বই আলোচনা
পরিবেশতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে বাংলা বদ্বীপের রাষ্ট্র, রাজনীতি ও সমাজ পরিবর্তনের ইতিহাস
দ্য বেঙ্গল ডেল্টা: ইকোলজি, স্টেট অ্যান্ড সোশ্যাল চেঞ্জ, ১৮৪০-১৯৪৩, ইফতেখার ইকবাল, বেসিংসটোক: পার্লগ্রেভ ম্যাকমিলান, ২০১০।
দ্য বেঙ্গল ডেল্টা: ইকোলজি, স্টেট অ্যান্ড সোশ্যাল চেঞ্জ, ১৮৪০-১৯৪৩ গ্রন্থে ইফতেখার ইকবাল বাংলা বদ্বীপের, বিশেষ করে বদ্বীপের পূর্বাংশের, এক শ বছরের সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তন এবং রাষ্ট্র গঠনের ব্যাখ্যা করেছেন। বাংলা তো বটেই, দক্ষিণ এশিয়ার পরিবেশতাত্ত্বিক ইতিহাসে দ্য বেঙ্গল ডেল্টা একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। ইফতেখার ইকবালের আগে বাংলা বদ্বীপ, বিশেষ করে পূর্ববঙ্গের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনকে কেউ পরিবেশগত দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে ব্যাখ্যা করেননি। সেদিক দিয়ে ইকবালের এই প্রচেষ্টা বাংলার পরিবেশতাত্ত্বিক ইতিহাস রচনার প্রথম প্রয়াস। এর আগে মূলধারার বেশির ভাগ ইতিহাসবিদ ও পণ্ডিত পরিবেশকে শুধু পটভূমি হিসেবে বর্ণনা করার মাঝেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রেখেছেন। তাঁরা পরিবেশকে একটি অপরিবর্তনশীল বিষয় হিসেবে দেখেছেন। কিন্তু ইকবালই প্রথম বাংলা বদ্বীপের ক্ষেত্রে দেখিয়েছেন, কীভাবে পরিবেশগত পরিবর্তন এ অঞ্চলের সমাজ, রাজনীতি ও রাষ্ট্রকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল।
ঔপনিবেশিক আমলে পরিবেশ (ecology) ও সমাজের মধ্যে যে পরিবর্তনশীল সম্পর্ক ছিল, তা অনুসন্ধান করতে গিয়ে ইকবাল তিনটি বৃহত্ ইস্যু সামনে এনেছেন। এগুলো হলো: ১. এ অঞ্চলে খোদ পরিবেশ জগতে (ecological regime) যে পরিবর্তন হচ্ছিল তা; ২. এ পরিবর্তন কীভাবে গ্রামীণ অর্থনীতি ও সমাজের ওপর প্রভাব ফেলেছিল এবং ৩. এ প্রভাবের ধরন এবং ফলটা কেমন ছিল, অর্থাত্ কীভাবে বিভিন্ন সামাজিক শক্তি (social forces) দীর্ঘ সময় ধরে এ পরিবেশগত সম্পদকে (ecological resources) তাদের স্বার্থে ব্যবহার করেছে।
ইকবালের মতে, পূর্ব বাংলার পরিবেশের, বিশেষ করে নদী ও বনব্যবস্থার বিপর্যয়ের কারণ হলো জটিল এক রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং ব্যাপক সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ, যা কুড়ি শতকে এ অঞ্চলের রাজনীতির ধারা, অর্থনীতি এবং সমাজকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছে (পৃ. ৪-৫)। কিন্তু পূর্ববঙ্গের গতিশীল এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ পরিবেশ ইতিহাসবিদদের জন্য গবেষণার উর্বর ক্ষেত্র হলেও তা এখন পর্যন্ত ইতিহাসবিদদের তেমন আকৃষ্ট করেনি। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চল নিয়ে পরিবেশ ইতিহাসবিদেরা কাজ করলেও বাংলা, বিশেষ করে পূর্ববঙ্গ রয়ে গেছে উপেক্ষিত। তা ছাড়া লেখকের মতে, দক্ষিণ এশিয়ার যেসব ইতিহাসবিদ পরিবেশ ইতিহাস নিয়ে কাজ করেছেন, তাঁদের বেশির ভাগই দৃষ্টি দিয়েছেন পরিবেশ ‘ধ্বংস’ এবং ‘রক্ষা’ এ দুইয়ের ওপর। কিন্তু কীভাবে এ উপমহাদেশের, বিশেষ করে বাংলার রাজনৈতিক ও সামাজিক চর্চার মধ্যে পরিবেশকে চিহ্নিত করা যায়, তার ওপর সেভাবে দৃষ্টিই দেওয়া হয়নি। এভাবে অনেক অঞ্চলই, যেমন বাংলা বদ্বীপ, বাদ পড়ে গেছে পরিবেশ ইতিহাস থেকে (পৃ. ৫)। তাঁর মতে, পরিবেশ ইতিহাসবিদেরা ধীরে ধীরে কৃষি ইতিহাসকে (agrarian history) তাঁদের গবেষণার সঙ্গে যুক্ত করেছেন। কিন্তু মূলধারার ইতিহাসবিদেরা পরিবেশকে তাঁদের ইতিহাসতত্ত্বের মধ্যে স্থাপন করতে ব্যর্থ হয়েছেন। ইকবালের মতে, দক্ষিণ এশিয়ার বেশির ভাগ পরিবেশতাত্ত্বিক ইতিহাস রাষ্ট্রকে দেখেছে, প্রকৃতি ব্যবস্থাপনায় প্রধান কর্তা। যেমন যাঁরা সংরক্ষণ নীতি বিশ্বাস করেন, তাঁদের কাছে শক্তিশালী রাষ্ট্রের ধারণা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে যখন তাঁরা দেখেন যে বোটানিক্যাল গার্ডেন ব্যবস্থাপনা করছে রাষ্ট্র, বিজ্ঞানীদের পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে রাষ্ট্র এবং ঔপনিবেশিক ল্যাবরেটরি বা গবেষণাগার চালাচ্ছে রাষ্ট্র। আবার অনেকে আছেন, যাঁরা ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রকে দেখেন নির্বিচারে প্রকৃতি ধ্বংসকারী হিসেবে। তাঁদের মতে, মুনাফা অর্জনের ক্ষুধা এবং খাজনা আদায়ের মোহ থেকে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র পরিবেশ ধ্বংসের কাজে উত্সাহিত হয়েছিল। যেসব এলাকায় এসব সংরক্ষণ এবং পরিবেশ ধ্বংস করা হয়েছে, সেসব এলাকায় ঘটে যাওয়া নিম্নবর্গের বিদ্রোহ এবং তা দমনে সরকারি বিভিন্ন পদক্ষেপকেও রাষ্ট্রের অপরিসীম ক্ষমতা হিসেবে দেখানো হয়েছে। লেখকের মতে, ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের যখন কোনো নির্দিষ্ট এলাকার কৃষি-পরিবেশ (agro ecology) সম্পর্কে অজানা বা কম জানা থাকে, তখন ঔপনিবেশিক আধুনিক রাষ্ট্রও কম কর্তৃত্বশীল ও সীমাবদ্ধ ছিল।
এখন দেখা যাক কীভাবে ইকবাল তাঁর প্রধান প্রধান যুক্তিকে দাঁড় করিয়েছেন যে বাংলা বদ্বীপে পরিবেশ কখনো পটভূমি বা স্থবির উপাদান হিসেবে হাজির ছিল না বরং এটি সব সময়ই সজীব, গতিশীল এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রকেও এ পরিবেশের কাছে বশবর্তী হতে হয়েছে। ভূমিকা ও উপসংহারসহ মোট নয়টি অধ্যায়ে লেখক তাঁর দ্য বেঙ্গল ডেল্টা গ্রন্থটিকে সাজিয়েছেন। প্রথম অধ্যায় হলো ভূমিকা। ‘ইকোলজি অ্যান্ড এগ্রেরিয়ান রিলেশন ইন দ্য নাইনটিনথ সেঞ্চুরি’, শিরোনামে দ্বিতীয় অধ্যায়ে লেখক দেখিয়েছেন, পরিবেশের সঙ্গে কৃষি প্রশ্নের কী সম্পর্ক ছিল (পৃ. ১৮-৩৮)। এ অধ্যায়ে তিনি আলোচনা করেছেন কীভাবে বাংলা বদ্বীপ, বিশেষ করে পূর্ববঙ্গের পরিবেশ ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের রাজস্ব ব্যবস্থাপনা এবং কৃষি ও কৃষকদের ওপর বিভিন্ন পদক্ষেপকে প্রভাবিত করেছে, নতুন করে ভাবতে বাধ্য করেছে অথবা ব্যর্থ করেছে। এখানে উদাহরণ হিসেবে তিনি টেনেছেন চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কথা। তিনি দেখিয়েছেন, ১৭৯৩ সালে ব্রিটিশরা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু করলেও বাংলায় এ ব্যবস্থা ঠিকভাবে কার্যকর ছিল না। বাংলার পরিবর্তনশীল ও গতিশীল পরিবেশ ব্রিটিশদের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের খুঁটিনাটি এখানে প্রয়োগে বাধা সৃষ্টি করেছিল। যেমন তিনি দেখিয়েছেন, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বাংলায় চালু হলেও একটি বিশাল অংশ এর আওতার বাইরে ছিল। এর উত্কৃষ্ট উদাহরণ হলো সুন্দরবন। এ ছাড়া পূর্ববঙ্গের নদীগুলো ক্রমাগত বিভিন্ন চর সৃষ্টি করছিল। প্রশাসকদের জন্য এসব জায়গা পরিমাপ করা ছিল দুঃসাধ্য। কারণ, কখন কোনখানে চর তৈরি হবে তা ধারণা করা সাধ্যের বাইরে। যেমনটা ব্রিটিশ এক প্রশাসক বলেছিলেন, এ অঞ্চলে প্রায় প্রতিদিনই নতুন চর জেগে উঠছিল। এ ছাড়া পুনরুদ্ধার করা হচ্ছিল চাষযোগ্য জঙ্গলাকীর্ণ জায়গা। এসব জেগে ওঠা চর এবং জঙ্গল ছিল চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের আওতার বাইরে। এভাবে ইকবাল দেখাচ্ছেন, কীভাবে পরিবেশ ঔপনিবেশিক সরকারের বিভিন্ন প্রশাসনিক পদক্ষেপকে নস্যাত্ করে দিচ্ছে। গতিশীল পরিবেশের কাছে হার মানতে হচ্ছে প্রশাসনকে।
তৃতীয় অধ্যায়ে লেখক আলোচনা করেছেন কৃষির বাণিজ্যিকীকরণে পরিবেশের ভূমিকা। কীভাবে পরিবেশ রাষ্ট্র ও কৃষককে নির্দিষ্ট কৃষিপণ্য উত্পাদনে প্রভাবিত করেছিল। এ অধ্যায়ে লেখক বিশ্লেষণ করেছেন, কী প্রক্রিয়ায় কৃষির উন্নতি এবং মানুষের ভালো থাকাকে (well-being) ও কৃষি সামাজিক গঠনকে (agrarian social formation) বদ্বীপের পরিবেশ প্রভাবিত করেছিল। বাংলা বদ্বীপের, বিশেষ করে পূর্ববঙ্গের পরিবেশ এখানকার কৃষি উত্পাদনের ওপর বিশেষ প্রভাব রেখেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় যে ব্যাপারটি, যা কৃষি উত্পাদনের ওপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছে, তা হলো এখানকার নদী। নদীগুলো দুটি উপায়ে বাংলা বদ্বীপের পূর্ব অংশ, অর্থাত্ পূর্ববঙ্গের ইকোসিস্টেমে ভূমিকা রেখেছে। এ অঞ্চলের নদীগুলো যে পলি জমা করে তা নতুন চর সৃষ্টি ছাড়াও সবচেয়ে বড় উপকারী যে ব্যাপারটি কৃষির জন্য করে, তা হলো নদীগুলো পলি বয়ে নিয়ে এসে পুরো catchment অঞ্চলকে উর্বর করে। দ্বিতীয়ত, নদীগুলো থেকে যে পরিমাণ পানি এবং যে গতিতে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে যায়, তা লবণাক্ত পানি সমুদ্রে নির্গমন করে স্বাদু পানির ইকোসিস্টেম চালু রাখতে সহায়তা করে। পূর্ব বদ্বীপের পরিবেশ ধান উত্পাদনের জন্য সহায়ক। এ জন্য দেখা যায়, এ অঞ্চলে বছরের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রকার ধান প্রচুর পরিমাণে উত্পন্ন হয়। সারা বিশ্বে ধান উত্পাদনকারী দেশ হিসেবে তাই বাংলাদেশের খ্যাতি রয়েছে। ধান এখানকার প্রধান ফসল। এ ছাড়া পাট চাষের জন্য পূর্ববঙ্গের পরিবেশ বেশ সহায়ক। বিশ্বের বাজারে পূর্ববঙ্গের পাটের বেশ সমাদর ছিল। ডান্ডি উত্পাদনকারীদের অর্থনৈতিক সহযোগিতায় পশ্চিম আফ্রিকা ও ব্রিটিশ গায়ানায় পাট উত্পাদনের প্রচেষ্টা হাতে নেওয়া হয়েছিল। জাপান এবং চীনেও সফলভাবে অল্প পরিমাণে পাট উত্পাদন করা হয়েছিল। কিন্তু বাংলার কাঁচা পাট সব সময়ই একচেটিয়া অধিকার ভোগ করেছিল। লেখক যে সময়ের কথা বলছেন, সে সময়ে পূর্ব বাংলার নদীগুলো ছিল সজীব ও গতিময়। অপরদিকে একই সময়ে নদীর গতিমুখ পরিবর্তন হয়ে তা পশ্চিম বদ্বীপকে অনুর্বর করে তুলেছিল। ঔপনিবেশিক সরকারের বিভিন্ন প্রতিবেদন, বিশেষ করে ডাফরিন এবং অন্যান্য ঔপনিবেশিক প্রশাসকের প্রতিবেদন, বিশ্লেষণ করে লেখক দেখিয়েছেন, এ অঞ্চলের কৃষকদের অবস্থা অন্যান্য অঞ্চল থেকে অনেক ভালো ছিল।
ইকবাল দেখিয়েছেন, কৃষি-পরিবেশগত সম্পদ যে সুযোগ-সুবিধা পূর্ববঙ্গের কৃষকদের দিয়েছিল, কৃষকেরা এর যৌক্তিক এবং বুদ্ধিদীপ্ত ব্যবহার করেছেন। দেখা যায়, তাঁরা সচেষ্ট ছিলেন ভূমি অধিকার নিশ্চিত এবং শস্য উত্পাদনে ভূমিকে সর্বোচ্চ ব্যবহার করার ব্যাপারে। পরিবেশ জগত্ আরেকটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তা হলো এটি কৃষকদের সক্ষম করেছিল দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারের চাহিদার বদলের ওপর ভিত্তি করে তাদের উত্পাদন বদলাতে। উদাহরণ হিসেবে লেখক দেখিয়েছেন, ১৮৭০ সালে পাটের দাম যখন হঠাত্ পড়ে যায়, তখন পূর্ববঙ্গের কৃষকেরা পাটের বদলে ধান চাষ করা শুরু করেছিলেন। এ রকম সুযোগ উপমহাদেশের অন্যান্য জায়গায় তেমন ছিল না। যেমন বিহারের কৃষকেরা আখ এবং নীল চাষ বাদ দিতে পারেননি। পূর্ববঙ্গের পরিবেশ অনেকাংশে এখানকার কৃষকদের এ সুবিধা করে দিয়েছিল। বদ্বীপের পরিবেশের কারণে এখানকার মাটি ধান এবং পাট এ দুটি কৃষিপণ্য চাষের জন্যই উপযোগী। লেখকের মতে, অপেক্ষাকৃত অর্থনৈতিক সচ্ছলতা উনিশ শতকে এ অঞ্চলের সমাজের গড়ন ও বিকাশে দীর্ঘস্থায়ী ভূমিকা রেখেছিল। তাঁর মতে, এ অর্থনৈতিক সচ্ছলতাই হয়তো ব্যাখ্যা করতে পারে কেন পূর্ববঙ্গ ‘ভিক্টোরিয়ান হলোকাস্ট’১ এড়াতে পেরেছিল।
চতুর্থ অধ্যায়ে লেখক আলোচনা করেছেন, ঊনবিংশ শতাব্দীতে কীভাবে ফরায়েজি আন্দোলন এত সফলতা লাভ করেছিল।২ এ ক্ষেত্রে লেখক দেখিয়েছেন, বিশেষ ওই শতাব্দীতে ফরায়েজি আন্দোলনের সফলতার ক্ষেত্রে পরিবেশ বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল। লেখক উত্তর খুঁজেছেন, কেন এমন সময়ে ফরায়েজিরা সফল হয়েছিলেন যে সময়ে ভূমিহীনতা অথবা চরম ক্ষুধা প্রকট ছিল না। লেখক যুক্তি দিয়েছেন, ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের বিভিন্ন এজেন্সি, যেমন ভূমি উদ্ধারকরণ প্রকল্পে অর্থলগ্নিকারী এবং জমিদারেরা পরিবেশগত সম্পদের উত্পাদনশীল মূল্যের ভাগ নিতে চেষ্টা করেছিলেন। এসব প্রতিদ্বন্দ্বীর কারণে ভূমিতে কৃষকের অধিকার বাধাগ্রস্ত হচ্ছিল। লেখকের মতে, বিশ্ব পণ্যবাজার এবং পরিবেশগত সম্পদের মধ্যে যে সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল, ঊনবিংশ শতাব্দীতে তা ফরায়েজি আন্দোলনের একটি স্পেস বা জায়গা তৈরি করে দিয়েছিল। এমন একটা সময়ে এ আন্দোলন হয়েছিল, যখন তাঁদের ভালো থাকার যে সম্পদ তথা চর এবং বনের অধিকার ছিল হুমকির মুখে। ইকবাল দেখিয়েছেন, ফরায়েজিরা যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলেন খাসমহল নিজেদের দখলে নেওয়ার। কিন্তু প্রশ্ন জাগে, কেনই বা বিংশ শতাব্দীতে এসে ফরায়েজি আন্দোলন স্তিমিত হয়ে গিয়েছিল। ইকবালের মতে, পরিবেশ এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। বিংশ শতাব্দীতে এসে এ অঞ্চলের নদী-নালাগুলো মানবসৃষ্ট ও প্রাকৃতিক—দুই কারণেই অবক্ষয় ঘটেছিল। নদী-নালার এ অবক্ষয় ফরায়েজি আন্দোলনের ওপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছিল। জলাবদ্ধতা এবং অস্বাভাবিক বন্যার মাত্রা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছিল। এর ফলে কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল, যার ওপর ফরায়েজি আন্দোলন ছিল অনেকটা নির্ভরশীল। দ্বিতীয়ত, ফরায়েজি যোগাযোগব্যবস্থা ছিল মূলত নদীকেন্দ্রিক। পানিপথকেন্দ্রিক ফরায়েজিদের প্রধান কেন্দ্রগুলোও নদীর সঙ্গে বিভিন্নভাবে সম্পৃক্ত ছিল। এভাবে ফরায়েজিরা পূর্ব বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলজুড়ে খুব সহজেই যাতায়াত করতে পারত। ইকবাল দেখিয়েছেন, উনিশ শতকের অন্যতম বড় আন্দোলনের, ফরায়েজি আন্দোলন, খুব গভীর সম্পর্ক ছিল পরিবেশের সঙ্গে। কিন্তু একটি বিষয় নিয়ে পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, লেখক যেসব সামাজিক আন্দোলন ও কৃষক সংগ্রামের কথা উল্লেখ করেছেন, এসব কি শুধুই পরিবেশ প্রভাবিত? তিনি কি পরিবেশকে অত্যধিক গুরুত্ব দিচ্ছেন? নাকি কিছুটা হলেও ঔপনিবেশিক সরকারের হস্তক্ষেপ নীতি বা কর্মকাণ্ড উসকে দিয়েছিল এই আন্দোলন-সংগ্রামকে? পার্বত্য অঞ্চলে, বর্তমানে বাংলাদেশের অন্তর্গত পার্বত্য চট্টগ্রাম, যেসব বিদ্রোহ হয়েছিল সেগুলোকে তিনি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?৩ উল্লিখিত সময়ে পূর্ব বদ্বীপে গতিশীল পরিবেশের জন্য যেসব আন্দোলন-সংগ্রামের কথা লেখক বলছেন, ঠিক সেই সময়ের কাছাকাছি সময়েই সাঁওতাল ও খাসিয়া বিদ্রোহ হয়েছিল। তাহলে এসব বিদ্রোহ কি পরিবেশ প্রভাবিত? নাকি সে সময়ে পাহাড়ে ব্রিটিশ সরকারের হস্তক্ষেপের ফলে বিদ্রোহের স্ফুরণ ঘটেছিল, সে প্রশ্ন থেকে যায়। আরেকটি ব্যাপার, তা হলো, বাংলায় বিপ্লব বিদ্রোহ তো শুধু লেখক উল্লিখিত বাংলায় কৃষিসহায়ক পরিবেশের কাল উনিশ শতকেই হয়নি? আঠারো শতকের ষাটের দশক থেকে শতকের শেষ পর্যন্ত ফকির সন্ন্যাসী এবং কৃষক বিদ্রোহ ছিল জোরদার। তাহলে এসব বিদ্রোহকে লেখক পরিবেশতত্ত্ব দিয়ে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
পঞ্চম অধ্যায়টি গ্রন্থের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায় (পৃ. ৯৩-১১৬)। এ অধ্যায়ে বিদ্যমান ইতিহাসতত্ত্বকে তিনি চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন। কর্তৃত্বশীল ইতিহাসতত্ত্বের মতে, ১৯৩০-এর দশকে মহামন্দা কৃষিতে যে প্রভাব ফেলে, এর ফলে ধনী কৃষক অপেক্ষাকৃত গরিব কৃষকের সহায়-সম্বল কিনে অনেক লাভবান হয়েছিলেন। এভাবে কৃষিতে ধনী কৃষকের আধিপত্য তৈরি হয়েছিল। এ ধনী কৃষকশ্রেণীর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ক্ষয়িষ্ণু জমিদার শ্রেণীও পেরে ওঠেনি। যার ফল শেষ পর্যন্ত গিয়ে গড়ায় ১৯৪৩-এর মহাদুর্ভিক্ষে। এ ইতিহাসতত্ত্ব দুর্ভিক্ষের জন্য ধনিক কৃষক শ্রেণীকে অনেকাংশে দোষী করেছে।৪ কিন্তু ইকবালের মতে তা সমর্থনযোগ্য নয়। কারণ, দেখা গিয়েছিল ১৯০৩ সালে স্বদেশি আন্দোলনের পর থেকে ভদ্রলোকেরা আবার সরাসরি কৃষিতে ফিরে গিয়েছিলেন। তাঁদের কৃষিতে এ প্রত্যাবর্তন ছিল আগের চেয়ে ভিন্ন। কারণ, এ সময়ে তাঁরা সরাসরি কৃষিকাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন। কৃষিতে ভদ্রলোক শ্রেণীর সরাসরি ফিরে যাওয়ার ক্ষেত্রে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রও বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে উত্সাহিত করেছিল। আর্কাইভসের প্রাথমিক প্রামাণ্য তথ্যের ভিত্তিতে তিনি দেখিয়েছেন, বিশ শতকের প্রথমার্ধে ভদ্রলোক সন্তানেরা ফরিদপুর, বরিশালসহ পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে খাসজমি বন্দোবস্ত নিয়ে নিজেরাই চাষাবাদ শুরু করেছিলেন। এভাবে তিনি দেখিয়েছেন, কৃষিতে ধনী কৃষকদের একচ্ছত্র যে আধিপত্যের কথা সুগত বোস, পার্থ চট্টোপাধ্যায় বা এ মতের অনুসারী ইতিহাসবিদেরা বলেছেন, তা প্রশ্নযোগ্য। তা ছাড়া তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, ১৯৩০-এর অর্থনৈতিক মহামন্দার সময়ে জমিদারেরা যেখানে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছেন, ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন, সেখানে ধনী কৃষকেরা কীভাবে মহামন্দার প্রভাব এড়িয়েছিলেন? কীভাবেই বা তাঁরা ক্ষুদ্র কৃষকদের সহায়-সম্বল কিনতে সমর্থ হয়েছিলেন?
লেখক দেখিয়েছেন, পূর্ববঙ্গে রেলওয়ে বিস্তারের সঙ্গে এর পরিবেশ ধ্বংসের একটি সম্পর্ক ছিল। পূর্ববঙ্গের মতো নদীবিধৌত ও জলাশয়পূর্ণ একটি এলাকায় রেলওয়ে নির্মাণ করা মানে ছিল অসংখ্য বাঁধ, কালভার্ট এবং ব্রিজ নির্মাণ করা। রেলওয়ে নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান এবং রেলওয়ে প্রকৌশলীরা তখন পরিবেশের কথা বলতে গেলে ভাবেনইনি। অসংখ্য বাঁধ এবং কালভার্ট নির্মাণ করায় পুরো পূর্ববঙ্গ ভাগ হয়ে গিয়েছিল ছোট ছোট জমিখণ্ডে। এতে পানি চলাচল অবরুদ্ধ হয়েছিল। ইকবাল দেখিয়েছেন, এসব দায়ী ছিল এ অঞ্চলের কৃষির অবনতির জন্য। রেলওয়ের বিস্তার এ অঞ্চলে অস্বাভাবিক বন্যা এবং রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটিয়েছিল। উদাহরণ হিসেবে লেখক আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ের কথা লিখেছেন। আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ে পূর্ববঙ্গের পরিবেশ বিপর্যয়ে বড় ভূমিকা রেখেছিল। রেলওয়ে ব্রিজ, কালভার্ট বা বাঁধের বিরূপ প্রভাব হিসেবে তিনি তুলে ধরেছেন হার্ডিঞ্জ ব্রিজের উদাহরণ। তিনি দেখিয়েছেন ব্রিজের পিলার নদীতে চর এবং নাব্যতা সমস্যা সৃষ্টি করেছিল। দেশের অন্যতম বড় জলাশয় চলনবিলে পানি এবং মত্স্য সম্পদ হ্রাস পাওয়ার পেছনে এ ব্রিজ ভূমিকা রেখেছিল।
এ ছাড়া বিশ শতকের প্রথম ভাগ থেকে পূর্ব বদ্বীপে পরিবেশ ধ্বংসের আরেকটি বড় কারণ হিসেবে ইকবাল উল্লেখ করেছেন কচুরিপানার বিস্তারকে (পৃ. ১৪০-১৫৯)। কচুরিপানা নিয়ন্ত্রণ বা ধ্বংস নিয়ে ঔপনিবেশিক সরকার সব সময়ই ছিল দ্বিধাগ্রস্ত। ঔপনিবেশিক প্রশাসকদের কেউ কেউ ভেবেছেন কীভাবে কচুরিপানাকে কাজে লাগানো যায়। অনেকে মতামত দিয়েছিলেন কচুরিপানাকে সার হিসেবে ব্যবহার করায়, যেহেতু কচুরিপানায় উচ্চমাত্রায় পটাশিয়াম পাওয়া যেত। আবার অনেকে ভেবেছিলেন একে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিতে পটাশিয়ামের ব্যাপক চাহিদা ছিল। ঔপনিবেশিক সরকার মেসার্স সও অ্যান্ড ওয়ালেস কোম্পানির সঙ্গে এ ব্যাপারে একটি চুক্তিও করেছিল যে তারা বাণিজ্যিকভাবে কোম্পানিটিকে কচুরিপানা পোড়ানো ছাই সরবরাহ করবে। সরকারের অন্য একটি দল ছিল কচুরিপানাকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করার পক্ষে। বিশ শতকে কচুরিপানা কৃষি ও পরিবেশের জন্য কতটা ক্ষতিকর ছিল, তা বোঝা যায় ইকবালপ্রদত্ত কয়েকটি উদাহরণ থেকে। তিনি দেখিয়েছেন, ১৯১৫ সালে কুমিল্লা জেলার নাসিরনগরের একদল কৃষক সরকারের কাছে পিটিশন করেছিলেন যে, বন্যা ও কচুরিপানার ফলে তাঁদের সব ফসল নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। এ ছাড়া ঢাকার পাশে মুন্সিগঞ্জের আড়িয়ল বিলে ব্যাপক পরিমাণ ধান নষ্ট হয়েছিল কচুরিপানার তাণ্ডবে। ১৯২৬ সালে একটি সরকারি প্রতিবেদনে বলা হয় যে বছরের পর বছর ১৫ থেকে ২০ ভাগ আমন ধান নষ্ট হয়েছিল। শুধু ঔপনিবেশিক আমলেই নয়, উত্তর ঔপনিবেশিক বাংলায়ও কচুরিপানা কৃষি ও পরিবেশের জন্য ছিল বড় হুমকি। আহমেদ কামাল তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, উত্তর ঔপনিবেশিক বাংলায় কুমিল্লাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে কচুরিপানার তাণ্ডবে আউশ ও আমন ধান উত্পাদনে মারাত্মক ক্ষতি হয়েছিল। আখাউড়ায় করণপুর গ্রাম থেকে কুমিল্লা জেলার পত্তন ইউনিয়ন পর্যন্ত প্রায় চার মাইল বিস্তৃত এলাকার ২০ হাজার একর ধানি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল কচুরিপানার কারণে।৫
১৯৪৩ সালে বাংলার দুর্ভিক্ষ নিয়ে এ পর্যন্ত অনেক গবেষণা হয়েছে। বিভিন্ন পণ্ডিত এবং ইতিহাসবিদ বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে মহাদুর্ভিক্ষের কারণকে ব্যাখ্যা করেছেন। কেউ কেউ, যেমন অমর্ত্য সেন, মহাদুর্ভিক্ষকে দেখেছেন খাদ্যের প্রাপ্যতার হ্রাস হিসেবে।৬ অনেকে সমালোচনা করেছেন যে অমর্ত্য সেন এবং তাঁর মতের অনুসারীরা দীর্ঘ দিন ধরে বাংলার কৃষিতে যে পরিবর্তন ঘটেছিল, তা বিবেচনায় নেননি। তাঁরা দুর্ভিক্ষের কারণ খুঁজতে আরও পেছনে গিয়েছেন। দুর্ভিক্ষের কারণ হিসেবে তাঁরা খাদ্য উত্পাদনে পরিবর্তন, কর বৃদ্ধি এবং ১৯৩০-এর দশকের মহামন্দা এ অঞ্চলের কৃষি ও অর্থনীতির ওপর যে প্রভাব ফেলেছিল সেসব আলোচনা করেছেন। সম্প্রতি তারেক ওমর আলি তাঁর একটি গবেষণায় দেখিয়েছেন, বিশ্ববাজারের সঙ্গে কীভাবে একেবারে প্রান্তের কৃষকও সম্পৃক্ত ছিল। পণ্যের দামের ওঠানামার সঙ্গে তাঁদের ভালোমন্দ জড়িত ছিল।৭ তবে এই প্রথম ইকবাল ১৯৪৩ সালে বাংলার দুর্ভিক্ষের একটি পরিবেশতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছেন। লেখক বলতে চেয়েছেন, দুর্ভিক্ষের পেছনে বিশ শতকে বাংলা বদ্বীপের পরিবেশ বিপর্যয়েরও একটি হাত ছিল। পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে এ অঞ্চলের কৃষি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। একসময় পূর্ববঙ্গ প্রচুর পরিমাণে ধান উত্পাদন করত। পূর্ববঙ্গ থেকে ধান ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে রপ্তানি হতো। কিন্তু বিশ শতকে এসে দেখা যায়, পূর্ববঙ্গকেই ধান আমদানি করতে হয়েছিল বার্মা থেকে।
লেখকের মতে, পূর্ববঙ্গে গ্রামীণ দারিদ্র্য শুরু হয়েছে কেবল বিশ শতকে এসে (পৃ. ১৮৪)। লেখকের এ অভিমত নিয়ে বিতর্ক রয়েছে বা থাকতে পারে। উনিশ শতককে লেখক কৃষি সমৃদ্ধির সময় হিসেবে দেখালেও অনেকে দেখিয়েছেন, গ্রামীণ দারিদ্র্য, কৃষক ও কারিগর শ্রেণীর দুরবস্থা লেখকের উল্লিখিত কৃষি সমৃদ্ধির শতকে বা এর আগেও কমবেশি ছিল। জাতীয়তাবাদী ইতিহাসবিদ রমেশ চন্দ্র দত্ত এবং দাদাভাই নওরোজী বিশ শতকের প্রথমার্ধে তাঁদের গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের শুরু থেকেই ব্রিটিশ নীতি, সম্পদ শোষণ এবং নির্গমনের ফলে এ অঞ্চলের অর্থনীতিকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করা হয়েছে। এ বিষয়ে রমেশ চন্দ্র দত্ত এবং দাদাভাই নওরোজী অনেক পরিসংখ্যানও প্রদান করেছেন।৮ কৃষির সমৃদ্ধির যুগেও বাংলার গরিব কৃষকদের অবস্থা যে আজকের দিনের চেয়ে খুব একটা ভালো ছিল, তা বলা যায় না। তাঁরা সব সময়ই শোষণের শিকার হয়েছেন। কখনো বা মোগল রাষ্ট্রযন্ত্র, জমিদার, ব্রিটিশ শোষণ বা ধনী কৃষকদের শোষণের শিকার হয়েছেন। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন শুরু হওয়ার পর থেকেই বিভিন্ন সময়ে বাংলায় দুর্ভিক্ষ গ্রামীণ দারিদ্র্যের প্রমাণ বহন করে। তবে সরকারি বিভিন্ন প্রতিবেদন ব্যবহার করে ইকবাল দেখিয়েছেন যে উনিশ শতকে বাংলার, বিশেষ করে পূর্ববঙ্গের, কৃষকেরা সচ্ছল ছিলেন। সরকারি প্রতিবেদনের ভিত্তিতে তিনি দেখিয়েছেন, উনিশ শতকে পূর্ববঙ্গে ভূমিহীন কৃষকের সংখ্যা কম ছিল এবং বেশির ভাগ কৃষকই দিনে দুই বেলা এবং তিন বেলা পেট পুরে খেতে পেরেছেন। তবে সরকারি এসব প্রতিবেদন সম্পূর্ণ নয়। ইকবাল শুধু দুই বা তিনটি অঞ্চলের ক্ষেত্রে এ প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করেছেন। তা ছাড়া দুই বেলা বা তিন বেলা পেট পুরে খেতে পেলেই যে গ্রামীণ দরিদ্রতা ছিল না বা কৃষকেরা সচ্ছল ছিলেন বলে ইকবাল মনে করছেন, তা ভেবে দেখার বিষয়। সে সময় কৃষকদের বার্ষিক আয় কী রকম ছিল, কত ভাগ কৃষক ভালো বা মোটামুটি ভালো আয় করতেন আর কত ভাগ দারিদ্র্যসীমার নিচে আয় করতেন, তা প্রাসঙ্গিকভাবেই পাঠকের জানার আগ্রহ জাগে। সচ্ছলতার যেসব মাপকাঠি, যেমন উনিশ শতকে গ্রামীণ কৃষকেরা কী কী শৌখিন দ্রব্য উপভোগ করতেন বা তাঁদের সঞ্চয়ই ছিল কি না, তা-ও জানার বিষয়। সে কারণে লেখক যেকথা বলছেন––‘Rural poverty in the area that is now Bangladesh emerged only in the twentieth century’––তা জোরালোভাবে প্রমাণ করার জন্য দরকার ছিল আঠারো, উনিশ এবং বিশ শতকে গ্রামীণ কৃষকের অর্থনৈতিক অবস্থার একটি তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরা।
কিছু কিছু সমালোচক বলেছেন, যে ইকবাল ঔপনিবেশিক যেসব সরকারি প্রতিবেদন এবং তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করেছেন, সেসব আরও সতর্কতার সঙ্গে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ব্যবহার করা দরকার ছিল। তা ছাড়া ষষ্ঠ অধ্যায়ে (১১৭-১৩৯) লেখক রেলওয়ে এবং পরিবেশ ধ্বংস ও কৃষির অবনতি নিয়ে যেসব যুক্তি উপস্থাপন করেছেন, ইতিহাসবিদ পিটার রবের মতে তা একপক্ষীয়। রেলওয়ের বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশ ও কৃষি ধ্বংসের কথা ইকবাল বলছেন, কিন্তু রেলওয়ে বিস্তার বাংলার অর্থনীতিতে কোনো অবদান রেখেছিল কি না, তা তুলনামূলকভাবে পরীক্ষা করা দরকার ছিল বলে তিনি মনে করেন।৯ তবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া ঔপনিবেশিক নথি ব্যবহারের যে কথা পিটার রব বলেছেন, তা পুরোপরি ঠিক নয়। কারণ, গ্রন্থজুড়েই দেখা যায় ইকবাল সরকারি বিভিন্ন নথিকে প্রশ্ন করছেন। একটি নথির সঙ্গে আরেকটি নথির তথ্যকে যাচাই করছেন। এ ছাড়া ঔপনিবেশিক নথি ছাড়াও অন্যান্য নথির সঙ্গে সেগুলো যাচাই করেছেন।
কেউ হয়তো বলতে পারেন যে পরিবেশতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বা পরিবেশকে বেশি গুরুত্ব দিতে গিয়ে অন্য অনেক বিষয়কে কম গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে হয়তো ঔপনিবেশিক ইন্টারভেনশন বা হস্তক্ষেপ, নিদারুণ ঔপনিবেশিক শোষণ এবং সম্পদ পাচারকে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে, যা এ অঞ্চলের ভালোমন্দের ওপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছিল বলে অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদ তত্ত্বের অনুসারীরা মনে করেন। বিশেষ করে, দেওয়ানি লাভের পর ঔপনিবেশিক সরকারের বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষাও বাংলার মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর বিশেষ প্রভাব ফেলেছিল।
কোনো কোনো সমালোচক, যেমন পিটার রব, গ্রন্থটির বিভিন্ন অধ্যায়ের মধ্যে পরস্পর সম্পর্কের অভাব দেখেছেন। এটা ঠিক যে বেঙ্গল ডেল্টার অধ্যায়গুলো বিভিন্ন বিষয়ের ওপর লেখা এবং আঁটসাঁট বন্ধনে আবদ্ধ নয়। তবে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে, প্রতিটি অধ্যায়ের বিষয়ই পরিবেশের সঙ্গে জড়িত। প্রতিটি অধ্যায়েই পরিবেশ এসেছে এবং পরিবেশ ও পরিবেশগত পরিবর্তনকে এ অঞ্চলের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে নিরীক্ষা করা হয়েছে। এভাবে একটি অধ্যায়ের সঙ্গে আরেকটি অধ্যায় কোনো না কোনো সূত্রে গাঁথা হয়েছে। গ্রন্থটিতে ইকবাল বাংলা বদ্বীপের অনেক অমীমাংসিত এবং বিতর্কিত বিষয়ের ওপর আলো ফেলেছেন এবং নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দাঁড় করিয়েছেন। সেদিক দিয়ে ইকবালের দ্য বেঙ্গল ডেল্টা উপমহাদেশের, বিশেষ করে বাংলা বদ্বীপের ইতিহাসচর্চায় একটি নতুন সংযোজন এবং এ অঞ্চলের ইতিহাসতত্ত্বে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।
তথ্যসূত্র
১. Late Victorian Holocausts:El Niño Famines and the Making of the Third World, Mike Davis-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। গ্রন্থটিতে লেখক উপনিবেশবাদের প্রভাব এবং পুঁজিবাদের সূচনা এবং এর সঙ্গে দুর্ভিক্ষের সম্পর্ক বিষয়ে আলোচনা করেছেন। ইফতেখার ইকবাল এখানে ‘ভিক্টোরিয়ান হলোকাস্টকে’ দুর্ভিক্ষের প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহার করেছেন।
২. ফরায়েজি আন্দোলন হলো উনিশ শতকে বাংলায় হাজী শরীয়তউল্লাহর নেতৃত্বে সংগঠিত অন্যতম বড় সংস্কার আন্দোলন। প্রাথমিক পর্যায়ে এটি ধর্ম সংস্কার আন্দোলন হিসেবে গড়ে উঠলেও পরবর্তী সময়ে এটি আর্থসামাজিক আন্দোলনে রূপ নিয়েছিল। এতে অংশগ্রহণ করেছিলেন ব্যাপকসংখ্যক কৃষক। এটাও দেখা গেছে যে হিন্দু কৃষকেরাও এ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে দেখুন, Muin-ud-Din Ahmed Khan, History of the Fara’idi Movement in Bengal, 1818-1906 (Karachi: Pakistan Historical Society, 1965).
৩. উল্লিখিত সময়ে পার্বত্যাঞ্চলে উল্লেখযোগ্য বিদ্রোহের মধ্যে ছিল সাঁওতাল বিদ্রোহ ও খাসিয়া বিদ্রোহের মতো আলোড়ন সৃষ্টিকারী বিদ্রোহ ।
৪. এ মতের অন্যতম প্রবক্তা হলেন সুগত বোস, বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন, Sugata Bose, Agrarian Bengal: Economy, Social Structure and Politics, 1919–1947 (Cambridge, 1986); আরও দেখুন, Sugata Bose, Peasant Labour And Colonial Capital (Cambridge: Cambridge University Press , 2007).
৫. দেখুন, Ahmed Kamal, State Against Nation: The Decline of the Muslim League in Pre-independence Bangladesh, 1947-54 (Dhaka: The University Press Limited, 2009),, পৃ. ১৪৮-৯।
৬. বিস্তারিত জানতে দেখুন, Amartya Sen, Poverty and Famines: An Essay on Entitlement and Deprivation (New Delhi: Oxford University Press, 1981).
৭. Tariq Omar Ali, ``The Envelope of Global Trade: The Political Economy and Intellectual History of Jute in the Bengal Delta, 1850s to 1950s,’’ (PhD Dissertation, Harvard University, 2012).
৮. দেখুন, Romesh Dutt, The Economic History of India: In the Victorian Age from the Accession of the Qeen Victoria in 1837 to the Commencement of the Twenteith Century (London: Kegan Paul, 1902); Dadabhai Naoroji, Poverty and Un-British Rule in India ( India:Minstry of Information and Broadcasting, 1988), AviI ˆ`Lyb Bipin Chandra Pal, The Rise and Growth of Economic Nationalism in India (India: Anamika Publishers, 2004).
৯. দেখুন পিটার রবের রিভিউ, can be accessed at http://www.history.ac.uk/ reviews/review/1083