বিয়ন্ড দ্য লাইনস: অ্যান অটোবায়োগ্রাফি, কুলদীপ নায়ার
ডেইলি স্টার, বাংলাদেশ সংস্করণ, নভেম্বর, ২০১২।
আত্মজীবনী কেবল ব্যক্তি নয়, সমকালীন সমাজ ও সমাজের অনেক মানুষের জীবন ধারণ করে। যে আত্মজীবনী নিজের চেয়ে সমকালীন সমাজের পিছিয়ে পড়া এবং এগিয়ে নেওয়া মানুষদের কথা বেশি বলে, সেটাই সার্থক আত্মজীবনী। যে আত্মজীবনী কালের কিংবা দেশের সীমা ছাড়িয়ে নব নব দিকের পানে পাঠককে নিয়ে যায়, সেটাই কালোত্তীর্ণ আত্মজীবনী। যে আত্মজীবনী ব্যক্তির চেয়ে তার চারপাশের চরিত্রগুলোর প্রতি অধিক মনোনিবেশ ঘটায়; পাঠককে নিয়ত আত্মজিজ্ঞাসা ও আত্মবিশ্লেষণে ব্যস্ত রাখে, সেই আত্মজীবনীই হয়ে ওঠে সময়ের দর্পণ। রাজনীতিকদের আত্মজীবনীতে ব্যক্তি ও দলের প্রচারণা বেশি থাকে, পণ্ডিতদের আত্মজীবনী তত্ত্বের ভারে আক্রান্ত হয়, বিজ্ঞানীদের আত্মজীবনীতে নিজের কাজের বাইরের কিছু দেখা যায় না, লেখক-কবিদের আত্মজীবনীতে ভাবালুতার আধিক্য লক্ষ করা যায়। কিন্তু সাংবাদিকদের আত্মজীবনী কেমন হয়ে থাকে? সাংবাদিক কি তাঁর আত্মজীবনীতে সব সময় পেশাগত বস্তুনিষ্ঠতা ও নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে পারেন? তিনি কি নিজেকে অতিক্রম করে সত্যকে তুলে ধরতে পারেন?
এই প্রেক্ষাপটে আমরা ভারতীয় সাংবাদিক কুলদীপ নায়ারের আত্মজীবনী বিয়ন্ড দ্য লাইনস মূল্যায়ন করব। বাংলাদেশের সাংবাদিকদের মধ্যে ফয়েজ আহমদ, এস এম আলী, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী প্রমুখ যা লিখেছেন, তা ঠিক আত্মজীবনী নয়; পেশাগত জীবনের পুনর্লিখন। বিশেষ করে ফয়েজ আহমদের চার খণ্ডের আত্মজীবনী বহু বিচিত্র অভিজ্ঞতা ও সরস ঘটনায় ভরা। কিন্তু কুলদীপ নায়ারের আত্মজীবনীতে ঘটনার চেয়ে অগ্রাধিকার পেয়েছে দেশ, মানুষ, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার।
কুলদীপ নায়ারের জন্ম ১৯২৩ সালে, অবিভক্ত পাঞ্জাবের শিয়ালকোটে। তাঁর বাবা ছিলেন নামকরা চিকিত্সক। সেই সুবাদে স্থানীয় হিন্দু-মুসলিম ও শিখদের অত্যন্ত প্রিয় ছিলেন। কুলদীপ নায়ার আইনে স্নাতক হয়েও সাংবাদিকতায় কর্মজীবন শুরু করেছিলেন, পরবর্তীকালে নিজেকে বহুমাত্রিক পরিচয়ে বিস্তৃত করেছেন। সাংবাদিকতার বিরতিতে তিনি সরকারি চাকরি করেছেন, বিদেশে ভারতের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেছেন, হয়েছেন দেশটির উচ্চপরিষদ তথা রাজ্যসভারও সদস্য।
কুলদীপ নায়ারের আত্মজীবনী বিয়ন্ড দ্য লাইনস বা সীমার ওপারে নামকরণটি তাত্পর্যপূর্ণ। এই সীমা যেমন অবিভক্ত ভারতের ইতিহাস তুলে আনে, যখন তিনটি দেশের মধ্যে কোনো সীমা ছিল না, তেমনি ভবিষ্যতেরও ইঙ্গিত দেয়। তাঁর বর্তমান দেশ ভারত হলেও বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে অবাধ যাতায়াত আছে। তাঁর কলাম ‘বিটুইন দ্য লাইন’ দেশ-বিদেশের ১৭টি ভাষার ৮০টি পত্রিকায় ছাপা হয়। কুলদীপ নিজেকে অবশ্যই ভারতীয় মনে করেন, কিন্তু তার চেয়েও বেশি মনে করেন উপমহাদেশীয়। তিনি বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে মৈত্রী চান, আবার পাকিস্তানের সঙ্গেও সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে আগ্রহী। তিনি উগ্র ধর্মবাদিতার মতো অপছন্দ করেন উগ্র জাতীয়তাবাদকে।
বিয়ন্ড দ্য লাইনস-এর শুরু শিয়ালকোটে, তার কৈশোরে যখন দেশ ভাগ হয়ে ভারত ও পাকিস্তান নামের দুটি রাষ্ট্র হয়, সমাপ্তি টেনেছেন মনমোহন সিংয়ের শাসনামলে এসে। এই যে প্রায় ৭০ বছরের কালপর্ব; এই সময়ে উপমহাদেশে রাজনৈতিক উত্থান-পতন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, মানবিক বিপর্যয়, যুদ্ধ-বৈরিতা, দ্বিপক্ষীয় ও ত্রিপক্ষীয় সম্পর্কের টানাপোড়েন—সবই বিবৃত হয়েছে তাঁর আত্মজীবনীতে। ১৯টি অধ্যায়ে বিভক্ত এই আত্মজীবনীকে আমরা মোটাদাগে তিন ভাগে ভাগ করতে পারি। ১. শৈশব থেকে দেশ বিভাগ পর্যন্ত; ২. দেশ বিভাগ থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং ৩. বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ থেকে হালনাগাদ।
কুলদীপ নায়ারের আত্মজীবনীর ক্যানভাস বিশাল। চরিত্র ও ঘটনাবলি অজস্র। কোনো কোনো বিষয়ে তিনি বিস্তৃত আলোচনা করলেও অনেক বিষয় বুড়িছুঁয়ে গেছেন। ফলে ইতিহাসের একনিষ্ঠ গবেষক কিংবা রাজনীতির পণ্ডিতেরা এ বইয়ে ইতিহাসের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ খুঁজতে গেলে হতাশ হবেন। কিন্তু বিষয়-বর্ণনায় লেখকের নির্মোহ ও মানবিক দৃষ্টি আমাদের চমকিত করে; তিনি কুশলী রিপোর্টারের মতো ঘটনার সত্যনিষ্ঠ বিবরণ দিয়ে গেছেন, মাঝেমধ্যে দু-একটি মন্তব্য করেছেন এবং নিজেকে বরাবর ঘটনার আড়ালে রাখতে সচেষ্ট থেকেছেন। এটাই সম্ভবত কুলদীপের লেখনীর বড় গুণ।
কুলদীপের আত্মজীবনীর প্রথম পর্বে রয়েছে: শৈশব ও দেশ বিভাগ, নেহরুর বছরগুলো, প্রথম দিকে শাসন, ইংরেজি সাংবাদিকতায় আমার প্রশিক্ষণ ও শিক্ষানবিশীকরণ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে গোবিন্দ বল্লভ পন্থ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে লাল বাহাদুর শাস্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে লাল বাহাদুর শাস্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইন্দিরা গান্ধীর শাসনামলের চালচিত্র। দ্বিতীয় পর্বে: বাংলাদেশের যুদ্ধ, শিমলা সম্মেলন, জরুরি অবস্থা ও তারপর, জনতা পার্টির সরকার, অপারেশন ব্লু স্টার। তৃতীয় পর্বে: রাজিব গান্ধী, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ভিপি সিং, নরসিমা রাওয়ের সরকার, সংসদে আমার সম্পৃক্ততা, বিজিপি অ্যাট দ্য হেলথ, মনমোহন সিংয়ের সরকার।
২.
আমরা দেশ বিভাগ নিয়ে পাকিস্তান ও ভারতের শাসকদের বিপরীতমুখী ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ লক্ষ করি। দেশ বিভাগের সময়ে সীমান্তের এপারে-ওপারে লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে, তার চেয়েও বেশিসংখ্যক নারী-পুরুষ ও শিশু অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশার মধ্যে পড়েছে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার শিকার হয়ে বহু মানুষকে জীবন দিতে হয়েছে, বহু নারী সম্ভ্রম হারিয়েছেন। কুলদীপ নায়ার নিজেও দেশ বিভাগের কারণে জন্মভূমি শিয়ালকোট থেকে নয়াদিল্লিতে এসে উদ্বাস্তু জীবন বেছে নিতে বাধ্য হন। সেই সময়ের ভয়াল পরিস্থিতির বিবরণ দিতে গিয়ে কুলদীপ নায়ার লিখেছেন, When I crossed the border on 13 September 1947 I had seen so much blood and destruction in the name of religion that I vowed to myself that the new India which we were going to build would know no deaths due to differences in religion or Caste. I therefore wept when I witnessed the mass-murder of Sikhs in 1984 and saw a repetition of such inhumanity in Gujarat in 2002, viewing it as a microcosm of the communal violence I had witnessed in 1947. (পৃষ্ঠা ৪২৯-৪৩০)
কুলদীপ নায়ার শিখ ও হিন্দু উভয় পারিবারিক ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী; তাঁর মা নিয়মিত গুরুদুয়ারায় যেতেন, তাঁরা শিখ হলেও লম্বা চুল রাখেননি; কুলদীপ নিজের নামের সিং বাদ দিয়ে নামের শেষে নায়ার যোগ করেছেন। তাঁদের পরিবারে হিন্দু ও শিখ উভয় ধর্মের অনুষ্ঠানাদি পালন করা হতো; তাঁরা ছিলেন সংস্কারমুক্ত। এমনকি একবার লক্ষ্মীপূজার আচারাদি পালনের সময় এক মুসলিম দম্পতি এসে পড়লে তাঁর মা তাঁদেরও তাতে যোগ দিতে বলেন। কুলদীপ নায়ার জাত-অজাত বিশ্বাস করতেন না; তাঁর ভাষায় অদ্ভুত কালচার হিন্দুধর্মের জাতপাতের বিভেদ সম্পর্কে সজাগ করে। স্কুলে সহপাঠীদের মধ্যে কেউ জুতো পরত; কেউ খালি পায়ে ছিল; কুলদীপ শিক্ষকদের প্রশ্ন করেন, কেন সবাই জুতা পরে আসবে না? যারা খালি পায়ে আসত, তারা ছিল নিম্ন ধরনের। কুলদীপ ধর্মের নামে এই অনাচার মানতে পারেননি শৈশব থেকে।
১৯৪৭ সালে যখন দেশ ভাগ হয় কুলদীপ নায়ার ২৩ বছরের যুবক; দেশ বিভাগের আগেই সীমান্তের দুই পারে হিন্দু, মুসলিম ও শিখ সম্প্রদায়ের মধ্যে দাঙ্গা শুরু হয়ে যায়। বাবা-মা তাঁকে এক সেনাসদস্যের সঙ্গে দিল্লিতে পাঠান; পথে তিনি যেসব রোমহর্ষক হত্যা ও দাঙ্গার ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছেন তার বর্ণনা দিয়েছেন, কুলদীপের ভাষায়, The refugees carried with them not only bitterness and vengeful thought but also stories of atrocities in the cities and villages where they had lived peacefully with other communities for centuries. If Partition was on the basis of religion, the killing only served to carve deep furrows. (পৃষ্ঠা ৮-৯)
কুলদীপ নায়ার তাঁর আত্মজীবনীতে সাতচল্লিশের উদ্বাস্তুদের ট্র্যাজেডির বিবরণ দিলেও একাত্তরে যে পাকিস্তানিদের হাতে নিগৃহীত হয়ে বাংলাদেশের প্রায় এক কোটি মানুষ দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছিল; যাদের ঠাঁই হয়েছিল ভারতের সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোতে; তাদের বেদনা ও দীর্ঘশ্বাসের কথা তাঁর লেখায় তেমন করে পাই না।
অনেক ইতিহাসবিদের মতো কুলদীপও মনে করেন, ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাব কংগ্রেস ও মুসলিম লিগ মেনে নিলে দেশ ভাগ এড়ানো যেত এবং এ জন্য জওহরলাল নেহরুর অনমনীয় ভূমিকাকে দায়ী করেন। সম্প্রতি বিজেপি নেতা নটবর সিং বই লিখেও তা জানিয়েছেন। মাওলানা আবুল কালাম আজাদের ইন্ডিয়া উইনস ফ্রিডম-এও এর সমর্থন পাওয়া যায়। কিন্তু মুহম্মদ আলী জিন্নাহ মুসলমানদের জন্য যে পুণ্যভূমি প্রতিষ্ঠার পণ করেছিলেন, সে কথাটি জোরালোভাবে কেউ বলেন না। আমাদের মনে রাখা দরকার ক্রিপস মিশনের প্রস্তাব প্রথমে জিন্নাহ গ্রহণ করলেও পরে নাকচ করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, হিন্দু ও মুসলিম দুটি জাতি। কেবল ধর্মবিশ্বাস নয়, তাদের আচার-রীতি, জীবনধারাও আলাদা। এ অবস্থায় কীভাবে দুই সম্প্রদায় এক দেশে বসবাস করে? অবাক ব্যাপার হলো, জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্বে ভারতীয় মুসলমানরা এতটাই আচ্ছন্ন ছিলেন যে যেসব এলাকার মুসলমান পাকিস্তানে যেতে পারবেন না জানতেন; তাঁরাও পাকিস্তান আন্দোলন সমর্থন করেছিলেন। এর পেছনে কাজ করেছে সংখ্যালঘু মনস্তত্ত্ব। আমার ধারণা, অধিকাংশ ভারতীয় লেখক-ইতিহাসবিদ জিন্নাহর ব্যক্তিগত জীবনাচরণকেই তাঁর রাজনৈতিক বিশ্বাস বলে ভুল ব্যাখ্যা দিয়েছেন। কুলদীপ নায়ারও এর ব্যতিক্রম নন।
মুদ্রার অপর পিঠ হলো, পাকিস্তানের লেখক-ইতিহাসবিদেরা মনে করেন না কংগ্রেসের অনমনীয়তার কারণে দেশ ভাগ হয়েছে। তাঁদের দাবি, মুসলমানদের জন্য মুহম্মদ আলী জিন্নাহ পাকিস্তান নামে একটি নতুন আবাসভূমি প্রতিষ্ঠা করেছেন। তবে এ-ও ঠিক মহাত্মা গান্ধী, আবুল কালাম আজাদ ও আবদুল গাফ্ফার খান পাকিস্তান ধারণাকে কখনোই মেনে নেননি। তাঁদের যুক্তি ছিল ধর্মের ভিত্তিতে দেশ ভাগ হতে পারে না। নেহরু-প্যাটেল মুসলমানদের চেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের স্বার্থ বড় করে দেখেছেন সত্য কিন্তু তাঁরা যথার্থই দুই ধর্ম দুই দেশ চিন্তা করেননি।
জিন্নাহ যখন দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করলেন তখন খণ্ডিত বাংলা, খণ্ডিত পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের বাইরের মুসলমানদের কথা ভাবলেন না। পৃথিবীতে ধর্মের ভিত্তিতে যে কোনো রাষ্ট্র হয় না, ‘আধুনিক ও সেক্যুলার’ জিন্নাহর মনোজগতে সেটি ধরা পড়েনি। তিনি ভারতে অবস্থিত কোটি কোটি মানুষের দুঃখ-দুর্দশার বিনিময়ে তৈরি নতুন দেশের পিতা হয়েছিলেন। কিন্তু সীমান্তের ওপারে একবারও তাকিয়ে দেখার প্রয়োজন বোধ করেননি। কুলদীপ নায়ার নিজেই জিন্নাহর উদ্ধৃত করেছেন: Hindus and Muslims belong to two different religions, philosophies, social customs, and literatures. They neither intermarry nor inter-dine, and indeed, they belong to two different civilizations that are based mainly on conflicting ideas and conceptions. (পৃষ্ঠা ২১)
কী ভয়ংকর কথা। এই জিন্নাহ নিজেও বিয়ে করেছেন এক পার্শি নারীকে।অস্বীকার করার উপায় নেই যে ভারতে দুই প্রধান সম্প্রদায়ের মধ্যে বৈষম্য ছিল। শিক্ষা, দীক্ষা, বিত্ত বেসাত এবং সংখ্যায় হিন্দুরা এগিয়ে এবং মুসলমানরা পিছিয়ে ছিল। জিন্নাহ সেই সমস্যার সমাধান খুঁজলেন দেশ ও জাতি ভাগের মাধ্যমে।
এর বিপরীতে আমরা আবুল কালাম আজাদের রাজনৈতিক দর্শন বিশ্লেষণ করলে দেখতে পাই, তিনি শেষ দিন পর্যন্ত পাকিস্তান আন্দোলনের বিরোধিতা করেছিলেন, যে কারণে জিন্নাহ তাঁকে কংগ্রেসের নেতা হিসেবে স্বীকার করেননি। তিনি মনে করতেন, মুসলমান মানেই মুসলিম লীগের সমর্থক হবেন। তবে এই মতবাদের ঘোরতর বিরোধী ছিলেন মাওলানা আবুল কালাম আজাদ। উর্দু সাময়িকী চেতন-এর সঙ্গে সাক্ষাত্কারে তিনি বলেছেন: Today the Muslims are not walking, they are flowing. The problem is that Muslims have not learnt to walk steadily; They either run or flow with the tide. When the group of people loses their confidence and self-respect, they are surrounded by imaginary doubts and dangers and fail to make a distinction between right and wrong. The true meaning of life is realized not through numerical strength but through firm faith and righteous action. (পৃষ্ঠা ৩৩)
বইয়ের ভূমিকায় কুলদীপ নায়ার বাংলাদেশ সম্পর্কে গভীর আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘বাংলাদেশ যেদিন স্বাধীন হয়, সেদিন থেকেই এর ঘটনাবলি প্রত্যক্ষ করে আসছি। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে অনেকের মতোই আমার ব্যক্তিগত যোগাযোগ আছে এবং সেই সম্পর্কের জন্য আমি গর্বিতও। আমি বিশ্বাস করি, একদিন দক্ষিণ এশিয়ার সবগুলো দেশ মিলে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য পরিচয় পরিত্যাগ না করেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো অভিন্ন ইউনিয়ন গড়ে তুলবে। এবং এটি আমাদের সব দেশের দারিদ্র্য সমস্যা দূর করতে এবং ধনী ও গরিবের মধ্যে বৈষম্য কমাতে সাহায্য করবে।’ (পৃষ্ঠা ১০)
তিনি আরও বলেন, ‘আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে একদিন দুই দেশ শান্তি, সম্প্রীতি ও সহযোগিতার মধ্যে বসবাস করার উদ্যোগ নেবে। বাণিজ্য ও সামাজিক অগ্রগতির লক্ষ্যে তারা একযোগে কাজ করবে।’ (পৃষ্ঠা ১১)
৩.
কুলদীপ নায়ারের সাংবাদিকতা শুরু উর্দু পত্রিকা আনজাম-এর মাধ্যমে। এই পত্রিকার মুসলিম মালিক তাঁকে চাকরি দিয়েছিলেন, সরকারের উচ্চ মহলে যোগাযোগ রেখে যাতে তাঁর পত্রিকা ও সম্পদ রক্ষা করা যায়। যখন সম্পাদকের সম্পদ রক্ষিত হলো না তখন তাঁকে ছাঁটাই করা হয়। এরপর স্বাধীনতাসংগ্রামী মাওলানা হাসরাত মাহানীর, যিনি প্রথম ভারতের স্বাধীনতার কথা বলেন, তাঁর পরামর্শে ইংরেজি পত্রিকায় সাংবাদিকতা করার চেষ্টা করেন। বৃত্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যান সাংবাদিকতা পড়তে, পরে একাধিক ইংরেজি দৈনিকে যোগ দেওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়ে লেখক-রাজনীতিক হুমায়ুন কবিরের সহায়তায় তাঁর ফিচার এজেন্সির মাধ্যমে ইংরেজি সাংবাদিকতা শুরু করেন। তাঁর প্রথম লেখা ছিল ‘To Every Thinking Refugee’। সেই নিবন্ধ তিনটি পত্রিকায় ছাপা হয় এবং পরবর্তীকালে কুলদীপ সিন্ডিকেটেড লেখক-সাংবাদিক হিসেবে ভারতে ও বিদেশে পরিচিতি লাভ করেন।
মাঝখানে সাংবাদিকতা ছেড়ে কুলদীপ নায়ার ভারত সরকারের প্রেস ইনফরমেশন ব্যুরোতে জনসংযোগ কর্মকর্তা হিসেবে চাকরি নেন; তিনি প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গোবিন্দ বল্লব পন্থ এবং পরে লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর সঙ্গে কাজ করেছেন। কিছুদিন জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে কাজ করারও অভিজ্ঞতা তাঁর ছিল। সে সময়ে কাছ থেকে কুলদীপ নায়ার এই তিন নেতাসহ কংগ্রেসের আরও অনেক নেতাকে দেখেছেন। তিনি যখন গোবিন্দ বল্লব পন্থের জনসংযোগ কর্মকর্তা, তখন ভাষার ভিত্তিতে রাজ্যগুলো পুনর্বিন্যস্ত করা হয়, প্রশাসনিক সংস্কার এবং পাকিস্তানের সঙ্গে সিন্ধু নদের পানি বণ্টন চুক্তি হয়। মন্ত্রীর সঙ্গে তিনি গুয়াহাটি ও সীমান্ত এলাকাও সফর করেছেন। তাঁর সেই সফরের অভিজ্ঞতা ছিল অম্লমধুর। এক সেনা কর্মকর্তা ট্রাংকে করে চোরাই মাল তাঁর পরিবারের কাছে পাঠান।
নেহরুর মৃত্যুর পর লাল বাহাদুর শাস্ত্রী প্রধানমন্ত্রী হন এবং সে সময়ে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ হয়। কুলদীপ নায়ার লিখেছেন, জওহরলাল নেহরু প্রচলিত কোনো ধর্মে বিশ্বাস করতেন না। ১৯৫৪ সালে তিনি লিখে গিয়েছিলেন, তাঁর মৃত্যুর পর ধর্মীয়ভাবে যেন শেষকৃত্য করা না হয়। কিন্তু ইন্দিরা গান্ধী ধর্মীয় রীতিতে শেষকৃত্য করার ব্যাপারে অনড় অবস্থান নেন। ফলে নেহরুর অন্তিম ইচ্ছেটি অপূর্ণই থেকে যায়। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের পর তাসখন্দে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব ও প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর মধ্যে শান্তি চুক্তি হয়। চুক্তি সইয়ের রাতেই হূদেরাগে মারা যান লাল বাহাদুর শাস্ত্রী। কিন্তু তাঁর স্ত্রী ললিতা শাস্ত্রী কুলদীপের কাছে অভিযোগ করেছেন, তিনি হূদেরাগে মারা যাননি। তাঁকে বিষ প্রয়োগ করে মারা হয়েছে। এ অভিযোগের তদন্ত হয়নি। মোরারজি দেশাই ক্ষমতায় আসার পর কুলদীপ তদন্তের ব্যাপারে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি এড়িয়ে যান।
শাস্ত্রী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগেই কুলদীপ নায়ার সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়ে সাংবাদিকতায় ফিরে যান। প্রথমে বার্তা সংস্থা ইউএনআই, এরপর স্টেটসম্যান, হিন্দুস্তান টাইমস। এখনো তিনি সাংবাদিকতাই করছেন।
৪.
কুলদীপ নায়ার তাঁর আত্মজীবনীতে ‘বাংলাদেশ যুদ্ধ’ নামে যে অধ্যায়টি লিখেছেন, সেটি মূলত বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান, পাকিস্তানি নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোসহ বিভিন্নজনের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাত্কার এবং নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে। পটভূমি হিসেবে এসেছে ১৯৭০ সালের নির্বাচন, বাঙালিদের বিরুদ্ধে ইয়াহিয়া-ভুট্টোর চক্রান্ত, ২৫ মার্চের সেনা অভিযান, ভারতে লাখ লাখ শরণার্থীর আশ্রয় গ্রহণ, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাঙালির প্রতিরোধ যুদ্ধে ভারতের সহায়তা, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ ইত্যাদি।
কুলদীপ নায়ার আরও জানাচ্ছেন, পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে খুব কম বিষয়েই অংশীদারি ছিল। পূর্ব পাকিস্তানিদের ভাষা, আচার, জীবনধারা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এই দুইয়ের মধ্যে একমাত্র সেতুবন্ধ ছিল ইসলাম। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর মুহম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় এসে যখন উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করতে চাইলেন, তখন সেই বন্ধনও শিথিল হয়ে গেল। পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষোভের প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়ায় এই ভাষা।
কুলদীপ নায়ার লিখেছেন, নাগা ও মিজো বিদ্রোহীদের যেভাবে পাকিস্তান সরকার সাহায্য-সহযোগিতা দিয়ে আসছিল, সেভাবেই ভারত সরকার বাঙালি গেরিলাদেরও সমর্থন জুগিয়েছে। এ ক্ষেত্রে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। বিএসএফ তত্কালীন প্রধান রুস্তমজির জবানিতেও আমরা জানতে পারি, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাঁর পুরো সবুজসংকেত দিয়ে বলেছিলেন, ‘সাহায্য করো কিন্তু ধরা পোড়ো না।’
কুলদীপ নায়ারের বিশ্লেষণ হলো, বাঙালি মুসলমান বাঙালি হিন্দুদের চেয়েও বেশি অপছন্দ করে পশ্চিম পাকিস্তানিদের। যেমনটি পশ্চিম পাঞ্জাবের মুসলমানরা পাঞ্জাবি হিন্দুদেরই কাছের মনে করে বাঙালি মুসলমানদের থেকে।
এ কারণে পশ্চিম পাকিস্তানিরা কাশ্মীর নিয়ে যখন আন্দোলন-সংগ্রাম করছে, পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা মনে-প্রাণে তার সঙ্গে একাত্ম হতে পারেনি। কেননা, তাদের কাছে কাশ্মীর অনেক দূরের। বাঙালি কূটনীতিক আজিজুল জলিল জানিয়েছেন, পঞ্চাশের দশকে তিনি যখন লন্ডনে পাকিস্তান হাইকমিশনে, শেখ মুজিবুর রহমান ওয়াশিংটন থেকে লন্ডন হয়ে দেশে ফিরছিলেন। লন্ডনে যাত্রাবিরতিকালে তাঁদের মধ্যে আলোচনা হয়। একপর্যায়ে কাশ্মীরের কথা উঠতেই মুজিব তাঁকে বললেন, ‘ওটি আমাদের সমস্যা না। পশ্চিম পাকিস্তানের সমস্যা।’
পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের বেরিয়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে কুলদীপ নায়ার অর্থনৈতিক বৈষম্য, পাকিস্তানি শাসকদের জবরদস্তি, ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ের পর অপ্রতুল সাহায্যের কথা লিখেছেন। কিন্তু বাঙালি মুসলমানের মনোজগতে যে অসাম্প্রদায়িক চেতনা লালিত, তাঁরাও যে রামমোহন, বিদ্যাসাগর ও রবীন্দ্রনাথের উত্তরাধিকার বহন করেন সে কথা উল্লেখ করেননি।
ইয়াহিয়া খান হামুদুর রহমান কমিশনের কাছে দেওয়া জবানবন্দিতে স্বীকার করেছেন, পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করতে ভুট্টো তাঁকে বাধ্য করেছিলেন। নায়ার মনে করেন, এই ঘটনাই পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে যায়।
১৯৭২ সালের ডিসেম্বরে ভুট্টো ইয়াহিয়া খানের কাছ থেকে খণ্ডিত পাকিস্তানের শাসনভার নেওয়ার পর পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিপর্যয়ের কারণ অনুসন্ধানে এই কমিশন গঠন করলেও রিপোর্ট প্রকাশ করেননি। নব্বইয়ের দশকের শেষার্ধে পারভেজ মোশাররফ এই রিপোর্ট প্রকাশ করলে পাকিস্তানে হইচই পড়ে যায়।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারত সহায়তা করলেও এর পরিণতি সম্পর্কে নিশ্চিত ছিল না, বিশেষ করে ভারতের ভয় ছিল আমেরিকা ও চীন এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে তাদের ওপরই বেশি আঘাত আসবে। সে কারণেই তারা অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে চুক্তি সইয়ের আগে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে আরেকটি চুক্তি সই করে।
মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রেকর্ড থেকে জানা যায়, মুজিবনগর সরকারের প্রতিনিধিরা কলকাতায় মার্কিন কনসাল জেনারেলের সঙ্গে যে আলোচনা করেন তাতেও ভারতের কোনো কোনো মহলের সম্মতি ছিল।
কুলদীপ নায়ার আরও জানান, ‘অক্টোবরেই এটি স্পষ্ট হয় যে আমরা এই বাংলাদেশের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে জড়িয়ে পড়েছি।’ প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিবেরা কয়েকজন সম্পাদককে একটি পরামর্শ সভায় আমন্ত্রণ জানান এবং মুজিবনগর নির্বাচনের অবস্থান প্রকাশ না করার জন্য তাঁদের ধন্যবাদ জানান। মুজিবনগর সরকার কলকাতায় অবস্থান করলেও পূর্ব পাকিস্তান বাংলাদেশের ভেতরে আছে বলে গণমাধ্যমে প্রচার করা হয়।
সেই বৈঠকে একজন সম্পাদক পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনসহ বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে একটি কমনওয়েলথ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দেন। তাঁর আশঙ্কা ছিল, বাংলাদেশ হবে তলাবিহীন ঝুড়ি, যাকে সহায়তা করার সামর্থ্য ভারতের নেই। এর জবাবে একজন সচিব জানান, ‘তিনিও তাঁর (সম্পাদক) সঙ্গে একমত। কিন্তু সিদ্ধান্ত আগেই হয়ে গেছে।’
বাংলাদেশের প্রথম ভারতীয় হাইকমিশনার সুবিমল দত্তের বরাত দিয়ে তিনি আরও জানান, The decision was to support the uprising against West Pakistan and help the movement for the creation of Bangladesh. (পৃষ্ঠা ২০৯)
যুদ্ধ ও প্রেমে সত্য নিহত হয়। কুলদীপ নায়ার সে সময় ভারতের গণমাধ্যমের একপেশে সংবাদ পরিবেশনার কথাও উল্লেখ করেছেন। স্বভাবতই ভারতের সব গণমাধ্যমের সহানুভূতি ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি। কুলদীপ নায়ারের বইয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে আরেকটি নতুন তথ্য দিয়েছেন, যা আগে চোখে পড়েনি। যুদ্ধের শুরুতে পাকিস্তান মনে করেছিল, ভারত শরণার্থীদের পুনর্বাসনের জন্য সীমান্ত এলাকাগুলো দখল করতে চেয়েছিল। পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিং বিদেশ সফরে গিয়ে ৫০ মাইল এলাকামুক্ত করার ইঙ্গিতও দিয়েছিলেন, স্থায়ী সমাধান না হওয়া পর্যন্ত জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে শরণার্থীদের পুনর্বাসন করা হবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের কারণে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। পাকিস্তানের ধারণা ছিল, ভারতের অভিযান হবে সীমিত পরিসরে। তারা ভারতের পশ্চিম সীমান্তে আক্রমণ চালায়, যাতে পূর্বাঞ্চল নিয়ে ওরা বেশি ব্যস্ত থাকতে না পারে।
কুলদীপের জবানিতে আমরা আরও জানতে পারি যে যুদ্ধের সময় লে. জেনারেল হরবক্স সিং সেনা অভিযান ও তাত্পর্যপূর্ণ ঘটনাবলি সম্পর্কে প্রতিদিন ব্রিফ করতেন। তিনি স্টেটসম্যান-এ প্রতিদিনই এ মিলিটারি এক্সপার্ট ছদ্মনামে একটি কলাম লিখতেন।
যুদ্ধের শেষদিকে ভারতীয় বাহিনীর মন্থর অগ্রাভিযানে মস্কো উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল। কেননা, তারা চায়নি বাংলাদেশ ভিয়েতনাম হোক। সোভিয়েত প্রথম উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী ভ্যাসিলি কুজনেটভ যুদ্ধের সর্বশেষ অবস্থা জানতে জরুরি ভিত্তিতে দিল্লি আসেন এবং তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাংলাদেশের জনগণ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে, তাদের কাঠামো ভেঙে পড়েছে এবং আত্মসমর্পণের ঘটনা তিন বা চার দিনের ব্যাপারমাত্র।
কুলদীপের জবানিতে আমরা আরও জানতে পারি, যুদ্ধের প্রহরটি সবার জন্যই ছিল উদ্বেগের। পাকিস্তান পরাজয় এড়াতে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সহায়তা চায়। নয়াদিল্লি ভারত-পাকিস্তান বিরোধে যুক্তরাষ্ট্র কোনো পক্ষ নেবে না, এই প্রতিশ্রুতির কথা ওয়াশিংটনকে মনে করিয়ে দেয়। চীনকে ভয় দেখাতে সোভিয়েতকে প্রস্তুত থাকতে বলে। যুক্তরাষ্ট্র যখন বুঝতে পারল যে পূর্ব পাকিস্তান ইসলামাবাদের হাতছাড়া হয়ে গেছে, তখন তারা মস্কোর মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তানে আর অগ্রসর না হওয়ার জন্য হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে। এমনকি তারা প্রস্তাবিত ব্রেজনেভ-নিক্সন বৈঠক বাতিল করারও হুমকি দেয়।
যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে ভয় দেখাতে পারমাণবিক অস্ত্রবাহী সপ্তম নৌবহর পাঠায় বঙ্গোপসাগরে। এর জবাবে মস্কো সোভিয়েত অষ্টম নৌবহর পাঠায়।
শরণ সিং জাতিসংঘ থেকে টেলিফোনে নয়াদিল্লিকে জানান দ্রুত অপারেশন শেষ করার জন্য। সোভিয়েত ইউনিয়ন তাঁকে জানিয়েছেন, বেশি দিন অস্ত্রবিরতি প্রস্তাব ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। অর্থাত্ বাংলাদেশের যুদ্ধে বৃহত্ শক্তিগুলো প্রত্যক্ষ না হলেও পরোক্ষভাবে জড়িয়ে পড়ে।
মস্কো জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে রাজনৈতিক সমাধানের যে প্রস্তাব দেয়, তা গ্রহণ করলে অস্ত্রবিরতি হয়ে যেত এবং তখন পাকিস্তানকে অপমানজনকভাবে আত্মসমর্পণ করতে হতো না। ১৫ ডিসেম্বর মার্কিন কূটনীতিকদের কাছ থেকে জেনারেল জ্যাকব টেলিফোন পান যে জেনারেল নিয়াজি ও রাও ফরমান আলি যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে রাজি হয়েছেন।
মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে কুলদীপ নায়ারের মূল্যায়ন, ভারতের অবদানের সঙ্গে তুলনা করলে বাংলাদেশের জনগণ ও মুক্তিবাহিনীর ভূমিকা বিরাট। তারা নিজেরাই যে নিজেদের স্বাধীনতা অর্জন করতে পারত সে ব্যাপারে আমার কোনো সন্দেহ নেই। ভারতের সমর্থন ছাড়া বাংলাদেশিরা আরও বেশি সমস্যায় পড়ত এবং যুদ্ধ আরও দীর্ঘ হতো কিন্তু তাদের অবিচলতা এবং দুঃখ-দুর্দশা মেনে নেওয়ার সক্ষমতা খাটো করে দেখা উচিত নয়।
কুলদীপ নায়ার লিখেছেন, পাকিস্তানি শাসকেরা যখন সামরিক অভিযান চালাল, যার ফলে ভারতে শরণার্থীদের ক্ষোভ বইতে থাকে, তখন ভারত সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়ারও চিন্তা করেছিল। পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিং বারবার প্রস্তাব সংসদে আনেন। কিন্তু তাঁর সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হয় এই যুক্তি দেখিয়ে যে এটি হবে ভারতের নীতির বিরোধী। এমনকি নেহরুর অবস্থান ছিল দুর্বিসহ ও বিপজ্জনক অবস্থায় যাঁরা আছেন, তাঁদের সহায়তার পক্ষে।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যা, ধর্ষণ ও লুটপাটের কথা উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন, ‘আমি বুঝতে পারি না পাকিস্তান কেন এসব নৃশংসতার জন্য ক্ষমা চাইছে না। হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে আণবিক বোমা ফেলার জন্য যদি যুক্তরাষ্ট্র জাপানের কাছে ক্ষমা চাইতে পারে, তাহলে পাকিস্তান নয় কেন?’ (পৃষ্ঠা ২১৭)
হামুদুর রহমান রিপোর্টের উদ্ধৃতি দিয়ে কুলদীপ নায়ার লিখেছেন, মদ ও নারীর প্রতি অদম্য বাসনা এবং জমি ও বাড়ির প্রতি লোভের কারণেই জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তারা যুদ্ধে তাদের পেশাগত সক্ষমতা হারিয়েছে, যা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পতন ত্বরান্বিত করেছে।
কুলদীপ নায়ার ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের আগে ও পরের কাহিনি বর্ণনা করতে গিয়ে এমন কিছু তথ্য দিয়েছেন, যা এর আগে কোনো বই বা দলিলে পাওয়া যায়নি। তাঁর সুবিধা হচ্ছে উভয় পক্ষের প্রধান কুশীলবের সঙ্গে সরাসরি আলোচনা করে তথ্যগুলো যাচাই-বাছাই করে নিয়েছেন। বাংলাদেশে ভারতীয় সেনাবাহিনী লুটপাট করেছে বলে বেশ গুজব চলছিল। বলা হয়েছিল, সেনারা ঢাকায় বেশ কিছু বাড়িঘর লুটপাট করেছে।
ইন্দিরা গান্ধী ক্ষুব্ধ হলেও তাঁর ভয় ছিল বাংলাদেশ যুদ্ধের পর জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে সেনাপ্রধান ম্যাম মানেক শ সরকারের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান ঘটাতে পারেন। ইন্দিরা গান্ধী সেনাপ্রধানকে টেলিফোন করে ভারতীয় সেনাদের লুটপাট সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান। তাঁর ভাষায়, ‘আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করে বলি, এ রকম কিছু ঘটেনি; তিনি যেন তাঁর কাজ করেন এবং আমাকে আমার কাজ করতে দেন।’ (পৃষ্ঠা ২১৪)
কুলদীপ নায়ার বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর মুজিব ও ভুট্টো দুই নেতার সঙ্গেই দেখা করেন এবং পরস্পরবিরোধী বক্তব্য পান। ভুট্টো বলেছেন, মুজিব তাঁকে প্রথমে পাকিস্তানের সঙ্গে একটি যোগসূত্র রাখার কথা বললে তিনি কথা দেননি। কিন্তু মুজিবের ভাষ্য হলো, ‘আমি ধর্মভীরু জেলারের কাছ থেকেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা জানতে পারি। আমাকে জেলখানা থেকে নেওয়ার সময়ে আমি বুঝতে পারি যে ভুট্টো আলোচনার জন্য এটি করেছেন। কিন্তু আমি তাঁকে বাংলাদেশ সম্পর্কে কিছু জানি, সেই ইঙ্গিত দিইনি। আমি তাঁকে এ-ও বলি যে আমি মুক্ত মানুষ না হওয়া পর্যন্ত কোনো কথা বলব না।’ তখন তিনি বললেন, “তুমি মুক্ত।” আমি এ-ও জানি যে ইয়াহিয়া খান যা করেছেন তার পেছনে ভুট্টো ছিলেন। তিনি আমাকে বললেন, পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা ও যোগাযোগের বিষয়টি বাংলাদেশ ও পাকিস্তান একসঙ্গে পরিচালনা করতে পারে কি না? আমি তাকে বলি, এটি এখন আর সম্ভব নয়। কিন্তু যখন তিনি এ ব্যাপারে চাপ দিচ্ছিলেন, তখন আমি তাঁকে বলি যে আমার জনগণের সঙ্গে কথা না বলে আমি তোমাকে কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারি না।’ (পৃষ্ঠা ২১৯)
কিন্তু ভুট্টো দাবি করেছেন, দুই দেশের মধ্যে যোগসূত্র রাখার ব্যাপারে মুজিব কোরআন শরিফ হাতে নিয়ে শপথ করেছিলেন। এ ব্যাপারে লেখক প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে মুজিব বলেন, ‘ভুট্টো একজন মিথ্যাবাদী। তিনি আমার জীবন বাঁচিয়েছেন, এ জন্য আমি তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে তিনি মিথ্যা প্রচারের অধিকার পেয়েছেন।’ (পৃষ্ঠা ২১৯)
এরপর কুলদীপের মন্তব্য হলো, মুজিবকে ছেড়ে দিয়ে ভুট্টো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে পাকিস্তানের ভাবমূর্তি কিছুটা উজ্জ্বল করতে চেয়েছিলেন। (তাঁর ভাষায়, ‘...আমি নাইট অ্যাঙ্গেলকে ছেড়ে দিয়েছি।’ কিন্তু দায়িত্ব নেওয়ার পর জাতির উদ্দেশে দেওয়া প্রথম ভাষণে তিনি ইয়াহিয়ার কথারই পুনরুক্তি করেন, ‘আমরা পাকিস্তানের মর্যাদা ও অখণ্ডতার জন্য লড়াই চালিয়ে যাব। পূর্ব পাকিস্তান পাকিস্তানের অবিচ্ছেদ্য অংশ।’ (পৃষ্ঠা ২২০)
কুলদীপ জানাচ্ছেন, সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, যুদ্ধের ময়দানে হেরে যাওয়ার পরও পাকিস্তানিরা প্রচারণা যুদ্ধ অব্যাহত রেখেছিল। রেডিও পাকিস্তানের ঘোষণায় পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের সময়ও বলা হতো। পাকিস্তানি সংবাদপত্রগুলোয় ঢাকা সংস্করণ উল্লেখ থাকত, যদিও বাস্তবে তা ছিল না।
কুলদীপ নায়ারের বইয়ে স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতির গতিপ্রকৃতিও সংক্ষেপে বিবৃত হয়েছে। তিনি বাংলাদেশের প্রায় সব রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। ১৯৭৫ সালে বিপথগামী সেনাসদস্যদের হাতে যখন মুজিব নিহত হন, তখন ভারতে চলছিল জরুরি অবস্থা, কুলদীপ জেলে। তিনি লিখেছেন, ভারতের গোয়েন্দারা মুজিবকে আগেই সতর্ক করে দিয়েছিল। জবাবে অতি আত্মবিশ্বাসী মুজিব বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশে আমাকে কে হত্যা করবে?’
কুলদীপের দেওয়া তথ্যে জানা যায়, বাংলাদেশে সেনা অভ্যুত্থান সম্পর্কে আগে থেকেই ভারতের আশঙ্কা ছিল। ১৯৭২ সালে ভারতীয় সেনাবাহিনীর বাংলাদেশ ত্যাগের সময়ই বাংলাদেশে যাতে কোনো ট্যাংক না রাখা হয় সে ব্যাপারে চাপ দিয়েছিলেন ডিপি ধর, ইন্দিরা গান্ধীর পরিকল্পনামন্ত্রী। তাঁর আশঙ্কা ছিল, বাংলাদেশে ট্যাংক রাখা হলে সেনাবাহিনী অভ্যুত্থান ঘটাতে পারে। (পৃষ্ঠা ২২৩) ১৯৭৫ সালে সেই অভ্যুত্থান তারা ঘটিয়েছে মুজিবকে আনোয়ার সাদাতের উপহার দেওয়া ট্যাংকের সহায়তায়।
কুলদীপ নায়ার শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার শাসনকে মোটামুটি কাছ থেকে দেখেছেন। এরশাদের শাসনামলে তিনি বহুবার বাংলাদেশে এসেছেন এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় দুই নেত্রীকে একযোগে আন্দোলন করার পরামর্শ দিয়ে বলেছেন, আপনারা এক হলেই কেবল সামরিক শাসনের অবসান ঘটতে পারে। নব্বইয়ে সামরিক শাসনের অবসান ঘটলেও গণতন্ত্র যে টেকসই হয়নি তার প্রমাণ বর্তমান বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক বিষয়ে কুলদীপ মনে করেন, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক টেকসই করার বিষয়টি বাংলাদেশের চেয়ে ভারতের ওপরই বেশি নির্ভর করে। যদি দুই দেশের সম্পর্ক খারাপ হয়ে থাকে সেটি হয়েছে দুই দেশের আমলাতন্ত্রের মানসিকতার কারণে। কিন্তু গত সেপ্টেম্বরে নয়াদিল্লিতে এ ব্যাপারে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব সুজাতা সিংয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, ‘ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত চুক্তি তো আমরা আটকে রাখিনি।’ (লেখকের সঙ্গে দিল্লিতে সাক্ষাত্কার) তাঁর এ মন্তব্যও বেঠিক নয়। তা ছাড়া কুলদীপ যে মানসিক সীমাবদ্ধতার কথা বলেছেন, তার দায় কেবল আমলা নয়, রাজনীতিকদেরও রয়েছে। বাংলাদেশ বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতিবসু ও বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য তুলে লিখেছেন, CPM leader Jyoti Basu had come around to sharing the water at the Farakka Barrage even at the expense of accumulation of silt in the Hoogly making it impossible for large ships berthing at Kolkata. Mamata may one day come around to sharing the Teesta waters with Bangladesh. Till that happens this issue will be a major irritant between Dhaka and New Delhi. (পৃষ্ঠা ২২৮)
৫.
কুলদীপ নায়ার যেসব নেতা ও রাষ্ট্রনায়কের সান্নিধ্যে এসেছেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহরু, রাজেন্দ্র প্রসাদ, জয় প্রকাশ নারায়ণ, লাল বাহাদুর শাস্ত্রী, গুজরাল লাল নন্দ, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, কৃষ্ণ মেনন, আবদুল গাফ্ফার খান, সরদার বল্লভ ভাই প্যাটেল, ইন্দিরা গান্ধী, মোরারজি দেশাই, বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং, চন্দ্র শেখর, আই কে গুজরাল, সোমনাথ চ্যাটার্জি, শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ, পাকিস্তানে মুহম্মদ আলী জিন্নাহ, আইয়ুব খান, জুলফিকার আলী ভুট্টো, নওয়াজ শরিফ, বেনজির ভুট্টো, শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়া প্রমুখ। বিভিন্ন ঘটনা ও কাহিনির মধ্য দিয়ে নেতা-নেত্রীদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন। সেখানে তিনি নিজেকে অনেকটা আড়ালে রেখে ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। সরকারি কর্মকর্তা ও সাংবাদিক হিসেবে কুলদীপ নায়ার উপমহাদেশের অনেক ঘটনার সাক্ষী। কুলদীপের ভাষায়, ‘অধিকাংশের কাজকর্ম আমাকে হতাশ করেছে এবং আমার অভিজ্ঞতা হলো যারা উচ্চপদে আসীন তাদের বেশির ভাগই তাদের মর্যাদা বাড়ায়নি, তারা কর্তৃত্বপরায়ণ কিন্তু অন্তঃসারহীন। তাঁর সাক্ষ্যদান সব ক্ষেত্রে শতভাগ নিরপেক্ষ হয়েছে বলা যাবে না। তবে দুটি বিষয়ে তিনি সব সময়ই আপসহীন—গণতন্ত্র ও মানবাধিকার। এ কারণেই কুলদীপকে আমরা ভারতে পাকিস্তানি বন্দীদের এবং পাকিস্তানে ভারতীয় বন্দীদের মুক্ত করার ব্যাপারে সোচ্চার হতে দেখি।’
কুলদীপ নায়ার এপিলগ নামে যে অধ্যায়টি লিখেছেন, তা মানবিক চেতনা ও হার্দিক অনুভূতিতে উজ্জ্বল। দেশে-বিদেশে যেকোনো অন্যায়, অবিচার ও বৈষম্য তাকে আহত করে। মানবাধিকারকর্মী হিসেবে তিনি কাশ্মীরে কাজ করছেন, যাঁরা তাঁদের নিজেদের সত্তা খুঁজে ফিরছেন। বিহারে কাজ করেছেন ভূমিদস্যু ও প্রতারণাকারীদের বিরুদ্ধে, বৃহত্ বাঁধের মাধ্যমে যেসব কৃষক ও আদিবাসীকে উচ্ছেদ করা হয়েছে তাঁদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তিনি স্মরণ করছেন, ১৯৯৬-এ রেলস্টেশনে এক মুসলিম যুবক তাঁর মাকে দাঙ্গাকারীদের হাত থেকে রক্ষা করছেন। কুলদীপ নায়ার কেবল তাঁর লেখার মাধ্যমে উপমহাদেশে শান্তি ও সম্প্রীতির পক্ষে প্রচারণা চালাননি, মানবাধিকারকর্মী হিসেবে তিনি এসব আন্দোলনেও সক্রিয় আছেন।
কুলদীপ নায়ার কৈশোরে বামপন্থী ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে জড়িত থাকলেও পরবর্তীকালে যথাসম্ভব বাম পন্থাকে এড়িয়ে চলেছেন। ব্যক্তিস্বাধীনতা ও মুক্ত অর্থনীতির প্রতিই তাঁর ঝোঁক। তার পরও ভারতের মাওবাদী আন্দোলনের প্রতি তাঁর সহানুভূতি লক্ষ করা যায়। তিনি লিখেছেন, ‘মাওবাদী সহিংসতার বিষয়টি আইনশৃঙ্খলাজাত সমস্যার চেয়ে বেশি কিছু ভাবতে হবে এবং এর সমাধানে আর্থসামাজিক বৈষম্য দূর করতে হবে। যদিও রাষ্ট্র কর্তৃত্ববাদী কায়দায় এই সমস্যার সমাধান করতে চাইছে।’ (পৃষ্ঠা ৪৪৬)
কুলদীপ নায়ার পর্যায়ক্রমে জনতা পার্টি, রাজিব গান্ধী, বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং, নরসিমা রাও, অটল বিহারি বাজপেয়ি, আই কে গুজরাল ও মনমোহন সিং সরকারের সাফল্য ও ব্যর্থতাগুলো খুব কাছ থেকে দেখেছেন। বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং ছাড়া অন্যদের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্কও ছিল চমত্কার। কিন্তু তিনি যখন কোনো নেতার প্রশংসা বা সমালোচনা করেছেন, সেটি ব্যক্তিগত সম্পর্কের ঊর্ধ্বে থেকেই।
তাঁর মতে, নরসিমা রাওয়ের সাফল্য ভারতে তিনিই প্রথম অর্থনৈতিক সংস্কারে হাত দেন, নেহরুর মিশ্র অর্থনীতি থেকে বেরিয়ে এসে ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে উন্নয়নের মডেল হিসেবে গ্রহণ করেন। অর্থমন্ত্রী হিসেবে যিনি এই গুরুদায়িত্ব পালন করেন তিনি ড. মনমোহন সিং, বর্তমানে দেশটির প্রধানমন্ত্রী। পরবর্তী সব কটি সরকারই অর্থনৈতিক সংস্কারের সেই ধারা এগিয়ে নিয়ে চলেছে।
নরসিমা রাওয়ের আমলে ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর কর সেবার নামে উগ্রপন্থী হিন্দুরা বাবরি মসজিদ গুঁড়িয়ে দেয়। তখন উত্তর প্রদেশে ক্ষমতায় ছিল বিজেপি। তাদের সহযোগী আরএসএস, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ। কুলদীপ নায়ার লিখেছেন, এসব কট্টরপন্থী সংগঠন যখন বাবরি মসজিদ গুঁড়িয়ে দেওয়ার ঘোষণা দিল কেন্দ্রীয় সরকার তাদের মোকাবিলায় কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
এ ব্যাপারে কুলদীপের কঠোর মন্তব্য, ‘দিনদুপুরে ধর্মনিরপেক্ষতাকে হত্যা করা হলো। বিজেপি নেতারা একে নিছক একটি স্থাপনা হিসেবে দেখলেও এটি ভারতের অন্যতম ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামো ছিল।’ সে সময়ে একটি পত্রিকা লিখেছিল, ‘মহাত্মা গান্ধী গুলিবিদ্ধ হন ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি, কিন্তু তিনি নিহত হন ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর।’ (পৃষ্ঠা ৩৮১)
নায়ার সাক্ষ্য দিচ্ছেন: ‘আমি এও জেনেছি যে নরসিমা রাও বাবরি মসজিদ ধ্বংস হওয়ার ঘটনাটি জানতেন। কর সেবকেরা যখন মসজিদ ভাঙতে শুরু করে তখন তিনি পুজো দিতে শুরু করেন এবং যখন শেষ পাথরটি সরানো হয় তখন পুজো থেকে ওঠেন। যখন একজন রাওয়ের কানে কানে বললেন, “মসজিদ ভাঙার কাজ শেষ হয়ে গেছে, এক সেকেন্ডের মধ্যে রাওয়ের পূজা-অর্চনাও শেষ হলো”।’
যদিও নরসিমা রাও তাঁর আত্মজীবনীতে বাবরি মসজিদ রক্ষায় তাঁর সরকার যথাসাধ্য সবকিছু করেছে বলে দাবি করেছেন। রাও তাঁর বইয়ে একটি খাঁটি কথা লিখেছিলেন, ‘সাম্প্রদায়িক রাজনীতি এমনই কলুষিত যে এর বিরোধিতা করতেও সাম্প্রদায়িকতার আশ্রয় নিতে হয়।’
তবে এও সত্য বাবরি মসজিদ ভাঙার ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রীসহ অনেক জাঁদরেল নেতাকেই তদন্ত কমিশনের সামনে জবানবন্দি দিতে হয়েছে।
কমিশন নরসিমা রাওকে জিজ্ঞেস করছিল, কংগ্রেস সরকার ভোটের সুবিধা আদায়ে ১৯৮৯ সালের ১০ নভেম্বর মসজিদের কাছে প্রতিমা স্থাপন করেছিল কি না। উত্তরে রাও বলেছেন, ‘আমি ব্যক্তিগতভাবে এ ব্যাপারে কিছু জানতাম না। তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বুটা সিংকে জিজ্ঞেস করে দেখা যেতে পারে, তিনিই এ বিষয়টি দেখতেন।’
প্রশ্ন: আপনি বিশ্ব হিন্দু পরিষদের ও ধর্ম সংসদকে কীভাবে দেখছেন?
উত্তর: আমি এদের সংগঠন হিসেবেই স্বীকার করি না।
প্রশ্ন: সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে আপনার ধারণা কী?
উত্তর: ভারতের সংস্কৃতি ভারত ছাড়িয়ে ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড এবং আরও বহু দেশে বিস্তৃতি লাভ করেছে। তাই আজ ভৌগোলিকভাবে যাকে ভারত বলা হয়, ভারতীয় সংস্কৃতির তুলনায় তা খুবই ছোট। (পৃষ্ঠা ৩৮২)
শিবারহান কমিশন রাওকে দায়মুক্তি দিলেও হালে রাহুল গান্ধীর মন্তব্যের তাত্পর্যটুকু উল্লেখ করেছেন কুলদীপ নায়ার, ‘গান্ধী পরিবারের কেউ থাকলে (দায়িত্বে) মসজিদ ধ্বংস হতো না।’
তত্কালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী রাজেশ পাইলট বলেছেন, তিনি রাতারাতি মন্দির সরিয়ে ফেলতে পারতেন, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী অনুমতি দেননি। কুলদীপ আরও জানাচ্ছেন, ‘সংস্কারমুক্ত ও সেক্যুলার’ রাজিব গান্ধীও এই দায় থেকে মুক্ত হতে পারেন না, কেননা ১৯৮৯ সালে বাবরি মসজিদের কাছাকাছি শিলান্যাসের মাধ্যমেই তিনি নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেছিলেন।
কুলদীপ আদভানির কঠোর সমালোচনা করে লিখেছেন, কল্যাণ সিং ও এল কে আদভানির হাত মুসলমানদের রক্তে রঞ্জিত, যাঁরা সমাজ ও ধ্বংসের কারণে নিহত হয়েছেন। (পৃষ্ঠা ৩৮৩)
কমিশন এই রিপোর্ট তৈরিতে ১৭ বছর সময় লাগিয়েছিল, তবে তারা যে রিপোর্টটি দিয়েছে তা যথার্থ। তারা বাবরি মসজিদ ভাঙার জন্য এল কে আদভানি, মরলী মনোহর যোশী, কল্যাণ সিংকে দায়ী করেছেন। কুলদীপ লিখেছেন, ‘বাবরি মসজিদ ধ্বংস হওয়ার ঘটনা আমাকে যে ব্যথিত করেছে তা অপরিসীম। মসজিদ আমার কাছে একটি স্থাপনা মাত্র নয়। এটি আমাদের বহুমাত্রিক চেতনা এবং সমন্বিত সংস্কৃতি প্রতিনিধিত্ব করে, যা শত শত বছর ধরে একখানা ইটের পর আরেকখানা ইট দিয়ে নির্মিত হয়েছে।’
২০০২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি গুজরাটে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির পদত্যাগ দাবি করে কুলদীপ নায়ার প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখেছিলেন। তিনি মনে করেন এই দাঙ্গার পেছনে নরেন্দ্রর ইন্ধন ছিল। এ রকম প্রতিবাদ তিনি আরও বহুবার করেছেন। অন্যান্য সাংসদ বিষয়টি সহজভাবে নিলেও নায়ার রাষ্ট্রপতির কাছে চিঠি লিখে জানান, ‘আমি যেহেতু অধিবেশনে যাইনি এ সময়ে ভাতা নেওয়া যুক্তিসংগত হবে না।’ তিনি যখন কাশ্মীরি জনগণের অধিকারের পক্ষে দাঁড়ান তখন নয়াদিল্লির শাসকেরা সন্দেহের চোখে দেখেন, আবার পাকিস্তানে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে কথা বললে ইসলামাবাদ অযাচিত হস্তক্ষেপ বলে মনে করেন।
কুলদীপ নায়ারের কর্মজীবন বৈচিত্র্যময়। তাঁর অভিজ্ঞতার ভাঁড়ারও সমসাময়িকদের চেয়ে অনেক বেশি সমৃদ্ধ। বিয়ন্ড দ্য লাইনসে তিনি সমাজের সেই সব মানুষের কথাই বেশি বলতে চেয়েছেন, যারা আছে সবার পিছে, সবার নিচে।
শত বিপত্তি এবং চড়াই-উতরাইয়ের মধ্যেও তিনি গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের পক্ষে অবিচল থাকেন। সেই বিবেচনায় বিয়ন্ড দ্য লাইনস গণতন্ত্র ও মানবাধিকারেরই দলিল।