সারসংক্ষেপ
এ প্রবন্ধের দুটো অংশ। প্রথম অংশে লেখক খুবই সংক্ষেপে পলাশী ষড়যন্ত্র সম্পর্কে অধ্যাপক রজত রায় ও সুশীল চৌধুরীর মতামত পর্যালোচনা করেছেন। দ্বিতীয় অংশে পলাশী যুদ্ধের অব্যবহিত পরবর্তীকালে (অর্থাত্ ১৮০০ সাল পর্যন্ত সময়ে) বাংলা থেকে ইংরেজ কোম্পানি যতটুকু সম্পদ পাচার করেছিল তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়েছেন। নবাব সিরাজউদ্দৌলা বিভিন্ন ষড়যন্ত্র ও প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়ে ২৩ জুন ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে১ চূড়ান্তভাবে পরাজিত হন। প্রবন্ধের প্রথম অংশে এ ঘটনার কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হবে। আলোচনার কেন্দ্রে থাকবে দুটো প্রশ্নে বিতর্ক: ইংরেজরা কি নবাবের অভ্যন্তরীণ শত্রুদের আমন্ত্রণে এ ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল, নাকি তারাই মূল ভূমিকা পালন করেছিল, যদি তা-ই হয় তাদের উদ্দেশ্য কী ছিল? প্রবন্ধের দ্বিতীয় অংশে পলাশীর ‘লুণ্ঠন’ (Palashi drain) এবং ইংল্যান্ডে সম্পদ পাচারের সূত্রপাতের ওপর আলোকপাত করা হবে।
মুখ্য শব্দগুচ্ছ: পলাশীর যুদ্ধ, ষড়যন্ত্র, ইংরেজদের ভূমিকা, সম্পদ পাচার, পাচারের পরিমাণ নিয়ে বিতর্ক |
পটভূমি
প্রথম থেকেই তরুণ নবাব সিরাজউদ্দৌলার ইংরেজ কোম্পানির প্রতি তিক্ততা ছিল। এর সর্বজনবিদিত তিনটি কারণ ছিল—অতিরিক্ত দুর্গ নির্মাণ প্রশ্ন, ১৭১৭ সালে সম্রাট ফররুখ শিয়ারের দেওয়া দস্তকের অপব্যবহার এবং তিপ্পান্ন লাখ রুপির তহবিল আত্মসাত্ করে কলকাতায় পালিয়ে যাওয়া কৃষ্ণদাসকে ফেরত দিতে অস্বীকৃতি। এ সমস্যাগুলো তাঁর ক্ষমতা গ্রহণের আগে থেকেই ছিল। তরুণ নবাব কোম্পানিকে অতিরিক্ত দুর্গ নির্মাণ বন্ধ, দস্তকের অপব্যবহারের অবসান এবং কৃষ্ণদাসকে ফিরিয়ে দিতে নির্দেশ দেন। কিন্তু কোম্পানি নবাবের কোনো কথাতেই কর্ণপাত করেনি। অন্যদিকে কোম্পানির কলকাতার কর্তাব্যক্তিরা এমন আচরণ করেন যে নবাবের প্রতি তাদের বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা নেই। অপরদিকে তারা সিরাজউদ্দৌলার খালা ঘসেটি বেগমের পছন্দমতো সিংহাসনের অপর দাবিদার শওকত জংকে সমর্থন করতে থাকে। এভাবে নবাব এবং কোম্পানির মধ্যে আরেকটি বিবাদের সূত্রপাত হয়। যা হোক, প্রথম দিকে নবাব ত্বরিতগতিতে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রমাণ দেন। তিনি তাঁর খালাকে গৃহবন্দী ও কলকাতা দখল করেন এবং তাঁর খালাতো ভাই শওকত জংকে পরাজিত করেন। নবাবের স্বল্পকালীন শাসনকালের মধ্যে এটাই ছিল সবচেয়ে ভালো সময়, কিন্তু এখানেই তাঁর পতনের সূত্রপাত। পতনের সূচনা ঘটে মাদ্রাজ কাউন্সিল থেকে প্রেরিত কর্নেল ক্লাইভ এবং অ্যাডমিরাল ওয়াটসনের দ্বারা কলকাতা পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে। নবাব কলকাতা পুনরুদ্ধারের এক সাহসী প্রচেষ্টা গ্রহণ করেন কিন্তু তিনি ব্যর্থ হন এবং আলীনগরের অবমাননাকর চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এ চুক্তির আওতায় কোম্পানি সব বাণিজ্যিক সুযোগ-সুবিধা ফিরে পায়, আর্থিক ক্ষতি পূরণের প্রতিশ্রুতি লাভ করে, কলকাতাকে সুরক্ষিত করা এবং মুদ্রা তৈরি করার অধিকার লাভ করে। অতঃপর ইংরেজ কোম্পানি ফরাসিদের অধীনে থাকা চন্দননগর দখল করে।
ঘটনার অগ্রগতি সম্পর্কে এখানে যে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে ঐতিহাসিকদের মধ্যে সে বিষয়ে মতপার্থক্য খুবই কম। যা হোক, ঐতিহাসিকদের মধ্যে ভিন্নমত রয়েছে, এ সময়ের পরবর্তীকালের ঠিক আগে তিন মাসের কিছু ঘটনা নিয়ে। এ প্রসঙ্গে রজত রায় ও সুশীল চৌধুরীর মধ্যকার মতপার্থক্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। রজত রায়ের মতে, নবাবের গুরুত্বপূর্ণ সভাসদ (মীর জাফর, ইয়ার লতিফ খান, খাজা ওয়াজিদ) এবং প্রদেশের বড় শেঠরা (জগত্ শেঠ ও উমিচাঁদ) সিরাজউদ্দৌলাকে সিংহাসনচ্যুত করার জন্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। তারা প্রত্যেকেই নিজ নিজ স্বার্থ দ্বারা তাড়িত হয়েছিল। যেমন মীর জাফর প্রদেশের নবাব হওয়ার উদ্দেশ্যে, জগত্ শেঠ নতুন নবাবকে ঋণ দিতে অস্বীকার করায় তাকে যে অপমান করা হয় তার প্রতিশোধ নিতে, উমিচাঁদ তার ব্যক্তিগত আর্থিক সুবিধার জন্য এ ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত হয়। আর এ ষড়যন্ত্রকারীদের পেছনে ছিল বেশ কিছু প্রভাবশালী জমিদার। প্রদেশে এ ধরনের ষড়যন্ত্র কোনো নতুন বিষয় ছিল না, এ সময়ে নতুনত্ব ছিল এই যে ষড়যন্ত্রকারীরা ইংরেজ কোম্পানিকে তাদের পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত করে। কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীরা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি যে রাজনৈতিক ক্ষমতা বিদেশিদের কাছে হস্তান্তর করতে হবে, সে ক্ষমতা তারা নিজেরা কুক্ষিগত করতে চেয়েছিল। বিদেশিদের সাহায্য না পেলেও অভ্যন্তরীণ শত্রুরা ক্ষমতা দখলের জন্য বদ্ধপরিকর ছিল। চন্দননগর দখল করার পর ক্লাইভ ও ওয়াটসন মাদ্রাজে ফিরে যাওয়ার পরিকল্পনা করছিল। রাজদরবারে নবাবের আহ্বানে তারা সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে কেন ক্লাইভ ও ওয়াটসন তাদের মত পরিবর্তন করেছিল এবং পলাশীর ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল? রজত রায়ের মতে, সিরাজউদ্দৌলা আলীনগর চুক্তির ও চন্দননগর হারানোর পরও ফরাসিদের তার দরবারে আশ্রয় দিয়েছিল এবং ফরাসি জেনারেল বুশির কাছে সামরিক সহায়তা চেয়েছিল, যা ইংরেজদের আতঙ্কের কারণ ছিল। এ পরিস্থিতিতে তারা উপলব্ধি করে যে ক্ষমতাসীন নবাবকে আর বিশ্বাস করা যায় না, সুতরাং তার স্থানে এমন কাউকে বসাতে হবে, যাকে তারা বিশ্বাস করতে পারে। এভাবে রজত রায়ের মতে, পলাশী ষড়যন্ত্রের পেছনে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক শক্তি জোরালো ভূমিকা পালন করেছিল।২
সুশীল চৌধুরী এর বিপরীত অবস্থান গ্রহণ করেছেন। তিনি যুক্তি দেখিয়েছেন যে ইংরেজ কর্মকর্তারাই এ নাটকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। তার মতে, যদিও মুর্শিদাবাদের কিছু সভাসদ সিরাজউদ্দৌলার প্রতি অসন্তুষ্ট ছিলেন, কিন্তু প্রাপ্ত তথ্যাবলি পরীক্ষা করলে ক্লাইভ ও ওয়াটসন যখন মাদ্রাজ থেকে বাংলায় পৌঁছান তখন এখানে ষড়যন্ত্রের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। কিন্তু একসময় তারা মুর্শিদাবাদের বিদ্যমান পরিস্থিতির সুযোগে ষড়যন্ত্রের সিদ্ধান্ত নেন। প্রকৃতপক্ষে মাদ্রাজ কাউন্সিল যে নির্দেশ দিয়ে ক্লাইভ ও ওয়াটসনকে বাংলায় পাঠায় তার মধ্যেই এ ষড়যন্ত্রের বীজ নিহিত ছিল। কাউন্সিলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, ‘শুধু কলকাতা পুনরুদ্ধার নয়’, ‘প্রচুর ক্ষতিপূরণ’ আদায় ও চন্দননগর দখল এবং একই সঙ্গে এমন কাউকে ক্ষমতায় বসাতে হবে যিনি ফরাসিদের প্রতি সহানুভূতিশীল হবে। সুশীল চৌধুরী এরপর বলেন, ষড়যন্ত্রের জন্য প্রয়োজনীয় শর্ত হলো ক্ষমতাসীন নবাবের বিপক্ষে অসন্তোষ তৈরি করতে হবে। অতএব এ কথা পরিষ্কার যে মাদ্রাজ কাউন্সিল কেবল আগের সব সুযোগ-সুবিধাসহ কলকাতাই ফেরত চায়নি, একই সঙ্গে তারা ফরাসিদের বিতাড়ন ও বাংলায় ‘ক্ষমতার পরিবর্তন’ চেয়েছিল। এভাবে দেখা যায় যে যখন রজত রায় অভ্যন্তরীণ শক্তির ওপর অধিক জোর দিয়েছেন তখন সুশীল চৌধুরী মনে করেন ইংরেজ কোম্পানিই প্রধান ভূমিকা পালন করেছিল।৩
ইংরেজ কোম্পানি কেন কলকাতা পুনরুদ্ধার করতে চেয়েছিল, এর সুযোগ-সুবিধাগুলো ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিল এবং ক্ষতিপূরণ দাবি করেছিল তা সহজেই বোঝা যায়। কিন্তু কেন কোম্পানি একটি ষড়যন্ত্রের সূত্রপাত করেছিল সিরাজউদ্দৌলার পরিবর্তে মীর জাফরের মতো একজনকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য? এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য আমাদের সামনে সমকালীন পর্যবেক্ষক এবং পরবর্তী ভাষ্যকারদের অনেক মত রয়েছে: ক. সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুরা মুসলমানদের স্বৈরশাসনে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিল খ. হিন্দু ব্যবসায়ী শ্রেণীর স্বার্থ জড়িত ছিল ইংরেজ কোম্পানির সঙ্গে গ. বাংলার অভ্যন্তরীণ সংকট ঘ. সম্ভ্রান্ত শ্রেণীর সঙ্গে নবাবের সম্পর্কচ্ছেদ। সুশীল চৌধুরী এসব মতামতকে প্রত্যাখ্যান করার পেছনে অনেক তথ্যপ্রমাণ দিয়েছেন। নিজের বক্তব্যের পক্ষে তিনি বলেন, ব্রিটিশদের হস্তক্ষেপ করতেই হতো, কেননা কোম্পানির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ব্যবসা বিপন্ন হয়ে পড়েছিল। তত্ত্বগতভাবে বলতে গেলে কোম্পানির কর্মচারীদের মূল দায়িত্ব ছিল কোম্পানির নিজস্ব ব্যবসা পরিচালনা করা, কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে তাদের সৌভাগ্যের চাবিকাঠি তাদের ব্যক্তিগত ব্যবসাই ছিল তাদের মূল উদ্বেগ। কিন্তু আরমেনিয়ান বণিকদের সহায়তায় পরিচালিত ফরাসিদের ব্যক্তিগত ব্যবসার ফলে ১৭৩০ সালের দিকে ইংরেজদের ব্যক্তিগত বাণিজ্য কমে আসে এবং ১৭৪০ সালের দিকে সংকট আরও ঘনীভূত হয়। ১৭৫০ সালের দিকে ব্রিটিশদের বিপক্ষে ফরাসি-বাংলা জোট গঠনের সম্ভাবনা ইংরেজ কোম্পানির জন্য এক সংকটপূর্ণ পরিস্থিতি তৈরি করে। এই পরিস্থিতিতে কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ব্যবসা ফিরে পেতে হলে ফরাসিদের বিতাড়িত করতে হতো এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করতে হতো, যা শুধু ব্যক্তিগত ব্যবসায়ের স্বার্থই সংরক্ষণ করত না, সরবরাহের উত্স, বাজারসমূহ, বণিক ও তাঁতশিল্পের ওপরও নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করবে।৪ সুশীল চৌধুরীর মতে, ইংরেজ কোম্পানির কর্মচারীদের এ ধরনের আচরণ এবং তাদের ব্যবসা বাড়ানোর কার্যাবলি এবং যদি সম্ভব হয় এ প্রক্রিয়ায় ব্রিটেনের জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করা (যা ছিল তাদের কাছে গৌণ) উপসাম্রাজ্যবাদ হিসেবে বর্ণনা করা যায়।৫
এ পর্যায়ে কয়েকটি মন্তব্য প্রাসঙ্গিক হবে আমাদের, যদি সুশীল চৌধুরীর তথ্যের ওপর নির্ভর করতে হয় তবে বলতে হয় যে কোম্পানি মাদ্রাজ কাউন্সিলের নির্দেশের বাইরে চলে গিয়েছিল। ক্লাইভ ও ওয়াটসনকে বলা হয়েছিল ক্ষমতায় একটি পরিবর্তন আনার জন্য (অর্থাত্ ক্ষমতাসীন নবাবের পরিবর্তে অন্য কাউকে ক্ষমতায় বসাতে), বাংলা জয় করার জন্য নয়। সুশীল চৌধুরী যথার্থই উল্লেখ করেছেন যে ইংরেজ ও ফরাসি কর্মকর্তারা মাঝেমধ্যে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের কথা বলতেন। দ্বিতীয়ত, সুশীল চৌধুরী কোম্পানির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ব্যবসা রক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন, যা কোম্পানির পলাশী ষড়যন্ত্রে জড়ানোর পেছনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ, সুশীল চৌধুরীর এই যুক্তি একেবারেই নতুন। ফরাসিদের উঠতি বাণিজ্যের বিপরীতে ইংরেজ কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত বাণিজ্য হ্রাস পাওয়ার তার যুক্তির পক্ষে তিনি যে তথ্য-উপাত্ত উল্লেখ করেছেন তা প্রণিধানযোগ্য। কিন্তু এখানে মনে হচ্ছে তিনি অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র সমস্যার (যেমন ব্যক্তিগত বাণিজ্য) ওপর অধিক জোর দিচ্ছেন এবং ফরাসি-বাংলা জোট গঠনের মতো বড় বিষয়কে খাটো করে দেখছেন। এ হুমকিকে মাদ্রাজ কাউন্সিল গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেছিল কেননা ক. দাক্ষিণাত্যে অ্যাংলো-ফরাসি প্রতিদ্বন্দ্বিতার অভিজ্ঞতা খ. সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধের প্রভাব৬ গ. ক্ষমতাসীন নবাবের ফরাসিপ্রীতি ও ইংরেজবিদ্বেষ। কলকাতা পুনরুদ্ধার, আলীনগর চুক্তির অবসান এবং চন্দননগর দখলের পরও সিরাজউদ্দৌলা যখন ফরাসি কর্মকর্তাকে তার দরবারে আশ্রয় দিয়েছিলেন এবং বুশির সঙ্গে সামরিক সহায়তার জন্য নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করেছিলেন। এসব অবশ্য ইংরেজ কোম্পানির জন্য সিরাজউদ্দৌলাকে অপসারণ করে অধিক বিশ্বাসযোগ্য কাউকে ক্ষমতায় বসানো বিষয়ে নতুন আবশ্যকতা যোগ করেছিল। মনে হচ্ছে যে এটা ছিল সেই পর্যায় যখন ইংরেজ কর্মকর্তারা উমিচাঁদের মাধ্যমে মুর্শিদাবাদ দরবারের ষড়যন্ত্রকারীদের সঙ্গে সমঝোতা শুরু করেছিল। আমরা যদি পলাশী যুদ্ধের কারণ খুঁজতে এভাবে এগোতে থাকি দেখতে পাব যে এ ক্ষেত্রে রজত রায়ের যুক্তি অধিক গুরুত্ব বহন করে। দুর্ভাগ্যক্রমে, পলাশী-পূর্ব মীর জাফরের সঙ্গে বোঝাপড়া৭ এমন কিছু প্রমাণ করে না যে ইংরেজ কোম্পানির কোনো রাজনৈতিক অভিলাষ ছিল: কোম্পানি ফরাসি হুমকিতে অধিক উদ্বিগ্ন ছিল, সুতরাং তারা মীর জাফরের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি আদায় করে যে কোম্পানির শত্রুকে (ফ্রান্স) তার নিজের শত্রু হিসেবে গ্রহণ করবে।
এরপর দেখা যায় যে সিরাজউদ্দৌলাকে ক্ষমতাচ্যুত করে নতুন নবাবকে ক্ষমতায় বসানোর স্বার্থে মুর্শিদাবাদের সভাসদ ও ইংরেজ কোম্পানি একত্র হয়। তার পরও প্রশ্ন থেকে যায় যে কে প্রথম কার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল এবং কে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল? সুশীল চৌধুরীর মতে, কেবল কোম্পানি ষড়যন্ত্র গঠনের প্রথম পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি, কোম্পানি এর চূড়ান্ত রূপ দান করেছিল এবং তা বাস্তবায়িত হয়েছিল। অন্যদিকে রজত রায়ের মতে, ষড়যন্ত্র গঠনে প্রথম পদক্ষেপ অভ্যন্তরীণভাবেই নেওয়া হয়েছিল। সমস্যার প্রকৃতি থেকে এটা প্রকৃতপক্ষে নির্ণয় করা কঠিন যে কোন পক্ষ প্রথম পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল। ক্লাইভের ষড়যন্ত্রে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব নিয়ে আলোচনার কার্যবিবরণী থেকে রজত রায় যে উদ্ধৃতি দিয়েছেন তাতে মনে হয় নবাবের দরবারের অসন্তুষ্ট ব্যক্তিরাই ক্ষমতা দখলের জন্য অধিক আগ্রহী ছিল। উদ্ধৃতিটি এরূপ: ‘নবাব সকল শ্রেণী ও পেশার মানুষদের নিকট ঘৃণিত; কর্মকর্তাদের প্রতি তাঁর দুর্ব্যবহার তার প্রতি সেনাবাহিনীর আনুগত্যও কমিয়ে দিয়েছিল এবং একটি বিপ্লব ছিল সর্বসাধারণের দাবি, এটা অবশ্যম্ভাবী ছিল যে একটি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে (এবং সফলভাবেই) আমরা সহায়তা করি আর না করি।৮
ষড়যন্ত্রকারীদের পক্ষে মীর জাফর ও ইংরেজ কোম্পানির পক্ষে ক্লাইভের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরের পর ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীতে দুই পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ হয়। ইংরেজদের দলে ছিল গোলন্দাজ পদাতিকসহ ৯০০ গোরা, ১০০ দেশি তোপচী এবং ২১০০ তেলেঙ্গা। অনেকের মতে, ৫০ হাজার সেনা ছিল। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় মীর জাফরের অধীন সৈন্যসংখ্যা ছিল তিন হাজার, যারা যুদ্ধে অংশ নেয়নি, আর যারা যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল তাদের সংখ্যা সাত-আট হাজার। কিন্তু প্রকৃত বিচারে পলাশীর যুদ্ধ কোনো বড় যুদ্ধ ছিল না। বলতে গেলে সেটি যুদ্ধই নয়, ইংরেজিতে যাকে বলে Skirmish অর্থাত্ বিচ্ছিন্ন সংঘাত। প্রথমদিকে যুদ্ধে নবাবের সৈন্যবাহিনী সাফল্য অর্জন করেছিল, যদিও মীর জাফর এতে অংশ নেয়নি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতায় নবাবের বাহিনী পরাজিত হয়। পাটনায় পালিয়ে যাওয়ার পথে সিরাজউদ্দৌলা ধৃত হন এবং পরে মুর্শিদাবাদে ঘাতকের হাতে নিহত হন। সন্ধির শর্ত মোতাবেক মীর জাফর বাংলার মসনদে উপবিষ্ট হন।
সুশীল চৌধুরী তাঁর প্রারম্ভিক মন্তব্যে বলেছেন, ‘১৭৫৭ সালে ইংরেজদের বিজয়ের মাধ্যমে যে বিপ্লব ঘটেছিল, তা কেবল ভারতের ইতিহাসেই নয়, বিশ্বের ইতিহাসেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বস্তুত পলাশীই ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন করে।’৯ এ প্রসঙ্গে কিছু বক্তব্য প্রাসঙ্গিক হবে। প্রথমত, ‘ব্রিটিশদের বাংলা বিজয়ে’ পলাশীই প্রধান ভূমিকা পালন করেনি। এটা সত্য যে ইংরেজ কোম্পানি, বিশেষ করে ক্লাইভ খুব ক্ষমতাধর হয়ে উঠেছিল। কিন্তু এটা এক দিনে হয়নি। কয়েকটি পরিস্থিতি ক্লাইভের উত্থানে সহায়ক পরিবেশ তৈরি করেছিল। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যেহেতু মীর জাফর ক্লাইভকে ৩০ মিলিয়ন রুপি দিয়ে দেউলিয়া হয়ে পড়েছিল, সে তার সৈন্যদের বেতনাদি পরিশোধ করতে না পারায় তার সৈন্যরা বিদ্রোহ করল। নবাবের আমন্ত্রণে ক্লাইভ এই বিদ্রোহ মোকাবিলা করে, কিন্তু এর জন্য মূল্য দিতে হয়েছিল। এভাবে পরিস্থিতি যতই তার আয়ত্তের বাইরে যাচ্ছিল, মীর জাফর ততই ক্লাইভের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছিল। দ্বিতীয়ত, কোম্পানি বাংলায় যে ক্ষমতা অধিকার করেছে তার আনুষ্ঠানিক কোনো ভিত্তি ছিল না। তৃতীয়ত, ইংরেজ কোম্পানি পলাশীতে বিজয়ী হয়েছে নবাবের সেনাপতির (মীর জাফরের) বিশ্বাসঘাতকতায়। কিন্তু মীর জাফরের বিরুদ্ধে ‘মহা বিশ্বাসঘাতকতার’ অভিযোগ আনা যায় না। কারণ সে যুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে সৈন্য পাঠাতে অস্বীকার করেছিল, এ জন্যও নয় যে সে চেয়েছিল ইংরেজরা জয়ী হোক, সে নিজে নবাব হতে চেয়েছিল। এই পরিপ্রেক্ষিতে বক্সারের যুদ্ধ বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কারণ এ সময়ে ইংরেজরা কেবল মীর কাসিমের (তত্কালীন বাংলার নবাব) সৈন্যবাহিনীকেই নয়, মুগল সম্রাট শাহ আলম ও অযোধ্যার নবাবকেও পরাজিত করে। অধিকন্তু এ যুদ্ধের ফলাফল ষড়যন্ত্র দ্বারা নয় বরং ইংরেজদের উন্নত যুদ্ধ শক্তির মাধ্যমে নির্ধারণ হয়। আবার বক্সার যুদ্ধ জয়ের ফলেই ইংরেজ কোম্পানি বাংলার দিউয়ানি লাভ করেছিল, যা তাদের কর্তৃত্বকে একটি আনুষ্ঠানিক ভিত্তি দান করে। এভাবে বিবেচনা করলে বক্সার জয়ই ইংরেজদের প্রকৃত ক্ষমতার উত্স।
সম্পদ পাচারের সূত্রপাত
উনিশ শতকের সপ্তম দশকের অন্যতম আলোচ্য বিষয় ছিল ভারত থেকে ইংল্যান্ডে সম্পদের পাচারের প্রসঙ্গ। দাদাভাই নওরৌজি থেকে শুরু করে প্রত্যেক জাতীয়তাবাদী লেখক এ বিষয় নিয়ে বারবার কথা বলেছেন এবং সম্পদ পাচার প্রশ্নটি ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে অভিযোগের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত হয়। ঔপনিবেশিক আমলাতন্ত্র এ বক্তব্যের বিরোধিতা করে। এভাবে যে বির্তকের সূত্রপাত হয়েছিল তা অদ্যাবধি চলছে। যা হোক, যদিও সম্পদের পাচার বিষয়টি নিয়ে উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে প্রবল বিতর্ক শুরু হয়েছিল, কিন্তু সম্পদের পাচার শুরু হয়েছিল বহু আগেই, বস্তুত পলাশীর পরাজয়ের ঠিক পরেই। ঔপনিবেশিক কালের আগে বাংলা থেকে কোম্পানির রপ্তানির (বিশেষ করে সুতি বস্ত্র) প্রায় ৭০ ভাগ মূল্য পরিশোধ করা হতো ইংল্যান্ড থেকে আমদানি করা সোনা রুপা দ্বারা১০, কারণ আনীত পণ্যের বাজার এখানে খুব সীমিত ছিল। আঠার শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাংলা থেকে কোম্পানির রপ্তানির পরিমাণ বেড়ে যায়। কিন্তু আগের মতোই আমদানি ছিল রপ্তানির চেয়ে অনেক কম। এ অবস্থায় সোনা-রুপার বাংলামুখী প্রবাহ বিদ্যমান থাকার কথা ছিল। কিন্তু তা ঘটেনি। অন্যদিকে পলাশীর পরপরই সোনা-রুপার প্রবাহ কেবল বন্ধই হয়নি, বরং এ সময় তার উল্টো স্রোত বইতে শুরু করল। এভাবে, রপ্তানির উদ্বৃত্ত কোনো বিনিময় ছাড়াই ইংল্যান্ডে নিষ্ক্রমণ হতে থাকে। সম্পদ নিষ্ক্রমণ হতে থাকে দুই ভাবে: ক. কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ব্যবসায়ের মাধ্যমে; ও খ. ১৭৫৭-৬৫ সাল পর্যন্ত কোম্পানির নিজস্ব ব্যবসায়িক ক্ষমতাবলে এবং ১৭৬৬ সাল পরবর্তীকালে ক্ষমতাসীন শাসক হিসেবে।
কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত সম্পদের উত্স কী ছিল এবং কীভাবে এ সম্পদ ইংল্যান্ডে স্থানান্তর হতো? ব্যক্তিগত সম্পদ কয়েকটি পন্থায় অর্জিত হতো। প্রথমত, কোম্পানির বিভিন্ন পদস্থ কর্মকর্তা-কর্মচারী, পরিচালক ও গভর্নর জেনারেলসহ সবাই পলাশী-পূর্ব বংশানুক্রমিক নবাবদের কাছ থেকে প্রচুর পরিমাণে উপহার-উপঢৌকন পেত। বস্তুত, প্রত্যেক নতুন নবাবের ক্ষমতায় বসানোর অনুষ্ঠানটি ছিল কোম্পানির জন্য কিংবদন্তির সেই প্যাগোডা-ট্রি ঝাঁকি দেওয়ার মতোই একটি উপযুক্ত সুযোগ। পলাশী পরবর্তীকালে যখন মীর জাফর নবাব হলেন তখন ব্রিটিশ কর্মকর্তা এবং সৈন্যরা ১২ লাখ পাউন্ড পেয়েছিল১১ যা থেকে ক্লাইভ নিজে পেয়েছিল ৩১,৫০০ পাউন্ড। যখন নাজিমুদ্দৌলা ১৭৬৫ সালে ক্ষমতা গ্রহণ করলেন তখন উপহার ২৩০ হাজার পাউন্ড বাড়ল।১২ ১৭৫৭ থেকে ১৭৬৫ সাল পর্যন্ত বাংলায় নবাব পরিবর্তনের মাধ্যমে কোম্পানির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আনুমানিক ২.২ মিলিয়ন অঙ্কের অর্থ লাভ করে। এ সময়ে ১০.৭ মিলিয়ন থেকে ৩.৭ মিলিয়ন পাউন্ড নগদ এবং ৭.০ মিলিয়ন ভূমি রাজস্ব ছাড়াই কোম্পানি ওই বাড়তি আয় করেছিল।১৩ ব্যক্তিগত পর্যায়ে ক্লাইভ ছিল সর্বোচ্চ সুবিধা ভোগকারী এবং পলাশীর ঠিক পরেই তিনি তাঁর বাবাকে জানান যে মীর জাফর তাঁকে ৩ মিলিয়ন পাউন্ডের মতো অর্থ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল এবং ‘তার দানশীলতা আমাকে আমার নিজ দেশ ত্যাগে সামর্থ্য জুগিয়েছিল, যা ছিল আমার আশাতীত’।১৪ ১৭৬৫ সাল পর্যন্ত উপহার পাওয়ার এ রীতি প্রচলিত ছিল, কেননা গভর্নর হেস্টিংস এবং উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা উপহার হিসেবে ৬.৩ মিলিয়ন রুপি মূল্যের মুক্তা ও রত্ন গ্রহণ করেছিলেন।
কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত বাণিজ্য ছিল তাদের অর্থ উপার্জনের আরেকটি উত্স। কোম্পানি বাংলা থেকে যেসব পণ্য রপ্তানি করত তা বিনা শুল্কে দেশের ভেতর দিয়ে চলাচলের অনুমতি দেওয়া ছিল। পলাশীর জয় কোম্পানিকে এক কর্তৃত্বপূর্ণ অবস্থান দিয়েছিল এবং এর যেসব কর্মচারী দেশের অভ্যন্তরে বাণিজ্যে লিপ্ত ছিল, তারাও এখন এ সুবিধা দাবি করে। অধিকন্তু তারা শিগগিরই লবণ, তামাক ও সুপারির ব্যবসা শুরু করে, যা আগে ইউরোপীয়দের জন্য নিষিদ্ধ ছিল। কোম্পানির কর্মচারী এবং গোমস্তারা বিনা শুল্কে পণ্য এক স্থান থেকে অন্য স্থানে বহন করত, যেখানে অন্য সব ব্যবসায়ীর জন্য নির্ধারিত ছিল চড়া শুল্ক। এ প্রক্রিয়ায় স্থানীয় বাণিজ্য ধ্বংস করা হয় এবং ভারতের অন্য অংশ থেকে আসা ও প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে বাণিজ্য প্রতিরোধ করা হয়েছিল এবং স্থলবাণিজ্য প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত বাণিজ্যের অনেক প্রমাণ অনেক ইংরেজ লেখক তাঁদের লেখায় রেখে গেছেন। উদাহরণস্বরূপ, ঐতিহাসিক জেমস মিল দুঃখ প্রকাশ করে বলেন যে কোম্পানির কর্মচারীদের আচরণ ‘ক্ষমতা ও স্বার্থের সবচেয়ে লক্ষণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করে, যা ন্যায়বিচার এমনকি লজ্জার সকল বোধকে শেষ করে দেয়’।১৫ এ ধরনের ব্যক্তিগত বাণিজ্য ১৭৬৫ সালের দিকে বন্ধ হয়। যা হোক, খুব শিগগির কোম্পানির কর্মচারীরা একটি নতুন উপায় তৈরি করতে চেষ্টা শুরু করে, যেহেতু ১৭৭০ সালের দুর্ভিক্ষ প্রদেশে আঘাত হানে। ইংরেজদের গোমস্তারা চাল ব্যবসায়ীদের বাধ্য করে সবচেয়ে কম দামে চাল বিক্রি করতে এবং তারপর তারা তা সবচেয়ে বেশি দামে বিক্রি করে। অধিকন্তু গোমস্তাদের সাহায্যে তারা তাঁতিদের অর্ধেক মূল্যে ভাগ বসায়। ওয়ারেন হেস্টিংসের শাসনকালে লাভজনক গোপন চুক্তি কোম্পানির কর্মচারীদের অন্য একটি লাভজনক আয়ের উত্স ছিল। উদাহরণস্বরূপ স্টিফেন সালিভান নামের এক ইংরেজ এক সিলিং ও বিনিয়োগ না করে পাওয়া একটি আফিম কন্ট্রাক্ট অন্য একজন ইংরেজের কাছে ৪০ হাজার পাউন্ডে বিক্রি করে, পরবর্তী সময়ে সে আবার একই কন্ট্রাক্ট আরেকজনের কাছে ৬০ হাজার পাউন্ডে বিক্রি করেন এবং চূড়ান্ত ক্রয়কারী প্রচুর লাভ করেছিল। ব্রিটেনের কেউ কেউ কোর্ট অব ডিরেক্টর থেকে ‘ভারতের একজন বণিকের মতোই এখানে ব্যবসা-বাণিজ্য করার’ অনুমোদন পেয়েছিল। স্বাধীন বণিক হিসেবে পরিচিত এরাও বাংলায় প্রচুর ব্যক্তিগত ঐশ্বর্য তৈরি করেছিল।১৬
১৭৫৭ থেকে ১৭৬৫ সালে দিউয়ানি লাভ করার মাধ্যমে কোম্পানির নিজস্ব ব্যবসা শুরু হয় এবং ১৭৬৫ সাল থেকে ইংরেজ শাসকেরা ক্ষমতাবলে বাংলা থেকে অর্থ পাচারের অন্য উপায় বের করে। এ পাচারের তিনটি অংশ ছিল—ক. কোনো সামঞ্জস্যপূর্ণ বিনিময় ছাড়াই ইংল্যান্ডে বিনিয়োগ এবং পণ্য রপ্তানি খ. চীনা বাণিজ্যে অর্থায়ন গ. বোম্বে ও মাদ্রাজের প্রশাসনিক ব্যয় এবং তাদের রপ্তানি ব্যয় মেটানো। প্রথম আট-নয় বছর কোম্পানির এ ধরনের নিষ্ক্রান্ত অর্থের উত্স ছিল রাজনৈতিক ও সামরিক সেবা দেওয়ার বিনিময়ে ভারতীয় শাসকদের কাছ থেকে প্রাপ্ত বিরাট অঙ্কের অর্থ এবং ১৭৫৭ সালে ক্লাইভ কর্তৃক কোম্পানির জন্য জমিদারি অধিকারপ্রাপ্ত চব্বিশ পরগনা ও ১৭৬০ সালে প্রাপ্ত বর্ধমান, চট্টগ্রাম ও মেদিনীপুর থেকে। এ ধরনের আয়ের উদ্বৃত্ত প্রকৃত ব্যয়ের পর তার রপ্তানি পণ্য ক্রয়ের জন্য ব্যবহার করা হতো। এ উদ্বৃত্তের আনুমানিক হিসাব প্রায় ৩ মিলিয়ন পাউন্ড। ১৭৫৭-৬৬ সময়কালে কোম্পানির আমদানি বাণিজ্য ছিল এক মিলিয়ন পাউন্ডেরও কিছু ওপরে। এভাবে কোম্পানি যদি ১৭৫৭ (১৭৯৭ সাল পর্যন্ত) সালের পর আর সোনা-রুপার বার আমদানি না করে, তাহলে পলাশী-পরবর্তী প্রথম নয় বছরে কোম্পানির সরাসরি সম্পদ পাচারের পরিমাণ হবে প্রায় দুই মিলিয়ন পাউন্ড।১৭
কোম্পানিকে মূলত যে সম্পদ পাচারের জন্য অধিক দায়ী করা হয় তা হলো বাংলার ভূমি রাজস্বের উদ্বৃত্তের বিনিয়োগ। ১৭৬৬ সাল থেকে এ ধরনের বিনিয়োগ নিয়মিত শুরু হয়। দিউয়ানি লাভের পর বাংলার ‘অবিশ্বাস্য’ সম্পদের ব্যাপারে ইংল্যান্ডে কতগুলো ধারণা তৈরি হয়। কোম্পানির কর্মকর্তাদের অপরিসীম সম্পদ তৈরি এবং ইংল্যান্ডে এর প্রভাব (তথাকথিত ‘নবাবদের’ বিলাসবহুল জীবনযাপন) এ ধারণাগুলোর জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী ছিল। এ সময় কোম্পানির মালিক ও ব্রিটিশ সরকার বাংলার ভূমি রাজস্ব দাবি করতে শুরু করে। ১৭৬৬ থেকে ১৭৮০ সালে অর্থ পাচার বন্ধ হওয়া পর্যন্ত কোম্পানির সব চাহিদা ও প্রয়োজন মেটানোর জন্য এর পরিমাণ ছিল প্রায় ১০ মিলিয়ন পাউন্ড।১৮একপর্যায়ে অ্যাডাম স্মিথ মত প্রকাশ করেন যে, ‘এটা প্রতীয়মান হয় যে বণিকদের একটি কোম্পানি সার্বভৌম হওয়া সত্ত্বেও নিজেদের সার্বভৌম ভাবতে অক্ষম...। এক অদ্ভুত যুক্তিতে তারা সার্বভৌমত্বের ধারণাকে বণিকদের স্বার্থের পরিপূরক হিসেবে বিবেচনা করে।’ এ উক্তি বস্তুত সঠিক প্রতীয়মান হবে যদি আমরা বাংলার শাসক হিসেবে কোম্পানির আচরণের দিকে লক্ষ করি। যা হোক, সমস্যাটা হলো ব্রিটিশ সরকারও বণিকদের লালসায় প্রভাবিত হয়েছিল। তবে কোম্পানি সরকার দ্বারা সম্পদ পাচারের আলোচনা এগিয়ে নিতে আমাদের এ বিতর্কের মুখোমুখি হতে হবে যে ১৭৮৩-৯৩-এর দশকে ইউরোপের জন্য রপ্তানিপণ্য কখনোই ব্যয়ের উদ্বৃত্ত রাজস্ব দ্বারা ক্রয় করা হয়নি। কিন্তু কোম্পানির একটি বার্ষিক রাজস্ব প্রতিবেদনে দেখায় যে এ বছরগুলোতে উদ্বৃত্ত ছিল এবং নিষ্ক্রমণ সত্যিকার অর্থে চলমান ছিল। এটা সত্য যে যদি মাদ্রাজ, বোম্বে, ফোর্ট মার্লবোরো এবং সেন্ট হেলেনার ঘাটতি বিবেচনা করি তবে উদ্বৃত্ত পাব না। কিন্তু আমরা এ ধরনের একটি হিসাব গ্রহণ করে বাংলার সম্পদ নিষ্ক্রমণের বিষয়টিকে প্রত্যাখ্যান করতে পারি না।১৯
১৭৫৭ সালে আরেক ধরনের নিষ্ক্রমণ শুরু হয় যখন চীনে কোম্পানির বিনিয়োগের তহবিল সরবরাহের জন্য বাংলা থেকে রুপা রপ্তানি শুরু করে। যেহেতু এর বিনিময়ে বাংলায় কোনো পণ্য আমদানি করা হয়নি, সুতরাং এটিও ছিল বাংলা থেকে ইংল্যান্ডে এক প্রকার পাচার। যদিও এভাবে সম্পদ পাচারের কোনো সঠিক হিসাব আমাদের কাছে নেই, কিন্তু সিলেক্ট কমিটির সদস্যদের মতানুসারে ১৭৬৬ সালে এ বাবদ বরাদ্দ ছিল তিন লাখ পাউন্ড। ১৭৮২-৮৩ সালের সিলেক্ট কমিটি প্রতিবছর এর আনুমানিক গড় হিসাব দেখায় এক লাখ পাউন্ড। আবার শুরুর দিকে বোম্বাই ও মাদ্রাজেও সম্পদ পাচার হয়েছিল। একটা আনুমানিক হিসাব করা হয়েছিল যে দিউয়ানি লাভের পর বার্ষিক আড়াই থেকে তিন মিলিয়ন রুপি এ দুটি প্রেসিডেন্সিতে পাঠানো হতো। এর একটি অংশ প্রশাসনিক ব্যয় মেটানোর জন্য এবং আরেকটি অংশ রপ্তানিপণ্য ক্রয়ের জন্য ব্যবহূত হতো। অন্যদিকে গোপন কমিটির (১৭৭৩) মতে, ১৭৬১-৬২ থেকে ১৭৭০-৭১ সাল পর্যন্ত মাদ্রাজ ও বোম্বাই প্রেসিডেন্সিতে মোট পাচারের পরিমাণ ছিল ২.৩ মিলিয়ন পাউন্ড।
পাচারের পরিমাণ নির্ণয় ও এর প্রভাব
আমাদের কাছে কোম্পানির বাংলা থেকে বিভিন্ন সময়ের সম্পদ পাচারের মোট চারটি হিসাব রয়েছে। প্রথমত, বি. কে. গুপ্তার এক হিসাবমতে, ১৭৫৭-৬৬ সালের মধ্যে বাংলা থেকে মোট পাচারকৃত অর্থের পরিমাণ পাঁচ মিলিয়নের একটু বেশি। এর বিবরণ টেবিল ১-এ দেওয়া হলো। এভাবে, এ ঐতিহাসিকের মতে, ২.৮ মিলিয়ন পাউন্ড ১৭৫৭-৬৫ সালের মধ্যে ইংল্যান্ডে স্থানান্তর করা হয়েছিল। কিন্তু এ তথ্য কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত অর্থ পাচারের পরিমাণের সঙ্গে সংযুক্ত নয়। এন কে সিনহার হিসাব অনুসারে ১৭৯৩ সাল পর্যন্ত ইউরোপে গড় অর্থ পাচারের যোগফল দাঁড়ায় ১৬ মিলিয়ন পাউন্ড।২০ এ হিসাবও এ অর্থে অসম্পূর্ণ যে এখানে চীন, মাদ্রাজ ও বোম্বাইতে অর্থ পাচারের হিসাব যোগ করা হয়নি। ১৭৮৬ সালে জেমস গ্রান্ট এক হিসাবে দেখান ১৮০ মিলিয়ন রুপি (১.৮ মিলিয়ন পাউন্ড) পাচার হয়েছিল প্রদেশের বাইরে।২১ কিন্তু পুনরায় এই হিসাবও অসম্পূর্ণ, কারণ এতে মাদ্রাজ ও বোম্বাইয়ের পাচার যোগ করা হয়নি। হল্ডেন ফারবার২২ ১৭৮২-৯৩ সালের পাচারের একই হিসাবে উপনীত হয়েছেন। প্রিন্সেপের২৩ মতে, প্রতিবছর বাংলা থেকে চার থেকে পাঁচ মিলিয়ন পাউন্ডের মাঝামাঝি পরিমাণ অর্থ পাচার হতো। জে সি সিনহা আরেকটি হিসাব দেন, যেখানে তিনি ১৭৫৭-৮০ সাল পর্যন্ত সামগ্রিকভাবে ৩৮.৪ মিলিয়ন পাউন্ডের একটি হিসাব দেন (টেবিল ২)।
টেবিল ১: ইংল্যান্ডে সম্পদ পাচার ১৭৫৭-৬৬ সাল
পাচারের স্থান অর্থের পরিমাণ (পাউন্ড)
ইংল্যান্ডে রপ্তানি ৩,৭৫২,২২১
ইংল্যান্ড থেকে রপ্তানি ৯,৭৭,৩৩৬
ইংল্যান্ডে উদ্বৃত্ত ২,৭৭৪,৮৮৫
ভারত ও চীনের অন্য অংশে রপ্তানি ২,৭৩৩,৬১০
ওই সব অঞ্চল থেকে রপ্তানি ৪,২৩,৯২০
উদ্বৃত্ত ২,৩০৯,৬৯০
মোট উদ্বৃত্ত ৫০,৮৪,৫৪০
উত্স: ফজলুল হকের উদ্ধৃতি, নবাব সিরাজউদ্দৌলা ও বাংলার মসনদ (ঢাকা, ২০০৪) পৃ. ১০০
টেবিল ২: ইংল্যান্ডে সম্পদ পাচার ১৭৫৭-৮০ সাল
উত্স পরিমাণ (পাউন্ডে)
১. বিদেশি কোম্পানির বিল ক্রয় ২৪ মিলিয়ন
২. কোম্পানির হিসাবে ১৭৫৭-৬৫ ২ মি.
৩. চীন থেকে রুপা রপ্তানির কারণে ২.৪ মি.
৪. উদ্বৃত্ত রাজস্বের বিনিয়োগ কোর্ট অব ডিরেক্টরের বিল বিক্রয় থেকে, ১৭৬৬-৮১ ১০ মি.
মোট ৩৮.৪ মিলিয়ন
উত্স: জে এস সিনহা, ইকোনমিক অ্যানালস অব বেঙ্গল (লন্ডন, ১৯২৭), পৃ. ৫২.
যা হোক, এ হিসাবও অসম্পূর্ণ। কারণ এতে দুটি উপায়ে ইংল্যান্ডের সোনা-রুপার রপ্তানির আর্থিক মূল্য সংযোজন করা হয়নি: ক. চীনে বেসরকারি ইংরেজদের ব্যক্তিগত ব্যবসা খ. বাংলার সরকার কর্তৃক বোম্বে ও মাদ্রাজে। অর্থনৈতিক পাচারকার্য পরবর্তী বছরগুলোতেও অব্যাহত ছিল এবং ১৮৩৮ সালে মার্টিনের লেখায় প্রতিবছরে পাচারের পরিমাণ দেখানো হয় তিন মিলিয়ন পাউন্ড, এভাবে পাচার বৃদ্ধির একটি পরিপূর্ণ কার্যকাল নির্দেশ করে।
ইংরেজ কোম্পানির সমসাময়িক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা যেমন লর্ড কর্নওয়ালিস, জন শোর, জন সালিভান, জন ম্যালকম, জর্জ উইংগেট এবং রাজনীতিবিদ যেমন এডমন্ড বার্ক মনে করতেন, পাচার ছিল অন্যায্য এবং এর ফলে বাংলার অর্থনীতিতে প্রতিকূল প্রভাব পড়েছিল। কার্ল মার্ক্স একই অবস্থান নিয়েছিল এবং শুরুতে যেমন উল্লেখ করা হয়েছে, দাদাভাই নওরোজির এবং আর সি দত্তের মতো জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিকেরাও এ মতাবলম্বী ছিলেন। অন্য চরম মতটি প্রকাশিত হয়েছিল জন ফারবারের দ্বারা, তিনি যুক্তি দেখান যে ভারতীয় সম্পদের বার্ষিক প্রেরণের ফলে ভারতের কোনোই ক্ষতি হতো না। অন্য পক্ষে—
এখানে অন্তত একটি সম্ভাবনা ছিল যে ১৭৮৩ এবং ১৭৯৩-এর মধ্যবর্তী সময়কালে ভারতের ইউরোপীয়দের কার্যক্রম মূলত ধ্বংসের চেয়ে সম্পদ তৈরিতে নিয়োজিত ছিল... স্বর্ণের বারের মাধ্যমে পাচার বন্ধের তাত্ক্ষণিক ফলাফল ছিল বাংলার এক-ষষ্ঠাংশ তাঁতি ও সুতা কাটা কারিগরের বেকারত্ব। আমরা বলতে পারি না যে যদি আঠারো শতকের শেষ ভাগে ইউরোপীয়রা ভারতে খ্যাতি, ঐশ্বর্য ও ক্ষমতার সন্ধানে না আসলে ভারত সামগ্রিকভাবে আরও সুখী ও সমৃদ্ধ হতে পারত কি না।২৪
জেমস গ্রান্ট ইংল্যান্ডে পাচারকে বৈধতা দিয়ে বলেন যে মোগল সরকারও বাংলা থেকে ১০ মিলিয়ন রুপি আদায় করত।২৫ থিওডোর মরিসন মনে করেন, রপ্তানি উদ্বৃত্ত হলেই তাকে পাচার বলা যায় না। এ ছাড়া তিনি এ বিষয়ের ওপরও জোর দেন যে কেউ যখন সম্পদ পাচারের কথা বলেন তখন তাদের এ বিষয়ও মনে রাখা প্রয়োজন যে এ সময়ে ভারতে আধুনিক সেনাবাহিনী গঠন, বেসামরিক এবং বিচারসংক্রান্ত প্রশাসন গঠন, একটি আইনি অবকাঠামো গঠন, ব্যাংকিং, সেচব্যবস্থা এবং রেলওয়ে নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছিল।২৬ পি জি মার্শালও একই বিষয়ে জোর দেন।২৭ এডমন্ড বার্ক জেমস গ্রান্টের যুক্তির প্রত্যুত্তরে বলেন যে যদি মুগলরা ত্রাস ও নিপীড়নের মাধ্যমে সম্পদের ভান্ডার গড়ে তোলে, তবু তারা ছিল দেশীয় মজুতদার,... অনেক বিশৃঙ্খলা এবং ক্ষমতার ওপর স্বল্প রাজনৈতিক প্রহরা, প্রকৃতিও ছিল তখন মুক্ত, সম্পদ অর্জনের উত্সগুলোও সম্পূর্ণ শুকিয়ে যায়নি এবং দেশের বাণিজ্য ব্যাপক বিস্তার লাভ করেছিল।২৮ ১৯৪৭-এর পরবর্তী সময়ের অনেক ভাষ্যকারও অর্থনৈতিক পাচারের সমালোচনা করেন এবং এর ক্ষতিকর প্রভাবগুলোর ওপর দীর্ঘ আলোচনা করেন। বস্তুত, শুরুতে যেমন বর্ণনা করা হয়েছে সম্পদ পাচারের ওপর বিতর্ক বর্তমানেও চলছে।
অর্থ পাচার বিষয়ে প্রতিটি মতামতের ওপর মন্তব্য করা এ অধ্যায়ে সম্ভব নয়। কিন্তু এ কথার পুনরাবৃত্তি করা প্রয়োজন যে নিশ্চিতভাবেই ইংল্যান্ডে সম্পদ পাচার হতো এবং মোগল সম্রাট বাংলা থেকে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ আদায় করত, এ অজুহাতে এ সত্যকে আড়াল করা যাবে না। অথবা ভারতে সুশাসন সূচনার দ্বারা এ পাচারকে বিচার করা যাবে না। ব্রিটিশ সেনাবাহিনী এবং বেসামরিক প্রশাসন এ সম্পদ দিয়ে ভারতের উন্নয়নের চেয়ে ইংল্যান্ডের সুবিধায় বেশি ব্যবহার করেছে। আরও অধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো প্রদেশের জিডিপির কোন অংশটি ইংল্যান্ডে পাঠানো হয়েছিল? ইরফান হাবিবের মতে, বাংলা, বিহার, বেনারস ও উত্তর সরকারের মোট জিএনপি ১৭৮৪-৮৯ সালের মধ্যে ২০ কোটি রুপির নিচে ছিল। ১৭৮৩/৮৪-১৭৯২/৯৩ সালের ফারবারের হিসাব (১.৭৮ মিলিয়ন পাউন্ড) গ্রহণ করে ইরফান হাবিব দেখান যে এটা ছিল মোট জিএনপির শতকরা নয় ভাগ।২৯অন্যদিকে, অমিয় বাগচি প্রস্তাব করেন যে বাংলা থেকে বাহ্যিক পাচারের পরিমাণ সম্ভবত ছিল মোট দেশজ বস্তুগত উত্পাদনের ৩ থেকে ৪ শতাংশ। তিনি মনে করেন যে আরও ২ থেকে ৩ শতাংশ সরকার কর্তৃক আরোপিত যুদ্ধব্যয় হিসেবে যোগ হতে পারে। তাহলে দেখা যায় যে হিসাবের আওতায় জনগণের বিনিয়োগ সম্ভাবনাময় সম্পদের ৫ থেকে ৬ শতাংশ পাচার হয়।৩০ কোন হিসাবটি বেশি নির্ভরযোগ্য তা বাছাই করা বেশ কষ্টসাধ্য। যা হোক, আমরা যদি ইরফান হাবিবের হিসাব ধরে এগিয়ে যাই দেখা যাবে যে ১৭৫৭-৮০ এ সময়ে বাংলা থেকে একটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সম্পদ পাচার হয়। অন্যভাবে বলা যায় যে বাংলাকে একটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে অর্থ ছাড়তে হয়েছে, যা এ দেশের সরকার বা জনগণ কোনো উত্পাদনশীল খাতে বিনিয়োগ করতে পারত। রপ্তানি উদ্বৃত্ত বিভিন্ন সমাজের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। কিন্তু ভারতের ক্ষেত্রে রাজনীতিকের ক্ষমতার ব্যর্থতার কারণে এ সম্পদের ওপর একটা দীর্ঘ সময় ধরে কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না।
এ প্রক্রিয়ায় দুটি শ্রেণী বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে—কৃষক ও তাঁতি। কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কারণ তারা বর্ধিত হারে ভূমি রাজস্ব দিতে বাধ্য ছিল এবং এভাবে উদ্বৃত্ত তৈরিতে অবদান রাখত, এ উদ্বৃত্তের দ্বারাই প্রদেশ থেকে রপ্তানি পণ্য (বিশেষত সুতিবস্ত্র) সংগ্রহ করা হতো। প্রসঙ্গক্রমে, দিউয়ানি লাভের তিন বছরের মধ্যে কোম্পনি ভূমি রাজস্ব প্রায় ৭০ শতাংশ বর্ধিত করে এবং ১৭৭০ সালের দুর্ভিক্ষের সময়েও কোনো ছাড় দেওয়া হয়নি, যা জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশের প্রাণ কেড়ে নেয়। তাঁতিদের সম্বন্ধে বলতে গেলে তারা তাদের উত্পাদিত পণ্য কোম্পানির প্রতিনিধিদের (গোমস্তা) কাছে বাজারমূল্যের কমে বিক্রি করতে বাধ্য থাকত। মাঝেমাঝেই তারা গোমস্তাদের দ্বারা শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতো। এভাবে কৃষকেরা উচ্চ ভূমি রাজস্ব দিতে এবং তাঁতিরা নিম্ন মূল্যে পণ্য বিক্রয় করতে বাধ্য হতো।৩১
ব্রিটিশ অর্থনীতির ওপর এর প্রভাব আলোচনা করতে গিয়ে অনেক ভাষ্যকার দৃঢ় অবস্থান নিয়ে বলেন যে এ অর্থ পাচার শিল্পবিপ্লব সূচনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। এ মতের গুরুত্বপূর্ণ দুজন সমর্থক হলেন ব্রুকস এডামস ও ওয়ালটার কানিংহাম। তারা দুজনই বাংলার সম্পদের ব্যাপক পাচার এবং ইংল্যান্ডে যন্ত্র বা প্রযুক্তির উদ্ভাবনের খুব গভীর সম্পর্ক নির্ণয় করেছেন, যা শিল্পক্ষেত্রে উত্পাদনের পরিমাণ বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছিল।৩২অনেক ভাষ্যকার, বিশেষভাবে মার্ক্সবাদীরা জোর দিয়েছেন ব্রিটিশ বাজারজাতকারীদের ভারতে বাজার দখল করা, যা শিল্পবিপ্লবে তাদের সফল করেছিল, কিন্তু ব্রুকস এডামস এবং কানিংহাম জোর দেন বাংলা থেকে সম্পদ পাচারের ভূমিকার ওপর। এ ধরনের তর্কের বৈধতা নির্ভর করে একটি প্রশ্নের ওপর, শিল্পবিপ্লবের শুরুর দিকে বাংলা থেকে অর্থ পাচার বিনিয়োগে কী পরিমাণ অবদান রেখেছিল। ইরফান হাবিব প্রয়োজনীয় সংখ্যাতাত্ত্বিক প্রমাণ উপস্থাপনের চেষ্টা করেছেন। তাঁর মতে, ১৮০১ সালে ভারত থেকে প্রদেয় করের বিক্রয়মূল্য ৪.২ মিলিয়ন পাউন্ড, যাকে তিনি ধরেছেন ইংল্যান্ডের জাতীয় আয়ের দুই শতাংশ। এ ধরনের হিসাবের ওপর ভিত্তি করে তিনি একটি উপসংহারে পৌঁছান যে এ নিষ্ক্রমণ মূল ব্রিটিশ দেশীয় বিনিয়োগের প্রায় ৩০ শতাংশে গিয়ে পৌঁছায়।৩৩ তাঁর এ হিসাবে অভিহিত মূল্য গ্রহণ করা কঠিন হবে।৩৪ যা হোক, আমরা যদি ধারণাও করি যে বাংলা থেকে পাচারকৃত অর্থের অবদান ছিল ৩০ শতাংশ, তাহলেও আমরা ব্রুক এডামস ও কানিংহামের মতো এ সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারি না যে শিল্পবিপ্লবে এর চূড়ান্ত অবদান ছিল।
উপসংহারে পৌঁছানোর আগে অন্য একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন। জে এন সরকার ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর যুদ্ধে সিরাজউদ্দৌলার পতনের ওপর আলোকপাত করতে গিয়ে বলেন,
আজকের ঐতিহাসিকগণ আজ থেকে দুই শতাব্দী পেছনে তাকিয়ে দেখলে জানবেন যে এটা ছিল গৌরবময় পরিবর্তনের একটা ধীর ও অলক্ষ্য আরম্ভ, যেমনটি বিশ্বের ইতিহাসে অন্যত্র কখনো দেখা যায়নি... যখন ক্লাইভ নবাবকে আক্রমণ করলেন, মোগল সভ্যতা অকেজো বুলেটের মতো হয়ে পড়ল। ইতিবাচক ক্ষেত্রে এর ক্ষমতা ও জীবনীশক্তি নিঃশেষ হয়ে গেল...এ রকম একটি নৈরাশ্যজনক সমাজের ওপর ইউরোপের যুক্তিবাদী উন্নত সমাজ এর অফুরন্ত প্রাণশক্তি নিয়ে আঘাত হানল। প্রথমেই ইংরেজদের দ্বারা পরিচালিত একটি সত্ ও দক্ষ প্রশাসন এদেশের উপর আরোপিত হলো। ... এক প্রজন্মেরও কম সময়ে পলাশী থেকে ওয়ারেন হেস্টিংস (১৭৫৭-১৭৬৬) পর্যন্ত বিশ বছরেই এ দেশ মধ্যযুগের বিবর্ণ ধর্মতান্ত্রিক শাসন থেকে মুক্তি লাভ করে। শিক্ষা, সাহিত্যিক সমাজ, ধর্ম—প্রতিটি ক্ষেত্রই পশ্চিমের সঞ্জীবনী ছোঁয়ায় এক নতুন বেগ লাভ করে। প্রাচ্যের স্থির সমাজের শুষ্ক হার স্বর্গ থেকে প্রেরিত জাদুকরের জাদুদণ্ডের অধীনে, প্রথমে ধীরগতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠে....। এটা ছিল প্রকৃত অর্থে পুনর্জাগরণ, ইউরোপের মতোই প্রসারিত, গভীর এবং অধিক বিপ্লবী...।৩৫
এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে মোগল সভ্যতার পতন, ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজনৈতিক ক্ষমতার উত্থান এবং একটি প্রকৃত রেনেসাঁ আরম্ভে যদুনাথ সরকার উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন। প্রথম থেকেই বাংলার বুদ্ধিজীবীরা, রামমোহন থেকে শুরু করে প্রায় সবাই সমভাবাবেগ প্রকাশ করেন। যা হোক সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো যদুনাথ রেনেসাঁর শুরুর সময় (১৭৫৭-১৭৭৬) হিসেবে অন্য সবার চেয়ে ভিন্নমত পোষণ করেন। কিন্তু এটা সর্বজনস্বীকৃত এবং আমাদের এ প্রবন্ধের বর্ণনা থেকে এটা পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন যে ব্রিটিশ শাসনের (কোম্পানি অথবা রাজ) প্রাথমিক বছরগুলো সবচেয়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়। উদাহরণস্বরূপ- জন স্ট্রেসি৩৬, যার পূর্বপুরুষগণ ভারতে উচ্চপদ গ্রহণ করেছিলেন, স্বীকার করেন যে যদিও সুদূর ভবিষ্যতে ব্রিটিশ শাসন ভারতের জন্য উপকারী প্রমাণিত হবে, অন্তত পনেরো বছরের জন্য বাংলার গ্রামগুলো ইংরেজ কোম্পানির দ্বারা পরিকল্পিত উপায়ে বিধ্বস্ত করা হয়েছে মারাঠাদের তুলনায় এবং এর কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত লোভ ছিল এর চালিকাশক্তি। আরও সাম্প্রতিক সময়ে আসলে আমরা দেখি এন কে সিনহা পর্যবেক্ষণ করেছেন যে পলাশী পরবর্তীকালে ‘বিশ্ব ইংরেজ কোম্পানির কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বন্ধনমুক্ত করে দিয়েছিল এবং তারাও তাদের স্বৈরতান্ত্রিক শক্তি নিয়ে বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল’।৩৭ সিনহা এখানে উল্লেখ করেননি যে ইংরেজরা তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা দ্বারা কী করেছিল, কিন্তু তার মূল বার্তাটি এখানে যথেষ্ট পরিষ্কার। সুতরাং এটা বিস্ময়কর যে জে এন সরকার কীভাবে পলাশীর ঠিক পরে বাংলায় কোম্পানি এবং এর কর্মচারীদের দুষ্কৃতির বিষয়ে বিস্মৃত হলেন।
উপসংহারে বলা যায়, আমরা এ প্রবন্ধটি শুরু করেছি পলাশীর ষড়যন্ত্রে ইংরেজ কোম্পানি এবং মুর্শিদাবাদ দরবারের ষড়যন্ত্রকারীদের ভূমিকা এবং তাদের স্বতন্ত্র উদ্দেশ্য সম্পর্কে দুজন বিখ্যাত লেখকের মতবিরোধ সম্পর্কে আলোচনার মাধ্যমে। আমরা প্রস্তাব করেছি যে কারা অধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল এবং কোম্পানির সুদূরপ্রসারী উদ্দেশ্য কী ছিল তা সঠিকভাবে নির্ণয় করা খুব কঠিন, আঠারো শতকের মাঝামাঝিতে তাদের বাংলার রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের পরিকল্পনা ছিল বলে মনে হয় না। এরপর আমরা আলোচনা করেছি পলাশী পরবর্তী অর্থনৈতিক পাচারের প্রশ্ন। উল্লেখ করেছি যে ১৭৮০ সালে বাংলা জিডিপির প্রায় ১০ শতাংশ পাচার হয়েছিল এবং এ ধরনের বিশাল অঙ্কের পাচার বাংলার অর্থনীতির ওপর উল্লেখযোগ্য নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল।
তথ্যসূত্র
১. পলাশীর যুদ্ধে সাধারণ মানুষ ছিল নিরব দর্শক। একজন প্রত্যক্ষ সাক্ষী হিসেবে ক্লাইভ বলেন, “অধিবাসীদের যারা সে ঘটনার দর্শক ছিলেন তার পরিমাণ অবশ্যই কয়েক হাজার এবং যদি তারা ইউরোপীয়দের ধ্বংস করতে চাইতো, তাহলে শুধু লাঠি এবং পাথর ছুড়েই তা করতে পারতো” শেখ বারাসাত হোসেনের উদ্বৃতি, উনবিংশ শতাব্দীর বাংলায় ভারতর্চচা, (কলকাতা, ২০০৯), পৃষ্ঠা. ৩০৩।
২. রজনীকান্ত রায়, পলাশির ষড়যন্ত্র ও সেকালের সমাজ, (কলকাতা, ১৯৯৪), অধ্যায়- ৪।
৩. সুশীল চৌধুরী, দ্য প্রিলিউড টু এম্পায়ার, পলাশি রেভ্যুলেশন, ১৭৫৭ (নিউ দিল্লি, ২০০০), বিশেষভাবে পঞ্চম অধ্যায়।
৪. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা. ৮০।
৫. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা. ৮০।
৬. ক্লাইভ ও ওয়াটসন ১৭৫৬ সালে মাদ্রাজ থেকে যাত্রা শুরু করে এবং একই সালের মে মাসে ‘সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধের’ সূত্রপাত ঘটে। তাই আমরা এটা ধরে নিচ্ছি যে ডিসেম্বর মাসের মধ্যে যুদ্ধের সংবাদ মাদ্রাজে পৌছেছিল।
৭. রজতকান্ত রায়, ১৯৯৪, পৃষ্ঠা. ২২৯-৩০।
৮. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা. ২২৩।
৯. সুশীল চৌধুরী, ২০০০, পৃষ্ঠা. ১।
১০. ১৭০৮-৫৭ সালের মধ্যে সোনার বারের আমদানি ছিল ১৯,৬৯৮,৭০৯ পাউন্ড। যেখানে পণ্যদ্রব্যের আমদানির পরিমাণ ছিল ৬,৮১৮,৭৪৯ পাউন্ড। এর মধ্যে পশমি দ্রব্যের পরিমাণই ছিল ৭১ শতাংশ। বিস্তারিত দেখুন, বি এল গাঙ্গুলি, ইন্ডিয়ান ইকনমিক থট (নিউ দিল্লি, ১৯৭৮) পৃ. ২১।
১১. আর. সি. দত্ত, দ্য ইকনমিক হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া, ভলিউম ১, (নিউ দিল্লি, ১৯৭০), পৃষ্ঠা. ২২।
১২. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা. ২২।
১৩. সুশীল চৌধুরী, ২০০০, পৃষ্ঠা. ১৬২।
১৪. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা. ১৬৩।
২৫. আর. সি. দত্তের উদ্বৃতি, ১৯৭০, পৃষ্ঠা. ২০।
৩৬. বিস্তারিত দেখুন, এন. কে. সিনহা, ইকনমিক হিস্ট্রি অব বেঙ্গল, ভলিউম ১, (কলকাতা, ১৯৬৫), পৃষ্ঠা. ২২৫।
৪৭. জে. সি. সিনহা, ইকনমিক এনালস অব বেঙ্গল (লন্ডন, ১৯২৭), পৃষ্ঠা. ৪৮।
৫৮. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা. ৫১।
৬৯. এন. কে. সিনহা, ১৯৬৫, পৃষ্ঠা. ২৩১।
২০. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা. ২৩১।
২১. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা. ২৩৬।
২২. হল্ডেন ফারবার, দ্য জন কোম্পানি ওয়ার্ক (কেমব্রিজ, ১৯৪৮), পৃষ্ঠা. ৩১৬।
২৩. অমিয় কে. বাগচির উদ্বৃত, দ্য পলিটিক্যাল ইকনমি অব আন্ডারডেভেলপমেন্ট (কেমব্রিজ, ১৯৪৮), পৃষ্ঠা. ৮১।
২৪. ফারবার, পৃষ্ঠা. ২১১-১২।
২৫. এন. কে. সিনহা, ১৯৬৫, পৃষ্ঠা. ২৩২।
২৬. টি. মরিসন, ইকনমিক ট্রানজিশন ইন ইন্ডিয়া, সুবোধ কে. মুখোপাধ্যায়ের উদ্বৃত, বাংলার আর্থিক ইতিহাস (অষ্টাদশ শতাব্দী), পৃষ্ঠা. ১৪২।
২৭. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা. ১৪২।
২৮. আর. সি. দত্তের উদ্বৃত, পৃষ্ঠা. ৩৩।
২৯. ইরফান হাবিব, এসেস ইন ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি (নিউ দিল্লি, ১৯৫৫), পৃ. ২৭৪। এ গ্রন্থে ৩৬০ পৃষ্ঠায় ১৮৮২ সালে ভারতের মোট সম্পদ পাচারের পরিমাণ দেখানো হয়েছে ১,৩৫৫ মিলিয়ন রুপি বা জিডিপি’ও ৪.১৪ শতাংশ। তিনি বলেন “এভাবে সঞ্চয়ের ধারাবাহিক ক্ষতি যে কোন অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দেয়।
৩০. অমিয় বাগচি, ১৯৪৮, পৃষ্ঠা. ৮১।
৩১. দেখুন, এন. কে. সিনহা, ভলিউম ১ ও ২।
৩২. তারা চাঁদ, হিস্ট্রি অব দ্য ফ্রিডম মুভমেন্ট ইন ইন্ডিয়া, ভলিউম ১, (নিউ দিল্লি, ১৯৬১), পৃষ্ঠা. ৩৮৮-৮৯।
৩৩. ইরফান হাবিব, ১৯৫৫, পৃষ্ঠা. ২৭৪।
৩৪. এ হিসাবের মূল উত্স আমি সংগ্রহ করতে পারিনি। তাই আমি এ তথ্য বা হিসাব সম্পর্কে কিছু বলা থেকে বিরত থাকলাম।
৩৫. জে. এন. সরকার, হিস্টোরি অব বেঙ্গল, ভলিউম ২, (ঢাকা, ২০০৬), পৃষ্ঠা. ৪৯৭-৯৮।
৩৬. তারা চাঁদ, পৃষ্ঠা. ৩৯০।
৩৭. এন. কে. সিনহা, ১৯৬৫, পৃষ্ঠা- ৩২।