বাংলাদেশে গণতন্ত্র সংকটাপন্ন বা সংকটাপন্ন হতে পারে—এ ধরনের কথা আমরা অহরহই শুনে থাকি। দেশের ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলই শুধু নয়, বিশ্লেষক ও সিভিল সোসাইটি বা জনসমাজের সদস্যরা এ ধরনের আশঙ্কা প্রকাশ করে থাকেন। কমবেশি সবাই বলেন যে বাংলাদেশে গণতন্ত্র টেকসই হয়নি বা তার শিকড় গভীরভাবে প্রোথিত নয়। দুই দশকের বেশি সময় ধরে নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় থাকলেও কোনো রকম চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার মতো গণতন্ত্র যে প্রতিষ্ঠিত হয়নি, সেটা সহজেই লক্ষণীয়। গণতন্ত্রের এই সংকট বা সম্ভাব্য সংকটের বিষয়টি যে কল্পনাপ্রসূত নয়, তা-ও বোধগম্য। এই বক্তব্যের পেছনে যুক্তি ও উদাহরণের অভাব হবে না। ২০০৬ সালে যে রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি হয়েছিল, তা-ই বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ভঙ্গুরতার একটা বড় উদাহরণ। অন্যান্য সূচকের মধ্যে রয়েছে পার্লামেন্টের অকার্যকারিতা, আইনের শাসনের অভাব, বিচার বিভাগের রাজনৈতিকীকরণ। এই বৈশিষ্ট্যগুলো যেহেতু বিশেষ কোনো একটি সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়, সেহেতু বিশ্লেষকেরা যথাযথভাবেই দাবি করেন যে এগুলো দেশের শাসনব্যবস্থার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। অব্যাহত আইনবহির্ভূত হত্যা এবং এ ধরনের কাজে যুক্ত অপরাধীদের দায় থেকে অব্যাহতি বাংলাদেশে গণতন্ত্রের দুর্বলতার একটা সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট লক্ষণ। সাম্প্রতিক কালে ‘নিখোঁজ’ বা ‘গুম’ হওয়ার ঘটনার শঙ্কাজনক বৃদ্ধিও এই লক্ষণের মতোই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের রাজনৈতিক শ্রেণী, দল-নির্বিশেষে, এসব বিষয় চিহ্নিত করা এবং তা মোকাবিলায় পদক্ষেপ গ্রহণে অনুত্সাহী।
বাংলাদেশের মানুষ যে গণতন্ত্রাকাঙ্ক্ষী, এ বিষয়ে সংশয় থাকার কোনো কারণ নেই। এ দেশের গণতন্ত্রাকাঙ্ক্ষী মানুষের অধিকারের প্রতি পাকিস্তানি শাসকেরা সম্মান জানাতে ব্যর্থ হয়েছে বলেই স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসের দিকে তাকালে কমপক্ষে তিনটি সুস্পষ্ট সূচক এই গণতন্ত্রাকাঙ্ক্ষার প্রমাণ বহন করে: অসংখ্য রাজনৈতিক দল, বিভিন্ন সময়ে গণ-আন্দোলন এবং জাতীয় নির্বাচনে ব্যাপক সংখ্যায় অংশগ্রহণ। এই আকাঙ্ক্ষা সত্ত্বেও বাংলাদেশে গণতন্ত্রের সংকট অব্যাহত রয়েছে বলেই আমরা একমত হতে পারি।
এই পটভূমিকায় বর্তমান প্রবন্ধে আমি বাংলাদেশে বিরাজমান ‘গণতন্ত্র’-এর প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করব। আমি এই যুক্তি তুলে ধরব যে বিরাজমান ব্যবস্থায় ‘অগণতান্ত্রিক’ বলে সহজে শনাক্তযোগ্য কতিপয় বৈশিষ্ট্য একটি বিশেষ ধরনের ত্রুটিপূর্ণ (Defective) গণতন্ত্রের লক্ষণ। যদিও এই বিশেষ ধরনের ‘গণতন্ত্র’ গণতন্ত্রায়ণ (Democratization) প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই উদ্ভূত হয়েছে। তবু তা গণতন্ত্রায়ণ-প্রক্রিয়ার একটি স্তর কি না, তা প্রশ্নসাপেক্ষ। এই প্রবন্ধে গত দুই দশকের রাজনৈতিক ঘটনাবলির বর্ণনা উপস্থাপন করা আমার লক্ষ্য নয়। বরং, আমার লক্ষ্য হচ্ছে, গণতান্ত্রিক শাসন ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদান বিষয়ে ভূয়োদর্শনলব্ধ উপাত্তের (Empirical Data) ভিত্তিতে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের গুণাগুণ বিচার করা।
আমার বক্তব্য অনুধাবনের জন্য গণতন্ত্র ও গণতন্ত্রায়ণ, বিশেষত গণতন্ত্রায়ণ বিষয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন। বিশ্বজুড়ে গত এক দশকে বিপরীত স্রোতে গণতন্ত্রের যাত্রা (Reverse wave) বিশ্লেষকদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে।১ বিশেষ করে মনোযোগ আকর্ষণ করেছে নতুন ধরনের শাসনব্যবস্থার উত্থান, যাকে বিশ্লেষকেরা হাইব্রিড রেজিম বলে বর্ণনা করছেন। এই আলোচনায় আমি এ ধরনের শাসনকে ‘সংকর শাসনব্যবস্থা’ বলে বর্ণনা করব। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের বিষয়ে আলোচনায় এই সংকর শাসনব্যবস্থার প্রসঙ্গটি সোপান হিসেবে বিবেচিত হবে।
গণতন্ত্রের সংজ্ঞা
গণতন্ত্রের কোনো সর্বজনীন সংজ্ঞা নেই। কেননা, কাল ও স্থানভেদে গণতন্ত্রের পার্থক্য ঘটে। সহজ ভাষায়, যেকোনো দুটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে ফারাক লক্ষ করা যায়। গণতন্ত্রের সংজ্ঞার প্রশ্নটি রাষ্ট্রবিজ্ঞানে দীর্ঘদিন ধরেই আলোচিত ও বিতর্কিত। কয়েক দশক ধরে গণতন্ত্র ও গণতন্ত্রায়ণ-বিষয়ক গবেষণা, আলোচনা ও পর্যবেক্ষণে গণতন্ত্রের সংজ্ঞা ও গণতন্ত্রের প্রকৃতি নিয়ে ব্যাপকভাবে আলোচনা হয়েছে।
সমাজবিজ্ঞানে, বিশেষত রাষ্ট্রবিজ্ঞানে, গণতন্ত্রের অর্থ নিয়ে চিন্তাভাবনার মধ্যে দুটি প্রধান ধারা রয়েছে। এর একটি ধারায় গণতন্ত্রকে বিবেচনা করা হয় একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা হিসেবে, যা নির্দিষ্ট ‘নির্বাচনী’ ও ‘পদ্ধতিগত’ মানদণ্ড (বা নির্ণায়ক) অর্জনে সক্ষম হয়েছে। অন্য ধারাটিতে গণতন্ত্র ও গণতন্ত্রায়ণকে সমাজে কতগুলো সঠিক গণতান্ত্রিক ‘সাংস্কৃতিক’ উপাদান অর্জিত হওয়ার নিরিখে বিবেচনা করা হয়। পদ্ধতিগত গণতন্ত্রের ধারণার জনক জোসেফ সুম্পিটারকে বলা যেতে পারে। সুম্পিটারের ১৯৪৬ সালে প্রকাশিত গ্রন্থ ক্যাপিটালিজম, সোশ্যালিজম অ্যান্ড ডেমোক্রেসি-এর (সুম্পিটার, ১৯৪৬/১৯৫০) লক্ষ্য হচ্ছে, গণতন্ত্র-সম্পর্কিত ‘অস্পষ্ট ধারণা’ থেকে সরে এসে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে পরিমাপ করা যায়, এমন সব সুস্পষ্ট নির্ণায়ক চিহ্নিত করা। তিনি গণতন্ত্রকে বর্ণনা করেন নেতৃত্ব নির্বাচনের ব্যবস্থা হিসেবে। সুম্পিটার লিখছেন:
The democratic method is that institutional arrangement for arriving at political decisions in which individuals acquire the power to decide by means of a competitive struggle for people's vote. (সুম্পিটার, ১৯৫০: ২৬৯)।
(গণতান্ত্রিক পদ্ধতি হচ্ছে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর এমন এক প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা, যেখানে জনগণের ভোট পাওয়ার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা লাভ করে।)
সহজ ভাষায় সুম্পিটারের কাছে গণতন্ত্র হলো, যারা সিদ্ধান্ত নেবে, তাদের নির্বাচনের ব্যবস্থা (সুম্পিটার, ১৯৫০: ২৯৬)। এই সংজ্ঞায় পদ্ধতিগত দিকটিই যে প্রাধান্য পেয়েছে, তা সহজেই লক্ষণীয়।
গণতন্ত্রের এই পদ্ধতিগত ধারণাকে রবার্ট ডাল তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ পলিয়ার্কি: পার্টিসিপেশন অ্যান্ড অপজিশন-এ বিস্তারিত ও সম্প্রসারিত করেন। ডাল যে ব্যবস্থার কথা তুলে ধরেন, সেটাকে তিনি বর্ণনা করেন ‘পলিয়ার্কি’ বা ‘বহুজনের শাসনব্যবস্থা’ হিসেবে। রবার্ট ডাল (১৯৭২) পদ্ধতিগত গণতন্ত্রের সুস্পষ্ট নির্ধারকের তাগিদ দিয়ে বলেন যে বহুজনের শাসনব্যবস্থার কতগুলো মৌলিক উপাদান রয়েছে। সেগুলো হলো: সরকারে সাংবিধানিকভাবে নির্বাচিত কর্মকর্তা থাকা; নিয়মিত, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন; সব পূর্ণবয়স্কের ভোটাধিকার এবং নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার অধিকার; মতপ্রকাশের স্বাধীনতা; সরকার বা কোনো একক গোষ্ঠীর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ রয়েছে এমন উেসর বিকল্প থেকে তথ্য পাওয়ার সুযোগ এবং সংগঠনের স্বাধীনতা। ডালের এই বক্তব্য থেকে স্পষ্ট যে বহুজনের শাসন হলো শাসনব্যবস্থার জন্য কতগুলো প্রতিষ্ঠান ও পদ্ধতির সমন্বিত রূপ। ডালের এই সংজ্ঞা বা বৈশিষ্ট্যগুলো নিয়ে বিস্তর সমালোচনা থাকলেও এখন পর্যন্ত গণতন্ত্রের সংজ্ঞা ও গুণাগুণ বিচারে এগুলোই সবচেয়ে ব্যবহূত মাপকাঠি। সুম্পিটার ও ডালের এই মাপকাঠিকে গণতন্ত্রের পদ্ধতিগত (Procedural) এবং সবচেয়ে সীমিত (Minimalist) সংজ্ঞা বলা হয়ে থাকে।
পদ্ধতিগত এই সংজ্ঞার বিপরীতে অনেকেই সাংস্কৃতিক দিকে নজর দেওয়ার প্রয়োজনের ওপর জোর দেন। গত কয়েক দশকে অনেক দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন সত্ত্বেও গণতন্ত্রের সমস্যা বিদ্যমান থাকার ফলে নির্বাচনভিত্তিক গণতন্ত্রের বদলে অন্যান্য কতিপয় বিষয়ের ওপর জোর দেওয়ার তাগিদ সৃষ্টি হয়। এই ধারণার প্রবক্তারা নাগরিকদের অধিকার, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও সিভিল সোসাইটি বা জনসমাজের সক্রিয় অংশগ্রহণকে নির্ধারকের জায়গায় স্থান দেওয়ার পক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করেন। এঁদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন ল্যারি ডায়মন্ড (ডায়মন্ড, ১৯৯৩, ১৯৯৯, ২০০০, ২০০১, ২০০৮)। তিনি বলেন, নির্বাচনী গণতন্ত্রের (Electoral Democracy) ওপর গুরুত্বারোপের ফলে গণতন্ত্রের সাফল্যের ব্যাপারে যে বিভিন্ন ধরনের চিত্র রয়েছে, তা ঠিক বোঝা যায় না। তাই তিনি রাজনৈতিক সংস্কৃতি, সুশীল সমাজ ও গণতন্ত্রের বিভিন্ন ধরনের বিষয় বিবেচনায় নিতে বলেন। ডায়মন্ড ও অন্য গবেষকদের (যেমন: চ্যান্ডলার, ২০০০) দেওয়া গণতন্ত্রের সংজ্ঞাকে গণতন্ত্রের সম্প্রসারিত সংজ্ঞা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
গণতন্ত্র সম্পর্কে যেসব গবেষণা হয়েছে, তাকে আমরা আরও দুটো ভাগে ভাগ করতে পারি। তা হলো: আদর্শিক (Normative) এবং ভূয়োদর্শনলব্ধ (Empirical)। প্রথম ধারা বলে গণতন্ত্র কেমন হওয়া উচিত, দ্বিতীয় ধারা ব্যাখ্যা করে কার্যত গণতন্ত্র কীভাবে কাজ করে। তা ছাড়া গণতন্ত্রের সীমিত সংজ্ঞা ও পরিবর্ধিত সংজ্ঞার পার্থক্যকে অনেকে ব্যাখ্যা করেন গণতন্ত্র একটি শাসনব্যবস্থা এবং গণতন্ত্র একগুচ্ছ মূল্যবোধ—এই দুই রকম দৃষ্টিভঙ্গির তফাত হিসেবে।
গণতন্ত্রসংক্রান্ত এই দুই ধরনের ধারণার সমন্বয়সাধনের চেষ্টা একেবারে হয়নি তা নয়, বরং অনেকের ধারণা, এই দুই ধারণার সমন্বয়েই আমরা কতগুলো নির্ণায়ক তৈরি করতে পারি, যা একটি দেশের গণতন্ত্রের গুণাগুণ বিচারে সাহায্য করতে পারে। এই সমন্বয়ী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে গণতন্ত্রের তিনটি উপাদানকে মৌলিক বা বুনিয়াদি বলে বিবেচনা করা যায়। এগুলো হলো: ১. সর্বজনীন ভোটাধিকার; ২. আইনসভা ও নির্বাহী বিভাগের প্রধানের পদের জন্য নিয়মিত, অবাধ, প্রতিযোগিতামূলক, বহুদলীয় নির্বাচন; ৩. মতপ্রকাশ ও সংগঠনের স্বাধীনতাসহ সব ধরনের নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের প্রতি সম্মান এবং আইনের শাসন, যার আওতায় রাষ্ট্রের প্রতিনিধি ও নাগরিক আইনিভাবে প্রকৃত অর্থেই সমানভাবে বিবেচ্য। এই বৈশিষ্ট্যগুলোর একটি পক্ষপাত সীমিত সংজ্ঞার প্রতি থাকলেও, এটা জোর দিয়ে বলা আবশ্যক যে এই তিনটি উপাদান পরস্পর সংশ্লিষ্ট। অর্থাত্ স্বতন্ত্রভাবে এর একটি উপাদানের সাফল্য গণতন্ত্রের আংশিক সাফল্যের পরিচায়ক নয়। গণতন্ত্রের জন্য এই তিনটি উপাদানকে সমভাবে কার্যকর থাকতে হবে এবং সাফল্য লাভ করতে হবে। তা ছাড়া এই উপাদানগুলোকে চূড়ান্ত লক্ষ্য বলে বিবেচনা করা যাবে না; বিবেচনা করতে হবে গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে।
গণতন্ত্রায়ণ
কোনো দেশে গণতন্ত্র থাকা অথবা না-থাকা কোনো নিশ্চল বিষয় নয়। ফলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে দীর্ঘদিন ধরেই এ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে যে কীভাবে একটি দেশ অগণতান্ত্রিক অবস্থা (বিভিন্ন ধরনের কর্তৃত্ববাদী শাসন, যেমন সামরিক আইন) থেকে গণতন্ত্রে উত্তরিত হয়। প্রশ্নগুলো সহজ ভাষায় বললে: কেন কিছু দেশ গণতান্ত্রিক এবং কিছু দেশ গণতান্ত্রিক নয়? কী করে একটি অগণতান্ত্রিক দেশ ‘অগণতন্ত্র’ থেকে ‘গণতন্ত্রে’ যেতে পারে? শেষ প্রশ্নের উত্তরের বিষয়টি গণতন্ত্রে উত্তরণ-প্রক্রিয়া বা গণতন্ত্রায়ণ বলে বর্ণনা করা হয়।
১৯৬০ ও ১৯৭০-এর দশকে আধুনিকায়ন তত্ত্বের (Modernization Paradigm) আলোকে গণতন্ত্রায়ণ-সম্পর্কিত আলোচনায় বলা হয় যে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ দেশেই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা বেশি (লিপসেট, ১৯৫৯; এলমন্ড ও ভারবা, ১৯৬৩; মুর, ১৯৬৩)। যদিও লিপসেট তাঁর আলোচনায় অর্থনৈতিক উন্নয়নকে (যেমন: নগরায়ণ, সম্পদ ও শিক্ষা) ‘আবশ্যক’ (Requisite) বলেছেন, ‘পূর্বশর্ত’ (Pre-requisite) বলেননি। পরবর্তী আলোচনায় এগুলো পূর্বশর্ত বলে বিবেচনা করা হতে থাকে।২ এমনকি ১৯৯০-এর দশকের শেষ পর্যন্ত আমরা এই ধারায় ভূয়োদর্শনলব্ধ গবেষণা (Empirical Study) পরিচালনা হতে দেখি (যেমন: ভ্যানহানেন, ১৯৯৭)। বাস্তবে ১৯৭০-এর দশকে এসে যখন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ধারা তৈরি হয় তখন এই যুক্তি কার্যত বাতিল হয়ে যায়। পশ্চিম ইউরোপের কয়েকটি দেশে দক্ষিণপন্থী একনায়কত্বের অবসানের মধ্য দিয়ে যে ধারার শুরু, ১৯৮০-র দশকে লাতিন আমেরিকার বেশ কয়েকটি দেশে তা ছড়িয়ে পড়ে। এরপর এশিয়ায় তার প্রভাব রাখে এবং দশকের শেষ নাগাদ পূর্ব ইউরোপের কমিউনিস্ট শাসিত দেশগুলো, এমনকি সোভিয়েত ইউনিয়নেও এর বাতাস লাগে। অব্যাহতভাবে দেশে দেশে একনায়কি শাসন, স্বৈরতন্ত্র, সামরিক শাসন, একদলীয় ব্যবস্থা ইত্যাদির বদলে নির্বাচিত সরকারের উত্থানকে ১৯৯১ সালে স্যামুয়েল হান্টিংটন বর্ণনা করেন ‘গণতন্ত্রের তৃতীয় ঢেউ’ (Third Wave of Democracy) বলে (হান্টিংটন, ১৯৯১)। ১৯৯০ সালে বাংলাদেশে জেনারেল এরশাদের সেনাশাসনের বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলনের সাফল্য এবং নেপালে রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে ‘জন-আন্দোলন’কে এই তৃতীয় ঢেউয়ের প্রভাব বলেও ধারণা করা হয়ে থাকে। দেশে দেশে নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠার এই ঢেউ এতটাই নাটকীয় ও অভূতপূর্ব ছিল, কেউ কেউ এরই আলোকে বিংশ শতাব্দীকে গণতন্ত্রের শতক বলে বর্ণনা করেন। এ নিয়ে আশাবাদ ও অতিশয়োক্তির ঘটনাও ঘটে। ফ্রান্সিস ফুকুইয়ামা বিজয়দৃপ্ত মনোভঙ্গিতে ঘোষণা করেন যে আমরা ইতিহাসের ‘অবসান’ প্রত্যক্ষ করছি (ফুকুইয়ামা, ১৯৮৯, ১৯৯২)।
১৯৭০-এর দশকে গণতন্ত্র অভিমুখে বিভিন্ন দেশের যাত্রা বিশ্লেষকদের মধ্যে এই ধারণার জন্ম দেয় যে গণতন্ত্রায়ণ একটি প্রক্রিয়া এবং এই প্রক্রিয়ার বিভিন্ন পর্যায় রয়েছে। তদুপরি এর প্রতিটি পর্যায়ের প্রতি গভীর মনোযোগ প্রদর্শন করা ও বিশ্লেষণ করা জরুরি। এই ধারণাই গণতন্ত্রায়ণ-প্রক্রিয়ার বিষয়ে নতুন নতুন তত্ত্বের জন্ম দেয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন এবং পূর্ব ইউরোপের দেশে নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা তাত্ত্বিকভাবে গণতন্ত্রায়ণ-প্রক্রিয়া বোঝার তাগিদকে জোরদার করে। এগুলোকে উত্তরণ তত্ত্ব (Transition Thesis) বলে চিহ্নিত করা হয়। কারও কারও মতে, গণতন্ত্রায়ণ-প্রক্রিয়ার চারটি পর্যায় রয়েছে: কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থার ক্ষয়, উত্তরণ, সংহতকরণ (Consolidation) এবং দৃঢ়করণ (Deepening)। কারও কারও মতে রয়েছে তিনটি স্তর: সুযোগ সৃষ্টি (Opening), ব্যূহভেদ (Breakthrough) এবং সংহতকরণ (Consolidation) (ক্যারোথারস, ২০০২)।
গণতন্ত্রায়ণের বিভিন্ন পর্যায় রয়েছে বলে যাঁরা মনে করেন, খানিকটা অবচেতনভাবেই তাঁরা একধরনের একরৈখিক পর্যায়ক্রমিক অগ্রগতির ধারণাকে গ্রহণ করে নেন। অর্থাত্ গণতন্ত্রায়ণের প্রক্রিয়া একবার শুরু হলে তা উত্তরণ পর্যায় হয়ে সংহতকরণ বা দৃঢ়করণ পর্যায়ে উপনীত হবে। ক্যারোথারস (২০০২: ৭) যথার্থই শনাক্ত করেন যে এই মতের প্রবক্তারা অস্বীকার করলেও এই ধারণার মধ্যে পরমকারণবাদের (Teleology) প্রভাব সুস্পষ্ট। গণতন্ত্রায়ণ, বিশেষত উত্তরণ পর্যায়ের দিককে যাঁরা প্রাধান্য দিয়েছেন, তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আরও অনেক ধরনের সমালোচনা ইদানীং প্রকাশিত হচ্ছে। অন্যতম দুটি প্রধান সমালোচনা হলো, উত্তরণবিষয়ক আলোচনা সব সময়ই পরিবর্তনের সূচনাটি ক্ষমতাসীনদের কাছ থেকে শুরু হয়েছে বলে ধারণা দিয়েছে (সেটা অর্থনৈতিক সংকট বা অভ্যন্তরীণ মতভিন্নতা, যে কারণেই ঘটুক না কেন)। তাঁরা কার্যত পরিবর্তনের চাপ যে নিচে থেকে অর্থাত্ তৃণমূল পর্যায় থেকে আসতে পারে, সেদিকটায় খুব গুরুত্ব দেননি। কিন্তু অনেক দেশেই তা লক্ষ করা গেছে। দ্বিতীয় সমালোচনা হলো, আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট ও তার ভূমিকা মোটেই আলোচিত হয়নি। কোনো দেশের গণতন্ত্রায়ণে বাইরের পরিস্থিতি, শক্ত রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট আদৌ প্রভাব ফেলেছে কি না, তা অনালোচিতই থেকেছে। জেওফ্রি প্রিধাম একে গণতন্ত্রায়ণের ‘বিস্মৃত মাত্রা’ বলে বর্ণনা করেছেন (প্রিধাম, ২০০৫)।
গণতন্ত্রায়ণের, বিশেষত পর্যায়ক্রমিক কিন্তু একরৈখিক ধারার ধারণা কেবল যে গবেষকদেরই প্রভাবিত করেছে তা নয়, বিভিন্ন দেশের এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার চিন্তাভাবনা ও কার্যক্রমকেও তা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে।
এই পটভূমিকায়ই আরেকটি প্রশ্ন ক্রমেই জোরদার হয়ে ওঠে, তা হলো—গণতন্ত্র কী করে পরিমাপ করা যায়? প্রশ্নটি কেবল এই নয় যে কোনটি ভালো আর কোনটি খারাপ, প্রশ্নটি হলো, মর্মবস্তুর বিবেচনায় কোনটি গণতন্ত্র? প্রশ্ন ওঠে, ‘গণতন্ত্র’ এবং ‘অগণতন্ত্র’ কি দ্বিমূল (Binary) ধারণা? (অর্থাত্ একটির অবস্থান অন্যটিকে নাকচ করে দেয়, একটি থাকলে অন্যটি উপস্থিত থাকতে পারে না।) নাকি গণতন্ত্র হচ্ছে স্তর বিন্যস্ত পরম্পরার (Continuum) একটি অবস্থান (অর্থাত্ গণতন্ত্রের ক্রমবিন্যাস করা সম্ভব)? অনেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী গণতন্ত্র-অগণতন্ত্রকে দ্বিবিভাজিত বলে মনে করেন এবং গণতন্ত্র পরিমাপ করার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের স্তরবিন্যাসের পক্ষে নন (সারটোরি, ১৯৮৭)। অন্যদিকে অনেকের ধারণা, গণতন্ত্রের সংজ্ঞা হওয়া দরকার চলমান ক্রমবিন্যাস-প্রক্রিয়া হিসেবে (বোলেন ও জ্যাকম্যান, ১৯৮৯)। এই বিতর্কের কোনো ধরনের সমাপ্তি না হলেও ক্রমবিন্যাসের ধারণার সমর্থকেরা অনেক বেশি গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেছেন গত কয়েক দশকে।
বিপরীত স্রোত
গণতন্ত্রের ‘তৃতীয় ঢেউ’ নিয়ে যে ধরনের উত্সাহ, আগ্রহ ও আশাবাদ দেখা দিয়েছিল এক দশকের মধ্যে তাতে ভাটার টান লাগে। ২০০০ সালের কিছু আগে থেকেই গবেষকেরা আশঙ্কা প্রকাশ করতে থাকেন যে প্রত্যাশা ও অর্জনের মধ্যে ফারাক তৈরি হচ্ছে। নতুন নতুন গবেষণার ফলাফল প্রকাশিত হতে থাকলে এবং বিশ্লেষকদের পর্যবেক্ষণ লক্ষ করে অনেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বলতে শুরু করেন যে গণতন্ত্র সংহত হওয়ার বদলে অনেক দেশ গণতন্ত্র গুটিয়ে ফেলছে বা পশ্চাদমুখী হয়ে পড়ছে। ২০০৮ সালে ফরেন অ্যাফেয়ার্স সাময়িকীতে ল্যারি ডায়মন্ডের ‘গণতন্ত্রের পিছু হটা’ শীর্ষক রচনাটি সবচেয়ে মনোযোগ আকর্ষণ করলেও থমাস ক্যারোথারস (২০০২), মেরিনা ওটাওয়ে (২০০৩) এবং এন্ডু নেথ্যানসহ (২০০৩) অনেকেই এ কথা দশকের গোড়াতেই বলতে শুরু করেন।
গবেষকেরা সে সময় থেকেই এটা চিহ্নিত করেন যে গণতন্ত্রের তৃতীয় ঢেউ শুরু হওয়ার পর কিছু দেশ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পথে ব্যাপক অগ্রগতি অর্জন করেছে, কিছু দেশ উল্টো পথে কর্তৃত্ববাদী শাসনে ফিরে গেছে। আর কিছু দেশ গণতন্ত্রের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য অর্জন করলেও হয় স্বেচ্ছায় বা অন্য কারণে নিশ্চল হয়ে পড়েছে। এই পরিস্থিতি উত্তরণ বা গণতন্ত্রায়ণ তত্ত্বের ধারণার সঙ্গে সম্পূর্ণ অসংগতিপূর্ণ। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের অনেকেই এ অবস্থার দিকে মনোনিবেশ করেন।
উদ্বিগ্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের কেউ কেউ মনে করিয়ে দেন যে গণতন্ত্রায়ণ নিয়ে আশাবাদের জোয়ারের মধ্যেও ১৯৮৬ সালে গুয়েলারমো ও’ডানেল এবং ফিলিপ স্মিটার এই বলে সতর্ক করেছিলেন যে কর্তৃত্ববাদী শাসন থেকে উত্তরণের ফল হতে পারে তুলনামূলক উন্মুক্ত কর্তৃত্ববাদী শাসন অথবা নিয়ন্ত্রণমূলক অনুদার (Illiberal) গণতন্ত্র (ও’ডানেল এবং স্মিটার, ১৯৮৬: ৯)। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটা আরও স্পষ্ট হয়, অনেক সরকারই সাংবিধানিক পথ ও নির্বাচনী প্রক্রিয়া গ্রহণ করেছেন (এই অর্থে যে নিয়মিতভাবে অবাধ, প্রতিযোগিতামূলক, বহুদলীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে এবং সীমিত আকারে রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকার চর্চার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে), কিন্তু গণতন্ত্রের যে মর্মবস্তু (শাসন পরিচালনায় জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন, তাদের কণ্ঠস্বরকে গুরুত্ব দেওয়া) তা অপূরিতই থেকে যাচ্ছে। এই অপূর্ণতা রাজনৈতিক শ্রেণীর আদর্শিক অবস্থানের পার্থক্য সত্ত্বেও বিভিন্ন দেশে লক্ষণীয় হয়ে ওঠে। এ অবস্থায় এটাও স্পষ্ট হয়ে যায়, গণতন্ত্র-অগণতন্ত্রের এই বিভাজন দিয়ে গণতন্ত্রের অবস্থা বোঝা সম্ভব নয়। ফলে প্রশ্ন ওঠে, এসব গণতন্ত্রকে কীভাবে বর্ণনা করা হবে?
বিশেষণসমৃদ্ধ গণতন্ত্র
এ ধরনের গণতন্ত্রকে বর্ণনা করার জন্য বিভিন্ন বিশেষণ ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এর মধ্যে রয়েছে আধা গণতন্ত্র (Semi-democracy), প্রায়-গণতন্ত্র (Virtual democracy), নির্বাচনী গণতন্ত্র (Electoral democracy), ছদ্ম গণতন্ত্র (Pseudo-democracy), অনুদার গণতন্ত্র (Illiberal democracy), আধা কর্তৃত্ববাদ (Semi-authoritarianism); কোমল কর্তৃত্ববাদ (Soft authoritarianism) এবং নির্বাচনী কর্তৃত্ববাদ (Electoral authoritarianism) (লেভিটস্কি এবং ওয়ে, ২০০২)। ল্যারি ডায়মন্ড এ ধরনের শাসনকে হাইব্রিড রেজিম (Hybrid regime) বা সংকর শাসনব্যবস্থা বলে বর্ণনা করেছেন (ডায়মন্ড, ২০০২)। গোড়ার দিকে এসব শাসনব্যবস্থার সঙ্গে ‘আধা’, ‘প্রায়’ ইত্যাদি বিশেষণ যুক্ত করে একে গণতন্ত্র বা কর্তৃত্ববাদী শাসনের পূর্ববর্তী বা পরবর্তী স্তর বলে ধারণা দেওয়ার চেষ্টা হলেও পরবর্তী সময় বিশ্লেষকেরা ক্রমেই স্বীকার করে নেন যে এগুলো গণতন্ত্র বা কর্তৃত্ববাদের কোনো উপরূপ নয়। বরং এগুলো হচ্ছে একটি বিশেষ ধরনের শাসন, নিজেই একটা বিশেষ রূপ। ফলে এদের গণতন্ত্র বা কর্তৃত্ববাদ বলে বর্ণনার সুযোগ নেই (বোগার্ড, ২০০৯)। ডায়মন্ড ২০০২ সালে খুব জোর দিয়ে বলেন যে সংকর শাসনকে, উত্তরণের পথে রয়েছে এমন শাসনব্যবস্থার সঙ্গে, গুলিয়ে ফেলা ঠিক হবে না। উত্তরণ পর্যায় হচ্ছে শাসনব্যবস্থা এক ধরন থেকে অন্য ধরনে যাওয়ার অন্তর্বর্তী অবস্থান—হাইব্রিড রেজিম তা নয়, এগুলো নিজেই একধরনের শাসনব্যবস্থা।
এক অর্থে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ও সংকর শাসনব্যবস্থার মধ্যে পার্থক্যটি হলো আনুষ্ঠানিক (Formal) গণতন্ত্র ও প্রকৃত (Substantive) গণতন্ত্রের পার্থক্য। আনুষ্ঠানিক গণতন্ত্র হলো, যেখানে গণতন্ত্রের প্রয়োজনীয় সব বা অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান উপস্থিত থাকে, কিন্তু সেগুলো নিয়ন্ত্রিত বা অপব্যবহূত হয় সংখ্যালঘু এলিটদের দ্বারা, তাদের নিজস্ব ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত স্বার্থে। এই ব্যবস্থা নিয়মিত নির্বাচন অনুষ্ঠান, আপাতদৃষ্টে রাজনীতিতে অংশগ্রহণের ব্যবস্থা এবং আইনের শাসনের কিয়দংশ বহাল রাখে; কিন্তু কার্যত তা তস্করের শাসন (Kleptocracy)। আন্দ্রিয়াস সেডলারের ভাষায় বললে, এরা ঠিকঠাক নির্বাচন অনুষ্ঠানের কাজটি করতে পারে, কিন্তু গণতান্ত্রিক সাংবিধানিক ব্যবস্থার অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দিক যেমন: আইনের শাসন, রাজনৈতিক জবাবদিহি, আমলাতান্ত্রিক সততা এবং উন্মুক্ত আলাপ-আলোচনা—এসবের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে ব্যর্থ হয় (সেডলার, ২০০২: ৩৭)।
প্রকৃত গণতন্ত্র, বিপরীতক্রমে, গণতন্ত্রের যে মর্মবস্তু—জনগণের ক্ষমতায়ন, যাতে করে তারা সমাজের সুরক্ষিত কাঠামোর স্বার্থ এবং সুবিধাভোগী গোষ্ঠীর প্রতিপত্তির বিরুদ্ধে স্বাধীনভাবে তাদের স্বার্থকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে—তাই অর্জন করতে চায়। প্রকৃত গণতন্ত্র চায় জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা করতে, মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে, আইনের শাসন পালন করতে এবং তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করতে।
কোনো কোনো বিশ্লেষক, যেমন ফরিদ জাকারিয়া, এই দুই বিপরীতধর্মী ব্যবস্থাকে অনুদার (Illiberal) ও উদার (Liberal) গণতন্ত্র বলে বর্ণনা করেছেন (জাকারিয়া, ১৯৯৭, ২০০৭)। তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী, অনুদার গণতন্ত্রে নির্বাচনের সঙ্গে সহাবস্থান করে নিয়মিত ও পরিকল্পিতভাবে রাজনৈতিক অধিকার এবং আইনবহির্ভূতভাবে জনগণের কোনো কোনো অংশের ভোটাধিকার হরণ। কিন্তু জাকারিয়ার এই শ্রেণীর বিভাজন ও বর্ণনা অনেককে সন্তুষ্ট করতে পারেনি; সেডলার (২০০২: ৪৩) মন্তব্য করেছেন, ‘অনুদার—অবশ্যই, কিন্তু গণতান্ত্রিক কি?’ আনুষ্ঠানিক গণতন্ত্রের যাঁরা সুবিধাভোগী, তাঁরা নিয়মিত নির্বাচন অনুষ্ঠানকে কেবল গণতন্ত্রের প্রমাণ হিসেবেই উপস্থাপন করেন না, তাঁরা নির্বাচনকে গণতন্ত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে দেখান এবং তার উপস্থিতির কারণে অন্য সব অপূর্ণতাকে অস্বীকার করতে চান।
বাংলাদেশে গণতন্ত্রের প্রকৃতি
নির্বাচিত বেসামরিক সরকারের বিভিন্ন ধরনসংক্রান্ত আলোচনা ও তাদের পার্থক্য বিবেচনা করে বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে প্রায়ই ‘নির্বাচনী গণতন্ত্র’ (Electoral Democracy) বলে বর্ণনা করা হয়ে থাকে। এই বর্ণনা ১৯৯১-পরবর্তী সব নির্বাচিত সরকারের শাসনকেই বোঝায়। এটা এই অর্থে সঠিক যে ১৯৯১-পরবর্তীকালে (একটি ব্যতিক্রম বাদে) নিয়মিতভাবেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং এই সময়ের শাসনব্যবস্থা কর্তৃত্ববাদী সেনাশাসন (১৯৭৫-৯০) থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। কিন্তু যথেষ্ট পরিমাণ উদাহরণ ও গবেষণালব্ধ উপাত্ত রয়েছে, যা থেকে দেখা যায় যে, সব সরকারই নাগরিক অধিকার সীমিত করতে আইনি ও আইনবহির্ভূত ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। তা ছাড়া জবাবদিহির বিষয়টি এখনো ‘সোনার হরিণ’ই থেকে গেছে।
বাংলাদেশের গণতন্ত্রের প্রকৃতি বোঝার জন্য এসব ঘটনা ও সীমিত উপাত্তের পুনরালোচনা না করে আমরা ব্যবহার করব গণতন্ত্র ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সূচকের সমন্বিত (Composite Indices) উপাত্ত। এসব উপাত্ত নির্বাচনের ক্ষেত্রে বিবেচনা করা হয়েছে: ১. ইতিমধ্যে জনসমক্ষে প্রকাশিত (Public Domain); ২. একাধিক বছরের উপাত্ত; ৩. একাধিক সরকার ক্ষমতাসীন থাকাকালীন উপাত্ত। যেসব ক্ষেত্রে সম্ভব হয়েছে, আমরা একই সূচকের ব্যাপারে দীর্ঘমেয়াদি প্রবণতার দিকে নজর দিয়েছি এবং একাধিক বছরের গড় সংখ্যাকে বিবেচনায় নিয়েছি। একই সূচকের জন্য ক্ষেত্রবিশেষে একাধিক সূত্রও ব্যবহূত হয়েছে।
আমরা ছয়টি সূচক নির্ধারণ করেছি, যেগুলো সংকর শাসনব্যবস্থার উপস্থিতি প্রমাণ দিতে পারে বা তাকে নাকচ করে দিতে পারে। এই সূচক নির্বাচনে আমরা অনুসরণ করেছি জোয়াকিম একম্যানকে (২০০৯)।৩ সূচক নির্বাচনে ইতিমধ্যে সংকর শাসনব্যবস্থা-বিষয়ক আলোচনায় যেসব বৈশিষ্ট্য গুরুত্ব পেয়েছে, সেগুলোকে খতিয়ে দেখা (অর্থাত্ নিয়মিত নির্বাচন অনুষ্ঠান, কিন্তু সহজে লক্ষ্যযোগ্য কতক দুর্বলতা থাকা) আমাদের লক্ষ্য। নির্বাচিত ছয়টি সূচক হলো: ১. প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন; ২. উঁচু মাত্রার দুর্নীতি; ৩. জবাবদিহির অনুপস্থিতি; ৪. গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় সমস্যাসংকুল পরিস্থিতি; ৫. নাগরিক অধিকার পরিস্থিতির দুর্বলতা; ৬. আইনের শাসনের অনুপস্থিতি।
উপাত্তগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে ছয়টি সূত্র থেকে। এগুলো হলো ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের ‘ডেমোক্রেসি ইনডেক্স’, ফ্রিডম হাউসের ‘ফ্রিডম ইন দ্য ওয়ার্ল্ড’, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের ‘করাপশন পারসেপশন ইনডেক্স’, রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারের ‘ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্স’, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের তথ্যের ভিত্তিতে ‘পলিটিক্যাল টেরর স্কেল’-এর উপাত্ত।
এ পর্যায়ে আমরা প্রতিটি সূচকের ব্যাপারে প্রাপ্ত উপাত্তগুলো আলাদা আলাদাভাবে আলোচনা করব। তারপর এগুলোকে একটি সারণিতে সমন্বয় করব।
গণতন্ত্রের একটি অত্যাবশ্যকীয় শর্ত হলো—অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান। সংকর শাসনব্যবস্থায় যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, তা আমরা আমাদের পূর্বোক্ত আলোচনায়ই জানি। এ ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক দিক হলো, নির্বাচন কোনো রকম পার্থক্য তৈরির সম্ভাবনা সৃষ্টি করে কি না। এখানে আমরা ইকোনমিস্ট-এর ডেমোক্রেসি ইনডেক্স থেকে নির্বাচনী প্রক্রিয়া ও বহুত্ববাদিতা-বিষয়ক স্কোরটি ব্যবহার করেছি। ইকোনমিস্ট-এর ‘ডেমোক্রেটিক ইনডেক্স’-এ এই প্রশ্নের উত্তরের জন্য বেশ কয়েকটি দিক দেখা হয়; যেমন দেশের আইনসভা ও সরকারের প্রধান নির্ধারণের জন্য যে নির্বাচন হয়, তা কি অবাধ? বিরোধী দলের কি সরকার গঠনের বাস্তবসম্মত সম্ভাবনা রয়েছে? এসব উত্তরের ভিত্তিতে ০-১০ স্কোরিং করা হয়। আমরা ছয় বা তার বেশিকে ধরে নিয়েছি ইতিবাচক বলে। চার বছরের উপাত্ত থেকে দেখা যায়, বাংলাদেশের গড় স্কোর হচ্ছে সাত (দ্রষ্টব্য: সারণি-১)।
সারণি-১
ইকোনমিস্ট-এর গণতন্ত্র সূচক
বছর | অবস্থান | সামগ্রিক স্কোর | নির্বাচনী প্রক্রিয়া ও বহুত্ববাদিতা | সরকারের কার্যক্রম
| রাজনৈতিক অংশগ্রহণ | রাজনৈতিক সংস্কৃতি
| নাগরিক অধিকার |
২০১১ | ৮৩ | ৫.৮৬ | ৭.৪২ | ৫.৪৩ | ৫.০০ | ৪.৩৮ | ৭.০৬ |
২০১০ | ৮৩ | ৫.৮৭ | ৭.৪২ | ৫.৪৩ | ৪.৪৪ | ৫.০০ | ৭.০৬ |
২০০৮ | ৯১ | ৫.৫২ | ৭.০০ | ৫.০৭ | ৪.৪৪ | ৩.৭৫ | ৭.৩৫ |
২০০৬ | ৭৫ | ৬.১১ | ৭.৪২ | ৫.০৭ | ৪.৪৪ | ৬.২৫ | ৭.৩৫ |
সূত্র: ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট, ডেমোক্রেসি ইনডেক্স, বিভিন্ন বছর।
দুর্নীতির মাত্রা নিরূপণের জন্য আমরা ব্যবহার করেছি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের করাপশন ‘পারসেপশন ইনডেক্সে’র স্কোর। এখানে ১-১০-এর তুলাদন্ডে ১০ হচ্ছে সবচেয়ে কম দুর্নীতির এবং ১ হচ্ছে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতির পরিচায়ন। ২০০৩ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত নয় বছরে বাংলাদেশ ২ দশমিক ৭ বা তার চেয়ে কম স্কোর পেয়েছে (দ্রষ্টব্য: সারণি-২)। নয় বছরের উপাত্ত প্রমাণ করে যে বাংলাদেশে দুর্নীতির মাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে উঁচু।
সারণি-২
দুর্নীতির উপস্থিতির সূচক
২০১১ | ২০১০ | ২০০৯ | ২০০৮ | ২০০৭ | ২০০৬ | ২০০৫ | ২০০৪ | ২০০৩ |
২.৭ | ২.৪ | ২.১ | ২.০ | ২.০ | ১.৭ | ১.৫ | ১.৩ | ১.২ |
সূত্র: ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, করাপশন পারসেপশন ইনডেক্স, বিভিন্ন বছর।
আমাদের তৃতীয় সূচক হলো জবাবদিহির অনুপস্থিতি। ইকোনমিস্ট-এর ‘ডেমোক্রেসি ইনডেক্স’ একে সরকারের কার্যক্রম হিসেবে সারণিবদ্ধ করেছে। এই স্কোরের জন্য ইকোনমিস্ট অনেকগুলো প্রশ্নের উত্তরের একটি গড় তৈরি করে। এই প্রশ্নগুলোর মধ্যে আছে—দুই নির্বাচনের মধ্যবর্তী সময়ে সরকারি কর্তৃত্ব (authority) প্রয়োগের ক্ষেত্রে ভারসাম্য নিশ্চিত করার কোনো পদ্ধতি রয়েছে কি না? জনপ্রশাসন সরকারি নীতি বাস্তবায়নে আগ্রহী ও সক্ষম কি না? আমরা এ ক্ষেত্রে চার বছরের যে চারটি স্কোর রয়েছে তার একটি গড় তৈরি করেছি। আমরা ছয় বা তার কমকে দুর্বলতা বলে শনাক্ত করেছি। চার বছরের সবগুলোতেই বাংলাদেশ ৬-এর কম স্কোর পেয়েছে (দ্রষ্টব্য: সারণি-১)।
গণমাধ্যমের স্বাধীনতাবিষয়ক সূচকটির উপাত্ত সংগৃহীত হয়েছে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারের ‘ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্স’ থেকে। এ ক্ষেত্রে স্কোর হচ্ছে ০ থেকে ১১০। এতে ০ (শূন্য) হচ্ছে কোনো ধরনের বাধানিষেধ না থাকা। অন্যদিকে ১১০ হচ্ছে সবচেয়ে বিরূপ পরিবেশ। রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারের ভাষ্য অনুযায়ী, ২০-এর অধিক হওয়ার অর্থই হচ্ছে ‘গণমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য সমস্যাসংকুল পরিস্থিতি’।
২০০২ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে একটি ব্যতিক্রম (৩৭.৩৩) ছাড়া সব সময়ই ৪০-এর ওপরে থেকেছে। দুই বছর (২০০৪ ও ২০০৫ সালে) বাংলাদেশের স্কোর ছিল ৬০-এর বেশি। ২০১১-১২ সালে বাংলাদেশের স্কোর ৫৭.০০ (দ্রষ্টব্য: সারণি-৩)।
সারণি-৩
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা
বছর | অবস্থান | স্কোর |
২০১১-১২ | ১২৯ | ৫৭.০০ |
২০১০ | ১২৬ | ৪২.৫০ |
২০০৯ | ১২১ | ৩৭.৩৩ |
২০০৮ | ১৩৬ | ৪২.৭০ |
২০০৭ | ১৩৪ | ৫৩.১৭ |
২০০৬ | ১৩৭ | ৪৮.০০ |
২০০৫ | ১৫১ | ৬১.২৫ |
২০০৪ | ১৫১ | ৬২.৫০ |
২০০৩ | ১৪৩ | ৪৬.৫০ |
২০০২ | ১১৮ | ৪৩.৭৫ |
সূত্র: রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার, ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্স। বিভিন্ন বছর
নাগরিক অধিকার পরিস্থিতি সূচক বিবেচনার জন্য আমরা ফ্রিডম হাউসের ‘ফ্রিডম ইন দ্য ওয়ার্ল্ড’-এর উপাত্ত ব্যবহার করেছি। এ ক্ষেত্রে আমরা তিন প্রস্থ দীর্ঘমেয়াদি উপাত্ত ব্যবহার করে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি। এগুলো হলো: ক. ২০ বছরের (১৯৯১-২০১০) মানবাধিকার পরিস্থিতির রেটিং (০ থেকে ৭ স্কেলে গড় স্কোর হয়েছে ৩.৯) (দ্রষ্টব্য: সারণি-৪); খ. ১০ বছরের (২০০৩-২০১২) বার্ষিক সামষ্টিক স্কোর (০ থেকে ৬০ স্কেলে গড় স্কোর ৩১.৮) (দ্রষ্টব্য: সারণি-৫); গ. সাত বছরের (২০০৬ থেকে ২০১২) উপশ্রেণী বিন্যস্ত উপাত্ত যাতে একটি উপশ্রেণী ৬০ শতাংশের বেশি স্কোর পেয়েছে (দ্রষ্টব্য: সারণি-৬)। তিনটি সারণিতে দেওয়া উপাত্ত থেকে এই অনুসিদ্ধান্তে পৌঁছা যায় যে এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থা মিশ্র।
সারণি-৪
নাগরিক অধিকার পরিস্থিতি
ফ্রিডম হাউস বার্ষিক স্কোর, ১৯৯১-২০১০
বছর রাজনৈতিক অধিকার স্কোর নাগরিক অধিকার স্কোর
২০১০ ৩ ৪
২০০৯ ৩ ৪
২০০৮ ৪ ৪
২০০৭ ৫ ৪
২০০৬ ৪ ৪
২০০৫ ৪ ৪
২০০৪ ৪ ৪
২০০৩ ৪ ৪
২০০২ ৪ ৪
২০০১ ৩ ৪
২০০০ ৩ ৪
১৯৯৯ ৩ ৪
১৯৯৮ ২ ৪
১৯৯৭ ২ ৪
১৯৯৬ ২ ৪
১৯৯৫ ৩ ৪
১৯৯৪ ২ ৪
১৯৯৩ ২ ৪
১৯৯২ ২ ৩
১৯৯১ ২ ৩
সূত্র: ফ্রিডম হাউস, ‘ফ্রিডম ইন দ্য ওয়ার্ল্ড’, বিভিন্ন বছর
সারণি-৫
নাগরিক অধিকার বার্ষিক সামষ্টিক স্কোর ২০০৩-২০১২
বছর রাজনৈতিক অধিকার (০-৪০) নাগরিক অধিকার (০-৬০)
২০১২ ২৫ ৩৩
২০১১ ২৬ ৩৪
২০১০ ২৬ ৩৩
২০০৯ ২২ ৩০
২০০৮ ১২ ২৮
২০০৭ ২২ ৩১
২০০৬ ২২ ৩১
২০০৫ ২২ ৩২
২০০৪ ২১ ৩৩
২০০৩ ২১ ৩৩
সূত্র: ফ্রিডম হাউস ‘ফ্রিডম ইন দ্য ওয়ার্ল্ড’, বিভিন্ন বছর
সারণি-৬
নাগরিক অধিকার, উপশ্রেণী বিন্যস্ত ২০০৬-২০১২
বছর রাজনৈতিক অধিকার
নির্বাচনী প্রক্রিয়া রাজনৈতিক অংশগ্রহণ সরকারের কার্যক্রম
২০১২ ৯ ১১ ৫
২০১১ ৯ ১১ ৬
২০১০ ৯ ১১ ৬
২০০৯ ৯ ৯ ৪
২০০৮ ৩ ৫ ৪
২০০৭ ৮ ১০ ৪
২০০৬ ৮ ১০ ৪
বছর নাগরিক অধিকার
মত প্রকাশের স্বাধীনতা সংগঠনের অধিকার আইনের শাসন ব্যক্তিগত অধিকার
২০১২ ৯ ৮ ৭ ৯
২০১১ ৯ ৯ ৭ ৯
২০১০ ৯ ৮ ৭ ৯
২০০৯ ৮ ৮ ৫ ৯
২০০৮ ৭ ৬ ৬ ৯
২০০৭ ৮ ৮ ৬ ৯
২০০৬ ৮ ৮ ৬ ৯
সূত্র: ফ্রিডম হাউস, ‘ফ্রিডম অব দ্য ওয়ার্ল্ড’, বিভিন্ন বছর
হাইব্রিড রেজিম বা সংকর শাসনব্যবস্থার একটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো দুর্বল আইনের শাসন। কেননা এ ধরনের শাসনব্যবস্থায় সরকার আইন তার অনুকূলে এবং বিরোধীদের হয়রানির জন্য প্রয়োগ করে থাকে। তা ছাড়া বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষতির সম্মুখীন হয়। সংকর শাসনব্যবস্থায় আইনবহির্ভূত হত্যার ঘটনা ঘটে। লক্ষণীয়ভাবে অনেক ক্ষেত্রেই সরকার হয় সরকারি আধা সামরিক গোষ্ঠী অথবা সরকার-সমর্থকদের দ্বারা তৈরি সশস্ত্র গোষ্ঠীকে কর্মকাণ্ড চালাতে দিচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিবেচনায় আমরা তিন প্রস্থ উপাত্ত ব্যবহার করেছি। এগুলো হলো: ক. ২০০৬ থেকে ২০১২ সালের ফ্রিডম অব দ্য ওয়ার্ল্ডের ‘আইনের শাসন’ উপশ্রেণীর তথ্য (০ থেকে ১৫ স্কেলে যত বেশি স্কোর পরিস্থিতি ততটা ভালো; বাংলাদেশের গড় স্কোর ৬.২) (দ্রষ্টব্য: সারণি-৬); খ. অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সন্ত্রাস পরিমাপক স্কেলের স্কোর, ১৯৯১ থেকে ২০১০ (১ থেকে ৫ স্কেলে গড় ৩.৪; যত বেশি স্কোর পরিস্থিতি ততটা আশঙ্কাজনক) (দ্রষ্টব্য: সারণি-৭); গ. যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের সন্ত্রাস পরিমাপক স্কেলের স্কোর, ১৯৯১ থেকে ২০১০ (১ থেকে ৫ স্কেলে গড় ৩.৭) (দ্রষ্টব্য: সারণি-৭)। এই তিনটি সূত্রের ওপর ভিত্তি করে আমাদের উপসংহার হলো আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উদ্বেগজনক।
সারণি-৭
সন্ত্রাস পরিমাপক স্কেল ১৯৯১-২০০৭
বছর অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল স্কোর যুক্তরাষ্ট্র পররাষ্ট্র দপ্তর স্কোর
২০১০ ৪ ৪
২০০৯ ৪ ৪
২০০৮ ৪ ৪
২০০৭ ৪ ৪
২০০৬ ৪ ৪
২০০৫ ৪ ৪
২০০৪ ৪ ৪
২০০৩ ৩ ৪
২০০২ ৩ ৪
২০০১ ৪ ৩
২০০০ ৩ ৩
১৯৯৯ ৩ ৩
১৯৯৮ ২ ৪
১৯৯৭ ৩ ৪
১৯৯৬ ৩ ৪
১৯৯৫ ৩ ৩
১৯৯৪ ৩ ৩
১৯৯৩ ৩ ৩
১৯৯২ ৪ ৪
১৯৯১ ৩ ৪
সূত্র: পলিটিক্যাল টেরর স্কেল, দেখুন: http://politicalterrorscale.org/ptsdata.php?start=0
সাতটি সারণিতে উপস্থাপিত উপাত্তের ভিত্তিতে আমরা সমন্বিত গুণবাচক সারণি-৮ তৈরি করেছি, যাতে সংকর শাসনব্যবস্থার নির্দেশক সূচকগুলোতে বাংলাদেশের অবস্থান দেখা হয়েছে। এই সারণির ছয়টি সূচকের মধ্যে পাঁচটি সূচকই নির্দেশ করে যে বাংলাদেশে যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা রয়েছে তাকে যথার্থভাবেই সংকর গণতন্ত্র বলা যায়।৪
সারণি-৮
সংকর গণতন্ত্রের সূচকে বাংলাদেশ
প্রতিদ্বন্দ্বিতা-মূলক নির্বাচন উঁচুমাত্রার দুর্নীতির উপস্থিতি জবাবদিহির অনুপস্থিতি গণমাধ্যমের স্বাধীনতার
সমস্যাসংকুল পরিস্থিতি
হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ
নাগরিক অধিকার পরিস্থিতির দুর্বলতা আইনের শাসনের অনুপস্থিতি মোট সূচক
না হ্যাঁ ৫
সূত্র: লেখকের তৈরি।
সংকর গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনায় আমরা দেখেছি যে এ ধরনের ব্যবস্থায় সবগুলোই একধরনের শাসন হয় না। সংকর গণতন্ত্র বললে বিভিন্ন ধরনের ব্যবস্থার কথাই বলা হয়। এই বিন্যাস বা বিভাগটি এত ব্যাপক যে গণতন্ত্র ও কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থায় পড়ে না, এমন সব শাসনকেই সম্ভবত এর আওতায় আনা যায়। সে কারণেই আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে আরও বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করা এবং তার প্রভাব খতিয়ে দেখা।
বাংলাদেশের গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য
বাংলাদেশের বিরাজমান সংকর গণতন্ত্রের সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে দুটি প্রত্যয় আমাদের সাহায্য করতে পারে: অভিভাবকসুলভ নিয়ন্ত্রণ (Tutelary Control) এবং প্রতিভূ গণতন্ত্র (Delegative Democracy)। অভিভাবকসুলভ নিয়ন্ত্রণ সব সময়ই গণতান্ত্রিক রাজনীতির কর্তৃত্বকে দুর্বল করে তোলে। কেননা ‘নির্বাচিত প্রতিনিধিরা তাঁদের জবাবদিহিহীন মালিকদের খেয়ালখুশির দাস হয়ে পড়ে’ (সেভলার, ২০০২: ৪৭)। হ্যান্স ইয়ুরগান পোহল বলেন, ত্রুটিযুক্ত গণতন্ত্রের একটি লক্ষণই হচ্ছে যে সেখানে অগণতান্ত্রিক শক্তি গণতন্ত্রবহির্ভূত (Extrademocratic) ক্ষমতাকেন্দ্র হিসেবে বা ভেটো ক্ষমতা নিয়ে কাজ করতে পারে (পোহল, ২০০৫)। নতুন গণতন্ত্রে এ ধরনের অভিভাবকসুলভ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা থাকে সেনাবাহিনীর হাতে (যেমন গুয়াতেমালা, এল সালভাদর) অথবা ধর্মীয় নেতাদের হাতে (যেমন ইরান)। এই প্রত্যয় সবচেয়ে বেশি ব্যবহূত হয়েছে লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর গণতন্ত্রের সমস্যা ও সম্ভাবনা বিচার করতে। ফলে তার বিশ্লেষণী মূল্য ইতিমধ্যেই বহুভাবে পরীক্ষিত হয়েছে (বিস্তারিত দেখুন: রাবকিন, ১৯৯২)। বাংলাদেশে এই অভিভাবকসুলভ ক্ষমতা অর্জনের জন্য সেনাবাহিনীর একটি প্রচেষ্টা লক্ষ করা যায় জেনারেল এরশাদের শাসনামলে। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কোনো প্রতিষ্ঠান বা গোষ্ঠীগতভাবে একদল মানুষ এ ধরনের ক্ষমতার অধিকারী হয়নি, কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটি উত্তরাধিকারের রাজনীতি ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক দলের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে। তিনটি প্রধান দল—আওয়ামী লীগ, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল এবং জাতীয় পার্টি—তিনজন নেতার কর্তৃত্বেই পরিচালিত হয়। দলের অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের অভাবই তার একমাত্র কারণ নয়, দলের নেতা পর্যায়ে শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়া এবং জেনারেল এরশাদ—অভিভাবক বলেই বিবেচিত হন (উত্তরাধিকারের রাজনীতিবিষয়ক আলোচনার জন্য দ্রষ্টব্য: রীয়াজ, ২০১০)। দলের যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া অনুসরণ করলেই দেখা যায় যে শীর্ষ পর্যায়ের কমিটিগুলো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার একজন ব্যক্তির ওপরই ন্যস্ত করে।
প্রতিভূ গণতন্ত্রের প্রবক্তা গুয়েলারমো ও’ডানেল অভিভাবকসুলভ নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে এই প্রত্যয়কে যুক্ত করেননি। কিন্তু ঘনিষ্ঠভাবে লক্ষ করলেই এদের সম্পর্ক বোঝা যাবে। ও’ডানেলের দেওয়া তাত্ত্বিক কাঠামো অনুযায়ী ক্যারিশমাসম্পন্ন, দৃঢ়প্রত্যয়ী এবং অধিকাংশ সময়ই মেরুকরণ করার মতো (Polarizing) নেতৃত্ব যখন একটি সংকটকালে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় তখনই প্রতিভূ গণতন্ত্রের সুযোগ সৃষ্টি হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই নেতা-নেত্রী দেশকে রক্ষার এক বিশেষ লক্ষ্যের দায়িত্ব স্বেচ্ছায় কাঁধে নেন এবং অত্যন্ত আবেগপ্রবণ বক্তব্যের মধ্য দিয়ে দেশের মানুষকে প্রভাবিত করতে চান। অর্থাত্ প্রতিভূ গণতন্ত্রের জন্য প্রয়োজন সংখ্যাগরিষ্ঠতা তৈরি এবং এই ধারণা প্রতিষ্ঠা করা যে নেতা-নেত্রী হচ্ছেন জাতির মূর্ত রূপ। বাংলাদেশে একজন প্রধানমন্ত্রী যখন সুস্পষ্টভাবে বলেন যে তাঁর চেয়ে বেশি দেশপ্রেমিক আর কেউ নেই তখন তিনি নিজেকে জাতির মূর্ত রূপ বলেই হাজির করেন।৫
যদিও এই ব্যবস্থা ব্যক্তিকেন্দ্রিক, এ কথা বিস্মৃত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই যে এই ব্যবস্থা নির্বাচনী ব্যবস্থার ওপর, নির্বাচনী সংখ্যাগরিষ্ঠতার ওপর জোর দিয়ে থাকে। এই ব্যবস্থায় ‘নির্বাচন অত্যন্ত আবেগপ্রবণ ও ঝুঁকিপূর্ণ ঘটনা’ (ও’ডানেল, ১৯৯৪)। কিন্তু পরিহাসের বিষয় হলো যে নির্বাচন ও নির্বাচকমণ্ডলীর (অর্থাত্ ভোটারদের) ভূমিকা নির্বাচন-উত্তরকালে খুবই সীমিত, প্রায় নেই বললেই চলে। কেননা একবার নির্বাচিত হওয়ার পর প্রার্থীরা ‘নগ্ন অপ্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা সম্পর্কের আরোপিত বাধানিষেধ’ ছাড়া আর কোনো কিছুরই তোয়াক্কা করেন না। তাঁরা শাসন করেন ও’ডানেলের ভাষায় ‘virtually free of all constraints’, কার্যত সব রকম বাধানিষেধমুক্তভাবে। ও’ডানেল বলছেন, প্রতিভূ গণতন্ত্রে নির্বাচিতরা সাংবিধানিকভাবে নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে যেভাবে তাঁরা সঠিক মনে করেন সেভাবেই শাসন করতে চান।
সাধারণত রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারব্যবস্থায়ই এ ধরনের ক্ষমতার ও প্রতিভূ গণতন্ত্রের উত্থান সম্ভব বলে মনে করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশে সংসদীয় ব্যবস্থায়ও তা সম্ভব হয়ে উঠেছে একাধিক কারণে। এর মধ্যে অন্যতম হলো সাংবিধানিকভাবে প্রধানমন্ত্রীর হাতে প্রভূত ক্ষমতা প্রদান ও তা নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা না থাকা। তদুপরি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী একাধারে তিন ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। তিনি প্রধানমন্ত্রী, সংসদীয় দলের প্রধান এবং তাঁর দলের প্রধান। উপরন্তু এই ব্যবস্থা যখন অভিভাবকসুলভ নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে তখন তার ভারসাম্যের আর কোনো পথই খোলা থাকে না।
ডেলিগেটিভ ডেমোক্রেসি নিয়ে এ যাবত্ যাঁরা আলোচনা করেছেন তাঁরা রাষ্ট্রপতিশাসিত পদ্ধতিকেই উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করেছেন। সে ক্ষেত্রে তাঁরা দেখান যে প্রেসিডেন্ট প্রায় সীমাহীন ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার ফলে আইনসভা ও বিচার বিভাগকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে ‘উপদ্রব’ বলেই তাঁরা মনে করেন। যাঁরা একদা ক্ষমতাসীন ছিলেন তাঁদের ক্ষেত্রেও এটা অনেকটাই প্রযোজ্য। অনেকেরই হয়তো মনে থাকবে, জাতীয় সংসদের এক অধিবেশনে একজন বিরোধীদলীয় নেত্রী ট্রেজারি বেঞ্চকে লক্ষ করে ‘চুপ বেয়াদব’ বলে ধমক দেন।৬
সংখ্যাগরিষ্ঠতার সূত্রে প্রাপ্ত সীমাহীন ক্ষমতা, জাতির মূর্ত রূপ হওয়া এবং অভিভাবকসুলভ নিয়ন্ত্রণ অর্জন করার ফলে নেতা-নেত্রীরা জবাবদিহিকে কোনোভাবেই গুরুত্ব দিতে রাজি নন। তাঁদের কাছে জবাবদিহি মানে উল্লম্ব (Vertical) জবাবদিহি; অর্থাত্ নির্দিষ্ট সময়ে ভোটারদের কাছে ব্যালট বাক্সে জবাবদিহি। কিন্তু যেসব দেশে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে, সেখানে জবাবদিহির আরেক রূপ হলো আনুভূমিক (Horizontal) জবাবদিহি। সমাজের অন্যান্য স্বশাসিত প্রতিষ্ঠান যারা নির্বাচিত ব্যক্তিদের ক্ষমতা প্রয়োগকে প্রশ্ন করতে পারবে এবং ক্ষমতার অপপ্রয়োগ হলে নির্বাচিত ব্যক্তিদের শাস্তিও দিতে পারবে (ও’ডানেল ১৯৯৪: ৬১-২)।
১৯৯৮ সালে প্রকাশিত অন্য এক প্রবন্ধে ও’ডানেল জোর দিয়ে বলেন যে নতুন গণতন্ত্রে যত সুষ্ঠু নির্বাচনই হোক, তা শক্তিশালী উল্লম্ব জবাবদিহি নিশ্চিত করে না। অসংহত দল-ব্যবস্থা, ইস্যুভিত্তিক নির্বাচন না হওয়া ইত্যাদি কারণে কয়েক বছরের ব্যবধানে অনুষ্ঠিত নির্বাচনই যথেষ্ট নয়। এসব ক্ষেত্রে বেশি দরকার আনুভূমিক জবাবদিহি। আনুভূমিক জবাবদিহির অনুপস্থিতিতে সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠে বলে তিনি হুঁশিয়ার করেন (ও’ডানেল, ১৯৯৮)।
আনুভূমিক জবাবদিহির জন্য প্রয়োজনীয় যেসব প্রতিষ্ঠানের কথা বলা হয়ে থাকে, তার অধিকাংশই হলো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। কিন্তু গত দুই দশকের অভিজ্ঞতা হলো এই যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক শ্রেণী, দল-নির্বিশেষেই, এ ধরনের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান তৈরির প্রচেষ্টায় বাধা দিয়েছে। বিএনপির সর্বশেষ শাসনের সময় (২০০১-২০০৬) আন্তর্জাতিক চাপের মুখে দুর্নীতি দমন কমিশন তৈরি হলেও তাকে অকার্যকর করে রাখা হয়। অন্যদিকে বর্তমান সরকারের গোড়া থেকেই দুর্নীতি দমন কমিশনের ক্ষমতা হ্র্রাস করার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। কমিশনের প্রধান ২০০৯ সালের অক্টোবর মাসে এক সংবাদ সম্মেলনে একে ‘দন্তহীন বাঘ’ বলে বর্ণনা করেন। সাম্প্রতিক কালে কমিশনের কার্যকলাপ একে আরও প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলেছে। একইভাবে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন গঠনে সরকারি অনীহা, প্রতিষ্ঠার পর তার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে অনাগ্রহ ও কমিশনের অনুরোধ উপেক্ষা করার ঘটনা প্রমাণ করে যে সরকারের জবাবদিহির ধারণায় এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের কোনো মূল্যই নেই।
সাম্প্রতিক কালে আনুভূমিক ও উল্লম্ব জবাবদিহির পাশাপাশি সামাজিক জবাবদিহির ধারণা তৈরি হয়েছে। এই সামাজিক জবাবদিহি হলো উল্লম্ব জবাবদিহি কিন্তু তা নির্বাচিত প্রতিষ্ঠানের কাছে নয়, বরং নাগরিকদের সংগঠন ও আন্দোলনের কাছে এবং গণমাধ্যমের কাছে (স্মুলোভিজ ও পেরুজোটি, ২০০০)। এ ধরনের জবাবদিহি যে ক্ষমতাসীন দলের কাছে একেবারেই অগ্রহণযোগ্য তা প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় নেতাদের মন্তব্য থেকেই স্পষ্ট। ২০১১ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় দুজন কৃতী চিত্রনির্মাতা তারেক মাসুদ ও আশফাক মুনীরসহ পাঁচজনের মৃত্যুর ঘটনার পর তরুণদের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ আন্দোলন প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্য এবং নিয়মিতভাবে গণমাধ্যমের সমালোচনাই এ কথা প্রমাণ করে।
উপসংহার
এই আলোচনায় আমি দেখাতে চেয়েছি, বাংলাদেশে যে শাসনব্যবস্থার উদ্ভব ঘটেছে তাকে সংকর শাসনব্যবস্থা বলে চিহ্নিত করা যায়। ওপরের আলোচনায় এই শাসনব্যবস্থার বিভিন্ন সূচক বিবেচনা করে এই কথাই বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে যে অন্যান্য কতিপয় দেশের মতোই গণতন্ত্রায়ণ-প্রক্রিয়ার একটি পর্যায়ে এসে এই ব্যবস্থার উদ্ভব ঘটেছে। তদুপরি দেশে বিরাজমান রাজনৈতিক সংস্কৃতির কারণে এই ব্যবস্থা প্রতিভূ গণতন্ত্র বা ডেলিগেটিভ ডেমোক্রেসির রূপ নিয়েছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে এই মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, সংকর শাসনব্যবস্থার যেকোনো রূপই আসলে আর উত্তরণের একটি পর্যায় নয়, এটি নিজেই একটি স্বতন্ত্র ব্যবস্থা। যার অর্থ এই অবস্থা থেকে পরিপূর্ণ গণতন্ত্রে উত্তরণ বা কর্তৃত্ববাদী শাসনে প্রত্যাবর্তন করা পূর্বনির্ধারিত নয়। ফলে খুব সহজে এ ধরনের ব্যবস্থার সম্ভাব্য ভবিষ্যত্ পথরেখা নির্দেশ করা সম্ভব নয়। বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যত্ নিয়ে বিভিন্ন মহলে যে শঙ্কার কথা আমি প্রবন্ধের গোড়াতে উল্লেখ করেছি, তার আংশিক কারণও এই।
সংকর শাসনব্যবস্থা বা হাইব্রিড রেজিমের যেসব রূপ তাত্ত্বিকভাবে আলোচিত হয়েছে, তার কোনোটিই খুব দীর্ঘ সময় ধরে বাস্তব রূপ নেয়নি। এদের অধিকাংশরই উদ্ভব ঘটেছে এক দশক বা তার কিছু বেশি সময় ধরে। ফলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও বিশ্লেষকদের হাতে যথেষ্ট পরিমাণ ভূয়োদর্শনলব্ধ উপাত্ত নেই, যা থেকে এ ধরনের ব্যবস্থার স্থায়িত্বের মেয়াদ বা ভবিষ্যত্ সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট মন্তব্য করা যেতে পারে।
তবে রাশিয়া, ভেনেজুয়েলা ও তানজানিয়া নিয়ে জোয়াকিন একম্যানের গবেষণা থেকে আমরা খানিকটা ইঙ্গিত পেতে পারি (একম্যান, ২০০৯)। ওই গবেষণায় সংকর শাসনব্যবস্থা সংরক্ষণে কী কী বিষয় গুরুত্বপূর্ণ তা আলোচনা করা হয়েছে। সাধারণভাবে বলা হয়ে থাকে যে নির্বাচন, নির্বাহী/আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। একম্যান বলছেন যে এর বাইরে জনসাধারণের ভূমিকা অপরিসীম।
সংকর শাসনব্যবস্থার বৈধতার ভিত্তি হচ্ছে নির্বাচন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসব নির্বাচন খুব প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হয়ে থাকে। ফলে এসব নির্বাচন প্রভাবিত করার চেষ্টা সহজেই লক্ষণীয়। তদুপরি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে প্রভাব বিস্তারের প্রবণতাও সহজেই দেখা যায়। নির্বাচনকে প্রভাবিত করা, স্বীয় স্বার্থে কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীনদের সাফল্য নির্ভর করে বিরোধী দলগুলোর এবং সিভিল সমাজের শক্তির ওপর। নির্বাচন প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে সংকর শাসনব্যবস্থায় সরকারের প্রচেষ্টা এখন পর্যন্ত প্রত্যক্ষ এবং কৌশলী দুই ধরনেরই হয়েছে। সাংবিধানিক ব্যবস্থাও যে ব্যবহূত হয়েছে তা সর্বসাম্প্রতিক রাশিয়ার নির্বাচন ও রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে ভ্লাদিমির পুতিনের প্রত্যাবর্তন থেকেই স্পষ্ট।
আইনসভা/নির্বাহী বিভাগের ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে দুর্বল আইনসভা ক্ষমতাসীনদের অনুকূলেই যায়। তবে আইনসভা থাকা এবং তাকে কার্যকর রাখা যেহেতু ক্ষমতাসীনদের জন্য বাধ্যতামূলক (তাদের বৈধতা ও গণতান্ত্রিক আবহ বজায় রাখতে) সেহেতু তা বিরোধীদের জন্য সুযোগ তৈরি করে দেয়।
তৃতীয় ক্ষেত্র—বিচার বিভাগের ওপর নিয়ন্ত্রণ সংকর শাসনব্যবস্থা, বিশেষত প্রতিভূ গণতন্ত্র, অব্যাহত রাখার একটি অত্যাবশ্যকীয় শর্ত। লেভিিস্ক এবং ওয়ে (২০০২) বলছেন যে এটা সাধারণত করা হয়ে থাকে উেকাচ প্রদান বা জোর করার মাধ্যমে এবং যদি সম্ভব হয় তবে বিচারক ও আইন কর্মকর্তাদের নিয়োগ এবং চাকরিচ্যুতির মাধ্যমে। ব্রাউন এবং ওয়াইজ (২০০৪) ইউক্রেনের ওপর গবেষণার ভিত্তিতে বলেছেন যে সুপ্রিম কোর্ট বা সাংবিধানিক আদালত কেবল সাংবিধানিক বিষয় ও আইনের মৌলিক নীতির সালিসকারীই হয় না, বরং ক্ষমতাসীনদের অধিবক্তা/সমর্থক হিসেবেও কাজ করে।
একম্যান তাঁর গবেষণায় আবিষ্কার করেছেন যে এ ধরনের ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে কাঠামোগত ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির ভূমিকা হচ্ছে সাহায্যকারীর। কাঠামোগত উপাদান হচ্ছে দুর্বল বা অকার্যকর বিরোধী শক্তি এবং ‘সাধারণ নাগরিক ও বিরোধী দলগুলোর মধ্যে যোগাযোগের অভাব’ (একম্যান, ২০০৯: ২৫)। রাজনৈতিক সংস্কৃতির ক্ষেত্রে সিভিক কালচার বা বহুত্ববাদী সংস্কৃতির অনুপস্থিতি এবং রাজনীতির ব্যাপারে হতাশা/অনুত্সাহিতা এই ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করে।
যেসব পদ্ধতি ও সহায়ক কারণ এ ধরনের সংকর শাসনব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখে তা কোনো অবস্থাতেই এর ভবিষ্যত্ পথরেখা নির্দেশ করে না। এসব থেকে বাংলাদেশে যে প্রতিভূ গণতন্ত্র বিরাজ করছে তার ভবিষ্যত্ও নিশ্চিত করে বলা যাবে না। তবে প্রতিভূ গণতন্ত্র থেকে ভিন্ন পথে অগ্রসর হতে চাইলে এসব পদ্ধতির বাস্তবায়ন রোধ ও সহায়ক কারণগুলো মোকাবিলা করা যে জরুরি, সেটা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
তথ্যসূত্র ও টীকা
১. সাম্প্রতিক কালে মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন সত্ত্বেও গত দুই দশকে গণতান্ত্রিক দেশের সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে। তা ছাড়া মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ‘সাফল্য’ এখনো সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত নয়।
২. সিমের লিপসেটের এই প্রবন্ধের কতিপয় দিক ভুলভাবে ব্যাখ্যা হয়েছে বলেই আমার ধারণা। লিপসেট তাঁর লেখায় প্রত্যক্ষভাবে মাথাপিছু আয় ও গণতন্ত্রের মধ্যে সম্পর্ক দেখাননি। বরং তিনি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উপস্থিতিকে একটি গুরত্বপূর্ণ বিষয় বলেই যুক্তি দেখিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ‘যে সমাজ ব্যাপক দরিদ্র জনগোষ্ঠী ও ছোট আকারের সুবিধাভোগী এলিটে বিভক্ত সেখানে গোষ্ঠী শাসন (Oligarchy) বা পীড়নমূলক ব্যবস্থা (Tyranny) তৈরি হবে’ (লিপসেট, ১৯৫৯: ৭৫)।
৩. জোয়াকিম একম্যান তাঁর প্রবন্ধে সম্ভাব্য ৫৯টি সংকর শাসনব্যবস্থাকে চিহ্নিত করে ছয়টি সূচকের ভিত্তিতে এই দেশগুলোকে বিবেচনা করেন। এর মধ্যে তিনটি দেশ—রাশিয়া, ভেনেজুয়েলা ও তানজানিয়া—নিয়ে তিনি বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তাঁর এই তালিকায় বাংলাদেশ অন্তর্ভুক্ত হলেও তিনি যেসব উত্স ব্যবহার করেছেন এই প্রবন্ধে তার বাইরে একাধিক সূত্র ব্যবহূত হয়েছে। একটি সূচকের জন্য একম্যান একটি সূত্রের ওপর নির্ভর করেছেন। কিন্তু আমরা অনেক সূচকের ক্ষেত্রে একাধিক সূত্রকে বিবেচনা করেছি। একম্যানের ব্যবহূত একটি সূচক ‘গণতান্ত্রিক মানের অনুপস্থিতি’কে সুনির্দিষ্টকরণের জন্য আমরা ‘জবাবদিহির অনুপস্থিতি’ বলে বর্ণনা করেছি।
৪. প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ্য, একম্যানের তালিকায় যে পাঁচটি দেশে পাঁচটির বেশি সূচক সে দেশে সংকর গণতন্ত্রের ইঙ্গিত দেয়, তার মধ্যে বাংলাদেশ একটি। অন্য দেশগুলো হলো: রাশিয়া, ভেনেজুয়েলা, জর্জিয়া ও মালাওয়াই।
৫. ২০১১ সালের ১৮ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগারগাঁওয়ে বিনিয়োগ বোর্ডের (বিওআই) প্রধান কার্যালয় ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করতে গিয়ে বলেন, ‘আমার প্রশ্ন হলো, কে বেশি দেশপ্রেমিক এবং দেশের স্বার্থের বিষয়টি আমার চেয়ে কে বেশি ভাবে?’ (প্রথম আলো, ১৯ জুন, ২০১১)
৬. সপ্তম সংসদে (১৯৯৬-২০০১) এই কথাটি বলেছেন বেগম খালেদা জিয়া। স্পিকার হুমায়ুন রশিদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক অধিবেশনে বেগম জিয়া ট্রেজারি বেঞ্চকে উদ্দেশ করে এই কথাটি বলেছিলেন।
গ্রন্থপঞ্জি
Almond, Gabriel and Verba, Sidney. 1963. The Civic Culture : Political Attitudes and Democracy in Five Nations. Princeton, NJ : Princeton University Press.
Bogaards, Matthijs. 2009. ‘How to classify hybrid regimes? Defective democracy and electoral authoritarianism’, Democratization, 16 (1) : 399-423.
Bollen, Kenneth and Robert Jackman. 1989. ‘Democracy, Stability and Dichotomies’, American Sociological Review, Vol. 54, no. 4 : 612-621, 1989.
Brown, Trevor L and Charles R. Wise, 2004. ‘Constitutional Courts and Legislative-Executive Relations : The Case of Ukraine’, Political Science Quarterly 119 (1) : 143-69.
Carothers, Thomas. 2002. ‘The End of the Transition Paradigm?’, Journal of Democracy, 13(1) : 5-12.
Chandler, David. 2000. Bosnia : Faking Democracy After Dayton. London : Pluto Press.
Dahl, Roberts. 1972. Polyarchy : Participation and Opposition. New Haven : Yale University Press.
Diamond, Larry. 2008. The Spirit of Democracy. New York : Times Books.
Diamond, Larry. 2006. ‘Is the Third Wave Over?’, Journal of Democracy 7 (July): 20-37.
Diamond, Larry. 2002. ‘Thinking about Hybrid Regimes’, Journal of Democracy, 13(2): 21-35.
Diamond, Larry. Ed. 2001. The Global Divergence of Democracy. London : Johns Hopkins University Press.
Diamond, Larry. 2000. ‘The end of the third way and the start of the fourth’. In Democratic Invention, edited by Marc F. Plattner, and Joao Carlos Espada. London : Johns Hopkins University Press.
Diamond, Larry. 1999. Developing Democracy : Toward Consolidation. London : Johns Hopkins University Press.
Diamond, Larry. 1993. ‘Three paradoxes of democracy’. In The Global Resurgence of Democracy, edited by Larry Diamond, and Marc Plattner. London : Johns Hopkins University Press.
Ekman, Joakim. 2009. ‘Political Participation and Regime Stability : A Framework for Analyzing Hybrid Regimes’, International Political Science Review 30(1): 7-21.
Fukuyama, Francis. 1991. The End of History and the Last Man. New York : Free Press.
Fukuyama, Francis. 1989. ‘The End of History?’, The National Interest, Summer.
Huntington, Samuel. 1991. The Third Wave : Democratization in the Late Twentieth Century., Norman : University of Oklahoma Press.
Levitsky, Steven and Lucan Way. 2002. ‘The Rise of Competitive Authoritarianism’, Journal of Democracy, 13(2): 51-65.
Lipset, Seymour Martin. 1959. ‘Some Social Requisites of Democracy, Economic Development and Political Legitimacy’, American Political Science Review 53(1): 69-105.
Moore, Barrington. 1966. Social Origins of Dictatorship and Democracy : Lord and Peasant in the Making of the Modern World. Boston, MA : Beacon Press.
Nathan, Andrew J. 2003. ‘Authoritarian resilience’. Journal of Democracy, 14(1), 6-17.
O'Donnell, Guillermo. 1998. ‘Horizontal Accountability in New Democracies’, Journal of Democracy, 9(3): 112-126.
O'Donnell, Guillermo. 1994. ‘Delegative Democracy’, Journal of Democracy, 5(1): 55-69.
O'Donnell, Guillermo and Philippe Schmitter, 1986. Transitions from Authoritarian Rule : Tentative Conclusions about Uncertain Democracies, Baltimore : Johns Hopkins University Press, 1986.
Ottaway, Marina. 2003. ‘Promoting democracy after conflict : the difficult choices’. International Studies Perspectives, 4(3), 314-322.
Pridham, Geoffrey, 2005. Designing Democracy : EU Enlargement and Regime Change in Post Communist Europe. New York : Palgrave Macmillan.
Puhle, Hans-Jurgen. 2005. ‘Democratic Consolidation and “Defective Democracies”’, Madrid : Universidad Autonoma de Madrid, Working Papers Online Series Working Paper 47.
Rabkin, Rhoda. 1992. ‘The Aylwin Government and “Tutelary” Democracy : A Concept in Search of a Case?’, Journal of Interamerican Studies and World Affairs, 34(4): 119-194, 1992-1993.
Riaz, Ali. 2010. ‘Dynastic Politics and the Political Culture of Bangladesh’, Journal of International Relations, 8(II): 1-16.
Sartori, Giovanni. 1987. The Theory of Democracy Revisited. New Jersey : Chatam House.
Schedler, Andreas. 2002. ‘The Menu of Manipulation’, Journal of Democracy, 13(2): 36-50.
Schumpeter, Joseph. 1946/1950. Capitalism, Socialism and Democracy, 3rd edition. London : Allen and Unwin.
Smulovitz, Catalina and Enrique Peruzzotti, 2000. ‘Societal Accountability in Latin America’, Journal of Democracy, 11(4): 147-158.
Vanhanen, Tatu. 1997. Prospects of Democracy. A Study of 172 Countries. London : Routledge.
Zakaria, Fareed. 1997. ‘The Rise of Illiberal Democracy’, Foreign Affairs, November-December.
Zakaria, Fareed. 2007. The Future of Freedom : Illiberal Democracy at Home and Abroad, New York : W.W. Norton & Company.