একবিংশ শতাব্দীতে গণতন্ত্রের নতুন চ্যালেঞ্জ

ভূমিকা

এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য দুটি। প্রথম উদ্দেশ্য, প্রচলিত গণতন্ত্রগুলোর সীমাবদ্ধতা উদ্ঘাটন। দ্বিতীয় উদ্দেশ্য, এসব সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে একবিংশ শতাব্দীতে নতুন গণতন্ত্র নির্মাণের ভবিষ্যত্ চ্যালেঞ্জগুলো চিহ্নিত করা।

গণতন্ত্রের বহুল প্রচলিত সংজ্ঞাটি হচ্ছে: জনগণের (of the people), জনগণের দ্বারা (by the people) এবং জনগণের জন্য (For the people) একটি ‘রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা’। এই জনপ্রিয় সংজ্ঞাটির বিভিন্ন প্রত্যয়ের প্রতিটি নিয়ে সুদীর্ঘ তাত্ত্বিক আলোচনা সম্ভব। আমি এ প্রবন্ধে যে অর্থে এই প্রত্যয়গুলো ব্যবহার করব বা করেছি, তার ব্যাখ্যা সংক্ষেপে এখানে উল্লেখ করছি।

‘জনগণ-এর (of the people)

‘এর’ শব্দটি এখানে ‘মালিকানা’ অর্থে ব্যবহূত হয়েছে, যেমন—মানুষের, ব্যক্তির, রাষ্ট্রের ইত্যাদি। জনগণ যেহেতু একটি যৌথ সত্তা, সেহেতু ‘জনগণ-এর’ অর্থ হচ্ছে বিবেচ্য জনসমষ্টির যৌথ মালিকানা। যেহেতু ‘মালিকানা’ প্রকাশ পায় কতিপয় অধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে, সেহেতু রাষ্ট্রটির ‘জনসমষ্টি’ তাদের সম্মিলিত অধিকারগুলো প্রয়োগের ক্ষমতা এবং সুযোগ উপভোগ কতটুকু করছেন সেটা দিয়েই সর্বপ্রথম আমাদের মাপতে হবে, রাষ্ট্রটি তার নাগরিকদের জন্য কতটুকু মাত্রায় গণতান্ত্রিক হয়ে উঠেছে। জনগণের মধ্যে বিভিন্ন শ্রেণী থাকলে বিভিন্ন শ্রেণীর পরস্পরবিরোধী দাবির গণতান্ত্রিক সমাধানটা কীভাবে হবে, সেটাও গণতন্ত্রের উপাদানে অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে। একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে, বিভিন্ন শ্রেণীর সর্বজনীন মানবিক অধিকার ও ক্ষমতাগুলোর সুনির্দিষ্টায়ন হবে কীভাবে। এ ক্ষেত্রে বর্তমানে দুটি পৃথক ভাবাদর্শগত প্রবণতা সুস্পষ্টভাবে বিদ্যমান। গণতন্ত্রের সংকীর্ণ ব্যাখ্যায় ‘মতপ্রকাশের’ অধিকার, দ্বিমত বা ভিন্নমত পোষণ ও প্রকাশের অধিকার এবং সংখ্যাগরিষ্ঠের মত বা ভোটের অধিকার, এগুলোই হচ্ছে সর্বোচ্চ প্রয়োজনীয় অধিকার, অর্থনৈতিক অধিকারগুলো এর অন্তর্ভুক্ত নয়। সীমাবদ্ধ এই অধিকারের নিশ্চয়তার জন্য দুটি শর্ত পূরণ করা প্রয়োজন। একটি হচ্ছে ‘স্বাধীন সংবাদপত্র’ এবং অন্যটি ‘নির্বাচন ও নির্বাচনে বিরোধী দলের অংশগ্রহণের অবাধ অধিকার’। পাশ্চাত্যের উন্নত দেশগুলোতে গণতন্ত্রের প্রচলিত সংকীর্ণ সংজ্ঞায় এ দুটি বিষয় উপস্থিত থাকলেই শাসনব্যবস্থাটি ‘জনগণ-এর’ বলে ধরে নেওয়া হয়।

এই ন্যূনতম ব্যাখ্যার অনেকগুলো সীমাবদ্ধতা রয়েছে। বিশেষ করে, অর্থনৈতিকভাবে শ্রেণী বিভক্ত সমাজের দুর্বল শ্রেণীগুলো ‘ভোট প্রদান’, ‘জটিল শাসনতান্ত্রিক সিদ্ধান্তগুলো সম্পর্কে জ্ঞানগর্ভ আলোচনা’, ‘মতামত গঠন’, ‘সংবাদপত্র পাঠ’ ইত্যাদি থেকে বাস্তবে বহুদূরে অবস্থান করে, নিত্যদিনের বেঁচে থাকার সংগ্রামেই অত্যধিক ব্যতিব্যস্ত থাকে এবং সর্বোপরি জটিল আর্থসামাজিক-জ্ঞানগত নির্ভরশীলতার সম্পর্কের কারণে অসংগঠিত ও দ্বিধাবিভক্ত থাকে। ফলে সেখানে শুধু আনুষ্ঠানিক ‘মতপ্রকাশ, দল গঠন ও ভোটের অধিকার’ গণতন্ত্রের অন্য অন্য দুটি আবশ্যকীয় দিক—‘জনগণের দ্বারা’ এবং ‘জনগণের জন্য’ রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা কায়েমে যথেষ্ট হয় না। উপরন্তু, এমনকি আনুষ্ঠানিক আইনি অধিকারগুলোও নিম্নবর্গের শ্রেণীগুলোর জন্য সর্বদা সুনিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। শাসকশ্রেণী প্রয়োজনমতো এই অধিকার বা সুযোগগুলো সংকুচিত বা প্রসারিত করতে পারে। সুযোগ থাকলেও যেহেতু ব্যক্তিগত অথবা/এবং শ্রেণীগত সক্ষমতা নেই, সেহেতু জনগণের কোনো কোনো অংশের জন্য আনুষ্ঠানিক গণতান্ত্রিক সুযোগগুলো প্রকৃত কার্যকরী কর্তৃত্বে পরিণত হয় না। কোনো কোনো সময়ে দেখা যায়, এই দুর্বল শ্রেণীগুলোই হয়তো সমাজের বা জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ। অবশ্য এ ক্ষেত্রে উল্টোটাও সম্ভব। সবার জন্য সমাজে ন্যূনতম সক্ষমতা সৃষ্টি করা হয়েছে, কিন্তু আনুষ্ঠানিক গণতান্ত্রিক সুযোগগুলো দেখা হয়নি, এ অবস্থায়ও গণতন্ত্রের অন্য দুটি আবশ্যকীয় দিক পূরণ করা সম্ভব হয় না। উত্তর কোরিয়ার ‘গণতন্ত্রকে’ এ ধরনের ‘স্বৈরতন্ত্রের’ দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করে এ প্রসঙ্গে অমর্ত্য সেন তাঁর সর্বশেষ প্রকাশিত গ্রন্থ The Idea of Justice-এ লিখেছেন:

The difficulty lies not just in the political and punitive pressure that is brought to bear on voters in the balloting itself, but in the way expressions of public views are thwarted by censorship, informational exclusion and a climate of fear, along with the repression of political opposition and the independence of the media, and the absence of basic civil rights and political liberties. All this makes it largely redundant for the ruling powers to use much force to ensure conformism in the act of voting itself. Indeed, a great many dictators in the world have achieved gigantic electoral victories even without any overt coercion in the process of voting, mainly through repressing public discussion and freedom of information, and through generating a climate of apprehension and anxiety. (এ কে সেন, ২০০৯, পৃ. ৩২৭)

[অনুবাদ: সমস্যাটি শুধু এ জায়গাতেই সীমাবদ্ধ নয় যে ভোটদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় ভোটারের ওপর ভোট-পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক বা শাস্তির চাপ এসে পড়ার আশঙ্কা থাকে; বরং যেভাবে সেন্সরশিপের মাধ্যমে জনমতের প্রকাশকে স্তব্ধ করা হয়, তথ্য গোপন রাখা হয়, কায়েম করা হয় ভয়ের সংস্কৃতি, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর দমন-পীড়নের পাশাপাশি হরণ করা হয় গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং মৌলিক নাগরিক অধিকার ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা বাতিল করা হয়, তাতে এসব কিছুর মধ্য দিয়েও ভোটারকে প্রভাবিত করা হচ্ছে। এসব সম্মিলিত কারণে, ক্ষমতাসীন শক্তির পক্ষে ভোটদানের ক্ষেত্রে বশ্যতা আদায় করার জন্য খুব বেশি বল প্রয়োগ করাটা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অপ্রয়োজনীয় হয়ে গেছে। প্রকৃত প্রস্তাবে, পৃথিবীর অনেক প্রতাপশালী স্বৈরাচারও ভোটদানের প্রক্রিয়ায় দৃষ্টিকটুভাবে বল প্রয়োগ ছাড়াই বিপুল ভোটে জয়লাভ করছে। এটা মূলত ঘটছে জনগণের মতবিনিময়ের ও তথ্যের অধিকার দমন করার মাধ্যমে, আশঙ্কা ও উত্কণ্ঠার একটি বাতাবরণ সৃষ্টির মাধ্যমে।]

কিন্তু সমধর্মী যুক্তি ব্যবহার করে যে কেউ পাল্টা বলতে পারেন, মার্কিনি গণতন্ত্রে ‘মতপ্রকাশের অবাধ অধিকার’ থাকলেও অর্থনীতিতে স্বৈরতন্ত্র বিরাজ করায় সেখানে গণতন্ত্র কার্যকর হচ্ছে না।সুতরাং, এ প্রবন্ধে আমি ধরে নিচ্ছি যে প্রকৃত গণতন্ত্র অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক—এ দুই রকম সক্ষমতা ছাড়া সম্ভব নয়। শুধু অর্থনৈতিক সাম্য বা সক্ষমতা রয়েছে, কিন্তু নির্ভয়ে মতপ্রকাশের প্রাতিষ্ঠানিক রাজনৈতিক সুযোগগুলোই যদি না থাকে, তাহলে যেমন অর্থনৈতিক ও সামাজিক ওই সক্ষমতা নিজেই রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বে পরিণত হতে পারে না, তেমনি অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তাই যদি না থাকে তাহলে মতপ্রকাশের প্রাতিষ্ঠানিক রাজনৈতিক সুযোগগুলো নিজেই রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বে পরিণত হতে পারে না। কিছুটা এ কে সেনকে অনুসরণ করেই তাই বলা যায়, ‘গণতান্ত্রিক আধেয় (Content) ছাড়া শুধু গণতান্ত্রিক আধার (Form)’ প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করতে অক্ষম। আবার ‘গণতান্ত্রিক আধার (Form) ছাড়া শুধু গণতান্ত্রিক আধেয় (Content)’ দিয়ে প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় না। জনগণের সব রকম সুযোগ ও সব রকম সক্ষমতার যুগপত্ বিকাশের মাধ্যমেই ‘জনগণের গণতন্ত্র’ গড়ে তুলতে হয়।

‘জনগণের দ্বারা (By the people)’

প্রদত্ত সংজ্ঞায় ‘জনগণের দ্বারা’ বলতে বোঝানো হচ্ছে, জনগণের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ও নিয়ন্ত্রণ। কিন্তু জনগণের সাধারণ বিষয়ে যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণে জনগণের প্রতিটি সদস্যের আগ্রহ সমান না-ও হতে পারে। এসব সিদ্ধান্ত কার্যকর করার দায়িত্বও প্রত্যেকে ব্যক্তিগতভাবে কাঁধে তুলে নিতে সমান আগ্রহী না-ও হতে পারেন। এ ক্ষেত্রেও তাই শ্রম-বিভাজনের প্রয়োজন দেখা দেয়। তাই প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র বাস্তব প্রয়োজনেই পরিণত হয়েছে প্রতিনিধিত্বশীল পরোক্ষ গণতন্ত্রে। জনগণ ভোট দিয়ে তাদের প্রতিনিধিদের হাতে প্রত্যক্ষ রাষ্ট্র পরিচালনার ও সেই সূত্রে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ও তা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বগুলো অর্পণ করে থাকে। এ অবস্থায় জনগণ ও জনপ্রতিনিধির মধ্যে সম্পর্কের ওপরই নির্ভর করবে ‘গণতন্ত্র’ কতটুকু মাত্রায় জনগণের দ্বারা হয়ে উঠেছে তা। এখানে যে প্রশ্নগুলো বিচার্য তা হচ্ছে: জনগণের প্রতিনিধিদের কার্যকলাপ ও সিদ্ধান্তগুলো কতটুকু স্বচ্ছ, অর্থাত্ সবকিছু জনগণকে জানানো হচ্ছে কি না? দ্বিতীয়ত, ওই সিদ্ধান্ত ও কাজগুলোর পরিকল্পনা প্রণয়নের সময় জনগণের মতামত প্রদানের ব্যবস্থা আছে কি না? তৃতীয়ত, ওই পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্তগুলো জনগণের পছন্দ না হলে জনগণ সেগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সংগঠিত করে জনপ্রতিনিধিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে কি না? সর্বশেষে জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ তা না চাইলে তা পরিবর্তিত হয় কি না? প্রচলিত গণতন্ত্রের এই দিকগুলো রক্ষার জন্য কয়েকটি সীমিত সুযোগ আছে। প্রচলিত আইনের আওতায় সংগঠিত বিক্ষোভ প্রকাশ, জমায়েত, জনমত গঠন, মানববন্ধন, ধর্মঘট ইত্যাদি গণতান্ত্রিক প্রতিবাদের অধিকারগুলো স্বীকৃত থাকে, যদিও আইনি বাধ্যবাধকতার আওতায় এ অধিকারগুলো প্রয়োগ করতে হয় বলে এগুলোর মাত্রা রাষ্ট্রের আইন ও শাসক দলের ইচ্ছা দ্বারা সীমাবদ্ধ থাকে। তবে আইন নিজেই অগ্রহণযোগ্য হলে সেই আইন ও আইনপ্রণেতাদেরও পরিবর্তনের প্রয়োজন হতে পারে এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সেই অধিকার জনগণের রয়েছে। তবে সাধারণত নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমেই সেই অধিকার প্রয়োগ করতে হয়। কোনো কোনো আধুনিক রাষ্ট্রে আইনপ্রণেতা জনপ্রতিনিধিদের নাগরিকদের কাছে জবাবদিহি নিশ্চিত করার জন্য রাষ্ট্রের মধ্যে নানা সাংবিধানিক সংস্থা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। যেমন: স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন, স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থা, ন্যায়পাল, রাষ্ট্রপতির সর্বশেষ কর্তৃত্ব, পরস্পর পাহারাদার দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা, রাজনৈতিক দলের সদস্যদের নিয়ন্ত্রণের জন্য কেন্দ্রীয় কন্ট্রোল কমিশন ইত্যাদি। কিন্তু জনপ্রতিনিধিদের জবাবদিহির জন্য যত ‘check and balance’-এর আয়োজনই করা হোক না কেন, যেকোনো প্রতিনিধিত্বশীল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাতেই ‘মালিকের প্রতিনিধি বনাম মালিক’ বা ‘জনপ্রতিনিধি বনাম জনগণ’ এই সুপ্ত প্রধান দ্বন্দ্বটি থেকেই যায়। অর্থনীতিবিদেরা এই সমস্যাকে ‘Principal-Agent’ সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। মালিকের প্রতিনিধি সচরাচর সমাজের অগ্রসর অংশরাই হয়ে থাকে এবং তারা যদি যথেষ্ট জবাবদিহি ও স্বচ্ছতার মধ্যে সক্রিয় না থাকে, তাহলে মালিকদের সঙ্গে তাদের দূরত্ব বৃদ্ধি পেতে পেতে একসময় ‘মালিকদের প্রতিনিধিরা’ নিজেরাই ‘স্বার্থপর মালিকে’ পরিণত হয়। এ কারণে প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের শাসন কখনো কখনো সংখ্যালঘিষ্ঠের দ্বারা শাসনে পরিণত হতে পারে। এই সুপ্ত সম্ভাবনা সব প্রতিনিধিত্বশীল ব্যবস্থার মধ্যেই রয়েছে। এ কথা ঠিক যে প্রচলিত গণতন্ত্রে নির্দিষ্ট সময় পরপর ‘মালিকদের প্রতিনিধিদের’ আবার মালিক বা জনগণের মুখোমুখি হতে হয় বলে এই বিপদ দীর্ঘস্থায়ী না-ও হতে পারে। কিন্তু স্থায়িত্ব যতটুকুই হোক না কেন, অন্তর্বর্তীকালীন কুশাসনের ফলে তত দিনে যা ক্ষতি হওয়ার, তা তো হয়েই যায়। উপরন্তু, জনগণ আবার যাঁকে নতুন করে প্রতিনিধি হিসেবে বেছে নেবে, তিনিও যে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি করবেন না, তার কী নিশ্চয়তা রয়েছে? বিভিন্ন পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের দ্বিদলীয় গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে এ ধরনের করুণ পরিণতি ঘটতে দেখা যায়। বিশেষ করে, সমাজের ক্ষমতাধর সংখ্যালঘিষ্ঠদের জন্য দ্বিদলীয় বুর্জোয়া গণতন্ত্রের ভোটের পুনরাবৃত্তিমূলক খেলা খুবই পছন্দনীয় একটি পদ্ধতিতে পরিণত হয়েছে। আমেরিকার গণতন্ত্র সম্পর্কে বলা হয় যে জনগণের ভোটে এখানে যে-ই ক্ষমতায় আসুক না কেন, সংখ্যালঘিষ্ঠ ক্ষমতাধর শ্রেণীগুলোর আধিপত্যের তাতে কোনো মৌলিক ক্ষতি-বৃদ্ধি হবে না। কতিপয় সংস্কারের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর ক্ষমতার কিছুটা হ্রাস-বৃদ্ধি হতে পারে, কিন্তু প্রকৃত জনকর্তৃত্ব সেখানে কখনোই প্রতিষ্ঠিত হয় না। প্রকৃত কর্তৃত্ব থেকে যাবে ক্ষমতাবান সংখ্যালঘিষ্ঠের হাতেই, যাঁরা পেছনে থেকে কলকাঠি নেড়ে রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সিদ্ধান্ত ও কাজগুলো নিয়ন্ত্রণ করে যাবেন। সম্ভবত এ জন্যই ধনকুবের হেনরি ফোর্ড একসময় বলেছিলেন, ‘আমেরিকায় “রিপাবলিকান” বা “ডেমোক্র্যাট” যে-ই জিতুক না কেন, আমি কখনো হারব না। কারণ, আমি সব সময় দুই ঘোড়াতেই বাজি রাখি।’ এ জন্যই সর্বশেষ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জনপ্রিয় ভোটে জেতা সত্ত্বেও প্রেসিডেন্ট ওবামাকেও শেষ পর্যন্ত ‘এক শতাংশের’ পক্ষেই অবস্থান গ্রহণ করতে হয় বা হচ্ছে! আমেরিকান জনগণের অভিযোগ আজ তা-ই।

এ আলোচনা থেকে বোঝা যাচ্ছে, গণতন্ত্রে ‘জনগণের দ্বারা’ বিষয়টি তখনই অর্জন করা সম্ভব হবে, যখন জনপ্রতিনিধিদের ওপর জনগণের কার্যকর ক্ষমতা অনুশীলনের সুযোগ সুনিশ্চিত হবে। আর জনপ্রতিনিধিদের তথা রাষ্ট্রের ক্ষমতার ক্ষেত্র বহুমাত্রিক—অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক, সেহেতু নানা ক্ষেত্রেই তাদের পাল্টাক্ষমতা (Countervailing Power) অনুশীলনের সুযোগ জনগণের থাকতে হবে। অর্থাত্ জনগণকে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতায়িত হতে হবে। যে মাত্রায় এই জনক্ষমতা গড়ে উঠবে, সে মাত্রায় গণতন্ত্র ‘জনগণের দ্বারায়’ পরিণত হবে। এ জন্যই সম্ভবত বলা হয়েছে, ‘প্রত্যেক জনগণ তেমন গণতন্ত্রই পায়, যেমনটা তাদের প্রাপ্য।’ একটি অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল, শিক্ষায়-স্বাস্থ্যে-জ্ঞানে পশ্চাত্পদ এবং সীমিত রাজনৈতিক সাংগঠনিক ক্ষমতার অধিকারী জনগণের দ্বারা যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে, তা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত দুর্বল গণতন্ত্রই হবে। সে ধরনের গণতন্ত্রে অত্যন্ত সীমিতসংখ্যক গণপ্রতিনিধি ও আমলারাই জনগুরুত্বসম্পন্ন বিষয়গুলো নিয়ে আলাপ-আলোচনা ও মতপ্রকাশ করবেন—আর এভাবে গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো কার্যকর করায় জনগণের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের মাত্রাও হবে সীমাবদ্ধ। অনুন্নত দেশের অনুন্নত গণতন্ত্র তাই এক বিষাক্ত সমস্যাচক্রে আবর্তিত হচ্ছে। গণতন্ত্র এখানে অনুন্নত, কারণ এখানে জনগণের চেতনা ও সক্ষমতা অনুন্নত। আবার জনগণের চেতনা ও সক্ষমতা অনুন্নত বলেই এখানে গণতন্ত্রও অনুন্নত। এই বিষাক্তচক্র ভাঙার একটি বহুল প্রচলিত সমাধান প্রস্তাব হচ্ছে বৈপ্লবিক গণজাগরণ। কিন্তু ঈপ্সিত বৈপ্লবিক গণজাগরণ ইতিহাসে প্রতিদিন সংগঠিত হয় না। এ জন্য জনগণকে প্রতিদিন নিজেদের যৌথ ক্ষমতায়নের জন্য নানা রকম সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে হয়। নিরন্তর নিজেকে বদলে অন্যকে বদলানোর সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হয়। বহুমাত্রিক ক্রমবৃদ্ধিশীল পরিমাণগত পরিবর্তনের (Incremental quantitative changes) মাধ্যমেই অবশেষে গুণগত পরিবর্তন সাধিত হয়। এ ব্যাপারে যুগোপযোগী উদ্দীপনামূলক মৌলিক শিক্ষণীয় বহুমুখী আশু করণীয়র সন্ধান পাওয়া যাবে দুজন বিশ্ববিখ্যাত বিপ্লবীর রচনায়। একজন হচ্ছেন দার্শনিক বিপ্লবী আন্তোনিও গ্রামসি এবং অন্যজন কবি ও রোমান্টিক বিপ্লবী আর্নেস্টো চে গুয়েভারা। (দেখুন খুইনটাইন হোয়ারে এবং জিয়োফ্রে নোয়েল স্মিথ, ১৯৯৬ এবং ডেভিড ডিউটশ্চমান, ২০০৪)

জনগণের ক্ষমতায়নের অন্য আরেক ধরনের বিকল্প (নাকি পরিপূরক?) প্রস্তাব হচ্ছে, ‘বিকেন্দ্রীভবনের’ মাধ্যমে ক্ষমতার কেন্দ্রগুলো নিচের স্তরে জনগণের কাছাকাছি নাগালের মধ্যে নিয়ে যাওয়া এবং তলা থেকে ধীরে ধীরে ওপরে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া চালু করা। ‘মাইক্রো’ থেকে ‘ম্যাক্রো’ বা ‘তৃণমূল গণতন্ত্রের’ ওপর নির্ভর করে রাষ্ট্রকে জনগণের নাগালের মধ্যে নিয়ে যাওয়ার এই প্রস্তাবটি বেশি এসেছে প্রাচ্যের র্যাডিক্যাল গণতন্ত্রবিদদের কাছ থেকে। অবশ্য সামন্ত ঐতিহ্যমুক্ত আমেরিকান গণতন্ত্রের উষালগ্নেও একধরনের বিকেন্দ্রীভূত কমিউনিটিভিত্তিক প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের প্রথা চালু ছিল (দেখুন টোকভিল, ১৮৫১)। কিন্তু আমরা আগে যেসব প্রথাগত গণতান্ত্রিক বিধিব্যবস্থার বিষয়ে আলাপ করেছি তা মূলত পাশ্চাত্যের, বিশেষত ইউরোপের বিকশিত বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক মডেলের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে প্রণীত। পাশ্চাত্য বুর্জোয়া গণতন্ত্রের উদ্ভবই হয়েছিল প্রধানত রাষ্ট্রক্ষমতায় বংশানুক্রমিক সামন্ত আধিপত্যের অবসান ঘটিয়ে উদীয়মান নতুন উত্পাদনশক্তির ধারক-বাহক বুর্জোয়াদের প্রতিযোগিতামূলক শাসন-কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার স্বার্থে। বুর্জোয়া বিপ্লবের আদিযুগে বুর্জোয়ারাই কৃষক ও শ্রমিকদের নিয়ে একত্রে এই মহান গণতান্ত্রিক বিপ্লবটি সম্পন্ন করেছিলেন। তখনকার ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতে সেই উদীয়মান ‘গণতন্ত্রগুলো’ ছিল অনেকাংশে ‘জনগণ-এর’ এবং ‘জনগণের দ্বারা’। যদিও ওই সব বিপ্লবের নেতৃত্বে ছিল জনগণেরই মনোনীত আরও অগ্রসর রাজনৈতিকভাবে সামন্ত প্রভুদের নিচে, কিন্তু সাধারণ কৃষক-শ্রমিকের ওপরে অবস্থিত একটি উদীয়মান বুর্জোয়া শ্রেণী। এটি ছিল সমাজের ‘তলদেশ’ এবং ‘মধ্যমের’ ঐক্যবদ্ধ এক বিপ্লব, যার মধ্যে নিহিত ছিল ‘মধ্যম’ কর্তৃক বিপ্লবের ফলাফল আত্মসাতের বীজ। তবে প্রথমদিকে ‘মধ্যমের’ এই উত্থান শ্রমিক-কৃষক বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠের জীবনেও অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছিল। পরবর্তী সময়ে ধীরে ধীরে জনগণের এই গণতন্ত্রের খোলসে বুর্জোয়া সংখ্যালঘিষ্ঠের আধিপত্যকে সংহত করা হয়েছে। পরে তৃতীয় বিশ্বে সান ইয়াত-সেন, গান্ধীজি, নেলসন ম্যান্ডেলা, জুলিয়াস, নায়ারে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখ জাতীয়তাবাদী মধ্যপন্থীর মনে গণতন্ত্রের নতুন যে স্বপ্নটি অঙ্কুরিত হয়েছিল, তা অনেকটাই ছিল ইউরোপীয় বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের ধাঁচে শ্রেণী সমন্বয়ভিত্তিক সমগ্র সমাজের সবাইকে নিয়ে সমন্বয়বাদী গণতন্ত্রের এক স্বপ্ন। এ ধরনের গণতন্ত্রে মূল শত্রু সামন্তবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে একাধিক শ্রেণী একত্র হয়ে কাজ করার প্রয়াস পায় এবং প্রতিটি শ্রেণী তার স্বাধীন অবস্থান থেকে গণতান্ত্রিক রীতিনীতি মেনে ওই ঐক্য ও জাতীয় লক্ষ্য অগ্রসর করে নেওয়ার চেষ্টা করে। জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের এই স্বপ্নদ্রষ্টারা তাঁদের স্বপ্ন কার্যকর করার মডেলটি পাশ্চাত্য গণতন্ত্রের প্রতিযোগিতামূলক দ্বিদলীয় গণতন্ত্রে খুঁজে পাননি—সর্বহারা বিপ্লবের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত সর্বহারার একনায়কত্বের মধ্যেও সেটি তাঁরা খুঁজে পাননি। সেটা তাঁরা খুঁজেছিলেন ও পেয়েছিলেন প্রাচ্যের বিভিন্ন নিজস্ব মডেলের ‘স্থানীয় বা তৃণমূল গণতন্ত্রের’ বিচিত্র ভান্ডারের বিচিত্র অভিজ্ঞতার মধ্যে। সেখানে ‘জনগণ-এর’ বিষয়টি প্রচলিত পাশ্চাত্য বুর্জোয়া গণতন্ত্রের তুলনায় আরেকটু বিস্তৃত ও গভীরতা পেয়েছে এবং কিছু পরিমাণে গণতন্ত্র প্রকৃতপক্ষেই ‘জনগণের দ্বারা’য় পরিণত হয়েছে। এসব মডেলে জনগণের প্রত্যক্ষ মতপ্রকাশ ও অংশগ্রহণ উভয়ের সুযোগ ছিল পাশ্চাত্যের পরিণত বুর্জোয়া গণতন্ত্রের তুলনায় বেশি। কিন্তু জনগণের সে সুযোগটা অর্থনৈতিক সক্ষমতার ভিত্তিতে সর্বত্র সমানভাবে কার্যকর হয়নি ঠিকই, তবে অর্থনৈতিক অসমতা ও অভ্যন্তরীণ শ্রেণীদ্বন্দ্ব সত্ত্বেও পরস্পরের অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে একধরনের অলিখিত মতৈক্যের ভিত্তিতে এবং ন্যূনতম জাতীয় লক্ষ্যে ব্যাপকতম ঐক্য বজায় রেখে এই গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো বিবর্তিত হয়েছে কখনো ইতিবাচকভাবে, কখনো নেতিবাচকভাবে।

এ ধরনের গণতন্ত্রের ইতিবাচক কোষ বা এককটি কেন্দ্র বা রাজধানীতে অবস্থিত নয়। এর ইতিবাচক এককটি তৃণমূলে অবস্থিত। অসংখ্য সক্রিয় তৃণমূল গণতন্ত্রের সমষ্টি হিসেবেই এ ধরনের গণতন্ত্রের ইতিবাচক অবয়বটি গড়ে উঠেছে। এর একটি সার্থক বর্ণনা দিয়েছেন আফ্রিকার জননন্দিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা। তিনি আফ্রিকানদের নিজস্ব প্রাচীন গণতান্ত্রিক অভিজ্ঞতা এবং নিজেদের স্বশাসনের জন্য নির্মিত ‘স্থানীয় গণতান্ত্রিক’ প্রতিষ্ঠানের বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেছেন:

Everyone who wanted to speak did so. It was democracy in its purest form. There may have been a hierarchy of importance among speakers, but everyone was heard, chief and subject, warriors and medicine man, shopkeeper and farmer, landowners and laborer...the foundation of self-government was that all men were free for voice their opinions and equal in their value as citizens. (উদ্ধৃত হয়েছে অমর্ত্য সেন, ২০০৯, পৃ. ৩৩২-এ। মূল উত্স নেলসন ম্যান্ডেলা, ১৯৯৪, পৃ. ২১)

[অনুবাদ: যাঁরা কথা বলতে চাইতেন, তাঁদের প্রত্যেকেই কথা বলতে পারতেন। এটা ছিল গণতন্ত্রের সবচেয়ে বিশুদ্ধ রূপ। সেখানে হয়তো বক্তাদের মধ্যে গুরুত্বের একটা স্তরবিন্যাস থাকত, কিন্তু সবার কথাই শোনা হতো, রাজা ও প্রজা, সৈনিক ও চিকিত্সক, দোকানদার ও কৃষক, ভূস্বামী ও দিনমজুর... স্বশাসনের ভিত্তি ছিল এই যে, এখানে সবাই তাঁদের মতামত প্রকাশ করার ব্যাপারে স্বাধীন এবং নাগরিক হিসেবে তাঁদের সবার গুরুত্ব সমান।]

এই কমিউনিটিভিত্তিক অংশগ্রহণমূলক মাইক্রো গণতন্ত্রকে নিছক দ্বিদলীয় বুর্জোয়া গণতন্ত্রের ছাঁচে ফেলা যাবে না। একে আবার ‘প্রলেতারিয়া একনায়কত্বের’ মডেলেও ফেলা যাবে না। গণবিরোধীদের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠিত জনগণের দমনমূলক একনায়কত্বও একে বলা যাবে না। এ হচ্ছে তৃণমূলে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের এমন একটি মডেল, যেখানে প্রতিটি শ্রেণীরই কণ্ঠস্বর প্রকাশের ও অংশগ্রহণের সুযোগ বিদ্যমান এবং তাদের সম্মিলিত কর্তৃত্বের ফলাফল বিশেষ কোনো একটি শ্রেণীর বা দলের স্বার্থে একচেটিয়াভাবে পরিচালিত হওয়াটা অনিবার্য নয়। অনেক ক্ষেত্রেই তা পরিচালিত হতে পারে সমন্বিত স্থানীয় বা জাতীয় স্বার্থ আদায়ের লক্ষ্যে। এখানে প্রধান চ্যালেঞ্জটি হচ্ছে, স্থানীয় বা জাতীয় পর্যায়ের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মধ্যে অসংখ্য শ্রেণী-ধর্ম-জাত-পাত, বর্ণ, আঞ্চলিক ও জেন্ডার বিভাজন সত্ত্বেও একটি সর্বসম্মত বীক্ষণের প্রতিষ্ঠা এবং তা বাস্তবায়নে স্থানীয় বা জাতীয় ঐক্যবদ্ধ সক্রিয়তা প্রতিষ্ঠিত করা। আর এটা করতে হবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে, ওপর থেকে চাপিয়ে দিয়ে নয়—নিচ থেকে অংশগ্রহণের মাধ্যমে।

যদিও উল্লিখিত গণতন্ত্রের চর্চা বা শিকড়ের সন্ধান প্রাচ্যে বহু শতাব্দী আগে থেকেই স্থানীয় পর্যায়ে পাওয়া যাবে, পাশ্চাত্যেও বর্তমানে গণতন্ত্রকে ‘সংখ্যাগরিষ্ঠের একনায়কত্ব’ হিসেবে না দেখে যতদূর পারা যায় সবাইকে নিয়েই যে গণতন্ত্র, তার প্রতি আগ্রহ বেড়েছে। ইউরোপের অধিকাংশ রাষ্ট্র এখন ‘Winner take all’ ব্যবস্থার পরিবর্তে ‘সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের’ দিকে ঝুঁকেছেন। এ ধরনের গণতন্ত্রে প্রতিনিধি নির্বাচন হয় অংশগ্রহণকারীদের প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যানুপাতে। ফলে এখানে প্রতিটি মতের ও পথের প্রাপ্ত ভোটের ভিত্তিতে একটি আনুপাতিক গুরুত্ব থাকে। ফলে বহুত্ববাদ এবং সমন্বয়ের প্রয়োজনীয়তা উভয়ই বৃদ্ধি পায়। এ ধরনের গণতন্ত্র ভারসাম্যপূর্ণ, বৈরিতাহীন ও অধিকতর উন্নয়ন-সহায়ক বলে প্রমাণিত হয়েছে। (এ বিষয়ে আরও বিস্তৃত আলোচনার জন্য দেখুন, নজরুল ইসলাম, ২০১১, পৃ. ৪৮।)

‘জনগণের জন্য (For the People)’

‘জনগণ’ কারা? প্রতিটি সমাজের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশকেই সেই সমাজের জনগণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। শ্রেণীবিভক্ত এবং শোষণমূলক সমাজে সাধারণত উত্পাদনশীল শ্রেণীগুলোকেই জনগণ বলে বিবেচনা করা হয়। এর মধ্যে শ্রমিক-কৃষক-মধ্যবিত্ত পেশাজীবী এবং উদ্যোক্তা বা সংগঠক (Entrepreneur) পুঁজিপতিরা পড়েন। মুষ্টিমেয় ধনকুবের, বিশাল অনুপার্জিত আয়ের অধিকারী, খাজনাভোগী, অলস ক্ষমতাবান শোষকেরা জনগণের পঙিক্তভুক্ত নয়। জনগণ ও জনগণের এসব শোষকের মধ্যে সম্পর্ক দিয়েই এদের পরস্পরকে চেনা যায় এবং সেই সম্পর্কটি হচ্ছে বৈরিতামূলক। একজনের ক্ষতি মানে আরেকজনের লাভ। তাই ক্ষমতার বিভিন্ন অঙ্গনে এই বৈরিতার সম্পর্কের ভিত্তিতে যে মেরুকরণ ঘটে, সেটাই ঐতিহাসিকভাবে নির্দিষ্ট কালপর্বে নির্দিষ্ট সমাজে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণকে পৃথক সত্তা প্রদান করে। একই সঙ্গে মুষ্টিমেয় গণশত্রুরাও চিহ্নিত ও পৃথক সত্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। যখন আমরা বলি, ইতিহাসের চালিকাশক্তি জনগণ, তখন আমরা আসলে সমাজে জনগণের সঙ্গে গণবিরোধীদের যে দ্বন্দ্ব বিদ্যমান, তাকেই নির্দেশ করে থাকি। দ্বন্দ্ব ছাড়া ইতিহাস সচল হয় না। ইতিহাস মানেই পরিবর্তন, এবং পরিবর্তন মানেই দ্বন্দ্ব। গণতন্ত্রেও প্রতিটি ক্ষেত্রেই এই দ্বন্দ্ব আছে। গণতন্ত্রের দ্বন্দ্বের সুফলগুলোও যদি জনগণের জন্য নিশ্চিত করতে হয়, তাহলে গণতন্ত্রকে বিমূর্ত শ্রেণী নিরপেক্ষতার নীতি মানলে চলে না। তাকে অবশ্যই জনগণের পক্ষে দাঁড়াতে হবে। দাঁড়াতে গেলে যে মাত্রায় ও যে কায়দায় সংখ্যালঘিষ্ঠ, গণশত্রুরা তার বিরোধিতা করবে, সে মাত্রায় এবং সেই কায়দায় তাদের গণতান্ত্রিক অধিকারগুলো সংকুচিত করাটাও গণতন্ত্রের আওতায় পড়ে। সুতরাং, সব রাষ্ট্রের মতো গণতন্ত্রও একটি ‘রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা’ এবং সেখানেও আইন, জেল, পুলিশ, সেনাবাহিনীর অস্তিত্ব আছে; এবং প্রয়োজনমতো গণবিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে বল প্রয়োগের ব্যবস্থা সেখানেও থাকে। এখানে মূল প্রশ্নটি হচ্ছে, ওই নিপীড়নের শক্তিগুলো কার স্বার্থ পাহারা দিচ্ছে এবং শেষ পর্যন্ত কাকে তা দমনের কাজে ব্যবহূত হচ্ছে। তবে সেই দমনের ক্ষেত্রে লঘু পাপে যাতে গুরু দণ্ড না হয়, সভ্য মানবিকতা যাতে রক্ষিত হয়—সেটাও গণতন্ত্রে খেয়াল রাখতে হবে।

শেষ বিচারে বিভিন্ন অঙ্গনে গণতন্ত্রের এই সংগ্রামের চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে গণতন্ত্রের মৃত্যু। যদি সমাজে গণবিরোধী কোনো শক্তিই শেষ পর্যন্ত আর না থাকে, বৈরিতামূলক দ্বন্দ্বগুলো একে একে লোপ পেয়ে সমাজে সর্বত্র সহযোগিতামূলক সম্পর্ক এবং অবৈরিতামূলক বৈচিত্র্য প্রতিষ্ঠা লাভ করে, তাহলে রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যায় এবং রাষ্ট্রের বিশিষ্ট রূপ হিসেবে গণতন্ত্রেরও তখন আর কোনো অস্তিত্ব থাকে না। এ রকম সংঘাতহীন স্বশাসনের সমাজ হচ্ছে আমাদের স্বপ্ন, যা আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে দেখা যায়নি। তবে দার্শনিক সরদার ফজলুল করিমের মতে, প্রায় প্রতিটি আদর্শ পরিবারের মধ্যে যেখানে সদস্যরা পরস্পরের মধ্যে পরস্পরকে আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছেন এবং আমি সত্তা ও আমরা সত্তা একটি রংধনুর মতো একীভূত হয়ে গেছে, সেখানে এ রকম স্বশাসন ইতিমধ্যে কার্যকর হয়েছে। স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজের থেকেই সেখানে পরিবারের প্রত্যেক সদস্য একে অন্যের প্রয়োজন সাধ্যমতো পূরণ করেন। ফলে এখানে বিরোধের কোনো অবকাশ থাকে না। মার্ক্স কথিত সাম্যবাদের বণ্টননীতি প্রত্যেকের কাছ থেকে সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ ও প্রত্যেককে তার প্রয়োজন অনুযায়ী প্রদানের নীতি এখানে স্বতঃস্ফূর্তভাবে কার্যকর হয়েছে। তাই ‘মিনি’ আকারে হলেও এ স্বপ্নের একটি মানবিক বাস্তবতা বিদ্যমান। (দেখুন, সরদার ফজলুল করিম, ১৯৯৩, পৃ. ১৪)

চীন ও আমেরিকা: অসম্পূর্ণ গণতন্ত্রের দুই পৃথক দৃষ্টান্ত

তাহলে কী দাঁড়াল? একটি শাসনব্যবস্থা শুধু ‘জনগণের’ এবং ‘জনগণের দ্বারা’ নির্মিত হলেই তা গণতন্ত্রের জন্য যথেষ্ট নয়। সেই রাষ্ট্র যদি জটিল মুহূর্তে জনগণের জন্য বাস্তব সুফল প্রদানে ব্যর্থ হয় বা জনগণের অর্জিত সুফলগুলো জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গণবিরোধীদের করালগ্রাস থেকে রক্ষা করতে না পারে, তাহলেও গণতন্ত্র নির্মাণ সুসম্পূর্ণ হয়নি বলেই ধরে নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে অবশ্য আমরা দুই ধরনের বিচ্যুতিই দেখতে পাব:

ক. একটি হচ্ছে জনগণের, জনগণের দ্বারা কিন্তু জনগণের বিরুদ্ধে পরিচালিত গণতন্ত্র। আমেরিকান রাষ্ট্র প্রসঙ্গে সর্বশেষ রসিকতা হচ্ছে এটি: ‘Of the people, by the people and against the people.’ এটি নিছক রসিকতা নয়। আমেরিকা থেকে সদ্য প্রত্যাগত এক অধ্যাপক আমাকে বলেছেন, আমেরিকান গণতন্ত্রে যেসব নানা প্রাতিষ্ঠানিক সুযোগ রয়েছে এবং অধিকাংশ নাগরিকের যে গড় বস্তুগত প্রাচুর্য ও সক্ষমতা বিদ্যমান, তাতে সেখানকার নাগরিকেরা সত্যই মনে করেন যে রাষ্ট্রটি তাঁদের নিজেদের এবং তাঁরা নিজেরাই রাষ্ট্রের অধিকর্তাকে নির্বাচিত করেছেন। কিন্তু তাঁরা আবার এটাও এখন মনে করেন যে তাঁদের এবং তাঁদের দ্বারা হওয়া সত্ত্বেও আমেরিকান রাষ্ট্র এখন বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠের বিরুদ্ধে কাজ করে যাচ্ছে।

খ. আরেকটি হচ্ছে ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ভোটে নয়, সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের দ্বারাও নয়, কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের জন্য সুফল’ প্রদানকারী গণতন্ত্র। কেউ কেউ একে Authoritarian Democracy  বা কর্তৃত্বমূলক গণতন্ত্র নামে অভিহিত করতে পছন্দ করেন। এর সম্ভাব্য একটি উদাহরণ হতে পারে বর্তমান আধুনিক চীনের তথাকথিত ‘চীনা স্টাইলের গণতন্ত্র’। চীনে দ্রুত উত্পাদনশক্তির বিকাশ ঘটছে এবং তার সুফল চীনের সব অঞ্চল ও সব নাগরিকই বর্তমানে কমবেশি ভোগ করছেন। অবশ্যই এ সুফলের ভাগবাটোয়ারা নিয়ে চীনে বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে দ্বন্দ্ব রয়েছে, যে দ্বন্দ্বের মধ্যস্থতা করছে ওই দেশের একক রাজনৈতিক দল চীনের কমিউনিস্ট পার্টি। যেহেতু ব্যবস্থাটি একদলীয়, সেহেতু নিঃসন্দেহে পাশ্চাত্য গণতন্ত্রের মাপকাঠিতে চীনে গণতন্ত্র নেই। অনেকেই এই মাপকাঠিতে নিশ্চিতভাবে বলবেন যে চীনে গণতন্ত্র নেই। কিন্তু আমি এ প্রবন্ধে পাশ্চাত্য গণতন্ত্রের সংকীর্ণ সংজ্ঞা গ্রহণ করিনি। যদি একটি রাষ্ট্রের অধিকাংশ জনগণ একটি জাতীয় দলের একক শাসনকেই কাম্য বলে মনে করে এবং নিরপেক্ষ ভোটে বা বিপ্লবী গণজাগরণের মাধ্যমে যদি কোথাও একদলীয় শাসনব্যবস্থা কায়েম হয়, তাহলে সেই নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক পটভূমিতে ‘একদলীয় শাসনব্যবস্থাই’ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। আমার বিবেচনায় গণতন্ত্রের সারাংশ হচ্ছে, ‘জনগণের—জনগণের দ্বারা এবং জনগণের জন্য’—এক দল বা বহু দল হচ্ছে গণতন্ত্রের স্থান-কাল-পাত্রভিত্তিক বিভিন্ন রূপবিশেষ। তবে Principal-Agent Problem, যার কথা আগে আলোচিত হয়েছে, তার বিরুদ্ধে যথেষ্ট রক্ষাকবচ হিসেবে চীনা পার্টিকেও জনগণের প্রতি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। আরও মনে রাখতে হবে, ক্ষমতার বিভিন্ন পরিসরে গণতন্ত্র অর্জনের ঐতিহাসিক প্রতিযোগিতা চলছে। চীনেও সেটা চলছে। এই প্রতিযোগিতায় গণশক্তির উত্থান-পতন-পুনরুত্থানের মাধ্যমেই সেখানে গণতন্ত্র ক্রমেই বিকাশ লাভ করছে। গণতন্ত্র কোনো ‘রসগোল্লা’ নয় যে তার একটি সুসম্পূর্ণ রূপ শিগগিরই আমরা পেয়ে যাব। তাই ব্যাপকার্থে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার যে প্রধান মাপকাঠিগুলো এ প্রবন্ধে ব্যবহূত হয়েছে, সেগুলো দিয়ে বিচার করতে হবে চীনে গণতন্ত্রের মাত্রা কতটুকু। সেই মাপকাঠিগুলো হচ্ছে:

ক. জনগণের অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক সক্ষমতা তৈরি হয়েছে কি হয়নি?

খ. এই সক্ষমতাগুলো প্রয়োগ করে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ নীতি ও পরিকল্পনাগুলো প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে তারা কার্যকর অংশগ্রহণের সুযোগ কতটুকু মাত্রায় পাচ্ছে?

গ. রাষ্ট্রীয় গণতান্ত্রিক ক্রিয়াকাণ্ডের সুফল অন্তিমে কতটুকু মাত্রায় জনগণ উপভোগ করছে, জাতীয় বা আন্তর্জাতিক গণশত্রুদের করালগ্রাস থেকে সেগুলোর সুরক্ষা করা যাচ্ছে কি?

এতগুলো জটিল মাপকাঠির বিচারে চীনে গণতন্ত্র কতটুকু আছে, তার পুনর্মূল্যায়নের দুঃসাহস আমি এ প্রবন্ধে করব না। কিন্তু এটুকু বলব যে ‘আমেরিকার গণতন্ত্রকে’ যদি আমরা এককথায় উড়িয়ে না দিয়ে নির্দিষ্ট মূর্ত সমালোচনা ও সীমাবদ্ধতার কথা বলি, যেমনটি এখানে আমরা বলেছি, তাহলে চীনের তথাকথিত ‘সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রকেও’ এককথায় উড়িয়ে না দিয়ে তার মূর্ত সমালোচনা তুলে ধরাই হবে একটি ন্যায়সংগত যৌক্তিক অবস্থান।

প্রতিটি বিদ্যমান ‘গণতন্ত্রকে’ যদি আমরা অসম্পূর্ণ ব্যবস্থা হিসেবেই দেখি এবং সম্পূর্ণ গণতন্ত্রের যে সাম্যবাদী স্বপ্নের কথা আমি আগে উল্লেখ করেছি তার দিকে, তথা ‘সম্পূর্ণ গণতন্ত্রের’ দিকে ধাবমান একটি প্রক্রিয়া হিসেবেই দেখি, তাহলে আমাদের অনেক যান্ত্রিক ছকবাঁধা চিন্তার কারাগার থেকে আমরা মুক্ত হতে পারব। তখন সাদা-কালো এভাবে চিন্তা না করে আমরা ‘সাদার মধ্যে কালো’ ও ‘কালোর মধ্যে সাদাকে’ দেখতে পাব এবং প্রয়োজনমতো প্রশংসা ও প্রয়োজনমতো সমালোচনাও করতে পারব। ‘গণতন্ত্রকে’ দ্বান্দ্বিক দৃষ্টিভঙ্গিতে পর্যালোচনা করেছেন—এ রকম একজন চীনা পণ্ডিতের লেখা থেকে উদ্ধৃতি তুলে ধরার লোভ সংবরণ করতে পারছি না। চীনের একাডেমি অব সোশ্যাল সায়েন্সের ভাইস প্রেসিডেন্ট লি শেনমিং ‘Some thoughts on Democracy and Universal Democracy’ প্রবন্ধে লিখেছেন:

My understanding is that, generally speaking, the democracy shaped in human societies can be divided into three categories: primitive democracy, state democracy and future socialist democracy in communist societies. Each category has its specificity, so each constitutes a specific form of democracy. The first and the third share a similarity because both give equal rights to all tribal and social members in economy, politics and culture. Hence these two can be termed ‘full democracy’. The democracy we talk a lot about nowadays is mainly the second one, namely state democracy. Again, state democracy can be divided farther into slave democracy, feudal democracy, capitalist democracy and socialist democracy. The types debated most heatedly today are the capitalist and socialist democracies. None of the four subcategories is full democracy, thus the ‘incomplete democracies’, which in this sense have a ‘common nature’ shared by slave democracy, feudal democracy, capitalist democracy and socialist democracy. (লি শেনমিং, ২০০৮-০৯, পৃ. ২৬৮)

[অনুবাদ: আমার বুঝ হলো, মোটাদাগে বলতে গেলে, মানবসমাজে গণতন্ত্র যেসব রূপ পরিগ্রহ করেছে, সেগুলোকে তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়: বুনিয়াদি গণতন্ত্র, রাষ্ট্রীয় গণতন্ত্র এবং সাম্যবাদী সমাজের ভাবীকালের সমাজতন্ত্রী গণতন্ত্র। এই প্রত্যেকটি ধারারই কিছু সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য আছে, ফলে এর মাধ্যমে গণতন্ত্রের একটি সুনির্দিষ্ট ধরন নির্মিত হয়েছে। এখানকার প্রথম ও তৃতীয় ধরনটির মধ্যে একটি সাযুজ্য আছে। এই দুই ছাঁচের গণতন্ত্রই এর গোত্রীয় ও সামাজিক সব সদস্যকে সমান অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার প্রদান করে। সে কারণেই এ দুটি ধরনকে বলা যায় ‘পূর্ণ গণতন্ত্র’। আর আজকাল যে ধরনের গণতন্ত্র নিয়ে আমরা প্রচুর কথাবার্তা বলি, সেটা মূলত দ্বিতীয় ধারার, যাকে আমরা বলি রাষ্ট্রীয় গণতন্ত্র। আবার রাষ্ট্রীয় গণতন্ত্রকেও কয়েকটি ভাগে ভেঙে নেওয়া যায়: দাস গণতন্ত্র, সামন্তবাদী গণতন্ত্র, পুঁজিবাদী গণতন্ত্র এবং সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র। এর মধ্যে আবার যে ছাঁচগুলো ঘিরে তর্ক এখন টগবগিয়ে ফুটছে, সেগুলো হচ্ছে পুঁজিবাদী ও সমাজতন্ত্রী গণতন্ত্র। এই চারটি উপশ্রেণীর কোনোটিকেই পূর্ণ গণতন্ত্র বলা চলে না। কাজেই এগুলো হলো ‘অসম্পূর্ণ গণতন্ত্র’, এই অর্থে অসম্পূর্ণতাই হচ্ছে দাস গণতন্ত্র, সামন্তবাদী গণতন্ত্র, পুঁজিবাদী গণতন্ত্র এবং সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের সাধারণ একটি বৈশিষ্ট্য।]

সুতরাং, চীনা ও আমেরিকান রাষ্ট্রীয় গণতন্ত্র উভয়কে অসম্পূর্ণ গণতন্ত্রের রকমফের হিসেবে দেখাই শ্রেয় হবে।

বাংলাদেশে বুর্জোয়া রাজনীতি ও গণতন্ত্র

স্বাধীনতার পরপর ঢাকায় এসে কমরেড ভবানী সেন একটি চমত্কার বক্তৃতা দিয়েছিলেন। তিনি ‘বুর্জোয়া গণতন্ত্রের’ অন্তর্নিহিত দুর্বলতা উদ্ঘাটন করার জন্যই এ গল্পটি বলেছিলেন।

গল্পটি হচ্ছে, জনৈক খদ্দের এক হোটেলে গিয়ে ‘খরগোশের মাংস’ খেতে চাইলে পরিবেশক ‘বয়’ বলল, তাদের এখানে শুধু ‘খরগোশের মাংস’ আলাদাভাবে পাওয়া যায় না। তবে ইচ্ছা করলে একটি ‘মিশ্র ডিশ’ দেওয়া যেতে পারে, যেখানে ‘ঘোড়া ও খরগোশের’ মাংস মিশ্রিত অবস্থায় পরিবেশন করা হয়। খদ্দেরটি তখন জিজ্ঞেস করলেন, ‘মিশ্র ডিশে’ ঘোড়ার মাংস থাকবে কতটুকু? আর খরগোশের মাংস থাকবে কতটুকু? ‘বয়’ উত্তর দিল, ‘এক অনুপাত এক’ অর্থাত্ অর্ধেক-অর্ধেক। খদ্দের তখন খুশি হয়ে ভাবলেন, অর্ধেক মাংস তো খরগোশের মাংস হবে, অতএব মন্দ কী? কিন্তু ‘মিশ্র ডিশ’ আসার পর খেতে বসে খদ্দের দেখেন, সবই হচ্ছে ‘ঘোড়ার মাংস’, খরগোশের কোনো মাংসই তিনি খুঁজে পাচ্ছেন না। তখন বিরক্ত হয়ে বয়কে ডেকে পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘খরগোশের মাংস কোথায়?’ বয় উত্তর দিল, আপনাকে তো আগেই বলেছি, এই মিশ্র ডিশে ‘এক অনুপাত এক’ অর্থাত্ একটি ঘোড়ার সঙ্গে একটি খরগোশ মেশানো হয়েছে!

এই গল্পের পর ভবানী সেন বললেন, ‘বুর্জোয়া গণতন্ত্র’ হচ্ছে একটি মিশ্র ব্যবস্থা। আর এখানে ‘বুর্জোয়া বিষয়গুলো’ হচ্ছে ‘ঘোড়ার মাংসের’ মতো বিশাল এবং ‘গণতন্ত্র’ হচ্ছে ‘খরগোশের মাংসের’ মতো ক্ষুদ্র। টাকাপয়সা, ধনদৌলত, সংবাদপত্র, জমিজমা, অনুগত বাহিনী, সন্ত্রাসী, অস্ত্র, রাষ্ট্র, পুলিশ, আইন-আদালত—সবই পুঁজিবাদী সমাজে থাকে মালিকশ্রেণীর মালিকানায় ও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণাধীন। পক্ষান্তরে শ্রমজীবীদের রয়েছে একমাত্র সংঘশক্তি ও ‘গণতান্ত্রিক ভোটের’ শক্তি। এখানে তাই ‘গণতন্ত্রের’ শক্তি সংখ্যায় বেশি হলেও গুণগত বা বস্তুগত শক্তিতে তা দুর্বল থেকে যায়। বিশেষ করে, যদি সংখ্যাগরিষ্ঠ গণতান্ত্রিক শক্তি সংগঠিত হতে না পারে, সচেতন হতে না পারে, বিত্ত-অর্থশক্তির প্রলোভন বা ভীতিকে মানসিক সচেতনতা দিয়ে জয় করতে না পারে, তাহলে তাদের জন্য অপেক্ষা করে থাকে নিশ্চিত পরাজয়। বাংলাদেশে বর্তমানে ‘বুর্জোয়া গণতন্ত্র’ চালু আছে। অর্থাত্ একটি অসম আর্থিক কাঠামো বা শ্রেণী কাঠামোর ওপর ‘এক মানুষ এক ভোট’-ভিত্তিক একটি অসামঞ্জস্যপূর্ণ ভিন্নধর্মী উপরিকাঠামো প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। তবে সম্প্রতি গণতান্ত্রিক শক্তির নানা আন্দোলন এবং বুর্জোয়াদের উলঙ্গ ব্যর্থতার কারণে নানা সংস্কারের মাধ্যমে বাংলাদেশে ‘গণতন্ত্রের’ পক্ষে জনমত একটু একটু করে বিস্তৃতও হচ্ছে। তলের শ্রমজীবী প্রার্থীরা বিগত সংসদ নির্বাচনে ভালো না করলেও স্থানীয় নির্বাচনে লাখ লাখ ভোট পেয়েছেন। যদিও এবার সংসদ নির্বাচনে নির্বাচিতদের ৪০ শতাংশ কোটিপতি (আসলে হয়তো আরও বেশি!) রয়েছেন। কিন্তু উপজেলায় সেই হার হয়েছে অনেক অনেক কম। এমনকি পয়সা খরচ না করেও কেউ কেউ নির্বাচিত হয়েছেন! পাশাপাশি বর্তমানে বুর্জোয়া দলগুলোর মধ্যেও টাকা দিয়ে মনোনয়ন কেনার যে প্রচলিত পদ্ধতি এত দিন চালু ছিল, তার নগ্নতা উদ্ঘাটিত হয়ে যাচ্ছে এবং সেখানেও কিছু কিছু সংযম দেখা যাচ্ছে। তা ছাড়া এ নিয়ে খোদ বুর্জোয়া দলগুলোর ভেতরেই এখন অন্তর্দ্বন্দ্বও সৃষ্টি হচ্ছে। এটা বাংলাদেশের জন্য একটি আশার ব্যাপার। (সাম্প্রতিক কালে অনুষ্ঠিত নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার নির্বাচন দ্রষ্টব্য।)

এ জন্যই গণতান্ত্রিক সংস্কার এবং গণতন্ত্রের এ প্রক্রিয়া ভবিষ্যতে টিকিয়ে রাখাটা হবে অত্যন্ত জরুরি একটি কাজ। একসময় ঢাকার মেয়র পদের নির্বাচনে বিএনপি থেকে মনোনয়নপ্রার্থী ছিলেন শিল্পপতি তানভীর আহমেদ সিদ্দিকীর ছেলে চৌধুরী ইরাদ আহমেদ। তিনি নিজেই আবার সাংবাদিকদের কাছে তখন এই বলে অভিযোগ করেছিলেন যে যখন তিনি বিএনপির চেয়ারপারসনের কাছ থেকে এই পদে মনোনয়ন ভিক্ষা করেন, তখন তিনি (খালেদা জিয়া) তাঁর কাছ থেকে জানতে চান যে তাঁর হাতে যথেষ্ট অর্থ আছে কি না? তিনি তখন জবাবে বলেন, ‘দেখুন, সত্ ও যোগ্য প্রার্থীদের যথেষ্ট অর্থ থাকার কথা নয়।...আমি পাঁচ কোটি টাকা আপনাকে (খালেদা জিয়া) ব্যাংক থেকে এনে দিতে পারব না। আমি মোসাদ্দেক আলী ফালু বা মির্জা আব্বাস নই।’ স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে, ‘বিএনপির’ মতো একটি বুর্জোয়া দলে টাকা দিয়ে মনোনয়ন কেনার ব্যাপারটি প্রতিযোগিতায় হেরে যাওয়া প্রার্থীদের কাছে প্রশ্নসাপেক্ষ হয়ে পড়ছে। আমরা অবশ্য এ ধরনের মনোনয়ন বিক্রির অভিযোগ আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রেও খবরের কাগজে অতীতে প্রচারিত হতে দেখেছি। তবে বুর্জোয়া বা ধনী দলগুলোর সমর্থকেরা এর পরও এ কথাই দাবি করেন, একটি সংসদীয় নির্বাচনে বৈধ ব্যয়ের পরিমাণই হচ্ছে ১৫ লাখ টাকা। আর এ রকম ব্যয় দরিদ্ররা করবে কীভাবে? সুতরাং, বৈধ ব্যয়ের সীমা রক্ষা করে ধনী ব্যক্তিদেরই প্রতিযোগিতায় নামতে হবে; এবং তাই স্বাভাবিকভাবেই সংসদে জয়ী হবেন ধনীরাই। যত দিন গরিবরা ধনীদের ভোট দিচ্ছেন, তত দিন এ নিয়ে অভিযোগ করার কী আছে? এটাই এখন নিষ্ঠুর সত্য কথা।

এ নিয়ে আসলে অভিযোগ করার কিছু নেই। যদিও এ জন্যই কেউ কেউ মনে করেন, বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এ ব্যবস্থার পরিবর্তন সম্ভব নয়। তাঁরা অবশ্য বিপ্লবের মাধ্যমে প্রথমে অসম আর্থিক ক্ষমতাকাঠামোটি সুষম করে তার পরে সেখানে প্রকৃত গণতন্ত্র কায়েম করার কথা বলে থাকেন। সে পরীক্ষাও ইতিমধ্যে পৃথিবীতে অনেক জায়গায় হয়েছে। কিন্তু সেটাও কোথাও কোথাও একদলীয় ব্যবস্থার অধীনে পুনরায় কেন্দ্রীভূত আমলাতন্ত্র ও একনায়কত্বের জন্ম দেওয়ায় সেখানকার জনগণ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। ইত্যাদি নানা অভিজ্ঞতার পর বর্তমানে নেপাল ও ভেনেজুয়েলায় বামপন্থী দলগুলো বহুদলীয় গণতন্ত্রের অধীনেই আর্থিক সাম্য প্রতিষ্ঠার আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। আমাদের পাশেই অবস্থিত পশ্চিমবঙ্গেও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অধীনেই সংস্কারের মাধ্যমে অর্থনীতি-রাজনীতিকে বৈষম্যহীন করার প্রচেষ্টা অব্যাহতভাবে চলে আসছে। এসব পরীক্ষার সাফল্য-ব্যর্থতার মাত্রা নিয়ে অবশ্য নানা বিতর্ক রয়েছে এবং থাকাটাই স্বাভাবিক। সম্ভবত বাংলাদেশেও আমরা সেই পথ দিয়েই অগ্রসর হব। তবে বুর্জোয়া দলগুলো গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির চর্চা নিজেদের দলের মধ্যে যদি আরও না বৃদ্ধি করে, গণতন্ত্রকে আরও অবাধ এবং পেশি ও অর্থশক্তির প্রভাবশূন্য করা না যায়, দলের ভেতরে ও বাইরে সত্ এবং যোগ্য লোকদের প্রতিযোগিতা করে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ না দেওয়া যায়, তাহলে ‘বুর্জোয়া গণতন্ত্রের’ সংস্কার না হয়ে তা ভবানী সেন কথিত ‘ঘোড়া ও খরগোশের’ মাংসের অসম মিশ্র ডিশ হিসেবেই থেকে যাবে। খরগোশরাও তখন হতাশ হয়ে রক্তক্ষয়ী বিপ্লবের দিকেই এগিয়ে যেতে বাধ্য হবে। তবু ইতিহাসের নানা চড়াই-উতরাই পার হয়ে আমরা আজ এ কথাই বলব যে বাংলাদেশে ‘গণতন্ত্রের ত্রুটির’ বিকল্প ‘অগণতন্ত্র’ নয়। এটা হতে হবে ‘অধিকতর গণতন্ত্র’। পৃথিবীব্যাপী মানবসমাজ আজ সেই পথেই অগ্রসর হচ্ছে। বাংলাদেশের জনগণকে বুঝতে হবে, ভোটের মাধ্যমে একটি ব্যর্থ সরকারকে বিদায় করা তাদের পক্ষে অতীতে সম্ভব হয়েছিল, এখনো হয়তো অসম্ভব হবে না; কিন্তু সেটা হচ্ছে সমস্যার অর্ধাংশ মাত্র! প্রয়োজন হচ্ছে এমন একটি নতুন সরকারকে ক্ষমতায় বসানো, যে হবে ‘জনগণের, জনগণের দ্বারা এবং জনগণের জন্য’! শুধু সরকারের পরিবর্তন করে এটা অর্জন করা যায় না। এর জন্য চাই রাষ্ট্রব্যবস্থার সামগ্রিক পরিবর্তন। এই জায়গাতেই অনেক বেশি ঘাটতি রয়ে গেছে। কিন্তু এ ঘাটতি পূরণের জন্য ওপরের কোনো নেতার বা কেন্দ্রীয় কোনো ত্রাতা শক্তির অপেক্ষায় না থেকে, নিজ নিজ পরিসরে অসংখ্য নিজস্ব গণতান্ত্রিক সংঘশক্তি বা গণসংগঠন নির্মাণ করে ধাপে ধাপে কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রশক্তিকে সর্বক্ষণ নজরদারি করা এবং ‘গোড়ালির ওপর নেতৃত্বকে দাঁড় করিয়ে’ রাখার ক্ষমতাটুকু অর্জন করতে হবে জনগণকে। এ দেশের জনগণ সাহস ও ত্যাগের বিনিময়ে অনেকবার নতুন নতুন বিজয় ছিনিয়ে এনেছে; কিন্তু বিজয় অর্জনের পর জনগণের নিজস্ব ক্ষমতার অভাবে এবং নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে প্রায় প্রতিটি বিজয়ই আবার চুরি হয়ে গেছে। ভবিষ্যতে জনগণকে তাই কখনোই ইতিহাসের নিষ্ক্রিয় কাঁচামাল হয়ে বসে থাকলে চলবে না। নেতিবাচক সংগ্রাম ও ইতিবাচক নির্মাণ ইতিহাসের উভয় পর্বেই তাকে সজাগ-ক্ষমতাবান ‘Subject’-এর ভূমিকা অক্ষুণ্ন রাখতে হবে।

একবিংশ শতকে গণতন্ত্র: শত পুষ্প ফুটছে

একবিংশ শতকে গণতন্ত্রের রূপবৈচিত্র্য শতগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই রূপবৈচিত্র্য এখন গণতন্ত্রকে একটি রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা হিসেবে আর দেখছে না; দেখছে একটি জীবনযাপন পদ্ধতি বা সংস্কৃতির উপাদান হিসেবে। যৌথ জীবনের যেকোনো ক্ষেত্রে একটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের চর্চা হিসেবে যদি আমরা গণতন্ত্রকে দেখি, তাহলে রাষ্ট্রবহির্ভূত নানা ধরনের গণতন্ত্রের কথা আমরা ভাবতে পারি। যেমন: রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের চর্চা (Inner Party Democracy), কারখানায় গণতন্ত্র (Enterprise Democracy), মহল্লার গণতন্ত্র (Neighbourhood Democracy), শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গণতন্ত্র (Academic Democracy), সামরিক বাহিনীর গণতন্ত্রায়ন (Democratization of Military) ইত্যাদি। গণতন্ত্রের এই রূপভেদের পেছনে সাধারণ যে অনুমান বা সত্যটি কাজ করে তা হচ্ছে, যেকোনো যৌথ কাজে অংশগ্রহণকারীরা নীতিনির্ধারণ, তা বাস্তবায়ন ও ফলাফল মূল্যায়নে অংশগ্রহণের স্বাভাবিক অধিকার (Natural Right) দাবি করতে পারে এবং সেই গণতান্ত্রিক সুযোগ তার থাকাটাই সমীচীন ও ন্যায়সংগত হবে। এই অনুমানের ঐতিহাসিক উত্স হচ্ছে সুপ্রাচীন রোমান আইনে উল্লিখিত একটি ধারা: ‘Quod omnes tangit ab omnibus approbetur’, যার ইংরেজি অনুবাদটি হচ্ছে ‘That which affects all people must be approved by all people’. কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, দ্বিদলীয় গণতন্ত্র বা অধিকাংশ প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্রের চর্চা বর্তমানে নানা কারণে এই মূলনীতি থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। এ প্রবন্ধে আমি বলতে চেষ্টা করেছি, দূরে সরে গেলে চলবে না—আবার তাকে এই সর্বজনীন গণতন্ত্রের অনুশীলনের দিকে ফিরতে হবে। তার টেকনিক্যাল বস্তুগত ভিত্তিটি এখন তৈরি আছে, দরকার শুধু উপযুক্ত মূল্যবোধ ও সংস্কৃতিসম্পন্ন নেতৃত্ব।

কিন্তু এ ধরনের সকলের দ্বারা সকলের শাসনের একটি বড় পূর্বশর্ত হচ্ছে, প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে সংশ্লিষ্ট অংশগ্রহণকারীদের মতামত ভীতিহীন পরিবেশে সংগ্রহ করে গণনা করে প্রধান মতটি নির্ণয়ের ব্যবস্থা করা। এর জন্য একটি সার্বক্ষণিক স্থায়ী তথ্য- নেটওয়ার্কের প্রয়োজন হবে। প্রয়োজন হবে সংশ্লিষ্ট সবার ওই তথ্য-নেটওয়ার্কে ইনপুট প্রদানের দক্ষতা ও আগ্রহের। আরও প্রয়োজন হবে এমন একটি কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ের, যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে যেকোনো ইস্যুতে যে কারও মতামতকে ওয়েবসাইটে প্রদানের পর তার পক্ষে সমর্থন-অসমর্থন ও অন্যান্য ‘র্যাংকিং’ (ক্রমমান) স্কোর প্রদান করে সেগুলোর নৈর্ব্যক্তিক যোগফল প্রণয়ন করতে সক্ষম হবে এবং পরে অংশগ্রহণকারী সবার সামনে তা বিশ্বাসযোগ্যভাবে উপস্থিত করতেও সক্ষম হবে। সমগ্র ব্যাপারটি হতে হবে গোপন ভোটের ভিত্তিতে, যাতে চূড়ান্ত ফলাফল নির্ধারণে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তির ব্যক্তিগত মতামতটি সেই ব্যক্তির ইচ্ছার বিরুদ্ধে কেউ জানতে না পারেন। টেকনিক্যালি বর্তমানে এটা খুবই সম্ভব। কিন্তু কেউ বলতে পারেন, ‘প্রধান মত’টি নির্ধারণের পরের স্তরটি হচ্ছে শক্তি প্রয়োগ ও বাস্তবায়নের স্তর এবং সব নষ্টের গোড়া সেখানেই নিহিত। এই আপত্তির বিরুদ্ধে আমার সংক্ষিপ্ত প্রত্যুত্তর হচ্ছে, ‘প্রধান মত’ নির্ধারণের পূর্ববর্ণিত স্তরগুলো যদি অতিক্রম করা সম্ভব হয়, তাহলে তার থেকেই সামাজিক শক্তি সঞ্চয় করে ‘প্রধান মতটি’ বাস্তবায়নযোগ্য হয়ে উঠবে।

সুখের বিষয়, এ রকম নানা ধরনের গণতান্ত্রিক নেটওয়ার্কিং স্বতঃস্ফূর্তভাবে পৃথিবীর আনাচে-কানাচে গড়ে উঠতে শুরু করেছে। পুঁজি, করপোরেট শক্তি বা ট্র্যাডিশনাল পার্টিগুলোর গতানুগতিক আমলাতান্ত্রিক ও উল্লম্বিক (Bureaucratic and Hierarchical) ভূমিকায় বিরক্ত হয়ে জনগণের বিভিন্ন অংশ নিজেরাই নিজেদের স্বতঃস্ফূর্ত উদ্যোগে তথ্যপ্রযুক্তিকে ব্যবহার করে গণতান্ত্রিক মতামত গড়ে তুলতে শুরু করেছে। শুধু তা-ই নয়, ওই জনমত গণতান্ত্রিক অবয়ব বজায় রেখেই নির্দিষ্ট দিনে, নির্দিষ্ট স্থানে, নির্দিষ্ট সময়ে সামষ্টিক শক্তিরূপে আবির্ভূত হতে শুরু করেছে। জন্ম দিয়েছে এমন এক পাল্টা ক্ষমতার (Countervailing Power), যা নিজে কখনো ক্ষমতাসীন (Ruling Power) হবে না, হতেও চায় না। সেই সামষ্টিক গণশক্তি এখনই জন্ম দিয়েছে ‘আরব বসন্ত’ এবং ‘ওয়াল স্ট্রিট দখলের’ মতো বিশাল বিশাল আপাতনেতৃত্বহীন গণতান্ত্রিক আন্দোলনের। এর বর্তমান ব্যবহারিক তাত্পর্যের নানা সীমাবদ্ধতা থাকলেও এর গর্ভে লুকিয়ে আছে একবিংশ শতকের বহুমাত্রিক গণতন্ত্রের বীজ। একেই পণ্ডিতেরা আগামী দিনের ‘সহযোগিতামূলক গণতন্ত্র’ বলে অভিহিত করেছেন। জনগণের নিজস্ব সহযোগিতায় গড়ে ওঠা জনগণের নিজস্ব সংস্থা। এদিকেই আজ আমাদের দৃষ্টি ফেরাতে হবে। অনেক বামপন্থী এখনো এসব আন্দোলন তীব্র সন্দেহের চোখে দেখেন, কিন্তু তাঁদের আমি একটু ভেবে দেখতে বলব, স্বয়ং লেনিন যে স্থানীয় ‘সোভিয়েত’ সংগঠনগুলোকে ব্যবহার করে বিপ্লবের দিকে এগিয়ে যেতে পেরেছিলেন, সেগুলোও কি প্রায় এই একই ধরনের সংগঠন ছিল না?

ইন্টারনেটে এ ধরনের গণতন্ত্রের ব্যাপারে অনুসন্ধান করতে গিয়ে আমি জেনে আনন্দিত ও বিস্মিত হয়েছি যে বর্তমানে ‘Collaborative Democracy’-এর (পরস্পর সহযোগিতামূলক গণতন্ত্র) নতুন একটি ধারণা নিয়ে অনেকেই গবেষণা করছেন এবং এসব গবেষণার ফল নিয়ে একাধিক সমৃদ্ধ ‘ই-জার্নাল অব ই-ডেমোক্রেসি’ নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে। এসব গবেষণায় ইতিমধ্যে ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির একটি গবেষণাকেন্দ্র এবং অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির গবেষকেরা অবদান রেখে চলেছেন। (আরও দেখুন প্যাট্রিক ক্লাউস-২০০৯) এ ছাড়া চীনেও টাউনশিপ বা মিউনিসিপাল গণতন্ত্র নিয়ে নানা সফল পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে।

আমার শেষ কথাটি হচ্ছে, নতুন যুগের নতুন প্রযুক্তি সব সময়ই পৃথিবীটাকে বদলে দেয়, এবারও তাই দেবে। হয়তো তারই সূচনা আমরা দেখতে পাচ্ছি। অবশ্য অনুন্নত দেশে যেখানে বিদ্যুত্ নেই, শিক্ষার প্রচণ্ড অভাব রয়েছে এবং সমাজে তীব্র ডিজিটাল বিভেদ বিরাজ করছে—সেখানে এ ধরনের প্রযুক্তির বিস্তার ও গণতন্ত্রের পরিসীমা অনেক সংকুচিত হতে বাধ্য। কিন্তু এর পরেও অনুন্নত সমাজের জনগণই নিজ স্বার্থে এই প্রযুক্তিকে বিপুল সমাদরে গ্রহণ করতে এগিয়ে এসেছে! আমরা আশা করতে পারি, তারাই এখন এসব সীমাবদ্ধতা চিহ্নিত করতে সক্ষম হবে এবং সমাধানের উপায়ও যেহেতু তাদের নাগালের মধ্যেই এসে গেছে, সেহেতু এই সীমাবদ্ধতাগুলো অতিক্রম করা তাদের জন্য আজ আর কোনো অসম্ভব চ্যালেঞ্জ হবে না। আমাদের নিজেদের দেশের চারদিকে তাকালেই আমরা দেখি, আগামী দিনের এই প্রযুক্তিক্ষমতাটি ক্রমাগতই জনগণের কাছে আরও বন্ধুসুলভ (User Friendly) হয়ে উঠছে।

গ্রন্থপঞ্জি

১. এ কে সেন (২০০৯), দি আইডিয়া অব জাস্টিস, পেঙ্গুইন বুকস, লন্ডন।

২. নেলসন ম্যান্ডেলা (১৯৯৪), লং ওয়াক টু ফ্রিডম, লিটল ব্রাউন কোম্পানি, বোস্টন অ্যান্ড লন্ডন।

৩. খুইনটাইন হোয়ারে এবং জিয়োফ্রে নোয়েল স্মিথ (১৯৯৬) সম্পাদিত, আন্তোনিও গ্রামসি, সিলেকশনস ফ্রম দ্য প্রিজন নোটবুকস, ওরিয়েন্ট লংম্যান, ইন্ডিয়া।

৪. ডেভিড ডিউটশ্চমান (২০০৪) সম্পাদিত, চে গুয়েভারা রিডার: রাইটিংস অন পলিটিকস অ্যান্ড রেভল্যুশন, লেফট ওয়ারড অ্যান্ড ওশান, ইন্ডিয়া।

৫. আলেক্সি ডি টোকভিল (১৮৫১), ডেমোক্রেসি ইন আমেরিকা, এ এস বার্নস, নিউইয়র্ক।

৬. কার্ল মার্ক্স (১৮৪৮), ‘দ্য বুর্জোয়া অ্যান্ড দ্য কাউন্টার রেভল্যুশন’, মার্ক্স অ্যান্ড অ্যাঙ্গেলস, সিলেক্টেড ওয়ার্কস, ভলিউম থ্রি, প্রোগ্রেস পাবলিশার্স, মস্কো।

৭. নজরুল ইসলাম, ‘বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার লক্ষ্যে দুটি প্রস্তাব’, প্রতিচিন্তা, জুলাই-সেপ্টেম্বর, ২০১১, ঢাকা।

৮. সরদার ফজলুল করিম (১৯৯৩), ‘সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদ প্রসঙ্গে’, নুহের কিশতি এবং অন্যান্য প্রবন্ধ, বাংলা একাডেমী, ঢাকা।

৯. লি শেনমিং (২০০৮-০৯), ‘সাম থটস অন ডেমোক্রেসি অ্যান্ড ইউনিভার্সাল ডেমোক্রেসি’, চাইনিজ একাডেমি অব সোশ্যাল সায়েন্স, মার্ক্সিস্ট স্টাডিজ ইন চায়না (২০০৮-২০০৯), ফরেন ল্যাঙ্গুয়েজ প্রেস, বেইজিং, চায়না।

১০. প্যাট্রিক ক্লাউস (২০০৯), ‘পার্টিসিপেশন অ্যান্ড ই-ডেমোক্রেসি: হাউ টু ইউটিলাইজ ওয়েব ২.০ ফর পলিসি ডিসিশন মেকিং’, দ্য টেনথ ইন্টারন্যাশনাল ডিজিটাল গভর্নমেন্ট রিসার্চ কনফারেন্স: সোশ্যাল নেটওয়ার্কস: মেকিং কানেকশনস বিটুইন সিটিজেনস, ডেটা অ্যান্ড গভর্নমেন্ট, পুয়েবলা, মেক্সিকো।

১১. জিন ও ওয়াল্ডার (১৯৯৯), প্রপার্টি রাইটস অ্যান্ড ইকোনমিক রিফর্মস ইন চায়না, স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ক্যালিফোর্নিয়া।