ছিটমহলের মানুষ: রাষ্ট্রহীনতার ইতিবৃত্ত

ভূমিকা

বাংলাদেশ-ভারত ছিটমহল এবং ছিটমহলে বসবাসকারী মানুষের ওপর এটি একটি পর্যবেক্ষণমূলক গবেষণা প্রবন্ধ। ছিটমহলের উত্পত্তি-সংক্রান্ত ইতিহাস, এই সমস্যার স্বরূপ, এ-সংক্রান্ত আন্তরাষ্ট্রীয় চুক্তি ও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক, ছিটমহলে বসবাসকারী মানুষের পরিচয়-সংকট এবং তাদের অধিকারহীনতা ও রাষ্ট্রীয় দায়দায়িত্ব এই প্রবন্ধের আলোচ্য বিষয়। ঐতিহাসিক তত্ত্ব-উপাত্ত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের পাশাপাশি মাঠ জরিপের মাধ্যমে প্রাপ্ত প্রাথমিক তথ্যাবলি ব্যবহার করে এই প্রবন্ধ প্রস্তুত করা হয়েছে।

ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশদের ২০০ বছরের দখলবাজি এবং রাজনৈতিক ভূগোলের যথেচ্ছ পরিবর্তন-প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই কার্যত বর্তমান বাংলাদেশ-ভারত ছিটমহলের উদ্ভব। কিন্তু যেহেতু সে সময়ে এই অঞ্চলে জাতিরাষ্ট্র এবং জাতিরাষ্ট্রের ভৌগোলিক সীমানায় বসবাসকারী মানুষের নাগরিক পরিচয়-সংক্রান্ত কোনো ধারণা ছিল না; এবং যেহেতু প্রশাসনের সঙ্গে সমাজজীবনের এবং সমাজজীবনের সঙ্গে নাগরিক পরিচয়ের সম্পর্ক ছিল খুবই শিথিল, তাই বর্তমান সময়ের ছিটমহলজাত নাগরিক ও রাজনৈতিক সমস্যার মতো জটিল কোনো সমস্যা সে সময়ে দেখা যায়নি। কিন্তু আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় পরিচয়কে অখণ্ড ভূখণ্ডের মধ্যে সমন্বিত করার ফলে রাষ্ট্রের নির্দিষ্ট সীমানা এবং সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাসকারী মানুষের নাগরিক পরিচয় অত্যাবশ্যক হয়ে পড়ে। অথচ ভারত-পাকিস্তান সীমানা নির্ধারণের সময় অযৌক্তিকভাবে উভয় দেশের মালিকানাধীন ছিটমহলগুলোকে রাষ্ট্রের সার্বভৌম সীমানার বাইরে রাখা হয়। ফলে ছিটমহলগুলোর অবস্থান এবং এগুলোর সার্বভৌম মালিকানা-সংক্রান্ত সাংঘর্ষিক অবস্থা ছিটমহলে বসবাসকারী মানুষের পরিচয়-সংকট তৈরি করে, যা তাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনকে সংকটাপন্ন করেছে।

১৯৪৭ সাল থেকে শত শত মানুষের জীবনে বিপর্যয় সৃষ্টিকারী ছিটমহল-সমস্যাটি মূলত ভারতের কারণেই আজও সমাধানের মুখ দেখেনি। ভারতের দিক থেকে উদ্ভূত সমস্যার কারণেই ছিটমহল বিনিময়ের লক্ষ্যে স্বাক্ষরিত ১৯৫৮ সালের নূন-নেহরু চুক্তি বাস্তবায়িত হয়নি। অতঃপর স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মধ্য দিয়ে ভারত-পাকিস্তান ছিটমহল ইস্যুটি বাংলাদেশ-ভারত ছিটমহল ইস্যুতে পরিণত হয়। ১৯৭৪ সালে স্বাক্ষরিত মুজিব-ইন্দিরা চুক্তিতে ছিটমহল বিনিময়ের লক্ষ্যে গৃহীত পদক্ষেপগুলো বাংলাদেশের দিক থেকে ত্বরিতগতিতে বাস্তবায়িত হলেও ভারত এই চুক্তি লঙ্ঘন করে এখন পর্যন্ত ছিটমহল বিনিময়ের বিষয়টি ঝুলিয়ে রেখেছে। মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার পর থেকে অনেক আলোচনা হয়েছে, অনেক শীর্ষ বৈঠক হয়েছে, অনেক কূটনৈতিক আশ্বাস এসেছে; কিন্তু কাজের কাজটি হয়নি। ফলে সাত দশক ধরে সকল প্রকার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে দুর্বিষহ জীবন যাপন করছে ছিটমহলের অসহায় মানুষেরা। যেকোনো বিচারে এটি এখন একটি মানবিক-সংকট।

২০১০ সালের হাসিনা-মনমোহন বৈঠকের প্রাক্কালে আশা করা হয়েছিল, দুই দেশের মধ্যে বিরাজমান অমীমাংসিত সীমানা নির্ধারণসহ ছিটমহল বিনিময় কার্যকর হবে, কিন্তু তা হয়নি। শুধু বৈঠক-পরবর্তী যৌথ ইশতেহারে বলা হয়, ‘উভয় প্রধানমন্ত্রী ১৯৭৪ সালের স্থল সীমানা চুক্তির চেতনায় অমীমাংসিত স্থলসীমানা-সংক্রান্ত বিষয়গুলো একযোগে সমাধানে সম্মত হয়েছেন এবং যৌথ সীমানা ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠক ডাকতে সম্মত হয়েছেন।’ তবে দিল্লি বৈঠকের পর বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে জোর দিয়ে বলা হয়, ২০১১ সালের ঢাকা শীর্ষ বৈঠকে ছিটমহল-সমস্যার সমাধান করা হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ‘super hope’-এর ঢাকা শীর্ষ বৈঠকের পরিণতি হয় ‘super flop’। মিডিয়াপাড়ায় হইচই ফেলে দেওয়া বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সবচেয়ে বড় এই শীর্ষ বৈঠকে শেষ পর্যন্ত কোনো চুক্তিই হয়নি। স্বাক্ষরিত হয়েছে শুধু কিছু সমঝোতা স্মারক ও প্রটোকল। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ঐতিহ্য অনুসারে এ কথা জোর দিয়েই বলা যায় যে এই বৈঠকে স্বাক্ষরিত ছিটমহল-সংক্রান্ত প্রটোকলের দিনের আলো দেখার সম্ভাবনা সুদূরপরাহত। এই বাস্তবতায় বাংলাদেশ-ভারত ছিটমহলের মানুষেরা নাগরিকত্বের দাবিতে নানা আন্দোলন কর্মসূচি পালন করছে। যথার্থভাবেই আজ তাদের মিছিলের স্লোগান, ‘অনেক হয়েছে মিথ্যাচার, এবার চাই মানবাধিকার’।

আন্তসীমান্ত সন্ত্রাস, সাম্প্রদায়িকতা এবং বিচ্ছিন্নতাবাদ তত্পর হলে যেকোনো দেশের সীমান্তই খুব স্পর্শকাতর হয়ে পড়ে এবং সেখানে উত্তেজনা বিরাজ করে। এসব দিক থেকে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যেও রয়েছে দীর্ঘ স্পর্শকাতর সীমানা। কিন্তু বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের যে অংশে ছিটমহল অবস্থিত, সেখানে এমন স্পর্শকাতর কোনো দৃশ্যের অবতারণা হয়নি। স্বাগতিক দেশের সঙ্গে আর্থসামাজিক দিক দিয়ে অবিচ্ছেদ্য ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আয়তনের (দু-চারটি বড় ছিটমহল ছাড়া) ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ছিটমহলগুলো ভৌগোলিক অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্বের দিক থেকেও স্বত্বাধিকারী দেশের জন্য তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। ছিটমহলগুলোতে স্বত্বাধিকারী দেশের অর্থনৈতিক কোনো স্বার্থ নেই বললেই চলে। হয়তো এ কারণেই ভারত এই সমস্যা সমাধানের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে না, যার নির্মম শিকার ছিটমহলে বসবাসকারী শত শত মানুষ। বস্তুত ভারতের দৃষ্টিভঙ্গিটা এমন যে ছিটমহল সমস্যার সমাধান হচ্ছে না, তাতে বিশেষ কোনো অসুবিধা নেই; এর সমাধানেই যত অসুবিধা! মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি বাস্তবায়ন তথা ছিটমহল বিনিময় না হওয়াটা বস্তুত উভয় দেশের সংবিধান, মানবাধিকার এবং আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন।

এক রাষ্ট্রের ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে অবস্থিত বা আশ্রিত অন্য রাষ্ট্রের মালিকানাধীন ছিটমহল নামের সেসব বিচ্ছিন্ন ভূখণ্ডের নিরপরাধ মানুষেরা কার্যত রাষ্ট্রহীন মানুষ! সার্বভৌমত্বের নামে এক ফালি জমির মালিকানার দাবিতে আধুনিক রাষ্ট্রযন্ত্র যেকোনো সময় যুদ্ধ বাধিয়ে দিতেও প্রস্তুত। কিন্তু ছিটমহলে বসবাসকারী মানুষকে নাগরিকত্ব দেওয়ার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রগুলোর কোনো আগ্রহ নেই। ছিটমহল বিনিময় হলে ভারত কোথায় একটু জমি ঠকবে অথবা কোথায় সংবিধান অশুদ্ধ হবে, সাত দশক ধরে শুধু এসব বিষয়কেই বিবেচনা করছেন সে দেশের নেতারা। অদৃশ্য দেয়ালে ঘেরা ছিটমহল নামের ওই সব ভূখণ্ডে নির্বাসিত, পরিত্যক্ত মানুষের ভাগ্যবিপর্যয় নিয়ে, তাদের বন্দিদশা নিয়ে তাঁরা ভেবেছেন বলে মনে হয় না। পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারত যেন ছিটমহলের মানুষ চায় না, মাটি চায়! মানবিক অনুভূতির কোনো কিছুই কি তবে এই রাষ্ট্রযন্ত্রে নেই? মানুষের জন্যই তো রাষ্ট্র, মানুষেরই তো সরকার! অথচ ছিটমহলে বসবাসকারী মানুষ ছিটমহলগুলোর ছিটমহল হওয়ার প্রক্রিয়ার সঙ্গে কোনোভাবেই জড়িত ছিল না বা এ জন্য তারা দায়ী নয়, রাষ্ট্রই দায়ী। আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং এর পরিচালনা ও পদ্ধতিগত মারপ্যাঁচের ধারণা জন্ম নেওয়ার বহু যুগ আগে থেকেই ওই সব মানুষ নিজেদের জায়গায় স্থায়ীভাবে বংশপরম্পরায় বসবাস করছিল। একদিন হঠাত্ তারা জানল, তারা কোনো রাষ্ট্রে নয়, ‘ছিটে’ বসবাস করে, যার মালিকানা ভিন্ন একটি রাষ্ট্রের। অর্থাত্, তারা ‘নিজভূমে পরবাসী’! তাদের কোনো রাষ্ট্র নেই! আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় সাধের নাগরিকত্ব তাদের কাছে অধরা! তাদের পরিচয়, তারা ‘ছিটের লোক’। পরিসংখ্যানেও তারা নেই—সেই অর্থে তারা হচ্ছে নেই-মানুষ (people of nowhere)। তাদের নিরাপত্তা নেই, ভাতের অধিকার নেই, ভোটের অধিকার নেই, অধিকার নেই কথা বলার! হারিয়ে যাওয়ার তালিকায় তারা শীর্ষে। ঘর থেকে বেরিয়ে স্বাধীনভাবে পা ফেলার জায়গা নেই। কারণ, চারদিকেই ভিনদেশের দুস্তর ভূখণ্ড, যেখানে পা রাখলেই হয় ‘অবৈধ অনুপ্রবেশ’, আধুনিক রাষ্ট্রের চোখে অপরাধ, শাস্তি অনিবার্য। একেকটি ছিটমহল যেন তাই একেকটি স্থলবেষ্টিত দ্বীপ। ছিটমহলে বসবাসকারী মানুষের এ অবস্থাকে একধরনের বন্দিদশা হিসেবেও উল্লেখ করা যায়।

আমাদের ইতিহাস এখনো পুরোদস্তুর ঔপনিবেশিক। তাই ইতিহাসেও ছিটমহলের মানুষ অনুপস্থিত। এমনকি ব্যতিক্রমধর্মী নিম্নবর্গের ইতিহাসেও এখনো ঠাঁই মেলেনি এসব মানুষের কথা। তাই যথার্থই তারা নাই-মানুষ। ছিটমহল নিয়ে দু-একটি প্রতিবেদন এবং প্রবন্ধ পাওয়া গেলেও সেগুলোতে বিষয়বস্তুর সামগ্রিকতা যেমন অনুপস্থিত, তেমনি অনুপস্থিত মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি। ডাচ্ ইতিহাসবিদ ভ্যান সেন্ডেল ছিটমহল নিয়ে লিখেছেন। ছিটমহল-সংক্রান্ত তাঁর লেখায় খানিকটা মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি স্থান পেয়েছে। ভ্যান সেন্ডেল (২০০২: ১১৬) যথার্থই বলেন:

Most writings on enclaves treat these as geographical curiosities, or as problems of state sovereignty, international law, and efficient administration. The literature on enclaves is highly statist. It contains very little information on how social life in enclaves evolves, what identities are created by enclave people, or their ways of coping with ideologies of the nation and citizenship.

তবে তিনি ছিটমহল সমস্যাটিকে উপনিবেশ-উত্তর (post-colonial) সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। ব্রিটিশ কলোনি ভেঙে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের উত্পত্তির ফলেই ছিটমহল সৃষ্টি হয়েছে বলে তিনি ইঙ্গিত করেন। এভাবে তিনি এ-সংক্রান্ত ঔপনিবেশিক দায়দায়িত্ব এড়িয়ে যান। তিনি (২০০২: ১১৭) বলেন:

…they (modern enclaves) came into existence in 1947 when British India disintegrated and the state of Pakistan and India were formed. During the worldwide process of decolonization in the twentieth century, most newly independent states retained the boundaries that were established during colonial rule. India and Pakistan were unusual in splitting apart at the moment of decolonization, creating completely new international borders between them. The enclaves were created at the same time.

কিন্তু ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের গঠন তো ঔপনিবেশিক শক্তির হাত দিয়েই। উপনিবেশ-পূর্ব যুগের স্রেফ বিচ্ছিন্ন ভূখণ্ডগুলো ঔপনিবেশিক শাসনের কুপ্রভাবে কীভাবে তাঁর ভাষায় ‘true enclave’ বা ‘modern enclaves’-এ পরিণত হয় এবং ব্রিটিশদের দখলবাজি ও ভূ-রাজনৈতিক খামখেয়ালির ফলেও কীভাবে নতুন নতুন ‘true enclave’ সৃষ্টি হয়, সে বিষয়গুলো তাঁর লেখায় পরিষ্কার হয়নি। তা ছাড়া সীমানা নির্ধারণ-সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক রীতিনীতির তোয়াক্কা না করে, মানবাধিকারকে ভূলুণ্ঠিত করে, লর্ড মাউন্ট ব্যাটেনের সীমানা নির্ধারণের নামে এ দেশের ইতিহাস-ভূগোলের সঙ্গে অপরিচিত এবং সীমানা নির্ধারণের কাজে অনভিজ্ঞ সিরিল র্যাডক্লিফকে দিয়ে সীমানা আঁকানোর যে ‘তুঘলকি কাণ্ড’ ছিটমহল বন্দিদশার মঞ্চ রচনা করে যায়, সে বিষয়টিও তাঁর আলোচনায় গুরুত্ব পায়নি। তবে ‘true enclave’-এর উত্পত্তির পেছনে ‘two patterns of colonial rule’-এরও ভূমিকা আছে বলে তিনি উল্লেখ করেছেন। ভ্যান সেন্ডেল (২০০২: ১১৬) আরও বলেন, ‘unlike much boundary-making in the colonial world, the border between East Pakistan (Bangladesh) and India owed little to “modern” concepts of spatial rationality.’ কিন্তু এ-সংক্রান্ত দায়দায়িত্ব তাঁর আলোচনায় গুরুত্ব পায়নি।

সর্বোপরি, তাঁর আলোচনায় ছিটমহলের মানুষের যাপিত জীবনের বাস্তবতায় তাদের পরিচয়-সংকটের প্রায়োগিক দিকের চেয়ে citizen, proxy citizen, transterritoriality, sovereignty, characteristics of Pakistani and Indian nationalism, connections between territory, nation and identity ইত্যাদি সংক্রান্ত তাত্ত্বিক আলোচনা বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। তিনি (২০০২: ১৩৪) বলেন:

This enclave identity was based on both negative and positive characteristics...Some proudly pointed to a shared history of creativity in staving of crises and in developing local institutions such as Enclave Citizens’ Committees, a land registration system, or some semblance of public works through corvee labor...Some said they could held their heads high because there were no powerful bureaucrats or policemen to lord over them. Most of all they were proud of their resilience.

কিন্তু এসবের মধ্যে বাস্তবিক পক্ষে কি ইতিবাচক কিছু আছে? আধুনিক সভ্যতা ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় কি এ ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণযোগ্য? রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের অভাবে বহুবিধ প্রাকৃতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় ছিটমহলের মানুষ যেসব বিকল্প কৌশল চালু করেছে, তা কি তাদের মৌলিক অধিকার বা নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পেরেছে? কোনো কোনো ছিটমহলে ‘ছিটমহল নাগরিক কমিটি’ আছে, এ কথা সত্য। কিন্তু সেগুলো কি প্রতিষ্ঠান বলা যায়? এসবের কি কোথাও কোনো গ্রহণযোগ্যতা বা কোনো পৃষ্ঠপোষকতা অথবা কোনো আর্থিক সংগতি বা প্রশাসনিক ক্ষমতা আছে? ছিটমহলের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সমাজের (miniature societies) এসব অনিয়মিত (informal) সামাজিক সংগঠন সেখানকার মানুষের দুর্দশা লাঘবে কতটুকু ভূমিকা রাখতে পারে? (কী পারে এবং কতটুকু করতে পারে, তা পরে বিস্তারিত আলোচিত হয়েছে) সুতরাং, এসব নিয়ে ছিটমহলের কোনো মানুষ যদি গর্ব বা সন্তুষ্টি প্রকাশ করে, সেটা হয় তাদের মনস্তাত্ত্বিক বা অশিক্ষাজনিত সমস্যা, অথবা তাদের ‘জ্ঞাত অসহায়ত্ব’ (learned helplessness)২ বা দীর্ঘস্থায়ী ক্ষোভের উল্টো বহিঃপ্রকাশ। পুলিশ ও সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়ন্ত্রণমুক্ত থাকতে পারার বিষয়ে তাদের সন্তুষ্টি প্রকাশও কেবল আমাদের রাষ্ট্রীয় চরিত্রের নেতিবাচক দিকটিই নির্দেশ করে। সুতরাং, আর যা-ই থাকুক, ছিটমহলে ইতিবাচক কিছু আছে বা ছিটমহলের মানুষ ভালো আছে, এমনটা বলার সুযোগ নেই। এ ক্ষেত্রে ভারতীয় ছিটমহল বালাপাড়া খাগড়াবাড়ীর অধিবাসী আবু বকর সরকারের (৭৬/২০০৪) একটি উক্তি উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেন:

এই ছিটে কোনো শাসন নাই। আমাদের কোনো খাজনা দিতে হয় না। অনেকেই মনে করে, আমরা ভালো আছি। আমাদের খাজনা দিতে হয় না, যা ইচ্ছে তা-ই করা যায়। কিন্তু তারা জানে না, প্রশাসনহীন জায়গায় থাকাটা কী বিপজ্জনক! কোনো লোককে সুন্দর বিছানায় ঘুমাতে দিয়ে তার ওপর যদি সুতা দিয়ে একটি ধারালো ছুরি এমনভাবে বেঁধে রাখা হয়, যেন যেকোনো সময় ওই ছুরিটা সুতা ছিঁড়ে তার শরীর ভেদ করতে পারে, তখন ওই লোকের প্রতিটা মুহূর্ত যেমন আতঙ্কে কাটবে, আমাদের ছিটের লোকদেরও তেমনি কাটে প্রতিদিন। কী পাপের কারণে যে আল্লায় আমাদের ছিটের মধ্যে ফালাইছে! আমি চাই না, শাসনহীন জায়গায় আমরা থাকি। শাসনহীন জায়গায় কে থাকতে চায়? খাজনা দেওয়া তো দেশের রেওয়াজ। আমাদের বাপ-দাদারা সারা জীবন খাজনা দিয়েছে। আমরা কেন দেব না? আর সইতে পারছি না বাবা! প্রতিটা মুহূর্তে মনে হয়, এই ছিটের জীবন আর নয়!

কোনো কোনো বিদেশি গবেষক দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা ও ‘তিনবিঘা’ করিডর পরিদর্শনলব্ধ অভিজ্ঞতা থেকে অপরাপর ছিটমহল সম্পর্কেও একই রকম চিত্র কল্পনা করেছেন। অথচ অবস্থান, আয়তন, জনসংখ্যা ও মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যোগাযোগব্যবস্থার দিক থেকে দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা বাংলাদেশ ও ভারতের সব ছিটমহল থেকে আলাদা। এটি ১৯৯২ সাল থেকে বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে ‘তিনবিঘা’ করিডরের মাধ্যমে। অনেকে আবার ‘তিনবিঘা’ করিডরকেই ছিটমহল হিসেবে উল্লেখ করে থাকেন। দহগ্রাম-আঙ্গরপোতার অধিবাসীদের মূল ভূখণ্ডে যাতায়াতের জন্য এই করিডরের ফটকটি ১৯৯২ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত সকাল ছয়টা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত প্রতি এক ঘণ্টা পর পর এক ঘণ্টা করে মোট ছয় ঘণ্টা খোলা রাখা হতো। ২০০১ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত সকাল ছয়টা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত ১২ ঘণ্টা খোলা রাখা হতো। সর্বশেষ ৮ সেপ্টেম্বর করিডরটি ২৪ ঘণ্টার জন্য খুলে দেওয়া হয়। ফটকের দুই পাশে ভারতীয় চেকপোস্টে দণ্ডায়মান সশস্ত্র বিএসএফ। করিডরের ১৭৮ মিটার রাস্তা পেরিয়ে দহগ্রামে ঢোকার মুখেই বাংলাদেশের চেকপোস্টে বিজিবির (পুরনো নাম বিডিআর, এই লেখার সর্বত্র নতুন নামটাই [বিজিবি] ব্যবহার করা হবে) সদস্যদের নজরদারি। করিডরের উভয় পাশে মাত্র কয়েক গজ দূরে ভারতের কাঁটাতারের বেড়া। প্রতিদিন নির্ধারিত সময়ে বিএসএফ ও বিজিবি নিজ নিজ দেশের পতাকা উত্তোলন করে। দহগ্রাম-আঙ্গরপোতার এসব অদ্ভুত আয়োজনের প্রতি আকৃষ্ট হয়েই হয়তো অস্ট্রেলীয় ভূগোলবিদ হোয়াইট (২০০২) ছিটমহল বিনিময়ের বিকল্প হিসেবে ছিটমহলগুলোকে টিকিয়ে রেখে এগুলোর চারপাশে পর্যটনশিল্প গড়ে তোলার পক্ষে মতামত দিয়েছেন। তিনি (২০০২: ৩৯) বলেন: ‘It is also hoped that exchange will be considered but one option among several. One possibility is to let the enclaves remain, and to develop a tourist industry around them as the world’s most complex boundary.’ কিন্তু ছিটমহলগুলোর বাস্তবচিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। ছিটমহলের মানুষের দিকে একটু মানবিক দৃষ্টিতে তাকালে সহজেই বোঝা যায়, হোয়াইটের এ প্রস্তাব সম্পূর্ণ বাস্তববিবর্জিত।

ছিটমহলের রাষ্ট্রহীন মানুষকে বেঁচে থাকার লড়াইয়ে প্রতিনিয়তই ‘অবৈধ’ অনুপ্রবেশ করতে হয় ভিন্ন একটি রাষ্ট্রে। ভিনদেশে ‘অবৈধ’ অনুপ্রবেশ আর ভিনদেশি মানুষের সঙ্গে ‘বেআইনি’ সামাজিক সম্পর্কই তাদের জীবনের একমাত্র অবলম্বন, রাষ্ট্রের চোখে যা অপরাধ! করুণা আর অবজ্ঞা মাথায় নিয়ে নিরাপত্তাহীনভাবে শুধু পেটের তাগিদে ভিনদেশে শ্রম বিক্রি করে চলা এই মানুষের অর্থনীতিও রাষ্ট্রের চোখে অপরাধপ্রবণ! কারণ, রাষ্ট্র তাদের স্বীকার করে না। ‘তিনবিঘা’ করিডর ইস্যুতে দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা বিভিন্ন সময়ে আলোচনায় এলেও দুই দেশের মধ্যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বাকি ছিটমহলগুলোতে বসবাসকারী হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষের বন্দিদশা তেমন কোনো গুরুত্ব পায়নি। দৃশ্যত, কোনো রাষ্ট্রই ছিটমহলের তেমন কোনো খবর রাখে না। হিসাব রাখে না ‘ছিটের নাগরিকদের’।

শুধু রাষ্ট্র নয়, ছিটমহলের মানুষকে মনে রাখেনি কেউই। কোনো মানবাধিকারকর্মী তাদের নিয়ে রাজপথে কোনো মিছিল করেননি। কোনো রাজনীতিবিদের বক্তৃতায় ছিটমহলের মানুষের বন্দিদশার মর্মান্তিক গল্প স্থান পায়নি। কোনো উন্নয়ন গবেষণায় এসব মানুষের গল্প লেখা হয় না। সমাজ উন্নয়ন ও মানবতার জন্য কাজ করা কোনো এনজিও তাদের কর্মপরিকল্পনায় এসব মানুষকে তালিকাভুক্ত করে না। ক্ষুদ্রঋণের কোনো সংস্থা তাদের ঋণ দেয় না। তাদেরও অজুহাত একটাই—ছিটমহলগুলো বিদেশি জায়গা, সেখানে যাওয়া বেআইনি। ছিটমহলের মানুষ কখনোই তাদের কথা বলার সুযোগ পায়নি। তাদের যখন প্রশ্ন করা হয়, এই বন্দিদশার বিরুদ্ধে তারা কোনো প্রতিবাদ করেছে কি না? প্রত্যুত্তরে তারা পাল্টা প্রশ্ন করে, ‘কার কাছে প্রতিবাদ করব?’ শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত এসব মানুষ জানে না, কীভাবে নিজেদের কথা বলতে হয়। আজন্ম বাক্স্বাধীনতাহীন এসব মানুষ তাই আড়ষ্ট। তারা তাদের এই দীর্ঘ বন্দিদশা থেকে এটুকু শুধু বুঝতে পেরেছে, দানবীয় রাষ্ট্রশক্তি তাদের মুক্তি দেবে না। তাই এই বন্দিদশা তাদের কাছে ‘জ্ঞাত অসহায়ত্ব’ বলে মনে হয়। তাদের অভিযোগ যেন শুধু সৃষ্টিকর্তার কাছে। ৬০ বছর ধরে কৃপাবিমুখ থাকা ঈশ্বরের কাছেই তবু তারা কৃপা প্রার্থনা করে; প্রার্থনা করে মুক্তির। অবশ্য ২০১১ সালের ভারত-বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ের ঢাকা শীর্ষ বৈঠককে কেন্দ্র করে ছিটমহল ইস্যুটি জোরালোভাবেই আলোচনায় আসে এবং সংবাদমাধ্যমগুলোও বিষয়টিকে বেশ গুরুত্ব দেয়। এসব কারণেই হয়তো ছিটমহলের মানুষেরা প্রথমবারের মতো তাদের মুক্তির দাবিতে মিছিল-মিটিং করার মতো সাহস অর্জন করেছে। নাগরিকত্বের দাবিতে তারা বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে।

উভয় দেশের ছিটমহলগুলোর পারস্পরিক বিনিময় ছাড়া এই সমস্যা সমাধানের আর কোনো বাস্তবসম্মত বিকল্প নেই বলেই ছিটমহল বিনিময়ে একাধিক আন্তরাষ্ট্রীয় চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে। এ-সংক্রান্ত নূন-নেহরু চুক্তি কার্যকর না হলেও মুজিব-ইন্দিরা চুক্তিটি বাংলাদেশ ত্বরিতগতিতেই বাস্তবায়ন করেছে এবং এই চুক্তির অধীনে ভারত দক্ষিণ বেরুবাড়ীর দক্ষিণ অংশ অধিগ্রহণ করেছে। অথচ চুক্তির অধীনে বাংলাদেশের পাওনা বুঝিয়ে দিতেই শুরু হয় ভারতের টালবাহানা। মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি বাস্তবায়ন তথা ছিটমহল বিনিময় না হওয়ার পেছনে ভারতের পক্ষ থেকে বারবার চুক্তির বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার অজুহাত দেখানো হয়েছে। এই অজুহাত চলেছে প্রায় দুই দশক। কিন্তু ১৯৯০ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট তিনবিঘা করিডর প্রদানের মাধ্যমে ভারতের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘনের অভিযোগকে একটি ‘non-issue’ বলে মামলাটি খারিজ করে দিয়েছে। তার পরও ১৯৯০ সাল থেকে ২০১১ পর্যন্ত দীর্ঘ ২১ বছরেও ভারত এ চুক্তিটি পার্লামেন্টে উত্থাপন করেনি। সুতরাং, সহজেই বোঝা যায় যে আসল সমস্যা রাজনৈতিক সদিচ্ছার জায়গায়। অথচ ভারতের ভৌগোলিক অখণ্ডতা এবং সার্বভৌমত্ব সমুন্নত রাখার জন্যও এ সমস্যার সমাধান হওয়া দরকার। এ প্রসঙ্গে জোন্স-এর মত প্রণিধানযোগ্য:

If territorial integrity were the critical concern for the Indian government, it would seem that an exchange would create more unified territory that demonstrates the unambiguous linkages between the citizens and the territory of the state, as most maps of India and Bangladesh already represent it. (Jones, 2009 : 379)

বলা প্রয়োজন, শুধু রাজনৈতিক সদিচ্ছা দিয়েই বাংলাদেশ সরকার মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির বিরুদ্ধে দায়ের করা একই ধরনের মামলা মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই নিষ্পত্তি করে এবং সংবিধানের তৃতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে চুক্তিটি অনুসমর্থন (ratify) করে দক্ষিণ বেরুবাড়ীর দক্ষিণ অংশ ভারতকে হস্তান্তর করে। অবশ্য মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি অনুসমর্থন এবং বাস্তবায়ন-সংক্রান্ত নৈতিক ও আইনি বাধ্যবাধকতা থেকে ভারত সম্ভবত অব্যাহতি পাচ্ছে। কারণ, সাম্প্রতিক কালে অজ্ঞাত কারণে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আর মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি বাস্তবায়নের দাবি করা হচ্ছে না। নতুন নতুন চুক্তির কথা বলা হয়, নতুন নতুন সমঝোতা স্মারক ও প্রটোকল সই করা হয়। অথচ বাংলাদেশ কর্তৃক বাস্তবায়িত মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি, যার অধীনে ভারত দক্ষিণ বেরুবাড়ীর প্রায় ২ দশমিক ৬৪ বর্গমাইল এলাকা অধিগ্রহণ করেছে, তা বাস্তবায়নের দাবি করা হয় না। কেন এই আত্মবিস্মৃতি?

ছিটমহল-এর ব্যুত্পত্তিগত অর্থ

‘ছিটমহল’ শব্দটি দুটি শব্দের সমন্বয়ে গঠিত। যথা ‘ছিট’ ও ‘মহল’। ‘ছিট’ বলতে সাধারণত বোঝায় টুকরো, খণ্ড বা বিচ্ছিন্ন ফালি অথবা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়া কালি বা কোনো তরল পদার্থের ফোঁটা। ‘মহল’ একটি আরবি শব্দ, যার অর্থ বাসভবনের বিশেষ কক্ষ, যেমন—অন্দরমহল, রংমহল ইত্যাদি। কিন্তু ছিটমহলে ব্যবহূত ‘মহল’ হচ্ছে আরেকটি আরবি শব্দ ‘মহাল’-এর বিকৃত রূপ, যার অর্থ তালুক বা ভূ-সম্পত্তি। সুতরাং, ছিটমহল শব্দের পুরো অর্থ দাঁড়ায় এলোমেলো, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মহাল বা ভূ-সম্পত্তি (যা মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন)। মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগের শুরুতে ভারতীয় উপমহাদেশের জমিদার ও স্থানীয় রাজন্যবর্গের এমন অনেক বিচ্ছিন্ন মহাল ছিল প্রতিবেশী রাজ্যের মধ্যে। মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন, অন্য রাজ্যের ভূখণ্ড দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিটমহল নামের এসব মহাল বা ভূ-সম্পত্তিই পরবর্তী সময়ে ঔপনিবেশিক ভূ-রাজনীতির মারপ্যাঁচের কারণে enclave-এ পরিণত হয়। ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তানের সীমানা নির্ধারণের ঔপনিবেশিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ ভারত ও কোচবিহারের পরস্পর ছিটমহলগুলো ভারত-পাকিস্তান আন্তর্জাতিক ছিটমহল বা ভ্যান সেন্ডেলের ভাষায় true enclave-এ পরিণত হয়। তখন থেকে enclave বোঝাতে বাংলা ভাষায় ‘ছিটমহল’ শব্দটিই ব্যবহূত হয়ে আসছে। ১৯৫৮ সালের নূন-নেহরু চুক্তিতে ছিটমহলকে ‘পরিবেষ্টিত এলাকা’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। জার্মান ও ফরাসি ভাষায় enclave শব্দটি দ্বারা কোনো দেশের এমন একটি স্থান বা ভূখণ্ডকে বোঝানো হতো, যা অন্য কোনো দেশের ভূখণ্ড দ্বারা পরিবেষ্টিত। সুতরাং বলা যায়, ছিটমহল হচ্ছে কোনো দেশের এমন একটি ভূখণ্ড, যা মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন এবং ভিন্ন রাষ্ট্রের খণ্ড দ্বারা পরিবেষ্টিত। ব্যুত্পত্তিগত দিক থেকে ছিটমহলগুলোর উত্পত্তি, আকার ও অবস্থানের সঙ্গে এর নামকরণ বেশ সামঞ্জস্যপূর্ণ ও সার্থক। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ছিটমহলের ভেতরও রয়েছে ছিটমহল। হোয়াইট (২০০২) ছিটমহল দ্বারা পরিবেষ্টিত বিপরীত মালিকানার এসব ছিটমহলকে counter enclave হিসেবে উল্লেখ করেন আর ভ্যান সেন্ডেল (২০০২) উল্লেখ করেন sub-enclave হিসেবে, বাংলায় যাকে প্রতি-ছিটমহল হিসেবে উল্লেখ করা যায়।

ছিটমহলের বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিত

মধ্যযুগে ইউরোপে ছিটমহলের উত্পত্তি ছিল সাধারণ ঘটনা। বিশেষ করে, পশ্চিম ইউরোপে অসংখ্য ছিটমহল ছিল। বিশ শতকেও ইউরোপ ও ঔপনিবেশিক অঞ্চলগুলোতে ভৌগোলিক আবিষ্কার-সংক্রান্ত জটিলতা, যুদ্ধ-বিগ্রহ এবং অন্তর্দেশীয় অনুপ্রবেশ (inland penetration) বা ভূমি অধিগ্রহণের মাধ্যমে প্রায়ই ছিটমহলের উদ্ভব হতো। একই সময়ে অবশ্য অনেক ছিটমহল উদীয়মান জাতিরাষ্ট্রের সীমানার মধ্যে বিলীন হয়ে যাচ্ছিল। উল্লেখ্য, ছিটমহলের বিষয়টি একটি দ্বিপক্ষীয় বিষয় হিসেবে প্রথম যে কূটনৈতিক দলিলে স্থান পায় তা হচ্ছে ফ্রান্স এবং ইতালির মধ্যে সম্পাদিত Treaty of Madrid, 1526, ১৫২৬।

আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার (জাতিরাষ্ট্র) বিকাশের ফলে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় পরিচয়কে অখণ্ড ভূখণ্ডের মধ্যে সমন্বিত করার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ছিটমহলগুলোর অধিকাংশই বিলুপ্ত হয়ে যায়। ১৮১৫ সালের ভিয়েনা কংগ্রেসের মধ্য দিয়ে ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর সীমা সংহতিকরণ (territorial consolidation) কার্যত সমাপ্ত হয়ে যায়। র্যাজেল (১৮৯৬) ও আরও কতিপয় ভূগোলবিদ এবং পরবর্তী সময়ে, বিশেষ করে German School of Geopolitics-এর ভূ-বিজ্ঞানীরা জাতিরাষ্ট্র কর্তৃক ছিটমহলগুলো আত্তীকরণকে প্রাকৃতিক বিভাজন দ্বারা রাষ্ট্রের সীমানা (natural boundaries of state) নির্ধারণের একটি গঠনমূলক বা প্রণালিগত প্রপঞ্চ (an organic phenomenon) হিসেবে উল্লেখ করেছেন। সর্বশেষ ১৯২৮ সালে জার্মান ভাষাভাষী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ১৯৬টি ছিটমহল পার্শ্ববর্তী জোটবদ্ধ রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত করে দেওয়া হয় (van Schendel, 2002 : 117)। বর্তমানে বিশ্বের চিহ্নিত মোট ২২৩টি ছিটমহল ও ৩২টি উপছিটমহল পৃথিবীর তিনটি অঞ্চলে অবস্থিত—পশ্চিম ইউরোপ, সাবেক সোভিয়েত সাম্রাজ্যের প্রান্ত অঞ্চল ও দক্ষিণ এশিয়া (Whyte, 2002 : 18)। বর্তমানে পৃথিবীর অধিকাংশ ছিটমহল বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের চারটি সীমান্তবর্তী জেলা—কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, লালমনিরহাট ও পঞ্চগড়ে অবস্থিত। অর্থাত্ বাংলাদেশ-ভারত ছিটমহল ছাড়া বিশ্বে অবশিষ্ট অল্পসংখ্যক ছিটমহল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয় এবং সেগুলোর আয়তনও উল্লেখযোগ্য নয়।

ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহলের উত্পত্তি অনুসন্ধান

বাংলাদেশের প্রায় চারদিকেই ভারতের সঙ্গে রয়েছে প্রায় চার হাজার ২০০ কিলোমিটারের দীর্ঘ সীমানা। যদিও বাংলাদেশ-ভারতের এই দীর্ঘ সীমানার অনেক অংশেই সীমানা-সংক্রান্ত নানা সমস্যা বিদ্যমান, কিন্তু ছিটমহল রয়েছে শুধু বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের চারটি জেলা—কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী ও পঞ্চগড়ের সীমান্ত এলাকায়। এর মধ্যে কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট ও নীলফামারী ছিল ব্রিটিশ জেলা রংপুরের অন্তর্ভুক্ত, আর পঞ্চগড় ছিল ব্রিটিশ জেলা দিনাজপুরের অন্তর্ভুক্ত। অন্যদিকে, ভারতীয় ভূখণ্ডে বর্তমানে ছিটমহল রয়েছে পার্শ্ববর্তী কোচবিহার জেলায়। ছিটমহলগুলোর কোনোটিরই প্রাথমিক উত্পত্তি সম্পর্কে সঠিক করে তেমন কিছু জানা যায় না। যদিও ছিটমহল নামের বিচ্ছিন্ন ভূখণ্ডগুলোর (remote holdings) প্রাথমিক উত্পত্তি হয়েছিল প্রাক্-ব্রিটিশ সময়েই, তবে এই বিচ্ছিন্ন ভূখণ্ডগুলো প্রকৃত অর্থে ছিটমহল বা enclave  হয়ে ওঠে ব্রিটিশদের হাত দিয়েই। প্রাথমিকভাবে এসবের উত্পত্তি হয়েছে অনিয়মিতভাবে, নানা পরিপ্রেক্ষিতে। যেমন জনশ্রুতি আছে, এ অঞ্চলের রাজন্যবর্গ ভ্রমণ বা শিকারের উদ্দেশ্যে রাজকীয় অতিথি হিসেবে প্রতিবেশী কোনো রাজ্যের অভ্যন্তরে গিয়ে কোনো স্থানে তাঁবু খাটালে তার প্রতি সম্মান দেখিয়ে সেই এলাকাটি তাকে উপঢৌকন দেওয়া হতো।৩ সুতরাং, উপঢৌকনের মতো বিভিন্ন ঘটনাবলির মাধ্যমেও এসব বিচ্ছিন্ন ভূখণ্ডের উত্পত্তি হয়ে থাকতে পারে, যা পরবর্তী সময়ে ছিটমহলে পরিণত হয়েছে। তবে কোচবিহার (কামতা), আসাম (কামরূপ), দিনাজপুর ও রংপুরের ভূ-রাজনৈতিক ইতিহাস পর্যালোচনা করে ছিটমহলের প্রাথমিক উত্পত্তি সম্পর্কে কিছু সিদ্ধান্তে পৌঁঁছানো যায়।

ষষ্ঠদশ শতকে প্রতিষ্ঠিত কোচবিহার (কামতা) রাজ্যটি মোগল সাম্রাজ্য এবং এর প্রতিবেশী ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা অঞ্চলের অহম ও তিব্বত রাজ্যের মধ্যে buffer state হিসেবে কৌশলগত কারণে উত্তর-পূর্ব ভারতে বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। সপ্তদশ শতকে কোচবিহার রাজপরিবারে অস্থিরতার সুযোগ নিয়ে মোগলরা কোচবিহারে বেশ কয়েকবার অভিযান পরিচালনা করে এবং কোচবিহারের উত্তরাংশের তিনটি চাকলা—কাকিনা, কাজিরহাট ও ফতেহপুর দখল করে নেয়। মোগলদের সঙ্গে কোচবিহার রাজপরিবারের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী এই দ্বন্দ্ব ১৭১৩ সালে উভয় পক্ষের মধ্যে স্বাক্ষরিত এক চুক্তির মধ্য দিয়ে শেষ হয়। চুক্তির অধীনে কোচবিহার উপরিউক্ত তিনটি চাকলার ওপর থেকে মালিকানা প্রত্যাহার করে নেয় এবং অন্য তিনটি চাকলা—বোদা, পাটগ্রাম ও পূর্ব ভাগের কর্তৃত্বও হারায়। মহারাজা শান্তনু নারায়ণের পক্ষ থেকে একজন নাজির এই চাকলা তিনটির জমিদারি গ্রহণ করেন। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, এই চাকলাগুলো অখণ্ড ছিল না। এই চাকলাগুলোর মধ্যে ছিল পার্শ্ববর্তী অন্য চাকলা বা জমিদারির পকেট বা বিচ্ছিন্ন ভূখণ্ড, যেগুলোর ওপর তখন পর্যন্ত কোচবিহার মহারাজার মালিকানা প্রতিষ্ঠিত ছিল। অনুরূপভাবে বোদা, পাটগ্রাম ও পূর্ব ভাগ চাকলার কিছু পকেট বা বিচ্ছিন্ন ভূ-সম্পত্তি ছিল পার্শ্ববর্তী কোচবিহার ভূখণ্ডে (Hunter, 1876 : v-8 : 316-17, v-10 : 405-30)। এই চাকলাগুলোর মধ্যে অবস্থিত পকেট বা বিচ্ছিন্ন ভূখণ্ডগুলো পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশদের হাতে ছিটমহলে পরিণত হয়।

বর্তমান রংপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধার সমন্বয়ে গঠিত ব্রিটিশ জেলা রংপুর প্রাচীনকালে ছিল কামরূপ (আসাম) হিন্দু রাজ্যের পূর্বাঞ্চল। অন্যদিকে বর্তমান দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড় নিয়ে গঠিত ছিল ব্রিটিশ জেলা দিনাজপুর। ১৫৮৪ সালে সম্রাট আকবরের সময় অঞ্চলটি মোগল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। দিনাজপুরের প্রায় সবটুকু ভূখণ্ড আইন-ই-আকবরীতে উল্লিখিত সরকার তাজপুর, সরকার পিঞ্জরা এবং সরকার ঘোড়াঘাটের অন্তর্ভুক্ত ছিল। সম্রাট শাহজাহানের রাজত্বকালের শেষ ভাগে কামতা (কোচবিহার) ও কামরূপ (আসাম) রাজ্যদ্বয় কর্তৃক উত্তরবঙ্গের এসব অঞ্চল আক্রান্ত ও অধিকৃত হয়। পরে ১৬৬০-৬১ সালে সম্রাট আওরঙ্গজেবের সেনাপতি মীর জুমলা এসব অঞ্চল পুনরুদ্ধার করেন। কোচরাজ্যের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য তিনি ঘোড়াঘাটে শক্তিশালী সামরিক ঘাঁটি নির্মাণ করেন। কোচবিহারের ইতিহাস অনুযায়ী উভয় রাজ্যের প্রান্তসীমায় অনেক সীমানা বান্দ বা বাঁধ নির্মাণপূর্বক কোচবিহার ও মোগলদের মধ্যে শান্তিচুক্তি স্থাপিত হয়। বাংলাবান্দ(া), হাতিবান্দ(া), বাহারবান্দ, ভিতরবান্দ, গাইবান্দ(া) নামে পরিচিত এসব রাজনৈতিক বান্দের বহু চিহ্ন দিনাজপুরের সর্বোত্তর সীমান্তে (বর্তমান পঞ্চগড় জেলার সীমান্ত অঞ্চল, বিশেষ করে তেঁতুলিয়া থানা) এবং রংপুর-গাইবান্ধা জেলার দক্ষিণ-পূর্ব অংশে দৃষ্ট হয় (আলী, ১৯৯৬: ৭৩)। যেকোনো রাস্তা বা বাঁধ নির্মাণের একটি সাধারণ কৌশল হচ্ছে যতটা সম্ভব সোজাসুজি করে নির্মাণ করা। সুতরাং, এই বান্দগুলো নির্মাণের সময় উভয় পক্ষের মালিকানাধীন বিচ্ছিন্ন কিছু অঞ্চল বা পকেট বান্দের বাইরে পড়াটা খুবই স্বাভাবিক। এবং যেহেতু বাংলাদেশ-ভারত ছিটমহলগুলো এ অঞ্চলেই অবস্থিত, সুতরাং ধারণা করা যায়, এসব সীমানা-বান্দ নির্মাণের ফলে উভয় রাজ্যের সীমান্তের আঁকাবাঁকা অংশ বা পকেট বা কিছু ভূখণ্ড সীমানা-বান্দ দ্বারা মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, যা পরবর্তী সময়ে ছিটমহলে পরিণত হয়।

ব্রিটিশ যুগে ছিটমহল

বাংলার নবাব মুর্শিদকুলি খানের সময় দিনাজপুরের অধিকাংশ অঞ্চল চাকলা আকবরনগর ও চাকলা ঘোড়াঘাটের অন্তর্ভুক্ত ছিল। মুর্শিদকুলি খান দিনাজপুরের রাজা প্রাণনাথকে আকবরনগর ও ঘোড়াঘাট চাকলার জমিদারি প্রদান করেন। এ দুই চাকলা একত্রে দিনাজপুরের জমিদারি হিসেবে পরিচিত ছিল। ১৭৬৫ সালে মোগল সম্রাট বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানি ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে প্রদান করলে দিনাজপুরের জমিদারি ব্রিটিশ শাসনাধীনে আসে। দিওয়ানি শাসনামলে দিনাজপুরের রাজা ক্রমবর্ধমান রাজস্ব চাপের মুখে তাঁর জমিদারির আয়তন আরও বাড়াতে সচেষ্ট হন। এর ফলে পার্শ্ববর্তী কিছু কিছু বিচ্ছিন্ন অঞ্চল দিনাজপুর জমিদারির অন্তর্ভুক্ত হয় (আলী, ১৯৯৬: ৭৮)। এই বিচ্ছিন্ন অঞ্চলগুলোর কোনো কোনোটির ছিটমহলে পরিণত হওয়া খুবই স্বাভাবিক।

১৭৭২ সালে কোচবিহার ব্রিটিশদের প্রথম করদরাজ্যে পরিণত হয়। সে সময় থেকেই মোগল-কোচবিহার ছিটমহলগুলো ব্রিটিশ-শাসিত অঞ্চলের আওতাভুক্ত হয়। ১৮৬৪-৬৫ সালে ভুটান এবং ব্রিটিশদের মধ্যে সংঘটিত দ্বিতীয় যুদ্ধের ফলে হিমালয় পর্বতমালার পাদদেশ ও ভুটানের মধ্যবর্তী ডুয়ার্স নামের সমভূমি অঞ্চলটি (বর্তমান জলপাইগুড়ি জেলার অধিকাংশ অঞ্চল) ব্রিটিশরা ভুটানের কাছ থেকে দখল করে নেয়। ফলে মোগল-কোচবিহার ছিটমহলগুলোর মতো ভুটান-কোচবিহার ছিটমহলগুলোও ব্রিটিশদের আওতাভুক্ত হয়। ব্রিটিশদের সাম্রাজ্যবাদী তত্পরতা এবং ভূ-রাজনৈতিক বিষয়ে নানা খামখেয়ালিপনাও কোথাও কোথাও নতুন করে ছিটমহলের জন্ম দেয়। যেমন: ১৮১৭ সালে কোচবিহার ও ভুটানের সীমানা নির্ধারণের মধ্য দিয়ে এ দুই দেশের মধ্যে নতুন করে কিছু ছিটমহলের উত্পত্তি হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ব্রিটিশরা ধুপগুড়ির নিকটবর্তী মারাঘাট নামের একটি অঞ্চল ভুটানের জন্য নির্ধারণ করলেও এ অঞ্চলে অবস্থিত বেশ কিছু মন্দির এবং ভূখণ্ডের মালিকানা দেয় কোচবিহারকে, যা পরবর্তী সময়ে ছিটমহলে পরিণত হয়। হান্টারের Statistical Account of Bengal-এ এসব ছিটমহলের পরিসংখ্যান, ছিটমহলগুলোতে বিদ্যমান সমস্যা এবং প্রশাসনিক জটিলতা-সংক্রান্ত প্রতিবেদন পাওয়া যায়। এ সি হার্টলে ১৯৩৭ সালে কোচবিহারের তত্কালীন ভূমি রাজস্ব আধিকারিক এন সি মুস্তাফির সহায়তায় কোচবিহার এবং রংপুরের একটি মানচিত্র প্রস্তুত করেন, যাতে ছিটমহলগুলোর অবস্থান ও আয়তন বিশেষ প্রাধান্য পায়। তাঁর Final Report of Rangpur Survey and Settlement Operations 1931-1938 শীর্ষক প্রতিবেদনেও (১৯৪০) ছিটমহল সমস্যার উল্লেখ পাওয়া যায়।

র্যাডক্লিফ কমিশনের অসারতা, বাটোয়ারার কুফল এবং ছিটমহলের পরিণতি

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিণতিতে যুদ্ধপরবর্তী বছরগুলোতে পৃথিবীব্যাপী জাতিরাষ্ট্রের আবির্ভাব ঘটতে থাকে। এর প্রভাবে ভারতীয় উপমহাদেশেও ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটে এবং ধর্মের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান নামের আলাদা দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি উপমহাদেশের দীর্ঘ নিয়মতান্ত্রিক স্বাধিকার আন্দোলন অগ্রাহ্য করে আসছিল। তাই উপমহাদেশের স্বাধীনতা দীর্ঘদিন ধরে অবশ্যম্ভাবী হওয়া সত্ত্বেও ক্ষমতা হস্তান্তরের কোনো প্রস্তুতি ব্রিটিশ সরকার গ্রহণ করেনি। অবশেষে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিণতিতে পৃথিবীব্যাপী ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক রাজত্ব যখন তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে, তখন তারা বাধ্য হয়ে অতি অল্প সময়ের মধ্যে ভারতকে বিভক্ত করে দুটি প্রতিপক্ষ নেতৃত্বের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে এবং নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয়। ক্ষমতা হস্তান্তরের সেই তড়িঘড়ি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তারা বিবিধ ভূ-রাজনৈতিক সমস্যার জন্ম দিয়ে যায়, যা পরবর্তী বছরগুলোতে প্রতিবেশী রাষ্ট্র দুটির দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিষয়ে পরিণত হয়। ছিটমহল সমস্যা তার মধ্যে একটি। হান্টার ও হার্টলে উল্লিখিত ছিটমহল সমস্যাগুলো সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে ব্রিটিশ রাজকর্মচারীরা র্যাডক্লিফ বাটোয়ারার মাধ্যমে ছিটমহল সমস্যাকে আরও জটিল করে তোলে এবং ছিটমহলের অধিবাসীদের ঠেলে দেয় এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে, যে অনিশ্চয়তা কাটেনি গত সাত দশকেও।

কূটকৌশল আর বিভাজন নীতিই (Divide and Rule Policy) ছিল ব্রিটিশদের ২০০ বছরব্যাপী শাসন-শোষণের মূল হাতিয়ার। কূটকৌশল আর প্রতারণা এ অঞ্চলের মানুষের কাছে তাদের চরিত্রকে এমনভাবে নির্মাণ করে যে তারা হয়ে যায় কূটকৌশলের প্রতীক। মীর জাফর যেমন বিশ্বাসঘাতকতার প্রতীক, তেমনি ‘ব্রিটিশ’ শব্দটি কূটকৌশলের প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহূত হয়। যা-ই হোক, অবশেষে তারা যখন চলে যেতে বাধ্য হয়, তখন র্যাডক্লিফ বাটোয়ারার মাধ্যমে তাদের কূটচালের শেষ উদাহরণটি স্থাপন করে যায়, যার খেসারত দিচ্ছে প্রতিবেশী তিনটি দেশ। জেনে-বুঝে অযৌক্তিকভাবে ভাগবাটোয়ারা করা হয়। যার ফলে দেশ বিভাগের মাত্র ২৪ বছরের মাথায় আরেকটি রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতাসংগ্রামের দরকার হয়।

১৯৪৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী পার্লামেন্টে ঘোষণা দিয়েছিলেন, ১৯৪৮ সালের ৩০ জুনের মধ্যে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে। কিন্তু ৩ জুন পরিকল্পনায় ক্ষমতা হস্তান্তরের সময় তড়িঘড়ি করে ১৯৪৭ সালের ১৪ ও ১৫ আগস্ট নির্ধারণ করা হয়। এই তড়িঘড়ি প্রক্রিয়ায় সীমানা নির্ধারণ-সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক রীতিনীতি তোয়াক্কা না করে, মানবাধিকারকে ভূলুণ্ঠিত করে র্যাডক্লিফকে দিয়ে সীমানা আঁকেন লর্ড মাউন্টব্যাটেন। ভারতের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ-সংস্কৃতি সম্পর্কে র্যাডক্লিফের কোনো অভিজ্ঞতা বা ধারণা ছিল না। তিনি কোনো রাজনীতিবিদও ছিলেন না, অথবা দেশ ভাগ ও বাটোয়ারা-সংক্রান্ত তাঁর কোনো অভিজ্ঞতাও ছিল না। এমন অনভিজ্ঞ এবং ভারতের রাজনৈতিক ভূগোলের সঙ্গে অপরিচিত একজন ব্রিটিশকে দিয়ে তড়িঘড়ি করে ভারত অপারেশন করা হয়। ১৯৪৭ সালের ৩ জুন র্যাডক্লিফকে বাউন্ডারি কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। ৮ জুলাই তিনি প্রথমবারের মতো ভারতে আসেন এবং ১৩ আগস্ট রোয়েদাদ পেশ করেন, যার ভিত্তিতে ১৪ ও ১৫ আগস্ট পাকিস্তান ও ভারতকে স্বাধীনতা দেওয়া হয় এবং ১৬ আগস্ট সেই রোয়েদাদ প্রকাশ করা হয়। অর্থাত্, কাজে যোগ দেওয়ার পর মাত্র এক মাস সময় দিয়ে মাউন্টব্যাটেন তাঁকে কাঁচি ধরিয়ে দিলেন ভারত কাটার জন্য। অনেকেই বলে থাকেন, মাউন্টব্যাটেন ও র্যাডক্লিফ সাহেবরা মাত্র ৭৪ দিনের (৩ জুন থেকে ১৪ আগস্ট) স্বল্পতম সময়ে দেশ বিভাগ করেছেন বলে এসব ভুল-ত্রুটি হয়েছে। কিন্তু এসব বলে ব্রিটিশ সরকারের দায়মুক্তির কোনো উপায় নেই। কারণ, ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতা কোনো আকস্মিক ঘটনা ছিল না। মহাত্মা গান্ধী ও জিন্নাহর নেতৃত্বে চলমান দীর্ঘ নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের ফলে ভারতের স্বাধীনতার ক্ষেত্র অনেক আগে থেকেই তৈরি হয়ে ছিল। লাখ লাখ মানুষের জীবনের সঙ্গে জড়িত সীমানা ভাগের মতো এত স্পর্শকাতর, জটিল, বিতর্কিত এবং বিশাল কাজটি র্যাডক্লিফ সাহেবকে দিয়ে অস্বাভাবিক রকমের দ্রুততার সঙ্গে কতটা কাণ্ডজ্ঞানহীন আর অযৌক্তিকভাবে করানো হয়েছে, তা সে সময়ের সংগৃহীত একটি পশ্চিমা কবিতায় ভালোভাবেই ফুটে উঠেছে:

Shut up in a lonely mansion, with police night and day
Patrolling the gardens to keep assassins away,
He got down to work, to the task of settling the fate
Of millions. The maps at his disposal were out of date
And the Census Returns almost certainly incorrect,
But there was no time to check them, no time to inspect
Contested areas. The weather was frightfully hot,
And a bout of dysentery kept him constantly on the trot,
But in seven weeks it was done, the frontiers decided,
A continent for better or worse divided.
The next day he sailed for England, where he quickly forgot
The case, as a good lawyer must. Return he would not,
Afraid, as he told his Club, that he might get shot.

(উদ্ধৃত, Khilnani, 1997 : 200)

সীমানা কমিশনের ‘To demarcate the boundaries of the two parts of the Punjab and Bengal, on the basis of ascertaining the contiguous majority areas of Muslims and non-Muslims. In doing so, it will also take into account other factors..’ (উদ্ধৃত Spate, 1947: 205) অর্থাত্ র্যাডক্লিফকে ‘সংলগ্ন সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা’র (contiguous majority areas) ওপর ভিত্তি করে সীমানা আঁকার নির্দেশনা দেওয়া হয় এবং ‘অন্যান্য বিষয়’ও (other factors) বিবেচনা করতে বলা হয়, যা কার্যত তাঁর কাজকে দুরূহ করেছিল। কারণ, ‘contiguous majority areas’ এবং ‘other factors’ সম্পর্কে কোনো ব্যাখ্যা সেখানে ছিল না। এবং যেহেতু কমিশনের হিন্দু ও মুসলমান সদস্যদের (বাংলা ও পাঞ্জাব উভয় কমিশনেই সদস্য হিসেবে মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে দুজন করে মুসলমান বিচারপতি ও কংগ্রেসের পক্ষ থেকে দুজন করে হিন্দু বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া হয় এবং র্যাডক্লিফ ছিলেন উভয় কমিশনেরই চেয়ারম্যান) মধ্যে কোনো মতৈক্য ছিল না, সেহেতু তাঁরা এই অনির্দিষ্ট ও অস্পষ্ট খণ্ডবাক্য (clause) দুটিকে তাঁদের বিবাদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোলবিদ ড. স্পেট, যিনি র্যাডক্লিফ কমিশনের সামনে পাঞ্জাবের মুসলমানদের বাটোয়ারা-সংক্রান্ত দাবি যথাযথভাবে উপস্থাপনের জন্য তাদের সাহায্যার্থে নিয়োজিত ছিলেন, যথার্থই বলেন:

As a result of this quasi-judicial procedure, the claims of each side were presented in a legalistic manner by counsel with a great gift for subtle analyses of the terms of reference but with no liberty to bargain. The judges also had no mandate to compromise and so, on all material points they divided two and two, leaving Sir Cyril Radcliffe the individious task of making the actual decision. It would certainly seem that the procedure itself was a mistake and that the matter could have been better settled by direct negotiation on the highest level, followed by fiat from Delhi. (Spate, 1947: 205) 

ফলে ভারতের রাজনৈতিক-ভূগোল সম্পর্কে অজ্ঞ ও অনভিজ্ঞ র্যাডক্লিফের স্বভাবতই বিব্রত বোধ করার কথা। অপর পক্ষে, র্যাডক্লিফকে সীমানা কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দিলেও এ কাজে তাঁকে স্বাধীনতা দেওয়া হয়নি। মাউন্টব্যাটেন নিজে র্যাডক্লিফকে নিয়ন্ত্রণ করেছেন। লেডি মাউন্টব্যাটেনের সঙ্গে নেহরুর সখ্য এবং তাঁর প্রভাবে নেহরু তথা ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রতি মি. মাউন্টব্যাটেনের পক্ষপাতদুষ্টতার অনেক প্রমাণ আছে:

The official documents show that in framing his plan he (Mountbatten) gave up all pretence of treating the Congress and Muslim League impartially. He showed documents to Nehru in “an act of friendship”, accepted Nehru’s suggestions and embodied them in the documents without showing those documents and suggestions to Jinnah, and obtaining Jinnah’s reactions. (উদ্ধৃত, মুহাইমেন, ১৯৯৪: ২০১)

এভাবে পক্ষপাতমূলকভাবে তিনি র্যাডক্লিফকে বাধ্য করেন সীমানা নির্ধারণে তাঁর কংগ্রেস-ঘেঁষা ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে। অর্পিত দায়িত্ব সম্পর্কে তাঁর অজ্ঞতা ও অদক্ষতা এবং কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মতানৈক্যের কারণে তিনি একদিকে যেমন দারুণ চাপে ছিলেন, অন্যদিকে ভীষণ বিরক্ত ছিলেন মাউন্টব্যাটেনের অনৈতিক হস্তক্ষেপে। কিন্তু র্যাডক্লিফ ছিলেন মাউন্টব্যাটেনের অধীন। ‘Radcliffe was at all turns harassed and hurried by outgoing Viceroy Mountbatten, who turned out to be ill prepared for the consequences of the Awards. In fact, after seeing the mayhem occurring on both sides of the boundary that was created by him, Cyril Radcliffe did the only thing he could have done to protest against Mountbatten. He refused his salary of 40000 rupees that was given to him for doing the most important job of his life.’৪

সম্ভবত মাউন্টব্যাটেনের পরামর্শেই র্যাডক্লিফ ভারত ত্যাগ করার আগে তাঁর সীমানা নির্ধারণ-সংক্রান্ত সব নথিপত্র ধ্বংস করে যান (Khilnani, 1997 : 200), যাতে করে সীমানা নির্ধারণ-সংক্রান্ত পক্ষপাত ও অনিয়মের কোনো তথ্য-প্রমাণ না থাকে। র্যাডক্লিফ সীমানা কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে তাঁর কৃতকর্মের পরিণতি সম্পর্কে ধারণা করতে পেরেছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, তাঁর আঁকা সীমানা এ অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষের জীবনে মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে আনবে, যার প্রমাণ পাওয়া যায় ভারত স্বাধীনতার ঠিক আগের দিন তাঁর সপত্নী-পুত্রকে লেখা একটি ব্যক্তিগত চিঠি থেকেও। সেই চিঠিতে তিনি লেখেন:

I thought you would like to get a letter from India with a crown on the envelop. After tomorrow evening nobody will ever again be allowed to use such stationery and after 150 years British rule will be over in India – Down comes the Union Jack on Friday morning and up goes – for the moment I rather forget what, but it has a spinning wheel or a spider’s web in the middle. I am going to see Mountbatten sworn as the first Governor-General of the Indian Union at the Viceroy’s House in the morning and then I station myself firmly on the Delhi airport until an aeroplane from England comes along. Nobody in India will love me for the award about the Punjab and Bengal and there will be roughly 80 million people with a grievance who will begin looking for me. I do not want them to find me. I have worked and travelled and sweated – oh I have sweated the whole time. (উদ্ধৃত, Heward, 1994 : 42)

পক্ষপাতের পুরস্কারস্বরূপই হয়তো মাউন্টব্যাটেন ভারত ডোমিনিয়নের গভর্নর জেনারেলের পদটি আরও কিছুদিন (১৯৪৮ সালের ২১ জুন পর্যন্ত) ধরে রাখতে সক্ষম হন। নেহরু কর্তৃক স্বাধীন ভারতের গভর্নর জেনারেল হিসেবে মি. মাউন্টব্যাটেনকে মেনে নেওয়ার পেছনে লেডি মাউন্টব্যাটেনের অন্তত আরও কিছুদিন ভারতে থাকতে পারার বিষয়টিও কাজ করেছিল কি না, ভবিষ্যত্ গবেষণা হয়তো এ বিষয়ে সঠিক উত্তর দেবে।

বাস্তববিবর্জিত র্যাডক্লিফ বাটোয়ারার সীমারেখা সীমান্ত অঞ্চলের জনজীবনকে সব দিক থেকেই চরমভাবে ব্যাহত করে। কৃষক ও কৃষিশ্রমিকের অর্থনৈতিক জীবনে নেমে আসে মহাবিপর্যয়। বাংলাদেশের ছিটমহল-অধ্যুষিত উত্তরাঞ্চলের ভূমির মালিকানা এবং চাষ পদ্ধতি ছিল বৈচিত্র্যপূর্ণ। সেখানে ছিল বিভিন্ন আকারের ভূ-সম্পত্তি, যার ওপর স্থানীয় চাকলাদার, জমিদার, তালুকদার, টপ্পাদার, জোতদার এবং রায়তদের যৌথ ও দ্বিমালিকানা (shared and bifurcate ownership) ছিল বেশ লক্ষণীয়। ভাগ-চাষি বা আধিয়ার নামের একটি বড় সংখ্যার কৃষিজীবী শ্রেণীও ছিল এ অঞ্চলে। একজন চাষি একই সঙ্গে নিজের জমি চাষ করতেন, অন্যের জমি বর্গা চাষ করতেন, আবার নিজের জমির কিছু অংশ প্রয়োজনে চাষের জন্য অন্যকে বর্গা দিতেন। বস্তুত, ভূমির ওপর যৌথ ও দূর মালিকানাসমৃদ্ধ এ অঞ্চলে একধরনের অবিচ্ছেদ্য ও মিশ্র কৃষি অর্থনীতি বিদ্যমান ছিল, যা কোনো প্রকার আর্থসামাজিক বিবেচনা ছাড়াই দ্বিখণ্ডিত করা হয়। নিকটতম প্রতিবেশীরা, যারা যৌথ পেশায় নিয়োজিত ছিল, অথবা জীবিকার জন্য একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল ছিল, তারা রাষ্ট্রসীমানা দ্বারা রাতারাতি আলাদা হয়ে গেল। উভয় দেশের মধ্যে চালু হলো ভিসা পদ্ধতি। অথচ ছিটমহলের মানুষকে পাসপোর্ট দেওয়ার কোনো ব্যবস্থা করা হলো না কোনো দেশেই। সেই থেকে গত ছয় দশকেও পাসপোর্ট বা ভিসা-সুবিধা পায়নি ছিটমহলের মানুষ। কারণ, পাসপোর্ট পাওয়ার জন্য ছিটমহলের একজন মানুষকে আগে একাধিকবার পাসপোর্ট-ভিসা ছাড়া অবৈধভাবে সীমান্ত পারাপার করতে হবে। এমন অদ্ভুত সংকটে পৃথিবীর আর কোথাও কি কোনো মানুষ পড়েছে? যদিও সীমানা নির্ধারণের পরও অল্প কয়েক বছর ধরে কৃষিশ্রমিকেরা শ্রম বিক্রির জন্য সীমানা পেরিয়ে এপার-ওপার যাতায়াত করতে পারত। কিন্তু তাতে করে উভয় দেশের সীমান্ত প্রহরীদের হাতে হয়রানি এবং তাদের গুলিতে নিহত হওয়ার মতো ঘটনা যখন ব্যাপকভাবে বাড়তে থাকে, তখন তারা উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া উপার্জনের উত্সগুলো ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। এমন পরিস্থিতিতে ছিটমহলের অধিবাসীরা আন্তর্জাতিক সীমানা দ্বারা মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে বঞ্চিত মানুষে পরিণত হয়। রাতারাতি নির্ধারিত এই সীমারেখা সীমান্ত অঞ্চলের মানুষের এবং বিশেষ করে, ছিটমহলের মানুষের প্রথানুগ জীবনযাপনকে বেআইনি করে তোলে। শ্রম বিক্রি, জমি চাষ এবং জীবিকা নির্বাহের অন্য সব কাজকর্মের জন্য যেদিকে যাতায়াত তাদের নিত্যদিনের কাজ, যুগ-যুগান্তরের অভ্যস্ততা—রাষ্ট্রের চোখে তা এখন অবৈধ অনুপ্রবেশ!

দুই দেশের আন্তর্জাতিক সীমানা ছিটমহল ও সীমান্ত অধিবাসীদের অনেক ক্ষেত্রে তাদের কৃষিজমি থেকে বিচ্ছিন্ন করে তাদের এমন একটা উভয় সংকটে ফেলেছিল, হয় তাদের বসতভিটা ছেড়ে কৃষিজমিতে গিয়ে আশ্রয় নিতে হতো, অথবা কৃষিজমির মায়া ত্যাগ করে বসতভিটা আগলে থাকতে হতো। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, র্যাডক্লিফ সীমারেখা অনেক বাড়ির চৌহদ্দিতে অবস্থিত বাঁশবাগান, সুপারিবাগান, তামাক বা সবজি চাষের জমিকে পর্যন্ত অন্য রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত করে দেয়। ফলে বিশেষ করে, ছিটমহলের অধিবাসীরা রাতারাতি দেখতে পেল, হয়তো তাদের পাট চাষের জমিটি পড়েছে পাকিস্তানে, আমন ধানের জমিটি পড়েছে ভারতে আর তামাক চাষের জমি বা সুপারিবাগান অথবা অন্য কিছু জমি হয়তো পড়েছে ছিটমহলে। এভাবে ছিটমহলের কোনো অধিবাসীর যে জমিটুকু স্বাগতিক দেশের মধ্যে পড়েছে, আইনগতভাবেই সেই জমির মালিকানা হারিয়েছে। অন্যদিকে যে জমিটুকু নিজের দেশে পড়েছে, তার ওপর তার আইনগত মালিকানা বহাল থাকলেও আন্তর্জাতিক সীমানা দ্বারা সেই জমি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে। এভাবেই তারা নিঃস্ব হয়ে ছিটমহলে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলার মেকলিগঞ্জে অবস্থিত বাংলাদেশি ছিটমহল কিসেমত নিজজমার বাসিন্দা রাজেন্দ্র বর্মণ (৬৯/২০০৪)৫ এ প্রসঙ্গে বলেন:

এখন আপনার সাথে যেই জমিতে বইসে কথা বলতাছি, এইটাই হামার জমি। আগে এখানেই ছিলাম। এই জায়গাটা বাংলাদেশের পাটগ্রাম থানার শ্রীরামপুর ইউনিয়নে পড়ছে। তিরিশ বছর আগে বর্তমানে যেইখানে আছি, সেইখানে চইলে গেছি। দেশভাগ হওয়ার সময় হামার অর্ধেক জমি পড়ছে বাংলাদেশে, আর অর্ধেক পড়ছে ভারতে। সেইটাকে (ভারতে অবস্থিত জমি) এখন সিট ল্যান্ড বলে। তখন হামার বাড়ি ছিল এইখানে, মানে বাংলাদেশে। আর হামার মহিষের বাতান ছিল ভারতে। মানে সীমানার এইপার আর ওইপার। আগে তো এইখানে থাইকে ওই দেশে গিয়ে হামার জমি চাষ করতাম। পরে নানান সমস্যার কারণে এইখানের জমিজমা সব ফালায়ে ওই দেশে ছিটে গিয়ে বাড়ি করছি। চইলে যাওয়ার পর এই দেশে হামার এই জমিগুলো খাস হয়ে গেছে।

ছিটমহল সৃষ্টির শেষ খলনায়ক জগদ্বীপেন্দ্র নারায়ণ

দেশভাগের প্রক্রিয়ায় ব্রিটিশদের বহুবিধ প্রহসনের একটি হলো, তাদের পরোক্ষ শাসনাধীনে থাকা করদরাজ্যগুলোকে না বিভক্ত করা, না স্বাধীনতা দেওয়া। ছিটমহল-অধ্যুষিত করদরাজ্য কোচবিহারের প্রতি মাউন্টব্যাটেনের এই নীতি এবং এই নীতির সঙ্গে সমন্বয়হীন র্যাডক্লিফের বাটোয়ারা নীতির যৌথ ভেলকিবাজির ফলাফলই মূলত আজকের বাংলাদেশ-ভারত ছিটমহল। তত্কালীন কোচবিহার মহারাজা জগদ্বীপেন্দ্র নারায়ণের এই নারায়ণী (করদরাজ) ক্ষমতাবলে তাঁকে পছন্দমতো ভারত অথবা পাকিস্তান রাষ্ট্রের সঙ্গে তাঁর রাজ্যকে একীভূত করার ক্ষমতা দেওয়া হয়। ফলে ভারত-পাকিস্তান বিভাগের দুই বছর পর তিনি রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের তীব্র আপত্তি সত্ত্বেও ১৯৪৯ সালের ২৮ আগস্ট ভারতের (Dominion of India) সঙ্গে Cooch Behar Merger Agreement স্বাক্ষর করে কোচবিহারকে ভারতের সঙ্গে একীভূত করেন। এই চুক্তির অনুচ্ছেদ ১-এর ধারার বলে কোচবিহার মহারাজার অধীন সব ভূ-সম্পত্তি ভারতের সার্বভৌমত্বের অধীনে ন্যস্ত হয়। চুক্তির ১ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়:

Article-1
His Highness the Maharaja of Cooch Behar hereby cedes to the Dominion Government full and exclusive authority, jurisdiction and powers for and in relation to the governance of the State and agrees to transfer the administration of the State to the Dominion Government on the 12th day of September 1949.
As from the said day the Dominion Government will be competent to exercise the said powers, authority and jurisdiction in such manner and through such agency as it may think fit.৬

ফলে রংপুর ও দিনাজপুর অঞ্চলে অবস্থিত কোচবিহার ছিটমহলগুলো ভারতীয় ছিটমহলে পরিণত হয় এবং সেসব ছিটমহলের অধিবাসীরা রাতারাতি ভারতের নাগরিকে পরিণত হয়। অন্যদিকে, দেশভাগের সঙ্গে সঙ্গেই রংপুর ও দিনাজপুর অঞ্চলের জমিদারিগুলো পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় কোচবিহার ও জলপাইগুড়ি ভূখণ্ডে অবস্থিত রংপুর ও দিনাজপুরের জমিদারদের ছিটমহলগুলো পাকিস্তানের ছিটমহলে পরিণত হয় এবং সেই ছিটমহলের অধিবাসীরা পাকিস্তানের নাগরিকে পরিণত হয়। সীমানা নির্ধারণের পর উভয় দেশই সীমান্তরক্ষী বাহিনী (ভারতের বিএসএফ ও পাকিস্তানের রেঞ্জার) নিয়োগের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সীমানাব্যবস্থা চালু করে। বন্ধ হয়ে যায় মানুষের সীমানা পারাপার। ফলে ভারতীয় এবং পাকিস্তানি (পরে বাংলাদেশি) ছিটমহলগুলোর সঙ্গে ভারত বা পাকিস্তানের কোনো সংযোগ থাকল না, অথচ প্রশাসনিক এখতিয়ার থাকল। এর মাধ্যমে ছিটমহল সমস্যায় যোগ হয় নতুন মাত্রা। অর্থাত্, ছিটমহলগুলো আন্তর্জাতিক মর্যাদা লাভ করে এবং প্রকৃত ছিটমহল (enclave) হিসেবে আবির্ভূত হয়।

যে ব্রিটিশদের ক্ষমতা ও ইচ্ছাবলে এই উপমহাদেশে অসম্ভব বলে কিছু ছিল না, তারা যদি তাদের আশ্রিত কোচবিহার মহারাজাকে র্যাডক্লিফ সীমারেখা দ্বারা বিচ্ছিন্ন ছিটমহলগুলোর মালিকানা পরিত্যাগ করতে বলত, তাহলে কি তা অগ্রাহ্য হতো? অবশ্যই না। অন্যদিকে, কোচবিহার ভূখণ্ডে অবস্থিত রংপুর ও দিনাজপুরের ছিটমহলগুলোর মালিকানা তো ব্রিটিশদের হাতেই ছিল। সুতরাং, এসব ছিটমহলের মালিকানাও তারা কোচবিহারের পক্ষে পরিত্যাগ করতে পারত। অথচ কোনোটিই তারা করেনি। এমনকি র্যাডক্লিফ রোয়েদাদে এ-সংক্রান্ত একটি বাক্য সংযুক্ত করাই ছিল এই সমস্যা সমাধানের জন্য যথেষ্ট। সমস্যাটির বাস্তবতা ও এর গুরুত্ব বুঝতে পেরে দেশ বিভাগের মাত্র ১০ বছরের মাথায় ভারত-পাকিস্তানের নেতারা ছিটমহল বিনিময়ের জন্য শীর্ষপর্যায়ে চুক্তি করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন, অথচ দেশ বিভাগের সময় ‘সুশিক্ষিত’ ব্রিটিশরা এই বাস্তবতাটুকু অনুভব করতে পারল না! হান্টার এবং হার্টলের প্রতিবেদনের পর তারা বিষয়টি জানত না, সেটাও তো বলার উপায় নেই। সুতরাং, ব্রিটিশদের এই ছিটমহল সমস্যার দায়ভার এড়ানোর কোনো সুযোগ নেই।

বাংলাদেশ-ভারত ছিটমহলের পরিসংখ্যান

বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে পরস্পরের ছিটমহলগুলো আয়তন, অবস্থান ও জনসংখ্যার দিক থেকে খুবই বৈচিত্র্যপূর্ণ। ছিটমহলগুলো বাংলাদেশ-ভারত প্রান্তসীমার মাত্র কয়েক মিটার দূরত্ব থেকে শুরু করে কয়েক কিলোমিটার দূরত্ব পর্যন্ত এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। সবচেয়ে ছোট ছিটমহলের আয়তন শূন্য দশমিক ২৭ একর, যেখানে কোনো জনবসতি নেই। অন্যদিকে, সর্ববৃহত্ ছিটমহল দহগ্রাম-আঙ্গরপোতার আয়তন ৩৮৭৭ দশমিক ০৫ একর এবং এখানকার জনসংখ্যা বর্তমানে প্রায় ২০ হাজার। কোনো কোনো ক্ষেত্রে একাধিক ছিটমহল একই সঙ্গে অবস্থিত। যেমন: পঞ্চগড় জেলার দেবীগঞ্জের চারটি ছিটমহল—শালবাড়ী, নাটকটোকা, বেওলাডাঙ্গা ও কাজলদিঘি একই সঙ্গে অবস্থিত। এসব ক্ষেত্রে একাধিক ছিটমহল একটি মৌজায় অন্তর্ভুক্ত। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে একটি বড় ছিটমহল একাধিক মৌজায় বিস্তৃত। ছিটমহলগুলোর প্রায় অনির্ধারণযোগ্য জটিল আকার ও আয়তন সত্যি বিস্ময়কর। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ছিটমহলের নাম, সেগুলোর সংখ্যা, আয়তন ও অবস্থান সম্পর্কে স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যে মতপার্থক্যও উল্লেখযোগ্য।

সাধারণভাবে বিভিন্ন সূত্রে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে ১৩০টি ভারতীয় ছিটমহল এবং ভারতের ভূখণ্ডে ৯৫টি বাংলাদেশি ছিটমহল দাবি করা হয়। সেসব তালিকায় অবশ্য ছিটমহলগুলোর জটিল আকার, আয়তন ও মিশ্রণ-সম্পর্কিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়নি। ছিটমহল-অধ্যুষিত মৌজাগুলোর ম্যাপ ও ছিটমহলের প্রাপ্ত তালিকা বিশ্লেষণ করে এবং বাংলাদেশে অবস্থিত বেশ কিছু ভারতীয় ছিটমহল সরেজমিনে পরিদর্শন করে দেখা যায়, যেসব ছিটমহল একাধিক মৌজায় বিস্তৃত, সেগুলোর ক্ষেত্রে একটি ছিটমহলকে প্রতিটি মৌজার নামে আলাদাভাবে একাধিক ছিটমহল হিসেবে গণনা করা হয়েছে। এ ছাড়া ভারতীয় ছিটমহলের প্রাপ্ত তালিকায় অনেক কোচবিহার ছিটমহলের নাম রয়েছে, যেগুলো আসলে জলপাইগুড়িতে অবস্থিত ছিল এবং ১৯৫২ সালে জলপাইগুড়ির সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়েছে। তালিকায় পাওয়া এমন কয়েকটি ছিটমহল হচ্ছে শাখাতি (জে এল নম্বর ৬৮), শাখাতি (জে এল নম্বর ৬৩), শাখাতি (জে এল নম্বর ৬২), বিন্নাগুড়ি (জে এল নম্বর ৬১), বিন্নাগুড়ি (জে এল নম্বর ৮১), দৈখাতা (জে এল নম্বর ৩৯) ও দৈখাতা (জে এল নম্বর ৪০)। অহস্তান্তরযোগ্য প্রতি ছিটমহলের (counter enclave) ধারণাও ছিটমহলের সংখ্যা নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। এসব বিষয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা যায়, বাংলাদেশের ভূখণ্ডে ১২৩টি ভারতীয় ছিটমহল রয়েছে। অপর পক্ষে ভারতের ভূখণ্ডে রয়েছে বাংলাদেশের ৯৫টি ছিটমহল। উল্লেখ্য, দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা যেহেতু মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়েছে, তাই এটি আর প্রকৃত ছিটমহলের চরিত্র বহন করে না এবং মুজিব-ইন্দিরা চুক্তিতেও এর বিনিময়ের কথা বলা হয়নি।

ভারতের ভূখণ্ডে বাংলাদেশি ছিটমহলগুলোর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলার হলদিবাড়ীতে ১৮টি, মেকলিগঞ্জে ২৭টি, সিতলকুচিতে ৯টি, দিনাহাটায় ৩২টি ও তুফানগঞ্জে ছয়টি অবস্থিত। এ ছাড়া জলপাইগুড়িতে বৈকুণ্ঠপুর নামের পাশাপাশি তিনটি বাংলাদেশি ছিটমহল (এক নামে) রয়েছে বলে কোনো কোনো সূত্রে জানা যায়। অন্যদিকে, বাংলাদেশের ভূখণ্ডে ভারতীয় ছিটমহলগুলো পঞ্চগড় জেলার সদর থানায় সাতটি, বোদা থানায় ১৯টি, দেবীগঞ্জে ১৪টি, বোদা ও দেবীগঞ্জের মধ্যবর্তী দুটি, দেবীগঞ্জ ও ডোমারের মধ্যবর্তী তিনটি, নীলফামারী জেলার ডিমলায় চারটি, লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রামে ৫৪টি, হাতিবান্ধায় চারটি (এর মধ্যে দুটির অবস্থান প্রাপ্ত তথ্যসূত্রে স্পষ্টভাবে উল্লেখ নেই), লালমনিরহাট সদর ও ফুলবাড়ীর মধ্যবর্তী দুটি, ফুলবাড়ী ও নাগেশ্বরীর মধ্যবর্তী একটি, কুড়িগ্রাম সদরে একটি এবং কুড়িগ্রাম জেলার ভুরুঙ্গামারীতে ১২টি অবস্থিত।৭

অবশ্য সরকারি পর্যায়ে ১১১টি ভারতীয় এবং ৫১ বাংলাদেশি ছিটমহলের কথা বলা হয়। সরকার কিসের ভিত্তিতে এই সংখ্যা নির্ধারণ করেছে, তা প্রকাশ করা হয়নি বা ছিটমহলের কোনো তালিকাও প্রকাশ করা হয়নি। ২০১১ সালের ঢাকা শীর্ষ বৈঠককে সামনে রেখে ছিটমহলে ‘যৌথ জরিপ’ পরিচালনার কথা বলা হয়েছে। কয়টি ছিটমহলে জরিপ করা হয়েছে; কী উদ্দেশ্যে, কেন জরিপ করা হয়েছে, জরিপের ফলাফল কী—এসব বিষয়ে কিছুই প্রকাশ করা হয়নি। তথ্যসূত্রভেদে ছিটমহলের সংখ্যা-সংক্রান্ত এসব পার্থক্য দূর করার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে যৌথ জরিপ, সংশ্লিষ্ট এলাকার মৌজা-ম্যাপসহ স্থানীয় ভূমি অফিসের নথিপত্র এবং বিভিন্ন সূত্রে প্রকাশিত ছিটমহলের তালিকা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এর একটি পূর্ণাঙ্গ যৌথ তালিকা অবস্থান ও আয়তনসহ প্রকাশ করা অত্যাবশ্যক। সেই সঙ্গে কেন সরকারের দাবি করা সংখ্যা সঠিক এবং কেন অন্যান্য তথ্যসূত্র থেকে পাওয়া তালিকা সঠিক নয়, সে বিষয়টিও ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন।

ছিটমহলের সংখ্যায় যেমন গরমিল রয়েছে, তেমনি অসংগতি রয়েছে ছিটমহলগুলোর আয়তন নিয়েও। মোট কথা, ছিটমহলের আয়তন-সংক্রান্ত সরকারি বা নির্ভরযোগ্য কোনো হিসাব পাওয়া যায় না। ছিটমহলের আয়তন-সংক্রান্ত প্রাপ্ত উত্সগুলো পরীক্ষা করে দেখা যায়, অনেক ক্ষেত্রে ছিটমহলের আয়তনের পরিবর্তে যে মৌজায় ছিটমহলটি অবস্থিত, সেই মৌজার আয়তন উল্লেখ করা হয়েছে। অথচ কোনো কোনো ক্ষেত্রে একই মৌজায় একাধিক ছিটমহল অবস্থিত, আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে একই ছিটমহল একাধিক মৌজায় বিস্তৃত। তাই প্রাপ্ত তথ্যসূত্রের ওপর ভিত্তি করে ছিটমহলগুলোর আয়তন সঠিকভাবে পরিমাপ করা সম্ভব নয়। প্রাপ্ত তথ্যমতে, ভারতীয় ভূখণ্ডে অবস্থিত বাংলাদেশি ছিটমহলগুলোর মোট আয়তন ১২২৮৯ দশমিক ৩৭ একর। কিন্তু দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা ছিটমহলটি ইতিমধ্যে মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে। তাই দহগ্রাম-আঙ্গরপোতার আয়তন বাদ দিয়ে বাংলাদেশি ছিটমহলের আয়তন আপাতত ৮৩০৩ দশমিক ০৭ একর বলে ধরে নেওয়া যায়। অন্যদিকে বাংলাদেশি ভূখণ্ডে ভারতীয় ছিটমহলের মোট আয়তন ২০৯৫৭ দশমিক ০৭ একর পাওয়া যায়। কিন্তু ১৯৫২ সালে যে ছিটমহলগুলো জলপাইগুড়ির সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়েছে, এগুলোকে সেই হিসাব থেকে বাদ দেওয়া হয়নি। সুতরাং, জলপাইগুড়ির সঙ্গে সংযুক্ত ছিটমহলগুলোর আয়তন বাদ দিয়ে অবশিষ্ট ভারতীয় ছিটমহলগুলোর মোট আয়তন আপাতত ১৭২০৩ দশমিক ১২ একর বলে ধরে নেওয়া যায়। এ প্রসঙ্গে স্পষ্টতই বলে রাখা উচিত, ছিটমহলগুলোর আয়তন-সংক্রান্ত কোনো দেশেরই কোনো পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। আর এই আয়তন নির্ধারণের কাজটি দুই দেশের সমন্বিত যৌথ উদ্যোগ ছাড়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়।

ছিটমহলের জনসংখ্যাগত ধারণা

বাংলাদেশ-ভারত ছিটমহলে বসবাসকারী নেই-মানুষের সংখ্যা কত? এ বিষয়ে কোনো দেশেরই সরকারি কোনো পরিসংখ্যান উল্লেখ করা সম্ভব নয়। কারণ, কোনো দেশের আদমশুমারি আজ পর্যন্ত ছিটমহলের মানুষের কাছে পৌঁছায়নি। এ বিষয়ে খুবই বস্তুনিষ্ঠ ও গুরুত্বপূর্ণ একটি তথ্য হলো, ১৯৯৫ সালের ২০ মার্চ ভারতের লোকসভার প্রশ্নোত্তর পর্বে এক প্রশ্নের জবাবে (প্রশ্ন নম্বর ৮০৯) ভারতের তত্কালীন বিদেশমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘(ভারত) সরকারের কাছে ছিটমহলগুলোর জনসংখ্যার বিশ্বাসযোগ্য কোনো তথ্য নেই (Roy Pradhan, 1995)।’ ১৯৫০-এর দশকে পরিচালিত আদমশুমারিতে উভয় দেশই, বিশেষ করে পাকিস্তান তাদের ছিটমহলে বসবাসকারী জনসংখ্যা গণনার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু গণনাকারীদের সীমানা অতিক্রম করে ছিটমহলে প্রবেশের ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষের অসহযোগিতার কারণে তা সম্ভব হয়নি। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ১৯৫১ সালের আদমশুমারিতে পাকিস্তানের গণনাকারীরা কোচবিহারের অভ্যন্তরে পাকিস্তানি ছিটমহলে প্রবেশের পথে ভারতীয় সীমান্ত প্রহরীরা তাদের আটক করেছিল। ফলে তখন থেকে আজ পর্যন্ত উভয় দেশের সব আদমশুমারি থেকেই বাদ পড়ে যায় ছিটমহলের অধিবাসীরা। তাই ছিটমহলের অধিবাসীদের প্রকৃত সংখ্যা সংশ্লিষ্ট দেশের সরকারগুলোরই অজানা। এমন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন সূত্রে ছিটমহলের জনসংখ্যা সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য পাওয়া যায়। রায়ের (১৯৯৫) মতে, এক লাখ ৫০ হাজার মানুষ ভারতীয় ছিটমহলে (বাংলাদেশে) বসবাস করে। বোসের (১৯৯৭) মতে, দুই লাখ মানুষ ভারতীয় ছিটমহলে (বাংলাদেশে) বসবাস করে। ছিটমহলের জনসংখ্যা-সংক্রান্ত এই পরিসংখ্যানগুলোর কোনোটিই বাস্তবসম্মত মনে হয় না। যদিও হোয়াইট (২০০২) ১৯৫১ সালের আদমশুমারি প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে ছিটমহলের বর্তমান জনসংখ্যা নির্ণয় করেছেন। কিন্তু তিনি কোন দেশের আদমশুমারি অনুসরণ করেছেন, তা উল্লেখ করেননি। উল্লেখ করা প্রয়োজন, ১৯৫১ সালে ছিটমহলে পাকিস্তানের আদমশুমারির প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার দালিলিক প্রমাণ আছে। অন্যদিকে ভারতও ছিটমহলে কোনো আদমশুমারি পরিচালনা করেছে বলে জানা যায় না। সুতরাং, হোয়াইটের (২০০২) দেওয়া পরিসংখ্যান নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। পাকিস্তানের ১৯৬১ সালের সেন্সাস প্রতিবেদনে বিভিন্ন জেলার ৮২টি গ্রামকে জনবসতিহীন হিসেবে দেখানো হয়েছে, যার অনেকটিই একেকটি ভারতীয় ছিটমহল বা তার অংশবিশেষ। বিষয়টি বিবেচনা করে ধারণা করা যায়, ১৯৬১ সালের আদমশুমারিতে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে অবস্থিত ভারতীয় ছিটমহলের জনসংখ্যা গণনা না করে বরং জনবসতিহীন গ্রাম হিসেবে দেখানো হয়েছে, যেমন জনবসতিহীন দেখানো হয়েছে নদীভাঙা গ্রামগুলোকেও। সবকিছু বিবেচনায় এনে এটুকু বলা যায়, ছিটমহলের জনসংখ্যা-সম্পর্কিত প্রাপ্ত কোনো তথ্যই নির্ভরযোগ্য নয়।

হোয়াইট (২০০২) তাঁর বর্ণিত ১৯৫১ সালের আদমশুমারি প্রতিবেদনে উল্লিখিত ছিটমহলের জনসংখ্যাকে বিগত দশকগুলোতে ছিটমহলের পার্শ্ববর্তী এলাকার জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার দিয়ে তুলনামূলক হিসাব কষে বাংলাদেশ ও ভারতের ছিটমহলগুলোতে বর্তমান জনসংখ্যা ৫৫ হাজার বলে দাবি করেছেন। ছিটমহলের জনসংখ্যা-সম্পর্কিত হোয়াইটের (২০০২) এই পরিসংখ্যান বেশ কিছু কারণে বাস্তবসম্মত নয়। প্রথমত, পঞ্চাশের দশকের ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় উভয় দেশের ছিটমহলের মানুষ জীবন রক্ষার তাগিদে ছিটমহল ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছিল। নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ছিটমহলবাসীর সীমান্ত অতিক্রমের ঘটনা ঘটেছে অসংখ্য। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রশমিত হলে বিশেষ করে, ১৯৫৮ সালে নূন-নেহরু বৈঠকের পর তাদের অনেকেই ছিটমহলে ফিরে আসে। সুতরাং, কোনো পক্ষ সেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় ছিটমহলের লোক গণনার দাবি করলেও তাদের প্রতিবেদনে ছিটমহলের জনসংখ্যার সঠিক হিসাব পাওয়া সম্ভব বলে মনে হয় না। হোয়াইট (২০০২) তাঁর হিসাবের পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে বলেছেন, ‘It would seem intuitive that the density of the enclaves is somewhat less than that of the surrounding areas, due to the disadvantages of residency there.’ কিন্তু অন্তত দুটি কারণে এ যুক্তি বাস্তবসম্মত নয়। প্রথমত, পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে ভারত ও তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানে পরিবার পরিকল্পনা প্রচলিত ছিল না। কিন্তু গত তিন দশকে পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি উভয় দেশেই জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার অনেকাংশে হ্রাস করেছে। অথচ বাংলাদেশ-ভারত ছিটমহলের অধিবাসীরা পরিবার পরিকল্পনার সুফল থেকে পুরোপুরিভাবে বঞ্চিত। কারণ, ছিটমহলগুলোতে আজ পর্যন্ত কোনো সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান পরিবার পরিকল্পনা বা স্বাস্থ্যসেবা-সংক্রান্ত কোনো কার্যক্রম পরিচালনা করেনি। সুতরাং, ছিটমহলগুলোতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার পার্শ্ববর্তী এলাকার তুলনায় কম নয়, বরং অনেক বেশি হওয়ার সম্ভাবনা। দ্বিতীয়ত, তিনি বিবেচনা করেননি, বসবাসের অসুবিধার কারণে ছিটমহলের বাইরে কোনো স্থানে গিয়ে সুবিধামতো বসতি স্থাপন করার কোনো সুযোগ ছিটমহলের মানুষের নেই। কারণ, কার্যত তারা উভয় দেশেরই নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত। তাদের একমাত্র পরিচয়—তারা ‘ছিটের লোক’। ছিটমহলই তাদের একমাত্র ঠিকানা। অতএব, ছিটমহলের জনসংখ্যা-সম্পর্কিত প্রাপ্ত কোনো পরিসংখ্যানই নির্ভরযোগ্য নয় এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে যৌথ জরিপ ছাড়া ছিটমহলের জনসংখ্যার সঠিক পরিসংখ্যান তৈরি করা সম্ভবও নয়।

দেশ বিভাগ-উত্তর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা: ‘ছিটের নাগরিক’দের ভাগ্যবিপর্যয়ের সূত্রপাত

আগে থেকে চলে আসা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা র্যাডক্লিফ রোয়েদাদ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে আরও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। এই দাঙ্গার জন্য হিন্দু ও মুসলমানেরা পরস্পরকে দোষারোপ করে নিজেদের দায় এড়াতে চায়। এই প্রবণতা বর্তমান সময়ের লেখক-গবেষকদের মধ্যেও লক্ষণীয়। তবে আসল কথা হলো, এই দাঙ্গায় উভয় দেশের উভয় ধর্মের হাজার হাজার নিরীহ মানুষ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ‘Muslims said the Hindus had planned and started the killing. According to the Hindus, the Muslims were to blame. The fact is, both sides killed. Both shot and stabbed and speared and clubbed. Both tortured. Both raped.’ (Time Magazine October 27, 1947) আর সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় উভয় দেশের ছিটমহলের অধিবাসীরা। সাম্প্রদায়িক আক্রমণে ছিটমহলের অধিবাসীদের জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। ফলে ছিটমহলের অনেক মানুষ জীবন বাঁচাতে ঘরবাড়ি, জমিজমা ত্যাগ করে আশ্রয় নেয় সীমান্তের অপর পারে (ভারত থেকে পাকিস্তানে, পাকিস্তান থেকে ভারতে)। দেবীগঞ্জ ও ডোমার থানার মধ্যবর্তী ভারতীয় ছিটমহল উপনচৌকী ভাজনীর অধিবাসী খলিলুর রহমান (৭০/২০০৪) (তিনি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় ভারতের ভূখণ্ডে অবস্থিত বাংলাদেশি ছিটমহল থেকে চলে এসে বাংলাদেশে অবস্থিত ভারতীয় ছিটমহলে আশ্রয় নিয়েছিলেন) এ প্রসঙ্গে বলেন:

হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার সময় ভারতে মুসলমানদের ওপর হিন্দুরা খুব অত্যাচার করেছে। ধরেন, কোনো দাড়িওয়ালা মুসলমান যদি সেই সময় হলদিবাড়ী বা জলপাইগুড়ি বাজারে যাইত, হিন্দুরা তাকে ধরে তার দাড়ি কাইটে দিত, ডাঙ্গ মারত। আর সেই রকম কোনো গুন্ডার হাতে পড়লে একেবারে মাইরেই ফেলত। তাই ওখান থেকে চইলে না আইসে উপায় ছিল না...তখন আমাদের জমিজমা যা ছিল, তা রাইখে এখানে চইলে আইছি। ভারত থাইকে বাংলায় ঢুইকে সরাসরি আমরা এই ছিটে আইছি এবং আজ পর্যন্ত এই ছিট থেকে অন্য কোথাও যাই নাই। এখানে আগে মস্ত বড় বামন (হিন্দু ব্রাহ্মণ) পাড়া ছিল। এই জায়গাটার নামই ছিল বামনপাড়া। সেই রায়টের (সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা) সময় এখানকার ব্রাহ্মণ-ঠাকুরেরা তাদের জায়গাজমি ফেলে শুধু জমির দলিলপত্র নিয়ে ভারতে চইলে যায়। আর আমরা তখন ভারতেই তাদের কাছ থেকে এই জমি খরিদ করে তারপর এখানে আইছি... এই জমিগুলো তখন কিনেছি খুব কম দামে। জমির দাম পড়েছে গোড়ান (গড়ে) পাঁচ টাকা (বিঘাপ্রতি মূল্য মাত্র পাঁচ টাকা)।

আবু বকর সরকার (৭৬/২০০৪) বিলাপ করে বলেন:

সাতচল্লিশ সালে দেশভাগের পর এই জায়গাটা যখন ছিটে পরিণত হয়, তখন আমরা বহুত ক্ষতিগ্রস্ত হই। বাইরে থেকে গুন্ডাপান্ডা সব কোথা থাইকে আইসে আমাদের এই জায়গায় ঢুইকে আমাদের সবকিছু এক্কেবারে তছনছ করে দিছে! মানসম্মান, ইজ্জত, গরু-ছাগল কিচ্ছু থয় নাই!

ছিটমহলের মানুষের ওপর হয়রানি এবং তাদের জানমালের ক্ষতি সাধিত হয় বিভিন্ন উপায়ে। তাদের পার্শ্ববর্তী হাটবাজারে যেতে এবং কেনাবেচা করতে বাধা দিত স্থানীয় দুষ্কৃতকারীরা। যেহেতু তারা সীমানা অতিক্রম করে মূল ভূখণ্ডে যেতে পারত না, তাই তাদের অবস্থা দাঁড়ায় অর্থনৈতিক অবরোধের পর্যায়ে। অবস্থার গুরুত্ব অনুধাবন করে ১৯৫০ সালের ২৯ ও ৩০ আগস্ট ঢাকায় অনুষ্ঠিত ভারত-পাকিস্তান মুখ্য সচিব পর্যায়ের এক সম্মেলনে ছিটমহলগুলোতে মূল ভূখণ্ড থেকে মাসে একবার নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী পাঠানোর ব্যাপারে উভয় দেশ একমত হয়। সম্মেলনের ঘোষণায় বলা হয়: ‘Only mustard oil, kerosene oil, sugar, matches, cloth, medicine, and medical appliances could be moved between mainland and enclaves i.e., commodities could be imported to the enclaves but local products especially jute, paddy and tobacco could not be exported to the mainland.’৮ এই সিদ্ধান্ত পরীক্ষা করলে দেখা যায়, ছিটমহলের অধিবাসীদের দুর্ভোগ লাঘবের চেয়ে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের বিষয়টি বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। যেহেতু ছিটমহলের অধিবাসীদের স্বাগতিক দেশের হাটবাজারগুলোতে কেনাবেচা করার বৈধ অধিকার ছিল না এবং ছিটমহলে উত্পাদিত পণ্যসামগ্রী মূল ভূখণ্ডে পাঠানোর অনুমতি দেওয়া হয়নি, সুতরাং এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ছিটমহলবাসীর ওপর কার্যত একধরনের অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপিত হয়। সেই থেকে আজ পর্যন্ত উভয় রাষ্ট্রের তরফ থেকে নানা অবরোধে চাপা পড়ে আছে এসব ভাগ্যহত মানুষ। এ ছাড়া সেই চুক্তিতে উভয় দেশের সংশ্লিষ্ট জেলা কর্মকর্তা এবং পুলিশ কর্মকর্তাদের প্রয়োজনে ছিটমহল পরিদর্শনের ব্যবস্থা করা হয়। সে ক্ষেত্রে কর্মকর্তাদের কোনো প্রকার অস্ত্র বহন না করা এবং ছবি-সংবলিত পরিচয়পত্র বহন করার বিধান রাখা হয়। তবে এ জন্য অন্তত ১৫ দিন আগে স্বাগতিক দেশের স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে অবহিত করারও বিধান রাখা হয়। এভাবে ছিটমহলে প্রতি ছয় মাসে একবার রাজস্ব আদায়েরও ব্যবস্থা রাখা হয় ওই চুক্তিতে। আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, কর্মকর্তাদের ছিটমহল পরিদর্শন এবং সেখান থেকে রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থা রাখা হলেও ছিটমহলের মানুষের মূল ভূখণ্ডে যাতায়াতের বিষয়টি সেই আলোচনায় ঠাঁই পায়নি।

জীবনের তাগিদে নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজে তাদের প্রতিদিন রাতের অন্ধকারে সীমানা পেরিয়ে ‘অবৈধভাবে’ যাতায়াত করতে হয়েছে মূল ভূখণ্ডে। কারণ, এক সের চাল অথবা আধা সের লবণ কিংবা একটা প্যারাসিটামলের প্রয়োজনেও মূল ভূখণ্ডে যাওয়া অথবা স্বাগতিক দেশে অবৈধ অনুপ্রবেশ করা ছাড়া তাদের সামনে আর কোনো বিকল্প নেই। আর এই করতে গিয়ে তাদের উভয় দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর হাতে নানাভাবে হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে যুগ যুগ ধরে। ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সীমান্তরক্ষী বাহিনীর দুর্নীতি ও অপেশাদারির খবর সবারই জানা। ছিটমহলের অসহায় দরিদ্র মানুষকে অবৈধভাবে আন্তসীমান্ত যাতায়াতের সময় সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে ঘুষ দিতে হয়। অথবা মেনে নিতে হয় শারীরিক নির্যাতন, গ্রেপ্তার, কারাবাস ইত্যাদি। ছিটমহলের নিরপরাধ মানুষের জীবনে দুর্ভোগ-দুর্দশা এভাবেই শুরু এবং এভাবেই চলছে বছরের পর বছর।

সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় আক্রান্ত হয়ে উভয় দেশের এবং উভয় ধর্মের অসংখ্য মানুষের সঙ্গে ছিটমহলের মানুষও সীমানা অতিক্রম করে নিজ নিজ ধর্মের দেশে পাড়ি জমায় (পাকিস্তান থেকে হিন্দুরা ভারতে আর ভারত থেকে মুসলমানেরা পাকিস্তানে)। ফলে সুযোগসন্ধানী দুষ্কৃতকারীরা ছিটমহলের অধিবাসীদের ফেলে যাওয়া ঘরবাড়ি, অর্থ-সম্পত্তি জবরদখল করে নেয়, আর ছিটমহলের মানুষ নতুন দেশে গিয়ে পরিণত হয় শরণার্থীতে। এমনিভাবে দীর্ঘস্থায়ী হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার বর্বরতায় ছিটমহলের মানুষ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আবু বকর সরকার (৭৬/২০০৪) দেশভাগের ফলে তাঁদের ক্ষয়ক্ষতির বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন:

দেশভাগের পর দাঙ্গার কারণে এই ছিটের আদি বাসিন্দা হিন্দুরা ওপারে চলে গেছে। আর মুসলমানরা বাংলাদেশে (মূল ভূখণ্ডে) আশ্রয় নিয়েছে। তারা (ব্রাহ্মণরা) তাদের সাথে আমাকেও চলে যেতে বলেছিল। তাদের সাথে আমার খুব ওঠাবসা ছিল। দেশভাগের আগে আমরা এখানে অনেক সুখে ছিলাম। এই জায়গায় অনেক লোক ছিল। অধিকাংশ লোক ছিল শিক্ষিত ব্রাহ্মণ। তারা কেউই এখন নেই।

অন্যদিকে ভারতে অবস্থিত বাংলাদেশি ছিটমহল কিসেমত নিজজমার আরেক বাসিন্দা জয় বর্মণ (৬৬/২০০৪) বলেন:

হামার (কিসেমত নিজজমা) ছিটে জমির পরিমাণ ২০৮ বিঘা। এই ছিটে বর্তমানে ৩২ ঘর (খানা) লোক আছে। হামার লোকসংখ্যা ১৪৪ জন। এই ছিটের সবাই হিন্দু। হামার মতো আর সবাই বাইরে থাইকে আইছে (সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময়ে)। আমি যত দূর জানি, খালি দুই ঘর লোক এই ছিটের আদি বাসিন্দা।

সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কারণে দেশত্যাগের সময় দুই দেশের ছিটমহলের মানুষের মধ্যে জমিজমার বেশ কিছু অলিখিত বিনিময় হয়েছিল। পঞ্চগড় জেলার দেবীগঞ্জ থানায় অবস্থিত ভারতীয় ছিটমহল বেওলাডাঙ্গা/শালবাড়ীর অধিবাসী খোকা (৫০/২০০৪) বিনিময়ের বিষয়টি বর্ণনা করেন এভাবে:

এই ছিটের আদি বাসিন্দা এখানে খুব কম আছে। এখানের অধিকাংশ লোক ইন্ডিয়া থাইকে বিনিময় করে আইছে। যখন হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা শুরু হয়, তখন তো ভারতে মুসলমানদের ওপর হিন্দুরা খুব অত্যাচার করত। এখানের হিন্দুরাও মুসলমানদের ভয়ে ইন্ডিয়া চইলে গেছে। আগে এখানে বেশির ভাগ মানুষ ছিল হিন্দু। এখন মাত্র দু-তিন ঘর হিন্দু আছে। ওই দাঙ্গার সময় সবাই চইলে গেছে। আর ভারত থাইকে মুসলমানরা হিন্দুদের সাথে জমাজমি, ঘরবাড়ি সব বিনিময় কইরে এখানে চইলে আইছে। ভারত থাইকে যারা সেই সময়ে চইলে আইছে, তাদের আসতেও অনেক কষ্ট হইছে। কারণ, সবার সামনে তো আর আসতে পারে নাই। লুকায়ে লুকায়ে আসতে হইছে।

সেই থেকে ছিটমহলের অধিবাসীদের দুর্ভাগ্যের সূত্রপাত। প্রায় সাত দশক ছিটমহলের হাজার হাজার নিরীহ মানুষ নাগরিকত্বহীনভাবে জীবন যাপন করে আসছে অদ্ভুত রাষ্ট্রীয় সীমানার এক অদৃশ্য দেয়ালে আবদ্ধ হয়ে। ছিটমহলে পরিণত হওয়া ভূখণ্ডগুলোতে যুগ যুগ ধরে বংশপরম্পরায় বসবাস করা মানুষ নিশ্চয়ই জানত না রাজরাজড়াদের খামখেয়ালিপনা আর ভূ-রাজনীতির মারপ্যাঁচে তাদের চিরচেনা দেশটি একদিন ভিনদেশে পরিণত হবে! আর তারা হবে নিজভূমে পরবাসী! চাপিয়ে দেওয়া নাগরিক পরিচয় একদিকে যেমন রাতারাতি তাদের নিজ দেশের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক সীমানা তাদের নাগরিকত্ব প্রদানকারী দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। তাই কার্যত তারা কোনো দেশেরই নাগরিক নয়। ফলে তারা রাষ্ট্রহীন মানুষের দুর্লভ উদাহরণে পরিণত হয়!

‘ছিটের নাগরিক’-এর পরিচয়-সংকট

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের মধ্য দিয়ে উপমহাদেশের আপামর মানুষ যখন পরাধীনতার অন্ধকার থেকে বেরিয়ে স্বাধীনতার আলোয় উদ্ভাসিত হয়, তখন ছিটমহলের হতভাগ্য মানুষের ভাগ্যে ঘটে তার উল্টোটা। এটা স্বীকার্য যে দেশ বিভাগ-পরবর্তী সময়ে ছিটমহলের মালিকানার ভিত্তিতে নির্ধারিত সেখানকার মানুষের নাগরিকত্বকে উভয় দেশই গুরুত্ব দিয়েছে। দেশ বিভাগ-সম্পর্কিত পরস্পরের দ্বান্দ্বিক ব্যাখ্যার কারণেই হয়তো অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে ছিটমহলে বসবাসকারী নাগরিকদেরও তারা গুরুত্ব দিয়েছে। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই এই নাগরিকেরা বিস্মৃত ও পরিত্যক্ত হয়ে যায়। গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়ে শুধু ছিটমহলের ভূমি আর রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব। এমন অবস্থায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বছরগুলোতে ছিটমহলের মানুষ নতুন করে নাগরিক পরিচয় ধারণের ক্ষেত্রে কৌশলগত উভয় সংকটে পড়ে। আর তাদের এই উভয় সংকট নাগরিকত্ব বাছাইয়ের ক্ষেত্রে ছিল না (এ ধরনের কোনো বিকল্প সুযোগ তাদের কখনো দেওয়া হয়নি), এটি ছিল কোন পরিচয়ে তারা উভয় দেশের উগ্র সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাকারীদের আক্রমণ থেকে তাদের জীবন, সম্পদ ও সম্ভ্রম রক্ষা করতে পারবে, তার সংকট। এমন পরিস্থিতিতে ছিটমহলের অশিক্ষিত জনগোষ্ঠীকে বিরল এক নাগরিক সমস্যার মোকাবিলা করতে হয়েছে। জীবন রক্ষার তাগিদে তাদের কখনো কখনো ছিটমহলের মালিকানার সূত্রে পাওয়া সীমান্তের অন্য পারের নাগরিক পরিচয়টা গোপন করতে হয়েছে, আবার কখনো কখনো সেই পরিচয়টাই ধারণ করতে হয়েছে। আত্মরক্ষার তাগিদে আবার কখনো কখনো মুসলমানকে হিন্দু সাজতে হয়েছে, আর হিন্দুকে সাজতে হয়েছে মুসলমান। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বছরগুলোতে ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতেই আক্রান্ত মানুষের আশ্রয় মিলেছে পার্শ্ববর্তী দেশে। সেই অর্থে সেই দেশের প্রতি তাদের নির্ভরতা ও আনুগত্যের বিষয়টিও দৃশ্যমান হয়। ভ্যান সেন্ডেল (২০০২) এ বিষয়কে proxy citizenship হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এই প্রবণতা ছিটমহলের মানুষের মধ্যেও ছিল। শেষ পর্যন্ত তাদের জন্য ছিটমহলের পরিচয়টাই অবশিষ্ট থেকেছে। তবে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, ছিটমহলের বাইরের (স্বাগতিক দেশের) মানুষের সঙ্গে তাদের রক্তের সম্পর্ক, প্রতিবেশিত্ব, বংশপরম্পরায় গড়ে ওঠা সামাজিক সম্পর্ক এবং সাংস্কৃতিক বন্ধন রাষ্ট্রীয় বিভক্তি ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার রোষানলে পুড়ে নিঃশেষ হয়ে যায়নি, বরং চাপিয়ে দেওয়া নতুন নাগরিক পরিচয়ের ফলে সৃষ্ট প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে বেঁচে থাকার লড়াইয়ে তাদের সামর্থ্য জুগিয়েছে।

একটি বিষয় এখানে উল্লেখযোগ্য, নূন-নেহরু চুক্তি এবং মুজিব-ইন্দিরা চুক্তিতে শুধু ছিটমহলের ভূমিকেই বিবেচনা করা হয়েছে। ছিটমহলে বসবাসকারী হাজার হাজার মানুষ সম্পর্কে একটি শব্দও কোনো চুক্তিতে উল্লেখ নেই। ছিটমহল বিনিময়ের ফলে সেখানে বসবাসকারী মানুষের ভাগ্যে কী ঘটবে, তারা কোন দেশের নাগরিকত্ব পাবে, তারা কি সেখানেই থাকবে নাকি তাদের মূল ভূখণ্ডে পুনর্বাসন করা হবে—এ-সংক্রান্ত একটি কথাও কোনো চুক্তিতে বলা হয়নি। ছিটমহলের মালিকানা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ছিটমহলের মানুষের নাগরিকত্ব পরিবর্তিত হবে কি না, তা-ও উল্লেখ নেই কোনো চুক্তিতে। এ ক্ষেত্রে ছিটমহলের অধিবাসীদের পছন্দের ভিত্তিতে মূল ভূখণ্ডে পুনর্বাসনের সুযোগ রাখলে ছিটমহলের মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে মূল্য দেওয়া হতো। কিন্তু এই গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুটি কোনো চুক্তিতেই বিবেচনা করা হয়নি। এ বিষয়টিও সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রগুলোর চরিত্র এবং মানুষের প্রতি তাদের অসংবেদনশীলতা বুঝতে সাহায্য করে।

অবশ্য দেশ বিভাগের প্রায় সাত দশক অতিবাহিত হওয়ার পর এ ইস্যুর এখন আর তেমন কোনো গুরুত্ব নেই। কারণ, ছিটমহলগুলোতে এখন নাগরিকত্বহীন তৃতীয় প্রজন্ম চলছে। সুতরাং, নাগরিকত্ব যাদের অভিজ্ঞতায় পুরোপুরিভাবে অনুপস্থিত, তারা বিশেষ কোনো দেশের নাগরিকত্বের প্রতি অনুরাগ বা বিরাগ পোষণ করবে, তা বাস্তবসম্মত নয়। তাদের দরকার কেবল নাগরিক পরিচয় এবং নাগরিক অধিকার, সে যে দেশেরই হোক। যে দেশের নাগরিকত্ব এখন বাস্তবসম্মত এবং যাতে তাদের সুবিধা, তারা তা-ই চায়। নাগরিকত্ব বিষয়ে তাদের কোনো নস্টালজিয়া বা হিস্টিরিয়া নেই; যাঁদের ছিল, (১৯৪৭-এর আগেই যাঁরা প্রাপ্তবয়স্ক ছিলেন) তাঁদের অধিকাংশেরই দেশভাগের ছয় দশক পর এখন আর বেঁচে থাকার কথা নয়। যা দু-একজন বেঁচে আছেন, তাঁদের মধ্যে এ-সংক্রান্ত নস্টালজিয়া আছে বৈকি। যেমন, ভারতীয় ছিটমহলের অধিবাসী আবু বকর সরকার (৭৬/২০০৪) বলেন: ‘জন্মগতভাবে আমরা কোচবিহার রাজার প্রজা ছিলাম, আজও আছি।’ তবে বাস্তবতা উপলব্ধি করে তিনি তাঁর এই নস্টালজিয়াকে আর গুরুত্ব দেন না। তাই নাগরিকত্বের প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এই জায়গা বাংলাদেশকে হস্তান্তর করে আমাদের বাংলাদেশি নাগরিকত্ব দেওয়া ছাড়া এই সমস্যা সমাধানের আর কোনো উপায় নাই। কারণ, বাংলাদেশের এত ভেতরের এই জায়গা ভারতের অংশ হিসেবে রাখার মতো অবস্থা নাই।’ অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলায় অবস্থিত বাংলাদেশি ছিটমহল ছিট ধবলসুতির অধিবাসী উমর নন্দন (৪৩/২০০৪) বলেন:

আমি ইন্ডিয়ার নাগরিক হবার চাই। কারণ, বাংলাদেশের নাগরিক হয়েও আমাদের কোনো লাভ নাই। ইন্ডিয়ার এত ভিতর তনে, কাঁটাতারের বেড়া পার হয়ে বাংলাদেশে যাতায়াত, কাজকর্ম করা যাইব না। তাই আমি চাই, ইন্ডিয়া আমাদের নাগরিক বানায়ে সব সুযোগ-সুবিধা দিক।

ছিটমহল বিনিময়ে আন্তরাষ্ট্রীয় চুক্তির কাগুজে প্রহসন-১: নূন-নেহরু চুক্তি (১৯৫৮)

১৯৫০-এর দশকে যখন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দক্ষিণ বেরুবাড়ী এবং দহগ্রাম-আঙ্গরপোতার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রভাবে উভয় দেশের সার্বিক দাঙ্গা-পরিস্থিতির অবনতি হয়, তখন ছিটমহল ইস্যুটি উভয় দেশের রাজনৈতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। পরিস্থিতি সামাল দিতে উভয় দেশের পক্ষ থেকেই ছিটমহল সমস্যা সমাধানের জন্য ছিটমহল জরিপ, সীমানা নির্ধারণ ইত্যাদি বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়। উভয় দেশের উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি ছিটমহল বিনিময়ের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু করে। ছিটমহল বিনিময়ের লক্ষ্যে তারা বেশ কিছু সমঝোতাও স্বাক্ষর করে, যা পশ্চিমবঙ্গের ক্ষতিপূরণের (পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থিত ভারতীয় ছিটমহলগুলোর মোট আয়তন ভারতে অবস্থিত পূর্ব পাকিস্তানের ছিটমহলগুলোর মোট আয়তনের চেয়ে বেশি বলে দাবি করা হয়) ইস্যুতে অকার্যকর হয়ে যায়। কলকাতাকেন্দ্রিক বেসরকারি উন্নয়ন গবেষণা সংস্থা Center for Development Activities (CDA)) আয়োজিত, ২০০১ সালের ১৫-১৮ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত এক সিম্পোজিয়ামে উপস্থাপিত ‘নেই মানুষের পাঁচালী’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়:

কোচবিহারের ভারতে অন্তর্ভুক্তির সময় থেকেই ছিটমহল সম্বন্ধে ভারত সরকারের সুনির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গির অভাব লক্ষ করা যায়। ’৪৯ থেকে ’৫৮ পর্যন্ত এ সমস্যা প্রায় অনুল্লিখিতই থাকে। যদিও ওই সময়েই ভারতীয় ছিটমহলবাসীদের ছিটমহল থেকে উচ্ছেদ হয়ে ভারতীয় মূল ভূখণ্ডে চলে আসা শুরু হয়ে গেছে। সমসময়ের শরণার্থীর স্রোতে এরা যে পূর্ব পাকিস্তানের লোক নয়, ভারতীয় ভূখণ্ড থেকেই উচ্ছেদ হয়ে আসা মানুষ, তা আর কারও নজরে পড়েনি।

সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সেই উত্তাল সময়ে ছিটমহল বিনিময়ের বিষয়টি, বিশেষ করে দক্ষিণ বেরুবাড়ী ও দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা উভয় দেশের জন-আলোচনার (public discourse) অংশ হয়ে পড়ে। অবশেষে ১৯৫৮ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু পাকিস্তানের তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী ফিরোজ খান নূনের সঙ্গে ছিটমহলসহ (পরিবেষ্টিত এলাকা) বিদ্যমান অন্যান্য সীমান্ত সমস্যা নিয়ে আলোচনায় বসতে সম্ভবত বাধ্য হয়েছিলেন। কেননা, শুরু থেকেই পাকিস্তান সরকার ভারত অধিকৃত দক্ষিণ বেরুবাড়ীর দক্ষিণ অংশের ওপর র্যাডক্লিফ রোয়েদাদ অনুযায়ী মালিকানা দাবি করে ভারতের ওপর ক্রমাগত চাপ প্রয়োগ করছিল। বিষয়টি আন্তর্জাতিক আদালতে নিয়ে যাওয়ার হুমকিও পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে ছিল। তাদের আলোচনা ১০ সেপ্টেম্বর একটি চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে শেষ হয়, যা Indo-Pakistan Agreement of 10 September 1958 বা সংক্ষেপে নূন-নেহরু চুক্তি হিসেবে পরিচিত। চুক্তিতে বলা হয়, পশ্চিমবঙ্গকে কোনোরূপ ক্ষতিপূরণ ছাড়াই ছিটমহল বিনিময় করতে হবে। অর্থাত্, ভারতের ভূখণ্ডে অবস্থিত পাকিস্তানের সব ছিটমহল ভারতের কাছে হস্তান্তর করা হবে, আর পাকিস্তানের ভূখণ্ডে অবস্থিত ভারতের সব ছিটমহল পাকিস্তানের কাছে হস্তান্তর করা হবে এবং পশ্চিমবঙ্গকে (ভারত) কোনোরূপ ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে না। আর দক্ষিণ বেরুবাড়ীকে দুই দেশের মধ্যে সমান দুই ভাগে ভাগ করে দেওয়া হবে। দিল্লি বৈঠক শেষে ১১ সেপ্টেম্বর করাচি প্রত্যাবর্তন করে মালিক নূন এক বিবৃতিতে বলেন, পূর্বাঞ্চলের সীমান্ত-বিরোধ সম্পর্কে তাঁরা মীমাংসায় উপনীত হতে সক্ষম হয়েছেন। ছিটমহল বিনিময় প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘পুরাতন কোচবিহারের পাকিস্তান পরিবেষ্টিত এলাকাসমূহ পাকিস্তানকে এবং ভারত পরিবেষ্টিত এলাকাসমূহ ভারতকে হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত করা হইয়াছে। উহার ফলে ভারতকে কোনোরূপ ক্ষতিপূরণ না দিয়াই পাকিস্তান প্রায় ১১ বর্গমাইল এলাকা অতিরিক্ত লাভ করিবে’ (দৈনিক আজাদ, ১২ সেপ্টেম্বর, ১৯৫৮)। অন্যদিকে ১২ সেপ্টেম্বর ভারতের লোকসভায় প্রশ্নোত্তর পর্বে পশ্চিমবঙ্গ থেকে নির্বাচিত এক সদস্য নূন-নেহরু চুক্তির বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, ‘পরিবেষ্টিত এলাকা হস্তান্তরের বিনিময়ে ভারতকে অধিক এলাকা দিতে হইবে এবং এতে অন্তত ১০ হাজার লোক জড়িত হইয়া পড়িবে।’ প্রত্যুত্তরে নেহরু বলেন:

ইহা সত্য যে, পরিবেষ্টিত এলাকার জন্য আমাদেরকে অধিক এলাকা হস্তান্তর করিতে হইবে। কিন্তু অন্য এলাকায় আমরা পাকিস্তান হইতে আরো বেশি পাইব। ঠিক সমানে সমানে ইহার সামঞ্জস্য বিধান করা যাইবে না। চুক্তির ব্যাপারে আর অন্য কোনো পথ নাই।...আমি এক চুক্তি করিয়াছি, শেষ পর্যন্ত ইহা মানিয়া চলিতে হইবে। আমি যদি ভুল করিয়া থাকি আপনারা আমার নিন্দা করিতে পারেন। কিন্তু আমাকে উপযুক্ত পালন করিতে হইবে। (দৈনিক আজাদ, ১৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৫৮)

পশ্চিমবঙ্গের পার্লামেন্ট দক্ষিণ বেরুবাড়ী বিভক্তির বিরোধিতা করে এবং এর ফলে নূন-নেহরু চুক্তি ভারতে একটি স্পর্শকাতর রাজনৈতিক ইস্যু ও উগ্র জাতীয়তাবাদের প্রতীকে পরিণত হয়। এমন পরিস্থিতিতে ভারত সরকার যদিও দক্ষিণ বেরুবাড়ীর অর্ধেক পাকিস্তানকে সমর্পণের জন্য ১৯৬০ সালে সংবিধানে একটি সংশোধনী এনেছিল, কিন্তু বিরোধী দলগুলোর আইনি লড়াইয়ের জটিলতায় তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি। বিরোধী দল থেকে নূন-নেহরু চুক্তিকে অসাংবিধানিক হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয় এবং সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে এই চুক্তির বিরুদ্ধে আদালতে বেশ কিছু মামলা হয়। ১৯৭১ সালে ভারতের সর্বোচ্চ আদালত যখন এই চুক্তির বিরুদ্ধে দায়ের করা সর্বশেষ মামলাটি খারিজ করে দেয়, তখন দেশ দুটির মধ্যে যুদ্ধ-পরিস্থিতি বিরাজ করছিল। তাই সেই সময়ে ছিটমহল বিনিময়ের বিষয়টি কোনো দেশই বিবেচনায় আনেনি। অতঃপর সেই চুক্তি কখনোই বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে নূন-নেহরু চুক্তি একটি কাগুজে প্রহসনে পরিণত হয়।

ছিটমহল বিনিময়ে আন্তরাষ্ট্রীয় চুক্তির কাগুজে প্রহসন-২: মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি (১৯৭৪)

১৯৪৭-৭১ সময়কালে ভারত ও পাকিস্তান ছিটমহল সমস্যার কোনো সমাধান করতে পারেনি। ফলে চলমান ছিটমহল সমস্যার দায়ভার এসে পড়ে স্বাধীন বাংলাদেশের ওপর। প্রসঙ্গত, তত্কালীন পাকিস্তান ভূখণ্ডে ভারতের যত ছিটমহল ছিল, তার সব কটিই ছিল বর্তমান বাংলাদেশ ভূখণ্ডে। অন্যদিকে, ভারতের অভ্যন্তরে পাকিস্তানের সব ছিটমহলই ছিল তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা বর্তমান বাংলাদেশ ভূখণ্ডের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। তাই স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মধ্য দিয়ে ভারত-পাকিস্তান ছিটমহলগুলো বাংলাদেশ-ভারত ছিটমহলে রূপান্তরিত হয়। ১৯৭৪ সালের ১৬ মে বাংলাদেশের তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর মধ্যে স্বাক্ষরিত ‘মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি’র ১২ ও ১৪ নম্বর সেকশনে ছিটমহল ইস্যুটি সমাধানের কথা বলা হয়। নূন-নেহরু চুক্তিতে গৃহীত ছিটমহল বিনিময়ের বিষয়টি মুজিব-ইন্দিরা চুক্তিতে স্বীকৃত হলেও ভারতের দাবির মুখে বাংলাদেশ অদূরদর্শীভাবে নূন-নেহরু চুক্তির ব্যত্যয় ঘটিয়ে দক্ষিণ বেরুবাড়ীর দক্ষিণ অংশ ভারতকে ছেড়ে দেয়। বিনিময়ে ভারতের ভূখণ্ডে অবস্থিত বাংলাদেশের বৃহত্তম ছিটমহল দহগ্রাম-আঙ্গরপোতাকে মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে সংযুক্ত করার সিদ্ধান্ত হয় এবং সেই লক্ষ্যে ভারত স্থায়ীভাবে বাংলাদেশকে পশ্চিমবঙ্গের মেকলিগঞ্জের ‘তিনবিঘা’ নামক স্থানে, ১৭৮ দ্ধ ৮৫ মিটার আয়তনের একটি করিডর চিরস্থায়ীভাবে বন্দোবস্ত দেওয়ার স্বীকৃতি প্রদান করে। পাঠকের সুবিধার্থে মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির অনুচ্ছেদ-১-এর ছিটমহল বিনিময়-সংক্রান্ত দুটি ধারা এখানে সন্নিবেশ করা হলো।

Article-1
Section 12. Enclaves : The Indian enclaves in Bangladesh and Bangladeshi enclaves in India should be exchanged expeditiously, excepting the enclaves mentioned in paragraph 14 without claim to compensation for the additional area going to Bangladesh.
Section 14. Berubari : India will retain the southern half of South Berubari Union no. 12 and the adjacent enclaves, measuring an area of 2.64 square miles approximately, and in exchange Bangladesh will retain the Dahagram and Angarpota enclaves. India will lease in perpetuity to Bangladesh an area of 178 meters x 85 meters near ‘Tin Bigha’ to connect Dahagram with Panbari Mouza (P. S. Patgram) of Bangladesh (The Constitution of the People’s Republic of Bangladesh).

চুক্তিটি বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে স্বাক্ষরিত হয়েছিল এবং এই চুক্তির প্রতি উভয় দেশের জনমত ছিল অত্যন্ত ইতিবাচক, যার প্রমাণ পাওয়া যায় সমসাময়িক পত্রপত্রিকায়। ১৯৭৪ সালের ১২ মে চুক্তির মাত্র তিন দিন আগে চুক্তি-সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে ভারতের তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী বলেন:

The relation between Bangladesh and India is one of sound and solid friendship and I would add growing friendship. It finds formal expression in the treaty between our two countries and we are both working sincerely to give effect to what is outlined in the treaty. (The Bangladesh Observer, 13 May 1974)

উভয় দেশের সংবাদমাধ্যম, বিশেষ করে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমগুলো এই চুক্তির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে। ১৯৭৪ সালের ১৮ মে বাংলাদেশ অবজারভার-এর সম্পাদকীয়তে বলা হয়:

The Just concluded Delhi summit meeting between Indira Gandhi and Sheikh Mujibur Rahman sets up a milestone on the road to subcontinental peace realized on the basis of sovereign interests of two close neighbors pledged to friendship and co-operation. (The Bangladesh Observer, 16 May 1974).

এই চুক্তির বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে বাংলাদেশে কাজী মোখলেছুর রহমান নামের এক ব্যক্তি একটি মামলা করেছিলেন। বাংলাদেশ সরকার শিগগিরই মামলাটি নিষ্পত্তি করে। মামলার রায়ে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজনীয়তার সিদ্ধান্ত দেয়। অতঃপর ত্বরিতগতিতে বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৪ সালের ২৮ নভেম্বর তৃতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে চুক্তিটি অনুসমর্থন করে এবং দক্ষিণ বেরুবাড়ীর দক্ষিণ অংশ ভারতকে হস্তান্তর করে। দক্ষিণ বেরুবাড়ীর দক্ষিণ অংশের দখল নেওয়ার পর চুক্তি নিয়ে শুরু হয় ভারতের টালবাহানা। ভারতেও তিনবিঘা করিডর প্রদানের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে মামলা হয়। চুক্তিটি অনুসমর্থনের জন্য পার্লামেন্টে উত্থাপন না করার পেছনে ভারত দীর্ঘদিন সেই মামলার অজুহাত দেখিয়েছে। কিন্তু ১৯৯০ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট তিনবিঘা করিডর প্রদানের মাধ্যমে ভারতের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘনের অভিযোগকে একটি ‘non-issue’ বলে মামলাটি খারিজ করে দিয়েছে। অথচ ১৯৯০ সাল থেকে ২০১১ পর্যন্ত দীর্ঘ ২১ বছরের ভারত সরকার এই চুক্তিটি পার্লামেন্টে উত্থাপন করেনি। ফলে ছিটমহল ইস্যুতে মুজিব-ইন্দিরা চুক্তিও একটি কাগুজে প্রহসনে পরিণত হয়। এক পক্ষ কর্তৃক বাস্তবায়িত একটি আন্তরাষ্ট্রীয় চুক্তি অপর পক্ষ (চুক্তির সুফলভোগী) কর্তৃক অগ্রাহ্য করার ঘটনা পৃথিবীতে বিরল এবং তা আন্তর্জাতিক বিধিবিধানের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।

‘তিনবিঘা’ করিডরের সাতকাহন

বাংলাদেশের পাটগ্রাম থানার পানবাড়ী থেকে দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা। মাঝে মাত্র ১৭৮ মিটার ভারতীয় ভূখণ্ড, যার কারণে দহগ্রাম-আঙ্গরপোতাবাসী আজীবন বন্দী। ১৯৪৭ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত ৪৫ বছর ধরে দহগ্রাম-আঙ্গরপোতার মানুষকে নিত্যপ্রয়োজনে এই ১৭৮ মিটার দুস্তর পারাবার লঙ্ঘন করতে হয়েছে রাতের অন্ধকারে, সীমান্তরক্ষী বাহিনীর গ্রেপ্তার, লাঠিচার্জসহ নানা হয়রানি সহ্য করে। মুজিব-ইন্দিরা চুক্তিতে দক্ষিণ বেরুবাড়ীর দক্ষিণ অংশের বিনিময়ে ভারতের তিনবিঘা নামক স্থানে দহগ্রাম-আঙ্গরপোতার সঙ্গে বাংলাদেশের মাত্র ১৭৮ দ্ধ ৮৫ মিটার আয়তনের একটি করিডর বাংলাদেশকে চিরস্থায়ীভাবে বন্দোবস্ত দেওয়ার কথা থাকলেও ভারত সরকার ১৯৭৪ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ১৮ বছর এ নিয়ে টালবাহানা করে। বাংলাদেশের অনবরত দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৮২ ও ১৯৯২ সালে নতুন করে আরও দুটি চুক্তির পর অবশেষে ১৯৯২ সালে সেই করিডর দেওয়া হয়। দুই পাশে সশস্ত্র বিএসএফের সার্বক্ষণিক পাহারায় ১৯৯২ সালের ২৬ জুন প্রথমে প্রতি দুই ঘণ্টা পর পর এক ঘণ্টা করে দিনে মোট তিন ঘণ্টার জন্য তিনবিঘা করিডর বাংলাদেশের নাগরিকদের যাতায়াতের জন্য খোলা রাখার ব্যবস্থা করা হয়। এর তিন মাস পর থেকে সকাল ছয়টা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত প্রতি এক ঘণ্টা পর পর এক ঘণ্টা করে মোট ছয় ঘণ্টা খোলা রাখার ব্যবস্থা করা হয় এবং এই ব্যবস্থা চলতে থাকে ২০০১ সাল পর্যন্ত। ২০০১ সালে নতুন ব্যবস্থা চালুর মাধ্যমে করিডরটি সকাল ছয়টা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্নভাবে ১২ ঘণ্টা খোলা রাখার ব্যবস্থা করা হয়। বাকি ১২ ঘণ্টার জন্য দহগ্রাম-আঙ্গরপোতার পুরো জনপদটি ছিল একটি কারাগার! অবশেষে ২০১১ সালের ঢাকা শীর্ষ বৈঠকের মধ্য দিয়ে ০৮ সেপ্টেম্বর ২০১১ থেকে করিডরটি ২৪ ঘণ্টার জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে।

করিডর দেওয়ার আগে এখানকার মানুষ বন্দীজীবন কাটিয়েছে। বর্তমানে যদিও তিনবিঘা করিডর ব্যবহার করে দহগ্রাম-আঙ্গরপোতায় বাংলাদেশের প্রশাসন নিয়মিতভাবে কাজ করছে, সেখানে স্থানীয় সরকার (ইউপি) প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, তবু দহগ্রাম-আঙ্গরপোতার অধিবাসীদের মানবাধিকার পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তিনবিঘা করিডরের সরু পাকা রাস্তাটির প্রবেশমুখে ভারতীয় ফটক, যার সার্বক্ষণিক নিয়ন্ত্রণ ভারতের হাতে। একটি স্বাধীন দেশের স্বাধীন বেসামরিক একটি জনগোষ্ঠীর এ রকম ফটকসমৃদ্ধ প্রবেশপথে নিরাপত্তা বাহিনীর তাক করা অস্ত্রের সামনে দিয়ে যাতায়াত করার দৃশ্য পৃথিবীতে বিরল। এখনো দহগ্রামের মানুষেরা বিএসএফের অনুমোদন ছাড়া তাদের গবাদিপশু হাটে নিয়ে বিক্রি করতে পারে না। বিএসএফ প্রতি হাটে মাত্র ১০টি গরু হাটে নেওয়ার অনুমতি দেয়।

মুজিব-ইন্দিরা চুক্তিতে ১৭৮ দ্ধ ৮৫ মিটার আয়তনের একটি করিডর দেওয়ার কথা থাকলেও যে করিডরটি দেওয়া হয়েছে, তার প্রস্থ মাত্র দুই মিটার। ভারতের সশস্ত্র বিএসএফের সার্বক্ষণিক ‘রক্তচক্ষু’ সহ্য করে মাত্র দুই মিটার প্রশস্ত করিডর দিয়ে চলে সেখানকার মানুষের প্রতিদিনের জীবন। দহগ্রাম-আঙ্গরপোতার মানুষ এসব থেকে মুক্তি চায়। তারা ‘তিনবিঘা’ করিডরের সার্বভৌম অধিকার চায়।

দিনে দিনে ভারতের অপদখলে চলে যাচ্ছে দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা

দহগ্রাম-আঙ্গরপোতার পশ্চিম ও দক্ষিণ পাশের সীমানা নির্ধারণী তিস্তা নদী ভাঙনপ্রবণ। যেহেতু তিস্তা নদী ভেঙে দহগ্রাম-আঙ্গরপোতার দিকে অগ্রসর হচ্ছে, এতে বিলীন হয়ে যাওয়া অংশ ধীরে ধীরে নদীর ওপারে পড়ে ভারতের দখলে চলে যাচ্ছে। এই সুযোগটি কাজে লাগাতেই ভারত সব জায়গায় কাঁটাতারের বেড়া দিলেও দহগ্রাম-আঙ্গরপোতার চারপাশে বেড়া দেয়নি। প্রতিবছর তিস্তার ভাঙনের ফলে দহগ্রাম-আঙ্গরপোতার অনেক ভূমি তিস্তার গর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের কোনো পদক্ষেপ নেই বলে জানিয়েছে এখানকার অধিবাসীরা। এভাবে চলতে থাকলে দহগ্রাম-আঙ্গরপোতার অস্তিত্ব হয়তো একদিন ভারতের জবরদখলের মধ্যে হারিয়ে যাবে।

‘ছিটের নাগরিক’-এর অধিকারহীনতা

আধুনিক সভ্যতায় মানুষের অধিকারকে দুই ভাগ করা হয়েছে—নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার এবং অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার। কিন্তু ১৯৪৭ সালের পর থেকে আজ পর্যন্ত ছিটমহলে বসবাসকারী শত শত নারী-পুরুষ এর কোনোটিই পায়নি। ছিটমহলের প্রবীণ অধিবাসী আবু বকর সরকার (৭৬/২০০৪) বলেন:

আমি এখন কোনো দেশেরই নাগরিক না। আগে কোচবিহার মহারাজার প্রজা ছিলাম। দেশভাগের সময় এটা ছিটমহল হওয়ায় আমরা ভারতের নাগরিক হিসেবে গণ্য হলেও বাংলাদেশের ভেতরে ছিটে থাকি বলে ভারত সরকার কোনো দিনই আমাদের নাগরিক বলে গণ্য করেনি এবং আমাদের কোনো নাগরিক অধিকার দেয়নি। আবার বাংলাদেশের ভেতরে বাস করলেও আমরা বাংলাদেশের নাগরিক না...প্রত্যেক মানুষেরই কিছু না কিছু অধিকার থাকে। আর মানুষের অধিকার পূরণ করে রাষ্ট্র। মানুষ হিসেবে আমাদেরও অধিকার আছে। কিন্তু আমরা কোনো রাষ্ট্রেরই নাগরিক নই বলে আমাদের অধিকার পাই না।

আধুনিক রাষ্ট্রের রাজনৈতিক অধিকার ও নাগরিক সুবিধা ভোগের মাধ্যমে নিজেদের অবস্থার উন্নতির সুযোগের পরিবর্তে এসব মানুষ প্রশাসনহীন ছিটমহলে আটকা পড়ে আছে সাত দশক ধরে। ফলে ‘ছিটের নাগরিক’রা আধুনিক কল্যাণমুখী রাষ্ট্রব্যবস্থার সঙ্গে পরিচিত হতে পারেনি কখনোই। সাম্প্রতিক সময়ে অস্ত্র ও মাদক চোরাচালান, নারী ও শিশু পাচার, আন্তসীমান্ত সন্ত্রাস এবং জঙ্গি-তত্পরতা ছিটমহলের মানুষের অনিরাপত্তা ও অসহায়ত্বকে বহু গুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। ছিটমহলের নিরীহ মানুষ উভয় দেশের সীমান্ত প্রহরী ও নিরাপত্তা বাহিনীর সন্দেহবশত হয়রানির শিকার হয় প্রতিনিয়ত। তা ছাড়া সীমান্তে কৃষকদের ওপর বিএসএফের আচমকা গুলিবর্ষণ, বাংলাদেশ ভূখণ্ডে তাদের ক্রমাগত অনুপ্রবেশ এবং বিজিবির সঙ্গে গুলিবিনিময়ের ফলে সীমান্তে অপমৃত্যুর ঘটনা বেড়েই চলেছে। আর সীমান্তে উত্তেজনা সৃষ্টিকারী প্রতিটি ঘটনাই উভয় দেশের ছিটমহলের অধিবাসীদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত করে। ছিটমহলের রাষ্ট্রহীন, অসহায় মানুষ এসব ঘটনায় আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। ছিটমহলে ক্রমাগত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ইস্যুতে উভয় রাষ্ট্রই নির্লিপ্ত ভূমিকা পালন করে আসছে, অথচ বাংলাদেশ ও ভারত—উভয় রাষ্ট্রই জাতিসংঘের Universal Declaration of Human Rights-এ স্বাক্ষর করেছে, যাতে বলা হয়েছে:

All People have the right of self-determination. By virtue of that right, they freely determine their political status and freely pursue their economic, social and cultural development. All People may freely dispose of their nature, wealth and resources without prejudice to any obligations arising out of international economic cooperation…In no case may a people be deprived of its own means of subsistence. (Universal Declaration of Human Rights, 1948)

শুধু মৌলিক চাহিদা বা মৌলিক সামর্থ্যের (basic capabilities) ভিত্তিতে ছিটমহলের মানবাধিকার-পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলেও ভয়াবহ চিত্র ফুটে ওঠে।

ছিটমহলের অধিবাসীরা কখনোই অধিকার আদায়ের জন্য কোনো আন্দোলন বা কোনো সরকারের কাছে তাদের অধিকার আদায়ের দাবি উত্থাপন করতে পারেনি। বস্তুত, অধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলন করা বা একত্র হয়ে সভা-সমাবেশ করার মতো কোনো সুযোগ ছিটমহলের মানুষের নেই। কারণ, তারা একটি বিদেশি রাষ্ট্রে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ছিটমহলে বসবাস করে এবং নিজেদের ছিটমহলের বাইরে যাতায়াতের আইনগত কোনো অধিকার তাদের নেই। তবে স্বাধীনতা-পরবর্তী সহজ সময়ে ১৯৭২ সালের ২৬ জানুয়ারি কোটভাজনী ছিটমহলে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় বাংলাদেশে অবস্থিত ভারতীয় ছিটমহলের অধিবাসীরা ছিটমহল নাগরিক কমিটি গঠন করেছিল। এ কমিটির উদ্দেশ্য ছিল, বাংলাদেশ ও ভারত সরকারের কাছে তাদের অধিকার আদায়ের দাবি তুলে ধরা। ভারতীয় ছিটমহলের কিছু অধিবাসী, যারা বিভিন্ন সময়ে ভারতে পাড়ি জমিয়েছিল, তারা ভারত সরকারের কাছে তাদের দাবি উত্থাপন করতে থাকে। তাদের মধ্যে বিমল কুমার চক্রবর্তী পশ্চিমবঙ্গে ছিটমহল নাগরিক কমিটি গঠন করে এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। কিন্তু ভারত সরকার তাদের দাবির প্রতি কখনো কর্ণপাত করেনি। অন্যদিকে, পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক দলগুলোর কোনো সমর্থন আদায়ে ব্যর্থ হয়ে ছিটমহল নাগরিক কমিটি তাদের আন্দোলন বেশিদূর এগিয়ে নিতে পারেনি। তবে তাদের অর্জন ছিল এই যে, তাদের দাবির মুখে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ভারতীয় ছিটমহলের নাগরিকদের বিশেষ প্রয়োজনে দু-তিন দিনের জন্য সীমান্ত পেরিয়ে মূল ভূখণ্ডে যাওয়ার অনুমতি দিত। ফলে বাংলাদেশে অবস্থিত ভারতীয় বড় বড় ছিটমহলে আলাদা আলাদা ছিটমহল নাগরিক কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটিগুলোর দেওয়া ছিটমহলের নাগরিকত্ব সনদ নিয়ে ছিটমহলের অধিবাসীরা বিভিন্ন কাজে, বিশেষ করে জমি বিক্রির কাজে দু-তিন দিনের জন্য নিজেদের দেশে গিয়ে অবস্থান করতে পারত। কিন্তু ১৯৯৭ সাল থেকে পশ্চিমবঙ্গ সরকার এ ব্যবস্থা বন্ধ করে দেয়। তখন থেকে মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে ছিটমহলের মানুষের আর কোনো ধরনের সম্পর্ক নেই। ভারতে অবস্থিত বাংলাদেশি ছিটমহলের অধিবাসীদের অবস্থাও তথৈবচ। সেখানে শত শত মানুষ আছে, যারা জীবনে একবারের জন্যও মূল ভূখণ্ডে পা ফেলার সুযোগ পায়নি। কেউ কেউ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দু-একবার হয়তো প্রিয় স্বদেশভূমিতে পা রাখতে পেরেছে। আবার এই করতে গিয়ে বিএসএফের হাতে হয়রানি ও হত্যাকাণ্ডের সংখ্যাও অনেক। লালমনিরহাট জেলার আদিতমারী থানাধীন ভারতের সিঙ্গিমারীতে অবস্থিত বাংলাদেশি ছিটমহল বত্রিশগাছের অধিবাসী কাদের মিয়ার ছেলের মৃত্যু হয় লুকিয়ে বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডে আসার পথে সীমান্তে জিরো লাইনের কাছে বিএসএফের গুলিতে। এক রাতে সিঙ্গিমারী নদী পেরিয়ে বাংলাদেশে ঢোকার চেষ্টা করে আলম নামের ১৮ বছরের ছেলেটি। বিএসএফ দেখতে পেয়ে তাকে চ্যালেঞ্জ করে। আলম দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করলে বিএসএফ গুলি চালায়। ঘটনাস্থলেই নিহত হয় আলম। লাশ সরিয়ে নেয় বিএসএফ। ছিটমহলবাসী লাশ ফেরত চেয়ে পায়নি, উল্টো বিএসএফের নির্যাতনের শিকার হয় (মণ্ডল, ২০০৫: ১৩)।

ছিটমহলের প্রবীণ নাগরিকদের কেউই সাত দশকে সেখানে কোনো প্রশাসন বা সরকারের সঙ্গে তাঁদের কোনো সম্পর্কের কথা স্মরণ করতে পারেননি। অন্যদিকে ছিটমহলগুলো যে দেশে আশ্রিত, সে দেশেরও বিদেশি ছিটমহলে কোনো প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার আইনগত অধিকার নেই। আইনত সংশ্লিষ্ট দেশের অনুমতি ছাড়া স্বাগতিক দেশের কোনো ব্যক্তি বা প্রশাসনের ছিটমহলে অনুপ্রবেশের কোনো অধিকার নেই। কোনো কারণে অনুপ্রবেশ ঘটলে আইনত তা হবে সংশ্লিষ্ট দেশের সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন। কিন্তু তাই বলে স্বাগতিক দেশেরও দায়িত্ব এড়ানোর সুযোগ নেই। ছিটমহল নামের সেই দুস্তর ভূখণ্ডগুলোতে না হয় কিছু করা সম্ভব হলো না। না হয় পরিত্যক্তই থাকল কয়েক হাজার একর ভূমি। ধরা যাক, দক্ষিণ তালপট্টির মতো এই স্থলবেষ্টিত দ্বীপগুলোও (landlocked archipelago) সমুদ্রে তলিয়ে গেল। তখন কি সেখানকার মানুষও সমুদ্রে তলিয়ে যাবে? সলিল সমাধি ঘটবে তাদের? নাকি তাদের অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে তাদের জীবন বাঁচাবে যেকোনো সভ্য সমাজ? যেকোনো সভ্য সমাজ বা রাষ্ট্রের মূল উদ্বেগের বিষয় হওয়া উচিত সেখানকার মানুষ। তাহলে স্বাগতিক রাষ্ট্র কি পারে না এসব মানুষকে নাগরিকত্ব দিয়ে তাদের এই বন্দিদশা থেকে মুক্তি দিতে? দ্বৈত নাগরিকত্ব তো আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় স্বীকৃত বিষয়। বাংলাদেশ ও ভারতে তো হাজার হাজার মানুষের দ্বৈত নাগরিকত্ব আছে। এ সমস্যার ন্যায়ত সমাধানে রাষ্ট্র যখন ব্যর্থ, তখন সে ব্যর্থতার দায়ভার তো রাষ্ট্রকেই বহন করতে হবে। তাই রাষ্ট্রের উচিত, এই ব্যর্থতার দায়ভার নিয়ে ছিটমহলের মানুষকে নাগরিকত্ব দিয়ে তাদের এই বন্দিদশা থেকে মুক্তি দেওয়া এবং ছিটমহলের আজকের শিশুদের নাগরিক পরিচয় নিয়ে স্বাধীনভাবে বড় হওয়ার অধিকার দেওয়া। এসব মানুষকে অন্তত শিক্ষার অধিকার এবং যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ করার অনুমতি (work permit) দিয়ে তাদের দুর্দশা খানিকটা লাঘব করা যায়।

ছিটমহলের অর্থনীতি

অনির্ধারণযোগ্য অবস্থান এবং অদ্ভুত আকার-আয়তনের ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ছিটমহলগুলো স্বাভাবিকভাবেই অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে স্বাগতিক দেশের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য। ছিটমহলগুলোর সীমানায় কদাচিত্, ১৯৩৪ সালে ব্রিটিশ ইন্ডিয়া এবং কোচবিহারের মধ্যে স্থাপিত দু-একটি সীমানা স্তম্ভ বা স্তম্ভের ধ্বংসাবশেষ ছাড়া এমন কোনো নিয়মানুগ সীমানা বা ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য দেখা যায় না, যার মাধ্যমে একটি ছিটমহলকে সহজেই চিহ্নিত করা যাবে। তবে অনুসন্ধানী চোখে ছিটমহলের আলাদা বৈশিষ্ট্য হিসেবে যে বিষয়টি সহজেই দৃশ্যমান হতে পারে তা হলো, চারপাশের অবকাঠামোগত উন্নয়নের ধারা ছিটমহলের সীমানায় এসে হঠাত্ থমকে যাওয়া। গত দুই দশকে সারা বাংলাদেশে গ্রামীণ রাস্তাঘাটের যে ব্যাপক উন্নতি হয়েছে, তা ছিটমহলকে আলাদাভাবে শনাক্ত করতে সাহায্য করে। উদাহরণস্বরূপ নীলফামারী জেলার ডোমার থানায় অবস্থিত বৃহদায়তনের ভারতীয় ছিটমহল কোটভাজনীর নাম উল্লেখ করা যায়। পাকা রাস্তা, মোটরযান, বিদ্যুত্ সংযোগ ইত্যাদি সবকিছুই এই ছিটমহলের চারপাশে আছে। কিন্তু কোনো রাস্তাই এই ছিটমহলে প্রবেশ করেনি এবং বিদ্যুত্ লাইনের একটি খুঁটিও ছিটমহলের মধ্যে পড়েনি। বাংলাদেশের একটি ইউনিয়নের মতো আয়তন ও বৃহত্ জনসংখ্যার এই ছিটমহলে পায়ে চলার পথ ছাড়া যানবাহন চলার মতো একটি রাস্তাও কোনো দিক থেকে প্রবেশ করেনি। ছিটের অধিবাসীরা নিজেদের অর্থায়নে ও শ্রমে ছোট ছোট কিছু পথঘাট তৈরি করেছে। খাল পারাপারের জন্য তারা নির্মাণ করেছে বাঁশের সাঁকো। এভাবেই চলছে বছরের পর বছর।

ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ছিটমহলগুলোর মধ্যে কোনো আন্তসম্পর্ক না থাকলেও মিল পাওয়া যায় সেখানকার মানুষের যাপিত জীবনের প্রতিকূল বাস্তবতা, সামাজিক বঞ্চনা, অর্থনৈতিক ঘাতোপযোগিতা, আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারহীনতা এবং সর্বোপরি জীবনের নিরাপত্তাহীনতায়। দীর্ঘদিন প্রতিকূল অবস্থার সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে ছিটমহলের মানুষেরা প্রাত্যহিক জীবনযাপনের আলাদা কিছু ধরন, ভিন্ন রকম কিছু সামাজিক সংগঠন এবং ছিটমহলের চারপাশের বিদেশি প্রতিবেশীদের সঙ্গে বিশেষ ধরনের ব্যক্তিগত ও সামাজিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন, যা তাঁদের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। ‘তৃতীয় বিশ্বের’ নানা উন্নয়ন মডেলের কোনো সামাজিক নিরাপত্তা জালের স্পর্শ আজ পর্যন্ত তাঁরা পাননি। ভারত ও বাংলাদেশের (পূর্বে পাকিস্তান) রাষ্ট্রযন্ত্র ছিটমহলের মানুষকে কোনো প্রকার বাহ্যিক সাহায্য বা হস্তক্ষেপ ছাড়াই বহুমুখী প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করতে বাধ্য করেছে। উমর নন্দন (৪৩) তাঁদের অসহায়ত্বের কথা জানান এভাবে:

হামার ছিটের মানুষেরা সব গরিব। সবাই খুব খারাপ অবস্থার মধ্যে আছি। মনে করেন, কারও কোনো চাকরি নাই, ব্যবসা-বাণিজ্য নাই। ওই হাতের পরই (দিনমজুরি করা) সবাইকে চলতে হয়। আমরা তো সরকারের কোনো সাহায্য পাই না। আমরা কোনো ঋণ পাই না। ছিটে কোনো সরকারি লোক আসে না। কোনো এনজিও আসে না। মনে করেন, ঝড়-তুফান, রোগ-বালাই হয়ে ছিটের মানুষ সব মারা গেলেও সরকারের ঘরত তনে এক সের আটাও আমাদের জন্য আসবে না। একটা কাপড়ও আসবে না। কারণ, আমরা ভারতের নাগরিক না।

রাজেন্দ্র বর্মণ (৬৯/২০০৪) বলেন:

সরকারের এক সের চাল কি এক সের গমও আমরা পাই না। হামার ছিটে কোনো টিউবওয়েল নাই। কুয়ার পানি খাই। আমাদের কারও বাড়িতে কোনো পায়খানা নাই। আমাদের আশপাশে তো দেখি সরকারিভাবে বাড়ি বাড়ি পাকা পায়খানা দেয়। হামার এখানে কাই দিবে? হামার তো কোনো সরকার নাই। রাস্তাঘাট, বিদ্যুতের আশা তো জীবনেও করতে পারি না...ভারতের নাগরিকেরা সরকারের কাছ থাইকে টিনের ঘর পাচ্ছে, গাভি পাচ্ছে, হাঁস-মুরগি পাচ্ছে। কিন্তু আমরা কিছু পাই না। আমাদের ছিটে কোনো এনজিও তো নাই আসে।

লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রাম থানায় অবস্থিত ভারতীয় ছিটমহল আজওয়ারপাড়ার অধিবাসী হামিদুর (৩৫) বলেন:

বিপদ-আপদে আমাদের কেউ সাহায্য করে না। ওই আমাদের নিজেদের বিপদ নিজেদেরই সামলাইতে হয়। কে আমাদের সাহায্য করবে? আমাদের তো কোনো সরকার নাই। মনে করেন, এখানে দুর্ভিক্ষ হয়ে মানুষ মারা গেলেও দেখার কেউ নাই। গত মঙ্গার সময় দেখলাম, বাংলাদেশ সরকার ১৫ দিন পর পর সবাইকে ১০ কেজি করে চাল দিল। আরও কত সাহায্য দিল। কই, আমরা তো কিছুই পাইলাম না! আমাদের এই ছিটে সরকারি কোনো ডাক্তার আসে না। কোনো পরিবার পরিকল্পনার লোক আসে না। কোনো এনজিও আসে না। আশপাশের গ্রামে গ্রামীণ ব্যাংক ঋণ দেয়। কিন্তু আমাদের ছিটের লোকদের দেয় না। তারা কয়, আমরা বাংলাদেশের নাগরিক না, তাই তারা আমাদের ঋণ দিলে তাদের চাকরি চইলে যাবে।

ছিটমহলের মানুষেরা জীবনের তাগিদে স্বাগতিক দেশে যেসব কাজ করে তা আইনত ‘অবৈধ’। স্বাগতিক দেশের মুদ্রাই প্রতিটি ছিটমহলে প্রচলিত। এসব কারণে রাষ্ট্রের চোখে তাদের অর্থনীতি অপরাধায়িত (criminalized economy)! অথচ খোদ রাষ্ট্রই এ জন্য দায়ী। এ প্রসঙ্গে উমর নন্দন বলেন:

আমরা যে ভারতের মধ্যে যাতায়াত করি, কাজকাম করি এইডা তো বৈধ না। কারণ, আমরা কাগজ-কলমে ভারতের নাগরিক নই। ভারতের পুলিশ যেকোনো সময় ধইরে যদি কার্ড (নাগরিক পরিচয়পত্র) চায়, আমরা তো দিতে পারুম না। তখন পুলিশ ইচ্ছে করলে আমাদের আটকায়ে দিতে পারে। এই জন্য যতক্ষণ ইন্ডিয়ার মধ্যে কাজকাম করি, ততক্ষণই একটা ভয়ের মধ্যে থাকি। নিশ্চিন্তে কোনো কিছুই করতে পারি না।

ছিটমহলসহ সীমান্তবর্তী মানুষের যুগ-যুগান্তরের প্রধান পেশা জমি চাষ করা এবং নদী চষা। নদী চষে তারা মাছ ধরে এবং পাথর উত্তোলন করে। কিন্তু ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে অবস্থিত সীমানা নির্ধারণকারী নদীগুলো এখন পুরোপুরিভাবে নিয়ন্ত্রণ করে ভারতীয় বিএসএফ। তাদের বাধার মুখে জীবিকা হারিয়ে চরম দারিদ্র্যের শিকার হচ্ছে বিভিন্ন ছিটমহল ও সীমান্তবর্তী অঞ্চলের মানুষ। অথচ ১৯৭৫-এর বর্ডার গাইডলাইন অনুযায়ী, নদীর মধ্যবর্তী ধারা থেকে এপারের অংশ বাংলাদেশের।

বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশেই বাজারব্যবস্থায় বেশ কিছু প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। গ্রামীণ জনপদে বাজার সম্প্রসারিত হয়েছে, যার ফলে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ বাজার অর্থনীতিতে প্রবেশ করতে পেরেছে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে ছিটমহলের অধিবাসীরা বাজার এবং প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষুদ্রঋণের অগ্রগতির সুফল থেকে পুরোপুরিভাবে বঞ্চিত, যা থেকে বঞ্চিত হয় না দরিদ্র ও অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠীও। এমনকি অতিদরিদ্র ব্যক্তিদের জন্য গৃহীত ব্যতিক্রমধর্মী ঋণ কার্যক্রমেও ছিটমহলের সেই অতিদরিদ্র মানুষগুলো কখনো অন্তর্ভুক্ত হয় না। এ প্রসঙ্গে খোকা বলেন:

এই ছিটে কোনো এনজিও আসে না। গ্রামীণ ব্যাংক, ব্র্যাক—এসব কোনোটাই এখানে কাজ করে না। আমরা কোনো সরকারের কাছ থেকেও সাহায্য পাই না, এনজিওর কাছ থেকেও কোনো সাহায্য পাই না। এখানে কোনো দিন কোনো স্বাস্থ্যকর্মী আসে না, কোনো পরিবার পরিকল্পনার লোকও আসে না।

রাষ্ট্রীয় সীমানার অদৃশ্য দেয়ালে ঘেরা ছিটমহলের মানুষকে শুধু খাদ্যের জন্য প্রতিদিন ‘অবৈধ’ অনুপ্রবেশ করতে হয় স্বাগতিক দেশে। স্বাগতিক দেশের মধ্যে শুধু কায়িক শ্রমের বিনিময়ে ন্যূনতম অন্ন-বস্ত্রের সংস্থান করা ছাড়া বাড়তি কোনো কিছু করার সুযোগ নেই তাদের। জন্মগতভাবেই প্রত্যেক মানুষ যেসব অধিকার ভোগ করে, রাষ্ট্রের প্রত্যেক নাগরিক যেসব অধিকার ভোগ করে তার সবকিছু থেকে বঞ্চিত এই মানুষগুলো। তিন প্রজন্ম ধরে সব ধরনের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত থাকার কারণে তাদের মধ্যে প্রজন্মান্তরে দারিদ্র্যের (inter generation transmission of poverty) হার শতভাগ। সার্বিক বিচারে ছিটমহলের মানুষের বাস্তবতা আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার সঙ্গে নিঃসন্দেহে সাংঘর্ষিক। সেখানে ক্রমাগত মৌলিক অধিকারের লঙ্ঘন আর মানুষের বেঁচে থাকার মর্মস্পর্শী সংগ্রাম আধুনিক সভ্যতা ও মানবতাবাদকে প্রশ্নবিদ্ধ করে প্রতিনিয়ত।

খাদ্যের নিরাপত্তাহীনতা

প্রথমেই নজরে আসে খাদ্যনিরাপত্তার অভাব। অনুন্নত ও উন্নয়নশীল প্রায় সব দেশেই কম-বেশি খাদ্যের ঘাটতি রয়েছে। যদিও প্রতিদিন অনাহারে থাকা পৃথিবীর ২০০ কোটি মানুষের তুলনায় বাংলাদেশ-ভারত ছিটমহলের মানুষের সংখ্যা খুবই কম, তবু ছিটমহলের মানুষের খাদ্যে নিরাপত্তাহীনতার মাত্রা যেকোনো জনগোষ্ঠীর তুলনায় বেশি। তাদের খাদ্যাভাবের পেছনে অনেক কারণ বিদ্যমান, যার জন্য দায়ী মূলত রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের অনুপস্থিতি। পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতির অনুপস্থিতিতে উচ্চ জন্মহার, আয়তনের তুলনায় অতিরিক্ত অশিক্ষিত ও অদক্ষ জনসংখ্যা এবং তাদের শ্রমবাজারে প্রবেশাধিকারের সুযোগ না থাকা ইত্যাদি কারণে ছিটমহলের মানুষের মধ্যে খাদ্য ঘাটতি থাকে সারা বছর। তা ছাড়া ছিটমহলের মানুষেরা এখন পর্যন্ত যথাসর্বস্ব পুরোনো পদ্ধতিতে জমি চাষ করে। কারণ, তাদের কৃষিকাজের জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতি, যেমন—সেচের জন্য মোটর ইত্যাদি ক্রয়ের কোনো সামর্থ্যও নেই, ক্ষেত্রবিশেষে অধিকারও (স্বাগতিক দেশের অনুমতি) নেই। ফলে তারা ভালো ফলন পায় না। ব্যবসা করার অধিকারও তাদের নেই। এমনকি গৃহপালিত পশু ক্রয়-বিক্রয়ের জন্যও স্বাগতিক দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী অথবা যেসব ছিটমহল সীমানারেখা থেকে অনেক ভেতরে, সেসব ক্ষেত্রে স্বাগতিক দেশের স্থানীয় সরকার প্রতিনিধির অনুমতি নিতে হয়। তারা তাদের প্রয়োজন মেটাতে একসঙ্গে বেশি পরিমাণে খাদ্যশস্য পর্যন্ত ক্রয় করতে পারে না। স্থানীয় বাজারে স্বল্প পরিমাণ বেচাকেনার জন্য তাদের অনুমতি দেয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী, যা অপর্যাপ্ত এবং যার সীমা তারা অতিক্রম করতে পারে না। এ বিষয়ে কোনো দেশেরই কোনো নীতিমালা নেই। এটা নির্ভর করে সীমান্ত প্রহরীদের মর্জির ওপর। এ প্রসঙ্গে উমর নন্দন বলেন:

মনে করেন, চাল-ডাল ছাড়া গরু-ছাগল বা অন্য কিছু বেচাকিনি করার দরকার হইলেই বিএসএফের কাছ থাইকে স্লিপ (অনুমতিপত্র) নিতে হয়, আবার পঞ্চায়েতের কাছ থাইকেও স্লিপ নিতে হয়। তাদের স্লিপ ছাড়া আমরা কিছুই করতে পারি না। ছিটের মানুষেরা এক বস্তার বেশি চাল কিনতে পারে না। কোনো বিয়ে-শাদি করাইতেও বিএসএফের অনুমতি নিতে হয়। রাতের বেলায় আমাদের ভারতের ভেতর যাওয়া নিষেধ।

স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ নেই ছিটমহলে

বাংলাদেশ ও ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশে খাদ্য ঘাটতির পাশাপাশি নিরাপদ পানি, স্যানিটেশন ও স্বাস্থ্যসেবার অভাব অন্যতম প্রধান সমস্যা। তথাপি সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য (MDGs) অর্জনে বাংলাদেশের অগ্রগতি উল্লেখযোগ্য। কিন্তু MDGs-এর সামাজিক লক্ষ্যমাত্রা, যেমন—নিরাপদ পানি, স্যানিটেশন, স্বাস্থ্যসেবা ইত্যাদি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে পরিচালিত সরকারি কার্যক্রমে কোনো ছিটমহলকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। সরেজমিন পরিদর্শন করে দেখা গেছে, কোনো ছিটমহলেই নিরাপদ পানির কোনো ব্যবস্থা নেই। ছিটমহলগুলোতে কদাচিত্ দু-একটি অগভীর নলকূপ দেখা গেলেও স্যানিটেশন ও স্বাস্থ্যসেবা পুরোপুরি অনুপস্থিত। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তারা মাটির কুয়ার পানি পান করে। কিন্তু এই কুয়াগুলো বর্ষাকালে বন্যায় প্লাবিত হয়। ফলে নানাবিধ স্বাস্থ্যসমস্যা দেখা দেয়। অথচ ছিটমহলের অধিবাসীদের স্বাস্থ্যসেবার কোনো সুযোগ নেই। গুরুতর অসুস্থতা, দুর্ঘটনা প্রভৃতি জরুরি মুহূর্তে তাদের চিকিত্সা নিতে ‘অবৈধভাবে’ নিকটবর্তী স্বাগতিক দেশের কোনো হাসপাতালে যেতে হয়, যেখানে চিকিত্সা পাওয়ার অধিকার তাদের নেই। ফলে চিকিত্সাপ্রাপ্তির বিষয়টি নির্ভর করে ডাক্তার ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দয়ার ওপর। বাংলাদেশে অবস্থিত ভারতীয় ছিটমহলে বসবাসকারী ভারতীয় নাগরিকদের দুর্দশার বর্ণনা দিতে গিয়ে ‘নেই মানুষের পাঁচালী’ শীর্ষক CDA-এর প্রবন্ধে বলা হয়:

ছিটমহলের সীমানায় দাঁড়ালে দেখা যায়, ভারতের সীমারেখা, জনস্বাস্থ্য কারিগরি বিভাগের উন্নত প্রযুক্তির সাহায্যে তৈরি নলকূপ, উপস্বাস্থ্যকেন্দ্র, প্রাথমিক বিদ্যালয়, যার সুবিধা ভোগ করার অধিকার এই ছিটমহলের মানুষেরও ভারতীয় সংবিধানে দেওয়া আছে। কিন্তু ছোঁয়া যায় না, মাঝখানে কোথাও এক একর কোথাও বা দুই একর বিদেশি জমির দুস্তর প্রাচীর এবং বিএসএফ ও বিডিআরের রক্তচোখ। কোচবিহারের ছিটমহলের প্রজাবর্গ ভারতের নাগরিকের মর্যাদা পেয়ে পরিণত হলো ‘নেই মানুষে’। ভারতের জনগণনায় এই মানুষেরা নেই, নির্বাচনী তালিকায় নেই। নির্বাচনী অধিকার সংবিধানে লেখা আছে—বাস্তবে নেই, স্বাস্থ্যব্যবস্থা নেই, শিক্ষাব্যবস্থা নেই, নিরাপত্তা নেই...। ‘নেই’-এর তালিকার পরবর্তী অংশ দীর্ঘতর হবে। বরং এই তালিকা বন্ধ করে এই পরিপ্রেক্ষিত থেকেই শুরু হোক ‘নেই মানুষের পাঁচালী’।

যেহেতু ছিটমহলগুলোতে যানবাহন উপযোগী কোনো রাস্তাঘাট নেই, জরুরি ভিত্তিতে কোনো রোগী বা দুর্ঘটনাকবলিত ব্যক্তিকে স্বাগতিক দেশের কোনো হাসপাতালে পৌঁছানোও অত্যন্ত কঠিন। লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রাম থানায় অবস্থিত ভারতীয় ছিটমহলের ১৭ নম্বর পানিশালার অধিবাসী মহসীন আলী (৫৭) চিকিত্সাপ্রাপ্তির ভোগান্তি বর্ণনা করে বলেন:

লম্বায় তিন-চার কিলোমিটার এই জায়গার মধ্যে আজ পর্যন্ত কোনো রাস্তা তো দূরের কথা, কোনো সরকার এক কোদাল মাটি পর্যন্ত ফেলে নাই...বর্ষার সময় একজন রোগীকে কাঁধে নিয়ে হাঁটুপানি, কোমরপানি ভাইঙ্গে পার হতে হয়। একজন জরুরি রোগীকে কাঁধে করে পানি ভাইঙ্গে আওলিয়ারহাটে গিয়ে মেইন রাস্তায় উঠতে উঠতে রোগীর অবস্থা শেষ হয়ে যায়।

শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিটমহলের শিশুরা

ছিটমহলের ছেলেমেয়েদের শিক্ষার জন্য স্বাগতিক দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে যেতে হয়। ছিটে জন্ম নেওয়ার ফলে ভর্তির সময় তারা স্বদেশি ছেলেমেয়েদের মতো সমান গুরুত্ব পায় না। যেহেতু অধিকাংশ ছিটমহলই আয়তনের দিক থেকে ক্ষুদ্র, তাই সেসব ছিটমহলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রত্যাশা করা বাস্তবসম্মত নয়। কিন্তু মাঝারি আয়তনের এবং কতিপয় বড় আকৃতির ছিটমহলে অন্তত একটি করে প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকাটা খুবই জরুরি। কিন্তু কোনো ছিটমহলেই কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই। যেখানে কোনো প্রশাসন নেই, সেখানে সরকারি স্কুল থাকবে না—এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও ছিটমহলগুলোতে কোনো শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে না। তাই অন্য সব বিষয়ের মতো ছেলেমেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারেও ছিটের মানুষকে নির্ভর করতে হয় নিকটবর্তী স্কুল কর্তৃপক্ষ এবং স্থানীয় নেতাদের দয়ার ওপর। ফলে ছিটমহলে কদাচিত্ দু-একজন স্কুলপাস লোক পাওয়া যায়। ছিটমহলের অধিবাসীরা কখনোই শিক্ষার সুযোগ পায়নি। একদিকে ছিটমহলের ছেলেমেয়েরা ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায় এমন স্কুলের (স্বাগতিক দেশের স্কুল) সংখ্যা যেমন খুবই কম, তেমনিভাবে ছিটমহলের অধিবাসীরা তাদের সন্তানদের লেখাপড়া শেখানোর ব্যাপারে কোনো উত্সাহও পায় না। কারণ, এক দেশের নাগরিকত্ব নিয়ে অন্য দেশে বসবাসের ফলে শিক্ষালাভের পরও তাদের কর্মসংস্থানের কোনো সুযোগ নেই। মানবিক কারণে ছিটমহলের কোনো মানুষ যদি লেখাপড়া করার সুযোগ পায় এবং মাধ্যমিক স্কুল বা কলেজও পাস করে, তারা যে দেশের নাগরিক, সেখানে তাদের এই শিক্ষা সনদের কোনো মূল্য নেই এবং তারা সে দেশে যেতেও পারে না। অপর পক্ষে ছিটমহলে বসবাসকারী বিদেশি নাগরিক হিসেবে স্বাগতিক দেশেও তাদের চাকরিপ্রাপ্তির কোনো সুযোগ নেই। রাজেন্দ্র বর্মণ তাঁদের সন্তানদের স্কুলে ভর্তির সমস্যা বর্ণনা করেছেন এভাবে:

পোলাপান স্কুলে ভর্তি করতেও কিছু সমস্যা হয়। এত দিন প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করাইতে গেলে পঞ্চায়েত, মাস্টার মশাইদের অনুরোধ করলে হইত। তাদের অনুরোধ করলে ভর্তি কইরে নিত। কিন্তু এখন তো আরেক সমস্যা দেখা দিছে। প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করার সময় জন্ম সার্টিফিকেট লাগে। মনে করেন, যারা ভারতের নাগরিক, তাদের কোনো সন্তান জন্ম হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা সরকার লিখে নিয়ে যায় এবং সময়মতো জন্ম সার্টিফিকেট দেয়। কিন্তু হামার ছিটে তো ওসব হয় না।

মহসিন আলী ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বলেন:

মনে করেন, আমাদের ছেলেমেয়েরা বাংলাদেশের স্কুলে লেখাপড়া করে। তাদের সার্টিফিকেট হচ্ছে বাংলাদেশি। এই সার্টিফিকেট ভারতে অচল। আবার বাংলাদেশ সরকারের কোনো চাকরি পাইলেও যখন পুলিশ ভেরিফিকেশন হয়, তখন আমরা আটক। কারণ, পুলিশ ভেরিফিকেশনে ধরা পড়ে যে আমরা ছিটের লোক।

এই বাস্তবতায় ছিটমহলের অধিবাসীরা শিক্ষা সম্পর্কে তাদের উত্সাহ হারিয়ে ফেলেছে, যার প্রমাণ পাওয়া যায় উমর নন্দনের বক্তব্যে:

আগে তো হামার ছিটের কাছাকাছি কোনো স্কুলই ছিল না। কয় বছর হইল পাশের গাঁওত একটা প্রাইমারি স্কুল হইছে। ওই তখন থাইক্যে ছিটের দুই-চারজন করে পোলাপাইন স্কুলত যায়। তা ওই প্রাইমারি স্কুল পর্যন্তই। বড় স্কুলত কেউ নাই যায়। ছিটের নাগরিকেরা নাকি ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিতে পারে না। পরীক্ষা দিয়া পাস দিবার না পারলে, চাকরিবাকরি না পাইলে, পাইসে-কড়ি খরচ করে স্কুল চালায়ে লাভ কী, কন? আমরা গরিব মানুষ। পেটের ভাতই তো জুটাইবার পারি না। তাই লেখাপড়া নিয়ে আমরা অত ভাবনা-চিন্তা করবার পারি না।

ছিটমহলে জমির মালিকানা-সংক্রান্ত জটিলতা

জমি কেনাবেচার জন্য রেজিস্ট্রি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলেও ছিটমহলের মানুষের এর কোনো সুযোগ নেই। ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত ভারতীয় ছিটমহলের অধিবাসীরা জমি কেনাবেচার রেজিস্ট্রি করার জন্য সীমানা পেরিয়ে কোচবিহার জেলার হলদিবাড়ী রেজিস্ট্রি অফিসে যেতে পারত। কিন্তু ১৯৯৭ সাল থেকে তা পুরোপুরিভাবে বন্ধ। ফলে বড় ছিটমহলগুলোতে ছিট কাউন্সিল একধরনের ভূমি রেজিস্ট্রেশনের ব্যবস্থা চালু করেছে, যার ধরন একেক ছিটমহলে একেক রকম। ছিট কাউন্সিলের সদস্য এবং কতিপয় সাক্ষীর উপস্থিতিতে কাউন্সিলের প্যাডে অথবা বাংলাদেশের নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পের ওপর জমি কেনাবেচার রেজিস্ট্রেশন করা হয়। আইনগত দিক থেকে এই রেজিস্ট্রেশন বা দলিলের কোনো দেশেই কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই। ফলে যাঁরা নতুন করে ছিটমহলে জমি ক্রয় করেছেন, জমির মালিকানা-সংক্রান্ত তাঁদের কোনো বৈধ দলিলপত্র নেই এবং এই মালিকানার ভবিষ্যত্ একেবারেই অনিশ্চিত। আবার ছোট ছোট ছিটমহলে, যেখানে ছিট কাউন্সিল নেই, সেখানে এ রকম রেজিস্ট্রেশনের ব্যবস্থাও নেই। সেখানে জমি হাতবদল হয় স্থানীয় গণ্যমান্য লোকদের উপস্থিতিতে মৌখিকভাবে। ফলে ছিটমহলের জমির দাম পার্শ্ববর্তী জমির দামের চেয়ে অনেক কম।

ছিটমহলে নিরাপত্তাহীনতা ও অপরাধ-প্রবণতা

রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের অনুপস্থিতিতে ছিটমহলগুলো অপরাধকারীদের নিরাপদ আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়েছে। দুষ্কৃতকারীরা দেশের মধ্যে মানুষ হত্যাসহ বড় বড় অপরাধ সংঘটিত করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাত থেকে বাঁচতে অনেক সময় ছিটমহলে গিয়ে আশ্রয় নেয়। কারণ, ছিটমহলে কোনো দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রবেশ করে না। ফলে তারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। অনেক সময় ছিটমহলের অধিবাসীরা চাপের মুখে অপরাধীদের আশ্রয় দিতে বাধ্য হয়। বস্তুতপক্ষে তারা ছিটমহলের নিরীহ মানুষকে জিম্মি করে রেখেছে। তাদের বাধা দিলে নানাভাবে হয়রানির শিকার হয় ছিটমহলের অসহায় মানুষেরা। এ প্রসঙ্গে রাজেন্দ্র বর্মণ বলেন:

হামার ছিটের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, ছিটের মানুষের কোনো নিরাপত্তা নাই। আমাদের কোনো সরকার নাই, আইন নাই। যেখানে আইন নাই, সেখানে কি ভালোভাবে বাঁচা যায়? কখন কে আইসে হামলা করে, কখন কে কার ক্ষতি করে তার কোনো ঠিক নাই। মনে করো, এই ছিটে যদি পাঁচটা খুনও হয়, ভারতের পুলিশ এখানে আইসে দেখবেও না এখানে কী হইছে।

সাম্প্রতিক সময়ে অস্ত্র ও মাদক চোরাচালান, নারী ও শিশু পাচার, আন্তসীমান্ত সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ইত্যাদি ছিটমহলের অধিবাসীদের বিদ্যমান অনিরাপত্তা ও অসহায়ত্ব বহু গুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। ছিটমহলের নিরীহ মানুষেরা উভয় দেশের সীমান্ত প্রহরী ও নিরাপত্তা বাহিনীর সন্দেহের শিকার হয়ে হয়রানির শিকার হয় প্রতিনিয়ত।

সীমান্তসংলগ্ন ছিটমহলগুলো নারী ও শিশু পাচার, মাদক পাচার এবং চোরাচালানির রুট হিসেবে ব্যবহূত হয়। কুড়িগ্রাম জেলার ভুরুঙ্গামারী থানার পাথরডুবি ইউনিয়নে অবস্থিত সীমান্তসংলগ্ন ভারতীয় ছিটমহল সেউতিকুর্শা নারী ও শিশু পাচারের ক্ষেত্রে অন্যতম ট্রানজিটে পরিণত হয়েছে বলে জানা যায়। স্থানীয়ভাবে ‘ঝুমকাওয়ালী’ নামে পরিচিত পাচারকারীদের অভয়ারণ্য যেন এই ছিটমহল (মণ্ডল, ২০০৫: ৩৩)। অনেক সময় ছিটমহলগুলোতে ব্যাপক গাঁজা চাষের খবরও পত্রপত্রিকায় প্রকাশ পায়। সংঘবদ্ধ মাদকচক্র তাদের গাঁজা চাষের উপকরণ সরবরাহ করে এবং উত্পাদিত গাঁজা ক্রয় করে। ছিটমহলগুলোতে গাঁজা চাষের পরিমাণ যখন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়, তখন বাংলাদেশের পুলিশ ও বিজিবি মাঝেমধ্যে ছিটমহলে অভিযান চালিয়ে গাঁজার আবাদ ধ্বংস ও গাঁজা জব্দ করলেও কারও বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে না। ছিটমহলের অধিবাসীরাও কেউ কেউ এসব অপরাধ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। তবে এ সংখ্যা খুবই কম। ছিটমহলের অধিকাংশ মানুষই নিরীহ ও শান্তিপ্রিয়।

ছিটমহলের সমাজ ও সামাজিক সম্পর্ক

মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্নতা এবং রাষ্ট্রহীনতার কারণে ছিটের নাগরিকদের জীবন-জীবিকার একমাত্র অবলম্বন স্বাগতিক দেশের বিদেশি প্রতিবেশীদের (alienated neighbours) সঙ্গে তাদের বংশপরম্পরার সামাজিক সম্পর্ক (social capital)। দেশ বিভাগ-পরবর্তী সময়ে ছিটমহলের মানুষেরা যে ক্ষতি ও হয়রানির শিকার হয়েছিল, তা ছিল মূলত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ফল। এটুকু ছাড়া র্যাডক্লিফ সীমানা দ্বারা রাতারাতি বিদেশিতে পরিণত হওয়া এবং ছিটমহলে আটকে পড়া এই মানুষগুলোর সামাজিক জীবন তেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি; বরং রাষ্ট্র কর্তৃক পরিত্যক্ত হওয়ার পর বিদ্যমান সামাজিক সম্পর্কই তাদের জীবনযাপনের একমাত্র অবলম্বনে পরিণত হয়। তবে দিনে দিনে এই সম্পর্কের রং বদলেছে। এই সম্পর্কের ক্ষেত্রে পারস্পরিক সম্মানের জায়গা দখল করে নিয়েছে এক পক্ষের অসহায়ত্ব ও নির্ভরশীলতা, আর অন্য পক্ষের করুণা এবং ক্ষেত্রভেদে করুণাজনিত অবজ্ঞা।

যদিও আপাতদৃষ্টিতে স্বাগতিক দেশের প্রতিবেশীদের (বিদেশি) সঙ্গে ছিটের নাগরিকদের ভালো সম্পর্কই বিদ্যমান (বিশেষ করে বাংলাদেশে), তবু ছিটমহলের মানুষের সামাজিক জীবনের অনিশ্চয়তা ও শঙ্কার মাত্রা অনেক বেশি। যেহেতু তাদের কোনো প্রশাসনিক নিরাপত্তা নেই, তাই যেকোনো সময় যেকোনো কারণে বিদ্যমান সামাজিক সম্পর্ক উল্টে যেতে পারে এবং তারা হয়রানির শিকার হতে পারে। একটি দেশ বা সমাজের যেকোনো স্থানেই দুষ্কৃতকারীরা কম-বেশি সক্রিয় থাকে। আর স্বাগতিক দেশের প্রতিবেশীদের সঙ্গে ছিটমহলের মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও লেনদেনের সম্পর্ক বিদ্যমান থাকলেও দুষ্কৃতকারীদের কাছে তারা অসহায়ই বটে।

স্বাগতিক দেশের প্রতিবেশীদের সঙ্গে ছিটমহলের মানুষের নির্ভরযোগ্য সম্পর্কের একটি মাধ্যম হচ্ছে বৈবাহিক সম্পর্ক। তাই ছিটের মানুষেরা সব সময় ছিটমহলের বাইরে স্বাগতিক দেশের স্থানীয় মানুষের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করে। স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে ছিটের মানুষেরা নিজেদের নিরাপদ মনে করে এবং তাদের অসহায়ত্ব খানিকটা লাঘব হয়। ভারতীয় ছিটমহল শালবাড়ীর অধিবাসী রহিম উদ্দিন (৬৬) এ প্রসঙ্গে বলেন:

আমরা বাংলাদেশের মধ্যে ছেলেমেয়ে বিয়ে দিতে বেশি চেষ্টা করি। কারণ, বাংলাদেশের ভেতরে একটা আত্মীয় হলেই আমাদের একটা সাহস বাড়ে। এই ছিটমহলে কখনো কোনো সমস্যা হলে তাদের কাছে আশ্রয় নিতে পারব। তা ছাড়া মনে করেন, বাংলাদেশের হাটবাজারে আমরা কোনো গরু বিক্রি করতে পারি না। কারণ, গরু বেচাকেনার জন্য যে রসিদ করতে হয়, সেখানে ছিটের নাম-ঠিকানা লেখা যায় না। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশে আমাদের কোনো আত্মীয় থাকলে তাদের মাধ্যমে আমরা এই কাজটা করতে পারি। তাই আমরা সবাই বাংলাদেশের ভেতরে আত্মীয়তা করার চেষ্টা করি।

কিন্তু চেষ্টা করা সত্ত্বেও তারা সব সময় ছিটের বাইরের লোকদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে না। কারণ, অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্থানীয় বাসিন্দারা ছিটের লোকদের সঙ্গে আত্মীয়তা করতে আগ্রহী নয়। তারা মনে করে, ছিটমহলে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে বিপদ ডেকে আনা হবে। কারণ, ছিটমহলে এক ঘর আত্মীয় থাকলে সেখানকার নিরাপত্তাহীনতার জন্য তাদেরও উত্কণ্ঠার মধ্যে থাকতে হবে এবং যেকোনো দাঙ্গা-হাঙ্গামার সময় সামাজিক দায়দায়িত্ব বহন করতে হবে। এ ছাড়া বিবাহ অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে ছিটমহলের নাগরিকদের বিবাহ নিবন্ধীকরণ-সংক্রান্ত জটিলতাও রয়েছে। যেহেতু ছিটমহলের অধিবাসীরা বিদেশি নাগরিক, তাই আইনত স্বাগতিক দেশে তাদের বিবাহ নিবন্ধনের কোনো সুযোগ নেই। তাই ছিটমহলের অধিবাসীরা অনেক সময় স্বাগতিক দেশের কোনো আত্মীয় বা বন্ধুবান্ধবের ঠিকানা ব্যবহার করে বিবাহ-সংক্রান্ত নিবন্ধন সম্পন্ন করে। তবে হিন্দুদের বেলায় এ সমস্যা কম। কারণ, হিন্দু সম্প্রদায়ে বিবাহ নিবন্ধন আইনত অত্যাবশ্যক নয়।

দীর্ঘকাল ধরে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের অভাবে ছিটমহলের রাষ্ট্রহীন মানুষেরা বেঁচে থাকার জন্য শুধু ভিনদেশি প্রতিবেশীদের সঙ্গে বিদ্যমান সম্পর্ককে পুঁজি করে জীবনধারণের যে পথ খুঁজে নিয়েছে, তা পৃথিবীতে বিরল। নীলফামারী জেলার ডিমলা থানায়, সীমানারেখা থেকে চার-পাঁচ কিলোমিটার ভেতরে অবস্থিত ভারতীয় ছিটমহল বড়খানকি খারাজী গিটালদহের অধিবাসী আবদার হোসেন (৬০) বলেন:

এই ছিটে কোনো সরকার কাজ করে না। বাংলাদেশের কোনো অফিসার তো এই ছিটের জমিতে পা-টাও ফালায় না। কয়, এইটা ভারতের জায়গা, আমরা ভারতের নাগরিক। কই, ভারত তনেও তো কেউ আমাদের দেখতে আসে না, আমাদের খোঁজখবর নেয় না? আমরা তো ভারত যাবারও পারি না...আমরা বাংলাদেশের মানুষের মতোই সব কাজকর্ম করি। কিন্তু সরকারিভাবে এই ছিটে কিছু করে না। সামাজিকভাবেই আমরা আমাদের কাজকর্ম করি। এই ছিটে কোনো গন্ডগোল হইলেও আশপাশের গণ্যমান্য লোকেরা মিলমিশ করে দেয়।

মোট কথা, ছিটমহলের অধিবাসীরা স্বাগতিক দেশে যদি নিয়মিতভাবে অবৈধ অনুপ্রবেশ না করে অথবা জীবিকার জন্য সেসব কাজ নিয়মিতভাবে না করে, যা উভয় রাষ্ট্রের চোখে অপরাধ, তবে তাদের পক্ষে বেঁচে থাকা অসম্ভব। এসব দিক বিবেচনা করলে বাংলাদেশ ও ভারতের ছিটমহলের মানুষেরা পৃথিবীর বিরল এক ছোট্ট জনগোষ্ঠী। বাংলাদেশি ছিটমহলের অধিবাসী উমর নন্দন বলেন:

পুলিশ কোনো দিনও আমাদের ছিটে ঢোকে নাই। পুলিশ কোনো দিন ঢুকবেও না। কারণ, জায়গাটা ইন্ডিয়ার নয়, বাংলাদেশের। পুলিশ কাউকে এখানে ধরতেও আসবে না। আবার ছিটের মানুষের মহা বিপদেও আসবে না। ছিটে যদি একটা জলজ্যান্ত মানুষ লাশ হয়ে পড়ে থাকে, পুলিশ দেখতেও আসবে না। থানায় বলতে গেলে কইবে, ‘ও তোমার বাংলাদেশের জায়গা, ওখানে হামার যাইবারও নয়, কিচ্ছু কইবারও নয়।’

ছিট কাউন্সিল: সামাজিক ‘স্থানীয় সরকার’

ছিটমহলের শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা করা এবং ছিটের সামাজিক বিষয়গুলো দেখাশোনা করার লক্ষ্যে অধিক জনসংখ্যার বড় আকারের ছিটমহলগুলোতে বাংলাদেশের ইউনিয়ন পরিষদের আদলে একধরনের ছিট কাউন্সিল গঠন করা হয়। কার্যত, এই কাউন্সিল একটি সামাজিক সংগঠন। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, পঞ্চগড় জেলার দেবীগঞ্জে অবস্থিত শালবাড়ী, নাটকটোকা, বেওলাডাঙ্গা ও কাজলদীঘি নামক চারটি (পরস্পর অবিচ্ছেদ্য) ভারতীয় ছিটমহলের অধিবাসীরা ছিট কাউন্সিল গঠনের জন্য নিজেদের মতো করে নির্বাচনের ব্যবস্থা করে। নির্বাচনের মাধ্যমে তারা একজন চেয়ারম্যান এবং তিনটি ওয়ার্ড থেকে নয়জন সদস্য নির্বাচন করে। শুধু পুরুষেরা এই নির্বাচনে ভোট দিতে পারে। ছিট কাউন্সিল তাদের ভোটার তালিকা তৈরি করে। ছিট কাউন্সিলের অনুরোধে স্বাগতিক দেশের পার্শ্ববর্তী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এবং নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা ছিটমহলের নির্বাচন অনুষ্ঠানে সহযোগিতা করেন। পার্শ্ববর্তী ইউনিয়নের একজন সাবেক চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে একটি নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়, যারা নির্বাচন পরিচালনা এবং নির্বাচনী ফলাফল ঘোষণা করে। এমন একটি নির্বাচনের আয়োজন করতে পেরে শালবাড়ী ছিটমহলের অধিবাসীরা নিজেদের গর্বিত মনে করে এবং এর মাধ্যমে তারা তাদের দেশে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের স্বাদ গ্রহণ করার চেষ্টা করে, যা থেকে তারা বরাবর বঞ্চিত। তবে এ নির্বাচন নিয়মিতভাবে অনুষ্ঠিত হয় না। অপেক্ষাকৃত ছোট ছিটমহলগুলোতে নির্বাচনের পরিবর্তে কাউন্সিল গঠিত হয় প্রস্তাব সমর্থনের (selection) মাধ্যমে। তারা সালিসের মাধ্যমে বিভিন্ন কলহ-বিবাদ নিষ্পত্তি করে। আর কোনো কোনো বিরোধ যদি তারা নিজেরা নিষ্পত্তি করতে ব্যর্থ হয়, তখন স্বাগতিক দেশের স্থানীয় নেতাদের সহযোগিতা নিয়ে একসঙ্গে বসে তা নিষ্পত্তি করে। শালবাড়ী ছিটমহলের অধিবাসী রহিম উদ্দিন (৬৮) ছিট কাউন্সিল সম্পর্কে বলেন:

এখানে আমাদের পুরুষ ভোটার আছে এক হাজার ৫০০ জন। আমাদের এই ছিটের ইলেকশনে মেয়েরা ভোট দিতে পারে না। কয় বছর পর পর আমরা নিজেরাই ইলেকশন করে চেয়ারম্যান, মেম্বার বানাই। ওই পরিষদ ছিটের রাস্তাঘাট ঠিকঠাক করে আর সামাজিক বিচার-আচার করে। ওই পরিষদের তো আর কোনো টাকা-পয়সা নাই, কোনো সরকারও কিছু দেয় না। এই ছিটমহলের মাঝে কয়টা ঘাট আছে, ইউনিয়ন পরিষদ ওই ঘাটগুলো বাত্সরিক ডাক দেয়। কিছু জলমহাল আছে, সেগুলো ডাক দেয়; খোঁয়াড় ডাক দেয়। এই সেই করে ইউনিয়ন পরিষদ বাত্সরিক ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা পায়। তার কিছু টাকা চেয়ারম্যান-মেম্বাররা খায়। কারণ, ওদের তো কোনো বেতন নাই। আর কিছু টাকা এখানকার রাস্তাঘাটের কাজে ব্যয় করা হয়।

স্থানীয় উন্নয়নে ছিটমহলের প্রতিবন্ধকতা

ছিটমহলগুলো উভয় দেশের স্থানীয় উন্নয়নের ক্ষেত্রেও এক-একটি অলঙ্ঘনীয় বাধা। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, দীর্ঘ প্রতীক্ষিত গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন, যেমন—রাস্তাঘাট, বিদ্যুত্ সরবরাহ, টেলিফোন সংযোগ ইত্যাদি ছিটমহলসমৃদ্ধ এলাকায় সোজাসুজি অগ্রসর হতে পারে না। কারণ, ছিটমহলের বিদেশি ভূখণ্ডের মধ্য দিয়ে স্বাগতিক দেশ কোনো উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে পারে না। মাঠপর্যায়ে গবেষণায় আরেকটি বিষয় পরিলক্ষিত হয় যে ছিটমহল দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়ে স্বাগতিক দেশের বেশ কিছু এলাকা পশ্চাদ্ভূমিতে পরিণত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, পঞ্চগড় জেলার বোদা থানায় অবস্থিত উমরখানা গ্রামের উল্লেখ করা যায়। করতোয়া নদীর পূর্ব তীরে অবস্থিত এই গ্রামটি উত্তর, পূর্ব ও দক্ষিণ দিক থেকে শালবাড়ী ছিটমহল (ভারতীয়) দ্বারা বেষ্টিত। অর্থাত্ এই গ্রামটি একদিকে নদী আর বাকি তিনদিকে ভারতীয় ছিটমহল দ্বারা পরিবেষ্টিত। এ অবস্থায় গ্রামটির সমস্যা হচ্ছে, বাংলাদেশ সরকার ভারতীয় ছিটমহলের ওপর দিয়ে উমরখানা গ্রামের সঙ্গে কোনো সংযোগ সড়ক নির্মাণ করতে পারছে না। অন্যদিকে মাত্র একটি গ্রামের মানুষের যাতায়াতের সুবিধার্থে করতোয়া নদীর ওপর বৃহত্ একটি ব্রিজ নির্মাণের জন্য বিশাল অঙ্কের টাকা ব্যয় করাও হয়তো সরকারের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। নিয়মিত কাজকর্মের জন্য এই গ্রামের মানুষের ভারতীয় ছিটমহলে অবৈধ অনুপ্রবেশ অথবা নদী পারাপারের কোনো বিকল্প নেই। ভারতীয় ছিটমহলের ছোট ছোট পথ এবং বাঁশের সাঁকোই এই গ্রামের মানুষের একমাত্র ট্রানজিট। ফলে এ গ্রামটি একটি পশ্চাদ্ভূমিতে পরিণত হয়েছে। অর্থাত্ উমরখানা গ্রামের মানুষেরাও যেন একটি ছিটমহলে আবদ্ধ।

সীমানা বেড়া: ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’

অত্যন্ত স্পর্শকাতর আরেকটি বিষয় হচ্ছে ভারতের সীমানা বেড়া। একমাত্র ইসরায়েল এবং যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো সীমানার কিছু অঞ্চল ছাড়া পৃথিবীর আর কোথাও সীমানা বেড়া নেই। পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারতই একমাত্র দেশ, যে হাজার হাজার মাইল সীমানাজুড়ে বেড়া নির্মাণ করছে। এই সীমানা বেড়া নিরপেক্ষভাবে উভয় পক্ষের যাতায়াত বন্ধ করেনি। কারণ, ভারতীয় সীমানা বরাবর কাঁটাতারের বেড়াঘেঁষে পাকা রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে এবং কিছুদূর পর পর ফটক রাখা হয়েছে, যার সার্বক্ষণিক নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বিএসএফ। ফলে দুই দেশের মধ্যে সংঘটিত আন্তসীমান্ত সন্ত্রাস এবং চোরাচালান এখন এককভাবে বিএসএফের নিয়ন্ত্রণে। এর মাধ্যমে ভারত ক্ষতিগ্রস্ত হয় এমন সব চোরাচালান বন্ধ হলেও ভারতের অনুকূলে সব চোরাচালান এখন বিএসএফের নিয়ন্ত্রণেই সম্ভব। সীমান্ত এলাকা ঘুরে জানা যায়, সীমানা বেড়া হওয়ার পর ভারত থেকে চোরাচালান হয়ে আসা পণ্যের তালিকায় বড় ধরনের পরিবর্তন হয়েছে। আগে ভারতীয় কাপড়, লবণ, চিনি ইত্যাদি চোরাচালানের শীর্ষ তালিকায় থাকলেও এখন ওই স্থান দখল করেছে ভারতীয় ফেনসিডিল, মদসহ বিভিন্ন ধরনের নেশাজাতীয় দ্রব্য। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে ভারতীয় ভূখণ্ডে গড়ে উঠেছে অসংখ্য ফেনসিডিল এবং অন্যান্য নেশাজাতীয় দ্রব্যের কারখানা। এ বিষয়গুলো এখানে বিস্তারিত আলোচনা করার সুযোগ নেই।

এখানে যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অবস্থিত ভারতীয় ছিটমহলের ভারতীয় নাগরিকদের পুনর্বাসিত না করে, তাদের কোনোরূপ নাগরিক অধিকার না দিয়ে বরং সীমানা বেড়ার মাধ্যমে তাদের রাষ্ট্র থেকে স্থায়ীভাবে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। এটি শুধু মানবাধিকার লঙ্ঘন নয়, ভারতীয় সংবিধানেরও সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এই সীমানা বেড়ার মাধ্যমে একই সঙ্গে ভারত ভূখণ্ডে অবস্থিত বাংলাদেশি ছিটমহলে বসবাসকারী বাংলাদেশের নাগরিকদেরও তাদের দেশ থেকে স্থায়ীভাবে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। তা ছাড়া সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের মাধ্যমে উভয় দেশের ছিটমহলগুলোকে স্ব-স্ব দেশ থেকে স্থায়ীভাবে বিচ্ছিন্ন করে ভারত সরকার নিজেই ছিটমহল বিনিময়ের আর কোনো বিকল্পের সম্ভাবনা রাখেনি। এর মাধ্যমে চূড়ান্তভাবে এও প্রমাণিত হয়েছে যে ছিটমহল সমস্যা সমাধানে, বিনিময়ের কোনো বিকল্প নেই।

হাসিনা-মনমোহনের দিল্লি-ঢাকা বৈঠক (২০১০/২০১১): ছিটমহল বিনিময়ে পুনশ্চ প্রহসন

আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের বাস্তবতা, ভারত-পাকিস্তান ও ভারত-চীন সম্পর্ক এবং ভারতের ‘সেভেন সিস্টার্স’-এ ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ আন্দোলন এবং এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভূকৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানের কারণে ভারতের নিরাপত্তা-ভাবনায় বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ গুণক (factor)। তাই বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারতের মূল লক্ষ্য বাংলাদেশের কাছ থেকে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’দের বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করতে না দেওয়ার নিশ্চয়তা পাওয়া এবং করিডর আদায় করা। আঞ্চলিক সহযোগিতার এই যুগে ভারতের এ উদ্দেশ্যে কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা তাদের কৌশলে। কারণ, তাদের কৌশল বন্ধুসুলভ নয়। ছিটমহল বিনিময়সহ সীমান্ত সমস্যাগুলো ঝুলিয়ে রাখার মাধ্যমে বাংলাদেশকে চাপে রেখে এই বিষয়গুলো আদায় করতে চায় ভারত, যার প্রমাণ পাওয়া যায় সাম্প্রতিক শীর্ষ বৈঠকগুলো থেকেও। ২০১০ সালের হাসিনা-মনমোহন বৈঠকের প্রাক্কালে আশা করা হয়েছিল, দুই দেশের মধ্যে বিরাজমান অমীমাংসিত সীমানা নির্ধারণসহ ছিটমহল বিনিময় কার্যকর হবে। কিন্তু এ বৈঠকে এসব বিষয় মোটেও উত্থাপিত হয়নি। পক্ষান্তরে, ভারত বাংলাদেশের কাছ থেকে কৌশলগত অনেক কিছুই অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।

দিল্লি শীর্ষ বৈঠক শেষে ২০১০ সালের ১২ জানুয়ারি প্রকাশিত যৌথ ইশতেহারের ২০ নম্বর ধারায় বলা হয়: ‘উভয় প্রধানমন্ত্রী ১৯৭৪ সালের স্থল সীমানা চুক্তির চেতনায় অমীমাংসিত স্থলসীমানা-সংক্রান্ত বিষয়সমূহ একযোগে সমাধানে সম্মত হয়েছেন এবং যৌথ সীমানা ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠক ডাকতে সম্মত হয়েছেন।’ বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক বিষয়ে যাঁদের সামান্য জ্ঞান আছে, তাঁরাও এই কূটনৈতিক ভাষার শঠতা সহজেই বুঝতে পেরেছেন। ‘একযোগে সমাধানে সম্মত হয়েছেন’—এ রকম পোশাকি ভাষার কার্যকারিতাহীন কূটনৈতিক বুলি মানুষ আগেও অনেক শুনেছে। এত চুক্তি, এত আলোচনা, এত বৈঠকের পর দুই প্রধানমন্ত্রীকে এসব সমস্যা সমাধানে নতুন করে সম্মত হতে হয়! তাঁদের এই ‘একযোগে সমাধানে সম্মত হওয়া’র মধ্য দিয়ে ছিটমহলসহ সীমানা সমস্যা সমাধানে ভারতের অনীহা এবং বাংলাদেশের ব্যর্থতা আবারও প্রমাণ হয়। কিন্তু ২০১০ সালের দিল্লি শীর্ষ বৈঠকের পর নানাভাবে সরকারের পক্ষ থেকে এমনটিই আভাস দেওয়া হয়েছিল যে মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময় বিদ্যমান অন্যান্য সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি ছিটমহল সমস্যারও সমাধান হবে। বিশেষ করে, ২০১১ সালের ঢাকা শীর্ষ বৈঠকের কয়েক মাস আগে থেকে সরকারের পক্ষ থেকে জোর দিয়ে বলা হয় যে ছিটমহল সমস্যার সমাধান করা হবে। ছিটমহল সমস্যার সমাধানের নামে কোনো কোনো ছিটমহলে যৌথ জরিপ হয়েছে। কী উদ্দেশ্যে জরিপ হয়েছে, জরিপের ফলাফল কী—তার কোনো কিছুই প্রকাশ করা হয়নি।

ধারণা করা যায়, ঢাকা শীর্ষ বৈঠককে সামনে রেখে ছিটমহল সমস্যা সমাধানের নামে যা বলা হয়েছে এবং ছিটমহল জরিপের নামে যা করা হয়েছে, তা ছিল দুই সরকারের লোক দেখানো ভাঁওতাবাজি। বাংলাদেশের জনগণকে ছিটমহল বিনিময়, তিস্তার পানি বণ্টনসহ অন্যান্য সমস্যা সমাধানের টোপ দিয়ে ভারত আসলে তার করিডর এবং নিরাপত্তা এজেন্ডা বাস্তবায়নের কূটকৌশল গ্রহণ করেছে। আর আমাদের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক দেউলিয়াত্ব ভারতকে সেই সুযোগ করে দিয়েছে। তবে সম্ভবত শেষ রক্ষা হয়নি। যতটুকু জানা গেছে, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তিস্তার পানি বণ্টন বিষয়ে আপত্তি করায় শেষ পর্যন্ত কোনো চুক্তিই স্বাক্ষরিত হয়নি। স্বাক্ষরিত হয়েছে শুধু কিছু সমঝোতা স্মারক ও প্রটোকল। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের ঐতিহ্য অনুসারে এসব সমঝোতা স্মারক ও প্রটোকলের দিনের আলো দেখার সম্ভাবনা সুদূরপরাহত। পত্রপত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছে যে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে মমতা ব্যানার্জিকে বলা হয়েছিল, তিনি যেন তাঁর আপত্তির কথা চুক্তি হওয়ার পরে উত্থাপন করেন। এটি সত্য হয়ে থাকলে মমতা ব্যানার্জি নিশ্চয়ই বাংলাদেশের মানুষকে ’৭৪-এর চুক্তির মতো আরেকটি চুক্তিভঙ্গের শিকার হওয়া থেকে বাঁচিয়ে দিলেন।

ঢাকা শীর্ষ বৈঠক-পরবর্তী যৌথ সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ‘তিনবিঘা’ করিডর ২৪ ঘণ্টা খোলা রাখার ঘোষণা দিয়েছেন মাত্র। কিন্তু মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির আর্টিকেল-১-এর ১৪ নম্বর সেকশন অনুযায়ী তিনবিঘা করিডরের ১৭৮ দ্ধ ৮৫ মিটার জায়গার ওপর বাংলাদেশের চিরস্থায়ী সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠিত। সেই অর্থে ওই করিডরের ওপর ভারতের ফটক ও যেকোনো স্থাপনা অবৈধ এবং বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন। সুতরাং, সেই ফটক কয় ঘণ্টা খোলা থাকবে তা আসলে কোনো ইস্যু নয়, ইস্যু হলো: ফটকটি অপসারিত হবে কবে?

পরিশেষ

ভৌগোলিক সান্নিধ্য, যৌথ প্রাকৃতিক সম্পদ, অবিচ্ছেদ্য আর্থসামাজিক কাঠামো এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের দিক থেকে বাংলাদেশ ও ভারত নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ হলেও এ সম্পর্ক এখন আস্থার সংকটে নিমজ্জিত। জাতিরাষ্ট্রের ধারণায় সম্ভবত কোনো প্রতিবেশীই প্রকৃত বন্ধু নয়। শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানই কেবল কাম্য, যা ইউরোপে দেখা যায়। কিন্তু ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তি পাওয়া এ অঞ্চলে এই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান থাকেনি ঔপনিবেশিক শাসনের কুফলজনিত কারণেই। ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার রাষ্ট্রগুলো আসলে স্মৃতি-বিস্মৃতির মধ্য দিয়ে এখনো ’৪৭-কেই উদ্যাপন করছে। এ কারণেই হয়তো ভারতের মতো এত বৃহত্ একটি দেশ বাংলাদেশের মতো একটি ছোট প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে ছিটমহল সমস্যার মতো ছোটখাটো সীমান্ত সমস্যাসমূহ জিইয়ে রাখার নীতি এখনো পরিত্যাগ করতে পারেনি। বাংলাদেশের প্রতি ভারতের প্রতিবেশীসুলভ বদান্যতা এখন সম্ভবত শূন্যের কোঠায়। নদীসন্ত্রাসের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক নদীর ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত করে বাংলাদেশকে মরুকরণের দিকে ঠেলে দেওয়ার নিষ্ঠুর বাস্তবতায় ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের মধ্যে বন্ধুত্ব কতটুকু, তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কটি আসলে আবেগ বা ঐতিহ্য দিয়ে নয়, বাস্তবতার নিরিখে যৌক্তিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন, যার সামর্থ্য বাংলাদেশ এখনো অর্জন করতে পারেনি। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর কোনো কোনোটি বিরোধী দলে গেলে অযথাই অতিমাত্রায় ভারত-বিদ্বেষী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। আবার মুজিব-ইন্দিরা সম্পর্কের হিস্টিরিয়ায় আক্রান্ত কেউ কেউ ‘দাদা’ বলতে অস্থির। আসলে বাংলাদেশের উচিত সরকারি দল, বিরোধী দল-নির্বিশেষে ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে কূটনৈতিক পেশাদারির সঙ্গে পরিচালনা করা। বর্তমান যুগ আঞ্চলিক সহযোগিতার যুগ। সুতরাং পারস্পরিক সহযোগিতার যেসব ক্ষেত্র চিহ্নিত হয়েছে, বাংলাদেশের উচিত সেসব ক্ষেত্রে ভারতকে সহযোগিতা করা। একই সঙ্গে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ন্যায্য হিস্যাগুলো বুঝে নিতে হবে। কারণ, ভারতকে আগে সুবিধা দিলে পরে বাংলাদেশেরটা যে আর সহজে পাওয়া যায় না, তারই উত্কৃষ্ট উদাহরণ হলো বিদ্যমান ছিটমহল সমস্যা ও মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি।

ছিটমহল বিনিময়ের লক্ষ্যে স্বাক্ষরিত মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি বাংলাদেশের দিক থেকে বাস্তবায়িত হলেও ভারতের চুক্তিভঙ্গের কারণে তা কার্যকর হচ্ছে না। ফলে বাংলাদেশ ও ভারতের ছিটমহলে বসবাসকারী হাজার হাজার অসহায় মানুষ সব ধরনের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে মানবেতরভাবে বন্দী জীবন যাপন করছে। ছিটমহল সমস্যার সমাধান জাতীয় স্বার্থের দিক থেকে তেমন কোনো স্পর্শকাতর বিষয় নয়। ইস্যুটি জিইয়ে রেখে কোনো দেশ লাভবান হচ্ছে, তা-ও নয়। অথচ সাত দশক ধরে অমীমাংসিত থেকে ছিটমহল সমস্যা একটি মানবিক সংকটে পরিণত হয়েছে। নেহরু-পরবর্তী সময়ে ভারতের রাজনীতিবিদেরা কখনো মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে ছিটমহল সমস্যার সমাধানে ইতিবাচক কোনো ভূমিকা রাখেননি; বরং তাঁরা ছিটমহল ইস্যুটি দলীয় রাজনীতির স্বার্থে ব্যবহার করেছেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, ১৯৯২ সালে ভারতের কংগ্রেস সরকার যখন ‘তিনবিঘা’ করিডরের মাধ্যমে দহগ্রাম-আঙ্গরপোতাকে বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে সংযুক্ত করে দেয়, তখন ভারতের প্রধান বিরোধী দল বিজেপি তীব্রভাবে এর বিরোধিতা করে। তারা এর বিরুদ্ধে পশ্চিমবঙ্গে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করে এবং ২৬ জুনকে ‘তিনবিঘা প্রতিবাদ দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে। ভারতে বাম রাজনীতির কিংবদন্তি জ্যোতি বসুর সরকার দীর্ঘদিন পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতায় থাকলেও ছিটমহলের মানুষগুলোর মুক্তির জন্য কেন কিছু করলেন না, তা-ও অবাক করার মতো বিষয়।

নূন-নেহরু চুক্তি হওয়ার পর ভারতের অতিমাত্রার জাতীয়তাবাদীরা, যাঁরা দেশ বেচে দেওয়ার অভিযোগ তুলে ছিটমহল বিনিময় ঠেকিয়েছিলেন, যাঁরা মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির বিরুদ্ধে অর্থহীন আইনি লড়াই করেছেন, যাঁরা চুক্তিভঙ্গের খলনায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন এবং এখনো যাঁরা সক্রিয় আছেন—তাঁদের কাছে ভূমিই কি কেবল সার্বভৌমত্ব ও জাতীয়তাবাদের অংশ? দেশের মানুষেরা, সংবিধানসিদ্ধ নাগরিকেরা কি সার্বভৌমত্ব ও জাতীয়তাবাদের অংশ নয়? আধুনিক রাষ্ট্রের কাছে, জাতীয়তাবাদের কাছে, সর্বোপরি মানুষের কাছে কিসের মূল্য বেশি—এক ফালি জমি, নাকি একটি নিষ্পাপ শিশু? তা ছাড়া ভারতের সর্বোচ্চ আদালত তো দীর্ঘ পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর বলেই দিয়েছেন যে ছিটমহল বিনিময়ে সংবিধান লঙ্ঘিত হবে না, সার্বভৌমত্বের কোনো ক্ষতি হবে না। অথচ এখনো যখন আন্তরাষ্ট্রীয় চুক্তি এবং এ-সংক্রান্ত আদালতের নির্দেশনা অমান্য করে, সংবিধান দ্বারা স্বীকৃত হাজার হাজার নাগরিককে তাদের অধিকার বুঝিয়ে না দিয়ে উল্টো সীমানা বেড়া দিয়ে তাদের স্থায়ীভাবে স্বদেশ-ভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়, তখন কি সংবিধান ও সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘিত হয় না?

ছিটমহলের মানুষ সব ধরনের নাগরিক অধিকার থেকে যুগ যুগ ধরে বঞ্চিত! এই সভ্য সমাজের মানুষেরা শত শত নিরপরাধ মানুষের এই বন্দিদশা আর কত দিন অগ্রাহ্য করবে? আজ যে শিশুটির অধিকারবিহীন জন্ম হলো ভারত কিংবা বাংলাদেশের ছিটমহলে, তার অপরাধ কী? তাকে যদি সারা জীবন বন্দিদশায় কাটাতে হয়, তাহলে মানবতার প্রতি মানুষের দায়িত্ববোধ কোথায়? ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল সমস্যা যতটা না রাষ্ট্রীয়, গত সাত দশকে তার চেয়ে অনেক বেশি মানবিক সংকটে পরিণত হয়েছে। তাই এ সংকট সমাধানে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত জরুরি এবং মানবাধিকারের প্রশ্নে ছিটমহল ইস্যুটি আন্তর্জাতিক আদালত পর্যন্ত যেতে পারে। কারণ, এ সংকটের আশু সমাধান শত শত জীবনের দাবি।

সর্বশেষ ঢাকা শীর্ষ বৈঠকে ছিটমহল বিনিময়ে একটি প্রটোকল স্বাক্ষরিত হয়েছে মাত্র। এর মধ্য দিয়ে ছিটমহল সমস্যা সমাধানে ভারতের অনীহা ও কালক্ষেপণ এবং বাংলাদেশের ব্যর্থতা আবারও প্রমাণ হলো। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে যে ছিটমহল বিনিময়ে আর কোনো বাধা নেই এবং শিগগিরই তা কার্যকর করা হবে। কোনো কোনো দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি আবার ছিটমহলকে ‘অতীত’ বলতেও ছাড়েননি। অথচ ছিটমহলগুলোতে কার্যত কোনো পরিবর্তন আসেনি এবং সেখানকার মানুষের আন্দোলন-কর্মসূচিও অব্যাহত আছে। মুজিব-ইন্দিরা চুক্তিকে আলোচনায় না রেখে এবং কোনো প্রকার চুক্তি ছাড়াই শুধু প্রটোকল স্বাক্ষরের মাধ্যমে ছিটমহল কীভাবে ‘অতীত’ হয়ে গেল, তা বোধগম্য নয়। মনে রাখা দরকার, মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি বাংলাদেশের সংবিধানের তৃতীয় সংশোধনী দ্বারা অনুসমর্থিত এবং বাংলাদেশ কর্তৃক বাস্তবায়িত। এ চুক্তিটি ভারতেও সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক বৈধ ঘোষিত। সুতরাং, এ চুক্তি বাস্তবায়ন না করে একই বিষয়ে অন্য যেকোনো চুক্তি হবে বেআইনি। তা ছাড়া ছিটমহল সমস্যা সমাধানে মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি বাস্তবায়ন করাটাই নিরাপদ। কারণ, নতুন যেকোনো চুক্তি নতুন করে বৈধতার চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কেন মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি বাস্তবায়নের দাবি করা হচ্ছে না, সেটিই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।

পাদটীকা

১. বাংলাদেশ ভূখণ্ডে অবস্থিত ভারতীয় ছিটমহলে এই সমীক্ষা পরিচালনা করা সহজ হলেও ভারতে অবস্থিত বাংলাদেশি ছিটমহলে তা সম্ভব হয়নি। সীমান্তের খুব কাছাকাছি অবস্থিত কয়েকটি বাংলাদেশি ছিটমহলের কয়েকজন বাংলাদেশি নাগরিকের নিবিড় সাক্ষাত্কার (indepth interview) গ্রহণ করা, যার ভিত্তিতে উভয় দেশের ছিটমহলের মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থা তুলে ধরা হয়েছে।

২.The theory of learned helplessness provides a model for explaining depression, a state characterized by a lack of affect and feeling. Depressed people became that way because they learned to be helpless. They learned that whatever they did is futile. See for details, Martin E. P. Seligman Presentation at the Technology, Entertainment & Design Conference, Feb 2004, University of Pennsylvania

http://en.wikipedia.org/wiki/Learned_helplessness; accessed 30/07/10.

৩. কথ্য ইতিহাস; সাক্ষাত্কার—আবু বকর সরকার, আবদুর রাজ্জাক মাস্টার (ডাকুয়া) এবং অন্যান্য, কোটভাজনী ছিটমহল, চিলাহাটি, ডোমার, নীলফামারী।

৪. বিস্তারিত দেখুন, http://en.wikipedia.org/wiki/Sir_Cyril_Radcliffe, accessed 01/07/10. (এ তথ্যসূত্রটির বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করা সম্ভব হয়নি। তথাপি এ-সংক্রান্ত আরও গবেষণার পথ নির্দেশ করতেই এ তথ্যসূত্রটি ব্যবহার করা হলো।)

৫. ভারতে অবস্থিত বাংলাদেশি ছিটমহলের অধিবাসী রাজেন্দ্র বর্মণসহ অন্যদের স্থানীয় লোক মারফত বাংলাদেশ সীমান্তে ডেকে এনে সীমানা পিলারের খুব কাছাকাছি বসে সাক্ষাত্কার গ্রহণ করা হয়েছে।

৬. ‘‘Royal History : Some Statements/Facts’, website of the Cooch Behar District, http://coochbehar.nic.in/Htmfiles/royal_history2.html; accessed 22/5/2010.

৭. ছিটমহলের পূর্ণাঙ্গ তালিকাসহ বিস্তারিত দেখুন, Brenden R. Whyte (2002), “The Cooch Behar Enclaves of India and Bangladesh: An Historical Overview and Determination of their Number, Areas and Population” in Oriental Geographer, vol. 46, No. 2, pp. 17-44. ‰es M. G. Rabbani (2007), ‘Statelessness in South Asia : Living in Bangladesh-India Enclave’ in I. Ahmed (ed) Theoretical Perspectives, Centre for Alternatives, v-12 & 13.

৮. Govt. of East Bengal, Department of Home (Political), ‘B’ Proceedings. CR 3C2-5/50 (2237- 2255), March 1953, vol. 15, (NAB).

তথ্যসূত্র

Unpublished Records
Govt. of East Bengal & Govt. of Pakistan, Home Department (Political)
Confidential Records (CR), ‘B’ proceedings, vol. 1-56, (National Archives of Bangladesh). 
Proceedings of Chhitmohal Nagorik Committee & Public Meeting, 26 January 1972.
Manifesto of the Chhitmohal Nagorik Committee, 26 January 1972.
Records of the Chhitmohal Nagorik Committee & Chhit Councils.
Contemporary Records of the Local Administration of Bangladesh Government.

Oral History Transcripts
Indepth interview of some inhabitants of the both Bangladeshi and Indian enclaves. 
Interview of some leaders of the Chhitmohal Nagorik Committee.
Life histories of 22 inhabitants of several enclaves (both Bangladeshi and Indian).

Published Records
Fazl, A. (1873), Ain-I-Akbari; vol. 1-3, Calcutta, Madrasa.
Firminger, W. K. (Ed) 1812, Affairs of the East India Company (Being the Fifth Report from the Select Committee of the House of Commons, 28th July 1812), vol. 1, Neeraj Publishing House, Delhi.
Fraser, L. (1911), India Under Carzon & After, London.
Khan, N. I. (1990), Bangladesh District Gazetteers, Rangpur, Bangladesh Governor Press, Dacca.
Hunter, W. W. (1876), A Statistical Account of Bengal, Districts of Maldah, Rangpur and Dinajpur; vol. 8, Trubner & Co. London. 
Hunter, W. W. (1876), A Statistical Account of Bengal, Districts of Darjiling, and Jalpaiguri, and State of Kuch Behar; vol. 10, Trubner & Co. London.
Husain, S. I. (1908), Final Report on The Survey and Settlement of Four Private Estates in the District of Rangpur, 1903-1907; East Bengal and Assam Secretariat Press.
Siddiqui, A. (1972), Bangladesh District Gazetteers, Dinajpur, Bangladesh Governor Press, Dacca.

Census Reports
BBS (1993), Bangladesh Population Census 1991, Community Series Panchagarh Statistics Division, Dhaka.
BBS (1995), Bangladesh Population census 1991, Community Series (Nilphamari, Lalmonirhat & Kurigram) Statistics Division, Dhaka.
MHKA (1961), Census of Pakistan Population, vol. 2, East Pakistan.
MHKA (1961), Population Census of Pakistan, Dinajpur; Parts 1-5. 
PGP (1951), Census of Pakistan, vol. 3 & 8.

প্রকাশিত গ্রন্থ ও প্রবন্ধ (বাংলা)

আলম, এম. (২০০৪), ‘দহগ্রাম কাঁদছে: বাংলাদেশীরা জাগো’, যায়যায়দিন, ২৯ জুন।

আহমেদ, এস. ইউ. (সম্পা.), (১৯৯৬), দিনাজপুর: ইতিহাস ও ঐতিহ্য, বাংলাদেশ ইতিহাস সমিতি, ঢাকা।

ইসলাম, এস. এ. (১৯৯৬), বাংলা অঞ্চলের ইতিহাস, প্যাপিরাস, ঢাকা।

এলাহী, এম. ও রহমান, এম. এস. (১৯৯২), ‘বাংলাদেশের ছিটমহল’, ভূগোল পত্রিকা, নং ১১, ভূগোল বিভাগ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

ওং ঝা, ডি. আর. (২০০৪), ‘আন্তর্জাতিক আদিবাসী দশক, বাংলাদেশের আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী ও মানবাধিকার’, প্রথম আলো, ৪ নভেম্বর।

কামাল, এম., চট্টোপাধ্যায়, আই. ও নাসরিন, জেড. (সম্পা.), (২০০১), নিজভূমে পরবাসী: উত্তরবঙ্গের অদিবাসীদের প্রান্তিকতা ডিসকোর্স, আর. ডি. সি, ঢাকা।

খান চৌধুরী, এ. এ. (১৯৩৬), কোচবিহারের ইতিহাস, কোচবিহার স্টেট প্রেস।

চট্টোপাধ্যায়, বি. (১৯৯৩), দেশবিভাগ: পশ্চাত্ ও নেপথ্য কাহিনী, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা।

ভদ্র, গৌতম ও চট্টোপাধ্যায়, পার্থ (সম্পা.), (১৯৯৮), নিম্নবর্গের ইতিহাস, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা।

মণ্ডল, গৌতম (২০০৫), ‘ছিটমহল ফলোআপ’, নিউজ নেটওয়ার্ক।

মুহাইমেন, এম. এ. (১৯৯৪), ইতিহাসের আলোকে দেশ বিভাগ ও কায়েদ-এ-আযম জিন্নাহ্, পাইওনিয়ার প্রেস লিমিটেড ঢাকা।

রহিম, এম. এ. (১৯৮২), বাংলার সামাজিক সাংস্কৃতিক ইতিহাস ১৫৭৬-১৭৫৭, দ্বিতীয় খণ্ড, বাংলা একাডেমী, ঢাকা।

রহিম, এম. এ., চৌধুরী, এ. এম., মাহমুদ, এ. বি. এম ও ইসলাম, এস. (সম্পা.), (১৯৭৭), বাংলাদেশের ইতিহাস, নওরোজ কিতাবিস্তান, ঢাকা।

রায়চৌধুরী, এল. (১৯৯৯), ক্ষমতা হস্তান্তর ও দেশবিভাগ, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা।

শ্বাসমল, বি. (১৯৮১), ভারত কি করে ভাগ হল, তিনসঙ্গী, কলকাতা।

সেন, বি. (২০০৪), ‘প্রান্তজনের কথা’, প্রথম আলো, ১৪ এপ্রিল।

Published books and articles (English)

Ahmed, I. (1993), State & Foreign Policy, India’s Role in South Asia; Academic Publishers, Dhaka.
Ahmed, I. (2006), ‘Bangladesh India Relations: The Context of SAARC and the Emerging Global Scenario’ (keynote paper presented at the seminar held at CIRDAP, organized by CDRB.
Ahmed, I. U. & Bhasin, A. S. (eds.), (2003), India-Bangladesh Relations Documents 1971-2002, vol. 4, Geetika Publishers, New Delhi.
Akhtar, S. (1999), ‘Administration of Sylhet Under The Nawabs’, in : Ahmed, S. U. (eds.) Sylhet, History and Culture; Bangladesh Itihas Samiti, Dhaka.
Akhtar, S. (1982), The Role of The Zamindars in Bengal 1707-1772; Asiatic
 Society Bangladesh, Dacca.
Annandale, C. (ed), (reprint 1990) The Modern Cyclopedia of Universal Information, vol. 3, Akashdeep Publishing House, Delhi.
Azad, A. K. (1959), India Wins Freedom, An Autobiographical Narrative; Oriented Longman Ltd. New Delhi.
BIDS (2001), Fighting Human Poverty, Bangladesh Human Development
Report 2000; Bangladesh Govt. & UNDP. 
CDA, (2001), ‘Problems of Chhitmohal and Adverse Possession’, Proceedings of the Symposium, Calcutta, 14 -15 Sept.
Chatterji, J. (1994), Bengal Divided, Hindu Communalism and Partition 1932-1947, Cambridge University Press, UK.
Chatterji, J. (1999), ‘The Fashioning of Frontier: The Radcliffe Line and Bengal’s Border Landscape, 1947-52’, in: Modern Asian Studies; vol. 33, Part 1.
Eaton, R. M. (1994), The Rise of Islam and the Bengal Frontier 1204-1760; Delhi. Hamza, E. L. (1944), Pakistan A Nation, (3rd ed.), Lahore.
Hanks, P. (1971), Encyclopedic World Dictionary; The Hamlyn Publishing Group Limited, London.
Haq, M. A. (1999), ‘Slow Progress in Land Demarcation. Settlement of Enclave Issue to Ease Border Tension’, in : The Daily Star; 3 October.
Heward, Edmund (1994), The Great and the Good: A Life of Lord Radcliffe, Chichester. 
Husain, S. A. (1995), ‘Ethnicity and Security of Bangladesh’, in : Iftekharuzzaman (ed), South Asia’s Security Primacy of Internal Dimension; Vikash Publishing House.
Islam, S. (ed), (2003), Banglapedia, National Encyclopedia of Bangladesh, vol. 3, Asiatic Society of Bangladesh, Dhaka.
Kalam, A. (ed), (1992), Bangladesh, South Asia And The World, Academy Publishers, Dhaka.
Karmaker, K. (2005), ‘Indian enclaves in 2 districts ‘safe havens’ for criminals, Large scale hemp cultivation in enclaves in Dinajpur, Panchagarh’, in : The Daily Star, 8 June, Dhaka.
Khan, A. R. (1976), India Pakistan Bangladesh, Sindabad, Dacca.
Khilnani, Sunil (1999), The Idea of India, Penguin Books, New Delhi.
Neilson, W. A. (1934), Webester’s New International Dictionary; Northampton, MASS.
Philips, C. H. & Wainwright, M. D. (eds), (1970), The Partition of India. Policies and Perspectives 1935-1947, George Allen And Unwin Ltd., London.
Raza, S. H. (ed), (1989), Mount Batten And The Partition of India; Atlantic Publishers & Distributors, New Delhi.
Sen, A. K. (2001), ‘Tales of Nowhere People’, presented at the Symposium on ‘Problems of Chhitmohal and Adverse Possession’, Centre For Development Activities, Calcutta, 14-15 Sept. 
Sen, B. & Hulme, D.(eds), (2006), The State of the Poorest 2005/2006, Chronic Poverty in Bangladesh, Tales of Ascent, Descent, Marginality and Persistence, BIDS & CPRC. 
Sills, D. L. (ed), (1968) International Encyclopedia of the Social Sciences; vol. 5. The Macmillan Company & The Free Press, USA.
Spate, O. H. K. (1947), ‘The Partition of the Punjab and of Bengal’, The Geographical Journal, Vol. 110, No. 4/6 (October-December 1947), pp. 201-218. 
Spate, O. H. K. (1948), ‘The Partition of India and Prospects of Pakistan’, in : Geographical Review; vol. 38.
Tarafdar. M. R. (1965), Husain Shahi Bengal, 1495-1538; University of Dhaka.
Van Schendel, W. (2002), ‘Stateless in South Asia : The Making of India-Bangladesh Enclaves’, in : The Journal of Asian Studies, February 2002.
Van Schendel, W. (2001), ‘Working Through Partition : Making a Living in the Bengal Border-lands’, in : International Review of Social History; 6 (2001), pp. 393-421.
Whyte, B. R. (2002), ‘The Cooch Behar Enclaves of India and Bangladesh : An Historical Overview And Determination of Their Number, Area And Population’, in: Oriental Geographer; vol. 46, No. 2, Dhaka.