বাংলাদেশ: যেখানে গণতন্ত্রের রং ধূসর

সারসংক্ষেপ

বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক বিকাশ যেভাবে হওয়ার কথা ছিল সেভাবে হয়নি। আজ যে গণতন্ত্র আমাদের দেশে স্থান করে নিয়েছে তাকে উদারনীতিবিহীন গণতন্ত্র হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। এর কারণ হিসেবে অনেকে দাবি করেন যে গণতন্ত্রের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক পূর্বশর্তগুলো আমাদের দেশে পূরণ না করেই আমরা গণতন্ত্র নিয়ে ভেবেছি। আর সে কারণে এখানে গণতন্ত্রের উপযুক্ত ক্ষেত্র তৈরি হয়নি। পূর্বশর্তের প্রশ্নে দুটি অবস্থান নিয়ে এই প্রবন্ধে আলোচনা করা হয়েছে। একটি আর্থসামাজিক উন্নয়ন, অন্যটি গণতন্ত্রের সাধারণ নীতিমালার প্রতি এলিট গোষ্ঠীর অঙ্গীকার এবং তাদের আন্তসম্পর্কগত সমঝোতা। এই উভয় পূর্বশর্তের শেকড় ইউরোপীয় সমাজের অভিজ্ঞতার সঙ্গে যুক্ত।

বাংলাদেশের জন্য সে কারণে তাদের উপযোগিতা অনেকটা প্রশ্নবোধক হয়ে পড়ে। ইউরোপ বেশ কয়েকটি সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সংস্কারের ধাপ অতিক্রম করে গণতন্ত্রে পৌঁছেছিল—প্রথমে জাতিগঠন, পরে রাজনৈতিক সংস্কার, শিল্প বিপ্লব এবং বিজ্ঞান প্রযুক্তির বিকাশ ঘটেছিল। এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে ইউরোপকে প্রায় পাঁচ শ বছর ব্যয় করতে হয়। দীর্ঘ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীনতা লাভ করে আমাদের দেশ একই সঙ্গে অর্থনৈতিক উন্নয়ন, রাজনৈতিক সংস্কার, জাতিগঠন এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়। ফলে ইউরোপীয় সমাজের সঙ্গে তুলনা করলে চ্যালেঞ্জটি এ ক্ষেত্রে অনেক গুণ বেশি। সেই পরিপ্রেক্ষিতকে মাথায় রেখে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের ওপর প্রবন্ধে আলোকপাত করা হলো।

মুখ্য শব্দগুচ্ছ: গণতন্ত্র, সিমোর লিপসেট, ধূসর এলাকা, ব্যারিংটন মুর, ‘মাফিয়া গণতন্ত্র’, এলিট সমঝোতার তত্ত্ব, রাজনৈতিক ঐক্য, আধুনিক গণতান্ত্রিক সমাজ, অনির্বাচিত আমলাতন্ত্র ও জনপ্রতিনিধি।

ভূমিকা

এ প্রবন্ধটি গণতন্ত্র নিয়ে লেখা। তবে গণতন্ত্রের সাধারণ দিক নিয়ে নয়। যে বিশেষ ধরনের গণতন্ত্র বাংলাদেশে আজ বহাল আছে তার হালচিত্র নিয়ে মূলত এটি লেখা হয়েছে। অনেকের মতে, বাংলাদেশে গণতন্ত্রের কোনো ভবিষ্যত্ নেই। কারণ সেখানে রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা যে মাত্রায় রক্তক্ষয়ী এবং সংঘাতময়, সেটি পৃথিবীর আর কোথাও দেখা যায় না। স্বাধীনতা লাভের ইতোমধ্যে ৪৪ বছর পার হয়েছে। অথচ গণতন্ত্র এখানে যৌবনে পৌঁছানোর আগেই অসুস্থতায় ভুগছে। এই অসুস্থ গণতন্ত্রের ওপর আলোচনার যৌক্তিকতা কতটুকু, সে প্রশ্ন এখানে অবান্তর নয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে মূলত দুটি কারণে গণতন্ত্রের ওপর এই আলোচনাটি হওয়া প্রয়োজন বলে মনে হয়। একটি কারণ, গণতন্ত্র নিয়ে বিশ্বব্যাপী আজ বিশেষ উত্তেজনা বিরাজ করছে, বিভিন্ন দেশে তাকে প্রতিষ্ঠা করার বিপুল তোড়জোড় চলছে। সেই ডামাডোলের দিকে তাকিয়ে দেশীয় গণতন্ত্রচর্চার সাক্ষাত্ চিত্রটি তুলে ধরার কৌতূহল থেকে নিবৃত্ত থাকা কঠিন। তা যতই মনে হোক না কেন তার ওপর কালো মেঘের এক গভীর প্রলেপ রয়েছে। বিজ্ঞজনেরা মনে করেন যেকোনো জিনিসের মধ্যে যেমন ভালো দিক আছে, তেমনি মন্দ দিকও আছে। কেবল মন্দের দিকে তাকিয়ে ভালোকে উপেক্ষা করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। সেদিক থেকে ভেবে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের সবটুকুকে নাকচ করা যুক্তিযুক্ত বলে মনে হয় না। সে কারণে কিছুটা দুঃসাহস দেখিয়ে তাকে বিচারের ঝুঁকি নেওয়ার সুযোগ রয়েছে বলে মনে হয়।

আরও একটি কারণ আছে, যা নিতান্তই দেশীয়। আমাদের দেশে গণতন্ত্র নিয়ে বিজ্ঞ সমাজে এবং বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রচুর আগ্রহ লক্ষ করা যায়। গণতন্ত্র নিয়ে আলাপচারিতার শেষ নেই। চায়ের কাপে আড্ডা থেকে শুরু করে ঘরোয়া পরিবেশ এবং বন্ধুমহলে গণতন্ত্রের ভাগ্য নিয়ে প্রচুর আলাপ হয়ে থাকে। দৈনিক পত্রপত্রিকার পাতায় গণতন্ত্রসংক্রান্ত নানা লেখা প্রতিদিন প্রকাশিত হচ্ছে। কিন্তু তার ওপর গবেষণাধর্মী রচনা চোখে পড়ে কদাচিত্। সেই ঘাটতিটুকু এখানে কিছুটা হলেও পূরণ করার প্রচেষ্টা থাকবে।

বাংলাদেশে গণতন্ত্রের চেহারা

মার্কিন নিউজউইক পত্রিকার সম্পাদক ফরিদ জাকারিয়ার মতো যাঁরা বিশ্বব্যাপী গণতান্ত্রিক প্রবণতা নিয়ে ভাবেন, তাঁদের বিশেষ উত্সাহ মূলত করে সেসব দেশকে নিয়ে যেসব দেশ দীর্ঘকাল স্বৈরশাসনের অধীনে থেকে ইদানীং গণতন্ত্রের পথে পা বাড়িয়েছে। সে ধরনের দেশের তালিকায় বাংলাদেশ অন্তর্ভুক্ত। বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে প্রায়ই ‘উদারনীতিবিহীন গণতন্ত্র’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। অনেকে মনে করেন গণতন্ত্রের বিচারে বাংলাদেশ এক ধূসর এলাকায় আটকে আছে। আর সে কারণে সামনে এগোনোর পথ তার জন্য অনেকটা রুদ্ধ। এই মূল্যায়ন কেন তার বেশ কিছু কারণ রয়েছে। প্রথমত, বাংলাদেশে যে ধরনের রাজনীতি স্থান করে নিয়েছে সে রাজনীতি মূলত সন্ত্রাসনির্ভর। রাজনৈতিক দল পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে উদার মনোভাব দেখায় না। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের প্রতি তাদের প্রত্যেকের রয়েছে প্রচণ্ড ঘৃণা। তারা সংকীর্ণ মনের, স্পর্শকাতর, ক্ষমতালোভী, অন্যের কল্যাণ পছন্দ করে না। প্রখ্যাত ভারতীয় চিন্তাবিদ নীরদ চৌধুরীর ভাষায় যাকে বলে, ‘আত্মঘাতী’। এই রাজনৈতিক এলিট গোষ্ঠী এমনই অনড় এবং আত্মকেন্দ্রিক যে নিরপেক্ষ নির্বাচনের ফল মেনে নিতে তারা যথেষ্ট কার্পণ্য দেখায়। সরকারি দল বা বিরোধী দলকে শত্রু হিসেবে দেখে এবং তাদের প্রতি অগণতান্ত্রিক, সভ্য জগতের রীতিনীতিবিরোধী আচরণ করে।

বিরোধী দলও তাদের ভূমিকায় রাজনৈতিক প্রতিযোগিতাকে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে ধরে নেয়। সমঝোতার দরজা বন্ধ করে দেয়, প্রতিযোগিতাকে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে না রেখে জাতীয় সংসদ বর্জন করে, রাস্তায় নেমে সরকার উত্খাতে সহিংস পথ অনুসরণ করে। এতে করে রাজনীতির প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ভেঙে পড়লেও দ্বিগুণ উল্লসিত হয়ে গণতন্ত্রের বিজয় হয়েছে ঘোষণা দিয়ে বিরোধী দল ক্ষমতা গ্রহণ করে। পুনরাবৃত্তি ঘটে সে একই চিত্রের। এবার তাদের পালা প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে নির্যাতন এবং নিপীড়ন চালানো, ঠিক যেভাবে তারা নিজেরাই নির্যাতিত হয়েছে। পরিচিত এই চক্রটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে আজ বলা চলে প্রতিষ্ঠিত সত্য।

এই বিশেষ রাজনৈতিক সংস্কৃতির কারণে যে ধরনের গণতন্ত্র বাংলাদেশে স্থান করে নিয়েছে সেটি নিদারুণভাবে সংকীর্ণ প্রকৃতির। তাকে পোশাকি গণতন্ত্র বললেও ভুল হয় না। সেখানে মেয়াদান্তে নির্বাচন হয়, যদিও সে নির্বাচন নিরপেক্ষ কি না তা নিয়ে তর্ক থাকে। সেখানে ক্ষমতার রদবদল মুখ্য লক্ষ্য হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। অর্থনীতি, সামাজিক সম্পর্ক, নাগরিক অধিকার, মানবিক অধিকারসহ একটি আধুনিক সংস্কৃতি নির্মাণের পথ বা মাধ্যম হিসেবে তাকে দেখা হয় না। ভাবা হয় না মানবিক গুণাবলির বহিঃপ্রকাশের ক্ষেত্র হিসেবে, যেখানে মেধার পূর্ণ বিকাশের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি সম্ভব হবে। এই সংকীর্ণ অর্থে গণতন্ত্রকে বোঝা এবং সহিংসতাকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার কারণে অর্থনীতি এবং রাজনীতির মধ্যে বিশাল অসামঞ্জস্য সৃষ্টি হয়ে আছে। দেশ অর্থনৈতিক দিক থেকে দ্রুতগতিতে এগিয়ে গেলেও দেশের শাসনপদ্ধতি তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগোচ্ছে না। অর্থনীতির বিশাল কর্মযজ্ঞে কোটি কোটি মানুষ অংশ নিলেও রাষ্ট্রপরিচালনার কৃতকৌশলে আধুনিকায়ন এবং গণতন্ত্রায়ণের লেশমাত্র নেই। রাজনৈতিক অংশগ্রহণের প্রশ্নে দৃশ্যত স্থান করে নিয়েছে সংকোচনের আবহাওয়া। সেটি প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে নানা দিক থেকে—সংসদ নির্বাচনে, তার কার্যক্রমে, বিচার বিভাগ বা অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানের দলীয়করণে, স্বাধীনতাহীন অস্তিত্বে। ফলে গণতন্ত্রের প্রতি এখানে কোনো ‘সক্রিয়, ইতিবাচক এবং গভীরভাবে অনুভূত আনুগত্য’ (Larry Diamond, 1999: 64) গড়ে ওঠেনি। অর্থাত্ গণতন্ত্র এখানে নাগরিক অভ্যাসে পরিণত হয়নি।

এই ধরনের গণতন্ত্রকে অনেকে Feckless pluralism (Carothers, 2002, p.11), নির্বাচনী গণতন্ত্র (electoral democracy), মিথ্যা গণতন্ত্র (pseudo democracy), দুর্বল গণতন্ত্র (weak democracy), আংশিক গণতন্ত্র (partial democracy), আবরণী গণতন্ত্র (facade democracy), আধা গণতন্ত্র (semi-democratic), পোশাকি গণতন্ত্র (formal democracy) উদারনীতিবিমুখ গণতন্ত্র (illiberal democracy) হিসেবে ব্যাখ্যা করতে কার্পণ্য করেন না। প্রবণতাটি কেবল যে বাংলাদেশের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য তা নয়। ব্রাজিল, বুরকিনা ফাসো, কঙ্গো, এলসালভাদর, ইন্দোনেশিয়া, কেনিয়া, মালয়েশিয়া, রাশিয়া, তানজানিয়া, ইউক্রেন, জাম্বিয়ার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ভেনেজুয়েলা, কলম্বিয়া, শ্রীলঙ্কায়ও সেটি লক্ষ করা যাচ্ছে এবং উল্লিখিত দেশগুলোতে গণতন্ত্রের মানের অবনতি ঘটেই চলেছে। সে কারণে অনেকে সেখানকার গণতন্ত্রকে frozen Democracy (Terry Lynn Karl, 1990) বলছেন। গণতন্ত্র সেখানে বরফের মতো নিশ্চল, প্রাণহীন, অথর্ব অথবা অকার্যকর। ওই একই প্রবণতা দেখা যায় দক্ষিণ আমেরিকায়। সেখানে স্থান করে নিয়েছে আরও ভয়ংকর এক মিশ্রণ। গণতন্ত্র স্বৈরতন্ত্রের আঁতাত থেকে জন্ম নিয়েছে ‘বাজার স্বৈরতন্ত্র’ (Market Authoritarianism)। অর্থনীতিতে নব্য উদারনীতিবাদ চালু রাখা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নানা ধরনের মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করে এ গণতন্ত্র জন্ম দিচ্ছে ভুঁইফোড় এক নব্য বুর্জোয়ার। এই একই মডেলের সাক্ষাত্ মেলে পূর্ব ইউরোপে। সেখানে সমাজতান্ত্রিক কাঠামোকে ভেঙে পুঁজিবাদ গড়ে উঠেছে বটে, কিন্তু দক্ষিণ আমেরিকার মতো করে সে পুঁজিবাদও নৈতিকতাবর্জিত। কঠোর পরিশ্রম, সততা, দায়িত্ববোধ যেগুলো পুঁজিবাদের ধ্রুপদি গুণ, সেগুলো সেখানে অনুপস্থিত। ফলে দুর্নীতিগ্রস্ত বণিক শ্রেণির সঙ্গে দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক এলিটের আঁঁতাত থেকে সেখানে জন্ম নিয়েছে ‘মাফিয়া গণতন্ত্র’। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়।

তবে এ ধরনের কঠোর মন্তব্যকে গ্রহণ করে নেওয়ার আগে একটি বিশেষ সত্য মাথায় রাখা উচিত। অন্যান্য তৃতীয় বিশ্বের দেশের মতো বাংলাদেশ আজ গণতন্ত্রের পথে যে সময় অতিক্রম করছে তাকে অন্তর্বর্তী সময় হিসেবে ধরে নিতে হবে এবং মানতে হবে যে যেকোনো অন্তর্বর্তীকালীন গণতন্ত্রের পক্ষে এই ধরনের সংকটে পড়ার আশঙ্কা থেকেই যায়। প্রখ্যাত মার্কিন পণ্ডিত সামুয়েল হান্টিংটনও সেটি উপলব্ধি করতে ভোলেননি। ১৯৯৬ সালে লেখা এক প্রবন্ধে তিনি বলেছেন, ‘a new reverse wave may be gathering which could lead to the ersion of some third-wave gains’ (Huntington, Samuel, 1996), এই পরিপ্রেক্ষিতে যে প্রশ্নটি অনেকে যুক্তিযুক্ত ভাবেন তা হলো—গণতন্ত্র নিয়ে ভাবার আগে দেখা প্রয়োজন দেশটি গণতন্ত্রের জন্য উপযোগী কি না। অর্থাত্ দেশটি গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত পূরণ করে কি না। সে কারণে তড়িঘড়ি করে গণতন্ত্রের পথে পা বাড়ানোর আগে আমাদের ভাবা উচিত দেশটি গণতন্ত্রের জন্য আদৌ প্রস্তুত আছে কি না।

দুটি পূর্বশর্ত

পূর্বশর্তের প্রশ্নকে কেন্দ্র করে দুটি তাত্ত্বিক অবস্থান গবেষণা জগতে এ পর্যন্ত স্থান পেয়েছে। এই দুইয়ের মধ্যে একটির দাবি হচ্ছে, কিছু পূর্বশর্ত পূরণ না করে কোনো দেশের পক্ষে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয় না। ধারাটি সমাজের আর্থসামাজিক কাঠামোর ওপর বিশেষ জোর দেয়। মনে করা হয় কোনো দেশ যদি আর্থসামাজিক অগ্রগতির বিশেষ পর্যায়ে না পৌঁছায় তাহলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া ব্যাহত হতে বাধ্য। ধারাটি ষাট এবং সত্তর দশকের দিকে বিশেষ জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। যাঁরা এই তাত্ত্বিক অবস্থানের সঙ্গে যুক্ত তাঁদের মধ্যে মুখ্য হলেন ব্যারিংটন মুর (১৯৬৬), ডিয়েত্রিক রুশমেয়ার, জন স্তেভেন্স (১৯৯২), সিমর লিপসেট এবং নদিয়া গিয়া (Nodia Ghia, 2002) প্রমুখ। এই ধারাটি পুঁজিবাদী অর্থনীতি গড়ে তুলে সমাজকে আধুনিক করা অপরিহার্য মনে করে। তা না হলে যেহেতু ব্যক্তি অধিকার স্বীকৃতি পায় না। সমাজ নানা শ্রেণিতে বিভক্ত না হলে (মধ্যবিত্ত শ্রেণি, পুঁজিপতি গোষ্ঠী বা শ্রমিক শ্রেণি) প্রতিদ্বন্দ্বিতার মানসিকতার জন্ম নেয় না, নাগরিক অধিকার এবং দাবির রাজনৈতিক প্রকাশ ঘটে না। জনগণ গণতন্ত্র বা রাষ্ট্রশাসনকে কেন্দ্র করে সুস্থ বিতর্কে অংশ নিতে পারে না। এরই সঙ্গে তাঁদের তালিকায় আরও রয়েছে একটি নাগরিক সমাজের প্রয়োজনীয়তা। সে নাগরিক সমাজই তাঁদের মতে, গণতন্ত্রের প্রধান শক্তি এবং রক্ষক। তাঁরা আরও জোর দেন নাগরিক সংস্কৃতির ওপর। তাঁদের ধারণায় গণতন্ত্রের প্রতি সাধারণ মানুষের আনুগত্য নিশ্চিত হলে এবং সেটি একটি সংস্কৃতিতে পরিণত হলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম সহজ হয়। সব মিলিয়ে দেশ ও সমাজের কাঠামোগত এবং সাংস্কৃতিক পরিবর্তন প্রথম, গণতন্ত্রের ভাবনা পরে। এই হলো আর্থসামাজিক পূর্বশর্তের দাবি।

এই চিন্তাধারা সিমোর লিপসেট (১৯৫৯) নামের একজন মার্কিন সমাজবিজ্ঞানী বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরেছেন। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি একটি দেশে গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত তৈরি করে—সেই ধারণাটি আমরা তাঁর কাছ থেকেই পেয়েছি। লিপসেটের সঙ্গে সুর মিলিয়ে নদিয়া গিয়া নামের আরও একজন গবেষক ওই একই যুক্তি তুলে ধরে বলেছেন, প্রথমে সমাজে বিপুল পরিবর্তন আনতে হবে। সেই পরিবর্তন গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত তৈরি করবে এবং দেশ গণতন্ত্রের দিকে এগিয়ে যাবে (Nodia Ghia, 2002, p.6)। প্রখ্যাত মার্ক্সবাদী সমাজতান্ত্রিক ব্যারিংটন মুর গণতন্ত্রের বিকাশকে এই একই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছিলেন। তিনি আধুনিকায়নকে একমাত্র পূর্বশর্ত হিসেবে দেখেননি। তার সঙ্গে তিনি আরও অন্তর্ভুক্ত করেছেন সামাজিক কাঠামো ও শ্রেণি আঁঁতাতের প্রসঙ্গকে। তাঁর বক্তব্য হচ্ছে—এক বিশেষ ঐতিহাসিক বিবর্তনের ফল হিসেবে ব্রিটেনে পুঁজিবাদ এসেছিল। ব্রিটিশ সমাজের বিশেষ কাঠামো, কৃষির সঙ্গে যুক্ত শক্তিশালী অভিজাততন্ত্রের সরব উপস্থিতি সেখানে না থাকলে গণতন্ত্র সেখানে প্রতিষ্ঠিত হতো কি না সন্দেহ। ওই শ্রেণি নিজেদের অর্থনৈতিক ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে রাজতন্ত্র, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, চার্চ, ধর্মযাজক এবং ভ্যাটিকানের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। অভিজাত শ্রেণি রাজার সমর্থনে না দাঁড়িয়ে রাজতন্ত্রের চিরশত্রু বুর্জোয়ার সঙ্গে আঁতাত গড়ে তুলেছিল, তাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রাজতন্ত্র উত্খাতের আন্দোলনে শরিক হয়ে। এই বিশেষ প্যাটার্নটি ইউরোপের অন্য আর কোথাও দেখা যায়নি। চীন বা রাশিয়ায় পুঁজিবাদ এসেছে স্বৈরতন্ত্রের হাত ধরে, গণতন্ত্রের সঙ্গে নয়। জার্মানির ক্ষেত্রেও ওই একই কথা প্রযোজ্য। সেখানেও পুঁজিবাদকে আসতে হয়েছে ফ্যাসিবাদের ঘাড়ে চেপে। কিন্তু ব্রিটিশ পুঁজিবাদ এবং তার অনুষঙ্গ হিসেবে গণতন্ত্রের ওই বিশেষ ধারাটি একেবারে স্বতন্ত্র।

ব্যারিংটন মুর ওই একই অবস্থান থেকে ঔপনিবেশিক ভারতকে বিচার করেছেন। ব্রিটিশ নীতির সহায়তায় সেখানে এক বিশেষ সামাজিক কাঠামো গড়ে ওঠে। ওই কাঠামোর মূল শক্তি ছিল ভূমিকেন্দ্রিক গ্রামীণ অভিজাত শ্রেণির সঙ্গে মুত্সুদ্দি এবং শিল্প বুর্জোয়ার আঁতাত। শহুরে মুত্সুদ্দি শ্রেণিও কৃষকের সঙ্গে আঁতাত করে এবং সেই আঁতাতের মূলে ভারতীয় কংগ্রেস পার্টির রাজনৈতিক নেতৃত্বের বিশেষ অবদান ছিল। এই একই নেতৃত্ব শ্রমিক এবং কৃষকের ঐক্যকে গ্রামীণ এবং শহুরে প্রভুত্বকারী শ্রেণির বিরুদ্ধে দাঁড়াতে দেয়নি। জাতীয় ঐক্য আরও সম্ভব হয়েছিল গ্রামীণ অভিজাত শ্রেণির রাজনৈতিক দুর্বলতার কারণে। ইংরেজি স্বার্থের সঙ্গে তাদের স্বার্থ যুক্ত থাকায় তাদের সামাজিক অবস্থানকে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী ভালো চোখে দেখেনি। সে কারণে অভিজাত বুর্জোয়া ঐক্য শ্রমিক বা কৃষক শ্রেণির বিরুদ্ধেও দাঁড়ায়নি। বরং ওই আঁতাতকে শক্তিশালী করেছে। ফলে ভারতে রাজনৈতিক শ্রেণিগুলোর মধ্যে যে ঐক্য গড়ে ওঠে সেটিই সেখানে গণতন্ত্রের ভিত হিসেবে কাজ করে এবং গণতান্ত্রিক গঠনে সাহায্য করে। লিপসেট, ব্যারিংটন মুর বা নদিয়া গিয়ার যুক্তি থেকে তাহলে যেটি দাঁড়ায় তা হলো—সমাজের আর্থসামাজিক অগ্রগতির পর্যায়, নানা শ্রেণির মধ্যে সম্পর্কের মিথষ্ক্রিয়া, যা কিনা ওই আর্থসামাজিক ক্ষেত্র থেকে উদ্ভূত, গণতন্ত্রের ভাগ্যকে নির্ধারণ করে। গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত হিসেবে কাজ করে।

এই তাত্ত্বিক ধারার ঠিক বিপরীতে অন্য একটি ধারা আছে। সে ধারাটির দাবি, আর্থসামাজিক পূর্বশর্ত পূরণ না করেই যেকোনো দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। এই মতের যাঁরা অনুসারী তাঁদের মধ্যে রবার্ট ভাল (১৯৮৯), রনালদ ইঙ্গেলহাট (১৯৯০), সিমোর লিপসেট (১৯৯৪), গ্যাব্রিয়েল আলমনড এবং সিডনি ভেরবা (১৯৬৩), রস্টো (১৯৭৩), জোসেফ সুম্পিটার (১৯৭৬), ল্যারি ডায়ামন্ড (১৯৯০), গুলিয়েরমো ও ডোনেল অন্যতম। তাঁদের মতে, একটি দেশের এলিট গোষ্ঠী বা প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব যদি তাদের স্বার্থের কথা মাথায় রেখে নিজেদের মধ্যে সমঝোতায় পৌঁছাতে পারে এবং গণতন্ত্রের মূল নীতিমালা মেনে চলার অঙ্গীকার করে, তাহলে আর্থসামাজিক পূর্বশর্ত ছাড়াই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়। ধারাটি ১৯৮৯ সালে সোভিয়েত এবং মার্কিন ঠান্ডা যুদ্ধের সমাপ্তির পর গণতন্ত্রসংক্রান্ত গবেষণায় বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছিল। ওই যুদ্ধ যখন শেষ হয় তখন বিশ্বের নানা দেশ পূর্বশর্তের অনুপস্থিতি সত্ত্বেও গণতন্ত্রের পথে এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সে দেশগুলোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল এককালের রাশিয়া, অন্য সোভিয়েত রিপাবলিকসমূহ, পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব এবং এশিয়া, আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকার বেশ কিছু দেশ। স্বৈরশাসন বা একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার বদলে নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন এবং নির্বাচিত প্রতিনিধি দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার প্রথা ওই সব দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়। অনেকে সে কারণে ধরেই নিয়েছিল যে আর্থসামাজিক বা রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক পূর্বশর্ত ছাড়াই একটি দেশ গণতন্ত্রের পথে এগিয়ে যেতে পারে, যদি সেখানকার এলিট শ্রেণির মধ্যে গণতন্ত্রের প্রক্রিয়াগত বিষয়ে মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হয়।

উভয় দৃষ্টিভঙ্গির অভ্যন্তরীণ গলদ

এই দুই অবস্থানের কোনোটিকে ত্রুটিমুক্ত ভাবা যায় না। প্রতিটির মধ্যে রয়েছে অভ্যন্তরীণ গলদ। প্রথম দৃষ্টিভঙ্গি সামাজিক এবং অর্থনৈতিক পূর্বশর্ত পূরণের ওপর জোর দেয়। তত্ত্বটি আধুনিকায়ন এবং পুঁজিবাদী বিকাশের ওপর ভর করে গড়ে উঠেছে এবং সেখানে উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে ইউরোপের পুঁজিবাদী বিকাশকে। পূর্বশর্তটি তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য কি না, সে প্রশ্ন থেকে যায়। কারণ উপনিবেশ শাসন থেকে মুক্ত হয়ে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে লিপ্ত রয়েছে। কিন্তু গণতন্ত্রের সঙ্গে তাকে আরও সংগ্রাম করতে হচ্ছে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্রন্টে। তার মধ্যে একটি হলো জাতি গঠন। এসব দেশে জাতি বিভেদ এবং ধর্ম বা গোত্রের সামাজিক অবস্থান এবং ভূমিকা নিয়ে মতভেদ আছে এবং সেগুলো আজও অমীমাংসিত রয়ে গেছে। সে কারণে একটি ঐক্যবদ্ধ সমাজ গড়ে তোলার পথে তারা এখনো অনেক পিছিয়ে রয়েছে। এরই সঙ্গে রয়েছে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নসংক্রান্ত নানা বাধা-বিপত্তি, আধুনিকায়ন এবং পুঁজিবাদী বিকাশের মতো কঠিন চ্যালেঞ্জগুলো। দীর্ঘ ঔপনিবেশিক শক্তির অধীনে থাকার কারণে এসব সমস্যা একসঙ্গে পুঞ্জীভূত হয়ে ছিল এবং তাদের প্রতিটিকে আজ সমান্তরালভাবে মোকাবিলা করতে হচ্ছে, তাদের প্রতিটির সমাধান খুঁজে বের করতে হচ্ছে। ইউরোপের ক্ষেত্রে পরিস্থিতিটি একেবারে ভিন্ন ছিল। তাদের ইতিহাসে তারা প্রথমে জাতি গঠনপ্রক্রিয়া শেষ করে ১৬৪৮ সালের দিকে। তিরিশ বছর (১৬১৮-১৬৪৮) ধরে চলে আসা নানা জাতির মধ্যে যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ইউরোপের জাতিগুলো তাদের ভৌগোলিক সীমানা নির্ধারণ করে এক একটি রাষ্ট্রের অধীনে আসে। জাতি গঠনপ্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পর ইউরোপ সামাজিক এবং কাঠামোগত পরিবর্তনে মনোযোগী হয়। পরে বিজ্ঞান এবং সাহিত্যের উদারবাদী মনোভাব মানুষের মননে প্রভাব ফেলে এবং উদারনীতির বিকাশ নিশ্চিত করে। তৃতীয় পর্যায়ে শিল্পায়ন এবং বৈজ্ঞানিক বিপ্লব ঘটে। তার পরেই আসে গণতন্ত্র। এই সমস্যাগুলোর প্রতিটির সমাধান খুঁজে বের করতে ইউরোপের হাতে যথেষ্ট সময় ছিল। তাদের সে সমস্যাগুলো একসঙ্গে আসেনি, এসেছে পর্যায়ক্রমে, ধাপে ধাপে।

এই ধরনের সুযোগ আমাদের দেশের ভাগ্যে জোটেনি। যে সমস্যাগুলো ইউরোপ দীর্ঘ সময় ধরে এবং পৃথক পৃথকভাবে মোকাবিলা করেছে, সেই সমস্যাগুলো আমরা মোকাবিলা করছি একসঙ্গে। ফলে যে ধাপে ধাপে গণতন্ত্রের পথ চিহ্নিত করা হচ্ছে এবং তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর ওপর তাকে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে, সেটি সঠিক নয়। সেটি ইউরোপীয় অভিজ্ঞতাপ্রসূত চিন্তা। আমাদের দেশের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, তার অতীত ঔপনিবেশিক ইতিহাস এই পূর্বশর্তের জন্য উপযোগী নয়। Maya Chadda নামের একজন গবেষক তাঁর Building Democracy in South Asia গ্রন্থে এ ধরনের পূর্বশর্ত চাপিয়ে দেওয়াকে যুক্তিসংগত মনে করেননি। আর্থসামাজিক পূর্বশর্তসংক্রান্ত তত্ত্বটি সব ক্ষেত্রে যে কার্যকরী নয়, সেটি ভারতের উদাহরণ থেকে দৃশ্যমান। ভারতে গণতন্ত্র টিকে রয়েছে প্রায় ৭০ বছর ধরে। ভারত গণতন্ত্রের বিচারে বিশ্বে একটি উদাহরণ। অথচ দেশটি আজও একটি অনুন্নত দেশ হিসেবে পরিচিত হয়ে আছে। সেখানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১৯৪৭ সাল থেকে কোনো অর্থনৈতিক বা সামাজিক পূর্বশর্ত পূরণ না করেই। চীনের উদাহরণও এই পূর্বশর্তকে ভুল প্রমাণিত করে। সেখানে অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রবল গতি নিয়ে এগিয়ে চলেছে। কিন্তু ওই উন্নয়নের কারণে সেখানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি (de Mesquita, Bruce Bueno and George Downs. 2005: 77-86)। ফলে অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ঢালাওভাবে গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত হিসেবে ভাবা সঠিক নয়।

এলিট সমঝোতা তত্ত্বেও বেশ কয়েকটি দুর্বল দিক লক্ষ করা যায়। প্রথমত, এই তত্ত্ব গণতন্ত্রকে নিছক প্রক্রিয়া হিসেবে দেখে। সেখানে গণতন্ত্রের প্রক্রিয়াগত দিকগুলো পালন করা মুখ্য লক্ষ্য হিসেবে বিবেচিত হয়। প্রক্রিয়াগত দিক বলতে সঠিক সময়ে নির্বাচন হচ্ছে কি না, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে কি না, মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার স্বীকৃত কি না, রাজনীতিতে আপামর জনসাধারণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত কি না ইত্যাদি বোঝায়। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চালু রাখতে হলে সমাজে ক্ষমতার নানা কেন্দ্রের মধ্যে সমঝোতার প্রয়োজন হয়। সমাজে ক্ষমতার কেন্দ্রগুলো নানা সময়ে নানা কারণে গড়ে ওঠে। যে এলিট গোষ্ঠী ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকে, তারা প্রতিনিয়ত উদীয়মান রাজনৈতিক এবং সামাজিক শক্তির মুখোমুখি হয় এবং আন্তদ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়। সেই দ্বন্দ্বের মীমাংসা যদি শান্তিপূর্ণভাবে সম্ভব হয়, তাহলে বিবাদরত ক্ষমতার কেন্দ্রগুলো নিজেদের মধ্যে সমঝোতায় পৌঁছাতে পারে এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় দেশ শাসনে একমত হয়। এভাবে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করে গণতান্ত্রিক প্রতিযোগিতা বহাল রাখা সম্ভব হয়।

অবশ্য এই শান্তিপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টির সঙ্গে একটি ভিন্ন পূর্বশর্ত যোগ করা হয়। তা হলো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় জনগণের অংশগ্রহণকে সীমিত রাখা। দাবিটি সুম্পিটার নামের একজন বিশেষজ্ঞের ব্যাখ্যা থেকে এসেছে। সে ব্যাখ্যায় তিনি গণতন্ত্রের এক সরলীকৃত এবং উপযোগবাদী সংজ্ঞা দিয়েছেন। তাঁর মতে, গণতন্ত্রকে এমন একটি ব্যবস্থা হিসেবে দেখতে হবে, যা কিনা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের একটি মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত হবে মাত্র। সেখানে ক্ষমতার পদপ্রার্থীরা প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনে অংশ নিয়ে ক্ষমতা গ্রহণ করবে (taken from Larry Diamond, 1999, page 8)। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অংশগ্রহণ এবং তাদের ভূমিকা রাজনৈতিক দল এবং নেতৃত্বের তুলনায় ন্যূনতম পর্যায়ে রাখা এ ক্ষেত্রে বাঞ্ছনীয়। সুম্পিটারের ধারণায়, গণতন্ত্র কোনো আদর্শ নয়, কোনো তত্ত্ব নয়। গণতন্ত্র একটি রাজনৈতিক পদ্ধতি, একটি প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা। সে ব্যবস্থার উদ্দেশ্য একটি প্রশাসনিক কাঠামো দাঁড় করানো এবং রাজনৈতিক, আইনি এবং প্রশাসনিক সিদ্ধান্তগুলো সে ব্যবস্থার অধীনে গ্রহণ করা। সুম্পিটার (Schumpeter, 1943, p. 242) গণতন্ত্রকে সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার কোনো মাধ্যম হিসেবে ভাবেননি। জনগণের দায়িত্ব বলতে তিনি ভোট দেওয়াকে বুঝেছেন। ভোটারদের দায়িত্ব বলতে তিনি দেখেছেন সবচেয়ে ভালো পণ্যটি কেনা—পণ্য বলতে এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক নেতা বা ব্যক্তিকে বোঝায়। ফলে গণতন্ত্রকে একধরনের বাজারে পরিণত করা হয়, যেখানে রাজনৈতিক দলের কর্তব্য হচ্ছে ওই বাজারকেন্দ্রিক প্রতিযোগিতাকে নিয়ন্ত্রণ করা এবং নেতা নির্বাচন করা। অনেকে এই তাত্ত্বিক কাঠামোকে ‘Classical doctrine’ হিসেবে আখ্যায়িত করে তাঁর ভূয়সী প্রশংসাও করেছেন (Pateman, C 1970:2)।

নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় তো বটে, বিশেষ করে দৈনন্দিন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে গণমানুষের অংশগ্রহণকে কেন সীমিত রাখতে হবে, তার পক্ষে যুক্তি আছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে রাজনৈতিক অংশগ্রহণ থেকে দূরে রাখা সম্ভব হলে বড় ধরনের মতবিরোধ থেকে পুরো শাসনব্যবস্থাকে দূরে রাখা সম্ভব হয়। সেটি অবশ্য পুরোপুরি অসত্য যে তা নয়। অনেক রাজনীতি বিশেষজ্ঞ লক্ষ করেছেন যেসব দেশে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেখানে স্বৈরাচারের শক্তি ভিত থেকে গেছে। জার্মানিতে ভাইমার রিপাবলিক তার একটি উদাহরণ। ভাইমার রিপাবলিক গণতন্ত্র ব্যর্থ হয়েছিল। ওই ব্যর্থতার কারণে জার্মানিতে ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। যুক্তিটি আরব বসন্ত নামে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে যে গণতান্ত্রিক বিপ্লব ঘটে, সে ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আরব বসন্ত কীভাবে গণতন্ত্রের বদলে নতুন করে স্বৈরশাসন বা গোত্র বিভক্তি ও সংঘাতকে উসকে দিল সেটি আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এটি প্রযোজ্য ভাবা যায়। এখানে জাতীয় মুক্তি আন্দোলনে মানুষের অভূতপূর্ব অংশগ্রহণ সত্ত্বেও গণতন্ত্র আজও সুপ্রতিষ্ঠিত হয়নি। এই তাত্ত্বিক ধারার আরও একজন প্রবক্তা রবার্ট ডাল (Dahl) জনবিচ্ছিন্ন গণতন্ত্রের আরও একটি মডেল প্রস্তুত করেছেন। তিনি তাঁর A Preface to Democractic Theory and Hirarchy, Democracy and Bargaining in Politics and Economics (১৯৫৬) তে গণতন্ত্রকে পলিয়ারখি হিসেবে দেখার উপদেশ দিয়েছেন। তাঁর যুক্তি হলো গণতন্ত্র একটি রাজনৈতিক পদ্ধতি, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সাজানো একটি ব্যবস্থা। ওই ব্যবস্থায় নির্বাচনী প্রক্রিয়া প্রধান, কিন্তু সেই প্রক্রিয়ায় খুব কম সংখ্যক নেতাকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ দেওয়া উচিত। সে ক্ষুদ্র সংখ্যক নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে নেতৃত্ব নির্বাচন হিসেবে দেখবে মাত্র।

গণতন্ত্রের এই ধারণাটি উত্তরঙ্কালিন গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে বিশেষভাবে জনপ্রিয় করার চেষ্টা নেওয়া হয়। সেখানে দাবি হলো কয়েক দফা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে এবং কিছু উদারনৈতিক (লিবারেল) নীতি বাস্তবায়ন করা গেলে ওই সব দেশে গণতন্ত্র স্থায়ী রূপ নেবে। যুক্তিটি যে সঠিক নয় সেটি নানা উদাহরণ থেকে দেখা যায়। নির্বাচনকেন্দ্রিক গণতন্ত্রের এই ধারণায় প্রথমে সংকটে পড়ে পাকিস্তান। সেখানে নওয়াজ শরিফের সরকারকে উত্খাত করে জেনারেল পারভেজ মোশাররফ ১৯৯৯ সালে সামরিক শাসন প্রবর্তন করেছিলেন। আরব বসন্ত এবং নানা রংবেরঙের বিপ্লব থেকেও এই ব্যর্থতার কিছু উদাহরণ পাওয়া যায়। উত্তর আফ্রিকার অনেক দেশে (লিবিয়া, মিসর, তিউনিসিয়া, ইয়েমেন) কয়েক দফায় নির্বাচন হওয়ার পরও সেসব দেশে গণতন্ত্র পাকাপোক্ত হয়নি, বরং সংকটে পড়েছে। দক্ষিণ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ওই একই প্রক্রিয়া লক্ষ করি। সেখানে বিপ্লবী উত্তেজনা থিতিয়ে পড়ার পর গণতন্ত্রের সংকট দেখা দেয়। এমনকি কিছু দেশ স্বৈরশাসনের দিকেও ফিরে যায়। চেকোস্লোভাকিয়া, রুমানিয়া, বুলগেরিয়া ওই সংকট এড়িয়ে গেলেও উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, বেলারুশ বা টোগোর গণতন্ত্র ব্যর্থ হয়েছে। ডানকার্ট রস্টো নামের একজন গবেষকের লেখায় এই ব্যর্থতার একটি ব্যাখ্যা মেলে। সেখানে তিনি এসব দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাকালে সামাজিক অবস্থানকে আমলে না নেওয়াকে বিশেষ কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তাঁর Transition to Democracy: Towards a Dynamic model নামের গ্রন্থে তিনি দেখিয়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপকে হুবহু অনুকরণ করে কোনো দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা ব্যর্থ না হয়ে পারে না। যে পথ ধরে ইউরোপ এবং আমেরিকায় গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটেছে, সে পথ সার্বজনীন পথ নয়। ওই একই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন এফ প্লাটার নামের আরও একজন বিশেষজ্ঞ। সমাজনির্ভর দৃষ্টিভঙ্গির ওপর গুরুত্ব দিয়ে তিনি তাকে ‘The Genetic Question’ হিসেবে দেখার পরামর্শ দিয়েছেন। তাঁর মতে, গণতন্ত্রের শুরু বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন অবস্থায় হতে পারে (Tyranny of starting conditions)। সে ভিন্ন ভিন্ন সামাজিক অবস্থানকে আমলে না নিয়ে কেবল নির্বাচনকে উত্সাহিত করে গণতন্ত্রের সংগ্রাম সফল হয় না। এ দাবির গুরুত্ব আমরা আরও লক্ষ করেছি আরব বসন্ত নামে গণতান্ত্রিক বিপ্লবের পর। সেখানে প্রতিটি দেশে গণতন্ত্রের সংকট প্রকট হয়ে দেখা দেয়, যেটি ওই সব দেশের আর্থসামাজিক, ঐতিহাসিক এবং রাজনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে যুক্ত। উদাহরণ হিসেবে তিউনিসিয়াতে সরকার উত্খাতের আন্দোলনে গণতন্ত্রীদের সশস্ত্র যুদ্ধ করতে হয়নি। লিবিয়াতে যুদ্ধ করতে হয়েছে। যুদ্ধ শেষে লিবিয়ায় অস্ত্রের ঝনঝনানি মারাত্মক রূপ ধারণ করে। সেখানে প্রবল গোত্র বিভক্তির কারণে গণতন্ত্রের সম্ভাবনা অনেক সীমিত হয়ে পড়ে। সেটি অন্য কোথাও লক্ষ করা যায়নি। মিসরে ঐতিহাসিকভাবে মানুষ সামরিক বাহিনীর প্রতি অনেক বেশি সহানুভূতিশীল। কিন্তু তিউনিসিয়ায় ব্যাপারটি ভিন্ন। সেখানে মানুষ সামরিক বাহিনীকে ঘৃণা করে। ফলে গণতন্ত্রায়ণের ক্ষেত্রে মিসরীয় সামরিক বাহিনী অনেক বেশি ভূমিকা রাখতে সক্ষম। অন্যদিকে মিসরের তুলনায় তিউনিসিয়ায় ইসলামপন্থী এবং ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির মধ্যে ভারসাম্য থাকায় গণতন্ত্রের সম্ভাবনা সেখানে অনেক বেশি উজ্জ্বল হয়ে দেখা দেয়। কিন্তু মিসরে ওই দুই শক্তির মধ্যে বিভেদ প্রকট হওয়ায় এবং ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির অভ্যন্তরীণ বিভেদ অন্যান্য দেশের চেয়ে প্রবল হওয়ার কারণে মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রার্থী মুরসি মাত্র ২৬% ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। তিউনিসিয়ায় বিরোধী দল এনাদা পার্টি অনেক বেশি পশ্চিমাপন্থী থাকায় মিসরের তুলনায় সেখানে অবস্থাটি ভিন্ন রূপ নেয়। এই আর্থসামাজিক এবং শ্রেণি ও রাজনৈতিক গ্রুপসংক্রান্ত বৈচিত্র্যের কারণে প্রতিটি দেশের গণতন্ত্র কিছু birth defect নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে। সে কারণে গণতন্ত্রকে কেবল পদ্ধতি হিসেবে দেখা সমীচীন নয়। আর্থসামাজিক বাস্তবতাবর্জিত কোনো গণতন্ত্র সফল হতে পারে না।

এলিট সমঝোতা তত্ত্বে আরও একটি দুর্বলতা হলো—ওই তত্ত্বে গণতন্ত্রকে শিল্প প্রতিষ্ঠান, ট্রেড ইউনিয়ন, রাষ্ট্র এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের মতো আমলাতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের আন্তসম্পর্কের সঙ্গে যুক্ত করে দেখা হয়। সমাজের স্থায়ী প্রতিষ্ঠানের ওপর মনোযোগ কেন্দ্রীভূত থাকায় সমাজের অভ্যন্তরে যে পরিবর্তনগুলো এখনো স্থায়ী প্রাতিষ্ঠানিক রূপ ধারণ করেনি, সেগুলোর প্রতি অবহেলা দেখানো হয়। সে কারণে প্রথাগত সামাজিক উপাদানগুলোকে উপেক্ষা করার বিশেষ প্রবণতা স্থান করে নেয়। এই উপেক্ষার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত থাকে ধর্ম, জাতি, বর্ণপ্রথা, ধর্মীয় বিভেদ, এমনকি এক ধর্মের অভ্যন্তরীণ বিভেদ বা জটিলতা। আধুনিক সমাজে প্রথাগত উপাদানের মূল্য নিতান্তই নগণ্য এবং সাময়িক বলে ধরে নেওয়া হয়। তার কারণ সেখানে এলিট প্রতিষ্ঠানের ওপর প্রাধান্য দেওয়া হয়। প্রথাগত প্রতিষ্ঠানকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবা হয় না। মনোযোগটি থাকে নেতার ওপর, নেতৃত্বের ওপর এবং প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর। অথচ ওই প্রথাগত পরিবর্তনগুলো গণতন্ত্রের পথকে প্রসারিত করা অথবা বাধাগ্রস্ত করার ক্ষেত্রে প্রচণ্ড ক্ষমতা রাখে।

পূর্বশর্তসংক্রান্ত যে দুটি তত্ত্ব এখানে আলোচনা করা হলো সে দুটি তত্ত্ব বাংলাদেশের বাস্তবতায় উপযোগী ভাবা কঠিন। তার দুটি কারণ রয়েছে। একটি কারণ হলো বাংলাদেশ আর্থসামাজিক পূর্বশর্তের কোনোটিই পূরণ করে না। রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং রাজনৈতিক এলিট শ্রেণিও এমন পরিপক্ব কোনো শক্তিতে পরিণত হয়নি যে নিজেদের মধ্যে তারা সমঝোতা করে গণতন্ত্রের প্রাথমিক পূর্বশর্তগুলো বাস্তবায়নে উদ্যোগী হবে। দ্বিতীয় কারণ হলো, উভয় তত্ত্বের কোনোটিকে পৃথক পৃথকভাবে বাংলাদেশে প্রয়োগ করা সম্ভব নয়। রাজনৈতিক এবং আর্থসামাজিক পূর্বশর্তকে গণতন্ত্রের একমাত্র পূর্বশর্ত ভাবা যায় না। আবার পাশ্চাত্য দেশের নির্বাচন পদ্ধতির ওপর নির্ভর করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বাস্তব কোনো দিকনির্দেশক হতে পারে না। গণতন্ত্রকে অর্থবহ এবং কার্যকর করতে হলে দেশীয় আর্থসামাজিক এবং সাংস্কৃতিক বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে বা তার শূন্যতায় গণতন্ত্র নিয়ে চিন্তা করা অবাস্তব। আবার গণতন্ত্রকে অর্থবহ করতে গেলে শুধু ওই আর্থসামাজিক এবং ঐতিহাসিক দিকের ওপর গুরুত্ব দিয়ে গণতন্ত্রের মৌলিক দিকগুলোকে উপেক্ষা করাও যুক্তিযুক্ত নয়। প্রয়োজন দুইয়ের ভারসাম্যপূর্ণ সমন্বয়। এখানে এই পূর্বশর্তের সমস্যা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।

প্রথম পূর্বশর্ত: আর্থসামাজিক এবং সাংস্কৃতিক

গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যে আর্থসামাজিক পরিবেশের কথা বলা হয় এবং তার পূরণকে পূর্বশর্ত হিসেবে ধরা হয় সে ধরনের পরিবেশ বাংলাদেশে বহুলাংশে অনুপস্থিত আছে। সে পূর্বশর্তগুলো পুরোপুরি পূরণ করতে গেলে বাংলাদেশকে আরও অনেক বছর অপেক্ষা করতে হবে। আমাদের দেশের অর্থনৈতিক বিকাশের সঙ্গে ধ্রুপদি পুঁজিবাদের এবং সে কারণে ধ্রুপদি গণতন্ত্রের সম্পর্ক নেই। ইউরোপীয় গণতন্ত্র যে ভিত বা সামাজিক কাঠামোর ওপর গড়ে উঠেছিল, সে ধরনের সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক বাস্তবতা আমাদের এখানে অনুপস্থিত। যেটুকু পুঁজিবাদ আমাদের দেশে গড়ে উঠেছে তার অনেকটাই রাষ্ট্রের সহায়তায়। পরবর্তী সময়ে আন্তর্জাতিক পুঁজির সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে এখানে পুঁজিবাদের প্রাথমিক কাঠামোটি গড়ে ওঠে। সেই অপরিপক্ব অর্থনৈতিক কাঠামোর ওপর একটি আধুনিক শাসনব্যবস্থা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল স্বাধীনতার পর পরই। আজও বহুলাংশে একটি কৃষিভিত্তিক অনুন্নত সমাজ হিসেবে এখানে নাগরিক চেতনার প্রবল অভাব রয়েছে। গোষ্ঠী চেতনাভিত্তিক গ্রামীণ সমাজ পুরোনো আচার এবং ধর্মীয় চেতনা দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হয়। শিল্পায়ন এবং আধুনিকায়ন ঘটলেও তার সুফল গোটা সমাজে পৌঁছাতে পারেনি। মানুষের চেতনায় পরিবর্তন আনা দীর্ঘমেয়াদি এক ব্যাপার। এখানে নগরায়ণ যথেষ্ট দ্রুতগতিতে সম্পন্ন হচ্ছে। কিন্তু নগরায়ণ এবং শিল্পায়ন যে মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্ম দিচ্ছে তাদের মন-মানসিকতায় গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বা আধুনিকতার প্রভাব তেমন পড়েনি। নগরায়ণের সঙ্গে অভ্যন্তরীণ অভিবাসনের নিকট যোগসূত্র থাকে। স্বাধীনতার পর গ্রাম থেকে লাখ লাখ মানুষ শহরে এসে বাস করতে শুরু করে। হাজার হাজার মানুষ বড় শহরগুলোতে ভিড় জমায়, সেখানে আশ্রয় নেয় বেকারত্বের বোঝা লাঘব করতে। ১৯৭৪ থেকে ১৯৮১ সালের মধ্যবর্তী সময়ে এ দেশের শহুরে জনসংখ্যা বছরে ১০.৯% হারে বৃদ্ধি পেয়ে এসেছে (Eusuf 1996: 11)। ১৯৯৬ সালের হিসাবমতে, শহরের জনসংখ্যা আজ বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ২২.৪৫ (Eusuf 1996:20) শতাংশে পৌঁছেছে। এই প্রবৃদ্ধির শতকরা ৫৮ ভাগই গ্রাম থেকে আসা মানুষ (Islam 1996:55)। সাইক্লোন, বন্যা, নদীভাঙনের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং কর্মসংস্থানের আকর্ষণে গ্রাম ত্যাগ করে শহরে আশ্রিত এই লাখ লাখ মানুষ এক নতুন শ্রেণির জন্ম দিচ্ছে। রাজধানী এবং দেশের প্রশাসনিক এবং রাজনৈতিক কেন্দ্র হিসেবে ঢাকা শহরের জনসংখ্যা ১৯৭৪ সালের মধ্যেই প্রায় ২ মিলিয়নে (Eusuf 1996:20) পৌঁছে গিয়েছিল। ১৯৯১ সালে সেটি আরও বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৪ মিলিয়নে (Eusuf 1996:20)। এই প্রবৃদ্ধির প্রবণতা শহরের জনসংখ্যাকে মোট জনসংখ্যার ২১ শতাংশে নিয়ে পৌঁছে দেয়। অভিবাসনের ফলে বাংলাদেশের ৪০ শতাংশ নগরায়ণের উন্নতি ঘটেছে ১৯৭৪ থেকে ১৯৮১ সালের মধ্যে। এক ঢাকা শহরেই নগরায়ণ বৃদ্ধি পেয়েছে ৭৪%। চিটাগাং ৪৩%, খুলনা ৭৩%, নারায়ণগঞ্জ ১৭%, ময়মনসিংহ ২৫% এবং রাজশাহী ৩৬% (নজরুল ইসলাম ২০০৩, পৃষ্ঠা ১৩০)। কিন্তু শহুরে মধ্যবিত্তের সাংস্কৃতিক ও মনস্তত্ত্বগত বিবর্তন এই পরিবর্তনের সঙ্গে সমানতালে চলেনি।

বেশ কয়েকটি কারণে অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে গণতন্ত্রের যোগসূত্র থাকে। অর্থনৈতিক অগ্রগতি শিক্ষিত পেশাজীবী মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যাপক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে। সেটি বাংলাদেশের ক্ষেত্রে লক্ষ করা যায়। এখানে শিক্ষার হার বৃদ্ধি পাচ্ছে, মানুষ আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে। কিন্তু গণতন্ত্রের মর্মবাণী উপলব্ধি করার সুযোগ আজও সীমিত হয়ে আছে। শিল্পায়ন জাতীয় সম্পদ উত্পাদনের প্রধান মাধ্যম না হলেও অর্থনীতি চাঙা থাকার কারণে মানুষের হাতে অর্থ সঞ্চিত হচ্ছে। জনগণের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্ম হচ্ছে। কিন্তু শহরে যারা নাগরিক জীবন যাপন করে তাদের মন-মানসিকতায় যে ধরনের কসমোপলিটান বা উদার দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠার কথা সেটি স্থানীয় নানাবিধ কারণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সংগঠন করার সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি হওয়ার ফলে মধ্যবিত্তের মানসিক ক্ষুধা পূরণের যে প্রেক্ষাপট তৈরি হয় সেটি এখানে এখনো অনেকটা সুপ্ত। রাজনৈতিকভাবে মানুষ সচেতন হলেও গণতন্ত্রের দাবি আদায়ে, দেশকে নৈতিকভাবে শাসনের প্রয়োজনসংক্রান্ত চেতনাগত দিকগুলো রাজনৈতিক দলের মানসিক পশ্চাত্পদতা এবং সংঘাতপ্রবণতার কারণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

যে উদার দৃষ্টিভঙ্গি গণতন্ত্রের পথকে সুগম করে সেটি ঐতিহাসিক কারণে সামনে এগিয়ে যেতে পারেনি। আমাদের অবস্থাটি ভারতের সঙ্গে তুলনা করে কিছুটা হলেও বোঝা সম্ভব। ভারত স্বাধীন হয়েছে পাকিস্তানের সঙ্গেই, বস্তুত পাকিস্তানের এক দিন পরে। কিন্তু পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ উভয়েই দীর্ঘ সামরিক শাসনের অধীনে কাটিয়েছে। আজও তারা প্রকৃত গণতন্ত্রে পৌঁছাতে পারেনি। ভারত পেরেছে। ভারতে জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক শ্রেণি উদারনীতিবাদের ওপর গড়ে ওঠে। সেখানকার রাজনীতিবিদদের অনেকেই ইংল্যান্ডে পড়াশোনা করেছেন। তাঁরা উপনিবেশব্যবস্থাকে অবৈধ মনে করলেও তাকে ধ্বংসের লক্ষ নিয়ে রাজনীতি করেননি। তার সংস্কারের পক্ষে মত দিয়েছেন। তাকে দেশীয় রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। সেকালের ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে দুটি ধারা ছিল। একটি উদারনীতিবাদী, অন্যটি উগ্র। ব্রিটিশ শাসকেরা ভারতে উদারনীতিকে প্রশ্রয় দিয়েছে। উগ্র ধারাকে নিপীড়ন করেছে। সে কারণে পাড়া-মহল্লা পর্যায়ে ভারতে স্থানীয় গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছিল। ব্রিটিশেরা ওই সব প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভর করে উগ্রবাদী জাতীয়তাবাদকে ঘায়েল করার সহজ পথ গ্রহণ করেছিল। তাতে করে ওই সব সংগঠনকে আধুনিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত করা সম্ভব হয়েছিল। সেখানে সদস্যপদের ব্যবস্থা, গণতান্ত্রিক উপায়ে কর্মকর্তা নির্বাচনের ঐতিহ্য অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র বিকাশের সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছিল।

একই সঙ্গে গণতন্ত্রের সঙ্গে উদারনীতিবাদী দর্শনের যে যোগসূত্র থাকে তার অন্তত কিছুটা বাংলা যে শেখেনি তা নয়। সেটি ঘটেছিল ঊনবিংশ শতাব্দীতে, রেনেসাঁ আন্দোলনের সময়। ওই সামাজিক এবং দার্শনিক আন্দোলন মানুষের মধ্যে সম-অধিকারের দাবির স্বীকৃতি দিয়েছিল। অবিভক্ত বাংলা কিছুটা শিখলেও ব্রিটিশ শাসনের অধীনে ইংরেজি শিক্ষা থেকে নিজেকে দূরে রাখার কারণে মুসলমান সম্প্রদায় ওই আন্দোলনের মর্মবাণীকে আত্মস্থ করেনি। ফলে গোষ্ঠী হিসেবে ওই আধুনিক জ্ঞানপ্রবাহ তার ওপর বিশেষ কোনো প্রভাব ফেলেনি। ওই আধুনিক গণতান্ত্রিক চিন্তা পুরোটাই আত্মস্থ করেছিল বাংলার হিন্দু সমাজ। ইংরেজি শাসকদের সহায়তায় রাজা রামমোহন রায়ের মতো মানুষ সতীদাহ নিবারণ করেছিলেন। তাদেরই প্রচেষ্টায় বাংলা সাহিত্য ও দর্শনে উদারনীতির নানা ধারা এবং বিশ্লেষণ পদ্ধতি স্থান করে নিয়েছিল। দার্শনিক বা রাজনৈতিক দর্শনের ক্ষেত্র হলেও জাতীয় মুক্তি আন্দোলনে এই ব্যক্তিস্বাধীনতার মন্ত্র, যা উপনিবেশ প্রভুর কাছ থেকে শেখা, স্বাধীনতার দাবিকে যৌক্তিক রূপ দিতে সাহায্য করেছিল। ব্রিটিশ উপনিবেশ শাসকেরা বাংলাকে যা শিখিয়েছে, তা দিয়েই বাংলা ব্রিটিশ শাসনকে ভারতবর্ষ থেকে বিদায় দিয়েছে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি অনুগত থেকে। অথচ মুসলিম সমাজকে গণতান্ত্রিক এবং উদারনীতিভিত্তিক করে গড়ে তোলার জন্য যেসব সংস্কারের প্রয়োজন (নারীর অধিকার) ছিল, সেগুলো না করে মোগল সাম্রাজ্যের পতনে অশ্রু বিসর্জন করেই মুসলমান সমাজ সময় কাটিয়েছে। অর্থাত্ গণতন্ত্রের সঙ্গে বাংলার পরিচিতি উপনিবেশ প্রভুদের থেকে, নিজের উত্স থেকে আসেনি যদিও, সেই পরিচিতির জগিট খণ্ডিতভাবে হিন্দু সম্প্রদায়কে উপকৃত করেছে। সমস্যাটা ওখানেই রয়ে গেছে। বাংলাদেশে এমন একটি সমাজবাস্তবতা গড়ে উঠেছে, যেখানে গণতান্ত্রিক আদর্শের আধ্যাত্মিক বা মানসিক ভিত অনুপস্থিত।

তবে এখানে উদারনীতিবাদ যে একেবারে বিকশিত হয়নি, সেটি সঠিক নয়। একটি বিশেষ ক্ষেত্রে ওই উদারনীতি বাস্তবায়নের সব ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সেটি ঘটেছে কেবল অর্থনীতিতে। প্রবণতাটি অনেকটা লাতিন আমেরিকার মতো করেই বাংলাদেশে ঘটেছে। অ্যাডাম স্মিথের পরামর্শে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সরকারের হস্তক্ষেপ এড়িয়ে যাওয়ার কথা রয়েছে, শিল্প উত্পাদনকে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণমুক্ত রাখতে হবে, বাণিজ্যে কোনো বাধা থাকবে না, শুল্কের ঝামেলা থাকবে না। মুক্ত বাণিজ্য বা ফ্রি ট্রেড বিশেষ গুরুত্ব পাবে। এই মুক্ত প্রতিযোগিতা, মুক্ত বাণিজ্য এবং মুক্ত উত্পাদনের পরিবেশ সৃষ্টি করে পুঁজিপতিরা প্রচুর মুনাফা লাভ করতে সক্ষম হয়। বিগত বছরে বিশ্ব অর্থনীতিতে এই ধরনের একটি অর্থনৈতিক কাঠামো দৃঢ়ভাবে স্থান করে নিয়েছে। নিও লিবারেল অর্থনীতির চমকে লাতিন আমেরিকায় অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটেছে। সেখানে শিল্পের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ ন্যূনতম পর্যায়ে রাখার জন্য deregulate-এর কথা বলা হয়েছিল। উপদেশ ছিল রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ থেকে ব্যক্তি খাতকে যতদূর সম্ভব মুক্ত রাখা, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য এবং বিনিয়োগকে উদার করা, মূল্য নিয়ন্ত্রণ থেকে দূরে থাকা, পুঁজির স্বাধীন এবং বাধাহীন বিকাশ নিশ্চিত করা ওই উদারনীতিকরণের প্রধান প্রধান দিক। রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ থেকে শিল্পপ্রতিষ্ঠান, রাস্তাঘাট, ব্যবসা-বাণিজ্য, ব্যক্তিমালিকানায় হস্তান্তর করা, সামাজিক সংযমের কথা বলে শ্রমকে নিয়মনীতির বাঁধনমুক্ত করে তাকে পুঁজিপতি এবং বহুজাতিক করপোরেশনের ওপর নির্ভরশীল করার সুযোগ সৃষ্টি হয়। এই প্রবণতা আজ সারা বিশ্বে ঘটে চলেছে। চিলির আলেন্দে সরকারকে উত্খাত করার পর জেনারেল পিনোচেট বিখ্যাত নব্য লিবারেল এবং বাজার অর্থনীতির বিশেষ প্রবক্তা মিলটন ফ্রিডম্যানকে সে দেশের অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। বাংলাদেশ অবশ্য অত বড় মাপের কোনো অর্থনীতিবিদকে আনেনি। কিন্তু উভয় দেশেই সামরিক শাসন ওই নব্য উদারনীতি বাস্তবায়ন করেছে জাতীয় অর্থনীতির প্রধান কৌশল হিসেবে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালের সমাজতান্ত্রিক পরীক্ষণকে বাতিল করে নিও লিবারেল নীতিতে দেশকে টেনে আনার জন্য সামরিক অভ্যুত্থানের প্রয়োজন হয়েছিল। এই সামরিক শাসন বিভিন্ন ধারায় ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত টিকে থাকে। এই সময়কালে দেশের অর্থনীতি ধীরে ধীরে বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়। পর্যাপ্ত পরিমাণ সস্তা শ্রমের কারণে এ দেশে পোশাকশিল্প গড়ে ওঠে। সে সঙ্গে অন্যান্য শিল্প রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত হয়। সেগুলো পর্যায়ক্রমে ব্যক্তিমালিকানায় হস্তান্তর করা হয়। ১৯৭৭ সাল থেকে শুরু করে পোশাকশিল্প এক বিশেষ শিল্পে পরিণত হয়। এই নিও লিবারেল অর্থনৈতিক ব্যবস্থা অর্থনীতিকে উদার করলেও বাকি সমাজে উদার মনোভাবের বিস্তার ঘটেনি। বরং অর্থনীতির সঙ্গে মানুষের মূল্যবোধগত অসামঞ্জস্য আরও প্রকট হয়েছে। পরিণতিতে এখানে জন্ম নিয়েছে ক্রনিক ক্যাপিটালিজম। এই বিশেষ পুঁজিবাদের অধীনে এসে রাজনীতি সংঘাতের ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা, ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শুরু করে অর্থনীতির প্রতিটি ক্ষেত্র রাজনৈতিক দল, দলীয় আনুগত্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে সমাজের মূল্যবোধকে ধ্বংস করছে। এ ধরনের আর্থসামাজিক পরিবেশ গণতন্ত্রের জন্য উপযোগী না হওয়ায় বাংলাদেশ গণতন্ত্রের ওই পূর্বশর্ত পূরণ করে না।

দ্বিতীয় পূর্বশর্ত: এলিট সমঝোতার তত্ত্ব

বাংলাদেশের এলিট শ্রেণি আজও সমঝোতার রাজনীতিতে বিশ্বাসী হয়ে ওঠেনি। সে কারণে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া আজও এখানে শক্ত ভিতের ওপর স্থানীভাবে দাঁড়াতে সংগ্রাম করছে। দেশে নিরপেক্ষ নির্বাচনপদ্ধতি গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। এলিট শ্রেণির নিজস্ব অপারগতার পাশাপাশি কিছু ঐতিহাসিক কারণও রয়েছে। ওই ঐতিহাসিক কারণের মধ্যে গণতন্ত্রের স্থায়ী ঐতিহ্যের অভাবকে উল্লেখ করা যায়। দেশ বিভাগের আগে ইংরেজের অধীনে বাংলায় দু-একটা নির্বাচন হয়েছে, যদিও সেগুলো স্থানীয় পর্যায়ের ছিল। ১৮৮০ সাল থেকে ব্রিটিশ শাসন আংশিকভাবে হলেও স্থানীয় পর্যায়ে স্বায়ত্তশাসন প্রবর্তন করেছিল। ১৯৩৬ সালে ভারতের ১১টি প্রদেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই প্রদেশগুলোর মধ্যে বাংলা অন্তর্ভুক্ত ছিল। সে নির্বাচনে কংগ্রেস পার্টি সবচেয়ে অধিক সংখ্যক আসন দখল করে। এরপর ১৯৩৫ সালের নির্বাচন এবং সবশেষে ১৯৪৬ সালে আরও একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৩৭ থেকে ১৯৩৯ সাল এবং ১৯৪৬ সালে কংগ্রেস পার্টি স্থানীয় পর্যায়ের শাসন অভিজ্ঞতাকে প্রাদেশিক পর্যায়ে উন্নীত করে। এই নির্বাচন ও গণতন্ত্রায়ণকে কংগ্রেস দল গুরুত্ব দিয়ে দেখেছিল। ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক চালু করা প্রতিনিধিত্বশীল প্রতিষ্ঠানগুলোকে তারা ভারতীয়করণ করে, রাজনৈতিক দল গঠন করে, পার্লামেন্টে পিটিশন জমা দেওয়া, ব্রিটিশ প্রদত্ত কাউন্সিলগুলোতে অংশগ্রহণ করা, আইনের প্রতি সম্মান দেখানো—এসবই ভারতীয় কংগ্রেস দলকে গণতন্ত্রের দীক্ষায় দীক্ষিত করতে সাহায্য করে। গান্ধীর নেতৃত্ব এ ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখে। তিনি ব্রিটিশ প্রদত্ত আইন বাতিল দাবি করেননি, যদিও তাকে লঙ্ঘন করেছেন।

অবিভক্ত ভারতের অধীনে থেকেও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই ঐতিহ্য তেমন কোনো প্রভাব রাখেনি। পাকিস্তানের অধীনে এসে ওই ব্যবস্থার বরং ক্ষয় লক্ষ করা গেছে। শুরু থেকেই পাকিস্তানে গণতন্ত্র নিয়ে অন্ধকার আবছায়া পরিবেশ বিরাজ করেছে। ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন হয়েছিল বটে। কিন্তু তার ফলাফল পাকিস্তানি শাসকদের কাছে জুতসই মনে না হওয়ায় খোঁড়া অজুহাত দেখিয়ে তার ফলাফল বাতিল করা হয়। এরপরের অবস্থা আরও নিদারুণ। শাসনতন্ত্র স্থগিত রেখে সামরিক শাসন আসে। আইয়ুব খানের বনিয়াদি গণতন্ত্র চালু হয়। এসব ওলটপালট দেখতে দেখতে আমাদের স্বাধীনতা এসে যায়। স্বাধীন হয়েও বাঙালির ভাগ্যে গণতন্ত্র মেলেনি। তিন বছর যেতে না যেতেই একদলীয় শাসন প্রবর্তন হয়। ১৯৭৫ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত বিভন্ন ফ্রেমে সামরিক শাসন বজায় থাকায় সে সময় গণতন্ত্র বিকশিত হয়নি। সামরিক বাহিনীর অধীনে নির্বাচিত প্রতিনিধি নিয়ে গঠিত জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকা নিতান্তই নগণ্য ছিল। প্রায় এক যুগ ধরে টিকে থাকা জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসনের পতন ঘটার পর ওই সালে নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এভাবে সতেরো বছর ধরে টিকে থাকা অগণতান্ত্রিক রাজনীতির (১৯৭৫-১৯৯০) সমাপ্তি ঘটে। জেনারেল এরশাদ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের শর্ত মেনে নেয়। ১৯৯১ সালে সুস্থ পরিবেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৯৬ এবং ২০০১ সালেও একইভাবে সফল নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু ২০০৭ সালে নির্বাচনপূর্ব ব্যাপক বিশৃঙ্খলার কারণে সেনাশাসিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা গ্রহন করে। অবশেষে ২৯ ডিসেম্বর ২০০৮ সালে নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এসবের পরও নিরপেক্ষ নির্বাচনসংক্রান্ত জটিলতা কাটেনি। নির্বাচনী নিরপেক্ষতা নিয়ে ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ব্যাপক উত্তেজনা এবং সহিংসতা দেখা দেয়। তার একটি কারণ ছিল পঞ্চদশ সংশোধনী। ওই সংশোধনী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগের নীতি বাতিল করে। সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সেটি সংসদে পাস করা হয় বটে। কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের অধীনে নির্বাচন কতটুকু নিরপেক্ষ হতে পারে তা নিয়ে জনমনে সন্দেহ থেকে যায়। স্বাধীন হওয়ার পর যে চার দশকেরও বেশি সময় কেটে গেছে সে সময়টি ঐতিহাসিক বিচারে স্বল্প হতে পারে। কিন্তু তা হলেও এই নির্বাচনসংক্রান্ত ব্যর্থতার কারণে বাংলাদেশ ইতিমধ্যে গণতন্ত্রের গ্রে এরিয়া বা ধূসর অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে।

এলিট সমন্বয় গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে আরও একটি বড় বাধা হচ্ছে জাতীয় ঐক্য। রাজনৈতিকভাবে দ্বিধাবিভক্ত এবং সে কারণে ঐক্যহীন হয়ে এলিট শ্রেণি এবং রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব এখানে ঐক্যবদ্ধ কোনো রাজনৈতিক সমাজ গড়ে তুলতে পারেনি। জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এলিট শ্রেণির সামনে তিনটি পথ খোলা ছিল। একটি পথ জাতীয়তাবাদী আদর্শকে ব্যবহার করা। স্বাধীনতার প্রাক্কালে ওই আদর্শ জাতীয় ঐক্যের একটি ভিত তৈরি করে দিয়েছিল। কিন্তু ওই ঐক্য পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক ঐক্যে পরিণত হয়নি। ১৯৬৫ থেকে ১৯৭২ সালের মধ্যবর্তী সময়ে দুই অর্থনীতি ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ আমাদের সংস্কৃতিকে ঘিরে শক্তিশালী হয়। সেখানে বাংলা ভাষা বিশেষ ভূমিকা পালন করে। ভাষাসৈনিকদের অবদানকে কাজে লাগিয়ে বাঙালি জাতির মনে আবেগ সৃষ্টি করা সম্ভব হয়। সেই আবেগ বাঙালি জাতিকে অনুপ্রাণিত করে। ঐক্য এবং প্রতিরোধের সংস্কৃতি গড়ে তুলতে আরও বিশেষ ভূমিকা রাখে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে নবাব সিরাজদ্দৌলার বীরত্বের গাথা, প্রীতিলতার আত্মদান, খুদিরামের বীরগাথা, জাতির অতীত ইতিহাস, পৌরাণিক গল্প, বীরত্ব অর্থাত্ আমাদের পূর্বপুরুষদের অতীত ইতিহাস। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সাহিত্য এখানে কম ভূমিকা পালন করেনি। এসব মিলিয়ে এখানে সৃষ্টি হয়েছিল জাতীয় ঐক্য। কিন্তু ওই ঐক্য বেশি দিন টেকেনি। একই সঙ্গে মুজিববাদ নামে এক রাজনৈতিক তত্ত্ব দিয়ে রাজনৈতিক ঐক্য গড়ার চেষ্টা হয়। সেটি ব্যর্থ হয়। শেখ মুজিবের পর যারা ক্ষমতায় আসে তারাও ১৯৭৫ থেকে ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক সমাজ গড়ার লক্ষ্যে আদর্শের ওপর ভর করে নানা প্রচেষ্টা গ্রহণ করে। কিন্তু সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। জেনারেল জিয়াউর রহমানের বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ক্ষেত্রে ওই একই পরিণতি ঘটে। ১৯৮১ থেকে ১৯৯০ সালের মধ্যে স্বৈরশাসনের সময়কালে কোনো আদর্শিক নকশা জাতিকে উপহার দেওয়া না গেলেও জেনারেল এরশাদের মূল লক্ষ্য ছিল একটি ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক গোষ্ঠী গড়ে তোলা। অন্যান্য উপনিবেশশাসিত দেশেও এভাবে রাজনৈতিক সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। আফ্রিকায় তাঞ্জানিয়ার প্রেসিডেন্ট (১৯৬১-১৯৮৫) নিয়েরেরে উজামা সমাজতন্ত্রের মাধ্যমে ওই ধরনের রাজনৈতিক সমাজ গঠন করতে চেয়েছিলেন। কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট জোমো কেনিয়াত্তা (১৯৬৩-১৯৭৮) হারাম্বি (Harambee) নামে একটি আদর্শ দিয়ে ওই রাজনৈতিক বাঁধন সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন। কঙ্গোর প্রেসিডেন্ট মবুতু (১৯৬৫-১৯৯৭) তাঁর দেশে ‘authenticite’ নামে এক আদর্শের সহায়তায় ওই একই প্রচেষ্টা নিয়েছিলেন। একটি সাহিত্যিক এবং রাজনৈতিক আদর্শ হলেও আফ্রিকায় আরও অনেক রাষ্ট্রপ্রধান Negritude নামের আদর্শ দিয়ে ওই একই প্রচেষ্টা গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু রাজনৈতিক সমাজ গড়ার বদলে প্রতিটি ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মতো করে তারা একধরনের কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র (monopoly state গড়ে তোলেন।

জাতীয় ঐক্যের লক্ষ্যে বাংলাদেশ আরও একটি ব্যর্থ পথ অনুসরণ করে। সেটি ছিল দেশটিকে একটি আধুনিক সমাজে পরিণত করা, আধুনিকায়নকে ব্যবহার করে একধরনের নতুন সামাজিক সংহতি গড়ে তোলা। কিন্তু সেটিও সফল হয়নি। আদর্শতাড়িত এবং অর্থনৈতিকভাবে অকার্যকর হওয়ায় বাংলাদেশের এলিট শ্রেণি এ ক্ষেত্রেও ব্যর্থ হয়। এরই পাশাপাশি নব্য মার্ক্সবাদী চিন্তার সহায়তায় রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে তোলার চেষ্টা হয়। সেখানে বাংলাদেশকে তার পূর্বের ঔপনিবেশিক শক্তি ব্রিটেন, আমেরিকা বা পাকিস্তানের বাঁধন থেকে মুক্ত করা এবং স্বনির্ভর শিল্পায়নের পথনির্দেশ করা হয়। ওই শিল্পায়ন দিয়ে নতুন সংহতি গড়ে তোলার প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হয়।

জাতীয়তাবাদের এই ব্যর্থতার কারণে এখানে ধর্মের আশ্রয় নিয়ে একটি গোষ্ঠীর উত্থান ঘটে। তারা প্রথম থেকেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে দ্বিমত পোষণ করে তার বিরোধিতা করে এসেছে। তাদের সংহতি ছিল ঔপনিবেশিক পাকিস্তান রাষ্ট্রের সঙ্গে। ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের প্রতি অনুগত এই শক্তি পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতা এবং স্বাধীনতাকে ঘোর বিরোধিতা করে এসেছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাদের কার্যকলাপ কিছুটা স্তিমিত থাকলেও পরবর্তী সময়ে ধর্মকে মূলধন করে পুনরায় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ শুরু করে। এর ফলে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিপরীতে মুসলিম জাতীয়তাবাদের সংঘর্ষপূর্ণ সম্পর্ক সৃষ্টি হয়ে জাতীয় ঐক্য ব্যাহত হয়েছে।

রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে তোলার জন্য একটি পথ হলো সমগ্র জাতিকে একটি বিশেষ শাসনকাঠামোতে অন্তর্ভুক্ত করা এবং সেই কাঠামোর ন্যায়সংগত তা প্রমাণ করে জাতীয় মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত করা। সে ধরনের ঐক্য সম্ভব ছিল রাষ্ট্রের শাসনপদ্ধতিতে নিরপেক্ষ গণপ্রতিনিধি নির্বাচনের প্রক্রিয়াকে সন্দেহমুক্ত রাখা। গণমানুষের প্রতিনিধিত্ব কতটুকু নিশ্চিত হচ্ছে, ওই প্রতিনিধিত্বের কাজটি কতটুকু সুস্থভাবে এবং নিরপেক্ষভাবে সম্পন্ন হচ্ছে বা সেটি কতটুকু কার্যকর বা সমস্যামুক্ত, সেটি গুরুত্বপূর্ণ। তার অর্থ হলো সময়মতো নির্বাচন হচ্ছে কি না, সব মানুষের ভোট দেওয়ার অধিকার নিশ্চিত হলো কি না, নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ কি না, মানুষের মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা আছে কি না, মানুষ বিনা দ্বিধায় সংগঠিত হতে পারে কি না, ইচ্ছা অনুযায়ী রাজনৈতিক সংগঠনে যোগ দিতে পারে কি না, রাজনৈতিক দল তাদের মেনিফেস্টো প্রচারে বাধার সম্মুখীন হয় কি না, বিচার বিভাগ স্বাধীন কি না ইত্যাদি শর্তকে ধরে নিয়ে গণতন্ত্রের সাবলীলতাকে বিচার করা হয়। এগুলো যদি পুরোপুরি বাস্তবায়ন সম্ভব হতো, তাহলে ওই রাজনৈতিক ঐক্যের প্রধান একটি ক্ষেত্র প্রস্তুত করা সহজ হতো। কিন্তু নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রশ্নে রাজনৈতিক এলিট ব্যর্থ হয়েছে। ১৯৯১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হয়। ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের পর পর দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম ও দ্বিতীয় নির্বাচন আপেক্ষিক অর্থে নিরপেক্ষ হলেও সংকট শুরু হয় ২০০৭ সাল থেকে। বিধি অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হন রাষ্ট্রের প্রধান বিচারপতি। কিন্তু ২০০৭ সালের নির্বাচনের ঠিক আগমুহূর্তে এমন একজন প্রধান বিচারপতিকে নিয়োগ করা হয়, তিনি ক্ষমতাসীন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের প্রতি অনুগত ছিলেন। নির্বাচন কমিশনের প্রধানের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। প্রশ্ন ওঠে ভোটার তালিকা নিয়ে। বিভিন্ন জেলা প্রশাসকের পদে দলের প্রতি সহানুভূতিশীল এমন লোকদের নতুন দায়িত্ব দেওয়ার প্রশ্নে বিতর্ক সৃষ্টি হয়। ভোটার তালিকায় ভুয়া ভোটারের সংখ্যা কয়েক কোটিতে দাঁড়ায়। এসব কারণে বিরোধী দলের নেতৃত্বে ব্যাপক আন্দোলন শুরু হয়। সামরিক বাহিনীর সহায়তায় এক অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণাকে পাশ কাটিয়ে সামরিক শাসনের অধীনে ২০০৭ সালে নির্বাচন হয়। পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগ সরকার দলীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা ব্যবহার করে জাতীয় সংসদে সংবিধানের ১৫তম সংশোধনী আনে এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করা হয়। নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সবচেয়ে কার্যকর পথ কোনটি, তা নিয়ে আজও বিতর্কের শেষ হয়নি। ৫ জানুয়ারি ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ওই নিরপেক্ষতার প্রশ্ন পুনরায় উত্থাপিত হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পুনঃপ্রবর্তন এবং তার অধীনে নির্বাচনের দাবিতে বিরোধী দল নির্বাচন বয়কট করে। সেই উত্তেজনা ও সংঘাতপূর্ণ মানসিকতা আজ দেশের পরিস্থিতিকে জটিল করে রেখেছে। নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিতে দেশ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে আছে। রাজনৈতিক ঐক্যের কোনো ভূমিতল তৈরি হয়নি।

সেই সঙ্গে তৃতীয় পথ ছিল রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থাকে গণমুখী করা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশে জনসেবার প্রশ্নটিকে কখনো গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়নি। সে কারণে গণপ্রতিনিধিদের দৃষ্টি জনকেন্দ্রিক নয়, বরং তা থেকে দূরে। জনগণের সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক কেমন হবে, তার অনেকখানি নির্ভর করে দেশের আমলাতন্ত্রের ওপর। তারাই সরকারের নির্বাহী ক্ষমতা বাস্তবায়নের দায়িত্বে থাকে এবং তারা সরকারের নীতি বাস্তবায়ন করে। কিন্তু বিগত বছরগুলোতে জনগণ ও সরকারের মধ্যে দূরত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। রাজনৈতিক ও সামাজিক ঐক্য গড়ে ওঠেনি। সেটি কেন হলো তার একটি কারণ নির্বাচিত প্রতিনিধির সঙ্গে অনির্বাচিত আমলাতন্ত্রের আন্তসম্পর্কের ধরনে নিহিত। বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হয়, তখন দেশ আমলাতন্ত্র এবং সামরিক বাহিনীর হাতে জিম্মি হয়ে পড়ে। সদ্য স্বাধীন একটি দেশে আমলাতন্ত্র এবং সামরিক বাহিনী তুলনামূলকভাবে সংগঠিত শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক দুরবস্থা, সংগঠনের অভাব, নেতা-কর্মীর নৈতিক স্খলন, লুটপাট এবং সম্পদ আহরণ মুখ্য তত্পরতায় পরিণত হওয়ায় জনগণ থেকে সরকার বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। আমলাতন্ত্র ও সামরিক বাহিনীও তাদের দক্ষতা, বিচারবুদ্ধি এবং সততা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। এসব কারণে দেশীয় অনভিজ্ঞ বুর্জোয়া বা ভূস্বামী শ্রেণি রাষ্ট্রের উপরিকাঠামোর সবচেয়ে দুর্বল অংশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এবং অতিমাত্রায় উন্নত উপরিকাঠামোর বাকি অংশের হাতে জিম্মি হয়ে পড়ে। উপনিবেশ-উত্তর সমাজে উপরিকাঠামো কেন শক্তিশালী ও অগ্রসর হয়, তার একটি ব্যাখ্যা হামজা আলাভির রচনায় পাওয়া যায়। সেখানে তিনি ঔপনিবেশিক শাসনের চরিত্রকে দায়ী করে দেখিয়েছেন শোষণযন্ত্রকে চালু রাখার জন্য ওই শাসন একটি উন্নত আধুনিক উপকরণে সজ্জিত রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলে। শোষণ-প্রক্রিয়াকে সুসংগত করা, শোষণের শাখা-প্রশাখাগুলোকে অভিন্ন এক নেটওয়ার্কের আওতায় আনার দায়িত্ব সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসনের ওপর ন্যস্ত হয়। সামরিক বাহিনী জনগণের ক্ষোভকে নিয়ন্ত্রণে রেখে শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পালন করে, অন্যদিকে শোষণের ধারাবাহিকতাকে প্রশাসনিক উপায়ে টিকিয়ে রাখা, তাকে যৌক্তিক রূপ দেওয়ার দায়িত্ব পড়ে আমলাতন্ত্রের ওপর। ওই শাসন থেকে মুক্ত হয়ে যখন নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হয়, তখন আমলাতন্ত্র ও সামরিক বাহিনী দক্ষতা এবং সাংগঠনিকভাবে সবচেয়ে গোছালো শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে আমলাতন্ত্র বা সামরিক বাহিনী কী অবস্থান দখল করবে, সমাজের বাকি শ্রেণিকাঠামো থেকে নিজেকে কতটুকু পৃথক করে স্বাধীনভাবে তার অবস্থানকে সুসংগত করবে, তা বুর্জোয়া শ্রেণির আপেক্ষিক শক্তি কতটুকু তার ওপর নির্ভর করে। নির্ভর করে নিজের অবস্থানকে পাকাপোক্ত করতে সে কতটুকু পারদর্শী, আমলাতন্ত্র ও সামরিক শক্তিকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে কতটুকু সক্ষম।

বাংলাদেশে অনির্বাচিত আমলাতন্ত্রের সঙ্গে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির সম্পর্ক অধস্তনের। নির্বাচিত প্রতিনিধিরা দেশ শাসনে কতটুকু উপযোগী, সেটি আমলাতন্ত্রের কাছে প্রশ্ন হিসেবে রয়ে গেছে। যারা রাজনীতির সঙ্গে আজ যুক্ত আছেন, তাঁদের অধিকাংশ কেবল শিক্ষাদীক্ষার ক্ষেত্রে নয়, দেশ শাসনে অকার্যকর, দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত, অদক্ষ, ধোঁকা দেওয়ায় পারদর্শী। সে কারণে এখানে নির্বাচিত প্রতিনিধি ও আমলাতন্ত্রের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হয়েছে। ক্ষমতাগত ভারসাম্য নির্বাচিত প্রতিনিধির বদলে আমলাতন্ত্রের দিকে ঝুঁকে পড়লে গণতন্ত্রের বিকাশ সেসব দেশে বাধাগ্রস্ত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে। সামুয়েল হান্টিংটন দেখিয়েছেন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, ইরাক, ইরান, সৌদি আরব, লিবিয়া বা ওমানের অর্থনীতি তেল রপ্তানির ওপর নির্ভরশীল হওয়ার কারণে সেখানে রাষ্ট্রীয় আমলাতন্ত্রের ভূমিকা ও প্রভাব প্রবল। সে কারণে সেখানে গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটেনি, জন্ম হয়েছে আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের। পূর্ব ইউরোপে সমাজতান্ত্রিক এবং কেন্দ্রীয় পরিকল্পনার ভিত্তিতে পরিচালিত অর্থনীতির মূল কান্ডারি আমলাতন্ত্র। সেখানেও গণতন্ত্রের অভাব রয়েছে (Sameul Huntington 1991:1)। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি অনির্বাচিত আমলাতন্ত্রের ওপর কতটুকু নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করবে, সেটি আরও নির্ভর করে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের কর্মদক্ষতা ও জনসমর্থনের ওপর। সেদিক থেকে ভাবলে রাজনৈতিক দলের ইতিহাস, তার গণমুখী চরিত্র, মাঠপর্যায়ে মানুষের সঙ্গে যোগাযোগের ধরন কেমন তার ওপর নির্ভর করে গণতান্ত্রিক বিকাশের প্রকৃতি এবং আমলাতন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণ ও গণমুখী করার ক্ষমতা। ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের একটি তুলনা এ ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক। ওই দুই দেশের গণতান্ত্রিক ভাগ্যের ক্ষেত্রে মৌলিক পার্থক্যটি রয়ে গেছে মুসলিম লীগ এবং কংগ্রেস পার্টির মধ্যে আমলাতন্ত্রকে কে কতটুকু নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছিল তার ওপর। অখণ্ড ভারতে মুসলিম লীগ ব্যাপক জনসমর্থিত কোনো রাজনৈতিক দল ছিল না। এ দলটি গড়ে উঠেছিল এলিট শ্রেণি থেকে আসা প্রতিনিধি দিয়ে। সে কারণে জনসংযোগের ক্ষেত্রে মুসলিম লীগের যথেষ্ট দুর্বলতা ছিল। এমনকি যেসব প্রদেশ এবং আঞ্চলিক এলাকায় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতা লক্ষ করা গিয়েছিল, সেখানেও মুসলিম লীগের গণভিত্তি দীর্ঘকাল অনুপস্থিত ছিল। কংগ্রেস সে তুলনায় ভিন্ন চরিত্রের একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে পেরেছিল। জাতি, বর্ণ, প্রদেশ এবং আঞ্চলিকভাবে বিভক্ত হলেও ভারতীয় কংগ্রেস নিজেকে সব ধরনের জনগোষ্ঠীকে অভিন্ন ভারতের (রাজনৈতিক ও ভৌগোলিকভাবে) প্রতিনিধি হিসেবে পরিচিত করে। ফলে দেশ বিভাগের পর কংগ্রেসের পক্ষে কিছুটা হলেও আমলাতন্ত্র ও সামরিক বাহিনীর ওপর একধরনের কর্তৃত্ব স্থাপন করা সহজ হয়েছিল। ফলে ভারতে স্বৈরতান্ত্রিক আমলাতন্ত্রের বিশেষ কোনো প্রভাব লক্ষ করা যায়নি। পাকিস্তানের ক্ষেত্রে ব্যাপারটি ভিন্ন ছিল। সেখানে সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্র গণপ্রতিনিধিদের নিয়ন্ত্রণ করেছে। ফলে পাকিস্তান রাষ্ট্র সামরিক আমলাতন্ত্র দিয়ে পরিচালিত হয়েছে। গণতন্ত্র সেখানে শক্ত ঘাঁটি গড়তে পারেনি। সমস্যাটি বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও কিছুটা প্রাসঙ্গিক।

একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণে আমলাতন্ত্রকে সবচেয়ে দক্ষ ও উপযোগী একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্ব গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে আমলাতন্ত্র এই ধারায় বিকশিত হতে পারেনি। এ ধারায় বিকশিত হওয়া হয়তো বা কোথাও, কোনো দেশেই শতভাগ সম্ভব হয় না। গোড়া থেকে সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্রের ছত্রচ্ছায়ায় বেড়ে ওঠার কারণে আমলাতন্ত্রের নিরপেক্ষতার প্রশ্নটি বাংলাদেশে কোনো সরকার গুরুত্ব দিয়ে দেখেনি, বরং দলীয়করণ করে প্রতিটি সরকার আমলাতন্ত্রকে তাদের অধীনে রাখার চেষ্টা করেছে। এ কারণে নিয়মনীতির প্রতি আনুগত্য না দেখিয়ে সেখানে গোষ্ঠী বা দলীয় আনুগত্য প্রাধান্য পেয়েছে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে (সরকারি আমলাতন্ত্রে) গণতন্ত্র বিকশিত হয়নি। জনগণের সেবক হিসেবে আমলাতন্ত্র নিজেকে প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে জনগণ ও সরকারের মধ্যকার আন্তসম্পর্কে কোনো ঐক্য বা বন্ধন গড়ে ওঠেনি।

বাংলাদেশে গণতন্ত্রের পথ কী?

বাংলাদেশে গণতন্ত্রের গুণগত পরিবর্তনের লক্ষ্যে দুটি স্বতঃসিদ্ধকে গুরুত্ব দিয়ে দেখা প্রয়োজন।

প্রথম স্বতঃসিদ্ধ

বাংলাদেশে গণতন্ত্রের সংগ্রাম কেবল গণতন্ত্রেরই সংগ্রাম নয়। তার সঙ্গে আরও যুক্ত রয়েছে আত্মপরিচয়ের সংগ্রাম, সমাজকে আধুনিক করা এবং সমাজজীবনে উদারনীতির বিকাশ নিশ্চিত করার সংগ্রাম। আরও রয়েছে অগ্রসর অর্থনীতি এবং দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসনিক কাঠামো গড়ার চ্যালেঞ্জ। সে কারণে বিশুদ্ধ অর্থে গণতন্ত্র অর্থাত্ মেয়াদান্তে নির্বাচন এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন শেষকথা নয়। স্বাধীনতা লাভের পর আমাদের দেশের ওপর একই সঙ্গে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, আধুনিকায়ন, পুঁজিবাদী বাজার অর্থনীতি গড়ে তোলার মতো কাজগুলো একসঙ্গে সম্পন্ন করার কঠিন দায়িত্ব পড়ে। ফলে ইউরোপের মতো প্রথমে জাতিগঠন, পরে অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং সবশেষে গণতন্ত্র—এই ছকটি আমাদের পক্ষে পালন করা কঠিন। এখানে সে কারণে বিশুদ্ধ অর্থে ইউরোপীয় মানদণ্ডের পরিমাপে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। গণতন্ত্রের সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত থাকবে জাতিগঠন, স্বাধীনতার শত্রু-মিত্রের সমস্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধের সাজা ইত্যাদি। দক্ষিণ এশিয়ায় গণতন্ত্র কোনো সামাজিক ও ঐতিহাসিক শূন্যতার মধ্যে জন্ম নিতে পারে না। গণতন্ত্র মানে বিভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক গ্রুপের কেবল সমন্বয় বোঝায় না, তার সঙ্গে তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়নের ব্যাপারটাকে আমলে নিতে হবে।

জাতিগত আত্মপরিচয়ের ক্ষেত্রে আমাদের দেশ বাঙালি জাতি এবং তার সংস্কৃতির ওপর ভিত্তি করে স্বাধীন হয়েছে। অথচ জাতির অস্তিত্বসংক্রান্ত প্রশ্নগুলো, জাতির ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত বিষয়গুলো দুঃখজনকভাবে আমাদের দেশে আজও অমীমাংসিত, দ্বিখণ্ডিত হয়ে আছে। বাঙালি সংস্কৃতি এবং জাতিপরিচয়কে ধর্মীয় পরিচিতির প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে উপস্থাপনের প্রচেষ্টা লক্ষ করা যায়। বাঙালি আত্মপরিচয়কে রক্ষা করা গণতন্ত্রের সংগ্রামে অন্যতম উপাত্ত বিষয় হিসেবে দেখতে হবে। এখানে নির্বাচন কেবল সঠিক এবং যোগ্য ব্যক্তি বা দলের নির্বাচনকে বোঝায় না। যেসব জাতীয় প্রশ্ন বাঙালি জাতির অস্তিত্বের সঙ্গে যুক্ত, সেগুলো গণতান্ত্রিক সংগ্রামের কর্মসূচির বাইরে রেখে গণতন্ত্রচর্চা সম্ভব নয়। রাজনীতি বা নির্বাচনে আজ অংশ নিচ্ছে এমন অনেক দল, যেসব দলে রয়েছে এমন সব ব্যক্তি বা গোষ্ঠী, যারা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে।

যারা দেশের উন্নতি বলতে বোঝায় পশ্চাত্পদ মধ্যযুগীয় ধ্যানধারণার বাস্তবায়নকে। জাতিপরিচয় এবং তার ইতিহাসকে বিকৃত করে জাতীয় ঐতিহ্যের প্রধান স্তম্ভ স্বাধীনতা দিবস, ভাষাশহীদ দিবস, বিজয় দিবসের ধারণাকে মনেপ্রাণে গ্রহণ করে না, যেগুলো জাতি পরিচিতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত। দেশটির ইতিহাস, বিভিন্ন নেতার অবদানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে দেশের স্বাধীনতাকে অবমূল্যায়ন করার লক্ষ্যে।

বাংলাদেশের অস্তিত্বের প্রধান দিকনির্দেশক হলো মুক্তিযুদ্ধ। তার প্রতি এবং সেই অর্থে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রতি আনুগত্য প্রধান শর্ত। পশ্চিমা বিশ্ব এই দিকটির প্রতি মনোযোগ দেয় না, যদিও এই বিভেদটি গুরুতর। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে অস্বীকার করে, নজরুল-রবীন্দ্রনাথের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে, মুজিব-জিয়ার মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে বাঙালি ও ইসলাম ধর্মকে প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখার সংস্কৃতির অবসান প্রয়োজন। মুসলিম, হিন্দু বৌদ্ধ, খ্রিষ্টধর্মের প্রতিষ্ঠানগুলো আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। বাঙালির জাতিগত ঐক্যের অভ্যন্তরে ফাটল সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়। জাতীয় সার্বভৌমত্বকে বিতর্কিত করা হয় জাতির পিতা শেখ মুজিব সম্পর্কে নানা কটূক্তি করে।

ফলে আমরা এক বিশেষ ডিলেমার মুখোমুখি হই। গণতান্ত্রিক পদ্ধতি অনুসরণ করে এমন শক্তির ক্ষমতায় আসাকে বাতিল করা যায় না, যারা দেশকে মধ্যযুগীয় পশ্চাত্পদতার দিকে টেনে নিতে পারে, যারা বাঙালি জাতির চেতনার পরিপন্থী পথ গ্রহণে, যারা সার্বভৌমত্বকে জলাঞ্জলি দিয়ে দেশকে মেলাতে পারে কোনো আন্তর্জাতিকতাবাদের সঙ্গে, ধর্মীয় বা ভিন্ন কোনো আদর্শকেন্দ্রিক মতবাদের সঙ্গে। সে ধরনের অভিজ্ঞতা ইতিহাসে রয়েছে। ১৯৩৩ সালে হিটলারের নির্বাচনে বিজয়ের কথা উদাহরণ হিসেবে ধরা যেতে পারে। যদি সে ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, তাহলে জাতির অস্তিত্বের সংকট নিয়ে ভাবতে হবে। সে কারণে গণতন্ত্রকে নির্বাচনসর্বস্ব প্রক্রিয়া হিসেবে ভাবা আমাদের দেশের ক্ষেত্রে কঠিন। গণতন্ত্রকে কেবল প্রক্রিয়া হিসেবে দেখার উপদেশ আমাদের নিজস্ব ধারণা থেকে আসেনি। এসেছে পশ্চিমা বিশ্ব ও বিশ্বপুঁজির সঙ্গে যুক্ত সংগঠনগুলো থেকে। বিগত তিন দশকে আমাদের অর্থনীতি পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থার কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। যারা ওই কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রক, তারা গণতন্ত্রের পদ্ধতি অনুকরণের কথা বলে, তারা জানে পুঁজির বিকাশ ও প্রসার শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ছাড়া সম্ভব নয়। সে কারণে তাদের দাবি গণতান্ত্রিক পদ্ধতি চালু করা, সমাজকে শান্ত রাখা, রাজনৈতিকভাবে উত্পাতহীন একটি পরিবেশ সৃষ্টি করা, যা ওই পুঁজির বিকাশকে নিশ্চিত করবে। তা ছাড়া আরও রয়েছে ১৬০ মিলিয়ন মানুষের এই দেশ, বাজার অর্থনীতির দিক থেকে যার গুরুত্ব বিশ্বপুঁজির কাছে কম নয়। এই পুঁজির ওপর ভর করে এখানে জন্ম নিয়েছে দেশীয় বুর্জোয়া ও রাজনৈতিক এলিট শ্রেণি। এই পুঁজির সঙ্গে নানাভাবে সম্পৃক্ত রয়েছে আমাদের নাগরিক সমাজ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি। এই পুঁজির দিকে তাকিয়ে তারা কথা বলে। তাদের আচরণের গণ্ডিকে সুনির্দিষ্ট করে। এই পুঁজি থেকে আসে তাদের অর্থ এবং কর্মস্পৃহার চালিকাশক্তি। সেদিক থেকে ভাবলে গণতন্ত্রের দাবিটি আমাদের দেশীয় বাস্তবতা থেকে পুরোপুরি আসেনি। দাবিটি চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু যে ধরনের গণতন্ত্র ওই বিশ্বপুঁজি আমাদের দেশে দেখতে চায়, সে গণতন্ত্র এক বিশেষ ধরনের গণতন্ত্র। সেখানে মেয়াদান্তে নির্বাচন হবে। এটুকুই। শাসক পাল্টাবে। তাদের কাছে এই নিয়মতান্ত্রিকতাটুকু প্রয়োজন। গণতন্ত্রের সারবস্তুর প্রতি, আর্থসামাজিক বাস্তবতা, সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক বাস্তবতাকে তারা ভ্রক্ষেপ করে না। এই ধাঁচে আমাদের দেশীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা কঠিন।

দ্বিতীয় স্বতঃসিদ্ধ

গণতন্ত্র বিকাশের প্রশ্নে আমাদের মূল দৃষ্টি রাজনৈতিক দল এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বের ওপর নিবদ্ধ রাখতে হবে দুটি কারণে। প্রথমত, বাংলাদেশে আর্থসামাজিক পরিবেশ গণতন্ত্রের জন্য উপযোগী নয়। আর আর্থসামাজিক পরিবেশ কবে উন্নত হবে, তার অপেক্ষায় অনির্দিষ্টকালের জন্য সময় ব্যয় করা যুক্তিযুক্ত নয়। দ্বিতীয়ত, জাতীয় সংসদে জনগণ প্রতিনিধি নির্বাচন করেন। কে নির্বাচিত হবেন, কে হবেন না, তার বিচারক জনগণ। জনগণই আবার জনপ্রতিনিধিদের কাজের মূল্যায়ন করেন। তার ওপর ভিত্তি করে জনগণ পরবর্তী নির্বাচনে কাকে নির্বাচিত করবেন, কাকে করবেন না, সেটি নির্ধারণের সুযোগ পান। সে কারণে প্রতিনিধিত্বের প্রশ্নে জনগণের ভূমিকা যেমন প্রধান, তেমনি নির্বাচিত হয়ে যাঁরা জনগণের প্রতিনিধিত্ব করেন, তাঁদের বিচারবুদ্ধির ওপর, সচেতনতার ওপর গণতন্ত্রের ভবিষ্যত্ নির্ভর করে। জনগণের সচেতনতার দিকটি উন্নত গণতন্ত্রে লক্ষ করা গেলেও বাংলাদেশের মতো অনুন্নত সমাজে জনগণ এক অদ্ভুত সমষ্টি হিসেবে রয়ে গেছে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, বাংলাদেশের জনগণ বুদ্ধিমান এবং রাজনীতির ব্যাপারে খোঁজখবর রাখে, দেশীয় রাজনীতি সম্পর্কে তাদের মতামত আছে। কিন্তু জনগণের যে ৮০ শতাংশ গ্রামে বাস করে, তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে হয় কৃষক, না হয় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, উকিল, মোক্তার, স্কুল, কলেজের শিক্ষক। এদের অধিকাংশ অশিক্ষিত। রাষ্ট্রপরিচালনার নীতির মতো জটিল বিষয় নিয়ে তারা ভাবে না। ভাবার সময় নেই বা সামর্থ্য নেই। সকাল থেকে বিকেলে তারা মাঠে সময় কাটায়। সন্ধ্যায় পাড়ার চায়ের দোকানে জটলা। টেলিভিশনের পর্দায় চোখ রেখে দেশকে দেখা। পর্দায় ভেসে ওঠে নানা খবর, মুখ বা ঘটনা। সেগুলোর ওপর চোখ বুলিয়ে কিছু বিক্ষিপ্ত-বিচ্ছিন্ন আলাপে জড়িত হয়ে বুঝে না বুঝে ঘরে ফেরা। এই নিয়ে গড়ে ওঠে অধিকাংশ মানুষের সচেতনতার পরিধি। মেয়াদান্তে নির্বাচন আসে। তার সঙ্গে থাকে কিছু ক্ষণিক উত্তেজনা। নির্বাচনকেন্দ্রে কয়েক ঘণ্টা কাটিয়ে ভোট দেওয়ার সুযোগ। কপাল মন্দ হলে সেটুকুও ভাগ্যে জোটে না। কেউ সে কাজটি ইতিমধ্যে হয়তোবা সম্পন্ন করে দিয়ে গেছে। তা ছাড়া রয়েছে অর্থের বিনিময়ে ভোট ক্রয়ের সংস্কৃতি। বাংলাদেশে গণতন্ত্রচর্চার এই হলো হাল-হকিকত, সচেতনতার পরিধি। এরাই সেই সার্বভৌম ক্ষমতার উত্স, যাকে ঘিরে গড়ে ওঠে গণতন্ত্রের বাকি অংশ—নেতা এবং রাজনৈতিক দল। তারা এই জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি হয়ে দেশের সার্বভৌমত্বের প্রতিনিধি হয় এবং দেশ শাসন করে।

জনগণের সচেতনতার ক্ষেত্রে আশু পরিবর্তন সম্ভব নয়। সে কারণে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উন্নতির জন্য রাজনৈতিক দলের গুণগত পরিবর্তন বিশেষভাবে কাম্য। সাধারণ জনগণের বুদ্ধিমত্তার অভাব এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে অদক্ষতা যদি বাংলাদেশের বাস্তবতা হয়ে থাকে, তাহলে গণতন্ত্রকে সজীব ও কার্যকর করার যে একমাত্র পথটি বাকি থাকে, তা হলো রাজনৈতিক দলের অগ্রণী ভূমিকা। রাজনৈতিক দল জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে। দলের প্রতিনিধি নির্বাচনে অংশ নিয়ে জনগণের সমর্থনে জনমানুষের প্রতিনিধি হিসেবে গণতন্ত্রের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ হয়। সে কারণে এখানে দলীয় সদস্যদের গুণগত মানের দিকটি যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি গুরুত্বপূর্ণ দলীয় নেতৃত্বের প্রশ্ন। রাজনৈতিক দলের গুণগত পরিবর্তনের মাধ্যমে গণমুখী নীতি, ওই নীতি বাস্তবায়নে আধুনিক আমলাতন্ত্র গড়ে তোলা এবং জনসেবাকে প্রাধান্য দেওয়ার প্রশ্নগুলোর সমাধান সহজ হয়। রাজনৈতিক দলের প্রধান ভূমিকা নিশ্চিত করতে হলে দেখতে হবে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে রাজনৈতিক দল কতটুকু শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়াতে পেরেছে। তৃতীয় বিশ্বের অন্য দেশগুলোর মতো বাংলাদেশে রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠানগতভাবে দুর্বল। যেসব দেশে গণতন্ত্র দীর্ঘদিন ধরে টিকে আছে বা যাকে বলে সুপ্রতিষ্ঠিত, সেসব দেশে রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠান হিসেবে অনেক বেশি শক্তিশালী। প্রতিষ্ঠান বলতে বোঝায়, রাজনৈতিক দলের আদর্শগত অবস্থান ও তার স্থায়িত্ব। জনগণ পার্টির ব্যবহার কী হবে, সে সম্পর্কে যদি নিশ্চিত থাকে, তাহলে দলের ওপর তাদের আস্থা জন্মায়। রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার ধরন সম্পর্কে জনসাধারণ নির্দিষ্ট ধারণা গড়ে তোলে। মানুষ যেহেতু পার্টির চরিত্র সম্পর্কে সঠিক ধারণা গড়ে তুলতে পারে, সেহেতু ওই পার্টির প্রতি তাদের আনুগত্য স্থায়ী হয়। রাজনৈতিক দলের গণভিত্তি গণতন্ত্রের জন্য জরুরি। সেই সঙ্গে দলীয় নেতৃত্বের প্রজ্ঞা ও দক্ষতাও গুরুত্বপূর্ণ। জনগণের স্বীকৃতি রাজনৈতিক দলের প্রাতিষ্ঠানিকতার একটি বড় দিক। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শক্তিশালী দলে মুষ্টিমেয় কয়েকজন দলকে নিয়ন্ত্রণ করে না। দল তাদের হাতে নির্ভরশীল থাকে না। বরং দলের স্থানীয় পর্যায়ের সদস্যরা দলের মূল কণ্ঠ হিসেবে পার্টির ওপর প্রভাব বজায় রাখে। সে কারণে দলের নেতৃত্ব নির্বাচনে ও নেতৃত্ব পরিবর্তনে সাধারণ সদস্যের ভূমিকা মুখ্য থাকা প্রয়োজন এবং নেতৃত্ব নির্বাচন ও পরিবর্তনকে নিয়মিতকরণ করা আবশ্যক। এ দিকটি বাংলাদেশে যথেষ্ট প্রশ্নবোধক হয়ে আছে।

কয়েকটি সিদ্ধান্ত

১। বাংলাদেশে রাজনৈতিক দল সংগঠনের চেয়ে একধরনের ব্যক্তিকেন্দ্রিক জনসমষ্টি, যারা ব্যক্তির দিকে তাকিয়ে একটি রাজনৈতিক ধারা অনুসরণ করে। রাজনৈতিক দলকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হবে। রাজনৈতিক দলের সদস্যপদ প্রথা শক্তভাবে অনুসরণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে রাজনৈতিক দলকে শক্তিশালী করতে হবে। দলের অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রায়ণ নিশ্চিত করতে হবে। স্বচ্ছ নির্বাচনের মাধ্যমে দলের নেতৃত্ব নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। সাধারণ সদস্যের অধিকারকে মূল্য দিতে হবে।

২। রাজনৈতিক সংলাপের প্রয়োজন রয়েছে, যদিও দুই জোটের মধ্যে বিভেদ গুরুতর। বিএনপি যে অবস্থানে আছে তাতে করে সংলাপ কঠিন। বঙ্গবন্ধুকে রাজাকার বলে বা স্বাধীনতার স্থপতিকে অস্বীকার করে বাংলাদেশের প্রকৃত ইতিহাসকে গ্রহণ না করে সংলাপ হওয়া কঠিন। বাঙালি জাতি শেখ মুজিবকে স্বাধীনতার সমার্থক হিসেবে দেখে। এ প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে একটি মেমোরেন্ডাম অব আন্ডারস্ট্যান্ডিং জাতীয়ভাবে তৈরি করতে হবে, যার প্রতি প্রতিটি রাজনৈতিক দল অনুগত থাকবে এবং নিজ নিজ গঠনতন্ত্রে স্বীকৃতি পাবে। এর জন্য সব রাজনৈতিক দলকে নিয়ে জাতীয় সম্মেলনের প্রয়োজন। যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে অস্বীকার করে, তাদের জাতিগঠন-প্রক্রিয়ায় রাখার কোনো প্রয়োজন দেখি না। বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় সব কর্মকাণ্ড মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে পরিচালিত হবে, যে চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল। এ বিষয়টি মেনে না নিয়ে কারও পক্ষে নৈতিকভাবে রাজনীতি বা সমাজনীতির ফ্রেমওয়ার্ক তৈরি করা নীতিবিরোধী হবে।

৩। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলকে বাকি প্রতিক্রিয়াশীল দলগুলো থেকে পৃথক হয়ে কেন্দ্র-ডানপন্থী দলে পরিণত হতে হবে। বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদী দলের প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু তার অভ্যন্তরে ডান এবং প্রতিক্রিয়াশীল যে প্রবণতা রয়েছে, তা থেকে তাকে দূরে সরে আসতে হবে। বিএনপিকে জামায়াত এবং অন্যান্য ইসলাম নাম ব্যবহারকারী দলের সঙ্গে সমর্থন ছেদ করতে হবে। বিএনপিকে উগ্র ডানের পরিবর্তে কেন্দ্র ডান পার্টি হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। একইভাবে আওয়ামী লীগকে জিয়ার অবদানকে কোনো না কোনো মাত্রায় বা পর্যায়ে স্বীকৃতি দিতে হবে। আওয়ামী লীগের আদর্শিক অবস্থানে পরিবর্তনের প্রয়োজন তেমন নেই। যেহেতু তার অভ্যন্তরে কেন্দ্র বাম ঝোঁক সুপ্রতিষ্ঠিত।

৪। রাজনৈতিক দলের গণতন্ত্রীকরণ প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা এবং সাংবিধানিক সংস্কৃতি জোরদার করা। গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোকে জোরদার করা।

৫। নাগরিক সমাজের বিরাজনীতিকীকরণ আবশ্যক। তাকে সত্যিকার অর্থে রাজনীতি ও অর্থনীতির মধ্যবর্তী অবস্থান গ্রহণের সুযোগ দিতে হবে।

৬। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধকরণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। ছাত্ররাজনীতি আজ টেন্ডারবাজি, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, হলের সিট বরাদ্দের ওপর নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদিকে বোঝায়, যা গণতন্ত্রের বিকাশে বাধাস্বরূপ।

৭। আমলাতন্ত্রকে নিরপেক্ষ ও দলীয়করণের অভিশাপ থেকে মুক্ত করে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন পেশাদারি একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড় করাতে হবে।

৮। সুশাসন প্রতিষ্ঠার প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। নিরপেক্ষ ন্যায়পালব্যবস্থা চালু করা, যারা নাগরিকদের বিভিন্ন অভিযোগের মীমাংসা করবে। এটি প্রতিটি সরকারি বিভাগের জন্য প্রযোজ্য হবে।

৯। জাতীয় নির্বাচন কমিশনকে নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। বিচার বিভাগীয় প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা এবং নিরপেক্ষতার প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ। সংসদীয় কমিটিগুলোকে (ব্যয় হিসাব কমিটি, আইন কমিটি ইত্যাদি) কার্যকর করে গড়ে তুলতে হবে।

গ্রন্থপঞ্জি

Alfred C. Stepan, Religion, Democracy, and the ‘Twin Tolerations', Journal of Democracy, Volume 11, Number 4, October 2000, pp.37-57.

Aguero, Felipe and Jeffrey Stark (ed) Fault Line of Democracy in Post-Transition Latin America, North-South Centre Press, University of Miami, 1998.

Andreas Schedier, The Democratic Revelation, Journal of Democracy, Volume 11, Number 4, October 2000, pp. 5-19.

Betham, David, 1994, `Liberal Democracy and the Limits of Democratisation' in Held, David (ed). Prospects for Democracy : Noth, South, East, West. Stanford : Stanford University Press, 55-73.

Cardoso, Fernando Henirique, Democracy in Latin America, in : Politics and Society, 1986, 15 : 23.

Carothers, Thomas The `sequencing' Fallacy, Journal of Democracy Vol 18, Number 1, January 2007, pp. 12-27.

Carothers, Thomas, The End of Transition Paradigm, Journal of Democracy 13 (1) 2002, p.11.

Carothers, Thomas. The `Sequencing' Fallacy, Journal of Democracy, Volume 18, Number 1, January 2007.

Carole, Pateman Particiption and Camocratic Theory, Cambridge, Cambridge University Press, 1974.

Chadda, Maya, Building Democracy in South Asia, Lynne Rienner Publishers London, 2011.

Croissant, Aurel and Marco Bunte (ed) The Crisis of Democratic Governance in Southeast Asia, London, Palgrave macmillan,

Dahl, Robert A. On Democracy, New Haven and London : Yale University Press, 1998.

Diamond Larry and Others, Reconsidering the Transition Paradigm, Journal of Democracy, Volume 25, Number 1, January 2014.

Diamond, Larry, Developing Democracy : Towards Consolidation, Baltimore, John Hopkings University Press, 1999.

Diamond, Larry, The Spirit of Democracy : The Struggle to build free societies throughout the world, Henry Holt and Company, New York, 2008.

Fukuyama, Cardoso, Fernando Henrique Democracy in Latin America, Politics Society, 1986, 15:23

Guillermo O'Donnell, Horizontal Accountability in New Democracy, Journal of Democracy, 9.3 (1998) pp. 112-126.

Huntington, Samuel P. `Democracy for the Long haul, Journal of Democracy, 7, no. 2 (1996) : 5.

Huntington, Samuel P. Democracy's Third Wave, University of Oklahoma Press, 1991.

Huntington, Samuel P. Democracy's Third Wave, Journal of Democracy Vol. 2. No. 2, Spring 1991.

Jackson. Roy. Nietzsche and Islam, Routledge, London, 2007

Jaffrelot, Christophe, 2002. India and Pakistan : Interpreting the Divergence of Two political Trajectories, Cambridge review of International Affairs 15(2) : 251-267.

Jalal Ayesha, Democracy and Authoritarianism in South Asia : A Comparative and Historical Perspective, Cambridge : Cambridge University Press, 1995.

Kurt Weyland, Neopopulism and Neoliberalism in Latin America : how much affinity? Third World Quarterly, Vol. 24, No. 6, pp. 1095-1115.

King, Geoffrey D. Varieties of Neoliberalism in Latin America, paper presented at Integrative Exercise Winter conference, 2010.

Kurt, Weyland, Neopoulism and Neoliberalism in Latin America : how much affinity? In Third World Quarterly, Vol. 24, No. 6. pp. 1095-2003.

Islam, Nazrul (1999) Urbanisation Migration and Development in Bangladesh : recent Trends and Emerging Issues, Centre for Policy Dialogue (125-146).

Laurence Whitehead, Strrings of Mutual Recognition, Journal of Democracy, Volume 11, Nember 4, October 2000, pp. 65-79.

Lechner, Norbert (1998) The Transformations of Politics in : Felipe Aguero and Jeffrey Stark (ed) Faultiness of Democracy in Post-Transition Latin America, University of Miami, North-South Center Press.

Lipset, Seymour Martin. 1959. Some Social Prerequisite of Democracy : Economic Development and Political Legitimacy. American Political Science Review, 53 (March); 69-105.

Marwah, Fransis, Sanjay Dimension of Development, Journal of Democracy, Volume 11, Number 4, October 2000, pp. 80-94.

Moore, Barrington. Social Origin of Dictatorship and Democracy. London : Allen Lane, 1966.

Muhlberger, Steve, Democracy in Ancient India. downloaded from internet, 2015.

Muller, Jorgen and Svend-Erik Skaaning, The Third Wave : Inside the Numbers, Journal of Democracy, Volume 24, Number 4, October 2013.

New York Times March 23, 2009 NAFTA's Promise Unfulfilled

Phillp Oldenburg, India, Pakistan, and Democracy (Solving puzzle of divergent path) NY Routledge, 2010.

Plattner, Marc F. Populism, Pluralism, and Liberal democracy, Journal of Democracy, Volume 21, Number 1 Junuary 2010, pp. 81-92.

Patricio Aylwin, Democracy in the Americas, Journal of Democracy, 9.3 (1998), pp.3-6.

Raby, D.L. Democracy and Revolution : Latin America and Socialism

Today, London, Pluto Press, 2006.

Robert Goodin, Global Democracy : in the beginning, International Theory (2010) 2.2, pp. 175-209.

Schumpeter, Joseph. Capitalism, Socialism and Democracy. New York : harper Collins. 1975.

Shifter, Michael. 2011. Latin America : a Surge to the Center, Journal of Democracy, Volume 22, Number 1, January, 107-121.

Siegle, Joseph T. Michael M. Weinstein, and Morton H. Halperin. Why Democracy Excel, Foreign Affairs, September/October 2004.

Sorensen, George. Democratisation in the Third World, The Role of Western Politics and Research, Purdue University, West Lafayette, February 25-27, 1998.

Stern, Robert W. Democracy and Dictatorship in South Asia : Dominant Classes and Political Outcomes in India, Pakistan and Bangladesh, Westport, Connecticus, and London : Praeger, 2010.

Stockton, David The Classical Athenian Democracy, Oxford, Oxford University Press, 2002, Page 165.

Terry Lynn Karl (1990) `Dilemmas of Democratisation in Latin America', Comparative Politics, Vol 23, No 1, pp. 1-21.

Vali Nasr The Rise of `Muslim Democracy', Journal of Democracy, Volume 16, Number 2, April 2005.

Varshney. Ashutosh Why Democracy Survives, Journal of Democracy 9:3 (1998) 36-50.

Wittes, Tamara Cofman, Islamist Parties : Three Kinds of movements, Journal of Democracy. Vol. 19, Number 3, July 2008, pp. 7-27.

Wucherpfenning Julian and Deutsch Franziska. Modernisation and Democracy : Theories and Evidence Revisited, Living Reviews in Democracy, Vol 1 (2009).