ছিটমহল বিনিময়: পেছনের কাহিনি ও সামনের চ্যালেঞ্জ

সারসংক্ষেপ

ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ১৯৭৪ সালে স্বাক্ষরিত ঐতিহাসিক স্থলসীমা চুক্তিটি দীর্ঘ ৪১ বছর পর ২০১৫ সালের মে মাসে ভারতের পার্লামেন্টের অনুসমর্থন পেল। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বিদ্যমান অচিহ্নিত সীমানা চিহ্নিতকরণ, অপদখলীয় ভূমি হস্তান্তর ও ছিটমহল বিনিময়সহ সীমান্ত সমস্যা নিরসনের লক্ষ্যে এই চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। বাংলাদেশ সে বছরই চুক্তিটি পার্লামেন্টে অনুসমর্থন করে এবং তা বাস্তবায়ন করে। কিন্তু সেই অনুসমর্থনের কাজটি করতে ভারত সরকার ৪১ বছর সময় ব্যয় করল। এই দীর্ঘ সময়ে ছিটমহলগুলোতে সৃষ্টি হয় মানবিক সংকট। ছিটমহল সমস্যার সমাধান জাতীয় স্বার্থের দিক থেকে কোনো দেশের জন্যই তেমন কোনো স্পর্শকাতর বিষয় ছিল না। ছিটমহল বিনিময়ের মাধ্যমে কোনো দেশেরই ক্ষতির কিছু ছিল না। সমস্যাটি জিইয়ে রেখে কোনো দেশ লাভবান হয়েছে, তা-ও নয়। তাহলে কেন এই বিলম্ব? স্থলসীমা চুক্তির অনুসমর্থন শেষ পর্যন্ত কীভাবে সম্ভব হলো? ছিটমহল বিনিময়ে দ্বিপক্ষীয় চ্যালেঞ্জগুলো কী? ছিটমহলের মানুষদের সংকটগুলো কী এবং তাদের পুনর্বাসনের চ্যালেঞ্জগুলো কী? এই প্রশ্নগুলোরই উত্তর খোঁজা হয়েছে এই পর্যবেক্ষণমূলক গবেষণা প্রবন্ধে।

মূখ্য শব্দগুচ্ছ: ছিটমহল বিনিময়, স্থলসীমা চুক্তি, ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, অনুসমর্থন।

প্রারম্ভিক কথা

অবশেষে ১৯৭৪ সালে স্বাক্ষরিত ঐতিহাসিক স্থলসীমা চুক্তিটি দীর্ঘ ৪১ বছর পর ২০১৫ সালের মে মাসে ভারতের পার্লামেন্টের অনুসমর্থন পেল। স্থলসীমা চুক্তি অনুসমর্থন-সংক্রান্ত ভারতের সংবিধানের এই ১০০তম সংশোধনীটি বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক এবং বিশেষ করে বাংলাদেশ-ভারত ছিটমহল বিনিময়ের ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক। কারণ, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বিদ্যমান সীমান্ত সমস্যা নিরসন ও ছিটমহল বিনিময়ের মতো বিষয়গুলো ৪১ বছর ধরে স্থলসীমা চুক্তির অনুসমর্থনের অপেক্ষায় ছিল। উল্লেখ্য, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সীমান্ত সমস্যা নিরসনের লক্ষ্যে ১৯৭৪ সালের ১৬ মে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয় Agreement on the demarcation of land boundary between Bangladesh and India, যা সংক্ষেপে Land Boundary Agreement বা স্থলসীমা চুক্তি নামে পরিচিত। চুক্তিটি ১৯৭৪ সালেই বাংলাদেশের পার্লামেন্টের অনুসমর্থন পায় এবং বাংলাদেশ সরকার ত্বরিতগতিতে চুক্তির অধীনে বাংলাদেশের করণীয় সম্পন্ন করে, যা পরবর্তী সময়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। উল্লেখ্য, এই দীর্ঘ সময়ে ছিটমহলে আবদ্ধ থাকা শত শত মানুষের জীবনে যে বঞ্চনার ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছে, তার সার্বিক বিবেচনায় ছিটমহল সমস্যা শুধু একটি আন্তরাষ্ট্রীয় সমস্যার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই; এটি এখন একটি মানবিক সংকট। ১৯৪৭ সালে সমগ্র ভারতবর্ষের মানুষ যখন ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তি লাভ করে, তখন রাতারাতি ছিটমহলের মানুষদের নাগরিকত্ব হরণ করা হয়েছিল। সিরিল র্যাডক্লিফের সীমানা নির্ধারণের কুচিন্তাপ্রসূত প্রক্রিয়ায় তারা হয়ে যায় ‘নিজভূমে পরবাসী’। কারণ, তারা ছিটমহল নামের বিচ্ছিন্ন ভূখণ্ডগুলোতে আবদ্ধ হয়ে যে দেশে আটকা পড়ে, সে দেশ তাদের নয়! সে দেশে তারা ‘ভিনদেশি’। আর আইনত তারা যে দেশের নাগরিক, সে দেশের সঙ্গে তাদের কোনো যোগাযোগ বা সম্পর্ক নেই। তাই তারা রাষ্ট্র ও নাগরিকত্বহীন মানুষ। ভারত-বাংলাদেশের ছিটমহলের শিশুদের নাগরিক পরিচয় নিয়ে স্বাধীনভাবে বড় হওয়ার অধিকার প্রদানের দায়িত্ব—বাংলাদেশ বা ভারত—কোনো রাষ্ট্রই এড়াতে পারে না। অথচ গত প্রায় সাত দশকে ছিটমহলগুলোতে যাদের জন্ম হয়েছে, তারা কেউই কোনো রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব পায়নি। কোনো রাষ্ট্রের কোথাও তারা নেই। এই ‘নেই মানুষ’দের পরিচয় হলো ‘ছিটের লোক’। সব ধরনের রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা ও মানবাধিকার থেকে তারা বঞ্চিত; সমাজ, রাষ্ট্র তথা ছিটমহলের বাইরের সমগ্র পৃথিবী থেকে তারা বিচ্ছিন্ন।

বাংলাদেশের লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, পঞ্চগড় ও নীলফামারী জেলার সীমান্ত এলাকা এবং ভারতের কোচবিহার ও জলপাইগুড়ি জেলার সীমান্ত এলাকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা, পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন ছিটমহলগুলো যেন একেকটি স্থলবেষ্টিত দ্বীপ। আয়তনের দিক থেকে বড় কয়েকটি ছিটমহলে সর্বোচ্চ ১০ থেকে ১৫ হাজার লোকের বসবাস। অধিকাংশ ছিটমহলে লোকের সংখ্যা কয়েক শ বা তার চেয়েও কম। আবার কোনো কোনো ছিটমহলে মাত্র দুই থেকে তিনটি পরিবারের বসবাস। এই অল্পসংখ্যক মানুষের বসতিবিশিষ্ট আবদ্ধ ছিটমহলগুলো একেকটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বতন্ত্র সমাজ। এমনকি এক ছিটমহলের সঙ্গে অন্য কোনো ছিটমহলেরও কোনো সম্পর্ক নেই। সবকিছু থেকে তারা বিচ্ছিন্ন ও বঞ্চিত।

১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর ১৯৫০-এর দশকেই ছিটমহল বিনিময়ে ভারত-পাকিস্তান উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল এবং ১৯৫৮ সালে শীর্ষ পর্যায়ে একটি চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়েছিল। কিন্তু সেটি বাস্তবায়িত হয়নি, যার পেছনে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিই দায়ী ছিল। ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ফলে ছিটমহল সমস্যাটি বাংলাদেশের ওপর বর্তায় আর পাকিস্তান ছিটমহল সমস্যা থেকে অব্যাহতি লাভ করে। কারণ, ছিটমহল ছিল শুধু তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানে যা বর্তমান বাংলাদেশ।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার অল্প সময়ের মধ্যেই বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যে স্থলসীমা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, তাতে ছিটমহল বিনিময়ের সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত হয়। স্থলসীমা চুক্তি স্বাক্ষরের ছয় মাসের মধ্যে বাংলাদেশ সরকার সংবিধানের তৃতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে চুক্তিটি অনুসমর্থন করে ত্বরিতগতিতে তা বাস্তবায়ন করে। কিন্তু সেই অনুসমর্থনের কাজটি করতে ভারত সরকার ৪১ বছর সময় ব্যয় করল। এই ৪১ বছরে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে ঘটেছে অসংখ্য অপ্রীতিকর ঘটনা আর ছিটমহলের মানুষদের জীবনে ঘটে গেছে নাগরিক ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের এক দীর্ঘ অধ্যায়, যা মানবসভ্যতার ইতিহাসে বিরল। অবশ্য যেমনটি আগেই বলেছি, ছিটমহলবাসীর মানবেতর জীবনযাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের মধ্য দিয়েই। সেই হিসাবে ভারতের পার্লামেন্টে স্থলসীমা চুক্তি অনুসমর্থনের মধ্য দিয়ে প্রকৃতপক্ষে ছিটমহলবাসীর জীবন থেকে ৬৮ বছরের একটি অন্ধকার যুগের অবসান ঘটতে যাচ্ছে, যেখানে তাদের না ছিল কোনো রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রীয় পরিচয়; না ছিল খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিত্সা, শিক্ষার মতো মৌলিক অধিকারসহ কোনো প্রকার মানবিক অধিকার; না ছিল জীবনের নিরাপত্তা। ছিটমহল বিনিময়ের মাধ্যমে সব ধরনের অধিকারবঞ্চিত ছিটমহলের অসহায় নারী, পুরুষ ও শিশুদের মুক্তির আয়োজন করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এমন একটি কাজ করলেন, যা ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকবে। অবশেষে ছিটমহল বিনিময় হতে যাচ্ছে দেখে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের ‘আই হ্যাব আ ড্রিম’ বক্তব্যের একটি লাইন বারবার মনে পড়েছে: ‘Now is the time to make justice a reality for all of God's children.’ (এখন সময় হলো সৃষ্টিকর্তার সব সন্তানের জন্য ন্যায়বিচারকে বাস্তবতায় পরিণত করা)।

ছিটমহল সমস্যা: ঔপনিবেশিক বাঁটোয়ারার কুফল

ছিটমহলগুলোর প্রাথমিক উত্পত্তি আরও আগে এবং বিচিত্রভাবে হলেও ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের উত্পত্তির সময় থেকেই সেগুলোর বর্তমান অবস্থা সৃষ্টি হয়। লর্ড মাউন্টব্যাটেনের নির্দেশনায় সিরিল র্যাডক্লিফ১ মাত্র ৭৪ দিনে (৩ জুন থেকে ১৪ আগস্ট) যেভাবে ভারতবর্ষের মতো একটি বিশাল দেশ ও বিশাল জনগোষ্ঠীকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের সঙ্গে দ্বিখণ্ডিত করেন, তাতে মানুষের সুবিধা-অসুবিধা বা ভবিষ্যত্ বিবেচিত হয়নি। লাখ লাখ মানুষের জীবনের সঙ্গে জড়িত সীমানাভাগের মতো এত স্পর্শকাতর, জটিল, বিতর্কিত ও বিশাল কাজটি করা হয়েছিল সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা ছাড়াই। সীমানা নির্ধারণ-সংক্রান্ত কোনো অভিজ্ঞতাও কাজে লাগানো হয়নি। সীমানা কমিশনের ‘টার্মস অব রেফারেন্স’-এ র্যাডক্লিফকে ‘সংলগ্ন সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা’র (contiguous majority areas) ওপর ভিত্তি করে সীমানা আঁকার নির্দেশনা দেওয়া হয়; আবার ‘অন্যান্য বিষয়’ও (other factors) বিবেচনা করতে বলা হয়, যা প্রকৃত প্রস্তাবে সীমানা নির্ধারণের কাজকে দুরূহ করেছিল। কারণ, ‘contiguous’, ‘areas’, ‘other factors’—এই পদগুলো ছিল অসংজ্ঞায়িত। এবং যেহেতু কমিশনের হিন্দু ও মুসলমান সদস্যদের মধ্যে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতায় পৌঁছানোর মতো কোনো পরিবেশ ছিল না, সেহেতু র্যাডক্লিফ একক সিদ্ধান্তে যা করেছেন, তারই ফলাফল হলো ছিটমহলসহ ভারত-বাংলাদেশ ও ভারত-পাকিস্তানের মাঝে বিদ্যমান বহুবিধ সীমান্ত সমস্যা।

বাস্তবতাবিবর্জিত র্যাডক্লিফ সীমানারেখা সীমান্ত অঞ্চলের জনজীবনকে সবদিক থেকেই চরমভাবে ব্যাহত করে। কৃষক ও কৃষি শ্রমিকের অর্থনৈতিক জীবনে নেমে আসে এক মহাবিপর্যয়। অনেকের বসতভিটা পড়ে এক দেশে আর চাষের জমি বা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান পড়ে আরেক দেশে। ফলে দেশভাগ-পরবর্তী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বাস্তবতায় সেই মানুষগুলো বসতভিটা আগলে রাখবে না চাষের জমি বা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আগলে রাখবে, তা নিয়ে ভয়ংকর এক উভয় সংকটের মুখোমুখি হয়। এবং তাদের এ-সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে রাতের আঁধারে। কারণ, তখন দাঙ্গার হাত থেকে জীবন বাঁচানোই ছিল কঠিন। তা ছাড়া নিকটতম প্রতিবেশীরা, যারা যৌথ পেশায় নিয়োজিত ছিল অথবা জীবিকার জন্য একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল ছিল, তারা রাষ্ট্রীয় সীমানারেখা দ্বারা রাতারাতি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। আর সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী বিপর্যয় নেমে আসে ছিটমহলের মানুষদের জীবনে। কারণ, ছিটমহলগুলোকে রাষ্ট্রীয় সীমানার বাইরে রাখার ফলে ছিটমহলের বাসিন্দারা এক দেশের নাগরিক হয়েও আবদ্ধ হয়ে পড়ে অন্য দেশে।

সীমানারেখা চাপিয়ে দিয়ে যে মানুষগুলোকে রাতারাতি ভাগ করে ফেলা হয়েছিল, বিচ্ছিন্ন করা হয়েছিল স্থাবর সম্পত্তি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, কর্মসংস্থান এবং পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্ক থেকে, জীবনের প্রয়োজনেই তাদের সীমানার এপার-ওপার যাওয়া-আসা অব্যাহত ছিল দেশভাগের পরেও। কিন্তু পরস্পর বৈরী রাষ্ট্র দুটির কর্ণধারেরা সাধারণ মানুষের জীবনের প্রয়োজনে সে যাওয়া-আসা মেনে নেয়নি। ফলে সীমান্তে শুরু হয় ভারতের বিএসএফ ও পাকিস্তানের রেঞ্জার্সের সশস্ত্র পাহারা। জীবনের তাগিদে এপার-ওপার করা মানুষের ওপর শুরু হয় সশস্ত্র সীমান্তরক্ষী বাহিনীর নির্যাতন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। আরও পরে ভারতের পক্ষ থেকে সীমান্তে নির্মাণ করা হয় বিপজ্জনক কাঁটাতারের বেড়া। এভাবেই উভয় রাষ্ট্রের সীমান্ত অঞ্চলে অবস্থিত ছিটমহলগুলো নিজ নিজ রাষ্ট্র থেকে সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।

ছিটমহল বিনিময়ে ভারত-পাকিস্তান উদ্যোগ

১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তানের জন্মই হয়েছিল পরস্পরের সঙ্গে দ্বন্দ্ব ও সাম্প্রদায়িক সংঘাতের মধ্য দিয়ে। দেশভাগ-পরবর্তী রক্তক্ষয়ী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বাস্তবতায় দক্ষিণ বেরুবাড়ী ও দহগ্রাম-আঙ্গরপোতার মালিকানা নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানে তীব্র উত্তেজনা শুরু হয়। শুরু থেকেই পাকিস্তান সরকার র্যাডক্লিফ রোয়েদাদ অনুযায়ী ভারত অধিকৃত দক্ষিণ বেরুবাড়ীর মালিকানা দাবি করে ভারতের ওপর ক্রমাগত চাপ প্রয়োগ করছিল। বিষয়টি আন্তর্জাতিক আদালতে নিয়ে যাওয়ার হুমকিও পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে ছিল। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দক্ষিণ বেরুবাড়ী ও দহগ্রাম-আঙ্গরপোতায় সংঘটিত দাঙ্গার প্রভাবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-পরিস্থিতির অবনতি হলে ছিটমহল ইস্যুটি উভয় দেশের রাজনৈতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। পরিস্থিতি সামাল দিতে ১৯৫৮ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু পাকিস্তানের তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী ফিরোজ খান নুনের সঙ্গে ছিটমহলসহ (পরিবেষ্টিত এলাকা) বিদ্যমান অন্যান্য সীমান্ত সমস্যা নিয়ে বৈঠকে বসেন। সে বৈঠকে স্বাক্ষরিত হয় Agreement between India and Pakistan on Border Disputes (East Pakistan) যা সংক্ষেপে নেহরু-নুন চুক্তি হিসেবে পরিচিত। এই চুক্তির ১০ নম্বর সিদ্ধান্তে ছিটমহল বিনিময় সম্পর্কে বলা হয় যে, Exchange of old Cooch Behar enclaves in Pakistan and Pakistan enclaves in India without claim to compensation for extra area going to Pakistan is agreed to.২ (পাকিস্তানে ভারতের পুরোনো কোচবিহারের ছিটমহলগুলো এবং ভারতে পাকিস্তানের ছিটমহলগুলো বিনিময়ে ঐকমত্য হলো, পাকিস্তান যে বাড়তি জায়গা পাবে, তার জন্য কোনো ক্ষতিপূরণ দাবি ছাড়াই।) অর্থাত্ ভারতের ভূখণ্ডে অবস্থিত পাকিস্তানের সব ছিটমহল ভারতের কাছে হস্তান্তর করা এবং পাকিস্তানের ভূখণ্ডে অবস্থিত ভারতের সব ছিটমহল পাকিস্তানের কাছে হস্তান্তর করার সিদ্ধান্ত হয় এবং ছিটমহল বিনিময়ের ফলে পাকিস্তান যে বাড়তি জায়গা পাবে, তার জন্য কোনো ক্ষতিপূরণ দিতে হবে না। আর ১২ নম্বর দক্ষিণ বেরুবাড়ী ইউনিয়নকে দুই দেশের মধ্যে সমান দুই ভাগে ভাগ করার সিদ্ধান্ত হয়। অর্থাত্ দক্ষিণ বেরুবাড়ীকে উত্তর-দক্ষিণ দুই ভাগে ভাগ করার এবং দক্ষিণ অংশ পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে আর উত্তর অংশ ভারতের সঙ্গে যুক্ত করার সিদ্ধান্ত হয়। চুক্তির ৩ নম্বর সিদ্ধান্তে দক্ষিণ বেরুবাড়ী সম্পর্কে বলা হয়,

This will be so divided as to give half the area to Pakistan and the other half adjacent to India being retained by India. The division of Berubari Union No. 12 will be horizontal starting from the North East corner of Debigang thana. The Division should be made in such a manner that the Chooch Behar enclaves between Panchagar thana of West Bengal will remain connected as at present with Indian territory and will remain with India. The Chooch Behar enclaves lower down Boda thana of East Pakistan and Berubari union No. 12 will be exchanged along with the general exchange of enclaves and will go to Pakistan.৩

এই চুক্তি বাস্তবায়িত হলে দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা ভারতের সঙ্গে যুক্ত হতো আর দক্ষিণ বেরুবাড়ীর দক্ষিণ অংশ পূর্ব পাকিস্তান তথা আজকের বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্ত হতো। কিন্তু চুক্তিটি বাস্তবায়িত হয়নি। কারণ, পশ্চিমবঙ্গের পার্লামেন্ট দক্ষিণ বেরুবাড়ী বিভক্তির বিরোধিতা করে এবং এর ফলে নেহরু-নুন চুক্তিটি ভারতে একটি স্পর্শকাতর রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হয়। পশ্চিমবঙ্গ পার্লামেন্টের এই বিরোধিতা বেঙ্গল কংগ্রেসের মুসলিম লিগবিরোধী মানসিকতার ধারাবাহিকতা বলেই মনে হয়। এমন পরিস্থিতিতে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার যদিও দক্ষিণ বেরুবাড়ীর দক্ষিণ অংশ পাকিস্তানকে সমর্পণের জন্য ১৯৬০ সালে সংবিধানে একটি সংশোধনী এনেছিল কিন্তু তখন তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। কারণ বিরোধী দল থেকে নেহরু-নুন চুক্তিকে অসাংবিধানিক আখ্যা দেওয়া হয় এবং সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে ওই চুক্তির বিরুদ্ধে আদালতে বেশ কিছু মামলা হয়। ১৯৭১ সালে ভারতের সর্বোচ্চ আদালত যখন ওই চুক্তির বিরুদ্ধে করা মামলা খারিজ করেন, তখন বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ চলছিল। ফলে তখন নেহরু-নুন চুক্তি বাস্তবায়নের সময় বা সুযোগ কোনোটিই ছিল না। ভারত-পাকিস্তানের ছিটমহলগুলোর সবই ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থিত ছিল। তাই ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মধ্য দিয়ে ভারত-পাকিস্তান ছিটমহলগুলো ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহলে পরিণত হয় এবং এই সমস্যাটি বাংলাদেশের ওপর এসে বর্তায়। অতএব দেখা যাচ্ছে যে ১৯৫৮ সালে স্বাক্ষরিত নেহরু-নুন চুক্তি যদি বাস্তবায়িত হতো তাহলে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ছিটমহল বলে কিছু থাকত না।

ছিটমহল ইস্যুতে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি

১৯৪৭-৭১ সময়ে ভারত-পাকিস্তান ছিটমহল সমস্যার সমাধান হয়নি শীর্ষ পর্যায়ে চুক্তি হওয়া সত্ত্বেও। আর স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ১৯৭৪ সালে স্বাক্ষরিত স্থলসীমা চুক্তিটি ভারতের পার্লামেন্টের অনুসমর্থন পেতে সময় লাগল ৪১ বছর। ২০১৫ সালের মে মাসে ভারতের পার্লামেন্টে স্থলসীমা চুক্তি অনুসমর্থিত হওয়ার পর যদিও ছিটমহল বিনিময়ের দিনক্ষণ সব ঠিক হয়ে গেছে, তবু ছিটমহল বিনিময় ও ছিটমহলের মানুষদের পুনর্বাসনের পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হতে আরও ঠিক কতটা সময় লাগবে, তা সময়ই বলে দেবে। কারণ, আমি যতটুকু বুঝি, ছিটমহল বিনিময়-প্রক্রিয়ার আগামী পর্বগুলো সম্পন্ন হবে দুই দেশের আমলা ও কূটনীতিকদের হাত দিয়ে। আর এই দুই দেশের কূটনীতি ও আমলাতন্ত্রে কাঠিন্য ও কালক্ষেপণের যে সংস্কৃতি চালু আছে, তাতে ছিটমহল বিনিময়-প্রক্রিয়া যেকোনো পর্যায়ে বিলম্ব হতে পারে। তবে আশার কথা এই যে চার দশকেরও বেশি সময় অতিবাহিত হওয়ার পর এই ইস্যুতে ভারতের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে অনেক বেশি দৃঢ় মনে হচ্ছে। এটি শেষ অবধি অব্যাহত থাকলে নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হবে বলে আশা করা যায়।

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ছিটমহল সমস্যার সমাধান না হওয়ার পেছনে পাকিস্তান আমলে পাকিস্তান যেমন দায়ী ছিল না, বাংলাদেশও দায়ী নয়। পাকিস্তান সরকার যেমন এই সমস্যা সমাধানে যৌক্তিক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল, বাংলাদেশ সরকারও প্রয়োজনীয় কাজ সম্পন্ন করেছিল অত্যন্ত ত্বরিতগতিতেই। কিন্তু এই সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে বরাবরই বাধা সৃষ্টি করেছে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি। ১৯৫৮ সালের নেহরু-নুন চুক্তি এবং ১৯৭৪ সালের মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি পর্যবেক্ষণ করলে এ বিষয়টি পরিষ্কার হয়। নেহরু ও ইন্দিরা-পরবর্তী ভারতীয় কোনো রাজনীতিক ছিটমহল ইস্যুটি মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিবেচনা করেছেন বা এই সমস্যা সমাধানে যৌক্তিক কোনো ভূমিকা রেখেছেন, এমন কোনো নজির নেই। বাম রাজনীতির কিংবদন্তি জ্যোতি বসুর সরকার দুই যুগ পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতায় থাকলেও ছিটমহলের মানুষদের মুক্তির লক্ষ্যে তিনি কোনো পদক্ষেপ নেননি। অথচ ছিটমহল বিনিময়ে ভারতের দায়-দায়িত্ব ছিল পরিষ্কার। প্রথমত, শীর্ষ পর্যায়ে স্বাক্ষরিত দুটি চুক্তি; স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর ১৯৫৮ সালের চুক্তিটি অকার্যকর হয়ে গেলেও, ১৯৭৪ সালের চুক্তিটি বাংলাদেশের পার্লামেন্টে অনুসমর্থিত এবং বাংলাদেশ কর্তৃক চুক্তিটি যথাযথভাবে বাস্তবায়িত। সুতরাং আন্তর্জাতিক নীতিমালা অনুযায়ী ভারত এই চুক্তি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে বাধ্য। দ্বিতীয়ত, ছিটমহল বিনিময় ও এ-সংক্রান্ত চুক্তিগুলোর সঙ্গে ভারতের জাতীয় নেতা জওহরলাল নেহরু ও ইন্দিরা গান্ধীর রাজনৈতিক অঙ্গীকার জড়িত।

প্রকৃত প্রস্তাবে, ভারতের রাজনীতিকেরা ছিটমহল ইস্যুটিকে তাঁদের ভোটের রাজনীতির ঘুঁটিতে পরিণত করেছিলেন। বাংলাদেশের ‘অনুপ্রবেশকারী’র কাল্পনিক সংখ্যা যেমন তাদের ভোটের রাজনীতির একটি অন্যতম উপাদান। বিশেষ করে জাতীয় নির্বাচনের সময় হলেই ‘অনুপ্রবেশকারী’দের কাল্পনিক সংখ্যা দাঁড় করিয়ে ভারতের কোনো কোনো রাজনৈতিক দল ভোটের রাজনীতি শুরু করে। ভারতীয় জনতা পার্টিই (বিজেপি) এ ধরনের রাজনীতির সবচেয়ে বড় পৃষ্ঠপোষক। এবং বিজেপি শুরু থেকেই ছিটমহল বিনিময়েরও বিরোধী ছিল। যদিও শেষ পর্যন্ত নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন সেই বিজেপি সরকারই স্থলসীমা চুক্তি পার্লামেন্টে অনুসমর্থন করে ছিটমহল বিনিময়ের পদক্ষেপ গ্রহণ করল। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ১৯৯২ সালের ২৬ জুন তত্কালীন কংগ্রেস সরকার যখন বাংলাদেশকে তিনবিঘা করিডর প্রদান করে দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা ছিটমহলকে বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে সংযুক্ত করে দিয়েছিল, তখন বিজেপি এর তীব্র বিরোধিতা করেছিল। তিনবিঘা করিডর প্রদানের বিরুদ্ধে পশ্চিমবঙ্গ বিজেপি প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করে এবং ২৬ জুনকে ‘তিনবিঘা প্রতিবাদ দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে। তাদের সঙ্গে ছিল আরেক রাজনৈতিক দল ফরোয়ার্ড ব্লক।

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি শুরু থেকেই ছিটমহল বিনিময়ের বিরোধিতা করে আসছিলেন। ছিটমহল বিনিময়কে তিনি বামফ্রন্ট সরকার কর্তৃক টাটা কোম্পানিকে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামে জমি প্রদানের সঙ্গে তুলনা করে একই রকম ভোটের রাজনীতি শুরু করেছিলেন। উল্লেখ্য, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের বামফ্রন্ট সরকার কর্তৃক পূর্ব মেদিনীপুরের সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামে টাটা কোম্পানিকে জমি প্রদানের বিরুদ্ধে এক রক্ত ঝরানো আন্দোলনের মধ্য দিয়েই ৩৪ বছর পশ্চিমবঙ্গ শাসন করা বামফ্রন্টকে হটিয়ে তিনি ২০১১ সালে প্রথমবারের মতো ক্ষমতায় এসেছিলেন। এবং তাঁর অমত ও অনুপস্থিতির কারণেই ২০১১ সালের ঢাকা শীর্ষ বৈঠকে বহুল প্রতীক্ষিত তিস্তার পানিবণ্টন ইস্যুর যেমন কোনো সুরাহা হয়নি, তেমনি ছিটমহল সমস্যারও কোনো সুরাহা হয়নি।

ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস যদিও কখনো ছিটমহল বিনিময়ের বিরোধিতা করেনি কিন্তু দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও তারা সময়মতো ছিটমহল বিনিময়ে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। কংগ্রেস সরকার আন্তরিকতা ও দৃঢ়তার সঙ্গে চাইলে ছিটমহল সমস্যা শুরুতেই সমাধান করা যেত। ১৯৭৪ সালের স্থলসীমা চুক্তি তো সে বছরই বাস্তবায়িত হওয়ার কথা ছিল। এবং সেটি যে সম্ভব ছিল, তা বাংলাদেশ সরকার মাত্র ছয় মাসের মধ্যে ওই চুক্তি অনুসমর্থন ও বাস্তবায়ন করে প্রমাণ করেছে। এ কথা জোর দিয়েই বলা যায় যে বাংলাদেশে এটি সম্ভব হয়েছিল যেমন রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও দৃঢ়তার কারণে, তেমনি ভারতে এটি সম্ভব হয়নি রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও দৃঢ়তার অভাবে। সুতরাং ছিটমহল বিনিময় বিলম্বিত হওয়ার পেছনে কংগ্রেসও দায় এড়াতে পারে না।

২০১১ সালে কংগ্রেস সরকারের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময় ছিটমহল বিনিময়ে কংগ্রেস সরকারকে দৃশ্যত তত্পর দেখালেও এই ইস্যুর অন্যমত পক্ষ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সঙ্গে যথাযথভাবে আলাপ-আলোচনা করা হয়নি বলেই জানা যায়। যে কারণে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির মনমোহন সিংয়ের সফরসঙ্গী হওয়ার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত তিনি তাঁর সফরসঙ্গী হননি। ফলে বাংলাদেশের মানুষের কাছে অতি আশার ঢাকা শীর্ষ বৈঠক অতি অকৃতকার্যতায় পর্যবসিত হয়। এই সফরে তিস্তার পানিবণ্টন ও ছিটমহল বিনিময়ের বিষয়ে কোনো সুরাহা না হওয়ার জন্য সংবাদমাধ্যমগুলোয় মমতা ব্যানার্জিকেই দায়ী করা হয়। যদিও তিস্তার পানিবণ্টন ইস্যুতে—যা ২০১৫ সালের ঢাকা শীর্ষ বৈঠকেও এজেন্ডাভুক্ত হয়নি মমতা ব্যানার্জির আপত্তির কারণেই—তাঁর দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। কিন্তু ২০১১ সালে ছিটমহল বিনিময় না হওয়ার দায় শুধু তাঁর ওপর চাপানো ঠিক হবে না। কারণ, তখন পর্যন্ত স্থলসীমা চুক্তি ইস্যুতে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মপরিকল্পনা সঠিক ছিল না বলেই মনে হয়। কারণ, ভারত সরকারের পক্ষ থেকে সীমান্তের অনিষ্পন্ন বিষয়গুলো একটা একটা করে পর্যায়ক্রমে নিষ্পন্ন করার ইচ্ছা ছিল। সে কারণেই হয়তো স্থলসীমা চুক্তিটি পাশ কাটানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। কারণ, যেহেতু স্থলসীমা চুক্তিতে ছিটমহল বিনিময়, সীমানা চিহ্নিতকরণ ও অপদখলীয় ভূমি হস্তান্তরসহ সব সমস্যা একসঙ্গে সমাধান করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং চুক্তিটি বাংলাদেশ কর্তৃক বাস্তবায়িত সেহেতু এই চুক্তি পাশ কাটানো ছাড়া সীমান্তের অনিষ্পন্ন বিষয়গুলো আলাদাভাবে নিষ্পন্ন করার সুযোগ নেই। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, তিনবিঘা করিডর নিয়ে ১৯৮২ ও ১৯৯২ সালে আলাদাভাবে দুটি ইজারা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল স্থলসীমা চুক্তিকে পাশ কাটিয়েই। ২০১১ সালে মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময়ও ভারত সরকার সে চেষ্টাই করেছে। এর পেছনেও কাজ করেছে নির্বাচনী রাজনীতি। কিন্তু এ বিষয়ে বাংলাদেশের অনমনীয় অবস্থানের কারণে তা সম্ভব হয়নি। ফলে ছাপা হওয়া প্রস্তাবিত প্রটোকলে শেষ পর্যন্ত হাতে লিখে ঘষামাজা করে স্বাক্ষর করে দুই দেশ।৪ এসব কারণেই হয়তো তখনো পর্যন্ত ভারতের পার্লামেন্টে স্থলসীমা চুক্তির অনুসমর্থনের বিষয়টি কংগ্রেস সরকার বিবেচনা করেনি। অথচ সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে স্থলসীমা চুক্তি ভারতের পার্লামেন্টে অনুসমর্থন ছাড়া ছিটমহল বিনিময়ের কোনো সুযোগ ছিল না। এই দ্বিপক্ষীয় চুক্তির অধীনে বাংলাদেশের যা করণীয় ছিল, বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৪ সালেই তা যথাযথভাবে সম্পন্ন করে এবং দক্ষিণ বেরুবাড়ীর দক্ষিণ অংশ ভারতকে ছেড়ে দেয়। সুতরাং এই চুক্তিটি ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময়ের ক্ষেত্রে অকাট্য ও অলঙ্ঘনীয় আন্তর্জাতিক দলিল।

২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর ছিটমহল ইস্যুতে বিজেপি যেমন অবস্থান পরিবর্তন করে, তেমনি ২০১৫ সাল নাগাদ মমতা ব্যানার্জির মনোভাবেরও পরিবর্তন হয়। যার ফলে অবশেষে স্থলসীমা চুক্তিটি ভারতের পার্লামেন্টে অনুসমর্থিত হয়েছে এবং ছিটমহল বিনিময়ের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তবে সর্বশেষ ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির আসাম শাখা স্থলসীমা চুক্তি নিয়ে নতুন করে ভোটের রাজনীতি শুরু করেছিল। স্থলসীমা চুক্তি পাস হলে ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিতব্য আসামের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি ভোট হারাতে পারে—এই ভয় দেখিয়ে আসাম বিজেপির সভাপতি সিদ্ধার্থ ভট্টাচার্য কেন্দ্রীয় সরকারকে আসামকে বাদ দিয়ে স্থলসীমা চুক্তি বাস্তবায়নে প্রভাবিত করেছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের আনন্দবাজার পত্রিকা  (১৭ এপ্রিল ২০১৫) ‘বিজেপির আপত্তিতে আপাতত নেই অসম’ শীর্ষক খবরে লিখে, ‘২০১৬ সালে অসমের বিধানসভা নির্বাচনের কথা মাথায় রেখেই সে রাজ্যের বিজেপি শাখার দাবি মেনে নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে স্থলসীমা চুক্তিটি আংশিকভাবে রূপায়ণ করার নতুন ভাবনাচিন্তা চলছে।...রাজ্য নেতৃত্বের সর্বশেষ হিসাব, এই চুক্তি হলে ভরাডুবি হবে বিজেপির। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে অসমের ১৪টি আসনের মধ্যে সাতটি আসন জিতে বিজেপি ইতিমধ্যেই সেখানে ক্ষমতার গন্ধ পেয়ে গিয়েছে। তাদের ভোটের শতকরা হারও যথেষ্ট ভালো (৫৬ দশমিক ৫ শতাংশ)। সে রাজ্যের সাম্প্রতিক পুর [পৌরসভা] নির্বাচনেও জিতেছে বিজেপি। ফলে আগামী বিধানসভা নির্বাচনে রাজ্য দখল করাটা স্বাভাবিকভাবেই অগ্রাধিকার পাচ্ছে।’ আসাম বিজেপির চাপে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা আসামকে বাদ দিয়ে স্থলসীমা চুক্তি অনুসমর্থনের অনুমোদনও দিয়েছিল। খবরটি বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমগুলোয় ফলাও করে প্রচার হয় এবং ছিটমহল বিনিময় আন্দোলনের নেতারাসহ সংশ্লিষ্ট সবাই এতে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। কিন্তু এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে কোনো কূটনৈতিক তত্পরতার খবর পাওয়া যায়নি। উপরন্তু বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন যে আসামকে বাদ দিয়ে স্থলসীমা চুক্তি বাস্তবায়নে ভারতের কাছ থেকে কোনো প্রস্তাব এলে বাংলাদেশ তা বিবেচনা করতে পারে।৫ পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর এই মন্তব্য ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে—বিষয়বস্তু না বুঝেই—আগ বাড়িয়ে আত্মসমর্পণের একটি উদাহরণ।

ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কারণে আসামকে বাদ দিয়ে স্থলসীমা চুক্তি অনুসমর্থনের এই তত্পরতায় ছিটমহল বিনিময়ে দীর্ঘসূত্রতার নতুন আরেকটি অধ্যায় শুরু হতে যাচ্ছিল। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণেই আসামকে বাদ দিয়ে স্থলসীমা চুক্তি বাস্তবায়ন করা সম্ভব ছিল না। কারণ, ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের সংবিধান সংশোধন করে এই চুক্তিটি অনুসমর্থন করা হয়েছে। তা ছাড়া এই চুক্তিটি ভারতের সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃক বৈধ ঘোষিত। একটি দ্বিপক্ষীয় চুক্তি এক দেশ কর্তৃক সংবিধান সংশোধন করে বাস্তবায়ন করার পর আরেক দেশ চাইলেই তাতে এককভাবে কোনো পরিবর্তন আনতে পারে না। সিদ্ধার্থ ভট্টাচার্য অবশ্য আরেকটি উদ্ভট প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তা হলো, আসামে অবস্থানকারী বাংলাদেশের ৬০ হাজার ‘অনুপ্রবেশকারী’কে যদি বাংলাদেশ সরকার ফিরিয়ে নেয় তবে ’৭৪-এর স্থলসীমা চুক্তি বাস্তবায়িত হতে পারে।৬ এটি ছিল একজন রাজনীতিকের বাস্তবতাবিবর্জিত দায়িত্বজ্ঞানহীন একটি মন্তব্য। অনুপ্রবেশকারী কারা, তার কোনো গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা নেই, আসামে বাংলাদেশের অনুপ্রবেশকারী আদৌ আছে কি নেই, থাকলে কত আছে, তার কোনো গ্রহণযোগ্য উত্তর নেই—এমন একটি বিতর্কিত ও অবস্তুনিষ্ঠ রাজনৈতিক ইস্যুর সঙ্গে জড়ানো হলো বহুল আলোচিত স্থলসীমা চুক্তিকে, যা বাংলাদেশ সরকার ৪১ বছর আগে সংবিধান সংশোধন করে বাস্তবায়ন করেছে এবং যার সঙ্গে ছিটমহলের হাজার হাজার নারী, পুরুষ ও শিশুর জীবন জড়িত। ছিটমহল নিয়ে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এই পর্যন্ত নেমেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নরেন্দ্র মোদির প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে কৌশলগত সুসম্পর্ক স্থাপনের বৃহত্তর কর্মসূচি আর বিরোধী দল হিসেবে কংগ্রেসের গঠনমূলক ভূমিকার কারণে আসাম বিজেপির ভোটের রাজনীতি হালে পানি পায়নি। ফলে সব ধরনের জল্পনা-কল্পনা ও ৪১ বছরের অবসান ঘটিয়ে নরেন্দ্র মোদির সরকার স্থলসীমা চুক্তি পার্লামেন্টে অনুসমর্থন করেছে এবং ১০০তম সংশোধনীর মাধ্যমে ছিটমহল বিনিময়ের ক্ষেত্রে এত দিন পর্যন্ত অলঙ্ঘনীয় মনে হওয়া বাধাটি অতিক্রম করেছে। এ ক্ষেত্রে আসামের মুখ্যমন্ত্রী তরুন গগৈও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে চিঠি লিখে সীমান্ত বিল থেকে আসামকে বাদ না দেওয়ার অনুরোধ করেন।৭

নরেন্দ্র মোদির সরকার যে বিষয়গুলো সামনে এনে স্থলসীমা চুক্তি অনুসমর্থনের বিষয়ে শরিকদের সমর্থন আদায়ে সমর্থ হয়, তা-ও ছিটমহল নিয়ে ভারতের রাজনীতির চিত্রই তুলে ধরে। যে বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়েছিল তা হলো: ১. স্থলসীমা চুক্তি পাস করানো না গেলে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হবে যাদের আন্তরিক সহযোগিতায় বিগত বছরগুলোয় ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল শান্ত রয়েছে। ২. স্থলসীমা চুক্তি পাস না করা পর্যন্ত সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ সম্পন্ন করা যাবে না ৩. বিলটি পাস হলে সীমান্তে অনুপ্রবেশ ঠেকানো সহজ হবে; এবং ৪. এই বিলের সব দায় কংগ্রেসের ঘাড়ে বর্তাবে; আসামের ভোটারদের বোঝানো যাবে যে কংগ্রেসের কারণেই আসামকে বাদ দিয়ে স্থলসীমা চুক্তি পাস করানো যায়নি। এসব বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছার পরই ৪ মে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার বৈঠকে স্থলসীমা চুক্তিটি হুবহু পার্লামেন্টে উত্থাপন ও অনুসমর্থনের অনুমোদন দেওয়া হয়।৮ কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় সীমান্ত চুক্তিটি হুবহু অনুমোদনের পর আসাম বিজেপির সভাপতি তাঁর প্রতিক্রিয়ায় সংবাদমাধ্যমে জানিয়েছিলেন, ‘আমাদের আর কোনো দায় থাকল না। আসামকে রেখে বিল পাসের ভালো-মন্দের সব দায় এখন মুখ্যমন্ত্রী তরুন গগৈর। আসামবাসীর কাছে তাকেই জবাবদিহি করতে হবে।’৯ স্থলসীমা চুক্তি নিয়ে এমন রাজনৈতিক মনোভাবকে ইঙ্গিত করেই আনন্দবাজার পত্রিকা (৫ মে ২০১৫) আসামসহ সীমান্ত বিল অনুসমর্থনের পুনঃসিদ্ধান্তের যে খবর ছেপেছিল, তার শিরোনাম ছিল: ‘কংগ্রেসের ঘাড়ে বন্দুক রেখে অসম থাকছেই চুক্তিতে।’ এভাবেই ছিটমহল বিনিময়ের মতো একটি মানবিক ইস্যু নিয়ে ভারতে ভোটের রাজনীতি অব্যাহত ছিল ১৯৫৮ সালে নেহরু-নুন চুক্তি স্বাক্ষরের পর থেকে ২০১৫ সালে ’৭৪-এর স্থলসীমা চুক্তি ভারতের পার্লামেন্টে অনুসমর্থনের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত। এবং অবশেষে স্থলসীমা চুক্তিটি অনুসমর্থনের মধ্য দিয়েই সেই রাজনীতির অবসান হয়। 

স্থলসীমা চুক্তি অনুসমর্থনে ভারত সরকারের বিলম্বিত উদ্যোগ

১৯৭৪ সালে স্বাক্ষরিত স্থলসীমা চুক্তিকে চ্যালেঞ্জ করে বাংলাদেশের আদালতে মামলা হয়েছিল। তবে বাংলাদেশ সরকার দ্রুততম সময়ের মধ্যে মামলাটি নিষ্পত্তি করে। মামলার রায়ে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট ওই চুক্তি বাস্তবায়নের আগে জাতীয় সংসদে অনুসমর্থন করানোর নির্দেশ দিলে বাংলাদেশ সরকার ত্বরিতগতিতে ১৯৭৪ সালের ২৮ নভেম্বর তৃতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে চুক্তিটি সংসদে অনুসমর্থন করে এবং দক্ষিণ বেরুবাড়ীর দক্ষিণ অংশ ভারতকে হস্তান্তর করে। কিন্তু দক্ষিণ বেরুবাড়ীর দক্ষিণ অংশের দখল বুঝে নেওয়ার পর থেকে এই চুক্তির বাকি অংশ বাস্তবায়নে ভারতের অনীহা দেখা দেয়। অর্থাত্ এই চুক্তির অধীনে দক্ষিণ বেরুবাড়ীর দক্ষিণ অংশের দখল বুঝে নেওয়ার পর, এর বিনিময়ে দহগ্রাম-আঙ্গরপোতার জন্য তিনবিঘা করিডর প্রদান এবং ছিটমহল বিনিময়ের প্রসঙ্গে অত্যন্ত অন্যায্য ও বেআইনিভাবে ভারত এই চুক্তির বিষয়ে অনাগ্রহী হয়ে ওঠে। ভারতেও তিনবিঘা করিডর প্রদানের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে মামলা হয়। সেই মামলার অজুহাত দেখিয়ে ভারত সরকার স্থলসীমা চুক্তিটি তখন পার্লামেন্টে উত্থাপন করেনি। দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে চলা সেই মামলার রায়ে ১৯৯০ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট তিনবিঘা করিডর প্রদানের মাধ্যমে ভারতের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘনের অভিযোগকে একটি “non issue” বলে মামলাটি খারিজ করে দেয়। তারপরেও স্থলসীমা চুক্তিটি পার্লামেন্টে উত্থাপন ও অনুসমর্থন করতে ভারত সরকার ২৫ বছর বিলম্ব করেছে।

দ্বিতীয়বারের মতো সরকার গঠনের পর আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ২০১০ সালের ভারত সফরকালে ছিটমহল বিনিময়ের বিষয়টি দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় গুরুত্ব পায়। এরপর ২০১১ সালে ভারতের তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরকে সামনে রেখে ছিটমহল বিনিময়ের বিষয়ে দৃশ্যত তোড়জোড় শুরু হয়। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আশা করা হয়েছিল যে ঢাকা শীর্ষ বৈঠকে ছিটমহল বিনিময় কার্যকর হবে। আশ্বাস মিলেছিল ভারতের পক্ষ থেকেও। মনমোহনের সফরের আগ দিয়ে বিনিময়ের উদ্দেশ্যে ছিটমহলগুলোয় যৌথ জরিপও হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ২০১১ সালের ঢাকা শীর্ষ বৈঠকে ’৭৪-এর স্থলসীমা চুক্তি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে শুধু একটি প্রটোকল স্বাক্ষরিত হয়েছিল।

ভারতের কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকার ২০১৩ সালে স্থলসীমা চুক্তিটি অনুসমর্থনের চেষ্টা করলেও বিজেপির বিরোধিতার কারণে তা সম্ভব হয়নি। ২০১৪ সালে ভারতের রাজনৈতিক পালাবদলের ফলে ক্ষমতায় আসে বিজেপি। বিজেপি শুরু থেকেই ছিটমহল বিনিময়ের বিরোধিতা করে এলেও নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে সরকার গঠনের পর ছিটমহল বিনিময় ইস্যুতে তারা তাদের অবস্থান পরিবর্তন করে এবং ২০১৫ সালে স্থলসীমা চুক্তিটি অনুসমর্থনের উদ্যোগ গ্রহণ করে।

যেভাবে অনুসমর্থন পেল স্থলসীমা চুক্তি

২০১৫ সালের জুন মাসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরকে সামনে রেখে স্থলসীমা চুক্তি অনুসমর্থনের বিষয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার তত্পর হয়। এই বিলটি যেহেতু ২০১৩ সালে পার্লামেন্টে উত্থাপিত হয়েছিল এবং এই চুক্তি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ২০১১ সালে একটি প্রটোকলও স্বাক্ষরিত হয়েছিল, তাই এ নিয়ে বিজেপি সরকারের তেমন কোনো কাজ ছিল না। এ-সংক্রান্ত সব প্রস্তুতি সম্পন্নই ছিল। শুধু পার্লামেন্টে উত্থাপন ও অনুসমর্থনের লক্ষ্যে শরিক দল ও বিরোধী দলগুলোর কাছ থেকে সমর্থন আদায় করাই ছিল বিজেপি সরকারের কাজ। ২০১৫ সালের এপ্রিল মাসে শুরু হওয়া ভারতের পার্লামেন্টের বাজেট অধিবেশনে স্থলসীমা চুক্তিটি অনুসমর্থনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। কিন্তু আসামে স্থলসীমা চুক্তি বিলের বিরোধিতা শুরু হয়, যা আগেই আলোচিত হয়েছে। সেই বিরোধিতা আবার কোনো বিরোধী দলের পক্ষ থেকে নয়, সরকারি দল আসাম বিজেপির পক্ষ থেকেই। তাই আসামকে বাদ দিয়েই এই চুক্তি বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেয় কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা। কিন্তু কংগ্রেস এতে আপত্তি জানিয়ে এর বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নেয়। কারণ, কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকারই প্রথম ২০১৩ সালে এই চুক্তিটি অনুসমর্থনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল, যা বিজেপির বিরোধিতার কারণে সম্ভব হয়নি। তাই কংগ্রেস স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয় যে কংগ্রেস সরকার যেভাবে ২০১৩ সালে স্থলসীমা বিলটি অনুসমর্থন করতে চেয়েছিল, হুবহু সে রকম না হলে তারা ওই বিলের বিরোধিতা করবে। আসামের মুখ্যমন্ত্রী তরুন গগৈও স্থলসীমা চুক্তি থেকে আসামকে বাদ দেওয়ার তীব্র বিরোধিতা করেন। এ অবস্থায়, যেহেতু বিলটি পাস করানোর মতো রাজ্যসভায় দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা বিজেপির ছিল না, সেহেতু কংগ্রেসের দাবি মেনে নেওয়া ছাড়া বিজেপি সরকারের আর কোনো উপায় ছিল না। আর চলতি অধিবেশনে বিলটি পাস করতে না পারলে সরকার সমস্যায় পড়ত। কারণ, পরবর্তী মাসেই নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত ছিল। আর নরেন্দ্র মোদির সফরে বাংলাদেশের চাওয়াগুলোর মধ্যে প্রধান দুটি ছিল তিস্তার পানিবণ্টন ও ছিটমহল বিনিময়। তিস্তার পানিবণ্টনের অনিশ্চয়তা সম্পর্কে নরেন্দ্র মোদি ওয়াকিবহাল ছিলেন। এ অবস্থায় স্থলসীমা চুক্তিটিও অনুসমর্থন করানো না গেলে তাঁর বাংলাদেশ সফরটি অনিশ্চয়তার মুখে পড়ত। এ অবস্থায়, বিজেপি সরকার কংগ্রেসের দাবি মেনে নিয়েই স্থলসীমা চুক্তি অনুসমর্থনের উদ্যোগ গ্রহণ করে।

২০১৫ সালের ৫ মে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা স্থলসীমা চুক্তিটি হুবহু অনুসমর্থনের অনুমোদন দেওয়ার পর ৬ মে সীমান্ত বিলটি রাজ্যসভায় উত্থাপিত হয় এবং সব অনিশ্চয়তা কাটিয়ে সর্বসম্মতিক্রমে তা পাস হয়। রাজ্যসভার ১৮১ সদস্যের সবাই এর পক্ষে ভোট দেয়। আনন্দবাজার পত্রিকা, (৭ মে ২০১৫) স্থলসীমা বিল পাসের খবরে লেখে: ‘ঘড়ির কাঁটা তখন সাড়ে চারটা ছুঁই ছুঁই। ভারত-বাংলাদেশ স্থলসীমা চুক্তি নিয়ে ভোটাভুটি শেষ। ফলাফল ফুটে উঠেছে রাজ্যসভার স্কোরবোর্ডে। ডেপুটি চেয়ারম্যান পি জে কুরিয়েন আবেগঘন কণ্ঠে বলেই ফেললেন, নতুন ইতিহাস তৈরি হলো আজ।’ সত্যিই এটি একটি নতুন ইতিহাস। এর পরের দিন ৭ মে ভারতের লোকসভায়ও সর্বসম্মতিক্রমে পাস হয় সীমান্ত বিল। তবে রাজ্যসভায় বিলটির কোনো বিরোধিতা না হলেও লোকসভায় আসামের রাজনৈতিক দল অল ইন্ডিয়া ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট এই বিলের বিরোধিতা করে। তিন সদস্যবিশিষ্ট এই রাজনৈতিক দলের নেতা সিরাজুদ্দিন আজমল বলেন, এই বিল পাস হলে আসামের বিন্দুমাত্র উপকার হবে না। রাজ্যের প্রচুর জমি বাংলাদেশ পেয়ে যাবে। তিনি বিলটি প্রত্যাহার করতে বলেন। তাঁর বক্তব্যের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ বলেন, ‘আপনারা আপনাদের বক্তব্য পেশ করেছেন, তা রেকর্ডেও থাকল। তাই অনুরোধ, আপনারা বিলের বিরুদ্ধে ভোট দেবেন না। আমরা যে রাজনীতির ঊর্ধ্বেও উঠতে পারি, তা গোটা পৃথিবীকে দেখানো দরকার।’ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর অনুরোধ মেনে তারা বিলের পক্ষেই ভোট দেন।১০

এর আগে, ছিটমহল বিনিময়ের ফলে নতুন করে ভারতের নাগরিকত্ব পেতে যাওয়া ছিটমহলের মানুষদের পুনর্বাসনের জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকার আর্থিক অনুদানের যে প্যাকেজ দাবি করেছিল, তা কোনো প্রকার কাটছাঁট না করেই অনুমোদন দেয় কেন্দ্রীয় সরকার। পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ লোকসভাকে জানান, পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে ৩০০৯ কোটি রুপি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এই অর্থের ৭৭৫ কোটি খরচ করা হবে অবকাঠামো উন্নয়নে। বাকি ২ হাজার ২৩৪ কোটি খরচ হবে যারা বাংলাদেশ থেকে ভারতে প্রত্যাবর্তন করবে, তাদের পুনর্বাসনে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি ছিটমহল বিনিময়ে আর যেন কোনো প্রশ্ন উত্থাপন না করতে পারেন, সে বিষয়টি বিবেচনায় রেখে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি পরিমাণ অর্থই বরাদ্দ দেওয়া হয়। তবে সংবাদমাধ্যম থেকে প্রাপ্ত সর্বশেষ সংবাদ অনুযায়ী বাংলাদেশের ভেতরের ছিটমহল থেকে প্রত্যাশিত সংখ্যক মানুষ ভারতে যেতে না চাওয়ায় এদের পুনর্বাসনের অর্থ কমিয়ে ১ হাজার কোটি রুপি করা  হয়েছে।

রাজ্যসভা ও লোকসভায় সর্বসম্মতিক্রমে পাস হওয়ার পরও সীমান্ত বিল নিয়ে নতুন করে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয় বিলটিতে একটি ‘টেকনিক্যাল এরর’ থাকায়। রাজ্যসভার চেয়ারম্যান হামিদ আনসারীর চোখে ধরা পড়া ‘টেকনিক্যাল এরর’টি ছিল, ২০১৩ সালে যে বিলটি উত্থাপন করা হয়েছিল, তা ছিল ১১৯তম সংশোধন বিল। কিন্তু পাসের পর তা হয় সংবিধানের ১০০তম সংশোধনী। এই পার্থক্যটি সব জায়গায় স্পষ্ট করে উল্লেখ করতে হয়। রাজ্যসভায় আলোচনাকালে সর্বত্র তা করা হলেও ‘শিডিউলিং’-এ বাদ পড়ে যায়।১১ ফলে বিলটি পাস হলেও তা গ্রাহ্য করা সম্ভব ছিল না। তাই নতুন করে ১১ মে বিলটি রাজ্যসভায় উত্থাপিত হয় এবং ভুল সংশোধন করে পুনরায় সর্বসম্মতিক্রমে পাস হয়। তবে স্থলসীমা চুক্তি বাস্তবায়নের আগে এই সংশোধনীটি ভারতের রাজ্য বিধানসভাগুলোর অন্তত ৫০ শতাংশের অনুমোদন লাগবে। আর এই কাজটি শেষ করতে অন্তত ছয় মাস সময় লাগবে।

ছিটমহল বিনিময়ের যৌথ প্রক্রিয়া

২০১৫ সালের ৬ জুন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরকালীন ভারত-বাংলাদেশ শীর্ষ বৈঠকে ১৯৭৪ সালের স্থলসীমা চুক্তি ভারতের পার্লামেন্টে অনুসমর্থনের দলিল ‘লেটার অব র্যাটিফিকেশন’ এবং ওই চুক্তি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে স্বাক্ষরিত ২০১১ সালের প্রটোকল বাংলাদেশকে হস্তান্তর করা হয়। ইতিমধ্যে বাংলাদেশের মন্ত্রিসভাও ২০১১ সালের প্রটোকলটি অনুমোদন দেয়। স্থলসীমান্ত চুক্তির দলিল বিনিময়-সংক্রান্ত বাংলাদেশ ও ভারতের পররাষ্ট্রসচিব স্বাক্ষরিত পত্রে বলা হয়, ১৯৭৪ সালে স্বাক্ষরিত স্থলসীমা চুক্তি এবং ২০১১ সালের প্রটোকল অনুযায়ী ২০১৫ সালের ৩১ জুলাইয়ের মধ্যরাত থেকে দুই দেশের ছিটমহল বিনিময় কার্যকর হবে। অর্থাত্ ওই সময় থেকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থাকা ১৭ হাজার ১৬০ দশমিক ৬৩ একর আয়তনের ভারতীয় ১১১টি ছিটমহল বাংলাদেশের ভূখণ্ডে পরিণত হবে। অন্যপক্ষে ভারতের অভ্যন্তরে থাকা ৭ হাজার ১১০ দশমিক ২ একর আয়তনের ৫১টি বাংলাদেশি ছিটমহল ভারতের ভূখণ্ডে পরিণত হবে। ওই পত্রে ৩১ জুলাইকে ‘অ্যাপয়েন্টেড ডে’ বা নিরূপিত দিন হিসেবে ধার্য করা হয়েছে। এবং ওই নিরূপিত দিনের আগেই দুই দেশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা যৌথভাবে ছিটমহল এলাকা পরিদর্শন করবেন এবং প্রয়োজনীয় প্রাথমিক কাজকর্ম সম্পন্ন করবেন।

ছিটমহল বিনিময়সহ সীমান্ত সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে ২০১১ সালের প্রটোকল অনুযায়ী ছিটমহল বিনিময়সহ স্থলসীমা চুক্তি বাস্তবায়নের রূপরেখা চূড়ান্ত বলে ইতিমধ্যেই খবর বেরিয়েছে। রূপরেখা অনুযায়ী ২০১৫ সালের ৩১ জুলাইয়ের মধ্যরাত থেকে ছিটমহল বিনিময় কার্যকর হবে এবং এ সময়ের মধ্যেই ছিটমহলবাসীকে তাদের পছন্দ অনুযায়ী ভারত কিংবা বাংলাদেশের নাগরিকত্ব বেছে নেওয়ার আবেদন করতে হবে। ২০১১ সালের জুলাই মাসে ছিটমহলগুলোয় যৌথ জরিপের সময় যারা তালিকাবদ্ধ হয়েছে এবং ওই সময় থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত যেসব শিশু ছিটমহলগুলোয় জন্মগ্রহণ করেছে, তারা এই সুযোগ পাবে।

ভারত বা বাংলাদেশের ছিটমহলে বসবাসকারী যেসব মানুষ ভূখণ্ড পরিবর্তন করতে চায় আর যারা বর্তমান ভূখণ্ডেই থাকতে চায়, তাদের চিহ্নিত করবে দুই দেশের যৌথ পরিদর্শক দল এবং সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসন। উভয় দেশের ছিটমহলবাসীর সামনে দুটি সুযোগই উন্মুক্ত আছে। ভূখণ্ড পরিবর্তন করতে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিজ নিজ পছন্দের দেশে চিরস্থায়ীভাবে চলে যেতে হবে। অর্থাত্ যারা ভারতের অভ্যন্তরে অবস্থিত ছিটমহল থেকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব নিয়ে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করতে চায়, আর বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অবস্থিত ছিটমহল থেকে ভারতীয় নাগরিকত্ব নিয়ে ভারতে প্রত্যাবর্তন করতে চায়, তাদের ২০১৫ সালের ৩০ নভেম্বরের মধ্যেই কাজটি সম্পন্ন করতে হবে। এই সময় পর্যন্ত তারা বাংলাদেশ ও ভারতের মূল ভূখণ্ডে কী ধরনের ভ্রমণ দলিল নিয়ে যাতায়াত করতে পারবে, তা উভয় দেশের সম্মতিতে ঠিক করা হবে। এই নাগরিকত্ব বিনিময়ের কর্মকৌশল ঠিক করবে ২০০০ সালে গঠিত জয়েন্ট বাউন্ডারি ওয়ার্কিং গ্রুপ জেবিডব্লিউজি। উল্লেখ্য, ২০১০ সালে এই গ্রুপ কাজ শুরু করে এবং ২০১১ সালের প্রটোকল স্বাক্ষর হয় তাদের সুপারিশের আলোকেই। নাগরিকত্ব বিনিময়ের পরও এ নিয়ে কোনো সমস্যা দেখা দিলে তা সমাধানে ২০২০ সালের জুন মাস পর্যন্ত এ কর্মকৌশল প্রযোজ্য হবে। ২০১৬ সালের ৩০ জুনের মধ্যে চুক্তি অনুযায়ী নির্ধারিত অপদখলীয় জমি ও অমীমাংসিত সীমানার ম্যাপ তৈরি ও বিনিময় করা হবে।১২

স্থলসীমা চুক্তি অনুযায়ী, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও আসামের সঙ্গে বাংলাদেশের ৬ দশমিক ১ কিলোমিটার স্থলসীমানা চিহ্নিত হবে। সর্বমোট ১৬২টি ছিটমহল বিনিময় হবে (১৯৯৭ সালের যৌথ হিসাব অনুযায়ী)। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থাকা ১১১টি ছিটমহল (লালমনিরহাটে ৫৯টি, পঞ্চগড়ে ৩৬টি, কুড়িগ্রামে ১২টি ও নীলফামারীতে চারটি) বাংলাদেশ পাবে যার আয়তন ১৭১৫৮ একর। আর ভারতের অভ্যন্তরে থাকা ৫১টি ছিটমহল (কোচবিহারে ৪৭টি, জলপাইগুড়িতে চারটি) ভারত পাবে যার আয়োতন ৭১১০ একর। অপদখলীয় ভূমির ২২৬৭ দশমিক ৬৮২ একর থাকবে বাংলাদেশের কাছে এবং ২৭৭৭ দশমিক ০৩৮ একর থাকবে ভারতের।

নাগরিকত্ব গ্রহণের সুযোগ: ছিটমহলবাসীর উভয় সংকট

ছিটমহল বিনিময়ের প্রক্রিয়ায়, ছিটমহলের সব মানুষকে দুই দেশের যেকোনো একটির নাগরিকত্ব বেছে নেওয়ার সুযোগ প্রদানের মাধ্যমে অবশেষে মানবাধিকারকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই অপূর্ব সুযোগটিও ছিটমহলের মানুষদের জন্য উভয় সংকট সৃষ্টি করেছে। অবশ্য ছিটমহলের মানুষদের জীবনে এমন উভয় সংকট নতুন কিছু নয়। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের মাধ্যমে ছিটমহলসহ বাংলা ও পাঞ্জাবের লাখ লাখ মানুষের জীবনেও নেমে এসেছিল এমন উভয় সংকট। ২০১৫ সালে নাগরিকত্ব গ্রহণ-সংক্রান্ত এই সংকট অনেকটা বেদনার হলেও সেই সময়ের সংকট ছিল জীবন-মরণ সংকট। সাদাত হাসান মান্টুর বিখ্যাত ছোটগল্প টোবা টেক সিং-এ যার একটি নিখুঁত চিত্র পাওয়া যায়। এই গল্পের একটি চরিত্র লাহোরের এক হিন্দু উকিল। প্রেমে ব্যর্থ হয়ে পাগল হয়ে যাওয়ার পর তার পাগলা গারদে ঠাঁই হয়। সেখানে যখন খবর এল যে পাঞ্জাব ভাগ হয়েছে এবং পাঞ্জাবের অমৃতসর ভারতে পড়েছে তখন সে খুবই কষ্ট পায়। কারণ, তার প্রেমিকা অমৃতসরে থাকে। তাই পাকিস্তান থেকে অমৃতসর বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার কথা শুনে সব হিন্দু ও মুসলমান নেতাকে সে গালমন্দ করছিল যারা দেশ ভাগ করে তাকে পাকিস্তানে ফেলেছে আর তার প্রিয়তমাকে ফেলেছে ভারতে। কিন্তু পরক্ষণেই যখন তাকে বলা হলো যে তাকে ভারতে পাঠানো হবে, তখন সে ভারতে যেতে অস্বীকার করল। কারণ, অমৃতসরে গেলে সেখানে তার ওকালতি ব্যবসা ভালো হবে না। টোবা টেক সিং ছোটগল্পের এই চরিত্রের উভয় সংকট—একদিকে তার প্রিয়তমা আরেক দিকে তার পেশা। ভারতবর্ষের অসংখ্য মানুষের জীবনে এমন উভয় সংকট সৃষ্টি করেছিল র্যাডক্লিফের সীমানারেখা। প্রায় সাত দশকের অন্ধকার জীবনের শেষ প্রান্তে এসে আবারও উভয় সংকটে পড়েছে ছিটমহলের অধিবাসীরা। অবশেষে তারা যখন নিজ দেশে প্রত্যাবর্তনের সুযোগ পেল, তখন এই সুযোগটি গ্রহণ করলে তাদের ছাড়তে হবে আপন ঘর ও পৈতৃক ভিটা। এখন তারা কোনটি বেছে নেবে? নিজের পৈতৃক বসত-ভিটা নাকি যে দেশটি নিজের দেশ হওয়ার কথা ছিল সেটি? এর চেয়ে বড় উভয় সংকটে কেউ কি কখনো পড়েছে! আমার গবেষণায় যতটুকু দেখেছি, ছিটমহলের অধিকাংশ মানুষ তার আপন ঘর, পৈতৃক বসত-ভিটা এবং যে সমাজের ওপর আশ্রয় করে সাত দশক ধরে টিকে আছে, তা ছেড়ে অন্য দেশে যাবে না। সেখানে তাদের নাগরিকত্ব না থাকলেও তার চারপাশের ভিনদেশি মানুষদের সঙ্গে একটা সামাজিক সম্পর্ক ঠিকই ছিল। প্রকৃতপক্ষে, ওই সামাজিক সম্পর্কের ওপর নির্ভর করেই ওই মানুষগুলো রাষ্ট্রহীন জীবন যাপন করতে সমর্থ হয়েছে। সেখানে তাদের জন্য বহুবিধ বঞ্চনা যেমন ছিল, বেঁচে থাকার অবলম্বনও ছিল। তা ছাড়া একটি নতুন দেশে গিয়ে নতুনভাবে জীবন শুরু করার ঝুঁকি নেওয়ার মতো মানসিক দৃঢ়তা শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত সেই মানুষগুলোর থাকার কথা নয়। ছিটমহলে যারা এখন ভূমিহীন, যাদের সামান্যতম কর্মসংস্থান নেই, যাদের অর্থনৈতিক অবস্থা শোচনীয়, যাদের সেখানে কোনো আশা নেই; তারাই হয়তো নতুন দেশের উদ্দেশে পা বাড়াবে। এবং সেই সংখ্যটি খুবই কম হওয়ার সম্ভাবনা।

ছিটমহল বিনিময়ে দ্বিপক্ষীয় চ্যালেঞ্জগুলো

ছিটমহল বিনিময়ের ক্ষেত্রে বেশকিছু চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান, যেগুলোর ব্যাপারে মাঠপর্যায়ে গবেষণা ছাড়া সঠিক কর্মকৌশল ঠিক করা যেমন সম্ভব নয়, তেমনি ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার টেবিল থেকে ন্যায্যতা অর্জন করাও সম্ভব নয়। বাংলাদেশসহ প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে যৌথ বিষয়াবলিতে ভারতের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত এবং এটি ধরে রাখার মতো সক্ষমতাও তাদের আছে। এমন একটি প্রতিবেশীর কাছ থেকে দর-কষাকষির মাধ্যমে ন্যায্যতা আদায় করার সক্ষমতা বাংলাদেশের অর্জন করতে হবে। যাতে প্রয়োজনে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার টেবিলে হোক, কোনো কূটনৈতিক চ্যানেলে হোক বা জন-আলোচনায় (public discourse) হোক, সঠিক তথ্য-উপাত্ত হাজির করে ন্যায্যতার দাবিতে দর-কষাকষি করা সম্ভব হয়। ছিটমহল বিনিময়ের ক্ষেত্রেও এমন কিছু বিষয় এখনো বিদ্যমান, যেগুলোর বিষয়ে যৌথ আলোচনায় সঠিক তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরে ন্যায্যতা অর্জনের চেষ্টা করা প্রয়োজন।

দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা বিতর্ক

ছিটমহল বিনিময়ের প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর নতুন করে বিতর্ক শুরু হয়েছে দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা নিয়ে। পশ্চিমবঙ্গের অনেকেই দাবি তুলেছেন যে সব ছিটমহলই যেহেতু বিনিময় হবে, তাহলে দহগ্রাম-আঙ্গরপোতাও বিনিময় হয়ে ভারতের সঙ্গে যুক্ত হবে না কেন? দহগ্রাম-আঙ্গরপোতাকে ভারতের সঙ্গে যুক্ত করা এবং তিনবিঘা করিডর বন্ধের দাবিতে কুচলিবাড়ী গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় ২৪ ঘণ্টার বনেধর (হরতাল) ডাক দিয়েছিল কুচলিবাড়ী সংগ্রাম কমিটি। কোচবিহার জেলা বিজেপিও ওই দাবি সমর্থন করেছিল। এই নিয়ে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমগুলোতে অনেক বিভ্রান্তিকর খবর ছাপা হয়েছে। বিভ্রান্তিকর খবর ছেপেছে পশ্চিমবঙ্গের দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকাও। পত্রিকাটির ‘তিনবিঘা করিডর রয়েই গেল, ফের আন্দোলন’ শীর্ষক একটি খবরে প্রশ্ন তোলা হয়: ‘ছিটমহল বিনিময় হলে কেন দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা ভারতের হবে না?’ ১৯৯২ সালে কেন তিনবিঘা করিডর প্রদান করা হয়েছিল সেই প্রশ্নও তোলা হয়। কিন্তু ’৭৪-এর স্থলসীমা চুক্তিতে কী আছে, তা খতিয়ে দেখার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেনি এই প্রভাবশালী পত্রিকাটি। অন্যদিকে ফরওয়ার্ড ব্লক তিনবিঘা করিডরের প্রতিবাদে আবারও আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছে। তারা ১৯৯২ সালেও বিজেপির সঙ্গে যৌথভাবে তিনবিঘা করিডরের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিল। কিন্তু তারা এ সত্যটুকু জানে না যে দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা ফেরত নিতে চাইলে বাংলাদেশকে ফেরত দিতে হবে ১২ নম্বর দক্ষিণ বেরুবাড়ী ইউনিয়নের দক্ষিণ অংশের আনুমানিক ২ দশমিক ৬৪ বর্গমাইল এলাকা। এই বিভ্রান্তি দূর করার জন্য স্থলসীমা চুক্তির অনুচ্ছেদ ১ এর ১২ ও ১৪ নম্বর সেকশন দুটি আলোচনা করা দরকার। অনুচ্ছেদ ১-এর ১২ নম্বর সেকশনে বলা হয় যে ১৪ নম্বর সেকশনে উল্লিখিত ছিটমহল (দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা) ছাড়া বাংলাদেশ ও ভারতের সবগুলো ছিটমহল অনতিবিলম্বে বিনিময় করা হবে, বাংলাদেশ যে বাড়তি জায়গা পাবে, তার জন্য কোনো প্রকার ক্ষতিপূরণ ছাড়াই। এবং ১৪ নম্বর সেকশনে বলা হয় যে ১২ নম্বর দক্ষিণ বেরুবাড়ী ইউনিয়নের দক্ষিণ অংশ ও সংলগ্ন ছিটমহলগুলো ভারতের থাকবে, যার আনুমানিক আয়তন ২ দশমিক ৬৪ বর্গমাইল। তার বিনিময়ে দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা ছিটমহল বাংলাদেশের হবে। দহগ্রামকে বাংলাদেশের পাটগ্রাম থানার পানবাড়ী মৌজার সঙ্গে সংযুক্ত করার জন্য ভারত তিনবিঘার নিকটে ১৭৮ মিটার দ্ধ ৮৫ মিটার পরিমাণ জায়গা বাংলাদেশকে চিরস্থায়ীভাবে ইজারা দেবে।

এখানে পরিষ্কারভাবে দেখা যাচ্ছে যে সব ছিটমহল বিনিময় হলেও দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা বাংলাদেশেরই থাকবে। কারণ দক্ষিণ বেরুবাড়ীর দক্ষিণ অংশের বিনিময়ে দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা ছিটমহলকে বাংলাদেশকে দেওয়া হয়েছে। অর্থাত্, দক্ষিণ বেরুবাড়ীর দক্ষিণ অংশের সঙ্গে বিনিময় হয়েই দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। এবং ভারত দক্ষিণ বেরুবাড়ীর দক্ষিণ অংশের দখল বুঝে নিয়েছে ১৯৭৪ সালেই। সুতরাং এখন যারা নতুন করে দাবি করছে যে ছিটমহল বিনিময় হলে দহগ্রাম-আঙ্গরপোতাও বিনিময় হয়ে ভারতের ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হবে, তারা স্থলসীমা চুক্তিটি সম্পর্কে অবগত নয়। তা ছাড়া তিনবিঘা করিডরের মাধ্যমে বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর থেকে ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য বিবেচনায় দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা আর ছিটমহল নেই। ১৯৯২ সাল থেকে এটি বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত। সুতরাং দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা নিয়ে নতুন করে বিতর্ক সৃষ্টি করার বা ভারতের পক্ষ থেকে দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা দাবি করার যেমন কোনো সুযোগ নেই, তেমনি তিনবিঘা করিডর বন্ধ করে দেওয়ারও কোনো সুযোগ নেই।

‘তিনবিঘা’ করিডর প্রসঙ্গ

বাংলাদেশের পাটগ্রাম উপজেলার সীমান্তবর্তী পানবাড়ী মৌজা থেকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মেকিলগঞ্জে অবস্থিত দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা ছিটমহলের দূরত্ব ১৭৮ মিটার। ‘তিনবিঘা’ নামক স্থানে এই ১৭৮ মিটার দৈর্ঘ্যের ভারতীয় ভূখণ্ড অতিক্রম করেই বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ড থেকে দহগ্রাম-আঙ্গরপোতায় যেতে হয়। ১৯৭৪ সালে স্বাক্ষরিত স্থলসীমা চুক্তি অনুযায়ী সেই ‘তিনবিঘা’ নামক স্থানে ১৭৮ মিটার দৈর্ঘ্য ও ৮৫ মিটার প্রস্থবিশিষ্ট একটি ভূখণ্ড করিডর হিসেবে বাংলাদেশকে চিরস্থায়ীভাবে বন্দোবস্ত দেওয়ার কথা। তাই করিডরটি ‘তিনবিঘা’ করিডর নামে পরিচিতি পেয়েছে। স্থলসীমা চুক্তিতে দক্ষিণ বেরুবাড়ীর দক্ষিণ অংশের বিনিময়ে ‘তিনবিঘা’ করিডর দেওয়ার কথা থাকলেও ১৯৯২ সাল পর্যন্ত তার বাস্তবায়ন হয়নি। বাংলাদেশের কূটনৈতিক তত্পরতায় ১৯৮২ ও ১৯৯২ সালে নতুন করে আরও দুটি ইজারা শর্ত স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে ১৯৯২ সালের ২৬ জুন আনুমানিক তিন-চার মিটার প্রস্থবিশিষ্ট একটি সরু রাস্তা খণ্ডকালীন ভিত্তিতে দহগ্রাম-আঙ্গরপোতার মানুষকে দেওয়া হয় বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডে যাতায়াতের জন্য। সেই রাস্তাটিই এখনো ‘তিনবিঘা’ করিডর নামে পরিচিত। দুই পাশে সশস্ত্র বিএসএফের সার্বক্ষণিক পাহারায় ভারতের ফটকসমৃদ্ধ রাস্তাটি  শুরুতে শুধু দিনের বেলায় প্রতি দুই ঘণ্টা পরপর এক ঘণ্টা করে দিনে মোট তিন ঘণ্টা খোলা রাখা হতো। এর তিন মাস পর থেকে প্রতি এক ঘণ্টা পর এক ঘণ্টা করে শুধু দিনের বেলায় মোট ছয় ঘণ্টা খোলা রাখা হতো। ২০০১ সালে রাস্তাটি সকাল ছয়টা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্নভাবে ১২ ঘণ্টা খোলা রাখার ব্যবস্থা করা হয়। অবশেষে ২০১১ সালের ঢাকা শীর্ষ বৈঠকের মাধ্যমে রাস্তাটি সার্বক্ষণিকভাবে খুলে দেওয়া হয়।

এখানে যে বিষয়টি মনে রাখা দরকার তা হলো ১৯৭৪ সালের স্থলসীমা চুক্তি অনুযায়ী দক্ষিণ বেরুবাড়ীর দক্ষিণ অংশের ২.৬৪ বর্গমাইল এলাকার বিনিময়ে ‘তিনবিঘা’ নামক স্থানে ১৭৮ মিটার দ্ধ ৮৫ মিটার আয়তনের একটি করিডর চিরস্থায়ীভাবে বন্দোবস্ত দিয়ে দহগ্রাম-আঙ্গরপোতাকে বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে সংযুক্ত করার কথা। ওই চুক্তির আর্টিকেল ১ এর ১৪ নম্বর সেকশনে বলা হয়েছে, “India will retain the southern half of South Berubari Union no. 12 and the adjacent enclaves, measuring an area of 2.64 square miles approximately, and in exchange Bangladesh will retain Dhahagram and Angarpota enclaves. India will lease in perpetuity to Bangladesh an area of 178 meters × 85 meters near ‘Tin Bigha’ to connect Dhahagram with Panbari Mouza (P.S. Patgram) of Bangladesh.” সে অনুযায়ী বাংলাদেশ দক্ষিণ বেরুবাড়ীর দক্ষিণ অংশ ভারতকে ১৯৭৪ সালেই ছেড়ে দিয়েছে এবং তার ওপর ভারতের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সুতরাং এর বিনিময়ে ১৭৮ মিটার দ্ধ ৮৫ মিটার আয়তনের একটি করিডর বাংলাদেশের পাওয়ার কথা এবং সেখানে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কথা। কিন্তু এখন পর্যন্ত বাংলাদেশকে দেওয়া হয়েছে মাত্র তিন-চার মিটার প্রস্থবিশিষ্ট একটি সরু রাস্তা, যার ওপর রয়েছে সশস্ত্র পাহারাধীন ভারতীয় ফটক ও ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের সার্বক্ষণিক নিয়ন্ত্রণ। দহগ্রাম-আঙ্গরপোতার মানুষের ওপর ভারতীয় নিয়ন্ত্রণের উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায় যে দহগ্রাম-আঙ্গরপোতার মানুষ এখন পর্যন্ত বিএসএফ কর্তৃক নির্দিষ্ট সংখ্যার বেশি গবাদিপশু বাংলাদেশের হাটে নিতে পারে না। একটি স্বাধীন দেশের প্রায় বিশ হাজার স্বাধীন, বেসামরিক মানুষের জন্য এ রকম ফটকসমৃদ্ধ সরু পথে সার্বক্ষণিক সশস্ত্র পাহারায় নিয়ন্ত্রিত যাতায়াতের ব্যবস্থা যৌক্তিকও নয়, মানবিকও নয়, যা ‘৭৪-এর স্থলসীমা চুক্তিতেও অনুধাবিত হয়েছে এবং করিডরটির প্রস্থ নির্ধারণ করা হয়েছে ৮৫ মিটার। এখন যেহেতু ’৭৪-এর স্থলসীমা চুক্তি বাস্তবায়ন হচ্ছে তাই সেই চুক্তি অনুযায়ী কোনো সরু রাস্তা নয়, বরং ১৭৮ মিটার দ্ধ ৮৫ মিটার আয়তনের একটি করিডর দহগ্রাম-আঙ্গরপোতার মানুষের জন্য অবমুক্ত করা উচিত।

স্থলসীমা চুক্তি বাস্তবায়নের পর ‘তিনবিঘা’ নামক স্থানে বাংলাদেশকে বন্দোবস্ত দেওয়া ১৭৮ মিটার দ্ধ ৮৫ মিটার জায়গার মধ্যে ভারতীয় যেকোনো ফটক বা স্থাপনা এবং বিএসএফ বা ভারতীয় যেকোনো বাহিনীর অবস্থান বা টহল হবে ’৭৪-এর স্থলসীমা চুক্তির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ‘তিনবিঘা’ করিডরের বর্তমান অবকাঠামো ও এর ব্যবস্থাপনা মানবাধিকারের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক। তাই ছিটমহল বিনিময় কার্যকরের সঙ্গে সঙ্গে ওই নির্দিষ্ট স্থানে নির্দিষ্ট পরিমাণ ভূমি অবমুক্ত করে দহগ্রাম-আঙ্গরপোতার মানুষের যাতায়াতের জন্য সেখানে একটি বেসামরিক ও মুক্ত পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে। স্থলসীমা চুক্তি বাস্তবায়ন ও ছিটমহল বিনিময়ের চলমান প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই বাংলাদেশ সরকার যদি দহগ্রাম-আঙ্গরপোতার মানুষের জন্য এই ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার বিষয়ে মনোযোগী না হয় তাহলে পরে আর তা সম্ভব হবে না। এবং দহগ্রাম-আঙ্গরপোতার মানুষও প্রকৃত মুক্তির স্বাদ কখনোই পাবে না।

ছিটমহলের উন্নয়ন চ্যালেঞ্জসমূহ

প্রায় সাত দশক ধরে রাষ্ট্রের বাইরে থাকার ফলে ছিটমহলের মানুষের যাপিত জীবনের বাস্তবতা সত্যি নির্মম। বংশপরম্পরায় সব ধরনের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত এই মানুষগুলোকে মূলধারায় সম্পৃক্ত করাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এই কাজটি করার জন্য অর্থ যেমন দরকার, তেমনি দরকার সঠিক কর্মপরিকল্পনা। সেখানকার মানুষের খাদ্যনিরাপত্তা, বাসস্থান, চিকিত্সা, শিক্ষা, কর্মসংস্থান, যাতায়াত ও যোগাযোগব্যবস্থাসহ রাষ্ট্র কর্তৃক প্রদত্ত সাধারণ সেবাসমূহ নিশ্চিত করার জন্য দরকার স্বল্পমেয়াদি, মধ্যম মেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনা। মনে রাখতে হবে যে সব ধরনের মৌলিক অধিকারসহ রাষ্ট্র ও আধুনিক সভ্যতার কোনো ছোঁয়াই ছিটমহলের মানুষ এখন পর্যন্ত পায়নি। সুতরাং সব ধরনের মৌলিক অধিকার ও রাষ্ট্রীয় সুযোগসুবিধা নিশ্চিত করার মাধ্যমে তাদের জীবনমান পরিবর্তন করে তাদের মূলধারায় ফিরিয়ে আনার কাজটি তাত্ক্ষণিকভাবে করা সম্ভব নয়। সে কারণেই ছিটমহলের মানুষের প্রয়োজনীয়তার ধরন ও সেগুলোর বাস্তবায়ন-প্রক্রিয়ার ধরন বিবেচনায় ওপরে উল্লিখিত তিন স্তরের উন্নয়ন পরিকল্পনা করতে হবে। সমগ্র উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে যেহেতু সরকারের বিভিন্ন সংস্থাকে সম্পৃক্ত হতে হবে, তাই আমলাতন্ত্রের কাঠিন্য ও কালক্ষেপণের সংস্কৃতি যেন এখানকার উন্নয়ন কর্মসূচিকে বাধাগ্রস্ত না করে সে জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে আন্তরিক হতে হবে এবং সবার মাঝে সমন্বয় থাকতে হবে।

প্রথমেই নজর দিতে হবে তাত্ক্ষণিক পুনর্বাসনে। বাংলাদেশ সরকার ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেটে ছিটমহলবাসীর পুনর্বাসনের জন্য ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছে। এই বরাদ্দকৃত অর্থের পরিমাণ পশ্চিমবঙ্গের বরাদ্দকৃত অর্থের তুলনায় খুবই কম। তবু সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে দুর্নীতিমুক্তভাবে যদি এই অর্থ ব্যয় করা যায়, তাহলে অনেক কিছুই করা সম্ভব। পাশাপাশি মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনার জন্য আগামী কয়েকটি অর্থবছরেও বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ অব্যাহত রাখতে হবে। যেমন দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা ছিটমহলের একটি বড় সমস্যা হলো এর পশ্চিম ও দক্ষিণ পাশের সীমানা নির্ধারণী তিস্তা নদীর ভাঙন। তিস্তা নদী দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা অংশে ভাঙার ফলে নদীতে বিলীন হয়ে যাওয়া অংশ ধীরে ধীরে নদীর ওপারে পড়ে ভারতের অপদখলে চলে যাচ্ছে। এই ভাঙন ঠেকাতে সরকারকে মধ্যম মেয়াদি প্রকল্প হাতে নিতে হবে। ছিটমহলের মানুষের শিক্ষা নিয়ে সরকারকে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করতে হবে। এসব কাজে আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলোর কাছ থেকেও সহযোগিতা পাওয়া সম্ভব। ইতিমধেই ইউএনডিপি প্রতিনিধিদল প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাত্ করে ছিটমহলের মানুষকে মূলধারায় ফিরিয়ে আনতে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে।১৩ 

ছিটমহল বিনিময়কে কেন্দ্র করে ভারতীয় নাগরিকত্ব পেতে একটি অসাধু চক্র ইতিমধ্যে সক্রিয় হয়েছে। ছিটমহলগুলোতে গোপনে তৈরি হচ্ছে জাল প্রমাণপত্র। এ কাজে সহায়তা করছেন কিছু আইনজীবী, রাজনীতিবিদ ও এনজিও কর্মকর্তা। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার এ-সংক্রান্ত একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন দিল্লি ও ঢাকায় প্রেরণ করা হয়েছে।১৪ বাংলাদেশ-ভারত ছিটমহলকে কেন্দ্র করে এমন জালিয়াত চক্রের তত্পরতা নতুন কিছু নয়। এর আগেও এই চক্র ছিটমহলের জাল পরিচয়পত্র তৈরি করে দুই দেশে যাওয়া-আসা করত। যে কারণে বাংলাদেশের অভ্যন্তরের ভারতীয় ছিটের নাগরিকেরা আগে ভারতে যাতায়াত করার সুযোগ পেলেও পরে ভারত সরকার তা বন্ধ করে দেয়। বাংলাদেশের ভূখণ্ডে থাকা দেউলডাঙ্গা, দাশিয়ার ছড়া (কুড়িগ্রাম), শালবাড়ী, কাজলদীঘিসহ (লালমনিরহাট) বেশ কয়েকটি ছিটমহলের বাসিন্দাদের জমিজমা, ঘরবাড়ি ছেড়ে ভারতে চলে যাওয়ার জন্য হুমকি দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।১৫ এই হুমকিদাতাদের উদ্দেশ্য পরিষ্কার, ছিটমহলের বাসিন্দারা ভারতে চলে গেলেই তাদের জমিজমা, ঘরবাড়ি নির্বিঘ্নে দখল করা যাবে। এই দুষ্ট চক্রকে আইনের আওতায় আনতে হবে এবং তারা যেন ছিটমহলের মানুষদের জিম্মি করতে না পারে তা নিশ্চিত করতে হবে।

শিক্ষা ও চাকরি প্রসঙ্গ

প্রায় সাত দশক ধরে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত এই মানুষগুলোর জন্য শিক্ষাক্ষেত্রে একধরনের ক্ষতিপূরণ প্যাকেজ নিয়ে ভাবতে হবে। যে মানুষগুলোর শিক্ষার বয়স পেরিয়ে গেছে, তাদের জন্য গণশিক্ষা কার্যক্রম চালু করা ছাড়া হয়তো আর কিছু করার সুযোগ নেই। কিন্তু তাদের সন্তানদের বিশেষ বিবেচনায়, যোগ্যতা শিথিল করে শিক্ষার সুযোগ দেওয়ার মাধ্যমে তাদের ক্ষতি কিছুটা পুষিয়ে দেওয়া সম্ভব। এসব বিবেচনায়, একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ছিটমহলের মানুষের জন্য শিক্ষা ও চাকরির ক্ষেত্রে যোগ্যতা ও বয়স শিথিল করে কোটা ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে। যারা ইতিমধ্যে কোনো না কোনোভাবে শিক্ষা লাভ করেছে, তাদের বিশেষ ব্যবস্থায় চাকরির সুযোগ করে দিতে হবে। ছিটমহলে অনেকেই আছে, যারা শিক্ষাজীবন শেষ করে চাকরি পাওয়ার পরও পুলিশ ভেরিফিকেশনে ছিটের লোক প্রমাণিত হওয়ায় চাকরি হারিয়েছে। তাদের খুঁজে বের করে চাকরি ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

দেশ পরিবর্তনকারীদের শিক্ষাসনদ নিয়ে অনিশ্চয়তা

ছিটমহল বিনিময়ের প্রক্রিয়ায় যারা দেশ পরিবর্তন করবে, শুরুতে তারা অনেক বিষয়ে অনিশ্চয়তার মুখে পড়বে সন্দেহ নেই। শিক্ষাসনদ তার মধ্যে অন্যতম। প্রায় সাত দশক পরে যখন তারা নিজের দেশে প্রত্যাবর্তন করবে, সে দেশে বর্তমান দেশের শিক্ষাসনদ গ্রহণ করা হবে কি না, এ নিয়ে ছিটমহলের মানুষের মাঝে উদ্বেগ-উত্কণ্ঠা শুরু হয়েছে। ছিটমহলের অনেকেই ভারত বা বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষা লাভ করে কর্মজীবনে প্রবেশ করেছে। তারাও চাকরি ছেড়ে দেশ পরিবর্তন করলে নতুন দেশে চাকরি পাবে কি না, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা আছে। এই মানুষগুলোকেও যেন সমমর্যাদার চাকরির ব্যবস্থা করা হয়। নতুন দেশে আগের শিক্ষাসনদের গ্রহণযোগ্যতা যদি না থাকে তাহলে ওই শিক্ষিত মানুষগুলো রাতারাতি অশিক্ষিত মানুষে পরিণত হবে। সে ক্ষেত্রে তারা যোগ্যতা অনুযায়ী কর্মসংস্থানের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে। এই বিষয়টি উভয় দেশের সরকারকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে এবং তাদের স্ব স্ব দেশের সমমানের সনদ প্রদানের ব্যবস্থা ও যোগ্যতা অনুযায়ী কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা দিতে হবে।

ছিটমহলের জমির মালিকানাসংক্রান্ত জটিলতা

ছিটমহলের জমির প্রকৃত মালিকানা নির্ধারণ করার বিষয়ে সরকারকে সতর্ক থাকতে হবে। ছিটমহলের জমির মালিকদের কাছে মালিকানাসংক্রান্ত কোনো দলিলপত্র নেই। সংশ্লিষ্ট ভূমি অফিসগুলোতে নেই ছিটমহলের ভূমিসংক্রান্ত কোনো নকশা বা খতিয়ান। ছিটমহলসমৃদ্ধ মৌজাগুলোর নকশায় ছিটমহলের জায়গাগুলো ফাঁকা আছে। ছিটমহলের অনেক জমির প্রকৃত মালিককে হয়তো এখন আর পাওয়াই যাবে না। ছিটমহলগুলোতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ খাসজমি আছে, যার অধিকাংশই স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের দখলে। ১৯৪৭ সালের দেশভাগ পরবর্তী দীর্ঘস্থায়ী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বাস্তবতায় ছিটমহলের বাসিন্দাদের অনেকেই জীবন বাঁচাতে ধর্মের পরিচয়ের অনুকূল দেশে পাড়ি জমায়। সীমান্তের এপার-ওপার পাড়ি জমানো ছিটমহলবাসীর মধ্যে অনেক ক্ষেত্রে ছিটমহলের জমিজমা ও বসতভিটা বিনিময় হয়েছে। অর্থাত্ তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশ) অভ্যন্তরে অবস্থিত ছিটমহলগুলোর অনেক হিন্দু অধিবাসী ভারতে চলে যায় এবং ভারতের ভূখণ্ডে অবস্থিত কোনো ছিটমহলে আশ্রয় গ্রহণ করে। একইভাবে ভারতের অভ্যন্তরে অবস্থিত ছিটমহলগুলোর অনেক মুসলমান অধিবাসী পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসে এবং পূর্ব পাকিস্তানের ভূখণ্ডে অবস্থিত কোনো ছিটমহলে আশ্রয় গ্রহণ করে। সীমান্ত অতিক্রম করা এই ছিটমহলবাসীর অনেকেই পরস্পরের সঙ্গে বসতভিটা ও জমিজমা বিনিময় করে একে অন্যের জায়গায় আশ্রয় গ্রহণ করে এবং সেই থেকে তারা সেখানেই আছে। এসব ক্ষেত্রে তাদের কাছে জমির মালিকানাসংক্রান্ত কোনো দলিলপত্র থাকার কথা নয়। এসব মানুষকে জমির মালিকানাসংক্রান্ত বৈধ দলিলপত্র প্রদান করতে হবে। মালিকানা নির্ধারণ ও ছিটমহলগুলোতে ভূমি জরিপ সম্পন্ন করে রেকর্ড করতে হবে এবং সংশ্লিষ্ট মৌজা ম্যাপগুলোতে তা অন্তর্ভুক্ত করে প্রকাশ করতে হবে।  

গত সাত দশকে দুই দেশের ছিটমহলের অনেকেই অভাবে পড়ে নামমাত্র মূল্যে মৌখিকভাবে তাদের জমি বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়েছে। এ অবস্থায় যারা জমি ক্রয় করেছে, তাদেরও কোনো বৈধ দলিলপত্র নেই। এ প্রক্রিয়ায় ছিটমহলের বাসিন্দাদের নিজেদের মাঝে যেসব জমি কেনাবেচা হয়েছে, সেগুলো যাচাই-বাছাই করে বৈধতা দিতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়ে যে বিষয়টি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে, তা হলো দীর্ঘ সাত দশকের বঞ্চনা ও অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা ছিটমহলের লোকদের অনেকের জমি জবরদখল করেছে অথবা ভয়ভীতি প্রদর্শন করে বা তীব্র অভাব ও নানাবিধ বিপদাপদের সুযোগ নিয়ে নামমাত্র মূল্যে তাদের জমি ক্রয় করেছেন। বাংলাদেশে তাদের নাগরিকত্ব, বাড়িঘর, জমিজমা থাকার পাশাপাশি তারা ছিটমহলের জমিরও মালিক। ছিটমহলগুলোতে এমন ধরনের মালিকানা পরীক্ষা করে দেখতে হবে। এবং এই প্রক্রিয়ায় যেসব ছিটমহলবাসী জমি হারিয়েছেন, তাঁদের অভিযোগ দাখিলের সুযোগ দিতে হবে এবং তা আমলে নিয়ে খতিয়ে দেখতে হবে। মনে রাখতে হবে, ছিটমহলের বাসিন্দারা সব ধরনের প্রশাসনিক ও আইনি সুযোগ থেকে সাত দশক ধরে বঞ্চিত ছিল। কোনো বিষয়েই কোথাও কোনো অভিযোগ দাখিলের সুযোগ তাদের ছিল না। এ অবস্থায় তাদের ওপর কোনো জুলুম হয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে হবে। ছিটমহলের জমিগুলো বর্তমানে যাদের ভোগদখলে আছে, কোনো প্রকার যাচাই-বাছাই ছাড়া তাদের মালিকানাসংক্রান্ত বৈধ দলিলপত্র দিলে ছিটমহলের অনেক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং তারা ভূমিহীন থেকে যাবে। আর ছিটের জমির মালিকানা চলে যাবে স্থানীয় প্রভাবশালীদের হাতে। ছিটমহল বিনিময়ের পর ছিটমহলের কোনো মানুষ যেন ভূমিহীন না থাকে তা নিশ্চিত করতে হবে। 

শেষ কথা

ছিটমহল সমস্যার সমাধান জাতীয় স্বার্থের দিক থেকে কোনো দেশের জন্যই তেমন কোনো স্পর্শকাতর বিষয় ছিল না। ছিটমহল বিনিময়ের মাধ্যমে কোনো দেশেরই ক্ষতি বা হারানোর কিছু নেই। সমস্যাটি জিইয়ে রেখে কোনো দেশ লাভবান হয়েছে তা-ও নয়। ভারতের সর্বোচ্চ আদালতও দীর্ঘ পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর বলে দিয়েছিলেন যে ছিটমহল বিনিময়ে সংবিধান লঙ্ঘিত হবে না, সার্বভৌমত্বের কোনো ক্ষতি হবে না। অপরপক্ষে, সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের মাধ্যমে উভয় দেশের ছিটমহলগুলোকে স্ব স্ব দেশ থেকে স্থায়ীভাবে বিচ্ছিন্ন করে ভারত সরকারই ছিটমহল বিনিময়ের আর কোনো বিকল্প খোলা রাখেনি। তা ছাড়া ছিটমহল বিনিময়ের মাধ্যমে কার্যত যা ঘটবে, তা কেবলই কাগজে-কলমে মালিকানা পরিবর্তন। নতুন করে কোনো রাষ্ট্রকেই কোনো জায়গা ছাড়তে হবে না। অর্থাত্ রাজনৈতিক ভূগোলের ক্ষেত্রে নতুন করে কোনো পরিবর্তন হবে না। বরং উভয় রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও ভৌগোলিক অখণ্ডতা সমুন্নত হবে। আর ছিটমহলের রাষ্ট্রহীন অসহায় মানুষগুলো পাবে রাষ্ট্র ও নাগরিক অধিকার। তাহলে ছিটমহল বিনিময়ে কেন এত বিলম্ব হলো? উত্তর একটাই। আর তা হলো ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি। সুতরাং যে কুিসত রাজনীতির কারণে শত শত মানুষের জীবনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এমন একটি বিষয় সাত দশক ধরে অমীমাংসিত থেকেছে এবং ছিটমহলগুলোতে মানবিক সংকট সৃষ্টি করেছে সে রাজনীতি পরিত্যাজ্য হোক। রাজনীতিকদের মনে সদাজাগ্রত থাকুক চণ্ডীদাসের সে অমর বাণী, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।’

ঢাকা শীর্ষ বৈঠকে তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে কোনো আলোচনা না হওয়ায় বাংলাদেশের মানুষের মাঝে হতাশা বেড়েছে সন্দেহ নেই। তবে সাত দশক পরে ছিটমহল বিনিময়ের সুরাহা হওয়ার ফলে নরেন্দ্র মোদির সরকারের প্রতি একধরনের আস্থাও তৈরি হয়েছে। ছিটমহল বিনিময় ও সীমান্ত সমস্যা সমাধানের এ উদ্যোগ ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি তাত্পর্যপূর্ণ ঘটনা। এর মাধ্যমে প্রতিবেশী দেশ দুটির সম্পর্ক অদূর ভবিষ্যতে আরও অর্থবহ হবে বলে আশা করা যায়। এবং এর ধারাবাহিকতায় উভয় দেশের সাধারণ মানুষের কল্যাণে তিস্তার পানি বণ্টনের মতো জনগুরুত্বপূর্ণ সমস্যাগুলোরও আশু সমাধান হবে সেটাই সবার প্রত্যাশা।

তথ্যসূত্র ও পাদটীকা

১.         লালমনিরহাট জেলায় ৫৯টি (পাটগ্রাম উপজেলায় ৫৫টি, হাতিবান্ধা উপজেলায় দুটি ও লালমনিরহাট সদর উপজেলায় দুটি), পঞ্চগড় জেলায় ৩৬টি (বোদা উপজেলায় ২৩টি, সদর উপজেলায় সাতটি ও দেবীগঞ্জ উপজেলায় ছয়টি), কুড়িগ্রাম জেলায় ১২টি (ভুরুঙ্গামারী উপজেলায় ১০টি, কুড়িগ্রাম সদর উপজেলায় একটি ও ফুলবাড়ী উপজেলায় একটি) এবং নীলফামারী জেলার ডিমলা উপজেলায় চারটি ছিটমহল রয়েছে। 

২.         ২০১১ সালের গণনা অনুযায়ী ভারতের অভ্যন্তরে অবস্থিত ৫১টি ছিটমহলে রয়েছে ১৪ হাজার ২২১ জন বাংলাদেশি। আর বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অবস্থিত ১১১টি ছিটমহলে রয়েছে ৩৭ হাজার ৩৬৯ জন ভারতীয়। আর বাংলাদেশের ভেতরে ৪৩টি ও ভারতের ভেতরে ২০টি ছিটমহলে কোনো জনবসতি নেই; আছে শুধু জমিজমা। (বিস্তারিত দেখুন, প্রথম আলো, ৭ জুলাই ২০১৫)। তবে বাস্তবে উভয় দেশে ছিটমহলের জনসংখ্যা ২০১১ সালের হিসাবের চেয়ে অনেক বেশি। এর প্রমাণও মিলছে ২০১৫ সালে ছিটমহলের জনগণনায় যখন অনেক লোক নতুন করে তালিকাবদ্ধ হতে আবেদন করছে। নানা কারণে তারা ২০১১ সালে তালিকাবদ্ধ হতে পারেনি। তাই ২০১৫ সালের চূড়ান্ত গণনায় ২০১১ সালের গণনাকে ভিত্তি হিসেবে ধরার সিদ্ধান্তে অনেকেই নতুন করে বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা করছে। বাদ পড়া মানুষেরা তাদের চূড়ান্ত তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানিয়েছে। ইন্ডিয়ান এনক্লেভস পিপল্স অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে কোচবিহার জেলা প্রশাসনের কাছে স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছে। দাবি না মানলে ওই সংগঠনটি আন্দোলনে যাওয়ার ঘোষণাও দিয়েছে। (বিস্তারিত দেখুন, আনন্দবাজার পত্রিকা, ৮ জুলাই ২০১৫)।

৩.        বাংলা ও পাঞ্জাবের জন্য আলাদা দুটি কমিশন গঠন করা হয়েছিল। উভয় কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন সিরিল র্যাডক্লিফ, আর উভয় কমিশনেই দুজন করে হিন্দু ও মুসলমান (অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি) সদস্য ছিলেন।

৪.         বিস্তারিত দেখুন, দৈনিক আজাদ, ১১ ও ১২ সেপ্টেম্বর ১৯৫৮।

৫.         Press Communiqué dated 12th September 1958, Page 18 (3) Berubari Union No. 12, Sl No. 16,

          1965 Dept. of Home, Political, CR (Confidential Record), West Bengal State Archives.

6.       Press Communiqué dated 12th September 1958, Page 18 (3) Berubari Union No. 12, Sl No. 16,

          1965 Dept. of Home, Political, CR (Confidential Record), West Bengal State Archives.

৭.         বিস্তারিত দেখুন, প্রথম আলো ৭ মে ২০১৫।

৮.        বিস্তারিত দেখুন, সমকাল, ৫ মে ২০১৫।

৯.         বিস্তারিত দেখুন, প্রথম আলো, ১৮ এপ্রিল ২০১৫।

১০.       বিস্তারিত দেখুন, আনন্দবাজার পত্রিকা, ৪ মে ২০১৫।

১১.       বিস্তারিত দেখুন, প্রথম আলো, ৬ মে ২০১৫।

১২.       বিস্তারিত দেখুন, ঐ, ৬ মে ২০১৫।

১৩.      বিস্তারিত দেখুন, ঐ, ৮ মে ২০১৫।

১৪.       বিস্তারিত দেখুন, ঐ, ৮ মে ২০১৫।

১৫.       বিস্তারিত দেখুন, ঐ, ৯ মে ২০১৫।

১৬.      বিস্তারিত দেখুন, সমকাল, ১১ জুন ২০১৫।

১৭.       আনন্দবাজার পত্রিকা, ৮ জুন ২০১৫।

১৮.      ঐ।

১৯.      ঐ।

২০.       বিস্তারিত দেখুন, প্রথম আলো, ১১ মে ২০১৫।

২১.       বিস্তারিত দেখুন, দৈনিক সমকাল, ২০ মে ২০১৫।

২২.       বিস্তারিত দেখুন, প্রথম আলো, ৯ মে ২০১৫।

২৩.      বিস্তারিত দেখুন, M. G. Rabbani, 2007, Statelessness in South Asia: Living in Bangladesh-India Enclaves, (Research Monograph), Theoretical Perspectives, Centre for Alternatives, Dhaka, pp.36-38.

সহায়ক গ্রন্থাবলি

—          খান চৌধুরী, এ. এ., ১৯৩৬, কোচবিহারের ইতিহাস, কোচবিহার স্টেট প্রেস।

—          রব্বানী, মোহাম্মদ গোলাম, ২০১১, ‘ছিটমহলের মানুষ: রাষ্ট্রহীনতার ইতিবৃত্ত’, প্রতিচিন্তা, অক্টোবর-ডিসেম্বর সংখ্যা, পৃষ্ঠা: ৮৯-১৪১। 

—          Chatterji, J., 1999, ‘The Fashioning of Frontier: The Radcliffe Line and Bengal’s Border Landscape, 1947-52’, Modern Asian Studies; vol. 33, Part 1.

—        Haq, M. A. , 1999, ‘Slow Progress in Land Demarcation. Settlement of Enclave Issue to Ease Border Tension’, Daily Star, 3 October.

—        Manto, Saadat Hasan, 1955,  "Toba Tek Singh" (A short story).

—        Philips, C.H. & Wainwright, M. D. (eds), 1970, The Partition of India - Policies and Perspectives, 1935-1947, George Allen And Unwin Ltd., London.

—        Rabbani, M. G., 2007, Statelessness in South Asia: Living in Bangladesh-India Enclaves, (Research Monograph), Theoretical Perspectives, Centre for Alternatives, Dhaka,

—        Raza, S. H. (ed), 1989, Mount Batten And The Partition of India; Atlantic Publishers & Distributors, New Delhi.

—        Sen, A. K., 2001, ‘Tales of Nowhere People’, presentation made at the Symposium on ‘Problems of Chhitmohal and Adverse Possession’, Centre For Development Activities, Calcutta, 14-15 Sept.

—        Schendel, W. van, 2002, ‘Stateless in South Asia: The Making of India-Bangladesh Enclaves’, The Journal of Asian Studies, February 2002.

— Schendel, W. van, 2001, ‘Working through Partition: Making a Living in the Bengal Border-lands’, International Review of Social History, 6 (2001), pp. 393-421.

—        Spate, O.H.K., 1947, ‘The Partition of the Punjab and of Bengal’, The Geographical Journal, Vol. 110, No. 4/6, pp. 201-218.

—        Spate, O.H.K., 1948, ‘The Partition of India and Prospects of Pakistan’, Geographical Review, vol. 38.

—        Whyte, B. R., 2002a, ‘The Cooch Behar Enclaves of India and Bangladesh: An Historical Overview And Determination of their Number, Area And Population’, Oriental Geographer, vol. 46, No. 2, Dhaka.

—        Whyte, B. R., 2002b, Waiting for the Esquimo – A historical and documentary study of the Cooch Behar enclaves of India and Bangladesh, The School of Anthropology, Geography and Environmental Studies, The University of Melbourne, Australia.