১. ভূমিকা
বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দেশ ভারত। ভৌগোলিকভাবে তিন দিক থেকে ভারত বাংলাদেশকে ঘিরে আছে। নৃতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিকভাবেও ভারত ও বাংলাদেশ ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। ব্রিটিশ শাসনের শেষাবধি এ দুই দেশ একই ইতিহাসের অংশীদার ছিল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সাফল্যের পেছনে ভারতের সমর্থন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক সে কারণে খুবই প্রত্যাশিত এবং আবশ্যক। ভারত একটি বৃহত্ দেশ। অর্থনৈতিক সক্ষমতা, জ্ঞান-বিজ্ঞান, সংস্কৃতি প্রভৃতিতে ভারত সমৃদ্ধ। বিগত দুই দশক ধরে দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের ফলে ভারতের অর্থনৈতিক সক্ষমতা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। এরকম একটি বৃহত্ এবং দ্রুত ধাবমান দেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব থেকে বাংলাদেশ বেশ উপকৃত হওয়ার আশা করতে পারে বৈকি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক আশানুরূপ ধারায় অগ্রসর হয়নি। এর বিভিন্ন কারণ রয়েছে। তবে, একটি অন্যতম কারণ হলো নদীর পানি ভাগাভাগির সমস্যা।
বাংলাদেশ মূলত বিভিন্ন নদ-নদী দ্বারা গঠিত একটি ব-দ্বীপ। এসব নদ-নদীর বেশির ভাগ ভারতের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে এবং শেষাবধি বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশেছে। উজানে অবস্থানের সুযোগ নিয়ে ভারত এসব নদ-নদীর পানি অপসারণ করে নিচ্ছে। ফলে বাংলাদেশের নদ-নদীগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে এবং এ দেশের ভূপ্রকৃতি ও অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ফারাক্কা এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে গজালডোবাসহ অন্যান্য বহু বাঁধ। সে জন্য ভারতের কথা উঠলে এখন বাংলাদেশিদের এসব বাঁধের কথাই বেশি মনে পড়ে। নদ-নদী বিষয়ে ভারতের আচরণ বাংলাদেশের মানুষের কাছে অন্যায্য বলে অনুভূত হয় এবং এই অনুভূতিই ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কোন্নয়নের পথে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাধা হিসেবে কাজ করছে।
কিন্তু যে ভৌগোলিক অবস্থানগত সুবিধার কারণে ভারত বাংলাদেশের নদ-নদীগুলো থেকে পানি প্রত্যাহার করে নিতে পারছে, সেই একই ভৌগলিক কারণে ভারত স্বীয় উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে সহজে পৌঁছানোর প্রয়োজনে ট্রানজিট পেতে বাংলাদেশের কাছে মুখাপেক্ষী। অন্যথায় এসব রাজ্যে পৌঁছাতে ভারতকে বাংলাদেশ ও নেপালের মধ্যকার মাত্র ২২ মাইল প্রস্থের সরু অংশের ওপর নির্ভর করতে হয়। দীর্ঘ ও সমস্যাসংকুল এ পথের ওপর নির্ভর করে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর আর্থসামাজিক উন্নয়ন অর্জন দুরূহ। অথচ, উন্নয়নের অভাব এসব রাজ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের অন্যতম কারণ। ফলে, ট্রানজিটের ইস্যু ভারতের জন্য স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্বের; এর সঙ্গে ভারতের ভৌগোলিক অখণ্ডতা ও নিরাপত্তার ইস্যু জড়িত।
সুতরাং, নদীর বিনিময়ে ট্রানজিট ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্কোন্নয়নের চাবিকাঠি হতে পারে। এই ফর্মুলার মাধ্যমে ভারত এবং বাংলাদেশ উভয়েই ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে অর্জিত স্বীয় সুবিধা পরস্পর বিনিময় করে নিতে পারে। এ ফর্মুলার অধীনে ভারত বাংলাদেশে প্রবাহিত সব নদ-নদী উন্মুক্ত করে দেবে, যাতে সেসব নদীর স্বাভাবিক পূর্ণ প্রবাহ বাংলাদেশে পৌঁছাতে পারে। বিনিময়ে বাংলাদেশ ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা দেবে। নিঃসন্দেহে ট্রানজিট ইস্যুর আরও বহু দিক আছে এবং সেসব ইস্যুর যথাযথ সমাধান হতে হবে। কিন্তু এখানে মূল সিদ্ধান্তটি রাজনৈতিক। বাংলাদেশের জন্য এ রাজনৈতিক সিদ্ধান্তটি কেবল তখনই নেওয়া সঙ্গত, যখন এর বিনিময়ে সে কোনো স্ট্র্যাটেজিক সুফল অর্জন করবে। একইভাবে ফারাক্কা, গজালডোবা প্রভৃতি বাঁধ অপসারণ করে নদ-নদীগুলো উন্মুক্ত করা ভারতের জন্যও একটি বড় ধরনের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্যও ভারতকে বিনিময়ে একটা স্ট্র্যাটেজিক সুফল পেতে হবে। বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ট্রানজিটের সুযোগ ভারতের জন্য তেমনই একটি স্ট্র্যাটেজিক সুফল।
বলা দরকার যে নদীর-বিনিময়ে-ট্রানজিট ফর্মুলার প্রতি বিরোধিতা প্রবল। বাংলাদেশের অনেকে মনে করেন যে নদ-নদীর বাধাহীন প্রবাহ বাংলাদেশের একটি স্বাভাবিক, প্রকৃতিপ্রদত্ত অধিকার ও প্রাপ্য। এ প্রাপ্য আদায়ের জন্য বিনিময়ে কিছু দেওয়ার প্রস্তাব তাঁরা সংগত মনে করেন না। তদুপরি তাঁরা মনে করেন যে ট্রানজিট একটি স্বতন্ত্র বিষয়, এবং সে বিষয়ে আলাদাভাবে সিদ্ধান্ত হতে হবে। এ বক্তব্য প্রসঙ্গে বলা দরকার যে নদ-নদীর বাধাহীন প্রবাহ বাংলাদেশের প্রাপ্য হলেও বাস্তবে ভারত এ প্রাপ্য স্বীকার করছে না এবং ক্রমাগতভাবে এ প্রবাহ আরও হ্রাস করছে। ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশ এযাবত্ এই প্রাপ্য আদায় করতে পারেনি। অন্যদিকে ভারত এ সমস্যার আন্তর্জাতিকীকরণেরও বিরোধী। ভারতের বিরোধিতা সত্ত্বেও বাংলাদেশ এ সমস্যা আন্তর্জাতিক ফোরামে উত্থাপন করতে পারে ঠিকই। কিন্তু ভারতের সম্মতি ভিন্ন এসব ফোরাম এ ইস্যু আলোচনার জন্য গ্রহণ করবে কি না, তার নিশ্চয়তা নেই। তদুপরি, তা করলেও এসব ফোরামের (স্বীয় অভিমতবিরোধী) কোনো সিদ্ধান্ত মেনে নেবে বলে কোনো লক্ষণ ভারত এযাবত্ প্রদর্শন করেনি। এই অবস্থায় নদ-নদীবিষয়ক প্রাপ্য আদায়ে বাংলাদেশের নিকট আর কী পথ খোলা আছে? এই প্রশ্নের কোনো সদুত্তর নদীর বিনিময়ে ট্রানজিট ফর্মুলার যাঁরা বিরোধীতা করছেন তাঁদের কাছ থেকে পাওয়া যায় না।
অন্যদিকে ভারতের অনেকে মনে করেন যে যেহেতু তাদের ভূখণ্ডের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে, সেহেতু নদ-নদীর প্রবাহ অপসারণের অধিকার তাঁদের আছে। তদুপরি, তাঁরা মনে করেন যে বর্তমান যুগে ট্রানজিট একটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত রীতি। সুতরাং, ট্রানজিটের বিনিময়ে বাংলাদেশ মাশুল, শুল্ক ইত্যাদি দাবি করতে পারে; কিন্তু নদ-নদীর প্রবাহ একটা ভিন্ন বিষয় এবং ট্রানজিটের বিনিময়ে নদ-নদীর প্রবাহ দাবি করা যৌক্তিক নয়।
দেখা যাচ্ছে, নদীর বিনিময়ে ট্রানজিট ফর্মুলার যাঁরা বিরোধিতা করছেন তাঁরা কোনো কার্যকর সমাধান প্রস্তাব করতে পারছেন না। তাঁরা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হচ্ছেন যে আপাতদৃষ্টিতে ভিন্ন মনে হলেও এ দুই ইস্যুর উত্স একই। সেটি হলো র্যাডক্লিফ রোয়েদাদের মাধ্যমে ১৯৪৭ সালে নির্ধারিত ভৌগোলিক সীমানা। এই ভৌগলিক সীমানাই নদ-নদীর পানি প্রবাহের ক্ষেত্রে ভারতকে নির্ধারণী ভূমিকা প্রদান করেছে, এবং এর ফলে, ভারতের পক্ষে বাংলাদেশের নদ-নদী থেকে পানি প্রত্যাহার সম্ভব হচ্ছে। আবার এই সীমানার কারণেই বাংলাদেশের কাছ থেকে ট্রানজিট লাভ করা ভারতের পক্ষে জরুরী হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের সামনে ট্রানজিট প্রদানে অস্বীকৃত হবার সুযোগ থাকছে। সুতরাং, এ দুই ইস্যু একই সমস্যার এপিঠ-ওপিঠ; এবং এ দুয়ের যুগপত্ সমাধান সম্ভব। নদীর বিনিময়ে ট্রানজিট হলো সেই সমাধানের ফর্মুলা। যত তাড়াতাড়ি বাংলাদেশ ও ভারতের জনগণ ও নীতিনির্ধারকেরা এই ফর্মুলার উপযোগিতা উপলব্ধি করতে পারেন ততই মঙ্গল, কেননা তার ফলে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কোন্নয়নের পথে মূল বাধাটি অপসারিত হবে।
বর্তমান প্রবন্ধের আলোচনার কাঠামোটি নিম্নরূপ। দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষিত ও তার প্রভাবের বিষয়টি আলোচিত হয়েছে। এই অনুচ্ছেদের আলোচনা থেকে বেরিয়ে আসবে যে ভূরাজনৈতিক অবস্থানের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হলেও সেটাই ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের সবটা নির্ধারণ করে না; বরং দ্বিপক্ষীয় বহু সমস্যাও এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তৃতীয় অনুচ্ছেদে এরূপ দ্বিপক্ষীয় ইস্যুর প্রতি দৃষ্টি দেওয়া হয়েছে। এ অনুচ্ছেদের আলোচনা থেকে দেখা যাবে যে বিভিন্ন দ্বিপক্ষীয় ইস্যুর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো নদ-নদীর পানি ভাগাভাগির ইস্যু। চতুর্থ অনুচ্ছেদে এ ইস্যুটি আলোচনার সূত্রপাত করা হয়। পঞ্চম অনুচ্ছেদে আমরা দেখবো যে এ সমস্যার উদ্ভবের কারণ হলো নদ-নদীর প্রতি ‘বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি’ (Commercial Approach), যা শিল্পবিপ্লবেরই একটি ফলশ্রুতি। কিন্তু কালক্রমে বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গির কুফলগুলো প্রকট হয়ে ওঠায় এর বিপরীতে নদ-নদীর প্রতি ‘প্রকৃতিসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি’ (Ecological Approach) জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে এবং ষষ্ঠ অনুচ্ছেদে এ দৃষ্টিভঙ্গির আলোচনা করা হয়েছে। এই আলোচনা থেকে দেখা যাবে, শুরুতে কেবল উন্নত বিশ্বে প্রসার লাভ করলেও ক্রমান্বয়ে প্রকৃতিসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি উন্নয়নশীল বিশ্বেও জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। সপ্তম অনুচ্ছেদে বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গিসঞ্জাত ফারাক্কা ও গজালডোবাসহ অভিন্ন নদ-নদীর ওপর ভারত কর্তৃক নির্মিত বাঁধগুলোর অভিজ্ঞতা আলোচনা করা হয়েছে এবং দেখানো হয়েছে যে সামগ্রিক ও দীর্ঘমেয়াদি বিচারে এসব বাঁধ কল্যাণকর নয়। অষ্টম অনুচ্ছেদে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর বিশেষ পরিস্থিতির আলোচনা করা হয়েছে এবং সেই সূত্রে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে এসব রাজ্যে পৌঁছানোর জন্য ট্রানজিট সুযোগের স্ট্র্যাটেজিক মূল্যটি পরস্ফুিট করা হয়েছে। নবম অনুচ্ছেদে দেখানো হবে যে জলবায়ু পরিবর্তন নদ-নদীর প্রতি প্রকৃতিসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণকে আরও জরুরি করে তুলেছে। এদিকে ব্রহ্মপুত্র নদের ক্ষেত্রে ভারতের উজানে রয়েছে চীন। এ উজান অবস্থানের সুযোগ নিয়ে চীন ব্রহ্মপুত্র নদের পানি উত্তরাভিমুখী অপসারণের পরিকল্পনা করছে বলে বিভিন্ন পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে। দশম অনুচ্ছেদে দেখানো হবে যে কেবল নদ-নদীর প্রতি প্রকৃতিসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণের মাধ্যমেই ভারত চীনের এ পরিকল্পনার বিরোধিতা করতে পারে এবং বাংলাদেশকে সে বিরোধিতায় পাশে পেতে পারে। একাদশ অনুচ্ছেদে নদীর বিনিময়ে ট্রানজিট প্রস্তাবটি তুলে ধরা হবে। দ্বাদশ অনুচ্ছেদে দেখানো হবে যে নদীবিষয়ক আন্তর্জাতিক আইন ও প্রথা নদ-নদীর প্রতি প্রকৃতিসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি এবং নদীর বিনিময়ে ট্রানজিট ফর্মুলাকে সমর্থন করে। সবশেষে ত্রয়োদশ অনুচ্ছেদে কিছু উপসংহার পরিবেশনের মাধ্যমে প্রবন্ধের সমাপ্তি টানা হবে।
২. ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষিত
আশির দশকের শেষ পর্যন্ত পৃথিবী মূলত দুই শিবিরে বিভক্ত ছিল। একটি ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পুঁজিবাদী শিবির। অন্যটি ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক শিবির। ভারত জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকলেও সাধারণভাবে সোভিয়েত নেতৃত্বাধীন শিবিরের সঙ্গেই অপেক্ষাকৃত বেশি ঘনিষ্ঠ ছিল। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় দীর্ঘমেয়াদি শান্তি ও সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে ভারত-সোভিয়েত সম্পর্ক একটা ঘনিষ্ঠতর পর্যায়ে উন্নীত হয়। ইন্দিরা গান্ধী ভারতের সংবিধান সংশোধন করে ‘সমাজবাদ’কে একটি লক্ষ্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেন। অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অভ্যুদিত বাংলাদেশের অন্যতম রাষ্ট্রীয় লক্ষ্য হিসেবেও ‘সমাজতন্ত্র’ গৃহীত হয়। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর মস্কো সফরকালে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে বাংলাদেশেরও দীর্ঘমেয়াদি শান্তি ও সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সুতরাং সে সময় ভূরাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ভারত ও বাংলাদেশ একই বলয়ের অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং তা এ দুই দেশের মধ্যে সুসম্পর্কের জন্য সহায়ক হয়।
সোভিয়েত-ভারত-বাংলাদেশ এক্সিসের বিপরীতে ছিল যুক্তরাষ্ট্র-চীন-পাকিস্তান এক্সিস। মতাদর্শগত ও অন্যান্য কারণে সোভিয়েতবিরোধিতার সূত্রে চীন সে সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী হয়। স্বাভাবিকভাবেই যুক্তরাষ্ট্র তাতে ইতিবাচক সাড়া দেয়। মার্কিন-ঘনিষ্ঠ পাকিস্তান চীন-মার্কিন সম্পর্কোন্নয়নের এ প্রচেষ্টায় দূতিয়ালির ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। সে কারণেই ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ তদানীন্তন মার্কিন পররাষ্ট্রসচিব হেনরি কিসিঞ্জারের এত বেশি বিরক্তির উদ্রেক করে। মুক্তিযুদ্ধের বিজয় ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র সপ্তম নৌবহরও ভারত মহাসাগর অভিমুখে রওনা করায়। কেবল সোভিয়েতের পাল্টা সামরিক হুমকি এবং নিরাপত্তা পরিষদে ভেটোই যুক্তরাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করে এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিজয় অর্জন করে।
কিন্তু ১৯৭১ সালের এ পরাজয় মার্কিনেরা সহজে মেনে নেয় না এবং বিভিন্ন ধরনের ষড়যন্ত্র অব্যাহত থাকে।১ এই ষড়যন্ত্রের ধারাতেই অবশেষে ১৯৭৫ সালে সামরিক ক্যুর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা এবং খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে একটি মার্কিনপন্থী সরকার অধিষ্ঠিত হয়। ফলে ১৯৭৫ সালের পর থেকে ভারত এবং বাংলাদেশ ভূরাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে প্রতিদ্বন্দ্বী শিবিরে অবস্থান নেয়। ভারত থেকে যায় সোভিয়েত শিবিরে; অন্যদিকে বাংলাদেশ প্রকারান্তরে মার্কিন শিবিরে প্রবেশ করে। এরূপ প্রতিদ্বন্দ্বী ভূরাজনৈতিক অবস্থান স্বাভাবিকভাবেই এ দুই দেশের সম্পর্কের অবনতি ডেকে আনে।
১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর দুই পরাশক্তিভিত্তিক দ্বিমেরুসম্পন্ন পৃথিবীর অবসান ঘটে। ভারতও সে সময় থেকে পূর্বতন সমাজতন্ত্রভাবাপন্ন বিভিন্ন নিয়ন্ত্রণমূলক অর্থনৈতিক নীতির পরিবর্তে পুঁজিবাদী মুক্তবাজারমূলক নীতিমালা গ্রহণ করতে শুরু করে। এ দুই ধারার পরিবর্তনের ফলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের সুসম্পর্ক গড়ে ওঠার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। সুতরাং, নব্বইয়ের দশক থেকে ভারত ও বাংলাদেশ উভয়েই আবার একই ভূরাজনৈতিক বলয়ের অন্তর্ভুক্ত হয় এবং সে কারণে এ দুই দেশের মধ্যে সুসম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার আন্তর্জাতিক অনুকূল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
কিন্তু গোটা পরিস্থিতি এত সরলও নয়। বাংলাদেশ-ভারত সংশ্লিষ্ট ভূরাজনীতিতে আরেক শক্তি হলো পাকিস্তান এবং মধ্যপ্রাচ্যের সম্প্রসারণবাদী ইসলামি মতাদর্শ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও বিশ্ব পুঁজিবাদের সঙ্গে এ শক্তির সম্পর্ক বৈপরীত্যমূলক। ধর্মীয় সূত্রে পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের যে ঐতিহাসিক বৈরিতা, তা যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নকেন্দ্রিক দ্বিমেরুসম্পন্ন পৃথিবীর অবসানের সঙ্গে তিরোহিত হয় না। ১৯৭৫ সালের পর থেকে পাকিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যের তেলের অর্থ দ্বারা পরিপুষ্ট সম্প্রসারণবাদী ইসলামি শক্তি বাংলাদেশের ওপর বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে। ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যের কারণে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশগুলো ভারতের জন্য একটি সমস্যাসংকুল এলাকা। এ এলাকার বিচ্ছিন্নতাবাদী তত্পরতাকে উত্সাহ দেওয়ার জন্য পাকিস্তান ও সম্প্রসারণবাদী ইসলামি শক্তি বাংলাদেশকে ব্যবহারে সচেষ্ট হয়। প্রতিক্রিয়া হিসেবে ভারত বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগোষ্ঠীর সশস্ত্র তত্পরতাকে সহায়তা দেয় বলেও অভিযোগ রয়েছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নকেন্দ্রিক দ্বিমেরুসম্পন্ন পৃথিবীর অবসান এবং আর্থসামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে ভারত ও বাংলাদেশ সাধারণভাবে একই বলয়ের অন্তর্ভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক জটিল থেকে যায়।
৩. ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে দ্বিপক্ষীয় সমস্যাবলি
কিন্তু ভূরাজনৈতিক সমস্যাবলিই ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে একমাত্র বাধা নয়। এ ক্ষেত্রে রয়েছে আরও বহু স্বার্থের সংঘাত। এর মধ্যে একটি হলো সীমান্তসংক্রান্ত। ১৯৪৭ সালে র্যাডক্লিফ রোয়েদাদের মাধ্যমে তদানীন্তন পূর্ব-পাকিস্তান ও পরবর্তীকালে বাংলাদেশের যে সীমান্ত প্রতিষ্ঠিত হয়, তাতে বেশ কিছু বিষয় অমীমাংসিত থাকে। তার মধ্যে অন্যতম ছিল বিভিন্ন ছিটমহলের সঙ্গে মূল ভূখণ্ডের যাতায়াতসংক্রান্ত। সমুদ্রসীমার বিষয়েও সংঘাত রয়েছে। সীমান্তের একটা বড় অংশজুড়ে ভারত ইতিমধ্যেই কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করেছে। সীমান্ত ইস্যুর সঙ্গে সম্পর্কিত হলো সীমান্তরক্ষীদের আচরণ। বাংলাদেশের অভিযোগ রয়েছে যে ভারতীয় সীমান্তরক্ষীরা অযাচিত ও অন্যায্যভাবে বাংলাদেশিদের ওপর গুলিবর্ষণ ও হত্যা করে। কিছুকাল আগে গুলি করে হত্যা করার পর ভারতীয় সীমান্তরক্ষীরা ফেলানী নামের এক বাংলাদেশি কিশোরীকে কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলিয়েও রাখে। সমপ্রতি ঘুষ না দেওয়ার কারণে ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের এক বাংলাদেশি যুবককে উলঙ্গ করে নির্বিচার প্রহার করার ঘটনা বাংলাদেশিদের অনুভূতিকে আঘাত করেছে।
ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় আরেকটি সমস্যা হলো বাণিজ্যসংক্রান্ত। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে অভিযোগ রয়েছে যে বিভিন্ন শুল্ক ও শুল্কবহির্ভূত বিধিনিষেধ দ্বারা ভারত স্বীয় দেশে বাংলাদেশের পণ্য আগমনকে বাধাগ্রস্ত অথবা নিরুত্সাহিত করছে। ফলে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ভারতের বিশাল উদ্বৃত্ত বিরাজ করছে। চোরাচালানির মাধ্যমে সম্পাদিত অবৈধ বাণিজ্যকে অন্তর্ভুক্ত করলে এ উদ্বৃত্ত আরও অনেক বেশি বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।২ বাণিজ্যে ক্রমাগতভাবে একতরফা উদ্বৃত্ত স্থিতিশীলতার জন্য অনুকূল নয়।
বাণিজ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত হলো বিভিন্ন ধরনের প্রবেশাধিকার। এর একটি উদাহরণ হলো টেলিভিশনের সম্প্রচারের ক্ষেত্র। যেখানে ভারতীয় চ্যানেলগুলো বাংলাদেশে অবাধে সম্প্রচারিত হতে পারছে, সেখানে বাংলাদেশি চ্যানেলগুলো ভারতে সম্প্রচারের ক্ষেত্রে বিভিন্ন বাধার সম্মুখীন হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সুতরাং, ভূরাজনৈতিক অবস্থান থেকে উদ্ভূত সমস্যাদি ছাড়াও ভারত-বাংলাদেশ সমস্যার ক্ষেত্রে বহুবিধ দ্বিপক্ষীয় সমস্যা রয়েছে। এসব দ্বিপক্ষীয় সমস্যার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে নদ-নদীর পানি ভাগাভাগির সমস্যা।
৪. নদ-নদীর পানি ভাগাভাগির সমস্যা
বাংলাদেশ মূলত গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা দ্বারা গঠিত একটি ব-দ্বীপ। কিন্তু এসব নদ-নদী (অথবা তাদের উত্স নদীগুলো) ভারতের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে এবং শেষাবধি বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশেছে। উজানে অবস্থানের সুযোগ নিয়ে ভারত এসব নদ-নদীর পানি অপসারণ করে নিচ্ছে। ফলে বাংলাদেশের নদ-নদীগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে এবং এ দেশের ভূপ্রকৃতি ও অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
এ প্রক্রিয়ার সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো ফারাক্কা বাঁধ। এ বাঁধের মাধ্যমে ভারত গঙ্গা নদীর পানির একটা বড় অংশ বাংলাদেশের পদ্মা থেকে পশ্চিমবঙ্গের হুগলি-ভাগীরথী নদীতে প্রবাহিত করছে। ফলে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নদ-নদীগুলো ক্রমান্বয়ে শুকিয়ে যাচ্ছে। একই ধারার দ্বিতীয় উদাহরণ হলো গজালডোবা বাঁধ। এ বাঁধের মাধ্যমে তিস্তাপ্রবাহের একটা বড় অংশ ভারত অপসারণ করে নিচ্ছে। ফারাক্কা ও গজালডোবা ছাড়াও অভিন্ন নদ-নদীর প্রায় সব কটির ওপরই ভারত পানি প্রত্যাহার কিংবা প্রবাহ নিয়ন্ত্রণমূলক কাঠামো নির্মাণ করেছে, নির্মাণে রত কিংবা নির্মাণের পরিকল্পনা করছে (চিত্র-১)। ভারতের এই আচরণের ফলে বাংলাদেশের সর্বত্র নদ-নদীর প্রবাহ হ্রাস পাচ্ছে এবং তীরবর্তী জনপদগুলোর প্রকৃতি ও পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে (চিত্র-২, ৩, এবং ৪ দ্রষ্টব্য)।
দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে এযাবত্ নদ-নদী ভাগাভাগি সমস্যার বিশেষ সুরাহা হয়নি। ১৯৭৪ সালে ভারত যখন ফারাক্কা বাঁধ পরীক্ষামূলকভাবে চালু করে, তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার ক্ষমতায়। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনৈতিক বন্ধুত্ব তখন সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ। এ সত্ত্বেও ভারত ফারাক্কা বাঁধসংক্রান্ত স্বীয় পরিকল্পনা বাস্তবায়নে দ্বিধা করেনি। এ ঘটনা থেকেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে ভূরাজনৈতিক বলয়গত অবস্থান অথবা রাজনৈতিক বন্ধুত্বের ঘাটতিই ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক উন্নয়নের পথে একমাত্র বাধা নয়। তারপর থেকে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে নদীর পানি ভাগাভাগির সমস্যা আরও তীব্র হয়েছে। সাম্প্রতিক কালে তিস্তা নদীর পানির ভাগাভাগি ও বরাক নদীর ওপর টিপাইমুখ বাঁধের ইস্যু এ দুই দেশের সম্পর্কোন্নয়নের প্রয়াসকে একটা অচলাবস্থায় উপনীত করেছে।
ভারতের প্রস্তাবিত ‘নদী সংযোগ প্রকল্প’ (River Linking Project, RLP) (চিত্র-৫) নদী ভাগাভাগির সমস্যা আরও কঠিন সংকটের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এ প্রকল্পের অধীনে ব্রহ্মপুত্র নদ ও গঙ্গা নদী ও তাদের বিভিন্ন উপনদীর পানি ১৪টি নতুন খনন করা খালের মাধ্যমে পশ্চিম ও দক্ষিণ ভারত অভিমুখে প্রবাহিত করা হবে। ফারাক্কার কারণে গঙ্গাপ্রবাহ হ্রাসের পর এখন ব্রহ্মপুত্র নদই বাংলাদেশের ভূপৃষ্ঠস্থ পানির প্রায় ৭০ শতাংশের উত্স। নদী সংযোগ প্রকল্পের মাধ্যমে যদি ভারত ব্রহ্মপুত্র নদের পানিও অপসারিত করে, তাহলে বাংলাদেশের বাকি অধিকাংশ নদ-নদী শুকিয়ে যাবে এবং এ দেশের অর্থনীতি ও প্রতিবেশ এক গভীর সংকটে নিপতিত হবে।
রণজিত্ কুমার নামের একজন আইনজীবীর প্ররোচনায় ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ২০০২ সালে একবার নদী সংযোগ প্রকল্পের সুপারিশ করেছিল।৩ কিন্তু বিভিন্ন মহলের প্রতিবাদের মুখে এবং এ ব্যয়বহুল প্রকল্পের উপযোগিতা সম্পর্কে সংশয়ের কারণে ভারতের তদানীন্তন সরকার এ প্রকল্পের সর্বাত্মক অনুমোদন ও বাস্তবায়ন থেকে বিরত থাকে। কিন্তু ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১২ তারিখে রণজিত্ কুমার আবার ভারতের সুপ্রিম কোর্টকে নদী সংযোগ প্রকল্পের পক্ষে রায় প্রদানে উদ্বুদ্ধ করতে সমর্থ হয়েছেন। এবারের রায়টি আরও বেশি কড়া। এ রায়ে ভারত সরকারকে ৩০ দিনের মধ্যে নদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু করে ২০১৬ সালের মধ্যে তা সম্পন্ন করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, এ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া তদারক করার জন্য আদালত নিজেই একটি কমিটি গঠন করে দিয়েছেন এবং মান্যবর রণজিত্ কুমারকে তার একজন সদস্য হিসেবে মনোনীত করেছেন। এ প্রকল্পের অনুমিত ব্যয় ধরা হয়েছে পাঁচ লাখ কোটি রুপি।৪
এ প্রকল্পের অধীনে মোট ৩০টি সংযোগ খালের মাধ্যমে ব্রহ্মপুত্র ও গঙ্গা এবং এই অববাহিকার অন্যান্য উপনদী থেকে পানি পশ্চিম ও দক্ষিণ ভারতে স্থানান্তরিত করা হবে।
বাংলাদেশের বিভিন্ন মহল থেকে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক নদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়নের আদেশের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের মূল কাজ হলো নিম্ন আদালতগুলোর বিভিন্ন রায় দেশের সংবিধান ও অন্যান্য আইনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হয়েছে কি না, তা পরীক্ষা ও নিশ্চিত করা। বন্যানিয়ন্ত্রণ ও সেচ সম্প্রসারণ কীভাবে অর্জিত হতে পারে, তার জন্য প্রকল্প নির্বাচন করা তার এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে না। বিচারকদের সে পারদর্শিতা থাকার কথা নয়। এ কাজ করার দায়িত্ব দেশের সরকারের। তদুপরি নদী সংযোগ প্রকল্প দ্বারা যেসব হিমালয়প্রসূত নদ-নদীর পানি ভিন্নমুখে প্রবাহিত করার কথা, সেগুলো আন্তর্জাতিক নদী; ভারতের অভ্যন্তরীণ নদী নয়। কাজেই এসব নদ-নদীর বিষয়ে বাংলাদেশের সম্মতি ভিন্ন কোনো পদক্ষেপ ভারত নিতে পারে না। এ সত্ত্বেও ভারতের সুপ্রিম কোর্ট কীভাবে এরূপ একটি অবিবেচনাপ্রসূত ও অপরিণামদর্শী আদেশ দিতে পারলেন, তা সত্যিই বিস্ময়কর।
ভারত সরকার কর্তৃক ইতিমধ্যে নির্মিত পানি প্রত্যাহারমূলক প্রকল্পগুলো এবং ভারতের সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক নদী সংযোগ প্রকল্পবিষয়ক ওপরে আলোচিত আদেশের পেছনে রয়েছে নদ-নদীর প্রতি এক বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি। এ দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ভিন্ন ভারত-বাংলাদেশের মধ্যকার নদীর পানি ভাগাভাগি সমস্যার সমাধান অর্জন করা কঠিন। কাজেই এ দৃষ্টিভঙ্গির দিকে এবার নজর দেওয়া যাক।
৫. নদ-নদীর প্রতি ‘বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি’
ভারত কর্তৃক অভিন্ন নদ-নদী থেকে পানি প্রত্যাহার এবং প্রবাহ নিয়ন্ত্রণমূলক কাঠামো নির্মাণের অন্যতম তলবর্তী কারণ হলো নদ-নদীর প্রতি ‘বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি’।৫ এ দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী নদ-নদীর পানি সমুদ্রে চলে যেতে দেওয়া অপচয়; বরং সবটা পানিই বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রয়োজনে শুষে নিতে হবে। নদ-নদীর প্রতি এ বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গির অন্তরালে আরও আছে শিল্পবিপ্লবের মধ্য দিয়ে প্রকৃতির ওপর অর্জিত প্রভুত্বকে আরও অগ্রসর করার বাসনা। শিল্পবিপ্লবের আগপর্যন্ত প্রকৃতির ওপর মানুষের ক্ষমতা ছিল সীমাবদ্ধ; বরং প্রকৃতির কাছে মানুষ বেশ অসহায়ই ছিল। তখন উত্পাদন প্রক্রিয়ার চালিকাশক্তির জন্য মানুষ মূলত নিজের এবং পশুর কায়িক শক্তির ওপরই নির্ভর করত। শিল্পবিপ্লবের আগেও বায়ু ও জলপ্রবাহ শক্তির কিছু ব্যবহার অর্জিত হয়েছিল ঠিকই; কিন্তু তার চরিত্র ও ব্যাপ্তি সীমাবদ্ধ ছিল।
শিল্পবিপ্লব প্রকৃতির ওপর মানুষের প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠাকে সুগম করে। উত্পাদনের চালিকাশক্তি হিসেবে যন্ত্রের আবির্ভাব ঘটে। প্রথমাবস্থায় এসব যন্ত্র জলপ্রবাহজনিত শক্তি নির্ভর হলেও দ্রুতই তাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে। বাষ্পচালিত ইঞ্জিন আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে মানবসভ্যতা এক নতুন যুগে প্রবেশ করে। পরবর্তীকালে বিদ্যুত্শক্তির আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে এই অগ্রগতি আরও উঁচু স্তরে উন্নীত হয়।
প্রকৃতির ওপর প্রভুত্ব অর্জনের এ ধারাতেই মানুষ নদ-নদীকে জয় করার প্রচেষ্টায় নিয়োজিত হয় এবং বৃহদাকার বাঁধ দ্বারা নদীপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করার পদক্ষেপের সূচনা ঘটে। বাঁধ দ্বারা জলবিদ্যুত্ উত্পাদন সম্ভব হওয়ায় এসব প্রচেষ্টা আরও আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। শিল্প-পুঁজিবাদী দেশগুলোতে বাঁধ নির্মাণ ও জলবিদ্যুত্ উত্পাদন এক গুরুত্বপূর্ণ কর্মতত্পরতায় পরিণত হয়।
একই সঙ্গে কৃষি উত্পাদনের ক্ষেত্রে সংঘটিত কতিপয় পরিবর্তনও নদ-নদীকে নিয়ন্ত্রণে আনার প্রক্রিয়াকে উত্সাহিত করে। শিল্পবিপ্লবসৃষ্ট প্রকৃতির ওপর প্রভুত্ব অর্জনের ধারা কৃষিক্ষেত্রেও অগ্রসর হয়। কৃত্রিম উপায়ে উচ্চ ফলনশীল বীজ উদ্ভাবন করা সম্ভব হয় এবং এসব বীজ দ্বারা ফসল উত্পাদনের জন্য কৃত্রিম সেচব্যবস্থা আবশ্যক হয়ে ওঠে। এ ছাড়া শিল্পবিপ্লব জনসংখ্যার স্ফীতি ডেকে আনে; এবং বর্ধিত এ জনসংখ্যার জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য উত্পাদনের জন্যও আরও বেশি জমিতে চাষাবাদের প্রয়োজন হয় এবং তার জন্য সেচের পানির প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।
প্রবাহনিয়ন্ত্রণ, জলবিদ্যুত্ উত্পাদন এবং সেচ সম্প্রসারণ এ ত্রিমুখী উপকারের প্রত্যাশায় নদ-নদীর ওপর ব্যাপক অভিযান পরিচালিত হয়। এই অভিযানের ফলে অনেক ক্ষেত্রে সত্যিই নদীর পানিকে আর সমুদ্র পর্যন্ত পৌঁছাতে দেওয়া হয় না; তার আগেই প্রবাহের সবটুকু শুষে নেওয়া হয়। আমেরিকার কলোরাডো নদী এ প্রক্রিয়ার অন্যতম উদাহরণ। প্রশান্ত মহাসাগরে পৌঁছানোর আগেই এ নদী এখন দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার মরুভূমিতে প্রাণ হারায়। একই পরিণতি ঘটেছে অস্ট্রেলিয়ার ডার্লিং-মারে নদীর।
শিল্প-পুঁজিবাদী দেশগুলোতে উদ্ভূত নদ-নদীর প্রতি এ বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি পরবর্তীকালে উন্নয়নশীল, উপনিবেশিত পুঁজিবাদী দেশগুলোতেও বিস্তৃত হয়। বিশেষত ভারত এবং চীন নদ-নদীর ওপর বাঁধ নির্মাণে বিশেষভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠে; বাঁধের সংখ্যার দৃষ্টিকোণ থেকে এ দুই দেশ উন্নত, শিল্প পুঁজিবাদের দেশগুলোকেও ছাড়িয়ে যায়।
ভারতের প্রস্তাবিত নদী সংযোগ প্রকল্প এ বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এ প্রকল্পের প্রস্তাবকদের মতে কোনো কোনো নদী অববাহিকা উদ্বৃত্ত পানিসম্পন্ন, আর কোনো কোনো নদী অববাহিকা পানির ঘাটতিসম্পন্ন। সে কারণে প্রথমোক্ত অববাহিকাগুলো থেকে পানি কৃত্রিম খাল খননের মাধ্যমে শেষোক্ত অববাহিকাগুলোতে স্থানান্তর করতে হবে।
বলাবাহুল্য, এ ধরনের চিন্তা হলো প্রকৃতির বিরুদ্ধচারিতা; বলা যেতে পারে, ‘খোদার ওপর খোদকারি করা’র প্রয়াস। ভূপ্রাকৃতিক বৈচিত্র্য প্রকৃতিরই একটি অন্যতম আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য। এ বৈচিত্র্যের অঙ্গ হিসেবে পৃথিবীর কোথাও পাহাড় আবার কোথাও নিম্নভূমি। তাই বলে কি পাহাড় কেটে নিম্নভূমি ভরাট করে পৃথিবীর সর্বত্র একই উচ্চতা অর্জন করতে হবে? তদ্রূপ, পৃথিবীর কোনো কোনো অঞ্চলে বৃষ্টিপাত বেশি হয়; আবার কোথাও বৃষ্টিপাত কম হয়। প্রথমোক্ত অঞ্চলের নদ-নদীতে শেষোক্ত অঞ্চলের নদ-নদী থেকে প্রবাহ বেশি থাকে। আবার একই অঞ্চলে বছরের সব ঋতুতে একই পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয় না। সে কারণে একই নদী অববাহিকায় বর্ষাকালে প্রবাহ বেশি থাকে; আবার শুষ্ক মৌসুমে প্রবাহ কমে যায়। প্রতিটি অববাহিকার প্রতিবেশ, অর্থনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতি এসব স্থান-কাল-ভেদসম্পন্ন বৈচিত্র্যের ওপর নির্ভর করেই গড়ে ওঠে। ভূপ্রাকৃতিক এ বৈচিত্র্যই উদ্ভিদ ও প্রাণিবৈচিত্র্যের জন্ম দিয়েছে। সুতরাং ‘উদ্বৃত্ত’ এবং ‘ঘাটতি’ অববাহিকা বলে কিছু নেই। প্রতিটি অববাহিকাই তার নিজ বৈশিষ্ট্য দ্বারা মণ্ডিত ও স্বকীয়। প্রতিটি অববাহিকার স্বকীয়তা অক্ষুণ্ন রাখাই মানবজাতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ করণীয়।
বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গির অনুসারীরা প্রকৃতিবিষয়ক এ মৌল সত্যটি উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হন। তাঁরা কেবল নদীর পানির সাক্ষাত্ উপযোগ মূল্যের সন্ধান করেন। তাঁরা ভুলে যান যে এক অববাহিকার পানি অন্য অববাহিকায় স্থানান্তরিত করা হলে উভয় অববাহিকারই ক্ষতিসাধিত হবে। ফলে তাঁরা প্রকৃতি-সংহারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। তারই প্রতিফলন দেখা যায় ভারতের প্রস্তাবিত নদী সংযোগ প্রকল্পের মধ্যে।
তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের কিছু অভিজ্ঞতা নদ-নদীর প্রতি বাণিজ্যিক পন্থার করুণ পরিণতির সাক্ষ্য দেয়। যেমন সে দেশের মধ্য এশিয়া অঞ্চলের আমু দরিয়া ও সির দরিয়া নামক দুটি গুরুত্বপূর্ণ নদী অনাদিকাল থেকে আরল সাগর অভিমুখে প্রবাহিত হতো। কিন্তু ষাট ও সত্তর দশকে কাজাখস্তান প্রজাতন্ত্রে তুলাচাষ বৃদ্ধির লক্ষ্যে এ দুই নদীর প্রবাহের গতিমুখ পরিবর্তিত করা হয়েছিল। এতে সাময়িকভাবে তুলাচাষের কিছু বৃদ্ধি হয়েছিল ঠিকই। কিন্তু দ্রুত জলাবদ্ধতা, লবণাক্ততা প্রভৃতি সমস্যার উদ্রেক ঘটে। অন্যদিকে আমু দরিয়া ও সির দরিয়ার প্রবাহ থেকে বঞ্চিত হয়ে আরল সমুদ্র ক্রমেই সংকুচিত হতে থাকে ও মৃত্যুমুখে উপনীত হয় (চিত্র-৬ এবং ৭ দ্রষ্টব্য)। পৃথিবীর আরও বহু স্থানেই নদ-নদীর প্রতি বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণের এরূপ করুণ ফলাফলের দৃষ্টান্ত দেখা যায়।
৬. নদ-নদীর প্রতি ‘প্রকৃতিসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি’
কিন্তু ভারত ও চীনসহ অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশে যখন নদীর প্রতি বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রসার লাভ করে এবং এসব দেশ বাঁধ নির্মাণে ব্যাপকভাবে নিয়োজিত হয়, তত দিনে খোদ উন্নত দেশগুলোতে বাঁধের লাভ-ক্ষতি সম্পর্কে দ্বিতীয় চিন্তার উদ্রেক ঘটে। অভিজ্ঞতা থেকে স্পষ্ট হয় যে বাঁধের লাভের দিকটিকে বাড়িয়ে দেখা হয়েছে এবং বাঁধের ক্ষতির দিকগুলোর দিকে পর্যাপ্ত মনোযোগ দেওয়া হয়নি। বাঁধবিষয়ক বিশ্ব কমিশনের রিপোর্টে (World Commission on Dams, 2000) এই উপলব্ধিটিই বেরিয়ে আসে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বাঁধের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে দেখা যায়, প্রায়ই ঘোষিত মাত্রার বিদ্যুত্ উত্পাদিত হয়নি; বন্যানিয়ন্ত্রিত না হয়ে অনেক সময় বাঁধ বাড়তি বন্যার কারণ হয়েছে; সেচের নামে পানির অপচয় সাধিত হয়েছে এবং জলাবদ্ধতা ও লবণাক্ততার নতুন সমস্যার উদ্ভব ঘটেছে। অন্যদিকে, বাঁধ দ্বারা সৃষ্ট জলাধার বিপুল এলাকাকে নিমজ্জিত করে সে এলাকার প্রকৃতিকে বিনষ্ট করেছে; নিমজ্জিত এলাকায় বসবাসরত জনগোষ্ঠীকে বিপর্যস্ত উদ্বাস্তুতে পরিণত করেছে এবং জলাধারগুলোকে মিথেন এবং অন্যান্য উষ্ণতা বৃদ্ধিকারক গ্যাস উদিগরণের উেস পরিণত করেছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এসব বাঁধ দ্বারা উত্পাদিত জলবিদ্যুত্ নিমজ্জিত এলাকার জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছায়নি; এবং যে উন্নয়নের নামে বাঁধ নির্মাণ তা এসব জনগোষ্ঠীকে স্পর্শ করেনি। বাঁধ নদীবাহিত পলিমাটির বিচ্ছুরণকে বাধাগ্রস্ত করে একদিকে প্লাবনভূমির স্বাভাবিক বিকাশকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, অন্যদিকে জলাধারে অতিরিক্ত পলিমাটিভরণের জন্ম দিয়েছে। বাঁধ নদীকে বিভক্ত করেছে এবং অবাধ চলাচলকে বাধাগ্রস্ত করে অনেক জলজ প্রাণীকে নিশ্চিহ্নতাপ্রাপ্তির দিকে ঠেলে দিয়েছে। এসব ক্ষতিকারক প্রতিফলের আলোকে দেখা যায় যে বৃহত্তর অর্থনৈতিক বিচারে জলবিদ্যুত্ মোটেও সস্তা প্রমাণিত হয়নি; বরং জলবিদ্যুতের জন্য অর্থনীতি ও সমাজকে অনেক চড়া মূল্য দিতে হয়েছে।
এসব অভিজ্ঞতার কারণেই আশির দশক থেকে নদ-নদীর প্রতি প্রকৃতিসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি প্রসার লাভ করে। এ দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী বাধাগ্রস্ত না করে বরং নদ-নদীর স্বাভাবিক প্রবাহের পরিমাণ ও গতিমুখ অক্ষুণ্ন রাখাই বাঞ্ছনীয় বলে বিবেচিত হয়। এ দৃষ্টিভঙ্গি কৃষি কিংবা নগরায়ণের জন্য পানির প্রয়োজনকে অস্বীকার করে না। কিন্তু লক্ষ্য করা হয় যে এসব উদ্দেশ্যে পানির অনেক সাশ্রয়ী ব্যবহার সম্ভব। বিশেষত সেচের জন্য পানির প্রয়োজনীয়তা বর্তমানের তুলনায় বহুগুণ হ্রাস করা যায়। যেমন, ড্রিপ পদ্ধতির ব্যবহারের মাধ্যমে অনেক কম পানি দিয়েও একই মাত্রার সেচ অর্জন করা যায়। পানি-সাশ্রয়ী ফসল আবাদের মাধ্যমেও সেচের প্রয়োজনীয়তা হ্রাস করা যায়। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে পানি-সাশ্রয়ী ফসলের নতুন বীজের উদ্ভাবন করাও সম্ভব। ফলে, কৃষি উত্পাদন বৃদ্ধির জন্য নদীর প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করে সেচ সম্প্রসারণ অপরিহার্য নয়। সেচের প্রয়োজনীয়তা হ্রাসের মাধ্যমে জমিকে জলাবদ্ধতা ও লবণাক্ততা থেকেও রক্ষা করা সম্ভব। সুতরাং, পানি-সাশ্রয়ী কৃষির মাধ্যমে শুধু নদী নয়, জমির স্বাভাবিক গুণাগুণও রক্ষা করা যায়।
একইভাবে নগরায়ণের জন্য প্রয়োজনীয় পানির পরিমাণও হ্রাস করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে পানির পুনর্ব্যবহার পদ্ধতির আশ্রয় নেওয়া যায়। সর্বোপরি জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার হ্রাসের মাধ্যমে নগরায়ণ ও কৃষি উত্পাদন বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তাও হ্রাস করা সম্ভব।
লক্ষ করা প্রয়োজন যে শিল্পবিপ্লবের পর থেকে জনসংখ্যা ও অর্থনৈতিক উত্পাদন, উভয় ক্ষেত্রেই প্রবৃদ্ধি অনেকটা আনুভূমিক থেকে উল্লম্বিক চরিত্র অর্জন করেছে (চিত্র-৮ এবং ৯ দ্রষ্টব্য)। এই উল্লম্বিক প্রবৃদ্ধি পৃথিবীর প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর বিপুল চাপের সৃষ্টি করেছে। এ চাপ ক্রমেই অসহনীয় হয়ে উঠছে। উষ্ণতা বৃদ্ধিকারক গ্যাসের উদিগরণ বৃদ্ধি ও তদ্বারা সৃষ্ট জলবায়ুর পরিবর্তনই তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ (চিত্র-১০ এবং ১১ দ্রষ্টব্য)। এসব পরিণতি থেকে স্পষ্ট যে সম্পদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে সাশ্রয়ী না হয়ে পৃথিবীর প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব নয়। ফলে নদ-নদীর প্রতি বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিত্যাগ করে প্রকৃতিসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ আজ অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।
আশার কথা যে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই নদ-নদীর প্রতি প্রকৃতিসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ এবং এ দৃষ্টিভঙ্গিসঞ্জাত কর্মতত্পরতার সূচনা ঘটেছে। যেমন, উন্নত দেশগুলোতে নদ-নদীর ওপর নির্মিত বাঁধ ভেঙে ফেলার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইতিমধ্যে পাঁচ শতাধিক বাঁধ অপসারিত করে নদ-নদীকে আগের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যেতে দেওয়া হয়েছে। জাপান এবং ইউরোপের অন্যান্য উন্নত দেশেও এখন নতুন বাঁধ নির্মাণ নিরুত্সাহিত হয়েছে এবং এর আগে নির্মিত বাঁধ ভেঙে দেওয়া হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিজ্ঞতার আলোকে এ দৃষ্টিভঙ্গি দিন দিন আরও জোরালো হচ্ছে।
নদ-নদীর প্রতি প্রকৃতিসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি উন্নয়নশীল বিশ্বেও প্রসার লাভ করছে। তারই উদাহরণ হিসেবে আমরা দেখি যে প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারের (বার্মা) সরকার সে দেশের ইরাবতী নদীর ওপর প্রস্তাবিত বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা পরিত্যাগ করেছে। চীনের সহযোগিতায় এ বাঁধটি নির্মাণের প্রক্রিয়া ইতিমধ্যে শুরু হয়েছিল এবং তা পরিত্যক্ত হওয়ার ফলে সংশ্লিষ্ট চীনা কোম্পানি আর্থিকভাবে যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সে কারণে এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে চীনের পক্ষ থেকে প্রতিবাদও করা হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও নদী, প্রকৃতি, পরিবেশ ও স্থানীয় জনগণের বৃহত্তর স্বার্থের কথা বিবেচনায় নিয়ে মিয়ানমার সরকার বাঁধ নির্মাণ বাতিলের সিদ্ধান্তে অটল থেকেছে।
একই ধারার আরেক উদাহরণ দেখা যায় সম্প্রতি লাওস সরকার কর্তৃক সে দেশে মেকং নদীর ওপর প্রস্তাবিত বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা পরিত্যাগ করার সিদ্ধান্তের মধ্যে। বাংলাদেশ ও ভারত কর্তৃক নদ-নদী ভাগাভাগি আলোচনায় এ উদাহরণটি আরও প্রাসঙ্গিক এ কারণে যে মেকং নদী ব্যবস্থাপনায় আঞ্চলিক সহযোগিতার একটি প্রশংসনীয় দৃষ্টান্তের সাক্ষাত্ পাওয়া যায়।
এসব উদাহরণ থেকে স্পষ্ট যে নদ-নদীর প্রতি প্রকৃতিসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি কেবল উন্নত বিশ্বে সীমাবদ্ধ নয়। তা ভারত ও বাংলাদেশের নিকট-প্রতিবেশী দেশগুলোতেও পরিদৃষ্ট হচ্ছে। এসব দৃষ্টান্ত থেকে প্রয়োজনীয় শিক্ষণীয় আহরণ নিতান্তই জরুরি।
৭. ফারাক্কা ও গজালডোবা বাঁধের অভিজ্ঞতা
নদ-নদীর প্রতি প্রকৃতিসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা ভারত কর্তৃক নির্মিত ফারাক্কা, গজালডোবা প্রভৃতি বাঁধের অভিজ্ঞতার আলোকেও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
প্রথমেই ফারাক্কা বাঁধের (ব্যারাজের) কথা ধরা যাক। এ ব্যারাজের মূল ঘোষিত লক্ষ্য ছিল কলকাতা বন্দরের নাব্যতা বৃদ্ধি, যাতে তা সামুদ্রিক বন্দর হিসেবে কাজ করতে পারে। ফারাক্কা বাঁধের প্রায় ৪০ বছর পূর্ণ হতে চলেছে। দীর্ঘ এই অভিজ্ঞতার আলোকে আজ স্পষ্ট যে ফারাক্কা তার কথিত মূল লক্ষ্য অর্জনে সফল হয়নি। ফারাক্কা ভাগীরথী-হুগলি চ্যানেলে পানিপ্রবাহ বৃদ্ধি করলেও কলকাতাকে সামুদ্রিক বন্দর হিসেবে কার্যক্ষম রাখতে পারেনি। সপ্তদশ শতাব্দীতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সমুদ্র থেকে প্রায় ১০০ মাইল অভ্যন্তরে কলকাতা বন্দরের পত্তন করেছিল। তখনকার পালতোলা সমুদ্রগামী জাহাজের আকৃতি এবং গভীরতা ছিল স্বল্প। ৩০০ বছর পরে বর্তমানকালের সমুদ্রগামী জাহাজের আকৃতি ও গভীরতা অনেকগুণ বেশি। পরিবর্তিত এ পরিস্থিতিতে কলকাতার পক্ষে সমুদ্রবন্দর হিসেবে কার্যক্ষম থাকা অসম্ভব ছিল এবং ফারাক্কা সে অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারেনি। অন্যদিকে ফারাক্কা এখন বিহার এবং পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে অপ্রত্যাশিত বন্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে বিহারের মানুষ এখন ফারাক্কা ভেঙে দেওয়ার জন্য হাতুড়ি, শাবল নিয়ে নিয়মিত মিছিল করছে।
এদিকে প্রকৃতিবিরোধী ফারাক্কা বাঁধের বিরুদ্ধে এখন খোদ গঙ্গা নদীই প্রতিশোধ নিতে শুরু করেছে। ফারাক্কায় বাধাগ্রস্ত হয়ে গঙ্গা নদীর মূল প্রবাহ এখন আরও উত্তরে সরে যাচ্ছে। এ প্রবণতা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে একসময় গোটা গঙ্গা নদীই ফারাক্কা ব্যারাজের বাইরে দিয়ে প্রবাহিত হবে; এবং তখন ফারাক্কা বাঁধ শুষ্ক নদীবক্ষে ভারতীয় অহমিকার একটি নিষ্ফলা দৃষ্টান্তে পরিণত হবে।৬
বাঁধের হতাশাকর ফলাফলের বিষয়টি গজালডোবা ব্যারাজের জন্যও প্রযোজ্য। কোনো বন্দরের নাব্যতা রক্ষা গজালডোবা বাঁধের লক্ষ্য নয়। এ বাঁধের পেছনে কেবল একটিই যুক্তি; তা হলো সেচের সম্প্রসারণ। কিন্তু আগেই উল্লিখিত হয়েছে যে এ জাতীয় সেচ প্রকল্প পানির অপচয় ডেকে আনে; জমিকে অনুপযোগী আবাদের দিকে ঠেলে দেয়; জমিতে লবণাক্ততার সৃষ্টি করে; এবং জমির গুণাগুণ বিনষ্ট করে। গজালডোবার ক্ষেত্রেও তা-ই লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
জল-সাশ্রয়ী ফসলের নির্বাচন, ড্রিপ-সেচের মতো অধিকতর দক্ষ সেচব্যবস্থার প্রচলন ইত্যাদি পদক্ষেপের মাধ্যমে গজালডোবার মতো নদীর পানির বৃহদাকার অপসারণভিত্তিক সেচব্যবস্থার প্রবর্তন ছাড়াই কৃষি উত্পাদন বৃদ্ধির বাঞ্ছিত লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব। গবেষণায় দেখা গেছে যে কৃষি উত্পাদন বৃদ্ধির এসব বিকল্প পদ্ধতি শুধু পরিবেশবান্ধবই নয়, অর্থনৈতিক লাভ-ক্ষতির বিচারেও অধিকতর দক্ষ।
উপরোক্ত আলোচনার আলোকে পরিষ্কার যে অভিন্ন নদ-নদীর ওপর ভারত কর্তৃক নির্মিত বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গিসঞ্জাত বাঁধগুলো দীর্ঘমেয়াদি ও সামগ্রিক বিচারে সুফল বয়ে আনতে পারেনি। একদিকে তা বাংলাদেশের প্রকৃতি ও অর্থনীতির সমূহ ক্ষতি ডেকে এনেছে, অন্যদিকে তা ভারতের নিজের জন্যও বিনিয়োজিত সম্পদের অপচয় সংঘটিত করেছে। এসব অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে যে ভারত কর্তৃক নদ-নদীর প্রতি বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিত্যাগ করে প্রকৃতিসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণের সময় এসেছে। আরও এক কারণে ভারতের দৃষ্টিভঙ্গির এ পরিবর্তন প্রয়োজন, তা হলো ট্রানজিট।
৮. ভারতের জন্য ট্রানজিটের প্রয়োজনীয়তা
যে ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে ভারত বাংলাদেশের নদ-নদী থেকে পানি প্রত্যাহার করে নিতে পারছে, সে একই কারণে ভারত স্বীয় উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে পৌঁছানোর প্রয়োজনে ট্রানজিটের জন্য বাংলাদেশের ওপর নির্ভরশীল। অন্যথায় এসব রাজ্যে পৌঁছানোর জন্য ভারতকে বাংলাদেশ ও নেপালের মধ্যবর্তী মাত্র ২২ মাইল প্রস্থের তথাকথিত হংস-গ্রীবার (goose neck) ওপর নির্ভর করতে হয় (চিত্র-১২)। এ সরু ও দীর্ঘ পথ দ্বারা উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে পৌঁছানো অনেক সময় ও ব্যয়সাপেক্ষ। যোগাযোগের এ সমস্যা ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর আর্থসামাজিক উন্নয়নের পথে একটি বড় বাধা। কিন্তু আর্থসামাজিক উন্নয়নের অভাব ভারতের এসব রাজ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনেরও অন্যতম কারণ। সুতরাং, ট্রানজিটের ইস্যুর সঙ্গে ভারতের ভৌগোলিক অখণ্ডতা ও নিরাপত্তার ইস্যুও জড়িত।
আগেই উল্লিখিত হয়েছে যে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যা ও রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বাংলাদেশের ওপর পাকিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যের ইসলামি সম্প্রসারণবাদী শক্তির প্রভাব বৃদ্ধি পায়। এ শক্তি ভারতীয় উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে বিচ্ছিন্নতাবাদী তত্পরতাকে উত্সাহিত করার জন্য বাংলাদেশকে ব্যবহারে সচেষ্ট হয়। ২০০৬ সালে চট্টগ্রামে চোরাচালান করা ১০ ট্রাক অস্ত্র আটক এবং পূর্বাপর অন্যান্য ঘটনার আলোকে স্পষ্ট যে এ প্রচেষ্টায় এ শক্তি যথেষ্ট সফলও হয়েছিল। সুতরাং, উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে উন্নয়ন ও বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন প্রশমনের জন্য বাংলাদেশের সহযোগিতা ভারতের বিশেষভাবে প্রয়োজন।
২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশের বর্তমান সরকার ভারতকে এ সহযোগিতা প্রদানে স্বতঃপ্রণোদিতভাবেই এগিয়ে আসে। ভারত বিভিন্ন সময়েই অভিযোগ করে আসছিল যে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনকে উত্সাহিত ও সাহায্য করার জন্য বাংলাদেশে, বিশেষত পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় অনেক ঘাঁটি নির্মিত হয়েছে। ওয়াকিবহাল মহলের ধারণামতে, বর্তমান সরকার ভারতের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের লক্ষ্যে এসব ঘাঁটি বিলুপ্ত করে।
শুধু তা-ই নয়। বর্তমান সরকার ট্রানজিটের ইস্যুতেও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে এবং এ ব্যাপারে একটি চুক্তিতে উপনীত হওয়ার জন্য আলাপ-আলোচনা শুরু করে। বস্তুত এরূপ চুক্তিতে উপনীত হওয়ার আগেই বাংলাদেশ সরকার ত্রিপুরা রাজ্যের তালপতাতে বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় ভারী যন্ত্রপাতি বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে পরিবহনের অনুমতি দেয়, যদিও এর জন্য প্রয়োজনীয় ধরনের সড়ক ও সেতু নির্মিত হয়নি। এ পরিবহন সুগম করার জন্য বাংলাদেশের তিতাস নদীর ওপর অবৈধভাবে ক্রসবাঁধও নির্মিত হয় (চিত্র-১৩ দ্রষ্টব্য)।
কিন্তু দুঃখজনক যে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এতখানি ইতিবাচক সাড়া দেওয়ার পরও ভারত নদ-নদীর প্রশ্নে নমনীয়তা প্রদর্শন করছে না। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরকালে তিস্তা নদীর পানি বণ্টন নিয়ে অর্ধেক-অর্ধেক ভাগাভাগির ভিত্তিতে যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার কথা ছিল, শেষাবধি তা হতে পারেনি। বলা হচ্ছে যে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অর্ধেক ভাগে সন্তুষ্ট নন। তিনি ৭৫ কিংবা ৮০ ভাগ পানি চান। তাঁর বিরোধিতার কারণে এ চুক্তি স্বাক্ষরিত হতে পারেনি। এদিকে খবরে প্রকাশ, সম্ভবত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আচরণে উত্সাহিত হয়ে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নিতীশ কুমার দাবি জানিয়েছেন, ১৯৯৬ সালে সম্পাদিত গঙ্গা চুক্তির পুনর্নিরীক্ষণ প্রয়োজন। অর্থাত্ তিনি মনে করছেন যে এ চুক্তির অধীনে বাংলাদেশকে যতটুকু পানি দেওয়ার কথা, সেটা আরও কমানো প্রয়োজন। অথচ, ১৯৯৬ সালের চুক্তিতে সর্বনিম্ন প্রবাহসংক্রান্ত কোনো গ্যারান্টি ধারা নেই এবং সে কারণে অধিকাংশ বছরেই এ চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশের যতটুকু পানি পাওয়ার কথা, তা দেওয়া হয়নি।
সুতরাং, পরিষ্কার যে নদ-নদীর প্রতি বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি বজায় রেখে নদ-নদী বিষয়ে ভারত-বাংলাদেশ সমঝোতা অর্জন দুরূহ। বরং দিন দিন এ সমস্যা আরও কঠিন হবে, কেননা বাংলাদেশের সীমান্তে পৌঁছানোর অনেক আগেই এসব নদ-নদী থেকে ক্রমাগতভাবে পানি প্রত্যাহূত হবে। ফলে সীমান্তে ভাগাভাগি করার মতো তেমন পানি আর অবশিষ্ট থাকবে না। গঙ্গা ও তিস্তা নদীর পানি বণ্টনের সমস্যার মধ্যে এ সত্যটিই প্রতিফলিত হচ্ছে।
নদ-নদী বিষয়ে ভারত কর্তৃক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন শুধু যে উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ট্রানজিট পাওয়ার জন্যই প্রয়োজন, তা-ই নয়। এটা আরও প্রয়োজন, কেননা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ভারত আরও এক ধরনের নিরাপত্তা সমস্যার সম্মুখীন হবে এবং তা মোকাবিলার জন্যও এ দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন প্রয়োজন। পরবর্তী অনুচ্ছেদে সে সমস্যা আলোচিত হবে।
৯. জলবায়ু পরিবর্তন এবং নদ-নদী ভাগাভাগির সমস্যা
সুবিদিত যে, জলবায়ু পরিবর্তন এখন বিশ্বের ও মানবজাতির জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুর্ভাগ্যের বিষয় যে যদিও এ পরিবর্তন ডেকে আনার পেছনে বাংলাদেশের বস্তুত কোনো ভূমিকাই নেই, কিন্তু এ পরিবর্তন দ্বারা বাংলাদেশই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যেসব বিভিন্ন ধারায় বাংলাদেশের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা, তার মধ্যে নিম্নের পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, নিমজ্জন। যেহেতু বাংলাদেশ মূলত একটি নিচু ব-দ্বীপ, সেহেতু জলবায়ু পরিবর্তন দ্বারা আহূত সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশের একটি বড় অংশ নিমজ্জিত হওয়ার আশঙ্কা (চিত্র-১৪ এবং ১৫)। দ্বিতীয়ত, লবণাক্ততার প্রসার। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশের যে অংশ নিমজ্জিত হবে না, সেখানেও লবণাক্ততা বিস্তৃত হবে। তার ফলে কৃষিসহ সমগ্র অর্থনীতির সবিশেষ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা। তৃতীয়ত, নদ-নদীপ্রবাহের আন্তঋতু চরমভাবাপন্নতার বৃদ্ধি। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে হিমালয়ের হিমবাহ গলে যাওয়ার কারণে হিমালয় উেসর নদ-নদীগুলোর শীতকালীন প্রবাহ আরও হ্রাস পাওয়ার আশঙ্কা (চিত্র-১৬)। অন্যদিকে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে গ্রীষ্মকালে ভারত মহাসাগর থেকে প্রবাহিত বায়ুপ্রবাহে আরও বেশি জলীয় বাষ্প থাকার কারণে বৃষ্টিপাত বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা। ফলে নদীপ্রবাহ একদিকে শুষ্ক মৌসুমে আরও হ্রাস, অন্যদিকে বর্ষা মৌসুমে আর বৃদ্ধি পাবে। চতুর্থত, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস প্রভৃতি চরম আবহাওয়ামূলক ঘটনাবলির সংখ্যা, ব্যাপ্তি ও প্রকটতা বৃদ্ধি পাবে। পঞ্চমত, বিভিন্ন রোগ ও মহামারি বৃদ্ধি পাবে।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে স্পষ্ট, জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করে দিতে পারে। বাংলাদেশের জনসংখ্যা এখনই ১৬ কোটির বেশি। ভবিষ্যতে তা বৃদ্ধি পেয়ে ২১ কোটিতে পৌঁছানোর কথা। এত বহুল জনসংখ্যার দেশের যদি এক-পঞ্চমাংশও নিমজ্জিত হয়, তাহলে প্রায় চার কোটি মানুষের বাস্তুহারা ও জীবিকাহারা হয়ে পড়ার আশঙ্কা। এ কোটি কোটি মানুষ আমেরিকা, ইউরোপ কিংবা অস্ট্রেলিয়া পৌঁছাতে পারবে না। তারা নিকটবর্তী প্রতিবেশী দেশেই আশ্রয় খুঁজবে। কোটি কোটি বেপরোয়া মানুষের জনস্রোতের মুখে কাঁটাতারের বেড়া ধসে পড়বে। ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের সম্ভাব্য অস্থিতিশীলতা ভারতকেও আক্রান্ত করবে। সুতরাং স্বীয় উন্মীলিত স্বার্থের কারণেই জলবায়ু পরিবর্তনের মুখে টিকে থাকার জন্য বাংলাদেশকে সহযোগিতা প্রদানে ভারতের এগিয়ে আসা প্রয়োজন।
লক্ষণীয়, ভারত কর্তৃক নদ-নদীর প্রতি বর্তমান বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিত্যাগ করে প্রকৃতিসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণই এরূপ সহযোগিতা প্রদানের সর্বোত্তম পন্থা। বাংলাদেশের ভূতাত্ত্বিক ইতিহাস থেকে দেখা যায় যে নদীবাহিত পলিমাটিভরণের মাধ্যমেই বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল এর আগে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি মোকাবিলা করেছে। যুগ যুগ ধরে এসব নদ-নদী প্রতিবছর প্রায় দুই কোটি টন পলি এ ব-দ্বীপে বহন করে এনেছে এবং প্লাবনভূমিতে ও বঙ্গোপসাগর উপকূলে জমা করেছে। এ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই প্রতিবছর বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের উচ্চতা প্রায় দুই মিলিমিটার করে বৃদ্ধি পেয়েছে। লক্ষণীয় যে বিভিন্ন বিশেষজ্ঞের মতে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠ বার্ষিক দুই মিলিমিটার করেই বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা। সুতরাং, পলিভরণের প্রক্রিয়া যদি আগের মতো অব্যাহত রাখা যায়, তবে বাংলাদেশ নিমজ্জনের বিপদ থেকে রক্ষা পেতে পারে; অন্তত নিমজ্জনের পরিধি সংকুচিত রাখতে পারে।
কিন্তু দুঃখজনক যে ভারত কর্তৃক বাংলাদেশের নদ-নদী থেকে পানি প্রত্যাহার এবং প্রবাহ বিঘ্নকারী অন্যান্য কাঠামো নির্মাণের ফলে বাংলাদেশে বাহিত পলিমাটির পরিমাণ ক্রমাগতভাবে হ্রাস পাচ্ছে। বিগত বছরগুলোতে পলিমাটির পরিমাণ দুই কোটি থেকে প্রায় এক কোটিতে হ্রাস পেয়েছে (চিত্র-১৭)। যদি ভারত নদীর প্রতি বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং এ দৃষ্টিভঙ্গিসঞ্জাত নদীর প্রবাহ বিঘ্নকারী কাঠামো নির্মাণ অব্যাহত রাখে, তাহলে ভবিষ্যতে এ পরিমাণ আরও হ্রাস পাবে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের নিমজ্জনের সমস্যা আরও বৃদ্ধি পাবে। সুতরাং, জলবায়ু পরিবর্তনসৃষ্ট বিপদের আলোকেও ভারত কর্তৃক নদ-নদীগুলোর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন প্রয়োজন।
১০. চীন কর্তৃক ব্রহ্মপুত্র নদের পানি প্রত্যাহারের বিপদ
লক্ষণীয়, ভারত যেমন উজানে অবস্থানের সুযোগ নিয়ে বাংলাদেশের নদ-নদী থেকে পানি প্রত্যাহার করছে, তেমনি চীনও উজানে অবস্থানের সুযোগ নিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি অপসারণ করতে পারে। বস্তুত বিভিন্ন সময় চীনের এমন পরিকল্পনার কথা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিতও হয়েছে। চীন দাবি করে, উত্তর চীনে পর্যাপ্ত পানি নেই এবং সে কারণে দক্ষিণের ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে পানি উত্তরমুখে অপসারণ করা প্রয়োজন। বলাবাহুল্য যে চীনের এ চিন্তার পেছনেও নদীর প্রতি বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি কাজ করছে। কীভাবে পানির প্রয়োজনীয়তা হ্রাস করা যায়, সেদিকে চিন্তা ধাবিত না করে বরং নদীর পানি কৃত্রিম উপায়ে ভিন্ন দিকে ধাবিত করে সে পানি শুষে নেওয়ার মাধ্যমে পানির অধিক চাহিদা মেটানোর চিন্তা করা হচ্ছে (চিত্র-১৮)।
প্রণিধানযোগ্য যে ভারত ব্রহ্মপুত্র নদ সম্পর্কে চীনের এ চিন্তার ঘোর বিরোধী। শুধু তা-ই নয়। ভারত চায় যে বাংলাদেশও চীনের এ পরিকল্পনার বিরোধিতায় ভারতের সঙ্গে যোগ দিক। ভারতের এই অবস্থান ও প্রত্যাশা যে কত স্ববিরোধী তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ভারতের বোঝা প্রয়োজন যে উজানে অবস্থানের সুযোগ নিয়ে বাংলাদেশের নদ-নদী থেকে পানি ক্রমাগতভাবে অপসারণ করে নেওয়ার মাধ্যমে সে চীন কর্তৃক ব্রহ্মপুত্র নদের পানি প্রত্যাহারমূলক পরিকল্পনার বিরোধিতা করার নৈতিক অধিকার হারিয়ে ফেলেছে। বস্তুত ভারতের নদী সংযোগ প্রকল্প যে যুক্তিতে রচিত, ব্রহ্মপুত্র নদবিষয়ক চীনের প্রস্তাবিত প্রকল্পের পেছনে সেই একই যুক্তি। এ থেকেই প্রমাণিত হয় যে নদ-নদীর প্রতি বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি কত ক্ষতিকর। একই কারণে নদ-নদীগুলো ভারতের অভ্যন্তরেও বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে সংঘাত সৃষ্টি করছে। দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে নদ-নদীর পানি ভাগাভাগির সমস্যা দীর্ঘকালের। অধুনাকালে উত্তর প্রদেশ, বিহার ও পশ্চিমবঙ্গের মধ্যেও নদ-নদীর পানি ভাগাভাগির সমস্যা তীব্র হচ্ছে।
সুতরাং, ভারত যদি ব্রহ্মপুত্র নদের পানি প্রত্যাহারমূলক চীনের পরিকল্পনার বিরোধিতা করতে চায় এবং আশা করে যে বাংলাদেশ তার সঙ্গে এ বিরোধিতায় যোগ দিক, তাহলে প্রথমে ভারতকে তার নদ-নদীর ব্যাপারে যে বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে সেটি পরিত্যাগ করতে হবে; বাংলাদেশে প্রবাহিত নদ-নদীর ওপর নির্মিত সব প্রবাহ বিঘ্নকারী কাঠামো অপসারণ করতে হবে এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের কাঠামো নির্মাণ না করায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে হবে। ভারতকে প্রস্তাবিত নদী সংযোগ প্রকল্প (অন্ততপক্ষে এ প্রকল্পের হিমালয়প্রসূত নদ-নদীসংক্রান্ত অংশ) বাতিল করতে হবে। তাহলেই কেবল নদ-নদীসমূহ প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে সংঘাত ও বৈরিতার উেসর পরিবর্তে মৈত্রীর রাখিবন্ধনে পরিণত হতে পারবে।
১১. নদীর বিনিময়ে ট্রানজিট
কিন্তু ভারত সহসাই নদ-নদীর প্রতি বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিত্যাগ করে প্রকৃতিসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করবে, এমন আশা করা দুরূহ। এটা ঠিক যে ভারতেও নাগরিক পর্যায়ে প্রকৃতিসম্মত দৃষ্টিভঙ্গির পক্ষে আন্দোলন গড়ে উঠছে। নর্মদা বাঁধের বিরুদ্ধে জোরালো আন্দোলনই তার একটি বড় প্রমাণ। বর্তমানে টিপাইমুখ বাঁধের বিরুদ্ধেও মণিপুর, নাগাল্যান্ড ও আসামে নাগরিক আন্দোলন পরিচালিত হচ্ছে।
কিন্তু নাগরিক পর্যায়ের এ আন্দোলনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধও প্রবল। এ প্রতিরোধের পেছনে রয়েছে স্বার্থ। এ স্বার্থ দুই ধরনের। একটি হলো প্রকৃত অর্থের বস্তুগত স্বার্থ। এ স্বার্থের অন্যতম প্রতিভূ হলো বাঁধ নির্মাণশিল্প। এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত আছে বহু কোম্পানি। মুনাফার প্রত্যাশায় এসব কোম্পানি ক্রমাগতভাবে বাঁধ নির্মাণের প্রকল্পকে উত্সাহিত করে। বাঁধ নির্মাণের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন পেশার লোকজনও স্বাভাবিক কারণেই বাঁধ নির্মাণকে সমর্থন করে। সরকারের ভেতরেও বাঁধের পক্ষে শক্তিশালী লবি কাজ করে। যত বেশি বাঁধ নির্মাণের প্রকল্প গৃহীত হয়, ততই নদী ও পানির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলোর বাজেট ও অর্থ সমাগম বাড়ে। সুতরাং কায়েমি বস্তুগত স্বার্থ নদ-নদীর প্রতি প্রকৃতিসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণের পথে বড় বাধা। রাজনীতিবিদেরাও নিজ নিজ এলাকায় বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধির প্রত্যাশায় বাঁধের সমর্থকে পরিণত হন।
দ্বিতীয় ধরনের স্বার্থ হলো ভ্রান্ত স্বার্থবোধ, যার দ্বারা বহু রাজনীতিবিদ, আমলা, পেশাজীবী ও সাধারণ মানুষ আক্রান্ত হন, যদিও তাঁরা হয়তো বাঁধ নির্মাণের বাজেট থেকে সরাসরিভাবে উপকৃত হবেন না। তাঁরা ভাবেন, বাঁধ হলে বিদ্যুত্ হবে, সেচ হবে, উন্নয়ন হবে। কিন্তু বাঁধ ছাড়াও যে বিদ্যুত্ হতে পারে, কৃষি উত্পাদন বৃদ্ধি পেতে পারে, উন্নয়ন হতে পারে সে ব্যাপারে তাঁদের সচেতন মনে হয় না। প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ ও সচেতনতা বিস্তারের মাধ্যমে এ ভ্রান্তবোধ হ্রাস করা যেতে পারে। কিন্তু তা সময় সাপেক্ষে এবং তার দ্বারা প্রথমোক্ত ধরনের কায়েমি স্বার্থ হ্রাস করা সম্ভব নয়। সুতরাং, দ্রুত ভারত কর্তৃক নদ-নদীর প্রতি প্রকৃতিসম্মত পন্থা গ্রহণ এবং তার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে বাংলাদেশের জন্য নদ-নদীগুলোর প্রবাহ উন্মুক্ত করে দেওয়ার সম্ভাবনা নেই।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাম্প্রতিক আচরণ থেকে এ সত্যটি আরও পরস্ফুিট হচ্ছে। তিস্তা নদীবিষয়ক প্রস্তাবিত বাংলাদেশ-ভারত চুক্তি সম্পাদনকে সুগম করার পরিবর্তে তিনি এখন আরও অভিযোগ তুলেছেন যে ফারাক্কা বাঁধের কতিপয় কপাট জীর্ণ হয়ে যাওয়ার কারণে বেশি পানি বাংলাদেশের পদ্মা নদীতে চলে যাচ্ছে। তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কাছে জোর দাবি তুলেছেন যাতে অবিলম্বে এসব জীর্ণ কপাট মেরামত করা হয় এবং বাংলাদেশে গঙ্গার পানিপ্রবাহ হ্রাস করা হয়। বলা বাহুল্য, যেখানে জীর্ণ ফারাক্কা বাঁধটি সম্পূর্ণ অপসারণের সময় এসেছে, সেখানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পূর্ণ উল্টো দাবি উত্থাপন করছেন। আরও আশ্চর্য যে বাংলাদেশে প্রবাহিত নদীর পানি হ্রাস করাই যেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নতুন সরকারের মুখ্য করণীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের আর্থসামাজিক উন্নয়নে এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ করণীয় যেন তিনি খুঁজে পাচ্ছেন না!
সুতরাং, অবস্থাদৃষ্টে পরিষ্কার যে কায়েমি ও ভ্রান্ত, এই উভয়বিধ স্বার্থের মুখে শুধু অনুরোধ-উপরোধ এবং শুভেচ্ছার ভিত্তিতে বাংলাদেশের নদ-নদী উন্মুক্ত হবে না। বরং দিন দিন এসবের প্রবাহ আরও বেশি করে অপসারিত হতে থাকবে। এ অবস্থায় নদ-নদীগুলো ফিরে পাওয়ায় বাংলাদেশের জন্য আর কি উপায় খোলা আছে?
উপায় একটিই এবং তা হলো, স্বার্থের সঙ্গে স্বার্থের বিনিময়। এ উপলব্ধি থেকেই নদীর বিনিময়ে ট্রানজিট ফর্মুলার প্রস্তাব উত্থাপিত হয়েছে।৭ যে ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে ভারত বাংলাদেশের নদ-নদীগুলো থেকে পানি প্রত্যাহার করতে পারছে, সেই ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেই ভারত বাংলাদেশের ওপর ট্রানজিটের জন্য নির্ভরশীল। ওপরের আলোচনায় পরিলক্ষিত হয়েছে যে ট্রানজিটের মধ্যে ভারতের গভীর স্বার্থ নিহিত। ট্রানজিট ছাড়া ভারতের ওপর প্রভাব বিস্তারের অন্য কোনো আইনি উপায় বাংলাদেশের জন্য খুঁজে পাওয়া কঠিন। সুতরাং, নদ-নদীর পূর্ণ প্রবাহ ফিরে পাওয়ার জন্য বাংলাদেশের ট্রানজিট ইস্যুকে ব্যবহারের কোনো বিকল্প ভারত খোলা রাখেনি।
পরিতাপের বিষয় যে নদ-নদীর ইস্যুতে বাঙালি অধ্যুষিত পশ্চিমবঙ্গের সরকারই এখন সবচেয়ে বৈরী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। কিন্তু ট্রানজিট ইস্যুতে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সরকারের স্বার্থ ও কেন্দ্রীয় সরকার ও অন্যান্য রাজ্যের স্বার্থ এক নয়। বিশেষত, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্যের সরকার ও জনগণ ট্রানজিট ও বাংলাদেশের সমুদ্রবন্দর ব্যবহারের সুযোগের জন্য বিশেষভাবে উদগ্রীব। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় না এলেও এসব রাজ্যের বেশ কয়েকজন মুখ্যমন্ত্রী ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরকালে তাঁর সঙ্গী হয়েছিলেন। নদীর বিনিময়ে ট্রানজিট ফর্মুলা তাঁদের জন্য বিশেষভাবে স্বার্থানুকূল। সুতরাং বাংলাদেশের অবস্থানের পক্ষে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অবস্থানই এ ক্ষেত্রে একমাত্র নির্ণায়ক নয়। সঠিক প্রচার ও যুক্তিপূর্ণ উপস্থাপনার মাধ্যমে ভারতের বহু মহলেরই নদীর বিনিময়ে ট্রানজিট ফর্মুলার পক্ষে সমর্থন অর্জন সম্ভব। আশা করা যায় যে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারও এ ফর্মুলার যৌক্তিকতা ও আকর্ষণীয়তা উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেও বুঝতে হবে যে বাংলাদেশে নদ-নদীর প্রবাহ হ্রাস করার প্রয়াসের মাধ্যমে তিনি পশ্চিমবঙ্গে স্বল্পকালের জন্য সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারেন। কিন্তু তাতে পশ্চিমবঙ্গের বিশেষ কোনো প্রগতি সাধিত হবে না; এবং তাঁর নিজের দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক ভবিষ্যতের জন্যও তা বিশেষ সহায়ক হবে না।
কিন্তু ভারতের সরকার ও জনগণকে নদীর বিনিময়ে ট্রানজিট ফর্মুলার যৌক্তিকতা ও উপযোগিতা বোঝানোর আগে বাংলাদেশের সরকার ও রাজনৈতিক নেতাদেরই আগে তা বুঝতে হবে।
অনেকে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে এবং ট্রানজিটের বিনিময়ে প্রাপ্য হিসেবে বাণিজ্যসংশ্লিষ্ট সুযোগ-সুবিধার ওপর জোর দেন। এর পেছনে যুক্তি আছে। ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যে বাংলাদেশের বিপুল ঘাটতির কথা ইতিমধ্যেই উল্লিখিত হয়েছে। ভারতে বাংলাদেশের পণ্য প্রবেশের সুযোগ বৃদ্ধির মাধ্যমে এ ঘাটতি হ্রাসের প্রয়াসটি নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু লক্ষ্য করা প্রয়োজন যে বাণিজ্য প্রসারের জন্য ঋণ বা এজাতীয় সুবিধা পেতে বাংলাদেশকে ভারতের ওপরই নির্ভর করতে হবে, এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। ভারত ভিন্ন অন্য দেশের সঙ্গেও বাংলাদেশ বাণিজ্য সম্প্রসারণে প্রয়াসী হতে পারে। এটা ঠিক যে প্রতিবেশী হওয়ার কারণে ভারতে এবং ভারত থেকে পণ্য পরিবহন খরচ তুলনামূলকভাবে কম হতে পারে। কিন্তু পরিবহন ব্যয়ই বাণিজ্যের একমাত্র অথবা মূল নির্ধারক নয়। সে কারণেই দেখা যায় যে ভারতের তুলনায় দূরবর্তী হওয়া সত্ত্বেও চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। একইভাবে মিয়ানমার ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাংলাদেশ বাণিজ্য বৃদ্ধি করায় প্রয়াসী হতে পারে।
একই কথা প্রযোজ্য অবকাঠামো নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় ঋণ ও কারিগরি সহায়তার বিষয়ে। বস্তুত এ ক্ষেত্রে ভৌগোলিক নৈকট্য আরও কম গুরুত্ব বহন করে। বাংলাদেশে অবকাঠামো নির্মাণে চীন অথবা কোরিয়ার ভূমিকা ইতিমধ্যেই ভারতের ভূমিকার তুলনায় অনেক বেশি। সে জন্য এ বিষয়েও ভারতের ওপর বাংলাদেশের কোনো বিশেষ নির্ভরশীলতা নেই।
কিন্তু নদ-নদীর প্রবাহের জন্য বাংলাদেশ ভারতের ওপরই মূলত নির্ভরশীল। এ বিষয়ে ভারতের শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া বাংলাদেশের কোনো বিকল্প নেই। সে জন্য ট্রানজিটের বিনিময়ে বাংলাদেশ ভারতের কাছে যা দাবি করতে পারে, তার মধ্যে নদীপ্রবাহই সবচেয়ে মূল্যবান ও স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্বের। এ বিষয়টি বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের বুঝতে হবে।
পরিতাপের বিষয় যে এ বিষয়ে পরিস্থিতি মোটেও সন্তোষজনক নয়। ট্রানজিট ইস্যুর স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্ব বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকেরা সঠিকভাবে হূদয়ঙ্গম করতে পারছেন বলে নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। সংশ্লিষ্ট আমলা ও উপদেষ্টাদের কেউ কেউ ট্রানজিটের বিনিময়ে ভারতের কাছ থেকে বাংলাদেশের কিছু পাওয়ার আছে, সেটাই যেন ভাবতে উত্সাহী নন। তাঁদের অনেকে ট্রানজিট ইস্যুর সঙ্গে নদীপ্রবাহের ইস্যুর কোনো সংযোগ দেখেন না। অন্যরা যখন এ সংযোগের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন, তখন তার প্রতি মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন মনে করেন না। এ ধরনের মনোভঙ্গি নিয়ে ভারতের কাছ থেকে বাংলাদেশের নদ-নদীর অধিকার আদায় যে দুরূহ, তা বলাই বাহুল্য।
ট্রানজিটের ইস্যুতে সরকারি আমলা ও উপদেষ্টাদের মূল মনোযোগ এখনো যেন মূলত মাশুল, শুল্ক, অবকাঠামো, ইত্যাকার ইস্যুর ওপর নিবদ্ধ। এসব ইস্যু নিয়ে নিশ্চয়ই আলোচনা করতে ও গ্রহণযোগ্য সমাধানে পৌঁছাতে হবে। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানেই এক দেশের ওপর দিয়ে আরেক দেশে যাত্রী ও মালামাল পরিবাহিত হচ্ছে। ইউরোপের জন্য এটা খুব সাধারণ ঘটনা। লাতিন আমেরিকার জন্যও তা প্রযোজ্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভেতর দিয়ে মেক্সিকো ও কানাডার মধ্যে বাণিজ্য সংঘটিত হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকায় এর উদাহরণ আছে। এসব বিভিন্ন স্থানের অভিজ্ঞতার আলোকে ট্রানজিট সংশ্লিষ্ট মাশুল, শুল্ক, অবকাঠামো ইত্যাদি বিভিন্ন ইস্যু সম্পর্কে সমাধানে পৌঁছানো খুব কঠিন হওয়ার কথা নয়। লক্ষ্য করা দরকার, যে হারেই নির্ধারিত হোক না কেন, ট্রানজিট থেকে মাশুল, শুল্ক ও অবকাঠামো ক্ষয়ক্ষতি বাবদ আদায় করা অর্থের পরিমাণ খুব বেশি হবে না। বিশেষত, প্রতিবছর প্রবাসী বাংলাদেশিদের পাঠানো রেমিট্যান্স অর্থের তুলনায় এর পরিমাণ নগণ্যই হবে। সুতরাং, এই অর্থের পরিমাণের মধ্যে ট্রানজিট ইস্যুতে বাংলাদেশের মূল স্বার্থ দেখা ঠিক হবে না। ট্রানজিট ইস্যুতে বাংলাদেশের মূল স্বার্থ নদীপ্রবাহ ফিরে পাওয়ার মধ্যে নিহিত।
কিন্তু আমলা ও উপদেষ্টারা না বুঝতে পারলেও দেশের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক নেতৃত্ব বোধকরি অনেকটা স্বজ্ঞাগতভাবেই ট্রানজিট ও নদীর মধ্যকার সম্পর্কটি কিছুটা হলেও উপলব্ধি করতে পেরেছেন। সে কারণেই দেখা যায় যে মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরকালে যখন শেষ মুহূর্তে স্পষ্ট হয় যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরোধিতার কারণে তিস্তা নদীবিষয়ক চুক্তি স্বাক্ষরিত হচ্ছে না, তখন বাংলাদেশ সরকার ট্রানজিটবিষয়ক চুক্তি সম্পাদনে বিরত থাকে।
এটা শুভ লক্ষণ। কিন্তু এ বিষয়ে অবস্থান আরও স্বচ্ছ করা প্রয়োজন। বাংলাদেশের জনগণের কাছে ও ভারতের সরকার ও জনগণের কাছে বিষয়টি স্পষ্ট করে তুলে ধরা প্রয়োজন। নদীর পূর্ণপ্রবাহের দাবিটি বাংলাদেশকে সাহসের সঙ্গে তুলে ধরতে হবে। যদি জোরের সঙ্গে দাবি তোলাই না হয়, তাহলে সে দাবির পূরণ আশা করা বৃথা। ভারতকে পরিষ্কারভাবে বলা প্রয়োজন যে নদীপ্রবাহ উন্মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত ট্রানজিট ইস্যুতে অগ্রগতি সম্ভব নয়। শুভেচ্ছার নিদর্শন হিসেবে ট্রানজিট ইস্যুতে বাংলাদেশ ইতিমধ্যে যেসব ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল, সেগুলো স্থগিত এবং প্রত্যাহার করে নেওয়া প্রয়োজন। কেবল এ ধরনের পদক্ষেপই ভারত সরকারকে নদীবিষয়ক বাংলাদেশের দাবিকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় প্রবুদ্ধ করবে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মান ভাঙানো বাংলাদেশের দায়িত্ব নয়। ট্রানজিটের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের বিশেষ স্বার্থ নেই। কিন্তু ট্রানজিট ও বাংলাদেশের বন্দর ব্যবহারের মধ্যে সামগ্রিকভাবে ভারত, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এবং বিশেষত ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাতটি রাজ্যের স্বার্থ প্রকট। এ স্বার্থের জন্যই শেষ পর্যন্ত ভারত নদ-নদীগুলোকে উন্মুক্ত করায় সম্মত হতে পারে। বাংলাদেশ ও ভারতের পক্ষে পরস্পরের স্বার্থ রক্ষায় নদীর বিনিময়ে ট্রানজিট ফর্মুলার কোনো বিকল্প নেই।
১২. নদ-নদীসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক আইন এবং নদীর বিনিময়ে ট্রানজিট ফর্মুলা
লক্ষণীয় যে নদ-নদীবিষয়ক আন্তর্জাতিক আইন, প্রথা ও অভিমত নদীপ্রবাহসংক্রান্ত নদীর বিনিময়ে ট্রানজিট ফর্মুলাকে সমর্থন করে।
১৯৬৬ সালে আন্তর্জাতিক আইন সমিতির ৫২তম সম্মেলনে আন্তর্জাতিক নদীবিষয়ক আইন প্রণয়নের প্রথম প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হয়। এর ফলশ্রুতিতে ‘আন্তর্জাতিক নদী ব্যবহার-সম্পর্কিত হেলসেঙ্কি নিয়মাবলি’ (Helsinki Rules on the Uses of Waters of International Rivers) (International Law Association 1967) গৃহীত হয়। পরে ১৯৯৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে আরও বিস্তারিত ‘আন্তর্জাতিক নদীর পরিবহন ভিন্ন অন্যান্য ব্যবহারসংক্রান্ত কনভেনশন’ (Convention on the Law of the Non-Navigational Uses of International Watercourses) (United Nations 2005) গৃহীত হয়। যদিও পর্যাপ্তসংখ্যক দেশ কর্তৃক স্বাক্ষরিত না হওয়ার কারণে এ কনভেনশন এখনো আরোপযোগ্য আইনি মর্যাদা লাভ করেনি, তা সত্ত্বেও তা সাধারণভাবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোভাব প্রতিফলিত করে। (১৯৯৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ১০৬ দেশের মধ্যে মাত্র তিনটি দেশ এ কনভেনশনের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছিল।) এ কনভেনশনের ‘নদীর অংশীদার দেশসমূহের প্রণিধানযোগ্য ক্ষতিসাধন থেকে বিরত থাকার বাধ্যবাধকতা’ শীর্ষক সপ্তম অনুচ্ছেদে বলা হয়:
১. অভিন্ন নদীর তীরবর্তী দেশসমূহ নিজ নিজ দেশের অভ্যন্তরে নদীর ব্যবহার সাধনের ক্ষেত্রে অন্যান্য অংশীদার দেশের প্রণিধানযোগ্য ক্ষতিসাধনমূলক তত্পরতা থেকে বিরত থাকায় সর্বাত্মক প্রচেষ্টা গ্রহণ করবে।
২. যদি এরূপ কোনো তত্পরতা দ্বারা অংশীদার কোনো দেশের প্রণিধানযোগ্য ক্ষতিসাধিত হয়, সে ক্ষেত্রে ক্ষতিসাধনকারী দেশ (যদি এ ধরনের ক্ষতিসাধনমূলক ব্যবহারসংক্রান্ত কোনো চুক্তি না থাকে) এ কনভেনশনের পঞ্চম ও ষষ্ঠ অনুচ্ছেদের আলোকে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের সঙ্গে পরামর্শক্রমে ওই ক্ষতি নিবারণ ও প্রশমনের জন্য সব প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে এবং প্রয়োজনবোধে ক্ষতিপূরণের বিষয় আলোচনা করবে।
এ কনভেনশনের ২০তম অনুচ্ছেদে পরিষ্কার বলা হয়:
আন্তর্জাতিক নদীর অংশীদার দেশগুলো এককভাবে এবং যে ক্ষেত্রে প্রয়োজন সে ক্ষেত্রে, যৌথভাবে নদীর ও নদী তীরবর্তী অঞ্চলের পরিবেশ-প্রতিবেশের সুরক্ষা করবে।
এ কনভেনশনের ২৩তম অনুচ্ছেদে বলা হয়:
আন্তর্জাতিক নদীর অংশীদার দেশগুলো এককভাবে এবং যে ক্ষেত্রে প্রয়োজন সে ক্ষেত্রে যৌথভাবে আন্তর্জাতিক নিয়ম ও মান অনুসরণ করে নদীর মোহনা অঞ্চল ও সামুদ্রিক পরিবেশের সুরক্ষা করবে।
বলাবাহুল্য, ভারত কর্তৃক বাংলাদেশে প্রবেশকারী নদ-নদীগুলোর প্রবাহ বিঘ্ন ও অপসারণকারী প্রতিটি পদক্ষেপ ও কাঠামো ১৯৯৭ সালের জাতিসংঘের কনভেনশনবিরোধী। এসব ব্যারাজ ও বাঁধ বাংলাদেশের প্রতিবেশ ও অর্থনীতির যে অপূরণীয় ক্ষতিসাধন করেছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এসব কাঠামো শুধু নদ-নদীর ইকোলজি ধ্বংস করেনি, আক্ষরিক অর্থে তাদের মৃত্যু ডেকে এনেছে। এসব কাঠামো নদ-নদীর মোহনা অঞ্চলের এবং সামুদ্রিক পরিবেশের ক্ষতিসাধন করেছে। এ ক্ষতির মধ্যে বাংলাদেশের উপকূলের সুন্দরবনের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ্য। ফারাক্কা ব্যারাজ দ্বারা বাংলাদেশের পদ্মা নদী থেকে পানি অপসারণের ফলে ইউনেসকো চিহ্নিত বিশ্বের প্রাকৃতিক উত্তরাধিকারের মধ্যে অন্যতম এ সুন্দরবন হুমকির সম্মুখীন।
আশ্চর্যের বিষয় নয় যে ভারত জাতিসংঘের ১৯৯৭ সালের এ কনভেনশন স্বাক্ষর করেনি। এ কনভেনশন অনুযায়ী, নদীর ব্যবহার সম্পর্কে অংশীদার দেশগুলোর মধ্যে বিবাদ নিরসনের জন্য আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের শরণাপন্ন হওয়ার বিধান আছে। কিন্তু পর্যাপ্তসংখ্যক দেশের এবং ভারতের নিজ কর্তৃক স্বাক্ষরের অনুপস্থিতিতে বাংলাদেশের জন্য এ পথ খোলা নেই। এটাও আশ্চর্যের বিষয় নয় যে ভারত চায় না তার প্রতিবেশী অন্যান্য দেশও জাতিসংঘের ১৯৯৭ সালের কনভেনশন স্বাক্ষর করুক। প্রথমত, বেশি দেশ স্বাক্ষর করলে এ কনভেনশন আইনি মর্যাদা পাবে। দ্বিতীয়ত, ভারতের নিজের ওপর এ কনভেনশন স্বাক্ষরের চাপ বৃদ্ধি পাবে। তৃতীয়ত, স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে প্রতিবেশী দেশগুলো ভারতের সঙ্গে নদীবিষয়ক বিবাদের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আদালতের শরণাপন্ন হওয়ায় উদ্বুদ্ধ হবে।
লক্ষণীয়, সম্ভবত ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতে নদ-নদীবিষয়ক ইস্যু নিরসনের আশায় এবং ভারতের ইচ্ছা উপেক্ষা করে বিরাগভাজন না হওয়ার চিন্তা থেকে বাংলাদেশও এ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক নদী ব্যবহারসংক্রান্ত জাতিসংঘের ১৯৯৭ সালের কনভেনশন স্বাক্ষর করা থেকে বিরত থেকেছে। বলাবাহুল্য যে অবিলম্বে এ নীতি ও অবস্থানের পরিবর্তন প্রয়োজন। বাংলাদেশের নিজে এ কনভেনশন স্বাক্ষর করা এবং ভারত এবং উপমহাদেশের অন্যান্য দেশকেও এ কনভেনশন স্বাক্ষর করার অনুরোধ জানানো প্রয়োজন।
লক্ষণীয়, আন্তর্জাতিক নদীবিষয়ক জাতিসংঘের ১৯৯৭ সালের কনভেনশন নদ-নদীর প্রতি প্রকৃতিসম্মত দৃষ্টিভঙ্গিকেই উত্সাহিত করে। আগের আলোচনা থেকে পরিষ্কার যে এ দৃষ্টিভঙ্গিই এক দেশকে নদীর অংশীদার অন্য দেশের ক্ষতিসাধন থেকে নিবৃত্ত রাখতে পারে; নদীর ইকোলজি রক্ষা করতে পারে; নদীর মোহনা এবং উপকূলীয় অঞ্চলের পরিবেশ রক্ষা করতে পারে।
নদীর বিনিময়ে ট্রানজিট ফর্মুলা ভারতকে নদীর প্রতি প্রকৃতিসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণে প্রবুদ্ধ করার একটি প্রচেষ্টা। যেহেতু ভারত নিজ থেকে প্রকৃতিসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণে এখনো প্রস্তুত নয়, সেহেতু একটি বড় স্বার্থবোধের তাগিদ দ্বারা এ দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণে তাকে সম্মত করাই নদীর বিনিময়ে ট্রানজিট ফর্মুলার অভীষ্ট লক্ষ্য। যত শিগগির ভারত এ স্বার্থবোধে সাড়া দিয়ে নদীর বিনিময়ে ট্রানজিট ফর্মুলা গ্রহণে এগিয়ে আসে, ততই ভারত ও বাংলাদেশ উভয়ের জন্যই মঙ্গল।
১৩. উপসংহার
বাংলাদেশ ও ভারত—এ দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে সুসম্পর্কই কাম্য। কিন্তু বর্তমানে নদ-নদীর পানি ভাগাভাগির ইস্যু এ দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কোন্নয়নের পথে একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। নদীর বিনিময়ে ট্রানজিট ফর্মুলা এ বাধা অপসারণ করে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কোন্নয়নের পথ প্রশস্ত করতে পারে। এ ফর্মুলা অনুযায়ী, ভারত বাংলাদেশে প্রবেশকারী নদ-নদীর ওপর নির্মিত সব পানি অপসারণকারী বাঁধ ও কাঠামো অপসারণ করবে যাতে তাদের স্বাভাবিক পূর্ণ প্রবাহ বাংলাদেশে পৌঁছাতে পারে। ভারত প্রস্তাবিত নদী সংযোগ প্রকল্প (অন্তত তার হিমালয়প্রসূত নদ-নদী সম্পর্কিত অংশ) বাতিল করবে। বিনিময়ে বাংলাদেশ ভারতকে তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাতটি রাজ্যে পৌঁছানোর জন্য প্রয়োজনীয় ট্রানজিট সুযোগ প্রদান করবে। ট্রানজিটের বিষয়ে শুল্ক, মাশুল, অবকাঠামো নির্মাণ এবং ক্ষতিপূরণ, ইত্যাদি অন্যান্য আরও অনেক ইস্যু নিশ্চয়ই আছে এবং আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সেসব ইস্যুর মীমাংসা হতে হবে। কিন্তু মূল ইস্যুটি রাজনৈতিক এবং স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্বের। বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ভারতকে ট্রানজিট দেওয়া হবে কি হবে না, সেটি বাংলাদেশের জন্য একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, নিছক শুল্ক ও মাশুলের নয়। তেমনি ট্রানজিট ভারতের জন্য একটি স্ট্র্যাটেজিক প্রয়োজন; কেননা তা উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করবে এবং এসব রাজ্যের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনকে প্রশমিত করতে সহায়ক হবে। কাজেই ট্রানজিটের সঙ্গে ভারতের ভৌগোলিক অখণ্ডতা ও নিরাপত্তার ইস্যু জড়িত।
বিগত দশকগুলোতে ভারত তার উজান অবস্থানের সুযোগ নিয়ে ক্রমাগতভাবে বাংলাদেশের নদ-নদী থেকে পানি প্রত্যাহার করে নিয়েছে। বাংলাদেশের মানুষের মনে ভারতের এই আচরণ গভীর ক্ষোভের সঞ্চার করেছে। ভারত বললেই বাংলাদেশের মানুষের এখন ফারাক্কা, গজালডোবা প্রভৃতি বাঁধের কথা মনে আসে। এসব বাঁধ বহাল রেখে বাংলাদেশের মানুষের মন জয় করা ভারতের পক্ষে সম্ভব নয়। আর সে কারণেই ভারতকে ট্রানজিট দেওয়া বাংলাদেশে ভারতের প্রতি বন্ধুমনোভাবাপন্ন সরকারের পক্ষেও কঠিন হচ্ছে। এসব বাঁধ অপসারণ করলে নদীর প্রবাহ যেমন বাধামুক্ত হবে, তেমনি বাংলাদেশের মানুষের মন গলে ভারতের প্রতি প্রীতি অনুভবের জোয়ার সঞ্চারিত হবে; এবং ভারতকে ট্রানজিট প্রদানের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক বাধা অপসারিত হবে।
বিভিন্ন নদীর ওপর নির্মিত বাঁধ অপসারণ করা ভারতের জন্যও কোনো সহজ কাজ নয়। এসব বাঁধকে কেন্দ্র করে প্রবল কায়েমি স্বার্থের উদ্ভব ঘটেছে। কিন্তু ভৌগোলিক অখণ্ডতা এবং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ভারতের জন্য সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। ট্রানজিট ভারতকে এ ইস্যু মোকাবিলায় প্রভূত সহায়তা করবে।
সুতরাং, নদীর বিনিময়ে ট্রানজিট ফর্মুলার পেছনে বাস্তব ভিত্তি রয়েছে। আশা করা যায়, দুই দেশের জনগণ এবং নেতারা এ বাস্তবতা স্বীকার করে সাহসী সিদ্ধান্ত নেবেন এবং দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হবে।
তথ্যসূত্র ও টীকা
১. এ বিষয়ে আলোচনার জন্য দ্রষ্টব্য: Lifshultz (1979)
২. এ বিষয়ে আলোচনার জন্য দ্রষ্টব্য: Rahman (2002)
৩. ভারতের তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি আবুল কালাম এ প্রকল্পের বিষয়ে উত্সাহী ছিলেন।
৪. এ রায় সম্পর্কে তথ্যের জন্য দ্রষ্টব্য: The Daily Star, February 27, 2012
৫. নদ-নদীর প্রতি ‘বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি’ এবং এর বিপরীত ‘প্রকৃতিসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি’ সম্পর্কে আলোচনার জন্য দ্রষ্টব্য Islam (1990, 1999, 2001, 2006a, 2006b)। এ প্রসঙ্গে আরও দ্রষ্টব্য Hughes et al. (1994) এবং Khalequzzaman (1994)
৬. বাংলাদেশের ওপর ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রভাব সম্পর্কে আলোচনার জন্য দ্রষ্টব্য: Islam (1997) এবং Khatun (2004)
৭. এ প্রস্তাবের জন্য দ্রষ্টব্য: ইসলাম (২০১১ক, ২০১১খ), Islam (2011)
নির্দেশিত রচনাবলি
DeLong, Bradford (1998), “Estimating World GDP, One Million B.C. - Present”, Berkeley, California : University of California, Berkeley. Available from http://www.j-bradford-delong.net/TCEH/1998_Draft/World_GDP/ Estimating_World_GDP.html.
Hughes, R., Adnan, S. and Dala-Clayton, B. (1994), “Floodplains or Floodplans? A Review of Approaches to Water Management in Bangladesh”, Institute of Environment and Development, London, and Research and Advisory Services, Dhaka, Bangladesh
International Law Association (1967), The Helsinki Rules on the Uses of the Waters of International Rivers, London.
Islam, Nazrul (1990), “Let the Delta Be a Delta! An Essay in Dissent on the Flood Problem of Bangladesh,” The Journal of Social Studies, No. 48, April, pp. 18-41
Islam, Nazrul (1997), “Notes on Farakka : The Problem of Water Sharing between India and Bangladesh,” The Journal of Social Studies, No. 76, April, pp. 1-9. Also in French as “Le barrage du Farakka ou le partage de l’eau entre l’Inde et le Bangladesh,” in Alternatives Sud, Vol. VIII (2001), No. 4, pp. 257-64
Islam, Nazrul (1999), “Flood Control in Bangladesh : Which Way Now?” Journal of Social Studies, No. 83, January, pp. 1-31
Islam, Nazrul (2001), “Open Approach to Flood Control : The Way to the Future,” Futures : the journal of forecasting, planning, and policy, Vol. 33, No. 8 (October), pp. 783-802
Islam, Nazrul (2006a), “The Commercial Approach vs. the Ecological Approach to Rivers : An Essay in Response to the Indian River Linking Project (IRLP),” Futures : the journal of forecasting, planning, and policy, Vol. 38, No. 5 (June), pp. 586-605
Islam, Nazrul (2006b), “IRLP, or the Ecological Approach to Rivers?” Economic and Political Weekly, Vol. 41, No. 17 (April-May), pp. 17-26
Islam, Nazrul (2009), “Climate Change and the Tasks for Bangladesh,” in Bhattacharya et al. (ed.), Climate Change and the Tasks for Bangladesh, pp. 13-35, Dhaka : BAPA and BEN.
Bmjvg, bRi‚j (2011K), ‘b`xi wewbgGq UÇvbwRU’, cÉ^g AvGjv, 27 RyjvB 2011
Bmjvg, bRi‚j (2011L), ‘ggZvnxbv ggZv?’ cÉ^g AvGjv, 19 ˆmG¶ŸÁ¼i 2011
Islam, Nazrul (2011), “Transit in Exchange for Rivers?” The Daily Star, August 8, 2011.
Khalequzzaman, Mohamed (1994), “Recent Floods in Bangladesh : Possible Causes and Solutions,” Natural Hazards, Vol. 9, pp. 65-80
Khatun, Tajkera (2004), “The Ganges Water Withdrawal in the Upstream at Farakka and Its Impact in the Downstream Bangladesh,” in M. Feroze Ahmed, Qazi K. Ahmad, and M. Khalequzzaman (eds.), Regional Cooperation on Transboundary Rivers : Impact of the Indian River Linking Project, Dhaka : BAPA, BEN, BEA, IEB, BUET, DU, and BWP, BGS, BUP, BNGA, and ASB
Lifshultz, Lawrence (1979), Bangladesh : Unfinished Revolution, London : Zed Press
Maddison, Angus (2007), Contours of the World Economy, 1-2030 AD : Essays in Macro-Economic History, New York : Oxford University Press
Nakicenovic, Neboja (2009), “Supportive Measures and Policies for Developing Countries : A Paradigm Shift”, Background Paper prepared for World Economic and Social Survey 2009 : New York, United Nations
Rahman, Mustafizur (2002), “Bangladesh-India Bilateral Trade : An Investigation into Trade in Services,” in T. N, Srinivason (editor), Trade, Finance, and Investment in South Asia, New Delhi : Social Science Press, pp. 183-238
United Nations (2005), Convention on the Law of the Non-navigational Uses of International Watercourses, New York
United Nations (2011), The Great Green Technological Transformation, World Economic and Social Survey, 2011, New York : UN DESA (http://untreaty.un.org/ilc/texts/instruments/english/conventions/8_3_1997.pdf)
World Commission on Dams (2000), Dams and Development : A New Framework : The Report of the World Commission on Dams, London and Sterling, VA : Earthscan (http://www.internationalrivers.org/files/world_ commission_on_dams_final_report.pdf)