সারসংক্ষেপ
অর্থনৈতিক অ্যাকাডেমিক মহলে নব্য উদারনীতিবাদ একটি পরিচিত ধারণা। ব্যাপারটা যেন এমন, দুনিয়ার অর্থনীতি এ ধারাতে চলছে এবং ভবিষ্যতেও চলবে। পৃথিবী নব্য উদারনীতিবাদী ধারা থেকে কখনো বেরোতে পারবে, বেশির ভাগ মানুষই এটা ভাবতে পারে না। কথা হচ্ছে, ১৯৭০-এর দশকে ভিয়েতনাম যুদ্ধের কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নব্য ব্যালান্স অব পেমেন্টের ঘাটতিতে পড়লে রক্ষণশীল অর্থনীতিবিদেরা তত্ত্ব দেন, কেইনসের অঙ্গীভূত উদারনীতিবাদ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তাঁরা বললেন, ধনীদের হাতে আরও বেশি করে টাকা তুলে দিতে হবে। তাঁদের সেই টাকা বিনিয়োগের জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত সেবা খাত বেসরকারীকরণ করতে হবে। ফলে তাঁরা সেখানে যে টাকা বিনিয়োগ করবেন, তার কিয়দংশ চুইয়ে চুইয়ে প্রান্তিক মানুষের হাতে যাবে। এতে তাদের জীবনমান উন্নত হবে। এ লক্ষ্যে রিগ্যান যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ করের হার ৭০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৮ শতাংশে নামিয়ে আনেন, আর ক্যাপিটাল গেইন করের হার কমিয়ে ২০ শতাংশে নামিয়ে আনেন, যেটা ছিল মহামন্দা-উত্তর যুগের সর্বনিম্ন। কিন্তু দেখা গেল, এর ফলে মানুষে-মানুষে ব্যবধান অনেক বেড়ে গেল। আয় ও সম্পদের বৈষম্য আকাশ স্পর্শ করল। তবে নব্য উদারনীতিবাদই শেষ কথা নয়। এখান থেকে বেরিয়ে আসার পথও আছে। এই প্রবন্ধে তার একটা রূপরেখাও দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।
মুখ্য শব্দগুচ্ছ
নব্য উদারনীতিবাদ, অঙ্গীভূত উদারনীতিবাদ, ভোকার-শক, রিগ্যান, বাজারের নিয়ন্ত্রণ শিথিল, মুদ্রানীতি, শ্রমিক আন্দোলন।
অর্থনীতিতে নিওলিবারেলিজম বা নব্য উদারনীতিবাদ সম্পর্কে মানুষের মনোভাবটা এমন যে এটি যেন খুব স্বাভাবিক ও অনিবার্য ব্যাপার। বিশেষ করে ছাত্রদের মধ্যে এ মনোভাব দেখা যায়, কারণ তাদের অধিকাংশেরই জন্ম ১৯৯০-এর দশকে। ১৯৮০-এর দশকে মার্গারেট থ্যাচার সবাইকে বোঝান, নব্য উদারনীতিবাদের বিকল্প নেই। এখন যেন এটা ঘরের আসবাবের মতো হয়ে গেছে, ডান ও বাম সবাই এটাকে সাধারণভাবে মেনে নিয়েছে। যদিও ব্যাপারটা ঠিক এ রকম ছিল না।
আজকের অর্থনীতিতে যেটা প্রমিত তত্ত্ব হিসেবে গৃহীত হয়েছে, ২০ শতকের বেশির ভাগ সময়জুড়ে সেটা অযৌক্তিক হিসেবে প্রত্যাখ্যাত হতো। একই রকম নীতি বাস্তবায়নের চেষ্টা আগেও করা হয়েছে, কিন্তু তা বিপর্যয় বয়ে এনেছে। ফলে তখনকার অধিকাংশ অর্থনীতিবিদই কেইনসীয় মতবাদ বা একধরনের সামাজিক গণতান্ত্রিক মতবাদ গ্রহণ করেছেন। সুসান জর্জ ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে: ‘কথা হচ্ছে, বাজার যে সমাজ ও রাষ্ট্রের অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেবে বা অর্থনীতিতে রাষ্ট্রের ভূমিকা সংকুচিত হবে বা করপোরেশনকে একদম পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা দেওয়া হবে বা ট্রেড ইউনিয়নের পরিসর ছোট হবে বা নাগরিক অধিকার হ্রাস পাবে—এসব চিন্তা আমাদের সময়ে কারও মাথায়ও আসত না।’
পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গিতে উদারনীতিবাদ
নব্য উদারনীতিবাদের গল্পটা শুরু হয় ১৯৩০-এর দশকের মহামন্দার পর থেকে। অর্থনীতিবিদদের ভাষায়, ‘অতি উত্পাদনের সংকট’ থেকেই এই মহামন্দা সৃষ্টি হয়। সে সময় উত্পাদনশীলতা বৃদ্ধি ও মজুরি হ্রাসের মাধ্যমে পুঁজিবাদ স্ফীত হচ্ছিল, কিন্তু এতে সমাজে যে গভীর অসমতা সৃষ্টি হয় তাতে মানুষের ভোগ-সক্ষমতা কমে যায়। দেখা গেল, বাজারে প্রচুর পণ্য পড়ে আছে, কিন্তু সেগুলো কেনার লোক নেই। এই সংকট দূর করতে এবং ভবিষ্যতে যাতে এর পুনরাবৃত্তি না ঘটে সে লক্ষ্যে জন মেইনার্ড কেইনসের নেতৃত্বে অর্থনীতিবিদেরা পরামর্শ দিলেন, পুঁজিবাদ নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্রকে রাশ টানতে হবে। তাঁরা যুক্তি দিলেন, বেকারত্বের হার কমানোর সঙ্গে মজুরি বাড়িয়ে ও পণ্যের চাহিদা সৃষ্টি করে রাষ্ট্র নিরবচ্ছিন্নভাবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সামাজিক কল্যাণ নিশ্চিত করতে পারে। এটা আসলে শ্রম ও পুঁজির মধ্যে একধরনের শ্রেণি সমঝোতা, যেটা ভবিষ্যত্ অস্থিতিশীলতার রাশ টানতে পারে।
এই অর্থনৈতিক মডেলকে ‘অঙ্গীভূত উদারনীতিবাদ’ হিসেবে অভিহিত করা হতো। অর্থাত্ এটা এমন একধরনের পুঁজিবাদ, যার নাড়ি সমাজেই পোঁতা থাকে, যার গতিপ্রকৃতি রুদ্ধ হয় রাজনৈতিক বিবেচনার দ্বারা। সামাজিক কল্যাণই যার অভীষ্ট। এটা ভদ্রস্থ পারিবারিক আয়ের বিনিময়ে অনুগত, বাধ্য ও উত্পাদনশীল মধ্য শ্রেণির উত্পাদক তৈরি করতে চেয়েছিল, যাদের মৌলিক পণ্য কেনার সামর্থ্য থাকবে। এই নীতি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে ঢালাওভাবে অনুসরণ করা হয়। নীতিপ্রণেতারা ভেবেছিলেন, এর মাধ্যমে আরেকটি বিশ্বযুদ্ধ এড়ানো সম্ভব হবে। ব্যালান্স অব পেমেন্ট ব্যবস্থা মসৃণ করতে এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউরোপের পুনর্গঠনে তারা ব্রেটন উডস ইনস্টিটিউশন গড়ে তোলেন (যেটা পরবর্তীকালে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও ডব্লিউটিওতে পরিণত হয়)।
১৯৫০ ও ৬০-এর দশকে শিল্পায়িত দেশসহ উত্তর-ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রেও এই অঙ্গীভূত উদারনীতিবাদ উচ্চ প্রবৃদ্ধি বয়ে আনে। কিন্তু ১৯৭০-এর দশকের শুরুতেই সংকট সৃষ্টি হয়। একদিকে উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও আরেক দিকে অর্থনৈতিক স্থবিরতা—এই দুয়ে মিলে বড় ঝামেলাই সৃষ্টি হয়। যেখানে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে ১৯৬৫ সালে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৩ শতাংশ, সেখানে ১৯৭৫ সালে তা দাঁড়ায় ১২ শতাংশে। অনেকেই এর নানা রকম ব্যাখ্যা দিয়েছেন। প্রগতিশীল অর্থনীতিবিদ পল ক্রুগম্যান দুটি বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। প্রথমত, ভিয়েতনাম যুদ্ধের খরচের কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ব্যালান্স অব পেমেন্ট ঘাটতিতে পড়ে যায়। এটা এমন পর্যায়ে চলে যায় যে উদ্বিগ্ন আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীরা ডলার তুলে নিতে শুরু করেন। এতে মূল্যস্ফীতি অনেকাংশেই বৃদ্ধি পায়। নিক্সনের কারণে ব্যাপারটা আরও খারাপ হয়। যুদ্ধের ক্রমবর্ধমান খরচ মেটাতে গিয়ে তিনি ১৯৭১ সালে ডলারকে স্বর্ণমান থেকে আনপেগ (বিচ্ছিন্ন) করলে সোনার দাম দ্রুত বৃদ্ধি পায় আর ডলারের দাম পড়ে যায়। দ্বিতীয়ত, ১৯৭৩ সালের তেলসংকটের কারণে জিনিসপত্রের দাম বাড়লেও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি স্থবির হয়ে যায়। ফলে এক স্থবিরতা সৃষ্টি হয়। কিন্তু রক্ষণশীল পণ্ডিতেরা এসব কারণ স্বীকার করতে চান না। তাঁরা বলেন, ধনীদের ওপর অতিরিক্ত করারোপ ও অর্থনীতিতে বেশি বেশি নিয়মকানুন আরোপের কারণে এমনটা হয়েছে। সে কারণে তাঁরা দাবি করলেন, অঙ্গীভূত উদারনীতিবাদের সময় শেষ হয়ে এসেছে।
দেখা গেল, এই রক্ষণশীল অর্থনীতিবিদদের যুক্তি ধনীদের বেশ মনে ধরল। ডেভিড হার্ভে বলেন১, এই ধনীরা আসলে তখন অঙ্গীভূত উদারনীতিবাদের যুগের পর নিজেদের শ্রেণি ক্ষমতা পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ এক শতাংশ ধনীর হাতে জাতীয় আয় পুঞ্জীভূত হওয়ার হার ১৬ থেকে কমে ৮ শতাংশে নেমে এসেছিল। যত দিন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার বেশি ছিল, তত দিন তাদের কোনো সমস্যা হয়নি। কিন্তু ১৯৭০-এর দশকের শুরুর দিকে যখন প্রবৃদ্ধির গতি কমে গেল ও মূল্যস্ফীতি বেড়ে গেল, তখন তাদের সম্পদও ব্যাপক হারে কমতে শুরু করে। এর প্রতিক্রিয়ায় তারা শুধু নিজেদের আয়ে প্রবৃদ্ধির স্থবিরতার প্রভাব উল্টে দিতেই চাইলেন না, এই সংকটের অজুহাতে তাঁরা অঙ্গীভূত উদারনীতিবাদই ঝেরে ফেলতে চাইলেন।
হ্যাঁ, ‘ভোকার শকের’ মাধ্যমে তাঁরা সমাধানটিও পেয়ে গেলেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার ১৯৭৯ সালে পল ভোকারকে ফেডারেল রিজার্ভের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেন। শিকাগো স্কুলের অর্থনীতিবিদ মিল্টন ফ্রিডম্যানের পরামর্শে ভোকার যুক্তি দিলেন, এই সংকট থেকে বেরিয়ে আসার একমাত্র পথ হচ্ছে, সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতির হার কমিয়ে আনা। চিন্তাটি ছিল এমন যে মুদ্রার সরবরাহ কমিয়ে সঞ্চয় উত্সাহিত করতে হবে, আর এর মাধ্যমে মুদ্রার মূল্যমান বাড়াতে হবে। এরপর রিগ্যান ১৯৮১ সালে ক্ষমতায় এলে ভোকারকে পুনর্নিয়োগ দিয়ে সুদের হার এক অঙ্কের ঘর থেকে বাড়িয়ে প্রায় ২০ শতাংশে তুলে আনেন। এতে ব্যাপক মন্দা সৃষ্টি হয়। বেকারত্বের হার ১০ শতাংশের ওপরে চলে যায়, সংগঠিত শ্রমিক আন্দোলনের শক্তি হ্রাস পায়। অথচ অঙ্গীভূত উদারনীতিবাদের আমলে সংগঠিত শ্রমিক আন্দোলন পুঁজিপতিদের অধিক শোষণ করা থেকে নিবৃত্ত করেছে, যার কারণে সেই মহামন্দা সৃষ্টি হয়েছিল। শ্রমিক শ্রেণির ওপর ভোকার শকের মারাত্মক প্রভাব পড়েছিল, কিন্তু এর ফলে মূল্যস্ফীতি কমে আসে।
কট্টর মুদ্রানীতি যদি নব্য উদারনীতিবাদের প্রথম বৈশিষ্ট্য হয়, তাহলে এর দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সাপ্লাই-সাইড অর্থনীতি। রিগ্যান অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর লক্ষ্যে ধনীদের হাতে আরও টাকা তুলে দিতে চেয়েছিলেন। ধারণাটি ছিল এ রকম যে তাঁরা এই টাকা উত্পাদনশীল কাজে বিনিয়োগ করবেন, যাতে প্রবৃদ্ধির চাকা সচল হবে, আর তার সুফল চুইয়ে চুইয়ে সমাজের নিম্নকোটির মানুষের কাছেও পৌঁছাবে (যেটা আসলে কাজ করেনি)। এ লক্ষ্যে রিগ্যান যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ করের হার ৭০ থেকে কমিয়ে ২৮ শতাংশে নামিয়ে আনেন, আর ক্যাপিটাল গেইন করের হার কমিয়ে ২০ শতাংশে নামিয়ে আনেন, যেটা ছিল মহামন্দা-উত্তর যুগের সর্বনিম্ন। এর আনুষঙ্গিক কাজ হিসেবে রিগ্যান আরও কিছু করেছিলেন, যেটা লোকে ঠিক জানে না, সেটা হলো, তিনি শ্রমিকদের মজুরির ওপরও কর আরোপ করেন। অর্থাত্ তিনি রিপাবলিকানদের কাঙ্ক্ষিত ‘সবার জন্য সমান’ করের নীতির দিকে অগ্রসর হন। রিগ্যানের অর্থনৈতিক পরিকল্পনার তৃতীয় দিকটি ছিল আর্থিক খাতের লাগাম শিথিল করা। কিন্তু ভোকার এ কাজ করতে অস্বীকৃতি জানালে রিগ্যান ১৯৮৭ সালে অ্যালান গ্রিনসপ্যানকে তাঁর জায়গায় নিয়োগ দেন। গ্রিনসপ্যান মূলত একজন মুদ্রানীতি-বিশেষজ্ঞ। পরবর্তীকালের রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট উভয় দলই তাঁকে কয়েকবার পুনর্নিয়োগ দিয়েছে, ফলে ২০০৬ সাল পর্যন্ত তিনি এ পদে আসীন ছিলেন। তাঁর হাত দিয়ে যে নিয়ন্ত্রণ শিথিল হতে শুরু করেছিল, তার ফলেই ২০০৮ সালের আর্থিক সংকট সৃষ্টি হয়, যে সময় ব্যাংকগুলো বন্ধকি সম্পত্তি পুনর্দখল করলে লাখ লাখ মানুষ বাড়িঘর হারায়২।
এসব নীতির সম্মিলিত ফলাফল হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অসমতার হার এ সময় ব্যাপক হারে বেড়ে যায়, নিচের লেখচিত্রে যা দেখা যাচ্ছে। লেখচিত্র ১-এ দেখা যায়, ১৯৭৩ সালের ভোকার শকের পর কীভাবে মজুরির হার কমলেও উত্পাদনশীলতা বাড়ে, যার মাধ্যমে উদ্বৃত্ত মূল্যের একটা বড় অংশ শ্রমিকদের কাছ থেকে পুঁজির মালিকদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। এ প্রবণতাকে আরও জোরদার করার জন্য ১৯৯০-এর দশকে সিইওদের বেতন বাড়ে ৪০০ শতাংশ, যেখানে শ্রমিকদের মজুরি বাড়ে মাত্র ৫ শতাংশ। আর ফেডারেল ন্যূনতম মজুরি কমে ৯ শতাংশে দাঁড়ায়৩। লেখচিত্র ২-এ দেখা যায়, সমাজের উচ্চকোটির মানুষের হাতে পুঞ্জীভূত জাতীয় আয়ের পরিমাণ ব্যাপক হারে বেড়ে যায়। সমাজের শীর্ষ এক শতাংশ ধনীর হাতে সম্পদ পুঞ্জীভবনের পরিমাণ ১৯৮০-এর দশকের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি বেড়ে যায়, সে সময় যার পরিমাণ ছিল ৮ শতাংশ, ১৯৯০-এর দশকে তা এসে দাঁড়ায় ১৮ শতাংশে। শুমারির তথ্যানুসারে, ১৯৮০ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ ৫ শতাংশ পরিবারের আয় ৭২ দশমিক ৭ শতাংশ বৃদ্ধি পায়, যেখানে মধ্যম সারির পরিবারের আয় স্থিতিশীল থাকে আর নিচের দিকের মানুষের আয় ৭ দশমিক ৪ শতাংশ কমে যায়৪।
কেমব্রিজের অর্থনীতিবিদ হা জুন ব্যাপারটা সঠিকভাবেই বলেছেন, ‘ধনী মানুষকে আরও ধনী বানালেই বাকিরা ধনী হয়ে যায় না।’ এতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি বাড়ে না, যেটা কি না সাপ্লাই সাইড অর্থনীতির একমাত্র যুক্তি। বস্তুত, এর বিপরীত ব্যাপারটাই সত্য হিসেবে আবির্ভূত হয়, কারণ নব্য উদারনীতিবাদী অর্থনীতি চালু হওয়ার পর শিল্পায়িত দুনিয়ায় মাথাপিছু আয় ৩ দশমিক ২ থেকে কমে ২ দশমিক ১ শতাংশে নেমে আসে৫। এতে বোঝা যায়, নব্য উদারনীতিবাদ উন্নয়নের হাতিয়ার হিসেবে একেবারেই ব্যর্থ হয়েছে, কিন্তু ধনীদের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে তা দারুণ কার্যকর হয়েছে।
কিন্তু কথা হচ্ছে, নব্য উদারনীতিবাদ যদি এতটাই ধ্বংসাত্মক হয়, তাহলে রাজনীতিকেরা কীভাবে এটা জায়েজ করলেন? এর আংশিক কারণ হচ্ছে, ভোকার শকের পর সংগঠিত শ্রমিকশ্রেণির ধ্বংস হওয়া। তার সঙ্গে আছে শ্রমিক ইউনিয়নকে ‘আসুরিক’ ও ‘আমলাতন্ত্রিক’ আখ্যা দেওয়া এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর বামপন্থীদের সমাজতন্ত্র ত্যাগ করা আর ‘ভোগবাদকে’ মার্কিন নাগরিকত্বের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ করে তোলা। আমরা মার্কিন রাজনীতিতে করপোরেট লবিংয়ের ক্রমবর্ধমান প্রভাব ও ওয়াল স্ট্রিটের সুবিধাভোগী অ্যাকাডেমিক অর্থনীতিবিদদের স্বার্থের দ্বন্দ্বকেও এর কারণ হিসেবে চিহ্নিত করতে পারি। কিন্তু সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে, নব্য উদারনীতিবাদকে মার্কিন সত্তার কেন্দ্রীয় মূল্যবোধ ‘ব্যক্তিস্বাধীনতার’ নামে বেশ ভালোভাবে বাজারে খাওয়ানো গেছে৬। রক্ষণশীল চিন্তক প্রতিষ্ঠান যেমন মন্ট পেরেলিন সোসাইটি, হেরিটেজ ফাউন্ডেশন ও বিজনেস রাউন্ডটেবিল ৪০ বছর ধরে বলে আসছে, বাজারের ‘স্বাধীনতার’ মাধ্যমেই কেবল ব্যক্তিগত স্বাধীনতা অর্জন করা সম্ভব। তারা মনে করে, রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ মানেই অবধারিতভাবে সমগ্রতাবাদের দিকে অগ্রসর হওয়া। এই কথার যুক্তি আরও জোরালো হয় তখন, যখন নব্য উদারনীতিবাদের দুই আইকন ফ্রিডরিখ ভন হায়েক ও মিল্টন ফ্রিডম্যান ১৯৭০-এর দশকে অর্থনীতির নোবেল খ্যাত সুইডিশ ন্যাশনাল ব্যাংক পুরস্কার পান, যদিও নোবেল ফাউন্ডেশন এই পুরস্কার দেয় না।
আন্তর্জাতিক পরিসরে উদারনীতিবাদ
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের মতো পশ্চিমা দেশগুলো যখন নব্য উদারনীতিবাদ নিয়ে নিজেদের মতো করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছে, তখন তারা উত্তর ঔপনিবেশিক দেশগুলোর ওপরও এই মডেল চাপিয়ে দিয়েছে, কখনো খুবই সহিংস রূপে।
আন্তর্জাতিক পরিসরে নব্য উদারনীতিবাদের চর্চা শুরু হয় ১৯৭৩ সালে। সে বছর ওপেকের তেল নিষেধাজ্ঞার পরিপ্রেক্ষিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আরব রাষ্ট্রগুলোর বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানের হুমকি দেয়, যদি তারা নিজেদের অতিরিক্ত পেট্রোডলার ওয়াল স্ট্রিটের ইনভেস্ট ব্যাংকে না রাখে। তারা সেটা করেছিল। এই টাকা দিয়ে কী করা হবে সে সিদ্ধান্ত ছিল ব্যাংকের ওপর, কারণ যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে তখন স্থবিরাবস্থা ছিল। ফলে তারা সিদ্ধান্ত নিল, এই টাকা উন্নয়নশীল দেশগুলোকে বেশি সুদে ঋণ দেওয়া হবে, তেলের বাড়তি দামের কারণে যে দেশগুলো মারাত্মক ধাক্কা খেয়েছিল। তখন মূল্যস্ফীতির হারও ছিল অনেক বেশি। ব্যাংকগুলো ভেবেছিল, বিনিয়োগ হিসেবে এটা খুব নিরাপদ হবে। কারণ তারা ভেবেছিল, সরকার তো আর সহজেই ঋণখেলাপি হবে না।
কিন্তু তারা ভুল ভেবেছিল। এই ঋণ যেহেতু মার্কিন ডলারে দেওয়া হয়েছিল, সেহেতু যুক্তরাষ্ট্রের সুদের হারের সঙ্গে এর সম্পর্ক ছিল। ১৯৮০-এর দশকের শুরুর দিকে ভোকার শকের আঘাত লাগলে ও সুদের হার আকাশ ছুঁলে কমজোর উন্নয়নশীল দেশগুলো ঋণ খেলাপ করার পর্যায়ে চলে যায়, যেটা শুরু হয় মেক্সিকোর মাধ্যমে। যেটা আজ ‘তৃতীয় বিশ্বের ঋণসংকট’ নামে পরিচিত। এই ঋণসংকটের কারণে ওয়াল স্ট্রিটের ব্যাংকগুলো ডুবতে বসেছিল, যার কারণে আন্তর্জাতিক আর্থিক ব্যবস্থার ভিত্তিও দুর্বল হয়ে যায়। এ রকম সংকট ঠেকাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এগিয়ে এল, যাতে মেক্সিকোসহ অন্যান্য দেশ ঋণ শোধ করতে পারে। আইএমএফের উদ্দেশ্য বদলে দিয়ে তারা সেটা করে ফেলে। অতীতে আইএমএফ নিজের টাকা দিয়ে বিভিন্ন দেশকে ব্যালান্স অব পেমেন্টের ঘাটতি মোকাবিলা করতে সহায়তা করত, কিন্তু সেবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আইএমএফকে ব্যবহার করে এটা নিশ্চিত করল যে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো বেসরকারি ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করতে পারে। ডেভিড হার্ভের মতে, ১৯৮২ সাল থেকে শুরু হওয়া সেই পর্যায়ে ব্রেটন উডস ইনস্টিটিউশনগুলোকে ধীরে ধীরে কেইনসীয় প্রভাব থেকে মুক্ত করা হয়। এরপর তারা নব্য উদারনীতিবাদী আদর্শের প্রবক্তা হয়ে যায়।
পরিকল্পনাটির এভাবে কাজ করার কথা ছিল: আইএমএফ উন্নয়নশীল দেশগুলোর ঋণ পরিশোধের ব্যবস্থা করে দেবে এই শর্তে যে তাদের কিছু ‘কাঠামোগত সমন্বয় কর্মসূচি’ বাস্তবায়নের ব্যাপারে সম্মত হতে হবে। এতে বৈপ্লবিক উপায়ে বাজারের ওপর নিয়ন্ত্রণ শিথিল করা হয় এই ধারণার ভিত্তিতে যে এটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে অর্থনীতির দক্ষতা বাড়িয়ে দেবে, ফলে প্রবৃদ্ধির গতি বাড়বে ও তারা ঋণ পরিশোধ করতে পারবে। খাদ্য, স্বাস্থ্যসেবা ও পরিবহন খাতে সরকারের ভর্তুকি কমিয়ে, সরকারি খাতকে বেসরকারি খাতে তুলে দিয়ে, শ্রমের ওপর নিয়ন্ত্রণ শিথিল করে, সম্পদ ব্যবহার, বাণিজ্যের শুল্ক কমিয়ে ‘বিনিয়োগের সুযোগ’ তৈরি ও ভোক্তা বাজার তৈরি করার মাধ্যমে তারা এটা করল। তারা মূল্যস্ফীতির হার কম রাখারও চেষ্টা করল, যাতে আইএমএফের কাছে তৃতীয় বিশ্বের ঋণ শেষ না হয়, যদিও এতে প্রবৃদ্ধির হার বাড়ানোর ক্ষেত্রে সরকারের সামর্থ্য কমে যায়। এসব নীতির অনেকগুলোই করা হয়েছিল বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের স্বার্থরক্ষায়, যাদের সরকারি সম্পদ কেনা, সরকারি নিলামে অংশগ্রহণ ও ইচ্ছামাফিক মুনাফা নিয়ে যাওয়ার স্বাধীনতা দেওয়া হয়।
ওদিকে বিশ্বব্যাংক উন্নয়নশীল দেশগুলোর ওপর এই নব্য উদারনীতিবাদ চাপিয়ে দেয়। তারা উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য এসব দেশকে ঋণ দেওয়ার শর্ত হিসেবে জুড়ে দেয় যে ঋণগ্রহীতা দেশকে বাজার উদারীকরণ করতে হবে (১৯৮০-এর দশকে এই ব্যাপারটা ঘটেছে)। অন্য কথায়, বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ সার্বভৌম রাষ্ট্রের অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য এই ঋণকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থাও বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে হাত মেলায়। তারা নাফটার মতো দ্বিপক্ষীয় মুক্ত বাণিজ্য চুক্তিসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোকে পশ্চিমা বাজারে ঢোকার সুযোগ পাওয়ার জন্য শর্ত দেয় যে, তাদের শুল্ক হার কমাতে হবে। এতে উন্নয়নশীল দেশের স্থানীয় শিল্প বাধাগ্রস্ত হয়েছে। কথা হচ্ছে, আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকে ভোট প্রদানের ক্ষমতা নির্ধারিত হয় প্রতিটি দেশের মালিকানার ভিত্তিতে, ঠিক যেমন করপোরেশনে হয়ে থাকে। সেখানে বড় সিদ্ধান্ত নিতে গেলে ৮৫ শতাংশ ভোট লাগে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উভয় প্রতিষ্ঠানেরই ১৭ শতাংশ মালিকানা ধারণ করে। ফলে তার হাতে কার্যত ভেটো প্রদানের ক্ষমতা রয়েছে। আর বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় ভোট প্রদানের ক্ষমতা নির্ধারিত হয় বাজারের আকার দিয়ে। ফলে ধনী দেশগুলো সব সময়ই নিজেদের সূচি বাস্তবায়ন করতে পারে। গরিব দেশ যদি বাণিজ্যের নিয়ম ভাঙে, তাহলে ধনী দেশগুলো কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে সে দেশের অর্থনীতি ভেঙে দিতে পারে।
আসলে বিশ্বায়নের নব্য উদারনীতিবাদী যুগের চূড়ান্ত ফলাফল হচ্ছে, বেশির ভাগ দেশের অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে। বহুজাতিক সংস্থাগুলো যেহেতু ‘সবচেয়ে ভালো’ বাণিজ্য পরিবেশ খোঁজার জন্য সারা পৃথিবী চষে বেড়াতে পারে, ফলে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সস্তা শ্রম নিয়ে হাজির হতে হয়। এমনকি সেসব দেশে এসব করপোরেশনকে দীর্ঘদিনের জন্য কর ছাড় দিতে হয়। কিন্তু এই নব্য উদারনীতিবাদ গরিব দেশগুলোকে সাহায্য না করে বরং তাদের একরকম ধ্বংস করেছে। ১৯৮০-এর দশকের আগ পর্যন্ত উন্নয়নশীল দেশগুলোর মাথাপিছু আয়ের প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৩ শতাংশ। কিন্তু নব্য উদারনীতিবাদের যুগে এসে তা দাঁড়াল ১ দশমিক ৭ শতাংশে৭। সাবসাহারা অঞ্চলে ১৯৬০ ও ৭০-এর দশকে মাথাপিছু আয় বাড়ার হার ভালোই ছিল, ১.৬ শতাংশ, কিন্তু নব্য উদারনীতিবাদের যুগে এসে তা দাঁড়ায় ০.৭ শতাংশে। আর এই নব্য উদারনীতিবাদের কাঠামোগত সমন্বয়ের যুগে আফ্রিকার দেশগুলোর জিএনপি ১০ শতাংশ কমে যায়৮। ফলে ১৯৮০-এর দশক থেকে দারিদ্র্যের মৌলিক কাঠামোতে থাকা দেশের সংখ্যা দ্বিগুণ বেড়ে যায়৯। লেখচিত্র ৩-এ দেখা যায়, লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতেও সেটা কীভাবে ঘটেছে। বিশ্বব্যাংকের অর্থনীতিবিদ উইলিয়াম ইস্টারলি দেখিয়েছেন, একটি দেশ যত কাঠামোগত সমন্বয় ঋণ নিয়েছে, ততই তার অর্থনীতির পতনের আশঙ্কা বেড়েছে১০।
এটা যে হয়েছে তাতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। এখানে এক বড় দ্বৈত নীতি চলছে: পশ্চিমা নীতিপ্রণেতারা উন্নয়নশীল দেশগুলোকে বলছে, প্রবৃদ্ধির জন্য তাদের অর্থনীতিকে উদার করতে হবে। কিন্তু কথা হচ্ছে, পশ্চিম নিজে যখন অর্থনীতিকে সংহত করেছে, তখন সে এ কাজ করেনি। কেমব্রিজের অর্থনীতিবিদ হা-জুন চ্যাং দেখিয়েছেন, আজকের সব ধনী দেশই একসময় নিজের অর্থনীতিকে সুরক্ষা দিয়ে উন্নত হয়েছে। বস্তুত, ব্রিটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একসময় দুনিয়ার সবচেয়ে আগ্রাসী সুরক্ষাবাদী রাষ্ট্র ছিল। তারা সরকারের ভর্তুকি, বাণিজ্য শুল্ক, সীমিত পেটেন্ট নীতি গ্রহণ করেছিল, যেটা আজকের নব্য উদারনীতিদবাদ
একদম খারিজ করে দেয়। উইলিয়াম ইস্টারলি বলেছেন, কিছু কিছু অপশ্চিমা
দেশ যেমন: জাপান, ভারত, চীন, তুরস্ক ও পূর্ব এশিয়ার ‘বাঘ’ বলে পরিচিত দেশগুলো একদম সোজাসাপটা মুক্তবাজার অর্থনৈতিক নীতি অনুসরণ না করলেও বেশ ভালো করেছে।
অর্থাত্ মোদ্দা কথা হলো, নব্য উদারনীতিবাদ আসলে ধনী দেশগুলোর স্বার্থে মুক্তবাজারের নীতিকে খুব সুনির্দিষ্ট উপায়ে ব্যবহার করা। যেমন মার্কিন নীতিপ্রণেতারা মুক্তবাজারের নীতি তখনই গ্রহণ করেন, যখন করপোরেশনগুলোকে বিদেশের সস্তা শ্রম শোষণ ও দেশের অভ্যন্তরীণ ইউনিয়নকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখানোর সুযোগ দেওয়া হয়। কিন্তু অন্যদিকে ডব্লিউটিও যখন তাদেন কৃষিতে বিপুল ভর্তুকি দেওয়ার নীতি বাদ দিতে বলে, তখন তারা সেটা শোনে না। এ কারণে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো প্রতিযোগিতার সুবিধা নিতে পারছে না। তারা এটা করবে না, কারণ তাহলে তা বড় করপোরেশনগুলোর স্বার্থের বিপক্ষে যাবে। ২০০৮ সালে আর্থিক খাতে সংকটের পর ব্যাংকগুলোকে যে বেইল আউট করা হলো, সেটা তাদের দ্বৈত নীতির আরেকটি নজির। প্রকৃত মুক্তবাজারে ব্যাংকের সমস্যা নিজেকেই মেটানোর কথা। আবার কখনো কখনো নব্য উদারনীতিবাদের অর্থ হলো, ধনীদের জন্য রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ আর গরিবদের জন্য মুক্তবাজার। আসলে নব্য উদারনীতিবাদের কারণে যেসব সমস্যা সৃষ্টি হয়, তার অনেকগুলোই বাজার নীতির দ্বারাই সমাধান করা সম্ভব। জার্মানি যে কাজটা করে থাকে। তারা অরডোলিবারেলিজম নামের এক নীতি প্রণয়ন করেছে, যার মাধ্যমে তারা রাষ্ট্রীয়ভাবে হস্তক্ষেপ করে একচেটিয়াতন্ত্র রোধ করে এবং ছোট ও মাঝারি আকারের উদ্যোক্তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করে।
কথা হচ্ছে, এই নব্য উদারনীতিবাদী বিশ্বায়নের কারণে বিশ্বের ধনীতম দেশগুলোতে বসবাসরত এক-পঞ্চমাংশ জনগণ ও দরিদ্রতম দেশগুলোতে বসবাসরত এক-পঞ্চমাংশ জনগণের মধ্যকার আয়ের বৈষম্য ব্যাপক হারে বেড়েছে, ১৯৮০ সালে যেটা ছিল ৪৪:১, ১৯৯৭ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৭৪:১১১। লেখচিত্র ৪-এ এই প্রবণতা দেখা যায়। আর আজ এই নীতির কারণে দুনিয়ার ৩৫৮ জন শীর্ষ ধনী ব্যক্তির হাতে ৪৫ শতাংশ গরিব মানুষের সম্পদ জড়ো হয়েছে। আরও মারাত্মক ব্যাপার হলো, বিশ্বের শীর্ষ তিন ধনী ব্যক্তির হাতে সবচেয়ে অনুন্নত দেশগুলোর সম্মিলিত সম্পদের সমপরিমাণ সম্পদ রয়েছে, অর্থাত্ ৬০০ মিলিয়ন মানুষের সম্পদ আছে তাদের হাতে১২। আজ বিশ্বের শীর্ষ ১ শতাংশ ধনীর হাতে ৪০ শতাংশ সম্পদ, আর ১০ শতাংশের হাতে আছে ৮৫ শতাংশ সম্পদ। আর নিচের কোটির ৫০ শতাংশের হাতে বিশ্বের মাত্র ১ শতাংশ সম্পদ রয়েছে১৩।
হ্যাঁ, নব্য উদারনীতিবাদ ধনীদের গরিবদের সম্পদ চুরি করার সুযোগ দিয়েছে। গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির এক সমীক্ষা অনুসারে, ১৯৭০-এর দশক থেকে এ পর্যন্ত বহুজাতিক কোম্পানিগুলো শুধু আফ্রিকা থেকেই ট্রান্সফার প্রাইসিং ও কর ফাঁকির মাধ্যমে ১.১৭ ট্রিলিয়ন ডলার চুরি করে নিয়ে গেছে।
আরেকটি বিশ্ব নির্মাণ সম্ভব
মোদ্দা কথা হলো, কিছু সুনির্দিষ্ট মানুষ নব্য উদারনীতিবাদী অর্থনৈতিক মডেল তৈরি করেছিল। ফলে মানুষই তা ভেঙে ফেলতে পারে।
২০০৮ সালের আর্থিক সংকটের পর থেকেই নব্য উদারনীতিবাদের বিরুদ্ধে মানুষের প্রতিরোধ শুরু হয়েছে। এই সংকটের মধ্য দিয়ে শুধু শিথিল নিয়ন্ত্রণের সংকটই উন্মোচিত হয়নি, রক্ষণশীল নীতিপ্রণেতারা এই সংকট কাজে লাগিয়ে ‘ঘাটতি কমানোর’ নামে অভূতপূর্ব কৃচ্ছ্রসাধনের নীতির যৌক্তিকতা প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেছে। যেমন: স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, গৃহায়ণ ও অন্যান্য সামাজিক কর্মসূচির বরাদ্দ ব্যাপক হারে কমানো হয়েছে (যেখানে করদাতাদের ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার বেসরকারি ব্যাংককে দেওয়া হয়েছে)। এটা শুধু যুক্তরাষ্ট্রে নয়, সারা ইউরোপেই চলছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রে অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট, স্পেন ও গ্রিসে ‘ইনডিগনাদোস’-এর মতো আন্দোলন যে গড়ে উঠেছে, তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। একই কথা গত ৫০ বছরের মধ্যে ব্রিটেনের ইতিহাসের সবচেয়ে শক্তিশালী ছাত্র আন্দোলন ও শ্রমিক বিক্ষোভের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
এই সমস্যার সমাধানের জন্য বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও ডব্লিউটিওর মতো প্রতিষ্ঠানগুলোকে গণতান্ত্রিক করতে হবে, যাতে উন্নয়নশীল দেশগুলো নিজেদের অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করতে পারে। জোসেফ স্টিগলিত্সকে তো এসব প্রতিষ্ঠানের সমালোচনা করার জন্য বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদের পদ থেকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। দ্বিতীয়, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর সব ঋণ মওকুফ করে দিতে হবে, যাতে ধনী দেশগুলো গরিব দেশের ওপর ছড়ি ঘোরানোর সুযোগ না পায়। তৃতীয়ত, বিদেশি সাহায্য ও উন্নয়ন ঋণ দেওয়ার জন্য গয়রহভাবে/ঢালাওভাবে কাঠামোগত সমন্বয়ের শর্ত বাদ দিতে হবে। এটা বুঝতে হবে যে প্রতিটি দেশের নিজস্ব চাহিদা রয়েছে। চতুর্থত, প্রতিটি দেশের জীবনযাত্রার ব্যয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে আন্তর্জাতিক ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করতে হবে, যাতে মজুরির ‘ক্রমহ্রাস’ বন্ধ করা যায়। পঞ্চমত, প্রতিটি দরিদ্র দেশকে নব্য উদারনীতিবাদের যুগের আগের প্রবৃদ্ধির হার অর্জনের সুযোগ দিতে হবে, যার জন্য তাদের আমদানি শুল্ক, ভর্তুকি, নিম্ন হারের আর্থিক ঘাটতি, নিম্ন সুদের হার, ট্রান্সফার প্রাইসিংয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ ও নতুন শিল্পে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ প্রভৃতি সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দিতে হবে।
শেষমেশ, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, আমাদের স্বাধীনতার ধারণা পুনরুদ্ধার করতে হবে। নব্য উদারনীতিবাদের স্বাধীনতার ধারণা হলো, বাজারের ওপর নিয়ন্ত্রণ শিথিলের ধারণা, যেটা আসলে ধনীদের সম্পদ আহরণের সুযোগ ব্যতীত কিছু নয়। আমাদের নতুন করে স্বাধীনতার ধারণা লাভ করতে হবে, যা আমাদের অর্থনীতিকে কাজে লাগিয়ে সুনির্দিষ্ট সামাজিক লক্ষ্য অর্জনে এগিয়ে নিয়ে যায়, যার সুফল গণতান্ত্রিকভাবে বণ্টন হয়, আর সবাই যাকে অনুমোদন করে।
তথ্যসূত্র:
1. Harvey, David. 2005. A Brief History of Neoliberalism. London: Oxford University Press.
2. Stiglitz, Joseph. 2010. Freefall. New York: W.W. Norton & Co.
3. Executive Excess 2006, the 13th annual CEO compensation survey from the Institute for Policy Studies and United for a Fair Economy.
4. U.S. Census Bureau, Historical Income Tables: Families.
5. Chang, Ha-Joon. 2007. Bad Samaritans: The Guilty Secrets of Rich Nations and the Threat to Global Prosperity. London: Random House. Pg. 26.
6. Hickel, Jason and Arsalan Khan. 2012. “The Culture of Capitalism and the Crisis of Critique,” Anthropological Quarterly 85(1).
7. Chang. 2007. Pg. 27.
8. Chang. 2007. Pg. 28.
9. World Bank. 2007. World Development Indicators.
10. Easterly, William. 2007. The White Man’s Burden. Penguin Books.
11. United National Development Programme. 1999. Human Development Report 1999: Globalization with a Human Face. New York. P. 38.
12. Milanovic, Branko. 2002. “True World Income Distribution, 1988 and 1993.” Economic Journal, 112(476).
13. United Nations University. 2009. 2008 Annual Report.
নিউ লেফট প্রজেক্ট.অর্গ থেকে নেওয়া।
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন