পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে সংখ্যাগরিষ্ঠের আধিপত্য

সারসংক্ষেপ

সংখ্যাগরিষ্ঠতার ওপর ভিত্তি করে ‘অবস্থানগত আধিপত্য’ কীভাবে বাংলাদেশের জাতীয় আদর্শ গঠনে সহায়তা করে, সেটিই এ প্রবন্ধের আলোচ্য বিষয়। এর ফলে বিশেষ বাঙালি পরিচয়ভিত্তিক জাতীয় পরিচয়গঠন রাষ্ট্রের অন্যান্য পরিচয়সংক্রান্ত দাবি এবং আদিবাসীদের পরিচয়সংক্রান্ত দাবিকে অগ্রাহ্য করে থাকে। একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও বৃহত্তর পার্বত্য অঞ্চলে আদিবাসীদের ওপর বাঙালিদের সাংস্কৃতিক আধিপত্যের কারণে শান্তি অধরা রয়ে গেছে।

মুখ্য শব্দগুচ্ছ: জাতি, নৃগোষ্ঠী, জাতীয়তাবাদ, বাঙালি, আদিবাসী, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল, আধিপত্য ও পরিচয়।

প্রারম্ভিক কথা

যে ১১টি দেশ ২০০৭ সালে জাতিসংঘে গৃহীত আদিবাসীদের অধিকার-সংক্রান্ত ঘোষণায় স্বাক্ষর করেনি, বাংলাদেশ তার একটি। ‘আদিবাসী’ শব্দটি সঠিকভাবে সংজ্ঞায়িত না হওয়ার যুক্তিতে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করা থেকে বিরত থাকে।১ এটি প্রমাণ করে যে বাংলাদেশের আদিবাসীদের চলমান সমস্যা রাষ্ট্র দ্বারা নিযুক্ত সংখ্যাগুরুর অবস্থানগত শক্তি সংখ্যালঘু আদিবাসী ‘অন্যান্যদের’ ভাগ্য নির্ধারণ করার ফলে বিরাজমান। ‘প্রাতিষ্ঠানিক’ জাতীয় পরিচিতি গঠনের বিষয়টি একটি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ নিয়ন্ত্রণ করে এবং এই সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ সাধারণত ক্ষমতাবলে তাদের ‘অবস্থানগত শক্তি’র ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করে। অধিকাংশ জনগণ বা অন্তত এলিট জনগোষ্ঠী এ ধারণা তৈরিতে নেতৃত্ব দেয় এবং তাদের ‘আদিবাসী অবস্থান’ ও এর সঙ্গে যুক্ত অন্যান্য বিশেষ অধিকার স্বীকৃতি দেওয়া বা না দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার ইতিহাসে এমন অনেক উদাহরণ আছে, যেখানে আদিবাসী বা ‘প্রথম মানুষ’ হিসেবে তাদের অধিকারের স্বীকৃতি উপেক্ষিত হয়। এটি বিভিন্ন জায়গায় ঘটেছে। পাশ্চাত্য ঔপনিবেশিক ইতিহাসে আদিবাসীদের উচ্ছেদের অনেক উদাহরণ রয়েছে এবং অন্যদিকে স্বীকৃতি ও পুনর্মিলনের সাম্প্রতিক প্রবণতা, বিশেষত অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের কাছে ‘ক্ষমা’র নিদর্শন রয়েছে। কিন্তু পাশ্চাত্য উপনিবেশে আদিবাসী উচ্ছেদ ও আদিবাসী পরিচয় জোর করে মুছে ফেলার ঘটনাও কম নয়, যা তাদের জাতিগঠনের একটি বৈশিষ্ট্য। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। ঠান্ডা যুদ্ধকালে স্বাধীনতা লাভকারী ৪৪ বছর বয়সী বাংলাদেশের জাতিগঠনের ইতিহাসও ত্রুটিহীন নয়। বাংলাদেশিরা ভুলে যায় যে পশ্চিম পাকিস্তানি এলিটরা বাঙালিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও তাদের বাঙালি আত্মপরিচয় শান্তিপূর্ণভাবে মেনে নেয়নি।

বাঙালিরা নিজস্ব পরিচয়ের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানি এলিটদের (মিলিটারি জান্তার) বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে এবং ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে নয় মাসের সহিংস যুদ্ধের পর স্বাধীনতা লাভ করে। বিজয়ী বাঙালিদের নতুন রাষ্ট্রের মধ্যে বসবাসকারী আদিবাসীরা স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের নাগরিক হয়ে পড়ে। আদিবাসী জনগোষ্ঠীও তাদের আত্মপরিচয়ের স্বীকৃতিপ্রত্যাশী। এ প্রত্যাশা বাংলাদেশকে শুরুতেই সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি ও আদিবাসীদের মধ্যে রাজনৈতিক অস্থিরতায় নিমজ্জিত করে, যা পরবর্তীকালে সামরিক দাঙ্গায় রূপান্তরিত হয়। এ সংকট ১৯৯৭ সালে আংশিক সমাধান হয়েছিল। কিন্তু সময়ে সময়ে তা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের পূর্ববর্তী পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, বাংলাদেশে কোনো আদিবাসী জনগোষ্ঠী নেই। এ দাবি আবারও বাংলাদেশি নাগরিক হিসেবে আদিবাসীদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও পরিচয়ের অধিকার নিয়ে উত্তপ্ত বিতর্ক উসকে দিয়েছিল। এ লেখাটি এসব বিতর্কের ঐতিহাসিক ও তাত্ত্বিক দিক নিয়ে একটি আলোচনা। লেখাটির যুক্তি হচ্ছে, অদিবাসীদের প্রতি বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠের আচরণ বাঙালি পরিচয় প্রতিষ্ঠার ফলে সৃষ্ট অত্যাচারকে প্রতিভাত করে, যা আন্তর্জাতিকভাবেও বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা উপস্থাপন করে। আরও বিশেষভাবে নিবন্ধটি উত্তর-ঔপনিবেশিক দেশগুলোর নিজেদের জন্য ‘আধুনিক’ জাতীয়তার একটি ভ্রান্ত ধারণার প্রতিলিপির প্রয়াসকে তুলে ধরে, যা তাদের সমগ্র জনসংখ্যার ওপর সমগোত্রীয়তা আরোপে বাধ্য করার ক্ষেত্র তৈরি করে। এ জন্য বাংলাদেশ এ ধরনের সংকটের একটি উল্লেখযোগ্য নজির স্থাপন করেছে, যেখানে জাতীয়তার চাহিদা সমগোত্রীয়তার চাহিদা তৈরি করেছে, যার ফলে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত আদিবাসী অধিকার খর্বিত হয়েছে। এখানে অবশ্যই মনে রাখতে হবে, অধিকাংশ উত্তর-ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রগুলোতে আদিবাসী সংস্কৃতি ও পরিচয় তদের অস্তিত্বের ওপর নির্ভরশীল ভূমির সঙ্গে সুষ্ঠুভাবে যুক্ত। এ আলোচনায় সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ যারা অবস্থানগত পরিচয়ের ফলে উচ্চতর রাজনৈতিক ক্ষমতাসীন এবং স্থানভিত্তিক আদিবাসী জনগণ যারা নৈতিক যুক্তিবলে এবং আন্তর্জাতিক আইন দ্বারা সমর্থিত, তাদের আলাদা করে দেখা হয়েছে।

প্রবন্ধটিতে প্রথমে জাতি এবং জাতিগত কিছু তাত্ত্বিক পর্যালোচনা রয়েছে, যা দুটি আন্তসম্পর্কিত প্রাসঙ্গিক ধারণার বিতর্কের ভিত্তি স্থাপন করে: আদিবাসী ও স্থানভিত্তিক পরিচিতি আর অন্যদিকে রাষ্ট্রভিত্তিক জাতীয়তার অবস্থানগত পরিচিতি, যা সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যার সমর্থনের জন্য এলিটদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এরপর এখানে ’সোনার বাংলা’ পুরাণের ওপর ভিত্তি করে বাঙালি অবস্থানগত পরিচয়ের গঠন কীভাবে আদিবাসীদের অধিকার অস্বীকার করে সেটা আলোচনা করা হয়েছে। প্রবন্ধে বলা হয়েছে যে অপরিহার্যভাবে সাদৃশ্যের ওপর ভিত্তি করে আধুনিক রাষ্ট্রগঠন একটি প্রচলিত কিন্তু ত্রুটিপূর্ণ ধারণা, যা বাংলাদেশি এলিটদের আদিবাসী জনগণের ওপর বাঙালি পরিচয় চাপিয়ে দিতে সচেষ্ট করেছে।

জাতি, নৃগোষ্ঠী ও আদিবাসী—কার দেশ/ কার জাতি?

জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণ ও রাজনৈতিক সার্বভৌমত্বের ভিত্তিতে দেশের রাজনৈতিক রূপান্তর একই সঙ্গে একটি মানুষের মৌলিক পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন তোলে এবং কোন গোষ্ঠী রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপন করে, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলে। যেখানে মতাদর্শ হিসেবে জাতীয়তাবাদ হলো একটি দেশের রাজনীতি প্রতিষ্ঠার প্রকাশ, কিন্তু এন্থনি ডি স্মিথ যুক্তি দেন যে নৃগোষ্ঠীরাই একটি জাতির পরমাণু। পরিচয় ব্যাপারটি কাল্পনিক, যা ঐতিহাসিক স্মৃতি ও ভূখণ্ডের সঙ্গে জড়িত।২

একটি দেশের জাতিগত অতীত তার বর্তমানের ওপর অবস্থান করে, যা জাতিকে ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত করে এবং এর বৈধতা বাড়ায়। জাতিগত সমস্যা সাংস্কৃতিক গুণাবলি ও পূর্বপুরুষের অনুমানের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা একটি পরিচয়, যা দিয়ে উন্নত দেশের বিপরীতে উন্নয়নশীল দেশগুলোর অনেক রাজনৈতিক সমস্যা ব্যাখ্যা করা হয়। অনেক ইউরোপীয় দেশে বৈচিত্র্য দেখা যায়, কিন্তু একতাবদ্ধ জাতীয়তার ধারণা ইউরোপে সুপ্রতিষ্ঠিত। এশিয়া ও আফ্রিকাতে অনেক মানুষ, বিশেষত যারা ‘উপজাতি’ হিসেবে পরিচিত, একটি জাতীয় সার্বভৌম রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপন করার জন্য কিছু নির্দিষ্ট চিহ্নের সংমিশ্রণ ও স্বাধীনতার জন্য স্ব-আরোপিত ‘জাতি’ গঠনের চেয়ে তাদের ভূমি বা স্থানের জন্য প্রবল আনুগত্য রয়েছে।৩ ‘উপজাতি’ মানুষদের জন্য প্রথমে ‘আদিম’ এবং পরে ‘আদিবাসী’ শব্দটি কিছু নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর স্থানভিত্তিক সংযুক্তির উত্থান হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়। এ ছাড়া তাদের শক্তি ও সম্পদের অভাব বৃহত্তর জনগোষ্ঠী থেকে তাদের আলাদা করে।

আদিবাসী ধারণাটি বলতে সাধারণত বংশানুক্রমিকভাবে বসতি স্থাপনকারী ভূমিকে বোঝায়। ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এ ধরনের ভূমি ‘টেরা নুলিয়াস’ (terra nullius) বা শূন্য ভূমি হিসেবে গণ্য। এর ফলে ঔপনিবেশিক শক্তি আদিবাসীদের ভূমিকে ‘বেওয়ারিশ’ হিসেবে গণ্য করার বৈধতা পায় এবং এই এলাকাতে ঔপনিবেশিক শক্তির পদার্পণই ‘প্রকৃতপক্ষে’ প্রথম বলে গণ্য করতে সহায়তা করে। এভাবে ভূমির ওপর আইনি দাবি এবং মূল বাসিন্দাদের দাবি উপেক্ষা করে, এমনকি তাদের মর্যাদাহানিকর শব্দ যেমন ‘ন্যাটিভ’ হিসেবে অভিহিত করে, যদিও অন্য প্রেক্ষাপটে ‘ন্যাটিভ’ হিসেবে একজনের সঙ্গে তার ও তার পূর্বপুরুষদের জন্মস্থান ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই আদিবাসী মানুষ তাদের নিজস্ব ভূমির আইনি বা রাজনৈতিক দাবি হারালেও তাদের পরিচয়ের অপরিহার্য উপাদান স্থানভিত্তিক অস্তিত্বের চেতনা চলে যায় না।

আদিবাসী ধারণাটি স্থানীয় জনগণের পরিচয়ের জন্য লড়াই এবং ঔপনিবেশিকদের শাসনের প্রত্যক্ষ পরিণতি হিসেবে এসেছে, যা ১৭ শতকে উত্তর আমেরিকাতে শুরু হয়ে পরে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের স্থানীয় জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।৪ আদিবাসী ধারণাটি ‘প্রথম মানুষদের’ (first people) প্রতিদিনের অভিজ্ঞতার প্রতিফলন হিসেবে দেখা হয়।৫ এটি শুধু নৃতাত্ত্বিক বা পাণ্ডিত্যপূর্ণ আবিষ্কার বা কেবল একটি ‘পুরোনো স্মৃতি জাগরণ নয়।৬ এমন ধারণা ষাট ও সত্তরের দশক থেকে বিকাশ হয়েছে, যেখানে ‘জায়গার সঙ্গে আবেগের সম্পৃক্ততা’র ওপর গুরুত্ব দিয়ে সাংস্কৃতিক ভূগোল ও পরিবেশগত মনোবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে স্থানভিত্তিক পরিচয় বিশ্লেষণ করা শুরু হয়।৭ এসব গবেষণায় দেখা যায়, একই ধরনের জাতীয় পরিচয়ের সঙ্গে স্থানভিত্তিক বন্ধনের প্রতিস্থাপন আদিবাসী জনগণের জন্য সন্তোষজনক নয়।

কার ভাবমূর্তি?

জাতি, নৃগোষ্ঠী এবং আদিবাসী আলোচনার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো এটি অন্তর্নিহিত শক্তির ধারণার সঙ্গে যুক্ত। এখানে প্রশ্ন হচ্ছে, কে জনগণের ভাবমূর্তি গঠন করে? জাতীয়তাবাদের ইতিহাস অনুযায়ী, জনগণের গতিশীলতা ও জাতীয় সংস্কৃতির প্রচারে সব সময় এলিট সম্প্রদায়ের প্রচেষ্টা ছিল। যেহেতু ফরাসি ব্যুত্পত্তিগত অর্থ অনুযায়ী ‘জাতি’ শব্দটি সম্প্রদায়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল এবং সার্বভৌমত্বের ধারণা প্রথমত এলিটদের সঙ্গে যুক্ত, তাই প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য উভয় ক্ষেত্রেই জাতীয় সংস্কৃতির গঠন এলিট সম্প্রদায়ের দ্বারা হয়। ফরাসি বিপ্লবের সময় জনগণের শক্তি সামনে চলে আসে। আর্নেস্ট গেলনার আমাদের মনে করিয়ে দেন যে জাতীয় ভাবমূর্তি তৈরি করার ক্ষমতা হলো এলিটদের ক্ষমতা ‘একটি সমাজের জন্য এটা অবশ্যই একক হতে হবে, যেখানে তারা সবাই একই ধারণার উত্পাদন করতে পারে এবং একই ধারণা ছড়িয়ে দিতে পারে। তাই এটি একটি একক সংস্কৃতি হতে হবে।৮বেনেডিক্ট এন্ডারসনও এদিকটায় জোর দিয়েছেন। তিনি ঐক্যবদ্ধ জাতীয়তাবাদী মনোভাব ছড়ানোর ক্ষেত্রে পুঁজিবাদের ভূমিকার পাশাপাশি ‘জাতীয় বংশবৃত্তান্ত’ গঠন করা, যা নির্দিষ্ট ‘জাতীয় সম্প্রদায়’ তৈরিতে সাহায্য করে, তার ওপরও গুরুত্বারোপ করেছেন। এসব ক্ষেত্রে একটি দেশ তার জাতীয়তা শক্তিশালী করার জন্য তার গৌরবগাথা মনে রাখে এবং অতীতের ভুলভ্রান্তি ইচ্ছাকৃতভাবে চাপা রাখে।৯ যে অতীত প্রায়ই বিস্মৃত হয়, তা হলো একটি জাতীয় আদিবাসী ইতিহাসের অতীত।

জাতীয়তাবাদী ধারণা তৈরির ক্ষেত্রে এলিটদের ভূমিকা গবেষণা করার মতো বিষয়। পণ্ডিতেরা তুলে ধরেছেন যে জাতিগঠন একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া সত্ত্বেও কীভাবে এলিটদের ধারণা বৃহত্তর জনগোষ্ঠী থেকে আলাদা হতে পারে। মন্টসেরাট গাইবার্নু এ ক্ষেত্রে কীভাবে ফরাসি জনগণ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত নিজেদের ফরাসি হিসেবে বিবেচনা করেনি, তা ইউজিন ওয়েবারের কাজ দেখিয়ে উদ্ধৃত করেছেন।১০ একইভাবে কেনাল কার্পটি যুক্তি দেন, তুর্কিতে জাতীয়তাবাদের গঠনের একটি ‘আত্মনিভৃত এলিটভিত্তিক’ প্রকল্প রয়েছে।১১ ভারতের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ পরিচয় ‘ভারতমাতা’ তৈরি হিন্দু ধর্মভিত্তিক, যা অন্যান্য জাতি ও ধর্মের জনগণকে ‘সঠিক’ ভারতীয় হিসেবে অস্বীকার করে।১২ মুসলিম ও আদিবাসী জনগণকে পৃথক্করণ করা হয়, যেখানে মুসলিমদের সামাজিকভাবে অচ্ছুত পরিচয় দেওয়া হয় এবং আদিবাসী জনগণের জমিতে উন্নয়ন প্রকল্পের নামে তাদের অধিকার সংকুচিত করা হয়।১৩ আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো একটি জাতি আরেকটি জাতির প্রত্যুত্তর হিসেবে গড়ে উঠতে পারে। যখন জাতিগুলো একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে নিজেদের সংগঠিত করে, যোগাযোগব্যবস্থার প্রসার এবং নতুন জায়গা আবিষ্কারের মাধ্যমে অন্যান্য জনগণের সঙ্গে পরিচয়ের ফলে নিজেদের ‘প্রথমত্ব’ গঠন নিয়ে সচেতন হয়। ইংরেজদের নিজস্ব নৃজাতি সংহতিকরণ এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে দেখা যায়। তাদের জাতিগত পরিচয়কে তারা এ ধরনের রূপান্তরের যোগ্য হিসেবে মনে করে এবং দাবি করে যে সমৃদ্ধ ভাষা, চেহারা ও সংস্কৃতি তুলে ধরার মাধ্যমে ইংরেজি পরিচয় তৈরি করা সম্ভব।১৪ ‘গ্রেট ব্রিটেন’ ধারণাটি মধ্য উনিশ শতকে উত্থান হয়। এটি ‘পৃথিবীর ইংরেজিতে কথা বলা মানুষদের’ অন্য জাতির সঙ্গে সংমিশ্রণ ঘটা সত্ত্বেও ইংল্যান্ডের সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক সম্পর্ক ও ভাষার মিল রয়েছে।১৫

জাতীয়তাবাদের আখ্যান আমাদের বলে যে এটি একটি নির্দিষ্ট সীমান্তের মধ্যে কিছু জনগণের কল্পনা, যেখানে এলিটরা সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রতিনিধিত্ব করে। এটা সব সময় পশ্চিমা ও অপশ্চিমা—দুই জায়গার দেশগুলোতে ‘ওপর থেকে নিচ’ অ্যাপ্রোচের অন্তর্গত। এস এন আইজেন্টাজের ভাষায়, তুর্কি এভাবে এলিটদের দ্বারা ‘জনগণের জন্য, কিন্তু জনগণ ছাড়া’ রাষ্ট্র হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে সচেষ্ট হয়১৬, ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু গোপনে বলেছেন, ‘আমি ভারত শাসনকারী সর্বশেষ ইংরেজ।’১৭ একটি রাষ্ট্রে প্রভাবশালী জাতি অবস্থানগত অস্তিত্ব ধরে রাখে রাষ্ট্রের ভেতর অন্যান্য স্থানভিত্তিক পরিচয়ের চাহিদাকে মোকাবিলা করার মাধ্যমে। ইটিনি বলিবারের মতে, ‘সীমান্ত ধারণার ব্যাপ্তি’ এমন একটি ধারণার তৈরি করে, যেটা একটি প্রভাবশালী রাজনৈতিক  ব্যবস্থাকে গ্রাসভূত করার শক্তি দেয়।১৮ যদিও বলিবারের প্রধান রেফারেন্স পয়েন্ট ছিল ইউরোপ, একই ‘ওপর থেকে নিচ’ অ্যাপ্রোচ বাংলাদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠদের অত্যাচার তৈরি করেছে, যেখানে এই জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আদিবাসী জনগণের পরিচয় দমন করা হয়েছে।

বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট

বাংলাদেশ ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতা লাভ করে। পশ্চিম পাকিস্তানের কেন্দ্রের বিপরীতে পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসকারী বাঙালিদের স্বায়ত্তশাসনের দাবি মূলত দুটি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল—পরিচয় ও ন্যায়বিচার। পাকিস্তান রাষ্ট্রটি ভারতের মুসলমানদের ভূমি হিসেবে কৃত্রিমভাবে গড়ে উঠেছিল, যা পূর্ব ও পশ্চিম—এ দুটি সেক্টরে বিভক্ত ছিল। ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত বিভাগের সময় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ব বাংলা পশ্চিম বাংলা থেকে আলাদা হতে চেয়েছিল। তবে, দেশ বিভাগের পেছনে ধর্মীয় পরিচয়ের চেয়ে অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের ধারণা ছিল মুখ্য।১৯ এ ধারণা শেষ পর্যন্ত অর্জিত হয়েছিল বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে, যার মূলে ছিল বাঙালি জাতিসত্তার স্ফুরণ।

পূর্ব বাংলার বাঙালিদের নিজস্ব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের আদিবাসী মানসের জাতীয় পরিচয়ের রূপান্তর ঘটিয়েছে বারবার—একবার তারা পাকিস্তানি রাষ্ট্র, আরেকবার তারা বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত হয়। এ অঞ্চলের আদিবাসী মানুষ যারা একত্রিতভাবে জুম্মা নামে পরিচিত, তারা বারবার রাষ্ট্রগৃহীত উন্নয়ন প্রকল্পের নামে বিভিন্ন রকম বঞ্চনার শিকার হয়।

জুম্মা—বাংলাদেশে আদিবাসী বলতে যা বোঝায়

বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ১ দশমিক ১৩ শতাংশ আদিবাসী।২০ পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বেশির ভাগ আদিবাসী বাস করে, যেখানে ১৩টি বিভিন্ন গোষ্ঠীকে এ অঞ্চলের আদিম আদিবাসী হিসেবে গণ্য করা হয়।২১ এসব জনগোষ্ঠীর নিজস্ব সংস্কৃতি থাকায় এবং প্রধানত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী হওয়ায় সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম বাঙালি জনগোষ্ঠী থেকে তারা স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখে। এ অঞ্চল সাধারণত আদিবাসী-অধ্যুষিত হলেও সরকার-সমর্থিত উদ্দেশ্যমূলক নীতির মাধ্যমে আগে কিছু বাঙালি অভিবাসী গোষ্ঠীকে বসতি স্থাপন করিয়ে বাঙালি জাতির ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি ঘটানো হয়। বাংলাদেশি সরকার কর্তৃক ক্রমাগত অভিবাসী নীতি কার্যকর করার মাধ্যমে ২০০৩ সালে বাঙালি-আদিবাসী অনুপাত দাঁড়ায় ৫৩:৪৭। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সাল থেকে অনুসৃত নীতি এবং আশির দশকের পর থেকে এর ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি এ অবস্থার সৃষ্টি করে। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পরের অবস্থার একদম বিপরীত চিত্র এটি। তখনকার পার্বত্য অঞ্চলের মোট জনসংখ্যার ৯৮% আদিবাসী ছিল।২২

চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চল ১৬৬৬ সালে মোগল শাসনের অধীনে এবং ১৭৬০ সালে ব্রিটিশ শাসনের অধীনে আসে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে এটি সিএইচটি ম্যানুয়াল ১৯০০-এর আওতায় তার স্বায়ত্তশাসন বজায় রেখেছিল। এর দুটি প্রধান উদ্দেশ্য ছিল—ব্রিটিশ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করা এবং বাঙালি অভিবাসনে বিধিনিষেধের মাধ্যমে আদিবাসী জনগণের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখা। ব্রিটিশ অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার মধ্য দিয়ে মিয়ানমার ও চীনে পৌঁছানোর পরিকল্পনা প্রথম অনুসৃত হয় ১৭৬১ সালে। কিন্তু গত শতকের আশির দশকের গবেষণামূলক প্রবন্ধগুলো এ ধারণাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। তারা মনে করে যে ব্রিটিশদের উদ্দেশ্যমূলে ছিল অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষা নয়, বরং আদিবাসী ও বাঙালিদের পৃথক্করণের প্রচেষ্টা। কিন্তু আমরা যদি ইতিহাস পর্যালোচনা করি, তাহলে দেখব যে এই ব্রিটিশ নীতির উদ্দেশ্য যা-ই হোক না কেন, তার বাস্তবিক মূূলে ছিল ১৮ শতকের শেষার্ধে চাকমা রাজার সঙ্গে করা শান্তি চুক্তি। এই শান্তি চুক্তি দুই পক্ষের মধ্যে কয়েকটি যুদ্ধের পর শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়।২৩ আশির দশকের পার্বত্য চট্টগ্রাম সংঘাত বিশ্লেষণ করে পরে গবেষকেরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে আদিবাসী জনগণকে রক্ষা করার জন্য ব্রিটিশদের বিকল্প উদ্দেশ্য ছিল, আর তা হলো বাঙালি ও আদিবাসীদের পৃথক্করণের প্রয়োজনীয়তা, যদিও ইতিহাসের পর্যালোচনা এ ধারণা সমর্থন করে না।২৪

১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ বিভাগের সময় জুম্মা জনগণ ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতা নীতিতে আকৃষ্ট হয়ে ভারতের অংশ হতে চেয়েছিল।২৫ পার্বত্য চট্টগ্রামকে প্রথমে ভারতের অধীনে দেওয়া হলেও রাজনৈতিক বিবেচনায় একটি শিখ-অধ্যুষিত এলাকাকে বদলে ভারতের নিকট থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামকে পাকিস্তানের নিকট হস্তান্তর করা হয়।২৬ ষাটের দশকে পাকিস্তান সরকারের স্থানচ্যুতি (Translocation) নীতির অধীনে বাঙালি জাতির আন্তপ্রবাহ শুরু হয়। এ অবস্থা চূড়ান্ত পর্যায়ে যায় ১৯৫৭-৬২ সালে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের সময়। কাপ্তাই বাঁধ আদিবাসী জনগণের জন্য একটি ‘মৃত্যুফাঁদ’ ছিল, যা এ অঞ্চলে অনেক পরিবেশগত উদ্বাস্তু জন্ম দিয়েছে।২৭

আয়ত্তকরণকারী বাংলা নীতিবাক্য

ষাটের দশক থেকে আদিবাসীদের অবস্থান দৃঢ় হতে থাকে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরে সত্তরের দশকে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি গঠনের মধ্য দিয়ে চরম মাত্রায় পৌঁছায়।২৮ সমষ্টিগত সচেতনতা বৃদ্ধির প্রধান কারণ এবং নির্দিষ্ট প্রসঙ্গ বর্ণনার জন্য এই সময়কাল গুরুত্বপূর্ণ। শেন্ডেল বলেছেন, ‘জুম্মার’ সৃষ্টি একটি প্রত্যাখ্যানের প্রকাশ...অন্যদিকে এটা নৃগোষ্ঠীগত উদ্ভাবনের প্রকল্প ছিল, যা ক্ষমতা হ্রাসের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিণতি এবং রাষ্ট্র ও সাংস্কৃতিক প্রান্তিকীকরণের মোকাবিলার হাতিয়ার।’২৯ এর কারণ হলো বাঙালি পরিচয়ের প্রকাশভঙ্গি, যা আদিবাসী পরিচয়কে বিলীন করে দেয়। এর ফলে প্যান আদিবাসী পরিচয় তৈরির প্রেক্ষাপট সুদৃঢ় হয়, যার মাধ্যমে ১৩টি জাতিগোষ্ঠী তাদের প্রাথমিক পরিচয় হিসেবে জুম্মা চেতনাকে গ্রহণ করে।

১৯৫৬ সালের পাকিস্তানের সংবিধানে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে ‘স্বতন্ত্র এলাকা’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ এলাকার মর্যাদা পরে সাংবিধানিকভাবে নেতিবাচক অবস্থায় পর্যবসিত হয় এবং ‘উপজাতীয় এলাকা’ হিসেবে অভিহিত হয়, যদিও পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকা ১৯০০ সালের সিএইচটি ম্যানুয়ালের অধীনেই শাসিত হতে থাকে। ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গৃহীত বাংলাদেশ সংবিধান বাংলাদেশের সীমানার ভেতরে বসবাসকারী সব অধিবাসীকে ‘বাঙালি’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছিল এবং এর মাধ্যমে বাংলাদেশে বসবাসকারী অন্য জাতিগোষ্ঠীর পরিচয়কে অস্বীকার করা হয়েছিল। সংবিধানের দ্বিতীয় অংশে রাষ্ট্রনীতির মূলতন্ত্রে বলা হয়েছে:

বাঙালি জাতির ঐক্য ও সংহতি, যা তার ভাষা ও সংস্কৃতির মধ্যে প্রস্ফুটিত এবং সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীন বাংলাদেশের অর্জিত স্বাধীনতাযুদ্ধের মাধ্যমে একতাবদ্ধ ও সুদৃঢ়, তা হবে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি।৩০

সংবিধান গৃহীত হওয়ার আগে ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চলের নিজেদের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বে আদিবাসী সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দেখা করেন। শেখ মুজিব তাঁদের দাবি প্রত্যাখ্যান করেন এবং বলেন নিজস্ব পরিচয় ভুলে যেতে। এর সঙ্গে যোগ করে তিনি বলেন, ‘বাড়ি যান, বাঙালি হয়ে যান।’৩১ এভাবে সংবিধান অনুযায়ী আদিবাসী জনগণের ওপর সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিদের আইনগত নিয়ন্ত্রণ স্থাপিত হয়। পরবর্তীকালে পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিদর্শনের সময় শেখ মুজিব তাঁর অবস্থানের পুনরাবৃত্তি করেন এবং আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে মূলধারার বাঙালি সংস্কৃতিতে যোগদানের আহ্বান জানান।৩২

১৯৭৫ সালে বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতিতে পরিবর্তনের কারণে মানবেন্দ্র লারমা ভারতে পালিয়ে যান। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই বলা প্রয়োজন যে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল ভারতের মণিপুর ও ত্রিপুরা রাজ্য দুটির মধ্যবর্তী হওয়ায় এ অঞ্চলে ভারতের সহজ আধিপত্য বিস্তারের ক্ষেত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ত্রিপুরাতে তাদের প্রধান কার্যালয় স্থাপনকারী শান্তি বাহিনীকে ভারত সামরিক সাহায্য প্রদান করে।৩৩ ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ সরকার এবং শান্তিবাহিনীর মধ্যে যে সামরিক সংঘাত শুরু হয়, তা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ১৯৯৭-এর মাধ্যমে আপাতসমাধান হয়েছিল। এ চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার আদিবাসী জনগণের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠাকে স্বীকৃতি দেয়। এ চুক্তির একটি বড় দিক ছিল ওই অঞ্চলে একটি বিশেষ শাসনব্যবস্থা চালু করা, যা ওই অঞ্চলের ভূমি বিরোধসংক্রান্ত সমস্যা, সামরিক ক্যাম্প প্রত্যাহার, আদিবাসী উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন করার কাজ করবে। তবে এর বেশির ভাগ বিধান এখন পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি; কিছু বিধান আংশিকভাবে সমাধান করা হয়েছে।

শান্তিপ্রক্রিয়া প্রসঙ্গ

১৯৮০ সালের দিকে আন্তর্জাতিক দাতাদের সমালোচনার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের সশস্ত্র বিদ্রোহ সমস্যার সমাধান করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি সামনে আনার ক্ষেত্রে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ভূমিকা প্রণিধানযোগ্য।

১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলসংক্রান্ত সব বিষয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে চলে আসে।৩৪ সেই সঙ্গে বাংলাদেশ সরকার শান্তিবাহিনীকে মোকাবিলার জন্য সামরিক বাহিনীর প্রয়োজনীয়তা সুদৃঢ়ভাবে অনুভব করার কারণে এ অঞ্চলে সামরিক বাহিনীর কার্যক্রম বৃদ্ধি পায়।৩৫ ইতিহাস পর্যালোচনা থেকে দেখা যায়, শেখ মুজিবের মৃত্যুর পর ভারত শান্তিবাহিনীকে সাহায্য করেছিল বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার জন্য।৩৬ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ভারত শান্তিবাহিনীর প্রতি তাদের সাহায্য প্রত্যাহার করে।৩৭ অন্যদিকে কিছু আদিবাসী জনগোষ্ঠী জুম্মা সম্প্রদায়ের মধ্যে চাকমা আধিপত্য নিয়ে প্রশ্ন তোলে এবং এটিকে মোকাবিলা করার জন্য সর্বোচ্চ জুম্মা পরিচয়ের পরিবর্তে তাদের নিজস্ব আদিবাসী পরিচয়কে প্রাধান্য দেয়।৩৮

পার্বত্য চুক্তির স্বচ্ছতা পর্যবেক্ষকদের দ্বারা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। এই আপস-প্রক্রিয়া আওয়ামী লীগ অথবা তত্কালীন বিরোধীদলীয় নেতাদের জানা ছিল না। অভিযোগ রয়েছে, সামরিক বাহিনীর একটি অংশ রাজনৈতিক প্রতিনিধিদের কাছে নিজেদের তৈরি করা আলোচ্য বিষয়বস্তু পর্যালোচনার জন্য প্রদান করে।৩৯ যদিও সরকার দাবি করে থাকে যে পার্বত্য চুক্তির বেশির ভাগ ধারাই বাস্তবায়ন করা হয়েছে, কিন্তু সরকারের প্রকৃত উদ্দেশ্য ও কর্মকাণ্ড প্রশ্নবিদ্ধ। বলা হয়ে থাকে যে যদিও ১৯৯৭ সালে স্বাক্ষরিত চুক্তি বিদ্রোহ এবং সামরিক অপারেশন বন্ধ করেছে, তবুও এই চুক্তি এ অঞ্চলের ওপর থেকে সামরিক বাহিনীর কার্যত প্রভাব দূর করতে পারেনি।৪০ সরকারি বাহিনী দ্বারা মানবাধিকার লঙ্ঘন একটি উদ্বেগের কারণ হিসেবে এখনো রয়ে গেছে, যা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে দেখানো হয়।৪১ তা ছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে সম্প্রতি বৌদ্ধদের ওপর আক্রমণের পাশাপাশি বাংলাদেশি ও আদিবাসীদের মধ্যে সময়ে সময়ে সংঘর্ষ হয়েছে।৪২ পার্বত্য চুক্তি অনুযায়ী এ অঞ্চল থেকে সামরিক বিস্তার কমানোর কথা ছিল, কিন্তু সেটা অব্যাহত রয়েছে। ধারাবাহিক সরকারগুলো জোর দিয়ে বলেছে যে বৃহত্ সামরিক উপস্থিতি এ অঞ্চলে সন্ত্রাস দমন এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রয়োজন, যদিও সামরিক দাঙ্গা শেষ হয়েছে।৪৩

জাতীয়তাবাদ: বৈধতার হাতিয়ার

তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে জাতিরাষ্ট্রের কাঠামোর মধ্যে অভ্যন্তরীণ জাতিগত দ্বন্দ্ব সম্পদের সঙ্গে অনেকাংশে সম্পর্কযুক্ত।৪৪ যেখানে সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণ ও দ্বন্দ্বের মধ্যে সম্পর্ক রয়েছে, সেখানে পরিচয় ও স্বীকৃতির মতো বিষয়গুলো অনেকাংশে উপেক্ষিত থাকে। অ্যাক্সেল হনেথের গবেষণায় এর আভাস দেখা যায়। হনেথ বলেন, নৈতিক অশ্রদ্ধা এবং সামাজিক সংঘাতের মধ্যে সম্পর্ক রয়েছে।৪৫ স্বার্থসংগ্রামের ওপর ভিত্তি করে হতে পারে, এ ধারণা মাথায় রেখে হনেথ মনে করেন যে সামাজিক দ্বন্দ্ব শুধু স্বার্থ দিয়েই চালিত হয় না, বরং এটি নৈতিক প্রতিক্রিয়া দ্বারাও চালিত।৪৬ তাই সামাজিক সংঘাতকে আপাতদৃষ্টিতে সম্পদের ওপর আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা বা সম্পদের পুনর্বিন্যাস-সংক্রান্ত মনে হলেও তার মূলে থাকতে পারে আত্মপরিচয়ের স্বীকৃতি না পাওয়ার বিষয়। এ সূত্র ধরে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আমরা জাতীয়তাবাদ ও আদিবাসী পরিচয়ের বিষয়কে পর্যালোচনা করতে গেলে দুটি মতামত পেতে পারি। প্রথমত, বাঙালি পরিচয় প্রধানত পশ্চিম পাকিস্তানিদের সমগোত্রীয় ও ইসলামভিত্তিক জাতীয় পরিচয় আরোপের প্রতিক্রিয়া। দ্বিতীয়ত, পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় আদিবাসীরা নিজেদের পরিচয়কে সংহত করতে চাওয়ার মূলে রয়েছে বাঙালিত্বকে রাষ্ট্রের একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকার করা। শেন্ডেল সঠিকভাবে দেখিয়েছেন যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর যেভাবে পূর্ব পাকিস্তানের ওপর উর্দু চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল, শেখ মুজিব একই অনমনীয় জিনিসের পুনরাবৃত্তি করেন পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের ওপর।৪৭ পরিণামে বাঙালি পরিচয় চাপিয়ে দেওয়ার ফলাফল হিসেবে আদিবাসীদের নিজস্ব পরিচয় হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয় এবং পরিণতিতে সহিংস সংঘাতের উত্পত্তি হয়।

বাঙালি পরিচয় গড়ে উঠেছে ‘সোনার বাংলা’ কল্পনার ওপর ভিত্তি করে তাদের নিজস্ব আলাদা পরিচয় অর্জন করার জন্য, যেখানে পাকিস্তানি এলিট তাদের ওপর ভিন্ন পরিচয় চাপিয়ে দিয়েছিল। এই সোনার বাংলা পূর্ব পাকিস্তানে জনপ্রিয় শিল্পকলা ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের মাধ্যমে গড়ে ওঠে।৪৮ প্রাক্স্বাধীন রাজনৈতিক সমাবেশগুলোতে স্লোগান হিসেবে প্রশ্ন তোলা হতো, ‘সোনার বাংলা শ্মশান কেন?’৪৯ পূর্ব বাংলার মুসলিম বাঙালিরা ‘বাঙালি মুসলিম’ পরিচয় সৃষ্টি করে বাংলার ওপর তাদের ঐতিহাসিক দাবির ভিত্তিতে। সোনার বাংলা কল্পনা বলতে পুরো বাংলা গঠনকে বোঝায়, যদিও রাজনৈতিক বাস্তবতায় পূর্ব বাংলার জাতীয় দাবি শুধু পূর্ব বাংলার ওপর ভিত্তি করে জাহির করা হয়। স্বাভাবিকভাবেই বাঙালি পরিচয় বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে অন্য পরিচয়গুলোর অস্তিত্ব প্রত্যাখ্যান করে।

বাঙালি পরিচিতির বিপরীতে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ধারণা মধ্য সত্তর দশকে বিএনপি (বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল) প্রস্তাব করে। সংবিধান সংশোধনীতে ‘বাঙালি’ শব্দের স্থলে ‘বাংলাদেশি’ শব্দ প্রতিস্থাপন করা হয়। এটি এমন একটি জাতীয়তাবাদী ধারণা প্রদান করে, যা বাংলাদেশে বসবাসকারী সবাইকে একটি রাষ্ট্রের মধ্যে সমমর্যাদার অধিকারী করে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশি জাতীয়তা একটি বাংলাদেশি নাগরিকত্বভিত্তিক সামগ্রিক পরিচয় প্রদান করতে সচেষ্ট হয়, যা বাঙালি জাতীয়তাবাদ করতে ব্যর্থ হয়।

বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে ইতিমধ্যেই বিদ্রোহ শুরু হয়ে যাওয়ার কারণে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের সর্বব্যাপকতা থাকা সত্ত্বেও তা আদিবাসীদের আকর্ষণ করতে পারেনি। একই সঙ্গে বিএনপি সরকারও নীতিগতভাবে আদিবাসীদের দাবির প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করতে ব্যর্থ হয়। তারা দাবি করে যে ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চুক্তিতে সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বার্থ রক্ষায় এ পর্যন্ত অনেক ছাড় দেওয়া হয়েছে। ২০০৫ সালে ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় বিএনপি সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে ভূমি দখল অব্যাহত রাখে। একই সঙ্গে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ২০১১ সালে সংসদে সন্তু লারমাকে ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে আখ্যা দেন।

‘বাঙালিই প্রথম’ ধারণার উদ্ভব

জাতীয় পরিচয়ের দাবির ক্ষেত্রে নতুন দিক উন্মোচিত হয়, যখন বাঙালিরা দাবি করে যে তারাই পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে প্রথম বসবাস শুরু করে।৫০ আদিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার পথে এটি একটি নতুন প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। ‘বাঙালিই প্রথম’ ধারণাটি একজন ঔপনিবেশিক প্রশাসকের লেখার ওপর ভিত্তি করে সৃষ্টি হয়, যেখানে তিনি জোর দেন যে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জনগণ মূলত আরাকান অঞ্চল থেকে আসা অভিবাসী।৫১ আরও বিশেষভাবে এটি ১৭৭৭ সালে ঔপনিবেশিক প্রশাসকের পার্বত্য উপজাতিদের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে।৫২ কিছু গবেষণায় দেখা যায়, এ অঞ্চলের আদিবাসীরা ১৫ শতকের শুরুর দিকে মিয়ানমার থেকে এসেছে; যদিও এ অঞ্চলের মূল বসতি স্থাপনকারী কারা, সেটা নিয়ে এসব গবেষণায় কিছু পাওয়া যায় না।৫৩ তবুও ঔপনিবেশিকদের তৈরি ‘উপজাতিবাদ’ এবং আদিবাসীদেরও মর্যাদাহানিকর জাতি, বিশেষত তাদের বন্য জাতি, হিংস্র, আদিম এবং অ্যাবরিজিনাল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যা অন্যদিকে বাঙালি উত্কর্ষকে তুলনামূলকভাবে বৃদ্ধিতে সহায়তা করেছে।৫৪ অন্যদিকে সমভূমির মানুষের সঙ্গে উপজাতিদের যোগাযোগ ছিল কি না, তার চেয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে, এই এলাকার জলবায়ু সমভূমির মানুষের বসতি স্থাপনের উপযোগী ছিল না। এই ভৌগোলিক বিষয়টি তাদের এ অঞ্চলে অভিবাসনে ব্যাপকভাবে নিরুত্সাহিত করেছে।’৫৫

২০১১ সালের ৩০ জুন পঞ্চদশ সংশোধনীর প্রেক্ষাপটে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরে আদিবাসী পরিচয়ের সমস্যাটি আবার সামনে আসে। এই সংশোধনী পঞ্চম সংশোধনীকে পুনরায় সংজ্ঞায়িত করে। ‘বাংলাদেশের জনগণ বাঙালি হিসেবে পরিচিত হবে এবং তাদের নাগরিকত্ব হবে বাংলাদেশি।’৫৬ প্রধানমন্ত্রী তাঁর সরকারের পক্ষ থেকে জাতীয় সংসদে বলেন, ‘নাগরিক হিসেবে আমরা বাংলাদেশি এবং আমাদের জাতীয়তা বাঙালি।’৫৭ আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ‘বাঙালি’ একটি মৌলিক মতাদর্শগত অবস্থান নিয়েছে, যদিও একই বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী যোগ করেন, ‘বাঙালিদের মতো অন্যান্য জাতিগোষ্ঠী যেমন: সাঁওতাল, চাকমা, গারো ইত্যাদির নিজস্ব পরিচয় থাকা উচিত।’৫৮ এভাবে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশের মধ্যে সব জাতিগোষ্ঠীর ওপর বাঙালিদের আইনি আধিপত্য আবার প্রতিষ্ঠিত হলো। একজন গবেষক বলেন:

সংবিধানের ৬ নম্বর অনুচ্ছেদকে রাষ্ট্র ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ওপর নৃশংস নীতি-হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে। যে আদিবাসী অবাঙালিরা সুপ্রাচীনকাল থেকে এ অঞ্চলে বসবাস করছে, এটি তাদের রাজনৈতিক অস্তিত্ব রদ কর। এটি রাষ্ট্রের আমলা, আইন প্রণয়নকারী, বিশেষত সেনাবাহিনীর অফিসারদের পার্বত্য অঞ্চলে যুদ্ধের একটি ভয়ংকর ‘আইনি নিদর্শন’ প্রদান করে। ‘আমরা’ অন্যদের পরোয়া করি না।৫৯

সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনির বিবৃতি এটাই নির্দেশ করে, যখন তিনি জোর দিয়ে বলেন, পঞ্চদশ সংশোধনীর অধীনে বাংলাদেশে বসবাসরত অবাঙালিরা আদিবাসীও নয় পাহাড়িও নয়। বরং তারা ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী। তিনি যুক্তি দেন যে ‘আদিবাসী জনগণ’ একটি ভুল নাম। দুর্ভাগ্যবশত বাংলাদেশ এবং বাঙালি জাতিরাষ্ট্র প্রাচীন নৃতাত্ত্বিক ভিত্তি, ঔপনিবেশিক ইতিহাস এবং বাঙালি জাতিগত পরিচয় সম্পর্কে বৈশ্বিক ভুল ধারণার শিকার।৬০ তিনি বলেন যে প্রত্নতাত্ত্বিক ফলাফল অনুযায়ী, বাঙালিরা বাংলাদেশের আদি বসতি স্থাপনকারী, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীরা এখানে পরে এসেছে এবং এভাবে তিনি বাঙালিদের ‘বাঙালিই প্রথম’ দাবিকে সমর্থন করেন।

এর প্রতিক্রিয়ায় চাকমা রাজা বলেন, যেহেতু বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার কনভেনশনের ১০৭ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুমোদন দিয়েছে, তার মূলকথা অনুযায়ী আদিবাসী জনগণের কোনো ভূমিতে তাদের অধিকার দাবি করার জন্য একটি জায়গায় হাজার বছর ধরে বসবাস করার প্রয়োজন নেই।৬১ একই সঙ্গে তিনি জাতিগোষ্ঠী হিসেবে আাাদিবাসীদের স্বীকৃতি দিলে ১ দশমিক ২ শতাংশ জনগণ বাকি ৯৮ শতাংশের ওপর আধিপত্য বিস্তার করবে বলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী যে আশঙ্কা করেছেন, সেই আশঙ্কাও অমূলক বলে মন্তব্য করেন। তা ছাড়া যদি অভিবাসনের প্রসঙ্গ সামনে আনা হয়, তাহলে বাংলাদেশের আদি বসতি কারা স্থাপন করেছে, সেই প্রশ্নটিও সামনে চলে আসে। এ ক্ষেত্রে বিতর্কিত প্রসঙ্গটি হবে যে বাংলাদেশে বসবাসকারী বাঙালিরা কোথা থেকে এসেছে? তারা কি আদৌ বাংলা ভাষাভাষী ছিল, নাকি উর্দুভাষী মুসলিম ছিল, নাকি বর্তমানকালের ভারত বা মিয়ানমার থেকে এসে এই সমতলভূমিতে বসতি স্থাপন করেছে?

একটি কৌতূহলোদ্দীপক প্রসঙ্গ হলো পররাষ্ট্রমন্ত্রী উয়ারী-বটেশ্বরের খননের ওপর ভিত্তি করে প্রত্নতাত্ত্বিক ফলাফলের মাধ্যমে ‘বাঙালিই প্রথম’ ধারণার যে দৃঢ় উক্তি দিয়েছেন, তা পরবর্তী গবেষণার ফলে বাতিল হয়ে যায়।৬২ উয়ারী-বটেশ্বরের খননকাজ যা বাঙালিদেরকে চার হাজার বছর ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাসিন্দা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি করে তার ভৌগোলিক সীমারেখা বাংলাদেশের বর্তমান ভৌগোলিক সীমারেখার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত নয়। এ আবিষ্কার ‘বাঙালিই প্রথম’ ধারণার প্রতি একটি আঘাত হিসেবে আবির্ভাব হলেও রাজনৈতিকভাবে তা বেশি আমলে নেওয়া হয়নি। শাহবাগ আন্দোলনে দেখা যায়, ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে যে আন্দোলন হয়, তার একটি প্রেক্ষাপট ছিল বাঙালি পরিচয়কে প্রাধান্য দেওয়া। আদিবাসীরা যারা এখানে অংশগ্রহণ করেছিল, তারা বাঙালি আধিপত্য স্বীকৃতিকারী রাজনৈতিক স্লোগানের কারণে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।৬৩

২০১৩ সালে পার্বত্য চুক্তির ১৬তম বার্ষিকী থাকলেও এর বাস্তবতা শুধু কাগজ-কলমে সীমাবদ্ধ রয়েছে। যেহেতু এটা আওয়ামী লীগ সরকারের সময় স্বাক্ষরিত হয়েছিল, সেহেতু বাস্তবায়নের দায়ভার তাদের ওপর অনেকাংশে বর্তায়। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের পর থেকে মাত্র দুবার ওই অঞ্চল সফরে যান। যদিও ২০০৮ সালের নির্বাচনে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন তাদের অন্যতম নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল, কিন্তু তাদের অঙ্গীকার অপূর্ণ থেকে গেছে।৬৪

শেষ কথা

এটা প্রমাণিত যে বাংলাদেশে পরিচয়ের রাজনীতি শুধু বাঙালি পরিচয়কেই প্রাধান্য দেয় এবং সংখ্যাগরিষ্ঠের ‘অবস্থানগত আধিপত্যকে’ তুলে ধরে। বাংলাদেশ রাষ্ট্র আইনের মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে সংখ্যালঘুদের অধিকার খর্ব করেছে। বলিবার বলেছেন, এটা ‘প্রক্ষিপ্ত’ মতাদর্শ হিসেবে জাতীয়তাবাদের চূড়ান্ত ব্যবহার।৬৫ একইভাবে আমরা হবসবামের যুক্তি দিয়ে বিচার করতে পারি কীভাবে একটি রাষ্ট্র জাতীয়তার বন্ধন দৃঢ় করতে জনগণকে উত্সাহিত করে এবং ‘জাতীয়’ প্রতিষ্ঠান তৈরি করে।৬৬ গ্রামসীয় বিশ্লেষণ অনুযায়ী, আওয়ামী লীগ সাংস্কৃতিক কর্তৃত্বের একটি ক্লাসিক উদাহরণ স্থাপন করেছে, যেখানে রাজনৈতিক নাগরিক সমাজ তাদের নিজস্ব স্বার্থের কারণে সমাজের তত্ত্ব ও অর্থ সৃষ্টি করেছে।৬৭ এভাবে বাঙালি সংখ্যাগরিষ্ঠদের অধিকারই প্রধান হয়ে উঠেছে। বাঙালি আধিপত্যের কাছে সংখ্যালঘু আদিবাসীদের অবস্থানগত পরিচয় পুরোপুরি ম্লান হয়ে পড়েছে। সংখ্যালঘু আদিবাসীদের অধিকার ও অবস্থা সম্পর্কে আন্তর্জাতিক আদর্শের কোনো প্রভাব নেই বললেই চলে।

তথ্যসূত্র ও টীকা

1.      See Kawser Ahmed, ‘Defining “Indigenous” in Bangladesh : International Law in Domestic Context,’ International Journal on Minority and Group Rights 17: 47 (2010).

2.     Anthony D. Smith, ‘Nations and History,’ in Montserrat Guibernau and John Hutchinson, eds., Understanding Nationalism (UK: Polity Press, 2001), 23.

3.     John Eade, ‘Ethnicity and the Politics of Cultural Difference : An Agenda for the 1990s?,’ in Terence Ranger, Yunas Samad, and Ossie Stuart, eds., Culture, Identity and Politics : Ethnic Minorities in Britain (UK : Ashgate, 1996), 58.

4.     John Brown Childs and Guillermo Delgado-P, ‘On the Idea of the Indigenous,’ Current Anthropology 40(2) : 211 (1999).

5.     Ibid., 211.

6.     Ibid., 211.

7.     M. Carmen Hidalgo and Bernardo Hernandez, ‘Place Attachment : Conceptual and Empirical Questions,’ Journal of Environmental Psychology 21: 274 (2001).

8.     Ernest Gellner, Nations and Nationalism (Ithaca, NY : Cornell University Press, 1983), 38.

9.     Benedict Anderson, Imagined Communities : Reflections on

the Origin and Spread of Nationalism (London, UK : Verso, 2006), 201.

10.     Montserrat Guibernau, The Identity of Nations (UK : Polity Press, 2007), 17.

11.     Kemal H. Karpat, The Politicization of Islam: Reconstructing Identity, State, Faith, and Community in the Late Ottoman State (Oxford, UK : Oxford University Press, 2001).

12.     Manjusha S. Nair, ‘Defining Indigeneity: Situating Transnational Knowledge,’ World Society Focus Paper Series, January 2006, http://www.rci.rutgers.edu/?manjusha/ (accessed 13 June 2013).

13.     Pankaj Mishra, Temptations of the West: How to be Modern in India, Pakistan, Tibet, and Beyond, Farrar, Straus, and Giroux, 2006; Sanjib Baruah, India Against Itself: Assam and the Politics of Nationality (Philadelphia, PA: University of Pennsylvania Press, 1999).

14.     Robert J. C. Young, The Idea of English Ethnicity (UK : Blackwell Publishing, 2008), 2.

15.     Ibid., 197.

16.     S. N. Eisenstadt, ‘The Kemalist Revolution in Comparative Perspective,’ in Ali Kazancigil and Ergun Ozbudun, eds., Ataturk : Founder of a Modern State (London, UK : Hurst & Company, 1997), 140.

17.     Fareed Zakaria, The Post-American World (New York, NY : W. W. Norton & Company, 2008).

18.     Etienne Balibar, Politics and the Other Scene, trans. Christine Jones, James Swenson, and Chris Turner (London, UK : Verso, 2002).

19.     Harun-Or-Rashid, The Foreshadowing of Bangladesh : Bengal Muslim League and Muslim Politics 1906–1947 (Dhaka : The University Press Limited, 2003), 324.

20.     BANGLAPEDIA : National Encyclopedia of Bangladesh, http://www.banglapedia.org/HT/ P_0226.HTM, (accessed 6

June 2013).

21.     Amena Mohsin, ‘Identity, Politics and Hegemony : The Chittagong Hill Tracts, Bangladesh,’ Identity, Culture and Politics 1(1) : 82 (2000).

22.     Khairul Chowdhury, ‘Politics of Identity and Resources in Chittagong Hill Tracts, Bangladesh : Ethnonationalism and/or Indigenous Identity,’ Asian Journal of Social Sciences 36 : 62 (2008).

23.     Capt. T. H. Lewin, Hill Tracts of Chittagong and the Dwellers Therein (Calcutta : Bengal Printing Company Limited, 1869), 4.

24.     The liberals have usually argued that the British policy was indeed used to segregate the Bengalis and the indigenous people, which could be interpreted as saying that had the British not created such a policy, the migration and settlement of Bengalis might not have assumed such a political issue in the present context. This has been one of the dominant views of Bangladeshi scholars writing on the CHT issue. For example, see Amena Mohsin, The Politics of Nationalism : the Case of the CHT, Bangladesh (Dhaka : The University Press Limited, 1997).

25.     Mizanur Rahman Shelley, The Chittagong Hill Tracts of Bangladesh : The Untold Story (Bangladesh : Centre for Development Research, 1992), 29.

26.     Amena Mohsin, ‘The Chittagong Hill Tracts/Bangladesh,’ Kreddha Autonomy Mapping Project,

       http://kreddha.org/mapping/downloads/CHT.pdf (accessed 6 June 2013).

27.     Eshani Chakraborty, ‘Understanding Women’s Mobilization in the Chittagong Hill Tracts Struggle : The Case of Mahila Samiti,’ Conference Paper Presented at 15th Biennial Conference of the Asian Studies Association of Australia,

       http://coombs.anu.edu.au/SpecialProj/ASAA/biennialconference/ 2004/Chakraborty-E-ASAA2004.pdf, 6 (accessed 17 June 2013).

28.     Nasir Uddin, ‘Politics of Cultural Difference : Identity and Marginality in the Chittagong Hill Tracts of Bangladesh,’ South Asian Survey 17(2) : 290 (2010).

29.     Wilhelm van Schendel, ‘The Invention of the “Jummas” : State Formation and Ethnicity in Southeastern Bangladesh,’ Modern Asian Studies 26(1) : 126 (1992).

30.     The Constitution of Bangladesh,

       http://bdlaws.minlaw.gov.bd/sections_detail.php?id=367& sections_id=24557 (accessed 6 June 2013).

31.     Subir Bhaumik, Insurgent Crossfire : Northeast India (New Delhi, India : Lancer Publishers, 2008), 86.

32.     As cited in Willem Van Schendel, A History of Bangladesh (New Delhi, India : Cambridge University Press, 2009), 186.

33.     Shanti Bahini (Forces of Peace) was formed as early as 1973. See Iftekharul Bashar, ‘Bangladesh’s Forgotten Crisis: Land, Ethnicity, and Violence in Chittagong Hill Tracts,’ International Center for Political Violence and Terrorism Research, 3(4) : (2011),

       http://www.hpu.edu/CHSS/History/ PapersCommentariesStudies/ CTTA-April11.pdf (accessed 6 June 2013).

34.     ‘Militarization in Chittagong Hill Tracts, Bangladesh : The Slow demise of the Region’s Indigenous People,’ IWGIA Report, May 2012, http://www.iwgia.org/iwgia_files_publications_files/0577_Igia_report_14_optimized.pdf, 13 (accessed 6 June 2013).

35.     Amena Mohsin, ‘The Chittagong Hill Tracts/Bangladesh.’

36.     Jenneke Arens and Kirti Nishan Chakma, ‘Bangladesh : Indigenous Struggles in the Chittagong Hill Tracts,’ Global Partnership for the Prevention of Armed Conflict,       http://conflictprevention.net/page.php?id=40&formid=73&action=show&surveyid=14 (accessed 13 June 2013).

37.     Amena Mohsin, ‘The Chittagong Hill Tracts/Bangladesh.’

38.     Abul Hasnat Monjurul Kabir, ‘Bangladesh : A Critical Review of the Chittagong Hill Tracts (CHT) Peace Accord’ (Working Paper 2, The Role of Parliaments in Conflict and Post Conflict in Asia), http://www.academia.edu/2504753/Bangladesh_A_Critical_Review_of_the_Chittagong Hill_Tract_CHT_ Peace_Accord, 18 (accessed 6 June 2013).

39.     Abul Hasnat Monjurul Kabir, ‘Bangladesh,’ 19.

40.     ‘Militarization in Chittagong Hill Tracts, Bangladesh,’ 8.

41.     ‘Implementation of CHT Peace Accord : Will They, Won’t They?,’ Indigenous Research Quarterly IV(1–2) : (2009),

       http://www.aitpn.org/IRQ/Vol-IV/issue_1-2/story04.html (accessed 6 June 2013).

42.     Inam Ahmed and Julfikar Ali Manik, ‘Attacks on Buddhist Temples : A Hazy Picture Arises,’ The Daily Star, 3 Oct. 2012,

       http://archive.thedailystar.net/newDesign/news-details.php?nid= 252212 (accessed 6 June 2013).

43.     Phil Humfhreys, ‘Peace in Our Time?,’ The Dhaka Tribune, 6 Dec. 2013, http://www.dhakatribune.com/bangladesh/2013/dec/06/peace-our-time (accessed 11 Dec. 2013).

44.     This was argued especially in case of ethnic conflicts taking place in Africa and Southeast Asia. See, for example, Solomon C. Madubuike, ‘Ethnic Conflicts : Social Identity and Resource Control, Agitations in the Niger Delta,’ IFRA.com, 2009, http://www.ifra-nigeria.org/IMG/pdf/Solomon_C-_MADUBUIKE__Ethnic_Conflicts_Social_Identity_and_Resource_Control_Agitations_in_the_Niger_Delta.pdf, (accessed 17 June 2013); Cyril Obi, ‘Nigeria’s Niger Delta: Understanding the Complex Drivers of Violent Oil-Oriented Conflict,’ Africa Development XXXIV(2) : (2009); Peter Vandergeest, ‘Racialization and Citizenship in Thai Forest Politics,’ Society & Natural Resources: An International Journal 16(1) : (2011).

45.     Axel Honneth, The Struggle for Recognition: TheMoral Grammar of Social Conflicts (Cambridge : MIT Press, 1995), 162.

46.     Ibid., 165.

47.     Van Schendel, A History of Bangladesh, 186.

48.     B. K. Jahangir, Nationalism, Fundamentalism and Democracy in Bangladesh (Dhaka : International Centre for Bengal Studies, 2002), 99.

49.     Muhammad Ghulam Kabir, Changing Face of Nationalism : The Case of Bangladesh (Dhaka: The University Press Limited, 1995), 178.

50.     Saila Parveen and I. M. Faisal, ‘People Versus Power : The Geopolitics of Kaptai Dam in Bangladesh,’ International Journal of Water Resources Development 18(1) : 201 (2002).

51.     Lewin, Hill Tracts of Chittagong, 28.

52.     Ibid., 21.

53.     Shelley, The Chittagong Hill Tracts of Bangladesh, 26.

54.     Uddin, ‘Politics of Cultural Difference,’ 288.

55.     Lewin, Hill Tracts of Chittagong, 7.

56.     ‘Fifteenth Amendment : All Citizens are Bengalees,’ The New Age, 12 June 2011,

       http://www.newagebd.com/special.php?spid=5&id=22 (accessed 6 June 2013).

57.     ‘Citizenship Bangladeshi, Nationalism Bengali : PM,’ BanglaNews24.com, 28 March 2011,

http://www.banglanews24.com/English/detailsnews.php?nssl=ee49fef85e1bed67b9f530391b9c74d9&nttl=2012072617585 (accessed 6 June 2013).

58.     Ibid.

59.     ‘Fifteenth Amendment.’

60.     ‘“Indigenous People” A Misnomer: Moni,’ bdnews24.com, 26 July 26, http://dev-bd.bdnews24.com/details.php?id= 201888&cid =2 (accessed 6 June 2013).

61.     ‘Raja Devasish Rejects FM’s Statement,’ The Daily Star,

28 July 2011,

       http://archive.thedailystar.net/newDesign/news-details.php?nid= 196091 (accessed 6 June 2013).

62.     Rahnuma Ahmed, ‘Bengalis are Indigenous to Their Lands : An Archaeologist Contends,’ The New Age, 9 April 2012, http://www.newagebd.com/detail.php?date=2012-04-09&nid=6612 (accessed 10 June 2013).

63.     Pahari Promity, ‘An Adivasi Speaks: What Brings Me to Shahbag, What Pulls Me Back from It,’ in Alal O Dulal,

       http://alalodulal.org/2013/02/25/shahbag-what-pulls-back/ (accessed 10 June 2013).

64.     ‘6th Years of CHT Peace Accord : Govt Initiative Goes Against the Hill People : Sultana Kamal,’ The New Age, 8 Dec. 2013, http://www.newagebd.com/detail.php?date=2013-12-08&nid=75933#.UqX0afQW02u (accessed 9 Dec. 2013).

65.     Balibar, Politics and the Other Scene, 58.

66.     Eric Hobsbawm, Nations and Nationalism since 1780 : Programme, Myth, Reality (Cambridge, UK: Cambridge University Press, 1992).

67.     Antionio Gramsci, Selections from the Prison Notebooks, ed. and trans. Quintin Hoare and Geoffrey Nowell Smith (New York, NY: International Publishers, 1971).

অনুবাদ সহযোগীতায়: জোশিতা জিহান