পূর্ববঙ্গে পাকিস্তানি উপনিবেশবাদ

পাক কলওনিয়্যালিজম ইন ইস্ট বেঙ্গল—ডি. আর. মানকেকার,

সুমাইয়া পাবলিকেশনস প্রাইভেট লিমিটেড, নয়াদিল্লি: ১৯৭১

ডি. আর. মানকেকার গ্রন্থিত পাক কলওনিয়্যালিজম ইন ইস্ট বেঙ্গল গ্রন্থটি সেপ্টেম্বর ১৯৭১, নয়াদিল্লিতে সুমাইয়া পাবলিকেশনস প্রাইভেট লিমিটেড কর্তৃক প্রকাশিত হয়। পাক কলওনিয়্যালিজম ইন ইস্ট বেঙ্গল গ্রন্থটি পর্যালোচনার ক্ষেত্রে এর রচনাকাল ও প্রকাশকাল উভয়ই বিবেচনায় রাখা উচিত। গ্রন্থটিতে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম থেকে বাংলাদেশের স্বাধিকার আদায়ে চলমান মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত সময়পরিক্রমায় পূর্ব পাকিস্তানের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসনের কার্যকারণ, প্রভাব ও পরিণতি তুলে ধরার প্রয়াস রয়েছে। ২৫৪ পৃষ্ঠার গ্রন্থটিকে লেখক ১৬টি অধ্যায়ে ভাগ করে বিষয়ভিত্তিক বিশ্লেষণ করেছেন। পাঠকদের সুবিধার্থে তিনি গ্রন্থের পরিশিষ্টে কিছু গুরুত্বপূর্ণ নথির অনুলিপি সংযুক্ত করেছেন। গ্রন্থটির গুরুত্ব ও তাত্পর্য এই যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন রচিত বলে হয়তো অনেক অনুমিত বর্ণনা একপক্ষীয় কিন্তু উত্থাপিত ও বর্ণিত বিষয়গুলো তত্কালীন সমসাময়িক বাস্তবতায় অকাট্য ও বাস্তব। ডি. আর. মানকেকার তাঁর গ্রন্থ রচনায় পাকিস্তানের দাপ্তরিক ও অ-দাপ্তরিক নথিপত্রের পাশাপাশি পাকিস্তানি ও বিদেশি সংবাদপত্রের ওপর নির্ভর করেছেন। বিশেষত ১৯৭১ সালের প্রথম পাঁচ মাসে প্রকাশিত পাকিস্তান টাইমস ও ডন-এর প্রতিবেদনগুলো তিনি সূত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন।

‘২০০ বছরের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের পরম্পরায় পশ্চিম পাকিস্তান এই ভূখণ্ডে নয়া উপনিবেশবাদ স্থাপন করেছে।’ গ্রন্থের মুখবন্ধে ডি. আর. মানকেকার (পৃষ্ঠা-১)

যখন বিশ্বে উপনিবেশবাদ বিলুপ্তির পথে এমন সময় পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়। পশ্চিম পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসন পূর্বসূরি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ অপেক্ষা ক্রূর এবং সহিংস ছিল। মানকেকার তাঁর গ্রন্থে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মুক্তির জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ববঙ্গের বাঙালিদের গণতান্ত্রিক শক্তির সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানিদের স্বৈরতন্ত্রের মধ্যে দ্বন্দ্বের বিষয়টিও তুলে ধরেছেন। অবশ্য পূর্ববঙ্গের মুসলিমদের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের মুসলিমদের (দেশ ভাগের আগে সাবেক ভারতীয় উচ্চবর্ণের মুসলিমদের) দ্বৈরথ নতুন কোনো বিষয় নয়। ২৫ মার্চ ১৯৭১ পর্যন্ত পাকিস্তানের উভয় অংশের রাজনীতিবিদেরা (জুলফিকার আলী ভুট্টো ছাড়া) নির্বাচনের রায় মেনে জনগণের ইচ্ছার সম্মান রাখতে শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর চেয়েছিলেন। তত্কালীন সময়ে পাকিস্তান টাইমস ও ডন-এর মতো ডাকসাইটে পত্রিকা শেখ মুজিবের ছয় দফা ও আওয়ামী লীগের সরকার গঠনের প্রক্রিয়াকে স্বাগত জানায়। মুমতাজ দৌলতানা ও শওকাত হায়াত খানের মতো কট্টর পাঞ্জাবি নেতা ও আবদুল কাইয়ুম খান ইয়াহিয়াকে ছয় দফার ভিত্তিতে শেখ মুজিবের সঙ্গে আলোচনার জন্য ২৫ মার্চ পর্যন্ত অনুরোধ করেছিলেন। পশ্চিম পাকিস্তানের অধিকাংশ রাজনৈতিক নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের নতুন সংবিধানের দাবিকে সমর্থন জানিয়েছিলেন। মানকেকারের মতে, শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর দলের বিরুদ্ধে ইয়াহিয়ার আগ্রাসী ও দমননীতির প্রতি সন্দেহাতীতভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের জনসাধারণ এবং অধিকাংশ রাজনৈতিক নেতৃত্বের সমর্থন ছিল না। ব্রিটিশরা ভারতীয়দের তীব্র বিরোধিতা ও পরিস্থিতির বৈরিতা বিবেচনা করে তাদের ঔপনিবেশিক কর্তৃত্ব পরিত্যাগ করেছিল কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তান তার ঔপনিবেশিক কর্তৃত্ব টিকিয়ে রাখতে সামরিক শাসন স্থাপনের জন্য নির্বিচারে জনমানুষের বিরুদ্ধে ট্যাংক, মেশিনগানের মতো ভারী অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করেছিল। পশ্চিম পাকিস্তানের পূর্ববঙ্গে উপনিবেশবাদের রক্তাক্ত পরিসমাপ্তি ঘটে। ভারতে ২০০ বছরের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের তুলনায় পূর্ববঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসন অত্যন্ত অমানবিক ও রক্তাক্ত ছিল।

ভারতীয় উপমহাদেশের দুই প্রান্তের দুই ভূখণ্ড নিয়ে পাকিস্তানের জন্মকে একটা রাষ্ট্রের জন্ম বলার চেয়ে একটা জাতির জন্ম বলাই যুক্তিযুক্ত। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়ে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ১২০০ মাইল দূরত্বে অবস্থিত এবং অন্য আরেকটি জাতিরাষ্ট্র দ্বারা বিভাজিত দুটি পৃথক ভূখণ্ড নিয়ে গঠিত হয় পাকিস্তান। পশ্চিমাংশের নামকরণ করা হয় পশ্চিম পাকিস্তান এবং পূর্বাংশ পরিচিতি লাভ করে পূর্ব পাকিস্তান বা পূর্ববঙ্গ নামে। ভাষা, সংস্কৃতি, নৃতাত্ত্বিকভাবে সম্পূর্ণ আলাদা এবং ভৌগোলিকভাবে অসম দূরত্বে অবস্থান সত্ত্বেও শুধু ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে গঠিত এই জাতিরাষ্ট্রের ভবিষ্যত্ জন্মের সময়ই নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল। শুধু সময়ের পরিক্রমায় এই জাতিরাষ্ট্রের পূর্বনির্ধারিত ভাঙন ২৪ বছরে বাস্তবায়িত হয়। অবিভক্ত পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের মধ্যে যে মরণঘাতী বিষফোড়া সুপ্ত ছিল, তা-ই সময়ের পটপরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মরণঘাতী ক্যানসারে রূপান্তরিত হয়। ২৪ বছরে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম-ত্রুটিগুলো বিষবৃক্ষ হয়ে বিষবাষ্প ছড়াতে শুরু করে। দুটি ভূখণ্ড, মাঝখানে হাজার মাইলেরও বেশি ভিন্ন রাষ্ট্রের দেয়াল নিয়ে একটা রাষ্ট্র হিসেবে জন্ম লাভ করার দৃষ্টান্ত আধুনিক ইতিহাসে নেই। হাজার হাজার মাইল ব্যবধান নিয়ে ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন রাষ্ট্র আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কা ও হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ মূল মার্কিন ভূখণ্ড থেকে বহু দূরে। কিন্তু আলাস্কা ক্রয়সূত্রে এবং হাওয়াই দখলি সূত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অংশ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্ম তাদের নিয়ে হয়নি। ব্রিটেন ও ফ্রান্সের অনেক দূরবর্তী ভূখণ্ড রয়েছে। কিন্তু সেগুলো উপনিবেশ, মূল রাষ্ট্র নয়। মালয়েশিয়ার মূল ভূখণ্ড ও তার সারাওয়াক অঞ্চলের মধ্যে অনেক ব্যবধান, কিন্তু তাদের মধ্যে কোনো ভিন্ন রাষ্ট্রের দেয়াল নেই। সুতরাং ভারতীয় উপমহাদেশের দুই প্রান্তের দুই ভূখণ্ড নিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মলাভ একেবারেই অনন্য একটা ঘটনা। এই অনন্য ঘটনা সংঘটিত হয়েছে দুই ভূখণ্ডের মানুষের এক জাতিত্বের ধারণা থেকে। ব্রিটিশ ভারতের ‘ভারতীয়’রা হিন্দু ও মুসলিম দুই পরিচয় নিয়ে মুসলমানেরা গঠন করল পাকিস্তান রাষ্ট্র। এই রাষ্ট্র গঠন সম্ভব হলো উপমহাদেশে মুসলমানদের একটা স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে জন্মলাভের ফলেই। অতএব জাতির জন্মটাই এখানে মুখ্য। এ কারণেই পাকিস্তানের জন্মকে একটা রাষ্ট্রের জন্ম না বলে একটা জাতির জন্ম বলে অভিহিত করা হয়েছে।

আজকের দুনিয়ায় যখন ভাষা ও অঞ্চলভিত্তিক জাতিরাষ্ট্র গঠনের বন্যা বয়ে চলেছে, সেই সময় মুসলিম জাতিভিত্তিক ভারত বিভাগ এবং রাষ্ট্র গঠন আধুনিক বিশ্বের এক নজিরবিহীন ঘটনা। এই জাতি গঠন ও রাষ্ট্র গড়ার মধ্য দিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের মুসলমানেরা অনন্য এক দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিল। কিন্তু রাষ্ট্রটি টিকল না আড়াই যুগও। পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটির ২৫তম স্বাধীনতা দিবস আসার আগেই ভেঙে পড়ল রাষ্ট্রটি। পূর্ব পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হলো। অবশ্য পূর্ব পাকিস্তান স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশে পরিণত হলেও ১৯৪৭-এর ভারত বিভাগ অক্ষুণ্নই থাকল। পূর্ব পাকিস্তান যেমন ছিল মুসলিম আবাসভূমি, বাংলাদেশও সেই পরিচয়কেই গ্রহণ করল। বাংলাদেশ এ পরিচয়কে বড় করে না দেখলে আঞ্চলিক স্বার্থ, সুযোগ ও ভাষার ঐক্যকে সামনে রেখে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে মিশে যাওয়াই তার জন্যে যুক্তিযুক্ত ছিল। ১৯০৫ সালের বঙ্গ বিভাগ টেকেনি কেন? টেকেনি কারণ, বিভাগটা ছিল প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক বিবেচনাপ্রসূত। এর বিরুদ্ধে কলকাতাবাসী শক্তিশালী যুক্তি উত্থাপন করেছিল অখণ্ড বাংলার, অখণ্ড বাঙালি ও অখণ্ড বাঙালি জাতিসত্তার। শেষে এই যুক্তিই জয়ী হয়েছিল। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের সময় বঙ্গ বিভাগের প্রশ্নে এ যুক্তি উঠেছিল। বলা হয়েছিল, বাংলার অখণ্ডত্বের কথা। পাকিস্তান ভেঙে এক অংশ স্বতন্ত্র স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রে পরিণত হলো, অপর অংশ পাকিস্তানই থাকল। কিন্তু পাকিস্তান ভাঙার এই কাজটা হলো রক্তক্ষয়ী। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানে বিজয় লাভ করল শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগ এবং পশ্চিম পাকিস্তানে জুলফিকার আলী ভুট্টোর পিপলস পার্টি। গণতন্ত্রের বিধান অনুসারে সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থনপুষ্ট শেখ মুজিব সরকার গঠন করার কথা। কিন্তু শাসনতন্ত্র প্রণয়নের সময়কাল এবং শাসনতন্ত্রের প্রকৃতি নিয়ে বিতর্ক তুলে জাতীয় পরিষদ আহ্বানও করা হলো না এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরও হলো না। তার বদলে শুরু হলো ভুট্টো-সামরিক কোটারি-পাঞ্জাবি স্বার্থের কুিসত ষড়যন্ত্র। এই ষড়যন্ত্র যুক্তির বদলে শক্তির আশ্রয় গ্রহণ করল এবং সামরিক শক্তি দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের দাবি দমন করতে চাইল। এই পরিস্থিতিই ডেকে নিয়ে এল রক্তক্ষয়ী সংঘাত। এই সংঘাতেই ভেঙে গেল পাকিস্তান এবং সৃষ্টি হলো স্বাধীন বাংলাদেশের। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক ঘটনা।

১৯৪৭ সালের পাকিস্তান-ভারত দেশভাগের মতো ১৯৭১ সালে পাকিস্তান আবার দেশভাগের শিকার হয়। পাকিস্তান ভাগের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক মানসিকতা এবং বিমাতাসুলভ আচরণ দায়ী। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের নিরঙ্কুশ বিজয় পাকিস্তানের ভাঙন সুনিশ্চিত করে। ১৯৭০ সালের নির্বাচন পূর্ববঙ্গের আনুষ্ঠানিক রাজনৈতিক পরিচয় গড়ে দেয় এবং স্বতন্ত্র জাতিগত ও সাংস্কৃতিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি প্রতিষ্ঠিত করে। শেখ মুজিবুর রহমানের ‘মুক্তির আন্দোলন’ সফল হলে পাকিস্তানের অন্যান্য অঞ্চলও স্বাধীনতার দাবি করবে, এই ভয়ে ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাঙালিদের ‘মুক্তির আন্দোলন’ নস্যাত্ করতে সর্বাপেক্ষা নৃশংস কৌশল বেছে নেন। স্বাধীন বাংলাদেশের আন্দোলন অতি দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠার প্রধান কারণ ছিল ২৪ বছরের পাশবিক ঔপনিবেশিক শোষণ।

পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রীয় সম্পর্কে আবদ্ধ ছিল না, ঔপনিবেশিক সম্পর্কে সম্পর্কিত হয়। পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ববঙ্গের বা পূর্ব পাকিস্তানের ওপর নব্য ঔপনিবেশিক শাসন স্থাপন করে। ২০০ বছরের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক মডেলে পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ববঙ্গকে ২৪ বছর ধরে শোষণ করেছে। অনেক ক্ষেত্রে এই শোষণের মাত্রা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সময়ের চেয়েও বেশি ছিল। সদ্য ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তি পাওয়া কোনো অঞ্চল সমগোত্রীয় আরেকটি অঞ্চলের ওপর এরূপ উপনিবেশ স্থাপন করার ঘটনা বিশ্ব ইতিহাসে বিরল। মানকেকার যথার্থই তাঁর গ্রন্থে বলেছেন, ‘বিশ্ব থেকে যখন উপনিবেশবাদ বিদায় নিচ্ছে সে সময় পশ্চিম পাকিস্তান নব্য উপনিবেশবাদী রাষ্ট্রদর্শন অনাকাঙ্ক্ষিত হলেও তাদের রাজনৈতিক দর্শনে এটি সহজাত ছিল (পৃষ্ঠা- ১)।’

লেখক তাঁর গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়ে পূর্ববঙ্গের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের সম্পর্ককে ঔপনিবেশিক সম্পর্ক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তাঁর মতে, পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ববঙ্গ বা পূর্ব পাকিস্তানের আদৌ কোনো যুক্তরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক ছিল না। পাকিস্তান সৃষ্টির সময় থেকে পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ববঙ্গ বা পূর্ব পাকিস্তানকে তাঁর ঔপনিবেশিক অঞ্চল হিসেবে বিবেচনা করে এসেছে। অথচ পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের প্রারম্ভে ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন দুটি অঞ্চল যুক্তরাষ্ট্রীয় সম্পর্কে সম্পর্কযুক্ত হওয়ার কথা ছিল। এই নব্য ঔপনিবেশিক শাসন তত্কালীন বৈশ্বিক রাজনীতির প্রেক্ষাপটে অভিনব বিষয় ছিল। এর ফলে বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলন ও স্বাধীনতার দাবির ন্যায্যতা বিশ্ববাসীর কাছে প্রমাণের জন্য ও তাদের সমর্থন আদায়ে বাংলাদেশকে অনেক বাধা ও প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করতে হয়েছে। বিশ্ববাসীর কাছে সামরিক শাসক জেনারেল ইয়াহিয়ার গণতন্ত্রমনা ইমেজের মুখোশ খুলে দেওয়া ছিল সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন আয়োজনের মধ্য দিয়ে ইয়াহিয়া একজন গণতন্ত্রপন্থী সামরিক শাসক হিসেবে শুধু বিদেশে নয়, পাকিস্তানে বিশেষত পশ্চিম পাকিস্তানে পরিচিতি পেয়েছিলেন।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ সাড়ে সাত কোটি মানুষের বিরুদ্ধে তিনি ইতিহাসের বর্বরোচিত জেনোসাইড শুরু করেন। দেশে-বিদেশে অনেকে প্রথমে তা সত্য বলে বিশ্বাস করতে বা মেনে নিতে পারেননি। ইয়াহিয়া খানের ওপর হিটলারের ভূত ভর করেছিল, সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ না থাকলেও অনেকেই সে সময় বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন বা অগ্রাহ্য করেছেন। আন্তর্জাতিক মহলে যখন ইয়াহিয়া খান কর্তৃক পূর্ববঙ্গে সংঘটিত জেনোসাইডের খবর প্রকাশিত হয়, তখন অনেকে একে বানোয়াট এবং ষড়যন্ত্রমূলক আখ্যা দিয়ে প্রত্যাখ্যান করেন। কিন্তু অতি স্বল্প সময়ের মধ্যেই তাঁদের এই ভ্রান্ত আস্থা ও বিশ্বাসের স্তম্ভ ভেঙে পড়ে, যখন পূর্ববঙ্গে দায়িত্ব পালনকারী বিদেশি সংবাদদাতাদের একের পর এক প্রামাণ্য প্রতিবেদন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। ইয়াহিয়া খান এবং তাঁর জেনারেলদের নেতৃত্বে সামরিক বাহিনী কীভাবে পূর্ববঙ্গের বর্তমান এবং ভবিষ্যত্ নেতৃত্বের উত্স বুদ্ধিজীবী সমাজ তথা ছাত্র, শিক্ষক, রাজনীতিবিদ ও পেশাদার ব্যক্তিবর্গকে নিধনের মাধ্যমে রাজনৈতিকভাবে সচেতন বাঙালি জনগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করতে যে আগ্রাসী হামলা চালায়, তার নগ্ন রূপ প্রকাশিত এবং প্রচারিত প্রামাণ্য সংবাদ এবং প্রতিবেদনগুলো থেকে জানা যায় (পৃষ্ঠা ১-২)।

অনুরূপভাবে ইয়াহিয়া খান পরিচালিত বাঙালি নিধনের হলোকাস্টে এক সপ্তাহের মধ্যে ঢাকায় ১০ হাজারসহ সারা দেশে দুই লাখ মানুষ হতাহত হওয়ার বিষয়টি আন্তর্জাতিক মহলে বানোয়াট সংবাদ হিসেবে পরিগণিত হয়। অবশ্য পরবর্তী সময়ে প্রমাণিত হয় এই সংখ্যা শুধু সত্য নয় বরং আরও কয়েক গুণ বেশি ছিল। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেসামরিক ছাত্রাবাস ট্যাংক হামলা চালিয়ে গুঁড়িয়ে দেয় এবং নিরীহ, নিরস্ত্র ছাত্র ও শিক্ষক এবং পুরান ঢাকার সংখ্যালঘু হিন্দুদের ওপর নির্বিচারে হামলা চালিয়ে তাদের নৃশংসভাবে হত্যা করে।

ইয়াহিয়া খানের সংঘটিত জেনোসাইড বা হলোকাস্ট আরও কিছুদিন চাপা থাকত যদি না তিনি পূর্ব পাকিস্তানে দায়িত্বরত ৩৫ জন বিদেশি সংবাদদাতাকে অপমানজনকভাবে বহিষ্কার না করতেন। ইয়াহিয়ার পূর্ববঙ্গের সামরিক প্রশাসন ৩৫ জন বিদেশি সাংবাদিককে গৃহবন্দী রাখে এবং তাঁদের নোটবুক, ক্যামেরার রিল ইত্যাদি জব্দ করে জোর করে ঢাকা ত্যাগ করতে বাধ্য করে। পরবর্তী সময় বিভিন্নভাবে অনুপ্রবেশকারী বিদেশি সাংবাদিকদের প্রতিবেদনে পূর্ববঙ্গে পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতার সত্য কাহিনি তুলে ধরা হয়। বিদেশি গণমাধ্যমে প্রচারিত প্রামাণ্য সংবাদ প্রতিবেদনের মাধ্যমে পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক সহিংস আগ্রাসনের বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। গ্রন্থকারের মতানুসারে, পাকিস্তানি বাহিনীর জেনোসাইডের দুটি প্রধান উদ্দেশ্য ছিল—প্রথমত, পূর্ববঙ্গের সনাতন ধর্মাবলম্বীদের (হিন্দু) হত্যা করা অথবা ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য করার মাধ্যমে তাদের সংখ্যা শূন্যতে নামিয়ে আনা। দ্বিতীয়ত, অবিভক্ত পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিদের সংখ্যালঘিষ্ঠে পরিণত করা। উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালে পূর্ববঙ্গে ৮০ লাখ সনাতন ধর্মাবলম্বী বসবাস করত এবং অবিভক্ত পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৫৬ শতাংশ (সাড়ে সাত কোটি) ছিল বাঙালি জনগোষ্ঠী।

ইয়াহিয়া খানের সামরিক প্রশাসন পরবর্তী সময় তাদের অপকর্ম সম্পর্কে প্রচারিত সংবাদ প্রতিবেদনগুলোকে বানোয়াট ও ষড়যন্ত্রমূলক প্রমাণ করার জন্য বিভিন্ন দেশের গণমাধ্যমের সংবাদদাতাদের পূর্ব পাকিস্তান পরিদর্শনের আমন্ত্রণ জানায়। পাকিস্তান সরকার সুনিয়ন্ত্রিতভাবে আগত বিদেশি সংবাদকর্মীদের পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শনে নিয়ে যায়। অবশ্য এই প্রচেষ্টা যে ব্যর্থ হয়েছে তার প্রমাণ অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের পশ্চিম পাকিস্তানের করাচিভিত্তিক ইংরেজি দৈনিক মর্নিং নিউজ-এর দায়িত্ব পরিত্যাগ এবং পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত জেনোসাইড নিয়ে দ্য সানডে টাইমসে সংবাদ প্রতিবেদন প্রকাশ। ঢাকা ও কুমিল্লায় পাকিস্তানি জেনারেলরা ৩০ বছর পূর্ব পাকিস্তানে তাদের উপনিবেশ টিকিয়ে রাখার প্রয়োজনে ২০ লাখ বাঙালিকে হত্যা করবে বলে অ্যান্থনি মাসকারেনহাস তাঁর প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন।

মানকেকার তাঁর গ্রন্থে তত্কালীন সময়ে অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকের বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য মুক্তিসংগ্রামকে নাইজেরিয়ার বায়োফ্রার বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের সঙ্গে তুলনা করাকে অযৌক্তিক বলে মন্তব্য করেছেন। তাঁর মতে, ইগবো নাইজেরিয়ার সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী এবং তারা সশস্ত্র স্বাধীনতা আন্দোলনের আগে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ লগোসদের সঙ্গে রাজনৈতিক সমাধানে পৌঁছাতে চেষ্টা করেনি। কিন্তু পাকিস্তানে বাঙালিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল এবং যথার্থভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিদের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন, ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ কখনো সংখ্যালঘিষ্ঠের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারে না। বস্তুত বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম কোনো বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন নয়, বরং স্বাধীনতার জন্য ন্যায়যুদ্ধ ছিল’ (পৃষ্ঠা ৫)। পূর্ববঙ্গ সশস্ত্র স্বাধীনতাসংগ্রামের পূর্বে লাগাতার ২০ বছর অসীম বৈষম্য হ্রাসের জন্য সংবিধান সংশোধন এবং স্বায়ত্তশাসনের জন্য আন্দোলন করেছে। আর বরাবর পশ্চিম পাকিস্তানভিত্তিক পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার সে আন্দোলনকে সহিংস পন্থায় দমনের চেষ্টা করেছে। পূর্ববঙ্গের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সর্বোচ্চ নিদর্শন ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে অবশ্যম্ভাবীভাবে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন। এই বিজয় স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে গণরায়ের নামান্তর।

পূর্ববঙ্গের এই যৌক্তিক এবং গণদাবি পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর কাছে অনভিপ্রেত ছিল। ইয়াহিয়া খানের সামরিক প্রশাসনের প্রাগুক্ত ধারণা ছিল না যে, আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা এত বেশি যে সাধারণ নির্বাচনে জনগণের রায় একচ্ছত্রভাবে আওয়ামী লীগের পক্ষে যাবে। তারা কোনোভাবেই পূর্ববঙ্গের ওপর তাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং আমলাতান্ত্রিক খবরদারি খর্ব হোক, তা মেনে নিতে পারেনি। পাকিস্তানের কেন্দ্রের শাসনক্ষমতা নিয়ন্ত্রণকারী এই গোষ্ঠী পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে পাকিস্তানের আপামর জনসাধারণকে গণতন্ত্র থেকে বঞ্চিত রেখে এসেছে।

বস্তুত ক্ষমতার এরূপ পটপরিবর্তন পাকিস্তানের প্রথাগত সেনা-আমলা-ব্যবসায়ী নিয়ন্ত্রিত কেন্দ্রীয় সরকারের জন্য হজম করা শক্ত ছিল। সেনা-আমলা-ব্যবসায়ী নিয়ন্ত্রিত কেন্দ্রীয় সরকারের শঙ্কা ছিল, শেখ মুজিবুর রহমান ক্ষমতায় এলে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী ও তাঁর কলেবর সংকোচন, প্রশাসনের বিকেন্দ্রীকরণ এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের উদারীকরণ করবে। ইয়াহিয়া শেখ মুজিবুর রহমানকে তাঁর ছয় দফা থেকে সরিয়ে আনতে বিভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক চাপ সৃষ্টি করেন। এই উদ্যোগ ব্যর্থ হলে ইয়াহিয়া চরমপন্থী সমাধান হিসেবে বাঙালি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করার নীতি গ্রহণ করেন। ইয়াহিয়ার এই পৈশাচিক ও অমানবিক নীতির ব্যাপারে শুরুতে বিশ্ব জনমত জাতিসংঘ সনদের দোহাই দিয়ে বিষয়টি পাকিস্তানের একান্তই অভ্যন্তরীণ এই অজুহাতে নীরব ভূমিকা পালন করে। মুসলিম বিশ্ব এই ঘৃণ্য ও বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদ করেনি। মুসলিম বিশ্বের বদ্ধমূল ধারণা ছিল, কোনো মুসলিম দেশ এ ধরনের ন্যক্কারজনক কাণ্ড করতেই পারে না। আবার অনেকে এই অঞ্চলের (পূর্ববঙ্গের) জনগোষ্ঠীকে মুসলিমই মনে করত না। অন্যদিকে বিশ্বের পরাশক্তিগুলো তাদের ক্ষমতার দ্বৈরথের প্রয়োজনে পূর্ববঙ্গের মতো পশ্চাত্পদ অঞ্চল ও জনগোষ্ঠীর স্বাধীনতা এবং জীবনমালের নিরাপত্তাকে খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি। যুক্তরাষ্ট্র বামভাবাপন্ন পূর্ববঙ্গের জন্য দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করতে মোটেও আগ্রহী ছিল না। ভারতের সঙ্গে বৈরী সম্পর্কের কারণে চীন পাকিস্তানকে সমর্থন অব্যাহত রাখে। শুধু জনমতের চাপে ব্রিটেন পশ্চিম পাকিস্তানি কর্মকাণ্ডের আনুষ্ঠানিক বিরোধিতা করে। দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের আধিপত্য বিস্তার রুখতে সোভিয়েত ইউনিয়ন পশ্চিম পাকিস্তানের সরাসরি বিরোধিতা করে। পরাশক্তিগুলোর পররাষ্ট্রনীতির একগুঁয়েমি অবস্থান জাতিসংঘের পূর্ব বাংলার জরুরি আবেদনে সাড়া দেবার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

ইয়াহিয়া খান ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়ের’ অজুহাতে তাঁর জেনোসাইড পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রয়াস পান। অথচ ন্যুরেমবার্গ সনদের অনুচ্ছেদ ২-এর ৭ম ভাগে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ও শান্তির জন্য হুমকিস্বরূপ কোনো বিষয় ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়’ বিবেচিত হবে না। জাতিসংঘে বাংলাদেশের সংগ্রামকে ‘আন্তর্জাতিক ইস্যু’ ঘোষণা করলে পরিস্থিতি এত নাজুক হতো না বলে যথার্থভাবে রহমতউল্লাহ খান মন্তব্য করেছিলেন। জাতিসংঘের সনদের ৯৯ অনুচ্ছেদ অনুসারে মহাসচিব নিরাপত্তা পরিষদে সরাসরি আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ও শান্তির জন্য হুমকিস্বরূপ বিরোধ নিষ্পত্তির বিষয়ে প্রস্তাব পেশ করতে পারেন। কঙ্গোর ক্ষেত্রে এরূপ ক্ষমতার প্রয়োগের নজির দেখা যায়। মানকেকার জাতিসংঘের ক্ষমতা ব্যবহারের অক্ষমতা বা পক্ষপাতদুষ্টের ব্যাপারে ড. সালভাদর মাদারেঙ্গার উক্তি উদ্ধৃত করেছেন—

“জাতিসংঘে যদি দুটি ক্ষুদ্র দেশের বিরোধ উত্থাপিত হয়, তাহলে বিরোধটি উবে যায়। কিন্তু যদি একটি ক্ষুদ্র দেশ ও পরাশক্তির মধ্যকার বিরোধ উত্থাপিত হয়, তাহলে ক্ষুদ্র দেশটি

উবে যায়। আর যদি দুই পরাশক্তির মধ্যকার বিরোধ উত্থাপিত হয়, তাহলে জাতিসংঘ উবে যায় (পৃষ্ঠা-৯)।’

মানকেকারের মতে, একই স্থানে যেমন উপর্যুপরি বজ্রপাত হয় না, তেমনি কোনো অঞ্চলে অন্তত ২০০ বছরের কম সময়ের ব্যবধানে ঔপনিবেশিক শাসন স্থাপিত হয় না (পৃষ্ঠা-১০)। ব্রিটিশ ২০০ বছরের ঔপনিবেশিক শাসনের পর পূর্ববঙ্গ ২৪ বছর পাকিস্তান নামক কল্পিত রাষ্ট্রের নব্য উপনিবেশ হিসেবে শোষিত ও নিষ্পেষিত হয়েছে। ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি উপনিবেশবাদের মধ্যে বৈশিষ্ট্যগত সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। অবশ্য নৃশংসতার মানদণ্ডে পাকিস্তান ব্রিটিশদের থেকে হাজার গুণ এগিয়ে ছিল। তিনি ব্রিটিশ উপনিবেশের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের পূর্ববঙ্গে ঔপনিবেশিক শাসনের সাদৃশ্য এবং উত্তরসূরি সূত্র খুঁজে পেয়েছেন। জওহরলাল নেহরু তাঁর দ্য ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া গ্রন্থে উনিশ শতকের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে উল্লেখ করেন—

‘শিল্পপ্রধান ইংল্যান্ডের শিল্পের জন্য কাঁচামাল সরবরাহের জন্য ভারতকে কৃষিপ্রধান উপনিবেশ হিসেবে গড়ে তোলা ছিল আধুনিক ঔপনিবেশিক অর্থনীতির প্রধান বৈশিষ্ট্য।’ (পৃষ্ঠা ১০-১১)

গ্রন্থকারের মতে, পাকিস্তানে পূর্ববঙ্গের ওপর ঔপনিবেশিক শাসন আধুনিক ঔপনিবেশিক অর্থনীতির প্রাগুক্ত উদাহরণের পুনরাবৃত্তি। মানকেকারের মতে, ১৮ ও ১৯ শতকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে তাঁতশিল্পকে যেমন ব্রিটিশ বস্ত্রশিল্পের কাঁচামাল সরবরাহের প্রয়োজনে এবং তৈরি পোশাকের বাজার রক্ষার্থে ধ্বংস করা হয়েছে, তদ্রূপ পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীও নিজেদের তৈরি পোশাকের বাজার সম্প্রসারণের জন্য পূর্ববঙ্গের তাঁতশিল্পকে ধ্বংস করেছে। ইংল্যান্ডের জবরদস্তিমূলক নীতি ও রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার ফলে শত শত কারিগর ও নকশাকার বেকার হয়ে পড়েন। একই রকম জবরদস্তিমূলক নীতি গ্রহণ করা হয়েছিল পাকিস্তানি আমলে। এর ফলে বাংলাদেশের শত শত হস্তশিল্পী বেকার হন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিজয়-পরবর্তী ঢাকা চেম্বার অব কমার্সের সংবর্ধনায় ২০ লাখ হস্তশিল্প কারিগর কেন্দ্রীয় সরকারের পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্পের বাজার রক্ষার জন্য গৃহীত পক্ষপাতদুষ্ট নীতির কারণে বেকার হয়েছেন বলে শেখ মুজিবুর রহমান অভিযোগ আনেন। তিনি আরও অভিযোগ করেন, পশ্চিম পাকিস্তানের তৈরি কাপড়ের দাম জাপানের তৈরি কাপড়ের দামের ছয় গুণ। অথচ জনগণকে বাধ্য করা হচ্ছে উচ্চমূল্যে কাপড় ক্রয়ে। অন্যদিকে বাঙালি পাটচাষিদের ও চা-শ্রমিকদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন পাকিস্তান আমলেও হয়নি। কিন্তু পাট ও চা ছিল পাকিস্তানের প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের খাত। অথচ পূর্ববঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের কোনো উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ হয়নি। পণ্যের মতো সেবা খাতও ছিল অবহেলিত পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলে (পৃষ্ঠা ১১-১৬)। পশ্চিম পাকিস্তানের স্বার্থে পূর্ববঙ্গে উপনিবেশ অর্থনীতি স্থাপন করা হয়। পূর্ববঙ্গের ঔপনিবেশিক শোষণের ফলে পশ্চিম পাকিস্তানের ব্যবসায়ীরা শুধু নন, আমলারাও লাভবান হয়েছেন। পূর্ববঙ্গ যে বিশ্বের আটটি দরিদ্রতম অঞ্চলের একটিতে পরিণত হয়, এর দায় পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর। পাট যেখানে পাকিস্তানের প্রধান বৈদেশিক আয়ের উত্স, সেখানে পূর্ববঙ্গের ঢাকায় এবং চট্টগ্রামে সে রকম কোনো পাট কারখানা গড়ে ওঠেনি বা গড়ে তোলা হয়নি।

পশ্চিম পাকিস্তানের ক্রমাগত ঔপনিবেশিক শোষণ পূর্ববঙ্গের স্বতন্ত্র জাতীয়তাবাদকে উসকে দেয় এবং আরও সংঘবদ্ধ করে। বাঙালি পরিচয়বাহী বৈশিষ্ট্যগুলো ক্রমশ পূর্ববঙ্গের মানুষের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। পাকিস্তানি পরিচয় যখন ক্ষয়িষ্ণু, তখন বাঙালি পরিচয় আরও সুস্পষ্ট হতে শুরু করে। শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির এই সংগ্রামকে ‘মুক্তির সংগ্রাম’ আখ্যা দিয়েছেন (পৃষ্ঠা ৩৪)। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসনকালে শোষণ এবং অপমানের ফলে পুঞ্জীভূত জনরোষ যেমন ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিপ্লবের মাধ্যমে বিস্ফোরিত হয়, পশ্চিম পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসনামলেও তা-ই ঘটে। বাঙালি দুর্বল এবং যুদ্ধে অপারঙ্গম—এই অজুহাতে বাঙালিদের সামরিক বাহিনী উচ্চপদ থেকে বঞ্চিত করা হয়। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাঙালি অধস্তন উপজাতি—এই অজুহাতে তাদের ওপর উর্দু রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। ভাষা কেড়ে নেওয়ার এই চেষ্টা সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের অংশ ছিল। পাকিস্তানি সরকারের উর্দুকে বাঙালিদের ওপর রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের জন্ম দেয়। দেশভাগের পর রাজনৈতিক পটপরিক্রমায় বাংলা বাঙালি সংস্কৃতি ও জাতীয়তাবাদের শক্তিশালী উদ্দীপকে পরিণত হয় (পৃষ্ঠা ৩৫)। বাঙালি সাংস্কৃতিক নবজাগরণের ফলে বাঙালিদের কাছে পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে নৃতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক পার্থক্য স্পষ্টতর ও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। পশ্চিম পাকিস্তানের পূর্বসূরি যেমন পশ্চিম এশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত, তেমনি পূর্ববঙ্গের মুসলমান সমাজের পূর্বসূরিদের সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সম্পর্ক ছিল।

১৯৪৮ সালে জিন্নাহর উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার মধ্য দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ববঙ্গের ভাষাভিত্তিক যে বিরোধের সূত্রপাত হয়, তার পরিণতি ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ এবং ১৯৭১ সালে বাঙালির সর্বাত্মক স্বাধীনতার সংগ্রাম। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর আরবি হরফে বাংলা লৈখিক রীতি প্রবর্তনের চেষ্টা কিংবা ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২-এর মতো ছাত্রদের প্রতিবাদ মিছিল-সমাবেশের ওপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ ও সান্ধ্য আইন আরোপ—কিছুই এই জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশকে রুখতে পারেনি। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী চীনের নীতি-কৌশল অনুসরণ করে বাঙালিদের সাংস্কৃতিক পরিচয় পরিবর্তনের চেষ্টা করে তা সময়ের পরিক্রমায় অসাড় ও অকার্যকর প্রমাণিত হয় (পৃষ্ঠা ৩৭)। পশ্চিম পাকিস্তানের আমলা এবং পরবর্তী সময় পাকিস্তান সরকারের মহাসচিব চৌধুরী মুহাম্মাদ আলী ১৯৫০ সালে পাকিস্তান সরকারের কাছে দুটি দিকনির্দেশনা পেশ করেছিলেন—

১.         আজ অথবা কাল পূর্ব পাকিস্তান পাকিস্তান থেকে বেরিয়ে যাবে। সুতরাং সরকারের এই

            অঞ্চলের অর্থনৈতিক প্রয়োজনীয়তার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া নিষ্প্রয়োজন।

২.         পূর্ববঙ্গে হিন্দুদের সংখ্যা হ্রাসের জন্য সরকারের উপায় অনুসন্ধান করতে হবে (পৃষ্ঠা ৪০)।

পাকিস্তানের জন্ম থেকেই পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে যোজন যোজন দূরত্ব ক্রমশ স্পষ্টতর হতে থাকে। পশ্চিম পাকিস্তানের পূর্ববঙ্গের ঔপনিবেশিক শোষণ এবং বৈরী মনোভাব শুধু এই দূরত্বকে দ্রুত সম্প্রসারিত করে। শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর দল বিচ্ছিন্নতাবাদী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত বলে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী যে অভিযোগ করেছিল, তা বহুলাংশে ভ্রান্ত ও বানোয়াট। পূর্ববঙ্গের রাজনৈতিক নেতৃত্ব শুধু এ অঞ্চলের প্রতি অর্থনৈতিক ন্যায্যতা, ক্ষমতার অংশীদারি দাবি করেছিল। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তান এ দাবিগুলো মেনে নিলে তাদের একচ্ছত্র আধিপত্য হারাবে—এই আশঙ্কায় ন্যায্য দাবিগুলোকে বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রচারণা হিসেবে আখ্যায়িত করে। ঐতিহাসিকভাবে সামন্তবাদী পাঞ্জাবিদের তুলনায় বাঙালি হিন্দু বা মুসলিম-নির্বিশেষে সবাই রাজনৈতিকভাবে স্বাধীনচেতা ও বুদ্ধিদীপ্ত। লন্ডনভিত্তিক দ্য ইকোনমিস্ট বাঙালি জাতিকে রাজনৈতিকভাবে ভারতের সবচেয়ে সচেতন জাতি হিসেবে আখ্যায়িত করেছিল (পৃষ্ঠা ৪২)।

পূর্ববঙ্গের মুসলিম সমাজের সঙ্গে ভারতীয় উচ্চবর্ণের মুসলিম বা উত্তর ভারতের মুসলিমদের সম্পর্ক ব্রিটিশ আমল থেকেই শীতল ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী ছিল মূলত উত্তর ভারতের মুসলিম সমাজের উত্তরসূরি, যারা দেশভাগের ফলে পাকিস্তানের পশ্চিমাংশে পাড়ি জমায় এবং অত্র অঞ্চলের নেতৃত্ব গ্রহণ বা দখল করে। বাঙালি মুসলমানেরা দেশভাগের ফলে তাদের ভাগ্যবিড়ম্বনার অচিরেই অবসান করবে বলে যে আকাশকুসুম কল্পনা করেছিল, তা অচিরেই ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়। দেশভাগের আগে যেখানে বাঙালি মুসলিমরা ভারতীয় মুসলমানদের জন্য আলাদা আবাসভূমির নেতৃত্বে আসীন ছিল, সেখানে তাদের পাকিস্তানের জন্মের পর কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব থেকে বিতাড়িত করা হয় (পৃষ্ঠা ৪৬)। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাবের মাধ্যমে ভারতীয় মুসলমানদের জন্য একাধিক স্বাধীন আবাসভূমির প্রস্তাব একজন বাঙালি মুসলিম নেতা শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক পেশ করেছিলেন।

১৯৪৬ সালে প্রাদেশিক নির্বাচনে মুসলিম লীগের জয়ের নায়ক ছিলেন একজন বাঙালি মুসলিম রাজনীতিবিদ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। প্রাদেশিক নির্বাচনে মুসলিম লীগ ১১৯ আসনের মধ্যে ১১৬টি আসনে বিজয়ী হয়। অথচ উত্তর ভারতে ৩৮টি আসনের মধ্যে তারা মাত্র ১৭টি আসনে বিজয়ী হয়েছিল (পৃষ্ঠা ৪৭)। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী কেন্দ্রীয় ও আঞ্চলিক হিন্দু নেতাদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন, হিন্দু-মুসলিম ঐক্য সম্ভব নয়। বাঙালি মুসলিম নেতারা মনে করেছিলেন, তাঁদের রাজনৈতিক নেতৃত্বের নিয়ন্ত্রণ এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ হিসেবে পাকিস্তানের শাসনভার তাঁদের ওপর বর্তাবে। কিন্তু উত্তর ভারতীয় নেতৃত্বের সূক্ষ্ম চালে বাঙালি মুসলিম নেতারা মার খেয়ে যান। পাকিস্তান ঘোষণাপত্রের রচয়িতা চৌধুরী খালেকুজ্জামান রাষ্ট্রগুলোর স্থলে শুধু রাষ্ট্র শব্দটি ব্যবহার করেন (পৃষ্ঠা ৪৮)। বিষয়টি অনেক বাঙালি মুসলিম নেতা জানতেন না, অথবা বুঝতে পারেননি। অবশ্য ঘোষণাপত্র প্রণয়ন কমিটিতে কোনো বাঙালি সদস্য ছিলেন না এবং সন্দেহাতীতভাবে বিষয়টি পূর্বপরিকল্পিত ছিল। পাকিস্তানের জন্ম থেকে পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের সঙ্গে যে ধরনের ছলনা ও বঞ্চনা করা হয়েছিল, তা হজম করা তাদের জন্য কষ্টসাধ্য ছিল। মুসলমানদের জন্য স্বাধীন আবাসভূমির দাবিতে শুধু বাংলায় ৯৯ শতাংশ ভোট পড়েছিল। বাংলার মতো অবিভক্ত ভারতের মুসলিম অধ্যুষিত অন্যান্য অংশে স্বাধীন আবাসভূমির দাবির পক্ষে জনমত জোরাল ছিল না। দেশভাগের সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানে রাজনৈতিক মেরুকরণ শুরু হয় এবং দ্রুত পাকিস্তানের নেতৃত্ব বাঙালিদের হাত থেকে উত্তর ভারত থেকে আসা মোহাজির নেতাদের হাতে চলে যায়। বাঙালি মুসলিম লীগের নেতা বেগম ইকরামুল্লাহ তাঁর পর্দা ইন পার্লামেন্ট গ্রন্থে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা উদ্ধৃত করে বলেন—

‘... আমি ইতঃস্ততা কাটিয়ে যখন করাচি এবং ঢাকায় গণপরিষদের ফিরতি বৈঠকের প্রস্তাবের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করলাম; প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘নারীরা কখনো বাস্তব সমস্যা বোঝে না।’ তখন আমি প্রত্যুত্তরে জবাব দিলাম, ‘আমরা যদি বুঝতাম তাহলে আমরা আজকের এই পাকিস্তান পেতাম না।’ (পৃষ্ঠা- ৫১)

১৯৪৮ সালে প্রথমবারের মতো একজন বাঙালি গণপরিষদে পাকিস্তানে পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণ অবহেলার শিকার হচ্ছে এবং পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানকে উপনিবেশ হিসেবে দেখছে বলে অভিযোগ করেন। ভাষার প্রশ্নে পশ্চিম পাকিস্তানের বৈরী মনোভাবের পর ১৯৪৮ সালে পূর্ববঙ্গের দুর্ভিক্ষ পশ্চিম পাকিস্তানের বিমাতাসুলভ আচরণকে আরও প্রত্যক্ষ করে তোলে। ১৯৫১ সালে পূর্ব বাংলা থেকে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন ভাষা প্রশ্নে বিরোধ আবার উসকে দেন উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার মাধ্যমে। খাজা নাজিমউদ্দিনের এই হঠকারী উদ্যোগের প্রতিবাদ রক্তক্ষয়ী রূপ নেয়। ২০ জন ছাত্র ও সাধারণ মানুষকে ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সালে গুলি করে হত্যার পর দুর্বার জন-আন্দোলনের মুখে কেন্দ্রীয় সরকারের উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার উদ্যোগ স্থগিতের মাধ্যমে ভাষার প্রশ্নে সংগ্রামের সাময়িক ইতি বা সমঝোতা স্থাপিত হয়। অন্যদিকে আহমদিয়াবিরোধী দাঙ্গায় নাজিমউদ্দিন পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর সমর্থন হারান। অবশ্য পূর্ব বাংলার নেতৃত্ব হস্তগত করার জন্য ষড়যন্ত্রমূলকভাবে এই দাঙ্গা লাগানো হয়েছিল বলে জানা যায়। ১৯৫৩ সালে তিনটি স্থানীয় রাজনৈতিক দল—এ কে ফজলুল হকের কৃষক-শ্রমিক লীগ, শহীদ সোহরাওয়ার্দীর আওয়ামী মুসলিম লীগ ও নেজাম-ই-ইসলাম ২১ দফার ভিত্তিতে মুসলিম লীগবিরোধী মোর্চা গঠন করে।

এই মোর্চা পক্ষান্তরে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরোধী ছিল। ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে এই মোর্চা ১৯৭০ সালের আওয়ামী লীগের মতো নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। ৩১০টি আসনের মধ্যে তারা ২২৬টিতে জয়লাভ করে। নুরুল আমিনের মতো মুসলিম লীগের ডাকসাইটে নেতা মোর্চার ১৮ বছর বয়সী তরুণ প্রতিদ্বন্দ্বীর কাছে হেরেছেন। ফজলুল হকের সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে নারায়াণগঞ্জের আদমজী পাটকলে অ-বাঙালিদের সঙ্গে বাঙালিদের দাঙ্গা লাগানো হয়। কলকাতায় ৩০ মে ফজলুল হকের আবেগঘন বক্তব্যের অপব্যাখ্যা দিয়ে তাঁকে দেশদ্রোহী প্রমাণের চেষ্টা করা হয়। ফজলুল হক এই অপব্যাখ্যার জবাব দিলেও তার প্রতি কর্ণপাত না করে তাঁকে গৃহবন্দী করা হয় এবং কেন্দ্রীয় সরকার ইস্কান্দর মির্জাকে গভর্নর নিযুক্ত করে ঢাকা প্রেরণ করে।

মওলানা ভাসানী ১৯৫৬ সালের জানুয়ারিতে এক জনসমাবেশে কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব বাংলার জনমানুষের দাবি পূরণ না করলে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হবে বলে হুঁশিয়ারি দেন। আইয়ুব খান রক্তপাতহীন ক্যু-এর মাধ্যমে পাকিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছিলেন। তিনি তাঁর ক্ষমতা দখলকে বিপ্লব আখ্যায়িত করেছিলেন (পৃষ্ঠা ৭৪)। ১৯৫৯ সালে আইয়ুব খান জাতীয় পুনর্গঠন ব্যুরো প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠান কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। ব্যুরো জনপ্রচারণার মাধ্যমে আবেগঘন সংহতিকরণের প্রচেষ্টা চালায়, যা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। ক্ষমতার স্থায়িত্ব বাড়াতে আইয়ুব খানের পূর্ববঙ্গের সমর্থনের প্রয়োজন ছিল। এই প্রয়োজনে মৌলিক গণতন্ত্রের নামে তিনি পূর্ববঙ্গের অনেক স্থানীয় নেতাকে তাঁর দলে সম্পৃক্ত করেন।

আইয়ুব খান ১৯৬৫ সালের পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধে বাঙালি সমর্থন আদায়ে ভারত সফরের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ওপর ভারতীয়রা হামলা চালিয়েছে, এমন অপপ্রচার চালান। পরবর্তী সময় জানা যায়, এ ধরনের কোনো ঘটনা আদৌ ঘটেনি। অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতা ও আমলাদের সঙ্গে কোন্দলের জের ধরে আইয়ুববিরোধী মোর্চা পশ্চিম পাকিস্তানে সংগঠিত হতে থাকে। পূর্ববঙ্গেও আওয়ামী লীগের সঙ্গে দ্বন্দ্বের জের ধরে আইয়ুব সরকার তার সমর্থন হারায়। ১৯৬৯ সালে পূর্ববঙ্গে আইয়ুববিরোধী গণ-অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়।

১৯৬৯ সালে ইয়াহিয়া খান আইয়ুব খানকে অপসারণ করে পাকিস্তানের ক্ষমতা দখল করেন। ১৯৫০-এর দশকে আওয়ামী লীগ তরুণ নেতৃত্বের হাত ধরে নবরূপে আবির্ভূূত হয়। ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা দাবি আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির পাশাপাশি বঞ্চনা ও শোষণে অতিষ্ঠ জনগণের খণ্ডিত অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক স্বপ্নগুলোকে এবং রাজনৈতিকভাবে জাতীয়তাবাদী চেতনায় সংগঠিত করে এবং নব্য জাতি হিসেবে নতুন আত্মপরিচয়ে পরিচিত করে তোলে। ১৯৬৯ সালে ছাত্র-শ্রমিকদের আওয়ামী লীগের ৬ দফাসহ ১১ দফা এবং আইয়ুববিরোধী গণ-অভ্যুত্থান আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তাকে উচ্চ শিখরে নিয়ে যায়। ১৯৭০ সালে পাকিস্তানে প্রাদেশিক ও জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয়ের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তার প্রতিফলন ঘটে।১ পূর্ব বাংলায় আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা যত বৃদ্ধি পেয়েছে, তত পশ্চিম পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন শাসকগোষ্ঠী, ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণকারী আমলা ও সামরিক সদস্যদের মধ্যে পূর্ব বাংলার জনগণের প্রতি অসহিষ্ণুতা ও ঘৃণা তত বেড়েছে।২

১৯৭০ সালের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রাপ্তি সত্ত্বেও আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি, কালক্ষেপণ এবং আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বিভ্রান্তিকর ও উসকানিমূলক বিদ্বেষী প্রচারণা চালায় পাকিস্তানের তত্কালীন সামরিক প্রশাসন এবং পশ্চিম পাকিস্তানে পাঞ্জাবিদের পছন্দের দল হিসেবে আবির্ভূত পিপলস পার্টির কান্ডারি জুলফিকার আলী ভুট্টো। জুলফিকার আলী ভুট্টো তাঁর পূর্ব কর্মসূত্রে পাঞ্জাবনিয়ন্ত্রিত পাকিস্তানের আমলাতন্ত্র ও সামরিক প্রশাসনের সঙ্গে ব্যক্তিগত সুসম্পর্কের ফায়দা নিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর দল আওয়ামী লীগকে নিষ্ক্রিয় করতে সচেষ্ট হন।

প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্তানের তত্কালীন সামরিক প্রশাসনকে পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং কর্মী ও সমর্থকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণে ইন্ধন জোগায়। পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে জাতিগত, ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক পার্থক্য এবং অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক বৈষম্য জাতিগত ঘৃণা, পারস্পরিক মতবিরোধ তৈরি করে এবং গণতান্ত্রিক ও মানবিক সহমর্মিতা ও সহযোগিতার অপমৃত্যু ঘটায়। অবিভক্ত পাকিস্তানের শাসকশ্রেণির স্বৈরাচারী ও বর্ণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি এবং আচরণের জন্য পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে ঐকমত্যের শেষ সম্ভাবনাও নস্যাত্ হয়ে যায়।

আমলাতন্ত্র, সামরিক বাহিনী এবং ব্যবসায়ী সম্প্রদায় যেমন পাঞ্জাবিদের নিয়ন্ত্রণে ছিল, তেমনি বাঙালি ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং তাদের দাবি ছিল ন্যায্য। এর ফলে ১৯৭০ সালে ইয়াহিয়া খানের সাধারণ নির্বাচনে পাঞ্জাবনিয়ন্ত্রিত প্রশাসন এবং সামরিক বাহিনী সত্ত্বেও বাঙালিরা নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। পাকিস্তানের ২৪ বছরের ইতিহাস শুধু গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে বারবার বাধাগ্রস্ত করার ইতিহাস। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তাদের একচ্ছত্র আধিপত্য বজায় রাখতে বারবার গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করেছে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বাঙালিদের নিরঙ্কুশ বিজয়ের পর এর ব্যত্যয় হবে, তা ভাবা বরং অস্বাভাবিক ছিল। স্বভাবতই নির্বাচনের পর ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে টালবাহানা শুরু হয়। পশ্চিম পাকিস্তানে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ক্ষমতা ও প্রাদেশিক নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার নানা উপায় অনুসন্ধান শুরু হয়।

১ মার্চ ইয়াহিয়া খান গণপরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন। তাঁর এই ঘোষণা পূর্ববঙ্গে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। পূর্ববঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বাঁধভাঙা জনরোষ দেখা দেয়। ৫ মার্চ ১৯৭১ করাচিতে পাঁচদলীয় বৈঠকে অবিলম্বে সামরিক সরকারের প্রতি নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য বলা হয় (পৃষ্ঠা ১০২)। ৭ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান রেসকোর্স ময়দানে জনসমাবেশে চূড়ান্ত মুক্তি সংগ্রামের নির্দেশনা দেন (পৃষ্ঠা ১০৩)। মার্চজুড়ে বিচ্ছিন্নভাবে পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন স্থানে নিরস্ত্র জনসাধারণের প্রতিবাদ মিছিল ও সমাবেশে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী গুলিবর্ষণ করে। দেশজুড়ে বহু হতাহত হয়। ইতিমধ্যে পাকিস্তানি জেনারেল টিক্কা খানকে প্রধান সামরিক প্রশাসক করে পূর্ব পাকিস্তানে পাঠানো হয়। ১৫ মার্চ ইয়াহিয়া খান অচলাবস্থা নিরসনে আলোচনার জন্য ঢাকায় আসেন (পৃষ্ঠা ১১৪)।

শেখ মুজিবের সঙ্গে ইয়াহিয়া খান ৩৫টি প্রশাসনিক নির্দেশনা নিয়ে আলোচনা করেন। অন্যদিকে শেখ মুজিবুর রহমানের বাঙালির ‘মুক্তি আন্দোলনের’ প্রতি মওলানা ভাসানী ও আতাউর রহমান খান পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করেন। ঢাকার রেডিও ও টেলিভিশন কেন্দ্র শেখ মুজিবুর রহমানের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। পূর্ববঙ্গের অফিস-আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান সবকিছু আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণাধীন হয়। কেন্দ্রীয় সরকারের সামরিক বাহিনী ব্যতীত কোনো কিছুর ওপর নিয়ন্ত্রণ ছিল না। আলোচনার অন্তরালে করাচি থেকে আকাশ ও সমুদ্রপথে পূর্ববঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সামরিক সমরাস্ত্র ও জনবলের সমাবেশ করা হয়।

বাংলাদেশে পাকিস্তানের সামরিক অভিযান যে পূর্বপরিকল্পিত ছিল, তার প্রমাণ পাওয়া যায় ১৯৭১ সালে দ্য টেলিগ্রাফ-এর দক্ষিণ এশীয় সংবাদদাতা ডেভিড লোসাকের বক্তব্যে, ‘১৯৭১ সালের শুরুর দিকে করাচি থেকে ঢাকাগামী পাকিস্তানের আন্তর্জাতিক বিমানের ফ্লাইটে আসন খালি পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার ছিল... রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান অভিযানের জন্য দীর্ঘ সময় ধরে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন... ইতিমধ্যে ২০,০০০ পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্য পূর্বাঞ্চলে পাঠানো হয়েছে।... জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তাদের পরিকল্পনা অনুসারে দখলদার সেনাবাহিনীর জনবল ৩৫-৪০ হাজার থেকে বাড়িয়ে ৬০ হাজার করা হয়েছে এবং ৩ হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে সৈন্যদের তাদের নতুন কর্মস্থলে যোগদান করতে হয়েছে।৩ পাকিস্তানি সামরিক অভিযান শুরু হওয়ার কিছুদিনের মধ্যে ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ান-এ দেওয়া সাক্ষাত্কারে শেখ মুজিবুর রহমানের অর্থবিষয়ক উপদেষ্টা রেহমান সোবহান বলেন, ‘আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে বাঙালি জাতীয়তাবাদের শক্তির যে পরিচয় পাওয়া গেছে, তা বিবেচনায় রেখে দুই বছর ধরে সামরিক অভিযানের পরিকল্পনা রচনা করা হয়।... লে. জেনারেল ইয়াকুবের স্থলে পাঞ্জাবি জেনারেলদের মধ্যে ভয়ংকর হিসেবে পরিচিত লে. জেনারেল টিক্কা খান ৭ মার্চ দায়িত্ব গ্রহণ করেন।’৪ ২৫ মার্চ, ১৯৭১ থেকে বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানিদের যে নৃশংস হামলা শুরু হয় তার প্রস্তুতি কয়েক মাস ধরে চলছিল। ৭ মার্চ, ১৯৭১ ওয়ার্কিং পিপলস ডেইলি (রেঙ্গুন) প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে, জাহাজ ও বিমানে করে পূর্ব পাকিস্তানে বিপুল পরিমাণ সমরাস্ত্র ও জনবল পাঠানো হচ্ছে।৫ মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে জ্যেষ্ঠ বাঙালি সামরিক কর্মকর্তাদের নিরস্ত্র এবং অন্তরীণ করার চেষ্টা শুরু হয় (পৃষ্ঠা ১৩২)। ২৫ মার্চ পূর্ব কোনো ঘোষণা ছাড়া ইয়াহিয়া খান ঢাকা ত্যাগ করেন। ২৫ মার্চ রাতে পূর্ববঙ্গে আওয়ামী সমর্থকগোষ্ঠী ও সনাতন ধর্মাবলম্বী সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সামরিক অভিযান শুরু হয়। পূর্ববঙ্গে পাকিস্তানের সামরিক অভিযান শুরুর সঙ্গে সঙ্গে জুলফিকার আলী ভুট্টো ঘোষণা দেন, ‘মহান আল্লাহকে ধন্যবাদ পাকিস্তানকে রক্ষা করার জন্য’ (পৃষ্ঠা ১৩৪)।

২৪ বছর পূর্বে উপমহাদেশের জনগণ দেশভাগের যে দুঃস্বপ্নের সাক্ষী হয়েছিল তার পুনঃ চিত্রায়ণ হয় পূর্ববঙ্গে ১৯৭১ সালে। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান নামক যে তাসের ঘর নির্মিত হয়েছিল, তার ভাঙন অবশ্যম্ভাবী ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর সামন্তবাদী আচরণ শুধু এই ভাঙনকে ত্বরান্বিত করে। পাকিস্তানের ভাঙনের কারণ পাকিস্তান রাষ্ট্রের কাঠামোর মধ্যে নিহিত ছিল। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে শেখ মুজিব ও তাঁর দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন সত্ত্বেও ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা এবং সামরিকভাবে জনসমর্থিত একটি রাজনৈতিক দলকে দমনের চেষ্টা পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভাঙনের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে মাত্র। ১৯৪৮ সালে ভাষার ওপর আঘাত হানার মাধ্যমে পাকিস্তান রাষ্ট্র ধ্বংস করার যে প্রক্রিয়া উদ্বোধন করা হয়, ২৫ মার্চ নিরীহ বাঙালিদের নিশ্চিহ্ন করতে অতর্কিতে ইয়াহিয়ার সামরিক বাহিনীর সামরিক হামলার মাধ্যমে পাকিস্তান রাষ্ট্রের ধ্বংসের সে প্রক্রিয়ার সফল সমাপ্তি নিশ্চিত করা হয়। ইয়াহিয়া খান পূর্ববঙ্গে শুধু পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক স্বার্থ নয়, বরং পাকিস্তানের ঐক্যের জন্য শেখ মুজিবুর রহমানের বাঙালির ‘মুক্তির আন্দোলন’ সশস্ত্রভাবে দমনে প্রয়াসী হয়েছিলেন, যা ছিল তাঁর উপর্যুপরি ভুল।

১৯৪৭ সালের দেশভাগের সময়ের মতো জীবন বাঁচাতে লাখ লাখ শরণার্থীর দেশত্যাগের মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তানের পূর্ববঙ্গের ওপর ঔপনিবেশিক শোষণের সমাপ্তি ঘটে। ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী হত্যাযজ্ঞ শুরু করার পর এপ্রিলের শুরুতে শরণার্থী সংখ্যা ৩ মিলিয়নে পৌঁছায়। ৩০ আগস্ট ভারত সরকার প্রদত্ত হিসাব অনুযায়ী ভারতে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীর সংখ্যা ছিল প্রায় ৯ মিলিয়ন। এই সময় প্রতিদিন গড়ে ৪০,০০০ শরণার্থী ভারতে প্রবেশ করছিল। পরিস্থিতির উন্নয়ন না হলে শরণার্থীসংখ্যা ১৫ মিলিয়ন ছাড়িয়ে যাবে বলে বিভিন্ন মহল থেকে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয় (পৃষ্ঠা ১৭৫)। এই সংখ্যা ছিল ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় পাকিস্তান-ভারত উভয় দিকে দেশান্তরিত মোট শরণার্থীদের সমান। ভারত সরকারকে এই বিশাল শরণার্থী জনগণের জন্য প্রতি মাসে ৪০ কোটি রুপি ব্যয় করতে হয়। এপ্রিল-জুন সময়কালে ভারত সরকার শরণার্থীদের ত্রাণসহায়তার জন্য মোট ১২০ কোটি রুপি ব্যয় করেছে। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শরণার্থীদের ত্রাণসহায়তার জন্য ভারত সরকার বৈদেশিক সাহায্যসহ মোট ৩১৬ কোটি রুপি ব্যয় করেছে। ভারতের জনবহুল রাজ্যগুলোতে শরণার্থীদের ঢল স্থানীয় পর্যায়ে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি করে। এই শরণার্থীরা হয়তো স্থায়ীভাবে থেকে যাবে এমন শঙ্কা জনমনে তৈরি হয়। কেন্দ্রীয় ভারত সরকার বাংলাদেশে শরণার্থী প্রত্যাবর্তনের পরিস্থিতি তৈরি না হলে শরণার্থীদের ফেরত না পাঠানোর নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল। কিন্তু ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে শান্তি আলোচনার কোনো সম্ভাবনা বা সুযোগ তৈরি করা সম্ভব ছিল না। শরণার্থীদের প্রথম ঢলে মুসলিম জনসাধারণ, আওয়ামী লীগের কর্মী, ছাত্র, পুলিশ, ইপিআর সদস্য ও বাঙালি সেনা সদস্যরা ছিলেন। কিন্তু পরবর্তী ঢলে প্রধানত ছিল হিন্দু ধর্মাবলম্বী জনসাধারণ।

ইয়াহিয়া খানও নিউজউইককে দেওয়া তাঁর সাক্ষাত্কারে ভারতে পাকিস্তানের ২ মিলিয়ন বা ২০ লাখ শরণার্থী আশ্রিত আছে বলে স্বীকার করেন। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ও প্রচারমাধ্যম পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর হিন্দুবিদ্বেষী মনোভাব ও হিন্দুদের প্রতি আগ্রাসন অবশ্য অস্বীকার বা লুকানোর কোনো চেষ্টা করেনি। পূর্ববঙ্গের হিন্দু সম্প্রদায়কে নিশ্চিহ্ন করার ব্যাপারে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বদ্ধপরিকর ছিল। অবশ্য এই সাম্প্রদায়িক গণহত্যা প্রতিরোধে জাতিসংঘ বা বিশ্বমানবতা এগিয়ে আসেনি। ভারতের সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের মৈত্রী চুক্তি এই সমস্যা সমাধানের জন্য পাকিস্তানের ওপর চাপ সৃষ্টি করার সুযোগ তৈরি করলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও গণচীনের সঙ্গে পাকিস্তানের আঁতাত এবং মুসলিম বিশ্বের পাকিস্তানের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন পরিস্থিতির ইতিবাচকভাবে দ্রুত পরিবর্তনে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে (পৃষ্ঠা-১৮০)।

জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে ইয়াহিয়ার আগ্রাসী সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে পূর্ববঙ্গের জীবনকে বাজি রেখে মুক্তির সংগ্রাম ছিল পাকিস্তানের ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়’ (পৃষ্ঠা-৬২)। বিশ্ব পরাশক্তিগুলোর কাছে এই সংগ্রাম অপেক্ষা দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বিশ্ব জনমতের কাছে পূর্ববঙ্গের এই বেদনাদায়ক ঘটনা মানবিক বিপর্যয়ের চেয়েও বেশি কিছু ছিল। শুধু ত্রাণসহায়তা এই সমস্যার সমাধান নয়, তা অচিরেই বিশ্ববাসী বুঝতে পারে।

বস্তুত ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান নামে একটি দেশ তৈরি করা হয়েছিল। রাষ্ট্রটির ধর্ম ভিন্ন কোনো ভিত্তি-কলাম ছিল না। পাকিস্তান নামক ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা রাষ্ট্রটির মেয়াদ ক্ষণস্থায়ী হবে তাঁর আলামত ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক, ভারতীয় উপমহাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতিবিদ ও ভারতীয় আধুনিক জাতীয়তাবাদের অগ্রজ প্রবক্তা মাওলানা আবুল কালাম আজাদ তাঁর জীবনী ইন্ডিয়া উইনস ফ্রিডম গ্রন্থে উল্লেখ করেছিলেন, ‘জিন্নাহ ও তাঁর অনুসারীরা বুঝতে পারছেন না যে ভৌগোলিক অবস্থান তাঁদের বিরুদ্ধে... এই দুই অঞ্চলের (পশ্চিম পাকিস্তান ও বাংলাদেশ) কোনো ধরনের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ স্থাপনের সুযোগ নেই। অঞ্চলদ্বয়ের অধিবাসীরা একে অপর থেকে যেকোনো বিচারে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র শুধু ধর্মীয় পরিচয় ব্যতিরেকে। ভৌগোলিক, অর্থনৈতিক, ভাষাতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক মৌলিক পার্থক্য সত্ত্বেও ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে ঐকমত্য স্থাপনের প্রচেষ্টা জনগণের সাথ ধোঁকাবাজি ছাড়া কিছু নয়।... সর্বাপেক্ষা আশাবাদী ব্যক্তিও আশা করবে না যে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান তাদের সব মতপার্থক্য ভুলে গিয়ে একটি জাতিতে পরিণত হবে।’৬

পাকিস্তান রাষ্ট্রের গঠনকাঠামোর সমস্যার কারণে রাজনৈতিক পরিকাঠামোতে আঞ্চলিক ও সাম্প্রদায়িক স্বার্থগুলোকে সম্মিলিতভাবে অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হয়নি। পাকিস্তানের রাজনৈতিক সমাজে এক অঞ্চলের নেতৃত্বের অন্য অঞ্চলের প্রতি সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় উচ্চমার্গীয় ও প্রভুত্ববাদী আচরণ বর্ণবাদী রূপ পরিগ্রহ করে। আইয়ুব খান এই বর্ণবাদকে তাঁর মৌলিক গণতন্ত্রের নামে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তানিদের সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘এ দেশের জনসংখ্যার সিংহভাগ ভারতীয় গোত্রভুক্ত। পাকিস্তানের জন্মের পূর্বে এদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিল না। তারা এ যাবত্ হিন্দু বর্ণপ্রথা, মোগল, পাঠান ও ব্রিটিশদের দ্বারা শাসিত হয়ে আসছে। এর ফলে তাদের মধ্যে এখনো হিন্দুয়ানি সংস্কৃতি এবং ভাষাতাত্ত্বিক প্রভাব রয়েছে। তারা সব সময় নতজানু জাতি এবং মানসিকভাবে এখনো নব্য স্বাধীনতার সঙ্গে মানিয়ে নিতে মানসিকভাবে প্রস্তুত নয়, পূর্ব বাংলার মানুষদের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের এ ধরনের আচরণ আঁতে ঘা সৃষ্টি করে। অথচ পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য জাতীয়তাবাদের অর্থনৈতিক উপাদান পূর্ব বাংলার মুসলিম সম্প্রদায়ই জোগান দিয়েছিল।’

পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে সাংস্কৃতিক ও ভাষাতাত্ত্বিক পার্থক্য সত্ত্বেও শুধু অবিভক্ত ভারতবর্ষে অর্থনৈতিক বৈষম্য ও শোষণের কারণে পূর্ব বাংলার জনগণ বিশেষত মুসলিম সম্প্রদায় পাকিস্তান প্রতিষ্ঠাকে সমর্থন করেছিল। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর অবশ্য নব্য শাসকগোষ্ঠীর পূর্বসূরিদের মতো শাসন ও শোষণ অব্যাহত রাখলে অল্প সময়ের মধ্যে পূর্ব বাংলার মধ্যবিত্ত ও কৃষক সমাজের স্বপ্নের সলিল সমাধি ঘটে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পূর্বে ব্রিটিশরাজে অন্তত সমতার প্রশ্নে কিছু সহযোগিতা পাওয়া যেত। পূর্ব বাংলার মুসলিম সমাজ কলকাতাকেন্দ্রিক বাবুদের ‘ভদ্রলোক’ বলে বিদ্রূপ করলেও পাকিস্তান রাষ্ট্রে নিজেরা ‘ভদ্রলোক’রূপে আবির্ভূূত হয়। পূর্ব বাংলার মুসলিম সমাজ পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের শাসকশ্রেণিকে ‘অভদ্র’ মনে করত, কারণ তারা রবীন্দ্রসংগীত বা কবি কাজী নজরুল ইসলামের সৃষ্টি সম্পর্কে জানত না, বুঝত না, কদর করত না। অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানিরা নিজেদের ইন্দো-ইসলামি সংস্কৃতির উত্তরাধিকারী হিসেবে বাঙালিদের নিম্ন শ্রেণির এবং রাজনৈতিকভাবে বিদ্রোহী মনোভাবাপন্ন মনে করত। পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের মধ্যে পরস্পরের প্রতি প্রতিক্রিয়াশীল দৃষ্টিভঙ্গি ক্রমশ সাগরসম ব্যবধান ও বিরোধিতা তৈরি করে এবং ভৌগোলিকভাবে দূরবর্তী অঞ্চলদ্বয়ের মধ্যে সম্পর্কের সেতু নির্মাণের আদৌ কোনো সুযোগ অবশিষ্ট ছিল না।

১৯৭১ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রটি ঘটনাপরম্পরায় অনিবার্যভাবে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে। পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বিরোধিতা শুধু সাংস্কৃতিক নয়, বরং অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কারণেও ত্বরান্বিত হয়েছে। রাজনৈতিক আদর্শগত ভিন্নতা এবং রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্বার্থের প্রশ্নেও ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত পাকিস্তানে আঞ্চলিক এবং জাতীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক সমাজে দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা এবং গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিকাশ সম্ভব হয়নি। পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনীতিতে পাঞ্জাবের কর্তৃত্ব বিস্তার এবং পাঞ্জাবি সামরিক-আমলাতান্ত্রিক সভ্যদের অন্যদের বিশেষত পূর্ব বাংলার মুসলিম সমাজের প্রতি বৈরী মনোভাব ও প্রতিক্রিয়াশীল আচরণ শুধু জাতিগত ঘৃণা ও হিংসা বৃদ্ধি করেছে। জাতিগত এই অসহিষ্ণুতা বাংলাদেশ জেনোসাইডের প্রধান উপজীব্য। জাতিগত ঘৃণা পাঞ্জাবনিয়ন্ত্রিত পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকে বাঙালি জাতিকে নৃশংসভাবে নিশ্চিহ্ন করতে প্রণোদিত করে। পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে জাতিগত, ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক পার্থক্য এবং অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামরিক বৈষম্য জাতিগত ঘৃণা, পারস্পরিক মতবিরোধ তৈরি করে এবং গণতান্ত্রিক ও মানবিক সহমর্মিতা ও সহযোগিতার অপমৃত্যু ঘটায়। অবিভক্ত পাকিস্তানের শাসকশ্রেণির উপনিবেশবাদী দৃষ্টিভঙ্গি এবং আচরণের জন্য পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে ঐকমত্যের শেষ সম্ভাবনার দ্বার চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়।

তথ্যসূত্র:

১.         K. Subrahmanyam and Mohammed Ayoob. The Liberation War, New Delhi: S. Chand & Co. (Pvt.) Ltd., 1972. Pp. 73-92.

২.         K. Subrahmanyam and Mohammed Ayoob. cÉvàî×, Pp. 94-110.

৩.        Devid Loshak, Pakistan Crisis, London, 1971, P.59.

৪.         Guardian (Manchester), June 5, 1971.

৫.         K. Subrahmanyam and Mohammed Ayoob. প্রাগুক্ত, P. 138.

৬.        K. Subrahmanyam and Mohammed Ayoob. প্রাগুক্ত, P.1