[আবু সাঈদ চৌধুরীর জন্ম ১৯২১ সালের ৩১ জানুয়ারি। তাঁর শৈশব কেটেছে টাঙ্গাইলে। জীবনের নানা পর্যায়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৭১ সালের ১৫ মার্চ ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদ থেকে ইস্তফা দেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রবাসী সরকারের পক্ষে জনমত গড়ে তোলার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি তিনি বাংলাদেশের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন। ১৯৮৭ সালের ২ আগস্ট লন্ডনে তাঁর মৃত্যু হয়।
মৃত্যুর কিছুকাল আগে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের কথ্য ইতিহাস প্রকল্পের আওতায় (৮, ৯ ও ১০ জুন ১৯৮৭—এই তিন দিন) তাঁর একটি দীর্ঘ সাক্ষাত্কার নেওয়া হয়েছিল। সেই সাক্ষাত্কারের নির্বাচিত অংশ পরিমার্জিত আকারে এখানে ছাপা হচ্ছে।]
সাক্ষাত্কার নিয়েছেন:
অধ্যাপক সালাহউদ্দীন আহমদ, অধ্যাপক মুস্তাফা নূরউল ইসলাম ও ড. এনামুল হক
১. পরিবার ও বাল্যকাল
প্রশ্ন: জনাব চৌধুরী, আমরা শুরু করব আপনার জন্ম, বাল্যকাল ইত্যাদি দিয়ে। তার পরে আমরা তার থেকে প্রশ্ন করে অগ্রসর হব।
আবু সাঈদ চৌধুরী: আমার জন্ম হয়েছিল একেবারে পদ্মা নদীর পাশঘেঁষা এলাচিপুর গ্রামে। তাই এই পৃথিবীতে আসামাত্রই সম্ভবত আমার কানে আছড়ে পড়েছিল পদ্মা নদীর কুলুকুলু ধ্বনি। সেটা ছিল ১৯২১ সালের ৩১ জানুয়ারি। এলাচিপুর তখন বৃহত্তর ঢাকা জেলার অন্তর্গত ছিল, আরিচা থেকে মাইল তিনেক দূরে। এখানে বসবাস করত বেশ কিছু মুসলিম পরিবার। বর্তমানে গ্রামটা পুরোপুরি পদ্মা নদীর গর্ভে চলে গেছে। পরিবারগুলো পরে সরে এসে পাশের যে গ্রামে বসতি স্থাপন করে, তারও নাম এলাচিপুর। আমার মামা বা নানার বাড়ি, যা-ই বলুন, সেখানেই আমার জন্ম। ২১ দিন পর বাবা মাকে আর আমাকে নিয়ে আসেন আমাদের বাড়িতে, নাগবাড়ীর আমাদের পৈতৃক ভিটায়। এখানেই আমার শৈশব কাটে। এলাচিপুর গ্রামে অনেক সম্ভ্রান্ত মুসলমান পরিবারের বাসস্থান। মনে করা হয়, হজরত শাহ ছিলেন এসব পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা। তাঁকে নিয়ে একটা কিংবদন্তি প্রচলিত আছে। তাঁর মৃত্যুর বহু বছর পর পদ্মা প্রথম ভাঙতে ভাঙতে যেদিন একেবারে এলাচিপুর গ্রামের কাছে চলে এল, তখন কেউ কেউ বলল যে মাজার শরিফের কাছে এসে পদ্মা ঠিক ঘুরে যাবে। কিন্তু সবাই সেটা ঠিক বিশ্বাস করল না। তারা তাঁর কবর খুঁড়তে শুরু করল। কবর খুঁড়ে কিছু পাওয়া গেল না। তাঁর দেহাবশেষ অন্যত্র সরিয়ে নিতেই কবর খুঁড়েছিল। কিন্তু কিছুই পাওয়া যায়নি। অবশ্য সেদিন রাতেই (আমি অনেকের মুখেই শুনেছি) আলোর এক রশ্মি পদ্মার ওপর দিয়ে ভেসে যেতে দেখতে পায় লোকজন; এবং পুরো এলাচিপুর গ্রাম নদীগর্ভে চলে যায়।
আধুনিককালে বা বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি অনেক জায়গা থেকে অনেক মুসলমান পরিবার আধুনিকতার অনুসারী হয়েছে বা সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে নেতৃত্ব দিয়েছে। এলাচিপুর হলো আশরাফউজ্জামান খান, আমানুজ্জামান খান, আনিসুজ্জামান খান, আদালত খানদের পৈতৃক ভিটা। তাঁদেরই পূর্বপুরুষদের একজন ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে লেখাপড়া করেছেন।
এলাচিপুরের সঙ্গে এ কে ফজলুল হক সাহেবেরও সম্বন্ধ ছিল। নওয়াব স্যার সৈয়দ শামসুল হুদাও বিয়ে করেছিলেন এই এলাচিপুরে। আমার পূর্বপুরুষদের মধ্যে হজরত শফিউদ্দিন নামের আরেকজন আধ্যাত্মিক সাধনার দিক দিয়ে এখানে খুব খ্যাতি লাভ করেছিলেন। তিনি আমার নানার বাবা।
শিল্পী রশিদ চৌধুরীর বাবাও আমাদের আত্মীয় ছিলেন। আমার নানি ইন্তেকাল করার পর আমার নানা তাঁর আপন ফুফুকে বিয়ে করেন। আর রশিদ চৌধুরীর চাচা হারোয়ার খান বাহাদুর আলিমুজ্জামান চৌধুরী সেই ব্রিটিশ আমলেই কেন্দ্রীয় আইনসভায় একনাগাড়ে পঁচিশ বছর মেম্বার ছিলেন। ফরিদপুরে তাঁর নামে অনেক কিছুই আছে।
ফরিদপুর জেলা বোর্ড স্থাপিত হওয়ার পর থেকে তিনি চেয়ারম্যান ছিলেন। জেলায় তিনিই প্রথম বিএ পাস করেন। তাঁর কাছে শুনেছি যে বিএ পাস করার পর লোকজন তাঁকে অনেক দূরদূরান্তের গ্রাম থেকে দেখতে এসেছিল। অত্যন্ত ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ছিলেন তিনি।
প্রশ্ন: আপনার বাবার দিকের কিছু বলুন?
আবু সাঈদ চৌধুরী: আমার বাবার তরফের কথা যদি ধরি তাহলে বলতে হবে, টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলায় ‘ব্রাহ্মণ শাসন’ বলে একটি গ্রাম আছে, সেই গ্রামে সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে শেখ নান্নু বলে একজন ইরাক থেকে আসেন এবং সেখানে বসবাস করতে শুরু করেন। তো, ব্রাহ্মণদের উত্পাতে ওই এলাকার গরিব মুসলমানদের বেশ একটু অসুবিধা হচ্ছিল। উনি তাদের শাসন করে সেখানে নিজের প্রাধান্য বিস্তার করেন। তাতে করে ওই গ্রামের নাম হয়ে যায় ‘ব্রাহ্মণ শাসন’। ঘাটাইলের রাস্তার পাশে এখনো সেই গ্রামটা আছে। শেখ নান্নুর প্রত্যক্ষ উত্তরসূরিরা ক্রমে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়েন। তাঁদেরই একজন এসেছিলেন নাগবাড়ী গ্রামে। তাঁরাই বলতে গেলে আমাদের প্রথম পিতৃপুরুষ।
আমার পিতার নাম আব্দুল হামিদ চৌধুরী। তিনি ক্যালকাটা প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়তেন। তবে পড়াশোনা শেষ না করেই চলে আসেন। ময়মনসিংহ ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের কাজ শুরু হয়। তিনি তার প্রথম লোকাল বোর্ডের মেম্বার হয়েছিলেন।
প্রশ্ন: সময়টা বলতে পারেন?
আবু সাঈদ চৌধুরী: এসবই প্রথম মহাযুদ্ধের পর পরই বা তার একটু আগের ঘটনা। একনাগাড়ে তিনি ৪০ বছর ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের মেম্বার ছিলেন এবং এই মেম্বার থাকার সময়েই তিনি ভাইস চেয়ারম্যান হন। এর অর্থ, ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের ৪০ বছরের ইতিহাসের সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন। শুধু তা-ই নয়, ময়মনসিংহ জেলার প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও বহু বছর ধরে তাঁর সক্রিয় সম্পর্ক ছিল। যেমন: ময়মনসিংহ ডিস্ট্রিক্ট স্কুল বোর্ডের প্রথম প্রেসিডেন্ট তিনি। ওই একই বোর্ডের প্রথম সেক্রেটারি ছিলেন খান বাহাদুর আবদুল হাকিম, পরবর্তী সময়ে যিনি ডিপিআই হন। তারপর আমার মনে হয়, পরে শামসুল হক—সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী—তিনিও ডিস্ট্রিক্ট স্কুল বোর্ডের সেক্রেটারি হয়েছিলেন। কারণ, আইনে এটা ছিল যে যিনি ডিস্ট্রিক্ট ইন্সপেক্টর অব স্কুল হবেন, পদাধিকারবলে তিনিই তার সেক্রেটারি হবেন। তারপর ১৯৩৭ সালে আমার বাবা বেঙ্গল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের সদস্য হন।
প্রশ্ন: কোন দল থেকে—কৃষক প্রজা, না মুসলিম লীগ?
আবু সাঈদ চৌধুরী: মুসলিম লীগ থেকে। তাঁর মৃত্যুর পর ঢাকার একটি পত্রিকার সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছিল যে তিনি তাঁর দীর্ঘ ৫০ বছরের রাজনৈতিক জীবনে কোনো দিন দলত্যাগ করেননি।
প্রশ্ন: তিনি কি প্রথম থেকেই রাজনৈতিক দলে ছিলেন?
আবু সাঈদ চৌধুরী: না, তখনকার দিনে রাজনীতিটা এ রকম ছিল যে যিনি লোকাল বোর্ডের মেম্বার, ব্যক্তিগতভাবে তিনি ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডেরও মেম্বার। তারপর ১৯৩৬ সালে যখন ঠিক হলো যে ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন অনুসারে নির্বাচন হবে, তখন ফজলুল হক সাহেব ময়মনসিংহে গিয়েও কৃষক প্রজা পার্টির সংগঠন শুরু করলেন। কিন্তু তিনি ময়মনসিংহে গিয়েছিলেন সপ্তাহ খানেক কি ১৫ দিন দেরি করে। তাঁর আগে শহীদ সোহরাওয়ার্দী সাহেব ওখানে উপস্থিত হয়েছিলেন। উপস্থিত হওয়ার পর তিনি চার সদস্যের একটি কাউন্সিল অব অ্যাকশন গঠন করলেন। মুসলিম লীগ অর্গানাইজ করার জন্য ময়মনসিংহ জেলায় আমার বাবাকে তিনি তার একজন সদস্য হওয়ার অনুরোধ করেন। আর বাবা তাঁকে বলে দিলেন, ‘আচ্ছা ঠিক আছে। আমি আছি আপনার সঙ্গে।’ তার দিন পনেরো পর ফজলুল হক সাহেব, আমার বেশ মনে আছে, সন্ধের সময় আগে থেকে না জানিয়ে আমাদের বাড়িতে হঠাত্ করেই উপস্থিত হলেন। আইনসভার সদস্য তৈয়বুদ্দিন আহম্মদও ছিলেন তাঁর সঙ্গে। আমরা বাইরের ঘরে বসে সবকিছু দেখছিলাম।
প্রশ্ন: এটা কি ময়মনসিংহ শহরে?
আবু সাঈদ চৌধুরী: হ্যাঁ, ঘটনাটি ঘটেছিল ময়মনসিংহ শহরে। ওই যে যেটাকে ইউরোপিয়ান কোয়ার্টার বলা হতো, আমাদের বাড়িটা ছিল তার ওই কোনায় ঠিক নদীর ধারে। সেখানে তো ফজলুল হক সাহেব গাড়ি থেকে নামলেন। আমার বাবাও বাইরেই বসেছিলেন। উনি তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে তাঁকে অভ্যর্থনা জানিয়ে নিয়ে গেলেন। ফজলুল হক সাহেব এলেন, চা খেলেন, ঘণ্টা খানেক গল্প করলেন; কিন্তু রাজনীতি প্রসঙ্গে কোনো কথা বললেন না। যখন উনি চলে যাচ্ছেন, তখন আমার বাবা কী রকম একটা অস্বস্তি বোধ থেকে হঠাত্ করেই বলে ফেললেন, ‘আপনি তো এসেছেন! হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীও এসেছিলেন। তিনি এখানে একটা মুসলিম লীগ সংগঠনের ব্যবস্থা করেছেন এবং আমাকে ওই কাউন্সিল অব অ্যাকশনের মেম্বার করেছেন।’ তখন ফজলুল হক সাহেব বাবার ঘাড়ে হাত দিয়ে বললেন, ‘আমি সব জানি। সব জায়গাতেই ভালো লোকের দরকার আছে। আপনি যেখানে আছেন, ওখানেই থাকুন না। ওখানে থেকে কাজ করতে থাকুন।’ তারপর একসময় ফজলুল হক সাহেব সত্যিই মুসলিম লীগের সঙ্গে কোয়ালিশন করে ফেললেন। আমার এখনো মনে আছে, তিনি ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে এসেছিলেন তৈয়বুদ্দিন আহম্মদের সঙ্গে। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের সময় তৈয়বুদ্দিন ছিলেন আইনসভার সদস্য। তিনি তাঁর সঙ্গে ছিলেন। ফজলুল হক সাহেবের কথা শুনে তিনি হাসছিলেন। আমার বাবা কী রকম একটু দ্বিধায় পড়ে গিয়েছিলেন তাঁর উপস্থিতিতে। তিনিও বলেছিলেন, ‘আমি সবই জানি। আমার সব জায়গাতেই লোকের দরকার হবে। ভালো লোক আইনসভায় এলেই হলো। কে কোথা থেকে আসছে, সেটা অত বেশি দেখবেন না। ভালো লোক সব জায়গা থেকে এলেই আমার কাজে লেগে যাবে।’ এভাবে ১৯৩৬ সালের শেষের দিকে বোধ হয় ইলেকশনটা হলো।
প্রশ্ন: তখন ময়মনসিংহ মুসলিম লীগের এই কাউন্সিল অব অ্যাকশনের সদস্য আর কে কে ছিলেন?
আবু সাঈদ চৌধুরী: তখন ময়মনসিংহ মুসলিম লীগের এই কাউন্সিল অব অ্যাকশনের সদস্য ছিলেন আরও তিনজন। তাঁরা হলেন এখনকার নৌবাহিনীর প্রধান অ্যাডমিরাল সুলতান আহম্মদের বাবা খান বাহাদুর শরফুদ্দিন আহম্মদ এবং মি. নূরুল আমীন ও গিয়াসউদ্দিন পাঠান।
প্রশ্ন: তখন তাঁদের বয়স?
আবু সাঈদ চৌধুরী: শেষের দুজন বয়সে তখন খুবই নবীন ছিলেন। আমার বাবার বয়সের তুলনায় নবীন তো বটেই।
প্রশ্ন: আবুল মনসুর আহমদ সম্পর্কে কিছু স্মৃতিচারণা করবেন?
আবু সাঈদ চৌধুরী: আবুল মনসুর আহমদ সাহেব, উনি প্রজা সমিতির সংগঠক ছিলেন এবং আমার বাবার সঙ্গে তাঁর খুবই বন্ধুত্ব ছিল। তাঁর মুখ থেকে গল্প শুনতে আমার অসম্ভব ভালো লাগত। আমি তাঁর বাড়িতে যেতাম। তিনিও চিরাচরিত কায়দায় হাসির গল্প বলতেন। আমার খুশির সীমা থাকত না। আমি মাঝেমধ্যেই তাঁর কাছে যেতাম।
মনসুর আহমদের সঙ্গে আমার বাবার যথেষ্ট বন্ধুত্ব ছিল এবং তখনকার দিনের রাজনৈতিক অবস্থা বুঝতে হলে এটা বুঝতে হবে যে আবুল মনসুর আহমদ আমার বাবার গাড়িতে উঠে তাঁর জন্য ক্যানভাসে বেরোতেন। আইনসভার নয়, ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের ইলেকশন বা স্কুল বোর্ডের ইলেকশনে ব্যক্তিগতভাবে আবুল মনসুর আহমদও আমার বাবার জন্য ক্যানভাস করেছেন। তখনকার দিনে এ রকম ভুল-বোঝাবুঝির অবকাশ রাজনীতিতে ছিল না।
প্রশ্ন: আপনি টাঙ্গাইলে পড়েছিলেন, ময়মনসিংহে পড়েছিলেন—আপনার স্মৃতি থেকে তখনকার সামাজিক অবস্থা, সাংস্কৃতিক জীবন সম্পর্কে কিছু বলুন?
আবু সাঈদ চৌধুরী: আমি টাঙ্গাইলে থাকতে শুরু করেছিলাম সেই আটাশ-ঊনত্রিশ [১৯২৮-২৯] সাল থেকে। আমাদের মনে করার জন্য খুব গৌরবের সময় সেটা। সাম্প্রদায়িকতা একরকম ছিলই না বলতে গেলে।
তখন আমাদের ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল খুবই কম। কলকাতার সঙ্গেই ছিল বেশি। একটু অসুখে পড়লে প্রায়ই চিকিত্সার জন্য বাবা আমাকে কলকাতায় নিয়ে যেতেন। তারপর মাঝেমধ্যে এমনিতেও যেতাম। আমার মামা কলকাতায় থাকতেন। আমাদের নিয়ে যেতেন বেড়াতে। কলকাতায় যাতায়াতের তেমন সরাসরি সুবিধা না থাকলেও ময়মনসিংহ থেকে যাওয়ার তো সুবিধা ছিলই। ট্রেনে চেপে সোজা জগন্নাথগঞ্জ ঘাট। সেখান থেকে সিরাজগঞ্জে গিয়ে ট্রেনে উঠলেই শিয়ালদহ।
যা-ই হোক, ময়মনসিংহ জিলা স্কুলে যখন আমি পড়তে এলাম, তখনকার কথা বলি। ক্লাস এইট, নাইন, টেন—এই তিন ক্লাস আমি জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার সঙ্গে পড়েছি। জ্যোতির্ময় ছিল ক্লাসের সেরা ছাত্র। সব সময় পড়াশোনা করত। অত্যন্ত বিনয়ী, নম্র ও ভদ্র। অন্যের কাছে নিজের পরিচয় তাকে দিতে হতো না। ওই বয়সেই তার ছিল প্রখর ব্যক্তিত্ব, যেটা আপনারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার সময়ও তার মধ্যে দেখেছেন। আমি তার সম্বন্ধে যে প্রবন্ধ লিখেছিলাম, কিছুই বানিয়ে লিখিনি। ওটা ছিল একেবারেই বস্তুনিষ্ঠ প্রবন্ধ। ওই বয়সেই সবার চোখে পড়ত সে; পড়াশোনা করার লোক ছিল, অধ্যবসায় ছিল।
বিন্দুবাসিনী স্কুলে ড. এম এন হুদাও আমার ঠিক সহপাঠী নন, তিনি বোধ হয় আমার এক ক্লাস ওপরে পড়তেন। তবে অবশ্যই সমসাময়িক। তার পরে মীর্জা সিরাজুল হক ভালোভাবে পাসটাস করেছিলেন। হয়েছিলেন পুলিশের ডিআইজি। বদরউদ্দিন আহম্মদ—ও আমার এক ক্লাস নিচে পড়ত আর কী। জুনিয়র ছিল। জ্যোতির্ময় আমার সহপাঠী ছিল ময়মনসিংহ জিলা স্কুলে।
রাজনৈতিক সভা-সমিতি ছাড়াও টাঙ্গাইলে তখন প্রায়ই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো। এই ছোট্ট মফস্বল শহর নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও উত্সবের জন্য খ্যাতি অর্জন করেছিল। মাঝেমধ্যেই অপেশাদার শিল্পীদের দিয়ে নাটক ও নৃত্যানুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। এদের মানও বেশ উন্নত ছিল। তা ছাড়া খেলাধুলার পাশাপাশি নানা ধরনের প্রদর্শনীরও আয়োজন করা হতো। আমার বাবা এসব কিছুকে সক্রিয়ভাবে উত্সাহ দিয়েছেন এবং তাঁর সঙ্গে আমিও এসব অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছি। যোগ দিয়েছি স্কুলের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানেও। আবৃত্তি করেছি কবিতা। আরও একটি ঘটনার কথা মনে আছে। কামাল পাশা নাটকের অভিনয়ের একটি ক্ষুদ্র অংশে আমি কামাল পাশার চরিত্রে অভিনয় করেছিলাম একবার এবং বেশ গম্ভীর হয়ে বলেছিলাম, ‘দুনিয়ার বুকে নয়, কোটি তুর্কি বেঁচে থাকতে তাদের প্রিয় মহামান্য খলিফাকে কোন উদ্ধত রাজশক্তি এই অপমানজনক সন্ধিতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করেছে! তুর্কি জাতি আজ সে কথা জানতে চায়?’ লেখক বললেন যে অভিনয়টা ভালো হয়েছে, কিন্তু খলিফার প্রতি যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন করা হয়নি। ওই বয়সেই বুঝেছিলাম, কামাল পাশার অভিব্যক্তি বোধ করি ভালোই ফুটিয়ে তুলতে পেরেছিলাম।
অভিনয়ের ফাঁকে ফাঁকে বা বিরতিতে কিছু না-কিছু নৃত্যানুষ্ঠান থাকত। অনুষ্ঠানের আয়োজন এভাবেই করা হতো। টাঙ্গাইলে যেসব সরকারি কর্মচারী গেছেন, তাঁরাও পরে আমাকে বলেছেন যে সাংস্কৃতিক দিক থেকে টাঙ্গাইলের মান সত্যিই অত্যন্ত ভালো। আর রাজনীতির দিক থেকে তো টাঙ্গাইল তখন, আমি মনে করি, জনগণের মধ্যে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেছে। কেননা, প্রায়ই খুব বড় বড় সভা-সমিতি হতো এবং কংগ্রেসেরও বড় বড় সভা হয়েছে। ধরুন, আমি বসে আছি, হঠাত্ শুনতে পেলাম দূর থেকে ভেসে আসা শব্দ ‘আল্লাহু আকবার’, ‘বন্দে মাতরম’, ‘হিন্দু মুসলমান কি জয়’ প্রভৃতি স্লোগান এবং সে সঙ্গে হাজার হাজার লোকের প্রসেশন। আর আমি সব সময় এসব প্রসেশনে যেতাম এবং সভা চলার সময় চুপ করে লোকজনের মধ্যে বসে থাকতাম। তখন আমার বয়স আর কত! আমার এসব বক্তৃতা শুনতে খুব ভালো লাগত।
প্রশ্ন: এসব তো সেই খেলাফত আন্দোলনের সময়কার কথা?
আবু সাঈদ চৌধুরী: হ্যাঁ, এসবই খেলাফত আন্দোলনের সময়কার কথা কি তার পরবর্তী সময়ের, অর্থাত্ ১৯২৮, ১৯২৯, ১৯৩০-এর মতো সময়ের কথা। টাঙ্গাইলে তখন এসব ব্যাপারে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন অমরেন্দ্রনাথ ঘোষ। ডাকসাইটে লোক। এবং বাংলাদেশের কোথাও সাম্প্রদায়িকতা থাকলেও তাঁদেরকে তা স্পর্শ করেনি। তাঁরা তো অন্য জগতের মানুষ ছিলেন। তিনি আমার দাদার বন্ধু ছিলেন। ফলে আমার বাবাকে উনি ছেলের মতোই ভালোবাসতেন। তিনি আমার কাছে পরে গল্প করেছেন। আমি নাকি একবার তাঁকে বলেছিলাম যে আমি তাঁর কোলে উঠব। তিনি আমাকে তাঁর কোলে তুলে নিয়েছিলেন। তখন এ ধরনের সম্পর্ক ছিল হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে।
প্রশ্ন: এবার আসা যাক টাঙ্গাইলে বিশের দশকের শেষের দিকে সংঘটিত সন্ত্রাসবাদ আন্দোলনের কথায়?
আবু সাঈদ চৌধুরী: আমি বলছি, এই আন্দোলনে প্রবীণদের মধ্যে ছিলেন অমরেন্দ্রনাথ ঘোষ, আর নবীনদের মধ্যে ছিলেন পরেশচন্দ্র সান্যাল। তাঁর চেহারাও ছিল অত্যন্ত সুন্দর। মানে, অত্যন্ত সুদর্শন। অমরেন্দ্রনাথ ঘোষ ছিলেন টাঙ্গাইল কংগ্রেস কমিটির সভাপতি এবং আমি যে সময়ের কথা বলছি, তার ছয়-সাত বছর আগে থেকেই, অর্থাত্ ১৯১৮ ও ১৯১৯-এর ভারত শাসন আইনের অধীনে যে বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভা ছিল, সেখানে উনি কংগ্রেসদলীয় সদস্য ছিলেন। মানে, দেশবন্ধু যখন কংগ্রেসে যেতে বলতেন, ওরা যেতেন। আর যখন বেরিয়ে আসতে বলতেন, তখন বেরিয়ে আসতেন। তিনি দেশবন্ধুর খুবই প্রিয় সহকর্মী এবং শিষ্য ছিলেন। দেবতুল্য মানুষ বলতে যা বোঝায়, তা-ই ছিলেন তিনি।
আমার জীবনে অনেক ভালো বক্তৃতা শোনার সৌভাগ্য হয়েছে। কিন্তু এই টাঙ্গাইলের পরেশ সান্যালের বক্তৃতা মানেই একটা বিরাট শিল্প এবং সেটা একটা শেখার জিনিস ছিল। পরেশ সান্যাল রবীন্দ্রনাথকে সমানে আবৃত্তি করে যেতেন। আর যখন সুভাষচন্দ্র এলেন, তখন ওর স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সদস্য হলেন পরেশ সান্যাল। একেবারে সামরিক পোশাক-টোশাক পরেই হয়ে গেলেন বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের সদস্য। মনে পড়ে, সুভাষ বসুকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য আমাদের একটা ঘোড়া পরেশ সান্যাল চেয়ে নিয়েছিলেন। তিনি ও অমরেন্দ্রনাথ ঘোষ যখন আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন, মুসলিম নেতারা তখন কংগ্রেসের আন্দোলন থেকে সরে গেছেন। আমি যখন কংগ্রেসের সভা ইত্যাদিতে গিয়ে জনতার মধ্যে ঢুকে চুপ করে ঘাসের ওপরে বসে থাকতাম, সে সময় চাঁদ মিয়া সাহেবেরা আর কংগ্রেসের সভায় আসতেন না। চাঁদ মিয়া সাহেব আমার বাবাকে খুবই ভালোবাসতেন, স্নেহ করতেন। তিনি প্রায়ই করটিয়ায় যেতেন। ওয়াজেদ আলী খান পন্নীকেও আমি দেখেছি ওই অবস্থায়। টাঙ্গাইলে থাকতে আমি অনেকবার এই দানবীরের স্নেহস্পর্শ লাভ করি। আমার বাবা যখনই তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যেতেন, আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন। আমি আমার বাবার একমাত্র সন্তান ছিলাম। আমার ভাইও নেই, বোনও নেই। বাবার এ রকমের একটা অভ্যাস দাঁড়িয়ে গিয়েছিল যে উনি গুরুত্বপূর্ণ কারও সঙ্গে দেখা করতে গেলে আমাকে প্রায়ই সঙ্গে নিয়ে যেতেন। ফলে ওই বয়সেই আমি বলতে পারি যে এ রকম বড় মাপের সব মানুষের সঙ্গে আমার দেখা-সাক্ষাত্ হয়েছে। অল্প বয়সেই আমি তাঁর ব্যক্তিত্ব, মানে ওয়াজেদ আলী খান পন্নীর ব্যক্তিত্বের সম্যক পরিচয় পেয়েছিলাম। অনুভব করতে পেরেছিলাম তাঁদের মতো মানুষের হূদয়ের ঔদার্য। স্বাধীনতা সংগ্রামের গৌরবদীপ্ত ভূমিকার প্রেক্ষাপটে তখন তিনি সমাজ-সংসারের কল্যাণ এবং শিক্ষার প্রসারে ব্রতী। একদিনের ঘটনার কথা বলছি। সেবার বাবার সঙ্গে তাঁর ওখানে বেড়াতে গিয়েছি, ময়মনসিংহে। তিনি আমার বাবাকে দেখে খুবই খুশি হলেন। বললেন, ‘তোমরা এসেছ, খুবই ভালো হয়েছে।’ তিনি তখন কী ধরনের কাজ করতেন, এ ঘটনা থেকে বুঝতে পারবেন। বাবাকে দেখেই পন্নী সাহেব বললেন, ‘জানো আব্দুল হামিদ, একটা অদ্ভুত ব্যাপার, বুঝতে পেরেছ, এটা একটা অদ্ভুত ব্যাপার। এই ঢুলি—ওরাও মুসলমান, আমরাও মুসলমান। আমি শুনলাম, ঢুলিদের সঙ্গে বসে নাকি আহার করা যায় না, যেহেতু তারা ঢোল বাজায়। আরে ঢোল বাজালে খাওয়া যাবে না কেন, বলো দেখি? আমি ওদের আজকে দাওয়াত করেছি। এই যে ফরাস বিছিয়েছি, আমি ওদের নিয়ে একসঙ্গে বসে খাব। তুমিও বসে যাও আমাদের সঙ্গে।’
তারপর খাওয়ার সময় হলো, ঢুলিরা এল। ঢুলিদের সঙ্গে বসে চাঁদ মিয়া সাহেব খেলেন। আমরাও বসে খেলাম। উনি আমার বাবাকে পুত্রপ্রতিম বলব না, পুত্রাধিক স্নেহ করতেন এবং আমার এই কথাটা বস্তুনিষ্ঠও বটে। একবার তাঁর ছেলের সঙ্গে একটা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। তিনি আমার বাবাকে আমার সামনেই বলেছিলেন, ‘ও তোমার সঙ্গে কেন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চাচ্ছে, বুঝতে পারছি না। ও তো কোনো কথা শুনবে না। আমি ওই লোকাল বোর্ডের মতো ওকে টাকাও তো দিয়ে দিতে পারি না। ও করুক না, নিজেই কাজ করুক। সমাজ সংস্কারের কাজ করুক। তা না, তোমার সঙ্গে ইলেকশনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে গেছে! এখন আমার কথা তো শুনবে না। আমি আর কী করতে পারি! আমি তোমাকে দোয়া করছি।’
অবশ্য শেষ পর্যন্ত বাবার সঙ্গে তাঁর ছেলের এবং আমারও খুব বন্ধুত্ব হয়ে যায়। স্থানীয় কিছু লোক তাঁর ছেলেকে বাবার সঙ্গে লাগিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিল; কিন্তু শেষ পর্যন্ত আপস হয়ে যায়। আর প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়নি। আবার দুজন একসঙ্গে মিলেজুলে কাজ করতে থাকেন।
প্রশ্ন: আমরা সন্ত্রাসবাদ আন্দোলন সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলাম। আপনি সে সম্পর্কে বলছিলেন?
আবু সাঈদ চৌধুরী: হ্যাঁ, টাঙ্গাইলে সন্ত্রাসবাদ আন্দোলন সম্পর্কে দুটো কথা না বললেই না। আব্দুল সামাদ বলে একজন যুবক ছিলেন। তাঁর একটি দোকান ছিল। দোকানটা বিকেলের দিকে পরিণত হতো ক্লাবে। এবং সেখানে আসতেন পরেশ সান্যাল। আসতেন ননী সেন আর আসতেন পিসি সরকার। তখন পিসি সরকার একজন যুবক মাত্র। তখনো তিনি ভুবনবিখ্যাত জাদুকর পিসি সরকার হয়ে ওঠেননি। তিনিও ওখানে আসতেন। আড্ডা দিতেন। টাঙ্গাইলে ঢোকার একটু আগেই ছিল তাঁদের বাড়ি। ওখানটায় অর্থাত্ ওই দোকানের সামনে বেঞ্চ ফেলা থাকত। বসে লোকজনের সঙ্গে তিনি আড্ডা দিচ্ছেন। এই ছিলেন তখনকার পিসি সরকার। একদিন বিকেলে ননী সেন, তারপর পরেশ সান্যাল এসে বসলেন ওই সামাদ সাহেবের দোকানে। সামাদ নামের ভদ্রলোক আবার আমার বাবার খুব ভক্ত ছিলেন। সে কারণে আমাকে খুব স্নেহ করতেন। বিকেলবেলা স্কুল থেকে এসে একটু বেড়াতে বেরোতাম। এক ফাঁকে তাঁর ওখানে গিয়ে বসতাম। তখন থেকেই যাঁদের গুণীজন বলা হয়, তাঁদের আমি ভালোবাসতাম, শ্রদ্ধা করতাম। পিসি সরকার তখন থেকেই রুমাল-টুমালের কিছু কিছু খেলা দেখান। আমাদের চোখে তখনই তিনি একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি। তাই আমিও ওখানে যেতাম। একদিন ওখানে বসে আছি। শুনলাম, ঢাকার ডিভিশনাল কমিশনার আলেকজান্ডার ক্যাসেলস টাঙ্গাইল পরিদর্শন করতে এসেছেন। উনি লোকাল বোর্ড অফিস পরিদর্শন করলেন। তারপর হাঁটতে হাঁটতে গেলেন সেন্ট্রাল কো-অপারেটিভ ব্যাংকে। আমার বেশ মনে আছে, এটা হলো ঠিক সেই সময়কার কথা, যখন টাঙ্গাইল একটা বাগানে ভরা শহর। তখন এক বাড়ি আরেক বাড়ির ওপর ওঠেনি। স্বচ্ছন্দে বিচরণ করা যায় পার্কে—সকালে-সন্ধ্যায়; শহরের সবাই মিলিত হন। কুশলবার্তা জিজ্ঞাসা করেন। অবসর সময়ে ধীরেসুস্থে রিলাক্সড ওয়েতে আলাপ-আলোচনা হতো। এ রকমই ছিল টাঙ্গাইল। তো, যা-ই হোক, আমি যা বলেছিলাম, সে কথায় ফিরে আসা যাক। আলেকজান্ডার ক্যাসেলস যখন সেন্ট্রাল কো-অপারেটিভ ব্যাংকের দিকে যাচ্ছিলেন, সে সময় কয়েকজনকে দৌড়ে আসতে দেখা গেল। তারপর ছোটাছুটি, চিত্কার, ডাকাডাকি, হুড়োহুড়ি ‘কী হয়েছে’, ‘কী হয়েছে’ বলে। কে যেন ছুটে যেতে যেতে বলল, ‘গুলি লেগেছে।’ কার গায়ে গুলি লেগেছে, কে গুলি করেছে—জানার আগেই দেখা গেল ক্যাসেলস সাহেবকে লোকজন অন্যদিকে নিয়ে চলে গেলেন। টাঙ্গাইল থেকে লঞ্চে করেই তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তাঁকে তাক করা গুলিটা লেগেছিল আলেকজান্ডার ক্যাসেলসের ঊরুতে। টাঙ্গাইলের যে মহকুমা ডাক্তার, তিনি তাঁর সঙ্গে গেলেন। ক্যাসেলস তাঁকে বললেন, ‘তুমি কিছু কোরো না। কেবল ব্যান্ডেজটা করে দাও, যাতে আমি ঢাকা পর্যন্ত যেতে পারি।’
পরে ঢাকায় এসে অপারেশন করে গুলিটা বের করে ফেলা হয়। উনি বেঁচে যান। ঠিক সন্ত্রাসবাদের মতো কেবল এই একটি ঘটনা আমি ঘটতে দেখেছি। টাঙ্গাইলে এ রকমের ঘটনার আর কিছু মনে পড়ছে না। এখানে টেররিজমের চেয়ে ন্যাশনালিজমই ছিল বেশি। সন্ত্রাসবাদের এক নেতার সঙ্গে, সর্বজনশ্রদ্ধেয় এক নেতার সঙ্গে আমার বাবার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব হয়। তিনি হলেন সুরেন্দ্রমোহন ঘোষ, যাঁকে পুরো কংগ্রেসি মহলে, বিপ্লবী মহলে, ‘যুগান্তর’ মহলে ‘মধুদা’ বলে ডাকা হতো। তাঁকে দেখলে তিনি যে ওই ধরনের কাজে লিপ্ত আছেন, এটা মনেই হতো না। সব সময় তাঁর মুখজুড়ে একটা সহজ, সুন্দর মিষ্টি হাসি। তাঁর জীবনের চল্লিশটি বছর কেটেছে জেলে। কিন্তু বাইরে কখনোই ইংরেজের বিরুদ্ধে তিক্ততা প্রকাশ করতেন না। কেবল এক ভাবনা, দেশকে স্বাধীন করতে হবে যেকোনোভাবেই হোক। এ ছাড়া অন্য আর কোনো ধরনের ভাবনা ছিল না তাঁর। তিনি এমন ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন যে কাউকে যখন বলতেন ‘তুই অমুক লোককে গুলি করতে যা’, সে তা-ই করতে যেত। এবং যে এই কাজ করতে যেত, সে জানত যে এই কাজ করে ধরা পড়লে তার ফাঁসি হতে পারে। তার পরও সে মনে করত, মধুদা আমাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন বলেই ফাঁসিতে লটকে মৃত্যুবরণ করার দায়িত্বটা আমাকেই তিনি দিয়েছেন। তখনকার দিনের যেসব ছেলে এ ধরনের কাজে নামত, তারা এ রকমের মনোভাব নিয়েই নামত। তো, এ রকমের যে টাঙ্গাইল, তার একটা কথা আপনাদের আমি বলি। আমি তখন যুব কংগ্রেসের মিটিংয়ে গেছি। তবে খোলা মন ছিল। আঞ্জুমানে ইসলামিয়ারও মিটিংয়ে একইভাবে গেছি। তো, সেই ‘আঞ্জুমানে ইসলামিয়া’ যেবার শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে আনল, তাঁকে দিয়ে বক্তৃতা দেওয়াল, সেবারও আমি তাদের সেই মিটিংয়ে গিয়েছিলাম। আমার অভ্যাস ছিল, বিখ্যাত মানুষজনের ভালো ভালো কথাবার্তা শোনা। মনোভাবটা ছিল এ ধরনের। কৃষ্ণকুমার মিত্র, বিখ্যাত সাংবাদিক, টাঙ্গাইলে বাড়ি—উনি এলেন আর গেলেন। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ও এলেন। তাঁকে আমি এই টাঙ্গাইলেই দেখি। তারপর তো তাঁর খুব কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ হয় আমার। টাঙ্গাইলে প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের কথা শুনি একটু দূরে দাঁড়িয়ে। কেননা, তখনো আমি ছাত্র। তা-ও আবার নিচের ক্লাসের। মাত্র ক্লাস সেভেনে পড়ি তখন। হেডমাস্টারের রুমে তাঁর জন্য খাবার-দাবারের কিছু ব্যবস্থা করা হয়েছিল। উনি বললেন, ‘না না, এসব আমি খেতে পারব না।’ কে একজন একটা কিছু বলতে গেছে ‘একটু কিছু খান’ বলে—জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি সবকিছু উদরস্থ করতে পারি না।’ আমি তখন রুমের মধ্যেই ছিলাম। পরবর্তী সময়ে যখন কলকাতায় যাই, তখন আমি আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে যত না এসেছি, তার চেয়ে অনেক বেশি আমাকে প্রভাবান্বিত করেছে ওই মানুষটির আচার-ব্যবহার ও চালচলন।
২. ছাত্রজীবন
প্রশ্ন: আমরা আবার একটু পেছনে ফিরে যাই। নানাবাড়ি থেকে আপনি টাঙ্গাইলে এলেন। সেখানেই বড় হয়েছেন এবং পড়াশোনা করেছেন। আপনার শিক্ষাজীবন সম্বন্ধে বলুন?
আবু সাঈদ চৌধুরী: আমার শিক্ষাজীবনের কথা বলতে গেলে এককথায় বলতে হবে অপূর্ব। অপূর্ব সেই জীবন। টাঙ্গাইল বিন্দুবাসিনী স্কুলে পড়তে আসার আগে আমি গুরু ট্রেনিং স্কুলের সঙ্গে যে প্রাইমারি স্কুল ছিল, সেখানে বছর খানেক পড়ি। বিন্দুবাসিনী স্কুলে এসে আমি ক্লাস থ্রিতে ভর্তি হলাম। এই স্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন দেবেন্দ্রচন্দ্র চক্রবর্তী। আমি ক্লাস থ্রি থেকে ক্লাস সেভেন পর্যন্ত এই স্কুলেই পড়াশোনা করি। এই কয়েক বছরই প্রতিদিন—কি শীত, কি গ্রীষ্মে—তাঁকে যে পোশাক পরে আসতে দেখেছি, সেটা ওই বঙ্কিমচন্দ্র ধরনের পোশাক। অবশ্য ছবিতে বঙ্কিমচন্দ্রের মাথায় যে টুপি দেখা যায়, তেমন কিছু তাঁকে পরতে দেখা যেত না। ওই এক চাপকান আর প্যান্ট পরে তিনি আসতেন। ঠিক নয়টায় ক্লাসে ঢুকে চেয়ারে বসে পড়তেন। এদিক-ওদিকও তাকাতেন না। স্কুল কমিটির প্রেসিডেন্ট ছিলেন এসডিও। তাঁদের প্রত্যেকেই ইংরেজ আইসিএস। কোনো দিন তিনি তাঁদের বাড়িতে যেতেন না এবং তাঁকে ডেকে পাঠান, এমন সাহসও কোনো ইংরেজ এসডিও কখনোই করেননি।
স্কুল কমিটির গভর্নিং বডির যে মিটিং হতো, সেটা হতো হেডমাস্টারের অফিসে। এসডিও সাহেব এখানে আসতেন হেডমাস্টারের প্রয়োজনে। অথচ তিনি কিন্তু বলে পাঠাতে পারতেন যে আমি আসছি কাগজপত্র নিয়ে। কিন্তু আমরা তাঁকে এসডিওর বাড়িতে কখনো যেতে দেখিনি।
প্রশ্ন: আপনি আপনার ছাত্রজীবনের কথা, কলকাতার কথা, কীভাবে আপনি সমাজের বিভিন্ন রকম সমস্যা, রাজনৈতিক সমস্যা দেখেছেন বা এ সম্পর্কে আপনার প্রতিক্রিয়া এবং আপনি ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন, সে সম্পর্কে বলেছেন। ১৯৪৮ সালে আপনি ছাত্রজীবন শেষ করে ব্যারিস্টারি পড়তে লন্ডনে যান। আমরা এখন সেখান থেকে শুরু করব?
আবু সাঈদ চৌধুরী: আমি কিছুটা বলেছি আমার শৈশবের কথা। আজকে আবার আমি সেই সময়ের আরও কিছু কথা বলছি। আমার শৈশব কেটেছে একেবারে একটি পাড়াগাঁয়ে—নাগবাড়ীতে। তখনকার দিনে টাঙ্গাইল মহকুমা, ময়মনসিংহ জেলা। ময়মনসিংহ এই উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় জেলা এবং এই গৌরব বহু দিন ধরে রাখতে পেরেছিল সে। এখন সেটা ভেঙে গেছে।
টাঙ্গাইলে আমি ক্লাস টু-থ্রি পর্যন্ত প্রাইমারি স্কুলে অল্প কিছুদিন লেখাপড়া করেছিলাম। তারপর ক্লাস থ্রিতে বিন্দুবাসিনী স্কুলে এসে ভর্তি হই। এখন যখন পেছনের দিকে ফিরে তাকাই, তখনকার সমাজজীবনকে অত্যন্ত ভালো লাগে। কেননা, একটা শূন্যতার পরিবেশ আমি সব জায়গায় দেখে এসেছি। আমি জানি না, ব্যক্তিগতভাবে শুধু আমিই দেখেছি, না সবাই দেখেছেন। কিন্তু আমার নিজের ধারণা, আমি যে পরিবেশের কথা মনে করে আনন্দবোধ করি এবং এখনো অনেক সময় বিছানায় শুয়ে শুয়ে আমি আমার শিক্ষকদের কথা মনে করি, যাঁদের সঙ্গে দেখা হলে আনন্দিত হতাম, তাঁদের অনেকেই বেঁচে নেই। এই যে একটা মধুর সম্বন্ধ, সেটা আমার জীবনে প্রথম থেকে গড়ে ওঠে। একদিক থেকে আমি অনেক সময় চিন্তা করি যে শিক্ষক-সৌভাগ্য বলে কোনো বিষয় যদি থাকে, তাহলে আমার জীবনে সেটা সীমাহীনভাবে এসেছে। কেননা, আমি যখনই যেখানে পড়েছি, শিক্ষকদের এমন আচার-ব্যবহার, আদর্শনিষ্ঠ জীবন দেখেছি যে আমি মুগ্ধ হয়ে গেছি। সেটা টাঙ্গাইলের গুরু ট্রেনিং স্কুলে, বিন্দুবাসিনী হাইস্কুলে, ময়মনসিংহ জিলা স্কুলে পেয়েছি। তাঁরা সমাজজীবনেও খুব আদর্শ ব্যক্তি ছিলেন। তাঁদের কথা বলতে গিয়ে আমি সত্যি সত্যি আপ্লুত হয়ে যাই। কেননা, তাঁরা তাঁদের কর্তব্য করেছেন, প্রত্যেক ছাত্রের জন্য তাঁদের সে কী আগ্রহ! অনেক শিক্ষকের মুখেই আমি অনেকবার শুনেছি যে তাঁদের গৌরব ছাত্রের সাফল্যে। সেই ধারাটি ঠিক এভাবে এখন সব সময় দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। এটা দুঃখের কথা। আমাদের জমিদারি থেকে দুটি হাইস্কুল চালানো হতো এবং সম্প্রতি আমি সেগুলো দেখতে গিয়ে শিক্ষকদের অমনোযোগিতা লক্ষ করে এত বিভ্রান্ত হয়েছি যে কী বলব! এখন আমার ভাবনা, হাইস্কুল প্রতিষ্ঠা করাই যথেষ্ট নয়, তার প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতে হলে আমাকে সেখানে যেতে হবে। সে জন্য দেখুন, শফিপুর থানায় আব্দুল হামিদ চৌধুরী হাইস্কুল প্রতিষ্ঠা করেছি; আমার বাবার নামে। তো, ওটা আমি দেখার জন্য খুব শিগগির সেখানে যাচ্ছি। আর নাগবাড়ীতে আমি গিয়েছিলাম আমার মায়ের নামে যে স্কুলটা প্রতিষ্ঠা করেছি, যার নাম হাসিনা চৌধুরী হাইস্কুল, ওটার সম্বন্ধে আমি যথেষ্ট খোঁজখবর নিয়ে এসেছি। ওটা চলছে খুবই ভালোভাবে। ওদের পরীক্ষাও অনেক ভালো হচ্ছে। কিন্তু যে পরিমাণ সম্পত্তি ওদের নামে দেওয়া হয়েছে, তাতে করে তাদের আরও ভালো চলা উচিত। সে যুগে হাইস্কুলের শিক্ষকেরা তাঁদের পরিবারের কথা চিন্তা করতেন না বলেই আমার মনে হয়। ব্যাপারটা অবশ্য আমি তলিয়ে দেখিনি। কেবল তাঁরা স্কুল আর ছাত্রদের নিয়ে চিন্তা করতেন। আপনারা বিশ্বাস করুন আর না-ই করুন, এটা একটা নিরেট সত্য কথা। আর এ যুগে এসে দেখছি যে শিক্ষকেরা কীভাবে অর্থ উপার্জন করবেন, সে চিন্তাই এখন বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি আমার নিজের স্কুলের অভিজ্ঞতা থেকে এটুকু বুঝতে পেরেছি। এটা খুবই দুঃখজনক।
যাক, আমি যে কথা বলছিলাম, সেটা বর্তমানের সঙ্গে তুলনা করার জন্য বলছি না। আমি অনেক সময় চিন্তা করি যে আমার যে শিক্ষক-ভাগ্য, এমনটা আর কজনের ভাগ্যে জুটেছে, আমি জানি না অথবা এ যুগেও সবাই যে ওই রকম ভাগ্যবান হবে, সেটা ভাবাও ভুল। আমার সহপাঠীদের যদি জিজ্ঞেস করেন, তাহলে একই রকম মন্তব্য পাবেন। আমি যেমন দেখেছি যে প্রতিটি ছেলেকে গড়ে তোলাই ছিল তখনকার শিক্ষকদের জীবনের একমাত্র সাধনা ও আদর্শ। আমি তো এর আগে বিন্দুবাসিনী স্কুলের হেডমাস্টার যোগেন্দ্র চক্রবর্তীর কথা আপনাদের কাছে বলেছি। তাঁর জীবনে আর কিছু ছিল না। আর সে কারণেই তিনি ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে একটি স্কুলের শিক্ষকতা করতে পেরেছিলেন। আর আমি খুশি হয়েছি যে ওই স্কুলের শতবার্ষিকী উত্সবে তাঁর পোর্ট্রেটটাই ছিল সবচেয়ে আকর্ষণীয়, যেটা তাঁরা তাঁদের সভায় রেখেছিলেন এবং প্রত্যেক বক্তাই তাঁর সম্বন্ধে বলেছেন। এই যে আমার বিন্দুবাসিনী স্কুলের অভিজ্ঞতা, আমি তাঁদের প্রত্যেকের নাম উল্লেখ করে বক্তব্য দীর্ঘায়িত করতে চাই না, আপনাদেরও বিরক্তি ঘটাতে চাই না। কিন্তু এ রকম একটি ইউনিফর্ম এক্সপেরিয়েন্স আমার জীবনে হয়েছিল। তাঁদের কোনো একটি দুর্বল মুহূর্তেও আমি কখনো কোনো শিক্ষকের কাছ থেকে কোনো ধরনের অবহেলা পাইনি। এটা টাঙ্গাইলের কথা, এটা বিন্দুবাসিনী স্কুলের কথা। দেখুন, প্রেসিডেন্সি কলেজে কোনো দিন স্ট্রাইক হয়নি, এখন হয়ে থাকতে পারে নিশ্চয়ই। কিন্তু আমি ১৯৪২ সালে এমএ পাস করে বের হওয়া পর্যন্ত প্রেসিডেন্সি কলেজে স্ট্রাইক হয়নি। কেবল একদিন হয়েছিল, ফজলুল হক তখন প্রধানমন্ত্রী।
প্রিন্সিপাল হিন্দু ছিলেন। আমি একটু এভাবে কথা বলছি, এই হিন্দু-মুসলমান প্রশ্ন তাতে আপনারা মনে করবেন না যে উনি এই কথাগুলো বললে সরাসরি বোঝার সুবিধা হয়। প্রিন্সিপাল হিন্দু, তাঁকে সবাই বিএম সেন বলে জানেন, ব্রজমোহন সেন। তাঁর তো মনে মনে খুশি হওয়া উচিত ছিল যে ফজলুল হকের মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে কলকাতার সব কলেজ রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তির দাবিতে হরতাল করল, তা প্রেসিডেন্সি কলেজের ছেলেরাও করেছে। অবশ্য মুসলিম লীগ ডমিনেটেড মিনিস্ট্রিটি বাতিল হয়েছে, তাতে তাঁর খুশি হওয়া উচিত ছিল; কিন্তু তিনি যে কাজটি করলেন, তার বর্ণনা একটু শুনুন আমার কাছে। আমার মনে কথাগুলো দাগ কেটে আছে, এগুলো আমি ওই একদিন শুনেছি এবং আজকে আমি সেগুলো পুনরাবৃত্তি করব। কিন্তু তাঁর ওই মৌখিক বক্তৃতা আরেকজন লোকের মনে যখন লেখা হয়ে থাকে, এটাও কিন্তু সেই শিক্ষকের প্রতি ছাত্রের শ্রদ্ধার কারণেই। তিনি পরের দিন লেকচার থিয়েটারে সব ছাত্রকে সে কথা বলেন। উনি বিজ্ঞানের শিক্ষক। কথা খুব আস্তে আস্তে বলেন। উনি ব্যক্তিগতভাবে আমাকে একদিন বলেওছিলেন, ‘আমি বক্তৃতা দিতে পারি না।’ কোথাও বক্তৃতা দেওয়ার দরকার নেই। কেননা, তাঁর অন্তর থেকে শব্দগুলো বেরিয়ে আসে। উনি পরের দিন লেকচার থিয়েটারে বললেন: ‘আই ওয়াজ স্ট্যান্ডিং অ্যাট দ্য উইন্ডো অব মাই অফিস অ্যান্ড ওয়াচিং পিপল অন দ্য কলেজ স্ট্রিট। আই ফাউন্ড দ্যাট দ্য ডক্টরস ওয়্যার অ্যাটেন্ডিং দেয়ার পেসেন্টস, ল ইয়ারস অ্যাট দেয়ার কোর্ট, বিজনেসম্যান ওয়্যার অ্যাটেন্ডিং দেয়ার ঔন বিজনেস, ট্রেড অ্যান্ড কমার্স, মাই স্টুডেন্টস ওয়্যার গ্যাদারিং নিয়ার মাই গেট। ইট শৌজ দ্যাট ইন দ্য সিটি অব ক্যালকাটা মাই স্টুডেন্টস হ্যাভ দ্য মোস্ট রিজার্ভড পিপল। ওয়েল, দিস ইজ নট দ্য ট্র্যাডিশন অব দ্য প্রেসিডেন্সি কলেজ। ইফ ইউ হ্যাভ কাম ফর স্টাডিস হেয়ার, ইউ মাস্ট ডু ইট নাউ অ্যান্ড প্রিপেয়ার ইউরসেলফ ফর দ্য ফিউচার। প্লিজ, ডোন্ট টেক ইট অ্যাজ প্রমিস। আই নো, মেনি অব ইউ পারসোনালি। আই নো, মেনি অব ইউর ফ্যামিলিজ অ্যান্ড আই হ্যাভ গিভেন দ্য সেম অ্যাডভাইস টু মণি সিংহ সেন অ্যাজ আই গিভিং ইউ। আই শ্যাল নট অ্যালাউ অ্যানি স্ট্রাইক ইন মাই কলেজ।’ তারপর তিনি তাঁর ফেল্ট হ্যাটটি তুলে মাথায় চাপিয়ে আস্তে করে বেরিয়ে চলে গেলেন। ওই যে কথাগুলো তিনি বলেছিলেন, একই কথা বলেছিলেন তিনি তাঁর ছেলেকেও। তিনি জোর দিয়েছিলেন ‘ছাত্রনং অধ্যয়নং তপঃ’। তাঁর একমাত্র পুত্র মণি সিংহ সেন পরে পরীক্ষা দিয়ে প্রতিযোগিতা করে আইসিএস পাস করেছিলেন এবং শেষের দিকে ভারত সরকারের কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থসচিব হয়েছিলেন। যা-ই হোক, এ রকম একটা পরিবেশ ছিল প্রেসিডেন্সি কলেজে।
৩. হিন্দু-মুসলমান সামাজিক সম্পর্ক
প্রশ্ন: ময়মনসিংহে ওই সময়ের হিন্দু রাজনীতিবিদ যাঁরা, তাঁদের সম্পর্কে কিছু বলুন।
আবু সাঈদ চৌধুরী: ময়মনসিংহের তখনকার হিন্দু রাজনীতিবিদদের সঙ্গেও আমার বাবার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠতা ছিল। সেটা এ কারণেই যে পিছিয়ে-পড়া এই মুসলমান জাতিকে সংগঠিত করতে হবে, তাদের উন্নতি করতে হবে, কিন্তু অন্যের ক্ষতি করে নয়—মুসলিম লীগ যাঁরা করতেন, তাঁদের এ রকমেরই মনোভাব ছিল। আমার বাবার মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার লেশমাত্র তাঁর সমগ্র জীবনে কেউ কখনো লক্ষ করেনি। একটি লোকও এ দেশে পাওয়া যাবে না যে বলবে, কোনোরকম সাম্প্রদায়িকতা তাঁর মধ্যে ছিল। তিনি মুসলিম লীগে থাকলেও ওভাবে ছিলেন না এবং সে কারণেই, লক্ষ করে দেখবেন যে বেশির ভাগ সময় তিনি ওখানে ডেপুটি প্রেসিডেন্ট থাকা মানেই তাঁকেও বেশ অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে চলতে হতো এবং কিছুটা দলগত স্বার্থের ওপরে থাকতে হতো সব সময়।
তিনি লেজিসলেটিভ এসেম্বলির উচ্চপরিষদে ডেপুটি প্রেসিডেন্ট অব কাউন্সিল ছিলেন। প্রথমবারে তো তিনি তিন বছরের জন্য ইলেক্টেড হলেন। তার পরেরবার ছয় বছরের জন্য ইলেক্টেড হলেন। সেবার তাঁর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন অধ্যাপক হুমায়ুন কবির। অথচ এ রকমটা আর কখনো হয়নি, যা নিয়ে তখন কৃষক পত্রিকায় আবুল মনসুর আহমদ ওই নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পর তাঁর চিরাচরিত প্রথায় একটা এডিটোরিয়াল লিখেছিলেন। তাতে তিনি বলেছিলেন, ‘আব্দুল হামিদ চৌধুরী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বঙ্গীয় আইনসভার উচ্চপরিষদে ডেপুটি প্রেসিডেন্ট পুনর্নির্বাচিত হইয়াছেন। তাহাকে আমরা অভিনন্দন দিতে বাধ্য এবং ডবল অভিনন্দন দিতে বাধ্য।’
আমি আপনাদের সেই সম্পাদকীয়টা দেখাব, আমার কাছে আছে। কেননা, তিনি মুসলিম লীগের নমিনেশন পেয়েছিলেন। অতএব, মুসলমান হিসেবে আমরা তাঁকে অভিনন্দন দিতে বাধ্য এবং তিনি বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির সমর্থন পেয়েছিলেন। তার জন্যও আমরা কংগ্রেসের ভাড়াটে হিসেবে তাঁকে অভিনন্দন দিতে বাধ্য। ব্যাপারটা হলো কি জানেন, শরত্ বোস এ রকম একটা নির্দেশ দিলেন যে মুসলিম লীগ যেখানে এমন একজন লোককে নমিনেশন দিয়েছে, যার ভেতরে, যাকে বলে দলগত বা সম্প্রদায়গত কোনো সংস্কার নেই এবং মুসলিম লীগ নির্বাচিত হবেই, সেখানে সেই জাতীয় লোকের সঙ্গে আমি কেন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করব? বরং আমরা দেখাই, লীগের তরফ থেকে এ জাতীয় লোক মনোনয়ন দিলে তেমন প্রশ্ন উঠবে না। তার পরও হুমায়ুন কবিরকে কেন মনোনয়ন দেওয়া হলো না, তার উত্তরে এ বিবৃতিই তিনি দিয়েছিলেন। সে কারণে আমরা হুমায়ুন কবিরকে সমর্থন দিলাম না। কারণ, হুমায়ুন কবির যদি নির্বাচিত হতেন, তাহলে অন্য রকম কিছু হতো। কিন্তু না, আমরা জানতাম যে তিনি নির্বাচিত হতে পারবেন না। এবং সিদ্ধান্তটা ছিল এ রকমের যে যাঁকে আমরাও পছন্দ করি, নির্বাচনে তাঁর বিরোধিতা করা উচিত নয়। ওই যে আবুল মনসুর সাহেবের সম্পাদকীয়র কথা বললাম, উনি আরেকটু টেনে নিয়ে বললেন যে এই কি প্রথমবার কংগ্রেস পরাজিত হতে যাচ্ছিল, যেটা অ্যাভয়েড করার জন্য এই ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। এ হলো এক নম্বর ব্যাপার। দুই নম্বর, ওই যে বললেন, ‘এমন একজন ব্যক্তিকে দিয়েছে, যাঁকে আমরাও পছন্দ করি’—এ রকম মন্তব্য আব্দুল হামিদ চৌধুরীর কাজে লাগবে, না তার বিরুদ্ধে যাবে—সেটাও ভেবে দেখার কথা। যা-ই হোক, সেটা তো ছিল ন্যাচারালই কৃষক প্রজা পার্টির পেপার; তার পরও দেখুন, তাদের এই বিরোধিতার মধ্যে বা ওই সম্পাদকীয়র মধ্যে রসিকতা ছিল, কিন্তু তিক্ততা ছিল না। সম্পাদকীয়টা দেখবেন, তাতে তাঁরা যখন তাঁদের কথাগুলো রেকর্ড করেছেন, একেবারেই তা তিক্ততাহীন। তখনকার দিনের রাজনীতি বুঝতে হলে এগুলো বুঝতে হবে।
প্রশ্ন: হিন্দু-মুসলমান কো-অপারেশন কী রকম ছিল?
আবু সাঈদ চৌধুরী: টাঙ্গাইল তো একেবারেই মুসলমানদের জায়গা; কিন্তু ছাত্র—আমার যতদূর মনে পড়ে, হিন্দুর সংখ্যা বোধ হয় বেশিই ছিল অথবা প্রায় সমান সমান। কিন্তু শিক্ষকদের প্রায় সবাই হিন্দু ছিলেন। এক-দুজন বাদে। ফারসি আর আরবি মৌলভি সাহেবেরা পড়াতেন। তাঁরা খুবই শ্রদ্ধাস্পদ মানুষ ছিলেন। তাঁদের সবাই খুব শ্রদ্ধা করত।
তারপর আমি ময়মনসিংহ চলে গেলাম। আমার বাবা তো—ওই যে বললাম আপনাকে, প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এসে তিনি লোকাল বোর্ডে কাজ করতে শুরু করলেন। ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের মেম্বার ছিলেন। ক্লাস সেভেনে যখন পড়ি, সেই নাইনটিন থারটি বা থারটি ওয়ানের সময় ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের ভাইস চেয়ারম্যান হন তিনি।
প্রশ্ন: তখনকার সামাজিক ব্যবস্থা, বিশেষ করে মুসলমানদের, টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহের দীপ্ত অবস্থা, সামাজিক অবস্থা, শহরে তাদের প্রাধান্য কী রকম ছিল বা ছিল না?
আবু সাঈদ চৌধুরী: আমার নিজের ধারণায় দেখুন, শহরগুলোতে তখন মিউনিসিপ্যালিটি হয়েছে, লোকাল বোর্ড হয়নি। কোথাও না। কেবল মিউনিসিপ্যালিটি হয়েছে। লোকাল বোর্ডের চেয়ারম্যানকে মুসলমান হতেই হবে—এমন কোনো ব্যাপার ছিল না। ঘোষণা করে সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি করার ব্যাপারটাই ছিল না, এখন যেমনটা হচ্ছে। এখন আর কোনো হিন্দু দাঁড়াচ্ছেই না। মোক্তার বলে এক ভদ্রলোক, আইনসভার সদস্য, একবার বোধ হয় টাঙ্গাইলে মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যানও হয়েছিলেন। আমার এ বিষয়টি খুব ক্ষীণভাবে স্মৃতিপটে আসছে। তখন সবাই এটা সহজভাবেই নিতেন যে মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান একজন হিন্দু হবেন। কোনো কোনো সময় মুসলমানও হয়েছেন। কিন্তু সত্যি বলতে কি, আমি হিন্দু-মুসলমানের যেটা সাম্প্রদায়িকতা, টাঙ্গাইলে তেমন কিছুই দেখিনি। রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা নেই, বার্তা নেই, লাগিয়ে দিলেন দাঙ্গা—এসব কিছু তখন দেখিনি। আপনিও দেখতে মানুষের মতো আর একজনও দেখতে মানুষেরই মতো। কিন্তু কে যেন বলে দিল তার হিন্দু নাম এবং তার মুসলমান নাম, অমনি তারা শুরু করে দিল মারপিট। এ ধরনের সাম্প্রদায়িকতা টাঙ্গাইল কেন, ময়মনসিংহেও চোখে পড়েনি, অন্য কোথাও পড়েনি। ১৯৪৬ সালে যখন এ রকম উন্মত্ত ব্যাপারস্যাপার কলকাতায় ঘটল, তখন ওই নারকীয় ব্যাপারটা আমাকে দেখতে হয়নি। কারণ, আমি তখন লন্ডনে ছিলাম। যা-ই হোক, মিউনিসিপ্যালিটিগুলোয় নেতৃত্ব করতেন তখন হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন। কিন্তু সেটাও মুসলমানরা এতটা সহজভাবে নিয়েছিলেন যে সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নই উঠত না। তা ছাড়া ব্যাপারটা নির্ধারিত হতো ভোটাভুটিতে। শহরে সবকিছু হতো গণতান্ত্রিকভাবে। এর মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা কোথায়? আর হিন্দুরা লোকাল বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে একজন মুসলমানকে নিলেও ভাইস চেয়ারম্যান কোনো কোনো সময় একজন হিন্দুও হতেন। যেমন ধরুন, ময়মনসিংহে পর্যন্ত জ্ঞানেন্দ্রনাথ দত্ত, তাঁকে ‘জ্ঞান দত্ত’ বলেই জানত লোকজন; পেশায় উকিল ছিলেন, অনেক দিন তিনি ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন। অত্যন্ত ভালো লোক ছিলেন রায় বাহাদুর উমেশচন্দ্র। দেখুন, সাম্প্রদায়িকতা যেভাবে মাঝেমধ্যেই কলকাতা ও ঢাকার মতো জায়গায় মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, আসলে আমি জানি না, কী করে এসব ঘটছে! আমি আসলে যেসব জায়গায় পড়াশোনা করেছি কিংবা থেকেছি, তার কোথাও আমি সাম্প্রদায়িকতা দেখিনি। আমাকে একজন ভদ্রলোক এক বিয়ের আসরে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আমি প্রেসিডেন্সি কলেজে কয় বছর পড়েছি? বলেছিলাম, ছয় বছর পড়েছি। পড়েছি আইএ থেকে এমএ পর্যন্ত।
সেটা নাইনটিন ফরটি সিক্সের কথা। ওই সময় আমি কখনো কোনো সাম্প্রদায়িকতা দেখিনি। এর অর্থ এই নয় যে আমি হিন্দুদের তোষামোদ করে বেড়াতাম। তাদের তোষামোদ না করার কারণেই হিন্দুরা আমাকে ভালোবাসত। বস্তুত, আমি সাম্প্রদায়িকতা দেখিনি। তাহলে তো ইতিহাসের বরখেলাপ করা হবে। আমি অল বেঙ্গল মুসলিম স্টুডেন্টস লিগের জেনারেল সেক্রেটারি ছিলাম। প্রায় একই সময়ে আমি প্রেসিডেন্সি কলেজেরও জেনারেল সেক্রেটারি হই। তার পরও আমি সাম্প্রদায়িক হতে পারিনি। ব্যাপারটা আমার বোধেই আসেনি। আমার বাবার চরিত্রের ধরনটা এ রকমের ছিল যে আমি আমার কর্তব্য করে যাব, অন্যের অশুভ কামনা করব না। এটা হিন্দুরাও বুঝেছিল, মুসলমানরাও বুঝেছিল এবং আমরা, মানে আমি যখন অল বেঙ্গল মুসলিম স্টুডেন্টস লিগের জেনারেল সেক্রেটারি ছিলাম, তখন আমি কেবলই চিন্তা করেছি যে আমাকে দিয়ে যেন হিন্দুদের কোনোরকম ক্ষতি না হয়। এই মনোভাব আমি পেয়েছিলাম আমার বাবার কাছ থেকে।
আমরা যেটা করতাম, তার নাম অল বেঙ্গল মুসলিম স্টুডেন্টস ফেডারেশন ছিল না। ওটার নাম ছিল অল বেঙ্গল মুসলিম স্টুডেন্টস লিগ। এটাই আসল সংগঠন ছিল। বোধ হয় ফজলুল কাদের চৌধুরীরা ফেডারেশন নামে একটা কিছু করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু ওটা দানা বাঁধেনি। ওটা পরের ব্যাপার এবং হলওয়েল মনুমেন্ট যখন অপসারিত হয়, তখন আমি ছিলাম অল বেঙ্গল মুসলিম স্টুডেন্টস লিগের জেনারেল সেক্রেটারি, আর ওয়াসেক সাহেব ছিলেন তার প্রেসিডেন্ট। তবে সেসব কথায় পরে আসা যাবে। সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে কথা বলতে গেলে বলতে হবে, আমি ব্যক্তিগতভাবে সাম্প্রদায়িকতার সংস্পর্শে কখনোই ছিলাম না। তবে সাম্প্রদায়িকতা কোনো কোনো জায়গা বা প্রদেশে ছিল। সেটা আমি দেখেছি। প্রেসিডেন্সি কলেজে কেন সাম্প্রদায়িকতা থাকবে! বারো শ ছাত্র ছিল। তার মধ্যে ১৩৫ জন ছাত্র মুসলমান। প্রেসিডেন্সি কলেজে যেসব হিন্দু ছেলে আসতেন, তাঁদের প্রত্যেকেই আসতেন বড় বড় সব গাড়িতে চড়ে; ধুতি আর পাঞ্জাবি পরে, দামি স্যান্ডেল পায়ে গাড়ি থেকে নামতেন। ধরা যাক, পাইকপাড়ার মহারাজার ছেলের কথা। তাঁর সঙ্গে কোনো মুসলমান ছেলের স্বার্থের সংঘাত লাগলে তো! তার অবকাশই ছিল না। তাহলে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ বাধতে যাবে কেন? যদি সংঘর্ষ না লাগে তাহলে তো দ্বন্দ্বই সৃষ্টি হয় না। উড়িষ্যার এক নেটিভ প্রিন্সের ছেলের কথাই ধরা যাক। সবাই তো আর একরকমের নয়। সাধারণ লোকজনের মধ্যে আসত। আর যে চুপ করে এক কোনার আসনে বসে থাকত, যেমন সত্যজিত্ রায়ের কথাই ধরুন, তার কী প্রয়োজন পড়েছে যে মুসলমানদের বিরুদ্ধে বসে বা দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দেবে?
প্রশ্ন: সত্যজিত্ রায় কি আপনার ক্লাসমেট?
আবু সাঈদ চৌধুরী: সত্যজিত্ রায় আমার ক্লাসমেট। তারপর ভাবুন সিদ্ধার্থ শংকর রায়ের কথা। তিনি তাঁর মায়ের কাছ থেকে গল্প শুনেছেন যে তাঁর নানা, অর্থাত্ তাঁর মাতামহ এ দেশে হিন্দু-মুসলমানের মিলন সৃষ্টির লক্ষ্যে জীবন উত্সর্গ করেছিলেন। হঠাত্ ইংরেজরা তাঁকে কী জানি কী বিষ খাইয়েছিল আর তার প্রতিক্রিয়ায় উনি আস্তে আস্তে নিস্তেজ হতে হতে দার্জিলিংয়ে মারা গেলেন। এখন ওই হিন্দু-মুসলমানের মিলন স্থাপনের কাজের ভার তাঁর নানা তাঁর ওপরেই দিয়ে গেছেন। একটু রসিকতার সুরেই কথাটা আমি বলছি; কিন্তু কথাটা সত্যি। সিদ্ধার্থ শংকর রায়, আমার সামনে, আমাদের সামনেই আমাদের সহপাঠী করিমকে—পরে পুলিশ অফিসার হয়েছিলেন, কিছুকাল আগে মারা গেছেন—বলেছিলেন, ‘এই দ্যাখ, প্রত্যেক ক্লাস থেকে রিপ্রেজেন্টেটিভ হিন্দু হবে নাকি রে? তুই দাঁড়া। আমি তোর হয়ে ক্যানভাস করব।’ এসব কথা এ কারণেই বলা।
প্রশ্ন: ওই সময় টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ এলাকায় আরও কিছু খ্যাতিমান ব্যক্তি ছিলেন, তাঁদের সম্পর্কে বলুন?
আবু সাঈদ চৌধুরী: নিশ্চয়, নিশ্চয়, যেমন পরেশ সান্যালের কথায় আসা যাক। ঠিক তাঁর সমবয়সী আরেকজন যুবক কীভাবে ওই একই সময়ে টাঙ্গাইলে আমাদের মতো কিশোর-তরুণদের অনুপ্রাণিত করেছেন, তাঁর কী রকম চরিত্র ছিল, সে কথা বলা যাক। তিনি রাজনীতি করতেন। কংগ্রেসে যোগ দিয়েছিলেন। তাঁর নাম ননী সেন। তিনি আমাকে নিজে বলেছিলেন যে তাঁর আঙুলের নিচ দিয়ে, তাঁর নখের নিচ দিয়ে যখন সুঁই চালিয়ে দেওয়া হয়েছে, তখন তিনি চুপ করে থাকার চেষ্টা করেছেন। চোখ থেকে যাতে পানি না পড়ে, সে চেষ্টা করেছেন। তো, সেই ধরনের লোক ছিলেন ননী সেন। তাঁর বাড়ি ছিল ঠিক কালিহাতী থানার কাছে। তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামের একজন নির্ভীক সৈনিক ছিলেন। তা ছাড়া খুবই নিবেদিতপ্রাণ সমাজকর্মীও ছিলেন। তার চেয়েও একটা বড় জিনিস বলব আপনাদের, যেটা বলার জন্যই বিশেষ করে ননী সেনের কথা উল্লেখ করছি। সেটা হলো যে কালিহাতীতে আপনারা সবাই গেছেন, দেখেছেন একটা নদী আছে। সেই নদীর পাড়ের গ্রামে একবার কলেরা লাগে। তখন আমি সেই জায়গার লোকজনের কাছ থেকে শুনি যে ননী সেন সেই বাড়িগুলোয় সশরীরে উপস্থিত হয়ে কলেরা রোগীদের সেবা করেছেন, তাদের কাপড়চোপড় নিজের হাতে ধুয়েছেন। উনি অনেকবার জেলেও গেছেন। কিন্তু তাঁর জেলে যাওয়ার চেয়ে আমি তাঁর ওই যে মানুষের সেবায় আত্মনিয়োগ করাকেই অনেক বড় কিছু বলে মনে করি। একেই বলে বীর্য। একে আমি একেবারেই বিরল ব্যাপার বলে মনে করি। জেলে যাওয়া এর চেয়ে অনেক সহজ। এ ধরনের যুবক এবং যুবনেতা টাঙ্গাইলের মতো জায়গায় তখন ছিল।
প্রশ্ন: এঁরা আদর্শ ব্যক্তিত্ব?
আবু সাঈদ চৌধুরী: এখন এ ধরনের চরিত্রের অধিকারী না হলে যুব সম্প্রদায়ই গড়ে উঠবে না। আর বৃদ্ধ এবং প্রৌঢ়দের মধ্যে, একটু আগেই বলেছি, চাঁদ মিয়া সাহেব অত্যন্ত সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে লালিত-পালিত, সেই মানুষটি, জানেন তো যে কংগ্রেসে যোগ দিয়েছিলেন এবং জেলেও গিয়েছিলেন। তারপর অবশ্য একটা সময় এল, যখন অনেক মুসলিম নেতা কংগ্রেস ছেড়ে দিলেন। সেই সময় উনিও ছেড়েছিলেন; কিন্তু কংগ্রেসের বিরোধিতা কোনো সময় করেননি। আর তখন তিনি ওই গ্রামীণ শিক্ষার প্রসার ও সমাজ সংস্কারের মতো কাজকর্ম নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন। আমার একটা সুবিধা ছিল এই যে ওই সময় যত লোকের সঙ্গেই আমি পরিচিত হয়েছি, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ এবং কলকাতায়, আমার বাবার মাধ্যমেই সেটা হয়েছি। আমার বাবার সুবাদেই আমি দেখা করতে গিয়েছি স্যার আব্দুল করিম গজনবীর শান্তিকুঞ্জের বাড়িতে। তিনি ব্রিটিশ আমলে ভাইসরয়ের এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের মেম্বার ছিলেন। তো উনি দেলদুয়ারে এলেন। আমার বাবাও দেলদুয়ারে গেলেন। সঙ্গে আমি। দেখলাম অত্যন্ত ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এই শ্রদ্ধাস্পদ মানুষটিকে। চাঁদ মিয়া সাহেবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তা ছিল। তাঁর ছেলে মাসুদ আলী খান পন্নী, যাঁর ডাকনাম নবাব মিয়া, তিনি ছিলেন গজনবী সাহেবের মেয়েজামাই। তাঁর মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন তিনি। চাঁদ মিয়া সাহেব আর গজনবী সাহেব, অর্থাত্ ওয়াজেদ আলী খান পন্নী ও স্যার আব্দুল করিম গজনবী—এঁরা বৈবাহিক সূত্রে আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন। এবং দুজনই মুসলমানদের উপকার করতে চান, দেশের উপকার করতে চান। একজন চান, দেশকে সম্পূর্ণ স্বাধীন করে তার ফল দেশের জনসাধারণের কাছে নিয়ে যেতে, দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করতে, ইংরেজকে বিতাড়িত করে দেশের সার্বিক ক্ষমতা সাধারণ মানুষের আওতায় নিয়ে যেতে। আর দ্বিতীয়জন মনে করলেন যে এ তো অনেক দূরের পথ। ফলে তিনি ইংরেজদের সঙ্গে সহযোগিতা করেই সমাজের উন্নতি করতে চেয়েছেন। স্যার আব্দুল করিম গজনবীকে আমি এভাবেই দেখেছি। নওয়াব আলী চৌধুরীর সঙ্গেও আমার বাবার অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। আমি যখন ভালো করে সব বুঝতে আরম্ভ করেছি, তার আগেই অবশ্য তিনি ইন্তেকাল করেছিলেন।
প্রশ্ন: তিনি ১৯২৯ সালে মারা গেছেন?
আবু সাঈদ চৌধুরী: হ্যাঁ, তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। আমার বাবার কাছ থেকে শুনেছি, তিনি অত্যন্ত আন্তরিক ও নিরহংকার মানুষ ছিলেন। ‘শরিফ’ শব্দটি তাঁর ক্ষেত্রে অনায়াসে ব্যবহার করা যায়। এ কথা কেবল তাঁর বংশের ঐতিহ্যের প্রেক্ষাপটে বলছি না, বলছি সামগ্রিক বিচারে। নওয়াবজাদা হাছান আলী চৌধুরীর সামাজিক আচার-ব্যবহারে আমরা নওয়াব আলী চৌধুরীর প্রায় হুবহু প্রতিফলন বা রিফ্লেকশন দেখতে পেয়েছি। স্যার আব্দুল করিম গজনবীর সঙ্গে আমার কলকাতায় কীভাবে দেখা হয়েছিল, সে কথা একটুখানি বলি। আমার বাবাকে উনি খুব স্নেহ করতেন। সে কারণেই তাঁর ওখানে আমাদের যাতায়াত ছিল। তা ছাড়া কলকাতা শহরে একটা সংগঠন আমরা গড়ে তুলেছিলাম। কলকাতা মহানগরীতে ময়মনসিংহের যেসব মুসলমান থাকতেন, তাঁদের একত্রে মিলিত হওয়ার জন্যই এ সংগঠনটি গড়ে তোলা হয়েছিল। তবে কোনোমতেই কোনো সাম্প্রদায়িক উদ্দেশ্য থেকে নয়। ওটার নাম ছিল ‘ময়মনসিংহ মুসলিম জেলা সমিতি’। সেই সংগঠনের সভাপতি করা হলো স্যার আব্দুল করিম গজনবীকে। সেক্রেটারি কে ছিলেন, এখন আর আমার ঠিক মনে পড়ছে না। আমি তাঁর অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ছিলাম। প্রথম দিকে আমি বছর দুয়েক বেকার হোস্টেলে ছিলাম। তারপর আমার বাবা ইলেক্টেড প্রেসিডেন্ট কাউন্সিলর হওয়ার পর থিয়েটার রোডে তিনি বাড়ি নিলে আমরা সেখানে থাকতে শুরু করলাম। ওখানে আমাদের নিজেদেরও বাড়ি ছিল। কিন্তু আমি যখন ওই মুসলিম অ্যাসোসিয়েশনের মিটিংয়ে যেতাম, তখন স্যার আব্দুল করিম গজনবী বেকার হোস্টেলে তাঁর গাড়ি পাঠিয়ে দিতেন। আমি সেখানে যেতাম, তাঁর গাড়িতে চেপেই। ঘরোয়া আসরের মতো কিছু একটা হতো সেখানে মাঝেমধ্যেই। যেমন: নজরুল ইসলামের জন্মবার্ষিকী সবাই পালন করছে, আমরা ময়মনসিংহের লোকজন তার থেকে বাদ যাব কেন? শেষ পর্যন্ত আমরা তাঁর পেছনে পেছনে ঘুরে নজরুল ইসলামকে ধরে নিয়ে এলাম। এ ধরনের কাজ ছিল। তারপর স্যার এফ রহমানকে ধরা হলো উনি একটা বক্তৃতা দেবেন বলে। ‘ময়মনসিংহ মুসলিম জেলা সমিতি’ ছিল একটা ক্লাবের মতোই। যদি এই কথা জিজ্ঞেস করেন যে মুসলমানদের পৃথকভাবে এমন কিছু করার দরকার ছিল কি না, সে ব্যাপারে আমি কিছু বলতে পারব না। কেননা, পৃথকভাবে কিছু করতে গেলেই ময়মনসিংহের মহারাজা এসে যেতেন, স্যার আব্দুল করিম গজনবীকেও তাতে রাখতে হতো। সেদিকে আমরা যাইনি। আমরাই কয়েকজনে বসে একান্ত ঘরোয়াভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে সংগঠনটা গড়ে তুলেছিলাম। বৃহত্তর কিছু করতে গেলে তো তার প্রেসিডেন্ট কে হবেন—ময়মনসিংহের মহারাজা সূর্যকান্ত, না অন্য কেউ, এসব কথাবার্তা চলে আসত।
প্রশ্ন: মুক্তাগাছার সূর্যকান্ত অথবা গৌরীপুরের আচার্য কিংবা সন্তোষের রাজা—এঁদের সম্পর্কে আপনি কী জানেন?
আবু সাঈদ চৌধুরী: মুক্তাগাছার সূর্যকান্ত অথবা গৌরীপুরের আচার্য কিংবা সন্তোষের রাজার মতো ব্যক্তিবিশেষের সঙ্গে বসে দীর্ঘ সময় ধরে আমি আমার দাদাদের গল্প করতে দেখেছি। কেননা, তাঁদের সবাই বয়স্ক মানুষ ছিলেন। আমি তো তাঁদের সঙ্গে গল্প করতে যেতে পারি না। আমি একমাত্র সন্তান হওয়ায় আমাকে আমার বাবা তাঁর সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন। তখনকার দিনে অনেক সময় ব্যাপারটা আমি ভালোও মনে করিনি। ব্রজেন্দ্রকিশোর আচার্য চৌধুরী তখন গৌরীপুরের জমিদার। ব্যক্তিত্ববান মানুষ। ছিলেন অতি ভদ্রলোক এবং দেশাত্মবোধও ছিল প্রখর। সেই দেশাত্মবোধ থেকেই তিনি টাকা দিতেন। এটা আমি তখনকার দিনের কংগ্রেস নেতাদের কাছ থেকেও শুনেছি। কম জমিদারই এটা করতেন। যেমন: ওয়াজেদ আলী খান পন্নী, চাঁদ মিয়া সাহেব—এঁরা তো যোগদান করতেন; কিন্তু এই ব্রজেন্দ্রকিশোর আচার্য চৌধুরী এবং মুক্তাগাছার জমিদার পরিবার ছিলেন দেশবন্ধুর প্রভাবে প্রভাবিত। জীবেন্দ্রকিশোর আচার্য চৌধুরী, যিনি এই দিন কয়েক আগেও আমার এখানে এসেছিলেন, আমি বলে একটা বই লিখেছেন, সেটা সবারই পড়া উচিত। ওই বইতে তত্কালীন জমিদারদের কীর্তিকলাপ (ওর ভেতরে আর কিছু নেই, ওই কারণেই এ নাম তিনি দিয়েছেন) জীবন বাবু যা কিছু দেখেছেন, দিয়েছেন তাঁরই বর্ণনা এ বইয়ে। কীভাবে ময়মনসিংহের রাজপরিবার, মানে এই জমিদার পরিবারগুলো কেমন আচরণ করত, সেসব কিছু তুলে ধরেছেন তার অংশীদার হয়ে। সে কারণেই তিনি বইটার নাম দিয়েছেন আমি। ওই আমিতে উনি লিখেছেন যে এখানে উনি আসতেন। আমার এখানে থাকতেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি প্রথম এসেছিলেন এখানে। বাংলা উন্নয়ন বোর্ডের আমি তখন চেয়ারম্যান। তখন ড. মুহম্মদ এনামুল হক, তিনি তখন বাংলা উন্নয়ন বোর্ডের ডাইরেক্টর ছিলেন, আমাকে একদিন বললেন যে এই বইগুলো তো পড়ে আছে মুক্তাগাছার জমিদারবাড়িতে। এভাবে থাকলে তো চুরি হয়ে যাবে। এগুলো কি আনা যায়? আমি আমার বাবাকে বললাম। তাঁর সঙ্গে ওই পরিবারের খুবই ঘনিষ্ঠতা ছিল। তিনি চিঠি লিখলেন কুমার জীবেন্দ্রকিশোর আচার্য চৌধুরীকে। তিনি তখন বহররমপুরে, যেখানে এত বড় একটা কাছারি ছিল, সেখানে তিনি গিয়ে আবার একটা ছোট কাছারি করেছেন, একটা হাইস্কুল করেছেন। এসব নিয়ে তিনি পড়ে থাকেন। ওখানে আমার বাবা চিঠি লিখতেই তিনি ঠিক ফেরত ডাকে উত্তর দিলেন এই বলে, ‘আমি খুব খুশি হলাম যে আমার বইগুলো শেষ পর্যন্ত রক্ষা পেল। আপনি এটাকেই লেটার অব অথরিটি মনে করে বাংলা উন্নয়ন বোর্ডকে বইগুলো নিয়ে আসতে বলুন।’
তারপর ড. এনামুল হক তাঁর লোকজন নিয়ে গিয়ে বই দেখলেন। তারপর ট্রাক বোঝাই করে আনলেন। গভর্নিং বডি থেকে হাজার পঞ্চাশেক টাকা মঞ্জুর করালেন। যেসব বই বাঁধানো দরকার, শেলফ তৈরি করা দরকার। সেসব কিছু করে খুব সুন্দর করে বইগুলো তিনি সাজিয়ে রাখলেন। তাঁদের একটি মাত্র অনুরোধ ছিল যে বইগুলো যেন আলাদাভাবে রাখা হয় এবং মুক্তাগাছার লাইব্রেরি হিসেবে যেন চিহ্নিত করা হয়। জীবেন্দ্রকিশোর আচার্যের পূর্বপুরুষ রাজা জগিকশোর লাইব্রেরিটা করেছিলেন। দেয়ালে টাঙানো ছবিটা দেখুন। তো, সেভাবেই ছিল বাংলা উন্নয়ন বোর্ডে। তারপর বাংলা উন্নয়ন বোর্ড আর বাংলা একাডেমী যখন একসঙ্গে মার্জ হয়ে যায়, তখন এই বইগুলো বাংলা একাডেমীতে এসেছিল। এলে আমি মঞ্জুরে মওলাকে এ সম্পর্কে বললাম। তিনি বললেন যে আমি তো ঠিক এ সম্পর্কে কিছু জানি না, স্যার। গ্রহণ করা সিদ্ধান্তমতে যাতে বইগুলো আমাদের এখানেও থাকে, সে ব্যবস্থা আমি নিশ্চয়ই করব। তিনি আমাকে আরও বলেছিলেন যে আমি জীবেন্দ্রকিশোর আচার্যকে নিমন্ত্রণ করব লাইব্রেরি সাজিয়ে। তিনি একবার এসে দেখে যান তাঁর বইগুলো কীভাবে আছে। তাতে করে তিনিও তৃপ্তি পাবেন, আমরাও তৃপ্তি পাব।
তারপর মঞ্জুরে মওলা বাংলা একাডেমী থেকে অন্যত্র চলে গেলেন। চলে গেলেন সচিবালয়ে। তখনকার দিনের রাজনীতি বুঝতে হলে এগুলো বুঝতে হবে।
একটু আগে মুক্তাগাছার জমিদার পরিবারের কথা বলছিলাম। তাঁদের কথা। ওই পরিবারের একজন জীবন বাবু। আমি যখন কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ি, তখন তিনি এসে ওই কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হন। ভারত ভাগের সময় ওই পরিবারের সবাই ভারতে চলে যায়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর জীবন বাবু বাংলাদেশে এসেছিলেন। তিনি মুক্তাগাছায় গিয়েছিলেন। তখন আমি শামসুল হুদাকে বললাম, ‘শামসুল হুদা, তুমি জীবনবাবুকে মুক্তাগাছা নিয়ে যাচ্ছ। বাংলা একাডেমীতে ওর যে বইগুলো আছে, ওকে সেগুলো একটু দেখিয়ে নিয়ে যাও।’ তখন সে বলল, ‘আচ্ছা, আমি এখনই ব্যবস্থা করছি।’ তারপর সে আবার আমাকে ফোন করল, ‘আমি ডিজিকে বলে দিয়েছি, সব ব্যবস্থা হবে।’ তারপর তিনি মুক্তাগাছা থেকে যেদিন এলেন, সেদিন বিকেলবেলাতেই বাংলা একাডেমীতে গেলেন। তাঁর লেখা আমি বইটি তিনি ওখানে গিয়ে দিয়ে এসেছিলেন। তাতে আপনি মুক্তাগাছার রাজপরিবারের সব কথা পাবেন। আর ওই যে মহারাজা শশীকান্তের কথা বললেন, সেই শশীকান্তকে আমি দেখেছি। দেখেছি শশীলজে। কুকুর-পরিবৃত হয়ে বাগানে ঘুরে বেড়াচ্ছেন তিনি। এবং আমাদের দেখতে পেয়েই বলে উঠেছেন, ‘চলো হাঁটি।’ তা আমি যেই বলেছি, ‘বাপরে বাপ, ওই কুকুরকে সঙ্গে নিয়ে কীভাবে হাঁটব!’ জবাবে তিনি বলেছেন, ‘না, না, এসো।’ তারপর হাঁটছেন, গল্প করছি। কলকাতার বাড়িতেও একই অবস্থা দেখেছি। আপনি এখন বলবেন যে আমি বুঝি জমিদারের প্রশংসা করছি। এ রকম কথা বললে আমি রীতিমতো মুশকিলে পড়ে যাব তাহলে। মনেই হতো না যে কোনোরকম জোতদার তিনি। সত্যি কথা বলতে কি, এতে কোনো অত্যুক্তি নেই। যাঁরা তাঁদের দেখেছেন, তাঁরা যদি বেঁচে থাকেন, তাঁরা আমার বক্তব্য সমর্থন করবেন। জীবন বাবু এখনো সেই বংশের ধারা বহন করে চলেছেন। সেবার জীবন বাবু গিয়েছিলেন বাংলা একাডেমীতে। আপনারা তো কেউ তাঁর সঙ্গে দেখা করেননি। যা-ই হোক, দেখা করলে আপনারা দেখতেন যে জীবন বাবু যে জমিদার, অর্থাত্ তাঁর জমিদারির আয় ১০ লাখ টাকা, সেটা তাঁর আচার-ব্যবহার, চালচলন থেকে বোঝার কোনো উপায় নেই। যাঁর বাড়িতে এক শটা হাতি ছিল, তার প্রতাপ তাঁর চেহারা কিংবা আচার-ব্যবহারে নেই। এখন জমিদারি চলে যাওয়াতেই যে এমন নম্র-ভদ্র হয়েছেন, তেমনটা ভাবারও অবকাশ নেই। আমি ঘনিষ্ঠভাবে মহারাজ শশীকান্তকে দেখেছি। দেখেছি, মহারাজা স্যার মন্মথনাথ রায় চৌধুরীকে। কেননা, আমার বাবা ছিলেন কাউন্সিলের ডেপুটি প্রেসিডেন্ট। আর তিনিও তখন কাউন্সিলে। আগে তিনি কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। মহারাজা স্যার মন্মথনাথ রায় চৌধুরী কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট হিসেবে কনস্টিটিউশনালিজম সম্পর্কে ভালো জানতেন বলে একটা খ্যাতি হয়েছিল তখনকার ভারতবর্ষজুড়ে। স্পিকারের কর্তব্যকর্ম সম্পর্কে তাঁর জ্ঞানগম্যি ছিল গভীর। আর আমার বাবাও পার্লামেন্টারি ডেমোক্রেসি খুবই ভালোবাসতেন এবং স্পিকারের যা ঐতিহ্য বা কর্তব্যকর্ম, সেটা তিনি এস্টাবলিশ করার জন্য খুবই চেষ্টা করেছেন। আমি ওঁর সম্পর্কে একটি মাত্র ঘটনার কথা বলছি। পাকিস্তান আমলে, একদিন তিনি হাউস অ্যাডজর্ন করে দিয়েছিলেন পরের দিন হাউসে কাজ ছিল না বলে। কে গভর্নরকে বুদ্ধি দিয়েছেন, ‘দেখ, কাজ নেই আর গিয়ে কী হবে, এখন একটা এক্সট্রা অর্ডিনারি গেজেট করে হাউস ফোল্ডআপ করে দাও।’ সেই মতো রাতারাতি এক্সট্রা অর্ডিনারি গেজেট করে হাউস মুলতবি করে দিলেন। কিন্তু ১৯৬২ সালের কনস্টিটিউশনে ছিল যে গভর্নর বা প্রেসিডেন্ট হাউস মুলতবি করলেও টু-থার্ড মেম্বার যদি হাউস সমর্থন করেন, তাহলে স্পিকার ইচ্ছে করলে হাউস চালিয়ে যেতে পারেন। মেম্বাররা যদি এটাকে হাউসের প্রতি, মানে সংসদের প্রতি গভর্নরের অন্যায় ব্যবহার হিসেবে নেন, তাহলে তাঁরা সংসদ রিকুইজিশন করতে পারবেন। করলেনও। রিকুইজিশন করার সঙ্গে সঙ্গে আমার বাবা গভর্নরকে কিছু জিজ্ঞাসাও করলেন না, তিনি হাউস কল করে দিলেন। তারপর হাউস বসল। এই উপমহাদেশে হাউস স্পিকার শাসন করেছেন, এ রকম ঘটনা এ ছাড়া আর ঘটেনি। তো, এ কারণেই মহারাজা স্যার মন্মথনাথ রায় চৌধুরীর সঙ্গে আমার বাবার খুব ঘনিষ্ঠতা ছিল। কেননা, তাঁরা পার্লামেন্টারি ট্র্যাডিশনস নিয়ে অনেক আলোচনা করতেন। মহারাজা শশীকান্ত ছিলেন একেবারে বাঙালি আর স্যার মন্মথনাথ রায় চৌধুরী পাশ্চাত্য-ঘেঁষা কালচার্ড ম্যান বলতে যা বোঝায়, তা-ই ছিলেন।
গৌরীপুরের ব্রজেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী আর তাঁর ছেলে বীরেন্দ্রকিশোর পর্যন্ত সংগীতের খুবই অনুরাগী ছিলেন। তাঁকে আমি নিজে দেখেছি, বাড়িতে গিয়ে তিনি বসে বসে বেহালা কিংবা সেতার বাজাচ্ছেন। তিনি যন্ত্রসংগীতে খুবই পারদর্শী ছিলেন। সারাক্ষণ সংগীত নিয়েই পড়ে থাকতেন। আবার উচ্চপরিষদের সদস্যও ছিলেন। ছিলেন আমার বাবার সহকর্মী। তো, সে হিসেবে বাবার সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতাও ছিল।
প্রশ্ন: এখানে একটা ভিন্ন প্রশ্ন করছি। ওস্তাদ এনায়েত খানকে গৌরীপুরে দেখেছেন?
আবু সাঈদ চৌধুরী: না, গৌরীপুরে ওস্তাদ এনায়েত খানকে আমি দেখিনি। আমি তাঁদের বাড়িতে, অর্থাত্ কলকাতার গৌরীপুর হাউসে, যেটা ওই বালিগঞ্জে, সেখানেও গেছি। গৌরীপুরেও গেছি তাঁদের বাড়িতে। কিন্তু তখন ওস্তাদ এনায়েত খাঁ সেখানে ছিলেন না।
প্রশ্ন: সাম্প্রদায়িকতার কোনো ব্যাপার ছিল কি?
আবু সাঈদ চৌধুরী: না, সাম্প্রদায়িকতার একেবারেই অস্তিত্ব ছিল না। আমার জানামতে, কোনো ছাত্রের মধ্যেও না। আরেকটি কথা, আপনাদের আমি সেদিন বলেছি, সাম্প্রদায়িকতার লেশমাত্র ছিল না, এটা আমার অভিজ্ঞতা এবং দু-একজনের কাছে এই কথা বলতেই তাঁরা সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন এই বলে, এ-ও কি সম্ভব! বিশ্বে প্রেসিডেন্সি কলেজ কি একটি দ্বীপের মতো কিছু ছিল? দেশে তো সাম্প্রদায়িকতা ছিল এবং আমিও কথাটা ঠিক বললাম কি না, সে জন্য ঢাকা শহরে আমার যে কয়েকজন মুসলমান সহপাঠী আছে, আমি তাদের জিজ্ঞেস করেছি, অকপটে তোমরা বলো যে কোনো শিক্ষকের ব্যবহারে সাম্প্রদায়িকতার লেশমাত্র ছিল কি না। প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রায় সবাই হিন্দু শিক্ষক ছিলেন। কুদরাত-এ-খুদা ভাইস প্রিন্সিপাল ছিলেন। কেন, তসলিম উদ্দিন আহমদকে জিজ্ঞেস করুন না। তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম স্বরাষ্ট্রসচিব হয়েছিলেন। তিনি আমার সহপাঠী, তাঁকে জিজ্ঞেস করুন, আমি নিজেই তাঁকে জিজ্ঞেস করেছি। কমান্ডার এরফান আহমদ, সত্যজিত্ রায়—তাঁরা এত গভীর উদার মনের মানুষ ছিলেন যে তাঁরা সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে ছিলেন। কমান্ডার আহমদ তো আমার সহপাঠী ছিলেন। উনি বেঁচে নেই, তাই তাঁকে জিজ্ঞেস করতে পারবেন না। কিন্তু তিনি তো কোনো দিন কোনো সাম্প্রদায়িকতার কথা বলেননি। তারপর এখানে শাহ মোহাম্মদ ইসরাইল হক আছেন, সৈয়দ আহমদ আমার সহপাঠী। সৈয়দ আহমদকে চিনতে পেরেছেন? ইনফরমেশন সেক্রেটারি ছিলেন। তাঁকে আমি জিজ্ঞেস করেছি। তাহলে সাম্প্রদায়িকতার প্রভাব কীভাবে এল? ওই যে সেদিন বললাম, মুসলমানদের রাজত্ব চলে গেল। তারা ইংরেজদের পুরোপুরি বয়কট করল। হিন্দুরা করল না। এটা কিন্তু ঠিক, যারা চাকরি-টাকরির জন্য দরখাস্ত দিয়েছে, তারা বলেছে, ‘আমার চাকরিটা হলো না।’ কারণ, অবিভক্ত বাংলায় তখনকার দিনে সব অফিসেই চাকরি দেওয়ার মতো পদে সাধারণত হিন্দুরাই অধিষ্ঠিত ছিলেন। বস্তুত, সেসব জায়গাতেই গোলমাল হয়েছিল। কিন্তু প্রেসিডেন্সি কলেজ, জিলা স্কুল, বিন্দুবাসিনী স্কুলের পরিবেশ ছিল অন্য রকম।
তারপর আপনারা আমার পরিবার সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন। সে কথা বলতে গেলে আমাকে একটি কথা বলতে হবে যে আমি আমার মা-বাবার একমাত্র সন্তান হওয়ায় তাঁরা তাঁদের মনের মতো করে আমাকে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। আমি কী হয়েছি, সেটা একদম অবান্তর কথা। যেটা বাস্তব, সেটা হলো তাঁদের চেষ্টায় কোনো ত্রুটি ছিল না। বিশেষ করে, আমার মাকে আমি দেখেছি কোন রূপে, সেটাই বোধ হয় বলা দরকার। আমি রবীন্দ্রনাথের কবিতাটির বর্ণনামতো আমার মাকে আমার জন্মের পর থেকে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত লক্ষ্মী আর কল্যাণী—এই রূপে দেখেছি এবং এ কথা আমি তাঁকে বিলেত থেকে একটি চিঠিতে লিখেছিলাম যে রবীন্দ্রনাথ তো কল্পনায় দেখেছিলেন মায়ের এই রূপ; তো, আমি তোমাতে সেটা দেখছি। উনি আমার মনটিকে গড়ে তোলার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন। উনি হিন্দু-মুসলমান—এ প্রশ্ন তো দূরের কথা, কোনো মানুষের মনে ব্যথা দেওয়ার কথা বলতে গিয়ে আমাকে বারবার বলেছেন, মসজিদ ভেঙে দেওয়া আর মানুষের মনে ব্যথা দেওয়া একরকমের অপরাধ। আরেকটি কথা বলেছেন, জীবনে কখনো সত্য থেকে বিচ্যুত হতে নেই। তাঁর নিজের জীবনেও আমি সেটা দেখেছি। তিনি এলাচিপুরের এক সম্ভ্রান্ত বংশের মেয়ে। সম্ভ্রান্ত এ কারণে যে ওই গ্রামের প্রতিটি বাড়ির প্রত্যেকেই শিক্ষিত ছিলেন এবং সেই নবাব-বাদশাদের আমল থেকেই তাঁদের অনেকে চাকরি-বাকরিও করতেন। তাঁদের মধ্যে ছিল আরবি-ফারসির চর্চা। তা ছাড়া আমার মা বঙ্কিমচন্দ্রের নভেল-টভেল পড়তেন। আমাকে তিনি গল্পচ্ছলে একবার বলছিলেন যে তাঁর মুরব্বিরা তাঁকে ওই সব বাংলা নভেল-টভেল পড়তে দেখলে অসন্তুষ্ট হতেন। তাই তিনি সেগুলো লুকিয়ে লুকিয়েই পড়তেন। তো, তাতে করে আপনারা বুঝতে পারেন যে আমার শৈশবকালে সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে বাংলা নভেল ইত্যাদি পড়া সহজ ছিল না।
আরেকটি কারণে আমার মনে কখনো হিন্দু-মুসলিম—এ প্রশ্নটা ওঠেনি। কেননা, আমাদের বাড়িতে সে সময় অন্তত কুড়ি-পঁচিশজন হিন্দু কর্মচারী ছিলেন। কর্মচারীদের বেশির ভাগই ছিলেন হিন্দু। আর ম্যানেজার তো হিন্দু ছিলেনই। কারণ, আমার পিতামহ একাদউদ্দিন সাহেব বুঝতে পেরেছিলেন যে এঁদের সবাই জমিটমির কাজ ভালো বোঝেন। এর সঙ্গে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই। তিনি ধার্মিক লোক ছিলেন। প্রতিদিন শেষ রাতে উঠে তাহাজ্জতের নামাজ পড়তেন; কিন্তু তাঁর ম্যানেজার ছিলেন হিন্দু। এবং এ রকমের পরিবেশেই আমার শৈশব কেটেছে। তা ছাড়া সবাইকে সমান চোখে দেখার ব্যাপারটা আমার স্বভাবে দাঁড়িয়ে গেছে।
অনুলিখন: রীতা ভৌমিক