সারসংক্ষেপ
আন্তর্জাতিক উত্পাদন চেইনে বাংলাদেশের পোশাক খাতের প্রতিযোগিতা সক্ষমতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে শ্রমিকসম্পর্কিত সামাজিক বিষয়ের অগ্রগতি হয়নি। ক্রেতানির্দেশিত উত্পাদন চেইনে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা অর্জিত হয়েছে প্রক্রিয়াগত এবং উত্পাদনগত উন্নয়নপ্রক্রিয়ায়। এ উন্নয়নে মূল নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে উন্নত বিশ্বের বাজারসুবিধা এবং সরকারি বিভিন্ন সুবিধা, যা উদ্যোক্তাকে বিনিয়োগের দীর্ঘমেয়াদি দিকনির্দেশনা দিয়েছে। স্বল্প খরচে পোশাকশ্রমিকের প্রাপ্যতাও এ ক্ষেত্রে শ্রমনির্ভর উত্পাদনপ্রক্রিয়া বিস্তারে সহায়তা করেছে। কিন্তু শ্রমিকসম্পর্কিত সামাজিক এবং ভৌত কমপ্লায়েন্সের অগ্রগতি যথেষ্ট আশাব্যঞ্জক ছিল না। শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি বিতর্ক, ওভারটাইম ভাতা প্রদান সমস্যা এবং অতিরিক্ত কর্মঘণ্টা ইত্যাদি সমস্যা রয়েছে। দুর্বল কর্মপরিবেশ এখন পোশাক খাতের বড় প্রশ্ন। দ্রুত বর্ধনশীল এ খাতে যথাযথ নিরাপত্তার মান না মানা এ জন্য দায়ী। এ ক্ষেত্রে তদারককারী সরকারি ও বেসরকারি কর্তৃপক্ষের সুশাসনগত দুর্বলতা দায়ী। বর্তমানে কর্মপরিবেশের উন্নতিকল্পে বিভিন্ন সংস্কার কার্যক্রম চলছে। যথাযথভাবে নির্দিষ্ট সময়ে এসব সংস্কার কার্যক্রম শেষ করা শ্রমিকের কর্মপরিবেশের নিরাপত্তার জন্য জরুরি। দীর্ঘ মেয়াদে তৈরি পোশাক খাতের উত্পাদন চেইনের জন্য এমন নীতিকাঠামো প্রয়োজন, যেখানে অর্থনৈতিক অগ্রগতির সঙ্গে পর্যাপ্ত সামাজিক অগ্রগতি নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
মুখ্য শব্দগুচ্ছ: উত্পাদন চেইন, পোশাক খাত, প্রতিযোগিতা সক্ষমতা, কমপ্লায়েন্স, শ্রমিক অধিকার, সামাজিক ইস্যু।
১. প্রারম্ভিক কথা
আন্তর্জাতিক উত্পাদন চেইনে স্বল্পোন্নত দেশের অংশগ্রহণ খুবই সীমিত। এর মধ্যে ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে অংশগ্রহণ আরও কম। বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। এ দেশের রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক খাত শুধু আন্তর্জাতিক উত্পাদন চেইনে অংশ নিচ্ছে তা নয়, এ খাত প্রতিযোগিতা সক্ষম এবং এর উত্তরোত্তর উন্নতি হয়েছে। আন্তর্জাতিক উত্পাদন চেইনে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বৃদ্ধির কারণে বিশ্ব পোশাক রপ্তানি বাজারে বাংলাদেশের অংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ, যা তৃতীয় সর্বোচ্চ। তবে বিগত তিন দশকে পোশাক খাতের উত্পাদন চেইনে পণ্য উত্পাদনে গুণগত ও পরিমাণগত প্রবৃদ্ধি হলেও শ্রমিকসম্পর্কিত সামাজিক ইস্যুর অগ্রগতি বেশ কম (ভট্টাচার্য ও মোয়াজ্জেম, ২০১৩)। এ চিত্র শুধু বাংলাদেশের নয়, বরং স্বল্পোন্নত দেশের শিল্প খাতের অধিকাংশ উত্পাদন চেইনে প্রায়ই সামাজিক ইস্যুর ক্ষেত্রে একই অবস্থা বিদ্যমান।
বাংলাদেশের সর্ববৃহত্ ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্প হিসেবে রপ্তানিমুখী পোশাকশিল্পের অর্জিত অগ্রগতি এবং এর অভ্যন্তরীণ সমস্যা ও সম্ভাবনা সার্বিকভাবে জাতীয় আয়, শিল্প খাতের প্রসার ও প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং দারিদ্র্য বিমোচন ইত্যাদি বিষয়ের ওপর প্রভাব ফেলে। বর্তমানে এ শিল্পের মাধ্যমে ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের ৪০ শতাংশ মূল্য সংযোজন, রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশ অর্জন এবং শিল্প খাতের প্রায় ৪০ শতাংশ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে। রপ্তানিতে কতিপয় পোশাকপণ্যের প্রাধান্য থাকলেও বাড়ছে পণ্যবৈচিত্র্য, ব্যবহূত কাঁচামালের বৈচিত্র্য, পরিবর্তন হচ্ছে উত্পাদন কৌশল এবং সার্বিকভাবে উন্নত হচ্ছে পণ্যের গুণগত মান। উল্লিখিত পরিবর্তনসমূহ দেশের পোশাকশিল্পের প্রক্রিয়াগত ও উত্পাদগত পর্যায়ে ধারাবাহিক উন্নতি নির্দেশ করে।
অন্যদিকে, পোশাক খাতের উত্পাদন চেইনে সামাজিক ইস্যুতে অগ্রগতি তেমন আশাব্যঞ্জক নয়। সামাজিক কমপ্লায়েন্সের কোনো কোনো ক্ষেত্রে উন্নতি হলেও শ্রমিকদের কর্মপরিবেশের নিরাপত্তা, শ্রম অধিকার এবং মজুরি ইত্যাদি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বেশ পিছিয়ে। দুর্ঘটনাজনিত কারণে প্রায়ই শ্রমিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটে, বিশেষত সাম্প্রতিক কালে তাজরীন গার্মেন্টসে অগ্নিকাণ্ডে ১১২ জন এবং রানা প্লাজা ধসে এক হাজার ১৩৪ জন শ্রমিকের মৃত্যুর পর পোশাক কারখানার কর্মপরিবেশের নিরাপত্তা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে উত্পাদন চেইনের অভ্যন্ত্তরীণ শাসনকাঠামোর দুর্বলতা নিয়ে, বিশেষত দেশীয় আইনের দুর্বলতা, তার প্রয়োগে শিথিলতা, আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের নির্দেশকৃত নীতিকাঠামোর (কোড অব কনডাক্ট) ঘাটতি এবং দুর্বলতা নিয়ে। একটি আন্তর্জাতিক মানের উত্পাদন চেইনে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা এবং সামাজিক অগ্রগতির মধ্যকার টানাপোড়েন অন্তর্নিহিত দুর্বলতা ইঙ্গিত করে।
আলোচ্য প্রবন্ধে পোশাক খাতের সার্বিক অগ্রগতির প্রেক্ষাপটে শ্রমিকসংক্রান্ত বিষয়ের সামাজিক অগ্রগতি বিশ্লেষণ করা হয়েছে। সেকশন ২-এ আন্তর্জাতিক উত্পাদন চেইনে সামাজিক ইস্যুর অবস্থানের একটি তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ তুলে ধরা হয়েছে। সেকশন ৩-এ পোশাক খাতের প্রতিযোগিতা সক্ষমতার বিস্তারিত বিশ্লেষণ করা হয়েছে। সেকশন ৪-এ পোশাক খাতের উত্পাদন চেইনে উন্নয়নের বিচ্ছিন্ন পর্যায় আলোচিত হয়েছে। সেকশন ৫-এ প্রতিযোগিতা সক্ষমতার চ্যালেঞ্জের ওপর আলোকপাত করা হয়েছে। সেকশন ৬-এ পোশাক খাতের সামাজিক অগ্রগতির বিভিন্ন ইস্যু, বিশেষত সামাজিক এবং ভৌত কমপ্লায়েন্স নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। সেকশন ৬-এ শ্রমিকসংক্রান্ত সামাজিক ইস্যুতে বিভিন্ন পক্ষের ভূমিকা নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হয়েছে। সবশেষে সেকশন ৭-এ ক্রেতা, উদ্যোক্তা এবং শ্রমিকসম্পর্ক বিশ্লেষণ করে পোশাক খাতের টেকসই উন্নয়নের স্বার্থে পরামর্শমূলক মন্তব্য করা হয়েছে।
২. আন্তর্জাতিক উত্পাদন চেইনে সামাজিক ইস্যুর অবস্থান: তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ
আন্তর্জাতিক উত্পাদন চেইনে দক্ষতা বিচার করা হয় অর্থনৈতিক সক্ষমতার দিক থেকে। এ ক্ষেত্রে মূল বিচার্য বিষয়গুলো হলো: মূল্য সংযোজন, মূল্য বিভাজন এবং মূল্য অর্জন; যার সৃষ্টি হয় উত্পাদন, বিতরণ এবং খুচরা বিক্রয় পর্যায়ে (বেয়ার, ২০০৯; জেরেফি, ২০০৫; জেরেফি এবং ক্যাপলিনিস্ক, ২০০১)। উত্পাদন চেইনের দক্ষতাসম্পর্কিত প্রাথমিক পর্যায়ের গবেষণায় শুধু অর্থনৈতিক সক্ষমতার উক্ত বিষয়গুলো বিবেচনা করা হতো (ব্যারিয়েনটোস, দোলান ও টালেনিটাইর, ২০০৩; কাম্বারস, নাটিভেল ও রাউটলেজ, ২০০৮)। প্রাথমিক পর্যায়ে কারখানা পর্যায়ের দক্ষতাকে মূল বিবেচ্য বিষয় হিসেবে গণ্য করা হতো—শ্রমিকের ‘শ্রম’ যেখানে শুধু উত্পাদনের একটি অন্তর্গত উপকরণ হিসেবে গণ্য হতো। এ ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সংখ্যক পণ্য উত্পাদনে শ্রমিকের সংখ্যা, শ্রম উত্পাদনশীলতা এবং শ্রমিকসম্পর্কিত ব্যয় বিবেচিত হতো। শ্রমিকের সামাজিক ইস্যু, বিশেষত কর্মস্থলে নিরাপত্তা, আইনি অধিকার, মজুরি ইত্যাদি বিষয় উত্পাদনকারী দেশের আইনি সুরক্ষার আওতায় হওয়ার কথা। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে উত্পাদনকারী দেশের আইনি দুর্বলতা এবং আইন প্রয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের গাফিলতিতে তা পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। অন্য কথায় প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হলেই সামাজিক ইস্যুর ক্ষেত্রে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সক্ষমতা অর্জিত হবে, এমন নয়। এ প্রেক্ষাপটে শ্রমিকের সামাজিক ইস্যুগুলো আলাদাভাবে দেখার প্রয়োজন রয়েছে।
শ্রমিককে সামাজিক এজেন্ট হিসেবে বিবেচনার ক্ষেত্রে শ্রমিকের সামাজিক ইস্যুগুলো বিবেচনায় নিতে হবে তাদের সক্ষমতা এবং প্রয়োজনের নিরিখে (সেন, ১৯৯৯, ২০০০)। প্রথমত, শ্রমিকের ভালো-মন্দ নির্ভর করে উত্পাদন চেইনে তার যে অধিকার রয়েছে, তা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার মাধ্যমে। এ ক্ষেত্রে দেশীয় আইনে বর্ণিত শ্রম অধিকার এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) নির্দেশিত আন্তর্জাতিক আইনি কাঠামো বিবেচনায় নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ।
প্রথমত, আন্তর্জাতিক উত্পাদন চেইনে শ্রমিকের প্রয়োজন নির্ধারিত হয় শ্রমিকের গুণগত মান এবং প্রাপ্যতার ওপর; শ্রমিকের সামাজিক ইস্যু মেনে চলার ক্ষেত্রেও এর প্রভাব রয়েছে (মিলবার্গ এবং উইনকার, ২০০৮)। এ ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতি বিদ্যমান। দ্বিতীয়ত, আন্তর্জাতিক উত্পাদন চেইনে যে ধরনের শ্রমিক ও দক্ষতা বিবেচনায় নেওয়া হয়, তার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত শ্রমিকের প্রাপ্য মজুরি এবং অধিকার প্রদান করা দেশীয় শ্রমবাজারের প্রেক্ষাপটে জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।
সার্বিকভাবে সামাজিক ইস্যুর অগ্রগতি এককভাবে পোশাক খাতের প্রতিযোগিতা সক্ষমতার দিক দিয়ে বিবেচনার সুযোগ নেই। সামাজিক ইস্যুর ক্ষেত্রে আলাদাভাবে পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে।
৩. বাংলাদেশের পোশাক খাতের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা
৩.১ বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির পরিস্থিতি
রপ্তানি চিত্র: আশির দশক থেকে বাংলাদেশের রপ্তানিমুখী পোশাক খাতের ধারাবাহিক অগ্রগতি ঘটেছে। বিজিএমইএর প্রকাশিত তথ্যমতে, সে সময় তিন শতাধিক কারখানার মোট রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১১৬ মিলিয়ন ডলার, যা ছিল দেশের মোট রপ্তানির মাত্র ১২ দশমিক ৪ শতাংশ। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে কারখানার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৮৩৪টি এবং রপ্তানির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৮৬৬ মিলিয়ন ডলার, যা ছিল দেশের মোট রপ্তানির প্রায় অর্ধেক। এ ধারাবাহিকতায় ২০০০-এর শুরুতে তিন হাজার ৪৮০টি কারখানায় মোট রপ্তানি হয়েছে চার হাজার ৮৫৯ মিলিয়ন ডলার। সর্বশেষ ২০১২-১৩ অর্থবছর শেষে পাঁচ হাজার ৬০০ কারখানায় মোট রপ্তানি হয়েছে ২২ বিলিয়ন ডলার। বিগত তিন দশকে এ খাতে শ্রম নিয়োজন বেড়েছে বহুগুণ—আশির দশকের শুরুতে শ্রমিকসংখ্যা ছিল মাত্র এক লাখ ২০ হাজার, যা বর্তমানে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪০ লাখ এবং এর প্রায় ৭০ শতাংশ নারী শ্রমিক।
পোশাক খাতের এ প্রবৃদ্ধি হয়েছে অনুভূমিক ও উল্লম্বভাবে। আশির দশকের শুরুতে কারখানা এবং শ্রমিকপ্রতি উত্পাদন ছিল যথাক্রমে শূন্য দশমিক ৩০ মিলিয়ন ডলার এবং ৯৬৮ ডলার; নব্বইয়ের দশকের শুরুতে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক শূন্য ৪ মিলিয়ন ডলার এবং দুই হাজার ১৬৭ ডলার; ২০০০-এর শুরুতে তা ছিল ১ দশমিক ৩৯ মিলিয়ন ডলার এবং দুই হাজার ৬৯৯ ডলার। ২০১২-১৩ অর্থবছর শেষে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ৮৪ মিলিয়ন ডলার এবং পাঁচ হাজার ৩৭৮ দশমিক ৯ ডলার। আগের দশকগুলোর তুলনায় ২০০০-পরবর্তী সময়কালে কারখানাপ্রতি এবং শ্রমিকপ্রতি উত্পাদন বৃদ্ধির হার অনেক বেশি। এ অগ্রগতির পেছনে অভ্যন্তরীণ এবং বহিস্থ বিভিন্ন নিয়ামক কাজ করেছে, যা পরবর্তী সেকশনে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে।
পণ্যবৈচিত্র্য: পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে ২০১২ সালে নিট ও ওভেন পোশাক মিলিয়ে সর্বমোট ২২১টি ক্যাটাগরির পণ্য রপ্তানি হয়েছে; যা এইচএস ৬ ডিজিটের মোট ক্যাটাগরির ১১ দশমিক ৭ শতাংশ (২০০৪ সালে এর সংখ্যা ছিল ২৩০টি)। এ সময়কালে ১৪টি নতুন পণ্য রপ্তানি খাতে সংযোজিত হয়েছে (যেমন ১২টি নিট এবং দুটি ওভেন) এবং ২৫টি পণ্য বিয়োজিত হয়েছে (যেমন ১৯টি নিট এবং ছয়টি ওভেন)। পণ্য রপ্তানিতে একদিকে যেমন ১২২টি পণ্যে ১০ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে, অন্যদিকে ১১০টি পণ্যে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধিও ঘটেছে। সার্বিকভাবে এ খাতের পণ্যতালিকায় পরিবর্তন হচ্ছে এবং পণ্য রপ্তানিতে নতুন নতুন পণ্য সংযোজিত হচ্ছে বলে ধারণা করা যায়। তবে পোশাক খাতের রপ্তানিতে এখনো পাঁচ-সাতটি পণ্যের প্রাধান্য বিদ্যমান।
কাঁচামাল ব্যবহার: কাঁচামাল ব্যবহারের দিক থেকেও পরিবর্তন ঘটেছে এ শিল্পে। কাঁচা তুলা আমদানি করে দেশীয় পর্যায়ে পশ্চাত্ সংযোজন প্রক্রিয়ায় সুতা এবং পোশাক উত্পাদনপ্রক্রিয়ায় ভিন্নতা এসেছে। ২০০৪ সালে পোশাক খাতের আমদানি করা কাঁচামালের মধ্যে প্রায় ৫০ শতাংশই ছিল কাঁচা তুলা, ১২ শতাংশ কাপড় এবং মাত্র ১ শতাংশ সুতা। ২০১১ সালে এসে আমদানি করা কাঁচামালের এ বিন্যাসের পরিবর্তন হয়েছে—যার মধ্যে ১৯ শতাংশ কাঁচা তুলা, ৫৩ শতাংশ কাপড় এবং ১০ শতাংশ সুতা। অর্থাত্ আমদানির ক্ষেত্রে প্রক্রিয়াকৃত কাঁচামালের আমদানি বাড়ছে। এর পাশাপাশি পোশাকশিল্পের কাঁচামাল হিসেবে কৃত্রিম তন্তুজাত সুতা ও কাপড়ের ব্যবহার বাড়ছে। কাঁচামালের বহুধাকরণ শিল্পের সক্ষমতা বৃদ্ধির ইঙ্গিত দিলেও বিভিন্ন ধরনের দাহ্য কাঁচামাল ব্যবহারের কারণে কর্মকালীন নিরাপত্তাঝুঁকি বাড়ছে। এসব কাঁচামাল যথাযথভাবে সংরক্ষণ না হলে অগ্নিকাণ্ডজনিত দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকে, যা সাম্প্রতিক সময়ে দেখা গেছে (মোয়াজ্জেম, ২০১৩)।
অন্যান্য প্রতিযোগী-সক্ষম দেশের রপ্তানি পরিস্থিতি
বিশ্বের পোশাক রপ্তানির উত্স ক্রমান্বয়ে সংকুচিত হচ্ছে। এর অন্যতম কারণ হলো পূর্ণাঙ্গ প্যাকেজ পণ্য সরবরাহ করার সক্ষমতা অনেক পোশাক রপ্তানিকারক দেশের না থাকা। এ প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে ২০০৫ সালে মাল্টিফাইবার অ্যারেঞ্জমেন্টের (এমএফএ) আওতায় কোটাপ্রথা বিলুপ্তির পর রপ্তানি উেসর বাজার উন্মুক্ত হওয়ার কারণে। সারণি-১ প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, পোশাক খাতের মূল রপ্তানি উত্স চীন উত্তরোত্তর তার অবস্থান সংহত করেছে। অন্যদিকে, বেশ কিছু দেশ যেমন তুরস্ক ও থাইল্যান্ড তাদের আগের অবস্থান ধরে রাখতে পারেনি। অন্যদিকে, বেশ কিছু দেশের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি অপেক্ষাকৃত দ্রুতগতিতে এগিয়েছে, যেমন: বাংলাদেশ, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, কম্বোডিয়া ইত্যাদি। সার্বিকভাবে বাংলাদেশ অন্যান্য প্রতিযোগী দেশের তুলনায় ব্যাপক অগ্রগতি সাধন করেছে।
সারণি ১: পোশাক রপ্তানিকারক দেশের তুলনামূলক অবস্থান: ২০০৪ ও ২০১১
| নিট পোশাক | ওভেন পোশাক | ||
২০০৪ | ২০১১ | ২০০৪ | ২০১১ | |
পোশাক রপ্তানি (বি. ডলার) | ১১৪.৮ | ২১০.৩ | ১৩৪.৫ | ২০১.১ |
রপ্তানি বাজারের অংশ (%) |
|
|
|
|
চীন | ২২.৫ | ৩৮.১ | ২১.৬ | ৩১.৪ |
বাংলাদেশ | ২.৬ | ৫.৩ | ২.৪ | ৪.৭ |
ভিয়েতনাম | ১.৪ | ২.৯ | ১.৯ | ৩.৮ |
ইন্দোনেশিয়া | ১.৩ | ১.৭ | ২.১ | ২.১ |
ভারত | ২.৩ | ২.৭ | ২.৮ | ৩.৮ |
পাকিস্তান | ১.৫ | ১.১ | ১.৩ | ০.৯ |
শ্রীলঙ্কা | ০.৮ | ১.০ | ০.৭ | ০.৯ |
নেপাল
| ০.০ | ০.০২ | ০.০ | ০.০৩ |
সূত: COMTRADE, 2013
৩.২ রপ্তানি বৃদ্ধিতে সহায়ক নিয়ামকসমূহ
বাজারসুবিধা: পোশাক খাতে উত্তরোত্তর অগ্রগতি ও পণ্য উত্পাদনে বিভিন্ন পরিবর্তনের ক্ষেত্রে উন্নত বিশ্বের বাজারে অগ্রাধিকারমূলক বাজারসুবিধাপ্রাপ্তি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ২০০৫ সালের আগ পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারে এমএফএর আওতায় কোটাসুবিধা, ২০০১ সাল থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারে EUEBA১-এর আওতায় অনুন্নত দেশের জন্য অগ্রাধিকারমূলক বাজারসুবিধা এবং ২০০২ সাল থেকে জিএসপির আওতায় কানাডার বাজারে শুল্কমুক্ত বাজারসুবিধা বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির বাজারকে সম্প্রসারিত করেছে। এ ছাড়া বিশ্বের অন্যান্য উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশ তাদের জিএসপির আওতায় বাংলাদেশকে কতিপয় পণ্যে বাজারসুবিধা দিয়ে থাকে, যার মধ্যে তৈরি পোশাক আংশিকভাবে অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকে। যেমন: অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, জাপান, ভারত ইত্যাদি। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি বাজার—মোট রপ্তানির প্রায় ৫৯ দশমিক ৭০ (২০১২) শতাংশ ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশে রপ্তানি হয় এবং প্রতিবছর এর অংশ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে দেশীয় কাঁচামাল ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা, যা উত্স নীতি (রুলস অব অরিজিন) নামে পরিচিত, বাংলাদেশি রপ্তানি পণ্যের বিভিন্নতা সৃষ্টির ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করছে। ২০০৫ সাল পর্যন্ত প্রচলিত কোটাব্যবস্থা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারে নির্দিষ্ট হারে পণ্য রপ্তানির সুযোগ করে দিয়েছিল। ২০০১ সাল থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়নে স্বল্পোন্নত দেশের প্রচলিত অগ্রাধিকারমূলক বাজারসুবিধার উত্সনীতিতে দ্বিস্তরে কাঁচামাল প্রক্রিয়াকরণের বাধ্যবাধকতা বাংলাদেশের নিট পোশাক উত্পাদনের সুতা ও কাপড় উত্পাদনকে উত্সাহিত করেছে। ২০১১ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়ন উত্সনীতিতে পরিবর্তন আনে এবং এক স্তরবিশিষ্ট কাঁচামাল প্রক্রিয়াকরণের বাধ্যবাধকতা আরোপ করে। এর ফলে আমদানি করা কাপড় ব্যবহারের মাধ্যমে রপ্তানিমুখী ওভেন পোশাক উত্পাদন প্রবণতা বৃদ্ধি পায়।
কাঁচামাল হিসেবে পণ্য উত্পাদনে তুলা এবং জাতীয় মধ্যবর্তী পণ্যের প্রাধান্য রয়েছে। ২০০১-২০১১ সাল পর্যন্ত ইউরোপের বাজারে উত্সনীতিতে দ্বিস্তরবিশিষ্ট উত্পাদনকাঠামো বজায় থাকার কারণে তুলাজাতীয় কাঁচামাল ব্যবহারের প্রবণতা বেশি দেখা যায়। ২০১১ সালে উত্সনীতিতে শিথিলতা আনার কারণে আমদানি করা কৃত্রিম তন্তুজাত কাপড়ের মাধ্যমে পণ্য রপ্তানির প্রবণতা বেড়েছে। কাঁচামালের ক্ষেত্রে ধীরে ধীরে যে পরিবর্তন ঘটছে, এর সঙ্গে উত্পাদনপ্রক্রিয়া দুর্ঘটনামুক্ত রাখার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত তুলাবহির্ভূত কাঁচামাল বিশেষত সিনথেটিক, পলিয়েস্টার সুতা বা বিভিন্ন কেমিক্যাল পদার্থ দাহ্য হয়। দুর্ঘটনা থেকে সৃষ্ট অগ্নিকাণ্ডের কারণে এসব দাহ্য কাঁচামালে সৃষ্ট ধোঁয়া শ্রমিকের জন্য জীবনঘাতী হওয়ার আশঙ্কা থাকে (মোয়াজ্জেম, ২০১৩)।
শ্রমিকের প্রাপ্যতা এবং নিম্ন শ্রম ব্যয়: শ্রমঘন শিল্পের বিকাশে প্রয়োজনীয় শ্রমিকের প্রাপ্যতা একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের নারী ও পুরুষ শ্রমিক এবং সাম্প্রতিক কালে শহরাঞ্চলের শ্রমিকের সরবরাহ এ খাতের সম্প্রসারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। একই সঙ্গে নিম্ন মজুরিজনিত ব্যয় অন্যান্য প্রতিযোগী দেশের চেয়ে নিচে রয়েছে। এ কারণে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা ধরে রাখা সহজতর হয়েছে।
সরকারের নীতি সহায়তা: রপ্তানিমুখী পোশাক খাতকে সরকারের পক্ষ থেকে অব্যাহত নীতি সহায়তা প্রদান এ খাতের সক্ষমতা ধরে রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। আশি ও নব্বইয়ের দশকে রপ্তানিমুখী পোশাক খাতের জন্য ডিউটি ড্রব্যাক সুবিধা, বন্ডেড ওয়্যারহাউস সুবিধা এবং পশ্চাত্সহযোগ শিল্প হিসেবে টেক্সটাইল খাতকে ক্যাশ ইনসেনটিভ প্রদান ইত্যাদি পোশাক খাতের উদ্যোক্তাদের রপ্তানি বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। পরবর্তীকালে এ সুবিধা অব্যাহত থাকে হ্রাসকৃত হারে রপ্তানিঋণ প্রদান, অপ্রচলিত বাজারে রপ্তানি সুবিধা ইত্যাদির মধ্য দিয়ে। আমদানি করা কাঁচামাল, মধ্যবর্তী পণ্য ও মূলধনি যন্ত্রপাতিতে শূন্য শুল্ক বিদ্যমান থাকা এ খাতকে বিশেষ সুবিধা দিয়েছে। রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে রপ্তানিকারকেরা বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত হন—প্লট, অবকাঠামোগত সুবিধা, কেন্দ্রীয় বন্ডেড ওয়্যারহাউস সুবিধা ইত্যাদির মাধ্যমে। সার্বিকভাবে তৈরি পোশাক খাতে সরকারের অব্যাহত নীতিসহায়তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
অবকাঠামোগত সুবিধা বৃদ্ধি: রপ্তানি বৃদ্ধির কারণে পোশাক খাতের ভৌত অবকাঠামোতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। বিভিন্ন শিল্পাঞ্চল যেমন: আশুলিয়া, টঙ্গী, গাজীপুর, সাভার, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, ঢাকা ইপিজেড ইত্যাদি এলাকায় নতুন কারখানা গড়ে উঠেছে। তবে এসব শিল্পাঞ্চলে কারখানা স্থাপনের পর্যাপ্ত সুবিধা নিশ্চিত করা যায়নি। জমির স্বল্পতা এবং জমির উচ্চমূল্যের কারণে অনেক সময়ে কারখানা উল্লম্বভাবে বর্ধিত করার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। পাশাপাশি বহুতল ভবনে অন্যান্য কারখানা বা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পোশাক কারখানা গড়ে উঠছে। এসব উল্লম্ব অবকাঠামোর ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় নিয়মকানুন অনুসরণ না করা হলে দুর্ঘটনায় শ্রমিকের আহত বা নিহত হওয়ার বেশি আশঙ্কা থাকে। দুঃখজনক হলো, এ খাতের প্রবৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে মানসম্পন্ন কারখানা পর্যাপ্তভাবে গড়ে ওঠেনি।
৪. পোশাক খাতের প্রক্রিয়াগত ও উত্পাদগত উন্নয়ন
উত্পাদন চেইনের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা এবং তার উন্নয়নের পেছনে সাধারণত তিন ধরনের পরিবর্তন ও উন্নয়ন জড়িত। এগুলো হলো প্রক্রিয়াগত উন্নয়ন, উত্পাদগত উন্নয়ন ও কার্যক্রমগত উন্নয়ন। এ ধরনের উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালিত হয় উত্পাদন চেইন কোন ধরনের অভ্যন্তরীণ নীতিকাঠামোতে পরিচালিত হচ্ছে তার ওপর। সাধারণত ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের উত্পাদন চেইনে তিন ধরনের নীতিকাঠামোর প্রচলন দেখা যায়: ১. স্তরপরম্পরা, ২. আংশিক স্তরপরম্পরা, ৩. নেটওয়ার্ক ও ৪. বাজার। তত্ত্বীয়ভাবে বলা হয়, একটি স্তরপরম্পরা কাঠামোতে ক্রেতানির্দেশনা পূর্ণাঙ্গভাবে বিক্রেতাকে পালন করতে হয় বলে উত্পাদনপ্রক্রিয়ার উন্নয়ন ঘটানোর সম্ভাবনা সীমিত থাকে। অপরদিকে, একটি প্রতিযোগিতামূলক নীতিকাঠামোতে ক্রেতার নির্দেশনা খুব সীমিত পর্যায়ে থাকে বলে উত্পাদনপ্রক্রিয়ায় বিভিন্নমুখী উন্নয়ন সম্ভব হতে পারে।
বাংলাদেশের উত্পাদন চেইন স্তরপরম্পরা এবং বাজারকাঠামোর মাঝামাঝি স্থানে অবস্থান করছে। বাংলাদেশে পোশাক খাত শুরুর দিকের স্তরপরম্পরা থেকে ধীরে ধীরে উন্নতি লাভ করে বর্তমানে নেটওয়ার্ক পর্যায়ে পৌঁছেছে। এ পর্যায়ে একজন ক্রেতা উত্পাদনপ্রক্রিয়ায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে বহুলাংশে স্বাধীনতা ভোগ করেন—এর মধ্যে রয়েছে কাঁচামালের উত্স নির্বাচন এবং তা ক্রয়ের স্বাধীনতা, পণ্য রপ্তানিতে ক্রেতার দায়ভার বৃদ্ধি (এফওবি ব্যবহার), পণ্যের স্যাম্পল ও ডিজাইন তৈরির ক্ষেত্রে সীমিত স্বাধীনতা ইত্যাদি। এসব কারণে বাংলাদেশে পণ্য উত্পাদনপ্রক্রিয়ায় প্রক্রিয়াগত ও উত্পাদগত বিষয়ে বিশেষ উন্নতি অর্জিত হয়েছে।
৪.১ প্রক্রিয়াগত উন্নতি
সাধারণভাবে প্রক্রিয়াগত উন্নয়ন বলতে বোঝায় উত্পাদনপ্রক্রিয়ায় উন্নত এবং বিভিন্নমুখী ব্যবহার উপযোগী যন্ত্রপাতির ব্যাপক ব্যবহার, শ্রম নিয়োজনপ্রক্রিয়ায় নিবিড়তা বৃদ্ধি, যন্ত্রপাতি ব্যবহারের দক্ষতা বৃদ্ধি এবং উত্পাদন কৌশলে ধারাবাহিক পরিবর্তন ইত্যাদি। ২০১২ সালে সিপিডি পরিচালিত ২২টি বড় ও মাঝারি কারখানার ওপর জরিপে দেখা যায়, ২০০৫ ও ২০১১ সালের মধ্যে কারখানাপ্রতি রপ্তানি বৃদ্ধি পেয়েছে ২০ শতাংশের বেশি (সারণি ২)। এ প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে কারখানার স্কেল অব অপারেশন বৃদ্ধির বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। যেমন কারখানার ফ্লোর স্পেস বেড়েছে ৫-৯ শতাংশ, লাইন সংখ্যা বেড়েছে ৬-১১ শতাংশ এবং কারখানাপ্রতি শ্রমিক বেড়েছে ৫ শতাংশের মতো। এর পাশাপাশি প্রক্রিয়াগত বিষয়ে গুণগত পরিবর্তনও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। স্বয়ংক্রিয় মেশিন যেমন সুইং ও নিটিং মেশিন ইত্যাদি ব্যবহারের মাধ্যমে উত্পাদনপ্রক্রিয়ায় উত্পাদনশীলতা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ছাড়া পণ্য জাহাজীকরণ-প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন (সিঅ্যান্ডএফ থেকে এফওবিভিত্তিক) করার মাধ্যমে বেশি মাত্রায় সরাসরি খুচরা ক্রেতাদের সঙ্গে কাজের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে এবং ক্রেতাদের রপ্তানি আদেশদান-প্রক্রিয়ার পরিবর্তন এসেছে। এসবের ফলে উত্পাদন সময়, উত্পাদন ব্যয় এবং পণ্যপ্রতি উদ্যোক্তার সময় বেড়েছে। উত্পাদনশীলতার উন্নতি বিশেষভাবে লক্ষ করা যায় লাইনপ্রতি ঘণ্টায় উত্পাদন, শ্রমিকপ্রতি উত্পাদন এবং মেশিন লাইন অনুপাত ইত্যাদি ক্ষেত্রে।
সারণি ২: নমুনা কারখানায় উত্পাদনশীলতা বৃদ্ধি: ২০০৫-২০১১
বিবরণ |
ধরণ |
২০০৫ |
২০১১ | ২০০৫ এবং ২০১১-এর মধ্যে বার্ষিক পরিবর্তন (%) |
লাইনপ্রতি ঘণ্টাপ্রতি উত্পাদন (পিস) | নিট | ১৫৮.৫ | ১৭৯.৬ | ১.২ |
ওভেন | ৯৩.৫ | ১০১.৫ | ১.৪ | |
লাইনপ্রতি মেশিন | নিট | ২৪ | ২৫ | ০.৭ |
ওভেন | ৭২ | ৭০.৯ | -০.২৫ | |
মেশিনপ্রতি শ্রমিক | নিট | ১.৬ | ১.২ | -৪.২ |
ওভেন | ১.৭৪ | ১.৪ | -৩.৩ | |
মেশিনপ্রতি ঘণ্টায় উত্পাদন (পিস) | নিট | ৬.৫ | ৬.৯ | ১.০ |
ওভেন | ১.৩ | ১.৫ | ২.৬ | |
কাঁচামাল অপচয় | নিট | ৭.৩ | ৬.৫ | -৬.৪ |
ওভেন | ৭.৮ | ৩.৯ | -১০.০ |
সূত্র: মোয়াজ্জেম এবং সেহরীন (২০১৩)
প্রক্রিয়াগত উন্নতি আরও দেখা যায় কাঁচামাল ব্যবহারে অপচয় কমানোর ক্ষেত্রে। কাঁচামাল আমদানি উেসর ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ ও আঞ্চলিক উত্স বিশেষত ভারত, পাকিস্তান ও চীনের ওপর নির্ভরতা বাড়ছে। শ্রমিকপ্রতি ফ্লোর স্পেস ব্যবহার নিট কারখানায় ২০ শতাংশ বাড়লেও ওভেন কারখানায় ১৪ শতাংশ কমেছে (সারণি ৩)। লাইনপ্রতি শ্রমিকের সংখ্যা নিট ও ওভেন উভয় ক্ষেত্রেই ১০ শতাংশের মতো কমেছে। লাইনপ্রতি শ্রমিকের উত্পাদন বেড়েছে ২০ থেকে ৫০ শতাংশ। এ প্রক্রিয়াগত উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিভিন্ন বিশেষায়িত কার্যক্রম বৃদ্ধি পেয়েছে যেমন: মানবসম্পদ উন্নয়ন, শ্রমিকের সম্পর্ক উন্নয়ন, উত্পাদন ব্যবস্থাপনা, শিল্প প্রকৌশল ইত্যাদি। প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে আইটির ব্যবহার বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে, বিশেষত কাজের অর্ডার নেওয়া, উত্স নির্ধারণ, স্যাম্পল নিশ্চিতকরণ, রপ্তানি নিশ্চিতকরণ, সার্বিক যোগাযোগ ইত্যাদি। এসব প্রক্রিয়াগত উন্নয়নের ফলে কারখানার সার্বিক উত্পাদনশীলতা বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে।
সারণি ৩: নমুনা কারখানায় শ্রম উত্পাদনশীলতার পরিবর্তন
বিবরণ |
| নিট | ওভেন |
ফ্লোরপ্রতি শ্রমিক ব্যবহার | ২০০৫ | ৪৬.৭ | ৫৫.০ |
২০১১ | ৫৭.২ | ৪৭.২ | |
পরিবর্তন | ২২.৪ | -১৪.২ | |
লাইনপ্রতি শ্রমিক ব্যবহার | ২০০৫ | ৮৩ | ২২২.৮ |
২০১১ | ৭৩ | ১৯২.৬ | |
পরিবর্তন | -১১.৮ | -১৩.৬ | |
দৈনিক শ্রমিকপ্রতি উত্পাদন | ২০০৫ | ১৪.৬ | ৪.৬ |
২০১১ | ১৭.৯ | ৫.৮ | |
পরিবর্তন | ২৩.৫ | ২৭.৫ | |
শ্রমিকপ্রতি লাইনপ্রতি উত্পাদন | ২০০৫ | ০.৯ | ১.০ |
২০১১ | ১.১ | ০.৬ | |
পরিবর্তন | ২১.৯ | -৫৯.২ | |
শ্রমিকদের কারখানা পরিবর্তন | ২০০৫ | ৭.৪ | ২০.৩ |
২০১১ | ১০.০ | ১৮.১ | |
পরিবর্তন | ৩৫.১ | -১০.৯ |
সূত্র: মোয়াজ্জেম এবং সেহরীন (২০১৩)
৪.২ উত্পাদগত উন্নয়ন
উত্পাদগত উন্নয়ন বলতে উত্পাদিত পণ্যের বহুধাকরণ, পণ্যমান ও গুণাগুণ, পণ্যমূল্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে উন্নতির বিষয়টিকে বোঝানো হয়। সিপিডি পরিচালিত জরিপকৃত কারখানাগুলোতে দেখা গেছে, সিংহভাগ কারখানা এখনো নিম্নাঙ্গের পোশাক প্রস্তুত করে। তবে ধীরে ধীরে ঊর্ধ্বাঙ্গের ও শিশুদের পোশাক উত্পাদন বাড়ছে এবং সার্বিকভাবে গুণ ও মানে বৈচিত্র্য আসছে। পণ্য ডিজাইনের বৈচিত্র্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি। নিট ও ওভেন দুই ধরনের পোশাকেই ডিজাইনে পরিবর্তন এবং একই সঙ্গে ফ্যান্সি পণ্যের উত্পাদন বাড়ছে। সার্বিকভাবে কারখানাগুলোতে সাধারণ, মধ্যম ও উচ্চমূল্যের পণ্য উত্পাদন বেড়েছে। ২০০৪ সালে নিট পোশাকের রপ্তানিতে সাধারণ, মধ্যম এবং উচ্চমানের পণ্যের অংশ ছিল যথাক্রমে ৫২, ৪৭ ও ১৬ শতাংশ; ২০১১ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ৩৭, ২৮ ও ২২ শতাংশ (সারণি ৩)। একইভাবে ওভেন পোশাকেও এ পরিবর্তন লক্ষণীয়। পোশাকের পণ্যমূল্যও বৃদ্ধি পাচ্ছে (সারণি ৪)। ২০০৪ সালের তুলনায় ২০১১ সালে নিট পোশাকে পণ্যমূল্যে বেসিক ও উচ্চমানের পোশাকের ক্ষেত্রে পরিবর্তন হয়েছে ২৭ দশমিক ৩ ও ৪০ দশমিক ৬ শতাংশের মতো। একইভাবে ২০১১ সালে ওভেন পোশাকে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে যথাক্রমে ৫৯ দশমিক শূন্য ও ৪৯ দশমিক ২ শতাংশ।
৪.৩ কার্যক্রমগত উন্নয়ন
কার্যক্রমগত উন্নয়ন বলতে উত্পাদনকারী প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব ডিজাইন, সরবরাহব্যবস্থা, ব্র্যান্ডিং সক্ষমতা ইত্যাদি বিষয়কে বোঝায়। বাংলাদেশের পোশাক খাতে এ ক্ষেত্রে লক্ষণীয় অগ্রগতি হয়নি। দেখা গেছে, খুব কমসংখ্যক কারখানায় নিজস্ব ডিজাইন ক্ষমতা রয়েছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কারখানাগুলো ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানের সরবরাহকৃত ডিজাইন নিয়ে কাজ করে থাকে। এ ক্ষেত্রে ২০০৫ সালের পরবর্তী সময়ে খুব উন্নতি হয়নি। নিট কারখানায় নিজস্ব ডিজাইন ক্ষমতায় পরিবর্তন হয়নি বললেই চলে। অন্যদিকে, ২০১১ সালে ওভেন কারখানায় নিজস্ব ডিজাইন ক্ষমতায় পরিবর্তন হয়েছে এমন কারখানার সংখ্যা ১ দশমিক ২ শতাংশের মতো, যা খুব সামান্য। তবে স্যাম্পল ডিজাইন প্রস্তুতিতে প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়েছে। নিজস্ব ব্র্যান্ডিংয়ে পণ্য উত্পাদন ও বাজারজাত অনেক ব্যয়সাধ্য। এ ক্ষেত্রে বাজারের ঝুঁকির পুরোটাই সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে বহন করতে হয়।
৫. পোশাক খাতের বহিস্থ চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশের পোশাক খাতের ধারাবাহিক প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ অব্যাহতভাবে মোকাবিলা করার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জের ক্ষেত্রে অবকাঠামোগত দুর্বলতা বিশেষত গ্যাস ও বিদ্যুতের সংকট, যোগাযোগের দুর্বলতা, পরিবহনসংকট ইত্যাদি রয়েছে। এর পাশাপাশি আমদানি-রপ্তানি ক্ষেত্রে সমুদ্রবন্দর, বিশেষত চট্টগ্রাম শহরের বন্দর অপেক্ষাকৃত কম দক্ষ ব্যবস্থাপনা, উচ্চ পরিবহন ব্যয় ইত্যাদিও রপ্তানির ক্ষেত্রে অন্যতম চ্যালেঞ্জ। ব্যাংকঋণের ক্ষেত্রে রপ্তানি ঋণের সুদের হার কম হলেও বিনিয়োগ ঋণের সুদের হার বেশ উচ্চ। আবার ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্যমানের ওঠানামাও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নমুখী প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। এসব সংকট ও চ্যালেঞ্জে সৃষ্ট বাড়তি ব্যয় এবং ঝুঁকি পোশাক খাতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংকট বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের প্রতিযোগিতা সক্ষমতার ক্ষেত্রে একটি বড় প্রতিবন্ধকতা। আশার কথা হলো, বৃহত্ রাজনৈতিক দলগুলো পোশাক খাতকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের আওতামুক্ত রাখার ব্যাপারে একধরনের অনানুষ্ঠানিক মতৈক্য মেনে চলে। এর ফলে পোশাক কারখানাগুলো রাজনৈতিক কার্যক্রম, বিশেষত ধর্মঘট, হরতাল ইত্যাদি কার্যক্রমের মধ্যেও অংশত চালু থাকে। তবে নির্বাচনী বছরে রাজনৈতিক অসহযোগিতামূলক কার্যক্রম বেড়ে যাওয়ার কারণে উত্পাদন ও রপ্তানি কার্যক্রমে এর নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ঘটে। ২০১৩ সালজুড়ে নির্বাচনী সংকটে সৃষ্ট অনিশ্চয়তায়, ৫৫ দিন হরতাল এবং ১৫ দিন অবরোধ কার্যক্রম চলার ফলে, তৈরি পোশাক খাতে এর বিভিন্নমুখী নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। ২০১৩ সালের দ্বিতীয়ার্ধের রাজনৈতিক সংকটে সৃষ্ট ক্ষতির পরিমাপ করতে গিয়ে বিজিএমইএ ৪২টি কারখানার ওপর জরিপ চালায়। এতে প্রায় ২৬ মিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ ক্ষতির প্রাথমিক হিসাব পাওয়া যায়। এসব ক্ষতির মধ্যে রয়েছে অর্ডার বাতিল হওয়া, কম মূল্যে পণ্য রপ্তানি, আকাশপথে পণ্য পরিবহন, পণ্য প্রেরণে দেরি হওয়া, ধ্বংসাত্মক কার্যক্রমে ক্ষতি, বাড়তি পরিবহন ব্যয় ইত্যাদি।
তবে বিভিন্নমুখী চ্যালেঞ্জের পরও পোশাক খাতের প্রক্রিয়াগত, উত্পাদগত ও কার্যক্রমগত উন্নয়নের ক্ষেত্রে সার্বিকভাবে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক নীতিসহায়তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। অভ্যন্তরীণ ও বহিস্থ সুবিধা উদ্যোক্তাকে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগে পরিষ্কার পথরেখা দিয়েছে। এর ফলে উদ্যোক্তারা স্টেট অব আর্ট প্রযুক্তি ব্যবহার, প্রযুক্তিতে বিভিন্নতা আনা, প্রযুক্তি নিবিড়তা বৃদ্ধি, শ্রম নিয়োজনে কার্যক্রম গ্রহণ এবং ব্যয়বহুল কিন্তু উত্পাদনশীল প্রযুক্তি ব্যবহার ইত্যাদিতে বিনিয়োগ করেছে। পাশাপাশি এ খাতের উত্পাদন ক্ষমতা বৃদ্ধিতেও বিনিয়োগ করেছে। স্বল্প খরচে শ্রম নিয়োজন এবং শ্রমের প্রাপ্যতা থাকায় উত্পাদনবহুল নিম্ন মূল্যের পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশ ক্রমান্বয়ে শীর্ষে উঠে এসেছে।
৬. পোশাক খাতে সামাজিক অগ্রগতি
উন্নয়নশীল দেশের উত্পাদন চেইনে পণ্য উত্পাদনপ্রক্রিয়ার উন্নয়নের সঙ্গে সামাজিক উন্নয়নের বিষয়টি অধিকাংশ ক্ষেত্রে কম সম্পর্কিত দেখা যায়। উত্পাদনপ্রক্রিয়ায় উদ্যোক্তা এবং বিদেশি ক্রেতার কাছে শ্রমিকের অধিকার, চাহিদা বা দাবির বিষয়টি প্রতিযোগিতা সক্ষমতার অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে সমভাবে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়নি। শ্রম অধিকার, কর্মপরিবেশ, নিরাপত্তা ইত্যাদি ক্ষেত্রে ন্যূনতম অগ্রগতি হয়েছে সংশ্লিষ্ট দেশের আইনের কাঠামোর ভিত্তিতে। এসবের বাস্তবায়নে সরকারি উদ্যোগ, ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব নীতিকাঠামোর পাশাপাশি শ্রমিকের অব্যাহত দাবি এবং ভোক্তা বা ভোক্তাসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের চাপ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
সামাজিক অগ্রগতি বিবেচনা করা হয় সাধারণত দুই ধরনের কমপ্লায়েন্স ইস্যুতে অগ্রগতি বিবেচনা করে: এক, সামাজিক কমপ্লায়েন্স, অন্যটি ভৌত অবকাঠামোগত কমপ্লায়েন্স। সামাজিক কমপ্লায়েন্সের ইস্যুগুলো শ্রমিকের আইনি অধিকার, সামাজিক সুবিধা ইত্যাদির সঙ্গে সম্পর্কিত। অন্যদিকে, ভৌত অবকাঠামোগত কমপ্লায়েন্সের ইস্যুগুলো শ্রমিকের কর্মকালীন পরিবেশের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার সঙ্গে সম্পর্কিত। আশির দশকে পোশাকশিল্পের শুরুর দিকে সামাজিক ইস্যু তেমন গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হয়নি। এ খাতের উত্তরোত্তর প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ভোক্তা পর্যায়ে এবং শ্রমিক পর্যায়ে দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সামাজিক কমপ্লায়েন্সের বিষয়টি ধীরে ধীরে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হতে থাকে। অন্যদিকে, ভৌত অবকাঠামোগত কমপ্লায়েন্সের বিষয়টি গুরুত্ব পেতে শুরু করেছে সাম্প্রতিক কালে।
৬.১ সামাজিক কমপ্লায়েন্স
সামাজিক কমপ্লায়েন্স বলতে শ্রমিকের কর্মকালীন আইনিভাবে প্রাপ্য এবং সামাজিকভাবে প্রদেয় বিভিন্ন সুবিধা বোঝানো হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে আইনানুযায়ী পূর্ণ মজুরি প্রাপ্তি এবং তা যথাসময়ে প্রদান, সুনির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা বজায় রাখা, সাপ্তাহিক ছুটির সুবিধা, নারী শ্রমিকদের মাতৃত্বকালীন সুবিধা, শিশুদের জন্য ডে-কেয়ার, ক্যানটিন সুবিধা ইত্যাদি। এসব সূচকের ক্ষেত্রে লক্ষণীয় উন্নতি হয়েছে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে। ২০০৬ সালে সিপিডি পরিচালিত গবেষণায় দেখা যায়, প্রায় ৫০ শতাংশ কারখানা প্রথম সপ্তাহে এবং ৪৫ শতাংশ কারখানা দ্বিতীয় সপ্তাহে শ্রমিকদের মজুরি প্রদান করত। বিভিন্ন প্রকাশিত তথ্য ও সংবাদের ভিত্তিতে বলা যায়, সাম্প্রতিক কালে প্রায় সব কারখানাই মূল মজুরি প্রথম সপ্তাহে প্রদান করে। মজুরি সময়মতো প্রদানের ক্ষেত্রে ছোট কারখানাগুলোতেও উন্নতি হচ্ছে। শ্রমিকদের কর্মকালীন সময় ২০০৬ সালে ছিল দৈনিক আট ঘণ্টা এবং অতিরিক্ত সময়ের কর্মঘণ্টা ছিল ২ দশমিক ৩ ঘণ্টা এবং সর্বমোট ১০ দশমিক ৩ ঘণ্টা। বর্তমানে কারখানাগুলোতে অতিরিক্ত সময়ে কাজের চাপ বেড়েছে, শ্রমিকদের মোট কর্মঘণ্টা বেড়ে গেছে। আপাতদৃষ্টিতে শ্রমিকদের অতিরিক্ত সময়ে কাজের ক্ষেত্রে আগ্রহ দেখা যায় বাড়তি আয়ে সংসারের ব্যয় নির্বাহের চেষ্টা থেকেই। সাপ্তাহিক ছুটি প্রদানের ক্ষেত্রে আশি বা নব্বইয়ের দশকের চেয়ে পরিস্থিতি এখন পুরোপুরি ভিন্ন। বর্তমানে শ্রমিকেরা সাপ্তাহিক ছুটি পাচ্ছেন। মাতৃত্বকালীন ছুটি নেওয়ার সুবিধা বর্তমানে বেড়েছে—২০০৫ সালে ৫০ থেকে ৮০ ভাগ কারখানায় শ্রমিকদের মাতৃত্বকালীন ছুটির সুবিধা প্রদান করা হতো বলে সিপিডি (২০০৮) গবেষণায় দেখা যায়। ৫০ থেকে ৮০ শতাংশ কারখানাতে ২০০৫ সালে ডে-কেয়ার সেন্টার এবং ক্যানটিন সুবিধা ছিল। এ ক্ষেত্রেও উন্নতি হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। এ ধরনের সুবিধা শ্রমিকদের দেওয়ার কারণে শ্রমিকদের উত্পাদনশীলতা বৃদ্ধি পায় বলে গবেষণায় দেখা যায়। সিপিডি (২০০৮) গবেষণায় দেখা গেছে, সামাজিক কমপ্লায়েন্সসম্পন্ন কারখানাগুলোতে শ্রমিকের উত্পাদনশীলতা অপেক্ষাকৃত কম কমপ্লায়েন্সসম্পন্ন কারখানা থেকে বেশি (সারণি ৪)।
সারণি ৪: শ্রমিকের উত্পাদনশীলতা (বছরপ্রতি ডলারে)
বিবরণ নিট ওভেন সোয়েটার শার্ট
কম কমপ্লায়েন্সসম্পন্ন কারখানা ১৮৬৯ ৯৯১ ১৩৯৭ ১৪১১
মধ্যম কমপ্লায়েন্সসম্পন্ন কারখানা ২২৯১ ১০৬৩ ১৫৫১ ১৩৪২
উচ্চ কমপ্লায়েন্সসম্পন্ন কারখানা ২২৪৬ ২৪২৯ ১০৬৭ ২২১৩
সূত্র: মোয়াজ্জেম এবং সেহরীন (২০১৩)
৬.২ অবকাঠামোগত কমপ্লায়েন্স
অবকাঠামোগত কমপ্লায়েন্স বলতে বোঝায় জরুরি বহির্গমনব্যবস্থা থাকার সুবিধা, অগ্নিনির্বাপণসুবিধা, কারখানার কাঠামোগত সুবিধা ইত্যাদি। এসব কমপ্লায়েন্সকে শ্রমিকের কর্মকালীন নিরাপত্তাসুবিধা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অবকাঠামোগত সুবিধা দেওয়ার বিষয়টি নির্ভর করে কারখানার কাঠামোগত অবস্থার ওপর। বাংলাদেশে সাধারণত তিন ধরনের কাঠামোতে কারখানাগুলো স্থাপন করতে দেখা যায়: ক. ভাড়াকৃত স্পেস, খ. ব্যবসায়িক স্পেস এবং গ. নিজস্ব জমির ওপর তৈরি কাঠামো। আশি ও নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশে অধিকাংশ কারখানা গড়ে উঠেছিল ভাড়াকৃত স্পেসে। এসব কাঠামোর অধিকাংশই শিল্প কাঠামো নির্মাণের উপযোগী ছিল না। এসব দুর্বল অবকাঠামোতে দুর্ঘটনার কারণে অনেক শ্রমিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। পরবর্তী সময়ে আইনি বাধ্যবাধকতা এবং ক্রেতাদের চাপে উদ্যোক্তারা শিল্প স্থাপনে সঠিক কাঠামোর ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেন। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য শ্রমিকদের জরুরি বহির্গমন সিঁড়ি নির্মাণ। পরবর্তীকালে শিল্পের কলেবর বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কারখানাগুলো ব্যবসায়িকভাবে নির্মিত কাঠামোতে গড়ে ওঠে। এসব কাঠামোতে বৃহত্তর স্পেসে শ্রমিকদের জন্য কিছুটা ভালো সুবিধা নিশ্চিত করা গেলেও আইনিভাবে প্রয়োজনীয় অভ্যন্তরীণ কাঠামো নিশ্চিত করা যায়নি। নব্বইয়ের দশক থেকে ধীরে ধীরে এবং ২০০০-পরবর্তীকালে বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলে নিজস্ব জমিতে পর্যাপ্ত সুবিধা দিয়ে কারখানা কাঠামো নির্মাণের উদ্যোগ দেখা যায়। কিন্তু দেখা গেছে, প্রায়ই এসব কাঠামো ত্রুটিপূর্ণভাবে নির্মিত।
সবচেয়ে বড় কথা, শ্রমিকদের কর্মপরিবেশের নিরাপত্তার জন্য পর্যাপ্ত নিরাপদ অবকাঠামো এখনো যথেষ্টসংখ্যক গড়ে ওঠেনি। কারখানায় জরুরি বহির্গমনব্যবস্থার সুবিধা অনেক বেড়েছে, বিশেষত শিল্পাঞ্চল এলাকাগুলোতে তৈরি নতুন কাঠামোগুলোতে এ সুবিধা রয়েছে। তবে ভাড়াকৃত কাঠামো এবং শহরাঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত কাঠামোতে এ সুবিধা পর্যাপ্ত নয়। আবার ত্রুটিপূর্ণ কাঠামো নির্মাণের কারণে দুর্ঘটনায় প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে। তাজরীন ফ্যাশনসের বিল্ডিং এবং রানা প্লাজা ত্রুটিপূর্ণ কাঠামো, অপর্যাপ্ত বহির্গমনব্যবস্থা এবং অপ্রয়োজনীয় অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা শ্রমিকের প্রাণহানি ঘটানোর জন্য দায়ী।
ভাড়াকৃত এবং কমার্শিয়াল স্পেসে কারখানা নির্মাণ বর্তমানে নতুন উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাড়তি উত্পাদন চাহিদা মেটাতে দ্রুততম সময়ে কারখানা স্থাপনের কারণে অনেক সময় কমপ্লায়েন্সসংক্রান্ত বিষয়ে পর্যাপ্ত নজর না দিয়ে কারখানার উল্লম্বভাবে বৃদ্ধি ঘটছে। এসব উল্লম্ব অবকাঠামোগুলোতে ত্রুটি থাকায় কারখানায় সব দুর্ঘটনায় মৃত্যুঝুঁকি অনেক বেড়েছে। এ ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত বিকল্প সিঁড়ি না থাকা, অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থায় ত্রুটি, দাহ্য পদার্থ থেকে সৃষ্ট ধোঁয়ার কারণে অতি দ্রুত মৃত্যুবরণ এবং অবকাঠামো ধ্বংসের মতো কারণ জড়িত।
কারখানার সামাজিক কমপ্লায়েন্স এবং অবকাঠামোগত কমপ্লায়েন্সের উন্নতির জন্য পর্যাপ্ত আইন থাকলেও তা বাস্তবায়নে দুর্বলতা দুর্ঘটনা এবং শ্রমিক মৃত্যুর জন্য অনেকাংশে দায়ী। দেশে বর্তমানে প্রচলিত শ্রম আইন, ২০০৬, সংশোধিত শ্রম আইন ২০১৩, অগ্নিনির্বাপণ আইন, ২০০১ এবং জাতীয় বিল্ডিং কোড, ২০০৬ ইত্যাদি বহাল রয়েছে। কিন্তু আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত উদ্যোগের ঘাটতি রয়েছে। আইন প্রয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের প্রায় প্রতিটিতে পর্যাপ্ত লোকবলের স্বল্পতা রয়েছে। কারখানা পরিদর্শন কর্তৃপক্ষের ঢাকা বিভাগীয় অফিসের পরিদর্শকসংখ্যা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। সাম্প্রতিক সময়ে কারখানা পরিদর্শন কর্তৃপক্ষকে উন্নীত করে প্রয়োজনীয় লোকবল বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অগ্নিনির্বাপণ কর্তৃপক্ষের জনবল ও যন্ত্রপাতি বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। কারখানায় সামাজিক ও অবকাঠামোগত কমপ্লায়েন্স না মানার পেছনে প্রায়ই পরিদর্শনকারী কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে।
কারখানা পর্যায়ে অগ্নিকাণ্ড বা অন্যান্য কারণে শ্রমিকের মৃত্যু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দুর্ঘটনাজনিত নয়। এসব মৃত্যুর পেছনে অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধে সতর্কতামূলক ব্যবস্থার অভাব, বৈদ্যুতিক ব্যবস্থায় ত্রুটি এবং কারখানার বিল্ডিংয়ে বিল্ডিং কোডের ব্যত্যয় ঘটিয়ে সম্প্রসারণ ঘটানো ইত্যাদি দায়ী বলে বিভিন্ন তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ পেয়েছে। দুঃখজনক হলো, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তদন্ত প্রতিবেদনে এসব শৈথিল্যজনিত মৃত্যুর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের আড়াল করার চেষ্টা থাকে। সর্বশেষ তাজরীন অগ্নিকাণ্ড এবং রানা প্লাজা দুর্ঘটনার জন্য অন্যান্যের সঙ্গে কর্তৃপক্ষকে দায়ী করা হয়েছে। দুঃখজনক হলো, অবকাঠামোগত কমপ্লায়েন্স মানসম্পন্ন রাখার জন্য কারখানাগুলোর যে বাড়তি বিনিয়োগ প্রয়োজন, তা খুব বেশি না। মোয়াজ্জেম (২০১৩) এ দেখা গেছে, একটি কারখানার অবকাঠামোগতভাবে কমপ্লায়েন্সে উন্নীত করার জন্য যে বাড়তি বিনিয়োগ প্রয়োজন, তা খুব বেশি নয়।
৬.৩ শ্রমিকের মজুরি
শ্রমিকের মজুরি তার সার্বিক ও প্রান্তিক উত্পাদনশীলতার সঙ্গে সম্পর্কিত হওয়ার কথা থাকলেও পোশাক খাতে মজুরি-উত্পাদনশীলতার মধ্যে সম্পর্ক সামান্যই। সিপিডি (২০০৮) এ দেখা গেছে, একজন শ্রমিক তাঁর উত্পাদনশীলতার মাত্র ৪৭ শতাংশ মজুরি হিসেবে পান। কমপ্লায়েন্সসমৃদ্ধ বৃহত্ কারখানার শ্রমিক বেশি মজুরি পেলেও এসব কারখানায় উত্পাদনশীলতা-মজুরির বৈষম্যও বেশি। দুর্ভাগ্যজনক হলো, শ্রমিকের ভিত্তি মজুরি এখনো ঠিক করা যায়নি, এর কারণ ন্যূনতম মজুরি নিয়ে এখনো বিতর্ক চলছে।
পোশাক খাতে এখনো ন্যূনতম মজুরি নির্ধারিত হয়। মজুরি নির্ধারণে ন্যূনতম মজুরির নিম্নমাত্রা বিবেচিত হয় বলে উত্পাদনশীলতার বিচারে পর্যাপ্ত মজুরিপ্রাপ্তি থেকে শ্রমিকেরা বঞ্চিত হন। ন্যূনতম মজুরি বোর্ড শ্রম আইন অনুযায়ী বিভিন্ন বিষয়ের আলোকে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করে। বিগত সাড়ে তিন দশকে পোশাক খাতে ন্যূনতম মজুরি সমন্বয় হয়েছে মাত্র চারবার। সপ্তম গ্রেডে ন্যূনতম মজুরি ১৯৮২ সালে ৬২০ টাকা, ১৯৯৩ সালে ৯৩০ টাকা, ২০০৬ সালে ১১৬২ দশমিক ৫ টাকা এবং ২০১০ সালে তিন হাজার টাকা। দীর্ঘ এ বিরতিতে মজুরি সমন্বয় করতে গিয়ে শ্রম আইন অনুযায়ী নির্ধারিত বিভিন্ন বিষয় যেমন: ন্যূনতম মূল্যস্ফীতি, দেশজ আয় প্রবৃদ্ধি, শ্রমিকের জীবন ব্যয় ইত্যাদি বিষয়ে পর্যাপ্তভাবে নজর দেওয়া হয়নি। সর্বশেষ ২০১৩ সালের জুন মাসে গঠিত ন্যূনতম মজুরি বোর্ড গঠিত হয়। নভেম্বর ২০১৩-এ সপ্তম গ্রেড পাঁচ হাজার টাকা ন্যূনতম মজুরিসহ অন্যান্য গ্রেডে নতুন মজুরি ধরা হয় (সারণি ৫)।
সারণি ৫: মজুরি বোর্ড কর্তৃক নির্ধারিত শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি
| ন্যূনতম মজুরি অক্টোবর ২০০৬ | ন্যূনতম মজুরি নভেম্বর ২০১০ | ন্যূনতম মজুরি ডিসেম্বর ২০১৩ |
গ্রেড ১ | ৫১৪০ | ৯৩০০ | ১৩০০০ |
গ্রেড ২ | ৩৮৪০ | ৭২০০ | ১০৯০০ |
গ্রেড ৩ | ২৪৪৯ | ৪২১৮ | ৬৮০৫ |
গ্রেড ৪ | ২২৫০ | ৩৮৬১ | ৬৪২০ |
গ্রেড ৫ | ২০৪৬ | ৩৫৫৩ | ৬০৪২ |
গ্রেড ৬ | ১৮৫১ | ৩৩২২ | ৫৬৭৮ |
গ্রেড ৭ | ১৬৬২ | ৩০০০ | ৫৩০০ |
সূত্র: দৈনিক পত্রিকা, ২০১৩
দেশের প্রচলিত আইনে (সংশোধিত শ্রম আইন, ২০১৩) শ্রম মজুরি সংজ্ঞায়িত করা হলেও ন্যূনতম মজুরির কোনো সংজ্ঞা নেই। অবশ্য ন্যূনতম মজুরির ক্ষেত্রে বিবেচ্য বিষয়গুলোর কথা আইনে বলা হয়েছে। যেমন: মূল্যস্ফীতি, কারখানার সক্ষমতা, শ্রমিকের জীবনযাত্রার ব্যয় ও মান, পণ্যমূল্য এবং অন্যান্য প্রতিযোগী সক্ষম খাতের পরিস্থিতি ইত্যাদি। অথচ এসব বিষয়ের পর্যাপ্ত তথ্য উপাত্ত জাতীয় পর্যায়ে নেই। ফলে ন্যূনতম মজুরিসংক্রান্ত দর-কষাকষি মালিক ও শ্রমিকপক্ষের উত্থাপিত নিজস্ব তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে হয়। এসব তথ্য-উপাত্ত বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়।
শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণে কোন কোন নিয়ামক বিবেচনা করা উচিত, তা নিয়ে তাত্ত্বিক পর্যায়ে ভিন্ন ভিন্ন মত রয়েছে। তবে মতভিন্নতার বড় উত্স শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি এবং বাজারভিত্তিক মজুরির সংজ্ঞাগত পার্থক্য। বাজারভিত্তিক মজুরির ধারণায় মজুরি নির্ধারণে শ্রমিকের প্রান্তিক উত্পাদনশীলতা গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। অন্যদিকে, শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরির সঙ্গে প্রান্তিক উত্পাদনশীলতার সম্পর্ক কম। ন্যূনতম মজুরি বাজারভিত্তিক মজুরির বেশ নিচে অবস্থান করে। দেখা গেছে, বিভিন্ন দেশে প্রচলিত ন্যূনতম মজুরি বাজারভিত্তিক মজুরির চেয়ে বেশ কম। বাংলাদেশে প্রচলিত ন্যূনতম মজুরিকাঠামোতে বিভিন্ন গ্রেডের জন্য আলাদাভাবে মজুরি নির্ধারণ করে দেওয়ার কারণে এটা মূলত ‘ন্যূনতম’ ও ‘বাজারভিত্তিক’ মজুরির একটি মিশ্রিত রূপ হিসেবে রয়েছে।
মোয়াজ্জেম ও সাইফা (২০১৩) তে আইএলওর ন্যূনতম মজুরিসংক্রান্ত ১৩১ নম্বর কনভেনশনের আলোকে ন্যূনতম মজুরির সংজ্ঞা সুপারিশ করা হয়েছে। ওই সংজ্ঞায় শ্রমিকদের পরিবারকে তাঁদের পরিবারের ইউনিট হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে উপার্জনক্ষম ব্যক্তি দিয়ে ভাগ করার কথা বলা হয়েছে। এ হিসেবে ন্যূনতম মজুরির সংজ্ঞা নিম্নরূপ:
এ সংজ্ঞা অনুসারে মাসিক ব্যয়ের তথ্যের ভিত্তিতে একজন শ্রমিকের পরিবারের ন্যূনতম জীবনযাত্রার ব্যয় দাঁড়ায় আট হাজার ৩০০ টাকা। সার্বিক সক্ষমতার কথা বিবেচনা করে মোয়াজ্জেম ও সাইফা (২০১৩) ছয় হাজার ৫০০ টাকা ন্যূনতম মজুরি সুপারিশ করেছে।
মজুরি নির্ধারণে কারখানার সক্ষমতা একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক। সক্ষমতা বিচারের ক্ষেত্রে মূল বিবেচ্য বিষয় হলো কারখানার পরিচালন ব্যয় ও মুনাফা অর্জন। মজুরি পুনর্নির্ধারণের কারণে কারখানার আয় যদি কারখানার পরিচালন ব্যয় মেটাতে ব্যর্থ হয়, তবে বোঝা যাবে ঘোষিত মজুরির কারণে কারখানা অলাভজনক হতে পারে। তবে এ ধরনের পরিস্থিতি বিচার-বিশ্লেষণের জন্য পর্যাপ্ত তথ্য ও উপাত্তের ঘাটতি রয়েছে। ফলে কোন ধরনের কারখানার ওপর পুনর্নির্ধারিত মজুরির চাপ কেমন, তা বিশ্লেষণ করা দুরূহ। সিপিডি (২০০৮) এ দেখা গেছে, ছোট কারখানাগুলোর লাভ বা আয়ের পরিমাণ বড় কারখানাগুলোর প্রায় ৮৫ শতাংশ। এ থেকে অনুমিত হয়, নতুন ব্যয় সমন্বয়ের কারণে ছোট কারখানা, বিশেষত সাব-কন্ট্রাক্টিং কারখানার সক্ষমতার ওপর একটা চাপ সৃষ্টি হতে পারে। তবে মজুরি পুনর্নির্ধারণের ক্ষেত্রে ব্যয় সমন্বয়ের প্রয়োজন রয়েছে। বিশেষত কারখানাগুলোর উত্পাদনপ্রক্রিয়ায় মেশিন ব্যবহার, শ্রমিক ব্যবহারে অনেক অদক্ষতা রয়েছে, যা উন্নতি করার মাধ্যমে বাড়তি উত্পাদন ব্যয়ের চাপ কমানো সম্ভব। শ্রমিকের মজুরি সমন্বয়ের ক্ষেত্রে ক্রেতার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে বাড়তি মজুরি সমন্বয়ের জন্য ক্রেতাপ্রদত্ত মূল্য, যা কাটিং অ্যান্ড মেকিং (সিএম) ফি হিসেবে পরিচিত তা বাড়ানো প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে উদ্যোক্তা ও ক্রেতার যৌথভাবে এগিয়ে আসা প্রয়োজন।
আইনিভাবে মজুরিকাঠামোর বাস্তবায়ন জানুয়ারি ২০১৪ থেকে শুরু হয়েছে। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, কারখানা পর্যায়ে মজুরি বাস্তবায়ন বিভিন্ন পর্যায়ে রয়েছে। বিজিএমইএর হিসাবমতে, জানুয়ারি ২০১৪-এর মজুরি প্রদান করেছে ৬৬ শতাংশ কারখানা। এর মধ্যে সমস্যাসংকুল আশুলিয়া এলাকায় মজুরিকাঠামোর বাস্তবায়ন অগ্রগতি ভালো। অন্যদিকে, ঢাকার বাইরে, বিশেষত চট্টগ্রামে এর বাস্তবায়ন পরিস্থিতি অপেক্ষাকৃত শ্লথ। বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্রাকৃতির কারখানাগুলো তখনো পিছিয়ে রয়েছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।
৬.৪ শ্রমিকদের সংগঠন করার অধিকার
পোশাক খাতে কারখানা পর্যায়ে শ্রমিক সংগঠন করার বিষয়টি দীর্ঘদিন তেমন এগোতে পারেনি। এ কারণে শ্রমিকদের জন্য পর্যাপ্ত সুবিধাপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা যায়নি বিগত দশকগুলোতে। কারখানা পর্যায়ে শ্রমিকদের জন্য ওয়ার্কার্স ওয়েলফেয়ার কমিটি (ডব্লিউডব্লিউসি) গঠন করা হয়েছিল, যা মূলত অরাজনৈতিক একটি কল্যাণমূলক প্ল্যাটফর্ম। কিন্তু এসব ডব্লিউডব্লিউসি অধিকাংশ ক্ষেত্রে কার্যকর ছিল না মূলত মালিকপক্ষের হস্তক্ষেপের কারণে। কার্যকরী ডব্লিউডব্লিউসির মাধ্যমেও শ্রমিকদের বিভিন্ন দাবি, বিশেষত সামাজিক কমপ্লায়েন্স ও কাঠামোগত কমপ্লায়েন্সের ক্ষেত্রে উন্নতি করার সুযোগ ছিল। বাস্তবিক পক্ষে, এসব কমিটির অকার্যকারিতায় তা সম্ভব হয়নি।
শ্রম আইন, ২০০৬-এ সংগঠিত হওয়ার কথা বলা হলেও কারখানা পর্যায়ে তার বাস্তবায়নে জটিলতা ছিল। এ আইনের আওতায় সংগঠন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে মালিকের অবগতির বিধান থাকায় কারখানা পর্যায়েই এ ধরনের সংগঠনের উদ্যোগ বন্ধ করে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। মালিকপক্ষের অনীহা এ ক্ষেত্রে মূল বাধা। তবে শ্রমিকদের অধিকার উপেক্ষিত থাকা এবং কর্মনিরাপত্তার ক্ষেত্রে হুমকি সৃষ্টি হওয়ার কারণে তাদের সংগঠিত হওয়ার দাবিটি উত্তরোত্তর জোরালো হয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে সংশোধিত শ্রম আইন, ২০১৩-এ শ্রমিকদের সংগঠিত হওয়ার ক্ষেত্রে বাধা দূর করার প্রচেষ্টা দেখা যায়।
৭. উত্পাদন চেইনে শ্রমিকসংক্রান্ত সামাজিক উন্নয়নে বিভিন্ন পক্ষের ভূমিকা
উত্পাদন চেইনে শ্রমিকসংক্রান্ত সামাজিক ইস্যুর উন্নয়নের ক্ষেত্রে ক্রেতা ও সরবরাহকারী মূল ভূমিকা পালন করে। এ ক্ষেত্রে দেশীয় আইনকে প্রাথমিক ভিত্তি হিসেবে গণ্য করা হয়। অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের মতো বাংলাদেশেও সামাজিক ইস্যুসংক্রান্ত আইনের ভিত্তিতে দুর্বলতা রয়েছে। বাংলাদেশে শ্রমিকের উত্পাদনপ্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্তি উত্তরোত্তর বাড়ার পাশাপাশি আইনি কাঠামোতে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন হয়নি। আইন প্রয়োগের দুর্বলতা আরেকটি ঘাটতির বিষয়। পর্যাপ্ত লোকবলের অভাব, সুশাসনের দুর্বলতা এবং সীমিত আকারে প্রশাসনিক বিকেন্দ্রায়ণের জন্য আইনের বাস্তবায়ন পুরোপুরি সম্ভব হয়ে ওঠেনি। ফলে সামাজিক উন্নয়নের বিষয়টি প্রায় পুরোপুরি নির্ভর করেছে ক্রেতাদের প্রয়োজনের নিরিখে।
উত্পাদন চেইনে উন্নয়নশীল দেশের সম্পৃক্ততা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ভোক্তা গ্রুপগুলোর কার্যক্রম বৃদ্ধি পেয়েছে। আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠনগুলো উন্নয়নশীল দেশের শ্রমিকদের অধিকারের ব্যাপারে জোরালো অবস্থান নিতে শুরু করেছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে ক্রেতারা শ্রমিকের সামাজিক উন্নয়নের ব্যাপারে সচেতন হয়েছে। ক্রেতারা কোড অব কনডাক্টে উত্তরোত্তর সামাজিক বিষয়গুলোর গুরুত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে।
সামাজিক ইস্যুর ক্ষেত্রে ক্রেতারা তৃতীয় পক্ষীয় অডিট করে থাকে। এসব অডিটে নির্দিষ্ট চেকলিস্টের ভিত্তিতে কারখানার সামাজিক কমপ্লায়েন্স পরীক্ষা করা হয়। কিন্তু এসব অডিটের ক্ষেত্রে কারখানায় কার্যকরভাবে তা বাস্তবায়নের বিষয়টি সব সময় নিশ্চিত করা যায় না। দেখা গেছে, বিজিএমইএ নির্দেশিত সামাজিক ও অবকাঠামোগত কমপ্লায়েন্স গাইডলাইন ১৯টি নির্দিষ্ট ইস্যু পর্যবেক্ষণে সীমিত থাকে। যে ১৯টি নির্দিষ্ট ইস্যু পর্যবেক্ষণ করা হয়, তা হলো ১. ন্যূনতম মজুরি ২. নিয়োগপত্র ৩. পরিচয়পত্র ৪. সময়মতো মজুরি ৫. ওভারটাইম ভাতা ৬. সাপ্তাহিক ছুটি ৭. নৈমিত্তিক ছুটি ৮. অসুস্থতার ছুটি ৯. উত্সব ছুটি ১০. বার্ষিক ছুটি ১১. পার্টিসিপেশন কমিটি গঠন ১২. ওয়েলফেয়ার কমিটি গঠন ১৩. শিশু শ্রমিক ১৪. বিকল্প সিঁড়ি/ফটক ১৫. শ্রমিকদের সার্ভিস বুক রক্ষণাবেক্ষণ ১৬. প্রয়োজনীয় অগ্নিনির্বাপকযন্ত্র ১৭. শিশু কক্ষ/ডে-কেয়ার সেন্টার ১৮. প্রাথমিক চিকিত্সাব্যবস্থা ও ১৯. মহিলা-পুরুষদের আলাদা টয়লেট। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব কার্যকরভাবে পরিপালনের চেয়ে ‘চেকলিস্ট’ পূরণের মতো বিষয়ে পরিণত হয়।
শ্রমিক ইস্যুর উন্নয়নের ক্ষেত্রে কারখানা পর্যায়ে দুর্বল শ্রমিক সংগঠনের উপস্থিতি অন্যতম কারণ। শ্রমিক কল্যাণ কমিটি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানগুলো শ্রমিকস্বার্থ পর্যাপ্তভাবে সংরক্ষণে কাজ করতে পারছে না। এ ক্ষেত্রে এসব কমিটিতে মালিকপক্ষের অতিমাত্রায় হস্তক্ষেপকে দায়ী করা হয়। তবে জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন এবং ট্রেড ইউনিয়ন পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের অধিকার আদায়ে ক্রমান্বয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিচ্ছে। তবে পোশাক খাতের শ্রমিকদের একটা বিশাল অংশের শ্রমিক নিজেদের অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে সাংগঠনিক কাঠামোর বাইরে গিয়ে প্রচেষ্টা চালিয়ে থাকে।
সামাজিক উন্নয়নের শ্লথগতির পেছনে দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অর্থনীতিও রয়েছে। বাংলাদেশের ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতিতে অন্যান্য উদ্যোক্তাদের সংগঠনের চেয়ে পোশাক খাতের উদ্যোক্তা সংগঠনের প্রভাব অনেক বেশি। ফলে কারখানার দুর্ঘটনাজনিত কারণে শ্রমিকের মৃত্যুর বিষয়ে যথাযথ তদন্ত চালানো, তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ এবং তদন্তে দোষীদের ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণে অধিকাংশ ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতা দেখা যায়। কারখানা পর্যায়ে শ্রমিকের কর্মকালীন নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামোগত এবং অন্যান্য সামাজিক সুবিধা পালনে ব্যর্থ প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে অধিকাংশ ক্ষেত্রে যথাযথ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ আটকে যায় আইনি মারপ্যাঁচে।
সাম্প্রতিক সময়কালে সংঘটিত তাজরীন গার্মেন্টসে অগ্নিকাণ্ড এবং রানা প্লাজা ধ্বংসের ঘটনার পর বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান তদন্তকাজ সম্পন্ন করেছে। তবে তদন্ত রিপোর্টগুলোতে অধিকাংশ ক্ষেত্রে দায়সারা গোছের এবং অপরাধী চিহ্নিতকরণে বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে দায়ী করা হয়েছে (মোয়াজ্জেম, ২০১৩)। তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বিভিন্ন ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যার মধ্যে কতিপয় উদ্যোক্তাও অন্তর্ভুক্ত। তবে পরবর্তীকালে আইনি কার্যক্রমের অগ্রগতিতে দীর্ঘসূত্রতা দেখা যাচ্ছে।
রানা প্লাজার ঘটনার পর বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশের পোশাক খাতের কর্মপরিবেশ এবং কর্মনিরাপত্তা নিয়ে কাজ করতে উত্সাহী হয়েছে। এর ফলে ইউরোপভিত্তিক অ্যাকর্ড এবং উত্তর আমেরিকাভিত্তিক অ্যালায়েন্স নামে ক্রেতাদের দুটি সংগঠন কারখানার দুর্বল কাঠামো, অগ্নিনির্বাপক ও বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনাব্যবস্থার ত্রুটি নিরূপণ এবং তা সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে। ইতিমধ্যে অ্যাকর্ডের অধীনে এক হাজার ৫৬৬টি এবং অ্যালায়েন্সের অধীনে ৬৮৬টি কারখানা চিহ্নিত করা হয়েছে পর্যবেক্ষণের জন্য। এর বাইরে আইএলও নিজস্ব উদ্যোগে এক হাজার ৫০০ কারখানা পর্যবেক্ষণ করবে। একটি জাতীয় কর্মপরিকল্পনা গৃহীত হয়েছে পোশাক খাতের বিভিন্নমুখী সংস্কার কার্যক্রমসংক্রান্ত। ক্রেতাদের এ উদ্যোগ প্রশংসিত হলেও এর সময়োপযোগী বাস্তবায়ন প্রয়োজন। এসব উদ্যোগের বাইরেও প্রায় এক হাজার ৫০০ কারখানা রয়ে গেছে, আইএলও এসব কারখানার ত্রুটি অনুসন্ধান এবং ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নিয়েছে। তবে এসব কার্যক্রম সময়সাপেক্ষ এবং এর জন্য পর্যাপ্ত সময় ও অর্থ ব্যবহারের প্রয়োজন।
সাম্প্রতিক কালে রাজনৈতিক অস্থিরতায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া এবং নতুন মজুরিজনিত ব্যয় বৃদ্ধি হওয়ার কারণে রপ্তানিমুখী খাত, বিশেষত পোশাক খাতের জন্য সরকার বিভিন্ন সহায়তা ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে রয়েছে উেস কর হ্রাস, রেয়াতি সুদে রপ্তানি ঋণ প্রদান, ঋণ তফসিলীকরণের সুবিধা ইত্যাদি। রপ্তানি খাতগুলোকে সহযোগিতার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক এক্সপোর্ট ডেভেলপড ফান্ড থেকে ১ দশমিক ২ শতাংশ হারে এক কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে। পোশাক ও টেক্সটাইল খাতের জন্য সরকার উেস করও ৮ থেকে শূন্য দশমিক ৩ শতাংশে হ্রাস করেছে। এই সুবিধা ২০১৫ সাল পর্যন্ত থাকবে। সরকার পোশাক রপ্তানিকারকদের জন্য অ্যাডভান্স টেলিগ্রাফ ট্রান্সফারের (টিটি) বিপরীতে নগদ প্রণোদনা গ্রহণ অনুমোদন করেছে। এই সুবিধার আওতায় নিট ও ওভেন পোশাক রপ্তানিকারকেরা পণ্য জাহাজীকরণের আগে অ্যাডভান্স টেলিগ্রাফ ট্রান্সফারের (টিটি) বিপরীতে বর্তমানে বিদ্যমান শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ হারে নগদ প্রণোদনা পাবে। বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারকে রপ্তানি ঋণের ওপর ৩ শতাংশ হারে ভর্তুকি দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। রপ্তানি খাতে নগদ প্রণোদনা বর্তমানের ৫ থেকে ৬ শতাংশে বৃদ্ধি করার বিষয়ে সরকার চিন্তাভাবনা করছে। চলতি অর্থবছরে বিভিন্ন রপ্তানিমুখী খাতে সরকার সর্বমোট ২৫ দশমিক ৫২ বিলিয়ন টাকা নগদ প্রণোদনা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এসব সুবিধা সরাসরি রপ্তানিতে জড়িত কারখানাগুলোর আয় বাড়িয়ে এবং ব্যয় কমিয়ে ঝুঁকিজনিত এবং ব্যয় বৃদ্ধিজনিত বাড়তি চাপ মেটাতে বিশেষ সহায়তা করবে। তবে এ সুবিধা রপ্তানিতে সরাসরি জড়িত নয় অর্থাত্ সাব-কন্ট্রাক্টিং কারখানাগুলোর জন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না, এসব কারখানায় একই ধরনের সুবিধা নিশ্চিত করতে দেশীয় মূল উদ্যোক্তা কারখানাগুলোকে উদ্যোগ নিতে হবে। মূল উদ্যোক্তা কারখানাগুলোকে পর্যাপ্ত পরিমাণে সাব-কন্ট্রাক্টিং কারখানায় মার্জিন বাড়িয়ে তা নিশ্চিত করতে হবে।
৮. উপসংহার: শ্রমিকদের সামাজিক উন্নয়নে কতিপয় সুপারিশ
উন্নয়নশীল দেশের উত্পাদন চেইনে শ্রমিকের সামাজিক উন্নয়ন প্রায়ই উপেক্ষিত থাকে। কখনো কখনো উত্পাদনপ্রক্রিয়ায় উন্নয়নের মধ্যেই সামাজিক উন্নয়নের দুর্বলতা লুকিয়ে থাকে। উত্পাদনপ্রক্রিয়ায় সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে ক্রেতা ও উদ্যোক্তার সঙ্গে শ্রমিককে উত্পাদন চেইনের অন্যতম নিয়ামক হিসেবে বিবেচনা করা দরকার। শ্রমিককে উত্পাদন চেইনে অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে তাঁর জন্য সামাজিক কমপ্লায়েন্স এবং অবকাঠামোগত কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করা আবশ্যকীয় হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে ক্রেতা ও উদ্যোক্তা প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ এবং ব্যয় নির্বাহ করতে প্রস্তুত থাকবে। শ্রমিকের কর্মপরিবেশের সামাজিক ও অবকাঠামোগত কমপ্লায়েন্সের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যয়কে মূল পরিচালনা ব্যয় হিসেবে বিবেচনা করার পর ক্রেতা ও উদ্যোক্তা নিজেদের মার্জিন হিসাব করবে। এ ব্যয়ের কারণে খুচরা পর্যায়ে পণ্যমূল্যের সমন্বয় প্রয়োজন হলে ক্রেতা তা করবে।
উদ্যোক্তা/উদ্যোক্তা সংগঠন: উদ্যোক্তা/উদ্যোক্তা সংগঠনের দৃষ্টিভঙ্গিগত পরিবর্তন দরকার। সময় বাঁচানো, মেশিনভিত্তিক, শ্রম-উত্পাদনশীল উত্পাদন কাঠামো থেকে বেরিয়ে আসা উচিত, শ্রমবান্ধব কর্মপরিবেশ স্থাপনে জোর দেওয়া দরকার। উদ্যোক্তা সংগঠনের সদস্যপদপ্রাপ্তির নিয়মকানুন মানার ক্ষেত্রে কঠোরতা অবলম্বন দরকার। কারখানাসংক্রান্ত নিয়মকানুন না মানা হলে সদস্যপদ প্রাপ্তি/নবায়নের ক্ষেত্রে ইউডি ইস্যু বন্ধ করা বা কারখানা বন্ধ করে দেওয়া উচিত। উদ্যোক্তা/উদ্যোক্তা সংগঠনের জিরো টলারেন্স নীতিমালা গ্রহণ করা উচিত। উদ্যোক্তা সংগঠন যেমন বিজিএমইএর কমপ্লায়েন্স সেলের দুটো আলাদা ভাগ থাকা দরকার—সামাজিক কমপ্লায়েন্স এবং কারখানা কমপ্লায়েন্স। এসব টিম আলাদাভাবে কাজ করতে পারে। বিজিএমইএর কমপ্লায়েন্সের গাইডলাইন পরিমার্জন করা দরকার এবং এর আওতা আরও বাড়ানো দরকার। এটিকে সংশ্লিষ্ট আইনের সঙ্গে পুরোপুরি মিলিয়ে দেখা দরকার।
সরকার: সরকারের উচিত শ্রমবান্ধব পোশাক খাত গড়ার লক্ষ্যে মালিক ও শ্রমিককে সমান গুরুত্ব দিয়ে একসঙ্গে কাজ করা। বেটার ওয়ার্ক প্রোগ্রাম বাস্তবায়নের কাজ এগিয়ে নেওয়া উচিত। কারখানা পর্যায়ে নিরাপত্তাঝুঁকি কমাতে ট্রেড ইউনিয়ন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। সরকার-শ্রমিক-মালিক মিলে এর কাঠামোগত রূপরেখা ঠিক করা দরকার। কারখানা পর্যায়ে ট্রেড ইউনিয়ন কার্যক্রম গ্রহণে শ্রম মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগের (যেমন ডিওএল) গতিশীল ভূমিকা প্রয়োজন। কারখানা পর্যায়ে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে তোলার স্বার্থে প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে শিল্পসম্পর্ক আইন প্রণয়ন করা যেতে পারে। এ আইনের আলোকে শ্রমিক তাঁর কাজের নিশ্চয়তা পাবেন, মালিক তাঁর কারখানা চালু রাখতে পারবেন, শ্রমিকেরা তাঁদের ন্যূনতম অধিকার আদায়ের দাবি করতে পারবেন। এর প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে আইএলওর শ্রমনিরাপত্তার কাঠামোগত রূপরেখাসংক্রান্ত কনভেনশন স্বাক্ষরের ব্যাপারে সরকারের সক্রিয় উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।
কারখানা পরিদর্শন কর্তৃপক্ষ বিশেষায়িত জ্ঞানের দক্ষ লোকের মাধ্যমে পরিচালিত হওয়া প্রয়োজন। এটি যেন শ্রম মন্ত্রণালয়ের অন্যান্য বিভাগের (যেমন ডিওএল) নিয়োগের ক্ষেত্রে পরিণত না হয়। প্রস্তাব অনুযায়ী কারখানা পরিদর্শন কার্যালয়কে ডাইরেক্টরেটে উন্নীত করা হলেও বাজেট বরাদ্দ বাড়ানো প্রয়োজন। কারখানা কর্তৃপক্ষের বিকেন্দ্রায়ণের উদ্যোগ হিসেবে ঢাকা, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জে অফিস খোলার মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের কার্যকর বাস্তবায়ন দরকার। একই সঙ্গে পর্যাপ্ত লোকবল নিয়োগ প্রয়োজন। জেলা পর্যায়ে কার্যক্রম সম্প্রসারণের প্রকল্প হাতে নেওয়া দরকার। কারখানা পরিদর্শন কর্তৃপক্ষের দুর্ঘটনাস্থলে যানবাহনের ব্যবস্থা থাকা, কর্মস্থল আধুনিকায়ন, টিএ-ডিএ বাড়ানো, উন্নত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, কম্পিউটার বেইজড তথ্য সংরক্ষণব্যবস্থা তৈরি, জনবল বৃদ্ধি। সব কারখানার পরিদর্শন ডেটাবেইস তৈরি। কারখানা পরিদর্শন আইন যুগোপযোগী করা। কর্তৃপক্ষের আইনি ক্ষমতা বাড়ানো। এ ক্ষেত্রে অন্যান্য দেশের অগ্নিনির্বাপণসংক্রান্ত গাইডলাইন দেখা যেতে পারে। শ্রম মন্ত্রণালয়ের বাজেট বাড়ানো দরকার। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে শ্রম মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ বৃদ্ধি করে কারখানা পরিদর্শনে পরিদর্শক বৃদ্ধি, কারখানা পরিদর্শন কার্যক্রম বাড়ানো, শ্রমকল্যাণ কেন্দ্র সংস্কার, নতুন কেন্দ্র স্থাপন ইত্যাদি পদক্ষেপ বাস্তবায়ন প্রয়োজন। বরাদ্দ অনুমোদনহীন প্রকল্প বছরের পর বছর না ঝুলিয়ে বরাদ্দ দিয়ে তা নির্দিষ্ট সময়ে বাস্তবায়ন করা। সম্মিলিত কমপ্লায়েন্সের কাঠামোগত রূপরেখা তৈরি করা দরকার। শ্রম মন্ত্রণালয়, বিশেষত কারখানা পরিদর্শন কর্তৃপক্ষের স্বাধীন কর্তৃপক্ষ হিসেবে কাজ করার সক্ষমতা অর্জন করা দরকার।
অগ্নিনির্বাপণ কর্তৃপক্ষের জনবল ও অর্থবল বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। নিয়মিত কারখানা পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি আকস্মিক পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা থাকা উচিত। অগ্নিনির্বাপণ কর্তৃপক্ষের ভূমিকা বৃদ্ধিকল্পে প্রয়োজনবোধে আইন সংস্কার করা যেতে পারে। সব পোশাক কারখানার অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থার তথ্য প্রকাশ করা উচিত।
ক্রেতা: ক্রেতাদের কোড অব কনডাক্টে প্রয়োজনীয় পরিমার্জন ও সংস্কার দরকার। ক্রেতাদের সরাসরি বা তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে কারখানার কমপ্লায়েন্স উন্নীত করতে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করা দরকার। এ ক্ষেত্রে সরকারি আইনকানুন মানার বিষয়টিও বিশেষ নজরে রাখা জরুরি। ক্রেতাদের উচিত হবে ত্রুটিপূর্ণ কমপ্লায়েন্স অডিট-প্রক্রিয়ায় জড়িত প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম মূল্যায়ন করা। তৃতীয়পক্ষীয় কমপ্লায়েন্স অডিট হলে তাদের দুর্বলতা থাকলে ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
অ্যাকর্ড এবং অ্যালায়েন্সের মাধ্যমে গৃহীত উদ্যোগে কারখানার দুর্বল কাঠামোগত, অগ্নিনির্বাপকব্যবস্থাগত ত্রুটি নিরূপণ এবং তা সংশোধনের কার্যক্রম যথাসময়ে শেষ করা প্রয়োজন। তবে এসব কার্যক্রম সময়সাপেক্ষ এবং এর জন্য পর্যাপ্ত সময় ও অর্থ ব্যবহারের প্রয়োজন। এসব কার্যক্রম বাস্তবায়নে ক্রেতা সংগঠন, সরকার এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কার্যক্রমে সমন্বয় সাধন করা জরুরি এবং প্রয়োজনীয় আর্থিক সহায়তার ব্যবস্থা করার জন্য এগিয়ে আসতে হবে।
টীকা
১. EUEBA: European Union Everything But Arms উদ্যোগ, যা স্বল্পোন্নত দেশের পণ্যকে শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা দেওয়ার জন্য প্রবর্তিত হয় ২০০৩ সালে।
তথ্যসূত্র
Bair, J. 2009. ‘Global Commodity Chains: Genealogy and Review.’pp. 1-34 in Jennifer Bair (ed.), Frontiers of Commodity Chain Research. Stanford, CA: Stanford University Press.
Barrientos, S. C. Dolan and A. Tallontire. 2003. ‘A Gendered Value Chain Approach to Codes of Conduct in African Horticulture.’ World Development. 31(9):1511-1526.
Bhattacharya, D and K.G. Moazzem. 2012. ‘Least Developed Countries (LDCs) in the Global Value Chain (GVC): Trends, Determinants and Challenges.’ CPD Working Paper 104. Dhaka: Centre for Policy Dialogue (CPD).
Cumbers, A., C. Nativel and P. Routledge. 2008. ‘Labour Agency and Union Positionalities in Global Production Networks.’ Journal of Economic Geography 8 (3): 369–87.
Gereffi, G. 2005. ‘The Global Economy: Organization, Governance and Development.’ pp. 160-182 in Neil J. Smelser and Richard Swedberg (eds.), Handbook of Economic Sociology, 2nd ed. Princeton, NJ: Princeton University Press and Russell Sage Foundation.
Gereffi, G. and R. Kaplinsky (eds.). 2001. ‘The Value of Value Chains: Spreading the Gains from Globalisation.’ Special issue of the IDS Bulletin 32 (3), July.
Moazzem, K.G. and F. Sehrin, (Mimeo). ‘An Exploratory Study on Technological Upgradation in Bangladesh’s Apparels Sector in the Dynamics and Changes of Global and Regional Value Chains.’ Report submitted to India Council for Research on International Economic Relations (ICRIER), New Delhi.
Moazzem, K.G. and F. Sehrin. 2013b. ‘পোশাক শিল্প শ্রমিকের কর্মকালীন নিরাপত্তা ঝুঁকি: কারণ ও করণীয়.’ Paper presented at a CPD dialogue on ‘পোশাকশিল্প শ্রমিকের কর্মকালীন নিরাপত্তা ঝুঁকি: কারণ ও করণীয়.’ 26 January, Dhaka, Bangladesh.
Moazzem, K.G . and R. Saifa. 2013. ‘Revision of the Minimum Wage in the RMG Sector in 2013: Proposals as regards Definition, Method of Determination and Levels.’ Paper presented at a CPD dialogue on ‘Revision of the Minimum Wage in the RMG Sector in 2013 Proposals as regards Definition, Method of Determination and Levels.’ 24 September, Dhaka, Bangladesh.
Milberg, W. and D. Winkler. 2008. ‘Measuring Economic and Social Upgrading in Global Production Networks.’ Concept note prepared for the workshop ‘Capturing the Gains: Economics and Social Upgrading in Global Production Networks.’ December 8-12, 2008. Manchester, UK.
Rahman, M., D. Bhattacharya and K.G. Moazzem. 2008. Bangladesh’s Apparels Sector in Post-MFA Period. Dhaka: Centre for Policy Dialogue (CPD).
Sen, A. 1999. Development as Freedom. Oxford: Oxford University Press.
Sen, A. 2000. ‘Work and Rights.’ International Labour Review 139 (2):119-128.