বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংঘাতের ইতিবৃত্ত

সংঘাতময় বাংলাদেশ
সংঘাতময় বাংলাদেশ

সংঘাতময় বাংলাদেশ: অতীত থেকে বর্তমান—
বদরুল আলম খান, প্রথমা প্রকাশন, ২০১৫

‘আওয়ামী লীগ একমাত্র বিরোধী দল। তাকে বাধাহীনভাবে রাজনৈতিক তত্পরতা চালিয়ে যাওয়ার অধিকার দিতে হবে। কারণ, বিরোধী দল ছাড়া কোনো গণতন্ত্র কার্যকর হতে পারে না’—এই উক্তিটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের।১ বঙ্গবন্ধু ১৯৫২ সালের মে মাসে তত্কালীন পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিনের সঙ্গে করাচি শহরে অনুষ্ঠিত এক কথোপকথনে এই দাবি জানিয়েছিলেন। প্রবন্ধের শুরুতে এই উক্তি উদ্ধৃত করার কারণ হচ্ছে, বিরোধী দলগুলোর কর্মকাণ্ডের বিষয়ে এই উক্তিটি ১৯৫২ সালে যেমন যথাযথ ছিল, ২০১৬ সালেও তা একইভাবে প্রযোজ্য। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটের একের পর এক গণবিরোধী পদক্ষেপে জনগণের মনোভাব ক্রমে সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রতি বিষিয়ে উঠছে। ৫ জানুয়ারি, ২০১৪ সালের বিতর্কিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সম্মুখীন হয় বৈধতার সংকটে এবং এটাকে ইস্যু বানিয়ে ২০-দলীয় জোট শুরু করে রাজনীতির নামে জনগণের জানমাল ধ্বংস। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুসারে ১৮ মার্চ, ২০১৫ পর্যন্ত হরতাল-অবরোধে পেট্রলবোমা এবং আগুনে দগ্ধ হয়ে মারা যান ৩৭ জন। আসকের নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামালের মতে, ‘এ যেন লাগামহীন ভয়ের রাজত্ব’।২

জাতীয় রাজনীতির এই সংকটকালে প্রকাশিত হয়েছে ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন সিডনির অধ্যাপক, সমাজতাত্ত্বিক বদরুল আলম খানের ‘সংঘাতময় বাংলাদেশ, অতীত থেকে বর্তমান’ গ্রন্থটি। বাংলাদেশের রাজনীতিতে দ্বন্দ্বের উত্সমুখগুলো চিহ্নিত করার পাশাপাশি সর্বশেষ অধ্যায়ে লেখক এই সমস্যাগুলোর স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের পথ বাতলে দিয়েছেন। গ্রন্থটির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে, এটিতে তথ্যের সাথে সাথে সমাজতাত্ত্বিক এবং রাজনৈতিক বিভিন্ন তত্ত্বের আলোকে বাংলাদেশের ইতিহাসের নানা দিকের বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এই গ্রন্থে লেখকের মূল থিসিস হচ্ছে: ‘সংঘাত-মানসিকতা বাঙালির আত্মপরিচয়ের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের রূপ ধর্মীয় হবে নাকি ধর্মনিরপেক্ষ হবে...আত্মপরিচয়ের সাথে যুক্ত সেই সব প্রশ্ন আজও অদ্ভুতভাবে অমীমাংসিত রয়ে গেছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক অথবা ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক শক্তি রাষ্ট্রকে তাদের নিজের মতো করে সংজ্ঞায়িত করতে চায়।...দ্বৈত পরিচয়ের কলহে একটি আধুনিক রাষ্ট্র নির্মাণের কর্মসূচি এখানে হয় নিষ্ক্রিয়, নয়তো পদে পদে তা বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। অথচ দুই সামাজিক শক্তির দ্বন্দ্ব অন্তর্গতভাবে অথবা প্রকাশ্য রূপ নিয়ে সমাজ, রাষ্ট্র, সংস্কৃতির প্রতিটি ক্ষেত্রকে প্রভাবিত করে চলেছে। সেই আত্মপরিচয়গত সংঘাতই দেশটির রাজনীতির প্রধান উত্তেজক’ (পৃ. ১৫)। এই থিসিসকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লেখক সংঘাতের পাঁচটি উত্সমুখ চিহ্নিত করেছেন: ক. প্রকৃতি ও বিশ্বাসের জগতে দ্বন্দ্ব; এটিকে লেখক আদি ইসলামের সঙ্গে রাজনৈতিক ও লোকপ্রিয় ইসলামের দ্বন্দ্ব হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, খ. আত্মপরিচয়ের দ্বন্দ্ব, যা জাতীয়তাবাদকেন্দ্রিক, গ. রাষ্ট্রকাঠামো এবং গণতান্ত্রিকায়নের দ্বন্দ্ব, ঘ. ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতির দ্বন্দ্ব, যেখানে লেখক মুজিব-জিয়া এবং শেখ হাসিনা-খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক অবয়বের তুলনা এবং ব্যাখ্যা করেছেন এবং ঙ. গ্রাম ও শহরের মধ্যকার দ্বন্দ্ব, এ অংশে গ্রাম ও শহরের মধ্যে পরস্পরের ওপর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা ও ব্যর্থতার সমাজতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা রয়েছে।

বাঙালি কেন ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করল?

এই অঞ্চলের মানুষদের ইসলাম ধর্ম গ্রহণের পেছনে অন্য লেখক ও গবেষকেরা তিনটি কারণ উল্লেখ করেছেন: ক. শক্তি প্রয়োগ বা তরবারির ব্যবহার, খ. বর্ণবৈষম্যের কারণে ইসলামের সমতার নীতির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে এবং বাড়তি সুযোগ-সুবিধা ও প্রলোভনের কারণে এবং গ. আরব ও মধ্যপ্রাচ্য থেকে বিপুলসংখ্যক মানুষের পূর্ব বাংলায় আগমন এবং বসতি স্থাপন। লেখক এই তিনটি দাবির সব কটিকেই নাকচ করে দিয়েছেন। শাসকরূপী মুসলিমরা ভারতীয় উপমহাদেশে যেহেতু উত্তর-ভারত দিয়ে প্রবেশ করেছিল, সেহেতু জোর প্রয়োগ যদি ধর্মান্তরকরণের মূল কৌশল হয়ে থাকত, তাহলে পাঞ্জাব বা দিল্লিতেই বেশি মুসলমান থাকার কথা ছিল। কিন্তু বাস্তব চিত্র তার থেকে ভিন্ন। ফলে লেখক শক্তি প্রয়োগে ধর্মান্তরকরণ তত্ত্বটি নাকচ করে দিয়েছেন, অন্তত বাংলার এই অংশের ক্ষেত্রে তা শতভাগ সত্য। একইভাবে লেখক আগত মুসলমানদের স্থানান্তর এবং বসতি স্থাপনের উপপাদ্যটিও ভুল প্রমাণিত করেছেন। লেখক নানা তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরে দেখিয়েছেন, ভারতের অন্যান্য অংশের তুলনায় তত্কালীন পূর্ববঙ্গ এবং আজকের বাংলাদেশে ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রভাব কতটা কম ছিল। এর দ্বারা তিনি বর্ণবৈষম্যের কারণেই যে এই অঞ্চলে হিন্দু ও বৌদ্ধরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল, এই দাবির সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন। লেখকের মতে, ইসলামের সমন্বয়বাদী ধারাটিই মূলত সাধারণ গ্রামীণ মানুষকে আকর্ষণ করেছিল। এ ক্ষেত্রে সুফিবাদের প্রভাব ও সাফল্যের কথা লেখক বেশ যুক্তিসহকারে উপস্থাপন করেছেন।

বাংলায় সুফিবাদের দীর্ঘ বর্ণনা পাওয়া যাবে এই বইতে। এই ক্ষেত্রে লেখক আশ্রয় নিয়েছেন রিচার্ড ইটনের The Rise of Islam and The Bengal Frontier, 1204-1760 (১৯৯৩) বইয়ের। সুফিবাদের গ্রহণযোগ্যতার অন্যতম কারণ ছিল তাদের জীবনঘনিষ্ঠ জীবনাচরণ এবং কৃষক সমাজের সঙ্গে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারা। অন্যদিকে সুফিবাদের সঙ্গে বৈষ্ণব এবং শ্রমণদের আন্তযোগাযোগের মাধ্যমে একধরনের সাম্প্রদায়িক সহাবস্থান তৈরি হয়েছিল। বাংলার এই অংশের ইসলামকে লেখক নাম দিয়েছেন ‘বাঙালি ইসলাম’। এই ইসলাম বস্তুতান্ত্রিক এবং জীবনমুখী, যা নিম্নবর্ণের এবং লৌকিক ধর্মের অনুসারীদের সহজেই ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করেছিল। তবে কালের প্রবাহে এই সমন্বয়বাদী ইসলামের জায়গা দখল করে নেয় গোঁড়া ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা। এর কারণ হিসেবে লেখক দেখেছেন বাজার অর্থনীতির বিকাশকে। বাজার অর্থনীতির বিকাশের কারণে সুফিদের সঙ্গে সমাজের এলিটদের যোগাযোগ বৃদ্ধি পায়, ফলে সুফিরা মৌলবাদীদের আক্রমণের শিকারে পরিণত হওয়া শুরু করে। লেখকের ভাষায়, ‘...সুফিসাধকদের সম্পৃক্ততার ধরনটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারায় গড়ে উঠতে থাকে। জনকল্যাণের চেয়ে সেখানে ব্যক্তিমাহাত্ম্য প্রাধান্য পায়। সুফি দরগাগুলো অর্থ, সম্মান, রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার কেন্দ্রে পরিণত হতে থাকে। সমাজের এলিট শ্রেণি বা ক্ষমতাবানদের সঙ্গে সুফি-দরবেশদের আঁতাত ‘বাঙালি ইসলামে’র অভ্যন্তরীণ বাঁধনকে ঢিলেঢালা করে ফেলে’ (পৃ. ৬২)। এটাকেই লেখক ‘বাঙালি ইসলামের সংকটকালের শুরু’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের শুরু থেকেই হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ এবং ব্রিটিশদের সঙ্গে সহযোগিতা করার মাধ্যমে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নিজেদের অবস্থানের উন্নয়ন করে। বাস্তবিক অর্থে সে রকম কোনো সুবিধা না পেলেও, মোগলদের হাত থেকে শাসনক্ষমতা ইংরেজদের হাতে চলে যাওয়াকে মুসলিমরা নিজেদের পতন হিসেবে দেখা শুরু করে। ফলে ইংরেজ শাসনের শুরু থেকেই কোম্পানির শাসকেরা এবং মুসলিমরা একে অপরকে সন্দেহের চোখে দেখা শুরু করে। পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশদের ‘ভাগ করো, শাসন করো’ নীতি এবং মুসলিম নানা সংস্কারের কারণে ব্রিটিশদের সঙ্গে মুসলমানদের দূরত্ব কমে এলেও, তার পরিবর্তে জন্ম নেয় সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির বিষবাষ্প। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনোত্তর রাষ্ট্রে হিন্দুদের প্রাধান্য বৃদ্ধি পাবে—এই আশঙ্কায় মুসলিমরা আরও বেশিভাবে ধর্মীয় প্রতীকের ব্যবহারের দিকে ঝুঁকে পড়ে, তবে তা কোনোভাবেই তাদের ধার্মিকতা বৃদ্ধি করেছে, এমন প্রমাণ পাওয়া যায় না। ধর্ম পালন এবং ধর্মীয় চিহ্নের ব্যবহারের এই বৈপরীত্য এখনো আমাদের সমাজে বহুলাংশে পরিলক্ষিত হয়। ভারত ভাগ-পূর্ব রাজনৈতিকীকরণের যে প্রলম্বিত চক্রে ইসলাম ধর্ম আটকে পড়ে, তার প্রতিক্রিয়াতেই ভারতীয় উপমহাদেশ বিভক্ত হয় এবং ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি পৃথক বৈরী রাষ্ট্রের জন্ম হয়।

শহুরে এবং গ্রামীণ চেতনার সমন্বয়/আত্মপরিচয়ের দ্বন্দ্ব: জাতি বনাম ধর্ম

স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরও আমাদের জাতীয় পরিচয় ‘বাংলাদেশি’ হবে, না ‘বাঙালি’ হবে কিংবা জাতীয়তাবাদ ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ হবে, না ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’ হবে তা নিয়ে বিতর্ক চলছে। অনেক ক্ষেত্রে এসব বিতর্ক নিছক বিতর্কের বাইরে গিয়ে ব্যক্তিগত আক্রমণের পর্যায়ে চলে যায়। এসব বিতর্ক থেকে জাতীয় সংসদও মুক্ত নয়।৩ পরিচয়ের এই দ্বন্দ্বে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করে ‘ধর্মের গুরুত্ব’। প্রচলিত ইউরোপীয় ধারণা অনুসারে কতিপয় বাম দল ছাড়া বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক দলই ‘সেক্যুলার’ না। প্রায় সব রাজনৈতিক দলই কোনো না কোনোভাবে রাজনীতির ময়দানে ধর্মকে ব্যবহার করেছে এবং করছে। তবে ঐতিহাসিক কারণেই প্রকাশ্য ধর্মীয় দলগুলো ছাড়া মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলো বিশেষত আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারের বিষয়টি প্রকাশ্যে স্বীকার করে না। এর একটি কারণ হতে পারে, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন গণহত্যা বৈধকরণে ধর্মের ব্যবহার। তবে যখন আত্মপরিচয়ের বিতর্ক দেখা দেয়, তখন আওয়ামী লীগ নিজেকে তথাকথিত ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ দল হিসেবে প্রচার করে। অন্যদিকে, বিএনপি তার রাজনৈতিক মতাদর্শ এবং প্রচার-প্রচারণায় বারবার ধর্মের দোহাই দেয়। লেখকের মতে, আত্মপরিচয়ের দ্বন্দ্বে এই বিতর্ক থাকলেও, এই দুই পরিচয়ের কোনোটির ভিতই বাংলাদেশে শক্তিশালী হয়নি। কিন্তু মাঝে মাঝে ক্ষমতাসীন দলের পৃষ্ঠপোষকতায় ভিন্ন ভিন্ন সময়ে এই দ্বন্দ্বের ভারসাম্য বদলেছে। সবশেষ শাহবাগ আন্দোলনের মাধ্যমে আমরা বাঙালি জাতীয়তাবাদী শক্তির এক ধরনের উত্থান লক্ষ করেছি। যদিও নানা আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় কারণে তা দীর্ঘস্থায়িত্ব লাভে ব্যর্থ হয়েছে।

ঐতিহাসিকভাবে বাঙালি জাতীয়তাবাদ তিনটি ধাপ অতিক্রম করেছে বলে লেখকের অভিমত। প্রথম ধাপে, ভারতীয় উপমহাদেশে যখন ব্রিটিশ শাসনের শেষ পর্ব চলছে, তখন ঐতিহাসিক কারণেই ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদ জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং এর ভিত্তিতেই ভারত ও পাকিস্তান নামের দুটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়। যদিও এর মধ্যেই হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং শরত্ বসুর নেতৃত্বে অবিভক্ত স্বাধীন বাংলার আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছিল, যার মূল ভিত্তি ছিল বাংলা ভাষা এবং জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে বাঙালিদের জন্য একটি পৃথক জাতিরাষ্ট্র। এই আন্দোলনের ব্যর্থতা বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রথম উত্থান প্রয়াসকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে দেয়। দ্বিতীয় ধাপকে লেখক বাঙালি জাতীয়তাবাদের সফলতার আখ্যান হিসেবে বর্ণনা করেছেন। এই পর্যায়ে দীর্ঘ দুই দশকেরও বেশি সময়ের পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক কায়দায় শাসনের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতীয়তাবাদ জেগে ওঠে এবং এরই ধারাবাহিকতায় বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। জাতীয়তাবাদী এই ধারার পূর্ণতা লাভ করতে দীর্ঘ দুই দশকেরও বেশি সময় প্রয়োজন হলেও তার অঙ্কুর জন্ম নিয়েছিল ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এবং সময়ের পটপরিবর্তনে তা ক্রমশ ধর্মনিরপেক্ষ রূপ ধারণ করে।

তৃতীয় ধাপকে লেখক বাঙালি জাতীয়তাবাদের সংকটকাল হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড এবং পরবর্তী সময়ে জিয়া ও এরশাদের শাসনামলে বাঙালি জাতীয়তাবাদ তার মূল ভিত্তি থেকে দূরে সরে যায় বা বলা যায় বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্থলে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদকে স্থাপন করা হয়। এই পরিবর্তনের মূল কান্ডারি জিয়া এবং এরশাদ সরকার, তবে পরোক্ষভাবে হলেও স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার অর্থাত্ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারকে এর দায় থেকে অব্যাহতি দেওয়া যায় না। স্বাধীন বাংলাদেশে বাঙালি জাতীয়তাবাদের যাত্রা কেন ব্যর্থ হলো, তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে লেখক বলেছেন, ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ যে আধুনিক সমাজের অঙ্গীকার করেছিল, তা গড়ার প্রক্রিয়াকে বেশি দূর এগিয়ে নেওয়া তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। আর এখানেই তার মৌলিক ব্যর্থতা’ (পৃ. ৯৮)। তবে পরিচয়ের প্রশ্নে একজন ব্যক্তি একই সঙ্গে বাঙালি এবং মুসলিম পরিচয়কে আঁকড়ে ধরে পরিচিত হতে পারেন কি না, সে প্রশ্ন এখানে বরাবরই এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। এটি বাঙালি বুর্জোয়ার ব্যর্থতা। লেখকের মতে, ‘বাঙালি বুর্জোয়ার এই ব্যর্থতার কারণে ধর্ম ও জাতিপরিচয়কে এ দেশে একে অপরের বিপরীত মেরুতে স্থাপন করার সুযোগ সৃষ্টি হয়। এই টানাপোড়েনের উগ্রতা একদিকে যেমন জাতিপরিচয়কে বিসর্জন দিতে চায়, তেমনি অন্যদিকে আধুনিক সমাজ নির্মাণভাবনা ধর্মপরিচয়কে উপেক্ষা করে এগোতে চায়। এভাবে জাতিপরিচয় ও ধর্মপরিচয় পরস্পরের মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়’ (পৃ. ১০৬)। লেখকের মতে, অসম্প্রদায়িক ও আধুনিক সমাজ গড়ে তোলা যদি বাংলাদেশের লক্ষ্য হয়, তবে কোনো মধ্যপথ খুঁজতে হবে। কিন্তু মধ্যপথে ইসলামের ভূমিকা কী হবে এবং এই ইসলাম ধর্মনিরপেক্ষ বা সোজা কথায় অবিশ্বাসীদের (অ্যাথিইস্ট) কীভাবে মূল্যায়ন করবে সে প্রশ্ন কিন্তু থেকেই গেল।

অন্যদিকে জাতীয়তাবাদ প্রশ্নে শহুরে চেতনার সঙ্গে গ্রামের মানুষের চেতনাগত পার্থক্য ঘুচল কীভাবে বা তার যোগসূত্র কী ছিল, তা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে সমালোচকদের তোলা বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন লেখক। এ ক্ষেত্রে তাঁর বিশ্লেষণ ইতিহাস এবং লোকসাহিত্যকেন্দ্রিক। লেখকের যুক্তি, বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে গ্রামীণ জনগোষ্ঠী শহরের তুলনায় পিছিয়ে থাকলেও, মানসিকভাবে গ্রামের মানুষ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন নানা চিহ্নের মাধ্যমে। ভাষার জন্য ঢাকার রাজপথে ছাত্ররা প্রাণ দিয়েছেন, এই আত্মদান গ্রামের মানুষের মনে নাড়া দিয়েছিল প্রবলভাবে। লেখকের মতে, পলাশীর যুদ্ধ এবং কারবালার যুদ্ধের স্মৃতি তাদের মনে একটি ক্ষত তৈরি করেছিল। সেই ক্ষতে নতুন খোঁচা দেন ১৯৫২-এর ভাষাশহীদেরা এবং তা কাজ করে একধরনের পরোক্ষ জাতীয়তাবাদী উত্থানের।

অন্যদিকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের দ্বিতীয় উপাদান ‘সোনার বাংলা’র চেতনা পরিপূর্ণ ঐতিহাসিক উপাদানে। ‘গোলা ভরা ধান আর পুকুর ভরা মাছে’র মতো আপ্তবাক্য বাঙালির মননে ভর করেছে। ঐতিহাসিক হারানোর বেদনা, যা শুরু হয়েছিল পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজদ্দৌলার পরাজয়ের পর এবং পুনরায় সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন তাকে আরেকবার জাতীয়তাবাদী চেতনায় চাঙা করে তোলে। লেখকের মতে, সোনার বাংলার প্রশ্নে মাত্রাতিরিক্ত কল্পনাপ্রবণ হয়েছিলেন স্বাধীনতা-উত্তর নেতৃত্ব। কিন্তু বাস্তবতার বন্ধুর পথে চলতে গেলে যে বাধাগুলো সামনে আসতে পারে বা এসেছিল, তার বাস্তবিক বা তাত্ত্বিক কোনো যোগ-বিয়োগ নিয়ে সোনার বাংলার স্বপ্নদ্রষ্টারা ভাবেননি। এ ক্ষেত্রে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা এবং তা ঘিরে যে সংঘাতময় রাজনীতির উত্থান, সেই উদাহরণটি লেখক টেনেছেন বেশ পটু হাতেই।

১৯৭২-৭৫ সালকে লেখক বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে বিশ্লেষণ করেছেন এবং বাংলাদেশিমাত্রই এর কারণ উপলব্ধি করা কঠিন নয়। এই সময় জাতীয় ঐক্য বা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ তৈরি করা খুব সহজ ছিল বা গণতান্ত্রিক ভিত তৈরির জন্য জনগণ তুলনামূলকভাবে অধিকতর উপযোগী ছিল। কিন্তু তত্কালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সে সুযোগটি হাতছাড়া করেছিল, অন্য কথায় বললে নষ্ট করেছিল। সংসদে ৩০০ আসনের মধ্যে ২৯৩টি আসন থাকা সত্ত্বেও ২৫ জানুয়ারি, ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) গঠন করেছিল। রাজনৈতিক সহনশীলতা এবং আলোচনার বদলে ভিন্নমতের সব পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। রাজনৈতিক সংঘাতের বর্তমান চেহারার উত্তরাধিকার খুঁজতে গেলে তাই ১৯৭২-৭৫ সময়কালকে আলোচনার বাইরে রাখা উচিত হবে না বলেই লেখক মনে করেন।

রাষ্ট্র এবং গণতন্ত্র

একটি গণতান্ত্রিক স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্যই এ দেশের মানুষ পাকিস্তানি স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। স্বাধীনতার পর গণতান্ত্রিক পথেই রাষ্ট্র তার যাত্রা শুরু করেছিল। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি বাংলাদেশের সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বহুদলীয় সরকার পদ্ধতি বিলুপ্ত করে বাকশাল গঠন করা হয়। এর মাধ্যমে স্বাধীন হওয়ার পাঁচ বছরেরও কম সময়ের মধ্যেই রাষ্ট্র স্বাধীনতাসংগ্রামের অন্যতম গণদাবি এবং ১৯৭২ সালের সংবিধানের চার মূলনীতির (জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা) একটি থেকে বাংলাদেশ বিচ্যুত হয়। গণতন্ত্রের পরিবর্তে গণতন্ত্রহীনতাকে আঁকড়ে ধরে বাংলাদেশ। পাকিস্তানের সঙ্গে সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রের রাজনৈতিক কাঠামোর পার্থক্য কোথায়, লেখক এই প্রশ্ন তুলেছেন। গণতন্ত্রহীনতার এই রেশ এখনো থেকে গিয়েছে তা হয়তো কেউই অস্বীকার করবে না।

বাংলাদেশের গণতন্ত্রের অন্যতম দুর্বলতা হচ্ছে এখানে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বজায় রাখার জন্য যেসব প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন, যেমন শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন, নিরপেক্ষ বিচার বিভাগ, নিরপেক্ষ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ইত্যাদি এখানে গড়ে ওঠেনি বা গড়ে তোলা হয়নি। অন্যদিকে, এসব প্রতিষ্ঠান গড়ার দায়িত্ব যাদের ছিল, অর্থাত্ রাজনৈতিক দলগুলোও তাদের সংগঠনের মধ্যেই গণতন্ত্রের চর্চা চালু করতে পারেনি। তার পরিবর্তে ব্যক্তিই দলের হয়ে সব সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং এর ফলও হয়েছে করুণ। মিজানুর রহমান খানের৪ মতে, ‘স্বাধীন বাংলাদেশ যেহেতু গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি রাজনৈতিক দল গঠনের দিকে নজর দেয়নি, তাই সব সময় ব্যক্তিকে ওঠানো ও নামানোর রাজনীতিটা বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। তাই একদলীয় নয়, বাংলাদেশ আসলে ব্যক্তির শাসনের সংকটে বেশি ভুগছে।’

এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য দিনা এম সিদ্দিকী৫ বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির কয়েকটি পরস্পর-সম্পর্কিত প্রতিপাদ্য চিহ্নিত করেছেন। প্রতিপাদ্যগুলো হচ্ছে: ক. সংকটের সময় স্বৈরতান্ত্রিকতাবাদের ওপর নির্ভরতা, খ. সংসদের বাইরে রাজনৈতিক মতপার্থক্য/দ্বন্দ্ব সমাধানের চেষ্টা, গ. জাতীয়তাবাদী মতাদর্শকেন্দ্রিক দ্বন্দ্বগুলোর প্রতি মানুষের আকর্ষণ, ঘ. রাজনৈতিকভাবে ভিন্নমত পোষণকারীদের রাষ্ট্রবিরোধী হিসেবে তুলে ধরা এবং ঙ. নির্বাচিত এবং সামরিক উভয় সরকারের আমলেই পৃষ্ঠপোষণের রাজনীতির রমরমা অবস্থা। সিদ্দিকীর মতে, ‘এসবের ফলে ক্রমান্বয়ে একধরনের রাজনৈতিক, মতাদর্শিক এবং আচরণগত অন্তঃসারশূন্যতা তৈরি হচ্ছে।’

লেখক বাংলাদেশে গণতন্ত্রের বিকাশের পথে কিছু বাধা চিহ্নিত করেছেন। লেখকের মতে, রাজনৈতিক নেতাদের স্বৈরাচারী চরিত্র, অপরিপক্বতা, গণতন্ত্রের পরিধি ও গভীরতার সীমাবদ্ধতা, নিরপেক্ষ নির্বাচন না হওয়া, জবাবদিহির অভাব, দেশে নাগরিক সংস্কৃতির অভাব, নিরপেক্ষ আমলাতন্ত্রের অনুপস্থিতি ইত্যাদি বাংলাদেশে গণতন্ত্র বিকশিত না হওয়ার অন্যতম কারণ। গণতন্ত্র বিকশিত না হওয়ার কারণগুলোর মধ্যে নিয়মিত সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হওয়া অন্যতম কারণ। বিশেষ করে জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে প্রায়ই ক্ষমতাসীন দল চেষ্টা করে ক্ষমতাকে আঁকড়ে ধরতে এবং এটা নিশ্চিত করার জন্য তারা নানা অপকৌশলের আশ্রয় গ্রহণ করে থাকে। সর্বশেষ ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতাকে কেন্দ্র করে তত্কালীন রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ দেশে জরুরি অবস্থা জারি করেন এবং সেনা-সমর্থিত ফখরুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে। রাজনীতিবিদদের দেউলিয়াপনার কারণেই ১৯৯০ সালের পর সেনাবাহিনী আবার সরাসরি রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করার সুযোগ পেয়েছিল। এরপর ২০১১ সালের ৩০ জুন তারিখে ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকার সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে এবং বাংলাদেশের রাজনীতি পুনরায় সংকটের মুখে পড়ে। সর্বশেষ ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোট নির্বাচন বয়কট করে এবং জাতীয় সংসদে ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৪ জন সাংসদ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন, যা সংসদীয় সরকারব্যবস্থায় শুধু বাংলাদেশেই নয়, গোটা বিশ্বেই বিরল। এবার শুধু গণতন্ত্র নয়, গোটা নির্বাচনব্যবস্থাই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায়! এই সংকটের সমাপ্তিবিন্দুই বলে দেবে বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্রের শেষ পরিণতি কী হয়।

ব্যক্তিত্বের সংঘাত: মুজিব বনাম জিয়া

রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের ব্যক্তিত্বের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লেখক বলেছেন, ‘এখানে না আছে সংঘাতের সম্মানজনক মীমাংসার পথ অনুসন্ধানের আগ্রহ বা পরিকল্পনা, না আছে প্রতিদ্বন্দ্বীর প্রতি সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দেওয়ার কৌশলগত দক্ষতা। রাজনৈতিক নেতৃত্ব এখানে নিজ নিজ সংগঠনের কোটরে বসে বিভেদের উঁচু প্রাচীর নির্মাণ করে রেখছে। সে প্রাচীর ভেদ করে আত্মোপলব্ধির জাগরণ অসম্ভব’ (পৃ. ২১৫-১৬)। বাংলাদেশে রাজনীতিতে ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্বের ধ্রুপদি উদাহরণ হচ্ছে মুজিব বনাম জিয়া দ্বন্দ্ব। যদিও তাঁরা দুজন বেঁচে থাকার সময় তাঁদের মধ্যে কখনো সামনাসামনি বা পরোক্ষভাবে এই নিয়ে বিতণ্ডা হয়েছে, তার কোনো স্পষ্ট প্রমাণ নেই। তবে অনেকে মনে করেন মুজিবের হত্যাকাণ্ডে জিয়ার প্রত্যক্ষ সায় ছিল বা জিয়া আগে থেকেই হত্যা পরিকল্পনা সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে এ নিয়ে অনেক জল ঘোলা করা হয়েছে। কোনো গবেষণা বা সাক্ষ্যপ্রমাণ ছাড়াই একদল মুজিবকে বিতর্কের ঊর্ধ্বে ভাবছে, অন্যদল তাঁর প্রতিপক্ষ হিসেবে জিয়াকে দাঁড় করিয়ে, তাঁকে মুজিবের সমকক্ষ বা প্রতিপক্ষ বানানোর প্রয়াস নিয়েছে, এ দুটি প্রচেষ্টাকেই ভ্রান্ত হিসেবে ধরে নেওয়া যায়। 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি এবং অগ্রনায়ক, সে বিষয়ে কোনো ধরনের বিরোধ থাকার অবকাশ নেই। মুজিবনগর সরকার বঙ্গবন্ধুর নামেই এবং তাঁকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান মেনেই মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিল। অনেক ভুল-ভ্রান্তি থাকা সত্ত্বেও মুজিবই আমাদের প্রধান জাতীয় নেতা। অন্যদিকে জিয়াউর রহমানের অনেক কর্মকাণ্ড নিয়ে বিতর্ক থাকলেও, তিনি যে একজন জনপ্রিয় রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন তা বোধ করি অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে দুই নেতাই রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। লেখকের মতে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডটি শুধু ব্যক্তিকেন্দ্রিক ছিল না, তা ছিল মুজিবের রাজনৈতিক ভাবাদর্শ ও শাসননীতির প্রতিও আঘাত। এটি প্রমাণিত হয় তাঁর পরিবারের সদস্যদের এবং জাতীয় চার নেতার (সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামান) হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। অন্যদিকে জেনারেল জিয়ার পতনের ও হত্যাকাণ্ডের বীজ রোপিত ছিল তাঁর শাসনক্ষমতা গ্রহণের মধ্যেই। লেখকের মতে, ‘যে রাজনৈতিক কূটকৌশল ও ষড়যন্ত্রের আঁকাবাঁকা পথ ধরে জিয়াউর রহমান ক্ষমতা গ্রহণ করেছিলেন, সেই পথেই তাঁর দৈহিক ও রাজনৈতিক জীবনের সমাপ্তি ঘটে’ (পৃ. ২২০)। 

একটা বিষয় বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতিতে সত্য যে মুজিব এবং জিয়ার মতো শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়াও তাঁদের নিজ নিজ দলে রাজনৈতিক এবং সাংগঠনিকভাবে একক আধিপত্য বিস্তার করতে সমর্থ হয়েছেন। আজও তাঁদের ডাকে হাজার হাজার মানুষ রাজপথে নামতে ইচ্ছুক। ফলে জনপ্রিয়তার প্রশ্নে তাঁরাই বাংলাদেশের রাজনীতির দুই অভিভাবক। অন্যদিকে ইতিহাস যে রকমই হোক না কেন মুজিব এবং জিয়া বাংলাদেশের রাজনীতির দুই ঐতিহাসিক রাষ্ট্রনেতা। লেখকের মতে, ‘বাংলাদেশের মানুষের মনে, যেভাবেই হোক, এই বিশ্বাস জন্ম নিয়েছে যে শেখ মুজিব ও জিয়াউর রহমান উভয়ই জাতির জন্য অপরিহার্য। উভয়েরই ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুটি দিকই রয়েছে’ (পৃ. ২২৭)। কিন্তু, তাঁদের ব্যক্তিগত বা রাজনৈতিকভাবে পরস্পরের সঙ্গে তুলনা করা বা সমকক্ষ মনে করা চূড়ান্ত বোকামির কাজ। শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রেও প্রায় একই কথাই প্রযোজ্য। যদিও বর্তমানে নেতৃত্ব, দূরদর্শিতা এবং আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন বিষয়ে তত্পরতায় শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়াকে অনেকখানি ছাড়িয়ে গিয়েছেন বলা বোধকরি অন্যায্য হবে না। অন্যদিকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে জাতীয় চার নেতার রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক অবদানকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করতে হবে। এটা ঐতিহাসিক সত্য যে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ কোনো একক প্রচেষ্টা ছিল না, এটা ছিল বাংলাদেশের মানুষের একটি সম্মিলিত প্রয়াস।

গ্রাম-শহরের বিরোধ

বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত মূলত গ্রামনির্ভর রাষ্ট্র। বর্তমানের জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ শহরে বাস করলেও, প্রায় প্রত্যেকেরই গ্রামের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যোগাযোগ রয়েছে। এখনো ঈদ বা পূজার মতো ধর্মীয় উত্সবগুলোতে লাখো মানুষ ঢাকা-চট্টগ্রামের মতো বড় শহরগুলো থেকে গ্রামের বাড়িতে ফিরে যায়। এই বন্ধন সত্ত্বেও, লেখকের মতে গ্রাম ও শহরের মধ্যে একটি প্রচ্ছন্ন বিরোধ বিদ্যমান। সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে লেখক বলেছেন, মনোজাগতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে শহর তার উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রামের মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে সমাজকাঠামোয় পরিবর্তন নিয়ে আসবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বাংলাদেশি বুর্জোয়া শ্রেণির অপরিণত বিকাশের ফলে প্রয়োজনীয় মনোজাগতিক বিকাশ এখনো এখানে অপরিপক্ব। ফলে গ্রামকে প্রভাবিত করা দূরে থাক, তারা নিজেরাও নাগরিক সচেতনতার মূলমন্ত্র আত্মস্থ করতে পারেনি।

অন্যদিকে প্রকৃত শিক্ষার অভাব এবং আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক নানা কারণে বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবন এখনো অনেকটাই রক্ষণশীল। এই রক্ষণশীলতার অন্যতম একটি উপাদান হচ্ছে ধর্মীয় বিষয়গুলোতে বিদ্যমান মারাত্মক স্পর্শকাতরতা। এই ধর্মীয় স্পর্শকাতরতা থেকে শহরের মানুষও মুক্ত নয়, কারণ তাদের অধিকাংশই মূলত অর্থনৈতিক এবং শিক্ষাগত কারণে গ্রাম থেকে সরাসরি শহরে এসেছে। ফলে একদিকে শহুরে আধুনিকতা এবং অন্যদিকে গ্রামীণ রক্ষণশীলতা একধরনের দ্বন্দ্বের জন্ম দিয়েছে। লেখকের মতে, ‘সমাজে সমস্যা-সংকট, পশ্চাত্পদতা বা অনুন্নয়ন, অনাচার, দুর্নীতি প্রতিকারের অন্য কোনো আদর্শ না থাকায়, ধর্মীয় চেতনা রাজনৈতিক ভাষায় পরিণত হয়েছে’ (পৃ. ২৯২)। অনেক ক্ষেত্রেই এই দ্বন্দ্ব ব্যক্তি পর্যায়ে সুপ্ত থাকলেও, জাতীয় রাজনৈতিক এবং সামাজিক কাঠামো এর থেকে পরিত্রাণ পায় না, কারণ এসব ব্যক্তির সমন্বয়েই বৃহত্তর সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলে গ্রাম ও শহরের মধ্যে মনোজাগতিক সমৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য না থাকায়, গ্রামের ওপর শহরের প্রভাব প্রয়োজনের তুলনায় স্বল্প। এই স্বল্পতা একধরনের ভারসাম্যহীনতা ও দ্বান্দ্বিকতার জন্ম দিয়েছে। এই দ্বান্দ্বিকতার প্রশমন কীভাবে হবে, তা অনেকটা জাতিরাষ্ট্রের ভবিষ্যত্ গতিপথের ওপরই নির্ভর করবে।

শেষ কথা: সংঘাত নিরসনের পথ

এটি শেষ অধ্যায়ের শিরোনাম। এই অধ্যায়ে বইটিতে আলোচিত দ্বন্দ্বগুলো সমাধানে লেখক কিছু সুনির্দিষ্ট সমাধানের পথ বাতলে দিয়েছেন। সমাধানগুলোর মধ্যে পাঠক অতটা নতুনত্ব খুঁজে নাও পেতে পারেন। এসব সমাধানের কথা আমরা বিগত আড়াই দশক অর্থাত্ ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকেই শুনে আসছি। সমাধানের এসব পথের অধিকাংশের সঙ্গেই একমত হলেও, কিছু বিষয় নিয়ে সচেতন পাঠক দ্বিমত পোষণ না করে হয়তো মানসিক শান্তি পাবেন না। বিদ্যমান দ্বন্দ্বগুলো সমাধানে লেখক একধরনের সামাজিক চুক্তির কথা বলেছেন, যার মাধ্যমে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো সুনির্দিষ্ট বিষয়ে মতৈক্য ঘোষণা করবে। লেখকের মতে, ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় সব কর্মকাণ্ড মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে পরিচালিত হবে...’ (পৃ. ৩০০)। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস হচ্ছে, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ এই প্রপঞ্চটির সংজ্ঞায়ন নিয়েও এখনো রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব বিদ্যমান। মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাপত্রকে৬ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মূল দলিল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সেটি একটি চমত্কার পথ হতে পারে। কিন্তু যাঁরা এই দাবির সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করবেন তাঁদের ক্ষেত্রে সংজ্ঞায়নের এই দ্বন্দ্বটি থেকেই যাচ্ছে।

অন্য একটি বিষয় আলোচনায় আনা জরুরি মনে করছি। বিষয়টি বেশ স্পর্শকাতর এবং ততটাই গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান সময়ে এবং বিগত বছরগুলোতে যেকোনো ব্যক্তিকে, যিনি শাসকদলের কোনো মতামত, নীতি বা সিদ্ধান্তের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেছেন, তাকে বা তাদের ‘স্বাধীনতাবিরোধী’ বা ‘দেশদ্রোহী’ বা ‘পাকিস্তানের দালাল’ ইত্যাদি অভিধায় চিহ্নিত করা হয়েছে। যদিও এই সংস্কৃতি নতুন কিছু নয়। ১৯৭৩ সালের সাধারণ নির্বাচনের আগে তত্কালীন ছাত্রলীগ নেতা নূরে আলম সিদ্দিকী ঘোষণা করেন যারা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ভোট দেবে তারা ‘রাজাকার’ এবং ‘স্বাধীনতার শত্রু’।৭ বিগত বিএনপি এবং তারপর চারদলীয় জোটের শাসনকালেও যখনই কেউ তাদের সমালোচনা করেছে, তাদের গণহারে ‘ভারতের দালাল’ বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে ‘ইসলামের শত্রু’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এখন যদি আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মতো মৌলিক বিষয়গুলোতে জাতীয় মতৈক্যে পৌঁছাতে পারি, তবে এসব অসার বাক্যবিনিময় রাজনীতিতে কিছুটা হলেও কমবে বলে আশা করা যায়। কারণ মনে রাখতে হবে, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম চেতনা বা প্রেরণা ছিল জাতি-ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গনির্বিশেষে গণতান্ত্রিক এবং শোষণমুক্ত শাসনব্যবস্থা গড়ে তোলা। যেখানে দ্বিমতের এবং যুক্তিযুক্ত বিরোধিতার যথেষ্ট স্থান থাকবে। এর প্রমাণ হিসেবে আবারও স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের কথা টানতে হয়। মুক্তিযুদ্ধের অনেকগুলো রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ঐতিহাসিক কারণ থাকলেও, মূলত ১৯৭০ সালের পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে গণতান্ত্রিকভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার পরও আওয়ামী লীগকে সরকার গঠন করতে না দেওয়াই এবং ২৫ মার্চের কালরাতে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর নির্মম গণহত্যার ঘটনাই মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম তাত্ক্ষণিক কারণ হিসেবে কাজ করেছিল।৮

রাজনৈতিক ও সামাজিক চুক্তি বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ৯ কিছু সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব তুলে ধরেছেন। সেই প্রস্তাবগুলো বিবেচনাযোগ্য, তাই প্রস্তাবগুলো এখানে হুবহু তুলে ধরছি। আহমেদের মতে এই চুক্তি বা রাজনৈতিক মতৈক্যের বিষয়গুলো হতে পারে:

‘১. ১৯৭১-এর ব্যাপারে কোনো আপস না করা। যেমন: যুদ্ধাপরাধ যদি কেউ করে, সেই অপরাধকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবেই দেখতে হবে। তবে একে যেন দলীয় রাজনীতির অংশ হিসেবে না দেখা হয়, তথা এর রাজনৈতিকীকরণ করা যাবে না। এ বিষয়টিকে নির্বাচন বা রাজনীতির ঊর্ধ্বে রাখতে হবে। যেহেতু এটা জনগণের দাবি, তাই আইনের শাসনের অংশ হিসেবেই একে দেখতে হবে। সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই।

২. জাতির পিতার ব্যাপারে, তাঁর অবদানের স্বীকৃতি বিষয়ে জাতীয়ভাবে অবস্থান গ্রহণ করতে হবে।

৩. বাংলাদেশের ফাউন্ডিং হিরো তথা প্রতিষ্ঠা নায়কেরা যেমন মাওলানা ভাসানী, তাজউদ্দীন আহমদ, জিয়াউর রহমানসহ যাঁরা স্বাধীনতাসংগ্রামের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বড় অবদান রেখেছেন, তাঁদের উচ্চসম্মানের আসন দিতে হবে, পরে তাঁদের ভূমিকা যা-ই হোক।

৪. ঘৃণা-বিদ্বেষের ভাষণ তথা ‘হেইট স্পিচ’ থেকে বিরত থাকা। সেটা সংসদের ভেতরে বা বাইরে যেখানেই করা হোক। রাজনৈতিক নেতা, সরকারি কর্মকর্তা, সিভিল সোসাইটি বা অন্য যেখানেই কেউ থাকুন, সবাইকেই এ ব্যাপারে দায়িত্বশীল হতে হবে।

৫. হরতাল ডাকা যেতে পারে, কিন্তু পিকেটিং করা বা কাউকে বাধ্য করা যাবে না। একে জনগণের ওপর ছেড়ে দিতে হবে। পিকেটিং বা সহিংসতা হলে তা ফৌজদারি অপরাধ বলে গণ্য হবে।

৬. দলগুলোর অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র নিশ্চিত করতে হবে। রাজনৈতিক দল যেহেতু জনগণের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়, সেহেতু তারা বলতে পারে না তারা নিজেদের মতো করে দলের নিয়মকানুন ঠিক করে নেবে। সব দলীয় পদে দলীয় নির্বাচন দিতে হবে এবং কোনো নেতা এক পদে দুই মেয়াদের বেশি থাকতে পারবেন না। ওই পদে ফিরে আসতে হলে তাঁকে মাঝখানে বিরতি দিয়ে আসতে হবে।

৭. সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ আসনের জোরে সংবিধান সংশোধন করা যাবে না। দেখা যায় ৫০ শতাংশের কম ভোট পেয়ে সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া সম্ভব। সুতরাং মৌলিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হলে গণভোট দিতে হবে।’

অন্যদিকে ১৯৯০ সালে তিনজোটের (আওয়ামী লীগ, বিএনপি এবং বাম দলগুলো) যে রূপরেখা সেটাকেও সমস্যা সমাধানের পথ হিসেবে বিবেচনা করা যায়, যদিও তাতে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’র মতো আদর্শিক বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত ছিল না। কিন্তু বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রওনক জাহানের মতে, এ ধরনের চুক্তি সম্পাদনের জন্য বর্তমান সময় ১৯৯০ সালের তুলনায় বেশ ভিন্ন। জাহানের মতে, ১৯৯০ সালে জোটগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি করার জন্য ছাত্রসংগঠনগুলো ছিল এবং সমঝোতার কাজটি করেছিল বাম দলগুলো; বর্তমানে যার কোনোটিই আগের মতো সংগঠিত এবং রাজনৈতিক পরিবর্তন আনতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ নয়। তবে তিনি সমাধানের একটি পথও বাতলে দিয়েছেন। তাঁর মতে, এ ক্ষেত্রে বর্তমান ক্ষমতাসীন জোটের নেতা শেখ হাসিনাকেই এগিয়ে আসতে হবে। জাহান মনে করেন, ‘এই পরিস্থিতিতে স্রেফ আওয়ামী লীগের নেতা শেখ হাসিনা যদি মনে করেন, বিএনপির কিছু দাবি মেনে নিলে তাঁর আলোকিত স্বার্থ সংরক্ষিত হবে, তাহলেই কোনো ঐকমত্য হতে পারে’।১০

‘গণতন্ত্রায়ণ-সংক্রান্ত স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা’র আওতায় লেখক অন্যান্যের মধ্যে একটি বিষয় সুপারিশ করেছেন: শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধকরণ। প্রথমত, এটা স্বীকার করে নিতে হবে যে বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বর্তমানে ছাত্ররাজনীতি একটি আতঙ্কের নাম। প্রায় সময়ই বিবদমান দলগুলোর মধ্যে বা একই দলের বিবদমান উপদলগুলোর মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ঘটে। এতে শুধু শিক্ষার পরিবেশই ব্যাহত হচ্ছে তা-ই নয়, প্রায়ই শিক্ষার্থীরা গুরুতরভাবে আহত হন এবং নিহত শিক্ষার্থীর সংখ্যাও কম নয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করে দিলেই এসব দ্বন্দ্বের সমাপ্তি হবে কি না এবং এর চেয়েও মৌলিক প্রশ্ন হচ্ছে ‘ছাত্ররাজনীতি’র নামে যা করা হচ্ছে, তা আদৌ রাজনীতির কোনো সংজ্ঞায়নে পড়ে কি না। ঐতিহাসিকভাবেই আমাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড কিছুটা সংঘর্ষপ্রবণ, লেখক তাত্ত্বিকভাবে তা ব্যাখ্যাও করেছেন। কিন্তু এই যুক্তিতে প্রতিপক্ষকে দিনের আলোয় বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে এবং কোনো কোনো সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সামনেই হত্যা করাকে জায়েজ করা যায় না। তাই নিষিদ্ধকরণের পরিবর্তে মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত ছাত্ররাজনীতির পুনর্গঠন। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোকেই উদ্যোগী হতে হবে। ক্যাম্পাসে সংঘর্ষকে নিছক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হিসেবে বিবেচনা করে প্রচলিত আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে। যদিও রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা হবে, তবে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব চাইলে এসব বাধা উপেক্ষা করা অসম্ভব নয় বলেই আশা করি।

উপসংহার

নিত্যদিনের হাজারো সমস্যা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। এগিয়ে যাওয়ার এক সহজাত প্রবৃত্তি আছে বাংলাদেশের মানুষের। স্বাধীনতা অর্জনের পাঁচ বছরের মধ্যেই একটি বড় দুর্ভিক্ষ, তিনটি সফল সামরিক অভ্যুত্থান, ৩০টি ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থান এবং চারটি ভয়াবহ বন্যার পরও বাংলাদেশ তার তলাবিহীন ঝুড়ি হওয়ার দুর্নাম দূর করতে সক্ষম হয়েছে।১১ এ দেশের মানুষের অমিত সম্ভাবনা এবং প্রাণশক্তির জোরেই, সুষ্ঠু শাসনের এত অভাব এবং দুর্নীতির রমরমা অবস্থা সত্ত্বেও অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রায় সবগুলো সূচকেই বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। সঠিক রাজনৈতিক নেতৃত্বের অভাবে বাংলাদেশ তার যোগ্য সম্ভাবনা যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারছে না। রাজনৈতিক সংঘাত এবং দুর্বৃত্তপরায়ণতার সঙ্গে সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে একদল ক্ষমতালোভী রাজনীতিবিদ, যারা ব্যক্তিস্বার্থের জন্য রাষ্ট্রকে ব্যবহার করছে। অন্যদিকে, শাসকশ্রেণি তার একাধিপত্য ধরে রাখতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কায়েম করছে ত্রাসের রাজত্ব। এরপরও আমরা আশাবাদী। আশার পাখায় ভর করেই আমরা আগামীর পথ চলতে চাই। এই প্রসঙ্গে মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী, নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অং সান সু চির কিছু কথা আমাদের আশার ভিত্তিমূলকে আরও দৃঢ় করতে পারে। সু চি তাঁর ‘ভয় থেকে মুক্তি’ শীর্ষক এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘যখন মানুষের মৌলিক মানবাধিকার অস্বীকার করা হয়, তখন ভয়ই নিয়মে পরিণত হয়। কিন্তু মানুষের পক্ষে কখনোই পুরোপুরি ভয়ের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো সম্ভব হয়ে ওঠে না। সে কারণেই এমনকি কঠিনতম সময়েও সাহসে ভর করে জেগে ওঠে মানুষ। কারণ ভয় তার সহজাত প্রবৃত্তি নয়, বরং সাহসই তার সহজাত’।১২

আমরা আশা করি, বাংলাদেশ অচিরেই সব ধরনের রাজনৈতিক সংঘাত সমাধানের প্রচেষ্টা শুরু করবে এবং এ ক্ষেত্রে বদরুল আলম খানের ‘সংঘাতময় বাংলাদেশ, অতীত থেকে বর্তমান’ গ্রন্থটি হবে একটি সময়োপযোগী দিকনির্দেশক।

তথ্যসূত্র:

১. শেখ মুজিবুর রহমান (২০১২), অসমাপ্ত আত্মজীবনী, ইউপিএল, ঢাকা, পৃ.২১৩।

২. সুলতানা কামাল (২০১৫), ‘ভয়ের সংস্কৃতি বনাম মানবাধিকার সংস্কৃতি’, আসক বুলেটিন, মার্চ, ২০১৫, ঢাকা।

৩. সংসদে অশালীন ভাষা, দৈনিক যুগান্তর, ২২ জুন, ২০১৩. http://www.jugantor.com/editorial/2013/06/22/7203 (সর্বশেষ দেখা হয়েছে ২২ ডিসেম্বর, ২০১৫)।

৪. মিজানুর রহমান খান (২০১৫), স্বায়ত্তশাসন বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ ও গণতন্ত্র, প্রতিচিন্তা, অক্টোবর-ডিসেম্বর সংখ্যা ২০১৫, পৃ. ১৫১-১৭৪।

৫. দেখুন Dina Mahnaz Siddiqi, Political Culture in Contemporary Bangladesh: Histories, ruptures and contradictions, in Ali Riaz and C. Christine Fair (edt.) (2011), Political Islam and Governance in Bangladesh, Routledge, New York.

৬. ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল তারিখে মুজিবনগর সরকারের জারিকৃত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র. সপ্তম তফসিল [১৫০(২) অনুচ্ছেদ], গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান, পুনর্মুদ্রণ, অক্টোবর ২০১১।

৭. দেখুন Muntassir Mamoon and Jayanta Kumar Ray (1996), Civil Society in Bangladesh: Resilience and Retreat, firma KLM, Calcutta, p. 106. ewYÆZ nGqGQ, Dina Mahnaz Siddiqi, Political Culture in Contemporary Bangladesh: Histories, ruptures and contradictions, in Ali Riaz and C. Christine Fair (edt.) (2011), Political Islam and Governance in Bangladesh, Routledge, New York.

৮. সলিমুল্লাহ খান (২০১৪), মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, www.bdnews24.com http://opinion.bdnews24.com/bangle/archives/16290 (সর্বশেষ দেখা হয়েছে ২০ ডিসেম্বর, ২০১৫)। 

৯. ইমতিয়াজ আহমেদ, রাজনৈতিক এবং সামাজিক চুক্তি জরুরি, প্রথম আলো, ২২ ডিসেম্বর, ২০১৫।

১০. রওনক জাহান, গণতান্ত্রিক উত্তরণের ২৫ বছর, প্রথম আলো, ২২ ডিসেম্বর, ২০১৫।

১১. মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, বাংলাদেশ প্যারাডক্স: বাংলাদেশ নামক ধাঁধা, প্রথম আলো, নববর্ষ সংখ্যা ১৪২০ বঙ্গাব্দ, ১৪ এপ্রিল, ২০১৩।

১২. উদ্ধৃত হয়েছে, সুলতানা কামাল, আসক বুলেটিন, মার্চ ২০১৫।