১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট মধ্যরাতে পাকিস্তানের জন্ম হয় এবং ভারতের পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত বাংলা প্রদেশকে ভাগ করা হয়। এই দ্বিখণ্ডিত প্রদেশটির পূর্বাংশ পূর্ব পাকিস্তান নামে পরিচিত হয়। ব্রিটিশরাজের কাছ থেকে স্বাধীনতাপ্রাপ্তি বা ভারতবিভক্তি, যা-ই বলা হোক না কেন, সম্ভবত এটিই হলো দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বাঁক। যেহেতু ঐতিহাসিক ঘটনার সূচনামুহূর্ত এবং সমাপ্তির কোনো নির্দিষ্টতা নেই, কাজেই এসবের সঠিক দিনক্ষণ শনাক্ত করাও অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার। দেশ বিভাগ মানুষের স্মৃতিতে এখনো বেঁচে আছে যতটা না ঐতিহাসিক নথিপত্রের মাধ্যমে, তার চেয়ে অনেক বেশি দেশ বিভাগের কারণে বিপর্যস্ত সেই সব ভুক্তভোগী পরিবারের বারবার কথিত বাস্তব জীবনকাহিনির আলাপচারিতায়। পূর্বপুরুষের ভিটা দেখতে গিয়ে প্রতিবারই এসব মানুষের মনে জেগে ওঠে দেশ বিভাগের স্মৃতি।
আমাদের অনেকেরই হয়তো সিপিএমের পশ্চিমবঙ্গীয় চিফ মিনিস্টার জ্যোতি বসু ও তাঁর স্ত্রীর বৃহত্তর ঢাকা জেলায় তাঁদের পৈতৃক নিবাসে বাংলা ভাগের পর প্রথম আগমনের কথা স্মরণে আছে। বসু পরিবারের দেশের মাটি ছোঁয়ার সময়কার আবেগময় প্রতিক্রিয়ার কথা সেই সময় একটি সাপ্তাহিকী অত্যন্ত অনুপুঙ্খভাবে বর্ণনা করেছিল। এমনকি যেখানে একসময় তাঁর শ্বশুরকুলের পূর্বপুরুষেরা তাঁদের দৈনন্দিন পূজা-আচার সম্পন্ন করতেন, সেই পরিত্যক্ত মন্দির থেকে জ্যোতি বসুর স্ত্রী দেশে ফিরে যাওয়ার সময় স্মৃতিস্বরূপ এক মুঠো মাটি নিয়ে গিয়েছিলেন। পূর্বপুরুষের এই নিবাস-দর্শনকে ঘিরে তাঁর মধ্যে বহু সংবেদনশীল অনুভূতির জন্ম হয়েছিল এবং তাঁর এই অভিজ্ঞতার প্রতিক্রিয়ার প্রকাশ ছিল একান্তই ধর্মীয়। পূর্বপুরুষের ভিটার মাটি তাঁর কাছে হয়ে উঠেছিল পবিত্র। সেই সাপ্তাহিকীর একই সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল সম্পাদকের কাছে লেখা একটা চিঠি। সেখানে বর্ণিত হয়েছিল বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী একটি জেলা সাতক্ষীরার একটি ঘটনা। এই ঘটনা চিঠির লেখককে অত্যন্ত বিস্মিত করেছিল। একবার তিনি দেখেছিলেন যে ওখানকার একটি ব্যাংকে ঢোকার সময় একজন শ্মশ্রুমণ্ডিত বৃদ্ধ মুসলমান জুতা খুলে ঢুকছেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ব্যাংকটি অবস্থিত ছিল ওই এলাকার এক হিন্দু জমিদারের পরিত্যক্ত ভবনে। কৌতূহলবশত পত্রলেখক বৃদ্ধকে তাঁর এ রকম আচরণের কারণ জিজ্ঞেস করেন। প্রতি-উত্তরে বৃদ্ধ লোকটি বলেন, ‘এই বাড়ি আমাদের জমিদারের। আমরা জুতা পায়ে কখনো এর চত্বরে প্রবেশ করিনি। যদিও তাঁরা বহুদিন হলো এ দেশ ছেড়ে চলে গেছেন, তবু আমি আগের মতোই এই বাড়ির প্রতি আমার সম্মান প্রদর্শন বজায় রেখেছি।’ এভাবে প্রজা ও জমিদারের মধ্যকার ক্ষমতার সম্পর্কের স্মৃতির মধ্য দিয়ে দেশ বিভাগের চিহ্ন রয়ে গিয়েছে। দেশ বিভাগ—বহুজনের দৃষ্টিকোণ থেকে হলো ছেলেবেলার গল্প—‘আমার গ্রাম, আমার শিশুকাল, আমার সন্তানের জন্মের সময়’। দেশ বিভাগ নির্দ্বিধায় দুই বাংলার বেশির ভাগ মানুষের জীবন-ইতিহাস নির্মাণে একটি উল্লেখযোগ্য প্রসঙ্গ। ‘দেশভাগের সময়’ বা ‘পাকিস্তানের বছর’ প্রভৃতি হলো লোকমুখে দেশ বিভাগের প্রচলিত অভিব্যক্তি।
‘দেশ বিভাগ’ সরকারি ইতিহাসে আলোচিত হয়েছে সাংবিধানিক ইতিহাসের পরিভাষায়, নতুন সৃষ্ট দুই রাষ্ট্রের মধ্যকার বিতর্ক; নেহরু, গান্ধী ও জিন্নাহর মধ্যকার সমঝোতা ও বিরোধিতা; কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যকার ক্রমবর্ধমান বিভাজন প্রভৃতিতে। অথচ সীমান্তের দুই পারের বাসিন্দা সাধারণ মানুষের জীবনের বিপর্যয় ও অভিজ্ঞতাকে তুলে ধরার সে রকম কোনো চেষ্টাই নেওয়া হয়নি। মনে রাখা দরকার, ভারতের বিভক্তিকরণ শুধু একটি সাংবিধানিক দেশবিভক্তিতেই নিষ্পত্তি হয়নি, বরং বহু ক্ষেত্রেই তা ছিল অসংখ্য ঘরগেরস্তালি, পরিবার ও মানুষের জীবনের মর্মান্তিক ব্যবচ্ছেদ। জ্ঞান পাণ্ডের মন্তব্য অনুযায়ী, ভারতীয় ইতিহাসচর্চায় দেশবিভক্তির অবস্থান স্ববিরোধী।
একদিকে জাতীয়তাবাদী এবং পেশাদার ঐতিহাসিকদের চেতনাবোধে দেশভাগ অনেকখানি আধিপত্য বিস্তার করেছিল। এর মূল কারণটি খুবই স্পষ্ট। এই উপমহাদেশের ইতিহাসে ভারতবিভক্তিকে বলা চলে বিশ শতকের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা। স্বাভাবিকভাবেই ‘সাম্প্রদায়িকতা’র ইতিহাসবেত্তারা অর্থাত্ উনিশ ও বিশ শতকের হিন্দু ও মুসলিম রাজনীতির ইতিহাস-রচয়িতারা এমনভাবে ইতিহাস লিখেছেন যে মনে হয় সবটাই যেন দেশবিভক্তির পূর্ব ইতিহাস। এর একই সমান্তরালে ভারতীয় জাতি ও তার জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বের জন্য ‘ভারতের সরকারি ইতিহাস ছিল অন্যতম সংকটের বিষয়’। এটি ছিল দেশভাগের ঘটনাবলির আড়ালে ঢাকা পড়া এক ষড়যন্ত্রের ইতিহাস, ভবিষ্যতের জাতির জন্য যেখানে রয়ে গেছে বহু শিক্ষণীয় বিষয়। এই ইতিহাস কখনোই সেই সব মানুষের জীবন আর অভিজ্ঞতার কথা ধরে রাখেনি, যাঁরা সেই সংকটকাল পাড়ি দিয়েছেন; এই ইতিহাস লেখেনি কীভাবে চল্লিশের দশকের ঘটনাপ্রবাহ তাঁদের মনে ছাপ ফেলেছে; উল্লেখ করেনি এই গণমানুষের পরিচিতির সংকট আর অনিশ্চয়তার কথা, যা দেশভাগের কারণেই তাঁদের জীবনে সৃষ্ট বা আরোপিত। সুমিত সরকার লিখেছেন, শুধু ব্রিটিশ, কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের আলাপ-আলোচনা প্রসঙ্গেই রয়েছে এক বিশাল পরিমাণ নথিপত্র, যার চূড়ান্ত পরিণতি হলো এমন এক স্বাধীনতাপ্রাপ্তি, যা ছিল পক্ষান্তরে এক ট্র্যাজিক দেশ বিভাগ।
মাতৃভূমি থেকে উত্খাত হওয়ার বাস্তবতা, উদ্বাস্তু সহস্র মানুষের দেশত্যাগ, সাম্প্রদায়িক ধর্ষণ, অপহরণ, বলপূর্বক ধর্মান্তরিতকরণ প্রভৃতি নির্মম ঘটনা দিয়ে নির্মিত হয়েছে দেশ বিভাগ নামক দেশ ব্যবচ্ছেদ, যা সংঘটিত হয়েছিল একটি নির্দিষ্ট কালব্যাপী এবং অব্যাহত থেকেছিল সরকারিভাবে বিভক্তিকরণের প্রায় অনেক দিন পর পর্যন্ত।
যদিও ভারতের জন্য দেশভাগ অবধারিতভাবে হয়ে উঠেছিল হারানোর আখ্যান, কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের নাগরিকত্বপ্রাপ্ত বহু মুসলমানের জন্য ওই সময় ছিল অত্যন্ত উচ্চাশা এবং নজিরবিহীন সামাজিক উত্থানের সময়। অতএব সাতচল্লিশ-উত্তর সরকারি ঘটনাপ্রবাহ এসব আনন্দোন্মাদনাপূর্ণ মুহূর্তে ভরা। নতুন মাতৃভূমি অর্জনের আনন্দে পূর্ব বাংলার উচ্চবর্গীয় মুসলিম জনগণ ওই মুহূর্তের সাক্ষ্যপ্রমাণ, হিন্দু জনগণের হারানোর দুঃখ কিংবা দুর্ভোগের ইতিহাসের চিহ্ন নথিপত্র থেকে মুছে ফেলেছিল। একই সঙ্গে উচ্চবর্গের বিবরণীতে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের স্বপ্ন এবং আকাঙ্ক্ষাকে তাদের নিজস্ব প্রকল্পের সঙ্গে এক করে দেখা হয়েছিল।
এবার সেই সময়কার উচ্চবর্গীয় শ্রেণীর কার্যকলাপে তাদের আনন্দোন্মাদনার নজিরের দিকে একটু দৃষ্টি দেওয়া যাক। ‘আজকের মধ্যরাতই ব্রিটিশ শাসনের শেষ রজনী এবং ভারতের স্বাধীন এবং স্বতন্ত্র সরকার ও শাসনামলের সূচনা।’ চল্লিশের দশকের এক তরুণ মুসলিম জাতীয়তাবাদী তাজউদ্দীন আহমেদ ১৯৪৭-এর ১৫ আগস্টে লেখা তাঁর ডায়েরির পাতায়, সদ্য রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া আর আনন্দকে এভাবেই তুলে ধরেছেন। তিনি ডায়েরির পাতার একদম ওপরে ‘স্বাধীনতা’ কথাটা বড় হরফে লিখেছিলেন, যা তাঁর সব আবেগ-অনুভূতির জমাটবদ্ধ প্রকাশ। তাঁর লেখাতেই জানা যায়, সেদিনকার উত্সবমুখর পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক রাজধানী ঢাকার বর্ণনা। ঢাকা শহরের মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় অধিবাসীরা দিন-রাত ব্যস্ত থেকেছে স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপনের উদ্দেশ্যে তোরণ নির্মাণ, সাজসজ্জা প্রভৃতির প্রস্তুতি নিয়ে।
একজন প্রখ্যাত জেলা পর্যায়ের কংগ্রেস নেতা প্রভাষচন্দ্র লাহিড়ীর বক্তব্যেও এর সমর্থন মেলে, ‘উত্তরবঙ্গের জেলা রাজশাহীতে আগত অগণন মানুষের প্রতিটি মুখ উদ্ভাসিত ছিল বহু আকাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতার বিজয়ানন্দে।’ তাজউদ্দীনের দিনলিপিতে আকর্ষণীয় বর্ণনায় উঠে এসেছে স্বাধীনতা ও মুক্তির আনন্দে মুখরিত সেদিনকার উত্সবমুখর প্রাদেশিক শহর ঢাকার জীবন্ত ছবি। এই বিপুল আনন্দ-উচ্ছ্বাস প্রকাশের জন্য ব্যবহূত হয়েছে ‘জাতীয় শক্তির বিস্ময়কর প্রকাশ’, ‘আনন্দোন্মাদনা’ প্রভৃতি অভিব্যক্তি।
বোঝাই যায়, এই বিজয়োত্সবের দর্শকদের ‘আনন্দোন্মাদনা’ ছিল একমাত্রিক। রাজনৈতিক মুক্তির মুহূর্তে জনগণের এই বিচিত্র ধরনের প্রতিক্রিয়াকে জাতীয়তাবাদীরা প্রায়ই এক সহজাত গভীর আনন্দবোধ হিসেবে বিবেচনা করেছেন। এক মুসলিম কবি স্বাধীনতা অর্জনের আনন্দে শরিক হতে গিয়ে পাকিস্তানকে অভিহিত করেছেন ‘চির ঈদের দেশ’ হিসেবে। অবশ্য এই গণহারে আনন্দোত্সব পালনের হিড়িক দেখে এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই যে স্বাধীনতার আগমন উদ্যাপনকারী সব মানুষই এক ও অভিন্ন অনুভূতির সমান ভাগীদার। কেননা ‘পাকিস্তান’কে ঘিরে থাকা বিভিন্ন ও বিপরীত প্রত্যাশাগুলোকে ‘আনন্দোন্মাদনা’ কথাটি একই সঙ্গে প্রকাশ ও আড়াল করে।
এমনকি জাতীয়তাবাদী রচনা এবং বক্তব্য এ দিনকে ১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে নবাবের পরাজয়ের পর থেকে সংঘটিত সব আন্দোলনের শীর্ষ মুহূর্ত হিসেবে অভিহিত করেছে। আবার অন্যপক্ষ একে ১৮৫৭-এর ব্যর্থ অভ্যুত্থানের কালক্রমে স্থাপন করেছে, ‘স্বাধীনতার জন্য তাদের অবচেতনভাবে প্রায় এক শতাব্দী প্রতীক্ষা করতে হয়েছিল।’ ‘পাকিস্তান—প্রতিশ্রুতির ভূমি, আশার ভূমি, সহস্র মানুষের জীবনের বিনিময়ে প্রাপ্ত যে দেশ’, জাতীয় সাহিত্যের পাতায় তখন এ ধরনের বক্তব্যের ছিল অবিরাম ছড়াছড়ি। কিন্তু এসব অত্যুক্তি মুসলিম লীগের চারপাশে ভ্রাম্যমাণ হাজার হাজার মানুষকে পরিণতিতে শ্রেণী ও ধর্মীয় বিভেদবর্জিত এক অভিন্ন মুসলিম জাতির ভ্রান্ত চেহারা ও ভাবমূর্তি দিয়েছিল।
একটি সূচনার ধারণাকে প্রকাশ করার জন্য ‘ইতিহাসের এক নতুন যুগ’ এবং ‘সূর্যোদয়’ প্রভৃতি উপমা ব্যবহার করা হতো। বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসন অত্যন্ত সঠিকভাবেই ‘প্রভাত’, ‘আলো’, ‘সূর্য’ প্রভৃতিকে শনাক্ত করেছেন ‘পুনরুজ্জীবন’, ‘পুনর্জন্ম’ ইত্যাদির প্রতীক হিসেবে, যখন জাতীয়তাবাদীদের জীবন পৃথিবীর অগ্রযাত্রার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছিল। সেটি ছিল এমন এক সময়, যখন মানুষের আশা বহুদিকে ছুটছিল। জাতীয়তাবাদী পণ্ডিতেরা এই জটিল প্রপঞ্চের প্রায়ই সরলীকরণ করেছেন।
এবার এসব জটিল প্রতিক্রিয়ার দিকে আলোকপাত করা যাক। ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলন মুসলিমদের আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবিকে সমর্থন দিত। একই সঙ্গে জাতীয় পর্যায়ে মুসলিম লীগের প্রতিনিধিত্বের দাবিকে তারা গ্রহণ করেছিল। কিন্তু পাকিস্তান বাস্তবায়নের সঙ্গে সঙ্গে কমিউনিস্টদের মোহভঙ্গ হয়। জাতীয়তাবাদীদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ক্রমেই হয়ে ওঠে স্পর্শকাতর এবং পরিণামে এক সময় তারা ভিন্ন পথ বেছে নেয়। শুধু পৃথক পথে বিচ্ছেদ নয়, তারা তখন পরস্পরের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। সেই সময় কমিউনিস্টদের স্লোগানে উচ্চারিত হয় ‘ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়’। মার্ক্সীয় ব্যাখ্যায় প্রাথমিক তিক্ততার এই ছাপ স্পষ্টই প্রতীয়মান। এমনকি কেউ কেউ বহু বছরের ব্যবধানে তত্কালীন প্রাপ্ত স্বাধীনতার বাস্তবতাকে নাকচ করে দিয়ে একে তুলনা করেছে ‘সাদা হাতির পিঠে কালো মাহুত’ বা ‘নতুন বোতলে পুরোনো মদ’ হিসেবে। আমূল সংস্কারকামীদের কাছে স্বাধীনতার মোহভঙ্গ এত গভীরপ্রসারী হয়েছিল যে তারা একে অন্ধকার যুগের আগমনের সঙ্গে তুলনা করেছে।
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির খুলনা শাখার একজন সাবেক সদস্য ধনঞ্জয় দাস বহু বছরের ব্যবধানে ১৯৭১ সালে এসেও ১৯৪৭-এর আগস্টে স্বাধীনতা উদ্যাপনের একজন অংশগ্রহণকারী ছিলেন বলে অনুশোচনা ও খেদ প্রকাশ করেছেন। সাম্প্রতিক কালে প্রকাশিত বরিশালের এক মুসলিম কমিউনিস্টের আত্মজীবনীতে ব্রিটিশ শাসনের বন্দিত্ব থেকে স্বাধীনতাপ্রাপ্তির অনুভূতিসংক্রান্ত কোনো কিছুর উল্লেখই নেই। সাতচল্লিশের তথাকথিত স্বাধীনতা বহু সমাজ-রূপান্তরবাদীর কাছেই ছিল শাসনকাঠামোর বহিরঙ্গের পরিবর্তন মাত্র, আর তারই অন্তরালে ব্রিটিশ, কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের একটি সমন্বিত ও ষড়যন্ত্রমূলক যোগসাজশ। একজন কমিউনিস্ট কর্মীর ব্যঙ্গোক্তিতে এর উদাহরণ মেলে, ‘কিছু পরিবর্তন ঠিকই হয়েছিল। ব্রিটিশ পুলিশের জায়গায় পাকিস্তানি পুলিশ তাদের ক্যাম্প বসিয়েছিল।’
তথাপি কমিউনিস্ট আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বাঙালি মুসলিমদের সমর্থন ঠিকই শনাক্ত করতে পেরেছিলেন, ‘পাকিস্তান সৃষ্টির পেছনে, অন্তত পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের প্রচণ্ড সজোর ও সক্রিয় সমর্থন ছিল।’ একই সঙ্গে তিনি আরও মন্তব্য করেন, ‘যদিও ভুলটি রাজনৈতিক সচেতনতার অভাবে ঘটেছিল, কিন্তু তার পরও পূর্ববঙ্গের শ্রমজীবী জনসাধারণ পাকিস্তানকে তাদের নিজস্ব ভূমি হিসেবেই গ্রহণ করেছিল। পাকিস্তানের তদানীন্তন কমিউনিস্ট লেখালেখির অন্যতম চরিত্র ছিল এই “সত্য অথচ ভ্রান্ত” গণচৈতন্যকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও স্বীকৃতি দেওয়া।’
পূর্ব বাংলার সমাজের অপর গুরুত্বপূর্ণ অংশ উচ্চবর্গের হিন্দু সম্প্রদায়ের অধিকাংশেরই অবস্থান ছিল জাতীয় কংগ্রেসের ছত্রচ্ছায়ায়। তাদের প্রতিক্রিয়া ও প্রত্যাশাও পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক জটিলতা সৃষ্টিতে অন্যতম প্রভাবী উপাদান ছিল। প্রথমেই সাতচল্লিশের ১৫ আগস্ট রাজনৈতিক স্বাধীনতা উপলক্ষে লাহিড়ীর প্রতিক্রিয়ার উদাহরণ টানা যাক, ‘বলাই বাহুল্য ১৯৪৭-এর ১৫ আগস্ট জেলা কংগ্রেস কমিটির প্রেসিডেন্ট অনেকটা ফাঁদে পড়েই মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে [পাকিস্তানি] পতাকা উত্তোলনে বাধ্য হলেন, যা পক্ষান্তরে অখণ্ড ভারতের জন্য আন্দোলনকারী এই সংস্থাকে অপদস্থ করে।’
পাকিস্তান সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে—এক পরাজয়বোধ, হতাশা ও বিশ্বাসভঙ্গের অনুভূতি পূর্ববঙ্গের উচ্চবর্ণের হিন্দু সমাজের মনে জেঁকে বসে। এক হিন্দু নেতা তাঁর মোহভঙ্গের কথা বর্ণনা করেছেন এভাবে, ‘হিন্দুরা কখনোই পাকিস্তানের জন্ম চায়নি। তাদের অনিচ্ছুক মাথার ওপর পাকিস্তানকে জোরপূর্বক চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।’ ঢাকার একজন প্রবীণ কমিউনিস্ট কর্মী জ্ঞান চক্রবর্তী উল্লেখ করেছেন, ‘হিন্দুদের কাছে গোড়া থেকেই পাকিস্তান অগ্রহণযোগ্য ছিল এবং বিপুলসংখ্যক হিন্দু স্বাধীনতার পরপরই দেশ ত্যাগ করে।’ তাঁর ভাষ্য অনুযায়ী, অধিকাংশ হিন্দু সরকারি কর্মচারীই সেই সময় পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করে।
কিছু স্থানে হিন্দু পেশাজীবীদের প্রতিক্রিয়া এত বেশি তিক্ত ছিল যে দেশত্যাগের আগে তারা সরকারি সম্পত্তির যথাসাধ্য ভাঙচুর করেছিল। অজয় ভট্টাচার্য উল্লেখ করেছেন, সিলেট হাসপাতালের হিন্দু কর্মচারীরা হাসপাতালের সম্পদ ভাঙচুরের পর সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে চলে যায়। সংবাদে প্রকাশিত হয়, মুন্সিগঞ্জ সাবজেলের হিন্দু কেরানি ও বন্দীরা স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে তাদের জন্য বরাদ্দকৃত বাড়তি রেশনের কোটা বর্জন করে। পূর্ব পাকিস্তানের সমাজে অগ্রগামী শ্রেণীগুলো মূলত সংগঠিত ছিল উচ্চবর্ণের হিন্দুদের দ্বারা এবং এরাই স্বাধীনতার পর রাজনৈতিক দিক থেকে রাতারাতি নিঃস্ব হলো। রাজনৈতিক স্বাধীনতাকে ঘিরে একদিকে উদ্যম, আশা ও প্রত্যাশা; অন্যদিকে, বাংলা দ্বিখণ্ডীকরণের ফলে হতাশা, তিক্ততা ও মোহভঙ্গজনিত বহু সম্পূরক ও বিপরীত অনুভূতি পরে এক চমকপ্রদ ইতিহাস নির্মাণের উপাত্ত তৈরি করেছে, যা এখনো লেখা হয়নি। লাহিড়ীর অভিমানসূচক অভিব্যক্তিতে প্রতিফলিত হয়েছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক উচ্চবর্গীয় হিন্দুর ব্যর্থতাবোধ, যারা পূর্ব বাংলায় সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রতিপত্তি থাকা সত্ত্বেও তাদের আধিপত্যের অবস্থান ও নেতৃত্ব হারিয়েছিল। অন্যদিকে, তফসিলি হিন্দুরা সাংবিধানিক রাজনীতিতে মুসলমানদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল।
মানুষের আশা তখন বহু দিকে ছুটছিল, জাতীয়তাবাদী পণ্ডিতেরা এই জটিল প্রপঞ্চের প্রায়ই সরলীকরণ করেছেন। তার পরও পূর্ববঙ্গের সমাজ পরিবর্তনের রাজনীতিতে যুক্ত বহু উচ্চবর্ণের হিন্দু এখানেই থেকে যাওয়ার এবং সেই সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক জীবনে অব্যাহত অবদান রাখার সিদ্ধান্ত নেন। ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী এঁদেরই একজন এবং তিনি লিখেছেন, ‘আমি ঠিক করলাম আমি দেশ ছাড়ব না। আমি পাকিস্তানেই রয়ে যাব। পাকিস্তানের জনগণের সুখ-দুঃখের ভাগীদার হয়ে আমি থেকে যাব। এই দেশ, এই পূর্ব বাংলা তো আমারই দেশ...কেন আমি এই দেশ ত্যাগ করব?’ এ দেশে রয়ে যাওয়া তাঁর মতোই মনোভাবসম্পন্ন আরও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কমিউনিস্ট দেশের ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির বিকাশে অবদান রাখার ইচ্ছায় এগিয়ে আসার মূল্য হিসেবে পরে পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন কারাগারে দীর্ঘ ও দুঃসহ যন্ত্রণা ভোগ করেন।
উপজাতি অধিষ্ঠিত অঞ্চলগুলোতেও অস্থিরতা দেখা যায়। কেননা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলো বিশেষভাবে অনুভব করে যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলোর প্রসঙ্গে নতুন রাষ্ট্রের কোনো নির্দিষ্ট নীতিমালা নেই। অতএব এক মাস না পেরোতেই ময়মনসিংহের পাশের এলাকার উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর একটি স্মারকলিপি পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর কাছে পেশ করা হয়। র্যাডক্লিফ রোয়েদাদের কারণে গারোদের একটি অংশ ভারতের পাহাড়ি অঞ্চলের আওতায় পড়ে যায়। এভাবে পূর্ব বাংলার সমতলবাসী গারোরা একটি ধর্মীয় ভিত্তিতে সৃষ্ট রাষ্ট্রের কারণে শঙ্কিত হয়ে ওঠে। এই স্মারকলিপির উদ্ভব ঘটে ১৯৪৭-এর ২৪ আগস্ট, উত্তর ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটের রংরাপাড়ায় আয়োজিত গারো উপজাতীয়দের এক সমাবেশে। সেখানে উপস্থিত প্রায় চার হাজার লোক তাদের বসবাসের অঞ্চলের একত্রীকরণ দাবি করে, যার মধ্যে ছিল ময়মনসিংহের অধীনে পাঁচটি থানা এবং ওই এলাকা-সন্নিহিত ভারতের আসাম প্রদেশ। ব্রিটিশরাজ কর্তৃক জাতিভিত্তিক নতুন রাষ্ট্র গঠনের এই বিশেষ পদক্ষেপটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলোকে তাদের স্বতন্ত্র গারো উপজাতির জনগোষ্ঠীকে তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণ ও স্বাধীনতার দাবি জানাতে অনুপ্রাণিত করল। পরস্পর যোগাযোগবিচ্ছিন্ন হয়ে এক সময়কার অখণ্ড গারো সম্প্রদায় যে পরিমাণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, সেই প্রসঙ্গে কখনোই তাদের কোনো মতামত নেওয়া হয়নি। সাতচল্লিশের রাজনৈতিক স্বাধীনতার সময় উপজাতিদের আশা ও ভীতি যেসব প্রসঙ্গের জন্ম দিয়েছিল, তা আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ সংকট হিসেবেই রয়ে গিয়েছে। স্বাধীনতাপ্রাপ্তির দিনগুলোতে আমরা যখন গ্রামীণ জনগণের প্রতিক্রিয়ার দিকে মনোনিবেশ করি, তখন স্বাধীনতার সেই বাগাড়ম্বরপূর্ণ অর্থ বহু রকম ব্যাখ্যা ধারণ করতে শুরু করে। তাজউদ্দীন আহমেদ লক্ষ করেন, ‘রাত নামতেই যখন উত্সব আনন্দ থিতিয়ে আসল, তখনো ঢাকার রাস্তায় বহু মানুষের ঢল, যাদের অধিকাংশই কেবল বিজয়োত্সবে অংশ নেওয়ার জন্য আশপাশের জেলাগুলোর বিভিন্ন গ্রাম থেকে ঢাকায় এসেছে।’
রাজশাহীতে লাহিড়ী সেদিনের অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করেছেন, বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ‘গ্রামের শতসহস্র মানুষ দলে দলে’ শহরে প্রবেশ করতে লাগল। ঢাকায় অনুষ্ঠিত স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে লাখো লোকের সমাবেশে সেদিন সমপরিমাণ হিন্দু ও মুসলমান উপস্থিত ছিল। ১৫ আগস্ট তাজউদ্দীন খেয়াল করেন, এদের অধিকাংশই জেলার বাইরের গ্রামগুলোর অধিবাসী। তাঁর ধারণা অনুযায়ী, মানুষ সুদূর কুমিল্লা ও ময়মনসিংহ অঞ্চল থেকেও পাকিস্তানের সুদৃঢ় আত্মপ্রকাশের মুহূর্তটিকে প্রত্যক্ষ করতে এসেছিল। যে জাতির বেশির ভাগ লোক গ্রামে বাস করে এবং স্বাভাবিকভাবেই যাদের গতিবিধি ছিল সীমিত, সেখানে কেবল ‘স্বাধীনতার বোধ’—তা যেভাবেই অনুধাবন করা হোক না কেন—তাদের সেদিন ট্রেনভর্তি করে নতুন ক্ষমতার কেন্দ্রস্থল ঢাকা শহরে নিয়ে আসতে পেরেছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, আমরা সেদিন সারা রাত ঢাকার পথে পথে ভ্রাম্যমাণ ‘পথচারী’দের সম্পর্কে বিশেষ কিছুই জানি না। কোনো অনভিপ্রেত ঘটনা ছাড়াই, হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের লোককেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে দিবসের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নিতে দেখা গেছে। সৌভ্রাতৃত্বপূর্ণ মৈত্রী অন্তত বাহ্যিকভাবে হলেও পরিলক্ষিত হয়েছে সারা দেশেই।
কিন্তু জনগণের এই অত্যধিক উচ্ছ্বাসে আক্রান্ত আচরণের প্রকৃতি দেখে ঢাকায় তাজউদ্দীন এবং রাজশাহীতে লাহিড়ী উভয়ই অত্যন্ত বিচলিত হয়েছেন। নেতাদের ভাষণ শুনতে আসা জনগণের উচ্ছৃঙ্খল আচরণ ও বিশৃঙ্খলা প্রত্যক্ষ করে তাজউদ্দীন ব্যথিত হয়েছিলেন, ‘তারা সব সময় স্থান গ্রহণ না করে ভিড় করছিল।’ অনিয়ন্ত্রিত জনগণ কেবল এই একটি কাজ করেই ক্ষান্ত হয়নি; লাহিড়ীর ভাষ্য অনুযায়ী; সেদিন কেউই ‘ট্রেনে টিকিট কাটার প্রয়োজন মনে করেনি।’ তাজউদ্দীনও খেয়াল করেন, যেসব লোক ঢাকায় এসেছিল, তাদের ‘ট্রেনের ভাড়া দিতে হয়নি’। মধ্যবিত্ত জাতীয়তাবাদী নেতাদের কাছে এসব নিয়মবহির্ভূত আচরণ ছিল অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক।
সে সময় আরও বহু বিশৃঙ্খলাসূচক ঘটনা ঘটেছিল। একটি সরকারি প্রতিবেদনে উল্লিখিত তথ্য থেকে জানা যায়, সাতচল্লিশের ১১ সেপ্টেম্বর মুন্সিগঞ্জ সাবজেল থেকে ৮৩ জন কয়েদি পালায়। এরা সবাই স্বাধীনতা দিবসে মুক্তিলাভের প্রত্যাশা করেছিল। আরও বেশ কিছু কয়েদির কাছে স্বাধীনতার আবির্ভাবকে মনে হয়েছিল তাদের ছাড়া পাওয়ার সুযোগ এবং সেই সঙ্গে পরবর্তী আত্মোন্নয়নের উপলক্ষ। ১৯৪৭-এর ১৪ সেপ্টেম্বর আজাদ পত্রিকার প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রায় সব কয়েদিই অনশন ধর্মঘট পালনে রত। এই বন্দীরা স্বাধীনতা উপলক্ষে তাদের মুক্তির জন্য প্রার্থনা জানিয়েছিল। উপরন্তু তারা কায়েদে আযম এবং খাজা নাজিমুদ্দিনের কাছে মুক্তিলাভের জন্য আবেদন জানায়, যাতে নিজেদের চরিত্র সংশোধনের একটি সুযোগ তাদের অন্তত দেওয়া হয়। অনেকেই স্বাধীনতাকে ব্যাপক হারে ধরে নিয়েছিল ব্রিটিশ শাসন-সংশ্লিষ্ট পুলিশ ও রাষ্ট্রীয় সব প্রতিষ্ঠানের অবলুপ্তির উপলক্ষ হিসেবে। জেলা পর্যায়ের একজন মুসলিম লীগ কর্মী আতাউর রহমান খানের প্রতি এক প্রবীণ গ্রামবাসীর জিজ্ঞাসা ছিল, ‘এখন যখন পাকিস্তান অর্জিত হয়েছে, এর পরও কি দেশে পুলিশ, কোর্ট-কাচারি, সেপাই-সাস্ত্রী, জেল এবং লকআপের অস্তিত্ব থাকবে?’ খান এর উত্তরে বলেন, ‘কেন নয়? এসব প্রতিষ্ঠান ছাড়া রাষ্ট্রকে প্রতিরক্ষা করবেন কীভাবে?’ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হতভম্ব বৃদ্ধ বলেছিলেন, ‘তাহলে কোন ধরনের পাকিস্তান আমরা পেলাম। দয়া করে এর নাম পাল্টে ফেলুন, আপনারা একে পাকিস্তান নামেই ডাকবেন আবার দুর্নীতি-অনাচারের অস্তিত্বকেও প্রশ্রয় দেবেন।’ স্বাধীনতার মূল্যবোধের বাস্তবায়নের পথে, রাষ্ট্রীয় ঔপনিবেশিক প্রতিষ্ঠান বিশেষত পুলিশ এবং আদালতকে এই বৃদ্ধের কাছে অন্তরায় বলে মনে হয়েছে।
‘পাকিস্তান’ বলতেই সাধারণ মুসলমান কৃষকের মনে ভেসে উঠত এক নতুন নৈতিক সমাজের ছবি, যেখানে সামাজিক জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করবে পারস্পরিক নীতিবোধ এবং ন্যায়বিচার-জ্ঞান। যুগ যুগ ধরে সমাজের উচ্চশ্রেণী এবং ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের সদস্যদের দ্বারা অবদমিত জীবনযাপনের পর তারা পাকিস্তান বলতে এক পবিত্র রাষ্ট্রের কথা ভাবত। অর্থাত্, পাকিস্তান নামের মধ্যে তারা একধরনের পবিত্রতা আরোপ করেছিল।
তাই এতে মোটেও আশ্চর্যবোধ হয় না, যখন পূর্ব পাকিস্তানের জন্মের অল্প পরই দেশের তাঁতি সম্প্রদায় জোলাদের নেতারা সরকারের কাছে এক আবেদনে তাদের একটি নতুন সামাজিক স্বীকৃতি ও অবস্থানে উত্তরণের দাবি করে। তত্কালীন রাজনৈতিক স্বাধীনতার আবহ ও আলোকে তাদের এই দাবিকে যুক্তিযুক্ত ও বৈধ মনে করেছিল। ওই সময় ‘পাকিস্তানের’ অস্তিত্বকে জনপ্রিয় করে তোলার জন্য উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে স্বর্ণযুগের আগমনবিষয়ক বিশ্বাসকে অভ্যস্ত করা হতো। বেশ্যালয়, মদ ও জুয়ার অবলুপ্তি প্রসঙ্গে ইসলামের নাম করে এই বিশ্বাসের প্রচারকেরা তাদের অবস্থান প্রতিষ্ঠিত করতে চাইত।
মুসলিম নেতারা ১৯৩৭-এর নির্বাচনের পর থেকেই ‘মুসলমান জনগণের ভবিষ্যত্ স্বদেশ’-এর এমন ছবি এঁকেছিলেন, যেখানে দরিদ্র চাষিদের ‘দিনে দুবেলা দুমুঠো অন্নের’ স্বপ্ন সত্যি হবে। ছেচল্লিশের মন্বন্তরের পর ‘বিপর্যয়-পরবর্তী কল্পরাজ্য’ তৈরিতে জনগণের কাছে বেঁচে থাকার জন্য দুই বেলা খাবারের স্বপ্নই ছিল তাদের পরিপূর্ণতার প্রতীক। গ্রিনোর (Greenough) বক্তব্য অনুসারে, বহু কৃষকের কাছে ‘ভাতের’ আরেক নাম ছিল স্বাধীনতা। সাধারণ মুসলমান চাষিদের আশাবাদ ও পাকিস্তানকেন্দ্রিক প্রত্যাশা নিঃসন্দেহে পূর্ব বাংলার সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যকার জাতীয়তাবাদী অনুভূতির অস্তিত্বের প্রতিফলন। অবশ্য তত্কালীন সমাজ ও রাজনীতির বৈশিষ্ট্যের সব দিক বিশ্লেষণ করলে প্রকৃত প্রস্তাবে জাতীয়তাবাদ হতে পারত একান্তই একটি উচ্চবর্গীয় অনুভূতি। কেননা মৃত্যু ও দুর্ভিক্ষের একদম মুখোমুখি দাঁড়ানো পরিস্থিতিতে, জাতীয়তাবাদ ছিল বহু বিপরীত শক্তির একটি, যা দরিদ্র জনগণকে সমাজ পরিবর্তনের আন্দোলনে নামতে বাধ্য করত।
ইসলামধর্ম স্বয়ং এবং ইসলামের ঐতিহ্যগত মানবিক সাম্যবাদের ধারণা তখন একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শক্তিতে রূপান্তরিত হলো, বিশেষত যখন উচ্চবর্গের হিন্দু সম্প্রদায়কে দেখা হয় নিপীড়ক শক্তির প্রতিনিধি হিসেবে। ইসলাম-দৈনন্দিন রাজনীতি সেই সময় এতই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল যে এমনকি ধর্মনিরপেক্ষ দাবিদাওয়াও ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ দ্বারা রঞ্জিত হতো। ১৯৪৮-এর সদ্যগঠিত বাংলা ভাষাকেন্দ্রিক সমাবেশের বহু ধারণা ও উদাহরণকে ইসলামের বাণী, সংগঠন ও ইতিহাস থেকে গ্রহণ করা হয়েছিল। নতুন রাষ্ট্রের সমালোচনাবিষয়ক প্রথম দিককার রচনাগুলোর ধরনে ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা ওমর ও তাঁর মতাদর্শে নেতৃত্বদানের মাধ্যমে একটি আদর্শ সমাজ অর্জন ও প্রতিষ্ঠার কথা উল্লেখ করা হয়েছে, ‘কবে আমরা হযরত ওমর (আ.)-এর মতো একজন আদর্শ শাসক পাব, যখন সেই চার খলিফার স্বর্ণযুগের মতো পরিস্থিতির পুনরাবির্ভাব ঘটবে।’
ইতিহাসবিদ গ্রিনো সদ্য স্বাধীনতা-উত্তর কালের সময়টিকে ‘বিশৃঙ্খলা ও দুর্দশা’র এক কাল হিসেবে বর্ণনা করেছেন। স্বাধীনতা তখন এক নতুন সূচনার পরিবর্তে নতুন সংকটের চেহারা নিল, যখন খাদ্যঘাটতি, বন্যা ও সরকার পরিবর্তনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত লক্ষাধিক মানুষের কাছে স্বাধীনতা নতুন সূচনা না হয়ে নতুন সংকট হয়ে দাঁড়াল।
পূর্ব বাংলার রাষ্ট্রযন্ত্রের জন্য রাজনৈতিক স্বাধীনতা এক অবধারিত অনিশ্চয়তার জন্ম দিল এবং জনগণের ‘উদ্যম’ প্রায়ই এই পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রযন্ত্রের নিয়ন্ত্রণের ঊর্ধ্বে ছিল। রাষ্ট্রকে সরকারি কার্যক্রিয়ার সমষ্টিমাত্র হিসেবে বিবেচনা করতেন আমলারা, পক্ষান্তরে সরকারনির্ভর লৌকিক আকাঙ্ক্ষার ধরন প্রায়ই রাজনৈতিক নেতাদের দুর্বোধ্য ধাঁধায় ফেলে দিত, কেননা নতুন রাষ্ট্র-সম্পর্কিত জনসাধারণের প্রত্যাশা ছিল সম্পূর্ণই ইউটোপিয়ান। অন্যদিকে, রাষ্ট্রের প্রশাসনিক যন্ত্রের পুনর্গঠন একান্ত প্রয়োজন ছিল, কেননা পূর্বতন এবং ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠিত ও প্রচলিত সংগঠনটি ছিল অগণতান্ত্রিক ও নিপীড়ন-অভ্যস্ত ঔপনিবেশিক কাঠামোর অনুসারী।
দেশভাগ পূর্ব পাকিস্তানের সরকারি নীতিপ্রণেতাদের জন্য এমন সুযোগ এনে দিয়েছিল, যার সুবাদে যখনই তাদের রাজনৈতিক বৈধতা হুমকির সম্মুখীন হতো, তখনই তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের কাছে ধর্মীয় সংহতির আবেদনকে ব্যবহার করত। যদিও প্রান্তিকীকরণের উদ্দেশ্য-সচেষ্ট এসব বাগাড়ম্বরের আবেদন খুবই স্বল্পায়ু ছিল, তবু বাংলাদেশের জন্মের সঙ্গে সঙ্গে এর দ্বারা সৃষ্ট বৈপরীত্য, জন্মগতভাবে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ এবং ‘গণতান্ত্রিক’ বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটেও সমস্যা সৃষ্টি করে চলেছে। এখানকার মুসলমানদের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের মুসলমানদের থেকে ভিন্ন, স্বতন্ত্র ও অখণ্ড একটি পরিচয় নির্মাণের জন্য পূর্ব পাকিস্তানের দেশ বিভাগের প্রসঙ্গটি ব্যবহার করেছিল। ঘটনাচক্রে কীভাবে তা পাকিস্তান নামের রাষ্ট্রের বৈধতায় ক্ষয় সৃষ্টি করেছিল এবং পাকিস্তানের নতুন পরিচয় গঠনে নেতিবাচক ভূমিকা পালন করছিল, তা বাঙালি জাতীয়তাবাদী আলোচনায় বহুল ব্যবহূত প্রসঙ্গ।
এতে আমরা একটু পরে ফিরে আসছি। ভারতীয় জাতির নিজস্ব পরিচয় খুঁজে পাওয়ার ক্ষেত্রে ব্যর্থতার কারণ বোঝার জন্য এখন ভারতীয় ইতিহাসশাস্ত্রে নতুন করে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। ১৯৮৪-তে শিখদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস এবং ১৯৯২-এ বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর সৃষ্ট সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এ ক্ষেত্রে ট্র্যাজিক প্রভাবকের ভূমিকা পালন করে। এখন দেশ বিভাগকেন্দ্রিক সন্ত্রাস এবং ইতিহাসে সন্ত্রাস বিষয়ে কীভাবে লেখা হবে, তা গবেষকদের নতুন করে ভাবাচ্ছে।
এভাবেই এই সন্ত্রাসের ইতিহাস আলোচিত হতে শুরু করেছে। ভারতের চলমান গণতান্ত্রিক আন্দোলন, দেশভাগের ইতিহাসে মহিলাদের প্রতিনিধিত্বের প্রসঙ্গটি পুনরুদ্ধার করার ক্ষেত্রে নারীবাদীদের উদ্যোগী ও আগ্রহী করেছে। উর্বশী বুটালিয়া, ঋতু মেনন, কমলা ভাসিন, বীণা দাস তাঁদের আলোচনায় প্রমাণ করেছেন, ধর্ষণ, অপহরণ, বলপূর্বক ধর্মান্তরিতকরণ এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে মহিলাদের স্বদেশে পুনর্বাসন দেশভাগের স্মৃতির বিশাল অংশজুড়ে আছে। এটা বললে হয়তো স্বতঃসিদ্ধ সত্যের মতো শোনায়, তবু এ কথা স্মৃতিতে বাস্তব যে যারা দেশচ্যুত, নিহত ও উদ্বাস্তু হয়েছিল, সেই জনগোষ্ঠীর এক বিশাল অংশই ছিল নারী।
এসব নতুন প্রশ্ন এবং অন্যান্য পরিপ্রেক্ষিত ঐতিহাসিকদের ধারণাকে উত্তরোত্তর আরও দৃঢ়মূল করেছে যে দেশ বিভাগ, সাধারণ মানুষের জীবন অভিজ্ঞতায় যেভাবে এসেছে তা জানার প্রচেষ্টার আশু প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। সাধারণ মানুষ অথবা তাদের অভিজ্ঞতাকে রোমান্টিকভাবে না দেখেও বলা যায় যে এসব অভিজ্ঞতা উচ্চবর্গের ইতিহাস থেকে অনেকখানি আলাদাই ছিল। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ইতিহাসে ধরে নেওয়া সংস্কৃতিগত অখণ্ড পরিচয়ের কারণে, যার মৌল ভিত্তি ছিল বাংলা ভাষা ও এর ঐতিহ্য, সাতচল্লিশের দেশভাগের অভিজ্ঞতাকে অমীমাংসিতই রেখেছে।
‘বাংলা’ নামের স্থান এবং ‘বাংলা’ ভাষার ধারণা—উভয়েরই রয়েছে একধরনের চিরন্তন স্বাভাবিকতা; মনে হয় যেন ইতিহাস, রাজনীতি এবং ধর্মের বাইরে এই ভূখণ্ড, তার জনগোষ্ঠী এবং সংস্কৃতি সব সময়ই সংযুক্ত অখণ্ড রূপ নিয়ে চিরকাল এখানেই ছিল। বাংলাদেশের অভ্যুদয় অর্থাত্ বাঙালিদের জন্য স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাকে দেখা হয় যুগপত্ এক অনন্য একাত্মবোধের জাতির কারণ ও পরিণতি হিসেবে, যা রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রথাগত কাঠামোয় বিচ্ছেদ সৃষ্টি করে। বাংলাদেশের ঐতিহাসিক বিবরণীতে, ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত সময়কালকে একধরনের পথচ্যুতি হিসেবে বিবেচনা করার প্রবণতা দেখা যায়—যেন বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্তরণের বিশাল উপাখ্যানে এটি ছিল একটি মুহূর্তিক বিচ্ছেদ। যদিও বাংলাদেশের সৃষ্টি অবধারিতই ছিল, যা এর অনন্য জনগোষ্ঠী-ভূখণ্ড, ভাষা ও সংস্কৃতিগত একাত্মতার মধ্য দিয়ে প্রমাণ করেছে—তবে উপনিবেশ-উত্তর সেই কালপর্বটিকে কীভাবে ব্যাখ্যা করা যায়, যে পর্বে বাঙালির পরিচয় ‘অন্য কিছু’র অন্তর্ভুক্ত হয়ে চাপা পড়ে ছিল। সমস্যাটি তখনই বহুমাত্রিক হয়ে ওঠে, যখন জানা যায় সেই ‘অন্য কিছু’টি ছিল প্রভাবশালী ধর্ম ইসলাম, যা পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার অন্যতম প্রাথমিক যোগাযোগের সূত্র হিসেবে বিবেচিত হতো, তখন বাঙালিত্বের পরিচয়ের সঙ্গে ইসলামের পরিচয়ের সম্পর্কটি স্বয়ং বিতর্কিত হয়ে ওঠে, যার প্রমাণ সাম্প্রতিক উত্তেজনাকর পরিস্থিতি।
পূর্ব পাকিস্তানের অস্তিত্বকাল (১৯৪৭-৭১) বাঙালি জাতীয়তাবাদী আখ্যানে একটি স্ববিরোধী বিষয় হয়ে দাঁড়ায়, যা একাধারে চূড়ান্ত পরিণামে জন্ম দেয় বাংলাদেশকে, আবার একই সঙ্গে ইসলাম ও বাঙালিত্বকে এর পরিচয়ের সহজাত উপাদান হিসেবে সমন্বিত করতে চায়। অতএব, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী ইতিহাসবিদ্যায় ব্যাখ্যা করতে হবে, প্রথমত কীভাবে ১৯৪৭-এ বাংলা বিভক্ত হলো (পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে), দ্বিতীয়ত কীভাবে একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম রাষ্ট্র পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারল (পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে)। জাতির কাহিনিতে সাতচল্লিশের দেশবিভক্তি এবং একাত্তরের দ্বিতীয় ভাঙনের ঘটনাগুলোকে কখনো দমন, কখনো বর্জন, কখনো বা সযত্ন নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বলা হয়েছে। দেখা যায়, সরকারি ইতিহাসে ১৯৭১-এর জাতীয় মুক্তিকে বিজয়ের মুহূর্ত হিসেবে আলোকিত করা হলেও সাতচল্লিশের ঐতিহাসিক মুহূর্তের গুরুত্বকে অনেকটাই অবমূল্যায়িত করা হয়েছে। এর অন্যতম একটি উদাহরণ হলো ১৯৯২-এ প্রকাশিত বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি সম্পাদিত তিন খণ্ডের বাংলাদেশের ইতিহাস। বিশেষত, রাজনৈতিক ইতিহাসবিষয়ক খণ্ডের প্রথম সংস্করণে, যেখানে ১৯৪০-এর মন্ত্রিসভা গঠনের বিষয়টি সামান্য স্পর্শ করেই এক লাফে ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনের প্রসঙ্গে চলে যাওয়া হয়েছে, বলা যেতে পারে উপনিবেশ-উত্তর বাঙালি জাতীয়তাবাদের সূচনামুহূর্তে। ১৯৪৭-এ পাকিস্তান সৃষ্টির ইতিহাস সেখানে সম্পূর্ণ অনুল্লেখিত থেকেছে।
যেভাবেই রচিত হোক না কেন, এসব সরকারি ইতিহাসে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর দেশ বিভাগের অভিজ্ঞতা এবং কীভাবে এসব তাদের দৈনন্দিন জীবন ও পরিচয়ের রূপান্তর ঘটিয়েছিল, তা তুলে ধরার কোনো প্রয়াস দেখা যায় না। সরকারি ইতিহাস অনেক সময় একই ইতিহাসের লৌকিক ধারণা ও স্মৃতিকথার অন্তর্নিহিত মৌলিকতা থেকে সরে এসেছে। দেশভাগ-সংক্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে বিভিন্ন শ্রেণী—যেমন কৃষক, শ্রমিক, নারী, গ্রামীণ জনগণ, নাগরিক শ্রেণী, জমিদার—বিভিন্ন ব্যাখ্যা লাভ করেছে। সরকারি ইতিহাস ও জনগণের স্মৃতি-আশ্রয়ী অভিজ্ঞতার মধ্যে যথাযথ বিচার ও সমস্যার যথার্থ শনাক্তকরণ হয়নি, বিশেষত রাষ্ট্র কীভাবে এ মুহূর্তের ইতিহাসের কাঠামো নির্মাণ করবে এবং তার প্রয়োগ ঘটাবে, তা এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।
দেশ বিভাগের অভিজ্ঞতা পাঞ্জাবের চেয়ে বাংলার অনেকাংশেই পৃথক ছিল। উদাহরণস্বরূপ, পূর্ব বাংলার বহু মুসলমান জমিদার ও কৃষক দেশ বিভাগকে বৈষয়িক উন্নয়নের নজিরবিহীন সুযোগ হিসেবে চিন্তা করেছে, যেহেতু অর্থ ও বিত্তগত দিক থেকে তখন প্রাধান্য বিস্তারকারী হিন্দুদের জোরপূর্বক দেশত্যাগ সংঘটিত হচ্ছিল। অতএব, ১৯৪৭-এ দেশ বিভাগকে তাই জমির মালিকানার পুনর্বিন্যাস ও মুসলিম মধ্যবিত্ত পেশাজীবীদের উত্থানের একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচনা হিসেবে বলা যেতে পারে।
নিঃসন্দেহে বলা চলে, এরাই পরে রাষ্ট্রের সম্পদ, গোষ্ঠীর সম্পদ এবং ১৯৪৭-এ দেশ বিভাগের সময় হিন্দুদের পরিত্যক্ত সমুদয় সম্পদের স্বত্ব ভোগকারী ছিল। নতুন আবির্ভূত বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনীতি, যার মূল বিষয় ছিল কেন্দ্র-প্রদেশবিরোধিতা, প্রতিস্থাপিত করল পুরোনো ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ধারাকে। অতএব, স্বাভাবিকভাবেই যে অভিজ্ঞতাগুলো বিকাশোন্মুখ জাতীয় ঐক্যকে বাধাগ্রস্ত করতে সক্ষম ছিল, সেগুলোকে প্রান্তীকরণ করা হয়। উপসংহারে আমি বলতে চাই, রাষ্ট্র যে একটি কাল্পনিক ধারণা, তা পণ্ডিতেরা এত দিনে মেনে নিয়েছেন। একই সঙ্গে এটিও প্রচ্ছন্ন যে রাষ্ট্র তার পরিপূর্ণ অস্তিত্ব পায় ঐতিহ্য, পুরাণ, ইতিহাস ও পরিচয় আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশে ক্ষুদ্র স্বার্থবাদের যেসব প্রবণতা রয়েছে—যেমন ‘জাতিগোষ্ঠীবাদ’, ‘সাম্প্রদায়িকতাবাদ’—এগুলো সেই কাল্পনিক সদ্যোজাত জাতিরাষ্ট্রের কল্পসমাজের বিপক্ষে আরেক ধরনের কল্পিত বাস্তবতা। উপরন্তু যে অভিন্ন ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এ রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে, সেসব প্রক্রিয়ার মধ্য থেকেই এসব কল্পিত সত্তার উদ্ভব হয়েছে এবং এ রাষ্ট্রের জন্য সেসব বিভেদকারী শক্তিগুলোই এখন আশঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তসলিমা নাসরিন রচিত লজ্জা উপন্যাস পাঠ করতে গিয়ে যে অস্বাচ্ছন্দ্য অনুভব হয়, তার কারণ এটি সাহিত্য হিসেবে নিম্নমানের বলে নয়, বরং তা বাংলাদেশের রাজনীতির দেহে ১৯৪৭-এর দেশ বিভাগের জন্মদাগগুলোকে স্পষ্ট ও প্রকট করে তোলে বলেই।