গৃহযুদ্ধ-পরবর্তী শ্রীলঙ্কা: দক্ষিণ এশিয়ায় জাতিরাষ্ট্রের সংকটের স্বরূপ

‘সকল যুদ্ধই তার পায়ের ছাপ রেখে যায় রাষ্ট্র ও সমাজের অলিগলিতে। শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রে যেন এটা ঘটেছে অধিকমাত্রায়। সেখানে শুধু এটা পায়ের ছাপ আকারে নেই। এ যেন দীর্ঘ এক স্থায়ী ছায়া। পুরো দেশেই কেবল নয়, প্রতিটি মননে পড়েছে এই যুদ্ধের ছায়া।’

—মোহন কে. টিক্কু, সাংবাদিক, লেখক১

সারসংক্ষেপ

আফগানিস্তান থেকে মিয়ানমার পর্যন্ত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সব দেশের কোনো না কোনো অঞ্চল দশকের পর দশক জাতিগত সংঘাতে জ্বলছে, পুড়ছে—আবার জ্বলছে। প্রতীকী হিসেবে নিলে শ্রীলঙ্কার তামিল সংকটের পূর্বাপর কমবেশি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সব নিপীড়িত জাতিসত্তারই ‘গল্প’। বিস্ময়কর হলেও সত্য ২৬ বছর স্থায়ী যুদ্ধের পূর্বে যেভাবে এই সংকটের বিস্তার—তথাকথিত ‘চূড়ান্ত যুদ্ধ’ শেষেও তার সমাপ্তি ঘটেনি। একইভাবে আমরা দেখব অস্থিরতার অবসান হয়নি আফগানিস্তানের হাজারা এলাকায়, পাকিস্তানের বেলুচিস্তানে, ভারতের কাশ্মীরে, মিয়ানমারের আরাকানে, নেপালের তরাইয়ে—এমনকি বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামেও। বস্তুত জাতি সমস্যার সমাধান রাজনৈতিক এবং বিদ্যমান রাষ্ট্রকাঠামোতে ‘প্রবল সংস্কৃতি’র রাজনীতিবিদদেরই সেই ‘সমাধান’ খুঁজে পেতে হয়। শ্রীলঙ্কার সিংহলি রাজনীতিবিদেরা ৭০ বছর হলো সেই সমাধান হাতড়াচ্ছেন। তাঁদের অর্জন ও ব্যর্থতা থেকে দক্ষিণ এশিয়ার সবার জন্য বিশেষ বার্তা আছে বলেই মনে হয়।

মুখ্য শব্দগুচ্ছ

রাষ্ট্র, তামিল, সিংহলি, তামিলনাড়ু, বহুত্ববাদ, হোমল্যান্ড, লোকগণনা, এথনো পলিটিকস, রাজাপক্ষে, চীন, এলটিটিই, ফনসেকা, হাইসিকিউরিসিটি জোন, উইগেনেশরন, জেভিপি, ইলম, সিরিসেনা, ফ্রিডম পার্টি, ন্যাশনালিস্ট পার্টি

ভূমিকা

শ্রীলঙ্কায় সিংহলি বনাম তামিল গৃহযুদ্ধের কাহিনি দক্ষিণ এশিয়ার এক পুরোনো দুঃখগাথা। তবে ২০০৯ সালে লিবারেশন টাইগার অব তামিল ইলমের (এলটিটিই) পরাজয়ের পর থেকে দেশটিতে তামিল জাতীয়তাবাদী সক্রিয়তা এবং তার সমাধানে বা মোকাবিলায় সরকারের কর্মকাণ্ড নতুন এক পর্যায়ে প্রবেশ করেছে। শ্রীলঙ্কায় এখন তামিল সশস্ত্রতা না থাকলেও জাতীয় রাজনীতি আন্দোলিত হচ্ছে জাতিগত বিষয় নিয়েই। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সবাই তাকিয়ে আছে শ্রীলঙ্কার নীতিনির্ধারকেরা তাঁদের জাতিগত বিবাদ কীভাবে মীমাংসা করেন, সেদিকে। বলাবাহুল্য, এসব প্রত্যাশার পাশাপাশি অনেকেই নজর রাখছেন দেশটির মাঠপর্যায়ের পরিস্থিতির দিকেও। বর্তমান লেখায় শ্রীলঙ্কার সর্বশেষ পরিস্থিতির একটি চুম্বকচিত্র তুলে ধরা হলো।

জনমিতি ও রাজনীতির অভিমুখ

দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশে রাষ্ট্রীয় লোকগণনায় রাজনীতির প্রবল আঁচ থাকে। শ্রীলঙ্কায় সেই আঁচ বিশেষভাবে ভয়াবহ। এ বিষয়ে শ্রীলঙ্কার খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয় পেরাদিনিয়ার সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক কলিঙ্গ টুডর সিলভা একদা মন্তব্য করে বলেছিলেন,

লোকগণনা যে প্রক্রিয়ায় হচ্ছে তাতে মানুষকে তার মানবিক পরিচয় থেকে বিচ্ছিন্ন করে খুবই সীমাবদ্ধ এক বর্ণ ও জাতিগত পরিচয়ে ঠেসে ধরা হচ্ছে। আবার (শ্রীলঙ্কার) লোকগণনার পুরো প্রক্রিয়াটি ধীরে ধীরে জাতিগত সমীকরণের বিরাট এক পাঠ্যে পরিণত হয়েছে। শুমারি প্রতিবেদন এখানে জাতিগত সংঘাতের অন্যতম আলোচ্য বিষয়। কোন জাতিসত্তা কোন অঞ্চলে সংখ্যায় কত বড় এবং কত ছোট তা যেমন লোকগণনার প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করছে, তেমনি গণনা প্রতিবেদনও জাতিগত সংঘাতকে প্রভাবিত করছে।২

ফলে এই আলোচনার শুরুতে আমরা দেশটির লোকগণনার সর্বশেষ চিত্রটির একটি বিশ্লেষণ তুলে ধরছি। দেশটিতে সর্বশেষ লোকগণনা হয়েছে ২০১২ সালে।

১৯৮১ সালে শ্রীলঙ্কায় মোট জনসংখ্যার ৬৯.২৯ শতাংশ ছিল বৌদ্ধ। আর ২০১২ সালে মোট জনসংখ্যার ৭০.১৯ শতাংশ হলো বৌদ্ধ। এ থেকে ধারণা করা যায়, দেশটিতে ভবিষ্যতের আর্থসামাজিক নীতিনির্ধারণে বৌদ্ধধর্মীয় প্রভাব কোনোভাবেই অগ্রাহ্যযোগ্য নয়।

অন্যদিকে ১৯৮১ সালে দেশটির জনসংখ্যার ১৫.৪৭ শতাংশ ছিল হিন্দু। ৭.৫৫ শতাংশ ছিল মুসলমান এবং ৭.৬১ শতাংশ ছিল যৌথভাবে ক্যাথলিক ও খ্রিষ্টান।৩ অর্থাত্ তিন দশক আগে অ-বৌদ্ধ তথা সংখ্যালঘু ধর্মীয় জনসংখ্যার সম্মিলিত হিস্যা ছিল দেশটিতে ৩০.৬৩ শতাংশ।

আর ২০১২ সালে মোট জনসংখ্যায় হিন্দুদের হিস্যা দাঁড়িয়েছে ১২.৫৮ শতাংশ, মুসলমানদের ৯.৬৬ শতাংশ এবং যৌথভাবে ক্যাথলিক ও খ্রিষ্টান ৭.৬২ শতাংশ। অর্থাত্ ২০১২ সালে সর্বমোট অ-বৌদ্ধ জনসংখ্যা ২৯.৮৬ শতাংশ।

অর্থাত্ দেশটিতে তিন দশক পরও অ-বৌদ্ধধর্মীয় জনসংখ্যা প্রায় একই হিস্যায় বহাল রয়েছে, যা দেশটির বহুত্ববাদী ধর্মীয় বৈশিষ্ট্যের স্মারক। এ থেকে এ-ও অনুমিত হয়, দেশটিতে ধর্মীয় স্বাধীনতার দাবি প্রবল থাকবে এবং দেশটির মানব-নিরাপত্তার জন্য আন্তধর্মীয় সম্প্রীতি এক জরুরি শর্ত।

শ্রীলঙ্কায় প্রধান চারটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে বেশি পিছিয়ে মুসলমানরা। কিন্তু গত তিন দশকে তাদের সংখ্যাগত বৃদ্ধির হার অন্য তিন সম্প্রদায়ের চেয়ে অধিক। ত্রিশ বছরের ব্যবধানে প্রতি ১০০ মুসলমান বৃদ্ধি পেয়ে ১৭৫ জন হয়েছে। বৌদ্ধদের ক্ষেত্রে এই বৃদ্ধি প্রতি ১০০ জনে ১৩৩ জন। ‘শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থানে পিছিয়ে থাকা সম্প্রদায়ের জন্মহার অধিক হয়’—এটা সেই তত্ত্বকে প্রমাণ করছে। আবার একই সঙ্গে এ-ও ধারণা করা যায়, ভবিষ্যতে দেশটিতে এ সম্প্রদায় অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক শক্তি হয়ে উঠতে পারে, যদিও তারা রাজনৈতিকভাবে অনেক বেশি অসংগঠিত এখনো।

সর্বশেষ লোকগণনায় দেশটিতে অঞ্চলভিত্তিক জটিল এক ধর্মীয় বৈশিষ্ট্যও লক্ষ করা গেছে। দেশটিতে ২৫টি জেলা রয়েছে। তার মাঝে সর্বদক্ষিণের হামবানতোতায় প্রায় ৬ লাখ জনসংখ্যায় ৯৭ ভাগই বৌদ্ধ। এই জেলায় ১৯৮১ সালে হিন্দু ছিল ২ হাজার। সর্বশেষ গণনায়, ২০১২ সালে আছে ১ হাজার। আবার একেবারে উত্তরের এলাকা জাফনায় প্রায় ৫ লাখ ৮৪ হাজার জনসংখ্যায় প্রায় ৮৩ শতাংশই হিন্দু। এই জেলায় ১৯৮১ সালে বৌদ্ধ ছিল প্রায় ৫ হাজার। বর্তমানে আছে ২ হাজার। ১৯৮১ সালে এখানে মুসলমান ছিল ১৪ হাজার, ২০১২ সালে ছিল ২ হাজার মাত্র। উপরিউক্ত চিত্র থেকে বলা যায়, দেশটিতে বহুধর্মীয় বর্ণিলতা থাকলেও অঞ্চলগুলো সেই চিত্র ধারণ করে না। বরং অঞ্চলগুলোতে একক ধর্মীয় আধিপত্য দৃঢ়তা পাচ্ছে। ফলে অনিবার্যভাবেই অঞ্চলগত রেষারেষি বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে এবং ইতিমধ্যে দেশটির জাতিগত বৈরিতা একটি আঞ্চলিক রূপ নিয়েও উপস্থিত।

শ্রীলঙ্কার উপরিউক্ত জনমিতিক গতিধারা তামিল৪ জাতীয়তাবাদীদের জন্যও একটি খারাপ বার্তা দিচ্ছে। তামিলরা বরাবর উত্তর ও পূর্বাঞ্চলকে (নর্দান ও ইস্টার্ন প্রভিন্স) নিজেদের ঐতিহাসিক ‘হোমল্যান্ড’ দাবি করে এবং তার সপক্ষে এই দুই প্রদেশের জনসংখ্যায় নিজেদের আধিক্যকে প্রমাণ হিসেবে তুলে ধরে। এ ক্ষেত্রে তুলনার জন্য পূর্বাঞ্চলের প্রধান দুটি শহর ত্রিংকোমালি ও বাত্তিকালোয়াকে যদি উদাহরণ হিসেবে নেওয়া হয়, তাহলে আমরা দেখব, ১৯৮১ সালে পূর্বাঞ্চলের এই দুই জেলায় ‘শ্রীলঙ্কার তামিল’ ছিল প্রদেশের মোট জনসংখ্যার ৫১ শতাংশ। কিন্তু ২০১২ সালে তা দাঁড়িয়েছে মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪৮ শতাংশ। প্রদেশটির তৃতীয় শহর আমপারাইয়ের জনসংখ্যাকে যুক্ত করলে তামিলদের হিস্যা আরও কমে যায়। কারণ, আমপারাইয়ে মুসলমানরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। পূর্বাঞ্চলে নিজেদের সংখ্যাগত ক্রমাবনতির এই প্রবণতা এ প্রদেশকেও ‘হোমল্যান্ড’ভুক্ত দাবি করা তামিলদের জন্য কঠিন করে তুলছে।

উপরিউক্ত জনমিতিক চিত্র শ্রীলঙ্কায় একটি স্বায়ত্তশাসিত মুসলমান প্রদেশের ভবিষ্যত্ সম্ভাবনারও ইঙ্গিত দিচ্ছে। পূর্বাঞ্চলের (ইস্টার্ন প্রভিন্সের) তিন জেলা ত্রিংকোমালি, আমপারা ও বাত্তিকালোয়ায় ১৯৮১ সালে মুসলমান জনসংখ্যা ছিল প্রদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩২.৫৪ শতাংশ। সর্বশেষ শুমারিতে দেখা যাচ্ছে, এই হিস্যা দাঁড়িয়েছে ৩৬ শতাংশে। স্পষ্টত পূর্বাঞ্চলের তিন শহরেই মুসলমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত আছে। এই প্রবণতা এই প্রদেশকে শ্রীলঙ্কার মুসলমান রাজনীতির ভরকেন্দ্র করে তুলবে। নর্দান প্রভিন্স যেভাবে তামিল রাজনীতির ভরকেন্দ্র হয়ে আছে।

জাতিগত সমীকরণের পরিবর্তনশীলতার পাশাপাশি শ্রীলঙ্কার জনমিতি আর্থসামাজিক কিছু পরিবর্তনেরও ইঙ্গিত দেয়। দেশটির বাণিজ্যিক রাজধানী কলম্বো। ১৯৮১ সালে এই শহরে বসবাস করত জাতীয় জনসংখ্যার প্রায় ১১ শতাংশ। সর্বশেষ শুমারিকালেও প্রায় অনুরূপ হার দেখা গেছে। ২৫টি জেলার দেশে একটি জেলাতেই নয় ভাগের এক ভাগ জনসংখ্যার উপস্থিতি (আয়তনে যে জেলা পুরো দেশের ১ শতাংশ মাত্র) বাংলাদেশের মতোই প্রধান শহরে অতি ঘন বসবাসের ইঙ্গিতবহ এবং দেশে প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণ না হওয়ারও বাস্তব ফল এটা।

শ্রীলঙ্কায় গৃহযুদ্ধ চলেছে প্রায় ২৬ বছর। যুদ্ধ জনসমাজে কিরূপ অমানবিক কামড় বসিয়েছে, তারও ছাপ রয়েছে এই শুমারি-তথ্যে। ২৬ বছর স্থায়ী গৃহযুদ্ধের অন্যতম মূল ভরকেন্দ্র ছিল নর্দান প্রভিন্স। এই প্রদেশের দুটি গুরুত্বপূর্ণ জেলা হলো জাফনা ও মান্নার।

ত্রিশ বছরের শুমারি-তথ্যের সবচেয়ে ব্যতিক্রমী দিক হলো দেশটির ২৫টি জেলার মধ্যে কেবল দুটিতে জনসংখ্যা ১৯৮১ সালের চেয়েও কমে গেছে ২০১২ সালে। অর্থাত্ বাকি ২৩ জেলায় জনসংখ্যা বাড়লেও জাফনায় তা কমে গেছে ৩০ শতাংশ ও মান্নারে কমেছে প্রায় ৬ শতাংশ। পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় এমন অঞ্চল বিরল যেখানে ত্রিশ বছরের ব্যবধানে লোখসংখ্যা কমেছে। কিন্তু শ্রীলঙ্কার তামিল-অধ্যুষিত এলাকায় এটা ঘটেছে। দেশটির অবিশ্বাস্য এই পরিস্থিতির দায় অবশ্যই সংখ্যাগুরু সিংহলিদেরই।

সংবিধান প্রণয়নের রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ: ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ

এটা সত্য, শ্রীলঙ্কায় এখন আর ‘যুদ্ধ’ নেই। তবে রয়ে গেছে যুদ্ধের প্রগাঢ় ছায়া। সেখানে যুদ্ধোত্তর সরকারগুলো এখন লড়ছে সেই ছায়ার বিরুদ্ধে। কিন্তু যেকোনো দেশের ‘সরকার’ই হলো সেই দেশের সংবিধানের ‘সৃষ্টি’। সে কারণেই আজকের শ্রীলঙ্কায় বিতর্কের কেন্দ্রে রয়েছে মূলত সংবিধান। ২০০৯ সাল থেকে সৃষ্ট রাজনীতির নতুন বাস্তবতায় সবার নজর সাংবিধানিক পরিবর্তনের পানে।

যুদ্ধ শেষে শ্রীলঙ্কায় নতুন সামরিক বাস্তবতা তৈরি হয়েছে। একই সঙ্গে তা নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতারও পটভূমি তৈরি করেছে। সামরিক বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে ভারত এখন জোর দিচ্ছে তামিল সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের ওপর। দিল্লির সরকারের এই নীতিই সমর্থন করছেন তামিলনাড়ুর রাজনীতিবিদেরাও।৫ অনেকটা ভারতীয় চাপেই শ্রীলঙ্কা সরকার দেশটিতে নতুন সংবিধান রচনায় উদ্যোগ নিয়েছে। তামিলদেরও এটা প্রধান একটা দাবি ছিল।

এটা অনেকেই জানেন যে স্বাধীনতার পর দেশটিতে দুদফা সংবিধান প্রণয়নের বড় ধরনের উদ্যোগ দেখা গেছে। সর্বশেষ সংবিধান তৈরি হয় ১৯৭৮ সালে। কিন্তু দেশটির নাগরিকদের মধ্যে যে রাজনৈতিক ঐক্যের ঘাটতি রয়েছে, তার জন্য এত দিনকার সংবিধানগুলোকেও দায়ী করা হয়। কারণ, এই সংবিধান নাগরিকদের মধ্যে কোনো একক দেশজ পরিচয় (Sri Lankan identity) তৈরি করতে পারেনি। এ বাস্তবতাতেই বর্তমানে, এই প্রবন্ধ রচনাকালে, দেশটিতে নতুন করে আরেক দফা সংবিধান প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এই লেখা প্রকাশের আগেই সেই সংবিধানও প্রকাশ হওয়ার সম্ভাবনা আছে। বর্তমান সংবিধানের ১৯তম সংশোধনী প্রস্তাবের মাধ্যমে ২০১৫ সালের এপ্রিলে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়। পরবর্তীকালে এই পার্লামেন্টকেই ‘সাংবিধানিক সভা’ হিসেবে অনুমোদন দেওয়া হয় এবং সম্ভাব্য সংস্কার প্রস্তাব তৈরির জন্য ২০ সদস্যের একটি কমিটিও করে দেওয়া হয়।

শুরু থেকে এই উদ্যোগের মধ্যে কিছু অস্পষ্টতা রয়ে গেছে। সরকার স্পষ্ট করে কখনো বলেনি যে তারা পুরোপুরি একটা নতুন সংবিধান তৈরি করতে যাচ্ছে, নাকি পুরোনো সংবিধানের সংস্কার করতে চাচ্ছে। তবে সরকারের ইতিমধ্যে প্রদত্ত বক্তব্য থেকে স্পষ্ট, বর্তমান সংবিধানে তিনটি মৌলিক পরিবর্তন আনতে আগ্রহী তারা। একটি হলো তামিল-অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে আরও স্বায়ত্তশাসন দেওয়া; দ্বিতীয়টি হলো রাষ্ট্রপতিশাসিত ব্যবস্থার পরিবর্তে সংসদীয় শাসনপদ্ধতি প্রবর্তন এবং তৃতীয়টি হলো ভোটের পদ্ধতিতে পরিবর্তন সাধন—যার ফলে সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্ব আরও বাড়ে। এরূপ সব পরিবর্তনকে নীতিনির্ধারক প্রস্তাবকেরা ‘অতীত ভুলের সংশোধন’ হিসেবে দেখছেন এবং মনে করছেন এর মাধ্যমে জাতিগত স্বার্থের সমন্বয় ঘটবে এবং ঐতিহাসিক জাতিবিদ্বেষ কমে আসবে। আবার একই সঙ্গে দেশটির বহুত্ববাদী সামাজিক ঐতিহ্যকেও আইনগত সংস্কারগুলো আরও বিকশিত করবে।

উল্লিখিত সম্ভাব্য এই তিনটি পরিবর্তনেই তামিলরা লাভবান হবে বলে আশা করা যায়। কারণ রাষ্ট্রপতিশাসিত ব্যবস্থায় তাদের কেউ কখনো রাষ্ট্রপতি হতে পারবে, এমন সম্ভাবনা দুরূহ। কিন্তু সংসদীয় ব্যবস্থায় কিছু আসন পেয়ে তারা সরকার গঠনে কিংবা সরকার পরিচালনায় ভালোভাবেই দর-কষাকষি করতে পারে। আবার উত্তর ও পূর্বাঞ্চলে অধিকতর স্বায়ত্তশাসন তাদের দীর্ঘদিনেরই দাবি। ফলে শুরু থেকে দেশটির নতুন সাংবিধানিক পথপরিক্রমায় তামিল দলগুলো ও ভারতের বিশেষ সায় রয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী বিক্রমাসিংহে বর্তমান সংসদকেই সংবিধান সভা হিসেবে ঘোষণার প্রস্তাব করলে একপর্যায়ে তা গৃহীত হয়। ইতিমধ্যে সংবিধান বিষয়ে জনগণের কাছ থেকে সুপারিশ এসেছে এবং সেই সুপারিশ গ্রহণের জন্য মন্ত্রিপরিষদ ২৪ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করেছে লাল উইজেনায়াকের নেতৃত্বে। প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন, ২০১৭-এর শুরুতে নতুন সংবিধানের প্রস্তাব তিনি পার্লামেন্টে তুলে ধরতে পারবেন। যদিও সেটা পারেননি তিনি। হয়তো শিগগিরই তা করা হবে। ইতিমধ্যে ৬টি কমিটি সম্ভাব্য সংস্কারের রূপরেখা নিয়ে কাজ শেষ করেছে। উল্লেখ্য, বর্তমান বিধানমতে নতুন সংবিধান অনুমোদনের জন্য পার্লামেন্টের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের অনুমোদন প্রয়োজন হবে এবং শেষে গণভোটও প্রয়োজন হবে।

সংবিধান প্রণয়ন বা সংস্কারের এই উদ্যোগকে কেন্দ্র করেই এ মুহূর্তে শ্রীলঙ্কার রাজনীতি আবর্তিত হচ্ছে। সংবিধান প্রণয়নের ক্ষেত্রে সমাজের শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধিদের মতামত আহ্বান খুবই গণতান্ত্রিক মনোভঙ্গির পরিচায়ক হলেও প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর ইঙ্গিতমতো সাংবিধানিক পরিবর্তনের পথে সম্ভাব্য কয়েকটি পাহাড়সম প্রতিবন্ধকতাও রয়েছে।

প্রথমত, সংবিধানে তামিল স্বার্থের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন কিছু সংস্কার সাধনে বর্তমান প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী উভয়ে আগ্রহী হলেও তাঁরা দুজনে দুটি ভিন্ন দলের প্রতিনিধিত্ব করছেন। যে দুটি দল আবার ঐতিহাসিকভাবে পরস্পরের প্রতিপক্ষ। ফলে তাঁদের দুজনের ব্যক্তিগত মতৈক্য কতটা স্থায়ী হবে, তা এখনই বলা যাচ্ছে না। ইতিমধ্যে প্রেসিডেন্টের দলে (ফ্রিডম পার্টি) ভাঙন প্রায় অনিবার্য হয়ে উঠেছে। প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী দুজনই সিংহলি জাতির অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় মূলধারার সিংহলিদের মতামতের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তামিলদের স্বার্থে প্রয়োজনীয় কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া তাঁদের জন্য রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হবে। এ বিষয়ে শ্রীলঙ্কায় দায়িত্বপালনকারী ভারতীয় হাইকমিশনার জে এন দীক্ষিতের মতামত এ রকম যে ...there are certain thresholds beyond which no Sinhalese leader can be fully responsive to Tamil aspirations, if he or she desires to survive in power.’৬

দ্বিতীয়ত, প্রেসিডেন্ট-শাসিত পদ্ধতির পরিবর্তনে পার্লামেন্ট-শাসিত শাসনে প্রত্যাবর্তনের পক্ষে দেশটিতে মতামতের পাল্লা ভারী হলেও প্রশাসন ও রাজনীতিতে এমন মতও যথেষ্ট শক্তিশালী যে এতে দেশটির শাসনপদ্ধতিতে আবার দুর্বলতার ছাপ প্রবল হয়ে উঠবে। এরূপ মতামত প্রদানকারীরা দেশের অধিকতর স্থিতিশীলতার স্বার্থে প্রেসিডেন্ট-শাসিত পদ্ধতির পক্ষে। অন্যদিকে, বিরুদ্ধ মতাবলম্বীরা বলছেন, বর্তমানের প্রেসিডেন্ট-শাসিত পদ্ধতি মাঝেমধ্যেই একনায়কতান্ত্রিক রূপ নেয়।

তৃতীয়ত, তামিল অঞ্চলগুলোতে স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নেও সিংহলি সমাজে প্রবল মতদ্বৈধতা রয়েছে। বিশেষত তামিলদের দাবি অনুযায়ী পুলিশ ও ভূমিব্যবস্থার ওপর প্রাদেশিক অধিকারদানের বিরুদ্ধে রয়েছে সিংহলি প্রধান অনেক রাজনৈতিক দল। তবে নতুন সংস্কার প্রস্তাবে এ ক্ষেত্রে পূর্বতন অবস্থার অতিরিক্ত কিছু ছাড় দেওয়া না হলে তামিল সম্প্রদায় যে এরূপ সংবিধান প্রত্যাখ্যান করবে তা নিশ্চিত। অন্যদিকে সিংহলি দলগুলোর প্রবল উপস্থিতির কারণে এ ক্ষেত্রে খুব বেশি ছাড় দেওয়ারও সুযোগ নেই। কারণ, তাহলে গণভোটে তা বাতিল হয়ে যাবে। কিন্তু সম্ভাব্য সাংবিধানিক সংস্কারের অন্যতম মনোযোগের বিষয় হবে অবশ্যই এমনতর বিকেন্দ্রীকরণ, যা কেন্দ্রে এবং বিশেষভাবে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বহুত্ববাদী নৃতাত্ত্বিক ধারার সবার মধ্যে ক্ষমতায়নের বোধ তৈরি করে ও সরাসরি প্রশাসনিক পরিমণ্ডলে তার ছাপ পড়াও জরুরি। অর্থাত্ ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের সম্পূরক হিসেবে প্রয়োজন হবে প্রশাসনের বিকেন্দ্রীকরণ। আরও স্পষ্ট করে বললে সাংবিধানিক ও আইনি সংস্কারকে প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে দৃশ্যগোচর হতে হবে। ফলে শেষোক্ত দুই ক্ষেত্রেও সংস্কার প্রয়োজন হবে। আবার একটি বহুত্ববাদী সমাজে সম্পদের বিকেন্দ্রীকরণের বিষয়েও সাংবিধানিক নির্দেশনা আবশ্যক। বিশেষ করে উন্নয়ন পরিকল্পনায় সব জাতি ও ধর্মীয় গোষ্ঠীর অংশগ্রহণের ধারা কীভাবে নিশ্চিত করা যায়, সেটা সম্ভাব্য সাংবিধানিক সংস্কারের জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে থাকবে। আবার রাষ্ট্রীয় সাংস্কৃতিক পরিচয়ে ও গণমাধ্যমে দেশটির বহুত্ববাদী সংস্কৃতির ছাপ কীভাবে প্রতিফলিত হবে এবং একই সঙ্গে কীভাবে তা একক পলিটিক্যাল কমিউনিটির কাঠামো গড়ে তুলবে—এ সবই আসন্ন দিনগুলোতে রাষ্ট্রীয় সংস্কার উদ্যোগের সফলতা ও ব্যর্থতাকে নির্দেশ করবে।

তবে ওপরে উল্লেখিত কাজগুলো যে সহজ নয়, তা বলাই বাহুল্য। কারণ, শ্রীলঙ্কার সংকটের মূলে ইতিহাসের এক বড় ভূমিকা রয়েছে। তামিল ও সিংহলি—উভয় সম্প্রদায় তাদের বাছাই করা কিছু ‘ঐতিহাসিক উত্স’কে ব্যবহার করে নিজ নিজ এমন ‘পরিচয়’ নির্মাণ করেছে, যা প্রতিনিয়ত তাদের বিবাদবাদী জাতীয়তাবাদী মনস্তত্ত্বকে ‘বৈধতা’ দিয়ে চলেছে। তাদের জাতিগত ‘পরিচয়’ দাঁড়িয়ে আছে যে ঐতিহাসিক স্মৃতিকথার ওপর, তা প্রতিনিয়ত উত্পাদন ও পুনরুত্পাদন করে চলেছে জাতীয়তাবাদী ভাবাবেগ, বেদনা ও গর্ব। এই ভাবাবেগ, পরাজয় ও গর্ব জাতিগত ‘অপর’-এর সঙ্গে সমন্বয়ের পরিবর্তে তার সঙ্গে প্রতিযোগিতা ও তার ওপর শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের কথাই বলে এবং বিজয় ও পুনর্বিজয়ের তাগিদ দেয়।৭

বস্তুত এটা আবার একই সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে এথনো পলিটিকসেরও সমস্যা। এই এথনো পলিটিকসে প্রধান এক ভূমিকা পালন করছে বিভিন্ন জাতিসত্তার স্ববাছাইকৃত ‘ইতিহাস’৮। এরূপ ইতিহাস আবার ‘মন্ত্র’-এর মতো মর্যাদাশীল। দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিটি জাতির ইতিহাস তাই ‘আলাদা’ ‘আলাদা’ এবং তারা পরস্পর নিজেদের ‘শ্রেষ্ঠত্ব’-এর কথা বলে, কেবল নিজেদের ইতিহাসকেই ‘সত্য’ বিবেচনা করে এবং পরস্পরের প্রতি নীরব বৈরিতা ও ঐতিহাসিক হিংসাও লালন করে। এরূপ ‘ঐতিহাসিক’ উপলব্ধি সর্বশেষ যে কথা সামনে নিয়ে আসে তা হলো, সংখ্যালঘু ‘অপর’-এর ওপর সংখ্যাগুরুর (প্রয়োজনীয়) চূড়ান্ত বিজয়ের মধ্য দিয়েই রাষ্ট্রের ‘স্থিতিশীলতা’ (stability) নিশ্চিত হতে পারে।

শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রে এরূপ ‘ইতিহাস চেতনা’র একটি বড় (ও বিপজ্জনক) নজির তার পতাকা নির্মাণের সংস্কৃতিতে দেখতে পাই আমরা। শ্রীলঙ্কা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল যে কেউ জানেন, দেশটিতে জনসাধারণের কাছে প্রিয় প্রাণী হলো হাতি। একে সেখানে পবিত্রও গণ্য করা হয়। মন্দিরে মন্দিরে সেখানে হাতি পোষা হয়। এমনকি পারিবারিক পরিসরে হাতিশাবক থাকা সেখানে এলিটদের কাছে মর্যাদার প্রতীকও বটে। কিন্তু এরূপ একটি দেশের জাতীয় পতাকায় যে প্রাণীটির ছবি রয়েছে, তা হলো সিংহ। ১৯৫০-এ তৈরি ‘স্বাধীন’ শ্রীলঙ্কার পতাকায় সিংহ তলোয়ার হাতে দাঁড়িয়ে আছে। শ্রীলঙ্কার জাতীয় পতাকার এই সিংহের ধারণা তারা নিয়েছে খ্রিষ্টপূর্ব সময়ের পূর্বপুরুষ ‘বিজয়’-এর মিথ থেকে। বলা হয়, বিজয় যখন (খ্রিষ্টপূর্ব আনুমানিক ৪৮৬ সালে) শ্রীলঙ্কায় বসতি স্থাপনের জন্য পদার্পণ করেছিলেন, তখন তাঁর হাতে সিংহ প্রতীক-সংবলিত পতাকা ছিল। আবার সিংহলি এই প্রতীকের বিপরীতে দাঁড়িয়ে এলটিটিই ‘তামিল ইলম’ (সম্ভাব্য তামিল রাষ্ট্র)-এর যে পতাকা তৈরি করেছে, সেখানে একগুচ্ছ বুলেটের মধ্যে স্থাপিত হয়েছে একটি ঝাঁপ দিতে উদ্ধত বাঘের ছবি। কৌতুককর বিষয় হলো, শ্রীলঙ্কায় বাঘ বা সিংহ কোনোটাই নেই।৯ সিংহলি শাসকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে নতুন রাষ্ট্র কায়েমের সংগ্রামে এলটিটিইও তার পতাকার বাঘ প্রতীক (তামিল ভাষায় যাকে বলা হয় পুলি কোডি; বাংলায় বাঘ পতাকা) নিয়েছে খ্রিষ্টপূর্ব দক্ষিণ ভারতীয় দ্রাবিড় চোলা রাজাদের সংস্কৃতি থেকে, যে চোলা রাজারা একদা শ্রীলঙ্কার সিংহলি এলাকায়ও রাজত্ব করেছে।

জাতিগত বৈরিতার পাশাপাশি এরূপ যুদ্ধংদেহী ‘ইতিহাস’-এর প্রভাব রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষাচিন্তায় কীভাবে পড়েছে তার কিছু নজির এ পর্যায়ে উল্লেখ করা যায় শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনীর বিভিন্ন স্থাপনার নামকরণ থেকে। দেশটির সেনাবাহিনীর সবচেয়ে সুদক্ষ রেজিমেন্টগুলোর নাম রাখা হয়েছে প্রাচীন যুদ্ধ ইতিহাসের সিংহলি রাজাদের নামে (যেমন গামুনু রেজিমেন্ট, গাজাবা রেজিমেন্ট, বিজয়বাহু রেজিমেন্ট ইত্যাদি)। যেসব রাজা লোকপ্রিয় মূলত দক্ষিণ ভারতীয় তামিলভাষীদের বিরুদ্ধে লড়াই করে। যে রাজারা যুদ্ধ করেছিলেন উত্তরের তামিল রাজাদের বিপক্ষে। শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে শক্তিশালী নৌযুদ্ধজাহাজের একটির নাম হলো পরাক্রম (রাজা পরাক্রমবাহুর নামে)।১০

বলা বাহুল্য, এরূপ ইতিহাসচর্চার আরও দুটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো স্বনির্মিত ‘হুমকি’ ও ‘ভীতি’র ধারণা। শ্রীলঙ্কায় যেমন সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলিরা সংখ্যালঘু তামিলদের ‘হুমকি’ এবং ‘আগ্রাসী’ জ্ঞান করছে এবং তাদের ‘ভীতি’ থেকে মুক্তির লক্ষ্যে তামিলদের ওপর সামরিক শ্রেষ্ঠত্বকে জরুরি মনে করে, তেমনি আমরা দেখব ভারতেও সংখ্যাগুরুদের রাজনৈতিক দর্শন ‘হিন্দুত্বভা’ সংখ্যালঘু মুসলমানদের ‘ঐতিহাসিক প্রতিপক্ষ’ সাব্যস্ত করে তাকে ‘হুমকি’ হিসেবে উপস্থাপন করে। এরূপ কল্পিত ‘হুমকি’ ও ‘ভীতি’র ধারণা, ক্রমাগত ছাপাখানাকেন্দ্রিক পুঁজিবাদের (Print Capitalism) বিকাশের মধ্য দিয়েই পরিগঠিত করছে বিশেষ বিশেষ সম্প্রদায়ের সম্মিলিত ‘জাতীয় চেতনা’ বা ‘জাতীয়তা’র ধারণা এবং এই ধারণাকে কাজে লাগানো হচ্ছে নৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ‘পুনর্জাগরণ’ ও কথিত ‘স্থিতিশীল’ রাষ্ট্র নির্মাণে।১১ আবার আন্তর্জাতিক বা আঞ্চলিক তৃতীয় পক্ষ এরূপ ‘হুমকি’ ও ‘ভীতি’র মনস্তত্ত্বে ইন্ধন জুগিয়ে পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে।

ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার আনুষ্ঠানিক এবং অনানুষ্ঠানিকভাবে সব সময়ই শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় সরকারকে তামিল ভাষা ও তামিল সংস্কৃতিকে সিংহলি ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে সমানাধিকারের জন্য চাপ দিয়ে গেলেও তাদের দেশে হিন্দির সঙ্গে দক্ষিণ ভারতীয় তামিল, কানাড়া ও তেলেগু ভাষা ও সংস্কৃতির তীব্র বিরোধিতার কথা সেখানে ধামাচাপা দেওয়া হয়। ‘হিন্দি ও হিন্দুত্বভা’ ভারতের স্বাধীনতার পর থেকেই দ্রাবিড় জাতীয়তাবাদকে প্রতিপক্ষ জ্ঞান করছে। তামিলনাড়ুর রাজনীতি তথা দ্রাবিড় জাতীয়তাবাদের মৌলিক ভিত্তি তৈরি হয়েছে উত্তর ভারতীয় হিন্দি ভাষা ও তার সংস্কৃতিকে বিরোধিতা করতে যেয়ে। তবে শ্রীলঙ্কায় সিংহলিদের বিপরীতে তামিলদের সংগ্রামে উত্তর ও দক্ষিণ ভারতীয় অবস্থান শর্তহীনভাবে তামিলদের পক্ষে।

বস্তুত এরূপ বিবিধ সংকট ও স্ববিরোধিতা ধামাচাপা দিয়েই দক্ষিণ এশিয়ার অধিকাংশ দেশ ‘জাতিরাষ্ট্র’ গঠনের চেষ্টা করেছে ও করছে। কিন্তু বিবদমান জাতিসত্তাগুলো যতক্ষণ ‘ঐতিহাসিক স্মৃতিকথা’র শক্তির ওপর নির্ভরতা বাদ দিয়ে একক পলিটিক্যাল ‘কমিউনিটি’ আকারে নিজেদের পুনর্গঠন না করছে, তত দিন এথনো পলিটিকসের চলতি সংকটের স্থায়ী সমাধান প্রায় অসম্ভব। এটা তাই কেবল পশ্চিমা ‘আধুনিকতা’র আলোকে কিছু সাংবিধানিক সংস্কারের মাধ্যমেই ফয়সালাযোগ্য বিষয় নয়। যদিও পশ্চিমের ওই ‘আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তা’ই ওপরে আলোচিত ‘ইতিহাস’রূপী ‘মন্ত্র’-এর শক্তিশালী সামাজিক ভূমিকাকে অগ্রাহ্য করে উপনিবেশ-উত্তর দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রকাঠামোতে বহু জাতিসত্তার সমন্বয়ে সেক্যুলার ‘জাতিরাষ্ট্র’ নির্মাণের চ্যালেঞ্জ রেখে গেছে। শ্রীলঙ্কাও তার ব্যর্থ চেষ্টা করে যাচ্ছে।

চতুর্থত, নতুন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে শ্রীলঙ্কায় প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী যৌথভাবে সংবিধানকে অধিকতর গণতান্ত্রিক ও জবাবদিহিমূলক করার ইঙ্গিত দেওয়ামাত্র সমাজে প্রগতিশীল অনেক আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে। যেমন অতীতে তামিল ও সিংহলি গণতান্ত্রিক আন্দোলনের একটি প্রবল দাবি ছিল কুখ্যাত ‘প্রিভেনশন অব টেররিজম অ্যাক্টের (পিটিএ)’ মতো বিতর্কিত আইনগুলো বাতিল বা এগুলোর সংস্কার সাধন করা। এমনকি ২০১৫ সালের ১ অক্টোবর ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন শ্রীলঙ্কাকে এই মর্মে হুঁশিয়ারও করেছিল যে পিটিএর সংস্কার সাধিত না হলে তারা বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবে। কিন্তু এরূপ পরিস্থিতিতেও আইনি সংস্কার সাধন সহজ হবে বলে মনে হয় না। দীর্ঘ যুদ্ধের মধ্য দিয়ে দেশটিতে সামরিক আমলাতন্ত্রের যে অধিকতর সবল উপস্থিতি তৈরি হয়েছে এবং সিংহলি জাতীয়তাবাদ যে বিজয়মূলক কর্তৃত্বশালী অবস্থায় রয়েছে, তাকে অবদমিত করে সংবিধানে রাষ্ট্রীয় মূলধারার বাইরের ভিন্নমত-ভিন্ন সংস্কৃতি-ভিন্ন মূল্যবোধের জন্য সাংবিধানিক রক্ষাকবচ তৈরি বেশ দুরূহ। ফলে নতুন সংবিধানকে ঘিরে গণতান্ত্রিক মহলের চলতি উচ্চ-আশাবাদ ব্যাপক হতাশাও তৈরি করতে পারে। ইতিমধ্যে সংস্কার প্রস্তাব আকারে যে অধিকারমালা অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে বলে জানা গেছে, তার মধ্যে জীবনের অধিকার, সব লিঙ্গ ও ধর্মের সমানাধিকার ইত্যাদিও রয়েছে। কিন্তু পিটিএর কোনো নমনীয় সংস্করণের আভাস পাওয়া যাচ্ছে না, বরং গণমাধ্যমে ফাঁস হওয়া ‘কাউন্টার টেররিজম অ্যাক্ট’ আকারে যে নতুন আইনের খসড়া দেখা গেছে, তাকে নিয়ে সমাজে ব্যাপক উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।১২

পঞ্চমত, সাংবিধানিক সংস্কার প্রস্তাবে ভোটপদ্ধতি পরিবর্তনেরও চেষ্টা চলছে। বর্তমানে দেশটিতে রাজনৈতিক দলগুলো জেলাভিত্তিক প্রাপ্ত ভোটের হিস্যা অনুযায়ী আসন পেয়ে থাকে। তবে নতুন পদ্ধতিকে সিংহলি, তামিল ও মুসলমান সমাজ দেখবে নিজ নিজ প্রতিনিধিত্বের সংখ্যা হ্রাস-বৃদ্ধির আলোকে। কেউই তাদের প্রতিনিধিত্ব কমবে—এমন কোনো সংস্কারের প্রস্তাব মেনে নেবে না, সেটা যত উত্তমই হোক।

ষষ্ঠত, শ্রীলঙ্কার নতুন সাংবিধানিক পথপরিক্রমায় নেপালের অভিজ্ঞতাও ভীতি ছড়াচ্ছে। নেপাল আপাতদৃষ্টিতে পূর্বাপেক্ষা গণতান্ত্রিক একটি সংবিধান তৈরি করেও ২০১৫-১৬ সময়ে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে পারেনি বড় প্রতিবেশীর সমর্থনপুষ্ট ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিসত্তার লাগাতার আন্দোলনের কারণে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা শ্রীলঙ্কার সামনেও অনুরূপ বিপদ আঁচ করছেন যদি না সম্ভাব্য সাংবিধানিক সংস্কার ভারতের মনঃপূত হয়। সে ক্ষেত্রে সিংহলি-তামিল-মুসলমান তিক্ততা আবারও তীব্রতাই পাবে কেবল। বস্তুত শ্রীলঙ্কার নাগরিকেরা এবং দক্ষিণ এশিয়ার আগ্রহী সবাই দেশটির নতুন সংবিধানে অন্য সব সংস্কার প্রস্তাবের চেয়েও বেশি মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করবে জাতীয় পরিচয়ের ক্ষেত্রে কী সমাধান আসছে, সেদিকে। এ ক্ষেত্রে লক্ষ করা হবে, সংস্কার করা সংবিধান ‘Sri Lankan Identity’-কে সব নাগরিকের মধ্যে বিস্তৃতি দিতে সক্ষম হচ্ছে, নাকি এখনকার বিবদমান ‘Ethnic Identity’-কে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার পদ্ধতি গ্রহণ করেছে। দুটোই কঠিন।

এখনো পারস্পরিক ক্রুদ্ধ অবিশ্বাস

শ্রীলঙ্কায় সিংহলি ও তামিলদের অটল মনস্তাত্ত্বিক ব্যবধান দেখে ১৯৯৮ সালে যুদ্ধরত একজন ব্রিগেডিয়ার হাস্যচ্ছলে বলেছিলেন, শ্রীলঙ্কায় জাতিগত বিবাদ নিরসনের একটিই পথ—তামিল ও সিংহলিদের মধ্যে বেশি বেশি বিয়ের ব্যবস্থা করা। কিন্তু কার্যত এটাও যে কোনো সমাধান নয়, সেটাই প্রমাণিত হয় দেশটির তামিলপ্রধান নর্দান প্রভিন্সের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী সি ভি উইগেনেশরণকে মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করলে। এই লেখা তৈরির সময় (২০১৬ সালে) লক্ষ করা গেছে, সাবেক এই তামিল বিচারপতি প্রায় প্রতিদিনই সিংহলিদের প্রতি সমালোচনামূলক কিছু না কিছু বলে সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় থাকছেন। কিন্তু উইগেনেশরণের দুই পুত্রই প্রভাবশালী সিংহলি রাজনৈতিক পরিবারের নারীদের বিয়ে করেছেন। ফলে তাঁর সিংহলি বিদ্বেষকে স্রেফ রাজনৈতিক কৌশল বলে অগ্রাহ্য করা গেলেও শ্রীলঙ্কার নেতৃস্থানীয় একটি বেসরকারি সংস্থা ‘সেন্টার ফর পলিসি অল্টারনেটিভস’-এর এক জরিপে,১৩ জাতিগত ব্যবধান দূর করা-সংক্রান্ত বিষয়ে মতামত প্রদানকারীদের মধ্যে দেখা গেছে, ৩৫ ভাগ (সিংহলি) মনে করছেন তামিলদের জন্য সরকার যথেষ্ট কিছু করেছে। মাত্র ৩ ভাগ (সিংহলি) বিপরীত মত দিয়েছে। অন্যদিকে ৪০ শতাংশ (তামিল) মনে করেছে সরকার কিছুই করেনি, আর ২ শতাংশ মনে করছে অনেক কিছু করেছে। বাকিরা কোনো মত দেয়নি।

অন্যদিকে একই সংস্থার অপর এক জরিপে দেখা গেছে,১৪ জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই মনে করে, যুদ্ধকালীন মানবাধিকার লঙ্ঘন বিষয়ে আর কোনো তদন্তের প্রয়োজন নেই। আবার যাঁরা বলছেন ওইরূপ বিষয়ে তদন্ত ও বিচার প্রয়োজন—তাদের মধ্যেও ব্যাপক মতপার্থক্য রয়েছে—বিচার আন্তর্জাতিক কাঠামোতে হবে, নাকি অভ্যন্তরীণ কাঠামোতে হবে, সে বিষয়ে।

সিংহলি-তামিল মনস্তাত্ত্বিক দূরত্ব ও পারস্পরিক অবিশ্বাসের আরেকটি স্মারক দেখা যায় নর্দান প্রভিন্সজুড়ে ব্যাপক সামরিক উপস্থিতির মধ্য দিয়েও। সেখানে তামিলদের বর্তমান অসন্তোষের অন্যতম একটি কারণ হলো তামিল মালিকানাধীন জমিগুলোতে অনেক সেনাচৌকির অবস্থান। কিন্তু সিংহলি শাসক এলিটদের পক্ষেও সেখান থেকে সামরিক উপস্থিতি প্রত্যাহার বা কমিয়ে আনার সুযোগ রয়েছে কমই—কারণ, রাষ্ট্রকে তামিলরা তদ্রূপ আত্মবিশ্বাসী দিতে পারেনি। উত্তর ও পূর্বাঞ্চলের পরিস্থিতিতে এমন উপাদান বিরল নয়, যা থেকে প্রতীয়মান হয় যে সামরিক বাহিনী সরে গেলে সেখানে আবার সশস্ত্রতা গড়ে উঠতে পারে। সিংহলি ও তামিলরা যে পরস্পরকে আস্থায় নিতে পারেনি, এটা তারই স্মারক।

এরূপ বৈরিতা কেবল উত্তর বা পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশে সীমাবদ্ধ নেই। এমনকি তা দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বহির্বিশ্বেও বিস্তৃত। যেমন এই লেখা যখন তৈরি হচ্ছিল তখন, ২০১৬ সালের ৪ সেপ্টেম্বর, মালয়েশিয়ায় নিযুক্ত শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রদূত ইব্রাহিম সাহিব আনসারকে সে দেশে থাকা তামিলরা দল বেঁধে কুয়ালালামপুর বিমানবন্দরে ‘নিরাপত্তা চৌহদ্দি’র মধ্যে মারাত্মকভাবে লাঞ্ছিত করেছে। আক্রমণকারী এই তামিলরা নিজেদের পরিচয় দিচ্ছিল, ‘আমরা তামিল’ (NaamThamizhar) নামে একটি দলের সদস্য হিসেবে এবং তাদের শরীরে এলটিটিইর প্রয়াত নেতা প্রভাকরণের ছবি শোভা পাচ্ছিল। রাষ্ট্রদূত ইব্রাহিম সাহিব সেদিন তাঁর দেশের একজন মন্ত্রীর আগমন ও অপর দুই মন্ত্রীর দেশে ফিরে যাওয়ার মুহূর্তে বিমানবন্দরে প্রটোকল অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করছিলেন। মালয়েশিয়া সরকারের পক্ষ থেকে এ ঘটনার অধিকতর তদন্তকালে দেখা যায়, আক্রমণকারীরা মূলত সাবেক প্রেসিডেন্ট রাজাপক্ষেকে খুঁজছিল এবং তারা তামিল হলেও দেশটিতে ভারতীয় পাসপোর্টধারী এবং তাদের নেতা হলেন দক্ষিণ ভারতীয় অভিনেতা ও পরিচালক সিমান (Seeman)।

বলা বাহুল্য, এ ঘটনা শ্রীলঙ্কাজুড়ে বিশেষ মনোযোগ পেয়েছে এবং সবার মধ্যেই এই মর্মে উদ্বেগ তৈরি করেছে যে এ ঘটনায় আক্রমণকারীরা যদি সাবেক রাষ্ট্রপতি রাজাপক্ষেকে আক্রমণ করতে সক্ষম হতো, তাহলে তার প্রতিক্রিয়াস্বরূপ দেশে বড় আকারে সাম্প্রদায়িক হানাহানি শুরু হয়ে যেতে পারত।

এদিকে মালয়েশিয়ার এ ঘটনার পরপরই দেশটির নর্দান প্রভিন্সের মুখ্যমন্ত্রী সি ভি উইগেনেশরণের একটি রাজনৈতিক উদ্যোগও এলটিটিই-বিরোধী ও একই সঙ্গে বর্তমান সরকারবিরোধী বদু বালা সেনাসহ (বিবিএস) সিংহলি প্রাধান্যপূর্ণ অনেক দলকে ক্ষুব্ধ করে তুলেছে। তামিলপ্রধান প্রদেশের তামিল মুখ্যমন্ত্রী উইগেনেশরণ তামিলদের আবার উঠে দাঁড়ানোর লক্ষ্যে ২০১৬-এর ২৪ সেপ্টেম্বর একটি গণমিছিলের আয়োজন করেন। তামিল ভাষায় তিনি একে অভিহিত করেছেন ‘Eluga Tamil’ (Rise Tamil) মিছিল নামে এবং এই মিছিল থেকে তামিলপ্রাধান্যপূর্ণ এলাকাগুলো থেকে বুদ্ধমূর্তি অপসারণ ও নর্দান প্রভিন্স থেকে সেনাবাহিনী প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়।

সি ভি উইগেনেশরণ তামিল জোট টিএনএ থেকে প্রদেশটিতে মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হলেও ‘Eluga Tamil’ উদ্যোগ নেওয়া হয় তাঁর নেতৃত্বে গঠিত তামিল পিপলস কাউন্সিল (টিপিসি) নামের একটি ব্যানার থেকে এবং এ আয়োজনকে এলটিটিই সহানুভূতিশীলদের একটি অহিংস মহড়া হিসেবেও দেখা হচ্ছে। তাঁর এই উদ্যোগের সমালোচনা করে সিংহলি রাজনীতিবিদদের একাংশ বলছে, যে মুহূর্তে জাতিগত বিভেদ অতিক্রম করে সব সম্প্রদায়ের সম্মিলিতভাবে উঠে দাঁড়ানো উচিত, সে মুহূর্তে তামিল প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী শুধু তামিলদের উঠে দাঁড়াতে বলা ২০০৯-পূর্ব সময়কে ডেকে আনা। এরূপ সমালোচকেরা মালয়েশিয়া অধ্যায়ের সঙ্গে সি ভি উইগেনেশরণের রাজনৈতিক উদ্যোগকে একই সূত্রে প্রোথিত দেখাতে ইচ্ছুক এবং তাঁদের মতে Eluga Tamil শোভাযাত্রা দেশটির আন্তসাম্প্রদায়িক স্পর্শকাতরতাকে নতুন করে জ্বালানি দিয়েছে।

যথারীতি কয়েক দিন পরই নর্দান প্রভিন্সেরই ভাবুনিয়াতে Eluga Tamil শোভাযাত্রার বিরুদ্ধে সমাবেশ ও মিছিল করেছে ‘বধু বালা সেনা’ (Bodu Bala Sena/Buddhist Power Force) নামের ডানপন্থী প্রভাবশালী ধর্মপ্রভাবিত দলটি। এমনকি দেশটির নর্দান প্রভিন্সিয়াল কাউন্সিল থেকে এমন দাবিও করা হয়েছে যে Eluga Tamil শোভাযাত্রা করার পর থেকে উইগেনেশরণকে হত্যার হুমকি দেওয়া হচ্ছে।১৫

আপাতদৃষ্টিতে এসব সমাবেশ ও পাল্টাসমাবেশকে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা আসন্ন নতুন সংবিধানকে ঘিরে জাতিগত দর-কষাকষির মহড়া হিসেবে বিবেচনা করলেও এ-ও সত্য, এরূপ ধারাবাহিকতা নিকট ভবিষ্যতে আরও তীব্রই হবে। কারণ, সিংহলি ও তামিল চরমপন্থী কোনো পক্ষই চাইছে না সংবিধানে জাতিগত বিভেদের এমন কোনো মধ্যপন্থী সমঝোতামূলক সমাধান আসুক, যা তাদের রাজনৈতিকভাবে প্রভাবহীন করে ফেলে।

Eluga Tamil (Rise Tamil) মিছিলকে কেন্দ্র করে ইতিমধ্যে তামিল আর্থসামাজিক পরিমণ্ডলেও ব্যাপক বিতর্ক হচ্ছে। এরূপ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বর্ণবাদী ও সাম্প্রদায়িকতা উসকে দিচ্ছে কি না, সে প্রশ্ন উঠেছে। উদ্যোক্তারা এরূপ আয়োজনের পেছনে তামিলদের ‘ন্যায্য দাবিদাওয়া’ উত্থাপনের প্রয়োজনীয়তার কথা বললেও সেখানে উত্তরাঞ্চল থেকে গৌতম বুদ্ধের মূর্তি অপসারণের দাবি বেশ জোরালোভাবেই উচ্চারিত হয়। স্বভাবত তামিলদের তরফ থেকে এরূপ স্পর্শকাতর দাবি ওঠায় দেশটির দক্ষিণে যেসব প্রগতিশীল সিংহলি নাগরিক তামিলদের সঙ্গে সমঝোতার লক্ষ্যে জনমত গঠনে সক্রিয়, তাদের কাজের পরিসর অনেক কমে গেছে। এ ধরনের রাজনৈতিক তত্পরতা এই বার্তাও দিচ্ছে যে তামিল পরিমণ্ডল এলটিটিইর অতীত রাজনৈতিক ও সামরিক নীতিকৌশলের কোনো আত্মসমালোচনা বা পর্যালোচনার লক্ষণ নেই এবং তারা বঞ্চনাভিত্তিক ইতিহাস-কাঠামো থেকে বেরিয়ে গঠনমূলক এমন কোনো অবস্থান নিতে সক্ষম হচ্ছে না, যাতে সিংহলি সমাজে তাদের ঘিরে সন্ত্রাসের ভয় লাঘব হয়। এ ক্ষেত্রে অস্ট্রেলিয়া-প্রবাসী একজন তামিল মোহন সেগারাম (Mohan Segaram)-এর নিম্নোক্ত বক্তব্য বিশেষ মনোযোগ দাবি করে:

We cannot forget what happened for the past three decades, however we need to put aside our emotions, despair and remember those lives, which were lost in bloody war in the name of ‘equality’. We (Tamils) have to now reconcile and win the trust of the nation…We are hanging on to views and ideologies, which formed thirty years ago, which are not appropriate anymore. I think that, in the past 20 years we have created a doubt in the minds of the Sinhalese and the nation, making them wonder whether every other Tamil is a Tamil Tiger or not.১৬

মোহন সেগারামের উল্লিখিত প্রত্যাশা বাস্তবায়িত হওয়ার প্রতিবন্ধকতা অনেক। যদিও তামিলদের বর্তমানের প্রধান রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম টিএনএও উল্লিখিত Eluga Tamil (Rise Tamil) মিছিলের উদ্যোগের বিরোধিতা করেছে কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে, বিশেষত আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এলটিটিইর যে যোগাযোগ নেটওয়ার্ক সক্রিয়, তারা বিভেদের ইতিহাসকে বাজারজাত করা বন্ধ করবে, এমন ভাবার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। তাদের দক্ষতাপূর্ণ প্রচারযুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক প্রচারমাধ্যমে শ্রীলঙ্কার জাতিগত সংকটের জন্য সিংহলিদেরই একতরফাভাবে দায়ী করা হয় এবং এর প্রতিক্রিয়া হিসেবেও দেশটিতে জাতিরাষ্ট্রের চেতনা প্রতিনিয়ত অবজ্ঞাত হয়।

অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সমীকরণ ও আসন্ন ‘স্তালিনগ্রাদ যুদ্ধ’

বর্তমানে শ্রীলঙ্কায় প্রেসিডেন্ট সিরিসেনার মেয়াদের তৃতীয় বছর এবং প্রধানমন্ত্রী বিক্রমাসিংহের মেয়াদের দ্বিতীয় বছর চলছে। অর্থাত্ সর্বশেষ প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়েছে ২০১৫ সালের ৮ জানুয়ারি এবং পার্লামেন্ট নির্বাচন হয়েছে ২০১৫ সালের ১৭ আগস্ট। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকালে এবং পার্লামেন্ট নির্বাচন শেষে দেশটির অভূতপূর্ব দুটি ঘটনা ঘটেছে, যা শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সুদূরপ্রসারী কিছু জটিলতার জন্ম দিয়েছে।

প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ফ্রিডম পার্টির রাজাপক্ষে হেরেছিলেন তাঁর দলেরই অপর প্রার্থী সিরিসেনার কাছে। সিরিসেনাকে সমর্থন দিয়েছিল ফ্রিডম পার্টিরই চিরশত্রু ন্যাশনাল পার্টি। আবার পার্লামেন্ট নির্বাচনে ন্যাশনাল পার্টি ২২৫ আসনের সংসদে ১০৬ আসন পেয়েও সরকার গঠন করতে পেরেছিল ফ্রিডম পার্টির একাংশের সমর্থনে, যে একাংশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন সিরিসেনা। ফ্রিডম পার্টি পার্লামেন্ট নির্বাচনে ৯৫টি আসন পেয়েছিল।

উপরিউক্ত পরিস্থিতিতে শ্রীলঙ্কায় নতুন যে অদ্ভুত অবস্থা তৈরি হয়েছে তা হলো দেশটির পার্লামেন্টে কার্যত কোনো বিরোধী দল নেই। যেহেতু দেশটির প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী প্রধান দুটি দলের পরিচয়ধারী এবং তাঁরা মতৈক্যের ভিত্তিতে দেশের নীতিনির্ধারণ করছেন এবং পরস্পরকে রাজনৈতিকভাবে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন তাতে দেশে, বিশেষ করে পার্লামেন্টে বিরোধী দল না থাকাই স্বাভাবিক। তবে এর মধ্যেই পার্লামেন্টের কিছু সদস্য মিলে ‘সম্মিলিত বিরোধী গ্রুপ’ নামে একটি জোট গড়ে তুলেছেন। এই জোটে রয়েছেন ফ্রিডম পার্টির (রাজাপক্ষে সমর্থক) একাংশের এমপিরা এবং জেভেপি (জনতা বিমুক্তি পেরামুনা) ও অন্যান্য ছোট ছোট কয়েকটি দলের এমপিরা।১৭

আলোচ্য ‘সম্মিলিত বিরোধী গ্রুপ’ নামের জোটটি গড়ে উঠেছে মূলত ফ্রিডম পার্টির অভ্যন্তরে সিরিসেনা ও রাজাপক্ষের বিভেদের পটভূমিতে। এই বিভেদ ক্রমে বাড়ছে এবং রাজাপক্ষের অনুসারীরা ক্রমে ফ্রিডম পার্টি থেকে নিজেদের পৃথক রাজনৈতিক সত্তা আকারে হাজির করছেন। এই রাজনৈতিক প্রক্রিয়া পূর্ণতা পেতে আরও কিছু সময় লাগলেও দ্রুত তা শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে দীর্ঘ ছায়া তৈরি করছে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে ফ্রিডম পার্টির সংখ্যাগরিষ্ঠ এমপি ও সংগঠক রাজাপক্ষের পক্ষেই রয়েছেন।

ফ্রিডম পার্টির এরূপ বিভক্তি দেশটির রাজনীতির বিদ্যমান ভারসাম্য ও সমীকরণ পুরোই পাল্টে দেবে। কিন্তু তার স্পষ্ট রূপটি এখনো বোঝা না গেলেও এর সরাসরি একটি প্রতিক্রিয়া হবে গণভোটকালে। নতুন সংবিধানকে চূড়ান্তভাবে কার্যকর হতে হলে গণভোটে তা অনুমোদিত হতে হবে। আর গণভোটকালে রাজাপক্ষে যদি সিরিসেনা-বিক্রমাসিংহে সমর্থিত রাজনৈতিক-সাংবিধানিক সংস্কারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন, যা প্রায় নিশ্চিত, তাহলে দেশটিতে বহুল প্রত্যাশিত ‘জাতীয় মতৈক্য’ সুদূরপরাহতই থেকে যাবে এবং ‘সাংবিধানিক এক ঠান্ডাযুদ্ধ’-এর জন্ম হবে।১৮ আবার গণভোটে তাদের প্রত্যাশিত ফল না আসার সম্ভাবনা দেখলেই তামিল রাজনৈতিক দলগুলো কোনো না কোনো অজুহাতে গণভোট বয়কট করবে। এটাও জাতীয় মতৈক্যের সম্ভাবনা বিঘ্নিত করবে।

এদিকে ২০০৯-এর পর থেকে দেশটির রাজনীতিতে তামিল সশস্ত্র সংগঠনগুলোর অনুপস্থিতিজনিত শূন্যতা পূরণে রাজনৈতিকভাবে এগিয়ে এসেছে তামিল ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স (টিএনএ) নামের জোট। এই জোট গড়ে উঠেছে সাবেক সশস্ত্র গ্রুপগুলোর নেতা ও মধ্যপন্থী তামিল রাজনীতিবিদদের সমন্বয়ে। এরাই বর্তমানে তামিলদের পক্ষে মূল রাজনৈতিক দর-কষাকষি করে থাকে। ২০১৫ সালের নির্বাচনে এই জোট ১৬টি আসন পেয়ে পার্লামেন্টে প্রধান বিরোধী দলে পরিণত হয়েছে। তবে সরকার পরিচালনায় তারা আবার বর্তমান ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক মিত্র।

টিএনএ তামিলদের জন্য পৃথক আবাসভূমির পরিবর্তনে উত্তর ও পূর্বের প্রদেশ সমন্বয় করে সেই একীভূত প্রদেশে স্বায়ত্তশাসন পেলেই সন্তুষ্ট হবে বলে জানিয়েছে। তবে এখনো তারা এলটিটিইকেই তামিলদের মূল প্রতিনিধি মনে করে। ধারণা করা যায়, টিএনএ সিরিসেনা ও বিক্রমাসিংহে সমর্থিত সাংবিধানিক-রাজনৈতিক সংস্কারের সমর্থকের ভূমিকায় থাকবে। তবে তামিলদের একাংশের মধ্যে টিএনএকে নিয়েও হতাশা রয়েছে। কারণ, নর্দান প্রভিন্সে এখন ক্ষমতায় রয়েছে তারা। কারণ নর্দান প্রভিন্সে টিএনএ ক্ষমতায় থাকলেও সেখানে তামিল সমাজের জন্য তারা প্রশাসনিকভাবে উল্লেখযোগ্য কিছু করতে পারেনি। আবার যুদ্ধ-পরবর্তী নিরাপত্তার সুযোগে টিএনএ তথা এলটিটিইবিরোধী তামিল সংগঠনগুলোও মাঠে কাজ করছে। ফলে ভবিষ্যতে টিএনএর প্রতিই তামিলদের সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন বহাল থাকবে কি না, সেটাও প্রশ্নবিদ্ধ।

বিগত বছরগুলোর অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, জাতীয়তাবাদী সিংহলিদের মোকাবিলায় ও ভারতের দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে টিএনএ তার রাজনৈতিক কৌশল পরিচালনা করে থাকে। যেমন ২০১০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তারা সাবেক সেনাপ্রধান শরথ ফনসেকাকে সমর্থন দিয়েছিল। এই শরথ ফনসেকাই এলটিটিইকে পরাজিত করার চূড়ান্ত যুদ্ধে শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনীকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। আবার ২০১৫ সালের সর্বশেষ নির্বাচনে সিরিসেনার দলকে সমর্থন জানায় তারা। অন্যদিকে ফনসেকাও এখন সিরিসেনাকে সমর্থন করছেন এবং একই সঙ্গে ন্যাশনাল পার্টির বিক্রমাসিংহের মন্ত্রিসভায় রয়েছেন।

রাজনৈতিক সমর্থনের সতত পরিবর্তনশীল এরূপ ধারা শ্রীলঙ্কায় পুরোনো ঐতিহ্য। এরূপ ঐতিহ্যের মধ্যেই শিগগিরই ঘোষিত হবে রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক সংস্কার প্রস্তাবসমূহ এবং একে ঘিরে পরিস্থিতি কিরূপ উত্তপ্ত হবে তার আলামত ইতিমধ্যে দৃশ্যমান। বিশেষ করে দেশটির ধর্মীয় পরিচয়, উত্তর ও পূর্বাঞ্চলকে দেওয়া স্বায়ত্তশাসনের ধরন, এককেন্দ্রিক রাষ্ট্রের বিপরীতে ফেডারেল ব্যবস্থা, বিচার বিভাগকে কতটুকু স্বাধীনতা দেওয়া হবে এবং প্রেসিডেন্ট ও পার্লামেন্টের সিদ্ধান্ত পর্যালোচনার ক্ষমতা বিচার বিভাগের থাকবে কি না, প্রেসিডেন্ট ও পার্লামেন্টের হাতে কতটুকু নির্বাহী ক্ষমতা থাকবে ইত্যাদি নিয়ে এই লেখা চলাকালেই দেশটিতে বিতর্ক শুরু হয়ে গেছে। বিশেষ করে নর্দান ও ইস্টার্ন প্রভিন্স একত্র করে একটি একক (তামিল) প্রভিন্স সৃষ্টি অন্যতম বিবাদিত বিষয় হয়ে উঠেছে। সাবেক প্রেসিডেন্ট এবং বর্তমান প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর অন্যতম সমর্থক চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গা দেশটিতে ফেডারেল ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পক্ষে অভিমত ব্যক্ত করেছেন সম্প্রতি।১৯ যদিও অতীতে দেশটির ক্ষমতাসীন সব সরকারই ফেডারেল ব্যবস্থার দাবি অগ্রাহ্য করেছে। সিংহলি দক্ষিণে এরূপ মনোভাব প্রবল যে ফেডারেল ব্যবস্থার অংশ হিসেবে উত্তর ও পূর্বাঞ্চলে একক তামিল প্রদেশ তৈরি মানেই তাতে পার্শ্ববর্তী তামিলনাড়ুর প্রভাবকে অনুপ্রবেশের সুযোগ দেওয়া এবং কলম্বোকেন্দ্রিক দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পরোক্ষ বিচ্ছিন্নতা তৈরি। অথচ এই দাবিটি তামিলদের অন্যতম প্রধান দাবি। ফলে এই সমস্যার যে সমাধানই সংবিধানে প্রস্তাব করা হোক, তা গণভোটে আসামাত্রই তীব্র রাজনৈতিক ভিন্নমত দেখা দেবে। বিশ্লেষকেরা যাকে বলছেন ‘শ্রীলঙ্কার স্তালিনগ্রাদ যুদ্ধ’।২০

যুদ্ধাপরাধের বিচার ও যুদ্ধ-উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন

সংবিধান ও রাজনৈতিক ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের মতোই যুদ্ধোত্তর শ্রীলঙ্কার অন্যতম বিবাদিত বিষয় যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রশ্ন। দেশটির গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারকেরা যখনই আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের মুখোমুখি হন, তখনই এ বিষয়ে প্রশ্ন ওঠে। সচরাচর তারা এ বিষয়ে উক্তরূপ অপরাধ ঘটার কথা স্বীকার করেন। উপরন্তু দেশটিতে যুদ্ধজয়ী সেনাবাহিনীকে বীর হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু তামিল সশস্ত্র সংগঠনগুলোকে নিমূর্লের সফলতায় সেই সময়কার সেনাপ্রধান ফনসেকা দেশটির দক্ষিণের সিংহলি জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠের কাছে এখন নায়ক হিসেবে বিবেচিত হলেও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অনেকেরই তাঁর কার্যকালে সেনাবাহিনী যুদ্ধাপরাধ করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। বলাবাহুল্য, যেকোনো গণতান্ত্রিক সমাজে সেনাবাহিনীর যুদ্ধাপরাধের দায় রাষ্ট্র ও সরকারের ওপরও বর্তায়। চূড়ান্ত যুদ্ধকালে শ্রীলঙ্কায় ক্ষমতায় ছিলেন রাজাপক্ষে। ক্ষমতায় থাকাকালে রাজাপক্ষে চীনপন্থী পদক্ষেপ নিতে থাকায় যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত তার বিরুদ্ধে সম্মিলিত অবস্থান নিয়েছিল। ফলে দেশটির এখনকার রাজাপক্ষেবিরোধী নেতৃত্বের ওপর যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের স্বার্থরক্ষার বিশেষ চাপ রয়েছে। পাশাপাশি রাজাপক্ষেকে চাপে রাখতে এলটিটিই নির্মূলাভিযানের সময় শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনী যুদ্ধাপরাধ করেছে বলে প্রবাসী তামিলরা যে প্রচারণা গড়ে তুলেছে, তা-ও চলমান রাখা হয়েছে। এর মাধ্যমে শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনী ও সিংহলি জাতীয়তাবাদীদের চাপে রাখার কৌশল নেওয়া হয়েছে এবং তা অত্যন্ত কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। যুদ্ধের পরপর দীর্ঘ সময় তামিলনাড়ুতে এই দাবি খুবই জোরদার ছিল যে ভারতের উচিত শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করা, যাতে দেশটি ২০০৯ সালের যুদ্ধাপরাধের তদন্তে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সুযোগ দিতে বাধ্য হয়। কিন্তু কলম্বোতে ভারতের প্রতি সহানুভূতিশীল সরকার ক্ষমতায় আসামাত্র এই দাবি এখন আর শোনা যায় না। তবে ইতিমধ্যে ভারত জাতিসংঘের ১৯তম অধিবেশনে যুক্তরাষ্ট্রের এরূপ প্রস্তাবে সমর্থন দিয়েছে, যাতে দেশটিকে যুদ্ধকালীন মানবাধিকার লঙ্ঘনের তদন্তের দাবি জানানো হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এ ক্ষেত্রে খুবই উত্সাহী। ইউরোপীয় ইউনিয়নের থিংকট্যাংক ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ’ তামিল-প্রশ্নে আন্তর্জাতিকভাবে খুবই সক্রিয় এখন। তারা বিশেষভাবে তামিল-অধ্যুষিত এলাকায় শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ কমানোর জন্য চাপ দিচ্ছে।২১ যা কার্যত এলটিটিইকে পুনরায় সংগঠিত হওয়ার সুযোগ করে দেবে। আন্তর্জাতিক মহল যুদ্ধাপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে কেবল শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনীর যুদ্ধাপরাধের প্রসঙ্গ তুলে ধরলেও এলটিটিইও যে মুসলমান ও সিংহলি বেসামরিক নাগরিকদের নির্বিচারে হত্যা করেছে, সে বিষয় উল্লেখ করছে কমই। তবে যুদ্ধাপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে এখনো বাস্তব অগ্রগতি কম। যুদ্ধকালে নিখোঁজ ব্যক্তিদের বিষয়ে শ্রীলঙ্কা সরকার একটা কমিশন গঠন করলেও অন্যান্য যুদ্ধাপরাধ তদন্তে তারা নিজস্ব উদ্যোগের ওপরই শুধু জোর দিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে প্রধান এক সমস্যা হলো, দেশটির জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আপাতদৃষ্টিতে স্বাধীন হলেও তারা এরূপ তদন্ত ও তার প্রতিকারের জন্য কাঠামোগতভাবে সামর্থ্যবান সংস্থা নয়। দ্বিতীয়ত, যুদ্ধাপরাধের তদন্ত ও বিচারের জন্য প্রত্যক্ষদর্শী ও ক্ষতির শিকার উভয়ের জন্য দীর্ঘস্থায়ী নিরাপত্তার প্রয়োজন, যা রাজনৈতিক মতৈক্য ছাড়া সম্ভব নয়। আবার এরূপ তদন্ত ও বিচারের জন্য রাষ্ট্রীয় সশস্ত্র ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর পূর্ণ সহযোগিতার অঙ্গীকার প্রয়োজন, যা নিশ্চিতভাবেই রাজনৈতিক নেতৃত্বের দৃঢ় অঙ্গীকার ছাড়া সম্ভব নয়। কিন্তু চরমভাবে দ্বিধাবিভক্ত শাসক এলিটদের মধ্যে এরূপ আন্তরিক অঙ্গীকার রয়েছে বলে এখনো মনে হয় না।

একইরূপ অঙ্গীকারের প্রশ্ন আসে যুদ্ধ-উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের প্রশ্নেও। শ্রীলঙ্কার যুদ্ধ হয়েছে প্রায় তিন দশক ধরে। ফলে বহু দফায় এখানে মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছে। যদিও চূড়ান্ত যুদ্ধের সময় উদ্বাস্তু সমস্যার ঢেউ বয়ে যায়। এরূপ উদ্বাস্তুদেরই ভাবুনিয়া জেলার বিভিন্ন স্কুলে ক্যাম্প করে রাখা হয়। সে সময় এসব ক্যাম্পের নাম দেওয়া হয় ‘welfare centres’ এবং সরকারিভাবে প্রায় ২ লাখ ৮০ হাজার এরূপ অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুর কথা বলা হলেও এক বছরের মধ্যে দাবি করা হয় যে সংখ্যাগরিষ্ঠ উদ্বাস্তুকে ‘পুনর্বাসন’ করা হয়েছে এবং ২০১২ সালের সেপ্টেম্বর থেকে উদ্বাস্তু ক্যাম্পগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বন্ধ’ ঘোষণাও করা হয়। তবে সরকারি-বেসরকারি সবাই স্বীকার করেন, ক্যাম্প বন্ধ হলেও সমস্যাটি রয়েই গেছে দেশটিতে।২২

অন্যদিকে অতীতে ও বর্তমানেও উদ্বাস্তু-সংকট এক গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক সমস্যা হিসেবে স্বীকৃত হলেও এর প্রকৃত সংখ্যা বিষয়ে নির্ভরযোগ্য কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। এ বিষয়ে বাস্তবসম্মত কোনো ম্যাপিং নেই। এই গ্রন্থ রচনার সময়ও বিভিন্ন সূত্রে দেশটিতে প্রায় ৪০ হাজার অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু রয়েছে বলে জানা যায়।২৩ ২০১৫ সালে এই সংখ্যা ছিল ৭৫ হাজার। নর্দান, ইস্টার্ন ও নর্থ-ইস্টার্ন প্রভিন্সেই অধিকাংশ উদ্বাস্তুর বাস।

রাজনৈতিক ও সামরিক কারণ ছাড়াও ২০০৪ সালের ২৬ ডিসেম্বরের সুনামির ফলে উদ্বাস্তু সমস্যা অধিকতর জটিল হয়েছে। আবার উদ্বাস্তুদের মধ্যে চূড়ান্ত যুদ্ধকালীন ‘নতুন উদ্বাস্তু’ এবং ১৯৮৩ থেকে সৃষ্ট ‘পুরোনো উদ্বাস্তু’ থাকলেও প্রথমোক্ত উদ্বাস্তুদের সমস্যাই সাধারণভাবে আলোচনায় আসছে। ফলে চূড়ান্ত যুদ্ধের বহু আগে এলটিটিই দ্বারা নর্দান প্রভিন্স থেকে উত্খাত হওয়া অ-পুনর্বাসিত অন্তত ৬০ হাজার মুসলমান উদ্বাস্তুর কথা কমই এখন আলোচনায় আসে।

সরকার ধারাবাহিকভাবে যুদ্ধের কারণে উদ্বাস্তু হওয়া মানুষদের পুনর্বাসন করা হচ্ছে বলে দাবি করলেও সেই ‘পুনর্বাসন’ কতটা টেকসইভাবে হচ্ছে বা হয়েছে, তা নিয়ে তামিলদের মধ্যে বিবিধ অসন্তোষ রয়েছে এবং দেশের বাইরে, বিশেষ করে ভারতেও এরূপ প্রায় ৬৫ হাজার উদ্বাস্তু রয়েছে পুনর্বাসনের অপেক্ষায়, যাদের ফেরত আনার বিষয়ে শ্রীলঙ্কা সরকারের জন্য সহজ নয়। কারণ তাদের মধ্যে কে এলটিটিইর সদস্য আর কে নয়, সেটা শনাক্ত করা দুরূহ। ভারত নিজেও যুদ্ধ-পরবর্তী পুনর্বাসনের নামে শ্রীলঙ্কার মাটিতে উপস্থিত রয়েছে। ইতিমধ্যে তারা যুদ্ধবিধ্বস্ত তামিলদের জন্য ৫০ হাজার বাড়ি তৈরির এক প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।

যদিও দেশটির সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রের তরফ থেকে সব নাগরিক সুরক্ষা পাওয়ার অধিকারী এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মানবাধিকার সনদেও শ্রীলঙ্কা স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্র কিন্তু যুদ্ধের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ও উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন প্রকৃতই দেশটিতে বড় এক চ্যালেঞ্জ। সরকারি ভাষ্য অনুযায়ী যেসব উদ্বাস্তুকে ‘পুনর্বাসিত’ বলা হচ্ছে, কার্যত তাদের অনেকে ‘মূল বাসস্থানে ফেরত’ যেতে পারেনি। কেউ কেউ তাদের গ্রামেও যেতে পারেনি। হয়তো কোনো নিকটাত্মীয়ের কাছে ফিরে গেছে। আবার কেউ কেউ নিজ গ্রামে ফিরে যেতে পারলেও হয়তো বাসস্থান বিধ্বস্ত হয়ে আছে কিংবা কৃষিজমি ফিরে পায়নি বা পুরোনো পেশায় ফিরে যাওয়ার উপায় নেই—এরূপ সমস্যা রয়েই গেছে। অনেক এলাকায় নিরাপত্তাহীনতার সংকট রয়ে যাওয়ায় ‘ফেরত যাওয়া’ মানুষেরা দিনে এক জায়গা এবং রাতে ভিন্ন জায়গায় থাকে। আবার অনেক স্থানেই আবাদি জমিগুলো মাইন কিংবা অবিস্ফোরিত অস্ত্রে ভরে আছে। কোথাও কোথাও এলাকাগুলো এখনো সামরিক বাহিনীর ‘হাইসিকিউরিটি জোন’ অভিধা দিয়ে অপ্রবেশযোগ্য ঘোষণা করে রাখা হয়েছে। আবার এমনও দৃষ্টান্ত রয়েছে ‘হাইসিকিউরিটি জোন’গুলো একপর্যায়ে ‘কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে’ ‘স্পেশাল ইকোনমিক জোন’ ঘোষণা করা হচ্ছে। ইস্টার্ন প্রভিন্সের ত্রিংকোমালির শ্যামপুরে এরূপ ঘটেছে। তাতে এক স্থানেই প্রায় ছয় হাজার অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুর পুনর্বাসন বিঘ্নিত হয় এবং পুরোনো মালিকদের পুরোনো পেশা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।২৪

অন্যদিকে অনেক উদ্বাস্তুই ভোটাধিকার-বঞ্চিত। কারণ ভোট দিতে হলে নিজ জেলায় ভোটার হিসেবে নথিভুক্তির বাধ্যবাধকতা রয়েছে। ফলে ‘পুনর্বাসন’, ‘ফিরে যাওয়া’, ‘নিরাপদ বাসস্থানে ফিরে যাওয়া’, ‘নিজ জেলায় ফিরতে পারা’, ‘জীবন-জীবিকা ফিরে পাওয়া’ ইত্যাদির মধ্যে বেশ ফারাক রয়েছে। যদিও সরকারি নীতিনির্ধারকেরা ইত্যাদি শব্দগুচ্ছের ফারাকটুকু ঊহ্য রেখেই প্রায়ই অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের দাবি করে যাচ্ছেন। আবার মানবিক ক্ষতি ছাড়াও যুদ্ধ অনেকেরই আয়-রোজগারের সবটুকু কেড়ে নিয়েছে। এরূপ মানুষদের ‘ক্ষতি’ কীভাবে ‘পূরিত’ হবে, সেটাই বস্তুত যুদ্ধের পর থেকে শ্রীলঙ্কার জন্য প্রধান মনোযোগের বিষয়। এরূপ ক্ষতিপূরণ আবার তখনই কেবল টেকসই হতে পারে যখন যুদ্ধোত্তর শান্তি ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি টেকসই কোন পাটাতন পাবে। কার্যত সে ক্ষেত্রে শ্রীলঙ্কা এখনো পুনর্গঠন-প্রক্রিয়ায় রয়েছে।

সামগ্রিকভাবে বলা যায়, জাতিবিদ্বেষ-সংক্রান্ত রাজনৈতিক-সামরিক সমস্যার মতোই তা থেকে উদ্ভূত উদ্বাস্তু-সংকটও শ্রীলঙ্কা সাত বছর পরও চূড়ান্তভাবে সমাধান করতে পারেনি।২৫ অনেক উদ্বাস্তু রয়েছে বিধবা, অনেক রয়েছে পিতা-মাতাহীন শিশু। আবার এমন নারীও রয়েছেন যাঁরা এখনো তাঁদের নিখোঁজ স্বামীদের খুঁজছেন এবং অনেক শিশু রয়েছে, যারা এলটিটিইর যোদ্ধা হিসেবে রিক্রুট হয়েছিল। এরূপ উদ্বাস্তু নারী, বিধবা২৬ ও পিতা-মাতাহীন শিশু এবং শিশু যোদ্ধাদের পুনর্বাসনের সঙ্গে বিবিধ মানবিক সহায়তার প্রশ্নও জড়িত। দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরে জানিয়েছিল যে তারা অন্তত ১,০৩৬ পিতা-মাতাহীন শিশুকে মান্নার ও ভাবুনিয়ার এতিমখানাগুলোয় পাঠিয়ে দিয়েছে।২৭ বলা বাহুল্য, এরূপ শিশুদের শুধু এতিমাখানায় পাঠানোই ‘পুনর্বাসন’ শর্ত পূরণ করে না, বরং তাদের প্রয়োজন দীর্ঘ মনস্তাত্ত্বিক সহায়তা। অন্যদিকে যেসব যুদ্ধবিধবা স্বামীদের ডেথ সার্টিফিকেট দেখাতে পারছেন তাঁদের ৫০ হাজার টাকা করে সহায়তার ঘোষণা এলেও এরূপ ডেথ সার্টিফিকেট জোগাড় করা অনেকের পক্ষেই সহজ নয় (এরূপ বিধবাদের মাসে ১৫০ রুপি করে সহায়তা দেওয়া হয়) এবং যাঁরা মনে করছেন তাঁদের নিখোঁজ স্বামীকে ফিরে পাবেন, তাঁদের জন্য এরূপ সহায়তার জন্য চেষ্টা করাই মানসিকভাবে অসম্ভব।

আবার যুদ্ধ শেষে প্রায় ১২ হাজার এলটিটিই যোদ্ধা প্রতিরক্ষা বাহিনীগুলোর হাতে আটক হয় বলে দাবি করা হয়েছে। এদের পুনর্বাসনও সরকারের জন্য এক চ্যালেঞ্জ এবং নিশ্চিতভাবেই পুনর্বাসন উদ্যোগসমূহের মধ্যে সবচেয়ে স্পর্শকাতর অংশ। কীভাবে এরূপ সাবেক যোদ্ধাদের ‘পুনর্বাসন’ করা হচ্ছে, সে বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানা যায় না। এমনও অভিযোগ ছিল যে সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত ক্যাম্প থেকে এরূপ যোদ্ধাদের অনেকে নিখোঁজ হয়ে গেছে।২৮ আবার বাকি সাবেক যোদ্ধাদের ‘পুনর্বাসন’ এই মর্মেও নতুন বিতর্ক তৈরি করেছে—যখন দেখা গেছে অনেক সাবেক যোদ্ধাই লোকসমাজে এসে ‘রহস্যময়’ রোগে মারা যাচ্ছে। ২০১৬ সালের আগস্ট পর্যন্ত নর্দান প্রভিন্সে ওইরূপ ১০৫ জন সাবেক এলটিটিই যোদ্ধা পুনর্বাসিত অবস্থায় মারা গেছেন এবং স্থানীয় সমাজে গুজব ছড়িয়ে পড়েছে, ক্যাম্পে আটক অবস্থায় এদের শরীরে এমন কিছু প্রবেশ করানো হচ্ছে যা তাদের মৃত্যুর কারণ। একজন তামিল রাজনীতিবিদ সুরেশ প্রেমচন্দ্রন (Suresh Pramachandran) এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক তদন্তের দাবি জানিয়ে জাতীয় বিতর্কেরও জন্ম দিয়েছেন।২৯ বলা বাহুল্য, এরূপ তথ্য প্রমাণবিহীন হলেও এসব বক্তব্য জাতিগত বিদ্বেষপূর্ণ একটি সমাজে সিংহলি প্রাধান্যপূর্ণ প্রশাসন এবং তামিল প্রাধান্যপূর্ণ এলাকার মধ্যে ব্যবধান ধরে রেখেছে এবং প্রকৃত পুনর্বাসনের নৈতিক শক্তিও দুর্বল করে রেখেছে। ভারতের, বিশেষ করে তামিলনাড়ুর প্রচারমাধ্যমগুলোতে শ্রীলঙ্কার এরূপ সংবাদ ব্যাপক কাভারেজ পাচ্ছে। এরূপ প্রেক্ষাপটে ২০১৬ সালের আগস্টে পুরো প্রদেশের সব জেলায় যুদ্ধ শেষে আটক অবস্থা থেকে পুনর্বাসিত এলটিটিই যোদ্ধাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য নর্দান প্রভিন্সের সরকার একটি উদ্যোগ নিয়েছে।

বস্তুত যুদ্ধের পরপরই উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন এক বড় চ্যালেঞ্জ হলেও কেবল সম্প্রতি শ্রীলঙ্কা সরকার প্রথম এই সমস্যা মোকাবিলায় একটি নীতিমালা (National Policy on Durable Solutions for Conflict-affected Displacement) করতে সমর্থ হয়েছে। শ্রীলঙ্কায় পুনর্বাসন বিষয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রণালয় রয়েছে এবং দেশটির মানবাধিকার কমিশনেও অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু বিষয়ে একটি বিশেষ ইউনিট বিদ্যমান। তবে যুদ্ধবিধ্বস্ত উদ্বাস্তু-সংকটের যে বহুমাত্রিকতা, তা প্রকৃতই অনেক বৃহত্তর রাষ্ট্রীয় সামর্থ্য দাবি করে। রাজনৈতিক অস্থিরতায় পূর্ণ শ্রীলঙ্কায় তা আপাতত নেই।

এ ক্ষেত্রে প্রধান এক চ্যালেঞ্জ হলো ভূমি। কৃষিভিত্তিক সমাজে পুনর্বাসন উদ্যোগমাত্রই জমির প্রয়োজন। আবার চরমভাবে জাতিগত বিদ্বেষের উপস্থিতির কারণে জমি পাওয়ামাত্রই কাউকে পুনর্বাসন করা সম্ভব নয়। আঞ্চলিক জাতিগত সমীকরণ এবং নিরাপত্তার প্রশ্ন জড়িয়ে থাকে তাতে। ২৬ বছর স্থায়ী গৃহযুদ্ধের অন্যতম বিবাদিত বিষয়ও ছিল জমি। ফলে পুনর্বাসনকালেও জমির প্রশ্ন স্পর্শকাতর বিষয় হয়ে আছে। যেসব উদ্বাস্তু নিরাপত্তাগত কারণে বা বেদখল হওয়ার কারণে তাদের বসতভিটায় ফিরতে পারছে না, তাদের ক্ষেত্রে পুনর্বাসনের সবচেয়ে জরুরি প্রশ্ন হলো ন্যায্য ক্ষতিপূরণ দেওয়া। এ ক্ষেত্রেও সমাধান সহজ নয়। কারণ, দেশটির আইনে ব্যক্তিগত সম্পত্তি সরকারি কাজে অধিগ্রহণ করা হলেই কেবল ক্ষতিপূরণের প্রশ্ন আসে। কিন্তু যুদ্ধকালে সৃষ্ট ‘হাইসিকিউরিটি জোনে’ জমি হারানো কীভাবে ক্ষতিপূরণযোগ্য হবে, সেসবও এই অনুসন্ধানকালেও বিবাদিত বিষয় হয়ে আছে।

ভারত-শ্রীলঙ্কা অর্থনৈতিক চুক্তি ও চীনের সঙ্গে ভারসাম্যের চেষ্টা

সংবিধানের পাশাপাশি এ মুহূর্তে শ্রীলঙ্কার রাজনীতিকে আচ্ছন্ন করে আছে ভারতের সঙ্গে সম্ভাব্য রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সম্পর্ককে ঘিরে আবর্তিত বিতর্ক। প্রধানমন্ত্রী বিক্রমাসিংহে ভারতের সঙ্গে বিশেষ অর্থনৈতিক সম্পর্ক তথা চুক্তির বিষয়ে খুব আগ্রহী।

দেশের ব্যবসায়ী সমাজের একাংশ, রাজাপক্ষে ও জেভিপি চুক্তির বিরোধিতা করছে। জেভিপির অন্যতম মুখ্য নেতা অনুরা কুমার দেশনায়েকে বিবৃতি দিয়ে বলেছেন, এই চুক্তি শ্রীলঙ্কায় ভারতীয় তরুণদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে মাত্র। তিনি এ বিষয়ে গণভোট অনুষ্ঠানের তাগিদ দেন।৩০ কিন্তু প্রধানমন্ত্রী বিক্রমাসিংহে বলছেন, ২০১৭ সাল শেষ হওয়ার আগেই ভারতের সঙ্গে ‘Economic and Technology Cooperation Agreement (ECTA) চুক্তি করা হবে। তবে দেশটির বিভিন্ন খাতের পেশাজীবীরা, বিশেষ করে তথ্যপ্রযুক্তিবিদেরা এই চুক্তির বিরোধী।

উল্লেখ্য, ২০০০ সাল থেকে ভারতের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার মুক্তবাণিজ্য চুক্তি রয়েছে। স্থানীয় রাজনৈতিক ভাষ্যকারেরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র চাইছে নতুন এই চুক্তির মাধ্যমে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি চীনের প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে ভারতীয় অর্থনীতির সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়ুক। ওবামার শাসনামলে যুক্তরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কাকে টিপিপি (Trans Pacific Partnership Agreement) চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত করারও চেষ্টা করেছিল বলে জানা যায়। বিক্রমাসিংহে, সিরিসেনা ও চন্দ্রিকার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্মিলিত বোঝাপড়ারই ফসল ছিল ২০১৪ সালে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় রাজাপক্ষের অপসারণ এবং সিরিসেনাকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে জয়ী করে নিয়ে আসা। দেশটির রাজনীতিতে এটা ছিল নাটকীয়তায় পরিপূর্ণ এক অধ্যায়। যুক্তরাষ্ট্র রাজাপক্ষের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল এই কারণে নয় যে তিনি তামিল সশস্ত্রতা নির্মূল করেছেন, বরং এই কারণে যে তিনি দেশটিকে চীনের ঘনিষ্ঠ মিত্রে পরিণত করেছিলেন। একই মনোভাব ভারতেরও।

বর্তমান সরকারের আমলে ভারত শ্রীলঙ্কাকে কাছে টানতে তামিলনাড়ু ও জাফনার মাঝে ব্রিজ নির্মাণের প্রস্তাবও দিয়েছে, আপাতদৃষ্টিতে যা খুবই উচ্চাভিলাষী প্রস্তাব বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।৩১ কিন্তু ভারতীয় অর্থনীতির বিস্তৃতির জন্য যা খুবই কার্যকর প্রমাণিত হতে পারে। একই সঙ্গে শ্রীলঙ্কায় তামিল জাতীয়তাবাদ ও তামিলনাড়ুর প্রভাবও তাতে ব্যাপকতা পাবে। যদিও স্থানীয় জনগণের বিরোধিতার ভয়ে শ্রীলঙ্কার নীতিনির্ধারকেরা এ বিষয়ে কিছু বলছেন না, কিন্তু ২০১৫ সালের ১৬ ডিসেম্বর ভারতীয় সড়কমন্ত্রী নীতিন গাটকর লোকসভায় জানিয়েছেন, তাঁর দেশ এডিবির কাছে ৫.২ বিলিয়ন ডলার ঋণ চেয়েছে তামিলনাড়ু-জাফনা ব্রিজ নির্মাণের লক্ষ্যে।

উল্লেখ্য, তামিলনাড়ুতে বর্তমানে যে আট কোটি অধিবাসী রয়েছে তার অন্তত ২০ শতাংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। তামিলাড়ুর সঙ্গে শ্রীলঙ্কার ব্রিজধর্মী যোগাযোগ হলে উল্লিখিত ২০ শতাংশ দরিদ্রের কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে শ্রীলঙ্কায় আগমন সহজ করবে। আবার পাশাপাশি ECTA চুক্তি হলে তা অ-দরিদ্র, দক্ষ পেশাজীবীদের জন্যও শ্রীলঙ্কার দরজা খুলে দেবে। কারণ, যদিও এরূপ চুক্তিতে উভয় দেশের পেশাজীবীদের পরস্পরের দেশে অবাধে যাতায়তের কথা বলা হয়েছে কিন্তু কার্যত ভারত থেকে শ্রীলঙ্কায় উচ্চমজুরির কারণে ভারতীয় পেশাজীবীদেরই কলম্বোমুখী হওয়ার সম্ভাবনা অধিক। ECTA মূলত দুই দেশে পেশাজীবীদের আগমন সহজতর করার লক্ষ্যে প্রণীত হচ্ছে এবং দুই দেশের আলোচনার টেবিলে তামিলদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ের চেয়েও তা অধিক গুরুত্ব পাচ্ছে। অন্যদিকে স্থল ব্রিজ বা সমুদ্রতলদেশ দিয়ে তৈরি টানেল শ্রীলঙ্কাকে ভৌগোলিকভাবেও উত্তর ভারতের সঙ্গে যুক্ত করে ফেলবে। এরূপ সম্ভাবনার কারণে শ্রীলঙ্কার সিংহলি সমাজে উল্লিখিত প্রকল্প ও চুক্তিগুলো নিয়ে এ মুহূর্তে ব্যাপকভিত্তিক বিতর্ক চলছে। এই বিতর্ক এ কারণেও হচ্ছে যে ভারত যখন তামিলদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন, অর্থনৈতিক চুক্তি ও তার স্থলভাগের সঙ্গে দ্বীপদেশটিকে যুক্ত করতে সচেষ্ট, তখন দুদেশের আন্তবাণিজ্য ব্যবধান ক্রমে বিপুলমাত্রায় বেড়েই চলেছে এবং উভয়ের সম্পর্কের অভিমুখ সেই ব্যবধান কমার কোনো ইঙ্গিত দেয় না।৩২ আবার বর্তমান শাসকদের একাংশ এই বিতর্কে রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে গিয়ে চীনকেও বাণিজ্য ও বিনিয়োগে ভারতের মতোই সুযোগদানের কৌশল নিয়ে এগোতে ইচ্ছুক। যার অংশ হিসেবে ২০১৬ সালের এপ্রিলে শ্রীলঙ্কা সরকার তার দেশের সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ প্রকল্প হিসেবে বিবেচিত চীনের ১.৪ বিলিয়ন ডলারের ‘কলম্বো পোর্ট সিটি প্রজেক্ট’ থেকে সাময়িক স্থগিতাদেশ তুলে নেয়। কিন্তু দেশটির জাতীয় পরিসরের দুই প্রধান দলেই ভারতের মতোই চীনের সঙ্গে সম্পর্কের গভীরতা নিয়ে মতদ্বৈধতা এবং উপদলীয় প্রতিযোগিতা থাকায় চীন-ভারত-শ্রীলঙ্কা সম্পর্কের ভারসাম্য মূলত নির্ভর করবে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে কোন উপদল কতটা শক্তিশালী ভূমিকায় থাকছে, তার ওপর। রাজাপক্ষে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার মধ্য দিয়ে আপাতত এই ভারসাম্য ভারতের পক্ষেই হেলে আছে এবং তামিল জাতীয়তাবাদীদের জন্য তা কিছুটা স্বস্তির কারণ।

তবে চীনও অতীতে ২০১০ থেকে ২০১৪ সময়ে কেবল রাজাপক্ষেকে সমর্থনদানকে ইতিমধ্যে ‘এক ঝুড়িতে সব ডিম রাখা’র মতো ভুল হিসেবে চিহ্নিত করে দেশটির অপরাপর গুরুত্বপূর্ণ নেতা ও রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গেও ‘সম্পর্ক’ বিকশিত করে চলেছে, যা ভারতের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।৩৩ ইতিমধ্যে চীন শ্রীলঙ্কার সর্বদক্ষিণে নির্মিত গভীর সমুদ্রবন্দরের নিয়ন্ত্রণ নিতে পেরেছে, যা সংশ্লিষ্ট সাগরে তার ভূকৌশলগত অবস্থান শক্তিশালী করেছে।

এলটিটিইর পুনর্গঠিত হওয়ার শঙ্কা কিংবা সম্ভাবনা

এলটিটিই নেই প্রায় সাত বছর পেরিয়ে গেছে। কিন্তু দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কায় যে এলটিটিইর দীর্ঘ ছায়া বিদ্যমান, সেটা তামিল কিংবা সিংহলি কেউই অনানুষ্ঠানিক আলাপে অস্বীকার করেন না। যদিও প্রকাশ্যে তাঁরা ভিন্ন কথাই বলেন। এলটিটিইর পুনর্জন্মের বিষয় নিয়ে শ্রীলঙ্কায় এবং বহির্বিশ্বে মাঝেমধ্যেই কিছু সংবাদ ও বিশ্লেষণ দেখা যায়। বর্তমান লেখক অন্যত্র৩৪ দেখিয়েছেন যে অভ্যন্তরীণ যুদ্ধে এলটিটিইর প্রায় পুরো কাঠামো বিধ্বস্ত হলেও তার আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক পুরোই অক্ষত রয়েছে। সব সূত্র দ্বারা এই তথ্যের নিশ্চয়তা মেলে।৩৫ ইতিমধ্যে আমরা বলেছি যে শ্রীলঙ্কার তামিল জাতীয়তাবাদের উত্থানে প্রবাসী তামিলদের রয়েছে এমন এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা, যা ইতিহাসে অন্য কোনো জাতীয়তাবাদী সংগ্রামে প্রায় দেখা যায়নি বললেই চলে। যেহেতু রাজনীতিসচেতন অর্থের প্রবাহ এখনো অক্ষুণ্ন রয়েছে, তাই সেখানে অস্থিতিশীলতা ও অন্তর্ঘাতমূলক তত্পরতা ঘটা অস্বাভাবিক নয়।

যদিও এ বিষয়ে রাজাপক্ষের মতো সিংহলি রাজনীতিবিদদের একাংশের অতিরিক্ত প্রচারণা রয়েছে এবং যদিও এলটিটিইর নেটওয়ার্ক বিভিন্ন উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়েছে কিন্তু সব গ্রুপের কাছেই রয়েছে বিপুল অর্থসম্পদ এবং সব গ্রুপই দেশটির উত্তর ও পূর্বাঞ্চলের তামিল এলাকায় যোগাযোগ গড়ে তুলতে সক্রিয়। বিশেষ করে বিদেশে অবস্থানকারী তামিল টাইগাররা দেশে অবস্থানকারী সাবেক টাইগারদের মধ্যে যারা আর্থিক সংকটে রয়েছে, তাদের সহায়তার মাধ্যমে পুনরায় সংগঠিত হতে উদ্বুদ্ধ করছে। শ্রীলঙ্কার সেনা গোয়েন্দা সূত্রে এবং গণমাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায় যে এলটিটিইর আন্তর্জাতিক কাঠামো বর্তমানে দুটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে কাজ করছে। এর একটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন পি শিভপরান (P. Sivaparan) ওরফে নিদিয়াওয়ান এবং অপর গ্রুপের নেতৃত্ব দিচ্ছেন ভিনয়াগম। প্রথমজন মূলত নরওয়েতে অবস্থান করে কার্যক্রম পরিচালনা করছেন এবং দ্বিতীয়জন অবস্থান করেন ফ্রান্সে। ভিনয়াগম এলটিটিইর গোয়েন্দা বিভাগের একজন সংগঠক ছিলেন। প্রভাকরণ মারা যাওয়ার পর এলটিটিইর আন্তর্জাতিক শাখা প্রথমে পাথমানাথন ওরফে ‘কেপি’কে সংগঠনের নতুন নেতা নির্বাচন করেছিল। পাথমানাথন (Pathmanathan) নিজেই এই ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু চার মাস পরই তিনি মালয়েশিয়ায় আটক হয়ে যান এবং শ্রীলঙ্কা সরকারের কাছে হস্তান্তরিত হন।৩৬

এই দুই ধারা ছাড়াও আরও কিছু সংগঠন আন্তর্জাতিক পরিসরে এখনো এলটিটিইর ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার বহন করতে তত্পর। এর মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ট্রান্সন্যাশনাল গভর্নমেন্ট অব তামিল ইলম (টিজিটিই) এবং ব্রিটেনভিত্তিক দ্য গ্লোবাল তামিল ফোরাম (জিটিএফ)। শেষোক্ত সংগঠনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন ফাদার এমানুয়েল। আর প্রথমটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন রুদ্রাক্ষ কুমার। সব সংগঠনেরই মূল কর্মক্ষেত্র প্রধানত তামিলনাড়ু এবং দ্বিতীয়ত, শ্রীলঙ্কার নর্দান প্রভিন্স। এ ক্ষেত্রে তামিলনাড়ুতে বিশেষ ভূমিকা রাখছে তামিল ইলম সাপোর্টার্স ফোরাম (টিইএসও)। উপরিউক্ত সব উদ্যোগ থেকেই কাজ চলছে মুখ্যত ওই এলাকার এনজিও এবং স্থানীয় রাজনীতিবিদদের সঙ্গে।

এ কাজের প্রক্রিয়াতেই ২০১২ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে এলটিটিইর পুনরুত্থানের অন্তত তিনটি ছোট পরিসরের ঘটনা ঘটে এবং তিনটিই শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনী বানচাল করে দেয়। প্রথমটি ঘটে ২০১২ সালের মার্চে, যখন ইস্টার্ন প্রভিন্সে সরকারপন্থী এক তামিল মিলিশিয়া সংগঠনে (EPDP) তামিলনাড়ু থেকে এলটিটিইর ১৫ সদস্যের একটি সেল গোপনে ঢুকে পড়ে। কিন্তু ওই সেলের সদস্যরা ইপিডিপির এক কর্মীর খুনের ঘটনায় যুক্ত হয়ে পড়লে বিষয়টি জানাজানি হয়ে যায়। দ্বিতীয় ঘটনা আবিষ্কৃত হয় ২০১২ সালের ডিসেম্বরে কলম্বোতে। একজন অপুনর্বাসিত এলটিটিই ক্যাডার ও ছয় তামিল যুবককে গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে তামিলনাড়ুতে নতুন করে তামিলদের রিক্রুটমেন্টের তথ্য জানা যায়। আর তৃতীয়টি ঘটে ২০১৪ সালের মার্চে কিলোনিচ্চিতে—সরাসরি গোলাগুলি আকারে। এ ঘটনায় ভাবুনিয়া জেলায় গবি, থাইভিগান ও আপ্পান নামে এলটিটিইর সাবেক তিন গেরিলা নিহত হন। উল্লেখ্য, গবিকে ধরার জন্য তথ্য দিয়ে সহায়তা করতে ১০ লাখ রুপি পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছিল। তিনটি ঘটনায়ই স্থানীয় তামিলদের সঙ্গে এলটিটিইর প্রবাসী সংগঠকদের যোগাযোগের প্রমাণ মেলে।৩৭ এ ছাড়া ২০১৭ সালেও নর্দান প্রভিন্সে এমনভাবে একজন পুলিশ নিহত হয়েছে, যাতে প্রমাণিত হয় এটা জাতিগত সহিংসতার অংশ।

উল্লেখ্য, চূড়ান্ত যুদ্ধ শেষে যে প্রায় ১২ হাজার এলটিটিই যোদ্ধাকে শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনী আটক করেছিল ২০১৪ সালের মধ্যে, তার প্রায় পুরোটাই ‘পুনর্বাসন’-এর মাধ্যমে ছেড়ে দেওয়া হয়। এলটিটিইর আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক এখন এদের মাধ্যমে সংগঠনকে আবার দেশে পুনর্গঠিত করতে চাইছে এবং এ ক্ষেত্রে অন্যতম কাজ হিসেবে নির্ধারিত হয়েছে বিগত যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে লুকিয়ে ফেলা অস্ত্র খুঁজে বের করা।

তবে এলটিটিইর উত্থানের সব দায় অবশ্যই সংগঠনের বিদেশি সংগঠকদেরই নয়। বরং বলা যায়, স্বল্প মেয়াদে না হলেও দীর্ঘ মেয়াদে শ্রীলঙ্কায় তামিল জাতীয়তাবাদের পুনঃসশস্ত্রতার ব্যাপক সম্ভাবনা এখনো বিদ্যমান—কারণ, তামিলদের প্রত্যাশিত দাবিদাওয়া এখনো পূরণ হয়নি। তবে পুনঃসশস্ত্রতার বাস্তব ঝুঁকি বিপুল। কারণ, দেশটির সেনাবাহিনীর আকার ইতিমধ্যে প্রায় দুই লাখ অতিক্রম করেছে৩৮ এবং এর প্রায় ৩০ শতাংশই বর্তমানে তামিল-অধ্যুষিত নর্দান ও ইস্টার্ন প্রভিন্সেই থাকছে। এসব এলাকায় তাদের নজরদারি ব্যাপক এবং তীব্র নজরদারির পরও ২০১৬ সালেও প্রভাকরণের জন্মদিন (২৬ নভেম্বর) পালিত হয়েছে জাফনার বহু স্থানে।৩৯

তবে বাস্তবে প্রভাকরণের মতো আরেকজন নেতা খুঁজে পাওয়া এবং সন্ত্রাসবিরোধী চলতি বৈশ্বিক মনোভাবের মধ্যে আবারও সশস্ত্রতার পক্ষে সক্রিয় ভারতীয় সহায়তা পাওয়া এলটিটিইর জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে আছে। নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা এ বিষয়ে একমত যে এলটিটিইর যেকোনো সশস্ত্র পুনরুত্থানের জন্য তামিলনাড়ুতে প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা পাওয়া জরুরি, যা এখন গোপনে বিদ্যমান হলেও প্রকাশ্যে পাওয়া সহজ নয়।৪০ অন্তত দুটি কারণে এটা দুরূহ। প্রথমত, শ্রীলঙ্কার নৌবাহিনীর শক্তি-সামর্থ্য এখন আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। দ্বিতীয়ত, তামিলনাড়ুতে গেরিলা উত্পাদনযন্ত্র সক্রিয় হলে তা ভারত-শ্রীলঙ্কার সম্পর্ককে গভীরভাবে প্রভাবিত করবে এবং তা থেকে যে চীন সুযোগ গ্রহণ করবে, সেটা ভারতের অজানা নয়।

এ ছাড়া ২০০৯ সালে শেষ হওয়া প্রায় ২৫ বছর স্থায়ী যুদ্ধের পর শ্রীলঙ্কার প্রভাবশালী নীতিনির্ধারকদের মধ্যে জাতিগত রেষারেষি থেকে বের হওয়ার ইচ্ছা লক্ষ করা যাচ্ছে। ফলে সিংহলি নীতিনির্ধারকদের মধ্যে যেরূপ মনোভাব তামিল পরিসরে পুনরায় সশস্ত্রতার পাটাতন তৈরি করতে পারে এবং তামিল তরুণদের মধ্যে সশস্ত্রতার আবেদন তৈরি করতে পারে, আপাতত তা দুর্বল। তবে শ্রীলঙ্কার সরকারের পক্ষ থেকে মাঝেমধ্যে এলটিটিইর সংগঠিত হওয়ার বিষয়ে বিভিন্নরূপ আশঙ্কার কথা ব্যক্ত করা হয় এই কারণেও যে তাতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সংগঠনটির নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ নবায়ন করানো সহজ হয়।

শেষ কথা

‘নিরাপত্তা ধারণা’র পুনর্বিন্যাস ও আঞ্চলিক ভারসাম্য রক্ষার চ্যালেঞ্জ

শ্রীলঙ্কায় তামিল জাতীয়তাবাদের উত্থান ও নিষ্ক্রিয় হওয়ার পরের সমকালীন পরিস্থিতির সংক্ষিপ্ত একটি চিত্র তুলে ধরা হয়েছে বর্তমান লেখায়। একই সঙ্গে জাতিরাষ্ট্র হিসেবে শ্রীলঙ্কার সংকট ও সেই সংকট উত্তরণের চেষ্টার পূর্বাপরও সংক্ষেপে পর্যালোচনার চেষ্টা করা হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশে দেশে এথনো পলিটিকস তথা জাতিগত টানাপোড়েনে ‘ইতিহাস’, মিথ ও সাংস্কৃতিক পক্ষপাত কীভাবে বিবাদের জন্ম ও পুনর্জন্ম দিয়ে চলেছে—অন্তত এই দৃষ্টান্ত আমাদের তার রক্তাক্ত হদিস দিচ্ছে।

শ্রীলঙ্কা থেকে সরে যাওয়ার সময় ব্রিটিশরা দেশটিকে বলত ‘স্থিতিশীলতার মরূদ্যান’। স্থিতিশীলতার সেই মরূদ্যানে ঝড় তুলেছিল এলটিটিই। আর এলটিটিইকে নিষ্ক্রিয় করার মধ্য দিয়ে শ্রীলঙ্কা তার রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতাকে এক দফা রক্ষা করতে পারল। গৃহযুদ্ধ শেষে শ্রীলঙ্কার মূল অর্জন এটাই। শ্রীলঙ্কার এই অর্জন দক্ষিণ এশিয়াকেও আপাত এক ‘স্থিতিশীলতা’ দিয়েছে। তামিল ‘ইলম’ সফল হলে সেটা স্বাভাবিকভাবেই উত্সাহব্যঞ্জক হয়ে দেখা দিত কাশ্মীর, নাগাল্যান্ড, আরাকান, পার্বত্য চট্টগ্রাম, বেলুচিস্তান ইত্যাদি স্থানে এবং বিশেষভাবে খোদ ভারতের তামিলনাড়ুতেও।

তবে এলটিটিইকে নিষ্ক্রিয় ও এর সামরিক উত্থানকে ধ্বংসের পরও শ্রীলঙ্কায় কেউই বিশ্বাস করে না, তামিল জাতীয়তাবাদ ধ্বংস হয়ে গেছে। পূর্বেকার আলোচনায় আমরা দেখেছি, যেহেতু তামিল জাতীয়তাবাদ সামরিকভাবে দমিত হয়েছে মাত্র—সে কারণে এর পুনরায় উত্থানের সম্ভাবনা বেশ ভালোভাবেই জারি আছে। ফলে শ্রীলঙ্কার জন্য শ্রীলঙ্কাবাসীর মতোই সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার উদ্বেগও এখনো শেষ হয়নি। দেশটিতে তাই পূর্বতন ‘নিরাপত্তা ধারণা’র সীমাবদ্ধতা চিহ্নিত করে নতুন ধরনের নিরাপত্তা ধারণা (New Security Paradigm) নিয়ে কাজ করার বাস্তবতা সৃষ্টি হয়েছে মাত্র। যে নিরাপত্তা ধারণার মূলে থাকবে ‘জাতীয় সংহতি’ গড়ে তোলা এবং নাগরিকদের মধ্যে জাতি ও ধর্মীয় পরিচয়-নির্বিশেষে বিশ্বাস ও আস্থার সেতু রচনা করা। তবে কাজটি সহজ নয়, অভ্যন্তরীণ ও বহির্দেশীয়—উভয় ধরনের প্রতিবন্ধকতা রয়েছে তাতে। কারণ, জাতিগত ‘শ্রেষ্ঠত্ব’-এর ঐতিহাসিক বয়ানগুলোকে অতিক্রম করে যেতে পারছে না বিবদমান কোনো সম্প্রদায়ই।

এলটিটিই বনাম সেনাবাহিনীর দ্বিপক্ষীয় যুদ্ধের পরও দেশটিতে চেতনাগত পরিসরে আধিপত্যের চেতনা (Hegemonism), বিচ্ছিন্নতার চেতনা (Secessionism) এবং বহুত্ববাদের চেতনার (Pluralism) ত্রিমুখী এক যুদ্ধ প্রবলভাবে জারি আছে। শ্রীলঙ্কা ‘রাষ্ট্র’ গৃহযুদ্ধকালীন ২৬ বছর তার জন্য ‘হুমকি’ মনে করেছে অভ্যন্তরীণভাবে তামিলদের এবং বহির্দেশীয়ভাবে তামিলদের প্রতি প্রকাশ্য ও গোপন ভারতীয় সহায়তাকে। এই দুই হুমকি মোকাবিলা করে দেশের ‘অখণ্ডতা’ রক্ষাই ছিল তার পূর্বতন ‘নিরাপত্তা ধারণা’র মূল কথা। বিশেষত ভারত কর্তৃক দলে দলে তামিল তরুণদের গেরিলা প্রশিক্ষণ দিয়ে শ্রীলঙ্কায় প্রেরণের মধ্য দিয়ে দেশটিতে চরম নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হয় এবং তার মোকাবিলায় সেখানে পাল্টা যে নিরাপত্তা ধারণা সৃষ্টি হয়, তারই চূড়ান্ত ফল ২০০৯ সালের চূড়ান্ত যুদ্ধ। ওই রূপ নিরাপত্তা ধারণার রেশ এখনো বহাল আছে। প্রধান দুই জনগোষ্ঠীর মধ্যে এখনো জাতীয়তাবাদী যুদ্ধরূপী মনোভঙ্গি প্রবল। যে মনোভঙ্গির প্রধান প্রকাশ হলো ‘অপর’কে পূর্ণ পরাজিত ও অধস্তন না করে ‘নিজ’-এর শান্তি আসতে পারে না। কিংবা ‘অপর’-এর বিরুদ্ধে ‘সামরিক বিজয়’ ব্যতীত নিরাপত্তা নিশ্চিত হতে পারে না। এরূপ মনোভাবের ফলে দেশটি কার্যত একটি ‘দুর্বল রাষ্ট্র’ হিসেবেই থাকছে। তার মানবসম্পদ এমনভাবে বিভক্ত যে অন্তত একাংশ ‘রাষ্ট্রীয় পরিচয়’কে ধারণ করতে অনিচ্ছুক, যা আবার এক দ্বিমুখী সংকট তৈরি করে। একদিকে দুর্বল রাষ্ট্র বলেই সে উপনিবেশ-উত্তর আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে গড়ে তুলতে বা পুনর্গঠন করতে পারছে না। আবার এগুলো গড়ে তুলতে অপারগতার কারণেই সে দুর্বল। এটাই আজকের শ্রীলঙ্কার সামনে প্রধান বিপদ এবং এরূপ ‘বিপদ’ থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অপরাপর কোনো দেশই কমবেশি মুক্ত নয়।

শ্রীলঙ্কার জন্য অপর এক বিপদ হলো যুদ্ধে ‘বিজয়’-এর মধ্য দিয়ে সমাজে-প্রশাসনে-রাষ্ট্রে সামরিক বাহিনীর অবস্থান ও মতামতের যে গুরুত্ব বাড়ছে এবং একই সঙ্গে সিংহলি-বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদের যে স্ফুরণ ঘটেছে উভয়ই তা তামিলদের সঙ্গে কোনোরূপ আপস বা ছাড়ের বিরোধী। এ-ও জাতিগত ‘পুনরেকত্রকরণ’ ধারণার বিপরীতে বড় এক চ্যালেঞ্জ। এরূপ চ্যালেঞ্জ আমরা দেখব রোহিঙ্গাদের নিয়ে বার্মায়, জুম্মদের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে, বালুচদের বিষয়ে পাকিস্তানে এবং বহু জাতিসত্তার মোকাবিলায় ভারতে।

তামিলদের যেসব ক্ষোভ এ মুহূর্তে খুবই তীব্র তার মধ্যে রয়েছে নর্দান ও ইস্টার্ন প্রভিন্সে অতীতে মানবাধিকারের ব্যাপক লঙ্ঘন। যার কোনো ন্যায়বিচার তারা পায়নি বলেই মনে করে। এরূপ বঞ্চনার বোধও তারা ভুলতে পারত যদি যুদ্ধ শেষে সিংহলি নেতৃত্ব রাষ্ট্রীয় কাঠামোর প্রত্যাশিত সংস্কার দ্রুত এগিয়ে নিতে সক্ষম হতো।

দেশটিতে মানবাধিকার সংকটের অন্যতম মূল কারণ হিসেবে এখনো রয়ে গেছে পারস্পরিক জাতিগত ঘৃণা। দীর্ঘ যুদ্ধের অভিজ্ঞতার পরও বিবদমান পক্ষগুলো মনে করে, পরস্পরকে ধারণ করার চেয়ে পরস্পরকে মোকাবিলা করাই তাদের নিরাপত্তার শর্ত। এই মনোভাবের কারণে মানবাধিকার লঙ্ঘনের চেতনার জন্ম ও পুনর্জন্ম হচ্ছে প্রতিনিয়ত। ফলে সেখানে হুমকি ও নাজুকতার আবহ থেকে নাগরিকদের মুক্তি ঘটেনি এখনো।

তামিল জাতীয়তাবাদ শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রীয় কাঠামোগত যে সংকটকে উন্মোচিত করেছিল, তা এখনো বহাল আছে। বৌদ্ধধর্মের পাশাপাশি অন্যান্য ধর্ম, সিংহলিদের পাশাপাশি অন্যান্য জাতি এবং অঞ্চলগত প্রশাসনিক ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের বিষয়গুলো দেশটি এখনো মীমাংসা করতে পারেনি। ফলে দেশটির সম্প্রদায়গত ও অঞ্চলগত অভ্যন্তরীণ সম্পর্ক সবল নয়। দেশটির শাসকশ্রেণি জাতিগত পরিচয়-নির্বিশেষে নাগরিকদের ওপর এখনো কোনো হেজিমনি কায়েম করতে পারেনি কিংবা বলা যায় তার হেজিমনির চরিত্র এখনো জবরদস্তিমূলক। এটাই শ্রীলঙ্কা ‘রাষ্ট্র’-এর ভাবাদর্শিক দুর্বলতার দিক। দক্ষিণ এশিয়ার অনেক রাষ্ট্রই এই রোগে ভুগছে।

তথ্যসূত্র:

১.         Mohan K. Tikku, Sri Lanka in Victory and War, Oxford U. P., 2016, p.161.

২.         Politics of Ethnicity and Population Censuses in Sri Lanka, Draft Paper, http://www.ciqss.umontreal.ca/Docs/SSDE/pdf/Silva.pdf (accessed on 20th Nov., 2016)

৩.        দেশটির শুমারি তথ্যে ক্যাথলিক ও খ্রিষ্টানদের পৃথক ক্যাটাগরি আকারে দেখানো হলেও বর্তমান লেখায় তা একক ‘খ্রিষ্টান’ ক্যাটাগরিরূপে তুলে ধরা হয়েছে।

৪.         ‘তামিল’ বলতে এখানে শ্রীলঙ্কার তামিলদের বোঝানো হচ্ছে। শ্রীলঙ্কায় তিন ধরনের তামিল রয়েছে: ভারতীয় তামিল (যারা মূলত চা-শ্রমিক), মুসলমান তামিল ও শ্রীলঙ্কান তামিল।

৫.         শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে ভারতের তামিলনাড়ুর প্রভাব নিয়ে বর্তমান লেখকের শ্রী লঙ্কার তামিল ইলম: দক্ষিণ এশিয়ার জাতি-রাষ্ট্রের সংকট গ্রন্থে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে।

৬.        J N Dixit, Assignment Colombo, Konaek Publishers, 1998, Delhi, p. xiii.

৭.         যেমন ভারতে ‘হিন্দুত্বভা’ দর্শন ‘ভারতভূমি’ থেকে মুসলমানদের উত্খাতের মাধ্যমেই একে ‘পরিশুদ্ধ’ করার কথা বলে। ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর উত্তর প্রদেশের অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ধ্বংসের উদ্যোগটি ছিল ঐতিহাসিক সেই পরিশুদ্ধি ও পুনর্বিজয়ের একটি প্রদর্শনী। একই রূপ পরিস্থিতি আমরা দেখব শ্রীলঙ্কাতেও। সেখানে ২০০৯-এর যুদ্ধে বিজয়ের পর তামিলপ্রধান এলাকাগুলোতে সিংহলিরা যে একের পর এক গৌতম বুদ্ধের মূর্তি তৈরির ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে কিংবা তামিলরা যে উক্তরূপ মূর্তি অপসারণের দাবি তুলছে, তা-ও ঐতিহাসিক এইরূপ ভাবনারই ধারাবাহিকতা যে বিশেষ বিশেষ ভূখণ্ড বিশেষ বিশেষ ধর্ম ও জাতির! ঐতিহাসিক নানান উপাখ্যানকে ব্যবহার করে সিংহলিদের কাছে তামিলরা যেমন ‘আগ্রাসী ও দখলদার শক্তি’ তেমনি দেশটির উত্তর ও পূর্বাংশের তামিলরা মনে করে ‘এখানে সিংহলিরা হলো বহিরাগত।’ যেমন ভারতেও মুসলমানরাও ভারতের হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের কাছে ‘বহিরাগত দখলদার’ শক্তি। মূর্তি স্থাপন থেকে শুরু করে পাঠ্যবই সংস্কার পর্যন্ত নানান রূপে এরূপ ‘আগ্রাসী শক্তি’র বিরুদ্ধে পুনঃ পুনঃ বিজয় অর্জন না করে দক্ষিণ এশিয়ার আধিপত্যশীল জাতিগুলোর ‘হারানো গৌরব’ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হতে পারে না!

৮.        সমাজবিজ্ঞানী Benedict Andersonতাঁর গ্রন্থে এরূপ ‘জাতি’সমূহকে বলেছেন Imagined Communities. বিস্তারিত আলোচনার জন্য দেখুন : Imagined Communities: Reflections on the Origin and Spread of Nationalism, Verso, 1983, London.

৯.         কিছু চিতাবাঘ পাওয়া যায়—তবে এলটিটিইর পতাকায় চিতাবাঘ নয়—বাঘের ছবিই ব্যবহূত হয়েছে।

১০.       যে সিংহলি রাজা (দুত্যুগামুনু, খ্রি.পূর্ব ১৬১-১৩৭) তামিল রাজা ইলারাকে হারিয়ে পুরো দেশকে সিংহলি নিয়ন্ত্রণে এনেছেন বলে সিংহলি মিথে দাবি করা হয়। তাঁর প্রধান তিন সেনাপতির নামেও রয়েছে শ্রীলঙ্কার নৌবাহিনীর তিনটি নেভাল বেস: কাঞ্চাদেওয়া, উইলুসুমানা ও গোতিমবারা।

১১.       Beedict Anderson, Ibid.

১২.       Sri Lanka: Proposed Counter Terrorism Act Worse Than The PTA, (18/10/2016),

          http://srilankabrief.org/2016/10/sri-lanka-proposed-counter-terrorism-act-worse-than-the-pta/

১৩.      http://www.nytimes.com/2015/09/28/opinion/sri-lankas-war-crimes-controversy.html (19 dec. 2015)

১৪.       http://www.cpalanka.org/democracy-in-post-war-sri-lanka-dec2015/ (20th Dec. 2015)

১৫.       NPC calls for investigation of death threats against Wigneswaran (8 Oct. 2016). http://www.tamilguardian.com/content/npc-calls-investigation-death-threats-against-wigneswaran

১৬.      Sinhala and Tamil: Let’s get together and reconcile, (31 May 2009), http://dbsjeyaraj.com/dbsj/archives/681 (accessed 18 Nov. 2016)

১৭.       যদিও সংবিধানের নিয়ম অনুযায়ী এই এমপিরা সংসদে ‘বিরোধী দল’ হতে পারেন না, কারণ তাঁরা মুখ্যত ফ্রিডম পার্টিরই সদস্য এখনো। কিন্তু তাঁরা সংসদে ও সংসদের বাইরে প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর রাজনীতির বিরোধিতা করছেন।

১৮.      বিশ্বে এরূপ বিষয়ে সাম্প্রতিক সব গণভোটে (ব্রিটেন, কলম্বিয়া, হাঙ্গেরি, থাইল্যান্ড) আপাত ‘গণতান্ত্রিক’ পথেই শান্তি ও জাতীয় মতৈক্যের প্রত্যাশার পরাজয় ঘটতে দেখা যাচ্ছে। যেমন ব্রিটেনে (জুন) ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকা, না থাকা নিয়ে গণভোটে না থাকার পক্ষে রায় হয়েছে। কলম্বিয়ায় (অক্টোবর) গণভোটে বামপন্থী বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সঙ্গে সমঝোতার বিপক্ষে রায় হয়েছে। একই দিন অনুষ্ঠিত হাঙ্গেরিতে গণভোটে শরণার্থী ঠেকাতে সীমান্ত বন্ধের পক্ষে রায় দিয়েছে দেশবাসী। আর থাইল্যান্ডে (আগস্ট) গণভোটে অবৈধ প্রক্রিয়ায় ক্ষমতা দখলকারী সামরিক বাহিনী প্রণীত সংবিধান অনুমোদিত হয়।

১৯.      CBK calls for a federal semi-secular constitution, 2016-09-15, http://www.dailymirror.lk/115874/CBK-calls-for-a-federal-semi-secular-constitution (accessed 22th Nov. 2016)

২০.       Dr. Dayan Jayatilleka, Referendum on New Constitution Would be the ‘Stalingrad Battle’ of Sri Lanka, 17 August 2016,

          http://dbsjeyaraj.com/dbsj/archives/47880 (accessed 10th Nov. 2016)

২১.       ‘India and Sri Lanka After the LTTE’, International Crisis Group, Asia Report, No 206 (2011),

            https://d2071andvip0wj.cloudfront.net/206-india-and-sri-lanka-after-the-ltte.pdf (accessed 10th Nov. 2016)

২২.       সরকার ওয়েলফেয়ার সেন্টার বললেও এতে উদ্বাস্তুদের চলাফেরায় নিয়ন্ত্রণ থাকায় তামিলরা একে বলত concentration camps.

২৩.      Sri Lankan IDP camps, https://en.wikipedia.org/wiki/Sri_ Lankan_IDP_camps (accessed 15th Nov., 2016)

২৪.       Fonseka Bhavani, Raheem Mirak, Trincomalee High Security Zone and Special Economic Zone, September 2009; A brief profile of the Trincomalee High Security Zone and other land related issues in Trincomalee District, The Centre for Policy Alternatives (CPA), Sri Lanka, May 2008.

২৫.       দেশটির উদ্বাস্তু তামিল নাগরিকদের অনেকে রয়েছেন ভারতেও। যুদ্ধ সমাপ্তির প্রায় সাত বছর পরও এ লেখার সময় ভারতে প্রায় এক লাখ তামিল শরণার্থী ছিল। ভারতে অবস্থানকারী এই শরণার্থীদের মধ্যে একদল আছেন সেখানকার রাজ্য সরকার-নিয়ন্ত্রিত ক্যাম্পগুলোতে। এদের সংখ্যা প্রায় ৭০ হাজারের মতো। এসব ক্যাম্পে শরণার্থীদের নির্দিষ্ট হারে ভাতা (পরিবারপ্রধানকে এক হাজার রুপি, প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ককে ৭৫০ রুপি এবং প্রত্যেক শিশুকে ৪০০ রুপি) ও চাল বা আটা দেওয়া হয়। এ ছাড়া সস্তায় জিনিসপত্র কেনার জন্য তাদের রয়েছে রেশন কার্ড। শরণার্থীদের সন্তানদের জন্য উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত লেখাপড়া ফ্রি। এই সুবিধা তারাই পায় যাদের শরণার্থী হিসেবে সনদ রয়েছে। তবে এর বাইরেও দেশটিতে অনেক তামিল রয়েছে। তাদের কেউ কেউ ভ্রমণ ভিসা নিয়ে এসে আর যাননি। আবার অনেক সাবেক তামিল সশস্ত্র ক্যাডারও পালিয়ে এসে এখানে আশ্রয় নিয়ে আছেন। সব ক্যাটাগরির শরণার্থীরা এখন আর দেশে ফিরতে ইচ্ছুক নন, বরং ভারতেই নাগরিকত্ব পেতে আগ্রহী তারা। তবে ভারত সরকার বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের হিন্দুদের সে দেশে নাগরিকত্ব দেওয়ার ঘোষণা দিলেও তামিল এই শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দিতে ইচ্ছুক নয়। নির্বাচন এলে এদের প্রতি স্থানীয় প্রধান দলগুলোর সোচ্চার সহানুভূতি দেখা গেলেও নির্বাচনের পরে তারা সচরাচর সেই সব অঙ্গীকার ভুলে যান। সর্বশেষ নির্বাচনে প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতা তাঁর রাজ্যের তামিল শরণার্থীদের জন্য ভারত ও শ্রীলঙ্কার দ্বৈত নাগরিকত্বের প্রস্তাব করেছিলেন।

২৬.      অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদের মতোই যুদ্ধবিধবাদের প্রকৃত সংখ্যা সম্পর্কেও দেশটিতে নির্ভরযোগ্য তথ্যের অভাব রয়েছে। দেশটির নারী ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মতে এই সংখ্যা ৮৯ হাজার। তার মধ্যে নর্দান প্রভিন্সে রয়েছে ৪০ হাজার এবং ইস্টার্ন প্রভিন্সে রয়েছে ৪৯ হাজার নারী। কেবল বাত্তিকালোয়া জেলাতেই ২০ হাজার যুদ্ধবিধবা রয়েছেন। উল্লেখ্য, দেশটির দক্ষিণেও বিপুল সিংহলি যুদ্ধবিধবা রয়েছেন, কারণ যুদ্ধে প্রচুর সিংহলি সৈনিকও মারা গেছে এবং অনেকে নিখোঁজও হয়েছে। অন্যদিকে, বেসরকারি হিসেবে যুদ্ধবিধবাদের সংখ্যা সরকারি হিসাবের চেয়ে অনেক বেশি। জাফনাভিত্তিক সেন্টার ফর উইমেন ডেভেলপমেন্ট দাবি করে থাকে, কেবল এই জেলাতেই ২৬ হাজার ৩৪০ জন বিধবা রয়েছেন, যাঁদের স্বামী যুদ্ধে মৃত বা নিখোঁজ। দেখুন : Subash Somachandran, Sri Lanka: War widows left in poverty. wsws.org, 27 Oct. 2010.

২৭.       ‘Orphaned children in North forgotten’, Daily Mirror, Sri Lanka, 23 July 2010

২৮.      Mohan K. Tikku, Ibid, P. 166.

২৯.       P K Balachandran, Mysterious deaths of ex-LTTE cadres create unease in North Sri Lanka, Friday, September 09, 2016, The Indian Express,

          http://www.newindianexpress.com/world/Mysterious-deaths-of-ex-LTTE-cadres-create-unease-in-North-Sri-Lanka/2016/08/05/ article3564839.ece (accessed 15th Nov., 2016)

৩০.      ETCA should not be alloud: JVP, (21 Sep., 2016),

          http://www.hirunews.lk/143447/etca-should-be-allowed-jvp (retrive on 20th September 2016

৩১.      ‘India to build sea bridge, tunnel to connect Sri Lanka,’ The Hindu (December16,2015),       http://www.thehindu.com/news/national/india-to-build-sea-bridge-tunnel-to-connect-sri-lanka/article7996560.ece

৩২.      ২০১৫ সালের হিসাবে দেখা যায়, শ্রীলঙ্কায় ভারতের রপ্তানি ছিল ৪,২৬৮ মিলিয়ন ডলার মূল্যের। আর ভারতে শ্রীলঙ্কার রপ্তানি ছিল মাত্র ৬৪৩ মিলিয়ন ডলার মূল্যের।

৩৩.      ২০১৬ সালে এমনকি তামিল রাজনীতিবিদদের সঙ্গেও কলম্বোয় চীনের রাষ্ট্রদূতকে বৈঠক করতে দেখা গেছে, যা স্থানীয় কূটনীতিকদের মধ্যে বিস্ময় জাগিয়েছে। দেখুন : China Adopts Balanced Policy in Sri Lanka by Cultivating Both the Maithri-Ranil Govt and Mahinda led Opposition (25 November 2016), http://dbsjeyaraj.com/dbsj/archives/49848 (retrive on 10th September 2016 )

৩৪.      আলতাফ পারভেজ, শ্রী লঙ্ককার তামিল ইলম: দক্ষিণ এশিয়ায় জাতি-রাষ্ট্রের সংকট, ঐতিহ্য, ২০১৭, ঢাকা।

৩৫.      United States (US). 11 February 2016. Central Intelligence Agency (CIA). ‘Sri Lanka.’ The World Factbook;

          https://www.cia.gov/library/publications/the-world-factbook/ geos/ce.html. [Accessed 22 Feb. 2016]

৩৬.     ২০০৯-এর পর সরকারের হাতে আটক এলটিটিইর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নেতা ছিলেন পাথমানাথন। কিন্তু তাঁর আটকের কিছুদিন পরই ২০১২-এর অক্টোবরে বিস্ময়করভাবে তিনি মুক্তিও পান এবং শ্রীলঙ্কার উত্তরে NERDO নামে একটি এনজিও গড়ে তোলেন। এই এনজিও থেকে যুদ্ধবিধ্বস্ত তামিলদের পুনর্বাসনকাজ চালাতে শুরু করেন। ধারণা করা হয়, প্রবাসী তাামিল সংগঠকদের সঙ্গে যোগাযোগ সূত্ররূপে সরকার পাথমানাথনের সঙ্গে রহস্যময় কিছু বোঝাপড়ায় এসেছে।

৩৭.      এই ঘটনাগুলোর বিস্তারিত জানতে দেখুন: R Hariharan, Revival of Tamil Tigers in Sri Lanka, http://www.claws.in/images/journals_ doc/1435402295_RHariharan.pdf. [Accessed 2oth March. 2016] Ges Times of India, 20th Dec. 2012 I Daily Mirror, 25th April 2014.. ২০১৪-এর এক হিসাবে দেখা গেছে,

            (http://www.globalfirepower.com/country-military-strength-detail.asp?country_id=srilanka) মূল যোদ্ধাসংখ্যা এখন তাদের প্রায় ১ লাখ ৬১ হাজার এবং রিজার্ভ সৈনিকসংখ্যা ৯৮ হাজার ২০০।

৩৮.     ‘SLA’s 200,000 men could face any threat: Army chief’, http://www.sundayobserver.lk/2010/07/25/sec04.asp [Accessed 10th March. 2016]

৩৯.      http://indianexpress.com/article/world/world-news/ltte-leader-velupillai-prabhakaran-birthday-celebrated-in-jaffna-4397022/ (Accessed, November 26, 2016)

৪০.       R Hariharan, Revival of Tamil Tigers in Sri Lanka,

          http://www.claws.in/images/journals_doc/1435402295_RHarihar an.pdf. [Accessed 2oth March. 2016]