[আবদুল আহাদ (১৯০৮-১৯৯৪) রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী, সুরকার, সংগীত পরিচালক। রাজশাহী শহরে জন্ম হলেও তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা উপজেলার ফুকুরহাটি গ্রামে। পিতা আবদুস সামাদ খান ও মাতার নাম রহমতুন্নেসা। পিতা ও মাতামহ খানবাহাদুর মোহাম্মদ সোলায়মান দুজনেই তত্কালীন শিক্ষা বিভাগে চাকরি করতেন। আবদুল আহাদ শৈশব থেকেই সংগীতের প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। ১৯৩৪ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করার পর কলকাতা সিটি কলেজে অধ্যয়নকালে ওস্তাদ বালি ও ওস্তাদ মঞ্জু সাহেবের নিকট তিনি উচ্চাঙ্গসংগীতে তালিম নেন। সে সময় তিনি কলকাতা বেতারে সংগীত পরিবেশনের জন্য মনোনীত হন এবং বাংলা ঠুমরি পরিবেশন করেন। ১৯৩৬ সালে অল বেঙ্গল মিউজিক কম্পিটিশনে ঠুমরি ও গজল প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করে সংগীতজগতে তাঁর আসন সুদৃঢ় করেন। ১৯৩৮ সালে সরকারি বৃত্তি নিয়ে তিনি রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনে ভর্তি হন। তখনকার দিনে তাঁর এ ভূমিকা ছিল অত্যন্ত সাহসদীপ্ত, কারণ তখন এ দেশের মুসলিম সমাজে সংগীতের তেমন প্রচলন ছিল না। শান্তিনিকেতনে অবস্থানকালে তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্নেহাশীষ লাভে ধন্য হয়েছিলেন। শান্তিনিকেতনে চার বছর অধ্যয়ন শেষে ১৯৪১ সালে তিনি কলকাতার এইচএমভি (হিজ মাস্টার্স ভয়েস) কোম্পানিতে সংগীত প্রশিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। তাঁর পরিচালনায় পঙ্কজকুমার মল্লিক এবং হেমন্তকুমার মুখোপাধ্যায়ের মতো প্রখ্যাত শিল্পীরা রবীন্দ্রসংগীত রেকর্ড করেছেন। আবদুল আহাদের একটি বড় কীর্তি এ দেশে আধুনিক গান ও দেশাত্মবোধক গানের গোড়াপত্তন করা। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর আবদুল আহাদ ঢাকায় চলে অসেন এবং পরের বছর ঢাকা বেতারকেন্দ্রে সুরকার ও প্রযোজক হিসেবে যোগদান করেন। সুরকার, প্রশিক্ষক ও সংগঠক হিসেবে ঢাকার সংগীতজগতে আবদুল আহাদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। দেশভাগের ফলে ঢাকার সংগীতজগতে শিল্পীর যে শূন্যতা দেখা দেয়, আবদুল আহাদ নতুন নতুন শিল্পী সৃষ্টির মাধ্যমে সে শূন্যতা পূরণের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। তিনি প্রায় দুই যুগ বেতারের ‘সংগীত শিক্ষার আসর’ পরিচালনা করেন এবং এর মাধ্যমে বেতারের সংগীতজগেক সংগঠিত ও সমৃদ্ধ করেন। আবদুল আহাদ সুরকার হিসেবেও বিশেষ প্রসিদ্ধি অর্জন করেন। বাংলাদেশ টেলিভিশনের সংগীতানুষ্ঠানে সুরকার হিসেবে তিনি নিয়মিত অংশগ্রহণ করতেন। উর্দু গজল ও গীত এবং বাংলাসহ এক হাজারের বেশি গানে তিনি সুরারোপ করেন। সংগীতে অবদানের জন্য তিনি একাধিকবার রাষ্ট্রীয় সম্মানে ভূষিত হন। পাকিস্তান সরকার তাঁকে ১৯৬২ সালে তমঘা-ই-ইমতিয়াজ, ১৯৬৯ সালে সিতারা-ই-ইমতিয়াজ এবং বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৮ সালে স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার প্রদান করে। অকৃতদার আবদুল আহাদ রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী হিসেবেই সমধিক পরিচিত ছিলেন। বাংলাদেশের জাতীয় জাদুঘরের কথ্য ইতিহাস প্রকল্পের আওতায় সাক্ষাত্কারটি গ্রহণ করেছিলেন প্রয়াত ইতিহাসবিদ ও জাতীয় অধ্যাপক সালাউদ্দিন আহমেদ এবং জাতীয় অধ্যাপক মুস্তফা নূরউল ইসলাম। গৃহীত সাক্ষাত্কারের ভিত্তিতে বর্ণনা আকারে এ রচনাটি ছাপা হলো।]
আমার জন্ম ১৯০৮ সালে রাজশাহীতে। অবশ্য আমাদের পৈতৃক ভিটা তখনকার বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা থানার ফুকুলহাটি গ্রামে। আমার বাবা শিক্ষা বিভাগে চাকরি করতেন। সাব-ইন্সপেক্টর অব স্কুল ছিলেন। পরে অবশ্য তিনি আরও ওপরে উঠেছিলেন। আমার নানা ওই শিক্ষা বিভাগেই আরও একটু উঁচু পদে চাকরি করতেন। তিনি ডিভিশনাল ইন্সপেক্টর অব স্কুল ছিলেন।
আমার শৈশবকাল কোথায় কেটেছে, সে কথা অবশ্য খুব ভালো মনে নেই। থাকারও কথা নয়। সম্ভবত রাজশাহীতেই। কারণ, ওখানেই আমি জন্মগ্রহণ করেছিলাম। তারপর আমার শৈশব-কৈশোর এবং যৌবনের কিছুটা সময় কেটেছে পাবনাতে।
আমি যে পারিবারিক পরিবেশে বেড়ে উঠেছি, সেই পরিবেশটা তখনকার অন্যান্য মুসলিম পরিবার থেকে একটু ভিন্ন ধরনের ছিল। কারণ, আমার একমাত্র আপন মামা গান-বাজনা করতেন। আমার নানার বাড়িতে একটা অর্গান ছিল। সেটা আমার মামারই। তবে নানা খুব পরহেজগার মানুষ ছিলেন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন। বাড়িতে তিনি প্রায়ই মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করতেন। গান-বাজনা করার আবহের পাশাপাশি ধর্মীয় যে পরিবেশ, সেটাও সেখানে ছিল।
আমার খালা কবি মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা১। তাঁকেও আমি দেখেছি। তার পাশেই ছোটবেলায় আমি ঘুমাতাম। আমার পাশ থেকেই নামাজ পড়তে উঠে যেতেন তিনি। ভোরে কি আসরের সময়। কাজেই ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক—এই দুটো দিকেরই চর্চা আমাদের বাড়িতে পাশাপাশি ভারসাম্য রক্ষা করে চলত।
আমি আগেই বোধ হয় উল্লেখ করেছি যে লেখাপড়ার দিক দিয়ে সেকালে আমাদের পরিবার বেশ এগিয়ে ছিল। আমার নানা যে ডিভিশনাল ইন্সপেক্টর অব স্কুল ছিলেন, তাঁকে ওই পর্যায়ে যেতে নিশ্চয়ই লেখাপড়া করতে হয়েছিল। আব্বা ছিলেন প্রথমে সাব-ইন্সপেক্টর অব স্কুল। পরে তাঁর পদোন্নতি হয়। কাজেই তিনিও ভালোই শিক্ষিত ছিলেন। কারণ, উচ্চপদে সরকারি চাকরি গ্র্যাজুয়েট না হলে পাওয়া যেত না।
ধর্মীয় শিক্ষা বলতে যা বোঝায়, সেটা আমি বা আমাদের পরিবারের কেউ মক্তব বা মাদ্রাসা থেকে পাইনি। অর্থাত্ মক্তব ও মাদ্রাসায় লেখাপড়া করিনি। তবে মৌলভি সাহেব ছিলেন, তিনি এসে আমাদের আরবি পড়া শেখাতেন।
আসলে আমি আমার শিক্ষাজীবন শুরু করি পাবনা থেকেই। কেননা, বাবার চাকরিসূত্রে জলপাইগুড়িতে যখন ছিলাম, তখন আমি একেবারেই ছেলেমানুষ। তারপরেই পাবনাতে চলে যাই আমি। ওখানেই আমার স্কুলজীবনের শুরু। ওখানে কলেজেও পড়েছিলাম কিছুদিন। মাঝে কিছুদিন আমি কলকাতায় কলেজে পড়েছিলাম। আমি আর্টস তথা মানবিক বিভাগের ছাত্র ছিলাম।
আমি গান-বাজনায় আকৃষ্ট হয়েছিলাম প্রধানত আমার মামার কারণেই। মামার প্রভাবেই আমি সংগীতের জগতে বিচরণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। আগেই বলেছি, মামা নানার একমাত্র ছেলে ছিলেন। বাড়িতে ব্যবহার করার জন্য তিনি একটা অর্গান কিনেছিলেন। অর্গান বাজিয়ে তিনি ভালোই গান করতেন। পাশাপাশি আমার নানার বাড়িতে প্রচুর গ্রামোফোন রেকর্ড ছিল। দিনরাত আমরা সেগুলো বাজিয়ে শুনতাম। রেকর্ডগুলো ছিল তখনকার দিনের বিখ্যাত গায়িকা আঙ্গুরবালা ও ইন্দুবালাসহ আরও সব বিখ্যাত গায়ক-গায়িকার। বেশির ভাগই কাজী নজরুল ইসলামের২। প্রথম গান শুনি আমি পাশের একটা হিন্দুবাড়িতে, একটা গজল গান—‘বাগিচায় বুলবুলি তুই’। কে. মল্লিকের গাওয়া নজরুলেরই গান। শুনে সে যে কী ভালো লেগেছিল আমার! আজও সে কথা আমি ভুলতে পারিনি।
তবে আনুষ্ঠানিক চর্চার কথা যদি বলা হয়, তা হলে বলতে হবে, আমার বাবার ইচ্ছা ছিল না যে আমি গান-বাজনা করি। তবে মা আমাকে কোনো দিনই বাধা দেননি।
আমি যখন দশম শ্রেণিতে পড়ি, তখন পাবনা শহরে একজন গানের শিক্ষক ছিলেন। আমি তাঁর বাসায় যেতাম। গিয়ে তাঁর কাছ থেকে কিছুটা গান শেখার চেষ্টা করতাম। তবে আমার বেশির ভাগ গান শেখা গ্রামোফোন রেকর্ড শুনে শুনে। বাড়িতে রেকর্ডের বিশাল সংগ্রহ ছিল। সেগুলো অবসর পেলেই বাজাতাম আর শুনতাম। একই বাড়িতে আমার মামাও সমানতালে গান-বাজনা করতেন।
তখনকার দিনে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা অত্যন্ত কম ছিল। দু-একটা পরিবার হয়তো শহরে থাকে। তাদের বাড়িতে গান-বাজনা হচ্ছে—সমাজনেতা বা ধর্মীয় নেতারা এসব কিছুর ব্যাপারে তেমন জোরালোভাবে না হলেও একটুআধটু আপত্তি তো তুলেই ছিলেন। আসলে আমার নানা এতটাই পরহেজগার আর মুসল্লি মানুষ ছিলেন যে, তাঁর জন্য তাঁরা মাথা তুলতে সাহস করেননি। তখন পর্যন্ত সংগীতচর্চার ব্যাপারটা মুসলমানরা সামাজিকভাবে গ্রহণ করেনি। গ্রহণ করার প্রশ্নই আসে না। এ ব্যাপারে পথিকৃত্ ছিলেন আব্বাস ভাই মানে আব্বাসউদ্দীন আহমদ। তিনিই প্রথম মুসলমান যিনি গান করলেন, রেকর্ড করলেন, বৃহত্তর বাংলার বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে গিয়ে তিনি মুসলমান সমাজে গান করলেন।
আগেই বলেছি যথার্থ অর্থে ওস্তাদ রেখে আমার গানের শিক্ষা হয়নি, রেকর্ড শুনে শুনেই সবকিছু শিখেছি। মামা গান করতেন। তাঁর গান শুনে শুনে আমার গানের তালিম পাওয়া। পাবনা শহরে দু-একটা অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। দু-একটা গানও সেসবখানে গেয়েছিলাম। সময়টা ১৯৩৩ সাল। তবে কী গান গেয়েছিলাম সে কথা এখন আর মনে নেই।
বিশের দশকের শেষ দিক থেকে তিরিশের দশকের কয়েকজনের কথা বলা হয়েছে। এঁদের মধ্যে আছেন আব্বাসউদ্দীন আহমদ৩, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, কবি গোলাম মোস্তফা৪, ওস্তাদ খসরু, জসীমউদ্দীন৫। এঁদের প্রত্যেকের সঙ্গেই আমার একটু-আধটু জানাশোনা ছিল।
নজরুলকে দিয়েই প্রসঙ্গটা শুরু করি। আমি তখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি। আমার খালা মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকাও কবি। নজরুল ইসলাম তখন, যে জায়গাটাকে সিমলা বলা হয়, সেখানকার বিবেকানন্দ রোডের একটা বাড়িতে থাকতেন। মনে আছে একটা ঘোড়ার গাড়িতে করে সন্ধ্যার দিকে তাঁর ওখানে গিয়েছিলাম। একটা রেকাবিতে করে আমাদের কিছু রসগোল্লা আর সন্দেশ খেতে দেওয়া হয়েছিল। এই প্রথম কাজী নজরুল ইসলামকে দেখলাম। বহুদিনের কথা। খালাই দেখা করতে গিয়েছিলেন আমাকে সঙ্গে করে। আমি তখন সপ্তম শ্রেণির ছাত্র।
নজরুলকে পরে গ্রামোফোন কোম্পানিতে দেখেছি। কলেজে পড়ার সময়ে আর দেখা হয়নি। পরে যখন গানের লাইনে এলাম, তখন তাঁকে আমি আর পাইনি।
কবি গোলাম মোস্তফার সঙ্গেও আমার যথেষ্ট পরিচয় ছিল। খালার সূত্রেই পরিচয়টা হয়েছিল। তবে আমি তাঁর কাছে খুব বেশি একটা যেতাম না।
এঁদের মধ্যে আমি আব্বাস ভাইয়ের সঙ্গে খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলাম। জসীমউদ্দীন সাহেবের সঙ্গে কিছুটা ঘনিষ্ঠ ছিলাম। মনে আছে তাঁর কাছ থেকে আমি একটা গানও শিখেছিলাম। ‘চলরে ঘাটে কদমতলে’। এই ভাঙা গলায় গাইতেন আর কী! কোনো বাদ্যযন্ত্রও বাজাতেন না। খালি গলায় গান গাইতেন। বরং বলা চলে, এদের মধ্যে ওস্তাদ খসরুর সঙ্গে আমার জানাশোনাটা খুবই ভালো রকমের ছিল। কিন্তু তাঁর ওখানে আমি তেমন একটা যেতাম না।
আব্বাস ভাই সম্পর্কেই বরং আরেকটু কথা বলি। আমি তখন হোস্টেলে থাকি। কলকাতায় কারমাইকেল হোস্টেলে। পড়ি সিটি কলেজে। আব্বাস ভাই থাকতেন বৌবাজারে ওসমানের মেস বলে একটা মেস ছিল, সেখানে। ওটার চারতলায় ওসমানের মেসে মুসলমান কেরানিদের বসবাস ছিল। বলতে গেলে ওটা ছিল বিশেষ করে তাদেরই মেস। বলেছি, আমি তখন কলেজে পড়ি। আর আব্বাস ভাই তখন ওই রাইটার্স বিল্ডিংয়ে৬ কেরানির চাকরি করতেন। চাকরির পাশাপাশি চলছিল সমানতালে তাঁর গান গাওয়ার ব্যাপারস্যাপার।
বিকেল হলে রোজই আমি আব্বাস ভাইয়ের কাছে সেই মেসের কামরায় চলে যেতাম। নানা রকম গল্প-গুজব হতো তাঁর সঙ্গে। কখনো কখনো তিনি আমাকে লক্ষ করে বলতেন, ‘চলো, আজকে আমার একটা গানের অনুষ্ঠান আছে।’ আমি তাঁর সঙ্গে সেসব অনুষ্ঠানে যেতাম। এভাবেই তখন আমাদের দিন কেটেছে। এ রকম অবস্থায় একদিন আমি আব্বাস ভাইকে বললাম যে, আমি আপনার মতো গান রেকর্ড করতে চাই।
আব্বাস ভাই আমাকে গ্রামোফোন কোম্পানিতে নিয়ে গেলেন। নিয়ে গেলেন কমলদাশ গুপ্তের৭ ভাই সুবলদাশ গুপ্তের কাছে। তিনিও তখন গ্রামোফোন কোম্পানির প্রশিক্ষক।
তো আমার খুব পছন্দ হলো না। আমি চেয়েছিলাম আরও বড় কারও কাছে যেতে। সেই থেকে আমি আর গ্রামোফোন কোম্পানিতে যাইনি। পরে অবশ্য আমি নিজের উদ্যোগে গিয়েছি। একটু ঘুরতি পথে। এসবই সেই তিরিশের দশকের কথা।
বাঙালি মুসলমানের সংগীতচর্চা সম্পর্কে বলতে গেলে বলতে হয়, একদিকে আমরা যেমন বাধা পেয়েছি নিজের সম্প্রদায় অর্থাত্ মুসলমান সম্প্রদায়ের কাছ থেকে। অন্যদিকে কলকাতায় আসার পর আরও ভালোভাবে গান শেখার চেষ্টা করতে গিয়ে, রেকর্ড করার চেষ্টা করতে গিয়েও নানা ধরনের বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে। একটা ভীষণ বিপদসংকুল পথ আমাদের অতিক্রম করতে হয়েছিল তখন।
তবে এসব বাধা-বিপত্তি অতিক্রমে আব্বাস ভাইকে আমি পাইওনিয়ার বা পথপ্রদর্শক বলব। তিনি গান করলেও তাঁর আধুনিক গান কিন্তু মুসলমান সমাজ গ্রহণ করেনি। কিন্তু যখন তিনি ইসলামি গান গাইতে শুরু করলেন, তখন সাংঘাতিকভাবে মুসলমান সমাজ তাঁকে গ্রহণ করে বসল। পথ তো তিনিই দেখিয়ে দিয়েছিলেন আমাদের। কাজেই খুব অসুবিধা তখন হয়নি। অবশ্য আফসারী খানমের বড় বোনকে অন্য নামে রেকর্ড করতে হয়েছিল। রেকর্ডে লেখা হয়েছিল বেবী নাম। বেবীও তখন তার গানের একটা রেকর্ড বের করেছিল।
কেন মুসলমান গায়ক-গায়িকাদের একটু ভিন্ন নাম গ্রহণ করতে হতো, সে সম্পর্কে বলতেগেলে বলতে হয়, মুসলমান সমাজ তো তখনো জাগেনি। মধ্যবিত্ত মুসলমান সমাজ তখন সবে দানা বাঁধছে। তখন পর্যন্ত তাদের গান-বাজনা বা সাংস্কৃতিক দিকে নজর দেওয়ার ফুরসত ছিল না। কাজেই রেকর্ড যাঁরা কিনতেন তাঁরা হচ্ছেন হিন্দু সম্প্রদায়। তখন যুগটা তো অন্য রকম ছিল।
সেই অন্য রকম যুগের কথা বলতে গেলে বলতে হবে, মুসলমানদের সম্পর্কে তখন রেকর্ড কোম্পানির মধ্যে এ রকমের একটা ভয় ছিল যে, মুসলমানি নাম দিলে হয়তো রেকর্ড বিক্রি হবে না। কাজেই গায়কের আসল নামটা গোপন করে যাও। কে. মল্লিকের কথা দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরা যেতে পারে। তিনি হিন্দুও হতে পারেন, মুসলমানও হতে পারেন। তার মানে হিন্দুর গান, মুসলমানের গান—এই রকমের একটা বিভাজন ছিল কি না, এ কথা বলা যাবে না। আসলে মুসলমানের গাওয়া গান হিন্দুরা কিনবে কি না, ব্যবসা চলবে কি না, এ ব্যাপারে রেকর্ড কোম্পানিগুলোর মধ্যে সন্দেহ ছিল। তবে এ ধরনের সন্দেহের কোনো ভিত্তি ছিল কি না, আমি বলতে পারব না। হিন্দু সমাজও তখন আজকের মতো এতটা সংস্কারমুক্ত ছিল না। তারা সংস্কারমুক্ত হয়েছে ধীরে ধীরে।
মনে পড়েছে বেবীর আসল নাম ছিল আশরাফী খানম৮, আফসারী খানমের বড় বোন। প্রথম মুসলমান মেয়ে হিসেবে প্রথম গানের রেকর্ড করেছিলেন তিনি। একটা রেকর্ডই বেরিয়েছিল তাঁর। আর ওটাই ছিল শেষ। তিনি এখনো বেঁচে আছেন। সুস্থ আছেন। যে সময়ের কথা বলছি, যতদূর জানি, প্রশিক্ষক হিসেবে ইংরেজের বেনিয়া কোম্পানি জমিরউদ্দিনকে প্রশিক্ষক হিসেবে নিয়েছিল। তিনি ওই সময় যেসব উর্দু গান ও হিন্দি গান হতো, সেগুলোর প্রশিক্ষক ছিলেন। বাংলা গানের প্রশিক্ষক হিসেবে তখন মুসলমান কেউ ছিলেন না। নজরুল ইসলামকে অবশ্য আমি প্রশিক্ষক বলব না।
এমনকি নজরুল ইসলামের গানের রেকর্ডেও তখন তাঁর নাম থাকত না। গানের কথাও যে নজরুল ইসলামের, তাও থাকত না। তাঁর কোনো নামই যেত না। অবশ্য একটা চলচ্চিত্রে সুরকার হিসেবে নজরুল ইসলামের নাম দেখেছিলাম। চলচ্চিত্রটার নাম চৌরঙ্গী। ধ্রুব ছবিতে নজরুল অভিনয় করেছিলেন। টাইটেলে তাঁর নাম ছিল কি না, মনে করতে পারছি না। কেননা, আমি তখন বয়সে বেশ ছোট। একেবারে ছেলেবেলার কথা। আমি আগেই বলেছি আমাদের পরিবারে সংগীত চর্চা হতো। তবে আমি রবীন্দ্রসংগীত চর্চায় কীভাবে এলাম, সে কথা যদি বলেন, তাহলে আরও দুটো কথা বলতে হবে। তখন উচ্চমাধ্যমিক তথা ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা শেষ হয়েছে। বিএতে ভর্তি হব হব করছি। বাড়ির সবাই তখন ওয়ালটেয়ারে গিয়েছি বেড়াতে। হঠাত্ কাগজে দেখলাম শান্তিনিকেতন থেকে স্কলারশিপ দেওয়া হচ্ছে। তো আমি সাত-পাঁচ না ভেবেই একটা দরখাস্ত করে বসলাম।
দিন কয়েকের মধ্যেই দরখাস্তের উত্তরও এসে যায়। আমাকে বলা হয়েছে, তুমি ছাত্র হিসেবে চলে এসো। কারণ, বৃত্তি পাওয়া দরকার। আমি আর অপেক্ষা না করে চলে গেলাম। এর আগে যখন আমি কলেজে পড়তাম, তখন দুবারের মতো অল বেঙ্গল মিউজিক কম্পিটিশানে ঠুমরি এবং গজলে প্রথম হয়েছিলাম। একটা ছিল ভুবন ঘোষের অল বেঙ্গল মিউজিক কম্পিটিশন। খুবই জাঁকজমকের সঙ্গে অনুষ্ঠিত হতো। আর একটা ছিল নাহার ফ্যামেলির উদ্যোগে। দুটোতেই আমি যোগ দিয়েছিলাম। ও হ্যাঁ, ভজনে বোধ হয় আমি দ্বিতীয় হয়েছিলাম।
এভাবে শান্তিনিকেতনে আমি স্রেফ কৌতূহলবশত দরখাস্ত করেছিলাম। ওই কাগজ-টাগজ দেখে। অবশ্য অন্যভাবে বলতে গেলে বলতে হয়, আমার গান শেখার কোনো পেশাদার প্রশিক্ষক ছিলেন না।
কলকাতায় যখন পড়তাম, যাঁর কাছে আমি গান শিখতাম, তাঁর নাম ছিল মঞ্জু সাহেব। তিনি ধ্রুপদাঙ্গের গান করতেন। ঠুমরিটা খুবই ভালো গাইতেন। তিনি ছিলেন মুর্শিদাবাদের নবাব পরিবারের উত্তর-প্রজন্মের সদস্য। খুবই গরিব ছিলেন। আমি তখন কারমাইকেলে হোস্টেলে থাকি। আমাকে তখন একজন বললেন, অল্প টাকায় একজন আছেন। পানবাগান লেনে থাকেন। চলো তোমাকে তাঁর কাছে নিয়ে যাই। এভাবেই আমি ওস্তাদ মঞ্জুর সঙ্গে পরিচিত হই এবং তাঁর কাছেই গান শিখি। তিনিই ছিলেন আমার গানের প্রথম আনুষ্ঠানিক ওস্তাদ। অবশ্য তার আগে আমি তো গান বেশ ভালোই শিখে ফেলেছিলাম। বলতে গেলে একেবারে নিজের চেষ্টাতেই।
রবীন্দ্রসংগীতের দিকে যাওয়া প্রসঙ্গে বলতে গেলে বলতে হয়, ওয়ালটেয়ার থেকে দরখাস্ত করার আগে রবীন্দ্রসংগীতই যে শিখব, এ ধরনের কোনো ইচ্ছে আমার ছিল না। মোটেই ছিল না। কারণ, আমি তো তখন ঠুমরি গাইতাম। ঠুমরি গেয়ে আমি প্রথম হয়েছি। অতএব আকর্ষণটা আমার ক্লাসিক্যাল সংগীতের ব্যাপারেই ছিল বেশি। আগেই বলেছি, আসলে শান্তিনিকেতনের৯ রবীন্দ্রসংগীত শেখার ব্যাপারে দরখাস্ত করেছিলাম একেবারেই ঝোঁকের বশে।
আমার নাম না শুনলেও ভর্তি করার আগে তারা আমার উপযুক্ততা বিচার করল ওই যে আমি দরখাস্তে উল্লেখ করেছিলাম যে আমি ঠুমরি গানের প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছিলাম, সেই কথাটা। ওখানে আমি মোট চার বছর ছিলাম। মানে রবীন্দ্রনাথের জীবনের শেষ চার বছর।
আসলে শান্তিনিকেতনে যে পরিবেশে গিয়ে পড়েছিলাম, সেটা দেখে আমি খুবই অবিভূত হয়ে পড়েছিলাম। আজকের শান্তিনিকেতন আর সেই শান্তিনিকেতন নেই। সেই শান্তিনিকেতন এখন অনেক দালান-কোঠা-বাড়ির ভিড়ে রীতিমতো হারিয়ে গেছে। তার শান্ত পরিবেশ আমরা মনের মধ্যে এখনো দাগ কেটে রয়েছে। এবং শিক্ষক ছাত্র সবকিছু মিলিয়ে মনে হতো আমরা যেন একটা একান্নবর্তী পরিবার। এখন আর ও ব্যাপারটা আশাও করা যায় না।
শিক্ষকদের মধ্যে এখনো বহাল তবিয়তে আছেন শৈলজানন্দ মজুমদার আর শান্তিদেব ঘোষ। আমাদের আসল গুরু ছিলেন শৈলজা বাবুই। তখন তিনি ছিলেন রসায়নশাস্ত্রের অধ্যাপক। সংগীত ভবনের সঙ্গে তখনো তিনি যুক্ত হননি। তবে তাঁর কাছে গিয়ে আমি গান শিখতাম। কারণ, কণিকাকে, তিনি তাঁর নিজের হাতে গড়েছেন বলে তাঁর প্রতি আমার একটা দুর্বলতা ছিল।
আমার সঙ্গে গান শিখত একটা মুসলমান ছেলে। তার নাম কালু। অন্ধ সে। ওখানকারই। মারাও গেছে। আর শিখত রাজেশ্বরী দত্ত, পরবর্তীকালে অনেক নাম করেছিল সে। তার নাম তখন ছিল রাজেশ্বরী বাসুদেব। পরবর্তীকালে সে ‘পরিচয়’ সম্পাদক কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্তের১০ স্ত্রী হয়ে হয় রাজেশ্বরী দত্ত। আমাদের দুজনের মধ্যে খুবই বন্ধুত্ব ছিল। আমরা নিজেদের মধ্যে তুই-তোকারি সম্বোধন করতাম। সেও মারা গেছে। তবে পাঞ্জাবি মেয়ে হয়ে সে রবীন্দ্রসংগীত শিখল কী করে, সে সম্পর্কে আমি ঠিক করে কিছু বলতে পারব না। আর ছিল খুবই নামকরা একজন। তবে নাচে। সে দক্ষিণ ভারতীয়। নাম সুনালিনী স্বামীনাথম। তার মা তখনকার দিনে সংসদ সদস্যা ছিলেন। আর কণিকা তখন স্কুলে দশম শ্রেণিতে পড়ত। আমি শান্তিনিকেতনে থাকতে থাকতেই সে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়েছিল। রাজেশ্বরী ছিল আমার ক্লাসফ্রেন্ড।
শান্তিনিকেতনে ছেলে বা মেয়ে, হিন্দু বা মুসলমানে কোনো রকম বিভাজন ছিল না। এ রকমের কোনো কিছু অন্তত আমি অনুভব করিনি। অবশ্য কারও মনে কিছু থাকলে, থাকতেও পারে। টের পাওয়া মুশকিল ছিল।
বিএ-এমএ না পড়ে গান শিখতে গেলাম, এটা আমার বাবা-মা কি দৃষ্টিতে দেখেছিলেন, সে সম্পর্কে বলতে গেলে বলতে হয়, বাবা তো চানইনি যে আমি গান-বাজনা শিখি। তাঁদের কাছে এটাই স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল। কেননা, আমি ছিলাম মা-বাবার জ্যেষ্ঠ সন্তান। তাদের স্বাভাবিক প্রত্যাশা ছিল আমি আরও লেখাপড়া করে সরকারি চাকরি করব। আমার গানের জগতে থাকাটা মায়ের জন্যই সম্ভব হয়েছিল। মা যখন দেখলেন যে, এদিকেই আমার ঝোঁক বেশি, তিনি আর বাধা দেননি। বরং তিনি শান্তিনিকেতনে গান শেখার ব্যাপারে আমাকে অনেকখানি সাহায্য করেছিলেন।
কণ্ঠশিল্পী বা শিক্ষক হিসেবে আমার নাম ছড়িয়েছিল চল্লিশের দশকে নয়, তার কিছুটা আগেভাগেই। কলকাতায় গিয়ে ওই যে আমি প্রতিযোগিতাগুলোতে ঠুমরি ও গজল ইত্যাদি গেয়ে প্রথম হয়েছিলাম, তখন থেকেই মুসলমান সমাজে আমার নাম কিছুটা ছড়িয়ে পড়েছিল। ‘মোহাম্মদী’তে১১ আমার ছবিসহ একটা ফিচার বের হয়েছিল। দৈনিক ‘আজাদ’১২-এও ‘প্রথম মুসলমান ছেলে নিখিল ভারত সংগীত প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছে’— আমার সম্পর্কে এই রকমের প্রশংসা করে খবর প্রকাশ করা হয়েছিল। এসব কিছুই ঘটেছিল আমার শান্তিনিকেতনে যাওয়ার আগেই।
আর একটা কথা, ওই চল্লিশের দশকেই কিন্তু পাকিস্তান আন্দোলন বেশ জোরদার হয়ে ওঠে। পাকিস্তান আন্দোলন আর রবীন্দ্রসংগীত—এ দুটো ঠিক একসঙ্গে চলে না। আমি সে সময়কার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে দেখেছি, পাকিস্তান আন্দোলনের পটভূমিতে মুসলমানদের মধ্যে রবীন্দ্রসংগীতের চর্চার ব্যাপারটা অন্যদের মধ্যে প্রশ্ন তুললেও, আমি ছিলাম ঠিক এসব কিছুর একেবারেই বাইরে।
কলকাতায় থাকতে আমার খুবই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল ফতেহ লোহানী১৩, জয়নুল আবেদিন১৪ ও কামরুল হাসানের১৫ সঙ্গে।
আমি তখন পার্ক সার্কাসে থাকি। একটা মেসে। আমি আর সালেক, সম্পর্কে সে আমার জামাই হয় এবং বটু বলে একটা ছেলে মিলেমিশে সেই মেসে থাকতাম।
কাসেম সাহেবের পরিচয় দিতে গেলে বলতে হয়, ভারতভাগের পরিণামে বাংলাভাগ হলেও তিনি কলকাতাতেই থেকে যান। কমিউনিস্ট পার্টি করতেন এবং এখনো ওই আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত আছেন। সালেকের ডাকনাম ছিল গুনু। বটু নামে আর একটা ছেলে ছিল আগেই বলেছি। আমরা এই তিনজন একটা ঘর ভাড়া নিয়ে তাকে মেসে পরিণত করেছিলাম।
ওই মেসে তখন থাকতেন ফতেহ লোহানীর ভগ্নিপতি ডাক্তার খান সাহেব। উনি একদিন এসে আমাকে তাঁদের বাসায় যাওয়ার দাওয়াত দিলেন। যাওয়ার পর ওখানেই ফতেহ লোহানীর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। পরবর্তীকালে ফতেহ লোহানী অবশ্য আমাকে চুনীদা বলে ডাকত। এমন ঘনিষ্ঠ হয়েছিলাম যে একদম আত্মীয়ের মতো। ফতেহ লোহানীর সঙ্গে যখন আমার পরিচয় হয়, তখন সে আসলে কিছুই করত না। ফ্রিল্যান্স সাংবাদিকতা করত। পাশাপাশি ছবি-টবিতে ছোটখাটো ভূমিকায় অভিনয়ের সুযোগ পাওয়ার জন্য এদিক-সেদিক ঘুরঘুর করে বেড়াত। কখনো নাটক-টাটকও করত।
তখনো সে পুরোপুরি অভিনেতা হতে পারেনি। তারপর ওবায়েদ-উল হক সাহেব একটা ছবি তৈরি করলেন। নাম ‘দুঃখে যাদের জীবন গড়া’। ওতে অবশ্য সে একটা বড় রোল পেয়েছিল। ছবিটা মুক্তিও পেয়েছিল। ওটার সংগীত পরিচালক ছিলাম আমি। ওটাই বাঙালি মুসলমানের তৈরি প্রথম ছবি। কলকাতায় মহাদাঙ্গা হয় যে বছর অর্থাত্ ছিচল্লিশের কিছু আগে ছবিটার নির্মাণকাজ শেষ হয়েছিল। দাঙ্গার কারণে অবশ্য শুটিং করতে গিয়ে অসম্ভব অসুবিধায় পড়তে হয়েছিল। ছবিটা মুক্তি পেয়েছিল ওই দাঙ্গার পরপরই। শান্তিপূর্ণ সময়ে মুক্তি দিতে পারলে হয়তো আরও ভালো হতো।
বাংলাদেশে ছবিটার প্রিন্ট আছে কি না, সে কথা আমি ঠিক করে বলতে পারব না। ছবিটার টাইটেলে কারও আসল নাম ছিল না। একমাত্র আমি ছাড়া আর কারোরই আসল নাম ছিল না।
নায়ক তো হিন্দুই ছিলেন। নামকরা। এই মুহূর্তে অবশ্য তার নামটা ঠিকমতো মনে করতে পারছি না।
ফতেহ লোহানী এই ছবিতে অভিনয় করেছিলেন পার্শ্বচরিত্রে। মূল নায়কের চরিত্রে নয়। গল্পটা ওবায়েদ-উল হক সাহেবের নিজেরই লেখা ছিল। যিনি এই ছবিটা পরিচালনা করেছিলেন, তাঁর নাম যায়নি। নাম গিয়েছিল কিন্তু অন্য একজনের। তাঁর নাম ছিল হিমাদ্রি চৌধুরী। একমাত্র আমার নাম ছাড়া সবাইকে নাম গোপন করতে হয়েছিল। আর ফতেহ লোহানীর নাম রাখা হয়েছিল বোধ হয় কিরণমল্লিক। আগে থেকেই পরিচিতি থাকায়, টাইটেলে আমার আসল নামই গিয়েছিল। এ ছবির অর্থের জোগানদাতা ছিলেন ওবায়েদ-উল হক সাহেব নিজেই।
শান্তিনিকেতন থেকে বেরিয়ে আমার কর্মক্ষেত্র হয়েছিল কলকাতা। কলকাতার এইচএমভি গ্রামোফোন কোম্পানিতে আমি সংগীত প্রশিক্ষক নিযুক্ত হয়েছিলাম। এই দায়িত্ব পাওয়ার পর আমি রবীন্দ্রসংগীত শেখাতাম এবং শেখানো গানগুলো রেকর্ড করতে সাহায্য করতাম। বলতে ভুলেই গিয়েছি যে, শান্তিনিকেতন থেকে বেরিয়েই আমি প্রথমে বোম্বে গিয়েছিলাম। সেখানে মোটমাট এক বছর ছিলাম। আমি ফিল্মের সংগীত পরিচালক হব বলেই বোম্বেতে গিয়েছিলাম। ওখানে অনেকের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল। পরিচয় হয়েছিল সিনেমা পরিচালক মেহবুব সাহেবের সঙ্গে। পরিচয় হয়েছিল তখনকার বিখ্যাত গায়িকা বেগম আখতারের সঙ্গে। পরিচয় হয়েছিল অনিল বিশ্বাসের সঙ্গেও। শেষের জনের সঙ্গে আমার সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ঠ হয়েছিল।
শুনলে আপনারা হাসবেন, বোম্বেতে একটা চলচ্চিত্রে আমি অভিনয়ও করেছিলাম। কলকাতার ফণী মজুমদার তখন বোম্বেতে একটা ছবি করছিলেন। আমি তখন রীতিমতো বেকার। তো আমাকে ফণী মজুমদার বললেন, ‘তুমি একটা ছোটখাটো রোল করবে কি ছবিতে?’ আমি বললাম, হ্যাঁ, করব না কেন? একটা ছোট ভূমিকায় অভিনয় করেছিলাম সেই ছবিতে।
তো বোম্বেতে যে উদ্দেশ্য নিয়ে গিয়েছিলাম, সেটা সহজে হওয়ার ছিল না। বড় কঠিন জায়গা ওটা। আসলে আমার ভুল হয়েছিল। প্রথমে বোম্বে না গিয়ে কলকাতাতেই আসা উচিত ছিল। উচিত ছিল পরে বোম্বে যাওয়া। সংগীত পরিচালনায় ঢুকতে গেলে অনেক কিছুর প্রয়োজন ছিল। কলকাতা থেকে আরও হাত পাকিয়ে তবেই আমার বোম্বে যাওয়া উচিত ছিল। ছ্যাঁকা খাওয়ার পর সেটা উপলব্ধি করলাম। এসব কিছু সত্ত্বেও বোম্বেতে ছিলাম এক বছর। এখানে-ওখানে ঘোরাঘুরি করে অনেকভাবে চেষ্টা করেছি। আসলে মানুষের জীবনে সবকিছু ঠিকঠাকমতো ঘটে না। যাতেই সে হাত দেয়, তার সবকিছুই সোনা ফলায় না। তো আমার জীবনেও সেই রকম একটা সময় ছিল বোম্বাইয়ের জীবন। বুঝতে পারছিলাম যে এখানে কিছু হবে না। কারণ, এর আগে এক জায়গায় নয়, আরও কয়েকটা জায়গায় ঢুঁ মেরে, চেষ্টা-চরিত্র করে আমি ব্যর্থ হয়েছি। তারপর সেখান থেকে সোজা কলকাতায় চলে এলাম।
কলকাতায় আসার পর আমার বিশেষ বন্ধু সন্তোষ সেনগুপ্ত, গায়ক, তার সঙ্গেই আমি প্রথম দেখা করি। ও-ই আমাকে সঙ্গে করে এইচএমভিতে নিয়ে যায়। এইচএমভির যিনি প্রতিনিধি, নাম হেম সোম, আমার গান শুনলেন। গান শোনার পর বললেন, তুমি এখানকার শিল্পী তো হলেই, পাশাপাশি তুমি প্রশিক্ষক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করবে। রবীন্দ্রসংগীতের প্রশিক্ষক। পরে অবশ্য অন্য গানও করেছি। নিজের সুর দেওয়া গানও গাইয়েছি। তো আমাকে হেম সোম বললেন যে, কাকে নিয়ে প্রথম গান রেকর্ড করানো যায়? সুধা ব্যানার্জি বলে একটি মেয়ে ছিল। খুবই ভালো গান করত। তাকেই প্রথম আমি দুটো রবীন্দ্রসংগীত শিখিয়ে দিলাম। ‘গহন রাতের শ্রাবণ ধারা’ এবং আরও একটি গান। এখন আর শেষের গানটির চরণগুলোর কথা মনে পড়ছে না।
তারপর থেকে তো একের পর এক আমি আরম্ভ করি গান রেকর্ড করার কাজ। সন্তোষ সেনগুপ্তকে দিয়ে আমি অনেক গান করিয়েছি। সে সময় যেসব রবীন্দ্রসংগীত রেকর্ড করা হয়েছে, তার সবই আমার পরিচালনায়। এ ছাড়া হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে১৬ দিয়ে ‘প্রাঙ্গণে মোর শিরীষ শাখায়’ ও ‘হে নিরুপমা’—এই দুটি গান প্রথম করাই আমার পরিচালনায়। আমি এইচএমভিতে যোগ দেওয়ার আগেভাগে কী কারণে যেন পংকজ বাবুর সঙ্গে গ্রামোফোন কোম্পানির একটা ঝগড়া হয়েছিল। ফলে অভিমান করে তিনি বলেছিলেন, আর আমি রেকর্ডই করব না। তাই আমাকে গ্রামোফোন কোম্পানির প্রতিনিধি হেম সোম একদিন বললেন, আজ তোমাকে আমি পংকজ বাবুর কাছে নিয়ে যাব। তাঁকে দিয়ে স্টুডিওতে গান রেকর্ড করাতেই হবে। এটা আমার জীবনের খুবই স্মরণীয় একটা ঘটনা। আমার তখন কতই-বা বয়স! আর পংকজ বাবুর তখন ভারত জোড়া নামডাক। আমি গিয়ে তাঁকে বললাম, পংকজ দা আপনাকে গান শেখানোর দুঃসাহস আমার নেই। আপনি গাইবেন, আপনার পাশে আমি শুধু বসে থাকব। আমার কথা শুনে তিনি ভয়ানক খুশি হলেন। পরে বললেন, ঠিক আছে, আপনি রোজ তিনটের সময় এখানে চলে আসবেন। চলচ্চিত্রের রিহার্সাল শেষ করে আপনাকে নিয়ে আমি বসব। তো এভাবে প্রায় এক মাসে দুটি গান আমার জন্য গাইলেন তিনি। একটি ‘যখন গহন রাত্রি’ আর অন্যটি ‘তুমি কি কেবলি ছবি’। এই দুটি গান রেকর্ড করেছিলেন তিনি। এবং আক্ষরিক অর্থে যাকে বলা হয় একেবারে হাতে-কলমেই তিনি আমার কাছে গান দুটির তালিম নিয়েছিলেন। উনি জানতেন গানগুলো। তবুও বললেন, না, আপনি যেমন করে গান করেন, ওভাবেই আমি গাইব। আশ্চর্য, আমাকে তো তিনি তোয়াক্কা না করলেও পারতেন। তখন তো আমার কোনো পরিচয়ই নেই বলতে গেলে। খুব অবাক হয়েছিলাম এত বড় গায়ক, সংগীতজ্ঞ, ভারত জোড়া যাঁর নামডাক, আমার প্রশিক্ষণে গান করতে কোনো ধরনের দ্বিধাবোধ করেননি। শুধু তাই নয়, মাস খানেক পরে দেখেছি, সেই সাড়ে ছয় ফুট লম্বা মানুষটি আমাকে জড়িয়ে ধরে আমার পাঞ্জাবির পকেটে হাত ঢুকিয়ে দিয়েছেন। আমি বলি, এটা কী করছেন?
উনি বললেন, কিছু না।
দেখলাম, বেশ কিছু টাকা তিনি আমার পকেটে ঢুকিয়ে দিয়েছেন।
আমি বললাম, এগুলো কেন?
বললেন, গ্রামোফোন কোম্পানির ওসব সম্মানি-টম্মানির কথা বাদ দিন। আপনি যে রোজ কষ্ট করে এখানে আসেন, তার একটা দাম আছে না?
এই রকমের মানুষ ছিলেন পংকজ মল্লিক১৭।
১৯৪৮ সালে ঢাকায় এসে যে অবস্থাটা দেখেছিলাম, এবার সে সম্পর্কে একটু কথা না বললেই নয়।
ঢাকায় গানের চর্চার তেমন কিছু ছিল না। মুসলমান মেয়েদের মধ্যে একমাত্র লায়লা আর্জুমান্দ বানু১৮ আর তার বোন মালেকা ছাড়া গান গাওয়ার মতো তৃতীয় আর কেউ ছিল না। অবশ্য কিছুদিনের মধ্যেই কলকাতা থেকে ঢাকায় চলে এলেন মোমতাজ আলী, আলী মুর্শিদ এরা। এ সময় আমি ভাবলাম যে, এভাবে তো চলতে পারে না। কিছু শিল্পী তো তৈরি করতেই হবে। শাহজাহান হাফিজকে তৈরি করেছিলাম আমি। খুবই ভালো কণ্ঠ ছিল তার। যদিও ডাক্তার হবার পর অবশ্য সে গান করা ছেড়ে দিয়েছিল। সুলতান বলে আর একটি ছেলেকে তৈরি করেছিলাম। এখন সে বিদেশে। এই দুজন মুসলমান ছেলের খুবই ভালো কণ্ঠ ছিল। আর আফসারী খানমের কণ্ঠ অপূর্ব হলেও গানের ব্যাকরণের কিছুই জানত না। ওকে শেখালাম। বলতে গেলে আফসারী খানম, হুসনা বানু খানম এবং লায়লা—এই তিনজন মুসলমান মেয়েই ছিল ঢাকার প্রথম দিককার মুসলমান নারী শিল্পী। আর কিছু হিন্দু শিল্পী ওপারে না গিয়ে এখানেই থেকে গিয়েছিল। তাদের দুয়েকজন অবশ্য পরে চলে যায়। ইভারাণী বলে একজন ছিল। আরও কে কে যেন ছিল, তাদের নাম মনে পড়ছে না। প্রধান কণ্ঠের অধিকারী ছিল তখন বিমল বলে একটি ছেলে। ওকেই একমাত্র দেখতাম। আর তো বাংলা গান গাইবার মতো তেমন কেউ ছিল না। পরে অবশ্য শাহজাহান হাফিজ ও সুলতানরা এলো। এরা সবাই রবীন্দ্রসংগীতই গাইত। আর সবাই গাইত পল্লীগীতি। পল্লীগীতির মঞ্চটা তারাই দখল করে বসল, যারা মূলত কলকাতা থেকে এসেছিল। যেমন মোমতাজ আলী খান। আলী মুর্শিদ তাঁর পরে আসে। সোহরাবও এসেছিল। বেদারউদ্দীন গাইত, আবদুল লতিফ১৯ গাইত। এদের সবাই এসেছিল কলকাতা থেকেই। কিন্তু রবীন্দ্রসংগীত চর্চার জায়গাটা তখন তো ফাঁকাই ছিল। যারা কলকাতা থেকে এসেছিল, তাদেরকে আমি এখানকার শিল্পী বলতে নারাজ। আমিও কলকাতা থেকে এসেছিলাম।
ঢাকা বেতার মূলত ছিল হিন্দু শিল্পীনির্ভর। দেশ ভাগ হয়ে যাওয়ার ফলে সবাই ওপারে অর্থাত্ এখান থেকে পশ্চিমবঙ্গে চলে যায়। কাজেই কলকাতার যেসব মুসলমান শিল্পী কিছুটা গান-বাজনা করতেন, তারা এসেই জাঁকিয়ে বসলেন এখানকার বেতার কেন্দ্রে। তখনকার পরিবেশ-পরিস্থিতিতে পাকিস্তানি ধর্মীয় গানের জোয়ার প্রবল হবে সেটাই ছিল অত্যন্ত স্বাভাবিক। ওই সময় পাকিস্তানের ভাবাদর্শ অনুসারী ধর্মীয় গান আমাকেও কিছুটা করতে হয়েছিল। কারণ, রেডিওতে কাজ করতে গেলে সবকিছু একেবারে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। ওটা ছিল চাকরিরই অংশ।
প্রথম দিকে অবশ্য রবীন্দ্রসংগীতের চর্চায় তেমন একটা বাধা দেওয়া হয়নি। শামসুল হুদা তখন পিপি ছিলেন। আরও কয়েকজন অনুষ্ঠান প্রযোজক ছিলেন। তারা ছিলেন শান্তিনিকেতনেরই। বেতারে রবীন্দ্রসংগীতচর্চায় যাতে কোনো ধরনের বাধার সৃষ্টি না হয়, তারা সেই চেষ্টা করেছেন। বাধাগ্রস্ত করার ব্যাপারে কোনো ধরনের সরকারি নীতি কোনো দিনই ছিল না। কিন্তু উত্সাহিত যে করা হতো, তাও নয়।
প্রথম দিকে তো আমিই হাল ধরি। আমার আগে কী হতো, জানি না। তবে আমি যখন এলাম, এসে দেখলাম যে একমাত্র লায়লা আর্জুমান্দ বানুদের পরিবারটাই গান-টানের চর্চা-টর্চা করে থাকে। তো সে তখন গজল খুবই ভালো গাইত। নজরুলের গানও গাইত। কলকাতায় থাকার সময় তাকে দিয়ে একবার রবীন্দ্রসংগীত আমি করিয়েছিলাম। প্রচারিত হয়েছিল অল ইন্ডিয়া রেডিও থেকে। তখন ঢাকা বেতারে প্রভাত মুখার্জি বলে একজন অনুষ্ঠান প্রযোজক ছিলেন। তাদের পিপি বলা হতো। কাউকে কাউকে বলা হতো পিএ অর্থাত্ প্রোগ্রাম অ্যাসিস্টেন্ট। সে আমাকে শান্তিনিকেতন থেকে বুক করে নিয়ে এসেছিল। লায়লাকে নিয়ে আমি তখন একটা প্রোগ্রাম করেছিলাম। সুন্দর একটা প্রোগ্রাম ছিল সেটা।
১৯৪৩ সালে কলকাতা থেকে আমি এখানে চলে এসেছিলাম। এখানে আসার পর আমাকে বলা হয়েছিল যে আপনি একটি সংগীত বিচিত্রা করুন। তখন লায়লাকে দিয়ে রবীন্দ্রসংগীতের ওপর একটা সংগীত বিচিত্রা করেছিলাম। লায়লা এবং আরও কে কে জানি ছিল সেই অনুষ্ঠানে, এখন আর তাদের নামধাম মনে নেই। ঘটনাটা পাকিস্তান হওয়ার বছর চারেক আগেকার।
এই অঞ্চলে রবীন্দ্রসংগীতের চর্চা কেবল বেতারকেন্দ্রিক ছিল না, ছিল তার বাইরেও। গোড়ার দিকে যাঁরা ছিলেন, সে কথা বলতে গেলে বলতে হয়, পাকিস্তানের সূচনায় রবীন্দ্রসংগীতচর্চা তেমন ছিল বলে তো আমার মনে হয় না।
চর্চাটা আসলে শুরু হয় আমি ঢাকায় আসার পর থেকেই। বেতারের বাইরে রবীন্দ্রসংগীতের চর্চা দু-একটা পরিবার ছাড়া আর কোথাও ছিল বলে তো আমার মনে হয় না। কারণ, মুসলমান সমাজে তখন গান-বাজনা প্রায় হারামতুল্য ব্যাপার। সবে পাকিস্তান হয়েছে। মুসলমানরা তো এমনিতেই গান গাইত না। এখানে এক লায়লা আর্জুমান্দ বানুদের পরিবারটা ছিল। কলকাতা থেকে এলেন হুসনা বানু খানম। মুসলমান শিল্পীদের আস্তে আস্তে তৈরি করতে হয়েছিল।
আমরা এখানে আসার পর রবীন্দ্রসংগীতের চর্চাটা কীভাবে শুরু করলাম, এবার সে সম্পর্কে সংক্ষেপে কিছু কথা বলব। আমার কলকাতা থেকে আসার পর বেতারকে কেন্দ্র করেই মূলত গানের চর্চাটা আরম্ভ হয়েছিল। যেমন আফসারী খানমকে প্রথম যেদিন দেখি, তার গান শুনি, মনে হলো, মেয়েটির বেশ সুন্দর গলা তো! আমি নিজেই যেচে তার বাড়িতে গিয়ে তাকে গান শেখাতে শুরু করলাম। আগে কোনো পরিবারে রবীন্দ্রসংগীত চর্চা হতো না। আগে লায়লা ও মালেকা দুজনেই রবীন্দ্রসংগীত গাইত। আর সন্জীদাদের পরিবারটি তখনো বেতারে আসেনি। তারা এসেছিল একটু পরে। সে সময় তারা কেবল বাড়িতে বসেই চর্চা করত। এই তো একদিকে লায়লা আর্জুমান্দদের পরিবার আর অন্যদিকে মোতাহার হোসেন সাহেবের পরিবার। আর আফসারী খানম তো ছিল একেবারে একা, বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের পর রবীন্দ্রসংগীতের এই চর্চা প্রসার লাভ করতে শুরু করে। অবশ্য ভাষা আন্দোলনের ঠিক একটু আগেভাগে এর প্রচার ও প্রসার আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল। ভাষা আন্দোলন তাতে আরও একটু গতিবেগ সঞ্চার করেছিল, সে কথা আমাকে বলতেই হবে। আমার মনে পড়ে ১৯৬১ সালে যখন সব ধরনের সরকারি বাধা উপেক্ষা করে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠান হলো, ওটার পর থেকেই তো রবীন্দ্রসংগীতের চর্চাটা আরও বাড়তে শুরু করল। আর প্রতিষ্ঠান বলতে তখন বুলবুল একাডেমী ছিল। তার কিছুদিন পর ছায়ানট গড়ে উঠল। যেটা গড়ে তুলেছিল সন্জীদারা মিলে। এই দুটো প্রতিষ্ঠানেই রবীন্দ্রসংগীতের চর্চা হতো। অবশ্য ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে রবীন্দ্রসংগীতের চর্চা সামান্য ধাক্কা খেলেও তার প্রবাহকে রোধ করা যায়নি। বরং এ কথা বলাটাই বোধ হয় যুক্তিসংগত হবে যে রবীন্দ্র-বিরোধিতা থেকে শেষ পর্যন্ত যে গণআন্দোলনের শুরু হয়, তার পরিণতিতেই রবীন্দ্রনাথের গান ব্যাপকভাবে গাওয়ার ধারাটির সূচনা হয়।
রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিয়ে তো গণআন্দোলন হতে পারে না। যেমন নজরুলকে বাদ দিয়ে তা হয় না, তেমনি রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিয়েও হয় না। তখন মূলত গাওয়া হতো রবীন্দ্র-নজরুলের ওই সব উদ্দীপনামূলক গানই। যেমন নজরুলের ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’, ‘শিকল পরা ছল’, ‘দুর্গমগিরি’ আর রবীন্দ্রনাথের ‘ও আমার দেশের মাটি’ ইত্যাদি গান।
দেশ স্বাধীন হওয়ার একেবারে অব্যবহিত পরেই জাতীয় সংগীতের জন্য রবীন্দ্রসংগীত খোঁজাখুঁজি শুরু হলো। ‘আমার সোনার বাংলা/ আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটা কিন্তু আগেই রেকর্ড করা হয়েছিল। আমরা রেকর্ড করে তা বঙ্গবন্ধুর হাতে তুলে দিয়েছিলাম। ঘটনাটা ঘটেছিল ১৯৭০ সালের একটু আগেভাগেই।।
তথ্যসূত্র
১. মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা
মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা, (১৯০৬-১৯৭৭) সাহিত্যিক। বাড়ি কুষ্টিয়া জেলায়। জন্ম পাবনায়, ১৯০৬ সালের ১৬ ডিসেম্বর। পিতা খানবাহাদুর মোহাম্মদ সোলায়মান ছিলেন একজন বিভাগীয় স্কুল পরিদর্শক এবং মা সৈয়দা রাহাতুননেসা খাতুন ছিলেন সাহিত্য ও সংগীতের প্রতি অনুরাগী। বিশ শতকে বাঙালি মুসলমানের সামাজিক জাগরণে নারীর অবস্থান যাঁরা নিশ্চিত করেছেন, তাঁদের অন্যতম ছিলেন মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা। আনুষ্ঠানিক শিক্ষায় উচ্চশিক্ষিত না হলেও সৃজনশীল মন ও বুদ্ধিবৃত্তিক মনন দিয়ে তিনি স্বকালের স্বসমাজে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। মাহমুদা খাতুনের প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ তিনটি: পশারিণী (১৩৩৮), মন ও মৃত্তিকা (১৯৬০) এবং অরণ্যের সুর (১৯৬৩)। ১৯৬৭ সালে বাংলা একাডেমী তাঁকে সাহিত্য পুরস্কার এবং ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ সরকার একুশে পদকে ভূষিত করে। ১৯৭৭ সালের ২ মে ঢাকায় তাঁর মৃত্যু হয়।
২. কাজী নজরুল ইসলাম
কাজী নজরুল ইসলাম, (১৮৯৯-১৯৭৬) বাংলাদেশের জাতীয় কবি এবং অবিভক্ত বাংলার সাহিত্য, সমাজ ও সংস্কৃতিক্ষেত্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব। নজরুল ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ (২৪ মে ১৮৯৯) পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা কাজী ফকির আহমদ ছিলেন মসজিদের ইমাম ও মাজারের খাদেম। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তিনি ‘বিদ্রোহী কবি’ এবং আধুনিক বাংলা গানের জগতে ‘বুলবুল’ নামে খ্যাত। রবীন্দ্রনাথের অনুকরণমুক্ত কবিতা রচনায় তাঁর অবদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর ব্যতিক্রমধর্মী কবিতার জন্যই ‘ত্রিশোত্তর আধুনিক কবিতা’র সৃষ্টি সহজতর হয়েছিল বলে মনে করা হয়। নজরুল সাহিত্যকর্ম এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অবিভক্ত বাংলায় পরাধীনতা, সাম্প্রদায়িকতা, সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ, মৌলবাদ এবং দেশি-বিদেশি শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেন। এ কারণে ইংরেজ সরকার তাঁর কয়েকটি গ্রন্থ ও পত্রিকা নিষিদ্ধ করে এবং তাঁকে কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে। কলকাতার বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত নজরুলের রচনাবলির মধ্যে রয়েছে বাউণ্ডুলের আত্মকাহিনী (সওগাত, মে ১৯১৯) নামক প্রথম গদ্য রচনা, প্রথম প্রকাশিত কবিতা ‘মুক্তি’ (বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা, জুলাই ১৯১৯) এবং অন্যান্য রচনা: গল্প ‘হেনা’, ‘ব্যথার দান’, ‘মেহের নেগার’, ‘ঘুমের ঘোরে’; কবিতা ‘আশায়’, ‘কবিতা সমাধি’ প্রভৃতি। ভারত সরকারের অনুমতিক্রমে ১৯৭২ সালের ২৪ মে কবিকে সপরিবারে স্বাধীন বাংলাদেশে আনা হয়। বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে কবির অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭৪ সালের ৯ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এক বিশেষ সমাবর্তনে কবিকে সম্মানসূচক ডিলিট উপাধিতে ভূষিত করে। ১৯৭৬ সালের জানুয়ারি মাসে নজরুলকে বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান এবং ২১ ফেব্রুয়ারি ‘একুশে পদকে’ ভূষিত করে। ২৯ আগস্ট ১৯৭৬ (১২ ভাদ্র ১৩৮৩) ঢাকার পিজি হাসপাতালে কবি শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের উত্তর পার্শ্বে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয় বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে।
৩. আব্বাসউদ্দীন আহমদ
আব্বাসউদ্দীন আহমদ, (১৯০১-১৯৫৯) কণ্ঠশিল্পী। ১৯০১ সালের ২৭ অক্টোবর পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলার তুফানগঞ্জ মহকুমার বলরামপুর গ্রামে তাঁর জন্ম। পিতা জাফর আলী আহমদ ছিলেন তুফানগঞ্জ মহকুমা আদালতের উকিল। বলরামপুর স্কুলে আব্বাসউদ্দীনের বাল্যশিক্ষা শুরু হয়। তুফানগঞ্জ স্কুল থেকে তিনি প্রবেশিকা (১৯১৯) এবং কোচবিহার কলেজ থেকে আইএ (১৯২১) পাস করেন। তখন থেকেই তিনি অধ্যয়ন পরিত্যাগ করে গানের জগতে নিমগ্ন হন। আব্বাসউদ্দীনের প্রধান পরিচয় একজন কণ্ঠশিল্পী হিসেবেই। তিনি আধুনিক গান, স্বদেশি গান, ইসলামি গান, পল্লিগীতি, উর্দু গান—সবই গেয়েছেন, কিন্তু পল্লিগীতিতেই তাঁর মৌলিকতা ও সাফল্য সবচেয়ে বেশি। কোনো ওস্তাদের নিকট কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তালিম নিয়ে তিনি গান শেখেননি। তিনি প্রথমে ছিলেন পল্লিগাঁয়ের একজন গায়ক। কলকাতায় অল্প সময়ের জন্য তিনি ওস্তাদ জমিরুদ্দীন খাঁর নিকট উচ্চাঙ্গসংগীতে তালিম নেন। রংপুর ও কোচবিহার অঞ্চলের ভাওয়াইয়া-ক্ষীরোল-চটকা গেয়ে আব্বাসউদ্দীন প্রথমে সুনাম অর্জন করেন। পরে জারি, সারি, ভাটিয়ালি, মুর্শিদি, বিচ্ছেদী, দেহতত্ত্ব, মর্সিয়া, পালাগান ইত্যাদি পল্লিগানের নানা শাখার গান গেয়ে ও রেকর্ড করে তিনি জনপ্রিয় হন। তাঁর দরদভরা সুরেলা কণ্ঠে পল্লিগানের সুর যেভাবে ফুটে উঠত, অন্য কোনো গায়কের কণ্ঠে তেমনটি হতো না। এ ক্ষেত্রে তিনি আজও অদ্বিতীয়। তিনি কাজী নজরুল ইসলাম, জসীমউদ্দীন, গোলাম মোস্তফা প্রমুখের ইসলামি ভাবধারায় রচিত গানেও কণ্ঠ দিয়েছেন। আব্বাসউদ্দীনের গানের রেকর্ডগুলো এক অমর কীর্তি। আমার শিল্পীজীবনের কথা (১৯৬০) তাঁর রচিত একমাত্র গ্রন্থ। তিনি সংগীতে অবদানের জন্য মরণোত্তর প্রাইড অব পারফরম্যান্স (১৯৬০), শিল্পকলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৭৯) এবং স্বাধীনতা দিবস পুরস্কারে (১৯৮১) ভূষিত হন। ১৯৫৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর তাঁর মৃত্যু হয়।
৪. গোলাম মোস্তফা
গোলাম মোস্তফা, (১৮৯৭-১৯৬৪) কবি ও লেখক। যশোর (বর্তমান ঝিনাইদহ) জেলার শৈলকুপা উপজেলার মনোহরপুর গ্রামে তাঁর জন্ম। তাঁর পিতা গোলাম রববানী এবং পিতামহ কাজী গোলাম সরোয়ার দুজনেই ছিলেন লোককবি। গোলাম মোস্তফা ১৯১৮ সালে কলকাতার রিপন কলেজ থেকে বিএ এবং ১৯২২ সালে ডেভিড হেয়ার ট্রেনিং কলেজ থেকে বিটি পাস করেন। এর আগে ১৯২০ সালে তিনি ব্যারাকপুর সরকারি স্কুলে শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন এবং ১৯৪৯ সালে ফরিদপুর জেলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। গোলাম মোস্তফা পাকিস্তানি আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন এবং ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় উর্দুর প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেন। ১৯৪৯ সালে গঠিত পূর্ববঙ্গ সরকারের ভাষা সংস্কার কমিটির সচিব হিসেবে তিনি কাজ করেন। তিনি গদ্য ও পদ্য রচনায় সমান দক্ষ ছিলেন, তবে কবি হিসেবেই তাঁর মুখ্য পরিচয় ছিল। রক্তরাগ (১৯২৪), খোশরোজ (১৯২৯), কাব্য-কাহিনী (১৯৩২), সাহারা (১৯৩৬), হাস্নাহেনা (১৯৩৮), বুলবুলিস্তান (১৯৪৯), তারানা-ই-পাকিস্তান (১৯৫৬), বনিআদম (১৯৫৮), গীতিসঞ্চালন (১৯৬৮) ইত্যাদি তাঁর মৌলিক কাব্য এবং মুসাদ্দাস-ই-হালী (১৯৪১), কালামে ইকবাল (১৯৫৭), শিকওয়া ও জওয়াব-ই-শিকওয়া (১৯৬০) অনুবাদকাব্য। তিনি আল কোরআনও (১৯৫৮) অনুবাদ করেন। তাঁর গদ্য রচনার মধ্যে বিশ্বনবী (১৯৪২), ইসলাম ও কমিউনিজম (১৯৪৬), ইসলাম ও জেহাদ (১৯৪৭), আমার চিন্তাধারা (১৯৫২), তাঁর নিজের সুরারোপিত কয়েকটি গানের রেকর্ডও পাওয়া যায়। তার মধ্যে আব্বাসউদ্দীনের সঙ্গে গাওয়া রেকর্ডও রয়েছে। সাহিত্য-সংস্কৃতিতে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি যশোর সংঘ কর্তৃক ‘কাব্য সুধাকর’ (১৯৫২) এবং পাকিস্তান সরকার কর্তৃক ‘সিতারা-ই-ইমতিয়াজ’ (১৯৬০) উপাধি লাভ করেন।
৫. জসীমউদ্দীন
জসীমউদ্দীন (১৯০৩-১৯৭৬) কবি, শিক্ষাবিদ। ১৯০৩ সালের ১ জানুয়ারি ফরিদপুর জেলার তাম্বুলখানা গ্রামে মাতুলালয়ে তাঁর জন্ম। পৈতৃক নিবাস একই জেলার গোবিন্দপুর গ্রামে। পিতা আনসারউদ্দীন মোল্লা ছিলেন একজন স্কুলশিক্ষক। শৈশবে ফরিদপুর হিতৈষী স্কুলে জসীমউদ্দীনের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয়। তারপর ফরিদপুর জিলা স্কুল থেকে প্রবেশিকা (১৯২১), রাজেন্দ্র কলেজ থেকে আইএ (১৯২৪) ও বিএ (১৯২৯) এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে তিনি এমএ (১৯৩১) পাস করেন। জসীমউদ্দীনের কর্মজীবন শুরু হয় পল্লিসাহিত্যের সংগ্রাহক হিসেবে। জসীমউদ্দীনের কবিত্ব শক্তির প্রকাশ ঘটে ছাত্রজীবনেই। জসীমউদ্দীন সাহিত্যের নানা শাখায় কাজ করেছেন, যেমন গাথাকাব্য, খণ্ডকাব্য, নাটক, স্মৃতিকথা, শিশুসাহিত্য, গল্প-উপন্যাস ইত্যাদি। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ রাখালী প্রকাশিত হয় ১৯২৭ সালে। তাঁর প্রধান গ্রন্থগুলো হলো: নক্সী কাঁথার মাঠ (১৯২৯), সোজন বাদিয়ার ঘাট (১৯৩৩), রঙ্গিলা নায়ের মাঝি (১৯৩৫), মাটির কান্না (১৯৫১), সুচয়নী (১৯৬১), পদ্মা নদীর দেশে (১৯৬৯), ভয়াবহ সেই দিনগুলিতে (১৯৭২), পদ্মাপার (১৯৫০), বেদের মেয়ে (১৯৫১), পল্লীবধূ (১৯৫৬), গ্রামের মায়া (১৯৫৯), ঠাকুর বাড়ির আঙিনায় (১৯৬১), জার্মানীর শহরে বন্দরে (১৯৭৫), স্মরণের সরণী বাহি (১৯৭৮), বাঙ্গালীর হাসির গল্প, ডালিম কুমার ইত্যাদি। তাঁর রচিত বাঙ্গালীর হাসির গল্প (দুই খণ্ড, ১৯৬০ ও ১৯৬৪) ও বোবা কাহিনী (১৯৬৪) উপন্যাসটি সুখপাঠ্য। বাংলাদেশের মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসিকান্না ও জীবনসংগ্রামের কাহিনিই তাঁর কবিতার প্রধান উপজীব্য। তাঁর কবিতায় দেশের মাটির সাক্ষাত্ উপলব্ধি ঘটে। এ জন্য ‘পল্লীকবি’ হিসেবে তাঁর বিশেষ ও স্বতন্ত্র পরিচিতি রয়েছে। জসীমউদ্দীন বাংলা সাহিত্যের একজন বিশেষ সম্মানিত ও বহু পুরস্কারে পুরস্কৃত কবি। তিনি প্রেসিডেন্টের প্রাইড অব পারফরম্যান্স পুরস্কার (১৯৫৮), রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানসূচক ডক্টর অব লিটারেচার ডিগ্রি (১৯৬৯), বাংলাদেশ সরকারের একুশে পদক (১৯৭৬) ও স্বাধীনতা দিবস পুরস্কারে (মরণোত্তর, ১৯৭৮) ভূষিত হন। তিনি ১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কারের জন্যও মনোনীত হয়েছিলেন, কিন্তু তা প্রত্যাখ্যান করেন। ১৯৭৬ সালের ১৩ মার্চ তিনি ঢাকায় মারা যান।
৬. রাইটার্স বিল্ডিং
রাইটার্স বিল্ডিং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সচিবালয় ভবন এবং বর্তমানে মুখ্যমন্ত্রীর সরকারি দপ্তর। ১৭০২ সালে কলকাতায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ফোর্ট উইলিয়াম প্রতিষ্ঠার পর থেকে দীর্ঘকাল একই নামেই এ ভবনটি তার ঐতিহাসিক গুরুত্ব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ১৭৭৬ সালে বাংলায় ব্রিটিশদের প্রকৃত শাসন শুরু হলে কোম্পানির করণিক বা রাইটারদের কাজ বহুবিধ হয়ে যায়। ফলে তাদের নতুন প্রশাসনিক ব্যবস্থার সঙ্গে একীভূত করতে গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিংস একটি নতুন কাঠামো নির্ধারণ করেন। সে সময় থেকেই এ ভবন রাইটার্স বিল্ডিং নামে পরিচিত হয়। তবে, ১৮০০ সাল পর্যন্ত এ ভবন কোম্পানির করণিকদের আবাসিক ভবনের কাজে ব্যবহূত হয়েছে। ভবনের একাংশে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের কার্যক্রম শুরু হলে রাইটারদের বাসস্থান স্থানান্তর করা হয়। এরপর রাইটার্স বিল্ডিং ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের সচিবালয়ে পরিণত হয় এবং ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের প্রশাসনিক প্রয়োজনের তাগিদে ভবনও পরিসরে দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে।
৭. কমল দাশগুপ্ত
কমল দাশগুপ্ত (১৯১২-১৯৭৪) কণ্ঠশিল্পী, সুরকার ও সংগীত পরিচালক। ১৯১২ সালের ২৮ জুলাই নড়াইল জেলায় তাঁর জন্ম। তাঁর পিতা তারাপ্রসন্ন দাশগুপ্ত ছিলেন উচ্চাঙ্গসংগীতের অনুরাগী। পুরো নাম কমলপ্রসন্ন দাশগুপ্ত হলেও তিনি কমল দাশগুপ্ত নামেই সমধিক পরিচিত। ১৯৫৭ সালে ইসলাম ধর্ম এবং কামালউদ্দীন আহমদ নাম গ্রহণ করে তিনি বাংলাদেশের প্রখ্যাত নজরুলসংগীতশিল্পী ফিরোজা বেগমের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। কমল দাশগুপ্তের সংগীতে হাতেখড়ি হয় সহোদর বিমল দাশগুপ্তের নিকট। পরে দিলীপকুমার রায়, কানা কেষ্ট, ওস্তাদ জমিরুদ্দিন খাঁ প্রমুখের নিকট তিনি সংগীত শিক্ষা করেন। তিনি আধুনিক বাংলা, উর্দু, হিন্দি, ঠুমরি এবং ছায়াছবির সংগীতে কণ্ঠদান ও সুরারোপ করেন। সুরের রাজ্যে কমল দাশগুপ্ত ছিলেন এক জীবন্ত কিংবদন্তি।
৮. আশরাফী খানম
খানম, আশরাফী প্রথম বাঙালি মুসলমান গায়িকা, যাঁর গান গ্রামোফোন ডিস্কে ধারণ করা হয়। মানিকগঞ্জ জেলার সিঙ্গাইর উপজেলার পারিল নওহাদ্দা গ্রামে এক জমিদার পরিবারে তাঁর জন্ম। তিনি ছিলেন আলী আহমদ হামিদুল্লাহ খানের (নয়া মিয়া) কন্যা। তাঁর পিতামহ মোয়াজ্জেম হোসেন খান ছিলেন সংগীতানুরাগী। ফলে কৈশোরেই আশরাফী পারিবারিক বলয়ে সংগীতচর্চার অনুকূল পরিবেশ লাভ করেন। বৃহত্তর পরিমণ্ডলে সংগীতচর্চার সুযোগ লাভের উদ্দেশ্যে আশরাফী খানম তাঁর ফুফু বেগম বদরুন্নেসা আহমেদের সঙ্গে কলকাতায় যান এবং সেখানে একান্তভাবেই নজরুলসংগীত অনুশীলনে আত্মনিয়োগ করেন। কলকাতায় তিনি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে আসেন এবং তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় আশরাফী তাঁর গান রেকর্ড করার সুযোগ পান। কলকাতার গ্রামোফোন কোম্পানি টুইন ব্রাদার্স কর্তৃক ১৯৩৪ সালে ‘কুমারী বেবী’ ছদ্মনামে তাঁর কণ্ঠে চারটি নজরুলসংগীত গ্রামোফোন ডিস্কে রেকর্ড করা হয়।
৯. শান্তিনিকেতন
শান্তিনিকেতন ১৮৬৩ সালে আশ্রম হিসেবে এর যাত্রা শুরু। রায়পুরের জমিদার ভুবনমোহন সিনহার কাছ থেকে ২০ বিঘা জমি কিনে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এটি প্রতিষ্ঠা করেন। পশ্চিম বাংলার বীরভূম জেলার অন্তর্গত বোলপুরের কাছে এই আশ্রম অবস্থিত। জাগতিক করণীয় কর্ম থেকে মুক্ত হয়ে প্রার্থনায় সময় কাটানোর জন্য গৃহী ব্যক্তিদের নির্জন আশ্রয় দান করা ছিল এই আশ্রমের উদ্দেশ্য। ১৮৮৮ সালে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত শান্তিনিকেতন ট্রাস্ট—একটি অতিথিভবন, প্রার্থনাকক্ষ এবং ধর্মীয় সাহিত্যের জন্য নিবেদিত গ্রন্থাগারের সংস্থান করেছিলেন। ১৯০১ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতন আশ্রমে শিশুদের জন্য একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ একটা আদর্শ স্কুল প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। বাল্যকালে তাঁকে যেসব স্কুলে পাঠানো হয়েছিল, সেগুলো সম্পর্কে তিনি খুশি ছিলেন না। তিনি মনে করতেন যে ইংরেজি স্কুলগুলো ছিল ভারতীয় জীবনধারা, সমাজ ও সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন। শান্তিনিকেতনকে বেছে নেওয়ার পেছনে তাঁর তিনটি স্পষ্ট লক্ষ্য ছিল: প্রকৃতির কাছাকাছি থেকে আদর্শ প্রাকৃতিক পরিবেশে শিশুদের বেড়ে ওঠা; পরিবর্তনশীল ভারতে শহর ও গ্রামের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার উদ্দেশ্যে শিক্ষাদান; এবং বৃহত্তর বিশ্বকে গ্রহণের উপযুক্ত করে তোলার জন্য জ্ঞানদান করা। নতুন এক শিক্ষার মাধ্যমে ভারতীয় মানসকে হীনম্মন্যতা থেকে মুক্ত করাও ছিল রবীন্দ্রনাথের প্রত্যাশা। তিনি ভেবেছিলেন যে এটি সম্ভব হলে নিছক জীবিকার প্রয়োজনের বাইরে তা জীবনের মূল উদ্দেশ্য প্রকাশ করবে। শিক্ষার শুরু থেকেই শিশুরা সহযোগিতা ও বন্ধুত্বের অর্থ উপলব্ধি করুক—এটা রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন। ১৯২১ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্বভারতীর প্রতিষ্ঠা হয়। রবীন্দ্রনাথ আমৃত্যু ছিলেন এর চ্যান্সেলর (আচার্য); অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সরোজিনী নাইডু ছিলেন তাঁর উত্তরসূরি।
১০. সুধীন্দ্রনাথ দত্ত
সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, (১৯০১-১৯৬০) কবি, প্রাবন্ধিক ও পত্রিকা সম্পাদক। ১৯০১ সালের ৩০ অক্টোবর কলকাতার হাতিবাগানে তাঁর জন্ম। পিতা হীরেন্দ্রনাথ দত্ত ছিলেন একজন বিশিষ্ট দার্শনিক। প্রসিদ্ধ গায়িকা রাজেশ্বরী বাসুদেব তাঁর স্ত্রী। সুধীন্দ্রনাথ ১৯১৪ থেকে ১৯১৭ সাল পর্যন্ত কাশীর থিয়সফিক্যাল হাইস্কুলে শিক্ষাগ্রহণ করেন। পরে কলকাতার ওরিয়েন্টাল সেমিনারি স্কুল থেকে এন্ট্রান্স (১৯১৮) এবং স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে আইএ (১৯২০) ও বিএ (১৯২২) পাস করে তিনি কিছুদিন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজিতে এমএ শ্রেণিতে অধ্যয়ন করেন। ১৯৩১ সাল থেকে দীর্ঘ ১২ বছর তিনি পরিচয় পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। ১৯৪৫-৪৯ সময়ে তিনি স্টেটসম্যান পত্রিকায় কর্মরত ছিলেন। প্রমথ চৌধুরীর সবুজপত্র-এর সঙ্গেও তাঁর সম্পৃক্ততা ছিল। ১৯৫৭-১৯৫৯ সময়ে তিনি আমেরিকার শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন এবং পরে কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্যের অধ্যাপক নিযুক্ত হন। সুধীন্দ্রনাথ কর্মজীবনের পাশাপাশি সাহিত্যচর্চাও করেছেন। আধুনিক মনন ও বৈশ্বিক চেতনার কারণে তিনি বাংলা কাব্যে স্বতন্ত্র স্থান লাভ করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো: কাব্য তন্বী (১৯৩০), অর্কেস্ট্রা (১৯৩৫), ক্রন্দসী (১৯৩৭), উত্তরফাল্গুনী (১৯৪০), সংবর্ত (১৯৫০), দশমী (১৯৫৬); গদ্যগ্রন্থ স্বগত (১৯৩৮), কুলায় ও কালপুরুষ (১৯৫৭)। এ ছাড়া প্রতিধ্বনি (১৯৫৪) নামে তাঁর একটি অনুবাদগ্রন্থও আছে। তিনি বাংলা গদ্যের আধুনিক রূপেরও প্রবর্তক। ১৯৬০ সালের ২৫ জুন কলকাতায় তাঁর মৃত্যু হয়।
১১. ‘মোহাম্মদী’
মোহাম্মদী একটি বাংলা মাসিক পত্রিকা। ১৯০৩ সালের আগস্ট মাসে মোহাম্মদ আকরম খাঁর সম্পাদনায় কলকাতা থেকে এটি প্রকাশিত হয়। ব্রিটিশ ভারত ও পাকিস্তানে বাংলার মুসলমানদের মধ্যে সাহিত্য-সংস্কৃতির একটি স্বতন্ত্র ধারা সৃষ্টি এবং জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্বভিত্তিক মুসলিম জাতীয়তাবাদের বিকাশ এবং শেষে পাকিস্তানি ভাবধারার প্রসার ঘটানো ছিল মোহাম্মদী প্রকাশের মূল উদ্দেশ্য। তবে এতে অন্য মতাদর্শের লেখকের লেখাও প্রকাশিত হতো। এতে যেসব মুসলমান লেখক, কবি-সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ লিখতেন তাঁরা হলেন সুফিয়া কামাল, শওকত ওসমান, তালিম হোসেন, আবদুল হাই, আবু জাফর শামসুদ্দীন, হবীবুল্লাহ্ বাহার চৌধুরী, মোহাম্মদ আকরম খাঁ, আবদুল্লাহ আল-মুতী শরফুদ্দিন, আবদুল গনি হাজারী, আলাউদ্দিন আল আজাদ, আবু রুশদ, জসীমউদ্দীন, আশরাফ সিদ্দিকী, ফেরদৌস খান প্রমুখ। তাঁরা অনেকেই পরবর্তীকালে লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ ও প্রতিষ্ঠা লাভ করেন।
১২. ‘দৈনিক আজাদ’
দৈনিক আজাদ একটি জাতীয় বাংলা দৈনিক পত্রিকা। ১৯৩৬ সালের ৩১ অক্টোবর পত্রিকাটি কলকাতা থেকে আত্মপ্রকাশ করে। মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁর সম্পাদনায় বাংলা ও আসামের মুসলমানদের মুখপত্র হিসেবে দৈনিক আজাদ প্রকাশিত হয়। আট পৃষ্ঠার এ পত্রিকাটি তখন নিজস্ব রোটারি মেশিনে ছাপা হতো। এ সময় আজাদ পত্রিকার বার্তা সম্পাদক ছিলেন মোহাম্মদ মোদাব্বের। পত্রিকা প্রকাশের সার্বিক দায়িত্ব পালন করতেন মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ ও তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র মোহাম্মদ খায়রুল আনাম খাঁ। এ সময় পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন আবুল কালাম শামসুদ্দীন ও নজীর আহমদ চৌধুরী। খায়রুল কবির তখন ছিলেন ঢাকার আঞ্চলিক রিপোর্টার। ভাষা আন্দোলনে আজাদ সাহসী ভূমিকা পালন করে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্রজনতার মিছিলে পুলিশের গুলিবর্ষণ ও ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে সমগ্র ঢাকা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। দৈনিক আজাদ গুলিবর্ষণের নিন্দা জানিয়ে বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে। আজাদ-এর সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক সভা থেকে পদত্যাগ করেন। আইয়ুব খানের সময়ে বিভিন্ন কালাকানুনের বিরুদ্ধে অন্যান্য পত্রিকার পাশাপাশি দৈনিক আজাদ জোরালো প্রতিবাদ জানায়। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রতিবাদে এবং উনসত্তরের গণ-আন্দোলনে দৈনিক আজাদ জনগণের পক্ষে বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করে। ১৯৬৯ সালে মাওলানা আকরম খাঁর মৃত্যুর পর পত্রিকাটির মালিকানা ও কর্তৃত্ব নিয়ে বিরোধ দেখা দেয়। স্বাধীনতার পর দৈনিক আজাদ সরকারি ব্যবস্থাপনা বেশ কিছুদিন প্রকাশিত হওয়ার পর পুনরায় ব্যক্তিমালিকানায় ছেড়ে দেওয়া হয়। ১৯৯০ সালে পত্রিকাটির প্রকাশনা স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যায়। বিক্রয় হয়ে যায় আজাদ পত্রিকার ভবনটিও।
১৩. ফতেহ লোহানী
ফতেহ লোহানী, (১৯২০-১৯৭৫) অভিনেতা, চলচ্চিত্র পরিচালক, লেখক ও সাংবাদিক। আবু নজীর মোহাম্মদ ফতেহ আলী খান লোহানী সিরাজগঞ্জে জম্মগ্রহণ করেন। তিনি একাধারে বহুগুণের অধিকারী ছিলেন। যেমন: বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে অগ্রণী অভিনেতা, চিত্রনাট্যকার, গীতিকার, বেতারের অনুষ্ঠান প্রযোজক, সংবাদপাঠক, আবৃত্তিকার ও অনুবাদক। কলেজে মঞ্চস্থ তাঁর প্রথম নাটক বনফুল রচিত শ্রী মধুসূদন-এ তিনি কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেন। তাঁর অভিনীত উল্লেখযোগ্য নাটক উত্পল দত্ত পরিচালিত হ্যামলেট। পরে তিনি শৌখিন নাট্যগোষ্ঠী ও সাধারণ রঙ্গমঞ্চের সঙ্গে জড়িত হন। তিনি সিরাজউদ্দৌলা নাটকটি পরিচালনা ও তাতে অভিনয় করেন। বাণী থিয়েটারের মঞ্চে তিনি রামের সুমতি নাটকে অভিনয় করেন। ১৯৫৭ সালে চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা (এফডিসি) প্রতিষ্ঠার পর তাঁর পরিচালিত প্রথম দুটি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ছিল আকাশ আর মাটি (১৯৫৯) ও আসিয়া (১৯৬০)। ১৯৬৫ সালে মুক্তি পায় তাঁর পরিচালিত উর্দু ছবি সাত রং। ১৯৬৭ সালে তিনি প্রথম অভিনয় করেন টেলিভিশন নাটক নির্ভীক-এ। ঢাকায় তাঁর অভিনীত প্রথম চলচ্চিত্র রাজা এল শহরে (১৯৬৪)। ফতেহ লোহানী অভিনীত অন্যান্য চলচ্চিত্রের মধ্যে মুক্তির বন্ধন (১৯৪৭), তানহা (১৯৬৪) বেহুলা (১৯৬৬), ফির মিলেঙ্গে হাম দোনো (১৯৬৬), আগুন নিয়ে খেলা (১৯৬৭), দরশন (১৯৬৭), জুলেখা (১৯৬৭), এতটুকু আশা (১৯৬৮) বাল্যবন্ধু (১৯৬৮), মোমের আলো (১৯৬৮), মায়ার সংসার (১৯৬৯), মিসর কুমারী (১৯৭০), তানসেন (১৯৭০), আঁকাবাঁকা (১৯৭০), অন্তরঙ্গ (১৯৭০), ঘূর্ণিঝড়, (১৯৭০), স্বরলিপি (১৯৭০), দর্পচূর্ণ (১৯৭০), দীপ নেভে নাই (১৯৭০), অপবাদ (১৯৭০), ডাকু মনসুর (১৯৭৪), দুই রাজকুমার (১৯৭৫), এক মুঠো ভাত (১৯৭৫), কুয়াশা (১৯৭৭) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। কর্মজীবনের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। এর মধ্যে: পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পুরস্কার (১৯৬১-তে শ্রেষ্ঠ বাংলা চলচ্চিত্র আসিয়া-র জন্য), পাকিস্তানের নিগার পুরস্কার (১৯৬-তে শ্রেষ্ঠ প্রযোজনা আসিয়া), পাকিস্তানের মজিদ আলমাক্কী পুরস্কার (১৯৬৮-তে শ্রেষ্ঠ বেতার নাট্য-অভিনেতা), বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি (বাচসাস) পুরস্কার ১৯৭৫ (অভিনয়—চলচ্চিত্র) এবং এফডিসির রজতজয়ন্তী ট্রফি (১৯৮৩) উল্লেখযোগ্য। চট্টগ্রামের কাপ্তাইয়ে কুয়াশা ছবির শুটিংয়ে নিয়োজিত থাকাকালে ১৯৭৫ সালের ১২ এপ্রিল ফতেহ লোহানীর মৃত্যু হয়।
১৪. জয়নুল আবেদিন
জয়নুল আবেদিন, (১৯১৪-১৯৭৬) আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অসাধারণ প্রতিভাবান শিল্পী। ইনস্টিটিউট অব আর্টস অ্যান্ড ক্র্যাফটস প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলাদেশে আধুনিক শিল্প আন্দোলনের তিনিই পুরোধা। ১৯৪৮ সালে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত এ প্রতিষ্ঠানের (বর্তমান চারুকলা ইনস্টিটিউ) তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষে জয়নুল আবেদিন ধারাবাহিকভাবে একাধিক চিত্র স্কেচ করেন। এ দুর্ভিক্ষে হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারায়। সস্তা প্যাকিং পেপারে চায়নিজ ইঙ্ক ও তুলির আঁচড়ে ‘দুর্ভিক্ষের রেখাচিত্র’ নামে পরিচিত জয়নুলের এ চিত্রকর্মে ফুটে উঠেছে শব-সওদাগরদের নিষ্ঠুরতা ও নৈতিক কলুষতা, সে সঙ্গে নিপীড়িতের অমানবিক দুর্দশা। চিত্রকর্মগুলো জয়নুলকে ভারতব্যাপী খ্যাতি এনে দেয়। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা, এগুলো মানুষের দুর্দশা, কষ্ট ও প্রতিবাদকে সামনে এনে বাস্তবধর্মী চিত্র অঙ্কনে তাঁর স্বকীয়তাকে বিকশিত করে। ‘দ্য রেবেল ক্রো’ (জলরং, ১৯৫১) এ ধারার সবচেয়ে উজ্জ্বল নিদর্শন। উচ্চ মার্গের নন্দনতত্ত্বের মিশেলে সামাজিক অনুসন্ধিত্সা ও প্রতিবাদের সম্মিলিত প্রকাশ রিয়ালিজমের এ নির্দিষ্ট ধারা বিভিন্ন সময়ে জয়নুলকে প্রেরণা জুগিয়েছে: যেমন ১৯৬৯ ও ১৯৭১ এ সময় জয়নুল তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কাজ করেছেন এ স্টাইলে। ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশের বিভক্তির পর জয়নুল আবেদিন তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় বসবাস শুরু করেন। সে সময়ে ঢাকাতে কোনো আর্ট ইনস্টিটিউট বা অন্য কোনো শিল্পসম্বন্ধীয় প্রতিষ্ঠান ছিল না। জয়নুল আবেদিন ও তাঁর কয়েকজন সহযোগী, যাঁরা দেশভাগের পর ঢাকায় অভিবাসী হয়েছিলেন, আর্ট ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেন। ‘দুই মহিলা’ (গোয়াশ, ১৯৫৩), ‘পাইন্যার মা’ (গোয়াশ, ১৯৫৩) ও ‘মহিলা’ (জলরং, ১৯৫৩) হলো এ আমলের উল্লেখযোগ্য চিত্রকর্ম। ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানের বিজয়কে ভিত্তি করে আঁকা ৬৫ ফুট দীর্ঘ স্ক্রল পেইন্টিং (চায়নিজ ইঙ্ক, জলরং ও মোম) ‘নবান্ন’ এবং ১৯৭০ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণ হারানো হাজারো মানুষের স্মৃতির উদ্দেশ্যে আঁকা ৩০ ফুট দীর্ঘ ‘মনপুরা’ পেইন্টিংটির মধ্যে তাঁর কর্মের বৈচিত্র্য লক্ষ করা যায়। জয়নুল যদিও প্রকৃতি ও মানবজীবনের চিত্র (পল্লি রমণীর ব্যক্তিগত মুহূর্তও অন্তর্ভুক্ত) এঁকেছেন, তবু ষাটের দশকের শেষ দিক ও সত্তর দশকে আঁকা তাঁর ছবির মধ্যে গতি, মুভমেন্ট পরস্ফুিটিত। ১৯৭৫ সালে জয়নুল আবেদিন সোনারগাঁওয়ে একটি লোকশিল্প জাদুঘর এবং ময়মনসিংহে একটি গ্যালারি (শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালা) প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭৬ সালের ২৮ মে ঢাকায় তাঁর মৃত্যু হয়।
১৫. কামরুল হাসান
কামরুল হাসান, (১৯২১-১৯৮৮) চিত্রশিল্পী। প্রকৃত নাম আবু শরাফ মোহাম্মদ কামরুল হাসান। ১৯২১ সালের ২ ডিসেম্বর পিতার কর্মস্থল কলকাতায় তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার নারেঙ্গা গ্রামে। পিতা মোহাম্মদ হাশিম ছিলেন তিলজলা গোরস্থানের সুপারিনটেন্ডেন্ট। কামরুল হাসানের শিক্ষাজীবন কাটে কলকাতায়। তিনি কলকাতার মডেল এম ই স্কুল (১৯৩০-৩৫) এবং কলকাতা মাদ্রাসায় (১৯৩৬-৩৭) প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। ১৯৩৮ সালে তিনি কলকাতার গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টসে ভর্তি হন এবং ১৯৪৭ সালে চিত্রকলায় স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ছাত্রজীবনে চিত্রাঙ্কনের পাশাপাশি তিনি বয়েজ-স্কাউট, শরীরচর্চা, ব্রতচারী আন্দোলন, শিশু সংগঠন মণিমেলা, মুকুল ফৌজ ইত্যাদি কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলেন। ১৯৪৫ সালে শরীরচর্চা প্রতিযোগিতায় তিনি বেঙ্গল চ্যাম্পিয়ন হন।
দেশ বিভাগের পর কামরুল হাসান ঢাকা চলে আসেন এবং শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের সঙ্গে মিলিত হয়ে ঢাকায় একটি আর্ট স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন (১৯৪৮)। ঢাকায় চিত্রকলার চর্চা ও প্রসারের লক্ষ্যে ১৯৫০ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন আর্ট গ্রুপ। ১৯৬০ সালে তিনি ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের নকশা কেন্দ্রের প্রধান নকশাবিদ নিযুক্ত হন এবং ১৯৭৮ সালে ওই পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। কামরুল হাসানের চিত্রকলার প্রধান উপাদান নর-নারী (বিশেষত রমণীর শরীর), পশুপাখি (প্রধানত গরু ও শৃগাল), সাপ ও প্রকৃতি। এসবের মধ্য দিয়ে তিনি আবহমান বাংলার গ্রামীণ সমাজের সামগ্রিক রূপ, বাংলার নিসর্গ, স্বৈরশাসকদের অত্যাচার, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যার চিত্র চমত্কারভাবে তুলে ধরেন। তাঁর অঙ্কিত চিত্রকলা ষাটের দশকে বাঙালি জাতিসত্তা বিকাশের আন্দোলনে, সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে এবং ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে জনসাধারণকে দারুণভাবে উজ্জীবিত করেছে। কামরুল হাসানের চিত্রকলায় লৌকিক ও আধুনিক রীতির মিশ্রণ ঘটায় তিনি ‘পটুয়া কামরুল হাসান’ নামে পরিচিতি লাভ করেন। তিনি বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার চূড়ান্ত নকশা ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সরকারি মনোগ্রাম তৈরি করার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। চিত্রকলায় অসাধারণ অবদানের জন্য কামরুল হাসান বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পুরস্কার ও সম্মানে ভূষিত হন। সেসবের মধ্যে প্রেসিডেন্ট পুরস্কার (১৯৬৫), কুমিল্লা ফাউন্ডেশন স্বর্ণপদক (১৯৭৭), স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার (১৯৭৯), চারুশিল্পী সংসদ সম্মান (১৯৮৪), বাংলা একাডেমির ফেলো (১৯৮৫) এবং কাজী মাহবুবউল্লাহ ফাউন্ডেশন পুরস্কার (১৯৮৫) উল্লেখযোগ্য। তাঁর ‘তিনকন্যা’ ও ‘নাইওর’ চিত্রকর্ম অবলম্বনে যথাক্রমে যুগোস্লাভিয়া সরকার (১৯৮৫) ও বাংলাদেশ সরকার (১৯৮৬) দুটি স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করেছে।
১৬. হেমন্ত মুখোপাধ্যায়
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, (১৯২২-১৯৮৯) কণ্ঠশিল্পী, সুরকার। ১৯২২ সালের ১৬ জুন বারানসীতে তাঁর জন্ম। তিনি কলকাতায় বড় হয়ে ওঠেন। গায়ক হওয়ার উদ্দেশে তিনি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া ছেড়ে দিয়েছিলেন। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ধ্রুপদি সংগীতের শিক্ষা গ্রহণ করেন ওস্তাদ ফৈয়াজ খানের কাছে আর লঘু শেখেন শৈলেশ দাশগুপ্তের কাছে। তাঁর প্রথম গ্রামোফোন রেকর্ড প্রকাশিত হয় ১৭ বছর বয়সে, শেষ রেকর্ড ৬৪ বছর বয়সে। তাঁর সংগীতজীবন বিস্তৃত ছিল অর্ধশতাব্দীরও কিছু বেশি সময় ধরে। তাঁর প্রথম হিন্দি গানের রেকর্ড প্রকাশিত হয় ১৯৪০ সালে। তিনি হিন্দি গানের একজন প্রধান শিল্পী এবং সংগীত পরিচালক ছিলেন। কয়েকটি হিন্দি ছায়াছবিও তিনি প্রযোজনা করেন। তবে তিনি বাংলায় জনপ্রিয়তা অর্জন করেন আধুনিক গান এবং রবীন্দ্রসংগীতের জন্য। পঙ্কজ মল্লিক ও দেবব্রত বিশ্বাসের সঙ্গে একদিকে রবীন্দসংগীতকে তিনি শহুরে ভদ্রলোকদের বৈঠকখানা থেকে বের করে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেন, অন্যদিকে ভারী কণ্ঠকে গানের আদর্শ কণ্ঠ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। তাঁর প্রথম রবীন্দ্রসংগীতের ডিস্ক (প্রাঙ্গণে মোর শিরীষ শাখায় এবং হে নিরুপমা, ১৯৪৪) আজও জনপ্রিয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের সময় হেমন্ত বিভিন্ন সংগীতানুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে শরণার্থীদের জন্য অর্থ সংগ্রহে সহায়তা করেন। সংগীতে অবদানের জন্য তিনি অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেন। ১৯৮৯ সালে ঢাকা থেকে একটি পুরস্কারে ভূষিত হয়ে কলকাতায় ফিরে যাওয়ার পরেই ২৬ জুন তিনি মারা যান।
১৭. পঙ্কজ মল্লিক
পঙ্কজ মল্লিক, (১৯০৫-১৯৭৮) রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী, সুরকার, সংগীত পরিচালক। ১৯০৫ সালের ১০ মে কলকাতার এক বৈষ্ণব পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব থেকেই সংগীতের প্রতি আকৃষ্ট হওয়ায় তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা খুব বেশিদূর অগ্রসর হয়নি। ১৯২১ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করার পর তিনি বঙ্গবাসী কলেজে ভর্তি হন, কিন্তু এখানেই তাঁর পড়াশোনার সমাপ্তি ঘটে। জনৈক আত্মীয়ের নিকট শৈশবেই পঙ্কজ কুমারের সংগীতশিক্ষা শুরু হয়। পরে কলেজে অধ্যয়নকালে তিনি পুরোপুরি সংগীতের প্রতি মনোনিবেশ করেন এবং বিভিন্ন উত্সব-অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশন করতে থাকেন। এমনি এক অনুষ্ঠানে তাঁর পরিচয় হয় তত্কালীন বিখ্যাত গায়ক দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। তিনি পঙ্কজের মধ্যে সংগীতের অফুরন্ত সম্ভাবনা দেখতে পান এবং তাঁকে রাগসংগীতে তালিম দিতে শুরু করেন। এভাবেই তাঁর পদ্ধতিগত সংগীত শিক্ষার শুরু। পঙ্কজ বঙ্গবাসীতে অধ্যয়নকালেই রবীন্দ্রসংগীতের প্রতি ঝুঁকে পড়েন এবং রবীন্দ্রনাথের কবিতায় সুরারোপ করে গাইতে থাকেন। পরবর্তীকালে তিনি দীনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিকট রবীন্দ্রসংগীত শিক্ষা করেন। পঙ্কজ শুধু একজন শ্রেষ্ঠ রবীন্দ্রসংগীত শিল্পীই ছিলেন না, রবীন্দ্রসংগীতে তিনি অনেক নতুন মাত্রাও যোগ করেন, যার ফলে রবীন্দ্রসংগীত ঐশ্বর্যমণ্ডিত হয়। আগে রবীন্দ্রসংগীতে তবলা ব্যবহার করা হতো না, পঙ্কজকুমারই প্রথম এতে তবলা সংগত করেন। তাঁর আগে রবীন্দ্রসংগীত বিশেষ একটি গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। পঙ্কজকুমার তাঁর ওজস্বী কণ্ঠ, পৌরুষদীপ্ত গায়নরীতি এবং হূদয়ের আবেগ দিয়ে রবীন্দ্রসংগীতে নতুন প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেন। পঙ্কজ ১৯২৭ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে কলকাতা বেতারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এ সময় তিনি বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। ১৯২৯ সালে কলকাতা বেতারে সংগীত শিক্ষার আসর প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি তাঁর পরিচালক ও শিক্ষক হিসেবে দীর্ঘকাল যুক্ত ছিলেন। এই আসরের মাধ্যমেই তিনি মূলত রবীন্দ্রসংগীতকে জনসাধারণের নিকট জনপ্রিয় করে তোলেন। এই আসরে তিনি নজরুলের গানও শেখাতেন। ১৯৩২ সাল থেকে কলকাতা বেতার থেকে দুর্গাপূজা উপলক্ষে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ নামে যে সংগীতালেখ্য প্রচারিত হতে থাকে, পঙ্কজ ছিলেন তার অন্যতম উদ্যোক্তা। এ অনুষ্ঠানে তাঁর সংগীত পরিচালনা এক মহতী কীর্তি হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। রবীন্দ্রনাথের অনেক কবিতায় সুরারোপ করে পঙ্কজকুমার অসাধারণ খ্যাতি অর্জন করেন এবং রবীন্দ্রনাথের গানের পাশাপাশি সুরারোপিত এই কবিতাগুলোও তিনি গান হিসেবে রেকর্ড করেন। তাঁর রেকর্ডকৃত গানের সংখ্যা চার শতাধিক। সংগীতে অসাধারণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ১৯৩২ সালে সারস্বত মহামণ্ডল কর্তৃক ‘সুরসাগর’, ১৯৫৬ সালে ‘সংগীতরত্নাকর’, ১৯৭০ সালে ভারত সরকার কর্তৃক ‘পদ্মশ্রী’, ১৯৭৩ সালে ‘দাদা সাহেব ফালকে’ এবং ১৯৭৪ সালে টেগোর রিসার্চ ইনস্টিটিউিট কর্তৃক ‘রবীন্দ্রতত্ত্বাচার্য’ উপাধিতে ভূষিত হন। ১৯৭৮ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় তাঁর মৃত্যু হয়।
১৮. লায়লা আর্জুমান্দ বানু
লায়লা আর্জুমান্দ বানু, (১৯২৯-১৯৯৫) গায়িকা ও সমাজকর্মী। তিনি ১৯২৯ সালের ৫ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকার ইডেন বালিকা বিদ্যালয়ে লেখাপড়া শেষ করে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফারসি ও দর্শনশাস্ত্রে পড়াশোনা করেন এবং ১৯৪৯ সালে বিএ ডিগ্রি লাভ করেন। লায়লা আর্জুমান্দ বানু ওস্তাদ গুল মুহম্মদ খানের তত্ত্বাবধানে উচ্চাঙ্গসংগীতে প্রাথমিক তালিম গ্রহণ করেন। নজরুলসংগীত, রবীন্দ্রসংগীত, গজল, আধুনিক ও লোকসংগীতে তাঁর বহুমুখী প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁর অসাধারণ কর্মজীবন শুরু হয় ১৯৩৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর ‘অল ইন্ডিয়া রেডিও’র ঢাকা বেতার কেন্দ্রের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে একক সংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে। দশ বছর বয়সে প্রথম মুসলিম কণ্ঠশিল্পী হিসেবে তিনি ঢাকা বেতারে সংগীত পরিবেশন করেন। এমন এক সময় ছিল, যখন পর্দাপ্রথা নারীদের ঘরের বাইরে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণে নিরুত্সাহিত করত, তখন লায়লা আর্জুমান্দ বানু তাঁর পিতা বিশিষ্ট ঐতিহাসিক সৈয়দ মোহাম্মদ তৈফুর ও মা সারা তৈফুরের সক্রিয় সহযোগিতায় সকল বাধা-নিষেধের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। তিনি ১৯৬৮ সালে ইরানের শাহ রেজা পাহলবীর নিকট থেকে ‘অভিষেক পদক’ এবং ১৯৬৯ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের নিকট হতে ‘প্রাইড অব পারফরম্যান্স’ পুরস্কার গ্রহণ করেন। ১৯৭৭ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত তিনি ঢাকা সংগীত কলেজের অবৈতনিক অধ্যক্ষ ছিলেন। তিনি ঢাকা জাদুঘরের ট্রাস্টি, ‘নজরুল স্বরলিপি শুদ্ধীকরণ বোর্ড’-এর চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ সংস্কৃতি কমিশনের উপদেষ্টা কমিটির সদস্য এবং এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশের উদ্যোগে প্রকাশিত ঢাকা পাস্ট প্রেজেন্ট ফিউচারের সংগঠনিক কমিটির সদস্য ছিলেন। বিদেশে সাংস্কৃতিক সফরে বহুবার তিনি দেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। তাঁর মৃত্যু হয় ১০ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৫।
১৯. আবদুল লতিফ
লতিফ, আবদুল (১৯২৪-২০০৬) সংগীতশিল্পী, গীতিকার ও সুরকার। তিনি বরিশালের রায়পাশা গ্রামে ১৯২৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন। রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও ছোটবেলা থেকেই গানের প্রতি তাঁর আকর্ষণ ছিল। এ আকর্ষণ তাঁর গ্রামে তাঁকে গায়ক হিসেবে পরিচিত করে তোলে। আবদুল লতিফ আল্লাহ্-রসুলের প্রশংসায় ভরা আব্বাসউদ্দীনের গাওয়া নজরুলের একটি ইসলামি গান গেয়ে শোনান। আবদুল লতিফ কলকাতা থেকে ১৯৪৮ সালে ঢাকা আসেন। এখানে বিখ্যাত গায়ক ও সংগীত পরিচালক আবদুল হালিম চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। ১৯৪৭-পরবর্তীকালে হিন্দু শিল্পী-গীতিকারদের দেশত্যাগের ফলে পূর্ব বাংলায় বড় রকমের শূন্যতা সৃষ্টি হয়। এ সংকটমুক্তির লক্ষ্যে তিনি আবদুল লতিফকে গান লিখতে উদ্বুদ্ধ করেন। ১৯৪৯-৫০ সালে তিনি প্রথমে আধুনিক গান ও পরে লেখেন পল্লিগীতি। আবদুল লতিফের মেজাজে গণসংগীতের উপাদান ছিল। তাঁর গানগুলোয় পূর্ব বাংলার অধিকারবঞ্চিত মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ ঘটেছে। ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের সময়ে লেখা তাঁর সবেচেয়ে জনপ্রিয় ও বিখ্যাত গান—‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়’। ১৯৮৫ সালে বাংলা একাডেমি প্রকাশ করে তাঁর ভাষার গান, দেশের গান। এতে আছে বাংলা ভাষা-সম্পর্কিত ২৪টি, দেশের গান ৫১টি, ৯৫টি গণসংগীত, দুটি জারি এবং আটটি মানবাধিকার-সম্পর্কিত গান। তাঁর অন্য দুটি বইয়ের নাম দুয়ারে আইসাছে পালকি (মরমি গান) এবং দিলরবাব। ২০০৬ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি তাঁর মৃত্যু হয়।