নার্স

সারসংক্ষেপ

এই নিবন্ধে আমি বাংলাদেশি নার্সদের অভিজ্ঞতা ও কাজ সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছি। এটা একটা এথনোগ্রাফিক গবেষণার ভিত্তিতে করা হয়েছে। বাংলাদেশের একটি সরকারি হাসপাতালের ওয়ার্ডে আমি এই গবেষণা চালিয়েছি। বাংলাদেশি সমাজের আদর্শ ও মূল্যবোধগুলো কীভাবে নার্সদের জীবনকে গড়ে দিয়েছে, এই গবেষণায় তা দেখানো হয়েছে। গবেষণা করতে গিয়ে দেখেছি, নার্স তাঁদের কাজটা ভয়ভীতির সঙ্গে করছেন এবং সমাজে তাঁদের ভাবমূর্তি নেতিবাচক। অর্থাত্ সমাজ তাঁদের এবং তাঁদের পেশাকে খুব ভালো চোখে দেখে না। আমি এই নিবন্ধে বলতে চেয়েছি, নার্সিং যে একটি মহান পেশা—এই ভাবনা বাংলাদেশি নার্সদের মধ্যে আর কাজ করে না। এই ভাবনা থেকে তাঁরা বেরিয়ে এসেছেন। বিশ্বের অন্যান্য অংশে নার্সরা যেভাবে দায়িত্ব পালন করেন, তার সঙ্গে আমাদের দেশের নার্সদের দায়িত্ব পালনের কোনো মিল নেই।

মুখ্য শব্দগুচ্ছ: এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, বাংলাদেশ, এথনোগ্রাফি, নার্সিং, কর্মক্ষেত্র

ভূমিকা

২০০৫ সালে আমি এই গবেষণা চালাই। আমার এই গবেষণার মূল উদ্দেশ্য ছিল দুটি। প্রথমটি হলো বাংলাদেশের একটি হাসপাতালে বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মাত্রা এবং বায়োমেডিকেল চর্চার স্থানীয় পদ্ধতির চিত্র তুলে ধরা। দ্বিতীয়টি হলো যেভাবে বাংলাদেশি সমাজের মূল্যবোধ ও নিয়মগুলো হাসপাতালের জীবনে প্রভাব ফেলে তা দেখানো। গবেষণায় দেখা গেছে, কীভাবে বাংলাদেশের একটি হাসপাতাল একটি ক্ষুদ্র বিশ্বে পরিণত হয়েছে। গবেষণার জন্য আমি হাসপাতালের ওই ওয়ার্ডে আসা রোগী, তাদের আত্মীয়স্বজন, ওয়ার্ড বয়, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, ডাক্তার ও নার্সদের সঙ্গে কথা বলেছি।

এই গবেষণা নিবন্ধে আমি বাংলাদেশি নার্সদের অভিজ্ঞতা এবং বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতি কীভাবে তাঁদের জীবনকে গড়ে দিয়েছে তা নিয়ে আলোচনা করেছি। মানবজাতির বিবরণ-সম্পর্কিত গবেষণার ঐতিহ্য অনুযায়ী ওয়ার্ডে বসে থেকে সেখানকার লোকজনের আচার-আচরণ পর্যবেক্ষণ করে এবং তাদের সঙ্গে কথা বলে তথ্য সংগ্রহ করেছি। আমার ভূমিকা ছিল একজন পর্যবেক্ষকের মতো। গবেষণা পরিচালনার জন্য আমি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অনুমতি ও মতামতও নিয়েছি। তবে কাজ করতে গিয়ে আমাকে নানা বাধার মুখে পড়তে হয়েছে। বিশেষ করে ওয়ার্ডে প্রবেশ এবং লোকজনের সঙ্গে কথা বলার বিষয়টা খুব মসৃণ ছিল না। যদিও আমার গবেষণার তথ্য সংগ্রহের জন্য হাসপাতালের মাত্র একটি ওয়ার্ডে কাজ করেছি, কিন্তু আমার ধারণা অন্য যেকোনো হাসপাতালে গেলেও একই চিত্র পাওয়া যাবে।

সাদা শাড়ি

আমি গবেষণা চালিয়েছি ১০০ শয্যার একটি অর্থোপেডিক ওয়ার্ডে। টারশিয়ারি পর্যায়ের এই হাসপাতাল এমন একটি এলাকায় অবস্থিত যেখানে ৫০ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকায় ৩০ লাখ মানুষ বাস করে। যার ফলে ১০০ শয্যার ওয়ার্ডটিতে সব সময় ২০ থেকে ২৫ জন রোগী বেশি থাকে। তাদের স্থান হয় মেঝেতে। তোশক বিছিয়ে তাদের শোয়ার ব্যবস্থা করা হয়। এখানে নার্সদের খুব সহজেই চেনা যায়, কারণ তাঁরাই একমাত্র স্টাফ যাঁরা কিনা ইউনিফর্ম পরেন। চিকিত্সকেরাও সাধারণত অ্যাপ্রোন পরেন না। নার্সদের অধিকাংশই নারী এবং তাঁরা সাদা শাড়ি এবং সাদা টুপি পরেন। পুরুষ নার্সরা সাদা শার্ট ও সাদা ট্রাউজার পরেন। নার্সরা বিভিন্ন রঙের বেল্ট পরেন। বেল্টের রং দেখে কারা সিনিয়র আর কারা জুনিয়র নার্স তা বোঝা যায়। আমার মাঠগবেষণার সময় ওই ওয়ার্ডে ১৮ জন নার্স পালাক্রমে কাজ করতেন। এঁদের মধ্যে ৬ জন ছিলেন পুরুষ নার্স। বাকি ১২ জন ছিলেন নারী। আমার মূল ফোকাস ছিল নারী নার্সদের ওপর। তবে দিনরাত মিলিয়ে নার্সদের উপস্থিতি সমান থাকত না। নার্সদের বেশির ভাগের আগ্রহ থাকত সকালবেলার শিফটের প্রতি। সকালে ওয়ার্ডে ৮ জন নার্স কাজ করতেন। বিকেলের শিফটে গড়ে ৪ জন। আর রাতের বেলায় ২ জন কাজ করতেন।

নার্সরা কাজ করেন নানা বসের অধীনে। নার্সিং সুপারভাইজার নার্সদের মধ্যে কাজ ভাগ করে দেন এবং কী কী কাজ করতে হবে তার নির্দেশ দেন। হাসপাতালের মেট্রনের (তত্ত্বাবধায়িকা) কাছে নার্সদের জবাবদিহি করতে হয়। মেট্রন মাঝে মাঝে ওয়ার্ড পরিদর্শনে আসেন। নার্সদের কাজ তদারক করেন ওয়ার্ডের ক্লিনিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট (সিএ)। এ ছাড়া ওয়ার্ডের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী অধ্যাপক নার্সদের কাজ তত্ত্বাবধান করেন।

বেশির ভাগ নার্স নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা। বাংলাদেশের বেশির ভাগ নার্স হচ্ছেন হিন্দু। পর্দাপ্রথার কারণে বহু বছর ধরেই মুসলমান মেয়েরা ঘরের বাইরে কোনো কাজে যেতে পারেন না। তবে খ্রিষ্টান নার্সের সংখ্যাও কম। ডাক্তাররা মেয়ে নার্সদের ‘সিস্টার’ ও ছেলে নার্সদের ‘ব্রাদার’ বলে সম্বোধন করেন। রোগীরাও তাঁদের এসব নামেই সম্বোধন করেন। তবে অনেকে তাঁদের ‘নার্স’ বলেই সম্বোধন করেন।

রেজিস্টার, ফাইল ও ফরসেপ

মজার বিষয় হলো নার্সরা তাঁদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব অর্থাত্ রোগীকে সেবা দেওয়ার চেয়ে প্রশাসনিক বিভিন্ন কাজ ও রেজিস্টার খাতা নিয়ে বেশি ব্যস্ত থাকেন। তাঁদের মূল দায়িত্ব রোগীকে সেবা দেওয়ার কাজটি তাঁরা খুব কমই করেন। নার্সরা তাঁদের ডিউটি রুমে বিশেষ করে সকালবেলার পালায় রেজিস্টার খাতা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। যেসব রেজিস্টার খাতা নিয়ে তাঁরা ব্যস্ত থাকেন সেগুলো হচ্ছে ১. অ্যাসাইনমেন্ট রেজিস্টার: ডিউটি নার্সদের প্রতিদিনের অ্যাসাইনমেন্ট এই রেজিস্টার খাতায় লেখা থাকে (নার্সিং সুপারভাইজার এই অ্যাসাইনমেন্ট লিখে থাকেন)।

২.         রেকর্ড রেজিস্টার: এই রেজিস্টার খাতায় ওয়ার্ডে ভর্তি ও ওয়ার্ড থেকে ছাড়া পাওয়া রোগীদের নাম-ঠিকানা ও রোগের বিবরণ থাকে।

৩.        হ্যান্ডওভার রেজিস্টার: এই রেজিস্টার খাতায় ওয়ার্ডের জিনিসপত্র যেমন: শিট, ম্যাট্রেস এবং অন্যান্য সরঞ্জামের নাম লেখা থাকে।

৪.         রাউন্ড রেজিস্টার: ওয়ার্ড রাউন্ড দেওয়ার সময় চিকিত্সকেরা এই খাতায় উপদেশ ও নির্দেশ দিয়ে থাকেন।

৫.         প্যাথলজি রিকুইজিশন রেজিস্টার: রোগীর কী কী প্যাথলজি পরীক্ষা করা হবে তার তালিকা থাকে এই খাতায়।

৬.        এক্স-রে রিকুইজিশন রেজিস্টার: যাদের এক্স-রে করা প্রয়োজন সেই রোগীদের তালিকা থাকে এখানে।

৭.         স্পেশাল অ্যাটেনশন রেজিস্টার: কোনো রোগীকে যদি বিশেষ মনোযোগ দেওয়ার প্রয়োজন হয় তাহলে নার্সরা তা এই খাতায় লিখবেন পরবর্তী শিফটের নার্সদের জন্য।

৮.        রেজিস্টার ফর পুলিশ কেস: পুলিশ কেস আছে এমন রোগীদের তালিকা থাকে এখানে (উদাহরণস্বরূপ: সড়ক দুর্ঘটনা বা অপরাধমূলক সহিংসতার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি)।

৯.         ডায়েট রেজিস্টার: বিভিন্ন রোগীর খাবারের তালিকা লেখা থাকে এই রেজিস্টার খাতায়।

১০.       ড্রাগ রেজিস্টার: হাসপাতালে পাওয়া যায় এমন ওষুধের তালিকা থাকে এই খাতায়।

১১.       রেজিস্টার ফর অ্যাবসকন্ডিং পেশেন্টস: ওয়ার্ড থেকে পালিয়ে গেছেন, এমন রোগীদের তালিকা থাকে এই খাতায়।

১২. রেফারেল রেজিস্টার: অন্য হাসপাতালে বা বিভাগে পাঠানোর জন্য রেফার করা হয়েছে, এমন রোগীদের তালিকা থাকে এই খাতায়।

১৩.      ডেথ রেজিস্টার: ওয়ার্ডে মৃত্যু হয়েছে এমন রোগীদের তালিকা থাকে এই খাতায়।

প্রতি সকালে একজন নার্সের ওপর দায়িত্ব থাকে একটি রিপোর্ট তৈরির জন্য। এই রিপোর্টকে বলা হয় ‘মর্নিং স্টেটমেন্ট’। এই রিপোর্টে ওই দিন কতজন রোগী ওয়ার্ডে ভর্তি হয়েছে তার সংখ্যা, তাদের কী কী পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে এবং আগের দিনে কতজনকে ওয়ার্ড থেকে ছাড়া হয়েছে ইত্যাদি লেখা হয়। এ ছাড়া এই রিপোর্টে কতজন রোগীর বিরুদ্ধে পুলিশের মামলা আছে, কতজন রোগী ওয়ার্ড থেকে পালিয়ে গেছে এবং কতজন মারা গেছে সেসব লেখা হয়। এই রিপোর্ট তৈরির সময় দায়িত্বপ্রাপ্ত নার্সকে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট রেজিস্টারদের সঙ্গে আলোচনা করে নিতে হয়। নার্সরা এই রিপোর্টের কার্বন কপি করেন এবং হাসপাতালের পরিচালকের কার্যালয়, মেট্রনের কার্যালয় এবং ডায়েট রুমে পাঠান। নার্সিং সুপারভাইজার এটা নিশ্চিত করবেন যে এই রিপোর্ট প্রতি সকালেই সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোতে পাঠানো হয়েছে। তবে নার্সদের বেশির ভাগেরই কোনো ধারণা নেই এ রিপোর্ট কোন কাজে ব্যবহার করা হয়। যখন আমি সুপারভাইজারকে জিজ্ঞাসা করলাম, ওই তিনটি কার্যালয় এই রিপোর্ট দিয়ে কী করবে? তিনি উত্তর দিলেন, কে জানে? হয়তো তারা এটা মন্ত্রণালয়ে পাঠাবে। সম্ভবত, তারা আমাদের কাজের মূল্যায়ন করতে চায়। আমার কাজ হচ্ছে নির্ধারিত অফিসে রিপোর্টটি পাঠানো। আমি এটা সময়মতো করার চেষ্টা করি। রিপোর্ট পাঠানো একটি তর্কাতীত নিয়ম। প্রতি সকালে একজন নার্স তাঁর কাজ শুরু করেন এই রিপোর্ট তৈরির মধ্য দিয়ে এবং একজন সুপারভাইজার তা নির্ধারিত কার্যালয়গুলোতে পাঠান। যদিও তাঁরা জানেন না, এই রিপোর্ট দিয়ে কী হয়।

একজন নার্সের দায়িত্ব হচ্ছে রেজিস্টার খাতা হস্তান্তর করা এবং নার্সরা এ নিয়ে খুব উদ্বেগের মধ্যে থাকেন। দায়িত্বপ্রাপ্ত নার্স আগের শিফটের একজন নার্সের কাছ থেকে রেজিস্টার খাতা নিয়ে থাকেন। এরপর তিনি খাতাগুলো একের পর এক পরীক্ষা করেন এবং তাঁর শিফটের পুরো সময়টা তা যত্নে রাখার চেষ্টা করেন। এরপর পরের শিফটের নার্সের কাছে এসব রেজিস্টার খাতা হস্তান্তর করেন। কোনো খাতা যদি না পাওয়া যায় বা হারিয়ে যায়, তাহলে যে নার্সের দায়িত্ব ছিল রেজিস্টার খাতাগুলো যত্নে রাখা তাঁকে জরিমানা করা হয়। দায়িত্বপ্রাপ্ত নার্সকে সাহায্য করার জন্য অন্য নার্সরাও রেজিস্টার খাতাগুলোর ওপর নজর রাখেন। নার্সরা মাঝে মাঝে শিক্ষানবিশ চিকিত্সকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলেন যে তাঁরা রোগীর বিছানার কাছ থেকে ফরসেপ, কাঁচি বা সার্জিক্যাল ট্রে সরিয়ে রাখতে ভুলে যান এবং তখন জিনিসগুলো হারিয়ে যায় বা সুযোগ বুঝে ওয়ার্ড বয়রা এসব জিনিস চুরি করে। এমনও দেখা গেছে, হাসপাতাল ছাড়ার সময় রোগী এবং তার স্বজনেরা বিছানার চাদর চুরি করে নিয়ে গেছে। এ জন্য নার্সদের সব সময় এসব দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হয়।

ওয়ার্ডে প্রফেসরদের দিনের রাউন্ড শেষ হওয়ার পর, কর্তব্যরত চিকিত্সক রাউন্ড রেজিস্টারে নতুন করে পরামর্শ ও কীভাবে চিকিত্সা দেওয়া হবে তার নির্দেশ দেন। এরপর রোগীর ফাইলে সেসব পরামর্শ ও ব্যবস্থাপত্র অন্তর্ভুক্ত করা হয়। নার্সরা সব ফাইল তাঁদের ডিউটি রুমে নিয়ে যান এবং নতুন পরামর্শ ও নির্দেশগুলো পর্যালোচনা করেন এবং সে অনুযায়ী প্যাথলজি, এক্স-রে ও ডায়েট রিকুইজিশন রেজিস্টারে সেগুলো নথিবদ্ধ করেন। এ ছাড়া তাঁরা বিভিন্ন পরীক্ষার জন্য ভিন্ন ভিন্ন রেফারেল স্লিপ তৈরি করেন, ওয়ার্ডে কী কী ওষুধ রয়েছে তা পরীক্ষা করেন এবং হাসপাতালের বাইরে থেকে কিনতে হবে এমন ওষুধের তালিকা তৈরি করেন। নার্সিং সুপারভাইজার তখন হাসপাতালের ওষুধের দোকানে প্রয়োজনীয় ওষুধের জন্য একটি রিকুইজিশন অর্ডার পাঠান এবং একজন মেডিসিন বয়কে পাঠান ওষুধগুলো নিয়ে আসার জন্য। নার্সরা কোনো রোগীর প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেওয়ার দরকার থাকলে তা পরবর্তী শিফটের নার্সদের জন্য লিখে রেখে যান। কোনো রোগীর শরীরে যদি রক্ত দেওয়ার প্রয়োজন হয় বা স্যালাইন বদলানোর প্রয়োজন হয় তাহলে সেসব কোন সময়ে করা হবে তা তাঁরা লিখে যান। আর কোনো রোগীর যখন অস্ত্রোপচার করা হবে, তখন নার্সদের রোগীকে অপারেশন থিয়েটারে পাঠানোর আগে অতিরিক্ত বেশ কতগুলো ফরম পূরণ করতে হয়। তাঁদের এটাও নিশ্চিত করতে হয় যে রোগীর পরীক্ষা-নিরীক্ষার সব কাগজপত্র রোগীর সঙ্গে আছে। এটা পরিষ্কার যে নার্সদের একটি বিরাট অংশের সময় কেটে যায় এসব রেজিস্টার, স্লিপ, ফাইল ও রিপোর্ট লিখতে লিখতে। এতে করে তাঁরা একধরনের হতাশায় ভুগতে থাকেন।

এ ব্যাপারে একজন নার্সিং সুপারভাইজার বলেন, ‘আমাদের নার্স নয়, কেরানি বলে ডাকা উচিত। সেই সকাল থেকে ফাইল, রেজিস্টার ইত্যাদি লেখা শুরু করি এবং সারা দিন তা চলতে থাকে। তাহলে কখন আমি রোগীর দেখাশোনা করব? আমি মনে করি পেপারওয়ার্ক করার জন্য আলাদা কর্মী দরকার। ১০ বছর আগে আমাদের কোনো পেপারওয়ার্ক করতে হতো না। আমার মনে আছে, আমরা তখন নিজ হাতে রোগীদের খাইয়ে দিয়েছি। রোগী বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পেপারওয়ার্কের পরিমাণও বেড়েছে। রোগীকে সেবা দেওয়ার মতো সময় আমাদের হাতে থাকে না।’

রোগীদের সংস্পর্শে আসা হয় খুবই কম

যখন নার্সিংয়ের ওপর শিক্ষা দেওয়া হয়, তখন তাঁদের বলা হয় কী কী দায়িত্ব তাঁদের পালন করতে হবে। এগুলো হচ্ছে রোগীদের গ্রহণ করা, তাদের শরীরের উল্লেখযোগ্য চিহ্নগুলোর রেকর্ড রাখা, ওষুধ বিতরণ করা, রোগীদের ওষুধ দেওয়া হচ্ছে কি না তা পর্যবেক্ষণ করা, ড্রেসিং করা এবং ক্ষতস্থান ড্রেসিং করতে অন্য নার্সকে সহায়তা করা, রোগীর শয্যা প্রস্তুত করা, রোগীর খাবার পর্যবেক্ষণ করা, রোগীকে ব্যায়াম করানো ও ব্যায়ামের প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং অস্ত্রোপচারে সহায়তা দেওয়া ইত্যাদি।

রোগীদের গ্রহণ করা মানে হলো যখন ওয়ার্ডে কোনো নতুন রোগী আসবে তখন নার্সরা সেই রোগীকে ওয়ার্ড বয়দের সহায়তা নিয়ে বিছানায় শোয়াবেন। এরপর তাঁরা নতুন রোগীর জন্য একটি ফাইল তৈরি করবেন। এতে তার নাম-ঠিকানা, রোগের বিবরণ থাকবে। তাঁরা ফাইলটি রোগীর বিছানার পাশে ঝুলিয়ে রাখবেন এবং ডাক্তারের নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করবেন। ওয়ার্ডে যেসব ওষুধ পাওয়া যায় নার্সরা তা বিতরণ করবেন। তবে বাস্তবতা হলো হাসপাতাল থেকে খুব কম ওষুধই ওয়ার্ডে দেওয়া হয়। বাকি ওষুধ রোগীদের বাইরে থেকে কিনতে হয়। নার্সরা রোগীদের বলে দেন কখন কোন ওষুধ কতবার খেতে হবে। তবে যা-ই হোক, আমি কখনো দেখিনি যে নার্সরা রোগীকে ওষুধ দেওয়ার দায়িত্বটি পালন করছেন। তাঁরা হয়তো রোগীর বিছানার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় জিজ্ঞেস করেন, তিনি সময়মতো ওষুধ নিয়েছেন কি না। তাঁরা সত্যিই রোগী ওষুধ খেয়েছে কি না তা দেখেন না। তবে রোগীকে ইনজেকশন দেওয়ার ব্যাপারে তাঁদের খুব বিবেকবান হতে দেখা যায়। নার্সদের অনেকে ইনজেকশন দিতে পেরে গর্ববোধ করেন। তাঁরা এটা ভেবে আনন্দ পান যে রোগীর আত্মীয়স্বজন বা দেখভালকারীরা এই কাজটা পারেন না। একজন স্টাফ নার্স আমাকে বলেছেন, ‘রোগীর আত্মীয়স্বজন ও দেখভালকারীরা আমাদের সব কাজ নিজেরাই করে ফেলে, কিন্তু ইনজেকশনের জন্য তাদের আমাদের ডাকতে হয়।’

রোগীর ক্ষতস্থান বা আঘাতের জায়গা সাধারণত শিক্ষানবিশ ডাক্তাররা ড্রেসিং করে দেন। তখন নার্সরা তাঁদের সহায়তা করেন। তবে মাঝে মাঝে ডাক্তাররা ব্যস্ত থাকলে নার্সরাই ড্রেসিং করে দেন। তবে রোগীর চাপ যখন বেশি থাকে তখন ওয়ার্ড বয়রাও ড্রেসিংয়ের কাজ করেন। অপারেশন থিয়েটারেও নার্সরা সহায়তা করেন। তাঁরা অস্ত্রোপচারের সরঞ্জাম এবং ডাক্তারদের গাউন প্রস্তুত করে রাখেন। এ ছাড়া রোগীর অস্ত্রোপচারের সময় মাঝে মাঝে তাঁরা ডাক্তারের নির্দেশ অনুযায়ী যন্ত্রপাতি এগিয়ে দেন।

সকালবেলা নার্সদের একজন রোগীর শয্যা প্রস্তুত করার দায়িত্ব পান। তিনি সাধারণত সহকারী নার্স বা শিক্ষার্থী নার্স হন। সত্যিকার অর্থে, তাঁরা শয্যা প্রস্তুত করতে তেমন কিছু করেন না। প্রফেসররা ওয়ার্ড রাউন্ড দিতে আসার আগে তাঁরা কেবল বিছানার চাদর পাল্টে দেন।

একজন শিক্ষার্থী নার্স বলেন, ‘আমরা বইতে রোগীর শয্যা প্রস্তুতকরণের ব্যাপারে অনেক কিছু পড়েছি। যেমন: আর্থ্রাইটিসের রোগীর জন্য শক্ত বিছানা, পুড়ে যাওয়া রোগীর জন্য নৌকা আকৃতির বিছানা ইত্যাদি। কিন্তু কী করে আমি সেসব বিছানা প্রস্তুত করব? এখানে সব রোগীর জন্য বিছানা দেওয়া হয় না। অনেক রোগী তাই বাধ্য হয়ে মেঝেতে আশ্রয় নেন। এ ছাড়া যেসব বিছানা আছে সেগুলো খুবই পুরোনো। বেশির ভাগই ভাঙা। আমি শুধু দেখি বিছানার চাদরগুলো ঠিক আছে কি না।’

ওয়ার্ডে রোগীর খাবারের দেখাশোনা করাও নার্সদের দায়িত্ব। একজন নার্স ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী রান্নাঘরে গিয়ে খাবারের ফরমাশ দেন। এসব খাবারের আবার কোড নম্বর আছে। যেমন ডায়েট ১ হচ্ছে রান্নাঘর থেকে প্রতিদিন যে খাবারটি আসে। ডায়েট ২ হচ্ছে উচ্চ প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার। ডায়েট ৩ হচ্ছে লবণমুক্ত খাবার। এই খাবার মূলত হাইপারটেনশন রোগীদের দেওয়া হয়। ডায়েট ৪ হচ্ছে চিনিমুক্ত খাবার। ডায়াবেটিসের রোগীদের এই খাবার দেওয়া হয়। ডায়েট ৫ হচ্ছে নতুন ভর্তি রোগীদের জন্য খাবার। রোগী ওয়ার্ডে ভর্তি হওয়ার পরপরই তাকে এই খাবার দেওয়া হয়। ডায়েট ৬ হচ্ছে তরল খাবার। সত্যি কথা হচ্ছে এসব খাবার সব সময় পাওয়া যায় না বা রোগীদের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী দেওয়া হয় না।

একজন নার্স আমাকে জানান, কয়েক বছর আগে রোগীদের এক টুকরো রুটি ও এক গ্লাস দুধ দেওয়া হতো, যেটাকে আমরা অ্যাডমিশন ডায়েট বলি। কিন্তু এখন আর কোনো অ্যাডমিশন ডায়েট দেওয়া হয় না। রান্নাঘরে কোনো লবণমুক্ত বা চিনিমুক্ত খাবার তৈরি হয় না। রোগীদের এখন দেওয়া হয় ডায়েট ১। এই খাবারটা সাধারণ খাবার বা কখনো কখনো তরল খাবার। মাঝে মাঝে উচ্চ প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবারের ফরমাশ দিলে রোগীর সাধারণ খাবারের সঙ্গে অতিরিক্ত একটি ডিম দেওয়া হয়।

নার্সদের কখনো কখনো রোগীদের বা তাদের অ্যাটেনডেন্টদের কীভাবে ব্যায়াম করতে হয় সে ব্যাপারে প্রশিক্ষণ দিতে হয়। রোগী হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলে তাকে প্রয়োজনীয় উপদেশ দেন নার্সরা ।

পাবলিককে সামলানোর জন্য আমাদের একা ছেড়ে দেওয়া হয়

ইংরেজি শব্দ পাবলিকের বাংলা করলে সাধারণত বিশৃঙ্খল জনগণকে বোঝায়। আর নার্সরা পাবলিক শব্দটি ব্যবহার করেন রোগী এবং তাদের স্বজনদের ক্ষেত্রে। নার্সরা মনে করেন, তাঁরা হচ্ছেন সেই জন যাঁদের পাবলিককে সামলানোর জন্য বাধ্য করা হয়। ডাক্তাররা রোগীদের থেকে দূরে থাকেন। এদিকে অধস্তন কর্মচারীরা চিকিত্সাসংক্রান্ত সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন না। এর ফলে রোগী ও তার স্বজনেরা নার্সের কাছে এসে সবকিছু জানতে চান। বিকেল ও রাতের শিফটে রোগীদের সামলানোর কাজটি খুবই কঠিন, বিশেষ করে যখন জুনিয়র ডাক্তাররা ওয়ার্ডে থাকেন।

একজন নার্স বলেন, ‘সকালবেলা রোগীরা ডাক্তারদের কোনো প্রশ্ন করতে ভয় পায়। যখন ডাক্তার ওয়ার্ড ছেড়ে চলে যান, তখন রোগীরা আমাদের কাছে এসে সব ধরনের প্রশ্ন করতে থাকে। তারা আমাদের তাদের এক্স-রে রিপোর্ট, রক্তের রিপোর্টসহ নানা রিপোর্ট দেখাতে চায়। আর বিকেল বা রাতের শিফটে ডাকার জন্য বা পরামর্শ করার জন্য কোনো ডাক্তার থাকেন না। কখনো কখনো দু-একজন শিক্ষানবিশ চিকিত্সক থাকেন। তবে তাঁরা অন্যান্য কাজে ব্যস্ত থাকেন। পাবলিককে সামলানোর জন্য আমাদের একা ছেড়ে দেওয়া হয়।’

নার্সদের মতে, পাবলিককে সামলানো খুবই কঠিন একটি কাজ। রোগী ও তার স্বজনেরা নার্সদের চিকিত্সকের মতোই মনে করে। মাঝে মাঝে তারা এমন অবান্তর প্রশ্ন করে যে নার্সরা তখন ক্ষুব্ধ হন।

একজন নার্স আমাকে জানান, ‘একদিন একজন রোগী আমাকে এসে বলল যে ক্যাপসুল তার শরীরে কোনো কাজ করছে না। আমার উচিত তাকে ইনজেকশন দেওয়া। কেননা ইনজেকশন অনেক শক্তিশালী। আরেক দিন আরেক রোগী আমাকে বলল, কেন তাকে আমি ছোট ট্যাবলেট দিয়েছি। পাশের বেডের রোগীকে তো বড় ট্যাবলেট দেওয়া হয়েছে। এ রকম কথা শুনলে কীভাবে আপনি আপনার মেজাজ ঠিক রাখতে পারবেন?’

আরেকজন নার্স আমাকে বলেন, ‘একজন রোগী আমাকে হাসপাতাল থেকে অ্যান্টিবায়োটিক ইনজেকশন এনে দেওয়ার জন্য বলছিল। আমি তাকে বললাম, হাসপাতাল থেকে এ ধরনের কোনো ইনজেকশন দেওয়া হয় না। কিন্তু সে আমার কথা বিশ্বাস করল না। বারবার আমাকে অনুরোধ করতে লাগল ইনজেকশন এনে দেওয়ার জন্য। এটা হতাশাজনক।’

কিছু নার্স নার্সিং পেশার প্রতি তাঁদের ক্ষোভ প্রকাশ করেন। একজন স্টাফ নার্স বলেন, ‘নার্সিং পেশায় আপনাকে সব সময় পাবলিকের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে হবে। আমি এটা ঘৃণা করি। এটা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ, কারণ পাবলিক মাঝে মাঝে খুব হিংস্র হয়ে যায়, যখন তাদের চাহিদা পূরণ হয় না। আমি যদি স্কুলশিক্ষকের চাকরি নিতাম খুব ভালো হতো। তাহলে আমাকে এ ধরনের পাবলিককে মোকাবিলা করতে হতো না। এখন আমাকে শত রকমের লোকের সঙ্গে মিশতে হয়। শিক্ষক হলে শুধু ছাত্রছাত্রী এবং সহকর্মীদের সঙ্গে মিশতে হতো। এ ছাড়া সমাজে শিক্ষকতা পেশাটি মর্যাদাপূর্ণ।’

গোঁয়ার পাবলিককে এড়ানোর জন্য নার্সরা নানা কৌশল অবলম্বন করেন। মাঝে মাঝে তাঁরা ডিউটি রুম থেকে বের হয়ে যান। মাঝে মাঝে তাঁরা রোগী ও তাদের স্বজনদের কথায় কোনো কর্ণপাত করেন না। তবে তাঁরা সব সময় সতর্ক থাকেন, যেন পাবলিকের সঙ্গে তাঁদের কোনো ধরনের বিরোধ বা কলহ না বাধে।

একজন নার্স বলেন, ‘রোগীর স্বজনেরা সব ধরনের অনুরোধ নিয়ে আমাদের কাছে আসে। কেউ বলে, স্যালাইনের ড্রিপটা মনে হয় ধীরে পড়ছে, একটু দেখুন না অথবা সিস্টার আমার রোগীর পেটে ভীষণ ব্যথা করছে, এদিকে একটু আসুন না। বেশির ভাগ সময় এগুলো মিথ্যা অভিযোগ। আমি চেষ্টা করি তাদের এড়িয়ে চলতে, কিন্তু যখন বুঝতে পারি তারা তাদের ধৈর্য হারাচ্ছে, তখন আমি সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য রোগীর পাশে যাই।’

যা হোক যেসব নার্স এই তিক্ত অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে গেছেন, তাঁরা ‘পাবলিক’ যখন রেগে যায়, তখন তাদের এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেন। এ ধরনের পরিস্থিতির উদ্ভব হলে হয় তাঁরা চুপ থাকেন, নয়তো তাঁরা ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন। ডাক্তার, ওয়ার্ড বয় বা ক্লিনারদের মতো পাবলিকের ওপর চেঁচামেচি করেন না বা তাদের বকাঝকা করেন না। নারী নার্সরা উপলব্ধি করেন যে তাঁরা রোগীর পুরুষ আত্মীয়স্বজনদের নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম নন। আর রোগীর পুরুষ স্বজনেরাও আশা করেন যে নারী নার্সরা নারীদের মতোই আচরণ করবেন। বেশি চেঁচামেচি তাঁরা করবেন না।

একজন নার্স বলেন, ‘আমি লোকজনের সঙ্গে কোনো ঝগড়ায় যাই না। এটা পুরুষশাসিত সমাজ। তারা মনে করে, কেন আমি একজন মহিলার কথা শুনব। মেয়েলোকে কী জানে?’

ডাক্তারই হচ্ছেন বস, কিন্তু...

হাসপাতালের নিয়ম অনুযায়ী নার্সরা ডাক্তারের অধস্তন। ডাক্তাররা নির্দেশ দেন আর নার্সরা তা পালন করেন। তবে ভিন্ন ভিন্ন কর্তৃপক্ষ থাকায় নার্সরা নির্দেশ ঠিকমতো পালন না করলেও ডাক্তাররা নার্সদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেন না। যদিও নার্সদের মূল্যায়নের জন্য ম্যাট্রন এবং পরিচালকেরা ডাক্তারের মন্তব্যের ওপর নির্ভর করেন। এটা খুব সাধারণ একটি দৃশ্য যে ডাক্তাররা নার্সদের ভুলের জন্য বকাঝকা করছেন, কিন্তু নার্সরা উচ্চবাচ্য না করে নীরব থাকেন। তবে কখনো কখনো এমনও দেখা যায় যে নার্সরা যখন বুঝতে পারেন ভুলটা তাঁদের নয়, তখন তাঁরা এ নিয়ে ব্যাপক রসিকতা করেন।

তবে জুনিয়র ডাক্তার বা শিক্ষানবিশ ডাক্তারদের ক্ষেত্রে অবশ্য নার্সরা এমন সহনশীলতা প্রদর্শন করেন না। তাঁরা কখনো কখনো তাঁদের নির্দেশ অমান্য করেন। কখনো কখনো তাঁরা চিকিত্সা দেরি করে শুরু করার জন্য শিক্ষানবিশ ডাক্তারদের অভিযুক্ত করেন। একদিন একজন সিনিয়র স্টাফ নার্স একজন শিক্ষানবিশ ডাক্তারের উদ্দেশে বলেন, ‘এই রোগীকে ভর্তি করা হয়েছে দুপুর একটায়, এখন সন্ধ্যা সাতটা বাজে। এখন পর্যন্ত আপনারা রোগীকে দেখেননি। রোগী এখন আমার ওপর বিরক্ত। আপনি চিকিত্সা দিতে দেরি করেছেন অথচ রোগী আমার ওপর রেগে যাচ্ছে।’

আরেকটি ঘটনায়, ডাক্তার দেখার আগেই একজন স্টাফ নার্স নতুন ভর্তি হওয়া রোগীকে একটি অ্যান্টিবায়োটিক ইনজেকশন দেন। কর্তব্যরত শিক্ষানবিশ চিকিত্সক এতে খুব বিরক্ত হন। তিনি বলেন, ‘কেন আপনি আমাকে জিজ্ঞেস না করে রোগীকে ইনজেকশন দিলেন?’ নার্স তখন উত্তর দিলেন, ‘কতক্ষণ আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করব? আমি জানি এই রোগীর খুব দ্রুত অ্যান্টিবায়োটিক ইনজেকশন দরকার। আমি এখানে পাঁচ বছর ধরে কাজ করছি।’

একজন শিক্ষানবিশ চিকিত্সক আমাকে বলেছেন, ‘নার্সরা যা করেন, তার তল পাওয়া কঠিন। ইন্টার্ন ডাক্তারদের নির্দেশ না মানাটা তাঁদের একটা প্রবণতা। একটি ফরসেপের জন্য আমাদের তাঁদেরকে তিনবার অনুরোধ করতে হয়।’

নার্স ও ডাক্তারদের মধ্যে আরও মারাত্মক সব দ্বন্দ্ব হয়। আমার মাঠগবেষণা শুরুর আগে অন্য একটি ইউনিটের একজন মেডিকেল অফিসার একজন নার্সকে তাঁর ভুলের জন্য চড় মারেন। এ ঘটনা এই হাসপাতালের নার্সদের মাঝে ক্ষোভের জন্ম দেয় এবং প্রতিবাদে সব নার্স একযোগে ধর্মঘট ডাকেন। এ ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি ওই ডাক্তারকে অন্য বিভাগে বদলি করে দেয়। এতে নার্সরা সন্তুষ্ট হয়ে এক সপ্তাহ পর কাজে ফিরে আসেন।

নার্সদের অনুধাবন হচ্ছে তাঁরা ডাক্তারদের যে গুরুত্বপূর্ণ সহযোগিতা করে থাকেন তা ডাক্তাররা স্বীকার করেন না। এ ব্যাপারে একজন নার্সের মন্তব্য হচ্ছে, ‘প্রতিটি রোগীর তথ্য আমাদের কাছে থাকে। ওয়ার্ডের অবস্থা জানার জন্য ডাক্তারদের সব সময় আমাদের জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজন পড়ে। যেহেতু আমরা পেপারওয়ার্ক করি, তাই ওয়ার্ডের সম্পূর্ণ পরিস্থিতি সম্পর্কে আমাদের জানা থাকে। আপনি একজন ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করুন, তিনি আপনাকে সব তথ্য দিতে পারবেন না। আমরা যদি অপারেশন থিয়েটারের জন্য একজন রোগীকে প্রস্তুত করে না দিই বা তার পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাগজপত্র ঠিকমতো সরবরাহ না করি তাহলে ডাক্তাররা ওই রোগীর অস্ত্রোপচার করতে পারবেন না। কিন্তু তাঁরা আমাদের কোনো কৃতিত্ব দিতে চান না। তাঁরা মনে করেন, আমরা ফাঁকিবাজ।’

তবে নার্সদের সঙ্গে ডাক্তারদের রসিকতাপূর্ণ গালগল্পও হয়ে থাকে। যদিও আমি কখনো দেখিনি কোনো নার্স গল্প করার জন্য ডাক্তারদের রুমে গেছেন। বরং ডাক্তাররাই নার্সদের রুমে আসেন গল্প করার জন্য। ডাক্তারদের সঙ্গে নার্সদের প্রেম, ভালোবাসা এমনকি বিয়ের ঘটনাও শোনা যায়, যদিও তাঁদের সামাজিক মর্যাদা সমান নয়। তবে এটা খুবই বিরল। আমি যে ওয়ার্ডে গবেষণা চালিয়েছি সেখানে এ রকম কিছু হতে দেখিনি। তবে রসিকতাপূর্ণ মন্তব্য করা অস্বাভাবিক কোনো ঘটনা নয়। একজন সিএ দুজন শিক্ষার্থী নার্সকে কড়া স্বরে ধমক দেওয়ার পর একজন নার্সিং সুপারভাইজার তাঁর উদ্দেশে বলেন, ‘আপনি মেয়েদের প্রতি একেবারেই কঠিন। আপনার হূদয়ে কিছু কোমলতা থাকা দরকার। প্রেম করেন, বিয়ে করেন। তখন আপনি শিখবেন কী করে মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে হয়।’

নার্সরা কোনো গ্ল্যামার গার্ল নয়

যদিও সেবা করার উদ্দেশ্য নিয়ে কিছু নার্স এই পেশায় আসেন, তবে বেশির ভাগের উদ্দেশ্য হচ্ছে অর্থ রোজগার করা। নিচের মন্তব্যগুলো পড়লেই তা বোঝা যাবে:

আমরা পাঁচ বোন, কোনো ভাই নেই। আমার বাবা সব সময় ছোট চাকরি করেছেন। তাঁর পক্ষে স্বল্প আয় দিয়ে সংসার চালানো কঠিন ছিল। বাড়ির বড় মেয়ে হিসেবে আমি ভাবলাম, আমাকে টাকা রোজগার করতে হবে এবং বাবাকে সাহায্য করতে হবে। আমার বাবার পক্ষে আমাকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করা সম্ভব ছিল না। আমাদের সেই সময়ে নারীদের জন্য খুব বেশি চাকরির সুযোগ ছিল না। নার্সিং পেশাটাই ছিল সবচেয়ে ভালো।

আমার একজন খালা নার্স ছিলেন। আমি তাঁর সঙ্গে প্রায়ই হাসপাতালে আসতাম। এ সময় নার্সদের সাদা পোশাক দেখে আমার খুব ভালো লাগত। তখন আমি স্বপ্ন দেখতাম, আমি একদিন এই পোশাক পরব। আমার পরিবার আর্থিকভাবে সচ্ছল ছিল না। তাই আমি চাইতাম আর্থিকভাবে স্বাধীন হতে। আমার উচ্চশিক্ষা ছিল না। তাই আমি নার্সিং পেশাকেই বেছে নিয়েছি।

আমার বিয়ের দুই বছর পর আমার স্বামী মারা যান। এক বছরের বাচ্চাকে নিয়ে বাঁচার জন্য আমি চাকরি খুঁজতে থাকি। আমার যা শিক্ষা ছিল তাতে নার্সিং পেশাই আমার জন্য ঠিক মনে হয়েছে। একসময় আমি নান হতে চেয়েছিলাম। নার্সিং পেশা আমাকে সৃষ্টিকর্তার সেবা করারও সুযোগ এনে দিয়েছে। এটা আমাকে অর্থনৈতিকভাবে বেঁচে থাকার সুযোগ করে দিয়েছে।

কিছু নার্স আমাকে বলেছেন, বহু বিধবা ও দুস্থ নারী নার্সিং পেশায় এসেছেন, কারণ এটা তাঁদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভিত্তি দিয়েছে। যদিও নার্সিং পেশায় আসার কারণে অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হয়েছে, তা সত্ত্বেও বেশির ভাগ নার্স তাঁদের সামাজিক ভাবমূর্তিতে অসন্তুষ্ট। তাঁরা অনুভব করেন যে একই শিক্ষাগত যোগ্যতার অন্য পেশার লোকের তুলনায় তাঁরা কম মর্যাদা পান। তবে কিছু পুরুষ নার্স আবার এমনটা মনে করেন না। নারী নার্সরা তাঁদের শ্রদ্ধার চোখে না দেখার কয়েকটি কারণ উল্লেখ করেছেন।

প্রথমটি হচ্ছে নার্সরা অনুভব করেন যে লোকজন মনে করে, নার্সিং একটি অনৈতিক পেশা, বিশেষ করে এ কারণে যে তাঁরা রাতের বেলা ডাক্তার ও অন্য পুরুষদের সঙ্গে হাসপাতালে অবস্থান করেন।

লোকজন মনে করে যে আমাদের কাজ শোভন নয়। আমরা রাতের বেলা কাজ করি। একজন মুসলিম নারীর জন্য রাতের বেলা বাড়ির বাইরে থাকা খারাপ। তারা মনে করে নার্সদের সঙ্গে ডাক্তার ও অন্য পুরুষ কর্মীদের অবৈধ সম্পর্ক রয়েছে। এ কারণে নার্সদের বিয়ে করার ক্ষেত্রে অনেক সমস্যার মুখে পড়তে হয়। আমার এক সহকর্মী নার্সের সঙ্গে একজন ডাক্তারের প্রেম হয় এবং তাঁরা বিয়েও করেন। কিন্তু ডাক্তারের পরিবার এই বিয়ে মেনে নেয়নি। তাঁর পরিবার বিয়েতে আসেনি। তাদের মতে, একজন ডাক্তারের একজন নার্সকে বিয়ে করা লজ্জার।

দ্বিতীয়ত, নার্সরা মনে করেন, লোকজন তাঁদের নিচু নজরে দেখে, কারণ তারা দরিদ্র পরিবার থেকে এসেছে এবং নার্সিংয়ের কাজটিকে তারা নোংরা বলে মনে করে।

আমাদের একজন সহকর্মী বিশেষ প্রশিক্ষণের জন্য লন্ডন যান। তিনি দেখেছেন ধনী পরিবারের শিক্ষিত মেয়েরা নার্সিং পেশায় এসেছেন, তাই তাঁরা সম্মানিত হন। এখানকার লোকজন মনে করে, এসব মেয়ে দরিদ্র পরিবার থেকে এসেছেন, নোংরা কাজ করে তাঁরা অর্থ উপার্জন করেন। সে জন্য তারা আমাদের কোনো দাম দেয় না।

সর্বশেষ, নার্সরা মনে করেন, যেহেতু ডাক্তাররা এবং ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ নার্সদের দাম দেয় না তাই লোকজনও নার্সদের দাম দেয় না।

ডাক্তাররা সব সময় আমাদের লোকজনের সামনে বকাঝকা করেন। যখন সুপারিনটেনডেন্ট আমাদের কাজ পরিদর্শনে আসেন, তখন তিনিও সবার সামনে আমাদের বকা দেন। তাহলে কীভাবে লোকজন আমাদের দাম দেবে?

আলোচনা

আমার গবেষণায় যা পেয়েছি তা হলো নার্সদের কাজের সময়ের বেশির ভাগ কাটে পেপারওয়ার্ক করে। তাঁরা খুব কমই সেবা বা চিকিত্সাসংক্রান্ত কাজ করেন। রিপোর্ট, রেজিস্টার খাতা আর ফাইল নিয়ে দৌড়াদৌড়িতে তাঁদের সময় কাটে। তাঁরা মূলত প্রশাসনিক রেকর্ড এবং ওয়ার্ডের সরঞ্জামের হেফাজতকারী। রোগীদের সেবা দেওয়ার কাজটি তাঁরা খুব কমই করেন। রোগীর দেখভালের কাজটি রোগীর আত্মীয়স্বজনেরাই করে থাকেন। রোগীদের কোনো আবেগগত সমর্থনও নার্সরা দেন না। তাঁদের চিকিত্সাসংক্রান্ত কাজ ওষুধ বিতরণ, ইনজেকশন দেওয়া, ক্ষতস্থান ড্রেসিং করা এবং অস্ত্রোপচারের সময় ডাক্তারকে সাহায্য করার মধ্যে সীমাবদ্ধ। এ ছাড়া কোনো ওয়ার্ডে রোগী গ্রহণের সময় তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলা, ভর্তির পর কাগজপত্রে রোগীর সই নেওয়া, শয্যা প্রস্তুত করা, রোগীর খাবার পর্যবেক্ষণ করা এবং রোগীদের কোনো এক্সারসাইজের প্রয়োজন হলে তা করানোর কাজটি নার্সরা করে থাকেন।

আমার এই পর্যবেক্ষণ ২০০৭ সালে হ্যাডলি ও রকোয়েসের করা গবেষণার সঙ্গে মিলে যায়। ওই গবেষণায় বলা হয়, বাংলাদেশি নার্সদের কাজের সময়ের মাত্র ৫.৩ শতাংশ তাঁরা সরাসরি রোগীর পেছনে ব্যয় করেন অর্থাত্ সরাসরি রোগীর সংস্পর্শে আসেন। হ্যাডলি ও রকোয়েস দেখেছেন, নার্সদের কাজের সময়ের ২২.৬ শতাংশ ব্যয় হয় পেপারওয়ার্ক করে, ৫০.১ শতাংশ ব্যয় হয় গল্পগুজব ও সেলাই ইত্যাদি কাজ করে এবং বাকি সময় ব্যয় হয় রোগীদের ওষুধ দেওয়া এবং ওয়ার্ডের নানা টুকটাক কাজে।

১৮ শতকের শেষ দিকে বিশ্বে নার্সিং পেশার উদ্ভব হয়। ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের অবদানের কারণে নারীদের জন্য এই পেশাকে সম্মানজনক পেশা হিসেবে দেখা হতো। ক্রিমিয়ার যুদ্ধের সময় আহত লোকজনকে সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর প্রচেষ্টার কারণে তাঁর নাম হয়েছিল ‘লেডি উইথ দ্য ল্যাম্প’, যিনি কিনা একজন আদর্শ, নিবেদিতপ্রাণ, স্নেহময়ী, আত্মত্যাগী নারী। সেবাদানের ক্ষেত্রে যাঁর কোনো ক্লান্তি নেই। নার্সরা যাতে এমন ভাবমূর্তি বজায় রাখেন সে জন্য পরে ট্রেনিং ইনস্টিটিউট গড়ে তুলে নার্সদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হলো।

কয়েক দশক আগে কোসার যুক্তরাষ্ট্রের মাউন্ট হারমন হসপিটালের নার্সদের ‘মায়ের মতো’ হিসেবে অভিহিত করেন। তবে তিনি তখন নার্সদের সম্পর্কে যা লিখেছিলেন, তা হয়তো এখনকার নার্সদের সঙ্গে পুরোপুরি মিল নেই। এখন তাঁরা অনেক বেশি পেশাদার। এখানে আবেগের জায়গা কম।

নার্সদের ইংরেজিতে বলা হয় সিস্টার। এই সম্বোধন দিয়ে এটা বোঝানো হয় যে নার্স এমন একজন ব্যক্তি, যিনি রোগীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ। একইভাবে ‘অসুস্থের সেবা করো’ এবং ‘শিশুর সেবা করো’ বাক্য দুটি বোঝায় যে নার্স মানে এমন একজন ব্যক্তি, যিনি রোগীকে সেবা দেবেন, যে সেবায় থাকবে আবেগ।

গত কয়েক দশকে ব্রিটেনে নার্সদের ভূমিকা পর্যালোচনা করে আর্মস্ট্রং বলেন, ডাক্তারদের বিপরীতে ব্রিটেনের নার্সরা রোগীকে সেবাদানের ক্ষেত্রে বড় ধরনের ভূমিকা পালন করছেন। তিনি লিখেছেন, চিকিত্সা সরঞ্জামাদি নিয়ে চলাফেরা করার কারণে রোগীরা অনেক সময় ডাক্তারকে বিপজ্জনক মনে করে। সে তুলনায় নার্সকে তাঁদের আপনজন মনে হয়। নার্সরা সব সময় রোগীর পাশে থাকেন, তাঁদের সব সুবিধা-অসুবিধার দিকে খেয়াল রাখেন এবং যত্ন নেন। ফলে রোগী ও নার্সের মধ্যে একটা নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

বিয়ার্ডউড, ওয়ালটারস, আইলেস এবং ফেঞ্চ (১৯৯৯) লিখেছেন, কীভাবে কানাডার নার্সরা রোগীদের আনুষ্ঠানিক অভিযোগের ভিত্তিতে তাঁদের পেশাকে পুনর্গঠন করেছেন। এরপর থেকে তাঁরা আরও বেশি রোগীবান্ধব হয়েছেন। উলফ (২০০৬) লিখেছেন, রোগীদের প্রতি যথাযথ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হওয়ার কারণে যুক্তরাষ্ট্রের নার্সদের আফসোস করতে দেখা গেছে।

যা হোক, পশ্চিমা দেশগুলোর নার্সদের এই ভাবমূর্তি আমাদের দেশের নার্সদের নেই। বেশ কয়েকটি কারণে বাংলাদেশের নার্সদের ভূমিকা পশ্চিমাদের চেয়ে ভিন্ন। বাংলাদেশি নার্সরা তেমন ভূমিকায় থাকবেন তা সামাজিকভাবে বা অবকাঠামোগতভাবে সম্ভব নয়। ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের মতো ‘লেডি উইথ দ্য ল্যাম্প’ হওয়া তাঁদের পক্ষে সম্ভব নয়। বাংলাদেশের নার্সদের ক্ষেত্রে ‘অসুস্থকে সেবা করো’ বা ‘শিশুকে সেবা করো’ এসব ধারণা এখন অনুপস্থিত। নার্সের বাংলা শব্দ হলো সেবিকা। এর অর্থ হলো যিনি সেবা দান করেন। কিন্তু বর্তমানে সেবিকা শব্দটিই আর উচ্চারণ হয় না। এখন নার্স আর রোগীর মধ্যে কোনো বিশেষ সম্পর্ক গড়ে ওঠে না। তা ছাড়া নার্স ও রোগীর অনুপাত এতই কম যে তাঁদের পক্ষে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া সব রোগীর যত্ন নেওয়া সম্ভব নয়। এ ছাড়া হাসপাতাল থেকে তাঁদের যা সরবরাহ করা হয়, তা দিয়ে রোগীদের প্রতি মায়ের মতো যত্ন নেওয়া তাঁদের পক্ষে সম্ভব হয় না।

কর্মকার (১৯৯৩) লিখেছেন, ১৯৪৭ সালে ঢাকায় প্রথম সিনিয়র নার্সিং স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়। একজন ব্রিটিশ ম্যাট্রন এর প্রধান ছিলেন। ভারত ও পাকিস্তান ভাগ হয়ে যাওয়ার পর মাত্র ৫০ জন নার্স ভারত থেকে এখানে আসেন। এ দেশ তখন পূর্ব পাকিস্তান নামে পরিচিত। এদের মধ্যে ৮ জনকে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য ১৯৪৯ সালে লন্ডনে পাঠানো হয়। ফিরে আসার পর এই নার্সদের বেশির ভাগই নার্সিং সেবায় নেতৃত্ব দেন। ১৯৭০ সালে প্রথম বাংলাদেশি নার্সিং কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বেশ কয়েকটি আন্ডারগ্র্যাজুয়েট ও পোস্টগ্র্যাজুয়েট নার্সিং ইনস্টিটিউট গড়ে ওঠে এবং একটি পৃথক অধিদপ্তরও প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে দেশে পেশাদার নার্সদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও এর মূল তাত্পর্য ও চরিত্র হারিয়ে গেছে।

বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে যখন হাসপাতালগুলোতে আমলাতান্ত্রিকতা শুরু হলো তখন নির্ধারিত কাজের বাইরেও নার্সদের দিয়ে নতুন নতুন কাজ করানো শুরু হলো। যেমন: প্রশাসনিক কাজ, কেরানির কাজ ইত্যাদি। কিন্তু বাংলাদেশে এমনটি হচ্ছে প্রশাসনিক কাজে দক্ষ লোকবলের অভাবে। কর্মকার (১৯৯৩) দেখেছেন, নার্সদের বেশির ভাগ সময় কেটে যায় পেপারওয়ার্ক করতে করতে। রোগীকে সেবাদানের কাজটি বলতে গেলে তাঁদের দিয়ে আর হয় না। এর ফলে তাঁরা আর রোগীদের কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ পান না। রোগী এবং তার স্বজনদের অভিযোগও আর শোনা হয় না তাঁদের। ভ্যান ডনগেন ও এলেমা তাঁদের বডিওয়ার্ক অব নার্সিং বইতে নার্সদের কাজ সম্পর্কে যে আলোচনা করেছেন তার সঙ্গে বাংলাদেশের নার্সদের কাজের কোনো মিল নেই। নার্সিং পেশায় রোগীর সংস্পর্শে আসাটা খুবই জরুরি। কারণ রোগী তাদের দৈনন্দিন কাজকর্ম, যেমন মুখ-হাত ধোয়া, খাওয়া, বিছানা থেকে ওঠা, জামাকাপড় পরিবর্তনের জন্য নার্সদের ওপর নির্ভরশীল।

বাংলাদেশের নার্সরা খুব কমই রোগীর দেহ স্পর্শ করেন। সাধারণত রোগীর সঙ্গে থাকা স্বজনেরাই রোগীর এ কাজগুলো করে দেন। রোগীকে সুরক্ষা দেওয়া ও সহানুভূতি জানানোর কাজটি স্বজনেরাই করেন, নার্সরা নয়। এ ছাড়া এ দেশের নার্সরা রোগীদের সামাজিকীকরণের এজেন্ট নন বা তাঁরা চিকিত্সক ও রোগীদের মধ্যকার মধ্যস্থতাকারী নন, যা কিনা পশ্চিমা দেশগুলোর নার্সরা করে থাকেন। মাঝে মাঝে বাংলাদেশি নার্সরা অবশ্য মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করেন। তাঁরা ডাক্তারদের দেওয়া পরামর্শই আবার রোগীদের দেন। এটা খুব কমই দেখা যায় যে কোনো বাংলাদেশি রোগী নার্সদের সঙ্গে গল্পগুজব করার চেষ্টা করছেন।

সিয়োরটিনো (১৯৯২) ইন্দোনেশিয়ার নার্সদের এই পরিবর্তিত ভূমিকা দেখেছেন। তিনি বলেছেন, ইন্দোনেশিয়ার গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে নার্সদের আনুষ্ঠানিক এবং আসল ভূমিকার মধ্যে অমিল রয়েছে। রোগীকে সেবা দেওয়ার বদলে তাঁরা মূলত রোগীর চিকিত্সা করেন। প্রয়োজনীয় চিকিত্সকের অভাব থাকায় এবং প্রশাসনিক সীমাবদ্ধতার কারণে তাঁরা এ কাজ করেন। নার্সিংয়ের কাজ বাদ দিয়ে তাঁরা রোগীর চিকিত্সা করেন। সিয়োরটিনো লিখেছেন, ইন্দোনেশিয়ার নার্সদের যা করা উচিত এবং যা তাঁরা শিখেছেন, তা তাঁরা করছেন না। ডিগবাই ও সুইট (২০০০) দক্ষিণ আফ্রিকার নার্সদের এই পরিবর্তিত ভূমিকা দেখেছেন। এটা দুঃখ ও উদ্বেগের বিষয় যে বাংলাদেশি নার্সরা তাঁদের পেশাকে পশ্চিমা দেশগুলোর নার্সদের চেয়ে ভিন্নতর বিবেচনা করেন। বাংলাদেশের নার্সদের হতাশার সবচেয়ে বড় উত্স হচ্ছে নার্স হিসেবে তাঁদের সামাজিক ভাবমূর্তি। নার্সিং পেশাকে এখানে সম্মানজনক বা মহান পেশা হিসেবে বিবেচনা করা হয় না।

বেগম ১৯৯৩ সালে দেখেছেন, বাংলাদেশের একমাত্র নার্সিং কলেজের ২০৮ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ৮০ শতাংশই তাঁদের এই নিম্ন সামাজিক মর্যাদা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। নার্সদের সামাজিক মর্যাদা নিম্ন হওয়ার পেছনের কারণ হচ্ছে তাঁদের নিম্ন আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট। নার্সদের বেশির ভাগই আসেন দরিদ্র পরিবার থেকে। বেগম তাঁর গবেষণায় দেখেছেন, নার্সদের সংখ্যাগরিষ্ঠ আসে দরিদ্র, কৃষিভিত্তিক পরিবার থেকে। এঁদের অনেকে বিধবা এবং নিঃস্ব বা সুবিধাবঞ্চিত, যাঁদের সামাজিক মর্যাদা নিম্ন। পেশাগত ক্ষেত্রে চিকিত্সকেরা নার্সদের তাঁদের অধস্তন বিবেচনা করেন (নাহার, ১৯৯১)।

বাংলাদেশে বিদ্যমান ধর্মীয় ধারণায়ও নার্সদের পেশা সম্পর্কে নেতিবাচক মতামত উঠে আসে। হিন্দু ধর্মমতে, হিন্দু জাতিভেদ প্রথা গড়ে উঠেছে এমন এক ধর্মীয় নীতির ওপর, যেখানে শুদ্ধ্যশুদ্ধির বিষয়টিকে খুব গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়। এই ধর্মে ক্রমাধিকারতন্ত্রের মূল কথা হচ্ছে ‘অশুদ্ধের ওপর বিশুদ্ধের শ্রেষ্ঠত্ব’। নার্সরা যে ‘নোংরা কাজটি’ করেন তা নিচু জাতের লোকেরাই করে থাকেন।

কিরকপ্যাট্রিক (১৯৭৯) আলোচনা করেছেন, ভারতে কীভাবে নার্সিং পেশাটা সামাজিকভাবে কলঙ্কজনক বলে মনে করা হয়। বাংলাদেশি হিন্দু নার্সরা এ ব্যাপারে তাঁদের উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

মুসলমান নার্সদের বেলায় চাকরির ধরনের কারণে বাড়ির বাইরে রাত কাটাতে হয়, যা কিনা নৈতিক দিক দিয়ে অবমাননাকর। একজন নার্স উল্লেখ করেছেন কীভাবে একজন চিকিত্সকের পরিবার অসম্মানিত বোধ করেছেন যখন তাঁদের ছেলেটি একজন নার্সকে বিয়ে করলেন। হারুন ও বানু আলোচনা করেছেন, কেন ঔপনিবেশিক ও পাকিস্তান আমলে বাংলাদেশের মুসলমান নারীরা নার্সিং পেশায় আসতে অনিচ্ছুক ছিলেন।

হ্যাডলি ও অন্যান্য (২০০৭) লক্ষ করেছেন, নার্সিং পেশার ব্রিটিশ মডেল এবং বাংলাদেশের সামাজিক নিয়মের মধ্যে দ্বন্দ্ব রয়েছে। তাঁরা বলেছেন, রাতের পালায় কাজের কারণে নার্সদের অনেক অচেনা লোকের সংস্পর্শে আসতে হয়। এ ছাড়া তাঁদের কাজকে ‘নোংরা’ হিসেবে বিবেচনা করায় নার্সরাও সমাজের কলঙ্ক হিসেবে বিবেচিত হন।

মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কিছু মুসলিম দেশে একই অবস্থা দেখা যায়। এল সানাবারি (১৯৯৬) সৌদি আরব এবং মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশে নার্সদের সামাজিক ভাবমূর্তি নিয়ে গবেষণা করেছেন। তিনি দেখেছেন ওই সব দেশে নার্সদের ভাবমূর্তি নেতিবাচক। ওই সব দেশের লোকদের ধারণা, নার্সরা বিপরীত লিঙ্গের মানুষের সঙ্গে বেশি মেলামেশা করে, যেখানে তা করা নিষেধ। ওই সব দেশে সাধারণভাবে মনে করা হয়, নার্সরা নৈতিক দিক দিয়ে অসত্ এবং তাঁরা বিভিন্ন অবৈধ সম্পর্কে জড়িত।

এল সানাবারি লিখেছেন, অন্যদিকে পশ্চিমা সাহিত্যে নার্সদের পবিত্র এবং পুণ্যবান হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে নার্সদের সম্পর্কে মনোভাব এই পেশাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।

এই গবেষণায় আমি দেখিয়েছি বাংলাদেশি নার্সদের ভূমিকা, ভাবমূর্তি ও উদ্বেগ সম্পর্কে, যা নার্সিং পেশার যে আদর্শ ভাবমূর্তি রয়েছে তার সঙ্গে অমিল রয়েছে। বিশ্বের আর সব দেশে যেভাবে নার্সিং পেশার চর্চা করা হয়, বাংলাদেশে সেভাবে চর্চা করা হয় না। বাংলাদেশি নার্সদের মধ্যে ত্যাগের মনোভাব নেই। ‘লেডিস উইথ ল্যাম্প’ ভাবমূর্তির বদলে তাঁরা বিরক্ত, হতাশায় পরিপূর্ণ নারী, যাঁরা কিনা রোগীদের সেবাদানের চেয়ে ফাইল ও রেজিস্টার খাতা নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকেন। নার্সদের এই পরিবর্তিত ভূমিকা বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশে জনশক্তি ঘাটতির কথাই মনে করিয়ে দেয়। অন্যদিকে নার্সিং পেশার নেতিবাচক ভাবমূর্তি থেকে আমরা নারীদের নৈতিকতা এবং সামাজিক মর্যাদা সম্পর্কে সমাজের মূল্যবোধগুলো দেখতে পাই। এখান থেকে বোঝা যায় যে বাংলাদেশের সমাজ নারীদের বিচ্ছিন্ন করে রাখার ধারণাকে সমর্থন করে এবং কায়িক শ্রমকে কম সম্মান দেয়।

* অনুবাদ: রোকেয়া রহমান

তথ্যসূত্র:

Armstrong, D. (1983). The fabrication of nurse-patient relationship. Social Science & Medicine, 17, 457-460.

            Beardwood, B., Walters, V., Eyles, J., & French, S. (1999). Complaints against nurses: A reflection of the new managerialism and consumerism in health care? Social Science & Medicine, 48(3), 363-374.

            Begum, C. S. (1993). A study on nurses opinion about their own profession. Dissertation. Dhaka, Bangladesh: National Institute of Preventive and Social Medicine (NIPSOM).

            Coser, R. (1962). Life in the ward. East Lansing, MI: Michigan State University Press.

            Digby, A., & Sweet, H. (2001). Nurses as cultural brokers in twentieth-century South Africa. In W. Ernst (Ed.), Plural medicine, tradition and modernity 1800-2000. London: Routledge.

            Dumont, L. (1980). Homo hierarchicus: The caste system and

its implications. Chicago: University Press. [Original French edition 1966]

            Ehrenreich, B., & English, D. (1973). Witches, midwives and nurses. London: Writers & Reader Publishing Cooperative.

            El-Sanabary, N. (1996). Women and the nursing profession in Saudi Arabia. In S. Sabbagh (Ed.), Arab women: Between defiance and restraint. New York: Olive Branch Press.

            Hadley, M. B., Blum, L. S., Mujaddid, S., Parveen, S., Nuremowla, S., Haque, M. E., et al. (2007). Why Bangladeshi nurses avoid “nursing”: Social and structural factors on hospital wards in Bangladesh. Social Science & Medicine, 64(6),

1166-1177.

            Hadley, M. B., & Roques, A. (2007). Nursing in Bangladesh: Rhetoric and reality. Social Science & Medicine, 64(6),

1153-1165.

            Harun, S., & Banu, A. (1991). Nursing in Bangladesh. Journal of the College of Nursing, Bangladesh, 1(1), 25-28.

            Johnson, J. L. (1997). Generalizibility in qualitative research: Excavating the discourse. In J. M. Morse (Ed.), Completing a qualitative project. London: Sage.

            Karmakar, R. (1993). An assessment of nursing care provided by nursing staff personnel in a selected hospital. Dissertation.

Dhaka, Bangladesh: National Institute of Preventive and Social Medicine (NIPSOM).

            Kirkpatrick, J. (1979). The sociology of an Indian hospital. Calcutta, India: Firma KLM Private.

            Nahar, S. (1991). A study of doctors’ attitudes towards nurses in two hospitals of Dhaka. Dissertation. Dhaka, Bangladesh: National Institute of Preventive and Social Medicine (NIPSOM).

            Savage, J. (2000). Participative observation: Standing in the shoes of others? Qualitative Health Research, 10, 324-339.

            Sciortino, R. (1992). Caretakers of cure: An anthropological study of health centre nurses in rural central Java. Bulaksumur India: Gadjah Mada University Press.

            Simpson, I. H. et al. (1979). From student to nurse: A longitudinal study of socialization. Cambridge: Cambridge University Press.

            Van der geest, S., & Finkler, K. (2004). Hospital ethnography: Introduction. Social Science & Medicine, 59(10), 1995-2001.

            Van Dongen, E., & Elema, R. (2001). The art of touching: The culture of “body work” in nursing. Anthropology & Medicine, 8(2/3), 149-162.

            William, S. M. (2002). Generalization in interpretative research. In T. May (Ed.), Qualitative research in action. London: Sage.

            Wolf, Z. R. (2006). “Never again” stories of nurses: Dilemmas in nursing practice. Qualitative Health Research, 16, 1191-1206.

            Zaman, S. (2005). Broken limbs, broken lives: Ethnography of a hospital ward in Bangladesh. Amsterdam: Het Spinhuis.

            Zaman, S. (2008). Native among the natives: Physician anthropologist doing hospital ethnography at home. Journal of Contemporary Ethnography, 37(1), 135-154.