সারসংক্ষেপ
অকালপ্রয়াত চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদের চলচ্চিত্রে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উপস্থাপনার ধরনটি অন্বেষণ করাই এই রচনার মূল অভিপ্রায়। তাঁর মুক্তিযুদ্ধ ও সমাজ-সংস্কৃতিভিত্তিক প্রামাণ্য-স্বল্প-পূর্ণদৈর্ঘ্য কয়েকটি চলচ্চিত্র বীক্ষণ করে দেখা গেছে যে তিনি অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদী তত্ত্বের স্বরূপ ও বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় বাস্তবতায় বিগত চার দশকে এর প্রয়োগ কীভাবে ঘটেছে, তা বোঝার চেষ্টা করেছেন। তত্ত্ব, মানুষ, ধর্ম, লোকসংস্কৃতি, রাষ্ট্র, রাজনীতি প্রভৃতি বিষয়কে তাঁর চলচ্চিত্রে স্থান করে দিয়ে এদের কার্যকারিতা-প্রাসঙ্গিকতাকে পরীক্ষা করেছেন। তিনি লক্ষ করেছেন যে এগুলো পরস্পর প্রায়ই একে অপরের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে তিনি এগুলোর মধ্যে একধরনের সমন্বয়ের প্রয়োজন অনুভব করেছেন। সে জন্য চরম বা পরম মনোভাব তাঁর মানসে অনুপস্থিত, আছে মরমি মনোভাব; যা কিছুটা আমাদের লোকসংস্কৃতির ভেতরকার অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও মানবিক এবং কিছুটা পারস্যের সুফিবাদী দর্শনের মানব-সম্পর্কিত ধারণার আলোকে গঠিত। বীক্ষণকর্ম থেকে দেখা গেছে যে রাষ্ট্রীয় বাস্তবতায় বাঙালি জাতীয়তাবাদের পাশাপাশি ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদ, সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ, নৃতাত্ত্বিক জাতীয়তাবাদ, আদিবাসী জাতীয়তাবাদ প্রভৃতি প্রপঞ্চ অবস্থান করছে। তারেক মাসুদ এ রকম একটি সমাজবাস্তবতায় বাঙালি জাতীয়তাবাদের পুনর্ব্যাখ্যার প্রস্তাব করেছেন।
মুখ্য শব্দগুচ্ছ: তারেক মাসুদের চলচ্চিত্র, লোকচলচ্চিত্র, চলচ্চিত্রবীক্ষণ, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ, ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদ, আদিবাসী জাতীয়তাবাদ, ধর্ম-ভাষা-ভূখণ্ড নিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদ, ধর্মীয় ইসলাম, রাজনৈতিক ইসলাম, লোকসংস্কৃতি, বাঙালি জাতীয়তাবাদী ধারণার রূপান্তর-পুনর্ব্যাখ্যা (মিউটেশন)।
প্রারম্ভিক কথা
তারেক মাসুদ১ স্বপ্রশিক্ষিত একজন চলচ্চিত্রকার ছিলেন। তিনি শুধু বাংলাদেশের শিল্প-চলচ্চিত্র সৃষ্টির ধারাকেই এগিয়ে দেননি, একে বিশ্বমুখীনও করেছিলেন। তাঁর বেশির ভাগ চলচ্চিত্র কেবল কাহিনি-কাঠামোর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, এগুলোর মধ্যে সমকালীন সমাজব্যবস্থার নানা প্রসঙ্গ যেমন মানবজীবন, লোকসংস্কৃতি, ধর্ম, রাজনীতি, রাষ্ট্র, জগত্ প্রভৃতি সম্পর্কে তাঁর ভাবনাও স্থান করে নিত। এই সূত্রেই তাঁর বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রে ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ প্রসঙ্গটিও গুরুত্ব পেয়েছে।
চলচ্চিত্র প্রকৃত প্রস্তাবে একটি নির্মাণ (কনস্ট্রাকশন)। চলচ্চিত্রবীক্ষণ হচ্ছে নির্মিত চলচ্চিত্রকে বিনির্মাণ (ডিকনস্ট্রাকশন) করার উদ্যোগ। এ রকম একটা তাত্ত্বিক অবস্থান থেকে তারেক মাসুদ নির্মিত মুক্তিযুদ্ধ ও সমাজ-সংস্কৃতিভিত্তিক চলচ্চিত্রে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উপস্থাপনা অনুধাবন করাই বক্ষ্যমাণ রচনার মূল লক্ষ্য। তারেক মাসুদের বাঙালি জাতীয়তাবাদ-সম্পর্কিত ধারণা প্রকাশ পেয়েছে প্রধানত তাঁর ও ক্যাথরিন মাসুদ নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র ও পূর্ণদৈর্ঘ্য-স্বল্পদৈর্ঘ্য কাহিনিচিত্রগুলোতে। এগুলের মধ্যে মুক্তির গান (১৯৯৫), মুক্তির কথা (১৯৯৮), মাটির ময়না (২০০২), অন্তর্যাত্রা (২০০৬), নরসুন্দর (২০০৮) ও রানওয়ে (২০১০) অন্যতম।
চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানের কর্মের ওপর নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র আদম সুরত (১৯৮২-১৯৮৯) দিয়ে তারেক মাসুদের চলচ্চিত্রযাত্রা শুরু হয়। শুধু তারেক মাসুদ নয়, ওই সময়ের অনেককেই সুলতান তাঁর ক্যারিশম্যাটিক ব্যক্তিত্ব ও অভিনব ধারায় আঁকা চিত্রকলা দিয়ে আকৃষ্ট করেছিলেন। মনীষী আহমদ ছফা ওই সময় সুলতানের চিত্রকর্ম নিয়ে লিখলেন অভিনব উদ্ভাসন নামে একটি চটি গ্রন্থ। তারেক মাসুদ গ্রন্থটি পড়ে থাকবেন। তাঁর ওপর সুলতান ও ছফার চিন্তাধারার প্রভাব পড়েছে। আদম সুরত নির্মাণের পর ১৯৯০ সালে তারেক মাসুদ যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দেন।
মুক্তির গান
যুক্তরাষ্ট্র যাওয়ার পর মার্কিন নাগরিক লিয়ার লেভিনের২ সঙ্গে ঘটনাচক্রে তারেক মাসুদের দেখা হয়। লেভিন মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৬ মিমি ক্যামেরায় প্রায় ২০ ঘণ্টার মতো ফুটেজ ধারণ করেছিলেন, যার অধিকাংশই অব্যবহূত থেকে যায়। তাঁর কাছ থেকে তারেক যেসব অব্যবহূত ফুটেজ পান, সেই ফুটেজ ও অন্যান্য জায়গা থেকে সংগ্রহ করা ফুটেজ দিয়ে দীর্ঘ পাঁচ বছর পরিশ্রম করে মুক্তির গান নির্মাণ করেন। ক্যাথরিন মাসুদ ছিলেন সহনির্মাতা। সেই ফুটেজ যদি তিনি না পেতেন, তাহলে আমরা আজকে যে তারেক মাসুদকে পাই, তাঁকে হয়তো পেতাম না। আমাদের সৌভাগ্য যে তিনি ফিরে এসেছিলেন এবং তাঁর কর্মসূত্রে এ দেশের চলচ্চিত্রও নতুন এক মাত্রা পায়। সেই ফুটেজগুলো পাওয়ার পর তারেক মাসুদ যখন মুক্তির গান নির্মাণ করতে যান, তখন তিনি নিজেও এখানে কিছু সংযোজন করেছেন। কিছু দৃশ্য তিনি চিত্রায়ণও করেছেন। মিশুক মুনীর ছিলেন ক্যামেরা-সঞ্চালক। তাতে করে যে প্রশ্নটা এখানে সামনে চলে আসে যে মুক্তির গান-এ যে দৃষ্টিভঙ্গি আছে, এটা কার দৃষ্টিভঙ্গি? ধারণা করি, প্রথমত এখানে লিয়ার লেভিনের একটা দৃষ্টিভঙ্গি কাজ করেছে, তারপর তারেক মাসুদ সেই ফুটেজের ভেতরে ঢুকে নিজস্ব একটা দৃষ্টিভঙ্গি দিতে চেষ্টা করেছেন। আর আছে সংস্কৃতিকর্মীদের দৃষ্টিভঙ্গি, যাঁরা ওই সময় গান দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দীপ্ত করা বা মুক্তিযুদ্ধকে একটা পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। মুক্তির সংগ্রামে তাঁদের কী দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, সেটা এখানে এসেছে। লিয়ার লেভিনের দৃষ্টিভঙ্গির কিছুটা পরিচয় পাওয়া যায় তারেকের রচনায়। তারেক লিখেছেন:
সিবিএস, এনবিসির মতো চ্যানেলগুলো মুক্তিযুদ্ধের সময় ব্যাপকভাবে বাংলাদেশকে কাভার করছিল। এগুলো ছিল নিউজ রিল।...লিয়ার লেভিন এসব প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। পেশায় তিনি ছিলেন একজন বিজ্ঞাপন নির্মাতা। ব্যক্তি উদ্যোগে পুরোপুরি পেশাদার চলচ্চিত্র ইউনিট নিয়ে তিনি আমাদের মুক্তিযুদ্ধে শামিল হয়েছেন। অক্টোবর মাসে তিনি কলকাতায় আসেন এবং মাত্র ছয় সপ্তাহ সেখানে থেকে শুটিং করতে পেরেছিলেন। সীমাহীন প্রতিকূলতায় বাধা ছিল তাঁর ওই সময়টুকু। একজন মার্কিন নাগরিক হওয়ায় তাঁকে চিহ্নিত করা হয় সন্দেহজনক ব্যক্তি হিসেবে। ভারত ও বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার তাঁকে ‘সিআইএর চর’ মনে করে। শরণার্থী শিবিরের বাইরে তাই লিয়ারের যাতায়াত নিয়ন্ত্রিত ছিল। আবেগী, উদ্যোগী লিয়ার এত বিধিনিষেধ মানতে পারেননি। এ জন্য তাঁকে শাস্তিও পেতে হয়। শিবিরের বাইরে শুটিং করায় এক দিন ও এক রাত হাজতেও কাটাতে হয় তাঁকে। ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ পুরোদমে শুরুর আগেই সরাসরি ভারত সরকারের নির্দেশে লিয়ারকে ভারত ছাড়তে হয়। ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হয়। দলে দলে মুক্তির ছেলেরা ঢাকায় প্রবেশ করে। কাঁধে ক্যামেরা নিয়ে লিয়ারের এই বিজয়ী মিছিলে থাকার কথা ছিল অথচ থাকতে পারেননি। তাঁর স্বপ্নের ছবিটা শেষ হয় না।...সাংস্কৃতিক দলটির সঙ্গে লিয়ারের পরিচয় হয় আকস্মিকভাবে। লিয়ার এ দলের সঙ্গে থেকে ছবি তোলার কাজ করতে থাকেন। লিয়ার লেভিন ছবিটি তৈরি করতে যাচ্ছিলেন মার্কিন দর্শকদের জন্য। এর জন্য বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে সাংস্কৃতিক দলটি যে বাংলা গানগুলো পরিবেশন করেছিল, তা খুব জুতসই ছিল না। লিয়ারের জয় বাংলায় যুদ্ধের দৃশ্য নেই, রাজনীতি নেই, আছে শুধু সৃষ্টিশীল ইমেজ।...বাংলাদেশের জন্মলগ্নকে ধারণ করতে না পারা ছিল লিয়ারের জন্য বড় ব্যর্থতা।৩
উদ্ধৃতিদৃষ্টে বলা যায়, লিয়ার লেভিনের ইচ্ছা ছিল বাংলাদেশের চলমান মুক্তিযুদ্ধের ওপর একটা প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করা, যার উদ্দিষ্ট দর্শক মার্কিন জনগণ কিন্তু তাঁর মতো করে তিনি দৃশ্য ধারণ করতে পারেননি। তার পরও জয় বাংলা শীর্ষক ৭২ মিনিট দৈর্ঘ্যের যে প্রামাণ্যচিত্রটি নির্মাণ করেন, তাতে ‘যুদ্ধের দৃশ্য নেই, রাজনীতি নেই’। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, লেভিনের হাতে কোনো চিত্রনাট্য ছিল না, ‘চিত্রনাট্য লেখার সাহস তিনি করে উঠতে পারেননি। অর্থের বিনিময়ে একজনকে চিত্রনাট্যের দায়িত্ব দেওয়া হয় কিন্তু রিচার্ড নামের এই চিত্রনাট্যকার একটি লাইনও লেখেননি’।৪ সব মিলিয়ে বলা যায় যে লেভিনের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল একটা পূর্ণাঙ্গ প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করা, যার মধ্যে থাকবে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে একটি অঞ্চলের স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার কথা। কিন্তু তাঁর সেই ‘স্বপ্নের ছবিটা’ তিনি শেষ করতে পারেননি, শেষ করেছেন তারেক ও ক্যাথরিন। তাই বলা যায়, মুক্তির গান-এ তারেকের নিজস্ব যে দৃষ্টিভঙ্গিটা পাওয়া যায়, সেটা আসলে কিছুটা লেভিনের দৃষ্টিভঙ্গি, পাশাপাশি ওই সময়ের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যাঁরা গান করে বেড়িয়েছেন এবং মুক্তিযুদ্ধকে উদ্দীপ্ত করেছেন, তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি মিলেমিশে তৈরি হয়েছে। ওই সময়ে সামগ্রিকভাবে আমাদের যে দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, সেটা হচ্ছে দেশকে মুক্ত করা, এখানে যে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসন-শোষণ চলছিল, তা থেকে বাঙালিদের মুক্ত করা। বস্তুত, বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষের একটা পর্বে সংস্কৃতিকর্মীরা একটা নির্দিষ্ট ভূমিকা পালন করেছেন এবং তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদী একটা রাষ্ট্র কায়েম করা, একটা ‘জাতিরাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠা করা।
সাধারণ জনগণ বা মুক্তিযোদ্ধাদের যে যুদ্ধযজ্ঞ, সেটা মুক্তির গান-এ কিছু আছে, পুরো চলচ্চিত্রেই কিছু স্টক ফুটেজ আছে। হয়তো লিয়ার লেভিন সেগুলো চিত্রায়ণ করেননি, তারেক মাসুদ নিজে করেননি, কিন্তু অন্যদের ফুটেজ তিনি সারা বিশ্ব থেকে সংগ্রহ করেছেন। নানা জায়গা থেকে, নানা সূত্র থেকে ফুটেজ তিনি ক্রয় করেছেন, উদ্ধার করেছেন; তারপর সেগুলো ব্যবহার করে মুক্তির গান তৈরি করেছেন। এটা আসলে একটা রিকনস্ট্রাকশন। তাই তাঁর একটা স্বাধীনতা ছিল। তিনি নিজে এই প্রামাণ্য চলচ্চিত্রের ভেতরে ঢুকে গেছেন। তারপর তিনি তাঁর মতো করে ব্যাখ্যা দিয়েছেন। সাধারণ মানুষ যাঁদের মুক্তির গান-এ পেয়েছি, বিশেষত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে, তাঁরা এই যুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিয়েছেন। তাঁদের স্বাধীনতা অর্জনের জন্যই তাঁরা এই কাজ করেছেন। প্রত্যেক নির্মাতাই, তাঁর যে ধরনের চলচ্চিত্রই হোক, প্রামাণ্য বা পূর্ণদৈর্ঘ্য বা স্বল্পদৈর্ঘ্য, সেখানে তিনি কতগুলো এজেন্ডা নিয়ে কাজ করেন। একটা বিষয় থাকে, একটা বক্তব্য থাকে। সেই বক্তব্যের একটা প্রবাহ তৈরি করেই তিনি চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেন। মুক্তির গান চলচ্চিত্রেও তারেক মাসুদ একটা বক্তব্যের প্রবাহ, যাকে ওয়েভ অব মিনিং বলতে পারি, সেটা তৈরি করেই কাজটি করেছেন। কাজটি তিনি করেছেন তাঁর একটা নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই। তাঁর একটা সাংস্কৃতিক, দার্শনিক, মনস্তাত্ত্বিক অভিব্যক্তির প্রকাশই এই চলচ্চিত্র।
এর নির্মাণভঙ্গিটাও গুরুত্বপূর্ণ। এখানে সংগীতবহুল আখ্যানধর্মী যে প্রামাণ্যচিত্রটা দেখা যায়, এটা কিছুটা যেন চলচ্চিত্রের আঙ্গিকে কেচ্ছা বলার মতো। সম্ভবত এ কারণেই তিনি এটাকে প্রামাণ্যচিত্র না বলে ‘প্রামাণ্যগল্প’ বা ‘কাহিনিচিত্র’ বলতে চেয়েছিলেন। কেচ্ছা বলার যে ধরনটি আমাদের লোকসংস্কৃতির ভেতরে আছে, যেটা একটা আঙ্গিক, এই আঙ্গিকটা তিনি সচেতনভাবেই মুক্তির গান-এ ব্যবহার করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘ছবিটি মিউজিক্যাল কাঠামোয় নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিলাম। এর সঙ্গে রোড মুভি ধরনের অর্থাত্ এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাব—এভাবে ছবিটি বানাব। আর এটা এমনভাবে সম্পাদনা করব, যেন দেখে প্রামাণ্যচিত্র মনে না হয়। মনে হবে, এটা কাহিনীচিত্র।’৫ এর যে বিষয়, তার একটা বড় জায়গাজুড়ে মুক্তিযুদ্ধ আছে। সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ তেমনভাবে নেই, এটাও সত্য। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ যে প্রাসঙ্গিক, প্রয়োজন, এটা তিনি এই মুক্তির গান প্রামাণ্যচিত্রে লোকগান, গণসংগীত দিয়ে বলতে চেয়েছেন। গণসংগীত, পুতুলনাচ ও লোকগান দিয়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধের যে বিপক্ষ শক্তি, তাদের বিরুদ্ধে যে লড়াই করতে হবে, এই প্রশ্ন সামনে নিয়ে এসেছেন। তখনকার যে রাজনীতি-সচেতন সংস্কৃতিকর্মীরা ছিলেন, তাঁরা গান দিয়ে একদিকে যেমন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন, অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধরত মুক্তিবাহিনীর মনোবল বাড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় প্রণোদনা জুগিয়েছেন। যেমন এখানে কয়েকটা গান আছে, ‘এই না সোনার বাংলা’ অথবা ‘দেশে দেশে ভ্রমি তব দুঃখগান গাহিয়ে’—এই গানগুলো এসেছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ঘৃণা প্রকাশ করা এবং পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণা দেওয়ার জন্য।
মুক্তির গান-এ আমরা দেখেছি যে গান দিয়ে প্রতিপক্ষকে শনাক্ত করা, চিহ্নিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, আমরা বাঙালি এবং আমাদের স্বাধীনভাবে বাংলাদেশে বসবাস করার একটা যৌক্তিক অধিকার আছে। মুক্তিযুদ্ধ তো শুরু হয়েছে ১৯৭১ সালে, কিন্তু যদি আমরা এর ইতিহাসটা দেখি, এর প্রেক্ষাপটটা আলোচনায় আনি, তাহলে দেখব যে ১৯৪৭ সালেই এখানে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ভাগ হওয়ার ফলে আমরা ধর্মের ভিত্তিতে বিভক্ত বিসদৃশ একটা রাষ্ট্র পেলাম: একদিকে পূর্ব পাকিস্তান, অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তান। যখন জন্মলাভ করে তখনই, কিন্তু এটা যে ভাঙবে, তার আভাস পাওয়া গিয়েছিল। ১৯৪৭-৪৮ সালে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য আন্দোলন শুরু হয়ে গিয়েছিল এবং শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত প্রসঙ্গটা তখনই তুলেছিলেন, ’৪৮ সালেই। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সেটা একটা চেহারা পায়। সাংস্কৃতিক স্বাধিকার আন্দোলনের ব্যাপারটাই বায়ান্ন সালে প্রকট হয়ে গিয়েছিল এবং ১৯৬২ সালে শিক্ষা অধিকার আদায়ের আন্দোলন হয়েছে। প্রথমটা সাংস্কৃতিক অধিকার, দ্বিতীয়টি শিক্ষার অধিকার। তারপরই আমরা দেখি ছয় দফার আন্দোলন, সেটা অর্থনৈতিক স্বাধিকার আন্দোলনেরই একটা সংগ্রাম ছিল। সেই সূত্র ধরে ১৯৬৯ সালে গণ-আন্দোলন হয়, ১৯৭০ সালে নির্বাচন হয় এবং আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। তার পরও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যেতে পারে না। ফলে যেটা হলো, ১৯৭১ সালে এখানে একটা রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হলো। সব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে, এই নানামুখী স্বাধিকার আন্দোলনগুলো মিলেমিশে একপর্যায়ে এসে ১৯৭১ সালে একটা রাজনৈতিক চেহারা অর্জন করে এবং একটা রাজনৈতিক স্বাধিকার আন্দোলনের দিকে অঞ্চলটা এগিয়ে যায়। সেই সময়কার মুক্তিযোদ্ধা, সংস্কৃতিকর্মী বা জনগণের কী ভূমিকা ছিল—সবই এই মুক্তির গান-এ চলে এসেছে। এই প্রামাণ্য চলচ্চিত্রে শুধু যে মুক্তির আকাঙ্ক্ষাই প্রতিফলিত হয়েছে, তা নয়; এখানে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, এই ধারণারও একটা প্রকৃষ্ট প্রতিফলন ঘটেছে। কারণ, পশ্চিম পাকিস্তানিদের ধর্মভিত্তিক, অর্থনীতিভিত্তিক, প্রশাসনিক, সামরিক যে আধিপত্য—এই সবকিছুর বিরুদ্ধে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ধারণাটি গড়ে উঠেছিল। এই ধারণা মুক্তিযুদ্ধের সময় সর্বাধিক গুরুত্ব পায় এবং মুক্তির গান-এ বাঙালি জাতীয়তাবাদের এই ধারণাকে রাজনৈতিকভাবে সামনে নিয়ে আসা হয়। মুক্তির গান-এ তারেক মাসুদ বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিপরীতে প্রচ্ছন্নভাবে রাজনৈতিক ইসলামকে প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখিয়েছেন।
এ প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই এসে যায়, বাঙালি জাতীয়তাবাদকে কেন রাজনৈতিকভাবে সামনে আনতে হলো? বাঙালি জাতীয়তাবাদ আসলে এসেছে পশ্চিমা শাসকেরা যে ইসলাম ধর্মের নামে আমাদের ওপর অত্যাচার শুরু করেছিল, তার বিপরীতে। বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্র—এই চারটি মূল স্তম্ভ মুক্তির প্রেরণা জুগিয়েছে এবং রাষ্ট্রের তাত্ত্বিক যে ভিত্তি, সেই ভিত্তিটা আমাদের এই চারটি মৌল ধারণা থেকেই আসলে বেড়ে উঠেছে। এই চারটি দিকের প্রথমটির উপস্থিতি মুক্তির গান-এ প্রবলভাবে দেখতে পাওয়া যায়। বাঙালি জাতীয়তাবাদের ধারণা রাজনৈতিকভাবে সম্মুখবর্তী হয়েছে পূর্ব পাকিস্তান পর্বের শেষ দিকে এসে। কিন্তু ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পরপরই বাঙালি মধ্যবিত্তের সাংস্কৃতিক পরিচয় অন্বেষণের প্রয়োজনেই সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের আলোকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রপঞ্চটি গুরুত্ব পেয়েছে বলে মনে হয়। এ সূত্রে বলা যায়, মুক্তির গান প্রামাণ্যচিত্রেই যে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উপস্থাপন প্রথম ঘটেছে তা নয়, ষাটের দশকের পূর্ণদৈর্ঘ্য কয়েকটি চলচ্চিত্রেও এর উপস্থিতি দেখতে পাওয়া যায়। এ প্রসঙ্গে ফরহাদ মজহারের অনুধাবন উল্লেখ করার মতো। তিনি লিখেছেন:
খান আতাউর রহমানের নবাব সিরাজউদ্দৌলা (১৯৬৭) সম্ভবত প্রথম ছবি, যেখানে ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের চেতনার লক্ষণ প্রথম চলচ্চিত্রে আত্মপ্রকাশ করে। এর তিন বছর পর ১৯৭০ সালে জহির রায়হানের জীবন থেকে নেয়া ছবিটি গণ-আন্দোলনের উত্তুঙ্গ মুহূর্ত সরাসরি ধারণ করে। ডকুমেন্ট্রি বা দলিলি ছবি আকারে নয়, ছবির গল্পের মধ্যেই। পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের জাতীয় চেতনা ততদিনে একটা রূপ নিয়ে নিয়েছে। ছবির মধ্যে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি সংযোজনের মধ্য দিয়ে জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের চেতনার চরিত্র নির্মাণে চলচ্চিত্র সরাসরি অংশগ্রহণ করে। সব মিলিয়ে ছবিটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক লড়াই-সংগ্রামের অংশ হয়ে যায়। এই ঘটনাগুলো ঘটেছে একাত্তরের আগে। পূর্ব পাকিস্তানে ছবি তৈরির সংকল্প, সাধনা, অধ্যবসায় ও পরিশ্রমের মধ্যে জাতীয় চৈতন্য নির্মাণের কাজগুলো বিচিত্র ও অদৃশ্য পথে নানানভাবে সম্পাদিত হয়েছে।৬
১৯৭১ সালে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতীয়তাবাদের আওতায় যে মুক্তিযুদ্ধটা হয়েছিল, সেটা শুধু মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি শেষ পর্যন্ত, এটা জনযুদ্ধে পরিণত হয়েছিল। মুক্তির গান-এ তাত্ত্বিকভাবে বেশি কিছু করার ছিল না তারেকের পক্ষে। তার পরও সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের অন্বেষণের এক মহান দলিল হয়ে ওঠে মুক্তির গান। এ প্রসঙ্গে খন্দকার সাখাওয়াত আলীর অভিমত:
বাঙালি জাতির সবচেয়ে বড় অহংকার যে মুক্তিযুদ্ধ, সেই মুক্তিযুদ্ধের অন্তঃসত্ত্বায় আর অন্তঃস্রোতের মাঝে লুকিয়ে থাকা আর হারিয়ে যাওয়া সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার খুঁজে পেতে ব্রতী হলেন ওঁরা (তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদ—সম্পাদক)। সময়টা ইতিবাচক পুনরুদ্ধার আর পুনর্নিমাণের কালপর্ব। মুক্তির গান দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি নতুনভাবে জেগে উঠল বাঙালি মধ্যবিত্তের জীবনে। মুক্তির গান স্মৃতির শামিয়ানার নিচে জড়ো করল বিচ্ছিন্ন-বিক্ষিপ্ত হয়ে যাওয়া বাঙালি চৈতন্য। শুরু হলো মুক্তির গান নিয়ে দেশজুড়ে যাত্রা। মুক্তির গান প্রদর্শিত হলো গ্রাম-শহর-বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের নানা প্রান্তজুড়ে। মুক্তিযুদ্ধের আবেগময় আচ্ছন্নতা আর ইতিহাসের পুনঃপাঠের উত্তেজনায় দর্শক স্মৃতিকাতর আর আত্মানুসন্ধানী হয়ে ওঠে। মুক্তির গান প্রদর্শনের অভিজ্ঞতাকে ভিত্তি করে ওঁরা নির্মাণ করেন মুক্তির কথা।৭
মুক্তির কথা
মুক্তির গান-এ ছিল সংস্কৃতিকর্মীদের নির্দিষ্ট একটা ভাবনা, যে ভাবনাগুলোকে তারেক ও ক্যাথরিন স্টক ফুটেজ ও গানের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন আর মুক্তির কথায় ওই প্রামাণ্যচিত্র দেখাতে গ্রামে-গঞ্জে যেখানেই তাঁরা গেছেন, সেখানকার নারী-পুরুষেরা যে ভাবনায় তখন তাড়িত ছিলেন, তাঁদের যে আশা ছিল, আশাভঙ্গ হয়েছিল—সেসব কথা চলে এসেছে। মুক্তির কথায় যাঁরা কথা বলেছেন, তাঁরা বৃহত্তর লোকসমাজের মানুষ। এখানে নারী-পুরুষ উভয়েই তাঁদের নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন। তাঁদের স্বপ্ন কী ছিল এবং সে স্বপ্ন যে কখনো কখনো ভেঙে গেছে, সে কথাও মুক্তির কথায় এসেছে। তারেক মাসুদও মুক্তিযুদ্ধের বহুমাত্রিক বাস্তবতার সঙ্গে পরিচিত হন। মুক্তিযুদ্ধ কোনো একরৈখিক ব্যাপার ছিল না, এটি বহুরৈখিক, বহুস্বরিক ও বহুস্তরিক একটা ব্যাপার ছিল। নারী-পুরুষেরা তাঁদের নিজ কণ্ঠে মুক্তির কথায় যে কথাগুলো বলেছেন, সেটা বহুস্বরিক (Polyphonic) এবং তা থেকে পাওয়া বহু জ্ঞান তারেক মাসুদকে ঋদ্ধ করেছে।
মুক্তির গান-এ শরণার্থী শিবির, মুক্তাঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধাদের চলাফেরা, সংস্কৃতিকর্মীদের গান, এগুলো এসেছে। মুক্তির গান দেখানোর পর মানুষের মধ্যে যে প্রতিক্রিয়া, সেগুলো মুক্তির কথায় এসেছে। মুক্তির গান-এ যাঁরা শরণার্থী শিবির এবং মুক্তাঞ্চলে ছিলেন, তাঁদের কথা এসেছে। আর মুক্তির কথায় তখন দেশের ভেতরে যাঁরা অবরুদ্ধ ছিলেন, তাঁদের কথা বেশি এসেছে। তাঁদের আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং আশাহত হওয়ার যেসব বিষয়, সেগুলো এসেছে। মুক্তির কথায় মানুষ অসহায় অবস্থা থেকে প্রতিরোধকারী যোদ্ধায় কীভাবে পরিণত হয়েছিল, সে কথা এসেছে। এটা মুক্তিযুদ্ধের দুটি প্রভিন্ন রূপ, যা দুই প্রান্তে ঘটেছিল। তারেক মাসুদের নিজস্ব চিন্তাভাবনা মুক্তির কথায় সংযোজনের কোনো সুযোগ ছিল না। কারণ, তিনি টোকাচ্ছিলেন মানুষের কথা, কারা কী বলছে না বলছে সেটা। তিনি যেভাবে কথাগুলো পেয়েছেন, সেভাবে সেগুলো এখানে গুছিয়েছেন দৃশ্যগুলোর মধ্যে বক্তব্যগত পরম্পরা রেখে। তখন তাঁর একটা দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়েছে। এই দৃষ্টিভঙ্গি বরাবরই একজন চিত্রপরিচালকের থাকে, তাঁর নিজস্ব এজেন্ডা-বক্তব্য থাকে, সেগুলো গুছিয়ে-গাছিয়ে নিজের মতো করে তিনি উপস্থাপন করেন। সেটা তিনি এই মুক্তির কথায় করেছেন। আমরা বলতে পারি, মুক্তির গান, মুক্তির কথা তাঁর একটা রিসার্চ বা অন্বেষণ অথবা প্রস্তুতিপর্ব। পরবর্তীকালে তাঁর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক কাহিনিধর্মী চলচ্চিত্রে বাঙালি জাতীয়তাবাদের যে উপস্থাপনা দেখি, তার ধারণা ধীরে ধীরে তাঁর ভেতরে দানা বেঁধেছে, তাঁর কাজের সূত্রে। এই দুটি প্রামাণ্যচিত্রেই সেই অন্বেষণ বা প্রস্তুতিপর্বের অনেক দৃষ্টান্ত আমরা পাই। এই দুটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করতে গিয়েই তারেক ও ক্যাথরিন মাসুদ বাঙালি জাতীয়তাবাদ-সংক্রান্ত ধারণার মুখোমুখি হন। তাঁরা অনুভব করেন যে এই ধারণা একরৈখিক এবং তা মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেহারা প্রকাশ করে না। মাটির ময়না প্রসঙ্গে আলোচনাকালে দেখব যে এই অন্বেষণ পর্বের যে বিবেচনা বা জ্ঞানগুলো, সেই জ্ঞানগুলোরই একটা সমন্বিত-সম্প্রসারিত প্রকাশ আমরা তাঁর পূর্ণদৈর্ঘ্য ফিচার ফিল্ম মাটির ময়না ও রানওয়েতে পাব। আর খানিকটা প্রচ্ছন্নভাবে অনুচ্চারিত স্বরে অন্তর্যাত্রায়। এই চলচ্চিত্রে তারেক মাসুদ বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষকালের সূতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ষাট-সত্তর দশকের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক জীবনের খণ্ডচিত্র দিয়ে বাঙালি জাতিসত্তা ও সাংস্কৃতিক গভীরতাকে ছুঁতে চেয়েছেন এলিট পরিবেশ-প্রতিবেশে। সব মিলিয়ে বলা যায়, তারেক বাঙালি জাতীয়তাবাদী ধারণার বাইরে খুব একটা যাননি।
মাটির ময়না
প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করে তারেক নিজেকে দক্ষ নির্মাতা হিসেবে তৈরি করেছেন। উল্লিখিত দুটি প্রামাণ্য চলচ্চিত্র থেকে যে শিক্ষাটা তিনি পেয়েছেন, বিশেষ করে দার্শনিক, সাংস্কৃতিক, মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে—সেসবের একটা বহিঃপ্রকাশ আমরা তাঁর পরবর্তীকালের কাজগুলোতে দেখি। মাটির ময়নায় অনেকগুলো প্লট আছে: তাঁর মাদ্রাসার জীবন আছে, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক একটা গল্প আছে, তাঁর মা-বাবার মনস্তাত্ত্বিক দিক ইত্যাদি আছে। মাটির ময়না যখন মুক্তি পায়, তখন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সম্পাদিত নতুন দিগন্ততে এর একটা সমালোচনা লিখি।৮ সেখানে বলার চেষ্টা করেছি যে মাটির ময়নায় তাঁর নিজস্ব জীবন, তাঁর পারিবারিক জীবন, তাঁর মা-বাবার জীবন, তারপর মুক্তিযুদ্ধ—এসব প্রসঙ্গ একসঙ্গে টেনেছেন তিনি। আমার বিবেচনায়, তাঁর মাদ্রাসার জগত্টাই তিনি চলচ্চৈত্রিকভাবে অর্থাত্ ইন টার্মস অব ভিজুয়াল ইমেজ অ্যান্ড অডিও ইমেজ সবচেয়ে চমত্কারভাবে এনেছেন। কারণ, মানুষ তাঁর যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতা চলচ্চিত্রাঙ্গিকে খুব ভালোভাবে আনতে পারে। আমি দেখেছি, তাঁর মাটির ময়নায় উপস্থাপিত তাঁর নিজের যে আত্মচরিত, তা ধীরে ধীরে একটি রাষ্ট্রের আত্মকথার সঙ্গে মিশে গেছে। বাঙালি জাতির আত্মানুসন্ধান বা জাতি গঠন-প্রক্রিয়ার একটি ক্রান্তিকালের ইতিহাস মাটির ময়নায় পুনর্গঠিত হয়েছে। তাঁর অন্বেষণ বা প্রস্তুতিপর্বে বাঙালি জাতীয়তাবাদের একটা চেহারা তিনি দেখতে পেয়েছিলেন, যা তখনকার ডমিন্যান্ট ইডিওলজি ছিল। মাটির ময়নায় তিনি তাঁর নিজের কাহিনি মথিত করে বাঙালি জাতীয়তাবাদের একটা চেহারা তুলে ধরেছেন। বস্তুত, মাটির ময়নায় তিন জোড়া পরস্পর বিরোধী দ্বন্দ্বমূলক ধারণা আছে: নারী-পুরুষ বা ঘর-বাহির, প্রতিষ্ঠান-প্রকৃতি এবং ভাষা-ধর্মকেন্দ্রিক দ্বন্দ্ব। প্রথম দ্বন্দ্বটিতে পুরুষতন্ত্র-পিতৃতন্ত্র জয়ী হয়। দ্বিতীয় দ্বন্দ্বটি তারেক মাসুদের মাদ্রাসাজীবনকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। মাদ্রাসা একটা প্রতিষ্ঠান, এই প্রতিষ্ঠানের ভেতরে তিনি ছিলেন। এখানে থেকে তিনি প্রকৃতিকে বাইরে এসে দেখতে পেতেন না। জানালা দিয়ে দেখতেন—কাকরাইল বা লালবাগ মসজিদে বন্দী জীবন যাপন করতেন, শিকের ভেতরে ছিলেন। তিনি কেবল একজন ‘অনলুকার’ ছিলেন। প্রতিষ্ঠানের ভেতরে তিনি বন্দী ছিলেন, ফলে প্রতিষ্ঠানবিরোধী একটা মনোভাব তাঁর ভেতরে জন্ম নিয়েছিল। এ জন্য মাদ্রাসার যে জীবন, সেটাকে তিনি খুব ভালোভাবে নেননি। কারণ, এখানে যে বেঁধে ফেলা, আঁকড়ে ধরা, এটা করা যাবে না, সেটা করা যাবে না—এই যে নানা রকমের বাধা, এটা তিনি পছন্দ করেননি। এটা তাঁর যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতা, যা তিনি মাটির ময়নায় সিনেম্যাটিকভাবে নিয়ে এসেছেন।
বাঙালি জাতীয়তাবাদ, যা ওই লেখায় তৃতীয় দ্বন্দ্বমূলক ধারণার মধ্যে ছিল, যে দ্বন্দ্ব ভাষা ও ধর্মের টানাপোড়েনে তৈরি হয়েছিল। মাটির ময়নায় এটা একটা বিরাট প্রসঙ্গ হয়ে এসেছে, আমরা যে রাষ্ট্রটা চাই, সেটা ভাষাভিত্তিক হবে, নাকি ধর্মভিত্তিক হবে? আমরা দেখি, মাটির ময়নায় দ্বন্দ্বটা প্রকট হয়ে উঠেছে। এর একটা সাময়িক অবসান দেখি ধর্মনিরপেক্ষ ও ভাষাভিত্তিক বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইঙ্গিত দিয়ে। তবে দ্বন্দ্বটার অবসান এখনো হয়নি। স্বাধীনতা অর্জনের পর অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন আমাদের হতে হয়েছে গত চার দশকে। ১৯৭৫ সালে যে পটপরিবর্তন হয়, তার ফলে দেশটা ক্রমেই তার জন্মলগ্নের তাত্ত্বিক পটভূমি থেকে সরে গেছে। আমরা সংগ্রাম করেছিলাম প্রধানত একটা বাংলা ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র গড়ব বলে, ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের বদলে; সে সংগ্রামে সফলও হয়েছিলাম, কিন্তু দেশটা আবার ধীরে ধীরে পেছনের দিকে ফিরে গেছে! তার একটা মূর্ত রূপ বর্তমানে আমরা দেখতে পাই আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রীয় পরিসরে।
অন্য একটা দিক থেকেও মাটির ময়নার ওই সমালোচনাকর্মে তারেকের মানসিকতা বোঝার চেষ্টা নেওয়া হয়েছিল। অনুমিত হয়েছিল যে তারেক মাসুদের জীবনদর্শন এবং বিশ্ববীক্ষার মধ্যে একটা মরমিবাদের প্রভাব আছে। একটা সেক্যুলার ব্যাপার আছে। তিনি মাওলানা রুমির কবিতা পছন্দ করতেন। মানুষকে নিধর্মীকরণ-সংক্রান্ত (de-theolization) রুমির জীবনদর্শনটি তাঁর পছন্দ ছিল। তারেক আসলে খুব একটা এক্সট্রেমিস্ট মানুষ ছিলেন না। মনে হয়, তিনি চিন্তাচেতনার দিক থেকে মধ্যপন্থার মানুষ ছিলেন। ওই লেখায় আমি তাঁকে একটু সমালোচনাও করেছি, বলেছি, এই যে মরমিবাদ, এটা দিয়ে হার্শ-ক্রড-স্টার্ক রিয়েলিটিকে মোকাবিলা করা যাবে না। প্রচণ্ডভাবে একটা দিক আঁকড়ে ধরতে হবে, হয় এদিক, না-হয় সেদিক। মাঝখানে থেকে কোনো রকমের ফয়সালা করা যাবে না। ভবিষ্যতেও রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক বা অন্যান্য ক্ষেত্রে যেখানেই আমাদের লড়াই করতে হবে, সেখানে আমাদের একটা পক্ষ নিয়ে কাজ করতে হবে। যাই হোক, মাটির ময়নায় তারেক বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মভিত্তিক মুসলিম জাতীয়তাবাদ, দুটোকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। জাতীয়তাবাদ-বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রসঙ্গে তারেকের মনোভাব জানা যায় ‘সত্যজিত্ ও রবীন্দ্রনাথ’ নামক একটি রচনা থেকে। তিনি লিখেছেন:
আমার কাছে সত্যজিত্ ও রবীন্দ্রনাথের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য মিল তাঁদের বৃহত্ বিশ্বদৃষ্টি। তাঁদের কেউই জাতীয়তাবাদের গণ্ডিবদ্ধ অন্ধতার শিকার হননি। লক্ষণীয় বিষয়, সত্যজিতের সমসাময়িক পরিচালক ঋত্বিক ঘটক যখন মারা গেলেন, সত্যজিত্ তাঁর শোকবার্তায় বললেন, ‘ঋত্বিক আমার চেয়ে বৃহত্তর বাঙালি ছিলেন।’ আমার মনে হয় না সত্যজিত্ এখানে কেবল বিনয় দেখাচ্ছেন। বরং এটা এমন একটা প্রশস্তি, যা তিনি নিজের জন্য বরাদ্দ রাখতে চাননি। বাঙালি জাতীয়তাবাদী প্রবণতা থেকে এই মানসিক দূরত্ব রবীন্দ্রনাথের বিশ্বচেতনারও একটি মৌলিক দিক।৯
ধারণা করি, বাঙালি জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ও সত্যজিতের মানসিক যে অবস্থান, তা তারেকের মানস গঠনে প্রভাব ফেলেছে। ফরহাদ মজহারের লেখায় তারেকের বাঙালি জাতীয়তাবাদ-সম্পর্কিত ধারণার একটা পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি লিখেছেন:
তারেক মাসুদ যখন ছবি করতে এসেছেন, তখন বাঙালি জাতীয়তাবাদ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা এবং বাঙালি পরিচয়ের প্রধান বয়ান হয়ে উঠেছে। তারেক মাসুদ খ্যাতি লাভ করলেন, যখন তাঁর মুক্তির গান ও মুক্তির কথা বাঙালি জাতীয়তাবাদের সেই প্রধান বয়ানের কাজে লেগে গেল এবং তাঁকে আরও শক্তিশালী করতে সক্ষম হলো।...তারেক সম্ভবত এই এককাট্টা জাতীয়তাবাদী বয়ানের মধ্যে অস্বস্তি বোধ করতেন।...জাতীয়তাবাদী বয়ানের ‘ভাবাবেগ ও একরৈখিকতা’ তারেকের অপছন্দ ছিল।...তারেক তাঁর পারসেপশন বা দৃষ্টিভঙ্গীকে বাঙালি জাতীয়তাবাদী বয়ানের বাইরে নিয়ে যাওয়ার সাধনা করেননি।...তারেক বাঙালি জাতীয়তাবাদী বয়ান থেকে বেরিয়ে আসেননি, কিন্তু মাটির ময়না বাঙালি জাতীয়তাবাদী বয়ানের সংকটকে সামনে নিয়ে এসেছে।...বাঙালি জাতীয়তাবাদী বয়ানের মধ্যে ইসলাম প্রশ্নে যে উত্কণ্ঠা ও ভীতি রয়েছে, তারেক তাঁর জায়গা থেকে সেই সবের একটা উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন। সেই চেষ্টার মূলকথা ছিল, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আশ্রয় করেই বাংলাদেশকে সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য নতুন বয়ান খুঁজতে হবে। ইসলাম যেখানে বাইরের প্রতিপক্ষ হয়ে থাকবে না।১০
মাটির ময়নায় কতগুলো বাহাসের দৃশ্য আছে। এই দৃশ্যগুলোতে ইসলামসহ অন্যান্য ধর্মীয় ও সামাজিক প্রসঙ্গে তারেকের মতামত পাওয়া যায়। আমাদের বৃহত্তর লোকসমাজের ভেতর বাহাসের একটা ঐতিহ্যই আছে। ঐতিহ্যবাহী পালাগান, কবির লড়াইয়ে আমরা বাহাস করি। আমাদের নির্দিষ্ট কিছু আঙ্গিকই আছে, যেখানে আমরা বাহাস করি। আমরা খুবই বাহাসপ্রবণ মানুষ এবং সমন্বয়বাদী মনোভাব আমাদের এখানে প্রবল। আমাদের একটা আরগুমেন্টেটিভ ট্র্যাডিশন আছে। কারণ, আমাদের এই অঞ্চলে নানা রকম ধর্মের আগমন ঘটেছে, উদ্ভবও ঘটেছে। একই এলাকায় নানা ধর্মের মানুষকে বসবাস করতে হয়েছে হাজার বছর ধরে। ফলে সব ধর্মের মানুষ একটা সমন্বয়ের চেষ্টা করেছে। তারেক মাসুদ এই বাহাসের ভেতরে ঢুকে দেখেছেন যে সবাই সমন্বয়ের ব্যাপারটা পছন্দ করে। মাটির ময়নায় গানের মধ্যে, করিম মাঝির সংলাপের ভেতর বাহাসের প্রসঙ্গ আছে, সমন্বয়ের কথা আছে। এই সমন্বয়ের বিষয়টা আমাদের লোকমানসের একটা দার্শনিক অবস্থান হয়ে গেছে বলে আমার ধারণা। মাটির ময়নায় তারেক মাসুদ একদিকে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, অন্যদিকে ধর্মভিত্তিক মুসলিম জাতীয়তাবাদকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান-জৈন-শাক্ত-বৈষ্ণব-বাউল-মুসলমান—যাদের কথাই বলি না কেন, তারা হাজার হাজার বছর ধরে এখানে বাস করছে। তাদের তো এখানেই থাকতে হয়েছে, হচ্ছে। তাই একটা সমন্বয়ের ভেতর দিয়ে, সম্প্রীতির ভেতর দিয়ে এবং নানা রকম অনৈক্যের মধ্য দিয়েও একটা ঐক্য স্থাপন করে গণতান্ত্রিক উপায়ে সহাবস্থান করতে হবে। আমাদের লোকসংস্কৃতির ভেতরে তিনটি বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ। মানবতাবাদ, গণতান্ত্রিক মনোভাব ও অসাম্প্রদায়িকতা। আমাদের বৃহত্তর লোকসমাজের এগুলো মূল স্তম্ভ। আমি দীর্ঘকাল ধরে তিতাস নদীর ওপারে গিয়ে লোকগান সংগ্রহ করছি। আমি দেখেছি যে তাদের ভেতরে গণতান্ত্রিক একটা চিন্তাভাবনা, সমন্বয়বাদী একটা চেতনা আছে। পাশাপাশি অসাম্প্রদায়িক চেতনাটাও তাদের মধ্যে খুব বেশি। সঙ্গে সঙ্গে তৃতীয় যে জিনিসটি আমি দেখেছি, সেটা হচ্ছে মানবতাবাদ। জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে তারা মানুষকে ভালোবেসেছে, মানুষপন্থী হয়েছে। সুফিবাদ ও বৈষ্ণববাদের মধ্যে যে মানুষপন্থী হওয়ার স্পৃহা আছে এবং বৌদ্ধধর্মের মধ্যে যে সহজিয়া মতবাদ আছে, সবেতেই সহাবস্থানের কথা আছে। সুফিইজম তো বাইরে থেকে এসেছে, এসে এখানে বৈষ্ণববাদের সঙ্গে সহাবস্থান করেছে। একই সঙ্গে বৌদ্ধ সহজিয়া মতের সঙ্গে গিয়ে মিশেছে। এই তিনটি মিশেই আবার বাউলতত্ত্বের জন্ম হয়েছে। বাউলতত্ত্বের ভেতরে, বাউলগানের ভেতরে যা পাওয়া যায়, তারেক মাসুদের চলচ্চিত্রেও তার কিছুটা পাওয়া যায়, বিশেষ করে কাহিনিধর্মী, স্বল্প ও পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে। আমি একটা প্রবন্ধে১১ দেখিয়েছি যে তারেক মাসুদ আসলে একজন ‘লোকচলচ্চিত্রকার’। আমি জানি না, পৃথিবীর কোথাও কেউ কোনো চলচ্চিত্রকার সম্পর্কে এ রকম অভিধা ব্যবহার করেছেন কি না।
আমরা একসঙ্গে বড় হয়েছি, বেড়ে উঠেছি সেই ১৯৭৫ সাল থেকে। আমি তারেককে কিছুটা চিনি এবং ওই প্রবন্ধে আমি লিখেছি যে তিনি অন্তত চারবার এই লোকসংস্কৃতির সঙ্গে ইন্টারঅ্যাকশনে গেছেন। প্রথম জীবনে গেছেন, যখন তিনি ছোট ছিলেন—যেগুলো উঠে এসেছে মাটির ময়নায়। ওই চলচ্চিত্রে আনুর কাকার সঙ্গে নৌকাবাইচ দেখতে যাওয়া, মেলায়-আড়ঙে যাওয়া, বাতাসা কেনা, মাটির তৈরি ময়না পাখি কেনা—এগুলো তাঁর লোকসংস্কৃতির সঙ্গে প্রথম জীবনের ইন্টারঅ্যাকশনের ফসল। তার যে মানস, সেটা ধীরে ধীরে তৈরি হয়েছে। প্রত্যেক শিল্পীর ক্ষেত্রেই এটা দেখা যায়। যাই হোক, প্রথম জীবনের ইন্টারঅ্যাকশন তিনি প্রায় ভুলেই গিয়েছিলেন। ঢাকায় এসে যখন এস এম সুলতানের ওপর আদম সুরত শীর্ষক প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ শুরু করেন যেটা ১৯৮২-তে শুরু হয়ে ১৯৮৯-তে শেষ হয়েছে, তখন সুলতানের সঙ্গে মিশে তিনি গ্রামে-গঞ্জে গেছেন, তখন লোকসংস্কৃতির সঙ্গে তাঁর দ্বিতীয়বার ইন্টারঅ্যাকশন ঘটে। আদম সুরত নির্মাণ প্রসঙ্গে তারেক যা লিখেছেন, তাতে তাঁর লোকসংস্কৃতির সঙ্গে দ্বিতীয় পর্যায়ের ইন্টারঅ্যাকশনের বিষয়টি স্পষ্ট হয়। তারেক লিখেছেন, ‘একধরনের বাউলাঙ্গের চলচ্চিত্র নির্মাণে আমরা জড়িয়ে গিয়েছিলাম।...বিভিন্ন লোকজ উত্সব, যেমন—কুমিল্লার পাগলার মেলা থেকে শুরু করে চট্টগ্রামের মাইজভান্ডারি, তারপর কুষ্টিয়া থেকে শুরু করে ময়মনসিংহের বিভিন্ন উত্সব, ফরিদপুরের নৌকাবাইচ, ধামরাইয়ের রথযাত্রা—যেখানেই শুনতাম লোকসংস্কৃতির কোনো যজ্ঞ চলছে, সেখানেই ক্যামেরা নিয়ে হাজির হয়ে যেতাম।’১২ অন্যত্র লিখেছেন, ‘সুলতানের সঙ্গে ঘুরতে গিয়ে আমি একক মূলধারার জাতীয় সংস্কৃতির বদলে সংস্কৃতির শত শত ক্ষুদ্র ধারা আবিষ্কার করেছি।’১৩
লোকসংস্কৃতির সঙ্গে তাঁর এই মিথস্ক্রিয়ার ফলেই তাঁর বুদ্ধিবৃত্তির অন্দরমহলে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। তিনি বহুত্ববাদী হয়ে ওঠেন। এর সত্যতা তাঁর লেখাতেই পাওয়া যায়। তিনি লিখেছেন, ‘শহুরে মধ্যবিত্তকে মনে করিয়ে দিতে হবে যে বৃহত্তর প্রজ্ঞা ও সৌন্দর্য লুকিয়ে রয়েছে আমাদের সুপ্রাচীন লৌকিক সংস্কৃতিতে।’১৪ বস্তুত, আমরা যারা যৌবনের একটা বড় সময় সুলতান ও ছফার সঙ্গে কাটিয়েছি, তাদের সবার অনুভব একই ধরনের। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি তৈরিতে সুলতান ও ছফার প্রভাব পড়েছে। আমরা একই ভূখণ্ডে বহু মত বহু পথের অস্তিত্ব স্বীকার করে নিয়েছি। তাঁর তৃতীয় ইন্টারঅ্যাকশনটা ছিল মুক্তির গান নির্মাণের সময়। ওখানে লোকগান, পুতুলনাচ দিয়েই মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে কথা বলছেন আমাদের সংস্কৃতিকর্মীরা। আর চতুর্থ একটা ইন্টারঅ্যাকশন হয়েছে তাঁর মৃত্যুর কিছুদিন আগে, যখন বাংলাদেশের বিভিন্ন উত্সবকে ক্যামেরাবন্দী করছিলেন একটা প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করার জন্য। এটা তাঁর ফোর্থ স্টেজ অব ইন্টারঅ্যাকশন উইথ দ্য লোকাল কালচারাল রুট প্যারাডাইমস। বস্তুত তারেক মাসুদের মানসিকতায় অসাম্প্রদায়িকতা, মানবতাবাদ, গণতান্ত্রিক মনোভাব, পরমতসহিষ্ণু হওয়ার যে ব্যাপারগুলো, এগুলো সব তাঁর ভেতরে আস্তে আস্তে দানা বেঁধেছে, তাঁর মানস গঠনে সহায়ক হয়েছে এবং তারই প্রতিফলন আমরা তাঁর বিভিন্ন চলচ্চিত্রে দেখতে পাই।
বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের অনেকে ইসলামকে যে দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখেন, তারেক সে দৃষ্টিভঙ্গি পরিহার করেছিলেন। ধর্মীয় ইসলামকে তারেক প্রতিপক্ষ করে তুলতে চাননি। ধর্মীয় ইসলামকে তিনি ধর্মপ্রাণ বাঙালির নিজস্ব বিশ্বাসের বলয়-কাঠামো বলে ভাবতেন। তাই মাটির ময়নায় দেখি যে তিনি আমাদের বৃহত্তর লোকসমাজের অসাম্প্রদায়িক চিহ্নজ্ঞাপক নানা উপাদান ব্যবহার করছেন। লক্ষণীয়, ধর্মীয় ইসলামের নানা দিক মাটির ময়নায় আনলেও রাজনৈতিক ইসলাম সম্পর্কে তিনি তখন কিছুটা নীরব থেকেছেন। সরব হয়েছেন রানওয়েতে এসে, সময়ের প্রয়োজনে।
তারেক মাসুদ আসলে কাজ করতে করতে এগিয়ে গেছেন। কাজ করতে করতে তাঁর মানস অনেক বেশি ঋদ্ধ হয়েছে। কোনো পূর্বনির্ধারিত ধারণাকে কেন্দ্র করে কাজ করেননি। মাটির ময়নায় তিনি অনেকগুলো ধারণাকে একসঙ্গে টেনে এগিয়ে গেছেন। সেখানে রাষ্ট্রের সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক কী হবে, এটা নিয়ে তিনি ভেবেছেন। এখানে তারেক মাসুদ স্পষ্টত ধর্মকে রাষ্ট্রের বাইরে রাখতে চেয়েছিলেন। এ ছাড়া তো আর উপায় ছিল না। সমাজ তার নিজের শরীরের ভেতরেই দ্বন্দ্বের জন্ম দেয় এবং এই দ্বন্দ্বগুলো কীভাবে নিরসিত হবে, কীভাবে সমাধানপ্রাপ্ত হবে, সেটাও সমাজ নিজেই ঠিক করে। এখানে ব্যক্তি ওপর থেকে কিছু চাপিয়ে দেয় না। সুতরাং রাষ্ট্রের সঙ্গে ধর্মের কী সম্পর্ক হবে, এটা তারেক মাসুদের এ সম্পর্কিত নিজস্ব ভাবনা কী, সেটার দ্বারা নির্ধারিত হয়নি। রাষ্ট্রটা ধর্মভিত্তিক হবে, না ভাষাভিত্তিক হবে, এটা নিয়ে যে ঝামেলাগুলো চলছিল, সেই ঝামেলাগুলো থেকে উত্তরণের উপায় আমাদের এই সমাজব্যবস্থাই বাতলে দিয়েছে এবং মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে হটিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদী ধারণাকে প্রতিস্থাপন করেছে। রাষ্ট্রটাকে ধর্মের সঙ্গে সম্পর্কিত করতে চায়নি। ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র—এগুলো ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদের সহচর।
একটা ভুল বোঝার অবকাশ থেকে যাবে যদি আমরা মনে করি যে তিনি মুসলিম জাতীয়তাবাদ বা রাজনৈতিক ইসলামকে প্রশ্রয় দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। সেটা তিনি করেননি। তিনি বলেছেনও একসময় যে ‘আমি ধার্মিক নই, কিন্তু আমি ভীষণভাবে আগ্রহী ধর্মের ব্যাপারে’।১৫ জাকির হোসেন রাজুর মতে, তারেক মাসুদ হলেন সেই ব্যতিক্রমী পরিচালক, যিনি ইসলাম, মুসলমানিত্ব ও মাদ্রাসাকে বিষমরূপে বা হেটারোজেনাস ডিসকোর্স আকারে উপস্থাপন করেছেন।১৬ তার মানে হচ্ছে যে তারেক বুঝতে চেয়েছেন আসলে মূল সংকট বা দ্বন্দ্বটা কী। মাটির ময়নায় যেই সময়টা ধরা হয়েছে সেই সময় রাষ্ট্রীয় সমাজবাস্তবতায় যে সংকট বা দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছিল, তার উত্স সন্ধানের জন্য ইসলাম, মুসলমানিত্ব, মাদ্রাসা, মুক্তিযুদ্ধ, রাষ্ট্র, জাতীয়তাবাদ প্রভৃতি বিষয়কে তিনি বুঝতে চেয়েছেন। এগুলো তাঁর কাছে কিছু প্রপঞ্চ হিসেবে এসেছে। এগুলোর পক্ষ নিয়ে তিনি কখনো ওকালতি করার কথা ভাবেননি বলেই আমার মনে হয়েছে; বিভিন্ন পরিস্থিতিতে এগুলোর কার্যকারিতাকেই পরখ করে দেখতে চেয়েছেন কেবল।
নরসুন্দর
নরসুন্দর একটি স্বল্পদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র। তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদ দুজন মিলে এটি নির্মাণ করেছেন। প্রত্যেক চলচ্চিত্র-নির্মাতার নিজের একটা বক্তব্য থাকে, ওয়েভ অব স্টেটমেন্ট থাকে। এই ওয়েভ অব স্টেটমেন্টগুলো একজন চলচ্চিত্রকার তাঁর কাজের ভেতর আনতে চান। এই স্টেটমেন্টগুলোর সবই যে নির্মাতার নিজের হয়, তেমন নয়। এ দেশে যাঁরা চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন, তাঁদের কোনো না কোনো সূত্র থেকে চলচ্চিত্রটা করার জন্য অর্থটা জোগাড় করতে হয়। অর্থটা কে দিচ্ছে, তাঁর বা তাঁদের কী লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য আছে, তাও তাঁদের দেখতে হয়। তারেক নরসুন্দর করেছেন রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরী মুভমেন্টস্ রিসার্চ তথা ‘রামরু’ নামক একটা সংস্থার অর্থে, যারা অভিবাসী-আটকে পড়া উদ্বাস্তু মানুষ প্রভৃতি ইস্যু নিয়ে কাজ করে। সেই সূত্রে বাংলাদেশে আটকে পড়া বিহারিদের নিয়েও তারা কাজ করে। নরসুন্দর-এর গল্পটা শেষ পর্যন্ত বিহারিদের পক্ষেই গেছে। তারেক মাসুদের বিবেচনায় মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে রচিত একটা পলিটিক্যাল থ্রিলার নরসুন্দর। কিন্তু এই থ্রিলারটার ভেতরে যে ইস্যুটা আসছে কাহিনির মধ্য দিয়ে সেটা আজকের পরিপ্রেক্ষিতে বা সমাজে কতটা গ্রহণযোগ্য, এই প্রশ্ন কিন্তু চলচ্চিত্র সমালোচক হিসেবে আমাকে করতেই হবে। কাহিনিটাতে আছে যে মুক্তিযুদ্ধের সময় একজন মুক্তিযোদ্ধা তাঁর মা-বাবাকে দেখতে আসেন, আর্মি খবর পেয়ে যায়, তাঁকে ধরতে আসে, তিনি পালান। তাঁকে না পেয়ে তাঁর মা-বাবাকে অত্যাচার করে। তিনি পালিয়ে গিয়ে ওঠেন এক সেলুনে। সেলুনে ওঠার সময় বিহারিরা দেখে তাঁর দাড়িটাড়ি হয়ে গেছে, তিনি খুব ভীতসন্ত্রস্ত, তাড়া খাওয়া খরগোশের মতো কাঁপছেন। ছেলেটি দাড়ি কামাতে বসে পড়ে। বিহারিরা যারা সেলুনের মালিক বা চুল কাটে, তারা কিন্তু বুঝে ফেলেছে যে ছেলেটি মুক্তিযোদ্ধাই হবে। কিন্তু তারা সেলুনে আর্মি এলেও ছেলেটিকে ধরিয়ে দেয় না। এখানেই তাদের গ্রেটনেস যে তারা তাকে ধরিয়ে দেয় না। কিন্তু যেভাবে তারা তাঁকে নিয়ে মশকারা-হাসি-ঠাট্টা-তামাশা করে, সেটা কিন্তু দর্শককে ভাবাবে যে ব্যাপারটা কী?
নরসুন্দর-এর প্রধান বক্তব্যটা তাহলে কী দাঁড়াচ্ছে? এটা কি এই যে এই বিহারিদের একাংশ যারা স্বাধীনতার চার দশক পরও এ দেশে রয়ে গেছে, তাদের কিছুটা মহীয়ান করে দেখাতে হবে? বলতে হবে যে একসময় তারাও মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল? আমি নরসুন্দর-এর বক্তব্যের প্রবাহ নিয়ে প্রশ্ন তুলছি বলে এটা ভাবার কোনো কারণ নেই যে আমি তারেকের খুঁত ধরার চেষ্টা করছি। আমি জানি, তারেকানুরাগীরা আমার এমন প্রশ্নে রাগ করবেন। কিন্তু যে কোনো চলচ্চিত্র পাঠ করার ক্ষেত্রে একটি প্রয়োজনীয় দিক হচ্ছে, যে উত্স থেকে চলচ্চিত্রটি নির্মাণের জন্য অর্থ এসেছে, সেই উত্সটির অভিপ্রায় অনুধাবন করা। তাহলে চলচ্চিত্রকারের ‘উদ্দেশ্য’টি বোঝা সহজ হয়। আমি তারেকের চলচ্চিত্রগুচ্ছের একজন মুগ্ধ দর্শক-সমালোচক। আমি কেবল বুঝতে চাইছি কেন, কী কারণে, কীভাবে নির্মিত চলচ্চিত্রের বক্তব্যের কাঠামোটি অবয়বপ্রাপ্ত হয়। বক্তব্যের পেছনে কীভাবে ‘চলচ্চিত্রের অর্থনীতি’ ক্রিয়াশীল থাকে। একই চলচ্চিত্রের ভিন্ন ভিন্ন পাঠ থাকাটাই স্বাভাবিক। নরসুন্দর-এরও আছে। নানা দৃষ্টিকোণ থেকে একটি চলচ্চিত্রকে পাঠ করার উদ্যোগ থেকেই ভিন্ন ভিন্ন সিদ্ধান্ত আসে। প্রণব ভৌমিকের মতে, ‘ঐতিহাসিকভাবে বিহারিরা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল। চলচ্চিত্রের শুরুতে এবং পরবর্তীকালে বিভিন্ন দৃশ্য ও সংলাপে ঐতিহাসিক এ সত্যের উপস্থাপন দেখা গেছে। সেই সঙ্গে এসেছে ব্যতিক্রমও। অর্থাত্ তারেক মাসুদ মুক্তিযুদ্ধে বিহারিদের ভূমিকা নিয়ে প্রচলিত ঐতিহাসিক ধারণার পাশাপাশি স্টেরিওটাইপিং প্রবণতা থেকে বেরিয়ে এসে একজন বিহারির ব্যতিক্রমধর্মী ভূমিকা দেখিয়েছেন।...মূলত একই ছকে সবাইকে না ফেলে সংবেদনশীলভাবে প্রতিটি মানুষকে বিবেচনার কথা বলা হয়েছে এ চলচ্চিত্রে। ফলে নরসুন্দর-এ তারেক মাসুদের জাতীয়তাবাদ-সংক্রান্ত ভাবনার আরেকটি নতুন দিক পাওয়া গেল।’১৭ প্রণব মনে হয় তারেকের বহুত্ববাদী মনোভাবের কথাই বলতে চেয়েছেন। নরসুন্দর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক একটি চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্রে মুক্তিযুদ্ধের উপস্থাপনার দিকটি সম্পর্কে তারেকের নিজের অনুধাবন হচ্ছে:
যুদ্ধের যেমন ভিন্ন ভিন্ন ন্যারেটিভ বা আখ্যান-উপাখ্যান থাকবে, তেমনি মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন বয়ান থাকবে। যারা বিপক্ষে ছিল বা পরে পক্ষ বদল করেছে, তাদের আখ্যান ছিল এবং আছে।... মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে যে উপাখ্যানটি তৈরি হয়েছে, তার মধ্যে ভাবাবেগ বেশি এসেছে, এসেছে একরৈখিকতা—সেটাই স্বাভাবিক। মুক্তিযুদ্ধের মহাকাব্যিক ব্যঞ্জনা, দ্যোতনার দিকটা, এর ধূসর ভূমির অংশটি, মুক্তির দিকটি না এসে যুদ্ধের দিকটি এসেছে।...মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের একটা প্রধান অংশ হলো মানুষ মানুষকে মেরেছে। কিন্তু এটাও পরম সত্য, একাত্তরে মানুষ মানুষকে বাঁচিয়েছে। একজন বাঙালিকে একজন বিহারি বাঁচিয়েছে। একজন বিহারিকে বাঙালি বাঁচিয়েছে। একজন বাঙালি একজন নিরস্ত্র বন্দী পাকিস্তানি সেনাকে বাঁচিয়েছে। একজন পাকিস্তানি একজন বাঙালিকে বাঁচিয়ে দিয়েছে।...আজকের বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও একই কথা। মুক্তিযুদ্ধের ছবিতে একাধিক আখ্যান থাকবে এবং পরস্পরবিরোধী বয়ান থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। মুক্তিযুদ্ধ মানেই যে ফর্মুলা, যাকে এভাবেই দেখতে হবে, অন্যভাবে বলা বা দেখার অধিকার শিল্পীর নেই, এটা ঠিক নয়। আমার মনে হয়, এখন সময় হয়েছে মুক্তিযুদ্ধকে অনেক ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখার। এটা মনে হয় দর্শকের কাছে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে, মুক্তিযুদ্ধকে এই ভিন্নভাবে দেখা, যেখানে সব পক্ষকে সমালোচনা করেও ছবি বানানো যেতে পারে। তবে নির্মাতার নিজের উদ্দেশ্য কী? মুক্তিযুদ্ধে তার গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্নটি থেকেই যায়।১৮
অন্তর্যাত্রা
নরসুন্দর দেখে মনে হয়েছে যে এর বক্তব্যের কাঠামোটি নির্ধারণের ক্ষেত্রে যারা চলচ্চিত্রটি নির্মাণের জন্য ফান্ড দিয়েছে, তাদের মতাদর্শের একটা ছাপ আছে। তারেকের অন্তর্যাত্রাতেও এই ছাপ আছে। পৃথিবীর সব ফান্ডেরই একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থাকে। সেই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অনুযায়ী চিত্রনাট্য রচনা ও চলচ্চিত্র নির্মাণ কোনো দোষের বিষয় নয়, বরং প্রতিযোগিতা করে ফান্ড পাওয়াটাই কৃতিত্বের ব্যাপার। অন্তর্যাত্রা নির্মাণের জন্য অর্থ দিয়েছে ‘রটরডাম উত্সব গ্রান্ট’ ও ঢাকার ‘ব্রিটিশ কাউন্সিল’। এই চলচ্চিত্রের বক্তব্যের কাঠামোটিতে এমন একটি আভাস দেওয়া আছে যে অভিবাসীজনেরা যদি তাঁদের পরবাসকেই আপন করে নেন, তবে তাঁদের মানসিক স্থিরতা বাড়বে। ধারণা করি, এই বক্তব্য ফান্ডের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এতে করে তারেককে নিজের সঙ্গে কিছুটা আপস করতে হয়েছে বলে মনে হয়। এখানে স্বাধীনভাবে নিজের বলার বিষয়টি নির্ধারণ করতে তিনি পারেননি। যদিও তারেক মনে করেন, অন্তর্যাত্রায় যে বক্তব্য তিনি হাজির করেছেন, তা অত্যন্ত ভ্যালিড। তিনি লিখেছেন, ‘অন্তর্যাত্রা—যার আক্ষরিক অনুবাদ হতে পারে ইনার জার্নি—স্বদেশ নিয়ে তৈরি। ঘরে ফেরার গল্প। স্বদেশ কি কেবল ভূমি? ভূমি কি স্বদেশ? আমাদের কল্পনায় কি কেবল স্বদেশ-ভূমি? আমরা ঠিক কোথাকার? কোথা থেকে এসেছি আমরা? কবি জালালুদ্দিন রুমির পঙিক্ত আছে, ‘আমি নই পুবের, নই আমি পশ্চিমের—দেশ আমার দেশহীন, ঠিকানা আমার ঠিকানাবিহীন। কান্দাহারে তাঁর জন্ম, মৃত্যু তুরস্কের কনইয়ায়। দুই জায়গাতেই কি নিজেকে তাঁর আগন্তুক মনে হতো? সম্ভবত তাঁর ঘর এ দুই জায়গার মাঝামাঝি কোথাও ছিল—তাঁর যাত্রার মধ্যে।’১৯ তারেকের এই মত অনুধাবন থেকে জীবন ও জগত্ সম্পর্কে তাঁর দার্শনিক অবস্থান স্পষ্ট হয়, তাঁর মানস যে সুফিবাদের ‘মরমিভাব’ দ্বারা আচ্ছাদিত, এ বিষয়ে আর সংশয় থাকে না।
অন্তর্যাত্রার কাহিনি ‘আত্মপরিচয়’ প্রসঙ্গকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। এতে জাতিসত্তা, ব্যক্তি, সমাজ ও বংশপরিচয়ের সূত্রগুলো ধরার চেষ্টা পরিলক্ষিত হয়। এর কাহিনি-কাঠামোর একাংশে ষাট-সত্তর-আশির দশকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও তত্কালীন তরুণ সমাজের প্রতিনিধিত্বকারী একটি অংশকে ধরা হয়েছে রফিক ও শিরিনের প্রেম ও বিয়ের মধ্য দিয়ে—‘তাদের নিজেদের পছন্দেই বিয়ে হয়। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তাঁরা একই সঙ্গে পড়েছে। প্রগতিশীল রাজনীতি আর সংস্কৃতির পরিমণ্ডলে তাঁরা বেড়ে উঠেছে। রফিক প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মী আর শিরিন ব্যস্ত গ্রুপ-থিয়েটার আর গান নিয়ে। রফিক গান ভালোবাসে, আর সে কারণেই ভালোবাসে শিরিনকে। সেই ভালো লাগা অবশেষে গড়ায় বিয়েতে। রফিকের অগ্রসর চিন্তা আর দৃষ্টিভঙ্গি শিরিনকে আকৃষ্ট করে তার প্রতি। ভালোবাসা সংসারে রূপ নিলে সম্পর্কের বাস্তবতা ক্রমে পাল্টাতে থাকে।’২০ রফিক ক্রমেই সবকিছু থেকে সরে এসে আত্মকেন্দ্রিক হয়ে বাঁচতে চায়। দুজনের ব্যক্তিত্বের সংঘাত পরবর্তীকালে সম্পর্কের ছেদ অবধি গড়ায়। লক্ষণীয় যে ওদের বেড়ে ওঠার কালটা বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষের একটা সন্ধিক্ষণ।২১
তারেক মাসুদ একেবারে নিজস্ব অর্থায়নে যখন চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন, তখন তিনি বক্তব্য প্রকাশের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা পেয়েছেন এবং তার প্রয়োগও করেছেন, কোনো বাদ-ভাবের তোয়াক্কা করেননি। এ ক্ষেত্রে আদম সুরত, মুক্তির গান, মুক্তির কথা, রানওয়ে-এর কথা বিশেষভাবে বলা যায়। মাটির ময়নাতেও তারেক নিজস্ব বক্তব্য উপস্থাপন করতে পেরেছেন, নানা উত্স থেকে অর্থ পাওয়া সত্ত্বেও। ধারণা করি, কাগজের ফুল-এর চিত্রনাট্যেও তিনি একেবারে স্বাধীনভাবে বক্তব্যের কাঠামোটি দাঁড় করিয়েছেন। কারণ এটি তিনি নিজস্ব অর্থায়নে নির্মাণ করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন।
রানওয়ে
মাটির ময়নায় বাঙালি মুসলমানের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানি পাঞ্জাবি মুসলমানের দ্বন্দ্বটা প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছিল। এই দ্বন্দ্বটা নিরসন করেই ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়। এই দ্বন্দ্বটা নিরসন হওয়ার পর বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোর মধ্যে বাঙালি ধর্মনিরপেক্ষ মুসলমানের সঙ্গে বাঙালি উগ্র ধর্মান্ধ মৌলবাদী মুসলমানদের দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এই দ্বন্দ্ব এখনো চলছে এবং এই দ্বন্দ্বেরই একটা বহিঃপ্রকাশ আমরা রানওয়েতে পাই। বস্তুত রাষ্ট্রের সঙ্গে ধর্মের সম্পর্কটা এখনো মীমাংসা করা সম্ভব হয়নি বাংলাদেশ নামক জাতিরাষ্ট্রে। এ জন্যই বারবার এই দ্বন্দ্বটা ঘুরেফিরে আসছে—বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার এত বছর পরও আবার ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পাঁয়তারা লক্ষ করা যাচ্ছে। মাটির ময়নার পর রানওয়েতে দ্বিতীয়বার অ্যাড্রেস হয়েছে এই দ্বন্দ্বটা।
রানওয়ে ২০০৫-২০০৬ সালে জাতীয় পর্যায়ে সংঘটিত জঙ্গিবাদী অপতত্পরতা নিয়ে নির্মিত। এতে দেশি-বিদেশি জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ডের খপ্পরে পড়ে রুহুল নামের এক সরল ছেলের জঙ্গিবাদী হয়ে ওঠা, জঙ্গিবাদী কার্যক্রমে অংশ নেওয়া প্রভৃতি দেখানো হয়েছে। রুহুলের এই জড়িয়ে পড়ার কারণে একপর্যায়ে সে নিজেই শুধু মানসিক দোলাচলে ভোগে না, তার পরিবারের সদস্যরাও আক্রান্ত হয়। সর্বোপরি সমাজ-রাষ্ট্রে অস্থিরতা দেখা দেয়। শেষাবধি রুহুল তার ভুল বুঝতে পারে এবং মায়ের কাছে ফিরে আসে। মা দুধ দিয়ে ছেলের মুখ ধুইয়ে তাকে ঘরে তুলে নেন।
বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব চলছিল, তার সমাধানটা তারেক মাটির ময়নায় লোকধর্মের মধ্যে খুঁজেছেন। রানওয়েতেও লোকধর্মের কাছে আশ্রয় নিয়েছেন। এর শেষ দৃশ্যে মায়ের ছেলেকে দুধ দিয়ে মুখ ধুইয়ে দেওয়ার প্রসঙ্গটি আমাদের লোকসংস্কৃতির পুরোনো একটি আচার। লোকায়ত সমাজে একটি আচার আছে, কোনো কিছুকে পরিশুদ্ধ করতে হলে নারকেলের পানি বা দুধ দিয়ে তা ধুইয়ে দিতে হবে। আসলে লোকধর্মের প্রতি তারেকের একধরনের পক্ষপাত ছিল। তাঁর মৃত্যুর পর যে স্মৃতিচারণামূলক অনুষ্ঠান হয়েছিল ব্রিটিশ কাউন্সিলে, তখন যাঁরা স্মৃতিচারণা করেছিলেন, তাঁদের কথা নিয়ে যে গ্রন্থটা বের হয়েছে, তার একটা সমালোচনা লিখেছিলাম।২২ ঠিক সমালোচনা নয় ওটা, তাঁকে একটা চিঠি লিখেছিলাম। পত্রপ্রবন্ধ বলা যায়। বিভিন্ন বক্তার সাহায্য নিয়ে সেই চিঠিতে উল্লেখ করেছি যে আসলে তিনি কী ধরনের মানসিকতার মানুষ ছিলেন। তাঁর মনন গড়ে উঠেছে আমাদের লোকসংস্কৃতির নানা উপাদান দ্বারা। এটা ঠিকই বৃহত্তর লোকসমাজের ভেতরে যেসব ধর্ম আছে, তারা একে অন্যকে কখনো কখনো আক্রমণ করলেও সতত সমন্বয়বাদী একটা মনোভাবের মধ্য দিয়েই এগিয়ে গেছে। লোকধর্ম যেটাকে বলা হচ্ছে, সেটা আসলে লোকসংস্কৃতির পর্যায়েই পড়ে। আমাদের লোকসংস্কৃতি খুবই সমৃদ্ধ। এখানে হিন্দু-মুসলমান এবং অন্য ধর্মাবলম্বীরা সবাই মিলেমিশে অবস্থান করছে। বিভিন্ন ধারণা একটা আরেকটার গায়ে লেগেই আছে। ধানখেত যখন বাতাসে দোলে, তখন ধানের ছড়া একটা আরেকটার গায়ে হেলে পড়ে, তেমনি অনেক দিন ধরে একই জায়গায় বসবাস করার ফলে একটা ধর্মের ধ্যানধারণা আরেকটা ধর্মে কিছুটা হলেও প্রভাব ফেলে। লোকসংস্কৃতি, লোকধর্ম—যাই বলি, এটাই তারেক মাসুদের পছন্দের ধর্ম ছিল। কারণ, ওই যে সমন্বয়বাদী মনোভাব, ওই যে মাঝামাঝি থাকা, একে অন্যকে আক্রমণ না করা—এই মনোভাবটাই তারেকের পছন্দের দর্শন ছিল।
সমাজ এমন কোনো সমস্যার জন্ম দেয় না, যার সমাধান তার নিজের মধ্যে নেই। দ্বন্দ্বগুলোর ভেতরে সমাধানটাও থাকে। হয়তো একটু সময় লাগে কিন্তু সমাধানটা আসেই। আমরা যদি বর্তমান বাংলাদেশে ইসলাম ধর্মের অবস্থা ও অবস্থানটা দেখি, তাহলে দেখব যে দুটি পক্ষ এর মধ্যে আছে। এক দলে আছেন ধর্মীয় ইসলামপন্থী, আরেক দলে আছেন রাজনৈতিক ইসলামপন্থীরা। তারেক মাসুদ ধর্মীয় ইসলামের পক্ষই নিয়েছেন। কারণ, ধর্মীয় ইসলাম এ দেশের অধিকাংশ মানুষের আচরণীয় ধর্ম। যেকোনো ধর্ম সমাজে দুটি প্রধান ভূমিকা পালন করে: ব্যক্তিগত ও দলগত উদ্বেগ লাঘব করে এবং একই সঙ্গে সমাজকে একটা রুটিন ও সিস্টেমে চলতে সাহায্য করে। এই রাষ্ট্রে সবাই একসঙ্গে থাকবে, এটাই তারেকের রাষ্ট্রদর্শন ছিল বলে প্রতীয়মান হয়। এই যে সমন্বয়বাদী একটা ব্যাপার, এটাই কিন্তু আমাদের লোকধর্মের একটা বিরাট রক্ষাকবচ, একটা বিরাট দার্শনিক অবস্থান। বাধ্য হয়ে আমাদের বৃহত্তর লোকসমাজ এই অবস্থান নিয়েছে। এটার এখনো দরকার আছে। পশ্চিম পাকিস্তানি পাঞ্জাবি মুসলমানদের সঙ্গে তো আমাদের দ্বন্দ্ব শেষ। তাহলে এখন দ্বন্দ্ব কার সঙ্গে, কোথায় হচ্ছে? এখন দ্বন্দ্বটা বেধেছে আমাদের নিজেদের মধ্যে: বাঙালি ধর্মনিরপেক্ষ মুসলমান বা উদারপন্থী, এরা এক পক্ষে আছে, আরেক পক্ষে কট্টরপন্থী মৌলবাদী রাজনৈতিক ইসলামপন্থী যাঁরা আছেন, তাঁদের মধ্যে। যে দ্বন্দ্বটা এখন দেখা দিয়েছে আমাদের সমাজে, এটা নিরসন না করে সমাজ এগোতে পারবে না। একটা সময় এবং পর্যায়ে এর সমাধানটা আসবে। এর জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে, কাজ করতে হবে। এবং সে জন্যই আমার মনে হয়, তারেক মাসুদ চরম এবং পরম বলে কোনো কিছুতে বিশ্বাস করতেন না। তিনি বিশ্বাস করতেন যেটা, সেটা হলো মাঝামাঝিতে থাকা। মাঝামাঝিতে থাকাই কিন্তু আমাদের বৃহত্তর লোকসমাজ ও লোকধর্মের একটা বড় দৃষ্টিভঙ্গি। আমার যেটা মনে হয়, সমাজ ও রাষ্ট্রের বাস্তব অবস্থাই তাঁকে বাধ্য করেছে এই পথ ধরতে। লোকধর্ম ও বাউলদের দর্শনই তারেক মাসুদকে উত্সাহ দিয়েছে এই মধ্যপন্থী হওয়ার ব্যাপারে।
শেষ কথা
সামগ্রিকভাবে তারেক ও ক্যাথরিন মাসুদ নির্মিত মুক্তিযুদ্ধ ও সমাজ-সংস্কৃতিভিত্তিক আলোচ্য চলচ্চিত্রগুচ্ছে তারেক মাসুদের বাঙালি জাতীয়তাবাদ-সংক্রান্ত ভাবনা উপস্থাপনের বিষয়টি তাহলে কী দাঁড়াচ্ছে? নাতিদীর্ঘ এই আলোচনার ভিত্তিতে বলা যায়, ক্রমান্বয়ে তাঁর চিন্তাভাবনার ভেতরে পরিবর্তন হয়েছে। পূর্বনির্ধারিত একটা থিম বা ভাবনা নিয়ে তিনি কাজে নামেননি। কাজ করতে করতে কাজের ভেতর থেকে তারেকের মধ্যে একটা ডিসকার্সিভ অ্যাপ্রোচ তৈরি হয়েছে। তাঁর মানস গঠন ও চলচ্চিত্রের বক্তব্যের কাঠামোতে সেই অ্যাপ্রোচের অ্যাসপেক্টগুলো ক্রিয়াশীল ছিল। ১৯৭১ সালে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে কেন বাঙালি জাতীয়তাবাদকে দাঁড় করাতে হয়েছিল, তা মুক্তির গান-এ তারেক বুঝতে পেরেছেন। বাঙালি জাতীয়তাবাদ, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ ও বাংলাদেশে অবস্থানরত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের ‘আদিবাসী জাতীয়তাবাদ’-সংক্রান্ত ধারণার মুখোমুখি হন মুক্তির কথা ও অন্তর্যাত্রা নির্মাণ করতে গিয়ে। মাটির ময়নায় ধর্মীয় ইসলাম ও রাজনৈতিক ইসলামের স্বরূপ প্রত্যক্ষ করেন। সেই সূত্রে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদের অভ্যন্তরীণ কাঠামোর পার্থক্য বুঝতে পারেন। রানওয়েতে ধর্মভিত্তিক ও ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদের সংঘর্ষ উপস্থাপন করে দ্বিতীয়টির পক্ষ নেন। ধর্মকে লোকাচারের অংশ হিসেবে গণ্য করেন। ফলে তাঁর মানস ভরে ওঠে মরমি-মধ্যপন্থী-সমন্বয়বাদী মনোভাবে।
তাঁর যে মরমি-মধ্যপন্থী-সমন্বয়বাদী মনোভাব, চরম বা পরমে না যাওয়া, যা তারেকের চিন্তা-কাঠামোর মধ্যে পাওয়া যায়—এগুলো তাঁর জ্ঞানগত কাঠামোতে এসেছে কাজ করতে করতে, কাজের অভিজ্ঞতার মধ্য থেকে। এবং একটু স্পষ্ট করে বলতে গেলে, যে আখ্যান বা ন্যারেটিভগুলোর ভেতরে তিনি ছিলেন, সেগুলো মিলে একটা মেটান্যারেটিভ তৈরি হয়েছিল—এগুলোর ভেতর থেকে তিনি কিছু বিশিষ্ট ধারণা পেয়েছেন এবং সেই বিশিষ্ট ধারণাগুলো তাঁর মননকে তৈরি করেছে। তিনি মাদ্রাসায় ছিলেন। সেটাও তাঁর মানস গঠনে প্রভাব ফেলেছে। তাঁর যে দৃষ্টিভঙ্গি-চেতনাগত জ্ঞানকাঠামো—যা-ই বলি না কেন, সেটাকে তিনি ধর্মের হেটারোজেনাস এলিমেন্টগুলোর সঙ্গে মিলিয়ে পরীক্ষা করে দেখতে চেয়েছেন। মাদ্রাসাজীবনটা তিনি বুঝতে চেয়েছেন, মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থার ভেতরে যে দুই ধরনের ব্যবস্থা আছে, কওমি ও আলিয়া, এগুলোও বুঝতে চেয়েছেন। মাটির ময়নায় রাষ্ট্র ধর্মভিত্তিক না ভাষাভিত্তিক হবে, তাও বুঝতে চেয়েছেন। রানওয়েতেও মাটির ময়নার দ্বন্দ্বটার দ্বিতীয় রূপটাকে অর্থাত্ বাঙালি ধর্মনিরপেক্ষ মুসলমান বনাম বাঙালি ধর্মান্ধ মৌলবাদী মুসলমান—এদের মধ্যে যে দ্বন্দ্বটা এখন চলছে আমাদের রাষ্ট্রে, সেটা বুঝতে চেয়েছেন। দ্বন্দ্বের নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে তিনি ধর্মীয় ইসলামের পক্ষ নিয়েছিলেন বলে আমার বিশ্বাস, রাজনৈতিক ইসলাম তাঁর কাছে গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়নি। বস্তুত, বাঙালি জাতীয়তাবাদী ধারণা বা চিন্তা-কাঠামোর বাইরে তিনি খুব একটা যাননি। এক্সট্রেমিস্ট হওয়ার জন্য রাজনৈতিক ইসলামের মধ্যে যে চিন্তাসূত্র আছে, সেটা তাঁকে প্রভাবিত করেনি বলে ধারণা করি। তিনি নিজের দেশের সমাজবাস্তবতায় যা পেয়েছেন, সেগুলোকে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে নিজের মতো করে ব্যবহার করেছেন তাঁর চলচ্চিত্রে। তারেক মাসুদের মানসিকতায় এই যে দার্শনিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, মনস্তাত্ত্বিক দিকগুলোর অবস্থান, তা একদিনে তৈরি হয়নি। তাঁর চিন্তাভাবনায় বিবর্তন হয়েছে, তবে কোনো কিছুর ভেতরে আটকে থাকেননি তিনি, কোনো কিছুতে বদ্ধ থাকেননি।
তারেক মাসুদ বাঙালি জাতীয়তাবাদ থেকে খুব একটা সরেছেন বলে মনে হয় না। আমাদের দেশে যে দুটি পক্ষ এখন দাঁড়িয়ে গেছে, বাঙালি ধর্মনিরপেক্ষ মুসলমান এবং বাঙালি ধর্মান্ধ উগ্রপন্থী মুসলমান—তাদের মধ্যে বাঙালি মডারেট বা উদারপন্থীদের পক্ষে যাঁরা আছেন, তাঁদের এখনো বাঙালি জাতীয়তাবাদকে আঁকড়ে ধরে থাকতে হচ্ছে, হবে। কারণ, অপর পক্ষটা সব সময় বাঙালি জাতীয়তাবাদকে আক্রমণ করেছে, এখনো করছে। সুতরাং বাঙালি জাতীয়তাবাদের মধ্যে যে রুট প্যারাডাইমগুলো আছে, সেগুলোকে আঁকড়ে ধরা এখন একটা জরুরি কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। চিত্রকলা, চলচ্চিত্র, নাট্যকর্ম, সাহিত্যকর্মসহ শিল্পাঙ্গিকের সব শাখাতেই এই কাজটা করা দরকার। তবে একটা বিষয়ে হুঁশিয়ার থাকতে হবে, যাতে বাঙালি জাতীয়তাবাদের নামে বাংলাদেশে বসবাসরত অন্য কোনো জাতিসত্তার ওপর অন্যায় আচরণ করা না হয়। স্মরণে রাখা দরকার, সব ধরনের জাতীয়তাবাদই একটা পর্যায়ে গিয়ে ফ্যাসিস্ট চরিত্র ধারণ করে, স্ট্রেইট ফ্যাসিজমের দিকে ধাবিত হয়। ‘ফ্যাসিবাদ’ সংগঠিত হয় এভাবে: জাতি -> জাতীয় -> জাতীয়তা -> জাতীয়তাবাদ -> ফ্যাসিবাদ—এই অ্যারো লাইন অনুসরণ করে। এখন আমাদের সংস্কৃতিকর্মীদের এটা একটা বড় দায়িত্ব হয়ে পড়েছে যে বাঙালি জাতীয়তাবাদও যেন এই পথ অনুসরণ করে ফ্যাসিবাদের দিকে ধাবিত না হয়, সেটা খেয়াল রাখা।
প্রকৃত প্রস্তাবে তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি জাতীয়তাবাদের রূপকল্পটি ছিল ভাষাভিত্তিক, নৃতাত্ত্বিক ও অসাম্প্রদায়িক। এই রূপকল্পের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসরত সব ধর্মের মানুষদের একটি অখণ্ড জাতি হিসেবে কল্পনা করা হয়েছিল এবং এই রূপকল্পের নির্মাতা ছিলেন প্রধানত তদানীন্তন আওয়ামী লীগের বাঙালি জাতীয়তাবাদী এলিটরা, তারা ‘খুব সহজেই অর্থনৈতিকভাবে শোষিত এবং রাজনৈতিকভাবে নিপীড়িত প্রাকৃত জনগোষ্ঠীকে এটা বোঝাতে সমর্থ হন, তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সক্ষমতার সমতা প্রতিষ্ঠা করতে হলে পাকিস্তানি রাষ্ট্রকাঠামো থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নৃতাত্ত্বিক জাতীয়তাবাদের ওপর ভিত্তি করে একটি নতুন দেশের জন্ম দিতে হবে এবং এর জন্য প্রয়োজন মুক্তিসংগ্রাম সংঘটিত করা।’২৩ সেই মুক্তিসংগ্রাম সংঘটিত হয়েছিল এবং নতুন রাষ্ট্র ‘বাংলাদেশ’-ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, কিন্তু শোষিত-নিপীড়িত মানুষের সার্বিক মুক্তির বদলে এলিট শ্রেণীর সার্বিক স্বার্থ রক্ষাই হয়েছে কেবল! নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কয়েক বছর পরই জন্ম নিয়েছে ভূখণ্ডভিত্তিক ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’-এর রূপকল্প। এরই ধারাবাহিকতায় পুনরায় সোচ্চার হয়েছে একদা পরাজিত ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদ। শুরু থেকেই বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিরোধিতা করা আদিবাসী বা লঘু নৃগোষ্ঠীরাও আদিবাসী জাতীয়তাবাদের বিষয়টি সামনে নিয়ে আসছে। এ অবস্থায় বাঙালি জাতীয়তাবাদ-সংক্রান্ত রূপকল্পটি নতুনভাবে ব্যাখ্যাত হওয়ার দরকার বলে মনে করি। সম্ভবত ধর্ম, ভাষা ও ভূখণ্ড নিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদের সপক্ষে নতুন রূপকল্পের কথা আমাদের ভাবতে হবে।
তথ্যনির্দেশ ও টীকা
১. তারেক মাসুদের জন্ম ফরিদপুরে, ১৯৫৬ সালে। অল্প বয়স থেকে দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন মাদ্রাসায় পড়ার পর ১৯৯৩ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষা দেন। তারপর নটর ডেম কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। এরপর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, ইতিহাস বিভাগে। বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন থেকেই নানা রকম সাংস্কৃতিক যজ্ঞে জড়িয়ে পড়েন। ছড়া লেখেন, কাজ করেন লেখক শিবিরে। ১৯৭৫ সালে নিজেকে জড়িত করেন চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের সঙ্গে। ১৯৭৬ সালে চলচ্চিত্র সংসদগুলো নিয়ে গঠিত ফেডারেশনে নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন। চলচ্চিত্রবিষয়ক লেখালেখিও করেন, নিজে ক্যাটওয়া নামে একটি চলচ্চিত্র সংসদও প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি বাংলাদেশ শর্ট ফিল্ম ফোরামের (১৯৮৬) প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, বাংলাদেশের প্রথম আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উত্সবের (১৯৮৮) সমন্বয়কারী। চলচ্চিত্র নিয়ে ভারত-যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনার উদ্যোগও নেন কিন্তু নানা কারণে যাওয়া হয়নি। এরই মধ্যে তিনি বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ পরিচালিত তৃতীয় ফিল্ম অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্স সম্পন্ন করেন। তখনই তাঁর মধ্যে চলচ্চিত্র নির্মাণের স্পৃহা জাগে। ১৯৮২ সালের দিকে চলচ্চিত্র নির্মাণে যুক্ত হন। ওই সালে চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানকে নিয়ে আদম সুরত শীর্ষক একটি পার্সোনালিটি ফিল্ম নির্মাণ শুরু করেন, যা ১৯৮৯ সালে শেষ হয়। ১৯৯১ সালে এর একটি প্রদর্শনী হয় গ্যেটে ইনস্টিটিউটে এস এম সুলতান, আহমদ ছফা প্রমুখের উপস্থিতিতে। ২০১৩ সালের ৬ ডিসেম্বর, তাঁর জন্মদিনে শিল্পকলা একাডেমীর জাতীয় চিত্রশালার মিলনায়তনে এর দ্বিতীয় প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। তারেক মাসুদ ১৯৯০ সালের দিকে যুক্তরাষ্ট্রে স্ত্রী ক্যাথরিনসহ চলে যান। ওখানে প্রায় পাঁচ বছর অবস্থান করেন, ওই সময়ই ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর লিয়ার লেভিনের তোলা ফুটেজের সন্ধান পান এবং মুক্তির গান নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়ে স্বদেশে ফিরে আসেন। বাঙালির মহান মুক্তিযুদ্ধের ওপর নির্মিত এই প্রামাণ্য চলচ্চিত্রটি তাঁকে চলচ্চিত্রস্রষ্টার আসনে বসিয়ে দেয়। এরপর একে একে নির্মাণ করেন মুক্তির কথা (১৯৯৯), নারীর কথা (২০০০), মাটির ময়না (২০০২), অন্তর্যাত্রা (২০০৬), নরসুন্দর (২০০৯) ও রানওয়ে (২০১০)। মাটির ময়না কান চলচ্চিত্র উত্সবে ক্রিটিকস প্রাইজ অর্জন করে। ২০১১ সালের ১৩ আগস্ট নির্মাণাধীন কাগজের ফুল-এর লোকেশন হান্টিং শেষে ঢাকায় ফেরার সময় মানিকগঞ্জে তিনি, ক্যামেরা-সঞ্চালক আশফাক মুনীর মিশুকসহ পাঁচজন নিহত হন।
২. ১৯৭১ সালে মার্কিন নাগরিক লিয়ার লেভিন সুপার সিক্সটিন মিলিমিটার ক্যামেরা সঙ্গে নিয়ে কলকাতায় এসেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের ওপর একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করার জন্য। সেই সময় তিনি বাংলাদেশের ভেতরে ঢুকতে চেয়েছিলেন, কিন্তু নানা কারণে খুব বেশি ভেতরে আসতে পারেননি। উদ্বাস্তু শিবির, মুক্তাঞ্চল প্রভৃতি জায়গার চিত্রই তাঁকে ধারণ করতে হয়েছিল। ফলে তিনি অনেক কিছু তুলতে পারেননি। অনেক ক্ষেত্রে অনেক দৃশ্য ধারণ করতে দেওয়াও হয়নি, কিছু রেস্ট্রিকশনও ছিল। তাঁকে মার্কিন গুপ্তচর হিসেবেও সন্দেহ করা হয়েছিল। বিএসএফ এক রাত তাঁকে হাজতেও রেখেছিল! লেভিন বাধ্য হয়ে ‘বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থা’ বলে যে গানের দলটা ছিল, তাদের সঙ্গে মাস দেড়েক থেকে ১৮-২০ ঘণ্টার মতো ফুটেজ নিয়ে দেশে ফিরে যান। দেশে ফিরে জয় বাংলা নামে বাহাত্তর মিনিটের একটা ফিল্ম বানালেও তা প্রচারে আসেনি। অনেক ফুটেজ অব্যবহূত থেকে যায়।
৩. তারেক মাসুদ, ‘লিয়ার লেভিন: আমাদের মুক্তির সারথি’, উদ্ধৃত হয়েছে চলচ্চিত্রকথা থেকে, দ্বিতীয় সংস্করণ, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১২, পৃ. ২৪-২৫।
৪. প্রাগুক্ত, পৃ. ২৪
৫. তারেক মাসুদ, ‘মুক্তির গান-এর গল্প’, উদ্ধৃত হয়েছে চলচ্চিত্রকথা থেকে, ২০১২, পৃ. ১৯।
৬. ফরহাদ মজহার, ‘শোকার্ত পূর্ণিমায় খণ্ড চিন্তা’, উদ্ধৃত হয়েছে তারেক মাসুদ, অপ্রকাশিত গবেষণাকর্ম থেকে, গবেষক: রুবাইয়াত্ আহমেদ, বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ, ঢাকা, ২০১১, পৃ. ১৩৮।
৭. খন্দকার সাখাওয়াত আলী, ‘অন্তরজগত্, অভিবাসন ও অন্তর্যাত্রা,’ বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ জার্নাল, প্রথম বর্ষ, সংখ্যা-০১, বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ, ঢাকা, ২০০৮, পৃ. ৫৩।
৮. সাজেদুল আউয়াল, ‘মাটির ময়না : একটি “মরমী” চলচ্চিত্রের নাম,’ নতুন দিগন্ত, প্রথম বর্ষ-চতুর্থ সংখ্যা, সমাজ-রূপান্তর অধ্যয়ন কেন্দ্র, ঢাকা, ২০০৩।
৯. তারেক মাসুদ, ‘সত্যজিত্ ও রবীন্দ্রনাথ’, উদ্ধৃত হয়েছে চলচ্চিত্রকথা থেকে, পৃ. ১০৩।
১০. ফরহাদ মজহার, ‘শোকার্ত পূর্ণিমায় খণ্ড চিন্তা,’ পৃ. ১৩৯-১৪৩।
১১. সাজেদুল আউয়াল, ‘তারেক মাসুদ ও তার লোকচলচ্চিত্র’, কালি ও কলম, আইস মিডিয়া লিমিটেড, ঢাকা, জুন ২০১২।
১২. তারেক মাসুদ, ‘যেভাবে আদম সুরত’, উদ্ধৃত হয়েছে চলচ্চিত্রকথা থেকে, পৃ. ১৩-১৪।
১৩. তারেক মাসুদ, ‘অন্তর্যাত্রা, বহির্যাত্রা: সিনেমা যখন সহযাত্রী’, উদ্ধৃত হয়েছে চলচ্চিত্রকথা থেকে, পৃ. ৪৫।
১৪. তারেক মাসুদ, ‘চলচ্চিত্রের চোখ: বাংলাদেশকে নতুন করে দেখার জন্য’, উদ্ধৃত হয়েছে চলচ্চিত্রকথা থেকে, পৃ. ১৭২।
১৫. Fahmidul Haq, ‘Popular culture as a safeguard against extremism’ (Interview with Fahmidul Haq), Forum (The Daily Star), Volume 5, Issue 9, উদ্ধৃত হয়েছে ‘তারেক মাসুদের ভাবনা: মাটির ময়না ও রানওয়ে চলচ্চিত্রের বিশ্লেষণ’ থেকে, সাবরিনা সুলতানা চৌধুরী, বাদল রহমান স্মারক বত্তৃতা-২০১৩ (অপ্রকাশিত), ঢাকা, ২০১৩, পৃ. ৪।
১৬. প্রাগুক্ত, পৃ. ৪।
১৭. প্রণব ভৌমিক, ‘তারেক মাসুদের চলচ্চিত্রে জাতীয় আত্মপরিচয়ের খোঁজ’, তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীর স্মারক বক্তৃতা-২০১৩, (অপ্রকাশিত রচনা), ঢাকা, ২০১৩, পৃ. ৩/৭।
১৮. তারেক মাসুদ, ‘মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র: ব্যতিক্রম ও বিতর্ক’, উদ্ধৃত হয়েছে চলচ্চিত্রকথা থেকে, পৃ. ১৬৫-১৬৮।
১৯. তারেক মাসুদ, ‘অন্তর্যাত্রা, বহির্যাত্রা: সিনেমা যখন সহযাত্রী’, উদ্ধৃত হয়েছে চলচ্চিত্রকথা থেকে, পৃ. ৪৬
২০. খন্দকার সাখাওয়াত আলী, ‘অন্তরজগত্, অভিবাসন ও অন্তর্যাত্রা’, পৃ. ৫৫।
২১. বর্তমান বিশ্ববাস্তবতায় বাংলাদেশ আজ আন্তর্জাতিক অভিবাসনের সড়ক ধরে হাঁটছে। অন্তর্যাত্রায় রফিকের বাবা নাতিকে মানসিক প্রস্তুতি গড়ে দিতে চা-বাগানে কাজ করতে আসা ইউরোপীয়দের কবরখানায় নিয়ে যান। এ কবরখানার এপিটাফগুলো সোহেলের সামনে ঔপনিবেশিকতার প্রেক্ষাপটটি স্পষ্ট করে তোলে। খন্দকার সাখাওয়াত আলী লিখেছেন: ‘দাদা বড় সহজভাবে সোহেলের কাছে বিশ্ব-অর্থনীতির সঙ্গে অভিবাসনের ইতিহাসগত উদাহরণগুলো তুলে ধরেন। এপিটাফ পড়ে সোহেল দেখতে পায় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সময়ে অনেক ইংরেজ তরুণ এ দেশে কাজ করতে আসে। এরা কাজ করত ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে, চায়ের বাগানসহ প্রশাসনের নানা কাজে। এদের মধ্যে কেউ কেউ খুবই কম বয়সে মারা গেছে। তাদের সমাধি রয়ে গেছে এ অঞ্চলে। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে, তরুণ সম্প্রদায় সব সময় দেশের বাইরে গিয়ে কাজ করে এটাই স্বাভাবিক রীতি, এটাই অর্থনীতি আর সমাজের নিয়ম। চা-বাগানের আদি শ্রমিকেরা এসেছিল উড়িষ্যা থেকে। শ্রমমূল্যের সুবিধা আদায়ের উদ্দেশ্যে এদের আনা হয়েছিল। আজও শ্রমমূল্যের সুবিধাজনক অবস্থান চা-শিল্প বহন করে চলেছে। বংশপরম্পরায় চা-শ্রমিকদের এই অবস্থান শ্রম দাসত্বের আরেক রূপ। আজ একই জিনিস অন্যভাবে ঘটছে। ইউরোপ, আমেরিকাসহ উন্নত দেশসমূহে তুলনামূলকভাবে শ্রমনির্ভর ও কর্মদক্ষতাসম্পন্ন কাজ করে অভিবাসিত মানুষেরা। এদের কয়েক প্রজন্ম স্থানীয়ভাবে বসবাসের সূত্রে মূলধারার সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে পড়ে। সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় এদের ধাপে ধাপে আত্মীকরণ করে নেওয়া হয়েছে। যা বিশ্ব-অর্থব্যবস্থারই একটি অংশ বা অনুষঙ্গ। পরোক্ষভাবে দাদা তার নাতিকে অতীতের এ অভিজ্ঞতা দিয়ে ভবিষ্যতের বাস্তবতাকে গ্রহণের মানসিক প্রস্তুতি তৈরি করে দেন।’ আত্মপরিচয় আর জাতিসত্তা নিয়ে টিকে থাকার লড়াইয়ের প্রসঙ্গটিকে তারেক মাসুদ অন্তর্যাত্রায় এভাবেই নানা অংশে বিভক্ত করে দক্ষতার সঙ্গে মূল বক্তব্যের কাঠামোর সঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছেন।খন্দকার সাখাওয়াত আলী, ‘অন্তরজগত্, অভিবাসন ও অন্তর্যাত্রা,’ পৃ. ৫৭।
২২. সাজেদুল আউয়াল, ‘তারেক মাসুদের জীবন, কর্ম ও স্বপ্নের পাঁচালী’, বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ জার্নাল, পঞ্চম বর্ষ, সংখ্যা-৫, বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ, ঢাকা, জুন ২০১২।
২৩. সাঈদ ইফতেখার আহমেদ, ‘গণজাগরণ মঞ্চ: আত্মপরিচয়ের পুনঃঅনুসন্ধান,’ প্রতিচিন্তা, অক্টোবর-ডিসেম্বর সংখ্যা-২০১৩, প্রথম আলো, ঢাকা, ২০১৩, পৃ. ৪৮।