমনি তা নীতিনির্ধারকদেরও সাহায্য করবে। সমাজ পরিবর্তনে আকাঙ্ক্ষী ব্যক্তিদের এবং শক্তিগুলোর জন্যও এ ধরনের আলোচনা সহায়ক বলে আমি মনে করি। কিন্তু এ ধরনের গবেষণা ও আলোচনার আবশ্যিক শর্ত হচ্ছে পূর্বধারণার বৃত্তে নিজেদের সীমিত না রাখা। অর্থাত্ অতীতে আমরা যাকে নিশ্চিত বলেই মনে করেছি, এমনকি তা যদি তত্কালীন সময়ের প্রেক্ষাপটে গবেষণালব্ধও হয়, সে বিষয়ে নতুন ধরনের ফলাফলের জন্য নিজেদের প্রস্তুত রাখা। একই সঙ্গে সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি ও রাষ্ট্রের পরিবর্তনের মধ্যকার গভীর এবং মিথোজীবী (সিম্বায়োটিক) সম্পর্ককে স্বীকার করে নেওয়াও এই আলোচনার একটি জরুরি দিক। এর যেকোনো একটি অপরকে প্রভাবিত করতে সক্ষম, সেটি বিবেচনায় না রাখলে পরিবর্তনগুলোকে বিচ্ছিন্ন বলেই মনে হবে।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার
এই নিবন্ধের খসড়া ভাষ্যটি পাঠ করে মন্তব্য করার জন্য অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ এবং ডক্টর সেলিম জাহানের কাছে লেখক আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ।
তথ্যসূত্র
Acemoglu, Daron and James A Robinson. ‘Why Did the West Extend the Franchise: Democracy, Inequality and Growth in Historical Perspective.’ Quarterly Journal of Economics, 115 (4), 1167-1199.
Alavi, Hamza, ‘The State in Post-Colonial Societies: Pakistan and Bangladesh,’ New Left Review I(74), July-August, 1972.
Bangladesh Planning Commission, Millennium Development Goals: Bangladesh Progress Report 2015, General Economics Division, Dhaka: Bangladesh Planning Commission, September 2015.file:///C:/Users/aliri/Downloads/MDGs%20Bangladeh%20Progress%20Report_%20PDF_Final_September%202015.pdf
Boston Consulting Group (BCG), Bangladesh:The Surging Consumer Market Nobody Saw Coming. Boston: BCG, 2015. https://www.bcgperspectives.com/content/articles/center-customer-insight-go-to-market-strategy-bangladesh-surging-consumer-market/
Bourdieu, Pierre. ‘The Forms of Capital’ in J E Richardson (ed.). Handbook of Theory of Research for the Sociology of Education (1986), New York: Greenwood Press, pp. 241-58. 1985.
Chen, Jie. A Middle Class Without Democracy: Economic Growth and the Prospects for Democratization in China. New York: Oxford University Press, 2013.
Chowdhury, Anis. ‘Democracy and Development’, bdnews24.com. 20 August 2015
http://opinion.bdnews24.com/2015/08/20/democracy-and-development-2/
Daily Star. ‘Bangladesh’s middle-class expanding’, Daily Star, 6 November 2015.
Dhaka Tribune. ‘BIDS: Middle-class people to reach 33% by 2030’, Dhaka Tribune, 6 November 2015.
Diamond, Larry. ‘Thinking about Hybrid Regimes,’ Journal of Democracy, 13(2): 21-35, 2002.
Dickenson, Bruce. Red Capitalist in China: The Party, Private Entrepreneurs, and Prospects of Political Change. New York: Cambridge University Press.
Evans, Peter B. Dietrich Rueschemeyer and Theda Skocpol. Bringing the State Back In, Cambridge: Cambridge University Press, 1985.
Frank, Andre Gunder. Latin America:Underdevelopment or Revolution. Monthly Review Press, 1969.
... Capitalism and Underdevelopment in Latin America. Monthly Review Press, 1967.
... The Development of Underdevelopment. Monthly Review Press, 1966.
Glassman, Ronald M. The Middle Class and Democracy in Socio-Historical Perspective. Leiden, the Netherlands: E J Brill, 1995.
Härdig, Anders C. and Tazreena Sajjad. ‘Between the Secular and the Sacred : The Changing Role of Political Islam in Bangladesh’ Washington D.C.: Woodrow Wilson International Center for Scholars. https://www.wilsoncenter.org/sites/default/files/hardigsajjadpaperfinal_0.pdf 2015.
Hashmi, Taj ‘Arabisation of Bangladesh: An Asset, Liability or Threat?’ Daily Star, July 14, 2015
Huntington, Samuel. The Third Wave: Democratization in the Late 20th Century. Norman: University of Oklahoma Press, 1991.
... The Clash of Civilizations and the Remaking of World Order. New York : Touchstone, 1996.
Inoguchi, Takashi and Edward Newman (eds.). ‘Asian Values’ and Democracy in Asia. Tokyo: United Nations University, 1997. http://archive.unu.edu/unupress/asian-values.html
Islam, Nazrul. ‘Beware, the Middle Class is being Hijacked by the World Bank!’ Bangladesh e-Journal of Sociology. 11 (2), July 2014.
Jahan, Selim. ‘The Middle Class: Engine for New Development,’ Working Paper 15, Poverty Division, Bureau for Development UNDP. New York: UNDP, September 2011.
Jamal, Eresh Omar. ‘Can Bangladesh become an economic powerhouse?’ Daily Star, 16 February 2017,
http://www.thedailystar.net/opinion/ the-overton-window/can-bangladesh-become-economic-powerhouse-1361704
Johnson Dale E. ‘Class and Social Development: Toward a Comparative and Historical Social Science’ in Middle Classes in Dependent Countries, ed. Dale E Johnson, 13-41, Beverley Hills, CA : Sage Publications. 1985.
Lipset, Seymour.‘Some social requisites of democracy: economic development and political legitimacy,’ The American Political Science Review, Vol. 53, No. 1 (March): 69–105. 1959.
Koo, Hagen. ‘Middle Classes, Democratization and Class Formation: The Case of South Asia, ‘Theory and Society 20 (4), 485-509, 1991.
Moore B, Jr. The Social Origins of Dictatorship and Democracy: Lord and Peasant in the Making of the Modern World. Boston: Beacon Press, 1966.
Odhikar. Annual Human Rights Report 2016. Dhaka: Odhikar. 2017.
Poulantzas, Nicos and Miliband, Ralph. ‘The Problem of the Capitalist State.’ In R. Blackburn, ed. Ideology in Social Science: Readings in Critical Social Theory. NY : Pantheon Books. pp. 238-262, 1972.
Przeworski, Adam. Democracy and the Market. Cambridge University Press, 1992.
Riaz, Ali. Unfolding State: The Transformation of Bangladesh. Ontario : de Sitter Publications, 2005.
... ‘A Crisis of Democracy in Bangladesh,’ Current History, Vol. 113, April 2014.
Rueschemeyer, Dietrich, Evelyn H. Stephens, and John D. Stephens. Capitalist Development and Democracy. Chicago, IL: University of Chicago Press, 1992.
Shi, Tianjian. ‘China: Democratic Values Supporting an Authoritarian System,’ in Yun-han Chu et al., eds., How East Asians View Democracy. New York: Columbia University
Press, 2008.
Sobhan, Rehman. ‘Identity and Inclusion in the Construction of a Democratic Society in Bangladesh’, Journal of Asiatic Society of Bangladesh, 51(2), 2006.
Wallerstein, Immanuel. The Modern World-System, vol. I: Capitalist Agriculture and the Origins of the European World-Economy in the Sixteenth Century. New York/London: Academic Press 1974.
... The Modern World-System, vol. II: Mercantilism and the Consolidation of the European World-Economy, 1600-1750. New York: Academic Press 1980.
@ The Modern World-System, vol. III: The Second Great Expansion of the Capitalist World-Economy, 1730-1840’s. San Diego : Academic Press, 1989.
Weber, Max. The Protestant ethic and the ‘spirit’ of capitalism and other writings. Hammersmith, England: Penguin, 2002.
আকাশ, ড. এম এম, ‘এই রাউন্ডেও কি শেখ হাসিনা জয়ী হবেন?’ সমকাল, ১৬ মার্চ ২০১৫
আমাদের বুধবার, ‘গণতন্ত্র নয় উন্নয়নের স্লোগান: স্বৈরতন্ত্রের জয়গান’, আমাদের বুধবার, ২৯ জুলাই ২০১৫
ইত্তেফাক, ‘সালমান এফ রহমান বিশ্বের ধনীদের তালিকায়’ ইত্তেফাক, ১০ মার্চ ২০১৭
ইসলাম, রিজওয়ানুল, ‘বাংলাদেশে কি কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধি হচ্ছে?’ প্রথম আলো, ৪ জুন ২০১৭
খালেক, এম এ, ‘মধ্যবিত্তের বিকাশ উন্নয়নের নির্দেশক’, যুগান্তর, ১২ নভেম্বর ২০১৫
খান, আবু তাহের, ‘মধ্যবিত্তের সামর্থ্য বৃদ্ধি বনাম ক্ষয়িষ্ণু মূল্যবোধ’, কালের কণ্ঠ, ৩ নভেম্বর, ২০১৫
প্রথম আলো, ‘এক বছরে ৭৩ হাজার কোটি টাকা পাচার’ প্রথম আলো, ৩ মে ২০১৭
বাংলাদেশ প্রতিদিন, ‘দেশে বাড়ছে বেকারত্ব’, বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২৬ এপ্রিল ২০১৬; আরও দেখুন ইসলাম, ২০১৭
মহাজন, সুজয়, ‘সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের অর্থ আরও বেড়েছে’, প্রথম আলো, ৩০ জুন ২০১৭
মানবজমিন, ‘দেশে কোটিপতির সংখ্যা ১১৯৩৬১’ মানবজমিন, ২৫ নভেম্বর ২০১৬
মাহমুদ, ওয়াহিদউদ্দিন, ‘উন্নয়ন, সুশাসন ও রাজনীতি মালয়েশিয়ার মডেল কি বাংলাদেশে খাটবে?’ প্রথম আলো, ৬ নভেম্বর ২০১৪
জাকারিয়া, এ কে এম, ‘আগে উন্নয়ন, পরে গণতন্ত্র?’ প্রথম আলো, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৪
রীয়াজ, আলী, ‘সেক্যুলারিজমের রূপ ও রূপান্তর’, প্রতিচিন্তা, জানুয়ারি-এপ্রিল ২০১৬
সেলিম, মুজাহিদুল ইসলাম, ‘বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণি সমাচার’, দৈনিক ইত্তেফাক, ১৬ নভেম্বর ২০১৫
সরকার, যতীন, ‘মোনাফেক মধ্যবিত্ত ও বাংলাদেশের পাকিস্তানীকরণ’, রাইজিংবিডি ডটকম, ৪ এপ্রিল ২০১৬
হোসেন, আনোয়ার, ‘গণতান্ত্রিক একনায়কত্ব’, বিডিনিউজ২৪, ১০ জানুয়ারি ২০১৪,
http://opinion.bdnews24.com/bangla/archives/14429
হোসেন, শওকত, ‘সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের অর্থ বেড়েছে সাড়ে ১০%’, প্রথম আলো, ১ জুলাই ২০১৬