প্রাচীন ও মধ্যযুগে বাংলার শিক্ষাব্যবস্থা এবং শূদ্র সম্প্রদায়

ভারতে প্রাচীনকালে সর্বসাধারণের জন্য শিক্ষার দ্বার উন্মুক্ত ছিল না। শিক্ষা ছিল কেবল শাসক, পুরোহিত ও সুবিধাপ্রাপ্তদের জন্য। চতুর্বর্ণের সর্বনিম্ন স্তরে থাকা শূদ্রদের এবং সকল বর্ণের নারীদের, শিক্ষার আঙিনায় প্রবেশাধিকার দেওয়া হয়নি। প্রাচীন ভারতে শূদ্ররা ছিল জনসংখ্যার সবচেয়ে বড় অংশ। তাদের সবার জন্য মন্ত্র উচ্চারণ ছিল নিষিদ্ধ। প্রাচীন ভারতে বেদ পাঠ ছিল শিক্ষালাভের একটি প্রধান দিক।

প্রাচীন ভারতের শিক্ষার বিষয় নিয়ে নানা মতভেদ রয়েছে। এই কালপর্বে শিক্ষা যেমন সর্বজনীন ছিল না, তেমনি শিক্ষাব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিক রূপও বহুকাল পর্যন্ত লক্ষ করা যায় না। মহাভারত থেকে জানা যায়, উপনয়নের পরই শিক্ষার শুরু। হিন্দু শাস্ত্রে উল্লেখিত ষোড়শ সংস্কারের অন্যতম হলো উপনয়ন। উপনয়ন সংস্কার না হওয়া পর্যন্ত কেউ দ্বিজ হতে পারে না। দ্বিজ কথাটার অর্থ হলো দ্বিতীয় জন্ম। দ্বিজত্ব লাভের সারকথা হলো ব্রহ্মচর্যের সঙ্গে পরিচয়। দ্বিজত্বপ্রাপ্তির মানে তাই শিশুর প্রথম জন্ম পিতামাতার দ্বারা, আর দ্বিতীয় জন্ম গুরুর কাছে শিক্ষালাভের মাধ্যমে। উপনয়নের মাধ্যমে গুরু আনুষ্ঠানিকভাবে শিষ্যকে শিক্ষা দিতে শুরু করেন। উপনয়ন-কালে নতুন শিষ্যকে মূলত গায়ত্রী মন্ত্র শেখানো হয়। প্রাচীন সমাজে উপনয়ন সংস্কার ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। এই অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়েই সমাজের নানা কাজে যুক্ত হওয়ার অধিকার জন্মাত বর্ণহিন্দুর। উপনয়নের মাধ্যমে দ্বিজত্ব লাভ করলে তবেই বেদবিদ্যা অধ্যয়নের অধিকার জন্মায়। সুপ্রাচীনকালে উপনয়নই ছিল বিদ্যারম্ভের একমাত্র বা প্রধান সংস্কার।

প্রাচীন ভারতের শিক্ষায় তাই উপনয়নের স্থান ছিল সর্বাগ্রে। দ্বিজত্ব লাভ বা উপনয়নের মধ্য দিয়েই একটি বালক সমাজের পূর্ণসদস্য হয়েছে বলে গণ্য করা হতো। উপনয়ন সংস্কারের জন্য নির্ধারিত বয়স ব্রাহ্মণের জন্য আট, ক্ষত্রিয়ের ১১, আর বৈশ্যদের বেলায় ১২। উপনয়নের পর শিক্ষার্থী একজন ব্রাহ্মণ গুরুর গৃহে কয়েক বছর থেকে শিক্ষা অর্জন করত। পণ্ডিতগণ উপনয়ন অনুষ্ঠানের আরেকটি অর্থ করেছেন, এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শিক্ষার্থী ব্রত, সংযম, নিয়ম, গুরু ও দেবতার সংস্পর্শে আসতেন। ব্রহ্মচর্যকালে শিক্ষার্থীর বেশভূষা বলতে ছিল নিম্নাঙ্গে বাস, ঊর্ধাঙ্গে অজিন, মুণ্ডিত মস্তক, দণ্ডধারী ব্রহ্মচারীর বেশ। দণ্ড ধারণের অর্থ হলো শিক্ষাজীবনে দীর্ঘ পরিক্রমার জন্য প্রয়োজনীয় অবলম্বন। এ ছাড়া থাকত যজ্ঞোপবীত বা পৈতা। উপনয়ন অনুষ্ঠানে অগ্নিকুণ্ড প্রজ্বলিত করে নাম ও জন্মপরিচয় দিয়ে নবীন শিক্ষার্থী গুরুর কাছে শিষ্যত্বলাভের আবেদন জানাতেন। শিক্ষাজীবনে একনিষ্ঠ থাকার শপথ নিতে হতো শিক্ষার্থীর। এই অনুষ্ঠানে শিষ্যের উদ্দেশ্যে গুরু যা বলতেন তার ভাবার্থ এ রকম: তাঁর হূদয়ের সঙ্গে শিষ্যের হূদয়ের যোগসূত্র স্থাপিত হোক, শিষ্যের অন্তর গুরুর অনুগামী হোক এবং গুরুতেই যেন শিষ্যের অবিচল মতি থাকে, শিষ্যের চিন্তা-ভাবনা-শ্রদ্ধা সবকিছু যেন গুরুতেই কেন্দ্রীভূত হয় ইত্যাদি। শিক্ষার প্রধান অবলম্বন ছিল বেদ।

বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই শিক্ষার্থীর কাছে বেদসংহিতা ছিল কিছু দুর্বোধ্য মন্ত্রের সংকলন। সব মন্ত্রের অর্থও সবার জানা ছিল না। খুব চমত্কার ভাষায় পরিব্রাজক আল বিরুনি লিখেছেন, ব্রাহ্মণরা বেদ আবৃত্তি করেন না বুঝেই এবং তা কণ্ঠস্থ করেন লোক পরম্পরায় শুনে শুনে। ঋষিদের মধ্যে এমন লোক অল্পই রয়েছেন, যাঁরা বেদের ব্যাখ্যা করতে পারেন। ব্রাহ্মণরা ক্ষত্রিয়দের বেদ শিক্ষা দেন। ক্ষত্রিয়রা বেদ শিক্ষা নিতে পারেন কিন্তু শিক্ষা দেওয়ার অধিকার তাঁদের নেই। বেদ শিক্ষা দেওয়ার একমাত্র অধিকার সংরক্ষণ করেন ব্রাহ্মণরা। প্রাচীনকালে বেদ লেখার অনুমতি দেওয়া হতো না। কারণ, বেদপাঠ করার সুনির্দিষ্ট সুর ও পদ্ধতি রয়েছে। বেদ লেখনী পরিহার্য বলেই বিবেচিত হয়। কারণ, তাতে ভুল-ত্রুটি থাকা সম্ভব এবং লিখিত পাঠে সংযোজন এবং বিয়োজন ঘটতে পারে।৩ ফলে বেদ শুধু মুখস্থই রাখতে হবে। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগবে, বেদপাঠে কেন শূদ্রদের অধিকার নেই? ঋগ্বেদ-এর দশম মণ্ডলের পুরুষসূত্রে বলা হয়েছে, ব্রহ্মার শির থেকে ব্রাহ্মণের জন্ম, রাজা বা ক্ষত্রিয়র জন্ম বাহু থেকে, বৈশ্য তার জঙ্ঘা থেকে ও শূদ্র তার পদযুগল থেকে সৃষ্ট। ব্রহ্মার পদযুগল থেকে সৃষ্ট—তাই শূদ্র খুবই নিম্নজাতের, এ কারণেই তার বেদপাঠে অধিকার নেই। বিদেশি পর্যটক আল বিরুনির রচনায় এ বিষয়ে বিশদভাবে বলা হয়েছে। তিনি লিখেছেন, হিন্দুধর্মে মানুষকে চার বর্ণে বিভক্ত করা হয়েছে, যা চতুর্বর্ণ নামে পরিচিত। সর্বোচ্চ বর্ণ হলো ব্রাহ্মণ। প্রাচীন ভারতে সৃষ্ট এই বর্ণভেদ-প্রথা তার শিক্ষাব্যবস্থার ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। এই প্রথার ফলেই শিক্ষাব্যবস্থা দীর্ঘকাল ধরে সর্বজনীন চরিত্র লাভ করতে পারেনি। সর্বনিম্ন বর্ণের শূদ্রদের বেদ উচ্চারণ বা আবৃত্তি করা তো দূরের কথা, বেদপাঠ শোনার অধিকার পর্যন্ত ছিল না।   

প্রাচীন ভারতে শিক্ষার্থীদের কঠোর নিয়মকানুন মেনে চলতে হতো। ছাত্রাবস্থায় ব্রহ্মচর্য পালন বাধ্যতামূলক ছিল। সংস্কৃত উচ্চশিক্ষা বা ব্রাহ্মণ্য শিক্ষাব্যবস্থার মূল বা চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল শিক্ষার্থীর আত্মিক উন্নতি সাধন। ব্রাহ্মণ্য শিক্ষাধারা জাতি বা বর্ণভিত্তিক সামাজিক শ্রেণীবিন্যাসকে লোকমানসে মান্যতা দিতে কার্যকর সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল। শিক্ষাব্যবস্থায় ব্রাহ্মণের একাধিপত্যের জোরে ধর্মের অভিভাবক হিসেবে ব্রাহ্মণরা সব ধর্মীয় ও সামাজিক রীতি, নীতি ও আচার-অনুষ্ঠানের টীকাকার, ব্যাখ্যাকার ও ভাষ্যকার হয়ে উঠেছিলেন। ভূস্বামী বা জমিদার শ্রেণী স্বাভাবিক কারণেই নিজেদের শ্রেণীস্বার্থে নিষ্কর ভূমিদান করে এই ব্রাহ্মণ সমাজকে সামাজিক স্থিতাবস্থা বজায় রাখার কাজে ব্যবহার করত। ব্রাহ্মণরা কার্যত রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের আবশ্যিক বিশেষ অঙ্গ হিসেবে দমনমূলক প্রশাসনিক পদ্ধতির প্রয়োজনীয়তা হ্রাস করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। তাদের আনুগত্যের অনুশাসন প্রশাসনিক ব্যয় কমাতেও সাহায্য করেছিল। সামন্ততান্ত্রিক সমাজে জাতি বা বর্ণভেদব্যবস্থা বিশেষ বলপ্রয়োগ ছাড়াই শ্রমজীবী মানুষকে কৃষি উত্পাদনব্যবস্থায় নিযুক্ত রাখার প্রশাসনিক ভূমিকা পালন করত। সন্দেহ নেই, ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও সংস্কৃত শাস্ত্রীয় শিক্ষাধারা রাষ্ট্রের প্রশাসনিক অঙ্গ হিসেবে, শোষণমূলক সামাজিক স্তরভেদকে টিকিয়ে রাখতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল।

ভারতীয় শিক্ষাধারা ছিল গুরুমুখী, শুনে শেখার ঐতিহ্য। কারণ, বেদ কণ্ঠস্থ করতে হতো এবং মুখস্থ রাখতে হতো। ছাত্রদের জন্য কোনো গ্রন্থ ছিল না। তাই বই পড়ে বেদ মুখস্থ করা চলত না। জোর গলায় পাঠ করা এবং বেদবর্ণ কর্ণগোচর করা বেদ-অধ্যয়নের অঙ্গ এবং গুরুর কাছে শুনেই তা করতে হতো। শ্রবণ হলো শিক্ষক বা গুরু কর্তৃক উচ্চারিত শব্দ বা পাঠ্যবিষয়। এই ব্যবস্থাটিকে ‘গুরু-শিষ্য পরম্পরা’ বলা হয়। গুরুর কাছ থেকে শিষ্য, শিষ্য থেকে তার শিষ্য—এই রূপে পরম্পরায় জ্ঞান প্রবাহিত ও সংরক্ষিত হতো। এই কারণে সে যুগে জ্ঞান গ্রন্থনাকে বলা হতো ‘স্মৃতি’ বা ‘শ্রুতি’। অর্থাত্ যা স্মৃতিতে ধরে রাখা হয়েছে বা যা শোনা গেছে। গুরুর মুখে শুনে শুনে শিক্ষালাভের আর একটি উদ্দেশ্য হলো, শিক্ষার সুযোগ সীমাবদ্ধ করে রাখা। এতে শূদ্ররা শিক্ষালাভের সব ধরনের সুযোগ হারাল। পাঠদানের লিখিত পদ্ধতি বা গ্রন্থ না থাকায় শূদ্ররা চাইলেও লুকিয়ে এই শিক্ষালাভ করতে পারত না। ঠিক এভাবে সমাজের বিরাট এক অংশকে শোষণ করার জন্য প্রাচীন ভারতে ব্রাহ্মণ্য শিক্ষাব্যবস্থা প্রথম থেকেই চাতুর্যের পথ গ্রহণ করেছিল, পরবর্তী সময়ে যা শূদ্রদের জন্য শাপে বর হয়েছিল।

ব্রাহ্মণ্য যুগে ভারতের শিক্ষাব্যবস্থা আবর্তিত হয়েছিল যজ্ঞানুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে। বর্ণাশ্রম প্রথা এবং চতুরাশ্রম ব্যবস্থা এই যজ্ঞানুষ্ঠানকে এক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ চরিত্র দান করেছিল। সংস্কৃত উচ্চশিক্ষার লক্ষ্য ছিল জ্ঞান আহরণ। প্রকৃত জ্ঞান বলতে বোঝানো হতো আত্মনিবেদনের মাধ্যমে পরমাত্মায় বিলীন হওয়া। আত্মনিবেদন বা আত্মোত্সর্গের শিক্ষা বলতে পিতৃঋণ, দেবঋণ, ঋষি বা গুরুঋণ পরিশোধের জন্য যজ্ঞানুষ্ঠান, অধ্যয়ন প্রভৃতি কর্তব্য সম্পাদন করাকে বোঝানো হতো। বেদ কথাটার সঠিক অর্থ হলো অজ্ঞাত কিছুর সম্বন্ধে সঠিক জ্ঞান আহরণ। হিন্দুদের মতে, বেদ হলো ধর্মশাস্ত্র, যা ঈশ্বরের কাছ থেকে প্রাপ্ত। ঠিক এই রকম বক্তব্য দানের মধ্য দিয়েই বেদের বিধানকে তাঁরা অনড় করে তুলতে চেয়েছিলেন। ব্রাহ্মণ ঋষিরা শিক্ষাজীবনকে এক অপরিবর্তনীয় সর্বজনীন জীবনধারার সমার্থক বলেই মনে করতেন। আর এই জীবনধারা গ্রথিত হয়েছিল ব্রহ্মচর্যের বাঁধনে। গুরুর আশ্রমে প্রাচীন ঋষিরা শিষ্যকে পুত্র, স্বামী এবং পিতা হিসেবে কী কী কর্তব্য পালন করতে হবে সে সম্পর্কে শিক্ষা দিতেন। দণ্ডনীতি, ধনুর্বেদ, সামাজিক বিধি-বিধান এবং বিভিন্ন বৃত্তিমূলক শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল সমাজজীবনের বিচিত্র কর্মকাণ্ডের কথা মনে রেখে। একদিকে পরমজ্ঞান, সত্যোপলব্ধি এবং অন্যদিকে পার্থিব দায়িত্ব পালন—এই দুই লক্ষ্য পূরণের জন্য গুরুগৃহে-তপোবন আশ্রমে বিদ্যাকে দুভাবে পরিবেশন করা হতো—পরাবিদ্যা ও অপরাবিদ্যা। ‘পরাবিদ্যা’ হলো পরমজ্ঞান লাভের জন্য তিন বেদ ছয় বেদাঙ্গ অনুশীলন করা; আত্মসংযম এবং যোগসাধনা দ্বারা এই বিদ্যা অর্জন করতে হতো। আর ‘অপরাবিদ্যা’র অর্থ হলো পার্থিব জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় দায়িত্ব পালনে যা কিছু প্রয়োজন তার অনুশীলন করা। বৈদিক শিক্ষা এই ‘পরা’ ও ‘অপরা’ বিদ্যার সমন্বয় ছিল।

প্রাচীন শিক্ষাব্যবস্থায় স্মৃতির উন্নতি সাধন করা ছিল সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সেই সময়কার শিক্ষায় বাচনিক স্মৃতির ক্ষমতা এত বেশি উত্কর্ষ লাভ করেছিল, যা আধুনিক কালে অবিশ্বাস্য বলে মনে হয়। গুরুর মুখে শুনে বেদ কণ্ঠস্থ করার মধ্যে যত দিন শিক্ষা সীমাবদ্ধ ছিল তত দিন অবশ্যই অন্তত ব্রাহ্মণদের প্রাক্-উপনয়ন শিক্ষার তেমন দরকার ছিল না। শিক্ষার সীমা প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে লেখার ও গ্রন্থের গুরুত্ব অবশ্যই বাড়তে লাগল। ক্রমে বেদ ছাড়াও অন্যান্য বিষয় শিক্ষার অঙ্গীভূত হলে লিখিত বিষয়ের অধ্যয়ন ও চর্চা চালু হয়। সেই সঙ্গে প্রাক্-উপনয়ন লেখাপড়ার প্রথা সীমাবদ্ধভাবে হলেও চালু হয়েছিল বলেই মনে হয়। প্রাচীন স্মৃতির যুগে লেখার যথেষ্ট প্রচলন ছিল সন্দেহ নেই। তবে তা রাজকার্যেই বেশি প্রচলিত ছিল, শাস্ত্রচর্চায় নয়। ধর্মসূত্র এবং গৃহ্যসূত্র-এর সাক্ষ্যে মনে হয় ব্রাহ্মণদের মধ্যে লেখা বা গণিত শেখার প্রথা বিশেষ ছিল না। কিন্তু প্রাচীন ভারতে গণিতশাস্ত্রের চর্চা যথেষ্ট এগিয়ে ছিল। বিশেষ করে জ্যোতির্বিদ্যা ও গণিতে যে অগ্রগতি ঘটেছিল তার প্রমাণ, হিন্দুরাই প্রথম ‘শূন্যে’র আবিষ্কারক। গণিতবিদ্যা যে সব বিদ্যার শ্রেষ্ঠ, বৈদিক সাহিত্যের একাধিক স্থানে তার উল্লেখ পাওয়া যায়। সহজ ভগ্নাংশের যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগের সঙ্গে বৈদিক হিন্দুরা পরিচিত ছিল। কিন্তু ব্রাহ্মণ্য শিক্ষাব্যবস্থায় গণিতের বা লিপির ব্যবহার ছিল না। ভারতে ব্যবহূত প্রাচীনতম সংখ্যালিপির যে নমুনা পাওয়া যায় তা খরোষ্ঠী ও ব্রাহ্মী। অশোকের শিলালিপিতে এই উভয়বিধ সংখ্যালিপির নিদর্শন মেলে। সমাজব্যবস্থাকে অনড় রাখার জন্য ব্রাহ্মণরা লিপির ব্যবহার না করে শূদ্রদের বেদ শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করেছিল। কিন্তু দেখা যায়, বেদ পাঠের অধিকার না থাকলেও শূদ্ররা ভিন্ন ধারার এক শিক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়। সব শূদ্র নয়, শূদ্রদের একটি অংশ। ব্রাহ্মণদের বেদ শিক্ষায় দেখা গেছে সেখানে লেখা বা অক্ষর শেখার ব্যাপার ছিল না। শিক্ষা ছিল শ্রুতি এবং স্মৃতির ওপর নির্ভরশীল। অথচ শূদ্রদের শিক্ষাধারায় লেখা এবং পড়া দুটোরই স্থান ছিল। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন আসতেই পারে নিম্নবর্ণের পক্ষে কী করে সেটা সম্ভব হলো?

শূদ্রদের পড়াশোনার ব্যাপারটা যে হঠাত্ ঘটে গিয়েছিল তা নয়। ধীরে ধীরে বিবর্তনের পথেই সেটা হয়েছিল। ভারতে মহাবীরের জৈনধর্ম এবং সিদ্ধার্থের বৌদ্ধধর্ম প্রচার প্রধানত ছিল একটি রাজনৈতিক ঘটনা। ক্ষত্রিয়রা শাসক হলেও সমাজে তাদের অবস্থান ছিল দ্বিতীয় স্তরে। ক্ষত্রিয় হিসেবে মহাবীর এবং বুদ্ধ কেউই ব্রাহ্মণদের এই আধিপত্য মেনে নিতে চাননি। কিন্তু তাঁরা জানতেন ব্রাহ্মণ্যধর্মের বিরুদ্ধে নতুন কোনো ধর্মমত প্রচার না করে তাকে প্রতিহত করা যাবে না। ভারতে জীব হত্যা নিয়ে প্রাচীনকাল থেকেই প্রশ্ন উঠেছে। ধর্মের নামে সেই একই প্রশ্ন তুলেছিলেন মহাবীর এবং বুদ্ধ। ভারতের মন্দিরে মন্দিরে গো হত্যার উত্সব ছিল একদা। পশু বলি পূজার প্রধান অঙ্গ ছিল। মন্দিরে মন্দিরে পশু বলির মহা-উত্সবের কারণে হালচাষের জন্য পশুর অভাব দেখা দিয়েছিল। মহাবীর তখন জীবহত্যা নিষেধ করলে সাধারণ কৃষকেরা খুব খুশি হয় এবং মহাবীরের ধর্মমত ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। কিছুদিন পর দেখা গেল, জীব হত্যার ব্যাপারে মহাবীরের নিষেধের কারণে চাষের জমিতে পোকামাকড় বা ইঁদুরের উপদ্রব দেখা দিলেও সেগুলোকে মেরে ফেলা যাচ্ছে না। জীব হত্যা নিষেধে গরু রক্ষা পেল ঠিকই, কিন্তু খেতের ফসল নষ্ট হতে লাগল পোকামাকড় ধ্বংস করতে না পারায়। কৃষকদের সেই সংকটে বুদ্ধ নতুন মত, ধর্মের নতুন বাণী প্রচার করলেন। তিনি জীব হত্যা নিষেধ করলেন না। বললেন, অকারণে জীব হত্যা কোরো না। সে কারণেই বুদ্ধদের একটি সম্প্রদায় মাংস খেয়ে থাকে। বুদ্ধের নতুন বাণীতে গো হত্যা যেমন রোধ করা গেল, তেমনি ফসলের খেতের পোকামাকড় হত্যায় কোনো বাধা রইল না। বুদ্ধের ধর্মমত তাই মহাবীরের চেয়ে বহুগুণ বেশি সাফল্য লাভ করে।

ভারতে বৌদ্ধধর্মের আবির্ভাব শূদ্রদের লেখাপড়ার পথকে সুগম করে দিয়েছিল। বৌদ্ধধর্ম বর্ণপ্রথার বিরোধিতা না করলেও সকল বর্ণের মানুষকে সম্মান দিতে কুণ্ঠিত হয়নি। বৌদ্ধধর্মের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিল বৈশ্যরা। নালন্দার বৌদ্ধবিহার প্রতিষ্ঠার জন্য ৫০০ বণিক ১০ কোটি স্বর্ণমুদ্রা ব্যয় করে একটি ভূমিখণ্ড ক্রয় করে বুদ্ধকে দান করে বলে হিউয়েন সাঙ উল্লেখ করেছেন।১০ ব্রাহ্মণ্যধর্মের বিরুদ্ধে বুদ্ধের মতকে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার ব্যাপারে বৈশ্য বা বণিক সম্প্রদায়ের বিরাট ভূমিকা ছিল। কারণ বুদ্ধ শূদ্র ও বৈশ্যদের স্বার্থকে রক্ষা করেছিলেন। ইতিহাসের গতিপথের কিছু দ্বান্দ্বিক নিয়ম রয়েছে। শূদ্রদের লেখাপড়া শেখার ক্ষেত্রে সেই দ্বান্দ্বিক নিয়ম কাজ করেছিল। প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের এক পর্বে ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়রা কায়িক পরিশ্রম থেকে সরে দাঁড়ালে চাষাবাদের দায়িত্ব পুরোটাই এসে পড়ে বৈশ্য ও শূদ্রদের ওপর। ফলে ইতিহাসের দ্বান্দ্বিক নিয়মেই শূদ্রদের ওপর ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়দের নির্ভরশীলতা বাড়তে থাকে। শূদ্রদের উত্পন্ন দ্রব্য না পেলে ব্রাহ্মণদের চলে না। প্রাচীনকালের কোনো এক পর্বে যেসব শূদ্র প্রধানত গৃহভৃত্য, দাস, কারিগর ও কৃষিশ্রমিক ছিল, আদি মধ্যযুগে তাদের কৃষক হিসেবে রূপান্তর ঘটে।

হিউয়েন সাঙ শূদ্রদের দেখেছেন কৃষিজীবী হিসেবে। বিভিন্ন পুঁথিতেই তাদের কৃষক বলা হয়েছে। কৃষির প্রসার কৃষিমজুর বা কৃষকের সংখ্যা বাড়ায়। শূদ্ররা এই পেশায় যোগ দিতে থাকে। একটা পেশাগত পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। সামাজিক পরিবর্তনের সঙ্গেই অবশ্য শিক্ষার পরিবর্তন ঘটেছে। বারো শতকে কল্হনের বিবরণে দেখা যায়, পথে পাওয়া একটি বাচ্চাকে শূদ্রা-ধাত্রী মানুষ করে। লেখাপড়া শিখে সে কোনো এক গৃহস্থের বাড়িতে শিশুদের জন্য শিক্ষক নিযুক্ত হয়। দুই দিক দিয়ে ঘটনাটি উল্লেখযোগ্য। প্রথমত, শূদ্রা-ধাত্রীর কাছে মানুষ হয়েও সে লেখাপড়া শিখেছে এবং দ্বিতীয়ত, সে গৃহশিক্ষকের কাজ করে। সেকালে শূদ্রের পড়ালেখা শেখা তাহলে একেবারে অসম্ভব ছিল না। বরং শূদ্রদের মধ্যে লেখা, পড়া আর গণিত শেখার রেওয়াজ কিছুটা চালু হচ্ছিল। ধনী বৈশ্য বা শূদ্ররা বৃত্তিমূলক শিক্ষা গ্রহণেই আগ্রহী ছিল। কারিগরি বা বৃত্তি শিক্ষণের ব্যবস্থা থাকত বণিক সংঘের কাছে বা নির্দিষ্ট পরিবারের ওপর। জীবিকার জন্য প্রয়োজনীয় বিদ্যাটুকুই সাধারণত তারা শিখত। বর্ণমালার সঙ্গে সঙ্গে এসব শিশুকে সাধারণ গণিত শেখানো হতো। এ ধরনের শিক্ষার পৃষ্ঠপোষক ছিল বণিক, গ্রাম্য করিগর ও কৃষকেরা। এই শিক্ষায় লেখার গুরুত্ব ছিল অনেক বেশি। সে কারণেই ছাত্রদের অক্ষর চিনতে হতো, নিরক্ষর হলে চলত না। সন্দেহ নেই তখনো জনশিক্ষার প্রচলন হয়নি। ব্যবসা-বাণিজ্য ও কৃষির প্রসার শূদ্রদের জন্য লেখাপড়ার সুযোগ সৃষ্টি করে এবং একটা পেশাগত পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। কিন্তু এতে নিশ্চিত সিদ্ধান্তে আসা যায় না যে প্রাচীন ভারতে শিক্ষার কোনো সাধারণ প্রথাবদ্ধ ধারা গড়ে উঠেছিল। প্রধানত ব্রাহ্মণ ও উচ্চবর্ণের মধ্যেই পড়াশোনা সীমাবদ্ধ ছিল।

রামশরণ শর্মা মনে করেন যে গুপ্ত সাম্রাজ্যে শূদ্রের অবস্থা তুলনামূলক কিছুটা ভালো হয়েছিল। বৈদিক যুগে শূদ্রদের কাজ ছিল মূলত দ্বিজগণের সেবা করা। রামশরণের মতে, মৌর্য আমলে অবস্থার কিছু পরিবর্তন হলেও গুপ্ত আমলেই শূদ্রদের অনেককে কৃষিকাজ, বাণিজ্য ও শিল্পকর্ম করতে দেখা যায়। প্রাচীন স্মৃতিশ্রাস্ত্রে এগুলো যদিও বৈশ্যের করণীয় কাজ বলে বিবেচিত। গুপ্ত আমলে বৈশ্যবৃত্তি অবলম্বন করে অনেক শূদ্র বেশ ধনী হয়ে ওঠে। এমনকি অনেক ব্রাহ্মণ এসব ধনী শূদ্রকে বেশ সমীহ করত। শূদ্রের শিক্ষা সম্পর্কে সমাজ অনেকটা উদারনীতি গ্রহণ করতে থাকে। ফলে শূদ্রদের মধ্যে লেখাপড়া শেখার প্রচলন দেখা যায়। কিন্তু সেটা ঠিক বেদ শিক্ষা নয়। হিসাবপত্র রাখা, চিঠিপত্র লেখার মতো দৈনন্দিন প্রয়োজনের শিক্ষা। কিছু কিছু ক্ষেত্রে গুপ্তযুগের পর থেকে সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে বৈশ্য ও শূদ্র পরস্পরের কাছাকাছি এসে যায়। বৈশ্য ও শূদ্র উভয়ই যেহেতু কৃষক নামে অভিহিত হতো, তাদের মধ্যে পার্থক্য খুব বেশি ছিল না। শূদ্রের জন্য নির্দেশিত অনেক ঘরোয়া আচার-অনুষ্ঠান, ধর্মীয় ব্রত ও তীর্থযাত্রার মাধ্যমে সাধারণ ব্রাহ্মণ ও নিম্নকোটির পুরোহিত বর্গের দান-দক্ষিণার সংস্থান হয়। শূদ্ররা রামায়ণ, মহাভারত ও পুরাণ পাঠ শোনার অধিকারী হয়।১১ গুপ্তযুগে বৈশ্য ও শূদ্রের মধ্যে লেখাপড়ার রেওয়াজ যে বাড়ছিল সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। ধর্মের সঙ্গে সম্পর্কশূন্য লেখা, পড়া আর গণিত শেখায় তাদেরই ছিল প্রাধান্য। পাশাপাশি শিক্ষাধারায় কিছুটা বৌদ্ধধর্মের প্রভাব লক্ষ করা যায় এ সময়। ব্রাহ্মণ্য চতুর্বেদ শিক্ষাদানের যে ব্যবস্থা শূদ্রদের শিক্ষাদানের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক ছিল না।

বর্ণভেদ-প্রথা প্রাচীন ভারতে সর্বশক্তি নিয়েই বিরাজিত ছিল। তা সত্ত্বেও ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, শূদ্র মাত্রেই অস্পৃশ্য ছিল, এ ধারণা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। মহাভারত-এর শান্তিপর্বে ও অনুশাসনপর্বে বলা হয়েছে, বৈদিক মন্ত্র ব্যতীত বাকি সব যজ্ঞের অনুষ্ঠান শূদ্র করতে পারবে। মনু ও যাজ্ঞবল্ক বিধান দিয়েছিলেন যে বেদ পাঠ বা বৈদিক যাগযজ্ঞ করার অধিকার শূদ্রের নেই। কিন্তু পরোক্ষ প্রমাণ আছে যে, ব্রাহ্মণ শূদ্রকে বেদ অধ্যয়ন করাত এবং শূদ্রের জন্য যাজন করত।১২ নিশ্চয় এগুলো ব্যতিক্রম। মনে রাখতে হবে টাকা বা সম্পদের শক্তিই বড় শক্তি। শূদ্রদের একটি অংশ ব্যবসা-বাণিজ্য ও চাষাবাদের সঙ্গে যুক্ত থেকে ধনী হয়ে উঠছিল। নানা রচনায় তার প্রমাণ মেলে। এসব শূদ্রের জন্য রাষ্ট্র বা ব্রাহ্মণদের নতুন নতুন বিধান তৈরি করতে হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে শূদ্রদের দুভাগে ভাগ করা হয়—সত্ ও অসত্। যারা অসত্ ছিল তারা ছিল অস্পৃশ্য। কিন্তু বৌদ্ধধর্মে সেটাকেও মানা হয়নি। ব্রাহ্মণরা যেখানে শূদ্রদের, এমনকি সকল বর্ণের নারীদের জন্য বেদ পাঠ বা বেদ শ্রবণ নিষিদ্ধ করেছিল, সেখানে বৌদ্ধধর্মমতে বৌদ্ধ ধর্মসংঘগুলোতে যেকোনো জাতের মানুষই সদস্য হতে পারত। সে ক্ষেত্রে জাতপাতের কারণে কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি হতো না।

সপ্তম শতাব্দীতে ভারতে আসেন হিউয়েন সাঙ। তিনি চার বর্ণের লোক এবং ব্রাহ্মণের প্রাধান্যের কথা বলেছেন। হিউয়েন সাঙ নালন্দা প্রভৃতি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিবরণও দিয়েছেন। সপ্তম শতকে চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙের সময় বহুতর বৌদ্ধমঠ বঙ্গের সর্বত্র দেখতে পাওয়া গিয়েছিল। হিন্দু ও বৌদ্ধ দুই ধর্মের প্রভাবই বাংলায় প্রচলিত ছিল বলে হিউয়েন সাঙ জানান। হিউয়েন সাঙের বিবরণে জানা যায়, একজন বাঙালি তখন নালন্দার বিশ্ববিশ্রুত বিহারের অধ্যক্ষের পদ অলংকৃত করেছিলেন। হিন্দু রাজা শশাঙ্ক বৌদ্ধমতের বিরুদ্ধে ছিলেন। পরবর্তীকালে রাজা আদিসুর বাংলায় বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণের অভাব লক্ষ করে কান্যকুব্জ থেকে ব্রাহ্মণদের স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য নিয়ে আসতে বাধ্য হন। এই ব্রাহ্মণরা ও তাদের বংশধরদের সাহায্যে পুনরায় বেদের ক্রিয়াকাণ্ড মধ্যবঙ্গে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। কিন্তু অন্যত্র, বিশেষত প্রত্যন্ত অঞ্চলে ও সমাজের নিম্নস্তরে বৌদ্ধ প্রভাব বলবত্ রয়ে গেল। সাধারণের মধ্যে কিঞ্চিত্ বিকৃত বৌদ্ধমতেরই সমধিক প্রচলন ছিল।১৩ কিন্তু হিন্দুধর্মে বেদ পাঠ আগের রীতি মেনেই চলছিল। মধ্যযুগেও তা ছিল মুখস্থ কিংবা আবৃত্তি করার ব্যাপার। পাশাপাশি ব্রাহ্মণ্য শিক্ষায় কিছুটা লেখার ধারাও চালু হয়েছিল। হিউয়েন সাঙ ব্রাহ্মণদের ৪৭ অক্ষর এবং এসব অক্ষরের যোগে বিভিন্ন শব্দ গঠনের কথা বলেছেন। প্রতিটি প্রদেশের প্রশাসকেরা সব ঘটনার লিখিত নথি রাখত বলেও তিনি উল্লেখ করেছেন।

শিশুরা সাত বছর বয়সের আগেই বারো অধ্যায়ের সিদ্ধ-বাস্তু পাঠ করত। হিউয়েন সাঙের বিবরণ থেকে বৌদ্ধ যুগের প্রাথমিক শিক্ষার পাঠক্রম থেকে জানা যায় যে শিশু শিক্ষার্থী সর্বপ্রথম পরিচিত হতো ‘সিদ্ধম’-এর সঙ্গে অথবা দ্বাদশ অধ্যায়যুক্ত প্রাথমিক পুস্তকের সঙ্গে। ওই পুস্তকে সংস্কৃত বর্ণমালা ও স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণের যৌথ বিন্যাস ছিল। বলা হয়ে থাকে যে সিদ্ধম, সিদ্ধবাস্তু বা সিদ্ধবস্তু মহেশ্বর প্রথম শিখিয়েছিলেন এবং শিশুরা এটা ছয় মাসে মুখস্থ করে। ছয় বছর বয়সে শিশুরা সিদ্ধ-বাস্তু মুখস্থ করত। সিদ্ধবাস্তু ব্যাকরণের প্রথম অধ্যায় মাত্র। সাত বছর বয়সে প্রাথমিক শিক্ষা আরম্ভ করার পর তা শেষ হলে উচ্চ শিক্ষাভিলাষী কিশোরেরা ১৬ বছর বয়সের পর পঞ্চবিদ্যা শিখত। সাধারণত ১৬ বছরের কম বয়সীরা এই শিক্ষা গ্রহণের অনুমতি লাভ করত না—কারণ, এই শিক্ষা গ্রহণের জন্য নিজগৃহ ছেড়ে দূরবর্তী স্থানে চলে যেতে হতো। হিউয়েন সাঙের মতে, এই পঞ্চবিদ্যা হচ্ছে শব্দবিদ্যা, শিল্পস্থানবিদ্যা, চিকিত্সাবিদ্যা, হেতুবিদ্যা ও অধ্যাত্মবিদ্যা। আর ব্রাহ্মণরা এর ওপর আবার চার বেদ পড়ত। এদের শিক্ষা শেষ হতো ৩০ বছর বয়সে। হিউয়েন সাঙের বিরবণ থেকেও লিপিশালা, পাঠশালা বা লেখা, পড়া, আর গণিত শেখার সাধারণ ধারা সম্পর্কে খুব একটা নতুন খবর পাওয়া যায় না। ছয় বছর বয়সে লেখা শেখানো হতো এমন কোনো উল্লেখ সেখানে নেই। সিদ্ধ-বাস্তু মুখস্থ করা হতো বলেই উল্লেখ আছে। পরবর্তী চীনা পর্যটক আই সিন ৪৯টি অক্ষরের উল্লেখ করেছেন। সিদ্ধ-বাস্তুতে এসব অক্ষরযোগে ৩০০ শ্লোক থাকত, যা মুখস্থ করতে হতো। চারটি পদে তৈরি একটি শ্লোকে ৩২টি শব্দাংশ থাকত। এরপর আট বছর বয়সে আট মাস ধরে ব্যাকরণের মূল সূত্রগুলো মুখস্থ করতে হতো।

স্বভাবতই বৈদিক যুগে প্রাথমিক শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে গুরুগৃহকেই সর্বাধিক প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। গুরুগৃহে বাসকালে শিক্ষার্থী যে শিক্ষালাভ করত, তাকে ‘গুরুকুল’ শিক্ষাও বলা হতো। এটাই ছিল সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থা। গুরুকুলকে বৈদিক যুগের মূল শিক্ষাকেন্দ্রও বলা যায়। বিভিন্ন গুরু বা ঋষি পরিচালিত ‘গুরুকুল’ বিভিন্ন হলেও এর পরই শুরু হতো উচ্চতর শিক্ষা। পরবর্তীকালে পরিষদ এবং বিতর্ক সম্মেলনও ছিল একধরনের উচ্চতর শিক্ষাকেন্দ্র। উচ্চশিক্ষাভিলাষী ছাত্ররা গুরুকুলের প্রথাগত প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেই তাঁদের জ্ঞান বাড়ানোর জন্য নিজেদের মধ্যে নানা ধরনের তত্ত্ব আলোচনা করতেন অথবা প্রসিদ্ধ খ্যাতনামা বিশেষ ঋষি শিক্ষকের সন্ধানে দেশ-দেশান্তরে ঘুরে বেড়াতেন। সত্যিকার অর্থে বৌদ্ধধর্মের প্রভাবে বৈদিক শিক্ষাচিন্তার অচলায়তন ভাঙতে শুরু করে। শিষ্যদের মনে নানা ধরনের প্রশ্ন জন্ম নিতে থাকে। বৌদ্ধধর্মের উদ্ভব হয়েছিল বেদ-বিরোধিতা, ব্রাহ্মণ প্রাধান্য ও বর্ণাশ্রম-চতুরাশ্রমপ্রথাকে অস্বীকৃতির মধ্য দিয়ে। বিশেষ বর্ণের সীমায় শিক্ষাকে আবদ্ধ না রেখে সর্বসাধারণ্যে শিক্ষার প্রসার ঘটিয়ে শিক্ষায় সর্বজনীনতাকে বৌদ্ধধর্ম স্বীকৃতি দিয়েছিল; গণশিক্ষার প্রসার ঘটেছিল বৌদ্ধযুগে।১৪ কিন্তু মৌখিক শিক্ষাপদ্ধতির ঐতিহ্য যেমন ব্রাহ্মণ্য শিক্ষার বৈশিষ্ট্য ছিল, বৌদ্ধশিক্ষার ক্ষেত্রেও তা-ই ছিল। মূলত বৌদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থায় আলোচনা ও বিতর্ককে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাপদ্ধতি হিসেবে বিবেচনা করা হতো। পূর্ণ ভিক্ষুত্বপ্রাপ্তির জন্য শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন স্তর অতিক্রম করতে হতো। পরবর্তী সময়ে বৌদ্ধশিক্ষা পাঠক্রম বহু বিস্তৃতি লাভ করে। ক্রমেই রসায়ন, ভেষজ, চিকিত্সা, শিল্প, স্থাপত্য ইত্যাদি বিষয়ও পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। বিশেষ করে নালন্দা শিক্ষাকেন্দ্রে লিখন ও পুঁথির অনুলিপি তৈরি করার ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়। এ জন্য ‘রত্নসাগর’, ‘রত্নদধি’, ‘রত্নরঞ্জক’ নামে তিনটি বিশাল গ্রন্থাগার তিনটি বৃহত্ অট্টালিকায় স্থান পায়। নালন্দার পাঠক্রমে শুধু তত্ত্বগত বিষয়ই ছিল না, সৃজনশীল বাস্তবসম্মত বিষয়ও স্থান পেয়েছিল। নালন্দার বহু আগে প্রথমাবস্থায় তক্ষশিলা ছিল বৈদিক শিক্ষার কেন্দ্র। পরবর্তী সময়ে বৌদ্ধধর্মের স্বর্ণযুগে তক্ষশিলা বৌদ্ধ শিক্ষাকেন্দ্ররূপে পরিগণিত হয়। নালন্দায় বৌদ্ধ শিক্ষাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর বাংলায় এর যথেষ্ট প্রভাব পড়ে।

বাংলার শাসক বল্লাল সেন তাঁর দানসাগর গ্রন্থের শিক্ষাদান অধ্যায়ে শেখা ও শেখানোর আদর্শ পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া বিষয়ে যথাযোগ্য আলোচনা করেছেন। ‘ভূমিদান’ ও ‘শিক্ষাদান’ নামক দুই অধ্যায়ে সেন আমলে বাংলায় সংস্কৃত উচ্চশিক্ষার প্রচলিত ব্যবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া আছে। শিক্ষাপ্রক্রিয়ার বাচনিক বা কথ্যধারা এই ‘শিক্ষাদান’ ধারণার অন্তর্ভুক্ত। বাংলার প্রথম মনুস্মৃতির টীকাতিথির মতে, ‘অধ্যয়ন’ শব্দের অর্থ উচ্চারণ বা আবৃত্তি ও তা শ্রুতিগোচর করা। মনে রাখতে হবে বেদকে শ্রুতি বলা হয়, যার অর্থ গুরুর উচ্চারণ বা আবৃত্তি শ্রবণ। আর শাস্ত্রীয় বিধানসমূহকে বলা হয় স্মৃতি, যার অর্থ স্মরণ-উদীর্ণ। আসলে সংস্কৃতে শিক্ষা কথার অর্থ অধ্যবসায় বা পুনঃপুন অভ্যাস করা। শিক্ষা ছয় বেদাঙ্গের একটি বিজ্ঞান, যা সঠিক উচ্চারণ ও উচ্চারণের বিবিধ কৌশল আয়ত্ত করার অভ্যাস। শিক্ষার সংজ্ঞা থেকেই এ কথা পরস্ফুিট যে এতে লেখার কোনো স্থান নেই। অন্তত প্রাচীনকালে ছিল না। ফা হিয়েন ভারত ভ্রমণ করেন পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতকে। তখনো মুখে মুখে শুনে শাস্ত্র শেখার রেওয়াজ ছিল বলেই তাঁর বিবরণ থেকে জানা যায়। ফা হিয়েন সারা উত্তর ও মধ্য ভারতের বিভিন্ন সংঘারাম ঘুরেও বিনয়পিটক-এর কোনো পুঁথি সংগ্রহ করতে পারেননি। শেষে পাটনায় এসে বিনয়ের একটা পুঁথি হাতে পান। এর থেকে বোঝা যায়, পুঁথি লেখা এবং লেখা পুঁথির সাহায্যে শিক্ষার প্রথা তখনো তেমন চালু ছিল না। বরং গুরুমুখে শুনে কণ্ঠস্থ করার রেওয়াজ তখনো চলছে। লিপিশালা বা লেখার প্রথা যদি ব্যাপক প্রসার লাভ করত, তবে নিশ্চয়ই বিনয়ের মতো ধর্মগ্রন্থের পুঁথির এমন অভাব দেখা যেত না। সপ্তম শতাব্দীতেও শাস্ত্রীয় শিক্ষা বাচনিক ধারাতেই চলত, কেননা লিখিত পাণ্ডুলিপির কোনো ভূমিকা দৃষ্টিগোচর হয়নি। এগারো বা বারো শতকের আগের পুঁথি মাত্র দু-একটিই পাওয়া গেছে, বেশির ভাগ পুঁথি যা পাওয়া গেছে, তা বারো শতকের পর লিপি করা।

বাচনিক বা কথা ধারায় শেখা ও শেখানোর প্রথা, শিক্ষা-প্রক্রিয়ায় শিক্ষকের একাধিপত্যকে সুনিশ্চিত করে। শিক্ষা একমাত্র শিক্ষকের থেকেই পেতে হবে। কাজেই দানসাগর-এর ‘শিক্ষাদান’ অধ্যায়ে শিক্ষকের প্রশংসা বা গুণকীর্তন একটি প্রধান বিষয়। দানসাগর-এ বলা আছে, শিক্ষক ব্যতীত শিক্ষা যেহেতু ফলপ্রসূ হয় না, তাই শিক্ষক সর্বদাই সম্মানীয়। শিক্ষকের উপস্থিতিতে অথবা অনুপস্থিতিতে যে সর্বদা মাল্য, বস্ত্র ও অলংকার দ্বারা শিক্ষককে পিনাকী বা শিবজ্ঞানে শ্রদ্ধা-ভক্তি করে সে সেই অনুযায়ী ফল লাভ করবে। অতএব সব শিক্ষার্থীরই যত্নসহকারে এ কাজ করা উচিত। দানসাগর অনুযায়ী শাস্ত্রীয় বিদ্যার চৌদ্দটি শাখা বা বিভাগ ছিল। সেগুলো হচ্ছে চার বেদ, ছয় বেদাঙ্গ বা বেদের আনুষঙ্গিক বিদ্যা, ধর্মশাস্ত্র পুরাণ, মীমাংসা অর্থাত্ কর্মমীমাংসা বা পূর্বমীমাংসা ও ব্রহ্মমীমাংসা বা উত্তর মীমাংসা বা বেদান্ত এবং তর্কবিদ্যা। এই চৌদ্দ শাখা থেকে আরও অনেক প্রশাখার উত্পত্তি হয়েছিল। যেমন: আয়ুর্বেদ, শস্যবেদ, ধনুর্বেদ, আত্মবিদ্যা, কলাবিদ্যা, বার্তা, শিল্পবিদ্যা প্রভৃতি। যদিও তখন ব্রাহ্মণ্য শিক্ষাধারায় মুখস্থ করার প্রক্রিয়াকেই গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছিল, তবুও বল্লাল সেনের গ্রন্থ রচনা এটা প্রমাণ করে যে ব্রাহ্মণসহ অন্য সব ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে তাদের পবিত্র রচনাসমূহ সংরক্ষণ এবং সংবহনের কাজে লেখন একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায় রূপে ইতিমধ্যে গণ্য হয়েছে। যখন শুধু স্মৃতির ভরসাতেই সংরক্ষণ করা হতো, তখনকার চেয়ে লেখনের মাধ্যমে সঠিকরূপে এসব টিকে থাকার সম্ভাবনা বেড়ে গেল। বিশেষ করে গদ্যের ক্ষেত্রে। যদিও শিক্ষকেরা নিজেদের স্বার্থে ছাত্রদের মুখস্থ করার ব্যাপারটাকে খুবই গুরুত্ব দিচ্ছিলেন।

দানসাগর-এ শিক্ষকের গুণাবলি বিষয়েও বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। দানসাগর-এর মতে, যে শিক্ষক অর্থ প্রকাশের উপযুক্ত বাগ্ধারা ও উচ্চারণের প্রাসঙ্গিক কৌশলসমূহে পারঙ্গম হয়ে শিক্ষণীয় বিষয়ের অন্তর্নিহিত তত্ত্ব সব যুক্তিপরম্পরায় প্রকাশে সমর্থ, তিনি গুণময় শিবশম্ভুর সমতুল্য। সূর্যের আলো ব্যতিরেকে যেমন পৃথিবী তমসাচ্ছন্ন, তেমনি শাস্ত্রসমূহ শিক্ষকের ব্যাখ্যা ব্যতিরেকে দুর্বোধ্য। উচ্চারণের কৌশল রপ্ত করে সঠিক উচ্চারণে পারঙ্গম না হলে এবং ব্যাকরণ, অলংকার ও ন্যায়শাস্ত্রে পারদর্শী না হলে, শাস্ত্রের অন্তর্নিহিত তত্ত্ব ও যুক্তিপরম্পরা উপলব্ধি ও ব্যক্ত করা সম্ভব নয়। শিক্ষাপ্রক্রিয়ায় বাচনিক ধারার প্রাধান্য বা একাধিপত্য এই আলোচনা থেকে সুস্পষ্ট। এখানে মনে রাখতে হবে প্রাক্ পাণিনি বৈদিক ভাষায় বহুক্ষেত্রেই উচ্চারণভেদে অর্থভেদ ঘটত। কাজেই উচ্চারণবিধি বা কৌশল রপ্ত করা শিক্ষকের অবশ্য কর্তব্য ছিল। সে জন্য সেই যুগের ছন্দোবদ্ধ আবৃত্তি ছিল একটি সুকুমার কলা। শিক্ষকের মুখ থেকে শোনা মন্ত্র নির্দিষ্ট ছন্দে ও ধ্বনিসহযোগে শিষ্যকে আয়ত্ত করে স্মৃতিতে ধরে রাখতে হতো। এ প্রসঙ্গে এ কথাও উল্লেখ করা প্রয়োজন যে বল্লাল সেনের আমলে শিক্ষা-প্রক্রিয়ায় পাণ্ডুলিপির কিছু স্থান ছিল, এমন সাক্ষ্যও পাওয়া যায়। বল্লাল সেন তাঁর দানসাগর-এ কীভাবে পুঁথি নকল বা অনুলিপি করতে হবে, কীভাবে তা সংশোধন করতে হবে সে সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। তা ছাড়া প্রতিপাদ্য বিষয়ের যথোচিত ব্যাখ্যা এবং এই ব্যাখ্যা যথার্থভাবে শ্রুতিগোচর করার নিয়ম ও পড়ার পদ্ধতি বিষয়েও তিনি আলোচনা করেছেন।

দানসাগর-এ বলা হয়েছে, পাণ্ডুলিপির বা পুঁথির অনুলিপিকারক পূর্বমুখী হয়ে সোনা, রুপা বা হাতির দাঁত অথবা ভালো কাঠের উপযুক্ত লেখনীর সাহায্যে মূল পাণ্ডুলিপির বিষয়সমূহ ভূর্জপত্রে বা অন্যপত্রে লিপিবদ্ধ করবে। অনুলিপির পত্রগুলো আকারে লেখা অংশের দ্বিগুণ হবে। অনুলিপি সাঙ্গ হলে মূল পাণ্ডুলিপির সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে হবে সঠিক লিপি হয়েছে কি না। কীভাবে এই পাণ্ডুলিপির বিষয়সমূহ শিক্ষক পাঠ ও ব্যাখ্যা করবেন, সে বিষয়েও আলোচনা করা হয়েছে। শিক্ষক হবেন একজন দক্ষ, বুদ্ধিমান ও পণ্ডিত ব্রাহ্মণ, যিনি শুধু লিপির অর্থ উদ্ধারেই সমর্থ হবেন না, সেই সঙ্গে ছন্দবিজ্ঞান ও শব্দশাস্ত্রেও তাঁর ব্যুত্পত্তি থাকতে হবে। তিনি হবেন সুকণ্ঠের অধিকারী এবং যথার্থ উচ্চারণে পারঙ্গম। তা ছাড়া বিদ্যার বিভিন্ন শাখায় থাকবে তাঁর অধিকার। দানসাগর-এ উল্লিখিত যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক নিশ্চয়ই সহজলভ্য ছিল না। শিক্ষককে উজ্জ্বল সূর্যের সঙ্গে তুলনা করে বলা হয়েছে, সূর্য যেমন পৃথিবী থেকে অন্ধকার দূর করে, তেমনি শিক্ষক তাঁর প্রাজ্ঞ উচ্চারণের দ্বারা শিক্ষার্থীর মনের অজ্ঞতার অন্ধকার দূর করেন। শিক্ষার্থী কীভাবে শিক্ষকের ব্যাখ্যা শুনবে এবং কীভাবে পাণ্ডুলিপি পাঠ করবে, সে বিষয়েও দানসাগর-এ বিশদ আলোচনা করা হয়েছে। শিক্ষার্থী শিক্ষকের দিকে মুখ করে গভীর মনোযোগের সঙ্গে শিক্ষকের পাঠ ও ব্যাখ্যা শুনবে। কোনোভাবেই অন্যমনস্ক হবে না বা শিক্ষকের পড়ানোয় ব্যাঘাত সৃষ্টি করবে না। কোনো বিষয়ে সন্দেহ থাকলে, শিক্ষকের ব্যাখ্যা শেষ হলে তবেই ছাত্র তা বিনম্রভাবে ব্যক্ত করবে। কিন্তু কোনোক্রমেই শিক্ষকের ব্যাখ্যার প্রতিবাদ বা বিরোধিতা করবে না।১৫

বল্লাল সেন বারো শতকের শুরুতে বাংলার শাসনভার গ্রহণ করেছিলেন। বল্লাল সেনের বাবা বিজয় সেন তার কিছুকাল আগে বাংলার সিংহাসন অধিকার করেছিলেন। বল্লাল সেন বা সেন বংশের রাজত্বের আগে বাংলায় তিন শ বছরের অধিক সময় পাল রাজাদের শাসন ছিল। পাল রাজারা বৌদ্ধধর্মের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। খ্রিষ্টীয় দশম শতকে পাল শক্তির পতন বৌদ্ধধর্মের ওপর আঘাত হানল। পাল রাজাদের আমলে ব্যাপকভাবে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত বাংলায় পরবর্তীকালে ব্রাহ্মণ্যধর্ম ও সংস্কৃতির প্রভাব বিস্তারে সেন রাজাদের ভূমিকা ও অবদান অনস্বীকার্য। তা সত্ত্বেও মধ্যযুগে ব্রাহ্মণ্যবাদ বা শাস্ত্রের কঠোর নিয়মসমূহের কিছু সংশোধন বা সংস্কার সাধন করে অনেকটাই নমনীয় করে তোলা হয়। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন বর্ণনা থেকে সংগতভাবেই অনুমান হয়, সেই সময় পাঠারম্ভের সংস্কার হিসেবে উপনয়ন সংস্কার তার তাত্পর্য হারিয়ে শুধু দ্বিজ সংস্কার বা পৈতে সংস্কারে পর্যবসিত হয়েছিল। এই সময়েই বাংলায় আনুষ্ঠানিক ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাধারার প্রবর্তন হয়, যা টোল নামে পরিচিত। সাধারণভাবে, সেন যুগে অর্থাত্ এগারো ও বারো শতকে সংস্কৃত উচ্চশিক্ষা বাংলায় যথেষ্ট প্রসার লাভ করেছিল বলেই অনুমান করা যায়। সেন বংশের কুলপ্রধান সেন রাজা বল্লাল সেন ব্রাহ্মণ্য শাস্ত্রীয় শিক্ষাচর্চা বা সংস্কৃত উচ্চশিক্ষার একজন প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তিনি বাংলার বাইরে থেকে ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের উর্বর গ্রাম দান করে বাংলায় বসতি করান বলেই কথিত আছে। এর পক্ষে কিছু প্রমাণও পাওয়া যায়।

বাংলায় সেনযুগে বৈদিকধর্ম এবং বেদ শিক্ষা উচ্চশ্রেণীর মধ্যেই প্রসার লাভ করেছিল। সাধারণের মধ্যে জৈন ও বৌদ্ধ মতেরই প্রভাব অধিক ছিল। কিন্তু মুসলিমদের আগমনে ভারতের শিক্ষাধারা আবার ভিন্ন মাত্রা পেতে থাকে। মুসলিম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর পাঠ্যক্রমের মধ্যে ছিল ব্যাকরণ, বাগ্মিতা, তর্কবিদ্যা, ব্রহ্মবিদ্যা, অধিবিদ্যা, সাহিত্য, জ্যোতির্বিজ্ঞান, গণিত, ঔষধশাস্ত্র এবং ব্যবহারশাস্ত্র। মোগল যুগের শেষ ভাগে পাঠক্রমে যুক্তিভিত্তিক বিজ্ঞানগুলোর প্রাধান্য দেখা যায়। সম্রাট আকবর-সৃষ্ট ভাষা শিক্ষার পদ্ধতিটিও উল্লেখযোগ্য। পড়তে শেখার পরে লিখতে শেখার ফারসি পদ্ধতিটির পরিবর্তে লিখতে শেখার সঙ্গে সঙ্গে পড়তে শেখার পদ্ধতিটিকেই তিনি গ্রহণযোগ্য মনে করেন। সময় বিভাজনও ঘোষিত হয়েছিল। যথা উচ্চারণসহ অক্ষর শেখার জন্য দুদিন, অক্ষরগুলো সাজানোর জন্য এক সপ্তাহ। তারপর অক্ষর সংযুক্ত করে ধর্মীয় ও নীতিশিক্ষাসংবলিত ছোট গদ্য ও পদ্য পড়া এবং শেষে নিজে নিজে পড়তে শেখা। আকবর চারটি দৈনিক কার্যসূচি ঘোষণা করেছিলেন—অক্ষর শেখা, অক্ষর সাজানো, নতুন পড়া এবং পুরোনো পাঠের পুনরাবৃত্তি।১৬ মুসলিম ও মোগল যুগের শিক্ষায় এভাবেই লিপিশিক্ষা ও লেখার বিষয়টি পাওয়া যায়, পুঁথির ব্যবহার আরম্ভ হয়। মুসলিম শাসনে বাংলা এর বাইরে ছিল না।

কালক্রমে বাংলার শিক্ষাধারায় পুঁথি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থান লাভ করে। কোনো শিক্ষণীয় বিষয়ে পুঁথি বা পাণ্ডুলিপি রচনাও ‘বিদ্যাদান’ হিসেবেই স্বীকৃতি পেত। শিক্ষা-প্রক্রিয়ায় পাণ্ডুলিপির ভূমিকা স্বীকৃতি পেলে শিক্ষা বা অধ্যয়নের সংজ্ঞারও সংস্কার প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। ষোলো শতকের প্রখ্যাত বাঙালি স্মৃতিকার ছিলেন রঘুনন্দন। রঘুনন্দনের মতে, তিনভাবে অধ্যয়ন করা যেতে পারে, যেমন ‘বাচিক’ বা উচ্চকণ্ঠে পাঠ, ‘উপাংশু’ বা অনুচ্চ স্বরে পাঠ এবং ‘মানস’ বা মনে মনে পড়া।১৭ সন্দেহ নেই, এই মানস চর্চা বা মনে মনে পড়ার সঙ্গে পুঁথির সম্পর্ক বাংলার সংস্কৃত শিক্ষা-প্রক্রিয়ায় এক নতুন মাত্রা যোগ করেছিল। যদিও শিক্ষক ও বাচনিক ধারার প্রাধান্য বজায় ছিল। আসলে পাণ্ডুলিপির ব্যবহার প্রধানত শিক্ষকের পড়ানোয় সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। সাধারণ শিক্ষার্থীর পক্ষে পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ করা খুব সহজ ছিল না। কথিত আছে, বাসুদেব পণ্ডিতের টোলে রঘুনাথ নবদ্বীপের পাঠ শেষ করেন। বাসুদেব নিজে আবার মিথিলায় গিয়ে মহামহোপাধ্যায় পক্ষধর মিশ্রের কাছে ন্যায়শাস্ত্র অধ্যয়ন করে সার্বভৌম উপাধি লাভ করে দেশে ফিরেছিলেন। দেশে ফিরে অসাধারণ স্মৃতিশক্তিবলে তিনি কুসুমাঞ্জলি গ্রন্থটি অবিকল লিখে ফেলেন। বাসুদেবকে নিয়ে এ রকম গল্প আছে: একবার একজন তাঁর ঝোলার মধ্যে কী কী পুঁথি আছে দেখতে চাইলে তিনি উত্তর দেন, ‘পুঁথিতে কী প্রয়োজন! গুরুর কৃপায় সবই স্মৃতিপটে অঙ্কিত আছে’।১৮

রঘুনন্দনের মতে, যে ব্যক্তি শিক্ষালাভ করেছে তার আবশ্যিক কর্তব্য উপযুক্ত কোনো শিক্ষার্থীকে শিক্ষাদান করা। তিনি বেদের সাক্ষ্যে, যে ব্যক্তি শিক্ষা লাভ করেছে অথচ শিক্ষাদান কর্তব্য পালন করেনি, তার মুক্তির পথ রুদ্ধ এমনই বলেছেন। এই শিক্ষাদান ত্রিবিধ উপায়ে করা যেতে পারে বলে তিনি মন্তব্য করেন। এ তিন উপায় হচ্ছে: শিক্ষক হিসেবে, কোনো বিষয়ের ব্যাখ্যাকার হিসেবে বা পুঁথি রচনা করে।১৯ রঘুনন্দন সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে মনুর অনেক বিধানেরই সংস্কার করেছিলেন। রঘুনন্দন আগের ব্রাহ্মণদের মতো শূদ্রদের শিক্ষার ব্যাপারে কঠোর থাকেননি। সমাজ বাস্তবতার কারণে সেটা আর সম্ভবও ছিল না। রঘুনন্দনের মতে, ব্রাহ্মণের উপনয়ন হবে সাধারণত আট বছর বয়সে, কিন্তু ‘ব্রহ্ম তেজস্কামী ব্রাহ্মণে পঞ্চমবর্ষে উপনয়ন করা উচিত’।২০ কালানুসারে রঘুনন্দনের সময় বিদ্যারম্ভের সংস্কার হিসেবে উপনয়নের গুরুত্ব ও তাত্পর্য হ্রাস পায়। ব্রাহ্মণের পক্ষে অবশ্যপালনীয় সংস্কার হিসেবে উপনয়নের গুরুত্ব বজায় থাকলেও তা শুধু পৈতে সংস্কার হিসেবেই পালিত হতে থাকে। উপনয়নের সঙ্গে বিদ্যারম্ভের সম্পর্ক রীতিমাত্র হয়ে দাঁড়ায়। অন্যপক্ষে প্রাক্-উপনয়ন বিদ্যারম্ভ সংস্কার প্রাধান্য পেতে থাকে, যা ‘হাতেখড়ি’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। নানা দিক বিবেচনা করে মনে হয়, আই সিনের দেওয়া বিবরণ ও বৌদ্ধ আমলের পার্থিব শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে পরবর্তী টোল-চতুষ্পাঠীর উত্স খোঁজার চেষ্টা করা যায়। গুরুগৃহ বা তপোবন আশ্রম থেকে টোল-চতুষ্পাঠীর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাধারার রূপান্তরের পথে হয়তো বৌদ্ধ মঠের শিক্ষাধারা একটা মধ্যবর্তী ধাপ। টোল ও চতুষ্পাঠীর শিক্ষায় দেখা যায় কাব্য-ব্যাকরণের প্রাধান্য। আর গুরুগৃহে বেদপাঠের যে প্রাধান্য, তা টোলের শিক্ষায় নেই বললেই চলে। বিশেষ করে বাংলার টোলগুলো সম্পর্কে এ কথা খুবই ঠিক।

মুসলিম শাসকদের আমলে ষোলো শতকের বাংলায় আগের ব্রাহ্মণদের নিয়মের বহু ব্যত্যয় ঘটে। বেদপাঠে সবার অধিকার না থাকলেও শিক্ষালাভের দ্বার সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। শিক্ষালাভের জন্য সর্বক্ষেত্রে আর উপনয়নের দরকার হতো না। সাধারণের জন্য উপনয়নের জায়গায় ‘হাতেখড়ি’র প্রচলন শুরু হয়। হিন্দুসমাজের চার বর্ণের শিশুরাই পঞ্চম বর্ষে বিদ্যারম্ভ সংস্কার বা হাতেখড়ির অধিকার লাভ করে। রঘুনন্দন বিদ্যারম্ভের পর এবং উপনয়নের আগেই শিক্ষা বিষয়ে আলোচনার অবতারণা করেছেন। এমনকি শিক্ষক বা গুরুর সংজ্ঞা বিষয়েও রঘুনন্দন যথেষ্ট উদার মনোভাবের পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর মতে, গুরু সে-ই যিনি বিদ্যা দান করেন, পুঁথি রচনা করেন বা শিক্ষার্থীর প্রয়োজন ও ক্ষমতা অনুযায়ী সংস্কৃত, প্রাকৃত বা শিক্ষার্থীর মাতৃভাষায় শিক্ষণীয় বিষয় ব্যাখ্যা করেন। লক্ষ করার বিষয়, বাংলার পণ্ডিতেরা শাস্ত্রব্যাখ্যায় মাতৃভাষার তাত্পর্য ও গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। হয়তো বৌদ্ধ ঐতিহ্য এ বিষয়ে তাঁদের কিছুটা প্রভাবিত করেছিল। সেন আমলে ব্রাহ্মণ্যধর্মের পুনরুত্থান যে বাংলার বৌদ্ধ ঐতিহ্যকে পুরোপুরি গ্রাস করতে পারেনি, তা বোঝা যাচ্ছে। দীনেশচন্দ্র সেন লিখেছেন, যখন মাগধী সভ্যতা নানাভাবে বিভক্ত ও চূর্ণবিচূর্ণ, মগধের লোকেরা তখন ক্রমাগত পূর্বমুখী হয়ে বাংলায় এসে বসবাস করতে শুরু করে। অন্যত্রও ছড়িয়ে পড়ে। দীনেশচন্দ্র সেন আরও লিখেছেন, বৌদ্ধ সংঘারামগুলো নষ্ট হওয়ার পর বাংলাদেশজুড়ে টোল বসার উদেযাগ শুরু হয়। সংঘারামগুলো ধ্বংস হওয়ার পর কে আর তিন শ ফুট উঁচু বিরাট মঠ নির্মাণ করবে বা বিশাল আয়তনের বিহার নির্মাণ করার টাকা কে জোগাবে, তাই তার স্থলে ছোট ছোট কুটিরে টোল বসে গেল।২১

বৃন্দাবন ঠাকুর লিখেছেন, ষোলো শতকে নবদ্বীপের টোলগুলোতে বহুসংখ্যক পড়ুয়া ছিল। সতেরো শতকে নবদ্বীপের টোলগুলো খুব জোরেশোরে চালু হয়েছিল। ক্যালকাটা মান্থলির ১৭৯১ সালের জানুয়ারি সংখ্যায় লেখা হয়েছে, নবদ্বীপের টোলগুলোর গৌরব সর্বজনবিদিত। টোলগুলোর মধ্যে তিনটি ছিল খুবই আলোচিত; নবদ্বীপ, শান্তিপুর ও গোপালপাড়ার টোল। এগুলোর ব্যয় নির্বাহের জন্য যথেষ্ট সম্পত্তি ছিল। নবদ্বীপের টোলেই প্রায় ১১০০ ছাত্র এবং ১৫০ জন অধ্যাপক রয়েছে। কিন্তু টোলগুলোর অবস্থা তখন পড়ন্ত দশায়। পত্রিকার প্রতিবেদক আরও জানাচ্ছেন যে রাজা রুদ্রের সময় ১৬৮০ সালে ছাত্রসংখ্যা ছিল চার হাজার এবং অধ্যাপকের সংখ্যা ছিল ছয় শ। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বহু দূরদেশ থেকে নদীয়াতে ছাত্রসমাবেশ হয় এবং ছাত্রমণ্ডলীর অধিকাংশই প্রৌঢ়। কারণ তাঁরা বহুকাল অন্যত্র দর্শন অধ্যয়ন করার পর নবদ্বীপের ন্যায়দর্শন পাঠ করার যোগ্যতা অর্জন করেন।

যারা সাহিত্যচর্চার জন্য নবদ্বীপের টোলে আসে, তারা প্রত্যেকেই টোলের বৃত্তি লাভ করে। তারা যেসব গ্রন্থ পাঠ করে, তা কণ্ঠস্থ করে ফেলতে হয়। যখন দুজন অধ্যাপক দর্শন নিয়ে কোনো একটা মত নিয়ে তর্ক করেন, ছাত্রছাত্রীদের তা শোনার অধিকার থাকে। যদি কারও কাছে অধ্যাপকদের আলোচনা ও তর্ক দুরূহ বা জটিল মনে হয়, তাহলে সেই ছাত্র দরকারমতো প্রশ্ন করে বিষয়টি বুঝে নেওয়ার অধিকার রাখে। বিদ্যাদান করে অর্থগ্রহণ ওই সব অধ্যাপক পাপ মনে করেন। নবদ্বীপের টোলে সাধারণত স্মৃতি ও ন্যায়শাস্ত্র পড়ানো হয়ে থাকে। এ বিষয়ে নদীয়ার খ্যাতি ভারতব্যাপী। ভারতের সর্বস্থান থেকেই এখানে ছাত্ররা অধ্যয়ন করতে আসে। স্মৃতির টোলে সাধারণত আট বছর পড়তে হয়, ন্যায়ের টোলে দশ বছরের কম নয়। টোলগুলো মাসে ১০ দিন করে বন্ধ থাকে। প্রতিপদ, অষ্টমী, ত্রয়োদশী, চতুর্দশী, পৌর্ণমাসী, শুক্ল ও কৃষ্ণ পক্ষের দুই তিথিতে টোল বন্ধ রাখা হয়। এ ছাড়া সরস্বতী পূজায় দুই সপ্তাহ এবং অন্যান্য পর্ব উপলক্ষে ছাত্ররা ছুটি পায়। ন্যায়ের টোলের ছাত্ররা আষাঢ় থেকে কার্তিক পর্যন্ত ছুটি ভোগ করে, স্মৃতির টোলের ছাত্ররা ভাদ্র থেকে কার্তিক পর্যন্ত। নবদ্বীপের টোলের পাঠ শেষ করতে পারলে সে পণ্ডিত ভারতের সমস্ত বিদ্যাকেন্দ্রে সম্মানিত হয়।২২

ন্যায়ই নবদ্বীপের টোলগুলোর প্রধান দিক ছিল। বাংলার টোলগুলোর এই ন্যায়শাস্ত্র বৌদ্ধধর্মের প্রভাবে গড়ে উঠেছিল। বৌদ্ধরা স্মৃতি-শ্রুতি স্বীকার করে না। সুতরাং তর্কবুদ্ধি তাদের প্রধান অবলম্বন। স্বয়ং বুদ্ধ তাদের শিষ্যদের বলেছিলেন, ‘পণ্ডিতেরা যেভাবে সোনাকে আগুনে পুড়িয়ে নিকষ পাথরে পরীক্ষা করে থাকে—হে ভিক্ষুগণ, তোমরা আমার কথাগুলোকে সেভাবে পরীক্ষা করে গ্রহণ করবে। কেবল আমার গৌরব রক্ষার জন্য তা গ্রহণ করবে না।২৩ যার অর্থ দাঁড়ায় বুদ্ধ তার শিষ্যদের অন্ধভাবে কোনো কিছু গ্রহণ করতে নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু স্মৃতির বিধান অন্ধভাবেই পালনীয় ছিল। তা সত্ত্বেও ইতিহাসের সেই আদিপর্বে হিন্দু দার্শনিকেরা তর্কবিতর্ক দ্বারা সত্য নিরূপণ করার চেষ্টা করতেন। নবীন যুবক নিমাই পণ্ডিত (শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু) অল্প বয়সে নবদ্বীপেই পাঠ শেষ করে ব্যাকরণের টোল খুলে শব্দ ও অলংকারশাস্ত্রে প্রতিভার পরিচয় দেন। মুকুন্দ সঞ্জয়ের বাড়িতে বড় চণ্ডীমণ্ডপে অনেকের এক সঙ্গে বসে পড়ার ব্যবস্থা ছিল। সেই চণ্ডীমণ্ডপে টোল খুলে নিমাই রীতিমতো অধ্যাপনা করতেন। সকাল থেকে দ্বিপ্রহর পর্যন্ত টোলে পাঠনা তারপর স্নান-আহার। বিকেলে আবার ভ্রমণের সময় গঙ্গাতীরে শিষ্যসঙ্গে মণ্ডলী করে বসে পাঠাদির আলোচনা—এভাবেই দিবা অতিবাহিত হতো।২৪ নদীয়াতে এ ধরনের বহু টোলের কথা জানা যায়। নদীয়ার এক প্রান্তে খালপাড়ে বিদ্যানগর পল্লি স্থাপিত হয়েছিল।

মধ্যযুগে বাংলায় সংস্কৃত উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো টোল নামেই পরিচিত ছিল। উত্তর ভারতে এ ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে সাধারণত চতুষ্পাঠী বলা হতো। সত্যিকারভাবে সংস্কৃত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে টোল আর চতুষ্পাঠীর মধ্যেও কিছু প্রভেদ ছিল। চতুষ্পাঠী কথার অর্থ চারবেদ পাঠের প্রতিষ্ঠান, যদিও অন্য শাস্ত্র পাঠের সুযোগও থাকতে পারে। এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে, উত্তর ভারতের সংস্কৃত উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চতুষ্পাঠীতে বেদবিদ্যা অধ্যয়ন আবশ্যিক হলেও বাংলার টোলে বেদ পাঠের তেমন প্রচলন ছিল না। আসলে বাংলায় বেদচর্চা তেমন বিস্তার লাভ করেনি কখনো। বাংলায় সাধারণত তিন ধরনের টোল ছিল। কিছু টোলে প্রধানত ব্যাকরণ, সেই সঙ্গে সাহিত্য, অলংকার ও কখনো পৌরাণিক কাব্য পড়ানো হতো। দ্বিতীয় ধরনের টোলে প্রধানত স্মৃতি এবং সেই সঙ্গে কখনো পৌরাণিক কাব্য পড়ানো হতো। আর তৃতীয় ধারার টোলে ন্যায়শাস্ত্রই ছিল প্রধান পাঠ্য বিষয়।

সাধারণত কোনো বিশেষ টোলে কোনো একটি বিষয়েই উচ্চতর শিক্ষা দেওয়া হতো। কিন্তু প্রায় সব টোলেই ব্যাকরণ ও অলংকার পড়ানো হতো। হয়তো টোলের বিশেষজ্ঞ পণ্ডিতদের পরিবর্তে কোনো প্রবীণ ছাত্র এসব বিষয়ে পাঠ দিতেন। আবার ব্যাকরণ, অলংকার বা কাব্য-সাহিত্যেও উচ্চতর বিশেষজ্ঞ শিক্ষার প্রচলন ছিল। এসব বিষয়ে বিশেষ শিক্ষাপ্রাপ্তরা সাধারণত ব্যাকরণতীর্থ, কাব্যতীর্থ বা কাব্যরত্ন উপাধি লাভ করতেন। যাঁরা ন্যায়শাস্ত্র বা স্মৃতিশাস্ত্রে অথবা উভয় বিষয়ে বিশেষজ্ঞ শিক্ষালাভ করতেন, তাঁরা ন্যায়তীর্থ বা স্মৃতিতীর্থ অথবা উভয় উপাধিই লাভ করতেন। একই বিষয়ে বিভিন্ন শিক্ষক ভিন্ন উপাধিও প্রদান করতেন। যেমন: স্মৃতিরত্ন, কাব্যরত্ন, ন্যায়রত্ন, ন্যায়বাগীশ বা তর্করত্ন প্রভৃতি। খুব কম ক্ষেত্রেই একজন শিক্ষার্থী পাঁচ বা সাতটি বিষয়ে উচ্চতর বিশেষজ্ঞ শিক্ষা পেতেন। এসব ছাত্র পঞ্চতীর্থ বা সপ্ততীর্থ উপাধিতে ভূষিত হতেন। এ ক্ষেত্রে একজন শিক্ষার্থীকে সাধারণত একাধিক শিক্ষকের কাছে বিভিন্ন টোলে শিক্ষালাভ করতে হতো। সংখ্যা কম হলেও যাঁরা বেদ বা বেদান্তে বিশেষজ্ঞ শিক্ষালাভ করতেন, তাঁরা বেদান্ততীর্থ উপাধি পেতেন।

ছাত্ররা প্রয়োজনানুসারে যথেষ্ট ব্যাকরণের শিক্ষা পেলে তবেই অন্য বিষয়সমূহ যেমন: কাব্য, স্মৃতি বা দর্শনের পাঠ শুরু করতেন এবং সেই সঙ্গে ব্যাকরণের অনধীত অংশের পাঠ চালিয়ে যেতেন। যেসব ছাত্র স্মৃতি ও ন্যায়শাস্ত্র অধ্যয়ন করতেন, তাঁরা এক বা একাধিক টোলে ছয়, আট, এমনকি দশ বছর পর্যন্ত পড়াশোনা চালিয়ে যেতেন। টোলের পাঠাভ্যাস প্রধানত বাচনিক ধারায়ই চলত—এ কথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, যদিও পুঁথির ব্যবহারও চালু ছিল পাশাপাশি। টোলের শিক্ষাপ্রক্রিয়ায় উচ্চস্বরে পাঠ ও শোনার গুরুত্বই ছিল সবচেয়ে বেশি। লক্ষণীয় যে প্রধানত মুখস্থ বা কণ্ঠস্থ করার দ্বারা বাংলার টোলের শিক্ষাপ্রক্রিয়া নির্বাহিত হলেও এই ব্যবস্থা অনেক সৃজনশীল প্রাজ্ঞপণ্ডিতের জন্ম দিয়েছে। বাংলায় বিভিন্ন ধরনের ও বিশেষ বিষয়ের উচ্চশিক্ষার টোল ছিল। সাধারণত ব্রাহ্মণ বসতিপূর্ণ গ্রামেই এসব টোল অবস্থিত ছিল। কারণ, শিক্ষক ও ছাত্রদের বিপুলাংশই ব্রাহ্মণ পরিবারভুক্ত হতেন। বাংলায় পুঁথির ব্যবহার বৃদ্ধিতেও টোলের শিক্ষক ও ছাত্রদের অবদান যথেষ্ট। অনেক শিক্ষকই পুঁথি রচনা করতেন। মনে রাখতে হবে, পুঁথি রচনার কাজও শিক্ষাদানের মর্যাদা পেত। পুঁথি নকল করা উপার্জনের একটি উপায় ছিল।

বাংলার জমিদার শ্রেণীর উদার ভূমিদান ব্যতিরেকে বাংলায় সংস্কৃত উচ্চশিক্ষা বা বাংলার টোলের শিক্ষাব্যবস্থার শ্রীবৃদ্ধি সম্ভব হতো না। বাংলার টোল বা সংস্কৃত উচ্চশিক্ষাব্যবস্থা তাদের অস্তিত্ব বজায় রাখতে এই ভূস্বামী শ্রেণীর ওপর প্রায় সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল। কিন্তু এই টোল ছাড়াও মধ্যযুগে বাংলায় আরও কয়েক ধরনের প্রতিষ্ঠানের কথা জানা যায়। মক্তব, মাদ্রাসা ও পাঠশালা। মক্তব ও মাদ্রাসা শাসক বা স্থানীয় ভূস্বামীর সহযোগিতা পেলেও বাংলার পাঠশালা শিক্ষাব্যবস্থা তেমনভাবে ভূস্বামী শ্রেণীর পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেনি। পাঠশালায় লেখা, পড়া এবং অঙ্ক শেখানো হতো। পাঠশালা শিক্ষাব্যবস্থা কবে থেকে চালু হয়েছিল নিশ্চিত করে বলা যায় না। ধারণা করা হয়, কৃষি বা ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার, কৃষিজমিতে ব্যক্তিগত মালিকানা, লিখিত নথির প্রচলন, হিসাবের নানা জটিলতা ক্রমেই লেখা আর গণিত শেখার প্রয়োজনকে বড় করে তুলেছিল। আর এই প্রয়োজনের তাগিদেই তৈরি হয়েছিল পাঠশালা শিক্ষাব্যবস্থা। বাংলার ব্যবসায়ী, কারিগর ও কৃষিজীবীরা মিলে নিজেদের প্রয়োজনে নিজ উদ্যোগে এই পাঠশালা শিক্ষার ভিত গড়ে তোলে। কৃষক ও কারিগরদের এই শিক্ষাব্যবস্থা ছিল ধর্মনিরপেক্ষ বা পার্থিব বিষয়কে কেন্দ্র করে। সাধারণ গ্রাম্য জনসাধারণেরা যুক্তি-তর্ক, ন্যায়শাস্ত্র বাদ দিয়ে তাদের দৈনন্দিন প্রয়োজনে সেই শিক্ষাধারা গড়ে তুলেছিল। ব্রাহ্মণদের দিক থেকেও এ শিক্ষাদানে কোনো বাধা ছিল না। কারণ, সময়ের প্রয়োজনে উত্পাদনব্যবস্থাকে ঘিরেই সে শিক্ষাধারার জন্ম।

বাংলার শূদ্ররা হচ্ছে স্থানীয় অধিবাসী, ব্রাহ্মণেরা তা নয়। বাংলা ও দক্ষিণ ভারতে ব্রাহ্মণদের তুলনায় অনেক সময়েই শূদ্রদের সংখ্যাধিক্য ঘটেছে। এদের বেশির ভাগ ছিল কৃষক ও কারিগর। বাংলার শূদ্র সম্প্রদায়ের অধিকাংশ লোকই চাষাবাদ বা খেতের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করত। অনেকে ব্যবসা ও হস্তশিল্পের সঙ্গে যুক্ত ছিল। সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় ব্যবসার চেয়ে জমি ছিল অধিক গুরুত্বপূর্ণ। বাংলার তত্কালীন সমাজ এই শূদ্রদের উপেক্ষা করতে পারেনি। কারণ, ঠিকমতো জমি চাষ বা কর্ষণ না হলে সমাজের ধ্বংস অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়। সমাজের সর্ববৃহত্ বা ব্যাপক অংশজুড়ে আছে শূদ্ররা, সামাজিক কাঠামো থেকে এদের বাদ দেওয়া হলে সমাজব্যবস্থাই টিকিয়ে রাখা অসম্ভব। ফলে, মনুর কঠোর বিধান ক্রমেই নমনীয় হয়ে আসে, শূদ্রদের লেখাপড়া করার অধিকার জন্ম নিতে থাকে। সমাজ বাস্তবতাও শূদ্রদের কিছু কিছু বাস্তব জ্ঞান আহরণের দিকে আগ্রহী করে তোলে। বিশেষ করে বৌদ্ধধর্মের প্রভাব এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের কারণে শূদ্রদের ব্যবহারিক শিক্ষালাভের সুযোগ সৃষ্টি হয়। জমিজমা চাষ ও শস্য উত্পাদনের সঙ্গে গণনা ও হিসাবের একটা সম্পর্ক রয়েছে। সে জন্য অন্তত গণিত শিক্ষা তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

বাংলায় পাল ও সেন রাজবংশের পর ত্রয়োদশ শতকে সুলতানি শাসনের গোড়াপত্তন হয়। সুলতানি আমলে বাংলায় শিক্ষার তিনটি স্তর ছিল: প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চস্তর। প্রাথমিক শিক্ষা মসজিদসংলগ্ন মক্তবে কিংবা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে, মন্দিরে, অভিভাবক বা শিক্ষকের গৃহে, পথিকের বিশ্রামগৃহে, দোকানের কোণে অথবা গাছের নিচে প্রদান করা হতো। মুসলিম সমাজের প্রতিটি শিশু চার বছর চার মাস চার দিন বয়সে উপনীত হলে তাকে সুন্দর পোশাকে সাজিয়ে পরিবারের সব সদস্য ও অন্য স্বজনদের সামনে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রাথমিক জ্ঞান প্রদানের সূচনা করা হতো। শিশুটিকে পবিত্র কোরআনের কিছু অংশ পাঠ করানোর চেষ্টা করা হতো—শিশুটি পড়তে না চাইলে তাকে অন্তত ‘বিসমিল্লাহ’ উচ্চারণ করানোর প্রথা ছিল। প্রাথমিক অবস্থায় জোর দেওয়া হতো বিশুদ্ধ উচ্চারণের দিকে। পরবর্তীকালে ধারাবাহিকভাবে পান্দনামাহ, আন্দনামাহ, গুলিস্তান, বোস্তান ইত্যাদি ফারসি শিক্ষার গ্রন্থ পাঠ শিক্ষার্থীর জন্য আবশ্যক ছিল। তা ছাড়া দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন ব্যাপার ফারসি ভাষায় প্রকাশ করতে শেখানো হতো। পাশাপাশি ছাত্রদের ইউসুফ-জোলেখা, লাইলি-মজনুর কাহিনি, সিকান্দারনামাহ, আলেকজান্ডারের বিজয়ের ইতিহাস ইত্যাদি অধ্যয়ন করানো হতো। প্রাথমিক পর্যায়ে একজন শিক্ষার্থী প্রথমে ফারসি নাম, পরে আরবি এবং তারপর অন্যান্য ভাষায় নাম লেখার অভ্যাস করত। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছাত্রদের ফারসি-আরবির পাশাপাশি বাংলা ভাষা শিক্ষার প্রচলন ছিল। বাংলা বহু মুসলমানের মাতৃভাষা ছিল বলে বাঙালি মুসলমানরা মাতৃভাষাকে অবহেলা করতে পারেনি। বহিরাগত মুসলমানরাও বাংলা ভাষা এবং এ দেশকে নিজের দেশ হিসেবে গ্রহণ করেছিল।২৫

বাংলায় সুলতানি শাসনামলে মাধ্যমিক ও উচ্চস্তরের বিদ্যালয়গুলো ‘মাদ্রাসা’ নামে আখ্যায়িত ছিল। সে যুগের প্রাথমিক শিক্ষাকেন্দ্র মক্তব থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত শিক্ষার সর্বস্তর ছিল অবৈতনিক। ছাত্রদের ওপর কোনো প্রকার বেতন ধার্য করা হতো না। মুসলিম শাসক ও সম্পদশালী অভিজাত ও জমিদারবর্গ করমুক্ত জমি দান করে মসজিদ, মক্তব, টোল ও মাদ্রাসার ব্যয় নির্বাহের ব্যবস্থা করতেন। পাঠশালার শিক্ষকেরা সামান্য বেতনেই ছাত্রদের নিজগৃহে শিক্ষা দিতেন বা স্থানীয়দের সঙ্গে মিলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতেন। ছাত্রদের শিক্ষার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট পাঠশালার গুরুই ছিলেন প্রধানতম বিচারক। ছাত্রের শিক্ষাগত যোগ্যতার ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হলেই তিনি ছাত্রকে সনদ প্রদান করতেন। রাষ্ট্র কর্তৃক পরীক্ষা গ্রহণের বাধ্যবাধকতা ছিল না। শিক্ষার্থীরা জানত যে শিক্ষকই তাদের মূল্য যাচাই করার একমাত্র কর্তা। সুতরাং, এই শিক্ষাব্যবস্থায় পরীক্ষায় কৃতকার্য হওয়ার জন্য বাছাই করে পড়ার বা ফাঁকি দেওয়ার অবকাশ ছিল না। বাংলায় অধ্যয়ন বলতে পড়াশোনা শব্দবন্ধের ব্যবহার কিন্তু বিশেষ তাত্পর্য বহন করে। বাংলার টোলের শিক্ষাপ্রক্রিয়াকে ‘পড়াশোনা’ বললেও বাংলা পাঠশালার শিক্ষাপ্রক্রিয়া থেকেই ‘লেখাপড়া’ শব্দবন্ধের উদ্ভব বলেই মনে হয়। যদিও পরবর্তীকালে পড়াশোনা ও লেখাপড়া সমার্থক হয়ে দাঁড়ায়। পাঠশালার পড়াশোনা শেষ করে যে কেউ ইচ্ছা করলে টোল বা মাদ্রাসায় উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে পারত।

মুসলিমদের আগমনের আগে বাংলার শিক্ষাব্যবস্থা প্রধানত ব্রাহ্মণদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। মুসলিম শাসকেরা সুবিধাভোগী হিন্দুশ্রেণীর কবল থেকে নিম্নবর্গের হিন্দুদের সুবিধালাভের সুযোগ করে দেন। ফলে, নিম্নবর্গের হিন্দুদের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের পথ উন্মুক্ত হয়। মুসলিম শাসকেরা শিক্ষার পৃষ্ঠপোষকতা করার জন্য যে করমুক্ত ভূমি দান করতেন, তা শুধু মুসলিম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্যই ছিল না, হিন্দুদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্যও করমুক্ত তথা লাখেরাজ সম্পত্তি দান করা হতো। নিষ্কর জমি সরকার থেকে দান করা হতো মাদ্রাসা ও টোলের জন্য, প্রাথমিক শিক্ষা বা পাঠশালার জন্য নয়। পাঠশালা শিক্ষা ছিল সম্পূর্ণ স্বনির্ভর। মুসলিম শাসকেরা পাঠশালা শিক্ষার জন্য কোনো নিষ্কর ভূমি বরাদ্দ না করলেও নিম্নবর্গের শিক্ষালাভের ক্ষেত্রে সেটা কখনো বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। হিন্দু কবির রচিত মানিকচন্দ্র রাজার গান নামক কাব্যগ্রন্থ থেকে জানা যায়, মুসলিম শাসনামলে হিন্দু সমাজের নিম্নশ্রেণীর ‘হরি’ ও ‘সউদ’গণ দলিলপত্র পড়া ও লেখার মতো যথেষ্ট শিক্ষিত ছিলেন। এমনকি নাপিত ও ঝাড়ুদাররা বিদ্যা ও সাহিত্যজ্ঞানে খ্যাতি অর্জন করেন। নল-দময়ন্তীর কবি মধুসূদন ছিলেন একজন নাপিত। একজন ধোপা ভাগমন্ত ধোপী হরিবংশ লিখে সম্মান অর্জন করেন।

সুলতানি আমলেই বাংলায় মাদ্রাসাশিক্ষার শুরু হলেও তা ছিল সাধারণভাবে মুসলমান শাসকদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তবে মুসলমান শাসকেরা কখনোই বাংলা ভাষার চর্চা বা শিক্ষার বিরোধিতা করেননি। বরং অনেক সুলতান বাংলার ভাষা ও সাহিত্যচর্চায় উত্সাহ দিয়েছেন। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে হুসেন শাহের নাম বারে বারে গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে। শ্রীকর নন্দী লিখেছেন, ‘নৃপতি হুসেন শাহ হএ ক্ষিতি পতি। সামদান দণ্ডভেদে পালে বসুমতী।’ সুলতানি আমলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যচর্চার বাড়বাড়ন্ত তাই কিছু অস্বাভাবিক নয়।২৬ যা-ই হোক, সুলতানি আমলের এই অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থায় গড়ে ওঠে মধ্যযুগের বিশাল বাংলা সাহিত্য আর পাশাপাশি গড়ে ওঠে বাংলা শিক্ষার প্রথাবদ্ধ ধারা বাংলা পাঠশালা। স্বাভাবিকভাবেই নিচুতলার শূদ্ররাই মূলত এই দুই ধারার ধারক-বাহক। সঙ্গে ছিল আর সবাই। পাদরি উইলিয়াম অ্যাডামের প্রতিবেদনে দেখা যায় যে, বর্ধমানের ১৩টি থানায় ৬২৯টি পাঠশালায় ৬৩৯ জন শিক্ষকের মধ্যে ৩৫৯ জনই ছিলেন কায়স্থ। বাকিদের ১০৭ জন ব্রাহ্মণ, ৫০ জন সদেগাপ, ৩০ জন আগুরি, ১৩ জন বৈষ্ণব, ১০ জন তেলি, নয়জন ভট্টা, ছয়জন গন্ধবণিক, ছয়জন কৈবর্ত, দুজন বাগদি; আর নাগ, তাঁতি, দৈবজ্ঞ, বৈদ্য, যুগী, বাড়ুই, কামার, ময়রা, ধোপা, রাজপুত ও কলু একজন করে। নয়জন মুসলমান আর তিনজন খ্রিষ্টান। বীরভূমে মোট যে ৪১৪ জন শিক্ষক সম্পর্কে খোঁজ পাওয়া যায়, তাঁদের মধ্যে ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, সদেগাপ ছিল মোট ৩৫৪ জন। বাকিরা অন্য বর্ণের বা ধর্মের। একমাত্র কায়স্থ শিক্ষকের সংখ্যাই ছিল ২৫৬। একজন ছিলেন মুসলমান শিক্ষক আর চারজন খ্রিষ্টান। দক্ষিণ বিহারে ২৮৫ জন শিক্ষকের মধ্যে ২৭৮ জনই ছিলেন কায়স্থ। মুর্শিদাবাদে ৬৭ জন শিক্ষকের ৩৯ জন ছিলেন কায়স্থ।২৭

সুলতানি আমলে গড়ে উঠলেও সতেরো শতক নাগাদই বাংলা পাঠশালার পূর্ণাঙ্গ বিকাশ ঘটে। সতেরো-আঠারো শতকের বাংলা সাহিত্য ও বিদেশি পর্যটকদের বিবরণে পাঠশালার উল্লেখ ও বর্ণনার ছড়াছড়ি। পাঠশালার প্রধান দুটি শিক্ষার বিষয় ছিল লেখা আর গণিত। উইলিয়াম ওয়ার্ড ১৮০৩ সালে লিখেছেন যে বাংলার প্রায় সব বড় গ্রামেই সাধারণ বিদ্যালয় ছিল। খড়-ছাওয়া মাটির ঘরে অথবা ছায়াযুক্ত গাছের তলায় এসব পাঠশালা বসত এবং দরিদ্র জনগণের শিক্ষার বাস্তব প্রয়োজন এই পাঠশালা বহুকাল ধরে মিটিয়ে আসছিল।২৮ তিনি আরও জানাচ্ছেন, গ্রামের বিদ্যালয়গুলোতে পার্থিব শিক্ষা দেওয়া হতো। পাঠশালার শিক্ষাপদ্ধতি সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, ‘অক্ষরে পরিচিতির পর যুক্তাক্ষর লিখতে হতো। তারপর মানুষের নাম, গ্রামের নাম, পশুপাখির নাম লিখতে হতো। পরে অঙ্ক লেখা শুরু হতো। পাতায় লেখা শুরু হলে পড়ুয়ারা দিনে দুবার সর্দার পড়ুয়ার সঙ্গে কড়া, গণ্ডা, বুড়ি, পণ ও কাহনের নামতা মুখস্থ বলত। তারপর এক থেকে এক শ পর্যন্ত সংখ্যা ও নামতা মুখস্থ করতে হতো। শেষে কলাপাতায় যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ এবং ওজনের নিয়ম ইত্যাদি শিখতে হতো। বড় ছেলেরা সাধারণ চিঠিপত্র ও দলিল বা চুক্তিপত্র লিখতে শিখত।’ উনিশ শতকের প্রথম দশকেই বুকানন হ্যামিলটন জানাচ্ছেন যে হিন্দু ও মুসলমান ছেলেদের প্রাথমিক শিক্ষা হতো পাঠশালায় কোনো গুরুমশাইয়ের কাছে। আর এই গুরুমশাইরা যেকোনো বর্ণের ও ধর্মের হতো। এসব পাঠশালায় শিক্ষকের জন্য কোনো সরকারি অনুদান বা সাহায্যের ব্যবস্থা ছিল না। জীবনধারণের জন্য তাঁদের সম্পূর্ণভাবে পড়ুয়াদের ওপর নির্ভর করতে হতো। তিনি আরও জানাচ্ছেন যে পাঁচ বছর বয়সেই শিশুরা পাঠশালায় যেত। এরা একই সঙ্গে লিখতে ও পড়তে শিখত। এই পদ্ধতি ছিল দারুণ।

তথ্যসূত্র

১ বেবী দত্ত, মধুমালা সেনগুপ্ত, দেবিকা গুহ, ভারতীয় শিক্ষার ইতিহাস, কলকাতা: প্রগতিশীল প্রকাশক, ২০১১, পৃ. ১৭।

২ দিজেন্দ্র নারায়ণ ঝা রচিত ও গৌরীশংকর দে অনূদিত, আদি ভারত, কলকাতা: প্রগ্রেসিভ পাবলিশার্স, ২০০৮, পৃ. ৬১।

৩ আল বিরুনি রচিত ও প্রভাত মুখোপাধ্যায় অনূদিত, ভারত, নয়াদিল্লি: ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট, দ্বিতীয় মুদ্রণ ২০১০, পৃ. ৪৪-৪৫।

৪ রামশরণ শর্মা, প্রাচীন ভারতের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাস, কলকাতা: ওরিয়েন্ট লংম্যান, ১৯৯৬, পৃ. ২৬।

৫ আল বিরুনি, পূর্বোক্ত, পৃ. ৩২।

৬ ভূতনাথ সপ্ততীর্থ অনূদিত, মনুস্মৃতির মেধাতিথি ভাষ্য, প্রথম খণ্ড, কলকাতা: সংস্কৃত কলেজ, ১৩৬১, পৃ. ১৫৯।

৭ বেবী দত্ত, মধুমালা সেনগুপ্ত, দেবিকা গুহ, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৪।

৮ অনিল ভট্টাচার্য, শিক্ষা সমাজ ও সময়, কলকাতা: প্রগতিশীল প্রকাশন, ২০১০, পৃ. ১৪-১৫।

৯ রাহমান চৌধুরী, ‘যন্ত্রসভ্যতা এবং পরিবেশ বিনাশের বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের নাটক’, নতুন দিগন্ত, দশম বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা, শ্রাবণ-আশ্বিন ১৪১৯, পৃ. ৩৭।

১০ বেবী দত্ত, মধুমালা সেনগুপ্ত, দেবিকা গুহ, পূর্বোক্ত, পৃ. ৪৫।

১১ রামশরণ শর্মা, পূর্বোক্ত, পৃ. ৪৯।

১২ ভাস্কর চট্টোপাধ্যায়, ভারতের আর্থ-সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা, কলকাতা: প্রগ্রেসিভ পাবলিশার্স, ২০০৪, পৃ. ১১৫।

১৩ কালীপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায়, মধ্যযুগে বাঙ্গলা, কলকাতা: দে’জ পাবলিশিং, ২০০২, পৃ. ৩৪।

১৪ বেবী দত্ত, মধুমালা সেনগুপ্ত, দেবিকা গুহ, পূর্বোক্ত, পৃ. ৩৪।

১৫ পরমেশ আচার্য, বাংলার দেশজ শিক্ষাধারা, কলকাতা: অনুষ্টুপ প্রকাশনী, ২০০৯, পৃ. ১৫২-১৫৩।

১৬ বেবী দত্ত, মধুমালা সেনগুপ্ত, দেবিকা গুহ, পূর্বোক্ত, পৃ. ৬৫।

১৭ স্মৃতিতীর্থ শশীভূষণ সম্পাদিত, জ্যোতিষতত্ত্বম, কলকাতা ১৩৩৪, পৃ. ৩৪২।

১৮ কালীপসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায়, মধ্যযুগে বাঙ্গলা, কলকাতা: দে’জ পাবলিশিং, ২০০২, পৃ. ৫৬।

১৯ স্মৃতিতীর্থ শশীভূষণ, পূর্বোক্ত, পৃ. ৩৪২।

২০ ঐ, পৃ. ৩৪৯।

২১ দীনেশচন্দ্র সেন, বৃহত্ বঙ্গ, কলকাতা: দে’জ পাবলিশিং, ১৯৯৩, পৃ ১৪১-১৪৫।

২২ ঐ,  পৃ ১৪৮।

২৩ ঐ, পৃ ১৫১।

২৪ কালীপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায়, পূর্বোক্ত, পৃ. ৫৪।

২৫ মো. আব্দুল্লাহ আল-মাসুম, ‘ব্রিটিশ আমলে বাংলার মুসলিম শিক্ষা: সমস্যা ও প্রসার, ঢাকা: বাংলা একাডেমী, ২০০৮, পৃ. ১২।

২৬ পরমেশ আচার্য, পূর্বোক্ত, পৃ. ৬২।

২৭ কাজী শহীদুল্লাহ, পাঠশালা থেকে স্কুল, আবদুল মমিন চৌধুরী অনূদিত, ঢাকা: বাংলা একাডেমী, ১৯৯৪, পৃ. ৭।

২৮ সুখময় সেনগুপ্ত, বঙ্গদেশে ইংরেজী শিক্ষা: বাঙালীর শিক্ষা চিন্তা, কলকাতা: পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ, ১৯৮৫, পৃ. ১১।