দুই অর্থনীতির তত্ত্বের মধ্য দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতিবিদদের মধ্যে চিন্তার সূত্রপাত হয়, কীভাবে সে অঞ্চলের অর্থনৈতিক অধিকার রক্ষা করা যায় এবং অর্থনীতির শ্লথ প্রবৃদ্ধির চাকা উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া যায়। এই নিম্ন প্রবৃদ্ধির কারণে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার বৈষম্য বৃদ্ধি পায়। পাকিস্তানের আর্থনীতিক কৌশল প্রণয়নের ক্ষেত্রে সবচেয়ে যথাযথ এবং গুরুত্বপূর্ণ বিশ্লেষণী ও ধারণাগত কাঠামো হিসেবে এই তত্ত্ব পেশ করা হয়েছিল।
একই সঙ্গে, রাজনৈতিক নেতারা রাজনৈতিক অধিকারের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিলেন, যার পরিণতিতে ১৯৫৪ সালে পূর্ব পাকিস্তানে মুসলিম লীগের কার্যত মৃত্যু হয়। পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোয় মুসলিম লীগ পূর্ব পাকিস্তানের ন্যায্য হিস্যা প্রতিষ্ঠিত করতে না পারায় দলটির এ পরিণতি হয়, ফলে ক্রমান্বয়ে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বায়ত্তশাসনের দাবির বিষয়টি উঠে আসে।
এই প্রবন্ধের লক্ষ্য হচ্ছে, দুই অর্থনীতির তত্ত্ব সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা দেওয়া এবং তার প্রকৃত ইতিহাসের ওপর আলোকপাত করা। পাকিস্তানের উন্নয়নের এই কাঠামোর উত্স নিয়ে গত কয়েক বছরে গণমাধ্যম ও বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে অনেকেই অনেক কথা বলেছেন, যার মধ্যে অনেক কথাই ভুল ও অযথাযথ। কিন্তু ছয় দফার—যার মূল অর্থনৈতিক প্রপঞ্চ ছিল এই ধারণা—ভিত্তিতে পরিচালিত স্বাধীনতার সংগ্রাম শেষমেশ সফল না হলে এই যুগান্তকারী ধারণা হয়তো মহাফেজখানায় পোকার খাদ্যে পরিণত হতো, সেটা এতটা দৃষ্টি আকর্ষণ করত না। সর্বোপরি, মানুষ সফলতার ভাগীদার হতে চায়, ব্যর্থতার নয়।
পাকিস্তানে যে দুটি অর্থনীতি বিরাজ করছে, এই ধারণা প্রথম তোলা হয় ১৯৫৬ সালে। পাকিস্তানের প্রথম খসড়া পঞ্চবার্ষিক (১৯৫৬-১৯৬০) পরিকল্পনার জন্য উন্নয়ন কৌশল প্রণয়নে অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতিবিদদের বিশেষ সম্মেলনে এই ধারণাটি পেশ করা হয়। ১৯৫৬ সালের আগস্ট মাসের শেষের দিকে ঢাকায় এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ওই সম্মেলনের বিশেষ প্রতিবেদনে এই ধারণার মূল দিকগুলো বিস্তৃত করা হয়, যে প্রতিবেদন ১৯৫৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর পাকিস্তান প্ল্যানিং কমিশনের কাছে পেশ করা হয়। পুরো প্রতিবেদনটি আমার বই বাংলাদেশ—মেকিং অব আ নেশন-এ পুনর্মুদ্রিত হয়েছে।
প্রতিবেদনের যে অংশটি নিচে উদ্ধৃত করছি, সেটার আর অধিক ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই: ‘পাকিস্তানের উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়নে, বিশেষ করে কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য, দেশটিকে দুটি ইউনিটে ভাগ করতে হবে। পাকিস্তানের দুটি ইউনিটের বৈশিষ্ট্য বিবেচনা করলেই তার উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়নের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা যায়, বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানের অধিক জনসংখ্যা, তুলনামূলক অধিক বেকারত্ব এবং দুটি ইউনিটের মধ্যে শ্রমিকদের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় একেবারেই না যাওয়া—এসব বিষয় আমলে নিতে হবে’। ‘আমাদের মতে, পরিকল্পনা প্রণয়নের প্রাথমিক অপরিহার্যতা হচ্ছে, দুটি অংশের পরিসংখ্যান আলাদা আলাদাভাবে দেখানো, যেমন: জাতীয় আয়, ব্যালান্স অব পেমেন্ট ও আর্থিক সম্পদ—অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক’। ১০ জন অর্থনীতিবিদ এটি প্রণয়ন ও স্বাক্ষর করেছিলেন, আর সস্মেলন তা অনুমোদনও করে। এই ১০ জনের মধ্যে আমিই ছিলাম সবচেয়ে কনিষ্ঠ অর্থনীতিবিদ, তার আগের বছরই অর্থাত্ ১৯৫৫ সালে আমি হার্ভার্ড থেকে ফিরে বিশ্ববিদ্যালয়ে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দিয়েছি। অন্যান্য অর্থনীতিবিদ হচ্ছেন: এম এন হুদা, মাজহারুল হক, এ রাজ্জাক, নুরুল ইসলাম, এ সাদেক, এ ফারুক, এ এন এম মাহমুদ, মো. সাইফুল্লাহ মুহাম্মদ হোসেন ও শফিকুর রহমান। অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, এই মানুষদের মধ্যে একমাত্র আমিই বেঁচে আছি। ১৯৫৯-৬০ সালে দ্রব্যমূল্যের দ্রুত বৃদ্ধির কারণ খতিয়ে দেখতে গঠিত প্রাইস কমিশনের প্রতিবেদন প্রস্তুত করার সময় আমি উপর্যুক্ত কাঠামোটি বাজিয়ে দেখতে পেরেছিলাম। কমিশনে আমিই ছিলাম একমাত্র পূর্ব পাকিস্তানি অর্থনীতিবিদ সদস্য। দুই অর্থনীতি তত্ত্বের মৌলিক প্রস্তাব ছিল, দাম বাড়াসহ সব অর্থনৈতিক বিষয়ই পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের ক্ষেত্রে আলাদা আলাদাভাবে বিশ্লেষণ করতে হবে, পৃথকভাবে বিবেচনা করতে হবে। পশ্চিম পাকিস্তানের চেয়ে পূর্ব পাকিস্তানের মূল্যস্ফীতির মাত্রা ছিল অনেক বেশি। আর এর কারণ ও তা থেকে পরিত্রাণের উপায়ও দুই পাকিস্তানের ক্ষেত্রে ভিন্ন। কমিশনের পশ্চিম পাকিস্তানি সদস্যরা এর কঠোর বিরোধিতা করেন। পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বিষয়গুলোকে নতুনভাবে দেখার ব্যাপারটা তাঁদের কাছে ছিল অভিশপ্ত ব্যাপারের মতো, এর মধ্যে তাঁরা বিচ্ছিন্নতাবাদের গন্ধ পেয়েছেন। কমিশনের প্রতিবেদনের সঙ্গে একটি অতিরিক্ত ও পৃথক নোট দিয়ে আমি বাধিত হয়েছিলাম।
পরবর্তী কাজ ছিল পাকিস্তানের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের কাছে এই ধারণা পেশ করা, অর্থাত্ দেশটির প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আইয়ুব খানের কাছে ব্যাপারটি তুলে ধরা। ১৯৬১ সালের মে মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের কয়েকজন অধ্যাপক তাঁর সঙ্গে সরাসরি কথা বলার আমন্ত্রণ পান। আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল পূর্ব পাকিস্তানের অনুন্নয়ন, আঞ্চলিক বৈষম্য ও তার সম্ভাব্য প্রতিকার। এই দলে ছিলেন এম এন হুদা, এ এফ এ হুসেইন, আবদুল্লাহ ফারুক (মাজহারুল হকের অনুপস্থিতিতে) ও নুরুল ইসলাম। তাঁর সঙ্গে আমাদের বিস্ময়করভাবে দীর্ঘ ও খোলামেলা মতবিনিময় হয়। আলোচনার পর তিনি একটি লিখিত স্মারকে আমাদের বিশ্লেষণ ও সুপারিশ পেশ করতে বলেন। ১৯৬১ সালের জুন মাসে আমরা সেই স্মারকলিপিটি তাঁর কাছে পেশ করি। দলের তরুণতম সদস্য হিসেবে প্রতিবেদনটি লেখার দায়িত্বও আমার ওপরই ন্যস্ত হয়। দলের সদস্যরা এর সঙ্গে একমত হয়ে তা অনুমোদন করলে আইয়ুব খানের সচিবের কাছে আমরা সেটা পাঠিয়ে দিই। যেহেতু তাঁদের মধ্যে একমাত্র আমিই জীবিত আছি, ফলে তরুণ প্রজন্মের কাছে আমার মৃত সহকর্মীদের অবদানের কথা পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব আমি নিজ কাঁধে তুলে নিলাম। স্মারকলিপিটির মূল বৈশিষ্ট্য ছিল, এটি পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতিবিদদের প্রণীত আগের একটি প্রতিবেদনের বিস্তৃত রূপ (আমার বই বাংলাদেশ—মেকিং অব আ নেশন-এ এটি পুনর্মুদ্রণ করেছি)।
স্মারকলিপিটির মূল বিশ্লেষণ ও সুপারিশ ছিল নিম্নরূপ: দুই অর্থনীতি তত্ত্বের সারকথা হলো, পাকিস্তানের দুই ইউনিটের শ্রমিকদের এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে আসা-যাওয়ার অভাব। পাকিস্তানের এক অংশে বিনিয়োগ হলে আরেক অংশের শ্রমিকেরা সে কারণে লাভবান হয় না। দুই অংশের মধ্যে পুঁজি সঞ্চালনের মাত্রাও সীমিত হওয়া এবং যোগাযোগের খরচ বেশি হওয়ায় পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। তা ছাড়া দেখা গেছে, যোগাযোগের খরচ বেশি হওয়ায় পাকিস্তানের এক অংশ থেকে আরেক অংশে পণ্য রপ্তানি করার চেয়ে একই দামের পণ্য বিদেশ থেকে আমদানি করা সাশ্রয়ী।
ভৌগোলিক অবস্থান বিবেচনা না করে মুনাফার ভিত্তিতে বিনিয়োগ হওয়ায় পূর্ব পাকিস্তানে বিনিয়োগের পরিমাণ কমে যায়, ফলে বৈষম্য বাড়ে। এর কারণ হচ্ছে, পশ্চিম পাকিস্তানের অনেক স্থানের ভৌগোলিক ও সামাজিক অবকাঠামো স্বাধীনতার আগে থেকেই উন্নত হওয়ায় সেখানে বিনিয়োগ করা অধিক লাভজনক ছিল। কিন্তু দেখা গেল, স্বাধীনতার পর পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে ভারসাম্য আনার জন্য পূর্ব পাকিস্তানে যে অধিকতর বিনিয়োগ করা প্রয়োজন ছিল, সেটা আর হলো না। পরিস্থিতি আরও খারাপ হলো এ কারণে যে স্বাধীনতার পর অনুন্নয়ন ব্যয়েরও সিংহভাগ পশ্চিম পাকিস্তানেই হয়েছে। আর প্রতিরক্ষা ব্যয়েরও সিংহভাগ সেখানেই হয়েছে। ফলত, অবকাঠামোতে ব্যাপক ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হয়। এসব ব্যয়ের পুঞ্জীভূত ফলাফল হিসেবে দেখা গেল, পশ্চিম পাকিস্তানের আয় ও সম্পদ বেড়ে গেল, যার ফলে আবার পশ্চিম পাকিস্তানে সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগ আরও বেড়ে গেল। উপার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা ও বিদেশি সহায়তার বণ্টনের বেলায়ও বৈষম্যমূলকভাবে পশ্চিম পাকিস্তানকে সুবিধা দেওয়া হয়েছে, ফলে পশ্চিমে তার ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়। এমনকি সেখানে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহও বেশ উদারভাবেই করা হয়েছে।
দুই অর্থনীতির ভিত্তিতে উন্নয়ননীতি প্রণয়ন করতে হলে উপার্জনমূলক কার্যক্রম ও কর্মংসংস্থান পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য আলাদা আলাদাভাবে করতে হবে। সে কারণে নিম্নোক্ত সুনির্দিষ্ট পরামর্শটি আমার দিয়েছিলাম: দুই অঞ্চলের জন্য স্বাধীনভাবে আয় বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানের পরিমাণগত লক্ষ্য গ্রহণ করতে হবে। এই স্বাধীন লক্ষ্য অর্জনে দুই অংশের জন্য পৃথক আঞ্চলিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা উচিত।
সক্রিয় পরিস্থিতিতে দুই অঞ্চলের খরচের তুলনামূলক আনুমানিক হিসাব করতে হবে, এর মধ্যে সামাজিক ও ভৌগোলিক ওভারহেড ক্যাপিটালের ভবিষ্যত্ বিকাশের পরোক্ষ প্রভাবও আমলে নিতে হবে। একইভাবে, পশ্চিমের সঙ্গে পূর্বের যেসব পণ্যের বাণিজ্য হবে, তার উত্পাদনমূল্যের সঙ্গে পশ্চিমের অ্যাবসোলিউট কস্টের তুলনা করা যাবে না। বরং পশ্চিম থেকে আমদানি করা পণ্যের ল্যান্ডেড কস্টের সঙ্গে তার তুলনা করতে হবে।
এর পাশাপাশি, পূর্ব পাকিস্তানে কর্মসংস্থান বাড়ানোর অতি জরুরি চাহিদা পূরণের জন্য দুই অংশের মধ্যকার মূল্যের তুলনার মানদণ্ড যখন প্রয়োজন তখনই বদলাতে হবে।
শেষমেশ, পাকিস্তানের দুই অংশের সম উন্নয়নের জন্য সংবিধানে ধারা থাকতে হবে। যেমন সেই ধারায় বলা থাকবে, ২০ বছরের মধ্যে পাকিস্তানের দুই অংশের উন্নয়নের ভার মূলত কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে ন্যস্ত হবে। সেই লক্ষ্য অর্জন করার জন্য এর সুপারিশ করা হয় যে পূর্ব পাকিস্তানের মোট বিনিয়োগ ১৯৬০-৬৫ কাল পর্যায়ে ৩০ শতাংশ থেকে ১৯৭৫-৮০ কালপর্বে ৬০ শতাংশে উন্নীত করতে হবে।
এই প্রতিবেদনের কৌশল ছিল পূর্ব পাকিস্তানের উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে আইয়ুব খান যে কথা বলেছিলেন, সেই কথা দিয়েই তাঁকে ধরা, আঞ্চলিক বৈষম্য কমানো। আর একই সঙ্গে সরকার-প্রধান হিসেবে তাঁকে দেখানো, তাঁর সরকার কীভাবে এই লক্ষ্য অর্জন করতে পারে। আর আইয়ুব খান যদি বলে ফেলেন, কেন্দ্রীয় সরকার কোনো দায়িত্ব নেবে না, তাহলে পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে আমরা বলতাম, দুই অঞ্চলের মধ্যে সম্পদ ভাগ করে দিয়ে নিজস্ব সম্পদের ভিত্তিতে তাদের উন্নয়ন হোক, যেটা একটা কাঙ্ক্ষিত সমাধান হতে পারে। সেই বিকল্প পরিস্থিতির জন্য আমরা নিম্নোক্ত সুনির্দিষ্ট পরামর্শটি দিয়েছিলাম:
কেন্দ্রের হাতে স্রেফ তিনটি কাজ থাকবে: প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্রনীতি ও দুই অংশের আন্তযোগাযোগের কয়েকটি দিক।
প্রতিটি অঞ্চলের মুদ্রা ও ঋণনীতি স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের স্থানীয় পরিচালকেরা নির্ধারণ করবেন, যদিও মুদ্রা থাকবে একটিই। সব সরকারি রাজস্ব ও বৈদেশিক মুদ্রা যে অঞ্চল থেকে এসেছে, তা সেই অঞ্চলেই ব্যয় হবে। দুই অঞ্চল নিজেদের সামর্থ্য ও কেন্দ্রীয় ব্যয়ের কারণে যেভাবে লাভবান হয়েছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যয়ভার বহন করবে।
প্রতিবেদনের উপসংহারে আমরা বলেছিলাম, উপর্যুক্ত পরামর্শগুলো গৃহীত হলে একটি বিশেষজ্ঞ দল এর বিস্তারিত খুুঁটিনাটি নির্ধারণ করতে পারবে। আমরা আরও বলেছিলাম, ‘বর্তমান দলটি সমস্যাগুলো খতিয়ে দেখছে, আর প্রয়োজন হলে তারা এই বিষয়ের ওপর প্রতিবেদনও দিতে পারে।’ আইয়ুব খানের সচিবালয় থেকে এই প্রতিবেদন-বিষয়ক কোনো সাড়া আমরা পাইনি। ফলে আমরা ধরে নিই, প্রতিবেদনটি তাঁর আস্থাভাজন উপদেষ্টা পরিকল্পনা ও অর্থমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হয়েছে। মন্ত্রীদ্বয় আমাদের দলটিকে বিপথগামী বা রাজনীতিকদের দ্বারা প্রতারিত বলে আখ্যা দেন, এমনকি তিনি আমাদের আরও খারাপ অভিধা দেন, আমাদের নাকি রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা আছে। সে কারণে তাঁরা আইয়ুব খানকে পরামর্শ দেন, এই প্রতিবেদনকে পাত্তা দেওয়ার দরকার নেই।
উল্লেখ্য, কেন্দ্রীয় সরকারের সংকুচিত কার্যক্রম সম্পর্কে একই রকম পরামর্শ ১৯৫০-এর মধ্যভাগেই দেওয়া হয়েছিল। যেমন: যুক্তফ্রন্ট তার ২১ দফা কর্মসূচিতে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে শুধু তিনটি বিষয় রাখার কথাই বলেছিল: প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র ও মুদ্রা।
আইয়ুব খানকে আমরা যে স্মারকলিপি দিয়েছিলাম, সেটা কিন্তু গোপনীয় দলিল ছিল না, যদিও কয়েকজন অর্থনীতিবিদি এটি পেশ করেছিলেন। এ ব্যাপারটি জোর দিয়ে বলতে চাই। সেই দলের সদস্যরা চাইলে আগ্রহীদের সঙ্গে প্রতিবেদনটি নিয়ে কথা বলতে পারতেন। ফলে তখন অনেক অর্থনীতিবিদই প্রতিবেদনটির মূল দিক ও সুপারিশগুলো সম্পর্কে জানতে পারেন, একদম টেকনিক্যাল খুঁটিনাটি সম্পর্কে না জানলেও। উপর্যুক্ত প্রতিবেদন পেশ করার পর তা গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছে। এরপর এই দুই অর্থনীতির তত্ত্ব ও আন্ত-আঞ্চলিক বৈষম্যের ব্যাপারটি পূর্ব পাকিস্তানের উন্নয়ন ও গণপরিসরে আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়, অর্থনৈতিক সাংবাদিক, অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের আলোচনায় বিষয়টি প্রাধান্য পায়। বিস্তৃত যুক্তিতর্কসহ এই স্মারকলিপি ও তার সুপারিশ পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক সম্পর্ক-বিষয়ক গণআলোচনার মধ্যে স্থান করে নেয়।
আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সহকর্মী রেহমান সোবহানের সঙ্গে প্রতিবেদনটি নিয়ে শুধু আলোচনাই করিনি, আমি এই দলিলের সব খুঁটিনাটি অর্থাত্ এর যুক্তিতর্ক ও সুপারিশ সবকিছু নিয়েই একদম পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা করেছি। এই বিষয়ক গণআলোচনার সঙ্গেও আমরা যুক্ত ছিলাম। আমার বিভিন্ন পেশাজীবী সহকর্মীর সঙ্গেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছি, যাঁরা এই বিষয়ে লিখতেন বা আলোচনা করতেন।
দ্বিতীয়ত, আইয়ুব খানের মন্ত্রিসভার পূর্ব পাকিস্তানি সদস্যদেরও এই প্রতিবেদনটির কপি দিয়েছি। আমার উদ্দেশ্য ছিল, এই সুপারিশের পক্ষে তাঁদের সমর্থন আদায় করা। তাঁদের মধ্যে বিচারপতি ইব্রাহীম ও এ কে খান প্রতিবেদনটির ব্যাপারে খুব উত্সাহী হয়ে উঠেছিলেন। আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তখন বিচারপতি ইব্রাহীম উপ-উপাচার্য ছিলেন। তিনি এত উত্সাহী হয়েছিলেন যে প্রতিবেদনটির পরামর্শসহ একটি মেমো পাঠিয়েছিলেন আইয়ুব খানের কাছে।
তৃতীয়ত, এই প্রতিবেদনটি আমরা পেশ করেছিলাম ১৯৬১ সালের মে-জুন মাসে, আর আইয়ুব খান সে বছরেরই অক্টোবর মাসে একটি ফিন্যান্স কমিশন গঠন করেন, যার কাজ ছিল: ক. কেন্দ্র ও প্রদেশগুলোর মধ্যে রাজস্ব আদায়ের কাজ ভাগ-বাঁটোয়ারা করে দেওয়া, খ. করসহ কেন্দ্রীয় রাজস্ব, বিদেশি সহায়তা ও অভ্যন্তরীণ ঋণের বোঝা দুই অঞ্চলের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া। আমি সেই কমিশনের সদস্য হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলাম। আমি কমিশনের একমাত্র অর্থনীতিবিদ ও পূর্ব পাকিস্তানের অনানুষ্ঠানিক সদস্য ছিলাম। এটা পরিষ্কার যে স্মারকলিপিটির বিষয়বস্তু প্রাসঙ্গিক ছিল। ফলে কমিশনের পূর্ব পাকিস্তানের সদস্যদের সঙ্গে আমি সে বিষয়ে কথা বলি। ডি কে পাওয়ার ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের অতিরিক্ত প্রধান সচিব (উন্নয়ন), তিনি ছিলেন সেই ফিন্যান্স কমিশনের পূর্ব পাকিস্তান অংশের নেতা। তিনি এই ব্যাপারে অত্যন্ত আগ্রহী হয়ে ওঠেন।
অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতিবিদদের অনেকেই তখন এই প্রতিবেদন সম্পর্কে জানতেন, তাঁরা গণপরিসরে আমাদের লাইনের দুই অর্থনীতি তত্ত্বের নীতিগত ব্যঞ্জনা নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা চালিয়ে যান। যেমন পূর্ব পাকিস্তানের তেমন একটি গোষ্ঠী ছিল ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন ফর ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল প্রগ্রেস, যে দলে ছিলেন রেহমান সোবহান, কামাল হোসেন, মোশাররফ হোসেন প্রমুখ। তাঁরা ১৯৬৬ সালে আমাদের প্রতিবেদন পেশের এক বছর পর দ্য চ্যালেঞ্জ অব ডিসপ্যারিটি নামে একটি পুস্তিকা লেখেন। এর খসড়া করেছিলেন রেহমান সোবহান, তাঁর মূল প্রতিপাদ্য আর আমাদের স্মারকলিপির মূল প্রতিপাদ্য একই ছিল।
আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন জোরদার হলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালে তাঁর পূর্ণাঙ্গ ছয় দফা দাবি পেশ করেন, যে আন্দোলনের সঙ্গে তিনি ১৯৫০-এর দশকের শুরু থেকেই গভীরভাবে যুক্ত ছিলেন। এর মধ্যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উপাদান যুক্ত ছিল, যেটা আমি আগে বর্ণনা করেছি। এর মাধ্যমে তিনি পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে এক নড়বড়ে কনফেডারেশন গঠনের প্রস্তাব করেন, যার মধ্যে আবার ভাঙনের সম্ভাবনা ছিল প্রবল। আর বাকিটা ইতিহাস।