পুঁজিবাদ ও জলবায়ু পরিবর্তন

বইয়ের প্রচ্ছদ
বইয়ের প্রচ্ছদ

দিস চেঞ্জেস এভরিথিং: ক্যাপিটালিজম ভার্সেস দ্য ক্লাইমেট—নাওমি ক্লাইন, সাইমন অ্যান্ড শুস্টার, নিউইয়র্ক, ২০১৪। পৃ. ৫৬৪। আইএসবিএন: ৯৭৮-১-৪৫১৬-৯৭৩৯-১

‘Our economic system and our planetary system are now at war.’
Naomi Klein, This Changes Everything, p. 21.

ভূমিকা

মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার গডার্ড ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুসারে বৈশ্বিক তাপমাত্রা প্রতিবছর তার আগের বছরের রেকর্ড ভেঙে বেড়েই চলেছে। ২০১৬ সালও তার ব্যতিক্রম ছিল না। ১৮৮০ সালে তাপমাত্রা সংরক্ষণের আধুনিক পদ্ধতি আবিষ্কৃত হওয়ার পর থেকে ২০১৬ সালই সবচেয়ে উষ্ণতম বছর হিসেবে রেকর্ড করা হয়েছে।১ অবশ্য ২০০০ সালের পর থেকে প্রতিবছরই তার আগের বছরের রেকর্ড ভেঙে উষ্ণতম বছর হিসেবে হাজির হয়েছে। ১৯৯২ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ৩ ইঞ্চি পর্যন্ত বেড়েছে।২ কিন্তু গত বছরের গবেষণার ফলাফল ধরে বিজ্ঞানীরা বলছেন, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে অ্যান্টার্কটিকা ও গ্রিনল্যান্ডের বরফ আগের ভবিষ্যদ্বাণীর চেয়ে বেশি দ্রুততায় গলবে এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাও আগের প্রত্যাশিত মাত্রার চেয়ে অধিক হারে বৃদ্ধি পাবে।৩  শিল্পবিপ্লবের পর থেকে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে ধরা হয় শীর্ষ বিন্দু। তাপমাত্রা এর চেয়ে বেশি হলে তার প্রভাব মোকাবিলা করা মানুষের জন্য কঠিন হয়ে পড়বে। বৈশ্বিক তাপমাত্রা যে তার চেয়ে বেশি হয়ে যাবে, সেটা শুধু বিশ্বব্যাপী পরিবেশবাদীরাই বলছিলেন না, বিশ্বব্যাংকই বলছিল, বৈশ্বিক তাপমাত্রা একুশ শতকের শেষ নাগাদ ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস হয়ে যাবে, ফলে চরম দাবদাহ হবে, বৈশ্বিক খাদ্য মজুত কমে যাবে, প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হবে এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাবে। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছিল, পৃথিবীর তাপমাত্রা ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস হয়ে গেলে জলবায়ু অভিযোজন সম্ভব নয়।৪ ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে সম্পাদিত প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে বলা হয়েছে, বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখার চেষ্টা করতে, কিন্তু কোনোভাবেই যেন ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রান্ত না হয়। এই চুক্তি বাস্তবায়নের ভবিষ্যত্ নির্ভর করছে স্বাক্ষরকারী দেশগুলোর প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের ওপর। তাই নিশ্চিতভাবে বলা যাবে না এর ভবিষ্যত্ কী হতে চলেছে। কারণ, তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখার যে লক্ষ্য, তা বরাবরই রাজনৈতিক পছন্দের ওপর নির্ভরশীল ছিল। ১৯৯৭ সালে স্বাক্ষরিত কিয়োটো প্রটোকল থেকে শুরু করে প্যারিস জলবায়ু চুক্তি অব্দি পৃথিবীর সব দেশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে মানুষ ও পৃথিবীর চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে এসেছে এবং যথারীতি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার লক্ষ্যকে রাজনৈতিক হাস্যরসের অংশে পরিণত করেছে।

৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার পৃথিবী কেমন হবে, তা নিশ্চিত করে এখনো বিজ্ঞানীরা কিছু বলতে পারছেন না। তবে সবচেয়ে ‘সুখকর’ চিত্রটাও হবে ধ্বংসাত্মক। জাতিসংঘের আন্তসরকার জলবায়ু পরিবর্তন প্যানেলের (আইপিসিসি) চতুর্থ ও পঞ্চম মূল্যায়ন প্রতিবেদন অনুযায়ী, একুশ শতকের শেষভাগ নাগাদ ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে বৈশ্বিক সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১ মিটার কিংবা ২ মিটার পর্যন্ত বাড়তে পারে এবং সামনের শতাব্দীগুলোতে আরও কয়েক মিটার বাড়ার অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে। এ রকম অবস্থায় কিছু দ্বীপরাষ্ট্র পুরোপুরি ডুবে যাবে। যেমন মালদ্বীপ ও টুভ্যালু এবং অসংখ্য দেশ যেমন ইকুয়েডর, ব্রাজিল, নেদারল্যান্ডস, যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া ও উত্তরাঞ্চলের অনেকাংশ এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক উপকূলীয় অঞ্চল প্লাবিত হবে। এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে জীবন ও জীবিকার ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ঘটবে।৫ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আসন্ন বিপদের অন্যতম ভুক্তভোগী বাংলাদেশ।

জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ আমাদের বিদ্যমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। নাওমি ক্লাইন দিস চেঞ্জেস এভরিথিং বইয়ে সেই চ্যালেঞ্জটির স্বরূপ ব্যাখ্যা করেছেন এমন সব যুক্তিতর্কের মাধ্যমে, যা ইতিপূর্বে আর কেউ করেননি। মানবসভ্যতার অন্যতম বড় এই সংকট বিদ্যমান বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা খুব জরুরি। কারণ, এ ব্যবস্থা পরিবর্তনের সামর্থ্যের ওপরই নির্ভর করছে আমরা এই সংকট মোকাবিলা করে কোন পর্যন্ত যেতে পারব। এ বাস্তবতাই ক্লাইনের এই বইয়ের পাঠকে আবশ্যক করে তুলেছে।

কে এই নাওমি ক্লাইন?

নাওমি ক্লাইন একজন পুরস্কার বিজয়ী সাংবাদিক, কলামিস্ট ও লেখক। তিনি বিখ্যাত মার্কিন হারপার’স  ম্যাগাজিনের প্রদায়ক সম্পাদক এবং দ্বিসাপ্তাহিক রোলিং স্টোন ম্যাগাজিনের প্রতিবেদক। তিনি দ্য নেশন পত্রিকায় নিয়মিত কলাম লেখক, যেটা নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার সিন্ডিকেট। উল্লেখযোগ্য আরও যেসব প্রকাশনায় তিনি লেখেন, তা হলো দ্য নিউইয়র্ক টাইমস, দ্য লস অ্যাঞ্জেলস টাইমস, দ্য গ্লোব অ্যান্ড মেইল, এল পাস, লাস্প্রেসো এবং দ্য নিউ স্টেটসম্যান। জলবায়ু-সংকট মোকাবিলায় বৈশ্বিক তৃণমূল আন্দোলন 350.org-এর তিনি পরিচালক সভার সদস্য। তিনি দ্য নেশন ইনস্টিটিউটের পুফিন ফাউন্ডেশন রাইটিং ফেলো এবং লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের সাবেক মিলিব্যান্ড ফেলো। সাংবাদিকতায় অনেক বিখ্যাত আন্তর্জাতিক পুরস্কার তিনি পেয়েছেন। কানাডার নভো স্কশিয়ায় অবস্থিত ইউনিভার্সিটি অব কিংস কলেজ তাঁকে সম্মানসূচক ডক্টর অব সিভিল ল প্রদান করেছে।

তাঁর আলোচিত বই দিস চেঞ্জেস এভরিথিং ২০১৪ সালে নন-ফিকশন ক্যাটাগরিতে হিলারি ওয়েস্টন রাইটার্স ট্রাস্ট পুরস্কার লাভ করে। ২০১৪ সালে সর্বাধিক বিক্রীত বইয়ের তালিকায় স্থান পাওয়া বইটি নিউইয়র্ক টাইমস-এর ২০১৪ সালের উল্লেখযোগ্য ১০০টি বইয়ের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এ ছাড়া একই বছর প্রকাশিত বহু তালিকায় সর্বোত্তম বই হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ২০টির বেশি ভাষায় অনূদিত এই বই পেন লিটেরারি অ্যাওয়ার্ডসের স্বল্প তালিকায় মনোনীত হয়েছে।

নাওমি ক্লাইনের প্রথম বই নো লোগো: টেকিং অ্যাইম অ্যাট ব্র্যান্ড বুলিজ আন্তর্জাতিক বেস্টসেলার নির্বাচিত হয়েছিল। ২৫টির বেশি ভাষায় অনূদিত এই বইয়ের ১০ লাখের বেশি মুদ্রিত কপি বিক্রি হয়েছিল। নিউইয়র্ক টাইমস এই বইকে ‘আন্দোলনের বাইবেল’ বলে আখ্যায়িত করেছিল। ২০১১ সালে টাইম ম্যাগাজিন ১৯২৩ সাল থেকে প্রকাশিত ১০০টি সেরা বইয়ের তালিকায় এটিকে স্থান দিয়েছিল।

ক্লাইনের অন্যতম বিখ্যাত বই শক ডকট্রিন: দ্য রাইজ অব ডিজাস্টার ক্যাপিটালিজম। বইটি ২০০৭ সালে প্রকাশিত হওয়ার পর আন্তর্জাতিক সর্বাধিক বিক্রীত বইয়ের স্বীকৃতি পায়। ৩০টির বেশি ভাষায় প্রকাশিত বইটির ১০ লক্ষাধিক মুদ্রিত কপি বিক্রি হয়েছিল।

বই সম্পর্কে মন্তব্য

তিনটি অধ্যায় ও তেরোটি উপ-অধ্যায়ের বইটির সর্বমোট পৃষ্ঠাসংখ্যা ৫৬৪। কিন্তু কৃতজ্ঞতা স্বীকার, তথ্যসূত্র ও নির্ঘণ্ট বাদে মূল বই ৪৬৬ পৃষ্ঠার। আলোচিত বইটি সম্পর্কে প্রখ্যাত কয়েকজনের উক্তি তুলে ধরলে পাঠকদের কাছে এর গুরুত্ব বোঝা সহজ হবে।

অধ্যাপক রব নিক্সন নিউইয়র্ক টাইমস-এর বই আলোচনায় বলেছেন, ‘দিস চেঞ্জেস এভরিথিং এমন এক প্রয়াস ও প্রভাবের বই, যা রিভিউ করা প্রায় অসম্ভব।...এটা নিঃসন্দেহে ক্লাইনের সবচেয়ে আশাবাদী বই। বিজ্ঞান, মনস্তত্ত্ব, ভূ-রাজনীতি, অর্থনীতি, নৈতিকতা ও রাজনৈতিক আন্দোলন, যা নিয়ে জলবায়ু প্রশ্ন গঠিত তার সব কটিকে তিনি একই সুতায় গেঁথেছেন। যার ফলাফল জন্ম দিয়েছে সাইলেন্ট স্প্রিং-এর পর সবচেয়ে আবশ্যক ও বিবাদপূর্ণ এই বইয়ের।’

গড অব স্মল থিংস-এর লেখক অরুন্ধতী রায় বলেছেন, ‘নাওমি ক্লাইন তাঁর সূক্ষ্ম, ক্রুদ্ধ ও নির্ভুল চিত্তকে আমাদের সময়ের সবচেয়ে বড় ও আশু প্রয়োজনীয় প্রশ্নে প্রয়োগ করেছেন।...আমি তাঁকে বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে অনুপ্রেরণামূলক রাজনৈতিক চিন্তকদের মধ্যে একজন মনে করি।’ 

ক্রিস বেন্টলি শিকাগো ট্রিবিউন-এ লিখেছেন, ‘যদি বৈশ্বিক উষ্ণতা একটা বিশ্বব্যাপী জাগরণের ডাক হয়ে থাকে, তাহলে আমরা সবাই বেশ গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন। ক্লাইন বলেছেন, আমরা কোনো অগ্রগতি করতে পারিনি। কারণ, আমরা এমন সব প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সমাধান আশা করছি, যারা আসলে এই সমস্যা সৃষ্টির পেছনে কলকাঠি নেড়েছে। ক্লাইনের তীক্ষ্ম বিশ্লেষণ জোর দিয়ে বলার চেষ্টা করেছে যে একটা গণজাগরণ এই উত্তরেরই অংশ।’

রয় স্ক্র্যান্টন রোলিং স্টোন-এ লিখেছেন, ‘প্রভাবনীয় ও চমকপ্রদ...ক্লাইন পৃথিবীর ভাগ্যের ব্যাপারে এমন এক চূড়ান্ত যুদ্ধের কথা লিখেছেন যে হয় আমরা পৃথিবী ধ্বংসকারী পুঁজিবাদীদের কাছ থেকে এর নিয়ন্ত্রণ পুনরায় ফিরিয়ে নেব, অথবা চেয়ে চেয়ে এর ভস্ম হয়ে যাওয়া দেখব।’

ওয়াশিংটন মান্থলি-তে ডি আর টাকার লিখেছেন, ‘দিস চেঞ্জেস এভরিথিং শুধু একটা বই নয়, শুধু একটা মুহূর্ত নয়, শুধু একটা আন্দোলন নয়, এটি একটি ন্যায়বিচারের অস্ত্র। এটি একটি বেঁচে থাকার পন্থা।’

পুঁজিবাদ বনাম জলবায়ু

নাওমি ক্লাইন এই বইয়ের মাধ্যমে বর্তমান বিশ্বের অন্যতম সংকট জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য চলমান বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে দায়ী করেছেন। তিনি ব্যাখ্যা করেছেন, কেন জলবায়ু পরিবর্তনকে মোকাবিলা করতে হলে মুক্তবাজার অর্থনীতির আদর্শকে পরিত্যাগ করতে হবে, বৈশ্বিক অর্থনীতিকে পুনর্বিন্যাস করতে হবে এবং আমাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে পুনর্গঠন করতে হবে। মূল কথাটা হলো, আমরা যদি মৌলিক পরিবর্তন নিজেরা না আনি, তাহলে মৌলিক পরিবর্তন আপনা থেকেই আসবে। কিন্তু সেটা হবে ধ্বংসাত্মক। দিস চেঞ্জেস এভরিথিং-এ ক্লাইন বলতে চেয়েছেন, জলবায়ু পরিবর্তন ট্যাক্স বা স্বাস্থ্যসেবার মতো কোনো ব্যাপার না, যেটা আমরা ফাইলে গুছিয়ে রেখে দিয়ে দায় সেরে ফেলতে পারব; বরং এটি একটি বিপত্সংকেতের ডাক, যা নব্য উদারনীতিবাদের মতো এমন একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে সংশোধন করার কথা বলছে, যেটা অনেক দিক থেকেই ব্যর্থ হয়েছে।

খুবই নিপুণভাবে তিনি দেখিয়েছেন, কীভাবে ব্যাপক হারে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমিয়ে আনাটা ক্রমবর্ধমান অসমতা কমানো, আমাদের ভঙ্গুর গণতন্ত্রকে নতুন করে সাজানো এবং আমাদের লুণ্ঠিত স্থানীয় অর্থনীতিগুলোর পুনর্গঠনের সবচেয়ে বড় সুযোগ। অসমতার প্রেক্ষাপটে ১৯৬১ সালে ফ্রাঞ্জ ফ্যানন তাঁর অনবদ্য অবদান রেচেড্ অব দ্য আর্থ-এ যেমনটা বলেছিলেন, ‘দিগন্তজোড়া যে বিষয়টি এখন সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ তা হলো সম্পদের পুনর্বণ্টন। এই বিষয়ের সমাধান মানুষকে করতেই হবে, ফলাফল যত ভয়ংকরই হোক না কেন।’৬ বিশ্ব অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলন ওয়ার্ল্ড ইকনোমিক ফোরাম ২০১৭ সালের সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হিসেবে বৈশ্বিক অসমতাকে চিহ্নিত করেছে এবং ধনী-গরিবের মধ্যে আয় বৈষম্যকে ব্রেক্সিট এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয়ের পেছনে ভূমিকা রেখেছে বলে দাবি করেছে৭, যদিও বিশ্বের শক্তিশালী পুঁজিবাদী অর্থনীতির দেশগুলোই এই ফোরামের সদস্য। বৈশ্বিক অসমতা এমন এক পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে, আগে শুধু সমাজতান্ত্রিক গোষ্ঠীগুলো এই দাবি জানিয়ে এলেও, এখন পুঁজিবাদীরাও ক্রমবর্ধমান অসমতার ফলে আসন্ন বিপদকে অন্তত স্বীকার করে নিচ্ছে। ক্লাইন এই বইয়ে বলেছেন, এসব আন্দোলন এখনো শেষ হয়নি। জলবায়ু পরিবর্তন আমাদের সামনে সেই সুযোগ এনে দিয়েছে, যার মাধ্যমে আমরা পুরোনো ভুলগুলোকে শুধরে নিতে পারি। এটাকে ক্লাইন বলছেন ‘দ্য আনফিনিশড বিজনেস অব লিবারেশন’ (পৃ. ৪৫৯)।

এই বইয়ে ক্লাইন অনেক কিছুর মুখোশ খুলে দিয়েছেন, যেমন জলবায়ু পরিবর্তনকে অস্বীকারকারী গোষ্ঠীগুলোর আদর্শিক বেপরোয়া ভাব, ভবিষ্যত্ জিও ইঞ্জিনিয়ারদের রক্ষাকর্তাসুলভ বিভ্রম এবং বহুসংখ্যক পরিবেশবাদী সংগঠনের মর্মান্তিক পরাজয়। স্পষ্টভাবে তিনি দেখিয়েছেন, কেন বাজারব্যবস্থা জলবায়ু-সংকটের সমাধান করতে পারেনি এবং পারবে না; বরং আরও খারাপ অবস্থার দিকে নিয়ে যাবে। চরমপন্থী এবং প্রতিবেশগত ধ্বংসাত্মক নিষ্কাশনবাদী পদ্ধতি এবং উন্মত্ত দুর্যোগ পুঁজিবাদের মাধ্যমে বিদ্যমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পরিবেশ ও জলবায়ুর ধ্বংসসাধন করতে থাকবে। গত সিকি শতাব্দীব্যাপী আমরা প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করার শর্তসাপেক্ষে জলবায়ু ও পরিবেশ-সংকটের সমাধান করতে চেয়েছি এবং সেটা বিদ্যমান ব্যবস্থার ছাঁচে পৃথিবীকে ফেলে করতে চেয়েছি। কিন্তু কোনো সমাধান আসেনি। ক্লাইন যেমনটা বলেছেন, ‘The Results have been disastrous, leaving us all in a great deal more danger than when the experiment began.’(পৃ. ২৬)।

ক্লাইন বলতে চেয়েছেন, মানবিকভাবে জলবায়ু-সংকটের মোকাবিলা করার জন্য প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের পরিবর্তন আনতে হবে। এই পরিবর্তন মানে চরম প্রায়শ্চিত্ত নয়; বরং একধরনের উপহার। এই উপহার ভঙ্গুর অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অগ্রাধিকারগুলো রূপান্তরে এবং দীর্ঘদিনের পচে যাওয়া ঐতিহাসিক ঘাকে সারাতে একটি অনুঘটক হিসেবে কাজ করবে। তিনি বলেছেন, অনুপ্রেরণামূলক বিভিন্ন আন্দোলন এই প্রক্রিয়া শুরু করেছে। বিভিন্ন সম্প্রদায় শুধু যে জীবাশ্ম জ্বালানি নিষ্কাশনের জমিন হিসেবে ব্যবহূত হতে অস্বীকার করছে তা নয়, তারা পুনঃ উত্পাদনশীল অর্থনীতিও গঠন করছে।

তিনটি অধ্যায়ের মধ্যে বইয়ের প্রথম অংশে ক্লাইন জলবায়ু পরিবর্তন বিজ্ঞান নিয়ে আলোচনা করেছেন এবং দেখিয়েছেন যারা জলবায়ু পরিবর্তনকে অস্বীকার করছে, তারা কীভাবে এই মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য বিনিয়োগ করছে। তিনি দেখিয়েছেন, জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়টির করপোরেট-সমর্থিত অস্বীকার এবং আর্থিক সংকট ও কৃচ্ছ্রসাধন নীতির সংমিশ্রণে পরিবেশ আন্দোলনকে লক্ষ্যচ্যুত করা হয়েছে। এই অস্বীকারের ইতিহাস এবং মুক্ত বাজার বাণিজ্যের আইন কীভাবে জলবায়ু পরিবর্তনে অবদান রাখছে, তার বর্ণনা রয়েছে। কীভাবে নিষ্কাশনবাদী মানসিকতা বড় বড় পরিবেশবাদী সংগঠন বা গ্রিন গ্রুপকে দুর্নীতিগ্রস্ত করে ফেলেছে, যেমন পরিবেশ সংরক্ষণ আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী ন্যাচার কনসারভেন্সি তার নিজের সংরক্ষিত জমিতে তেল উত্তোলন করছে। এসব সংরক্ষণবাদী সংগঠনের পরিচালনা পর্ষদে রয়েছে বড় বড় কার্বন নির্গমনকারী বহুজাতিক তেল-গ্যাস কোম্পানির পরিচালকেরা। তাঁরাই এসব পরিবেশ সংরক্ষণ আন্দোলনের সংগঠনগুলোর কার্যক্রমের জন্য অর্থ প্রদান করছেন। সুতরাং এসব সংগঠন এই ব্যবস্থা পরিবর্তনে অবদান রাখবে এমনটা আশা করা যায় না।

বেশির ভাগ মানুষ যে সমাধানের ওপর আস্থা রাখছে, যাকে ক্লাইন ‘জাদুকরি চিন্তা’ বা ‘ম্যাজিক্যাল থিংকিং’ বলে আখ্যায়িত করেছেন, তার বর্ণনা রয়েছে বইয়ের দ্বিতীয় অংশে। এর মূল কথা হলো, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রযুক্তিগত সমাধান। এই অংশে জিও ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মতো বিতর্কিত বিষয়সহ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রযুক্তিগত সমাধান সামনে নিয়ে আসার করপোরেট পরিকল্পনার ভয়াবহতা ব্যাখ্যা করেছেন তিনি। ধনবান বিজ্ঞানী এবং তথাকথিত বিজ্ঞান পল্লবগ্রাহীরা (বিল গেটসসহ) জিও ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে সূর্যকে ঢেকে দিয়ে এবং বায়ুমণ্ডলীয় সালফার ইনজেকশনের মাধ্যমে পৃথিবীকে শীতল করার পরিকল্পনা করছে। সহজতর ও কম ঝুঁকিপূর্ণ পদ্ধতি যেমন নতুন নতুন চরমপন্থী জ্বালানি উন্নয়নের রাশ টেনে না ধরে, ‘সোলার রেডিয়েশন ম্যানেজমেন্ট’কে করা হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার প্ল্যান ‘এ’। জলবায়ু পরিবর্তনের মূল কারণ গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমানোর ব্যাপারে এই জিও ইঞ্জিনিয়ারিং কোনো সমাধান দেবে না। এটা হয়তো তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে হিমবাহ গলে যাওয়ার সমাধান দিতে পারবে, কিন্তু ক্রমবর্ধমান কার্বন নির্গমন রোধ করবে না, ফলে মহাসাগরগুলোর শোষণ বাড়তেই থাকবে এবং দ্রুত অম্লীকরণ ঘটতে থাকবে। সামুদ্রিক অম্লীকরণের ফলে ইতিমধ্যে সামুদ্রিক প্রাণীগুলোর মৃত দশা। এ ছাড়া সূর্যকে ঢেকে দিতে একবার বায়ুমণ্ডলে বিভিন্ন পদার্থ স্প্রে করা শুরু করলে আর থামা সম্ভব না। কারণ, তা থামিয়ে দিলে জমানো সব তাপ এক ধাক্কায় পৃথিবীতে আছড়ে পড়বে।

ক্লাইন লিখেছেন, ‘Once you start spraying material into the stratosphere to block the sun, it would basically be impossible to stop because if you did, all the warming that you had artificially suppressed by putting up that virtual sunshade would hit the planet's surface in one single tidal wave of heat, with no time for gradual adaptation.’(পৃ. ২৬০)।

জিও ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ফলে হয়তো ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকার প্রিসিপিটেশন অল্প পরিবর্তন হতে পারে কিন্তু আফ্রিকার নিরক্ষীয় এলাকায় মারাত্মক খরা দেখা দেবে। এ ছাড়া সূর্য ঢেকে দিলে ভূমির তাপমাত্রা কমে যাবে, ফলে দক্ষিণ এশিয়াসহ এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চলে মৌসুমি বায়ু দুর্বল হয়ে পড়বে। এই মৌসুমি বায়ু এসব অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের উত্স, যা এখানকার জীবিকার প্রধান উপায় কৃষিকে ধ্বংস করবে (পৃ. ২৬০)।

বইয়ের শেষ অংশটি অনেক বেশি আশাব্যঞ্জক এই কারণে যে এখানে ক্লাইন তৃণমূল পর্যায়ের পরিবেশ আন্দোলনের কথা তুলে ধরেছেন। নব্য উদারনীতিবাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে সংঘটিত আন্দোলনগুলো নিয়ে আলোচনা করেছেন। এসব আন্দোলনকে তিনি ‘ব্লক্যাডিয়া’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। জীবাশ্ম জ্বালানি নিষ্কাশনের মাধ্যমে হুমকিগ্রস্ত এসব প্রাকৃতিক এলাকায় আদিবাসীসহ সবাই নিজেদের মধ্যে পার্থক্য ভুলে গিয়ে রুখে দাঁড়াচ্ছে, প্রতিবাদ করছে। মানুষ বিভিন্ন জায়গায় রাস্তা অবরোধ করছে, বুলডোজারের সামনে অকুতোভয়ে দাঁড়াচ্ছে এবং তেল পাইপলাইনের ওপর ঝুঁকি নিয়ে উঠছে প্রতিবাদ জানাতে। এর ফলে নিষ্কাশকেরা এ পর্যন্ত যা ইচ্ছা তা করতে পারলেও, এখন স্তম্ভিত হয়ে যাচ্ছে। এসব আন্দোলন সম্পর্কে ক্লাইন বলেছেন,

‘The climate movement has yet to find its full moral voice on the world stage, but it is most certainly clearing its throat – beginning to put the very real thefts and torments that ineluctably flow from the decision to mock international climate commitments alongside history’s most damned crimes.’ (পৃ. ৪৬৪)।

অস্বীকারের পুঁজিবাদ

দিস চেঞ্জেস এভরিথিং জলবায়ু পরিবর্তনের চেয়ে অস্বীকারের মনস্তত্ত্বে বেশি জোর দিয়েছে। বইয়ের একটা বড় অংশ জুড়ে দক্ষিণপন্থী ধনবান থিংক ট্যাংক এবং লবি গ্রুপগুলো জলবায়ু পরিবর্তনকে অস্বীকার করতে কীভাবে প্রচুর অর্থ ঢালছে তার বর্ণনা রয়েছে। যেমন প্রভাবশালী মার্কিন থিংক ট্যাংক হার্টল্যান্ড ইনস্টিটিউটকে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে করপোরেট কোম্পানিগুলোর পক্ষ অবলম্বন করতে দেখা যায়। কিন্তু দেখা গেছে, এক্সনমোবিল, প্রভাবশালী মার্কিন ব্যবসায়ী গ্রুপ কোচ ব্রাদারস ও রক্ষণশীল প্রয়াত অর্থদাতা রিচার্ড মেলন স্কেইফের কাছ থেকে হার্টল্যান্ড ইনস্টিটিউট ১০ লাখ ডলারের বেশি অর্থ গ্রহণ করেছে। এসব অর্থদাতাই বৃহদাকারে কার্বন নির্গমন করে থাকে। জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়কে আক্রমণ করার জন্য এক ব্যক্তি ৮০ লাখ ৬০ হাজার ডলার দিয়েছে বলে হার্টল্যান্ড ইনস্টিটিউটের একটি ফাঁস হয়ে যাওয়া নথিতে তথ্য পাওয়া গেছে। কিন্তু সেই ব্যক্তির নাম প্রকাশ করা হয়নি সেই নথিতে (পৃ. ৪৫)। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রভাবশালী ব্রিটিশ পত্রিকা দ্য গার্ডিয়ান একটি প্রতিবেদনে দেখিয়েছে, যেসব গোষ্ঠী জলবায়ু বিজ্ঞান নিয়ে সন্দেহ ছড়াচ্ছে, তাদের মার্কিন ধনকুবেরদের একটি নেটওয়ার্ক প্রায় ১০ কোটি ২০ লাখ ডলার অর্থ প্রদান করেছে।

জলবায়ু পরিবর্তন বিজ্ঞান নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। মানুষের ক্রিয়াকলাপের ফলে জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটছে এবং যদি এটা নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তাহলে মানুষের বসবাসের এই পৃথিবী বদলে যাবে। কিন্তু এ ব্যাপারে রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া সব সময়ই দ্ব্যর্থবোধক থেকেছে। প্যারিস জলবায়ু চুক্তির মতো ত্রুটিপূর্ণ চুক্তির যে অর্জন, সেটুকুও এত দিন পর্যন্ত অর্জন করা সম্ভব হচ্ছিল না।

ক্লাইন এই বইয়ে বলেছেন, তিনি ২০০৭ সালে শক ডকট্রিন নামের বইয়ে করপোরেট এলিটরা কীভাবে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় জলবায়ু পরিবর্তনকে প্রান্তিক অবস্থানে ঠেলে দিয়েছে, তা তুলে ধরেছিলেন। সেখানে পরিবেশ ও সামাজিক ধ্বংসসাধন করে চলা নব্য উদারনীতিবাদের নীতির সমালোচনা করেছেন তিনি। শক থেরাপির মাধ্যমে নব্য উদারনীতিবাদ তার নীতি বাস্তবায়ন করে থাকে, যা স্বাভাবিক সময়ে করা সম্ভব নয়। তাই দুর্যোগের মাধ্যমে এমন একটা অবস্থা সমাজে তৈরি হতে হয়, যখন মানুষের সামনে সেসব নীতি গ্রহণ করা ছাড়া আর কোনো পথ খোলা থাকে না। এটাকেই ক্লাইন দুর্যোগ পুঁজিবাদের উত্থান (দ্য রাইজ অব ডিজাস্টার ক্যাপিটালিজম) বলে আখ্যায়িত করেছেন। ২০০৮ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে জলবায়ুসহিষ্ণু ফসলের বীজে ২৬১টি স্বত্ব দেওয়া হয়েছে। এর ৮০ শতাংশই পেয়েছে বিতর্কিত মনসান্টো, সিনজেনটাসহ মাত্র ছয়টি বড় কৃষি ব্যবসায়ী কোম্পানি। সুপারসাইক্লোন স্যান্ডির ফলে হালকা ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় আবাসন নির্মাণের জন্য নিউজার্সির রিয়েল এস্টেট কোম্পানিগুলো লাখ লাখ ডলার পেয়েছে, যদিও হারিকেন ক্যাটরিনা আঘাত হানার পর যেসব আবাসন এসব কোম্পানি তৈরি করেছে, তা সেখানকার অধিবাসীদের জন্য এখনো এক দুঃস্বপ্ন হয়ে আছে। ক্লাইনের মতে, আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদকে বেসরকারীকরণ করা এবং দুর্যোগ থেকে মুনাফা বের করার এই বিষয়ে আশ্চর্যান্বিত হওয়ার কিছু নেই। আমাদের বিদ্যমান ব্যবস্থা তৈরিই হয়েছে এই কাজ করার জন্য (পৃ. ৯)। 

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংসকারী প্রকল্প গ্রহণের মাধ্যমে নেওয়া বেশির ভাগ প্রকল্পের ক্ষেত্রেই সাধারণত বলা হয়, এগুলো পরিবেশের ক্ষতি করবে না বা খুব কম ক্ষতি করবে। প্রকৃতির রেজিলিয়েন্স বা সহিষ্ণুতা অনেক বেশি এবং একটু-আধটু ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবে বলে প্রশংসা করা হয়। কিন্তু সহ্য ক্ষমতা থাকলেই কাউকে অত্যাচার করতে হবে? কোনো প্রাণের স্বাভাবিক বৃদ্ধি আর সংগ্রাম করে টিকে থাকা কি এক? স্বাভাবিক বৃদ্ধি যেখানে তার পুনঃ উত্পাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি করে, সংগ্রাম করে টিকে থাকা খুব বেশি হলে শুধু তার বেঁচে থাকা নিশ্চিত করে। ক্লাইন একটি পরিচ্ছেদে লিখেছেন, রাইট টু রিজেনারেট বা পুনর্জন্মের অধিকার নিয়ে। সেখানে তিনি বলেছেন, ‘Just because biology is full of generosity does not mean its forgiveness is limitless. With proper care, we stretch and bend amazingly well. But we break too- our individual bodies, as well as the communities and ecosystems that support us.’ (পৃ. ৪৪২)।

বইয়ের সীমাবদ্ধতা

জন গ্রে দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় ক্লাইনের প্রশংসা করেছেন সময়ের সেরা বইটি উপহার দেওয়ার জন্য। তবে কয়েকটা জায়গায় ক্লাইনের বইয়ের সীমাবদ্ধতা দেখিয়েছেন। তিনি বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের সব দোষ করপোরেট এলিটদের ঘাড়ে চাপানো ঠিক নয়, কারণ পুঁজিবাদের উত্থানের আগেও পরিবেশের ধ্বংসসাধন করা হয়েছে। ক্লাইন নিজেই তাঁর বইয়ে বিয়ন্ড এক্সট্রাকটিভিজম পরিচ্ছেদে বলেছেন, মানুষের ক্রিয়াকর্ম কয়েক শতক আগে থেকেই জলবায়ু পরিবর্তন ঘটিয়ে চলছিল। ‘We started treating the atmosphere as a waste dump when we began using coal on a commercial scale in the late 1700s and engaged in similarly reckless ecological practices well before that.’ এ ছাড়া কেন্দ্রীয়-নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতির সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মাও সে তুংয়ের চীনেও নিষ্কাশনবাদী মডেল ব্যবহার করা হয়েছিল, যেখানে বিংশ শতকের সবচেয়ে বড় ও জঘন্যতম পরিবেশ বিপর্যয় ঘটেছিল।

পরিবেশ-সংকটে অতিরিক্ত জনসংখ্যার ভূমিকাকে সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত না করার সমালোচনা করেছেন জন গ্রে। তিনি মনে করেন, নিষ্কাশনবাদী মডেল শুরুই হয়েছিল কৃষি আবিষ্কারের ফলে। আর এর উদ্দেশ্য ছিল বাড়তি জনসংখ্যার চাপকে মোকাবিলা করা। কিন্তু জন গ্রের এই সমালোচনা বইয়ের মূল আবেদনের সঙ্গে মানানসই নয় বলে মনে হয়েছে। ক্লাইনের এই বই জোর দিয়েছে পরিবেশ আন্দোলনের ওপর। আর এই আন্দোলন নিশ্চিতভাবেই বিদ্যমান প্রবৃদ্ধিকেন্দ্রিক নব্য উদারনীতিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। যত সম্ভব নির্দিষ্ট লক্ষ্যে স্থির থাকার ওপর আন্দোলনের সাফল্য নির্ভর করে। জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বিষয়ে গণজাগরণের জন্য মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে নির্দিষ্ট বিষয়ে স্থির থাকাটাই কাম্য।

জন গ্রে আরও বলেছেন, ক্লাইন বিদ্যমান পুঁজিবাদের সমালোচনা করলেও বিকল্প অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কী হতে পারে, সে সম্পর্কে কিছু বলেননি। শুধু তৃণমূল পর্যায়ে কীভাবে এসব পরিবেশ ধ্বংস ও শোষণের বিরুদ্ধে স্থানীয় সংগ্রাম সংঘটিত হচ্ছে, তার কথা বলেছেন। এখানেও বলা যায়, বিদ্যমান সমস্যাকে চিহ্নিত না করে তার বিকল্প বের করা সম্ভব নয়। নিষ্কাশনবাদী এই ব্যবস্থার শোষণবাদী আচরণে শুধু মানুষ নয়, সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতিও যে বিপর্যস্ত, তার একটা বিস্তৃত বিশ্লেষণ ক্লেইনের এই বই। সেখান থেকে এর সমাধানে বিকল্প ব্যবস্থার আলোচনা আসতে পারে।

জন গ্রের এসব সমালোচনার উদ্দেশ্য ছিল ক্লাইনের আলোচনাকে সমৃদ্ধ করা। তবে ক্লাইন যেসব বিষয় তুলে এনেছেন, সেগুলোর সঙ্গে তিনি দ্বিমত পোষণ করেননি।

শেষ কথা

পুঁজিবাদ ও পৃথিবীর মধ্যে চলমান যুদ্ধ জলবায়ু পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হচ্ছে। যুদ্ধ চলছে এবং পুঁজিবাদ বিজয়ী হচ্ছে প্রতিবার। জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনগুলোয় প্রবৃদ্ধি ধরে রাখার জন্য রাষ্ট্রগুলো কার্বন নির্গমন কমাতে আগ্রহী হয় না। উন্নত রাষ্ট্রগুলো বিশ্বব্যবস্থায় নিজেদের শক্তিশালী অবস্থান ধরে রাখতে যেমন প্রবৃদ্ধি কমাতে চায় না, তুলনামূলক গরিব রাষ্ট্রগুলো যারা আবার জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী, তারা ধনী দেশগুলোর সমান পরিবেশদূষণ না করে থামবে না বলে গোঁ ধরে আছে। কারণ, প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হলে পরিবেশদূষণ করতে হবে বলেই তারা বিশ্বাস করে। এর ফলে মূল সমাধানে জোর দেওয়া সম্ভব হয় না। আসল সমাধান হলো জলবায়ু ন্যায়বিচার, যার মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের দোহাই দিয়ে কার্বন নির্গমন করে চলা উন্নয়নশীল ও দরিদ্র দেশগুলোতে যথেষ্ট পরিমাণ সম্পদ ও প্রযুক্তি ধনী দেশগুলো থেকে স্থানান্তর নিশ্চিত হবে। যে জন্য বলিভিয়ার জলবায়ু আলোচনাকারী এঞ্জেলিকা নাভারো ল্যানোস বলেছেন, পৃথিবীকে বাঁচাতে হলে একটা মার্শাল প্ল্যান দরকার৮ এবং এই অবস্থার পরিবর্তন আনতে হলে আমাদের বিশ্ববীক্ষার মৌলিক পরিবর্তন দরকার, যেটাকে ক্লাইন বলছেন, ‘…a worldview will need to rise to the fore that sees nature, other nations, and our own neighbors not as adversaries, but rather as partners in a grand project of mutual reinvention.’ (পৃ. ২৩)। পৃথিবীর অস্তিত্বই যদি না থাকে, তাহলে পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে কীভাবে, সে ব্যাপারে কারও কোনো মাথাব্যথা দেখা যাচ্ছে না।

এখন প্রশ্ন হলো, আমরা আর কবে স্থায়ী সমাধানে পৌঁছাব, যেখানে পারস্পরিক দোষারোপ নয়, প্রাধান্য পাবে অসংখ্য প্রাণের আধার এই পৃথিবী? আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থা দুই বছর আগে বলেছিল, আমরা যদি কার্বন নির্গমনের লাগাম টেনে ধরতে না পারি, তাহলে ২০১৭ সালেই শেষ বছর, যার পরে আর কোনো কার্বন নির্গমন করা সম্ভব নয়। জীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভর অর্থনীতির এটাই হবে শেষ বছর। কারণ, কার্বন বাজেটিংয়ের মাধ্যমে বায়ুমণ্ডলে সর্বোচ্চ যে পরিমাণ কার্বন নির্গমনের সীমারেখা নির্ধারণ করা হয়েছিল, তা ২০১৭ সালেই শেষ হয়ে যাবে। যার মানে হলো, পৃথিবীর ধ্বংসসাধন বন্ধ করতে হলে জীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভর সব কলকারখানা বন্ধ করে দিতে হবে, যা অনেক বেশি ব্যয়সাপেক্ষ ব্যাপার।৯ কিন্তু বিদ্যমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় পৃথিবীকে রক্ষা করার প্রচেষ্টা নেই বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে।

২০১৫ সালে সম্পাদিত প্যারিস জলবায়ু চুক্তিকে বিশ্বের প্রথম সফল জলবায়ু চুক্তি বলা হচ্ছে। তবে প্যারিস চুক্তির সাফল্য নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। রাষ্ট্রগুলো কতটুকু তাদের প্রতিশ্রুতি রাখবে, তা সময়ের হাতে ছেড়ে দিয়েছি আমরা। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্পের বিজয় সে অর্জনকে করেছে প্রশ্নবিদ্ধ। বিদ্যমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় জলবায়ু পরিবর্তনের সমাধান যে কত বেশি বিপন্ন, তার উদাহরণ হলো প্যারিস চুক্তিকে ছুড়ে ফেলার হুংকার। ট্রাম্প শুধু এই হুংকার দিয়েই থেমে নেই, তিনি ইতিমধ্যে মার্কিন পরিবেশ প্রতিরক্ষা কর্তৃপক্ষ বা ইপিএর নীতি পরিবর্তন করেছেন। জলবায়ু পরিবর্তন-সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত ইপিএর ওয়েবসাইট থেকে সরিয়ে ফেলার আদেশ দিয়েছেন।১০ এর প্রধান করা হয়েছে তাঁর নীতির সমর্থক রক্ষণশীল স্কট প্রুইটকে, যিনি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে সন্দিহান। শুধু তা-ই নয়, প্রুইট কার্বন নির্গমনকারী তেল-গ্যাস উত্পাদকদের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি। যার ফলে, পরিবেশ দূষণকারী এসব কোম্পানির বিরুদ্ধে তিনি কতটুকু ব্যবস্থা নেবেন সে বিষয়ে বিস্তর সন্দেহ রয়েছে।    

এসব ঘটনা প্রমাণ করে, বিদ্যমান ব্যবস্থার সংস্কার না হলে জলবায়ু প্রশ্নে আমরা কোনো স্থায়ী সমাধানে পৌঁছাতে পারব না। মাঝেমধ্যে কিছু আশাব্যঞ্জক পদক্ষেপ নেওয়া হবে, কিন্তু তারপরেই ট্রাম্পের মতো কোনো ঝড় এসে সেসব পদক্ষেপকে চূর্ণ করবে নিমেষেই। এর ফলে ফ্রেডরিক জেমসন যে প্রচলিত বিশ্ববীক্ষার কথা বলেছিলেন যে ‘পুঁজিবাদের সমাপ্তি কল্পনা করার চেয়ে পৃথিবীর সমাপ্তি কল্পনা করা সহজ’, তা আরও দৃঢ় হতে থাকবে।

তথ্যসূত্র

1.  ‘NASA, NOAA Data Show 2016 Warmest Year on Record Globally,’ National Aeronautics and Space Administration, January 18, 2017. Can be accessed at https://www.giss.nasa.gov/research/news/20170118/

2. Tim Folger, ‘Oceans Will Rise Much More Than Predicted, NASA Says,’ National Geographic, August 27, 2015. Can be accessed at http://news.nationalgeographic.com/2015/08/150827-NASA-climate-oceans-seas-greenland/

3. Chris Mooney, ‘The alarming science driving much higher sea level projections for this century,’ The Washington Post, March 30, 2016. Can be accessed at https://www.washingtonpost.com/news/energy-environment/wp/2016/03/30/the-alarming-science-behind-projections-of-much-higher-seas-in-this-century/?utm_term=. 1c59209575ac

4. Hans J. Schellnhuber et al., ‘Turn Down the Heat: Why a 40C Warmer World Must Be Avoided,’ A Report for the World Bank, November 2012, p. xviii.

5. Working Group II contributions to the 4th and 5th Assessment Reports of the IPCC, both available at http://www.ipcc.ch/

6. Frantz Fanon, The Wretched of the Earth, Translation from French by Richard Philcox, New York: Grove, 2004, p. 55.

7. ‘The Global Risks Report 2017,’ World Economic Forum, can be accessed at https://www.weforum.org/reports/the-global-risks-report-2017

8. Angelica Navarro Llanos, ‘Climate Debt: The Basis of a Fair and Effective Solution to Climate Change,’ presentation to Technical Briefiing on Histotrical Responsibility, UNFCCC, Bonn, Germany, June 4, 2009.

9. ‘World Energy Outlook 2011,’ International Energy Agency, p. 40.

10. Valerie Volcovici, ‘Trump administration tells EPA to cut climate page from website: sources,’ Reuters, January 25, 2017. Can be accessed at http://www.reuters.com/article/us-usa-trump-epa-climatechange-idUSKBN15906G