নৃতত্ত্ব
নিম্নবর্গের সমুদ্র-জিজ্ঞাসা: বাংলাদেশের সমুদ্র প্রতিবেশ, বৈচিত্র্য ও সংস্কৃতি বিষয়ে এক নিম্নবর্গীয় বয়ান
সারসংক্ষেপ
এই প্রবন্ধের মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে বাংলাদেশের গ্রামীণ নিম্নবর্গের সমুদ্রবিষয়ক প্রচলিত ধারণা। বাংলাদেশ মূলত নদীবিধৌত সমভূমি হলেও সাধারণ মানুষের কল্পনা, সাহিত্য, জীবনাচরণ, কৃষি এবং অর্থনীতির নানা চলতি আলাপে ঘুরেফিরে এসেছে সমুদ্রের কথা। নিম্নবর্গের রূপকল্পে স্থান করে নিয়েছে সমুদ্র। বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনা, মিথ, গল্প, খাদ্যশস্যের এবং স্থানের নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে সমুদ্র বা সমুদ্র-সম্পর্কিত নানান বিষয়। কৌতূহলের বিষয় হচ্ছে নিম্নবর্গের এসব মানুষের অনেকেই কখনো সমুদ্র দেখেইনি। তারপরও তাদের কল্পনায়, সাহিত্যে এবং ঐতিহ্যে সমুদ্র উপস্থিত। এই উপস্থিতির এবং বর্ণনার বৈচিত্র্যের দিকটিই এই প্রবন্ধের মূল আলোচ্য বিষয়। এখানে সমুদ্র শুধু নীল জলের বিশাল ভৌগোলিক এলাকাবিশেষই নয়, বরং ইতিহাসের উপাদান। নিম্নবর্গের সমুদ্র ভাবনা-ধারণা ও তার ইতিহাসের অনুসন্ধান প্রচেষ্টা এই প্রবন্ধের মূল উদ্দেশ্য।
মুখ্য শব্দগুচ্ছ
সমুদ্র, নিম্নবর্গ, লোককাহিনি, প্রতিবেশ, সৃষ্টিতত্ত্ব, দিকনির্ণয়, লিঙ্গদেমাগ, সমুদ্র-কৃত্য।
ডুবল জাহাজ লবলং সাগরে
জামালরূপে পাগল হইয়া
ডুবল জাহাজ লবলং সাগরে।।
(সূত্র: বাদশা বদিউজ্জামাল ছয়ফুলমুলক পুঁথি, ভেরামতলী, শ্রীপুর, গাজীপুর, বাংলাদেশ। ১২ মে ২০০৮, ব্যক্তিগত সংগ্রহ)
আলাপের ফেনা
বাংলাদেশের গ্রামীণ নিম্নবর্গের সমুদ্রজীবন থেকে চলতি আলাপখানির২ বিস্তার। প্রতিবেশ, বৈচিত্র্য ও কৃত্য আরাধনার বিবেচনায় নিম্নবর্গের সমুদ্র-জিজ্ঞাসা এক প্রাথমিক স্তরের আলাপ। বলা ভালো, আলাপের খসড়া ভূমিকামাত্র। নদীমাতৃক বাংলাদেশে সাগরও কম নয়। দিনাজপুরের রামসাগর, গাজীপুরের লবলং সাগর, সুনামগঞ্জের কালিদহ সাগর, নীলফামারীর নীলসাগর আর বঙ্গোপসাগর। এ ছাড়া দেশে অনেক দিঘি আর স্থানের নামে জড়িয়ে আছে সমুদ্র। টাঙ্গাইলের ঘাটাইলের সাগরদিঘি, হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ের কমলারানীর সাগরদিঘি, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলের টিঘর জামাল সাগরদিঘি। সাগরযান জাহাজের স্মৃতি নিয়েও আছে কত স্থানের নাম। পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জের শালডাঙ্গা ইউনিয়নের এক গ্রামের নাম জাহাজমনি, রংপুর শহরে আছে জাহাজ কোম্পানির মোড়। বিস্ময়করভাবে এক বঙ্গোপসাগর ছাড়া আর কোথাও সমুদ্র নেই সশরীরে। চলতি আলাপখানি শুরুও হচ্ছে দেশের সমুদ্রহীন অঞ্চল থেকেই। সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সিলেট, হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা আর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিস্তৃত হাওরাঞ্চল দেশের মোট আয়তনের তিন ভাগের এক ভাগ। হাওরাঞ্চলের মৌখিক আখ্যানমতে, কালিদহ নামে এক বিস্তৃত সাগর থেকেই আজকের হাওরের জন্ম। পুস্তকি পণ্ডিতেরাও বলে থাকেন, সাগর থেকেই হাওর শব্দটি এসেছে৩। নীলফামারী সদরের গোড়গ্রাম ইউনিয়নে ৫৩.৯০ একর জায়গা নিয়ে নীলসাগরের অবস্থান। মহাভারতের কাহিনিকে ঘিরে এই দিঘির নাম হয়েছিল বিরাটদিঘি। পঞ্চপাণ্ডব যখন বিরাট রাজার রাজ্যে আত্মগোপন করে তখন তাদের জলতৃষ্ণা মেটাতে বিরাট রাজা এই দিঘি খনন করেন। তাঁর নামেই এটি পরিচিত ছিল। কেউ বলেন, বিরাট রাজার কন্যা বিন্ন্যাবতীর নামে, এর নাম বিন্না দিঘি। ১৯৭৯ সালে সব নাম সরিয়ে নীলফামারীর তত্কালীন জেলা প্রশাসক এর নাম দেন ‘নীলসাগর’। দিনাজপুর সদরের আউলিয়াপুর ইউনিয়নের তাজপুর গ্রামে অবস্থিত ৪,৩৭,৪৯২ মিটার আয়তনের রামসাগর দিঘি বর্তমানে জাতীয় উদ্যানও বটে। দিনাজপুরের রাজা রামনাথ পলাশীর যুদ্ধের আগে এই দিঘি খনন করেন। গাজীপুরের শ্রীপুরে রাথুরা শালবনের ভেতর প্রাকৃতিক এক জলাভূমির নাম লবলং সাগর। শোনা যায়, বাদশা বদিউজ্জামালের জাহাজ ডুবে যায় এই লবলং সাগরে। এ নিয়ে স্থানীয় পুঁথিপালাতে বলে, ডুবল জাহাজ লবলং সাগরে/ জামালরূপে পাগল হইয়া/ডুবল জাহাজ লবলং সাগরে৪। ভারত মহাসাগরের উত্তর-পূর্বে অবস্থিত এক উপসাগরের নাম বঙ্গোপসাগর। বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়াকে ছুঁয়ে আছে ২,১৭২,০০০ বর্গকিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত এই নোনা সমুদ্র৫। এই সমুদ্রের উত্তর-পূর্বেই দুনিয়ার দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার৬। বাংলাদেশের কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, বরগুনা, পিরোজপুর, পটুয়াখালী, ভোলা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, খুলনা সরাসরি সমুদ্র উপকূলভূমি। কিন্তু চলতি আলাপটি সমুদ্র অঞ্চল থেকে শুরু হচ্ছে না। বঙ্গোপসাগর থেকে বহুদূরের সমুদ্রহীন জনপদ থেকে এই আলাপ শুরু হচ্ছে। অরণ্যভূমি থেকে জন্ম নিয়ে নানা স্মৃতির জলকণা নানা প্রবাহে নানা নামের নদী হয়ে ‘মেশে’ সমুদ্রে। চলতি আলাপখানি অনেকটাই নদীর সেই স্বভাবদর্শনটি ধার করেছে। অরণ্যভূমি থেকে সমুদ্রের স্মৃতি আর জাগরণ নিয়ে এক দীর্ঘ দূরের বঙ্গোপসাগরের দিকে প্রবাহিত হওয়ার সাহস করছে। উজান-ভাটির জলপ্রতিবেশের ব্যাকরণ আর নিম্নবর্গের ঐতিহাসিক সমুদ্র-জিজ্ঞাসাই এই সাহসের উত্স।
নামহীন সাগরের মাঝে কারাম গাছের উপরে
বাসা তো আমরা বানিয়েছি,
এখন কোথায় আমরা তাকাব
কোথায়ই বা আমরা থাকব না
এই সাগরের মাঝে কোনো স্থলভাগ নাই
বাবা ঈশ্বর চান্দোবঙ্গা আমাদের প্রার্থনা শোন
বলে দাও কোথায় আমরা থাকব
কোথায়ই বা আমরা থাকব না।
(সাঁওতাল সৃষ্টিপুরাণ নিয়ে রামদাস টুডু রেস্কা রচিত ‘খেরওয়াল বংশা ধরম পুঁথি’ থেকে নেওয়া হয়েছে৭)
সমুদ্রফেনা, চিগেলবাড়িওয়ারিখুট্টি ও পিলচুদের সাঁতার
সমুদ্রফেনা ধান
সমুদ্রফেনা নামের এক ধানের সঙ্গে আমার পয়লা সাক্ষাত্ হয় মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের হাইল হাওরে। ধানটি বোরো মৌসুমের, চালের রং সাদা। যে সাদাকে ‘সমুদ্রের ফেনার’ মতো হিসেবে বর্ণনা করেন হাইল হাওরের কৃষক নারীরা। তাঁদের ভাষ্য, তাঁরা কখনোই সমুদ্র দেখেননি, এমনকি বড় নদীও। তবে শুনেছেন সমুদ্র অনেক বড়, সেখানে ঢেউ থেকে ফেনা হয়, ফেনার রং সাদা। পাতিহাঁসের ডিম, দুধ, পাকা চুল, চুন, বাতাসা, কদমা, দাঁত সাদা রঙের হলেও ‘সমুদ্রফেনা’ ধানের রং সমুদ্রের ফেনার মতোই সাদা। এভাবেই বংশ থেকে বংশে সমুদ্রের ফেনার রূপকল্প নিয়ে বঙ্গোপসাগর থেকে অনেক দূরের হাইল হাওরে টিকে আছে এক ধান। এককালে হাওরে জন্মাত সমুদ্রফেনার মতো টেপী, বোরো, রাতা, শাইল, লাখাই, মুরালী, চেংড়ি, কাচালত, হাসিকলমী, দুধলাকি, দুধসাগর, লাটলি, আখনিশাইল, গাছমালা, খৈয়াবোরো, রাতাশাইল, দেউড়ি, কন্যাশাইল, বিচিবারই, লালাটেপী, পশুশাইল, হাঁসের ডিম, গুয়ারশাইল, বুয়ালের দাঁত, বেতী, ময়নাশাইল, গদালাকি, বিরঅইন, খিলই, ছিরমইন, আগুনী, গুলটিহি, ল্যাঠা, জাগলীবোরো এমনসব অবিস্মরণীয় গভীর পানির ধান জাত। দুনিয়ার প্রথম গভীর পানির ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৩৪ সালে হাওরের হবিগঞ্জ জেলার নাগুড়াতে। হাওরাঞ্চলে অনেক গভীর পানির ধান জাত থাকলেও কোনোটির নামই সমুদ্রকে ঘিরে নয়। তাহলে এই ধান কেন সমুদ্রের স্মৃতি নিয়ে টিকে আছে? কারা এই ধানের এমন নাম রেখেছে? যে অঞ্চলে সমুদ্রের কোনো শারীরিক সাক্ষাত্ নেই, সে অঞ্চলে সমুদ্রের ফেনা কীভাবে এক জটিল রূপকল্প হয়ে বিকশিত হয়ে পড়ল? তখন থেকেই এক গভীর ‘সমুদ্র-জিজ্ঞাসা’ উথলে ওঠে চারধারজুড়ে। সমুদ্র মানে কী? কী এর রূপ ও বিস্তার? তারপর দেশের সমুদ্রহীন ও সমুদ্র অঞ্চলের গ্রামীণ নিম্নবর্গের সঙ্গে এ নিয়ে আলাপ হয়েছে বিস্তর। সেখান থেকেই চলতি আলাপখানির প্রবাহ।
সৃষ্টিতত্ত্ব
দেশে বাঙালি-ভিন্ন প্রায় সব জাতির ভেতরেই মৌখিক বয়ানে সৃষ্টিতত্ত্ব বহমান। প্রায় সব সৃষ্টি-কাহিনিতেই দুনিয়ায় প্রথম তৈরি হয়েছে জল। বলা হয় ‘বিস্তীর্ণ জলরাশি’। সৃষ্টি-কাহিনির এই জলবিস্তার সমুদ্রের কাছাকাছি। আর প্রায় প্রতিটি কাহিনিই বয়ান করে সমুদ্র থেকেই জীবনের উদ্ভব। গাজীপুরের বর্মণ-ক্ষত্রিয় জাতির সৃষ্টিপুরাণ মতে, ভগবান কুম্ভী রানীকে মানুষ সৃষ্টির আদেশ দিলেন। কুম্ভী রানীর বাস অকূল সমুদ্রে। কুম্ভী রানীর পিঠের ময়লা মাটি থেকেই জন্ম হলো মানুষের। মান্দি সৃষ্টিপুরাণমতে, মিদ্দি (দেবতা) বাগবাবরম্বির চিপাং ফাকসা (তলপেট) থেকেই দুনিয়ার সব প্রাণ ও প্রকৃতি জন্ম নিয়েছে। তারপর সাগল আমার (সাগর) তলদেশ থেকে চিজং (কাছিম)-এর আনা মাটি দিয়ে নস্তুনপান্তু প্রথম মানুষ আমা ফালদি ও আচ্চুজানির জন্ম দিলেন। আর প্রাণের এই প্রথম বিকাশ ঘটেছে চিগেলবাড়িওয়ারিখুট্টি নামে সমুদ্রঘেরা এক অরণ্যদ্বীপে। সাঁওতালি ভাষায় জালাপুরি মানে সমুদ্র। দেবতা জিয়োর আদেশে ঈশ্বর বঙ্গা লিটো প্রথম জন্ম দিলেন পিলচু হাড়াম ও পিলচু বুঢ়হির। তারা সমুদ্রে সাঁতার কেটে কেটে একসময় বসতি গড়ে তোলেন হিহিড়ি পিপিড়ি থেকে সাসাংবেডা হয়ে সিন্ধু অববাহিকার নানা গাঢ়ে (দুর্গ)। নিদারুণভাবে বর্মণ, সাঁওতাল কি মান্দি কেউই আজ আর সমুদ্র-বাসিন্দা নয়। সমুদ্র থেকে অনেক দূরেই তাদের বসতিস্থল। তাহলে আমরা যখন সমুদ্র নিয়ে আলাপ তুলব তখন কি দেশের নানা প্রান্তে ও জনজীবনে বহমান সমুদ্রস্মৃতিগুলোকে অস্বীকার করব? কেবল শারীরিকভাবে যাঁরা সমুদ্র অঞ্চলে বসবাস করছেন বা যাঁদের একটা দীর্ঘ যাপিত সম্পর্ক তৈরি হয়েছে উজান-ভাটির সমুদ্র তরঙ্গে তাদের সংস্কৃতিকেই সমুদ্র-সংস্কৃতি হিসেবে পাঠ করব? নিদারুণভাবে তা-ই ঘটে চলেছে।
সমাপ্তি না উত্পত্তিস্থল
এ ক্ষেত্রে বিদ্যায়তনিক ‘ভূগোলবিদ্যা’ আমাদের কী জানায়? সচরাচর বলা হয়, অরণ্য পাহাড় থেকে বিন্দু বিন্দু জলে নদীর জন্ম। তারপর নদী কত পথ পাড়ি দিয়ে ‘মিলিত’ হয় সমুদ্রে। সব নদীর পরিণতি হচ্ছে সমুদ্রে মিলন, সমুদ্র হচ্ছে জলপ্রবাহের শেষ অন্তিম ঠিকানা। চলতি আলাপে এই চিন্তাটিকে আমরা ‘অধিপতি’ চিন্তা হিসেবে পাঠ করছি। সমুদ্রকে যেখানে দেখা হয় মিলনস্থল ও প্রবাহের সমাপ্তি আধার হিসেবে, সেখানে দেশের অনেক আদিবাসী সমাজে সমুদ্রকে দেখা হয় প্রাণের উত্পত্তিস্থল হিসেবে। জীবনপ্রবাহের শেষ ঠিকানা নয়, জীবনের শুরুই সমুদ্রে। সমুদ্রে জন্ম নেওয়া প্রাণের বিস্তার ঘটে নানা স্থানে নানা রূপে ও নানা ভঙ্গিতে। প্রাণের সেসব বিস্তার আবারও নদীপ্রবাহের ভেতর দিয়ে উত্পত্তিস্থলে এসে দেখা দেয়। জানান দেয় তার দীর্ঘ ভ্রমণের আখ্যান। সমুদ্র পরখ করে দেখে কোন প্রবাহের কী দশা। বিগত জীবনের আঘাতের দাগ ও বয়ে আনা ব্যঞ্জনাগুলো পাঠ করে। এখানে প্রাণপ্রবাহের হিসাবনিকাশ হয়। সব সৃষ্টি আর প্রবাহকে জায়গা দিতে হয় বলেই সমুদ্র অনেক বিস্তৃত আর গভীর। নালা, ঝিরি, পুকুর, দিঘি, ছড়া, ঝরনা, খাল, বাইদ, খাঁড়ি, দহ, কুণ্ড, নদ, নদী, হ্রদ, বাঁওড়, বিল, হাওর সবার চেয়ে। কারণ সমুদ্রকে নিরন্তর ধারণ করতে হয়, জন্মপ্রবাহ সচল রাখতে সজাগ থাকতে হয়। সমুদ্র নির্ঘুম, সদা জাগ্রত। নদীপথকে উজান আর সমুদ্রকে ভাটি হিসেবে দেখেন গরিষ্ঠভাগ জনগণ। নদীর উত্পত্তিস্থলের মানুষেরা মনে করেন নদীর মাথা সাগরের দিকে এগিয়ে যায়। সমুদ্র অঞ্চলের মানুষেরা নদীর সমুদ্রে মিশে যাওয়ার অংশকে সেই নদীর ‘মুখ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। চট্টগ্রামের পতেঙ্গা ও আনোয়ারার বারশত ইউনিয়নের দুধকুমড়ার (পারকি) কাছে কর্ণফুলী নদী সমুদ্রে মিশেছে। এ অংশটি স্থানীয়দের কাছে ‘কর্ণফুলীর মুখ’।
হীরামন পাখির সমুদ্র
অধিকাংশ সময় সমুদ্রকে দেখা হয় অধিপতি পুস্তকি বাঙালি মধ্যবিত্ত পুরুষের চোখেই। বাঙালি সমাজে প্রচলিত রূপকথাগুলোর ভেতর রাজপুত্র, মন্ত্রীপুত্র বা কোটালপুত্রের ‘সাতসমুদ্র তের নদী’ পাড়ি দেওয়া এক বহুলব্যবহূত রূপকল্প। রূপকথার ক্ষীরসাগর, দুধসাগর এখনো বিকশিত আছে মৌখিক বয়ানের স্মৃতিতে। এসব সমুদ্র পাড়ি দিলেই মেলে নানা রাজ্য কি জঙ্গল। তবে সমুদ্র এমনি এমনি বা যে কেউ পাড়ি দিতে পারে না। এর জন্য কসরত জানা লাগে, জাদুবিদ্যা লাগে, ‘অলৌকিক বর’ লাগে। বিস্ময়করভাবে কোনো রূপকথাতেই সমুদ্রকে ‘অসীম’, ‘অনতিক্রম্য’ হিসেবে দেখানো হয়নি। দেখানো হয়েছে সমুদ্রের একটা সীমা আছে, একে অতিক্রম করা যায়। এর একটি নির্দিষ্ট আয়তন ও অবস্থান আছে। আর তাই সমুদ্র পাড়ি দিয়ে ওই পাড়ে পৌঁছে যায় রাজপুত্র কি কোটালপুত্র। কিন্তু সমুদ্রের ওই পাড়ে কখনোই মানুষ থাকে না, থাকে ‘রাক্ষস খোক্কস বা দৈত্য দানো’। সেখানে মানুষ হিসেবে ‘রাজকন্যাকে’ ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়। রাক্ষস ও দৈত্যকে হত্যা করে রাজকন্যাকে জয় করে নিজ দেশে ফেরার ভেতর দিয়েই শেষ হয় কাহিনি। পাশাপাশি দেখা যায়, সমুদ্রের কথা এবং সমুদ্রপাড়ের ‘রাক্ষসপুরির’ কথা কোনো মানুষ জানে না, জানে শুকসারি কি হীরামন পাখিরা। রূপকথার নিরিখে দাঁড়াচ্ছে বর্ণিত রূপকথার কারিগর বাঙালিরা ঐতিহাসিকভাবে সমুদ্রবিচ্ছিন্ন বর্ণিত ‘রাক্ষস দৈত্যদের’ চেয়ে। এই রাক্ষস, দৈত্য, হীরামন পাখি কে বা কারা এ নিয়ে বিস্তর তর্ক তালাশ আছে। রহমান (১৯৯৭) ‘রাক্ষসীর রূপকথা’ শীর্ষক তাঁর একটি লেখায় জানান, রাক্ষস-রাক্ষসীরা এ দেশের প্রাচীনকালের কোনো অনুন্নত মানবগোষ্ঠী৮। তার মানে কি সাঁওতাল, কোল, লালেং, মান্দি, ম্রো, কডা, কড়া, খাসি, রাখাইন জাতির কেউ? পাশাপাশি পালিত (২০০৫) তাঁর এক লেখায় জানান, এ দেশের আদিম আধিবাসীরা-হড়, হো (কোল) নামক জাতি, এরাই এ দেশের আদিব মানব; তারাই তাদের দেশকে বলত ‘বাংলো’। এ দেশটা জলবহুল দেশ, জলাভূমি যথেষ্ট, ছেঁচে জল ক্ষেত্রে দিতে হতো না। বাং মানে না, আর লো মানে পাত্র ডুবিয়ে জল তোলা। তা থেকে জল ছেঁচাও বোঝায়। যে দেশে ছেঁচে জল দিতে হয় না, জল ছেঁচার আবশ্যক হয় না, অর্থাত্ ধান্যক্ষেত্রে জলের অভাব হয় না সেই দেশই ‘বাংলোদিশম’। ইহাই তাদের জন্মভূমি (আয়ু-দিশম)। আর্য বৈদিকেরা এ দেশের নাম করেন নাই৯। নামতর্ক যাই হোক না কেন, রাজধানী ঢাকায় তিন আদিবাসী জাতির নামে তিনটি এলাকার নাম মুছে না ফেললেও সেখানে তো আর আগের আদিবাসীরা নেই। মগবাজার, মণিপুরিপাড়া ও কুর্মিটোলা। এখনো তো বাঙালি ভিন্ন দেশের সব আদিবাসী জাতিসমূহকে ‘অনুন্নত, আদিম, রাক্ষস, অনাধুনিক, বন্য, বর্বর’ হিসেবেই দেখা হয় বা দেখার প্রবল১০ মনস্তত্ত্ব জারি আছে।
লিঙ্গদেমাগ
প্রচলিত ইতিহাসগ্রন্থন ও উপস্থাপনের দুর্নিবার কায়দা বরাবরই জাত্যভিমানী, লিঙ্গদেমাগিও বটে। মধ্যবিত্ত বাঙালির সমুদ্রচিন্তা বারবার পুরুষালি কায়দায় বিবৃত ও নির্মিত হয়ে আসছে। ‘ধরণি সর্বংসহা’, সবকিছু সহ্য করতে পারে বলেই এই অধিপতি চিন্তাপদ্ধতিতে পৃথিবীকে মাতৃরূপে নারী হিসেবে দেখা হয়। ধরেই নেওয়া হয় দুনিয়ার বুকে যত জখম আর জালিয়াতি সবকিছু তাকে সহ্য করতেই হবে। সহ্য করার ভেতর দিয়েই তাকে সর্বংসহা হয়ে জগত্জননী হিসেবে ‘প্রমাণিত’ হতে হবে। সমুদ্রকেও দেখা হয় সবকিছু ধারণ করার ক্ষেত্র হিসেবে। এমনকি ‘পতিতদের’ অঞ্চল। কারণ বলা হয় সব নদী সমুদ্রে ‘পতিত’ হয়। সমুদ্রের সঙ্গে নদীপ্রবাহের সাক্ষাত্ যেন নদীর চারিত্রিক স্খলন। তাই সমুদ্রে মিশে যাওয়ার আগে সে প্রবাহিত হয়, কিন্তু সমুদ্রের সঙ্গে সাক্ষাতে সে ‘পতিত’ হয়ে যায়। এভাবেই জলপ্রবাহের সারা জনমের দীর্ঘ পথযাত্রাকে অস্বীকার করে পুরুষালি বাস্তবতাকে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। জনমভর নদী সবার তরে জান দিয়ে দিলেও যখনই নদীর জন্য কোনো বসত জমিন নিশ্চিহ্ন হয় তখনই মানুষ নদীকে ‘রাক্ষুসী’, ‘প্রমত্তা’ আর ‘সর্বগ্রাসী’ বানিয়ে দেয়। নদীর স্রোতের ফলে তীরের ভাঙনকে সচরাচর বলা হয় ‘নদীগর্ভে বিলীন’, গণমাধ্যমে লেখা হয় নদীর করালগ্রাস। নদীর কোনো বিশেষ সময়ের বৈশিষ্ট্যকে নেতিবাচক ও নারীর কাজ হিসেবে দেখা হয় এবং তখন একতরফাভাবে সমাজের লিঙ্গদেমাগি মনস্তত্ত্বকেই প্রতিষ্ঠা করা হয়। বিস্ময়করভাবে সমুদ্রকে ‘করালগ্রাসী’, ‘সর্বনাশী’, ‘রাক্ষুসী’ হিসেবে আখ্যা দেওয়ার চল বিরল। এ বিষয়ে সমুদ্রহীন ও সমুদ্র অঞ্চলের জনগণ তেমন একটা লম্বা আলাপ করেননি।
সমুদ্রসঙ্গম
নদীপ্রবাহ ও সমুদ্রের সাক্ষােক ‘মিলন’ হিসেবেই দেখার প্রচলিত চল। আর মিলনকে ‘যৌনমিলন’ হিসেবেই দেখা হয়। তাই তো নদী ও সমুদ্রের মিলনস্থল হলো ‘সঙ্গমস্থল’। যেন নদীজন্মের একমাত্র গন্তব্য সমুদ্রের সঙ্গে সঙ্গম। নদী যেন তার দীর্ঘ পথে যৌনক্রিয়ার জন্যই মরিয়া থাকে। এভাবেই দীর্ঘ সময়জুড়ে নদীকে কামার্ত হিসেবে চিন্তা করার যৌনবাদী চিন্তার চল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এমনিভাবে সমুদ্রও যেন যাবতীয় যৌনগ্রন্থি আর অঙ্গ মেলে জলপ্রবাহের জন্য প্রতীক্ষা করে, কখন ঘটবে যৌনসঙ্গম! বাংলাদেশে নদীপ্রবাহকে নদ ও নদী হিসেবে নারী-পুরুষদের ব্যঞ্জনা হিসেবে দেখা হয়। যেমন: ব্রহ্মপুত্র, কুমার, কপোতাক্ষ নদ। আবার কর্ণফুলী, করতোয়া, মেঘনা হলো নদী। নদ ও নদী সবাই তো সমুদ্রে ‘মিলিত’ হয়, নারী এবং পুরুষ জলপ্রকৃতির উভয়েই। সমুদ্রের কি কোনো লিঙ্গ পরিচয় আছে? সমুদ্র নারী, পুরুষ না হিজড়া কোন প্রকৃতির? নাকি সমুদ্র এতই বিশাল যে তার লিঙ্গপরিচয় বিলীন হয়েছে! তাহলে নদ ও নদীর সঙ্গে সমুদ্র সঙ্গমের সময় কি নদ ও নদী তাদের লিঙ্গপরিচয় খারিজ করে। নাকি বিবর্গীকরণ ঘটে? নদী ও নদ তার দীর্ঘ যাত্রাপথে প্রবল অধিপতি লিঙ্গদেমাগকে চুরমার করতে করতে সমুদ্রের কাছে হাজির হয়। নারী ও পুরুষদেহকে বিলীন করে জলদেহ নিয়ে নদ ও নদী মিশে যায় সমুদ্রের জলদেহে। তবে পুস্তকি দলিল আর বিদ্যায়তনে সমুদ্রকে কখনো কখনো নারী হিসেবে দেখার চল আছে। তাই বলা হয় ‘সমুদ্রগর্ভ থেকে উত্থিত হয়’, সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার অঞ্চলের সমুদ্রগামী জেলেদের ভাষ্য, সমুদ্র হলো নারীপ্রকৃতি। নদী এবং সমুদ্রদের সঙ্গম ঘটে। আর এই মিলনস্থল বা সঙ্গমস্থলটি সমুদ্রের সব সীমানার চেয়ে বেশি ‘গরম’। এই গরম প্রত্যয়টি তাঁরা অধিক যৌনাবেগ হিসেবেই বোঝাতে চান। অমাবস্যা ও পূর্ণিমার রাতে এই স্থলটি অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে চলাচলের জন্য বেশি ‘বিপজ্জনক’ হয়ে ওঠে। এখানে তখন স্রোত ও ঢেউয়ের প্রাবল্য বেশি হয়। তাদের ভাষ্য, সে সময়েই নদী ও সমুদ্রের ‘মেলামেশা’ বা ‘সঙ্গমলীলা’ চলে। আবার কক্সবাজারের মহেশখালী, সদর ও চকরিয়ার অনেকেই মনে করেন সমুদ্রের সঙ্গে নদীর মিলন বা সঙ্গম ঘটেনি, বরং একটি ‘সংঘর্ষমূলক’ আছে। সেখানে নদী ও সমুদ্রের তিনটি জলধারা একসঙ্গে না মিশে ত্রয়ী ধারার এক বিরল প্রবাহ তৈরি হয়েছে।
লবণ ও বিড়াল
চলতি সমুদ্র-জিজ্ঞাসার এক কেন্দ্রতল হচ্ছে সমুদ্রহীন ও সমুদ্র অঞ্চলের যাপিত জীবনে সমুদ্র তারপরও কীভাবে সম্পর্ক তৈরি করল। কীভাবে সমুদ্র অঞ্চল থেকে বহুদূরে থেকেও সাঁওতাল বা মান্দি জাতির মতো এক বিশাল বাংলাদেশ সমুদ্রকে বয়ে নিয়ে চলেছে? সমুদ্রের কি কোনো ‘গৃহপালিত’ রূপকল্প তৈরি হয়েছে? সমুদ্রচিন্তার এমনি এক সন্ধ্যারাতে চট্টগ্রামের আনোয়ারার পারকি সমুদ্রসৈকত থেকে ফেরার সময় ম্যাঁও করে উঠল এক বিড়াল। সাদা রঙের বিড়াল শিশু। বিড়াল নিয়ে সারা দেশে আছে নানা আচার। বিড়ালের মৃত্যু হলে সমপরিমাণ সামুদ্রিক লবণ দান করতে হয়। আর জিজ্ঞাসার একটি সূত্র যেন সেখান থেকেই থলের বিড়াল হয়ে বেরিয়ে আসতে চাইল। সূত্রটি হলো লবণ। সমুদ্র থেকে কী অবলীলায় আজ দেশের প্রতিটি ঘরে জায়গা করে নিয়েছে লবণ। লবণ মানেই সমুদ্রের স্মৃতিস্মারক। ঠিক যেন বিড়ালের মতোই, একদা অরণ্য জীবন ছেড়ে কী অবলীলায় বিড়াল যেমন ঢুকে গেছে মানুষের ঘরে নিত্যসঙ্গী হিসেবে। কালো বিড়াল, সাদা বিড়াল, সাদা লবণ, কালো লবণ এসব নিয়েও আছে নানা আচার। সাঁওতালি ভাষায় লবণ মানে বুলুং আর মান্দিদের আচিক ভাষায় খাসিম। অনেকে বলতে পারে শংখ, শাঁখা এসবও সমুদ্রেরই স্মৃতিস্মারক, এসবও সঙ্গী হয়েছে সমাজের। সমুদ্রহীন কি সমুদ্র অঞ্চলে। কিন্তু এর বিস্তার ও আবশ্যকীয়তা সর্বজনীন নয়। লবণ সর্বজনীন সমুদ্রস্মৃতি হিসেবে নিরন্তর আমাদের সমুদ্র-সম্পর্ককে জানান দিয়ে চলেছে। চলতি আলাপটি এখন ধীরে ধীরে সমুদ্রের দিকে প্রবাহিত হওয়ার কিছুটা রসদ পেয়েছে। পরবর্তী অংশে মূলত চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও সুন্দরবন অঞ্চলের সমুদ্রগামী জেলে ও সমুদ্রনির্ভর গ্রামীণ নিম্নবর্গের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা থেকে সমুদ্রপাঠের কিছু নমুনা হাজির হচ্ছে।
সমুদ্রের সীমা ও রূপ
সাগল আমা রিব্বক মিচ্চিক
বাল্ওয়া বালশিরি মি.শিখেল্ রংমিসেপ্মুঙ
মিখাচিখু বাদুরিমুং
দকদই মুগাদে
না.নিমামুঙ মি.নিমামুঙ
রূপফাদ্দি জাম্ফাদ্দি
মি.নিমা মুগনাবাদ্দি
না.নিমা সিম্ফাগিদ্দি
ও’নবো ম্যুকেখা...
(মান্দিদের হাবাহুইছাআ বা জুম আবাদের আগের কৃত্য গালমাকদুআ। গালমাকদুআ কৃত্যের একটি খ্রীতা বা মন্ত্রের এই অংশে বলা হচ্ছে: ও আমার সমুদ্রমাতা, ধবধবে নারী। ঝোড়ো হাওয়া-বাতাসের সাথে, উপর দিকে তুলে, অর্ঘ্য দিয়ে, ডালি সাজিয়ে ভাত দিয়েছি, তরকারি দিয়েছি। নামো বৃষ্টি হয়ে নামো, নামো...)
কক্সবাজার অঞ্চলে সমুদ্রকে বলে দইজ্জ্যা বা দরিয়া, চট্টগ্রাম অংশে বলে সাগর। কক্সবাজারের তঞ্চংগ্যারা সমুদ্রকে বলে ‘দইয়া’। রাখাইন ভাষায় সমুদ্র মানে ম্রাইনা। বড় (পাটের রশি) জলে ফেলে সমুদ্রের পানির গভীরতা মাপে জেলেরা। এই মাপকে বাম বলে। এক বাম মানে সাড়ে তিন হাত। এক এক বামে এক এক রকম সমুদ্রের রং ও রূপ। সমুদ্রগামী জেলেরা মনে করে সমুদ্রের তলায় মাটি আছে। সমুদ্রের উপরের তল বা সমুদ্রপৃষ্ঠকে বলে চরএলাকা, তারপরের অংশটি খাঁড়ি, তারপর মাটি। এক এক অংশে এক এক রকম মাছ ও প্রাণী। উপরে থাকে নাইল্যা মাছ, এক বাম নিচে ইলিশ, তারপর মাইট্ট্যা তারপর উন্দরা মাছ থাকে। ৬০-৭০ বাম নিচে থাকে হাঙ্গর ও বড় তিমি, সেখানে লাকু ও পুখা মাছও থাকে। তবে ২২ বামের নিচে নৌকা যেতে পারে না, সেখানে বড় বড় জাহাজ যায়।
সমুদ্রে ‘আবাম-পানি’ নামে একটা জায়গা আছে। আবাম মানে যার কোনো কূল বা বাম নেই। সমুদ্রগামী জেলেদের মতে এই স্থলটি দক্ষিণে। এখানে সচরাচর কোনো সমুদ্রযান যায় না, সেখানে যান গেলে উল্টে ডুবে যায়। চট্টগ্রামের সমুদ্রগামী জেলেদের কাছে সমুদ্রে পরপর তিনটি অঞ্চল আছে। ৫ থেকে ৬ বাম গভীরতায় মথুরা পানি, ১৫ থেকে ২০ বামে লাল পানি এবং ৩০ থেকে ৪০ বামে কালা পানি।
সমুদ্রের নানা জায়গায় নানা বর্ণ। সচরাচর সমুদ্রের ‘সুন্দর নান্দনিক’ ছবি হিসেবে সমুদ্রকে নীল বর্ণ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। কিন্তু সমুদ্রের এই নীল রং সমুদ্রগামী জেলেদের জন্য নিদারুণ সংকেত। জলের রং নীল মানে সমুদ্রে মাছ পাওয়া যেতেও পারে আবার নাও পারে। একধরনের অনিশ্চয়তা। সমুদ্রের পানি লালচে আভা ধারণ করলে বোঝা যায় সেখানে ইলিশ মাছ আছে। পানির রং ঘোলাটে ধূসর মানে কোরাল মাছ আছে। পানির রং কালচে হলে সেখানে মাইট্ট্যা মাছের বিচরণ আর পানির রং সবুজ মানে সেখানে নাইল্যা মাছের ঘরসংসার। কক্সবাজার অঞ্চলের সমুদ্রগামী তঞ্চংগ্যারা মনে করে তাপমাত্রা বাড়লে ইলিশ কম দেখা যায়, কিছুটা ঠান্ডা আবহাওয়ায় ইলিশ বেশি দেখা যায়। শীতের সময় কুয়া (কুয়াশা) বেশি হলে ইলিশ দেখা যায় না। বেশি কুয়াশা পড়লে মাছ গভীর পানির নিচে চলে যায়। সমুদ্র উত্তাল হলে এবং বড় বড় ঢেউ হলে ইলিশ মাছ একেবারেই দেখা যায় না, তারা তখন নিরাপদস্থলে চলে যায়। সমুদ্রে সাত দিন ‘জো’ থাকে, জো-এর সময় সমুদ্র ‘গরম (উত্তাল)’ হয়ে যায়। এ সময় মাছ কম পাওয়া যায়। মাসের ২৮ তারিখ থেকে সমুদ্রের পানি নেমে যেতে থাকে। এই অবস্থাকে ডালা বলে, এটি ৩ থেকে ৭ দিন থাকে। ডালাতেও মাছ পাওয়া যায় না, তবে ইলিশ মাছ কিছু পাওয়া যায়। সমুদ্রে কোনো মিষ্টিপানি নেই, তবে সমুদ্রে এক এক জায়গায় লবণের স্বাদ ও মাত্রা এক এক রকম। তীর থেকে যত গভীরে যাওয়া যায় লবণের মাত্রা তত বাড়ে।
সমুদ্রের তলায় দেশ আছে১১
আমরা সচরাচর স্থলভাগের দেশের কথাই জানি। কিন্তু সমুদ্রেও দেশ আছে, জলের তলার দেশ। সেই দেশেরই নাম আইস্যারা। সাগরের একেবারে মাঝখানে এই দেশ। মেলা দূরের পথ। ওই খানে নানান জায়গার নানান নাম। নীল পানি, সাদা পানি, কালা পানি, মথুরা পানি। ওইখানে কেউ কোনো দিন যেতে পারে না। ওইখানে খোয়াজখিজিরের বাস। খোয়াজখিজির দরিয়ার মাঝে আইস্যারা দেশের মালিক। ওইখানে বড় বড় ছুছুম (ইরাবতী ডলফিন) থাকে। আইস্যারা দেশ পশ্চিম দিকে সমুদ্রের গভীরে জলের তলায়। জেলেরা খুব বেশি ৩০-৪০ বাম যায়, কিন্তু ওই দেশ আরও মেলা দূরে। এক বাম মানে প্রায় সাড়ে তিন হাত গভীর।
একবার সুলেমান বাদশা আইস্যারা দেশে যেতে চেয়েছিল। পুরো দরিয়া সে মাপতে চেয়েছিল। সাত মাস ধরে সে দরিয়াকে মাপতে চায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেও সেখানে থাকতে পারে না। আইস্যারা দেশে দরিয়ার বুকে শোলা ডুবে আর লোহা ভাসে। সুলেমান বাদশা যখন দরিয়ায় যাত্রা শুরু করে তখন প্রচণ্ড ঢেউ ওঠে। ঢেউয়ের ভেতর থেকে একটা বিশাল সাপ মাথা তোলে। সুলেমান বাদশা সাপটিকে ধরার জন্য একটি বড় বড়শি ফালায়। সাপ যখন বড়শি গিলতে উপরে ওঠে হাঁ করে তখন সুলেমান বাদশা সাপের মুখে গরম সিসা ঢেলে দেয়। সাপটি তখন মরে যায় এবং একটি পিলার হয়ে দরিয়ায় দাঁড়িয়ে থাকে। ওই পিলারই দরিয়ার শেষ সীমান্ত। এরপরে আর যাওয়া যায় না। এরপরেই আইস্যারা দেশের শুরু।
কিন্তু সুলেমান বাদশা আবারও যাত্রা শুরু করে। এবার বাদশা একটা দেচরু পাখিকে ধরে উড়িয়ে দেয়। বলে, পাখি তুমি ঘুরে এসে জানাও আইস্যারা দেশটি কত বড়। দেচরু পাখি উড়তে উড়তে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। টানা ছয় মাস ধরে উড়ে উড়ে পাখি এক বিশাল মাছের দাঁড়ার ওপর গিয়ে বসে। মাছ বলে, পাখি তুমি কোথায় যাবে? পাখি বলে, সুলেমান বাদশা আমাকে হুকুম দিয়েছে আইস্যারা দেশ কত বড় তা জানানোর। মাছ বলে, তুমি এক্ষুনি ফেরত যাও। গিয়ে বলো, ওইখানে গেলে কেউ ফেরত আসতে পারে না। ওইখানে গেলেই তুমি মরবে। পাখিটি উড়ে উড়ে আবার ফেরত আসে।
সুলেমান বাদশা তারপর মাছেদের কাছ থেকে আইস্যারা দেশের কথা জানতে মাছেদের জন্য এক বিরাট দোদ (মেলা) করে। নানান জাতের মাছ আসে। চেউয়া, দামবুরুক, ফুলচিরিম, দনদনা ইলিশ, ছুরি, মুছ, পাইপচান্দা, ছুছুম, রূপচান্দা, ফিটকেলা অনেক জাতের মাছ। হঠাত্ সেখানে পানিতে ঢেউ তুলে একটা ইচা মাছ আসে। বিশাল বড় ইচা মাছ। ইচা মাছ সুলেমান বাদশার পুরো মাছের মেলা একাই গিলে ফেলে। ইচা মাছ বলে, তুমি মাছের মেলা করে আইস্যারা দেশের কথা জানতে চেয়েছ, আমি একাই সব খেয়েছি। আরও দিলে আরও খাব। সুলেমান বাদশা তারপর ক্ষান্ত হয় এবং দরিয়া থেকে চলে আসে। আইস্যারা দেশে যাওয়ার স্বপ্ন পূরণ হয় না। তারপর সুলেমান বাদশা আইস্যারা দেশের মালিক খোয়াজখিজিরের নামে একটি কিল্লা বানায়। আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে কলার ভুরায় করে একটি এক রঙের কোড়া (মুরগি) দরিয়ায় ভাসিয়ে দেয় খোয়াজখিজিরের নামে।
দইজ্জ্যা-পরবাস
সমুদ্র অঞ্চল থেকে জেলেরা মাছ ধরতে গেলে প্রায় এক সপ্তাহ থেকে দশ দিন সমুদ্রে থাকে। সমুদ্রকালীন জেলেদের এ সময়টাকে ‘দইজ্জ্যা-পরবাস’ বলে। এ সময় সমুদ্র ও বাড়িতে নানা নিয়ম পালন করতে হয়। সমুদ্রে যাওয়ার সময় কোড়ার (মুরগি) ডিম খাওয়া যায় না। চলর (ছাগল) মাংস খেয়ে যাওয়া যায় না। সমুদ্রে থাকাকালীন সাম্পানে পাকা কলা খাওয়া যায় না এবং কলা খেয়ে যাত্রা করা যায় না। গোসল করে সমুদ্রে যাত্রা করতে হয়। সমুদ্রে যাওয়ার আগে চুল দাঁড়ি কাটা যাবে না, সমুদ্র থেকে ফিরে কাটতে হয়। সমুদ্রে পরবাসে সাধারণত পুরুষেরাই যায়। তবে বরগুনা, পিরোজপুর ও ভোলা অঞ্চলে অনেক পরিবারে নারীরাও পরবাসে নৌকায় থাকে। সমুদ্রে পরবাসকালীন সময়ে সহবাস ও সব ধরনের যৌনকাজ নিষিদ্ধ। বাড়ি থেকে কেউ সমুদ্রে গেলে সেই বাড়ির নারীদের নানা নিয়ম পালন করতে হয়। তারা পরবাসের সময়টাতে মাথায় তেল-সাবান দিতে পারে না। চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়ানো যায় না। কোনো জলাধার থেকে পানি তুলতে গেলে উথালপাথাল শব্দ করে পানি তোলা যায় না। এ সময়টায় ঘর লেপা যায় না। মাটির উনুন থেকে ছাই ও কয়লা বের করে পরিষ্কার করা যায় না। মাথার চুল বেঁধে মাথা ঢেকে রাখতে হয়। এ সময়টায় সুচ দিয়ে কোনো কিছু সেলাই করা যায় না। পরবাসে যাওয়ার জন্য সাম্পান, বোট, টেম্পো ও ট্রলার নৌকা ব্যবহূত হয়। একটি দলে আট থেকে দশজন থাকে। দলের প্রধানকে মাঝি বলে, অন্যদের গইড়/গৌড় বলে। এদের একজন রান্না করে, অন্যরা নৌকা বায় ও জাল টেনে মাছ ধরে। সমুদ্রে যাওয়ার অন্যতম কারণ হলো মাছ ধরতে যাওয়া। কক্সবাজার অঞ্চলে একে বলে ‘জাল মাইত্তো যাইয়ম’। তবে চট্টগ্রাম অঞ্চলের সমুদ্রযাত্রায় একটি নৌকায় ৩০ থেকে ৩৫ জন থাকে। দলপ্রধানকে বলে স্রাং/সারেং, নির্দেশক হিসেবে থাকেন একজন, তাকে বলে গলাইয়া, গলাইয়ার অধীনে ৪ জন বরগুর থাকে, একজন বাবুর্চি এবং বাদবাকি সবাই গাউর বা নাইয়া মানে শ্রমিক।
বছরের প্রথম দরিয়াযাত্রার আগে পাড়ার সবাইকে নিয়ে মুসলিম সমাজে মিলাদ পড়ানো হয় এবং হিন্দুদের মধ্যে পূজা দেওয়া হয়। বছরের প্রথম ধরা মাছ সমুদ্র থেকে ফিরে এসে পাড়ার অনেককে নিয়ে খাওয়া হয় এবং একটা উত্সব তৈরি হয়। দরিয়াযাত্রার সময় মাঝি ঘাট থেকে নৌকা ছাড়ার আগে নৌকার আগায় তিন বালতি পানি ঢেলে নৌকাকে ডানে ঘুরিয়ে তারপর সোজা দক্ষিণ বরাবর নৌকা ছাড়ে। শুক্রবারে সাধারণত দরিয়াযাত্রা করা যায় না। সমুদ্র থেকে সাধারণত বিঙ্গি জাল বা কুড়ি জাল দিয়ে মাছ ধরা হয়, এ ছাড়া আছে বাসা জাল। আগের দিনে দরিয়াযাত্রার আগে প্রবীণেরা সংফুল সুতা দিয়ে জাল বানাত, এখন সেই সুতা নেই। এখন নাইলনের সুতা দিয়ে বানানো জালে মাছ ওঠে কম, মাছ পিছলে যায়। সমুদ্রে থাকাকালে নৌকায় নতুন জাল বানানো যায় না। আকাশে বিজলি চমকালে এবং বজ্রপাত হলে আর সমুদ্রে থাকা যায় না, তখন তীরে এসে উঠতে হয়। একটি সমুদ্রযাত্রার পর মাছ নিয়ে জেলেরা ফিরে আসে তীরে। অধিকাংশ সমুদ্রগামী জেলেই কোনো না কোনো মালিকের অধীনে একজন ‘দাসশ্রমিক’ হিসেবে কাজ করে। আগাম মজুরি বিক্রি করে সমুদ্রে নামতে হয় এবং ধৃত মাছের মজুত মালিকের জিম্মায় ঢেলে দিতে হয়। একটি সমুদ্রযাত্রা থেকে আরেক যাত্রায় যাওয়ার আগে ৭ থেকে ১০ দিনের একটি বিরতি থাকে। তখন জাল ও নৌকা মেরামত করতে হয়। বাইজ্জ্যা বাঁশ দিয়ে বানানো দাইস্যা ও টবিল নামের সুই দিয়ে মাছ ধরার জালগুলো সারানো হয়।
পরবাস থেকেই হয়তো পরবাসী ও প্রবাসী ধারণাটি তৈরি হয়েছে। তবে জলের ওপর জীবিকার প্রয়োজনে সাময়িক অবস্থানই পরবাস। এটি জলজীবন নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর উত্পাদনসম্পর্কের এক নিজস্ব মাত্রা। তবে মাঙতা-বেদেদের ভেতর বহর নিয়ে নদী থেকে নদীতে সাময়িক স্থানান্তরও ‘পরবাস’ নামেই প্রচলিত।
চন্দ্রগ্রহণ ও সূর্যগ্রহণের সময় সমুদ্রে থাকা যায় না। এ সময় সমুদ্র থেকে তীরের কাছাকাছি চলে আসতে হয়। গ্রহণের সময় সমুদ্রে মাছ ধরা নিষেধ এবং তখন কোনো আহার পর্যন্ত গ্রহণ করা যায় না। গ্রহণের সময় নৌকায় কোনো মাছ বা কোনো কিছু লাফিয়ে উঠলে তা খুব নিরাপদে আবার সমুদ্রের পানিতে ছেড়ে দিতে হয়।
সমুদ্রে দিকনির্ণয়
সমুদ্রে দিকনির্ণয় বহুচর্চার বিজ্ঞান। সমুদ্র অঞ্চলের মানুষেরা শৈশব থেকে প্রবীণ বয়স সারা জীবন এ বিজ্ঞান রপ্ত করে চলে। তবে এই দিকনির্ণয়ের জন্য প্রায় অঞ্চলেই দক্ষ লোক থাকেন। যাঁদের বিশেষভাবে কদর হয় সমুদ্রযাত্রায়। মূলত আকাশের তারা দেখেই দিক নির্ণয় করা হয়। এ ছাড়া বাতাসের গতি ও বেগ, কখনো চারপাশের গন্ধ, পাখির আচরণ ও মাছের বিচরণ, মেঘের ধরন, পানির স্রোত ও বর্ণ-গন্ধ এসব থেকেও দিক সম্পর্কে কিছু ধারণা করা যায়। সমুদ্রগামী জেলেরা বংশপরম্পরায় বিশ্বাস করেন সূর্য পূর্ব দিকে ওঠে এবং পশ্চিমে ডুবে যায়। সূর্য ওঠা মানে দিনের শুরু এবং ডুবে যাওয়া মানে রাতের শুরু। সূর্য সব সময়ের জন্য আকাশে থাকে, কিন্তু চাঁদ ১৫ দিন ঘুমিয়ে থাকে এবং ১৫ দিন জেগে থাকে। চাঁদের নির্ঘুম রাতকে পূর্ণিমা বলে এবং তখন সমুদ্রে যৌবনতরঙ্গ বয়। এ সময় পূর্ব থেকে দক্ষিণে বাতাস বইলে সমুদ্র উত্তাল হয়ে ঝড়-জলোচ্ছ্বাস হওয়ার আশঙ্কা থাকে। সূর্য সব সময় গোল থালার মতো হয়, কিন্তু চাঁদের আকার ভিন্ন ভিন্ন হয়। কখনো গোল, কখনো বাঁকা এবং কখনো অর্ধেক। সূর্য ও চাঁদ গোল থালার মতো হলেও তারাগুলো দেখতে ফালি ফালি করা কামরাঙা ফলের মতো। একটি তারার পাঁচটি আঙুল থাকে। তারাদের জন্ম ও মৃত্যু আছে। মাঝে মাঝেই মৃত তারারা আকাশ থেকে পড়ে যায়। তারাদের মৃতদেহ সমুদ্রের পানিতে মিশে যায়। সমুদ্রগামী জেলেরা অধিকাংশ সময়ই তারার অবস্থান দেখে মূলত পূর্বদিককে চিহ্নিত করে। ওলা তারা, সাত বইন সুরতি তারা এবং ডিঙ্গি তারার অবস্থান পূর্ব দিকে। রাতের আকাশে এই তারাদের দেখে তারা পূর্ব দিককে চিনতে পারে। পূর্ব দিক চিনলেই বাকি দিকগুলো চেনা হয়ে যায়। পূর্বের উল্টোদিক পশ্চিম, পূর্বের ডান দিক দক্ষিণ এবং বাম দিক উত্তর। তবে কুয়াশাচ্ছন্ন ও মেঘলা দিনে তারা দেখা যায় না, তখন বাতাসের গতিভাব দেখে দিক নির্ণয় করা হয়। শরীরে বাতাসের অনুভব করেই দিক নির্ণয় করা যায়। কক্সবাজারের সমুদ্রগামী জেলেদের ভাষ্য, সমুদ্রে থাকাকালীন কোনো বাতাস যদি শরীরে লেগে ‘উটাল মারে (ডিগবাজি খেয়ে একধরনের শিহরণ তৈরি করে)’ তবে বুঝতে হবে সেই বাতাস দক্ষিণ থেকে বইছে। উত্তর দিক থেকে আসা বাতাস শরীরে লাগলে শরীর জুড়িয়ে যায়, শরীর ঠান্ডা হয় এবং খুব আরাম লাগে। পূর্ব দিক থেকে আসা বাতাসকে জেলেরা ‘নূরানী বাতাস’ বলে, এই বাতাস সচরাচর ভোর থেকে সকালের দিকে বয় এবং খুব আস্তে ধীরে। পশ্চিম দিক থেকে আসা বাতাস গভীর সমুদ্র থেকে মাছেদের টেনে তীরের কাছাকাছি কম গভীরতায় নিয়ে আসে। কিন্তু উত্তর দিকের বাতাসের ফলে মাছেরা আবার উত্তর স্রোতের মাধ্যমে গভীর সমুদ্রে চলে যায়।
সমুদ্রের প্রাণ ও বৈচিত্র্য
কক্সবাজার, সুন্দরবন, চট্টগ্রাম অঞ্চলের সমুদ্রগামী জেলেদের ভাষ্য, গত ১০০ বছরে মাছেদের বিচরণস্থল ও বংশবিস্তার পাল্টে গেছে। অনেক মাছ খুব কম দেখা যাচ্ছে। সমুদ্র গভীরতায় মাছেদের বসতিস্থলও বদলে গেছে। পাইপচান্দা, পোকা, ছুরি, মুছ, রাঙাছই, গমদানা বা দনদনা ইলিশ, বোল, জৈর, করুল, রাচৈর, কালাকইল্যা, তেইল্যা, সিরসিরি, কাউয়া ইছা, উলাইল্যা, চাগা, টুইন্যা, খইরতা, বিষকৈ, বাড়া, হরুম, বিছাতারা, মুড় বাইল্যা, ছিরিং, লাকউয়া, লামপুকা, ফইল, উন্দরা, গুয়ারা, চান্দিকাঁটা, তেইল্যা, নারকেলি, পাঙাশ এসব মাছ বর্তমানে অনেক কম দেখা যায়। তবে চট্টগ্রামের সমুদ্রগামী জেলেরা জানালেন রূপচান্দা, কাউয়া, বোমমাইটা, মাইট্টা, তবল, পেটবাজানি, লেদরা, বরা, পাগলা, হাছিনা, লাল, মুছ, কাটা, কালপোয়া, পুগা, সোনালি, লগা মাছ এখন সমুদ্রে কম দেখা যায়। চট্টগ্রামের আনোয়ারা ও বাঁশখালী অঞ্চলের সমুদ্রগামী জেলেরা ইলিশকে ‘ইলিম’ বলেন। কক্সবাজারের তঞ্চংগ্যারা ইলিশকে বলে ‘নাহলং মাত’। মিয়ানমার থেকে উচ্ছেদ হওয়া রোহিঙ্গারা ইলিশকে বলে ‘ঙা জুলুক’। কক্সবাজারের সমুদ্রগামী জেলেরা পুইট্টা, গমদানা বা দনদনা ও জাতি ইলিশ এভাবে তিন জাতের ইলিশ ভাগ করেন। তাঁদের মতে, দনদনা বা গমদানা ইলিশ সমুদ্রের সবচেয়ে সুন্দর ইলিশ। এই মাছ না নারী না পুরুষ। খেতে স্বাদ কম। পেটে কোনো ডিম হয় না। শরীরে খুব গন্ধ হয়। বর্ষায় এই মাছ খুব পাওয়া যেত। দনদনা ইলিশ কখনোই একা চলাফেরা করে না। এদের সঙ্গে থাকে খইপুড়ি মাছ। সমুদ্রে জন্মানো উদ্ভিদ নিয়ে তেমন একটা হদিস রাখেন না সমুদ্রগামী জেলেরা। তবে সমুদ্রতটে জন্মানো গুল্মলতাগুলো স্থানীয়দের নানা কাজে লাগে। সমুদ্রের বালিয়াড়িতে মিউন্দ্যা হয় খুব, এর পাতা জ্বর সারাতে ও মুখে রুচি বাড়াতে কাজে লাগে। ইয়ানচি ফল, ছলেলাইদ্যা গুলা ফল খাওয়া যায়। কেউরগা গুলা, ছুনে গুলা, শিউলিগুলা, গাকগুলা, কেয়াড়াগুলা, উন্দুরাগুলা, চরকিগুলা, সুগুলা ও গুরুপ ফল ভেসে আসে স্রোতে। পরবাসকালীন এসব ফল জালে ধরে খায় সমুদ্রগামী জেলেরা। সমুদ্রের তীরজুড়ে থাকা লাল কেয়ারা (লাল কাঁকড়া) এখন কমে যাচ্ছে। ভাদ্র মাসে আগে তঞ্চংগ্যারা এই কাঁকড়া খেত, এখন তেমন দেখা যাচ্ছে না। সমুদ্রের তীরে জন্মানো বিউকাঁটা (হরগোজা) ফুল দিয়ে স্থানীয় রাখাইন ও বাঙালি হিন্দুরা পূজা করে।
সমুদ্র অববাহিকা ও তীর জন্ম দিয়েছে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ কৃষি আবাদের। পটুয়াখালীর সমুদ্রতীর ক্যানছাই চুয়ানে (কুয়াকাটায়) একসময় রাখাইনরা জুম আবাদ করত। কক্সবাজার অঞ্চলে সমুদ্র লাগোয়া ঢেউখেলানো ধাপ ধাপ স্তরের জমিনকে স্থানীয়ভাবে বলে পোয়াইন্যা জমি। এ ধরনের জমি বরেন্দ্র অঞ্চল থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। পোয়াইন্যার জমির উপরের অংশকে বলে পিউক এবং তারপর পাহাড়। কক্সবাজারের টেকনাফ অঞ্চলের তঞ্চংগ্যারা আগে গিলাতইল্যা মুড়া, মগরশিয়া ও কাট্টলখাইয়াতে জুম আবাদ করত। কট্টমনি, আমে, টুই, গ্যাল্লং, রাঙা খবক, নাইজইল্যা বিনি, কালাবিনি এসব ধান জুমে হতো। পোয়াইন্যা জমিনে সমুদ্র উপকূলীয় বাঙালি পরিবার আগে চাষ করত বৈলাম, লম্বরু, কষ্টমনি, বিনি, জটাবেতি, লাড়ুম, গিরিং, কদমণি, চীনাগুরুম, আশাইল, পাইজাত, ছোট পাইজাত ধানের জাত। গেতু, আসাইল, লাটুম ছিল আউশ জাত। উল্লিখিত ধান জাতের আবাদ এখন উঠে গেছে।
দুনিয়ার বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ অরণ্য সুন্দরবনের টিকে থাকার বিজ্ঞান সমুদ্রকে ঘিরে। সমুদ্র উপকূলেই দেশের গর্জন মাতৃবৃক্ষের শেষ অরণ্যস্থল। হাতি থেকে কাঁকড়াভুক প্যারাইল্ল্যা বানর সমুদ্র উপকূলীয় বনগুলোকে করেছে বৈশিষ্ট্যময়।
সমুদ্র কৃত্য
ক্ষীরসাগরে ক্ষীরের ঢেউ ঢল ঢল করে
লক্ষ হাজার পদ্মফুল ফুটে আছে থরে।
ঢেউ থই থই সোনার কমল, তারি মাঝে কি?
দুধের বরণ হাতির মাথে গজমোতি।
(দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের ঠাকুরমার ঝুলি নামের রূপকথা সংকলনের দুধের সাগর অংশে একটি রূপকথার নাম শীতবসন্ত। এই পদ্যখানি শীতবসন্ত থেকে নেওয়া)
সমুদ্রগামী জেলেরা বিশ্বাস করে সমুদ্রের রক্ষাকবচ মা গঙ্গা ও খোয়াজখিজির। গঙ্গার নাম একভাবে উচ্চারিত হলেও, বঙ্গোপসাগরের নানা অংশে খোয়াজখিজিরের নামের উচ্চারণে ভিন্নতা দেখা যায়। খোয়াজখিজির, খোয়াস খিতি, সোয়াস খিতি, খুয়াজ খিতির, খিজিরে সালাম, গাজী কালু এ রকম নামগুলো পাওয়া গেছে। সমুদ্রগামী জেলেরা বিশ্বাস করে পানিতে খোয়াজখিজিরই পানির সব জীবকে রক্ষা করে, এমনকি সমুদ্রগামী জেলেদেরও। মূলত বাংলা ভাদ্র মাসে খোয়াজখিজিরের নামে শিরনি দেওয়া হয় এবং বেড়া ভাসানো হয়। আষাঢ়-শ্রাবণ এ দুই মাস সমুদ্রে যাওয়া বারণ, তখন খোয়াজখিজির সমুদ্র থেকে উঠে আল্লাহর কাছে সওয়াল জবাবের জন্য চলে যায়। তখনই সাগর উত্তাল হয়ে ওঠে। খোয়াজখিজির আবার সমুদ্রে ফিরে এলে সমুদ্রে নামে জেলেরা। সমুদ্রে পূর্ব দিকে পাহাড়ে মোহাম্মদ হানিফার টং, তার ঠিক পশ্চিমে নাফ নদী ও সমুদ্রের মিলনস্থলে একটি মসজিদ আছে। ওইখানেই বিশ্রাম নেন খোয়াজখিজির। সমুদ্রগামী জেলেরা এখানে নামাজ পড়েন। এখান থেকে কখনোই মাছ ধরা হয় না। কখনো কখনো গভীর সমুদ্রে ‘গায়েবি আজান’ ও ‘শঙ্খধ্বনি’ শোনা যায়। তখন মাছ ধরা বন্ধ রেখে জেলেরা খোয়াজখিজির ও মা গঙ্গার কাছে প্রার্থনা করেন। খোয়াজখিজিরের নামে মানস (মানত) করা হয়। লাল রঙের কোড়া (মুরগি) মাটির হাঁড়িতে ভরে কলার ভুরায় (ভেলা) সমুদ্রের পানিতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়।
সমুদ্রগামী জেলেরা বিশ্বাস করে সমুদ্রে জিনও থাকে। এই জিনের নাম জেইক্ক। এই জিন যাকে নজর দেয় তার পেছন ছাড়ে না, এর শক্তি বেশি। এ ছাড়া সমুদ্রে থাকে মাচ্ছাদেইও। এরা সমুদ্রে জেলেদের কাছে মাছ চায়, মাছ দিলে কোনো ক্ষতি করে না। না দিলে নৌকা ডুবিয়ে দেয়। তবে চট্টগ্রামের সমুদ্রগামী জেলেরা মনে করেন সমুদ্রে বসবাস করে ‘কাল’। এই কাল খুবই ভয়ংকর, সবাই ভয় পান। তাই কালের নামে সমুদ্রগামী জেলেরা ফাতিহা পাঠ করেন এবং মানস (মানত) করেন।
সমুদ্রে অনেক সময় কোনো কোনো মাছ এমনিতেই লাফিয়ে নৌকায় উঠে আসে। সেই মাছ যত্নে তুলে আবার পানিতে ছেড়ে দিতে হয়। জেলেদের বিশ্বাস খোয়াজখিজির তার কোনো সঙ্গীকে এভাবে মাছের রূপ ধরে পাঠিয়ে জেলেদের লোভ পরীক্ষা করতে চায়। শুধু জালে যেসব মাছ ওঠে তাই জেলেরা সংগ্রহ করেন। তবে সব ধরনের মাছ বাঙালি মুসলিম জেলেরা খায় না। তারা ছুছুম, মুতরা ইছা, দামবুরুক ও চেউয়া মাছ খায় না। কক্সবাজারের মহেশখালীতে বাঁকখালীর টেক বা নাজিরাটেকের মাথার কাছে সমুদ্র ও নদীর মিলিত প্রবাহস্থলে সমুদ্রগামী জেলেরা সমুদ্রে নামার আগে ফুল, চাল, ফলফলাদি উত্সর্গ করেন।
সুন্দরবনের সমুদ্র-রাস
জলপ্রবাহের নানা প্রান্তে নানা স্রোতে নানা নাম, নানা আচার। দীর্ঘ বঙ্গোপসাগরের সব অংশও রূপে ও চর্চায় ভিন্ন ভিন্ন। বিস্তৃত সমুদ্রও কোথাও কোথাও পেয়েছে ‘পবিত্রস্থলের’ আখ্যা। দক্ষিণাঞ্চলের সুন্দরবনের দুবলারচরের সমুদ্রতট এমনি এক আরাধনার থান। প্রতিবছর রাসপূর্ণিমা তিথিতে সমুদ্রস্নানের মানতে মানুষে মানুষে ভরে ওঠে সৈকত। সুন্দরবনের দুবলারচরে রাসমেলা আয়োজনের শুরুর কাহিনিগুলো খুব একটা জানা না গেলেও এখানকার রাসেও স্থানীয় বনজীবীদের নিজস্ব বিশ্বাস ও রীতি-রেওয়াজই প্রাধান্য পেয়েছে। খুলনা, সাতক্ষীরা, শরণখোলা ও চাঁদপাই রেঞ্জের ভেতর বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলা ও সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের শরণখোলা রেঞ্জে প্রায় আটটি কাছাকাছি চর নিয়ে দুবলারচর। দুবলারচরের প্রায় আটটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপচরের পঁচিশটি এলাকায় প্রায় ২০ হাজার মৌসুমি জেলে মাছ ও কাঁকড়া ধরার জন্য অক্টোবর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত গোল-গরানের মাচাঘর তৈরি করে বসবাস করে। সুন্দরবনের রাসমেলার মূল আনন্দের অংশীদার এরাই। দুবলারচরে রাস উত্সবের মূল প্রাণ সাগর সঙ্গমে রাসস্নান। রাস স্নানের সঙ্গে জমে ওঠে মেলা, কীর্তন গান এবং পূজা। আছে মানতকারীদের মানত উত্সর্গ করার বৈচিত্র্যময় আচাররীতি। সাধারণত পরিবার বা গ্রামভিত্তিক এক একটি বড় নৌকায় দুই থেকে চার দিনের জলপথ পাড়ি দিয়ে দুবলারচরের রাসমেলাতে পৌঁছাতে হয়। খাওয়াদাওয়া, রান্নাবান্না, ঘুম, গানবাজনা সবই নৌকাতে করতে হয়।
তিথি অনুযায়ী রাসে আগত মানতকারী ও তীর্থযাত্রীরা সাগরের কিনারে ঠায় বসে মাঝরাত থেকেই অপেক্ষা করে। পুণ্যতিথির সঙ্গে সঙ্গে স্নান শুরু হয়, কেউ কেউ পিণ্ডদান করতে বসে পড়েন। কেউ কেউ মানত উত্সর্গ করেন। মানতের পাঁঠা-মুরগি-কবুতর সাগরের জলে ছেড়ে দেওয়া হয়। পরে এগুলো জল থেকে তুলে বনের কিনারে ছেড়ে দেওয়া হয়, আবার অনেকে খাওয়ার জন্যও নিয়ে যান।
রাস স্নানের আগের দিন শিবঠাকুর ও গঙ্গাদেবীর পূজা দিয়ে রাসের পূজা শুরু হয় আলোরকোলে। সন্ধ্যায় বনবিবির পূজা হয়। রাতে চম্পকলতা, বিশখা, বুড়িমা, বৃন্দী, রাধা-কৃষ্ণ, ললিতা, চন্দ্রাবলী, ইন্দুরেখা, তুঙ্গবিদ্যা, গাজী, কালু ও মত্স্যদেবীর পূজা হয়। রাসমন্দিরে বনবিবি, কালু, গাজীদের সঙ্গে রাধাকৃষ্ণের অষ্টসখী যেমন: বৃন্দী, ললিতা, চন্দ্রাবলী, ইন্দুরেখা, তুঙ্গ-বিদ্যা, বিশখা, চম্পককলা ও বুড়িমার পূজার চল কয়েক বছর হলো শুরু হয়েছে। আগে এখানে রাস উত্সবে বনবিবি-গাজী-কালু ও রাধাকৃষ্ণের পূজা হতো। আগে এখানে কেবল বনবিবির পূজা হতো রাতের বেলায় আর ভোরে স্নান করে সবাই চলে যেত। এখন রাস উত্সবে রাতের বেলা আলোরকোলে রাসপ্রাঙ্গণে জমে ওঠে রাসলীলাকীর্তন।
রক্তলাগা লবণফুল১২
সূর্য ওঠেরে তেজমারি
ও ভাই লবণ বসেরে ফুলকুটি
দল পুইজ্জা উঠিলাম মাঠে যাই
পূবালী বাতাসন লাগে আঁঁরার গায়
সে বাতাসে কত আরাম আঁঁরা পায়,
আরো কত শান্তি লাগে—
লবণ বেচি টাকা লইলে হাতে১৩।।
(লবণ চাষের গান, লবণচাষি সম্প্রদায় বই থেকে গানটির অংশবিশেষ উল্লেখ করা হলো)
মৌলঙ্গী সম্প্রদায় সমুদ্রজল থেকে লবণ উত্পাদনের বিজ্ঞান উপহার দিয়েছিলেন দুনিয়াকে। যেন সমুদ্রের তরতাজা স্বাদ আর ঝাঁঝ লেগে থাকে যাপিত জীবনের প্রতিটি ক্ষণে। এক দানা লবণ যেন এক দানা সমুদ্রের বিস্তার। এভাবেই নানা ব্যঞ্জনার সমুদ্রস্মৃতিগুলো এক করেছে লবণ। অধিপতি ইতিহাস মৌলঙ্গীদের অস্বীকার করে দুমড়েমুচড়ে তৈরি করেছে করপোরেট লবণ-বাণিজ্যের মারদাঙ্গা বাজার। সুন্দরবন ও সমুদ্র উপকূলে সমুদ্রের পানি জাল দিয়ে লবণ বানাতেন মৌলঙ্গীরা। বর্তমানে ওই পদ্ধতি নেই, বলা ভালো জোর করে তা রুদ্ধ করা হয়েছে। ব্রিটিশ উপনিবেশকালে লবণ উত্পাদনে নিষেধাজ্ঞা১৪ আনা হয়, তখনো গোপনে মৌলঙ্গীরা লবণ বানাতেন। এমনও তথ্য১৫ আছে প্রতিবছর সন্দ্বীপ থেকে ২০০ জাহাজ লবণের চালান যেত ইউরোপে। লবণ এমনই গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য পণ্য হয়ে ওঠে যে লবণ থেকেই ‘বেতন’ কথাটির জন্ম হয়১৬। ব্রিটিশ শাসকেরা লবণকে নিজেদের জিম্মায় নিয়ে যায়। ১৯৩০ সালে মহাত্মা গান্ধী লবণ আইন অমান্য করে আন্দোলন শুরু করেন। পাকিস্তান আমলে লবণ উত্পাদনের ওপর ধার্য করা হয় উচ্চ কর। ১৯৬০ সালে ৪০ সের লবণের দাম ছিল ১ টাকা। কিন্তু ১৯৬১ সালে হঠাত্ লবণের দাম বেড়ে যায়। একটি দেশলাই বাক্সের খোলের ভেতর যতটুকু লবণ ধরে ততটুকু লবণের দাম হয়েছিল ৪ আনা। ১৯৭১ সালে ১ মণ লবণের দাম হয় ৪০০ টাকা।
জোয়ারের পানি জমিতে আটকে প্রায় সাতটি পর্বে লবণদানা তৈরি হয়। অগ্রহায়ণ মাস থেকে শুরু হয় লবণ মৌসুম, শেষ হয় বৈশাখে। আয়োডিন অভাবজনিত রোগ প্রতিরোধ আইন ১৯৮৯ অনুসারে, তৈরি প্যাকেট ব্যাতীত কোনো ব্যক্তি অন্য কোনো প্রকারে ভোজ্য লবণ বিক্রয়, গুদামজাত, বিতরণ ও প্রদর্শন করতে পারবে না। আইন লঙ্ঘন করলে তিন বছরের কারাদণ্ড বা পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে। পৃথিবীর আর কোনো দেশে আইন করে লবণে আয়োডিন মিশিয়ে খাওয়ানোর নজির নেই১৭। সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চল থেকে গ্রামীণ জনগণের ঐতিহাসিক লবণ উত্পাদনের অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে। পাশাপাশি সমুদ্র উপকূলীয় কৃষিজমিগুলো প্রায় জোর করে দখল করে নিচ্ছে শহর থেকে আসা লবণ কোম্পানিরা। কৃষিজমি হারিয়ে অনেকেই দিনমজুরি এবং অনেকে দরিয়ার জেলে বা শহরের পথে প্রতিদিন নিরুদ্দেশ হচ্ছে। আগে টেকনাফের শাহপরীতে সব ছিল চাষের জমি, এখন সব নোনার মাঠ। এত লবণ যে কেডায় খায় ন বুঝি। এই নোনার মাঠের জন্যই আমাদের সব দুঃখ১৮। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে উপকূলীয় অঞ্চলে যে প্রশ্নহীনভাবে করপোরেট লবণ-বাণিজ্য শুরু হয়েছে তা কিন্তু স্থানীয় খাদ্য সুরক্ষাকেই আঘাত করছে যে তা নয়, একই সঙ্গে তা মিয়ানমার থেকে আসা রাজনৈতিক শরণার্থী রোহিঙ্গাদের সঙ্গেও সংঘর্ষমূলক পরিস্থিতি তৈরি করছে।
অংশেংথা ম্রো ও হলুদ ফুলের দেশ১৯
দেশের সমুদ্র উপকূলের আদি বাসিন্দা রাখাইনদের ভাষায় সমুদ্র উপকূলের প্রায় জায়গারই একটি রাখাইন নাম আছে। ক্যানছাই-চুয়ান মানে কুয়াকাটা, ঠিক তেমনই রামুকে রাখাইন ভাষায় বলে প্যাঙ-ওয়া মানে হলদে ফুল। একসময় রামু আরাকানের প্রাদেশিক রাজধানী ছিল। আবুল কাশেম তাঁর রামুর ইতিহাস বইতে লিখেছেন, গৌতম বুদ্ধ রাজা চানসুরিয়ার আমলে সেবক আনন্দকে নিয়ে ধান্যবতীর এক ধর্মসম্মেলনে আনন্দকে বলেছিলেন ভবিষ্যতে পশ্চিম সমুদ্রের পূর্ব উপকূলে গৌতম বুদ্ধের বক্ষাস্থি স্থাপিত হবে। তখন এর নাম হবে রাং-উ মানে বুকের হাড়। অনেকে মনে করেন বর্মী শব্দ ‘রাং-উ’ থেকেই এই রামু নামের উত্পত্তি। সম্প্রতি আক্রান্ত রামুকে অনেকে বলছেন এককালের প্রাচীন মগধ রাজ্যের অংশ, যেখানে বাংলা অঞ্চলের বৌদ্ধ সংস্কৃতি ও রাখাইন বৌদ্ধ সংস্কৃতির এক মিশ্রণ ঘটেছে। রাখাইনরা এ অঞ্চলের সভ্যতার আদি কারিগর হলেও নানান কারণে এখানে রাখাইনরা উদ্বাস্তু ও নিরুদ্দেশ হয়েছেন। রামুর জোয়ারিনালা ইউনিয়নে একসময় এক সমৃদ্ধ রাখাইন গ্রাম ছিল ছেঃঘ্রি, এখন এই গ্রামের নাম মাছুয়াখালী ধলীরছড়া। এখানে এখন কোনো রাখাইন বসতি নেই। ঠিক তেমনি এক রাখাইন জনপদের নাম তংছাওয়ারা, এটিও জোয়ারিনালা ইউনিয়নেই। এখন আর এখানে কোনো রাখাইন বসতি নেই।
১৬৩৮ খ্রিষ্টাব্দে আরাকান রাজা সুধম্মার মৃত্যুর পর রাজ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। রাজপুত্র ঙা থ্যেং খাইন আরাকান থেকে পালিয়ে অরণ্যে আশ্রয় নেয়। পরিবারের অন্য সদস্যরা চট্টগ্রামের ক্যানথায় চলে আসে। আরাকানের এক মন্ত্রী ঙা লাত্ রুং বিশাল সৈন্যবহর নিয়ে চট্টগ্রামে আসেন। তিনি বৌদ্ধ ভিক্ষু হয়ে অগ্গামেধাবী নাম ধারণ করেন এবং বাঘোলি (বাঁকখালী) নদীর তীরে অংশেংথা নাম নিয়ে জনবসতি গড়ে তোলেন। অংশেংথা মানে সমৃদ্ধ শান্তিময় নগর। ১৭৯৪ সালের দিকে ক্যাপ্টেন হিরাম কক্স অংশেংথা গ্রামে উপনিবেশ স্থাপন করেন এবং রাখাইনরা তাঁর নামে গ্রামের নতুন নাম দেয় ‘ফালংশেই বা ফালংঝেই ম্রো’ মানে অধিকর্তা বা অফিসারের বাজার। সেখান থেকেই নাম হয়ে যায় কক্স সাহেবের বাজার ‘কক্সবাজার’। কক্সবাজারের চৌফলদণ্ডীর রাখাইন নাম ছ-লি-গ্যা, ভারুয়াখালীর নাম লে-ছং-র, পানেরছড়ার নাম ন-রৌ-তং, মহেশখালীর নাম মাহাঝো, পটুয়াখালীর খেপুপাড়ার নাম শেং-ফ্রু-র।
সমুদ্রের সঙ্গে রাখাইনদের ঐতিহাসিক সম্পর্ককে কখনোই ন্যায়বিচার করা হয়নি। এই জনপদ বাংলাদেশকে লবণ, পান, নাপ্পি্, শুঁটকি আর মাছ দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে। কিন্তু রাষ্ট্র এই সমুদ্র উপকূলের আদিবাসী জীবন ও বৌদ্ধসভ্যতাকে অস্বীকার করে চলেছে। বঙ্গোপসাগরের ব্যাকরণ বুঝতে রাখাইন সমুদ্র জীবনের আপন বিকাশ জরুরি।
মসলিন, মৌলঙ্গী ও ‘নীল অর্থনীতি’
চলতি আলাপটি সমুদ্রের কাছে চলে এসেছে। আর কাছে এসেই সমুদ্র ঘিরে ঔপনিবেশিক মারদাঙ্গা আর নয়াউদারবাদী বাহাদুরির জখম দেখতে পাচ্ছে। আলাপটি মসলিন, নীল, গাঁজা, পাট হয়ে সমুদ্রের লবণের ভেতর এক মিল খুঁজে পাচ্ছে। এদের সবাইকেই পাড়ি দিতে হয়েছে এক দীর্ঘ ঔপনিবেশিক ক্ষত আর অন্যায়। কারণ এরা সবাই এই জনপদের অবিস্মরণীয় ভৌগোলিক নির্দেশনা। এই জনপদ দুনিয়াকে এসব উপহার দিয়েছে। মসলিন, নীল, গাঁজা, পাট আর লবণের উত্পাদন, প্রক্রিয়া ও কারিগরি এখানেই জন্ম নিয়েছে। দীর্ঘ ঔপনিবেশিকতা এসবকে ছিনিয়ে নিয়েছে। মসলিন তাঁতিদের কবজি কেটেছে, মৌলঙ্গীদের লবণ তৈরি নিষিদ্ধ করেছে। সম্পদ ও জ্ঞানের ওপর নিম্নবর্গের সার্বভৌমত্ব খারিজ করে দিয়ে তৈরি করেছে একতরফা নিয়ন্ত্রিত বাজার।
সমুদ্র আজ নিজেই নয়াউদারবাদী যন্ত্রণায় কাতর। সমুদ্রগামী জেলেদের ভাষ্য, সমুদ্রতল দিনে দিনে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। কক্সবাজারের সমুদ্রগামী মধ্যবয়স্ক জেলেদের ভাষ্য, সমুদ্রে পানি বাড়ছে না, দিনে দিনে সমুদ্রের পানি কমছে। অনেকে এই পানি কমে যাওয়াকে সমুদ্রের গভীরতা কমে যাওয়া হিসেবে ব্যাখা করেন। তাদের অভিজ্ঞতায় ১৯৬০ সালের দিকে এই গভীরতা ১৫০ থেকে ২০০ বাম ছিল। পরবর্তী সময়ে এই গভীরতা কমতে কমতে বর্তমানে এই গভীরতা ৫ থেকে ৪০ বামে এসে দাঁড়িয়েছে। ১৯৮০ সালের দিকেও সমুদ্রগামী জেলেরা ১৪ থেকে ২০ বাম থেকে মাছ ধরতেন, কিন্তু চলতি সময়ে ৫ থেকে ৭ বামেই মাছ ধরা হয়। পাশাপাশি সমুদ্র আজ নানা রাসায়নিক বর্জ্য, তেল আর প্লাস্টিক দূষণে অস্থির। ষাটের দশকে চালু হওয়া তথাকথিত ‘সবুজ বিপ্লবের’ ধাক্কায় কৃষি জমিনে ব্যবহূত রাসায়নিক বিষের তলানি জমা হচ্ছে সমুদ্রতলেই। দুনিয়াজুড়েই সমুদ্র আর বর্জ্যের ভাগাড়। তেল-গ্যাস খননের আওতা থেকেও মুক্ত নয় বঙ্গোপসাগর। সোনাদিয়ায় প্রস্তাবিত গভীর সমুদ্রবন্দর নিয়ে তর্ক উঠেছে। বাগেরহাটে সুন্দরবনে রামপাল তাপবিদ্যুত্ প্রকল্পের দূষণ-বর্জ্যের যন্ত্রণাও সইতে হবে সমুদ্রকেই। সমুদ্র-দ্বীপগুলোর কোনো সুরক্ষাই আজ নিশ্চিত নয়। সমুদ্র উপকূলের অরণ্য ও পাহাড়ে পড়েছে করপোরেট বাণিজ্য কোপ। একের পর এক পাহাড় ধসে পড়ছে সমুদ্র উপকূল অঞ্চলে। ২০০০ সালের ১৭ আগস্ট প্রভাবশালীদের নির্বিচার পাহাড় দখল ও কাটার ফলে কক্সবাজারের বৈদ্যেরঘোনা পাহাড়ে অবস্থিত শত বছরের প্রাচীন বৌদ্ধ প্যাগোডাটি ধসে পড়ে এবং প্রায় ১২ জন আহত হয়২০। কক্সবাজারের সমুদ্র উপকূলের পাহাড়টিলা জঙ্গল পুরোটাই আজ বাণিজ্যিক পর্যটনের দখলে। লাগাতার হোটেল আর বাণিজ্যিক বসতি তৈরি করে সমুদ্র-পাহাড়ের জটিল বাস্তুসংস্থান চুরমার করে দেওয়া হচ্ছে। আর এই দখলদারদের সঙ্গে সমুদ্রের কোনো জন্মসম্পর্ক কি রক্তসম্পর্ক নেই। এরা একেবারেই বহিরাগত প্রভাবশালী অন্যায় কারবারি।
সমুদ্রে লাগাতার রাসায়নিক ও তেল-দূষণের কোনো নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিকার নেই। বাগেরহাটের মংলায় দেশের এক গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য বন্দর। এ বন্দরের কাছাকাছি ১৯৮৮ সালের ১ জুলাই তেল কার্গো ফুটো হয়ে সুন্দরবনে ডিজেল ছড়িয়ে পড়ে এবং একই সালের ১০ আগস্ট সুন্দরবনের মাজহার পয়েন্টে ট্যাংক সংঘর্ষে উচ্চমাত্রার সালফারযুক্ত তেলে ছড়িয়ে যায় সুন্দরবনে। ১৯৯৪ সালের আগস্টে মংলা বন্দরগামী একটি বিদেশি জাহাজ সুন্দরবনের পাশে বানীশান্তায় ডুবে যায় এবং ভাটিতে ২০ কিলোমিটার এলাকায় তেল ছড়িয়ে পড়ে (সূত্র: পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন, ২০০২)। ২০১৪ সালের ৯ ডিসেম্বর সুন্দরবন বন বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের মৃগমারী এলাকায় ‘এমটি সাউদার্ন স্টার-৭’ নামের এক কার্গোবোট ডুবে ৩ লাখ ৫৭ হাজার ৬৬৪ লিটার ফার্নেস তেল ছড়িয়ে পড়ে শ্যালা নদীসহ চাঁদপাই রেঞ্জের প্রায় ২০টি খাল, দুটি ভাড়ানী ও বন স্তরে। ২০১৩ সালের ৩১ জুলাই চট্টগ্রামের দোহাজারীর কালুরঘাটে তেলবাহী ওয়াগন লাইনচ্যুত হয়ে কর্ণফুলীসহ আশপাশে ছড়িয়ে পড়ে ফার্নেস তেল। প্রায় সব কটি তেল-বিপর্যয়েই দেখা গেছে জোয়ারের পানিতে তেল-দূষণ ঘটেছে সমুদ্র পর্যন্ত, এ ছাড়া সমুদ্রে নিত্য তেল-দূষণ তো আছেই। পাশাপাশি নিয়ন্ত্রণহীন বাণিজ্যিক পর্যটনের চাপে দেশের সব কটি সমুদ্র তীর আজ ছিন্নভিন্ন, চলছে সমুদ্রতট দখলের লাগাতার নৈরাজ্য।
এ রকম এক নয়াউদারবাদী করপোরেট এজেন্সি নিয়ন্ত্রিত বিশ্বায়িত দুনিয়ায় ‘সমুদ্রের টকটকে নীল পানিকে’ নিয়ে ‘নীল অর্থনীতির’ শোরগোল উঠেছে। এই নীল অর্থনীতি কার চোখে, কার জিম্মায়? জানা যায়, ব্রিটিশ উপনিবেশকালে লবণ উত্পাদনে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছিল বলে অনেক মানুষ আরাকানে চলে যায়। রাজনৈতিক পালাবদলে ভূগোলের নাম পরিবর্তন হয়। আবারও মিয়ানমার থেকে উদ্বাস্তু রোহিঙ্গারা আসতে থাকে বাংলাদেশে, বাংলাদেশ থেকে সমানে মানুষ জীবিকার সন্ধানে ভাসে অকূল দরিয়ায়। বাস্তব কি স্বপ্নে, দেখা কি অদেখায়, ধরা কি অধরায় সমুদ্র যেন বাংলাদেশের নিম্নবর্গের বিকাশমান সভ্যতার এক অনিবার্য অভিজ্ঞতা। সমুদ্র কি সমুদ্রহীন অঞ্চল সবখানেই সমুদ্র এক টানটান রূপকল্প আর স্মৃতিময়তা। সমুদ্রবিষয়ক সব ভাবনা ও কারিগরি সবকিছুতেই সমুদ্র ঘিরে নিম্নবর্গের এই বহুমাত্রিক জিজ্ঞাসাকে মর্যাদা ও স্বীকৃতি দেওয়া জরুরি। রূপকথা থেকে চলতি সময়ের রাজপথ, রাখাইন থেকে রোহিঙ্গা, মসলিন থেকে লবণ, মগবাজার থেকে প্যাঙওয়া, মান্দি থেকে ক্ষমতার মসনদ বাংলাদেশের সব গ্রন্থিতেই লেগে আছে সমুদ্রের দাগ। এই দাগ কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে না। সমুদ্রহীন ও সমুদ্র অঞ্চলের নিম্নবর্গীয় আখ্যানে এই সমুদ্র-সম্পর্ককে জোয়ার-ভাটার বিজ্ঞান হিসেবেই পাঠ করা হয়। চলতি আলাপখানি সমুদ্র দেখার সাহস করেছে। আবারও এক ক্ষুদ্র জিজ্ঞাসা দিয়ে চলতি আলাপের বিস্তার এখানে ইতি টানছে। সচরাচর বলা হয়, নদী সমুদ্রের পানে ছুটে যায়। সমুদ্র তাহলে ছোটে কার পানে? সমুদ্র কি তবে স্থির, টানহীন?
হর্ণফুলি দুলি দুলি
হুদু যেবে হনা
যেদুং চাং ত সমারে
মরে নে জানা।
হুন মোনত্তুন এচ্চোত তুই
হুন সায়রত যেবে
মই যেম ত সমারে
মরে তুই হি নিবে?
(একটি চাঙমা প্রচলিত গান। এখানে কর্ণফুলী নদীকে অনুরোধ করা হচ্ছে নদীর সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার জন্য, জিজ্ঞেস করা হচ্ছে কোন পাহাড় থেকে জন্ম তোমার, কোন সাগরে তুমি যাবে। এই চাকমা গানটিতেও নদীর সঙ্গে সমুদ্র মিলনের অনিবার্যতাকে পাঠ করা হয়েছে।)
তথ্যসূত্র:
১. ‘কক্সবাজার আন্তর্জাতিক দ্বি-বার্ষিক চিত্রকলা উত্সবে’ ‘সমুদ্র-জিজ্ঞাসা’ শিরোনামে চলতি আলাপখানির প্রাথমিক রূপটি পঠিত হয়েছিল। ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৫, কক্সবাজার।
২. মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, সিলেট, নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, শেরপুর, জামালপুর, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, মাগুরা, ঝিনাইদহ, যশোর, কুষ্টিয়া, সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, ঢাকা, গাজীপুর, নাটোর, রংপুর, লালমনিরহাট, নীলফামারী, গাইবান্ধা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নওগাঁ, দিনাজপুর, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, কক্সবাজার, ঝালকাঠি, নোয়াখালী দেশের এই ৪৫ অঞ্চলের গ্রামীণ নিম্নবর্গের জ্ঞানভাষ্য ও যাপিত জীবনের সমুদ্র-অভিসন্দর্ভের ভেতর দিয়ে চলতি আলাপটি দাঁড়িয়েছে। চলতি আলাপে বিবৃত সকল তথ্যের মালিকানা এসব অঞ্চলের বাঙালি ও আদিবাসী জনগণের। বিবৃত তথ্যের একতরফা বাণিজ্যিক ব্যবহার মেধাস্বত্ত্ব অধিকার লঙ্ঘন হিসেবে বিবেচ্য হবে।
৩. দেখুন: বাংলা একাডেমি ব্যবহারিক বাংলা অভিধান, ২০০২, ‘হ’ অংশ, সম্পাদনা করেছেন ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হক, শিবপ্রসন্ন লাহিড়ী, স্বরোচিষ সরকার, বাংল একাডেমি, ঢাকা, পৃ. ১২২৪
৪. দেখুন: পাভেল পার্থ, ২০১৩, ‘ভাওয়াল শালবন বনাম দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম সাফারি পার্ক’, http://www.obosorbd.com/
৫. দেখুন: উইকিপিডিয়া/বঙ্গোপসাগর, https://bn.wikipedia.org/wiki/
৬. দেখুন: http://www.smh.com.au/news/travel/theworldslongestbeach/ 2007/01/31/1169919381993.html
৭. রামদাস টুডু রেস্কা রচিত সাঁওতাল ধর্ম ও সংস্কৃতির আদিগ্রন্থ খেরওয়াল বংশা ধরম পুঁথি অনুবাদ ও সম্পাদনা করেছেন সুকুমার টুডু ও সারদা প্রসাদ কিস্কু, নির্মল বুক এজেন্সি, কলকাতা, ভারত, পৃ. ৯৪।
৮. আতোয়ার রহমান, ১৯৯৭, ‘রাক্ষসীর রূপকথা,’ লেখাটি লোককৃতি কথাগুচ্ছ পুস্তক থেকে নেওয়া, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, পৃ. ১৯-২০
৯. শ্রী হরিদাস পালিত, ২০০৫ (এই লেখাটি কায়স্থ সমাজ পত্রিকায় ১৯৩২ সালে প্রকাশিত হয়েছিল)। বাংলার আদিম জাতি ও সভ্যতা, দীপংকর ঘোষের সংকলন ও সম্পাদনায় ভারতের প্রাক-স্বাধীনতাপর্বে প্রকাশিত নৃতত্ত্ব ও আদিবাসীচর্চা বিষয়ক প্রবন্ধ সংকলন বাংলা সাময়িকপত্রে আদিবাসীকথা নামক পুস্তক থেকে লেখাটি নেওয়া হয়েছে, লোকসংস্কৃতি ও আদিবাসী সংস্কৃতি কেন্দ্র, পশ্চিমবঙ্গ সরকার, ভারত, পৃ. ৫৪-৫৫।
১০. বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় পাঠ্যপুস্তকে লেখা ছিল, সাঁওতালদের প্রধান খাবার ভাত, পিঁপড়া ও মদ। চারুলাল মুখার্জির দ্য সান্তালস বইয়ের ৭১ নং পাতায় বলা আছে, ‘O, they (Santals) will eat anything that flies except aeroplanes and anything that swims except boats’.
১১. চলতি এই আখ্যানটির একটা ছোট ফিরিস্তি আছে। কক্সবাজারের টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ বঙ্গোপসাগরের সমুদ্র উপকূলের এক সমুদ্রগামী জেলে জনপদ। সমুদ্রগামী জেলেদের ভাষ্য, শাহপরী নামে এক বুজুর্গ নারীর নামে এই এলাকার নাম শাহপদ্দি বা শাহপরী হয়েছে। অনেকে বলে, আগে এই দ্বীপে পরীরা বসবাস করত। নোয়াপাড়ার ঝিনাখালে বাঁধ দিয়ে লবণ চাষ করার আগ পর্যন্ত শাহপরীর দ্বীপ পুরোটাই সমুদ্রবেষ্টিত দ্বীপ ছিল। টেকনাফ থেকে প্রায় ২০ কি.মি. দূরের এই দ্বীপ জনপদের মানুষেরা একেবারে শিশুকাল থেকেই সাগরে সাগরে বড় হয়। বর্ষায় ২-৭ দিন আর শীতে প্রায় এক মাস দূর দরিয়ায় (সাগর) কাটিয়ে মাছভর্তি নৌকা নিয়ে ফেরে পুরুষেরা। নারীরা সমুদ্রের নোনা জল থেকে লবণ বানায়, মাছ শুকিয়ে রাখে। শাহপরীর দ্বীপে ১৩৪০ বাংলায় জন্ম আবদুল জলিলের। মা খদিজা, বাবা মতলুব হোসন। শাহপরীর দ্বীপের সাহসী সমুদ্রগামী জেলেদের ভেতর দনদানা ইলিশ ধরায় তাঁর বেশ সুনাম। ভূমিহীন এই পরিবার বর্তমানে কক্সবাজারের টেকনাফের সাবারাং ইউনিয়নের ডাংগরপাড়ায় থাকেন। সমুদ্রগামী জেলেরা বঙ্গোপসাগরকে বলেন দরিয়া। দরিয়ার সবখানে যাওয়া যায় না। সমুদ্রগামী জেলেদের ভেতর নানান নিষেধাজ্ঞা আছে। দরিয়ার রক্ষক খোয়াজখিজির। তাকে মেনেই সমুদ্রগামী জেলেদের সব কাজকারবার। দরিয়ায় জেলেদের জীবন বাঁচায় গাজী-কালু। তবে আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে যদি কেউ দরিয়ায় নামে আর মারা যায় তবে গাজী-কালু তার জবাব দিতে পারে না। ২৩ জুলাই ২০১০ তারিখে সন্ধ্যায় শাহপরীর দ্বীপে সমুদ্র থেকে ফিরে আসা জেলেদের আড্ডায় আইস্যারা দেশের কাহিনিটি শোনান আবদুল জলিল। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, মানুষ এখন কোনো নিয়ম মানতে পারছে না। অভাবের তাড়নায় আষাঢ়-শ্রাবণ মাসেও দরিয়ায় নামতে বাধ্য হয় মানুষ। অশান্ত দরিয়ায় তাই অনেকে জান হারায়। গাজী-কালুরও একটা নিয়ম আছে, আমরা সেই নিয়ম মেনেই চলার চেষ্টা করি। আবদুল জলিল দরিয়া নিয়ে এ ধরনের কাহিনি সমুদ্রগামী জেলেদের আড্ডাতেই শুনে শুনে বড় হয়েছেন।
১২. সমদ্রের পানি লবণ উত্পাদনের জমিনে রোদের তাপে শুকিয়ে লবণ তৈরির ধাপে যখন প্রথম দানাদার লবণ তৈরি হতে থাকে সেই দানাকে স্থানীয়ভাবে বলে ‘লবণ ফুল’। এই অংশটুকু তৈরি করা হয়েছে কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের লবণচাষিদের গ্রামে দলগত আলোচনা ও সাক্ষাত্কারের ভিত্তিতে। এতে অংশ নিয়েছেন : মো. মোস্তাফিজ (৭০), লবণচাষি, মা-আলমাছ খাতুন, বাবা-আলা মিয়া, বদরুদ্দিনপাড়া, রাজাখালী ইউনিয়ন, পেকুয়া, কক্সবাজার; নূর আলম (৭৫), লবণচাষি, মা-রসিদা খাতুন, বাবা-আমির হামজা, রাজাখালী, পেকুয়া, কক্সবাজার; মোস্তাক (৫৬), লবণচাষি, মা-হাজেরা খাতুন, বাবা-কালা মিয়া, রাজাখালী, পেকুয়া, কক্সবাজার; রাসেল (১০), লবণ পরিবহনকারী শ্রমিক, মা-খজিদা বেগম, বাবা-সৈয়দ নূর, রাজাখালী, পেকুয়া, কক্সবাজার; ফিরোজ আহমেদ (৮০), লবণচাষি, মা-মোবারেকা, বাবা-মতিয়ার রহমান, হায়দারঘোনা, বাঁশখালী, চট্টগ্রাম; সুলতান আহমেদ (৭০), লবণচাষি, মা-রওশন আরা, বাবা-মখলেছুর রহমান, ছনুয়া, বাঁশখালী, চট্টগ্রাম।
১৩. খান, শরীফুজ্জামান আগা। ২০০৫, লবণচাষি সম্প্রদায়, প্রগতিশীল নাগরিক সমাজ, ঝিনাইদহ, বাংলাদেশ, পৃ. ৬২
১৪. ১৯২৫ সালে ধীরাজ ভট্টাচার্য কক্সবাজারের টেকনাফের সহকারী দারোগা ছিলেন, সেই স্মৃতি নিয়ে লিখেছেন যখন পুলিশ ছিলাম। সেই বইতে আছে মাত্র ৪ সের লবণ পাওয়া গিয়েছিল বলে এক প্রবীণ নারী ও ২০ সের লবণের জন্য এক পুরুষকে আটক করে সরকার।
১৫. দেখুন: ছৈয়দ আহমেদুল হক, ১৯৯০, ‘শিল্প ও বাণিজ্য,’ লেখাটি কক্সবাজারের ইতিহাস শীর্ষক পুস্তকে প্রকাশিত, কক্সবাজার ফাউন্ডেশন, পৃ. ১৬৬-১৭৭
১৬. ল্যাটিন শব্দ ংধষধত্রঁস থেকে ংধষধত্ু শব্দটি এসেছে। স্যালারিয়াম মানে লবণ যা মুদ্রা বা মজুরি হিসেবে ব্যবহূত। রোমান ঐতিহাসিক প্লিনির উদ্ধৃতি দিয়ে এটি লিখেছে উইকিপিডিয়া। দেখুন: http://penelope.uchicago.edu/Thayer/L/Roman/ Texts/Pliny_the_Elder/31*.html
১৭. শরীফুজ্জামান আগা খান, ২০০৫, লবণচাষি সম্প্রদায়, প্রগতিশীল নাগরিক সমাজ, ঝিনাইদহ, বাংলাদেশ, পৃ. ৫১
১৮. মো. সিরাজ মিয়া (৫৬), সমুদ্রগামী জেলে (আগে ছিলেন কৃষক), মা-লালমতি, বাবা-ওমর হামজা, মাঝেরপাড়া, শাহপরীর দ্বীপ, সাবারাং ইউনিয়ন, টেকনাফ, কক্সবাজার।
১৯. আলাপের এ অংশটুকু বাংলাদেশের রাখাইন সম্প্রদায় : ইতিহাস, ঐতিহ্য ও জীবনধারা শীর্ষক পুস্তকের কাছে ঋণ স্বীকার করছে। এটি লিখেছেন মং বা অং (মং বা), প্রকাশ করেছেন লেখক নিজেই, প্রকাশকাল-২৫৪৭ বুদ্ধাব্দ (২০০৩ খ্রিষ্টাব্দ), কক্সবাজার।
২০. দেখুন: দৈনিক কক্সবাজার, ১৮ আগস্ট ২০০০, কক্সবাজার।